Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৪/আমাদের ২৪ ঘন্টার রুটিন, ও ঘুম থেকে নামাজ উত্তম:-৩)
[*যদি তোমরা কুফরী কর, তবে কি করে আন্তরক্ষা করবে সেদিন:-/এবং কাফির-রা বলে:-২৯]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল
পারা:২৯
১-২০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১
یٰۤاَیُّہَا الۡمُزَّمِّلُ ۙ﴿۱﴾
বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-২
قُمِ الَّیۡلَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۙ﴿۲﴾
রাতে সালাতে দাঁড়ান , কিছু অংশ ছাড়া !
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৩
نِّصۡفَہٗۤ اَوِ انۡقُصۡ مِنۡہُ قَلِیۡلًا ۙ﴿۳﴾
অর্ধরাত্রি কিংবা তার চাইতে অল্প।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৪
اَوۡ زِدۡ عَلَیۡہِ وَ رَتِّلِ الۡقُرۡاٰنَ تَرۡتِیۡلًا ؕ﴿۴﴾
অথবা তার চেয়েও একটু বাড়ান। আর কুরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে;
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৫
اِنَّا سَنُلۡقِیۡ عَلَیۡکَ قَوۡلًا ثَقِیۡلًا ﴿۵﴾
আমি অতি শীঘ্র তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাযিল করবো।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৬
اِنَّ نَاشِئَۃَ الَّیۡلِ ہِیَ اَشَدُّ وَطۡاً وَّ اَقۡوَمُ قِیۡلًا ؕ﴿۶﴾
প্রকৃতপক্ষে রাতের বেলা জেগে ওঠা৬ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশী কার্যকর এবং যথাযথভাবে কুরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৭
اِنَّ لَکَ فِی النَّہَارِ سَبۡحًا طَوِیۡلًا ؕ﴿۷﴾
দিবাভাগে তোমার জন্য রয়েছে দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৮
وَ اذۡکُرِ اسۡمَ رَبِّکَ وَ تَبَتَّلۡ اِلَیۡہِ تَبۡتِیۡلًا ؕ﴿۸﴾
সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাতে মগ্ন হও।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৯
رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ فَاتَّخِذۡہُ وَکِیۡلًا ﴿۹﴾
তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তাই তাঁকেই নিজের উকীল হিসেবে গ্রহণ করো।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১০
وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ اہۡجُرۡہُمۡ ہَجۡرًا جَمِیۡلًا ﴿۱۰﴾
আর লোকেরা যা বলে বেড়াচ্ছে সে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করো এবং ভদ্রভাবে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাও।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১১
وَ ذَرۡنِیۡ وَ الۡمُکَذِّبِیۡنَ اُولِی النَّعۡمَۃِ وَ مَہِّلۡہُمۡ قَلِیۡلًا ﴿۱۱﴾
এসব মিথ্যা আরোপকারী, সম্পদশালী লোকদের সাথে বুঝাপড়ার ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর কিছু কালের জন্য এদেরকে এ অবস্থায়ই থাকতে দাও।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১২
اِنَّ لَدَیۡنَاۤ اَنۡکَالًا وَّ جَحِیۡمًا ﴿ۙ۱۲﴾
আমার কাছে (এদের জন্য) আছে শক্ত বেড়ি, জ্বলন্ত আগুন,
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৩
وَّ طَعَامًا ذَا غُصَّۃٍ وَّ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿٭۱۳﴾
আর আছে এমন খাদ্য, যা গলায় আটকে যায় এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৪
یَوۡمَ تَرۡجُفُ الۡاَرۡضُ وَ الۡجِبَالُ وَ کَانَتِ الۡجِبَالُ کَثِیۡبًا مَّہِیۡلًا ﴿۱۴﴾
যেদিন পৃথিবী ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে এবং পর্বতসমূহ বহমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৫
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ رَسُوۡلًا ۬ۙ شَاہِدًا عَلَیۡکُمۡ کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ رَسُوۡلًا ﴿ؕ۱۵﴾
আমি তোমাদের নিকট একজন রসূল পাঠিয়েছি তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ যেমন ফেরাউনের নিকট একজন রসূল পাঠিয়ে ছিলাম।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৬
فَعَصٰی فِرۡعَوۡنُ الرَّسُوۡلَ فَاَخَذۡنٰہُ اَخۡذًا وَّبِیۡلًا ﴿۱۶﴾
কিন্তু ফির‘আউন সে রাসূলকে অমান্য করেছিল, ফলে আমরা তাকে অত্যন্ত শক্তভাবে পাকড়াও করেছিলাম।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৭
فَکَیۡفَ تَتَّقُوۡنَ اِنۡ کَفَرۡتُمۡ یَوۡمًا یَّجۡعَلُ الۡوِلۡدَانَ شِیۡبَۨا ﴿٭ۖ۱۷﴾
অতএব যদি তোমরা কুফরী কর, তবে কি করে আন্তরক্ষা করবে সেদিন যে দিনটি কিশোরদেরকে পরিণত করবে বৃদ্ধে,
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৮
السَّمَآءُ مُنۡفَطِرٌۢ بِہٖ ؕ کَانَ وَعۡدُہٗ مَفۡعُوۡلًا ﴿۱۸﴾
যেদিন আকাশ হবে বিদীর্ণ; তাঁর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৯
اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ﴿٪۱۹﴾
নিশ্চয় এটা এক উপদেশ, অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক !
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-২০
اِنَّ رَبَّکَ یَعۡلَمُ اَنَّکَ تَقُوۡمُ اَدۡنٰی مِنۡ ثُلُثَیِ الَّیۡلِ وَ نِصۡفَہٗ وَ ثُلُثَہٗ وَ طَآئِفَۃٌ مِّنَ الَّذِیۡنَ مَعَکَ ؕ وَ اللّٰہُ یُقَدِّرُ الَّیۡلَ وَ النَّہَارَ ؕ عَلِمَ اَنۡ لَّنۡ تُحۡصُوۡہُ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ فَاقۡرَءُوۡا مَا تَیَسَّرَ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ عَلِمَ اَنۡ سَیَکُوۡنُ مِنۡکُمۡ مَّرۡضٰی ۙ وَ اٰخَرُوۡنَ یَضۡرِبُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ یَبۡتَغُوۡنَ مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ ۙ وَ اٰخَرُوۡنَ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۫ۖ فَاقۡرَءُوۡا مَا تَیَسَّرَ مِنۡہُ ۙ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ اَقۡرِضُوا اللّٰہَ قَرۡضًا حَسَنًا ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ عِنۡدَ اللّٰہِ ہُوَ خَیۡرًا وَّ اَعۡظَمَ اَجۡرًا ؕ وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿٪۲۰﴾
নিশ্চয় আপনার রব জানেন যে, আপনি সালাতে দাঁড়ান কখনও রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনও অর্ধাংশ এবং কখনও এক-তৃতীয়াংশ এবং দাঁড়ায় আপনার সঙ্গে যারা আছে তাদের একটি দলও। আর আল্লাহ্ই নির্ধারণ করেন দিন ও রাতের পরিমান । তিনি জানেন যে, তোমারা এটা পুরোপুরি পালন করতে পারবে না , তাই আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করলেন । কাজেই কুরান থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়, আল্লাহ্ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, আর কেউ কেউ আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্ৰমন করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহ্র পথে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। কাজেই তোমরা কুরআন হতে যতটুকু সহজসাধ্য ততটুকু পড়। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্ৰদান কর এবং আল্লাহ্কে দাও উত্তম ঋণ । তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম পাঠাবে তোমরা তা পাবে আল্লাহ্র কাছে । তা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর। আর তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহ্র কাছে; নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
১-২০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৭৩-মুজ্জাম্মিল) : নামকরণ:
সূরার প্রথম আয়াতের الْمُزَّمِّلُ (আলমুয্যাম্মিল, শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এটা শুধু সূরাটির নাম, এর বিষয়বস্তুর শিরোনাম নয়।
(৭৩-মুজ্জাম্মিল) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরার দুটি রুকূ দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নাযিল হয়েছে।
প্রথমে রুকূর আয়াতগুলো মক্কায় নাযিল হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত।এর বিষয়বস্তু এবং বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনা থেকেও তা বুঝা যায়।তবে প্রশ্ন থেকে যায় যে, মক্কী জীবনের কোন পর্যায়ে তা নাযিল হয়েছিল? হাদীসের বর্ণনাসমূহ থেকে আমরা এর কোন জবাব পাই না। তবে পুরো রুকূটির বিষয়বস্তুর আভ্যন্তরীণ প্রমাণ দ্বারা এর নাযিল হওয়ার সময়-কাল নির্ণয় করতে যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া যায়।
প্রথমত, এতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের বেলা উঠে আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে তাঁর মধ্যে নবুয়াতের গুরু দায়িত্ব বহনের শক্তি সৃষ্টি হয়। এ থেকে জানা গেল যে, এ নির্দেশটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়াতের প্রথম যুগে এমন এক সময় নাযিল হয়ে থাকবে যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এ পদমর্যাদার জন্য তাঁকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল।
দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে তাঁকে তাহজ্বুদ নামাযে অর্ধেক রাত কিংবা তার চেয়ে কম বা বেশী রাত পর্যন্ত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একথা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তখন পর্যন্ত কুরআন মজীদের অন্তত এতটা পরিমাণ নাযিল হয়েছিল যা দীর্ঘক্ষণ তিলাওয়াত করা যেতো।
তৃতীয়ত, এ রুকূতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিরোধীদের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারনের উপদেশ এবং মক্কার কাফেরদের আযাবের হুমকি দেয়া হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রুকূটি যখন নাযিল হয়েছিল তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের প্রকাশ্য তাবলীগ বা প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন এবং মক্কায় তাঁর বিরোধিতাও তীব্রতা লাভ করেছিল।
দ্বিতীয় রুকূ সম্পর্কে মুফাস্সিরগণ যদিও বলেছেন যে, এটিও মক্কায় নাযিল হয়েছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক মুফাস্সির একে মদীনায় অবতীর্ণ বলে মত ব্যক্ত করেছেন। এ রুকূটির বিষয়বস্তু থেকে এ মতটিরও সমর্থন পাওয়া যায়। কারণ এর মধ্যে আল্লাহর পথে লড়াই করার উল্লেখ আছে। মক্কায় এর কোন প্রশ্নই ছিল না। এতে ফরযকৃত যাকাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এটা প্রমাণিত বিষয় যে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে যাকাত দেয়া মদীনাতে ফরয হয়েছে।
(৭৩-মুজ্জাম্মিল) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
প্রথম সাতটি আয়াতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যে মহান কাজের গুরু দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব ঠিকমত পালনের জন্য আপনি নিজেকে প্রস্তুত করুন। এর বাস্তব পন্থা বলা হয়েছে এই যে, আপনি রাতের বেলা উঠে অর্ধেক রাত কিংবা তার চেয়ে বেশী সময় বা কিছু কম সময় পর্যন্ত নামায পড়ুন।
৮ থেকে ১৪ নং পর্যন্ত আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের অধিপতি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে যান। নিজের সমস্ত ব্যাপার তাঁর কাছে সোর্পদ করে দিয়ে নি:শংক ও নিশ্চিন্ত হয়ে যান। বিরোধীরা আপনার বিরুদ্ধে যা বলছে সে ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করুন, তাদের কথায় ভ্রুক্ষেপ করবেন না। তাদের ব্যাপারটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিন। তিনিই তাদের সাথে বুঝাপড়া করবেন।
এরপর ১৫ থেকে ১৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মক্কার যে সমস্ত মানুষ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা করেছিলো তাদের এ বলে হুশিয়ারী দেয়া হয়েছে যে, আমি যেমন ফেরাউনের কাছে রসূল পাঠিয়েছিলাম ঠিক তেমনি তোমাদের কাছে একজন রসূল পাঠিয়েছি। কিন্তু দেখো, আল্লাহর রসূলের কথা না শুনে ফেরাউন কিরূপ পরিণামের সম্মুখীন হয়েছিল। মনে করো, এ জন্য দুনিয়াতে তোমাদের কোন শাস্তি দেয়া হলো না। কিন্তু কিয়ামতের দিনের শাস্তি থেকে তোমরা কিভাবে নিষ্কৃতি লাভ করবে?
