Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২০২/হে মানুষ:-১২) [# # النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُۗۖ #رَاضِیَةً مَّرْضِیَّةًۚ # ইতিহাসের অহংকারী জাতি : – # পরীক্ষা :- # উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সঠিক বন্টন:- #ধন-সম্পদের প্রেমে তোমরা মারাত্মকভাবে বাঁধা পড়েছ!:-] www.motaher21.net

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০২/হে মানুষ:-১২)
[#
# النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُۗۖ

#رَاضِیَةً مَّرْضِیَّةًۚ

# ইতিহাসের অহংকারী জাতি : –
# পরীক্ষা :-
# উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সঠিক বন্টন:-
#ধন-সম্পদের প্রেমে তোমরা মারাত্মকভাবে বাঁধা পড়েছ!:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর
পারা:৩০
১-৩০ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১
وَ الۡفَجۡرِ ۙ﴿۱﴾
শপথ ফজরের।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২
وَ لَیَالٍ عَشۡرٍ ۙ﴿۲﴾
শপথ দশ রাত্রির।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৩
وَّ الشَّفۡعِ وَ الۡوَتۡرِ ۙ﴿۳﴾
শপথ জোড় ও বেজোড়ের।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৪
وَ الَّیۡلِ اِذَا یَسۡرِ ۚ﴿۴﴾
এবং শপথ রাত্রির, যখন তা গত হতে থাকে।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৫
ہَلۡ فِیۡ ذٰلِکَ قَسَمٌ لِّذِیۡ حِجۡرٍ ؕ﴿۵﴾
নিশ্চয়ই এর মধ্যে শপথ রয়েছে জ্ঞানবান ব্যক্তির জন্যে।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৬
اَلَمۡ تَرَ کَیۡفَ فَعَلَ رَبُّکَ بِعَادٍ ۪ۙ﴿۶﴾
তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক আ’দ জাতির সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন;
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৭
اِرَمَ ذَاتِ الۡعِمَادِ ۪ۙ﴿۷﴾
সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী আদে-ইরামের৩ সাথে,
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৮
الَّتِیۡ لَمۡ یُخۡلَقۡ مِثۡلُہَا فِی الۡبِلَادِ ۪ۙ﴿۸﴾
যার সমতুল্য জাতি অন্য কোন দেশে সৃষ্টি হয়নি।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৯
وَ ثَمُوۡدَ الَّذِیۡنَ جَابُوا الصَّخۡرَ بِالۡوَادِ ۪ۙ﴿۹﴾
এবং সামূদ জাতির সাথে? যারা উপত্যকায় পাথর কেটে গৃহ নির্মাণ করেছিল?
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১০
وَ فِرۡعَوۡنَ ذِی الۡاَوۡتَادِ ﴿۪ۙ۱۰﴾
এবং কীলকওয়ালা ফির‘আউনের প্রতি ?
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১১
الَّذِیۡنَ طَغَوۡا فِی الۡبِلَادِ ﴿۪ۙ۱۱﴾
যারা দেশের মধ্যে উদ্ধত আচরণ করেছিল।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১২
فَاَکۡثَرُوۡا فِیۡہَا الۡفَسَادَ ﴿۪ۙ۱۲﴾
অতঃপর সেখানে অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৩
فَصَبَّ عَلَیۡہِمۡ رَبُّکَ سَوۡطَ عَذَابٍ ﴿ۚۙ۱۳﴾
ফলে তোমার প্রতিপালক তাদের উপর শাস্তির চাবুক হানলেন।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৪
اِنَّ رَبَّکَ لَبِالۡمِرۡصَادِ ﴿ؕ۱۴﴾
নিশ্চয় আপনার রব সতর্ক দৃষ্টি রাখেন ।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৫
فَاَمَّا الۡاِنۡسَانُ اِذَا مَا ابۡتَلٰىہُ رَبُّہٗ فَاَکۡرَمَہٗ وَ نَعَّمَہٗ ۬ۙ فَیَقُوۡلُ رَبِّیۡۤ اَکۡرَمَنِ ﴿ؕ۱۵﴾
মানুষ তো এরূপ যে, তার প্রতিপালক যখন তাকে পরীক্ষা করেন, পরে তাকে সম্মানিত করেন এবং সুখ ও সম্পদ দান করেন, তখন সে বলে, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে সম্মানিত করেছেন।’
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৬
وَ اَمَّاۤ اِذَا مَا ابۡتَلٰىہُ فَقَدَرَ عَلَیۡہِ رِزۡقَہٗ ۬ۙ فَیَقُوۡلُ رَبِّیۡۤ اَہَانَنِ ﴿ۚ۱۶﴾
আর যখন তাকে পরীক্ষা করেন তার রিয্ক সংকুচিত করে, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে হীন করেছেন।’
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৭
کَلَّا بَلۡ لَّا تُکۡرِمُوۡنَ الۡیَتِیۡمَ ﴿ۙ۱۷﴾
না, কখনই নয়। বস্তুতঃ তোমরা পিতৃহীনকে সমাদর কর না।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৮
وَ لَا تَحٰٓضُّوۡنَ عَلٰی طَعَامِ الۡمِسۡکِیۡنِ ﴿ۙ۱۸﴾
এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৯
وَ تَاۡکُلُوۡنَ التُّرَاثَ اَکۡلًا لَّمًّا ﴿ۙ۱۹﴾
এবং উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পূর্ণরূপে আত্মসাৎ করে থাক।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২০
وَّ تُحِبُّوۡنَ الۡمَالَ حُبًّا جَمًّا ﴿ؕ۲۰﴾
এবং তোমরা ধন-সম্পদকে অত্যধিক ভালোবেসে থাক।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২১
کَلَّاۤ اِذَا دُکَّتِ الۡاَرۡضُ دَکًّا دَکًّا ﴿ۙ۲۱﴾
না এটা সঙ্গত নয়! যখন পৃথিবীকে ভেঙ্গে পূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২২
وَّ جَآءَ رَبُّکَ وَ الۡمَلَکُ صَفًّا صَفًّا ﴿ۚ۲۲﴾
এবং তোমার রব এমন অবস্থায় দেখা দেবেন। যখন ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৩
وَ جِایۡٓءَ یَوۡمَئِذٍۭ بِجَہَنَّمَ ۬ۙ یَوۡمَئِذٍ یَّتَذَکَّرُ الۡاِنۡسَانُ وَ اَنّٰی لَہُ الذِّکۡرٰی ﴿ؕ۲۳﴾
সেদিন জাহান্নামকে সামনে আনা হবে। সেদিন মানুষ বুঝবে কিন্তু তার বুঝতে পারায় কী লাভ?
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৪
یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِیۡ قَدَّمۡتُ لِحَیَاتِیۡ ﴿ۚ۲۴﴾
সে বলবে, ‘হায়! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম!’
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৫
فَیَوۡمَئِذٍ لَّا یُعَذِّبُ عَذَابَہٗۤ اَحَدٌ ﴿ۙ۲۵﴾
সেদিন তাঁর শাস্তির মত শাস্তি কেউ দিতে পারবে না,
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৬
وَّ لَا یُوۡثِقُ وَ ثَاقَہٗۤ اَحَدٌ ﴿ؕ۲۶﴾
এবং তাঁর বন্ধনের মত বন্ধন কেউ বাঁধতে পারবে না।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৭
یٰۤاَیَّتُہَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ ﴿٭ۖ۲۷﴾
হে প্রশান্ত আত্মা !
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৮
ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّکِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً ﴿ۚ۲۸﴾
তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে ,
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৯
فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾
সুতরাং তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৩০
وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ ﴿٪۳۰﴾
এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।

