Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৯৩/হে মানুষ:-৫/এবং কাফের-র। বলে:-৩৭) [**ভ্রুকুঞ্চিত করা:!:- **মানুষেরা কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!:- *নিজের সাথী, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ভুলে যাবে:- *তারাই কাফির ও পাপাচারী:-] www.motaher21.net সুরা: ৮০ : আবাসা পারা:৩০ ১-৪২ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:- তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৩/হে মানুষ:-৫/এবং কাফের-র। বলে:-৩৭)
[**ভ্রুকুঞ্চিত করা:!:-
**মানুষেরা কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!:-
*নিজের সাথী, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ভুলে যাবে:-
*তারাই কাফির ও পাপাচারী:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮০ : আবাসা
পারা:৩০
১-৪২ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সুরা: ৮০ : আবাসা:-১
عَبَسَ وَ تَوَلّٰۤی ۙ﴿۱﴾
ভ্রুকুঁচকাল ও মুখ ফিরিয়ে নিল,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২
اَنۡ جَآءَہُ الۡاَعۡمٰی ؕ﴿۲﴾
যেহেতু তার নিকট অন্ধ লোকটি আগমন করেছিল।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩
وَ مَا یُدۡرِیۡکَ لَعَلَّہٗ یَزَّکّٰۤی ۙ﴿۳﴾
তুমি কি জানো, হয়তো সে শুধরে যেতো ,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৪
اَوۡ یَذَّکَّرُ فَتَنۡفَعَہُ الذِّکۡرٰی ؕ﴿۴﴾
অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে তা তার উপকারে আসত।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৫
اَمَّا مَنِ اسۡتَغۡنٰی ۙ﴿۵﴾
পক্ষান্তরে যে লোক বেপরোয়া,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৬
فَاَنۡتَ لَہٗ تَصَدّٰی ؕ﴿۶﴾
তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিলে।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৭
وَ مَا عَلَیۡکَ اَلَّا یَزَّکّٰی ؕ﴿۷﴾
অথচ সে যদি শুধরে না যায় তাহলে তোমার উপর এর কি দায়িত্ব আছে?
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৮
وَ اَمَّا مَنۡ جَآءَکَ یَسۡعٰی ۙ﴿۸﴾
পক্ষান্তরে যে তোমার নিকট ছুটে এল,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৯
وَ ہُوَ یَخۡشٰی ۙ﴿۹﴾
এবং সে ভীত হচ্ছে,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১০
فَاَنۡتَ عَنۡہُ تَلَہّٰی ﴿ۚ۱۰﴾
তার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো!
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১১
کَلَّاۤ اِنَّہَا تَذۡکِرَۃٌ ﴿ۚ۱۱﴾
কখনো নয়, এটা তো উপদেশ বাণী ,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১২
فَمَنۡ شَآءَ ذَکَرَہٗ ﴿ۘ۱۲﴾
যে ইচ্ছা করবে সে তা স্মরণ রাখবে (ও উপদেশ গ্রহণ করবে)।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৩
فِیۡ صُحُفٍ مُّکَرَّمَۃٍ ﴿ۙ۱۳﴾
এমন সব বইতে লিখিত আছে, যা সম্মানিত,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৪
مَّرۡفُوۡعَۃٍ مُّطَہَّرَۃٍۭ ﴿ۙ۱۴﴾
যা উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ, পূত-পবিত্র।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৫
بِاَیۡدِیۡ سَفَرَۃٍ ﴿ۙ۱۵﴾
এমন লিপিকারদের হস্ত দ্বারা (লিপিবদ্ধ)।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৬
کِرَامٍۭ بَرَرَۃٍ ﴿ؕ۱۶﴾
(যারা) সম্মানিত ও পুণ্যবান (ফিরিশতা)।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৭
قُتِلَ الۡاِنۡسَانُ مَاۤ اَکۡفَرَہٗ ﴿ؕ۱۷﴾
লানত মানুষের প্রতি, সে কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৮
مِنۡ اَیِّ شَیۡءٍ خَلَقَہٗ ﴿ؕ۱۸﴾
কোন্ জিনিস থেকে আল্লাহ‌ তাকে সৃষ্টি করেছেন?
সুরা: ৮০ : আবাসা:-১৯
مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ؕ خَلَقَہٗ فَقَدَّرَہٗ ﴿ۙ۱۹﴾
এক বিন্দু শুত্রু থেকে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন, পরে তার তকদীর নির্দিষ্ট করেছেন,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২০
ثُمَّ السَّبِیۡلَ یَسَّرَہٗ ﴿ۙ۲۰﴾
তারপর তার জন্য জীবনের পথ সহজ করেছেন।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২১
ثُمَّ اَمَاتَہٗ فَاَقۡبَرَہٗ ﴿ۙ۲۱﴾
তারপর তাকে মৃত্যু দিয়েছেন এবং কবরে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২২
ثُمَّ اِذَا شَآءَ اَنۡشَرَہٗ ﴿ؕ۲۲﴾
এরপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৩
کَلَّا لَمَّا یَقۡضِ مَاۤ اَمَرَہٗ ﴿ؕ۲۳﴾
কখখনো নয়, আল্লাহ‌ তাকে যে কর্তব্য পালন করার হুকুম দিয়েছিলেন তা সে পালন করেনি।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৪
فَلۡیَنۡظُرِ الۡاِنۡسَانُ اِلٰی طَعَامِہٖۤ ﴿ۙ۲۴﴾
সুতরাং মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৫
اَنَّا صَبَبۡنَا الۡمَآءَ صَبًّا ﴿ۙ۲۵﴾
আমিই তো প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করি,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৬
ثُمَّ شَقَقۡنَا الۡاَرۡضَ شَقًّا ﴿ۙ۲۶﴾
তারপর যমীনকে অদ্ভূতভাবে বিদীর্ণ করেছি।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৭
فَاَنۡۢبَتۡنَا فِیۡہَا حَبًّا ﴿ۙ۲۷﴾
এরপর তার মধ্যে উৎপন্ন করেছি শস্য,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৮
وَّ عِنَبًا وَّ قَضۡبًا ﴿ۙ۲۸﴾
আঙ্গুর, শাক-সবজি।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-২৯
وَّ زَیۡتُوۡنًا وَّ نَخۡلًا ﴿ۙ۲۹﴾
যয়তুন, খেজুর।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩০
وَّ حَدَآئِقَ غُلۡبًا ﴿ۙ۳۰﴾
ঘন বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যানসমূহ।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩১
وَّ فَاکِہَۃً وَّ اَبًّا ﴿ۙ۳۱﴾
ফলমূল এবং পশুখাদ্য।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩২
مَّتَاعًا لَّکُمۡ وَ لِاَنۡعَامِکُمۡ ﴿ؕ۳۲﴾
তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুর জীবন ধারণের সামগ্রী হিসেবে।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৩
فَاِذَا جَآءَتِ الصَّآخَّۃُ ﴿۫۳۳﴾
অতঃপর যখন (কিয়ামতের) ধ্বংস-ধ্বনি এসে পড়বে।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৪
یَوۡمَ یَفِرُّ الۡمَرۡءُ مِنۡ اَخِیۡہِ ﴿ۙ۳۴﴾
সেদিন মানুষ পালাতে থাকবে — নিজের ভাই,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৫
وَ اُمِّہٖ وَ اَبِیۡہِ ﴿ۙ۳۵﴾
নিজের মা, বাপ ,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৬
وَ صَاحِبَتِہٖ وَ بَنِیۡہِ ﴿ؕ۳۶﴾
নিজের সাথী, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের থেকে।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৭
لِکُلِّ امۡرِئٍ مِّنۡہُمۡ یَوۡمَئِذٍ شَاۡنٌ یُّغۡنِیۡہِ ﴿ؕ۳۷﴾
তাদের প্রত্যেকে সেদিন এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে যে, নিজের ছাড়া আর কারোর কথা তার মনে থাকবে না।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৮
وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍ مُّسۡفِرَۃٌ ﴿ۙ۳۸﴾
সেদিন কতক চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে,
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৩৯
ضَاحِکَۃٌ مُّسۡتَبۡشِرَۃٌ ﴿ۚ۳۹﴾
হাসিমুখ ও খুশীতে ডগবগ করবে।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৪০
وَ وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍ عَلَیۡہَا غَبَرَۃٌ ﴿ۙ۴۰﴾
পক্ষান্তরে বহু মুখমন্ডল হবে সেদিন ধূলি-ধূসর।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৪১
تَرۡہَقُہَا قَتَرَۃٌ ﴿ؕ۴۱﴾
সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে কালিমা।
সুরা: ৮০ : আবাসা:-৪২
اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکَفَرَۃُ الۡفَجَرَۃُ ﴿٪۴۲﴾
তারাই কাফির ও পাপাচারী।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৩/হে মানুষ:-৫/এবং কাফের-র। বলে:-৩৭)
[**ভ্রুকুঞ্চিত করা:!:-
**মানুষেরা কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!:-
*তারাই কাফির ও পাপাচারী:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮০ : আবাসা
পারা:৩০
১-৪২ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৮০-আবাসা) : নামকরণ:

এই সূরার প্রথম শব্দ عَبَسَ কে এর নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

(৮০-আবাসা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ একযোগে এ সূরা নাযিলের নিম্নরূপ কারণ বর্ণনা করেছেন। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে মক্কা মুয়ায্‌যমার কয়েক জন বড় বড় সরদার বসেছিলেন। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগী করার জন্য তিনি তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করছিলেন। এমন সময় ইবনে উম্মে মাকতূম (রা.) নামক একজন অন্ধ তাঁর খেদমতে হাজির হলেন এবং তাঁর কাছে ইসলাম সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। তার এই প্রশ্নে সরদারদের সাথে আলাপে বাঁধা সৃষ্টি হওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হলেন। তিনি তার কথায় কান দিলেন না। এই ঘটনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সূরাটি নাযিল হয়। এ ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে এ সূরা নাযিলের সময়-কাল সহজেই নির্দিষ্ট হয়ে যায়।

এ ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে, হযরত ইবনে উম্মে মাকতূম (রা.) একেবারেই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী ও হাফেজ ইবনে কাসীর বলেন: اَسْلَمَ بِمَكَةَ قَدِيْمًا (তিনি একেবারেই প্রথম দিকে মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন) এবং هُوََ مِمَنْ اَسْلَمَ قَدِيْمًا (তিনি একেবারেই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত । অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের একেবারেই শুরুতে তিনি মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয়, যেসব হাদীসে এ ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে তার কোন কোনটি থেকে জানা যায়, এ ঘটনাটির আগেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবার কোন কোন হাদীস থেকে প্রকাশ হয়, এ সময় তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং সত্যের সন্ধানেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসেছিলেন। হযরত আয়েশার (রা.) বর্ণনা মতে, তিনি এসে বলেছিলেন: يَا رَسُوْلَ اللهِ اَرْشِدْنِىْ “হে আল্লাহর রসূল! আমাকে সত্য সরল পথ দেখিয়ে দিন।” (তিরমিয, হাকেম ইবনে হিব্বান, ইবনে জারীর, আবু লাইলা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন: তিনি এসেই কুরআনের একটি আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করতে থাকেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন: يَا رَسُوْلَ اللهِ عَلِمْنِى مِمَا عَلَمَكَ الله “হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ আপানাকে যে জ্ঞান শিখিয়েছেন আমাকে সেই জ্ঞান শেখান।” (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম) এসব বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর নবী এবং কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মেনে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে ইবনে যায়েদ তৃতীয় আয়াতে উল্লেখিত لَعَلَهُ يَزَكَى (হয়তো সে পরিশুদ্ধ হবে) এর অর্থ করেছেন لَعَلَهُ يُسْلِمُ (হয়তো সে ইসলাম গ্রহণ করবে। (ইবনে জারীর) আবার আল্লাহ নিজেই বলেছেন: “তুমি কী জানো, হয়তো সে সংশোধিত হয়ে যাবে অথবা উপদেশের প্রতি মনোযোগী হবে এবং উপদেশ দেয়া তার জন্য উপকারী হবে?” এছাড়া আল্লাহ এও বলেছেন: “যে নিজে তোমার কাছে দৌঁড়ে আসে এবং ভীত হয় তার কথায় তুমি কান দিচ্ছো না।” একথা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন তার মধ্যে সত্য অনুসন্ধানের গভীরতর প্রেরণা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই হেদায়াতের উৎস মনে করে তাঁর খেদমতে হাযির হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছেই নিজের চাহিদা পূরণ হবে বলে মনে করছিলেন। তাঁর অবস্থা একথা প্রকাশ করছিল যে, তাঁকে সত্য সরল পথের সন্ধান দেয়া হলে তিনি সে পথে চলবেন।

তৃতীয়ত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে সে সময় যারা উপস্থিত ছিল বিভিন্ন রেওয়ায়াতে তাদের নাম উল্লেখিত হয়েছে। তারা ছিল উতবা, শাইবা আবু জেহেল, উমাইয়া ইবনে খালাক, উবাই ইবনে খালফ প্রমুখ ইসলামের ঘোর শত্রুরা। এ থেকে জানা যায়, এ ঘটনাটি তখনই ঘটেছিল যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এই লোকগুলোর মেলামেশা বন্ধ হয়নি। তাদের সাথে বিরোধ ও সংঘাত তখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছেনি যে, তাঁর কাছে তাদের আসা যাওয়া এবং তাঁর সাথে তাদের মেলামেশা বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকবে। এসব বিষয় প্রমাণ করে, এ সূরাটি একেবারেই প্রথম দিকে নাযিলকৃত সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

(৮০-আবাসা) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

আপাতদৃষ্টিতে ভাষণের সূচনায় যে বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা দেখে মনে হয়, অন্ধের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন ও তার কথায় কান না দিয়ে বড় বড় সরদারদের প্রতি মনোযোগ দেবার কারণে এই সূরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিরস্কার ও তাঁর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পুরো সূরাটির সমস্ত বিষয়বস্তুকে একসাথে সামনে রেখে চিন্তা করলে দেখা যাবে, আসলে এখানে ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে কুরাইশদের কাফের সরদারদের বিরুদ্ধে। কারণ এই সরদাররা তাদের অহংকার, হঠধর্মিতা ও সত্য বিমুখতার কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যের দাওয়াতকে অবজ্ঞা ও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করছিল। এই সংগে এখানে নবীকে তাঁর সত্য দ্বীনের দাওয়াত দেবার সঠিক পদ্ধতি শেখাবার সাথে সাথে নবুওয়াত লাভের প্রথম অবস্থায় নিজের কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে তিনি যে পদ্ধতিগত ভুল করে যাচ্ছিলেন তা তাঁকে বুঝানো হয়েছে। একজন অন্ধের প্রতি তাঁর অমনোযোগিতা ও তার কথায় কান না দিয়ে কুরাইশ সরদারদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কারণ এ ছিল না যে, তিনি বড়লোকদের বেশী সম্মানিত মনে করতেন এবং একজন অন্ধকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন, নাউযুবিল্লাহ তাঁর চরিত্রে এই ধরনের কোন বক্রতা ছিল না যার ফলে আল্লাহ তাঁকে পাকড়াও করতে পারেন। বরং আসল ব্যাপার এই ছিল, একজন সত্য দ্বীনের দাওয়াত দানকারী যখন তাঁর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দৃষ্টি চলে যায় জাতির প্রভাবশালী লোকদের দিকে। তিনি চান, এই প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করুক। এভাবে তাঁর কাজ সহজ হয়ে যাবে। আর অন্যদিকে দুর্বল, অক্ষম ও সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তিহীন লোকদের মধ্যে তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়লেও তাতে সমাজ ব্যবস্থায় কোন বড় রকমের পার্থক্য দেখা দেয় না। প্রথম দিকে রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও প্রায় এই একই ধরণের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর এই কর্মপদ্ধতি গ্রহণের পেছনে একান্তভাবে কাজ করেছিল তাঁর আন্তরিকতা ও সত্য দ্বীনের দাওয়াতকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার প্রেরণা। বড়লোকদের প্রতি সম্মানবোধ এবং গরীব, দুর্বল ও প্রভাবহীন লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার ধারণা এর পেছনে মোটেই সক্রিয় ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে বুঝালেন, এটা ইসলামী দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। বরং এই দাওয়াতের দৃষ্টিতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুরুত্বের অধিকারী, যে সত্যের সন্ধানে ফিরছে, সে যতই দুর্বল, প্রভাবহীন ও অক্ষম হোক না কেন আবার এর দৃষ্টিতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুরুত্বহীন, যে নিজেই সত্যবিমুখ, সে সমাজে যত বড় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন। তাই ইসলামের দাওয়াত আপনি জোরেশোরে সবাইকে দিয়ে যান কিন্তু যাদের মধ্যে সত্যের দাওয়াত গ্রহণ করার আগ্রহ পাওয়া যায় তারাই হবে আপনার আগ্রহের আসল কেন্দ্রবিন্দু। আর যেসব আত্মম্ভরী লোক নিজেদের অহংকারে মত্ত হয়ে মনে করে, আপনি ছাড়া তাদের চলবে কিন্তু তারা ছাড়া আপনার চলবে না, তাদের সামনে আপনার এই দাওয়াত পেশ করা এই দাওয়াতের উন্নত মর্যাদার সাথে মোটেই খাপ খায় না।

সূরার প্রথম থেকে ১৬ আয়াত পর্যন্ত এই বিষয়বস্তুই আলোচিত হয়েছে। তারপর ১৭ আয়াত থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী কাফেরদের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা নিজেদের স্রষ্টা ও রিযিকদাতা আল্লাহর মোকাবিলায় যে দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল প্রথমে সে জন্য তাদের নিন্দা ও তিরস্কার করা হয়েছে। সবশেষে তাদেরকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের এই কর্মনীতির অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণাম দেখতে পাবে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২

اَنْ جَآءَهُ الْاَعْمٰىؕ

কারণ সেই অন্ধটি তাঁর কাছে এসেছে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এই প্রথম বাক্যটির প্রকাশ ভংগী বড়ই চমকপ্রদ। পরবতী বাক্যগুলোতে সরাসরি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। এ থেকে একথা প্রকাশ হয় যে, ভ্রুকুঁচকাবার ও মুখ ফিরিয়ে নেবার কাজটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই করেছিলেন। কিন্তু বাক্যটির সূচনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে মনে হয়েছে, তিনি নন অন্য কেউ এ কাজটি করেছে। এই প্রকাশ ভংগীর মাধ্যমে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনে এই অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এটা আপনার করার মতো কাজ ছিল না। আপনার উন্নত চরিত্রের সাথে পরিচিত কোন ব্যক্তি এ কাজটি দেখলে ভাবতো, আপনি নন বরং অন্য কেউ এ কাজটি করছে।

এখানে যে অন্ধের কথা বলা হয়েছে, ইতিপূর্বে ভূমিকায় আমরা এ সম্পর্কিত আলোচনায় বলেছি, তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে উম্মে মাকতূম (রা.)। হাফেজ ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল ইসতিআব’ এবং হাফেজ ইবনে হাজর ‘আল আসাবাহ’ গ্রন্থে তাঁকে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা.) ফুফাত ভাই বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা লিখেছেন, তাঁর মা উম্মে মাকতূম ছিলেন হযরত খাদীজার (রা.) পিতা খুওয়াইলিদের সহোদর বোন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর এই আত্মীয়তার সম্পর্ক জানার পর তিনি যে তাঁকে গরীব বা কম মর্যাদা সম্পন্ন মনে করে তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছিলেন এবং বড়লোকদের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ থাকে না। কারন তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপন শ্যালক। বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে সমাজের সাধারণ শ্রেণীভুক্ত নন বরং অভিজাত বংশীয় ছিলেন। তাঁর প্রতি তিনি যে আচরণ করেছিলেন তা ‘অন্ধ’ শব্দটি থেকেই সুস্পষ্ট। রসূলের ﷺ অনাগ্রহ ও বিরূপ আচরণের কারণ হিসেবে আল্লাহ নিজেই এ শব্দটি উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ রসূলে করীমের (সা.) ধারণা ছিল, আমি বর্তমানে যেসব লোকের পেছনে লেগে আছি এবং যাদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছি তাদের একজনও যদি হেদায়াত লাভ করে তাহলে তার মাধ্যমে ইসলামের শক্তি অনেকগুণ বেড়ে যেতে পারে। বিপরীত পক্ষে ইবনে উম্মে মাকতূম হচ্ছেন একজন অন্ধ। দৃষ্টিশক্তি না থাকার কারণে এই সরদারদের মধ্য থেকে একজনের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের জন্য যতটা লাভজনক হবে ইবনে মাকতূমের ইসলাম গ্রহণ ততটা লাভজনক হতে পারে না। তাই তিনি মনে করেছিলেন, সরদারদের সাথে আলোচনার মাঝখানে বাঁধা না দিয়ে অন্য সময় তিনি যা কিছু জানতে চান জেনে নিতে পারবেন।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১০

فَاَنْتَ عَنْهُ تَلَهّٰىۚ

তার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ ﷺ এই মূল বিষয়টির প্রতিই অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন। আর এই বিষয়টি বুঝাবার জন্যই মহান আল্লাহ‌ প্রথমে ইবনে উম্মে মাকতূমের সাথে আচরণের ব্যাপারে তাঁকে পাকড়াও করেন। তারপর সত্যের আহবায়কের দৃষ্টিতে কোন্ জিনিসটি সত্যিকারভাবে গুরুত্ব লাভ করবে এবং কোন্ জিনিসটি গুরুত্ব লাভ করবে না তা তাঁকে জানান। একদিকে এক ব্যক্তির বাহ্যিক অবস্থা পরিষ্কারভাবে একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে সত্যের সন্ধানে ফিরছে, বাতিলের অনুগামী হয়ে আল্লাহর গযবের মুখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ভীত সন্ত্রস্ত। তাই সত্য সঠিক পথ সম্পর্কে জানার জন্য সে নিজে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। অন্যদিকে আর এক ব্যক্তির আচরণ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে যে, সত্য সন্ধানের কোন আগ্রহই তার মনে নেই। বরং সে নিজেকে কারোর সত্য পথ জানিয়ে দেবার মুখাপেক্ষীই মনে করে না। এই দু’ধরনের লোকের মধ্যে কে ঈমান আনলে দ্বীনের বেশী উপকার হতে পারে এবং কার ঈমান আনা দ্বীনের প্রচার এই প্রসারের বেশী সহায়ক নয়, এটা দেখার বিষয় নয়। বরং এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, কে হেদায়াত গ্রহণ করে নিজেকে সুধরে নিতে প্রস্তুত এবং কে হেদায়াতের এই মূল্যবান সম্পদটির আদতে কোন কদরই করে না। প্রথম ধরনের লোক অন্ধ, কানা, খোঁড়া, অংগহীন সহায়-সম্বল শক্তি সামর্থ্যহীন হলে এবং বাহ্যত দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন বড় রকমের অবদান রাখার যোগ্যতা সম্পন্ন না হলেও হকের আহবায়কের কাছে তিনিই হবেন মূল্যবান ব্যক্তি। তার দিকেই তাঁকে নজর দিতে হবে। কারণ এই দাওয়াতের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর বান্দাদের জীবন ও কার্যক্রম সংশোধন করা। আর এই ব্যক্তির অবস্থা একথা প্রকাশ করছে যে, তাকে উপদেশ দেয়া হলে সে সংশোধিত হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় ধরনের লোকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা সমাজে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, সত্যের আহবায়কের তাদের পেছনে লেগে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতিই প্রকাশ্যে একথা জানাচ্ছে যে, তারা সংশোধিত হতে চায় না। কাজেই তাদের সংশোধন করার প্রচেষ্টায় সময় ব্যয় করা নিছক সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা সংশোধিত হতে না চাইলে তাদেরই ক্ষতি, সত্যের আহবায়কের ওপর এর কোন দায়-দায়িত্ব নেই।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১১

كَلَّاۤ اِنَّهَا تَذْكِرَةٌۚ

কখখনো নয়, এটি তো একটি উপদেশ,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এমনটি কখনো করো না। যেসব লোক আল্লাহকে ভুলে আছে এবং যারা নিজেদের দুনিয়াবী সহায়-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অহংকারে মত্ত হয়ে আছে, তাদেরকে অযথা গুরুত্ব দিয়ো না। ইসলামের শিক্ষা এমন কোন জিনিস নয় যে, যে ব্যক্তি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তার সামনে নতজানু হয়ে তা পেশ করতে হবে। আবার এই ধরনের অহংকারী লোককে ইসলামের দিকে আহবান করার জন্য এমন ধরনের কোন প্রচেষ্টা চালানোও তোমার মর্যাদা বিরোধী, যার ফলে সে এ ভুল ধারণা করে বসে যে, তার সাথে তোমার কোন স্বার্থ জড়িত আছে এবং সে মেনে নিলে তোমার দাওয়াত সম্প্রসারিত হবার পথ প্রশস্ত হবে। অন্যথায় তুমি ব্যর্থ হয়ে যাবে। সে সত্যের যতটা মুখাপেক্ষী নয় সত্যও তার ততটা মুখাপেক্ষী নয়।

# অর্থাৎ কুরআন।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১৪

مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍۭۙ

উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন ও পবিত্র।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# অর্থাৎ সব ধরনের মিশ্রণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। এর মধ্যে নির্ভেজাল সত্যের শিক্ষা পেশ করা হয়েছে। কোন ধরনের বাতিল, অসৎ ও অন্যায় চিন্তা ও মতবাদের কোন স্থানই সেখানে নেই। দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মগুলো যেসব ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধে ভরে তোলা হয়েছে তার সামান্য গন্ধটুকুও এখানে নেই। মানুষের চিন্তা-ভাবনা কল্পনা বা শয়তানী ওয়াসওয়াসা ও দুরভিসন্ধি সবকিছু থেকে তাকে পাক-পবিত্র রাখা হয়েছে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১৬

كِرَامٍۭ بَرَرَةٍؕ

ও পূত চরিত্র লেখকদের হাতে থাকে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এখানে একদল ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে। তাঁরা আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ অনুসারে কুরআনের বিভিন্ন অংশ লেখা, সেগুলোর হেফাজত করা এবং সেগুলো হুবহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের প্রশংসায় এখানে দু’টি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। একটি হচ্ছে মর্যাদাবান এবং অন্যটি পূত পবিত্র। প্রথম শব্দটির মাধ্যমে একথা প্রকাশ করা হয়েছে যে, তাঁরা এত বেশী উন্নত মর্যাদার অধিকারী যার ফলে যে আমানত তাঁদের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে তা থেকে সামান্য পরিমাণ খেয়ানত করাও তাঁদের মতো উন্নত মর্যাদার অধিকারী সত্তার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আর দ্বিতীয় শব্দটি ব্যবহার করে একথা জানানো হয়েছে যে, এই কিতাবের বিভিন্ন অংশ লেখার, সেগুলো সংরক্ষণ করার এবং সেগুলো রসূলের কাছে পৌঁছাবার যে দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে পূর্ণ বিশ্বস্ততা সহকারে তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

# যে ধারাবাহিক বর্ণনায় এই আয়াতগুলো উদ্ধৃত হয়েছে সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে জানা যায়, এখানে নিছক কুরআন মজীদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করার জন্য তার এই প্রশংসা করা হয়নি। বরং এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেসব অহংকারী লোক ঘৃণাভরে এর দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তাদেরকে পরিষ্কারভাবে একথা জানিয়ে দেয়া যে, এই মহান কিতাবটি তোমাদের সামনে পেশ করা হবে এবং তোমরা একে গ্রহণ করে তাকে ধন্য করবে, এই ধরনের কোন কার্যক্রম এর জন্য কোন প্রয়োজন নেই এবং এটি এর অনেক ঊর্ধ্বে। এ কিতাব তোমাদের মুখাপেক্ষী নয় বরং তোমরাই এর মুখাপেক্ষী। নিজেদের ভালো চাইলে তোমাদের মন মগজে যে শয়তান বাসা বেঁধে আছে তাকে সেখানে থেকে বের করে দাও এবং সোজা এই দাওয়াতের সামনে মাথা নত করে দাও। নয়তো তোমরা এর প্রতি যে পরিমাণ অমুখাপেক্ষিতা দেখাচ্ছো এটি তার চাইতে অনেক বেশী তোমাদের অমুখাপেক্ষী। তোমরা একে ঘৃণ্য ও তুচ্ছ জ্ঞান করলে এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে সামান্যতম পার্থক্যও দেখা দেবে না। তবে এর ফলে তোমাদের গর্ব ও অহংকারের গগণচুম্বী ইমারত ভেঙে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়া হবে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১৭

قُتِلَ الْاِنْسَانُ مَاۤ اَكْفَرَهٗؕ

লানত মানুষের প্রতি, সে কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এখান থেকে আল্লাহর সত্য দ্বীনের প্রতি মুখাপেক্ষিতা অস্বীকার করে আসছিল এমন ধরনের কাফেররা ক্রোধের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। এর আগে সূরার শুরু থেকে ১৬ আয়াত পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। সেখানে পর্দান্তরালে কাফেরদের প্রতি ক্রোধ বর্ষণ করা হয়েছে। সেখানে বর্ণনাভংগী ছিল নিম্নরূপঃ হে নবী! একজন সত্য সন্ধানীকে বাদ দিয়ে আপনি এ কাদের পেছনে নিজের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করছেন? সত্যের দাওয়াতের দৃষ্টিতে এদের তো কোন মূল্য ও মর্যাদা নেই। আপনার মতো একজন মহান মর্যাদা সম্পন্ন নবীর পক্ষে কুরআনের মতো উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব এদের সামনে পেশ করার কোন প্রয়োজন নেই।

# কুরআন মজীদের এই ধরনের বিভিন্ন স্থানে মানুষ শব্দটি মানবজাতির প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়নি। বরং সেখানে মানুষ বলতে এমন সব লোককে বুঝানো হয়েছে যাদের অপছন্দনীয় গুণাবলীর নিন্দা করাই মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে। কোথাও অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ঐসব অপছন্দনীয় গুণাবলী পাওয়া যাওয়ার কারণে “মানুষ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কোথাও এর ব্যবহারের কারণ এই দেখা দিয়েছে যে, বিশেষ কিছু লোককে নির্দিষ্ট করে যদি তাদের নিন্দা বা তিরস্কার করা হয় তাহলে তার ফলে তাদের মধ্যে জিদ ও হঠধর্মিতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে উপদেশ দেবার জন্য সাধারণভাবে কথা বলার পদ্ধতিই বেশী প্রভাবশালী প্রমাণিত হয়।

# এর আর একটি অর্থ হতে পারে। অর্থাৎ কোন জিনিসটি তাকে সত্য অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? অন্য কথায় বলা যায়, কিসের জোরে সে কুফরী করে? কুফরী অর্থ এখানে সত্য অস্বীকার হয়, নিজের উপকারীর উপকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করাও হয়, আবার নিজের স্রষ্টা, মালিক, প্রভু ও রিযিকদাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর মতো আচরণ করাও হয়।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১৯

مِنْ نُّطْفَةٍ١ؕ خَلَقَهٗ فَقَدَّرَهٗۙ

এক বিন্দু শুত্রু থেকে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন, পরে তার তকদীর নির্দিষ্ট করেছেন,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# প্রথমে তো তার নিজের মৌলিক সত্তা সম্পর্কে একটু চিন্তা করা দরকার। কোন্ জিনিস থেকে সে অস্তিত্ব লাভ করেছে? কোথায় সে লালিত হয়েছে? কোন্ পথে সে দুনিয়ায় এসেছে? কোন্ ধরনের অসহায় অবস্থার মধ্যে দুনিয়ায় তার জীবনের সূচনা হয়েছে? নিজের এই প্রকৃত অবস্থা ভুলে গিয়ে সে কেমন করে “আমার সমতুল্য কেউ নেই” বলে ভুল ধারণা পোষণ করতে পারে? নিজের স্রষ্টার প্রতি বিদ্রূপ ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা সে কোথা থেকে পেলো? (এই একই কথা সূরা ইয়াসীনের ৭৭-৭৮ আয়াতে বলা হয়েছে)।

# সে মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় তার তকদীর নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সে কোন্ লিংগের হবে? তার গায়ের রং কি হবে? সে কতটুকু উঁচু হবে? তার দেহ কতটুকু কি পরিমাণ মোটা ও পরিপুষ্ট হবে? তার অংগ-প্রত্যংগগুলো কতটুকু নিখুঁত ও অসস্পূর্ণ হবে? তার চেহারা সুরাত ও কণ্ঠস্বর কেমন হবে? তার শারীরিক বল কতটুকু হবে? তার বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা কতটুকু হবে? কোন্ দেশে, পরিবারে এবং কোন্ অবস্থায় ও পরিবেশে সে জন্মগ্রহণ করবে, লালিত-পালিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত কি হয়ে গড়ে উঠবে? তার ব্যক্তিত্ব গঠনে বংশ ও পরিবারের প্রভাব, পরিবেশের প্রভাব এবং তার নিজের ব্যক্তিসত্তা ও অহমের প্রভাব কি পর্যায়ে ও কতটুকু থাকবে? দুনিয়ার জীবনে সে কী ভূমিকা পালন করবে? পৃথিবীতে কাজ করার জন্য তাকে কতটুকু সময় দেয়া হবে? এই তকদীর থেকে এক চুল পরিমাণ সরে আসার ক্ষমতাও তার নেই। এর মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও সে করতে পারবে না। এত সব সত্ত্বেও তার একি দুঃসাহস, যে স্রষ্টার তৈরি করা তকদীরের সামনে সে এতই অসহায়, তার মোকাবেলায় সে কুফরী করে ফিরছে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২০

ثُمَّ السَّبِیْلَ یَسَّرَهٗۙ

তারপর তার জন্য জীবনের পথ সহজ করেছেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# দুনিয়ায় তার জীবন যাপনের সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করেছেন। নয়তো স্রষ্টা যদি তার এই শক্তিগুলো ব্যবহার করার মতো এসব উপায় উপকরণ পৃথিবীতে সরবরাহ না করতেন তাহলে তার দেহ ও মস্তিস্কের সমস্ত শক্তি ব্যর্থ প্রমাণিত হতো। এছাড়াও স্রষ্টা তাকে এ সুযোগও দিয়েছেন যে, সে নিজের জন্য ভালো বা মন্দ, কৃতজ্ঞতা বা অকৃতজ্ঞতা, আনুগত্য বা অবাধ্যতার মধ্যে যে কোন পথ চায় গ্রহণ করতে পারে। তিনি উভয় পথই তার সামনে খুলে রেখে দিয়েছেন এবং প্রত্যেকটি পথই তার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এখন এর মধ্য থেকে যে পথে ইচ্ছা সে চলতে পারে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২১

ثُمَّ اَمَاتَهٗ فَاَقْبَرَهٗۙ

তারপর তাকে মৃত্যু দিয়েছেন এবং কবরে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# কেবল তার সৃষ্টি ও তকদীরের ব্যাপারেই নয়, মৃত্যুর ব্যাপারেও তার স্রষ্টার কাছে সে একেবারেই অসহায়। নিজের ইচ্ছায় সে সৃষ্টি হতে পারে না। নিজের ইচ্ছায় মরতেও পারে না। নিজের মৃত্যুকে এক মুহূর্তকালের জন্য পিছিয়ে দেবার ক্ষমতাও তার নেই। যে সময় যেখানে যে অবস্থায়ই তার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করে দেয়া হয়েছে ঠিক সে সময় সে জায়গায় সে অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। আর মৃত্যুর পর তার জন্য যে ধরনের কবর নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে ঠিক সেই ধরনের কবরেই সে স্থান লাভ করে। তার এই কবর মৃত্তিকা গর্ভে, সীমাহীন সাগরের গভীরতায়, অগ্নিকুণ্ডের বুকে বা কোন হিংস্র পশুর পাকস্থলীতে যে কোন জায়গায় হতে পারে। মানুষের তো কোন কথাই নেই। সারা দুনিয়ায় সমস্ত সৃষ্টি মিলে চেষ্টা করলেও কোন ব্যক্তির ব্যাপারে স্রষ্টার এই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে না।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২২

ثُمَّ اِذَا شَآءَ اَنْشَرَهٗؕ

তারপর যখন তিনি চাইবেন তাকে আবার উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মৃত্যুর পর স্রষ্টা আবার যখন তাকে জীবিত করে উঠাতে চাইবেন তখন তার পক্ষে উঠতে অস্বীকার করার ক্ষমতাও থাকবে না। প্রথমে সৃষ্টি করার সময় তাকে জিজ্ঞেস করে সৃষ্টি করা হয়নি। সে সৃষ্টি হতে চায় কিনা, এ ব্যাপারে তার মতামত নেয়া হয়নি। সে সৃষ্টি হতে অস্বীকার করলেও তাকে সৃষ্টি করা হতো। এভাবে এই দ্বিতীয়বার সৃষ্টিও তার মর্জির ওপর নির্ভরশীল নয়। মরার পর সে আবার উঠতে চাইলে উঠবে, আবার উঠতে অস্বীকার করলে উঠবে না, এ ধরনের কোন ব্যাপারই এখানে নেই। এ ব্যাপারেও স্রষ্টার মর্জির সামনে সে পুরোপুরি অসহায়। যখনই তিনি চাইবেন তাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তাকে উঠতে হবে, হাজার বার না চাইলেও।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২৩

كَلَّا لَمَّا یَقْضِ مَاۤ اَمَرَهٗؕ

কখখনো নয়, আল্লাহ‌ তাকে যে কর্তব্য পালন করার হুকুম দিয়েছিলেন তা সে পালন করেনি।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# হুকুম বলতে এখানে এমন হুকুমও বুঝানো হয়েছে, যা স্বাভাবিক পথনির্দেশনার আকারে মহান আল্লাহ‌ প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে সংরক্ষিত রেখেছেন। এমন হুকুমও বুঝানো হয়েছে, যেদিকে মানুষের নিজের অস্তিত্ব এবং পৃথিবী থেকে নিয়ে আকাশ পর্যন্ত বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি অণু পরমাণু এবং আল্লাহর অপরিসীম শক্তি সমন্বিত প্রতিটি বস্তুই ইঙ্গিত করছে। আবার এমন হুকুমও বুঝানো হয়েছে, যা প্রতি যুগে আল্লাহ‌ নিজের নবী ও কিতাবের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন এবং প্রতি যুগের সৎলোকদের মাধ্যমে যাকে চতুর্দিকে পরিব্যপ্ত করেছেন। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা দাহার ৫ টীকা) এ প্রসঙ্গে একথাটি যে অর্থে বলা হয়েছে তা হচ্ছেঃ ওপরের আয়াতগুলোতে যেসব মৌলিক সত্যের আলোচনা করা হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে মানুষের উচিত ছিল তার স্রষ্টার আনুগত্য করা। কিন্তু সে উল্টো তাঁর নাফরমানির পথ অবলম্বন করেছে এবং আল্লাহর বান্দাহ হবার দাবী পূরণ করেনি।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২৪

فَلْیَنْظُرِ الْاِنْسَانُ اِلٰى طَعَامِهٖۤۙ

মানুষ তার খাদ্যের দিকে একবার নজর দিক।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# যে খাদ্যেকে সে মামুলি জিনিস মনে করে সে সম্পর্কে তার একবার চিন্তা করা দরকার। কিভাবে এই খাদ্য উৎপন্ন করা হয়। আল্লাহ‌ যদি এর উপকরণগুলো সরবরাহ না করতেন তাহলে কি জমি থেকে এই খাদ্য উৎপন্ন করার ক্ষমতা মানুষের ছিল?

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২৫

اَنَّا صَبَبْنَا الْمَآءَ صَبًّاۙ

আমি প্রচুর পানি ঢেলেছি।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এর অর্থ বৃষ্টি। সূর্য তাপে সমুদ্র পৃষ্ঠের বিপুল বারি রাশিকে বাষ্পের আকারে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। তা থেকে সৃষ্টি হয় ঘন মেঘ। বায়ু প্রবাহ সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়। তারপর মহাশূন্যের শীতলতায় সেই বাষ্পগুলো আবার পানিতে পরিণত হয়ে দুনিয়ার প্রত্যেক এলাকায় একটি বিশেষ পরিমাণ অনুযায়ী বর্ষিত হয়। এরপর এই পানি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে বর্ষিত হয়, ভূ-গর্ভে কূয়া ও ঝর্ণার আকার ধারণ করে, নদী-নালায় স্রোতের আকারেও প্রবাহিত হয়। আবার পাহাড়ে জমাট বাঁধা বরফের আকার ধারণ করে গলে যেতেও থাকে। এভাবে বর্ষাকাল ছাড়াও অন্যান্য মওসুমে নদীর বুকে প্রবাহিত হতে থাকে। এসব ব্যবস্থা কি মানুষ নিজেই করেছে? তার স্রষ্টা তার জীবিকার জন্য যদি এসবের ব্যবস্থা না করতেন তাহলে মানুষ কি পৃথিবীর বুকে জীবন ধারণ করতে পারতো?

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২৬

ثُمَّ شَقَقْنَا الْاَرْضَ شَقًّاۙ

তারপর যমীনকে অদ্ভূতভাবে বিদীর্ণ করেছি।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# যমীনকে বিদীর্ণ করার মানে হচ্ছে, মাটি এমনভাবে ফাটিয়ে ফেলা যার ফলে মানুষ তার মধ্যে যে বীজ, আঁটি বা চারা রোপণ বা বপন করে অথবা যা বাতাস ও পাখির মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে তার মধ্যে পৌঁছে যায় তা অংকুর গজাতে পারে। মানুষ বড় জোর মাটি খনন করতে বা তার মধ্যে লাঙল চালাতে পারে এবং আল্লাহ‌ যে বীজ সৃষ্টি করেছেন তাকে মাটিতে রোপণ করতে পারে। এর বেশী সে কিছুই করতে পারে না। এছাড়া সমস্ত কাজ আল্লাহ‌ করেন। তিনি অসংখ্য জাতের উদ্ভিদের বীজ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই এসব বীজের মধ্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে মাটির বুকে এদের অংকুর বের হয় এবং প্রতিটি বীজ থেকে তার প্রজাতির পৃথক উদ্ভিদ জন্ম নেয়। আবার তিনি মাটির মধ্যে এমন যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন যার ফলে তা পানির সাথে মিশে ঐ বীজগুলোর প্রত্যেকটির খোসা আলগা করে তার মুখ খুলে দেয় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদের জন্য তার উপযোগী খাদ্য সরবরাহ করে তার উদগম ও বিকাশ লাভে সাহায্য করে। আল্লাহ‌ যদি এই বীজগুলোর মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি না করতেন এবং মাটির এই উপরি স্তরকে এই যোগ্যতা সম্পন্ন না করতেন তাহলে মানুষ কি এখানে কোন খাদ্য লাভ করতে পারতো?

# কেবল তোমাদের জন্যই নয়, তোমাদের যেসব পশু থেকে তোমরা গোশত, চর্বি, দুধ, মাখন ইত্যাদি খাদ্য সামগ্রী লাভ করে থাকো এবং যারা তোমাদের আরো অসংখ্য অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূর্ণ করে থাকে, তাদের জন্যও। এসব কিছুই কি এজন্য করা হয়েছে যে, তোমরা এসব দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার করে লাভবান হবে এবং যে আল্লাহর রিযিক লাভ করে তোমরা বেঁচে আছো তাঁর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করবে?

#এখানে কিয়ামতের শেষ শিংগা ধ্বনির কথা বলা হয়েছে। এই বিকট আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই মরা মানুষেরা বেঁচে উঠবে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-৩৬

وَ صَاحِبَتِهٖ وَ بَنِیْهِؕ

নিজের সাথী, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের থেকে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে সূরা মা’আরিজের ১০ থেকে ১৪ পর্যন্ত আয়াতে। পালাবার মানে এও হতে পারে যে, সেদিন মানুষ নিজের ঐসব প্রিয়তম আত্মীয়-স্বজনকে বিপদ সাগরে হাবুডুবু খেতে দেখে তাদের সাহায্যার্থে দৌড়ে যাবার পরিবর্তে উল্টো তাদের থেকে দূরে পালিয়ে যেতে থাকবে, যাতে তারা সাহায্যের জন্য তাকে ডাকতে না থাকে। আবার এর এ মানেও হতে পারে যে, দুনিয়ায় আল্লাহর ভয় না করে পরস্পরকে গোমরাহ করতে থেকেছে, তার কুফল সামনে স্বমূর্তিতে প্রকাশিত দেখে তাদের প্রত্যেকে যাতে অন্যের গোমরাহী ও গোনাহের দায়িত্ব কেউ তার ঘাড়ে না চাপিয়ে দেয় এই ভয়ে অন্যের থেকে পালাতে থাকবে। ভাই ভাইকে, সন্তান মা-বাপকে, স্বামী স্ত্রীকে এবং মা-বাপ সন্তানকে এই মর্মে ভয় করতে থাকবে যে, নিশ্চয়ই এবার আমার বিরুদ্ধে মামলায় এরা সাক্ষী দেবে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-৩৭

لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ یَوْمَئِذٍ شَاْنٌ یُّغْنِیْهِؕ

তাদের প্রত্যেকে সেদিন এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে যে, নিজের ছাড়া আর কারোর কথা তার মনে থাকবে না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# হাদীস গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ও সনদ পরম্পরায় বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ একেবারেই উলংঙ্গ হয়ে উঠবে।” একথা শুনে তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্য থেকে কোন একজন (কোন কোন বর্ণনা মতে হযরত আয়েশা, কোন বর্ণনা মতে হযরত সওদা আবার কোন বর্ণনা অনুযায়ী অন্য একজন মহিলা) ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের লজ্জাস্থান কি সেদিন সবার সামনে খোলা থাকবে? জবাবে রসূলুল্লাহ ﷺ এই আয়াতটি তেলাওয়াত করে বলেন, সেদিন অন্যের দিকে তাকাবার মতো হুঁশ ও চেতনা করো থাকবে না। (নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে জারীর, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া, বায়হাকী ও হাকেম)।

তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৩/হে মানুষ:-৫/এবং কাফের-র। বলে:-৩৭)
[**ভ্রুকুঞ্চিত করা:!:-
**মানুষেরা কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!:-
*নিজের সাথী, স্ত্রী ও ছেলে -মেয়েদের ভুলে যাবে:-
*তারাই কাফির ও পাপাচারী:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮০ : আবাসা
পারা:৩০
১-৪২ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আবাসা

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৮০

ফী জিলালিল কুরআন:

  সংক্ষিপ্ত আলোচনা : আখেরাত সংঘটিত হওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে ৩০ পারার অন্যান্য সূরার মধ্যে যেসব উদাহরণ দিয়ে বুঝানো হয়েছে, এ সূরাটিতেও অনুরূপ যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে। আখেরাতের আগমন যে অবশ্যম্ভাবী, তা কতো ভয়ানক, তার দৃশ্যাবলী কতো কঠিন এবং এই পৃথিবীর পরিণতির জন্যে আখেরাত সংঘটিত হওয়ার গুরুত্ব কতো বেশী, তা এই সূরার ছত্রে ছত্রে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। মহান স্রষ্টার সুনিপুণ তৈরী পৃথিবীর উপরিভাগ ও অভ্যন্তরভাগের প্রতিটি জিনিসে এর পরিণতির আভাসও এখানে ফুটে উঠেছে তারপর এর বাসিন্দাদের যে আখেরাতে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে হিসাব নিকাশের সম্মুখীন হতে হবে তার বহু যুক্তি এ সূরায় বর্ণিত হয়েছে। আখেরাতের বাস্তবতা সম্পর্কে মানব মনে প্রত্যয় জন্মানোর উদ্দেশ্যে প্রথমেই এক ভীষণ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। অনুভূতির তীব্রতা বৃদ্ধির জন্যে এই ভীতিজনক বিষ্ময়কর ও কঠিন অবস্থার বর্ণনার সাথে সাথে কতো দ্রুতগতিতে কেয়ামত সংঘটিত হবে সে বিষয়ে পাঠককে সচকিত করা হয়েছে। এ সূরাটিতে অত্যন্ত দৃঢ় ও সিদ্ধান্তকারী কিছু কথা আলোচনা করা হয়েছে। এতে বহু সুক্ষ এবং হৃদয়গ্রাহী তথ্য, উপস্থাপনা বৈচিত্র্যের অনুপম দৃষ্টান্ত, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব এবং অনুভূতিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়ার মতো সুরের মুর্ছনা রয়েছে । সূরাটির প্রথম অংশে ইসলামের প্রথম যুগের একটি বিশেষ ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়েছে। একদিন নবী করীম (স.) কোরায়শ নেতাদের একটি দলকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে দাওয়াত দিচ্ছিলেন । এমন সময়ে আব্দুল্লাহ্‌ বিন উম্মে মাকতুম (রা.) সেখানে এসে হাযির হলেন । তিনি ছিলেন একজন দরিদ্র ও অন্ধ ব্যক্তি । রসূল (স.) তখন কয়েকজন নেতৃস্থানীয় লোকের সাথে যে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন এ কথা তিনি জানতেন না। তাই তিনি এসে রসূল (স.)-কে অনুরোধ করলেন আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা থেকে তাকে কিছু শেখাতে ৷ এ সময় রসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে ব্যাপারটা একটু খারাপ লাগলো, তাই তিনি একটু বেজার হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তার পরপরই কঠোর ভাষায় তিরস্কার স্বরূপ কোরআনের এই সূরাটি নাযিল হলো । এই সূরাতে একটি মযবুত মুসলিম সমাজের বুনিয়াদ কিভাবে গড়ে ওঠে এবং ইসলামী দাওয়াতের মূলকথা ও প্রকৃতি কী- সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে- ভ্রকুঞ্চিত করলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিলো এই কারণে যে, একজন অস্ধ ব্যক্তি এসেছে। তুমি কি জানো? …….. (আয়াত-১-১৫) এ সূরার দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ওই মহামূল্যবান কেতাবের প্রতি মানুষের অস্বীকৃতি ও আল্লাহর প্রতি লজ্জাকর অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্পর্কে । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে স্মরণ করাচ্ছেন কিভাবে সে অস্তিত্ব পেলো, কিভাবেই বা তার জন্যের সূচনা হলো, আর কেমন করেই বা আজ তার জীবন সহজ-সুন্দর হলো আর পরিশেষে মৃত্যুর পর তার রবের কাছে হাশরের ময়দানে সে হাযির হবে, এতদসত্ত্বেও কেমন করে আজ তার রবের হুকুম অনান্য করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে, ‘ধ্বংস হোক (অপরিণামদর্শী) মানুষ, কী নিদারুণ অকৃতজ্ঞ সে! জানো কোন জিনিস দিয়ে তাকে তিনি সৃষ্টি করেছেন? একবিন্দু শুক্র থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর এক নির্দিষ্ট পরিমাপ মতো তার গঠন কাজ সম্পন্ন করেছেন । এরপর তার জীবন যাপনের পথকে সহজ করে দিয়েছেন। পরবর্তীকালে তাকে মুত্যু দান করে কবরস্থ করার ব্যবস্থা করেছেন । এরপর যখন তিনি চাইবেন তাকে হাযির করবেন হাশরের ময়দানে ৷ এতদসত্ত্বেও কিছুতেই সে বিবেকের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না এবং যে নির্দেশ তাকে দেয়া হয়েছে তা পালন করছে না।’ সূরাটির তৃতীয় অংশে মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে তার দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত এমন কিছু জিনিষের দিকে ফেরানো হয়েছে যেগুলোর সাথে তার সার্বক্ষনিক সর্ম্পক বিদ্যমান সেগুলো হচ্ছে তার ও তার পশুর খাদ্যদ্রব্য। আরো মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে ওই সকল জিনিসের দিকে যেগুলো চেষ্টাসাধ্য করলে অর্জন করা যায়, যেগুলো তার ভাগ্যে নির্ধারিত রয়েছে, যার ফলে সে ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে যায়। এরশাদ হচ্ছে- “মানুষের (অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে) তাকানো উচিত তার খাদ্যদ্রব্যের দিকে । অবশ্যই আমি প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করিয়েছি, তারপর ফাটিয়ে চৌচির করে দিয়েছি যমীনকে, অতপর তার থেকে বের করেছি খাদ্যশস্য, আংগুর ও শাকসবজি । আরও বের করেছি বিভিন্ন ফলমূল ৷ যেমন যায়তুন ও খেজুর, ঘন সন্নিবেশিত পত্রপল্লবে সজ্জিত বাগবাগিচা, আরও বহু প্রকারের ফল ও তৃণলতা, যা তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ভোগের বস্তু।” সূরাটির সমাপ্তি পর্যায়ে কেয়ামতের বিকট চিৎকারধ্বনি সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। যেদিন সেই মহাবিপজ্জনক দিন তার ভয়াল মূর্তি নিয়ে হাযির হবে, সেদিনকার ওই দৃশ্যের ভয়াবহতা আলোচ্য অংশে বিবৃত শব্দগুলোর মাধ্যমে যেন ঠিক সেইভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে, সেদিন মানুষের অবস্থা এমন হবে যার থেকে একমাত্র নিজেকে বাচাতেই বাস্ত হয়ে যাবে এবং বাকী সবকিছু থেকে গাফেল হয়ে যাবে। নিদারুণ সে কষ্টের ছাপ লেগে থাকবে অনেকের চেহারায় । এরশাদ হচ্ছে, “যখন এসে যাবে সেই বিকট চিৎকারধ্বনি, সেদিন মানুষ তার ভাই থেকে পালাতে থাকবে, মা থেকে, বাপ থেকে, তার স্ত্রী ও সন্তান থেকেও ৷ প্রত্যেক ব্যক্তির সেদিন এমন এক কঠিন অবস্থা হবে, যা তাকে অন্য সবকিছু ভুলে যেতে বাধ্য করবে। কিছু চেহারা থাকবে সেদিন শুভ্র-সমুজ্জ্বল, হাস্যোদ্ভাসিত, সুসংবাদের আনন্দে মাতোয়ারা ৷ আবার কিছু চেহারা থাকবে সেদিন কালিমালিপ্ত ও ধূলোমলিন ৷ এরাই হবে তারা, যার৷ ছিলো অকৃতজ্ঞ ও সত্যকে অস্বীকারকারী চরম পাপাচারী।”

