Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৮৫/এবং কাফির-রা‌ বলে:-৩০) [**সকল যুগের সকল দুশমন এক ও অভিন্ন :- *আর শির্ক পরিহার করে চলুন:- *কাফেরদের জন্য মোটেই সহজ হবে না।:-] www.motaher21.net সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির পারা:২৯ ১- ২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৫/এবং কাফির-রা‌ বলে:-৩০)
[**সকল যুগের সকল দুশমন এক ও অভিন্ন :-
*আর শির্ক পরিহার করে চলুন:-
*কাফেরদের জন্য মোটেই সহজ হবে না।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
পারা:২৯
১- ২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তফসীরে ফী জিলালিল‌‌কু কুরআন:;-
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১
یٰۤاَیُّہَا الۡمُدَّثِّرُ ۙ﴿۱﴾
হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২
قُمۡ فَاَنۡذِرۡ ۪ۙ﴿۲﴾
উঠ, সতর্ক কর,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩
وَ رَبَّکَ فَکَبِّرۡ ۪﴿ۙ۳﴾
এবং তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪
وَ ثِیَابَکَ فَطَہِّرۡ ۪﴿ۙ۴﴾
তোমার পোশাক পবিত্র রাখো,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫
وَ الرُّجۡزَ فَاہۡجُرۡ ۪﴿ۙ۵﴾
আর শির্ক পরিহার করে চলুন ,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৬
وَ لَا تَمۡنُنۡ تَسۡتَکۡثِرُ ۪﴿ۙ۶﴾
আর বেশী পাওয়ার প্রত্যাশায় দান করবেন না ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৭
وَ لِرَبِّکَ فَاصۡبِرۡ ؕ﴿۷﴾
এবং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ কর।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৮
فَاِذَا نُقِرَ فِی النَّاقُوۡرِ ۙ﴿۸﴾
যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৯
فَذٰلِکَ یَوۡمَئِذٍ یَّوۡمٌ عَسِیۡرٌ ۙ﴿۹﴾
সেদিন হবে এক সংকটের দিন।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১০
عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ غَیۡرُ یَسِیۡرٍ ﴿۱۰﴾
কাফেরদের জন্য মোটেই সহজ হবে না।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১১
ذَرۡنِیۡ وَ مَنۡ خَلَقۡتُ وَحِیۡدًا ﴿ۙ۱۱﴾
আমাকে ছেড়ে দাও এবং তাকে যাকে আমি একাই সৃষ্টি করেছি।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১২
وَّ جَعَلۡتُ لَہٗ مَالًا مَّمۡدُوۡدًا ﴿ۙ۱۲﴾
আমি তাকে দিয়েছি বিপুল ধন-সম্পদ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৩
وَّ بَنِیۡنَ شُہُوۡدًا ﴿ۙ۱۳﴾
এবং নিত্য সঙ্গী পুত্রগণ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৪
وَّ مَہَّدۡتُّ لَہٗ تَمۡہِیۡدًا ﴿ۙ۱۴﴾
আর তাকে দিয়েছি স্বাচ্ছন্দ জীবনের প্রচুর উপকরণ-
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৫
ثُمَّ یَطۡمَعُ اَنۡ اَزِیۡدَ ﴿٭ۙ۱۵﴾
এরপরও সে কামনা করে যে, আমি তাকে আরো অধিক দিই।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৬
کَلَّا ؕ اِنَّہٗ کَانَ لِاٰیٰتِنَا عَنِیۡدًا ﴿ؕ۱۶﴾
কখনো নয়, সে তো আমাদের নিদর্শনসমূহের বিরুদ্ধাচারী।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৭
سَاُرۡہِقُہٗ صَعُوۡدًا ﴿ؕ۱۷﴾
আমি অচিরেই তাকে ক্রমবরন শাস্তি দ্বারা আচ্ছন্ন করব।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৮
اِنَّہٗ فَکَّرَ وَ قَدَّرَ ﴿ۙ۱۸﴾
সে তো চিন্তা করল এবং সিদ্ধান্ত করল।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-১৯
فَقُتِلَ کَیۡفَ قَدَّرَ ﴿ۙ۱۹﴾
সুতরাং ধ্বংস হোক সে! কেমন করে সে এ সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করল !
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২০
ثُمَّ قُتِلَ کَیۡفَ قَدَّرَ ﴿ۙ۲۰﴾
আবার ধ্বংস হোক সে! কেমন করে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল!
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২১
ثُمَّ نَظَرَ ﴿ۙ۲۱﴾
সে আবার চেয়ে দেখল।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২২
ثُمَّ عَبَسَ وَ بَسَرَ ﴿ۙ۲۲﴾
অতঃপর সে ভ্রূকুঞ্চিত ও মুখ বিকৃত করল।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৩
ثُمَّ اَدۡبَرَ وَ اسۡتَکۡبَرَ ﴿ۙ۲۳﴾
অতঃপর সে পিছনে ফিরল এবং দম্ভ প্রকাশ করল।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৪
فَقَالَ اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا سِحۡرٌ یُّؤۡثَرُ ﴿ۙ۲۴﴾
অবশেষে বললোঃ এ তো এক চিরাচরিত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৫
اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا قَوۡلُ الۡبَشَرِ ﴿ؕ۲۵﴾
এ তো মানুষের কথা মাত্র।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৬
سَاُصۡلِیۡہِ سَقَرَ ﴿۲۶﴾
আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাক্বার (জাহান্নামে)।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৭
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا سَقَرُ ﴿ؕ۲۷﴾
তুমি কি জানো, সে দোযখ কি?
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৮
لَا تُبۡقِیۡ وَ لَا تَذَرُ ﴿ۚ۲۸﴾
এটা অবশিষ্ট রাখবে না এবং ছেড়েও দেবে না ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-২৯
لَوَّاحَۃٌ لِّلۡبَشَرِ ﴿ۚۖ۲۹﴾
ওটা দেহের চামড়া দগ্ধ করে দেবে।

সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
পারা:২৯
১- ২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তফসীরে ফী জিলালিল‌‌কু কুরআন:;-

সুরা: আল-মুদ্দাস্সি

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৭৪

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই সূরাটি নাযিল হওয়ার কারণ ও সময় প্রসংগে পূর্ববর্তী সূরা আল মুযযাম্মিল-এ যা কিছু আলােচিত হয়েছে, এই সূরাটির ক্ষেত্রেও তা প্রযােজ্য। সেখানে এই মর্মে একাধিক বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, এটি সূরা আল আলাক-এর পরে নাযিল হওয়া প্রথম ওহী। অপর একটি বর্ণনা এই মর্মেও উদ্বৃত হয়েছে যে, প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার এবং রসূল(স.)-এর ওপর মোশরেকদের নির্যাতন শুরু হওয়ার পর এটা নাযিল হয়েছে। ইমাম বুখারী(র.) বর্ণনা করেন যে, ইয়াহিয়া ইবনে কাসীর বলেন, আমি আবু সালমা ইবনে আব্দুর রহমানকে কোরআনের প্রথম নাযিল হওয়া অংশ কোনটি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জবাবে বলেন, সূরা আল মুদ্দাসসির। আমি বললাম, লোকেরা তাে বলে সূরা আল আলাক। আবু সালমা বললেন, আমিও জাবের ইবনে আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এবং তুমি আজ আমাকে যা বললে, সে কথা আমিও তাকে বলেছিলাম। কিন্তু জাবের আমাকে বললেন, আমি তােমাকে যা বলছি তা খােদ রসূল(স.) আমাকে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমি হেরায় কিছুকাল অবস্থান করেছিলাম। সেই অবস্থান শেষ হওয়ার পর নেমে আসতেই শুনলাম কে যেন আমাকে ডাকছে । আমি ডান দিকে তাকালাম। কিছুই দেখলাম না। অবশেষে ওপরের দিকে তাকাতেই একটা কিছু দেখে সংগে সংগেই আমি খাদীজার কাছে এসে বললাম, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও এবং আমার ওপর ঠান্ডা পানি ঢালাে। আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হলাে এবং আমার ওপর ঠান্ডা পানি ঢালা হলাে। এরপরই সূরা ‘মুদ্দাসসির’ নাযিল হলাে। মুসলিম শরীফের বর্ণনা অনুসারে রসূল(স.) বলেন, ‘আমি চলার সময়ে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়ায শুনতে পেলাম। আমি তৎক্ষণাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে আছেন সেই ফেরেশতা, যিনি হেরার গুহায় আমার কাছে এসেছিলেন। আমি হাঁটু গেড়ে প্রায় মাটির সাথে মিশে বসে পড়লাম। তারপর আমার পরিবারের কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে ঢেকে দেয়া হলাে। এই সময় সূরা আল মুদ্দাসসির নাযিল হলাে। এরপর ক্রমাগত ওহী আসতে লাগলাে। উল্লেখ্য যে, বােখারীতেও এ হাদীসটি অবিকল একই ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। ইবনে কাসীর স্বীয় তাফসীরে এই হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, এই বিবরণটিই মনে হয় সংরক্ষিত। আর এ বিবরণ থেকে মনে হয়, এর আগেও ওহী নাযিল হয়েছিলাে। কেননা রসূল(স.) বলেছেন, দেখলাম যে ফেরেশতা আমার কাছে হেরা গুহায় এসেছিলেন তিনিই, আসলে তিনি হচ্ছেন জিবরাঈল। তিনি ইতিপূর্বে সূরা আলাক নিয়ে এসেছিলেন। এরপর ওহীর বিরতি ঘটে। তারপর পুনরায় ফেরেশতা নাযিল হয়। সুতরাং দুই বর্ণনার সমন্বয়ের উপায় এই যে, এই সূরা (সূরা মােদ্দাসসের) একেবারে প্রথম নাযিল হওয়া সুরা নয়, বরং বিরতির পর নাযিল হওয়া প্রথম সুরা। তাবরানীতে অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) বলেন, একদিন ওলীদ ইবনে মুগীরা কোরায়শ বংশের লােকদেরকে দাওয়াত করে বললাে, এই লােকটি (মােহাম্মদ সা.) সম্পর্কে তােমাদের ধারণা কী? তখন কেউ বললো, জাদুকর। কেউ বলে, না, জাদুকর নয়। আবার কেউ বললাে, জ্যোতিষী। কেউ বললাে, না, জ্যোতিষী নয়। কেউ বলে, কবি। আবার কেউ বললাে, না কবি নয়। কেউ বললাে, বরঞ্চ প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে চলে আসা এটা একটা জাদুমন্ত্র । অতপর সবাই একমত হলাে যে, মুহাম্মদ(সা.) কর্তৃক প্রচারিত বাণী বংশানুক্রমে প্রাপ্ত একটা জাদুমন্ত্র। কাফেরদের এই সমাবেশ ও তাদের অভিব্যক্তি এই মতামতের কথা জানতে পেরে রসূল(স.) ভীষণ মর্মাহত হলেন এবং বিমর্ষ অবস্থায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন। এমতাবস্থায় সুরার এই প্রাথমিক আয়াত কয়টি নাযিল হলাে! ‘হে কম্বলাচ্ছাদিত। ওঠো। সতর্ক করাে। তােমার প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা করাে। তােমার পােশাক পবিত্র করাে। অপবিত্রতাকে বর্জন করো। অধিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে দান করাে না। নিজের প্রতিপালকের (সন্তুষ্টির) উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ করাে।’ সূরা আল মুযযাম্মিল-এ নাযিল হওয়ার কারণ প্রসংগে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, অবিকল সেটা আলােচ্য সূরা সংক্রান্ত বর্ণনাও হতে পারে। এই অনিশ্চয়তার কারণে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না যে, এই দুই সূরার মধ্যে কোনটি আগে নাযিল হয়েছে এবং কোনটি কোন উপলক্ষে নাযিল হয়েছে। এ আয়াত কয়টির উদ্দেশ্যে রাসূল(স.)-কে তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের যােগ্য করে গড়ে তােলা। অতপর প্রকাশ্যভাবে ও পরিপূর্ণরূপে ইসলামের দাওয়াতদানের মাধ্যমে কোরায়শদের মােকাবেলা করা। এ কাজ করতে গিয়ে স্বভাবতই তাকে নানা রকম নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হবে, আর তার সম্মুখীন হতে হলে তাকে পূর্বাহ্নে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। উভয় সূরার এই প্রথম আয়াত কয়টির পরবর্তী অংশ সম্ভবত কিছুকাল পরে নাযিল হয়েছে, যখন কোরায়শরা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, একগুয়েমী প্রদর্শন করেছে এবং রসূল(স.)-কে মিথ্যা অপবাদ ও হীন চক্রান্ত দ্বারা কষ্ট দিয়েছে। তবে উল্লেখিত দুটি সম্ভাবনার যেটিই বাস্তব হােক-এটা মােটেই বিচিত্র নয় যে, উভয় সুরার প্রথমাংশ ও পরবর্তী অংশ এক সাথে নাযিল হয়ে থাকতে পারে। কেননা উভয়াংশের একটা অভিন্ন প্রেক্ষাপট ও উপলক্ষ্য রয়েছে। মােট কথা হচ্ছে, রসূল(স.)-কে মিথ্যুক সাব্যস্ত করা, প্রত্যাখ্যান করা এবং কোরায়শ নেতাদের ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধির জন্যে রাসূল(স.)-এর প্রচন্ডভাবে মর্মাহত হওয়া। এটা যদি মেনে নেয়া হয়, তাহলে উভয় সূরার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সুরা আল কালাম-এর মতাে হবে। সেই প্রেক্ষাপট আমরা সুরা ‘আল কালাম’-এর শুরুতে আলােচনা করেছি। সুরার নাযিল হওয়ার প্রকৃত কারণ ও উপলক্ষ্য যাই হােক না কেন, এর প্রথমেই যে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীদের সম্বােধন করে ইসলামী দাওয়াত ও তাবলীগের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার দায়িত্বে ন্যস্ত করেছেন এবং তাকে তার ঘুম, ভীরুতা ও জড়তা কাটিয়ে উঠে জিহাদ, সংগ্ৰাম ও কঠোর সাধনায় আত্মনিয়োগ উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রথম দুটি আয়াতেই এই সম্বােধন ও নির্দেশনা সুস্পষ্ট হয়ে আছে। যথা, ‘হে কম্বলাচ্ছাদিত, ওঠো, সতর্ক করাে।’ তারপর পরবর্তী ৫টি আয়াতে তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করা এবং আল্লাহর নির্দেশিত কার্যক্রমের মাধ্যমে শক্তি আহরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যথা, ‘তােমার প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা করাে, তােমার পােশাক পবিত্র করাে, অপবিত্রভাকে বর্জন করাে, অধিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে দান করাে না। আর তােমার প্রভুর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ করাে। সূরা মুজাম্মিলের মতাে এখানেও সূরার প্রথমাংশের নির্দেশাবলীর শেষে স্থান পেয়েছে ধৈর্যের আদেশ। এরপরই সূরায় অংগীভূত হয়েছে আখেরাতকে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুমকি, হুঁশিয়ারি ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ঘােষণা। এ ক্ষেত্রেও সূরা আল মুযযাম্মিল-এর সাথে এ সূরার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যখন শিংগায় ফুক দেয়া হবে, সেদিনটি হবে এক কঠিন দিন।… অচিরেই আমি তাকে দুরূহ জায়গায় আরােহন করবে।(আয়াত ৮-১৭) সূরা আল কালাম-এর মতো সূরা মুদ্দাসসির সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেরদের মধ্য থেকে একজনকে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট দ্বারা চিহ্নিত করেছে এবং তার অসংখ্য দুরভিসন্ধির মধ্য থেকে নিদিষ্ট একটির দৃশ্য অংকিত করেছে। সম্ভবত উভয় ক্ষেত্রে একই ব্যক্তিকে বুঝানাে হয়েছে। অনেকের মতে এই ব্যক্তিটি হচ্ছে ওলীদ ইবনে মুগীরা। আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে আগামীতে এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ সবিস্তারে উল্লেখ করা হবে। পরবর্তী আয়াতগুলােতে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে—কি কি কারণে আল্লাহ তায়ালা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ‘সে চিন্তা-ভাবনা করেছে এবং কিছু কথাবার্তা রচনা করার চেষ্টা চালিয়েছে। পুনরায় আল্লাহর অভিশাপ হােক তার ওপর!… শেষ পর্যন্ত সে বললাে, এতাে আর কিছু নয়, আগে থেকে চলে আসা জাদুমন্ত্র মাত্র। এতে মানুষের কথা ছাড়া আর কিছু নয়।'(আয়াত ১৮-২৫) পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘দোযখে নিক্ষেপ করবাে। আর তুমি কি জানাে, সে দোযখটা কেমন? তা কিছুই অবশিষ্ট রাখে না, কাউকে ছাড়েও না। চামড়া ঝলসিয়ে দেয়। তার ওপর উনিশ জন কর্মচারী নিয়ােজিত।’ অতপর দোযখের দৃশ্য, দোযখের দায়িত্বশীল উনিশ জন ফেরেশতার উল্লেখ এবং এই উনিশ সংখ্যাটির কথা শুনে মােশরেক ও দুর্বল মােমেনদের মধ্যে হৈ চৈ, সন্দেহ সংশয় বিভ্রান্তি, কুটিল প্রশ্ন ও বিদ্রুপের যে হিড়িক চলেছিলাে, সেই প্রসংগে এই সূরার পরবর্তী আয়াতে এই সংখ্যা উল্লেখের পেছনে আল্লাহর কি গভীর ও মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আল্লাহর অদৃশ্য জ্ঞানের খানিকটা অজানা রহস্য উন্মােচন করে প্রসংগত এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, গায়েব বা অদৃশ্য জগতের জ্ঞান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। উন্মোচিত এই অজানা রহস্য গায়েবের প্রতি ঈমানের একটি জরুরী তথ্যের ওপর আলােকপাত করে। আয়াতটির বক্তব্য, আমি কিছু সংখ্যক ফেরেশতা ছাড়া আর কাউকে দোযখের দায়িত্বশীল বানাইনি, আর তাদের সংখ্যা শুধু এ জন্যে উল্লেখ করেছি যেন কাফেররা বিভ্রাটে পড়ে। প্রভুর সৈন্য সামন্তের সংখ্যা কতাে, তা কেবল তিনিই জানেন। এই দোযখের উল্লেখ মানুষের জন্যে স্মরণিকা ছাড়া আর কিছু নয়।’ (আয়াত ৩১) অতপর আখেরাত, দোযখ এবং দোযখের দায়িত্বশীলদের বিষয়টির সাথে দৃশ্যমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর সংযােগ স্থাপন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের মনে চেতনা ও সতর্কতা সৃষ্টির জন্যে উক্ত উভয় প্রকারের নিদর্শনের সাহায্য নেয়া হবে। বলা হয়েছে, কখনাে নয়, চাঁদের শপথ, পশ্চাদপসরনরত রাতের শপথ এবং বিকাশমান প্রভাতের শপথ। নিশ্চয় দোযখ বড় বড় নিদর্শনসমূহের অন্যতম। মানুষের জন্যে ভীতি প্রদর্শনকারী। তােমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এগিয়ে যেতে যায় অথবা যে ব্যক্তি পিছিয়ে থাকতে চায় তার জন্যে ভীতিপ্রদ।’ অতপর অপরাধীদের ও সৎ কর্মশীলদের অবস্থানস্থল বর্ণনা করা হচ্ছে। এখানে বলা হচ্ছে যে, অপরাধীরা দীর্ঘ যবানবন্দীতে তাদের অপরাধের স্বীকারােক্তি দেবে এবং যে যে কারণে তারা কেয়ামতের দিন আটকাবস্থায় ও যিম্মী হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে, তা খুলে বলবে। তারপর তাদের ব্যাপারে কারাে সুপারিশেও যে কাজ হবে না, সে কথাও লক্ষণীয়, ‘প্রত্যেক প্রাণী স্বীয় কৃতকর্মের বিনিময়ে যিম্মী হবে। কেবল দক্ষিণ বাহু ওয়ালারা (অর্থাৎ কর্মশীলরা) বাদে। এরা বেহেশতে অবস্থান করে অপরাধীদের জিজ্ঞাসা করবে, কি কি কারণে তােমরা দোযখে গিয়ে? তারা বলবে, আমরা নামায পড়তাম না, দরিদ্রদেরকে খাবার খাওয়াতাম না, আর সত্যের বিরুদ্ধে বাজে কথা রটনাকারীদের সাথে যােগ দিয়ে আমরাও তা রটনা করতাম, আর কর্মফল দেয়ার দিনটিকে অস্বীকার করতাম। শেষ পর্যন্ত আমরা সেই অকাট্য সত্যের সম্মুখীন হয়ে পড়লাম। এই সময় সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোনাে উপকারে আসবে না। কেয়ামতের এই অবমাননাকর দৃশ্য ও অপমানজনক স্বীকারােক্তির প্রেক্ষাপটে কোরআন তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের বর্তমান অভিমত কি জানতে চাইছে। সেই ভয়াবহ পরিণতি থেকে। রেহাই পাওয়ার ও সময় থাকতে সদুপদেশ গ্রহণের এই আহবান সম্পর্কে তাদের বিবেচনা কি তা জানতে চাইছে। আর সেই সাথে এই দাওয়াত থেকে তাদের বন্য পশুর মতাে ছুটে পালানাের একটা হাস্যকর ও বিদ্রুপাত্মক দৃশ্য তুলে ধরেছে। যথা, ওদের কি হলাে যে, এই স্মরণিকাকে উপেক্ষা করছে, যেন ওরা বাঘ থেকে ছুটে পালানাে বন্য গাধা। অতপর তাদের সেই মতিভ্রমের রহস্য উন্মােচন করা হচ্ছে, যা তাদেরকে ঘেরাও করে রাখছে এবং পরম হিতাকাংখী উপদেশদাতার দাওয়াত কবুল করতে বাধা দিচ্ছে, আসলে তাদের প্রত্যেকের ইচ্ছা যেন তাকে প্রকাশ্য গ্রন্থসমূহ দেয়া হয়।’ বস্তুত এরূপ ইচ্ছার পেছনে রয়েছে রসূল(স.)-এর প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ। প্রত্যেকের কাছে আসমানী কিতাব নাযিল করা হােক এই তাদের বাসনা। আর অপর সুপ্ত কারণ হলাে তাদের ভীতির অভাব, কখনাে নয়, আসল কথা হলাে, তারা আখেরাতকে ভয় পায় না।’ উপসংহারে এক আপােষহীন ঘােষণার মাধ্যমে সব কিছুকে আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার হাতে সােপর্দ করা হচ্ছে। বলা হয়েছে কখনাে নয়; নিশ্চয়ই এ এক স্মরণিকা। যার ইচ্ছা, সে এসে স্মরণ করুক। আল্লাহর ইচ্ছা না হলে কেউ স্মরণ করবে না। তিনিই তাকওয়ার উপযুক্ত এবং তিনিই ক্ষমা করার মালিক। এভাবে এ সূরা কোরআনের সেই জিহাদের একটি অংশ রূপে বিবেচ্য, যা কোরায়শদের অন্তরে বদ্ধমূল জাহেলিয়াত ও জাহেলী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে কোরঅান পেশ করেছে। অনুরূপভাবে ইসলামী দাওয়াতের প্রতি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে যে উপেক্ষা প্রদর্শন ও প্রচন্ড শত্রুতার মনােভাব পোষণ করেছিলাে এবং নানা চক্রান্ত এটেছিলাে, কোরআন তার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালিয়েছে। এদিক দিয়ে সূরা মুজাম্মিল, সূরা মুদ্দাসসির ও সূরা কালাম-এর বিষয়বস্তুতে এতো সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় যে, তা দেখলে মনে হয়, এই তিনটি সূরাই কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়েছিলাে। অবশ্য সূরা মুযযাম্মিল-এর শেষাংশ এর ব্যাতিক্রম। কেননা আমরা আগেই বলেছি যে, এ অংশটি রসূল(স.) ও তার সাথীদের একটি গােষ্ঠির বিশেষ রুহানী প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছিলাে। শব্দগত ও ধ্বনিগত কাঠামাে ও আংগিক সৌষ্ঠবের দিক থেকে সূরাটির বিন্যাস চমকপ্রদ। একটি মাত্র আয়াত ছাড়া সমগ্র সূরা ছােট ছােট আয়াতে বিন্যস্ত। অত্যন্ত দ্রুত পড়ে যাওয়া যায় । প্রত্যেক আয়াতের শেষের শব্দগুলাে মিত্রাক্ষর। আয়াতগুলাে কখনাে গুরু কখনাে লঘু ছন্দে ছন্দায়িত। বিশেষত, এই কট্টর কাফেরটির চিন্তা পরিকল্পনা, কপাল সংকুচিত করা ও মুখ বাঁকা করার দৃশ্য যেখানে অংকন করা হয়েছে, আর দোযখের দৃশ্য যেখানে এই বলে অংকন করা হয়েছে যে, তা কোনাে কিছুই অবশিষ্ট রাখে না ও কাউকে ছাড়ে না। যেখানে তাদের পালানাের চিত্র। অংকন করা হয়েছে এই বলে যে, তারা যেন বাঘ দেখে পালানাে কতিপয় বন্য গাধা। এভাবে মর্মগত ও বিষয়গত বিভিন্নতার সাথে সাথে আয়াতের আংগিক বিন্যাস তথা ছন্দগত ও মিত্রাক্ষরজনিত বিভিন্নতা সুরায় সামগ্রিকভাবে একটা বিশেষ ধরনের স্বাদ সৃষ্টি করে। তাছাড়া স্থান বিশেষে এই বিভিন্নতার বিশেষ উদ্দেশ্যও রয়েছে। কোথাও তার উদ্দেশ্য নানা প্রশ্ন ও ধিক্কার তুলে ধরা, কোথাও কাফেরদের দুষ্কর্মের প্রতি বিদ্রুপ ও উপহাস করা। এবার সূরার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করার প্রয়াস পাবাে।

