Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৩/হে মু’মিনগণ!-৭৪ ও ৭৫) [*ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়:- *পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে। মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে:- *বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো :-] www.motaher21.net সূরা:৪৯-হুজরাত। পারা:২৬ ৯-১২ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৩/হে মু’মিনগণ!-৭৪ ও ৭৫)
[*ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়:-
*পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে। মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে:-
*বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৯-হুজরাত। পারা:২৬
৯-১২ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সূরা:৪৯-হুজরাত-৯
وَ اِنۡ طَآئِفَتٰنِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اقۡتَتَلُوۡا فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَہُمَا ۚ فَاِنۡۢ بَغَتۡ اِحۡدٰىہُمَا عَلَی الۡاُخۡرٰی فَقَاتِلُوا الَّتِیۡ تَبۡغِیۡ حَتّٰی تَفِیۡٓءَ اِلٰۤی اَمۡرِ اللّٰہِ ۚ فَاِنۡ فَآءَتۡ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَہُمَا بِالۡعَدۡلِ وَ اَقۡسِطُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ ﴿۹﴾
ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তারপরও যদি দু’টি দলের কোন একটি অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ করো। আল্লাহ‌ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।
সূরা:৪৯-হুজরাত-১০
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَ اَخَوَیۡکُمۡ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ﴿٪۱۰﴾
মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই ; কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।
সূরা:৪৯-হুজরাত-১১
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡہُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡہُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۱۱﴾
হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রূপ করো না। এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর গোনাহর কাজে প্রসিদ্ধি লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম।
সূরা:৪৯-হুজরাত-১২
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡہِ مَیۡتًا فَکَرِہۡتُمُوۡہُ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ تَوَّابٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۲﴾
হে ঈমানদারগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ‌ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।

আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসার নীতিমালা : দুটি মােমেন দল যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের মধ্যে আপােস করিয়ে দাও। এ হচ্ছে ইসলামী সমাজকে শত্রুতা ও ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করার বাস্তব বিধান। ফাসেকের খবরের সত্যাসত্য যাচাই এবং উত্তেজনাবশত ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ সংক্রান্ত বক্তব্যের পরই এ বিষয়টির আগমন ঘটলাে। বিভিন্ন রেওয়ায়াতের বক্তব্য অনুসারে এ আয়াত নাযিল হওয়ার পেছনে কোনা সুনির্দিষ্ট ঘটনা থাকুক, অথবা এ ধরনের পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্যে এ বিধি জারী হয়ে থাকুক-উভয় অবস্থাতেই মুসলিম জাতি এ আয়াতটিতে, রাষ্ট্র, সমাজ বা সংগঠনকে দলাদলি ও সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করার সুনিশ্চিত ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। অতপর সত্য, ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠায় এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর ভয় ও অনুগ্রহের আশা পােষণেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। মােমেনদের যে কোনাে দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার মতাে ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কোরআন নাযিল হওয়ার সময় দেখা দিয়ে থাকতে পারে অথবা কোরআন এর সম্ভাবনা আঁচ করে থাকতে পারে। আর দুই দলের এরূপ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সত্তেও তাদের উভয়ের একটি অপরটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হওয়া সত্তেও অথবা উভয় দলেরই কোনাে না কোনাে দিক দিয়ে বিদ্রোহী হওয়া সত্তেও তাদের উভয়ের মধ্যে ঈমান বহাল থাকা সম্ভব বলে কোরআন স্বীকার করে। এরূপ পরিস্থিতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের সাথে যারা জড়িত নয় সেই সাধারণ মুসলমানদের ওপর সে এই দায়িত্ব অর্পণ করে যে, তারা যেন সংঘর্ষে লিপ্ত দল দুটির বিবাদ মিটিয়ে দেয়। কিন্তু দুই পক্ষের এক পক্ষ যদি এই মীমাংসা না মানে ও হক পথে ফিরে আসতে রাযী না হয় অথবা উভয় পক্ষই সন্ধি বা মীমাংসা অগ্রাহ্য করে এবং বিবদমান বিষয়ে আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে, তাহলে অমান্যকারী উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করা মুসলমানদের কর্তব্য। যতক্ষণ তারা আল্লাহর বিধান মেনে নিতে সম্মত না হয়, ততক্ষণ এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এখানে আল্লাহর বিধান বলতে বুঝায় মুমিনদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদ ও যুদ্ধের কারণ ঘটিয়েছে সে বিষয়ে, আল্লাহর নির্দেশ ও ফয়সালা মেনে নেয়া। সংঘর্ষে লিপ্তরা যখন আল্লাহর ফয়সালা ও নির্দেশ মেনে নেবে, তখন মুসলমানদের কর্তব্য হবে সূক্ষ্ম ইনসাফের ভিত্তিতে স্থায়ী মীমাংসার ব্যবস্থা করা যাতে আল্লাহর আনুগত্য ও সন্তুষ্টি লাভ নিশ্চিত হয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। সংঘর্ষ বন্ধ করা ও স্থায়ী মীমাংসা করিয়ে দেয়ার এই আহবান জানানাে ও নির্দেশ দানের পর মুমিনের হৃদয়ে আবেগ ও উদ্দীপনা সঞ্চার, তাদের ভেতরকার অটুট বন্ধনকে পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর ভয় দ্বারা তাঁর যে রহমত লাভ করা যায় তার আশার সঞ্চার করা হয়েছে।

*মােমেনরা পরস্পর ভাই : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মােমেনরা তাে পরস্পরের ভাই ছাড়া আর কিছু নও। অতএব, তােমরা তােমাদের দুই (বিবদমান) ভাই-এর মধ্যে আপােস করিয়ে দাও, আর আল্লাহকে ভয় কর। তাহলে আশা করা যায় যে, তােমরা আল্লাহর রহমত পাবে।’ এই ভ্রাতৃত্বের অনিবার্য ফলশ্রুতি এই যে, পারস্পরিক মমত্ব সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক সহযােগিতা ও ঐক্য মুসলিম জাতি, সমাজ ও দলের মূল অবস্থা হিসাবে বিরাজ করবে। মতভেদ ও যুদ্ধ বিগ্রহ যদি ঘটেই, তবে তা ঘটবে ব্যতিক্রম ও দুর্ঘটনা হিসাবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে মূল অবস্থায় ফিরে যাওয়া অপরিহার্য কর্তব্য রূপে গণ্য হবে। মুসলিম ভাইদের মধ্যে যারা এতাে জেদী ও হটকারী হবে যে, কোনােক্রমেই আপােস মীমাংসা মেনে নিতে রাযী নয়, তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য মুসলমানদের যুদ্ধ করতে হবে যাতে তারা ঐক্য ও মীমাংসার পথে ফিরে আসে। যে কোনাে