এ পর্যন্ত যা বর্ণিত হলো তা প্রথম রুকূর বিষয়বস্তু। হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়েরের বর্ণনা অনুসারে এর দশ বছর পর দ্বিতীয় রুকূটি নাযিল হয়েছিল। তাহজ্বুদ নামায সম্পর্কে প্রথম রুকূর শুরুতেই যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এতে তা সহজ করে দেয়া হয়েছে। এখন নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তাহজ্বুদ নামায যতটা সহজ ও স্বাচ্ছন্দে আদায় করা সম্ভব সেভাবেই আদায় করবে। তবে মুসলমানদের যে বিষয়টির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে তাহলো পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায পূর্ণ নিয়মানুবর্তিতাসহ আদায় করবে। যাকাত যেহেতু ফরয তাই তা যথাযথভাবে আদায় করবে এবং আল্লাহর পথে নিজের অর্থ-সম্পদ বিশুদ্ধ নিয়তে খরচ করবে। সবশেষে মুসলমানদের উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়াতে তোমরা যেসব কল্যাণমূলক কাজ আঞ্জাম দেবে তা ব্যর্থ হবে না। বরং তা এমন সব সাজ-সরঞ্জামের মত যা একজন মুসাফির তার স্থায়ী বাসস্থানে আগেই পাঠিয়ে দেয়। আল্লাহর কাছে পৌছার পর তোমরা তার সবকিছুই পেয়ে যাবে যা দুনিয়া থেকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলে। আগেভাগেই পাঠিয়ে দেয়া এমন সরঞ্জাম-সমগ্রী তোমরা দুনিয়াতে যা ছেড়ে যাবে তার চেয়ে যে শুধু ভাল তাই নয়, বরং আল্লাহর কাছে তোমরা তোমাদের আসল সম্পদের চেয়ে অনেক বেশী পুরষ্কারও লাভ করবে।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-১
یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُۙ
হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ শব্দগুলো দ্বারা আল্লাহ তা’আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন রাতের বেলা ওঠেন এবং ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, সে সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অথবা ঘুমানোর জন্য চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তাকে হে নবী (সাঃ ) অথবা হে রসূল বলে সম্বোধন করে হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী বলে সম্বোধন একটি তাৎপর্যপূর্ণ সম্বোধন। এর যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলো, এখন আর সে সময় নেই যখন তিনি নিশ্চিন্তে আরামে ঘুমাতেন। এখন তাঁর ওপর এক বিরাট কাজের বোঝা চাপানো হয়েছে যার দাবী ও চাহিদা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-২
قُمِ الَّیْلَ اِلَّا قَلِیْلًاۙ
রাতের বেলা নামাযে রত থাকো। তবে কিছু সময় ছাড়া।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, নামাযে দাঁড়িয়ে রাত অতিবাহিত করো এবং রাতের অল্প কিছু সময় মাত্র ঘুমে কাটাও। দুই, তোমার কাছে সমস্ত রাতই নামায পড়ে কাটিয়ে দেয়ার দাবী করা হচ্ছে না। বরং তুমি বিশ্রামও করো এবং রাতের একটি ক্ষুদ্র অংশ ইবাদত-বন্দেগীতেও ব্যয় করো। কিন্তু পরবর্তী বিষয়বস্তুর সাথে প্রথমোক্ত অর্থটাই অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূরা দাহরের ২৬ নং আয়াত থেকে একথারই সমর্থন পাওয়া যায়। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছেঃ
وَمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ لَهُ وَسَبِّحْهُ لَيْلًا طَوِيلًا
“রাতের বেলা আল্লাহর সামনে সিজদায় পড়ে থাকো এবং রাতের বেশীর ভাগ সময় তাঁর তাসবীহ ও প্রশংসায় অতিবাহিত করো। “
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-৪
اَوْ زِدْ عَلَیْهِ وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًاؕ
অথবা তার ওপর কিছু বাড়িয়ে নাও। আর কুরআন থেমে থেমে পাঠ করো।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# যে সময়টুকু ইবাদাত করে কাটাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সেময়ের পরিমাণ কি হবে এটা তারই ব্যাখ্যা। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে, তিনি ইচ্ছা করলে অর্ধেক রাত নামায পড়ে কাটাতে পারেন কিংবা তার চেয়ে কিছু কম বা বেশী করতে পারেন। তবে বাচনভঙ্গী থেকে বুঝা যায় যে, অর্ধেক রাত-ই অগ্রাধিকার যোগ্য। কারণ অর্ধেক রাতকে মানদণ্ড নির্ধারিত করে তার থেকে কিছু কম বা তার চেয়ে কিছু বেশী করার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে।
# অর্থাৎ তাড়াতাড়ি ও দ্রুতগতিতে পড়ো না। বরং ধীরে ধীরে প্রতিটি শব্দ সুন্দরভাবে মুখে উচ্চারণ করে পড়ো। এক একটি আয়াত পড়ে থেমে যাও যাতে মন আল্লাহর বাণীর অর্থ ও তার দাবীকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে এবং তার বিষয়বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয়। কোন জায়গায় আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর উল্লেখ থাকলে তার মহত্ব শ্রেষ্ঠত্ব ও ভীতি যেন মনকে ঝাঁকুনি দেয়। কোন জায়গায় তাঁর রহমত ও করুণার বর্ণনা আসলে হৃদয়-মন যেন কৃতজ্ঞতার আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। কোন জায়গায় তাঁর গযব ও শাস্তির উল্লেখ থাকলে হৃদয়-মন যেন তার ভয়ে কম্পিত হয়। কোথাও কোন কিছু করার নির্দেশ থাকলে কিংবা কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়ে থাকলে কি কাজ করতে আদেশ করা হয়েছে এবং কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা যেন ভালভাবে বুঝে নেয়া যায়। মোটকথা কুরআনে শব্দগুলো শুধু মুখ থেকে উচ্চারণ করার নাম কুরআন পাঠ নয়, বরং মুখ থেকে উচ্চারণ করার সাথে সাথে তা উপলব্ধি করার জন্য গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনাও করতে হবে। হযরত আনাসকে (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোরআন পাঠের নিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ নবী ﷺ শব্দগুলোকে টেনে পড়তেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পড়ে বললেন যে, তিনি আল্লাহ, রহমান এবং রাহীম শব্দকে মদ্দ করে বা টেনে পড়তেন। (বুখারী) হযরত উম্মে সালমাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেনঃ নবী ﷺ এক একটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন এবং প্রতিটি আয়াত পড়ে থামতেন। যেমন اَلحَمْدُ لَلّهِ رَبِّ العَلَمِيْنَ পড়ে থামতেন, তারপর الرَّحْمَانِ الّرحِيْمٍ পড়ে থামতেন এবং কিছু সময় থেমে থেকে مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ পড়তেন। (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) আরেকটি রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেনঃ নবী ﷺ এককেটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে পড়তেন। (তিরমিযী, নাসায়ী) হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান বর্ণনা করেছেন যে, একদিন রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামায পড়তে দাঁড়ালাম। আমি দেখলাম, তিনি এমভাবে কুরআন তেলাওয়াত করছেন যে, যেখানে তাসবীহের বিষয় আসছে সেখানে তিনি তাসবীহ পড়ছেন, যেখানে দোয়ার বিষয় আসছে সেখানে দোয়া করছেন এবং যেখানে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার বিষয় আসছে সেখানে তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। (মুসলিম, নাসায়ী) হযরত আবু যান বর্ণনা করেছেন যে, একবার রাতের নামাযে কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে নবী ﷺ যখন এ আয়াতটির কাছে পৌঁছলেনاِنْ تَعُذُّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَاِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اََنْتَ الْعَزِيْْزُ الْحَكِيْمُ “তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও, তারা তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও তাহলে তুমি পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ। তখন তিনি বার বার এ আয়াতটিই পড়তে থাকলেন এবং এভাবে ভোর হয়ে গেল। ” (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী)
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-৫
اِنَّا سَنُلْقِیْ عَلَیْكَ قَوْلًا ثَقِیْلًا
আমি অতি শীঘ্র তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাযিল করবো।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এর অর্থ হলো তোমাকে রাতের বেলা নামায পড়ার এ নির্দেশ এ জন্য দেয়া হচ্ছে যে, আমি একটি অতি গুরুভার বাণী তোমার ওপরে নাযিল করছি। এ ভার বহন করার এবং তা বরদাশত করার শক্তি তোমার মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। তুমি এ শক্তি অর্জন করতে চাইলে আরাম পরিত্যাগ করে রাতের বেলা নামাযের জন্য ওঠো এবং অর্ধেক রাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম বা বেশী রাত ইবাদাত বন্দেগীতে কাটিয়ে দাও। কুরআনকে গুরুভার বাণী বলার কারণ হলো, তার নির্দেশ অনুসার কাজ করা, তার শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা, সারা দুনিয়ার সামনে তার দাওয়াত বা আহবান নিয়ে দাঁড়ানো এবং তদনুযায়ী আকীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, নৈতিক চরিত্র ও আচার-আচরণ এবং তাহযীব-তামাদ্দুনের গোটা ব্যবস্থায় বিপ্লব সংঘটিত করা এমন একটি কাজ যে, এর চেয়ে বেশী কঠিনও গুরুভার কাজের কল্পনাও করা যায় না। এ জন্যও একে গুরুভার ও কঠিন বাণী বলা হয়েছে যে, তার অবতরণের ভার বহন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত(রা.) বর্ণনা করেছেন যে, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল হওয়ার সময় তিনি আমার উরুর ওপর তাঁর উরু ঠেকিয়ে বসেছিলেন। আমার উরুর ওপর তখন এমন চাপ পড়ছিলো যে, মনে হচ্ছিলো তা এখনই ভেঙে যাবে। হযরত আয়েশা বর্ণনা করেনঃ আমি প্রচণ্ড শীতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল হতে দেখেছি। সে সময়ও তাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরতে থাকতো। (বুখারী, মুসলিম, মালিক, তিরমিযী, নাসায়ী) আরেকটি রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেনঃ উটনীর ওপর সওয়ার থাকা অবস্থায় যখনই তাঁর ওপর অহী নাযিল হতো উটনী তখন তার বুক মাটিতে ঠেকিয়ে দিতো। অহী নাযিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারতো না। (মুসনাদে আহমাদ, হাকেম, ইবনে জারীর)।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-৬
