Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৪/হে মানুষ -২) [*  *মানবীয় সমাজে আসল মূল্যবোধ :- ঈমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করতে হবে:- *সত্যিকার ঈমান কি :-] www.motaher21.net সূরা:৪৯-হুজরাত। পারা:২৬ ১৩-১৮ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৪/হে মানুষ -২)
[*  *মানবীয় সমাজে আসল মূল্যবোধ :-
ঈমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করতে হবে:-
*সত্যিকার ঈমান কি :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৯-হুজরাত। পারা:২৬
১৩-১৮ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

সূরা:৪৯-হুজরাত:-১৩
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ ﴿۱۳﴾
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ‌ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।
সূরা:৪৯-হুজরাত:-১৪
قَالَتِ الۡاَعۡرَابُ اٰمَنَّا ؕ قُلۡ لَّمۡ تُؤۡمِنُوۡا وَ لٰکِنۡ قُوۡلُوۡۤا اَسۡلَمۡنَا وَ لَمَّا یَدۡخُلِ الۡاِیۡمَانُ فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ ؕ وَ اِنۡ تُطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ لَا یَلِتۡکُمۡ مِّنۡ اَعۡمَالِکُمۡ شَیۡئًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۴﴾
বেদুঈনরা বলে, ‘আমারা ঈমান আনলাম ’। বলুন, ‘তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমারা বল, ‘আমারা আত্নসমর্পণ করেছি’, কারণ ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর তবে তিনি তোমাদের আমলসমূহের সওয়াব সামান্য পরিমাণও লাঘব করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
সূরা:৪৯-হুজরাত:-১৫
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوۡا وَ جٰہَدُوۡا بِاَمۡوَالِہِمۡ وَ اَنۡفُسِہِمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الصّٰدِقُوۡنَ ﴿۱۵﴾
প্রকৃত ঈমানদার তারাই যারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করেনি। তারপর প্রাণ ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছে। তারাই সত্যবাদী।
সূরা:৪৯-হুজরাত:-১৬
قُلۡ اَتُعَلِّمُوۡنَ اللّٰہَ بِدِیۡنِکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۱۶﴾
বলুন, ‘তোমারা কি তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে আল্লাহকে অবগত করাচ্ছ? অথচ আল্লাহ জানেন যা কিছু আছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু আছে যমীনে। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।
সূরা:৪৯-হুজরাত:-১৭
یَمُنُّوۡنَ عَلَیۡکَ اَنۡ اَسۡلَمُوۡا ؕ قُلۡ لَّا تَمُنُّوۡا عَلَیَّ اِسۡلَامَکُمۡ ۚ بَلِ اللّٰہُ یَمُنُّ عَلَیۡکُمۡ اَنۡ ہَدٰىکُمۡ لِلۡاِیۡمَانِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۱۷﴾
তারা ইসলাম গ্রহণ করে তোমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। বল, ‘তোমাদের ইসলাম গ্রহণ আমাকে ধন্য করেছে মনে করো না; বরং আল্লাহ ঈমান (বিশ্বাসের) দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
সূরা:৪৯-হুজরাত:-১৮
اِنَّ اللّٰہَ یَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ اللّٰہُ بَصِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿٪۱۸﴾
আল্লাহ আসমান ও যমীনের প্রতিটি গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে জানেন। তোমরা যা কিছু করছো তা সবই তিনি দেখছেন।
১৩-১৮ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মানবীয় সমাজে আসল মূল্যবোধ : মুসলমানদেরকে বারবার সম্বােধন করে এরূপ উন্নত সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক রীতিনীতি শিক্ষাদান, তাদের সম্মান, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দান এবং তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনে উদ্বুদ্ধ করার পর পরবর্তী আয়াতে গােটা মানব জাতিকে সম্বােধন করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ বংশ-নির্বিশেষে সকল মানুষের মূল যে এক ও অভিন্ন, তাদের মর্যাদা নিরূপণের মানদন্ড যে এক ও অভিন্ন এবং সেটাই যে এই মহান ইসলামী সমাজের ভিত্তি, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। বলা হয়েছে, ‘হে মানবমন্ডলী, আমি তােমাদেরকে একজন পুরুষ ও স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। এবং তােমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তােমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারাে। নিশ্চয় তােমাদের মধ্যকার সবচেয়ে আল্লাহভীরু ব্যক্তিই সবচেয়ে সম্মানিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী।’ অর্থাৎ বহু বর্ণে ও জাতিতে বিভক্ত হে মানব সমাজ, তােমাদের মূল এক ও অভিন্ন। সুতরাং তােমরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়াে না, দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে লিপ্ত হয়াে না এবং ধ্বংস হয়ে যেওনা।। হে মানব সকল, যিনি তােমাদেরকে সম্বােধন করেছেন তিনিই তােমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন। তােমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গােত্রে বিভক্ত করার উদ্দেশ্য এ নয় যে, তােমরা পরস্পরে দ্বন্দু-কলহ ও মারামারি কাটাকাটি করে মরবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু পারস্পরিক পরিচিতি। বর্ণ, ভাষা, স্বভাব, চরিত্র, প্রতিভা ও যােগ্যতার বিভিন্নতা একটা সৃষ্টিগত বৈচিত্র মাত্র। এ বিভিন্নতা বিবাদ-বিসম্বাদ ও শত্রুতা দাবী করে না। বরং মানবজাতির সকল দায়িত্ব বহনে ও সকল চাহিদা পূরণে পারস্পরিক সহযােগিতা দাবী করে। বর্ণ, বংশ, ভাষা, ভূমি এবং এ ধরনের অন্য সকল উপকরণের কোনাে মূল্য আল্লাহর দৃষ্টিতে নেই । আল্লাহর চোখে একটি মাত্র জিনিস রয়েছে, যা দ্বারা মানুষের মান-মর্যাদা পরিমাপ করা হয়ে থাকে এবং মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হয়ে থাকে। নিশ্চয় তােমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি সে, যে তােমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা খােদাভীরু ও সৎ। আর আল্লাহর কাছে যে সম্মানিত সেই যে প্রকৃত পক্ষে সম্মানিত, সে ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ থাকতে পারে না। তিনি তােমাদেরকে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিমাপ করে থাকেন। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি ছাড়া সম্মান ও মর্যাদার আর সকল মানদন্ডের বিলােপ সাধন করা হলাে। পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ এবং বিবাদ-বিসম্বাদের অন্য সকল কারণও এতে করে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মানুষের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের প্ররােচক সকল কারণ দূরীভূত হয়ে যায় । মৈত্রী ও সহযােগিতার একটি মাত্র বড় কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা সকলের একমাত্র উপাস্য এবং মানুষ সৃষ্টির মূল ও উৎস এক। আর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের যােগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হলাে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। এই মাপকাঠিকেই ইসলাম সর্বোচ্চ মাপকাঠিরূপে ঘােষণা করেছে। মানব জাতিকে সকল বর্ণ, বংশ, গােত্রভিত্তিক সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্যে। কেননা, এ সবই জাহেলিয়াত থেকে উদ্ভূত-চাই তার যতাে রকম নাম-পরিচয় থাক না কেন। এগুলাের সাথে ইসলামের কোনােই সম্পর্ক নেই। ইসলাম এই জাহেলী আভিজাত্যের বিরুদ্ধে লড়েছে তা যে কোনাে আকৃতির ও প্রকৃতির হােক কেন। সে চেয়েছে তার বিশ্বমানবিক ব্যবস্থাকে একক পতাকার তলে প্রতিষ্ঠিত করতে। ইসলামের পতাকা হলাে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পতাকা। জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ বা গােত্রবাদের পতাকা নয়। এগুলাে সবই বাতিল পতাকা, এগুলাে ইসলামের কাছে ঘৃণিত। রসূল(স.) বলেছেন, ‘তােমাদের সবাই আদমের সন্তান। আদম হচ্ছে মাটির সৃষ্টি। যারা তাদের পিতৃপুরুষ নিয়ে গর্বিত, তাদের সংযত হওয়া উচিত। নচেৎ আল্লাহর কাছে তারা গোবরে পােকার চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে যাবে।'(বাযযার) জাহেলী আভিজাত্য সম্পর্কে রাসূল(স.) বলেছেন, ‘এই নােংরা জিনিসটাকে তােমরা পরিত্যাগ কর।’ এ হচ্ছে সেই মূলনীতি, যার ওপর ইসলামী সমাজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। মানব জাতি মনগড়া ধ্যান-ধারণা অনুসারে বিশ্ব-জোড়া মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। কেননা, এ কাজের যে একমাত্র নির্ভুল ও অব্যর্থ পথ রয়েছে, সে পথ তারা অনুসরণ করছে না। সেটি হচ্ছে আল্লাহর পথ। আর যে একমাত্র পতাকার নিচে সমবেত হয়ে এ কাজ করা সম্ভব, সেই আল্লাহর পতাকার নিচে তারা সমবেত হচ্ছে না।
*ঈমানের যথার্থ দাবিদার কারা : সূরার শেষাংশে ঈমানের প্রকৃত মর্ম ও মূল্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঈমানের মর্মার্থ উপলব্ধি না করে মােমেন হবার দাবীদার আরব বেদুইনদের জবাব দেয়ার জন্যে এটি করা হয়েছে। তারা রসূল(স.)-এর কাছে এসে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বুঝাবার চেষ্টা করতাে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করে যেন রসূল(স.)-এর বিরাট একটা উপকার করে ফেলেছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে ঈমান আনয়নের তাওফীক দিয়ে যে বিরাট অনুগ্রহ ও করুণা করেছেন, সেটা তারা উপলব্ধি করতাে না এবং সেই অনুগ্রহের কদর করতাে না। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘বেদুইনরা বলেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি। তুমি বলে দাও যে, তােমরা ঈমান আনেনি । তােমরা কেবল আত্মসমর্পণ করেছো। এখনাে ঈমান তােমাদের অন্তরে ঢোকেনি…’ কথিত আছে যে, এখান থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত বনু আসাদ গােত্রের বেদুইনদের উপলক্ষে নাযিল হয়েছিলাে। তারা ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রথম সুযােগেই এই দাবী করে এবং রসূল(স.)-এর বিরাট উপকার করেছে বলে জাহির করতে থাকে। তারা বলেছিলাে, ‘হে রসূলুল্লাহ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। আরবরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু আমরা করিনি।’ এ কথাটা তারা যখন বলতাে, তখন তাদের মনে যে জিনিসটি ছিলাে তা আসলে ঈমান না অন্য কিছু সেটাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এখানে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বুঝাচ্ছেন যে, তারা আত্মসমর্পণ পূর্বক ইসলাম গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ঈমানের স্তরে উন্নীত হয়নি। এ আয়াত দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, ঈমানের প্রকৃত মর্ম তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়নি এবং তাদের আত্মা একে আত্মস্থ করেনি। তথাপি আল্লাহ তায়ালা নিজ দয়া ও মহানুভবতার গুণে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তাদের দ্বারা যা কিছু সৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তার প্রতিদান দেবেন এবং তাতে মােটেই কোনাে কাটছাট করবেন না। এই বাহ্যিক ইসলাম, যা অন্তরে বদ্ধমূল হয়নি, ফলে দৃঢ় ও অনমনীয় ঈমানের রূপ ধারণ করেনি, এরূপ ইসলাম তাদের সৎকাজ গুলােকে গ্রহণযােগ্য করার জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে এবং কাফেরদের সৎকাজের মতাে বৃথা যায়নি। যতক্ষণ তারা আনুগত্যশীল থাকবে, ততক্ষণ তাদের সৎকাজ গুলাের সওয়াবও কমবে না। এ কথাই বলা হয়েছে এভাবে, ‘তােমরা যদি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকো, তাহলে তোমাদের সমাজের কিছুই নষ্ট হবে না।’ এর কারণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা দয়া ও ক্ষমার অধিকতর নিকটবর্তী। তিনি বান্দার প্রথম পদক্ষেপটিই গ্রহণ করেন এবং তার আনুগত্য ও আত্মসমর্পণে সন্তুষ্ট হয়ে যান, যতক্ষণ না সে ঈমানের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে এবং সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত হয়।
*সত্যিকার ঈমান কি : এরপর ঈমানের প্রকৃত মর্মার্থ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এভাবে যে, ‘মােমেন তারাই যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতপর আর কোনাে সন্দেহকে প্রশ্রয় দেয়নি। এবং জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদ করেছে। তারাই সত্যবাদী।’ বস্তুত, ঈমান হলাে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি হৃদয়ের পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা জ্ঞাপনের নাম। এমন বিশ্বাস যে, এরপর আর কোনাে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দেয় না। দোদুল্যমানতা বা কূ-প্ররােচনার শিকার হতে হয় না এবং অন্তরে ও চেতনায় কোনাে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয় না। এই মনই হলাে আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে জেহাদ করার ইচ্ছার উৎস। হৃদয় বা মন যখন এই ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে, তখন সেদিকেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন সে অন্তরের বাইরের বাস্তব জগতেও ঈমানের বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। এ আয়াতে মানুষের মনের ঈমানী তত্ত্বের উপলব্ধি এবং বাস্তব জগতের জীবনধারার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। চেতনায় বিদ্যমান ঈমানের রূপ এবং বাইরের জগতে বিদ্যমান বাস্তব অবস্থার সাথে কোনাে অসামঞ্জস্য মোমেনের পক্ষে অসহনীয়। কেননা, এই অসামঞ্জস্যতা তাকে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট দেয়। এ কারণেই জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ জেহাদ আসলে মােমেনের অন্তরের স্বতস্ফুর্ত ও স্বাভাবিক আকাংখা। এ দ্বারা সে তার হৃদয়ে বিদ্যমান ঈমানের দীপ্তিমান রূপকে সমাজ জীবনে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়। আর মােমেনের সাথে তার আশপাশের জাহেলী জীবনধারার বিরােধ একটা স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক বিরোধ। নিজের ঈমানী চেতনা ও বিশ্বাস এবং বাস্তব জীবনের মাঝে দ্বৈত জীবন যাপনে তার অক্ষমতার কারণেই এই বিরােধের সূত্রপাত হয়। তার ঈমানী চেতনাকে সে বাস্তবের বিকৃত ও ভ্রষ্ট ইসলাম বিরোধী জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বাধ্য করতে অক্ষম। তাই তার মাঝে ও তার আশপাশে বিরাজমান জাহেলিয়াতের সাথে তার যুদ্ধ বেধে যাওয়া অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী-যতক্ষণ না এই জাহেলিয়াত ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ‘তারাই সত্যবাদী’ অর্থাৎ তাদের বিশ্বাসে তারা সত্যবাদী। তারা সত্যবাদী যখন তারা বলে যে, তারা মােমেন। অতপর অন্তরে যখন সেই চেতনা ও আবেগ সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকে না এবং বাস্তব জীবনেও তার কোনাে প্রভাব ও আলামত দেখা যায় না, তখন বাস্তবে ঈমানের অস্তিত্ব আছে একথা বলা যায় না। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস স্থাপন এবং তার কেবল বুলি আওড়ানাে দ্বারা কেউ সত্যবাদী হতে পারে না। যতক্ষণ তার বাস্তব জীবনে তথা কাজে-কর্মে তা প্রতিফলিত না আয়াতের একটি অংশ, ‘প্রকৃত মােমেন তারাই, যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতপর কোনাে সন্দেহ-সংশয়ে পতিত হয়নি’ নিয়ে একটু ভাবার প্রয়ােজন রয়েছে। এটা নিছক কথার কথা নয়, বরং বাস্তব ও সচেতন অভিজ্ঞতার সাথে এর সংযােগ রয়েছে। ঈমানের পরেও মনের ভেতরে যে সন্দেহ-সংশয় থেকে যাওয়া সম্ভব, সেই স্পর্শকাতর সত্যটির প্রতিই এখানে ইংগিত দেয়া হয়েছে এবং এর প্রতিকার করা হয়েছে। ‘অতপর কোনাে সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত হয়নি’ এই উক্তিটি কোরআনের অন্যত্র বিদ্যমান এই উক্তিটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, ‘যারা বলেছে যে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা-অতপর তার ওপর অবিচল থেকেছে… আল্লাহর প্রতি ঈমানে সংশয়হীনতা ও আল্লাহর প্রভুত্বে অবিচল আস্থা এই দুটো উক্তি থেকেই বুঝা যায় যে, মােমেনের মনেও কখনাে কখনাে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার প্রভাবে কিছুটা সন্দেহ-সংশয়, অস্থিরতা ও দোদুল্যমানতা দেখা দিতে পারে। মােমেনের মন দুনিয়ার জীবনে বহু কঠিন বিপদ-মুসিবতে নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তি এরূপ পরিস্থিতিতে মনকে স্থির রাখে, আস্থা ও বিশ্বাস বজায় রাখে এবং সঠিক পথে কদম অবিচল রাখে, তার কোনাে বিপর্যয় ঘটে না, সন্দেহ সংশয় তার ক্ষতি করতে পারে না এবং এরূপ ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করে থাকে। এখানে এমন বাচনভংগি ব্যবহৃত হয়েছে যে, এতে মােমেনদেরকে পথের পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক স্থানগুলাে সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে, যাতে তারা সচেতন হয়, দৃঢ় মনােবল অর্জন করে, নির্ভুল পথ অবলম্বন করে এবং পরিবেশ গুমট, অন্ধকার ও ঝড়-ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ হলেও সন্দেহ সংশয়ে লিপ্ত না হয়।
এরপর পুনরায় বেদুইনদের প্রসংগ আলােচিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তাদের অন্তর কেমন ও তাতে কি আছে, সেটা আল্লাহই ভালাে জানেন। আল্লাহই তাদের অন্তরে কি আছে সে কথা তাদেরকে জানান। এ সংক্রান্ত জ্ঞান তাকে তাদের কাছ থেকে অর্জন করতে হয় না। তুমি বলাে, তােমরা কি তােমাদের আনুগত্যের কথা আল্লাহকে জানাচ্ছাে? অথচ আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা জানেন। তিনি তাে সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী।’ মানুষ জ্ঞানের দাবীদার। অথচ সে নিজেকেই জানে না। তার ভেতরে কী কী আবেগ অনুভূতি ও চেতনা রয়েছে তা সে জানে না। সে তার নিজের ও তার আবেগ অনুভূতির নিগুঢ় তত্ত্ব জানে না। মানুষের বিবেক বুদ্ধি কিভাবে কাজ করে, তাও তার কাছে অজানা ব্যাপার। কেননা, সে যখন কর্মব্যস্ত থাকে, তখন তার ওপর সে পর্যবেক্ষণ চালাতে পরে না। নিজের ওপর যখন পর্যবেক্ষণ চালায়, তখন তার স্বাভাবিক তৎপরতা ও ব্যস্ততা স্তব্ধ হয়ে যায়। সুতরাং তখন কিসের পর্যবেক্ষণ চালাবে? আর যখন সে স্বাভাবিক তৎপরতায় নিয়ােজিত থাকবে, তখন একই সময় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই নিজের সত্তার বৈশিষ্ট ও নিজের সত্ত্বার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জনে সে অক্ষম। অথচ এই সত্তাটা নিয়েই মানুষ কতাে গর্ব করে। ‘আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু জানেন’ অর্থাৎ তিনিই প্রকৃত ও নির্ভুল জ্ঞান রাখেন। তিনি বিশ্বজগতের শুধু বাহ্যিক জ্ঞান রাখেন না, শুধু তার লক্ষণসমূহের জ্ঞান রাখেন না-তিনি তার সম্পর্কে নিগূঢ়তম ও গভীরতম জ্ঞান রাখেন এবং ব্যাপকতম সর্বব্যাপী ও সীমাহীন জ্ঞান রাখেন। ‘তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী।’ অর্থাৎ সর্বব্যাপী ও সর্বাত্মক জ্ঞানের অধিকারী, সীমাহীন ও অফুরন্ত জ্ঞানের অধিকারী।
*ঈমান আল্লাহর একটি বিশেষ দান : এ পর্যন্ত ঈমানের সেই আসল ও প্রকৃত রূপ বর্ণনা করা হলাে, যা বেদুইনরা অর্জন করতে পারেনি। এরপর তারা ইসলামের অনেক উপকার করেছে বলে যে কৃতিত্ব যাহির করতে ও বাহবা, কুড়াতে চায়, তার উল্লেখ করে রসূল(স.)- কে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এই বাহবা কুড়ানাের ও কৃতিত্ব যাহির করার ইচ্ছাটাই প্রমাণ করে যে, তাদের হৃদয়ে যথার্থ ও প্রকৃত ঈমান তখনাে পর্যন্ত বদ্ধমূল হয়নি এবং তাদের অন্তর তখনাে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ উপভােগ করতে পারেনি। বলা হয়েছে, ‘ওরা তােমার কাছে নিজেদের কৃতিত্ব যাহির করে যে, ইসলাম গ্রহণ করে তারা ইসলামের কথা না উপকার করেছে। তুমি বলাে, তােমাদের ইসলাম গ্রহণের জন্যে আমার কাছে কৃতিত্ব জাহির করােনা। বরঞ্চ তােমাদেরকে ঈমানের পথের সন্ধান দিয়ে আল্লাহই তােমাদের মস্তবড় উপকার করেছেন, যদি তােমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকো।’ তারা ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের উপকার করেছে বলে দাবী করতাে এবং ঈমান এনেছে। বলে কৃতিত্ব যাহির করতাে। তাদেরকে এ আয়াতে জবাব দেয়া হয়েছে যে, তােমরা ইসলামের উপকার করার দাবী করো না। তোমাদের ঈমানের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে জেনে রেখে যে, আল্লাহই তােমাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। এই জবাবটি নিয়ে আমাদের একটু চিন্তাভাবনা করা প্রয়ােজন। এখানে একটি মস্তবড় সত্য নিহিত রয়েছে। এ সত্যটি সম্পর্কে অনেকেই-এমনকি মােমেনদেরও অনেকে উদাসীন। সেই সত্যটি এই যে, ঈমান হচ্ছে আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামত ও বড় অনুগ্রহ, যা তিনি তাঁর কোনাে বান্দাকে পৃথিবীতে দিয়ে থাকেন। এটি এমনকি বান্দার অস্তিত্বের চেয়েও এবং অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত জীবন, জীবিকা, স্বাস্থ্য ও সহায় সম্পদের চেয়েও বড় নেয়ামত। এই নেয়ামত ও অনুগ্রহই মানব জীবনকে ও মানুষের অস্তিত্বকে বৈশিষ্টমন্ডিত করে থাকে এবং মহাবিশ্বে তাকে মৌলিক ও প্রধান ভূমিকা পালনের যােগ্য বানায় ।  *সত্যিকার মানুষ কারা : ঈমান অন্তরে বদ্ধমূল হওয়ার পর তা মানব সত্ত্বার ভেতরে যে পরিবর্তন আনে, তা এই যে, বিশ্বজগত সম্পর্কে তার ধারণা ব্যাপকতা লাভ করে, ব্যাপকতা লাভ করে তার সাথে তার সংযোগ, তার ভূমিকা, বিশুদ্ধ হয় পারিপার্শ্বিক ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনাবলী ও মূল্যবোধ সম্পর্কে তার ধারণা। পৃথিবী নামক এই গ্রহে সে আজীবন স্বস্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। পারিপার্শিক জগতের প্রতিটি বস্তুর সাথে এবং তার ও বিশ্বজগতের স্রষ্টার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ও মৈত্রী গড়ে ওঠে। তার নিজের মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে তার সঠিক চেতনা জন্মে এবং সর্বোপরি তার মধ্যে এই অনুভূতি জন্মে যে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখা ও বিশ্বজগতের সব কিছুর কল্যাণ সাধন করার মতাে ভূমিকা পালন সে তার ধারণার ব্যাপকতার স্বাভাবিক ফল এই দাড়ায় যে, সে স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার উর্ধে উঠে যায় এবং মহাবিশ্বের ব্যাপক ও বিপুল পরিসরে স্থান লাভ করে। এই মহাবিশ্বে কতাে যে অজানা শক্তি সঞ্চিত ও গােপন রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে, কে তার খবর রাখে? বস্তুত জাতিগতভাবে সে মানব জাতির একজন সদস্য। তার একটা নির্দিষ্ট উৎস রয়েছে। প্রথমে সে আল্লাহর রূহ বা আত্মা থেকে একটা মানবীয় আত্মা ফুৎকারের মাধ্যমে পেয়েছে। এই ফুৎকার মাটির তৈরী মানুষকে আল্লাহর নূর বা জ্যোতির সাথে সংযুক্ত করে থাকে। আল্লাহর এই নূর এক মুক্ত ও অসীম বস্তু, যার কোনাে আদিঅন্ত নেই এবং স্থান ও কালের মধ্যে যা সীমাবদ্ধ নয়। এই অসীম ও মুক্ত উপাদানটিই মানুষকে সৃষ্টি করেছিলাে। কোনাে মানুষের অন্তরে উক্ত ধারণা বদ্ধমূল হওয়া তার নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট। যদিও সে পৃথিবীতে বাস করে। এই উচ্চ ধারণা সৃষ্টির পাশাপাশি তার হৃদয় আল্লাহর নূরে উদ্ভাসিত হয়ে প্রথম নূরের দিকে ছুটে যায়, যা তাকে জীবনের এই রূপটি উপভােগ করায়। সম্পর্কের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সে মুসলিম জাতির একজন সদস্য। এই মুসলিম জাতি মানব সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে চলে আসছে। এর নেতৃত্বে ছিলেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম অন্যান্য নবী। এই ধারণাটা তার হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকাই যথেষ্ট। এতে সে বুঝতে পারবে যে, সে একটি সংঘটিত, পবিত্র ও সুদূর প্রসারী বৃক্ষের ফল। এই অনুভূতি অর্জিত হলে সে জীবনের একটা আলাদা স্বাদ উপভােগ করতে পারবে। এরপর তার ধারণা আরাে প্রশস্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে সে তার নিজের ও গােটা মানব জাতির উর্ধে উঠে যায়। সে এই বিশ্বজগতকে মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে বিবেচনা করে। সে নিজেও এই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তার ফুৎকারেই সে মানুষ হয়ে জন্মেছে। তার ঈমান তাকে জানিয়ে দেয় যে, গােটা বিশ্বজগত একটা সজীব জিনিস এবং তা জীবন্ত জিনিসসমূহ দ্বারা গঠিত। প্রত্যেক বস্তুর আত্মা বা প্রাণ আছে। প্রত্যেক বস্তু ও এই মহাবিশ্বের আত্মা তার স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত। মানুষের নিজের আত্মার ন্যায় এই বিশ্বজগতের আত্মাও আল্লাহর গুণকীর্তন ও তাসবীহ পাঠ করে থাকে, তার প্রশংসা ও আনুগত্য করে থাকে এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ করে বিশ্বাস স্থাপন করে। এভাবে সে উপলব্ধি করতে পারে যে, সে নিজেও এই মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ, যা মহান আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর প্রতি অনুগত। অতপর সে এও বুঝতে পারে যে, সে এই বিশ্বজগতের চেয়েও বড় একটি সৃষ্টি, পার্শ্ববর্তী সকল আত্মার সাথে সে পরিচিত, আল্লাহর প্রদত্ত আত্মা যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার সাথেও সে পরিচিত এবং সে গােটা সৃষ্টিজগতের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করতে সক্ষম। সে উপলব্ধি করতে পারে যে, সে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এই গােটা সৃষ্টিজগতের সমান। এখানে সে অনেক জিনিস তৈরী করতে ও অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটাতে পারে। সে প্রত্যেক জিনিস দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং প্রত্যেক জিনিসের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অতপর বৃহত্তম শক্তি থেকে সে সাহায্য গ্রহণ করতে পারে-যে বৃহত্তম শক্তি কখনাে দুর্বল হয় না বা উধাও হয় না।  *নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি : এই ব্যাপক ধারণা থেকে সে সংগ্রহ করে জিনিস, ঘটনা, ব্যক্তি, মূল্যবােধ, মনােযােগ ও আকাংখ্যাসমূহের নতুন ও প্রকৃত মানদন্ড। এ বিশ্বজগতে তার প্রকৃত ভূমিকা কী এবং এই জীবনে তার প্রকৃত কাজ কী তাও সে নিরূপণ করে। মানুষ স্বয়ং মহাবিশ্বে আল্লাহর একটি শক্তি, যাকে তিনি এই উদ্দেশ্যে নির্দেশাবলী প্রদান করেন যেন তাকে দিয়ে ও তার ওপর নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়িত করতে পারেন, আর এই গ্রহে সে যেন স্থির ও অবিচল পদক্ষেপে, খোলা চোখে ও অতন্দ্র বিবেকে বিচরণ করতে পারে। পারিপার্শ্বিক সৃষ্টিজগতের প্রকৃত স্বরূপ, মানুষের জন্যে নির্ধারিত ভূমিকার প্রকৃত স্বরূপ এবং এই ভূমিকা পালনের জন্যে তাকে দেয়া শক্তির প্রকৃত মর্ম ও মাত্ৰাসংক্রান্ত এই জ্ঞান ও পরিচিতি থেকে সে মানসিক শান্তি, তৃপ্তি ও স্বস্তি লাভ করে এবং পারিপার্শিক ঘটনাবলী সম্পর্কে যথার্থ ব্যাখ্যা লাভ করে। সে জানতে পারে কোথা থেকে সে এসেছে, কেন এসেছে, কোন দিকে সে যাচ্ছে এবং সেখানে গিয়ে কী সে পাবে। সে একথা ইতিমধ্যেই জেনেছে যে, পৃথিবীতে তার একটা কাজ বা দায়িত্ব রয়েছে। সে জেনেছে যে, তাকে উক্ত কাজ সম্পন্ন করার নিমিত্তে প্রতিটি ঘটনা শক্তি যােগাচ্ছে। সে এও জেনেছে যে, দুনিয়া হচ্ছে আখিরাতের কৃষি ক্ষেত। তাকে ছােট-বড় প্রতিটি কাজের ফলাফল ভোগ করানাে হবে। তাকে নিরর্থক সৃষ্টি করা হয়নি এবং তাকে দায়িত্বহীনভাবে ছেড়েও দেয়া হয়নি। উৎস ও পরিণতি সংক্রান্ত অজ্ঞতা, পথের গুপ্ত অংশ না দেখা এবং সেই পথে যাত্রা করা ও আসা যাওয়ার পেছনে প্রচ্ছন্ন কর্মকুশলতায় আস্থা না থাকার কারণে যে উদ্বেগ, সংশয় ও বিস্ময় জন্ম নেয়, তা জ্ঞান অর্জন করলে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ওমর খৈয়ামের চেতনার মতােই চেতনার বিলুপ্তি ঘটে। ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘আমি জীবনের পােশাক পরিধান করেছি, অথচ কারাে কাছে পরামর্শও চাইনি, আর নিজেও নানা চিন্তাধারার মধ্যে উদ্ভ্রান্ত থেকেছি। অচিরেই এ পােশাক আমি খুলে ফেলবাে, অথচ এখনাে আমি জানলাম না কেন এসেছি এবং কোথায় আমার ঠিকানা।’  *ঈমান এক অসাধারণ শক্তি : মােমেন নিশ্চিত মনে ও সংশয়হীন বিবেকে জানে ও বােঝে যে, সে জীবনের পােশাক পরে কেবল সেই আল্লাহর ফয়সালা অনুসারে, যিনি সর্বোচ্চ মাত্রার কর্মকুশলতা ও প্রজ্ঞা সহকারে গােটা সৃষ্টিজগতকে পরিচালনা করেন। আর যে হাত তাকে জীবনের পােশাক পরায়, সে হাত তার চেয়েও প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ও দয়ালু। সুতরাং তার কাছে তার পরামর্শ চাওয়ার প্রয়ােজন নেই। কেননা, যে হাত উক্ত জীবনের পােশাক পরায় সে যেমন পরামর্শ দিয়ে থাকে, মােমেন তেমন পরামর্শ দিতে সক্ষম নয়। সে হাত তাকে জীবনের পােশাক পরায়, এই মহাবিশ্বে এমন একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করার জন্যে যা এখানকার সব কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সব কিছুকে প্রভাবিত করে। তার এই ভূমিকা এই মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির সকল কার্যকলাপ ও ভূমিকার সাথে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সুসমন্বিত। এভাবে জ্ঞান লাভের পর মােমেন জানে সে কেন দুনিয়ায় এসেছে এবং তার ঠিকানা কোথায় নানাবিধ চিন্তার মধ্যে তাকে ঘুরপাক খেতে হয় না। বরং সে নিসংশয় ও পরম আত্মবিশ্বাসে নিজ ভূমিকা পালন করে। ঈমানী জ্ঞানে যখন তার আরাে উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধিত হয়, তখন সে স্বীয় ভূমিকা পালন করে অধিকতর আনন্দ ও তৃপ্তি বােধ করে এবং মহান আল্লাহর কাছ থেকে জীবনরূপী উপহার পেয়েও স্বীয় ভূমিকা পালন করতে পেরে কৃতার্থ হয়। কোরআনের ছায়াতলে আশ্রয় লাভের আগে এবং মহান আল্লাহ তায়ালা আমার হাত ধরে আমাকে তার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দানের আগে আমি যে মানসিক উদ্বেগ, উৎকষ্ঠা ও | বিভ্রান্তিতে পতিত থাকতাম, আমার সেই উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি যেমন বিপরিত হয়েছে, তেমনি ভাবে প্রত্যেক মােমেনের উদ্বেগ বিদূরিত হয়ে থাকে। আমি এই উদ্বেগ বিদূরিত হওয়ার পর আপন মনে বলেছিলাম মহাবিশ্ব এ কথা ভেবে আপন যাত্রা থামিয়ে দিয়েছে যে, সে কোথায় চলেছে, কেন চলেছে ও কিভাবে চলেছে। বৃথা চেষ্টা, ব্যর্থ তৎপরতা ও অসন্তোষজনক পরিণতি তাকে খুশী করতে পারেনি। আল্লাহর শােকর, আমি আজ জানি যে, কোনাে চেষ্টাই বৃথা যায় না। সকল কাজেরই কিছু না কিছু প্রতিদান পাওয়া যায়। সব শ্রমেরই কিছু না কিছু ফল হয়। ভালাে কাজের পরিণতি সন্তোষজনক হয়ে থাকে। কারণ তা একজন সুবিচারক ও দয়ালু মালিকের বিবেচনাধীন থাকে। আল্লাহর প্রশংসা যে, বিশ্বজগত তার যাত্রা চিরদিনের জন্যে স্থগিত করে না। কেননা বিশ্বজগত তার স্রষ্টা ও প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তার প্রশংসা করে তার প্রতি অনুগত থাকে এবং তার বিধান অনুসারে চলে পরিপূর্ণ নিষ্ঠা, সন্তোষ ও আত্মােৎসর্গের চেতনা নিয়ে। এটা একটা বিরাট অর্জন ও প্রাপ্তি, চাই তা চেতনা ও চিন্তার জগতেই হােক, দেহ ও স্নায়ুর জগতেই হােক এবং তৎপরতা, প্রভাবিত হওয়া ও প্রভাব বিস্তার করার জগতেই হােক। ঈমান একটি উদ্দীপক শক্তি ও ঐক্যবদ্ধকারী শক্তি। ঈমান কারাে হৃদয়ে অবস্থান করতে করতে এক সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিজের অস্তিত্বকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে, তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রূপকে পরস্পরের সাথে সমন্বিত করে মানব সত্তায় বিরাজমান কর্মতৎপরতার উৎসসমূহের ওপর আপন কর্তৃত্ব বিস্তার করে এবং তাকে পথে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ হচ্ছে মানুষের মনের ওপর ইসলামী আকীদা ও আদর্শের কার্যকারিতার রহস্য এবং এই আকীদা ও আদর্শের ওপর মনের বা বিবেকের শক্তির রহস্য। ইসলাম পৃথিবীতে যে অসাধ্য সাধন করেছে এবং প্রতিনিয়ত করে চলেছে, এ হচ্ছে তার রহস্য। ইসলাম পৃথিবীর জীবনধারায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আনছে এবং ব্যক্তি ও সমাজকে বৃহত্তর ও অবিনশ্বর জীবনের জন্যে সীমাবদ্ধ নশ্বর পার্থিব জীবনকে উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এক নগণ্য ও দুর্বল ব্যক্তিকে পরাক্রান্ত শাসক শক্তির বিরুদ্ধে অর্থ ও অস্ত্রের শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধে উদ্বুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সেই প্রবল ও পরাক্রান্ত শক্তি সেই ব্যক্তির ঈমানী শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। এত বড় বড় শক্তিকে এই নগণ্য ব্যক্তিটি পরাভূত করে তা নয়, বরং সেই বৃহত্তম শক্তিই পরাভূত করে, যা তার আত্মায় সংগৃহীত হয়। এই মহা পরাক্রমশালী ঈমানী শক্তি কখনাে দুর্বল হয় না বা পরাভূত হয় না। ( আমার লেখা ইসলাম ও বিশ্ব শান্তি) ইসলাম ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনে যে অসাধ্য সাধন ও অলৌকিক কর্মকান্ড সম্পাদন করে তা কোনাে অস্পষ্ট কাল্পনিক ধ্যানধারণার ভিত্তিতে করে না। বরং তা করে সুনির্দিষ্ট কারণ ও স্থায়ী বিধির ভিত্তিতে। ইসলাম একটা সামগ্রিক ও সর্বব্যাপী চিন্তাধারা, যা মানুষকে প্রকৃতির গােপন ও প্রকাশ্য শক্তিগুলাের সাথে সংযুক্ত করে, তার আত্মাকে বিশ্বাস ও আস্থা দ্বারা শক্তিশালী করে, তাকে বাতিল শক্তির মােকাবেলা করার ক্ষমতা দান করে এবং তা দান করে বিজয়ের প্রত্যয় ও আল্লাহর ওপর আস্থার শক্তির মাধ্যমে। ব্যক্তির সাথে তার পরিবেশে বিদ্যমান জিনিস, ঘটনা ও মানুষের সম্পর্ক কী এবং তার জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি কী, ইসলাম তাও বিশ্লেষণ করে। আনুরূপভাবে যে তার যাবতীয় শক্তি ও ক্ষমতাকে একত্রিত করে ও একটি নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত করে। আর এভাবেও তার শক্তি বৃদ্ধি ঘটে। মােমেনের শক্তিবৃদ্ধির আরাে একটা কারণ এই যে, তার সকল তৎপরতা এমন একটি দিকে পরিচালিত হয়, যেদিকে গােটা বিশ্বজগত পরিচালিত। মহাবিশ্বে যতাে প্রচ্ছন্ন শক্তি রয়েছে তা ঈমানী পথেই পরিচালিত হয়। ফলে মােমেনের যাত্রাপথে তার সাথে সম্মিলন ঘটে এবং তাকে বাতিলের ওপর হককে বিজয়ী করার সংগ্রামে সহযােগিতা করে। ফলে বাতিল বাহ্যদৃষ্টিতে যতই শক্তিশালী হােক না কেন, তার সামনে টিকতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা সত্যই বলেছেন, ‘তারা ইসলাম এনেছে বলে তােমার সামনে কৃতিত্ব ফলায়। তুমি বলাে, তােমাদের ইসলাম গ্রহণের কৃতিত্ব আমার সামনে যাহির করাে না। বরঞ্চ আল্লাহই তােমাদের ওপর নিজের কৃতিত্বের দাবীদার যে, তিনি ঈমান আনার জন্যে তােমাদেরকে হেদায়াত করেছেন যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।’ বস্তুত এটা এতাে বড় অনুগ্রহ যে, এটা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ দিতেও পারে না এবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে ছাড়া কাউকে তিনি দেনও না। আল্লাহ তায়ালা সত্যই বলেছেন। ভেবে দেখতে হবে যে, যে ব্যক্তি ঈমানী সম্পদে সমৃদ্ধিশালী হয়েছে, সে আর কিছুই হারায়না। আর যে এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত, সে পশুর মতাে যতােই আহার-বিহার করুক, এবং যতাে অগাধ সম্পত্তি ভােগ করুক, সে কিছুই পায় না। বস্তুত এ ধরনের মানুষের চেয়ে পশু অধিকতর সুপথগামী। কেননা, তারা জন্মগতভাবে মােমেন ও আল্লাহর বিধানের অনুগত।
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় অদৃশ্য বিষয় জানেন এবং তিনি তােমাদের সকল কাজ দেখেন।’ যিনি আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য খবর জানেন, তিনি মানুষের হৃদয় জগতে লুকিয়ে রাখা তথ্যও জানেন এবং তাদের কাজেরও খবর রাখেন। সুতরাং আল্লাহকে তাদের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে তাদের কথাবার্তার ওপর নির্ভর করতে হয় না। কেননা তিনি তাদের হৃদয়ে বিদ্যমান ভাবাবেগের কথাও জানেন। এই হলাে একটি মহান সমাজ ব্যবস্থার পবিত্র বৈশিষ্টসমূহের রূপরেখা বর্ণনাকারী আঠারােটি আয়াতের সমষ্টি সূরা আল-হুজুরাত। এ সূরা মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে যে সব মহান তত্ত্ব ও তথ্য বদ্ধমূল করে দেয় তা যথার্থই অমূল্য ও দুর্লভ।

১৩-১৮ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মুসলিম সমাজকে বিভিন্ন অকল্যাণ ও অনাচার থেকে রক্ষা করার জন্য যেসব পথনির্দেশের প্রয়োজন ছিল পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য করে সেসব পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এখন এ আয়াতে গোটা মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে একটি বিরাট গোমরাহীর সংশোধন করা হচ্ছে যা আবহমান কাল ধরে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে।অর্থাৎ বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ এবং জাতীয়তার গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতা। প্রাচীনতম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক যুগে মানুষ সাধারণত মানবতাকে উপেক্ষা করে তাদের চারপাশে কিছু ছোট ছোট বৃত্ত টেনেছে। এ বৃত্তের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীদের সে তার আপন জন এবং বাইরে জন্মগ্রহণকারীদের পর বলে মনে করেছে। কোন যৌক্তিক বা নৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে এ বৃত্ত টানা হয়নি বরং টানা হয়েছে জন্মের ভিত্তিতে যা একটি অনিচ্ছাকৃত ব্যাপার মাত্র। কোথাও এর ভিত্তি একই খান্দান, গোত্র ও গোষ্ঠিতে জন্মগ্রহণ করা এবং কোথাও একই ভৌগলিক এলাকায় কিংবা এক বিশেষ বর্ণ অথবা একটি বিশেষ ভাষাভাষী জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করা। তাছাড়া এসব ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আপন ও পরের বিভেদ রেখা টানা হয়েছে। এ মানদণ্ডে যাদেরকে আপন বলে মনে করা হয়েছে পরদের তুলনায় তাদের কেবল অধিক ভালবাসা বা সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এ বিভেদনীতি ঘৃণা, শত্রুতা, তাচ্ছিল্য ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতনের জঘন্যতম রূপ পরিগ্রহ করেছে। এর সমর্থনে দর্শন রচনা করা হয়েছে। মত ও বিশ্বাস আবিষ্কার করা হয়েছে। আইন তৈরী করা হয়েছে। নৈতিক নীতিমালা রচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র এটিকে তাদের স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বিধান হিসেবে গ্রহণ করে বাস্তবে অনুসরণ করেছে। এর ভিত্তিতেই ইহুদীরা নিজেদেরকে আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি বলে মনে করেছে এবং তাদের ধর্মীয় বিধি-বিধানে পর্যন্ত অইসরাঈলীদের অধিকার ও মর্যাদা ইসরাঈলীদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ে রেখেছে। এ ভেদনীতিই হিন্দুদের মধ্যে বর্ণাশ্রমের জন্ম দিয়েছে যার ভিত্তিতে ব্রাহ্মনদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। উচ্চ বর্ণের লোকদের তুলনায় সমস্ত মানুষকে নীচ ও অপবিত্র ঠাওরানো হয়েছে এবং শুদ্রদের চরম লাঞ্ছনার গভীর খাদে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কালো ও সাদার মধ্যে পার্থক্য টেনে আফ্রিকা ও আমেরিকায় কৃষ্ণাংগদের ওপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই বরং আজ এ শতাব্দীতেই প্রতিটি মানুষ তার নিজ চোখে দেখতে পারে। ইউরোপের মানুষ আমেরিকা মহাদেশে প্রবেশ করে রেড ইণ্ডিয়ান জাতি গোষ্ঠির সাথে যে আচরণ করেছে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার দুর্বল জাতিসমূহের ওপর আধিপত্য কায়েম করে তাদের সাথে যে ব্যবহার করেছে তার গভীরেও এ ধ্যান-ধারণাই কার্যকর ছিল যে, নিজের দেশ ও জাতির গণ্ডির বাইরে জন্মগ্রহণকারীদের জান-মাল ও সম্ভ্রম নষ্ট করা তাদের জন্য বৈধ। তাদেরকে লুট করা, ক্রীতদাস বানানো এবং প্রয়োজনে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অধিকার তাদের আছে। পাশ্চাত্য জাতিসমূহের জাতিপূজা এক জাতিকে অন্যান্য জাতিসমূহের জন্য যেভাবে পশুতে পরিণত করেছে তার জঘন্যতম দৃষ্টান্ত নিকট অতীতে সংঘটিত যুদ্ধসমূহেই দেখা গিয়েছে এবং আজও দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে নাৎসী জার্মানদের গোষ্ঠী দর্শন ও নরডিক প্রজাতির শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা বিগত মহাযুদ্ধে যে ভয়াবহ ফল দেখিয়েছে তা স্মরণ রাখলে যে কোন ব্যক্তি অতি সহজেই অনুমান করতে পারবে যে, তা কত বড় এবং ধ্বংসাত্মক গোমরাহী। এ গোমারাহীর সংশোধনের জন্যই কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়েছে।এ ছোট্ট আয়াতটিতে আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মানুষকে সম্বোধন করে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সত্য বর্ণনা করেছেনঃএকঃ তোমাদের সবার মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে তোমাদের গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। বর্তমানে পৃথিবীতে তোমাদের যত বংশধারা দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে তা একটি মাত্র প্রাথমিক বংশধারার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা যা একজন মা ও একজন বাপ থেকে শুরু হয়েছিল। এ সৃষ্টি ধারার মধ্যে কোথাও এ বিভেদ এবং উচ্চ নীচের কোন ভিত্তি বর্তমান নেই। অথচ তোমরা এ ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত আছো। একই আল্লাহ তোমাদের স্রষ্টা। এমন নয় যে, বিভিন্ন মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন খোদা সৃষ্টি করেছেন। একই সৃষ্টি উপকরণ দ্বারা তোমরা সৃষ্টি হয়েছো। এমন নয় যে, কিছু সংখ্যক মানুষ কোন পবিত্র বা মূল্যবান উপাদানে সৃষ্টি হয়েছে এবং অপর কিছু সংখ্যক কোন অপবিত্র বা নিকৃষ্ট উপাদানে সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। একই নিয়মে তোমরা জন্মলাভ করেছো। এমনও নয় যে, বিভিন্ন মানুষের জন্মলাভের নিয়ম-পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। তাছাড়া তোমরা একই পিতা-মাতার সন্তান। এমনটিও নয় যে, সৃষ্টির প্রথম দিককার মানব দম্পতির সংখ্যা ছিল অনেক এবং তাদের থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আলাদা আলাদা জন্মলাভ করেছে।দুইঃ মূল উৎসের দিক দিয়ে এক হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভিক্ত হওয়া ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। একথা স্পষ্ট যে, সমগ্র বিশ্বে গোটা মানব সমাজের একটি মাত্র বংশধারা আদৌ হতে পারতো না। বংশ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন খান্দান ও বংশধারার সৃষ্টি হওয়া এবং তারপর খান্দানের সমন্বয়ে গোত্র ও জাতিসমূহের পত্তন হওয়া অপরিহার্য ছিল। অনুরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের পর বর্ণ, দেহাকৃতি, ভাষা এবং জীবন যাপন রীতিও অবশ্যম্ভাবীরূপে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। একই ভূখণ্ডের বসবাসকারীরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ এবং দূর-দূরান্তের ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের মধ্যে পরস্পর ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃতিগত এ পার্থক্য ও ভিন্নতার দাবী এ নয় যে, এর ভিত্তিতে উচ্চ ও নীচ, ইতর ও ভদ্র এবং শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্ট হওয়ার ভেদাভেদ সৃষ্টি হবে, একটি বংশধারা আরেকটি বংশধারার ওপর কৌলিন্যের দাবী করবে, এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণের লোকদের হেয় ও নীচ মনে করবে, এক জাতি অন্য জাতির ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য কায়েম করবে এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এক জাতি অন্য জাতির ওপর অগ্রাধিকার লাভ করবে। যে কারণে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানব গোষ্ঠীসমূহকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের আকারে বিন্যস্ত করেছিলেন তা হচ্ছে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক জানা শোনা ও সহযোগিতার জন্য এটাই ছিল স্বাভাবিক উপায়। এ পদ্ধতিতে একটি পরিবার, একটি প্রজাতি, একটি গোত্র এবং একটি জাতির লোক মিলে একটি সম্মিলিত সমাজ গড়তে এবং জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে একে অপরের সাহায্যকারী হতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি প্রকৃতি যে জিনিসকে পারস্পরিক পরিচয়ের উপায়ে বানিয়েছিল শুধু শয়তানী মূঢ়তা ও মূর্খতা সে জিনিসকে গর্ব ও ঘৃণার উপকরণ বানিয়ে নিয়েছে এবং বিষয়টিকে অত্যাচার ও সীমালংঘনের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছে।তিনঃ মানুষের মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ যদি কিছু থেকে থাকে এবং হতে পারে তাহলে তা হচ্ছে নৈতিক মর্যাদা। জন্মগতভাবে সমস্ত মানুষ সমান। কেননা, তাদের সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও সৃষ্টির নিয়ম-পদ্ধতিও এক এবং তাদের সবার বংশধারা একই পিতা-মাতা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। তাছাড়া কোন ব্যক্তির কোন বিশেষ দেশ, জাতি অথবা জাতি-গোষ্ঠীতে জন্মলাভ করা একটি কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। এতে তার ইচ্ছা, পছন্দ বা চেষ্টা-সাধনার কোন দখল নেই। একদিক দিয়ে কোন ব্যক্তির অন্য কোন ব্যক্তির ওপর মর্যাদালাভের কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। যে মূল জিনিসের ভিত্তিতে এক ব্যক্তি অপর সব ব্যক্তিদের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহ ভীরু মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং নেকী ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী। এরূপ ব্যক্তি যে কোন বংশ, যে কোন জাতি এবং যে কোন দেশেরই হোক না কেন সে তার ব্যক্তিগত গুণাবলীর কারণে সম্মান ও মর্যাদার পাত্র। যার অবস্থা এর বিপরীত সর্বাবস্থাই সে একজন নিকৃষ্টতর মানুষ। সে কৃষ্ণাঙ্গ হোক বা শ্বেতাঙ্গ হোক এবং প্রাচ্যে জন্মলাভ করে থাকুক বা পাশ্চাত্যে তাতে কিছু এসে যায় না।এ সত্য কথাগুলোই যা কুরআনের একটি ছোট্ট আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে-রসূলুল্লাহ ﷺ তা তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও উক্তিতে আরো স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। মক্কা বিজয়ের সময় কা’বার তাওয়াফের পর তিনি যে বক্তৃতা করেছিলেন তাতে বলেছিলেনঃ

الحمد لله الذى اذهب عنكم عيبة الجاهلية وتكبرها – يا ايها الناس , الناس رجلا , برتقى كريم على الله , وفاجر شقى هين على الله – الناس كلهم بنو ادم وخلق الله ادم من تراب- (بيهقى فى شعب الايمان – ترمذى)

“সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের দোষ-ত্রুটি ও অহংকার দূর করে দিয়েছেন। হে লোকেরা! সমস্ত মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত। এক, নেককার ও পরহেজগার—যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদার অধিকারী। দুই, পাপী ও দূরাচার যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট। অন্যথায়, সমস্ত মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির সৃষ্টি।” (বায়হাকী–ফী শুআবিল ঈমান, তিরমিযী)বিদায় হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময়ে নবী (সা.) বক্তৃতা করেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেনঃ

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَلاَ إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ – لاَ فَضْلَ لِعَرَبِىٍّ عَلَى أَعْجَمِىٍّ وَلاَ لِعَجَمِىٍّ عَلَى عَرَبِىٍّ وَلاَ لاَسْوَدَ عَلَى أَحْمَر ولا لأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ إِلاَّ بِالتَّقْوَى, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ –الا هل بلغتُ؟ قَالُوا بَلى يا رَسُولُ اللَّهِ قَالَ فليُبَلِّغِ اشَّاهِدُ الْغَائِبَ(بيهقى)

“হে লোকজন! সাবধান! তোমাদের আল্লাহ একজন। কোন অনারবের ওপর কোন আরবের ও কোন আরবের ওপর কোন অনারবের, কোন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের ও কোন শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই আল্লাহভীতি ছাড়া। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। বলো, আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি? সবাই বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে যারা এখানে উপস্থিত আছে তারা যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ বাণী পৌঁছিয়ে দেয়।” (বায়হাকী)একটি হাদীসে নবী (সা.) বলেছেনঃ

كلكم بنو ادم وادم خلق من تراب ولينتهين قوم يفخرون بأيائهم او ليكونن اهون على الله من الجعلان – (بزار)

“তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আর আদমকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল। লোকজন তাদের বাপদাদার নাম নিয়ে গর্ব করা থেকে বিরত হোক। তা না হলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা নগণ্য কীট থেকেও নীচ বলে গণ্য হবে।” (বাযযার)আর একটি হাদীসে তিনি বলেছেনঃ

ان الله لايسئلكم عن احسابكم ولاعن انسابكم يوم القيامة ان اكرمكم عند الله اتقكم – (ابن جرير)

“আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তোমাদের বংশ ও আভিজাত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। তোমাদের মধ্যে যে বেশী আল্লাহভীরু সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী।” (ইবনে জারীর)আরো একটি হাদীসের ভাষা হচ্ছেঃ

إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ(مسلم , ابن ماجه)

“আল্লাহ তা’আলা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন।” (মুসলিম ও ইবনে মাজাহ)এসব শিক্ষা কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং সে শিক্ষা অনুসারে ইসলাম ঈমানদারদের একটি বিশ্বভ্রাতৃত্ব বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়ে দিয়েছে। যেখানে বর্ণ, বংশ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তার কোন ভেদাভেদ নেই, যেখানে উচ্চ নীচ, ছুত-ছাত এবং বিভেদ ও পক্ষপাতিত্বের কোন স্থান নেই এবং যে কোন জাতি, গোষ্ঠী ও দেশেরই হোক না কেন সেখানে সমস্ত মানুষ সম্পূর্ণ সমান অধিকার নিয়ে শরীক হতে পারে এবং হয়েছে। ইসলামের বিরোধীদেরও একথা স্বীকার করতে হয়েছে যে, মানবিক সাম্য ও ঐক্যের নীতিমালাকে মুসলিম সমাজে যেভাবে সফলতার সাথে বাস্তব রূপদান করা হয়েছে বিশ্বের আর কোন ধর্ম ও আদর্শে কখনো তার কোন নজির পরিলক্ষিত হয়নি। একমাত্র ইসলাম সেই আদর্শ যা বিশ্বের সমগ্র অঞ্চলে ও আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীকে মিলিয়ে একটি জাতি বানিয়ে দিয়েছে।এ পর্যায়ে একটি ভ্রান্ত ধারণা দূর করাও অত্যন্ত জরুরী। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে ইসলামী আইন ‘কুফু’ বা ‘সমবংশ’ হওয়ার প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করে, কিছু লোক তার অর্থ গ্রহণ করে এই যে, কিছুসংখ্যক জ্ঞাতি গোষ্ঠী আছে কুলীন ও অভিজাত এবং কিছু সংখ্যক ইতর ও নীচ। তাদের পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক আপত্তিজনক। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। ইসলামী আইন অনুসারে প্রত্যেক মুসলমান পুরুষের প্রত্যেক মুসলমান নারীর সাথে বিয়ে হতে পারে। তবে দাম্পত্য জীবনের সফলতা স্বামী-স্ত্রীর অভ্যাস, আচার-আচরণ, জীবন-যাপন পদ্ধতি, পারিবারিক ও বংশগত ঐতিহ্য এবং আর্থিক ও সামাজিক পরিবেশের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার ওপর নির্ভর করে যাতে তারা পরস্পরের সাথে ভালভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ‘কুফু’ বা সমবংশ হওয়ার মূল লক্ষ্য এটিই। যেখানে পুরুষ ও নারীর মধ্যে এদিক দিয়ে অনেক বেশী দূরত্ব হবে সেখানে জীবনব্যাপী বিস্তৃত বন্ধুত্বের সম্পর্ক বনিবনার আশা কমই করা যায়। তাই ইসলামী আইন এ রকম দাম্পত্য বন্ধনকে পছন্দ করে না। এখানে আশরাফ ও আতরাফের কোন প্রশ্নই নেই। বরং উভয়ের অবস্থার মধ্যে যদি স্পষ্ট পার্থক্য ও ভিন্নতা থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে দাম্পত্য জীবন ব্যর্থ হওয়ার অধিক সম্ভাবনা থাকে।
# প্রকৃতপক্ষে কে গুণাবলীর দিক দিয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ আর কে নীচু মর্যাদার মানুষ তা আল্লাহই ভাল জানেন। মানুষ নিজেরা নিজেদের উচ্চ নীচের যে মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হতে পারে দুনিয়াতে যাকে অনেক উচ্চ মর্যাদার মানুষ মনে করা হতো আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালায় সে অতি নীচুস্তরের মানুষ হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং যাকে এখানে অতি নগণ্য মনে করা হয়েছে সেখানে সে অনেক উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। আসল গুরুত্ব দুনিয়ার সম্মান ও লাঞ্ছনার নয়, বরং কেউ আল্লাহর কাছে যে সম্মান ও লাঞ্ছনা লাভ করবে তার। তাই যেসব গুণাবলী আল্লাহর কাছে মর্যাদা লাভের উপযুক্ত বানাতে পারে নিজের মধ্যে সেসব বাস্তব গুণাবলী সৃষ্টির জন্য মানুষের সমস্ত চিন্তা নিয়োজিত হওয়া উচিত।
# এর অর্থ বেদুঈন নয়। বরং এখানে কতিপয় বিশেষ বেদুঈন গোষ্ঠীর উল্লেখ করা হচ্ছে যারা ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে এই ভেবে মুসলমান হয়ে যায় যে, মুসলমানদের আঘাত থেকেও নিরাপদ থাকবে এবং ইসলামী বিজয় থেকে সুবিধাও ভোগ করবে। এসব লোক প্রকৃতপক্ষে সরল মনে ঈমান গ্রহণ করেছিল না। শুধু ঈমানের মৌখিক অঙ্গীকার করে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজেদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। তাদের এ গোপন মানসিক অবস্থা তখনই ফাঁস হয়ে যেতো যখন তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সে নানা রকমের দাবী-দাওয়া পেশ করতো এবং এমনভাবে নিজেদের অধিকার ফলাতো যে, ইসলাম গ্রহণ করে তারা যেন রসূলের ﷺ মস্তবড় উপকার সাধন করেছে। বিভিন্ন রেওয়ায়াতে কয়েকটি গোষ্ঠির এ আচরণের উল্লেখ আছে। যেমনঃ মুযাইনা, জুহাইনা, আসলাম, আশজা, গিফার ইত্যাদি গোত্রসমূহ। বিশেষ করে বনী আসাদ ইবনে খুযায়মা গোত্র সম্পর্কে ইবনে আব্বাস এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের বর্ণনা করেছেন যে, একবার দুর্ভিক্ষের সময় তারা মদিনায় এসে আর্থিক সাহায্য দাবী করে বারবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে লাগলোঃ আমরা যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই মুসলমান হয়েছি, অমুক ও অমুক গোত্র যেমন যুদ্ধ করেছে আমরা আপনার বিরুদ্ধে তেমন যুদ্ধ করিনি। একথা বলার পেছনে তাদের পরিষ্কার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করা এবং ইসলাম গ্রহণ করা যেন তাদের একটি বড় দান। তাই রসূল ও ঈমানদারদের কাছে এর বিনিময় তাদের পাওয়া উচিত। মদীনার আশেপাশের বেদুঈন গোষ্ঠিসমূহের এ আচরণ ও কর্মনীতি সম্পর্কে এ আয়াতগুলোতে সমালোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ সমালোচনা ও পর্যালোচনার সাথে সূরা তাওবার ৯০ থেকে ১১০ আয়াত এবং সূরা ফাতহের ১১ থেকে ১৭ আয়াত মিলিয়ে পড়লে এ বিষয়টি আরো ভালভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে।
# মূল আয়াতে قُوْلُوْا اَسْلَمْنَا কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর আরেকটি অনুবাদ হতে পারে, “বলো, আমরা মুসলমান হয়ে গিয়েছি” এ আয়াতাংশ থেকে কোন কোন লোক এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, কুরআন মজীদের ভাষায় ‘মু’মিন’ ও ‘মুসলিম’ দু’টি বিপরীত অর্থ জ্ঞাপক পরিভাষা। মু’মিন সে ব্যক্তি যে সরল মনে ঈমান আনয়ন করেছে এবং মুসলিম সে ব্যক্তি যে ঈমান ছাড়াই বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। এখানে অবশ্য ঈমান শব্দটি আন্তরিক বিশ্বাস এবং ইসলাম কেবল বাহ্যিক আনুগত্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এমনটি বুঝে নেয়া ঠিক নয় যে, এ দু’টি শব্দ কুরআন মজীদের দু’টি স্থায়ী ও বিপরীত অর্থজ্ঞাপক পরিভাষা। কুরআনের যেসব আয়াতে ইসলাম ও মুসলিম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির জন্য যে জীবন বিধান নাযিল করেছেন কুরআনের পরিভাষায় তার নাম ইসলাম। ঈমান ও আনুগত্য উভয়টি এর অন্তর্ভুক্ত। আর মুসলিম সে ব্যক্তি যে সরল মনে মেনে নেয় এবং কার্যত আনুগত্য করে। প্রমাণ স্বরূপ নিম্ন বর্ণিত আয়াতগুলো দেখুনঃإِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ (ال عمران : 19)“নিশ্চতভাবেই আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ‘ইসলাম’।” ( আলে ইমরান, ১৯ )وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ (ال عمران : 85)“যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন ব্যবস্থা চায় তার সেই জীবন ব্যবস্থা কখনো গ্রহণ করা হবে না।” ( আলে ইমরান , ৮৫)وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا (المائدة : 3)“আমি তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছি।” ( আল মায়েদা, ৩ )فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ ( الانعام : 125)“আল্লাহ যাকে হিদায়াত দান করতে চান তার হৃদয় মনকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।” ( আল আনআম, ১২৫ )قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَسْلَمَ (الانعام : 14)“হে নবী! বলে দাও, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হই।” (আল আনআম, ১৪ )فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا (ال عمران : 20)“এরপর তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে হিদায়াত প্রাপ্ত হলো।” ( আলে ইমরান, ২০ )يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا (المائدة :44)“সমস্ত নবী—যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাওরাত অনুসারে ফায়সালা করতেন।” ( আল মায়েদা, ৪৪ )এসব আয়াতে এবং এ ধরনের আরো বহু আয়াতে ইসলাম গ্রহণের অর্থ কি ঈমানবিহীন আনুগত্য করা? একইভাবে ‘মুসলিম’ শব্দটি যে অর্থে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে তার জন্য নমুনা হিসেবে নিম্ন বর্ণিত আয়াতসমূহ দেখুনঃيَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (ال عمران :102)“হে ঈমান গ্রহণকারীগণ! আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় করো। আর মুসলিম হওয়ার আগেই যেন তোমাদের মৃত্যু না আসে।” ( আলে ইমরান, ১০২ )“তিনি এর পূর্বেও তোমাদের নামকরণ করেছিলেন মুসলিম তাছাড়া এ কিতাবেও।” ( আল হাজ্ব, ৭৮)مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا (ال عمران : 67)“ইবরাহীম ইহুদী বা খৃস্টান কোনটাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম।” ( আলে ইমরান, ৬৭ )رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ (البقرة : 128)“(কা’বা ঘর নির্মাণের সময় হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের দোয়া) হে আমাদের রব, আমাদের দু’জনকেই তোমার অনুগত বানাও এবং আমাদের বংশ থেকে এমন একটি উম্মত সৃষ্টি করো যারা তোমার অনুগত হবে।” ( আল বাকারা, ১২৮ )يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (البقرة : 132)নিজের সন্তানদেরকে হযরত ইয়াকূবের (আ) অসীয়ত “হে আমার সন্তানেরা, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য এ জীবন বিধানকেই মনোনীত করেছেন। অতএব, মুসলিম হওয়ার আগে যেন তোমাদের মৃত্যু না আসে।” ( আল বাকারা, ১৩২ )এসব আয়াত পাঠ করে এমন ধারণা কে করতে পারে যে, এতে উল্লেখিত মুসলিম শব্দের দ্বারা এমন লোককে বুঝানো হয়েছে যে বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করলেও আন্তরিকভাবে তা মানে না? সুতরাং কুরআনের পরিভাষা অনুসারে ইসলাম অর্থ ঈমানহীন আনুগত্য এবং কুরআনের ভাষায় কেবল বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণকারীকেই মুসলিম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এরূপ দাবী করাও চরম ভুল। অনুরূপ এ দাবী করাও ভুল যে, কুরআন মজীদে উল্লেখিত ঈমান ও মু’মিন শব্দ দু’টি অবশ্যই সরল মনে মেনে নেয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব শব্দ নিঃসন্দেহে এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এমন অনেক স্থানও আছে যেখানে এ শব্দ ঈমানের বাহ্যিক স্বীকৃতি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। যারা মৌখিক স্বীকারোক্তির মাধ্যমে মুসলমানের দলে শামিল হয়েছে। يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا বলে তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা সত্যিকার মু’মিন, না দুর্বল ঈমানের অধিকারী না মুনাফিক তা বিচার করা হয়নি। এর বহুসংখ্যক উদাহরণের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটির জন্য দেখুন, আলে ইমরান, আয়াত, ১৫৬ ; আন নিসা, ১৩৬ ; আল মায়েদা, ৫৪ ; আল আনফাল, ২০ থেকে ২৭ ; আত তাওবা , ৩৮ ; আল হাদীদ, ২৮ ; আস-সফ , ২ ।

আয়াতের ব্যাখ্যায়:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এতক্ষণ সামাজিক বিধি-বিধান আলোচনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টির সূচনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তোমরা একজন মাত্র নর-নারী তথা আদম ও হাওয়া (আঃ) থেকে সৃষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা মানুকে চারটি পদ্ধতিতে সৃষ্টি করেছেন। (১) কোন নারী-পুরুষ ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, যেমন আদম (আঃ)। (২) পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন নারী ছাড়া, যেমন হাওয়া (আঃ), (৩) নারী থেকে সৃষ্টি করেছেন কোন পুরুষ ছাড়াই, যেমন ঈসা (আঃ), (৪) নারী-পুরুষের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন যেমন সকল মানুষ।

আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করার পর বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন যাতে একে অপরকে চিনতে পারে। যেমন সে অমুকের ছেলে, সে অমুক গোত্রের লোক ইত্যাদি। এ জন্য বিভিন্ন গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করেন যে, অমুক গোত্র অমুক গোত্র থেকে, অমুক জাতি অমুক জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ। আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি একটিই, তা হলো তাকওয়া। সে কৃষ্ণাঙ্গ হোক বা শ্বেতাঙ্গ হোক, আরবি হোক আর অনারবি হোক, প্রাচুর্যশালী হোক আর নিঃস্ব হোক।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো : কোন্ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করেছে সে বেশি সম্মানিত…..। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৮৩)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

إِنَّ اللّٰهَ لَا يَنْظُرُ إِلَي صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَي قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ

নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের আকৃতি ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না। বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখবেন। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৬৩)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হাজ্জে বলেছেন : তাকওয়া ব্যতীত অন্য কোন কিছুর কারণে আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- অধ্যায় : বিদায় হাজ্জ)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মানব জাতির উৎস আদম ও হাওয়া (আঃ)।
২. মানব জাতিকে বিভিন্ন গোত্রে ও জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে পরস্পরে পরিচয় লাভের জন্য ।
৩. শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি একমাত্র তাকওয়া। গোত্র, জাতি বা দেশ নয়।
১৪-১৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

الْأَعْرَابُ অর্থ বেদুঈন, মরুবাসী, যারা গ্রামে বসবাস করে। কোন কোন মুফাস্সিরের মতে, এ বেদুঈন লোকগুলো হলো, মদীনার বনু আসাদ ও খুযাইমাহ্ গোত্রের মুনাফিক। তারা দুর্ভিক্ষের সময় কেবল সাদকা লাভের উদ্দেশ্যে অথবা হত্যা ও বন্দী হওয়া থেকে বাঁচার জন্য মৌখিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করার কথা ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু তাদের ঈমান, ‘আক্বীদাহ্ এবং ইসলামের আন্তরিকতা মুক্ত ছিল। (ফাতহুল কাদীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এখানে এমন বেদুঈন লোকদের বুঝানো হয়েছে যারা নতুন মুসলিম হয়েছিল, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে তখনো দৃঢ়ভাবে স্থান পায়নি। অথচ তাদের অন্তরে যতটুকু ঈমান ছিল দাবী করেছিল তার চেয়ে বেশি।

ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিতে বললেন যে, বলো না আমরা ঈমান এনেছি বরং বলো ইসলাম গ্রহণ করেছি। তোমাদের অন্তরে এখনো পূর্ণ ঈমান প্রবেশ করেনি।

আয়াতের ভাষ্য দ্বারা বুঝা যাচ্ছে ঈমান ও ইসলামে পার্থক্য রয়েছে। এরূপ একটি হাদীস দ্বারাও বুঝা যায় যে, ঈমান ও ইসলামের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতগুলো লোককে (দানের মাল হতে) দান করলেন এবং একটি লোককে কিছুই দিলেন না। তখন সা‘দ (রাঃ) বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি অমুক অমুককে দিলেন আর অমুককে দিলেন না। অথচ সে মু’মিন। এ-কথা তিনবার বললেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাবে বললেন : সে কি মুসলিম? (সহীহ বুখারী হা. ২৭)

আবার অনেক আয়াত ও হাদীস প্রমাণ করে যে, ঈমান ও ইসলামের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَأَخْرَجْنَا مَنْ كَانَ فِيْهَا مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ – فَمَا وَجَدْنَا فِيْهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ الْمُسْلِمِيْنَ)

“সেখানে যেসব মু’মিন ছিল আমি তাদের বের করে নিলাম। এবং সেখানে একটি পরিবার [লূত-এর পরিবার] ব্যতীত কোন মুসলিম আমি পাইনি।” (সূরা যারিয়াত ৫১ : ৩৫-৩৬)

হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) উভয়ের মাঝে সমাধান দিতে গিয়ে বলেন : যখন ঈমান ও ইসলাম একত্রে উল্লেখ থাকবে তখন আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহার হবে, আর যখন আলাদা আলাদা করে উল্লেখ থাকবে তখন একই অর্থ প্রকাশ করবে।

(قُوْلُوْآ أَسْلَمْنَا)

‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি’ প্রকৃতপক্ষে তাদের ঈমান ছিল না, হত্যা ও বন্দি হওয়ার ভয়ে বাহ্যিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। এটা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। বাহ্যিকভাবে মু’মিনদের মত ইসলামের কিছু বিধান পালন করলেই মু’মিন হওয়া যায় না যতক্ষণ না অন্তরের বিশ্বাস ও মহব্বতের সাথে আমল করবে। তাই তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামের কিছু বিধান মেনে নিয়ে দাবী করছে আমরা মু’মিন হয়েছি, মূলত তারা মু’মিন ছিল না, তাই ইসলামের প্রতি তাদের বাহ্যিক আত্মসমর্পণ করাকে আভিধানিক অর্থে মুসলিম বলা হয়েছে।

(لَا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ)

অর্থাৎ যদি তোমরা প্রকৃতপক্ষে স্বচ্ছ ঈমান এনে থাক তাহলে আল্লাহ তোমাদের কর্মের প্রতিদান কম করে দেবেন না, নষ্ট করবেন না।

যেমন আল্লাহ বলেন : ‏

(وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَاتَّبَعَتْھُمْ ذُرِّیَّتُھُمْ بِاِیْمَانٍ اَلْحَقْنَا بِھِمْ ذُرِّیَّتَھُمْ وَمَآ اَلَتْنٰھُمْ مِّنْ عَمَلِھِمْ مِّنْ شَیْءٍﺚ کُلُّ امْرِئئ بِمَا کَسَبَ رَھِیْنٌ)‏
“এবং যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততিও ঈমানে তাদের অনুসারী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং আমি তাদের কর্মফলের ঘাটতি করব না, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী।” (সূরা তূর ৫২ : ২১)

অতঃপর শুধু মুখে নয় প্রকৃতপক্ষে যারা মু’মিন তাদের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : মু’মিন তারাই যারা ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করেনি বরং ঈমানের ওপর অটল থাকে এবং জান মাল দিয়ে জিহাদ করে আর তারাই সত্যবাদী।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا)

“নিশ্চয়ই যারা বলে : আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচলিত থাকে।” (সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১ : ৩০)

(أَتُعَلِّمُونَ اللّٰهَ بِدِينِكُمْ)

‘তোমরা কি তোমাদের দীনের খবর আল্লাহকে জানাচ্ছ?’ এখানে تعليم শব্দটি اعلام বা জানানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের দীন ও অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলাকে অবগত করছ? বেদুঈনরা যখন নিজেদেরকে মু’মিন বলে দাবী করল আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে নির্দেশ দিলেন : “তুমি বল : তোমরা ঈমান আননি ও তোমাদের অন্তরে এখনো ঈমান প্রবেশ করেনি” বলে তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য এবং আরো নির্দেশ দিলেন যেন তিনি তাদেরকে ভর্ৎসনা করে বলেন : “তোমরা কি তোমাদের দীনের খবর আল্লাহকে জানাচ্ছ?”। তোমরা মুখে যতই বল আমরা মু’মিন, প্রকৃতপক্ষে কে মু’মিন আর কে ছদ্মবেশী মু’মিন, নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ইসলামের ছায়া তলে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা তার সব কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।

(قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ)

‘বল : তোমাদের ইসলাম দ্বারা আমাকে ধন্য করনি’ অর্থাৎ বেদুঈন আরবদের আচরণে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা মনে করে আমরা ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মাদকে অনুগ্রহ করেছি, তার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, বলে দাও! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমাকে অনুগ্রহ করোনি বরং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে হিদায়াত দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : হে আনসাররা! আমি কি তোমাদের পথহারা পাইনি, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন? তোমরা বিভিন্ন দলে বিচ্ছিন্ন ছিলে আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে একত্র করে দিয়েছেন? তোমরা নিঃস্ব ছিলে আমার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা ধনী করে দিয়েছেন? সাহাবীরা প্রত্যেক প্রশ্নের জবাবে বললেন : আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়েও বেশি আমাদের ওপর অনুগ্রহকারী। (সহীহ বুখারী হা. ৪৩৩০)

(إِنَّ اللّٰهَ يَعْلَمُ غَيْبَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীর গায়েবের বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন’ অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(اَلَآ اِنَّھُمْ یَثْنُوْنَ صُدُوْرَھُمْ لِیَسْتَخْفُوْا مِنْھُﺚ اَلَا حِیْنَ یَسْتَغْشُوْنَ ثِیَابَھُمْﺫ یَعْلَمُ مَا یُسِرُّوْنَ وَمَا یُعْلِنُوْنَﺆ اِنَّھ۫ عَلِیْمٌۭ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ)

“সাবধান! নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর নিকট গোপন রাখার জন্য তাদের বক্ষ দ্বিভাঁজ করে। সাবধান! তারা যখন নিজেদেরকে বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে তখন তারা যা গোপন করে ও প্রকাশ করে, তিনি তা জানেন। অন্তরে যা আছে, নিশ্চয়ই তিনি তা সবিশেষ অবহিত।” (সূরা হূদ ১১ : ৫)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. প্রকৃত মু’মিনদের মুখের জবান ও অন্তরের বিশ্বাস এক ও অভিন্ন থাকবে।
২. ঈমান ও ইসলামের মাঝে সম্পর্ক একটি অপরটির পরিúূরক; বিপরীত নয়।
৩. প্রকৃত মু’মিনরা ঈমান আনার পর ঈমান থেকে সরে পড়ে না।
৪. সকল সৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান দ্বারা বেষ্টিত।
৫. সকল গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়ত্ত, অন্য কেউ গায়েব জানে না।
৬. ভাল কাজ করলে তা নিজের উপকারে আসবে আর খারাপ কাজ করলে তার পরিণতি নিজেকেই ভোগ করতে হবে।

আয়াতের ব্যাখ্যায়:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
আল্লাহ তা’আলা বলছেন যে, তিনি সমস্ত মানুষকে একটি মাত্র প্রাণ হতে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) হতে। হযরত আদম (আঃ) হতেই তিনি তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এ দু’জন হতে তিনি সমস্ত মানুষ ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে দিয়েছেন। (আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দ হতে (আরবী) বা সাধারণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আরব (আরবী)-এর অন্তর্ভুক্ত। তারপর কুরায়েশ, গায়ের কুরায়েশ, এরপর আবার এটা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়া এসবগুলো (আরবী)-এর মধ্যে পড়ে। কেউ কেউ বলেন যে, (আরবী) দ্বারা অনারব এবং (আরবী) দ্বারা আরব দলগুলোকে বুঝানো হয়েছে। যেমন বানী ইসরাঈলকে (আরবী) বলা হয়েছে। আমি এসব বিষয় একটি পৃথক ভূমিকায় লিখে দিয়েছি, যেগুলো আমি আবূ উমার ইবনে আবদিল বারর (রঃ)-এর কিতাবুল ইশবাহ’ হতে এবং ‘কিতাবুল ফাসদ ওয়াল উমাম ফী মা’রেফাতে আনসাবিল আরাবে ওয়াল আজামে’ হতে সগ্রহ করেছি। এই পবিত্র আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, হযরত আদম (আঃ) যাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার দিকে সম্পর্কিত হওয়ার দিক দিয়ে সারা জাহানের মানুষ একই মর্যাদা বিশিষ্ট। এখন যিনি যা কিছু ফযীলত লাভ করেছেন বা করবেন তা হবে দ্বীনি কাজকর্ম এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যের ভিত্তিতে। রহস্য এটাই যে, এই আয়াতটিকে গীবত হতে বিরত রাখা এবং একে অপরকে অপদস্থ, অপমানিত এবং তুচ্ছ ও ঘৃণিত জ্ঞান করা হতে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত আয়াতের পরে আনয়ন করা হয়েছে যে, সমস্ত মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কের দিক দিয়ে সমান। জাতি, গোত্র ইত্যাদি শুধু পারস্পরিক পরিচয়ের জন্যে। যেমন বলা হয়ঃ অমুকের পুত্র অমুক, অমুক গোত্রের লোক। আসলে মানুষ হিসেবে সবাই সমান।

হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, হুমায়ের গোত্র তাদের মিত্রদের দিকে সম্পর্কিত হতো এবং হিজাযী আরব নিজেদেরকে নিজেদের গোত্রসমূহের দিকে সম্পর্কযুক্ত করতো।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা নসবনামা বা বংশ তালিকার জ্ঞান লাভ কর, যাতে তোমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখতে পার। আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখার কারণে জনগণ তোমাদেরকে মহব্বত করবে এবং তোমাদের ধন-মাল ও জীবন-আয়ুতে বরকত হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এই সনদে এ হাদীসটি গারীব)

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আল্লাহ তাআলার নিকট বংশ গরিমা মর্যাদা লাভের কোন কারণ নয়, বরং) আল্লাহ তাআলার নিকট তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “সর্বাধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি কে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু (সেই সর্বাধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি)।” সাহাবীগণ (রাঃ) বললেনঃ “আমরা আপনাকে এটা জিজ্ঞেস করিনি।” তখন তিনি বললেনঃ “তাহলে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান ছিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ)। তিনি নিজে আল্লাহর নবী ছিলেন, আল্লাহর নবীর তিনি পুত্র ছিলেন, তাঁর দাদাও ছিলেন নবী এবং তাঁর দাদার পিতা তো ছিলেন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আঃ)।” তাঁরা পুনরায় বললেনঃ “আমরা আপনাকে এটাও জিজ্ঞেস করিনি।’ তিনি বললেনঃ “তাহলে কি তোমরা আমাকে আরবদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছো?” তাঁরা জবাবে বললেনঃ “হ্যাঁ।” তিনি তখন বললেনঃ “অজ্ঞতার যুগে তোমাদের মধ্যে যারা উত্তম ছিল, ইসলামেও তারাই উত্তম হবে যখন তারা দ্বীনের বোধশক্তি লাভ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তোমাদের আকৃতির দিকে দেখেন না এবং তোমাদের ধন-মালের দিকেও দেখেন না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তরের দিকে ও তোমাদের আমলের দিকে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “তুমি মনে রেখো যে, তুমি লাল ও কালোর কারণে কোন মর্যাদা রাখে না। হ্যাঁ, তবে তুমি মর্যাদা লাভ করতে পার আল্লাহভীরুতার মাধ্যমে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত খারাশ আল আসরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “মুসলমানরা সবাই পরস্পর ভাই ভাই। কারো উপর কারো কোন ফযীলত নেই, শুধু তাকওয়ার মাধ্যমে ফযীলত রয়েছে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসেম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা সবাই আদম সন্তান, আর আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি দ্বারা। (মানব) সম্প্রদায় যেন তাদের বাপ-দাদাদের নামের উপর গৌরব প্রকাশ করা হতে বিরত থাকে, নতুবা তারা আল্লাহ তা’আলার নিকট বালুর ঢিবি অথবা আবী পাখি হতেও হালকা হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি আবু বকর আল বাযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর কাসওয়া নামক উষ্ট্রীর উপর সওয়ার হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন। তাঁর হাতের ছড়ি দ্বারা তিনি রুকনগুলো চুম্বন করেন। অতঃপর মসজিদে উষ্ট্ৰীটিকে বসাবার মত জায়গা ছিল না বলে জনগণ তাকে হাতে হাতে নামিয়ে নেন এবং উজ্জ্বীটিকে বাতনে সায়েলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেন। অতঃপর তিনি স্বীয় উষ্ট্রীর উপর সওয়ার হয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন যাতে আল্লাহ তা’আলার হামদ ও সানা বর্ণনা করার পর তিনি বলেনঃ “এখন আল্লাহ তা’আলা তোমাদের হতে অজ্ঞতার যুগের উপকরণসমূহ এবং বাপ দাদার নামে গর্ব করার প্রথা দূর করে দিয়েছেন। দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ তো নেককার, পরহেযগার এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আর দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ বদকার এবং আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত।” অতঃপর তিনি (আরবী) এই আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ “আমি আমার এ কথা বলছি এবং আমি আমার জন্যে ও তোমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত উকবা ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের এই নসবনামা বা বংশ-তালিকা তোমাদের জন্যে কোন ফলদায়ক নয়। তোমরা সবাই সমভাবে হযরত আদম (আঃ)-এরই সন্তান। তোমাদের কারো উপর কারো কোন মর্যাদা নেই। মর্যাদা শুধু তাকওয়ার কারণে রয়েছে। মানুষের মন্দ হওয়ার জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, সে হবে কর্কশ ভাষী, কৃপণ ও অকথ্যভাবে উচ্চারণকারী।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তোমাদের বংশাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক আল্লাহভীরু।

হযরত দুররাহ বিনতে আবি লাহাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা মিম্বরের উপর ছিলেন এমন সময় একটি লোক জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম লোক কে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “যে সবচেয়ে বেশী অতিথি সেবক, সর্বাপেক্ষা বেশী পরহেযগার, সবচেয়ে বেশী ভাল কাজের আদেশদাতা, সর্বাপেক্ষা অধিক মন্দ কাজ হতে নিষেধকারী এবং সবচেয়ে বেশী আত্মীয়তার সম্পর্ক মিলিতকারী (সেই সর্বাপেক্ষা উত্তম লোক)।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহকে ভয় করে এরূপ লোক ছাড়া দুনিয়ার কোন জিনিস এবং কোন লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কখনো মুগ্ধ করতো না।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ তোমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানেন এবং তোমাদের সমস্ত কাজ-কর্মের খবর রাখেন।’ হিদায়াত লাভের যে যোগ্য তাকে তিনি হিদায়াত দান করে থাকেন এবং যে এর যোগ্য নয় সে সুপথ প্রাপ্ত হয় না। করুণা ও শাস্তি আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ফযীলত বা মর্যাদা তাঁরই হাতে। তিনি যাকে চান তাকে বুযুর্গী দান করে থাকেন। সমস্ত বিষয়ের খবর তিনি রাখেন। কিছুই তার জ্ঞান বহির্ভূত নয়।

এই আয়াত এবং উপরে বর্ণিত হাদীসগুলোকে দলীল রূপে গ্রহণ করে আলেমগণ বলেন যে, বিবাহে বংশ ও আভিজাত্য শর্ত নয়। দ্বীন ছাড়া অন্য কোন শর্তই ধর্তব্য নয়। কোন কোন আলেমের মতে বংশ ও আভিজাত্যের বিচার বিবেচনা করাও শর্ত। এঁদের অন্য দলীল রয়েছে, যা ইলমে ফিকাহর কিতাবগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরাও এগুলোকে কিতাবুল আহকামে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলারই প্রাপ্য।

হযরত আবদুর রহমান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বানু হাশেম গোত্রের একটি লোককে তিনি বলতে শুনেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে আমিই সবচেয়ে বেশী সম্পর্কযুক্ত। তখন আর একটি লোকে বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে তোমার যে সম্পর্ক রয়েছে তদপেক্ষা বেশী সম্পর্ক তার সাথে আমার রয়েছে।” (এটা ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১৪-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

যেসব আরব বেদুঈন ইসলামে দাখিল হওয়া মাত্রই বাড়িয়ে-চাড়িয়ে নিজেদের ঈমানের দাবী করতে শুরু করেছিল, অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তরে ঈমান দৃঢ় হয়নি তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা এই দাবী করতে নিষেধ করছেন। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, যেহেতু ঈমান তাদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রবেশ করেনি সেই হেতু তারা ঈমান এনেছে একথা যেন না বলে, বরং যেন বলে যে, তারা ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে এসেছে এবং নবী (সঃ)-এর অনুগত হয়েছে।

এ আয়াত দ্বারা এটা জানা গেল যে, ঈমান ইসলাম হতে মাখসূস বা বিশিষ্ট, যেমন এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব। হযরত জিবরাঈল (আঃ) যুক্ত হাদীসটিও এটাই প্রমাণ করে। তিনি (হযরত জিবরাইল আঃ) ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন এবং পরে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করেন ইহসান সম্পর্কে। সুতরাং সাধারণ হতে ক্রমান্বয়ে বিশিষ্টের দিকে উঠে যান। তারপর উঠে যান আরো খাস বা বিশিষ্টের দিকে।

হযরত সা’দ ইবনে আবি অক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কতগুলো লোককে (দানের মাল হতে) প্রদান করলেন এবং একটি লোককে কিছুই দিলেন না। তখন হযরত সা’দ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি অমুক, অমুককে দিলেন আর অমুককে দিলেন না, অথচ সে মুমিন?” একথা তিনি তিনবার বললেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “অথবা সে মুসলিম?” এই জবাবই তিনিও তিনবার দিলেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ “নিশ্চয়ই আমি কতক লোককে প্রদান করি এবং তাদের মধ্যে আমার নিকট যে খুবই প্রিয় তাকে ছেড়ে দিই, কিছুই দিই না এই ভয়ে যে, (যাদেরকে প্রদান করি তাদেরকে প্রদান না করলে) তারা (হয়তো ইসলাম পরিত্যাগ করবে এবং এর ফলে) উল্টো মুখে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাদের নিজ নিজ সহীহ গ্রন্থে তাখরীজ করেছেন) সুতরাং এ হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুমিন ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করলেন এবং জানা গেল যে, ইসলামের তুলনায় ঈমান অধিক খাস বা বিশিষ্ট। আমরা এটাকে দলীল প্রমাণাদিসহ সহীহ বুখারীর কিতাবুল ঈমানের শরাহতে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলারই প্রাপ্য।

এ হাদীস দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, এ লোকটি মুসলমান ছিল, মুনাফিক ছিল না। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে কিছু প্রদান করেননি এবং তাকে তার ইসলামের উপর সমর্পণ করে দেন। সুতরাং জানা গেল যে, এই আয়াতে যে বেদুঈনদের বর্ণনা রয়েছে তারা মুনাফিক ছিল না, তারা ছিল তো মুসলমান, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হয়নি। তারা ঈমানের এমন উচ্চ স্তরে পৌছার দাবী করেছিল যেখানে তারা আসলে পৌঁছতে পারেনি। এ জন্যেই তাদেরকে আদব বা ভদ্রতা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এই ভাবার্থই হবে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তির। এটাকেই ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) গ্রহণ করেছেন। আমাদের এসব কথা এজন্যেই বলতে হলো যে, ইমাম বুখারী (রঃ)-এর মতে এলোকগুলো মুনাফিক ছিল, যারা নিজেদেরকে বাহ্যিকভাবে মুমিন রূপে প্রকাশ করতো, কিন্তু আসলে মুমিন ছিল না।

এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, ঈমান ও ইসলামের মধ্যে ঐ সময় পার্থক্য হবে যখন ইসলাম স্বীয় হাকীকতের উপর না হবে। যখন ইসলাম হাকীকী হবে তখন ঐ ইসলামই ঈমান। ঐ সময় ঈমান ও ইসলামের মধ্যে কোনই পার্থক্য থাকবে না। এর বহু সবল দলীল প্রমাণ ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় কিতাব সহীহ বুখারীর মধ্যে বর্ণনা করেছেন।

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা যে বলেছেনঃ বরং তোমরা বল’ এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমরা নিহত হওয়া থেকে এবং বন্দী হওয়া থেকে বাঁচার জন্যে ফরমানের প্রতি অনুগত হলাম।

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি বানু আসাদ ইবনে খুযাইমার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াত ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা মনে করেছিল যে, তারা ঈমান এনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতি অনুগ্রহ করেছে। কিন্তু প্রথমটিই সঠিক কথা যে, এই আয়াতটি ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা ঈমানের স্থানে পৌঁছে যাওয়ার দাবী করতো, অথচ সেখানে তারা পৌঁছতে পারেনি। সুতরাং তাদেরকে আদব বা দ্রতা শিক্ষা দেয়া হয় যে, তখন পর্যন্ত তারা ঈমানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। যদি তারা মুনাফিক হতো তবে অবশ্যই তাদেরকে ধমকানো হতো এবং ভীতি প্রদর্শন করা হতো। আর করা হতো তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত। যেমন সূরায়ে বারাআতে মুনাফিকদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে তো শুধু তাদেরকে আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য কর তবে তোমাদের কর্ম সামান্য পরিমাণও লাঘব হবে না। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদের আমল হতে কিছুই কমিয়ে দিই নি।” (৫২:২১)। মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ যারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে থাকেন এবং তাদের প্রতি দয়া করেন। কেননা, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারাই পূর্ণ মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না, বরং ঈমানের উপর অটল থাকে এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ। অর্থাৎ এরাই এমন লোক যারা বলতে পারে যে, তারা ঈমান এনেছে। তারা ঐ লোকদের মত নয় যারা শুধু মুখেই ঈমানের দাবী করে।

হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ায় তিন প্রকারের মুমিন রয়েছে। (এক) যারা আল্লাহর উপর ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে, অতঃপর কোন সন্দেহ পোষণ করেনি এবং নিজেদের মাল-ধন ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। (দুই) যাদের থেকে লোকেরা নিরাপত্তা লাভ করেছে। তারা না তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করে, না তাদেরকে হত্যা করে। (তিন) যারা লোভনীয় বস্তুর দিকে ঝুঁকে পড়ার পর মহামহিমান্বিত আল্লাহর (ভয়ের জন্যে তা পরিত্যাগ করে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ তোমরা তোমাদের ঈমান ও দ্বীনের কথা আল্লাহকে জানাচ্ছ? অথচ আল্লাহ এমনই যে, যমীন ও আসমানের অণুপরিমাণ জিনিসও তাঁর নিকট গোপন নেই। যা কিছু আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে রয়েছে সবই তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।

মহান আল্লাহ বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! যেসব আরব বেদুঈন ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে তোমাকে অনুগ্রহের খোটা দিচ্ছে তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা ইসলাম কবুল করেছে বলে আমাকে অনুগ্রহের খোটা দিয়ো না। তোমরা ইসলাম কবুল করলে, আমার আনুগত্য করলে এবং আমাকে সাহায্য করলে তোমাদের নিজেদেরই উপকার হবে, বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, এটা তোমাদের প্রতিই আল্লাহর বড় অনুগ্রহ, যদি তোমরা তোমাদের ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী হও।

সুতরাং আল্লাহ তা’আলার কাউকেও ঈমানের পথ দেখানো অর্থ তার উপর তার ইহসান বা অনুগ্রহ করা। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুনায়েনের যুদ্ধের শেষে (যুদ্ধলব্ধ মাল বন্টনের ক্ষেত্রে) আনসারদেরকে বলেছিলেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পেয়েছিলাম না? অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আমার কারণে তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেছেন? তোমরা তো পৃথক পৃথক হয়েছিলে? অতঃপর আমার কারণে আল্লাহ তোমাদেরকে একত্রিত করেছেন এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি করেছেন? তোমরা তো দরিদ্র ছিলে? অতঃপর আল্লাহ আমার কারণে তোমাদেরকে সম্পদশালী করেছেন?” তারা তার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে সমস্বরে বলতে থাকেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর চেয়েও বেশী আমাদের উপর অনুগ্রহকারী।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বানু আসাদ গোত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করে এবং বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা মুসলমান হয়েছি এবং আরবরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু আমরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সম্পর্কে বলেনঃ “এদের বোধশক্তি কম এবং তাদের মুখ দ্বারা শয়তানরা কথা বলছে।” তখন (আরবী)-এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। পুনরায় আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রশস্ত ও ব্যাপক জ্ঞান এবং বান্দাদের সমস্ত আমল সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। তাঁর বান্দাদের সমস্ত আমলের তিনি পূর্ণ খবর রাখেন।

Leave a Reply