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১-১৬

كِرَامٍۭ بَرَرَةٍؕ

ও পূত চরিত্র লেখকদের হাতে থাকে।

ফী জিলালিল কুরআন:

আলোচ্য সূরার বিভিন্ন অংশে ও আয়াত গুলোতে পরপর বর্ণিত কথাগুলো পাঠকের মনে ভীষণভাবে দাগ কেটে যায়। এর মধ্যে প্রদত্ত সংবাদগুলো ও বর্ণনাভংগি এতো বেশী শক্তিশালী যে, কোনো মানব হৃদয়ই এতে বিগলিত না হয়ে পারে না। এখন আমরা এ সূরাটির এমন কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই, যা অত্যন্ত গভীরভাবে মনের ওপর রেখাপাত করে । যদিও প্রথম নযর ও‌ ভাসাভাসা দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘ভ্রুকুঞ্চিত করলো ও মুখ ফিরিয়ে নিলো সে…… উপদেশ গ্রহণ করবে আর সে উপদেশ তার কাজে লাগবে ।’ অপরদিকে যে ব্যক্তি তোমার কথার কোনো শুরুত্বই দেয়নি তুমি তার দিকেই বেশী মনোযোগ দিলে অথচ তোমার ওপর মানুষকে পবিত্র করার দায়িত্ব অর্পন করা হয়নি। যে ব্যক্তি ভীত-বিহবল অবস্থায় তোমার কাছে দৌড়ে এসেছে, তুমি তার থেকে গাফেল হয়ে যাচ্ছো এবং তাকে অবহেলা করছো? তুমি হয়তো ভেবেছো যে, নেতাগোছের লোকটি ইসলাম গ্রহণ করলে ইসলামের বিজয় হবে? না- তা কিছুতেই হবার নয়। এ তো এক যুক্তিপূর্ণ সদুপদেশ, যার ইচ্ছা এর থেকে শিক্ষা নিক! এ কথাগুলো একটি মর্যাদাবান কেতাবে লেখা রয়েছে। এ কেতাবের মরতবা হচ্ছে অতি উর্ধে। যাবতীয় সন্দেহ ও ভুল ভ্রান্তি থেকে এ কেতাব পবিত্র । ওই পাক সাফ লোকদের হাতেই এ কেতাব শোভা পায়,যারা সম্মানিত ও নেককার। মানুষের সঠিক মূল্যায়ন : যে ঘটনাটির কারণে সূরাটি নাযিল হয়েছিলো তা অবশ্যই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা! প্রথম দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব যতোই বুঝা যাক না কেন, তার থেকেও অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ সে ঘটনাটি ৷ এ উপদেশটি নিশ্চিত একটি মো’জেযা । এ উপদেশবাণী এবং এগুলোর মাধ্যমে যে আসল সত্যকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, আর এগুলো দ্বারা তিনি সমাজ জীবনে যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন, তা সম্ভবত ইসলামের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অলোৌকিক ঘটনা ৷ কিন্তু একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রত্যক্ষ মন্তব্যের মাধ্যমে এই উপদেশগুলো দেয়া হয়েছে। কোরআনে আল্লাহর পেশকৃত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে এটা এক বিশেষ প্রক্রিয়া । এই ঘটনার মাধ্যমে ইসলামের এক মৌলিক এবং স্থায়ী নীতি তুলে ধরা হয়েছে। সত্য বলতে কি, যে মূলনীতিটি এখানে পেশ করা হয়েছে এবং সমাজ জীবনে তার যে প্রতিফলন ঘটে তাই হচ্ছে বাস্তব ইসলাম। জীবনের এই বাস্তব দিকটি সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য । ইতিপূর্বে যতোগুলো আসমানী কেতাব এসেছে সবগুলোর উদ্দেশ্য ছিলো এটিই এবং এই ইনসাফ প্রতিষ্ঠাই ছিলো সেগুলোর মূল কাজ ৷ যদিও আজ সেগুলো মুল অবস্থায় না থাকার কারণে বাস্তব জীবন সম্পর্কিত কথা সেখানে তেমন বেশী কিছু পাওয়া যায় না। এ সত্যটি আজ অবিমিশ্র নেই। সংমিশ্রণ-দুষ্ট হওয়ায় বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়েছে এবং বিষয়টি আজ একারণে খুব সহজ সরলও নেই ৷ প্রশ্ন হলো, এসব ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি একটি জনপদ বা এক জনগোষ্ঠীর সাথে কিভাবে ব্যবহার করা হবে। এই ঘটনার ভিত্তিতে কোরআনের যে মন্তব্য আমাদের সামনে আছে তা-ই হচ্ছে সূরাটির মূল তাৎপর্য, যাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটাই সূরার তাৎক্ষণিক ও স্থায়ী আলোচ্য বিষয় । মানুষ কিভাবে জীবনের সকল বিষয়কে মূল্যায়ন করে, সে সম্পর্কে এখানে বিশদ আলোচনা এসেছে। আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, কোত্থেকে মানুষ তাদের আসল মূল্যবোধ লাভ করে এবং এ মূল্যায়নের‌ মাপকাঠিই বা কী? সূরাটির শুরুতে আল্লাহর যে নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে তার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে এ কথা স্পষ্টভাবে জানানো যে, মানুষ যেন পৃথিবীর জীবনে তার যাবতীয় কাজ ও ব্যবহারকে আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিতে পরিমাপ করে। এ নির্দেশগুলো তো সরাসরি আসমান থেকে নাযিল হয়েছে যার মধ্যে পার্থিব কোনো জিনিসের বা কোনো জায়গার স্থানীয় কোনো প্রভাব স্বার্থ বিজড়িত নেই, কোনো সংকীর্ণ গন্ডি বা কারো কোনো সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণার দখলও সেখানে নেই। এ নির্দেশ যেমন শুরুত্বপূর্ণ, তেমনই কঠোর। নিজ মান সম্ভ্রম, মূল্যবোধ ও জীবন যাপন করা অবশ্যই বড়ো কঠিন । এরপর মানবতার অবমাননা ও অবমুল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম তার বক্তব্য নিয়ে হাযির হয়েছে৷ বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্যে সে-ই সব থেকে বেশী সম্মানী যে আল্লাহর কাছে সব থেকে বেশী পরহেযগার’ মানুষের জীবনে সাধারণভাবে যেসব জিনিস গুরুত্বপূর্ণ এবং যে মাপকাঠি দিয়ে মানুষকে মানুষের মান মর্যাদাকে মাপা হয় সে বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাদের চেতনার মধ্যে এক দায়িত্ববোধ কাজ করে। এটা মানুষের মর্যাদাকে পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রভাবিত করে! তাই সেই ধ্যান ধারণার ওপর কঠিন আঘাত হেনে এই বস্তুবাদী মূল্যবোধকে বদলে দেয়া হচ্ছে এবং তাতে নতুন চেতনা সংযোজন করা হচ্ছে । এটা সরাসরি আকাশ থেকে তাদের জানানো হচ্ছে । মহান আল্লাহর দাড়িপাল্লায় মর্যাদার একমাত্র মান হিসেবে এই তাকওয়া-পরহেযগারীই একমাত্র স্বীকৃত ৷‌ এরপর অবস্থার প্রেক্ষিতে জীবনের সঠিক মূল্যবোধকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্যে তাতে ওই তীব্র সতর্কবাণী আসছে। আসছে মাপের যন্ত্র বা দাড়িপাল্লা, এখানে অন্য কোনোটির কোনো মূল্য নেই। একমাত্র পরাক্রমশালী আল্লাহর নিক্তিতে যার মূল্য আছে তাই হচ্ছে আসল মূল্য । মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হচ্ছে মানুষ দুনিয়াবী দৃষ্টিতে যে জিনিসটাকে মুল্যবান বলে গণ্য করে, তা প্রত্যাখ্যান করা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মানুষের মান মর্যাদা সম্পর্কে যে ধারণা বিরাজ করছে, যে সকল জিনিস দিয়ে মানুষের মর্যাদা পরিমাপ করে ও স্বীকৃতি দেয় মহান আল্লাহর কাছে তার এক কানাকড়ি মূল্য নেই। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মর্যাদা যেভাবে দিচ্ছেন সেটাই হচ্ছে প্রকৃত মর্যাদা ৷ একবার তাকিয়ে দেখুন দৃশ্যের দিকে, আসছে সেই দরিদ্র অন্ধ ব্যক্তিটি । কে সে? ইবনে উম্মে মাকতুম। আসছে কার কাছে আসছে! স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে। দৃশ্যটি ছিলো এমন, রসূলুল্লাহ (স.) কোরায়শদের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথায় ব্যস্ত। এরা রাবিয়ার দুই পুত্র ওৎবা ও শায়বা, আবু জাহল আমর ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ, ওলীদ ইবনে মুগীরা এবং রসূল (স.)-এর আপন চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালেব ৷ ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে এদের সাথে গভীর মনোনিবেশ সহকারে কথা বলছেন আল্লাহর রসূল (স.)। বড় আশা তার মনে, এরা ইসলাম গ্রহণ করলে মক্কায় ইসলামের যে দুর্দিন চলছে, যে কঠিন অবস্থার মোকাবেলা তাঁকে ও মুসলমানদেরকে করতে হচ্ছে তার অবসান ঘটবে । ওই দলটিই তাদের ধন-সম্পদ, সামাজিক দাপট ও শক্তি-ক্ষমতা নিয়ে তার পথের কীটা হয়ে রয়েছে। প্রবল বাধা সৃষ্টি করে তারা জনগণকে স্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে রেখেছে। এভাবে তারা এক ভীষণ ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছিলো যাতে করে শেষ পর্যন্ত মক্কায় ইসলামের প্রসার থেমে যায় এবং কেউ প্রকাশ্যে ইসলামের কথা বলতে না পারে। মক্কার বাইরেও যাতে কেউ ইসলাম গ্রহণ করতে না পারে তার জন্যে এসব ব্যক্তি নিজ নিজ আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলো ৷ এ জন্যে তারা সর্বপ্রথম তাদের গোত্রীয় সংহতিকে কাজে লাগিয়েছে কারণ আরবে গোত্রীয় বন্ধন ছিলো খুবই মযবুত । ন্যয় হোক বা অন্যায় হোক, স্বগোত্রীয় হলেই যে কোনো মূল্যে এবং সর্বাবস্থায় তাকে সমর্থন দিতে হবে- এটা ছিলো তৎকালীন জাহেলিয়াতের এক বিরাট বৈশিষ্ট্য । এই পরিস্থিতিতে রসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে অন্ধ ও দরিদ্র ব্যক্তিটির আগমন ঘটছে, আর তিনি ওই দলটিকে কিভাবে দীনের পথে আনা যায় যায় সেই ব্যাপারে আলোচনা ব্যস্ত। এ উদ্যোগ ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের কারণে নয়, নয় কেনো ব্যক্তিগত উপকারের জন্যে, কেবলাত্র ইসলামের জন্যে এবং ইসলামের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির খাতিরেই এই প্রচেষ্টা । একমাত্র এই অনুভূতিই তার মধ্যে কাজ করছিলো যে, ওরা ইসলাম গ্রহণ করলে মক্কায় বিরাজমান ইসলামের কঠিন বিরোধিতা ও ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর যে নির্যাতন চলছিলো তা বন্ধ হয়ে যাবে। মক্কার বাইরে আশপাশে যে সকল গোত্র আছে তাদের অপতৎপরতাও এদের ইসলাম গ্রহণ করার কারণে থেমে যেতে বাধ্য হবে । এমনই এক কঠিন মুহূর্তে এই ব্যক্তিটি এসে রসূলুল্লাহ (স.)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি যে কী বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছেন এটা তার মোটেই অজানা নয়। এমতাবস্থায় মাঝপথে তার কথাকে কেটে দেয়া ও তার কথার গুরুত্বকে হালকা করে দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার খারাপ লেগেছে এবং খারাপ লাগাটা তাঁর চেহারায়ও ফুটে উঠেছে, যা ওই অন্ধ ব্যক্তিটি দেখতে পায়নি। কিছু রসূলুল্লাহ (স.)-এর মুখ বেজার হয়ে গিয়েছে এবং তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ওই দরিদ্র অন্ধ ব্যক্তি থেকে, যে এমন এক জরুরী বিষয়ে আলোচনার ধারাটা কেটে দিয়েছে, যে আলোচনার মাধ্যমে তিনি আশা করেছিলেন যে, মক্কার নেতৃস্থানীয় লোকেরা দ্বীন গ্রহণ করবে ও ইসলামের সাহায্যে হাত বাড়াবে । এখানে তার বেজার হওয়াটা দাওয়াতী কাজে তার একনিষ্ঠতার পরিচয়ই বহন করছিলো । তাদের সাথে আলোচনায় এই যে, মহব্বত ও আন্তরিকতা সে তো ইসলামের জন্যেই ৷ তার উৎকণ্ঠা ও একাগ্রতা একমাত্র ইসলামের প্রসারের জন্যেই। তারপরও মহানবী (স.)-কে আল্লাহ তায়ালা কঠোরভাবে তিরস্কার করছেন। যাকে কোরআনে পাকের অন্য স্থানে মহান চরিত্রের অধিকারী বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং তার নিকটতম বন্ধু বলা হয়েছে। তাকে এভাবে ধমক দেয়ার কারণ হচ্ছে, যে বিষয়ে তাকে তাঁর ব্যবহারকে আপত্তিকর বলা হয়েছে সে বিষয়টি দ্বীন ইসলামের ওই মৌলিক জিনিসগুলোর অন্যতম, যেগুলোর ওপর ইসলামের গোটা প্রাসাদ দাড়িয়ে আছে। যে ভাষায় কোরআনের মধ্যে এই তিরস্কারটি এসেছে, তাও এমন এক স্বতন্ত্র ভাষা, যা মানুষের তৈরী কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিলো না। সাধারণভাবে লেখ্য ভাষায় তা যে কোনো ভাষারই হোক তার নিজস্ব একটি পদ্ধতি প্রকাশভংগি থাকে যাতে কোনো না কোনো ব্যক্তি বা জাতির বাকরীতরি অনুকরণ দেখা যায়। এই ধরনের কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করলে কোরআনে বর্ণিত এই বিশেষ প্রকাশভংগির সাবলীলতা এবং হৃদয়ের ওপর তার প্রভাব বিস্তারকারী ভাবগাম্ভীর্য মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হতে পারে। কতো মর্মস্পর্শীভাবে ছোট ছোট বাক্যাংশের মাধ্যমে কথাগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে, ‘সে ভ্রু কুঞ্চিত কালো এবং মুখ ফিরিয়ে নিলো, এ কারণে যে, এই অন্ধ ব্যক্তিটি তার কাছে এসেছে।’ কথাটি এমনই অসম্ভোষজনক ও অপ্রিয় যে, আল্লাহ তায়ালা তার নবী ও পরম বন্ধুকে সরাসরি ওই কঠিন কথাটি বলা পছন্দ করেননি বরং নাম পুরুষের বা তৃতীয় ব্যক্তির জন্যে বলা পদ্ধতিতে বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। এতে একদিকে যেমন ওই ব্যবহারের প্রতি ঘোরতর আপত্তি প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি সরাসরি সম্বোধন করে তিরস্কার করার কারণে যে বেদনাদায়ক অবস্থার‌ সৃষ্টি হতে পারতো সেটাও এড়ানো সম্ভব হয়েছে। অপরদিকে নবী (স.) এর মর্যাদা, তার প্রতি আল্লাহর করুণা ও সম্মান ওই অপ্রিয় কথাটি উল্লেখ করার কারণে কোনোক্রমেই ক্ষুন্ন হয়নি। এভাবে যে ব্যবহারটি কঠিন তিরস্কার ও অসম্ভোষ ছিলো তা প্রকাশ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে অতি সূক্ষভাবে তাকে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এ জন্যে পরক্ষণে সরাসরি সম্বোধনটি অত্যন্ত হালকাভাবে করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ‘তোমার কি জানা আছে, হয়তো সে-ই পবিত্রতা গ্রহণ করবে অথবা সে-ই শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং সে শিক্ষা তারও কাজে লাগবে।’ তোমার কি জানা আছে যখন এই মহা কল্যাণ সংঘটিত হবে তখন হয়তো সেই অন্ধ ও দরিদ্র ব্যক্তিটিই পবিত্রতা অর্জন করবে৷ আগ্রহ নিয়ে এই অন্ধ ব্যক্তিটি তোমার কাছে কিছু কল্যাণ লাভের আশায় এবং তার অন্তরকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ছুটে এসেছে। যার ফলে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে এবং সে শিক্ষা তার কাজ লাগবে । তুমি জানো যে, এই হৃদয়টি দরিদ্র বেচোরার অন্তরটি আল্লাহর নূরের আলোকে আলোকিত হয়ে যাবে এবং এই উর্ধলোকের নূরের সাথে সংযোগ লাভে ধন্য হবে। হেদায়াত কবুল করার জন্যে যে যে এভাবে উন্মুক্ত হয়ে যায় তখন তাকে দেখে আরও বহু অন্তর হেদায়াতের আলোকে আলোকিত হয়৷ এই আন্তরিক মহব্বত ও নিষ্ঠার সাথে ঈমান আনাই হচ্ছে সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা আল্লাহর পাল্লায় ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে । পরবর্তী কথায় তিরঙ্কার আরো তীব্রতর হয়ে উঠেছে, আরও কঠোর হয়ে আসছে কথার সুর। সে সুরে তিরস্কার কিছুটা বিস্ময়ে রূপান্তরিত হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, “কী আশ্চর্য! যে ব্যক্তি তোমার কথার কোনো পরোয়াই করেনি, তুমি তাকে নিয়েই ব্যস্ত। তোমার কিসের মাথা ব্যথা? সে যদি পবিত্র না হতে চায়, না হোক । ভীতসন্ত্রস্ত হৃদয় নিয়ে যে তোমার কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, তুমি তার প্রতি গাফেল হয়ে গেলে।” অর্থাৎ তোমার থেকে, তোমার দেখানো জীবন পথ থেকে, তোমার কাছে হেদায়াত ও কল্যাণের যে ব্যবস্থা আছে যে সত্যের আলো ও পবিত্রতা আছে, তা থেকে যে হঠকারী ব্যক্তিটি মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং দুনিয়ার লোভ লালসায় মজে থাকা যেসব মানুষ সত্যের প্রতি উদাসীন ভাব প্রকাশ করলো, তাদের জন্যেই তুমি ব্যস্ত হয়ে ওই গরীব বেচারার প্রতি উদাসিনতা দেখালে! তোমার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়ে রইলো দুনিয়াপাগল লোকদের জন্যে? তোমার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা জারি রইলো কেবল তাদেরকে হেদায়াত করার জন্যে? তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে ওই অন্ধ ব্যক্তিটি থেকে, তাও আবার এমন লোকদের জন্যে, যারা তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রইলো । তোমার কি এসে যায় যদি তারা পবিত্র না-ই হয়? তারা যদি পাপ পংকিলতায় ডুবে থাকে, যদি জীবনভরে অপবিত্র থাকে, তাতে তোমার ক্ষতি কী? তোমাকে তো তাদের অপরাধের জন্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না বা তোমার কাছে তাদের ব্যাপারে কোনো কৈফিয়তও তলব করা হবে না। তাদের তারা দ্বীন গ্রহন করলে তুমি যে কোনো সাহায্য পাবে এমনও তো নয়। কেয়ামতের দিন তাদের মোকদ্দমা নিয়ে তুমি আল্লাহর দরবারে হাযির হবে তাও তো নয়। অপরদিকে যে ব্যক্তি আগ্রহ ভরে তোমার কাছে ছুটে এলো, এলো স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে । যে ব্যক্তি মনে প্রাণে । অন্যায়-অপবিত্রতা থেকে বাচার চেষ্টা করছে তুমি তার থেকেই গাফেল হয়ে গেলে! যে ব্যক্তি সঠিক পথপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে এসেছে, তার প্রতি উদাসীনতা দেখানোর কারণেই সাংঘাতিকতভাবে ঘটনাটি এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে।  দ্বীনের দাওয়াত নিজস্ব গতিতে চলবে :  এরপর আরও তীব্র হচ্ছে তিরস্কারের সুর। এমনকি শেষ পর্যন্ত চরম ধমকের সুরে বলা হয়েছে, তুমি কি ভেবেছো, ওই সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারণে ইসলামের ইযযত বাড়বে, তাই না? না, কিছুতেই তা হবে না। এভাবে সম্বোধন করে এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝার জন্যে চিন্তা করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। তারপর এই দাওয়াতের মূল তাৎপর্য, এর মূল্যমান এবং এর গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সাথে সাথে এটাও বলা হয়েছে যে, ইসলাম কোনো কিছুরই মুখাপেক্ষী নয়। এ এক মহান দাওয়াত ৷ কেউ সমর্থন করুক আর না করুক, ইসলাম আপোষহীনভাবে নিজ পথে চলবে। যে ইসলাম গ্রহণ করবে একমাত্র তার জন্যেই ইসলাম চিন্তা ভাবনার পথ খুলে রাখবে ৷ যে এর স্বাদ গ্রহণ করতে চাইবে একমাত্র সে-ই এর উপকার লাভে ধন্য হবে- সমাজে তার মর্যাদা বা গুরুত্ব যাই-ই হোক না কেন। এরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই এ হচ্ছে এক উপদেশ, যার ইচ্ছা হয় সে একে গ্রহণ করুক । এ উপদেশসমূহ লিখিত রয়েছে সম্মানিত কেতাবে, যার মর্যাদা অতি উচ্চে। এ কেতাব অতি পবিত্র। এ কেতাব থাকে পাক-সাফ লোকদের হাতে, তারা সম্মানিত, তারা নেককার ।’ মর্যাদাবান এ কেতাব, সকল বিবেচনায় তা নির্ভুল, এর পাতাগুলো পবিত্র এবং সম্মানিত ৷ এ মহান কিতাব সেই নিবেদিতপ্রাণ নেতৃস্থানীয় বার্তাবাহক ফিরিশতাদের মাধ্যমে রাসূলদের কাছে পৌছানো হয়েছে, পৌছানো হয়েছে নিজ নিজ উম্মতের কাছে পৌছে দেয়ার জন্যে । এ কারণে সেই রাসূলরাও সম্মানিত জাহেলিয়াতের অন্ধকারে সঠিক পথের খৌজে যারা হাতড়ে মরেছে, তাদের কাছেই ইসলামের দাওয়াত পৌছানো প্রয়োজন, যেন তারা এর থেকে জীবনের অমানিশায় সঠিক পথের সন্ধান পায় । সুতরাং এর থেকে সে-ই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, যে এর মর্যাদা বুঝবে এবং এর মাধ্যমে পবিত্রতা লাভ করতে চাইবে । এটিই আসল মানদণ্ড, এটা আল্লাহর নিজস্ব পরিমাপ যন্ত্র । এ পাল্লার দ্বারা সকল কাজ ও ব্যবহারের মূল্যায়ন করা যায় এবং সমস্ত মানুষকে এ দিয়ে পরীক্ষা করা যায়। এ কথাটিই এখানে আল্লাহ্‌ তায়ালা তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং এই মাপকাঠিতেই সব রকমের পরিবেশ পরিস্থিতিতে যে কোনো জিনিসই বিচার বিশ্লেষণ করা যায়। এখন প্রশ্ন আসে, কোথায় এবং কখন এ ঘটনাটি ঘটেছিলো? ঘটনাস্থল ছিলো মক্কা নগরী । যেখানে ইসলামের দাওয়াত সকল দিক থেকে বাধা বিপত্তি প্রতিরোধ ও ষড়যন্ত্রের স্বীকার হচ্ছিলো। মুসলমানদের অবস্থা ছিলো অতি করুণ । সংখ্যায় তারা ছিলো নগণ্য ৷ এ সময়ে মক্কার গোত্রপতিদের একটি দলকে খাতির করা এবং তাদের মন জয় করার চেষ্টা করাটা কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে ছিলো না এবং একটু গভীরভাবে ভাবলে এটা বুঝা যায় যে, ওই দরিদ্র অন্ধ ব্যক্তির সাময়িক প্রতি অমনোযোগিতাও কোনো স্বার্থের কারণে ছিলো না। কোনো ব্যক্তি বিশেষকে অবহেলা বা অবজ্ঞার যা-ই এখানে ঘটেছে তা ছিলো একমাত্র দাওয়াতী কাজের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে । এই মুল্যবোধের ভিত্তিতেই মানুষকে আল্লাহ তায়ালা পরিমাপ করেন তার মধ্যে গ্রহণযোগাতা কতোটুকু আছে বা আদৌ আছে কি না তা পরখ করে নেন। এই মূল্যবোধকে জীবনের কোনো পর্যায়ে বা কোনো অবস্থাতে উপেক্ষা করা যেতে পারে না। কারণ এর ওপরই ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা এবং মানবমন্ডলীর জন্যে ইসলামের কল্যাণকামিতা নির্ভর করছে। এই মূল্যবোধের ওপরই এর মর্যাদা, এর শক্তি এবং সকল দিক ও বিভাগ থেকে এর প্রতি সমর্থন ও বাস্তব সাহায্য নির্ভর করে। ইসলামী সমাজের প্রাণ : ওপরে বর্ণিত এই বিচ্ছিন্ন ঘটনার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান হচ্ছে সেই আসল কথাটি যাকে বলা যায় ইসলামর প্রাণ । তা হচ্ছে, মানুষকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সকল সাহায্য সহযোগিতা, গৌরব, শক্তি সামর্থ্য, একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে । পার্থিব কোনো উপায় উপাদান থেকে তা আসতে পারে না। সাময়িকভাবে কোনোটি মূল্যবান হলেও তা নিছক সাময়িক এই কথাটি অত্যস্ত স্পষ্টভাবে কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সব থেকে বেশী সম্মানিত, যে সব থেকে বেশী আল্লাহকে ভয় করে চলে।’ আর এটা নিশ্চিত যে, যার মধ্যে ওই তাকওয়ার গুণটি আছে, সে-ই বেশী মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য । তার দিকেই বেশী খেয়াল দেয়া কর্তব্য এবং তার প্রয়োজন পূরণ করার চেষ্টাই আগে করা উচিত । যদিও তার মধ্যে অন্যান্য গুণ, যোগ্যতা, ধনসম্পদ, বংশীয় মর্যাদা, শক্তি সামর্থ বা সামাজিক তেমন কোনো পরিচিতি না থাকে। আল্লাহর কাছে এমন মানুষের কোনো মূল্যই নেই যার মধ্যে ঈমান, তাকওয়া ও পরহেযগারীর গুণ নেই। যে যোগ্যতা আল্লাহর কাছে স্বীকৃতি পাবে তা হচ্ছে ঈমান, তাকওয়া বা পরহেযগারী । আলোচ্য এই সূরাটির মধ্যে এই মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই আল্লাহ তায়ালা তুলে ধরেছেন এবং ওই বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির বর্ণনার মাধ্যমে এই মূল সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ রব্বুল ইযযত যেভাবে এ বিষয়টি উল্লেখ করে ইসলামের মূল শিক্ষাটি তুলে ধরেছেন এবং কঠোরভাবে তিরস্কার করে যে কঠিন সত্যটিকে তার সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাতে রসূলুল্লাহ (স.) গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি ভীষণভাবে চমকে উঠেছেন। এরপর তিনি নিজের জীবনে ও গোটা মুসলিম সমাজে এই মহা সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার প্রথম পদক্ষেপ ছিলো এই যে, এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে তাকে যে শিক্ষা দেয়া হলো এবং যে কঠোর তিরস্কার করা হলো তা ঘোষণার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে, ঘোষণাটি ছিলো বড়ই চমকপ্রদ । একমাত্র আল্লাহর রসূলের পক্ষেই এই কঠিন তিরস্কারের কথা জনসাধারণের সামনে ঘোষণা করা সম্ভব ছিলো । একজন রাসূল ব্যতীত অন্য কোনো মানুষের পক্ষে এভাবে নিজের এই সাময়িক দুর্বলতা ও ত্রুটির কথা প্রকাশ করার চিন্তাই করা যায় না। অবশ্যই এ এক চরম সত্য যে, একমাত্র রসূলই পারেন অকপটে নিজের দুর্বলতাকে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিতে ৷ কারণ নবী রসূলের দুর্বলতাকেই আল্লাহ তায়ালা দূরীভূত করেছেন। মানুষকে একথা জানানো হয়েছে, একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণে তাকে এমন কড়াভাবে তিরস্কার করা হয়েছে- তাও শুধুমাত্র একটি পদস্খলনের কারণে, এটা কোনো সহজ ব্যাপার ছিলো না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ছাড়া অন্য যে কোনো মহৎ ব্যক্তির জন্যে এটাই যথেষ্ট হতো যে, তিনি নিজের ত্রুটি বুঝে এবং স্বীকার করে এর পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে জন্যে পরবর্তীতে সতর্ক থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন। কিন্তু এতোটুকু করেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সন্তুষ্ট হননি এবং একে যথেষ্টও মনে করেননি, বরং তার ব্যবহার ছিলো অন্যরূপ। কোরায়শদের ওই সম্পদশালী, শক্তিমান ও অহংকারী লোকদের দলের প্রত্যেকের আসল চেহারা মুসলমানদের সেই চরম দুর্দিনে সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরা, এটা কোনো চাট্টিখানি ব্যাপার ছিলো না। এ ছিলো এক চরম দুঃসাহস । এমন সাহসিকতার পরিচয় একমাত্র নবীর পক্ষেই দেয়া সম্ভব ছিলো তার মনের মধ্যে স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার অনুভূতি সদা জাগরূক ছিলো বলেই এটা সম্ভবপর হয়েছিলো । পরিস্থিতি সেখানে তো এই বিরাজ করছিলো যে, হাশেমের পুত্র আব্দুল মোত্তালেব, তার মৃত পুত্র আব্দুল্লাহর ছেলে মোহাম্মদের মুখ দিয়ে ওই সম্ভ্রান্ত কোরায়শ নেতাদের সম্পর্কে অমন বিরূপ মন্তব্য ছিলো তাদের জন্যে চরম অসহনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য ঔদ্ধত্য! তারা বলতো আল্লাহর কেতাব কোরআন মক্কা-মদীনার কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির ওপর নাযিল হলো না কেন? যদিও মোহাম্মদ (স.)এর পূর্বপুরুষরা মক্কার নেতৃত্ব দিতেন। কিছু নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে মোহাম্মদ তো কোনো রাষ্ট্রের কর্তা বা শাসক ছিলেন না, এটাই ছিলো তাদের প্রশ্নের মূল বিষয়। এ সমাজে এবং ওই কঠিন সময়ে এতো বড় কঠিন নীতিকে চালু করা একমাত্র ওহীর অধিকারী হওয়ার কারণেই রসূলুল্লাহর পক্ষে সম্ভব ছিলো। এটা পার্থিব কোনো শক্তি সামর্থের অবদান হতে পারে না। গোটা সমাজের চরম বিরোধিতার মুখে দাড়িয়ে এতো দীর্ঘদিন ধরে ইসলামের কঠিন নীতিগুলো চালু করার জন্যে একমাত্র আল্লাহর সাহায্যই ছিলো তার সম্বল. আর এই সম্বলকে অবলম্বন করেই নবী মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এই অবর্ণনীয় ও অব্যক্ত শক্তি অনুভব করতেন এবং সকল প্রকার বিরোধিতার মোকাবেলায় দাড়িয়ে অবিচল হয়ে থাকার সাহস অনুভব করতেন । ইসলামী সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই নবী (স.) কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে অন্তরের মধ্যে এই প্রকার দৃঢ়তা ও শক্তি অনুভব করতেন।এভাবে ওই সমাজের স্তরে স্তরে ইসলামী মূলনীতির যে শেকড় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা বহু শতাব্দী ধরে মুসলিম জাতিকে পৃথিবীতে মান-সন্ত্রম নিয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে, যে কোনো বড় থেকে বড় বিপদের মোকাবেলা করতে মানসিক শক্তি যুগিয়েছে । পৃথিবীর সব রকমের শক্তিকে উপেক্ষা করে ভ্রমোন্নতির পথে তাকে এগিয়ে দিয়েছে। আর এ কারণেই বলা যায়, ইসলামের এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ছিলো গোটা মানব জাতির জন্যে এক পুনর্জন্মের শামিল ৷ সত্য বলতে কি, প্রথম মানুষ সৃষ্টির থেকেও এ পুনর্জাগরণ ছিলো বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের সংস্পর্শে এসে তৎকালীন আরবের মানুষ পার্থিব সম্পর্ক, মান সম্ভ্রমের নীতি ও উঁচু নীচুর ব্যবধান থেকে মুক্তি লাভ করে। অপরদিকে আখেরাতকেন্দ্রিক জীবনধারা গড়ে ওঠার কারণে সমাজে মানুষের মূল্যায়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় যা দুনিয়ার চিন্তা চেতনা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । অবশ্য মূল্যায়নের এ নতুন ধারা তৎকালীন নিগৃহীত মানবমন্ডলীর সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং প্রায় সকল মহলের কাছে ক্রমান্বয়ে এ মতবাদ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলো । এ সময় এমন একটি ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেলো যাকে কেন্দ্র করে নবী মোহাম্মদ (স.)-কে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্ক করা প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এই সতর্কাকিরণের মাধ্যমে মুসলিম জনসাধারণের বিবেকও সমধিক জাগ্রত হয়েয়গেলো। সাথে সাথে গোটা মুসলিম সমাজ কিসের ভিত্তিতে মানুষের কদর হওয়া উচিত, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট এক দিক নির্দের্শনা পেয়ে গেলো । সম্ভবত মানবতার এই পুনর্জন্মের তাৎপর্য আমরাই ভালো করে বুঝতে পারবো না। কারণ যে সমাজে আমরা বাস করি, সেখানে মানুষের মান সম্ভ্রমের মানদন্ড অন্য কিছু ৷ এ সমাজে মানুষের ঐতিহ্য, মূল্যায়ন ও ব্যবহার বছকাল ধরেই গড়ে উঠেছে। আমরা হঠাৎ করে সে বলয়ের বাইরে চলে আসতে পারি না বা সে চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তও হতে পারি না। তবে এখানে আমরা  এই সত্যই উপলব্ধি করছি যে, আমাদের সমাজে মানুষের যুল্যায়ন করা হয় তার সম্পদের ভিত্তিতে । এ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদেরকে বস্তুবাদের গোড়ার ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। বস্তুবাদের প্রবক্তারা বরাবরই ধনসম্পদের অধিকারী হওয়া  হওয়া-না হওয়ার ওপর মানুষকে মর্যাদা দিয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বস্তুবাদী সভ্যতায় মানুষের বিশ্বাস, সভ্যতা ও কৃষ্টি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, আইন কানুন, পরিচিতি, জীবন ও জগত সম্পর্কে এক বিশেষ ধ্যান ধারণা গড়ে উঠেছে। বস্তুবাদের এই উগ্র সভ্যতার মধ্যে ইসলামের আগমনে যে নতুন সত্যতা ও ব্যবহার পদ্ধতি শুরু হলো এবং তৎকালীন সমাজের গোটা কাঠামোকে ভেংগে চুরে মানুষের দৃষ্টিভংগিতে আমুল পরিধর্তনের যে উত্তাল ঢেউ এলো- তা ছিলো ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ঢেউ, তা ছিলো রীতিমতো এক অত্যাশ্চার্য ব্যাপার । যাকে এক বিরাট মোজেযা বললেও অত্যুক্তি হবে না! জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও ইসলাম : মানব সভ্যতার জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামের প্রবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা সবসময়ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে এবং অন্যান্য সকল দৃষ্টিভংগি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেছে! কিন্তু তৎকালীন আরব পরিবেশ পরিস্থিতিতে এই পরিবর্তন কোনো সরল ও সহজ ব্যাপার ছিলো না। মুসলমানদের নিজেদের কাছেও প্রথম দিকে এই পরিবর্তন বড় কঠিন জিনিস বলে মনে হয়েছিলো । কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এই ঘটনার মাধ্যমে যে শিক্ষা পেলেন এবং যেভাবে তিনি প্রভাবিত হলেন, কোরআনে বর্ণিত সেই মহান নীতিকে তিনি তাঁর নিজের ব্যবহার ও বাস্তব কাজকর্মের দ্বারা তার সংগী সাথীদের মধ্যে ও সমাজের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার নতুন লাগানো এই মূলনীতির চারাগাছটির পরিচর্যা করেছেন, একে সযত্নে গড়ে তুলেছেন। অবশেষে এই মহান নীতি সমাজের গভীরে শেকড় গাড়তে এবং শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে তার ছায়াতলে বহু যুগ ধরে গোটা মুসলিম সমাজকে আশ্রয়দানে সমর্থ হয়েছে, যদিও একে উৎখাত করার জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা যুগ যুগ ধরে বহু অপচেষ্টা চালিয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে দেখলেই অত্যন্ত হৃদয়াবেগ নিয়ে অভিনন্দন জানাতেন এবং মুচকি হেসে সম্বোধন করে বলতেন, স্বাগতম বন্ধু হে আমার, বন্ধু তোমার খাতিরেই আল্লাহ তায়ালা আমাকে দারুণভাবে তিরস্কার করেছেন। মদীনায় হিজরত করার পর দু’দু’বার তিনি তাকে নিজের অনুপস্থিতিতে মদীনার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেছেন। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ভেদাভেদ ও উঁচু-নীচুর এই কৃত্রিম ব্যবধানকে খতম করার মানসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তার নিজ ফুফাতো বোন আসাদ গোত্রের যয়নাব বিনতে জাহশকে তার আযাদ করা ক্রীতদাস হারেসার পুত্র যায়েদের সাথে বিয়ে দেন৷ যদিও বিবাহ ব্যাপারটা বড় নাযুক জিনিস এং বিশেষ করে আরব দেশের সেই সমাজে সামাজিক ভেদাভেদের অবস্থা ছিলো আরও বেশী কঠিন । হিজরতের প্রথম যুগে রসূলুল্লাহ (স.) মদীনায় আগমনের পর মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করতে গিয়ে তার নিজ চাচা হামযা (রা.)-এর সাথে তার মুক্ত ক্রীতদাস যায়েদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করলেন। ভাই ভাই বন্ধনে আবদ্ধ করলেন খালেদ ইবনে রোয়ায়হা আল খাসআমী ও বেলাল ইবনে রাবাহকে। এরপর তিনি মুতার কঠিন রণক্ষেত্রে যায়েদকে সেনাপতি বানিয়ে পাঠালেন। এ যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে যে তিন জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিলো তাদের প্রথম জন ছিলেন যায়েদ (রা.)। (প্রকাশ থাকে যে, এক জনের শাহাদাতের পর পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনের দায়িত্ব গ্রহণের কথা বলায় নামাংকিত ওই ব্যক্তিরা স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন যে, তারা অচিরেই শহীদ হয়ে যাবেন ৷ অবশ্য এতে নিবেদিতপ্রাণ ওই মুজাহিদদের মধ্যে এতোটুকু ভাবান্তর ঘটেনি) । তৎকালীন বৃহত্তম শক্তি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রেরিত আনসার ও মোহাজেরীনের সম্মিলিত তিন হাজার মোজাহেদের এই ছোট্ট দলের পরিচালনা ভারের প্রথম দায়িত্ব দেয়া হলো যায়েদকে। তার অবর্তমানে পতাকা তুলে নেবেন জাফর ইবনে আবি তালেব এবং তিনি না থাকলে আস্দুল্লাহ ইবনে আবি রাওয়াহা এ দায়িত্ব পালন করবেন। এ দলের মধ্যে মহাবীর খালিদ ইবনে ওলীদও ছিলেন । তবু প্রথম দায়িত্ব দেয়া হলো একজন মুক্ত ক্রীতদাসকে, এটা করা হয়েছিলো শুধুই সামাজিক ছোট বড় ভেদাভেদকে তুলে দেয়ার উদ্দেশ্যে । একবার কল্পনার চোখে তাকিয়ে দেখুন সে মহান ছোট্ট দলটির দিকে । অগ্রভাগে পতাকা হাতে রসুলুল্লাহ (স.)-এর মুক্ত ক্রীতদাস হযরত যায়েদ, সংগে চলেছেন আনসার মোহাজেরদের বড় বড় নেতারা। কোন সে পরশমনি যার সংস্পর্শে এসে উচ্ছৃংখল দুর্ধর্ষ ও অনমনীয় আরব শার্দুলরা এমন ভারসাম্যপূর্ণ ও অনুগত হয়ে গেলো । কোন সে মহান বাণী ছিলো এটি: যার সংস্পর্শে দুর্দম্য সামাজিক ব্যবধানের খোলস এভাবে খান খান হয়ে ভেংগে গেলো । যে সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সকল নবীর আগমন, যে সত্যের অনির্বাণ শিখা জ্বালাতে গিয়ে রহমানুর রহীম আল্লাহ তায়ালাও অত্যন্ত আপন পেয়ারা হাবীবকে কঠিনভাবে ধমক দিলেন আল্লাহর কাছে ওই বিষয়টির গুরুত্ব কতো বেশী ছিলো তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য! এই ছোট্ট মহান দলটিকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে স্বয়ং আল্লাহর রসূল মৃদু মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছেন। এই তো সেই যুদ্ধ, রসূলের নেতৃত্বে পরিচালিত মোজাহেদ দলের যুদ্ধ, এতে আল্লাহর রসূল নিজে ময়দানে শরীক না থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তার সরাসরি নিয়ন্ত্রনে এ দলটি এগিয়ে গিয়েছিলো এবং তারা সারাক্ষণই তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো। আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি পর পর তিনজন কমান্ডারের শাহাদাতের ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কী করতে হবে সে বিষয়ে মুসলিম বাহিনীর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তকে চূড়ান্তরূপে গ্রহণ করার হুকুমও দিয়ে দিয়েছিলেন । এই যুদ্ধনীতি পার্থিব অন্যান্য যুদ্ধনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । ইসলামী রাষ্ট্রের মূল পরিচালক, মোজাহেদদের আনুগত্য, নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বিবেচনায় এবং যুদ্ধের ময়দানের সংকট নিরসনকল্পে বিশেষ ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এ অধিকার দিতে পারেন, যেমন আল্লাহর রসূল সে রণক্ষেত্রের কিছু ব্যক্তিকে দিয়েছিলেন ৷ সামাজিক দৃষ্টিভংগির মধ্যে এ পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে আল্লাহর রসূলের সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিলো এই যায়েদের পুত্র ওসামাকে তৎকালীন শক্তিগর্বী রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে সেনাপতি বানিয়ে পাঠানো । যাকে বলা হয়েছে, ‘গাযওয়ায়ে রোম’ ৷ এতে শরীক ছিলেন রসূলুল্লাহ (স.)-এর প্রধান দুই সংগী ও মন্ত্রণাদাতা, যারা পরবর্তীকালে মুসলমানদের সম্মিলিত রায়ে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন । এই দু’জন ছিলেন আবু বকর ও ওমর (রা.)। এদের সাথে ছিলেন মোহাজের ও আনসারদের বিরাট একটি সংখ্যা । ওসামার নেতৃত্বে পরিচালিত ওই দলে আরও ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের একান্ত কাছের সংগী ও একেবারে গোড়ার দিককার ইসলাম গ্রহণ করা সাহাবা সা’দ এবনে আবি ওয়াক্কাস ৷ যেহেতু ওসামা ছিলেন সে সময় একেবারেই একজন তরুণ যুবক, তাই এই দলটি রওয়ানা হওয়ার সময় কোনো কোনো সাহাবার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি ভাব পরিলক্ষিত হয় । দেখুন এই যুবক সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-বলেন, স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পাঠাচ্ছেন এক বাহিনীকে, বাহিনীর সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছেন নওজোয়ান ওসামা ইবনে যায়েদ (রা.)-কে, এতে কোনো কোনো ব্যক্তি তার নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছু সমালোচনা করলো । রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কানে কথাটি পৌছলে তিনি দুঃখের সাথে বললেন, ‘তোমরা আজ ওসামার সমালোচনা করছো, এমনি করে এর পূর্বে একদিন তার বাপ যায়েদের বিরুদ্ধেও তোমরা নানা কথা বলেছিলে । অথচ শোনো! আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, তখন সেনাপতি পদের জন্যে আমার বিবেচনায় সে (যায়েদ) ছিলো সব থেকে বেশী যোগ্য এবং সকল মানুষের থেকে বেশী প্রিয়, আর আজ তার ছেলে এই যে তরুণ যুবক ওসামা আমার কাছে সকল মানুষ থেকে উত্তম ।’ আবার যখন সালমান ফারসী (রা.) সম্পর্কে নানা প্রকার নিন্দনীয় কথা শুরু হলো, যখন আরব ও আজম বা আরবী ও ফারসী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিষ ছড়ানো হতে লাগলো, উস্কানি দেয়া হতে লাগলো মানুষের মনের মধ্যে, তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সে সকল হীন মনোবৃত্তিকে চিরতরে খতম করার জন্যে এক সিদ্ধান্তকরী ঘোষণা দিলেন । বললেন, ‘সালমান আমাদের লোক, সে আহলে বায়তের (নবী ঘরের) একজন সদস্য ।’ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ঘোষণা সকল প্রকার বংশমর্যাদার গরিমাকে স্তব্ধ করে দিলো ৷ এ ঘোষণা আরবের জাতীয়তাবাদ ও গোত্রীয়বাদের সমস্ত অহংকারকে ধ্বংস করে দিলো ৷ এভাবে আহলে বায়তের লোক বলে আখ্যা দিয়ে তাকে তিনি আরবদের ওপর নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দিলেন। একদিন আবু যর গিফারী ও বেলাল ইবনে আবি রাবাহের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিলে হঠাৎ করে আবু যর (রা.)-এর মুখ থেকে একটি অপ্রীতিকর কথা বেরিয়ে গেলো। তিনি বলে ফেললেন, ‘ওহে কালো মায়ের ছেলে ।’ এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ভীষণভাবে রেগে তার মুখের ওপর কথাটি ছুড়ে মেরে বললেন, শোনো আবু যর, তুমি খুব বেশী রকম বাড়াবাড়ি করে ফেলেছো। তোমার আমলনামার প্রতি আফসোস, তুমি নিজের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছো । তুমি নিজে তোমার আমলনামাকে কালিমালিপ্ত করেছো । জেনে রেখো তোমার মতো ফর্সা মায়ের সন্তানের জন্যে কালো মায়ের সন্তানের ওপর গৌরবান্বিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই হচ্ছে ইসলামের সঠিক মূল্যায়ন, যা মূর্খ সমাজের মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক । ইসলামের দৃষ্টিতে সে-ই ভালো, যে আল্লাহর দৃষ্টিতে ভালো। দুনিয়ার কোনো কিছুর কারণে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করাই হচ্ছে জাহেলিয়াত বা নিদারুণ মূর্খতা ৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের এই কঠোর সতর্কবাণী আবু যর (রা.)-এর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করলো । তিনি ভীষণভাবে অনুতপ্ত হলেন এবং মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে কসম খেয়ে এই বলে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, বেলাল (রা.) নিজে তার মাথা পদদলিত না করা পর্যন্ত তিনি আর মাথা তুলবেন না। এভাবে তিনি তার কঠিন অপরাধ স্খলনের প্রায়শ্চিত্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন । হযরত বেলাল রো.) আল্লাহর দরবারে বহু উঁচু সম্মান লাভ করেছিলেন ৷ সমাজেও তিনি ছিলেন বেশ সম্মানী লোক। সাধারণভাবে তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। তার মর্যাদার পরিমাপ আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে, দুনিয়ার বিবেচনায় যদি নাও হয়ে থাকে তাতে কিছু আসে যায় না। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম একদিন বেলাল (রা.)-কে ডেকে বললেন, হে বেলাল, কোন সে ভালো কাজ তুমি ইসলাম গ্রহণ করার পর করেছো যার কারণে আমি তোমাকে গত রাতে এক ভাগ্যবান ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পেলাম । আমি গত রাতে জান্নাতের সামনে তোমার জুতার শব্দ শুনতে পেলাম! তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, আমি তো ইসলাম গ্রহণ করার পর তেমন কোনো ভালো কাজ করেছি বলে মনে পড়ে না, যার কারণে আমি বিশেষ কোনো মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী হওয়ার আশা করতে পারি। তবে, এটুকু আমার মনে পড়ে যে, দিনে রাতে যখনই আমি ওযু করেছি, তখনই আমি কিছু নফল নামায আদায় করেছি । (বোখারী ও মুসলিম  ) আর একটি হাদীসে জানা যায়, একদিন হযরত ইবনে ইয়াসের এবং হযরত আম্মার (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দরবারে আসার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, হা, স্বাগত জানাই পবিত্র ও উত্তম আম্মারকে ।