Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৬)
[** بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
ঊনিশ এর মোজেযা:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
পারা:২৯
৩০- ৩১ নং আয়াতের বেখ্যা :-
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩০
عَلَیۡہَا تِسۡعَۃَ عَشَرَ ﴿ؕ۳۰﴾
ওর তত্ত্বাবধানে রয়েছে উনিশ জন প্রহরী।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩১
وَ مَا جَعَلۡنَاۤ اَصۡحٰبَ النَّارِ اِلَّا مَلٰٓئِکَۃً ۪ وَّ مَا جَعَلۡنَا عِدَّتَہُمۡ اِلَّا فِتۡنَۃً لِّلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ۙ لِیَسۡتَیۡقِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ وَ یَزۡدَادَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِیۡمَانًا وَّ لَا یَرۡتَابَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ وَ لِیَقُوۡلَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ وَّ الۡکٰفِرُوۡنَ مَاذَاۤ اَرَادَ اللّٰہُ بِہٰذَا مَثَلًا ؕ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰہُ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَا یَعۡلَمُ جُنُوۡدَ رَبِّکَ اِلَّا ہُوَ ؕ وَ مَا ہِیَ اِلَّا ذِکۡرٰی لِلۡبَشَرِ ﴿٪۳۱﴾
আর আমরা তো জাহান্নামের প্রহরী কেবল ফেরেশ্তাদেরকেই করেছি ; কাফিরদের পরীক্ষাস্বরূপই আমরা তাদের এ সংখ্যা উল্লেখ করেছি যাতে কিতাবপ্রাপ্তদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ঈমান বেড়ে যায়। আর কিতাবপ্রাপ্তরা ও মুমিনরা সন্দেহ পোষণ না করে। আর যেন এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফিররা বলে, আল্লাহ্ এ (সংখ্যার) উপমা (উল্লেখ করা) দ্বারা কি ইচ্ছা করেছেন?’ এভাবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছে হেদায়াত করেন। আর আপনার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না। আর জাহান্নামের এ বর্ণনা তো মানুষের জন্য এক উপদেশ মাত্র।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
৩০-৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
কোরআনে ১৯ সংখ্যার মিরাকল?
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে :-
১) *বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর আরবি অক্ষরে ১৯ টি বর্ন আছে।
২)*কুরআন মাজিদে ১১৪টি সুরা আছ ।
১১৪÷১৯=৬
অর্থাৎ এটা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য।
৩) সূরা : ৯ : তওবা এর শুরুতে
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
এই আয়াতটি নেই। কিন্তু
সুরা: ২৭ : আন্-নমল
আয়াত নং :-৩০
اِنَّهٗ مِنْ سُلَیْمٰنَ وَ اِنَّهٗ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِۙ
তা সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং আল্লাহ রহমানুর রহীমের নামে শুরু করা হয়েছে।”
এইভাবে ১১৪টী সংখ্যা ১৯ দারা ঠিক করা আছে।
সুবহানাল্লাহ।
আল্লাহ হু আকবার।
৪) কুরআন যে অবিকৃত আছে এটার একটা প্রমাণ এই যে:-
কেউ যদি এটা পরিবর্তন করত তাহলে প্রথমে সুরা তওবার শুরুতে
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
লিখে দিত!
(তখন এটার ব্যপারে কেউই আপত্তি করতো না!)
৫) সুরা:৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩১
আল্লাহ তাআলা এই ব্যপারে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়েছেন।
وَ مَا جَعَلۡنَاۤ اَصۡحٰبَ النَّارِ اِلَّا مَلٰٓئِکَۃً ۪ وَّ مَا جَعَلۡنَا عِدَّتَہُمۡ اِلَّا فِتۡنَۃً لِّلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ۙ لِیَسۡتَیۡقِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ وَ یَزۡدَادَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِیۡمَانًا وَّ لَا یَرۡتَابَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ وَ لِیَقُوۡلَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ وَّ الۡکٰفِرُوۡنَ مَاذَاۤ اَرَادَ اللّٰہُ بِہٰذَا مَثَلًا ؕ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰہُ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَا یَعۡلَمُ جُنُوۡدَ رَبِّکَ اِلَّا ہُوَ ؕ وَ مَا ہِیَ اِلَّا ذِکۡرٰی لِلۡبَشَرِ ﴿٪۳۱﴾
আর আমরা তো জাহান্নামের প্রহরী কেবল ফেরেশ্তাদেরকেই করেছি ; কাফিরদের পরীক্ষাস্বরূপই আমরা তাদের এ সংখ্যা উল্লেখ করেছি যাতে কিতাবপ্রাপ্তদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ঈমান বেড়ে যায়। আর কিতাবপ্রাপ্তরা ও মুমিনরা সন্দেহ পোষণ না করে। আর যেন এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফিররা বলে, আল্লাহ্ এ (সংখ্যার) উপমা (উল্লেখ করা) দ্বারা কি ইচ্ছা করেছেন?’ এভাবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছে হেদায়াত করেন। আর আপনার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না। আর জাহান্নামের এ বর্ণনা তো মানুষের জন্য এক উপদেশ মাত্র।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:-
