Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯১/ঘুম থেকে নামাজ উত্তম:-২/এবং কাফের-রা বলে:-৩৫)
[**মহা খবর:-
*তোমাদের ঘুমকে করেছি শান্তির বাহন,:-
*এবং কাফের বলে উঠবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা
পারা:২৯
১-৪০.নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর
যে মুশরিকরা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করতো এবং ওকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মানসে পরস্পরকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতো, এখানে আল্লাহ তা’আলা তাদের ঐ সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন এবং কিয়ামত যে অবশ্যই সংঘটিত হবে এটা বর্ণনা করতঃ তাদের দাবী খণ্ডন করছেন। তিনি বলেনঃ তারা একে অপরের নিকট কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে?’ অর্থাৎ তারা একে অপরকে কি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারা কি কিয়ামত সম্পর্কে একে অপরের নিকট প্রশ্ন করছে। অথচ এটা তো এক মহা সংবাদ! অর্থাৎ এটা অত্যন্ত ভীতিপ্রদ ও খারাপ সংবাদ এবং উজ্জ্বল সুস্পষ্ট দিবালোকের মত প্রকাশমান।
হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) ও হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) (আরবি) দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান উদ্দেশ্য নিয়েছেন। কিন্তু হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর। দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সঠিকতর বলে মনে হচ্ছে অর্থাৎ এর দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানই উদ্দেশ্য।
(আরবি) (যেই বিষয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে), এতে যে মতানৈক্যের কথা বলা হয়েছে তা এই যে, এ বিষয়ে তারা দুটি দলে বিভক্ত রয়েছে। একটি দল এটা স্বীকার করে যে, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে। আর অপর দল এটা স্বীকারই করে না।
এরপর আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত অস্বীকারকারীদেরকে ধমকের সুরে বলছেনঃ কখনই না, তাদের ধারণা অবাস্তাব, অলীক, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে। আবার বলিঃ কখনই না, তারা অচিরেই জানাবে, এটা তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার কঠিন ধমক ও ভীষন শাস্তির ভীতি প্রদর্শন।
এরপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বিস্ময়কর সৃষ্টির সূক্ষ্মতার বর্ণনা দেয়ার পর নিজের আজীমুশশান ক্ষমতার বর্ণনা দিচ্ছেন, যার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, তিনি এসব জিনিস কোন নমুনা ছাড়াই প্রথমবার যখন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তখন তিনি দ্বিতীয়বারও ওগুলো সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। তাই তো তিনি বলেনঃ আমি কি ভূমিকে শয্যা (রূপে) নির্মাণ করিনি?’ অর্থাৎ আমি সমস্ত সৃষ্টজীবের জন্যে এই ভূমিকে কি সমতল করে বিছিয়ে দিইনি? এই ভাবে যে, ওটা তোমাদের সামনে বিনীত ও অনুগত রয়েছে। নড়াচড়া না করে নীরবে পড়ে রয়েছে। আর পাহাড়কে আমি এই ভূমির জন্যে পেরেক বা কীলক করেছি যাতে এটা হেলাদোলা না করতে পারে এবং ওর উপর বসবাসকারীরা যেন উদ্বিগ্ন হয়ে না পড়ে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি সৃষ্টি করেছি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায়। অর্থাৎ তোমরা নিজেদেরই প্রতি লক্ষ্য কর যে, আমি তোমাদেরকে নর ও নারীর মাধ্যমে সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা একে অপর হতে কামবাসনা পূর্ণ করতে পার। আর এভাবেই তোমাদের বংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা অলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (৩০:২১)।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি বিশ্রাম।’ অর্থাৎ তোমাদের দ্রিাকে আমি হট্টগোল গণ্ডগোল বন্ধ হওয়ার কারণ বানিয়েছি যাতে তোমরা আরাম ও শান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের সারা দিনের শ্রান্তি-ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এর অনুরূপ আয়াত সূরায়ে ফুরকানে গত হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’আলার উক্তিঃ “আমি রাত্রিকে করেছি আবরণ।’ অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার ও কৃষ্ণতা জনগণের উপর ছেয়ে যায়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “শপথ রজনীর যখন সে ওকে আচ্ছাদিত করে।” (৯১:৪) আরব কবিরাও তাঁদের কবিতায় রাত্রিকে পোশাক বা আবরণ বলেছেন।
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, রাত্রি শান্তি ও বিশ্রামের কারণ হয়ে যায়।
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ “আমি দিবসকে জীবিকা, সংগ্রহের জন্যে (উপযোগী) করেছি।’ অর্থাৎ রাত্রির বিপরীত দিকে আমি উজ্জ্বল করেছি। দিনের বেলায় আমি অন্ধকার দূরীভূত করেছি যাতে তোমরা ওর মধ্যে জীবিকা আহরণ করতে পার।
মহান আল্লাহর উক্তিঃ “আর আমি নির্মাণ করেছি তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে সুস্থিত সপ্ত আকাশ।’ অর্থাৎ সাতটি সুউচ্চ, সুদীর্ঘ ও প্রশস্ত আকাশ তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে নির্মাণ করেছি যেগুলো চমৎকার ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। সেই আকাশে তোমরা হীরকের ন্যায় উজ্জ্বল চকচকে নক্ষত্র দেখতে পাও। ওগুলোর কোন কোনটি পরিভ্রমণ করে ও কোন কোনটি নিশ্চল ও স্থির থাকে।
আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ “আর আমি সৃষ্টি করেছি প্রোজ্জ্বল দীপ।’ অর্থাৎ আমি সূর্যকে উজ্জ্বল প্রদীপ বানিয়েছি যা সমগ্র পৃথিবীকে আলোকোজ্জ্বল করে। থাকে এবং সমস্ত জিনিসকে ঝঝকে তকতকে করে তোলে ও সারা দুনিয়াকে আলোকময় করে দেয়।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘এবং আমি বর্ষণ করেছি মেঘমালা হতে প্রচুর বারি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রবাহিত বায়ু মেঘমালাকে এদিক ওদিক নিয়ে যায়। তারপর ঐ মেঘমালা হতে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং তা ভূমিকে পরিতৃপ্ত করে। আরো বহু তাফসীরকার বলেছেন যে, দ্বারা বায়ুই উদ্দেশ্য। কিন্তু কোন কোন মুফাসসির বলেছেন যে, এর দ্বারা ঐ মেঘ উদ্দেশ্য যা বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি বরাবর বর্ষাতেই থাকে।
আরবে (আরবি) ঐ নারীকে বলা হয় যার মাসিক ঋতুর সময় নিকটবর্তী হয়েছে কিন্তু এখনো ঋতু শুরু হয়নি। অনুরূপভাবে এখানেও অর্থ এই যে, আকাশে মেঘ দেখা দিয়েছে কিন্তু এখনো মেঘ হতে বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়নি। হযরত হাসানঃ (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, (আরবি) দ্বারা আসমাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল উক্তি। এর দ্বারা উদ্দেশ্য মেঘ হওয়াই বিকাশমন উক্তি। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ, তিনি বায়ু প্রেরণ করেন, ফলে এটা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে, অতঃপর তিনি একে যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন, পরে একে খণ্ড-বিখণ্ড করেন এবং তুমি দেখতে পাও যে, ওটা হতে নির্গত হয় বারিধারা।” (৩০:৪৮)
(আরবি)-এর অর্থ হলো ক্রমাগত প্রবাহিত হওয়া এবং অত্যধিক বর্ষিত হওয়া। একটি হাদীসে রয়েছেঃ “ঐ হজ্ব হলো সর্বোত্তম হজ্ব যাতে ‘লাব্বায়েক’ খুব বেশী বেশী পাঠ করা হয়, খুব বেশী রক্ত প্রবাহিত করা হয় অর্থাৎ অধিক কুরবানী করা হয়।” এ হাদীসেও (আরবি) শব্দ রয়েছে।
একটি হাদীসে রয়েছে যে, ইসহাযাহর মাসআলা সম্পর্কে প্রশ্নকারিণী একজন সাহাবিয়া মহিলাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুলার পুঁটলী কাছে রাখবে।” মহিলাটি বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার রক্ত যে অনবরত আসতেই থাকে। এই রিওয়াইয়াতেও (আরবি) শব্দ রয়েছে। অর্থাৎ বিরামহীনভাবে রক্ত অসিতেই থাকে। সুতরাং এই আয়াতেও উদ্দেশ্য এটাই যে, মেঘ হতে বৃষ্টি অনবরত বর্ষিত হতেই থাকে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ঐ পাক পবিত্র ও বরকতময় বারি দ্বারা আমি উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ, ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্যান। এগুলো মানুষ ও অন্যান্য এর আহারের কাজে লাগে। বর্ষিত পানি খালে বিলে জমা রাখা হয়। গরপর ঐ পানি পান করা হয় এবং বাগ-বাগিচা সেই পানি পেয়ে ফুলে-ফলে, রূপে-রসে সুশোভিত হয়। আর বিভিন্ন প্রকারের রঙ, স্বাদ ও গন্ধের ফলমূল মাটি হতে উৎপন্ন হয়, যদিও ভূমির একই খণ্ডে ওগুলো পরস্পর মিলিতভারে রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও অন্যান্য গুরুজন বলেন যে, এর অর্থ হলো জমা বা একত্রিত। এটা আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবি)
অর্থাৎ “পথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখণ্ড, তাতে আছে দ্রাক্ষা-কানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক শিরাবিশিষ্ট অথবা এক শিরা বিশিষ্ট খজুর বৃক্ষ সিঞ্চিত একই পানিতে, আর ফল হিসেবে ওগুলোর কতককে কতকের উপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে এতে রয়েছে। নিদর্শন।” (১৩:৪)
১৭-৩০ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা (আরবি) অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সম্পর্কে বলেন যে, ওটা একটা নির্ধারিত দিন। এটা পূর্বেও আসবে না এবং পরেও আসবে না, বরং ঠিক নির্ধারিত সময়েই আসবে। কিন্তু কখন আসবে তার সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই রয়েছে। তিনি ছাড়া আর কারো এর জ্ঞান নেই। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি ওটাকে শুধু নির্ধারিত সময়ের জন্যেই বিলম্বিত করছি।” (১১:১০৪)
ইরশাদ হচ্ছে সেই দিন শিংগায় ফুত্তার দেয়া হবে এবং তোমরা দলে দলে সমাগত হবে। প্রত্যেক উম্মত নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথক পৃথক থাকবে। যেমন আহ অলি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যেই দিন আমি সমস্ত মানুষকে তাদের ইমামদের সাথে আহ্বান করব।” (১৭:৭১)।
(আরবি) এই আয়াতের তাফসীরে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “উভয় শিংগার মধ্যবর্তী সময় হবে চল্লিশ।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “চল্লিশ দিন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমি বলতে পারি না। তারা আবার প্রশ্ন করলেনঃ “চল্লিশ মাস কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “তা আমি বলতে পারবো। তারা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ “চল্লিশ বছর?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমি এটাও বলতে অস্বীকার করছি। তিনি বলেনঃ অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ফলে যেভাবে উদ্ভিদ মাটি হতে অঙ্কুরিত হয়। দ্রুপ মানুষ ভূ-পৃষ্ঠ হতে উথিত হতে থাকবে। মানুষের সারা দেহ পচে গলে যায়। শুধুমাত্র একটি জিনিস বাকী থাকে। তা হলো কোমরের মেরুদণ্ডের অস্থি। ঐ অস্থি থেকেই কিয়ামতের দিন মাখলুককে পুনর্গঠন করা হবে।
“আকাশ উন্মুক্ত করা হবে, ফলে ওটা হবে বহু দ্বার বিশিষ্ট।” অর্থাৎ আকাশকে খুলে দেয়া হবে এবং তাতে ফেরেশতামণ্ডলীর অবতরণের পথ ও দরজা হয়ে যাবে।
“আর চলমান করা হবে পর্বতসমূহকে, ফলে সেগুলো হয়ে যাবে মরীচিকা।” যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তুমি পর্বতসমূহ দেখছো ও ওগুলোকে জমাট বলে ধারণা করছো, অথচ ওগুলো কিয়ামতের দিন মেঘের ন্যায় চলতে থাকবে।” (২৭:৮৮) অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “পর্বতসমূহ হবে ধূনিত রংগিন পশমের মত।” (১০১:৫)
এখানে আল্লাহ পাক বলেন যে, পর্বতগুলো হয়ে যাবে মরীচিকা। দর্শকরা মনে করবে যে, ওটা নিশ্চয়ই একটা কিছু, আসলে কিন্তু কিছুই নয়। শেষে ওটা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বলঃ আমার প্রতিপালক ওগুলোকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। অতঃপর তিনি ওকে পরিণত করবেন মসৃণ সমতল ময়দানে। যাতে তুমি বক্রতা ও উচ্চতা দেবেন।” (২০:১০৫-১০৭) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “স্মরণ কর, যেদিন আমি পৰ্বতকে করবো সঞ্চালিত এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে উন্মুক্ত প্রান্তর।” (১৮:৭)
আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ “নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে; (ওটা হবে) সীমালংঘনকারীদের প্রত্যাবর্তন স্থল।” যারা হলো উদ্ধত, নাফরমান ও রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণকারী। জাহান্নামই তাদের প্রত্যাবর্তন ও অবস্থান স্থল। হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদাহ (রঃ)-এর অর্থ এও করেছেন যে, কোন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যে পর্যন্ত না জাহান্নামের উপর দিয়ে গমন করবে। যদি আমল ভাল হয় তবে মুক্তি পেয়ে যাবে, আর যদি আমল খারাপ হয় তবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। হযরত সুফইয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, ওর উপর তিনটি পুল বা সেতু রয়েছে।
এপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘সেথায় তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।
(আরবি) শব্দটি (আরবি) শব্দের বহুবচন। দীর্ঘ যুগকে (আরবি) বলা হয়। কেউ কেউ বলেন যে (আরবি) আশি বহরে এক হয়। বারো মাসে হয় এক বছর। ত্রিশ দিনে এক মাস হয় এবং প্রতিটি দিন হাজার বছরের হবে। বহু সাহাবী এবং তাবেয়ী হতে এটা বর্ণিত আছে। কারো কারো মতে সত্তর বছরে এক (আরবি) হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এক (আরবি) এ হয় চল্লিশ বছর। বছরগুলোর প্রতিটি দিন হাজার বছরের। বাশীর ইবনে কাব (রঃ) তো বলেন যে, এক একটি দিন এরূপ বড় এবং এরূপ তিনশ বছরে এক হকব। একটি মারফু হাদীসে আছে যে, (আরবি)-এর মাসগুলো ত্রিশ দিনের, বছরগুলো বারো মাসের, বছরগুলোর দিনের সংখ্যা তিনশ ষাট এবং প্রতিটি দিন দুনিয়ার গণনা হিসেবে এক হাজার বছরের হবে। (এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। কিন্তু এ হাদীসটি অত্যন্ত মুনকার। এর একজন বর্ণনাকারী রয়েছে জাবির ইবনে যুরায়েরের পুত্র কাসেম এবং তার থেকে বর্ণনা করেছে জাফর ইবনে যুবায়ের। দুই জনই পরিত্যাজ্য)
অন্য একটি বিওয়াইয়াতে আছে যে, আবু মুসলিম ইবনে আ’লা (রঃ) সুলাইমান ভাইমী (রঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ “জাহান্নাম হতে কেউ বের হবে।
কি?” সুলাইমান তাইমী (রঃ) উত্তরে বলেনঃ “আমি নাফে’ (রঃ) হতে শুনেছি এবং তিনি শুনেছেন হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর কসম! জাহান্নামে সুদীর্ঘকাল অবস্থান ব্যতীত কেউই জাহান্নাম হতে বের হবে না। তারপর বলেনঃ “আশির উপর কিছু বেশী বছরে এক (আরবি) হয়। প্রতি বছরে তিনশ ষাট দিন রয়েছে তোমরা গণনা করে থাকো।”
সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, জাহান্নামীরা জাহান্নামে সাতশ’ ‘হকব’ পর্যন্ত থাকবে। প্রতিটি হকবে’ সত্তর বছর রয়েছে, প্রতিটি বছরের দিনের সংখ্যা হলো তিনশ ষাট এবং প্রতিটি দিন দুনিয়ার হাজার বছরের সমান।
হযরত মুকাতিল ইবনে হিব্বান (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি (আরবি)-এই আয়াত দ্বারা মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে।
হযরত খালিদ ইবনে মা’দান (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি এবং (আরবি) (অর্থাৎ জাহান্নামীরা জাহান্নামে থাকবে আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা করবেন) এই আয়াতটি একত্ববাদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ ‘এও হতে পারে যে, (আরবি) সম্পর্কযুক্ত হবে। (আরবি) এর সাথে অর্থাৎ ফুটন্ত পানি ও পুঁজ’ এই। একই শাস্তি যুগ যুগ ধরে হতে থাকবে। তারপর অন্য প্রকারের শাস্তি শুরু হবে। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, জাহান্নামে অবস্থানকালের পরিসমাপ্তিই নেই।
হযরত হাসান (রঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ ‘আহকাব’ এর অর্থ হলো জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করা। কিন্তু (আরবি) বলা হয় সত্তর বছরকে যার প্রতিটি দিন দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, আহকাব কখনো শেষ হবার নয়। এক হাকব শেষ হলে অন্য হাকব শুরু হয়ে যাবে। এই আহকাবের সঠিক সময়ের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই রয়েছে। তবে মানুষকে শুধু এতোটুকু জানানো হয়েছে যে, আশি বছরে এক (আরবি) হয়। এক বছরের মধ্যে রয়েছে তিনশ ষাট দিন এবং প্রতিটি দিন দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান।
এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সেথায় তারা আস্বাদন করবে না শৈত্য, না কোন পানীয়। অর্থাৎ জাহান্নামীদেরকে এমন ঠাণ্ডা জিনিস দেয়া হবে না যার ফলে তাদের কলিজা ঠাণ্ডা হতে পারে এবং ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে দেয়া হবে না। বরং এর পরিবর্তে পান করতে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি ও রক্ত পুঁজ।
(আরবি) এমন কঠিন পমকে বলা হয় যার পরে গরম বা উষ্ণতার আর কোন স্তর নেই। আর (আরবি) বলে জাহান্নামীদের ক্ষতস্থান হতে নির্গত রক্ত পুঁজ ইত্যাদিকে। ই গরমের মুকাবিলায় এমন শৈত্য দেয়া হবে যে, তা স্বয়ং যেন একটা আবাৰ এবং তাতে থাকবে অসহনীয় দুর্গন্ধ। সূরায়ে সাদ’ -এর মধ্যে (আরবি)- তাফসীর গত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তা’আলা তার অশেষ রহমতের বদৌলতে আমাদেরকে তার সর্বপ্রকারের শাস্তি হতে রক্ষা করুন! আমীন!