মূল্যে মূল অবস্থার এই ব্যত্যয় ও ব্যতিক্রমের অবসান ঘটাতেই হবে। এটি একটি অপরিহার্য কঠোর ব্যবস্থা হিসাবে গৃহীত হবে। এই বিধানের স্বাভাবিক দাবী এই যে, বিদ্রোহ ও সংঘাত অবসানের এই যুদ্ধে কোনাে পক্ষের আহত ব্যক্তিকে হত্যা করা যাবে না। বন্দীকে হত্যা করা যাবে না, যুদ্ধ ছেড়ে ও অস্ত্র ফেলে পলায়নরতদের পশ্চাদ্ধাবন করা যাবে না এবং বিদ্রোহীদের ধন সম্পদকে গনীমত হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। কেননা, তাদের সাথে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য তাদেরকে ধ্বংস করা নয়, বরং শুধু ঐক্য ও আপােসের পথে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত করা।  *মুসলমানদের একক নেতৃত্ব : মুসলিম জাতির মূলনীতি এই যে, পৃথিবীর সকল অঞ্চল জুড়ে একই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বিরাজ করবে এবং কোনাে একজন নেতা বা শাসকের প্রতি সমর্থন দিয়ে তাকে শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পর শাসন ক্ষমতার দ্বিতীয় দাবীদারকে হত্যা করা ওয়াজেব হবে। এই ব্যক্তি ও তার সাথীদেরকে বিদ্রোহী গণ্য করতে হবে এবং মূল নেতার ও শাসনের সেনাদলে যোগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা মুসলমানদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে। এই মূলনীতির আলােকেই হযরত আলী(রা.) উষ্ট্র যুদ্ধ ও সিফফীন যুদ্ধে বিদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী ও মর্যাদাশীল সাহাবী তাঁর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তবে ওসামা ইবনে যায়েদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর সহ কিছু সংখ্যক সাহাবী অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। এর কারণ এও হতে পারে যে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোন পক্ষ সত্যের ওপরে আছে, তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেননি এবং ঘটনাটাকে একটা ফিতনা বা পরীক্ষা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। ইমাম জাসসাসের মতানুসারে এর কারণ এও হতে পারে যে, তারা ভেবেছেন, হযরত আলী(রা.) নিজের জন্যে তার সংগী সাথীদেরকেই যথেষ্ট বলে মনে করেন। তাই তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত থাকাকে বৈধ মনে করেছেন। তবে প্রথমােক্ত মতটিই অগ্রগণ্য। কারণ, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর কর্তৃক এই যুদ্ধে অংশ না নেয়ার জন্যে পরবর্তীকালে অনুশােচনা প্রকাশ করা থেকে বুঝা যায় আগের মতটিই সঠিক। এই মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত আছে মেনে নিলেও কোরআনের এই বিধানের প্রয়ােগ সর্বাবস্থায় সম্ভব। এমনকি মুসলিম অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন ও বহু দূরে অবস্থিত বিভিন্ন দেশে একাধিক শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মতাে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেও কোরআনের এই বিধান প্রয়োগ করা সম্ভব। এ সব ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে যুদ্ধ করা মুসলমানদের কর্তব্য। অনুরূপভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, এমন দলগুলাে যখন পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করা সাধারণ মুসলমানদের কর্তব্য। এরূপ ক্ষেত্রে বিদ্রোহী তথা আপোস প্রচেষ্টা অমান্যকারী পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ তারা আল্লাহর হুকুম মানতে তথা আপােস মীমাংসা মানতে সম্মত না হয়। এভাবে কোরআনের এ বিধি সর্বাবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব। মীমাংসা করে