ফী জিলালিল কুরআন:   *দাওয়াতের দায়িত্ব ও দায়ীর গুণ : ‘ওহে কম্বলাচ্ছাদিত। ওঠো, সতর্ক করাে… এবং তােমার প্রভুর (সন্তুষ্টির) উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধরো।’ সূরার এই প্রথম সাতটি আয়াতের প্রথমটিতেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল(স.) কে সম্বােধন করে তাকে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, মানব জাতিকে সতর্ক করা, জাগ্রত করা, পার্থিব জীবনের যাবতীয় দুর্দশা ও দুষ্কর্ম থেকে মুক্ত ও রক্ষা করা, তাকে আখেরাতে দোযখ থেকে মুক্ত করা এবং তাকে সময় থাকতে মুক্তির পথে পরিচালিত করা। এ দায়িত্ব যখন একজন ব্যক্তির ওপর অর্পিত হয়, চাই তিনি নবী বা রসূল যেই হােন না কেন, তখন তা যথার্থই একটা গুরুদায়িত্ব বটে। কেননা মানব জাতি সামগ্রিকভাবে এই দাওয়াতের প্রতি এত বিদ্রোহী, এত একগুঁয়ে, এত বিভ্রান্ত এবং এত বিমুখ যে, যে কোনাে মানুষের পক্ষে এই দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ‘তাদের সতর্ক করাে’ এই সতর্ক করার কাজটি হচ্ছে রিসালাতের প্রধান কাজ, গােমরাহীতে লিপ্ত অচেতন ও উদাসীন লােকদের জন্যে যে আসন্ন ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে, তার সম্পর্কে সাবধান করা। আল্লাহ তায়ালা এই সতর্কীকরণের ব্যবস্থাটি করে তাঁর বান্দাদের প্রতি পরম করুণাই প্রদর্শন করেছেন। কারণ তারা গােমরাহ হয়ে গেলে বা গােমরাহীতে নিমজ্জিত থাকলে আল্লাহর রাজ্যের কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না। আর তারা সুপথপ্রাপ্ত হলে আল্লাহর রাজ্যে কোনােই বৃদ্ধি ঘটেনা। তবে তার দয়া ও করুণা তাদেরকে আখেরাতের আযাব থেকে বাচানাের জন্যে এবং দুনিয়ার বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্যে হেদায়াতের ও সতর্কীকরণের এই ব্যবস্থা করেছেন। করুণার বশবর্তী হয়েই তিনি মানব জাতিকে আল্লাহর ক্ষমা ও বেহেশত লাভ করার জন্যে নবী ও রসূলদের প্রেরণ করেন, যারা মানবজাতিকে আল্লাহর বিধানের দিকে দাওয়াত দেন। অন্যদেরকে সতর্ক করার দায়িত্ব অর্পনের পরই আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রসূলকে ব্যক্তিগত গুণাগুণের দিকে মনােনিবেশ করার নির্দেশ দেন, তােমার প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করাে। এখানে স্বীয় প্রভুর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা ও বর্ণনা করার জন্যে রসূলকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এই সাথে এর বর্ণনাভংগীর ভেতরে এই ভাবধারাও সুপ্ত রয়েছে যে, একমাত্র তােমার প্রভুরই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করাে। কেননা একমাত্র তিনিই শ্রেষ্ঠতম এবং তারই শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা করা সমীচীন, অন্য করাে নয়। এ নির্দেশটি আল্লাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত আকীদার একটি দিকের ব্যাখ্যা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। বস্তুত এ বিশ্ব জগতে যত প্রাণী, বস্তু ও তত্ত্ব আছে, তার সবই ছােট, সবই নগণ্য। একমাত্র আল্লাহই বড়, শ্রেষ্ঠ ও মহান। সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্ববৃহৎ সর্বোৎকৃষ্ট, সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম আল্লাহর সামনে সকল সত্ত্বা, শক্তি, বস্তু, ঘটনা, তত্ত্ব, ইত্যাদি অদৃশ্য ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । এই ঈমানী আকীদা-বিশ্বাস প্রত্যয় ও চেতনা নিয়ে মানবজাতিকে সতর্ক করা ও তাদেরকে তাদের অশুভ পরিণতি ও দুর্দশা থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার দায়িত্ব পালনের জন্যে রসূল(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। উক্ত চেতনা ও প্রত্যয় নিয়ে যদি তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তার কাছে সকল ষড়যন্ত্র, সকল বাধা এবং সকল প্রতিকূল শক্তিকে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে হবে, আর একমাত্র আল্লাহই তার কাছে বড় মনে হবে, যিনি তাঁকে এই সতর্কীকরণের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছেন। বন্তুত দাওয়াতের কাজে যে কঠিন বাধাবিঘ্ন ও বিপদ মুসিবতের সম্মুখীন হতে হয়, তার মােকাবেলায় টিকে থাকার জন্যে এই চেতনা সর্বক্ষণ হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকা প্রয়োজন। সবসময় তার এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস পােষণ করতে হবে যে, দুনিয়ার সকল শক্তি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ, একমাত্র আল্লাহই অজেয় ও পরাক্রান্ত। এরপর তাকে পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। বলা হয়েছে, ‘তােমার পােশাক পবিত্র করাে।’ আরবী ভাষায় পােশাকের পবিত্রতা দ্বারা মনের পবিত্রতা ও কর্মের পবিত্রতা এককথায় গােটা সত্ত্বা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর পবিত্রতা বুঝানাে হয়। আর পবিত্রতা হলাে এমন একটি অবস্থার নাম, যা মানুষকে আল্লাহর ঘনিষ্টতম ফেরেশতাদের কাছ থেকে বাণী গ্রহণের যােগ্য বানায়। এই অবস্থাটা রেসালাতের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। সতর্কীকরণ ও ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালনের এটি হচ্ছে অপরিহার্য গুণ। নানা প্রতিকূল অবস্থা ও নােংরা পরিবেশে ইসলামী দাওয়াত ও প্রচারের কাজ চালাতে হলে, বিশেষত নিজে নােংরামী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে নােংরা মানুষদেরকে পবিত্র করতে হলে তাকে পরিপূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করতেই হবে। নানা রকমের ও পরিস্থিতিতে নানা রকমের মানসিকতাসম্পন্ন জনতার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌছানাের ব্যাপারে এটি একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও লক্ষণীয় বিষয়। এরপর রাসূল(স.)-কে শিরক পরিত্যাগ করা এবং আযাবের কারণ হতে পারে এমন যাবতীয় দোষ থেকে মুক্ত হওয়ার আদেশ দেয়া হচ্ছে, মলিনতা পরিহার করাে।’ রাসূল(স.) নবুয়তের আগে শিরক এবং অন্য সকল দুষণীয় কাজ পরিহার করে চলতেন। এই বিকৃতি, অন্যায় ও অসত্য আকীদা-বিশ্বাস এবং চরিত্র ও অভ্যাসের মলিনতা ও নােংরামী থেকে তার পবিত্র স্বভাব সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলাে। জাহেলিয়াতের যমানায়ও কোনাে দুষ্কর্মে তিনি কখনাে এক মুহূর্তের জন্যেও জড়িত হয়েছেন বলে জানা যায়নি। তবে এখানে যে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, তা হচ্ছে শিরক থেকে চূড়ান্তভাবে সম্পর্কচ্ছেদ এবং আপােষহীনভাবে কুফরী পরিহার করার ঘােষণা সম্বলিত। এটি এবং স্বভাবসুলভ শিরক এর দ্বারা শিরকজনিত যাবতীয় নােংরা স্বভাব থেকে মুক্ত থাকাও বুঝানাে হয়েছে। ‘রুজঝ’ শব্দটির অর্থ আযাব, কিন্তু এখানে এ দ্বারা আযাবের কারণ বুঝানাে হয়েছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে শিরকের মলিনতা ও নােংরামী যেন তােমাকে স্পর্শ করতে না পারে সে ব্যাপারে সাবধান থাকো। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি নিজের কোনাে চেষ্টা সাধনাকে বড় বা বেশী করে না দেখান এবং নিজে যেন তার কৃতিত্ব দাবী না করেন। ‘অধিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু দান করাে না।’ কেননা তাকে ভবিষ্যতে আরাে অনেক অনুগ্রহ ও অনেক দান করতে হবে এবং অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা চান তিনি যেন নিজের কোনাে কাজ বা দানকে বড় করে না দেখেন, যেন তার বিনিময়ে আরাে বেশী পাওয়া ও খােটা দেয়া না হয়। এই দাওয়াত এমন কোনাে ব্যক্তি চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় না যে নিজের দান ও চেষ্টা সাধনাকে বড় বলে অনুভব করে। কোনাে দান বা সকর্ম করলে তাকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হবে এবং মনে করতে হবে যে, এটা করতে পারাও আল্লাহর দান। এ কাজটি করার সুযােগ ও ক্ষমতা যে আল্লাহ তায়ালা তাকে দিয়েছেন, সে জন্যে বড়াই নয় বরং আল্লাহর শােকর করা উচিত। পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর প্রভুর উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দিচ্ছেন। এই দাওয়াতের দায়িত্ব যখনই অর্পণ করা হয়, তখনই তার প্রতি এই আদেশের পুনরাবৃত্তি করা হয়। আসলে আল্লাহর দিকে দাওয়াতের এই কঠিন সংগ্রামে ধৈর্যই হচ্ছে আসল রসদ। এ সংগ্রাম একই সাথে পরিচালনা করতে হয় নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে নিজের কামনা বাসনার বিরুদ্ধে এবং শয়তানের নেতৃত্ব ও প্ররােচনায় পরিচালিত ইসলাম বিরােধীদের বিরুদ্ধেও। এটি এমন একটি সর্বাত্মক ও প্রাণান্তকর সংগ্রাম, যার ধৈর্য ছাড়া আর কোনাে রসদ নেই, আর তাও এমন ধৈর্য যার উদ্দেশ্য আল্লাহকে সস্তুষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হবে না।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-১৫