اِنَّ نَاشِئَةَ الَّیْلِ هِیَ اَشَدُّ وَطْاً وَّ اَقْوَمُ قِیْلًاؕ
প্রকৃতপক্ষে রাতের বেলা জেগে ওঠা৬ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশী কার্যকর এবং যথাযথভাবে কুরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূল ইবারতেنَاشِئَةَ اللَّيْلِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার ব্যাখ্যায় মুফাস্সির ও ভাষাবিদদের চারটি ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। একটি মত হলো, ناشئة শব্দের মানে রাতের বেলা শয্যা ত্যাগকারী ব্যক্তি। দ্বিতীয় মতটি হলো এর অর্থ রাত্রিকালীন সময়। তৃতীয় মত হলো এর অর্থ রাতের বেলা জেগে থাকা বা ওঠা। আর চতুর্থ মতটি হলো, এর অর্থ শুধু রাতের বেলা ওঠা বা জেগে থাকা নয়। বরং ঘুমিয়ে পড়ার পর জেগে ওঠা। হযরত আয়েশা এবং মুজাহিদ এ চতুর্থ অর্থটিই গ্রহণ করেছেন।
# আয়াতে اشد وطاء আসাদ্দু ওয়াতয়ান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ এতো ব্যাপক যে, একটি মাত্র বাক্যে তা বুঝানো সম্ভব নয়। এর একটি অর্থ হলো রাতের বেলা ইবাদাত-বন্দেগীর কাজ, শয্যা ত্যাগ করে ওঠা এবং দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা যেহেতু মানুষের স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজ, মানুষের মনও প্রবৃত্তি এ সময় আরাম কামনা করে, তাই এটি এমন একটি কাজ ও চেষ্টা-সাধনা যা প্রবৃত্তিকে অবদমিত ও বশীভূত করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর পন্থা। যে ব্যক্তি এ পন্থায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় এবং দেহ ও মন-মগজের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের এ শক্তিকে আল্লাহর পথে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সত্য ও শাশ্বত এ দ্বীনের দাওয়াতকে পৃথিবীতে বিজয়ী করার কাজ করতে পারে। দ্বিতীয় অর্থ হলো, এ কাজটি মানুষের হৃদয়-মন ও বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করার একটা কার্যকর উপায়। কারণ রাতের এ সময়টিতে বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে আর কেউ আড়াল হয়না। এ অবস্থায় মানুষ মুখে যা বলে তা তার হৃদয়ের কথার প্রতিধ্বনি। তৃতীয় অর্থ হলো, এটি মানুষের ভেতর ও বাহিরের মধ্যে সঙ্গতি ও মিল সৃষ্টির অতি কার্যকর একটি উপায়। কারণ যে ব্যক্তি রাতের নির্জন নিথর পরিবেশে আরাম পরিত্যাগ করে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য উঠবে সে নিঃসন্দেহে খালেস মনেই এরূপ করবে। তাতে প্রদর্শনীর বা লোক দেখানোর আদৌ কোন সুযোগ থাকে না। চতুর্থ হলো, মানুষের জন্য এ ধরনের ইবাদত-বন্দেগীর যেহেতু দিনের বেলার ইবাদত-বন্দেগীর চেয়ে অনেক বেশী কষ্টকর। তাই তা নিয়মিত করার ফলে মানুষের মধ্যে অনেক বেশী দৃঢ়তা সৃষ্টি হয় সে অত্যন্ত শক্ত হয়ে আল্লাহর পথে অগ্রসর হতে পারে এবং এ পথে কঠোরতা সমূহকে সে অটল ও অবিচল থেকে বরদাশত করতে পারে।
# মূল ইবারতে اقوم قيلا বলা হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হলো, কথাকে আরো বেশী যথার্থ ও সঠিক বানায়। তবে এর মূল বক্তব্য হলো, সে সময় মানুষ আরো বেশী প্রশান্তি, তৃপ্তি ও মনোযোগ সহকারে বুঝে কুরআন শরীফ পড়তে পারে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে اجدران يفقه في القران অর্থাৎ গভীর চিন্তা-ভাবনা ও মনোনিবেশ সহ কুরআন পাঠের জন্য এটা একটা অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত সময়। (আবু দাউদ)
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-৮
وَ اذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَ تَبَتَّلْ اِلَیْهِ تَبْتِیْلًاؕ
নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করতে থাকো। এবং সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁরই জন্য হয়ে যাও।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# দিনের বেলার ব্যস্ততার উল্লেখ করার পর “তোমার রবের নাম স্মরণ করতে থাকো” এ নির্দেশ দেয়া থেকে আপনি আপনি একথাটির প্রকাশ পায় যে, দুনিয়াতে হাজারো কাজের মধ্যে ডুবে থেকেও তোমার রবের স্মরণ থেকে গাফেল যেন না হও। বরং কোন না কোনভাবে তাকে স্মরণ করতে থাকো। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন সূরা আহযাব, টীকা ৬৩)
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-৯
رَبُّ الْمَشْرِقِ وَ الْمَغْرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِیْلًا
তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তাই তাঁকেই নিজের উকীল হিসেবে গ্রহণ করো।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# উকিল বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যার প্রতি আস্থা রেখে কোন ব্যক্তি নিজের ব্যাপার তার ওপর সোর্পদ করে। উর্দু ভাষাতে প্রায় এ অর্থেই আমরা এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে উকিল শব্দটি ব্যবহার করি আমাদের মামলা-মোকাদ্দমা যার হাতে অর্পণ করে কেউ এতটা নিশ্চিন্ত হয়ে যায় যে, সে তার পক্ষ থেকে ভালভাবেই মামলাটি লড়বে এবং তার নিজের এ মামলা লড়ার কোন দরকার হবে না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতটির অর্থ হলো, দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার কারণে তোমার বিরোধিতার যে তুফান সৃষ্টি হয়েছে এবং তোমার ওপর যেসব বিপদ-মুসিবত আসছে সেজন্য তুমি অস্থির বা উৎকণ্ঠিত হয়ো না। তোমার প্রভু তো সেই সত্তা যিনি পূর্ব ও পশ্চিম তথা সমগ্র বিশ্ব জাহানের মালিক। ইলাহী ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁর ছাড়া আর কারো হাতে নেই। তুমি তোমার সমস্ত ব্যাপার তাঁর হাতে সোর্পদ করে দাও এবং নিশ্চিন্ত হয়ে যাও যে, এখন তোমার মোকাদ্দমা তিনি নিজে লড়বেন, তোমার বিরুদ্ধবাদীদের সাথে তিনিই বুঝাপড়া করবেন এবং তোমার সব কাজ তিনিই সম্পন্ন করবেন।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-১০
وَ اصْبِرْ عَلٰى مَا یَقُوْلُوْنَ وَ اهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِیْلًا
আর লোকেরা যা বলে বেড়াচ্ছে সে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করো এবং ভদ্রভাবে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাও।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# “আলাদা হয়ে যাও” কথাটির অর্থ এই নয় যে, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলামের তাবলীগের কাজ বন্ধ করে দাও। বরং এর অর্থ হলো, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করো না, তাদের অন্যায় ও অর্থহীন আচরণ উপেক্ষা করে চলো এবং তাদের কোন অভদ্র আচরণের জবাব দিও না। তবে তাদের প্রতি এ উপেক্ষা এবং নির্লিপ্ততাও যেন কোন প্রকার ক্ষোভ, ক্রোধ এবং বিরক্তিসহ না হয়। বরং তা যেন এমন উপেক্ষা হয়, যেমন একজন ভদ্র মানুষ কোন অসভ্য বাউণ্ডেলে বা বখাটে লোকের গালি শুনে যেমন তা উপেক্ষা করে এবং মনকে ভারাক্রান্ত হতে পর্যন্ত দেয় না। এ থেকে এরূপ ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়া ঠিক নয় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মপদ্ধতি বোধ হয় এ থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের ছিল। তাই আল্লাহ তাঁকে এ আদেশ করেছেন। তিনি মূলত প্রথম থেকেই এ কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। তবে কুরআনে এ নির্দেশ দেয়ার উদ্দেশ্য হলো কাফেরদের একথা জানিয়ে দেয়া যে, তোমরা যে আচরণ করছো তার জবাব না দেয়ার কারণ দুর্বলতা নয়। বরং এরূপ আচরণের জবাবে আল্লাহ তাঁর রসূলকে এ ধরনের ভদ্রজনোচিত পন্থা গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছেন।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল আয়াত নং :-১১
, وَ ذَرْنِیْ وَ الْمُكَذِّبِیْنَ اُولِی النَّعْمَةِ وَ مَهِّلْهُمْ قَلِیْلًا
এসব মিথ্যা আরোপকারী, সম্পদশালী লোকদের সাথে বুঝাপড়ার ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর কিছু কালের জন্য এদেরকে এ অবস্থায়ই থাকতে দাও।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# একথা থেকে এ মর্মে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মক্কায় যেসব লোক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপ করছিল এবং নানাভাবে ধোঁকা দিয়ে এবং নানা রকমের স্বার্থপ্রীতি সংকীর্ণতা ও বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে তাঁর বিরোধিতায় নামছিল তারা সবাই ছিল জাতির সচ্ছল, সম্পদশালী ও বিলাসপ্রিয় মানুষ। কারণ ইসলামের এ সংস্কার আন্দোলনের আঘাত তাদের স্বার্থের ওপর সরাসরি পড়ছিল। কুরআন আমাদের বলে যে, এ আচরণ শুধু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেই ছিল না বরং যে গোষ্ঠী চিরদিনই সংস্কার ও সংশোধনের পথ রুদ্ধ করার জন্য জগদ্দল পাথরের মত বাধা সৃষ্টি করে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, সূরা আল আরাফ, আয়াত ৬০ , ৬৬ , ৭৫ , ৮৮ ; আল মু’মিনূন , ৩৩ ; সাবা, ৩৪ও ৩৫ এবং আয যুখরুফ , ২৩ ) ।
# জাহান্নামে পাপী ও অপরাধীদের পায়ে ভারী বেড়ী পরানো হবে। তারা যাতে পালাতে না পারে সেজন্য এ বেড়ি পরানো হবে না, বরং তা পরানো হবে এজন্য যে, তারা যেন উঠতে না পারে। এ বেড়ি পালিয়ে যাওয়ার রোধ করার জন্য নয় বরং শাস্তি বৃদ্ধি করার জন্য। ফী জিলালিল কুরআন: ১২-১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ১৯ নং আয়াতে পড়ুন।
#সে সময় পাহাড়সমূহের বিভিন্ন অংশকে পরস্পর সংযুক্ত রাখার কেন্দ্রীয় বল নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই প্রথমে তা মিহি বালুর স্তুপে পরিণত হবে। অতঃপর ভূমিকম্প গোটা পৃথিবীকে প্রবলভাবে কাঁপিয়ে তুললে বালুর এ স্তুপ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে এবং গোটা ভূপৃষ্ঠ একটা বিশাল প্রান্তরে রূপান্তরিত হবে। এ অবস্থার একটি চিত্র সূরা ত্বা-হার ১০৫ থেকে ১০৭ আয়াত পর্যন্ত এভাবে তুলে ধরা হয়েছেঃ “লোকেরা তোমাকে এসব পাহাড়ের অবস্থা কি হবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বলো, আমার প্রভু পাহাড়সমূহকে ধুলির মত করে ওড়াবেন এবং ভূপৃষ্ঠকে এমন সমতল বিশাল প্রান্তরে রূপান্তরিত করবেন যে, তুমি সেখানে উঁচু নিচু বা ভাঁজ দেখতে পাবে না। “ ফী জিলালিল কুরআন: ১২-১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ১৯ নং আয়াতে পড়ুন।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-১৫