দেয়া এবং মীমাংসা অমান্যকারী পক্ষের বিরুদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করা যতক্ষণ সে মীমাংসা মানতে সম্মত না হয় এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা এই পথে পরিচালিত সকল মানবীয় চেষ্টা সাধনার ওপর কালগত দিক দিয়ে অধিকারের দাবী রাখে। মানুষের সীমিত অভিজ্ঞতার পরিসরে তার পরিচালিত সকল চেষ্টা তৎপরতার মধ্যে এই ব্যবস্থাটা নিখুঁতও বটে। বিশেষত এই ব্যবস্থাটা পরিচ্ছন্নতা, বিশ্বস্ততা ও সর্বাত্মক ইনসাফের গুণে গুণান্বিত। কেননা, এখানে আল্লাহর বিধানের আলােকে মীমাংসার ওপর জোৱ দেয়া হয়েছে, যা সকল স্বার্থপরতা, প্রবৃত্তির লালসা ও ত্রুটি বিচ্যুতির উর্ধে। মানুষের সামনেই নিখুঁত ও নির্ভুল পথ থাকা সত্ত্বেও সে যখন মনগড়া পন্থায় সমস্যাবলীর সমাধান করতে চায় এখন তা হয় ক্রটিপূর্ণ ও ভ্রান্ত।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য : ‘হে মােমেনরা। কোনাে গােষ্ঠীর উচিত নয় অপর গােষ্ঠীকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা…’ কোরআনের পথনির্দেশিকা অনুসারে ইসলাম যে মহান সমাজ প্রতিষ্ঠা করে সে সমাজে একটা উন্নত মানের কৃষ্টি ও আচরণ-রীতি বিরাজ করে। সে সমাজে প্রতিটি ব্যক্তি এমন মর্যাদা ও অধিকার ভােগ করে যে অলংঘনীয়। ব্যক্তির সম্মান তার চোখে সমষ্টির সম্মানেরই অংশ এবং ব্যক্তির প্রতি কটাক্ষ ও অসদাচরণ সমষ্টির প্রতি অসদাচরণেরই অংশ। কেননা, সমাজ একটি অখন্ড একক এবং তার মর্যাদাও অখন্ড। কোরআন এখানে আবার সেই প্রিয় সম্বােধনটির পুনরাবৃত্তি করেছে, ‘হে মােমেনরা!’ অতপর তাদেরকে পরস্পরের প্রতি বিদ্রুপ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছে, চাই তা পুরুষ কিংবা স্ত্রী যেই হােক না কেন। কেননা, যাকে বিদ্রুপ করা হয় সে আল্লাহর দৃষ্টিতে বা মূল্যায়নে বিদ্রুপকারী বা বিদ্রুপকারিণীর চেয়ে ভালােও হয়ে যেতে পারে। এখানে পরােক্ষভাবে এ কথাই বলা হয়েছে যে, পুরুষ ও স্ত্রীলােকেরা নিজেদের মধ্যে যে সব জিনিসকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড মনে করে থাকে, সেগুলাে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপ করার প্রকৃত মানদন্ড নয়। শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপ করার আরো কিছু মানদন্ড থাকতে পারে, যা হয়তাে মানুষ জানে না, শুধু আল্লাহ তায়ালা জানেন এবং তা দিয়ে তাঁর বান্দাদেরকে মূল্যায়ন করে থাকেন। কখনাে ধনী পুরুষ দরিদ্র পুরুষকে, সবল পুরুষ দুর্বল পুরুষকে, সুঠাম ও সুদর্শন পুরুষ কুৎসিত পুরুষকে, মেধাবী, চতুর ও দক্ষ মানুষ অমেধাবী সাদাসিধে ও অদক্ষ মানুষকে, সন্তানধারী মানুষ নিসন্তান মানুষকে এবং যার পিতামাতা আছে সে পিতৃমাতৃহীনকে উপহাস করে থাকে। আবার সুন্দরী রমণী কুশ্রী রমণীকে, যুবতী বৃদ্ধাকে, সর্বাঙ্গ সুগঠিত নারী বিকলাংগ নারীকে এবং ধনী নারী দরিদ্র নারীকে ব্যংগ-বিদ্রুপ করে থাকে। কিন্তু এসব উপকরণ পার্থিব উপকরণ মাত্র-মানদন্ড নয়। এ সব উপকরণ ছাড়াই আল্লাহর মানদন্ডে মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে।   *হিংসা অপবাদ বিদ্বেষ সম্পর্কিত হুঁশিয়ারী : কিন্তু কোরআন শুধু এই পরােক্ষ উক্তি করেই ক্ষান্ত থাকেনি; বরং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আবেগ জাগিয়ে তুলেছে এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, যাদেরকে দোষারােপ করা হয়, তারা আসলে আপন লােক। তাদেরকে দোষারােপ করলে নিজেদেরকেই দোষারােপ করা হয়। তাই কোরআন বলছে, ‘তােমরা নিজেদেরকে দোষারােপ করাে না।’ ‘লাম’ শব্দটার অর্থ দোষ। তবে এ শব্দটি থেকে এমন একটি ধ্বনি ঝংকৃত হয় এবং অন্তরে তা এমন রেখাপাত করে যে, একে একটা অনুভবযোগ্য আবর্জনা বলে মনে হয়, সূক্ষ্ম ও মানসিক দোষ বলে মনে হয় না। মানুষকে রকমারি ঘৃণ্য উপাধিতে ভূষিত করার মাধ্যমে তাকে বিদ্রুপ, উপহাস ও দোষারােপ করা হয়ে থাকে। এটা প্রত্যেক মুসলমানের ন্যায্য অধিকার যে, সে অন্য কোনাে মুসলমানের পক্ষ থেকে এমন কোনাে উপাধি লাভ করবে না যা সে অপছন্দ করে এবং যা দ্বারা তার ওপর কোনাে কলংক আরােপ করা হয়। আর প্রত্যেক মােমেনের এটা কর্তব্য ও আদবের অন্তর্ভুক্ত যে, তার দ্বীনী ভাইকে সে এধরনের উপাধি দ্বারা সম্বােধন করার মাধ্যমে লাঞ্ছিত করবে না। রসূল(স.) জাহেলিয়াত যুগের এমন বহু নাম ও উপাধি পাল্টে দিয়েছিলেন, যাকে তার সংবেদনশীল অনুভূতি ও মহানুভব হৃদয় দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তা উক্ত নাম বা উপাধির অধিকারীর ওপর কলংক লেপন বা দোষারােপ করে। আল্লাহর চোখে শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃত মানদন্ড কী, সে সম্পর্কে পরােক্ষভাবে ধারণা দেয়ার পর এবং ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জাগিয়ে দেয়ার পর আয়াতটি ঈমানের প্রকৃত মর্মার্থ বিশ্লেষণ করছে এবং মােমেনদেরকে এই শুণটি অর্থাৎ ঈমানের গুনটি হারানাে ও তা থেকে বিপদগামী হয়ে মানুষকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, দোষারােপ করা ও বিকৃত উপাধি দ্বারা সম্বােধন করা থেকে বিরত থাকার জন্যে সতর্ক করে দিচ্ছে। বলছে, ‘ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা খুবই গর্হিত কাজ। মন্দ নামে ডাকা তথা নাম বিকৃত করে খারাপ উপাধি দিয়ে সম্বোধন করা ইসলামকে পরিত্যাগ করার পর্যায়ভুক্ত। অতপর একে যুলুম বলে অভিহিত করার হুমকি দেয়া হয়েছে যা কিনা শিরকের অপর নাম। বলা হয়েছে, ‘যে তাওবা করে না, সে জালেম।’ এভাবে মহানুভব ও ভদ্র ইসলামী সমাজের মনস্তাত্ত্বিক আচরণবিধি রচনা করা হয়েছে আয়াতটিতে।

ফী জিলালিল কুরআন:

পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তােমরা অত্যধিক ধারণা পােষণ থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই কোনাে কোনাে ধারণা পাপ।’ এ আয়াতে ইসলামী সমাজের আর একটি বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে, যা এই সমাজে লােকদের মর্যাদা ও অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। পাশাপাশি এতে মানুষের বিবেক ও আবেগ-অনুভূতিকে কি ভাবে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করা যায় ও রাখা যায় তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভংগিতে শেখানাে হয়েছে। এ আয়াতও একই প্রিয় সম্বােধন হে মুমিনরা দ্বারা শুরু করা হয়েছে। আদেশ দেয়া হয়েছে ধারণার আধিক্য পরিহার করে চলতে এবং নিজ নিজ মনকে অপরের সম্মন্ধে সন্দেহ সংশয় ও ধারণার লীলাভূমিতে পরিণত করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর এর কারণ বর্ণনা করা হয়েছে এই বলে যে, ‘কিছু কিছু ধারণা পাপ’। এখানে নিষেধাজ্ঞাটি যেহেতু অধিকাংশ ধারণার বিরুদ্ধে এবং কিছু ধারণা পাপ, তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, খারাপ ধারণা পােষণ সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। কেননা, কোন ধারণাটি পাপ, তা নিশ্চয় করে বলা যায় না। এভাবে কোরআন মানুষের মনকে খারাপ ধারণার নােংরামি থেকে পবিত্র করেছে, যাতে সে পাপে লিপ্ত হওয়া ও সন্দেহ সংশয় থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এভাবে ইসলামী সমাজের প্রত্যেক মানুষের মনে শুধু তার ভাইয়ের প্রতি ভালােবাসা সংশয়হীনতা ও পরিপূর্ণ মানসিক শক্তি বিরাজ করবে। যাবতীয় কূ-ধারণামুক্ত একটি সমাজে জীবন যে কতাে শান্তিময় ও আনন্দময় হতে পারে, তা সত্যিই