ثُمَّ یَطْمَعُ اَنْ اَزِیْدَۗۙ

এরপরও সে লালায়িত, আমি যেন তাকে আরো বেশী দান করি।

ফী জিলালিল কুরআন:

  *ইসলাম বিরােধীদের প্রতি সতর্কবাণী : রসূল(স.)-কে দেয়া এই নির্দেশের পর পরবর্তী আয়াতে অন্যদেরকে সতর্ক ও সচেতন করা হয়েছে, ‘যখন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন সেটি হবে বড়ই কঠিন দিন, কাফেরদের জন্যে মােটেই সহজ নয়।’ বস্তু তার আগাগােড়াই কঠিন। তার মাঝে কোথাও এক মুহূর্তের জন্যে আরামদায়ক কোনাে অবস্থার সৃষ্টি হবে না। দিনটি কত কঠিন ও কষ্টদায়ক হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়নি এবং সংক্ষিপ্তভাবে শুধু কঠিন ও কষ্টকর দিন বলে সেখানকার সার্বিক দুঃখ কষ্টের ও দুর্দশার প্রচন্ডতা আরাে তীব্রভাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। সুতরাং শিংগায় ফুঁক দেয়া ও সেই কঠিন দিনের মুখােমুখী হওয়ার আগেই সতর্ককারীর সতর্কবাণী শুনে সাবধানতা অবলম্বন করা কাফেরদের জন্যে একান্তই বাঞ্ছনীয়। এই সাধারণ হুঁশিয়ারী ও হুমকির পর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্য থেকে এক বিশেষ ব্যক্তির মােকাবেলা করা হয়েছে। মনে হয়, দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান ও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানাের কাজে এই শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির ভূমিকা ছিলো। এ জন্যে তাকে লক্ষ্য করে কঠোরতম হুমকি উচ্চারণ করা হয়েছে। তার এমন একটি বিভৎস চিত্র অংকন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত কুটিল ও বিদ্রুপাত্মক এবং তাকে একটি জীবন্ত ও চলন্ত বিষধর সাপের আকারে চিত্রিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমাকে এবং আমি যাকে একলা সৃষ্টি করেছি তাকে একলা ছেড়ে দাও… তুমি কি জানাে এ দোযখ কি বস্তু, তা কোনাে জিনিসকে অবিশিষ্ট রাখেনা এবং কাউকে ছেড়ে দেয় না। তার দায়িত্বে আছে উনিশ জন। একাধিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এই আয়াতগুলােতে যে নরাধমের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সে হচ্ছে ওলীদ ইবনুল মুগীরা। ইবনে জারীর বর্ণনা করেন যে, একবার ওলীদ ইবনুল মুগীরা রসূল(স.)-এর কাছে এলাে। রসূল(স.) তাকে কোরআন পড়ে শােনালেন। এতে তার ভেতরে কিছুটা ভাবান্তর ঘটলাে বলে মনে হলাে। আবু জেহেল একথা জানতে পেরে তার কাছে এসে বললাে, চাচা আপনার গোত্রের লােকেরা আপনার জন্যে টাকা সগ্রহ করতে ইচ্ছুক। ওলীদ বললাে, কেন? আবু জেহেল বললাে, আপনাকে দিবে। কারণ আপনি মােহাম্মাদের কাছে এসেছেন এবং তার কাছে যে ধর্ম রয়েছে তা দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন। (অত্যন্ত নােংরা পন্থায় আবু জেহেল ওলীদের অহমবােধ উস্কে দিতে চাইছিলাে এবং যে দিকটায় ওলীদের আত্মসম্মানবােধ বেশী টনটনে সেদিকটাতেই সে আঘাত করছিলাে।) ওলীদ বললাে, কোরায়শরা তাে জানে যে, আমি কোরায়শ বংশের সবেচেয়ে ধনী ব্যক্তি। আবু জেহেল বললাে, তাহলে আপনি মুহাম্মদ সম্পর্কে এমন কিছু বলুন যাতে লােকেরা বুঝতে পারে যে, আপনি তার ঘাের বিরোধী। সে বললাে, তাহলে আমি তার সম্পর্কে কী বলবাে? আল্লাহর কসম, তােমরা কেউ কবিতা সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশী জানাে না। এমন কি জিনদের কবিতাও আমি জানি। অথচ মােহাম্মাদের আনীত বাণীর সাথে সেসব কবিতার মােটেই মিল নেই। তার কথায় এক অদ্ভুত স্বাদ আছে। তা তার নীচের সব কিছুকে কাবু করে দেয়। সেই বাণী সবকিছুর ওপরে থাকে-কোনাে কিছুর নিচে নয়। আবু জেহেল বললাে, ওর সম্পর্কে কিছু না বললে আপনার গােত্রের লােকেরা আপনার ওপর খুশী হবে না। ওলীদ বললাে, ঠিক আছে। আমাকে একটু ভাবতে দাও। কিছু সময় চিন্তাভাবনার পর সে বললাে, এটা অন্যদের কাছ থেকে শেখ জাদুমন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এই সময়ে নাযিল হয়, আমাকে.. ছেড়ে দাও.. উনিশ জন। আরেক বর্ণনায় আছে কোরায়শরা বলতে আরম্ভ করেছিলাে যে, ওলীদ যদি মােহাম্মাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যায় তাহলে সমগ্র কোরায়শ এ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যাবে। আবু জেহেল একথা শুনে বললাে, আমি একা তােমাদের সকলের মােকাবেলায় যথেষ্ট। তারপর সে ওলীদের কাছে গেলে ওলীদ খানিকক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বললাে, নিশ্চয়ই ওটা অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া জাদুমন্ত্র । দেখাে না সে (মােহাম্মাদ) এ দ্বারা মানুষের সাথে স্ত্রীর, সন্তানের ও আত্মীয় স্বজনের সম্পর্ক ছিন্ন করে। এ হচ্ছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে ঘটনাটার যে রূপ দাঁড়ায় তাই। কোরআন কিন্তু  অত্যন্ত জীবন্ত ও দৃপ্তকণ্ঠে কঠোর হুমকির মধ্য দিয়ে পরবর্তী আয়াতগুলােতে এ ঘটনা বর্ণনা করে, আমাকে এবং আমি যাকে একাকী সৃষ্টি করেছি তাকে ছেড়ে দাও।’ এখানে সম্বােধন করা হয়েছে রাসূল(স.)-কে। বলা হচ্ছে যে, এই ব্যক্তিটিকে-যাকে আমি একাকী সৃষ্টি করেছিলাম, সৃষ্টির সময়ে তার এতাে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি ছিলাে না-তাকে ও আমাকে ছেড়ে দাও। তার চক্রান্তে ততােমরা বিচলিত হয়াে না, তাকে শায়েস্তা কিভাবে করতে হয় সে ভার আমিই নিচ্ছি। এখানে এসে অনুভূতিতে তীব্র শিহরণ জাগে। ভয়ে ও ত্রাসে শ্রোতার গােটা স্নায়ুমন্ডল কম্পমান হয়। কল্পনার চোখে সে দেখতে পায়, অসীম শক্তির অধিকারী এক মহাপরাক্রান্ত ও মহাপ্রতাপশালী সম্রাট যেন এই অতি ক্ষুদ্র, অতি নগন্য, অতীব দুর্বল ও অতীব অক্ষম সৃষ্টির ঘাড় মটকাতে ছুটে চলেছেন। এহেন বিভীষিকাময় দৃশ্য কোরআন শুধু তার ভাষার মাধ্যমে পাঠক ও শ্রোতার মনে ভীতির সঞ্চার করে চলেছে ভাষার মাধ্যমে। আর যে হতভাগা মানুষ বাস্তবে এই মহাশক্তিধর সত্ত্বার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তার কি অবস্থা হতে পারে, সেটা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বৃথা ও অসার আস্ফালনে রত এই নগণ্য সৃষ্টির অবস্থা ও চরিত্রের বিবরণ কোরআন আরাে দীর্ঘায়িত করে পেশ করেছে। তার ক্ষমাহীন গােয়ার্তুমির বর্ণনা দেয়ার আগে আল্লাহ তায়ালা তাকে কি কি নেয়ামত দান করেছেন, তার উল্লেখ করেছেন। তিনি যখন তাকে সৃষ্টি করেন, তখন তার কাছে কিছুই ছিলাে না, এমনকি তার পরনে কাপড়ও ছিলাে না। তারপর তাকে প্রচুর সম্পদ দিয়েছেন, সর্বক্ষণ তার চারপাশে উপস্থিত অনেক পুত্র সন্তানও তাকে দিয়েছেন। এরপর সে আরাে পাওয়ার লােভে লালায়িত। যা পেয়েছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয় এবং কৃতজ্ঞও নয়। হয়তাে বা সে এরূপ আশা করে যে, তার কাছে ওহী নাযিল হােক এবং কিতাব নাযিল হােক। যেমন সূরার শেষাংশ আছে, ‘এবং তাদের প্রত্যেকে চায় তাকে পুস্তকসমূহ দেয়া হোক।’

ফী জিলালিল কুরআন:- 
*সকল যুগের সকল দুশমন এক ও অভিন্ন : বস্তুত এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ওলীদ ইবনুল মুগীরা রসূল(স.)-কে নবুওতের জন্যে ঈর্ষা করে। তার এই অবাঞ্ছিত অন্যায় অভিলাষকে ‘কাল্লা’ (অর্থাৎ কখনাে নয়) শব্দটি এবং তার পরবর্তী বাক্য দ্বারা কঠোর ভাষায় খন্ডন করা হয়েছে। কেননা তাকে ইতিপূর্বে যেসব নেয়ামত দান করা হয়েছে তার জন্যে সে মােটেই কৃতজ্ঞ হয়নি, আনুগত্য প্রদর্শন করেনি এবং কোনাে ভালাে কাজ করেনি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কখনাে নয়, নিশ্চয়ই সে আমার আয়াতের কট্টর দুষমন ছিলাে।’ অর্থাৎ সত্য, ন্যায় ও ঈমান সংক্রান্ত যাবতীয় ওহীর নির্দেশনার বিরুদ্ধে সে চরম হঠকারিতা ও গােয়ার্তুমি প্রদর্শন করে। ইসলামী দাওয়াতের পথ রুখে দাঁড়াতাে। রাসূল(স.)-এর প্রচারকার্যে সর্বাত্মক বাধার সৃষ্টি করতাে, নিজেকে ও অন্যদেরকে তার কাছ থেকে দূরে রাখতে এবং দাওয়াতী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে নানা বিভ্রান্তি ছড়াতাে। তার অবাঞ্ছিত অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষ খন্ডন করার পর আল্লাহ তায়ালা তাকে এই মর্মে হুমকি দিচ্ছেন যে, তাকে দেয়া সকল সুযােগ সুবিধা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে কঠিন ও দুরূহ পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হবে। বলা হয়েছে, ‘আমি অচিরেই তাকে একটা কঠিন কড়াইতে চড়াবো।’ এটা একটা রূপক অর্থবােধক বাকধারা। এ দ্বারা কঠিন ও দুরূহ পথে চলাফেরা বা কঠিন পরিশ্রমের কাজ বুঝানাে হয়ে থাকে। উঁচু-নিচু রাস্তায় চলা এমনিতেই অপেক্ষাকৃত কষ্টকর। তদুপরি যাত্রীকে যদি অনিচ্ছাসত্তেও নিচু থেকে উঁচুতে চড়তে হয় তাহলে সেটা হয় আরাে প্রাণান্তকর ব্যাপার। এ উক্তিটি দ্বারা আরাে একটি সত্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেটি এই যে, যে ব্যক্তি ঈমানের সহজ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়, সে উঁচু-নিচু ও দুর্গম পথে চলতে বাধ্য হয় এবং চরম দুর্দশা ও কষ্টের ভেতর দিয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। না তার যাত্রা পথে কোনাে পাথেয় ও রসদ থাকে, না তার যাত্রা শেষে কোনা শান্তি ও আশা ভরসার অবকাশ থাকে। এরপর সেই হাস্যোদ্দীপক অবস্থাটার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যখন আল্লাহদ্রোহী লােকটি কোরআনের মধ্যে একটা কিছু নতুন দোষত্রুটি খুঁজে বের করার জন্যে গভীর চিন্তাভাবনা ও গবেষণা চালায়। এজন্যে সে অবিরাম মাথা ঘামায় ও নিজের মনমগযের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করে। সে চিন্তাভাবনা করেছে ও কিছু কথা রচনা করার চেষ্টা চালিয়েছে। ‘এটা তাে গতানুগতিকভাবে পাওয়া জাদুমন্ত্র ছাড়া কিছু নয়…’ এ আয়াত কয়টিতে তার প্রতিটি মুহূর্তের পরিবর্তনশীল গতিবিধি অংকিত করা হয়েছে, যেন শব্দ দিয়ে নয় বরং তুলি দিয়ে অথবা একটি চলচ্চিত্রের মধ্যমে গোটা দৃশ্যকে নিখুঁতভাবে অংকন করা হয়েছে। চিন্তাভাবনা করতে করতে সে যেন একটা কিছু খুঁজে পায়, সেই সাথে একটা বদদোয়াও তার কপালে জোটে এবং সেটাই তার শেষ পাওনা। বলা হয়েছে, ‘তার ওপর অভিশাপ হােক।’ এটা একটা ধিক্কার এবং পুরােপুরি বিদ্রুপ । এরপর এই বদ দোয়া ও ধিক্কারের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আবারও সে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে এবং করতে করতে সে একটা কিছু খুঁজে পায়। একটা কল্পিত ত্রুটি আবিষ্কার করে কোরআনে। অতপর কৃত্রিম গাম্ভীর্য দেখিয়ে সে এদিক সেদিক তাকায়। তার তাকানাে থেকেই বিদ্রুপের গন্ধ পাওয়া যায়। আবারও সে একটা কিছুর সন্ধান পায় আর তাতে তার কপাল কুঞ্চিত ও মুখ বিকৃত হয়ে যায়। এভাবে তার চিন্তাধারা একটা হাস্যকর রূপ ধারণ করে। কিন্তু এতসব ভান করলেও আসলে সে কিছুরই সন্ধান পায়না। সে শুধু ঐশী আলোর বিরুদ্ধে চক্রান্ত আঁটে এবং অহংকারের সাথে সত্যকে উপেক্ষা করে। তাই সে বলে ‘এটা তাে যুগ যুগ ধরে চলে আসা জাদুমন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এটা তাে মানুষেরই কথা।’ বস্তুত শিল্পীর তুলি কিংবা চলচ্চিত্রের সংলাপের চেয়ে কোরআনের এ জীবন্ত দৃশ্য অংকন অনেক বেশী শক্তিশালী ও সুন্দর, আর যার দৃশ্য কোরআন অংকন করেছে, তাকে চিরকালের জন্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপহাসের পাত্র হিসাবেই গণ্য করা হবে। এই হাস্যোদ্দীপক জীবন্ত দৃশ্য অংকন শেষ হবার পর আল্লাহ তায়ালা উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর হুমকি দিয়েছেন এভাবে, ‘অচিরেই আমি তাকে দোযখে ঢুকাবাে।’ এই ‘সাকার’ বা দোষখকে অজ্ঞাত জিনিসের পর্যায়ে রেখে তাকে আরাে ভয়ংকর করে তােলা হয়েছে। যথা, ‘তুমি কি জানাে সে দোযখ কি জিনিস?’ তা হচ্ছে কল্পনাতীতভাবে ভয়ংকর। তারপর তার ভয়াবহ বৈশিষ্টটি বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তা কিছুই অবশিষ্ট রাখে না।’ তারপর ‘তা চামড়াকে ঝলসে দেয়।’ যেমন ‘মায়ারিজ’-এ বলা হয়েছে, ‘যে পশ্চাদপসরণ করে ও পালিয়ে যায় সে তাকে ডাকে।’ এ থেকে বুঝা যায় যে, নিজের ভয়াল রূপ দেখিয়ে দোযখ মানুষের মনে ত্রাস ও আতংক সৃষ্টি করে।

সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
পারা:২৯
১- ২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ:-

সুরা: আল-মুদ্দাস্সি

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৭৪

নামকরণ : الْمُدَّثِّرُ অর্থ :

বস্ত্রাবৃত, বস্ত্রাচ্ছাদিত। এর দ্বারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الْمُدَّثِّرُ শব্দ থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছ।

শানে নুযূল :

ইয়াহইয়া বিন আবী কাসীর (রহঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি আবূ সালামাহ বিন আব্দুর রহমানকে কুরআনের কোন্ আয়াতটি সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয় এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেন :

(يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ)

এ আয়াতটি। ইয়াহইয়া বলছেন : মানুষ বলে-

(اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ)

এ আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। আবূ সালামাহ বললেন : এ সর্ম্পকে আমি জাবের (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করেছি এবং তাকে সেরূপ বলতে শুনেছি তুমি যেরূপ আমাকে বলেছ। জাবের (রাঃ) বলছেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা আমাকে বলেছেন তোমাকে তাই বলব। তিনি বলেছেন : আমি হেরা পর্বতের গুহায় আমার প্রভুর ইবাদতে মগ্ন ছিলাম। সেখান থেকে অবতরণ করে আমি শুনতে পেলাম, কে যেন আমাকে ডাকছে। আমি আমার সামনে-পেছনে, ডানে এবং বামে তাকালাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি তখন মাথা উপরের দিকে তুললে কিছু দেখতে পেলাম। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, সে ফেরেশতাকে দেখতে পেলাম যে হেরা গুহায় আগমন করেছিল। সে একটি চেয়ারে বসে আছে। (সহীহ বুখারী : ৪৯২৫) আমি খাদিজা (রাঃ)-এর কাছে চলে আসি। (পূর্বের বর্ণনায় রয়েছে আমি ভয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ি) খাদিজা (রাঃ)-কে বলি : আমাকে চাদরাবৃত কর এবং ঠাণ্ডা পানি ঢালতে থাকো। খাদিজা (রাঃ) তা-ই করলেন। তখন

(يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ)

আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী : ৪৯২৪)

শানে নুযূল থেকে বুঝা গেল এ আয়াতগুলো প্রথম অবতীর্ণ নয়। কারণ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেন : সেই ফেরেশতাকে দেখতে পেলাম যে হেরা গুহায় এসেছিল। অর্থাৎ ইতোপূর্বে জিবরীল (আঃ) ওয়াহী নিয়ে হেরা গুহায় এসেছিলেন। মূলত এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কিছু দিন (ওয়াহী আসা বন্ধ থাকার) পর। তাই প্রথম অবতীর্ণ সূরা বলা হয়েছে। (মাবাহিস ফী উলূমুল কুরআন)

সূরাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দাওয়াতী মিশনে অনুপ্রেরণা ও আল্লাহ তা‘আলার সস্তুষ্টির জন্য দাওয়াতী কাজে ধৈর্য ধারণ করা এবং নিজের আমল সংশোধন করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

১-১০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

সূরার প্রথম সাতটি আয়াত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে মানব জাতিকে সতর্ক, পার্থিব জীবনের যাবতীয় দুর্দশা, দুষ্কর্ম ও শিরকের পংকিলতা থেকে রক্ষা করে আখিরাতের আযাব থেকে নাজাতের দিকে আহ্বান করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ সতর্ক করার কাজটি রিসালাতের প্রধান কাজ, যুগে যুগে প্রত্যেক রাসূল এ অমিয়বাণী নিয়েই স্বজাতির কাছে আগমন করেছিলেন। এখন যেহেতু নাবী আসবে না তাই এ মহৎ দায়িত্বটি উম্মাতে মুহাম্মাদীর ওপর আরোপিত হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রত্যেক অনুসারীদের ওপর তা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(قُلْ ھٰذِھ۪ سَبِیْلِیْٓ اَدْعُوْٓا اِلَی اللہِ عَلٰی بَصِیْرَةٍ اَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِیْ وَسُبْحٰنَ اللہِ وَمَآ اَنَا مِنَ الْمُشْرِکِیْنَ))

“বল : ‎ ‘এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সজ্ঞানে ও দলীল-প্রমাণের সাথে আমি এবং আমার অনুসারীগণও। আল্লাহ মহিমান্বিত এবং যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে আমি তাদের অন্ত‎র্ভুক্ত নই।” (সূরা ইউসুফ ১২ : ১০৮)

তবে মানুষ গোমরাহ হলে আল্লাহ তা‘আলার কোন ক্ষতি বা মানুষ সুপথ পেলে আল্লাহ তা‘আলার কোন উপকার হবে এমন নয় বরং মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার দয়া যে, তিনি চান না কোন বান্দাকে জাহান্নামে দিতে। তিনি চান প্রত্যেক বান্দাই জান্নাতে যাক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(مَا يَفْعَلُ اللّٰهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَاٰمَنْتُمْ ط وَكَانَ اللّٰهُ شَاكِرًا عَلِيْمًا)

“তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর ও ঈমান আন তবে তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহ কী করেন? আল্লাহ পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা নিসা ৪ : ১৪৭) কিন্তু মানুষ তাদের কর্মের মাধ্যমে নিজেদেরকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়।

(قُمْ فَأَنْذِرْ) অর্থাৎ তুমি ওঠো, শুয়ে থেকো না। মানুষকে আখিরাতের শাস্তির ভয় দেখাও। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ)

“আর তুমি তোমার নিকটতম আন্তীয়-স্বজনদের ভীতি প্রদর্শন কর” (সূরা শুআরা ২৬ : ২১৪)। প্রথম ওয়াহী দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নাবীরূপে মনোনীত করা হয়েছে, আর এ ওয়াহী দ্বারা তাঁকে রাসূল বানানো হয়েছে। (ইবনু কাসীর)

(وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ)

অর্থাৎ একমাত্র তোমার প্রতিপালকের বড়ত্ব বর্ণনা কর। বস্তুত এ বিশ্ব জগতে যত প্রাণী, বস্তু ও সৃষ্টি আছে তার সবই ছোট ও নগণ্য। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই বড়, শ্রেষ্ঠ ও মহান। সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোৎকৃষ্ট, সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম আল্লাহ তা‘আলার সামনে সকল সত্তা, শক্তি ও বস্তু ইত্যাদি অদৃশ্য ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ ঈমানী আকীদাহ-বিশ্বাস, প্রত্যয় ও চেতনা নিয়ে মানবজাতিকে সতর্ক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ)

এ আয়াতের দুটি তাফসীর হতে পারে :

(১) এর দ্বারা উদ্দেশ্য আমলকে সকল প্রকার রিয়া, খারাবী, নিফাকী ও অহংকার ইত্যাদি থেকে সংশোধন ও পবিত্র করা। এতে কাপড়ের পবিত্রতাও শামিল। কেননা কাপড়কে পবিত্র রাখা আমলকে পবিত্র রাখার পরিপূর্ণতা, বিশেষ করে সালাতে। এটাই অধিকাংশ আলেমের অভিমত।

(২) কাপড় পবিত্র রাখা। অর্থাৎ সকল প্রকার নাজাসাত থেকে পবিত্র হওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। (তাফসীর সা’দী)

(وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ)

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : الرُّجْزَ হল মূর্তি, প্রতিমা। আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করা হয়। যহহাক (রহঃ) বলেন : আয়াতের অর্থ হল : অবাধ্য কাজ ছেড়ে দাও। (ইবনু কাসীর)

আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : الرُّجْزَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল সকল খারাপ কাজ ও কথা। তাই বলা যায়, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ছোট-বড়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার পাপ কাজ বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশে শির্কও শামিল। মূলত এটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে উম্মাতের সকলকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

(وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন : উপহার বা বেশি পাওয়ার আশায় কোন প্রকার দান কর না (ইবনু কাসীর)। বরং তোমার সকল কাজ ও দানের প্রতিদান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছেই আশা কর।

(وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ)

‘এবং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ কর।’ মুজাহিদ বলেন : তুমি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ করবে।

(فَإِذَا نُقِرَ فِي النَّاقُوْر)

ইবনু আব্বাস, মুজাহিদ, হাসান বাসরীসহ প্রমুখ বলেন : النَّاقُوْر হল শিংগা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমি কি করে শান্তিতে থাকতে পারি? অথচ শিংগা ধারণকারী ফেরেশতা নিজের মুখে শিংগা ধরে রেখেছে এবং ললাট ঝুঁকিয়ে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমের অপেক্ষায় বসে আছে কখন হুকুম হয়ে যাবে এবং তিনি শিংগায় ফুঁৎকার দেবেন। সাহাবীগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আপনি কী করতে বলছেন ? জবাবে তিনি বলেন : তোমরা নিম্নের কালেমাটি বলতে থাকবে :

حَسْبُنَا اللّٰهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ عَلَي اللّٰهِ تَوَكَّلْنا

আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি কতইনা উত্তম কর্মবিধায়ক, আমরা আল্লাহ তা‘আলার ওপরেই ভরসা করি। (তিরমিযী হা. ২৪৩১, সহীহ)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : عَسِيْرٌ অর্থ شديد বা কঠিন। (সহীহ বুখারী) অর্থাৎ যেদিন শিংগায় ফুঁ দেওয়া হবে সেদিনটি খুবই কঠিন, বিশেষ করে কাফিরদের জন্য। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে যেমন সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকবে, কোন প্রকার নাজাসাত ও শিরকে লিপ্ত হবে না তেমনি সে পবিত্রতার দিকেও মানুষদেরকে আহ্বান করবে। তাহলে উম্মাতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা সম্ভব হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রত্যেক অনুসারীর ওপর আবশ্যক মানুষকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করা।
২. একজন মু’মিন তার সকল প্রকার কাজ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদন করবে।
৩. শির্ক এক প্রকার অপবিত্রতা, তা থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক।

১১-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

শানে নুযূল :

এ আয়াতগুলো নরাধম ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। সে ছিল আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের চরম শত্র“। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন তিরস্কার করলেন যা অন্য কাউকে করেননি। যারা সত্যের বিরোধিতা করে তাদের জন্য দুনিয়াতে এরূপ লাঞ্ছনা আর আখিরাতে রয়েছে মহাশাস্তি। (তাফসীর সা‘দী)

(خَلَقْتُ وَحِيْدًا)

অর্থাৎ নিঃসঙ্গ করে সৃষ্টি করেছি। সে যখন মায়ের পেট থেকে বের হয় তখন তার কোন সম্পদ ছিলনা, কোন পরিবার ছিল না এবং কোন প্রকার আত্মীয়-স্বজন ছিল না। তারপর তার অনেক সম্পদ দান করেছি, সন্তান দান করেছি। কেউ বলেছেন ওয়ালিদ বিন মুগীরাহর সাত জন ছেলে ছিল, কেউ বলেছেন বার জন ছিল। তাদের তিনজন ইসলাম কবূল করেছেন। তারা হলেন খালেদ, হিশাম এবং ওয়ালিদ বিন ওয়ালিদ। (ফাতহুল কাদীর)

شُهُوْدًا অর্থাৎ ওয়ালিদের ছেলেরা সর্বদা তার কাছে উপস্থিত থাকত। ছেলেদের দ্বারা সে উপকার নিত, প্রয়োজন মেটাতো ও সহযোগিতা নিত।

(ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيْدَ)

অর্থাৎ এসব নেয়ামত পাওয়ার পরেও সে আশা করে আরো নেয়ামত পাওয়ার জন্য যেমন দুনিয়ার নেয়ামত পেয়েছে।

كَـلَّا কখনো এরূপ পাবেনা। কারণ সে আমার নিদর্শনাবলীর বিরোধিতা করে।

عَنِيْد বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যে জানার পরেও সত্যের বিরোধিতা করে ও প্রত্যাখ্যান করে।

(سَأُرْهِقُه۫ صَعُوْدًا)

অর্থাৎ এমন আযাবে পতিত করব যা সহ্য করা খুবই কঠিন হবে।

إرهاق অর্থ হল : মানুষের ওপর কোন ভারী জিনিস চাপিয়ে দেওয়া। (ফাতহুল কাদীর)

(إِنَّه۫ فَكَّرَ وَقَدَّرَ)

অর্থাৎ কুরআন এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা শুনে সে এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করল যে, আমি এর উত্তর কী দেব? মনে মনে সে উত্তর প্রস্তুত করল।

(ثُمَّ نَظَرَ) অর্থাৎ সে যা বলছে তা চিন্তা করে দেখে।

(سِحْرٌ يُّؤْثَرُ)

অর্থাৎ এটা একটা জাদু, যা মুহাম্মাদ অপরের কাছ থেকে শিখেছে। তাই এটা মানুষের তৈরি কথা, আল্লাহ তা‘আলার কথা নয়।

سَقَرَ আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তিনি তাকে সাকার নামক জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। পরের আয়াতে সাকার জাহান্নামের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন :

((لَا تُبْقِيْ وَلَا تَذَرُ

অর্থাৎ সাকারের শাস্তি এত মারাত্মক কঠিন যে, শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির গায়ে গোশত ও হাড় কিছু বাকি রাখেনা, সব একাকার করে দেয়। এবং শরীরের চামড়া পুড়িয়ে দেয়।

(عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ)

জাহান্নামের প্রহরী ঊনিশজন। যখন জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের কথা আল্লাহ তা‘আলা ঊনিশজন বলে উল্লেখ করলেন তখন আবূ জাহল কুরাইশদেরকে সম্বোধন করে বলল : তোমাদের থেকে প্রত্যেকে দশজনের একটি দল এক এক জন ফেরেশতার জন্য যথেষ্ট নও কি? কেউ বলেন : কাতাদাহ নামক এক ব্যক্তি (যে নিজ শক্তির ব্যাপারে বড়ই অহংকারী ছিল) সে বলল : তোমরা কেবল দু’জন ফেরেশতাকে সামলে নিও, বাকী সতের জন ফেরেশতার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। বলা হয়, এ লোকই কয়েকবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুস্তি লড়াই করার জন্য চ্যালেঞ্জ করেছিল। অথচ প্রত্যেকবারেই সে হার মেনেছে। কিন্তু ঈমান আনেনি।

সুতরাং যুগে যুগে যারাই ইসলামের ও মুসলিমদের বিরোধিতা করেছে, মুসলিমদেরকে ধ্বংস করার জন্য চক্রান্ত করেছে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে এভাবেই শাস্তি দিয়েছেন আর আখিরাতে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. অনেক ক্ষেত্রে সন্তান ও সম্পদ অবাধ্যতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে যাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা রহম করেন তারা ব্যতীত।
২. যারা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনের বিদ্রোহ করে তারা সবচেয়ে বড় কাফির।
৩. যারাই আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলদের অবাধ্য হয়েছে তারাই দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদের জন্য আখিরাতে আছে মহা শাস্তি।

সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
পারা:২৯
১- ২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তফসীরে‌ তাফহীমুল কুরআন:-

সুরা: আল-মুদ্দাস্সি

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

(৭৪-মুদ্দাস্সির) : নামকরণ:

প্রথম আয়াতে الْمُدَّثِّرُ (আল মুদ্দাস্সির) শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটিও শুধু সূরার নাম। এর বিষয় ভিত্তিক শিরোনাম নয়।