اِنَّاۤ اَرْسَلْنَاۤ اِلَیْكُمْ رَسُوْلًا١ۙ۬ شَاهِدًا عَلَیْكُمْ كَمَاۤ اَرْسَلْنَاۤ اِلٰى فِرْعَوْنَ رَسُوْلًاؕ
আমি তোমাদের নিকট একজন রসূল পাঠিয়েছি তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ যেমন ফেরাউনের নিকট একজন রসূল পাঠিয়ে ছিলাম।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মক্কার যেসব কাফের রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করেছিলো এবং তাঁর বিরোধিতায় অতি মাত্রায় তৎপর ছিল এখানে তাদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে।
# লোকদের জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাক্ষী বানিয়ে পাঠানোর একটি অর্থ হলো, তিনি দুনিয়ায় তাদের সামনে নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে সত্যের সাক্ষ্য পেশ করবেন। আরেকটি হলো, আখেরাতে যখন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে সে সময় তিনি সাক্ষ্য দেবেন যে, এসব লোকের কাছে আমি সত্যের আহবান পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন সূরা আল বাকারা, টীকা ১৪৪ ; আন নিসা, টীকা, ৬৪ ; আন নাহল, আয়াত ৮৪-৮৯ ; আল আহযাব, টীকা ৮২ ; আল ফাত্হ্ টীকা ১৪ )
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-১৭
فَكَیْفَ تَتَّقُوْنَ اِنْ كَفَرْتُمْ یَوْمًا یَّجْعَلُ الْوِلْدَانَ شِیْبَاۗۖ
তোমরা যদি মানতে অস্বীকার করো তাহলে সেদিন কিভাবে রক্ষা পাবে যেদিনটি শিশুকে বৃদ্ধ বানিয়ে দেবে?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ প্রথম তো তোমাদের এ ভয় করা উচিত যে, আমার প্রেরিত রসূলের কথা যদি তোমরা না মানো তাহলে এ একই অপরাধের কারণে ফেরাউন যে দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম ভোগ করেছে অনুরূপ পরিণাম দুনিয়াতেই তোমাদের ভোগ করতে হবে। আর মনে করো, দুনিয়ায় যদি তোমাদের জন্য কোন আযাবের ব্যবস্থা নাও করা হয় তাহলেও কিয়ামতের আযাব থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি পাবে?
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-২০
اِنَّ رَبَّكَ یَعْلَمُ اَنَّكَ تَقُوْمُ اَدْنٰى مِنْ ثُلُثَیِ الَّیْلِ وَ نِصْفَهٗ وَ ثُلُثَهٗ وَ طَآئِفَةٌ مِّنَ الَّذِیْنَ مَعَكَ١ؕ وَ اللّٰهُ یُقَدِّرُ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ١ؕ عَلِمَ اَنْ لَّنْ تُحْصُوْهُ فَتَابَ عَلَیْكُمْ فَاقْرَءُوْا مَا تَیَسَّرَ مِنَ الْقُرْاٰنِ١ؕ عَلِمَ اَنْ سَیَكُوْنُ مِنْكُمْ مَّرْضٰى١ۙ وَ اٰخَرُوْنَ یَضْرِبُوْنَ فِی الْاَرْضِ یَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ١ۙ وَ اٰخَرُوْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ١ۖ٘ فَاقْرَءُوْا مَا تَیَسَّرَ مِنْهُ١ۙ وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَقْرِضُوا اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا١ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ هُوَ خَیْرًا وَّ اَعْظَمَ اَجْرًا١ؕ وَ اسْتَغْفِرُوا اللّٰهَ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ۠
হে নবী, তোমার রব জানেন যে, তুমি কোন সময় রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কোন সময় অর্ধাংশ এবং কোন সময় এক তৃতীয়াংশ সময় ইবাদতে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দাও। তোমার সঙ্গী একদল লোকও এ কাজ করে।২০ রাত এবং দিনের সময়ের হিসেব আল্লাহই রাখেন। তিনি জানেন, তোমরা সময়ের সঠিক হিসেব রাখতে পারো না। তাই তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। এখন থেকে কুরআন শরীফের যতটুকু স্বাচ্ছন্দে পড়তে পারবে ততটুকুই পড়বে। তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যকার কিছু লোক হবে অসুস্থ, কিছু লোক আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে ভ্রমণরত, এবং কিছু লোক আল্লাহর পথে লড়াই করে। তাই কুরআনের যতটা পরিমাণ সহজেই পড়া যায় ততটাই পড়তে থাকো। নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে “কর্জে হাসানা” দিতে থাকো। তোমরা নিজের জন্য যে পরিমাণ কল্যাণ অগ্রিম পাঠিয়ে দেবে তা আল্লাহর কাছে প্রস্তুত পাবে। সেটিই অধিক উত্তম এবং পুরস্কার হিসেবে অনেক বড়। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# ইতিপূর্বে তাহাজ্জুদ নামাযের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এ আয়াতের মাধ্যমে তা শিথিল ও সহজ করা হয়েছে। এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার সময়-কাল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন রেওয়ায়াত আছে। মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম ও আবু দাউদে এ রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে যে, তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কে প্রথম নির্দেশের পর এ দ্বিতীয় নির্দেশটি এক বছর পর নাযিল হয়েছিল এবং রাতের বেলার ইবাদত-বন্দেগী ফরয পর্যায়ে না রেখে নফল করে দেয়া হয়েছিল। ইবনে জারীর এবং ইবনে আবী হাতেম হযরত আয়েশা (রা.) থেকেই আর একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ নির্দেশটি প্রথম নির্দেশের আট মাস পরে দেয়া হয়েছিল। হযরত আয়েশা থেকে ইবনে আবী হাতেম তৃতীয় আরেকটি হাদীস বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এতে পরবর্তী নির্দেশটি ষোল মাস পরে নাযিল হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আবু দাউদ, ইবনে জারীর এবং ইবনে আবী হাতেম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এক বছর সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়েরের বর্ণনা হলো, নির্দেশটি দশ বছর পর নাযিল হয়েছিল। (ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম) আমাদের মতে এ বর্ণনাটিই অধিক বিশুদ্ধ। কারণ প্রথম রুকূ’র বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তা মক্কায় নাযিল হয়েছিল এবং মক্কী যুগেরও একদম প্রথম দিকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের পর তখন বড় জোর চারটি বছর অতিবাহিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় রকূর বিষয়বস্তু স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে তা মদীনাতে নাযিল হয়েছিল বলে মনে হয়। তখন কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং যাকাত ফরয হওয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছিল। তাই এ দু’টি রুকূ’র নাযিল হওয়ার সময়কালের মধ্যে অনিবার্যভাবে কম করে হলেও দশ বছরের ব্যবধান হওয়া উচিত।
# প্রাথমিক নির্দেশে যদিও অধিক রাত বা তার চেয়ে কিছু কম বা বেশী সময় নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু নামাযে নিমগ্নতার কারণে সময়ের আন্দাজ বা পরিমাপ ঠিক থাকতো না। আর সে সময় ঘড়িও ছিল না যে, সময় ঠিকমত পারিমাপ করা যাবে। সুতরাং কোন সময় দুই-তৃতীয়াংশ রাত পর্যন্ত ইবাদতে কেটে যেতো আবার কোন সময় তা হ্রাস পেয়ে শুধু এক-তৃতীয়াংশের মত হতো।
# প্রথম পর্যায়ে নির্দেশ দেয়ার সময় শুধু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই সম্বোধন করা হয়েছিল এবং তাঁকেই রাতে নামায পড়তে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় মুসলমানদের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ এবং নেকী অর্জনের যে অস্বাভাবিক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল সে কারণে অধিকাংশ সাহাবী এ নামাযকে গুরুত্ব দিতেন এবং তা পড়তেন।
# কুরআন তেলাওয়াত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণেই যেহেতু নামায দীর্ঘায়িত হয় সেজন্য বলেছেন যে, তাহাজ্জুদ নামাযে যতটা পরিমাণ কুরআন সহজে ও স্বাচ্ছন্দ্যে পড়তে পার, ততটাই পড়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী নামায আপনা থেকেই হ্রাস প্রাপ্ত হবে। এ কথাটির শব্দমালা বাহ্যিক ভাবে যদিও নির্দেশের মত, কিন্তু এ বিষয়ে সবাই একমত, যে তাহাজ্জুদের নামায ফরয নয়, বরং নফল। হাদীসেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলে, রসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ তোমাদের জন্য দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। সে জিজ্ঞাস করলোঃ এছাড়া অন্য কিছু কি আমার জন্য অবশ্য করণীয়? জবাবে বলা হলো, “না।” তবে তুমি স্বেচ্ছায় কিছু পড়লে, তা ভিন্ন কথা। (বুখারী ও মুসলিম)। এ আয়াত থেকে আরো একটি কথা জানা গেল যে, নামাযে রুকূ’ ও সিজদা যেমন ফরয তেমনি কুরআন মজীদ পড়াও ফরয। কারণ আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য স্থানে যেমন রুকূ’ ও সিজদা শব্দ নামায অর্থে ব্যবহার করেছেন তেমনি এখানে কুরআন পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এর অর্থ নামাযে কুরআন পড়। এভাবে প্রমাণ পেশ করার ব্যাপারে কেউ যদি একথা বলে আপত্তি উত্থাপন করে যে, তাহাজ্জুদের নামাযই যখন নফল, তখন সে নামাযে কুরআন মজীদ পড়া ফরয হয় কি করে? এর জবাব হলো, কেউ যখন নফল নামায পড়বে তখন নফল নামাযেরও সব শর্ত পূরণ করা এবং তার সব রুকূন’ ও ফরয আদায় করা আবশ্যক। কেউ একথা বলতে পারে যে, নফল নামাযের জন্য কাপড় ও শরীর পবিত্র হওয়া, অযু করা এবং সতর ঢাকা ওয়াজিব নয় এবং নফল নামাযে দাঁড়ানো, বসা এবং রুকূ’ ও সিজদা করা সবই নফল।
# হালাল ও বৈধ উপায়ে রুজি অর্জনের উদ্দেশে সফর করাকে কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর মেহেরবাণী ও করুণা অনুসন্ধান বলে আখ্যায়িত করেছে।