# এখান থেকে “তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ অবহিত নয়” পর্যন্ত বাক্যগুলোতে একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। “দোযখের কর্মচারীর সংখ্যা শুধু উনিশ জন হবে” একথা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনে যারা সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিল এবং কথাটা নিয়ে হাসি-ঠাট্রা করতে শুরু করেছিল প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের মাঝখানে বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনে তাদের কথার জবাব দেয়া হয়েছে। তাদের কাছে একথাটি বিস্ময়কর মনে হয়েছে যে, এক দিকে আমাদের বলা হচ্ছে আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ কুফরী করেছে এবং কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়েছে তাদের সবাইকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। অপরদিকে আমাদের জানানো হচ্ছে যে, এত বড় বিশাল দোযখে অসংখ্য মানুষকে আযাব দেয়ার জন্য মাত্র উনিশ জন কর্মচারী নিয়োজিত থাকবে। একথা শুনে কুরাইশ নেতারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আবু জেহেল বললোঃ আরে ভাই, তোমরা কি এতই অকর্মা ও অথর্ব হয়ে পড়ছো যে, তোমাদের মধ্য থেকে দশ দশ জনে মিলেও দোযখের একজন সিপাইকে কাবু করতে পারবে না? বনী জুমাহ্ গোত্রের এক পলোয়ান সাহেব তো বলতে শুরু করলোঃ সতের জনকে আমি একাই দেখে নেব। আর তোমরা সবাই মিলে অবশিষ্ট দুই জনকে কাবু করবে। এসব কথার জবাব হিসেবে সাময়িকভাবে প্রসঙ্গ পাল্টে একথাগুলো বলা হয়েছে।
# অর্থাৎ মানুষের দৈহিক শক্তির সাথে তুলনা করে তাদের শক্তি সম্পর্কে অনুমান করা তোমাদের বোকামী ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা মানুষ নয়, বরং ফেরেশতা। তোমাদের পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব নয় যে, কি সাংঘাতিক শক্তিধর ফেরেশতা আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন।
# অর্থাৎ দোযখের কর্মচারীদের সংখ্যা বর্ণনা করার বাহ্যত কোন প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু তাদের সংখ্যা আমি এজন্য উল্লেখ করলাম যাতে তা সেসব লোকের জন্য ফিতনা হয়ে যায় যারা নিজেদের মনের মধ্যে এখনও কুফরী লুকিয়ে রেখেছে। এ ধরনের লোক বাহ্যিকভাবে ঈমানের প্রদর্শনী যতই করুন না কেন তার অন্তরের কোন গভীরতম প্রদেশেও যদি সে আল্লাহর উলুহিয়াত ও তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা কিংবা অহী ও রিসালাত সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বও পোষণ করে থাকে তাহলে আল্লাহর এত বড় জেলখানায় অসংখ্য অপরাধী মানুষ ও জিনকে শুধু উনিশ জন সিপাই সামলে রাখবে এবং আলাদাভাবে প্রত্যেককে শাস্তিও দেবে একথা শোনামাত্র তার লুকিয়ে রাখা কুফরী স্পষ্ট বেরিয়ে পড়বে।
# কোন কোন মুফাস্সির এর এ অর্থ বর্ণনা করেছেন যে, আহলে কিতাবের (ইয়াহুদ ও খৃস্টান) ধর্মগ্রন্থেও যেহেতু দোযখের ফেরেশতাদের এ সংখ্যাটিই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই একথা শোনামাত্র তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হবে যে, প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর কথাই হবে। কিন্তু আমাদের মতে দু’টি কারণে এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। প্রথম কারণটি হলো, ইয়াহুদ ও খৃস্টানদের যে ধর্মগ্রন্থ বর্তমানে দুনিয়ায় পাওয়া যায় তাতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও দোযখের কর্মচারী ফেরেশতার সংখ্যা উনিশ জন একথা কোথাও পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় কারণটি হলো, কুরআনের বহুসংখ্যক বক্তব্য আহলে কিতাবের ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত বক্তব্যের অনুরূপ। কিন্তু ইয়াহুদ ও খৃস্টানরা এসব বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলে যে, মুহাম্মাদ ﷺ এসব কথা তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে গ্রহণ করেছেন। এসব কারণে আমাদের মতে একথাটির সঠিক অর্থ হলোঃ মুহাম্মাদ ﷺ ভাল করেই জানতেন যে তার মুখে দোযখের কর্মচারী ফেরেশতার সংখ্যা উনিশ, একথা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর প্রতি হাসি-তামাসা ও ঠাট্রা-বিদ্রূপের অসংখ্য বাণ নিক্ষিপ্ত হবে। তা সত্ত্বেও আল্লাহর প্রেরিত অহীতে যে কথা বলা হয়েছে, তা তিনি কোন প্রকার ভয়-ভীতি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে সবার সামনে পেশ করলেন এবং কোন প্রকার ঠাট্রা-বিদ্রূপের আদৌ পরোয়া করলেন না। জাহেল আরবরা নবীদের মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত ছিল না ঠিকই, কিন্তু আহলে কিতাব গোষ্ঠী ভাল করেই জানতো যে