Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮১)
[** ‘হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয় আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি আহবান করেছি’ :-
*মুসলিমদের এইভাবে কাজ করার সকল পর্যায়েই জন্যে সুসংবাদ:-
*সৃষ্টি দেখে স্রষ্টাকে চেনা :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭১: সুরা নূহ।
পারা:২৯
১- ২০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِہٖۤ اَنۡ اَنۡذِرۡ قَوۡمَکَ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱﴾
আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম (এ নির্দেশ দিয়ে) যে, একটি কষ্টদায়ক আযাব আসার আগেই তুমি তাদেরকে সাবধান করে দাও।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২
قَالَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡ لَکُمۡ نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ۙ﴿۲
তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী—
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৩
اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ اتَّقُوۡہُ وَ اَطِیۡعُوۡنِ ۙ﴿۳
‘এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্র ‘ইবাদাত কর এবং তাঁরা তাকওয়া অবলম্বন কর, আর আমার আনুগত্য কর ;
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৪
یَغۡفِرۡ لَکُمۡ مِّنۡ ذُنُوۡبِکُمۡ وَ یُؤَخِّرۡکُمۡ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اِنَّ اَجَلَ اللّٰہِ اِذَا جَآءَ لَا یُؤَخَّرُ ۘ لَوۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴﴾
আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেবেন। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহর নির্ধারিত সময় যখন এসে যায় তখন তা থেকে বাঁচা যায় না। আহ্! যদি তোমরা তা জানতে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৫
قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ دَعَوۡتُ قَوۡمِیۡ لَیۡلًا وَّ نَہَارًا ۙ﴿۵
তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয় আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি আহবান করেছি।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৬
فَلَمۡ یَزِدۡہُمۡ دُعَآءِیۡۤ اِلَّا فِرَارًا ﴿۶
কিন্তু আমার আহবান তাদের পলায়ন-প্রবণতাই বৃদ্ধি করেছে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৭
وَ اِنِّیۡ کُلَّمَا دَعَوۡتُہُمۡ لِتَغۡفِرَ لَہُمۡ جَعَلُوۡۤا اَصَابِعَہُمۡ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ وَ ا
سۡتَغۡشَوۡا ثِیَابَہُمۡ وَ اَصَرُّوۡا وَ اسۡتَکۡبَرُوا اسۡتِکۡبَارًا ۚ﴿۷
যাতে তাদের ক্ষমা করে দাও এ উদ্দেশ্যে আমি যখনই তাদের আহবান করেছি তখনই তারা কানে আঙুল দিয়েছে, এবং কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছে, নিজেদের আচরণে অনড় থেকেছে এবং অতিমাত্রায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৮
ثُمَّ اِنِّیۡ دَعَوۡتُہُمۡ جِہَارًا ۙ﴿۸
অতঃপর নিশ্চয় আমি তাদেরকে আহবান করেছি প্রকাশ্যে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-৯
ثُمَّ اِنِّیۡۤ اَعۡلَنۡتُ لَہُمۡ وَ اَسۡرَرۡتُ لَہُمۡ اِسۡرَارًا ۙ﴿۹
তারপর প্রকাশ্যে তাদের কাছে তাবলীগ (প্রচার ) করেছি এবং গোপনে চুপে চুপে বুঝিয়েছি।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১০
فَقُلۡتُ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ اِنَّہٗ کَانَ غَفَّارًا ﴿ۙ۱۰
আমি বলেছি তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১১
یُّرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَیۡکُمۡ مِّدۡرَارًا ﴿ۙ۱۱
তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১২
وَّ یُمۡدِدۡکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّ بَنِیۡنَ وَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ جَنّٰتٍ وَّ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ اَنۡہٰرًا ﴿ؕ ۱۲﴾
তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন বহু বাগান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৩
مَا لَکُمۡ لَا تَرۡجُوۡنَ لِلّٰہِ وَقَارًا ﴿ۚ۱۳
তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে বলে মনে করছো না?
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৪
وَ قَدۡ خَلَقَکُمۡ اَطۡوَارًا ﴿۱۴
অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৫
اَلَمۡ تَرَوۡا کَیۡفَ خَلَقَ اللّٰہُ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا ﴿ۙ۱۵
‘তোমরা কি লক্ষ্য করনি আল্লাহ্ কিভাবে সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করে?
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৬
وَّ جَعَلَ الۡقَمَرَ فِیۡہِنَّ نُوۡرًا وَّ جَعَلَ الشَّمۡسَ سِرَاجًا ﴿۱۶
এবং সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৭
وَ اللّٰہُ اَنۡۢبَتَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ نَبَاتًا ﴿ۙ۱۷
তিনি তোমাদেরকে মাটি হতে উদ্ভূত করেছেন।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৮
ثُمَّ یُعِیۡدُکُمۡ فِیۡہَا وَ یُخۡرِجُکُمۡ اِخۡرَاجًا ﴿۱۸
‘তারপর তাতে তিনি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেবেন এবং পরে নিশ্চিতভাবে বের করে নিবেন,
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-১৯
وَ اللّٰہُ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ بِسَاطًا ﴿ۙ۱۹
আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য বিছানার মত করে পেতে দিয়েছেন।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২০
لِّتَسۡلُکُوۡا مِنۡہَا سُبُلًا فِجَاجًا ﴿٪۲۰
‘যাতে তোমরা সেখানে চলাফেরা করতে পার প্রশস্ত পথে।’ ।
সুরা: নূহ
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৭১
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আলােচ্য সূরার সবটুকুর মধ্যেই নূহ আলাইহিস সালামের কিসসা ও তাঁর জাতির করুণ অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীর বুকে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে কতাে ধরনের অভিজ্ঞতা একজন মানুষের হতে পারে তার বাস্তব ছবি এ সূরার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর বিশেষ একটি সময়ের অবস্থাকে তুলে ধরে স্থায়ীভাবে জাহেলিয়াতরূপী কঠিন রােগটির চিকিৎসা সম্পর্কেও এখানে জানানাে হয়েছে। এ বর্ণনার মধ্যে একথাটাও জানানাে হয়েছে যে, ভালাে ও মন্দের মধ্যে সংঘর্ষ এক চিরন্তন ব্যাপার। নূহ(আ.)-এর ঘটনা জানার পর মানুষ যে সকল অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার মধ্যে একটি বড় অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, প্রতিহিংসাপরায়ন, বিপথগামী, অহংকারী এবং ভুল নেতৃত্বাধীনে বসবাসরত ব্যক্তিরা বরাবরই সত্যবিমুখ থাকে। হেদায়াতের যুক্তিপ্রমাণ ও ঈমান উজ্জীবনকারী বিষয়গুলাে তারা কিছুতেই বুঝতে চায় না। তাদের নিজেদের অস্তিত্বের মধ্যে যেসব বিস্ময়কর জিনিস তারা অনুভব করে এবং আদিগন্ত বলয়ে মনােমুগ্ধকর যা কিছু আছে তা থেকে ওরা মােটেই শিক্ষা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় । দৃশ্য ও অদৃশ্য এ সব কিছুর মধ্যে আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের নিদর্শন রয়েছে যা মানব মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। সেই নেয়ামতগুলাের দিকে একটু ভালােভাবে দৃষ্টিপাত করলে সেগুলাের আলোকে সঠিক পথপ্রাপ্তি মােটেই কঠিন হয় না। আল্লাহর সেই বিধানসমূহ হিংস্র, বিপথগামী, অসৎ, সত্যবিমুখ ও অহংকারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবক্তাদের মনেও রসূল(স.)-এর আগমনের যথার্থতা ও কল্যাণকারিতা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মায়। এইসব প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে সাথে রয়েছে নবী রসূলদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, ইসলামের ভুবন মােহিনী দাওয়াতকে মানব সাধারণের দ্বারে দ্বারে পৌছে দেয়ার জন্যে তাদের পূর্ণাংগ আত্মনিবেদন, এ কাজের জন্যে বাঞ্ছনীয় নানা প্রতিকুলতার মােকাবেলায় পর্বত-সম তাদের অবিচলতা এবং নিরন্তর অধ্যবসায়, যা ভুলপথে পরিচালিত বিরােধী মনােভাবাপন্ন, পাপপ্রবণ ও উচ্ছৃংখল মানুষকে সঠিক পথ দেখানাের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নিখুঁত ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আফসােস, ওদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, ওরা বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ ত্যাগ করার যৌক্তিকতা বুঝতে পারছে না, ওদের কাছে সত্যপথের পথিক যারা হেদায়াতের পথে চলছে, তাদের কোনাে মূল্য বা মর্যাদা নেই, তারা ঈমানী যিন্দেগীর মধ্যে উপস্থিত কোনাে লাভ দেখতে পায় না। তারা তাে মনে করে স্কুল কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে কাজ করলে, পড়াশুনা করলে বা পড়ালে যেমন মজুরী বা নানা প্রকারের সুযােগ-সুবিধা পাওয়া-যায়, ইসলাম গ্রহণ করলেও সে ধরনের কিছু না কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। যারা ইসলাম গ্রহণ করছে তাদেরকে যখন এরা উপস্থিত ও তার কোনাে একটিও পেতে দেখে না, তখন তারা পরবর্তীকালে অবশ্যম্ভাবী সাফল্যের খবরের প্রতি কোনােভাবেই আস্থা আনতে পারে না। এমনি ধরনের এক পরিবেশের মােকাবেলা করতে হয়েছে নূহ(আ.)-কে। দীর্ঘ সাড়ে নয় শত বছর নিরন্তর চেষ্টা করার পর তিনি তার হতভাগা জাতির বিরুদ্ধে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে নালিশ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনে তিনি বিরােধীদের ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্যে দিবারাত্র চেষ্টা করেছেন, এর জন্যে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টা চালানাের সময়ে বিরােধীদের সকল বাধা-বিপত্তি, উপহাস, বিদ্রুপ, অবহেলা ও অবজ্ঞা-নীরবে সহ্য করেছেন। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকার বিরােধীদেরকে পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগ নিয়ে দীর্ঘ সাড়ে নয় শত বছর আহ্বান করার পর তিনি তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর দরবারে পেশ করার প্রয়ােজন বােধ করেন। তিনি এই বলে দোয়া করেন, ‘হে আমার রব, অবশ্যই আমি আমার জাতিকে রাত-দিন ডেকেছি, কিন্তু আমার সেই আহবানের ফল তাদের জন্যে পালানাে ছাড়া আর কিছু বৃদ্ধি করেনি; আর যতবারই আমি তাদেরকে ক্ষমা করার উদ্দেশ্যে ডেকেছি ততবারই তারা কানে আংগুল দিয়ে থেকেছে। এরপর বলেছি, ক্ষমা চাও তােমাদের প্রতিপালকের কাছে, …. নূহ(আ.) পুনরায় দোয়া করতে গিয়ে বলছেন, হে আমার রব, ওরা আমার সাথে নাফরমানী করেছে এবং সেই ব্যক্তির আনুগত্য করেছে যার ধনসম্পদ এবং সন্তান শুধু তার ক্ষতিই বৃদ্ধি করেছে… সামগ্রিকভাবে এই হচ্ছে তৎকালীন সমাজের অবস্থা, আর পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা প্রেরিত নবী(আ.)-এর দায়িত্ব পালন প্রণিধানযােগ্য। তিনি রেসালাতের হক আদায় করতে একটুও কসুর করেননি। অনুরূপভাবেই সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করার জন্যে মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে। সমগ্র পৃথিবীর বুকে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা তথা আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েমের দায়িত্ব ছিলাে শেষ যামানার নবীর প্রতি মহাপবিত্র এক আমানত। রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি অর্পিত দায়িত্বসমূহের মধ্যে এটাই ছিলাে সবচাইতে বড় এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনকালে তাকে দেখানাে হচ্ছে, তাঁর পূর্বসূরী তারই এক ভাই নূহ(আ.) পৃথিবীতে ঈমানী যিন্দেগী প্রতিষ্ঠার জন্যে কতাে কঠিন দায়িত্ব কতাে দীর্ঘকাল ধরে পালন করেছেন। তাঁকে আরও জানানাে হচ্ছে, দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার সময়ে তাকে অতীতে কতাে সাংঘাতিক বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, দেখানাে হয়েছে সত্য-সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিরােধিতায় বাতিলপন্থী নেতারা কতাে কঠিন ও হিংস্র। আরও এটাও দেখানাে হয়েছে যে, এতসব বাধা বিঘ্ন ও অসৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্তেও মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষকে সৎ পথে আনার জন্যে এবং আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন-কানুন চালু করার জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলদের প্রেরণের এক অবিরত ধারা, যার একটি পর্যায় নূহ আলাইহিস সালামের ওপর এসে শেষ হয়েছে। বিশেষভাবে মক্কার মুসলমানদের সামনে এবং সাধারণভাবে সকল মুসলমানের সামনে নূহ(আ.)-এর যামানার সেই মহা সংকট ও সেই চরম বিদ্রোহী জাতির শাস্তির অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। জানানাে হয়েছে যে, পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌছানাের জন্যে এই মুসলিম জাতিই নবী(স.)-এর ওয়ারিস বা উত্তরাধিকার হিসেবে কাজ করবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর পথে মানুষকে এগিয়ে আনার জন্যে দাওয়াত দানের কাজ তারা করবে, সেই জনপদকে সত্যের দিকে আহবান জানানাের জন্যে কাজ করবে, যারা শিরক বিদয়াতে ভরা পরিপূর্ণ জাহেলিয়াতের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত, যারা জাহেলিয়াতের মধ্যে বরাবর হাবুডুবু খেয়েছে তারা হচ্ছে সেই সকল জাহেল যারা দ্বিতীয় মানব সভ্যতার মধ্যে অবস্থিত সৎ কর্মের সকল সীমাকে অস্বীকার করে সবরকম অন্যায় ও অপকর্মের মধ্যে মজবুতভাবে টিকে থাকার জন্যে চূড়ান্ত রকমের চেষ্টা করেছে এবং সেই সময়কার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করেছে। সংখ্যায় তারা যদিও ছিলাে অতি নগণ্য। কোরায়শদের সামনে নুহ(আ.)-এর সময়কার সেই দীর্ঘ কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে যাতে করে তারা হৃদয়ের চোখ দিয়ে তাদের পূর্বসূরী সত্যবিরােধী ও সত্যকে অস্বীকারকারীদের পরিণতিকে দেখতে পায়, তাদের কাছে প্রেরিত রসুলের মায়াভরা ব্যবহার যেন দেখতে পায়। এ অবস্থায় নিশ্চিত তারা অনুভব করবে যে, রসূল(স.) তাদেরকে কোনাে ধ্বংসের দিকে আহবান জানাচ্ছেন না, বরং তারা তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নির্ধারিত দয়ার এক প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখবে-সুনির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে ঢিল দেয়া বা অবকাশ দেয়ার অবস্থাকেও তারা দেখতে পাবে। যেহেতু সত্যকে বুঝার জন্যে সর্বপ্রকার উপায়-উপকরণ ও উদাহরণ তাদের সামনে চূড়ান্তভাবে এসে গেছে, এ জন্যে নূহ(আ.)-এর যামানার মতাে এতাে দীর্ঘ সময়ের জন্যে দাওয়াত পেশ করার এখন আর প্রয়ােজন হবে না। নূহ(আ.)-এর প্রার্থনার ফলে যে কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলাে সেই কঠিন পরিস্থিতিও এখন আর কোনােদিন আসবে না। কিন্তু আফসােস সেই কুরাইশদের জন্যে, এ সকল যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ কথা তাদের গােমরাহী বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনাে কাজই করলাে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘নূহ দোয়া করতে গিয়ে বললাে, হে আমার রব, পৃথিবীতে কাফেরদের একটি ঘরও ধ্বংস না করে তুমি ছেড়ে দিয়াে না। যদি তুমি (ধ্বংস না করে) তাদেরকে ছেড়ে দাও তাহলে তারা তােমার বান্দাদেরকে গােমরাহ করবে, আর অপরাধপ্রবন ও অস্বীকারকারী কাফের ব্যতীত তারা অন্য কোনাে সন্তানই জন্ম দেবে না।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর দিকে মানুষকে বরাবর যে আহ্বান জানানাে হয়েছে সেই একই দাওয়াত মােহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(স.) তার দেশবাসীর কাছে পেশ করেছেন, আর তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালাই যে একমাত্র মালিক ও একক শক্তি এই চরম ও পরম সত্য গ্রহণ করার জন্যে আহবান জানানাে, এ কথাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা, নিজে মেনে নেয়া এবং এর মূলনীতিসমূহকে দৃঢ়ভাবে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিলাে এই দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য। বিরােধীদের জন্য এটা কোনাে নতুন ও অস্বাভাবিক জিনিস ছিলাে না। তারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল সৃষ্টিকুলের সব কিছুর মধ্যে প্রতিনিয়ত একই সুর ধ্বনিত হচ্ছে, সব কিছুর মধ্যে পারস্পরিক একটা অবিচ্ছেদ্য গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং সব কিছু একই শক্তির ইচ্ছার অধীনে নিরন্তর গতিশীল কাজ করে যাচ্ছে। সৃষ্টিজগতের সব কিছু আবহমানকাল ধরে এক সুপরিকল্পিত কর্মসূচী মােতাবেক কাজ করে চলেছে। সৃষ্টিকুলের এ রহস্য সমূহের সবকিছুকেই নূহ(আ.) তার জাতির সামনে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ কথা দ্বারা তুলে ধরেছিলেন। কেমন করে আল্লাহ তায়ালা তার কথার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন তা লক্ষণীয়, ‘সে(নূহ) বললাে, হে আমার জাতি, অবশ্যই আমি তােমাদের জন্যে স্পষ্ট সতর্ককারী, আমি তোমাদের এ কথাটি গ্রহণ করতে আহবান জানাচ্ছি যে, তােমরা একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব কর এবং তাকেই ভয় কর, আর আনুগত্য করাে একমাত্র আমারই, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের (অতীতের) সকল অপরাধ মাফ করে দেবেন এবং তােমাদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেন। অবশ্যই সব কিছুর জন্যে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব নির্ধারিত এক মেয়াদ, সেই নির্দিষ্ট ক্ষণ যখন এসে যাবে তখন আর কাউকে একটুও সময় দেয়া হবে না। হায়, তােমরা যদি একথা জানতে।’ অর্থাৎ, এ সম্পর্কে যদি তােমাদের সঠিক কোনাে জ্ঞান থাকতাে এবং সে জ্ঞানকে তােমরা কাজে লাগাতে! তাহলে তোমরা, এইভাবে তােমাদের ধ্বংস ডেকে আনতে না। অর্থাৎ, কি ব্যাপার, আল্লাহর কোনাে মর্যাদা আছে বলেও কি তােমরা মনে করাে না, অথচ তিনি তােমাদেরকে কয়েকটি পর্যায়ে সৃষ্টি করেছেন। তােমরা কি দেখছাে না কেমন করে তিনি সাতটি আসমানকে সুসামঞ্জস্যভাবে সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে চাঁদকে স্নিগ্ধ বাতি বানিয়ে দিয়েছেন এবং সূর্যকে মহা সমুজ্জ্বল আলােকবর্তিকা-স্বরূপ বানিয়েছেন। আবার তােমাদেরকে পৃথিবী থেকে অন্যান্য গাছপালার মতাে করে উৎপন্ন করেছেন, তারপর এক সময় আসবে যখন এই যমীনের মধ্যেই তােমাদেরকে তিনি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন এবং এরপর একদিন তােমাদেরকে এই যমীন থেকে বের করে নিবেন। এটা তাে এক বাস্তব সত্য যা তােমরা দেখছো। আল্লাহ তায়ালা যমীনকে তােমাদের জন্যে বিছানার বানিয়ে দিয়েছেন যাতে করে তােমরা তার গিরিসংকটের মধ্য থেকে পথ বের করে নিতে পারাে। মুসলমানদের অন্তরের মধ্যে বাস্তব সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তাদের সামনে নুহ(আ.)-এর কাহিনীকে এখানে পেশ করা হয়েছে। কোরায়শ জনগণের মধ্যে শুরু থেকে যে গভীর গােত্রীয় সম্প্রীতি বিরাজ করছিলাে, তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে যে একাত্মতা, দলীয় সংগঠন ও সংঘবদ্ধতা গড়ে উঠেছে সেই সৌহার্দকে টিকিয়ে রাখার জন্যেই এই দাওয়াতী কাজের প্রসার প্রয়ােজন। মানুষকে দাওয়াতের মাধ্যমে যে জীবন ব্যবস্থা দান করা হয়েছে তার ওপর তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়ােজন। এটাই আল্লাহর প্রাচীনতম ও মজবুত পথ, যার ওপর মানুষ দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আল্লাহর রসূলরা যখনই বিরােধী মনােভাবাপন্ন ও পথহারা মানুষকে সঠিক পথ দেখানাের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে বার্তা বহন করে এনেছেন, তখনই মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কখনও তাদেরকে অজানা এক ভয় ভীতি পেয়ে বসেছে যে, তারা বাপ-দাদার আমল থেকে যে দেব-দেবীর পূজা করে আসছিলাে তাদেরকে পরিত্যাগ করলে তারা কষ্ট হবে, অকল্যাণ ডেকে আনবে-এমনকি অভিশাপ দিয়ে তাদেরকে ছারখার করে দেবে। এই বিরােধী লােকেরা একের পর এক রসূলদের আগমন সম্পর্কে নানাপ্রকার ভুল চিন্তা-ভাবনা করতাে। মানুষের মনে স্বভাবতই এ প্রশ্ন জাগে যে, নুহ(আ.) এতাে দীর্ঘকাল ধরে যে দাওয়াতী কাজ করলেন, এতাে ত্যাগ স্বীকার করলেন এবং মহা প্লাবনের পর আরও দীর্ঘ বছর ধরে যে মােমেন গােষ্ঠী গড়ে তুললেন তারা মােহাম্মদ(স.) এর যামানা আসতে আসতে কেন গােমরাহ হয়ে গেলাে? এই সূরা ও কোরআনে বর্ণিত আরও কয়েকটি সূরায় নূহ (আ.)