# এখানে আল্লাহ তা’আলা হালাল রুজি উপার্জন এবং আল্লাহর পথে জিহাদের উল্লেখ এক সাথে যেভাবে এবং অসুস্থতা জনিত অক্ষমতা ছাড়া এ দু’টি কাজকেও তাহাজ্জুদ নামায এবং অব্যাহতি লাভের কিংবা তা কিছুটা লাঘব করার কারণ হিসেবে গণ্য করেছেন তা থেকে বুঝা যায় যে, ইসলাম বৈধ পন্থায় রুজি উপার্জন করা কত বড় মর্যাদার কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণীত হাদীসে উল্লেখ আছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ ما من جالب يجلب طعاما الى بلد من بلدان المسلمين فيبيعه لسعر يومه الا كانت منزلته عند الله ثم قرا رسول الله صلى الله عليه وسلم واخرون يضربون فى الارض ……………….. যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন শহর বা জনপদে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসে এবং সে দিনের বাজার দরে তা বিক্রি করে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। এরপর রসূলুল্লাহ ﷺ এ আয়াতটি পড়লেন। واخرون يضربون فى الارض …………….. হযরত উমর (রা.) বলেছেনঃ ما من حال ياتينى عليه الموت بعد الجهاد فى سبيل الله احب الى من ان ياتينى وانا بين شعبتى جبل التمس من فضل الله وقرأ هذه الاية- আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া আর কোন অবস্থায় প্রাণ দেয়া আমার কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে থাকলে তা হলো এই যে, আমি আল্লাহর অনুগ্রহ বা মেহেরবানী অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে কোন গিরিপথ অতিক্রম কালে সেখানে মৃত্যু এসে আমাকে আলিঙ্গন করছে। তার পর তিনি এ আয়াতটি পড়লেন। (বায়হাকী ফী শু’আবিল ঈমান)
# এখানে নামায কায়েম করা এবং যাকাত দেয়া বলতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায এবং ফরয যাকাত বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে মুফাস্সিরগণ সবাই একমত।
# ইবনে যায়েদ বলেনঃ এর অর্থ যাকাত দেয়া ছাড়াও নিজের অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করা। এ খরচ আল্লাহর পথে জিহাদ করা, আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করা, জনকল্যাণমূলক কাজ করা কিংবা অন্যান্য কল্যাণকর কাজেও হতে পারে। আল্লাহকে কর্জ এবং উত্তম কর্জ দেয়ার অর্থ কি তার ব্যাখ্যা, আমরা ইতিপূর্বে বিভিন্ন স্থানে করেছি। (দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা আল বাকারাহ, টীকা ২৬৭ ;আল মা-য়েদাহ, টীকা ৩৩ এবং আলহাদীদ, টীকা ১৬ )।
# এর অর্থ হলো, আখেরাতের জন্য যা কিছু তোমরা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছো তা তোমাদের ঐ সব জিনিসের চেয়ে অনেক বেশী উপকারী যা তোমরা দুনিয়াতেই রেখে দিয়েছো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্ত কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করোনি। হাদীসে উল্লেখ আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন যে, এক সময় রসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেনঃ أَيُّكُمْ مَالُهُ أَحَبُّ إلَيْهِ مِنْ مَالِ وَارِثِهِ “তোমাদের এমন কেউ আছে যার নিজের অর্থ-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদের চেয়ে তার কাছে বেশী প্রিয়? জবাবে লোকেরা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কেউ-ই এমন নেই যার নিজের অর্থ-সম্পদ তাঁর কাছে তার উত্তরাধিকারীর অর্থ-সম্পদ থেকে বেশী প্রিয় নয়। ” তখন তিনি বললেনঃ “তোমরা কি বলছো তা ভেবে দেখো। ” লোকেরা বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, আমাদের অবস্থা আসলেই এরূপ। একথা শুনে নবী ﷺ বললেনঃ إنَّمَا مَالُ أَحَدِكُمْ مَا قَدَّمَ وَمَالُ وَارِثِهِ مَا أَخَّرَ তোমাদের নিজের অর্থ-সম্পদ তো সেই গুলো যা তোমরা আখেরাতের জন্য অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছো। আর যা তোমরা রেখে দিয়েছো সেগুলো ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের অর্থ-সম্পদ। (বুখারী, নাসায়ী ও মুসনাদে আবু ইয়ালা)।
১-২০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
মুসনাদে বাযযারে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কুরায়েশরা দারুণ নদুওয়াতে একত্রিত হয়ে পরস্পর বলাবলি করলোঃ এসো, আমরা এই ব্যক্তির (হযরত মুহাম্মাদ সঃ)-এর এমন এক নাম স্থির করি যে, সবারই মুখ দিয়ে এই নামই বের হবে, যাতে বাইরের লোকেরা একই আওয়ায শুনে যায়। তখন কেউ কেউ বললো যে, তার নাম ‘কাহিন’ বা গণক রাখা হোক। একথা শুনে অন্যেরা বললো যে, প্রকৃতপক্ষে সে তো ‘কাহিন’ বা গণক নয়। আর একটি প্রস্তাব উঠলো যে, তাহলে এর নাম ‘মাজনুন’ বা পাগল রাখা হোক। এর উপরও অন্যেরা আপত্তি উঠালো যে, সে পাগলও নয়। এরপর প্রস্তাব রাখা হলো যে, এর নাম ‘সাহির’ বা যাদুকর রাখা হোক। কিন্তু এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হলো। কারণ বলা হলো যে, সে ‘সাহির’ বা যাদুকরও নয়। মোটকথা তারা তাঁর এমন কোন খারাপ নাম স্থির করতে পারলো না যাতে সবাই একমত হতে পারে। এভাবেই ঐ মজলিস ভেঙ্গে গেল। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট আসলেন এবং “হে বস্ত্রাবৃত’ বলে তাঁকে সম্বোধন করলেন। (এই বর্ণনার একজন বর্ণনাকারী মুআল্লা ইবনে আবদির রহমানের নিকট হতে যদিও আহলে ইলমের একটি দল রিওয়াইয়াত নিয়ে থাকেন এবং তার থেকে হাদীস বর্ণনা করে থাকেন, কিন্তু তাঁর রিওয়াইয়াত সমূহের মধ্যে এমন বহু হাদীস রয়েছে যেগুলোর উপর তাঁর অনুসরণ করা যায় না)
১-৯ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন রাত্রিকালে কাপড় জড়িয়ে শয়ন করা পরিত্যাগ করেন এবং তাহাজ্জুদের নামাযে দাঁড়িয়ে থাকার কাজ অবলম্বন করেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশংকায়, আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা হতে তারা ব্যয় করে।” (৩২:১৬) রাসূলুল্লাহ (সঃ) সারা জীবন এ হুকুম পালন করে গেছেন। তাহাজ্জুদের নামায শুধু তাঁর উপর ফরয ছিল। অর্থাৎ এ নামায তাঁর উম্মতের উপর ওয়াজিব নয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এবং তুমি রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে; এটা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় যে, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” (১৭:৭৯) এই হুকুমের সাথে সাথে পরিমাণও বর্ণনা করে দিলেন যে, অর্ধেক রাত্রি বা কিছু কম-বেশী।
(আরবি) বলা হয় শয়নকারী ও বস্ত্রাবৃত ব্যক্তিকে। আবার এ অর্থও করা হয়েছেঃ হে কুরআনকে উত্তম রূপে গ্রহণকারী! তুমি অর্ধরাত্রি পর্যন্ত তাহাজ্জুদের নামাযে মগ্ন থাকো। অথবা কিছু কম বেশী করো। আর কুরআন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে, যাতে ভালভাবে বুঝতে পারা যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ হুকুম ও বরাবর পালন করে এসেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন কারীম খুবই ধীরে ধীরে ও থেমে থেমে পাঠ করতেন। ফলে খুব দেরীতে সূরা শেষ হতো। ছোট সূরাও যেন বড় হয়ে যেতো। সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, হযরত আনাস (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কিরআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুব টেনে টেনে পাঠ করতেন।” তারপর তিনি (আরবি) পাঠ করে শুনিয়ে দেন, যাতে তিনি (আরবি) এবং (আরবি) শব্দের উপর মদ করেন অর্থাৎ ওগুলো দীর্ঘ করে পড়েন।
ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কিরআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেকটি আয়াতের উপর পূর্ণ ওয়াকফ করতেন বা থামতেন। যেমন (আরবি)পড়ে থামতেন, (আরবি) পড়ে থামতেন (আরবি) এর উপর ওয়াফ করতেন এবং (আরবি) পড়ে থামতেন। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবী দাউদ এবং ‘জামে’ তিরমিযীতেও রয়েছে)
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কুরআনের পাঠককে কিয়ামতের দিন বলা হবেঃ ‘পড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে ও স্পষ্টভাবে পড়তে থাকো যেমন দুনিয়ায় পড়তে। তোমার মনযিল ও মরতবা হলো ওটা যেখানে তোমার আখিরী আয়াত শেষ হয়। (এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদ, জামে তিরমিযী ও সুনানে নাসাঈতেও রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন) আমরা এই তাফসীরের শুরুতে ঐ সব হাদীস আনয়ন করেছি যেগুলো ধীরে ধীরে পাঠ মুস্তাহাব হওয়া এবং ভাল ও মিষ্টি সুরে কুরআন পাঠ করার কথা বলে দেয়। যেমন এ হাদীসটি, যাতে রয়েছেঃ কুরআনকে স্বীয় সুর দ্বারা সৌন্দৰ্য্য মণ্ডিত কর এবং ঐ ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় যে মিষ্টি সুরে কুরআন পাঠ করে না। আর হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ কথা বলাঃ “তাকে হযরত দাউদ (আঃ)-এর বংশধর এর মধুর সুর দান করা হয়েছে এবং হযরত আবূ মূসা (রাঃ)-এর একথা বলাঃ “আমি যদি জানতাম যে, আপনি আমার কুরআন পাঠ শুনছেন তবে আমি আরো উত্তম ও মধুর সুরে পড়তাম।”
আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর এ কথা বলাঃ “বালুকার মত কুরআনকে ছড়িয়ে দিয়ো না এবং কবিতার মত কুরআনকে অভদ্রতার সাথে। পড়ো না, ওর চমৎকারিত্বের প্রতি খেয়াল রেখো এবং অন্তরে তা ক্রিয়াশীল করো। আর সূরা তাড়াতাড়ি শেষ করার পিছনে লেগে পড়ো না।” (এটা ইমাম বাগাভী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