কেউ কেউ (আরবি) শব্দের অর্থ ঘুমও বলেছেন। আরব কবিদের কবিতায়ও শব্দটি ঘুমের অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ ‘এটাই উপযুক্ত প্রতিফল। এখানে তাদের দুষ্কৃতি লক্ষ্যণীয়। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, হিসাব-নিকাশের কোন ক্ষণ আসবেই না। আল্লাহ যেসব দলীল প্রমাণ তাঁর নবীদের উপর অবতীর্ণ করেছেন, তারা এ সব কিছুকেই একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতো। (আরবি) শব্দটি মাসদার’ বা ক্রিয়ামূল। এই ওজনে আরো মাসদার রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার উক্তিঃ সব কিছুই আমি সংরক্ষণ করেছি লিখিতভাবে। অs আমি আমার বান্দাদের সমস্ত আমল অবগত রয়েছি এবং ওগুলোকে লিখে রেখেছি। সবগুলোরই আমি প্রতিফল প্রদান করবো। ভাল কাজ হলে ভাল প্রতিফল এবং মন্দ কাজ হলে মন্দ প্রতিফল।
জাহান্নামীদেরকে বলা হবেঃ এখন তোমরা শান্তির স্বাদ গ্রহণ কর। এরকমই এবং এর চেয়েও নিকৃষ্ট শাস্তি বৃদ্ধি করা হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, জাহান্নামীদের জন্যে এর চেয়ে কঠিন ও নৈরাশ্যজনক কোন আয়াত আর নেই। তাদের শাস্তি সদা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি হযরত অ হ আসলামী (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলামঃ জাহান্নামীদের জন্যে কঠিনতম আয়াত কোনটি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে (আরবি) এ আয়াতটি পাঠ করার পর নিম্নের বাক্যটি বলতে শুনেছিঃ “কওমকে তাদের মহামহিমান্বিত আল্লাহর অবাধ্যাচরণ ধ্বংস করে দিয়েছে। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (কঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর একজন বর্ণনাকারী জাসর ইবনে ফারকাদ অত্যন্ত দুর্বল)
৩১-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর
পরহেযগার ও পুণ্যবানদের জন্যে আল্লাহর নিকট যেসব নিয়ামত ও রহমত রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বল আলামীন বলছেন যে, এই লোকগুলো হলো সফলকাম। এদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে এবং এরা জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভ করে জান্নাতে পৌঁছে গেছে।
(আরবি) বলা হয় খেজুর ইত্যাদির বাগানকে। এই পুণ্যবান ও পরহেযগার লোকগুলো উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী অর্থাৎ হূর লাভ করবে, যারা হবে উঁচু ও স্ফীত বক্ষের অধিকারিণী এবং সমবয়স্কা। যেমনঃ সূরায়ে ওয়াকিআ’র তাফসীরে এর পূর্ণ বর্ণনা গত হয়েছে।
হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ নিশ্চয়ই জান্নাতীদের গায়ের) জামাগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টিরূপে প্রকাশিত হবে। তাদের উপর মেঘমালা ছেয়ে যাবে এবং তাদেরকে ডাক দিয়ে বলা হবে “হে জান্নাতবাসিগণ! তোমরা কি চাও যে, আমি তোমাদের উপর তা বর্ষণ করি?” (অতঃপর তারা যা কিছু চাইবে তা-ই তাদের উপর বর্ষিত হবে) এমন কি তাদের উপর সমবয়স্কা উদভিন্ন যৌবনা তরুণীও বর্ষিত হবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
তারা পবিত্র শরাবের উপচে পড়া পেয়ালা একটির পর একটি লাভ করবে। তাতে এমন কোন নেশা হবে না যে, অশ্লীল ও অর্থহীন কথা তাদের মুখ দিয়ে বের হবে যা অন্য কেউ শুনতে পাবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তথায় থাকবে না কোন অসার ও পাপের কথা ।” অর্থাৎ তাতে কোন অর্থহীন বাজে কথা এবং অশ্লীল ও পাপের কথা প্রকাশ পাবে না। সেটা হলো দারুস সালাম বা শান্তির ঘর। যেখানে কোন দূষণীয় বা মন্দ কথাই প্রকাশ পাবে না।
পুণ্যবানদেরকে এসব নিয়ামত তাদের সৎ কর্মের বিনিময় হিসেবে আল্লাহ তাআলা দান করবেন। এটা হলো মহান আল্লাহর অশেষ করুণা ও রহমত। আল্লাহ পাকের এই করুণা ও অনুগ্রহ সীমাহীন, ব্যাপক ও পরিপূর্ণ। আরবরা বলে থাকেঃ
(আরবি) অর্থাৎ “তিনি আমাকে ইনআম দিয়েছেন এবং পরিপূর্ণরূপেই দিয়েছেন। অনুরূপভাবে বলা হয়ঃ (আরবি) অর্থাৎ “সর্বদিক দিয়ে আ উত্তমল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট।”
৩৭-৪০ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, একমাত্র তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সমস্ত মাখলুকের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি রহমান বা পরম দয়াময়। তাঁর রহমত বা করুণা সব কিছু পরিবেষ্টন করে আছে। তার সামনে কেউ মুখ খুলতে পারবে না। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কে সে, যে তার অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করবে?” (২:২৫৫) আল্লাহ তা’আলা আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেই দিন ঐ সময় আসবে সেই দিন কেউই তার অনুমতি ছাড়া তাঁর সামনে মুখ খুলতে বা কথা বলতে সাহস পাবে না।” (১১:১০৫)।
রূহ দ্বারা হয়তো উদ্দেশ্য সমস্ত মানুষের রূহ বা সমস্ত মানুষ, অথবা এক প্রকারের বিশেষ মাখলূক যারা মানুষের মত আকার বিশিষ্ট, পানাহার করে থাকে, যারা ফেরেশতাও নয়, মানুষও নয়। অথবা রূহ দ্বারা হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে অন্য জায়গাতেও রূহ বলা হয়েছে। যেমনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “ওটাকে বিশ্বস্ত আত্মা তোমার অন্তরে অবতীর্ণ করেছে যাতে তুমি ভয় প্রদর্শকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।” (২৬:১৯৩-১৯৪) এখানে রূহ দ্বারা নিশ্চিত রূপেই হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, সমস্ত ফেরেশতার মধ্যে বুযুর্গতম, অহী বাহক, আল্লাহর নৈকট্যলাভে
সমর্থ হয়েছেন এমন ফেরেশত হলে এই জিবরাঈল (আঃ)। অথবা রূহ দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে নিম্নের আয়াতটি পেশ করা। যেতে পারেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এভাবেই আমি আমার আদেশে তোমার প্রতি অহী অবতীর্ণ কবি।” (২৫২) এখানে রূহ দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য। ষষ্ঠ উক্তি এই যে, এই রুহ হলেন সমগ্র মাখকের সম আয়তন বিশিষ্ট এক ফেরেশতা।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এই ফেরেশতা সমস্ত ফেরেশতা হতে বহু গুণে বড়।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, রূহ নামক এই ফেরেশতা চতুর্থ আসমানে রয়েছেন। তিনি সমস্ত আকাশ, সমগ্র পাহাড়-পর্বত এবং সমস্ত ফেরেশতা হতে বড়। প্রত্যহ তিনি বারো হাজার তাসবীহ পাঠ করে থাকেন। প্রত্যেক তাসবীহ হতে একজন করে ফেরেশতা জন্ম লাভ করে থাকেন। কিয়ামতের দিন তিনি একাই একটি সারিরূপে আসবেন। কিন্তু এই উক্তিটি হাদীসের সংজ্ঞায় খুবই গরীব বা দুর্বল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “ফেরেশতাদের মধ্যে এমন এক ফেরেশতাও রয়েছেন যে, যদি তাকে বলা হয়ঃ আকাশ ও পৃথিবীকে এক গ্রাসে নিয়ে যাও, তবে তিনি এক গ্রাসেই সবকে নিয়ে নিবেন। তার তাসবীহ হলোঃ(আরবি) অর্থাৎ “আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি আপনি যেখানেই থাকুন না কেন।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস। এমনকি এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উক্তি হওয়া সম্পর্কেও সমালোচনা করা হয়েছে। সম্ভবতঃ এটা হযরত আল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি হবে। আর ওটাও হয় তো তিনি বানী ইসরাঈল হতেহণ করেছেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এসব উক্তি আনয়ন করেছেন, কিন্তু কোন ফায়সালা করেননি। আমার মতে তো এখানে রূহ দ্বারা সমস্ত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ‘দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত (ৱে কথা বলবে না)।” আল্লাহ পাকের এই উক্তিটি তাঁর নিম্নের উক্তির মতো (আরবি) অর্থাৎ “যখন ঐ দিন আসবে তখন তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ছাড়া কেউই। কথা বলবে না।” (১১:১০৫) সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “ সেইদিন রাসূলগণ ছাড়া কেউই কথা বলবে না।”
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “এবং সে যথার্থ বলবে।’ সর্বাধিক সত্য কথা হলোঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই।”
মহান আল্লাহর উক্তিঃ ‘এই দিবস সুনিশ্চিত। অর্থাৎ অবশ্যই এটা সংঘটিত হবে। অতএব যার অভিরুচি সে তার প্রতিপালকের শরণাপন্ন হোক।’ অর্থাৎ যে ইচ্ছা করবে সে তার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাবার পথ তৈরী করুক, যে পথে চলে সে সোজাভাবে তার কাছে পৌঁছে যাবে।
মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি হতে সতর্ক করলাম।’ অর্থাৎ কিয়ামতের শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন করলাম। যা আসবে তাকে এসেই গেছে মনে করা উচিত। কারণ যা আসার তা আসবেই। সেই দিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে। ঐদিন নতুন, পুরাতন, ছোট, বড় এবং ভাল ও মন্দ সমস্ত আমল মানুষের সামনে থাকবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ তারা যে আমল করেছে তা উপস্থিত পাবে।” (১৮:৪৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সেই দিন মানুষকে অবহিত করা হবে যা সে অগ্রে পাঠিয়েছে ও যা পশ্চাতে রেখে গেছে সে সম্পর্কে।” (৭৫:১৩)
“আর কাফির বলবেঃ হায়, আমি যদি মাটি হতাম।” অর্থাৎ দুনিয়ায় যদি আমরা মাটিরূপে থাকতাম, যদি আমাদেরকে সৃষ্টিই না করা হতো এবং আমাদের কোন অস্তিত্বই না থাকতো তবে কতই না ভাল হতো! তারা সেদিন আল্লাহর আযাব স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। নিজেদের মন্দ ও পাপকর্মগুলো সামনে থাকবে যেগুলো পবিত্র ফেরেশতাদের ন্যায়পূর্ণ হস্তে লিখিত হয়েছে।
সুতরাং একটি অর্থ তো এই হলো যে, তারা দুনিয়াতেই মাটি হবার আকাঙ্ক্ষা করবে। অর্থাৎ সৃষ্টি না হওয়া কামনা করবে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, যখন জীবজন্তুগুলোর ফায়সালা হয়ে যাবে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়ে দেয়া হবে, এমন কি যদি শিংবিহীন বকরীকে শিংবিশিষ্ট বকরী মেরে থাকে তবে তারও প্রতিশোধ নিয়ে দেয়া হবে। তারপর তাদেরকে (জন্তুগুলোকে) বলা হবেঃ তোমরা মাটি হয়ে যাও, তখন তারা মাটি হয়ে যাবে। তখন এই কাফির লোকও বলবেঃ হায়, যদি আমি (এদের মত) মাটি হয়ে যেতাম! অর্থাৎ যদি আমিও জন্তু হতাম এবং এভাবে মাটি হয়ে যেতাম তবে কতই না ভাল হতো!