(তিরমিযি) আরও এরশাদ হয়েছে, আম্মারের গোটা শরীর এমনকি তার মাথার চুলের আগা পর্যন্ত- সে পবিত্রতার এক প্রতিমূর্তি ।(নাসায়ী) হযরত হোযায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মধুমাখা বাণী উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলেছেন, জানি না আমি আর কতোদিন তোমাদের মাঝে আছি। আমার পরে এ ব্যক্তিদের আনুগত্য করো ৷ একথা বলে তিনি হযরত আবু বকর এবং হযরত ওমরে (রা.)-র দিকে ইশারা করলেন। এরপরে বললেন, আম্মারদের দেখানো পথে চলবে, আর আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ তোমাদের কাছে যে হাদীস বলবে, তা সত্য বলে গ্রহণ করো ।(তিরমিযি) মদীনায় নতুন এসেছে এমন যে কোনো ব্যক্তি ইবনে মাসউদ (রা.)-কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাড়ীর মানুষ অর্থাৎ আহলে বায়তের একজন ভাবতো ৷ হযরত আবু মূসা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার ভাই ইয়েমেন থেকে আসার পর বেশ কিছু দিন ধরে ইবনে মাসউদ (রা.) ও তার মাকে রসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে কাছে দেখতাম এবং প্রায় সব সময়েই তিনি রসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে আসা যাওয়া করতেন ।(বোখারী, মুসলিম ‘ও তিরমিযি) জুলাইবীব ছিলেন একজন মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস ৷ এক আনসারী মহিলার সাথে তার বিয়ের জন্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নিজেই প্রস্তাব পাঠান । এতে ওই মহিলার বাপ-মা অস্বীকার করলে মহিলা বললেন, আপনারা কি আল্লাহর রসূল (স.)-এর প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন? তিনি যদি খুশী মনে ওই ব্যক্তির সাথে আপনাদের আত্মীয়তা করার জন্যে রাযি হয়ে থাকেন তাহলে আপনারাও খুশী মনে রাযি হয়ে যান এবং ওই ব্যক্তির সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিন। তখন তারা রাযি হলেন এবং সেই মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিলেন। (মোসনাদে ইমাম আহমাদ ও আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত) জুলাইবীব এ বিয়ের অল্প দিন পরে এক যুদ্ধে যোগদান করেন যুদ্ধ শেষে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এ বিষয়ে হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রা.)-এর বর্ণনা পাওয়া যায়, যাতে তিনি বলেছেন তিনি একটি যুদ্ধে শরীক হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাকে খুঁজতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কাউকে কি তোমরা খুঁজে পাচ্ছো না? সাহাবারা বললেন, হা, ইয়া রসূলাল্লাহ অমুক অমুক ব্যক্তিকে পাওয়া যাচ্ছে না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আবারও বললেন, আর কেউ কি হারিয়েছে? উপস্থিত ব্যক্তিরা বললেন, জি না ইয়া রসূলাল্লাহ, আর কেউ হারিয়ে যায়নি । তখন রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন, কিন্তু আমি তো জুলাইবীবকে খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর সবাই তার অনুসন্ধান করতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণ পরে সাতটি মৃতদেহের কাছে তার লাশটিও পাওয়া গেলো । ওদেরকে হত্যা করার পর তিনি নিজেই শহীদ হয়েছেন। তখন নবী (স.) নিজে তার লাশের কাছে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বললেন, ‘সে সাতজনকে হত্যা করার পর ওরা তাকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে, সে আমার পরিবারের লোক, আমিও তার পরিবারের একজন ।’ তারপর রসূলুল্লাহ (স.) তাকে নিজের দু’হাতের ওপর তুলে নিলেন। তাকে কবরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রসূলুল্লাহ (স.)-এর দু’টি হাত ব্যতীত কোনো খাটিয়া ব্যবহার করা হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, জুলাইবীব কবর খোড়া হলো এবং রসূলুল্লাহ (স.) নিজ হাতে তার লাশ কবরে রাখলেন। অবশ্য তাকে গোসল দেয়া হয়েছে কিনা তা বর্ণনাকারী উল্লেখ করেননি ৷ (মুসলিম-এ বর্ণিত)  মানবতার পুনর্জন্ম : আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ ও রসূলুল্লাহ (স.)-এর পরিচালনায় নীতি নৈতিকতার এই নব মূল্যায়নের মাধ্যমে মানুষের পুনরুজ্জীবন লাভের কাজ এক অভিনব উপায়ে সম্পন্ন হলো এবং এভাবে সমাজের লোকেরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে সঠিক মুল্য পেলো । তারা মুক্তি পেলো দুনিয়ার পারিপার্শিকতার নানা প্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে । এটা ছিলো ইসলামের অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। এই মহা আশ্চর্য ব্যাপার সংঘটিত হওয়া আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব ছিলো না। আর যে ঘটনা কেন্দ্র করে এই কথাগুলো নাযিল হয়েছে এটাই প্রমাণ করে যে, এ জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এবং যার মাধ্যমে তা এসেছে তিনি অবশ্যই একজন রসূল । এ কাজের জন্যে আল্লাহর ব্যবস্থাপনায় আগত আর একটি জিনিস হলো রসূলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তেকালের পরে প্রথম ও দ্বিতীয় বিচক্ষণ ব্যক্তির পর পর দায়িত্ব গ্রহণ। এরা রসূল (স.) প্রদর্শিত পথে চলার ব্যাপারে ছিলেন সব থেকে বেশী অনমনীয়। এদের মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা ছিলো যেমন গভীর, তেমনই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পদাংক অনুসরণ করে অন্যায় কাজগুলোকে বর্জন ও ন্যায় পরায়নতার পথ অবলম্বন করার ব্যাপারে এরাই ছিলেন সব থেকে বেশী দৃঢ়সংকল্প ৷ একই আদর্শে আবু বকর (রা.) : রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কর্তৃক চালিত অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার দায়িত্ব আবু বকর (রা.) গ্রহণ করেন এবং সঠিকভাবেই তিনি তা পালন করেন। তাই দেখা যায়, খেলাফতের পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর প্রথম যে কাজটি তিনি করেন তা ছিলো ওসামাকে সেনাপতি বানিয়ে যে বাহিনীকে প্রেরণের জন্যে আল্লাহর রসূল (স.) প্রস্তুত করেছিলেন সেই বাহিনীকে রওয়ানা করিয়ে দেয়া । এই বাহিনীকে বিদায় দিতে গিয়ে তিনি মদীনার বাইরে বেশকিছু দুর পর্যন্ত এগিয়ে যান ৷ তাকিয়ে দেখুন সেই বিস্ময়কর দৃশ্যের দিকে, ওসামা এগিয়ে চলেছেন সওয়ারীর পিঠে চড়ে আর মুসলিম বিশ্বের খলীফা চলেছেন তার পাশাপাশি পায়ে হেঁটে । লজ্জায় অস্থির হয়ে ওঠেন তরুণ ওসামা ৷ তিনি নওজোয়ান হয়ে থাকবেন সওয়ারীতে, আর বৃদ্ধ আবু বকর পায়ে হেঁটে চলবেন তার সাথে- এ কী করে হয়! তাই অধীর হয়ে তিনি বলে উঠলেন, হে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি, হয় আপনি কোনো সওয়ারীতে আরোহণ করুন অথবা আমি নেমে পড়ি। জবাবে খলীফা কসম দিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি নামবে না। আর আমিও সওয়ারীতে চড়বো না। আমার কি এমন অবস্থা হলো যে, আমি আল্লাহর পথে জেহাদের কাজে একটি ঘন্টাও দু’টি পায়ে ধুলো মাখাতে পারবো না? দেখুন আর একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, আবু বকর (রা.) ভাবছেন খেলাফতের কাজে সাহায্য করার জন্যে ওমর (রা.)-কে তার প্রয়োজন, কিন্তু তিনি তো ওসামার বাহিনীর একজন সৈনিক । কওসামা তার আমীর ৷ অতএব তাকে পেতে হলে ওসামার অনুমতি প্রয়োজন ৷ তখন খলীফা বলছেন, আপনি যদি অপছন্দ না করেন, ওমরকে ছুটি দিয়ে আমাকে একটু সাহায্য করবেন? কী বিনীত অনুরোধ । মুসলিম জগতের খলীফা হয়ে তিনি অনুমতি চাইছেন খেলাফতের কাজের জন্যে তারই অধীনস্থ একজন তরুণ সেনাপ্রধানের কাছে। এ ধরনের মহানুভবতা প্রদর্শন একমাত্র আল্লাহর মেহেরবানীতে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব । তারপর অত্যস্ত দ্রুতগতিতে সময় এগিয়ে চলে আর আমরা দেখতে পাই ওমর (রা.) খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে কুফার গভর্নর পদে নিয়োগ করছেন। ওমর (রা.)-এর উদাহরণ : আর একটি দৃশ্য, হযরত ওমর (রা) যখন আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা.) কুফার গভর্ণর নিয়োগ করছিলেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলো মুক্ত স্বাধীন সম্ভ্রান্ত কোরায়শ নেতৃবৃন্দের একটি দল অপেক্ষমান । যাদের মধ্যে রয়েছেন সোহায়ল ইবনে আমর ইবনুল হারেস ইবনে হিশাম এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারবও । তাদের সামনেই ওমর (রা.) কথা বলার অনুমতি দিচ্ছেন সোহায়ব ও বেলাল (রা.)-কে। কারণ এরা দু’জনই প্রথম দিককার ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি এবং বদরী সাহাবা ৷ এই ব্যবহারে আবু সুফিয়ানের নাক রাগে ফুলে উঠলো । জাহেলী যুগের অনুভূতি নিয়েই সে বলে উঠলো, আজকের মতো এ রকম অবস্থা আমি আর কখনো দেখিনি । আমাদেরকে বাদ দিয়ে এই ক্রীতদাসদের মতামত নেয়া হচ্ছে, আর আমরা সেখানে দরজায় ঠায় দাড়িয়ে! ওমর (রা.) জবাবে বললেন, অবশ্যই আমি তোমাদের চেহারায় অসম্তোষবহ্নি দেখতে পাচ্ছি। তোমরা যদি ভয়ানক রেগে গিয়ে থাকো তো এ রাগ তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই হওয়া উচিত ৷ সমগ্র জাতিকে যখন ইসলামের দিকে আহ্বান জানানো হয়েছে, তখন তোমাদেরকেও আহ্বান জানানো হয়েছিলো। সে সময় তারাই দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করলো, কিন্তু তোমরা দেরী করলে। কেয়ামতের দিন ওদেরকে যখন ডাকা হবে এবং তোমাদেরকে পরিত্যাগ করা হবে, তখন তোমাদের কেমন লাগবে? (আল আদালাতুল ইজতেমায়িয়াতু ফিল ইসলাম’ নামক একটি বই থেকে) ওমর (রা.) তার নিজের ছেলে আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে ওমর থেকে ওসামা ইবনে যায়েদকে গনীমতের মাল বেশী দিতেন । বেশ কয়েকবার এরকম দেখে অবশেষে একদিন আব্দুল্লাহ এই তারতম্যের কারণ জিজ্ঞাসা করে বসলেন ৷ জবাবে তিনি তাকে বললেন, হে আমার পুত্র, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কাছে তোমার পিতার থেকে যায়েদ অধিক প্রিয় ছিলেন এবং তিনি ওসামাকে তোমার থেকে বেশী ভালোবাসতেন । (তিরমিযি) হযরত ওমর (রা.) ভালোভাবেই জানতেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কি কারণে ভালোবাসার এ তারতম্য করেছিলেন! একবার ওমর (রা.) আম্মার (রা.)-কে খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর হিসাব নিকাশ নেয়ার জন্যে পাঠিয়েছিলেন । অথচ হযরত খালেদ ছিলেন মুসলিম বাহিনীর চির বিজয়ী বীর সেনানায়ক এবং অত্যন্ত সদ্বংশজাত ব্যক্তি । প্রশাসনিক কারণে তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগের তদন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো ৷ আম্মার (রা.) হযরত খালেদের নিজের পাগড়ি দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন । কোনো কোনো বর্ণনায় জানা যায় জিজ্ঞাসাবাদের পুরো সময় খালেদ (রা.)-কে তার নিজের পাগড়ি দিয়ে হযরত আম্মার হাত বেঁধে রেখেছিলেন । অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হলে এবং তিনি নির্দোষ সাব্যস্ত হলে আম্মার (রা.) তার হাতের বাধন খুলে দেন এবং নিজ হাতে তার মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেন। এ ব্যবহারকে খালেদ (রা.) মোটেই আপত্তিকর মনে করেননি, কারণ তিনি জানতেন যে, ওই ব্যক্তি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিকটতম সাথী হযরত আম্মার, যিনি ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন প্রথম সারির লোক এবং যার সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ওমর(রা.) বলেছেন, ‘তিনি আমাদের নেতা এবং তিনি আমাদের আর এক নেতাকে মুক্ত করেছেন অর্থাৎ বেলালকে মুক্ত করেছেন ।’ এই বেলাল (রা.) উমাইয়া ইবনে খালফের গোলাম ছিলেন: এবং সে তাকে বড় কঠোর নির্যাতন করতো । শেষ পর্যন্ত আবু বকর (রা.) তাকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন। আর তার সম্পর্কেই ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলছেন আমাদের নেতা আর একজন নেতা বেলালকে মুক্ত করেছেন। ওমর (রা.) সেই ব্যক্তি, যিনি সালেম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, আবু হোযায়ফার মুক্ত ক্রীতদাস সালেম যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমি তাকে আমার পরে খলীফা হিসেবে মনোনীত করতাম । তিনি একদিকে একথা বলছেন, অপরদিকে ওসামাকে খলীফা মনোনীত করছেন না, আলীকেও করছেন না, তালহাকেও নয়, যোবায়েরকেও নয়, বরং তিনি তারপর খলীফা নির্বাচনের জন্যে দায়িত্ব দিচ্ছেন ছয়জন ব্যক্তির ওপর । আরো কিছু ঘটনা : আবার আলী ইবনে আবু তালেব- আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্মানিত করুন- তার ব্যবহার দেখুন । আয়শা (রা.)-এর সাথে যে বিষয়টি নিয়ে সাময়িক টানাপড়েন চলছিলো- তা নিয়ে কুফাবাসীরা যাতে কোনো রকম বাড়াবাড়ি না করে, সে জন্যে যখন তিনি হযরত হাসান ও আম্মার (রা.)-কে কুফায় পাঠাচ্ছিলেন । তখন আয়েশা (রা.) সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, “অবশ্যই আমি জানি তিনি আমাদের নবী (স.)-এর স্ত্রী । দুনিয়াতে যেমন তিনি তার স্ত্রী ছিলেন, আখেরাতেও তিনি তার স্ত্রী থাকবেন ৷ তবু আল্লাহ্‌ তায়ালা তোমাদেরকে এই দুই ব্যক্তির ব্যাপারে এক বিরাট পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন । তোমরা হয়তো এই ব্যক্তির আনুগত্য করবে, না হয় তার আনুগত্য করবে। (বোখারী এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন) উম্মুল মোমেনীন ও আবু বকর সিদ্দীকের কন্যা হযরত আয়েশা (রা.) সম্পর্কে তার মুখের এই কথা লোকেরা খেয়াল করে শুনছিলো। আর একটি ঘটনা : বেলাল ইবনে আবি রাবাহ তার দ্বীনী সম্পর্কের এক ভাই আবী কুয়ায়হা আল খাসয়ামীর বিয়ের জন্যে ইয়েমেনের এক এলাকায় প্রস্তাব দিতে চাইছেন। এ প্রসংগে তিনি বলছেন, দেখো আমি বেলাল ইবনে আবি রাবাহ, আর এটি হচ্ছে আমার ভাই আবু কুয়ায়হা। সে স্বভাব ও দ্বীনদারী উভয় দিক থেকেই খারাপ। এটা জেনেও তোমাদের গোত্রের মেয়ে তার সাথে বিয়ে দিতে যদি আপত্তি না থাকে তবে দিতে পারো, আর তোমরা রাযি না থাকলে সেটাও তোমাদের ব্যাপার। দেখুন, তাদেরকে তিনি ধোকাও দিচ্ছেন না বা তার ব্যাপারে কোনো কথা গোপনও করছেন না। এটা উল্লেখ করছেন না যে, তিনি মধ্যস্থতাকারী, অথচ যা বলছেন সে ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে সে কথাও ভুলে যাচ্ছেন না। তাই তিনি স্পষ্ট করে যা সত্য তা-ই বলছেন। তার এই সত্যবাদিতায় তারা সন্তুষ্ট হয়ে তার ভাইকে তাদের গোত্রে শাদী করিয়ে দিলো । তারা ছিলো আরবের অন্যতম সম্ভ্রান্ত জনপদ, তাদের সাথে বিয়ে শাদীর মধ্যস্থতা করছে একজন মুক্ত নিগ্রো কৃতদাস, তবু তারা খুশী মনে এ প্রস্তাব গ্রহণ করলো । গুণের কদরই আসল কদর, ইসলামী সমাজে ওই মহাসত্যটি মযবুততভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং ওই সময়ের পর আরও বহু শতাব্দী ধরে তা প্রতিষ্ঠিত থেকেছে ৷ যদিও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে অনেক ক্রটি বিচ্যুতি এসে গিয়েছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে এমন শিক্ষাই তারা পেয়েছিলেন যে, সামাজিক উঁচুনীচু, ছোট বড়, কৃত্রিম ভেদাভেদ ও বহুদিন থেকে চলে আসা আজমী-আরবীর পার্থক্য সব তারা ভুলে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন ৷ এ কারণেই দেখা যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর নাম নিতে গিয়ে তার সাথে তার মুক্ত ক্রীতদাস ইকরামার নামও নেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে ওমর (রা.) এর প্রসংগ যখন এসেছে, তখন তার সাথে তার মুক্ত ত্রীতদাসের নামও উল্লেখ হয়েছে। আনাস ইবনে মালেকের নাম নিতে গিয়ে তার মুক্ত ক্রীতদাস ইবনে সীরীনের নামও নেয়া হয়েছে। আবু হোরায়রা (রা.)-এর নাম নিতে গিয়ে তার মুক্ত.ত্রীতদাস আব্দুর রহমান ইবনে হুরমুজের নামও নেয়া হয়েছে। আবার দেখুন বসরাতে বাস করতেন হাসান আল বাসরী, মক্কায় ছিলেন মোজাহেদ ইবনে জারীর, আতা ইবনে আবী রাবাহ, তাউস ইবনে ফায়সাল। এরা সবাই ছিলেন বড় বড় ফকীহ । মিসরে ছিলেন মশহুর তরুণ ফকীহ ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব । তিনি ছিলেন হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীযের সময়ে দেনকালার অধিবাসী একজন নিগ্রো ক্রীতদাস (আবদুল হালীম আনজুনদীর কাছে আবু হানীফার লিখিত একটি পত্র থেকে)। সম্মানের মাপকাঠী : আল্লাহ রব্বুল ইযযতের তরফ থেকে এবং তাঁর ইচ্ছাক্রমে মোত্তাকী পরহেযেগার লোকদেরকে সম্মান দানের এই ভাবধারা ইসলামী সমাজে বরাবরই চালু থেকেছে। যদিও পার্থিব ধন সম্পদ থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত ছিলেন । দুনিয়ার বিবেচনায় যার যথেষ্ট মূল্য আছে এমনকি ওই সকল জিনিসের মূল্য তাদের নিজেদের কাছেও আছে এবং আশপাশের লোকদের কাছেও আছে। তবু সেসব কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী সমাজে বরাবরই তাকওয়ার গুরুত্ব ছিলো সর্বাধিক । সাম্প্রতিককালে অবশ্য তাকওয়ার গুরুত্ব থেকে বস্তুগত জিনিসের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে, যেহেতু আজকের নব্য জাহেলী যুগে দুনিয়ার সর্বত্র বস্তুবাদী সভ্যতার ঢেউ খেলে যাচ্ছে এবং এখন পাশ্চাত্যে পরাশক্তির অধিকারী নেতৃস্থানীয় মহাদেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে একজন মানুষকে পরিমাপ করা হয়, ব্যাংকে তার কি পরিমাণ পুঁজি আছে তার ভিত্তিতে ৷ অপরদিকে প্রাচ্যের নেতৃস্থানীয় দেশ রাশিয়াতে বস্তুবাদিতা চরম রূপ নিয়েছে, সেখানে মানুষের মূল্য যন্ত্র থেকেও অনেক কম । (এটা কমিউনিষ্ট শাসিত রাশিয়ার কথা) বর্তমানে নামধারী মুসলিম দেশেও আদিকালের জাহেলী মন মানসিকতা আচার আচরণ মহামারীর মতো ছেয়ে গেছে, অথচ এই জাহেলিয়াত দূর করার জন্যেই ইসলামের আগমন ঘটেছিলো । যার থেকে ইসলাম মানুষের মুক্তি ঘোষণা করেছে বহুকাল আগে সেই জাহেলী মতবাদ, যার মূলোৎপাটন করে ঈমান ও তাকওয়ার বীজ বপন করাই ছিলো ইসলামের লক্ষ্য, তা আজ পুনরুজ্জীবিত হয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশেই জেঁকে বসেছে। এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে একটিমাত্র আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ইসলামী দাওয়াত যেভাবে সফলতা লাভ করছে তাতে হয়তো অচিরেই আর একবার দুস্থ মানবতা জাহেলিয়াতের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করার এবং একবার যেমন মানবতার পুনরুজ্জীবন সংঘটিত হয়েছিলো এই নতুন আন্দোলনের হাতে ৷ আশা করা যায় মানবতা পুনরায় তার সেই হৃত গৌরব ফিরে পাবে, ফিরে পাবে হয়তো সেই অবস্থা যার ঘোষণা এই সুরার শুরুতে চূড়ান্তভাবে দেয়া হয়েছে। আলোচ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাহেলিয়াতের মোকাবেলায় ওই মহাসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিলো সূরার সূচনাতে আলোচনার লক্ষ্য ৷  দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে যে, মানুষ জেনে বুঝে কেমন করে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে, ঈমান আনার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাচ্ছে এবং তার আসল মনীবের দিকে যখন তাকে ডাকা হচ্ছে তখন সে মুর্খের মতো অহংকার দেখাচ্ছে! এ অধ্যায়ের আলোচনায় মানুষের বিরোধিতাপূর্ণ অন্যান্য কাজের সাথে সাথে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার প্রতি তার অবিশ্বাস সম্পর্কেও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে৷ কিসের থেকে তার অস্তিত্ব দুনিয়ায় এলো এবং কিভাবে সে বেড়ে উঠলো তা সে মোটেই চিন্তা করে না! দেখে না সে আল্লাহ্‌র মেহেরবানীকে ৷ জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে ও আখেরাতে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই যে তার ওপর কর্তৃত্ব করছেন, অন্য কারো কোনো ক্ষমতা কোথাও নেই, সে বিষয়েও সে চিন্তা করে না। যিনি তাকে পয়দা করেছেন, খাদ্য-পানীয় দান করছেন এবং যার কাছে তাকে হিসেব দিতে হবে তার প্রতি এতোটুকু কৃতজ্ঞতাও তার নেই।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-১৭-২০

