Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০২/হে মানুষ:-১২)
[#
# النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُۗۖ
#رَاضِیَةً مَّرْضِیَّةًۚ
# ইতিহাসের অহংকারী জাতি : –
# পরীক্ষা :-
# উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সঠিক বন্টন:-
#.তোমরা ধন-সমপ্পদের প্রেমে মগ্ন:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর
পারা:৩০
১-৩০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৮৯-ফজর) : নামকরণ: \n প্রথম শব্দ ( وَالْفَجْرِ ) কে এই সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(৮৯-ফজর) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল : \n এই সূরার বিষয়বস্তু থেকে জানা যায়, এটি এমন এক যুগে নাযিল হয় যখন মক্কা মুয়ায্যমায় ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর ব্যাপকভাবে নিপীড়ন নির্যাতন চলছিল। তাই মক্কাবাসীদেরকে আদ, সামূদ ও ফেরাউনের পরিণাম দেখিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
(৮৯-ফজর) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য: \n এর বিষয়বস্তু হচ্ছে আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের সত্যতা প্রমাণ করা। কারণ মক্কাবাসীরা একথা অস্বীকার করে আসছিল। এ উদ্দেশ্যে ধারাবাহিক পর্যায়ে যে যুক্তি পেশ করা হয়েছে সে ধারাবাহিকতা সহকারে এ বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। \nপ্রথম ফজর, দশটি রাত, জোড় ও বেজোড় এবং বিদায়ী রাতের কসম খেয়ে শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যে বিষয়টি তোমরা অস্বীকার করছো তার সত্যতার সাক্ষ্য দেবার জন্য কি এই জিনিসগুলো যথেষ্ট নয়? সামনের দিকে টীকায় আমি এ চারটি জিনিসের ব্যাখ্যা দিয়েছি তা থেকে জানা যাবে যে, দিন-রাত্রির ব্যবস্থায় যে নিয়মানুবর্তিতা দেখা যায় এগুলো তারই নির্দশন। এগুলোর কসম খেয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত এই বিজ্ঞান সম্মত ব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করার পরও যে আল্লাহ এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি আখেরাত কায়েম করার ক্ষমতা রাখেন এবং মানুষের কাছ থেকে তার কার্যাবলীর হিসেব নেয়া তাঁর এ বিজ্ঞতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য দাবী, একথার সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করার জন্য কি আর কোন জিনিসের প্রয়োজন থাকে? \nএরপর মানবজাতির ইতিহাস থেকে প্রমাণ পেশ করে উদাহরণ স্বরূপ আদ ও সামূদ জাতি এবং ফেরাউনের পরিণাম পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যখন তারা সীমা পেরিয়ে গেছে এবং পৃথিবীতে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তখন আল্লাহর আযাব তাদেরকে গ্রাস করেছে। একথা প্রমাণ করে যে, কোন অন্ধ-বধির শক্তি এই বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করছে না এবং এ দুনিয়াটা কোন অথর্ব রাজার মগের মূল্লুকও নয়। বরং একজন মহাবিজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী শাসক এ বিশ্ব-জাহানের ওপর কর্তৃত্ব করছেন। তিনি বুদ্ধি-জ্ঞান ও নৈতিক অনুভূতি দান করে যেসব সৃষ্টিকে এ দুনিয়ায় স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দিয়েছেন তাদের কাজের হিসেব-নিকেশ করা এবং তাদেরকে শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া তাঁর জ্ঞানবত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার অনিবার্য দাবী। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা এর অবিচ্ছিন্ন প্রকাশ দেখি। \nতারপর মানব সমাজের সাধারণ নৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে আরব জাহেলিয়াতের অবস্থা সে সময় সবার সামনে বাস্তবে সুস্পষ্ট ছিল। বিশেষ করে তার দু’টি দিকের সমালোচনা করা হয়েছে। এক, সাধারণ মানুষের বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগী। যার ফলে তারা নৈতিক ভালো-মন্দের দিকটাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র পার্থিব ধন-দওলাত, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অর্জন বা এর অভাবকে সম্মান লাভ ও সম্মানহানির মানদণ্ড গণ্য করেছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল, সম্পদশালিতা কোন পুরস্কার নয় এবং আর্থিক অভাব অনটন কোন শাস্তি নয় বরং এ দুই অবস্থাতেই মহান আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছেন। সম্পদ লাভ করে মানুষ কি দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করে এবং আর্থিক অনটন ক্লিষ্ট হয়ে সে কোন পথে চলে– এটা দেখাই তাঁর উদ্দেশ্য। দুই, লোকদের সাধারণ কর্মনীতি। পিতার মৃত্যুর সাথে সাথেই তাদের সমাজে এতিম ছেলেমেয়েরা চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হয়। গরীবদের খবর নেবার এবং তাদের পক্ষে কথা বলার একটি লোকও পাওয়া যায় না। যার ক্ষমতা থাকে সে মৃতের সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করে বসে। দুর্বল হকদারদের খেদিয়ে দেয়া হয়। অর্থ ও সম্পদের লোভ একটি দুর্নিবার ক্ষুধার মতো মানুষকে তাড়া করে ফেরে। যত বেশী পায় তবুও তার পেট ভরে না। দুনিয়ার জীবনে যেসব লোক এ ধরনের কর্মনীতি অবলম্বন করে তাদের কাজের হিসেব নেয়া যে ন্যায়সংগত, লোকদের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করাই হচ্ছে এ সমালোচনার উদ্দেশ্য। \nসবশেষে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, সমালোচনা ও হিসেব-নিকেশ অবশ্যি হবে। আর সেদিন এই হিসেব-নিকেশ হবে যেদিন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে। শাস্তি ও পুরস্কার অস্বীকারকারীদের হাজার বুঝালেও আজ তারা যে কথা মেনে নিতে পারছে না। সেদিন তা তাদের বোধগম্য হবে। কিন্তু তখন বুঝতে পারায় কোন লাভ হবে না। অস্বীকারকারী সেদিন আফসোস করে বলবে: হায়, আজকের দিনের জন্য যদি আমি দুনিয়ায় কিছু সরঞ্জাম তৈরি করতাম। কিন্তু এই লজ্জা ও দু:খ তাকে আল্লাহর আযাবের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। তবে যেসব লোক আসামানী কিতাব ও আল্লাহর নবীগণের পেশকৃত সত্য পূর্ণ মানসিক নিশ্চিন্ততা সহকারে মেনে নিয়েছিল আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং তারাও আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিদান পেয়ে সন্তুষ্ট হবে। তাদেরকে আহবান জানানো হবে, তোমরা নিজেদের রবের প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করো।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১
وَ الۡفَجۡرِ ۙ﴿۱﴾
শপথ ফজরের।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২
وَ لَیَالٍ عَشۡرٍ ۙ﴿۲﴾
শপথ দশ রাত্রির।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৩
وَّ الشَّفۡعِ وَ الۡوَتۡرِ ۙ﴿۳﴾
শপথ জোড় ও বেজোড়ের।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৪
وَ الَّیۡلِ اِذَا یَسۡرِ ۚ﴿۴﴾
এবং শপথ রাত্রির, যখন তা গত হতে থাকে।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-5
টিকা নং:1,
هَلْ فِیْ ذٰلِكَ قَسَمٌ لِّذِیْ حِجْرٍؕ
এর মধ্যে কোন বুদ্ধিমানের জন্য কি কোন কসম আছে?১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) এই আয়াগুলোর ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণের মধ্যে ব্যাপক মত বিরোধ দেখা যায়। এমন কি জোড় ও বেজোড় সম্পর্কে ছত্রিশটি বক্তব্য পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় এগুলোর ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেও সম্পর্কিত করা হয়েছে। কিন্তু আসলে রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোন ব্যাখ্যা প্রমাণিত নেই। নয়তো তাঁর ব্যাখ্যার পর সাহাবা, তাবেঈ ও পরবর্তী তাফসীরকারদের মধ্য থেকে কোন একজনও এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা নির্ধারণ করার সাহস করতেন না।
বর্ণনা ভংগি সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায়, প্রথম থেকে কোন আলোচনা চলছিল। সেখানে রসূলুল্লাহ ﷺ একটি কথা পেশ করছিলেন এবং অস্বীকারকারীরা তা অস্বীকার করছিল। এ প্রসঙ্গে রসূলের কথার সত্যতা প্রমাণ করে বলা হয়েছে, ওমুক ওমুক জিনিসের কসম। এর অর্থ ছিল, এই জিনিসগুলোর কসম, যা কিছু মুহাম্মাদ ﷺ বলছেন সব সত্য। তারপর এ প্রশ্নের ভিত্তিতে এ বক্তব্য পেশ করা হয়েছে যে, কোন বুদ্ধিমান লোকের জন্য কি এর মধ্যে কোন কসম আছে? অর্থাৎ এই সত্য কথাটির পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্য এরপর কি আর কোন কসমের প্রয়োজন আছে? মুহাম্মাদ ﷺ যে কথা বলছেন তা জেনে নেবার জন্য কি একজন বুদ্ধি-বিবেকমান ব্যক্তির জন্য এই কসমই যথেষ্ট নয়?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে প্রসঙ্গে এই চারটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা কি ছিল? এজন্য আমাদের পরবর্তী আয়াতগুলোতে “তুমি কি দেখনি তোমার রব তাদের সাথে কি ব্যবহার করেছিলেন” থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত সমগ্র আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এ থেকে জানা যায়, আলোচনা চলছিল শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে। মক্কাবাসীরা একথা অস্বীকার করছিল এবং রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের থেকে এর স্বীকৃতি আদায় করার জন্য অনবরত তাদেরকে দাওয়াত ও উপদেশ দিয়ে চলছিলেন। এজন্য ফজর, দশটি রাত, জোড়-বেজোড় এবং বিদায়ী রাতের কসম খেয়ে বলা হয়েছে, এই বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য এই চারটি জিনিস যথেষ্ট নয় কি? এজন্য কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির সামনে কি আর কোন জিনিস পেশ করার প্রয়োজন আছে?