সূরের (শিংগার) সুদীর্ঘ হাদীসেও এই বিষয়টি এসেছে এবং হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী হতেও এটা বর্ণিত হয়েছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১
عَمَّ یَتَسَآءَلُوۡنَ ۚ﴿۱﴾
তারা একে অন্যের কাছে কী বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে?
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২
عَنِ النَّبَاِ الۡعَظِیۡمِ ۙ﴿۲﴾
সেই বড় খবরটা সম্পর্কে কি, ?
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩
الَّذِیۡ ہُمۡ فِیۡہِ مُخۡتَلِفُوۡنَ ؕ﴿۳﴾
যে ব্যাপারে এরা নানান ধরনের কথা বলে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে?
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৪
کَلَّا سَیَعۡلَمُوۡنَ ۙ﴿۴﴾
কখনই না, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৫
ثُمَّ کَلَّا سَیَعۡلَمُوۡنَ ﴿۵﴾
আবার বলি, কখনই না, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৬
اَلَمۡ نَجۡعَلِ الۡاَرۡضَ مِہٰدًا ۙ﴿۶﴾
আমি কি পৃথিবীকে শয্যা (স্বরূপ) সৃষ্টি করিনি?
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৭
وَّ الۡجِبَالَ اَوۡتَادًا ﴿۪ۙ۷﴾
পাহাড়গুলোকে গেঁড়ে দিয়েছি পেরেকের মতো?
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৮
وَّ خَلَقۡنٰکُمۡ اَزۡوَاجًا ۙ﴿۸﴾
আমি সৃষ্টি করেছি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায়।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৯
وَّ جَعَلۡنَا نَوۡمَکُمۡ سُبَاتًا ۙ﴿۹﴾
তোমাদের ঘুমকে করেছি শান্তির বাহন,
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১০
وَّ جَعَلۡنَا الَّیۡلَ لِبَاسًا ﴿ۙ۱۰﴾
রাত্রিকে করেছি আবরণ স্বরূপ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১১
وَّ جَعَلۡنَا النَّہَارَ مَعَاشًا ﴿۪۱۱﴾
এবং দিবসকে করেছি জীবিকা অন্বেষণের উপযোগী।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১২
وَّ بَنَیۡنَا فَوۡقَکُمۡ سَبۡعًا شِدَادًا ﴿ۙ۱۲﴾
তোমাদের ওপর সাতটি মজবুত আকাশ স্থাপন করেছি।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৩
وَّ جَعَلۡنَا سِرَاجًا وَّہَّاجًا ﴿۪ۙ۱۳﴾
একটি অতি উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত বাতি সৃষ্টি করেছি?
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৪
وَّ اَنۡزَلۡنَا مِنَ الۡمُعۡصِرٰتِ مَآءً ثَجَّاجًا ﴿ۙ۱۴﴾
আর বর্ষণ করেছি পানিপূর্ণ মেঘমালা হতে প্রচুর পানি।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৫
لِّنُخۡرِجَ بِہٖ حَبًّا وَّ نَبَاتًا ﴿ۙ۱۵﴾
যাতে তার সাহায্যে উৎপন্ন করতে পারি শস্য, শাক সবজি ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৬
وَّ جَنّٰتٍ اَلۡفَافًا ﴿ؕ۱۶﴾
এবং ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্যানসমূহ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৭
اِنَّ یَوۡمَ الۡفَصۡلِ کَانَ مِیۡقَاتًا ﴿ۙ۱۷﴾
নিঃসন্দেহে বিচারের দিনটি নির্ধারিত হয়েই আছে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৮
یَّوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ فَتَاۡتُوۡنَ اَفۡوَاجًا ﴿ۙ۱۸﴾
সে দিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে অতঃপর তোমরা দলে দলে সমাগত হবে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-১৯
وَّ فُتِحَتِ السَّمَآءُ فَکَانَتۡ اَبۡوَابًا ﴿ۙ۱۹﴾
আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে, ফলে তা হবে বহু দ্বার বিশিষ্ট।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২০
وَّ سُیِّرَتِ الۡجِبَالُ فَکَانَتۡ سَرَابًا ﴿ؕ۲۰﴾
এবং চালিত করা হবে পর্বতসমূহকে, ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২১
اِنَّ جَہَنَّمَ کَانَتۡ مِرۡصَادًا ﴿۪ۙ۲۱﴾
আসলে জাহান্নাম একটি ফাঁদ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২২
لِّلطَّاغِیۡنَ مَاٰبًا ﴿ۙ۲۲﴾
বিদ্রোহীদের আবাস।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৩
لّٰبِثِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَحۡقَابًا ﴿ۚ۲۳﴾
সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৪
لَا یَذُوۡقُوۡنَ فِیۡہَا بَرۡدًا وَّ لَا شَرَابًا ﴿ۙ۲۴﴾
সেখানে কোন রকম ঠাণ্ডা এবং পানযোগ্য কোন জিনিসের স্বাদই তারা পাবে না।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৫
اِلَّا حَمِیۡمًا وَّ غَسَّاقًا ﴿ۙ۲۵﴾
ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া ;
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৬
جَزَآءً وِّفَاقًا ﴿ؕ۲۶﴾
এটাই উপযুক্ত প্রতিফল ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৭
اِنَّہُمۡ کَانُوۡا لَا یَرۡجُوۡنَ حِسَابًا ﴿ۙ۲۷﴾
তারা (পরকালে) হিসাবের আশঙ্কা করত না।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৮
وَّ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا کِذَّابًا ﴿ؕ۲۸﴾
আমার আয়াতগুলোকে তারা একেবারেই মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-২৯
وَ کُلَّ شَیۡءٍ اَحۡصَیۡنٰہُ کِتٰبًا ﴿ۙ۲۹﴾
সব কিছুই আমি সংরক্ষণ করে রেখেছি লিখিতভাবে।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩০
فَذُوۡقُوۡا فَلَنۡ نَّزِیۡدَکُمۡ اِلَّا عَذَابًا ﴿٪۳۰﴾
সুতরাং তোমরা আস্বাদন কর, এখন তো আমি শুধু তোমাদের শাস্তিই বৃদ্ধি করতে থাকব।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩১
اِنَّ لِلۡمُتَّقِیۡنَ مَفَازًا ﴿ۙ۳۱﴾
নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য আছে সাফল্য,
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩২
حَدَآئِقَ وَ اَعۡنَابًا ﴿ۙ۳۲﴾
উদ্যানসমূহ ও নানাবিধ আঙ্গুর।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৩
وَّکَوَاعِبَ اَتۡرَابًا ﴿ۙ۳۳﴾
নবযৌবনা সমবয়সী তরুণীবৃন্দ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৪
وَّ کَاۡسًا دِہَاقًا ﴿ؕ۳۴﴾
এবং উচ্ছসিত পানপাত্র।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৫
لَا یَسۡمَعُوۡنَ فِیۡہَا لَغۡوًا وَّ لَا کِذّٰبًا ﴿ۚ۳۵﴾
সেখানে তারা শুনবে না কোন বাজে ও মিথ্যা কথা।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৬
جَزَآءً مِّنۡ رَّبِّکَ عَطَآءً حِسَابًا ﴿ۙ۳۶﴾
প্রতিদান ও যথেষ্ট পুরস্কার তোমাদের রবের পক্ষ থেকে,
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৭
رَّبِّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا الرَّحۡمٰنِ لَا یَمۡلِکُوۡنَ مِنۡہُ خِطَابًا ﴿ۚ۳۷﴾
যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রব, দয়াময়; তাঁর কাছে আবেদন-নিবেদনের শক্তি তাদের থাকবে না ।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৮
یَوۡمَ یَقُوۡمُ الرُّوۡحُ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ صَفًّا ؕ٭ۙ لَّا یَتَکَلَّمُوۡنَ اِلَّا مَنۡ اَذِنَ لَہُ الرَّحۡمٰنُ وَ قَالَ صَوَابًا ﴿۳۸﴾
যেদিন রূহ ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। পরম করুণাময় যাকে অনুমতি দেবেন এবং যে ঠিক কথা বলবে, সে ছাড়া আর কেউ কথা বলবে না।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৩৯
ذٰلِکَ الۡیَوۡمُ الۡحَقُّ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ مَاٰبًا ﴿۳۹﴾
এ দিনটি সত্য; অতএব যার ইচ্ছে সে তার রবের নিকট আশ্রয় গ্ৰহণ করুক।
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা:-৪০
اِنَّاۤ اَنۡذَرۡنٰکُمۡ عَذَابًا قَرِیۡبًا ۬ۚۖ یَّوۡمَ یَنۡظُرُ الۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ یَدٰہُ وَ یَقُوۡلُ الۡکٰفِرُ یٰلَیۡتَنِیۡ کُنۡتُ تُرٰبًا ﴿٪۴۰﴾
যে আযাবটি কাছে এসে গেছে সে সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম। যেদিন মানুষ সেসব কিছুই দেখবে যা তার দু’টি হাত আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে এবং কাফের বলে উঠবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম।
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯১/ঘুম থেকে নামাজ উত্তম:-২/এবং কাফের-রা বলে:-৩৫)
[**মহা খবর:-
*তোমাদের ঘুমকে করেছি শান্তির বাহন,:-
*এবং কাফের বলে উঠবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৮: আন্-নাবা
পারা:২৯
১-৪০.নং আয়াতের বেখ্যা :-
সুরা: আন-নাবা
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৭৮
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ :
(النبأ) নাবা শব্দের শাব্দিক অর্থ : সংবাদ, খবর ইত্যাদি। এখানে ‘নাবা’ দ্বারা কিয়ামত দিবসকে বুঝানো হয়েছে, এটি কিয়ামতের অন্যতম একটি নাম। সূরার দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত ‘নাবা’ শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া এ সূরাতে মহা সংবাদ বা কিয়ামত ও তার পূর্ব মুহূর্তে পৃথিবীর অবস্থা কিরূপ হবে, কিয়ামতের ভয়াবহতা, জ্ঞানীদের জন্য কিয়ামতের প্রমাণ উপস্থাপন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরাতে আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পুনরুত্থানের প্রতি গুরুত্বারোপ, জান্নাতীদের আরাম-আয়েশ ও জাহান্নামীদের দুঃখ কষ্টের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
১-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
সকল যুগের নাস্তিক ও বস্তুবাদীদের ন্যায় মক্কার মুশরিকদের ধারণা ছিল মানুষের পরিণতি দুনিয়াতেই শেষ। অন্যান্য বস্তু যেমন পচে গলে মাটিতে মিশে যায়, মানুষও তেমনি মাটি হয়ে শেষ হয়ে যাবে। অতএব খাও-দাও ফূর্তি কর, শক্তি ও সাধ্যমত অন্যের উপর জুলুম কর। কিয়ামত সংঘটিত হওয়াকে অস্বীকারকারীদের এসব অমূলক ধারণা খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তারা আপোষে আল্লাহ তা‘আলার কোন নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে? তারপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করে দিচ্ছেন যে, তারা ‘মহা সংবাদ’ সম্পর্কে পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ মহা সংবাদ কী এ নিয়ে মুফাসসিরদের মাঝে কয়েকটি উক্তি থাকলেও সঠিক কথা হলো এর দ্বারা উদ্দেশ্য কিয়ামত, মৃত্যুর পর যা কিছু হবে সবই এতে শামিল। এজন্যই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: এ বিষয়ে তারা মতবিরোধে লিপ্ত। অর্থাৎ কুরআন কিয়ামত সম্পর্কে যে সংবাদ প্রদান করেছে তার প্রতি যে বিশ্বাস স্থাপন করে তারা মু’মিন আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না তারা কাফির। যারা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করে তাদেরকে পরবর্তী দু‘আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ধমক দিয়েছেন। মানুষ উপস্থিত বা নগদটাই বিশ্বাস করে ও বুঝে, আর দৃষ্টির বাইরে যা রয়েছে তা সে বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ মানুষের দৃষ্টি শক্তির বাইরে অনেক সত্য লুকিয়ে আছে। মানুষ দুনিয়াতে এসে আর যেতে চায়না, সে চায় আরো যদি বেঁচে থাকতাম। অথচ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মানুষকে দুনিয়া ছাড়তে হয়ই। অতএব দুনিয়ার পরেই আখিরাত, সেথায় তাদের জন্য সুসংবাদ যারা দুনিয়া থেকেই আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সাধ্যমত সৎ আমল করেছে। আর যারা কেবল নগদে বিশ্বাসী তাদের কারণে দুনিয়াতে যত অশান্তি। কারণ শক্তি ও বুদ্ধির জোরে তারা সাধারণ ও দুর্বল মানুষের ওপর জুলুম করে। তাই পরজগতে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বড় বড় কয়েকটি নিদর্শনের বিবরণ দিচ্ছেন যাতে মানুষ সহজেই কিয়ামত সংঘঠিত হওয়ার সত্যতা অনুধাবন করতে পারে। তিনি জমিনকে সৃষ্টি করেছেন مِهَادًا বা বিছানাস্বরূপ। এজন্য মায়ের কোলকে مهد বা বিছানা বলা হয়। কারণ মায়ের কোল শিশুর বিছানা, সেখানে সে ঘুমায়। তাই ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে :
(وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَّمِنَ الصّٰلِحِيْنَ)
“আর তিনি শৈশবে (মায়ের কোলে) এবং বার্ধক্যে মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ৪৬)
أَوْتَادًا শব্দটি وتد এর বহুবচন, অর্থ হলো পেরেক। অর্থাৎ পাহাড়কে তিনি পেরেকস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন যাতে জমিন নড়াচড়া করতে না পারে। কেননা পৃথিবী নড়াচড়া করলে বসবাস করা সম্ভব হতো না। এ বিশাল ও বিস্ময়কর সৃষ্টি যিনি প্রথমবার অস্তিত্বে এনেছেন কেবল একটা হুকুম ‘কুন ফা-ইয়াকুন’ (হও, অতএব হয়ে গেল) এর মাধ্যমে, সুতরাং তাঁর পক্ষে মানুষের মত একটা ক্ষুদ্র জীবকে পুনরায় সৃষ্টি করা ও পুনরুত্থান ঘটানো কোন ব্যাপারই নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে প্রশ্ন করছেন:
(أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَا۬ءُ ط بَنٰهَا)
“তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিন কাজ, না আকাশের? তিনিই এটা নির্মাণ করেছেন।” (সূরা নাযিআত ৭৯ : ২৭)
أَزْوَاجًا অর্থাৎ পুরুষ ও নারীরূপে। যাতে পরস্পরের মিলনে বংশধারা অব্যাহত থাকে। এ জোড়া পরস্পরের বিপরীতধর্মী এবং পরস্পরের প্রতি আকর্ষণপ্রবণ। জোড়া কেবল মানুষের মধ্যে নয়; বরং তা প্রাণী ও জড় জগতের মাঝেও বিরাজমান। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় পজেটিভ বা প্রোটন এবং নেগেটিভ বা ইলেকট্রন। শুধু এগুলোই নয় বরং আমাদের জানা-অজানা সকল ক্ষেত্রেই জোড়ার অস্তিত্ব রয়েছে, যা পরস্পরের বিপরীতধর্মী। যেমন রংয়ের মধ্যে সাদা ও কালো, গুণের মধ্যে ভাল ও মন্দ ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(سُبْحَانَ الَّذِيْ خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْـ ـبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُوْنَ )
“পবিত্র তিনি, যিনি জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬: ৩৬)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ )
“আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায়-জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা যারিআত ৫১ : ৪৯) সুতরাং একথাও প্রমাণ করে সৃষ্টিজগতের সবই জোড়া জোড়া। বেজোড় কেবলমাত্র একজন; তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা।
سُبَاتًا এর অর্থ : ছিন্ন করা বা কাটা। অর্থাৎ সারাদিন কাজকর্ম করে শরীর যে ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে তা ঘুমের মাধ্যমে দূর হয়ে যায়। তাই তাকে – سُبَاتًا বলা হয়। মানুষসহ সকল প্রাণীর জন্য নিদ্রা হল আল্লাহ তা‘আলার দেওয়া বিশেষ এক নেয়ামত। নিদ্রা বা ঘুম কত বড় নেয়ামত, যাদের ঘুম আসে না তাদের জিজ্ঞাসা করলে জানা যায়। ঘুম না থাকলে কোন কাজেই উদ্যম ও আগ্রহ থাকে না। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ঘুমকে একটি নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন (সূরা রূম ৩০ : ২৩) সূরা ফুরকানে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুতঃ ঘুমিয়ে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে রয়েছে মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বাস্তব উদাহরণ। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে পুনরুস্থানের সত্যতার অকাট্য প্রমাণ। ঘুমিয়ে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার দু‘আ পাঠ আমাদের সর্বদা মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুর কথা ও আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে যাওয়ার কথা। অতএব ঘুম থকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে মৃত্যু ও পুনরুত্থান সম্পর্কে এবং মানুষের অসহায়ত্ব ও আল্লাহ তা‘আলার একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে।
لِبَاسًا শব্দের অর্থ : পোশাক। পোশাকের কাজ আবৃত করে নেয়া, ঢেকে নেয়া। রাত তার অন্ধকার কালো বর্ণ দ্বারা পোশাকের ন্যায় সব কিছু নিজের আঁচলে ঢেকে নেয়, যাতে মানুষসহ জীবজগত নিরিবিলি পরিবেশে সুস্থিরভাবে নিদ্রা যেতে পারে। আবার শেষরাতে উঠে শান্ত ও প্রফুল্ল চিত্তে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে রত হতে পারে। তাই রাতকে লেবাস বা পোশাক বলা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشٰهَا)
“শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে”। (সূরা শামস ৯১: ৪)
مَعَاشًا অর্থ وقت معاش বা জীবিকা অন্বেষণকাল, অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা দিনকে আলোকজ্জ্বল করেছেন যাতে লোকেরা জীবিকা অর্জনের জন্য কর্ম ও পরিশ্রম করতে পারে। দিবসের চেয়ে বড় নেয়ামত হল সূর্য। কারণ দিনের বেলায় সূর্য আলো না দিলে দিন কোন উপকারে আসে না। কারো মাঝে কর্মচাঞ্চল্য আসে না। সূর্য কিরণ না দিলে মানুষ, পশু, উদ্ভিদ কারো মাঝে শক্তি-সামর্থ্য সৃষ্টি হত না। সূর্য জীবদেহে শক্তির যো—–গান দেয়, তাই আমরা শক্তিশালী হই, উদ্ভিদজগত শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। ধান, গম ইত্যাদি স্ব-স্ব গাছের শিষে শুকিয়ে যায়, অতঃপর তা আমাদের জন্য খাবারের উপযুক্ত হয়।
(سَبْعًا شِدَادًا)
অর্থাৎ মজবুত সুদৃঢ় সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন। সাত আকাশের অনুরূপ সাত জমিনও সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَللّٰهُ الَّذِيْ خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ وَّمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ ط يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوْآ أَنَّ اللّٰهَ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ لا وَّأَنَّ اللّٰهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا)
“আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং এর অনুরূপ পৃথিবী, ওগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; যাতে তোমরা জানতে পার যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুই পরিবেষ্টন করে রেখেছেন।” (সূরা তালাক ৬৩ : ১২)
আলোচ্য আয়াতে সাত আকাশকে মজবুত ও সুদৃঢ় বলার মধ্যে বিজ্ঞানীদের জন্য ইঙ্গিত রয়েছে যে, এসব আকাশসমূহের গঠন প্রকৃতি এমন যে, যা ভেদ করা কঠিন ও দুরূহ। অন্য আয়াতে আকাশকে
(سَقْفًا مَّحْفُوْظًا)
সুরক্ষিত ছাদ (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৩২) বলা হয়েছে। এতদ্ব্যতীত নক্ষত্ররাজি রাতের অন্ধকারে আলো দিয়ে ও দিক নির্দেশনা দিয়ে এবং বহু অজানা সেবা দিয়ে প্রতিনিয়ত জীবজগতের উপকার করছে যা আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহ।
(سِرَاجًا وَّهَّاجًا)
সিরাজ অর্থ প্রদীপ। এখানে প্রদীপ দ্বারা সূর্যকে বুঝানো হয়েছে। وَّهَّاجًا অর্থ وقادا জ্বলন্ত। অর্থাৎ আমি সূর্যকে জ্বলন্ত প্রদীপের ন্যায় বানিয়েছি। মানুষের আবাসস্থল পৃথিবীকে সূর্য থেকে এমন দূরে ও এমন কোণে স্থাপন করেছেন যেখান থেকে সূর্য সামান্য এগিয়ে এলে পৃথিবী জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আবার সামান্য পিছনে গেলে তা ঠান্ডা ও বরফে পরিণত হয়ে যাবে। বলা হয় সূর্য পৃথিবী থেকে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে অবস্থিত।
الْمُعْصِرٰتِ
এমন মেঘমালাকে বলা হয় যা পানি দ্বারা পূর্ণ কিন্তু এখনো তা থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হয়নি। ثَجَّاجًا অর্থ হলো : অতিরিক্তভাবে প্রবাহিত হয় এমন পানি। হাদীসে এসেছে; সর্বোত্তম হাজ্জ হলো উচ্চৈঃস্বরে তালবীয়া পাঠ করা ও প্রচুর রক্ত প্রবাহিত করা (কুরবানীর পশু জবাই করা)। (শুআবুল ঈমান হা. ৭৩২০) অর্থাৎ সূর্যের আলোচনার পর বৃষ্টির কথা নিয়ে আসলেন। বৃষ্টিপাতের অন্যতম কারণ হল সূর্য কিরণ। সাগরের লবণাক্ত পানি সূর্যতাপে বাষ্প হয়ে ওপরে উঠে যায়। অতঃপর তা ঘনীভূত হয়ে মেঘ ও বৃষ্টিতে পরিণত হয়। সূর্যের তাপে জমি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে আবাদের অনুপোযোগি হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে বাতাস উপযুক্ত স্থানে মেঘমালা বহন করে নিয়ে যায় এবং বর্ষণ করে। বৃষ্টির সাথে মাঝে মধ্যে আসে বিদ্যুৎ, যাতে নাইট্রোজেন থাকে। এ নাইট্রোজেন জমির উর্বরতা ক্ষমতা বাড়ায়। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের ওপর অনুগ্রহ করে থাকেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمِنْ اٰيٰتِه۪ أَنَّكَ تَرَي الْأَرْضَ خَاشِعَةً فَإِذَآ أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَا۬ءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ ط إِنَّ الَّذِيْٓ أَحْيَاهَا لَمُحْيِي الْمَوْتٰي ط إِنَّه۫ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ)
“আর তাঁর একটি নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখতে পাও শুষ্ক, অতঃপর আমি তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করলে তা আন্দোলিত ও ষ্ফীত হয়; যিনি ভূমিকে জীবিত করেন তিনিই মৃতের জীবন দানকারী। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১: ৩৯)
أَلْفَافًا অর্থাৎ অধিক ডাল-পালার কারণে একে অপরের সাথে মিলে যাওয়া গাছপালা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُّتَجٰوِرٰتٌ وَّجَنّٰتٌ مِّنْ أَعْنَابٍ وَّزَرْعٌ وَّنَخِيْلٌ صِنْوَانٌ وَّغَيْرُ صِنْوَانٍ يُّسْقٰي بِمَا۬ءٍ وَّاحِدٍ قف وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلٰي بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَآيٰتٍ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ)
“পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখণ্ড, এতে (পৃথিবীতে) আছে বিভিন্ন আঙ্গুরকানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক শীষ বিশিষ্ট অথবা এক শীষবিশিষ্ট খেজুর বৃক্ষ, সিঞ্চিত একই পানিতে, এবং ফল হিসাবে তাদের কতককে কতকের উপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্নসম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।” (সূরা রা‘দ ১২: ৪)
বৃষ্টি বর্ষণের অন্যতম একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল শস্য, উদ্ভিদ ও উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করা। এখানে মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে প্রধান তিন জাতের উৎপন্ন দ্রব্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন শস্যদানা বলতে ধান, গম, যব ইত্যাদি বুঝানো হয়েছে। نَبَاتًا বা উদ্ভিদ বলতে নানাবিধ সবজি, ঘাস ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। অতঃপর جَنّٰتٍ বা উদ্যান বলতে খেজুর, আঙ্গুর, কলা, আম ইত্যাদি ফল মূল বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এসব আল্লাহ তা‘আলার অপূর্ব নিদর্শন যে, তিনি একই বৃষ্টির পানি দ্বারা বিভিন্ন জাতের ও বিভিন্ন স্বাদের ফলও ফসল উৎপন্ন করেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামত একদিন অবশ্যই সংঘঠিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
২. আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন নেয়ামতরাজি দান করেছেন যাতে বান্দারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়।
১৭-৩০ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
সূরা শুরু করা হয়েছে ‘মহাসংবাদ’ দিয়ে। এক্ষণে তা সংঘটিত হওয়ার সময়কাল, সংঘটিত হওয়ার সময়ের অবস্থা ইত্যাদির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সৃষ্টি ও লালন-পালন শেষে পৃথিবী ধ্বংস ও প্রলয়কাল সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : কিয়ামতের জন্য একটি নির্ধারিত দিন রয়েছে। এ সুনির্দিষ্ট দিন বা তারিখ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ জানে না। (সূরা মূলক ৬৭ : ২৬) যদিও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মত ব্যক্ত করে থাকে যে, ৫০০ বছর পর পৃথিবী আলোহীন হয়ে যাবে ইত্যাদি তা নিছক ধারণা মাত্র, প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে, তিনি ছাড়া কেউ তা জানে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَا يَزَالُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ مِرْيَةٍ مِّنْهُ حَتّٰي تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً أَوْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابُ يَوْمٍ عَقِيْمٍ )
“যারা কুফরী করেছে তারা তাতে সন্দেহ পোষণ করা হতে বিরত হবে না, যতক্ষণ না তাদের নিকট কিয়ামত এসে পড়বে আকস্মিকভাবে, অথবা এসে পড়বে এক বন্ধ্যা দিনের শাস্তি।” (সূরা হজ্জ ২২: ৫৫)
(يَوْمَ الْفَصْلِ)
অর্থ ফায়সালার দিন, আর তা হল কিয়ামতের দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ভাল-মন্দ কর্মের ফায়সালা করবেন। (كَانَ مِيْقَاتًا) অর্থ
كان وقتا وميعادا محددا الأولين والأخرين
পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য তার সময় ও প্রতিশ্রুত সময় নির্ধারিত। যা কোনরূপ কমবেশি হবে না। এ সম্পর্কে কাফিররা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَا نُؤَخِّرُھ۫ٓ اِلَّا لِاَجَلٍ مَّعْدُوْدٍ)
“এবং আমি নির্দিষ্ট কিছু কালের জন্য সেটা স্থগিত রেখেছি মাত্র।” (সূরা হূদ ১১: ১০৪) এখানে সরাসরি বা কিয়ামতের দিন বলে বা ফায়সালার দিন বলার মাধ্যমে বুঝাতে চাচ্ছেন কিয়ামতের মূল উদ্দেশ্য বান্দার কর্মের হিসাব-নিকাশ নেওয়া এবং তার যথাযথ বিচার ফায়সালা করা।
أَفْوَاجًا অর্থ হলো দলে দলে। ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন : প্রত্যেক জাতি তাদের রাসূলদের সাথে কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَوْمَ نَدْعُوْا كُلَّ أُنَاسٍ ۭبِإِمَامِهِمْ)
“স্মরণ কর, সে দিনকে যখন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা-সহ আহ্বান করব।” (সূরা ইসরা ১৭: ৭১)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : দুবার শিংগায় ফুঁ দেয়ার মাঝে সময় হলো চল্লিশ। সাহাবীগণ বললেন : চল্লিশ দিন? তিনি বললেন : আমি বলতে পারি না। তারা আবার বললেন : চল্লিশ মাস কি? তিনি বললেন : আমি বলতে পারি না। পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : চল্লিশ বছর কি? তিনি বললেন : বলতে পারি না। অতঃপর তিনি বললেন : আল্লাহ তা‘আলা আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, ফলে মানুষ (মাটি থেকে) উঠবে যেমন উদ্ভিদ গজায়। মানুষের মেরুদণ্ডের শেষাংশের হাড় ব্যতীত দেহের সব কিছু মাটিতে বিনষ্ট হয়ে যাবে। ঐ হাড় দ্বারা কিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টিকে পুনরায় গঠন করা হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৩৫)
এ আয়াতে বর্ণিত ফুঁক দ্বিতীয় বারের ফুঁক। প্রথম ফুঁতে সবকিছু ধ্বংস হবে। আর দ্বিতীয় ফুঁতে মানুষ কবর থেকে উঠবে।
أَبْوَابًا শব্দটি باب এর বহুবচন, অর্থ দরজাসমূহ, অনেক পথ। কিয়ামতের দিন ফেরেশতা অবতরণের জন্য আকাশে অনেক রাস্তা হয়ে যাবে। আকাশ অত্যন্ত সুরক্ষিত যা ভেদ করে যে কেউ ওপরে উঠতে পারে না। প্রত্যেক আকাশের দরজা রয়েছে এবং সেখানে দ্বাররক্ষী ফেরেশতা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মি‘রাজের রাতে আকাশের দিকে নিয়ে যাওয়া হলে জিবরীল (আঃ) প্রত্যেক দরজায় প্রবেশের পূর্বে দ্বাররক্ষী ফেরেশতার অনুমতি নিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৩৪৯, সহীহ মুসলিম হা. ১৬৩)
দ্বিতীয় ফুঁৎকারের পর আকাশ-জমিন পুনরায় বহাল হয়ে যাবে এবং নতুন আকাশ ও জমিন সৃষ্টি হবে ও সকল মানুষ আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে উপস্থিত হবে। নতুন সে পৃথিবী সমতল হবে, তাতে কোনরূপ বক্রতা বা উঁচু-নিচু থাকবে না।
سَرَابًا অর্থ : মরীচিকা। এমন ধু-ধু মরুভূমি যা রোদের তাপে দূর থেকে মনে হয় পানি দ্বারা ভরপুর। কিয়ামতের পূর্বে পাহাড়গুলোকে-
প্রথমত:
চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَّاحِدَةً)
“আর পৃথিবী ও পর্বতমালাকে উত্তোলন করা হবে এবং একই ধাক্কায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া হবে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৮: ১৪)
