Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯২/এবং কাফের-র। বলে:-৩৬)
[*তারা (কাফেররা) বলে, “সত্যিই কি আমাদের আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে?:-
*পাপ থেকে বাঁচার উপায় : –
*তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাতকাল অবস্থান করেছে।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত
পারা:৩০
১-৪৬ নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১
وَ النّٰزِعٰتِ غَرۡقًا ۙ﴿۱﴾
সেই ফেরেশতাদের কসম যারা ডুব দিয়ে টানে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২
وَّ النّٰشِطٰتِ نَشۡطًا ۙ﴿۲﴾
এবং খুব আস্তে আস্তে বের করে নিয়ে যায়।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩
وَّ السّٰبِحٰتِ سَبۡحًا ۙ﴿۳﴾
আর (সেই ফেরেশতাদেরও যারা বিশ্বলোকে) দ্রুত গতিতে সাঁতরে চলে,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪
فَالسّٰبِقٰتِ سَبۡقًا ۙ﴿۴﴾
অতঃপর (শপথ তাদের;) যারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৫
فَالۡمُدَبِّرٰتِ اَمۡرًا ۘ﴿۵﴾
এরপর (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) সকল বিষয়ের কাজ পরিচালনা করে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৬
یَوۡمَ تَرۡجُفُ الرَّاجِفَۃُ ۙ﴿۶﴾
সেদিন প্রকম্পিত করবে (মহাপ্রলয়ের) প্রথম শিংগাধ্বনি।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৭
تَتۡبَعُہَا الرَّادِفَۃُ ؕ﴿۷﴾
তার অনুগামী হবে পরবর্তী (পুনরুত্থানের) শিংগাধ্বনি।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৮
قُلُوۡبٌ یَّوۡمَئِذٍ وَّاجِفَۃٌ ۙ﴿۸﴾
কতক হৃদয় সেদিন ভয়ে কাঁপতে থাকবে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৯
اَبۡصَارُہَا خَاشِعَۃٌ ۘ﴿۹﴾
হবে তাদের ভীতি বিহবল।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১০
یَقُوۡلُوۡنَ ءَاِنَّا لَمَرۡدُوۡدُوۡنَ فِی الۡحَافِرَۃِ ﴿ؕ۱۰﴾
তারা (কাফেররা) বলে, “সত্যিই কি আমাদের আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে?
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১১
ءَ اِذَا کُنَّا عِظَامًا نَّخِرَۃً ﴿ؕ۱۱﴾
পঁচা-গলা হাড্ডিতে পরিণত হয়ে যাওয়ার পরও?”
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১২
قَالُوۡا تِلۡکَ اِذًا کَرَّۃٌ خَاسِرَۃٌ ﴿ۘ۱۲﴾
তারা বলে, ‘তাই যদি হয় তবে তো এটা এক সর্বনাশা প্ৰত্যাবর্তন।’
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৩
فَاِنَّمَا ہِیَ زَجۡرَۃٌ وَّاحِدَۃٌ ﴿ۙ۱۳﴾
এটা তো এক মহাগর্জন মাত্র।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৪
فَاِذَا ہُمۡ بِالسَّاہِرَۃِ ﴿ؕ۱۴﴾
এবং হঠাৎ তারা হাযির হবে একটি খোলা ময়দানে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৫
ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ مُوۡسٰی ﴿ۘ۱۵﴾
আপনার কাছে মূসার বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি ?
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৬
اِذۡ نَادٰىہُ رَبُّہٗ بِالۡوَادِ الۡمُقَدَّسِ طُوًی ﴿ۚ۱۶﴾
যখন তাঁর রব পবিত্র উপত্যকা ‘তুওয়া’য় তাঁকে ডেকে বলেছিলেন,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৭
اِذۡہَبۡ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿۫ۖ۱۷﴾
“ফেরাউনের কাছে যাও, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৮
فَقُلۡ ہَلۡ لَّکَ اِلٰۤی اَنۡ تَزَکّٰی ﴿ۙ۱۸﴾
এবং (তাকে) বল, ‘তোমার কি আত্মশুদ্ধির কোন আগ্রহ আছে?
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-১৯
وَ اَہۡدِیَکَ اِلٰی رَبِّکَ فَتَخۡشٰی ﴿ۚ۱۹﴾
আর আমি কি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের পথ দেখাব, ফলে তুমি তাঁকে ভয় করবে?’
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২০
فَاَرٰىہُ الۡاٰیَۃَ الۡکُبۡرٰی ﴿۫ۖ۲۰﴾
অতঃপর সে তাকে মহা নিদর্শন দেখাল।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২১
فَکَذَّبَ وَ عَصٰی ﴿۫ۖ۲۱﴾
কিন্তু সে মিথ্যা মনে করে প্রত্যাখ্যান করলো ও অমান্য করলো,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২২
ثُمَّ اَدۡبَرَ یَسۡعٰی ﴿۫ۖ۲۲﴾
তারপর চালবাজী করার মতলবে পিছন ফিরলো।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৩
فَحَشَرَ فَنَادٰی ﴿۫ۖ۲۳﴾
সে সকলকে সমবেত করল এবং উচ্চ স্বরে ঘোষণা করল।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৪
فَقَالَ اَنَا رَبُّکُمُ الۡاَعۡلٰی ﴿۫ۖ۲۴﴾
আর বলল, ‘আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।’
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৫
فَاَخَذَہُ اللّٰہُ نَکَالَ الۡاٰخِرَۃِ وَ الۡاُوۡلٰی ﴿ؕ۲۵﴾
অবশেষে আল্লাহ তাকে আখেরাত ও দুনিয়ার আযাবে পাকড়াও করলেন।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৬
اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَعِبۡرَۃً لِّمَنۡ یَّخۡشٰی ﴿ؕ٪۲۶﴾
যে (আল্লাহকে) ভয় করে, তার জন্য অবশ্যই এতে শিক্ষা রয়েছে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৭
ءَاَنۡتُمۡ اَشَدُّ خَلۡقًا اَمِ السَّمَآءُ ؕ بَنٰہَا ﴿ٝ۲۷﴾
তোমাদের সৃষ্টি করা বেশী কঠিন কাজ, না আকাশের? আল্লাহই তাকে সৃষ্টি করেছেন।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৮
رَفَعَ سَمۡکَہَا فَسَوّٰىہَا ﴿ۙ۲۸﴾
তিনি তার ছাদকে সুউচ্চ ও সুবিন্যস্ত করেছেন।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-২৯
وَ اَغۡطَشَ لَیۡلَہَا وَ اَخۡرَجَ ضُحٰہَا ﴿۪۲۹﴾
তার রাতকে ঢেকে দিয়েছেন এবং তার দিনকে প্রকাশ করেছেন।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩০
وَ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ ذٰلِکَ دَحٰىہَا ﴿ؕ۳۰﴾
এবং তারপর তিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩১
اَخۡرَجَ مِنۡہَا مَآءَہَا وَ مَرۡعٰہَا ﴿۪۳۱﴾
তিনি তা থেকে বের করেছেন তার পানি ও তৃণভূমি,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩২
وَ الۡجِبَالَ اَرۡسٰہَا ﴿ۙ۳۲﴾
এবং তার মধ্যে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৩
مَتَاعًا لَّکُمۡ وَ لِاَنۡعَامِکُمۡ ﴿ؕ۳۳﴾
জীবন যাপনের সামগ্রী হিসেবে তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুদের জন্য,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৪
فَاِذَا جَآءَتِ الطَّآمَّۃُ الۡکُبۡرٰی ﴿۫ۖ۳۴﴾
অতঃপর যখন মহাসংকট (কিয়ামত) সমাগত হবে,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৫
یَوۡمَ یَتَذَکَّرُ الۡاِنۡسَانُ مَا سَعٰی ﴿ۙ۳۵﴾
সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, যা সে করে এসেছে।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৬
وَ بُرِّزَتِ الۡجَحِیۡمُ لِمَنۡ یَّرٰی ﴿۳۶﴾
এবং প্রত্যেক দর্শনকারীর সামনে জাহান্নাম খুলে ধরা হবে,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৭
فَاَمَّا مَنۡ طَغٰی ﴿ۙ۳۷﴾
সুতরাং যে সীমালঙ্ঘন করে,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৮
وَ اٰثَرَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا ﴿ۙ۳۸﴾
দুনিয়ার জীবনকে বেশী ভালো মনে করে বেছে নিয়েছিল,
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৩৯
فَاِنَّ الۡجَحِیۡمَ ہِیَ الۡمَاۡوٰی ﴿ؕ۳۹﴾
জাহীম (জাহান্নাম)ই হবে তার আশ্রয়স্থল।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪০
وَ اَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّہٖ وَ نَہَی النَّفۡسَ عَنِ الۡہَوٰی ﴿ۙ۴۰﴾
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল ।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪১
فَاِنَّ الۡجَنَّۃَ ہِیَ الۡمَاۡوٰی ﴿ؕ۴۱﴾
তার ঠিকানা হবে জান্নাত।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪২
یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ السَّاعَۃِ اَیَّانَ مُرۡسٰہَا ﴿ؕ۴۲﴾
তারা তোমাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তা কখন সংঘটিত হবে?
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪৩
فِیۡمَ اَنۡتَ مِنۡ ذِکۡرٰىہَا ﴿ؕ۴۳﴾
এ ব্যাপারে তোমার কি বলার আছে?
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪৪
اِلٰی رَبِّکَ مُنۡتَہٰىہَا ﴿ؕ۴۴﴾
এর চূড়ান্ত জ্ঞান আছে তোমার প্রতিপালকের নিকটেই।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪৫
اِنَّمَاۤ اَنۡتَ مُنۡذِرُ مَنۡ یَّخۡشٰہَا ﴿ؕ۴۵﴾
তাঁর ভয়ে ভীত এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে সতর্ক করাই শুধুমাত্র তোমার দায়িত্ব।
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত:-৪৬
کَاَنَّہُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَہَا لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا عَشِیَّۃً اَوۡ ضُحٰہَا ﴿٪۴۶﴾
যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাতকাল অবস্থান করেছে।
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯২/এবং কাফের-র। বলে:-৩৬)
[*তারা (কাফেররা) বলে, “সত্যিই কি আমাদের আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে?:-
*পাপ থেকে বাঁচার উপায় : –
*তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাতকাল অবস্থান করেছে।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৯: আন্-নাযিয়াত
পারা:৩০
১-৪৬ নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আন-নাযিআত
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৭৯
