Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৯৪/হে মানুষ:-৬) [* কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো? :- *নিশ্চয়ই এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের আনীত বাণী:- *হেদায়াত চেয়ে নিতে হয় :-] www.motaher21.net সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর পারা:৩০ ১-২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- # তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- # তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৪/হে মানুষ:-৬)
[* কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো? :-
*নিশ্চয়ই এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের আনীত বাণী:-
*হেদায়াত চেয়ে নিতে হয় :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর
পারা:৩০
১-২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-

# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১
اِذَا الشَّمۡسُ کُوِّرَتۡ ۪ۙ﴿۱﴾
যখন সূর্য গুটিয়ে নেয়া হবে।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২
وَ اِذَا النُّجُوۡمُ انۡکَدَرَتۡ ۪ۙ﴿۲﴾
আর যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে ,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৩
وَ اِذَا الۡجِبَالُ سُیِّرَتۡ ۪ۙ﴿۳﴾
পর্বতসমূহকে যখন চলামত করা হবে,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৪
وَ اِذَا الۡعِشَارُ عُطِّلَتۡ ۪ۙ﴿۴﴾
যখন পূর্ণ-গর্ভা উষ্ট্রী উপেক্ষিতা হবে,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৫
وَ اِذَا الۡوُحُوۡشُ حُشِرَتۡ ۪ۙ﴿۵﴾
যখন বন্য পশুগুলিকে একত্রিত করা হবে,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৬
وَ اِذَا الۡبِحَارُ سُجِّرَتۡ ۪ۙ﴿۶﴾
যখন সমুদ্রগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৭
وَ اِذَا النُّفُوۡسُ زُوِّجَتۡ ۪ۙ﴿۷﴾
যখন আত্মাসমূহকে (স্ব-স্ব দেহে) পুনঃসংযোজিত করা হবে,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৮
وَ اِذَا الۡمَوۡءٗدَۃُ سُئِلَتۡ ۪ۙ﴿۸﴾
যখন জীবিত পুঁতে ফেলা মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-৯
بِاَیِّ ذَنۡۢبٍ قُتِلَتۡ ۚ﴿۹﴾
কোন্ অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১০
وَ اِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتۡ ﴿۪ۙ۱۰﴾
যখন আমলনামাসমূহ খুলে ধরা হবে।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১১
وَ اِذَا السَّمَآءُ کُشِطَتۡ ﴿۪ۙ۱۱﴾
যখন আকাশের আবরণকে অপসারিত করা হবে।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১২
وَ اِذَا الۡجَحِیۡمُ سُعِّرَتۡ ﴿۪ۙ۱۲﴾
আর যখন জাহান্নামকে ভীষণভাবে প্ৰজ্জ্বলিত করা হবে,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৩
وَ اِذَا الۡجَنَّۃُ اُزۡلِفَتۡ ﴿۪ۙ۱۳﴾
এবং জান্নাতকে যখন নিকটবর্তী করা হবে।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৪
عَلِمَتۡ نَفۡسٌ مَّاۤ اَحۡضَرَتۡ ﴿ؕ۱۴﴾
তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে, সে কি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৫
فَلَاۤ اُقۡسِمُ بِالۡخُنَّسِ ﴿ۙ۱۵﴾
আমি প্রত্যাবর্তনকারী তারকাপুঞ্জের শপথ করছি;
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৬
الۡجَوَارِ الۡکُنَّسِ ﴿ۙ۱۶﴾
যা চলমান হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৭
وَ الَّیۡلِ اِذَا عَسۡعَسَ ﴿ۙ۱۷﴾
শপথ রাত্রির, যখন তার অবসান হয়।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৮
وَ الصُّبۡحِ اِذَا تَنَفَّسَ ﴿ۙ۱۸﴾
শপথ প্ৰভাতের যখন তার আবির্ভাব হয়,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-১৯
اِنَّہٗ لَقَوۡلُ رَسُوۡلٍ کَرِیۡمٍ ﴿ۙ۱۹﴾
নিশ্চয়ই এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের আনীত বাণী ।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২০
ذِیۡ قُوَّۃٍ عِنۡدَ ذِی الۡعَرۡشِ مَکِیۡنٍ ﴿ۙ۲۰﴾
যিনি বড়ই শক্তিধর, আরশের মালিকের কাছে উন্নত মর্যাদার অধিকারী,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২১
مُّطَاعٍ ثَمَّ اَمِیۡنٍ ﴿ؕ۲۱﴾
সেখানে তার হুকুম মেনে চলা হয়, তিনি আস্থাভাজন।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২২
وَ مَا صَاحِبُکُمۡ بِمَجۡنُوۡنٍ ﴿ۚ۲۲﴾
আর (হে মক্কাবাসীরা!) তোমাদের সাথী পাগল নয়।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৩
وَ لَقَدۡ رَاٰہُ بِالۡاُفُقِ الۡمُبِیۡنِ ﴿ۚ۲۳﴾
তিনি তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন ,
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৪
وَ مَا ہُوَ عَلَی الۡغَیۡبِ بِضَنِیۡنٍ ﴿ۚ۲۴﴾
সে অদৃশ্য (অহী) প্রচারে কৃপণ নয়।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৫
وَ مَا ہُوَ بِقَوۡلِ شَیۡطٰنٍ رَّجِیۡمٍ ﴿ۙ۲۵﴾
এবং এ (কুরআন) বিতাড়িত শয়তানের কথা নয়।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৬
فَاَیۡنَ تَذۡہَبُوۡنَ ﴿ؕ۲۶﴾
সুতরাং তোমরা কোথায় চলেছ?
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৭
اِنۡ ہُوَ اِلَّا ذِکۡرٌ لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۲۷﴾
এ তো শুধু বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ মাত্র;
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৮
لِمَنۡ شَآءَ مِنۡکُمۡ اَنۡ یَّسۡتَقِیۡمَ ﴿ؕ۲۸﴾
তোমাদের মধ্য থেকে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে সত্য সরল পথে চলতে চায়।
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর:-২৯
وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿٪۲۹﴾
আর তোমাদের চাইলেই কিছু হয় না, যতক্ষণ না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা চান।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৪/হে মানুষ:-৬)
[* কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো? :-
*নিশ্চয়ই এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের আনীত বাণী:-
*হেদায়াত চেয়ে নিতে হয় :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮১ : আত্-তাকভীর
পারা:৩০
১-২৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

# তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-

সুরা: আত-তাকভীর

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৮১

# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

# ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এ সূরাটিকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রত্যেক ভাগে ইসলামী আকীদার মূলনীতিসমূহের প্রধান প্রধান এক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে । প্রথম বিষয়টি হচ্ছে কেয়ামতের বাস্তব দৃশ্য তুলে ধরা এবং সংঘটিত হওয়ার সময় সৃষ্টিরাজির মধ্যে যে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হবে সে সম্পর্কে আলোচনা ৷ এ বিপর্যয় আসবে সূর্যে, তারকারাজিতে, পাহাড়-পর্বতসমূহে, সমুদ্রে, পৃথিবীতে, আকাশে, গৃহপালিত পশু ও হিংসু জীব-জন্তুতে এবং মানুষের মধ্যে, সবখানে । দ্বিতীয় বাস্তব সত্যটি হচ্ছে ওহী এবং যে ফেরেশতা এ ওহী বহন করে এনেছেন তার বৈশিষ্ট্য ও যার কাছে ওহী পৌছেছে সেই নবী সম্পর্কে । তারপর আলোচনা করা হয়েছে ওই জাতি সম্পর্কে, যাদেরকে সম্বোধন করে ওহী পাঠানো হয়েছিলো । সূরাটির মধ্যে যে ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা এসেছে তা হচ্ছে মহা প্রলয়ংকর এক আলোড়ন । যা শুরু হয়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করে ফেলবে ৷ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়ে যাবে প্রতিটি জিনিস ৷ স্থির পদার্থগুলো ছুটে বেড়াতে থাকবে এবং যারা নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছিলো তারা সব ভয়ে বিহ্বল হয়ে যাবে । বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে মানুষ সকল পরিচিতদের থেকে । চেনা জিনিসকেও আর কেউ চিনতে পারবে না। বিপদের এই ঘনঘটায় মানুষ বহু সময় ধরে ভীষণভাবে দুলতে থাকবে । দুনিয়াতে যাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিলো তাদের সকল সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে কেটে যাবে । কিছুতেই এক সাথে থাকতে পারবে না তারা, যারা জীবনভর একসাথে থেকেছে। সেদিন যে ভয়ানক তুফান প্রবাহিত হবে তা পাখীর পশমের মতো সবকিছুকে এমনভাবে ঝাঁট দিয়ে নিয়ে যাবে যেন সেগুলোর কোনো ওযনই নেই এবং কোনো স্থায়িত্ব কোনোদিন ছিলো না। সেদিন সকল শক্তির মালিক এক আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেউ কোনো আশ্রয় অথবা মাথা গোজার ঠাই পাবে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই চিরন্তন, শাশ্বত ও স্থায়ী । শুধু তার এবং একমাত্র তার কাছেই দাড়ানোর জায়গা পাওয়া যাবে ও প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব হবে। চূড়ান্তভাবে সে দিনই মানুষ এ কথা বুঝবে । এ সূরাটিতে একথাই বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে যে, সে যাদের কাছে নিশ্চিন্ত মনে সারা জীবন থেকেছে এবং যার সাহায্যের ওপর নির্ভর করেছে সেসব থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। যাতে করে সে একমাত্র আল্লাহর কাছেই আশ্রয় নিতে পারে, তার আশ্রয়েই এগিয়ে আসে এবং তার কাছেই নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব কামনা করে। সূরাটি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি তুলে ধরার কারণে । এতে যেমন আমাদের জানা বর্তমান জগতের অনেক চমকপ্রদ ছবি-তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি তুলে ধরা হয়েছে আখেরাতের বহু দৃশ্যের বিবরণ । তখন এমন অনেক আশ্চর্যজনক পরিবর্তন সংঘটিত হবে, যেগুলো আমাদের জানাও নেই, আর সেগুলোর কল্পনাও আমরা করতে পারি না। যে বর্ণাঢ্য বর্ণনা সূরাটিতে পেশ করা হয়েছে তাও এর শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। সূরাটি ছোট্ট হলেও এর বর্ণনাভংগির বৈচিত্র, শব্দগুলোর চমৎকার মিল, ভাবমূর্তি ও প্রকাশের স্বচ্ছতা, সবকিছু মিলে একে করেছে অনবদ্য । যার ফলে অর্থ বুঝে মনোনিবেশ সহকারে সূরাটি পড়লে মনের গভীরে দাগ কাটে এবং সে চিহ্ন দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকে । কিছু অপরিচিত শব্দ সূরাটিতে ব্যবহৃত হয়েছে যা বর্তমান যমানার পড়ুয়াদের বোধগম্যের বাইরে । তা না হলে আমি হয়তো এর ওপর কোনো ব্যাখ্যা বা মন্তব্য করতাম না। কিন্তু আমি অনুভব করেছি যে, এর মধ্যে এমন কিছু জটিল ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে, কিছু তথ্য ও দৃশ্যের বিবরণ এসেছে, যা মানুষের ভাষায় প্রকাশিত হতে পারে না, কিছু তা হৃদয়পটে গভীরভাবে রেখাপাত করে ও মনকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। মানুষের ভাষা সেই তথ্যগুলো পেশ করতে সক্ষম না হলেও মানুষের স্রষ্টা সেগুলো পেশ করতে এবং সেগুলোর তাৎপর্য সার্থক ও ক্রিয়াশীলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম । আমাদের এ যমানায় কোরআনকে বুঝার জন্যে যে গুরুত্ব দিয়ে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন, তা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গিয়েছি । এটাই আমাদের দুর্ভাগ্যের সব থেকে বড়ো কারণ । এরশাদ হচ্ছে, ‘সূর্যকে যখন জ্যোতিহীন করে দেয়া হবে, তারাগুলো যখন আলোহীন হয়ে ম্লান হয়ে যাবে ……..তখন মানুষ জানবে কোন  জিনিস নিয়ে সে হাযির হয়েছে।’  (আয়াত-১-১৪) এটাই হচ্ছে সেই সর্বগ্রাসী বিপর্যয়, যা পৃথিবীর সবকিছুকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলবে । এ হবে এমন এক বিপর্যয়, যা থেকে কোনো কিছু রেহাই পাবে না। আকাশ ও পৃথিবীর সকল স্কুদ্র বৃহৎ থেকে নিয়ে হিংস্র প্রাণী, গৃহপালিত পশু এবং সকল মানুষ স্থানচ্যুত হয়ে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে৷ সেদিন সকল অপ্রকাশিত জিনিস প্রকাশিত হবে এবং সকল অজানা তথ্য বেরিয়ে পড়বে। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামনে ওই সকল কাজ, কথা ও ব্যবহার দেখতে পাবে, যা সে পরকালের পাথেয় হিসেবে জমা করে রেখেছে। সেদিন চতুর্দিকের সবকিছু বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকবে এবং কোনো কিছুই তার আসল অবস্থায় টিকে থাকতে পারবে না। এ সূরাতে বর্ণীত সেদিনকার সেই সর্বগ্রাসী বিপর্যয় এই ইংগিত বহন করছে যে, যখন আসবে সেই ভয়ংকর দিন, তখন বর্তমানের আকাশ, পৃথিবী ও সকল প্রাণীর মধ্যে আজ যে শৃংখলা বিরাজ করছে, পারস্পরিক সম্পর্কের ভারসাম্য- যা পরম দয়াময় সতর্ক ও চরম শৃংখলা বিধানকারীর সৃষ্টি, সে সবকিছু সেই মহা প্রলয়ের দিনে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। থাকবে না কোনো নিয়ম শৃংখলা এবং বস্তুসমূহের মধ্যে আজকের বিরাজমান সম্পর্ক সব বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । সেদিন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে যা পূর্ব থেকেই স্থিরীকৃত ৷ আসবে নতুন জীবন ও জগত, যা হবে আজকের জীবন ও জগত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সূরার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অন্তরে অবশ্যম্ভাবী ওই মহা প্রলয়ের অনুভূতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাতে করে তারা পার্থিব জীবন ও তার সুখ সম্পদের প্রতি অধিক গুরুত্ব না দেয়। এই সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তার তাৎপর্য একমাত্র আল্লাহ্‌ তায়ালাই জানেন ৷ কেয়ামতের ঘটনা হচ্ছে সেই মহা সত্য, যা আমাদের চিন্তা ভাবনা, বুঝ ও জ্ঞানের উর্ধ্বের জিনিস । এ নিয়ে যতো চিন্তাই আমরা করি না কেন, তা সম্যক উপলব্ধি করা কোনোভাবেই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীতে আমরা যতো প্রকার ঝড় তুফান ও ভূমিকম্প দেখি বা কল্পনা করি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভয়ংকর সে অবস্থা । ভীষণ আগ্নেয়গিরি যা শত সহস্র জনপদ ধ্বংস করে দেয়, সমুদ্রের উচ্ছ্বাস যা শহর, নগর, বন্দরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এসব কিছু থেকেও কেয়ামতের দৃশ্য অতি ভয়ংকর। বোমা ফাটার শব্দ, বাজ পড়ার কর্ণবিদারক ধ্বনি এবং ওই ধরনের যতো কিছুর কল্পনা আমরা করি না কেন, কোনোটি দ্বারাই আমরা কেয়ামতের সঠিক অবস্থা বুঝতে পারি না। এমনকি পৃথিবী থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে অবস্থিত সূর্যের মধ্যে যে বিস্ফোরণ ঘটার অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করেছি তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ানক হলেও কেয়ামতের দিনে যা সংঘটিত হবে তার তুলনায় এগুলো অতি তুচ্ছ এবং অনেকটা ছেলেখেলার মতো। প্রকৃতপক্ষেই যদি আমরা কেয়ামতের ভয়ংকর অবস্থা বুঝতে চাই, তাহলে যতো প্রলয় এ পর্যন্ত বিশ্বের বুকে ঘটেছে সেগুলোর সাথে শুধু একটু তুলনা করতে পারি মাত্র।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-১

اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ۪ۙ

যখন সূর্য গুটিয়ে নেয়া হবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# সূর্যকে আলোহীন করে দেবার জন্য এটা একটা অতুলনীয় উপমা। আরবী ভাষায় তাকভীর মানে হচ্ছে গুটিয়ে নেয়া। মাথায় পাগড়ী বাঁধার জন্য “তাকভীরুল আমামাহ” বলা হয়ে থাকে। কারণ আমামা তথা পাগড়ী লম্বা কাপড়ের হয়ে থাকে এবং মাথার চারদিকে তা জড়িয়ে নিতে হয়। এই সাদৃশ্য ও সম্পর্কের কারণে সূর্য থেকে যে আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে সমগ্র সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে তাকে পাগড়ীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন এই বিছিয়ে থাকা পাগড়ীটি সূর্যের গায়ে জাড়িয়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ তার আলোক বিচ্ছুরণ বন্ধ হয়ে যাবে‌।

ফী জিলালিল কুরআন:

সূর্যের ম্লান হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সম্ভবত এটাই যে, তা ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে অনন্তকাল ধরে যে সুর্যরশ্মি বিকীর্ণ করে তা স্তিমিত হয়ে যাবে। সূর্যের অত্যধিক উত্তাপের কারণে এটা বাষ্প আকারে বর্তমান রয়েছে এবং তাপের সর্বোচ্চ মাত্রা হচ্ছে ১২,০০০ ডিগ্রী । এর অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার অর্থ সম্ভবত এটাই যে, ভূপৃষ্টের তাপের মতো এর তাপের মাত্রা সমমাত্রায় নেমে আসবে এবং এর আকৃতি প্রসারিত না হয়ে গোলাকারই থাকবে ।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-২

وَ اِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَتْ۪ۙ

যখন তারকারা চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# যে বাঁধনের কারণে তারা নিজেদের কক্ষপথে ও নিজেদের জায়গায় বাঁধা আছে তা খুলে যাবে এবং সমস্ত গ্রহ-তারকা বিশ্ব-জাহানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়াও ‘ইনকিদার’ শব্দটির মধ্যে ‘কুদরাত’ এর অর্থও রয়েছে। অর্থাৎ তারা শুধু ছড়িয়েই পড়বে না বরং এই সঙ্গে আলোহীন হয়ে অন্ধকার হয়েও যাবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

কেয়ামতের কিছু খন্ডচিত্র : ওপরে বর্ণিত অর্থই সম্ভবত সুরাটির গোড়ার দিকে ব্যক্ত করা হয়েছে। অবশ্য অন্য অর্থও হতে পারে। কিভাবে এ বিপর্যয় সংঘটিত হবে এবং কোন কোন কারণে এটা সংঘটিত হবে তার খবর একমাত্র বিশ্বনিয়ন্তা মহান আল্লাহ্‌ তায়ালাই জানেন, আমাদের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। তারকারাজির পতনের অর্থ হয়তো এই হবে যে, সেগুলো কক্ষচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়বে এবং যে ব্যবস্থার বন্ধনে আজকে সেগুলো আবদ্ধ রয়েছে সে মহা বিপর্যয়ের কারণে সে ব্যবস্থা ভেংগে যাবে এবং একটির সাথে অন্যটির কোনো সম্পর্ক থাকবে না আলো বিকিরণের যে ব্যবস্থা আজ আছে তা শেষ হয়ে যাবে এবং তার ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যাবে । আর আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন কোন কোন তারকা এর প্রভাব বলয়ে পড়বে। যেগুলো ভূ-পৃষ্টের কাছাকাছি আছে বা সৌরমন্ডলে সূর্যের নিকটবর্তী এবং তার প্রভাববলয়ের সকল তারকা অথবা সমগ্র ওই তারকারাজি, যার সংখ্যা হবে বহু কোটি এবং যাদের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে অথবা জানা-অজানা সকল তারকারাজি, যার সংখ্যা কতো ও কোথায় কোনটা কিভাবে আছে এবং কি কাজ করছে এর কোনো জ্ঞান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও কাছে নেই৷ এটা অবশ্য জানা গেছে যে, মহাবিশ্বের মধ্যে অসংখ্য ছায়াপথ আছে এবং প্রত্যেক ছায়াপথের আওতায় আছে এক একটি বিরাট শূন্যতা ।(আরো জানার জন্যে আমার ‘প্রজন্মের প্রহসন’ বইটি আপনার কাজে লাগবে ।-সম্পাদক)

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-৩

وَ اِذَا الْجِبَالُ سُیِّرَتْ۪ۙ

যখন পাহাড়গুলোকে চলমান করা হবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# অন্য কথায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই পাহাড়ের ওজন ও ভারত্ব আছে এবং তা এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। কাজেই এই শক্তি বিলুপ্ত হবার সাথে সাথেই সমস্ত পাহাড় পর্বত সমূলে উৎপাটিত ও ওজনহীন হয়ে এমনভাবে পৃথিবীর বুকে চলতে থাকবে যেমন মেঘ শূন্যে ভেসে বেড়ায়।

ফী জিলালিল কুরআন:

পর্বতমালার সজোরে সঞ্চালিত হওয়া বলতে সম্ভবত একথা বুঝায় যে, সেগুলো ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে এবং অন্যান্য সূরার বর্ণনামতে সেগুলো স্থানচ্যুত হয়ে ধূলাবালিতে পরিণত হবে এবং সেগুলো এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে । (কোরআন-২০:১০৫)  অন্যত্র বলা হচ্ছে, পর্বতগুলো ফেটে চৌটির হয়ে যাবে এবং বিক্ষিপ্ত ধূলাবালিতে পরিণত হবে। আরো বলা হয়েছে পর্বতগুলোকে এতো দ্রুত বেগে সঞ্চালিত করা হবে যে, সেগুলো মরুর মরীচিকায় পরিণত হবে । অর্থাৎ এতো তীব্র বেগে ধুলাবালির রূপ নিয়ে সেগুলো উড়তে থাকবে যে, ধু-ধু মরীচিকায় যেমন কম্পমান বাতাস মানুষকে পানি বলে প্রতারিত করে, তেমনি পর্বতগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে তার সূক্ষ বালু কণাগুলো দর্শকদের চোখে পানির প্রবাহরূপে দেখা দেবে। এ সকল আয়াতেই পাহাড় পর্বতের সঞ্চালিত হওয়ার বিভিন্ন অবস্থার দিকে ইংগিত রয়েছে। প্রোথিত পর্বতমালার দৃঢ়তা শিথিল হয়ে যাবে৷ মাটির অভ্যন্তরে যে শেকড় গেড়ে থাকায় তা নিজ নিজ জায়গায় মযবুত হয়ে রয়েছে, সে জায়গার বন্ধন সেগুলোকে আর ধরে রাখতে পারবে না। যার কারণে তাদের স্থায়িত্ব খতম হয়ে যাবে। কেয়ামতের ধ্বংসলীলা শুরু হবে ভূমির প্রচন্ড কম্পন থেকে, যার সম্পর্কে কোরআনের ঘোষণা, ‘যখন পৃথিবী প্রকম্পিত হবে প্রচন্ড বেগে এবং যমীন তার মধ্যে লুকানো সব ভারি বোঝাগুলোকে বের করে দেবে ।’ আর এসব কিছু সেই দীর্ঘস্থায়ী (কেয়ামতের) দিনে সংঘটিত হবে।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-৪

وَ اِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ۪ۙ

যখন দশ মাসের গর্ভবতী উটনীগুলোকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া হবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# আরবদেরকে কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা বুঝাবার জন্য এটি ছিল একটি চমৎকার বর্ণনা পদ্ধতি। আধুনিক কালের বাস ও ট্রাক চলাচলের আগে আরবদের আছে গর্ভবতী উটনীর চাইতে বেশী মূল্যবান আর কোন সম্পদই ছিল না, যার প্রসবের সময় অতি নিকটে। এ সময় তার হেফাজত ও দেখাশুনার জন্য সবচেয়ে বেশী যত্ন নেয়া হতো। উটনীটি যাতে হারিয়ে না যায়, কেউ তাকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে না যায় অথবা কোনভাবে তা নষ্ট না হয়ে যায় এ জন্য খুব বেশী সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। এই ধরনের উটনীদের থেকে লোকদের গাফেল হয়ে যাওয়ার মানে এই দাঁড়ায় যে, তখন নিশ্চয়ই এমন কোন কঠিন বিপদ লোকদের ওপর এসে পড়বে যার ফলে তাদের নিজেদের এই সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ সংরক্ষণের কথা তাদের খেয়ালই থাকবে না।

ফী জিলালিল কুরআন:

আল্লাহর বাণী, ‘আর দশ মাসের (গর্ভবতী) উটনীকে (অযত্নে- অবহেলায়) ছেড়ে দেয়া হবে দশ মাসের উটনী বলতে বুঝায় সেই উটনী, যে গর্ভধারণ করার পর দশম মাসে পড়েছে এবং যেকোনো সময়ে বাচ্চা দিতে পারে। এই পর্যায়ে এসে এই জীবটি দেখতে যেমন সুশ্রী হয় তেমনি এর মূল্যও হয় সবচে বেশী । যে কোনো আরব বেদুইনের কাছে এ পর্যায়ের গর্ভবতী উটনী তার কাছে সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। এ অবস্থায় তার মূল্য সর্বাধিক হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, সে তখন বাচ্চা ও প্রচুর পরিমাণে দুধ উভয়টি দান করার পর্যায়ে এসে গিয়েছে। তার থেকে সর্বোচ্চ যে উপকার পাওয়া যায়, তা দেয়ার জন্যে সে সম্পূর্ণ উপযুক্ত। এমনি পর্যায়ে আসার পর যখন উটনীর মালিক ও তার গোটা পরিবার তৃপ্তির সাথে দুধ খাবে বলে আশা করছে ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই লোমহর্ষক বিপদ আসার কারণে তারা এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবে যে, ওই মহামূল্যবান জীবের প্রতি খেয়াল দেয়ার মতো মানসিকতা ও ক্ষমতা তাদের থাকবে না। এমনকি ওই জিনিসের কোনো মূল্যই তাদের কাছে তখন অনুভূত হবে না। আরব বেদুইনদের লক্ষ্য করেই প্রথমত কথাটি বলা হয়েছে, এ কথাটি বলা তাদের জন্যে যথোপযুক্ত । যেহেতু ওরা সর্বাত্মক মহা বিপদ ছাড়া এমন মূল্যবান জানোয়ারকে অবহেলায় ছেড়ে দেয় না বা দিতে পারে না।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-৫

وَ اِذَا الْوُحُوْشُ حُشِرَتْ۪ۙ

যখন বন্য পশুদের চারদিক থেকে এনে একত্র করা হবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# দুনিয়ার কোন সাধারণ বিপদ দেখা দিলে সব ধরনের পশুদের পালিয়ে এক জায়গায় জড়ো হতে দেখা যায়। সে সময় সাপ দংশন করে না এবং বাঘও আক্রমণ করে না।

ফী জিলালিল কুরআন:

“হিংস্র জন্তুগুলোকে যখন একত্রিত করা হবে।’ এই সকল বন্য হিংস্র জন্তু যখন দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে, তখন বনের মধ্যেও অপর বন্য জন্তুর জন্যে এরা এক আতংক হিসেবে বিরাজ করে। কিন্তু সেই ভয়ানক দিনে এরা পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতা ভূলে গিয়ে সবাই একত্রিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ এ ভয়ংকর দিনটি এতোই কঠিন হবে সবার জন্যে যে, কেউ কারো দিকে তাকানো বা অন্য কোনো চিন্তার অবসর পাবে না। ওই কঠিন দুঃসময়ের ভয়াবহতায় এরা নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে না বা যারা গর্তের মধ্যে থাকবে, তারা বেরও হতে পারবে না, অন্য কোনো জন্তুকে আক্রমণের তো কথাই আসতে পারে না। জীব জন্তুর অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে মানুষের অবস্থা কী হতে পারে একবার ভেবে দেখা দরকার ।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-৬

وَ اِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ۪ۙ

যখন সমুদ্রগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এখানে سُجِّرَتۡۙ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মূল হচ্ছে তাসজীর ( سُجِّرَتۡۙ ) এবং তা থেকে অতীতকালে কর্মবাচ্য এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণত চুল্লীতে আগুন জ্বালাবার জন্য ‘তাসজীর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। কিয়ামতের দিন সমুদ্রে আগুন লেগে যাবে, একথাটা আপাত দৃষ্টে বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু পানির মূল তত্ত্ব ও উপাদান সম্পর্কে ধারণা থাকলে এর মধ্যে কোন কিছুই বিস্ময়কর মনে হবে না। আল্লাহ‌ তাঁর অসীম ক্ষমতা ও অলৌকিক কার্যক্রমের সাহায্যে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের মত এমন দু’টি গ্যাসকে একসাথে মিশ্রিত করে রেখেছেন যাদের একটি আগুন জ্বালায় এবং অন্যটি নিজে জ্বলে। এই দু’টি গ্যাসের সংমিশ্রণে পানির মতো এমন একটি বস্তু সৃষ্টি করেছেন যা আগুন নিভিয়ে দেয়। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার একটি ইঙ্গিতই পানির এই মিশ্রণ পরিবর্তন করে দেবার জন্য যথেষ্ট। তখন তারা পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে তাদের মূল প্রকৃতি অনুযায়ী জ্বালাবার ও জ্বলার কাজে ব্যাপৃত হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

সমুদ্রে আগুন : এরপর আসছে সমুদ্রে আগুন ধরে যাওয়ার প্রশ্ন। আরবী শব্দ ‘তাসজীর’ দ্বারা এর একটি অর্থ এই বুঝায় যে, সমুদ্র স্ফীত হয়ে উপরে পড়বে । অর্থাৎ আগ্নেয়গিরি ও পর্বতসমূহ সমুদ্রগুলোকে যে বিভক্ত করে রেখেছে, সেগুলো সব একত্রিত হয়ে গিয়ে এক মহা তুফান, পানির উচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিবায়ুর সৃষ্টি হবে। পানিবাহী সেই ঘূর্ণি হাওয়ার গতির তীব্রতায় সমুদ্রে আগুন ধরে যাবে এবং দাবানলের মতো সে আগুন সবখানে ছড়িয়ে পড়বে। (সূরা নাযিয়াত-এ আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি) ৷ অর্থাৎ উত্তাল তরংগের আঘাতে সমুদ্রে ভীষণ অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি হবে। এই- আরবী শব্দটি (তাসজীর)-এর আর একটি অর্থও হয়, তা হচ্ছে সমুদ্র বিস্ফোরিত হবে এবং আগুন ধরে যাবে। কোরআনের অন্যত্র এই অর্থ ব্যক্ত হয়েছে। সমুদ্র যখন বিস্ফোরিত হবে, এর ফলে পানির মধ্যে বিদ্যমান উপাদান হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দু’টি পৃথক হয়ে যাবে। এ দু’টি উপাদানের একটিতে আগুন জ্বলে এবং অপরটি জ্বলতে সাহায্য করে। এই সকল বস্তুর মধ্যে বস্তুর সূক্ষাতিসুক্ষ কণার নাম হচ্ছে অণু (এটম)। ভীষণ ঝড়ের তান্ডবলীলা, সাগরের বুক ফেটে আগ্নেয়গিরির সংস্পর্শে আসা, উত্তাল তরংগের বাষ্পীভূত হয়ে ওই অনুগুলো পৃথক হয়ে যাওয়া এবং প্রচন্ড ঘূর্ণি হাওয়ার ঝাপটায় পানির কণাগুলো পৃথক পৃথক হয়ে গিয়ে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে আলাদা করে দেবে । এভাবে সমগ্র পানিভাগে আগুন ধরিয়ে দেয়া- এসবই সম্ভব হবে সেই মহা বিপর্যয়ের দিন। এ অবস্থা হবে কতো ভয়াবহ, তা মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাশক্তির আয়ত্বের বাইরে । এই মহা সাগরের বাইরে রয়েছে যে জাহান্নাম, তাও আমাদের ধ্যান-ধারণার বাইরে ।(সম্প্রতি মহাসাগরসমূহের অভ্যন্তর থেকে যে আগ্নেয়গিরী বিস্ফোরিত হচ্ছে তাতে আল্লাহ্‌ তায়ালার কালামের সত্যতাই প্রমাণিত হয় ।–সম্পাদক)

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-7
টিকা নং:7, 8,

وَ اِذَا النُّفُوْسُ زُوِّجَتْ۪ۙ

যখন প্রাণসমূহকে৭ (দেহের সাথে) জুড়ে দেয়া হবে। ৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) এখান থেকে কিয়ামতের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হয়েছে।

টিকা:৮) অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে মানুষ দুনিয়ায় যেমন দেহ ও আত্মার সাথে অবস্থান করছিল আবার ঠিক সেই অবস্থায়ই তাকে নতুন করে জীবিত করা হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

“যখন মানুষের আত্মাগুলো নিজ নিজ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে জোড়ায় জোড়ায় মিলিত হবে ।” এ কথার অর্থ এটা হতে পারে যে, মানুষের আত্মা ও দেহ কেয়ামতের দিন একত্রিত হয়ে যাবে । আর এও হতে পারে যে, আত্মাগুলোর সমশ্রেণীর দল অপর দলের সাথে মিলিত হবে অথবা নিজ নিজ দলে গিয়ে মিশবে ৷ যেমন কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, তোমরা হয়ে যাবে তিনটি দলে বিভক্ত । অর্থাৎ এক দল হবে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত, আর একটি ডানপন্থী এবং অপরটি হবে বামপন্থী । অথবা অন্য আরও কোনো পন্থায় এই বিভক্তি আসতে পারে।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-9
টিকা নং:9,

بِاَیِّ ذَنْۢبٍ قُتِلَتْۚ

কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে?৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৯) এই আয়াতের বর্ণনাভংগীতে মারাত্মক ধরনের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যায়। এর চেয়ে বেশী ক্রোধের কল্পনাও করা যেতে পারে না। যে বাপ মা তাদের মেয়েকে জীবিত পুঁতে ফেলেছে আল্লাহর কাছে তারা এত বেশী ঘৃণিত হবে যে, তাদেরকে সম্বোধন করে একথা জিজ্ঞেস করা হবে না, তোমরা এই নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করেছিলে কোন অপরাধ? বরং তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোট্ট নিরপরাধ মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধে মেরে ফেলা হয়েছিল? জবাবে সে নিজের কাহিনী শুনাতে থাকবে। জালেম বাপ মা তার প্রতি কি অত্যাচার করেছে এবং কিভাবে তাকে জীবিত পুঁতে ফেলেছে সে কথা সে সবিস্তারে বর্ণনা করতে থাকবে। এ ছাড়াও এই ছোট্ট আয়াতটিতে দু’টি বড় বড় বিষয়বস্তু সংযোজিত করা হয়েছে। এ জন্য কোন শব্দের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়াই শুধুমাত্র বর্ণনাভংগী থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক, এর মধ্যে আরববাসীদের মনে এই অনুভূতি জাগাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, জাহেলিয়াত তাদেরকে নৈতিক অবনতি এমন নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে যার ফলে তারা নিজেদের সন্তানকে নিজ হাতে জীবিত অবস্থায় মাটির মধ্যে প্রোথিত করার কাজ করছে। এরপরও তারা নিজেদের এই জাহেলী কর্মকাণ্ডকে সঠিক মনে করে তার ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এই বিকৃত সমাজ জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য যে সংস্কারমূলক কর্মসূচী এনেছেন তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করছে। দুই, এর মধ্যে আখেরাতের অপরিহার্যতার ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট যুক্তি পেশ করা হয়েছে। যে মেয়েকে জীবিত অবস্থায় মাটির মধ্যে প্রোথিত করা হয়েছে তার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার কোথাও হওয়া দরকার এবং যেসব জালেম এই জুলুমের কাজটি করেছে এমন একটি সময় আসা দরকার যখন তাদের এই নিষ্ঠুরতার জন্য তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যে মেয়েটিকে মাটির মধ্যে পুতে ফেলা হয়েছে তার ফরিয়াদ শুনার মতো তখন তো দুনিয়ায় কেউ ছিল না। জাহেলী সমাজ ব্যবস্থায় এ কাজটিকে সম্পূর্ণ বৈধ করে রাখা হয়েছিল, বাপ-মা এ জন্য একটুও লজ্জিত হতো না। পরিবারেও কেউ তাদের নিন্দা ও তিরস্কার করতো না। সমগ্র সমাজ পরিবেশে একজনও এ জন্য তাদেরকে পাকড়াও করতো না। তাহলে আল্লাহর প্রভুত্ব-কর্তৃত্বের অধীনে এই বিরাট জুলুম ও অন্যায়ের কি কোন বিচার হবে না?