দ্বিতীয়ত:
তা ধূনিত রঙ্গিন পশমের মত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَتَكُوْنُ الْـجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوْشِ)
“এবং পর্বতমালা হবে ধূনিত রঙিন পশমের মত।” (সূরা কারিয়াহ ১০১ : ৫)
তৃতীয়ত:
তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণার মত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَکَانَتْ ھَبَا۬ئً مُّنْۭبَثًّا)
“তখন তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত হবে।” (সূরা ওয়াকিয়াহ ৫৬: ৬)
চতুর্থত:
পাহাড়গুলোকে উড়িয়ে দেয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنْسِفُهَا رَبِّيْ نَسْفًا)
“তারা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল: ‘আমার প্রতিপালক তাদেরকেসমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দেবেন।” (সূরা ত্বহা ২০: ১০৫)
আর পঞ্চম অবস্থায় তা মরীচিকার মত অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। (ফাতহুল কাদীর) এসব আলোচনার পর জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের অবস্থা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
مِرْصَادًا অর্থ হলো ঘাঁটি। যেখানে আত্মগোপন করে শক্রর অপেক্ষা করা হয়। সুযোগ পেলেই হামলা চালাবে। অনুরূপভাবে জাহান্নামের প্রহরীরা সুযোগ পেলেই কাফিরদেরকে শাস্তি দেবে।
أَحْقَابًا শব্দটি حقب এর বহুবচন। এর অর্থ হলো যুগ বা জামানা। উদ্দেশ্য হলো যুগযুগ ধরে অনন্তকাল কাফিররা জাহান্নামে থাকবে। কখনও সেখান থেকে বের হতে পারবে না। জাহান্নামে প্রবেশ করার পর তারা এমন কোন কিছু পাবে না যা অন্তর ও দেহ ঠান্ডা করে যন্ত্রণা নিবারণ করাবে। তবে পাবে ফুটন্ত গরম পানি ও তাদের দেহ নির্গত পুঁজ। এসব তাদের তৃষ্ণা নিবারণে কোন উপকারে আসবে না, বরং অর্ধগলা পর্যন্ত গিয়ে আটকে থাকবে যা মৃত্যুযন্ত্রণা আরো বৃদ্ধি করবে। এসব তাদের কৃত আমলের পূর্ণ পরিণাম। কারণ তারা আখিরাতে বিশ্বাসী ছিল না এবং আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের জন্য দিন নির্ধারিত হয়ে আছে।
২. কিয়ামতের পূর্বে দুনিয়ার কী অবস্থা হবে তা জানতে পারলাম।
৩. কাফিররা যে শাস্তি পাবে তার বিবরণ জানলাম।
৩১-৩৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
জাহান্নামীদের দুঃখ-কষ্টের কথা আলোচনা করার পর জান্নাতীদের সুখ-সাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এটাকেই রীতি বা পরস্পর বিপরীতমুখী বর্ণনা বলা হয়। অর্থাৎ কুরআনে যেখানে ঈমানের কথা বর্ণনা হয়েছে সেখানেই কুফরের কথা বর্ণনা হয়েছে। যেখানেই জাহান্নাম ও তার দুর্দশার কথা বর্ণনা হয়েছে, সেখানেই জান্নাত ও সুখ সাচ্ছন্দ্যের কথাও নিয়ে আসা হয়েছে। যারা দুনিয়াতে তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলত তারা আখিরাতে সফলকাম হবে অর্থাৎ তারা চোখের পলকে পুলসিরাত পার হতে সক্ষম হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّآ اُخْفِیَ لَھُمْ مِّنْ قُرَّةِ اَعْیُنٍﺆ جَزَا۬ئًۭ بِمَا کَانُوْا یَعْمَلُوْنَ)
“কেউই জানে না তাদের জন্য নয়ন জুড়োনো কী কী সামগ্রী লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদানস্বরূপ?” (সূরা সাজদাহ ৩২: ১৭)
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শ্রবণ করেনি এবং মানুষের কল্পনায় যা কখনও আসেনি। (সহীহ বুখারী হা. ৪৭৭৯, সহীহ মুসলিম হা. ২৮২৪)
كَوَاعِبَ শব্দটি كاعب এর বহুবচন। শাব্দিক অর্থ হলো : পায়ের গিঁট বা টাখনু। টাখনু যেমন সর্বদা উঁচু থাকে, জান্নাতী নারীদের স্তনগুলো অনুরূপ সর্বদা উঁচু উঁচু থাকবে, কখনও ঝুলে পড়বে না যা তাদের রূপ ও সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ।
أَتْرَابًا অর্থ : সমবয়স্কা। অর্থাৎ জান্নাতীরা যে সব হুর পাবে তারা হবে সমবয়স্কা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: জান্নাতী নারীদের বয়স হবে ৩০ বা ৩৩ বছর। (তিরমিযী হা. ২৫৪৫, হাসান) আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাড়িতে প্রবেশ করলেন। তখন এক বৃদ্ধা আমার নিকটে বসা ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ইনি কে? আমি বললাম : উনি সম্পর্কে আমার খালা। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : কোন বৃদ্ধা মহিলা জান্নাতে যাবে না। এ কথা শুনে বৃদ্ধা মহিলাটি কাঁদতে লাগলেন। আয়িশাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -কে এ খবর জানালে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন : ঐ সময় সকল নর-নারী যুবক যুবতী হয়ে থাকবে। (তিরমিযী হা. ২৫৩৯, হাসান)
دِهَاقًا অর্থ: পরিপূর্ণ। অর্থাৎ জান্নাতে শরাবে পরিপূর্ণ পেয়ালা পরিবেশন করা হবে।
(لَغْوًا وَّلَا كِذَّابًا)
অর্থাৎ কোন অসার ও অশ্লীল কথাবার্তা সেখানে শুনবে না। বরং সেখানে থাকবে সালাম আর সালাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَا يَسْمَعُوْنَ فِيْهَا لَغْوًا وَّلَا تَأْثِيْمًا إِلَّا قِيْلًا سَلَامًا سَلَامًا)
“তারা শুনবে না কোন অসার অথবা পাপ বাক্য। ‘সালাম’ আর ‘সালাম’ বাণী ব্যতীত।” (সূরা ওয়াকিয়াহ ৫৬: ২৫-২৬) এ সম্পর্র্কে সূরা ওয়াকিয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
(جَزَا۬ءً مِّنْ رَّبِّكَ)
এ সব তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আমলের প্রতিদান। অতএব যারা সৎ আমল করবে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা আখিরাতে নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন। তাই আমাদের সৎ আমলের দিকে অগ্রগামী হওয়া উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. তাক্বওয়ার ফযীলত জানতে পারলাম।
২. মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতে যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে তা জানতে পারলাম।
৩৭-৪০ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলার মহত্ব ও বড়ত্ব বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তাঁর সামনে কিয়ামত দিবসে কথা বলার কেউ সাহস পাবে না। এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার ২৫৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
الرُّوْحُ দ্বারা জিবরীল (আঃ) কে বুঝানো হয়েছে।
(ذٰلِکَ الْیَوْمُ الْحَقُّ…..)
অর্থাৎ সেই দিন সত্য। অবশ্যই তা সংঘঠিত হবে। অতএব যে ব্যক্তি কিয়ামত দিবসকে ভয় করে সে যেন দুনিয়াতে তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং সৎ আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে আশ্রয় স্থল অর্জন করে নেয়।
(عَذَابًا قَرِيْبًا)
অর্থাৎ কিয়ামত দিবসের শাস্তিকে নিকটতম আযাব বলা হয়েছে। কারণ কিয়ামত অবশ্যই সংঘঠিত হবে আর যা অবশ্যই সংঘঠিত হবে তা তো মূলত নিকটেই। তাছাড়া নাবী (সাঃ) বলেন: আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আর কিয়ামত এমন কাছে। এই বলে মধ্য ও শাহাদাত আঙ্গুল তুলে দেখালেন। অর্থাৎ দুই আঙ্গুলের মাঝে যেমন দূরত্ব আমার প্রেরণ ও কিয়ামতের মাঝে ততটুকু সময় অবশিষ্ট আছে। (সহীহ বুখারী হা. ৫৩০১)
(يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ)
অর্থাৎ মানুষ দুনিয়াতে তার কৃত আমল আখিরাতে দেখতে পাবে। কাফিররা তাদের খারাপ আমলগুলো দেখে আফসোস করে বলবে: হায় যদি মাটি হয়ে যেতাম। কিন্তু কোন দিন তা সম্ভব হবে না এবং সে আফসোস কোন কাজে আসবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আকাশ জমিনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার।
২. যাদেরকে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে কেবল তারাই সুপারিশ করতে পারবে।
৩. কাফিররা কিয়ামত দিবসে আফসোস করবে, কিন্তু এ আফসোস কোন কাজে আসবে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৭৮-নাবা) : নামকরণ:
নামকরণ সূরার দ্বিতীয় আয়াতের عَنِ النَبَاِ الْعَظِيمِ বাক্যাংশের ‘আন নাবা’ শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এটি কেবল নামই নয়, এই সূরার সমগ্র বিষয়বস্তুর শিরোনামও এটিই। কারণ নাবা মানে হচ্ছে কিয়ামত ও আখেরাতের খবর। আর এই সূরায় এরই ওপর সমস্ত আলোচনা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে।
(৭৮-নাবা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
সূরা আল মুরসালাতের ভূমিকায় আগেই বলে এসেছি, সূরা আল কিয়ামাহ থেকে আন নাযিআ’ত পর্যন্ত সবক’টি সূরার বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে একটা মিল আছে এবং এ সবগুলোই মক্কা মুআয্যমার প্রাথমিক যুগে নাযিল হয়েছিল বলে মনে হয়।
(৭৮-নাবা) : বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয় :
সূরা আল মুরসালাতে যে বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে এখানেও সেই একই বিষয়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ এখানেও কিয়ামত ও আখেরাত অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ এবং তা মানা ও না মানার পরিণতি সম্পর্কে লোকদের অবহিত করা হয়েছে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম দিকে মক্কা মুআযযমায় তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এক, আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে কাউকে শরীক করা যাবে না। দুই, তাঁকে আল্লাহ নিজের রসূলের পদে নিযুক্ত করেছেন। তিন, এই দুনিয়া একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর শুরু হবে আর এক নতুন জগতের। সেখানে আগের ও পরের সব লোকদের আবার জীবিত করা হবে। দুনিয়ায় যে দৈহিক কাঠামো ধারণ করে তারা কাজ করেছিল সেই কাঠামো সহকারে তাদের উঠানো হবে। তারপর তাদের বিশ্বাস ও কাজের হিসেব নেয়া হবে। এই হিসেব-নিকেশের ভিত্তিতে যারা কাফের ও ফাসেক প্রমাণিত হবে তারা চিরকালের জন্য প্রবেশ করবে জাহান্নামে।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্য থেকে প্রথমটি আরবদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন তারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। তারা আল্লাহকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও সর্বশ্রেষ্ঠ রব এবং স্রষ্টা ও রিজিকদাতা বলেও মানতো। অন্য যেসব সত্তাকে তারা ইলাহ ও মাবুদ গণ্য করতো তাদের সবাইকে আল্লাহরই সৃষ্টি বলেও স্বীকার করতো। তাই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতায় এবং তাঁর ইলাহ হবার মূল সত্তায় তাদের কোন অংশীদারীত্ব আছে কি নেই এটিই ছিল মূল বিরোধীয় বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি মক্কার লোকেরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তবে নবুওয়াতের দাবি করার আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে চল্লিশ বছরের যে জীবন যাপন করেছিলেন সেখানে তারা কখনো তাঁকে মিথ্যুক, প্রতারক বা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী হিসেবে পায়নি। এ বিষয়টি অস্বীকার করার কোন উপায়ই তাদের ছিল না। তারা নিজেরাই তাঁর প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, শান্ত প্রকৃতি, সুস্থমতি ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাই হাজার বাহানাবাজী ও অভিযোগ–দোষারোপ সত্ত্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব ব্যাপারেই সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ছিলেন। কেবলমাত্র নবুওয়াতের দাবীর ব্যাপারে নাউযুবিল্লাহ তিনি ছিলেন মিথ্যুক এ বিষয়টি অন্যদের বুঝানো তো দূরের কথা তাদের নিজেদের পক্ষেও মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল।
এভাবে প্রথম দু’টি বিষয়ের তুলনায় তৃতীয় বিষয়টি মেনে নেয়া ছিল মক্কাবাসীদের জন্য অনেক বেশী কঠিন। এ বিষয়টি তাদের সামনে পেশ করা হলে তারা এর সাথে সবচেয়ে বেশী বিদ্রূপাত্মক ব্যবহার করলো। এ ব্যাপারে তার সবচেয়ে বেশী বিস্ময় প্রকাশ করলো। একে তারা সবচেয়ে বেশী অযৌক্তিক ও অসম্ভব মনে করে যেখানে সেখানে একথা ছড়াতে লাগলো যে তা একেবারে অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়। কিন্তু তাদেরকে ইসলামের পথে নিয়ে আসার জন্য আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসকে তাদের মনের গভীর প্রবেশ করিয়ে দেয়া অপরিহার্য ছিল। কারণ আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী না হলে হক ও বাতিলের ব্যাপারে চিন্তার ক্ষেত্রে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারতো না, ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে তাদের মূল্যমানে পরিবর্তন সূচিত হওয়া সম্ভবপর হতো না এবং দুনিয়া পূজার পথ পরিহার করে তাদের পক্ষে ইসলাম প্রদর্শিত পথে এক পা চলাও সম্ভব হতো না। এ কারণে মক্কার প্রাথমিক যুগের সূরাগুলোতে আখেরাত বিশ্বাসকে মনের মধ্যে মজবুতভাবে বদ্ধমূল করে দেয়ার ওপরই বেশী জোর দেয়া হয়েছে। তবে এজন্য এমনসব যুক্তি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যার ফলে তাওহীদের ধারণা আপনা আপনি হৃদয়গ্রাহী হতে চলেছে। মাঝে মাঝে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের সত্যতা প্রমাণের যুক্তিও সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ যুগের সূরাগুলোতে আখেরাতের আলোচনা বারবার আসার কারণ ভালোভাবে অনুধাবন করার পর এবার এই সূরাটির আলোচ্য বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়া যাক। কিয়ামতের খবর শুনে মক্কার পথে-ঘাটে, অলি-গলিতে সর্বত্র এবং মক্কাবাসীদের প্রত্যকটি মাহফিলে যেসব আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য ইত্যাদি শুরু হয়েছিল এখানে সবার আগে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারপর অস্বীকারকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তোমাদের জন্য যে জমিকে আমি বিছানা বানিয়ে দিয়েছি তা কি তোমাদের নজরে পড়ে না ? জমির মধ্যে আমি এই যে উঁচু উঁচু বিশাল বিস্তৃত শ্রেণী গেঁড়ে রেখেছি তা কি তোমাদের নজরে পড়ে না। তোমরা কি নিজেদের দিকেও তাকাও না, কিভাবে আমি তোমাদের নারী ও পুরুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি? তোমরা