প্রত্যেক যুগে নবীদের নীতি ও পদ্ধতি এটাই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের কাছে যা কিছু আসতো মানুষ পছন্দ করুন বা না করুক তারা তা হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতেন। তাই আশা করা গিয়েছিল যে, এ চরম প্রতিকূল পরিবেশে রসূলকে ﷺ বাহ্যত অদ্ভূত একথাটি কোন প্রকার দ্বিধা-সংকোচ না করে সারাসরি পেশ করতে দেখে অন্তত আহলে কিতাব গোষ্ঠীর দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাবে যে, এটি একজন নবীর কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। এক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় আহলে কিতাব গোষ্ঠীর কাছ থেকে এ আচরণ লাভের প্রত্যাশা ছিল বেশী। উল্লেখ্য যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এ কর্মনীতি বেশ কয়েকবার প্রতিফলিত হয়েছে। এর মধ্যে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য হলো মি’রাজের ঘটনা। তিনি কাফেরদের সমাবেশে নিসংকোচে ও দ্বিধাহীন চিত্তে মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। এ বিস্ময়কর ঘটনা শুনে তাঁর বিরোধীরা কত রকমের কাহিনী ফাঁদবে তার এক বিন্দু পরোয়াও তিনি করেননি।
#একথাটি ইতিপূর্বে কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানে বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি পরীক্ষার সময় একজন ঈমানদার যদি তার ঈমানে অটল ও অচল থাকে এবং সন্দেহ-সংশয় কিংবা আনুগত্য পরিহার কিংবা দ্বীনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পথ বর্জন করে দৃঢ় প্রত্যয়, আস্থা, আনুগত্য ও অনুসরণ এবং দ্বীনের প্রতি আস্থা পোষণের পথ অনুসরণ করে তাহলে তার ঈমান দৃঢ়তা ও সমৃদ্ধি লাভ করে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৭৩ ; আল আনফাল, আয়াত ২ ; টীকা ২ ; আত্ তাওবা, ১২৬ ; টীকা ১২৫ ; আল আহযাব, আয়াত ২২ , টীকা ৩৮ ; আল ফাতাহ, আয়াত ৪ ; টীকা ৭ )।
# কুরআন মজীদে সাধারণত “মনের রোগ” কথাটি মুনাফেকী অর্থে ব্যবহার করা হয়। তাই এক্ষেত্রে এ শব্দটির ব্যবহার দেখে কোন কোন মুফাস্সির মনে করেছেন, এ আয়াতটি মদীনাতে নাযিল হয়েছে। কারণ, মদীনাতেই মুনাফিকদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু এ ধারণা কয়েকটি কারণে ঠিক নয়। প্রথমত এ দাবী ঠিক নয় যে মক্কায় মুনাফিক ছিল না। আমরা তাফহীমুল কুরআন সূরা আনকাবুতের ভূমিকায় এবং ১ , ১৩ , ১৪ , ১৫ .ও ১৬নং টীকায় এ ভ্রান্তি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। দ্বিতীয়ত বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ আয়াতসমূহের কোন একটি আয়াত সম্পর্কে একথা বলা যে, তা অন্য কোন পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছে এবং কোন পূর্বাপর সম্পর্ক ছাড়াই এখানে জুড়ে দেয়া হয়েছে, এভাবে কুরআনের কোন আয়াতের তাফসীর করা আমরা সঠিক মনে করি না। নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতসমূহ থেকেই আমরা সূরা মুফাস্সিরের এ অংশের ঐতিহাসিক পটভূমি জানতে পারি। মক্কী যুগের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে এ অংশটি নাযিল হয়েছিল। ঘটনার সাথে বক্তব্যের ধারাবাহিকতার পুরোপুরি সামঞ্জস্য রয়েছে। যদি এ একটি বাক্য কয়েক বছর পর মদীনাতেই নাযিল হয়ে থাকে তাহলে তাকে এ বিশেষ বিষয়ের মধ্যে এনে জুড়ে দেয়ার কি এমন অবকাশ বা যুক্তি আছে? এখন একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, “মনের রোগ” বলতে তাহলে কি বুঝানো হয়েছে? এর জবাব হলো, এর অর্থ সন্দেহের রোগ। অকাট্যভাবে এবং নিসংশয়ে আল্লাহ, আখেরাত, অহী, রিসালাত, জান্নাত ও দোযখ অস্বীকার করে এমন লোক শুধু মক্কায় নয় গোটা পৃথিবীতে আগেও যেমন কম ছিল এখনও তেমনি কম আছে। আল্লাহ আছেন কিনা, আখেরাত হবে কি হবে না, ফেরেশতা, জান্নাত ও দোযখ বাস্তাবিকই আছে না কাল্পকাহিনী মাত্র? রসূল কি প্রকৃতই রসূল ছিলেন? তাঁর কাছে কি সত্যই অহী আসতো? প্রত্যেক যুগে এ ধরনের সন্দেহ পোষণকারী লোকের সংখ্যাই অধিক ছিল। এ সন্দেহই অধিকাংশ মানুষকে শেষ পর্যন্ত কুফরীতে নিমজ্জিত করেছে। তা না হলে যারা এসব সত্য অকাট্যভাবে অস্বীকার করে পৃথিবীতে এরূপ নির্বোধের সংখ্যা কোন সময়ই বেশী ছিল না। কেননা যার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ বিবেক-বুদ্ধিও আছে সেও জানে যে, এসব বিষয়ের সত্য ও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করে দেয়া এবং অকাট্যভাবে অসম্ভব ও অবাস্তব বলে সিদ্ধান্ত দেয়ার আদৌ কোন ভিত্তি নেই।
# এর অর্থ এ নয় যে, তারা একে আল্লাহর বাণী বলে মেনে নিচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করছিলো এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা একথা বললেন কেন? বরং প্রকৃতপক্ষে তারা বলতে চাচ্ছিলো যে, যে বাণীতে এরূপ বিবেক-বুদ্ধি বিরোধী ও দুর্বোধ্য কথা বলা হয়েছে তা আল্লাহর বাণী কি করে হতে পারে?