এই কসমগুলোর এই পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী আলোচনা এগুলোর যে অর্থ নির্দেশ করে আমাদের অপরিহার্যভাবে সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে। প্রথমে বলা হয়েছে “ফজরের কসম”। ফজর বলা হয় প্রভাত হয়ে যাওয়াকে। অর্থাৎ যখন রাতের অন্ধকারা ভেদ করে দিনের প্রথম আলোক রশ্মি পূর্বদিগন্তে একটি সাদা রেখার মতো আত্মপ্রকাশ করে। তারপর বলা হয়েছে “দশটি রাতের কসম”। ধারাবাহিক বর্ণনাগুলো সামনে রাখলে জানা যায়, এর অর্থ হচ্ছে মাসের তিরিশটি রাতের প্রত্যেক দশটি রাত। প্রথম দশটি রাতের চাঁদ সরু কাস্তের আকারে শুরু হয়ে প্রতি রাতে বাড়তে থাকে। এভাবে তার অর্ধেকেরও বেশী এলাকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দশটি রাতে চাঁদের আলোয় রাতের বৃহত্তম অংশ আলোকিত থাকে। শেষ দশটি রাতে চাঁদ আস্তে আস্তে একেবারে ছোট হয়ে যেতে থাকে এবং রাতের বেশীর ভাগ অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। এমনকি মাসের শেষ রাতটি হয় পুরোপুরি অন্ধকার। এরপর বলা হয়েছে, “জোড় ও বেজোড়ের কসম”। জোড় বলা হয় এমন সংখ্যাকে যাকে দু’টি সমান ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন ২, ৪, ৬, ১০। অন্যদিকে বেজোড় বলা হয় এমন স্যংখ্যাকে যাকে সমান দু’ভাগে ভাগ করা যায় না। যেমন ১, ৩, ৫, ৭, ৯। সাধারণভাবে দেখলে এর অর্থ হতে পারে বিশ্ব-জাহানের সমস্ত জিনিস। কারণ প্রতিটি জিনিস হয় জোড়, নয় বেজোড়। কিন্তু যেহেতু এখানে দিন ও রাতের কথা আলোচনা হচ্ছে তাই বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে এখানে জোড় ও বেজোড় মানে হচ্ছে, দিন-রাত্রির পরিবর্তন। অর্থাৎ মাসের তারিখ এক থেকে দুই এবং দুই থেকে তিন হয়ে যায়। আর প্রত্যেকটি পরিবর্তন একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি করে। সবশেষে বলা হয়েছে, “রাতের কসম যখন তা বিদায় নিতে থাকে”। অর্থাৎ সূর্য ডোবার পর থেকে পৃথিবীর বুকে যে অন্ধকার ছেয়ে ছিল তার অবসান ঘটেছে এবং আলোকময় ঊষার উদায় হতে যাচ্ছে।
এখন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাস্তি ও পুরস্কারের যে খবর দিচ্ছিলেন তার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য যে চারটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তাদের ওপর একবার সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করুন। এসব জিনিস এই সত্যটি প্রমাণ করছে যে, একজন মহাশক্তিশালী স্রষ্টা এই বিশ্ব-জাহানের ওপর রাজত্ব করছেন। তিনি যে কাজটিই করছেন, তা উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন, অর্থহীন নয় এবং তার পেছনে কোন বিজ্ঞতাপূর্ণ পরিকল্পনা নেই একথা বলা যাবে না। বরং তাঁর প্রত্যেকটি কাজের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পনা সক্রিয় রয়েছে। তাঁর পৃথিবীতে কখনো এমন দেখা যাবে না যে, এখনই রাত আবার এখনই হঠাৎ সূর্য একেবারে মাথার ওপর উঠেছে। অথবা একদিন চাঁদ উঠলো কাস্তের মতো সরু হয়ে এবং তারপর একে বারে গোল থালার মতো পূর্ণচন্দ্র আকাশে শোভা পেতে লাগলো। অথবারাত এলো কিন্তু তা আর শেষই হচ্ছে না, স্থায়ীভাবে ঠায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। অথবা আদতে দিন-রাত্রির পরিবর্তনের কোন স্থায়ী ব্যবস্থাই নেই। যার ফলে তারিখের হিসাব রাখা যায় না। আজ কোন্ মাসের কয় তারিখ, কোন্ তারিখে কোন্ কাজটি শুরু করা হয়েছিল এবং কবে খতম হবে, গ্রীষ্মকাল কবে থেকে শুরু হচ্ছে এবং বর্ষাকাল ও শীতকাল কবে আসবে—এসব জানা সম্ভব হয় না। বিশ্ব-জাহানের অন্যান্য অসংখ্য জিনিস বাদ দিয়ে মানুষ যদি শুধুমাত্র দিন-রাত্রির এই যথা নিয়মে যাওয়া আসার বিষয়টি মনোযোগ সহকারে দেখে এবং এ ব্যাপারটি নিয়ে একটু মাথা ঘামায়, তাহলে এক সর্বশক্তিমান সত্তা যে এই বিরাট নিয়ম শৃংখলা ও আইনের রাজত্ব কায়েম করেছেন এবং এই নিয়ম-শৃংখলার সাথে এখানে সৃষ্টজীবের অসংখ্য স্বার্থ ও কর্মপ্রবাহ জড়িত তার সাক্ষ্য-প্রমাণ সে এর মধ্যেই পেয়ে যাবে। এখন এই ধরনের জ্ঞানবান ও বিজ্ঞানময় এবং মহাশক্তিধর স্রষ্টার আখেরাতে শাস্তি ও পুরস্কার দেবার বিষয়টি যদি দুনিয়ার কোন মানুষ অস্বীকার করে তাহলে সে দু’টি নির্বুদ্ধিতার মধ্য থেকে কোন একটিতে অবশ্যি লিপ্ত। হয় সে তাঁর ক্ষমতা অস্বীকার করে এবং মনে করে তিনি এই অকল্পনীয় নিয়ম-শৃংখলা সহকারে এই বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন কিন্তু মানুষকে পুনর্বার সৃষ্টি করে তাকে শাস্তি ও পুরস্কার দান করার ক্ষমতা তাঁর নেই অথবা সে তাঁর জ্ঞানবত্তা ও বিজ্ঞানময়তা অস্বীকার করে এবং তাঁর সম্পর্কে একথা মনে করে নিয়েছে যে, তিনি মানুষকে দুনিয়ায় বুদ্ধি-বিবেক ও ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি কখনো তার কাছ থেকে এই বুদ্ধি-বিবেক ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারকে সে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে তার হিসেব নেবেন না। আর তিনি ভালো কাজের পুরস্কার দেবেন না এবং খারাপ কাজের শাস্তিও দেবেন না। এই দু’টি কথার কোন একটিকেও যে ব্যক্তি মেনে নেবে সে একজন প্রথম শ্রেণীর নির্বোধ।
আর কেউ নেই । এ দুটি কথার তাফসীর করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ব-প্রকৃতির মনোরম বস্তুগুলো ফজরের সময় বিশেষ করে সেই দশটি রাতে আনুগত্য প্রকাশ করে ও ভক্তি প্রদর্শনের মানসে ঝুঁকে পড়ে মহান আল্লাহর সামনে ৷ তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসেও এভাবেই বলা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে এ ব্যাখ্যাটিই সবচে বেশী গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এই দিনক্ষণগুলো এমন সুন্দর যখন এর বিনম্র আত্মাগুলো প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায় এবং সে প্রিয় ও পছন্দনীয় রাতগুলো ও শান্ত সমুজ্জ্বল প্রথম প্রভাতের আগমনে নিজেদেরকে করুণাময়ের দরবারে সঁপে দিয়ে কৃতার্থ বোধ করে। ‘আবার কসম সেই বিদায়ী রাতের যা (ধীর গতিতে নিজ পথে শান্ততাবে) চলে যায়। এখানে রাত বলতে বুঝানো হয়েছে এমন এক সৃষ্টজীবকে, যা সজীব অবস্থায় বিরাজ করছে এবং যা সৃষ্টিজগতে গতিশীল অবস্থায় বর্তমান এবং তা যেন অন্ধকারের বুকে সদা পরিভ্রমণরত কোনো জীব, অথবা সে যেন দূর দেশের এমন এক মুসাফির যে, বিরামহীন চলতেই ভালবাসে ৷ আহ্ কী চমৎকার এ ব্যাখ্যা! কি সুন্দর মনোরম এ দৃশ্য । কতো মনোমুগ্ধকর এ নেয়ামতগুলো! আর এই বর্ণনা পরস্পরা একটির পর অপরটি, ফজরের সাথে দশটি রাতের কী সুনিবিড় সম্পর্ক এবং জোড় ও বে-জোড়ের সেসব কিছুর কী মধুর যোগসূত্র! সবকিছু মিলে এ যেন এক আনন্দের মেলা । এগুলো শুধুমাত্র কিছু কথা ও কিছু ব্যাখ্যাই নয়, এগুলো হচ্ছে প্রথম প্রভাতের সুবাসিত নিশ্বাস, যে এমন মধুর সমীরণ যা মনমাতানো অপূর্ব সুরভিতে ভরপুর ৷ এটা কি আন্তরিক বিমুগ্ধকারী এক অতি বড় নেয়ামত, আত্মার প্রশান্তি, মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্য বিশ্বব্যাপী আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্যের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী এক যাদুস্পর্শ। এটা এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, প্রভাত বেলার এমন কোমলমধুর প্রাণ মাতানো রূপ যার বর্ণনা কোনো সৌন্দর্যপূজারী বাকপটু কবি আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি বা পারবে না। কারণ এ হচ্ছে প্রকৃতিকে আল্লাহর দেয়া অপরূপ রূপ, যার সাথে অন্য কোনো জিনিসের তুলনা সম্ভব নয় এবং সে সৌন্দর্য নিজেই নিজ বর্ণনায় অনুপম । এই কারণেই এই প্রসঙ্গ শেষ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য এই মনোমুগ্ধকর জিনিসের মধ্যে কসম খাওয়ার কিছু আছে কি? এ দাবী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই আসলে এই জিজ্ঞাসা । প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্যই আলোচ্য বিষয়ের ওপর কসম খাওয়ার মতো অনেক কারণ আছে-আছে অনেক যুক্তি । যার তীব্র অনুভুতি শক্তি আছে এবং যার চিন্তা ভাবনা করার মতো অন্তরের যথেষ্ট প্রশ্বস্ততা আছে, তার জন্য এই সুন্দর প্রভাতের কসম খাওয়ার মধ্যে অনেক যুক্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবোধক কথা বলে দাবীকৃত বিষয়ের যৌক্তিকতাকেই আরো জোরদারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ফিসফিসে এই মধুর বাণী শোনার জন্যে প্রয়োজন অতি সুক্ষ অনুভূতি, যা বুঝার জন্যে প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ ও চিন্তা-ভাবনা এভাবে পূর্ববর্তী মধুর আলোচনার সাথে পরবর্তী আলোচনার এক গভীর যোগসূত্র বুঝা যায়। শপথের মূল বিষয়টি আলোচনা থেকে এখানে বাদ দেয়া হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে অত্যাচার-অনাচার এবং দুর্নীতির যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে তাতে মূল আলোচ্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অহংকারী, সীমালংঘনকারী এবং বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদেরকে পাকড়াও করা হবে বলে যেসব কড়া ধমক এসেছে সেই কথাগুলোকেই অতি সুন্দরভাবে বুঝানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা কসম খেয়েছেন বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন জিনিসের । বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখোনি তোমার রব আ’দ জাতির মধ্যকার ইরাম গোত্রের কেমন অবস্থা করলেন। …….. অবশ্যই তোমার রব তাদেরকে পাকড়াও করার জন্য ওঁৎপেতে ছিলেন ।’ এ ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবোধক বাক্য ব্যবহার করে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্যে এবং সত্যের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এক কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। এ পর্যায়ের প্রথমেই সম্বোধন করা হয়েছে নবী (স.)-কে। তারপর সম্বোধন করা হয়েছে ওই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে, যারা ওই সকল জাতির কঠিন দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। ওই সকল লোককেও সম্বোধন করেছেন, যারা নবী (স.)-এর যমানায় বর্তমান ছিলো । কোরআনের সম্বোধনের প্রথম লক্ষ্য ছিলো, যারা তাকে সম্যকভাবে জানতো ও চিনতো ৷ এই সম্বোধনের লক্ষ্য ওই সকল অতীতের জনগোষ্ঠীও বটে, যারা কিসসা কাহিনী ও কিংবদন্তীর মাধ্যমে ওই মন্দ লোকদের কঠিন পরিণতির কথা জানতে পেরেছে। নিজ চোখে দেখা বা শোনার যে ক্রিয়াবাচক শব্দটি ‘তোমার রব দেখবেন’ বলে ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মোমেন ব্যক্তিও আছে, যার অন্তর নিশ্চিন্ততায় ভরা, মানুষকে ভালোবেসে যারা শান্তি পায় এবং বিশেষভাবে ওই ‘তোমার’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে প্রত্যেক ওই তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তির জন্যেও যারা মক্কায় বাস করতো এবং বদমেযাজী অহংকারী লোকদেরকে তাদের সীমালংঘনকর কাজে সাহায্য যোগাতো ৷ উপরন্তু তাদের ওপর জবরদস্তিকারীদেরকে তাদের যুলুমে সমর্থন দিতো ৷ একদিকে এদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং অপরদিকে এদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা কড়া দৃষ্টিৌনূ কি রেখেছেন।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-6
টিকা নং:2,
اَلَمْ تَرَ كَیْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ۪ۙ
তুমি২ কি দেখনি তোমার রব আদে-ইরামের সাথে কি আচরণ করেছেন,