#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আল-ফাজর

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৮৯

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : আলোচ্য সূরাটি আমপারার অন্যান্য সুরার মতোই এমন এক হৃদয়স্পশী সূরা যা মানুষকে ঈমান, তাকওয়া, জাগ্রত হওয়া ও প্রকৃতির সবকিছু সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার আহ্বান জানায় । শুধু তাই নয় এ সূরার মধ্যে অন্যান্য সূরার তুলনায় বিশেষ আরও একটি দিক রয়েছে এতে অত্যন্ত মনমাতানো ছন্দের মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনাবলী তুলে ধরে আলোচ্য বিষয়টাকে এমনভাবে হৃদয়গ্রাহী করে তোলা হয়েছে। যে, এ সুরাটি পাঠকের হৃদয়কে সৎকাজের প্রতি দারুণভাবে উৎসাহিত করে। এখানে এমন কিছু দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে যেগুলোতে একাধারে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি এবং মহাশূন্যলোকের সুক্ষাতিসূক্ষ রহস্যের ইংগিত পাওয়া যায়। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে সেগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন মনে হয় কিন্তু সেগুলোর মধ্যে যে একই সুরের মুর্ছনা বর্তমান। তা সূরাটি একটু খেয়াল করে পড়লেই বুঝা যায়। এরশাদ হচ্ছে-  ‘কসম প্রথম প্রভাতের, দশটি রাতের কসম, কসম জোড় ও বেজোড়ের, আরও কসম নিশীথ রাতের যখন এ রাত সহজ ও সাবলীল গতিতে অতিক্রান্ত হয়।’ আবার প্রকৃতির মধ্যে এমনও কিছু দৃশ্য ও বিভিন্ন সুরের ঝংকার পাওয়া যায় যেগুলোর পরস্পরের মধ্যে মিল ও বেমিল দুটোই একসাথে আছে বলে মনে হয়। যেমনটি দেখা যায় পরবর্তী আলোচ্য কঠিন ভীতিকর দৃশ্যের মধ্যে । ‘কখনো নয়, (এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনি থাকবে না, চিন্তা করা দরকার (ওই সময়ের কথা) যখন পৃথিবীতে প্রচন্ড আলোড়ন হবে এবং উপর্যুপুরী ভীষণ কম্পনে পৃথিবীর সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে৷ সে সময় তোমার রব সবার দৃষ্টির সামনে হাযির হয়ে সবাইকে দেখা দেবেন । আরও আসবে ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে।’ সেদিন কাছে এগিয়ে আনা হবে জাহান্নামকে ৷ সেই ভয়ংকর জাহান্নামের দৃশ্য দেখে মানুষ অবশ্যই কিছু শিক্ষা নিতে চাইবে ৷ কিন্তু সেদিন কীইবা কাজে লাগবে তার এই ইচ্ছা। বলবে হায়, আফসোস যদি এই দিনের জন্যে আমি জীবদ্দশাতেই কিছু পাথেয় সঞ্চয় করতাম। সে দিন তার আযাব আর কেউ লাঘব করে দেবে না বা দিতে পারবে না এবং যেভাবে অপরাধীদেরকে সেদিন তিনি বেঁধে রাখবেন, সেভাবে আর কেউ কাউবে বাধবে না বা বাধতে পারবে না। আরও কিছু দৃশ্য থাকবে সেদিন, যা হবে যেমন মনোহর, তেমনি হবে সন্তোষজনক, আনন্দদায়ক ও প্রশান্তি আনয়নকারী । এসব দৃশ্যের মধ্যে থাকবে চোখে পড়ার মতো অবিচ্ছেদ্য এক সামঞ্জস্য যা দেখা যায় সূরাটির শেষের আয়াতগুলোতে, ‘হে প্রশান্ত অন্তর, ফিরে এসো তোমার রবের কাছে সন্তুষ্ট  চিত্তে এবং খুশিমনে ৷ তারপর দাখিল হয়ে যাও আমার (নেককার) বান্দাদের দলে আর দাখিল হয়ে যাও আমার জান্নাতে ।’ সুরাটিতে আরও এ ভীষণ ধ্বংসলীলার বেশী কিছু ইংগিত পাওয়া যায় যা নেমে এসেছিলো অতীতের অনেক অহংকারী জাতির ওপর ৷ এ ধ্বংসাত্মক অবস্থা কখনও এসেছে মধ্যম ধরনের আবার কখনও এসেছে অতি ভয়ংকর রূপ নিয়ে। এরশাদ হচ্ছে- ‘তুমি কি দেখোনি বা শোনোনি কেমন ব্যবহার করেছেন তোমার রব আদ জাতির সাথে? তাদেরই এক গোত্র ছিলো ইরাম, তারা ছিলো বড় বড় স্তম্ভ বিশিষ্ট দালান কোঠার অধিবাসী বিরাটকায় মানুষ ৷ যাদের মতো শক্তিশালী ও সামর্থবান মানুষ দুনিয়ার আর কোথাও কখনও পয়দা করা হয়নি। এবং (দেখোনি কি) সামুদ জাতিকে যারা পাথরের পাহাড় পর্বত কেটে কেটে সেই উপত্যকায় ঘরবাড়ী তৈরি করেছিলো?’ আবার তাকাও ফেরাউনের দিকে, ‘যে ছিলো বহু মযবুত খুঁটিওয়ালা তাবু নির্মাণকারীদের অধিপতি ৷ ফেরাউনের এই লোকজন সারাদেশের সকল শহ্‌র বন্দরে অত্যন্ত সীমালংঘনকারী হিসেবে বিবেচিত হতো । সারা পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে চরম অহংকারী ও অত্যাচারী বলে জানতো। সেখানে তারা বহু বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিলো যার ফলে তোমার রব তাদের ওপর আযাবের কশাঘাত (চাবুক) বর্ষণ করেছিলেন । নিশ্চয়ই তোমার রব সর্বক্ষণ তাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন ।’ এ সূরার মধ্যে এক বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় বেশ কিছু সংখ্যক ওইসব বে-ঈমান লোকের চিন্তা ভাবনা ও তাদের মনগড়া মতবাদের, যারা জীবনের এক বিশেষ মুল্যবোধ গড়ে তুলেছিলো। এই বিবরণ দিতে গিয়ে এক বিশেষ ভঙ্গিমার অবতারণা করা হয়েছে। দেখুন, বলা হচ্ছে, ‘মানুষের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যখন তার রব তাকে কোনো পরীক্ষায় ফেলেন, তখন তাকে প্রচুর পরিমাণ সম্মান দেন এবং নানা প্রকার সুখ সম্পদও দিয়ে থাকেন । তখন সে বলে ওঠে, আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আবার যখন তাকে দেয়া সুখ সম্পদ সংকুচিত করে দিয়ে তাকে পরীক্ষা করেন, তখন সে বলে ওঠে, আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন ।’ এরপর তাদের ওই ধ্যান-ধারণাকে খন্ডন করে তাদের আসল অবস্থা তুলে ধরা হচ্ছে যা তৎকালীন বিশেষ বিশেষ মনগড়া মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিলো । এ প্রসঙ্গে এখানে দু’ধরনের বর্ণনাভংগি ও রং-রসে ভরা আলোচনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, যা ভেবেছো তা কখনোও নয় বরং তোমরা এতীমকে কোনো মান-মর্যাদা দাও না এবং ছিন্নমূল ব্যক্তিকে খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনো চিন্তা ভাবনা নিজেরা করো না এবং অন্য কাউকে করতে উৎসাহ দাও না। আর এতীমদের মীরাসের মাল সম্পদ তোমরা উম্মাদের মতো নির্দয়ভাবে ভক্ষণ করো এবং প্রতিটি সুখ-সম্পদের জিনিসকে গভীরভাবে ভালবাসো । এখানে দেখা যায়, এই শেষের বর্ণনাভংগিটি এবং তার ছন্দের মধ্যে অবস্থিত চমৎকার সুর ঝংকার তাদের বর্তমান ভ্রান্তিপূর্ণ অবস্থা ও অনাগত ভবিষ্যতে যে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন তাদেরকে হতে হবে এ দুইয়ের মধ্যে যেন এক সেতুবন্ধ নির্মাণ করেছে। এরপর আসছে আর একটি ভয়ংকর দৃশ্যের বর্ণনা । সম্পদের মোহে তারা যতোই ডুবে থাকুক না কেন, কিছুতেই তা চিরদিন থাকবে না। এক সময় উপর্যুপরি আলোড়নে বা ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে সবকিছু । অবশ্য আলোচ্য এ বর্ণনাটি হচ্ছে প্রথমদিকে উল্লেখিত বিবরণ ও শেষোক্ত তিরঙ্কারের মধ্যবর্তী এক আলোচনা ।এই উপস্থাপিত আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, গোটা সূরাই বিভিন্ন বর্ণাঢ্য বর্ণনায় ভরা এবং এই সুরা এক চমৎকার ভংগিতে অতীতের বিভিন্ন সীমালংঘনকারী জনগোষ্ঠীর শাস্তির অবস্থা তুলে ধরে ভবিষ্যতের মানুষের জন্য এক শিক্ষা উপস্থাপিত করেছে। আর এই প্রয়োজনে একই কথা বারবার বিভিন্ন ভংগিতে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ জন্য গভীর অর্থব্যঞ্জক শব্দাবলী প্রয়োগ করা হয়েছে। যার ফলে, পাঠকের মনে আলোচ্য বিষয়ের মর্ম এবং বিভিন্ন দৃশ্যের প্রভাব কার্যকরভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং বর্ণনার চাতুর্যের দিক দিয়ে চিন্তা করতে গেলে কোরআনে বর্ণীত রূপে রসে ভরা সূরাগুলোর এক চমৎকার দৃষ্টান্ত হিসাবে গোটা কালামে পাকের মধ্যেও এ সুরাটি এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। সর্বোপরি সূরাটির সর্বত্রই এক অতি আকর্ষণীয় সৌন্দর্য বর্তমান রয়েছে, যা যে কোনো পাঠকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অবশ্য সূরাটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অত্যন্ত সুসামঞ্জস্য এবং এক অনবদ্য ও সুন্দর জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যার আলোচনা বিস্তারিতভাবে নীচে প্রদত্ত হলো ।

সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-5

هَلْ فِیْ ذٰلِكَ قَسَمٌ لِّذِیْ حِجْرٍؕ

এর মধ্যে কোন বুদ্ধিমানের জন্য কি কোন কসম আছে?