নিজেদের নিদ্রাকে দেখো না, যার মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে তোমাদেরকে কাজের যোগ্য করে রাখার জন্য আমি তোমাদের কয়েক ঘন্টার পরিশ্রমের পর আবার কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছি? তোমরা কি রাত দিনের আসা-যাওয়া দেখছো না, তোমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী যাকে যথারীতি ধারাবাহিকভাবে জারী রাখা হয়েছে? তোমরা কি নিজেদের মাথার উপর মজবুতভাবে সংঘবদ্ধ আকাশ ব্যবস্থাপনা দেখছো না? তোমরা কি এই সূর্য দেখছো না, যার বদৌলতে তোমরা আলো উত্তাপ লাভ করছে? তোমরা কি বৃষ্টিধারা দেখছো না, যা মেঘমালা থেকে বর্ষিত হচ্ছে এবং যার সাহায্যে ফসল, শাক-সবজি সবুজ বাগান ও ঘন বন-জংগল সৃষ্টি হচ্ছে? এ সব জিনিস কি তোমাদের একথাই জানাচ্ছে যে, যে মহান অপ্রতিদ্বন্দী শক্তিধর এসব সৃষ্টি করেছেন, তিনি কিয়ামত অনুষ্ঠান ও আখেরাত সৃষ্টি করতে অক্ষম? এই সমগ্র কারখানাটিতে যে পরিপূর্ণ কলাকূশলতা ও বুদ্ধিমত্তার সুস্পষ্ট ষ্ফূরণ দেখা যায়, তা প্রত্যক্ষ করার পর কি তোমরা একথাই অনুধাবন করছো যে, সৃষ্টিলোকের এই কারখানার প্রতিটি অংশ, প্রতিটি বস্তু ও প্রতিটি কর্ম একটি উদ্দেশ্যের পেছনে ধাবিত হচ্ছে কিন্তু মূলত এই কারখানাটি নিজেই উদ্দেশ্যবিহীন? এ কারখানায় মানুষকে মুখপাত্রের (Foreman) দায়িত্বে নিযুক্ত করে তাকে এখানে বিরাট ও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে কিন্তু যখন সে নিজের কাজ শেষ করে কারখানা ত্যাগ করে চলে যাবে তখন তাকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে না এবং ভালোভাবে কাজ করার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হবে না ও পেনশন দেয়া হবে না এবং কাজ নষ্ট ও খারাপ করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং শাস্তি দেয়া হবে না; এর চাইতে অর্থহীন ও বাজে কথা মনে হয় আর কিছুই হতে পারে না। এ যুক্তি পেশ করার পর পূর্ণ শক্তিতে বলা হয়েছে, নিশ্চিতভাবে বিচারের দিন তার নির্ধারিত সময়ে অবশ্যি আসবে। শিংগায় একটি মাত্র ফুঁক দেবার সাথে সাথেই তোমাদের যেসব বিষয়ের খবর দেয়া হচ্ছে তা সবই সামনে এসে যাবে। তোমরা আজ তা স্বীকার করো বা না করো, সে সময় তোমরা যে যেখানে মরে থাকবে সেখানে থেকে নিজেদের হিসেব দেবার জন্য দলে দলে বের হয়ে আসবে। তোমাদের অস্বীকৃতির সে ঘটনা অনুষ্ঠানের পথ রোধ করতে পারবে না।
এরপর ২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, যারা হিসেব-নিকেশের আশা করে না এবং যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে তাদের প্রত্যেকটি কথা ও কাজ গুণে গুণে আমার এখানে লিখিত হয়েছে। তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য জাহান্নাম ওঁৎপেতে বসে আছে। সেখানে তাদের কর্মকাণ্ডের পুরোপুরি বদলা তাদেরকে চুকিয়ে দেয়া হবে। তারা ৩১ থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতে এমন সব লোকের সর্বোত্তম প্রতিদানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যারা নিজেদেরকে দায়িত্বশীল ও আল্লাহর কাছে নিজেদের সমস্ত কাজের জবাবদিহি করতে হবে মনে করে সবার আগে দুনিয়ার জীবনে নিজেদের আখেরাতের কাজ করার কথা চিন্তা করেছে। তাদের এই মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে যে, তাদের কার্যবলীর কেবল প্রতিদানই দেয়া হবে না বরং তার চাইতে যথেষ্ট বেশী পুরস্কারও দেয়া হবে। সবশেষে আল্লাহর আদালতের চিত্র আঁকা হয়েছে। সেখানে কারোর নিজের জিদ নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে যাওয়া এবং নিজের সাথে সম্পর্কিত লোকদের মাফ করিয়ে নেয়া তো দূরের কথা, অনুমতি ছাড়া কেউ কথাই বলতে পারবে না। আর অনুমতি হবে এ শর্ত সাপেক্ষে যে, যার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে একমাত্র তার জন্য সুপারিশ করা যাবে এবং সুপারিশে কোন অসংগত কথাও বলা যাবে না। তাছাড়া একমাত্র তাদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে যারা দুনিয়ায় সত্যের কালেমার প্রতি সমর্থন দিয়েছে এবং নিছক গুনাহগার আল্লাহর বিধানের প্রতি বিদ্রোহভাবাপন্ন কোন সত্য অস্বীকারকারী কোন প্রকার সুপারিশ লাভের হকদার হবে না।
তারপর এক সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বক্তব্য শেষ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে দিনের আগমনী সংবাদ দেয়া হচ্ছে সেদিনটি নিশ্চিতভাবেই আসবে। তাকে দূরে মনে করো না। সে কাছেই এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা সেদিনটির কথা মেনে নিয়ে নিজের রবের পথ অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু এ সাবধানবাণী সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তাঁকে অস্বীকার করবে একদিন সমস্ত কর্মকাণ্ড তার সামনে এসে যাবে। তখন সে কেবল অনুতাপই করতে পাবে। সে আফসোস করে বলতে থাকবে, হায়! যদি দুনিয়ার আমার জন্মই না হতো। আজ যে দুনিয়ার প্রেমে সে পাগলপারা সেদিন সেই দুনিয়ার জন্যই তার মনে এ অনুভূতি জাগবে।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩
الَّذِیْ هُمْ فِیْهِ مُخْتَلِفُوْنَؕ
যে ব্যাপারে এরা নানান ধরনের কথা বলে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# বড় খবর বলতে কিয়ামত ও আখেরাতের কথা বুঝানো হয়েছে। মক্কাবাসীরা অবাক হয়ে কিয়ামত ও আখেরাতের কথা শুনতো। তারপর তাদের প্রত্যেকটি আলাপ আলোচনায়, বৈঠকে, মজলিসে এ সম্পর্কে নানান ধরনের কথা বলতো ও ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো। জিজ্ঞাসাবাদ বলতেও এ নানা ধরনের কথাবার্তা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের কথাই বোঝানো হয়েছে। লোকেরা পরস্পরের সাথে দেখা হলে বলতো, আরে ভাই, শুনেছো নাকি? মানুষ নাকি মরে যাবার পরে আবার জীবিত হবে? এমন কথা আগে কখনো শুনেছিলে? যে মানুষটি মরে পচে গেছে, যার শরীরের হাড়গুলো পর্যন্ত মাটিতে মিশে গেছে, তার মধ্যে নাকি আবার নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হবে, একথা কি মেনে নেয়া যায়? আগের পরের সব বংশধররা জেগে উঠে এক জায়গায় জমা হবে, একথা কি যুক্তিসম্মত? আকাশের বুকে মাথা উঁচু করে পৃথিবী পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বড় বড় পাহাড় নাকি পেঁজা তুলোর মতো বাতাসে উড়তে থাকবে? চাঁদ, সুরুজ আর তারাদের আলো কি নিভে যেতে পারে? দুনিয়ার এই জমজমাট ব্যবস্থাটা কি ওলটপালট হয়ে যেতে পারে? এই মানুষটি তো গতকাল পর্যন্তও বেশ জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছিল, আজ তার কি হয়ে গেলো, আমাদের এমন সব অদ্ভূত অদ্ভূত খবর শুনিয়ে যাচ্ছে? এ জান্নাত ও জাহান্নাম এতদিন কোথায় ছিল? এর আগে কখনো আমরা তাঁর মুখে একথা শুনিনি কেন? এখন এরা হঠাৎ টপকে পড়লো কোথা থেকে? কোথা থেকে এদের অদ্ভূত ধরনের ছবি এঁকে এনে আমাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে? هُم فِيهِ مُختَلِفُونَ আয়াতাংশটির একটি অর্থ তো হচ্ছেঃ “এ ব্যাপারে তারা নানান ধরনের কথা বলছে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে।” এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে, দুনিয়ার পরিণামসম্পর্কে তারা নিজেরাও কোন একটি অভিন্ন আকীদা পোষণ করে না বরং “তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়।” তাদের কেউ কেউ খৃস্টানদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল। কাজেই তারা মৃত্যুর পরের জীবন স্বীকার করতো। তবে এই সঙ্গে তারা একথাও মনে করতো যে, এই জীবনটি শারীরিক নয়, আত্মিক পর্যায়ের হবে। কেউ কেউ আবার আখেরাত পুরোপুরি অস্বীকার করতো না, তবে তা ঘটতে পারে কিনা, এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ ছিল। কুরআন মজীদে এ ধরনের লোকদের এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ اِن نَظُنُ اِلا ظَنَا وَمَا نَحنُ بِمُستَيقِنِينَ “আমরা তো মাত্র একটি ধারণাই পোষণ করি, আমাদের কোন নিশ্চিত বিশ্বাস নেই।” আল জাসিয়াহ, ৩১ আবার কেউ কেউ একদম পরিস্কার বলতোঃ اِن هِىَ اِلا حَيَا تُنَا وَمَا يَهلِكُنَا اِلا الدَهْرُ “আমাদের এ দুনিয়ার জীবনটিই সবকিছু এবং মরার পর আমাদের আর কখনো দ্বিতীয়বার উঠানো হবে না।” আল আন’আম ২৯ তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ সবকিছুর জন্য সময়কে দায়ী করতো। তারা তারা বলতোঃ مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ “আমাদের এই দুনিয়ার জীবনটিই সব কিছু । এখানেই আমরা মরি , এখানেই আমরা জীবন লাভ করি এবং সময়ের চক্র ছাড়া আর কিছুই নেই যা আমাদের ধবংস করে।” আল জাসিয়া, ২৪ আবার এমন কিছু লোকও ছিল , যারা সময়কে সবকিছুর জন্য দায়ী না করলেও মৃত্যুর পরের জীবনকে অসম্ভব মনে করতো। অর্থাৎ তাদের মতে, মরা মানুষদের আবার জীবিত করে তোলার ক্ষমতা আল্লাহর ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিলঃ مَنْ يَحِْى الْعِظَامَ وَ هِىَ رَمِيْمُُُُ ‘এই হাড়গুলো পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবার পর আবার এইগুলোকে জীবিত করবে কে?” ইয়াসীন, ৭৮ তাদের এসব বিভিন্ন বক্তব্য একথা প্রমাণ করে যে , এ বিষয়ে তাদের কোন সঠিক জ্ঞান ছিল না। বরং তারা নিছক আন্দাজ-অনুমান ও ধারণার বশবর্তী হয়ে অন্ধকারে তীর ছুঁড়ে যাচ্ছিল। নয়তো এ ব্যাপারে তাদের কাছে যদি কোন সঠিক জ্ঞান থাকতো তাহলে তারা সবাই একটি বক্তব্যের উপর একমত হতে পারতো ( আরো বেশী জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আয্ যারিয়াতের ৬ টীকা দেখুন)।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৪
كَلَّا سَیَعْلَمُوْنَۙ
কখখনো না, শীঘ্রই এরা জানতে পারবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে যেসব কথা এরা বলে যাচ্ছে এগুলো সবই ভুল। এরা যা কিছু মনে করেছে ও বুঝেছে তা কোনক্রমেই সঠিক নয়।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৫
ثُمَّ كَلَّا سَیَعْلَمُوْنَ
হ্যাঁ, কখখনো না, শীঘ্রই এরা জানতে পারবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# যে বিষয়ে এরা নিজেরা নানা আজেবাজে কথা বলছে ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরছে সেটি যথার্থ সত্য হয়ে এদের সামনে ফুটে ওঠার সময় মোটেই দূরে নয়। সে সময় এরা জানতে পারবে, রসূল এদেরকে যে খবর দিয়েছিলেন তা ছিল সঠিক এবং আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে এরা যেসব কথা তৈরী করছিল তা ছিল ভিত্তিহীন অসার।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৬
اَلَمْ نَجْعَلِ الْاَرْضَ مِهٰدًاۙ
একথা কি সত্য নয়, আমি যমীনকে বিছানা বানিয়েছি?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# যমীনকে মানুষের জন্য বিছানা অর্থাৎ একটি শান্তিময় আবাস ভূমিতে পরিণত করার মধ্যে আল্লাহর যে নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান, ক্ষমতা ও কর্মকুশলতা সক্রিয় রয়েছে সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে তাফহীমুল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নীচের স্থানগুলো দেখুনঃ তাফহীমুল কুরআন, আন নামল ৭৩ , ৭৪ ও ৮১ টীকা, ইয়াসীন ২৯ টীকা , আল মু’মিন ৯০ ও ৯১ টীকা, আয্ যুখরুফ ৭ টীকা , আল জাসিয়াহ ৭ টীকা এবং কাফ ১৮ টীকা।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৭
وَّ الْجِبَالَ اَوْتَادًا۪ۙ
পাহাড়গুলোকে গেঁড়ে দিয়েছি পেরেকের মতো?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# পৃথিবীতে পাহাড় সৃষ্টির কারণ এবং এর পেছনে আল্লাহর যে কল্যাণ স্পর্শ রয়েছে তা জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আন নাহল ১২ টীকা, আন নামল ৭৪ টীকা এবং আল মুরসালাত ১৫ টীকা দেখুন।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৮
وَّ خَلَقْنٰكُمْ اَزْوَاجًاۙ
তোমাদের (নারী ও পুরুষ) জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মানবজাতিকে নারী ও পুরুষের জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার যে মহান কল্যাণ ও উদ্দেশ্যে রয়েছে তা বিস্তারিতভাবে জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আল ফুরকান ৬৯ টীকা , আর রুম ২৮ , ২৯ , ৩০ টীকা, ইয়াসীন ৩১ টীকা , আশ শূরা ৭৭ টীকা , আয্ যুখরুফ ১২ টীকা এবং আল কিয়ামাহ ২৫ টীকা দেখুন।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৯
وَّ جَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًاۙ
তোমাদের ঘুমকে করেছি শান্তির বাহন,
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মানুষকে দুনিয়ায় কাজ করার যোগ্য করার জন্য মহান আল্লাহ অত্যন্ত কর্মকুশলতা সহকারে তার প্রকৃতিতে ঘুমের এক অভিলাষ বা চাহিদা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। প্রতি কয়েক ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর এই চাহিদা আবার তাকে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাতে বাধ্য করে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআনের সূরা আর রুম ৩৩ টীকা।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-১১
وَّ جَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا۪
এবং দিনকে জীবিকা আহরণের সময়?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ রাতকে অন্ধকার করে দিয়েছি। ফলে আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তার মধ্যে তোমরা সহজেই ঘুমের প্রশান্তি লাভ করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে দিনকে আলোকোজ্জ্বল করে দিয়েছি। ফলে তার মধ্যে তোমরা অতি সহজেই নিজেদের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করতে পারবে। পৃথিবীতে রাত-দিনের নিয়মিত ও নিরবিছিন্ন আবর্তনের মধ্যে অসংখ্য কল্যাণ রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে থেকে মাত্র এই একটি কল্যাণের দিকে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ একথা বুঝাতে চান যে, এখানে যা কিছু ঘটছে এগুলো উদ্দেশ্যহিনভাবে ঘটছে না। বরং এর পেছনে একটি কল্যাণকর উদ্দেশ্য কাজ করছে। তোমাদের নিজেদের স্বার্থের সাথে এ উদ্দেশ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তোমাদের অস্তিত্বের গঠন প্রকৃতি নিজের আরাম ও প্রশান্তির জন্য যে অন্ধকারের অভিলাষী ছিল তার জন্য রাতকে এবং তার জীবিকার জন্য যে আলোর অভিলাষী ছিল তার জন্য দিনকে সরবরাহ করা হয়েছে। তোমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পাদিত এই ব্যবস্থাপনা নিজেই সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যে, কোন জ্ঞানময় সত্তার কর্মকৌশল ছাড়া এটা সম্ভবপর হয়নি। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনুস ৬৫ টীকা , ইয়াসীন ৩২ টীকা, আল মু’মিন ৮৫ টীকা এবং আয্ যুখরুফ ৪ টীকা )।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-১২