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : আখেরাত সংঘটিত হওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে ৩০ পারার অন্যান্য সূরার মধ্যে যেসব উদাহরণ দেয়া হয়েছে, এ সূরাটিতেও অনুরূপ যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে। আখেরাতের আগমন যে অবশ্যম্ভাবী, তা কতো ভয়ানক, তার দৃশ্যাবলী কতো কঠিন এবং এই পৃথিবীর পরিণতির জন্যে আখেরাত সংঘটিত হওয়ার গুরুত্ব কতো বেশী, এই সূরার ছত্রে ছত্রে তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ফুটে উঠেছে মহান স্রষ্টার সুনিপুণ তৈরী পৃথিবীর উপরিভাগ ও অভ্যন্তরভাগের প্রতিটি জিনিসের পরিণতির আভাস । তারপর এর বাসিন্দাদের যে আখেরাতে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে হিসাব নিকাশের সম্মুখীন হতে হবে তার বহু যুক্তি ও এ সূরায় বর্ণিত হয়েছে। আখেরাতের বাস্তবতা সম্পর্কে মানব মনে প্রত্যয় জন্মানোর উদ্দেশ্যে প্রথমেই এক ভীষণ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। অনুভূতির তীব্রতা বৃদ্ধির জন্যে এই ভীতিজনক বিস্ময়কর ও কঠিন অবস্থার বর্ণনার সাথে সাথে কতো দ্রুতগতিতে কেয়ামত সংঘটিত হবে সে বিষয়ে পাঠককে সূচকিত করা হয়েছে। ওই ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা করতে গিয়ে প্রথমেই যে বর্ণনা এসেছে তা মানুষ শুধু কল্পনাই করতে পারে এবং এ বর্ণনা মানুষের মনকে ভীষণ ভয়ে বিহ্বল করে দেয়। তার হৃদয়ে এমন কাপুনি সৃষ্টি করে যে, তার হৃদয়ের তারগুলো যেন ছিড়ে যেতে চায়। তার গোটা সত্ত্বা অবশ্যন্তাবী ওই বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করতে থাকে এবং গভীর পেরেশানীতে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসতে চায়। ‘গভীরভাবে ডুব দেয়া ও সজোরে বিচ্ছিন্নকারী ফেরেশতাদের কসম, আবার কসম ওই ফেরেশতাদের, যারা ধীর গতিতে ও আসানিতে জানগুলো কবয করে নেয়। কসম তাদের যারা রূহগুলো নিয়ে (উন্মুক্ত আকাশের পরিমন্ডলে) সাতার কেটে চলে যায়। তাদেরও কসম, যারা (নেককার রূহগুলো নিয়ে) প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যায় এবং পরপর আল্লাহর সকল হুকুম পালন করে চলে ।’ মানুষের কল্পনার চোখে ওই কাপিয়ে তোলার মতো ঘটনাবলী তুলে ধরে সে দিনের ভীষণ দৃশ্যাবলীর প্রথম অবস্থাটি তুলে ধরা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে অন্যান্য অবস্থাগুলো পরপর এমনভাবে আসতে থাকবে যেন এগুলোর আগমন পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে এবং অতি সংগোপনে একটি ঘটনার পরিণতিতে অপরটি আসা অবধারিত হয়ে আছে । দেখুন, বর্ণনা ধারা- ‘সেদিন আসবে ভীষণ কম্পনসৃষ্টিকারী প্রচন্ড এক ধাক্কা, যার পরে আসবে আবারও’ ….(আয়াত-৬-১৪) পরবর্তী অবস্থাগুলোও পরপর আসতে থাকবে । মহাশূন্য ভয়ে কাপতে কাপতে অবশেষে স্থির হয়ে যাবে। এভাবে সবকিছু এক বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে । মূসা ও ফেরাউনের সময়কার যে সব বিদ্রোহী সীমালংঘনকারী ব্যক্তি আল্লাহর আযাবে পতিত হয়েছিলো তাদের মতো অন্যান্য সবাই এই ধ্বংসাত্মক অবস্থায় পতিত হবে। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে৷ এভাবে তাদের সম্পর্কে উচ্চারিত ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হবে। এরশাদ হচ্ছে-‘এসেছে কি তোমার কাছে মূসার কাহিনী? স্মরণ করে দেখো সে সময়ের কথা, যখন তার রব তাকে তুয়া নামক উপত্যকায় ডেকে বললেন, যাও ফেরাউনের কাছে, ……… পাকড়াও করলেন। এর মধ্যে অবশ্যই শিক্ষা রয়েছে সেসব ব্যক্তির জন্যে যে (তাকে) ভয় করে।’ (আয়াত-১৪-২৬) এভাবে আল্লাহ তায়ালা ওই মহাসত্য জানানোর জন্যে এখানে একটি ভূমিকা পেশ করছেন। এরপর এ ঐতিহাসিক পটভূমির বর্ণনা শেষে প্রকৃতির উন্মুক্ত গ্রন্থ তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে তার সর্বশক্তিমান মহান সত্ত্বার অস্তিত্বের বহু চিহ্ন ফুঠে রয়েছে। যা সেই মহান সত্ত্বার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছার কথা জানায়, জানায় দুনিয়া ও আখেরাতের সবকিছুর ওপর তার কর্তৃত্বের কথা, তার তদারকির কথা! সেই মহাশক্তিই যে অতি সংগোপনে সবকিছুকে পরিচালনা করছে এবং তার ইচ্ছাক্রমেই যে সবকিছু চলছে এ সূরার শুরুতে তারই আভাস দেয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের সৃষ্টিটা বেশী কঠিন, না আকাশ সৃষ্টি বেশী কঠিন? এই মহাকাশকে তিনি তৈরী করলেন, এর ছাদকে সমুন্নত করলেন এরপর সুসমন্বিত করলেন এর গঠন প্রণালীকে ৷ এরপর ঢেকে দিলেন রাতকে (অন্ধকারের চাদর দিয়ে), আর বের করলেন তার থেকে উদীয়মান দিনের উজ্জ্বল আলো । তারপর বিছিয়ে দিলেন যমীনকে, তার থেকে পানি ও তার চারণভূমি বের করলেন, আর তার মধ্যে পর্বতমালাকে গেড়ে দিলেন, যে পানি তোমাদের জন্যে জীবন সামগ্রী এবং তোমাদের গবাদিপশুর জন্যেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করে।’ (আয়াত-২৭-৩৩) এই হৃদয়গ্রাহী ভূমিকা ও প্রাণসঞ্চারী অনুভূতি জাগানোর পর মহাপ্রলয়ের দৃশ্য এবং দুনিয়ার জীবনে কৃত যাবতীয় কাজের পরিণতির বিবরণ এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যে প্রতিদান নেককার (লোকদেরকে) দেয়া হবে তার কিছু দৃষ্টান্ত এমনভাবে প্রকৃতির মধ্যে বর্তমান রয়েছে, যা দেখে পাপাচারীদের সর্বনাশা পরিণতি বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার হেদায়াতের বাতিকে নিভিয়ে দেয়ার জন্যে মানুষ যা কিছু চেষ্টা সাধনা বা ষড়যন্ত্র করেছিলো সেদিন তা খুব ভালোভাবেই সে স্মরণ করবে এবং (সেদিন) জাহান্নামকে এগিয়ে আনা হবে সে ব্যক্তির জন্যে যে তা নিজের চোখে দেখতে পাবে অর্থাৎ সেই-ই সেদিন তার উপযুক্ত হবে। অতএব যে সীমালংঘন করেছিলো এবং দুনিয়ার জীবনকে বড়ো করে দেখেছিলো, জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা এবং যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দাড়াতে হবে বলে ভয় করেছিলো এবং তার মনকে প্রবৃত্তির দাসত্ব করা থেকে থামিয়ে রেখেছিলো নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার ঠিকানা । সেই মহাপ্রলয়ের বিভীষিকাময় দৃশ্যের বর্ণনা শুনে যখন আমাদের অন্তর অভিভূত হয়ে পড়ছে সেই মুহূর্তেই বলা হচ্ছে- ‘দোযখকে তার ভয়ংকর চেহারাসহ তাদের সামনে এগিয়ে দেয়া হবে, যারা নিজ চোখে দেখতে পাবে ওই উন্মত্ত দোযখকে ৷ যারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের তুলনায় বড়ো করে দেখেছে, আর যারা তাদের রবের সামনে দাড়াতে হবে- এ চিন্তায় মনকে তার লাগামছাড়া চাহিদা পূরণ করা থেকে দমন করবে, নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার ঠিকানা ।’ এই পর্যায়ে এসে সূরার মোড় ফিরে যাচ্ছে ওই ভয়ানক কেয়ামতের অস্বীকারকারীদের দিকে, যারা রসূল(স.)-এর কাছে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। ওদের প্রশ্ন প্রসংগে কেয়ামতের ভয়াল চিত্র তুলে ধরায় তাদের অন্তরের ভয় আরও বেড়ে গেলো । কেয়ামতের সর্বগ্রাসী চেহারার হৃদয় বিদারক বর্ণনা অপরাধীদের মনকে ভয়ে বিহ্বল করে দিলো । দেখুন সে বর্ণনা- “ওরা জিজ্ঞাসা করছে কেয়ামত সম্পর্কে ….. তাদের কাছে মনে হবে (দুনিয়ার সুখের জীবনে) একটি মাত্র রাত অথবা একটি মাত্র উজ্জ্বল প্রভাত তারা কাটিয়েছে। মাদ্ চিহ্ন বিশিষ্ট ‘হা’ দ্বারা দীর্ঘস্থায়ী কেয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে, যার ভয়ানক অবস্থা ও বিশালত্বও মনকে কীপিয়ে দেয়।” (আয়াত-৪২-৪৬)
ফী জিলালিল কুরআন: “কসম গভীরভাবে ডুব দিয়ে (প্রাণ) বিচ্ছিন্নকারী (আযাবের ফেরেশতা)দের, আবার কসম সুনিপুণভাবে ও ধীর স্থির গতিতে (নেককার লোকদের) রূহ কবযকারী ফেরেশতাদের), কসম সন্তরণকারী ফেরেশতাদের, যারা রূহগুলো নিয়ে উন্মুক্ত আকাশে সাতার কেটে চলে যায়। তারপর ওই রহমাতের ফেরেশতাদের কসম যারা (নেককার লোকদের রূহ নিয়ে) প্রতিযোগিতা করে অগ্রগামী হয়। তারপর আরও কসম কার্যনির্বাহী ও দায়িত্বশীল ফেরেশতাদের ।’ এই বাক্যগুলোর তাফসীর করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন ওই সকল ফেরেশতা হলেন তারা, যারা মৃদু-মন্ত্র গতিতে অতি নিপুণভাবে রূহ কবয করে, উড়ে যায় উর্ধাকাশে- যেন সাতার কেটে চলে যায়। তারা তাদের রবের প্রতি ঈমান ও আনুগত্য প্রকাশে অগ্রগামী ভূমিকা রাখে এবং হুকুম পাওয়ার সাথে সাথেই তা তামিল করে। আবার কেউ বলেছেন, ওরা হচ্ছে সেই তারকারাজি যারা নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে নড়েচড়ে বেড়ায় আর অতি সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয় এবং আল্লাহর ঝুলন্ত মহাশূন্যলোকে সন্তরণ (বা বিচরণ) করতে থাকে । আর এই বিচরণকালে প্রত্যেকেই একে অন্যের থেকে এগিয়ে যেতে চায় । এর ফলে পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের প্রতি আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে, যার ফলে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় । কারও মতে ‘নাযেয়াত’, ‘নাশেতাত’, ‘সাবেহাত’, ও ‘সাবেকাত’, বলতে ওই তারকারাজিকে বুঝায় যার এন্তেযাম ও পরিচালনায় রয়েছে ফেরেশতারা । আর এক মত হচ্ছে, ‘নাযেয়াত’, ‘নাশেতাত’ এবং ‘সাবেহাত’ হলো তারকারাজি এবং ‘সাবেকাত”’ প্রেতিযোগিরা) ও মুদাব্বেরাত (কার্য সম্পাদনকারিরা) এরা হলেন ফেরেশতাকুল ৷ এসব শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা যাই-ই করা হোক না কেন কোরআনের এই বিশেষ বর্ণনাভংগী সর্বপ্রথম ও সর্বাগ্রে আমাদের অন্তরে এক কাপন সৃষ্টি করেছে এবং এক অজানা ভয়ের অনুভুতি মনকে ছেয়ে ফেলেছে। এভাবে সর্বপ্রথম এসেছে হিসেব দেয়ার দুশ্চিন্তা, তারপর এসেছে মহা ধ্বংসলীলার সংবাদে অন্তরে প্রচন্ড এক প্রকম্পন ৷ এই কারণে আমরা এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খুব বেশী বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই না। আয়াতগুলোতে বর্ণিত কথাগুলো স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অন্তরে এক বিশেষ ক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে আমরা মনে করি। হৃদয়ের মধ্যে কাপন সৃষ্টি হওয়া এবং অন্তর জেগে ওঠাই ওই কথাগুলোর আসল লক্ষ্য, যা কোরআনের অতি চমৎকার ও বিভিন্ন বর্ণনাভংগী আমাদের মধ্যে পয়দা করতে চেয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সামনে হযরত ওমর বিন খাত্তাবের একটি উদাহরণ রয়েছে। তিনি একবার সুরা ‘আবাসা ওয়া তাওয়াল্লা’ (ভ্রু কুঞ্চিত করলো ও মুখ ফিরিয়ে নিলো) পড়তে শুরু করলেন । আল্লাহ্র সুমধুর আশ্বাসবাণী, ‘ওয়া ফাকিহাতাও ওয়া আব্বা (ফলমূল ও খাদ্যশস্য)’ পর্যন্ত পড়ার পর তিনি থেমে গিয়ে বললেন, ব্যস, আমরা ফলমূল (ফাকিহাতান) কি তা বুঝে গেলাম, কিন্তু ‘আব্বা’ কী জিনিস? তাতো বুঝলামনা তারপর নিজেকে তিরস্কার করতে করতে বললেন, তোমার জীবনের কসম, হে ওমর বিন খাত্তাব, তুমি খামাখা এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো? আল্লাহর কেতাবের কোনো একটি কথা (আল আব্বু) যদি নাই-ই বুঝে থাকো তাতে তোমার এমন কী অসুবিধা হলো? তারপর বললেন, আল্লাহর কেতাবের যেটুকু স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছো, সেটুই পালন করো, আর যেখানে সংকট বোধ করো, সেখানে থেমে যাও (কোনো নির্দেশ জানতে না পারলে চুপ হয়ে যাও) । এটাই হচ্ছে আদবের দাবী । এই আদবই আমরা আল্লাহর মহান কালাম থেকে শিখেছি। এটাই মহান প্রভু প্রতিপালকের সামনে বান্দার আদব ৷ এই আদবের প্রতি প্রত্যেকের লক্ষ্য রাখা উচিত । তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার আশা করা যায়।