একটি লোক এসে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে বললোঃ “আমি মুফাসসালের সমস্ত সূরা আজ রাত্রে একই রাকআতে পাঠ করে ফেলেছি।” তার একথা শুনে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাকে বললেনঃ “তা হলে সম্ভবতঃ তুমি কবিতার মত তাড়াতাড়ি করে পাঠ করে থাকবে। ঐ সূরাগুলো আমার বেশ মুখস্থ আছে যেগুলি রাসুলুল্লাহ (সঃ) মিলিয়ে পড়তেন। তারপর তিনি মুফাসসাল সূরাগুলোর মধ্যে বিশিষ্ট সূরার নাম লিখেন যেগুলোর দু’টি করে সূরা মিলিত করে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক এক রাকআতে পাঠ করতেন।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করছি গুরুভার বাণী। অর্থাৎ তা আমল করতেও ভারী হবে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও বৃহত্তের কারণে অবতীর্ণ হওয়ার সময়েও খুবই কষ্টদায়ক হবে। যেমন হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) বলেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তার উরু আমার উরুর উপর ছিল। তখন ওহীর বোঝা আমার উপর এমন ভারীবোধ হলো যে, আমার ভয় হলো না জানি হয়তো আমার উরু ভেঙ্গেই যাবে।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় আপনি কিছু অনুভব করেন কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “আমি এমন শব্দ শুনতে পাই যেমন কোন জিঞ্জীরের শব্দ হয়। আমি নিঃশব্দ হয়ে পড়ি। যখনই ওহী অবতীর্ণ হয় তখন তা আমার উপর এমন বোঝা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় যে, আমার মনে হয় যেন আমার প্রাণই বেরিয়ে পড়বে।”
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত হারিস ইবনে হিশাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার কাছে ওহী কিভাবে আসে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “কখনো কখনো খুবই কষ্ট হয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর্যায় শেষ হওয়ার সাথে সাথে ওহী আমার মুখস্থ হয়ে যায়। আবার কখনো কখনো ফেরেশতা মানুষের রূপ ধরে আগমন করে ও ওহী অবতীর্ণ করেন। তিনি কথা বলতে থাকেন এবং আমি তা মুখস্থ করতে থাকি।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমি একবার নবী (সঃ)-কে এমন অবস্থায় দেখেছি যে, তার উপর ওহী অবতীর্ণ হচ্ছে। তখন শীতকাল ছিল। এতদসত্ত্বেও তাঁর ললাট ঘর্মাক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং ঘর্ম টপ টপ করে পড়ছিল।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কোন কোন সময় উষ্ট্রীর উপর সওয়ার থাকতেন এবং ঐ অবস্থাতেই তাঁর উপর ওহী অবতীর্ণ হতো। তখন উন্ত্রী ওহীর ভারে ঝুঁকে পড়তো। তাফসীরে ইবনে জারীরে এও রয়েছে যে, অতঃপর যে পর্যন্ত ওহী বন্ধ না হতো উষ্ট্ৰী নড়তে পারতো না এবং তার গর্দান উঁচু হতো না। ভাবার্থ এই যে, স্বয়ং ওহীর ভার বহন করা কঠিন ছিল। এবং আহকাম পালন করাও ছিল অনুরূপ কঠিন। হযরত ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর উক্তি এটাই। হযরত আবদুর রহমান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, দুনিয়াতে যেমন এটা ভারী কাজ, তেমনই আখিরাতেও এর প্রতিদান ও পুরস্কার ভারী হবে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ অবশ্য রাত্রিকালের উত্থান দলনে প্রবলতর এবং বাক্য স্ফুরণে সঠিক। আবিসিনীয় ভাষায় (আরবি) শব্দের অর্থ হলো দাঁড়িয়ে থাকা। সারা রাত্রি দাঁড়িয়ে থাকলে (আরবি) বলা হয়।
তাহাজ্জুদের নামাযের উৎকৃষ্টতা এই যে, এর ফলে অন্তর ও রসনা এক হয়ে যায়। তিলাওয়াতের যে শব্দগুলো মুখ দিয়ে বের হয় তা অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। দিনের তুলনায় রাত্রির নির্জনতায় অর্থ ও ভাব অন্তরে ভালভাবে গেঁথে যায়। কেননা দিবস হলো কোলাহল ও অর্থোপার্জনের সময়।
হযরত আনাস (রাঃ) (আরবি) কে (আরবি) পড়লে জনগণ বলে ওঠেঃ আমরাতো (আরবি) পড়ে (আরবি) থাকি? উত্তরে তিনি বলেনঃ (আরবি) এবং একই অর্থবোধক শব্দ।
ইরশাদ হচ্ছেঃ (হে নবী সঃ)! দিবাভাগে তোমার জন্যে রয়েছে দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। তুমি শুয়ে-বসে থাকতে পার, বিশ্রাম করতে পার, বেশী বেশী নফল আদায় করতে পার এবং তোমার পার্থিব কাজ-কাম সম্পন্ন করতে পার। অতএব রাত্রিকে তুমি তোমার আখিরাতের কাজের জন্যে নির্দিষ্ট করে নাও। এ হুকুম ঐ সময় ছিল যখন রাত্রির নামায ফরয ছিল। তারপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করেন এবং হালকাকরণের জন্যে রাত্রির কিয়ামের সময় হ্রাস করে দেন এবং বলেনঃ তোমরা রাত্রির অল্প সময় কিয়াম কর। এই ফরমানের পর হযরত আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) (আরবি) হতে (আরবি) পর্যন্ত পাঠ করলেন। তাঁর এ উক্তিটি সঠিকও বটে।
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত সাঈদ ইবনে হিশাম (রঃ) তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন এবং মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। উদ্দেশ্য এই যে, তিনি তাঁর সেখানকার ঘরবাড়ী বিক্রি করে ফেলবেন এবং ওর মূল্য দিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি ক্রয় করে জিহাদে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি রোমকদের সাথে লড়াই করতে থাকবেন। অতঃপর হয় রোম বিজিত হবে, না হয় তিনি শাহাদাত বরণ করবেন। মদীনায় পৌঁছে তিনি তাঁর কওমের লোকদের সাথে মিলিত হন। এবং তাঁদের কাছে স্বীয় উদ্দেশ্য প্রকাশ করেন। তাঁর এই সংকল্পের কথা শুনে তাঁরা বললেনঃ তাহলে শুনুন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবদ্দশায় আপনারই কওমের ছয়জন লোক এটাই সংকল্প করেছিল যে, তারা নিজেদের স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দিবে এবং ঘরবাড়ী ইত্যাদি বেচে দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে দাঁড়িয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ খবর পেয়ে তাদেরকে ডেকে বললেনঃ “আমি কি তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ নই? খবরদার! এ কাজ করো না।” এভাবে তিনি তাদেরকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। এ হাদীস শুনে হযরত সাঈদ (রাঃ) তাঁর ঐ সংকল্প ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তাঁর কওমের লোকদেরকে বললেনঃ “তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমি আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলাম। তারপর তিনি সেখান হতে বিদায় নিয়ে স্বস্থানে চলে আসলেন। স্বীয় জামাআতের সাথে মিলিত হয়ে তিনি তাদেরকে বললেনঃ আমি এখান থেকে যাওয়ার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গমন করি এবং তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিতর নামায পড়ার পদ্ধতি জিজ্ঞেস করি। তিনি উত্তরে বলেনঃ এ মাসআলাটি হযরত আয়েশা (রাঃ) সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন। সুতরাং তুমি সেখানে গিয়ে তাঁকেই জিজ্ঞেস করো। তুমি তাঁর কাছে যা শুনবে তা আমাকেও বলে যেয়ো। আমি তখন হযরত হাকীম ইবনে আফলাহ (রাঃ)-এর কাছে গেলাম এবং তাকে বললাম আমাকে একটু হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে নিয়ে চলুন। তিনি প্রথমে যেতে অস্বীকার করলেও আমার পীড়াপীড়িতে শেষে যেতে সম্মত হলেন। সুতরাং আমরা উভয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে গেলাম। হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত হাকীম (রাঃ)-এর গলার স্বর শুনেই তাঁকে চিনতে পারলেন এবং বললেন “কে, হাকীম?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হ্যাঁ, আমি হাকীম ইবনে আফলাহ (রাঃ)। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার সাথে ওটা কে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “এটা সাঈদ ইবনে হিশাম (রাঃ)।” তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “কোন হিশাম? আমিরের ছেলে হিশাম কি?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “হ্যাঁ, আমিরের ছেলে হিশামই বটে।” এ কথা শুনে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর হযরত আমির (রাঃ)-এর জন্যে রহমতের দু’আ করলেন এবং বললেনঃ “আমির (রাঃ) খুব ভাল মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন।” আমি তখন আরয করলামঃ হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চরিত্র কেমন ছিল তা আমাকে অবহিত করুন। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “তুমি কি কুরআন পড়নি?” আমি উত্তর দিলাম ও হ্যাঁ, পড়েছি বটে। তিনি তখন বললেনঃ “কুরআনই তার চরিত্র।” আমি তখন তাঁর নিকট হতে বিদায় গ্রহণের অনুমতি চাওয়ার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু হঠাৎ আমার মনে পড়লো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) রাত্রির নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করা দরকার। আমার এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেনঃ “তুমি কি সূরা মুযযাম্মিল পড়নি?” আমি জবাব দিলামঃ হ্যাঁ, অবশ্যই পড়েছি। তিনি বললেনঃ “তাহলে শুনো। সূরার এই প্রথম ভাগে রাত্রির কিয়াম (দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়া) ফরয করা হয় এবং এক বছর পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীগণ তাহাজ্জুদের নামায ফরয হিসেবে আদায় করতেন। এমন কি তাঁদের পা ফুলে যেতো। বারো মাস পরে এই সূরার শেষের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং মহান আল্লাহ ভার লাঘব করে দেন। তাহাজ্জুদের নামাযকে তিনি ফরয হিসেবে না রেখে নফল হিসেবে রেখে দেন।” এবার আমি বিদায় গ্রহণের ইচ্ছা করলাম। কিন্তু বিতর নামাযের মাসআলাটি জিজ্ঞেস করার কথা মনে পড়ে গেল। তাই আমি বললামঃ হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিতর নামাযের পদ্ধতিও আমাকে জানিয়ে দিন। তিনি তখন বললেনঃ শুননা, (রাত্রে) আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে মিসওয়াক, অযুর পানি ইত্যাদি ঠিক করে একদিকে রেখে দিতাম। যখনই আল্লাহর ইচ্ছা হতো তিনি চক্ষু খুলতেন। তিনি উঠে মিসওয়াক করতেন ও অযু করতেন এবং আট রাকআত নামায পড়তেন। মধ্যে তাশাহহুদে মোটেই বসতেন না। আট রাকআত পূর্ণ করার পর তিনি আত্তাহিয়্যাতুতে বসতেন, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার যিকির করতেন, দু’আ করতেন এবং সালাম না ফিরিয়েই উঠে পড়তেন। আর নবম রাকআত পড়ে যিকির ও দুআ করতেন এবং উচ্চ শব্দে সালাম ফিরাতেন। এ শব্দ আমরাও শুনতে পেতাম। তারপর বসে বসেই দুই রাকআত নামায পড়তেন। হে আমার প্রিয় পুত্র! সব মিলিয়ে মোট এগারো রাকআত হলো। অতঃপর যখন তাঁর বয়স বেশী হয় এবং দেহ ভারী হয়ে যায় তখন থেকে তিনি সাত রাকআত বিতর পড়ে সালাম ফিরাতেন এবং পরে বসে বসে দুই রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং হে প্রিয় বৎস! এটা নয় রাকআত হলো। আর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, যখন তিনি কোন নামায পড়তে শুরু করতেন তখন তা চিরস্থায়ীভাবে পড়তে থাকতেন। তবে হ্যাঁ, কোন ব্যবস্থা বা ঘুম অথবা দুঃখ কষ্টের কারণে কিংবা রোগের কারণে রাত্রে ঐ নামায পড়তে না পারলে দিনের বেলায় বারো রাকআত পড়ে নিতেন। আমার জানা নেই যে, তিনি গোটা কুরআন রাত থেকে নিয়ে সকাল পর্যন্ত পড়ে শেষ করেছেন এবং রমযান ছাড়া অন্য কোন পুরো মাসই রোযা রেখেছেন।” অতঃপর আমি উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট হতে বিদায় নিয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট আসলাম এবং তাঁর সামনে সমস্ত প্রশ্ন ও উত্তরের পুনরাবৃত্তি করলাম। তিনি সবটারই সত্যতা স্বীকার করলেন এবং বললেনঃ “আমিও যদি তাঁর কাছে যাতায়াত করতে পারতাম তবে আমি নিজের কানে শুনে আসতাম।