(৭৪-মুদ্দাস্সির) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এর প্রথম সাতটি আয়াত পবিত্র মক্কা নগরীতে নবুওয়াতের একেবারে প্রাথমিক যুগে নাযিল হয়েছিল। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এবং মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের কোন কোন রেওয়ায়াতে এতদূর পর্যন্ত বলা হয়েছে যে, এগুলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল হওয়া সর্বপ্রথম আয়াত। কিন্তু গোটা মুসলিম উম্মাহর কাছে এ বিষয়টি প্রায় সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম যে অহী নাযিল হয়েছিল তা ছিল اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক) থেকে مَا لَمْ يَعْلَمْ (মালাম ইয়া’লাম) পর্যন্ত। তবে বিশুদ্ধ রেওয়ায়াতসমূহ থেকে একথা প্রমাণিত যে, এ প্রথম অহী নাযিল হওয়ার পর কিছুকাল পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল হয়নি। এ বিরতির পর নতুন করে আবার অহী নাযিলের ধারা শুরু হলে সূরা মুদ্দাস্সিরের এ আয়াতগুলো থেকেই তা শুরু হয়েছিল। ইমাম যুহরী এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এভাবে:

“কিছুকাল পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল বন্ধ রইলো। সে সময় তিনি এতো কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন যে, কোন কোন সময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সেখান থেকে নিজেকে নীচে নিক্ষেপ করতে বা গড়িয়ে ফেলে দিতে উদ্যত হতেন। কিন্তু যখনই তিনি কোন চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছতেন তখনই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সামনে এসে বলতেন: ‘আপনি তো আল্লাহর নবী’ এতে তাঁর হৃদয় মন প্রশান্তিতে ভরে যেতো এবং তাঁর অশ্বস্তি ও অস্থিরতার ভাব বিদূরিত হতো।” (ইবনে জারীর)

এরপর ইমাম যুহরী নিজে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রেওয়ায়তেই এভাবে উদ্ধৃত করেছেন:

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম فَتْرَةِ الْوَحْىِ (অহী বন্ধ থাকার সময়)-এর কথা উল্লেখ করে বলেছেন: একদিন আমি পথে চলছিলাম। হঠাৎ আসমান থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম। ওপরের দিকে তাকিয়েই দেখতে পেলাম হেরা গিরা গুহায় যে ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিল সে ফেরেশতা আসমান ও যমীনের মাঝখানে একটি আসন পেতে বসে আছে। এ দৃশ্য দেখে আমি অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম এবং বাড়ীতে পৌঁছেই বললাম: আমাকে চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করো। আমাকে চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করো। সুতরাং বাড়ীর লোকজন আমাকে লেপ (অথবা কম্বল) দিয়ে আমাকে আচ্ছাদিত করলো। এ অবস্থায় আল্লাহ অহী নাযিল করলেন: يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّر “এরপর অব্যাহতভাবে অহী নাযিল হতে থাকলো।” (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর)।

প্রকাশ্যভাবে ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রথমবার মক্কায় হজ্বের মওসুম সমাগত হলে সূরার অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ ৮ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত নাযিল হয়। ‘সীরাতে ইবনে হিশাম’ গ্রন্থে এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা পরে তা উল্লেখ করবো।

(৭৪-মুদ্দাস্সির) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সর্বপ্রথম যে অহী পাঠানো হয়েছিল তা ছিল সূরা ‘আলাকে’র প্রথম পাঁচটি আয়াত। এতে শুধু বলা হয়েছিল:

“পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘জমাট রক্ত’ থেকে। পড়, তোমার রব বড় মহানুভব। যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জ্ঞান শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।”

এটা ছিল অহী নাযিল হওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহসা এ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কত বড় মহান কাজের জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরো কি কি কাজ তাকে করতে হবে এ বাণীতে তাঁকে সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়েছিল না। বরং শুধু একটি প্রাথমিক পরিচয় দিয়েই কিছু দিনের জন্য অবকাশ দেয়া হয়েছিল যাতে অহী নাযিলের এ প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর মন-মানসিকতার ওপর যে কঠিন চাপ পড়েছিল তার প্রভাব বিদূরিত হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে অহী গ্রহণ ও নবুওয়াতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যান। এ বিরতির পর পুনরায় অহী নাযিলের ধারা শুরু হলে এ সূরার প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হয় এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ মর্মে আদেশ দেয়া হয় যে, আপনি উঠুন এবং আল্লাহর বান্দারা এখন যেভাবে চলছে তার পরিণাম সম্পর্কে তাদের সাবধান করে দিন। আর এ পৃথিবীতে এখন যেখানে অন্যদের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব জেঁকে বসেছে, সেখানে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের ঘোষণা দিন। এর সাথে সাথে তাঁকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, এখন থেকে আপনাকে যে কাজ করতে হবে তার দাবি হলো আপনার নিজের জীবন যেন সব দিক থেকে পূত-পবিত্র হয় এবং আপনি সব রকমের পার্থিব স্বার্থ উপেক্ষা করে পূর্ণ নিষ্ঠা ও ঐক্যান্তিকতার সাথে আল্লাহর সৃষ্টির সংস্কার-সংশোধনের দায়িত্ব পালন করেন। অতপর শেষ বাক্যটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যে কোন কঠিন পরিস্থিতি এবং বিপদ মুসিবতই আসুক না কেন আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশ্যে ধৈর্য অবলম্বন করুন।

আল্লাহর এ ফরমান কার্যকরী করার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলামের প্রচার শুরু করলেন এবং একের পর এক কুরআন মজীদের যেসব সূরা নাযিল হচ্ছিলো তা শুনাতে থাকলেন তখন মক্কায় রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেল এবং বিরোধিতার এক তুফান শুরু হলো। এ অবস্থায় কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর হজ্বের মওসূম এসে পড়লে মক্কার লোকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। তারা ভাবলো, এ সময় সমগ্র আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজীদের কাফেলা আসবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি যদি এসব কাফেলার অবস্থান স্থলে হাজির হয়ে হাজীদের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বিভিন্ন স্থানে হজ্বের জনসমাবেশসমূহে দাঁড়িয়ে কুরআনের মত অতুনীয় এ মর্মস্পর্শী বাণী শুনাতে থাকেন তাহলে সমগ্র আরবের আনাচে কানাচে তাঁর আহবান পৌঁছে যাবে এবং না জানি কত লোক তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়বে। তাই কুরাইশ নেতারা একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা করলো। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, মক্কায় হাজীদের আগমনের সাথে সাথে তাদের মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে প্রচার প্রোপাগাণ্ডা শুরু করতে হবে। এ বিষয়ে ঐক্যমত হওয়ার পর ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা সমবেত সবাইকে উদ্দেশ করে বললো: আপনারা যদি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে লোকদের কাছে বিভিন্ন রকমের কথা বলেন, তাহলে আমাদের সবার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই কোন একটি বিষয় স্থির করে নিন যা সবাই বলবে। কেউ কেউ প্রস্তাব করলো, আমরা মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গণক বলবো। ওয়ালীদ বললো: তা হয় না। আল্লাহর শপথ, সে গণক নয়। আমরা গণকের অবস্থা জানি। তারা গুণ গুণ শব্দ করে যেসব কথা বলে এবং যে ধরনের কথা বানিয়ে নেয় তার সাথে কুরআনের সামান্যতম সাদৃশ্যও নেই। তখন কিছু সংখ্যক লোক প্রস্তাব করলো যে, তাঁকে পাগল বলা হোক। ওয়ালীদ বললো: সে পাগলও নয়। আমরা পাগল ও বিকৃত মস্তিষ্ক লোক সম্পর্কেও জানি। পাগল বা বিকৃত মস্তিষ্ক হলে মানুষ যে ধরনের অসলংগ্ন ও আবোল তাবোল কথা বলে এবং খাপছাড়া আচরণ করে তা কারো অজানা নয়। কে একথা বিশ্বাস করবে যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে বাণী পেশ করছে তা পাগলের প্রলাপ অথবা জিনে ধরা মানুষের উক্তি? লোকজন বললো: তাহলে আমরা তাঁকে কবি বলি। ওয়ালীদ বললো: সে কবিও নয়। আমরা সব রকমের কবিতা সম্পর্কে অবহিত। কোন ধরনের কবিতার সাথে এ বাণীর সাদৃশ্য নেই। লোকজন আবার প্রস্তাব করলো: তাহলে তাঁকে যাদুকর বলা হোক।ওয়ালীদ বললো: সে যাদুকরও নয়। যাদুকরদের সম্পর্কেও আমরা জানি। যাদু প্রদর্শনের জন্য তারা যেসব পন্থা অবলম্বন করে থাকে সে সম্পর্কেও আমাদের জানা আছে। একথাটিও মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ব্যাপারে খাটে না। এরপর ওয়ালীদ বললো: প্রস্তাবিত এসব কথার যেটিই তোমরা বলবে সেটিকেই লোকেরা অযথা অভিযোগ মনে করবে। আল্লাহর শপথ, এ বাণীতে আছে অসম্ভব রকমের মাধুর্য। এর শিঁকড় মাটির গভীরে প্রোথিত আর এর শাখা-প্রশাখা অত্যন্ত ফলবান। একথা শুনে আবু জেহেল ওয়ালীদকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। সে বললো: যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদ সম্পর্কে কোন কথা বলছো ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার কওমের লোকজন তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। সে বললো: তাহলে আমাকে কিছুক্ষণ ভেবে দেখতে দাও। এরপর সে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে বললো: তাঁর সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য যে কথাটি বলা যেতে পারে তা হলো, তোমরা আরবের জনগণকে বলবে যে, এ লোকটি যাদুকর। সে এমন কথা বলে যা মানুষকে তার পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র এবং গোটা পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ওয়ালীদের একথা গ্রহণ করলো। অতপর হজ্বের মওসূমে পরিকল্পনা অনুসারে কুরাইশদের বিভিন্ন প্রতিনিধি দল হাজীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং বহিরাগত হজ্বযাত্রীদের তারা এ বলে সাবধান করতে থাকলো যে, এখানে একজন বড় যাদুকরের আর্বিভাব ঘটেছে। তার যাদু পরিবারের লোকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয়। তাঁর ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। কিন্তু এর ফল দাঁড়ালো এই যে, কুরাইশ বংশীয় লোকেরা নিজেরাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম সমগ্র আরবে পরিচিত করে দিল। (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৮-২৮৯। আবু জেহেলের পীড়াপীড়িতেই যে ওয়ালীদ এ উক্তি করেছিল, সে কথা ইবনে জারীর তার তাফসীরে ইকরিমার রেওয়ায়াত সূত্র উদ্ধৃত করেছেন)।

এ সূরার দ্বিতীয় অংশে এ ঘটনারই পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর বিষয়বস্তুর বিন্যাস হয়েছে এভাবে:

৮ থেকে ১০ আয়াত পর্যন্ত ন্যায় ও সত্যকে অস্বীকারকারীদের এ বলে সাবধান করা হয়েছে যে, আজ তারা যা করছে কিয়ামতের দিন তারা নিজেরাই তার খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হবে।

১১ থেকে ২৬ আয়াত পর্যন্ত ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার নাম উল্লেখ না করে বলা হয়েছে: মহান আল্লাহ এ বক্তিকে অঢেল নিয়ামত দান করেছিলেন। কিন্তু এর বিনিময়ে সে ন্যায় ও সত্যের সাথে চরম দুশমনী করেছে। এ পর্যায়ে তার মানসিক দ্বন্দ্বের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অংকন করা হয়েছে। একদিকে সে মনে মনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের প্রতি সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু অপরদিকে নিজ গোত্রের মধ্যে সে তার নেতৃত্ব, মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিও বিপন্ন করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই সে শুধু ঈমান গ্রহণ থেকেই বিরত রইলো না। বরং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নিজের বিবেকের সাথে বুঝা পড়া ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর আল্লাহর বান্দাদের এ বাণীর ওপর ঈমান আনা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রস্তাব করলো যে, এ কুরআনকে যাদু বলে আখ্যায়িত করতে হবে। তার এ স্পষ্ট ঘৃণ্য মানসিকতার মুখোশ খুলে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে যে, নিজের এতো সব অপকর্ম সত্ত্বেও এ ব্যক্তি চায় তাকে আরো পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হোক। অথচ এখন সে পুরষ্কারের যোগ্য নয় বরং দোযখের শাস্তির যোগ্য হয়ে গিয়েছে।

এরপর ২৭ থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্ত দোযখের ভয়াবহতার উল্লেখ করা হয়েছে এবং কোন্ ধরনের নৈতিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের অধিকারী লোকেরা এর উপযুক্ত বলে গণ্য হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে।

অতপর ৪৯-৫৩ আয়াতে কাফেরদের রোগের মূল ও উৎস কি তা বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যেহেতু তারা আখেরাত সম্পর্কে বেপরোয়া ও নির্ভীক এবং এ পৃথিবীকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে মনে করে, তাই তারা কুরআন থেকে এমনভাবে পালায়, যেমন বন্য গাধা বাঘ দেখে পালায়। তারা ঈমান আনার জন্য নানা প্রকারের অযৌক্তিক পূর্বশর্ত আরোপা করে। অথচ তাদের সব শর্ত পূরণ করা হলেও আখেরাতকে অস্বীকার করার কারণে তারা ঈমানের পথে এক পাও অগ্রসর হতে সক্ষম নয়।

পরিশেষে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে, আল্লাহর কারো ঈমানের প্রয়োজন নেই যে, তিনি তাদের শর্ত পূরণ করতে থাকবেন। কুরআন সবার জন্য এক উপদেশবাণী যা সবার সামনে পেশ করা হয়েছে। কারো ইচ্ছা হলে সে এ বাণী গ্রহণ করবে। আল্লাহই একমাত্র এমন সত্তা, যার নাফরমানী করতে মানুষের ভয় পাওয়া উচিত। তাঁর মাহাত্ম্য ও মর্যাদা এমন যে, যে ব্যক্তিই তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পথ অনুসরণ করে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। পূর্বে সে যতই নাফরমানী করে থাকুক না কেন।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-১

یٰۤاَیُّهَا الْمُدَّثِّرُۙ

হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# ওপরে ভূমিকায় আমরা এসব আয়াত নাযিলের যে পটভূমি বর্ণনা করেছি সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে একথাটি ভালভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে يَاَيُّهَا الرَّسُوْلُ ইয়া আয়্যুহাল রাসূল বা يَاَيُّهَا النَّبِىُّ (ইয়া আয়্যুহান্নাবীয়ু) বলে সম্বোধন করার পরিবর্তে يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (ইয়া আয়্যুহাল মুদ্দাস্সির) বলে সম্বোধন কেন করা হয়েছে। নবী (সা.) যেহেতু হঠাৎ জিবরাঈলকে আসমান ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি আসনে উপবিষ্ট দেখে ভীত হয়ে পড়েছিলেন এবং সে অবস্থায় বাড়ীতে পৌঁছে বাড়ীর লোকদের বলেছিলেনঃ আমাকে চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করো, আমাকে চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করো। তাই আল্লাহ তাঁকে يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ বলে সম্বোধন করেছেন। সম্বোধনের এ সূক্ষ্ম ভংগী থেকে আপনা আপনি এ অর্থ পরিস্ফূটিত হয়ে ওঠে যে, হে আমার প্রিয় বান্দা, তুমি চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছো কেন? তোমার ওপরে তো একটি মহৎ কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য তোমাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উঠে দাঁড়াতে হবে।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-২

قُمْ فَاَنْذِرْ۪ۙ

ওঠো এবং সাবধান করে দাও,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে নবুওয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করার সময় যে আদেশ দেয়া হয়েছিল এটাও সে ধরনের আদেশ। হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে বলা হয়েছিলঃ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ “তোমার নিজের কওমের লোকদের ওপর এক ভীষণ কষ্টদায়ক আযাব আসার পূর্বেই তাদের সাবধান করে দাও।” ( নূহ, ১ ) আয়াতটির অর্থ হলো, হে বস্ত্র আচ্ছাদিত হয়ে শয়নকারী, তুমি ওঠো। তোমার চারপাশে আল্লাহর যেসব বান্দারা অবচেতন পড়ে আছে তাদের জাগিয়ে তোল। যদি এ অবস্থায়ই তারা থাকে তাহলে যে অবশ্যম্ভাবী পরিণতির সম্মুখীন তারা হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের সাবধান করে দাও। তাদের জানিয়ে দাও, তারা “মগের মুল্লুকে” বাস করছে না যে, যা ইচ্ছা তাই করে যাবে, অথচ কোন কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে না।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৩