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) দিন-রাত্রির আবর্তন ব্যবস্থা থেকে শাস্তি ও পুরস্কার বিধানের প্রমাণ পেশ করার পর এখন তার নিশ্চিত সত্য হবার ব্যাপারে মানুষের ইতিহাস থেকে প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। ইতিহাসের কয়েকটি পরিচিত জাতির কর্মপদ্ধতি ও তাদের পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে একথা বলার উদ্দেশ্যে যে, এই বিশ্ব-জাহান কোন অন্ধ ও বধির প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে না। বরং এক বিজ্ঞানময় আল্লাহ এই সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন। আর এই আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের মধ্যে তোমরা যাকে প্রাকৃতিক আইন মনে করো কেবল মাত্র সেই আইনটিই সক্রিয় নেই বরং এই সাথে একটি নৈতিক আইনও এখানে সক্রিয় রয়েছে, যার অনিবার্যদাবী হচ্ছে, কাজের প্রতিফল এবং শাস্তি ও পুরস্কার দান। এই আইন যে সক্রিয় রয়েছে তার চিহ্ন এই দুনিয়াতেই বার বার প্রকাশ হতে থেকেছে এবং তা থেকে বুদ্ধি-বিবেকবান মানুষ বিশ্ব-জাহানের শাসন কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও স্বভাব সুস্পষ্টভাবে জানতে পেরেছে। এখানে যেসব জাতি আখেরাতের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এবং আল্লাহর শাস্তি ও পুরস্কারের ভয় না করেই নিজেদের জীবনের ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে তারা পরিণামে বিপর্যস্ত হয়েছে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর যে জাতিই এ পথে চলেছে বিশ্ব-জাহানের রব তার ওপর শেষ পর্যন্ত আযাবের চাবুক বর্ষণ করেছেন। মানুষের ইতিহাসের এই ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার দু’টি কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছেঃ
এক, আখেরাত অস্বীকার করার কারণে প্রত্যেক জাতি বিপথে পরিচালিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ততা তাকে ধ্বংসের আবর্তে নিক্ষেপ করেছে। কাজেই আখেরাত একটি যথার্থ সত্য। প্রত্যেক সত্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার যে ভয়াবহ পরিণতি হয় এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ফলও তাই হয়।
দুই, কর্মফল কোন এক সময় পূর্ণ মাত্রায়ও দেয়া হবে। কারণ বিপর্যয় ও বিকৃতির শেষ পর্যায়ে এসে আযাবের চাবুক যাদের ওপর বর্ষিত হয়েছে তাদের পূর্বে শত শত বছর পর্যন্ত বহু লোক এই বিপর্যয়ের বীজ বপন করে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল এবং তাদের ওপর কোন আযাব আসেনি। আল্লাহর ইনসাফের দাবী এই যে, কোন এক সময় তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক এবং তারা কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক। (কুরআন মজীদে আখেরাতের ব্যাপারে এই ঐতিহাসিক ও নৈতিক যুক্তির বিশ্লেষণ বিভিন্ন জায়গায় করা হয়েছে এবং সব জায়গায় আমি এর ব্যাখ্যা করেছি। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত জায়গাগুলো দেখুনঃ তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আরাফ ৫ – ৬ টীকা , ইউনুস ১২ , হূদ ৫৭ , ১০৫ , ১১৫ টীকা, ইবরাহীম ৯ টীকা, আন নহল ৬৬ ও ৮৬ টীকা, আর রূম ৮ টীকা , সাবা ২৫ টীকা, সাদ ২৯ ও ৩০ টীকা, আল মু’মিন ৮০ টীকা , আদ দুখান ৩৩ ও ৩৪ টীকা, আল জাসিয়াহ- ২৭ ও ২৮ টীকা, কাফ ১৭ টীকা এবং আয যারিয়াত ২১ টীকা ।)
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-7
টিকা নং:3,
اِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ۪ۙ
সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী আদে-ইরামের৩ সাথে,
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) ‘আদে ইরাম’ বলতে আদ জাতির সেই প্রাচীন ধারাটির কথা বুঝানো হয়েছে যাকে কুরআন মজীদ ও আরবের ইতিহাসে ‘আদে উলা’ (প্রথম) বলা হয়েছে। সূরা আন নাজমে বলা হয়েছেঃ ( وَاِنَّهُ اَهْاَكَ عَادَانِ الُوْلى ) “আর তিনি প্রাচীন আদ জাতিকে ধ্বংস করেছেন।” (৫০ আয়াত) অর্থাৎ সেই আদ জাতিকে যাদের কাছে হযরত হূদ আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছিল এবং যাদের ওপর আযাব নাযিল হয়েছিল। অন্যদিকে এই জাতির যেসব লোক আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার পর নিজেদের জাতি সত্তার সমৃদ্ধি সাধন করেছিল, আরবের ইতিহাসে তাদেরকে ‘আদ উখ্রা’ (দ্বিতীয় আদ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রাচীন আদ জাতিকে “আদে ইরাম” বলার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা সিরিয় বংশজাত আদদের সেই বংশধারার সাথে সম্পর্কিত যাদের উদ্ভব হয়েছিল নূহ আলাইহিস সালামের নাতি ও সামের ছেলে ইরাম থেকে। ইতিহাসে আদদের এই শাখার আরো কয়েকটি উপশাখা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। সামূদ এদের অন্যতম। কুরআনে এই জাতিটির উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আরমিয়ান (Arameana) জাতি। এরা প্রথমে সিরিয়ার উত্তর এলাকায় বসবাস করতো। এদের ভাষা আরামী (Aramic)। সিরিয়ার ভাষাগুলোর মধ্যে এই ভাষাটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আদের জন্য ‘যাতুল ইমাদ’ (সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ তারা বড় বড় উঁচু উঁচু ইমারত তৈরি করতো। দুনিয়ায় তারাই সর্বপ্রথম উঁচু উঁচু স্তম্ভের ওপর ইমারত নির্মাণ করার কাজ শুরু করে। কুরআন মজীদের অন্য জায়গায় তাদের এই বৈশিষ্ট্যকে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ হযরত হূদ (আ) তাদেরকে বলেন, اَتَبۡنُوۡنَ بِكُلِّ رِيۡعٍ اٰيَةً تَعۡبَثُوۡنَ “তোমাদের এ কেমন অবস্থা, প্রত্যেক উঁচু জায়গায় অনর্থক একটি স্মৃতিগৃহ তৈরি করছো এবং বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করছো, যেন তোমরা চিরকাল এখানে থাকবে।” (আশ শু’আরা, ১২৮-১২৯
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-8
টিকা নং:4,
الَّتِیْ لَمْ یُخْلَقْ مِثْلُهَا فِی الْبِلَادِ۪ۙ
যাদের মতো কোন জাতি দুনিয়ার কোন দেশে সৃষ্টি করা হয়নি?৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) অর্থাৎ তারা সমকালীন জাতিদের মধ্যে ছিল একটি তুলনাবিহীন জাতি। শক্তি, শৌর্য-বীর্য, গৌরব ও আড়ম্বরের দিক দিয়ে সে যুগে সারা দুনিয়ায় কোন জাতি তাদের সমকক্ষ ছিল না। কুরআনের অন্যান্য স্থানে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
وَزَادَكُمۡ فِىۡ الۡخَلۡقِ بَصۜۡطَةًۚ
“দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে তোমাদের অবয়বকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন। ( আল আরাফ, ৬৯)
فَاَمَّا عَادٌ فَاسۡتَكۡبَرُوۡا فِىۡ الۡاَرۡضِ بِغَيۡرِ الۡحَقِّ وَقَالُوۡا مَنۡ اَشَدُّ مِنَّا قُوَّةًؕ
“আর তাদের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, তারা কোন অধিকার ছাড়াই পৃথিবীর বুকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করেছে। তারা বলেছেঃ কে আছে আমাদের চাইতে বেশী শক্তিশালী?” ( হা-মীম আস্ সাজদাহ , ১৫)
وَاِذَا بَطَشۡتُمۡ بَطَشۡتُمۡ جَبَّارِيۡنَ
“আর তোমরা যখন কারোর উপর হাত উঠিয়েছো প্রবল পরাক্রান্ত হয়েই উঠিয়েছো।” ( আশ শু’আরা, ১৩০ )
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-9
টিকা নং:5,
وَ ثَمُوْدَ الَّذِیْنَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ۪ۙ
আর সামূদের সাথে, যারা উপত্যকায় পাথর কেটে গৃহ নির্মাণকরেছিল?৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) উপত্যকা বলতে ‘আলকুরা’ উপত্যকা বুঝানো হয়েছে। সামূদ জাতির লোকেরা সেখানে পাথর কেটে কেটে তার মধ্যে গৃহ নির্মাণ করেছিল। সম্ভবত ইতিহাসে তারাই প্রথম জাতি হিসেবে চিহ্নিত যারা পাহাড়ের মধ্যে এভাবে ইমারত নির্মাণের রীতি প্রচলন করেছিল। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আরাফ ৫৭-৫৯ টীকা, আল হিজর ৪৫ টীকা এবং আশ শু’আরা ৯৫-৯৯ টীকা)
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-10
টিকা নং:6,
وَ فِرْعَوْنَ ذِی الْاَوْتَادِ۪ۙ
আর কীলকধারী ফেরাউনের৬ সাথে?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৬) ফেরাউনের জন্য ‘যুল আউতাদ’ (কীলকধারী) শব্দ এর আগে সুরা সাদের ১২ আয়াতেও ব্যবহার করা হয়েছে। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। তার সেনাবাহিনীকে কীলকের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং সেই অর্থে কীলকধারী মানে সেনাবাহিনীর অধিকারী। কারণ তাদেরই বদৌলতে তার রাজত্ব এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যেমন কীলকের সাহায্যে তাঁবু মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এর অর্থ সেনা দলের সংখ্যাধিক্যও হতে পারে। এক্ষেত্রে এর অর্থ হবে, তার সেনাদল যেখানে গিয়ে তাঁবু গাঁড়তো সেখানেই চারদিকে শুধু তাঁবুর কীলকই পোঁতা দেখা যেতো। আবার এর অর্থ সেই কীলকও হতে পারে যা মানুষের শরীরে গেঁড়ে দিয়ে সে তাদেরকে শাস্তি দিতো। এও হতে পারে, মিসরের পিরামিডগুলোকে কীলকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ সেগুলো ফেরাউনদের পরাক্রম ও শান শওকতের নিদর্শন হিসেবে হাজার হাজার বছর থেকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১০
وَ فِرۡعَوۡنَ ذِی الۡاَوۡتَادِ ﴿۪ۙ۱۰﴾
এবং কীলকওয়ালা ফির‘আউনের প্রতি ?
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১১
الَّذِیۡنَ طَغَوۡا فِی الۡبِلَادِ ﴿۪ۙ۱۱﴾
যারা দেশের মধ্যে উদ্ধত আচরণ করেছিল।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১২
فَاَکۡثَرُوۡا فِیۡہَا الۡفَسَادَ ﴿۪ۙ۱۲﴾
অতঃপর সেখানে অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-১৩
فَصَبَّ عَلَیۡہِمۡ رَبُّکَ سَوۡطَ عَذَابٍ ﴿ۚۙ۱۳﴾
ফলে তোমার প্রতিপালক তাদের উপর শাস্তির চাবুক হানলেন।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-14
টিকা নং:7,
اِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِؕ
আসলে তোমার রব ওঁৎপেতে আছেন।৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৭) জালেম ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কার্যকলাপের প্রতি নজর রাখার জন্য ওঁৎ পেতে থাকা প্রবাদটির ব্যবহার করা হয়েছে রূপক হিসেবে। কোন ব্যক্তির কারো অপেক্ষায় কোন গোপন স্থানে এই উদ্দেশ্যে লুকিয়ে বসে থাকা যে, তার আয়ত্বের মধ্যে আসার সাথে সাথেই সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, একে বলা হয় ওঁৎ পেতে থাকা। যার জন্য লুকিয়ে বসে থাকা হয় সে জানতে পারে না যে, তার ওপর আক্রমণ করার জন্য কেউ কোথাও লুকিয়ে বসে আছে। সে নিশ্চিন্তে চারদিকে সম্পর্কে অসতর্ক হয়ে ঐ স্থান অতিক্রম করতে থাকে তখন অকস্মাৎ সে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়ায় যেসব জালেম বিপর্যয়ের তুফান সৃষ্টি করে থাকে আল্লাহর মোকাবিলায় তাদের অবস্থাও অনুরূপ হবে। আল্লাহ যে একজন আছেন এবং তিনি তার সমস্ত কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য রাখছেন, এ অনুভূতিই তার থাকে না। সে একেবারে নির্ভয়ে দিনের পর দিন বেশী বেশী শয়তানী কাজ করে যেতে থাকে। তারপর একদিন যখন সে এক সীমান্তে পৌঁছে যায় যেখান থেকে আল্লাহ তাকে আর এগিয়ে যেতে দিতে চান না তখন তার ওপর হঠাৎ আল্লাহর আযাবের চাবুক বর্ষিত হয়।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-15
টিকা নং:8,
فَاَمَّا الْاِنْسَانُ اِذَا مَا ابْتَلٰىهُ رَبُّهٗ فَاَكْرَمَهٗ وَ نَعَّمَهٗ١ۙ۬ فَیَقُوْلُ رَبِّیْۤ اَكْرَمَنِؕ
কিন্তু৮ মানুষের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তার রব যখন তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তাকে সম্মান ও নিয়ামত দান করেন তখন সে বলে, আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৮) এখন লোকদের সাধারণ নৈতিক অবস্থার সমালোচনা করে বলা হচ্ছে, যেসব লোক দুনিয়ার জীবনে এই দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে তাদের কার্যাবলীর হিসেব কখনো না নেয়ার কি কারণ থাকতে পারে? দুনিয়ায় এসব কাজ-কারবার করে যখন মানুষ বিদায় নেবে তখন তার কাজের জন্য সে কোন শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করবে না একে বুদ্ধি ও নৈতিক বৃত্তির দাবী বলে কেমন করে মেনে নেয়া যেতে পারে।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-16
টিকা নং:9,
وَ اَمَّاۤ اِذَا مَا ابْتَلٰىهُ فَقَدَرَ عَلَیْهِ رِزْقَهٗ١ۙ۬ فَیَقُوْلُ رَبِّیْۤ اَهَانَنِۚ
আবার যখন তিনি তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রিযিক তার জন্য সংকীর্ণ করে দেন তখন সে বলে, আমার রব আমাকে হেয় করেছেন।৯