ফী জিলালিল কুরআন:

‘কসম প্রথম প্রভাতের এবং কসম দশটি রাতের, আরো কসম জোড় (সৃষ্টি) ও বে-জোড় (আল্লাহ পাক)-এর আবার রাতেরও কসম যা সহজে অতিবাহিত হয়। বুদ্ধিমান যে কোনো ব্যক্তির জন্য এর মধ্যে কসম খাওয়ার কোনো যুক্তি আছে কি?’ আল্লাহর শপথ বাক্য : এ সূরার শুরুতে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দৃশ্য এবং সৃষ্টিলোকের সেই সব জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে যা অত্যন্ত সুক্ষ্ম,মনোরম এবং যার মধ্যে প্রচুর প্রাণ প্রবাহের অস্তিত্ব রয়েছে বলে আমরা অনুভব করি। ‘কসম প্রভাতবেলার’ । এ এমন একটি মুহূর্ত যখন জীবন যেন শ্বাস ছাড়ে অত্যন্ত কোমল, মধুর এবং ধীর হাসিমাথা গতিতে । এ এমন এক সময় যখন তনুমন সজীব হয়ে যায় এবং আশেপাশের সব কিছু যেন এক মুগ্ধ আবেশে আলিঙ্গন করে। দেহমন পুলকিত হয়ে উঠে যেন অদেখা, অজানা কোনো বন্ধুর মধুর স্পর্শে । যেন মৃদু মন্থর গতিতে সে বলতে থাকে, ওঠো বন্ধু ওঠো, আর কতো ঘুমাবে, এবার উঠে পড়ো । এই মধুমাখা ডাকে সাড়া দিয়ে জেগে উঠে ধীরে ধীরে প্রকৃতির সবকিছু এবং শ্রদ্ধা জানায় পরম পুলকে মালিকের দরবারে । আর ‘দশটি রাতের কসম’ কোরআনে পাকে এতটুকু কথা বলেই এ প্রসঙ্গে ইতি টানা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কেউবলেছেন, এর ইশারা হচ্ছে যিলহজ্জ মাসের দশটি রাত । যে যাই-ই বলুন না কেন, এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, এ রাতগুলো অত্যন্ত মোবারক অর্থাৎ রহমত ও বরকতে ভরা। তবে সুনির্দিষ্টতাবে একমাত্র আল্লাহ্‌ তায়ালাই এগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন । একমাত্র তিনিই সেগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারেন । নিসন্দেহে এ রাতগুলো তাঁর কাছে বড় মর্যাদাপূর্ণ। এগুলোর বর্ণনাভংগিতে মনে হয় যেন এগুলো ব্যক্তিত্বপূর্ণ কোনো এক জীবন্ত সত্ত্বা । কোরআনের বর্ণনায় আরো যেন মনে হয়, এগুলো আমাদের সাথে নিবিড় এক বন্ধনে আবদ্ধ । আর আমরাও যেন এগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । আরো কসম (সৃষ্টি সকল) জোড় জিনিসের আর বেজোড় সেই মহান সত্ত্বার যার দ্বিতীয় বলতে আর কেউ নেই । এ দুটি কথার তাফসীর করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ব-প্রকৃতির মনোরম বস্তুগুলো ফজরের সময় বিশেষ করে সেই দশটি রাতে আনুগত্য প্রকাশ করে ও ভক্তি প্রদর্শনের মানসে ঝুঁকে পড়ে মহান আল্লাহর সামনে ৷ তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসেও এভাবেই বলা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে এ ব্যাখ্যাটিই সবচে বেশী গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এই দিনক্ষণগুলো এমন সুন্দর যখন এর বিনম্র আত্মাগুলো প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায় এবং সে প্রিয় ও পছন্দনীয় রাতগুলো ও শান্ত সমুজ্জ্বল প্রথম প্রভাতের আগমনে নিজেদেরকে করুণাময়ের দরবারে সঁপে দিয়ে কৃতার্থ বোধ করে। ‘আবার কসম সেই বিদায়ী রাতের যা (ধীর গতিতে নিজ পথে শান্ততাবে) চলে যায়। এখানে রাত বলতে বুঝানো হয়েছে এমন এক সৃষ্টজীবকে, যা সজীব অবস্থায় বিরাজ করছে এবং যা সৃষ্টিজগতে গতিশীল অবস্থায় বর্তমান এবং তা যেন অন্ধকারের বুকে সদা পরিভ্রমণরত কোনো জীব, অথবা সে যেন দূর দেশের এমন এক মুসাফির যে, বিরামহীন চলতেই ভালবাসে ৷ আহ্‌ কী চমৎকার এ ব্যাখ্যা! কি সুন্দর মনোরম এ দৃশ্য । কতো মনোমুগ্ধকর এ নেয়ামতগুলো! আর এই বর্ণনা পরস্পরা একটির পর অপরটি, ফজরের সাথে দশটি রাতের কী সুনিবিড় সম্পর্ক এবং জোড় ও বে-জোড়ের সেসব কিছুর কী মধুর যোগসূত্র! সবকিছু মিলে এ যেন এক আনন্দের মেলা । এগুলো শুধুমাত্র কিছু কথা ও কিছু ব্যাখ্যাই নয়, এগুলো হচ্ছে প্রথম প্রভাতের সুবাসিত নিশ্বাস, যে এমন মধুর সমীরণ যা মনমাতানো অপূর্ব সুরভিতে ভরপুর ৷ এটা কি আন্তরিক বিমুগ্ধকারী এক অতি বড় নেয়ামত, আত্মার প্রশান্তি, মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্য বিশ্বব্যাপী আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্যের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী এক যাদুস্পর্শ। এটা এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, প্রভাত বেলার এমন কোমলমধুর প্রাণ মাতানো রূপ যার বর্ণনা কোনো সৌন্দর্যপূজারী বাকপটু কবি আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি বা পারবে না। কারণ এ হচ্ছে প্রকৃতিকে আল্লাহর দেয়া অপরূপ রূপ, যার সাথে অন্য কোনো জিনিসের তুলনা সম্ভব নয় এবং সে সৌন্দর্য নিজেই নিজ বর্ণনায় অনুপম । এই কারণেই এই প্রসঙ্গ শেষ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য এই মনোমুগ্ধকর জিনিসের মধ্যে কসম খাওয়ার কিছু আছে কি? এ দাবী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই আসলে এই জিজ্ঞাসা । প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্যই আলোচ্য বিষয়ের ওপর কসম খাওয়ার মতো অনেক কারণ আছে-আছে অনেক যুক্তি । যার তীব্র অনুভুতি শক্তি আছে এবং যার চিন্তা ভাবনা করার মতো অন্তরের যথেষ্ট প্রশ্বস্ততা আছে, তার জন্য এই সুন্দর প্রভাতের কসম খাওয়ার মধ্যে অনেক যুক্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবোধক কথা বলে দাবীকৃত বিষয়ের যৌক্তিকতাকেই আরো জোরদারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ফিসফিসে এই মধুর বাণী শোনার জন্যে প্রয়োজন অতি সুক্ষ অনুভূতি, যা বুঝার জন্যে প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ ও চিন্তা-ভাবনা এভাবে পূর্ববর্তী মধুর আলোচনার সাথে পরবর্তী আলোচনার এক গভীর যোগসূত্র বুঝা যায়। শপথের মূল বিষয়টি আলোচনা থেকে এখানে বাদ দেয়া হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে অত্যাচার-অনাচার এবং দুর্নীতির যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে তাতে মূল আলোচ্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অহংকারী, সীমালংঘনকারী এবং বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদেরকে পাকড়াও করা হবে বলে যেসব কড়া ধমক এসেছে সেই কথাগুলোকেই অতি সুন্দরভাবে বুঝানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা কসম খেয়েছেন বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন জিনিসের । বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখোনি তোমার রব আ’দ জাতির মধ্যকার ইরাম গোত্রের কেমন অবস্থা করলেন। …….. অবশ্যই তোমার রব তাদেরকে পাকড়াও করার জন্য ওঁৎপেতে ছিলেন ।’ এ ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবোধক বাক্য ব্যবহার করে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্যে এবং সত্যের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এক কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। এ পর্যায়ের প্রথমেই সম্বোধন করা হয়েছে নবী (স.)-কে। তারপর সম্বোধন করা হয়েছে ওই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে, যারা ওই সকল জাতির কঠিন দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। ওই সকল লোককেও সম্বোধন করেছেন, যারা নবী (স.)-এর যমানায় বর্তমান ছিলো । কোরআনের সম্বোধনের প্রথম লক্ষ্য ছিলো, যারা তাকে সম্যকভাবে জানতো ও চিনতো ৷ এই সম্বোধনের লক্ষ্য ওই সকল অতীতের জনগোষ্ঠীও বটে, যারা কিসসা কাহিনী ও কিংবদন্তীর মাধ্যমে ওই মন্দ লোকদের কঠিন পরিণতির কথা জানতে পেরেছে। নিজ চোখে দেখা বা শোনার যে ক্রিয়াবাচক শব্দটি ‘তোমার রব দেখবেন’ বলে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মোমেন ব্যক্তিও আছে, যার অন্তর নিশ্চিন্ততায় ভরা, মানুষকে ভালোবেসে যারা শান্তি পায় এবং বিশেষভাবে ওই ‘তোমার’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে প্রত্যেক ওই তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তির জন্যেও যারা মক্কায় বাস করতো এবং বদমেযাজী অহংকারী লোকদেরকে তাদের সীমালংঘনকর কাজে সাহায্য যোগাতো ৷ উপরন্তু তাদের ওপর জবরদস্তিকারীদেরকে তাদের যুলুমে সমর্থন দিতো ৷ একদিকে এদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং অপরদিকে এদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা কড়া দৃষ্টি রেখেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন: ইতিহাসের অহংকারী জাতি : আলোচ্য সংক্ষিপ্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা অতীত ইতিহাসের পাতা থেকে কয়েকটি চরম অহংকারী ও অত্যাচারী জাতির ভয়াবহ পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন। একটি ধ্বংসস্থল হচ্ছে আ’দ জাতির ইরাম গোত্রের এলাকা ৷ এরা আ’দ জাতির প্রথম গোত্র । এরা ছিলো প্রাচীন আরবের অধিবাসীদের একটি গোত্র অথবা আরব বেদুইনদের একটি গোত্র। তাদের বাসস্থান ছিলো পবর্তঞ্চলের আকাবাঁকা পথের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে । যেখানে বালুর স্তুপগুলো বর্তমান-সেই দুর্গম এলাকায় । এ এলাকাটি অবস্থিত হাদরে মওত ও ইয়েমেনের মাঝে দক্ষিণ উপদ্বীপে । এরা ছিলো আরব বেদুঈন এক দুরন্ত যাযাবর । পাহাড় পর্বতের বিস্তীর্ণ এলাকার ফাঁকে ফাঁকে এরা তাঁবু গেড়ে বাস করতো। এগুলোকে স্থির রাখার জন্য এরা খুবই মযবুত খুঁটি ব্যবহার করতো। কোরআনে পাকের মধ্যে এদেরকে অত্যন্ত শক্তিশালী ও ভীষণ এক দুঃসাহসী জাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আ’দ জাতিই তৎকালীন অন্যান্য সকল জাতি থেকে বেশী শক্তিশালী ছিলো। বলা হয়েছে, যাদের মতো শক্তিশালী সারাদেশে (অথবা সকল দেশের মধ্যে) আর কাউকে পয়দা করা হয়নি । ‘এবং ঐ সামুদ জাতি যারা উপত্যকার মধ্যে পাথর কেটে কেটে ঘরবাড়ী তৈরী করেছিলো’ এই সামুদ জাতি বাস করতো উত্তর উপদ্বীপে অবস্থিত মদীনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকায় । এরা পাথর কেটে কেটে বিরাট বিরাট মযবুত অট্টালিকা তৈরী করেছিলো ৷ এমনকি পর্বতের অভ্যন্তরে নিরাপদ এলাকা ও বহু গুহা এরা তৈরী করেছিলো । ‘আর ফেরাউন (এর সাথে কি ব্যবহারটাই করেছেন তোমর রব, তাও কি দেখোনি?) সে ছিলো খুঁটি স্থাপন করে তাবু প্রতিষ্ঠাকারী।’ সম্ভবত এ কথা দ্বারা মিসরের ওই সুউচ্চ পিরামিড শ্রেণীকে বুঝানো হয়েছে, যা ওই শক্ত মালভূমি অঞ্চলের মধ্যে খুঁটির মতো অত্যন্ত মযবুতভাবে আজও প্রতিষ্ঠিত আছে, ফেরাউন নামে প্রাচীন মিশরে যে কোনো বাদশাহকে অভিহিত করা হলেও এখানে ফেরাউন বলতে বুঝানো হয়েছে মূসা (আ.)-এর যামানার মহা অহংকারী ও বিদ্রোহী ফেরাউনকে । এরাই হচ্ছে সেইসব লোক যারা সারাদেশে বা বিশ্বে সীমালংঘন করেছিলো । যার ফলে তারা ভীষণভাবে সমাজে ও দেশে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিলো। বলা বাহুল্য বিদ্রোহ ও সীমালংঘনকর কাজের পরিণতি অশাস্তি ও বিশৃংখলা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিদ্রোহাত্মক কাজ বিদ্রোহীর কবলে পতিত ব্যক্তিদেরকে এবং বিদ্রোহীর সংগী সাথী সবাইকে সমভাবে কষ্ট দেয়। অশান্তিতে ফেলে দেয় গোটা সমাজকে ৷ এমনকি গোটা বিদ্রোহ কবলিত এলাকার মধ্যে চরম বিশৃংখলা ও অশাস্তি ছড়িয়ে পড়ে৷ সে সকল স্থানে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও শান্তিপূর্ণ জীবন সবদিক দিয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত হয়ে যায়। এমনকি গঠনমূলক কাজের দাবীদার ও সংস্কারবাদী মনোভাবের ওই মানুষগুলো নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পৃথিবীতে মানুষ যে আল্লাহর খলীফা তা আর স্বীকৃতি পায় না। এই বিদ্রোহীরা দাবী যাই-ই করুক না কেন, সে তার কৃপ্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়। যেহেতু সে কোনো নির্দিষ্ট ও স্থায়ী নীতিতে বিশ্বাসী থাকে না বা কোনো সীমাও মানে না। এর ফলে যে অশান্তির সৃষ্টি হয়, তার প্রথম শিকার হয় সে নিজেই ৷ সে তখন নিজেকে আর আল্লাহর বান্দা ও প্রতিনিধি মনে করে না। সে কারো অধীনে আছে এবং কারো কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে এ কথাও সে ভুলে যায় । এমনি করেই তো ফেরাউন দাবী করে বসেছিলো. ‘আমি তোমাদের সর্বোচ্চ মনিব, প্রতিপালক, শাসনকর্তা ।’ এভাবে যখনই মানুষকে তার বিদ্রোহাত্মক মনোভাব বিপথগামী করে, তখন সে নিজেকে আর কারো অসহায় গোলাম বলে ভাবে না এবং সে যে একজন সৃষ্টজীব যার ক্ষয় আছে এবং লয় আছে তা আর মনে করতে পারে না। তার এই মনোবৃত্তি এমন এক অশান্তির বীজ বপন করে, যার বিষফল তাকে এবং তার স্বগোত্রীয় সবাইকে ডুবিয়ে মারে । এভাবে সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই অহংকারী দাম্ভিক লোকেরা তার দেশের গোটা জনগোষ্ঠীকে দাস বানিয়ে ফেলে এবং এক অবমাননাকর জীবনযাপন করতে বাধ্য করে। সে জাতি তখন এত নির্জীব হয়ে যায় যে, তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও ক্রোধে উদ্দীপ্ত হওয়ার যে স্বাভাবিক প্রবণতা তা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমনকি প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণাবোধও আর সৃষ্টি হয় না। এর ফলে মানুষের আত্মসম্ভ্রমবোধ পর্যন্ত খতম হয়ে যায়। এহেন পরিবেশে সে যে একজন স্বাধীন মানুষ, এ চেতনা এমনভাবে হারিয়ে যায় যে, পুনরায় এ স্বাধীনতা বিকাশের আর কোনো পথ খুঁজে পায় না। এর ফলে সে আত্মপুজারী বা হীন স্বার্থবাদী এবং রোগগ্রস্ত মানসিকতার শিকার হয়। তখন তার দৃষ্টি ও অনুভুতিশক্তি সঠিক গতিপথ হারিয়ে ফেলে এবং সাহস, হিম্মত ও মাথা উঁচু করে দাড়ানোর কোনো শক্তিই আর তার থাকে না। এই অবলুপ্তিই হচ্ছে চরম অশান্তি যা অন্য সকল অশান্তির ওপরে । তারপর, সে যে কোনো জিনিসের সুষ্ঠ পরিমাপ করা থেকেও জীবনের মুল্যবোধ ও সঠিক চিন্তাশক্তি প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ এই চিত্তাশক্তিই তো বিদ্রোহী ও বিদ্রোহের জন্য বিপজ্জনক । সুতরাং মেকি ও ভুল পথের নিগড়ে আবদ্ধ থেকে সে জাতির পক্ষে জীবনের মূল্যবোধের সঠিক পরিমাপ করার চেতনা এতদূর মুর্দা হয়ে যায় এবং জগদ্দল পাথরের মতো মিথ্যা ও ভ্রান্ত নীতি এমনভাবে সেই জনগণের বুকের ওপর চেপে বসে যে, তখন সেচ্ছাচারী একনায়কতন্ত্রই তাদের কাছে সহজ, স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্যই শুধু নয়, বরং এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি বলে তারা মনে করতে শুরু করে। এটাই হচ্ছে মানবতার চরম গ্লানি এবং চরম অশান্তি। এ অরাজকতা অন্য সকল বিশৃংখলাকে হার মানায় । এমনিভাবে অহংকারী বিদ্রোহী শ্রেণী যখন গোটা পৃথিবীকে অশান্তিতে ভরে দিলো, তখন পৃথিবীকে ফাসাদ মুক্ত করে মানবতার মুক্তি ঘোষণার প্রয়োজন অবধারিত হয়ে গেলো। ওই সমাজব্যধির একমাত্র চিকিৎসাই ছিলো তখন পূর্ণ সমাজ সংস্কার বা চরম খোলাই । আর এই কারণেই  ‘তোমার রব তাদের ওপর বর্ষণ করলেন আযাবের চাবুক, কারণ তোমার রব, তো সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন ।’ অর্থাৎ তোমার রব তাদের সকল অবস্থার পর্যবেক্ষক হিসেবে সদা সচেতন এবং তাদের সকল কাজই তার নথিতে রেকর্ডভুক্ত বা রেজিষ্ট্রি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তা হারিয়ে বা মুছে যাওয়ার মতো নয়, যেমন করে সরকারী রেজিষ্ট্রি অফিসে কিছু রেজিষ্ট্রি হয়ে গেলে তা আর হারিয়ে যায় না। মানব সরকারের কোনো রেকর্ড খোয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার যে সরকারী দফতর, তার থেকে কোনো কিছু খোয়া যাওয়া সম্ভব নয়, তার কর্মচারীরা অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দিনরাত পূর্ণ আনুগত্য সহকারে কাজ করে যাচ্ছেন। তারপর যখন অশান্তি ও বিশৃংখলা চরমভাবে ছড়িয়ে পড়লো, তখন তাদের ওপর আযাবের চাবুক বর্ষণও বেড়ে গেল । চাবুক শব্দটি ব্যবহার করে আযাবের সর্বগ্রাসী চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেহেতু তরল পদার্থ কারো ওপর দিয়ে ঢেলে দিলে যেমন তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সবকিছুতে সে পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ছিলো ওই চরম অহংকারী জাতির ওপর আসা আযাব । যেহেতু তারা সারাদেশে চরম অশান্তি সৃষ্টি করে রেখে ছিলো । একারণে ওই দুর্নীতিবাজ শাসক ও তাদের তল্লীবাহকদের ওপর ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক আযাব নেমে এলো । এই ধ্বংসস্তূপের পাশাপাশি আর এক দল লোক মানসিক শান্তি লাভ করে, তারা হচ্ছে মোমেন শ্রেণী । এরা সর্বকালে, সবদেশে বিদ্রোহীদের হাতে নিপীড়িত হয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চয়ই তোমার রব ওঁৎ পেতে প্রত্যক্ষ করছেন সবাইকে ।’ মোমেন ব্যক্তি বিশেষভাবে শান্তি লাভ করে। যেহেতু তোমার রব সেখানে এমনভাবে তার দেখাশুনা করছেন যে, তার নযর থেকে কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না, কোনো কিছু হারিয়েও যাচ্ছে না বা কোনো কিছু গোপনও থাকছে না। এর ফলে মোমেন ব্যক্তি শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে, কেননা সে সদা সর্বদা আল্লাহর রহমতের দৃষ্টিতে আছে। অন্যদিকে বিদ্রোহী, অন্যায়কারী ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের জন্য তিনি গোপন স্থানে থেকে তাদের পাকড়াও করার জন্য ওঁৎ পেতে আছেন। এইভাবে আমরা দেখতে পাই দ্বীনের দাওয়াতের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত এক ব্যবস্থা আছে, যার এক ভিন্নধর্মী উদাহরণ এখানে পেশ করা হয়েছে এবং যা সূরা ‘বুরূজে’ উল্লেখিত আসহাবুল উখদূদ (গর্তবাসীর) থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের ৷ কোরআন এসব বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ পেশ করে সকল অবস্থা ও পরিবেশে আল্লাহর পথে দৃঢ়ভাবে টিকে থাকার জন্যে মোমেনদেরকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদেরকে এমনভাবে প্রস্তুত করে যেন তারা অনুকূল বা প্রতিকূল যে কোনো অবস্থায় মনের ভারসাম্য না হারায় এবং প্রশান্ত মনে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে নিজ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে যায়। সর্বোপরি কোরআন মোমেনদেরকে এ প্রেরণা যোগায় যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ভাগ্য লিখন যা রেখেছেন তার বাইরে কোনো কিছু করার মতো কোনো ক্ষমতা বিরোধী কোনো ব্যক্তিরই নেই। অবশ্যই তোমার রব দৃষ্টির অন্তরালে থেকে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছেন, দেখছেন। সময়মতো তিনি সবার হিসাব এমন এক পাল্লায় মেপে নিয়ে সবাইকে পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন যে পাল্লায় কখনও ভুল হয় না।