وَ رَبَّكَ فَكَبِّرْ۪ۙ

তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এ পৃথিবীতে এটা একজন নবীর সর্বপ্রথম কাজ। এখানে এ কাজটিই তাঁকে আঞ্জাম দিতে হয়। তাঁর প্রথম কাজই হলো, অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এ পৃথিবীতে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ মেনে চলছে তাদের সবাইকে অস্বীকার করবে এবং গোটা পৃথিবীর সামনে উচ্চ কণ্ঠে একথা ঘোষণা করবে যে, এ বিশ্ব-জাহানে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ নেই। আর এ কারণেই ইসলামে “আল্লাহু আকবার” (আল্লাহই শ্রেষ্ঠ) কথাটিকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। “আল্লাহু আকবার” ঘোষণার মাধ্যমেই আযান শুরু হয়। আল্লাহু আকবার একথাটি বলে মানুষ নামায শুরু করে এবং বার বার আল্লাহু আকবার বলে ওঠে ও বসে। কোন পশুকে জবাই করার সময়ও “বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার” বলে জবাই করে। তাকবীর ধ্বনি বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সর্বাধিক স্পষ্ট ও পার্থক্যসূচক প্রতীক। কারণ, ইসলামের মহানবী ﷺ আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার মাধ্যমেই কাজ শুরু করেছিলেন।

এখানে আরো একটি সূক্ষ্ম বিষয় আছে যা ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার। এ সময়ই প্রথমবারের মত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে নবুওয়াতের বিরাট গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ আয়াতগুলোর “শানে নুযুল” থেকেই সে বিষয়টি জানা গিয়েছে। একথা তো স্পষ্ট যে, যে শহর, সমাজ ও পরিবেশে তাঁকে এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার জন্য তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিল তা ছিল শিরকের কেন্দ্রভূমি বা লীলাক্ষেত্র। সাধারণ আরবদের মত সেখানকার অধিবাসীরা যে কেবল মুশরিক ছিল, তা নয়। বরং মক্কা সে সময় গোটা আরবের মুশরিকদের সবচেয়ে বড় তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা লাভ করেছিল। আর কুরাইশরা ছিল তার ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী, সেবায়ত ও পুরোহিত। এমন একটি জায়গায় কোন ব্যক্তির পক্ষে শিরকের বিরুদ্ধে এককভাবে তাওহীদের পতাকা উত্তোলন করা জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করার শামিল। তাই “ওঠো এবং সাবধান করে দাও” বলার পরপরই “তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো” বলার অর্থই হলো যেসব বড় বড় সন্ত্রাসী শক্তি তোমার এ কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে হয় তাদের মোটেই পরোয়া করো না। বরং স্পষ্ট ভাষায় বলে দাও, যারা আমার এ আহবান ও আন্দোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আমার “রব” তাদের সবার চেয়ে অনেক বড়। আল্লাহর দ্বীনের কাজ করতে উদ্যত কোন ব্যক্তির হিম্মত বৃদ্ধি ও সাহস যোগানোর জন্য এর চাইতে বড় পন্থা বা উপায় আর কি হতে পারে? আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের নকশা যে ব্যক্তির হৃদয়-মনে খোদিত সে আল্লাহর জন্য একাই গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অনুভব করবে না।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৪

وَ ثِیَابَكَ فَطَهِّرْ۪ۙ

তোমার পোশাক পবিত্র রাখো,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এটি একটি ব্যাপক অর্থ ব্যঞ্জক কথা। এর অর্থ অত্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি অর্থ হলো, তুমি তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ নাপাক বস্তু থেকে পবিত্র রাখো। কারণ শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদের পবিত্রতা এবং “রূহ” বা আত্মার পবিত্রতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোন পবিত্র আত্মা ময়লা-নোংরা ও পূতিগন্ধময় দেহ এবং অপবিত্র পোশাকের মধ্যে মোটেই অবস্থান করতে পারে না। রসূলুল্লাহ ﷺ যে সমাজে ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন তা শুধু আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক আবিলতার মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল না বরং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে পর্যন্ত সে সমাজের লোক অজ্ঞ ছিল। এসব লোককে সব রকমের পবিত্রতা শিক্ষা দেয়া ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ। তাই তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন তাঁর বাহ্যিক জীবনেও পবিত্রতার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখেন। এ নির্দেশের ফল স্বরূপ নবী (সা.) মানবজাতিকে শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদের পবিত্রতা সম্পর্কে এমন বিস্তারিত শিক্ষা দিয়েছেন যে, জাহেলী যুগের আরবরা তো দূরের কথা আধুনিক যুগের চরম সভ্য জাতিসমূহও সে সৌভাগ্যের অধিকারী নয়। এমনকি দুনিয়ার অধিকাংশ ভাষাতে এমন কোন শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না যা “তাহারাত” বা পবিত্রতার সমার্থক হতে পারে। পক্ষান্তরে ইসলামের অবস্থা হলো, হাদীস এবং ফিকাহর গ্রন্থসমূহে ইসলামী হুকুম-আহকাম তথা বিধি-বিধান সম্পর্কে সব আলোচনা শুরু হয়েছে “কিতাবুল তাহারাত” বা পবিত্রতা নামে অধ্যায় দিয়ে। এতে পবিত্রতা ও অপবিত্রতার পার্থক্য এবং পবিত্রতা অর্জনের উপায় ও পন্থাসমূহ একান্ত খুঁটিনাটি বিষয়সহ সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে।

একথাটির দ্বিতীয় অর্থ হলো, নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখো। বৈরাগ্যবাদী ধ্যান-ধারণা পৃথিবীতে ধর্মাচরণের যে মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছিল তাহলো, যে মানুষে যাতো বেশী নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন হবে সে ততো বেশী পূত-পবিত্র। কেউ কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরলেই মনে করা হতো, সে একজন দুনিয়াদার মানুষ। অথচ মানুষের প্রবৃত্তি নোংরা ও ময়লা জিনিসকে অপছন্দ করে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর বাহ্যিক অবস্থাও এতোটা পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া প্রয়োজন যেন মানুষ তাকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে এবং তার ব্যক্তিত্বে এমন কোন দোষ-ত্রুটি যেন না থাকে যার কারণে রুচি ও প্রবৃত্তিতে তার প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়।

একথাটির তৃতীয় অর্থ হলো, নিজের পোশাক পরিচ্ছদ নৈতিক দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র রাখো। তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তো অবশ্যই থাকবে তবে তাতেও কোন প্রকার গর্ব-অহংকার, প্রদর্শনী বা লোক দেখানোর মনোবৃত্তি, ঠাটবাট এবং জৌলুসের নামগন্ধ পর্যন্ত থাকা উচিত নয়। পোশাক এমন একটি প্রাথমিক জিনিস যা অন্যদের কাছে একজন মানুষের পরিচয় তুলে ধরে। কোন ব্যক্তি যে ধরনের পোশাক পরিধান করে তা দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই মানুষ বুঝতে পারে যে, সে কেমন স্বভাব চরিত্রের লোক। নওয়াব, বাদশাহ ও নেতৃ পর্যায়ের লোকদের পোশাক, ধর্মীয় পেশার লোকদের পোশাক, দাম্ভিক ও আত্মম্ভরী লোকদের পোশাক, বাজে ও নীচ স্বভাব লোকদের পোশাক এবং গুণ্ডা-পাণ্ডা ও বখাটে লোকদের পোশাকের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকে। এসব পোশাকই পোশাক পরিধানকারীর মেজাজ ও মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর মেজাজ ও মানসিকতা স্বাভাবিকভাবেই এসব লোকদের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। তাই তার পোশাক-পরিচ্ছদ তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে স্বতন্ত্র ধরনের হওয়া উচিত। তাঁর উচিত এমন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা যা দেখে প্রত্যেকেই অনুভব করবে যে, তিনি একজন শরীফ ও ভদ্র মানুষ, যাঁর মন-মানস কোন প্রকার দোষে দুষ্ট নয়।

এর চতুর্থ অর্থ হলো, নিজেকে পবিত্র রাখো। অন্য কথায় এর অর্থ হলো, নৈতিক দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র থাকা এবং উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়া। ইবনে আব্বাস, ইবরাহীম নাখয়ী, শা’বী, আতা, মুজাহিদ, কাতাদা, সা’ঈদ ইবনে জুবায়ের, হাসান বাসরী এবং আরো অনেক বড় বড় মুফাসসিরের মতে এটিই এ আয়াতের অর্থ। অর্থাৎ নিজের নৈতিক চরিত্রকে পবিত্র রাখো এবং সব রকমের দোষ-ত্রুটি থেকে দূরে থাকো। প্রচলিত আরবী প্রবাদ অনুসারে যদি বলা হয় যে, فلان طاهر الثياب وفلان طاهر الذيل (অমুক ব্যক্তির কাপড় বা পোশাক পবিত্র অথবা অমুক ব্যক্তি পবিত্র।” তাহলে এর দ্বারা বুঝানো হয় যে, সে ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র খুবই ভাল। পক্ষান্তরে যদি বলা হয় فلان دنس الثياب (অমুক ব্যক্তির পোশাক নোংরা তাহলে এ দ্বারা বুঝানো হয় যে, লোকটি লেনদেন ও আচার-আচরণের দিক দিয়ে ভাল নয়। তার কথা ও প্রতিশ্রুতির উপর আস্থা রাখা যায় না)।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৫

وَ الرُّجْزَ فَاهْجُرْ۪ۙ

অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# অপবিত্রতার অর্থ সব ধরনের অপবিত্রতা। তা আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার অপবিত্রতা হতে পারে, নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্মের অপবিত্রতা হতে পারে আবার শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ এবং উঠা বসা চলাফেরার অপবিত্রতাও হতে পারে। অর্থাৎ তোমার চারদিকে গোটা সমাজে হরেক রকমের যে অপবিত্রতা ও নোংরামী ছড়িয়ে আছে তার সবগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখো। কেউ যেন তোমাকে একথা বলার সামান্য সুযোগও না পায় যে, তুমি মানুষকে যেসব মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্ত করছো তোমার নিজের জীবনেই সে মন্দের প্রতিফলন আছে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৬

وَ لَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ۪ۙ

বেশী লাভ করার জন্য ইহসান করো না!

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মূল বাক্যাংশ হলো وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ একথাটির অর্থ এতো ব্যাপক যে, একটি মাত্র কথায় অনুবাদ করে এর বক্তব্য তুলে ধরা সম্ভব নয়।

এর একটি অর্থ হলো, তুমি যার প্রতিই এহসান বা অনুগ্রহ করবে, নিস্বার্থভাবে করবে। তোমার অনুগ্রহ ও বদান্যতা এবং দানশীলতা ও উত্তম আচরণ হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। ইহসান বা মহানুভবতার বিনিময়ে কোন প্রকার প্রার্থিব স্বার্থ লাভের বিন্দুমাত্র আকাংখাও তোমার থাকবে না। অন্য কথায় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইহসান করো, কোন প্রকার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইহসান করো না।

দ্বিতীয় অর্থ হলো, নবুওয়াতের যে দায়িত্ব তুমি পালন করছো। যদিও তা একটি বড় রকমের ইহসান, কারণ তোমার মাধ্যমেই আল্লাহর গোটা সৃষ্টি হিদায়াত লাভ করছে। তবুও এ কাজ করে তুমি মানুষের বিরাট উপকার করছো এমন কথা বলবে না এবং এর বিনিময়ে কোন প্রকার ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করবে না।

তৃতীয় অর্থ হলো, তুমি যদিও অনেক বড় ও মহান একটি কাজ করে চলেছো কিন্তু নিজের দৃষ্টিতে নিজের কাজকে বড় বলে কখনো মনে করবে না এবং কোন সময় চিন্তাও যেন তোমার মনে উদিত না হয় যে, নবুওয়াতের এ দায়িত্ব পালন করে আর এ কাজে প্রাণপণ চেষ্টা-সাধনা করে তুমি তোমার রবের প্রতি কোন অনুগ্রহ করছো।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৭

وَ لِرَبِّكَ فَاصْبِرْؕ

এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# যে কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে তোমাকে কঠিন বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হতে হবে। তোমার নিজের কওম তোমার শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। সমগ্র আরব তোমার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লাগবে। তবে এ পথে চলতে গিয়ে যে কোন বিপদ-মুসিবতই আসুক না কেন তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে সেসব বিপদের মুখে ধৈর্য অবলম্বন করো এবং অত্যন্ত অটল ও দৃঢ়চিত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকো। এ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, বন্ধুত্ব-শত্রুতা এবং ভালবাসা সব কিছুই তোমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এসবের মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজের অবস্থানে স্থির ও অটল থাকবে।

এগুলো ছিল একেবারে প্রাথমিক দিকনির্দেশনা। আল্লাহ তা’আলা তাঁর রসূলকে যে সময় নবুওয়াতের কাজ শুরু করতে আদেশ দিয়েছিলেন সে সময় এ দিকনির্দেশনাগুলো তাঁকে দিয়েছিলেন। কেউ যদি এসব ছোট ছোট বাক্য এবং তার অর্থ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে তাহলে স্বতস্ফূর্তভাবে তার মন বলে উঠবে যে একজন নবীর নবুওয়াতের কাজ শুরু করার প্রাক্কালে তাঁকে এর চাইতে উত্তম আর কোন দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে না। এ নির্দেশনায় তাঁকে কি কাজ করতে হবে একদিকে যেমন তা বলে দেয়া হয়েছে তেমনি এ কাজ করতে গেলে তাঁর জীবন, নৈতিক চরিত্র এবং আচার-আচরণ কেমন হবে তাও তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর সাথে সাথে তাঁকে এ শিক্ষাও দেয়া হয়েছে যে, তাকে কি নিয়ত, কি ধরনের মানসিকতা এবং কিরূপ চিন্তাধারা নিয়ে একাজ আঞ্জাম দিতে হবে আর এতে এ বিষয়েও তাঁকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, একাজ করার ক্ষেত্রে কিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে এবং তা মোকাবিলা কিভাবে করতে হবে। বর্তমানেও যারা বিদ্বেষের কারণে স্বার্থের মোহে অন্ধ হয়ে বলে যে, (নাউযুবিল্লাহ) মৃগী রোগে আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে এমন কথা উচ্চারিত হতো, তারা একটু চোখ খুলে এ বাক্যগুলো দেখুক এবং নিজেরাই চিন্তা করুক যে, এগুলো কোন মৃগী রোগে আক্রান্ত মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত কথা না কি মহান আল্লাহর বাণী যা রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য তিনি তার বান্দাকে দিচ্ছেন?

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৯

فَذٰلِكَ یَوْمَئِذٍ یَّوْمٌ عَسِیْرٌۙ

সেদিনটি অত্যন্ত কঠিন দিন হবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# আমরা ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছি যে, এ সূরার এ অংশটা প্রথম দিকে নাযিলকৃত আয়াতসমূহের কয়েক মাস পরে এমন সময় নাযিল হয়েছিল যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ইসলামের তাবলীগ ও প্রচারের কাজ শুরু হওয়ার পর প্রথম বারের মত হজ্জের মওসুম সমাগত হলো এবং কুরাইশ নেতৃবৃন্দ একটি সম্মেলন ডেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, বহিরাগত হাজীদের মনে কুরআন ও মুহাম্মাদ ﷺ সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টির জন্য অপপ্রচার ও কুৎসা রটনার এক সর্বাত্মক অভিযান চালাতে হবে। এ আয়াতগুলোতে কাফেরদের এ কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করা হয়েছে। আর একথাটি দ্বারাই পর্যালোচনা শুরু করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, ঠিক আছে যে ধরনের আচরণ তোমরা করতে চাচ্ছো তা করে নাও। এভাবে পৃথিবীতে তোমরা কোন উদ্দেশ্য সাধনে সফল হলেও যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং কিয়ামত কায়েম হবে সেদিন তোমরা নিজেদের কৃতকর্মের মন্দ পরিণাম থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? (শিংগা সম্পর্কে ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন’আম টীকা ৪৭ ; ইবরাহীম, টীকা ৫৭ ; ত্বা-হা টীকা ৭৮ ; আল হাজ্জ, টীকা ১ , ইয়াসীন, টীকা ৪৬ ও ৪৭ , আয্ যুমার, টীকা ৭৯ এবং ক্বাফ, টীকা ৫২ )।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-১০

عَلَى الْكٰفِرِیْنَ غَیْرُ یَسِیْرٍ

কাফেরদের জন্য মোটেই সহজ হবে না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এ বাক্যটি থেকে স্বতঃই প্রতিভাত হয় যে, সেদিনটি ঈমানদারদের জন্য হবে খুবই সহজ এবং এর সবটুকু কঠোরতা সত্যকে অমান্যকারীদের জন্য নির্দিষ্ট হবে। এছাড়া বাক্যটি থেকে এ অর্থও প্রতিফলিহত হয় যে, সেদিনটির কঠোরতা কাফেরদের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে। তা এমন ধরনের কঠোরতা হবে না যা পরে কোন সময়ে হালকা বা লঘূ হয়ে যাওয়ার আশা করা যাবে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-১১