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৯) অর্থাৎ এটি হচ্ছে মানুষের বস্তুবাদী জীবন দর্শন। এই দুনিয়ার ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, কর্তৃত্বকেই সে সবকিছু মনে করে। এগুলো পেলে সে আনন্দে উল্লাসিত হয় এবং বলে আল্লাহ আমাকে মর্যাদা দান করেছেন। আবার না পেলে বলে, আল্লাহ আমাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেছেন। অর্থাৎ ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা-কর্তৃত্ব পাওয়া না পাওয়াই হচ্ছে তার কাছে মর্যাদা ও লাঞ্ছনার মানদণ্ড। অথচ প্রকৃত ব্যাপারটিই সে বোঝে না। আল্লাহ দুনিয়ায় যাকেই যা কিছুই দিয়েছেন পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন। ধন ও শক্তি দিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। এগুলো পেয়ে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না অকৃতজ্ঞ হয়, তা তিনি দেখতে চান। দারিদ্র ও অভাব দিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। ধৈর্য ও পরিতুষ্টি সহকারে মানুষ আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সন্তুষ্ট থাকে এবং বৈধ সীমার মধ্যে অবস্থান করে নিজের সমস্যা ও সংকটের মোকাবিলা করে, না সততা, বিশ্বস্ততা ও নৈতিকতার সব বাঁধন ছিন্ন করে আল্লাহকেই গালমন্দ দিতে থাকে, তা আল্লাহ অবশ্যই দেখতে চান।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-17
টিকা নং:10, 11,
كَلَّا بَلْ لَّا تُكْرِمُوْنَ الْیَتِیْمَۙ
কখনোই নয়,১০ বরং তোমরা এতিমের সাথে সম্মানজনক ব্যবহার কর না ১১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১০) অর্থাৎ এটি কখনই মর্যাদা ও লাঞ্ছনার মানদণ্ড নয়। তোমরা মস্তবড় ভুল করছো। একে সৎ চারিত্রিক মনোবৃত্তি ও অসৎ চারিত্রিক মনোবৃত্তির পরিবর্তে তোমরা মর্যাদা ও লাঞ্ছনার মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছো।
টিকা:১১) অর্থাৎ তার বাপ জীবিত থাকাকালে তার সাথে তোমরা এক ধরনের ব্যবহার করো। আর তার বাপ মারা যাবার সাথে সাথেই প্রতিবেশী ও দূরের আত্মীয়দের তো কথাই নেই, চাচা, মামা এমনকি বড় ভাই পর্যন্ত তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-18
টিকা নং:12,
وَ لَا تَحٰٓضُّوْنَ عَلٰى طَعَامِ الْمِسْكِیْنِۙ
এবং মিসকীনকে খাওয়াবার জন্য পরস্পরকে উৎসাহিত কর না।১২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১২) অর্থাৎ তোমাদের সমাজে গরীবদের আহার করাবার কোন রেওয়াজই নেই। কোন ব্যক্তি নিজে অগ্রসর হয়ে কোন অভুক্তকে আহার করাবার উদ্যোগ নেয় না। অথবা ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণ করার কোন চিন্তাই তোমাদের মনে আসে না এবং এর ব্যবস্থা করার জন্য তোমরা পরস্পরকে উৎসাহিতও করো না।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-19
টিকা নং:13,
وَ تَاْكُلُوْنَ التُّرَاثَ اَكْلًا لَّمًّاۙ
তোমরা মীরাসের সব ধন-সম্পদ সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেলো১৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৩) আরবে মেয়েদের ও শিশুদের এমনিতেই মীরাস থেকে বঞ্চিত রাখা হতো। এ ব্যাপারে লোকেরা যে মত পোষণ করতো তা ছিল এই যে, মীরাস লাভ করার অধিকার একমাত্র এমন সব পুরুষের আছে যারা লড়াই করার ও পরিবারের লোকদের হেফাজত করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে। এছাড়াও মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হতো সে নিশ্চিন্তে সমস্ত মীরাস নিজের একার দখলে নিয়ে নিতো এবং যারা নিজেদের অংশ হাসিল করার ক্ষমতা রাখতো না তাদের সবারটা গ্রাস করে ফেলতো। অধিকার ও কর্তব্যের কোন গুরুত্বই তাদের কাছে ছিল না। অধিকারী নিজের অধিকার হাসিল করতে পারুক বা না পারুক ঈমানদারীর সাথে নিজের কতর্ব্য মনে করে তাকে তার অধিকার প্রদান করার কথা তারা চিন্তাই করতো না।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-20
টিকা নং:14,
وَّ تُحِبُّوْنَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّاؕ
এবং এই ধন-সম্পদের প্রেমে তোমরা মারাত্মকভাবে বাঁধা পড়েছ।১৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৪) অর্থাৎ বৈধ-অবৈধ ও হালাল-হারামের কোন পার্থক্যই তোমাদের কাছে নেই। যে কোন পদ্ধতিতে সম্পদ অর্জন করতে তোমরা মোটেই ইতস্তত করো না। যত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদই তোমরা লাভ করো না কেন তোমাদের লোভের ক্ষুধা মেটে না।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-21
টিকা নং:15,
كَلَّاۤ اِذَا دُكَّتِ الْاَرْضُ دَكًّا دَكًّاۙ
কখনই নয়,১৫ পৃথিবীকে যখন চূর্ণবিচূর্ণ করে বালুকাময় করে দেয়া হবে
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৫) অর্থাৎ তোমাদের চিন্তা ভুল। তোমরা দুনিয়ায় যত দিন জীবন যাপন করবে, এসব কিছুই করতে থাকবে এবং এজন্য তোমাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না, একথা ঠিক নয়। যে শাস্তি ও পুরস্কারের বিষয়টি অস্বীকার করে তোমরা এই জীবন পদ্ধতি অবলম্বন করেছো সেটি কোন অসম্ভব ও কাল্পনিক ব্যাপার নয়। বরং সে বিষয়টি অবশ্যি সংঘটিত হবে। সামনের দিকে সেটি কখন সংঘটিত হবে সে সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-22
টিকা নং:16,
وَّ جَآءَ رَبُّكَ وَ الْمَلَكُ صَفًّا صَفًّاۚ
এবং তোমার রব এমন অবস্থায় দেখা দেবেন।১৬ যখন ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৬) মূলে বলা হয়েছে ( جَاءَرَبُّكَ ) এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে, “তোমার রব আসবেন।” তবে আল্লাহর জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই একে রূপক অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। এর উদ্দেশ্য এমনি ধরনের একটি ধারণা দেয়া যে, সে সময় আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব, শাসন ও প্রতাপের নিদর্শনসমূহ পূর্ণরূপে প্রকাশিত হবে। দুনিয়ায় কোন বাদশাহর সমগ্র সেনাদল এবং তার মন্ত্রীপরিষদ ও সভাসদদের আগমনে ঠিক ততটা প্রভাব ও প্রতাপ সৃষ্টি হয় না যতটা বাদশাহর নিজের দরবারে আগমনে সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টিই এখানে বুঝানো হয়েছে।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-23
টিকা নং:17,
وَ جِایْٓءَ یَوْمَئِذٍۭ بِجَهَنَّمَ١ۙ۬ یَوْمَئِذٍ یَّتَذَكَّرُ الْاِنْسَانُ وَ اَنّٰى لَهُ الذِّكْرٰىؕ
সেদিন জাহান্নামকে সামনে আনা হবে। সেদিন মানুষ বুঝবে কিন্তু তার বুঝতে পারায় কী লাভ?১৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৭) মূলে বলা হয়েছে يَوْمَءِذٍيَّتَذَكَّرُ الانَسانُ وَاَنّى لَهُ الذّكْرى এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেদিন মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু করে এসেছে তা স্মরণ করবে এবং সেজন্য লজ্জিত হবে। কিন্তু তখন স্মরণ করায় এবং লজ্জিত হওয়ায় কোন লাভ হবে না। দুই, সেদিন মানুষ সচেতন হবে। সে উপদেশ গ্রহণ করবে। সে বুঝতে পারবে, নবীগণ তাকে যা কিছু বলেছিলেন তাই ছিল সঠিক এবং তাদের কথা না মেনে সে বোকামি করেছে। কিন্তু সে সময় সচেতেন হওয়ায়, উপদেশ গ্রহণ করায় এবং নিজের ভুল বুঝতে পারায় কী লাভ?
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৪
یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِیۡ قَدَّمۡتُ لِحَیَاتِیۡ ﴿ۚ۲۴﴾
সে বলবে, ‘হায়! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম!’
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৫
فَیَوۡمَئِذٍ لَّا یُعَذِّبُ عَذَابَہٗۤ اَحَدٌ ﴿ۙ۲۵﴾
সেদিন তাঁর শাস্তির মত শাস্তি কেউ দিতে পারবে না,
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৬
وَّ لَا یُوۡثِقُ وَ ثَاقَہٗۤ اَحَدٌ ﴿ؕ۲۶﴾
এবং তাঁর বন্ধনের মত বন্ধন কেউ বাঁধতে পারবে না।
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-27
টিকা নং:18,
یٰۤاَیَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُۗۖ
(অন্যদিকে বলা হবে) হে প্রশান্ত আত্মা!১৮
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৮) ‘প্রশান্ত আত্মা’ বলে এমন মানুষকে বুঝানো হয়েছে যে, কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় ছাড়াই পূর্ণ নিশ্চিন্ততা সহকারে ঠাণ্ডা মাথায় এক ও লা-শরীক আল্লাহকে নিজের রব এবং নবীগণ যে সত্য দ্বীন এনেছিলেন তাকে নিজের দ্বীন ও জীবন বিধান হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছ থেকে যে বিশ্বাস ও বিধানই পাওয়া গেছে তাকে সে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিয়েছে। আল্লাহর দ্বীন যে জিনিসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাকে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নয় বরং এই বিশ্বাস সহকারে বর্জন করেছে যে, সত্যিই তা খারাপ। সত্য-প্রীতির পথে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে নির্দ্ধিধায় তা করেছে। এই পথে যেসব সংকট, সমস্যা, কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে হাসি মুখে সেগুলো বরদাশত করেছে। অন্যায় পথে চলে লোকদের দুনিয়ায় নানান ধরনের স্বার্থ, ঐশ্বর্য ও সুখ-সম্ভার লাভ করার যেসব দৃশ্য সে দেখছে তা থেকে বঞ্চিত থাকার জন্য তার নিজের মধ্যে কোন ক্ষোভ বা আক্ষেপ জাগেনি। বরং সত্য দ্বীন অনুসরণ করার ফলে সে যে এই সমস্ত আবর্জনা থেকে মুক্ত থেকেছে, এজন্য সে নিজের মধ্যে পূর্ণ নিশ্চিন্ততা অনুভব করেছে। কুরআনের অন্যত্র এই অবস্থাটিকে ‘শারহে সদর’ বা হৃদয় উন্মুক্ত করে দেয়া অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। (আল আন’আম, ১২৫)
সুরা: আল-ফাজর
আয়াত নং :-28
টিকা নং:19,
ارْجِعِیْۤ اِلٰى رَبِّكِ رَاضِیَةً مَّرْضِیَّةًۚ
চলো তোমার রবের দিকে,১৯ এমন অবস্থায় যে তুমি (নিজের শুভ পরিণতিতে) সন্তুষ্ট (এবং তোমরা রবের) প্রিয়পাত্র।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৯) একথা তাকে মৃত্যুকালেও বলা হবে, যখন কিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে যেতে থাকবে সে সময়ও বলা হবে এবং আল্লাহর আদালতে পেশ করার সময়ও তাকে একথা বলা হবে। প্রতিটি পর্যায়ে তাকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দান করা হবে যে, সে আল্লাহর রহমতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৮
ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّکِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً ﴿ۚ۲۸﴾
তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে ,
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-২৯
فَادۡخُلِیۡ فِیۡ যে عِبٰدِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾
সুতরাং তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও।
সুরা: ৮৯ : আল্ – ফাজর:-৩০
وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ ﴿٪۳۰﴾
এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:
الْفَجْرِ ফজর বলতে ফজরের সময়কে বুঝানো হয়েছে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الْفَجْرِ শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বের সূরাগুলোতে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে।
সূরাতে কয়েকটি বিষয় আলোচনা স্থান পেয়েছেন যেমন সূরার শুরুতে কয়েকটি বিষয়ের শপথ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, কাউকে সম্পদ দেয়া আর না দেয়া, সম্মান-অসম্মানের বিষয় নয় বরং যদি আল্লাহ তা‘আলা কাউকে ঈমান ও সৎআমলের তাওফীক দান করেন সেটাই প্রকৃত সম্মান। তারপর অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের চারটি মন্দ আচরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, সর্বশেষে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় বান্দাদের পুরস্কার জান্নাতে সসম্মানে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে।
১-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের শপথ করার পর পূর্ববর্তী কয়েকজন নাবীর জাতির আলোচনা নিয়ে এসেছেন, যারা ঈমান বর্জন করত জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
الْفَجْرِ ফজর রাতের বিদায় ও দিনের আগমনের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেউ বলেছেন : এখানে ফজর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো يوم النحر বা যিলহাজ্জের ১০ তারিখের কুরবানী দিনের ফজর। আবার কেউ বলেছেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ফজরের সালাত ইত্যাদি। তবে সঠিক কথা হলো এর দ্বারা প্রতি দিনের সাধারণ ফজরকে বুঝানো হয়েছে। কোন নির্দিষ্ট দিনের ফজর উদ্দেশ্য নয়। (তাফসীর মুয়াসসার)
(وَلَيَالٍ عَشْرٍ)
দশ রাত দ্বারা দু’টি উদ্দেশ্য হতে পারে।
