Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২০০/হে মানুষ:-১০) [# সহজ সরল জীবনযাপন : – #কাজেই তুমি উপদেশ দাও, যদি উপদেশ উপকারী হয়:- #সফলকাম হতে পবিত্রতা অবলম্বন কর:-] www.motaher21.net সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা পারা:৩০ ১- ১৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- #তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- #তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০০/হে মানুষ:-১০)
[# সহজ সরল জীবনযাপন : –
#কাজেই তুমি উপদেশ দাও, যদি উপদেশ উপকারী হয়:-
#সফলকাম হতে পবিত্রতা অবলম্বন কর:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা
পারা:৩০
১- ১৯ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আল-আ’লা

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৮৭

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : হযরত আলী (রা.) থেকে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন যে, এই সূরাটি ছিলো রসূল (স.)-এর খুব প্রিয়। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দুই ঈদ ও জুময়ার নামায সূরা আ’লা ও সূরা গাশিয়া দিয়ে পড়তেন । কখনো কখনো ঈদ ও জুময়া একই দিনে অনুষ্ঠিত হতো এবং তিনি সে ক্ষেত্রে উভয় নামায এই দুই সূরা দিয়ে পড়তেন । যেহেতু এই সূরাটি সমগ্র বিশ্ব জগতকে এবাদাতের স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে, তার সর্বত্র বিশ্বপ্রভুর তাসবীহ ও গুণগান ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয় এবং তাকে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণার একটা স্থান হিসাবে তুলে ধরে, তাই রসূল (স.)-এর কাছে এটি প্রিয় হওয়ারই কথা । ‘তোমার সর্বোচ্চ গ্রভুর পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করো, যিনি ……… ‘ সূরার এই সুললিত সুদীর্ঘ ছন্দময় ভাষণ সুদূর প্রসারী গুণগানের আবহ ছড়িয়ে দেয়। সূরাটিতে রসূল (স.)-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তার ওপর মানুষকে ইসলামের বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়৷ ও তা প্রচার করার দায়িত্ব অর্পণের পর তাকে এই বলে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, ‘আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো, তখন আর তুমি ভুলবে না……. তোমার জন্য তোমার কাজকে সহজ করে দেবো……….।’ এভাবে আল্লাহ তায়ালা এই কোরআনের জন্য রসূল (স.)-এর মনকে সুরক্ষিত করা এবং তার ঘাড় থেকে এই বিরাট দায়িত্ব সরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন, আর তার সকল কাজকে এবং এই দাওয়াত প্রচারের কাজকে সহজ করে দেয়ার ওয়াদা করেছেন । এ কারণেও এ সূরা তার কাছে প্রিয় হওয়া স্বাভাবিক । এই সূরা ঈমানী চিন্তাধারার সুদৃঢ় স্তম্ভসমূহের বিবরণ বক্ষে ধারণ করে রেখেছে মহান স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহর একত্ব, তার ওহীর সত্যায়ন এবং আখেরাতের কর্মফল প্রাপ্তির সত্যতা প্রমাণ এ সূরার অন্যতম আলোচ্য বিষয়। এগুলো ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের প্রাথমিক উপাদান ৷ তারপর এই আকীদা তার সূদর প্রসারী শেকড়ের সাথে ও সুপ্রাচীনকাল থেকে বিরাজমান মূলের সাথে সংযুক্ত হয়। যেমন বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এ বক্তব্য পূর্ববর্তী কেতাবসমূহেও রয়েছে, ইবরাহীম ও মূসার কেতাবে ৷’ এই আকীদা-বিশ্বাসের যে স্বভাব প্রকৃতি এবং এই আকীদা বিশ্বাস প্রচারকারী রসূল ও বহনকারী উম্মতের যে স্বভাব প্রকৃতির চিত্র সূরাটিতে তুলে ধরা হয়েছে, তা হচ্ছে উদারতা ও সরলতা । এই সব কিছুই সূরার মূল আলোচ্য বিষয় থেকে বিচ্ছুরিত ও তার আওতাধীন । এর বাইরে রয়েছে আরো বহু সুদূর প্রসারী বিষয়বস্তু ৷

(৮৭-আলা) : নামকরণ:

প্রথম আয়াতে উপস্থাপিত আ’লা শব্দটিকে এর নাম গণ্য করা হয়েছে।

(৮৭-আলা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এর আলোচ্য বিষয় থেকে জানা যায়, এটি একেবারে প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম। ষষ্ঠ আয়াতে “আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো, তারপর তুমি আর ভূলবে না” এ বাক্যটিও একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, এটি এমন সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিল, যখন রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালোভাবে অহী আয়ত্ত্ব করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেননি। এবং অহী নাযিলের সময় তার কোন শব্দ ভুলে যাবেন বলে তিনি আশংকা করতেন। এই আয়াতের সাথে যদি সূরা ত্ব-হা’র ১১৪ আয়াত ও সুরা কিয়ামাহ’র ১৬-১৯ আয়াতগুলোকে মিলিয়ে পড়া হয় এবং তিনটি সূরার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোর বর্ণনাভংগী ও পরিবেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে এখানে উল্লেখিত ঘটনাবলীকে নিম্নোক্তভাবে সাজানো যায়: সর্বপ্রথম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে যে, তুমি চিন্তা করো না, আমি এ বাণী তোমাকে পড়িয়ে দেবো এবং তুমি আর ভুলে যাবে না। তারপর বেশ কিছুকাল পরে যখন সূরা কিয়ামাহ নাযিল হতে থাকে তখন তিনি অবচেতনভাবে অহীর শব্দগুলো পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। তখন বলা হয় “হে নবী! এই অহী দ্রুত মুখস্থ করার জন্য নিজের জিহ্বা সঞ্চালন করো না। এগুলো মুখস্থ করানো ও পড়িয়ে দেবার দায়িত্ব আমার। কাজেই যখন আমরা এগুলো পড়ি তখন তুমি এর পড়া মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকো, তারপর এর মানে বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমার।” শেষবার সূরা ত্ব- হা নাযিলের সময় মানবিক দুর্বলতার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার এই পরপর নাযিল হওয়া ১১৩টি আয়াতের কোন অংশ স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যাবার আশংকা করেন, ফলে তিনি সেগুলো স্মরণ রাখার চেষ্টা করতে থাকেন। এর ফলে তাঁকে বলা হয়: “আর কুরআন পড়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে এর অহী সম্পূর্ণরূপে পৌঁছে না যায়।” এরপর আর কখনো এমনটি ঘটেনি। নবী (সা.) আর কখনো এ ধরনের আশংকা করেননি। কারণ এ তিনটি জায়গা ছাড়া কুরআনের আর কোথাও এ ব্যাপারে কোন ইঙ্গিত নেই।

(৮৭-আলা) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এই ছোট্ট সূরাটিতে তিনটি বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে। এক, তাওহীদ। দুই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দান। তিন, আখেরাত।

তাওহীদের শিক্ষাকে প্রথম আয়াতের একটি বাক্যের মধ্যেই সীমিত করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে: আল্লাহর নামে তাসবীহ পাঠ করো। অর্থাৎ তাঁকে এমন কোন নামে স্মরণ করা যাবে না যার মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি, অভাব, দোষ, দুর্বলতা বা সৃষ্টির সাথে কোন দিক দিয়ে কোন প্রকার মিল রয়ে গেছে। কারণ দুনিয়ায় যতগুলো ভ্রান্ত আকীদার জন্ম হয়েছে তার সবগুলোর মূলে রয়েছে আল্লাহ সম্পর্কিত কোন না কোন ভুল ধারণা। আল্লাহর পবিত্র সত্তার জন্য কোন ভুল ও বিভ্রান্তিকর নাম অবলম্বন করার মাধ্যমে এ ভুল ধারণাগুলো বিকশিত হয়েছে। কাজেই আকীদা সংশোধনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হচ্ছে, মহান আল্লাহকে কেবলমাত্র তাঁর উপযোগী পূর্ণ গুণান্বিত ও সর্বাঙ্গ সুন্দর নামে স্মরণ করতে হবে।

এরপর তিনটি আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের এমন এক রবের তাসবীহ পাঠ করার হুকুম দেয়া হয়েছে যিনি বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে সমতা কায়েম করেছেন। তার ভাগ্য তথা তার ক্ষমতাগুলোর সীমারেখা নির্ধারণ করেছেন এবং যে কাজের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সম্পন্ন করার পথ তাকে বাতলে দিয়েছেন। তোমরা নিজের চোখে তাঁর ক্ষমতার বিস্ময়কর ও বিচিত্র প্রকাশ দেখে চলছো। তিনি মাটির বুকে উদ্ভিদ ও গাছপালা উৎপন্ন করেন আবার সেগুলোকে প্রাণহীন আবর্জনায় পরিণত করেন। তিনি ছাড়া আর কেউ বসন্তের সজীবতা আনার ক্ষমতা রাখেন না আবার পাতাঝরা শীতের আগমন রোধ করার ক্ষমতাও কারো নেই।

তারপর দু’টি আয়াতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে: এই যে কুরআন তোমার প্রতি নাযিল হচ্ছে এর প্রতিটি শব্দ কিভাবে তোমার মুখস্ত থাকবে, এ ব্যাপারে তুমি কোন চিন্তা করো না। একে তোমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত করে দেয়া আমার কাজ। একে তোমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখার পেছনে তোমার নিজম্ব কোন কৃতিত্ব নেই। বরং এটা আমার মেহেরবানীর ফল। নয়তো আমি চাইলে তোমার স্মৃতি থেকে একে মুছে ফেলতে পারি।

এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে: প্রত্যেক ব্যক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়নি। বরং তোমার কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র সত্যের প্রচার। আর এই প্রচারের সরল পদ্ধতি হচ্ছে, যে ব্যক্তি উপদেশ শুনতে ও তা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে তাকে উপদেশ দাও। আর যে ব্যক্তি তাতে প্রস্তুত নয় তার পেছনে লেগে থাকার প্রয়োজন নেই। যার মনে ভুল পথে চলার অশুভ পরিণামের ভয় থাকবে সে সত্য কথা শুনে তা মেনে নেবে এবং যে দুর্ভাগা তা শুনতে ও মেনে নিতে চাইবে না সে নিজের চোখেই নিজের অশুভ পরিণাম দেখে নেবে।

সবশেষে বক্তব্যের সমাপ্তি টেনে বলা হয়েছে: সাফল্য কেবল তাদের জন্য যারা আকীদা- বিশ্বাস, কর্ম ও চরিত্রে পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা অবলম্বন করবে এবং নিজেদের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়বে। কিন্তু লোকেরা শুধুমাত্র এ দুনিয়ার আরাম-আয়েশ এবং এর স্বার্থ ও আশা আনন্দের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে। অথচ তাদের আসলে আখেরাতের চিন্তা করা উচিত। কারণ এ দুনিয়া তো ক্ষণস্থায়ী। অন্যদিকে আখেরাত চিরস্থায়ী। আর দুনিয়ার নিয়ামতের তুলনায় আখেরাতের নিয়ামত অনেক বেশী ও অনেক উন্নত পর্যায়ের। এ সত্যটি কেবল কুরআনেই কুরআনেই বর্ণনা করা হয়নি, হযরত ইব্রাহীম (আ) ও হযরত মূসার (আ) সহীফাসমূহেও মানুষকে এই একই সত্যের সন্ধান দেয়া হয়েছিল।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১

سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَىۙ

(হে নবী!) তোমার সুমহান রবের নামের তাসবীহ পাঠ করো।১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) এর শাব্দিক অনুবাদ হবে, “তোমার সুমহান রবের নামকে পবিত্র ও মহিমাময় করো।” এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে এবং সবকটিই এখানে প্রযোজ্য। এক, আল্লাহকে এমন নামে স্মরণ করতে হবে যা তাঁর উপযোগী। তাঁর মহান সত্তার সাথে এমন নাম সংযুক্ত না করা উচিত যা অর্থের দিক দিয়ে তাঁর অনুপযোগী এবং তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। অথবা যে নামে তাঁর জন্য কোন ত্রুটি, অমর্যাদা বা শিরকের চিহ্ন পাওয়া যায়। অথবা যাতে তাঁর সত্তা, গুণাবলী বা কার্যবালী সম্পর্কে কোন ভুল বিশ্বাস পাওয়া যায়। এজন্য কুরআন মজীদে আল্লাহ নিজেই নিজের জন্য যেসব নাম ব্যবহার করেছেন অথবা অন্য ভাষায় এই নামগুলোর সঠিক অনুবাদ যে শব্দগুলোর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো ব্যবহার করাই হবে সবচেয়ে বেশী সংরক্ষিত পদ্ধতি। দুই, সৃষ্টির জন্য যেসব নাম নির্ধারিত রয়েছে সেগুলো আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা অথবা আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত নামগুলো সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা যাবে না। আর যদি এমন কিছু গুণবাচক নাম থাকে যেগুলো শুধু আল্লাহর জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত না হয়ে থাকে বরং বান্দার জন্যও সেগুলোর ব্যবহার বৈধ হয় যেমন রউফ (পরম স্নেহশীল) রহীম (পরম করুণাময়) করীম (মেহেরবান), সামী (সবকিছু শ্রবণকারী), বসীর (সর্বদ্রষ্টা) ইত্যাদি, তাহলে এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর জন্য এ শব্দগুলো যেভাবে ব্যবহার করা হয় বান্দার জন্য ঠিক সেভাবে ব্যবহার করা যাবে না। তিন, পরম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও মর্যাদাসহকারে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে হবে। এমন কোন পদ্ধতিতে বা এমন কোন অবস্থায় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা যাবে না, যা তাঁর প্রতি মর্যাদাবোধের পরিপন্থী। যেমন হাসি-ঠাট্টা করতে করতে, মলমূত্র ত্যাগকালে অথবা কোন গোনাহ করার সময় তাঁর নাম উচ্চারণ করা। অথবা এমন লোকদের সামনে তাঁর নাম উচ্চারণ করা যারা তা শুনে বেআদবী করতে থাকবে। এমন মজলিসেও তাঁর নাম বলা যাবে না। যেখানে লোকেরা অশালীন কাজে লিপ্ত থাকে এবং তাঁর নাম উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই তারা বিদ্রূপ করতে থাকবে। আবার এমন অবস্থায়ও তাঁর পবিত্র নাম মুখে আনা যাবে না যখন আশঙ্কা করা হবে যে, শ্রোতা তাঁর নাম শুনে বিরক্তি প্রকাশ করবে। ইমাম মালেকের (র) জীবনেতিহাসে একথা উল্লেখিত হয়েছে যে, কোন প্রার্থী তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি যদি তাকে তা দিতে না পারতেন তাহলে সাধারণ লোকদের মতো “আল্লাহ তোমাকে দেবেন” একথা না বলে অন্য কোনভাবে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করতেন। লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, প্রার্থীকে কিছু না দিয়ে অক্ষমতা প্রকাশ করলে আসলে তার মনে বিরক্তি ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ অবস্থায় আল্লাহর নাম নেয়া আমি সঙ্গত মনে করি না। কারণ সে বিরক্তি ও ক্ষোভের সাথে আল্লাহর নাম শুনবে।

হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত উকবাহ ইবনে আমের জুহানী (রা.) থেকে রেওয়ায়াতে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ এ আয়াতের ভিত্তিতেই সিজদায় سُبحَانَرَبِّى الْاَعْاى পড়ার হুকুম দিয়েছিলেন। আর রুকূ’তে তিনি سُبحَا نَرَبِّىَ الْعَضِيْم পড়ার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার ভিত্তি ছিল সূরা ওয়াকিয়ার শেষ আয়াতটি فَسَبِّح بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَضِيْمِ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, হাকেম ইবনুল মুনযির)

ফী জিলালিল কুরআন:

তোমার সর্বোচ্চ প্রভুর নামে পবিত্রতা ঘোষণা করো ………. মৃদু উচ্চারিত সুললিত এই প্রারন্তিক বক্তব্য দ্বারা সূরার সূচনা গোটা পরিবেশকে আল্লাহর গুণগান ও পবিত্রতা ঘোষণার ধ্বনিতে মুখরিত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা ও গুণগানের তত্ত্ব । পবিত্রতা ঘোষণার আদেশের পরপরই যে বিশেষণগুলো একের পর এক উল্লেখ হয়েছে, তা হচ্ছে, ‘সর্বোচ্চ (প্রভু) যিনি সৃষ্টি করেছেন, অতপর সৃষ্টিকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, যিনি পরিকল্পনা করেছেন অতপর পথ দেখিয়েছেন, যিনি বিচরণ ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন, অতপর তাকে বানিয়েছেন শস্যহীন বিরাণ।’ এ সকল বিশেষণ দ্বারা গোটা সৃষ্টিজগতকে এমন একটা এবাদাতখানা হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যার প্রতিটি কোণ এই সব প্রশংসা কীর্তনে মুখরিত ৷ এ দ্বারা মহাবিশ্বকে এমন একটা প্রদর্শনী ক্ষেত্র রূপে চিত্রিত করা হয়েছে, যাতে মহান ও সুনিপূণ স্রষ্টার নিদর্শনসমূহ প্রতিভাত ৷ ইনি সেই স্রষ্টা, যিনি কোনো নমুনা ও মডেল ছাড়াই সৃষ্টি করেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টিকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন এবং যিনি পরিকল্পনা করেছেন ও পথ দেখিয়েছেন ৷’ তাসবীহ পাঠ কি ও কেন? : তাসবীহ হচ্ছে মহত্ত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণা করা, আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম গুণাবলীর মর্ম স্মৃতিপটে জাগরূক করা, সেই গুণাবলী থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি, তা থেকে নির্গত প্রেরণা ও উদ্দীপনা, তা থেকে আধ্যাত্মিক স্বাদ হৃদয় ও চেতনা দিয়ে উপভোগ করা । তাসবীহ শুধু মুখে সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ জপ করাই নয়। ‘তোমার সর্বোচ্চ প্রভুর নামে তাসবীহ করো’ এ কথাটি মানুষের মনমস্তিস্কে ও চেতনায় এমন একটি অবস্থা ও ভাবের সৃষ্টি করে, যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। চেতনা দিয়ে অনুভব করা, উপলব্ধি করা ও আস্বাদন করা যায়। এই গুণাবলীর মর্মোপলব্ধি থেকে বিচ্ছুরিত আলো দ্বারা জীবনকে উদ্ভাসিত করার প্রেরণা পাওয়া যায়। এ সূরায় সর্বপ্রথম যে গুণবাচক শব্দটির উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো ‘রব’ ও ‘আ’লা’ ৷ ‘রব’ শব্দ দ্বারা বুঝায় লালন-পালনকারী ও তত্ত্বাবধানকারী । এই গুণবাচক শব্দের মর্ম ও তার সৃষ্টি করা আবহ সূরার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট, তার সুসংবাদ ও সুললিত ছন্দময় শব্দ বিন্যাসের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর ‘আ’লা’ শব্দটি সীমাহীন দিগন্ত অভিমুখে অভিযাত্রার পথ উন্মোচন করে এবং আল্লাহ্‌র গুণকীর্তন ও তাসবীহ করতে করতে অনির্দিষ্ট সীমানার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য আত্মাকে উৎসাহিত করে । এটি মহত্ত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণার ভাবধারার সাথে সংগতিপূর্ণ । গুণবাচক এই ‘আ’লা’ শব্দটিকে গভীরভাবে হৃদয়ংগম করা উক্ত পবিত্রতা ঘোষণার ভাবধারার সাথেও ওতপ্রোততাবে জড়িত । এখানে প্রাথমিক সম্বোধন রসূল (স.)-কে করা হয়েছে। ‘পবিত্রতা ঘোষণা করো’ এ আদেশটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হয়েছে। এ বাক্যটিতে যে প্রগাঢ় মমত্ত্ব সৌহার্দ প্রকাশ করা হয়েছে, তার স্থান ভাষাগত অভিব্যক্তি থেকে অনেক উর্ধে। এ আদেশটি রসূল (স.) যখনই পড়তেন, সূরার অন্যান্য আয়াত পড়ার আগে এর প্রতি তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে বলতেন, ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ অর্থাৎ আমার সর্বোচ্চ প্রভুর পবিত্রতা ঘোষণা ও গুণকীর্তন করছি। সুতরাং এটি একাধারে আল্লাহর ডাক ও রসূলের সাড়া, আল্লাহর আদেশ ও রসূলের আনুগত্য এবং আল্লাহর মমত্ত্ব প্রকাশ ও রসূলের জবাব । তিনি তাঁর প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত ৷ প্রত্যক্ষভাবে তার কথা শোনেন ও জবাব দেন। অত্যস্ত ঘনিষ্ঠ সংযোগ ও মমত্বপূর্ণ পরিবেশে এই আলাপ বিনিময় হয়। যখন এ আয়াত অর্থাৎ সূরা আ’লার প্রথম আয়াত নাযিল হলো, রসূল (স.) বললেন, এটিকে তোমরা তোমাদের সেজদার অন্তর্ভুক্ত করো (অর্থাৎ ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ এর আকারে) এভাবে এই তাসবীহ রুকু ও সেজদার চিরস্থায়ী অংশ হয়ে নামাযের সাথে যুক্ত হয়েছে। এ তাসবীহ প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর । এটিকে নামাযে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য এই যে, এটি একটি প্রত্যক্ষ আদেশের প্রত্যক্ষ ইতিবাচক সাড়া হয়ে টিকে থাকুক, অথবা আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, একটি প্রত্যক্ষ অনুমতির প্রত্যক্ষ জবাব । বস্তুত আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তার বান্দাদেরকে নিজের প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার অনুমতি দান তাদের ওপর তার একটি অন্যতম নেয়ামত ও অনুগ্রহ বিশেষ । অর্থাৎ এটা হচ্ছে তার সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি । মানুষের সীমিত বুদ্ধিতে নৈকট্য লাভের যতো উত্তম উপায় কল্পনা করা যেতে পারে, নামায তার মধ্যে সর্বোত্তম নৈকট্য লাভের উপায় । এই উপায়ে আল্লাহ্‌ তায়ালা তার বান্দাদেরকে সুযোগ দেন যেন তারা তার গুণাবলী প্রকাশ ও গুনকীর্তনের মাধ্যমে তার সত্ত্বাকে তাদের সাধ্য ও সামর্থ অনুসারে জানতে ও বুঝতে পারে । আর এ কথা বলারই অপেক্ষা রাখে না যে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির যে কোনো অনুমতি, চাই তা সম্পর্ক সৃষ্টির যে কোনো উপায় অনুসরণের মাধ্যমেই হোক না কেন, বান্দাদের ওপর তার এক অসাধারণ অনুগ্রহ ও দান।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-২

الَّذِیْ خَلَقَ فَسَوّٰى۪ۙ

যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং সমতা কায়েম করেছেন।২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২) অর্থাৎ পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আর যে জিনিসটিই সৃষ্টি করেছেন তাকে সঠিক ও সুঠাম দেহ সৌষ্ঠব দান করেছেন। তার মধ্যে ভারসাম্য ও শক্তির অনুপাত সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাকে এমন আকৃতি দান করেছেন যে, তার জন্য এর চেয়ে ভালো আকৃতির কল্পনাই করা যেতে পারে না। একথাটিকে সূরা আস সাজদায় নিম্নোক্তভাবে বলা হয়েছেঃ اَلَّزِيْآ اَحْسَنَ كُلَّ شَىْء خَاَقَةُ “তিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে চমৎকার তৈরি করেছেন।” এভাবে দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের যথোপযোগী ও যথা অনুপাতে সৃষ্টি হওয়াটাই একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কোন এক মহাবিজ্ঞ স্রষ্টা এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। কোন আকস্মিক ঘটনাক্রমে অথবা বহু স্রষ্টার কর্মতৎপরতায় বিশ্ব-জাহানের এই অসংখ্য অংশের সৃষ্টিতে এ ধরনের সুষ্ঠ রুচিশীলতা এবং সামগ্রিকভাবে এদের সবার অংশের সম্মিলনে বিশ্ব-জাহানে এ ধরনের শোভা ও সৌন্দর্য সৃষ্টি হওয়া সম্ভবপর নয়।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৩

وَ الَّذِیْ قَدَّرَ فَهَدٰى۪ۙ

যিনি তাকদীর গড়েছেন৩ তারপর পথ দেখিয়েছেন।৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৩) অর্থাৎ প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করার আগে দুনিয়ায় তাকে কি কাজ করতে হবে, এই কাজ করার জন্য তাকে কতটুকু সময় দেয়া হবে, তার আকার-আকৃতি কেমন হবে, তার মধ্যে কি কি গুণাবলী থাকবে, তার স্থান কোথায় হবে, তার জন্য প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব এবং কাজের জন্য কি কি সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ সরবরাহ করা হবে, কখন সে অস্তিত্ব লাভ করবে, নিজের অংশের কাজটুকু সে কতদিনে সম্পন্ন করবে এবং কবে কিভাবে খতম হয়ে যাবে, এসব কিছুই ঠিক করে দিয়েছেন। এই সমগ্র পরিকল্পনাটির সামগ্রিক নাম হচ্ছে “তাকদীর।” বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের জন্য মহান আল্লাহ এই তাকদীর গড়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, কোন রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই এমনি হঠাৎ উদ্দেশ্যহীনভাবে এই সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন হয়নি। বরং স্রষ্টার সামনে এজন্য একটি পূর্ণ পরিকল্পনা ছিল। সবকিছুই সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন হচ্ছে। (আরো বেশী ব্যাখ্যা জানার জন্য তাফহীমুল কুরআন, আল হিজর, ১৩ – ১৪ টীকা , আল ফুরকান ৮ টীকা , আল ক্বামার ২৫ টীকা এবং আবাসা ১২ টীকা দেখুন।)

টিকা:৪) অর্থাৎ কোন জিনিসকে কেবলমাত্র সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি বরং যে জিনিসকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে সেই কাজ করার পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন। অন্য কথায় তিনি শুধুমাত্র স্রষ্টাই নন, পথ প্রদর্শকও। যে জিনিসটিকে তিনি যে মর্যাদার অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন তাকে তার উপযোগী পথনির্দেশনা দেবার এবং তার জন্য শোভনীয় উপায়ে পথ দেখাবার দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও তারকাকে তিনি এক ধরনের পথ দেখিয়েছেন। সে পথে তারা চলতে এবং তাদের ওপর যে কাজের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সম্পাদন করে যাচ্ছে। আর এক ধরনের পথনির্দেশনা দিয়েছেন। পানি, বায়ু, আলো, জড় পদার্থ ও খনিজ পদার্থকে। সেই অনুযায়ী যে কাজের জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে ঠিক সেই কাজই তারা করে যাচ্ছে। উদ্ভিদকে অন্য এক ধরনের পথনির্দেশনা দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী তারা মাটির অভ্যন্তরে নিজেদের শিকড় বিস্তার করছে ও মাটির বুক চিরে অংকুরিত হচ্ছে। যেখানে যেখানে আল্লাহ তাদের জন্য খাদ্য সৃষ্টি করে রেখেছেন সেখান থেকে তা আহরণ করছে। কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে, পাতা ও ফুলে ফলে সুশোভিত হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য যে কাজ নির্ধারিত করা হয়েছে তা করে যাচ্ছে। এক ধরনের পথনির্দেশনা দিয়েছেন স্থলভাগ, জলভাগ ও শূন্যে উড্ডয়নশীল অসংখ্য প্রজাতির এবং তাদের প্রত্যেকটি প্রাণীর জন্য। প্রাণীদের জীবন যাপন এবং তাদের কার্যকলাপে এর বিস্ময়কর ও সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। এমনকি একজন নাস্তিকও অবশেষে একথা মানতে বাধ্য হয় যে, বিভিন্ন ধরনের প্রাণীরা এমন কিছু নৈসর্গিক জ্ঞানের অধিকারী হয় যা মানুষ তার ইন্দ্রিয় তো দূরের কথা নিজের যন্ত্রপাতির সাহায্যেও অর্জন করতে পারে না। তারপর মানুষের জন্য রয়েছে আবার দু’টি আলাদা ধরনের পথনির্দেশনা। তার মধ্যে যে দু’ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক ধরনের পথনির্দেশনার সম্পর্ক রয়েছে মানুষের জৈবিক জীবনের সাথে। এরই বদৌলতে প্রতিটি মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই দুধ পান করা শিখে নেয়। এরই মাধ্যমে মানুষের চোখ, নাক, কান, হৃদয়, মস্তিস্ক, যকৃৎ, হৃদপিণ্ড, কলিজা, ফুসফুস, পাকস্থলী, অন্ত্র, স্নায়ু, শিরা-উপশিরা সবকিছু যার যার কাজ করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষ সচেতন থাক বা নাই থাক তাতে কিছু আসে যায় না। তারই ইচ্ছা-অনিচ্ছার সাথে এই অংগ-প্রত্যংগগুলোর কাজের কোন সম্পর্ক নেই। এ পথনির্দেশনার আওতাধীনেই মানুষের মধ্যে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যাবস্থায় এমন সব শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসতে থাকে যা কোথাও এবং কোন ক্ষেত্রেই তার ইচ্ছা, সংকল্প, আশা আকাংক্ষা এমন কি তার চেতনা শক্তিরও মুখাপেক্ষী নয়। দ্বিতীয় পথনির্দেশনাটির সম্পর্ক হচ্ছে মানুষের বুদ্ধি ও চেতনাগত জগতের সাথে। চেতনাহীন জগতের পথনির্দেশনা থেকে এর ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ জীবনের এ বিভাগে মানুষকে এক ধরনের স্বাধীন কর্মক্ষমতা দান করা হয়েছে। যার ফলে যে ধরনের পথনির্দেশনা স্বাধীন কর্মক্ষমতাবিহীন জীবনের উপযোগী তা এ বিভাগের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। এ দ্বিতীয় পর্যায়ের পথনির্দেশনাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য মানুষ যতই চেষ্টা করুক এবং যতই যুক্তি-তর্কের আশ্রয় নিক না কেন, যে স্রষ্টা এই সমগ্র বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসকে তার আকৃতি, প্রকৃতি ও অবস্থা অনুযায়ী পথনির্দেশনা দেবার ব্যবস্থা করেছেন তিনি মানুষকে এই দুনিয়ায় স্বাধীনভাবে সব জিনিস ভোগ-ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এই ক্ষমতা ব্যবহারের সঠিক ও ভ্রান্ত পদ্ধতি কি হতে পারে তা তাকে জানিয়ে দেননি, একথা অবশ্যি মেনে নেবার কোন কারণ নেই। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নাহল ৯ , ১০ , ১৪ ও ৫৬ টীকা, ত্বা-হা ২৩ টীকা , আর রহমান ২ ও ৩ টীকা এবং আদ দাহর ৫ টীকা )।

ফী জিলালিল কুরআন:

সৃষ্টিজগত ও স্রষ্টা : ‘তোমার সর্বোচ্চ প্রভুর প্রশংসা করো, যিনি সৃষ্টি করেছেন অতপর ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন এবং যিনি পরিকল্পনা করেছেন অতপর পথ প্রদর্শন করেছেন।’ অর্থাৎ যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে সৃষ্টি করে তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, অতপর তার সৃষ্টিকে পূর্ণতা দান করেছেন এবং তাকে তার সমুচিত পূর্ণতার স্তরে পৌছে দিয়েছেন……… আর প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য তার কাজ, তার পথ ও গন্তব্য পরিকল্পনা করেছেন, অতপর যে উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করেছেন তার দিকে পথ প্রদর্শন করেছেন, তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি সেটা তাকে জানিয়েছেন এবং যতোদিন সে বেঁচে থাকবে, ততোদিন তার জন্যে যা উপযুক্ত, তা নির্ধারণ করেছেন ও তার দিকে পথ প্রদর্শনও করেছেন। এই সর্ববৃহৎ সত্যটি সৃষ্টিজগতের প্রতিটি জিনিসে প্রতিফলিত ৷ বিশ্বজগতে বিরাজমান প্রতিটি বস্তু এ সত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে, চাই সে বস্তু যতোই ছোট বা বড় এবং যতোই মর্যাদাবান বা নগণ্য হোক না কেন। প্রতিটি জিনিস ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, প্রতিটি জিনিস নিজের কর্তব্য পালনের যোগ্যাতাসম্পন্ন, প্রতিটি জিনিসের সৃষ্টির উদ্দেশ্য নির্ধারিত, সেই উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে সহজতম পন্থা তার হস্তগত করে দেয়া হয়েছে এবং সকল বস্তুর মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য ও সমন্বয় বিদ্যমান, যাতে তারা তাদের সামষ্টিক ভূমিকা সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, আবার ব্যক্তিগত ভূমিকা পালন করার জন্য এককভাবেও ক্ষমতাবান । একটি পরমাণু এককভাবে তার সকল ইলেকট্রোন ও প্রোটোনের সাথে সুসমন্বিত, যেমন সৌরজগতের সূর্য, নক্ষত্র ও গ্রহ-উপ্রহের মধ্যে পূর্ণ সমন্বয় বিরাজমান । এই সৌরজগত ও তার সকল জ্যোতিঙ্ক আলাদা আলাদাভাবে ও সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকেফহাল এবং তা সে পালনও করে। শরীরের প্রতিটি একক সজীব কোষ, আপন কাঠামোতে ও নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন, পৃথিবীর সর্বাধিক উন্নত, সজীব ও সংযুক্ত সৃষ্টির পর্যায়ভুক্ত একা একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব । একটি একক পরমাণু সৌরজগতের মধ্যে যেমন মজুত রয়েছে তেমনি একটি একক দেহকোষ ও উন্নততম প্রাণীদের মধ্যেও রয়েছে এর সংগঠন ও সংযোগের বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় । এই ধরনের কাঠামোগত পূর্ণতায়, এই ধরনের সামষ্টিক সমন্বয়ে এবং এই ধরনের ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় তিনিই রয়েছেন যিনি এগুলোকে শাসন ও পরিচালনা করেন। আর সমগ্র সৃষ্টিজগত সেখানে উপস্থিত থেকে এই সুগভীর সত্যকে প্রত্যক্ষ করছে। মানুষের মন এই মহাসত্যকে তখনই সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করে যখন এই মহাবিশ্বের দৃশ্যগুলোকে সে পর্যবেক্ষণ করে এবং উন্মুক্ত অনুভূতি দ্বারা সকল জিনিসকে উপলব্ধি করে। এই ঐশী উপলব্ধি তথা এলহাম যে কোনো মানুষ যে কোনো পরিবেশে, জন্মগতভাবে অর্জিত জ্ঞানের ন্যায় যে কোনো সময়েই অর্জন করতে পারে। যখন তার হৃদয়ের জানালাগুলো খুলে যায় এবং মহাবিশ্বের দৃশ্যগুলো পর্যবেক্ষণের জন্যে তার অনুভূতির তন্ত্রীগুলো সজাগ হয়ে ওঠে তখন বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেই এর উত্তর খুজে পাওয়া যায়। এরপর পর্যবেক্ষণ ও অর্জিত জ্ঞান পৃথক পৃথক দৃষ্টান্ত দিয়ে এলহাম বা ঐশী উপলব্ধির প্রথম দৃষ্টিতে অর্জিত তত্ত্ব ও তথ্যের বিশ্লেষণ করে । উক্ত পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে সঞ্চিত জ্ঞানের কিছু তথ্য মহাবিশ্বে বিরাজমান মহাসত্যের অংশ বিশেষের কিঞ্চিত আভাস দেয় । নিউইয়র্কস্থ বিজ্ঞান একাডেমীর চেয়ারম্যান বিজ্ঞানী ক্রেসী মোরিসন রচিত “মানুষ একাকী বাস করে না’ গ্রন্থে(অধ্যাপক মাহমুদ সালেহ, আল্ফালাকী গ্রন্থটির যে অনুবাদ করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘বিজ্ঞান ঈমানেরই উদ্দীপক) বলেন, ‘আপন জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনে পাখিকুলের প্রচন্ড সহজাত ঝোঁক থাকে। আপনার ঘরের দরজার পাশেই যে চড়ুইর বাসা, সে শরৎকালে দক্ষিণের অজানা গন্তব্যে চলে যায়, কিন্তু পরবর্তী বসন্তে সে ঠিক মতোই তার বাসায় ফিরে আসে । সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের (অর্থাৎ আমেরিকার) অধিকাংশ পাখি দক্ষিণ দিকে চলে যায়। অধিকাংশ সময় তারা সমুদ্রের ওপর দিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে, কিন্তু তারা তাদের পথ হারায় না বা ঠিকানা ভোলে না। আর পত্রবাহক পায়রা যখন কোনো খাঁচার ভেতরে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণকালে অনেক নতুন শব্দ শুনতে শুনতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তখন ক্ষণিকের জন্য আশপাশে চক্কর কাটে এবং তারপরেই নিজের গম্ভব্য স্থানের দিকে নির্ভুলভাবে পাড়ি জমায় । গাছপালার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়-ঝঞ্ঝা যখন মৌমাছির পথ চিনে চলার পরিচিত সকল আলামত নষ্ট করে দেয়, তখনও মৌমাছি নিজের চাক চিনতে কিন্তু ভুল করে না। ঘরে ফেরার এই অনুভূতি ও চেতনা মানুষের ভেতরে দুর্বল। তাই তারা এর স্বল্প পরিমাণ পুঁজিকে সে সফরে জ্ঞানের সরঞ্জামাদি দ্বারা পূর্ণ করে নেয়। এই তীব্র জন্মগত ঝোঁক ও তাড়না আমাদের প্রয়োজন বটে। তবে আমাদেরও বোধশক্তি সেই প্রয়োজন অনেকটা মিটিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীট পতংগের অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো শক্তিশালী চোখ রয়েছে। সেসব চোখের শক্তির মাত্রা আমাদের জানা নেই বটে। শকুনের রয়েছে টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ জাতীয় চোখ। এখানেও মানুষ স্বীয় যান্ত্রিক সরঞ্জামাদির জোরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। মানুষ টেলিস্কোপ দিয়ে এত দূরের নীহারিকাকে দেখতে পায়, যা দেখতে তার খালি চোখের আরো ২০ লক্ষ গুণ বেশী দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হওয়া দরকার।‌ খালি চোখে একেবারেই দেখা যায় না এমন জীবাণুকেও বৈদ্যুতিক মাইক্রোষ্কোপ (অনুবীক্ষণ যন্ত্র) দিয়ে দেখতে পায়। এমনকি যে ক্ষুদ্র কীটপতংপ বিভিন্ন বস্তুকে কামড়ে পড়ে থাকে তাও দেখা যায়। আপনি আপনার বৃদ্ধ ঘোড়াকে যখন একাকী রাস্তায় ছেড়ে দেবেন, তখন তা রাস্তা ধরেই চলতে থাকবে, রাতের অন্ধকার যতোই গাঢ় হোক না কেন। অস্পষ্ট ভাবে হলেও সে রাস্তা দেখতে পায়। রাস্তায় ও রাস্তার দু’পাশে তাপমাত্রার যে তারতম্য ঘটে, তাও সে টের পায়। রাস্তার ধূলোময়লার ভেতর দিয়ে আসা আলোর প্রভাবে তার চোখ দুটো সামান্যই ধাঁধায় । পেঁচা ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতেও বরফাচ্ছাদিত ঘাসের ওপর দিয়ে চলাচলরত ইঁদুরকে দেখতে পায় আর যে প্রক্রিয়াকে আমরা আলো বলি, তাতে বিকিরণ ঘটিয়েই আমরা রাতকে দিনে রূপান্তরিত করি। ‘শ্রমিক মৌমাছিরা মৌমাছি পালনে ব্যবহৃত কাঠামোতে বিভিন্ন আকারের বহু সংখ্যক কক্ষ বানায় । এগুলোর মধ্য থেকে ছোট ছোট কক্ষগুলো দক্ষ শ্রমিকদের জন্যে এবং সবচেয়ে বড়টি হয় পুরুষ মৌমাছির জন্য । তারা একটা বিশেষ কক্ষ বানায় গর্ভবতী রাণীদের জন্য । রাণী মৌমাছি পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট কূঠরিগুলোতে অনুৎপাদনশীল ডিম পাড়ে, অথচ স্ত্রীজাতীয় শ্রমিক মৌমাছিও অপেক্ষমান রাণী মৌমাছিদের জন্য নির্ধারিত কক্ষগুলোতে উৎপাদনশীল ডিম পাড়ে । যে সব স্ত্রীজাতীয় মৌমাছি নতুন প্রজন্মের আগমনের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন কাটানোর পর স্ত্রীর ভূমিকায় পরিবর্তিত দায়িত্ব গ্রহণ করে, তারা শিশু মৌমাছির জন্য খাদ্য তৈরী করার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যায়। মধু ও রেণু চিবানো ও অগ্রিম পরিপাকের মাধ্যমে তারা এ কাজ সম্পন্ন করে। এরপর পুরুষ ও স্ত্রী মৌমাছিদের বয়স বাড়ার পর এক পর্যায়ে গিয়ে তারা চিবানো ও অগ্রিম পরিপাকের কাজ থেকে অবসর নেয়। তারা তখন মধু ও রেণু ছাড়া আর কিছুই খাওয়ায় না। যে সকল স্ত্রীজাতীয় মৌমাছি এভাবে কাজ করে তারা শ্রমিকে পরিণত হয়। রাণী মৌমাছির কক্ষগুলোতে যে সব স্ত্রী মৌমাছি থাকে, তাদের জন্য চিবানো ও অগ্রিম পরিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকে। আর এ কাজ যারা করে তারাই একদিন মৌমাছিদের রাণী হয়ে যায়। আর শুধু এরাই উৎপাদনশীল ডিম পাড়ে । এই পৌনপুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য অনেকগুলো বিশেষ কক্ষ ও বিশেষ বিশেষ ডিমের প্রয়োজন হয়। অনুরূপ খাদ্য পরিবর্তনের বিস্বয়কর প্রভাবেরও প্রয়োজন হয় । আর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটার জন্য যা অত্যাশ্যক তা হলো ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করা, বাছবিচার করা ও খাদ্যের কার্যকারিতা সংক্রান্ত তথ্য বাস্তবায়ন। এই পরিবর্তনগুলো বিশেষভাবে একটি সামষ্টিক জীবনে কার্যকর এবং এগুলো তাদের অস্তিত্বের জন্যই অপরিহার্য । এ জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা অত্যাবশ্যক, তা এই সামষ্টিক জীবন শুরু করার পর অনিবার্যভাবেই অর্জিত হয়ে যায়। অথচ এই জ্ঞান ও দক্ষতা জন্মগতভাবে মৌমাছির সত্ত্বা ও তার টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য নয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, বিশেষ বিশেষ অবস্থায় খাদ্যের কার্যকারিতা সংক্রান্ত জ্ঞান মানুষের চেয়েও মৌমাছির বেশী । কুকুরকে যে অনুসন্ধানী নাক দেয়া হয়েছে, তার কল্যাণে তার কাছ দিয়ে যে প্রাণীটাই যাক না কেন, সে টের পায়। অথচ মানুষ আজ পর্যন্ত এমন কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেনি, যা তার নিজের দুর্বল ঘ্রাণ শক্তিকে তীব্রতর করতে পারে। এতদসত্ত্বেও আমাদের ঘ্রাণশক্তি যতো দুর্বলই হোক না কেন-অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না এত সুক্ষ কণিকাকেও ঘ্রাণ নিয়ে চিনতে পারি। সকল প্রাণীই এমন অনেক শব্দ শুনতে পায়, যা আমাদের শ্রবণশক্তির নাগালের বাইরে, আমাদের সীমিত শ্রবণশক্তির তুলনায় তাদের শ্রবণশক্তি অনেক বেশী তীব্র । এদিকে মানুষের শ্রবণশক্তির অবস্থা এই যে, সে তার আবিষ্কৃত বিভিন্ন সাজসরঞ্জামের সাহায্যে একটা মাছির আওয়ায বহু মাইল দূর থেকে এরূপ শুনতে পায় যেন মাছিটি তার কানের কাছেই ভনভন করছে। এ ধরনের সরগঞ্জামাদির সাহায্যে মানুষ মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব পর্যন্ত এখন রেকর্ড করতে সক্ষম। একটা জলজ মাকড়সা নিজস্ব জাল দিয়ে নিজের জন্য বেলুন আকৃতির বাসা তৈরী করে। সেই বাসাকে সে পানির নিচে যে কোনো জিনিসের সাথে বেঁধে রাখে । তারপর সে দক্ষতার সাথে তার শরীরের ভেতরের পশমের সাথে একটি বাতাসের বুদুবুদ লটকিয়ে দেয়, সেটিকে পানির ভেতরে বহন করে অতপর তাকে নিজের বাসার নিচে ছেড়ে দেয়। যতক্ষণ মাকড়সার বাসা ফুলে ফেঁপে না ওঠে, ততক্ষণ এই কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে৷ এরপরই সে নিজের সন্তান প্রসব করে ও তাকে লালন করে। এভাবে সে পূর্বাহ্নেই সন্তানকে বাতাসের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নেয়। এখানে আমরা দেখতে পাই একটা সুসমন্বিত বংশানুক্রম পদ্ধতি- যাতে একাধারে প্রকৌশল, নির্মাণ এবং বৈমানিক বিদ্যার সমাবেশ ঘটেছে। ‘স্যামন’ মাছ বছরের পর বছর সমুদ্রে কাটানোর পর তার নিজস্ব নদীতে ফিরে আসে । (ইংল্যান্ডের লোকেরা স্কটল্যান্ডের এই মাছটিকে ‘স্যামন’ ফিস বলে উচ্চারণ করে।) আরো বড় কথা এই যে, সে যে উপনদীতে জন্ম গ্রহণ করেছিলো, সেই উপনদীর উৎস বৃহৎ নদীর দিকে উজিয়ে যায় । এভাবে সুনির্দিষ্টভাবে নিজের জন্মস্থানের দিকে ফিরে যেতে এ মাছকে কিসে উদ্বুদ্ধ করে? স্যামন মাছ যখন আপন নদী অভিমুখে উজিয়ে চলে, তখন যদি তাকে অন্য কোনো উপনদীতে নিক্ষেপ করা হয়, তবে সে তৎক্ষণাত বুঝতে পারে যে, ওটা তার জন্মদাত্রী জলাধার নয়। এ জন্যে সে নদীর ভেতর দিয়ে নিজের আলাদা চলার পথ বের করে নেয় এবং স্রোতের বিপরীতমুখী পথে চলতে চলতে নিজের জন্মস্থানের দিকে এগিয়ে যায়। এখানে এর চেয়েও জটিল একটা রহস্য রয়েছে, যার জট খোলা এখনো বাকী । রহস্যটা এক ধরনের জলজ সাপের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ সাপের স্বভাব ঠিক স্যামন মাছের বিপরীত ৷ এই বিস্ময়কর প্রাণী পরিণত বয়সে পৌছামাত্রই নিজ নিজ পুকুর ও নদী-খাল থেকে হিজরত করতে থাকে। সে যদি ইউরোপে থাকে, তবে মহাসাগরের ভেতর দিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে বারমুডার দক্ষিণে বহু দূর চলে যায়। তারপর সেখানেই ডিম পাড়ে ও মারা যায়। এই সাপের বাচ্চারা যখন নিজেদেরকে একটা বিচ্ছিন্ন ও অচেনা জলাশয়ে দেখতে পায়, তখন পেছনের দিকে ফিরে যায় এবং তাদের মায়েরা যে কিনারা থেকে এসেছিলো সেদিকে চলে যায়। সেখান থেকে প্রত্যেক নদীতে, হ্রদে ও পুকুরে ছড়িয়ে পড়ে । এজন্য জলজ সাপ যে কোনো জলাশয়ে বাস করতে সক্ষম । এরা তীব্র স্রোতের মোকাবেলা করে, ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে পাঞ্জা লড়ে এবং প্রচন্ড ঢেউয়ের বুক চিরে এক তীর থেকে আরেক তীরে গিয়ে ওঠে ৷ এর পরেই তারা শারীরিক পরিপক্বতা লাভ করে। এই পরিপক্বতা লাভের পর এবং এই সমগ্র ভ্রমণটি সম্পন্ন হওয়ার পর এক গোপন আইন তাকে পুনরায় তার আদি বাসস্থানে পাঠিয়ে দেয় । কোথা থেকে সে এই প্রেরণা লাভ করে, যা তাকে এরূপ নির্দেশনা দেয়? এমন কখনো ঘটেনি যে, আমেরিকার জলজ সাপ ইউরোপের জলাধারে বা ইউরোপের জলজ সাপ আমেরিকার জলাধারে ধরা পড়েছে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মে ইউরোপীয় জলজ সাপের পরিণত বয়সে পৌছতে এক বছর বা কিছু বেশী বিলম্ব ঘটে, যাতে সে যে অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করে, তা পুষিয়ে নিতে পারে। কেননা তার সফরের দূরত্ব তার সহযাত্রী মার্কিন সাপের দূরত্বের চেয়ে বেশী। আপনার কি মনে হয় যে, একটা জলজ সাপের ভেতরে যখন ধূলিকণা ও অণু পরমাণুগুলোর মিশ্রণ ঘটে, তখন সেই জিনিসটাই তার ভেতরে অপ্রতিরোধ্য ও দুর্নিবার ইচ্ছাশক্তি ও নির্দেশনা গ্রহণের ক্ষমতার জন্ম দেয়। আর যখন প্রবল বাতাসের ঝাপটায় কোনো নারী জাতীয় পতংগ জানালার মধ্য দিয়ে ঘরের চিলেকোঠায় আশ্রয় নেয়, তখন সে একটা গোপন সংকেত না পাঠিয়ে সেখান থেকে সরে না। তার স্বজন পুরুষ পতংগটি যতো দূরেই থাক এবং আপনি তাদের উভয়কে বিপথগামী করার জন্য নিজের কোনো তৎপরতা দ্বারা যতোই বাধা সৃষ্টি করুন, পুরুষ পতংগ ওই সংকেত পাবেই এবং তার প্রতি সাড়াও দেবে। তাহলে আপনি কি মনে করেন, ওই নগণ্য সৃষ্টির হাতে কোনো বেতারকেন্দ্র এবং পুরুষ পতংগের হাতে কোনো শব্দবাহী তারের পরিবর্তে কোনো মনস্তাত্ত্বিক বেতারযন্ত্র রয়েছে? আপনি কি মনে করেন, ওই নারী পতংগ বায়ু তরঙ্গে কম্পন সৃষ্টি করে এবং পুরুষ পতংগের যন্ত্রে সেই কম্পন ধরা পড়ে? টেলিফোন ও রেডিও দুটো বিস্ময়কর যন্ত্র । এ দুটি দ্বারা আমরা ত্বরিত যোগাযোগের সুযোগ পাই। তবে এই দুটির ক্ষেত্রেও আমরা একটা তার ও স্থানের মুখাপেক্ষী । এদিক থেকে দেখা যাচ্ছে, পতংগের এ সবের প্রয়োজন নেই। এই বিদ্যায় সে আমাদের চেয়েও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। উদ্ভিদ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে সুকৌশলে বিভিন্ন সৃষ্টিকে কাজে লাগায় যদিও ওইসব সৃষ্টির এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ থাকে না। যেমন কিছু কীটপতংগ এক ফুল থেকে রেণু নিয়ে আরেক ফুলে পৌছে দেয়। বাতাস এবং অন্যান্য চলমান প্রাণী ও বস্তু উদ্ভিদের বীজ স্থানান্তরের কাজ করে । সর্বশেষে এই উদ্ভিদ দোর্দন্ড প্রতাপশালী মানুষকে পর্যন্ত ফাদে আটকায় ৷ উদ্ভিদ প্রকৃতিকে সুন্দর করে এবং অঢেল চারা জন্মিয়ে দাতাগিরিতে মানুষকে পেছনে ফেলে দেয়৷ তবে চারা জন্মাতে সে অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করে ফেলে ৷ আর সে কারণে মানুষকে নিয়মিত লাংগল ও নিড়ানি ব্যবহারের ঝামেলা পোহাতে হয়। বীজ বপন, ফসল কাটা, বীজ সংরক্ষণ, আগাছা নির্মূল করা, শস্যকে কাটছাট করা ও তাদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা এ সবের দায়িত্ব মানুষেরই ঘাড়ে ন্যস্ত হয়। মানুষ এ দায়িত্ব পালনে গড়িমসি করলে তার ভাগ্যে জোটে ক্ষুধা, সভ্যতার ঘটে অধপতন এবং পৃথিবী ফিরে যায় আদিম প্রাকৃতিক অবস্থায় । কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরনের কিছু প্রাণী আছে, যাদের একটা দাড়া বা নখর খোয়া গেলে ধরে নিতে হয় যে তার শরীরের পুরো একটা অংশই বিনষ্ট হয়েছে। এমন দুর্ঘটনা ঘটলে সংগে সংগেই সে তার দেহকোষ ও প্রজননকারী উপাদানগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করার মাধ্যমে নতুন নখর জন্মাতে আরম্ভ করে। এ কাজ সম্পন্ন হওয়া মাত্রই পেশীগুলো নিষ্কৃয় হয়ে পড়ে। তারা তখন কোনো না কোনো উপায়ে জানতে পারে যে, তাদের বিশ্রামের সময় এসে গেছে। বহু সংখ্যক জলজ কীটপতংগ এমনও রয়েছে, যাদের দেহ দু’ভাগ হয়ে গেলেও সে এই দুই অর্ধেকের একটির সাহায্যে নিজেকে আবার জোড়া দিতে পারে। শিকার ধরার জন্য ব্যবহৃত এক ধরনের পোকা আছে, যার মাথা কেটে ফেললেও মারা যায় না বরং তৎক্ষণাত নতুন একটা মাথা তৈরী করতে শুরু করে দেয়। আমরা অনেক সময় ক্ষত স্থানকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হই ৷ তবে জানি না, শল্য চিকিৎসকরা কবে জানবার সুযোগ পাবে যে, তারা ক্ষতস্থানে নতুন হাড়, মাংস, নখ, স্নায়ু ও হাত সংযোজন করতে দেহকোষগুলোকে কিভাবে সক্রিয় হতে পারবে? অবশ্য যদি কখনো তা সম্ভব হয়। আরো একটা বিস্ময়কর তথ্য আছে, যা বর্তমান সৃষ্টিকে পুনরায় সৃষ্টি করার রহস্যের ওপর কিছুটা আলোকপাত করে। কোষগুলো যখন ভ্রমবিকাশের প্রাথমিক স্তরে থাকে, তখন যদি তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদাভাবে একটা করে পূর্ণাংগ প্রাণী সৃষ্টির ক্ষমতা জন্মে । এখান থেকে এ তথ্যও পাওয়া যায় যে, প্রথম কোষটি যখন দু’ভাগ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তা থেকে দুটো আলাদা সত্ত্বা জন্ম লাভ করে। জমজ সন্তানেরা কেন এত সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, তার ব্যাখ্যাও এখানে থাকতে পারে। তবে এর তাৎপর্য আরো বেশী ৷ সেটি এই যে, প্রতিটি কোষ শুরুতে একটা পূর্ণাংগ সত্ত্বায় রূপান্তরিত হতে পারে। অতএব এ ব্যাপারে আর কোনোই সন্দেহের অবকাশ নেই যে, প্রত্যেক কোষে এবং প্রত্যেক পেশীতে তুমি আছো, অর্থাৎ তোমার মতো একটা পূর্ণাংগ সত্ত্বা বা ব্যক্তি রয়েছে।(কে জানে বিজ্ঞানের বিশ্বযয়কর আবিষ্কার ‘ক্লোনিং’ তথা একই জীবসন্তার “ডিএনএ’ দিয়ে ঠিক তারই মতো আরেক সত্ত্বার উৎপাদন-এ থেকে এসেছে কিনা স্কটল্যান্ডে কিছু দিন আগে “ডলি শিপ ক্লোনিং’ বিষয়টি দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। শহীদ কুতুব যখন এই তাফসীর রচনা করেছিলেন তখন এ বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কৃত হয়নি। মনে রাখতে হবে ক্লোনিং কিছু নতুন সৃষ্টির নাম নয়, তাই এব্যাপারে আমাদের মনে কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকা উচিত নয়।-সম্পাদক) লেখক অপর এক জায়গায় বলেন, ‘ওক বৃক্ষের ফল যখন মাটিতে পড়ে, তখন তার তামাটে রংয়ের খোসা তাকে সংরক্ষণ করে এবং এই অবস্থায় পৃথিবীর যে কোনো স্থানের মাটিতে গড়িয়ে পড়ুক না কেন। বসন্ত কালে তার ভেতরকার অংকুর জেগে ওঠে, ফলে খোসা ফেটে চৌচির হয়ে যায় এবং ফলের শ্বাস থেকে তা খাদ্য গ্রহণ করে। এই শ্বাস দেখতে ডিমের মতো এবং এর ভেতরেই লুকিয়ে থাকে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের সূক্ষ্মতম জীবাণু । এই ফলের শাস মাটিতে বীজ ছড়িয়ে দেয় । সহসা একদিন একটা ক্ষুদ্র চারাগাছের আবির্ভাব ঘটে ৷ তারপর আরো কয়েক বছর পর পুরোদস্তুর একটা বৃক্ষে পরিণত হয়। অসংখ্য জীবাণু ধারণকারী এই অংকুর অতপর লক্ষ কোটি গুণ গাছ জন্মায় । উৎপন্ন করে গাছের কান্ড, খোসা, পাতা ও ফল ৷ এসব অবিকল সেই ওক বৃক্ষেরই সদৃশ্য, যা থেকে এই ফলের উৎপত্তি ঘটেছে। এরপর শত শত বছর কেটে গেলেও ওক বৃক্ষের অগণিত ফলের মধ্য দিয়ে অণু পরমাণুর সেই আদিমতম বিন্যাস পরিপূর্ণ ভাবে অব্যাহত থাকে, যা লক্ষ কোটি বছর আগে প্রথম ওক বৃক্ষটির জন্ম দিয়েছিলো ।’ (সূরা তারেকে বর্ণিত শুক্রকীটের ভ্রমণ বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য) গ্রন্থকার স্বীয় পুস্তকের তৃতীয় অধ্যায়ে বলেন, ‘যে কোনো জীবন্ত প্রাণীর দেহে উৎপন্ন প্রতিটি কোষকে এমনভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, যাতে তা গোশতের অংশে পরিণত হয়, নচেৎ তাকে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে হয়। যেমন চামড়ার একাংশ পুরানো হয়ে যাওয়া পর্যন্ত‌ আপন অবস্থায় বহাল থাকে। দাতের ওপরের মসৃণ ও কঠিন আচ্ছাদন নির্মাণ, চোখের ভেতরের স্বচ্ছ তরল পদার্থ উৎপাদন এবং কান ও নাক তৈরীতে অবদান রাখাও এই কোষের দায়িত্ব ৷ শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রত্যেক কোষের কর্তব্য আকৃতির দিক দিয়েও নিজেকে সংগতিপূর্ণ ও মানানসই করে নেয়া এবং এমন প্রতিটি গুণ বৈশিষ্টের দিক দিয়েও নিজেকে যুৎসই বানানো, যা তার জন্যে নির্দিষ্ট হবে, এটা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন । অথচ একটা কোষ ডান কানের এবং অপর একটা কোষ বাম কানের অংশে পরিণত হয়। হাজার হাজার কোষ এমনভাবে সৃষ্ট যেন তারা সঠিক সময় সঠিক জায়গায় সঠিক কাজটি করতে বাধ্য ।’ চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক বলেন, ‘সৃষ্টির মন্ড বা প্রাথমিক উপাদানের ভেতরেই অনেক সৃষ্ট জীবের অত্যন্ত উঁচু মানের সুনির্দিষ্ট আকৃতির গুণ বৈশিষ্ট, মেধা এবং আমাদের অজানা আরো অনেক কিছু লুকিয়ে রাখা হয়। উদাহরণ স্বরূপ ভিমরুল বা বোলতা উড়ন্ত ফড়িং শিকার করে মাটিতে গর্ত খোঁড়ে এবং ফড়িংকে যথাস্থানে দংশন করে তার বোধশক্তিকে বিকল করে দেয়, এর ফলে সে বেঁচে থাকে এক ধরনের সংরক্ষিত মাংস পিন্ড হিসাবে । স্ত্রী ভিমরুল যথোপযুক্ত স্থানে ডিম পাড়ে। সম্ভবত সে জানে না যে, তার বাচ্চারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই খাদ্য গ্রহণে সক্ষম হবে। কেননা তা করলে সেটা হতো তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি । এটা অনিবার্যভাবে সত্য যে, ভিমরুল শুরু থেকেই এ কাজ করে এসেছে এবং সর্বদা এর পুনরাবৃত্তি করেছে। নচেৎ পৃথিবীতে একটা ভিমরুলও থাকতো না। এই রহস্যময় ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের জানা নেই। তাই বলে একে নিরেট ঘটনাত্রম বলে চালিয়ে দেয়ার অবকাশও নেই ।’ ‘পিঁপড়ের কোনো কোনো শ্রেণীতে এরূপ নিয়ম চালু আছে যে, শ্রমিক পিপড়েরা ছোট ছোট দানা নিয়ে আসে অন্য পিঁপড়েকে শীতকালে খাওয়ানোরে জন্য । পিঁপড়ের ‘খাদ্য গুদাম’ তৈরী করার কথা সুপ্রসিদ্ধ । খাদ্য তৈরীর জন্য যে পিঁপড়ের বড় বড় চোয়াল রয়েছে, সেই পিঁপড়েকে গোটা পিপড়ে পল্লীর জন্য খাবার তৈরীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এটাই হয় তার একমাত্র কাজ। শরৎকাল এলে যখন খাদ্যের দানাগুলো সবই চূর্ণ করা হয়ে যায়, তখন পিঁপড়ের বৃহত্তর অংশের জন্য ‘সর্বোচ্চ পরিমাণ কল্যাণ সাধন’ এই নীতির অনুসরণে সেই গোটা খাদ্য সম্ভারের সংরক্ষণ সবচেয়ে জরুরী হয়ে দাড়ায় । এই সময় পিপড়ের নতুন প্রজন্ম বিপুল সংখ্যক চূর্ণকারী পিঁপড়ে সংগ্রহ করতে থাকে আর সেই অবসরে পিপড়ের সৈন্যরা কর্মরত চূর্ণকারী পিঁপড়েদেরকে হত্যা করতে থাকে । সম্ভবত হত্যাকারীরা এই বলে নিজেদের কীটোচিত বিবেককে প্রবোধ দেয় যে, সে পিপড়েরা খাদ্য দানা চূর্ণ করার সময় তা দ্বারা উপকৃত হওয়ার অর্থাৎ আহার করার প্রথম সুযোগ পেয়েছে । কাজেই তারা পর্যাপ্ত প্রতিদান বা মজুরী পেয়ে গেছে! আরো এক ধরনের পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। সহজাত আবেগ অথবা চিন্তা ভাবনার বশবর্তী হয়ে তারা কিছু ‘খাদ্য গুদাম’ তৈরী করে। তাদের এই সব খাদ্য গুদামের সমষ্টিকে একত্রে ‘খাদ্য গুদামের পাড়া’ নামে অভিহিত করা হয়। তারা বিভিন্ন রকমের ক্ষুদ্র পোকা ও ছত্রাক খেয়ে জীবন ধারণ করে। এ সব প্রাণী হচ্ছে পিঁপড়ের গরু, ছাগল অর্থাৎ তাদের গৃহপালিত জন্তু । পিঁপড়েরা এগুলো থেকে মধুসদৃশ এক ধরনের তরল পদার্থ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। পিঁপড়ের আর একটা স্বভাব হলো, সে বিভিন্ন শ্রেণীর পিঁপড়েকে বন্দী করে ও দাসে পরিণত করে। কোনো কোনো পিঁপড়ে নিজের ঘর বানানোর সময় হুবহু ঘরের ইপ্সিত আকৃতি অনুসারে পাতা কাটে। যখন কতিপয় শ্রমিক পিঁপড়ে ওই ঘরের পাশ ধরে যথাস্থানে রাখে, তখন একই স্থানে ঘরটিকে সুতো দিয়ে বুনে দেয়ার জন্য এমন সব শিশু পিঁপড়েদেরকে নিযুক্ত করে, যারা ছত্রাকের ভূমিকায় কাজ করে এবং রেশমী সুতো কাটতে পারে বলে মনে করা হয় । অনেক সময় কোনো শিশু পিঁপড়ে রেশমের সুতো বানানোর কাজ থেকে বিরত থাকে কিন্তু সে পিঁপড়ে সমাজের জন্য কোনো না কোনো পর্যায়ে কাজ করে থাকে । বস্তুর যে সব অণুপরমাণু থেকে পিপঁড়ের সৃষ্টি হয়, তারা এ সব জটিল কাজ কিভাবে করতে সক্ষম হয়? সন্দেহ নেই যে, একজন স্রষ্টা রয়েছেন যিনি তাদেরকে এ সব কাজের পথ দেখিয়েছেন! জি, হ্যাঁ, পিঁপড়ে বা তার উৎস অণুপরমাণুকে এবং অন্যান্য সৃষ্টিকে- তা সে ছোট বড় যাই হোক না কেন, সকলকে পথ দেখানোর জন্য এক মহান স্রষ্টা অবশ্যই রয়েছেন। তিনিই সেই ‘সর্বোচ্চ সত্ত্বা, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সংহত ও ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, যিনি পরিকল্পনা করেছেন অতপর পথ প্রদর্শন করেছেন।’ উপরোক্ত বিজ্ঞানীর বক্তব্য থেকে এখানে যে উদ্ধৃতি আমি তুলে ধরলাম, এটা উদ্ভিদ, কীট-পতংগ, পশু ও পাখি সম্পর্কে মানুষের যা কিছু পর্যবেক্ষণ এ যাবত সংরক্ষিত হয়েছে, তার অতি সামান্য একটি অংশ মাত্র। এ ধরনের আরো বহু বক্তব্য রয়েছে ।(আধুনিক বিজ্ঞান এমন বছ বিষয়কে আমাদের সামনে হাযির করছে, যার ফলে দিনে দিনে আল্লাহ্‌ তায়ালার বাণীগুলোই সত্যে পরিণত হচ্ছে। এ পর্যায়ে সম্প্রতি অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকরা সেগুলো পড়লে একথার সত্যতা অনুধাবন করতে পারবেন ।-সম্পাদক) সুরা আল আ’লার প্রাথমিক আয়াত কয়টিতে বণীত আল্লাহর ‘সৃষ্টি করা, ভারসাম্যপূর্ণ করা, পরিকল্পনা করা ও পথ প্রদর্শন করা’র মধ্যে যে বিপুল সংখ্যক জড় ও জীব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং এই দৃশ্যগোচর সৃষ্টি জগতে যার খুব কম সংখ্যকই আমাদের জ্ঞানের আওতায় এসেছে। উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে এবং এ যাবত লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত অন্যান্য বিজ্ঞানীর সকল পর্যবেক্ষণ ও উদ্ভাবনে তার প্রতি সামান্য কিছু আভাস ইংগিতই শুধু দেয়া সম্ভব হয়েছে। উপরন্তু এর বাইরে রয়েছে বিশাল অদৃশ্য জগত যার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সামান্য কিছুই অবহিত করেছেন। আমাদের দুর্বল মানবীয় সত্ত্বায় যতোটা ধারণা ও উপলদ্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব, ততোটুকুই আমাদেরকে অবগত করেছেন।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৪

وَ الَّذِیْۤ اَخْرَجَ الْمَرْعٰى۪ۙ

যিনি উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছেন।৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৫) মূলে মারআ (مَرْعَى) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তৃণভূক প্রাণীদের খাদ্যের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। এই আয়াতের পরবর্তী আলাচনা থেকে বুঝা যায়, এখানে কেবল উদ্ভিদজাত খাদ্যের কথা বলা হয়নি বরং মাটিতে উৎপন্ন সব ধরনের উদ্ভিদের কথাই বলা হয়েছে।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৫

فَجَعَلَهٗ غُثَآءً اَحْوٰىؕ

তারপর তাদেরকে কালো আবর্জনায় পরিণত করেছেন।৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) অর্থাৎ তিনি কেবল বসন্তকালের আগমন ঘটান না, শীতেরও আগমন ঘটান। তোমাদের চোখ তাঁর উভয় প্রকার ক্ষমতার প্রকাশই দেখছে। একদিকে তিনি সবুজ শ্যামল বৃক্ষলতায় ভরে দেন। তাদের তরতাজা শ্যামল শোভা দেখে মন আনন্দে ভরে ওঠে। আবার অন্যদিকে এ বৃক্ষলতাকে তিনি শুষ্ক শ্রীহীন করে কালো জঞ্জালে পরিণত করেন। এগুলো বাতাসে উড়ে বেড়ায় এবং বন্যার স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। তাই এই দুনিয়ায় কোন ব্যক্তির এই ভুল ধারণা করা উচিত নয় যে, সে এখানে কেবল বসন্তকালই দেখবে, শীতের সাথে তার সাক্ষাতই হবে না। এই একই বক্তব্য কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় অন্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন দেখুন সূরা ইউনস ২৪ আয়াত , সূরা কাহাফ ৪৫ আয়াত এবং সূরা হাদীদ ২০ আয়াত ।

ফী জিলালিল কুরআন:

উদ্ভিদ জগত : এ পর্যন্ত এই বিরাট ও বিশাল সৃষ্টি জগতের দৃশ্য তুলে ধরার পর এবং তার সর্বদিকে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের কথা এবং বহু দুরব্যাপী বিশ্বনিখিলে সেই প্রশংসা ও গুণকীর্তন প্রতিধ্বনিত হওয়ার বর্ণনা দেয়ার পর, আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী দুটি আয়াতে বৃহত্তম তাসবীহ বা গুণকীর্তনের পূর্ণতা সাধন করছেন সমগ্র উদ্ভিদের জীবনে সেই তাসবীহের ইংগিতপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ছাপ তুলে ধরার মাধ্যমেঃ ‘আর যিনি উদ্ভিদ উদগত করেছেন, অতপর তাকে কালো আবর্জনায় পরিণত করেছেন ‘ এখানে উদ্ভিদ বলতে সকল উদ্ভিদই বুঝানো হয়েছে। আর প্রত্যেক উদ্ভিদই আল্লাহর কোনো না কোনো সৃষ্টির জন্য উপযোগী ও উপকারী । আমরা সচরাচর যেমন ধারণা করে থাকি যে উদ্ভিদ আমাদের গবাদি পশুর জন্য সৃষ্ট, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয় বরং তার চেয়েও ব্যাপক। বস্তুত আল্লাহ্‌ তায়ালা এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করার পর গোটা সৃষ্টির জন্য খাদ্যপুষ্টি ও শক্তির যাবতীয় উৎস এর ভেতরেই সৃষ্টি করেছেন। ভূপৃষ্ঠের ওপরে, ভূগর্ভে বা মহাশূন্যে যতো প্রাণী বিচরণ করে থাকে, তাদের সকলের খাদ্য সঞ্চিত রেখেছেন এই পৃথিবীতেই । উদ্ভিদ প্রথম যখন চারাগাছ হিসাবে আবির্ভূত হয়, তখন সবুজ থাকে, তারপর ক্রমাম্বয়ে শুকিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করে, যখন সে সবুজ থাকে, তখন খাদ্য হবার যোগ্য থাকে আবার যখন কালো আবর্জনায় পরিণত হয় তখনো খাদ্য হবার যোগ্য থাকে । আর এ দুই অবস্থার মাঝে যখন যে অবস্থায়ই থাকুক, মহান সৃষ্টিকর্তা, ভারসাম্য রক্ষণকারী, পরিকল্পনাকারী ও পথনির্দেশক আল্লাহর সার্বিক পরিকল্পনা ও বিচার-বিবেচনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে তা এই সৃষ্টির জীবনের কোনো না কোনো কাজের উপযোগী হয়ে থাকে, কোনো না কোনো উপায়ে কারো না কারো উপকার ও কল্যাণ সাধন করে। এখানে উদ্ভিদ জীবনের প্রতি যে ইংগিত করা হয়েছে, তা একটা সুক্ষ তাৎপর্য বহন করছে। সেটি এই যে, প্রতিটি উদ্ভিদ যেমন ধ্বংসশীল, তেমনি প্রতিটি প্রাণী মরণশীল ৷ পরবর্তীতে দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবন সম্পর্কে যে আলোচনা আসছে, তার সাথে এই বক্তব্যের মর্মগত মিল রয়েছে ‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকো। অথচ আখেরাতই উত্তম ও চিরস্থায়ী ।’ বস্তুত দুনিয়ার জীবন এই উদ্ভিদের মতোই, যা একদিন কালো আবর্জনায় পরিণত হয়ে খতম হয়ে যায়, আসলে আখেরাতই স্থায়ী জীবন ।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৬

سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسٰۤىۙ

আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো, তারপর তুমি আর ভুলবে না।৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) হাকেম হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াককাস (রা.) থেকে এবং ইবনে মারদুইয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তারা বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ ভুলে যাবার ভয়ে কুরআনের শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে থাকতেন। মুজাহিদ ও কালবী বলেন, জিব্রীল অহী শুনিয়ে শেষ করার আগেই ভুলে যাবার আশঙ্কায় রসূলুল্লাহ ﷺ গোড়ার দিক থেকে আবার পড়তে শুরু করতেন। এ কারণে আল্লাহ তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, অহী নাযিলের সময় তুমি নিরবে শুনতে থাকো। আমি তোমাকে তা এমন ভাবে পড়িয়ে দেবো যার ফলে চিরকালের জন্য তোমার মুখস্থ হয়ে যাবে। এর কোন একটি শব্দ তুমি ভুলে যাবে, এ ভয় করো না। এ নিয়ে তৃতীয়বার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অহী আয়ত্ব করার পদ্ধতি শেখানো হয়। এর আগে আরো দু’বার সূরা ‘ত্বা-হা’র ১১৪ আয়াতে এবং সূরা ‘কিয়ামাহ’র ১৬-১৯ আয়াতে এর আলোচনা এসেছে। এই আয়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয়, কুরআন যেমন মু’জিযা হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল করা হয়েছিল ঠিক তেমনি মুজিযা হিসেবেই তার প্রতিটি শব্দ তাঁর স্মৃতিতে সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছিল। এর কোন একটি শব্দ তিনি ভুলে যাবেন অথবা একটি শব্দের জায়গায় তাঁর সমার্থক অন্য একটি শব্দ তাঁর মুবারক কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হবে, এ ধরনের সকল সম্ভাবনার পথই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৭

اِلَّا مَا شَآءَ اللّٰهُ١ؕ اِنَّهٗ یَعْلَمُ الْجَهْرَ وَ مَا یَخْفٰىؕ

তবে আল্লাহ‌ যা চান তা ছাড়া।৮ তিনি জানেন প্রকাশ্য এবং যা কিছু গোপন আছে তাও।৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৮) এই বাক্যটির দু’টি অর্থ হতে পারে।

এক, সমগ্র কুরআনের প্রতিটি শব্দ তোমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ার পেছনে তোমার নিজের শক্তির কোন কৃতিত্ব নেই। বরং এটি আল্লাহর মেহেরবানী এবং তাঁর তাওফীকের ফল। নয়তো আল্লাহ চাইলে এগুলো তোমার স্মৃতি থেকে উধাও করে দিতে পারেন। এ বক্তব্যটি কুরআনের অন্যত্রও নিম্নোক্তভবে বলা হয়েছেঃ

وَلَءِنْ شِءْنَا لَنَذْ هَبَنَّ بِا لَّذِيْآ اَوْحَيْنَلآ اَليْكَ

“আমি চাইলে অহীর মাধ্যমে তোমাকে যা কিছু দিয়েছি সব ছিনিয়ে নিতে পারি।” ( বনি ইসরাঈল ৮৬ )

দুই, কখনো সাময়িকভাবে তোমার ভুলে যাওয়া এবং কোন আয়াত বা শব্দ তোমার কোন সময় ভুলে যাওয়া এই ওয়াদার ব্যতিক্রম। যে ব্যাপারে ওয়াদা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তুমি স্থায়ীভাবে কুরআনের কোন শব্দ ভুলে যাবে না। সহী বুখারীর নিম্নোক্ত হাদীসটিকে এ অর্থের সমর্থনে পেশ করা যেতে পারেঃ একবার ফজরের নামাযে রসূলুল্লাহ ﷺ সূরা পড়ার সময় মাঝখানে একটি আয়াত বাদ দিয়ে যান। নামাযের পর হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) এ আয়াতটি মানসূখ (রহিত) হয়েছে কিনা জিজ্ঞেন করেন। জবাবে রসূল্লাল্লাহ ﷺ বলেন, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

টিকা:৯) এমনিতে এ শব্দগুলো সাধারণভাবে ব্যবহৃত এবং তার অর্থ এই যে, আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই জানেন। কিন্তু যে বক্তব্য প্রসঙ্গে একথাগুলো এখানে বলা হয়েছে তা সামনে রাখলে এর যা অর্থ দাঁড়ায় তা হচ্ছেঃ তুমি জিব্রীলের (আ) সাথে সাথে যে কুরআন পড়ে চলেছো। তা আল্লাহ জানেন এবং ভুলে যাবার ভয়ে যে এমনটি করছো তাও আল্লাহ জানেন। তাই তাঁকে নিশ্চয়তা দান করে বলা হচ্ছে, তোমার ভুলে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই।

ফী জিলালিল কুরআন:

কোরআনের হেফাযত : সৃষ্টি জগতের এই বিশাল ও বিরাট প্রান্তরকে উন্মোচনকারী এই বিস্তৃত পটভূমি বর্ণনার পর সূরার পরবর্তী আলোচনা আসছে। তা এই বিশ্বনিখিলের সাথে সম্পৃক্ত এবং এই মনোরম প্রেক্ষিতের সাথে সংযুক্ত। আরো লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, এই পারার অধিকাংশ সূরার বিষয়বস্তু এগুলোর সমকালীন পরিবেশ ও অন্তর্নিহিত প্রভাবের সাথে অংগাংগিভাবে জড়িত ও পরিপূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।(আমার প্রণীত ‘আত্ তাসওয়ীরুল ফান্নী কোরআন’ এ ‘আল-কোরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) এর অব্যবহিত পরই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উস্মাতের জন্য সেই মহান সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে যে, ‘আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো, ফলে তুমি আর ভুলবে না, অতএব স্মরণ করিয়ে দাও, যদি তাতে উপকার হয় ।’ সুসংবাদটির সূচনা হচ্ছে এই বলে যে, আল্লাহ্‌ তায়ালা তার রসূল (স.)-কে এই কোরআন স্মরণ রাখার কষ্ট থেকে অব্যহতি দেবেন ৷ ‘আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো, কাজেই তুমি আর ভুলে যাবে না।’ অর্থাৎ তার কাজ হলো আল্লাহর দেয়া ক্ষমতাবলে তিনি পড়বেন, আর প্রতিপালক স্বয়ং যা তাকে পড়াবেন; তা তিনি ভুলবেন না। এটি এমন একটি সুসংবাদ, যা রসূল (স.)-কে তার একান্ত প্রিয় এই সুন্দর মহিমান্বিত কোরআনের ব্যাপারে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করে । কোরআনের প্রতি ভক্তি, আসক্তি ও আগ্রহের আতিশয্যে এবং তার সর্বাত্মক অনুকরণ ও অনুসরণের তাগিদে ও প্রেরণায় তিনি এত ব্যাকুল হয়ে পড়তেন যে, যখনই জিবরাঈল তার কাছে ওহী নিয়ে আসতেন, তখন তিনি বিড়বিড় করে এক একটি আয়াত বারবার উচ্চারণ করতেন এবং জিহবা নাড়াতে থাকতেন। কারণ তা না হলে ভুলে যাওয়ার আশংকা বোধ করতেন। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে এই আশ্বাস দেয়া হয় যে, আল্লাহ তায়ালা নিজেই তার পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, যাতে তিনি এর একটি অক্ষরও ভুলে না যান। রসুল (স.)-এর অনুগামী ও অনুসারী উম্মাহর জন্যও এটি একটি আশ্বাসবাণী ৷ এ সংক্রান্ত মূল আকীদার ব্যাপারে এ আয়াতে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। বস্তুত কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে । আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীর অন্তরে এ কোরআনকে সুরক্ষিত করেছেন। এটা স্বয়ং আল্লাহর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের অধীন । এ নিশ্চয়তা স্বয়ং আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে এ দ্বীনের উচ্চ মর্যাদারও প্রতীক এবং তার দাড়িপাল্লায় ইসলামের গুরুত্বের নিদর্শন । প্রসংগত এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, যেখানেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সুদৃঢ় ও অকাট্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় কিংবা কোনো শাশ্বত নীতি ঘোষণা করা হয়, সেখানে সংগে সংগে এমন কিছু বক্তব্যও দেয়া হয়, যা দ্বারা বুঝানো হয় যে, আল্লাহ তায়ালা স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার মালিক, তিনি কোনো বাধ্যবাধকতার অধীন নন, এমনকি নিজের ওয়াদা এবং শাশ্বত নীতি ও ঘোষণা দ্বারাও তার স্বাধীন ইচ্ছা শৃংখলিত হয় না। তার ইচ্ছা সকল ওয়াদা ও চুক্তির উর্ধে । কোরআন এ সত্যটি সর্ব ক্ষেত্রেই বর্ণনা করে থাকে । এই গ্রন্থে আগেও আমরা এর উদাহরণ লক্ষ্য করেছি। এখানেও তার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যথা: ‘তবে আল্লাহ তায়ালা যা ইচ্ছা করেন।’ রসূল (স.) যাতে ভুলে না যান, তার ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা করবেন এই মর্মে অলংঘনীয় প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর এই বাক্যে আল্লাহর ইচ্ছার স্বাধীনতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ দ্বারা আসলে গোটা বিষয়কে আল্লাহর বৃহত্তম ও সর্বোচ্চ ইচ্ছার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অতীতে যে ওয়াদাই করুন না কেন, বান্দাকে সব সময় আল্লাহর ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে তার ওপরই নির্ভরশীল ও তার জন্য প্রস্তুত ও প্রতীক্ষারত থাকতে হবে৷ মনকে চিরদিনের জন্য আল্লাহর ইচ্ছার সাথে বেঁধে দিতে হবে। ‘নিশ্চয়ই তিনি প্রকাশ্য ও গোপন সবই জানেন ।’ ধরে নেয়া যায় যে, ওপরে যে কোরআন সংরক্ষণের ওয়াদা ও আল্লাহর ইচ্ছাকে তার ব্যতিক্রম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বাক্যটিতে তার সবটারই কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে অর্থাৎ যে আল্লাহ তায়ালা সকল গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং প্রত্যেক বিষয়ের সকল দিক সম্পর্কে অবগত রয়েছেন, তার সূক্ষদর্শিতা, বিচক্ষণতা, বিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার ওপরই সব কিছুর চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ভরশীল ৷ তিনি সর্বদিক বিবেচনা করে যেমন ভালো মনে করবেন তেমন সিদ্ধান্ত নেবেন দ্বিতীয় সর্বব্যাপী আশ্বাসবাণী ও সুসংবাদটি হলো, ‘তোমাকে আমি সহজ পন্থার সুযোগ দেবো ‘ এটিও স্বয়ং রসূল (স.)-এর জন্যে ব্যক্তিগতভাবে এবং তার উম্মাতের জন্য সামগ্রিকভাবে একটি সুসংবাদ ৷ সেই সাথে এই বাক্যটিতে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার স্বভাব-প্রকৃতি ও মেযাজ, এই খোদায়ী আহ্বানের তাৎপর্য ও মানুষের জীবনে তার ভূমিকা এবং এই বিশ্ব ব্যবস্থায় তার স্থান কি, তা তুলে ধরা হয়েছে। বাক্যটি ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের ও মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে ধরছে। এই রসূল, এই দ্বীন এবং এই বিশ্বপ্রকৃতি এই তিনটিরই স্বভাব প্রকৃতি পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত । মানুষের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিশ্বজগত সামগ্রিকভাবে সহজ সরল প্রকৃতির, আপন নির্দিষ্ট কক্ষপথে তার বিচরণ ও গতি সহজ ও স্বচ্ছন্দ। আপন লক্ষ্য ও গন্তব্যের দিকে তার যাত্রা সহজ ও স্বাভাবিক ৷ বস্তুত এ আয়াত আল্লাহর নূরের একটি বিস্ফোরণ । এ বিস্ফোরণে সত্যের সীমাহীন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৮

وَ نُیَسِّرُكَ لِلْیُسْرٰىۚۖ

আর আমি তোমাকে সহজ পথের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছি।

ফী জিলালিল কুরআন:

নবীজীর সহজ সরল জীবনযাপন : আল্লাহ তায়ালা যাকে সহজ ও সরল পথে চলার সুযোগ করে দেন, তার গোটা জীবনই সহজ ও সরলভাবে অতিবাহিত হয় । বিশ্বজগতের সাথে তার পূর্ণ সমন্বয়, সহযোগিতা ও সদ্ভাব বজায় থাকে। আর বিশ্বজগতের প্রতিটি গতিবিধিতে, সংযোগ ও সংগঠনে এবং আল্লাহর দিকে যাত্রায় ও আবর্তনে এখানে পূর্ণ সমন্বয় ও একাত্মতা রয়েছে । কাজেই যে ব্যক্তি সহজ সরল জীবন ও চালচলনের অধিকারী, বিশ্বজগতের সহজ সরল ও সুশৃংখল যাত্রাপথ থেকে বিচ্যুত ব্যক্তিদের সাথে ছাড়া আর কারো সাথেই তার সংঘর্ষ ঘটে না। আর এই সরল পথ বিচ্যুত বিকৃত স্বভাবের লোকদেরকে যখন মহাবিশ্বের সাথে তুলনা ও পরিমাপ করা হয় তখন তাদের কোনোই গুরুত্ব ও ভারত্ব থাকে না। সহজ সরল জীবন যাপনকারী ব্যক্তি চালচলনে ও আচরণে সরল, বিনয়ী, কোমল ও অমায়িক হয়ে থাকে। বিশ্বজগতের সব কিছুর সাথে, সকল বস্তু, প্রাণী ও ব্যক্তির সাথে এবং সকল ঘটনায় ও সকল পরিবেশ পরিস্থিতিতে সে তার এই অমায়িক ও বিনয়ী চালচলন ও আচরণ অব্যাহত রাখে। এমন কি ভাগ্যবিধি বেলায়ও সে সহজ সরল ও বিনয় আচরণ করে এবং ভাগ্যকে নির্বিবাদে মেনে নেয়। তার হাতে, তার জিহ্বায়, তার পদচারণায়, তার কাজে, তার কল্পনায়, তার চিন্তায়, তার কর্মোদ্যোগে, তার ব্যবস্থাপনায় এবং তার নিজের সাথে ও অন্যের সাথে সমভাবে বিনয়, কোমলতা ও অমায়িকতার ছাপ থাকে। রসূল (স.)ও তার সকল আচরণে এ রকমই ছিলেন৷ বোখারী মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে এই মর্মে হাদীস বর্ণীত হয়েছে যে, রসূল (স.) যখনই কোনো দু’টি ব্যাপারে ক্ষমতা ও অধিকার লাভ করতেন, তখন ওই দুটির মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত সহজ, সেটিকেই গ্রহণ করতেন। হযরত আয়েশা (রা.) আরো বলেছেন যে, ‘বাড়ীতে ব্যক্তিগত পরিবেশে রসূল (স.) ছিলেন সবচেয়ে কোমল ও অমায়িক এবং সদা হাসিমুখ ।’ সহীহ বোখারীতে আরো রয়েছে যে, রসূল (স.) এতো সহজ সরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে, একটি দাসী রসূল (স.)-এর হাত ধরে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারতো । পোশাক, খাদ্য ও বিছানা ইত্যাদির ব্যাপারেও রসূল (স.)-এর অনুসৃত নীতি এটাই ছিলো যে, তিনি সহজ সরল ও অনাড়ম্বর জীবনই অবলম্বন করতেন। রাসূল (স.)-এর পোশাক পরিধানের রীতি সম্পর্কে ঈমাম শামসুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ্‌ মুহাম্মদ ইবনে কাইয়েম আল জাওযী স্বীয় গ্রন্থ ‘যাদুল মায়াদে’ বলেন, ‘তার সাহাব নামের একটা পাগড়ী ছিলো, বেশ উঁচু করে তা পরতেন এবং তার নিচে টুপি পরতেন । কখনো পাগড়ী ছাড়া টুপি আবার কখনো টুপি ছাড়া পাগড়ী পরতেন । যখনই পাগড়ী পরতেন, তখন পাগড়ীর একপাশ দুই কাধের মাঝখান দিয়ে ঝুলিয়ে দিতেন ।’ এটি সহীহ মুসলিমের বর্ণনা । ওমর ইবনে হুরাইস (রা.) থেকে বর্ণীত যে,’ তিনি বলেন, আমি রসূল (স.)-কে মেস্বারে এভাবে বসা দেখেছি যে, তার মাথায় কালো পাগড়ী পরা ছিলো এবং পাগড়ীর এক পাশ দুই ঘাড়ের মাঝখানে দিয়ে ঝুলানো ছিলো । মুসলিম শরীফে হযরত জাবেরের বর্ণনায় আছে যে, একটা পাকানো দড়ি বা গুচ্ছ ঝুলানো ছিলো ।’ এই হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, রসূল (স.) গুচ্ছটিকে সব সময় দুই ঘাড়ের মাঝখানে ঝুলাতেন না। এরূপ বর্ণনাও আছে যে, তিনি যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন তিনি সামরিক বেশভূষায় সজ্জিত ছিলেন এবং তার মাথায় ছিলো লৌহ শিরন্ত্রাণ ৷ সুতরাং এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে তিনি সেখানকার উপযোগী পোশাক পরতেন । ‘যাদুল মায়াদ’ গ্রন্থের অপর এক অধ্যায়ে ইমাম ইবনে কাইয়েম বলেন, ‘সত্য কথা এই যে, যে পদ্ধতি ও পন্থা রসূল (স.) গ্রহণ করেছেন, চালু করেছেন, অন্যদেরকে গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন এবং সব সময় পালন করেছেন-সেই পদ্ধতি ও পন্থাই হচ্ছে সর্বোত্তম। পোশাকের ব্যাপারে তার অনুসৃত নীতি ছিলো এই যে, যে পোশাক সহজে ও অনায়াসে পাওয়া যায়, সেটাই তিনি পরতেন । কখনো পশমী, কখনো সুতী, কখনো কাতান, কখনো ইয়েমেনী চাদর, কখনো সবুজ চাদর, কখনো জুব্বা, কখনো কুবা, কখনো জামা, চাদর, জুতা ও মোজা পরতেন। পাকানো দড়ি বা গুচ্ছ (যুয়াবা) কখনো পেছন দিক থেকে ঝুলিয়ে দিতেন, আবার কখনো ঝুলাতেন না ।……’ খাদ্য সম্পর্কে তার অনুসৃত রীতি সম্পর্কে ‘যাদুল মায়াদ’ গ্রন্থে, বলা হয়েছে, ‘খাদ্য সম্পর্কেও রসূল (স.)-এর রীতি এরকমই ছিলো । যে খাদ্য উপস্থিত, তার কোনোটা প্রত্যাখ্যান করতেন না, যা অনুপস্থিত, তা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতেন না, যে কোনো হালাল জিনিস তাঁর সামনে হাযির করা হতো, তা তিনি খেতেন । কোনো খাদ্য নিজের কাছে অরুচিকর মনে হলে খেতেন না, কিন্তু অন্যদেরকে খেতে নিষেধ করতেন না। গিরগিটী খেতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না বিধায় খাননি;  কিন্তু উম্মতের জন্য তা খাওয়া নিষিদ্ধ করেননি। বরং তার সাথে একই মজলিসে বসে অন্যরা খেয়েছে আর তিনি দেখেছেন। হালুয়া ও মধু তার প্রিয় খাদ্য ছিলো। খেজুর ও খোরমা খেতেন, খাটি দুধও খেতেন, পানিতে মেশানো দুধও খেতেন । ছাতু ও মধু পানি মিশিয়ে খেতেন । খোরমার রস খেতেন। আটা ও দুধের তৈরী ‘খাযীরা’ খেতেন । খেজুরের সাথে শসা খেতেন, পনির খেতেন, রুটির সাথে কোরমা এবং সির্কা দিয়ে রুটি খেতেন। শুকনো গোশ্ত্‌ খেতেন, সিদ্ধ ও রান্না করা উভয় প্রকারের তরিতরকারি খেতেন। তবে, রান্না করাটাই বেশী পছন্দ করতেন। মাখনের সাথে রুটি, তেলের সাথে রুটি এবং খেজুরের সাথে তরমুজ খেতেন। তিনি ননীর সাথে খোরমা খেতেন এবং এটা ছিলো তার প্রিয় খাবার। কোনো হালাল জিনিস ফেরতও দিতেন না, তার প্রতি কৃত্রিম অনাগ্রহও দেখাতেন না। তার নীতি ছিলো, সহজে যা জোটে তা খাওয়া ৷ যা জোটে না তার জন্য হা-হুতাশ না করা……।” আল্লামা ইবনে কাইয়েম একই গ্রন্থে রসূল (স.)-এর ঘুম ও ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস সম্পর্কে বলেন,’ কখনো নিজের বিছানায় শুতেন আবার কখনো শুতেন শক্ত পাটিতে বা নরম মাদুরে। কখনো মাটির ওপর, কখনো খাটের ওপর কালো কম্বল পেতে ।’ সহজ সরল ও সাদাসিধে জীবন যাপন এবং উদার ও বিনীত আচরণ সম্পর্কে উৎসাহিত করে রসূল (স.)-এর এমন বাণীর সংখ্যা এতো বেশী যে, তার ইয়ত্তা করা কঠিন। তাঁর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি, ‘এই দ্বীন সহজ, যে ব্যক্তি এই দ্বীনকে কঠিন করার চেষ্টা করবে, সে তাকে পরাভূত করবে ।’ (বোখারী) ৷ ‘তোমরা নিজেদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করো না, তাহলে তোমাদের ওপর কড়াকড়ি আরোপকরা হবে । একটি জাতি নিজেদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছিলো, ফলে তাদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো ।’ (আবু দাউদ) ৷ ‘অতিমাত্রায় কড়াকড়ি আরোপকারী ব্যক্তি হেঁটেও পথ অতিক্রম করতে পারে না, কোনো জন্তুর পিঠকেও অক্ষত রাখে না।’ (বোখারী) ৷ ‘তোমরা সহজ করো কঠিন করো না ।’ (বোখারী ও মসলিম) ৷ লেনদেন ও আচার ব্যবহারে রাসূল (স.)-এর বাণী ‘ক্রয় বিক্রয় ও দাবী আদায়ের বেলায় উদারনীতি অবলম্বনকারীর ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হয়।’ (বোখারী) । ‘মোমেন অমায়িক ও বিনয়ী  ।’ (বায়হাকী)। ‘মোমেন অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় এবং অন্যের সহানুভূতি অর্জন করে’ (দারাকুতনী) ৷ ‘বিদ্বেষপরায়ণ ও ঝগড়াটে লোক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী ধিকৃত ও ঘৃণিত ।’ (বোখারী ও মুসলিম) । রাসূল (স.) সব রকমের কঠোরতা ও জটিলতাকে অপছন্দ করতেন, এমন কি নামকরণে ও মুখমন্ডলের আলামতেও তা অপছন্দ করতেন । এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার । এ দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জন্মগতভাবে এবং স্বভাবগতভাবেই এরূপ সরলমতি বানিয়েছিলেন। সাঈদ ইবনুল মুসায়ব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রসূল (স.)-এর কাছে উপস্থিত হলে রসূল (স.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কি? তিনি বললেন, হাযান (অর্থাৎ কঠিন), রাসূল (স.) বললেন, তুমি তো হচ্ছে সরল । তিনি বললেন, আমার পিতা আমার যে নাম রেখেছেন তা আমি পাল্টাবো না। সাঈদ ইবনুল মোসায়ব বলেন, এরপর থেকে আমাদের পরিবারে দুঃখ কষ্ট লেগেই ছিলো ।’ (বোখারী) ৷ হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বণীত যে, রাসূল (স.) আসিয়া (শব্দার্থ পাপিষ্ঠা) নামী জনৈক মহিলার নাম পাল্টে জামীলা (শব্দার্থ সুন্দরী) রাখেন । (মুসলিম) ৷ রাসূল (স.) বলেছেন, ‘তোমার ভাই এর সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ কর!ও একটা পুণ্যের কাজ ৷’ (তিরমিযী) বস্তুত এটা অত্যন্ত নায়ক ও স্পর্শকাতর এক অনুভূতি, যা কঠোরতা, রুক্ষতা ও নিষ্ঠুরতাকে উপলব্ধি করে ও ঘৃণা করে, এমনকি তা যদি মানুষের নামে বা তার আচার আচরণে এবং হাবভাবেও প্রকাশ পায়, তবু তার অগোচরে থাকে না। একজন আদর্শ মানুষের অনুভূতি এরকমই হয়ে থাকে এবং সে সরলতা, বিনয় ও অমায়িকতার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের গোটা জীবনই উদারতা, সরলতা, অমায়িকতা ও বিনয়েরই সমষ্টি, আর সকল কাজে এই সরলতা ও কোমলতার প্রতি সকলকে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো তার নীতি । রসূল (স.) কিভাবে মানুষের মনের চিকিৎসা করতেন তার একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। এ উদাহরণ থেকে এটাও জানা যায় যে, রসূল (স.)-এর স্বভাব ও কর্মপদ্ধতি কতো কোমল ও উদার ছিলো, ‘একদিন তার কাছে এক বেদুঈন এলো এবং সে যা চাইলো তিনি তা তাকে দিলেন । তারপর রসূল (স.) তাকে বললেন, আমি তোমার উপকার করলাম তো? সে বললো, না, কোনো সুন্দর আচরণই করেননি। উপস্থিত মুসলমানরা এ কথা শুনে তার ওপর ভীষণভাবে চটে গেলেন এবং তার দিকে রুখে গেলেন । রসূল (স.) ইংগিতে তাদেরকে থামার আদেশ দিলেন। অতপর তিনি নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। তারপর বেদুঈনকে তার কাছে আসতে খবর পাঠালেন এবং তাকে আরো কিছু দিলেন। এবার তাকে বললেন, আমি কি তোমার উপকার করেছি? সে বললো, হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালা এ জন্য আপনাকে নিজের আত্মীয় স্বজন ও পরিবার পরিজনের কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। তখন রসূল (স.) তাকে বললেন, শোনো, তুমি যা বলেছো, তাতে আমার সাহাবীদের মনে আঘাত লেগেছে। কাজেই তুমি যদি পছন্দ করো, তবে যে কথা এখন আমার সামনে বললে, তা তাদের সামনে একটু বলো। তাহলে তাদের মনে তোমার প্রতি যে ক্ষোভ জন্মেছিলো তা দূর হয়ে যাবে। সে বললো, ঠিক আছে তাই হবে। পরদিন সকালে বেদুঈনটি এলো । রসূল (স.) সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, এই বেদুঈন যা বলেছে, তা তো তোমরা জানো। পরে আমি তাকে আরো কিছু দিয়েছি এবং এতে সে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। কি হে তাই তো? বেদুঈন বললো জি হ্যাঁ, এজন্যে আল্লাহ্‌ তায়ালা আপনাকে আত্মীয় স্বজন ও পরিবার পরিজনের দিক থেকে উত্তম প্রতিদান দিন। তখন রসূল (স.) বললেন, আমার এবং এই বেদুঈনের ব্যাপারটি সেই ব্যক্তির মতো, যার একটা (দুষ্ট ও অবাধ্য) উটনী ছিলো। উটনীটি ছুটে পালালো ৷ লোকেরা তার পেছনে যতোই ছুটতে লাগলো, উটনীটিও ততোই উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগলো । এ অবস্থা দেখে উটনীর মালিক তাদেরকে ডেকে বললো, তোমরা আমাকে ও আমার উটনীকে একা ছেড়ে দাও। কেননা, আমি তার প্রতি অধিকতর বিনম্র ও সদয় এবং তার সম্পর্কে আমিই অধিকতর ওয়াকেফহাল । অতপর উটনীর মালিক সোজা উটনীর মুখোমুখি হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলো ৷ সে উটনীর জন্য মাটিতে পড়ে থাকা কিছু আবর্জনা হাতে নিয়ে তাকে আস্তে আস্তে নাড়াতে ও ঘুরাতে লাগলো । এটা দেখে উটনীটি তার কাছে এলো এবং ধরা দিলো। আর মালিক তৎক্ষণাত তাকে শক্ত করে বেঁধে ফেললো এবং তার ওপর আরোহণ করলো ৷ এই বেদুঈনটি কাল যে কথা বলেছিলো, সেই কথার ওপর আমি যদি তোমাদেরকে রেখে চলে যেতাম, তারপর তোমরা যদি তাকে মেরে ফেলতে, তবে সে জাহান্নামবাসী হতো ।’ বস্তুত বিদ্রোহী ও উদ্ধত স্বভাবের মানুষকে রসূল (স.) এভাবেই পাকড়াও করতেন। এহেন উদারতা, সরলতা ও নম্রতা দ্বারা এবং এরূপ উদ্বুদ্ধকারী আচরণ দ্বারা তার চিকিৎসা করতেন। তার সমগ্র জীবন জুড়ে এ ধরনের ভূরিভুরি উদাহরণ বিদ্যমান । এটাই সেই “সহজতম পথের যাত্রাকে সহজ করে দেয়ার” খোদায়ী ওয়াদা ও শুভ সংবাদের বাস্তব উদাহরণ । আল্লাহ তায়ালা শুধু ওয়াদা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, কার্যত রসূল (স.)-এর জীবনে তার দাওয়াতে ও সকল কাজে এর প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষমতা দিয়েছেন। এই সর্বজনপ্রিয়, উদার ও মহানুভব ব্যক্তিত্বের জন্য সহজতম পথে চলাকে সহজ করে দেয়া হয়েছিলো শুধু এ জন্য যে, তিনি যেন সমগ্র মানব জাতির কাছে এই দাওয়াত পেশ করতে পারেন। এতে করে মানবজাতির স্বভাব-চরিত্র এই দাওয়াতের স্বভাব-প্রকৃতির নমুনা অনুসারে এবং মানব জাতির বাস্তবতা এই দাওয়াত তথা এই দ্বীনের বাস্তব নমুনা অনুসারে তৈরি হবে। এভাবে তার সেই সুমহান ব্যক্তিত্ব, তার বহন করা এই বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্যে যথেষ্ঠ সহায়ক, আর এই ব্যক্তিত্ব যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট, চাই সে যতোই কঠিন হৃদয়ের মানুষ হোক না কেন। আল্লাহর তাওফীক দান ও সহজকরণের ফলেই এরূপ হওয়া সম্ভব। কেননা, রেসালাতের দায়িত্ব এই সহজীকরনের ফলে কঠিন বোঝা থেকে একটা প্রিয় কাজে, একটা চমৎকার সুন্দর শারীরিক ও মানসিক কসরত এবং একটা আনন্দময় অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয়। রসূল (স.)-এর গুণ বৈশিষ্ট এবং তিনি যে দায়িত্ব সম্পন্ন করতে এসেছেন তার গুণ বৈশিষ্ট বর্ণনা প্রসংগে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য করুণাস্বরূপ বানিয়ে পাঠিয়েছি ।’ (সুরা আম্বিয়া ১০৭) আরো বলা হচ্ছে- ‘যারা অনুসরণ করে সেই নিরক্ষর নবীর, যার বিবরণ তারা তাওরাতে ও ইনজীলে লিখিতভাবে পায় যে, তিনি তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেন, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখেন, পবিত্র জিনিসগুলোকে তাদের জন্য হালাল করেন, অপবিত্র জিনিস গুলোকে নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের ওপর আরোপিত কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ রহিত করেন ।’ (সূরা আ’রাফ ১০৭) রসূল (স.) মানব জাতির জন্য করুণা তথা ত্রাণকর্তা স্বরূপ এসেছেন, নিজেরা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করার কারণে তাদের ওপর যে সব কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছিলো, তা তাদের ওপর থেকে অপসারণ করে তাদের জন্য সব কিছু সহজ করে দিতে এসেছেন। যে বার্তা রসূল (স.) বহন করে এনেছেন, তার গুণ বৈশিষ্ট বর্ণনা প্রসংগে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি কোরআনকে স্মরণ ও আবৃত্তি করার সুবিধার্থে সহজ করে দিয়েছি। কেউ কি আছে শিক্ষা গ্রহণকারী?’ (সুরা ক্কামার-২২) ‘তিনি এই দ্বীনে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেননি ।’ (সূরা হজ্জ ৭৮) ‘আল্লাহ তায়ালা কোনো প্রাণীকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো দায়িত্ব দেন না ।’ (সূরা বাকারা ২৮৬) ‘আল্লাহ তায়ালা চান না যে তোমাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেন, তবে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে ইচ্ছুক ।’ (সূরা আহযাব) । বস্তুত রেসালাতের এই দায়িত্ব মানুষের ক্ষমতার আওতাধীনে এমন সহজ করে দেয়া হয়েছে যে, মানুষকে কোনো সংকীর্ণতা ও কষ্টের শিকার করা হয়নি। এই সরলতার ছাপ যেমন রেসালাতের মৌল বৈশিষ্টে বিরাজমান, তেমনি তার দায়িত্বসমূহেও বিদ্যমান ৷ ‘এটা আল্লাহর সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট, যার ওপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ।’ (সূরা রুম ৩০) আর যখনি মানুষ এই মহান আকীদা অনুসরণ করে চলতে থাকে, তখন প্রতিটি পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে সে দেখতে পায় সহজ সরল ও সুবিধাজনক নীতি, দেখতে পায় সব কিছুকে মানবীয় শক্তি সামর্থ ও রকমারি পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার ব্যবস্থা ৷ খোদ ইসলামী আদর্শ একেবারেই সহজবোধ্য । একজন ইলাহ আছেন, যার সমতুল্য ও সমকক্ষ কেউ নেই ৷ তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য নবী ও রসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। তারা মানুষকে তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দিকে মনোযোগী করেন এবং পরবর্তী সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য এই আকীদা থেকেই সুসমন্বিতভাবে উৎসারিত হয়ে থাকে ৷ তাতে কোনো বক্রতা ও বিচ্যুতি নেই। মানুষের সাধ্যমতো এগুলো পালন করা কর্তব্য । রসূল (স.) বলেন, ‘আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কাজের আদেশ দেই, তখন তোমরা যতোটা পারো তা কার্যকরী করো আর যা নিষেধ করি, তা বর্জন করো।’ (বোখারী ও মুসলিম) যখন কোনো উপয়ান্তর না থাকে, তখন নিষিদ্ধ কাজও করা যায়। সূরা আনয়ামের ১১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কেবলমাত্র সেই নিষিদ্ধ কাজটি করতে পারো, যা না করে তোমাদের উপায় থাকে না।’ এই প্রশস্ত সীমানার মধ্যে সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমিত থাকে । এ জন্য রসূল (স.)-এর মেযাজ ও স্বভাব রেসালাতের স্বভাব প্রকৃতির সাথে এবং প্রত্যেক দাওয়াতকারীর স্বভাব ও মেযাজ দাওয়াতের স্বভাব প্রকৃতির সাথে এই মৌলিক বৈশিষ্টে একীভূত থাকে । অর্থাৎ রসূল (স.) যেমন সরলতা ও উদারতা পছন্দ করেন, রেসালাতও তেমনি উদারতা ও সরলতায় পরিপূর্ণ । অনুরূপভাবে যে উন্মাতের কাছে এই উদারপন্থী ও সরলমতি রসূল স্বীয় উদার ও সরল সহজ রেসালাত নিয়ে এসেছিলেন, তারা মধ্যমপন্থী উম্মত ৷ চরমপন্থী বা উদারপন্থী নয়। এ উম্মত আল্লাহর অনুগ্রহভাজন ও উদারপন্থী উম্মত ৷ এ উম্মাতের জন্মগত স্বভাব গোটা সৃষ্টি জগতের প্রকৃতি ও স্বভাবের অনুরূপ ও অনুকূল ৷ আর এই বিশ্বজগত নিজের সুসমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ তৎপরতার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টিকুশলতার ঔদার্য ও সমন্বয়কে প্রতিফলিত করে । এই ঔদার্য ও সমন্বয়ে কোনো সংঘাত বা প্রতিকূলতার মিশ্রণ নেই। কোটি কোটি জড়পিন্ড আল্লাহর অথৈ মহাশূন্যে সাতার কেটে চলেছে এবং নিজেদের কক্ষপথে স্বাধীনভাবে ঘুরে চলেছে। এদের পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ সাযুজ্য, সহযোগিতাই শুধু বিরাজ করে না, বরং একে অপরকে আকৃষ্ট করেও রাখে । এদের ভেতরে কখনো সংঘর্ষ বাধে না এবং বিশৃংখলা বা নৈরাজ্য দেখা দেয় না। কোটি কোটি প্রাণী এর ভেতর সুশৃংখল ও স্থিতিশীল ব্যবস্থাধীনে নিজ নিজ নিকটবর্তী বা দূরবর্তী লক্ষ্যের দিকে ধাবমান থেকে জীবন অতিবাহিত করছে। এদের সকলকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য যাতে সহজে ও স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ধাবমান ৷ এই মহাবিশ্বে কোটি কোটি ঘটনা, অবস্থা ও তৎপরতা একত্রে মিলিত হয় আবার পৃথক হয়। অথচ তা রকমারি বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত বাদকদলের বাজনার সুরের মতো আপন নিয়মে নানা বৈচিত্র নিয়ে বাজতে থাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা একটিমাত্র ঐকতানে বিলীন হয়ে যায়। বস্তুত সৃষ্টির স্বভাব প্রকৃতি, রেসালাতের স্বভাব প্রকৃতি, রুলের স্বভাব প্রকৃতি এবং মুসলিম উম্মাতের স্বভাব প্রকৃতি সম্পূর্ণ রূপে একই সূত্রে গাথা, পরিপূর্ণ ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ । কেননা এগুলো তো একই প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞানী স্রষ্টা আল্লাহর সৃষ্টি । সুতরাং এই ঐক্য ও সমন্বয় নিতান্তই স্বাভাবিক ।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-৯

فَذَكِّرْ اِنْ نَّفَعَتِ الذِّكْرٰىؕ

কাজেই তুমি উপদেশ দাও, যদি উপদেশ উপকারী হয়১০

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) সাধারণভাবে মুফাসসিরগণ এ দু’টি বাক্যকে পৃথক পৃথক অর্থে গ্রহণ করেছেন। তারা প্রথম বাক্যের অর্থ করেছেন, আমি তোমাদেরকে একটি সহজ শরীয়াত দিচিছ। এ শরীয়াত অনুযায়ী কাজ করা সহজ। আর দ্বিতীয় বাক্যটির অর্থ করেছেন, উপদেশ দাও, যদি তা কাজে লাগে। কিন্তু আমার মতে “ফাযাক্কির” (فَذَكِّرْ) শব্দটি উভয় বাক্যকে পরস্পর সংযুক্ত করে দিয়েছে এবং শেষের বাক্যটির বিষয়বস্তু প্রথম বাক্যটির বিষয়বস্তুর ওপরই সংস্থাপিত হয়েছে। তাই আল্লাহর এই বাণীটির অর্থ আমি যা বুঝেছি তা হচ্ছেঃ হে নবী! দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে আমি তোমাকে কোন সংকটের মুখোমুখি করতে চাই না। যার শ্রবণশক্তি নেই তাকে শুনাতে হবে এবং যার দৃষ্টিশক্তি নেই তাকে দেখাতে হবে, এ ধরনের সংকটে তোমাকে ফেলতে চাই না। বরং তোমার জন্য একটি সহজ পথ তৈরি করে দিচ্ছি। সে পথটি হচ্ছে, যেখানে তুমি অনুভব করো কেউ উপদেশ গ্রহণ করতে এবং তা থেকে উপকৃত হতে প্রস্তুত সেখানে উপদেশ দিতে থাকো। এখন কে উপদেশ থেকে উপকৃত হতে এবং কে উপকৃত না হতে চায়, তার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে সাধারণ প্রচারের মাধ্যমেই। কাজেই সাধারণ প্রচার জারী রাখতে হবে। কিন্তু সেখানে তোমাদের উদ্দেশ্য হবে এমনসব লোকদের খুঁজে বের কর যারা এর সাহায্যে উপকৃত হয়ে সত্য সরল পথ অবলম্বন করবে। এসব লোকই তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার অধিকার রাখে এবং এদের শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি তোমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এদেরকে বাদ দিয়ে এমন সব লোকের পেছনে পড়ার তোমাদের কোন প্রয়োজন নেই। যাদের ব্যাপারে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তোমরা জানতে পেরেছো যে, তারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় না। প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তুই সূরা আবাসায় অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাব দেখায় তার প্রতি তুমি দৃষ্টি দিচ্ছো। অথচ সে সংশোধিত না হলে তোমার ওপর তার কী দায়িত্ব বর্তায়? আর যে ব্যক্তি নিজে তোমার কাছে দৌঁড়ে আসে এবং সে দৌঁড়রত রয়েছে, তার প্রতি তুমি অনাগ্রহ দেখাচ্ছো। এতো একটি উপদেশ, যে চায় এটা গ্রহণ করতে পারে।” ( ৫-১২ আয়াত)

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১০

سَیَذَّكَّرُ مَنْ یَّخْشٰىۙ

যে ভয় করে সে উপদেশ গ্রহণ করে নেবে।১১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) অর্থাৎ যে ব্যক্তির মনে আল্লাহর ভয় এবং খারাপ পরিণতির আশঙ্কা থাকবে সেই ভাবতে থাকবে যে, সে ভুল পথে যাচ্ছে কি-না এবং সেই ব্যক্তিই হেদায়াত ও গোমরাহীর পার্থক্য এবং সাফল্য ও সৌভাগ্যের পথের দানকারীর উপদেশ মনোযোগ সহকারে শুনবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব : অতএব, ‘আমি তোমাদের পড়িয়ে দেবো অতপর তুমি তা ভূলে যাবে না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, যা আল্লাহ্‌ তায়ালা ইচ্ছা করেন । অতপর তার জন্য সহজ সরল পথে চলাকে সহজ করে দিয়েছেন, যাতে তিনি এত বড় আমানতকে বহন করতে ও তা নিয়ে দাড়াতে পারেন । যাতে তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে, এ জন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ জন্যই তাকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। ‘অতএব, যখনই স্মরণ করানোর সুযোগ পাও, স্মরণ করাও’ ৷ যখনই মানুষের মনে কথা প্রবেশের সুযোগ ও ফীঁক সৃষ্টি হয়, অমনি তাকে উপদেশ দাও । যখনই প্রচারের কোনো মাধ্যম পাও, অমনি প্রচার করো ‘যদি তাতে উপকার হয়।’ বস্তুত স্বরণ করানো দ্বারা সব সময়ই মানুষের উপকার হয়। এ দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা কমই হোক বা বেশীই হোক, কখনো শূন্যের কোঠায় নামে না। মানুষের কোনো প্রজন্ম এবং পৃথিবীর কোনো ভূখন্ড আল্লাহর বাণীকে শ্রবণ করা ও তা থেকে উপকৃত হওয়া মানুষ থেকে একেবারে বঞ্চিত কখনো হবে না-তা মানুষ যতোই বিনষ্ট ও বিভ্রান্ত হোক, যতোই পাষাণ হৃদয় হোক এবং তার হৃদয়ে যতোই মরিচা ধরে আচ্ছন্ন হয়ে যাক। কোরআনের আয়াতের এই ধারাবাহিকতা নিয়ে যখন চিন্তা করি, তখন বুঝতে পারি আল্লাহর এই আমানত এবং নবুওতের এই দায়িত্ব কতো গুরুত্বপূর্ণ ও কতো বড়ো । কারণ, এ দায়িত্ব বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ বলেই তাকে সহজ করে দেয়ার এতো ব্যবস্থা করা ও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। রাসূল কে তা পড়িয়ে দেয়া ও মুখস্থ করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং গ্রহণ করে তার বোঝা হালকা করে দিয়েছেন, যাতে রসূল (স.) স্মরণ করানোর দায়িত্ব বহন করতে পারেন । এ কারণেই তাকে এতো বিপুল ও বিরাট সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত করা হয়েছে। অতপর যখন রসূল (স.) এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন, তখন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন হবে এবং তারপর দুনিয়ার মানুষ নিজেদের কাজ-কারবারের জন্য নিজেরাই দায়ী হবে । মানুষ বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী হবে, বিভিন্ন রকমের পরিণাম ও ফলাফল ভোগ করবে এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে যেমন আচরণ করতে চান করবেন তবে সেটা এই স্মরণিকা তথা কোরআনের দাওয়াতকে তারা গ্রহণ করে কিনা, তার ওপর নির্ভরশীল হবে। এ কথাই পরবর্তী আয়াত কয়টিতে বলা হয়েছে যে, ‘এই স্মরণিকা থেকে সেই উপদেশ গ্রহণ করবে যে খোদাভীরু, আর এ স্মরণিকাকে সে-ই এড়িয়ে চলবে যে হবে সবচেয়ে হতভাগা, যে আগুনে প্রবেশ করবে, অতপর সেখানে সে মরবেও না, বাচবেও না। মুক্তি পাবে সেই ব্যক্তি, যে পবিত্র হবে এবং আপন প্রতিপালকের নাম উচ্চারণ করবে ও নামায পড়বে ।’ অর্থাৎ তোমার কাজ স্মরণ করানো সে কাজ তুমি করে যাও। তবে এ দ্বারা কেবল খোদাভীরু লোকই উপকৃত হবে, উপকৃত হবে সেই ব্যক্তি, যার হৃদয়ে আল্লাহর আযাব ও গযবের ভয় বিদ্যমান। জীবন্ত ও প্রাণবন্ত মন সতর্ক থাকে এবং ভয়ও পায়। কেননা সে জানে যে, এ ৷ বিশ্বজগতের একজন ইলাহ রয়েছেন, যিনি সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন। যিনি পরিকল্পনা করেছেন ও ভাগ্য নির্ণয় করেছেন, অতপর পথনির্দেশ দিয়েছেন কাজেই তিনি মানুষকে বিনা পথ প্রদর্শনে ছেড়ে দিতে পারেন না। তাদেরকে উদ্দেশ্যহীন ছেড়ে দিতে পারেন না। কেননা, তিনি তো তাদের ভালোমন্দের হিসাব না নিয়ে ছাড়বেন না, ন্যায়বিচার না করে ছাড়বেন না। এ জন্যই সে ভয় পায়। তাই তাকে যখন স্মরণ করানো হয়, তখন সে স্মরণ করে, যখন তাকে দেখানো হয়, তখন সে দেখে এবং যখন তাকে সদুপদেশ দেয়া হয়, তখন সে তা গ্রহণ করে।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১১

وَ یَتَجَنَّبُهَا الْاَشْقَىۙ

আর তার প্রতি অবহেলা করবে নিতান্ত দুর্ভাগাই,

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১২

الَّذِیْ یَصْلَى النَّارَ الْكُبْرٰىۚ

যে বৃহৎ আগুনে প্রবেশ করবে,

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৩

ثُمَّ لَا یَمُوْتُ فِیْهَا وَ لَا یَحْیٰىؕ

তারপর সেখানে মরবেও না, বাঁচবেও না।১২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১২) অর্থাৎ তার মৃত্যু হবে না। যার ফলে আযাব থেকে রেহাই পাবে না। আবার বাঁচার মতো বাঁচবেও না। যার ফলে জীবনের কোন স্বাদ-আহলাদও পাবে না। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপদেশ আদৌ গ্রহণ করেনি এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে পর্যন্ত কুফরী, শিরক বা নাস্তিকতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তারাই এ শাস্তি লাভ করবে। আর যারা মনের অভ্যন্তরে ঈমানকে পোষণ করে কিন্তু নিজেদের খারাপ কাজের দরুন জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে তাদের সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে, তারা নিজেদের শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহ তাদের মৃত্যু দান করবেন। তারপর তাদের পক্ষে শাফা’আত কবুল করা হবে। তাদের অগ্নিদগ্ধ লাশ এনে জান্নাতের ঝরণার কিনারে ফেলে দেয়া হবে। জান্নাতবাসীদের বলা হবে, ওদের ওপর পানি ঢালো। বৃষ্টির পানি পেয়ে যেমন মৃত উদ্ভিদ জীবন্ত হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি জান্নাতের পানি পেয়ে তারাও জেগে উঠবে। এ সম্পর্কিত হাদীস মুসলিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে এবং বায্যারে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

দ্বীন গ্রহণ না করার কারণ : ‘হতভাগা ব্যক্তি এই স্মরণিকাকে এড়িয়ে চলে” অর্থাৎ উপেক্ষা করে। ফলে তা শ্রবণ করে না এবং উপকৃতও হয় না। সুতরাং এরূপ অবস্থায় সেই সবচেয়ে বড় হতভাগা প্রমাণিত হয়। এরূপ ব্যক্তি সর্বতোভাবে হতভাগা এবং চরম হতভাগা । পৃথিবীতেও সে হতভাগা । কারণ, তার আত্মা এতো মৃত, এতো নির্জীব এবং এতো মরিচা ধরা যে, প্রাকৃতিক সত্যকে সে অনুভব ও উপলব্ধি করে না। প্রকৃতির অকাট্য সত্য সাক্ষ্যে সে কর্ণপাত করে না এবং এর গভীরে সুপ্ত সংকেতগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয় না। পৃথিবীতে যা আছে তার লোভেই অস্থিরভাবে জীবন কাটায় । এই নগণ্য পার্থিব সম্পদের জন্য খেটে খেটে নাজেহাল হয় । আখেরাতেও সে হয় চরম হতভাগা । কেননা, সেখানে সে সীমাহীন শাস্তি ভোগ করবে। ‘সে বৃহত্তম আগুনে প্রবেশ করবে, অতপর সেখানে মরবেও না, বাচবেও না ।’ বৃহত্তম আগুন হচ্ছে জাহান্নামের আগুন ৷ বৃহত্তম তার তীব্রতায়, বৃহত্তম তার দীর্ঘস্থায়িত্বে এবং বৃহত্তম তার বিশাল আয়তনে । এই হতভাগার জীবনকাল সেখানে অনন্তকাল স্থায়ী হবে। ‘সেখানে মরবেও না’ যে মরে গিয়ে বিশ্রামের সুযোগ ভোগ করবে, আবার ‘সেখানে তারা বাচবেও না’ অর্থাৎ শান্তিতে বাচবে না। সে আযাব হবে চিরস্থায়ী আযাব । এ আযাবে যে ভুগবে সে মৃত্যুর জন্যে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করবে। অনুরূপভাবে সে বৃহত্তম আশা পূরণের জন্যও অপেক্ষা করবে।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৪

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰىۙ

সে সফলকাম হয়েছে, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে১৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৩) পবিত্রতা অর্থ কুফর ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা, অসৎ আচার-আচরণ ত্যাগ করে সদাচার অবলম্বন করা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে সৎ কাজ করা। সফলতা বলতে পার্থিব সমৃদ্ধি বুঝানো হয়নি বরং আসল ও সত্যিকার সফলতার কথা বুঝানো হয়েছে। এর সাথে পার্থিব সমৃদ্ধি অর্জিত হোক বা না হোক তাতে কিছু আসে যায় না। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনুস ২৩ টীকা , আল মু’মিনুন ১ , ১১ , ৫০ টীকা এবং সূরা লুকমান ৪ টীকা )।

ফী জিলালিল কুরআন:

এই আয়াতে আমরা দেখতে পাই মুক্তি ও সাফল্য পবিত্রতা ও শিক্ষা গ্রহণের সাথে সম্পর্কিত কিছু বিষয়। ‘যে ব্যক্তি পবিত্রতা অর্জন করলো এবং নিজের প্রতিপালকের নাম স্মরণ করলো ও নামায পড়লো সে সফলকাম ।’ ‘পবিত্রতা অর্জন’ বলতে সকল ধরনের নাপাকি ও নোংরামি থেকে অব্যাহতি লাভ বুঝায়। আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, এই পবিত্রতা অর্জনকারী এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে হৃদয়ে তার শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ অংকনকারী ব্যক্তিই মুক্তি লাভ করবে। এখানে ‘সালাত’ শব্দের অর্থ বিনয় প্রকাশ করাও হতে পারে, আবার পারিভাষিক অর্থে নামাযও হতে পারে বস্তুত আল্লাহর স্মরণ, তার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয় অন্তরে জাগরূক করা এবং হৃদয়ে তার ভয়াল রূপ অনুধাবন করার মাধ্যমে উক্ত উভয় রকমের ‘সালাত’ এর প্রেরণা সৃষ্টি হয়ে থাকে । এভাবে পবিত্রতা অর্জন, স্মরণ ও সালাত আদায় সুনিশ্চিত মুক্তি অর্জনের সহায়ক ৷ এ মুক্তি দুনিয়াতেও অর্জিত হয় আল্লাহ নৈকট্য লাভের মাধ্যমে, অন্তরের সজীবতা লাভের মাধ্যমে, আল্লাহর স্মরণে স্বাদ পাওয়া ও আল্লাহর স্মরণকে স্বতস্ফূর্তভাবে ভালোবাসা ও তার প্রতি অন্তরের আকর্ষণ বোধের মাধ্যমে । এ মুক্তি বৃহত্তম ও ভয়ালতম আগুন থেকে অব্যাহতি এবং বেহেশতের নেয়ামত ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের মাধ্যমে আখেরাতেও অর্জিত হবে ।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৫

وَ ذَكَرَ اسْمَ رَبِّهٖ فَصَلّٰىؕ

এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করেছে১৪ তারপর নামায পড়েছে।১৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৪) ‘স্মরণ করা’ বলতে আল্লাহকে মনে মনে স্মরণ করা এবং মুখে তা উচ্চারণ করাও বুঝানো হয়েছে। এই উভয়টিই যিকরুল্লাহ বা আল্লাহকে স্মরণ করার অন্তর্ভুক্ত হবে।

টিকা:১৫) অর্থাৎ কেবল স্মরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং নিয়মিত নামাযও পড়ে সে প্রমাণ করেছে যে, যে আল্লাহকে সে নিজের ইলাহ বলে মেনে নিয়েছে কার্যত তাঁর আনুগত্য করতেও সে প্রস্তুত এবং তাঁকে সর্বক্ষণ স্মরণ করার জন্য সে ব্যবস্থা অবলম্বন করছে। এই আয়াতে পর্যায়ক্রমে দু’টি কথা বলা হয়েছে। প্রথমে আল্লাহকে স্মরণ করা তারপর নামায পড়া। এ অনুযায়ী ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামায শুরু করার পদ্ধতি করা হয়েছে। রসূলুল্লাহ ﷺ নামাযের যে পদ্ধতি প্রচলন করেছেন তার সকল অংশই যে কুরআনের ইশারা ইঙ্গিত থেকে গৃহীত, এটি তার অসংখ্য প্রমাণের অন্যতম। কিন্তু আল্লাহর রসূল ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির পক্ষে এই ইঙ্গিতগুলো জমা করে নামাযকে এ আকারে সাজানো কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৬

بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا٘ۖ

কিন্তু তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো।১৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৬) অর্থাৎ দুনিয়া ও তার আরাম-আয়েশ এবং তার স্বার্থ ও আনন্দ স্বাদ লাভ করার জন্যই তোমাদের সমস্ত চিন্তা ও কর্মপ্রচেষ্টা উৎসর্গিত। তোমরা মনে করে থাকো, এখানে যা কিছু পাওয়া যায়, তাই নীট লাভ এবং এখানে যা থেকে বঞ্চিত হও তাই তোমাদের জন্য আসল ক্ষতি।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৭

وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰىؕ

অথচ আখেরাত উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।১৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৭) অর্থাৎ আখেরাত দু’দিক দিয়ে দুনিয়ার মোকাবিলায় অগ্রধিকার পাওয়ার যোগ্য। প্রথমত তার সুখ, স্বাচ্ছন্দ, আরাম-আয়েশ দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামতের চাইতে অনেক বেশী ও অনেক উচ্চ পর্যায়ের। দ্বিতীয়ত, দুনিয়া ধ্বংসশীল এবং আখেরাত চিরস্থায়ী।

ফী জিলালিল কুরআন:

সর্বাধিক হতভাগা ব্যক্তির ভাগ্যে জোটা ভয়াবহতম ও বিশালতম আগুন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীর জন্য মুক্তি ও সাফল্যের এই দৃশ্য অংকনের পর আল্লাহ তায়ালা শ্রোতাদেরকে পুনরায় সম্বোধন করে দুর্ভাগ্যের কারণ, তাদের গাফলতির উৎস, তাদের পবিত্রতা, স্মরণ ও মুক্তির পথ থেকে বিচ্যুতকারী এবং বৃহত্তম আগুনে ও নিকৃষ্টতম দুর্ভাগ্যে নিক্ষেপকারী উপকরণগুলো চিহ্নিত করছেন, ‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকো, অথচ আখেরাতই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী !’ বস্তুত দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়াই হলো সকল আপদের মূল ৷ এই অগ্রাধিকার থেকে উৎপত্তি হয় কোরআনকে উপেক্ষা করার মনোভাব । কেননা, এই কোরআন মানুষকে আখেরাতের হিসাব নিকাশকে অগ্রাধিকার দেয়ার দাবী জানায় । অথচ তারা দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয় এবং দুনিয়াকেই কামনা করে। দুনিয়াকে দুনিয়া নামে নামকরণ কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়! এর শাব্দিক অর্থ যেমন নিচু ও নিকৃষ্ট, আসলেও তা তাই । দুনিয়ার আর এক অর্থ ত্বরিত সংঘটিত । ‘আখেরাত শ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী ।’ অর্থাৎ আখেরাতের জীবন মানের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং মেয়াদের দিক দিয়ে চিরস্থায়ী। বস্তুত এই বাস্তবতার আলোকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, আখেরাতের ওপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দান বোকামি এবং নিকৃষ্ট মূল্যায়ন । কোনো বুদ্ধিমান দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোক এমন কাজ করতে পারে না।

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৮

اِنَّ هٰذَا لَفِی الصُّحُفِ الْاُوْلٰىۙ

পূর্বে অবতীর্ণ সহীফাগুলোয় একথাই বলা হয়েছিল,

সুরা: ৮৭ : আল্ -আলা:-১৯

صُحُفِ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰى۠

ইবরাহীম ও মূসার সহীফায়।১৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৮) এই দ্বিতীয়বারের মতো কুরআনে হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত মূসা (আ) এর সহীফা শিক্ষার বরাত দেয়া হয়েছে। এর আগে সূরা আন নাজমের তৃতীয় রুকূ’তে আর একবার এ ধরনের বরাত দেয়া হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

পরিশেষে এ দাওয়াতের প্রাচীনত্ব এর উৎসের আভিজাত্য, এর কালোত্তীর্ণ ও শাশ্বত মৌলিকত্ব এবং স্থান ও কালের ব্যবধান সত্ত্বেও এর মূলের একত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘নিশ্চয়ই এ বক্তব্য পূর্ববর্তী গ্রন্থাবলীতেও রয়েছে, ইবরাহীম মুসার গ্রন্থাবলীতে ।’ অর্থাৎ ইসলামের শাশ্বত ও সুমহান আকীদা সংক্রান্ত যে বক্তব্য এই সূরায় রয়েছে, তা পূর্বতন গ্রন্থাবলীতে এবং ইবরাহীম ও মূসার গ্রন্থাবলীতেও আছে। সত্য যখন এক, আকীদা আদর্শ ও তত্ত্ব যখন এক, তখন তা স্বতস্ফূর্তভাবেই সাক্ষ্য দেয় যে, তার উৎসও এক এবং মানুষের নিকট রসূল প্রেরণের সিদ্ধান্তও এক ৷ মূলত এ সত্য একই মহাসত্য, অকাট্য সত্য এবং এর উৎসও একই ৷ নতুন নতুন প্রয়োজন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে তার বিস্তারিত রূপ ও খুঁটিনাটি নীতিতে পার্থক্য থাকে। কিন্তু তা সেই একই মুলে গিয়ে মিলিত এবং একই উৎস থেকে নির্গত হয়। সে উৎস হচ্ছেন শ্রেষ্ঠতম প্রভু যিনি সৃষ্টিকর্তা, ভারসাম্যদানকারী, পথনির্দেশদানকারী ও ভাগ্য নিরূপণকারী ও পরিকল্পনাকারী ।

Leave a Reply