প্রাচীনকালে আরবে মেয়েদের জীবিত কবর দেবার এ নিষ্ঠুর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এর বিভিন্ন কারণ ছিল। এক, অর্থনৈতিক দুরবস্থা। এই দুরবস্থার দরুন লোকেরা চাইতো খাদ্যের গ্রহণকারীর সংখ্যা কম হোক এবং তাদের লালন পালনের বোঝা যেন বহন করতে না হয়। পরবর্তীকালে অর্থ উপার্জনে সহায়তা করবে এই আশায় ছেলেদের লালন পালন করা হতো। কিন্তু মেয়েদের ছোটবেলায় লালন পালন করে বড় হয়ে গেলে বিয়ে দিয়ে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে, এ কারণে মেরে ফেলে দেয়া হতো। দুই, দেশের আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে সাধারণ নিরাপত্তাহীনতার কারণে এটা মনে করে পুত্রসন্তানের প্রতিপালন করা হতো যে, যার যত বেশী ছেলে হবে তার তত বেশী সাহায্যকারী হবে। অন্যদিকে গোত্রীয় সংঘর্ষ ও যুদ্ধের সময় মেয়েদের সংরক্ষণ করতে হতো এবং তারা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোনো কাজেই লাগতো না। তিন, আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে সাধারণ দুরবস্থার কারণে শত্রু গোত্ররা পরস্পরের ওপর অতর্কিত হামলা করার সময় প্রতিপক্ষ শিবিরের যতগুলো মেয়েকে হামলাকারীরা লুটে নিয়ে যেতো, তাদেরকে বাঁদী বানিয়ে রাখতো অথবা কোথাও বিক্রি করে দিতো। এসব কারণে আরবে কোথাও সন্তান প্রসবকালেই মায়ের সামনেই একটি গর্ত খনন করে রাখা হতো। মেয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তখনই তাকে গর্তে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হতো। আবার কোথাও যদি মা এতে রাজী না হতো বা তার পরিবারের কেউ এতে বাধ সাধতো তাহলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাপ কিছুদিন তাকে লালন পালন করতো। তারপর একদিন মরুভূমি, পাহাড় বা জংগলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে কোথাও তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিতো। এই ধরনের রেওয়াজ আরবের বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত ছিল। এক্ষেত্রে শিশু কন্যাদের সাথে কেমন নির্দয় ব্যবহার করা হতো তার একটি কাহিনী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক সাহাবী একবার তাঁর কাছে বর্ণনা করেন। সুনানে দারামির প্রথম অধ্যায়ে এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার জাহেলী যুগের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ আমার একটি মেয়ে ছিল। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো। তার নাম ধরে ডাকলে সে দৌড়ে আমার কাছে আসতো। একদিন আমি তাকে ডাকলাম। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পথে একটি কূয়া পেলাম। তার হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে কূয়ার মধ্যে ফেলে দিলাম। তার যে শেষ কথাটি আমার কানে ভেসে এসেছিল তা ছিল, হায় আব্বা! হায় আব্বা! একথা শুনে রসূলুল্লাহ ﷺ কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে একজন বললেনঃ ওহে, তুমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শোকার্ত করে দিয়েছো। তিনি বললেনঃ থাক, তোমরা একে বাধা দিয়ো না। যে বিষয়ে তার কঠিন অনুভূতি জেগেছে সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করতে দাও। তারপর তিনি তাকে বললেনঃ তোমার ঘটনাটি আবার বর্ণনা করো। সেই ব্যক্তি আবার তা শুনালেন। ঘটনাটি আবার শুনে তিনি এত বেশী কাঁদতে থাকলেন যে, চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে গেলো। এরপর তিনি বললেন, জাহেলী যুগে যা কিছু করা হয়েছে আল্লাহ‌ তা মাফ করে দিয়েছেন। এখন নতুন করে জীবন শুরু করো।

একথা মনে করা ভুল হবে যে, আরববাসীরা এই চরম অমানবিক কাজটি কদর্যতার কোন অনুভূতিই রাখতো না। কোন সমাজ যত বেশী বিকৃতই হোক না কেন তা কখনো এই ধরনের জুলুম ও অমানবিক কাজকে একেবারেই অন্যায় মনে করবে না, এমনটি কখনই হতে পারে না। তাই কুরআন মজীদে এই কাজটির কদর্যতা ও দূষণীয় হওয়া সম্পর্কে কোন লম্বা চওড়া ভাষণ দেয়া হয়নি। বরং কতিপয় লোমহর্ষক শব্দের মাধ্যমে কেবল এতটুকু বলেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, এমন এক সময় আসবে যখন জীবিত পুঁতে ফেলা মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন দোষে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল? আরবের ইতিহাস থেকেও জানা যায়, জাহেলী যুগে অনেক লোকের এই রীতিটির কদর্যতার অনুভূতি ছিল। তাবারানীর বর্ণনা মতে কবি ফারাযদাকের দাদা সা’সা’ ইবনে নাজীয়াহ আলমুজাশেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করে, যে আল্লাহর রসূল! আমি জাহেলী যুগে কিছু ভালো কাজও করেছি। এরমধ্যে একটি হচ্ছে, আমি তিনশ ষাটটি মেয়েকে জীবিত কবর দেয়া থেকে রক্ষা করেছি। তাদের প্রত্যেকের প্রাণ বাঁচাবার বদলে দু’টি করে উট বিনিময় মূল্য হিসেবে দিয়েছি। আমি কি এর প্রতিদান পাবো? জবাবে তিনি বলেনঃ তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে এবং সে পুরস্কার হচ্ছে, আল্লাহ‌ তোমাকে ইসলামের নিয়ামত দান করেছেন।

আসলে এটি ইসলামের একটি বিরাট অবদান। ইসলামের কেবলমাত্র আরবের এই নিষ্ঠুর ও জঘন্য প্রথাটি নির্মূল করেনি বরং এই সঙ্গে মেয়ের জন্ম যে একটি দুর্ঘটনা এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও একে গ্রহণ করে নিতে হয়–এই ধরনের চিন্তাও ধারণারও চিরতরে অবসান ঘটিয়েছে। বিপরীত পক্ষে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে, মেয়েদের লালন পালন করা, তাদেরকে উত্তম দীক্ষা দেয়া এবং ঘর সংসারে কাজে পারদর্শী করে গড়ে তোলা অনেক বড় নেকীর কাজ। রসূলুল্লাহ ﷺ এ ব্যাপারে মেয়েদের সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ধারণা যেভাবে পরিবর্তন করে দেন হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে তা আন্দাজ করা যাবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমি নীচে কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করছিঃ

مَنْ اِبْتُلِىَ مِنْ هَذِهِ الْبَنَاتِ بِشَىْْءٍ فَاَحْسَنَ اِلَيْهِنَ كُنَ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَارِ

“এই মেয়েদের জন্মের মাধ্যমে যে ব্যক্তিকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়, তারপর সে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণে পরিণত হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)

مَنْ عَالَ جَارِ يَتَيْنَ حَتَى تَبْلُغاَ جاَءَ يَوْمَ الْقِياَمَةِ اَنَا وَ هَكَذَا وَضَمَ اَصَابِعَهُ

“যে ব্যক্তি দু’টি মেয়ের লালনপালন করে, এভাবে তারা বালেগ হয়ে যায়, সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে ঠিক এভাবে আসবে। একথা তিনি নিজের আঙুলগুলো একসাথে করে দেখান।” (মুসলিম)

مَنْ عَالَ ثَلَاثَ بَنَاتٍ اَوْ مِثْلَهُنَّ مِنَ الْاَخَوَتِ فَاَدَّ بَهُنَّ وَرَحْمَهُنَّ حَتَّى يُغْنِِيْهِنَّ اَللهُ اَوْجَبَ اللهُ لَهُ الْجَنَّةَ فَقَالَ رَجُلُ يَا رَسُوْلَاللهِ اَوِاثْنَتَيْنِ حَتَّى لَوْ قَالُوْا اَوْ وَاحِدَةٍ

“যে ব্যক্তি তিন কন্যা বা বোনের লালনপালন করে, তাদেরকে ভালো আদব কায়দা শেখায় এবং তাদের সাথে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করে, এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা তার সাহায্যের মুখাপেক্ষী না থাকে, তার জন্য আল্লাহ‌ জান্নাত ওয়াজিব করে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেনঃ যে আল্লাহর রসূল! আর যদি দু’জন হয়। জবাব দেন, দু’জনকে এভাবে লালন পালন করলে তাই হবে। হাদীসের বর্ণনাকারী ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যদি লোকেরা সে সময় একজনের লালন পালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো তাহলে তিনি একজনের সম্পর্কেও এই একই জবাব তিনি দিতেন।” (শারহুস সুন্নাহ)

مَنْ كَانَتْ لَهُ اُنْثَى فَلَمْ يَئْدِهَا وَلَمْ يَهْنَّهَا وَلَمْ يُّؤْثَرْ وَلَدَهُ عَلَيْهَا اَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ

“যার কন্যা-সন্তান আছে, সে তাকে জীবিত কবর দেয়নি, তাকে দ্বীনহীন ও লাঞ্ছিত করেও রাখেনি এবং পুত্রকে তার ওপর বেশী গুরুত্বও দেয়নি, আল্লাহ‌ তাকে জান্নাতে স্থান দেবেন।” (আবু দাউদ)

مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثَ بَنَاتٍ وَ صَبَرَ عَلَيْهِنَّ وَكَسِاهُنَّ مِنْ جِدَّتِهِ كُنَّ لَهُ حِجَايًا مِّنَ النَّارِ

“যার তিনটি কন্যা আছে, সেজন্য সে যদি সবর করে এবং নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে ভালো কাপড় পরায়, তাহলে তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ে পরিণত হবে।” (বুখারীর আদাবুল মুফরাদ ও ইবনে মাজাহ)

مَا مِنْ مُسْلِمٍ تُدْرِكُهُ ابْنَتَا نِ فَيُحْسِنُ صَحْبَتَهُمَا اِلاَّ اَدْخَلَناَهُ الْجَنَّةَ

“যে মুসলমানের দু’টি মেয়ে থাকবে, সে যদি তাদেরকে ভালোভাবে রাখে, তাহলে তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।” (ইমাম বুখারীর আদাবুল মুফরাদ) اِنَّ النَّبِىَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ قَالَ لِسُرَقَةَ بْنِ جَعْشَمَ اِلاَّ اَدُلُّكَ عَلَى اَعْظَمِ الصَّدَقَةِ اَوْ مِنْ اعْظَمِ الصَّدَقَةِ قَالَ بَلَى يَا رَسُوْ لَ اللهِ قَالَ اِبْنَتُكَ الْمُرْدُوْدَةُ اِلَيْكَ لَيْسَ لَهاَ كاَسِبٌ غَيْرُكَ

“নবী ﷺ সুরাকাহ ইবনে জা’শূমকে বলেন, আমি কি তোমাকে বলবো সবচেয়ে বড় সাদকাহ (অথবা বলেন, বড় সাদকাগুলোর অন্যতম) কি? সুরাকাহ বলেন, অবশ্যই বলুন হে আল্লাহর রসূল! তিনি বলেন, তোমার সেই মেয়েটি যে (তালাক পেয়ে অথবা বিধবা হয়ে) তোমার দিকে ফিরে আসে এবং তুমি ছাড়া তার আর কোন উপার্জনকারী থাকে না।” (ইবনে মাজাহ ও বুখারী ফিল আদাবিল মুফরাদ) এই শিক্ষার ফলে মেয়েদের ব্যাপারে কেবল আরবদেরই নয় দুনিয়ার অন্যান্য যেসব জাতি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সবার দৃষ্টিভংগীই বদলে গেছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

আবার ‘যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যা সন্তানকে জিজ্ঞাসা করা হবে- কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো? জাহেলিয়াতের যুগে লজ্জা অথবা দারিদ্রের ভয়ে কন্যা সন্তানকে হত্যা করার প্রবণতা সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে ছিলো ৷ সেই বদভ্যাসের কথা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। এ অভ্যাস ছিলো জাহেলী যুগের একটি বৈশিষ্ট্য। ইসলাম এসে আরবদের মধ্যে এই বদভ্যাসের অবসান ঘটায় এবং এভাবে মানবতাকে সে মহা পাপ থেকে রক্ষা করে। অন্যত্র বলা হয়েছে, আর তোমাদের কাউকে যদি কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়, তখন তোমাদের মুখ কালো হয়ে যায় এবং তোমাদের হৃদয় হয়ে যায় দুঃখে ভারাক্রান্ত । যে কি না লালিত পালিত গহনা গাটির মধ্যে, আর ঝগড়া-বিবাদ বা যুক্তিতর্ক করার সময়ে নিজের কথাকে যে স্পষ্ট করে বলতে পারে না, তাকেই তোমরা আল্লাহর সন্তান বলে অভিহিত করছো? আরও এক জায়গায় বলা হয়েছে, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। আমি সর্বশক্তিমান (আল্লাহ) তাদেরকে রিযিক (জীবনধারণ সামগ্রী) দান করি এবং তোমাদেরকেও দিই। তখন যিন্দা দাফন করে ভীষণ নিষ্ঠুর পন্থায় কন্যা সন্তানকে হত্যা করা হতো। যখন কন্যাটিকে মাটিতে প্রোথিত করা হতো, তখন সে জীবিতই থাকতো ৷ অর্থাৎ জীবিতাবস্থায় দাফন করা হতো । যারা তাৎক্ষণিকভাবে যিন্দা দাফন করতো না অর্থাৎ জন্মের সাথে সাথে দাফন না করে দেরী করতো, তারা বিভিন্ন চক্রান্তের আশ্রয় নিতো । ওদের কেউ কেউ এভাবে করতো যে, কারও কন্যা সন্তান হলে ছয় বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকতো । তারপর ছয় বছর পূর্তির পর কোনো এক দিন তার মাকে বলতো তাকে গোসল করিয়ে ভালো কাপড় চোপড় পড়িয়ে সাজিয়ে দাও, আমি ওকে গর নানী বাড়ী নিয়ে যাবো। পূর্বেই সে মরুভূমিতে একটি কুয়া খুঁড়ে রাখতো । সেই কুয়ার কাছে পৌছে সে মেয়েটিকে বলতো, দেখো তো এর মধ্যে কী আছে? মেয়েটি কুঁয়ার মধ্যে তাকানোর জন্যে এগিয়ে গেলে তাকে ধাক্কা মেরে তার মধ্যে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতো ৷ আরও এক পন্থায় হত্যা করা হতো বলে জানা যায়, আর তা হচ্ছে মায়ের প্রসব বেদনা উঠলে সে একটি গর্তের কিনারায় গিয়ে বসতো এবং বাচ্চাটি কন্যা সন্তান হলে তাকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিতো । ছেলে জন্ম নিলে তাকে রাখতো। কোনো কোনো ব্যক্তি কন্যা সন্তান জন্ম হলে ছাগল চরানোর বয়স পর্যন্ত অত্যন্ত ঘৃণার সাথে তাকে জীবিত রাখতো ও চরম দুর্ব্যবহার করতো । তারপর একদিন পশমী জুব্বা পরিয়ে অথবা লোমের তৈরী জুব্বা পরিয়ে তাকে উট চরাতে মাঠে পাঠিয়ে দিতো । নারীর মর্যাদা দানে ইসলাম : যারা কন্যা সন্তানকে জ্যান্ত কবর দিতো না বা উট ছাগল চরানোর জন্যে মাঠে পাঠাতো না তারা অন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতো, যাতে সে জ্যাস্ত কবরস্থ হওয়ার বা হীন জীবনযাপন করার স্বাদ পেতে পারে । এমনও করতো যে, মেয়েটির বিয়ে হওয়ার পর স্বামী মারা গেলে তার অভিভাবক এগিয়ে এসে তার জামা সে মেয়েটির ওপর নিক্ষেপ করতো । এর অর্থ ছিলো অন্য কেউ তাকে আর বিয়ে করতে পারবে না। এরপর তাকে ওই অভিভাবক বিয়ে করতে চাইলে করতো । কিন্তু মেয়েটির মতামতের কোনো তোয়াক্কা করতো না বা সে সমাজে তার মতামতের কোনো মৃূল্যই ছিলো না। আর বিয়ে না করলে সে অবস্থায় তাকে ফেলে রেখে দিতো এবং মৃত্যু পর্যন্ত অন্য কারো সাথে তার বিয়ে হতে দেয়া হতো না। কেউ এভাবেও নির্যাতন করতো যে, সে স্ত্রীকে তালাক দিতো এবং শর্ত বসিয়ে দিতো, তার অনুমতি ছাড়া বা তার পছন্দমতো ব্যক্তি ছাড়া অন্য আর কারো সাথে বিয়ে বসতে পারবে না। তবে সে যা দিয়েছে তা ফেরত দিলে তাকে স্বাধীনতা দেয়া হতো । আবার কেউ কেউ এমনও‌ করতো যে, কোনো ব্যক্তি মারা গেলে সে ব্যক্তির স্ত্রীকে বাচ্চা মানুষ করার জন্যে পুনরায় বিয়ে বসতে না দিয়ে আবদ্ধ করে রেখে দিতো । বাচ্চাটা বড়ো হলে তাকে বিয়ে করতো। আবার কোনো সময় এমনও করতো যে, অভিভাবক এতীম মেয়েকে নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করতো । এই উদ্দেশ্যে বিয়ে দিতো না যে, তার বর্তমান স্ত্রী মারা গেলে তাকে বিয়ে করবে। অথবা তার না-বালেগ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে রাখতো । যাতে তার সম্পদ-সম্পত্তি ও সৌন্দর্য ভোগদখল করা যায়। এই ছিলো জাহেলী যুগে মেয়েদের সাথে ব্যবহারের দশা । শেষ পর্যন্ত ইসলামের আগমন ঘটলো যা মেয়েদেরকে এসব হীনতা, দীনতা, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি দিলো ৷ জ্যান্ত কবর দেয়ার রীতি চিরতরে খতম করে দিলো এবং তাদের সাথে যে কোনো দুর্ব্যবহারের জন্যে কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে ঘোষণা জারী করলো । নারী তথা মানবতার প্রতি এই চরম অবমাননার দ্বার রুদ্ধ করে মাতৃ জাতিকে ইসলাম দিলো তার ন্যায্য অধিকার । জানিয়ে দিলো কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার তাদের প্রতি করা হলে তার জন্যে পাকড়াও হতে হবে আল্লাহর দরবারে । জীবন্ত প্রোথিত কন্যাদেরকে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন অপরাধের জন্যে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো এবং সেই ভয়ংকর দিনে তাদের ন্যায্য পাওনা তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যে মান মর্যাদা ও অধিকার ইসলাম নারীদেরকে দিয়েছে, জাহেলী সমাজের কোনো পর্যায়েই সে মর্যাদা দেয়া হয়নি । আর ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে মানব রচিত কোনো ব্যবস্থায় তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব ছিলো না। মায়ের জাতির প্রতি এ মর্যাদাবিধান প্রকারান্তরে গোটা মানবজাতির জন্যে ছিলো এক মহা নেয়ামত । মেহেরবান আল্লাহর প্রিয়তম সৃষ্টি রক্ষার্থে এবং তাদের জন্যে পরিপূর্ণ শান্তিবিধান করলেন, তাদেরকে মর্যাদা দান নারীত্বের জন্যে যথাযথ এবং এক অপরিহার্য শর্ত । এ শর্ত পূরণ করা ব্যতীত অন্য কোনোভাবে শাস্তির আশা করা বৃথা। ইসলামের আগমনের পর নারীদেরকে আল্লাহর তরফ থেকে অসাধারণ সম্মান দান করা হলো। তার ফলে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হলো ৷ যতোদিন ইসলাম বিজয়ী ব্যবস্থা হিসেবে চালু থেকেছে, ততোদিন মানুষের অর্ধেক নারী সমাজ সহ গোটা মানবজাতি শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু যখন ইসলাম বিজয়ী অবস্থা থেকে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং বস্তুবাদিতার প্রসার হয়েছে, তখন থেকে নারী সমাজ পুনরায় নির্যাতন ও অবিচারের শিকারে পরিণত হয়েছে। আজ নারীদেরকে পুরুষের সমান অধিকারের নামে এবং স্বাধীনতার নামে ঘর থেকে বের করে পুরুষের পাশাপাশি দাড় করিয়ে যে অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে প্রকৃতপক্ষে তাদের মর্যাদা বাড়েনি বরং তাদেরকে নির্যাতন করার নতুন নতুন পথ খুলে গেছে। এ ব্যবস্থা মানুষের তৈরী, যা নির্ভুল ও নিখুঁত হতে পারে না।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-11
টিকা নং:10,

وَ اِذَا السَّمَآءُ كُشِطَتْ۪ۙ

যখন আকাশের পরদা সরিয়ে ফেলা হবে।১০

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) অর্থাৎ এখন যা কিছু দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে তা সব সুস্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠবে। এখন তো আকাশ কেবল শূন্যই দেখা যায় এবং তার মধ্যে দেখা যায় মেঘ, ধুলিকনা, চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ-তারকা। কিন্তু সেদিন আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব তার নিজস্ব ও আসল রূপে আবরণ মুক্ত হয়ে সবার সামনে প্রকাশ হয়ে পড়বে।

ফী জিলালিল কুরআন:

কিয়ামতের আরো কিছুু খন্ড চিত্র : ‘আর যখন (আমলনামার) পাতাগুলো খুলে তুলে ধরা হবে’ ওই পুস্তক হচ্ছে কর্মসমূহের পুস্তক বা আমলনামা । এই পুস্তক খুলে তুলে ধরার মাধ্যমে তার কাজ গুলোকে তার গোচরীভূত করা হবে। প্রত্যেক হৃদয়ে কিছু গোপন কথা থাকে৷ এগুলো প্রকাশ করে দিলে সে লজ্জিত হয় ও প্রকম্পিত হয় নিজ কীর্তিকলাপ দেখে । সে গোপন কথাকে চাপতে চাইলেও সেদিন তা পারবে না। এই প্রকাশ করে দেয়া- এটাও সেই ভয়াবহ দিনের ভীতিজনক পরিস্থিতির অন্যতম, বরং সকল গোপন তথ্য ও কথা যা বুকের মধ্যে লুকায়িত থাকে, যা মানুষ কোনো অবস্থায় প্রকাশ করতে চায় না, সেদিন সেগুলো প্রকাশ করে দেয়া সে দিনকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বুকের অভ্যন্তরের কথাগুলো প্রকাশ হওয়া এবং আকাশের পর্দা উঠে যাওয়ার মধ্যে বেশ একটা ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে। আকাশের নীলাভ স্তর, যা আমাদের কাছে দূরত্বের কারণে অনুভূত হয় তা তখন থাকবে না। ‘আর যখন আকাশের পর্দা তুলে নিয়ে তাকে গুটিয়ে দেয়া হবে।” এ কথাগুলো পাঠ করার সময় মন-মগযে এ কথাটা সংগে সংগে এসে যায় যে এখনকার যে পর্দাটা ওপরের দিকে তাকালেই আমাদের নযরে পড়ে তা আর থাকবে না। গুটিয়ে নেয়া অর্থ সরিয়ে নেয়া বুঝায় ৷ কেমন করে এটা সংঘটিত হবে এবং কোন পদ্ধতিতে এই অপসারণের কাজ সম্পন্ন হবে তা বুঝার কোনো উপায় নেই। তবে এতোটুকু আমরা কল্পনা করতে পারি যে, ওপরের দিকে যে গম্বুজাকৃতি আমরা দেখি তা আর দেখা যাবে না। এটাই হবে পর্দা তুলে নেয়া বা আকাশের ওই পর্দাকে গুটিয়ে নেয়ার ফল, এর বেশী অনুমান করা বা বুঝার মতো চিন্তাশক্তি আমাদের নেই ।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-13
টিকা নং:11,

وَ اِذَا الْجَنَّةُ اُزْلِفَتْ۪ۙ

এবং যখন জান্নাতকে নিকটে আনা হবে।১১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) অর্থাৎ হাশরের ময়দানে যখন লোকদের মামলার শুনানী চলতে থাকবে, তখন জাহান্নামের উদ্দীপ্ত আগুনও সবাই দেখতে পাবে। জান্নাতও তার সমস্ত নিয়ামত সহকারে সবার সামনে হাযির থাকবে। এভাবে একদিকে অসৎলোকেরা জানতে পারবে তারা কোন্ ধরনের জিনিস থেকে বঞ্চিত হয়ে কোন্ দিকে যাচ্ছে এবং সৎলোকেরাও জানতে পারবে তারা কোন্ জিনিসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে কোন্ ধরনের নিয়ামত লাভ করতে যাচ্ছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

তারপর শেষের দু’টি আয়াতে সেই ভয়াবহ আতংক সৃষ্টিকারী দিনের শেষ দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে । বলা হচ্ছে, ‘যখন জাহান্নামকে ভীষণভাবে প্রজ্জ্বলিত করা হবে এবং জান্নাতকে কাছে এগিয়ে আনা হবে ।’ কোথায় জাহান্নামকে আগুন লাগানো হবে বা জাহান্নাম জ্বলতে শুরু করবে, এর মধ্যে কোথায় আগুনের স্ফূলিংগ বাড়তে থাকবে কি দারুণ দাউ দাউ বেগে এটা জ্বলবে, কতো হবে এর উত্তাপ, কোথায় হবে এ জাহান্নামের স্থান? ধরানো হবে কিভাবে এবং কি দিয়েই বা আগুনকে উস্কে দেয়া হবে, কোন দ্রব্য হবে এর জ্বালানি- এসব কিছুর জবাব আল্লাহর এ নিম্নবর্ণীত বাণী ছাড়া আর কিছুই নেই যে,  ‘এর জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর ।’ কিন্তু সে তো হবে পাপী মানুষকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করার পর। তার আগে কি হবে তার জ্বালানি বা কিভাবে তা জ্বলবে? এর জবাব আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন ।  কোথায় জান্নাতকে নিকটবর্তী করা হবে এবং কেমন করে তাকে জান্নাত বাসীদের কাছে নিয়ে আসা হবে? প্রকাশিত হবে তাদের সামনে সহজ প্রবেশ পথ । কি সহজ পদ্ধতিতে তারা প্রবেশ করবে এগুলোর কোনো জবাব আমাদের কাছে নেই। কোরআনের মাধ্যমে শুধু আমাদেরকে জানানো হচ্ছে, জান্নাতকে তার প্রাপকদের জন্যে সবদিক দিয়ে প্রস্তুত করে এগিয়ে নিয়ে আসা হবে তাদের কাছে। যে শব্দ এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে বুঝা যায়, ঘষা অবস্থায় টেনে আনা হবে জান্নাততকে এবং স্ক্রু খোলার মতো জান্নাতীদের পাতগুলোও ওই রকম ঘষা অবস্থায় এগিয়ে যাবে।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-১৪

عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّاۤ اَحْضَرَتْؕ

সে সময় প্রত্যেক ব্যক্তি জানতে পারবে সে কি নিয়ে এসেছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

যেদিন এ সকল ভয়ংকর ঘটনা সৃষ্টিলোকের সর্বত্র সংঘটিত হবে, যেদিন জীবন্ত ও জড় সবকিছুর মধ্যে আসবে এই বিবর্তন, সেদিন কোনো ব্যক্তির কাছে তার কাজের সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকবে না যা সে দুনিয়ার বুকে করেছে। অর্থাৎ দুনিয়ার বুকে সে যা কিছু করেছে, কোনো কম বেশী না করে অবিকলভাবে সেগুলো নিয়েই সে হাযির হবে। আর যে পাথেয় ওই দিনের জন্যে সে সঞ্চয় করেছে সেগুলো নিয়েই আল্লাহর আদালতে হিসেবের মুখোমুখি হবে। এরশাদ হচ্ছে, (সেদিন) মানুষ ‘জানবে যা সে হাযির করেছে।’ ওই কঠিন দিনে প্রত্যেক ব্যক্তিই কোনো না কোনো আমল নিয়ে হাযির হবে৷ নেক আমল হলে পুরস্কার আর বদ আমল হলে তার কঠিন ফল তাকে ভোগ করতে হবে। জানবে ওই ভয়ানক পরিণতির কথা, যা তাকে ঘিরে ফেলবে এবং যা তার ভরাডুবি ঘটাবে ৷ এমন সময় এবং এমনভাবে জানবে যে, তখন আর তার কিছু করার থাকবে না। তার আনীত পাথেয়র মধ্যে কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন আনার সাধ্য তার থাকবে না। কোনো উপায়ে কম বেশী করারও কোনো ক্ষমতা থাকবে না, কারণ তার কষ্ট লাঘব করার জন্যে কোনো দরদী এগিয়ে আসবে না কোনো কিছু নিয়ে । সেদিন সকলের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক কেটে যাবে। সে নিজেও যেমন কারো সাথে সম্পর্ক রাখবে না, অন্য কেউ তার সাথে সম্পর্ক রাখবে না। সেদিন সব কিছু আকারে প্রকারেও অন্যান্য সকল দিক দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে যাবে । থাকবে সেদিন মহান আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তার ইচ্ছার কার্যকারিতা- যা টলবে না, বদলাবে না। সুতরাং আজই সেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার চেয়ে তালো জিনিস আর কি হতে পারে। এর পরিণতিতে মানুষ অবশ্যই সে দিনই উচিত বিনিময় পাবে যেদিন সৃষ্টির সবকিছুই বদলে যাবে । এভাবে সূরাটির প্রথম অধ্যায় শেষ হচ্ছে, যা মানুষের অনুভূতিকে ওই ভয়াবহ দিনের বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-15
টিকা নং:12,

فَلَاۤ اُقْسِمُ بِالْخُنَّسِۙ

কাজেই, না,১২ আমি কসম খাচ্ছি পেছনে ফিরে আসা

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১২) অর্থাৎ তোমাদের এ ধারণা ঠিক নয় যে, কুরআনে যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো কোন পাগলের প্রলাপ বা শয়তানের ওয়াস্ওয়াসাহ্ ও কুমন্ত্রণা।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-18
টিকা নং:13,

وَ الصُّبْحِ اِذَا تَنَفَّسَۙ

এবং প্রভাতের, যখন তা শ্বাস ফেলেছে।১৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৩) যে বিষয়ের ওপর এই কসম খাওয়া হয়েছে তা সামনের আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধরনের কসমের অর্থ হচ্ছে, মুহাম্মাদ ﷺ অন্ধকারে কোন স্বপ্ন দেখেননি। বরং যখন তারকারা অস্তমিত হয়েছিল, রাত বিদায় নিয়েছিল এবং প্রভাতের উদয় হয়েছিল তখন উন্মুক্ত আকাশে তিনি আল্লাহর ফেরেশতাকে দেখেছিলেন। কাজেই তিনি যা কিছু বর্ণনা করছেন তা সবই তাঁর নিজের চোখে দেখা। সুস্পষ্ট দিনের আলোয় পূর্ণচেতনা সহকারে তিনি এসব দেখেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

বিস্ময়কর শপথ বাক্য : এরপর আসছে আলোচ্য সূরাটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের আলোচনা । এ আলোচনা শুরু হয়েছে বিশ্বের অতি চমৎকার কিছু দৃশ্যের কসম খেয়ে ৷ ওই সুন্দর জিনিসগুলোর কসম খাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে অবতীর্ণ কথাগুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। রসূলের গুণাবলীকে জনসমক্ষে তুলে ধরা, যিনি সে ওহী বহন করে এনেছেন এবং আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী মানুষের কাছে যথাযথভাবে তা পৌছে দিচ্ছেন ৷ বলা হচ্ছে, “অতএব আমি কসম খাচ্ছি, সরে সরে যায় যে তারকাগুলো তাদের, যারা………. তাহলে তোমরা কোথায় যাচ্ছো? যা সে বলছে তা এছাড়া আর কিছুই নয় যে, সেগুলো গোটা বিশ্বজগতের জন্যে উপদেশ স্বরূপ। (আয়াত-১৫-১৭) ‘আল খুন্নাস, আল জাওয়ারিল কুন্নাস’ বলতে বুঝায় সেই তারাগুলোকে যেগুলো, কক্ষপথে চলার সময় ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় আসে । যেমন দ্রুতগতিতে সেগুলো চলে যায়, তেমনি (অপর গোলার্ধে যাওয়ার কারণে) আমাদের নযরে গোপন হয়ে লুকিয়ে যায় । এই তারাগুলোর চমৎকার গতিকে বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা ওদেরকে ওই চঞ্চলা হরিণীদের সাথে তুলনা করেছেন, যারা দ্রুতগতিতে ছুটে যায়। হঠাৎ করে থামে, এদিকে ওদিকে স্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকায়, সচকিত পদে আবার দৌড়ায়। আবার সে অন্য এক স্থান থেকে ফিরে আসে ৷ হরিণীর এই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে তার লুকানো, পূনরায় আত্মপ্রকাশের মধ্যে দারুণ এক সৌন্দর্য আছে যা অনুভূতিশীল মনকে আনন্দে আত্মহারা করে তোলে ৷ এই সৌন্দর্যকে বর্ণনা করতে গিয়ে অতি সুন্দর শব্দ ও প্রকাশভংগী ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আর রাত যখন ধরণীকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেলে ।’ অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে গোটা বিশ্বকে ৷ কিন্তু ওই অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে মনে হয় রাত একটি জীবন্ত কিছু ৷ যা তার নিজ অদৃশ্য হাতে বা পায়ে যেন অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে দেয়। রাত সম্পর্কে কথা বলার এ এক অভিনব পদ্ধতি এবং রীতিমতো রহস্যজনক ৷ আরবী ভাষার এ প্রকাশভংগী এতোই চমৎকার, যা অন্য কোনো ভাষায় কল্পনা করা যায় না! অনুরূপ আর একটি চমৎকার বাক্য ‘আর প্রভাত বেলার কসম, যা দিনের আলোয় নিশ্বাস নেয়।’ এ আয়াতটির ‘প্রভাত’ যেন একটি জীবন্ত কিছু । তার প্রাণশক্তি আরও অধিক মূর্ত হয়ে উঠেছে আরবী ওই শব্দগুলোতে ৷ ভাবখানা এই যে, প্রভাতবেলা এমন কোনো জীবস্ত প্রাণী- যা শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। হা, তার বিশ্বাস হচ্ছে ওই স্নিগ্ধ আলো যা জীবন ও সঞ্চালন শক্তি দান করে অন্য বহু জীবন্ত প্রাণীকে । আমার মনে হয় প্রভাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে এতো মধুর ও চমৎকার শব্দ আর কোথাও ব্যবহৃত হয়নি । আর রাত শেষে দিনের প্রথম আগমনে মন-দিল যেভাবে প্রফুল্ল হয় এবং দেহে যে সজীবতা আসে তাতে মনে হয় প্রভাত বুঝি সত্যিই নিশ্বাস ফেলছে এবং তার মাধুর্যে সকলকে করছে বিমুগ্ধ। উপরন্তু আরও একটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই কথাটি আরও জোরদার হয় যে, আঁধারের ঘোর কেটে গিয়ে প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো মৃদু-মন্দ প্রভাতী সমীরণ ও আরও অনেক অজানা জিনিস ওই সময় পাওয়া যায় যা হয়তো আমাদের এখনও জানতে অনেক বাকী । যে কোনো সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষ উল্লেখিত চারটি আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা ভাল্লোভাবে বুঝতে পারবে। যেখানে বলা হচ্ছে, ‘কসম থেমে থেমে আসা তারকারাজির, যারা দ্রুতগতিতে আসে, আবার হঠাৎ করে লুকিয়ে যায়। কসম ওই রাতের, যা বিশ্বকে আঁধার দিয়ে ঢেকে দেয় এবং কসম প্রভাত বেলার, যা দিনের আলোয় নিশ্বাস ছাড়ে ।’ এর ব্যাখ্যা মানুষের অনুভুতিরাজ্যে প্রবল এক আবেগ সৃষ্টি করে, যখন সে বিশ্বের এসব রহস্যের দিকে খেয়াল করে তাকায় । এসব আয়াত বিশ্ব ভান্ডারের যে তথ্যের সন্ধান দেয় তা যেমন মহা মূল্যবান, তেমনি অতি সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর, যা মানুষের অনুভূতিরাজ্যে স্থায়ীভাবে দাগ কেটে যায়। বিশ্বের এই রহস্যরাজি যে কোনো কবি মনকে দারুণভাবে দোলা দেয়। মহাবিশ্বের এই সকল দৃশ্য থেকে যে জীবন বা সজীবতার সন্ধান পাওয়া যায়, তা সকল মনকেই সজীব ও বলীয়ান করে। এর ব্যাখ্যা থেকে সজীব ও সুন্দর মানুষের মন আরও চাংগা ও প্রফুল্ল হয় । তার সামনে নিত্যনতুন রহস্য উন্মোচন হয়। যে ঈমান আনার আহ্বান জানিয়ে তাদের কাছে দাওয়াত পেশ করা হয়েছে তা গ্রহণ করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যায় । সেই সত্যটিকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তাতে সাধারণ বুদ্ধির লোকেরাও প্রভাবিত না হয়ে পারে না।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-19
টিকা নং:14,

اِنَّهٗ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِیْمٍۙ

এটি প্রকৃতপক্ষে একজন সম্মানিত বাণীবাহকের বাণী,১৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৪) এখানে সম্মানিত বাণীবাহক ( রসূল করীম ) বলতে অহী আনার কাজে লিপ্ত ফেরেশতাকে বুঝানো হয়েছে। সামনের আয়াতে একথাটি আরো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আর কুরআনকে “বাণীবাহকের বাণী” বলার অর্থ এই নয় যে , এটি ঐ সংশ্লিষ্ট ফেরেশতার নিজের কথা। বরং “বাণীবাহকের বাণী” শব্দ দু’টিই একথা প্রকাশ করছে যে , এটি সেই সত্তার বাণী যিনি তাকে বাণীবাহক করে পাঠিয়েছেন । সূরা “ আল হাক্কা’র ৪০ আয়াতে এভাবে কুরআনকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী বলা হয়েছে। সেখানেও এর অর্থ এই নয় যে, এটি নবী ( সা) নিজের রচনা। বরং একে “ রসূলে করীমের ” বাণী বলে একথা সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে , আল্লাহর রসূল হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি পেশ করছেন , মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ হিসেবে নয়। উভয় স্থানে বাণীকে ফেরেশতা ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত করার কারণ হচ্ছে এই যে , আল্লাহর বাণী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বাণীবহনকারী ফেরেশতার মুখ থেকে এবং লোকদের সামনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল। ( আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন সূরা আল হাক্কার ২২ টীকা দেখুন )

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-20
টিকা নং:15,

ذِیْ قُوَّةٍ عِنْدَ ذِی الْعَرْشِ مَكِیْنٍۙ

যিনি বড়ই শক্তিধর,১৫ আরশের মালিকের কাছে উন্নত মর্যাদার অধিকারী,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৫) সূরা আন নাজমের ৪-৫ আয়াতে এই বিষয়বস্তুটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى – عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى

“এ তো একটি ওহী, যা তার ওপর নাযিল করা হয়। প্রবল শক্তির অধিকারী তাকে তা শিখিয়েছেন।” জিব্রীল আলাইহিস সালামের সেই প্রবল ও মহাপরাক্রমশালী শক্তি কি? এটি আসলে “মুতাশাবিহাত”-এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ‌ ছাড়া এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য কারোর জানা নেই। তবে এ থেকে এতটুকু কথা অবশ্যি জানা যায় যে, নিজের অসাধারণ ক্ষমতার দিক দিয়ে তিনি ফেরেশতাদের মধ্যেও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মুসলিম শরীফে কিতাবুল ঈমানে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ আমি দু’বার জিব্রীলকে তার আসল আকৃতিতে দেখেছি। তাঁর বিশাল সত্তা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সমগ্র মহাশূন্য জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও মুসনাদে আহমদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে ছ’টি ডানা সমন্বিত অবস্থায় দেখেছেন। এ থেকে তাঁর অসাধারণ শক্তির বিষয়টি কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-21
টিকা নং:16, 17,

مُّطَاعٍ ثَمَّ اَمِیْنٍؕ

সেখানে তার হুকুম মেনে চলা হয়, ১৬ তিনি আস্থাভাজন।১৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৬) অর্থাৎ তিনি ফেরেশতাদের কর্মকর্তা। সমস্ত ফেরেশতা তাঁর হুকুমে কাজ করে।

টিকা:১৭) অর্থাৎ নিজের পক্ষে থেকে তিনি কোন কথা আল্লাহর অহীর সাথে মিশিয়ে দেবেন না। বরং তিনি এমন পর্যায়ের আমানতদার যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু বলা হয় সেগুলো তিনি হুবহু পৌঁছিয়ে দেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

জিব্রাইলের গুণাবলী : দেখুন সে মর্মস্পর্শী কথা, ‘অবশ্যই এটা এক সম্মানিত রসূলের কথা, যে শক্তিমান এবং আকাশবাসীর (আল্লাহর) কাছে সম্মানজনক স্থান পাওয়ার যোগ্য ৷ স্বতস্ফূর্তভাবে যার আনুগত্য করা হয়। সেখানে সে রসূল বিশ্বনবী বলে পরিচিত । এ কোরআন হচ্ছে আখেরাতের বিবরণ সম্বলিত একজন মহান রসূলের (আনীত) বাণী ৷ সে (বার্তাবাহক) হলেন জিবরাইল ৷ যিনি বহন করে এনেছেন এ কথাগুলো এবং পৌছে দিয়েছেন তা যথাযথভাবে । এই দায়িত্বের কারণেই তাকে বার্তাবাহক বা রসূল বলা হয়েছে। এ বার্তাবাহকের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, তাকে এ বার্তা পৌছে দেয়ার জন্যে মনোনীত করা হয়েছে৷ তিনি (জিবরাইল) সম্মানিত তার মনীবের কাছে, আর তার রব তিনি, যিনি তার সম্পর্কে বলছেন ‘শক্তিমান’ এবং তা হচ্ছে তার ওহী বহন করার কারণেই ৷ কেননা এই মহাবাণী বহন করার জন্যে যথেষ্ট শক্তির প্রয়োজন ৷ ‘তিনি আরশবাসীর কাছে সম্মানজনক স্থানের অধিকারী ।’ সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আরশের মালিক ৷ সেখানে তার কথা যথাযথভাবে মানা হয়। তিনি সকল মর্যাদাপূর্ণ ফোরশতাদের কাছে বিশ্বস্ত বলে পরিচিত ৷ যেহেতু তিনি তার রবের সম্মানিত বাণী বহন করেন ও নবীদের কাছে পৌছে দেন। সামগ্রিকভাবে তাকে এ গুণাবলী দেয়া হয়েছে ওই মহাবাণীর ধারক ও বাহক হওয়ার কারণেই । সুতরাং এ নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কোরআন মহাসম্মানিত এক গ্রন্থ যা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এবং বহু মূল্যবান বাণী সম্বলিত । আর এ বাণী মানুষের কাছে পৌছানোতে একথাও স্পষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের ব্যাপারে খুবই যত্নবান ৷ মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যেই এ বাণী পাঠানোর ব্যবস্থা এমন একজন বার্তাবাহক মহান ফেরেশতার মাধ্যমে করা হয়েছে যিনি আল্লাহর মনোনীত ৷ মানুষকে পথ দেখানোর জন্যে এই সুনিপুণ ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করে। প্রত্যেক মানুষের চিন্তা করা দরকার এবং বিনীত ও লজ্জিত হওয়া উচিত ৷ কারণ আল্লাহর এ মহা সাম্রাজ্যে সে তুচ্ছ এক সৃষ্টিমাত্র। কী এমন হতো যদি তার প্রতি আল্লাহ তায়ালা এভাবে যত্নবান না হতেন এবং তাকে সৃষ্টির সেরা জীব বলে এই সম্মান না দিতেন।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-22
টিকা নং:18,

وَ مَا صَاحِبُكُمْ بِمَجْنُوْنٍۚ

আর (হে মক্কাবাসীরা!) তোমাদের সাথী১৮ পাগল নয়।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৮) সাথী বলতে এখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। তাঁকে মক্কাবাসীদের সাথী অভিহিত করে আসলে তাঁকে এ বিষয়ের অনুভূতি দেয়া হয়েছে যে, তিনি তাদের জন্য কোন আগন্তুক বা অপরিচিত লোক নন। বরং তিনি তাদেরই জাতি ও গোত্রভুক্ত। তাদের মধ্যেই সারা জীবন তিনি অবস্থান করেছেন। তাদের শহরের প্রতিটি আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁকে চেনে। তিনি কোন্ ধরনের জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও সচেতন ব্যক্তি তা তারা ভালোভাবেই জানে। এই ধরনের এক ব্যক্তিকে জেনেবুঝে পাগল বলতে গিয়ে তাদের অবশ্যই কিছুটা লজ্জা অনুভব করা উচিত। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা আন নাজমের ২ ও ৩ টীকা দেখুন)

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-23
টিকা নং:19,

وَ لَقَدْ رَاٰهُ بِالْاُفُقِ الْمُبِیْنِۚ

সেই বাণীবাহককে দেখেছে উজ্জ্বল দিগন্তে।১৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৯) সূরা আন নাজমের ৭ থেকে ৯ পর্যন্ত টীকায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ পর্যবেক্ষণকে আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নাজম ৭-৮ টীকা)

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-24
টিকা নং:20,

وَ مَا هُوَ عَلَى الْغَیْبِ بِضَنِیْنٍۚ

আর সে গায়েবের (এই জ্ঞান লোকদের কাছে পৌঁছানেরা) ব্যাপারে কৃপণ নয়।২০

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২০) অর্থাৎ রসূলুল্লাহ ﷺ তোমাদের কাছ থেকে কোন কথা গোপন রাখেন না। গায়েব থেকে তাঁর কাছে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, ফেরেশতা, মৃত্যুর পরের জীবন, কিয়ামত, আখেরাত বা জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে যা কিছু সত্য ও নির্ভুল তথ্য আসে তা সবই তিনি একটুও কমবেশী না করে তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-25
টিকা নং:21,

وَ مَا هُوَ بِقَوْلِ شَیْطٰنٍ رَّجِیْمٍۙ

আর এটা কোন অভিশপ্ত শয়তানের বাক্য নয়।২১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২১) অর্থাৎ কোন শয়তান এসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কানে এসব কথা বলে যায়, তোমাদের এ ধারণা ভুল। শয়তান কেন মানুষকে শিরক, মূর্তিপূজা, কুফরী ও আল্লাহদ্রোহিতা থেকে সরিয়ে আল্লাহপরস্তি ও তাওহীদের শিক্ষা দেবে? কেন সে মানুষের মনে লাগামহীন উটের মতো স্বাধীন জীবন যাপন করার পরিবর্তে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন ও তাঁর সামনে জবাবদিহি করার অনুভূতি জাগাবে? জাহেলী রীতিনীতি, জুলুম, দুর্নীতি ও দুস্কৃতির পথে চলতে বাধা দিয়ে কেন সে মানুষকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ জীবন যাপন এবং ন্যায়, ইনসাফ, তাকওয়া ও উন্নত নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করতে উদ্ধুদ্ধ করবে? এই ধরনের কাজ করা শয়তানের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আশ শু’আরা ২১০-২১২ আয়াত ও ১৩০-১৩২ টীকা এবং ২২১-২২৩ আয়াত ও ১৪০-১৪১ টীকা)

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-27

اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَۙ

এটা তো সারা জাহানের অধিবাসীদের জন্য একটা উপদেশ।

ফী জিলালিল কুরআন:

মোহাম্মদ (স-)-এর গুণাবলী : এতো গেলো ওই বার্তাবাহক সম্পর্কে কিছু কথা যিনি স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে ওই বাণী বহন করে নিয়ে এসেছেন এবং পৌছে দিয়েছেন যথাযথ স্থানে । এখন বিবরণ দেয়া হচ্ছে সেই বার্তাবাহকের যিনি তোমাদের কাছে সে বার্তা পৌছে দিয়েছেন । তাকে তোমরা সঠিকভাবে চেনো জানো । দীর্ঘ চল্লিশটি বছর ধরে তাকে দেখার সুযোগ তোমরা পেয়েছো। সুতরাং তিনি যখন তোমাদের কাছে সেই মহা সত্যকে নিয়ে এলেন, তখন তোমরা কেন এটা ওটা বলতে শুরু করলে? তার ব্যাপারে তোমরা নানা মতে বিভক্ত কেন হতে লাগলে? তিনি তো তোমাদের অতি কাছের সংগী এবং তিনি তোমাদের অপরিচিত কেউ নন । আল্লাহর বাণী পৌছে দেয়ার জন্যে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্বস্ত, যার নিশ্চিত প্রমাণ তার কাজকর্ম ও চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ইতিমধ্যেই তোমরা পেয়েছো। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর (শোনো) তোমাদের একান্ত প্রিয় সংগী, সে কোনো পাগল নয়। আর দিনের উজ্জল আলোয় সে দেখেছে ওই জিবরাইলকে ৷ আর গায়ব (অদেখা সে জিনিস) সম্পর্কে জানানোর ব্যাপারে সে মোটেই কৃপণ নয়। আর ওই কথাগুলো কোনো বিতাড়িত শয়তানের কথাও নয়। তবে (বলো) কোথায় তোমরা চলে যাচ্ছ? শোনো, ওই কথাগুলো গোটা বিশ্বের জন্যে ও তার অধিবাসীদের জন্যে এক মহা উপদেশ ।’ ওরা সেই সম্মানিত নবী সম্পর্কে আপত্তিকর অনেক কথাই বলেছে। যাকে তারা সঠিকভাবে জানে, তার বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কেও তারা খবর রাখে। তার সত্যবাদিতা বিশ্বস্ততা ও ব্যক্তিত্বসহ সর্ববিষয়েই তারা ওয়াকিফহাল ৷ তবু তারা বললো, ও পাগল, যে কথাগুলো সে বলছে তা এক শয়তান এসে ওকে বলে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এ কথা তাঁর বিরুদ্ধে ও তার আনীত দাওয়াতের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হিসেবে বলতো যাতে করে ওই কথাগুলো অন্য কেউ মনোযোগ দিয়ে না শোনে । আবার কেউ ওই কথাগুলো বিষ্মিত হয়ে এবং অনেক সময়ে ভয়ে পড়েও বলতো। কেননা তাদের মধ্যকার দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ওই সকল দেবদেবীর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতো না। তারা ওই দেব দেবীদেরকেও ভালোবাসতো, আর যেহেতু তাদের এক বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে, কবিদের সাথে সর্বদাই এমন কোনো জীবন থাকে, যে মাঝে মধ্যে নতুন ও অভিনব কথা তাদের শিখিয়ে দেয়। শয়তান অনেক সময় মানুষকে আছর করে এবং তার মুখ দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। এভাবে ওহীর মাধ্যমে যে সত্য কথাগুলো তাদের কাছে পৌছানো হচ্ছিলো, সেগুলোর যৌক্তিকতা খুঁজে দেখার মতো মানসিকতাও তারা হারিয়ে ফেলেছিলো। এভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মহাবাণী থেকে তারা অনেক দূরে সরে থাকছিলো। সুতরাং এ সময় কোরআন তার সর্বগ্রাহী সৌন্দর্য ও যৌক্তিকতা নিয়ে হাযির হলো । এ সূরার বর্তমান আলোচ্য অধ্যায়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক চমৎকার বিবরণ দেয়া হয়েছে যা দেখে যে কোনো মানুষের মনে অবশ্যই এ কথা জাগে যে, কোরআনের এই সুমধুর বাণী এসেছে সেই মহিমান্বিত আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি দান করেছেন প্রকৃতির বুকে ওই অঢেল ও তুলনাহীন সুষমা আর তিনিই দিয়েছেন সেই রসূল (স.)-কে এক মহান চরিত্র ৷ তিনি কোরআনকে পৌছে দিয়েছেন পথহারা মানুষের দ্বারে দ্বারে । তিনি তো তাদের কাছে এমন কোনো নতুন ব্যক্তি নন যাকে তারা চেনে না বা জানে না। তিনি তাদের বহু বছরের চেনা জানা এক অতি মহান চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি । তাদের কাছে পরম বিশ্বাসী ব্যক্তিই তো দেখেছেন সেই মর্যাদাবান ফেরেশতা জিবরাইলকে সঠিকভাবে নিজ চোখে এবং অতি স্পষ্টভাবে ওই দিকচক্রবালে ৷ এ ব্যাপারে তাদের মনে কোনো প্রকার সন্দেহই ছিলোনা । আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অন্তরেও সন্দেহের লেশমাত্র ছিলো না যে ওই মহান ফেরেশতা যে বাণী এনেছেন তা অবশ্যই আল্লাহ রব্বুল ইযযতের কাছ থেকে পাওয়া এবং এ ব্যাপারে তার মন ছিলো সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বিগ্ন । অতএব, সে ফেরেশতার সততা ও সত্যবাদিতা ছিলো তার কাছে নিশ্চিত বিশ্বাসের জিনিস। এ বিষয়ের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘এগুলো কোনো মরদূদ শয়তানের কথা নয়।’ এমন মযবুত স্থির, নিশ্চিত্ততার সাথে পরিপূর্ণ এবং নিশ্চয়তা দিয়ে কথা বলা কখনো শয়তানদের কাজ হতে পারে না। তাই চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং তাদের নির্বৃদ্ধিতার দিকে ইংগিত করে বলা হচ্ছে, ‘কোথায় চলেছে৷ তোমরা?’ অর্থাৎ কি কথা বলা স্থির করেছো তোমরা এবং কী করতে চাও বলো তো দেখি । সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তোমরা কোথায় চলে যাচ্ছ। যেখানেই তোমরা যাও না কেন সবখানেই আমার দূত তোমাদের মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তি ও জ্ঞানের ক্ষুরধার তরবারি নিয়ে । ‘অবশ্যই এ কালাম গোটা বিশ্ববাসীর জন্যে এক মহা উপদেশ ৷’ এমন উপদেশ, যা তাদেরকে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে। জানায় তাদেরকে তাদের সৃষ্টির রহস্য এবং প্রকৃতির স্বরূপ। তাদেরকে সেই জিনিস অবহিত করে, যা তাদের চতুর্দিকে বিরাজ করছে। বিশ্ববাসীর জন্যে সে এক বিশ্বজনীন দাওয়াত ৷ একেবারে গোড়াতেই এই দাওয়াত দান করা হয়েছে৷ কিন্তু মক্কায় এ দাওয়াত দানের পরিণতি হয়েছে বড়োই দুঃখজনক । এ দাওয়াত বার বার ঠোকর খেয়ে ফিরে এসেছে সাধারণভাবে । মক্কা ও মক্কাবাসীর আচার আচরণের দিকে তাকালে তাদের এ করুণ দৃশ্যই নযরে পড়ে।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-28
টিকা নং:22,

لِمَنْ شَآءَ مِنْكُمْ اَنْ یَّسْتَقِیْمَؕ

তোমাদের মধ্য থেকে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে সত্য সরল পথে চলতে চায়।২২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২২) অন্য কথায় বলা যায়, এ বাণীটি তো সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য উপদেশ একথা ঠিক কিন্তু এর থেকে ফায়দা একমাত্র সেই ব্যক্তি হাসিল করতে পারে যে নিজে সত্য-সরল পথে চলতে চায়। এ থেকে উপকৃত হবার জন্য মানুষের সত্য-সন্ধানী ও সত্য প্রিয় হওয়া প্রথম শর্ত।

সুরা: আত-তাকভীর
আয়াত নং :-29
টিকা নং:23,

وَ مَا تَشَآءُوْنَ اِلَّاۤ اَنْ یَّشَآءَ اللّٰهُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ۠

আর তোমাদের চাইলেই কিছু হয় না, যতক্ষণ না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা চান।২৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২৩) এ বিষয়বস্তুটি ইতিপূর্বে সূরা মুদ্দাসসিরের ৫৬ আয়াতে এবং সূরা দাহারের ৩০ আয়াতে আলোচিত হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন, আল মুদ্দাসসির ৪১ টীকা দেখুন।)

ফী জিলালিল কুরআন:

হেদায়াত চেয়ে নিতে হয় : অপরদিকে ওহীলন্ধ এই সূক্ষ বিবৃতি তাদেরকে একথাও স্পষ্ট করে জানাচ্ছে এবং স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, হেদায়াতের সঠিক পথ যে পেতে চায়, তার জন্যে এ পথ বড়োই সহজ । সুতরাং তারা দায়ী হবে তাদের নিজেদের জন্যেই অর্থাৎ যে পথ পেতে চায় তাকে তো এ দাওয়াত অবশ্যই সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু যে এ দাওয়াতের বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা বুঝবে,কিছু পার্থিব সুযোগ সুবিধা ও স্বার্থের কারণে তা গ্রহণ করবে না, তাদের এই হঠকারিতার জন্যে তাদের নিজেদেরকেই দায়ী হতে হবে। অথচ পথ যারা পেতে চায়, তাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা সে পথপ্রাপ্তি সহজ করে দিয়েছেন। তাই ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে চাইবে এ পথে দৃঢ় হয়ে থাকতে তার জন্যে এ দাওয়াত গ্রহণ করা সহজ’। যে মযবুত হয়ে থাকতে চায় আল্লাহর দেখানো পথে, যে চলতে চাইবে তাঁর রাস্তায় । এ কথাগুলো এসে যাওয়ার পর অবশ্যই এ দাওয়াত গ্রহণ সহজ যে মযবুত হয়ে থাকতে চায় আল্লাহর দেখানো পথে, যে চলতে চাইবে তার রাস্তায়। এ কথাগুলো এসে যাওয়ার পর অবশ্যই এ দাওয়াত গ্রহণ করা সহজ, যেহেতু এ বিবৃতি সকল সন্দেহ ঘুচিয়ে দেয় এবং সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে দেয়। তখন অযুহাত দেখানোর আর কোনো উপায় থাকে না। কাজেই ভালো মনের অধিকারী ব্যক্তির কাছে এ ওহী সরল সঠিক ও সুন্দর পথকে কার্যকরভাবে হাযির করে। এমতাবস্থায় দাওয়াত পাওয়ার পরও যে সত্যের পথকে মযবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে না, সত্য পথ থেকে ফিরে যাওয়ার জন্যে তাকেই দায়ী হতে হবে, যেহেতু তার সামনে সঠিক পথ দেদীপ্যমান ছিলো । সত্য বলতে কি, সত্য পথের যৌক্তিকতা এবং ঈমান আনার জন্যে যে প্রমাণাদি প্রয়োজন তা মানুষের নিজের মধ্যে এবং বিশ্বের সবখানে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে প্রয়োজন ইচ্ছাকৃত এক পদক্ষেপ এবং অনমনীয় এক হঠকারী জিদ ৷ বিশেষ করে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো জানার পর তা না-বুঝা এবং সত্যকে গ্রহণ না করা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওই বিরোধীদের কাছে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে অবশেষে সেই মহাসত্য প্রতিষ্ঠার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা এসে গিয়েছে এবং হেদায়াতের পথ গ্রহণ করা মানুষের জন্যে অনেকাংশে সহজ হয়ে চলেছে তখন বাধ্য হয়ে তারাও সত্য পথ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে এলো এবং এটাও তারা বুঝলো যে, সবকিছুর ওপর পরাক্রমশালী আল্লাহর ইচ্ছাই আসল ইচ্ছা । এ বিষয়ে আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা যা কিছু চাও তা হব্বার নয়, হবে তাই যা আল্লাহ তায়ালা চান।’ আর এ কথা সম্ভবত এ জন্যেই বলা হয়েছে, যেন এ কথা তারা না বুঝে যে, তাদের ইচ্ছা আল্লাহর সেই ইচ্ছা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জিনিস যার দিকে সবকিছু ফিরে যাবে। এটা আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী যে তিনি সবাইকে স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবন পথ বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিয়েছেন এবং হেদায়াতের পথ পাওয়াকে সহজ করে দিয়েছেন। অবশ্যই সবকিছু আল্লাহর সেই সর্বব্যাপী ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে, যা চিরদিন বিজয়ী ছিলো এবং বিজয়ী হবে। মহান সৃষ্টিকর্তা রব্বুল ইযযতের ইচ্ছার বর্ণনা কোরআনে কারীমের যতো জায়গাতে এসেছে, সে সবখানেই এ সকল যুক্তি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈমানী চিন্তা-চেতনাকে সঠিক বলে ঘোষণা করা এবং আল্লাহর মহান ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করা। বিশ্ববাসীকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, সৃষ্টিজগতে যা কিছু আছে তার সবকিছুকে অবশেষে আল্লাহর ইচ্ছাই মেনে নিতে হবে। এখন একটি প্রশ্ন জাগে যে, মানুষের কিছু ইচ্ছা যে বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়, তা কিভাবে হয়? তার জরাব হচ্ছে, মানুষকে দেয়া কিছু ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা তাও আল্লাহর ইচ্ছার একটি অংশ মাত্র । যেমন রয়েছে অন্যান্য স্থানে তাকদীর ও তাদবীরের সম্পর্ক ৷ তার সঠিক মর্যাদা বুঝতে হলে ফেরেশতাদের দিকে তাকাতে হবে, যারা নিরন্তর আল্লাহর নির্দেশগুলো যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছে এবং যেসব নির্দেশ তাদেরকে দেয়া হচ্ছে তা পালন করতে তারা পুরোপুরি সক্ষমও বটে । মানুষকেও শিক্ষাদান করা এবং সবকিছুর বিবরণ জানানোর পরে, ভালো ও মন্দের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নেয়ার যে স্বাধীনতা- এই স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের যে ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়েছে তাও সেই মহামহিমের মহান ইচ্ছার একটি দিক মাত্র ৷ মোমেনদের ধ্যান-ধারণার মধ্যেও এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা করা জরুরী যাতে করে তারা প্রকৃত সত্যকে যথাযথভাবে বুঝে । সাহায্য ও সক্ষমতা লাভের জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছেই প্রার্থনা জানায় এবং এ পথে চলতে গিয়ে কী প্রয়োজন এবং কোন পথ গ্রহণ করা উচিত তা বুঝার জন্যে তার সাথেই যোগাযোগ করে।

# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

Leave a Reply