ثُمَّ السَّبِیْلَ یَسَّرَهٗۙ

তারপর তার জন্য জীবনের পথ সহজ করেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

মানব সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় : এরশাদ হচ্ছে- “ধ্বংস হোক মানুষ, কতো অকৃতজ্ঞ সে! কোন সে বস্তু থেকে ……….. কিছু কিছুতেই সে কোনো প্রকার কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেনি এবং তাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাও পালন করেনি” নিহত হোক মানুষ! তার অদ্ভুত ও যুক্তিহীন ব্যবহারের কারণে । তাকে হত্যা করাটাই ছিলো উচিত সাজা এবং ওটাই তার সঠিক প্রাপ্য । বাক্যের ধরণটাই অত্যন্ত ভয়ানক, যা মনের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করে। এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জঘন্য ও নিন্দনীয় ব্যবহার এবং তার ফল কী হতে পারে সেই দিকে ইংগিত করেছেন। কতো অকৃতজ্ঞ সে অর্থাৎ তার অস্বীকৃতি, অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং আল্লাহ তায়ালাই যে তার লালন-পালন ও শ্রীবৃদ্ধি করে চলেছেন, তা মানতে না চাওয়া যে কি চরম অকৃতজ্ঞতা তা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল । এ সকল বিষয়ের দিকে সে যদি এতোটুকু দৃষ্টিপাত করতো, তাহলে তার সৃষ্টিকর্তার শোকর না করে সে পারতো না, বরং দুনিয়াতে সে বিনয়ী হয়ে থাকতো এবং সদা সর্বদা আখেরাতকে স্মরণ করে চলতো! যদি সে এটা না করে তাহলে সে বলুক, কোন জিনিসের বড়াই সে করে! কী নিয়ে সে উদাসীন হয় ও প্রকৃত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। তার মৃল্যই বা কি এবং শুরুই বা হয়েছে কিসের থেকে? কোন্‌ জিনিস দিয়ে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন? যা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তা অতি তুচ্ছ ও সামান্য জিনিস, প্রকৃতির দিক দিয়ে তা বড়োই তুচ্ছ। আল্লাহর ইচ্ছা ও মেহেরবানী ছাড়া সে জিনিসের কোনো মূল্যই নেই। একটি শুক্রবিন্দু দিয়ে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর এক নির্দিষ্ট পরিমাপ মতো তাকে গঠন করেছেন। এ এমন এক জিনিস যার কোনো মূল্যই নেই এবং এটা এমনই মৌলিক পদার্থ যার কোনো স্থায়িত্ব নেই। কিন্তু এর সৃষ্টিকর্তা যিনি, তিনিই এর মূল্য বানিয়েছেন, মুল্যায়ন করেছেন অপরূপ সৃষ্টি বৈচিত্র্য দিয়ে ও বিভিন্ন নির্দেশ দান করার মাধ্যম । একে তিনি সুগঠিত করেছেন! তার প্রদত্ত এক বিশেষ পরিমাপ ও ব্যবহারোপযোগী গঠন দান করে তাকে করেছেন সুসামঞ্জস্য । এভাবে তাকে এক সম্মানজনক ও সম্ভ্রান্ত সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করেছেন। আর এভাবেই তো সেই মোলায়েম মাটি প্রকৃতিতে তাকে গড়ে তুলেছেন নম্র, ভদ্র ও রুচিশীল মেযাজের মানুষ করে। তারপর তাকেই তিনি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। এতো মর্যাদাবান করেছেন যে, পৃথিবীর ভেতর ও বাইরের জিনিসগুলোকে তারই নিয়ন্ত্রণে এনে দিয়েছেন। তারপর তার জীবন পথকে করে দিয়েছেন অতান্ত সহজ ৷ জীবনের পথকে সহজ ও সুগম পথে চলতে বলা হয়েছে সে পথে চলা তার জন্যে সহজ করে দেয়া হয়েছে। জীবন পথ-পরিক্রমা অথবা জীবন পথকে চিনতে পারা দুটো অর্থই এখানে ব্যক্ত হয়েছে। অবশেষে এ জীবনের সফর শেষে যখন সকল প্রাণীকে অপরিহার্য পরিসমাপ্তিতে পৌছতে হবে, তখন তার কোনো ইচ্ছা প্রয়োগের এবং পলায়নের সুযোগ থাকবে না।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২১-২৩

كَلَّا لَمَّا یَقْضِ مَاۤ اَمَرَهٗؕ

কখখনো নয়, আল্লাহ‌ তাকে যে কর্তব্য পালন করার হুকুম দিয়েছিলেন তা সে পালন করেনি।

ফী জিলালিল কুরআন:

“তখন তিনি তাকে মৃত্যুদান করবেন এবং কবরস্থ করার ব্যবস্থা করবেন ।” সুতরাং, পরিসমাপ্তিতে তার অবস্থা তেমনই হবে যেমন ছিলো প্রথম অবস্থা । তার হাতের মধ্যেই তাকে পৌছতে হবে, যিনি তাকে জীবন দান করেছেন, আবার যখন চাইবেন তার জীবনাবসান ঘটাবেন। সাময়িকভাবে পৃথিবীর পেটের মধ্যে তার আবাসস্থল নির্ধারণ করেছেন। এটা তার জন্যে সম্মানজনক এক পন্থায় জীবনধারার সাময়িক বিরতিপর্ব । কারণ হিংস্র পশুর খোরাক হিসেবে পৃথিবীর পিঠের ওপর তাকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে না দিয়ে পৃথিবীর পেটের মধ্যে সুরক্ষিত করে রাখার ব্যবস্থা অবশ্যই তার জন্যে অবশ্যই এক বিশেষ ব্যবস্থা । এটা আল্লাহর ব্যবস্থাপনার একটি অতি সুন্দর দিক । আবার যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে, তখন পুনরায় তাকে জীবন দান করা হবে। পুনরায় জীবিত করা হবে তার হিসেব গ্রহণ করার জন্যে । তারপর যখন চাইবেন তাকে তুলবেন । তাকে একেবারে বেকার ছেড়ে দেয়া হবে না, বিনা হিসেবে বা কোনো প্রতিদান না দিয়ে, এমনি এমনি তাকে রেখে দেয়াও হবে না। এজন্যেই তার এই উদাসিনতার দিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে হিসেব দেয়ার জন্যে তাকে কোনো প্রস্তুতি নিতে দেখেছো কিঃ? কিছুতেই না, যে নির্দেশ তাকে দেয়া হয়েছে সে তা পালন করেনি। সাধারণভাবে সকল মানুষ, যে কোনো ব্যক্তি এবং সকল জনপদ, প্রথম থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কেউই আল্লাহর সকল হুকুম যথাযথভাবে পালন করেনি বা করতে পারছে না। অবশ্যই কিছু না কিছু ত্রুটি সে করেছে ও করছে। কখনোই সে তার দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় করেনি। তার সূচনা কিভাবে হলো এবং কিভাবে বা সে গড়ে উঠলো সে তা স্মরণ করেনি। এমনকি তাকে স্মরণ করানোর পরও সে তা বুঝতে চায়নি। তার সৃষ্টিকর্তার শোকরিয়া আদায় করেনি, যিনি তাকে পথ দেখালেন এবং তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করলেন তার প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি সে। তারপর সে যতোদিন বেঁচে আছে ততোদিনে পরকালের জন্যে কোনো প্রস্তুতিও নেয়নি, চিন্তা করেনি হিসাব দিবসে কী হিসাব সে দেবে! এ কথাটা গোটা মানব জাতির জন্যেই প্রযোজ্য । তারপরও বেশীর ভাগ মানুষই অহংকারপূর্ণভাবে আল্লাহর তরফ থেকে আসা পথনির্দেশনার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দিয়েছে।

সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২৪-২৬

ثُمَّ شَقَقْنَا الْاَرْضَ شَقًّاۙ

তারপর যমীনকে অদ্ভূতভাবে বিদীর্ণ করেছি।

ফী জিলালিল কুরআন:

খাদ্য দ্রব্য নিয়ে ভাবা প্রয়োজন : পরবর্তাঁ অধ্যায়ে আলোচনার গতি ভিন্ন একটি প্রসংগের দিকে ফিরে যাচ্ছে এবং তা হচ্ছে মানুষের প্রবৃদ্ধির প্রসংগ ৷ একটু সন্ধানী দৃষ্টিকোণ নিয়ে কেন সে তাকায় না তার নিজের ও খাদ্যের দিকে এবং তার গবাদিপশুর খাদ্যের দিকে? এদের বেঁচে থাকার জন্যে যে বিচিত্র ধরনের খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা করেছেন এ প্রসংগে সেগুলোরও উল্লেখ প্রয়োজন ৷ তাই বলা হচ্ছে, তার খাদ্য খাবারের দিকে তার চিন্তাপূর্ণ ও উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করা দরকার। এরশাদ হচ্ছে, ‘কেমন করে আমি মুষলধারে পানি বর্ষণ করেছি, তারপর ফাটিয়ে চৌচির করে দিয়েছি যমীনকে। তারপর তার মধ্যে জন্মিয়েছি খাদ্যশস্য, আঙুর, শাকসবজি, যায়তুন, খেজুর এবং ঘনসন্নিবেশিত বাগিচা, ফলমূল ও ঘাসপাতা, যা তোমাদের ও তোমাদের পোষা জানোয়ারদের প্রয়োজন মেটায় ৷ এটা হচ্ছে মানুষের খাদ্য কাহিনী । পর্যায়ত্রুমে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যাতে করে মানুষ এগুলো বুঝতে পারে! অতএব মানুষের এগুলো নিয়ে চিন্তা করা দরকার। এসব সৃষ্টির মধ্যে কারো কুদরতী হাতের নিয়ন্ত্রণ না থেকে কিভাবে পারে এগুলোর ব্যবস্থাপনায় কারো কোনো ভূমিকা কি কার্যকর নেই? একটু ভাবলে এটা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেই কুদরতি হাতই এগুলো সৃষ্টি করেছে, যে কুদরতি হাত মানুষ সৃষ্টি করেছে সুতরাং এগুলোর সৃষ্টি সমধিক বিস্ময়কর ৷ তাই মানুষের চিন্তা করা দরকার তার খাদ্য সামগ্রী সম্পর্কে । এটা তার সব থেকে নিত্যসংগী নিকটতম দ্রব্য এবং এমন জিনিস যার সাথে তার সম্পর্ক সুনিবিড় । তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকানো দরকার সেই সহজ অথচ অতি জরুরী জিনিসের দিকে, যা তার জীবনে বারবার আসে । এর সহজ সরল ও সহজলভত্যতার কারণে এর মধ্যে নিহিত বিস্ময়কর দিকটির কথা মানুষ প্রায়ই ভুলে যায়। বাস্তবে এটা তেমনই আশ্চর্যজনক যেমন তার সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধি আশ্চর্যজনক তার প্রতিটি পদক্ষেপই সেই মহান সত্ত্বার নিয়ন্ত্রণে থাকে, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। পানি জীবন ও উদ্ভিদের উন্মেষ আল্লাহ্‌ তায়ালা বলছেন, ‘আমি মুষলধারে পানি বর্ষণ করেছি’ । আসলে বৃষ্টি আকারে পানি বর্ষণ এমন একটি সত্য, যা প্রতিটি এলাকা, প্রতিটি পরিবেশের সকল মানুষই বুঝে, তা তার জ্ঞানবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা যা-ই হোক না কেন। সুতরাং এখানে আল্লাহ্‌ তায়ালা দুনিয়ার সকল শ্রেণীর মানুষকে লক্ষ্য করে কথাটি বলেছেন। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির সাথে সাথে মানুষ আরও তারা ব্যাপকভাবে এ কথাটির অর্থ বুঝবে । এর তাৎপর্য আরও গভীরভাবে তারা বুঝবে যা সাধারণ মানুষের নযরে হয়তো ধরা পড়ে না। আজকের মানুষ একথা সহজে বুঝতে পারে যে, মহাসাগরগুলো থেকে পানি বাষ্প আকারে উত্থিত হয়ে বাতাসের বিশেষ প্রক্রিয়ায় মেঘের আকার ধারণ করে এবং পরে বৃষ্টি আকারে নেমে আসে । এভাবে এটাও বুঝা সহজ যে, সাগরের পানি যা একসময় নীল আকাশে বিরাজমান ছিলো, তা মুষলধারে বৃষ্টি আকারে পৃথিবীতে বর্ষিত হয়েছে। এ ব্যাপারে বর্তমান সময়কার একজন মনীষীর মন্তব্য হচ্ছে, যদি এটা সঠিক হয়ে থাকে যে, পৃথিবী যখন সূর্য থেকে বিচ্যুত হয়েছিলো, তখন তার তাপ মাত্রা ছিলো প্রায় ১২,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, পৃথিবীর পৃষ্ঠের উত্তাপও ছিলো প্রায় একইরূপ, তাহলে এটাও ঠিক যে, পৃথিবীর সবকিছুই ছিলো একই প্রকার উত্তপ্ত এবং এর মধ্যকার সব কিছু ছিলো একটা থেকে অপরটি বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন ৷ সুতরাং তার মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যুক্ত পদার্থের অস্তিত্ব বর্তমান থাকা সম্ভব ছিলো না। তারপর যখন পৃথিবী বা তার সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অংশগুলো ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করলো, তখন এই অংশগুলো পরস্পর মিলিত হয়ে আমাদের জানা এই পৃথিবীর আকার ও রূপ ধারণ করলো ৷ ৪,০০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত উত্তাপ না নেমে আসা পর্যন্ত অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন একে অপরের সাথে মিলিত হতে পারে না। এই উত্তাপে নেমে আসার পরই ওই বস্তুকণাগুলো ছুটে এসে পরস্পর মিলিত হয়ে এ নতুন জিনিসের সৃষ্টি হয়। আমরা আজ পানি আকারে যা কিছু দেখছি তা সবই তখন বাতাসের আকারে বর্তমান ছিলো। আজকের সকল সমুদ্র তখন পানি আকারে আকাশের মহাশুন্যতায় ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ছিলো । পানি সৃষ্টির জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো পারস্পরিক মিলনের পূর্বে বায়বীয় গ্যাস আকারে তা বর্তমান ছিলো। তারপর দীর্ঘদিন ধরে সে সব কিছু ঠান্ডা হয়ে পানিতে পরিণত হয় এবং তা ক্রমান্বয়ে পৃথিবীতে নেমে আসতে থাকে৷ কিন্তু পৃথিবীতে পৌছানোর পূর্বেই পৃথিবী পৃষ্ঠের ভীষণ উত্তাপের কারণে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকতেই এগুলো গ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। পরে একটি সময় আসে যখন এক ঝড়ো হাওয়া পৃথিবীর ওপর প্রবাহিত হয়ে পুনরায় তা বাষ্পের রূপ নেয়। এই সমুদ্রগুলো বাতাসের আকারে থাকাকালে ঠান্ডা হতে থাকার সাথে সাথে সীমাহীন ও কল্পনাতীত তীব্রতায় ঝড়োবন্যা আকারে সেখানে প্রবাহিত হয়। এ প্রবাহ কতোকাল চলতে থাকে তা বলা সম্ভব নয় ।'(Cressy Morison রচিত ‘Man does not stand alone’ পুস্তক থেকে, লন্ডন, ১৯৬২) যদিও কোরআনে বর্ণিত তথ্য ও এই বর্ণনার মধ্যে সুনিশ্চিত কোনো যোগসূত্র আছে বলে আমরা দাবী করি না। কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা পানি সৃষ্টি, বর্ষণ ও তা দিয়ে পৃথিবীবাসীর প্রয়োজন পূরণের যে ব্যাখ্যা দেয় তা বুঝা সহজ আর এ কারণে কোরআন ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সমন্বয়ে পানি সৃষ্টির যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা সঠিক বলে মনে হয় । অন্যান্য আরও কিছু ব্যাখ্যাও এখানে সেখানে দেয়া হয়েছে। অবশ্য কোরআন যে ব্যাখ্যাগুলোকে সমর্থন করে সেগুলোই সর্বযুগে এবং সকল সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে এসেছে। খাদ্য সৃষ্টি ও তার প্রয়োগ গ্রণালীর এই হচ্ছে এক বিস্ময়কর ইতিহাস । ‘আমি বর্ষণ করেছি পানি প্রচুর পরিমাণে’ । কেউ এ কথার দাবী করে না যে, সে পৃথিবীর কোনো এক পর্যায়ে বা কোনো কালে কোনো না কোনোভাবে পানি সৃষ্টি করেছে বা মানুষ ও জীবজন্তুকে খাদ্য সরবরাহ করার জন্যে পানি বর্ষণ করেছে। ‘আর ফাটিয়ে চৌচির করে দিয়েছি যমীনকে ।’ এই পানি বর্ষণের ব্যাপারে কারো কোনো হাত আছে বলে দাবী করার মতো দুঃসাহস ইতিহাসে আজও পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি। তারপর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যমীন ফাটানোর দৃশ্য দেখাচ্ছেন এং পানি বর্ষণ করিয়ে এবং তা দিয়ে যমীনকে ভিজিয়ে গাছপালা, শাকসবজি, তরুলতা ও খাদ্যশস্য উৎপাদন করে মানুষ ও জীব জন্তুর প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক পাপিষ্ঠই নিজেকে রব বলে দাবী করেছে কিছু কেউই আজ পর্যন্ত এ বৃষ্টির পানি দ্বারা গাছপালা বৃদ্ধি ও হাওয়া বাতাস নিয়ন্ত্রণ এবং এসব কিছুর পারস্পরিক সহযোগিতায় পৃথিবীকে শস্য সম্ভারে ভরে দেয়ার দাবী করার মতো ঔদ্ধত্ব কেউ দেখিয়েছে বলে কোনো ইতিহাস নেই৷ কারণ এই দাবী করলে তাকে পাগল ছাড়া আর কিছু যে মানুষ বলবে না তা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট । অনাদিকাল থেকে মানুষ দেখে আসছে এবং এবং অনুধাবনও করছে যে, এগুলার কোনোটিরই ওপর কোনো মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই৷ সে দেখছে মাটির স্তরগুলো ভেদ করে ভেতরে পানি প্রবেশ করে। সে আরও দেখছে বীজ থেকে অংকুর গজিয়ে মাটির বুক চিরে আল্লাহর ইচ্ছাতে চারাগাছগুলো বেরিয়ে আসে। সে এটাও দেখছে, ভারি ও শক্ত যমীন থেকে অত্যন্ত নাযুক ও ক্ষীণ অংকুরের শুঁড় বেরিয়ে আসে, এসব কার ইচ্ছায়, কার ক্ষমতায়? একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা বলেই তা সম্ভব হয়। মানুষ চিন্তা করলে এর মধ্যে স্রষ্টারই ইচ্ছা ক্রিয়াশীল দেখতে পাবে। অনুভব করবে এই নাযুক ও সুচারু প্রতিটি অংকুর শীষে বিশ্বস্রষ্টার শক্তি অত্যন্ত সুক্ষভাবে ও গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে কোরআনের বর্ণিত এই তথ্য সম্পর্কে আরও অনেক নতুন জিনিস ধীরে ধীরে মানুষ জানতে পারবে । যমীন ফেটে যাওয়ার ফলে শাকসবজি, গুল্মলতা ও গাছপালা উৎপাদনে এগুলো এতো বেশী সহায়ক হবে যার কল্পনাও আমরা করতে পারি না। কোরআনে বর্ণিত এ কথাগুলো হয়তো এই বন্যায় প্লাবিত নতুন ভূমিস্তরের দিকে ইংগিত করছে যা বন্যাপ্লাবিত হওয়ার কারণে শতধা বিদীর্ণ হয় এবং পলিমাটির সংস্পর্শে এসে নতুন জীবন লাভ করে। ঝড়বাদল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তনে এগুলো শক্তি পায়, বিশেষ করে যখন পৃথিবীর উপরিভাগের শিলাস্তর ফেটে গিয়ে এক অভাবনীয় প্রক্রিয়ায় শক্তি সঞ্চয়ের বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করে । একথাগুলো আধুনিক বিজ্ঞানীরা যদিও অনেক পরে জানতে পেরেছে কিন্তু আসমানী জ্ঞান থেকে অনেক আগেই আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের জানিয়ে দিয়েছেন।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-২৭-৩২

مَّتَاعًا لَّكُمْ وَ لِاَنْعَامِكُمْؕ

তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুর জীবন ধারণের সামগ্রী হিসেবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

ফলমূল উৎপাদন : সূর্যকিরণের ফলে হোক বা বন্যাপ্লাবনের ফলে হোক, শিলাপ্লাবনে শিলাগুলোর বিস্ফোরণে যখন বিবর্তন আসে তখনই সেখানে গাছপালাগুলোর বিভিন্নতা ও বৃদ্ধির প্রশ্ন আসে । এই তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনায় মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় গাছপালা, যা আল্লাহর রহমতে মাটি থেকে উৎপন্ন হয়, যা রং ও স্বাদ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে ছোটবড় নির্বিশেষে সবার প্রিয় ও সবার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম সেগুলোর প্রতি লক্ষ করার জন্যে মানুষদেরকে সরাসরি সম্বোধন করে এই আলোচনার এই অবতারণা করা হয়েছে- ‘উৎপন্ন করেছি আমি খাদ্যশস্য, বীজ’ ৷ এ খাদ্যবীজ বা খাদ্যশস্য দ্বারা সে সব খাদ্য বুঝায় যা মানুষ ও জীবজন্তু খায় এবং যা থেকে তারা জীবন ধারনোপযোগী শক্তি ও সজীবতা লাভ করে। বেঁচে থাকার জন্যে যেমন এক প্রকার দানা বা খাদ্যশস্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শারীরিক প্রবৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধির জন্যে ফলমূল ও শাক সবজি যা মানুষকে সুন্দর এবং রোগমুক্ত থাকতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন- ‘আরও (উৎপন্ন করেছি) আংগুর’- আংগুর এমন একটি ফল যার আকৃতি, রং, স্বাদ ও উপকারিতার কারণে সারা পৃথিবীতে এ ফল সর্বজন পরিচিত। শাকসবজির দ্বারা জীব জন্তু ও মানুষের প্রয়োজনীয় সকল প্রকার শাকসবজিই বুঝায়, যার অভাবে মানুষ নানাবিধ রোগ ব্যধির শিকার হয়। এগুলো টাটকা এবং তরতাজা অবস্থায় খাওয়াই নিয়ম। যেহেতু তরতাজা অবস্থায় এগুলো সবুজ শ্যামল থাকে। আর শ্যামলতাই চর্মরোগসহ আরও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সমর্থ ৷ এগুলো শুধু মানুষের জন্যেই নয়, পশু পাখীর জন্যও প্রয়োজন ৷ এ জন্যেই সহজলভ্যতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং এ কারণেই দুনিয়ার সর্বত্র কিছু না কিছু শাকসবজির ব্যবস্থা মজুদ রাখা হয়েছে, ‘আরও উৎপন্ন করেছি যায়তুন ও খেজুর, ঘনসন্নিবেশিত বাগ-বাগিচা এবং ফলমূল ও ঘাসপাতা’। সকল আরববাসীর কাছেই যায়তুন ও খেজুর সুপরিচিত ৷ ‘হাদীকা’ শব্দটির বহুবচন ‘হাদায়েক’ অর্থাৎ বাগিচাসমূহ ৷ যার দ্বারা বুঝায় প্রাচীর ঘেরা ফলবান গাছে ভরা বিস্তীর্ণ স্থান । “গুলবা’ শব্দটি একবচন, ‘গুলবা’-উ’ বহুবচন, এর দ্বারা বুঝায় এক বিরাট বাগিচা যা ঘন ঘন গাছে ভরা এবং ‘ফাকিহাত’ বলতে বুঝায় বাগিচাসমূহের মধ্যে উৎপন্ন বিভিন্ন প্রকারের ফলমূল ৷ আর ‘আব্বা’ অর্থে বেশীর ভাগ লোক মনে করেন সেই সবুজ তরতাজা ঘাস, যা খেয়ে গবাদিপশু জীবন ধারণ করে। এ বিষয়েই ওমর (রা.) (নিজেকে অথবা কাউকে) জিজ্ঞাসা করার পর নিজের প্রতি রুষ্ট হয়ে কিছু কথা বলেছিলেন যা সূরা নাযেয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যেসব ফল খেয়ে মানুষ জীবন ধারণ করে ও জীবনের সজীবতা অনুভব করে, সেগুলোর মধ্যে যায়তুন ও খেজুর বিশেষভাবে কোরআনে উল্লেখ হয়েছে। হাদীসের ভাষায় ও কোরআনে যায়তুনের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে বুঝা যায় যে, এতে খাদ্য ও ফল উভয়ের প্রয়োজনই মেটে । খেজুর সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে, ‘আজওয়া’ বা উৎকৃষ্ট মানের ৭টি খেজুর খেলে এক বেলা খাবারের কাজ হয়৷ অর্থাৎ খাবারের মধ্যে যেমন কার্বোহাইড্রেটসহ তরিতরকারিজাত অন্যান্য আরও বহু উপাদান থাকে, ৭টি পুষ্ট খেজুরের মধ্যে সেগুলো তো আছেই আরও আছে ফলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য! ফল মূল ও সবুজ ঘাসপাতার উপকারিতা । খাদ্য তালিকা দেয়ার পর এই সম্পূরক শব্দদ্বয় ব্যবহার করে জীবন ধারণের জন্যে এগুলোর অপরিহার্যতা ব্যক্ত করা হয়েছে। উল্লেখিত বস্তুগুলো দিয়ে মানুষ ও জীব জানোয়ারের জন্যে এক পরিপূর্ণ খাদ্য তালিকা যিনি দান করেছেন। মূলত তার পক্ষ থেকেই দেয়া হয়েছে এ দুই ধরনের উপাদানসমৃদ্ধ জিনিস। এগুলোর সঠিক ব্যবহারে মানুষ জীবনধারণসহ রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধ করার প্রচুর উপাদান পেতে পারে। এগুলোর ওপর গবেষণা চালালে মানুষ অচিরেই এমন কিছু হাসিল করতে পারবে যাতে সে চমৎকৃত হয়ে যাবে এবং অনেক অনেক কষ্ট থেকে সে নাজাত পাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এগুলোর ওপর গবেষণা অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। হাকিমী চিকিৎসা বিদ্যায়ও এগুলোর ওপর খুব বেশি গবেষণা হয়নি৷ যার কারণে বেশীর ভাগ মানুষই খাদ্য ও ফল মূলের সমন্বিত ব্যবহার না বুঝে ক্যামিক্যাল জাতীয় ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এগুলো তো গেলো খাদ্য খাবারের কাহিনী । এগুলো সবই সেই মহান হাতের সৃষ্টি যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ সকল জিনিসের উৎপাদনে কোনো পর্যায়েই মানুষের নিজের কোনো হাত আছে বলে সে দাবী করতে পারে না। এমনকি যে বীজ ও শস্যদানা সে বপণ করে তাও সে নিজে তৈরী করেনি বা আবিষ্কারও করেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এ বীজ ও খাদ্যদানা কিভাবে প্রথম আবিষ্কৃত হলো তা মানুষের ধ্যান-ধারণা ও বোধের সম্পূর্ণ অগম্য । একই যমীনে বিভিন্ন প্রকারের বীজ ও খাদ্যদানা বপণ করার পর একই পানি থেকে সেচ দেয়ার পরও দেখা যায় প্রতিটি দানা নিজ নিজ জাতের ফসল উৎপাদন করছে। এ হচ্ছে সে মহান কীর্তিমান কুদরতী হাতের ক্রিয়া, যিনি প্রত্যেক ফসল ও ফলের বীজের মধ্যে নিজ নিজ জাতের ফসল ও ফল আনয়ন করার ক্ষমতা সুপ্ত রেখেছেন, যা উপযুক্ত পরিবেশ ও অনুকূল আবহাওয়া পেলে নিজ নিজ প্রকৃতিতে বেরিয়ে আসে ৷ কিন্তু এসব কিছু মানুষের জ্ঞান ও দৃষ্টির আলোকে কোন বীজটি জীবন্ত হয়ে বেরিয়ে আসবে আর কোনটি আসবে না তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা নয়। কোন প্রক্রিয়ায় সে সকল দানা অংকুরিত হবে তাও মানুষের সম্পূর্ণ অজানা ৷ এর ওপর মানুষের কোনোই কর্তৃত্ব নেই। এগুলো সবই আল্লাহর নিজস্ব সৃজন পদ্ধতির অবদান । মানুষের নিজেদের ও তাদের ঘরে পালিত পশুর কল্যাণ ও প্রয়োজন মেটানোর জন্যে এ সকল ব্যবস্থা ।
সুরা: আবাসা
আয়াত নং :-৩৩-৪২

اُولٰٓئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ۠

তারাই হবে কাফের ও পাপী।

ফী জিলালিল কুরআন:

কিয়ামতের কিছু চিত্র : একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এ কল্যাণ অব্যাহত থাকবে, তারপর একদিন সব শেষ হয়ে যাবে। যতোদিন জীবন আছে ততোদিনের জন্যে এ সকল ভোগ্য সামগ্রী তোমাদেরকে আনন্দই দেবে। তারপর সকল ভোগ-বিলাসের পেছন পেছন আসবে আর একটি অবস্থা । সে সময়টি আসার পূর্বেই সে সময়ের জন্যে মানুষের চিত্তা করা দরকার । বলা হচ্ছে, “যখন আসবে সেই মহা চিৎকারধ্বনি, সেদিন মানুষ পালাতে থাকবে তার ভাই থেকে, মা থেকে, বাপ থেকে, জীবন সংগিনী থেকে এবং এমনকি আপন সন্তান থেকেও । প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে সেদিন এমন এক আতংকজনক অবস্থা হবে যা সবকিছু থেকে তাকে উদাসীন করে দেবে। সেদিন কিছু চেহারা থাকবে উজ্জ্বল, হাসিখুশী এবং সুসংবাদের আনন্দে মাতোয়ারা, আর কিছু চেহারা থাকবে ধুলাবালিতে ঢাকা এবং কালিমালিপ্ত, তারাই হচ্ছে অস্বীকারকারী কাফের ।” এ অবস্থা আসার সাথে সাথে তার সম্ভোগ ও বিলাসিতার সমাপ্তি ঘটবে । আর এই অবস্থাই তার দীর্ঘ ভাগ্যলিপি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। এই ভাগ্যলিপিতে মানুষের ক্রমোন্নতির পর্যায়গুলোও লিপিবদ্ধ রয়েছে! সূরার পরিশেষে যে দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছে প্রথমদিকে বর্ণিত দৃশ্যের সাথে তা পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল ৷ যাতে বলা হয়েছে, কেউ এগিয়ে আসবে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় আর অনেকে আসবে ধূলোমলিন মুখ নিয়ে । এক দল হবে তারা- যারা ছিলো হেদায়াতের আলো থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী। এই দুই দলকেই আল্লাহর ইনসাফের পাল্লায় মাপা হবে এবং আল্লাহর সামনে তাদের অবস্থা খুলে যাবে। ‘সাখখাহ’-র অর্থ একটি আরবী প্রতিশব্দের কাছাকাছি যার অর্থ হচ্ছে ভীষণ এক কড়া শব্দ । যখন সে শব্দ উত্থিত হবে তখন তা কানের গভীরে প্রবেশ করে পর্দা ফাটিয়ে দিতে চাইবে এবং বাতাস চিরে এগিয়ে যাবে৷ ওই শিংগা থেকে উত্থিত বিকট শব্দ আমাদের সামনে সেই দৃশ্য তুলে ধরে যার বর্ণনা ওপরে এসেছে । অর্থাৎ মানুষ মানুষ থেকে পালাতে থাকবে । সেদিন মানুষ তার ভাই, মা বাপ, স্ত্রী ও ছেলে থেকে পালাতে থাকবে । এরা সে সকল ব্যক্তি, যাদের মধ্যে পরস্পরের সাথে রয়েছে সাধারণ পরিস্থিতিতে এক অবিচ্ছেদ্য গভীর সম্পর্ক; কিন্তু এই ভয়ংকর গগণবিদারী শব্দ এ সমস্ত সম্পর্ককে পুরোপুরিভাবে কেটে দেবে এবং যাবতীয় আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করে ফেলবে। এ দৃশ্যের মধ্যে মানসিক ভীতি হবে অত্যন্ত গভীর, যা মনকে এতো বেশী ভারাক্রান্ত করবে যে, আশপাশের সবকিছু থেকে সে অমনোযোগী হয়ে যাবে এবং সমস্ত মন ভয়ে বিহ্বল হয়ে যাবে! প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন অবস্থা নিয়ে অস্থির থাকবে। মানুষের চিন্তা তার মনকে এমনভাবে ছেয়ে রাখবে যে, আত্মরক্ষা করা বা আত্মরক্ষার চেষ্টা করার মতো কোনো অবস্থাই তার থাকবে না । প্রত্যেকের এমন এক অবস্থা হবে, যা তাকে সবকিছু থেকে ভুলিয়ে দেবে । ওই সময়ে যে ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি হবে, তা বুঝানোর জন্যে এখানে যে বর্ণনা এসেছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং গভীর অর্থবোধক ৷ এই কঠিন দিনে মন ও আত্মার ওপর যে বিষাদ ছেয়ে যাবে, তার বর্ণনা আরও সংক্ষেপে এবং আরও ব্যাপকভাবে দেয়ার মতো অন্য কোনো ভাষা নেই। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে এমন এক কঠিন অবস্থা আসবে, যা তাকে অন্যদের থেকে উদাসীন করে দেবে।( “মাশাহেদুল ক্ট্য়োমাহ ফিল কোরআন”-নামক গ্রন্থ থেকে গৃহীত) সেই ভয়ানক দিনে যখন সেই মহা চিৎকারধ্বনি আসবে তখন ভয়াবহ আতংকের কারণে সমগ্র মানব সৃষ্টির একই অবস্থা হবে। তারপর আল্লাহর আদালতে বিচার অনুষ্ঠিত হবে প্রত্যেকের অবস্থা ও পরিণতি কী হবে তা স্থির হয়ে গেলে মোমেন ও কাফেরদের কার কি অবস্থা হবে, তা আবার পৃথক পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে- “কিছু সংখ্যক চেহারা সেদিন থাকবে উজ্জ্বল আভায় সমুজ্জ্বল, হাস্যোজ্জ্বল, সুসংবাদের খুশীতে মাতোয়ারা ” এ চেহারাগুলো থাকবে সেদিন আনন্দভরা এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্তিতে এতো উজ্জ্বল যে দেখলে মনে হবে সে চেহারাগুলোর ওপর উজ্জ্বল আলোর আভা পড়ে রয়েছে এবং ঝলমল করছে। নেককার ব্যক্তি তার পরওয়ারদেগারের কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার বুকভরা আশা নিয়ে আল্লাহর সতুষ্টিপ্রাপ্তির চেতনায় নিশ্চিন্ত ও পরিতৃপ্ত থাকবে। এই আনন্দের অনুভূতি কেয়ামতের ভয়ভীতি থেকে তাদের মনকে মুক্ত করে দেবে। যে নিদারুণ আতংক অপরাধীদেরকে একান্ত আপনজন থেকে গাফেল করে দেবে, মোমেনরা তার প্রভাবমুক্ত থেকে মহান আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার সুসংবাদ প্রাপ্তির কারণে হাসি খুশীতে আনন্দোচ্ছল থাকবে । প্রকৃত অবস্থা এদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, আর এ কারণেই তাদের চেহারা আনন্দে ঝলমল করে উঠবে । প্রথম দিকে যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তাদেরকে আপনজন থেকে উদাসীন হতে বাধ্য করবে, পরে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের সুসংবাদপ্রাপ্তির কারণে তাদের মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। আবার কিছু চেহারা থাকবে এমন- যেগুলোর ওপর হতাশা ও ব্যর্থতার ছাপ ফুটে উঠবে । দুঃখের গ্লানিতে সে মুখগুলো থাকবে কালিমালিপ্ত। এরা হলো সেই মহা অপরাধীর দল যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছিলো, অস্বীকার করেছিলো এই পরম সত্যকে ! এ দলের লোকদের চেহারায় দুঃখ ও আফসোসের গ্লানি পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। হীনতা ও হৃদয়ের সংকীর্ণতার কালিমা তাদেরক আচ্ছন্ন করে রাখবে! এরা হবে সেই সব লোক, যারা তাদের পূর্বেকার সব কীর্তি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারবে । সুতরাং তাদের জন্যে যে প্রতিদান নির্দিষ্ট রয়েছে তারা তার জন্যে অপেক্ষমান থাকবে ৷ এরাই হচ্ছে অস্বীকারকারী কাফের । এরা ভীষণ গুনাহগার, যারা আল্লাহকে সর্বশক্তিমান ও মুখাপেক্ষীহীন বলে বিশ্বাস করে নি এবং তিনি যে তার মনোনীত রসূলদের মাধ্যমে মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্যে কোনো পয়গাম পাঠিয়েছেন, তাও বিশ্বাস করে নি। তারা আল্লাহর সীমানা বা নিয়ন্ত্রণ লাইন থেকে বের হয়ে গেছে এবং তারা তার নিষিদ্ধ জিনিসগুলো ও পরিত্যাগ করেনি। এরা শক্তভাবে ভুল পথ আঁকড়ে ধরেছে এবং গুনাহের কাজগুলোকে ছেড়ে দেয়নি । এসব পাপিষ্ঠদের মধ্যে এমন শ্রেণীও রয়েছে যারা যিদ করেই আল্লাহর নির্দেশগুলোকে কথা ও কাজের মাধ্যমে উপেক্ষা করেছে। এ সকল কারণেই প্রত্যেক শ্রেণীর পরিণতি কি হবে তা তাদের চেহারায় পরিস্ফূট হয়ে থাকবে অর্থাৎ চেহারা দেখলেই তাদের চেনা যাবে । ওইসব লোকদের পরিণতি সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত প্রকাশভংগি বড়ই অভিনব । বলা হচ্ছে, ‘তাদের চোখগুলো স্থির হয়ে যাবে।’ এই বর্ণনা-পরিক্রমায় আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছি যে, সূরার শুরুতে আলোচিত কথাগুলোর সাথে শেষের কথাগুলো পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল । শুরুতে পাপপূণ্যের পরিমাপ করে প্রতিদান বা সাজা দেয়ার যুক্তি পেশ করা হয়েছে এবং পরিসমাপ্তিতে হিসাব গ্রহণের পর তার ফল কী দাড়াবে তার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে, আর এটা যথার্থ কথা যে, এ ছোট্ট সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বহু তথ্য একত্রে বর্ণনা করেছেন। বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্যে উপমা অনেক দৃশ্য পেশ করেছেন, দিয়েছেন বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার বিবরণ, এসব বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি এমন অভূতপূর্ব, হৃদয়গ্রাহী ও চমৎকার বর্ণনাভংগী ব্যবহার করেছেন, যা অত্যন্ত সূক্ষভাবে

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৩/হে মানুষ:-৫/এবং কাফের-র। বলে:-৩৭)
[**ভ্রুকুঞ্চিত করা:!:-
**মানুষেরা কত বড় সত্য অস্বীকারকারী!:-
*নিজের সাথী, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ভুলে যাবে:-
*তারাই কাফির ও পাপাচারী:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮০ : আবাসা
পারা:৩০
১-৪২ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

নামকরণ:

عَبَسَ আবাসা শব্দের অর্থ ভ্রুকুঞ্চিত করা বা মুখ ভার করা। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত এ শব্দ থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

সূরায় কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে:

যেমন সমাজের দুর্বল মানুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রভাব ও বিত্তশালীদের প্রতি মনোনিবেশ করার কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তিরস্কার করা, কুরআনের গুরুত্ব ও মর্যদার বর্ণনা কয়েকটি নেয়ামতের দিকে ভাবনার দৃষ্টিতে দেখার নির্দেশ এবং আখিরাতের ভাল মন্দের প্রতিদান ইত্যাদি।

১-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর:

শানে নুযূল:

সূরাটি সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। একদা নাবী (সাঃ) কুরাইশ নেতাদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন এ আশায় যে, হয়তো তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। এমতাবস্থায় হঠাৎ ঐ মাজলিসে আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রাঃ) উপস্থিত হয়ে বলেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ) ! আমাকে সঠিক পথ দেখান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটু বিরক্তি ভাব পোষণ করে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তাই নাবী (সাঃ)-কে সতর্ক করে এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (তিরমিযী সূরা আবাসার তাফসীর)

আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রাঃ) অনেক আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (ইবনু কাসীর) আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে খুবই সমাদর করতেন। (মুসনাদে আবূ ইয়ালা হা. ৩১২৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধে যাওয়াকালে তাকে প্রায়ই মদীনার প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদর, ওহুদ ও বিদায় হাজ্জসহ মোট ১৩ বার মদীনা ত্যাগকালে তাকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান। (ইবনু হাজার, আল ইসাবাহ হা. ৫৭৫৯) বেলাল তাহাজ্জুতের আযান দিতেন আর আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম ফযরের আযান দিতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৬১৭) এসব ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ হতে বিশেষ মর্যাদা দানের ফল। এ মর্যাদার কারণ হল তার শানে উক্ত আয়াতগুলো নাযিল হওয়া।

এ ধরণের দরিদ্র কয়েকজন সাহাবীর ব্যাপারে আরো কিছু আয়াত নাযিল হয়েছে যারা সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে থাকতেন। মক্কার কাফিররা তিরস্কার করে বলত : হে মুহাম্মাদ! এ লোকগুলোকেই কি আল্লাহ তা‘আলা বেছে নিয়ে আপনার ওপর অনুগ্রহ করেছেন? আর আমরা এদের আনুগত্য করব? এদের সরিয়ে দিন। তাহলে আমরা আপনার অনুসারী হতে পারি। তখন সূরা আন‘আমের ৫২-৫৩ নম্বর আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَا تَطْرُدِ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ رَبَّھُمْ بِالْغَدٰوةِ وَالْعَشِیِّ یُرِیْدُوْنَ وَجْھَھ۫ﺚ مَا عَلَیْکَ مِنْ حِسَابِھِمْ مِّنْ شَیْءٍ وَّمَا مِنْ حِسَابِکَ عَلَیْھِمْ مِّنْ شَیْءٍ فَتَطْرُدَھُمْ فَتَکُوْنَ مِنَ الظّٰلِمِیْنَﮃوَکَذٰلِکَ فَتَنَّا بَعْضَھُمْ بِبَعْضٍ لِّیَقُوْلُوْٓا اَھٰٓؤُلَا۬ئِ مَنَّ اللہُ عَلَیْھِمْ مِّنْۭ بَیْنِنَاﺚ اَلَیْسَ اللہُ بِاَعْلَمَ بِالشّٰکِرِیْنَ‏)‏

“যারা তাদের প্রতিপালককে সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ডাকে তাদেরকে তুমি বিতাড়িত কর না। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয় এবং তোমারও কোন কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তাদের নয় যে, তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে; করলে তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি এভাবে তাদের একদলকে অন্যদল দ্বারা পরীক্ষা করেছি যেন তারা বলে, ‘আমাদের মধ্যে কি এদের প্রতিই আল্লাহ অনুগ্রহ করলেন? আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন?” (সূরা আন‘আম ৬: ৫২-৫৩)

الْأَعْمٰي অন্ধ ব্যক্তি দ্বারা উদ্দেশ্য আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম।

(وَمَا يُدْرِيْكَ) অর্থাৎ

أي شئ يجعلك عالما بحقيقة أمره؟

কোন্ জিনিস তোমাকে তার প্রকৃত ব্যাপার অবগত করেছে? অর্থাৎ তুমি তার প্রকৃত ব্যাপার জাননা।

এ আয়াতগুলো প্রমাণ করছে, নাবী (সাঃ) গায়েব জানতেন না। তিনি কেবল ততটুকুই জানতেন যতটুকু তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে জানানো হত। আর এও প্রমাণ করে যে, তিনি দীনের কোন বিধান লুকাননি। যদি গোপন করতেন তাহলে তাঁকে তিরস্কারমূলক আয়াতগুলো গোপন করতেন। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি বলবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার দীনের কোন কিছু গোপন করেছেন সে তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করবে।

ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন : নাবীদেরকে যারা নিষ্পাপ মনে করে না, তারা এ ঘটনা থেকে দলীল গ্রহণ করে নাবী (সাঃ)-কে গুনাহগার বানাতে চায়। অথচ এটি কোন গুনাহর বিষয় নয়। কেননা এ অন্ধ সাহাবী পূর্ব থেকেই মুসলিম ছিলেন।

এ আয়াত থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, শীয়াদের দাবী মিথ্যা, বানোয়াট। কেননা তারা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে যে কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন, যাকে ‘মুসহাফে ফাতেমা’ বলা হয় তা এ কুরআনের চাইতে তিনগুণ বড় এবং বর্তমান কুরআনের একটি হরফও সেখানে নেই। (আশ শীয়া ওয়াস সুন্নাহ, ইহসান ইলাহী জহীর, পৃ : ৮০-৮১)

(مَنِ اسْتَغْنٰي)

অর্থাৎ যারা তোমার হিদায়াত থেকে বিমুখ হয়, তোমার হিদায়াত প্রয়োজন মনে করে না, অথচ তুমি তাদের নিয়েই ব্যস্ত। হিদায়েতের মালিক তুমি নও বরং তোমার দায়িত্ব কেবল পৌঁছে দেয়া, তুমি তাই কর।

(وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكّٰ)

অর্থাৎ তোমার কাজ তো কেবল প্রচার করা। সুতরাং এই শ্রেণির কাফিরদের পেছনে পড়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই।

(كَلَّآ إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ)

অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! তুমি যে কাজ করেছো তা উচিত হয়নি। এ সূরা তোমার ও যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য শিক্ষা। অতএব আগামীতে যেন এরূপ না হয়। (তাফসীর মুয়াসসার)

তাই দাওয়াতী কাজে গরীব-মিসকীন ও নিম্নশ্রেণির মানুষ উপেক্ষা করে চলা আদৌ উচিত নয়। কারণ কার ভাগ্যে হিদায়াত আছে আর কার দ্বারা ইসলামের উপকার হবে তা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কেউ জানে না।

(فَمَنْ شَا۬ءَ ذَكَرَه۫)

অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট সত্যের দাওয়াত পৌঁছেছে এখন সে ইচ্ছা করলে যেন সত্য কবুল করতঃ আমল করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ قف فَمَنْ شَا۬ءَ فَلْيُؤْمِنْ وَّمَنْ شَا۬ءَ فَلْيَكْفُرْ) ‏

“বল: ‎ ‘সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে; সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক ও যার ইচ্ছা কুফরী করুক।” (সূরা কাহ্ফ ১৮: ২৯)

অতঃপর এ উপদেশবাণীর অবস্থান ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فِيْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ)

বা সম্মানিত সহিফা অর্থাৎ লওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ যার মর্যাদা সুউচ্চ এবং যা সকল প্রকার নাপাকি ও কম-বেশি থেকে পবিত্র।

(بأَيْدِيْ سَفَرَةٍ) سافر

এর অর্থ হলো: দূত। ইমাম বুখারী ও ইবনু জারীরসহ অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে سفرة হলো ফেরেশতা। আর এটাই সঠিক। (ইবনু কাসীর) অর্থাৎ ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলদের মাঝে দূতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে।

(كِرَامٍ ۭبَرَرَةٍ)

অর্থাৎ কুরআন বহনকারী ফেরেশতারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং কাজকর্ম, কথায় পূত পবিত্র ও উত্তম। তাই প্রতিটি মু’মিন যারা কুরআনের ধারক বাহক তাদের এমন চরিত্রের অধিকারী হওয়া দরকার। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন :

الماهر بالقرآن مع السفرة الكرام البررة، والذي يقرأ القرآن ويتتعتع فيه، وهو عليه شاق، له أجران

যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং সে তাতে সুদক্ষ সে কিরামিম বারারাহ বা সম্মানিত পূন্যবান ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে কিন্তু কষ্টের সাথে (পড়তে গেলে আটকে যায়) তার জন্য দ্বিগুণ নেকী রয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৯৮)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম <-এর ফযীলত জানতে পারলাম। ২. যারা সাগ্রহে দীন গ্রহণ ও শিক্ষা নিতে চায় তাদেরকে সে বিষয়ে সময় ও সুযোগ করে দেয়া আবশ্যক তিনি যেই হোক না কেন। ৩. কুরআনের ধারক-বাহকদের কেমন চরিত্রের অধিকারী হওয়া উচিত তা জানতে পারলাম। ৪. কুরআন তেলাওয়াতকারীদের ফযীলত জানলাম। ১৭-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর: যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তিরস্কার ও অভিশাপ করে বলছেন যে, কাফির ব্যক্তিদের ওপর অভিশাপÑতারা কতই না অকৃতজ্ঞ ও নিমক হারাম। ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: এর অর্থ এটাও হতে পারে أي شئ جعله كافرا কোন্ জিনিস তাকে কাফির বানালো? অথচ তার খেয়াল করা উচিত, তাকে এক বিন্দু বীর্য দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার আয়ু, রিযিক, আমল সবকিছু নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, তার পরেও কি তার এরূপ কুফরী করা শোভা পায়? (ثُمَّ السَّبِيْلَ يَسَّرَه۫) অর্থাৎ মানুষকে সৃষ্টি করার পর ভাল-মন্দের পথ বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (إِنَّا هَدَيْنٰهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِرًا وَّإِمَّا كَفُوْرًا) “আমি তাকে পথ দেখিয়েছি, এরপর হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো হবে অকৃতজ্ঞ।” (সূরা দাহ্র ৭৬: ৩) তারপর তার আয়ু শেষ হলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে মৃত্যু দান করেন এবং তাকে কবরস্থ করেন। যাতে মানুষের সম্মান হানি না হয়। কেননা যদি কবরস্থ না করা হয় তাহলে হিংস্র পশু পাখি লাশ ছিঁড়ে ফেড়ে খাবে ফলে মানুষের যে সম্মান তা থাকবে না। কেউ কেউ এ আয়াতের অর্থ বলেছেন : অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য মায়ের পেট থেকে বের হওয়ার পথ সহজ করে দিয়েছেন। (ثُمَّ إِذَا شَا۬ءَ أَنْشَرَه۫) অর্থাৎ তোমাদের মৃত্যুর পর যখন ইচ্ছা তখন তিনি তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَمِنْ اٰیٰتِھ۪ٓ اَنْ خَلَقَکُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ اِذَآ اَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُوْنَ) “আর তাঁর দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে (অন্যতম) এই যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর এখন তোমরা মানুষ সব জায়গায় বিস্তার লাভ করেছ।” (সূরা রূম ৩০: ২০) (كَلَّا لَمَّا يَقْضِ مَآ أَمَرَه۫) অর্থাৎ কাফিররা যেমন বলে থাকে বিষয়টি তেমন নয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের যে ঈমান আমলের নির্দেশ দিয়েছেন তা তারা পালন করেনি। (তাফসীর মুয়াসসার) অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যে সকল নেয়ামত দান করেছেন তার কয়েকটি উল্লেখ করে মানুষকে তার দিকে চিন্তার দৃষ্টিতে তাকানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলোর দিকে মানুষ চিন্তার দৃষ্টিতে তাকালে সহজেই আল্লাহ তা‘আলাকে চিনতে পারবে। غُلْبً অর্থ ঘন বৃক্ষ, أَبًّا অর্থ এমন তৃণলতা যা চতুষ্পদ প্রাণী খায়। এজন্যই বলা হয়েছে, এটা তোমাদের ও তোমাদের পশুদের উপভোগের জন্য। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মানুষ যদি তার সৃষ্টি প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করে তাহলে কখানো আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করত না। ২. মৃত্যুর পরেও মানুষের সম্মান রক্ষার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কবরস্থ করার ব্যবস্থা করেছেন। ৩. আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করলে তাঁকে চেনা যায়। ৩৩-৪২ নম্বর আয়াতের তাফসীর: কিয়ামত দিবসে মানুষের যে অবস্থা হবে যেমন একজন অন্যজন হতে পলায়ন করবে, কেউ কাউকে দেবে না, সে কথাসহ দু’শ্রেণির মানুষের কথা এখানে আলোচনা করা হয়েছে যাদের একশ্রেণির চেহারা উজ্জ্বল হবে আরেক শ্রেণির চেহারা হবে ধূলায় ধূসরিত। الصَّاخَّةُ কিয়ামতের একটি অন্যতম নাম। কিয়ামতকে الصَّاخَّةُ বা শ্র্রবণশক্তি হরণকারী ধ্বংস ধ্বনি এ জন্য বলা হয় যে, এটা অতি ভয়ংকর আওয়াজের সাথে সংঘটিত হবে এবং তা কর্ণকে বধির করে ফেলবে। (لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ....) অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির এমন অবস্থা হবে যার কারণে সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : تُحْشَرُونَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا، قَالَتْ عَائِشَةُ : فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَي بَعْضٍ؟ فَقَالَ : الأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يُهِمَّهُمْ ذَاكِ তোমাদেরকে হাশর করানো হবে নগ্ন পায়ে, হেঁটে হেঁটে, উলঙ্গ ও খতনাবিহীন অবস্থায়। আয়িশাহ (রাঃ) বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের একজন কি অন্যজনের লজ্জাস্থানের দিকে তাকাবে না? তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : কিয়ামতের বিষয় এত কঠিন যে, তার দিকে মানুষ মনস্থও করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৬৫২৭) অন্য বর্ণনায় রয়েছে তখন নাবী (সাঃ) এ আয়াতটি পাঠ করলেন। (তিরমিযী হা. ১১৬৪৭, সহীহ।) (ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ) সহাস্য ও প্রফুল্ল। তাদের অন্তরের খুশির কারণে চেহারা এরূপ প্রফুল্ল হবে। যাদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তাদের এরূপ উজ্জ্বল চেহারা হবে। غَبَرَةٌ ধূলায় ধূসর। ترهقها অর্থ غشاها বা আচ্ছন্ন করে নেবে। অর্থাৎ যারা কাফির ও পাপাচারী তাদের চেহারা এরূপ হবে। (الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ) অর্থাৎ তাদের অন্তর কাফির আর কাজকর্ম খারাপ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوْآ إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا) “তুমি যদি তাদেরকে ছেড়ে দাও তারা তোমার‎ বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং যারা জন্ম লাভ করবে তারা হবে দুষ্কৃতকারী ও কাফির।” (সূরা নূহ ৭১: ২৭) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. কিয়ামতের দিন ভাই তার ভাইয়ের থেকে, পিতা-মাতা তার সন্তান থেকে পলায়ন করবে। ২. কিয়ামতের দিন এমন পরিস্থিতি হবে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকক্ষ। ৩. ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের চেহারা কিয়ামতের দিন উজ্জ্বল ও হাসিখুশি হবে। ৪. যারা বাম হাতে আমলনামা পাবে তাদের চেহারা ধূলায় ধূসরিত হবে। তাফসীরে ইবনে কাছীর:- ১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর বহু তাফসীরকার লিখেছেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) কুরায়েশ নেতাদেরকে ইসলামের শিক্ষা, সৌন্দর্য ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত করছিলেন এবং সেদিকে গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি আশা করছিলেন যে, হয়তো আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকেই ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দান করবেন। ঐ সময়ে হঠাৎ আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) নামক এক অন্ধ সাহাবী তাঁর কাছে এলেন। ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) বহু পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। প্রায়ই তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে হাযির থাকতেন এবং ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। মাসআলা মাসায়েল জিজ্ঞেস করতেন। সেদিনও তার আচরিত অভ্যাসমত এসে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন এবং সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁর প্রতি তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মহানবী (সঃ) তখন একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ জন্যে তিনি আব্দুল্লাহ্ (রাঃ)-এর প্রতি তেমন মনোযোগ দিলেন না। তাঁর প্রতি তিনি কিছুটা বিরক্তও হলেন। ফলে তার কপাল কুঞ্চিত হলো। এরপর এই আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে রাসূল (সঃ)। তোমার উন্নত মর্যাদা ও মহান চরিত্রের জন্যে এটা শোভনীয় নয় যে, একজন অন্ধ আমার ভয়ে তোমার কাছে ছুটে এলো, ধর্ম সম্পর্কে কিছু জ্ঞান লাভের আশায়, অথচ তুমি তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অহংকারী ও উদ্ধতদের প্রতি মনোযোগী হয়ে গেলে? পক্ষান্তরে সে ব্যক্তি তোমার কাছে এসেছিল, তোমার মুখ থেকে আল্লাহর বাণী শুনে পাপ ও অন্যায় হতে। বিরত থাকার সম্ভাবনা ছিল তার অনেক বেশী। সে হয়তো ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতো। অথচ তুমি সেই অহংকারী ধনী লোকদের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করলে এ কেমনতর কথা? ওদের সৎ পথে নিয়ে আসতেই হবে এমন দায়িত্ব তো তোমার উপর নেই। ওরা যদি তোমার কথা না মানে তবে তাদের দুষ্কৃতির জন্যে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে না। অর্থাৎ ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে বহু ছোট, ধনী-গরীব, সবল-দুর্বল, আযাদ-গোলাম এবং পুরুষ ও নারী সঝই সন। তুমি সবাইকে সমান নসীহত করবে। হিদায়াত আকার হাতে রয়েছে। আল্লাহ যদি কাউকে সৎ পথ থেকে দূরে রাখেন তবে তাৰ বুহস্য তিনিই জানেন, আর যদি কাউকে সৎপথে নিয়ে আসেন সেটার বৃহস্যও তিনিই ভাল জানেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) যখন এসেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উবাই ইবনে খালুফের সাথে কথা বলছিলেন। এরপর থেকে নবী (সঃ) হযরত ইবনে উন্মি মাকতুম (রাঃ)-কে খুবই সম্মান করতেন এবং তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেনঃ আমি ইবনে উম্মি মাকতূম (রাঃ)-কে কাদেসিয়ার যুদ্ধে দেখেছি যে, তিনি বর্ম পরিহিত অবস্থায় কালো পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ যখন ইবনে উন্মি মাকতুম (রাঃ) এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বললেনঃ “আমাকে দ্বীনের কথা শিক্ষা দিন”, তখন কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সামনে উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদেরকে ধর্মের কথা শোনাচ্ছিলেন আর জিজ্ঞেস করছিলেনঃ “বল দেখি, আমার কথা সত্য কি-না?” তারা উত্তরে বলছিলঃ “জ্বী, আপনি যথার্থই বলছেন। তাদের মধ্যে উত্বা ইবনে রাবীআহ, আবু জাহল ইবনে হিশাম এবং আব্বাস ইবনে আবদিল। মুত্তালিবও ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন যে, এরা যেন মুসলমান হয়ে যায় এবং সত্য দ্বীন গ্রহণ করে। এমনি সময়ে ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে কুরআনের কোন একটি আয়াত শুনিয়ে আল্লাহর কথা শিক্ষা দিন!” ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)-এর কথা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে অসময়োচিত মনে হলো, তিনি মুখ ফিরিয়ে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। তাদের সাথে কথা শেষ করে ঘরে ফেরার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মাথা ছিল নীচু, চোখের সামনে ছিল অন্ধকার। এই আয়াত ততক্ষণে নাযিল হয়ে গেছে। তারপর থেকে নবী (সঃ) ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)-কে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাঁর কথা শুনতেন। আসা-যাওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করতেন যে, তাঁর কোন প্রয়োজন আছে কি-না, কোন কথা আছে কি-না এবং কোন কিছু তিনি চান কি-না। এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীসের সংজ্ঞায় এই বর্ণনাটি গারীব এবং এর সনদ সম্পর্কেও কথা আছে। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “বিলাল (রাঃ) রাত থাকতেই আযান দেয়, সুতরাং তখন তোমরা পানাহার করবে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) আযান না দেয়া পর্যন্ত খেতে থাকবে, তার আযান শোনা মাত্র পানাহার বন্ধ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) ইনি সেই দৃষ্টিহীন লোক যার সম্পর্কে সূরা (আরবি) অবতীর্ণ হয়েছে। ইনিও মুআযযিন ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, পাশের লোকেরা যখন বলতো যে, সুবহে সাদেক হয়ে গেছে তখন তিনি আযান দিতেন। সুপ্রসিদ্ধ মত এই যে, তার নাম আবদুল্লাহ্ (রাঃ)। কেউ কেউ বলেন যে, তাঁর নাম আমর (রাঃ)। অবশ্য এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। (আরবি) অর্থাৎ না, এই আচরণ অনুচিত, এটা তো উপদেশ বাণী। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়তো এই সূরা অথবা ইলমে দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে মানুষের মাঝে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সমতা রক্ষার উপদেশ, যে, তাবলীগে দ্বীনের ক্ষেত্রে ছোট-বড়, ইতর-দ্র সবাই সমান। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, (আরবি) দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। যে ইচ্ছা করবে সে এটা স্মরণ রাখবে। অর্থাৎ আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং সকল কাজ-কর্মে তাঁর ফরমানকেই অগ্রাধিকার দিবে ? ক্রিয়া (আরবি) সঙ্গীয় যমীর বা সর্বনাম দ্বারা অহীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই সূরা, এই নসীহত তথা সমগ্র কুরআন সম্মানিত ও নির্ভরযোগ্য সহীফায় সংরক্ষিত রয়েছে, যা অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যা অপবিত্রতা হতে মুক্ত এবং যা কমও করা হয় না বা বেশীও করা হয় না। (আরবি) অর্থ ফেরেশতাগণ, তাঁদের পবিত্র হাতে কুরআন রয়েছে। এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত যহহাক (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ)-এর উক্তি। অহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রঃ) বলেন যে, দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে। কাতাদা (রঃ) বলেন। যে, তারা হচ্ছেন কুরআনের পাঠকগণ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এটা নতী ভাষার শব্দ, যার অর্থ হলো কারিগণ। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর মতে এর দ্বারা ঐ ফেরেশতাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্ এবং তার মাখলুকের মাঝে সাফীর বা দূত হিসেবে রয়েছেন। তিনি এটাকেই সঠিক উক্তি বলেছেন। যারা মানুষের মধ্যে সমঝোতা, আপোষ-মীমাংসা এবং কল্যাণের জন্যে চেষ্টা করেন তাদেরকে সাফীর বা দূত বলা হয়। যেমন কবি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি আমার সম্প্রদায়ের মাঝে দৌত্যকার্য পরিত্যাগ করি না এবং আমি চললে অচৈতন্য হয়ে চলি না।” ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন যে, এখানে (আরবি) দ্বারা ফেরেশতাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্ তা'আলার নিকট হতে অহী ইত্যাদি নিয়ে আসেন। তাঁরা মানুষের মাঝে শান্তি রক্ষাকারী দূতদেরই মত। তাদের চেহারা সুন্দর, পবিত্র ও উত্তম এবং তাঁদের চরিত্র ও কাজকর্মও পূত-পবিত্র ও উত্তম। এখান হতে এটাও জানা যায় যে, কুরআন পাঠকদের আমল-আখলাক অর্থাৎ কাজকর্ম ও চরিত্র ভাল হতে হবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে ও তাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করে সে মহান ও পূত-পবিত্র লিপিকর ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কুরআন পাঠ করে তার জন্যে দ্বিগুণ পুণ্য রয়েছে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে) ১৭-৩২ নং আয়াতের তাফসীর মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে যারা বিশ্বাস করে না এখানে তাদের নিন্দে করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি)-এর অর্থ করেছেনঃ মানুষের উপর লা'নত বর্ষিত হোক। তারা কতই না অকৃতজ্ঞ! আর এও অর্থ করা হয়েছে যে, সাধারণভাবে প্রায় সব মানুষই অবিশ্বাসকারী। তারা কোন দলীল-প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র ধারণার বশবর্তী হয়ে একটি বিষয়কে অসম্ভব মনে করে থাকে। নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধির স্বল্পতা সত্ত্বেও ঝট করে আল্লাহ্ তা'আলার বাণীকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করে বসে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এটাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে তাকে কোন্ জিনিস উদ্বুদ্ধ করছে? তারপর মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ কেউ কি চিন্তা করে দেখেছে যে, আল্লাহ্ তাকে কি ঘৃণ্য জিনিস দ্বারা সৃষ্টি করেছেন? তিনি কি তাকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন না? শুক্র বিন্দু বা বীর্য দ্বারা তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তাদের তকদীর নির্ধারণ করেছেন অর্থাৎ বয়স, জীবিকা, আমল এবং সৎ ও অসৎ হওয়া। তারপর তাদের জন্যে মায়ের পেট থেকে বের হওয়ার পথ সহজ করে দিয়েছেন। অর্থ এও হতে পারেঃ আমি স্বীয় দ্বীনের পথ সহজ করে দিয়েছি অর্থাৎ সুস্পষ্ট করে দিয়েছি। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।” (৭৬:৩) হযরত হাসান (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) এ অর্থটিকেই সঠিকতর বলেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ “তৎপর তার মৃত্যু ঘটান এবং তাকে কবরস্থ করেন। আরবদের বাক-বিনিময়ের মধ্যে এ কথা প্রচলিত আছে যে, যখন তারা কোন লোককে দাফন বা কবরস্থ করে তখন বলে থাকেঃ “আমি লোকটিকে কবরস্থ করলাম।” আর এ কথাও বলেঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ্ তাকে কবরস্থ করলেন।” এ ধরনের আরো কিছু পরিভাষা তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা তাকে কবরের অধিবাসী করেছেন। আবার যখন ইচ্ছা তিনি তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। এটাকেই (আরবি) এবং (আরবি) বলা হয়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছো।” (৩০৪ ২০) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আর অস্থিগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর, কিভাবে আমি সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোত দ্বারা ঢেকে দিই।” (২:২৫৯) হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, “মেরুদণ্ডের হাড় ছাড়া মানব দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাটিতে খেয়ে ফেলে।” জিজ্ঞেস করা হলো। “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ওটা কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ “ওটা একটা সরিষার বীজের সমপরিমাণ জিনিস, ওটা থেকেই তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এটা ভাষার কিছু পার্থক্যসহ বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে প্রশ্ন ও উত্তরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে) এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ অকৃতজ্ঞ এবং নিয়ামত অস্বীকারকারী মানুষ বলে যে, তাদের জান-মালের মধ্যে আল্লাহর যেসব হক ছিল তা তারা আদায় করেছে। কিন্তু আসলে তারা তা আদায় করেনি। মূলতঃ তারা আল্লাহ্র ফারায়েয আদায় করা হতে বিমুখ রয়েছে। তাই তো আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ তিনি তাদেরকে যা আদেশ করেছেন তা তারা এখনো পুরো করেনি। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, কোন মানুষের পক্ষেই আল্লাহ্ তা'আলার ফারায়েয পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব নয়। হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতেও এ ধরনের একটি উক্তি বর্ণিত রয়েছে। মুতাকাদ্দিমীনের মধ্যে আমি এটা ছাড়া অন্য কোন উক্তি পাইনি। আমার মনে হয় আল্লাহ্ তা'আলার এই উক্তির ভাবার্থ এই যে, পুনরায় তিনি যখনই ইচ্ছা করবেন তখনই পুনরুজ্জীবিত করবেন, সেই সময় এখনো আসেনি। অর্থাৎ এখনই তিনি তা করবেন না, বরং নির্ধারিত সময় শেষ হলে এবং বানী আদমের ভাগ্যলিখন সমাপ্ত হলেই তিনি তা করবেন। তাদের ভাগ্যে এই পৃথিবীতে আগমন এবং এখানে ভালমন্দ কাজ করা ইত্যাদি আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়ার পর সমগ্র সৃষ্টিকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করবেন। প্রথমে তিনি যেভাবে সৃষ্টি করেছিলেন দ্বিতীয়বারও সেভাবেই সৃষ্টি করবেন। মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত অহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উযায়ের (আঃ) বলেনঃ “আমার নিকট একজন ফেরেশতা এসে আমাকে বলেন যে, কবরসমূহ জমীনের পেট এবং যমীন মাখলুকের মাতা। সমস্ত মাখলুক সৃষ্ট হবার পর কবরে পৌছে যাবে। কবরসমূহ পূর্ণ হবার পর পৃথিবীর সিলসিলা বা ধারা পূর্ণতা লাভ করবে। ভূ-পৃষ্ঠে যা কিছু রয়েছে সবই মৃত্যুবরণ করবে। জমীনের অভ্যন্তরে যা কিছু রয়েছে জমীন সেগুলো উগলিয়ে ফেলবে। কবরে যতো মৃতদেহ রয়েছে সবকেই বাইরে বের করে দেয়া হবে।” আমরা এই আয়াতের যে তাফসীর করেছি তা এই উক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মহান ও পবিত্র আল্লাহই সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞানী। এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হওয়ার প্রমাণ এর মধ্যেও নিহিত রয়েছে। হে মানুষ! শুষ্ক অনাবাদী জমি থেকে আমি যেমন সবুজ-সতেজ গাছেন জন্ম • দিয়েছি, সেই জমি থেকে ফসল উৎপন্ন করে তোমাদের আহারের ব্যবস্থা করেছি, ঠিক তেমনি পচে গলে বিকৃত হয়ে যাওয়া হাড় থেকে আমি একদিন তোমাদের পুনরুত্থান ঘটাবো। তোমরা দেখতে পাচ্ছ যে, আমি আকাশ থেকে ক্রমাগত বারি বর্ষণ করে ঐ পানি জমিতে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। তারপর ঐ পানির স্পর্শ পেয়ে বীজ থেকে শস্য উৎপন্ন হয়েছে। কত রকমারী শস্য, কোথাও আঙ্গুর। কোথাও আবার তরি-তরকারী উৎপন্ন হয়েছে। (আরবি) সর্বপ্রকারের দানা বা বীজকে বলা হয় (আরবি)-এর অর্থ হলো আঙ্গুর। বলা হয় সেই সবুজ চারাকে যেগুলো পশুরা খায়। আল্লাহ্ তা'আলা যায়তুন পয়দা করেছেন যা তরকারী হিসেবে রুটির সাথে খাওয়া হয়। তাছাড়া ওকে জ্বালানী রূপে ব্যবহার করা যায় এবং তা হতে তেলও পাওয়া যায়। তিনি সৃষ্টি করেছেন খেজুর বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের কাঁচা-পাকা, শুকনো এবং ভিজে খেজুর তোমরা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকো। সেই খেজুর দিয়ে তোমরা শিরা এবং সিরকাও তৈরী করে থাকো। তাছাড়া আল্লাহ্ বাগান সৃষ্টি করেছেন। (আরবি) খেজুরের বড় বড় ফলবান বৃক্ষকেও বলা হয়। (আরবি) এমন বাগানকে বলা হয় যা খুবই ঘন এবং ফলে ফলে সুশোভিত। মোটা গ্রীবাবিশিষ্ট লোককেও আরববাসীরা বলে থাকে। আর আল্লাহ্ তা'আলা মেওয়া সৃষ্টি করেছেন। বলা হয় ঘাস পাতা ইত্যাদিকে যা পশুরা খায়, কিন্তু মানুষ খায় না। মানুষের জন্যে যেমন ফল, মেওয়া তেমনি পশুর জন্যে ঘাস। হযরত আতা (রঃ) বলেন যে, জমিতে যা কিছু উৎপন্ন হয় তাকে (আরবি) বলা হয়। যহ্হাক (রঃ) বলেন যে, মেওয়া ছাড়া বাকী সবকিছুকে (আরবি) বলা হয়। আবুস সায়েব (রঃ) বলেন যে, মানুষ এবং পশু উভয়ের খাদ্য বা আহার্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “কোন আকাশ আমাকে তার নীচে ছায়া দিবে? কোন্ জমীন আমাকে তার পিঠে তুলবে? যদি আমি আল্লাহর কিতাবের যে বিষয় ভাল জানি না তা জানি বলে উক্তি করি?” অর্থাৎ এ সম্পর্কে আমার জানা নেই। ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-কে পাননি। সহীহ্ সনদে তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত উমার ফারুক (রাঃ) থেকে বর্ণিত এ রিওয়ায়িত আছে যে, তিনি মিম্বরের উপর সূরা (আরবি) পাঠ করতে শুরু করেন এবং বলেনঃ (আরবি)-এর অর্থ ততা আমরা মোটামুটি জানি, কিন্তু এর অর্থ কি? তারপর তিনি নিজেই বলেনঃ “হে উমার (রাঃ)! এ কষ্ট ছাড়ো!” এতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, (আরবি) যমীন থেকে উৎপাদিত জিনিসকে বলা হয়, কিন্তু তার আকার-আকৃতি জানা যায় না...... (আরবি) দ্বারা এর চেয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। এরপর আল্লাহ্ পাক বলেনঃ এটা তোমাদের ও তোমাদের পশুগুলোর ভোগের জন্যে। কিয়ামত পর্যন্ত এই সিলসিলা বা ক্রমধারা অক্ষুন্ন থাকবে এবং তোমরা তা থেকে লাভবান হতে থাকবে। ৩৩-৪২ নং আয়াতের তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবি) কিয়ামতের একটি নাম। এ নামের কারণ এই যে, কিয়ামতের শিংগার আওয়াজ ও শোরগোলে কানের পর্দা ফেটে যাবে। সেদিন মানুষ তার নিকটাত্মীয়দেরকে দেখবে কিন্তু তাদেরকে দেখে পালিয়ে যাবে। কেউ কারো কোন কাজে আসবে না। স্বামী তার স্ত্রীকে দেখে বলবেঃ আমি পৃথিবীতে তোমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছিলাম? স্ত্রী উত্তরে বলবেঃ নিঃসন্দেহে আপনি আমার সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। এ কথা শুনে স্বামী বলবেঃ আজ আমার একটি মাত্র পুণ্যের প্রয়োজন, তাহলেই আমি আজকের এই মহা বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারি। ঐ একটি পুণ্য তুমি আমাকে দাও। স্ত্রী বলবেঃ আপনি তো সামান্য জিনিসই চেয়েছেন, কিন্তু আমি যে অক্ষম! আজ পুণ্যের আমার নিজেরই একান্ত প্রয়োজন। আশংকা করছি আমিও বিপদে পড়ি না কি? কাজেই পুণ্য দেয়া সম্ভব নয়। পুত্র পিতার সাথে দেখা করে একই রকম আবেদন-নিবেদন জানাবে এবং একই রকম জবাব পাবে। সহীহ্ হাদীসে শাফাআত প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ বড় বড় পয়গাম্বরদের কাছে জনগণ শাফাআতের জন্যে আবেদন জানাবে, কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই বলবেনঃ “ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসী!' এমনকি হ্যরত ঈসা রুহুল্লাহ্ (আঃ) পর্যন্ত বলবেনঃ আজ আল্লাহ্ তা'আলার কাছে নিজের প্রাণ ছাড়া অন্য কারো জন্যে আমি কিছুই বলবো না। এমনকি যার গর্ভ থেকে আমি ভূমিষ্ট হয়েছি সেই মা জননী হযরত মরিয়ম (আঃ)-এর জন্যেও কিছু বলবো না। মোটকথা, বন্ধু বন্ধুর কাছ থেকে, আত্মীয় আত্মীয়ের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ও বিব্রত থাকবে। অন্যের প্রতি কেউ ক্ষেপ করবে না। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “তোমরা নগ্নপদে, নগ্নদেহে খত্নাবিহীন অবস্থায় আল্লাহ্র কাছে জমায়েত হবে।” এ কথা শুনে তার এক স্ত্রী বলেনঃ “হে আল্লাহ্র রাসূল (সঃ)! তাহলে তো অন্যের লজ্জাস্থানের প্রতি চোখ পড়বে!” রাসূলুল্লাহ্ বললেন! ঐ মহা প্রলয়ের দিনে সব মানুষ এতো ব্যস্ত থাকবে যে, অন্যের প্রতি তাকানোর সুযোগ কারো থাকবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, অতঃপর আল্লাহর নবী (সঃ) (আরবি) আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। অন্য এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঐ স্ত্রী ছিলেন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)। হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি নিবেদিত হোক! আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করছি, আপনি তার উত্তর দিন।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “জানা থাকলে অবশ্যই উত্তর দিবো।” হযরত আয়েশা (রাঃ) তখন জিজ্ঞেস করলেনঃ “মানুষের হাশর কিভাবে হবে?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তর দিলেনঃ আল্লাহর নবী (সঃ) উত্তর দিলেনঃ “নগ্নপায়ে ও নগ্নদেহে।” কিছুক্ষণ পর হযরত আয়েশা জিজ্ঞেস করলেনঃ “মহিলারাও কি ঐ অবস্থায় থাকবে?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা।” এ কথা শুনে উম্মুল মুমিনীন দুঃখ করতে লাগলেন। তখন আল্লাহর নবী (সঃ) বললেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! এই আয়াতটি শোননা, তারপর পোশাক পরিধান করা না করা নিয়ে তোমার কোন আফসোস বা দুঃখ থাকবে না।” হযরত আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “কোন্ আয়াত?” জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করলেন। অন্য এক বর্ণনায় উম্মুল মুমিনীন হযরত সাওদা (রাঃ) -এর জিজ্ঞেস করার কথা উল্লিখিত হয়েছে। সব মানুষ নগ্নপায়ে, নগ্নদেহে খত্নাবিহীন অবস্থায় হাশরের মাঠে সমবেত হবে। কেউ কান পর্যন্ত ঘামের মধ্যে ডুবে যাবে, কারো মুখ পর্যন্ত ঘাম পৌছবে তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এই আয়াত তিলাওয়াত করেন। এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ সেখানে লোকদের দুটি দল হবে। এক দলের চেহারা আনন্দে চমকাতে থাকবে। তাদের মন নিশ্চিন্ত ও পরিতৃপ্ত থাকবে। তাদের মুখমণ্ডল সুদর্শন এবং উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তারা হবে জান্নাতি দল। আর একটি দল হবে জাহান্নামীদের। তাদের চেহারা মসিলিপ্ত, কালিমাময় ও মলিন থাকবে। হাদীস শরীফে আছে যে, তাদের ঘাম হবে তাদের জন্যে লাগামের মত। তারা ধূলি-মলিন অবস্থায় পড়ে থাকবে। এরা সেই দল যাদের মনে কুফরী ছিল এবং আমল ছিল পাপে পরিপূর্ণ। যেমন অন্য এক জায়গায় আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তারা জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুষ্কৃতিকারী কাফির।” (৭১:২৭)

Leave a Reply