ফী জিলালিল কুরআন: মহাপ্রলয়ের সেই দিন : সূরাটি এক শপথবাণী দ্বারা শুরু হয়েছে। এর দ্বারা পরবর্তীতে বর্ণীত বিষয়ের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যেদিন প্রচন্ড বেগে কাপতে থাকবে গোটা পৃথিবী, তারপরেই আসবে আর এক প্রচন্ড ধাক্কা । সেদিন বহু হৃদয় কাঁপতে থাকবে। অনেক চোখ ভয়ের চোটে অবনমিত থাকবে । তারা বলবে পচাগলা হাড্ডি হয়ে যাওয়ার পরও আমরা কি আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবো ? তাহলে তো এ প্রত্যাবর্তন হবে ভীষণ ক্ষতির ও অপমানজনক ৷ এ সময় একটি মাত্র ঝাকুনি আসবে আর অমনি এক বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরে পরিণত হয়ে যাবে সবকিছু ।’ প্রচন্ড ভূমিকম্পে পৃথিবীর যে বিপর্যয় ঘটবে তা কোরআনে কারীমের অপর একটি সূরাতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, সে দিন পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতগুলো প্রকম্পিত হবে। এরপর এর অনুসরণকারী (অনুরূপ আর একটি ধাক্কা) বলতে কেয়ামতকে বুঝানো হয়েছে, যা ভূমির কম্পনের পরপরই এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে । তখন সবকিছু ফেটে চৌচির হয়ে যাবে এবং আকাশের তারাগুলো সব চতুর্দিকে ছিটকে পড়বে। এভাবে কথাটা এসেছে যে, ওই কাপুনি হচ্ছে প্রথম মহাপ্রলয়, যা এক বিরাট চিৎকার ধ্বনির ফলে সংঘটিত হবে। যার কারণে পৃথিবী, পাহাড়, পর্বত এবং জীবজস্তু সবকিছু কাপতে থাকবে । এর ফলে আকাশন্ডমলীর সবকিছু এবং পৃথিবীবাসী সবাই বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে৷ তবে আল্লাহ তায়ালা যদি কাউকে রেহাই দেন তার কথা আলাদা ৷ পেছনে আগমনকারী (ধাক্কাটি) হচ্ছে (শিংগার) দ্বিতীয় ফুক, যার প্রচন্ড শব্দ সবার ওপর ছেয়ে যাবে, তারা সবাই হাশরের ময়দানে হাযির হয়ে যাবে। (যেমন এসেছে সূরায়ে ঝুমারের ৬৮ নং আয়াতে) এর অর্থ এটা হোক বা সেটা হোক- এটা নিসন্দেহে সত্য যে, আলোচ্য সূরাতে ও অন্যান্য সূরার বর্ণনায় যে কথাগুলো এসেছে তাতে মানব হৃদয় ভূমিকম্প, প্রকম্পন, আতংক ও পেরেশানীই অনুভব করছে। ভয়ে চমকে ওঠা, থরথর করে কাপতে থাকা এবং আতংকে পেরেশান হয়ে যাওয়া- আলোচ্য আয়াতগুলোতে এই অনুভূতিই করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন সেদিন যে ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি হবে তার তীব্র অনুভুতি মানব হৃদয়ে জাগুক এবং সে সময়ের বাস্তবতা স্বীকার করুক ৷ অবশ্য আল্লাহর কথাগুলো মানুষ ঠিক মতোই বুঝেছে এবং সে তা অনুভবও করেছে। যাতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের হৃদয়গুলো ভয়ে কাপতে থাকবে, তাদের চোখগুলো ভয়ে অবনত হয়ে যাবে ।’ এটা হবে মৃত্যুর ওই কঠিন আতংক, যার শুরুতে থাকবে হীনমন্যতা, এরপর আসবে ভয় ও নুয়ে পড়া অবস্থা, আরও আসবে থর থর করে কাঁপন ও কষ্টকর গোঙ্গানি ৷ এরপর যে চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো সেই সময়ের অবস্থা যখন কেয়ামতের কাঁপন সবকিছুকে ঝাকিয়ে তুলবে ৷ যার পেছনে আসবে আর একটি প্রচন্ড ঝাকুনি, আর এই অবস্থাকে বুঝাতে গিয়েই ‘নাযিয়াতে গারকান’ (সজোরে বিচ্ছিন্নকারী) ‘নাশিতাতে নাশতান’, (সহজে কবযকারী) ‘সাবিহাতে সাবহান’ (সাতার কাটা সাতারু), ‘সাবিকাতে সাবকান’ (পাল্লা দিয়ে অগ্রগামী) তারপর ‘ফাল মোদাব্বিরাতে আমরান’ কর্ম সম্পাদনকারী শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এ সূরার মধ্যে বর্ণিত দৃশ্যাবলীর বিবরণ এর সূচনাতে যে কসম খাওয়া হয়েছে তার সাথে কেয়ামতের অবস্থা পুরাপুরি সামঞ্জস্যশীল । পুনরুত্থান কিভাবে হবে তারপর সূরাটির বর্ণনার মধ্যে যে আলোচনা এগিয়ে চলেছে তাতে দেখা যায়, কবর থেকে যখন তারা উঠে আসবে, তখন তাদের বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়া, আশ্চর্যান্বিত হয়ে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে থাকা এবং আতংকে অস্থির হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে । তখন কবর থেকে উঠে ওরা বলে উঠবে, আমাদের কি আগের মতোই কোনো যেন্দেগী দান করা হবে, যাতে মতো কাজকর্ম করতে পারি? পচাগলা হাডিডতে পরিণত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কি সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব? ‘হাফেরাতুন’ মধ্যে ফিরে যাওয়া বলতে বুঝানো হয়েছে ওই পথে ফিরে যাওয়া যে পথ একবার পার হয়ে আসা হয়েছে। ওরা বিষ্ময় ও পেরেশানীর হালতে জিজ্ঞাসা করবে যে, তাদেরকে পূর্ব জীবনে ফিরিয়ে দেয়! হবে কি না! ওই অবস্থার কথা চিন্তা করে তারা বিশ্বয়ে অভিভূত হয়ে পড়বে যে, পঁচাগলা হাডিডতে পরিণত হওয়ার পর আবার আগের মতো জীবন লাভ করা কি করে সম্ভব! এই পর্যায়ে এসে তারা হতবুদ্ধি হয়ে যায়। তবে হা, পূর্নজীবন লাভ, অবশ্যই সম্ভব কিন্তু এটা সেই দুনিয়ার হারানো জীবন নয়, তা হবে নতুন আর একটি জীবন ৷ এ কারণে এই প্রত্যাবর্তনকে তারা ভীষণ ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক মনে করবে এবং তাদের মুখ থেকে এ কথাগুলো বেরিয়ে আসবে। ওরা বলবে, ওটাতো বড়োই ক্ষতিকর অবস্থা হবে! এমন প্রত্যাবর্তনের কোনো চিন্তাই তারা কোনোদিন করেনি । আর সে জন্যে কোনো পাথেয় তারা সঞ্চয় করেনি। নিরেট ক্ষতিই হবে সেদিন তাদের পাওনা ৷ এখানে এই দৃশ্যকে সামনে রেখে অনাগত ভবিষ্যতে যে অবস্থা অবশ্যই আসবে তার বর্ণনা কোরআন পেশ করছে। বলা হচ্ছে, ব্যস, তা হবে একটিমাত্র ভীষণ শব্দ অমনি তারা উন্মুক্ত এক মহা প্রান্তরে নিজেদের হাযির দেখতে পাবে। ‘ঝাজরাতু’ন ভীষণ শব্দ চিৎকার ধ্বনি কিছু এই কঠিন শব্দটি এখানে ব্যবহার করে সূরার মধ্যে বর্ণিত অন্যান্য দৃশ্যের সাথে এর সংযোগ দেখানো হয়েছে এবং এ শব্দটির মাধ্যমে তখনকার অবস্থার ভয়াবহতা আরো তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। ‘সাহিরাহ’ বলতে বুঝানো হয়েছে শুভ্র উজ্জ্বল খোলা ময়দান (যেমন ধূসর বালুময় বিশাল সাহারা মরুভূমিকে সাহারা বলা হয়) ৷ এটাই হাশরের ময়দান, যা কখন সংঘটিত হবে তা আমাদের কারো জানা নেই । আর এর খবর আমরা সেই থেকে পাই যা স্বয়ং আল্লাহর বাণী । অতএব তার সাথে কোনো কিছু আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যোগ করতে পারি না, সেটা আমাদের ক্ষমতার বাইরে ৷ কোরআনে বর্ণিত এ এক মহা ভয়ংকর শব্দ এবং তা হচ্ছে সম্ভবত দ্বিতীয় শিংগার ফুঁক, যার সাথে সাথে পুনরুত্থান ও হাশরের ময়দানে সবার সমবেত হওয়া সংঘটিত হবে। এ সূরার মধ্যে বর্ণিত সকল অবস্থাই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একের পর এক আসবে । ভীত সন্ত্রস্ত অন্তরগুলোও তীব্রভাবে দূরুদূরু করতে থাকবে, সুতরাং এ সূরার মধ্যে বর্ণীত ওই সময়ে ঘটিতব্য প্রতিটি অবস্থা, দৃশ্য ও অনুভূতির মধ্যে বর্ণিত পূর্ণ সামঞ্জস্য থাকবে।
সুরা: আন-নাযিআত
আয়াত নং :-২৬
,
اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّمَنْ یَّخْشٰى٢ؕ۠
আসলে এর মধ্যে রয়েছে মস্তবড় শিক্ষা, যে ভয় করে তার জন্যে।
ফী জিলালিল কুরআন:
মুসা (আ.) ও ফেরাউনের কাহিনী : এরপর বর্ণনাশৈলীর গতিকে কিছুটা শ্লথ মনে হয়। যাতে পরবর্তী অবস্থার সাথে তার সামঞ্জস্য টিকে থাকে। কারণ এর পর এসেছে মূসা (আ.) ও ফেরাউনের মধ্যেকার সংলাপ । এ আলোচনা শেষ হয়ে ফেরাউনের বাড়াবাড়ি ও যুক্তি ও নৈতিকতার সকল সীমালংঘনের পরিণতির বিবরণ দিয়ে । এরশাদ হচ্ছে- ‘এসেছে কি তোমার কাছে মূসার ইতিহাস? ওই সময়ের কথা একবার স্মরণ করো, অবশ্য অবশ্যই ওই ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে ওইসব ব্যক্তির জন্যে যে ভয় করে।’ আয়াত ১৫-২৬ মূসার কাহিনী এমন শিক্ষণীয় কাহিনী, যা কোরআনে কারীমের মাঝে সব চাইতে বেশী এবং বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ সূরার পূর্বে আরও বহু সূরায় এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্নভাবে, নানা ভংগিতে । প্রত্যেক স্থানেই প্রাসংগিক আলোচনার সাথে পূর্ণ সংগতি রেখে বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনার ভংগিমায় অবস্থার বিশেষ গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে। বর্ণনাভংগির এই বৈচিত্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐতিহাসিক পটভূমি ও ঘটনার সাথে এ বর্ণনার যোগসূত্র তুলে ধরা। অর্থাৎ যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে ওই ঘটনা ঘটেছিলো এবং আলাপ আলোচনা হয়েছিলো তার সাথে আলোচ্য বিষয়ের একটা সাযুজ্য পেশ করা। এখানে এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে এবং ‘তুয়া’ নামক উপত্যকায় মূসাকে ডাকা থেকে নিয়ে ফেরাউনের পাকড়াও পর্যন্ত ঘটনা ব্যক্ত করে দুনিয়া ও আখেরাতে তার শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যাতে করে সূরাটির আসল আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ আখেরাতের বাস্তবতা বুঝা সহজ হয়! আখেরাত সংঘটিত হবেই- এই বাস্তব সত্যটিকে তুলে ধরার জন্যেই যাবতীয় ঘটনা ও দৃশ্যের অবতারণা ৷ কথার শুরুতে রালূল(স.)-কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, তোমার কাছে কি মুসার ইতিহাস পৌছেছে? এভাবে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে কথা শুরু করে প্রকৃতপক্ষে পাঠকের মন ও কানকে ওই কাহিনী শোনার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। মূসার প্রতি আল্লাহর ডাকের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে এটা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, যখন ডাকলেন তাকে তার রব ‘তুয়া’ নামক পবিত্র উপত্যকায় ‘তুয়া’ সম্ভবত একটি উপত্যকার নাম, উত্তর হেজায থেকে আসার পথে তুর পাহাড় পড়ে, তার ডানদিকে অবস্থিত এই উপত্যকা । যে সময়ে ডাকা হয়েছিলো সে সময়টি ছিলো দারুণ ভীতিকর ৷ কারণ এ ছিলো স্বয়ং মহান আল্লাহর তরফ থেকে তার বান্দাদের একজনের প্রতি অতি আশ্চর্য এক ডাক এ এমন এক ভীতিপ্রদ ডাক, যা মানুষের ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রাব্বুল ইযযতের রহস্যরাজির মধ্য থেকে এ ছিলো এক অত্যাশ্চর্য রহস্য, যা গোটা সৃষ্টির মধ্যে তিনি নিহিত রেখেছেন, যা মানুষকে আল্লাহ তায়ালা না জানালে নিজ চেষ্টায় কেউ জানতে পারে না। কোরআনের অন্য স্থানে আল্লাহ তায়ালা ও মূসা (আ.)-এর মধ্যকার এই নিভৃত আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। এখানে সংক্ষেপে এই ঘটনার উল্লেখ করে মূসা (আ.)-কে ‘তুয়া’ উপত্যকায় ডেকে যে মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো পবিত্র সে বিষয়ের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছিলো, যাও ফেরাউনের কাছে- অবশ্যই সে বিদ্রোহ করেছে। গিয়ে তাকে বলো, তুমি কি পবিত্র হতে চাও? তাহলে আমি তোমাকে তোমার মালিকের পক্ষ থেকে সঠিক পথ দেখাবো, যার ফলে তুমি তাকে ভয় করতে পারবে। ‘যাও ফেরাউনের কাছে, অবশ্যই সে বিদ্রোহ করেছে ।’ আল্লাহর যমীনে কারো বিদ্রোহ করা বা বিদ্রোহে টিকে থাকার কোনো সুযোগ নেই৷ এটা যেমন অপ্রিয় কাজ তেমনই বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী । প্রথমত এটা আল্লাহ্র পছন্দনীয় কাজ এবং এ কাজ অন্যান্য সকল অপ্রিয় কাজের সূচনা করে। এ জন্যেই এই জঘন্য কাজকে তার সকল বান্দার জন্যে চিরদিনের জন্যে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ জন্যে আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা তার নেক বান্দাদের মধ্য থেকে একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন যাতে করে সে অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করে, মালিকের রাজ্যে বিশৃংখলা বন্ধ করে এবং বিদ্রোহের যাবতীয় পথ রুদ্ধ করে দেয়! এটা এমন এক অপছন্দীয় কাজ যে, এটা বন্ধ করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের এক বান্দাকে সম্বোধন করে ওই অহংকারী ব্যক্তির কাছে যাওয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে এই পাপের পরিণতি হিসেবে তাকে পাকড়াও করা হলে তাকে সতর্ক করা হয়নি বলে কোনো ওযর সে যেন পেশ করতে না পারে। তাই বলা হচ্ছে, ‘যাও ফেরাউনের কাছে, নিশ্চয়ই সে বিদ্রোহ করেছে।’ তারপর তাকে (মূসাকে) আল্লাহ্ তায়ালা শেখাচ্ছেন কেমন করে ওই সীমালংঘনকারী মহাপাপীকে সম্বোধন করতে হয়। সুন্দরতম ও মর্মস্পর্শী পদ্ধতিই এই দাওয়াতী কাজের জন্যে ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, যাতে সে অন্যায় কাজ থেকে ফিরে আসে, বিদ্রোহাত্মক কাজকর্ম বন্ধ করে এবং আল্লাহর গযব ও পাকড়াওকে ভয় করতে শুরু করে। এরশাদ হচ্ছে- (তাকে) বলো তুমি কি পবিত্র হতে চাও? তুমি কি বিদ্রোহের খারাবী ও নাফরমানীর পাপ থেকে মুক্ত হতে চাও? তুমি কি রহমত ও বরকতের পথে চলতে চাও? চাইলে আমি তোমাকে তোমার মালিকের নৈকট্য লাভের পথ বাতলাবো, আর এর ফলে তুমি তাকে ভয় করে চলতে পারবে । তুমি কি চাও তোমার মালিকের কাছে পৌছানোর পথ তোমাকে আমি দেখিয়ে দেই? যখন তুমি তা জানতে পারবে, দেখবে তোমার অন্তর ভরে গেছে তার ভয়ে। আসলে মানুষ তখনই বিদ্রোহ করে এবং নাফরমানিতে লিপ্ত হয় যখন সে তার মালিক থেকে দূরে চলে যায় । যখনই কেউ আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে যায় তখনই তার দিল শত্ত হয়ে যায় এবং সে নানা প্রকার অশান্তিকর কাজে লিপ্ত হয়ে যায় । আর তখনই তার থেকে বিদ্রোহ ও অহংকার প্রকাশ পায়। ফেরাউন কর্তৃক আহত জনাকীর্ণ সমাবেশে এ কথাগুলো পৌছানোর দায়িত্ব দিতে গিয়ে মূসাকে এ কথাগুলো বলা হলো। এরপর আসছে সমবেত জনতার সামনে কথাগুলো সরাসরি পেশ করা ও যথাযথভাবে পৌছে দেয়ার দৃশ্য । এই তাবলীগের পর জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অযথা এর পুনরাবৃত্তি থেকে তিনি বিরত হয়ে গেলেন। কথাগুলো গুটিয়ে নিলেন ও সংক্ষিপ্ত করে ফেললেন । তার কথাগুলো নিয়ে সে প্রতিক্রিয়াশীল মজলিসে অনেকক্ষণ বাকবিতন্ডার ওপর এখানে যবনিকাপাত করা হলো। তারপর আল্লাহ তায়ালা মূসাকে সে মহা নিদর্শন দেখালেন যা দেখে ফেরাউন অস্বীকার করলো এবং মুসাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে চরম নাফরমানী করলো। অবশ্যই মুসা (আ.) তাকে প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেইভাবেই ফেরাউনের কাছে কথা পৌছে দিয়েছিলেন যেভাবে তাঁর মালিক তাকে হুকুম দিয়েছিলেন এবং যে পদ্ধতিতে জানাতে বলেছিলেন সেভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন ৷ কিন্তু আত্মম্ভরী ও দেমাগী হৃদয় থেকে নবীর যবানীতে তার রবের কথাগুলো ঠোকর খেয়ে ফিরে এলো । যার কারণে মুসা (আ.) তাকে এক মহা নিদর্শন দেখালেন। সে নিদর্শন হলো লাঠি ও শুভ্র সমুজ্জ্বল হাত, যার বিবরণ অন্যান্য স্থানে এসেছে কিন্তু, সে এসব কিছু অমান্য করলো ও স্পষ্ট নাফরমানী করলো। এভাবে অবজ্ঞাপূর্ণ অস্বীকৃতি ও নাফরমানীর সংক্ষেপে ও অল্প সময়ে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত বার্তা পৌছানোর দৃশ্যের ইতি টানা হলো। এরপর আসছে আর একটি দৃশ্য । মুসার কাছ থেকে ফেরাউনের মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য । যেখানে যাদু ও সত্যের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ফুটে উঠেছে এবং সে সময়ে সত্য ও সঠিক পথের কাছে নতি স্বীকার করতে সে বাধ্য হয়েছে। বলা হচ্ছে, তারপর পরাজিত মনোভাব নিয়ে দুরভিসন্ধির মানসে ওখান থেকে সে চলে গেছে। অতপর সে অসংখ্য লোকজনকে জড়ো করেছে এবং ঘোষণা করেছে- আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রব, প্রতিপালনকারী, আইনদাতা। এ আলোচনা প্রসংগে ওই মহা অহংকারী কাফেরটির দম্ভভরা উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং সংক্ষিপ্তভাবে তার ষড়যন্ত্রের বর্ণনা দেয়ার পর যাদুকরদের জড়ো করার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে- ‘আলবৎ, দুরভিসন্ধির মানসে সে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলো ও নানা প্রকার চেষ্টা চালালো ৷ এ অপচেষ্টায় সে যাদুকর ও জনতার এক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত করলো ৷’ এরপর আসছে ওই হঠকারী মূর্খ ব্যক্তির চরম লজ্জাকর দম্ভভরা উক্তি, ‘আমি তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রব, প্রতিপালক ৷’ এই দদ্ভোক্তি করলো সেই দাম্ভিক ও ধোকাবাজ ব্যক্তি, যে তার প্রজাদের অন্ধ আনুগত্যকে ব্যবহার করেছিলো । তবে এটা চিরসত্য যে, এ স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিরা বরাবরই নিসংগ ও একাকী থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে এদের নিজেদের কোনো শক্তি ও ক্ষমতাই থাকে না। যেহেতু প্রজারা হীনমন্যতায় ভোগে ও রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে উদাসীন থাকে। এই সুযোগে তারা ওদের পিঠে সওয়ার হয়ে তাদের মুখে লাগাম পরিয়ে তাদের ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে বেড়ায় । এই হীনমন্যতার কারণে তারা ওই দাম্ভিক রাজাদের সামনে মাথানত করে থাকে এবং ওই রাজারা তাদের ওপর প্রভৃত্ব চালিয়ে যায় ও তাদের মানসম্ভ্রম কেড়ে নিয়ে তাদেরকে অসহায় গোলামে পরিণত করে৷ অপরদিকে হত ভাগারা ভয় ও প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে এই করুণ অবস্থা বরণ করে নেয়। এই ভয়ের সূত্রপাত হয় এক অলীক কল্পনা থেকে ৷ অথচ এই ধরনের দাম্ভিক নরপতিরা এক একজন একক ব্যক্তি ছাড়া আর কোনোদিনই কিছু ছিলো না এবং হয়ও না। সে লাখ লাখ ব্যক্তি থেকে কখনোই শক্তিশালী হতে পারে না। হায়! সাধারণ জনগণ যদি মানবতা, আত্মস্ত্রম ও মানুষের গোলামী থেকে মুক্তির চেতনায় বলীয়ান হতো! হীনমন্যতা ও উদাসীনতার কারণেই বিশাল জনতার প্রত্যেক ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী শাসকদের হাতে বন্দীত্ব বরণ করে শক্তিহীন হয়ে পড়ে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ এক সাংঘাতিক প্রতারণা, যার মাধ্যমে জনগণের ওপর শাসকশ্রেণী প্রভৃত্ব কায়েম রাখার সুযোগ করে নেয়। কোনোদিন কোনো আত্মসম্ভ্রম বোধসম্পন্ন অথবা চেতনাশীল ব্যক্তি তার সামনে মাথা তুলতে সক্ষম হয় না। গোটা জাতির মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তিত্ববান লোক থাকে না যে, সে তার আসল মালিককে চিনতে পারে এবং তার ওপর ঈমান আনতে পারে। আসলে কোনো শাসক কোনো ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। ফেরাউনের প্রকৃত অবস্থা এটাই ছিলো যে, সে তার জাতিকে অজ্ঞতার অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন পেয়েছিলো । তারা চরম হীনমন্যতায় ভুগছিলো এবং আসল মালিকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছিলো না। এই কারণেই তারা এই পাপাচারী অহংকারী ব্যক্তির অহংকারপূর্ণ দাবীকে উপেক্ষা করতে পারেনি। সে বলেছিলো, আমিই তো তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রব। একথাটা কষ্মিনকালেও সে বলতে পারতো না যদি সচেতন আত্মসন্ত্রমশীল কোনো একদল ঈমানদার লোক সেখানে হাযির থাকতো । আর তখনই সে বুঝতে পারতো যে, আসলে সে কতো দুর্বল, কতো অক্ষম এবং কতো অসহায় । সে এতো দুর্বল যে, কোনো একটি মাছি তার থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নিলে সে জিনিসটি ফেরত নেয়ার মতো ক্ষমতা পর্যন্ত তার নেই । ওই নরাধম ব্যক্তি চরম ঘৃণা অহংকারের সাথে মূসা (আ.)-এর প্রতি যে নির্লজ্জ ব্যবহার করেছিলো তার পরিপ্রেক্ষিতে মহাশক্তিমান আল্লাহর শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠলো এবং এই কারণেই তিনি তাকে পাকড়াও করলেন শুধু আখেরাতের আযাবেই নয়- দুনিয়ার শাস্তিতেও। একটি শিক্ষনীয় ঘটনা : এখানে দুনিয়ার শাস্তির কথা বলার আগে আখেরাতের আযাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ আখেরাতের আযাব দুনিয়ার কষ্ট থেকে অনেক বেশী কঠিন ও অধিক দীর্ঘস্থায়ী । এটাই হচ্ছে ওই আসল শাস্তি যা বিদ্রোহী ও নাফরমানদের জন্যে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। তা যেমনি কঠিন তেমনি চিরস্থায়ী । এটাই হচ্ছে ওই আসল শাস্তি যা বিদ্রোহী ও নাফরমানদের জন্যে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। তা যেমনি কঠিন তেমনি চিরস্থায়ী । এই আলোচনা প্রসংগে আখেরাতের কথাটাই প্রধানত বলা হয়েছে এবং এটাই এখানকার মূল আলোচ্য বিষয়। এখানে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো অনুষ্ঠিতব্য প্রকৃত মূল ঘটনার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল । দুনিয়ার পাকড়াও নিসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন পাকড়াও হবে, কিন্তু, এ শাস্তি ও কষ্ট যতো কঠিনই হোক না কেন আখেরাতের শাস্তি তার থেকেও অনেক অনেক বেশী কঠিন ও ধ্বংসাত্মক ৷ ফেরাউন ছিলো একজন শক্তিশালী ও একচ্ছত্র অধিপতি ৷ সে ছিলো সম্ভ্রান্ত ও সদ্বংশজাত; কিছু এসব কিছু তার কোনো কাজেই লাগেনি। আলোচনায় আরো একটি শ্রেণীর কথা অস্বীকারকারীদের মধ্য থেকে যাদের এসব শক্তি ক্ষমতা ছিলো না ওই সকল মোশরেকদের কাছে দাওয়াত পৌছানোর পর যখন তারা তা কবুল করেনি তখন প্রশ্ন আসে যে, তাহলে কোন কারণে তারা সত্যকে অস্বীকার করলো এবং তাদের পরিণতিই বা কি হতে পারে! এসব চিন্তা জাগানোর উদ্দেশ্যে এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই সে অবস্থার মধ্যে এক বিরাট শিক্ষা রয়েছে তাদের জন্যে, যারা ভয় করে চলতে চায়।’ অতএব, যে মানুষ তার রবকে চেনে ও ভয় করে, সে অবশ্যই ফেরাউনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে । আর যে ব্যক্তির অন্তরে তার ভয় নেই, সে শিক্ষা নেয়ার ব্যাপারে অন্তরের মধ্যে এক প্রবল বাধা অনুভব করবে, কোনো উপদেশ তার কাজে লাগবে না। অবশেষে তার নির্ধারিত শেষ পরিণতি উপস্থিত হবে এবং আল্লাহ তায়ালা তখন তাকে আখেরাতের আযাবে পাকড়াও করবেন এবং দুনিয়ার শাস্তিতেও। এটা চির সত্য কথা যে, প্রত্যেক ভাগ্যখেলার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে এবং সত্যিকারে তারাই শিক্ষা নিতে পারে যারা আল্লাহকে ভয় করে। পৃথিবীর বলদর্পী, শক্তি মদোন্মত্ত ও অহংকারী ব্যক্তিদের ঘটনা পরিক্রমার পর একইভাবে ওই মোশরেকদের ইতিবৃত্ত আসছে, যারা নিজেদের শক্তির বড়াই করেছিলো!
সুরা: আন-নাযিআত
আয়াত নং :-৩৩
مَتَاعًا لَّكُمْ وَ لِاَنْعَامِكُمْؕ
জীবন যাপনের সামগ্রী হিসেবে তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুদের জন্য।
ফী জিলালিল কুরআন:
পুনরুজ্জীবনের যৌক্তিক বাস্তবতা : প্রকৃতির যে সকল জিনিসের মাধ্যমে মহা শক্তিমান আল্লাহ তায়ালার শক্তির প্রকাশ ঘটেছে, যার রহস্য আজও মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়নি, তার কোনো কোনোটির দিকে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, “তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করাটা কি বেশী কঠিন, না সুদূর নীল আসমানের সৃষ্টিটা বেশী কঠিন? এই আকাশকে তৈরী করার পর তিনি তার ছাদকে সুউচ্চে তুললেন এবং তাকে সুবিন্যস্ত করলেন (যেভাবে সাজালে তা সুন্দর হয় ও মানুষের জন্যে উপকারী হতে পারে সেইভাবে তাকে সাজালেন)। আর রাতকে করলেন অসন্ধকারাচ্ছন্ন এবং তার মধ্য থেকে সমুজ্জ্বল দিবাভাগের উন্মেষ ঘটালেন। এরপর (বিছানার মতো আরামদায়ক করে) যমীনকে বিছিয়ে দিলেন । বের করলেন তার থেকে পানি ও চারণভূমি এবং মযবুত পাহাড় পর্বতগুলোকে গেড়ে দিলেন তার মধ্যে । এগুলো তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর জন্যে ফায়দার জিনিস এবং তোমাদেরকে জীবন ধারণ সামগ্রী হিসেবে এগুলো দান করলেন যাতে করে তোমরা খুশী হতে পারো ।” এটা এমন একটি প্রশ্ন, যার একটিই মাত্র জবাব হতে পারে, যার মধ্যে দ্বিরুক্তি বা দ্বিমতের কোনো উপায়ই নেই৷ অবশ্যই আসমান সৃষ্টি বেশী কঠিন । এর মধ্যে কোনো দ্বিমত পোষণ করা বা বিতর্কের সুযোগ নেই। এখন এমন কে আছে, যে তোমাদেরকে এ কথা বলে ধোকা দেবে যে, আকাশ সৃষ্টির তুলনায় তোমাদের সৃষ্টি বেশী কঠিন এবং সৃষ্টিকর্তার তুলনায় তোমরাই বেশী শক্তিশালী? প্রশ্নের এ হলো একটি দিক, অপর দিক হচ্ছে, তোমাদেরকে একবার সৃষ্টি করার পর পুনরায় সৃষ্টি করাটা কি তার জন্যে বেশী কঠিন হয়ে গেলো! অথচ অনেক অনেক বেশী কঠিন আকাশ সৃষ্টি- তা যখন তিনি করতে পেরেছেন তখন পুনরায় সৃষ্টি করাটা তার জন্যে অবশ্যই অনেক সহজ কাজ, তা কেন তিনি পারবেন না? নিসন্দেহে আকাশ সৃষ্টি সব থেকে কঠিন কাজ, যা তিনিই করেছেন । আর একথা কি ঠিক নয় যে, যে কোনো ইমারত বানাতে হলে শক্তি ও সরঞ্জাম উভয়ের প্রয়োজন হয়। আকাশ সৃষ্টির জন্যে অনুরূপ মাল মশলা বা যোগাড়যন্ত্রের প্রয়োজন ছিলো বৈকি, যাতে এক অংশ অপর অংশকে মযবুতভাবে ধরে রাখতে পারে। এর তারকারাজি ও গ্রহ উপগ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। একটি অপরটির সাথে মিশতেও পারে না বা নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুতও হতে পারে না। একে তিনি উঁচুতে তুলেছেন এবং তাকে পূর্ণাংগ আকৃতি দিয়েছেন । এভাবে সবকিছুকে উঁচুতে তুলে তাদের অবস্থান ও পরস্পর সুসম্পর্কের ভিত্তিতে পরিভ্রমণের জন্যে তাদেরকে সুবিন্যস্ত করেছেন। খোলা চোখের সাধারণ দৃষ্টিতেও গ্রহ নক্ষত্রের এই সহযোগিতাপূর্ণ পরিভ্রমণ ধরা পড়ে৷ এই রহস্যপূর্ণ বিষয়টিই এই আয়াতের তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপাদ্য বিষয়। এই বিশাল সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু বিরাজ করছে এবং যা কিছু যোগ হচ্ছে তার অতি সামান্যই মানুষের জ্ঞানে ধরা পড়েছে। যেটুকু তারা জেনেছে তাতেই তারা হয়রান হয়ে গেছে, নিসাড় হয়ে গেছে। তাদের চেতনা অবরুদ্ধ হয়ে গেছে এবং এক ভয়ংকর আতংক তাদের পেয়ে বসেছে । সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এসব কর্মকান্ডের পেছনে যে যুক্তি বুদ্ধি কাজ করেছে তা নির্ণয় করতে মানুষ অক্ষম। অবশেষে মানুষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, এক মহান পরাশক্তি এসব কিছুর পরিকল্পনা করেছেন এবং তিনি নিজেই এসব কিছু পরিচালনা করেছেন এই পরম সত্যকে সে সকল মানুষও আজ মেনে নিয়েছে, যারা আদৌ কোনো ধর্ম মানে না। “তিনি এই রাতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন এবং আলোকোজ্জ্বল করেছেন এর প্রথম দিবাভাগকে ৷” এ আয়াতে যে আরবী শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার সুর ও অর্থের মধ্যে শক্তির ইংগিত পাওয়া যায়। যাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এসব কিছু এক মহা শক্তিমান সত্ত্বার কীর্তি । ‘আর ঢেকে দিয়েছেন (অন্ধকার দিয়ে) এর রাতকে’ ৷ অর্থাৎ রাতকে অন্ধকার করেছেন, আর দিন থেকে বের করেছেন তার আলো; অর্থাৎ দিনকে আলোকময় করেছেন, কিন্তু একটি অবস্থার সাথে আর একটি অবস্থার সম্পর্ক বুঝানোর জন্যে যে উপযুক্ত আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যায় আরও অনেক কথা জানা যায়, যেগুলো এ আলোচনার সংগে সংগতিপূর্ণ ৷ রাতের অন্ধকার ও তার পেছনে পেছনে দিনের আলো ফুটে ওঠা তো সবার সামনে আছে এবং এটা সবার বোধগম্য । একটির পর আর একটি আসছে এ জন্যে এ বিষয়ে তেমন কোনো গভীর চিন্তা আসতে চায় না। তাই কোরআন প্রতিটি হৃদয়ের তন্ত্রীতে এই আগমন ও প্রত্যাগমনের তাৎপর্য তুলে ধরেছে। চিন্তাশীল হৃদয়ে এ দৃশ্যাবলী প্রতিদিন চির নতুন এক মাধুর্য জাগায়। চেতনা তাজা হয়ে ওঠে এবং নতুন কর্মোদ্দীপনায় সজীব হয় । এই আবর্তনের ওপর প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়ন্ত্রণ এতো সংক্ষিপ্ত ও অত্যাশ্চর্য যে, এ বিষয়ে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির সাথে সাথে হৃদয়ও মুগ্ধ আবেগে বিগলিত হয় । ‘এরপর তিনি যমীনকে বিছিয়ে দিয়েছেন, বের করেছেন এর থেকে পানি ও তৃণগুল্মলতায় ভরা চারণভূমি। আর তার পরে পাহাড় পর্বতকে (মযবুত করে) গেড়ে দিয়েছেন।’ যমীনকে বিছিয়ে দেয়া বলতে বুঝায় এর উপরিভাগকে সমতল করে দেয়া । যাতে করে এর উপরে চলাচল করা সহজ ও আরামদায়ক হয় আর যমীন সমান্তরাল হলে তা শাক সবজি ও তরিতরকারি উৎপাদনে ও ফসল চাষের উপযোগী হয়। অপরদিকে পাহাড় পর্বতকে গেড়ে দেয়ার দ্বারা এটা বুঝা যায় যে, মানুষের বাসোপযোগী করে পৃথিবীকে সাজানোর পর এর মধ্যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা দান করা হয়েছে, যাতে করে আল্লাহর বান্দারা আরামে জীবন ধারণ ও বসবাস করতে পারে। এরপর এই অবস্থার স্থিতিশীলতাকে টিকিয়ে রাখার মানসে প্রয়োজনমতো ছোটো বড়ো পাহাড় শ্রেণী গোটা পৃথিবীকে কোমরবন্ধের মতো বেঁধে রেখেছে। এগুলো থেকে বের করা হয়েছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা, যার থেকে মানুষ ও গবাদি পশু তৃপ্তি সহকারে পান করে, ফসল ফলায় এবং নদ নদী প্রবাহিত হয়ে ভরে দেয় আবাদী ভূমিতে সবুজ শ্যামল গাছপালা ও তরুলতায়। পর্বতমালার উপরিভাগ থেকে নেমে আসে যে প্রস্রবণ, তার প্রবাহ থেকে বাষ্পীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি হয় এবং যার থেকে বৃষ্টি আকারে পানি নেমে এসে এক বিশেষ মাপ মতো মানুষকে তৃপ্তিদান করে। তৃণলতা, গুল্ম, ফলমূল এবং তরিতরকারি উৎপন্ন করে ও এর চারণভূমিকে সুশোভিত করে । এর দ্বারা বিভিন্নভাবে মানুষ ও গবাদিপশু উপকৃত হয় এবং অন্যান্য জীব জন্তু কখনও সরাসরি এর থেকে খাদ্য পায় আবার কখনও অন্যের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মেটায় । এসব কিছুর ব্যবস্থা হয়েছে আকাশ সৃষ্টি, রাতের অন্ধকার নেমে আসা এবং দিনের আলোর আগমনের ওপর । জ্যোতির্বিদ্যার আবিষ্কৃত অতি সাম্প্রতিক তত্ত্ব ও তথ্য কোরআনের এ বর্ণনাকে সমর্থন করে জানিয়েছে যে, পৃথিবী সমতল ও বিস্তৃত হওয়ার পূর্বে এর রাত ও দিনসহ কোটি কোটি বছর ধরে এটা তার কক্ষপথে আবর্তন করছিলো। তারপর এক সময়ে এ পৃথিবীকে গাছপালা জন্মানোর উপযোগী তাপমাত্রায় নামিয়ে আনা হয় কিন্তু তখনও পৃথিবী বর্তমানের আকৃতি লাভ করেনি এবং এতে পাহাড় পর্বত, উপত্যকা ও সমভূমির উৎপত্তি হয়নি। কোরআন ঘোষণা করছে যে, এসব উৎপত্তি তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ফায়দার জন্যে । এই বর্ণনা দ্বারা মানুষকে স্মরণ করানো হচ্ছে যে, তার জীবনধারণ ও প্রয়োজন মেটানোর জন্যে আল্লাহর পরিকল্পনা কতো পূর্ণাংগ ও কতো ব্যাপক । আকাশের এই আকৃতি লাভ হঠাৎ করে হয়ে যায়নি, প্রয়োজনীয় সকল উপকরণে ভরা সাজানো গোছানো এই পৃথিবী কোনো আকষ্মিক ঘটনা নয়। খলীফা হিসেবে মানুষের অস্তিত্বের ব্যাপারটিকে সামনে রেখেই সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেকগুলো উপায় উপাদানের ওপর মানুষের অস্তিত্ব ও অগ্রগতি নির্ভর করে যা সাধারণভাবে বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে বিরাজ করে আর বিশেষভাবে তা নির্ভর করে সৌরজগতের আবর্তনের ওপর । আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে হয় তা নির্ভর করে পৃথিবীর নিজস্ব অবস্থার ওপর ৷ অবশ্য এককভাবে এর কোনোটাই ক্রিয়াশীল নয়। এগুলোর সবকিছু পারস্পরিক পূর্ণ সহযোগিতা ও সহকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর গৃহিত পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ বিষয়ে কোরআনের বর্ণনাভংগী হচ্ছে সংক্ষিপ্ত ও মূল সত্যকে বুঝার লক্ষ্যে ইংগিতবাহী ও বিভিন্ন জিনিসের উদাহরণ দ্বারা বোধোদয়ের জন্যে এক কার্যকর প্রচেষ্টা । এই লক্ষ্যে আকাশের নির্মাণশেলী, রাতকে ঢেকে ফেলার বিবরণ, দিনের আলোর প্রকাশ, পৃথিবীর বিস্তার দান, তার থেকে পানি ও তৃণভূমির উন্মেষ এবং পবর্তমালাকে মযবুতভাবে প্রোথিত করার দৃষ্টান্তগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব কিছু মানুষ ও গবাদিপশুর ফায়দার জন্যে । এ বর্ণনার মাধ্যমে বিশ্বের অনেক কিছুর এমন বিশদ পরিকল্পনা জানা যায়, যা সবাই বুঝতে পারে। সারা বিশ্বের সবকিছুর মধ্য দিয়ে এমন অনেক কিছুর বহিপ্রকাশ ঘটছে যা বুঝার জন্যে বিশেষ কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের পরিচিত বুদ্ধিগ্রাহ্য এই তথ্যাদি অতি প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে, যাতে করে সব যামানার সব এলাকার লোক তা সহজে বুঝতে পারে! এই সহজ সরল মহাসত্য জিনিসগুলোর বাইরে আরও অনেক জিনিস আছে যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য । তা হচ্ছে এ বিশ্ব সৃষ্টি কোনো আকস্মিক ঘটনার পরিণতি হতে পারে না। সবকিছুর আশ্চর্যজনক সম্মিলনের মাঝে একই সুরের-ঝংকার কোনো আকশ্মিক ঘটনা হতে পারে না। সবকিছুর মধ্যে পারস্পরিক মিল, অবিচ্ছেদ্য ও একসাথে চলার অভ্যাস বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা থেকেই শুরু হয়েছে এবং তা সৌরজগত থেকে নিয়ে কোটি কোটি নক্ষত্রমন্ডলীর সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত ৷ নক্ষত্রমন্ডলী ও সৌরমন্ডল এবং সবগুলোর মধ্যে পৃথিবী এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে যাকে মানুষের বসবাস ও জীবন ধারণোপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রকৃতির অধিকারী দ্বিতীয় আর কোনো গ্রহ এমন নেই, যেখানে মানুষ নিশ্বাস ফেলতে পারে এবং সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারে। আজ পর্যন্ত মানুষ অনুরূপ কোনো গ্রহের সন্ধান পায়নি হা, এটিই একমাত্র গ্রহ যা মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ উপযোগী ৷ এ গ্রহটিকেই একমাত্র এমন উপকরণ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে যার মধ্যে মানুষেরা বেঁচে থাকার মতো উপায় উপাদান খুঁজে পায় এবং যার মধ্যে মানুষের বংশধারা বৃদ্ধি ও বিস্তার সম্ভব৷ প্রতিটি আয়তনসম্পন্ন সৃষ্টির বাস করার জন্যে উপযোগী জায়গা প্রয়োজন । যে কোনো গ্রহে মানুষ বাস করতে পারে যদি সেখানে তার বাস করার মতো উপযোগী কিছু ব্যবস্থা থাকে । (ইদানীং অবশ্য চাঁদ ও মংগলগ্রহে পানির অস্তিত্ব রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা কিছু প্রমানাদী পেয়েছেন । কে জানে ভবিষ্যতে হয়তো অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহেও পানির অস্তিত্ব আবিস্কৃত হবে, আর পানির সাথে যেহেতু জীবনের সম্পর্ক রয়েছে তাই অন্য কোথাও যদি. জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় তাতেও আশ্চর্য্যান্বিত হবার কিছু থাকবে না। আল্লাহ তায়ালার কুদরত অনস্ত অসীম ।-সম্পাদক ) যেমন মহাশূন্যে তারার চতুম্পার্শে যে গ্রহগুলো থাকে সেগুলোকে ওই তারকারা নিজ নিজ আকর্ষণে নিজেদের দিকে টেনে রাখে যাতে করে সেগুলো ছিটকে অন্যত্র চলে না যায়। এই নির্দিষ্ট জ্যোতিষ্ক থেকে পরিমাপ মতো এক নির্দিষ্ট দূরত্বে পৃথিবীর অবস্থান! বেশী কাছে থাকলে তা গলে যাবে, আর বেশী দূরে চলে গেলে জমে তা বরফ হয়ে যাবে, যেখানে কোনো প্রাণীর পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আবার সেখানে এমন কিছু উপাদান থাকতে হবে যা খেয়ে এবং ব্যবহার করে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে। আবার এ গ্রহের অবস্থানটাও এমন হতে হবে যে এই শর্তগুলোর সব কটা তার মধ্যে বর্তমান থাকবে। কারণ জীবনধারনের জন্যে ওইসব এক সাথে প্রয়োজন। এগুলো ছাড়া মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব বলে আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। এ শর্তগুলোর সব ক’টি একমাত্র পৃথিবীর মধ্যেই বর্তমান আছে। এই মহাবিশ্বের বিস্তারিত নির্মাণ পরিকল্পনা তৈরী করা এবং এর মধ্যে মানুষকে বিশেষ মর্যাদা দান করা এমন একটি বিষয় যা হৃদয় ও স্বাভাবিক বুদ্ধিবুদ্ধিকে আখেরাত সংঘটিত হওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে জানায় এবং হিসাব গ্রহণ করে প্রতিদান দেয়া সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করে ও প্রশান্ত মনে তা মেনে নিতেও উদ্বুদ্ধ করে। বিশ্ব সৃষ্টি ও মানব সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে যদি কেউ এমন উদ্ভট চিন্তা করে যে, কোনোদিন এর পরিসমাপ্তি ঘটবে না, ভালোমন্দ যে যাই-ই করুক, তার কোনো প্রতিদান দেয়া হবে না, অহংকারী ও অন্যায়কারী যুলুমবাজ লোকেরা অবলীলাক্রমে নাজাত পেয়ে যাবে এবং নেক, ইনসাফকারী ও হক পথের পথিকরা কোনো প্রতিদান পাবে না, নশ্বর এ ধরার বুকে মানুষের সংক্ষিপ্ত জীবনের মধ্যে সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটে যাবে, তাহলে তা হবে অনুমান প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে বিরাজমান নিয়মনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী । এই কারণে আলোচ্য সূরার এই অংশে যে সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে তা আখেরাতের বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করার জন্যে অন্তর ও বুদ্ধিতে বিপুল পরিমাণে সাড়া জাগায়।