وَّ بَنَیْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًاۙ
তোমাদের ওপর সাতটি মজবুত আকাশ স্থাপন করেছি।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মজবুত বলা হয়েছে এ অর্থে যে, আকাশের সীমান্ত অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সংঘবদ্ধ, তার মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও কখনো হয় না। এ সীমানা পেরিয়ে উর্ধ্বজগতের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্য থেকে কোন একটিও কখনো অন্যের সাথে সংঘর্ষ বাঁধায় না এবং কোনটি কক্ষচ্যুত হয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়েও পড়ে না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআন আল বাকারাহ ৩৪ টীকা , আর রা’দ ২ টীকা , আল হিজর ৮ ও ১২ টীকা, আল মু’মিনুন ১৫ টীকা , লুকমান ১৩ টীকা , ইয়াসীন ৩৭ টীকা , আস সাফফাত ৫ ও ৬ টীকা , আল মু’মিন ৯০ টীকা এবং কাফ ৭ ও ৮ টীকা)।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-১৩
وَّ جَعَلْنَا سِرَاجًا وَّهَّاجًا۪ۙ
এবং একটি অতি উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত বাতি সৃষ্টি করেছি?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
#. এখানে সূর্যের কথা বলা হয়েছে। মূলে وَهَاجْ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে অতি উত্তপ্ত আবার অতি উজ্জ্বলও। তাই আয়াতের অনুবাদে আমি দু’টো অর্থই ব্যবহার করেছি। এ ছোট বাক্যটির মধ্যে মহান আল্লাহর শক্তি ও কর্মকুশলতার যে বিরাট নিদর্শনটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে সে নিদর্শনটির অর্থাৎ সূর্যের ব্যাস পৃথিবী থেকে ১০৯ গুণ বেশী এবং তার আয়তন পৃথিবী তুলনায় ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার গুণ বড়। তার তাপমাত্রা ১ কোটি ৪০ লক্ষ সেন্টিগ্রেড। পৃথিবী থেকে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তার আলোর শক্তি এত বেশী যে, মানুষ খালি চোখে তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করলে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলবে। তার উত্তাপ এত বেশী যে পৃথিবীর কোথাও তার উত্তাপের ফলে তাপমাত্রা ১৪০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মহান আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান ও সৃষ্টিকুশল তার মাধ্যমে পৃথিবীকে সূর্য থেকে এক ভারসাম্যপূর্ণ দূরত্বে স্থাপন করেছেন। পৃথিবী তার অবস্থানের চাইতে সূর্যের বেশী কাছাকাছি নয় বলে অস্বাভাবিক গরম নয়। আবার বেশী দূরে নয় বলে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডাও নয়। এ কারণে মানুষ, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের জীবন ধারণ সম্ভবপর হয়েছে। সূর্য থেকে শক্তির অপরিমেয় ভাণ্ডার উৎসারিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এ শক্তিই পৃথিবীর বুকে আমাদের জীবন ধারণের উৎস। তারই সাহায্যে আমাদের ক্ষেতে ফসল পাকছে এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী তার আহার লাভ করছে। তারই উত্তাপে সাগরের পানি বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে যায়, তারপর বাতাসের সাহায্য দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে বারি বর্ষণ করে। এ সূর্যের বুকে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ এমন বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রেখেছেন যা কোটি কোটি বছর থেকে সমগ্র সৌরজগতে আলো, উত্তাপ ও বিভিন্ন প্রকার রশ্মি অব্যাহতভাবে ছড়িয়ে চলছে।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-১৬
وَّ جَنّٰتٍ اَلْفَافًاؕ
ও নিবিড় বাগান?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থাপনা এবং উদ্ভিদের তরতাজা হয়ে ওঠার মধ্যে প্রতিনিয়ত আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও সৃষ্টিকুশলতার যে বিস্ময়কর আত্মপ্রকাশ ঘটে চলছে সে সম্পর্কে তাফহীমুল কুরআনের নিম্নোক্ত স্থানসমূহে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছেঃ সূরা আন নাহল ৫৩ টীকা , আল মু’মিনুন ১৭ টীকা , আশ শূ’আরা ৫ টীকা , আর রুম ৩৫ টীকা , ফাতের ১৯ টীকা , ইয়াসীন ২৯ টীকা , আল মু’মিন ২০ টীকা , আয্ যুখরুফ ১০ – ১১ টীকা এবং আল ওয়াকিয়াহ ২৮ , ২৯ , ৩০ টীকা। এ আয়াতগুলোতে একের পর এক বহু প্রাকৃতিক নিদর্শন ও যুক্তি প্রমাণ পেশ করে কিয়ামত ও আখেরাত অস্বীকারকারীদেরকে একথা জানানো হয়েছে যে, যদি তোমরা চোখ মেলে একবার পৃথিবীর চারদিকে তাকাও, পাহাড়-পর্বত, তোমাদের নিজেদের জন্ম, নিদ্রা, জাগরণ এবং দিন-রাত্রির আবর্তনের এই ব্যবস্থাপনাটি গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করো তাহলে এসবের মধ্যে তোমরা দু’টি জিনিস সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবে। এক, একটি জবরদস্ত শক্তির সহায়তা ছাড়া এসব কিছু অস্তিত্বশীল হতে পারে না এবং এ ধরনের নিয়ম-শৃংখলার আওতাধীনে জারীও থাকতে পারে না। দুই, এসব জিনিসের প্রত্যেকটির মধ্যে একটি বিরাট হিকমত তথা প্রজ্ঞা ও তীক্ষ্ণ কর্মকুশলতা সক্রিয় রয়েছে এবং উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোন একটি কাজও হচ্ছে না। যে মহাশক্তি এসব জিনিসকে অস্তিত্ব দান করতে পারে, এদেরকে ধ্বংস করে দেবার এবং ধ্বংস করার পর আবার নতুন করে অন্য আকৃতিতে সৃষ্টি করার তাঁর ক্ষমতা নেই, এ ধরনের কথা এখন কেবলমাত্র একজন মূর্খই বলতে পারে। আর একথাও কেবলমাত্র একজন নির্বোধই বলতে পারে যে, যে জ্ঞানময় সত্তা এই বিশ্ব-জাহানের কোন একটি কাজও বিনা উদ্দেশ্যে করেননি, তিনি নিজের এ জগতে মানুষকে জেনে বুঝে ভালো ও মন্দের পার্থক্য, আনুগত্য ও অবাধ্যতার স্বাধীনতা এবং নিজের অসংখ্য সৃষ্টিকে কাজে লাগাবার ও ইচ্ছা মতো ব্যবহার করার ক্ষমতা বিনা উদ্দেশ্যেই দান করেছেন। একথাও কেবলমাত্র একজন নির্বোধই বলতে পারে। মানুষ তাঁর সৃষ্ট এ জিনিসগুলোকে ভালোভাবে ব্যবহার করুক বা খারাপভাবে উভয় অবস্থায় পরিণাম সমান হবে, একজন ভালো কাজ করতে করতে মারা যাবে, সে মাটিতে মিশে খতম হয়ে যাবে আর একজন খারাপ কাজ করতে করতে মারা যাবে সেও মাটিতে মিশে খতম হয়ে যাবে, যে ভালো কাজ করবে সে তার ভালো কাজের কোন প্রতিদান পাবে না এবং যে খারাপ কাজ করবে সেও তার খারাপ কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে না এবং কোন প্রতিফল পাবে না, এ ধরনের কথা একজন জ্ঞানহীন মানুষই বিশ্বাস করতে পারে। মৃত্যুর পরের জীবন, কিয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কিত এসব যুক্তিই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তাফহীমুল কুরআনের নিম্নোক্ত স্থানগুলো দেখুনঃ আর রা’আদ ৭ টীকা, আল হজ্জ ৯ টীকা , আর রুম ৬ টীকা , সাবা ১০ ও ১২ টীকা এবং আস সাফফাত ৮ ও ৯ টীকা ।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-১৮
یَّوْمَ یُنْفَخُ فِی الصُّوْرِ فَتَاْتُوْنَ اَفْوَاجًاۙ
যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তোমরা দলে দলে বের হয়ে আসবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে শিংগার শেষ ফুঁকের কথা বলা হয়েছে। এর আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই সমস্ত মরা মানুষ অকস্মাৎ জেগে উঠবে। “তোমরা বলতে শুধুমাত্র যাদেরকে তখন সম্বোধন করা হয়েছিল তাদের কথা বলা হয়নি বরং সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যতগুলো লোক দুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছে ও করবে তাদের সবার কথা বলা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইবরাহীম ৫৭ টীকা , আল হাজ্জ ১ টীকা , ইয়সীন ৪৬ ও ৪৭ টীকা এবং আয্ যুমার ৭৯ টীকা
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-২০
وَّ سُیِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًاؕ
আর পর্বতমালাকে চলমান করা হবে, ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে মনে রাখতে হবে, কুরআনের অন্যান্য স্থানের মতো এখানেও একই সাথে কিয়ামতের বিভিন্ন পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে, প্রথম আয়াতটিতে শেষ দফায় শিংগায় ফুঁক দেবার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আর পরবর্তী দু’টি আয়াতে দ্বিতীয় দফায় শিংগায় ফুঁক দোবার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে তাফহীমুল কুরআনের সূরা আল হাক্কার ১০ টীকায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। “আকাশ খুলে দেয়া হবে” এর মানে হচ্ছে উর্ধজগতে কোন বাঁধা ও বন্ধন থাকবে না। সবদিক থেকে সব রকমের আসমানী বালা মুসিবতের এমন বন্যা নেমে আসতে থাকবে যেন মনে হবে তাদের আসার জন্য সমস্ত দরজা খুলে গেছে এবং তাদের বাঁধা দেবার জন্য কোন একটি দরজাও বন্ধ নেই। আর পাহাড়ের চলার ও মরীচিকায় পরিণত হবার মানে হচ্ছে, দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যে পর্বতমালা স্থানচ্যুত হয়ে শুন্যে উড়তে থাকবে। তারপর ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, যেখানে একটু আগে বিশাল পর্বত ছিল সেখানে দেখা যাবে বিশাল বালুর সমুদ্র। এ অবস্থাকে সূরা ত্বাহায় নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ “এরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, সেদিন এ পাহাড় কোথায় চলে যাবে? এদের বলে দাও, আমার রব তাদেরকে ধূলোয় পরিণত করে বাতাসে উড়িয়ে দেবেন এবং যমীনকে এমন একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন যে, তার মধ্যে কোথাও একটুও অসমতল ও উঁচুনীচু জায়গা এবং সামান্যতম ভাঁজও দেখতে পাবে না।” (১০৫-১০৭ আয়াত এবং ৮৩ টীকা)
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-২১
اِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا۪ۙ
আসলে জাহান্নাম একটি ফাঁদ।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# শিকার ধরার উপযোগী করে যে জায়গাটিকে গোপনে তৈরী করা হয় এবং নিজের অজ্ঞাতসারে শিকার যেখানে চলে এসে তার মধ্যে আটকে যায়, তাকেই বলে ফাঁদ। জাহান্নামের ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা অবলম্বন করে তারা জাহান্নামের ভয়ে ভীত না হয়ে দুনিয়ায় এ মনে করে লাফালাফি দাপাদাপি করে ফিরছে যে, আল্লাহর সার্বভৌমত কর্তৃত্ব তাদের জন্য একটি ঢালাও বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে তাদের পাকড়াও হবার কোন আশঙ্কা নেই। কিন্তু জাহান্নাম তাদের জন্য একটি গোপন ফাঁদ যেখানে তারা আকস্মিকভাবে আটকা পড়ে যায় এবং সেখানে থেকে বের হবার আর কোন উপায় থাকে না।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-২৩
لّٰبِثِیْنَ فِیْهَاۤ اَحْقَابًاۚ
সেখানে তারা যুগের পর যুগ পড়ে থাকবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূলে আহকাব (اَحْقاَبْ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, একের পর এক আগমনকারী দীর্ঘ সময়। এমন একটি ধারাবাহিক যুগ যে, একটি যুগ শেষ হবার পর আর একটি যুগ শুরু হয়ে যায়। এ থেকে লোকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, জান্নাতের জীবন হবে চিরন্তন কিন্তু জাহান্নাম চিরন্তন হবে না। কারণ এ যুগ যতই দীর্ঘ হোক না কেন, এখানে যখন যুগ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তখন এ থেকে একথাই বুঝা যাচ্ছে যে, এ সময় অশেষ ও অফুরন্ত হবে না। বরং একদিন তা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দু’টি কারণে এই যুক্তি ভুল। এক, আরবীতে ‘হাকব’ শব্দের আভিধানিক অর্থের মধ্যেই এ ভাবধারা রয়েছে যে, একটি হাকবের পিছনে আর একটি হাকব রয়েছে। কাজেই আহকাব অপরিহার্যভাবে এমন যুগের জন্য বলা হবে যা একের পর এক আসতেই থাকবে এবং এমন কোন যুগ হবে না যার পর আর কোন যুগ আসবে না। দুই, কোন বিষয় সম্পর্কে কুরআন মজীদের কোন আয়াত থেকে এমন কোন অর্থ গ্রহণ করা নীতিগতভাবে ঠিক নয়, যা সেই একই বিষয় সম্পর্কিত কুরআনের অন্যান্য বর্ণনার সাথে সংঘর্ষশীল হয়। কুরআনের ৩৪ জায়গায় জাহান্নামবাসীদের জন্য ‘খুলুদ’ (চিরন্তন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তিন জায়গায় কেবল “খুলুদ” বলেই শেষ করা হয়নি বরং তার সাথে “আবাদান” “আবাদান” (চিরকাল) শব্দও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এক জায়গায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, “তারা চাইবে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু তারা কখনো সেখান থেকে বের হতে পারবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব।” (আল মায়েদাহ ৩৭ আয়াত) আর এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ “যতদিন পৃথিবী ও আকাশ প্রতিষ্ঠিত আছে ততদিন তারা এ অবস্থায় চিরকাল থাকবে, তবে তোমার রব যদি অন্য কিছু চান।” জান্নাতবাসীদের সম্পর্কেও এ একই কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “যতদিন পৃথিবী ও আকাশ প্রতিষ্ঠিত আছে ততদিন জান্নাতে তারা চিরকাল থাকবে, তবে তোমার রব যদি অন্য কিছু চান।” (হুদ ১০৭-১০৮আয়াত) এই সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর ‘আহকাব’ শব্দের ভিত্তিতে একথা বলার অবকাশ আর কতটুকু থাকে যে, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণকারীরা জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করবে না বরং কখনো না কখনো তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে?