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে মাদুর বিছিয়ে রাখতাম যার উপর তিনি তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। লোকেরা এ খবর জানতে পেরে রাত্রির নামাযেও তাঁর ইকতিদা করার জন্যে এসে পড়ে। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) রাগান্বিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে যান। উম্মতের প্রতি তিনি বড়ই মেহেরবান ছিলেন এবং সাথে সাথে এ ভয়ও করতেন যে, হয়তো এ নামায ফরয হয়ে যাবে, তাই তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ “হে লোক সকল! ঐ সব আমলের উপরই কষ্ট স্বীকার কর যেগুলো পালনের তোমাদের শক্তি রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা পুণ্যদানে অপারগ হবেন না। বরং তোমরাই আমলে অপারগ হয়ে যাবে। ঐ আমলই সর্বাপেক্ষা উত্তম যার উপর চিরস্থায়ীভাবে থাকা হয়। এদিকে কুরআন কারীমে এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং সাহাবীগণ রাত্রির কিয়াম শুরু করে দেন এবং ঘুম যেন না আসে এ জন্যে তারা রশি বেঁধে লটকিতে লাগলেন। আট মাস এই ভাবেই কেটে গেল। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁদের এ চেষ্টা দেখে আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করলেন এবং রাত্রির কিয়ামকে এশার ফরয নামাযের দিকে ফিরিয়ে দিলেন। আর রাত্রির কিয়াম ছেড়ে দিলেন। (এ রিওয়াইয়াতটি মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমেও রয়েছে। কিন্তু এর বর্ণনাকারী মূসা ইবনে উবাইদাহ যুবাইদী দুর্বল। আসল হাদীস সূরা মুয্যাম্মিলের নাযিল হওয়ার উল্লেখ ছাড়া সহীহ গ্রন্থেও রয়েছে) এই হাদীসের শব্দাবলীর ভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, এটা মাদানী সূরা, অথচ প্রকৃতপক্ষে এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। অনুরূপভাবে এ রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, আর্ট মাস পরে এর শেষের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। এই উক্তিটিও দুর্বল। সহীহ ওটাই যা মুসনাদের উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক বছর পরে শেষের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সূরা মুযযাম্মিলের প্রাথমিক আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) রমযান শরীফের রাত্রির কিয়ামের মতই কিয়াম করতে শুরু করেন। আর এ সূরার প্রাথমিক ও শেষের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার মাঝে প্রায় এক বছরের ব্যবধান ছিল। তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত আবূ উমামাহ (রাঃ) হতেও অনুরূপ বর্ণিত আছে।
হযরত আবূ আবদির রহমান (রঃ) বলেন যে, প্রাথমিক আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবীগণ (রাঃ) এক বছর পর্যন্ত কিয়াম করেন, এমন কি তাদের পা ও পদনালী ফুলে যায়। অতঃপর (আরবি) অবতীর্ণ হয় এবং তাঁরা শান্তি পান। হযরত হাসান বসরী (রঃ) হযরত সুদ্দীরও (রঃ) উক্তি এটাই। মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে এ রিওয়াইয়াতটি হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে ষোল মাসের সময়কালের সাথে বর্ণিত আছে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, সাহাবীগণ (রাঃ) এক বছর বা দু’বছর পর্যন্ত কিয়াম করতে থাকেন। তাঁদের পা ও পদনালী ফুলে যায়। তারপর সূরার শেষের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং তাঁদের ভার লাঘব হয়ে যায়। হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) দশ বছরের মেয়াদের কথা বলেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রাথমিক আয়াতগুলোর হুকুম অনুযায়ী মুমিনগণ রাত্রির কিয়াম শুরু করেন, কিন্তু তাঁদের খুবই কষ্ট হয়। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি দয়া করেন এবং (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন এভাবে তাঁদের প্রতি প্রশস্ততা আনয়ন করেন এবং সংকীর্ণতা দূরীভূত করেন। সুতরাং আল্লাহ তা’আলারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁতে মগ্ন হও। অর্থাৎ দুনিয়ার কাজ-কারবার হতে অবসর লাভ করে প্রশান্তির সাথে খুব বেশী বেশী তার যিকির করতে থাকো, তার দিকে ঝুঁকে পড়ে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ কর। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “অতএব যখনই অবসর পাও সাবধান করো।” একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি) অর্থাৎ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং দুনিয়া ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন।
এখানে ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! পার্থিব সৃষ্টিকূল হতে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করার একটা সময় অবশ্যই নির্দিষ্ট করে নাও।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহই হলেন মালিক ও ব্যবস্থাপক। পূর্ব ও পশ্চিম সবই তাঁর অধিকারভুক্ত। তিনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কেউ নেই। সুতরাং হে নবী (সঃ)! তুমি যেমন এই আল্লাহরই ইবাদত করছো, তেমনই একমাত্র তার উপরই নির্ভরশীল হয়ে যাও। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ তারই ইবাদত কর এবং তার উপর ভরসা কর।” এই বিষয়টিই নিম্নের আয়াতেও রয়েছেঃ
(আরবি) অর্থাৎ “আমরা শুধু আপনারই ইবাদত করি এবং শুধু আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।” এই অর্থের আরো বহু আয়াত রয়েছে যে, ইবাদত, আনুগত্য এবং ভরসা করার যোগ্য একমাত্র আল্লাহ।
১০-১৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে কাফিরদের বিদ্রুপাত্মক কথার উপর ধৈর্য ধারণের হিদায়াত করছেন এবং বলছেনঃ তাদেরকে কোন তিরস্কার ধমক ছাড়াই তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। আমি স্বয়ং তাদেরকে দেখে নিবো। আমার গজব ও ক্রোধের সময় দেখবো কি করে তারা মুক্তি পেতে পারে। তাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী ও স্বচ্ছল লোক, যারা তোমাকে নানা প্রকারে কষ্ট দিচ্ছে, যাদের উপর দ্বিগুণ প্রাপ্য রয়েছে, এক জানের আর এক মালের, আর তারা কোনটাই আদায় করছে না, তাদের সাথে তুমি সম্পর্ক ছিন্ন করে দাও, তারপর দেখে নিয়ো, আমি তাদের সাথে কি ব্যবহার করি। অল্প দিন তারা দুনিয়ায় ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকুক, পরিণামে তারা কঠিন শাস্তির মধ্যে পতিত হবে। কেমন আযাব? এমন কঠিন আযাব যে, তাদেরকে শৃংখল পরিয়ে জাহান্নামের প্রজ্বলিত অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হবে। আর তাদেরকে এমন খাদ্য খেতে দেয়া হবে যা কণ্ঠ নালীতে আটকে যাবে। নীচেও নামবে না এবং উপরেও উঠবে না। আরো নানা প্রকারের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে দেয়া হবে। এমন এক সময়ও হবে যখন পৃথিবী ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে। পর্বতসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বালুকারাশিতে পরিণত হয়ে যাবে। যে বালুকারাশিকে বাতাস এদিক-ওদিক উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কারো কোন নাম-নিশানাও বাকী থাকবে না। যমীন এক সমতল ভূমিতে পরিণত হবে, যেখানে কোন উঁচু-নীচু পরিলক্ষিত হবে না।
এরপর প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ হে লোক সকল এবং বিশেষ করে হে কাফিরদের দল! আমি তোমাদের নিকট তোমাদের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ এক রাসূল (সঃ) পাঠিয়েছি, যে রাসূল সত্যবাদী ও সত্যায়িত, যেমন আমি ফিরাউনের নিকট আমার আহকাম পৌঁছাবার জন্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ফিরাউন যখন তাকে অমান্য করলো তখন আমি তাকে কিরূপ কঠিন শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম তা তো তোমাদের জানা আছে। সুতরাং আমার এই নবী (সঃ)-কে যদি তোমরা অমান্য কর তবে তোমাদেরও পরিণাম ভাল হবে না। তোমাদের উপরও আল্লাহর আযাব এসে পড়বে এবং তোমাদেরকে তচনচ করে দেয়া হবে। কেন না এই রাসূল (সঃ) সমস্ত রাসূলের নেতা। সুতরাং তাকে অমান্য করার শাস্তিও হবে অন্যান্য শাস্তি অপেক্ষা বড়।