# অর্থাৎ এভাবে আল্লাহ তা’আলা মাঝে মধ্যে তাঁর বাণী ও আদেশ-নির্দেশে এমন কিছু কথা বলেন যা মানুষের জন্য পরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে কথা শুনে একজন সত্যপন্থী, সৎপ্রকৃতির এবং সঠিক চিন্তার লোক সহজ-সরল অর্থ গ্রহণ করে সঠিক পথ অনুসরণ করে একজন হঠকারী বক্রচিন্তাধারী এবং সত্যকে এড়িয়ে চলার মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি সে একই কথার বাঁকা অর্থ করে তাকে ন্যায় ও সত্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার একটা নতুন বাহানা হিসেবে ব্যবহার করে। প্রথমোক্ত ব্যক্তি নিজে যেহেতু সত্যপন্থী তাই আল্লাহ তা’আলা তাকে হিদায়াত দান করেন। কারণ, হিদায়াত প্রার্থী ব্যক্তিকে জোর করে গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট করা আল্লাহর নীতি নয়। শেষোক্ত ব্যক্তি যেহেতু নিজেই হিদায়াত চায় না, বরং গোমরাহীকেই পছন্দ করে তাই আল্লাহ তাকে গোমরাহীর পথেই ঠেলে দেন। কারণ যে ন্যায় ও সত্যকে ঘৃণা করে তাকে জোর করে হকের পথে টেনে আনা আল্লাহর নীতি নয়। (আল্লাহ তা’আলার হিদায়াত দান করা এবং গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করার বিষয়টি সম্পর্কে এ তাফসীর গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ নীচে উল্লেখিত জায়গাসমূহে দেখুন, সূরা আল বাকারাহ, টীকা ১০ , ১৬ , ১৯ ও ২০ ; আন নিসা, ১৭৩ ; আল আন’আম, টীকা ১৭ , ২৮ ও ৯০ ; ইউনুস, টীকা ১৩ ; আল কাহফ, টীকা ৫৪ এবং আল কাসাস, টীকা ৭১ )
# অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা এ বিশ্ব-জাহানে ভিন্ন ভিন্ন কত শত রকমের জীব-জন্তু যে সৃষ্টি করে রেখেছেন, তাদের কত রকম শক্তি সামর্থ যে দান করেছেন এবং তাদের দ্বারা কত রকম কাজ যে আঞ্জাম দিচ্ছেন একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। পৃথিবীর মত ক্ষুদ্র একটি গ্রহে বসবাসকারী মানুষ তার সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে চার পাশের ক্ষুদ্র পৃথিবীকে দেখে যদিও ভুল ধারণা করে বসে যে, সে তার ইন্দ্রিয়সমূহের সাহায্যে যা কিছু দেখছে ও অনুভব করছে কেবল মাত্র সেগুলোই আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বধীন তাহলে এটা তার মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’আলার সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বধীন এ বিশ্ব-জাহান এত ব্যাপক ও বিশাল যে, মানুষের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এর ব্যাপকতা ও বিশালতার সবটুকু জ্ঞানের স্থান সংকুলান তো দূরের কথা এর কোন একটি জিনিস সম্পর্কেও পুর্ণ জ্ঞান লাভ করা তার সাধ্যাতীত। টিকা:২৬) অর্থাৎ দোযখের উপযুক্ত হয়ে যাওয়া এবং তার শাস্তি লাভের পূর্বেই লোকেরা যেন তা থেকে নিজেদের রক্ষার চিন্তা করে।
ফী জিলালিল কুরআন: *ফেরেশতার সংখ্যা নির্ণয়ের তাৎপর্য : ‘দোযখের প্রহরী থাকে উনিশ জন।’ এই ফেরেশতারা ব্যক্তি না গােষ্ঠী, তা আমরা জানি না। পরবর্তীতে আমরা এ সম্পর্কে সবিস্তারে আলােচনা করবাে ইনশাআল্লাহ। ঈমানদাররা এই প্রহরী সংক্রান্ত কথাগুলােকে যথার্থ আদব শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পনের মনােভাব নিয়ে গ্রহণ করেছে এবং পুরােপুরিভাবে তা বিশ্বাস করেছে। কোনাে বিষয় নিয়েই তারা তর্কে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু মােশরেকরা এই সংখ্যাকে গ্রহণ করেছে ঈমান-শুন্য মন ও শ্রদ্ধাহীন মানসিকতা নিয়ে। আল্লাহর এই মহান দাওয়াত গ্রহণ না করার কষ্টের মনােভাব নিয়ে তারা বিষয়টিকে দেখেছে। আল্লাহর এই মহান দাওয়াতকে গ্রহণ না করার মনােভাব নিয়েই তারা তা শ্রবণ করে। অধিকন্তু তার প্রতি বিদ্রুপ করে, উপহাস করে ও দৃষ্টতা দেখায়। তাদের কেউ কেউ বলে, কোরায়শ বংশের দশ দশজন মিলেও কি এই উনিশ জনের এক একজনকে পরাভূত করা যাবে না? আবার এক দাম্ভিক এসে বলে, ঠিক আছে কোরায়শদের সবাই মিলে দুইজনের মােকাবেলা করুক। বাকী সতেরাে জনকে আমি একাই পরাস্ত করতে পারবাে। এই পর্যায়ে পরবর্তী আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াতে আল্লাহর অদৃশ্য গুণের এই দিকটি প্রকাশ করা ও এই সংখ্যাটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য কি, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং অদৃশ্য গুণ যে শুধু আল্লাহর একক ও একচেটিয়া অধিকার তাও ঘােষণা করা হয়েছে। মােশরেকরা যে উনিশ জনকে নিয়ে বাকাবিতন্ডা শুরু করেছিলাে তার রহস্য নিয়েই আয়াতটি শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আমি দোযখের দায়িত্বশীল হিসেবে ফেরেশতা ছাড়া আর কাউকে নিযুক্ত করিনি।’ বস্তুত ফেরেশতা হচ্ছে সেই অদৃশ্য সৃষ্টি যার স্বভাব ও শক্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। তিনি তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে যা আদেশ করেন তা তারা অমান্য করে না এবং যা তাদেরকে করতে বলা হয় তারা তা করে।’ এ থেকে বুঝা গেলাে যে, আল্লাহর আদেশ যারা পালন করে এবং তা করার ক্ষমতাও তাদেরকে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে যে অর্পন করা হয় সাথে সাথে তা করার ক্ষমতাও তাদেরকে দেয়া হয়। কাজেই তাদেরকে যখন দোযখের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে তখন সেটিকে পরিচালনা করার ক্ষমতাও তাদেরকে দেয়া হয়েছে। কাজেই মানুষের মত দুর্বল সৃষ্টি তাদরকে পরাভূত করবে এটা কোনােক্রমেই সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তারা যে সব কথাবার্তা বলেছিলো, তা নিছক তাদের অজ্ঞতাপ্রসুত। আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর বিশ্ব পরিচালনার রহস্য তাদের জানা ছিলােনা বলেই ওসব কথা তারা বলতে পেরেছিলাে। ‘তাদের সংখ্যাকে আমি কাফেরদের পরীক্ষার বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছি।’ বস্তুত তারা এমনই স্বভাবের মানুষ যে, সংখ্যার উল্লেখ মাত্রই তাদের মনে তর্কের স্পৃহা জেগে ওঠে। কোথায় নির্বিবাদে কথা মেনে নিতে হয় এবং কোথায় তর্ক করতে হয় তাও তারা জানেনা। এটা একটা অদৃশ্য বিষয়। এ সংক্রান্ত কোনাে জ্ঞানই আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ রাখেনা এবং মানুষের কাছে এর কম বা বেশী কিছুই নেই। আল্লাহর এই অদৃশ্য বিষয় সংক্রান্ত খবর কারােই জানা নেইযখন আল্লাহ তায়ালা এই অদৃশ্য বিষয় সংক্রান্ত কোনাে তথ্য জানান, সেই তথ্যটুকুরও একমাত্র উৎস তিনিই। মানুষের কাজ হলাে নির্বিবাদে এই তথ্যটুকু মেনে নেয়া। তার এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা কর্তব্য যে, যে বিষয় সম্পর্কে যতটুকু তথ্য আল্লাহ তায়ালা জানালেন, শুধুমাত্র ততটুকু জানার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত। এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোনাে অবকাশ নেই। কারণ মানুষ শুধু তখনই বিতর্কে লিপ্ত হয়, যখন কোনাে বিষয়ে তার আগে থেকে জ্ঞান থাকে এবং নতুন প্রাপ্ত তথ্য তার বিরুদ্ধে যায়। ফেরেশতার সংখ্যা উনিশ কেন হলাে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আল্লাহই সমগ্র সৃষ্টি জগতের সমন্বয় ও শৃংখলা বিধান করেন এবং সকল জিনিসকে নির্দিষ্ট পরিমানে সৃষ্টি করেন। আলােচ্য সংখ্যাটি অন্য যে কোনাে সংখ্যার মতােই। এ সংখ্যাটি নিয়ে যে ব্যক্তি বিতর্কে লিপ্ত হয়, তারপক্ষে অন্য যে কোনাে সংখ্যা নিয়ে একইভাবে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া সম্ভব। সে প্রশ্ন করতে পারে যে, আকাশ সাতটি কেন; মানুষ মাটি থেকে এবং জ্বিন আগুন থেকে সৃষ্টি কেন? মানুষ মায়ের পেটে নয় মাস থাকে কেন? কচ্ছপ হাজার হাজার বছর বাঁচে কেন? এটা কেন? ওটা কেন? সব প্রশ্নেরই জবাব এই যে, সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি যা খুশী তাই ইচ্ছা করেন, এটাই এসব ব্যাপারে শেষ কথা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এই সংখ্যা নির্ধারণের উদ্দেশ্য এই যে, কিতাবধারীরা যেন দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, আর মােমেনদের বিশ্বাস যেন আরাে মযবুত হয় এবং কিতাবধারীরা ও মােমেনরা সন্দেহে লিপ্ত না হয়। দোযখের প্রহরীদের সংখ্যা জেনে কারাে ঈমান মযবুত হবে এবং কারাে ঈমান বাড়বে। আর কিতাবধারীদের তাে এ সম্পর্কে কিছু জানা আছেই। উপরন্তু তারা যখন কোরআন থেকে এ তথ্য জানবে, তখন নিশ্চিত হতে পারবে যে, কোরআন তাদের পূর্বে প্রাপ্ত আসমানী গ্রন্থের সমর্থক। আর মােমেনদের তাে কথাই আলাদা। আল্লাহর প্রতিটি কথাই তাদের ঈমান বাড়ায়। কেননা তাদের মন থাকে সর্বক্ষণ উক্ত ও আল্লাহর সাথে সংযুক্ত। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত তত্ত্ব ও তথ্য তাদের মনে আপনা থেকেই ও স্বতস্ফুর্তভাবে গৃহীত হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কথাই তার কাছে আসে তা তাকে আল্লাহর অধিকতর ঘনিষ্ট ও প্রিয় করে। তাই এই ফেরেশতাদের সংখ্যার নিগুঢ় রহস্যও তারা উপলব্ধি করবে এবং তা তাদের ঈমান বাড়াবে। আর মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত লােকেরা ও কাফেররা যেন বলতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারা কি উদাহরণ দিতে চান? এভাবে একই সত্য বিভিন্ন রকমের মানুষের অন্তরে বিভিন্ন রকমের প্রভাব বিস্তার করে। একদিকে কিতাবধারীদের ঈমান মযবুত হয়। মােমেনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কাফের ও মােনাফেকরা হতবুদ্ধি হয়ে প্রশ্ন করে যে, আল্লাহ তায়ালা এ দ্বারা কি উদাহরণ দিতে চান? তারা এই আশ্চর্য বিষয়ের নিগুঢ় তত্ত্ব জানতে পারে না। আর প্রত্যেক সৃষ্টিতেই যে আল্লাহর কোনাে কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তা তারা স্বীকার করে না। আর এই অজানা তত্ত্বকে জনসমক্ষে নিয়ে আসায় যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং তা যে সম্পূর্ণ সত্য তাও তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে না। এভাবে আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা গােমরাহ করেন ও যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন। আল্লাহ তায়ালা শুধু মাত্র তথ্য অবহিত করেন। তাতে বিভিন্ন মানুষের মনে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া হয়। আল্লাহর ইচ্ছায় তা দ্বারা কেউ হেদায়াত লাভ করে, আবার কেউ বিভ্রান্ত হয়। সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তিনি মানুষকে হেদায়াত ও গােমরাহীর উভয়ের যােগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই যে গােমরাহ কিংবা সুপথপ্রাপ্ত হয়, তারা উভয়েই আল্লাহর ইচ্ছার সীমার ভেতরেই থাকে। তারপর কে কোনটি বাস্তবে গ্রহণ করবে, সে ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে উভয় পথই সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহর অবাধ ইচ্ছা ও গুপ্ত মহৎ উদ্দেশ্যর ভিত্তিতেই তা করেছেন। সৃষ্টি জগতে যা কিছু ঘটে, তা আল্লাহর অবাধ ইচ্ছাক্রমেই ঘটে, এই বিশ্বাস মানুষের বিবেক তথাকথিত অদৃষ্টের অধীনতা ও ইচ্ছার