ذَرْنِیْ وَ مَنْ خَلَقْتُ وَحِیْدًاۙ

আমাকে এবং সে ব্যক্তিকে ছেড়ে দাও যাকে আমি একা সৃষ্টি করেছি।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছেঃ হে নবী, কাফেরদের সে সম্মেলনে যে ব্যক্তি (ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা) তোমাকে বদনাম করার উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিয়েছিল যে, সমগ্র আরব থেকে আগত হাজীদের কাছে তোমাকে যাদুকর বলে প্রচার করতে হবে তার ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দেও। এখন আমার কাজ হলো, তার সাথে বুঝাপড়া করা। তোমার নিজের এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কোন প্রয়োজন নেই।

# একথাটির দু’টি অর্থ হতে পারে এবং দু’টি অর্থই সঠিক। এক, আমি যখন তাকে সৃষ্টি করেছিলাম সে সময় কোন প্রকার ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি এবং মর্যাদা ও নেতৃত্বের অধিকারী ছিল না। দুই, একমাত্র আমিই তার সৃষ্টিকর্তা। অন্য যেসব উপাস্যের খোদায়ী ও প্রভুত্ব কায়েম রাখার জন্য সে তোমার দেয়া তাওহীদের দাওয়াতের বিরোধিতায় এত তৎপর, তাদের কেউই তাকে সৃষ্টি করার ব্যাপারে আমার সাথে শরীক ছিল না।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-১৩

وَّ بَنِیْنَ شُهُوْدًاۙ

এবং আরো দিয়েছি সবসময় কাছে থাকার মত অনেক পুত্র সন্তান।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার দশ বারটি পুত্র সন্তান ছিল। তাদের মধ্যে হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদ ইতিহাসে অনেক বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এসব পুত্র সন্তানদের জন্য شهود শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর কয়েকটি অর্থ হতে পরে। এক, রুযী রোজগারের জন্য তাদের দৌড় ঝাপ করতে বা সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে কিংবা বিদেশ যাত্রা করতে হয় না। তাদের বাড়ীতে এত খাদ্য মজুদ আছে যে, তারা সর্বক্ষণ বাপের কাছে উপস্থিত থাকে এবং তাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকে। দুই, তার সবগুলো সন্তানই নামকরা এবং প্রভাবশালী, তারা বাপের সাথে দরবার ও সভা-সমিতিতে উপস্থিত থাকে। তিন, তারা সবাই এমন সামাজিক পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষ্য বা মতামত গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-১৫

ثُمَّ یَطْمَعُ اَنْ اَزِیْدَۗۙ

এরপরও সে লালায়িত, আমি যেন তাকে আরো বেশী দান করি।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# একথার একটি অর্থ হলো, এসব সত্ত্বেও তার লালসা ও আকাংখার শেষ নেই। এত কিছু লাভ করার পরও সে সর্বক্ষণ এ চিন্তায় বিভোর যে, দুনিয়ার সব নিয়ামত ও ভোগের উপকরণ সে কিভাবে লাভ করতে পারবে। দুই, হযরত হাসান বসরী ও আরো কয়েকজন মনীষী বর্ণনা করেছেন যে, সে বলতোঃ মুহাম্মাদের ﷺ একথা যদি সত্য হয়ে থাকে যে, মৃত্যুর পর আরো একটি জীবন আছে এবং সেখানে জান্নাত বলেও কিছু একটা থাকবে তাহলে সে জান্নাত আমার জন্যই তৈরী করা হয়েছে।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-২৫

اِنْ هٰذَاۤ اِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِؕ

এ তো মানুষের কথা মাত্র।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মক্কায় কাফেরদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে সে সম্মেলনে সংঘটিত ঘটনার কথা বলা হচ্ছে। সূরার ভূমিকায় ঘটনাটির যে বিস্তারিত বিবরণ আমরা উল্লেখ করেছি তা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, এ ব্যক্তি মনে প্রাণে যে বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে, কুরআন আল্লাহর বাণী। কিন্তু নিজের গোত্রের মধ্যে তার মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য ঈমান আনতে প্রস্তুত ছিল না। কাফেরদের সে সম্মেলনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে কুরাইশ নেতাদের প্রস্তাবিত অভিযোগসমূহ সে নিজেই যখন খণ্ডন করলো তখন আরবের লোকদের মধ্যে রটিয়ে দিয়ে নবীকে (সা.) বদনাম করা যায় এমন কোন অভিযোগ তৈরি পেশ করতে খোদ তাকেই বাধ্য করা হলো। এ সময় সে যেভাবে তার বিবেকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং বেশ কিছু সময় কঠিন মানসিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকার পর পরিশেষে সে যেভাবে একটি অভিযোগ তৈরী করলো, তার একটা পূর্ণাংগ চিত্র এখানে পেশ করা হয়েছে।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-২৮

لَا تُبْقِیْ وَ لَا تَذَرُۚ

যা জীবিতও রাখবে না আবার একেবারে মৃত করেও ছাড়বে না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হলো, যাকেই এর মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে তাকেই সে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে। কিন্তু জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়েও সে রক্ষা পাবে না। বরং আবার তাকে জীবিত করা হবে এবং আবার জ্বালানো হবে। আরেক জায়গায় কথাটা এভাবে বলা হয়েছেঃ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَى সেখানে সে মরে নিঃশেষ হয়েও যাবে না আবার বেঁচেও থাকবে না ( আল আ’লা, ১৩) । এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে এই যে, আযাবের উপযুক্ত কেউ-ই তার কবল থেকে রক্ষা পাবে না। আর যে তার কবলে পড়বে তাকেই আযাব থেকে রেহাই দেবে না।

সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-২৯

لَوَّاحَةٌ لِّلْبَشَرِۚۖ

গায়ের চামড়া ঝলসিয়ে দেবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# “তা দেহের কোন অংশই না জ্বালিয়ে ছাড়বে না” একথা বলে আবার “চামড়া ঝলসিয়ে দেবে” কথাটি আলাদা করে উল্লেখ করাটা বাহ্যত অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। কিন্তু এ বিশেষ ধরনের আযাবের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্যে হলো, মূলত মুখমণ্ডল ও দেহের চামড়াই মানুষের ব্যক্তিত্বকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরে বা প্রকাশ করে। তাই চেহারা ও গাত্রচর্মের কুৎসিত দর্শন ও কুশ্রী হওয়া তার জন্য সর্বাধিক মানসিক যন্ত্রনার কারণ হবে। শরীরের আভ্যন্তরীণ অংগ-প্রত্যংগে তার যত কষ্ট ও যন্ত্রণাই হোক না কেন সে তাতে ততটা মানসিক যাতনাক্লিষ্ট হয় না। যতটা হয় তার চেহারা কুৎসিত হলে কিংবা শরীরের খোলা মেলা অংশের চামড়া বা ত্বকের ওপর বিশ্রী দাগ পড়লে। কারণ কোন মানুষের চেহারা ও গাত্র চর্মে বিশ্রী দাগ থাকলে সবাই তাকে ঘৃনা করে। তাই বলা হয়েছেঃ এ সুদর্শন চেহারা এবং অত্যন্ত নিটোল ও কান্তিময় দেহধারী যেসব মানুষ নিজেদের ব্যক্তিত্ব গৌরবে আত্মহারা তারা যদি আল্লাহর আয়াতের সাথে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার মত শত্রুতার আচরণ করতেই থাকে তাহলে তাদের মুখমণ্ডল ঝলসিয়ে বিকৃত করে দেয়া হবে আর তাদের গাত্রচর্ম পুড়িয়ে কয়লার মত কালো করে দেয়া হবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-১০ নং আয়াতের তাফসীর

সহীহ বুখারীতে হ্যরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কুরআন কারীমের (আরবি)-এ আয়াতটি সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। কিন্তু জমহুরের উক্তি এই যে, সর্বপ্রথম ওহী হলো (আরবি) (৯৬:১) এ আয়াতটি। যেমন এই সূরার তাফসীরে আসবে ইনশা আল্লাহ।

সহীহ বুখারীতে হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীর (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আবূ সালমা ইবনে আবদির রহমান (রাঃ)-কে কুরআন কারীমের কোন আয়াতটি সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয় এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ (আরবি)-এই আয়াতটি।” ইয়াহইয়া (রঃ) তাঁকে পুনরায় বলেনঃ “লোকেরা তো বলছে যে, …… (আরবি)-এ আয়াতটি সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে?” উত্তরে হযরত আবূ সালমা (রাঃ) বলেনঃ হযরত জাবির (রাঃ)-কে আমি এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম এবং তিনি আমাকে ঐ জবাবই দিয়েছিলেন যা আমি তোমাকে দিলাম। তারপর আমি আবার তাঁকে ঐ প্রশ্নই করেছিলাম যা তুমি আমাকে করলে। আমার এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত জাবির (রাঃ) বলেছিলেনঃ আমি তোমাকে ঐ কথাই বললাম যে কথা আমাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “আমি হেরা পর্বতের গুহায় আমার প্রতিপালকের ধ্যান করছিলাম। সেখান হতে অবতরণ করে আমি শুনতে পেলাম যে, কে যেন আমাকে ডাকছে। আমি আমার সামনে পিছনে ডানে এবং বামে তাকালাম, কিন্তু কাউকেও দেখতে পেলাম না। আমি তখন মাথা উঠিয়ে উপরের দিকে তাকালাম তখন কিছু একটা দেখতে পেলাম। আমি তখন হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে আসলাম এবং তাকে বললামঃ আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর এবং আমার উপর ঠাণ্ডা পানি ঢালতে থাকো। হযরত খাদীজা (রাঃ) তাই করলো এবং ঐ সময়। (আরবি) আয়াতগুলো অবতীর্ণ হলো।

সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওহী বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ “একদা আমি চলতে রয়েছি, হঠাৎ আকাশের দিক হতে আমার কানে একটা শব্দ পৌঁছলো! চক্ষু উঠিয়ে দেখলাম যে, হেরা পর্বতের গুহায় যে ফেরেশতা আমার নিকট এসেছিলেন তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি কুরসীর উপর বসে রয়েছেন। আমি ভয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং বাড়ী এসেই বলিঃ আমাকে বস্ত্রদ্বারা আবৃত করে দাও। আমার কথামত বাড়ীর লোকেরা আমাকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করে। তখন (আরবি) হতে (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।”

হযরত আবূ সালমা (রাঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো মূর্তি। তারপর ক্রমান্বয়ে ওহী অবতীর্ণ হতে থাকে। এটা সহীহ বুখারীর শব্দ এবং এই হিসাবই রক্ষিত আছে। এর দ্বারা স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, এর পূর্বেও কোন ওহী এসেছিল। কেননা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই উক্তিটি বিদ্যমান রয়েছেঃ “ইনি ঐ ফেরেশতা যিনি হেরা পর্বতের গুহায় আমার নিকট এসেছিলেন।” অর্থাৎ হযরত জিবরাঈল (আঃ), যিনি তাঁকে সূরা আলাকের নিম্নের আয়াতগুলো গুহার মধ্যে পড়িয়েছিলেনঃ (আরবি)

এরপর কিছু দিনের জন্যে তাঁর আগমন বন্ধ হয়ে যায়। তারপর যখন তার যাতায়াত আবার শুরু হয় তখন প্রথম ওহী ছিল সূরা মুদ্দাসসিরের প্রাথমিক আয়াতগুলো। এইভাবে এদু’টি হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যাচ্ছে যে, আসলে সর্বপ্রথম ওহী হচ্ছে সূরা আলাকের প্রাথমিক আয়াতগুলো। তারপর ওহী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে সর্বপ্রথম ওহী হলো এই সূরা মুদ্দাসিরের প্রাথমিক আয়াতগুলো। এর স্বপক্ষে রয়েছে মুসনাদে আহমাদ প্রভৃতিতে বর্ণিত হাদীসগুলো, যেগুলোতে রয়েছে যে, ওহী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম ওহী হলো সূরা মুদ্দাসিরের প্রাথমিক আয়াতগুলো।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা কুরায়েশদেরকে যিয়াফত দেয়। খাওয়া-দাওয়ার পর তারা পরস্পর বলাবলি করেঃ “আচ্ছা, তোমরা এই লোকটিকে [হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে] কি বলতে পার?” কেউ কেউ বললো যে, তিনি যাদুকর। অন্য কেউ বললো যে, না, তিনি যাদুকর নন। কেউ কেউ তাঁকে গণক বললো। আবার অন্য কেউ বললো যে, না তিনি গণকও নন। কেউ কেউ তাকে কবি বলে মন্তব্য করলো, কিন্তু অন্য কেউ বললো যে, তিনি কবিও নন, তাদের কেউ কেউ এই মন্তব্য করলো যে, তিনি এমন যাদুকর যে যাদু তিনি লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত হয়েছেন। পরিশেষে তারা এতেই একমত হলো যে, তাঁকে এরূপ যাদুকরই বলা হবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ খবর পেয়ে খুবই দুঃখিত হলেন এবং তিনি কাপড় দ্বারা মাথা ঢেকে নেন এবং গোটা দেহকেও বস্ত্রাবৃত্ত করেন। ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা নিম্নের আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেনঃ

(আরবি) এর শানে নুযূল এটাই বর্ণনা করা হয়েছে।” (এটা ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ উঠো, সতর্ক বাণী প্রচার কর। অর্থাৎ দৃঢ় সংকল্পের সাথে প্রস্তুত হয়ে যাও এবং জনগণকে আমার সত্তা হতে, জাহান্নাম হতে এবং তাদের দুষ্কর্মের শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন কর।

প্রথম ওহী দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে নবী রূপে মনোনীত করা হয়েছে। আর এই ওহী দ্বারা তাঁকে রাসূল বানিয়ে দেয়া হয়েছে।

এরপর বলেনঃ তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এবং তোমার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখো। অর্থাৎ অবাধ্যতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মসাত করা হতে দূরে থাকো। যেমন কবি গাইলান ইবনে সালমা সাকাফী বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ আল্লাহর প্রশংসা যে, আমি পাপাচারের পোষাক ও বিশ্বাসঘাতকতার চাদর হতে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র রেখেছি।” স্বীয় কাপড় পবিত্র রাখো অর্থাৎ পাপকার্য ছেড়ে দাও এবং আমলকে সংশোধন করে নাও, এরূপ ব্যবহার আরবী পরিভাষায়ও বহু দেখা যায়। ভাবার্থ এও হতে পারেঃ হে নবী (সঃ)! তুমি গণকও নও এবং যাদুকরও নও, সুতরাং মানুষ তোমাকে যাই বলুক না কেন তুমি কোন পরোয়া করবে না।

যে ব্যক্তি ওয়াদা অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না তাকে আরবরা ময়লা ও অপরিষ্কার কাপড় ওয়ালা বলে থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলে, বিশ্বাসঘাতকতা করে না তাকে পবিত্র কাপড় ওয়ালা বলে থাকে। কবি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “মানুষ যখন দুষ্কার্য ও মলিনতা দ্বারা নিজের মর্যাদাকে কলুষিত ও অপবিত্র করবে না, তখন সে যে কাপড়ই পরিধান করবে তাতেই তাকে সুন্দর দেখাবে।” ভাবার্থ এও হবেঃ অপ্রয়োজনীয় পোশাক পরিধান করো না, নিজের কাপড়কে পাপ মলিন করো না, কাপড়কে পাক-সাফ রাখো, ময়লা ধুয়ে ফেলো, মুশরিকদের মত নিজের পোষাককে অপবিত্র রেখো না। প্রকৃতপক্ষে এই ভাবার্থগুলো সবই ঠিক। এটাও হবে, ওটাও হবে। সাথে সাথে অন্তরও পবিত্র এবং কলুষমুক্ত হতে হবে। অন্তরের উপর কাপড়ের প্রয়োগ আরবদের কথায় পরিলক্ষিত হয়। যেমন কবি ইমরুল কায়েস বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে ফাতিমা (কবির প্রেমিকা)! তুমি তোমার এসব চলনভঙ্গী ছেড়ে দাও, আর যদি তুমি আমা হতে পৃথক হয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করে থাকো তবে উত্তমরূপে পৃথক হয়ে যাও। আমার কোন ব্যবহার ও চরিত্র যদি তোমার কাছে খারাপ লেগে থাকে তবে আমার কাপড়কে তোমার কাপড় হতে পৃথক করে দাও, তাহলে তা পৃথক হয়ে যাবে।”

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে নিজের অন্তরকে ও নিয়তকে পরিষ্কার রাখো। মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কারাযী (রঃ) ও হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ তোমার চরিত্রকে ভাল ও সুন্দর কর।