-এর ত্যাগ তিতীক্ষার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে এতাে দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ ত্যাগ তিতীক্ষার কষ্ট করেছেন বলে কোনাে নবীর নেই। এতদসত্তেও কেন তার জাতির বিরােধিতা শেষ হলাে না? বরং ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস-উপেক্ষা অবিরাম গতিতে চলতে থাকল। এসত্তেও নূহ(আ.) এসব কিছু পরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, উত্তম ব্যবহার, অতি সুন্দর ও বিনয় আচরণ এবং স্নিগ্ধ ও মনােরম বাচনভংগীতে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। তার প্রাঞ্জল ও মনমােহিনী ভাষায় দাওয়াত দানের সূচনা থেকেই সেই দীর্ঘস্থায়ী বিরােধিতা শুরু হয়ে যায় এবং মহাপ্লাবন না আসা পর্যন্ত একটি দিনের জন্যেও তার কাজ বন্ধ থাকেনি। আরও বহু রসূল দুনিয়ায় এসেছেন, যাদের মধ্যে কাউকে উপহাস বিদ্রুপ করা হয়েছে, কাউকে আগুনে পােড়ানাে হয়েছে, কাউকে করাত দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছে, কাউকে পরিবার ও বাড়ী ঘর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর মহান বার্তার আগমন দিবস সমাগত হলো। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগ্রাম সাধনা শুরু হলাে। এ সংগ্রাম সমকালীন সবাই দেখেছে এবং জেনেছে। রাসূল(স.) নিজেও যেমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার সাথে তেমনি স্বীকার করেছেন তাঁর সাহাবারাও। তারপর থেকে সকল যামানায় ও সকল দেশে যখন এই দাওয়াত পেশ করা হয়েহে বিরােধীদের মােকাবেলায় যারাই এই সংগ্রাম করেছে তার অব্যাহত ধারা সমান গতিতে চলেছে। কিন্তু সকল যামানার সকল সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকারকে একত্রিত করলেও কি নূহ(আ.)-এর সাথে তার জাতি যে দুর্ব্যবহার করেছে তার সমান হবে? আবার তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা ও মনােবল, দুর্ব্যবহার সহ্য করার জন্যে দান করা হয়েছিলাে, তাও কি অন্যান্য সবার সম্মিলিত ধৈর্য থেকে কোনাে অংশে কম হবে নিসন্দেহে এখানে নুহ(আ.)-এর ত্যাগ তিতিক্ষা হবে সব কিছুর ওপরে। একথা সত্য যে, পৃথিবীতে আল্লাহর ওপর ঈমান আনার কাজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই এই কঠিন সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলাে। এই সহিষ্ণুতা, অবিচলতা, এই দুঃখ-কষ্ট ছিলাে সকল যামানার রাসূল ও তাদের সংগীসাথীদের পক্ষ থেকে এক মহান ত্যাগ। সম্ভবত পৃথিবীতে আল্লাহর ওপর ঈমান আনার যে প্রচেষ্টা চালানাে হয় তা অন্যান্য সকল বিষয়ের জন্যে চেষ্টা করা থেকে অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ; বরং সত্য বলতে কি, আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস গােটা পৃথিবী এবং এর ওপর অবস্থিত সকল জিনিস থেকে বড় অথবা অন্য অর্থে তােমাদের অনুভূতি ও দৃষ্টিতে যেগুলাে ধরা পড়তে পারে সে সব কিছু থেকেও ঈমানের গুরুত্ব অনেক বেশী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা হয়েছিলাে তিনি সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ কিছু গুণসম্পন্ন একটি জীবের অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় পাঠাবেন, তাই এই গুণাবলী দেয়া হয়েছে তার বুঝ-শক্তির মধ্যে। তার জীবন-পদ্ধতিতে ঠিক সে পরিমাণ দেয়া হয়েছে যা সে আল্লাহর সাহায্য ও নিজ নিজ তৌফিক অনুসারে চেষ্টা করে অর্জন করতে পারে। কিন্তু এ সব গুণাবলী দ্বারা ভূষিত করে কেন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পয়দা করলেন এটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবে বুঝে সুঝে ইচ্ছা শক্তি প্রয়ােগ করে চেষ্টা সাধনা করার জন্যে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঈমানকে তার নিজের চিন্তা চেতনার মধ্যে এবং জীবনে চলার পথে বাস্তবে যেন সে প্রয়ােগ করতে পারে তার জন্যে কোনাে চাপ প্রয়ােগ না করে তার সুবিবেচনার ওপর এই ভার দেয়া হয়েছে। ঈমান গ্রহণ ও আনুগত্য প্রদর্শনে ফেরেশতাদের মতাে তাদেরকে মযবুর করা হয়নি। আবার অন্যায় ও অপরাধজনক কাজ করার জন্যেও তাকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি যে, শয়তানের মতাে সর্বদা অন্যায় এবং অযৌক্তিক কাজই সে করে যাবে। এর রহস্য আমাদের বােধগম্য নয়, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি গােটা সৃষ্টিজগতের সাথে সংযোগ রক্ষা করার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা এ সব বৈশিষ্ট্য দিয়ে আমাদেরকে পয়দা করেছেন। সুতরাং ঈমানদার মানুষের কর্তব্য গােটা মানবমন্ডলীর মধ্যে ঈমানের তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যগুলােকে প্রতিষ্ঠিত করা। এই দায়িত্ব দিয়েই তিনি নবী রসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের এই চেষ্টা সাধনাকে বরাবরই কবুল করেছেন। তাদের অনুসারীদের মধ্যে যাদেরকে কবুল করেছেন তারা হচ্ছে সত্যবাদী মােমেনদের দল। পৃথিবীর বুকে সত্য প্রতিষ্ঠায় তারা হচ্ছে নিবেদিতপ্রাণ। যারা জান মালকে নিঃশেষে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর যমীনে আল্লাহর প্রভুত্বকে কায়েম করার প্রচেষ্টায় তাদের সার্বিক ত্যাগের পুরস্কারস্বরূপ দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। অন্তরের মধ্যে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা সেই অন্তরে আল্লাহর নুরের ঝলক পয়দা করে দেয়। এই কারণেই তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সৃষ্টির বহু রহস্য সম্পর্কে অবগত হন। আর এই কারণেই সৃষ্টির মধ্যে যেসব রহস্য বর্তমান রয়েছে সেগুলাের বহুলাংশকে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অবহিত করান। এটাই হচ্ছে বাস্তব কথা, এটা কোনাে ভাষাভাষা ছবি বা কোনাে অলীক অভিব্যক্তি নয়। এটা হচ্ছে সব থেকে বড় সত্য, যা মানুষের মধ্যে, যমীন ও আসমানের মধ্যে এবং সৃষ্টির সব কিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। এমনি করে কোনাে এক জনগােষ্ঠীর মধ্যে ঈমানের অস্তিত্ব থাকার অর্থ হচ্ছে পার্থিব জীবনের সাথে আখেরাতের জীবনের সমন্বয় সাধন এবং তার জীবনকে এতটা উন্নীত করা যেন উভয় জীবনের মধ্যে তা সংযােগ স্থাপন করার যােগ্য হয়ে গড়ে উঠে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ক্ষয়িষ্ণু জীবন ও স্থায়ী জীবনের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপন করা। পরিপূর্ণ জীবনের সাথে আংশিক জীবনের যােগাযােগ সৃষ্টি করা, এ হচ্ছে এমন একটি বস্তু যা বহু চেষ্টা-সাধনা করেই পাওয়া যায়। এর জন্যে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। যদি কেউ উভয় জীবনের সমন্বয়ে স্থায়িত্ব লাভ করতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে কিছু না কিছু কষ্ট করতেই হবে, কিছু ত্যাগ স্বীকার তাকে করতেই হবে। এই কষ্ট-পরিশ্রম ও ত্যাগই তার জন্যে জীবনের দুর্গম পথ পরিক্রমায় এক উজ্জ্বল আলােক হিসেবে কাজ করবে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে বারবার একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে আল্লাহর ওপর মযবুত ঈমান ব্যতীত কোনাে ব্যক্তিই জীবনে কোনাে মহৎ কাজ সম্পাদন করতে পারে না। এই গুণের ধারক ও বাহক হওয়ার কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অতীতে দীর্ঘকাল যাবত এসব মানুষের সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থেকেছে। যাদের অধীনে মানুষ উন্নতির চরম শিখরে আরােহন করতে সমর্থ হয়েছে। বরং এটা যে কতাে বড় সত্য তা মানুষ চিন্তা ভাবনা করে বুঝতে পারে না, আসলে এটাই হচ্ছে সেই অনুপম বিশ্বাস যা মানুষের জীবনকে ঈমানের ধারা সঞ্জীবিত করে। মানুষের চিন্তা প্রসূত কোনাে কাজ, তার রচিত কোনাে জীবন-দর্শন, তার গবেষণালব্ধ কোনাে জ্ঞান-বিজ্ঞান বা আবিষ্কার, অথবা পৃথিবীতে বিরাজমান কোনাে ধর্ম অথবা জীবন পদ্ধতি মানুষকে সেই ভাবে কখনাে পথ দেখাতে পারেনি, যেমন করে আল্লাহর ওপরে ঈমানের দৃঢ়তা মানুষের জীবনকে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের চরিত্রকে গড়ে তুলতে পেরেছে, তাদের ধ্যান-ধারণাকে উজ্জীবিত করতে সমর্থ হয়েছে এবং তাদের জীবনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও মর্যাদা দান করতে পেরেছে-এমনটি দ্বিতীয় নেই। এই সঠিক বিষয় থেকেই পূর্ণাংগ-জীবনের জন্যে সঠিক পথপ্রাপ্তি সম্ভব হয়েছে। ঈমানের সেই উৎস থেকে উৎসারিত জীবন পথের এ দিশা অতীতের নবীদের কাছে সংক্ষিপ্ত আকারে এসেছে, কিন্তু শেষ নবী মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ওপর অবতীর্ণ কিতাবে গােটা মানবমন্ডলীর জন্যে সত্য সঠিক জীবন লাভের বিস্তারিত ও বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এই আকীদা হচ্ছে এমন এক অকাট্য বিষয়, যা স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে। এ হচ্ছে সেই সত্য, যা ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাবলীর মাধ্যমে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ঈমানী যিন্দেগী যাপন করে মানুষ যা লাভ করছে তা মানুষের তৈরী কোনাে তন্ত্রমন্ত্রের দ্বারা অর্জিত হয়নি। কোনাে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কোন দর্শন, কোন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, কোন মানব রচিত জীবন ব্যবস্থা-কোনটিই ঈমানী যিন্দেগীর মতো অবদান রাখতে পারেনি। একারণে পৃথিবীতে যখনই প্রকৃত মােমেনদের নেতৃত্ব বিলুপ্ত হয়েছে তখন তাদের স্থান অন্য কেউ কোনােভাবেই পূরণ করতে পারেনি। বরং তাদের জীবনের মূল্যমান এর ফলে অনেক নিচে নেমে গিয়েছে, মানবতার মর্যাদা এতে দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এইভাবে তারা ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতি, চিন্তার নৈরাজ্য এবং দলীয় সংকীর্ণতাসহ নানাপ্রকার ব্যাধির শিকারে পরিণত হয়েছে; যদিও বস্তুগত কিছু কিছু ময়দানে তারা অগ্রসর হয়েছে এবং পার্থিব ভােগ-বিলাসের জিনিস ও আমোদ-প্রমোদের বিষয়াদিতে তারা যদিও বহু উন্নতি করেছে বলে মনে হয়েছে, কিন্তু সেসব কিছু পাওয়া সত্তেও তারা মানসিক প্রশান্তি ও মানবতাবােধ থেকে অনেক যােজন যােজন দূরে সরে গিয়েছে। ঈমানের