ফী জিলালিল কুরআন: আল্লাহর পরীক্ষা : কারো ওপর কোনো যুলুম তিনি করবে না। বাহ্যিক রূপ চেহারা দেখে কারো বা কোনো কিছুর বিচার তিনি করবেন না এবং প্রতিটি জিনিসের আসল অবস্থা জেনে সেই অনুযায়ী সবার বিচার করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও পরিমাপ শক্তি তার কাছে না পৌছায়, ততক্ষণ মানুষের অবস্থা তো এই থাকে যে, অনেক সময় সে তার ওযনের পাল্লায় ভুল করে এবং প্রায় সময়েই সে বাইরে প্রকাশিত তথ্য ও যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করে। অভ্যন্তরীণ সব কিছুর রহস্য উদঘাটন করে আসল সত্যকে জানা অনেক সময় তার পক্ষে সম্ভব হয় না। মানুষের অবস্থা সামনে রাখলে দেখা যায়, যখন তার রব তাকে পরীক্ষা করেন আর এই পরীক্ষা করতে গিয়ে কখনও তাকে সম্মানিত করেন ও সুখ-সম্পদের প্রাচুর্য দেন, তখন সে খুশীতে বলে ওঠে, আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যাকে তিনি পরীক্ষা করতে গিয়ে তার আয় রোযগার ও স্বাস্থ্য সমৃদ্ধি সব কিছুকে সংকীর্ণ ও সংকট পূর্ণ করে দেন, তখন সে বলে ওঠে, আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন। যখন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা করেন, তখন এটিই হয় মানুষের মানসিক অবস্থা । প্রশস্ততা, সংকীর্ণতা, সচ্ছলতা ও সংকট দ্বারা তিনি পরীক্ষা করেন, আবার কখনও নেয়ামত ও সম্মান দ্বারা, কখনও মাল সম্পদ ও মান মর্যাদা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু সে এগুলো পরীক্ষা বলে মনে করে না বরং সে এগুলোকে পুরস্কারের সূচনা ভেবে মনে করে দুনিয়াতে ভোগ-বিলাসের জন্যেই তাকে এগুলো দেয়া হয়েছে। আর তাকে দেয়া এই মর্যাদা সম্পর্কে সে ভাবতে শুরু করে যে, আখেরাতেও তাকে যে বিশেষ সুখ-সম্পদ ও মানসম্মান দেয়া হবে এগুলো তারই প্রমাণ । সে আরো ভাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে যে পছন্দ করেন এবং অন্যদের মধ্য থেকে তাকেই যে নেয়ামতের অধিকারী বলে বাছাই করেছেন, তা এটাই প্রমাণ করে যে, সে আল্লাহর নিকট অতি প্রিয়জন হিসাবে বিবেচিত ৷ এর ফলে বিপদ-আপদ যা আসে সেগুলোকে সে শাস্তি মনে করে এবং ওই পরীক্ষার বিষয়টিকেই পরীক্ষার আসল বলে মনে করে। কোনো ব্যক্তিকে প্রদত্ত পার্থিব সুখ-সম্পদকে আল্লাহর নযরে তার সম্মানিত হওয়ার প্রতীক বলে তারা ধরে নেয়। আর যখন আল্লাহ তায়ালা তার জীবনধারণ সামগ্রীকে সংকীর্ণ করে দেন, তখন সে মনে করে এটা তার কৃতকর্মেরই শাস্তি । সে প্রত্যেকটি পরীক্ষাকে মনে করে তার শাস্তি এবং যেকোনো জীবন সামগ্রীর কমতিকে, অভাবকে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া অপমান মনে করে। কারণ, তার বিবেচনায় আল্লাহ তায়ালা তাকে অপমান বা অবজ্ঞা করতে না চাইলে তার জীবনসামগ্রী সরবরাহের পথকে এমনভাবে সংকুচিত করে দিতেন না। আসলে এই উভয় ক্ষেত্রেই তার চিন্তা ভ্রান্তিপ্রসূত এবং এভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে তার একটি ভুল ধারণা মাত্র। আসলে রিযিকের দরজা প্রশস্ত করা অথবা সংকুচিত করা, উভয়টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া এক পরীক্ষা । এই পরীক্ষা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা পরখ করতে চান, কে তার নেয়ামতের শোকর করে আর কে না-শোকরি করে এবং এই পরীক্ষাকালীন সময় ধৈর্য ও অবিচলতার পরিচয় দেয়, আর কে একটু কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হলেই অস্থির হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিদান তো তার যে ব্যবহার পরবর্তীতে প্রকাশ পাবে তার ভিত্তিতেই দেয়া হবে। তার সম্পদ সম্পত্তি কি আছে না আছে তার ভিত্তিতে তাকে কোনো প্রতিদান দেয়া হবে না। আল্লাহর কাছে সম্মান পাওয়ার সাথে কারো ধন সম্পদের মালিক হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আর দুনিয়াতে কাউকে ধন-দৌলত দেয়া হয়েছে বা দেয়া হয়নি এর সাথে আল্লাহর সন্তুষ্ট হওয়া বা অসন্তুষ্ট হওয়ারও কোনো সম্পর্ক নেই। দুনিয়ায় ভালো-মন্দ বিচার না করে সবাইকেই তিনি জীবনধারণ সামগ্রী সম্পদ সরবরাহ করে থাকেন৷ কাউকে কম দিয়েছেন বা কাউকে একেবারেই দেননি- শুধু এই কারণেই আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া বা না হওয়া নির্ভর করে না। এমনও দেখা যায় যে, কোনো সময় ভাল মন্দ বিচার না করে তিনি কাউকে জীবন সামগ্রী দেন এবং কোনো সময় সৎ অসৎ বিচার না করেই দেখা যায় কাউকে খুব কম দেন বা বঞ্চিত করেন। আসলে, যে জিনিসের কারণে তিনি মানুষের বিচার করবেন তা হচ্ছে তাদের কৃতকর্ম । পরীক্ষার খাতিরেই কখনো কাউকে প্রাচুর্য দেন, আবার কাউকে সে ধন-সম্পদ থেকে বঞ্চিতও করেন। আর যে হিসাব গ্রহণ বা ধরপাকড় তাকে করা হবে তা হবে তার পরীক্ষার ফলস্বরূপ ৷ অপরদিকে মানুষের অন্তর যখন ঈমান থেকে খালি হয়ে যায়, তখন সুখ-সম্পদ দেয়া বা না দেয়ার আসল রহস্য সে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না সে আল্লাহর পাল্লায় ওযনের রহস্য । তারপর যখন তার দিল ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে যায়, তখন সে বুঝে আল্লাহর পাল্লা কি এবং কিভাবেই তা পরিমাপ করে মানুষের কর্মকান্ডকে ৷ তখন পার্থিব সুখ সম্পদ ও ভোগ বিলাসের দ্রব্যগুলো তার কাছে অত্যন্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়, আর তখনই সে দুনিয়ার এই পরীক্ষা নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আখেরাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ পুরস্কার লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে । সে সময় রুযি-রোযাগর কম হোক বা বেশী হোক এতে তার কোনো পরোয়া থাকে না। সংকট ও সচ্ছলতা উভয় অবস্থাই তার কাছে সমান মনে হয় । উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ্‌ তায়ালার মূল্যায়নকে সে প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করে। যখন আল্লাহর পাল্লায় তার কিছু ওযন আছে বলে সে বুঝতে পারে, তখন পার্থিব জীবনের আপাতমধুর মূল্য কম হলেও সে উদ্বিগ্ন হয় না। দেখুন, প্রথমেই মক্কাবাসীদেরকে কোরআনে পাক সম্বোধন করছে! এরা ছিলো এমন এক জনপদ যাদের মতো জনগোষ্ঠী প্রত্যেক যামানাতেই কিছু না কিছু বর্তমান ছিলো । যারা পৃথিবীর প্রশস্ততার ক্ষেত্রে এবং সময়ের ব্যবধানে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই সব জাহেল নাদান মুর্খরা সুখ-সম্পদের বস্তু প্রদানের যে তারতম্য সৃষ্টি জগতে রয়েছে তার তৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ হয়। যেহেতু তাদের নিকট এই নশ্বর জীবনে মাল সম্পদ এবং এর ভোগ-বিলাসের জিনিসগুলোই সবকিছু। এ দুটির উর্ধের কোনো জিনিস তাদের বুঝে আসে না। এই নশ্বর পৃথিবীর অতি ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য তারা পাগলপ্রায় হয়ে ছুটোছুটি করে। এই জীবনের আরাম-আয়েশকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সে সর্বপ্রকার ধন-দৌলত পুঞ্জীভূত করতে চায় এবং এই ধন সম্পদের মোহব্বতে যে কোনো সীমালংঘনে তারা কুষ্ঠাবোধ করে না।

সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-20

وَّ تُحِبُّوْنَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّاؕ

এবং এই ধন-সম্পদের প্রেমে তোমরা মারাত্মকভাবে বাঁধা পড়েছ।

ফী জিলালিল কুরআন:

সমাজ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় : আল্লাহর দৃষ্টিতে কোনো আমলের মুল্য কতোটুকু তা ভুলে যাওয়ার কারণেই মানুষের লোভ-লালসার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না এবং এই একই কারণে তাদের অস্তরের ঔদার্য বিনষ্ট হয়ে যায় ও তারা চরম সংকীর্ণমনা হয়ে উঠে। কোরআন এসব লোভাতুর জাতির স্বরূপ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে এবং পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাসের প্রতি অন্ধ মোহই যে ধন সম্পদ কম-বেশী দেয়ার তাৎপর্য বুঝতে না পারার আসল কারণ তা ঘোষণা করছে। (তোমরা যা চিন্তা করছো তা) কিছুতেই নয় বরং তোমাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমরা এতিম বাচ্চাদেরকে কোনো মর্যাদা দাওনা এবং বাস্তুহারা নিশ্ব যারা তাদেরকে খাবার দেয়ার ব্যাপারে কোনো উৎসাহও দাওনা, বরং তোমরা মীরাসী সূত্রে প্রাপ্ত (ওই এতীম বাচ্চাদের) মাল-সম্পদ খেয়ে ফেলো এবং ওই সম্পদকে তোমরা অত্যন্ত গভীরভাবে ভালোবাসো। কিছুতেই ব্যাপার সেটা নয়, যা একজন ঈমানহারা ব্যক্তি বলে। জীবন সামগ্রী বেশী পাওয়াটাই আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত হওয়ার জন্য কোনো দলীল নয়। আর সংকট-সমস্যার মধ্যে থাকার অর্থ এই নয় যে, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে ছোট বা অবহেলার পাত্র। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহ্‌র নেয়ামত লাভ করার পর তোমরা শোকর করো না এবং তোমাদেরকে প্রদত্ত মালের হকও আদায় করো না (অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের প্রতি কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে)। ওই ছোট্ট এতীম বাচ্চাদের-যাদের বাপ মারা যাওয়ার পর তাদের অভিভাবক হওয়ার দায়িত্ব তোমরা পেয়েছো, তাদেরকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দাওনা এবং নিজেদের মধ্যে তোমরা পরম্পর মিসকীনদেরকে খাওয়ানোর ব্যাপারে উৎসাহও দাওনা । মিসকীন বলতে ওই ব্যক্তিকে বুঝায় যে, অভাবগ্রস্ত কিন্তু নিজের অভাব জানিয়ে কিছু চায় না। এ জন্যই মিসকীনকে খাওয়ানোর ব্যাপারে একে অপরকে উৎসাহিত না করা এবং পরস্পরকে উপদেশ না দেয়াকে রীতিমতো অন্যায় ও অপ্রীতিকর বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেহেতু সামাজিক জীবনে অনেক সময়ে অভিভাবক হওয়া এবং সামাজিক শান্তিবিধানের জন্য যথাযথভাবে সে দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন হয় এবং এর ওপরই নির্ভর করে একটি সুষ্ঠ সমাজের শান্তি-এটাই ইসলামের বাস্তব দৃষ্টিভংগি, যা জীবনকে সুশৃংখলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আল্লাহ তায়ালা এখানে মূল যে কথাটি বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, পরীক্ষায় ফেলার তাৎপর্য তোমরা বুঝো না, আর এই কারণেই তোমরা পরস্পরকে এতীমদের মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে এবং মিসকীনদেরকে খাওয়ানো সম্পর্কে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টাটুকু পর্যন্ত করো না, বরং এর বিপরীত ওরা মীরাসি সূত্রে যে ধন সম্পদ পায় তা নিকৃষ্ট লোভী ব্যক্তির ন্যায় মেরে খাও। মাল সম্পদকে তোমরা মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসো ৷ এ সময়ে কারো উপকার করা বা অভাবগ্রস্তদেরকে মানসম্মান ও খাদ্য খাবার দিয়ে মর্যাদা দেয়ার কথা তোমাদের অন্তরের মধ্যে কিছুতেই ঠাই পায়নি। ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, মক্কাতে ইসলাম এসব কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করেছে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। বৈধ অবৈধ তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিলোনা যেকোনো ভাবেই হোক তারা ধন-দৌলত ও টাকা পয়সা পুঞ্জীভূত করে রাখার জন্য পাগল ছিলো। এ সম্পদের মোহে তাদের অন্তর কৃপণতা ও সংকীর্ণতায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো । এতীমদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব তাদের মাল সম্পদ দখল করার পথকে খুবই সহজ করে দিয়েছিলো ৷ বিশেষ করে তারা মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করতো বেশী ৷ তারা অসহায় সেসব এতীম মেয়েদের ধন সম্পদ তো লুটপাট করে খেতোই, তাছাড়াও তাদেরকে আরো বিভিন্নভাবে তারা নির্যাতন করতো । ‘ফী যিলালিল কোরআন’-এর বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মেয়েরা এতীম হয়ে যাওয়ার পর যেসব ব্যক্তির অভিভাবকত্বে তারা আশ্রয় পেতো সেই সব অভিভাবকরা যথেচ্ছভাবে তাদের মাল-সম্পদ ব্যবহার করতো। এভাবে আজও ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগের মতো আল্লাহ বিমুখ লোকদের মধ্যে ধন-সম্পদের মোহব্বত বিরাজ করছে। তারা সুদী ব্যবস্থা এবং অন্যান্য আরো বহু কায়দায় সম্পদ জমা করে রাখে ৷ এটাই সকল যামানায় ও সকল দেশে জাহেলিয়াতের লক্ষণ হিসাবে পরিচিত ছিলো-আজও আছে। এ আয়াত কয়টির মাধ্যমে ওই নিষ্ঠুর ব্যক্তিদের আসল অবস্থাটা শুধু তুলে ধরাই হয়নি বরং তাদের ওই নির্দয় ব্যবহারের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সে অবস্থা নিরসনের জন্য অত্যন্ত জোর দাবী জানানো হয়েছে। ‘কাল্লা’ শব্দটির বারংবার প্রয়োগ দ্বারা তাদের প্রতি ঘৃণার বহিপ্রকাশ ঘটেছে যথেষ্টভাবে। বিভিন্ন ছন্দপূর্ণ শব্দ, ব্যাখ্যা ও তুলনা দ্বারা ওই ঘৃণ্য অবস্থার স্বরূপ তুলে ধরে তার অবসান কামনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা চরম লোভের বশবর্তী হয়ে মীরাসের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মাল খেয়ে ফেলো, আর অত্যন্ত গভীরভাবে সম্পদকে ভালবাসো ।’

সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-26

وَّ لَا یُوْثِقُ وَ ثَاقَهٗۤ اَحَدٌؕ

এবং আল্লাহ‌ যেমন বাঁধবেন আর কেউ তেমন বাঁধতে পারবে না।

ফী জিলালিল কুরআন:

কিয়ামতের কিছু খন্ড চিত্র : তাদের এই জঘন্য প্রকৃতির স্বরূপ উদঘাটন করার পাশাপাশি পার্থিব ভোগ সামগ্রীর মঞ্জুরীর মূল রহস্য সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণার আলোচনা শেষ করা হয়েছে, এরপর মহা ভয়ংকর বিচার দিনের অবস্থা তুলে ধরে তাদেরকে চূড়ান্তভাবে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘কিছুতেই নয়, (সে দিনের কথা স্মরণ করো) যে দিন ধ্বংস করে দেয়া হবে পৃথিবীকে প্রচন্ড কম্পনের ওপর কম্পন দ্বারা এবং তোমার রব আসবেন, ফেরেশতারাও আসবেন সারিবদ্ধভাবে। আর যেদিন জাহান্নামকে এগিয়ে এনে সবার সামনে হাযির করা হবে, সেই দিন মানুষ অবশ্যই উপদেশ কবুল করবে (করতে চাইবে), কিন্তু কীইবা কাজে লাগবে তার এই উপদেশ গ্রহণ! সেদিন বলবে, হায় আফসোস! জীবদ্দশাতে আমি যদি (আজকের জন্য) কিছু প্রস্তুতি নিতাম! (কিন্তু সেদিন তার এই আক্ষেপ কোনো কাজেই আসবে না) । সেদিন তার মতো কঠিন আযাব আর কেউ দেবে না, আর তাঁর মতো আর কেউই কাউকে বাধবে না।’ পৃথিবীর ধ্বংস বলতে বুঝায়, এর মধ্যে ঘরবাড়ী ও বিভিন্ন এলাকাকে চেনার জন্য যে সকল জিনিস রয়েছে তা জানার ও চেনার জন্য যতো প্রকার চিহ্ন আছে তা সব ধ্বংস হয়ে একাকার হয়ে যাবে। এটাই হবে প্রথম কেয়ামত, যার আগমনে সৃষ্টির সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। কিন্তু ‘তোমার রব আসবেন, আরো আসবে ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে’, এ এমন ব্যাপার যা মোটেই আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এগুলো সম্পর্কে জানা তো দূরের কথা সম্যক উপলব্ধি করার মতো কোনো চেতনাশক্তিও আমাদের নেই। কোনো ব্যাখ্যার প্রয়াস না পেয়ে শুধু এতোটুকু আমরা অনুভব করি যে, এ হবে এক গুরুগম্ভীর এবং চরম ভয়াবহ অবস্থা । এ ধরনের অপর জিনিস হচ্ছে জাহান্নাম । এ সম্পর্কে এতোটুকু বুঝা যায় যে, এটা নিকটে এসে যাবে এবং যাদেরকে জাহান্নামে ফেলা হবে তাদেরই কাছে এসে যাবে জাহান্নাম । বাস্তবে কি অবস্থা সংঘটিত হবে এবং কেমনভাবে তা সংঘটিত হবে তা একমাত্র আল্লাহ্‌ আলেমুল গায়বের জ্ঞানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। অন্য কারো পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। সে জ্ঞান ও রহস্য অনাগত সেই ভয়ংকর দিনেই প্রকাশিত হবে । এই আয়াতগুলোতে যে জাদুকরী বর্ণনা পেশ করা হয়েছে তাতে যে কোনো পাঠকের হৃদয়ে ওই কঠিন দিনের এক ভয়াল চিত্র ফুটে ওঠে ৷ তার হৃদয় মন ভয়ে কাপতে থাকে। চোখগুলো আতংকে আড়ষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবী সেই মহাপ্রলয়ের দিনে-যেদিন সবকিছু চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে এবং সকল শক্তির মালিক যিনি বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম, তিনি সরাসরি সেদিন সকল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং সব কিছুর চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেবেন । ফেরেশতারা মূক ও বধিরের মতো নির্ভিকভাবে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে থেকে সবকিছু অবলোকন করবে। তারপর এগিয়ে আনা হবে জাহান্নামকে, যা আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় স্থিরভাবে দাড়িয়ে থাকবে । সেদিন মানুষ পেছনের অবস্থাকে স্মরণ করবে, মানুষ স্মরণ করবে, যে ধন সম্পদ দেয়া ও না দেয়ার মধ্যে যে কি নিগূঢ় রহস্য রয়েছে তা সেদিন সে বুঝতে পারেনি। এতীম বালক বালিকাদের মীরাসী সূত্রে প্রাপ্ত ধন সম্পদ পৈশাচিক লোভের বশবর্তী হয়ে এবং অদম্য চাহিদা সামলাতে না পেরে সে খেয়ে ফেলেছে। যে ব্যক্তি ধন সম্পদকে গভীরভাবে ভালবেসেছে, আর যে ব্যক্তি এতীমকে কোনো মর্যাদা দেয়নি এবং ফকীর মিসকীনকে খানা খাওয়ানোর ব্যাপারে কাউকে উৎসাহিত করেনি। যে ব্যক্তি অহংকারপূর্ণ হৃদয় নিয়ে নীতি নৈতিকতার সকল সীমা লংঘন করেছে । যে সমাজের বুকে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে এবং সঠিক কথা থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। সে সেদিন পেছনের সকল অপকর্মকে স্মরণ করে উপদেশ গ্রহণ করতে চাইবে এবং সঠিক জিনিসকে মানতে চাইবে । কিন্তু সেদিন এই স্মরণ তার কোনো কাজেই লাগবে না। সে দেখবে উপদেশ গ্রহণ করে সংশোধন হওয়ার সকল সুযোগ ও সময় তখন পার হয়ে গেছে। কাজেই, কী ফায়দা হবে তার স্মরণ করে ও উপদেশ গ্রহণ করে। তখন উপদেশ গ্রহণের সময় তো একেবারেই শেষ । সেই শেষ বিচার দিনে, কাউকেই কোনো কথা পেশ করার বা কোনো ব্যাপারে কোনো আপত্তি জানানোর কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। দুনিয়ার জীবনে ভালো কাজ করার তার যে সুযোগ ছিলো সে কথা স্মরণ করে সেদিন সে শুধু আক্ষেপই করতে থাকবে । আর সে সময় তার সামনে সকল সত্য উদঘাটিত হয়ে যাবে। তখন সে বলে উঠবে, হায় আফসোস। আমার জীবদ্দশাতে আমি আজকের জন্য যদি কোনো প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম! অর্থাৎ বেঁচে থাকাকালীন সময়ে যদি আজকের জন্য কিছু পাথেয় যোগাড় করে রাখতাম! কারণ আজকের শুরু হওয়া এই জীবনই তো প্রকৃত জীবন- যাকে সঠিক অর্থে জীবন বলা যেতে পারে। এই জীবনের জন্যেই তো প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন ছিলো । এর জন্যেই তো সঞ্চয় করা দরকার এবং এই জীবনের জন্যই তো পুঁজি যোগাড় করা জরুরী ছিলো। ‘ইয়া লাইতানী’ শব্দটি দ্বারা দুঃখের সাথে এমন একটি জিনিসের জন্য আফসোস প্রকাশ করা হয়, যা মানুষের নাগালের অনেক অনেক দূরে । এ কথাটি সে সেদিন এ জন্য বলবে যে, আখেরাতের সেই দিনে তার হারানো বস্তু থাকবে তার থেকে অনেক অনেক দূরে । এই দুঃখজনক আক্ষেপ ও ব্যর্থ আকাংখার পর সে তার পরবর্তী বাসস্থানের কথা চিন্তা করতে থাকবে কিন্তু সেদিন আল্লাহ তায়ালা বাধবেন তাকে এমন কঠিনভাবে যে, অন্য কেউ এমনভাবে বাধে না বা বাধতে পারে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অপরিমেয় শক্তিশালী । তিনি যেকোনো কাজ করাতে মানুষকে বাধ্য করতে পারেন। একমাত্র তিনিই সেদিন সেই আযাব দিতে পারবেন, যে আযাব অন্য কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। তিনিই সেদিন তাকে সেই ভীষণভাবে বাধবেন, যেভাবে বাধা আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেয়ামতের দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে এই আযাব দেয়া ও বাধা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আরও অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। এখানে সংক্ষেপে শুধু এতোটুকু বলেই তিনি শেষ করেছেন যে, ওইভাবে আযাব দেয়া ও বেঁধে রাখা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। অথবা এটা বলা যায়, কোনো সৃষ্টির পক্ষেই সেভাবে কষ্ট দেয়া বা বাধা সম্ভব নয়। আর এসব কথা আ’দ, সামুদ ও ফেরাউনের জাতিকে পৃথিবীতে তাদের বাড়াবাড়ি, বিশংখলা সৃষ্টি ও চরম সীমালংঘনের কারণে যে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়েছিলো তা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, সে আযাবের মধ্যে তৎকালীন মানুষকে প্রদত্ত নানা প্রকার শাস্তি শেকল দিয়ে বাধা এবং দন্ডবেড়ী পরানোর শাস্তিও ছিলো। আজকেও তো তোমার সেই রব বর্তমান রয়েছেন এবং তিনিই ভবিষ্যতে একই শাস্তি দেবেন । অতএব হে নবী, হে বিশ্বাসী, তিনি আজ এই ভয়ংকর দিনে সেই ব্যক্তিকে শাস্তি দেবেন এবং বাধবেন যে মানুষকে নানা প্রকার শাস্তি দিয়েছিলো ও হাত-পা বেঁধে কষ্ট দিয়েছিলো । কিন্তু জেনে রাখা দরকার, মানুষ যে কষ্ট দিয়েছিলো তার মধ্যে এবং আল্লাহ তায়ালা যে কষ্ট দেবেন তার মধ্যে বহু পার্থক্য রয়েছে। তাদের বাধা এবং আল্লাহ তায়ালার বাধার মধ্যেও রয়েছে বিরাট পার্থক্য এই আখেরাতের যিন্দেগীতে তার জন্য এমন অপমান অপেক্ষা করছে যা কোনো সৃষ্টির পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। একমাত্র যিনি সৃষ্টিকর্তা ও সকল কাজের পরিচালনা যিনি করেন তার পক্ষেই ওই ভীষণ পরিণতি দান সম্ভব । অতএব অহংকারী ও সীমালংঘনকারীরা যাকে যেভাবে কষ্ট দিতে চায় দিক, শীঘ্রই তাদেরকে তিনি এমনভাবে শাস্তি দেবেন এবং এমনভাবে বাধবেন যে, তা কারো ধ্যান-ধারণার মধ্যে আসতে পারে না।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-30