আল্লাহ তা’আলার উক্তি (আরবি) অর্থাৎ অপবিত্রতা হতে দূরে থাকো। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ প্রতিমা বা মূর্তি হতে দূরে থাকো। হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত যুহরী (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদও (রঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো প্রতিমা বা মূর্তি। হযরত ইবরাহীম (রঃ) ও হযরত যহহাক (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ নাফরমানী পরিত্যাগ কর। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না।”(৩৩:১) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “এবং মূসা (আঃ) তার ভাই হারূনকে বলেছিলঃ আমার পরে তুমি আমার কওমের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করবে, সংশোধন করবে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ করবে না।” (৭:১৪২)

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অধিক পাওয়ার প্রত্যাশায় দান করো। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবি) রয়েছ। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ অধিক চাওয়ার সাথে আল্লাহর উপর নিজের ভাল আমলের ইহসান প্রকাশ করো না। রবী ইবনে আনাসেরও (রঃ) এটাই উক্তি। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটা পছন্দ করেছেন। হযরত খাসীফ (রঃ) হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ কল্যাণ প্রার্থনার আধিক্য দ্বারা দুর্বলতা প্রকাশ করো না। হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ নবুওয়াতের ইহসানের বোঝা মানুষের উপর রেখে ওর বিনিময়ে দুনিয়া তলব করো না। সুতরাং চারটি উক্তি হলো। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সর্বোত্তম। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল। জানেন।

মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ কর। অর্থাৎ আল্লাহর পথে কাজ করতে গিয়ে জনগণের পক্ষ হতে তোমাকে যে কষ্ট দেয়া হয় তাতে তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে ধৈর্য অবলম্বন কর। আল্লাহ তোমাকে করেছেন তাতে সদা লেগে থাকো।

(আরবি) শব্দ দ্বারা সূর বা শিংগাকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি)-এ আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ “আমি কি করে শান্তিতে থাকতে পারি? অথচ শিংগাধারণকারী ফেরেশতা নিজের মুখে শিংগা ধরে রেখেছেন এবং ললাট ঝুঁকিয়ে আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় রয়েছেন যে, কখন হুকুম হয়ে যাবে এবং তিনি শিংগায় ফুৎকার দিবেন।” সাহাবীগণ (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে আমাদেরকে আপনি কি করতে বলছেন?” জবাবে তিনি বলেনঃ “তোমরা নিম্নের কালেমাটি বলতে থাকবে (আরবি) অর্থাৎ “আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক, আমরা আল্লাহর উপরই ভরসা করি।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে সেই দিন হবে এক সংকটের দিন অর্থাৎ কঠিন দিন, যা কাফিরদের জন্যে সহজ নয়। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “কাফিররা বলবেঃ এটা কঠিন দিন।”(৫৪:৮)

বর্ণিত আছে যে, হযরত যারারাহ ইবনে আওফা (রঃ) বসরার কাযী ছিলেন। একদা তিনি তাঁর মুক্তাদীদেরকে ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন এবং নামাযে তিনি এই সূরাটিই তিলাওয়াত করছিলেন। পড়তে পড়তে যখন তিনি (আরবি) এই আয়াতগুলো পর্যন্ত পৌঁছেন তখন হঠাৎ তিনি ভীষণ জোরে চীকার করে ওঠেন এবং সাথে সাথে মাটিতে পড়ে যান। দেখা যায় যে, তাঁর প্রাণ পাখী তাঁর দেহ পিঞ্জিরা থেকে বেরিয়ে গেছে! আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন!

১১-২৯ নং আয়াতের তাফসীর

যে কলুষিত ব্যক্তি আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং পবিত্র কুরআনকে মানুষের কথা বলে আখ্যায়িত করেছে, এখানে তার শাস্তির বর্ণনা হচ্ছে। যে নিয়ামতরাশি তাকে দেয়া হয়েছে, প্রথমে তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, সে একাকী মায়ের পেট হতে বের হয়েছে। তার না ছিল কোন মাল-ধন ও না ছিল কোন সন্তান সন্ততি। সঙ্গে তার কিছুই ছিল না। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাকে মালদার বানিয়েছেন। তাকে প্রচুর মাল দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন যে, হাজার দীনার বা স্বর্ণ মুদ্রা, কারো কারো মতে লক্ষ দীনার, আবার কেউ কেউ বলেন যে, জমি-জমা ইত্যাদি দান করেছেন। সন্তান দান করার ব্যাপারে কেউ কেউ বলেন যে, তেরোটি সন্তান এবং অন্য কেউ বলেন যে, দশটি সন্তান দান করেছেন, যারা সবাই তার পাশে বসে থাকতো। চাকর-বাকর, দাস-দাসী তার জন্যে কাজ-কর্ম করতো এবং সে মজা করে সন্তান-সন্ততি নিয়ে জীবন যাপন করতো। মোট কথা, তার ধন-দৌলত, দাস-দাসী এবং আরাম-আয়েশ সব কিছুই বিদ্যমান ছিল। তবুও প্রবৃত্তির চাহিদা পূর্ণ হতো না। সে আরো বেশী কামনা করতো। মহান আল্লাহ বলেনঃ এখন কিন্তু আর এরূপ হবে না। সে তো আমার নিদর্শন সমূহের উদ্ধত বিরুদ্ধাচারী। অর্থাৎ সে জ্ঞান লাভের পরেও আমার নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। আমি অচিরেই তাকে ক্রমবর্ধমান শাস্তি দ্বারা আচ্ছন্ন করবো।

মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অয়েল’ হলো জাহান্নামের একটা উপত্যকার নাম, যার মধ্যে কাফিরকে নিক্ষেপ করা হবে। চল্লিশ বছর পর্যন্ত সে নীচের দিকে যেতেই হবে তবুও ওর তলদেশে পৌছতে পারবে না। আর ‘সাউদ’ হলো জাহান্নামের একটি অগ্নি পাহাড়ের নাম যার উপর কাফিরকে চড়ানো হবে। সত্তর বছর পর্যন্ত সে উপরে উঠতেই থাকবে। তারপর সেখান থেকে নীচে ফেলে দেয়া হবে। সত্তর বছর পর্যন্ত নীচের দিকে গড়িয়ে পড়তেই থাকবে এবং চিরস্থায়ীভাবে সে এই শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।” (এ হাদীসটি জামে তিরমিযীতেও রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বা দুর্বল বলেছেন। সাথে সাথে এতে অস্বীকৃতিও রয়েছে)

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “সাঊদ হলো জাহান্নামের একটি আগুনের পাহাড়ের নাম। জাহান্নামীকে এর উপর চড়তে বাধ্য করা হবে। তাতে হাত রাখা মাত্রই তা গলে যাবে এবং উঠানো মাত্রই স্বাভাবিক হাত হয়ে যাবে। পায়ের অবস্থাও তাই হবে।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সাউদ হলো জাহান্নামের এক কংকরময় ভূমির নাম, যার উপর দিয়ে কাফিরকে মুখের ভরে টেনে আনা হবে। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, সাউদ হলো জাহান্নামের এক শক্ত পিচ্ছিল পাথর যার উপর জাহান্নামীকে উঠানো হবে। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আয়াতের ভাবার্থ হলোঃ আমি তাকে কষ্টদায়ক শাস্তি প্রদান করবো। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এমন শাস্তি যা হতে কখনো শান্তি লাভ করা যাবে না। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি তাকে এই কষ্ট ও শাস্তির নিকটবর্তী এ জন্যেই করেছি যে, সে ঈমান হতে বহু দূরে ছিল এবং চিন্তা-ভাবনা করে এটা গড়ে নিচ্ছিল যে, কুরআন কারীম সম্পর্কে সে একটা মন্তব্য করবে!

অতঃপর তার উপর দুঃখ প্রকাশ করে বলা হচ্ছেঃ অভিশপ্ত হোক সে! কেমন করে সে এই সিদ্ধান্ত করলো! আরবদের পরিভাষা অনুযায়ী তার ধ্বংসের শব্দ উচ্চারণ করা হচ্ছে যে, সে ধ্বংস হোক! সে কতই না জঘন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে! সে কতই না নির্লজ্জতাপূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছে! বারবার চিন্তা-ভাবনা করার পর ভ্রূকুঞ্চিত করেছে ও মুখ বিকৃত করেছে। অতঃপর সে পিছন ফিরেছে ও দম্ভ প্রকাশ করেছে। তারপর ঘোষণা করেছে যে, এই কুরআন আল্লাহর কালাম নয়, বরং মুহাম্মাদ (সঃ) তার পূর্ববর্তী লোকদের যাদুমন্ত্র বর্ণনা করছে এবং ওটাই মানুষকে শুনাচ্ছে। সে বলছেঃ এটা তো তোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছুই নয়। এটা তো মানুষেরই কথা।

ঐ অভিশপ্ত ব্যক্তির নাম হলো ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা মাখযুমী, যে কুরায়েশদের নেতা ছিল। হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ঘটনাটি হলোঃ একদা এই অপবিত্র ওয়ালীদ হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর কাছে আসলো এবং তাঁর নিকট হতে কুরআন কারীমের কিছু অংশ শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। হযরত আবূ বকর (রাঃ) তখন তাকে কুরআনের কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শুনালেন। এতে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। এখান থেকে বের হয়ে সে কুরায়েশদের সমাবেশে গিয়ে হাযির হলো এবং বলতে লাগলোঃ “হে জনমন্ডলী! বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) যে কুরআন পাঠ করে থাকেন, আল্লাহর কসম! ওটা কবিতাও নয়, যাদু-মন্ত্রও নয় এবং পাগলের কথাও নয়। বরং খাস আল্লাহর কথা! এতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই।” কুরায়েশরা তার একথা শুনে নিজেদের মাথা ধরে নেয় এবং বলেঃ “এ যদি মুসলমান হয়ে যায় তবে কুরায়েশদের একজনও মুসলমান হতে বাকী থাকবে না।” আবূ জেহেল খবর পেয়ে বললোঃ “তোমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ো না। দেখো, আমি কৌশলে তাকে ইসলাম হতে বিমুখ করে দিচ্ছি।” একথা বলে সে মাথায় এক বুদ্ধি এঁটে নিয়ে ওয়ালীদের বাড়ীতে গেল এবং তাকে বললোঃ “আপনার কওম আপনার জন্যে চাঁদা ধরে বহু অর্থ জমা করেছে এবং ওগুলো তারা আপনাকে দান করতে চায়।” এ কথা শুনে ওয়ালীদ বললোঃ “বাঃ! কি মজার ব্যাপার? আমার তাদের চাঁদা ও দানের কি প্রয়োজন? দুনিয়ার সবাই জানে যে, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধনী। আমার সন্তান-সন্ততিও বহু রয়েছে।” আবূ জেহেল বললোঃ “হ্যাঁ, তা ঠিক বটে। কিন্তু লোকদের মধ্যে এই আলোচনা চলছে যে, আপনি যে আবূ বকর (রাঃ)-এর কাছে যাতায়াত করছেন তা শুধু কিছু লাভের আশায়।” এ কথা শুনে ওয়ালীদ বললোঃ “আমার বংশের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে যে এসব গুজব রটেছে তা তো আমার মোটেই জানা ছিল না? আচ্ছা, এখন আমি কসম খেয়ে বলছি যে, আর কখনো আমি আবূ বকর (রাঃ), উমার (রাঃ) এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কাছে যাবো না। মুহাম্মাদ (সঃ) যা কিছু বলে তা তো লোকপরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছুই নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন।

হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) বলেন যে, ওয়ালীদ কুরআন কারীম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলঃ “কুরআনের ব্যাপারে বহু চিন্তা-ভাবনার পর এই ফলাফলে পৌঁছেছে যে, ওটা কবিতা নয়, ওতে মধুরতা রয়েছে, ঔজ্জ্বল্য রয়েছে। এটা বিজয়ী, বিজিত নয়। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা যাদু।” এই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা নবী (সঃ)-এর নিকট আগমন করে। নবী (সঃ) তাকে কুরআন পাঠ করে শুনান। কুরআন শুনে তার অন্তর নরম হয়ে যায় এবং পুরোপুরি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আবূ জেহেল এ খবর পেয়ে বড় ঘাবড়ে যায় এবং ভয় করে যে, না জানি হয়তো সে মুসলমান হয়েই যাবে। তাই, সে তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে পড়ে এবং একটা মিথ্যা কথা বানিয়ে নিয়ে তাকে বলেঃ “আপনার কওম আপনার জন্যে মাল জমা করতে চায়।” সে জিজ্ঞেস করেঃ “কেন?” সে উত্তরে বলেঃ “আপনাকে দেয়ার জন্যে। উদ্দেশ্য হলো মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নিকট আপনার যাতায়াত বন্ধ করা। কেননা, আপনি সেখানে শুধু মাল লাভ করার উদ্দেশ্যেই গমন করে থাকেন।” এ কথা শুনে ওয়ালীদ ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং বলেঃ “আমার কওমের মধ্যে আমি যে সবচেয়ে বড় মালদার এটা কি তারা জানে না?” আবূ জেহেল উত্তর দিলোঃ “হ্যাঁ, জানে বটে। কিন্তু এখন তো মানুষের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনি শুধু মাল লাভের আশাতেই তাঁর হয়ে গেছেন। আপনি যদি এই বিশ্বাস মানুষের অন্তর হতে মুছে ফেলতে চান তাহলে আপনি মুহাম্মাদ (সঃ)-এর ব্যাপারে একটি কঠোর উক্তি করুন। যাতে লোক বুঝতে পারে যে, আপনি তার সম্পূর্ণ বিরোধী এবং আপনি তার কথাকে মোটেই পছন্দ করেন না।” সে বললোঃ “আমি তার ব্যাপারে কি বলবো? প্রকৃত ব্যাপার তো এই যে, সে যে কুরআন আমাকে শুনিয়েছে, আল্লাহর কসম! ওটা কবিতা নয়, কাসীদা নয়, ছন্দ নয় এবং জ্বিনের কথাও নয়। তোমাদের তো খুব ভাল জানা আছে যে, দানব ও মানবের কথা আমার খুবই ভাল স্মরণ আছে এবং আমি একজন খ্যাতনামা কবিও বটে। ভাষার ভালমন্দ গুণ সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কালাম এগুলোর কোনটিই নয়। তাঁর কালামের মধ্যে এমন মধুরতা ও লালিত্য রয়েছে যে, ওটা সমস্ত কালামের নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তার কালামের মধ্যে বড়ই আকর্ষণ রয়েছে। সুতরাং তুমিই বল, আমি তাঁর কালামের বিরুদ্ধে কি বলতে পারি?” আবূ জেহেল তখন বললোঃ “দেখুন, আপনি এর বিরুদ্ধে কিছু একটা না বলা পর্যন্ত আপনার সম্পর্কে আপনার কওমের মনে যে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে তা দূর হতে পারে না। সে তখন বললোঃ “আচ্ছা, তাহলে আমাকে কিছু অবকাশ দাও, আমি চিন্তা করে এর সম্পর্কে কিছু একটা উক্তি করবো।” সুতরাং সে চিন্তা-ভাবনা করে নিজের নেতৃত্ব বজায় রাখার খাতিরে শেষে বলে ফেললোঃ “এটা তো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছুই নয়।” তখন (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো নাযিল হয়। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, দারুন নুদওয়াতে বসে কাফিররা পরামর্শ করলো যে, হজের মৌসুমে জনগণ চতুর্দিক থেকে আসবে। সুতরাং এই লোকটি (হযরত মুহাম্মাদ সঃ) সম্বন্ধে কি উক্তি করা যেতে পারে? তার সম্পর্কে এমন একটা উক্তি করা যাক যা সবাই এক বাক্যে বলবে, যাতে তা আরবে এবং আরো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন কেউ কবি বললো, কেউ বললো যাদুকর, কেউ বললো গণক, কেউ জ্যোতির্বিদ বললো এবং কেউ পাগল বললো। ওয়ালীদ বসে বসে চিন্তা করছিল। বহুক্ষণ চিন্তা করার পর সে বড় রকমের ভঙ্গিমা করে বললোঃ “দেখো, এ লোকটির কথা তো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন কিছুই নয়। এটা তো মানুষেরই কথা।” আল্লাহ্ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ দেখো, তারা তোমার কি উপমা দেয়, তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা পথ পাবে না।” (১৭:৪৮)।

এরপর আল্লাহ্ তার শাস্তির বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ আমি তাকে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে ডুবিয়ে দিবো যা অত্যন্ত ভয়াবহ শাস্তির আগুন।

যা গোশত, অস্থি, চর্ম সবই খেয়ে ফেলবে। আবার এগুলোকে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হবে এবং পুনরায় জ্বালিয়ে দেয়া হবে। সুতরাং এ শাস্তি না তাদেরকে জীবিতাবস্থায় রাখবে, না মৃত অবস্থায় ছেড়ে দিবে। এই জাহান্নামের তত্ত্বাবধানে রয়েছে ঊনিশ জন প্রহরী। তারা হবে অত্যন্ত কঠোর হৃদয়। তাদের অন্তরে দয়ার লেশমাত্র থাকবে না।

Leave a Reply