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-২৫
اِلَّا حَمِیْمًا وَّ غَسَّاقًاۙ
গরম পানি ও ক্ষতঝরা ছাড়া।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূলে গাসসাক (غَسَاق) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হয়ঃ পুঁজ, রক্ত, পুঁজ মেশানো রক্ত এবং চোখ ও গায়ের চামড়া থেকে বিভিন্ন ধরনের কঠোর দৈহিক নির্যাতনের ফলে যেসব রস বের হয়। এছাড়াও এ শব্দটি ভীষণ দুর্গন্ধ ও পঁচে গিয়ে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এমন জিনিসের জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-২৮
وَّ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا كِذَّابًاؕ
আমার আয়াতগুলোকে তারা একেবারেই মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ হচ্ছে তাদের জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব ভোগ করার কারণ। প্রথমত, দুনিয়ায় তারা এ মনে করে জীবন যাপন করতে থাকে যে, আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজেদের আসনের হিসেব পেশ করার সময় কখনো আসবে না। দ্বিতীয়, আল্লাহ নিজের নবীদের মাধ্যমে তাদের হিদায়াতের জন্য যেসব আয়াত পাঠিয়েছিলেন সেগুলো মেনে নিতে তারা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এবং সেগুলোকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করে।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-২৯
وَ كُلَّ شَیْءٍ اَحْصَیْنٰهُ كِتٰبًاۙ
অথচ প্রত্যেকটি জিনিস আমি গুণে গুণে লিখে রেখেছিলাম।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ তাদের সমস্ত কথা ও কাজ, তাদের সব রকমের উঠাবসা-চলাফেরা এমনকি তাদের চিন্তা, মনোভাব, সংকল্প ও উদ্দেশ্যাবলীর পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড আমি তৈরি করে রাখছিলাম। সেই রেকর্ড থেকে কোন কিছুই বাদ যেতে পারেনি। অথচ সেই নির্বোধদের এসবের কোন খবর ছিল না। তারা নিজেদের জায়গায় বসে মনে করছিল, তারা কোন মগের মুল্লুকে বাস করছে, নিজেদের ইচ্ছে মতো তারা এখানে যাচ্ছেতাই করে যাবে এবং তাদের এসব স্বেচ্ছাচারের জন্যে কারোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩১
اِنَّ لِلْمُتَّقِیْنَ مَفَازًاۙ
অবশ্যি মুত্তাকীদের জন্য সাফল্যের একটি স্থান রয়েছে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে মুত্তাকী শব্দটি এমন সব লোকের মোকাবিলায় ব্যবহার করা হয়েছে যারা কিয়ামতের দিন নিজেদের দুনিয়ার কার্যক্রমের হিসেব দেবার কোন ধারণা পোষণ করতো না। এবং যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই নিশ্চিতভাবেই এ আয়াতে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর আয়াতকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল এবং একথা মনে করে দুনিয়ায় জীবন যাপন করেছিল যে, কিয়ামতের দিন তাদের দুনিয়ায় সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩৩
وَّ كَوَاعِبَ اَتْرَابًاۙ
নবযৌবনা সমবয়সী তরুণীবৃন্দ।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এর অর্থ এও হতে পারে যে, তারা পরস্পর সমবয়স্কা হবে। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, তাদেরকে যেসব পুরুষের স্ত্রী হিসেবে দেয়া হবে তারা সে সব স্বামীদের সমবয়স্কা হবে। ইতিপূর্বে সূরা সা’দ –এর ৫২আয়াতে এবং সূরা ওয়াকিয়ার ৩৭ আয়াতেও এ বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩৫
لَا یَسْمَعُوْنَ فِیْهَا لَغْوًا وَّ لَا كِذّٰبًاۚ
সেখানে তারা শুনবে না কোন বাজে ও মিথ্যা কথা।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# জান্নাতে মানুষ কোন বাজে, নোংরা, মিথ্যা ও অর্থহীন কথা শুনবে না। মানুষের কান এ থেকে সংরক্ষিত থাকবে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টিকে জান্নাতের বিরাট নিয়ামত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। জান্নাতে কোন কটূকথা ও আজেবাজে গপসপ হবে না। কেউ কারোর সাথে মিথ্যা কথা বলবে না এবং কারোর কথাকে মিথ্যাও বলবে না। দুনিয়ায় গালিগালাজ, মিথ্যা দোষারোপ, অভিযোগ, কুৎসা প্রচার ও অন্যের ওপর মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেবার যে ব্যাপক প্রচেষ্টা মানুষের সমাজে চলছে তার ছিঁটে ফোটাও সেখানে থাকবে না। (আরো বেশী ব্যাখ্যা জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা মারয়াম ৩৮ টীকা এবং আল ওয়াকিয়াহ ১৩ ও ১৪ টীকা।)
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩৬
جَزَآءً مِّنْ رَّبِّكَ عَطَآءً حِسَابًاۙ
প্রতিদান ও যথেষ্ট পুরস্কার তোমাদের রবের পক্ষ থেকে,
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# প্রতিদান শব্দের পরে আবার যথেষ্ট পুরস্কার দেবার কথা বলার অর্থ এ দাঁড়াবে যে, তারা নিজেদের সৎকাজের বিনিময়ে যে প্রতিদান লাভের অধিকারী হবে কেবলমাত্র ততটুকুই তাদেরকে দেয়া হবো না বরং তার ওপর অতিরিক্ত পুরস্কার এবং অনেক বেশী পুরস্কার দেয়া হবে। বিপরীত পক্ষে জাহান্নামবাসীদের জন্য কেবলমাত্র এতটুকুই বলা হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের যে পরিমাণ অপরাধ তার চেয়ে বেশী শাস্তি দেয়া হবে না এবং কমও দেয়া হবে না। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরা ইউনুস ২৬-২৭ আয়াত, আন নামল ৮৯-৯০ আয়াত, আল কাসাস ৮৪ আয়াত , সাবা ৩৩ আয়াত এবং আল মু’মিন ৪০ আয়াত ।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩৭
رَّبِّ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ مَا بَیْنَهُمَا الرَّحْمٰنِ لَا یَمْلِكُوْنَ مِنْهُ خِطَابًاۚ
সেই পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি পৃথিবী ও আকাশসমূহের এবং তাদের মধ্যবর্তী প্রত্যেকটি জিনিসের মালিক, যার সামনে কারো কথা বলার শক্তি থাকবে না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারের শান-শওকত, প্রভাব ও প্রতিপত্তি এমন পর্যায়ের হবে যার ফলে পৃথিবী বা আকাশের আধিবাসী কারোর আল্লাহর সামনে কথা বলার অথবা তাঁর আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার সাহস হবে না।
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৩৮
یَوْمَ یَقُوْمُ الرُّوْحُ وَ الْمَلٰٓئِكَةُ صَفًّا١ۙۗؕ لَّا یَتَكَلَّمُوْنَ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ وَ قَالَ صَوَابًا
যেদিন রূহ ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। পরম করুণাময় যাকে অনুমতি দেবেন এবং যে ঠিক কথা বলবে, সে ছাড়া আর কেউ কথা বলবে না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে এখানে জিব্রীল আলাইহিস সালামের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর দরবারে তিনি উন্নত মর্যাদার অধিকারী হবার কারণে এখানে অন্যান্য ফেরেশতাদের থেকে আলাদাভাবে তাঁর কথা বলা হয়েছে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আল মা’আরিজ ৩ টীকা)
# এখানে কথা বলা মানে শাফায়াত করা বলা হয়েছে, কেবলমাত্র দু’টি শর্ত সাপেক্ষে সেদিন এ শাফায়াত সম্ভব হবে। এক, যে ব্যক্তিকে যে গুনাহগারের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া হবে একমাত্র সে-ই তার জন্য শাফায়াত করতে পারবে। দুই, শাফায়াতকারীকে সঠিক ও যথার্থ সত্য কথা বলতে হবে। অন্যায় সুপারিশ করতে পারবে না। দুনিয়ায় কমপক্ষে সত্যের কালেমার সমর্থক অর্থাৎ নিছক গুনাহগার ছিল, কাফের ছিল না, এমন ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করতে হবে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল বাকারাহ ২৮১ টীকা , ইউনুস ৫ টীকা , হূদ ১০৬ টীকা , মারয়াম ৫২ টীকা , ত্বা-হা ৮৫ – ৮৬ টীকা, আল আম্বিয়া ২৭ টীকা , সাবা ৪০ – ৪১ , আল মু’মিন ৩২ টীকা , আয যুখরুফ ৬৮ টীকা , আন নাজম ২১ টীকা এবং আল মুদদাসসির ৩৬ টীকা )
সুরা: আন-নাবা
আয়াত নং :-৪০
اِنَّاۤ اَنْذَرْنٰكُمْ عَذَابًا قَرِیْبًا١ۖۚ۬ یَّوْمَ یَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ یَدٰهُ وَ یَقُوْلُ الْكٰفِرُ یٰلَیْتَنِیْ كُنْتُ تُرٰبًا۠
যে আযাবটি কাছে এসে গেছে সে সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম। যেদিন মানুষ সেসব কিছুই দেখবে যা তার দু’টি হাত আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে এবং কাফের বলে উঠবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# আপাতদৃষ্টিতে এক ব্যক্তি এখানে একথা চিন্তা করতে পারে যে যাদেরকে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছিল তারা চৌদ্দ’শ বছর আগে দুনিয়া থেকে চলে গেছে এবং এখনো বলা যেতে পারে না, কিয়ামত আগামী কত শত, হাজার বা লক্ষ বছর পরে আসবে, তাহলে একথাটি কোন অর্থে বলা হয়েছে যে, যে আযাবটি কাছে এসে গেছে সে সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম? তাছাড়া সূরার সূচনায় কেমন করে একথা বলা হলো যে, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে? এর জবাব এই যে মানুষ যতক্ষণ এ দুনিয়ার স্থান ও কালের সীমানায় রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে অবস্থান করে কেবল ততক্ষণই তার মধ্যে সময়ের অনুভূতি থাকে। মরণের পরে যখন শুধুমাত্র রূহই বাকি থেকে যাবে তখন আর সময়ের চেতনা ও অনুভূতি থাকবে না। আর কিয়ামতের দিন মানুষ যখন পুনর্বার জীবিত হয়ে উঠবে তখন তার মনে হবে যেন এখনি ঘুমের মধ্যে কেউ তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার বছর পরে তাকে আবার জীবিত করা হয়েছে, এ অনুভূতির লেশমাত্রও তখন তার মধ্যে থাকবে না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নামল ২৬ টীকা , বনি ইসরাঈল ৫৬ টীকা , ত্বা-হা ৮০ টীকা এবং ইয়াসীন ৪৮ টীকা )
# দুনিয়ায় জন্মই না হতো অথবা মরে গিয়ে মাটিতে মিশে যেতাম এবং আবার জীবিত হয়ে ওঠার সুযোগ না হতো।