স্বাধীনতা-এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে সীমিত সংকীর্ণ বিতর্ক থেকে মুক্ত করে। এ বিতর্ক কোনাে নির্ভুল ধারণায় উপনীত হতে দেয় না। কেননা তা বিষয়টিকে একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা ও পর্যলােচনা করে। অতপর তাকে সে কতিপয় সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের রূপ দেয়, যা মানুষের যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও সীমিত ধ্যান ধারণা থেকেই উদ্ভূত হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্যে হেদায়াতের পথ ও গোমরাহীর পথ উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাদের জন্যে এমন একটি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন যার অনুসরণ করলে আমরা হেদায়াত পাই, শান্তি পাই ও সাফল্যমন্ডিত হতে পারি। পক্ষান্তরে তিনি আমাদেরকে এমন বহু সংখ্যক পথের কথাও বলে দিয়েছেন, যার অনুসরণ করলে আমরা গােমরাহ হবাে, অসুখী হবা ও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এর বাইরে কিছু জানার জন্যে আমাদেরকে দায়িত্বও দেননি, ক্ষমতাও দেননি। তিনি আমাদেরকে বলেছেন, আমার ইচ্ছা অবাধ, স্বাধীন এবং কার্যকর। এখন আমাদের উচিত সাধ্যমত আল্লাহর স্বাধীন ও কার্যকর ইচ্ছার তত্ত্বকে প্রয়োগ করা যে, সঠিক পথ রয়েছে মাত্র একটি, আর আমাদেরকে সেই পথই অনুসরণ করতে হবে। আর বিভ্রান্তির একাধিক পথগুলােকে বর্জন করতে হবে। যে অদৃশ্য তত্ত্ব আমাদের নাগালের বাইরে রাখা হয়েছে তা নিয়ে নিস্ফল বিতর্কে লিপ্ত হওয়া অনুচিত। এ কারণে প্রাচীন (কালাম) তর্ক শাস্ত্রবিদরা অদৃষ্ট তত্ত্ব নিয়ে যেভাবে কথা বলেছেন, তা ব্যর্থ চেষ্টা বলেই আমার কাছে মনে হয়। আল্লাহর ইচ্ছা একটা গায়বী বা অদৃশ্য বিষয়। এটা আমরা ঠিক ঠিক জানি না। তবে আমরা জানি আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাছে কি কি চান, কি কি করলে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করাকে তিনি নিজের দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করেন। তাও আমরা জানি। কাজেই আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনেই আমাদের শক্তি ব্যয় করা উচিত। আর আমাদের ব্যাপারে তার গােপন ইচ্ছা কি, তা তার হাতেই ন্যস্ত করা আমাদের কর্তব্য। যা বাস্তবে সংঘটিত হবে সেটাই বুঝতে হবে তার ইচ্ছা। সেটা আমরা সংঘটিত হওয়ার পরেই জানতে পারবাে আগে নয়। আর কোনাে জিনিসের পেছনে কোন্ উদ্দেশ্য ও কল্যাণ নিহিত, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। এটাই হচ্ছে মােমেনের চিন্তার পদ্ধতি। *আল্লাহ তায়ালার অদৃশ্য বাহিনী : ‘তােমার প্রভুর বাহিনীর সংখ্যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।’ বস্তুত এটাও একটা গায়বী বা অদৃশ্য তত্ত্ব। আল্লাহর সৈন্যরা কেমন, কি তাদের কাজ, কেমন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা, এ সবই গােপন তথা গায়বী তত্ত্ব। গায়বের যে তত্ত্ব তিনি প্রকাশ করতে চান-করেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর কথাই চূড়ান্ত। কাজেই এরপর কারাে এ নিয়ে মাথা ঘামানাে বা বিতর্ক করা উচিত নয় এবং যা আল্লাহ তায়ালা জানাননি তা জানতে চেষ্টা করাও বৈধ নয় । ‘এখানে মানব জাতির জন্যে উপদেশ ছাড়া আর কিছু নয়।’ এখানে আল্লাহর সৈন্য সামন্তকে, অথবা দোযখ ও তার কর্মকর্তাদের সম্পর্কিত বিষয়টাকে মানব জাতির জন্যে উপদেশ আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর দোযখ ও তার কর্মকর্তারাও আল্লাহর সৈন্য সামন্তের অন্তর্ভূক্ত। এর উল্লেখ করা হয়েছে মানুষকে সতর্ক ও সাবধান করার জন্যে, কোনাে বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যে নয়। যারা মােমেন তারা একে উপদেশ হিসেবেই গ্রহণ করে এবং সতর্ক হয়। যারা গােমরাহ তারা এ দ্বারা বির্তক সৃষ্টির প্রয়াস পায়। এ পর্যন্ত যে অদৃশ্য বিষয়টি আলােচিত হলাে এবং তাকে কেন্দ্র করে কারাে বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারায় লিপ্ত হওয়া এবং কারাে ভালাে ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার যে কথা বলা হলাে, তার সূত্র ধরে পরবর্তী কয়টি আয়াতে আরাে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে।
আয়াতের ৩০-৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
#
(عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ)
জাহান্নামের প্রহরী ঊনিশজন। যখন জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের কথা আল্লাহ তা‘আলা ঊনিশজন বলে উল্লেখ করলেন তখন আবূ জাহল কুরাইশদেরকে সম্বোধন করে বলল : তোমাদের থেকে প্রত্যেকে দশজনের একটি দল এক এক জন ফেরেশতার জন্য যথেষ্ট নও কি? কেউ বলেন : কাতাদাহ নামক এক ব্যক্তি (যে নিজ শক্তির ব্যাপারে বড়ই অহংকারী ছিল) সে বলল : তোমরা কেবল দু’জন ফেরেশতাকে সামলে নিও, বাকী সতের জন ফেরেশতার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। বলা হয়, এ লোকই কয়েকবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুস্তি লড়াই করার জন্য চ্যালেঞ্জ করেছিল। অথচ প্রত্যেকবারেই সে হার মেনেছে। কিন্তু ঈমান আনেনি।
সুতরাং যুগে যুগে যারাই ইসলামের ও মুসলিমদের বিরোধিতা করেছে, মুসলিমদেরকে ধ্বংস করার জন্য চক্রান্ত করেছে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে এভাবেই শাস্তি দিয়েছেন আর আখিরাতে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