১. যিলহাজ্জের প্রথম দশ রাত-দিন। হাদীসে এসেছে, নাবী (সাঃ) বলেন : যিলহাজ্জের প্রথম দশ দিনের কৃত আমলের চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিক পছন্দনীয় আর কোন আমল নেই। সাহাবীরা বললেন : আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদও না? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদও না, তবে ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে তার জান মাল নিয়ে বের হয়ে গেছে আর ফিরে আসতে পারেনি। (সহীহ বুখারী হা. ৯৬৯)
২. রমযানের শেষ দশ রাত। এ রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। তবে অধিকাংশ আলেমগণ প্রথম মতটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
(وَّالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ)
এখানে জোড় ও বেজোড় দ্বারা কী উদ্দেশ্য এ নিয়ে অনেক মতামত তাফসীর গ্রন্থে পাওয়া যায়। ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) এ ব্যাপারে সাতটি মত বর্ণনা করেছেন। এ সকল মতামত পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় এর দ্বারা নির্দিষ্ট কোন কিছু বুঝানো হয়নি। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জোড় ও বেজোড় সংখ্যা এবং জোড় ও বেজোড় সংখ্যক বস্তু। (আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন)
(وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ)
অর্থাৎ রাত যখন আগত হয় এবং যখন বিদায় নেয়। কেননা يسير শব্দটি আসা ও যাওয়া উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়।
(قَسَمٌ لِّذِيْ حِجْرٍ)
অর্থাৎ পূর্বে উল্লিখিত শপথসমূহ কি জ্ঞানীদের জন্য مقنع বা উপকার নেই। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।
(لِّذِيْ حِجْرٍ) অর্থ :
لِّذِيْ عقل ولب
বা জ্ঞানী, বুদ্ধিমান। حِجْرٍ শব্দের শাব্দিক অর্থ : বাধা দেয়া, বারণ করা। জ্ঞানীদেরকে حِجْرٍ বলার কারণ হলো : জ্ঞান মানুষকে এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে বা বাধা প্রদান করে যা তার জন্য উপযোগী নয়। এখান থেকেই বলা হয় حجر البيت বা বাইতুল্লাহর প্রতিবন্ধক। কেননা তা তওয়াফকারীদেরকে শামী দেয়ালের সাথে লেপটে থাকা থেকে বাধা দেয়। (ইবনু কাসীর)
(أَلَمْ تَرَ كَيْفَ….. الْبِلَادِ)
অর্থাৎ যখন আদ জাতি তাদের নিকট প্রেরিত রাসূল হূদ (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, তাঁর আনুগত্য বর্জন করল, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আযাব দ্বারা গ্রাস করলেন। যেমন সূরা হাক্কাতে আলোচনা করা হয়েছে।
(إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ) ارم-
‘ইরাম’ একটি গোত্রের নাম। আবার বলা হয় إِرَمَ আদ জাতির পিতামহের নাম। যেমন তাদের বংশ তালিকা হলো ‘আদ বিন আউস বিন ইরাম বিন সাম বিন নূহ। عاد দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রথম আদ বা তাদের সন্তানরা। (ফাতহুল কাদীর)
(ذَاتِ الْعِمَادِ)
(স্তম্ভ ওয়ালা) বলে তাদের ক্ষমতা, শক্তি, সামর্থ্য ও দৈহিক দীর্ঘতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাছাড়া তারা অট্টালিকা নির্মাণেও খুব দক্ষ কারিগর ছিল। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: তারা সে সময় উঁচু উঁচু প্রাসাদসমূহে বসবাস করত এবং দৈহিক আকৃতি ও বস্তুগত ক্ষমতায় ছিল সে যুগের সেরা শক্তিশালী জাতি। হূদ (আঃ) তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করল এবং তারা হঠকারিতা করল ও বাপ-দাদার আমল থেকে ফিরে না আসার দোহাই দিয়ে শির্কের ওপর অটল রইল। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন।
(لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ)
অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে তাদের মত শক্তিশালী আর কোন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاذْکُرُوْٓا اِذْ جَعَلَکُمْ خُلَفَا۬ئَ مِنْۭ بَعْدِ قَوْمِ نُوْحٍ وَّزَادَکُمْ فِی الْخَلْقِ بَصْۜطَةًﺆ فَاذْکُرُوْٓا اٰلَا۬ئَ اللہِ لَعَلَّکُمْ تُفْلِحُوْنَ)
“এবং স্মরণ কর! ‘আল্লাহ তোমাদেরকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের দৈহিক গঠনে অধিকতর হৃষ্টপুষ্ট-বলিষ্ঠ করেছেন। সুতরাং তোমরা ‘আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর! হয়ত তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৬৯)
তাই তারা গর্ব করে বলত :
(فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوْا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوْا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً)
“আর ‘আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করত এবং বলত: আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী কে আছে?” (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১: ১৫) তাদের অহংকার ও হঠকারীতার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি প্রবল বায়ু প্রেরণ করলেন। যা আট দিন ও সাত রাত স্থায়ী ছিল এবং সব কিছু সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوْا بِرِيْحٍ صَرْصَرٍ عٰتِيَةٍ سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَّثَمٰنِيَةَ أَيَّامٍ لا حُسُوْمًا فَتَرَي الْقَوْمَ فِيْهَا صَرْعٰي كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ)
“আর ‘আদ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় দ্বারা। যা তিনি তাদের ওপর প্রবাহিত করেছিলেন বিরামহীনভাবে সাত রাত ও আট দিন, তুমি (উপস্থিত থাকলে) সেই সম্প্রদায়কে দেখতে খেজুর কাণ্ডের ন্যায় সেখানে ছিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে আছে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯: ৬-৮)
এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী সনদবিহীন একটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন যে, আদ এর দুই পুত্র ছিল, একজন শাদ্দাদ ও অপর জন শাদীদ। শাদীদের মৃত্যুর পর শাদ্দাদ রাজত্বের মালিক হয়। সে নয়শ বছর জীবিত ছিল। জান্নাতের কথা শুনে সে আদনের মরুভূমিতে তিনশ বছর ধরে বিশাল শহর নির্মাণ করে ও তাকে জান্নাত নামে নামকরণ করে। সেখানে সোনা-রূপা ও মনি মুক্তা ইত্যাদি দিয়ে বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করে ও বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ রোপণ করে। নির্মাণ শেষ হলে শাদ্দাদ তার দলবল নিয়ে সেখানে পৌঁছার একদিন ও একরাতের পথ বাকী থাকতেই এক ভীষণ আসমানী বজ্রধ্বনি এসে সব ধ্বংস করে দেয়। (তাফসীর কুরতুবী) তবে ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) এ সম্পর্কে বলেন : এসবই ইসরাঈলী বর্ণনা যা তাদের কতক নাস্তিকগণ তৈরি করেছে, এর দ্বারা মূর্খ লোকদের জ্ঞানের পরিধি জানার জন্য। যাতে তারা তাদের সবকিছুকে বিশ্বাস করে নেয়। (ইবনু কাসীর) সুতরাং এসব কাহিনী মিথ্যা বানোয়াট এবং এর উদ্দেশ্য মানুষকে ধোঁকায় নিপতিত করা ছাড়া কিছুই নয়।
(وَثَمُوْدَ الَّذِيْنَ جَابُوا الصَّخْرَ)
অর্থাৎ সামূদ জাতি যাদের নিকট সালেহ (আঃ)-কে প্রেরণ করা হয়েছিল, তারাও যখন নাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতঃ আনুগত্য বর্জন করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন। এরা এতো শক্তিশালী ছিল যে, তারা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করত। তারপরেও তারা আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে রেহাই পায়নি। এ সম্পর্কে সূরা শুয়ারার ১৪৯ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَفِرْعَوْنَ ذِي الْأَوْتَادِ)
অর্থাৎ ফির‘আউনকেও আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করেছেন, যে অনেক সৈন্যের মালিক ছিল এবং বিশাল রাজত্বের অধিপতি ছিল। যখন সে কুফরী এবং নাবী ও ঈমানদারদের হত্যা করার চেষ্টা করে ও জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল তখন সে তার এ বিশাল রাজত্ব ও সৈন্য বাহিনী আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেনি। صَبَّ অর্থ ঢেলে দেয়া, سَوْطَ অর্থ চাবুক দিয়ে মারা। অর্থাৎ তাদের ওপর আযাব ঢেলে দেয়া হয়েছিল।
(إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ)
অর্থাৎ যে অপরাধ করে তাকে আল্লাহ তা‘আলা কিছু সময়ের অবকাশ দেন, তারপর কঠিনভাবে পাকড়াও করেন। যুগে যুগে যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করেছে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন। তাদের থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হওয়া উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যেকোন সৃষ্টির নামে শপথ করতে পারেন; কিন্তু মানুষ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নাম ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে শপথ করতে পারবে না।
২. আল্লাহ তা‘আলা যে জিনিসের শপথ করেন তার গুরুত্ব অপরিসীম।
৩. যিলহাজ্জের প্রথম দশ দিনের ফযীলত জানতে পারলাম।
৪. পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতির ঘটনা বর্ণনা করে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, নাবীদের আনুগত্য বর্জন করলে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করা হবে।
১৫-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি চিরাচরিত স্বভাবের কথা তুলে ধরেছেন যে, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা যখন সুখ-সাচ্ছন্দ্য দান করেন তখন আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে সে ভাল ধারণা করে, পক্ষান্তরে মানুষ দুঃখ কষ্টে পতিত হলে আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করে। মানুষকে যখন আল্লাহ তা‘আলা ধন-দৌলত ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য দান করেন তখন মনে করে সে একজন আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল বান্দা যার কারণে দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এসব দান করে সম্মানিত করেছেন। আবার দরিদ্রতায় পতিত হলে মনে মনে খারাপ ধারণা পোষণ করে, আসলে প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَيَحْسَبُوْنَ أَنَّمَا نُمِدُّهُمْ بِه۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِيْنَ لا نُسَارِعُ لَهُمْ فِي الْخَيْرَاتِ ط بَلْ لَّا يَشْعُرُوْنَ)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করি। তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।” (সূরা মু’মিনূন ২৩ : ৫৫-৫৬)
মূলত সুখ-সাচ্ছন্দ্য, বালা-মসিবত ইত্যাদি দেওয়া হয় পরীক্ষা করার জন্য, কে অসচ্ছল অবস্থাতেও ঈমান নিয়ে অবিচল থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ الْمَوْتِ ط وَنَبْلُوْكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً ط وَإِلَيْنَا تُرْجَعُوْنَ)
“জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে।” (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৩৫)
যদি মানুষ মু’মিন হয় তাহলে তার সুঃখ-দুখ সর্বাবস্থায়ই কল্যাণকর। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : মু’মিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক। তাদের প্রত্যেক কাজ কল্যাণ কর। যদি ভাল কিছু পায় তাহলে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোন বিপদে পতিত হয় তাহলে ধৈর্য ধারণ করেÑএটাও তার জন্য কল্যাণকর। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৯৯) আর যদি মু’মিন না হয় তাহলে দুনিয়ার সুখ-সাচ্ছন্দ্য তার জন্য ক্ষণিকের জন্য অবকাশ মাত্র, অতঃপর তাকে কঠিন আযাবে পতিত হতে হবে।
(كَلَّا بَلْ لَّا……)
অর্থাৎ তোমরা যেমন ধারণা করছ বিষয়টি তেমন না যে, ধন-সম্পদ পেলে সম্মানিত হয়ে গেলাম আর না পেলে অপমানিত হলাম। না, বরং তোমরা ইয়াতীমদের সাথে সদাচরণ কর না, তাদের হক আদায় কর না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: সে ঘর সর্বোত্তম যে ঘরে ইয়াতীমদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হয়। আর সে ঘর সবচেয়ে খারাপ যে ঘরে ইয়াতীমদের সাথে অসদাচরণ করা হয়। অতঃপর নাবী (সাঃ) দুই আঙ্গুল একত্র করে বললেন: আমি ও ইয়াতিমের দায়িত্বশীল ব্যক্তি জান্নাতে এভাবে পাশাপাশি থাকব। (সহীহ বুখারী হা. ৫৩০৪)
(وَتَأْكُلُوْنَ التُّرَاثَ….)