এর পরবর্তী আয়াতের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হলোঃ যদি তোমরা কুফরী কর তবে বল তো ঐ দিনের শাস্তি হতে তোমরা কিরূপে মুক্তি পেতে পার যে দিনের ভয়াবহতা কিশোরকে বৃদ্ধে পরিণত করবে? দ্বিতীয় অর্থ হলোঃ তোমরা যদি এতো বড় ভয়াবহ দিনকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস কর তবে তোমরা, তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় কিরূপে লাভ করতে পার? এই উভয় অর্থই উত্তম হলেও প্রথম অর্থটিই বেশী উত্তম! এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি) এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “এটা হলো কিয়ামতের দিন যেই দিন আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আঃ)-কে বলবেনঃ ‘উঠো এবং তোমার সন্তানদের মধ্য হতে জাহান্নামীদেরকে পৃথক কর।’ তখন হযরত আদম (আঃ) বলবেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! কতজনের মধ্য হতে কতজন? আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ প্রতি হাজারের মধ্য হতে নয়শ নিরানব্বই জনকে।’ এ কথা শুনে মুসলমানদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল এবং তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-ও তাদের চেহারা দেখে তা বুঝে নিলেন। সুতরাং তিনি তাদেরকে সান্ত্বনার সুরে বললেনঃ জেনে রেখো যে, হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান অনেক। ইয়াজুজ ও মাজুজও হযরত আদম (আঃ)-এরই সন্তান। তারা এক একজন নিজের পিছনে এক হাজার করে সন্তান ছেড়ে যায়। সুতরাং তারা এবং তাদের মত লোক মিলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে। সুতরাং ঘাবড়াবার কিছুই নেই। জান্নাত তোমাদের জন্যে এবং তোমরা জান্নাতের জন্যে।” (ইমাম তিবরানী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এটা গারীব হাদীস) সূরা হজ্বের শুরুতে এরকম হাদীস সমূহের বর্ণনা গত হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ঐ দিনের ভয়াবহতার কারণে আকাশও বিদীর্ণ হয়ে যাবে। কেউ কেউ (আরবি)-এর (আরবি) সর্বনামটি আল্লাহর দিকে ফিরিয়েছেন। কিন্তু এটা সবল নয়। কেননা এখানে তাঁর যিকিরই নেই।
মহান আল্লাহ বলেনঃ ঐদিনের ওয়াদা নিশ্চিতরূপে সত্য। ওটা সংঘটিত হবেই। ঐ দিনের আগমনে কোন সন্দেহই নেই।
১৯-২০ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, এই সূরাটি জ্ঞানীদের জন্যে সরাসরি উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয়। যে কেউ হিদায়াত প্রার্থী হবে সেই প্রতিপালকের মর্জি হিসেবে হিদায়াতের পথ পেয়ে যাবে এবং তাঁর কাছে পৌঁছে যাওয়ার ওয়াসীলা লাভ করবে। যেমন অন্য সূরায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা ইচ্ছা করবে না যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (৭৬:৩০)।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এবং তোমার সাহাবীদের একটি দল যে কখনো কখনো দুই তৃতীয়াংশ রাত্রি পর্যন্ত কিয়াম কর, কখনো কখনো অর্ধেক রাত্রি পর্যন্ত এবং কখনো কখনো এক তৃতীয়াংশ রাত্রি পর্যন্ত কিয়াম করে থাকে এবং তাহাজ্জুদের নামাযে কাটিয়ে দাও তা আল্লাহ খুব ভালই জানেন। অবশ্য তোমরা এর সঠিক হিসাব রাখতে পার না। কেননা এটা খুবই কঠিন কাজ। দিবস ও রজনীর সঠিক পরিমাণ একমাত্র আল্লাহই নির্ধারণ করে থাকেন। কারণ কখনো দিন ও রাত উভয়ই সমান সমান হয়ে থাকে, কখনো রাত ছোট হয় ও দিন বড় হয় এবং কখনো দিন ছোট হয় ও রাত বড় হয়। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা জানেন যে, এটা পালন করার শক্তি তোমাদের নেই। সুতরাং এখন থেকে তোমরা রাত্রির নামায ততটাই পড় যতটা তোমাদের জন্যে সহজ। কোন সময় নির্দিষ্ট থাকলো না যে, এতোটা সময় কাটানো ফরয। এখানে কিরআত দ্বারা নামায অর্থ নেয়া হয়েছে। যেমন সূরা বানী ইসরাইল রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তুমি তোমার কিরআত খুব উচ্চ স্বরেও পড়ো না এবং খুব নিম্ন স্বরেও না।” এখানে (আরবি) দ্বারা কিরআতকে বুঝানো হয়েছে।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর সাথীগণ এ আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া বাধ্যতামূলক নয়। সূরা ফাতিহাকে পড়া যাবে এবং অন্য কোন জায়গা হতেও পড়া চলবে। একটি আয়াত পড়াও যথেষ্ট হবে। আবার এই মাসআলার দৃঢ়তা ঐ হাদীস দ্বারা করেছেন যাতে রয়েছে যে, তাড়াতাড়ি করে নামায আদায়কারীকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “কুরআনের যে অংশ তোমার নিকট সহজ তা দ্বারা নামায পড়।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে) এ মাযহাব জমহূরের বিপরীত। জমহূর তাদেরকে এ জবাব দেন যে, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করলো না তার নামায হলো না।”
সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ নামায, যাতে উম্মুল কুরআন (অর্থাৎ সূরা ফাতিহা) পাঠ করা হয় না তা অকেজো, তা অকেজো, তা অকেজো ও অসম্পূর্ণ।”
ইবনে খুযাইমার (রঃ) সহীহ গ্রন্থে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে মারফূ’রূপে বর্ণিত আছেঃ “ঐ ব্যক্তির নামায হয় না যে নামাযে উম্মুল কুরআন পাঠ করে না।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে। এ আয়াতটি, বরং পুরো সূরাটি মাক্কী। এটা মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে। ঐ সময় জিহাদ ছিল না, বরং মুসলমানরা অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় ছিলেন। এরপরও গায়েবের এ খবর দেয়া এবং কার্যতঃ ওটা প্রকাশ পাওয়া যে, মুসলমানরা পরবর্তীকালে পুরোপুরিভাবে জিহাদে লিপ্ত হয়েছেন, সুতরাং এটা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নবুওয়াতের একটা বড় ও স্পষ্ট নির্দশন। উপরোক্ত ওযরগুলোর কারণে মুসলমানরা রাত্রির কিয়ামের দায়িত্ব হতে মুক্ত হয়ে যায়।
হযরত আবূ রাজা’ মুহাম্মাদ (রঃ) হযরত হাসান (রঃ)-কে প্রশ্ন করেনঃ “হে আবূ সাঈদ (রঃ)! যে ব্যক্তি পূর্ণ কুরআনের হাফিয হয়েও তাহাজ্জুদের নামায পড়ে না, শুধু ফরয নামায আদায় করে, ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “সে তো কুরআনকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছে। তার উপর আল্লাহর অভিশাপ! আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে বলেনঃ সে ঐ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল যে, আমি তাকে শিখিয়ে ছিলাম। আরো বলেনঃ তোমাদেরকে ওটা শিখানো হয়েছে যা তোমরা নিজেরা জানতে না এবং তোমাদের বাপ দাদারাও জানতো না।” তখন আবূ রাজা’ (রঃ) তাঁকে আবার বলেনঃ “হে আবূ সাঈদ (রঃ)! আল্লাহ তা’আলা তো বলেছেনঃ কুরআন হতে তোমরা যা সহজভাবে পড়তে পার পড়।” হযরত হাসান (রঃ) উত্তরে বলেনঃ “হ্যাঁ, তা ঠিক বটে। পাঁচটি আয়াত হলেও পড়।” সুতরাং বাহ্যতঃ জানা যাচ্ছে যে, কুরআনের হাফিযের রাত্রের নামাযে কিছু না কিছু কিয়াম করা হযরত ইমাম হাসান বসরী (রঃ)-এর মাযহাবে ওয়াজিব ছিল। একটি হাদীসও এর প্রমাণ দিচ্ছে, যাতে রয়েছে যে, সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে এমন একটি লোক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “এটা হলো ঐ ব্যক্তি যার কারণে শয়তান প্রস্রাব করে থাকে। এর এক ভাবার্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যে এশার ফরয নামাযও পড়ে না। এটাও বলা হয়েছে যে, রাত্রে নফল হিসেবে কিয়াম করে না।
সুনানে রয়েছেঃ “হে কুরআন ওয়ালাগণ! তোমরা বিতর পড়তে থাকো।” অন্য এক হাদীসে আছেঃ “যে ব্যক্তি বিতর পড়ে না সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।” হাসান বসরী (রঃ)-এর উক্তি হতেও বেশী গরীব হলো আবূ বকর ইবনে আবদিল আযীয হাম্বেলীর (রঃ) উক্তি, যিনি বলেন যে, রমযান মাসের কিয়াম ফরয। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
মু’জামে তিবরানীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) (আরবি) এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেনঃ “ওটা একশটি আয়াত। (এটা অত্যন্ত গারীব হাদীস। ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনঃ আমি শুধু এটা মুজামে তিবরানীতেই পেয়েছি)
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ তোমরা নামায কায়েম কর ও যাকাত প্রদান কর। অর্থাৎ তোমরা ফরয নামাযের হিফাজত কর এবং ফরয যাকাত আদায় কর। এ আয়াতটি ঐ গুরুজনদের দলীল যারা বলেন যে, মক্কা শরীফেই যাকাত ফরয হওয়ার হুকুম নাযিল হয়েছে। তবে কি পরিমাণ বের করা হবে, নেসাব কি ইত্যাদির বর্ণনা মদীনা শরীফে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলাই এসব ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত হাসান (রঃ), হযরত কাতাদাহ (রঃ) প্রমুখ পূর্বযুগীয় মনীষীদের উক্তি এই যে, এই আয়াত পূর্ববর্তী রাত্রির কিয়ামের হুকুম সম্বলিত আয়াতকে মানসূখ বা রহিত করে দিয়েছে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে বলেনঃ “দিন-রাত্রে পাচঁ ওয়াক্ত নামায ফরয।” লোকটি প্রশ্ন করেঃ “এ ছাড়া কি অন্য কোন নামায আমার উপর ফরয আছে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “না, তবে তুমি নফল হিসেবে পড়তে পার।”
মহান আল্লাহর উক্তিঃ তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করতে থাকো, যার উপর আল্লাহ তোমাদেরকে খুবই উত্তম ও পুরোপুরি বিনিময় প্রদান করবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কে সে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? তিনি তার জন্যে এটা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন।”(২:২৪৫) আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্যে ভাল কাজ যা কিছু অগ্রীম প্রেরণ করবে তোমরা তা পাবে আল্লাহর নিকট। ওটা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে নিজের সম্পদের চেয়ে (নিজের) উত্তরাধিকারীর সম্পদকে বেশী ভালবাসে?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে নিজের সম্পদের চেয়ে উত্তরাধিকারীদের সম্পদকে বেশী ভালবাসে।” তিনি বললেনঃ “যা বলছো চিন্তা করে বল।” তাঁরা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তো এটা ছাড়া অন্য কিছু জানি না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যে ব্যক্তি যা (আল্লাহর পথে) খরচ করবে তাই শুধু তার নিজের সম্পদ, আর যা সে রেখে যাবে তাই তার উত্তরাধিকারীদের সম্পদ।” (এ হাদীসটি হাফিয আকূল ইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সুনানে নাসাঈতেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। অর্থাৎ খুব বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তোমাদের সমস্ত কার্যে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা, তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু ঐ ব্যক্তির উপর যে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে।