Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৯৬/এবং কফেরর-রা বলে:-৩৮) [* দুর্নীতিবাজদের পরিণতি:- *কাফিররা যা করত:-] www.motaher21.net সুরা: ৮৩: আল্ – মুতাফফিফীন পারা:৩০ ১- ৩৬ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- # তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:- # তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৬/এবং কফেরর-রা বলে:-৩৮)
[* দুর্নীতিবাজদের পরিণতি:-
*কাফিররা যা করত:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৩: আল্ – মুতাফফিফীন
পারা:৩০
১- ৩৬ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-
# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১
وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ ۙ﴿۱﴾
ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়,
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২
الَّذِیۡنَ اِذَا اکۡتَالُوۡا عَلَی النَّاسِ یَسۡتَوۡفُوۡنَ ۫﴿ۖ۲﴾
তাদের অবস্থা এই যে, লোকদের থেকে নেবার সময় পুরোমাত্রায় নেয় ,
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩
وَ اِذَا کَالُوۡہُمۡ اَوۡ وَّزَنُوۡہُمۡ یُخۡسِرُوۡنَ ﴿ؕ۳﴾
এবং তাদেরকে ওজন করে বা মেপে দেবার সময় কম করে দেয়।
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৪
اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓئِکَ اَنَّہُمۡ مَّبۡعُوۡثُوۡنَ ۙ﴿۴﴾
তারা কি চিন্তা করে না যে, তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে!
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৫
لِیَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ۙ﴿۵﴾
এক মহা দিবসে;
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৬
یَّوۡمَ یَقُوۡمُ النَّاسُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ؕ﴿۶﴾
যেদিন সমস্ত মানুষ রব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৭
کَلَّاۤ اِنَّ کِتٰبَ الۡفُجَّارِ لَفِیۡ سِجِّیۡنٍ ؕ﴿۷﴾
কখ্খনো নয়, নিশ্চিতভাবেই পাপীদের আমলনামা কয়েদখানার দফতরে রয়েছে।
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৮
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا سِجِّیۡنٌ ؕ﴿۸﴾
আর তুমি কি জানো সেই কয়েদখানার দফতরটা কি?
সুরা: ৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৯
کِتٰبٌ مَّرۡقُوۡمٌ ؕ﴿۹﴾
একটি লিখিত কিতাব।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১০
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾
সেদিন মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য ধ্বংস সুনিশ্চিত,
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১১
الَّذِیۡنَ یُکَذِّبُوۡنَ بِیَوۡمِ الدِّیۡنِ ﴿ؕ۱۱﴾
যারা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা মনে করে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১২
وَ مَا یُکَذِّبُ بِہٖۤ اِلَّا کُلُّ مُعۡتَدٍ اَثِیۡمٍ ﴿ۙ۱۲﴾
আর সীমালংঘনকারী পাপিষ্ঠ ব্যতীত কেউই ওকে মিথ্যা মনে করে না।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৩
اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِ اٰیٰتُنَا قَالَ اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿ؕ۱۳﴾
তাকে যখন আমার আয়াত শুনানো হয় ৬ সে বলে, এ তো আগের কালের গল্প।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৪
کَلَّا بَلۡ ٜ رَانَ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ مَّا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۱۴﴾
না এটা সত্য নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের হৃদয়ে জং ধরিয়ে দিয়েছে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৫
کَلَّاۤ اِنَّہُمۡ عَنۡ رَّبِّہِمۡ یَوۡمَئِذٍ لَّمَحۡجُوۡبُوۡنَ ﴿ؕ۱۵﴾
কখ্খনো নয়, নিশ্চিতভাবেই সেদিন তাদের রবের দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখা হবে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৬
ثُمَّ اِنَّہُمۡ لَصَالُوا الۡجَحِیۡمِ ﴿ؕ۱۶﴾
অতঃপর নিশ্চয়ই তারা জাহীম (জাহান্নামে) প্রবেশ করবে;
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৭
ثُمَّ یُقَالُ ہٰذَا الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تُکَذِّبُوۡنَ ﴿ؕ۱۷﴾
এরপর তাদেরকে বলা হবে, এটি সেই জিনিস যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৮
کَلَّاۤ اِنَّ کِتٰبَ الۡاَبۡرَارِ لَفِیۡ عِلِّیِّیۡنَ ﴿ؕ۱۸﴾
কখ্খনো নয়,৯ অবশ্যি নেক লোকদের আমলনামা উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের দফতরে রয়েছে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-১৯
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا عِلِّیُّوۡنَ ﴿ؕ۱۹﴾
আর তোমরা কি জানো, এ উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের দফতরটি কি?
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২০
کِتٰبٌ مَّرۡقُوۡمٌ ﴿ۙ۲۰﴾
এটি একটি লিখিত কিতাব।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২১
یَّشۡہَدُہُ الۡمُقَرَّبُوۡنَ ﴿ؕ۲۱﴾
নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতারা এর দেখাশুনা করে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২২
اِنَّ الۡاَبۡرَارَ لَفِیۡ نَعِیۡمٍ ﴿ۙ۲۲﴾
নিঃসন্দেহে নেক লোকেরা থাকবে বড়ই আনন্দে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৩
عَلَی الۡاَرَآئِکِ یَنۡظُرُوۡنَ ﴿ۙ۲۳﴾
সুসজ্জিত আসনে বসে তারা দেখতে থাকবে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৪
تَعۡرِفُ فِیۡ وُجُوۡہِہِمۡ نَضۡرَۃَ النَّعِیۡمِ ﴿ۚ۲۴﴾
তুমি তাদের মুখমন্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের সজীবতা দেখতে পাবে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৫
یُسۡقَوۡنَ مِنۡ رَّحِیۡقٍ مَّخۡتُوۡمٍ ﴿ۙ۲۵﴾
তাদেরকে মোহর করা বিশুদ্ধ পানীয় হতে পান করান হবে;
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৬
خِتٰمُہٗ مِسۡکٌ ؕ وَ فِیۡ ذٰلِکَ فَلۡیَتَنَافَسِ الۡمُتَنَافِسُوۡنَ ﴿ؕ۲۶﴾
এর মোহর হচ্ছে কস্তুরীর। আর তা লাভের জন্যই প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৭
وَ مِزَاجُہٗ مِنۡ تَسۡنِیۡمٍ ﴿ۙ۲۷﴾
এর মিশ্রণ হবে তাসনীমের (পানির)।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৮
عَیۡنًا یَّشۡرَبُ بِہَا الۡمُقَرَّبُوۡنَ ﴿ؕ۲۸﴾
এটা একটি প্রস্রবণ, যা হতে নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পান করবে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-২৯
اِنَّ الَّذِیۡنَ اَجۡرَمُوۡا کَانُوۡا مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا یَضۡحَکُوۡنَ ﴿۫ۖ۲۹﴾
অপরাধীরা দুনিয়াতে ঈমানদারদের বিদ্রূপ করতো।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩০
وَ اِذَا مَرُّوۡا بِہِمۡ یَتَغَامَزُوۡنَ ﴿۫ۖ۳۰﴾
এবং তারা যখন মুমিনদের নিকট দিয়ে যেত, তখন চোখ টিপে ইশারা করত।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩১
وَ اِذَا انۡقَلَبُوۡۤا اِلٰۤی اَہۡلِہِمُ انۡقَلَبُوۡا فَکِہِیۡنَ ﴿۫ۖ۳۱﴾
নিজেদের ঘরের দিকে ফেরার সময় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফিরতো।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩২
وَ اِذَا رَاَوۡہُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ لَضَآلُّوۡنَ ﴿ۙ۳۲﴾
আর যখন মুমিনদেরকে দেখত তখন বলত, ‘নিশ্চয় এরা পথভ্ৰষ্ট।’
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩৩
وَ مَاۤ اُرۡسِلُوۡا عَلَیۡہِمۡ حٰفِظِیۡنَ ﴿ؕ۳۳﴾
অথচ তাদেরকে এদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩৪
فَالۡیَوۡمَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنَ الۡکُفَّارِ یَضۡحَکُوۡنَ ﴿ۙ۳۴﴾
আজ ঈমানদাররা কাফেরদের ওপর হাসছে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩৫
عَلَی الۡاَرَآئِکِ ۙ یَنۡظُرُوۡنَ ﴿ؕ۳۵﴾
সুসজ্জিত আসনে বসে তাদের অবস্থা দেখছে।
সুরা:৮৩:আল্-মুতাফফিফীন:-৩৬
ہَلۡ ثُوِّبَ الۡکُفَّارُ مَا کَانُوۡا یَفۡعَلُوۡنَ ﴿٪۳۶﴾
কাফিররা যা করত, তার ফল তারা পেল তো?

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৬)/এবং কফেরর-রা বলে:-৩৮)
[* দুর্নীতিবাজদের পরিণতি:-
*কাফিরর যা করত:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৩: আল্ – মুতাফফিফীন
পারা:৩০
১- ৩৬ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-

সুরা: আল-মুতাফফিফীন

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৮৩

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই সূরাটির মূল লক্ষ্য মানুষের হৃদয়ে জাগরণ ও চেতনায় আলোড়ন সৃষ্টি করা। ওহীর মাধ্যমে আকাশ থেকে নাযিল হওয়া ইসলামী দাওয়াত বিশ্ববাসী ও আরববাসীদের জীবনে যে অভিনব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো সেদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ সূরায় সাধারণভাবে সর্বাত্মক, পূর্ণাংগ ও নতুন জীবন দর্শন আলোচিত হয়। তবে এর পাশাপাশি এতে ইসলামী আন্দোলনের সামনে আবির্ভূত মক্কার জনজীবনের একটা বাস্তব সমস্যাও আলোচিত হয়েছে। সূরার শুরুতেই মক্কার সমাজ জীবনের এই বাস্তব সমস্যাটির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে মাপে কমবেশী করা লোকদেরকে কেয়ামতের দিনে ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দেয়া হয়েছে। সূরার শেষেও এধরনের অন্য একটি সামাজিক আচরণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । এটি হচ্ছে অপরাধপ্রবণ কাফেরদের পক্ষ থেকে মোমেনদের সাথে বেয়াদবী, অসদাচরণ, চোখ টিপে খারাপ ইংগিত করা বা কটাক্ষ করা, হাসিঠাট্টা ও বিদ্রুপ করা এবং তাদেরকে ‘গোমরাহ’ বা বিপথগামী বলে আখ্যায়িত করা। পুণ্যবান ও পাপিষ্ঠ এই দুই শ্রেণীর মানুষের অবস্থা বর্ণনা ও কেয়ামতের দিন উভয় শ্রেণীর পরিণতি বিশ্লেষণ করাও এ সূরার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে । সূরাটি মোটামুটি চারভাগে বিভক্ত । প্রথম ভাগটি শুরু হয়েছে মাপে কম দেয়া লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে । বলা হয়েছে, ‘যারা কমবেশী করে তাদের জন্যে অত্যস্ত শোচনীয় পরিণতি! যারা কারো কাছ থেকে কিছু মেপে আনলে ঠিকমতো আনে আর মেপে বা ওযন করে কাউকে কিছু দিলে কম দেয়। তারা কি মনে করে না যে, এক ভয়াবহ দিনে তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে, যেদিন মানব জাতি বিশ্বপ্রভুর সামনে দাড়াবে ।’ সূরার দ্বিতীয় অংশটিতে পাপীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাদেরকে কঠোর হুমকি ও শাসানি দেয়া হয়েছে চরম খারাপ পরিণতি ও ধ্বংসের জন্যে । তাদের অপরাধ ও পাপ কাজকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে এই অন্ধত্বের কারণ, আর কেয়ামতের দিন তাদের কি প্রতিদান দেয়া হবে। আল্লাহর কাছ থেকে তাদেরকে ঠিক সেই ভাবে লুকিয়ে রাখা হবে, যেভাবে পৃথিবীতে তার পাপ তার হৃদয়কে আবদ্ধ করে রেখেছিল- এ কথাও এতে আলোচিত হয়েছে। সেই সাথে কাফেরদের জন্য ‘জাহীম’ বা জাহান্নামকে চিহ্নিত করা হয়েছে চরম লাঞ্ছনা ও অবমাননার প্রতীক হিসাবে। বলা হয়েছে, ‘কখনো নয়, পাপীদের পুস্তক থাকবে সিজ্জীনে ৷ সিজ্জীন কি তুমি তা জানো? (তা এক) লিখিত গ্রন্থ। সেদিন অস্বীকারকারীদের জন্যে থাকবে………… তারপর তারা জাহাম্নামে ঢুকবে । তারপর তাকে বলা হবে যে, তোমরা যে জিনিসকে মিথ্যা সাব্যস্ত করতে, এই তো সে জিনিস ।’ (আয়াত ৭-১৭) সূরার তৃতীয় অংশে তুলে ধরা হয়েছে ঠিক এর বিপরীত পুণ্যবান ও সৎকর্মশীলদের অবস্থা । এখানে আছে তাদের উচ্চতর মর্যাদা ও সুখশান্তিতে পরিপূর্ণ পরকালীন জীবনের বর্ণনা । বলা হয়েছে, তাদের চেহারা থাকবে সতেজ, উজ্জ্বল ও প্রফুল্ল । বালিশে হেলান দিয়ে তারা পরম সুখে ‘রাহীক’ তথা সুস্বাদু পানীয় পান করবে৷ এ অংশটি এক উজ্জ্বল ও প্রাচূর্যময় অংশ । ‘শুনে রাখো, পুণ্যবান লোকেরা থাকবে ‘ইল্লিয়্যীনে’। ইল্লিয়্যীন কি তা কি তুমি জানো? তা এক……বস্তুত এই জিনিসের জন্যই বুদ্ধিমানদের প্রতিযোগিতা করা উচিত । (আয়াত ১৮-২৬) আর শেষাংশে বর্ণনা করা হয়েছে সৎকর্মশীলরা মিথ্যা অহংকারে লিপ্ত পাপীদের পক্ষ থেকে গালাগালি, উপহাস ও বেয়াদবীর আকারে যে সকল পরিস্থিতির সম্মুখিন হতো সে সম্পর্কে ৷ অতপর উভয় শ্রেণী বাস্তবে কি পরিণাম ভোগ করেছে তার উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই অপরাধীরা মোমেনদের প্রতি উপহাস করতো । তাদের কাছে দিয়ে যাবার সময় তাদের প্রতি কটাক্ষ করতো। আর আপন পরিজনের কাছে ফিরে গিয়ে তৃপ্তি অনুভব করতো। মোমেনদেরকে দেখে বলতো, এরা বিভ্রান্ত । অথচ তাদেরকে মোমেনদের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়ে পাঠানো হয়নি। আজ মোমেনরা কাফেরদের প্রতি উপহাস করবে এবং বালিশে হেলান দিয়ে তাকাবে। কাফেররা কি তাদের কৃতকর্মের ফল ছাড়া আর কিছু ভোগ করবে? সামগ্ৰিকভাবে এ সূরা মক্কার দাওয়াতী পরিবেশের একটি দিক তুলে ধরে। অপরদিকে সেই পরিবেশে বিরাজমান অবস্থার মোকাবেলায় দাওয়াতের যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিলো তারও একটা দিক এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মানবীয় মন ও মনস্তত্ত্বের একটা দিক এখানে প্রস্ফুটিত হয়েছে। সূরার বিস্তারিত আলোচনার সময় আমি তা তুলে ধরবো ।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-৩

وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ یُخْسِرُوْنَؕ

এবং তাদেরকে ওজন করে বা মেপে দেবার সময় কম করে দেয়।

ফী জিলালিল কুরআন:

“যারা মাপে কমবেশী করে তাদের জন্য শোচনীয় পরিণাম, যারা কারো কাছ থেকে কিছু মেপে আনলে তা ঠিকমতো আনে এবং মেপে বা ওযন করে কাউকে কিছু দিলে কম দেয়, তারা কি মনে করে না এক ভয়াবহ দিনে তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে, যেদিন মানবজাতি বিশ্বপ্রভুর সামনে দাড়াবে?” এ আয়াতের মাধ্যমে সূরাটি মাপে কমবেশী কাজে নিয়োজিত লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। শোচনীয় পরিণাম-এর অর্থ ধ্বংস । এই অপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের ধ্বংস সাধিত হয়েছে অথবা ধ্বংস সাধিত হোক এ দুই অর্থের যেটিই বুঝানো হোক না কেন, উভয় অবস্থায় যে তার ধ্বংস অবধারিত এ কথাই ব্যক্ত হচ্ছে! কেননা আল্লাহ্‌ তায়ালা যখন বলেন অমুক জিনিস হোক, তখন ধরে নিতে হবে যে, তা হওয়া অবধারিত। পরবর্তী দুটো আয়াতে ‘মোতাফফিফীন’ তথা যারা মাপে কমবেশী করে তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। তারা হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি, ‘যারা মেপে আনার সময় পুরোপুরি আনে, আর মেপে দেয়ার সময় কম দেয় ।’ এর অর্থ দাড়ালো এই যে, তারা যখন ক্রেতা হয়, তখন পণ্যদ্রব্য মেপে পুরোপুরি আনে । আর যখন বিক্রেতা হয়, তখন মানুষকে মেপে দেয়ার সময় কম দেয়। পরবর্তী তিনটি আয়াতে মাপে কম দেয়ার অপকর্মে লিপ্ত ব্যবসায়ীবৃন্দ তথা ‘মোতাফফিফীন’দের কার্যকলাপে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। তারা এমনভাবে আচরণ করে যেন পার্থিব জীবনে তাদের উপার্জিত সম্পদ সম্পর্কে কোনো জবাবদিহি বা হিসাব নিকাশ হবেই না, যেন এত বড় কোনো স্থান নেই, যেখানে কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনে সকলে আল্লাহ্‌র সামনে একত্রিত হবে এবং তারই সামনে হিসাব নিকাশ ও শাস্তি প্রদান করা হবে। বলা হচ্ছে, ‘তারা কি বিশ্বাস করে না যে, একটি বিরাট দিনে যখন সমগ্র মানব জাতি বিশ্বপ্রভুর সামনে দাড়াবে সেদিন তারা পুনরুজ্জীবিত হবে?” দূর্নীতি দমনে কোরআন : কোন মক্কী সূরায় ব্যবসায়িক দূর্নীতি ও বিকৃতির শিকার লোকদেরকে এত কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা একটা লক্ষণীয় ব্যাপার বটে । কেননা মক্কী সূরা সাধারণত মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের ওপরই বেশী জোর দিয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, আল্লাহর একত্ব, তার ইচ্ছার অপ্রতিরোধ্যতা, মানুষ ও বিশ্বজগতের ওপর তার সার্বভৌমত্ব ও নিরংকুশ আধিপত্য, ওহী ও নবুওতের তাৎপর্য, আখেরাত, হিসাব-নিকাশ ও কর্মফল প্রভৃতি বিষয় তার প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে থাকে । তবে সেই সাথে সাধারণভাবে নৈতিক অনুভূতি ও চেতনা জাগ্রত করার দিকেও মনোযোগ দেয়া হয় এবং মূল আকীদা বিশ্বাসের সাথে তার সংযোগ স্থাপন করা হয়। পক্ষান্তরে কোনো নৈতিক বিষয়, তথা মাপে কম দেয়ার এবং সাধারণ লেনদেনের বিষয় কিছুকাল পরে মাদানী সূরায় আলোচিত হয়। সে সময় মদীনার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা অনুসারে সমাজ জীবনকে পুনর্গঠিত করার প্রস্নুতি চলছিলো । বস্তুত এই বিষয়টি এ সূরায় আলোচিত হওয়া মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো ব্যাপার ৷ এই তিনটি ক্ষুদ্র আয়াতের ভেতরে কয়েকটা সুক্ষ ইংগিত রয়েছে। প্রথমত ইসলাম মক্কার পরিবেশে মারাত্মক ধরনের ব্যবসায়িক দূর্নীতির দেখতে পেয়েছিলো এবং এ দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল তৎকালীন সমাজের নেতৃস্থানীয় বক্তিরা। এসব লোকের হাতে প্রচুর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানাদি ছিলো এবং সেই সুবাদে তারা বিপুল সম্পদের অধিকারী ছিলো । এ সব সম্পদ দ্বারা তারা বাণিজ্যিক কাফেলার মাধ্যমে সিরিয়া ও ইয়েমেনে গ্রীষ্ম ও শীতে ব্যবসা করতো। এছাড়া তারা বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে মেলা গড়ে তুলতো। যেমন হজ্জের সময় ওই ওকাজের মেলা বসতো । এ সব মেলায় তারা ব্যবসায়িক লেনদেন ও চুক্তি সম্পাদনের পাশাপাশি কবিতা পাঠের আসরও বসাতো। এখানে পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ব্যবসায়িক দুর্নীতিতে লিপ্ত যে সব লোককে আল্লাহ তায়ালা শোচনীয় পরিণতির হুমকি দিয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তারা সমাজের উঁচু স্তরের প্রভাবশালী লোক ছিলো । তারা এতটা ক্ষমতাশালী ছিলো যে, গোটা সমাজকে তাদের ইচ্ছামতো চলতে বাধ্য করতো । এ জন্যই বলা হয়েছে যে, তারা যখন ক্রেতার ভূমিকায় নামতো, তখন ক্রীত সামগ্রী পুরোপুরিভাবে আদায় করে নিতো। এ থেকে বুঝা যায়, জনগণের ওপর যেন তাদের এক ধরনের আধিপত্য ছিলো, তা সে যে কারণেই হোক না কেন। সেই ক্ষমতা ও আধিপত্যের জোরে নিজেদের বেলায় তারা পুরোপুরি আদায় করে নিতো । অর্থাৎ এক ধরনের বল প্রয়োগের রীতি চালু ছিল, ন্যায়সংগতভাবে আদান প্রদান হতো না। নচেৎ এতে এমন যুদ্ধ ঘোষণার কোনো ব্যাপার ছিলো না। এখানে বুঝানো হচ্ছে যে, বল প্রয়োগের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রাপ্যের চেয়ে বেশী আদায় করতো, যতোটা বেশী চাইতো জোর করে নিয়ে নিতো । পক্ষান্তরে যখন তারা বিক্রেতার ভূমিকায় থাকতো এবং কাউকে কিছু মেপে দিতো, তখন তাদের সেই আধিপত্যের জোরে তারা ক্রেতাদেরকে ঠকাতো এবং কম দিতো। অথচ ক্রেতারা কোথাও ইনসাফ পেতো না এবং তাদের প্রাপ্য আদায় করার কোনো সুযোগ পেতো না। এই বলপ্রয়োগ রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের বলেই হোক, বা গোত্রীয় ক্ষমতার বলেই হোক, অর্থবলের জোরেই হোক, কিংবা তাদের কাছে যে সব অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী থাকতো, তার ওপর তাদের একচেটিয়া অধিকার থাকার কারণে জনগণ তাদের যুলুম ও বল প্রয়োগ মেনে নিতে বাধ্য হতো বলেই হোক-সবই সমান। আজকের ব্যবসার জগতেও এ ধরনের কর্মকান্ড বিদ্যমান । বস্তুত ব্যবসায়িক দুর্নীতি এমন এক অসহনীয় পর্যায়ে পৌছেছিল, যার ফলে মক্কী জীবনেই তার দিকে আগাম দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো ৷ মক্কার পরিবেশে ব্যবসায়িক দুর্নীতি ও যুলুমের প্রতি এই আগাম দৃষ্টিদান দ্বারা অপর যে আনুষংগিক ফায়দা অর্জিত হয়েছে তা হলো এই যে, ইসলামী জীবন বিধানের প্রকৃতি এবং তার গুণগত ও স্বভাবগত রূপটি কেমন, তা জানা গেলো। লেনদেনের ক্ষেত্রে এত বড় অসহনীয় যুলুম এবং এত বড় নৈতিক বিকৃতিকে ইসলাম আদৌ পছন্দ করেনি, বরং ইসলামের বিধান মানুষের গোটা জীবন ও যাবতীয় কর্মকান্ডকে আল্লাহর মনোনীত ও অবিকৃত নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর । ইসলাম তখনো জাতীয় জীবনকে রাষ্ট্রীয় শক্তি ও আইনের বল প্রয়োগের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র শরীয়তের অধীনে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশক্তিকে হস্তগত করেনি। তথাপি সে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের এই দুর্নীতিবাজ ও যুলুমবাজ মোতাফ্ফিফীনদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে এবং ধ্বংস ও খারাপ পরিণামের ভীতি প্রদর্শন করেছে। অথচ সেদিনকার এই যুলুমবায, এ লোকেরা ছিলো স্বয়ং মক্কার সর্দাররা ৷ তাদের হাতেই ছিলো ক্ষমতা ও আধিপত্যের চাবিকাঠি ৷ তাদের ক্ষমতা ও প্রতাপের দাপট শুধু অংশীবাদী আকীদা-বিশ্বাসের বদৌলতে জনগণের জীবন ও ভাবাবেগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও জীবিকার উৎসের ওপরও বিস্তৃত ছিলো । মানুষের ওপর পরিচালিত এই নিকৃষ্ট অর্থনৈতিক শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইসলাম গগণবিদারী আওয়ায তুললো । একদিকে ছিলো এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত ও নিপীড়িত মানুষ। অপরদিকে তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যবসায় রত তাদের নেতৃবৃন্দ, যারা ছিলো একাধারে মুনাফাখোর পুঁজিপতি । মানুষের ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধ্যান-ধারণাকে পুঁজি করে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী । উঁচু শ্রেণীর লোকদের ইসলাম বিদ্বেষ : ইসলাম তার এই গগনবিদারী আওয়ায তুলে মহাকাশের ওপর থেকে আগত আদর্শের বলে এবং নিজস্ব শক্তির বলে শোষিত জনগণকে জাগ্রত ও উচ্চকিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলো ৷ মক্কার সেই অবরোধের ভেতরে নিষ্পেষিত হতে থাকা অবস্থায়ও এই আওয়াযকে সে গোপন ও অবদমন করেনি। বলদর্পী-স্বৈরাচারী কোরায়শ নেতারা যখন অর্থবল, জনবল, পদবল ও ধর্মের দোহাই দিয়ে মক্কার মানুষের ওপর আপন ক্ষমতার গদা ঘুরাচ্ছিলো, ইসলাম তখন সেই অবরুদ্ধ মানবতার উপর এই যুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়ায তুলতে বিলম্ব করেনি। এখান থেকেই আমরা কিছুটা বুঝতে পারি কি কি কারণে কোরায়শ নেতারা ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এত মারমুখো হয়ে এমন প্রচন্ড বিদ্বেষ সহকারে রুখে দাড়িয়েছিলো। তারা নিসন্দেহে বুঝতে পেরেছিলো যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনীত এই নতুন বিধান শুধু মনমগজে লুকিয়ে থাকা কোনো আকীদা বিশ্বাস নয়, তাদের কাছ থেকে শুধু এই মর্মে মৌখিক উচ্চারিত একটা সাক্ষ্য নিয়েও তা সন্তুষ্ট থাকবে না যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ (স.) আল্লাহর রসূল । এ নতুন আদর্শ শুধু মূর্তিপূজা মুক্ত নামায পেয়েও সন্তুষ্ট থাকবে না। বরঞ্চ এ এমন একটা জীবন বিধান, যা তাদের যাবতীয় রীতিনীতি, স্বার্থ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সকল জাহেলী ভিত্তি ভেংগে গুড়িয়ে দেবে। তারা এও অনুধাবন করেছিলো যে, ইসলাম কখনো কোনো বিকল্প বা কোনো আপোস ফর্মুলা গ্রহণ করবে না এবং এমন কোনো পার্থিব জিনিসের সাথে তার সমম্বয় ঘটাবে না, যা ইসলামের সমধর্মী নয়। যে সমস্ত পার্থিব ধ্যান-ধারণা ও কর্মকান্ডের ওপর জাহেলিয়াতের ভিত্তি স্থাপিত, ইসলাম তার সবগুলোর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন করে। এ কারণেই কোরায়শ নেতারা ইসলামের সাথে এমন এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যার অবসান হিজরতের আগেও ঘটেনি, পরেও ঘটেনি ৷ এ যুদ্ধ ছিলো ইসলামের সকল রীতিনীতি ও কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তাদের যাবতীয় রীতিনীতি ও কর্মকান্ড রক্ষা করার যুদ্ধ । এটা নিছক আকীদা ও বিশ্বাস রক্ষার যুদ্ধ ছিলো না। মানব জীবনের ওপর ইসলামী আদর্শের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে প্রতিরোধ করতে যারা যুগে যুগে ও দেশে দেশে তৎপর, তারা এ সত্যটাকে খুব ভালো করেই উপলব্ধি করে থাকে । তারা খুব ভালো করেই জানে যে, তাদের কৃত্রিম জীবন-রীতি, গায়ের জোরে ছিনতাই করা সুযোগ সুবিধা, ঘুণে খাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্র এবং বিকৃত চরিত্র ও চালচলন, এর কোনোটাই ইসলামের চির অটুট ও সুমহান আদর্শের সামনে টিকে থাকতে সক্ষম নয়। যুলুমবায, স্বৈরাচারী, আল্লাহদ্রোহী ও ধোঁকাবাজ লোকেরা তাই তাদের ধোঁকাবাজি ও শোষণ যে পর্যায়েরই হোক না কেন, শুধু আর্থিক শোষণে সীমাবদ্ধ থাকুক অথবা সকল অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে বিস্তৃত হোক ইসলামের শাশ্বত ও পরিচ্ছন্ন নীতির আধিপত্য ও কর্তৃত্ব মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিস্তার করাকে তারাই সবচেয়ে বেশী ভয় পায়। কারণ এ আদর্শ মোটেই আপোস, দর কষাকষি অথবা স্বার্থের ভাগাভাগিকে প্রশ্রয় দেয় না। আওস ও খাযরাজের যে সব প্রতিনিধি হিজরতের পূর্বে দ্বিতীয় আকাবার বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তারাও ইসলামের এই আপোসমহীন চরিত্রকে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। আসেম ইবনে ওমার ইবনে কাতাদাহর বরাত দিয়ে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন যে, মদীনা থেকে আগত দলটি যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বাইয়াতের জন্যে সমবেত হলো, তখন আব্বাস ইবনে ‘ওবাদাহ ইবনে নায্লা আনসারী যিনি বনু সালেম বিন আওফের লোক ছিলেন। বললেন, ‘ওহে খাযরাজীরা! তোমরা কি জানো, এই ব্যক্তির (মোহাম্মদ স.) সাথে কি ব্যাপারে বাইয়াত করছো? তারা বললো হা, জানি। তিনি বললেন, তোমরা তার সাথে এই মর্মে বাইয়াত করছো যে, (প্রয়োজনে) সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যদি তোমরা মনে করো যে, কোনো বিপদে পড়ে তোমাদের ধনসম্পদ ধ্বংস হয়ে গেলে এবং তোমাদের নেতারা নিহত হলে তোমরা তাকে (মোহাম্মদকে) শত্রুর হাতে ফিরিয়ে দেবে, তাহলে এখনই সেটা করো। কেননা অমন কাজ যদি তোমরা করো, তবে খোদার কসম, তা হবে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গায় লাঞ্ছনার শামিল । আর যদি তোমরা মনে করে! যে, তোমাদের জানমালের যতো ক্ষয়ক্ষতিই হোক না কেন, তোমরা যে উদ্দেশ্যে ও যে ওয়াদা দিয়ে তাকে আহ্বান জানিয়েছো, তা পূরণ করতে পারবে, তাহলে তোমরা তার বাইয়াত গ্রহণ করো। কেননা সেটা হবে দুনিয়া ও আখেরাতের পরম কল্যাণকর কাজ ৷ তারা সবাই বললো আমরা আমাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও আমাদের নেতাদের প্রাণনাশের বিনিময়েও এ বাইয়াত গ্রহণ করবো। হে আল্লাহর রসূল, এতে আমরা কী পাবো? রসূল (স.) বললেন, বেহেশত পাবে । তখন সবাই বললো, আপনার হাত বাড়ান । তিনি তার হাত বাড়ালেন এবং তাঁরা সকলে তাঁর সাথে বাইয়াত করলেন। ইসলামের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে বাইয়াত গ্রহণকারী মোমেনরা যেমন ওয়াকেফহাল ছিলেন, তেমনি ওয়াকেফহাল ছিলো কোরায়শ নেতারাও ৷ তারা জানতো যে, ইসলাম একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই, প্রয়োজনে তরবারি প্রয়োগ করেও সমাজে ইনসাফ কায়েম করবে এবং মানুষের জীবনকে সে অনুযায়ী পুণর্গঠন করবে। তারা এও বৃঝেছিলো যে, ইসলাম কোনো আগ্রাসন, কোনো যালেমের যুলুম এবং কোনো অহংকারীর দর্প বরদাশত করবে না। মানুষের ওপর শোষণ নিপীড়নও সে হতে দেবে না। তাই প্রত্যেক আগ্রাসী শক্তি ও প্রত্যেক বলদর্পী শোষক তার প্রতিরোধ করে এবং তার দাওয়াত ও তার আহ্বায়কদের বিরুদ্ধে পদে পদে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে ‘তারা কি মনে করে না যে, তাদেরকে এক ভয়ংকর দিনে পুনরুজ্জীবিত করা হবে, যেদিন মানবজাতি বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে?’ অর্থাৎ তাদের ভাবগতিক বড়ই আশ্চর্যজনক আসলে সেই ভয়াবহ দিনে যে পুনরুজ্জীবিত হতে হবে, সেদিন যে একেবারেই অসহায় অবস্থায় তারা বিশ্বপ্রভুর সামনে দাড়াবে, সেদিন যে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদের আর কোনো সহায় থাকবে না, তিনি তাদের ব্যাপারে যে বিচার ফয়সালা করবেন, তার অপেক্ষা করা ছাড়া যে তাদের গত্যস্তর থাকবে না এবং তিনি ছাড়া যে তাদের কোনোই অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না, শুধুমাত্র এই ধারণাটুকুই তাদেরকে অবৈধ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসা বাণিজ্য থেকে, অবৈধ উপায়ে মানুষের ধনসম্পদ ও ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট ছিলো । কিন্তু তারা এ সব অপকর্মে, তথা লেনদেন ও কেনাবেচার ক্ষেত্রে নিজে জেতা ও অপরকে ঠকানোর কূটকৌশল এমন তাবে চালিয়ে যাচ্ছিলো যেন কোনো কালেও তাদের পুনরুজ্জীবিত হয়ে এ সবের জন্য জবাবদিহি করতে হবে বলে তারা ভাবতেই পারে না। বস্তুত এটা একটা আশ্চর্য আচরণ এবং একটা বিশ্বয়কর কর্মকান্ড ।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-১০

وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَۙ

সেদিন মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য ধ্বংস সুনিশ্চিত,

ফী জিলালিল কুরআন:

দুর্নীতিবাজদের পরিণতি : সূরার প্রথমাংশে এই নিজে জেতা ও অপরকে ঠকানো ধোকাবাজ ব্যবসায়ীদেরকে ‘মোতাফ্ফিফীন’ তথা ঠগবাজ ফড়িয়া আখ্যায়িত করে দ্বিতীয় অংশে তাদেরকে ‘ফুজজার’ তথা পাপিষ্ঠ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এদেরকে পাপীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর মতামত কি, তাদের বর্তমান অবস্থা কি এবং কেয়ামতের দিন তাদের জন্য কি পরিণাম অপেক্ষা করছে এ সকল প্রশ্নের জবাব রয়েছে এই দ্বিতীয় অংশে । ‘সাবধান! পাপীদের আমলনামা সিজ্জীনে রয়েছে। সিজ্জীন কী তা কি তুমি জানো? তা হচ্ছে একটা লিখিত পুস্তক ৷ কর্মফল দিবসকে যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাদের জন্যে সেদিন ধ্বংস অবধারিত । সেদিনটিকে সীমা অতিক্রমকারী মহাপাপী ছাড়া আর কেউ মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না। যখন তার সামনে আমার আয়াতগুলো পড়া হয়, অমনি সে বলে ওঠে, ‘এতো প্রাচীন লোকদের কাহিনী ।’ কখনো নয়! আসলে তাদের অর্জিত পাপকাজসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। মনে রেখো, তাদেরকে সেদিন তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হবে। তারপর তারা জাহান্নামে ঢুকবে। তারপর তাদেরকে বলা হবে, “তোমরা যে সব জিনিসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে এই যে তা উপস্থিত” কেয়ামতের দিনে পুনরুজ্জীবিত হতে হবে এ কথা তারা বিশ্বাস করতো না বলেই কোরআন তাদেরকে এভাবে ধমক দিচ্ছে এবং ভৎর্সনা করছে। কোরআন তাদেরকে নিশ্চিত করছে যে, তাদের সমস্ত তৎপরতার হিসাব রাখার জন্য একটি রেজিস্টার রয়েছে! তাদের সেই লেখা রেজিস্টার যেদিন খোলা হবে, সেদিন তাদের শোচনীয় পরিণতি ও ধ্বংস সংঘটিত হবে বলে ভীতি প্রদর্শন করছে। ‘সাবধান! পাপীদের আমলনামা রয়েছে সিজ্জীনে ৷ ফুজ্জার’ (পাপীরা) শব্দ দ্বারা এমন পাপীদেরকে বুঝানো হয় যারা পাপ কাজ করতে গিয়ে কোনো সীমা-সরহদ্দ মানে না। আর তাদের ‘কেতাব’ হচ্ছে তাদের আমলনামা । এই রেজিস্টার বা আমলনামাটি কিরূপ তা আমরা জানি না, জানবার দায়িত্বও আমাদের নেই। এটা একটা অদৃশ্য বা গায়বী বিষয় যার সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যতোটুকু জানিয়েছেন তার চেয়ে বেশী আমরা জানি না। পাপীদের কর্মকান্ডের রেজিস্টার সম্পর্কে কোরআন বলছে, তা সিজ্জীনে আছে। তারপর কোরআনের ভাষায় তাকে ভয়াবহ ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে ধরা হয়েছে এই বলে যে, ‘সিজ্জীন কী তা কি তুমি জানো?’ এ প্রশ্ন দ্বারা, তার একটা নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করা দ্বারা এই আমলনামার সত্যতা সম্পর্কে শ্রোতার বিশ্বাস দৃঢ়তর করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিষয়টিকে এই সীমিত তথ্য সহকারে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এটাই। এরপর পাপীদের আমলনামার আরো বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে, তা একটা লিখিত বই । অর্থাৎ চূড়ান্ত রেজিস্টার । তা থেকে আর কিছু কমানোও যাবে না, বাড়ানোও যাবে না। কেয়ামতের দিন রেজিস্টার খোলার আগ পর্যন্ত তা এ অবস্থাতেই বহাল থাকবে হবে ।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-১৭

ثُمَّ یُقَالُ هٰذَا الَّذِیْ كُنْتُمْ بِهٖ تُكَذِّبُوْنَؕ

এরপর তাদেরকে বলা হবে, এটি সেই জিনিস যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে।

ফী জিলালিল কুরআন:

কি জিনিসকে অস্বীকার করে এবং কেমন স্বভাব চরিত্রের লোকেরা অস্বীকার করে তার বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যারা কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে, আর সীমা অতিক্রমকারী মহাপাপী ছাড়া কেউ সেই দিনকে অস্বীকার করে না। যখন আমার আয়াতগুলো তার সামনে তেলাওয়াত করা হয় তখন বলে, এতো হচ্ছে প্রাচীন কালের মানুষের গল্পগুজব ।’ এ থেকে বুঝা যায় যে, পাপাসক্তি ও সীমালংঘনের প্রবণতা মানুষকে কেয়ামত অস্বীকৃতির দিকে টেনে নিয়ে যায়৷ শুধু তাই নয়, ওটা তাকে কোরআনের সাথেও বেয়াদবী করতে প্ররোচিত করে। তাই সে কোরআনের আয়াতগুলো যখন পড়া হয়, তখন তাকে প্রাচীনকালের গল্পগুজব বলে আখ্যায়িত করে। কোরআনে প্রাচীনকালের লোকদের কিছু ঘটনা শিক্ষা ও উপদেশ প্রদানের লক্ষ্যে বর্ণিত হয়েছে বলেই তারা এ কথা বলে। এসব শিক্ষামূলক কিসসা কাহিনী মানুষকে আল্লাহর শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে অবহিত করে। সে সব কিসসা কাহিনী মানুষকে এক অলংঘনীয় ও শাশ্বত বিধানের সন্ধান দেয়। এই অস্বীকৃতি ও উদাসীনতা এবং অস্বীকারকারীদের মনের বৈকল্যের কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ‘কখনো নয়।’ অর্থাৎ তারা যা বলে তা নয়; বরং তাদের কৃত অপকর্মের দরুন তাদের অন্তরে মরিচা ধরে গেছে।’ অর্থাৎ তাদের কৃত পাপ কাজ তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। পাপ কাজের দরুন অন্তর বিকল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । এর কারণে অন্তরের ওপর মোটা পর্দা পড়ে যায়, যার দরুন হেদায়াতের আলো তার ওপর প্রতিফলিত হয় না। ফলে তার অনুভূতি শক্তি ক্ষীণ হতে হতে এক সময় তা একেবারেই মৃত হয়ে যায় । হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রসূল (স.) বলেন, ‘বান্দা যখন একটি গুনাহর কাজ করে, তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে৷ এরপর যদি সে তওবা করে, তবে তৎক্ষণাৎ তা তার মন থেকে মুছে যায় । আর যদি আরো পাপ কাজ করে, তবে তা আরো বেড়ে যায়।’ (ইবনে জারীর, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ) । নাসায়ীর বর্ণনাটি এ রকম, ‘বান্দা যখন একটি গুনাহর কাজ করে, তখন তার মনে একটা কালো বিন্দু পড়ে যায়। এরপর সে যদি ওই কাজ পরিত্যাগ করে, তাওবা করে ও মাফ চায়, তার মনকে পরিষ্কার করে দেয়া হয়। আর যদি সে গুনাহর কাজের পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে কালো বিন্দু বেড়ে যেতে থাকে । অবশেষে তা গোটা হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে । এটাই হচ্ছে আল্লাহর কেতাবে বর্ণিত মরিচা আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কখনো নয়! বরং তাদের মনে তাদের কৃতকর্মের দরুন মরিচা ধরে গেছে । হাসান বসরী বলেন, ‘গুনাহর পর গুনাহ করতে করতে অন্তর অন্ধ হয়ে যায় এবং অবশেষে মরে যায় । ওপরে অস্বীকারকারী পাপীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে । আর এখানে পাপ ও অস্বীকৃতির কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। অতপর সেই ভয়ংকর দিনে পাপীদের পরিণতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, যা পাপাচার ও আখেরাত অস্বীকৃতির কারণের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ কখনো নয়, নিশ্চয়ই তারা সেদিন তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আড়ালে থাকবে, তারপর জাহান্নামে ঢুকবে, তারপর তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যে দিনকে অস্বীকার করতে, তা এখন উপস্থিত ।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-২৪

تَعْرِفُ فِیْ وُجُوْهِهِمْ نَضْرَةَ النَّعِیْمِۚ

তাদের চেহারায় তোমরা সচ্ছলতার দীপ্তি অনুভব করবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

নেককারদের সফলতা :  এরপরে অবতারণা করা হয়েছে পুণ্যবানদের সম্পর্কে আলোচনা । পরস্পর বিরোধী দুই শ্রেণীর ব্যাপারে তুলনামূলক আলোচনা করা কোরআনের একটি রীতি ৷ এতে করে দু’টি বাস্তবতা, দুটি পরিস্থিতি ও দুটি পরিণতি সম্পর্কে পেশ করা তুলনা পূর্ণাংগ হতে পারে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “কখনো নয়, সৎ ও পুণ্যবান লোকদের আমলনামা থাকবে ইল্লিয়্যীনে ৷ তুমি কি জানো ইল্লিয়্যীনটা কী জিনিস? সেটি তো হচ্ছে লিখিত পুস্তক ৷ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা তা প্রত্যক্ষ করবে। নিশ্চয়ই পুণ্যবানরা প্রাচুর্যের মধ্যে থাকবে। বালিশে হেলান দিয়ে তাকাতে থাকবে ৷ তুমি তাদের মুখমন্ডলে প্রত্যক্ষ করবে প্রাচুর্যজনিত প্রফুল্পতা ৷ ……..” আলোচনার শুরু হয়েছে (কাল্লা) শব্দ দিয়ে, যার অর্থ ‘কখনো নয়।’ এটা পূর্ববর্তী বাক্যে যে অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাসের উল্লেখ রয়েছে, সেটিকে খন্ডন করার অর্থ প্রকাশ করে। এরপর পুণ্যবানদের সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চয়তা ও দৃঢ়তা সহকারে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। পাপীদের আমলনামা থাকবে সিজ্জীনে, আর পুণ্যবানদের আমলনামা থাকবে ইল্লিয়ীনে ! ‘আবরার’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে যারা যাবতীয় সৎকাজ ও পুণ্যের কাজে নিয়োজিত থাকে। এরা সেই সব ফুজ্জারের ঠিক বিপরীত, যারা পাপাচারের সকল সীমা অতিক্রম করে। ‘ইল্লিয়্যীন’ শব্দটি উচ্চতা অর্থবোধক । এ দ্বারা ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সিজ্জীন নিম্নতা নির্দেশক । এরপর বিষয়টির গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘তুমি কি জানো ইল্লিয়্যীন কী?’ এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, এটা মানবীয় জ্ঞান ও বুদ্ধির উর্ধের ব্যাপার। পরবর্তী আয়াতে পুণ্যবাদের আমলনামার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে ‘একখানা লিপিবদ্ধ পুস্তক, যা ঘনিষ্ঠজনেরা প্রত্যক্ষ করবে ।’ ‘মারকুম’ অর্থ যে লিপিবদ্ধ তা আগেই বলা হয়েছে। আর এখানে এ তথ্যও সংযোজন করা হচ্ছে যে, ঘনিষ্ঠ ফেরেশতারা এই আমলনামা দেখবে ৷ এ বর্ণনাটি পুণ্যবানদের আমলনামা সম্পর্কে একটা উচ্চ স্তরের, মহৎ ও পবিত্র ধারণার সৃষ্টি করে। বস্তুত এই আমলনামা আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদের দেখার মতো জিনিস এবং পরম আদর ও শ্রদ্ধার বিষয় । কারণ তাতে তো কেবল মহৎ ও পুণ্যকর্ম এবং সদগুণাবলীর বিবরণ থাকে । বস্তুত এটি একটি মহৎ ও স্বচ্ছ রূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই এর উল্লেখ করা হচ্ছে। পরবর্তী আয়াতে কেয়ামতের দিন পুণ্যবানদের অবস্থা কী হবে, কিরূপ প্রাচুর্য ও সুখ শান্তিতে তারা থাকবে, তা বর্ণনা করা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই পুণ্যবানরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে থাকবে৷’ অর্থাৎ তারা সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে। যেদিক খুশি তাকাবে, কোনো কষ্ট বা বিব্রতকর বোধের কারণে তাদের চোখ বুঁজে থাকতে বা দৃষ্টি সংযত করতে হবে না। ‘আরায়েক’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে গদি সজ্জিত খাট বা পালংক। পার্থিব জৌলুসের দিক দিয়ে এটি তৎকালীন নীরস আরব্য জীবনে সবচেয়ে উঁচুমানের প্রাচুর্য ও বিলাসিতার দ্রব্য বলে পরিগণিত ছিলো । তবে পরকালীন জৌলুসের দিক দিয়ে এটি কি ধরনের, সেটা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। শুধু এতটুকু বলা যায় যে, পার্থিব অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনার আলোকে মানুষ যতো উঁচু স্তরের বিলাসদ্রব্য কল্পনা করতে পারে, এটা তার চেয়েও উঁচু স্তরের জিনিস। এই প্রাচুর্য ও সুখ সমৃদ্ধির ভেতরে থেকে তারা দৈহিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে পরম আনন্দ, তৃপ্তি ও প্রফুল্লতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে, তাদের মুখমন্ডল ও বাহ্যিক অবয়ব থেকে উৎফুল্লতা ঠিকরে পড়বে । ফলে তাদেরকে যে-ই দেখবে, বলবে, তাদের মুখমন্ডলে প্রাচুর্যজনিত আনন্দ ও উৎফুল্পতা দেখা যায়।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-২৮

عَیْنًا یَّشْرَبُ بِهَا الْمُقَرَّبُوْنَؕ

এটি একটি ঝরণা, নৈকট্য লাভকারীরা এর পানির সাথে শরাব পান করবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

রাহীকুল মাখতুম : ‘তাদেরকে পান করানো হবে সিল করা ‘রাহীক’ থেকে, যাতে মেশ্ক মিশ্রিত ছিপি আটা থাকবে।’ ‘রাহীক’ হচ্ছে নির্ভেজাল ও বিশুদ্ধ পানীয়, যাতে কোনো মলীনতা ও মিশ্রণ নেই। এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে যে, তাতে মেশ্‌ক দিয়ে সিল মারা বা ছিপি আঁটা থাকবে ৷ এ দ্বারা পানীয় সংরক্ষণের পাত্রও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে এবং এই সব পাত্র হয়তো সিল মারা ও বন্ধ থাকবে, যা কেবল পান করার সময় খোলা হবে । এ বর্ণনা দ্বারা এই ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, জিনিসটি অত্যন্ত সংরক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ । অনুরূপভাবে, মেশ্কের ন্যায় সুগন্ধিযুক্ত জিনিস কর্তৃক সিল মারা দ্বারা বুঝা যায় জিনিসটি হবে অত্যন্ত মূল্যবান ও উপকারী । এ বিষয়টিকে মানুষের পক্ষে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র পার্থিব ধারণা ও কল্পনার সীমানার মধ্যে যতোটুকু আয়ত্তে আসে, ততোটুকুই বুঝা সম্ভব৷ মানুষ যখন সেই স্থানে পৌছে যাবে, তখন তাদের সেখানকার উপযোগী রুচি ও বোধশক্তি জন্মাবে। সেই রুচি ও বোধশক্তি হবে সীমিত ইহকালীন পরিবেশের তুলনায় বিশাল, প্রশস্ত ও সীমাহীন । এই পানীয়ের বিবরণ শেষ হবার আগে পরবর্তী দুটি আয়াতে আরো একটি তথ্য সংযোজন করা হচ্ছে যে, ‘তাসনীম’ থেকে তার মিশ্রণ ঘটবে। ‘তাসনীম’ হচ্ছে ঘনিষ্ঠজনদের পান করার ঝর্ণা । অর্থাৎ উক্ত সিলমারা পানীয় থোলা হবে । অতপর তাসনীম নামক ঝর্ণা থেকে তাতে কিছু মেশানো হবে, যা ঘনিষ্ঠজনেরা পান করে থাকে । আর এর অব্যবহিত পরেই ইংগিত ও নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, ‘এই জিনিস নিয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত ।’ বস্তুত এটি একটি সংক্ষিপ্ত ইংগিত হলেও তা প্রচুর তাৎপর্যবহ। একদিকে রয়েছে অন্যকে মাপে কম দেয়া ও নিজে পুরোপুরি মেপে আনা ঠগবাজ ও দুর্নীতিবাজ হারামখোর ব্যবসায়ীর দল, যারা মানুষের সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করে, আখেরাতের জবাবদিহী ও হিসাব নিকাশের পরোয়া করে না, কর্মফল দিবসের অস্তিত্ব মানে না এবং পাপের আধিক্য দ্বারা নিজেদের অন্তরকে কালিমাচ্ছন্ন করে ফেলে ৷ এরা প্রতিযোগিতা করে সমাজ তুচ্ছ পার্থিব সম্পদের জন্য । প্রত্যেকেই চেষ্টা করে যাতে অন্যকে পেছনে ফেলে নিজে সে জিনিস অথবা তার বৃহত্তর অংশ অর্জন করতে পারে। সে জন্য সে যুলুম করে, পাপ কাজ করে এবং নশ্বর পার্থিব সম্পদের জন্য যা কিছু করা সম্ভব তা করে। অথচ এ সব তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী জিনিসের জন্য প্রতিযোগিতা করা সমীচীন নয়। প্রতিযোগিতা করা উচিত আখেরাতের সেই অঢেল ও অমূল্য সম্পদ, দুর্লভ সম্মান ও মর্যাদা লাভের জন্য । কেননা ওটাই প্রতিযোগিতা করার উপযুক্ত জিনিস পার্থিব সম্পদ- তা সে যত বড় দামী ও সম্মানজনক হোক না কেন অর্জনের জন্য যারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তারা একটা ক্ষণস্থায়ী, তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের জন্য প্রতিযোগিতা করে। আল্লাহর কাছে দুনিয়ার মূল্য একটা মাছির ডানার সমানও নয়, কিন্তু আখেরাত তাঁর পাল্লায় খুবই ভারী। তাই প্রতিযোগিতা করার যোগ্য জিনিস যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা আখেরাত ছাড়া আর কিছু নয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আখেরাতের ব্যাপারে যারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তাদের সকলেরই মর্যাদা বাড়ে আর পার্থিব ব্যাপারে প্রতিযোগিতাকারীদের সকলেরই মর্যাদা কমে । আখেরাতের সুখ-সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের জন্যে কৃত চেষ্টা-সাধনা দুনিয়ার জীবনকেও বিশুদ্ধ করে, উন্নত করে এবং সকল দুনিয়াবাসীর জন্য তাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে। পক্ষান্তরে পার্থিব সম্পদের জন্য কৃত চেষ্টা-সাধনা পৃথিবীকে একটা নোংরা পুঁতিগন্ধময় আস্তাকুঁড়ে পরিণত করে, যেখানে কেবল পোকামাকড় কিলবিল করে এবং পরস্পরকে খাওয়ার চেষ্টা করে অথবা বিভিন্ন রকমের সরীসৃপ ও কীটপতংগ পূতপবিত্র পুণ্যবান লোকদের গায়ে নিরন্তর দংশন করে। আখেরাতের সম্পদ ও সুখ লাভের জন্যে প্রতিযোগিতা করলে তাতে দুনিয়া বিধ্বস্ত ও জীর্ণ হয় না। যদিও কোনো কোনো বিপথগামী লোক তাই মনে করে। ইসলাম তো দুনিয়াকে আখেরাতের শস্যক্ষেত্রে পরিণত করে৷ ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়ায় যোগ্যতা ও সততা সহকারে গঠনমূলক কাজ করার মাধ্যমে খেলাফতের দায়িত্ব পালন সত্যিকার মোমেনের কর্তব্য । এই খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার সময় তাকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর অনুগত থাকতে হবে। এটিকে পুরোপুরি আল্লাহর এবাদাতে পরিণত করতে হবে এবং একেই নিজের জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা নিজে এ কাজকেই মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সূরা আয যারিয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষ ও জীন জাতিকে আমার এবাদাত করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি ।'(২৭শ পারায় সূরা ‘আয যারিয়াতের’ তাফসীর দেখুন।) বস্তুত আল্লাহর এই উক্তি ‘এই বিষয় নিয়েই প্রতিযোগিতাকারীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত’ আসলে দুনিয়াবাসীকে দুনিয়ার খেলাফত ও উন্নয়নকাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের চক্ষু ও মনকে দুনিয়ার তুচ্ছ ও ক্ষূদ্র স্বার্থের অপর পারে প্রসারিত করতে উদ্বুদ্ধ করছে। এ উক্তি মানব জাতিকে পৃথিবীর নোংরা আস্তাকুঁড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে এই আস্তাকুঁড়ের উর্ধে পূতপবিত্র জগতের দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আহ্বান জানায়। মনে রাখতে হবে, মানুষের ইহকালীন জীবনের আয়ুষ্কাল সীমাবদ্ধ । পক্ষান্তরে পরকালে তার আয়ুঙ্কাল কতো দীর্ঘ, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এই পৃথিবীর সহায় সম্পদ সীমাবদ্ধ, কিন্তু বেহেশতের সহায় সম্পদের প্রাচুর্য ও বিস্তৃতি মানুষের কল্পনারও অতীত ৷ এই পৃথিবীর সম্পদ ও প্রাচুর্যের স্থায়িত্ব কতোটুকু, তা সর্বজনবিদিত । অথচ আখেরাতের সম্পদ ও প্রাচুর্য চিরস্থায়ী, সুতরাং এই দুই ধরনের কর্মক্ষেত্রে ও এই দুই ধরনের জীবন লক্ষ্যের মধ্যে বিরাট ব্যবধান বিদ্যমান।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-৩২

وَ اِذَا رَاَوْهُمْ قَالُوْۤا اِنَّ هٰۤؤُلَآءِ لَضَآلُّوْنَۙ

আর তাদেরকে দেখলে বলতো, এরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট।

ফী জিলালিল কুরআন:

মোমেনদের যারা ঠাট্টা করবে : মানুষ যেভাবে লাভ ক্ষতির হিসাব করে সে হিসাবেও উভয়ের মধ্যে কোনো মিল নেই । তবে সেটা যাই হোক, প্রতিযোগিতা আখেরাতকে নিয়েই করা উচিত৷ পুণ্যবান ও সৎ লোকদের জন্য আখেরাতে অপেক্ষমান সুখ ও প্রাচুর্যের বিবরণ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ৷ সম্ভবত এর উদ্দেশ্য কাফের ও পাপিষ্ঠদের পক্ষ থেকে যে গালিগালাজ, ঠাট্টাবিদ্রুপ, আস্ফালন ও তিরস্কার অচিরেই বর্ষিত হতে যাচ্ছে, তার জন্য মোমেনদেরকে প্রস্তুত করা। তাছাড়া জাহান্নামে বসে কাফেররা যখন পুণ্যবান মোমেনদের সুখ ঐশ্বর্য দেখবে, তখন মোমেনদের পক্ষ থেকে তারা যে পাল্টা বিদ্রুপ শুনবে, তার বিবরণ দিয়ে সূরার সমাপ্তি টানা ও এই বিবরণ দীর্ঘায়িত করার অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা মোমেনদেরকে দেখে ঠাট্টা করতো। তারা তাদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় টিপ্পনী ও ভেংচি কাটতো।…….আজ মোমেনরা কাফেরদেরকে ঠাট্টা করবে । বালিশে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকবে । কাফেররা যা করেছে, তারই ফল তারা ভোগ করছে তো?’ এখানে কোরআন মোমেনদের প্রতি কাফেরদের ঠাট্টা বিদ্রুপ, বেয়াদবী, অহংকার ও আস্ফালন এবং তাদেরকে বিপথগামী বলে মন্তব্য করার যে সব দৃশ্য তুলে ধরেছে, তা মক্কার বাস্তব অবস্থাই চিত্র । তবে বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন প্রজন্মে এগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। এমনকি আমাদের সমকালীন অনেকেই এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী । যেন এ সব আয়াত তাদের জীবনে সংঘটিত সেই সব ঘটনারই চিত্র ও বিবরণ তুলে ধরেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মোমেন ও পুণ্যবান লোকদের সাথে আচরণে পাপিষ্ঠ অপরাধী লোকদের ভূমিকা সর্বকালে ও সকল পরিবেশে এক ও অভিন্ন প্রকৃতির । ‘অপরাধীরা মোমেনদের ঠাট্টা বিদ্বপ করতো ‘ হা, দুনিয়ার জীবনে তারা এটা করতো বটে, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের সে পাট চুকে গেছে। এখন সহসাই তারা আখেরাতে উপস্থিত । পুণ্যবান লোকদের সুখ শাস্তি স্বচক্ষে দেখছে। দুনিয়াতে তাদের কি অবস্থা ছিলো তা তাদের বেশ মনে পড়ে! তারা মোমেনদেরকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো । এর কারণ ছিলো তাদের দারিদ্র ও দুঃখ-দৈন্য, অথবা আক্রমণ প্রতিহত করতে অক্ষমতা, অথবা অসভ্য মূর্খ লোকদের অশিষ্টাচারের সামনে নিজেদের ভদ্রতা বজায় রাখতে ধৈর্য অবলম্বন । এ সবই অপরাধী লোকদের হাসির উদ্রেক করে থাকে ৷ এ কারণে মোমেনদেরকে তারা হাসি-ঠাট্টার পাত্র মনে করে। তারা তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যায়, আর তাদের কষ্ট দেথে উপহাসের হাসি হাসে । অথচ মোমেনরা ধৈর্য ও ভদ্র আচরণ অব্যাহত রাখে। ‘তারা মোমেনদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় টিপ্পনী কাটে ও ভেংচি দেয়।’ অর্থাৎ চোখ দিয়ে কিংবা হাত দিয়ে ইশারার মাধ্যমে টিপ্পনী ও ভেংচি দেয়। অথচ নিজেদের পরিচিত অন্য কোনো পন্থায় মোমেনদেরকে উপহাস করে। এগুলো অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর বেয়াদবী ও অসভ্যপনা ৷ এগুলোর উদ্দেশ্য মোমেনদেরকে দাবিয়ে রাখা, তাদের মনে হীনতা ও বিব্রতবোধ জাগিয়ে রাখা। আর এসব ষন্ডাপান্ডারা তাদের সাথে উপহাস ছলে ভেংচি দেয় ও টিপ্ননী কাটে! ‘আর যখন তারা নিজেদের পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যায়, তখন পূর্ণ তৃপ্তি ও উল্লাস সহকারে ফিরে যায়।’ অর্থাৎ মোমেনদেরকে বিদ্রুপ, গালাগালি ও উত্ত্যক্ত করে যখন তাদের ইতর ও অভদ্র মন তৃপ্ত হয়, তখন উল্লসিত হয়ে ফিরে যায়। এতে কোনো অনুতাপ ও অনুশোচনা বোধ করে না। তারা কতো হীন ও জঘন্য আচরণ করলো তা অনুভবই করে না। এটি ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের এমন শোচনীয় ও মর্মান্তিক শূন্যাবস্থা যে, এ পর্যায়ে এসে বিবেক ও মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অপমৃত্যু ঘটে । ‘আর যখন তারা মোমেনদেরকে দেখে অমনি বলে যে, এরা বিপথগামী!’ এটা সত্যিই আরো বেশী বিষ্ময়কর। যাদের আপাদমস্তক পাপ ও অপরাধের নোংরামিতে কলুষিত, তারা কে সুপথগামী কে বিপথগামী এ নিয়ে আলোচনা করবে, মোমেনদেরকে দেখামাত্রই তাদেরকে বিপথগামী বলে মন্তব্য ঝাড়বে এবং তাচ্ছিল্যবশত ও অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে জোর দিয়ে এ কথা বলবে, এর চেয়ে বিষ্ময়কর ব্যাপার আর কিছু থাকতে পারে না। বস্তুত পাপাসক্ত মানুষের কুকর্ম ও কুকথার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। কোনো কথা বলতে তারা লজ্জাবোধ এবং কোনো কাজ করতে তারা সংকোচ বোধ করে না। মোমেনদের সাথে দেখা হতেই অপরাধীরা একথা বলা যে, ওরা বিপথগামী, এটা এ কথাই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, অপরাধ প্রবণতা, পাপাসক্তি ও অসততার প্রকৃতিই এমন যে, তা কোনো সীমা-সরহদ মানে না। এখানে কোরআন মোমেনদের, পক্ষ নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করে না। অপরাধীদের এ উক্তিটা যে কতো বড়ো নির্জলা মিথ্যা ও কতো নিম্নস্তরের মিথ্যা, সে ব্যাপারেও সে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয় না। কেননা ওটা একটা চরম উদ্ভট উক্তি, যা নিয়ে আলোচনা করাই সাজে না ‘ তবে সে তাদের দিকে অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের একটা বিদ্রুপ বান ছুঁড়ে দেয়, যারা কোনো বিষয়ে অনধিকার চর্চা করে এবং অনাহুতভাবে অজানা বিষয়ে নাক গলায়। সে বলে, ‘তাদেরকে মোমেনদের তত্ত্বাথধায়ক করে পাঠানো হয়নি ।’ অর্থাৎ তাদেরকে মোমেনদের অভিভাবক নিয়োগ করা হয়নি, তাদের রক্ষক ও প্রহরী করে পাঠানো হয়নি, তাদের অবস্থার মূল্যায়ন ও মর্যাদা নিরূপণের দায়িত্বও তাদেরকে দেয়া হয়নি। সুতরাং মোমেনরা বিপথগামী কি সুপথগামী, সে বিষয়ে রায় দেয়ার তারা কে? দুনিয়াতে অপরাধীরা কি আচরণ করতো তার উল্লেখ করেই এই উচ্চমার্গের বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের সমাপ্তি টানা হয়েছে। এ দৃশ্য এখানেই গুটিয়ে নেয়া হয়েছে যাতে মোমেনদের বেহেশতের অফুরন্ত সুখের রাজ্যে প্রবেশ করার বর্তমান দৃশ্যটি তুলে ধরা যায়! সে দৃশ্যটি হলো, “আজ মোমেনরা কাফেরদের প্রতি বিদ্বপ করবে, বালিশে হেলান দিয়ে দেখবে…..।” অর্থাৎ আজ যখন কাফেররা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আড়ালে লুকানো থাকবে, যখন এই আড়ালে থাকার কষ্ট তাদের মানব জন্মকে ব্যর্থ করে দেবে, যখন চরম অবমাননা ও লাঞ্ছনার সাথে জাহান্নামে পৌছে যাবে, আর সেখানে তাদেরকে বলা হবে, ‘এই তো সেই জিনিস যা তোমরা অস্বীকার করতে ।’ বস্তুত আজ অর্থাৎ কেয়ামতের দিন সেই দিন, যখন মোমেনরা বালিশে হেলান দিয়ে স্থায়ী সুখ ও শান্তির পরিবেশে কাফেরদের অসহায় অবস্থার দিকে চেয়ে থাকবে, তাসনীমে মিশ্রিত মেশক দ্বারা আবদ্ধ পাত্রের পানীয় পান করবে, আর এই অবস্থায় মোমেনরা কাফেরদের প্রতি বিদ্রুপ করবে। এ পর্যায়ে এসে কোরআন স্বীয় উচ্চমার্গের বিদ্রুপ ও কটাক্ষের পুনরাবৃত্তি করে বলে, ‘কাফেররা যা করেছে, তার প্রতিদান পেয়েছে তো?’ হা, তারা কি কৃতকর্মের প্রতিফল পেয়েছে? মূল আরবীতে ‘সওয়াব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ প্রতিফল বা প্রতিদান ৷ তবে প্রচলিত অর্থে এটি ভালো অর্থে অর্থাৎ শুভ প্রতিদান অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । কিন্তু তারা প্রচলিত অর্থে ‘সওয়াব’ অর্থাৎ শুভ প্রতিদান পায়নি। এ মুহূর্তে আমরা তাদেরকে জাহান্নামে দেখতে পাচ্ছি। তারা নিসন্দেহে তাদের কর্মফল ভোগ করছে। সেটাই তাদের ‘সওয়াব’ বটে! বস্তুত সওয়াব শব্দটিতে এখানে রয়েছে সূক্ষ্ম কটাক্ষ! এক মুহূর্ত আমরা এই দৃশ্যটির সামনে থামবো, যার আলোচনা কোরআন কিছুটা দীর্ঘায়িত করেছে। এটি হচ্ছে দুনিয়াতে অপরাধী ও পাপিষ্ঠদের পক্ষ থেকে মোমেনদের সাথে বিদ্রুপ ইতিপূর্বে সৎ লোকদের পুরস্কার ও পরকালীন সুখ সমৃদ্ধির বিবরণও কোরআন বিশদভাবে দিয়েছে। এর প্রভাব নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, এটা একটা উচ্চাংগের বাককৌশল ও নিপুণ বাচনভংগী ৷

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-৩৬

هَلْ ثُوِّبَ الْكُفَّارُ مَا كَانُوْا یَفْعَلُوْنَ۠

কাফেররা তাদের কৃতকর্মের “সওয়াব” পেয়ে গেলো তো?

ফী জিলালিল কুরআন:

মোমেনদের প্রতি আল্লাহর সান্তনা : অনুরূপভাবে এটা একটা উচ্চাংগের মনস্তাত্মিক চিকিৎসাও বটে । কেননা মক্কার সেই অতি ক্ষুদ্র মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মোশরেকদের পক্ষ থেকে এত নিষ্ঠুর নির্যাতন ভোগ করে আসছিলো যে, তা তাদের মনে গভীর ও প্রচন্ড ক্ষতের সৃষ্টি করে ফেলেছিলো ৷ অপর দিকে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাদেরকে কোনো সহায়তা, বা কোনো প্রবোধ ও সান্ত্বনা না দিয়ে ওইভাবে ফেলে রাখতে চাইছিলেন না। এই প্রেক্ষাপট দেখলে বুঝা যায় যে, মোশরেকদের পক্ষ থেকে মোমেনদের ওপর পরিচালিত নির্যাতন ও নিপীড়নের এই বিশদ বিবরণ (পবিত্র কোরআনের আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নাযিল হওয়া) তাদের মনোবেদনার কিছুটা উপশমের কারণ হতে পারে। এতে দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রভূ পরওয়ারদেগার নিজেই তাদের এই কষ্টের বিবরণ দিচ্ছেন । কেননা তিনি তা দেখতে পান এবং তাদের এই কষ্টকে তিনি অবহেলা করেন না। তিনি কাফেরদের সাময়িকভাবে অবকাশ দিয়েছেন, শুধুমাত্র এতটুকু উপলদ্ধিই মোমেনের মনকে প্রবোধ দান ও তার দুঃখ-বেদনা ও আঘাতকে নিরাময় করার জন্য যথেষ্ট । আল্লাহ তায়ালা দেখতে পান বিদ্রুপকারীরা কিভাবে তাদের সাথে বিদ্রুপ করে। অপরাধীরা কি নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকে নির্যাতন করে। আর তাদের দুঃখ ও কষ্ট দ্বারা তারা কিভাবে উল্লসিত হয় এবং কিছুমাত্র অনুতাপ ও অনুশোচনা বোধ করে না। এর কোনো কিছুই তাদের প্রভুর নযর এড়ায় না এবং তিনি তার ওইীতে তার বিবরণ দেন। তাহলে এটা তার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার! এতটুকুও কম কিসের? মোমেন হৃদয় যতই আঘাতে আঘাতে জর্জরিত, আহত ও ব্যথিত হোক না কেন, এই বিবরণই তার প্রবোধ দানের জন্য যথেষ্ট। এরপর তাদের প্রভু অপরাধীদের সাথে ভদ্র ভাষায় হলেও সুক্ষ বিদ্রুপ করে তাদের মনেও পাল্টা আঘাত হানেন। হয়তো তাদের পাপের কালিমায় আচ্ছন্ন মরিচা ধরা হৃদয়ে এটা অনুভুত নাও হতে পারে। কিন্তু মোমেনের সংবেদনশীল ও স্বচ্ছ মন তা অনুভব ও হৃদয়ংগম করে এবং সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভ করে! এরপর মোমেনদের মানসচক্ষুতে এটাও দেখানো হয় যে, তাদের প্রভুর কাছে তাদের কেমন আদর-যত্ন হবে। তার বেহেশতে তাদের কিরূপ সুখ-শান্তির ব্যবস্থা থাকবে। ফেরেশতাদের উচ্চতর মহলে তাদের সম্মান ও মর্যাদা কতো । অপরদিকে সেই উচ্চ মহলে তাদের দুশমনদের কি দুর্গতি ও অপমান এবং জাহান্নামে তাদের কি লাঞ্ছনাকর শাস্তি হবে তাও দেখানো হয়। একজন মোমেন পাশাপাশি এই দুটি দৃশ্যকেই সবিস্তারে দেখতে পায়। সে এ উভয় পরিণতি শুধু অনুভবই করে না বরং নিশ্চিত বিশ্বাস দ্বারা এর স্বাদ উপভোগও করে। আর এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই উভয় দৃশ্যের স্বাদ উপভোগ তার অন্তরের সেই তীব্র জ্বালা যন্ত্রনা ও তিক্ততা দূর করে দেয়, যা গালিগালাজ, কটূক্তি, কটাক্ষ, ঠাট্টা বিদ্রূপ এবং সংখ্যা-স্বল্পতা ও দুর্বলতা হেতু সৃষ্টি হয়েছিলো। এমনকি এটাও বিচিত্র নয় যে, স্বয়ং মহান আল্লাহর বর্ণনায় এ দৃশ্যাবলী উপভোগ করার পর কোনো কোনো মোমেনের হৃদয়ে নির্যাতন-নিপীড়নজনিত এই তিক্ততা মিষ্টতায় রূপাস্তরিত হয়ে যেতে পারে। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখের দাবী রাখে । সেটি এই যে, কাফের ও মোশরেকদের পক্ষ থেকে মুসলমানরা যে পাশবিক নির্যাতন ও মানসিক নিপীড়ন ভোগ করতো, যে নিষ্ঠুর কটুক্তি ও বর্বরোচিত উপহাসে জর্জরিত হতো, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার একমাত্র সান্তনা এটাই দেয়া হয়েছিলো যে, মোমেনদের জন্যে জান্নাত রয়েছে, আর কাফেরদের জন্যে জাহান্নাম । অন্য কথায়, দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে তাদের উভয় গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে উপনীত হওয়া ৷ রসূল(স.)-এর হাতে হাত দিয়ে যারা জান ও মাল আল্লাহর হাতে ব্যয় করার প্রতিজ্ঞা করে বাইয়াত করছিলেন, তাদের থেকে তিনি কেবল এই একটি মাত্র ওয়াদাই নিয়েছিলেন। পার্থিব জীবনের সাফল্য ও বিজয়ের কথা কোরআনের মক্কী অংশে মোমেনদের সান্তনা ও প্রবোধ দেয়ার জন্যে ঘুর্ণাক্ষরেও উল্লেখ করা হয়নি। বস্তুত কোরআন একদল মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের এই আমানত বহন করার যোগ্য করে গড়ে তোলার কাজে ব্যাপৃত ছিলো। এই মানুষগুলোর মন এত মযবুত, এত দৃঢ় ও এত নিঃস্বার্থ হওয়া প্রয়োজন ছিলো, যেন তারা সব কিছু হারিয়েও এবং সকল দুর্ভোগ মাথা পেতে নিয়েও এই পার্থিব জীবনে কোনো প্রতিদান পাওয়ার আশা না করে। তারা যেন কোন অবস্থাতেই আখেরাতের শান্তি ও আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুর প্রত্যাশা না করে। তাদের মন-মানস যেন দুনিয়ার জীবনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও এবং সকল দুঃখ কষ্ট, নির্যাতন, বঞ্চনা ও ত্যাগ তিতিক্ষার পরও এই দুনিয়াতে অচিরেই কোনো পুরস্কার পেতে অভিলাষী না হয়, এমনকি সেই ত্যাগ ও সংগ্রামের ফলে আন্দোলনের সাফল্য, ইসলামের বিজয় এবং মুসলমানদের প্রতিষ্ঠা যদি অবধারিত হয়েও দেখা দেয়, তবু সেটাই যেন তাদের লক্ষ্য না হয়! দুনিয়ার জীবনে কোনো বিনিময় বা প্রতিদান ছাড়াই কেবল যে ত্যাগ স্বীকার করে যেতে হবে, শুধুমাত্র আখেরাতেই যে পুরস্কার পাওয়া যাবে এবং সত্য ও মিথ্যার ফায়সালা হবে সে কথা জেনেও এই সত্য সংগ্রামী দলটি যখন সংগ্রামের দায়িত্ব পালন করবে এবং আল্লাহ তায়ালা তার বাইয়াত ও ওয়াদার যথার্থতা ও নিয়তের একনিষ্ঠতায় সন্তুষ্ট হবেন, তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা একদিন দেখবে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াতেই সাহায্য এসে পড়েছে। তখন তারা এ সাহায্য ও বিজয়কেও নিজেদের ভোগের সামগ্রী হিসাবে নয় বরং আল্লাহর দেয়া আমানত হিসাবে গ্রহণ করবে। তাদের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়িত করা। বস্তুত এ কাজটিই হবে আমানতের প্রতি যথার্থ সুবিচার । কেননা তাকে এর বিনিময়ে কখনো দুনিয়ার কোনো স্বার্থ উদ্ধারের সুযোগ দেয়া হবে বলে ওয়াদা করা হয়নি। তাই তারা তার প্রত্যাশাও করে না। তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই কাজ করেছে। তাই তার সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছু তারা চায় না। দুনিয়ায় বিজয় ও সাফল্যের উল্লেখ করে যে সব আয়াত নাযিল হয়েছে, তার সবই নাযিল হয়েছে মদীনায় । তার পরে এবং মোমেনের মন থেকে এই পার্থিব বিজয় ও সাফল্যের সকল আশা ও প্রতীক্ষা পরিত্যক্ত হবার পর বিজয় এসেছে স্বতস্ফূর্তভাবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং চেয়েছেন যে, তার এই সুমহান আদর্শ মানব জীবনে বাস্তবায়িত হোক, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে! এটা ত্যাগ, কোরবানী ও দুঃখ যাতনা ভোগের পুরস্কার ছিলো না, বরং আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা ছিলো। যার পেছনে বহু সূক্ষ ও সুদূরপ্রসারী কল্যাণ কামনা সক্রিয় ছিলো। সেই সূক্ষ কল্যাণ কামনা কি ছিলো, সেটা এখন আমরা বুঝবার চেষ্টা করতে পারি।

# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৮৩-মুতাফফিফীন) : নামকরণ:

প্রথম আয়াত وَيُلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

(৮৩-মুতাফফিফীন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এই সূরার বর্ণনাভঙ্গী ও বিষয়বস্তু থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এটি মক্কা মু’আয্যমায় প্রথম দিকে নাযিল হয়। সে সময় আখেরাত বিশ্বাসকে মক্কাবাসীদের মনে পাকা-পোক্তভাবে বসিয়ে দেবার জন্য একের পর এক সূরা নাযিল হচ্ছিল। সূরাটি ঠিক তখনই নাযিল হয় যখন মক্কার লোকেরা পথে-ঘাটে-বাজারে-মজলিসে-মাহফিলে মুসলমানদেরকে টিটকারী দিচ্ছিল এবং তাদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করছিল। তবে জুলুম, নিপীড়ন ও মারপিট করার যুগ তখনো শুরু হয়নি। কোন কোন মুফাস্সির এই সূরাকে মদীনায় অবতীর্ণ বলেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর নিম্নোক্ত বর্ণনাটিই মূলত এ ভুল ধারণার পেছনে কাজ করছে। তিনি বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় এলেন তখন এখানকার লোকদের মধ্যে ওজনে ও মাপে কম দেবার রোগ ভীষণভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। তখন আল্লাহ নাযিল করেন وَيُلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ সূরাটি। এরপর থেকে লোকেরা ভালোভাবে ওজন ও পরিমাপ করতে থাকে। (নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে মারদুইয়া, ইবনে জারীর, বাইহাকী ফী শু’আবিল ঈমান) কিন্তু যেমন ইতিপূর্বে সূরা দাহারের ভূমিকায় আমি বলে এসেছি, সাহাবা ও তাবেঈগণ সাধারণত কোন একটি আয়াত যে ব্যাপারটির সাথে খাপ খেতো সে সম্পর্কে বলতেন, এ আয়াতটি এ ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। কাজেই ইবনে আব্বাস (রা.)- এর রেওয়ায়াত থেকে যা কিছু প্রমাণ হয় তা কেবল এতটুকু যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের পরে যখন মদীনার লোকদের মধ্যে এ বদঅভ্যাসটির ব্যাপক প্রসার দেখেন তখন আল্লাহর হুকুমে তাদের এ সূরাটি শুনান এবং এর ফলে তারা সংশোধিত হয়ে যায়।

(৮৩-মুতাফফিফীন) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এর বিষয়বস্তুও আখেরাত।

ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সাধারণ বেঈমানীটির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল প্রথম ছ’টি আয়াতে সে জন্য তাদের পাকড়াও করা হয়েছে। তারা অন্যের থেকে নেবার সময় ওজন ও মাপে পুরো করে নিতো। কিন্তু যখন অন্যদেরকে দেবার সময় আসতো তখন ওজন ও মাপে প্রত্যেককে কিছু না কিছু কম দিতো। সমাজের আরো অসংখ্য অসৎকাজের মধ্যে এটি এমন একটি অসৎকাজ ছিল যার অসৎ হবার ব্যাপারটি কেউ অস্বীকার করতে পারতো না। এ ধরনের একটি অসৎকাজকে এখানে দৃষ্টান্ত স্বরূপ পেশ করে বলা হয়েছে। এটি আখেরাত থেকে গাফেল হয়ে থাকার অপরিহার্য ফল। যতদিন লোকদের মনে এ অনুভূতি জাগবে না যে, একদিন তাদের আল্লাহর সামনে পেশ হতে হবে এবং সেখানে এক এক পাইয়ের হিসেব দিতে হবে ততদিন তাদের নিজেদের কাজ-কারবার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে পূর্ণ সততা অবলম্বন সম্ভবই নয়। সততা ও বিশ্বস্ততাকে “উত্তম নীতি” মনে করে কোন ব্যক্তি কিছু ছোট ছোট বিষয়ে সততার নীতি অবলম্বন করলেও করতে পারে কিন্তু যেখানে বেঈমানী একটি “লাভজনক নীতি” প্রমাণিত হয় সেখানে সে কখনই সততার পথে চলতে পারে না। মানুষের মধ্যে একমাত্র আল্লাহর ভয়ে ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের ফলেই সত্যিকার ও স্থায়ী সত্যতা বিশ্বস্ততা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ এ অবস্থায় সততা একটি “নীতি” নয়, একটি “দায়িত্ব” গণ্য হয় এবং দুনিয়ায় সততার নীতি লাভজনক হোক বা অলাভজনক তার ওপর মানুষের সততার পথ অবলম্বন করা বা না করা নির্ভর করে না।

এভাবে নৈতিকতার সাথে আখেরাত বিশ্বাসের সম্পর্ককে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও মনোমুগ্ধকর পদ্ধতিতে বর্ণনা করার পর ৭ থেকে ১৭ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতিকারীদের কাজের বিবরণী প্রথমেই অপরাধজীবীদের রেজিষ্টার (Black list) লেখা হচ্ছে এবং আখেরাতে তাদের মারাত্মক ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হবে। তারপর ১৮ থেকে ২৮ পর্যন্ত আয়াতে সৎলোকদের উত্তম পরিণামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের আমলনামা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোকদের রেজিষ্টারে সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতারা এ কাজে নিযুক্ত রয়েছেন।

সবশেষে ঈমানদারদেরকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে এবং এই সংগে কাফেরদেরকে এই মর্মে সতর্কও করে দেয়া হয়েছে যে, আজ যারা ঈমানদারদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করার কাজে ব্যাপৃত আছে কিয়ামতের দিন তারা অপরাধীর পর্যায়ে থাকবে এবং নিজেদের এ কাজের অত্যন্ত খারাপ পরিণাম দেখবে। আর সেদিন এ ঈমানদাররা এ অপরাধীদের খারাপ ও ভয়াবহ পরিণাম দেখে নিজেদের চোখ শীতল করবে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,

وَیْلٌ لِّلْمُطَفِّفِیْنَۙ

ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়।১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) মূলে مُطَفِّفِيْنَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি এসেছে تَطْفِيْفِ থেকে। আরবী ভাষার তাফীফ طَفِيْف ছোট্ট, তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসকে বলা হয়ে থাকে। পারিভাষিক অর্থে তাফীফ মানে হচ্ছে মাপে ও ওজনে চুরি করা। কারণ এ কাজ করার সময় এক ব্যক্তি মাপ ও ওজনের মাধ্যমে কোন বড় পরিমাণ জিনিস চুরি করে না। বরং হাত সাফাইয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক ক্রেতার অংশ থেকে সামান্য সামান্য করে বাঁচিয়ে নেয়। ফলে বিক্রেতা কি জিনিস কতটুকু চুরি করেছে ক্রেতা তা টেরও পায় না।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-3
টিকা নং:2,

وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ یُخْسِرُوْنَؕ

এবং তাদেরকে ওজন করে বা মেপে দেবার সময় কম করে দেয়।২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২) কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে ওজনে ও মাপে কম করার কঠোর নিন্দা এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাণ করার জন্য কড়া তাগিদ করা হয়েছে। সূরা আন’আমে বলা হয়েছেঃ “ইনসাফ সহকারে পুরো ওজন ও পরিমাপ করো। আমি কাউকে তার সামর্থ্যের চাইতে বেশীর জন্য দায়িত্বশীল করি না।” ( ১৫২ আয়াত ) সূরা বনী ইসরাঈলে বলা হয়েছেঃ “মাপার সময় পুরো মাপবে এবং সঠিক পাল্লা দিয়ে ওজন করবে।” ( ৩৫ আয়াত ) সূরা রহমানে তাগিদ করা হয়েছেঃ “ওজনে বাড়াবাড়ি করো না, ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না। ( ৮-৯আয়াত) শো’আইবের সম্প্রদায়ের ওপর এ অপরাধের কারণে আযাব নাযিল হয় যে, তাদের মধ্যে ওজনে ও মাপে কম দেবার রোগ সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং হযরত শো’আইব (আ) –এর বারবার নসীহত করা সত্ত্বেও এ সম্প্রদায়টি এ অপরাধমূলক কাজটি থেকে বিরত থাকেনি।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-4
টিকা নং:3,

اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓئِكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَۙ

এরা কি চিন্তা করে না, এদেরকে উঠিয়ে আনা হবে?৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৩) কিয়ামতের দিনটিকে মহাদিবস হিসেবে উপস্থাপিত করে বলা হয়েছেঃ সেদিন আল্লাহর আদালতে সকল জিন ও মানুষের কাজের হিসেব নেয়া হবে একই সঙ্গে এবং আযাব ও সওয়াব দানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ফায়সালা করা হবে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-7
টিকা নং:4, 5,

كَلَّاۤ اِنَّ كِتٰبَ الْفُجَّارِ لَفِیْ سِجِّیْنٍؕ

কখ্খনো নয়,৪ নিশ্চিতভাবেই পাপীদের আমলনামা কয়েদখানার দফতরে রয়েছে।৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) অর্থাৎ দুনিয়ায় এ ধরনের অপরাধ করার পর তারা এমনি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে এবং কখনো এদের আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার জন্য হাযির হতে হবে না, তাদের এ ধারণা একেবারে ভুল।

টিকা:৫) আসলে সিজ্জীন سِجِّيْنُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি এসেছে সিজন سِجْن থেকে। সিজন মানে জেলখানা বা কয়েদখানা। সামনের দিকে যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা থেকে জানা যায়, এর অর্থ হচ্ছে এমন ধরনের রেজিষ্টার খাতা যাকে শাস্তিলাভ যোগ্য লোকদের আমলনামা লেখা হচ্ছে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-13
টিকা নং:6,

اِذَا تُتْلٰى عَلَیْهِ اٰیٰتُنَا قَالَ اَسَاطِیْرُ الْاَوَّلِیْنَؕ

তাকে যখন আমার আয়াত শুনানো হয় ৬ সে বলে, এ তো আগের কালের গল্প।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) অর্থাৎ যেসব আয়াতে বিচার দিনের খবর দেয়া হয়েছে সেই সব আয়াত।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-14
টিকা নং:7,

كَلَّا بَلْ١ٚ رَانَ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ مَّا كَانُوْا یَكْسِبُوْنَ

কখ্খনো নয়, বরং এদের খারাপ কাজের জং ধরেছে।৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) অর্থাৎ শাস্তি ও পুরস্কারকে গল্প বা উপকথা গণ্য করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু যে কারণে তারা একে গল্প বলছে তা হচ্ছে এই যে, এরা যেসব গোনাহ করতে থেকেছে এদের দিলে পুরোপুরি তার মরীচা ধরেছে। ফলে পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত কথাও এদের কাছে গল্প বলে মনে হচ্ছে। এই জং ও মরীচার ব্যাখ্যায় রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ বান্দা যখন কোন গোনাহ করে, তার দিলে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। সে তওবা করলে দাগটি উঠে যায়। কিন্তু যদি সে গোনাহ করে যেতেই থাকেই তাহলে সমগ্র দিলের ওপর তা ছেয়ে যায়। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে জারীর, হাকেম, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে হিব্বান ইত্যাদি)

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-15
টিকা নং:8,

كَلَّاۤ اِنَّهُمْ عَنْ رَّبِّهِمْ یَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوْبُوْنَؕ

কখ্খনো নয়, নিশ্চিতভাবেই সেদিন তাদের রবের দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখা হবে।৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৮) অর্থাৎ একমাত্র নেক লোকেরাই আল্লাহর সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করবে এবং পাপীরা তার থেকে বঞ্চিত হবে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল কিয়ামাহ ১৭ টীকা )

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-18
টিকা নং:9,

كَلَّاۤ اِنَّ كِتٰبَ الْاَبْرَارِ لَفِیْ عِلِّیِّیْنَؕ

কখ্খনো নয়,৯ অবশ্যি নেক লোকদের আমলনামা উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকদের দফতরে রয়েছে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৯) অর্থাৎ মানুষের ভালো ও মন্দ কাজের কোন পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে না, তাদের এ ধারণা একেবারেই ভুল।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-26
টিকা নং:10,

خِتٰمُهٗ مِسْكٌ١ؕ وَ فِیْ ذٰلِكَ فَلْیَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَؕ

তার ওপর মিশক-এর মোহর থাকবে।১০ যারা অন্যদের ওপর প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে চায় তারা যেন এই জিনিসটি হাসিল করার জন্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হবার চেষ্টা করে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) মূলে “খিতামুহু মিস্ক” خِتَامُهُو مِسْكٌ বলা হয়েছে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, যেসব পাত্রে এই শরাব রাখা হবে তার ওপর মাটি বা মোমের পরিবর্তে মিশ্কের মোহর লাগানো থাকবে। এ অর্থের দিক দিয়ে আয়াতের মানে হয়ঃ এটি হবে উন্নত পর্যায়ের পরিচ্ছন্ন শরাব। ঝরণায় প্রবাহিত শরাবের থেকে এটি বেশী উন্নত গুণাবলী সম্পন্ন হবে। জান্নাতের খাদেমরা মিশ্কের মোহর লাগানো পাত্রে করে এনে এগুলো জান্নাতবাসীদের পান করাবে। এর দ্বিতীয় মানে হতে পারেঃ এই শরাব যখন পানকারীদের গলা থেকে নামবে তখন শেষের দিকে তারা মিশকের খুশবু পাবে। এই অবস্থাটি দুনিয়ার শরাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে শরাবের বোতল খোলার সাথে সাথেই একটি বোটকা গন্ধ নাকে লাগে। পান করার সময়ও এর দুর্গন্ধ অনুভূত হতে থাকে এবং গলা দিয়ে নামবার সময় মস্তিস্কের অভ্যন্তরেও পচা গন্ধ পৌঁছে যায়। এর ফলে শরাবীর চেহারায় বিস্বাদের একটা ভাব জেগে ওঠে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-27
টিকা নং:11,

وَ مِزَاجُهٗ مِنْ تَسْنِیْمٍۙ

সে শরাবে তাসনীমের১১ মিশ্রণ থাকবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) তাসনীম মানে উন্নত ও উঁচু। কোন ঝরণাকে তাসনীম বলার মানে হচ্ছে এই যে, তা উঁচু থেকে প্রবাহিত হয়ে নীচের দিকে আসে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-31
টিকা নং:12,

وَ اِذَا انْقَلَبُوْۤا اِلٰۤى اَهْلِهِمُ انْقَلَبُوْا فَكِهِیْنَ٘ۖ

নিজেদের ঘরের দিকে ফেরার সময় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফিরতো।১২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১২) অর্থাৎ একথা ভাবতে ভাবতে ঘরের দিকে ফিরতোঃ আজ তো বড়ই মজা। উমুক মুসলমানকে বিদ্রূপ করে, তাকে চোখা চোখা বাক্যবাণে বিদ্ধ করে বড়ই মজা পাওয়া গেছে এবং সাধারণ মানুষের সামনে তাকে চরমভাবে অপদস্থ করা গেছে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-32
টিকা নং:13,

وَ اِذَا رَاَوْهُمْ قَالُوْۤا اِنَّ هٰۤؤُلَآءِ لَضَآلُّوْنَۙ

আর তাদেরকে দেখলে বলতো, এরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট।১৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৩) অর্থাৎ এরা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। মুহাম্মাদ ﷺ এদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের চক্করে ফেলে দিয়েছেন। ফলে এরা নিজেরা নিজেদেরকে দুনিয়ার লাভ স্বার্থ ও ভোগ-বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে এবং সব রকমের আশঙ্কা ও বিপদ আপদের মুখোমুখি হয়েছে। যা কিছু এদের সামনে উপস্থিত আছে তা কেবল এ অনিশ্চিত আশায় ত্যাগ করছে যে, এদের সাথে মৃত্যুর পরে কি এক জান্নাত দেবার ওয়াদা করা হয়েছে, আর পরবর্তী জগতে নাকি কোন জাহান্নাম হবে, এদেরকে তার আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে এবং তার ফলেই এরা আজ এ দুনিয়ায় সবকিছু কষ্ট বরদাশ্ত করে যাচ্ছে।

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-33
টিকা নং:14,

وَ مَاۤ اُرْسِلُوْا عَلَیْهِمْ حٰفِظِیْنَؕ

অথচ তাদেরকে এদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি।১৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৪) এই ছোট বাক্যটিতে বিদ্রূপকারীদের জন্য বড়ই শিক্ষাপ্রদ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে অর্থাৎ ধরে নেয়া যাক মুসলমানরা যা কিছুর প্রতি ঈমান এনেছে সবকিছুই ভুল। কিন্তু তাতে তারা তোমাদের তো কোন ক্ষতি করছে না। যে জিনিসকে তারা সত্য মনে করেছে সেই অনুযায়ী তারা নিজেরাই একটি নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে। এখন বলো, আল্লাহ‌ কি তোমাকে কোন সেনা নায়ক বানিয়ে পাঠিয়েছেন? যে তোমাকে আক্রমণ করছে না তুমি তাকে আক্রমণ করছো কেন? যে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে না তুমি তাকে অযথা কষ্ট দিচ্ছো কেন? আল্লাহ‌ কি তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন?

সুরা: আল-মুতাফফিফীন
আয়াত নং :-36
টিকা নং:15,

هَلْ ثُوِّبَ الْكُفَّارُ مَا كَانُوْا یَفْعَلُوْنَ۠

কাফেররা তাদের কৃতকর্মের “সওয়াব” পেয়ে গেলো তো?১৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৫) এই বাক্যের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম বিদ্রূপ লুকিয়ে আছে যেহেতু কাফেররা সওয়াবের কাজ মনে করে মুসলমানদেরকে বিরক্ত করতো ও কষ্ট দিতো। তাই বলা হয়েছে, আখেরাতে মু’মিনরা জান্নাতের আরামে বসে বসে জাহান্নামে কাফেরদের আগুনে জ্বলতে দেখবে। তাদের এ অবস্থা দেখে মু’মিনরা মনে মনে বলতে থাকবে ওদের কাজের কেমন চমৎকর সওয়াব ওরা পেয়ে গেলো।

Leave a Reply