অর্থাৎ ইয়াতীমদের মীরাস অন্যায়ভাবে সম্পূর্ণ তোমরা ভক্ষণ করে থাক। আয়াতে ইয়াতীমদের মীরাসের কথা উল্লেখ থাকলেও সকল প্রকার উত্তরাধিকার এতে শামিল। যারা ওয়ারীসদারের প্রাপ্য ওয়ারিস থেকে বঞ্চিত করে তাদের জন্যও এ ধমক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত জমিন অন্যায়ভাবে দখল করল কিয়ামতের দিন তাকে সাত তবক জমিনের বেড়ী পরানো হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩১৯৮, সহীহ মুসলিম হা. ১৬১০)
অর্থ প্রসিদ্ধ তাবেয়ী সুদ্দী (রহঃ) বলেন : أكلا شديدا বা দারুনভাবে ভোগ করা। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : হারাম-হালাল যেকোন পন্থায় হোক হাসিল করা।
جَمًّا শব্দটি كثير বা অত্যধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচুর্যের লালসা তাদেরকে এমন বানিয়ে নিয়েছে যে, তারা সম্পদ থাকা-না থাকাই সম্মানের কারণ হিসাবে বিবেচনা করছে। রাসূলুল্লাহ বলেছেন : আদম সন্তানের যদি একটি পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকে তাহলে তারা চাইবে যদি এরূপ দুটি স্বর্ণের পাহাড় হত। মূলত তাদের মুখ মাটি ছাড়া কিছুই ভরতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৩৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষের চিরাচরিত স্বভাবের কথা জানতে পারলাম যা অব্যশ্যই বর্জনীয়।
২. ইয়াতিমদের দেখাশুনার গুরুত্ব ও ফযীলত জানতে পারলাম।
৩. সম্পদের প্রতি মানুষের মোহ কত বেশি তাও জানতে পারলাম।
২১-৩০ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতগুলোতে কিয়ামতের ভয়াবহতা ও মানুষ সেদিন আফসোস করে যা বলবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। كَلّاَ অর্থাৎ ইয়াতিমদের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ ও তাদের সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কখনও উচিত নয়। বরং তোমাদের সামনে এমন দিন আগমন করছে যেদিন জমিন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সেদিন তোমাদেরকে সেসব অন্যায় কর্মের বিচারের জন্য মুুখোমুখি হতে হবে। সুতরাং সেদিনকে তোমাদের ভয় করা উচিত।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : مرة بعد مرة অর্থ একের পর এক কম্পন আসা ও সবকিছু সমান করে ফেলা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمٰوٰتُ وَبَرَزُوْا لِلهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ)
“যেদিন এ পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশসমূহও; এবং মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সম্মুখেÑযিনি এক, পরাক্রমশালী।” (সূরা ইবরাহীম ১৪: ৪৮)
(وَّجَا۬ءَ رَبُّكَ….)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ফায়সালা করার জন্য আগমন করবেন এবং প্রত্যেক আকাশের ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে আসবে। আর জাহান্নামকেও ফেরেশতারা শেকলে বেঁধে নিয়ে আসবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: কিয়ামতের দিন জাহান্নামকে নিয়ে আসা হবে। তখন তার সত্তর হাজার লাগাম থাকবে আর প্রত্যেক লাগামে সত্তম হাজার ফেরেশতা থাকবে। তাহলে সর্বমোট ৭০০০০×৭০০০০=৪৯০০০০০০০০ জন ফেরেশতা জাহান্নাম টেনে নিয়ে আসবে। (সহীহ মুসলিম, তিরমিযী হা. ২৫৭৩)
আল্লাহ তা‘আলা বিচার ফায়সালার জন্য আগমন করবেন, তবে কিভাবে আসবেন, তার ধরণ কী হবে? তিনি আসলে আরশ খালি হয়ে যাবে কি-না ইত্যাদি বিষয় তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। কারণ
(لَيْسَ كَمِثْلِه۪ شَيْءٌ ج وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ)
“কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা” (সূরা শুরা ৪২: ১১)
সুতরাং তিনি যেভাবে চান, যখন চান তাঁর মর্যাদার সাথে যেমন উপযোগী সেভাবেই আগমন করেন ও করবেন। যেমন হাদীসে এসেছে, তিনি প্রতি রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে আসেন (সহীহ বুখারী হা. ১১৪৫)। এ বিষয়ে বলা যাবে না যে, আল্লাহ তা‘আলা আসেন না বরং তাঁর নির্দেশ আসে কিম্বা এসব রূপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
(يَوْمَئِذٍ يَّتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ)
অর্থাৎ সেদিন মানুষ দুনিয়াতে তার কৃত ভাল মন্দ আমলের কথা স্মরণ করতে পারবে কিন্তু সে স্মরণ কোন কাজে আসবে না। আফসোস করে বলবে: হায়! যদি জীবনে ভাল আমল করতাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰي يَدَيْهِ يَقُوْلُ يٰلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلًا)
“জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ দু’হাত দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম!” (সূরা ফুরকান ২৫: ২৭)
এ জন্য নাবী (সাঃ) বলেন : পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে গনিমত মনে কর। তার প্রথম হলো মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে। অর্থাৎ মারা যাওয়ার পূর্বে জীবনে আখিরাতের জন্য সৎ আমল করে পাথেয় গ্রহণ করে নাও। (ফাতহুল বারী ১৮ : ২২৪)
(فَیَوْمَئِذٍ لَّا یُعَذِّبُ عَذَابَھ۫ٓ اَحَدٌ)
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অবাধ্যতার শাস্তি আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে দেবেন তার চেয়ে কঠিনভাবে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা আর কারো নেই। দুনিয়ার কোন শাস্তি আখেরাতের শাস্তির তুলনায় কিছুই নয়।
(وَّلَا یُوْثِقُ وَثَاقَھ۫ٓ اَحَدٌ)
অর্থাৎ পাপীদেরকে জাহান্নামের শেকল দ্বারা মজবুত করে বাঁধা হবে এবং মুখের ওপর দিয়ে হেঁচড়িয়ে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে। পক্ষান্তরে যারা মু’মিন তাদেরকে বলা হবে: হে প্রশান্ত আত্মার অধিকারী মু’মিনগণ! তোমরা প্রতিপালকের প্রতিদান ও সুখ সামগ্রীর নিকট ফিরে আস।
(رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ও আল্লাহ তা‘আলা আমলের প্রতিদানস্বরূপ যে সম্মাননার ব্যবস্থা করে রেখেছেন তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে এস এবং আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রতি সন্তুষ্ট। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ط ذٰلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّه۫)
“আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার প্রতিপালককে ভয় করে।” (সূরা বায়্যিনাহ ৯৮: ৮)
(فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ)
অর্থাৎ আমার সৎ বান্দাদের সাথে শামিল হয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর। এ কথা বিচার শেষে বলা হবে। فِيْ عِبَادِيْ ‘আমার বান্দাদের মধ্যে’ অর্থ
في الصالحين من عبادي
আমার নেককার বান্দাদের মধ্যে। (কুরতুবী) যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِي الصّٰلِحِيْنَ)
“যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আমি অবশ্যই তাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করব।” (সূরা আনকাবূত ২৯: ৯) এজন্য বিগত নাবীরা দু‘আ করে বলতেন :
(رَبِّ هَبْ لِيْ حُكْمًا وَّأَلْحِقْنِيْ بِالصّٰلِحِيْن)
‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞান দান কর এবং সৎকর্মপরায়ণদের মধ্যে শামিল কর।’ (সূরা শুআরা ২৬ : ৮৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি তার সাথেই থাকবে যাকে সে দুনিয়াতে ভালবাসতো। (সহীহ বুখারী হা. ৬১৬৯, সহীহ মুসলিম হা. ২৬৪০)
আল্লাহ আমাদেরকে সৎ সঙ্গ বেছে নিয়ে সৎ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আগমন করবেন “আল্লাহ তা‘আলা আগমন করেন” এ গুণটির প্রমাণ পেলাম।
২. জাহান্নাম কত বিশাল তার অনুমান করা যায় টেনে আনার ফেরেশতাদের সংখ্যা দ্বারা।
৩. সেদিন কাফিররা আফসোস করবে কিন্তু আফসোস কোন কাজে আসবে না।
৪. মু’মিনদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যে সম্মান ও মর্যাদার ব্যবস্থা করে রেখেছেন তা জানতে পারলাম।
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সুনানে নাসাঈতে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুআয (রাঃ) নামায পড়াচ্ছিলেন, একটি লোক এসে ঐ নামাযে শামিল হয়। হযরত মুআয (রাঃ) নামাযে কিরআত লম্বা করেন। তখন ঐ আগন্তুক জামাআত ছেড়ে দিয়ে মসজিদের এক কোণে গিয়ে একাকী নামায আদায় করে চলে যায়। হযরত মুআয (রাঃ) এ ঘটনা জেনে ফেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে অভিযোগের আকারে এ ঘটনা বিবৃত করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন ঐ লোকটিকে ডেকে নিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি এছাড়া কি করবো? আমি তার পিছনে নামায শুরু করেছিলাম, আর তিনি শুরু করেছিলেন লম্বা সূরা। তখন আমি জামাআত ছেড়ে দিয়ে মসজিদের এক কোণে একাকী নামায আদায় করে নিয়েছিলাম। অতঃপর মসজিদ হতে বের হয়ে এসে আমার উন্ত্রীকে ভূষি দিয়েছিলাম। তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত মুআয (রাঃ)-কে বলেন যে, হে মুআয (রাঃ)! তুমি তো জনগণকে ফিত্নার মধ্যে নিক্ষেপকারী। তুমি কি (আরবি) এবং (আরবি) এই সূরাগুলো পড়তে পার না?”
১-১৪ নং আয়াতের তাফসীর
এটা সর্বজন বিদিত যে, ফজরের অর্থ হলো সকাল বেলা। হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত সুদ্দীর (রঃ) এটা উক্তি। হযরত মাসরুক (রঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ ইবনে কাব (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা বিশেষভাবে ঈদুল আযহার সকালবেলাকে বুঝানো হয়েছে। আর ওটা হলো দশ রাত্রির সমাপ্তি। কারো কারো মতে এর অর্থ হলো সকাল বেলার নামায। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এর দ্বারা পুরো দিনকেই বুঝানো হয়েছে।
দশ রজনী দ্বারা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে, যেমন এ কথা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবনে যুবায়ের (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং পূর্ব ও পর যুগীয় আরো বহু গুরুজন বলেছেন। সহীহ বুখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে মারফুরূপে বর্ণিত আছেঃ “কোন ইবাদতই এই দশ দিনের ইবাদত হতে উত্তম নয়।” রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আল্লাহর পথে জিহাদও কি নয়?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে হ্যা, যে ব্যক্তি নিজের জান-মাল নিয়ে বেরিয়েছে, তারপর ওগুলোর কিছুই নিয়ে ফিরেনি (তার কথা স্বতন্ত্র)।” কেউ কেউ বলেছেন, যে, এর দ্বারা মুহররমের প্রথম দশদিনকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রমযান মাসের প্রথম দশ দিন। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সঠিকতম। অর্থাৎ যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন।
মুসনাদে আহমদে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ (আরবি) হলো ঈদুল আযহার দিন, (আরবি) হলো আরাফার দিন এবং (আরবি) হলো কুরবানীর দিন।” এ হাদীসের সনদে কোন প্রকার গরমিল নেই। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
(আরবি) হলো আরাফার দিন। এটা যদি নবম তারিখ হয়ে থাকে তাহলে (আরবি)শব্দের অর্থ হবে দশম তারিখ অর্থাৎ ঈদুল আযহার দিন।
হযরত ওয়াসিল ইবনে সায়েব (রঃ) হযরত আতা (রঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ (আরবি) দ্বারা কি বিতরের নামায উদ্দেশ্য?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “না, বরং হলো আরাফার দিন এবং হলো ঈদুল আযহার রাত।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) খুৎবাহ্ দিচ্ছিলেন, এমন সময় একটি লোক দাঁড়িয়ে বললোঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! (আরবি) কি এবং (আরবি) কি?” তিনি জবাবে বললেনঃ “আল্লাহ তা’আলা যে বলেছেনঃ (আরবি) (২:২০৩) এখানে দুই দিন দ্বারা (আরবি) এবং(আরবি) এখানে একদিন দ্বারা কে বুঝানো হয়েছে।” তিনি আরো বলেছেন যে, (১১ই, ১২ই ও ১৩ই যিলহজ্জ) এর মাঝামাঝি দিন হলো (আরবি) এবং (আরবি) হলো শেষ দিন।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এই নামগুলো মুখস্থ করে নিবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি (আল্লাহ) বেতর বা বেজোড় এবং তিনি বেতরকে ভালবাসেন।”