وَ ادْخُلِیْ جَنَّتِیْ۠

এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।

ফী জিলালিল কুরআন:

এই ভয়ভীতি ও ভয়ংকর অবস্থা এবং এই ভীষণ শাস্তি ও কঠিন বাধন- যার কল্পনা কেউ করতে পারে না, এর মধ্যেই উর্ধাকাশ থেকে আসবে মোমেনদের জন্য এক ঘোষণা- ‘হে প্রশান্ত আত্মা, ফিরে যাও তোমার রবের দিকে প্রশান্ত মনে ও সন্তুষ্ট চিত্তে, তারপর দাখিল হয়ে যাও আমার বান্দাদের মধ্য, আর দাখিল হয়ে যাও আমার জান্নাতে ।’ এভাবে আদর মহব্বতের সাথে যেন খুব কাছ থেকে আল্লাহ তায়ালা ডাক দিয়ে বলছেন, ‘হে, ওই’, আরো আন্তরিকতা ও সম্ভ্রমের শব্দ প্রয়োগ করে বলা হয়েছে, ‘হে আত্মা’ আরো প্রশংসাসূচক শব্দ ও শান্ত স্বরে বলা হয়েছে, ‘হে প্রশান্ত নিশ্চিন্ত আত্মা ‘ আর এইভাবে ডাক দেয়া হয়েছে সেই কঠিন দুঃসময়ে যখন বাঁধা চলছে অপরাধীদেরকে । দেখুন কতো সাবলীল গতিতে এবং কতো নরম সূরের এই ডাক- ‘ফিরে যা তোর রবের কাছে’, অর্থাৎ ফিরে যাও তোমার মূল জায়গায় যেখান থেকে তুমি বিচ্যুত হয়ে এসেছিলে আর দীর্ঘ দিন ধরে অজানা অচেনা পৃথিবীতে বাস করেছিলে । তারপর আপনজনদের থেকে বিচ্যুত হয়ে কবরে শায়িত ছিলে কতোকাল। সেখান থেকেই তুমি তোমার আসল জায়গায় ফিরে যাও ৷ ফিরে যাও তোমার রবের কাছে যার সাথে রয়েছে তোমার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, পরিচয় ও গভীর সম্পর্ক ৷ সন্তুষ্ট চিত্ত ও নিশ্চিম্ততার এ ডাক সঞ্চারিত হয় মহাশূন্যলোকে ৷ বান্দার প্রতি আকর্ষণ ও সন্তোষ মাখা এ ডাক গুঞ্জরিত হয়ে দিকে দিকে প্রতিধ্বনিত হয়। সে গুঞ্জরণে ধ্বনিত হয়, এসো, প্রবেশ করো আমার (প্রিয়) বান্দাদের দলে (যারা আনুগত্যের মাধ্যমে আমার প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছে) ৷ এরা আমার অতি আপনজন, আমার অতি কাছাকাছি এদের স্থান । কাছে রাখার জন্য আমি নিজেই ওদেরকে বাছাই করে নিয়েছি। দাখিল হয়ে যাও, আমার বাগ-বাগিচায়, আরামে বসবাস করো যা চিরদিন সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা, নির্ঝরিণী ও ফুলফল শোভিত থাকবে । যেথায় আছে মায়াভরা সংগিনীদের মধুমাথা কণ্ঠের গান ও পাখিদের প্রাণ মাতানো তান। সেই চিরস্থায়ী জান্নাতে তোমাদেরকে আমার সাদর সম্ভাষণ জানাই ৷ এসো আমার আলিঙ্গনে, এসো আমার রহমতের বাহুবন্ধনে। এ হচ্ছে এমন এক মহব্বত, যার সুবাস ছড়িয়ে রয়েছে জান্নাতের পাতায় পাতায় । যার সৌরভে সুরভিত এই ফুলবাগিচার প্রতিটি কলি । চিরস্থায়ী এ আনন্দমেলা হাসিখুশী ভরা প্রাণ মাতানো । এ মেলা প্রথম স্বাগত জানানোর দিন থেকে শুরু হওয়ার পর আর শেষ হবে না কোনো দিন৷ বলা হবে, সেই জান্নাতেই এসো তোমরা, হে আমার পরম আদরের বান্দারা, এসো প্রশান্ত মনে। এভাবে যাদেরকে ডাকা হবে তারা নিশ্চিন্ত থাকবে । পাক পরোয়ারদেগারের কাছে আসতে পেরে তারা তাদের পথের মাধুরীতে নিশ্চিন্ত থাকবে নিশ্চিন্ত থাকবে তারা আল্লাহ তায়ালার আদরে, বেহেশতী বান্দারা আজ নিশ্চিন্ত, এদের মন সন্দিগ্ধ নয় । এই নিশ্চিন্ততায় মোমেন বান্দার মন এমনভাবে ছেয়ে রয়েছে যে, তার মনে কখনও দোদুল্যমান ভাব আসে না। এতো নিশ্চিন্ত সে তার কোনো ভীতিকর দিনের ভয় থাকে না। তারপর গোটা প্রকৃতির মধ্যে দেখা যায় সবকিছু নিরাপদে, শান্তিতে ও পরিতৃপ্তির সাথে আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থায় কাজ করে যাচ্ছে। এটা আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার বাস্তব নিদর্শন হিসাবে পরিদৃশ্যমান । এগুলোর পরস্পরের মধ্যে যেন রয়েছে পারস্পরিক সহযোগিতা, একতা, মিল ও মহব্বত এবং এক অত্যন্ত নিকটতম একটা সম্পর্ক, যার ফলে সর্বত্র অবিচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজমান থাকে । যে জান্নাতের সুসংবাদ এ আয়াতগুলোতে দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এক সুবাসিত মনোরম বাগিচা, তার মধ্যেই বিরাজমান রয়েছে মহাসম্মানিত ও পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত ।

Leave a Reply