শান্তি ছায়ায় যেমন করে মানুষের জীবনের উন্নতি হয়েছে তেমন উন্নতি আর কোনাে অবস্থায় কোনােদিনই হয়নি। ঈমানী জীবন যাপন কালে মানুষ যেমন করে তাদের বিশ্বাসের ফল লাভে সমর্থ হয়েছে, তেমনি করে অন্য কোনাে জিনিসের বিনিময়ে তা লাভ করতে দেখা যায়নি। এটা একথার এক অকাট্য দলীল যে, এই দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহর পক্ষ থেকেই আগত সেই মহাসত্য, যার ছোঁয়া পেয়ে মানব জাতির উন্নতিতে এক যুগান্তর সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ঈমান তার জীবনকে এমন গরীয়ান মহীয়ান করেছে যা মানবরচিত কোনাে পথ বা পদ্ধতির মাধ্যমে কখনও অর্জিত হয়নি। ঈমানের ছায়াতলে এসে জীবন সম্পর্কে তার চিন্তাধারার যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তাও ইতিপূর্বে কখনও হয়নি। এই আকীদা বিশ্বাসের কারণে সৃষ্টিজগতের সাথে তার যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা অন্য কোনাে জিনিসের মাধ্যমে কখনও গড়ে উঠা সম্ভব নয়। এই ঈমানের বদৌলতে মানুষের মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবোেধ গড়ে উঠেছে তা কখনও অন্য কোনাে জিনিসের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি। এইভাবে ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে আমরা যে ধ্যান-ধারণা পাই তা হচ্ছে এই যে অন্যান্য সকল সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। সুতরাং নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় যে, পৃথিবীতে ঈমানী যিন্দেগী প্রতিষ্ঠার জন্যে এবং আল্লাহর আলাের পরশ পাওয়ার জন্যে যে চূড়ান্ত চেষ্টা সাধনা এবং যে ত্যাগ কোরবানী স্বীকার করা হয় তার মধ্য দিয়েই বাস্তব জীবনের জন্যে আল্লাহর প্রদর্শিত পথ বেরিয়ে আসে, মানুষের চিন্তার ক্ষেত্র উন্নত হয় এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মানুষের কাজ ও ব্যবহারেরও ব্যাপক উন্নতি হয়। মানব জীবনের ইতিহাস বরাবর একথার সাক্ষ্য বহন করে এসেছে যে, একমাত্র আল্লাহর ওপর যারা ঈমান এনেছে এবং যারা তার ভয়ভীতিকে অন্তরে পােষণ করে জীবন যাপন করেছে তারাই মানবজীবনের দীর্ঘস্থায়ী শান্তি সমৃদ্ধি স্থাপনের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। অতীতের ঘটনাপঞ্জীর নিরীখে আমরা একথা নিসংকোচে বলতে পারি যে, শীঘ্রই মানব জাতি সেসব ঘটনা ও তার পাশাপাশি মানুষের সে কঠিন ব্যবহার প্রত্যক্ষ করবে, যা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা আলাইহিমুস সালাম ও মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং তাদের সংগী সাথীদের দাওয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়েছিলাে। অচিরেই সে দিন আসবে যখন ভুল-ভ্রান্তির মধ্যে পতিত এক গােমরাহ নেতৃত্ব ক্ষমতায় আসতে থাকবে, এরা অন্যায় ও গােমরাহীর কাজে পরস্পর সহায়তা করবে। সত্যের দিকে আহবানকারীদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করবে এবং বিভিন্নভাবে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করবে। এভাবেই একদিন ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তারা আগুনে নিক্ষেপ করেছিলাে, আবার কাউকে তারা করাত দিয়ে চিরে ফেলেছিলাে। আরাে কিছু লােক নবী-রসূলদেরকেও ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাস উপেক্ষা করে যে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে, বিশ্বের ইতিহাস আজও তাদের সে নির্যাতনের সাক্ষ্য বহন করছে। এতদসত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছায় তার দিকে আহ্বান করার এই কাজ নিজ গতিতে চলতে থাকবে। যেহেতু এ সকল কাজের দাবীই হচ্ছে চূড়ান্ত সগ্রাম এবং মহান কোরবানী, এজন্যে যত ক্ষুদ্র আকারেই কাজ করা হােক না কেন এ কাজ যখনই সঠিকভাবে শুরু করা হবে-বাতিলপন্থীদের তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া আসবেই, আর সেই প্রতিক্রিয়ার মােকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন করতে গিয়ে আল্লাহর নূর এবং তার মেহেরবানীর পরশ প্রত্যেক দায়ী ইলাল্লাহ (আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী) ব্যক্তি তার অন্তরের গভীরে অনুভব করবে। ‘দায়ী ইলাল্লাহর’ এই জনগােষ্ঠী নূহ(আ.)-এর সময় থেকে মােহাম্মদ(স.) -এর যামানা পর্যন্ত যারাই রসূল হয়ে এসেছিলেন তারা প্রত্যেকেই আল্লাহর ইচ্ছানুসারে ঈমান-এর তাৎপর্য বুঝানাের উদ্দেশ্যে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। তাদের এই দাওয়াতের প্রকৃতি এবং প্রতিক্রিয়া সর্বকালে একই রকম থেকেছে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে কম যে কাজটি ‘দায়ী ইলাল্লাহ’ করতে পারেন তা হচ্ছে যদি অন্য কেউই তাদের ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে তারা তাদের নিজেদের অন্তরের মধ্যে আমরণ ঈমানের এই আমানতকে নিজেরা সংরক্ষণ করে যাবে। মৃত্যু থেকে ভয়ংকর কোনাে পরিস্থিতিও যদি আসে সেক্ষেত্রেও সত্যের এই আহ্বানকারীরা এ দায়িত্ব থেকে পিছপা হবেন না। নবী রসূলদের এই বৈশিষ্টের কারণে তাদের মর্যাদা হামেশাই দুনিয়ার অন্য সবার ওপরে। দুনিয়ার কোনাে আকর্ষণ বা দুনিয়ার ভােগ-বিলাস তাদেরকে গাফেল করতে পারে না-না পারে তাদের কর্তব্যচ্যুৎ করতে। তাদের সেরা মানুষ হওয়ার জন্যে তাদের এই শুণটিই যথেষ্ট। এটাই তাদের চুড়ান্ত সফলতার প্রতীক। নবীদের মতাে এটা দাওয়াত দানকারীদেরও এক অমূল্য উপার্জন, যারা এ গুণটি অর্জন করতে পারে তারাও দুনিয়ার মান ইযযত লাভ করা ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্যে এই গুণটিকে এক মহান সম্পদ রূপে মনে করতে পারে। এই গুণটির কারণেই আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব বহনকারী এই মানুষ আল্লাহর ফেরেশতাদের সিজদা পাওয়ার যােগ্য বিবেচিত হয়েছে, যদিও এই মানুষের মধ্যে পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ ছড়ানাে ও রক্তক্ষয়ী বিবাদ-বিসম্বাদ করার প্রবণতাও বিদ্যমান ছিলাে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী এবং আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান জানানাের দৃঢ় ইচ্ছা পােষণ করে, এজন্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করে, এর জন্য সবরকমের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয় এবং দুর্বল ও অক্ষম হওয়া সত্তেও এই সকল কাজের বিনিময়ে আল্লাহর জমীনে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যে তার কাছেই সে সাহায্য-প্রার্থী। সেই হচ্ছে সফল ব্যক্তি, কেননা, তারা চায় আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান আল্লাহর যমীনে কায়েম হােক। এই উদ্দেশ্যেই সে প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষদের দাওয়াত দেয়, সে মনে প্রাণে চায় আল্লাহর দ্বীনের সংস্পর্শে এসে মানুষের জীবন উদ্ভাসিত হােক। এতে সে সবরকম কষ্ট, দুঃখ এমনকি মৃত্যু যন্ত্রনা অথবা এর থেকেও কষ্টকর কিছুকে হযম করতে প্রস্তুত। বিশ্বাসের দৃঢ়তার কারণেই এই দুঃখ কষ্ট সে সহ্য করতে পারবে, যেহেতু তার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, এর বিনিময়ে সে আখেরাতে মুক্তি পাবে। আখেরাতের বিশ্বাসের কারণেই সে কর্তব্য সচেতন হয়, আর যে ব্যক্তি কর্তব্য বােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করে সে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই নিজ মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। মানুষের অন্তরের মধ্যে আখেরাতের মুক্তির প্রেরণা যখন একবার স্থান লাভ করে তখন তার কাছে দুনিয়ার চেষ্টা সাধনাজনিত কাজের কষ্ট লাঘব হয়ে যায়, কষ্টের অনুভূতি কমে যায় এবং যে কোনাে ত্যাগ স্বীকার করা তার জন্যে তখন মােটেই আর কঠিন থাকে না। এগুলাে তার আমলনামায় যােগ হয়ে তার সৎকর্মের পাল্লাকে ভারী করে দেয়, এটাই হয় তার সব পাওয়ার বড় পাওয়া।
ফী জিলালিল কুরআন: এখন আমরা নুহ (আ.) এর ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে পেশ করতে চাই, যা এই সূরার মধ্যে পেশ করা হয়েছে। এই আলােচনার মাধ্যমে যে মূল সত্যটি এ সূরার মধ্যে নিহিত রয়েছে-তাও ইনশাআল্লাহ ফুটে উঠবে। ‘অবশ্যই আমি নূহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম, নির্দেশ দিয়েছিলাম… আফসােস যদি এ অবস্থাটি তােমরা জানতে পারতো।’ সূরাটি শুরু হচ্ছে রিসালাত ও ঈমান আকীদার উৎসের বর্ণনা এবং এর সমধিক গুরুত্বের আলােচনা দিয়ে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমি নূহ-কে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম।’ যিনি পাঠিয়েছেন তিনিই হচ্ছেন এখানে মূল উৎস, তার থেকে গােটা সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করেছে। তার কাছ থেকেই রসূলরা রিসালাত-এর নিয়ােগ পেয়েছেন। তারা একথা জেনেছেন যে, তার ওপর গভীর বিশ্বাসই হচ্ছে সকল কাজের মূল প্রাণ শক্তি। তিনিই জীবন-দাতা; আর তিনিই মহান আল্লাহ তায়ালা যিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, সর্বোপরি তিনি তাকে চেনার এবং তার আনুগত্য করার তাদেরকে তৌফিক দিয়েছেন। এরপর যখনই তারা আল্লাহ তায়ালা থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে এবং সঠিক পথকে বাদ দিয়ে বাঁকা পথ ধরেছে তখনই তাদেরকে সঠিক পথে চালানাের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের কাছে তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন, যাতে করে সে ভ্রান্ত মানবগােষ্ঠী আবার তার দিকে ফিরে আসতে পারে। আদম(আ.)-এর পর নূহ(আ.)ই ছিলেন প্রথম সেই রসূল যিনি সঠিক পথ থেকে সরে যাওয়া মানুষকে আবার সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। আদম(আ.) এর এই দুনিয়ায় আগমন ও এখানে মানব জাতির আবাদী স্থাপনের পর কোনাে রিসালাত (আল্লাহর কাছ থেকে প্রেরিত বার্তা) পেয়েছিলেন বলে সরাসরি উল্লেখ না পাওয়া গেলেও এ কথা নিশ্চিত সত্য যে, তিনি আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি যে জ্ঞান নিয়ে এসেছিলেন সেই জ্ঞানের আলােকে তিনি তার সন্তানদের জন্যে শিক্ষাদাতার ভূমিকায় কাজ করেছিলেন। তার অন্তর্ধানের পর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গেলে মানুষ এক আল্লাহর হুকুম মত জীবন যাপন করার নীতি থেকে অনেক দূরে সরে চলে যায় এবং তাদের নিজ হাতে তৈরী মৃত হন সর্বময় ক্ষমতার মালিক বানিয়ে নেয়। প্রথম প্রথম তারা কিছু মূর্তি তৈরী করে তাদেরকে শক্তি-ক্ষমতার প্রতীক মনে করতে থাকে এবং আল্লাহর অদৃশ্যমান শক্তি ক্ষমতাকে দৃশ্যমান কোনা জিনিসের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে মনের সান্ত্বনা খুঁজতে থাকে। পরবর্তীকালে এই প্রতীক বা কল্পনা’র কথা ভুলে গিয়ে তারা স্বয়ং সে মূর্তিগুলােরই পূজা শুরু করে দেয়। তারা সে পাঁচটি জিনিসের কথা প্রচার করতে থাকে যার বিবরণ এই সূরার মধ্যেই পরবর্তীতে আসছে। এই সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের কাছে নূহ(আ.)-কে প্রেরণ করেন যাতে করে তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনতে পারেন এবং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ও সৃষ্টির তত্ত্ব সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণাকে সংশােধন করতে পারেন। *নূহ(আ.)-এর দাওয়াত : কোরআনের পূর্ববর্তী অবতীর্ণ কিতাবসমূহে নূহ(আ.)-এর আগমনের উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু সেই সকল কিতাবের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা অনেক কিছু মুছে যাওয়ার কারণে মুসলমানদের কাছে সেই সকল কিতাবের সকল কথা এখন আর গ্রহণযােগ্য নয়। কোরআনে করীমে নূহ(আ.)-এর যে বিবরণ এসেছে তা খেয়াল করলে যে কোনাে ব্যক্তিই বুঝবে যে, মানুষ জাতির প্রসারের সূচনালগ্নেই নূহ(আ.) এর আগমন ঘটেছিলাে। তার বয়সের সাড়ে ন’শ বছর তিনি তার জাতিকে সত্যের দিকে দাওয়াত দান করার কাজে লাগিয়েছিলেন। এই কারণেই মনে হয়, সে সময়কার মানুষেরা এ রকম দীর্ঘজীবিই ছিলাে। তার ও তার সময়কার মানুষের এ প্রকার দীর্ঘজীবী হওয়া এই কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, পরবর্তী মানুষের প্রসার যেভাবে ঘটেছে সেই সময় মানুষ সংখ্যায় সে রকম বেশী ছিলাে না। আমাদের এই ধারণার আরেকটি কারণ হচ্ছে এই যে, সংখ্যায় কম হলে তাদের দীর্ঘজীবন দান করা এটাই মনে হয় আল্লাহর নিয়ম যাতে করে সৃষ্টির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য বিরাজ করে। অবশ্য আল্লাহ তায়ালাই সব কিছু ভালাে জানেন, আমরা আল্লাহর নিয়ম যা কিছু নিজেরা প্রত্যক্ষ করি তারই ওপর একটা ধারণা গড়ে তুলি মাত্র। আলােচ্য সূরাটি শুরু হয়েছে রিসালাত -এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব-সম্পর্কিত আলােচনা দিয়ে, তারপর রিসালাত-এর অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, আর সংক্ষেপে বলতে গেলে এর গোটা তাৎপর্যই হচ্ছে ভীতি-প্রদর্শন এবং সতর্কীকরণ। এরশাদ হচ্ছে, ‘বেদনাদায়ক একটা শান্তি আসার পূর্বেই তোমার জাতিকে সতর্ক করাে।’ নূহ(আ.)-এর জাতি যে কঠিন শিরক-এর অবস্থায় ছিলাে তাতে তাদের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিলাে। নবীর প্রতি তাদের প্রত্যাখ্যানজনিত মানসিকতা, অহংকার, হিংসা এবং গােমরাহী দীর্ঘ সময় ধরে চলছিলাে, যার কারণে নূহ(আ.) রাব্বুল আলামীনের দরবারে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ দায়ের করতে বাধ্য হলেন। দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করা ও দুনিয়া, আখেরাতে ও বেদনাদায়ক আযাবের কথাগুলােকে উপেক্ষা করার কারণেই অবশেষে তাদের ওপর সর্বগ্রাসী সেই আযাব নাযিল হলাে যা তাদের কোনাে এক ব্যক্তিকেও রেহাই দিলাে না। শাস্তির এই দৃশ্যের অবতারণা শেষে দর্শকের দৃষ্টি সরাসরি আকৃষ্ট করা হচ্ছে ‘তাবলীগে দ্বীনের’ সংক্ষিপ্ত আলােচনার দিকে, কিন্তু সেখানেও সতর্কীকরণ ও ভীতি প্রদর্শনের দিকটিই প্রধান। অবশ্য সাথে সাথে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গুনাহ খাতা যা কিছু ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঘটেছে সেগুলাের প্রতি ক্ষমা ঘােষণা করা হয়েছে। তাদের হিসাব গ্রহণকে আখেরাতে বিচার দিন আসার পূর্ব পর্যন্ত বিলম্বিত করা হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে এটাই তাদের প্রতি দাওয়াত দানের মূল কথা। এরশাদ হচ্ছ, নুহ(আ.) দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে বললাে, হে আমার জাতি অবশ্যই… আফসােস যদি তারা জানতো। ‘হে আমার জাতি, আমি তােমাদের জন্যে স্পষ্টভাবে সতর্ককারী।’ এখানে যে বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক করা হচ্ছে তা প্রত্যেক শ্রোতার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নূহ(আ.)-এর দেয়া যুক্তি প্রমাণ এতাে স্পষ্ট যে, সব কিছু বুঝার ব্যাপারে মানুষের মনকে তা সন্দেহমুক্ত করে দেয়, যে কথাগুলাের দিকে তিনি আহবান জানিয়েছেন সে ব্যাপারে কোনাে দ্বিধা দ্বন্দ্ব, অজানার অস্পষ্টতা বা কোনাে সন্দেহই শ্রোতাকে বিচলিত করে না। যে সত্যের প্রতি নবী আহবান জানান তার সত্যতা কোনাে গােপন বা অবােধ্য জিনিস নয় যে, অস্বীকারকারীরা এব্যাপারে কোন অজুহাত পেশ করতে পারে। নবী নূহ(আ.) যে সঠিক কথার প্রতি আহবান জানাচ্ছেন, তা যেমন ব্যাপক, তেমনি স্পষ্ট এবং মজবুত ভিত্তির ওপর স্থাপিত, আল্লাহর দাসত্ব করার কথা বলেছেন যার কোনাে অংশীদার নেই, সেই আল্লাহকে ভয় করা মানুষের বুঝ শক্তি ও বাস্তব ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রহণযােগ্য কোনাে বস্তু নয়। তাঁর রসূলকে আনুগত্য দানের মাধ্যমেই তার সেই নির্দেশ পালন করা যায় যার থেকে গােটা জীবনকে পরিচালনা করা এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি জানা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা জ্ঞান ও নির্দেশাবলী পাই এবং একে বাস্তবায়িত করার পদ্ধতি বুঝতে পারি। পৃথক পৃথকভাবে কিংবা বিস্তারিতভাবে মহান আল্লাহর বিশাল এই সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান দান করার জন্যেও তা প্রয়ােজন। সর্বোপরি গােটা মানব জাতির বৈচিত্রময় ও বিস্ময়কর অবস্থা বুঝানাের উদ্দেশ্যে এখানে বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করাই হচ্ছে জীবনের একমাত্র পথ। এই দ্বিধাহীন আনুগত্যই আল্লাহতায়ালা ও তার বান্দার মধ্যে সম্পর্কের তাৎপর্যকে তুলে ধরে। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যকার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে জানায়। শক্তি, শক্তির মালিক এবং এই নিরংকুশ আনুগত্য সারা জগতের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর শক্তির নিদর্শনকে ফুটিয়ে তােলে। এই আনুগত্যবােধের ওপরই মানুষের জীবনে শান্তি-সুখের প্রাসাদ গড়ে উঠে। যারা তাদের মালিকের আনুগত্য সঠিকভাবে করে তাদের জীবন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়, আল্লাহর অনুমােদিত সে পথে চলতে গিয়েই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা ও তার অনুগত বান্দার মধ্যে একটা নিবিড় ও মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। বান্দা সেই মজবুত ও সােজা পথটি লাভ করে যা আল্লাহ তায়ালা সকল প্রাণী ও প্রাণহীন বস্তুর জন্যে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহর ভয় বা তাকওয়াই এ সত্য সঠিক পথে টিকিয়ে রাখার জন্যে মানুষকে যাবতীয় নিশ্চয়তা দান করে। এ জীবন ও এর পরের জীবনে আল্লাহবিমুখতা থেকে তাকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম করার প্রচেষ্টার কোনাে হিলা-বাহানা তালাশ করা থেকেও তাকে বাঁচায়। এইভাবে আল্লাহভীরু প্রত্যেক ব্যক্তিই এমনভাবে নিজ দায়িত্বের অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে কাজ করতে থাকে, যেন তাদেরকে খােদ আল্লাহ তায়ালা সরাসরি দায়িত্ব দিয়েছেন। এতে তাদের নিজেদের মাতব্বরী ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কোনাে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় না। রসূল(স.)-এর আনুগত্য হচ্ছে সঠিক পথে টিকে থাকার একমাত্র মাধ্যম, কারণ রসূলের মাধ্যমেই মানুষ সঠিক পথের সন্ধান পায়। তার মাধ্যমেই আল্লাহর কাছ থেকে আগত সঠিক পথের দিশা (হেদায়াত) বান্দার কাছে পৌছান হয়, আর এইভাবে আল্লাহর হেদায়াত বান্দা পর্যন্ত সরাসরি আসার পথে রাসূল একটি জীবন্ত ষ্টেশন হিসেবে কাজ করেন। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার জন্যে নির্মিত এই প্রশান্ত পথসমূহের দিকেই মানব জাতির প্রসারলগ্নে নুহ(আ.) আহ্বান জানিয়ে যে কথাগুলাে বলেছিলেন, তাই প্রত্যেক যামানার নবীরা বলেছেন। তিনি তাদেরকে সেই সমস্ত ওয়াদা দিয়েছেন যা আল্লাহর প্রতিটি যামানার তাওবাকারী এবং আল্লাহমুখী লােকদের তিনি দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন, ‘তােমাদেরকে তিনি সকল গুনাহ থেকে মুক্ত করে মাফ করে দেবেন, আর তােমাদের একটি নির্দিষ্ট সময় অবধি হায়াত দান করবেন।’ আল্লাহর এবাদাত করার আহ্বানে যারা সাড়া দেবে এবং রসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহর কাছ থেকে তাদের প্রতিদান হচ্ছে সার্বিক ক্ষমা তথা আগের অপরাধ থেকে অব্যাহতি দান। উপরন্ত একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের হিসাব নেয়ার ক্ষণটিকে বিলম্বিত করা হবে, আর সেই ক্ষণটি হবে শেষ বিচারের দিন । আল্লাহর মেহেরবানীর আরও বড় দিক হচ্ছে, মানুষের অতীতের অপরাধ (যা তার ধ্বংস হওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলাে) ক্ষমা করে দিয়ে তাকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রেহাই দেয়া। যে হিসাব নেয়ার ব্যাপারে নূহ(আ.) আল্লাহর দরবারে আরজী পেশ করেছিলেন, তার থেকেও নিকৃষ্ট হিসাব এই দুনিয়ার জীবনেই নেয়া হবে, যদি সকল জ্ঞান ও যুক্তিপূর্ণ কথা এসে যাওয়ার পরও মানুষ সত্য সঠিক পথ থেকে দূরে সরে থাকে। এরপর তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন যে, সেই ওয়াদা করা একদিনে হঠাৎ করেই পূর্ব নির্দিষ্ট এবং পূর্ব নির্ধারিত আযাব এসে যাবে। দুনিয়ার কষ্ট যেমন এড়ানাে যায় বা বিলম্বিত করার কোনাে না কোনাে উপায় বের হয়েও যায় তেমন করে সেই আযাবকে কিন্তু বিলম্বিত করা যাবে না। সেটিই হচ্ছে সব থেকে বড় এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার একমাত্র ব্যবস্থা। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর সে সুনির্দিষ্ট সময়টি যখন এসে যাবে, তখন তাকে মােটেই বিলম্বিত করা হবে না, আফসোস! যদি তােমরা জানতে। তােমাদের জ্ঞান যদি কাজে লাগতো।’ আলােচ্য আয়াতগুলােতে যে কথা বলা হয়েছে তাতে প্রতিটি ঘটনা তার নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে একটা ইংগীত পাওয়া যায়, যাতে সাধারণভাবে মানুষ অনুষ্ঠিতব্য প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে সময় থাকতেই সজাগ হয়ে যায়। বলা হয়েছে, ‘যদি তারা আনুগত্য করে এবং ফিরে আসে, তাহলে তাদেরকে হিসাব দিবস পর্যন্ত সময় দেওয়া হবে।’