অভাবনীয় । মানুষের হৃদয় ও বিবেককে ইসলাম শুধু যে কু-ধারণামুক্ত থাকার প্রশিক্ষণ দিয়েই ক্ষান্ত থাকছে, তা নয়, বরং এই শিক্ষাকে সামাজিক আচরণের ভিত্তি এবং একটি পরিচ্ছন্ন সমাজে সহাবস্থানের একটি মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সমাজের কাউকে নিছক ধারণার বশে পাকড়াও করা যাবে না। সন্দেহের বশে বিচারে সােপর্দ করা যাবে না। ধারণা ও অনুমানকে বিচারের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি ধারণার ভিত্তিতে তদন্তেও অগ্রসর হওয়া যাবে না। রাসূল(স.) বলেছেন, যখন তুমি কোনাে ধারণা পােষণ করবে, তখন তদন্ত চালাবে না।(তাবারানী) অর্থাৎ মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও সম্মান সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরাপদ থাকবে-যতক্ষণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হয় যে, সে সেই কাজটি সত্যিই করেছে, যার জন্যে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কাউকে তদন্তের শিকার করতে নিছক ধারণা ও অনুমান যথেষ্ট নয়, বরং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আবশ্যক। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, এ আয়াতগুলােতে মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে কতাে ব্যাপকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে যে সব দেশে সর্বোচ্চ পরিমাণ গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকার সংরক্ষিত, তাতে কোরআনে নির্দেশিত ইসলামী সমাজের বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং তারও আগে মুসলিম গনমানসে, বিবেকে ও চেতনায় জাগ্রত সেই মানবাধিকারের কতােটুকু খুঁজে পাওয়া যাবে? এরপর ধারণা ও অনুমানের সাথে সংশ্লিষ্ট আরাে একটি মূলনীতি বর্ণনার মাধ্যমে সমাজকে রক্ষাকবচ দেয়া। দোষ অন্বেষণের কাজটি কখনাে ধারণা ও অনুমানের পরে সংঘটিত হতে পারে, আবার মানুষের গােপনীয়তা উদঘাটনের কৌতূহলবশত সূচনাতেও সংঘটিত হতে পারে। এই হীন কাজটিকে কোরআন নৈতিক দিক দিয়ে প্রতিরােধ করে থাকে, যাতে মানুষের গােপনীয়তা উদঘাটনের ঘৃন্য মনােভাব থেকে সমাজ মানসকে পবিত্র করা যায় এবং নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পবিত্রতা আনয়নের বিঘােষিত লক্ষ্য পূরণ করা যায়। এ কাজটির লক্ষ্য শুধু সাময়িক পবিত্রতা সাধন নয় বরং এর চেয়েও সুদূরপ্রসারী। এটি ইসলামের সামাজিক বিধানের একটি প্রধান মূলনীতি এবং ইসলামের আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি উল্লেখযােগ্য স্থায়ী বিধি। ইসলাম মানুষের জন্যে এমন স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও সম্মানের নিশ্চয়তা দিয়েছে, যা কোনাে অবস্থাতেই লংঘিত হতে পারে না।  *ইসলামী শাসনে মানবাধিকার : উন্নত, উদার ও মহানুভব ইসলামী সমাজে মানুষ পরিপূর্ণ জানের নিরাপত্তা, মালের নিরাপত্তা, বাসস্থানের নিরাপত্তা, ও গােপনীয়তার নিরাপত্তা ভােগ করে থাকে এবং এর কোনাে একটিরও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্যে কোনাে ছলছুতা ধােপে টেকে না। এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রে অপরাধ তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকেও মানুষের ওপর গােয়েন্দাগিরি পরিচালনা করার অধিকার দেয়া হয়নি। মানুষকে বাইর থেকে যেমন মনে হয়, তেমনই থাকতে দিতে হবে এবং তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া যাবে না। প্রকাশ্য অপরাধ বা বিদ্রোহ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। কোনােরূপ অনুমান বা আশংকার ভিত্তিতেও পদেক্ষপ নেয়া যাবে না। এমনকি গােপনে কেউ কোনাে ব্যাপারে বিরােধিতা করে জানা গেলেও তার ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে তাকে আটক করা বা বিধিনিষেধ আরােপ করা যাবে না। নাগরিকদের কোনাে অপরাধ প্রকাশিত ও সংঘটিত হলেই কেবল তাকে গ্রেফতার করা যাবে, তবে সে ক্ষেত্রেও তার জন্যে যে সব নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তা লংঘন করা চলবে না। আবু দাউদ শরীফে একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইবনে মাসউদ(রা.)-কে বলা হয়েছিলাে যে, অমুকের দাড়ি থেকে ফোটা ফোটা মদ টপকাতে দেখা গেছে। তিনি বললেন, ‘আমাদের গােয়েন্দাগিরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে আমাদের সামনে কোনাে অপরাধ প্রকাশিত হয়ে পড়লে আমরা তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবে।’ ‘দোষ অন্বেষণ করাে না’ এ উক্তির তাফসীর প্রসংগে মােজাহেদ বলেন, অর্থাৎ যে দোষ প্রকাশ পায় তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নাও, আর আল্লাহ তায়ালা যা গােপন রেখেছেন, তা গােপন রাখবে। ইমাম আহমদের এক রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, আকাবার সেক্রেটারী দাজীন আকাকে বললেন, আমাদের কতিপয় প্রতিবেশী মদ খায়। আমি তাদের জন্যে পুলিশ ডেকে আনি এবং তারা তাদেরকে ধর-পাকড় করুক। আকাবা বললেন, এরূপ করাে না। তাদেরকে উপদেশ দাও এবং হুঁশিয়ারি দাও। দাজীন তাও করে দেখলাম কিন্তু তাতেও কানাে লাভ হলাে না। তারা মদ ত্যাগ করলাে না। দাজীন তার কাছে এসে বললাে, আমি তাদেরকে নিষেধ করেছি। কিন্তু তারা বিরত হয়নি। তাই আমি তাদের জন্যে পুলিশ ডাকলে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আকাবা তাকে বললেন, দেখো, এমন করাে না। আমি রসূল(স.)-কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি কোনাে মােমেনের গােপনীয় ব্যাপার ঢেকে রাখলাে, সে যেন জ্যান্ত পুঁতে মারা একটি শিশু মেয়েকে পুনরুজ্জীবিত করলাে।(আবু দাউদ ও নাসাঈ) হযরত মুয়াবিয়া(রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূল(স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তুমি যদি মানুষের গোপন দোষ খুঁজতে থাকো, তাহলে তাদেরকে নষ্ট করে ফেলবে অথবা নষ্ট করার উপক্রম করবে।(আবু দাউদ) আবু দারদা(রা.) বলেন, রসূল(স.)-এর কাছ থেকে মুয়াবিয়ার শােনা এই কথাটা তার অনেক উপকার সাধন করেছে। এভাবে ওহীর বিধান শুধুমাত্র বিবেক ও মনের পবিত্রতা সাধন করে ক্ষান্ত থাকেনি, বরং ইসলামী সমাজে বাস্তবে প্রযুক্ত হয়েছে এবং মানুষের অধিকার-স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং কোনাে ছলছুতায় তা লংঘন করা যায়নি। ১৪ শত বছর পরের আজকের পৃথিবীতে সর্বোচ্চ গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দাবীদার দেশগুলােতে এর কতােটুকু পাওয়া যাবে ?  *পরনিন্দার অভিশাপ : এরপর এক অভিনব পন্থায় গীবত করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তােমাদের কেউ যেন অন্য কারাে গীবত না করে। তােমাদের কেউ কি নিজের মৃত ভাই-এর গােশত খাওয়া পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তােমরা তা ঘৃণা করেছো।’ প্রথমে গীবত করতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপর একটা চরম নােংরা ও দুঃসহ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। এক ভাই কর্তৃক তার মৃত অপর ভাইয়ের গােশত খাওয়ার দৃশ্য। এরপর স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে যে, এই ঘৃন্য কাজকে তারা নিশ্চয়ই অপছন্দ করে, আর তাই তারা গীবতও অপছন্দ করে। এরপর এ আয়াতে চেতনা জাগিয়ে তােলার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এ সব কাজের কোনােটিতে কেউ লিপ্ত হয়ে থাকলে তাকে তাওবা করে আল্লাহর রহমত কামনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহকে ভয় করাে। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ কোরআনের এই নির্দেশাবলী মুসলিম সমাজে এমনভাবে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে যে, তা মানুষের মর্যাদা রক্ষায় এক দুর্লংঘ্য প্রাচীরের রূপ ধারণ করে এবং মানুষের অন্তরে এক সুগভীর সদাচার-বিধি বদ্ধমূল করে দেয়। অধিকন্তু গীবতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও আতংক সৃষ্টিতে কোরআনের অনুসৃত এই অভিনব পদ্ধতি অনুসরণ করে রাসূল(স.) আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছেন। আবু দাউদ শরীফের হাদীসে আছে যে, রসূল(স.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলাে, হে রসূলুল্লাহ, গীবত কাকে বলে? রসূল(স.) বললেন, তােমার ভাই-এর অসাক্ষাতে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা সে অপছন্দ করে। পুনরায় বলা হলাে, আমি যা বলি তা যদি তার মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে তাহলে?’ রাসূল (স.) বললেন, যদি তা তার মধ্যে থেকে থাকে, তবে তাে তুমি গীবত করলে! নচেত তুমি তার ওপর অপবাদ আরােপ করলে।’ তিরমিযীতে এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা(রা.) বর্ণনা করেন যে, আমি একবার রসূল(স.)-কে বললাম, সুফিয়ার এই একটা দোষই আপনার বিবেচনার জন্য যথেষ্ট। (অর্থাৎ তার বেঁটে হওয়া) রসূল(স.) বললেন, তুমি এমন একটা কথা বলেছো যা সমুদ্রের পানির সাথে মিশিয়ে দিলেও গােটা সমুদ্র দুষিত হয়ে যাবে। আর একবার তার কাছে একজন মানুষ সম্বন্ধে আলােচনা করেছিলাম। রসূল(স.) বললেন, আমাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করা হলেও আমি পছন্দ করি না যে, কাউকে নিয়ে আলােচনা করি।(আবু দাউদ) রসূল(স.) বলেছেন, মিরাজের রাত্রে আমি কিছু লােক দেখলাম, তাদের তামার নখ রয়েছে এবং তা দিয়ে তারা নিজেদের মুখ ও বুক খামচাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে জিবরাঈল, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেই সব লােক যারা মানুষের গােশত থায় এবং তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।'(আবু দাউদ) মায়েয ও গামেদ গোত্রের একটি মহিলা যখন ব্যাভিচারের স্বীকারােক্তি করলাে এবং রসূল(স.) তার স্বেচ্ছাকৃত স্বীকারােক্তি ও পবিত্র করার কাকুতিমিনতির কারণে যখন পাথর মেরে হত্যা করে ফেললেন, তখন রসূল(স.) শুনতে পেলেন এক ব্যক্তি তার সাথীকে বলছে, ‘দেখলে? এই লােকটার অপরাধ আল্লাহ তায়ালা গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু সে নিজে তা গােপন থাকতে দিলাে না। ফলে কিভাবে কুকুরের মতাে পাথরের আঘাতে নিহত হলাে। এরপর রসূল(স.) তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাদের কাছাকাছি এক জায়গায় একটা মরা গাধা দেখে বললেন, অমুক অমুক ব্যক্তিদ্বয় কোথায়? তােমরা এসাে এবং এই মরা গাধার লাশ থেকে গােশত খাও।’ তারা বললাে, হে রসূল, আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্ষমা করুন, এ কি খাওয়া যায়? রসুল(স.) বললেন, তােমরা তােমাদের ভাইয়ের সাথে একটু আগে যে আচরণ করলে, তা এই মরা গাধা খাওয়ার চেয়েও খারাপ কাজ। যে আল্লাহর হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, মায়েয এই মুহূর্তে বেহেশতের কোনায় গোসল করছে।(ইবনে কাসীর) বস্তুত এরূপ স্থায়ী ও অব্যাহত চিকিৎসার ফলেই ইসলাম পবিত্র ও উন্নত হতে পেরেছিলাে এবং তা পৃথিবীতে একটি বাস্তব স্বপ্ন ও ইতিহাসের বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলাে।

Leave a Reply