সুরা: আন-নাযিআত
আয়াত নং :-৩৯
فَاِنَّ الْجَحِیْمَ هِیَ الْمَاْوٰىؕ
জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা।
ফী জিলালিল কুরআন:
কেয়ামতের খন্ডচিত্র : আলোচনার শেষাংশে মহাপ্রলয় কখন কোথায় ঘটবে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে- ‘তারপর যখন সেই মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে সেই দিন মানুষ স্মরণ করবে তার কৃতকর্মকে এবং সেদিন জাহান্নাযকে এমনভাবে তার সামনে তুলে ধরা হবে যে, সে তা নিজ চোখে দেখতে পাবে। অতএব, যে বিদ্রোহ করেছে এবং দুনিয়ার জীবনকে বড়ো করে দেখেছে, নিশ্চয়ই জাহান্নাম হবে তার ঠিকানা এবং যে তার রবের সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে বলে ভয় করেছে এবং মনকে তার স্বাধীন ওইচ্ছামত চলা থেকে বিরত রেখেছে নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার ঠিকানা।’ অবশ্যই দুনিয়ার জীবন এক আনন্দময় অবস্থা এবং আরামদায়ক জীবন যা সংক্ষিপ্ত এবং এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত মানুষকে দেয়া হয়েছে৷ মহাবিশ্ব ও মানব জীবনের সাথে সঙ্গতি রেখে সৃষ্টির যে মহা পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছে সেই অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের স্থিতিকাল নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু এটা এক মজার জীবন, যা এক নির্দিষ্ট সময় শেষে খতম হয়ে যাবে। তারপর যখন সেই মহাপ্রলয় আসবে, তখন তা সব কিছুকে লন্ডভন্ড করে দেবে এবং সব কিছুকে হতবুদ্ধি করে দেবে, পরিসমাপ্তি ঘটবে সীমাবদ্ধ আনন্দ অভিলাযের ৷ দুনিয়ার চলমান জীবনের এই গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে। সমগ্র বিশ্ব, এর মযবুত আকাশ, প্রশস্ত পৃথিবী, দৃঢ়ভাবে প্রোথিত পর্বতমালা, জীবন্ত প্রাণী এবং সকল জীবজগত ও জড় পদার্থ সব কিছু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বে এবং দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকবে । এটা হবে সকল বিপদের বড়ো বিপদ । এই সময়ে মানুষ স্মরণ করবে তার অতীত জীবনের সকল কৃতকর্মকে । মানব জীবনে করা সকল কাজকর্মের সংরক্ষিত রেকর্ড সে সামনে দেখতে পাবে, যেগুলোকে সে জীবদ্দশায় সুখ-শান্তিতে মেতে থাকাকালে খেয়াল করতে পারেনি এবং ভোগবিলাসের দ্রব্যসামগ্রী এই দিনের স্মরণ থেকে তাকে ভুলিয়ে রেখেছিলো । কিন্তু সময় হারিয়ে এই স্মরণ সেদিন আর কোনো কাজে লাগবে না। শুধু দুঃখ ও আফসোস এবং কোন আযাব ও বিপদ সামনে রয়েছে সেই চিন্তাই তার গোটা সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে । সেদিন বাস্তবে প্রকাশ করা হবে। জাহান্নামকে সেই ব্যক্তির সামনে এবং সে তা স্বচক্ষে দেখতে পাবে। সেদিন জাহান্নাম উন্মুক্ত হয়ে সকল চোখওয়ালাদের সামনে হাযির হয়ে যাবে। ‘বুররিঝাত’ শব্দটি এক বিশেষ শক্তিপূর্ণ শব্দ অর্থাৎ শব্দটি যেন কঠিন এক দৃশ্য তুলে ধরে। অর্থাৎ এ শব্দটি শোনার সাথে সাথে যেন এক কঠিন অবস্থা সামনে ভেসে উঠতে চায়, তেমনই শব্দটির সুরের মধ্যে কঠোরতার এক ঝংকার ফুটে ওঠে । পরিণতি ও গম্তব্যস্থল বিভিন্ন হওয়ার কারণে সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির পূর্ব জীবনের মূল লক্ষ্য সেদিন সব প্রকাশ হয়ে পড়বে । সুতরাং যে বিদ্রোহ করেছিলো ও দুনিয়ার জীবনকে বড়ো করে দেখেছিলো তার জন্যে জাহান্নামই হবে ঠিকানা চিরস্থায়ী আবাসস্থল ৷ ‘তুগইয়ান’ (বিদ্রোহ বা সীমালংঘন) বলতে ওই ব্যক্তির কাজকে বুঝায় যে সত্য ও সঠিক পথ থেকে সরে দীড়ায় ৷ রাজা বাদশাহ বা স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতাদপী দাপট থেকে বিদ্রোহী শব্দটির মধ্যে আরও কঠিন অর্থ বুঝা যায়। এতে সত্য সঠিক পথকে সর্বতোভাবে পরিহার করা বুঝায়, আর বিদ্রোহী বলতে বুঝায় প্রত্যেক ওই ব্যক্তিকে যে দুনিয়ার জীবনকে অধিক গুরুত্ব দেয়। সে আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়াকেই গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী ধন সম্পদ অর্জনে আমরণ চেষ্টা সাধনা করে চলে ৷ এ ধরনের লোকেরা আখেরাতের ভালোমন্দের কোনো পরোয়াই করে না, আর আখেরাতের গুরুত্বের অর্থ হচ্ছে মানুষের নিজ যুক্তি বুদ্ধি ও বিবেক অনুসারে প্রতিটি জিনিসের মূল্যায়ন, সুতরাং যে আখেরাতের হিসেবকে উপেক্ষা করবে অথবা তার ওপর দুনিয়ার জীবনকে বড়ো করে দেখে, সে নিজ হাতে জীবনের সঠিক মূল্যবোধকে গলা টিপে হত্যা করে। সে প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান বোধশক্তি ও সঠিকভাবে জীবন পরিচালনার নিয়মনীতিকে উপক্ষো করলো এবং সে অহংকারী বিদ্রোহী ও সীমালংঘনকারী হয়ে গেলো। এমন ব্যক্তির জন্যে জাহান্নামই হবে শেষ পরিণতি অর্থাৎ উন্মুক্ত জাহান্নাম যা তার সর্বগ্রাসী ভয়াল মূর্তি নিয়ে দ্রুতগতিতে ওই বিদ্রোহীর কাছে এসে যাবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে হাযির হতে হবে বলে ভয় করেছে এবং মনকে তার লাগামছাড়া চাহিদা মেটানো থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে, নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা চিরকালীন বাসস্থান ।
ফী জিলালিল কুরআন: পাপ থেকে বাঁচার উপায় : আসলে আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়ার চিন্তা যার মধ্যে আছে এবং যার মনে আল্লাহর ভয় আছে সে গুনাহের কাজে অগ্রসর হতে পারে না। কোনো সময়ে মানবীয় দুর্বলতার কারণে অগ্রসর হলেও আল্লাহ্ তায়ালার ভয় তাকে অনুতপ্ত হতে, এস্তেগফার ও তাওবা করতে উদ্বুদ্ধ করে! যার কারণে সে আনুগত্যের গন্ডির মধ্যে পুনরায় ফিরে আসে ৷ নফসের খাহেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই হচ্ছে আনুগত্যের বৃত্তের মধ্যে মূল কেন্দ্রবিন্দু ৷ কৃপ্রবৃত্তি বা লাগামছাড়া চাহিদা হচ্ছে যে কোনো অন্যায়, বিদ্রোহাত্মক কাজ ও সীমালংঘনের প্রধান কারণ । এটাই সব সর্বনাশের মূল ও যাবতীয় অন্যায়ের উৎস। যে কোনো অন্যায় কাজে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে মানুষের অন্তরে এর জন্যে প্রবল একটা চাহিদা সৃষ্টি হয় । এরপর অজ্ঞতা ও ভুলে যাওয়ার স্বভাব (যা অনেকের মধ্যে বর্তমান আছে) ওই চাহিদারূপ ব্যধি নিরাময়ে সহায়তা করে অথবা নিজের অজানা অবস্থায় কোনো দিকে মন ঝুঁকে পড়লে তাকে ফেরানো যায়; কিন্তু জেনে বুঝে কেউ কোনো অন্যায়ের প্রতি ধাবিত হলে সেটা যে কোনো ব্যক্তির জন্যে এমন এক বিপদ হয়ে দাড়ায় যে, তা সংশোধন করা বড়োই কঠিন ৷ অপরাধ থেকে ফিরে আসার জন্যে তাকে দীর্ঘ সময় ধরে কঠিন চেষ্টা সাধনার প্রয়োজন হয় । আল্লাহ্ তায়ালার ভয় নফসের কঠিন খাহেশকে দমন করার জন্যে এক মযবুত ঢাল বা বর্ম হিসেবে কাজ করে। এই আল্লাহভীতি ব্যতীত অন্য কোনো জিনিস কদাচিত মানুষকে নফসের বাধনছাড়া চাহিদাকে রুখতে পারে । এই জন্যেই আল্লাহ তায়ালা একই আয়াতে দুটি অবস্থার আকর্ষণ ও পরিণতি সম্পর্কে জানিয়েছেন । যিনি এ বিষয়ে কথা বলছেন তিনি মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা । তিনিই মন (নফস)কে সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি ভালো করেই জানেন মনের এ ব্যধি সম্পর্কে এবং এর কার্যকর ওষুধ তারই জানা আছে । এ ব্যাধি কোন গোপন পথে অনুপ্রবেশ করে, সে তো একমাত্র তারই জানার কথা এবং কোনভাবে তাকে প্রতিরোধ করা যাবে তাও তিনিই ভাল জানেন। মহান আল্লাহ, তায়ালা এতো নিষ্ঠুর নন যে, মনের মধ্যে কোনো মন্দ ভাবের উদয় হবে আর অমনি তিনি তাকে দায়ী করবেন ও পাকড়াও করবেন । কারণ তিনি তো নিজেই জানেন যে, এটা মানুষের এক স্বাভাবিক প্রবণতা ৷ একে নির্মূল করা তার সাধ্যের বাইরে এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছেন একে নিয়ন্ত্রণ করতে, দমন করতে এবং লাগাম কষতে আর আল্লাহর ভয় মনের মধ্যে রেখে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে ৷ এ ভয় পয়দা হবে সর্বশক্তিমান ও জাব্বার কাহহার আল্লাহ্র দরবারে একদিন হাযির হতে হবে এই অনুভূতি থেকে । তার নির্দেশের জন্যে তাকে নিজ নফসের বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধে নামতে হবে, যার বিনিময়ে সে চিরস্থায়ী জান্নাত পাবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই জান্নাত হবে তার ঠিকানা।’ এই আশ্বাসবাণী এ জন্যেই আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে যে, তিনি জানেন যে এ সংগ্রাম কতো কঠিন। তাই সভ্য, ভদ্র ও মযবুত হৃদয়ের এই সকল ব্যক্তিকে তিনি অত্যন্ত উঁচু মর্যাদায় সমাসীন করবেন । হা, প্রকৃতপক্ষে সেই-ই মানুষ যে এইভাবে মনকে দমন করেছে, এইভাবে সার্বক্ষণিক জেহাদে লিপ্ত হয়েছে এবং এভাবে নিজের মর্যাদাকে উঁচুতে তুলেছে। সে তো মানুষই নয়, যে তার নফসকে তার খুশীমত চলার জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। একটা সহজাত চাহিদা ও তুচ্ছ আকর্ষণের বস্তু লাভের জন্যে তার কূপ্রবৃত্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে। নিসন্দেহে এটা সত্য যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যেমন আবেগ-অনুভূতি ও বিশেষ বিশেষ চাহিদা দিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিজেকে শৃংখলায় রাখার মতো মানসিক শক্তি, আর যখন সে এই শক্তির সদব্যবহার করে এবং নফসের সাথে নিরন্তর সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে মানবতার উচ্চতম শিখরে সদব্যবহার করে এবং নফসের সাথে নিরন্তর সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে মানবতার উচ্চতম শিখরে নিজেকে উন্নীত করে, তখন তার জন্যে বিনিময় হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছেন চিরস্থায়ী বাসস্থান জান্নাত । মানুষকে দু’টি বিষয়ের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহর তরফ থেকে তাকে প্রদত্ত সম্মানের এক সমুজ্জ্বল প্রতীক ৷ তার একটি হলো নফসের খাহেশ ও লোভ লালসাকে দমন করার ক্ষমতা, যার মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছে নিজের মান মর্যাদা উন্নীত করে। যখন সে নিজের কূপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হয় তখন সে দেখতে পায় যে সীমাহীন চাহিদা ও লোভ-লালসা তাকে আর পীড়া দিতে পারছে না বরং এক নিয়ন্ত্রিত ও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে তার চাহিদাগুলোকে সে কাজে লাগাতে পারবে। এটাই তো প্রকৃতপক্ষে তার স্বাধীনতার দাবী । অপরদিকে নফসের চাহিদার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, মন যা চায় তাই-ই করতে থাকা এটাই পাশবিক চাহিদা, এটাই তথাকথিত স্বাধীনতা এখানে এসেই সে নফসের কাছে পরাভূত হয় এবং নফসের খাহেশের দাসত্ব করতে গিয়ে তার মানবতার হয় চরম পরাজয় । এ স্বাধীনতা প্রকৃত ক্ষমতা নয়। হতে পারে না এটা সত্যিকারে কোনো ক্ষমতা বরং ক্ষমতার নামে এটা হচ্ছে মানবতার চরম গ্লানি । এর দ্বারা মনুষ্যত্ব থেকে সে অনেক দূরে চলে যায়। আল্লাহর কাছে যারা সম্মানিত : আল্লাহর কাছে তারাই প্রথম শ্রেণীর মানুষ যারা নিজেদের মর্যাদা উন্নত করেছে এবং পরবর্তী কালের স্থায়ী বসবাসের স্থান জান্নাতের সুন্দর ও মধুময় জীবনের জনো প্রস্তুত করেছে। অপরদিকে সেখানে পাপিষ্ঠরা বঞ্চিত হবে এবং তাদেরকে নিক্ষেপ করা হবে এমন স্থানে যেখানে লেলিহান আগুনকে সারাক্ষণ প্রজ্জ্বলিত রাখা হবে । তার জ্বালানি হবে এই পাপাচারী শ্রেণীর মানুষ এবং পাথর। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উভয় শ্রেণীর জন্যে এটিই হচ্ছে স্বাভাবিক পরিণতি, যার ভিত্তিতে প্রত্যেককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া যায়।
সুরা: আন-নাযিআত
আয়াত নং :-৪৬
كَاَنَّهُمْ یَوْمَ یَرَوْنَهَا لَمْ یَلْبَثُوْۤا اِلَّا عَشِیَّةً اَوْ ضُحٰىهَا۠
যেদিন এরা তা দেখে নেবে সেদিন এরা অনুভব করবে যেন (এরা দুনিয়ায় অথবা মৃত অবস্থায়) একদিন বিকালে বা সকালে অবস্থান করেছে মাত্র।
ফী জিলালিল কুরআন:
অবশেষে সূরাটির পরিসমাপ্তিতে যে বর্ণনা এসেছে তাতে এক তীব্র ভীতিজনক অনুভূতি পয়দা হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা তোমাকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে, (বলছে) কবে তা সংঘটিত হবে? এর সংঘটিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? এর জ্ঞান তো একমাত্র তোমার প্রতিপালকের জ্ঞানভান্ডারে সীমাবদ্ধ (অর্থাৎ একমাত্র তিনি ব্যতীত আর কেউ সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না)। তুমি তো শুধুমাত্র সতর্ককারী সে ব্যক্তির জন্যে, যে একে ভয় করে। যখন তারা ওই (কেয়ামতের) অবস্থা স্বচক্ষে দেখবে, তখন তাদের কাছে মনে হবে যে (পৃথিবীর বুকে) একটি মাত্র সন্ধ্যা অথবা একটি মাত্র সকাল তারা কাটিয়েছে। যতোবারই এই কঠিন হৃদয়ের মোশরেকরা কেয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্যের কথা ও বিবরণ জেনেছে এবং হিসাব গ্রহণ করার পর তাদের পুরস্কার বা শাস্তির সতর্কবাণীর কথা শুনেছে ততোবারই তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে এর নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে। (বলছে), ‘কখন এটা সংঘটিত হবে?’ জবাবে বলা হয়েছে, ওই বিষয় বলার সাথে তোমার কী সম্পর্ক অর্থাৎ বিষয়টি জানানো তো তোমার কাজ নয়। অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাবে ও সম্ভ্রমের সাথে জবাব দেয়া হয়েছে। এভাবে জবাব দেয়ার কারণে বুঝা যাচ্ছে যে, কেয়ামতের ওই মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জানতে চাওয়া এক চরম বেওকুফী এবং দুঃখজনক ব্যাপার । একমাত্র নির্বোধ লোকেরাই এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারে। মহানবী (স.)-কেই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, ওই সুনির্দিষ্ট সময়ের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? কেয়ামতের ব্যাপারটা তো এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, তোমার পক্ষে বা অন্য কারো পক্ষে তার সুনির্দিষ্ট সময় জানতে চাওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারটি শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন, আর কারো জ্ঞানের পরিধির মধ্যে এটা আসা সম্ভব নয়। এই বিষয়ের চূড়ান্ত জ্ঞান তো তোমার রব আল্লাহর কাছেই রয়েছে৷ তিনি নিজেই সবকিছুর মালিক ৷ নবী করীম(স.)-এর দায়িত্ব কর্তব্যের সীমারেখা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, এই সীমা অতিক্রম করা তার উচিত নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই । এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমার দায়িত্ব শুধু তাদেরকে সতর্ক করা, যারা একে ভয় করে।’ তাদেরকেই তার সতর্ক করতে হবে যারা এ সতর্কীকরণকে ভালো মনে গ্রহণ করে এবং উপকৃত হয়। এই সকল ব্যক্তিই কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাকে সত্য বলে বুঝবে এবং এর পরণতিকে ভয় করব ৷ তারাই নির্দিষ্ট সময়ে এব আগমন অবশ্যম্ভাবী বলে বিশ্বাস করবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করবে। মানুষের সুক্ষ অনুভূতিতে কিয়ামতের বর্ণনা এসেছে তাতে এক তীব্র ভীতিজনক অনুভূতি পয়দা হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা তোমাকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে, (বলছে) কবে তা সংঘটিত হবে? এর সংঘটিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? এর জ্ঞান তো একমাত্র তোমার প্রতিপালকের জ্ঞানভান্ডারে সীমাবদ্ধ (অর্থাৎ একমাত্র তিনি ব্যতীত আর কেউ সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না)। তুমি তো শুধুমাত্র সতর্ককারী সে ব্যক্তির জন্যে, যে একে ভয় করে। যখন তারা ওই (কেয়ামতের) অবস্থা স্বচক্ষে দেখবে, তখন তাদের কাছে মনে হবে যে (পৃথিবীর বুকে) একটি মাত্র সন্ধ্যা অথবা একটি মাত্র সকাল তারা কাটিয়েছিলো। ওই দিনের ভয়ানক দৃশ্য মানুষের অন্তরকে এমনভাবে হতবিহ্বল করে ফেলবে যে, পার্থিব জীবনের সকল আনন্দ অভিলাষ ও সুখসম্পদের ভোগবিলাস সব কিছু মনে হবে যেন একটিমাত্র সন্ধ্যা বা একটিমাত্র সকালের স্থিতিকাল ৷ জগতের শত শত বছরের উত্থান পতন ও বিবর্তন সবই এক সকাল সন্ধ্যার সময়কাল থেকে বেশী সেদিন মনে হবে না। সবকিছুই যেন সংকুচিত হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি কাটাকাটি করে একে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, মানুষকে কষ্ট দিয়ে এবং নানাপ্রকার অপরাধ করে যে আরামের জীবন সে গড়তে চেয়েছিলো, তার সবকিছু সেদিন অতি তুচ্ছ বিষয় হয়ে যাবে । আজ, তাই তাকে স্মরণ করানো হচ্ছে, সাবধান হয়ে যাও, সময় থাকতেই সতর্ক হও এবং অবশ্যম্ভাবী সেই মহা ভয়ংকর দিনের জন্যে উপযুক্ত পাথেয় সঞ্চয় করো ৷ দুনিয়ার এই ক্ষয়িষ্ণু ভোগ বিলাসের জন্যে আখেরাতের ওই চিরস্থায়ী আবাসস্থলকে যদি বিঘ্নিত করো তাহলে এর মতো বেওকূফী ও ধৃষ্টতা আর কিছুই হবে না। নবীর মুখনিসৃত বাণীর প্রতি খেয়াল করো, চিন্তা-ভাবনা করো এবং সময় থাকতেই বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আখেরাতের যেন্দেগীর প্রাপ্যকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করো, তবেই তুমি আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানী লাভে ধন্য হবে বলে আশা করা যেতে পারে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-১৪ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে ফেরেশতাদের কথা বলা হয়েছে যারা কোন কোন মানুষের রূহ কঠিনভাবে টেনে বের করেন এবং কারো কারো রূহ এমন সহজভাবে ক্য করেন যে, যেন একটা বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। কাফিরদের রূহ টেনে হিচড়ে বের করে নেয়া হয়, তারপর জাহান্নামে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এটা মৃত্যুর সময়ের আলোচনা। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, দ্বারা মৃত্যু উদ্দেশ্য। হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) দ্বারা নক্ষত্ররাজিকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা কঠিনভাবে সংগ্রামকারীকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রথমটিই সঠিক উক্তি। অর্থাৎ এর দ্বারা রূহ বেরকারী ফেরেশতাগণ উদ্দেশ্য। অনুরূপভাবে তৃতীয় আয়াত সম্পর্কেও এই তিনটি তাফসীর বর্ণিত আছে। অর্থাৎ ফেরেশতা, মৃত্যু ও নক্ষত্র। হযরত আতা (রঃ) বলেন যে, এখানে নৌকা উদ্দেশ্য।
(আরবি) শব্দের তাফসীরেও এই তিনটি উক্তি রয়েছে। অর্থ হচ্ছে ঈমান ও তাসদীকের দিকে অগ্রগামী। আতা (রঃ) বলেন যে, মুজাহিদদের ঘোড়াকে বুঝানো হয়েছে।
(আরবি) (অতঃপর যারা সকল কর্ম নির্বাহ করে)। এর দ্বারা ও ফেরেশতামলী উদ্দেশ্য। এটা হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত আতা (রঃ), হযরত আবু সালেহ (রঃ), হযরত হাসান (রঃ), হযরত কাতাদাহ (রঃ), হযরত রাবী ইবনে আনাস (রঃ) এবং হযরত সুদীর (রঃ) উক্তি। হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, যে ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশক্রমে আকাশ হতে পৃথিবী পর্যন্ত সর্বত্র কর্ম নির্বাহকারী। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এই উক্তিগুলোর মধ্যে কোন ফায়সালা করেননি।
“সেই দিন প্রথম শিংঙ্গাধ্বনি প্রকম্পিত করবে ও ওকে অনুসরণ করবে পরবর্তী শিঙ্গাধ্বনি’ এটা দ্বারা দুটো শিঙ্গাধ্বনি উদ্দেশ্য। প্রথম শিঙ্গার বর্ণনা (আরবি) (যেই দিন যমীন ও পাহাড় প্রকম্পিত হবে) এই আয়াতে রয়েছে আর দ্বিতীয় শিংগার বর্ণনা রয়েছে নিম্নের আয়াতেঃ (আরবি) অর্থাৎ “পবর্তমালাসহ পৃথিবী উৎক্ষিপ্ত হবে এবং একই ধাক্কায় ওগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।” (৬৯:১৪)
হযরত কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রথম প্রকম্পিতকারী আসবে এবং ওকে অনুসরণ করবে পরবর্তী প্রকম্পিতকারী। অর্থাৎ মৃত্যু স্বসঙ্গীয় সমস্ত বিপদ আপদ নিয়ে আসবে।” একটি লোক জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি যদি আমার অযীফা পাঠের সারাক্ষণ আপনার উপর দুরূদ পাঠ করতে থাকি (তবে কি হবে)?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “তাহলে ততা আল্লাহ তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ও দুঃখ-দুর্দশা হতে রক্ষা করবেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
জামে তিরমিযী ও মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, যখন রাত্রির দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হতে তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) উঠে পড়তেন ও বলতেনঃ “হে জনমণ্ডলী! তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর। প্রথম প্রকম্পিতকারী এসে পড়েছে। এবং পরবর্তী প্রকম্পিতকারী ওর অনুসরণ করছে এবং মৃত্যু তার সঙ্গীয় বিপদ-আপদ নিয়ে চলে আসছে।”
কত হৃদয় সেদিন সন্ত্রস্ত হবে, তাদের দৃষ্টি ভীতি-বিহ্বলতায় নত হবে। কেননা তারা নিজেদের পাপ এবং আল্লাহর আযাব আজ প্রত্যক্ষ করেছে।
যে সব মুশরিক পরস্পর বলাবলি করতোঃ কবরে যাওয়ার পরেও কি পুনরায় আমাদেরকে জীবিত করা হবে? আজ তারা নিজেদের জীবনের গ্লানি ও অবমাননা স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করবে।
(আরবি) কবরকে বলা হয়। অর্থাৎ কবরে যাওয়ার পর দেহ সড়ে-পড়ে যাবে এবং অস্থি পচে-গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। এরপরেও কি পুনরুজ্জীবিত করা হবে? তাহলে তো দ্বিতীয়বারের এ জীবন অপমানজনক ও ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হবে। কুরায়েশ কাফিররা এ সব কথা বলাবলি করতো। (আরবি) শব্দের অর্থ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা জাহান্নামের নাম বলে উল্লেখ আছে। এই জাহান্নামের বহু নাম রয়েছে। যেমন জাহীম, সাকার, হাবিয়াহ, অধিনাহ, লাযা, হুতামাহ্ ইত্যাদি।
এখন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তারা যে বিষয়টিকে বিরাট ও অসম্ভব বলে মনে করছে সেটা আমার ব্যাপক ক্ষমতার আওতাধীনে খুবই সহজ ও সাধারণ ব্যাপার। এটা তো শুধুমাত্র এক বিকট শব্দ। এর ফলে তখনই ময়দানে তাদের আবির্ভাব হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে নির্দেশ দিলে তিনি শিঙ্গায় ফুঙ্কার দিবেন। তাঁর ফুৎকারের সাথে সাথেই আগের ও পরের সবাই জীবিত হয়ে যাবে এবং আল্লাহর সামনে এক ময়দানে সমবেত হবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যে দিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন তখন তোমরা তার প্রশংসা করতে করতে জবাব দিবে এবং জানতে পারবে যে, খুব অল্প সময়ই তোমরা অবস্থান করেছো।” (১৭:৫২) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমার আদেশ এতো কম সময়ের মধ্যে পালিত হবে যে, ঠিক যেন চোখের পলক ফেলার সময়।” (৫৪:৫০) অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কিয়ামতের আদেশ চোখের পলক ফেলার মত সময়ে কার্যকরী হবে, বরং এর চেয়েও কম সময়ে।” (১৬:৭৭) এখানেও বলা হয়েছেঃ “এটা তো এক বিকট শব্দের বিলম্ব মাত্র, তখনই ময়দানে তাদের আবির্ভাব হবে।’ ঐদিন প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ ভীষণ ক্রুদ্ধ হবেন। এই শব্দও ক্রোধের সাথেই হবে। এটা হলো, শেষ ফুকার, যেই ফুঙ্কারের পরেই সমস্ত মানুষ জমীনের উপরে এসে পড়বে। অথচ এর পূর্বে তারা ছিল মাটির নীচে।
(আরবি) শব্দের অর্থ হলো ভূ-পৃষ্ঠ ও সমতল ময়দান। সাওরী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা সিরিয়ার যমীনকে বুঝানো হয়েছে। উসমান ইবনে আবিল আনিকার (রঃ) উক্তি এই যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বায়তুল মুকাদ্দাসের যমীন। অহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো বায়তুল মুকাদ্দাসের এক দিকের একটি পাহাড়। কিন্তু এটা হলো সবচেয়ে গারীব বা দুর্বল উক্তি। প্রথমটিই সঠিকতম উক্তি অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠ। সমস্ত মানুষ ভূ-পৃষ্ঠে সমবেত হবে। ঐ সময় ভূ-পৃষ্ঠ হবে সাদা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং শূন্য। যেমন ময়দার রুটি হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশমণ্ডলীও, আর মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সামনে, যিনি এক, পরাক্রমশালী।” (১৪:৪৮) আল্লাহ পাক আরো বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ তারা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলঃ আমার প্রতিপালক ওগুলোকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। অতঃপর তিনি ওকে পরিণত করবেন মসৃণ সমতল ময়দানে। যাতে তুমি বক্রতা ও উচ্চতা দেখবে না।” (২০:১০৫-১০৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ ‘আর যেদিন আমি পাহাড়কে চালিত করবো এবং ভূ-পৃষ্ঠ পরিষ্কার রূপে প্রকাশ হয়ে পড়বে।” (১৮:৪৭) মোটকথা, সম্পূর্ণ নতুন একটি যমীন হবে, যেই যমীনে কখনো কোন অন্যায়, খুনাখুনি এবং পাপাচার সংঘটিত হয়নি।
১৫-২৬ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ)-কে অবহিত করছেন যে, তিনি তাঁর বান্দা ও রাসূল হযরত মূসা (আঃ)-কে ফিরাউনের নিকট পাঠিয়েছিলেন এবং মু’জিযা দ্বারা তাকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ফিরাউন ঔদ্ধত্য, হঠকারিতা ও কুফরী হতে বিরত হয়নি। অবশেষে তার উপর আল্লাহর আযাব নাযিল হলো এবং সে ধ্বংস হয়ে গেল। মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে নবী (সঃ) তোমার বিরুদ্ধাচরণকারী এবং তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী কাফিরদেরও অনুরূপ অবস্থা হবে। এজন্যেই এই ঘটনার শেষে বলেনঃ “যে ভয় করে তার জন্যে অবশ্যই এতে শিক্ষা রয়েছে।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ) কে বলেনঃ তোমার নিকট কি মূসা (আঃ)-এর বৃত্তান্ত পৌঁছেছে। ঐ সময় হযরত মূসা (আঃ) তুওয়া নামক একটি পবিত্র প্রান্তরে ছিলেন। তুওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা সূরা তোয়াহা’ এর মধ্যে গত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আঃ)-কে আহ্বান করে বলেনঃ ফিরাউন হঠকারিতা, অহংকার ও সীমালংঘন করেছে। সুতরাং তুমি তার কাছে গমন কর এবং আমার বার্তা তার নিকট পৌঁছিয়ে দাও। তাকে জিজ্ঞেস কর যে, তোমার কথা শুনে সে সরল, সত্য ও পবিত্র পথে পরিচালিত হতে চায় কি না? তাকে তুমি বলবেঃ তুমি যদি আমার কথা শ্রবণ কর ও মান্য কর তবে তুমি পবিত্রতা অর্জন করবে। আমি তোমাকে আল্লাহর ইবাদতের এমন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করবো যার ফলে তোমার হৃদয় নরম ও উজ্জ্বল হবে। তোমার অন্তরে বিনয় ও আল্লাহ ভীতি সৃষ্টি হবে। আর তোমার মন হতে কঠোরতা, রূঢ়তা ও নির্মমতা বিদূরিত হয়ে যাবে।
হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউনের কাছে গেলেন, তাকে আল্লাহর বাণী শশানালেন, যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করলেন এবং নিজের সত্যতার স্বপক্ষে মু’জিযা দেখালেন। কিন্তু ফিরাউনের মনে কুফরী বদ্ধমূল ছিল বলে সে হযরত মূসা (আঃ)-এর কথা শোনা সত্ত্বেও তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো না। সে বারবার সত্যকে অস্বীকার করে নিজের হঠকারী স্বভাবের উপর অটল রয়ে গেল। হক ও সত্য সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও হতভাগ্য ফিরাউন ঈমান আনতে পারলো না।
ফিরাউনের মন জানতো যে, তার কাছে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে যিনি এসেছেন তিনি সত্য নবী এবং তাঁর শিক্ষাও সত্য। কিন্তু তার মন জানলেও সে বিশ্বাস করতে পারলো না। জানা এক কথা এবং ঈমান আনয়ন করা অন্য কথা। মন যা জানে তা বিশ্বাস করাই হলো ঈমান, অর্থাৎ সত্যের অনুগত হয়ে যাওয়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর কথার প্রতি আমল করার জন্যে আত্মনিয়োগ করা।
ফিরাউন সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং সত্যবিরোধী তৎপরতা চালাতে শুরু করলো। সে যাদুকরদেরকে একত্রিত করে তাদের কাছে হযরত মূসা (আঃ)-কে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইলো। সে স্বগোত্রকে একত্রিত করে তাদের মধ্যে ঘোষণা করলোঃ “আমিই তোমাদের বড় প্রতিপালক।” একথা বলার চল্লিশ বছর পূর্বে সে বলেছিলঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি ছাড়া তোমাদের কোন মাবুদ আছে তা আমি জানি না।” (২৮:৩৮) এবার তার হঠকারিতা এবং ঔদ্ধত্য একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেল। সে খোলাখুলিভাবে বলে ফেললোঃ “আমিই তোমাদের মহা প্রভু। আমি সবার উপর বিজয়ী।”
“অতঃপর আল্লাহ, তাকে আখিরাতে ও দুনিয়ায় কঠিন শাস্তি দেন।” অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা তাকে এমন শাস্তি দেন যে, তা তার মত আল্লাহ দ্রোহীদের জন্যে চিরকাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটা তো দুনিয়ার ব্যাপার। এছাড়া আখিরাতের শাস্তি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি তাদেরকে জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী নেতা বানিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।” (২৮:৪১) আয়াতের সঠিক অর্থ এটাই যে, আখিরতি ও উলা দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতকে বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা ফিরাউনের দুইটি উক্তি উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তার এ কথা বলাঃ “আমি ছাড়া তোমাদের কোন মা’বুদ আছে বলে আমার জানা নেই।” এবং এরপরে বলাঃ “আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক। আবার অন্য কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুফরী ও নাফরমানী। কিন্তু প্রথমটিই সঠিকতম উক্তি। আর এতে কোন সন্দেহ নেই। এতে ঐ লোকদের জন্যে শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে যারা উপদেশ গ্রহণ করে এবং যাদের অন্যায় হতে বিরত থাকার মানসিকতা রয়েছে।
২৭-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর
যারা মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করতো না তাদের সামনে আল্লাহ তাআলা যুক্তি পেশ করছেন যে, আকাশ সৃষ্টি করার চেয়ে মৃত মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা আল্লাহর নিকট বহুগুণে সহজ ব্যাপার। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আসমান ও জমীন সৃষ্টি করা মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা বহুগুণে কঠিন কাজ।” (৪০:৫৭) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহা স্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।” (৩৬:৮১) ।
তিনি অত্যন্ত উঁচু, প্রশস্ত ও সমতল করে আকাশ সৃষ্টি করেছেন। তারপর অন্ধকার রাত্রে চমকিত ও উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি ঐ আকাশের গায়ে বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি অন্ধকার কৃষ্ণকায় রাত্রি সৃষ্টি করেছেন। দিনকে উজ্জ্বল এবং আলোকমণ্ডিত করে সৃষ্টি করেছেন। জমীনকে তিনি বিছিয়ে দিয়েছেন। পানি এবং খাদ্যদ্রব্যও তিনি বের করেছেন। সূরা হা-মীম সাজদায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আকাশের পূর্বেই জমীন সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে যমীনের বিস্তৃতিকরণ আকাশ সৃষ্টির পরে ঘটেছে। এখানে এটাই বর্ণনা করা হচ্ছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং বহু সংখ্যক তাফসীরকার এ রকমই বর্ণনা করেছেন। ইবনে জারীরও (রঃ) এই উক্তিটি পছন্দ করেছেন। পাহাড়সমূহকে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছেন। তিনি বিজ্ঞানময় এবং অভ্রান্ত ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর সৃষ্টজীবের প্রতি দয়ালু ও পরম করুণাময়।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যখন আল্লাহ তা’আলা যমীন সৃষ্টি করেন তখন তা দুলতে শুরু করে। সূতরাং তিনি তখন পাহাড় সৃষ্টি করে যমীনের বুকে স্থাপন করে দেন। ফলে যমীন স্থির ও নিশ্চল হয়ে যায়। এতে ফেরেশতামণ্ডলী খুবই বিস্মিত হন। তাঁরা আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ের অপেক্ষাও অধিক শক্ত অন্য কিছু আছে কি?” তিনি উত্তরে বলেন! হ্যা আছে। তা হলে লোহা।” ফেরেশতাগণ পুনরায় প্রশ্ন করেনঃ “লোহা অপেক্ষাও কঠিনতর কিছু আছে কি?” আল্লাহ তা’আলা জবাবে বলেনঃ “হ্যা, আছে। তা হলো আগুন। ফেরেশতারা আবার জিজ্ঞেস করেনঃ “আগুন অপেক্ষাও বেশী কঠিন কিছু কি আছে?” আল্লাহ তা’আলা উত্তর দেনঃ “হ্যা আছে। তা হলো পানি।” তাঁরা পুনরায় প্রশ্ন করেন “পানির চেয়েও বেশী কঠিন কিছু আছে কি?” তিনি জবাবে বলেনঃ “হ্যা, আছে। তা হচ্ছে বাতাস।” তারা আবারও প্রশ্ন করেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে বায়ু অপেক্ষাও অধিক কঠিন কিছু কি আছে? তিনি জবাব দেনঃ “হ্যা আছে। সে হলো ঐ আদম সন্তান যে তার ডান হাতে যা খরচ (দান) করে বাম হাত তা জানতে পারে না।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণনা করা হয়েছে)
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আল্লাহ যখন যমীন সৃষ্টি করেন তখন তা কাঁপতে থাকে এবং বলতে থাকেঃ “আপনি আমার উপর আদম (আঃ)-কে এবং তাঁর সন্তানদেরকে সৃষ্টি করলেন যারা আমার উপর তাদের ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করবে এবং আমার উপরে অবস্থান করে পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়বে? তখন আল্লাহ তা’আলা পাহাড় স্থাপন করে যমীনকে স্থির ও নিশ্চল করে দেন। তোমরা বহু সংখ্যক পাহাড় পর্বত দেখতে পাচ্ছ। আরো বহু পাহাড় তোমাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়েছে। পর্বতরাজি স্থাপনের পর যমীনের স্থির হয়ে যাওয়া ঠিক তেমনিই ছিল যেমন উট যবেহ করার পর ওর গোশত কাঁপতে থাকে এবং কিছুক্ষণ কম্পনের পর স্থির হয়ে যায়।” (এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর (রঃ)। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস)
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এসব কিছু তোমাদেরও তোমাদের জন্তুগুলোর উপকারের জন্যে ও উপভোগের জন্যে (সৃষ্টি করা হয়েছে)। অর্থাৎ যমীন হতে কূপ ও ঝর্ণা বের করা, গোপনীয় খনি প্রকাশিত করা, ক্ষেতের ফসল ও গাছ-পালা জন্মাননা, পাহাড়-পর্বত স্থাপন করা ইত্যাদি, এগুলোর ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন যাতে তোমরা জমীন হতে পুরোপুরি লাভবান হতে পার। সবকিছুই মানুষের এবং তাদের পশুদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। ঐসব পশুও তাদেরই উপকারের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন। তারা কোন পশুর গোশত ভক্ষণ করে, কোন পশুকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে এবং এই পৃথিবীতে সুখে-শান্তিতে জীবন অতিব
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৩৪-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর
(আরবি) দ্বারা কিয়ামতের দিন উদ্দেশ্য। কেননা, ঐদিন হবে খুবই ভয়াবহ ও গোলযোগপূর্ণ দিন। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “কিয়ামত বড়ই কঠিন ও অপছন্দনীয় দিন।” (৫৪:৪৬) যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সেই দিন মানুষ উপদেশ গ্রহণ করবে, কিন্তু তখন উপদেশ গ্রহণে কি কাজ হবে?” (৮৯:২৩) অর্থাৎ ঐ সময় উপদেশ গ্রহণে কোনই উপকার হবে। মানুষের সামনে জাহান্নামকে নিয়ে আসা হবে। তারা ঐ জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখবে। পার্থিব জীবনে যারা শুধু পার্থিব চিন্তায় ও তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, সেই দিন তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। তাদের খাদ্য হবে যাককূম নামক গাছ এবং পানীয় হবে হামীম বা ফুটন্ত পানি। তবে হ্যা, যারা আল্লাহ তা’আলার সামনে দখুন হওয়ার ভয় করেছে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেদেরকে বিরত রেখেছে, তাদের ঠিকানা হবে জান্নাত। সেখানে তারা সর্বপ্রকারের নিয়ামত লাভ করবে।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে একথা তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে। তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ আমি সেটা জানি না এবং শুধু আমি কেন, আল্লাহর মাখলুকাতের মধ্যে কেউই তা জানে না। এর সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। ওটা আকাশ ও পৃথিবীর উপর বোঝা হয়ে আছে, অকস্মাৎ এসে পড়বে। জনগণ তোমাকে এমনভাবে জিজ্ঞেস করছে যে, যেন তুমি সেটা জান। অথচ মহামহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া সে সম্পর্কে কারো কোন জ্ঞান নেই।
হযরত জিবরাঈল (আঃ) যখন মানুষের রূপ ধরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন এবং তাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন তখন তিনি সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। তাকে কিয়ামতের দিন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন “জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞেসকারী অপেক্ষা বেশী জানে না।”
আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ হে নবী (সঃ)! যে এর ভয় রাখে তুমি শুধু তাকেই সতর্ককারী। অর্থাৎ তুমি একজন সতর্ককারী মাত্র। যারা ঐ ভয়াবহ দিনকে ভয় করে তারাই শুধু এতে লাভবান হবে। তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করবে বলে সেই দিনের ভয়াবহতা থেকে তারা রক্ষা পেয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যারা তোমার সতর্কীকরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে না, বরং তোমার বিরোধিতা করবে তারা সেই দিন নিকৃষ্ট ধরনের ধ্বংসাত্মক আযাবের কবলে পতিত হবে।
মানুষ যখন নিজেদের কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে সমবেত হবে তখন পৃথিবীর জীবনকাল তাদের কাছে খুবই কম বলে অনুভূত হবে। তাদের মনে হবে যে, তারা যেন সকাল বেলার কিছু অংশ অথবা বিকেল বেলার কিছু অংশ পৃথিবীতে অতিবাহিত করেছে।
যুহরের সময় থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কে (আরবি) বলা হয় এবং সূর্যোদয় থেকে নিয়ে অর্ধ দিন পর্যন্ত সময়কে (আরবি) বলা হয়। অর্থাৎ আখিরাতের তুলনায় পৃথিবীর সুদীর্ঘ বয়সকেও অতি অল্পকাল বলে মনে হবে।