সুরা: নূহ
আয়াত নং :-৯
ثُمَّ اِنِّیْۤ اَعْلَنْتُ لَهُمْ وَ اَسْرَرْتُ لَهُمْ اِسْرَارًاۙ
তারপর প্রকাশ্যে তাদের কাছে তাবলীগ করেছি এবং গোপনে চুপে চুপে বুঝিয়েছি।
ফী জিলালিল কুরআন:
*নুহ-এর জাতির উন্নাসিকতা : নুহ(আ.) যিন্দেগী ভর অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর জাতিকে হেদায়াতের জন্যে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক মানুষ ব্যতীত, সামগ্রিকভাবে কোনাে সংস্কার বা সংশােধনীকে তার জাতি গ্রহণ করেনি। এ পথে তাকে দীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর ধরে দুঃখ কষ্ট এবং বিরােধিতা সহ্য করতে হয়েছে। দাওয়াতী কাজের কারণেই তাকে এই ঠাট্টা বিদ্রুপ, অহংকার ও অস্বীকার ও অস্বীকৃতির মােকাবেলা করতে হয়েছে। এতাে দীর্ঘ সময় ধরে তাদেরকে সত্যের প্রতি আহ্বান জানানাের ফলে তার অনুসারীদের সংখ্যা কিন্তু কিছুমাত্র বৃদ্ধি পায়নি, বরং তাদের ভ্রান্তি ও গােমরাহী উপর্যুপরি বেড়েই চলেছিলাে । অবশেষে তিনি তার প্রতিপালকের কাছে আরজি দাখিল করেছেন-যিনি তাকে যে মহান কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। যদিও তার রব সব কিছু সম্পর্কেই ওয়াকেফহাল, তিনি নিজে কি কি কাজ করেছেন এবং তাকে কোন কোন পরিস্থিতির মােকাবেলা এখানে করতে হয়েছে, সব কিছুর বিবরণ তিনি পেশ করেছেন। অবশ্য নূহ(আ.) নিজেও জানতেন যে, তার রবের কাছে আসলে অজানা কিছুই নাই, তবুও শ্রান্ত ক্লান্ত হৃদয়ের এ ছিলাে আকুল নিবেদন। যেভাবে অন্যান্য সকল নবী রসূল ও ঈমানদাররা আল্লাহর কাছে শিকায়েত করেছেন, সেইভাবে তিনিও আল্লাহর দরবারে নালিশ করেছেন। আল্লাহতায়ালা তার ভাংগা হৃদয়ের কথা এখানে উদ্ধৃত করছেন, ‘সে বললাে, হে আমার মালিক, অবশ্যই আমি আমার জাতিকে রাত দিন ধরে ডেকেছি। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার ডাক তাদের জন্যে আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি। আমি যতবার তাদেরকে তােমার ক্ষমা লাভ করার জন্যে ডেকেছি, ততবারই তারা কানে আংগুল দিয়েছে, তাদের কাপড় দ্বারা নিজেদেরকে ঢেকে ফেলেছে, জিদ করেছে এবং ভীষণ অহংকার করেছে। তারপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যভাবে ডেকেছি, কখনও ঘােষণা দিয়ে ডেকেছি, আবার কখনও সংগােপনে বুঝিয়েছি, বলেছি তােমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাে, নিশ্চয়ই তিনি মাফ করবেন, এ কি হলাে তােমাদের, আল্লাহর প্রতি তােমরা একটুও শ্রদ্ধাবােধ করো না? আল্লাহ তায়ালা যমীন থেকে বিভিন্ন প্রকারের শাক-সজি উৎপন্ন করেছেন, তারপর তার মধ্যেই তােমাদেরকে পুনরায় ফিরিয়ে নেবেন এবং পরবর্তীতে তােমাদেরকে সেখান থেকে সম্পূর্ণভাবে বের করবেন। আবার বলছি, তোমাদের জন্যে যমীনকে তিনি বিছানার মত করে বানিয়েছেন যাতে করে তার গিরিপথগুলােকে তােমরা তােমাদের চলার পথ হিসেবে ব্যবহার করতে পারাে।’ এই হচ্ছে সেইসব জিনিস যা নূহ(আ.) তাদের সামনে পেশ করেছেন। অবশেষে তিনি তার রবের কাছে তার আরজী দাখিল করলেন এবং দীর্ঘকালের দাওয়াতী কাজ শেষে তাঁর কাজের হিসাব পেশ করলেন। এমনভাবে তিনি তার অবিরাম ও অসমাপ্ত কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন যা কোনােদিন থেমে যায়নি, ‘আমার আহ্বান তাদের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি।’ এই পালানাে ছিলাে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী নবী থেকে। আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী থেকে পালানাে প্রকারান্তরে আল্লাহ তায়ালা থেকে পালানােকেই বুঝায় । এই নবী ছিলেন সকল সৃষ্টি ও সকল জীবন্ত জিনিস এর মূল প্রকাশক, সকল নেয়ামত ও আরাম-আয়েশের সন্ধানদাতা তিনি, সকল হেদায়াত ও সকল আঁধারের আলাে দানকারীও তিনি। তিনি তাঁর এই পরিশ্রমের বিনিময়ে কোনাে প্রতিদান চাননি, তার কথা শোনানাের জন্যে কোনাে মজুরী, পথ প্রদর্শনের জন্যে কারাে কাছ থেকে কোনাে ট্যাক্সের দাবীও করেননি। তাঁর থেকে পালানাের অর্থ হচ্ছে এমন ব্যক্তি থেকে পালানাে যিনি আল্লাহর দিকে ডাকছেন যাতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদের গুনাহ খাতা মাফ করে দেন। তারপরও যখন পালানাে সম্ভব হলাে না, কারণ দাওয়াত দানকারী তাদেরকে সর্বদাই সম্বােধন করতে থেকেছেন, তাদের কানে দাওয়াত পৌছানাের জন্যে নূহ(আ.) সকল সুযােগ গ্রহণ করেছেন। যদিও তারা তার কণ্ঠস্বর শুনতে পছন্দ করেনি, যদিও তারা তার দিকে তাকাতেও চায়নি! তারা জিদ ধরে গােমরাহীর মধ্যে পড়ে থেকেছে এবং সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থার আওয়ায ও দাওয়াত কবুল করার ব্যাপারে অহংকার প্রদর্শন করতে থেকেছে। তার কথার উদ্ধৃতি পেশ করতে গিয়েই আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আর আমি যতবারই তাদেরকে তুমি ক্ষমা করবে বলে ডেকেছি ততবারই তারা তাদের কানে আংগুল দিয়েছে, তাদের কাপড় দিয়ে তারা নিজেদেরকে ঢেকে ফেলেছে, তারা হঠকারিতা করেছে এবং চরম অহংকার প্রদর্শন করেছে।’ একথার দ্বারা পরোক্ষভাবে এটাও বুঝায় যে, যে কোনাে প্রকার বিরতি না দিয়ে তাদের কাছে দাওয়াত পৌছানাের কাজ নূহ(আ.) নিরন্তর গতিতে চালিয়ে গেছেন। অপরদিকে গােমরাহীর ওপর হঠকারিতার সাথে টিকে থাকার অর্থ হচ্ছে অহংকারী ও জেদী এবং অবুঝ বাচ্চাদের মতাে কোনো কিছুর ওপর আড় হয়ে বসে থাকা। কানে আংগুল দেয়া এবং কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়ার অর্থ দাঁড়ায় চরম উচ্ছৃংখল ও বাচাল ছেলে মেয়েদের মতাে বিরােধী হয়ে যাওয়া। তাঁর ভাষায় তারা তাদের কানে আংগুল দিলাে। এখানে আংগুলগুলাের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সব আংগুল তাে আর কানে একত্রে দেয়া যায় না। সুতরাং এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে তাদের আংগুলের পাশগুলাে দিয়ে তারা কান বন্ধ করে দিতাে। অর্থাৎ অত্যন্ত কঠিনভাবে তারা তাদের কানগুলাে বন্ধ করে দিতাে যাতে কোনাে কথাই কানে প্রবেশ করতে না পারে । জেদী ও হঠকারী বাচ্চাদের মতাে ছিলাে তাদের এই বিরােধিতা। দাওয়াত দিতে থাকার সাথে কোনাে সময়ই বিরতি না দেয়ার অর্থ দাঁড়ায় সকল বিরােধী শক্তির মােকাবেলায় তিনি অবিরত কর্মতৎপর থেকেছেন এটা বুঝানাে। দাওয়াত-দানের যতপ্রকার পদ্ধতি হতে পারে কোনােটাই তিনি বাদ দেননি। কখনও প্রকাশ্যে ডেকেছেন, কখনও বা পর্যায়ক্রমে ঘােষণা দিয়ে ডেকেছেন আবার কখনও ডেকেছেন গোপনে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর আমি তাদের ডেকেছি প্রকাশ্যে, কখনও ঘােষণা দিয়ে বলেছি, আবার গােপনেও তাদের কাছে কথা পেশ করেছি।’
ফী জিলালিল কুরআন: *মুসলিমদের জন্যে সুসংবাদ : এইভাবে কাজ করার সকল পর্যায়েই নূহ (আ.) তাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ ও আখেরাতের সাফল্যের আশ্বাস দান করেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন তাদেরকে ক্ষমাপ্রাপ্তির সম্ভাবনার। যখনই তারা পরওয়ারদেগারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হবে, আল্লাহ তায়ালাকে তখনই তারা পাবে তাদের সকল গুনাহর ক্ষমাকারী হিসেবে। হযরত নূহ(আ.)-এর কথার উদ্ধৃতি, তখন আমি বললাম, তােমরা তােমাদের রব-এর কাছে ক্ষমা চাও, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তাদেরকে নুহ(আ.) আরও আশ্বাস দিয়েছেন, তারা যদি গােমরাহীর পথ ত্যাগ করে তার আহ্বানে সাড়া দেয় তাহলে সর্বপ্রকার জীবন ধারণ সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে তাদেরকে দেয়া হবে, তাদের জানা ও আকাঙ্খিত সকল উপায় উপকরণকে তাদের জন্যে সহজলভ্য করে দেয়া হবে; আর তা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত, যার দ্বারা নানা প্রকার ফসল উৎপন্ন হবে এবং নদ-নদী প্রবাহিত হয়ে তাদেরকে স্বচ্ছলতা ও স্বস্তি দান করে। আরাে তাদেরকে ওয়াদা দেয়া হয়েছিলাে যে, তাদেরকে সন্তান-সন্ততি ও ধন-দৌলত পর্যাপ্ত পরিমাণে দান করা হবে। ক্ষমা ও এসব রিযিকের মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে আল্লাহ তায়ালা জানিয়েছেন। কোরআনে করীমের বহুস্থানে সত্য সুন্দর হৃদয় ও হেদায়াতের পথে মযবুত হয়ে টিকে থাকার মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ বিদ্যমান রয়েছে, সম্পর্ক রয়েছে জীবন ধারণের বিভিন্ন সামগ্রীর সহজলভ্য হওয়ার সাথে এই এবাদাতেরও। এক জায়গায় কাথাটা এইভাবে এসেছে, ‘যদি সেই এলাকবাসী ঈমান আনতো এবং তাকওয়া পরহেযগারীর জীবন যাপন করতো তাহলে আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী থেকে বহু বরকত (অযাচিত দান) এর দরজা তাদের জন্যে খুলে দিতাম। কিন্তু তারা অস্বীকার করলাে। যার কারণে আমি তাদের কৃতকর্মের ফল হিসেবে তাদেরকে পাকড়াও করলাম।’ অন্য এক স্থানে এসেছে, ‘যদি আহলে কিতাবের লােকেরা ঈমান আনতো এবং ভয় করে চলতাে, তাহলে তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আমি মুছে দিতাম এবং তাদেরকে নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করতাম। আর যদি তারা তাওরাত, ইনজিল এবং তাদের রব-এর কাছ থেকে অবতীর্ণ অন্যসব কিছুর ওপর কায়েম থাকতাে তাহলে তারা তাদের ওপর থেকে বর্ষিত এবং নীচে থেকে উদ্গত জিনিস থেকে খাবার গ্রহণ করতো।’ অন্য আর এক স্থানে এসেছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারাে দাসত্ব করাে না। অবশ্যই আমি তােমাদের জন্যে সতর্ককারী এবং সুসংবাদদাতা। তােমাদের পরােয়ারদেগারের কাছে তােমরা ক্ষমা চাও এবং তার কাছে তাওবা করাে। তাহলে তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তােমাদের সুন্দর ভােগ-বিলাসের বস্তু দান করবেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার সমমানের মর্যাদা দান করবেন।’ এই মূলনীতিটি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনের বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। সেই সঠিক মূলনীতিটি হচ্ছে, আল্লাহর ওয়াদা কিন্তু শর্তবিহীন নয়। আর জীবনের নিয়মসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ নিয়ম হচ্ছে মানুষের বাস্তব কর্মকান্ডের কারণেই পুরস্কার বা শাস্তি পেয়েছে। বিভিন্ন জাতির অভিশপ্ত ব্যক্তিরা কিসের কারণে অভিশপ্ত হলাে? অথচ যারা অভিশপ্ত হয়েছে তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শরীয়ত (চলার পথ) দেয়া হয়েছে, কিন্তু তারা তা অমান্য করেছে। আর যেসব ব্যক্তি আল্লাহর প্রদত্ত-সঠিক পথ বেছে নিয়েছে, ভালাে কাজ করেছে। আল্লাহকে ভয় করে চলার নির্দেশ পেয়ে যারা তাওবা-ইস্তেগফার করেছে তাদের পথ ভিন্ন। যারা আল্লাহকে ভয় করে চলেছে, সঠিকভাবে তার আনুগত্য করে চলেছে, আল্লাহর শরীয়তকে চালু করতে গিয়ে গােটা মানবমন্ডলীর জন্যে সুবিচার ও নিরাপত্তার বিধান চালু করেছে, তাদের ওপর আল্লাহর রহমতের বারিধারা অবিরাম ধারায় বর্ষিত হয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করেছেন এবং তাদেরকে তার পৃথিবীতে নতুন কিছু গড়ে তােলার ব্যাপারে, তার প্রতিনিধিত্বের সম্মান দান করেছেন। অবশ্য অনেক জায়গায়ই আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, বহু জাতি ও জনপদ এমন আছে যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে চলছে না এবং আল্লাহর বিধানকেও চালু করছে না, তবুও তাদের ওপর প্রাচুর্যের প্রবাহ চলছে, পৃথিবীতে তারা ক্ষমতাও দখল করে রেখেছে। এগুলাে আসলেই একপ্রকার পরীক্ষা। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘আমি তােমাদেরকে দুরবস্থা ও স্বচ্ছলতা দান করে পরীক্ষা করবাে।’ তারপর ধীরে ধীরে তাদের ওপর অবনতি নেমে আসবে। সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের সহ অবস্থান এবং নৈতিক অবক্ষয় তাদেরকে এমন মুসীবতে ফেলে দেবে যা তাদেরকে ধ্বংসের। অতলে নিক্ষেপ করবে। তারা যুলুম ও বিদ্রোহাত্মক কাজ দ্বারা মানুষের মর্যাদাকে খতম করে দেবে। আজ আমাদের সামনে দুটি বড়াে শক্তি রয়েছে যারা অর্থ সম্পদে বলীয়ান এবং তারা পৃথিবীর বিরাট বিরাট দুটি এলাকা জুড়ে ক্ষমতার মসনদেও সমাসীন। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং অপরটি সামজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এদের মধ্যে প্রথমটির নেতা হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যারা নৈতিক অবক্ষয়ের এমন পর্যায়ে এসেছে সর্বপ্রকার হিংস্র জীবজস্তুকেও তারা এখন হার মানিয়েছে এবং জীবন সম্পর্কে তাদের ধ্যান-ধারণা এখন ডলার দিয়েই পরিমাপ করা হয়। দ্বিতীয় হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের নেতা রাশিয়া, এরা মানুষকে দাসত্বের স্তর থেকেও নীচে নামিয়ে দিয়েছে এবং ঘরে ঘরে একের বিরুদ্ধে অপরকে গােয়েন্দা বানিয়ে দিয়েছে, প্রতি মুহূর্তে মানুষের মনে ভয় বিরাজ করছে যেন সে কসাইখানার দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেক মানুষই ভাবতাে যে সকালে তার কাঁধে মাথা থাকবে না। এটা কোনাে মনুষত্বের মর্যাদা সম্পন্ন অবস্থা নয়। ধীরে ধীরে মানুষ সেখানে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে এগিয়ে চলেছে। [এ তাফসীর যখন প্রকাশিত হয় তখন সােভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্যমনি ছিল তার মধ্যাকাশে। কিন্তু ১৯৯১ সালের দিকে এসে তাদের মধ্যে ভাংগন শুরু হয় এবং এক বছরের মধ্যেই রাশিয়ার মূল ভুখন্ডটি বাদে বাকী প্রায় সবগুলাে অংগরাজ্যই স্বাধীনতা ঘােষণা করে। যে সমাজাতন্ত্র পৃথিবীর তিনভাগের দুই ভাগ এলাকার ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল তা তাসের ঘরের মতাে ধুলিশ্বাৎ হয়ে গেল। আজ এ বিভীষিকা থেকে মানুষ মুক্ত। সেখানে আল্লাহর দ্বীনের ঝান্ডা বুলন্দ হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং সেদিনও হয়তাে দূরে নয় যেদিন আল্লাহর প্রভুত্ব সেখানে কায়েম হবে এবং মানুষ মানুষের গােলামী থেকে নাজাত পাবে -সম্পাদক]।
ফী জিলালিল কুরআন: আসুন এবারে আমরা নূহ(আ.)-এর সাথে তার দীর্ঘকালের মহান জিহাদের সাথে শরীকদার হয়ে এগিয়ে যাই, দেখবাে তিনি তার জাতিকে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অবলােকন করাচ্ছেন তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই। সৃষ্টিজগতের মধ্যেও যে সকল নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এবং তাদের আশপাশের সব কিছুর মধ্যে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার যেসব নিদর্শন বিরাজ করছে সে দিকে তাদের দৃষ্টি এগিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বিম্বিত হচ্ছেন তাদের ঔদ্ধত্য দেখে, বােকামীপূর্ণ উক্তি শুনে। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছেন আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কী নিদারুণ ও কঠিন বেয়াদবী তারা করে চলেছে! এ বােকামীপূর্ণ ব্যবহার তাদের নিজেদের কাছেও ভালাে লাগছে না। তাই তাদের বাবাকে আকর্ষণ করার জন্যে বলা হচ্ছে, ‘কি হলো তােমাদের, তােমরা আল্লাহর কোনাে সম্মান আছে বলেও মনে করাে না? অথচ তিনি তােমাদেরকে কতাে সুন্দর সুন্দর আকৃতি ও কতাে বিভিন্ন পর্যায়ের অবস্থা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।’ বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্টি করার কথা যে যামানায় বলা হয়েছে তখনকার মানুষরা অবশ্যই তা বুঝতো, বুঝতাে বলেই তো এতসব রহস্যপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। এই জ্ঞানগর্ভ ও সূক্ষ্ম কথা তাদের সামনে তুলে ধরাতে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যাচ্ছিলাে যে, তারা নূহ(আ.)-এর কথায় কান দেবে, তিনি যে দাওয়াত দিচ্ছেন তার যৌক্তিকতা বুঝার চেষ্টা করবে। ‘আতওয়ার’ শব্দটির অর্থ বুঝতে গিয়ে অধিকাংশ মুফাসসির এই ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে শুক্রবিন্দু থেকে রক্তপিন্ড এবং রক্তপিন্ড থেকে মাংসপিন্ড গঠন হয়, তারপর পূর্ণাংগ আকৃতি দিয়ে মাতৃগর্ভে মানবশিশুকে গড়ে তােলা হয়। এ কথাগুলাে তাদের সামনে যখন পেশ করা হচ্ছিলাে তখন তাদের পক্ষে এর সত্যতা গ্রহণ করা স্বাভাবিক ছিলাে যেহেতু পূর্নাংগ আকৃতি লাভ করার পূর্বেই যে সকল ভ্রুণ-এর পতন ঘটে, সেগুলাে দেখে নূহ(আ.)-এর কথার সত্যতা তাদের বুঝার জন্যে সহজ ছিলাে। মানব আকৃতি ধারণ করার পূর্বে ভ্রুণে বিভিন্ন রূপ নেয়, সেগুলাে দেখে তখন বুঝাই যায় না অবশেষে কি পয়দা হবে। ভ্রুণগুলাে যখন পানি, পােকা, ব্যংগাচির মতাে আকৃতি ধারণ করে তখন কার পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব যে অবশেষে সে এমন সুন্দর এক মানব শিশুতে পরিণত হবে? এ সব কিছু নূহ(আ.)-এর উদ্ধৃত আল্লাহর কথার সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য বহন করছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর তাকে অপর আর একটি সৃষ্টির রূপ দিয়েছি, কতাে বরকতময় আল্লাহ তায়ালা, কতাে চমৎকার ও সুন্দরতম সৃষ্টিকর্তা তিনি।’ এই আয়াতটির সাথে ইতিপূর্বে যে আয়াতটি বলা হয়েছে তার আরও অনেক তাৎপর্য হতে পারে, যেগুলাে এখনও আমাদের জ্ঞান-গবেষণায় ধরা পড়েনি। আর কোনো আয়াতের তাৎপর্য আমরা চূড়ান্তভাবে বুঝেছি, এর বাইরে এ আয়াতের অন্য কোনাে অর্থই হতে পারে না-এ দাবীও আমরা করতে পারি না। নূহ(আ.) মানুষের নিজেদের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করার জন্যে তাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন, তাদেরকেও আল্লাহ তায়ালা এ একইভাবে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রমের পর বর্তমান পর্যায়ে এনেছেন; একথাগুলাে তাদের কাছে অপ্রিয় হলেও তা এক অমােঘ সত্য। তারপরও সেই মহান স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা দিতে তারা নারাজ। এটা কোনাে সৃষ্ট জীব-এর জন্যে বড়ই লজ্জাকর বৈ কি?
সুরা: নূহ
আয়াত নং :-১৬
وَّ جَعَلَ الْقَمَرَ فِیْهِنَّ نُوْرًا وَّ جَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا
ওগুলোর মধ্যে চাঁদকে আলো এবং সূর্যকে প্রদীপ হিসেবে স্থাপন করেছেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
*সৃষ্টি দেখে স্রষ্টাকে চেনা : এইভাবে এই উন্মুক্ত আকাশ ও পৃথিবী নামক মহাগ্রন্থের দিকে দৃষ্টিপাত করার জন্যে নূহ(আ.) তাদেরকে আবারও আহ্বান জানাচ্ছেন; এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমরা কি দেখনি কি চমৎকারভাবে তিনি সাতটি আকাশকে পরস্পর সম্পৃক্ত করে সৃষ্টি করেছেন, বানিয়েছেন স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময় চাঁদকে, আরও বানিয়েছেন আলাে দানকারী সূর্যকে?’ প্রকৃতির এই বস্তুসমূহের ওপর আজ পর্যন্ত যত জান গবেষণা চালানাে হয়ে থাকুক না কেন, আর জ্যোতির্বিদ্যা যতই উৎকর্ষতা লাভ করুক না কেন, সাতটি আসমান বলতে আল্লাহ তায়ালা কি বুঝাতে চেয়েছেন তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। এ ব্যাপারে কারাে আন্দাজ অনুমান বা গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কোনাে অবস্থায় চূড়ান্তও মনে করা যাবে না। মহাশূন্যের বুকে এগুলাে সবই তাত্ত্বিক ও অনুমানভিত্তিক জিনিস। নূহ(আ.) তাঁর জাতিকে আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাদেরকে সেইভাবেই এই তত্ত্বগুলাে জানিয়েছেন যেভাবে আল্লাহতায়ালা তাকে শিখিয়েছেন। এগুলাে একটি আর একটি সদৃশ সাতটি তালা বা সাতটি স্তরে সজ্জিত আসমান। এগুলাের মধ্যেই স্নিগ্ধ বাতিরূপে রয়েছে চাঁদ আর রয়েছে মহাজ্যোতির্ময় আলােৰ্তিকারূপে দেদীপ্যমান একটি সূর্য। ওরা চাঁদ সূর্য উদয়ের তেমন করেই দেখছে-যেমন করে দেখছে আসমান নামক জিনিসটিকে। কিন্তু আসমান নামক সে বস্তুটিও সুদূর নীলাভ মহাশূন্যতা বৈ আর কিছুই নয়, তাহলে যে আসমানের কথা বলা হচ্ছে সেটা কি? ওদের কাছে এর জওয়াব পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি আজ পর্যন্ত এর জওয়াব অন্য কেউই দিতে পারেনি। তাদেরকে সেই নীল আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেরানাের কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে চারিদিকে যা কিছু আছে সেই দিকে তাকিয়ে তারা দেখুক এবং চিন্তা করুক এগুলাে আসলে কি? একটু চিন্তা করা দরকার-কিভাবে এগুলাে পয়দা হলাে, কিভাবে এগুলাে চলছে এবং কার। ইচ্ছানুযায়ী সব কিছুর মধ্যে এক বিস্ময়কর সামঞ্জস্য বিরাজ করছে। এ সকল বিষয় থেকে তিনি তার জাতির দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর অন্যান্য জিনিসের দিকে। তিনি তাদের দেখাচ্ছেন যে, সব কিছু এই পৃথিবী থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এবং এই পৃথিবীর মধ্যেই মৃত্যুর পরে সব কিছুকে ফিরে যেতে হবে। আবার একদিন আসবে যখন এই পৃথিবী থেকেই তাদের সবাইকে উঠে আসতে হবে।
সুরা: নূহ
আয়াত নং :-১৮
ثُمَّ یُعِیْدُكُمْ فِیْهَا وَ یُخْرِجُكُمْ اِخْرَاجًا
আবার এ মাটির মধ্যে তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন এবং অকস্মাৎ এ মাটি থেকেই তোমাদের বের করে আনবেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
*মানব সৃষ্টির কিছু বিস্ময়কর তথ্য : এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা (ঠিক গাছপালার মতােই) তােমাদেরকে পৃথিবী থেকে উৎপন্ন করেছেন, তারপর এর মধ্যেই তােমাদেরকে ফিরিয়ে দিবেন এবং একদিন আসবে যখন সবাইকে তিনি এর মধ্য থেকেই বের করে আনবেন।’ মানুষকে গাছপালার মতাে পৃথিবী থেকে পয়দা করার ব্যখ্যা আসলেই বড়াে বিস্ময়কর। বিভিন্নভাবে কোরআনে করীমে একথাগুলাের বিবরণ এসেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘পবিত্র সে শহর, যা তার রব-এর অনুমতিক্রমে তার উৎপন্ন দ্রব্যসমূহ বের করে, আর যেটা নষ্ট হয়ে যায় তা অপ্রীতিকর জিনিস ছাড়া আর কিছুই হয় না।’ এখানে শাকসবজির মতােই মানুষ উৎপন্ন হওয়ার দিকে ইংগীত করা হয়েছে। কোরআনের আরও কিছু স্থানেও শাকসবজির মতাে মানুষ উৎপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সূরায়ে ‘হজ্জ’ এ একটি আয়াতের মধ্যে দুটি জিনিসের বর্ণনা একত্রে এসেছে, যার মধ্যে পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে প্রামাণ্য দলীল পেশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোরআন বলছে, ‘হে মানুষরা, পুনরুথান সম্পর্কে যদি তােমরা কোনাে সন্দেহের মধ্যে থেকে থাকে তাহলে জেনে রাখাে, আমি তােমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে, এর পর রক্ত-পিন্ড থেকে, তারপর আকৃতি সম্পন্ন ও আকৃতিবিহীন মাংসপিন্ড থেকে, যাতে করে আমি তােমাদেরকে (তোমাদের সৃষ্টির রহস্য) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে পারি। তারপর যাকে ইচ্ছা তাকে আমি জরায়ুর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টিকিয়ে রাখি; এরপর তােমাদেরকে শিশু-আকারে বের করে নিয়ে আসি। তারপর এমনভাবে তােমাদের লালন পালনের ব্যবস্থা করি যে, তােমরা শক্তিসম্পন্ন হয়ে যাও, আবার তােমাদের মধ্যে এমনও কেউ আছে তাকে এই যুবক বয়সেই মৃত্যু দান করা হয়, আবার কেউ আছে যাকে দুর্বলতার বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা হয়, যখন তারা ভুলে যায় জ্ঞান বিজ্ঞানের বহু জিনিস যা যুবক বয়সে তারা শিখেছিলাে। আবার খেয়াল করে দেখাে, পৃথিবীকে তােমরা স্থির দেখছে, কিন্তু যখন আমি এর ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন এই স্থির পৃথিবী নড়ে চড়ে উঠে, ভিজে যায় এবং তা বিভিন্নরকমের মনােরম ও মনোমুগ্ধকর গাছপালা উৎপন্ন করে।’ সূরায়ে ‘মােমেনূন’-এ যে কথা বলা হয়েছে তাতে ভ্রুণ এর প্রবৃদ্ধির পর্যায়গুলাের আলাচনা ঠিক সূরায়ে ‘হজ্জ’ এর অনুরূপই এসেছে। এরপর বলা হয়েছে, ‘আমি তােমাদের জন্যে খেজুর ও আংগুরের বাগ-বাগিচা তৈরী করেছি।’ কোরআনের আরও বহুস্থানে এ ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। এ সব কিছু এতাে পরিস্কার যে এগুলাে বুঝতে কারােই অসুবিধা হয় না। শুধু চাই সদিচ্ছা নিয়ে ভালাে করে তার প্রতি খেয়াল করে দেখা, একবার ভালাে করে দেখলেই সকল সন্দেহ ঘুচে যাবে। সৃষ্টির সব কিছু একটি কথারই সাক্ষ্য বহন করছে যে, পৃথিবীর বুকে যা কিছু আছে তা একই নিয়মে চলছে এবং অবশ্যই এসব কিছুর স্রষ্টা হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। পৃথিবীর অন্যান্য সকল সৃষ্টির ন্যায় মানুষের সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধি সব কিছুই এই পৃথিবী থেকেই হচ্ছে; যা কিছু মানুষ খায় তার থেকে যেমন তার অস্তিত্ব টিকে আছে, তেমনি তার শরীরে উৎপন্ন যে বীজ দিয়ে তাও মানুষ তৈরীর সূচনা হয় তাও পার্থিব বিভিন্ন উপাদান থেকে গঠিত হয়। মায়ের বুকে যে দুধ আসে এই পৃথিবীর উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্য উপাদান থেকেই গঠিত; সুতরাং একথা স্পষ্ট যে শাকসবজি ও গাছপালার মতাে মানুষও পৃথিবী থেকেই সৃষ্ট। এই মাটির বুক থেকে সবাই তাদের খাদ্য পায়। এমনি করেই মােমেনের মধ্যে ঈমান সৃষ্টি হয়। ঈমান একটি কাল্পনিক অবস্থা যা ধরে দেখানাে যায় না। তবে অন্তরে ঈমান থাকলে বাস্তব কাজ ও ব্যবহারের মাধ্যমে তার বহিপ্রকাশ ঘটে। এবং পৃথিবীর জীব ও নির্জীব জিনিস এর ব্যবহারের সাথে ঈমানের সম্পর্ক টের পাওয়া যায়। এ এমন এক কাল্পনিক বস্তু যার মাধ্যমে বুঝ শক্তিরও প্রকাশ ঘটে। এর কারণ হচ্ছে একটি জীবন্তু সত্তা অর্থাৎ মানুষের বিবেকের মধ্যেই থাকে ঈমানের অবস্থান। আর কোরআনকে সঠিকভাবে হৃদয়ংগম করার জন্যে এই ঈমানই হচ্ছে একমাত্র অপরিহার্য গুণ। মাটি থেকে সৃষ্ট মানুষ সেই মাটিতেই ফিরে যাবে। আল্লাহ তায়ালা মাটি থেকেই তাদের একবার বের করেছিলেন সেই মাটির মধ্যেই তাকে ফিরিয়ে নেবেন। তার দেহের ভগ্নাবশেষ এক সময় মাটির সাথেই মিশে যাবে। তাদের শরীরের অণু পরমাণুও মাটির অণু পরমাণুর সাথে মিশে একাকার হয়ে যাবে, যেমন করে সে মানুষ পয়দা হওয়ার পূর্বে এগুলাে মাটির সাথেই মিশেছিলাে। তারপর একদিন আসবে যখন সেই মহান সত্তা সেই মাটি থেকেই তাকে আবার বের করবেন-ঠিক সেখান থেকে তিনি তাদেরকে প্রথমবার বের করেছিলেন। এটা একটা সহজ ব্যাপার যা বুঝার জন্যে এক মুহূর্তও বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। মানুষ যখন কোরআনের বর্ণনা অনুসারে বুঝার চেষ্টা করে তখন তা বুঝা তার জন্যে খুবই সহজ হয়ে যায়। এই পরম সত্যের দিকেই মূসা(আ.) তার জাতির মনােযােগ আকর্ষণ করছেন যাতে করে তারা আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার কথা অন্তরে অনুভব করে, অনুভব করতে পারে তাঁর কথা-যিনি তাদেরকে এই মাটি থেকে পয়দা করেছেন, তিনি সেই যমীনের মধ্যেই তাদেরকে পুনরায় ফিরিয়ে দেবেন। তারপর আর একবার সেই যমীন থেকে বের করবেন ও হিসাব গ্রহণ করার জন্যে সেই মহা বিচার দিনে তাদের একত্রিত করবেন। এ ঘটনা অতি সহজভাবেই সংঘটিত হবে এবং সারা পৃথিবীব্যাপী এই পুনরুত্থান কাজটি একত্রে সংঘটিত হবে। মানুষের প্রশস্ত বুঝশক্তি দ্বারা এই ব্যাপারটা বুঝা মােটেই কঠিন নয়। কোনাে প্রশস্ত হৃদয়ের লােক এ বিষয়ে কোনাে বিতর্ক তােলে না।
সুরা: নূহ
আয়াত নং :-২০
لِّتَسْلُكُوْا مِنْهَا سُبُلًا فِجَاجًا۠
যেন তোমরা এর প্রশস্ত পথে চলতে পারো
ফী জিলালিল কুরআন:
*বিছানার মতাে আমাদের এই যমীন : পরিশেষে নূহ(আ.) তাঁর জাতির লােকদের অন্তরগুলােকে তাদের ওপর বর্ষিত আল্লাহর নেয়ামতের দিকে ফেরাতে আহবান জানাচ্ছেন। যে নেয়ামতের কারণে তিনি পৃথিবীতে তাদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছেন, এই যমীনকেও তাদের সফর করার উপযােগী বানিয়ে দিয়েছেন। তাদের জীবন যাপনের জন্যেও একস্থান থেকে অন্যস্থানে তাদের পণ্য দ্রব্য নিয়ে যাওয়ার জন্যে সর্বপ্রকার পথ তিনি বের করে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের জন্যে পৃথিবীকে (বিছানার মতাে) বানিয়েছেন, যাতে করে তোমরা তার গিরিপথ সমূহ থেকে যাতায়াতের পথ বের করে নিতে পারো।’ তাদের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও দৃষ্টির সম্মুখে এ সত্যটি অতি সহজেই ধরা পড়ে। নূহ(আ.)-এর আহ্বানকে উপেক্ষা করে এবং তাঁর সতর্কীকরণকে প্রত্যাখ্যান করে যেভাবে তারা তার থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাে কিন্তু এই যমীন থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে তারা কোনাে পথ পাবে না। কল্পনার চোখ দিয়ে দেখতে চাইলে তারা দেখতে পাবে এই যমীন সত্যিই তাদের জন্যে বিছানা এবং আরামদায়ক দোলনার মতাে সুখকর। এমনকি পাহাড় পর্বতগুলাের চড়াই-উত্রাই পার হয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়ার জন্যেও সেখানে তিনি বহু পথ বের করে দিয়েছেন, গিরিপথগুলাের মাধ্যমে সুউচ্চ পবর্তমালার অপর প্রান্তে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সমতল ভূমিতে সফর করা তাে এমনিই সহজ করেছেন। একইভাবে তারা আল্লাহর রহমত পাওয়ার উদ্দেশ্যে দুর্গমগিরি কান্তার মরু পার হয়ে বহু বহু দূরে চলে যায়। দূর দেশে বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে গিয়ে এর বিনিময়ে জীবন ধারণ সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে তারা আহরণ করে এবং বিভিন্নভাবে লাভবান হয়। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করা ছাড়াই চোখে দেখা এসকল সত্যকে তারা বাস্তবে অনুভব করতাে। আদিগন্ত বিস্তৃত এই গ্রন্থরাজি থেকে তারা এই পাঠ গ্রহণ করতাে যে, সবখানেই একজন নিয়ামক আছেন। যিনি সবার জীবনকে পৃথিবীর বুকে নিয়ন্ত্রিত করছেন এবং এর মধ্যে তাদের জীবনকে সবদিক থেকেই সহজ করে দিচ্ছেন। মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সত্যকে আরও ব্যাপকভাবে জানার নুতন নুতন পথ খুলে যাচ্ছে। নতুন দিগন্ত তাদের কাছে উন্মােচিত হয়ে চলেছে। এমনি করেই নূহ(আ.) তার দাওয়াতী জীবনের কঠিন পথে পাড়ি দিয়েছেন, তার জাতির বিবেকের কাছে সত্য পথের দিশা তুলে ধরার জন্যে বিভিন্ন কায়দায় এবং বিভিন্ন উপায়ে দীর্ঘকাল ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অতি সুন্দর সবর, ধৈর্য, অবিচলতা ও অত্যন্ত ভদ্রজনােচিত ব্যবহার দ্বারা তিনি সাড়ে নয়শত বছর ধরে তাদের মধ্যে কাজ করেছেন। সব কিছু ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি তার রব-এর কাছে ব্যথিত মন ও ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ফিরে এসেছেন। তিনিই আল্লাহ তায়ালা, তিনি সর্বজ্ঞ। তিনিই তাকে সেই হতভাগা জাতির কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি তার মালিকের কাছে বিগত বছরগুলাের কাজের হিসাব পেশ করছেন, তাঁর হৃদয় ভরা দুঃখের কথা জানাচ্ছেন। কি নিদারুণ তার কষ্টভরা বিবৃতি ও কি হৃদয় নিংড়ানাে তার কণ্ঠস্বর। এই বিবৃতি থেকেই আমরা সেই মহান নবীর সবর, প্রচেষ্টা এবং কষ্টকর সংগ্রামের কথা বুঝাতে পারি। আসলে আল্লাহর প্রেরিত রসূলদের মধ্যে তিনি হচ্ছেন একজন মর্যাদাবান রসূল। এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ যামানার ভ্রান্ত, গােমরাহ ও হঠকারী লােকদের কাছে সত্যের আহ্বান নিয়ে এসেছেন। নূহ(আ.)-এর এই সকল বিবরণের পর সেই কঠিন অবস্থাকে বুঝানাের মতাে দ্বিতীয় কোনাে ভাষা আর নেই।