#
(وَّمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً)
পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- জাহান্নামের প্রহরী মাত্র ঊনিশজন ফেরেশতা। এ আয়াতে বলা হচ্ছে ঊনিশজন ফেরেশতা জাহান্নামের প্রহরী বানানোর কারণ হল : এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করবেন। ফলে যারা কাফির তাদের কুফরী আরো বৃদ্ধি পাবে আর যারা মু’মিন তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পাবে। যেমন মিরাজ একটি নিদর্শন যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে যারা কাফির তাদের জন্য এ মি‘রাজ বিশ্বাস করা অসম্ভব হয়ে গেল, ফলে কুফরীর দিকে তারা আরো বেশি ধাবিত হল। আর মু’মিনদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেল।
(الَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ)
এ অংশ দ্বারা মুনাফিকদের বুঝোনো হয়েছে। এরূপ উদাহরণ বর্ণনা করার হিকমত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : এ সব নিদর্শন দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন আবার যাকে ই্চ্ছা পথভ্রষ্ট করেন।
(وَمَا يَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ)
অর্থাৎ কাফিররা ঊনিশজন ফেরেশতার কথা শুনে মনে করতে পারে আল্লাহ তা‘আলার আর ফেরেশতা নেই। মূলত আল্লাহ তা‘আলার যে কত বাহিনী আছে তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। মূসা (আঃ)-এর অবাধ্য জাতিকে ব্যাঙ, উকুন, রক্ত ইত্যাদি দ্বারা তিনি শাস্তি প্রদান করেছেন। এগুলো আল্লাহ তা‘আলার বাহিনী। হাদীসে এসেছে : সাত আকাশের ওপর বাইতুল মা‘মুর নামে একটি ঘর বয়েছে যাতে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। কিয়ামতের পূর্বে তাদের দ্বিতীয় বার পালা আসবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৩২০৭, সহীহ মুসলিম হা. ১৬২)
আয়াতের ৩০-৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
# হযরত বারা’ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি (আরবি) আল্লাহ্ পাকের এই উক্তি সম্পর্কে বলেন যে, ইয়াহূদীদের একটি দল রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাহাবী (রাঃ)-এর একজন লোককে জাহান্নামের রক্ষকদের সংখ্যা জিজ্ঞেস করে। তিনি উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-ই এ সম্পর্কে ভাল জানেন।” তখন একজন লোক এসে নবী (সঃ)-কে এ খবর দেন। ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা (আরবি)-এ আয়াত অবতীর্ণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদেরকে এ খবর দিয়ে দেন এবং তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা তাদেরকে (ইয়াহূদীদেরকে) আমার কাছে ডেকে আন। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করবো যে, জান্নাতের মাটি কেমন? আর তোমরা জেনে রেখো যে, জান্নাতের মাটি হলো সাদা ময়দার মত।” তারপর ইয়াহুদীরা তাঁর কাছে আসলো এবং তাঁকে জাহান্নামের রক্ষকদের সংখ্যা জিজ্ঞেস করলো। তিনি স্বীয় হস্তদ্বয়ের অঙ্গুলিগুলো দু’বার উত্তোলন করলেন এবং দ্বিতীয়বার এক হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বন্ধ রাখলেন (অর্থাৎ অঙ্গুলির ইশারায় তিনি তাদেরকে জানালেন যে, তাঁরা সংখ্যায় উনিশ জন)। অতঃপর তিনি ঐ ইয়াহুদীদেরকে প্রশ্ন করলেনঃ “জান্নাতের মাটি কেমন?” তারা তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললোঃ “হে ইবনে সালাম (রাঃ)! আপনিই এঁদেরকে এ খবরটি দিয়ে দিন!” তখন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে সালাম (রাঃ) বললেনঃ “যেন ওটা সাদা রুটী।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তখন বললেনঃ “জেনে রেখো যে, ওটা ঐ সাদা রুটীর মত যা নির্ভেজাল ময়দা দ্বারা তৈরী।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক নবী (সঃ)-এর কাছে এসে বললোঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আজ তো আপনার সাহাবীগণ হেরে গেছে?” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “কি ভাবে।” সে উত্তর দিলোঃ “ইয়াহূদীরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তাদের নবী কি তাদেরকে জাহান্নামের রক্ষকদের সংখ্যা জানিয়ে দিয়েছেন? উত্তরে তারা বলেছে যে, তারা তাদের নবীকে জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত এর উত্তর দানে অক্ষম।” এ কথা শুনে নবী (সঃ) বললেনঃ “এমন কওমকে কি করে পরাজিত বলা যেতে পারে যাদেরকে এমন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় যা তাদের জানা নেই। তখন তারা বলে যে, তারা ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না যে পর্যন্ত না তারা তাদের নবীকে জিজ্ঞেস করে? আল্লাহ্ ঐ দুশমনদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো যারা তাদের নবীর কাছে আবেদন করেছিল যে, তিনি যেন তাদের প্রতিপালককে প্রকাশ্যভাবে তাদেরকে দেখিয়ে দেন। তখন তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আপতিত হয়।” অতঃপর ঐ ইয়াহূদীদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে ডেকে আনা হলে তারা বললোঃ “হে আবূল কাসিম (সঃ)! জাহান্নামের রক্ষকদের সংখ্যা কত?” উত্তরে নবী (সঃ) তাঁর হস্তদ্বয়ের অঙ্গুলিগুলো খুলে দিয়ে দু’বার দেখান এবং দ্বিতীয় বারে এক হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বন্ধ রাখেন অর্থাৎ অঙ্গুলির ইশারায় তিনি জানান যে, জাহান্নামের রক্ষীরা হলেন সংখ্যায় ঊনিশ জন। আর তিনি স্বীয় সাহাবীদেরকে বললেনঃ “তোমাদেরকে জান্নাতের মাটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তোমরা বলবে যে, ওটা সাদা ময়দার মত।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ইয়াহূদীদের প্রশ্নের উত্তরে জাহান্নামের রক্ষীদের সংখ্যা বলে দেয়ার পর তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করলেনঃ “বলতো, জান্নাতের মাটি কেমন?” তখন তারা একে অপরের দিকে তাকালো এবং শেষে বললোঃ “হে আবূল কাসিম (সঃ)! ওটা রুটির মত।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “সাদা ময়দার রুটির মত।” (এ হাদীসটি হাফিয আবূ বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা জামে তিরমিযী এবং মুসনাদে আহমাদেও বর্ণিত হয়েছে)।
#
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ শাস্তির কাজের উপর এবং জাহান্নামের রক্ষণাবেক্ষণের উপর আমি ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করেছি, যারা নির্দয় ও কঠোর ভাষী। এ কথার দ্বারা কুরায়েশদের দাবী খণ্ডন করা হয়েছে। যখন জাহান্নামের প্রহরীদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় তখন আবূ জেহেল বলেঃ “হে কুরায়েশদের দল! তোমাদের দশ জন কি তাদের এক জনের উপর জয় লাভ করতে পারবে না?” তখন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি জাহান্নামের প্রহরী করেছি ফেরেশতাদেরকে। তারা মানুষ নয়। সুতরাং তাদেরকে পরাজিত করাও যাবে না এবং ক্লান্ত করাও যাবে না।
এটাও বলা হয়েছে যে, আবূল আশদাইন, যার নাম ছিল কালদাহ ইবনে উসায়েদ ইবনে খালফ, বলেঃ “হে কুরায়েশদের দল! তোমরা (জাহান্নামের উনিশ জন প্রহরীদের) দু’জনকে প্রতিহত কর, বাকী সতেরো জনকে প্রতিহত করার জন্যে আমি একাই যথেষ্ট।” সে ছিল বড় আত্মগর্বী এবং সে বড় শক্তিশালীও ছিল। তার শক্তি এতো বেশী ছিল যে, সে গরুর চামড়ার উপর দাঁড়াতো। তখন দশজন লোক তার পায়ের নীচ হতে ঐ চামড়াকে বের করার জন্যে এতো জোরে টান দিতো যে, চামড়া ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো, তথাপি তার পা একটুও নড়তো না। এ ছিল ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে এসে বলেছিলঃ “আসুন, আমরা দু’জন মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। যদি আপনি আমাকে ভূপাতিত করতে পারেন তবে আমি আপনার নবুওয়াতকে স্বীকার করে নিবো।” তার কথামত রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার সাথে মল্লযুদ্ধ করে কয়েকবার তাকে ভূপাতিত করেন, কিন্তু এর পরও ঈমান আনয়নের সৌভাগ্য সে লাভ করেনি। ইমাম ইবনে ইসহাক (রঃ) মল্লযুদ্ধ সম্বলিত ঘটনাটি রাকানাহ্ ইবনে আবৃদি ইয়াযীদ ইবনে হাশিম ইবনে আবদিল মুত্তালিবের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। আমি (ইবনে কাসীর রঃ) বলি যে, এই দু’জনের মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। সম্ভবতঃ ওর এবং এর, উভয়ের সাথেই মল্লযুদ্ধ হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ এই সংখ্যার উল্লেখ পরীক্ষা স্বরূপই ছিল। এক দিকে কাফিরদের কুফরী খুলে যায় এবং অপরদিকে কিতাবীদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে যে, এই রাসূল (সঃ)-এর রিসালাত সত্য। কেননা, তাদের কিতাবেও এই সংখ্যাই ছিল। তৃতীয়তঃ এর ফলে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পায়। মুমিন ও কিতাবীদের সন্দেহ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়। পক্ষান্তরে, যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে অর্থাৎ মুনাফিকরা এবং কাফিররা বলে উঠলোঃ আল্লাহ্ তা’আলা এই অভিনব উক্তি দ্বারা কি বুঝাতে চেয়েছেন? এখানে এটা উল্লেখ করার মধ্যে কি হিকমত রয়েছে? আল্লাহ্ তা’আলা বলেন যে, এ ধরনের কথা দ্বারা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করেন। আল্লাহ্ এ সমুদয় কাজ হিকমত ও রহস্যে পরিপূর্ণ।
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই ওয়কিফহাল। তাদের সঠিক সংখ্যা এবং তাদের সংখ্যার আধিক্যের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই আছে। এটা মনে করো না যে, তাদের সংখ্যা মাত্র ঊনিশই। যেমন গ্রীক দার্শনিকরা এবং তাদের মতবাদে বিশ্বাসী লোকেরা অজ্ঞতা বশতঃ বুঝে নিয়েছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘উকূলে আশারাহ্’ এবং নুফুসে তিসআহ’। কিন্তু এটা তাদের এমন একটা দাবী যার উপর দলীল কায়েম করতে তারা সম্পূর্ণরূপে অপারগ। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এই আয়াতের প্রথম অংশের উপর তো তাদের দৃষ্টি পড়েছে বটে, কিন্তু এর শেষাংশের সাথে তারা কুফরী করতে রয়েছে! যেখানে সুস্পষ্ট শব্দ বিদ্যমান রয়েছেঃ তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। সুতরাং শুধু ঊনিশের কি অর্থ হতে পারে? সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মিরাজ সম্বলিত হাদীসে এটা সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বায়তুল মা’মূরের বিশেষণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ “ওটা সপ্তম আকাশের উপর রয়েছে। ওর মধ্যে প্রত্যহ পালাক্রমে সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে থাকেন। কিয়ামত পর্যন্ত এভাবে তারা তাতে প্রবেশ করতেই থাকবেন। কিন্তু ফেরেস্তাদের সংখ্যা এতো অধিক যে, একদিন যে সত্তর হাজার ফেরেশতা ঐ বায়তুল মা’মূরে প্রবেশ করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত আর তাদের ওর মধ্যে প্রবেশ করার পালা পড়বে না।”