হযরত হাসান বসরী (রঃ) এবং হযরত ইবনে আসলাম (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলো সমস্ত সৃষ্টি জগত। এর মধ্যে (আরবি) রয়েছে এবং (আরবি) রয়েছে। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, (আরবি) হলো ফজরের নামায এবং (আরবি) হলো মাগরিবের নামায। এটাও উল্লিখিত হয়েছে যে, মাখলুক বা সৃষ্টিজগত হলো এবং হলেন আল্লাহ। এ উক্তিও রয়েছে যে, এর অর্থ হলো জোড়া জোড়া এবং হলেন আত্মাহ রাব্দুল আলামীন। যেমন আসমান-জমীন, জল-স্থল, মানুষ-জ্বিন, সূর্য-চন্দ্র ইত্যাদি। কুরআন কারীমে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি সকল জিনিসকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পার।” (৫১:৪৯) অর্থাৎ যেন তোমরা জানতে পার যে, সকল জিনিসের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বল আলামীন, তাঁর কোন শরীক নেই। এটাও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলো জোড় বেজোড়ের গণনা। একটি হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) এর অর্থ হলো দুদিন এবং (আরবি) এর অর্থ হলো তৃতীয় দিন। এক বর্ণনায় রয়েছে যে, এর অর্থ হলো নামায, এতে জোড় রয়েছে, যেমন ফজরের দুই রাকআত এবং যুহর, আসর ও ইশার চার রাকআত। আবার বেজোড়েও রয়েছে যেমন মাগরিবের তিন রাকআত। একটি মারফু হাদীসে শুধু নামায অর্থেও এ শব্দ দুটির ব্যবহারের কথা রয়েছে। কোন কোন সাহাবী বলেছেন যে, এ দুটি শব্দ দ্বারা ফরয নামায উদ্দেশ্য। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ শপথ রাত্রির যখন তা গত হতে থাকে। আবার এ অর্থও করা হয়েছে যে, রাত্রি যখন আসতে থাকে। এটাই অধিক সমীচীন বলে মনে হয়। এ উক্তিটি (আরবি) এর সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। ফজর বলা হয় যখন রাত্রি শেষ হয়ে যায় এবং দিনের আগমন ঘটে ঐ সময়কে। কাজেই এখানে দিনের বিদায় ও রাত্রির আগমন অর্থ হওয়াই যুক্তিসংগত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “শপথ রজনীর যখন ওর আগমন ঘটে এবং অন্ধকার ছড়িয়ে দেয় এবং শপৰ সকালের যখন তা আসে ও আলো ছড়িয়ে দেয়।” (৮১:১৭-১৮)
ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এখানে অর্থ হলো মুযদালিফার রাত্রি। (আরবি) এর অর্থ হহে আকল বা বিবেক। হিজর বলা হয় প্রতিরোধ বা বিরতকরণকে। বিবেক ও ভ্রান্তি, মিথ্যা ও মন্দ থেকে বিরত রাখে বলে ওকে আকল বা বিবেক বলা হয় (আরবি) এ কারণেই বলা হয় যে, কা’বাতুল্লাহর যিয়ারতকারীদেরকে শামী দেয়াল থেকে এই বিরত রাখে। এ থেকেই হিজরে ইয়াম মা শব্দ গৃহীত হয়েছে। এ কারণেই আরবের লোকেরা বলে থাকে।(আরবি) অর্থাৎ শাসনকর্তা অমুককে বিরত রেখেছেন। যখন কোন লোককে বাদশাহ বাড়াবাড়ি করতে বিরত রাখেন তখন আরবরা একথা বলে থাকে।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ নিশ্চয়ই এর মধ্যে শপথ রয়েছে বোধসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে। কোথাও ইবাদত বন্দেগীর শপথ, কোথাও ইবাদতের সময়ের শপথ, যেমন হজ্জ, নামায ইত্যাদি। আল্লাহ তা’আলার পুণ্যবান বান্দারা তাঁর নৈকট্য লাভ করার জন্যে সচেষ্ট থাকে এবং তাঁর সামনে নিজেদের হীনতা প্রকাশ করে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। পুণ্যবান নেককারদের গুণাবলী বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা’আলা তাদের বিনয় ও ইবাদত বন্দেগীর কথা উল্লেখ করেছেন, সাথে সাথে বিদ্রোহী, হঠকারী, পাপী ও দুবৃত্তদেরও বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, হে নবী (সঃ)! তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক স্তম্ভসদৃশ আ’দ জাতির সাথে কি করে ছিলেন? কিভাবে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন? তারা ছিল হঠকারী এবং অহংকারী। তারা আল্লাহর নাফরমানী করতো।, রাসূলকে অবিশ্বাস করতো এবং নিজেদেরকে নানা প্রকারের পাপকর্মে নিমজ্জিত রাখতো। তাদের নিকট আল্লাহর রাসূল হযরত হূদ (আঃ) আগমন করেছিলেন।
এখানে প্রথম আ’দ (আ’দেউলা) এর কথা বলা হয়েছে। তারা আদ ইবনে ইরম ইবনে আউস ইবনে সাম ইবনে নূহের (আঃ) বংশধর ছিল। আল্লাহ তা’আলা তাদের মধ্যকার ঈমানদারদেরকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং বাকি সব বেঈমানকে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ক্রমাগত সাত রাত্র ও আট দিন পর্যন্ত ঐ সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়েছিল। তাতে আ’দ সম্প্রদায়ের সমস্ত কাফির ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাদের একজনও ভয়াবহ শাস্তি হতে রক্ষা পায়নি। মাথা ও দেহ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়ে রয়েছিল। কুরআনের মধ্যে কয়েক জায়গায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সূরা আল হাককাহতেও এর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আর আ’দ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্জা বায়ু দ্বারা; যা তিনি তাদের উপর প্রবাহিত করেছিলেন সপ্তরাত্রি ও অষ্টদিবস বিরামহীনভাবে। তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখতে তারা সেথায় লুটিয়ে পড়ে আছে সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়। অতঃপর তাদের কাউকেও তুমি বিদ্যমান দেখতে পাও কি?” (৬৯:৬-৮) (আরবি) (ইরাম গোত্রের প্রতি-যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের) তাদের অতিরিক্ত পরিচয় প্রদানের জন্যে এটা (আরবি) হয়েছে। তাদেরকে (আরবি) বলার কারণ এ যে, তারা দৃঢ় ও সুউচ্চ স্তম্ভ বিশিষ্ট গৃহে বসবাস করতো। সমসাময়িক যুগের লোকদের তুলনায় তারা ছিল অধিক শক্তিশালী এবং দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। এ কারণেই। হযরত হূদ (আঃ) তাদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অবয়ব অন্য লোক অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়ত তোমরা সফল কাম হবে।” আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আদ সম্প্রদায় অন্যায়ভাবে ভূ-পৃষ্ঠে অহংকার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল এবং বলেছিলঃ আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে। তারা কি দেখে নাই যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী।” (৪১:১৫) আর এখানে আল্লাহ পাক বলেনঃ যার সমতুল্য (প্রাসাদ) কোন দেশে নির্মিত হয়নি। তারা খুবই দীর্ঘ দেহ ও অসাধারণ শক্তির অধিকারী ছিল। সেই যুগে তাদের মত দৈহিক শক্তির অধিকারী আর কেউ ছিল না। ইয়াম ছিল তাদের রাজধানী। তাদেরকে শুভের অধিকারী বলা হতো কারণ তারা ছিল খুবই দীর্ঘ দেহী। তাদের মত অন্য কেউ ছিল না।
হযরত মিকদাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) (আরবি) এর উল্লেখ করে বলেনঃ “তাদের এতো বেশী শক্তি ছিল যে, তাদের কেউ উঠতো এবং একটি (প্রকাণ্ড) পাথর উঠিয়ে অন্য কোন সম্প্রদায়ের উপর নিক্ষেপ করতো। এ পাথরে চাপা পড়ে ঐ সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই মারা যেতে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস ইবনে আইয়ায (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত সাওর ইবনে যায়েদ দাইলী (রঃ) বলেনঃ “আমি একটি পাতায় দেখেছি যে, তাতে লিখিত ছিলঃ “আমি শাদ্দাদ ইবনে আদি, আমি শুম্ভ মজবুত করেছি, আমি হাত মযবুত করেছি, আমি সাথে হাতের একটি ধনভাণ্ডৱ জমা করে রেখেছি। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর উমত এটা বের করবে।” (এটাও ফুলে ইবনে আবি হাতিয়ে বর্ণিত হয়েছে) অথবা এটা বলা যায় যে, তারা উৎকৃষ্ট উচ্চবিশিষ্ট গৃহে বাস করতো। অথবা বলা যায় যে, তারা ছিল উচ্চ স্তম্ভের অধিকারী। অথবা ভায়া ছিল উন্নতমানের অক্সশর মালিক। অথবা তারা দীর্ঘ দেহেয়, অধিকারী ছিল। অর্থাৎ ভাৱ এক কওম বা সম্প্রদায় ছিল যাদের কথা কুরআনে সামূদ সম্প্রদায়ের সাথে বহু জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। এখানেও আদ ও সামূদ উভয় কওমের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
কেউ কেউ বলেছেন যে, (আরবি) হলো একটি শহর, তার নাম হয় তো আমে অথবা আলেকজান্দ্রিয়া। কিন্তু এ উক্তি সঠিক বলে অনুভূত হয় না। কারণ এতে আয়াতের অর্থে সঙ্গতি পরিলক্ষিত হয় না। তাছাড়া এখানে এটা বুঝানো হয়েছে যে, প্রত্যেক হঠকারী বিশ্বাসঘাতককে আত্মাহ তাআলা ধ্বংস করে দিয়েছেন যাদের নাম ছিল আলী, কোন শহরের কথা বুঝানো হয়নি। আমি এ সব কথা এখানে এ কারণেই বর্ণনা করেছি যে, যেন কতিপয় তাফসীরকারের অপব্যাখ্যায় কেউ বিভ্রান্ত না হয়। তাঁরা লিখেছেন যে, ইরুম একটি শহরের নাম যার একটি ইট সোনার ও অন্যটি কপার, এভাবে শহরটি নির্মিত হয়েছে। অ সেই শহরের বাড়ি-ঘর, বাগবাগীচা সবই সোনা-রূপার তৈরি, কংকর হলে মুতা ও জওহর এবং মাটি হলো মিশক। ঝর্ণাসমূহ প্রবাহমান এবং ফল ভারে বৃক্ষগুলো আনত। সেই শহরের বসবাস করার মত কোন মানুষ নেই। ঘর দুয়ার সব শূন্য। হাঁ হুঁ করার মত কেউ নেই। এই শহর স্থানান্তরিত হতে থাকে, কখনো সিরিয়ায়, কখনো ইয়ামনে, কখনো ইরাকে এবং কখনো অন্য কোথাও। এসব অপকাহিনী বানী ইসরাইল বানিয়ে নিয়েছে। তারা এ সব মনগড়া গল্প তৈরি করে মুখদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে থাকে।
সালাবী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মুআবিয়ার (রাঃ) শাসনামলে এক বেদুঈন তার হারানো উট খোঁজ করার উদ্দেশ্যে এক জন-মানব শূন্য জঙ্গলে গিয়ে প্রবেশ করে। ঐ জঙ্গলে সে উপরোল্লিখিত গুণাবলী বিশিষ্ট একটি শহর দেখতে পায়। ঐ শহরে গিয়ে সে ঘোরাফেরা করে। তারপর ফিরে এসে জনগণের নিকট তা বর্ণনা করে। জনগণও তখন সেখানে গমন করে কিন্তু তারা সেখানে কিছুই দেখতে পায়নি।
ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) এখানে এ ধরনের কাহিনী খুব লম্বা চওড়াভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ কাহিনীও সত্য নয়। বেদুঈনের কাহিনীটি যদি সনদের দিক দিয়ে সত্য বলে ধরে নেয়াও হয় তাহলে বলতে হয় যে, বেদুঈন মনে মনে এ কাহিনী কল্পনা করেছিল, ফলে তার দৃষ্টিভ্রম ঘটেছিল। সে ভেবে বসেছিল যে, সে যা দেখেছে তা সেই কল্পিত শহর। প্রকৃতপক্ষে সে কিছুই দেখতে পায়নি।
অনুরূপভাবে যে সব মূর্ণ এবং কল্পনাবিশ্বাসী মনে করে যে, কোন বিশেষ স্থানে মাটির তলায় সোনা কৃপা লুকানো রয়েছে, হীরাজহরত ও মণিমাণিক্য রয়েছে, কিন্তু সেখানে পৌছতে পারে না। যেমন বলা হয়ঃ ধন-ভাণ্ডারের মুখে বড় অজগর বসে আছে অথবা তার উপর জ্বিনের পাহারা রয়েছে। এ ধরনের বাজে ও ভিত্তিহীন কাহিনী বর্ণনা করে থাকে। কখনো ধ্যানে বসে, কখনো বা রোগ-ব্যাধির মুক্তির উপায় আছে বলে জানায়। এসব আইয়ামে জাহেলিয়াতের বা প্রাচীন যাণ পর প্রখত কোন ধন সম্পদ ঘটনাক্রমে কেউ পেতে পেতে পারে, সেখানে দেও, জ্বি, ভূত প্রেত বা সাপ বিন্দু ইত্যাদির আশংকা সম্পূর্ণ অমূলক। এসৰ অপকাহিনী ফন্দিবাজরা প্রচার করে বেড়ায়। আল্লাহ এদের সুবুদ্ধি দান করুন!
ইমাম ইবনে জাৱীর (রঃ) বলেছেন যে, সম্ভবতঃ এখানে সম্প্রদায় বুঝানো হয়েছে অথবা হয়তো শহর বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা সঠিক নয়। এখানে তো সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এটা একটা কওমের বর্ণনা। এটা কোন শহরের বর্ণনা নয়। এ কারণেই আদ সম্প্রদায়ের বর্ণনার পরেই সামূদ সম্প্রদায়ের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সামূদ সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করতো। যেমন আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা পাহাড় কেটে প্রশস্ত ও আরামদায়ক বাসগৃহ নির্মাণ করছে।” (২৬:১৪৯)
ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, সামুদরা ছিল আরবের অধিবাসী। তারা ফুরা নামক স্থানে বসবাস করতো। আদদের কাহিনী সূরা আ’রাফে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আর (তুমি কি দেখোনি যে, তোমার প্রতিপালক কি করেছিলেন) কীলক ওয়ালা ফিরাউনের সঙ্গে? (আরবি) এর অর্থ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কাহিনী বা দল বলে উল্লেখ করেছেন যারা ফিরাউনের কার্যাবলী সুদৃঢ় করতো। এমনও বর্ণিত আছে যে, ফিরাউনের ক্রোধের সময় তারা লোকদের হাতে পায়ে পেরেক পুঁতে মেরে ফেলতো। উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে মাথার মগজ বের করে ফেলতো, তারপর মেরে ফেলা হতো। কেউ কেউ বলেন যে রশি এবং পেরেক নিয়ে তার সামনে খেলা করা হতো। এর একটি কারণ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, তার স্ত্রী (হযরত আছিয়া (রাঃ) মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে পিঠের ভরে শুইয়ে দিয়ে হাতে পায়ে পেরেক মেরে দেয়া হয়েছিল। তারপর পেটের উপর প্রকাণ্ড পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আল্লাহ তা’আলা ঐ পুণ্যবতী মহিলার প্রতি অনুগ্রহ করুন!
মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা দেশে সীমালংঘন করেছিল। অর্থাৎ যারা নগরসমূহে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার পরে অধিক মাত্রায় উপদ্রব করেছিল। যারা মানুষকে খুবই নিকৃষ্ট মনে করতো এবং নানাভাবে অত্যাচার উৎপীড়ন করতো। ফলে আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি শাস্তির বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন। তাই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! অতঃপর তোমার প্রতিপালক তাদের উপর শাস্তির কষাঘাত হানলেন। অর্থাৎ তাদের প্রতি অবশেষে এমন শাস্তি এসেছে যে, তা টলানো যায়নি। ফলে তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি প্রত্যেককে ভাল মন্দের বিনিময় প্রদান করবেন। সমস্ত মানুষ অবশ্যই তাঁর কাছে ফিরে যাবে এবং সবাই এককভাবে বিচারের জন্য দাঁড়াবে। ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা সবারই প্রতি সুবিচার করবেন। তিনি সর্বপ্রকার অত্যাচার হতে মুক্ত ও পবিত্র। এখানে ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ওটা খুবই গরীব বা দুর্বল হাদীস। ওর সনদের ব্যাপারে বক্তব্য রয়েছে এবং ওর সঠিকতার ক্ষেত্রেও চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। ঐ হাদীসটি হযরত মুআয (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে মুআয (রাঃ)। (জেনে রেখো যে,) মুমিন ব্যক্তি হকের নিকট বন্দী। হে মুআয! পুলসিরাত পার না হওয়া পর্যন্ত মুমিন ভয় ও উদ্বেগ হতে নিরাপত্তা লাভ করবে না। হে মুআয (রাঃ)! কুরআন মুমিনকে তার অনেক ইচ্ছা হতে বিরত রাখে।, যাতে সে ধ্বংস হতে রক্ষা পেতে পারে। কুরআন তার দলীল, ভয়ভীতি তার হুজ্জত, আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ তার বাহন, নামায তার আশ্রয়, রোযা তার ঢাল, সাদকা তার ছাড়পত্র, সততা তার আমীর এবং লজ্জা তার উযীর। এ সবের পরেও তার প্রতিপালক তার সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। তিনি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন।” (এ হাদীসটি দু’জন বর্ণনাকারী ইউনুস হিযা, ও আবু হামযাহ অজ্ঞাত। এটা মুরসাল হাদীস। সম্ভবতঃ এটা আবূ হামযাহর উক্তি হবে)
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমেরই অন্য একটি বর্ণনা রয়েছে যে, হযরত ইবনে আবদিল কালাঈ (রঃ) তাঁর একভাষণে বলেনঃ হে জনমণ্ডলী! জাহান্নামের সাতটি পুল রয়েছে। প্রত্যেকটির উপর সিরাত বা পথ রয়েছে। প্রথম পুলসিরাতের উপরই মানুষকে আটক করে দেয়া হবে। সেখানে আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদেরকে বলবেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ তাদেরকে থামাও, কারণ তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।” অতঃপর তাদের কাছে নামাযের হিসাব নেয়া হবে। তারপর যারা মুক্তি পাবার তারা মুক্তি পাবে এবং যারা ধ্বংস হবার তারা ধ্বংস হবে। এরপর যখন তারা দ্বিতীয় পুলসিরাতে পৌঁছবে তখন তাদের কাছে আমানতের হিসাব নেয়া হবে যে, কিভাবে তা আদায় করেছিল এবং কিভাবে খিয়ানত করেছিল। সুতরাং এখানেও যারা মুক্তি পাওয়ার তারা মুক্তি পাবে এবং যারা ধ্বংস হওয়ার তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর যখন তারা তৃতীয় পুলসিরাতে পৌছবে তখন তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে আত্মীয়তার সম্পর্ক সম্বন্ধে যে, কিভাবে তারা তা মিলিত রেখেছে এবং কিভাবে ছিন্ন করেছে। এখানেও যারা পরিত্রাণ লাভ করার তারা পরিত্রাণ লাভ করবে এবং যারা ধ্বংস হওয়ার তারা ধ্বংস হবে। এই আত্মীয়তা সেই দিন স্বয়ং অবয়ব ধারণ করে বলবেঃ “হে আল্লাহ! যে আমার সাথে সম্পর্ক মিলিত রেখেছে তার সাথে আপনিও সম্পর্ক মিলিত রাখুন এবং যে আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আপনিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন!” আল্লাহ তা’আলার এরশাদ করেন (আরবি) এর ভাবার্থ এটাই।”
১৫-২০ নং আয়াতের তাফসীর
ভাবার্থ হচ্ছেঃ যে সব লোকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং প্রশস্ততা পেয়ে মনে করে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্মান করেছেন, তারা ভুল মনে করে। বরং এটা তাদের প্রতি একটা পরীক্ষা বৈ কিছু নয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি যে তাদের ধন-মাল ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করছি, এতে কি তারা ধারণা করছে যে, আমি তাদের কল্যাণ সাধন করছি? (না, তা কখনও নয়) বরং তারা বুঝে না।” (২৩:৫৫-৫৬) এটা তাদের জন্যে তাদের প্রতিপালকের দেয়া সম্মান, কল্যাণ ও পুরস্কার নয়। বরং এটা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদের উপর একটা পরীক্ষা।
আবার যখন তাদেরকে তাদের প্রতিপালক পরীক্ষা করেন এবং তাদের রিক সংকুচিত করে দেন তখন তারা বলেঃ আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে হীন করেছেন। অথচ এসব আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাদের উপর পরীক্ষা ছাড়া কিছুই নয়। এ কারণেই (আরবি) দ্বারা উপরোক্ত উভয় ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে। এটা প্রকৃত ব্যাপার নয় যে, আল্লাহ যার মাল ধনে প্রশস্ততা দান করেছেন তার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং যার ধন সম্পদ সংকুচিত করে দিয়েছেন তার প্রতি তিনি অসন্তুষ্ট। বরং এই উভয় অবস্থায় স্বীয় চরিত্র ঠিক রেখে কাজ করে যাওয়াই তার সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র উপায়। ধনী হয়ে আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং দরিদ্র হয়ে ধৈর্য ধারণ করাই বরং আল্লাহর প্রেমিকের পরিচয়। আল্লাহ তা’আলা উভয় প্রকারেই তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে থাকেন।
অতঃপর ইয়াতীমদেরকে সম্মান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন হাদীস শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “যে ঘরে ইয়াতীম রয়েছে এবং তাকে উত্তমরূপে প্রতিপালন করা হচ্ছে সেই ঘর সবচেয়ে উত্তম ঘর। আর যে ঘরে ইয়াতীম রয়েছে এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে সেই ঘর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘর।” অতঃপর নবী করীম (সঃ) স্বীয় আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে বললেনঃ “আমি এবং ইয়াতীমের লালন পালনকারী এই ভাবে জান্নাতে অবস্থান করবো।” সুনানে আবি দাউদে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি এবং ইয়াতীমদের লালন পালনকারী এভাবে জান্নাতে থাকবো। ঐ সময় তিনি তাঁর শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলিকে মিলিত করে ইশারা করলেন।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান ও আদর যত্ন কর না এবং অভাব গ্রস্তদেরকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না এবং তোমরা উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে ভক্ষণ করে থাকো আর তোমরা ধন-দৌলতের প্রতি অতিমাত্রায় ভালবাসা রাখ (কিন্তু এটা মোটেই উচিত নয়)।
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
২১-৩০ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলছেনঃ নিশ্চয়ই সেদিন জমীনকে নিচু করে দেয়া হবে, উচু নিচু জমীন সব সমান করে দেয়া হবে। সমগ্র জমীন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হবে। পাহাড় পবর্তকে মাটির সাথে সমতল করে দেয়া হবে। সকল সৃষ্ট জীব কবর থেকে বেরিয়ে আসবে। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি জগতের বিচারের জন্যে এগিয়ে আসবেন। সকল আদম সন্তানের নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে সুপারিশের জন্যে অনুরোধ করা হবে। অবশ্য এর পূর্বে সমস্ত মাখলুক বড় বড় নবীদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে সুপারিশের আবেদন জানাবে। কিন্তু তারা নিজেদের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করবেন। তারপর তারা মহানবী (সঃ)-এর কাছে এসে সুপারিশের আবেদন জানাবেন। তিনি বলবেনঃ হ্যা, আমি এ জন্যে প্রস্তুত।” নবী করীম (সঃ) তখন আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন। তিনি বলবেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্যে আসুন।” এটাই প্রথম সুপারিশ। এ আবেদন মাকামে মাহমুদ হতে জানানো হবে। অতঃপর আল্লাহ রাব্বল ইযযত ফায়সালার জন্যে এগিয়ে আসবেন। তিনি কিভাবে আসবেন সেটা তিনিই ভাল জানেন। ফেরেশতারাও তাঁর সামনে কাতারবন্দী হয়ে হাযির হবেন। জাহান্নামকেও নিয়ে আসা হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সেদিন জাহান্নামের সত্তর হাজার লাগাম থাকবে এবং প্রত্যেক লাগামে সত্তর হাজার ফেরেশতা থাকবে। তারা জাহান্নামকে টেনে নিয়ে আসবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে এটা ইমাম তিরমিযীও (রঃ) আবদুল্লাহ ইবনে আবদির রহমান দারিমী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন) সেদিন মানুষ তার নতুন পুরাতন সকল আমল বা কার্যাবলী স্মরণ করতে থাকবে। মন্দ আমলের জন্যে অনুশোচনা করবে, ভালো কাজ না করা বা কম করার কারণে দুঃখ আফসোস করবে। পাপ কর্মের জন্যে লজ্জিত হবে।
হযরত মুহাম্মদ ইবনে উমরাহ (রাঃ) নামক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একজন সাহাবী হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ কোন বান্দা যদি জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকে এবং অল্লাহ তা’আলার পূর্ণ আনুগত্যে সারা জীবন কাটিয়ে দেয় তবুও সে কিয়ামতের দিন তার সকল পুণ্যকে তুচ্ছ ও সামান্য মনে করবে। তার একান্ত ইচ্ছা হবে যে, যদি সে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আরো অনেক পুণ্য সঞ্চয় করতে পারতো।’
এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সেইদিন আল্লাহর দেয়া আযাবের মত আযাব আর কেউ দিতে পারবে না। তিনি তার অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে যে ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করবেন ঐরূপ শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই এবং তার বন্ধনের মত বন্ধনও কেউ করতে পারে না। ফেরেশতারা আল্লাহর অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে নিকৃষ্ট ধরনের শিকল এবং বেড়ী পরিধান করাবেন।
পাপী ও অন্যায়কারীদের পরিণাম বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা’আলা এখন পুণ্যবানদের অবস্থা ও পরিণাম বর্ণনা করছেন। যে সব রূহ তৃপ্ত, শান্ত, পাক পবিত্র এবং সত্যের সহচর, মৃত্যুর সময়ে এবং কবর হতে উঠার সময় তাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে, তার পুণ্য ও পারিশ্রমিকের কাছে, জান্নাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে ফিরে চলো। এই রূহ আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও এর প্রতি সন্তুষ্ট। এই রূহকে এতো দেয়া হবে যে, সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। তাকে বলা হবেঃ তুমি আমার বিশিষ্ট বান্দাদের মধ্যে শামিল হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ আয়াত হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-এর শানে নাযিল হয়। হযরত বুরাইদাহ্ ইবনে হাসীব (রঃ) বলেন যে, এ আয়াত হযরত হামযাহ্ ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাঃ)-এর শানে অবতীর্ণ হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন প্রশান্ত চিত্ত আত্মাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের সাথী অর্থাৎ দেহের নিকট ফিরে যাও যে দেহ পৃথিবীতে তোমরা ধারণ করেছিলে। তোমরা একে অন্যের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত(আরবি) আছে যে, তিনি এই ভাবে পাঠ করতেন। অর্থাৎ “হে প্রশান্ত চিত্ত রুহ্! তুমি আমার বান্দার মধ্যে অর্থাৎ তার দেহে চলে যাও।” ইকরামা (রাঃ) এবং সাকাবী (রঃ)-ও এ কথাই বলেছেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও এটাই পছন্দ করেছেন। কিন্তু এ উক্তিটি গারীব বা দুর্বল। প্রথম উক্তিটিই প্রকাশমান। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “অতঃপর সকলকেই তাদের প্রকৃত প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে।” (৬:৬২) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবি) অথাৎ “আমাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর নিকট।” (৪০:৪৩) অর্থাৎ তাঁর আদেশের প্রতি এবং তাঁরই সামনে।
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (আরবি) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি তখন বলে ওঠেনঃ “হে আল্লাহ্র রাসূল (সঃ)! কি সুন্দর বাণী এটা।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “(হে আবু বকর (রাঃ)!) তোমাকেও এ কথাই বলা হবে।” অন্য এক রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সামনে হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) এ আয়াত পাঠ করেছিলেন। তখন হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেছিলেন! “কী চমক্কার বাণী!” তখন নবী করীম (সঃ) তাঁকে বলেছিলেন, “হে আবূবকর (রাঃ)!) তোমাকে তোমার মৃত্যুর সময় ফেরেশতা এ কথাই বলবেন।”
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তায়েফে মৃত্যুবরণ করেন। ঐ সময় এমন এক পাখি এলো যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায় নাই। পাখিটি এসে তাঁর মৃতদেহের মধ্যে প্রবেশ করলো। এর পরে পাখিটিকে আর বের হতে দেখা যায় নাই। তাঁকে দাফন করা হলে তাঁর কবরের এক কোণ হতে (আরবি) এ আয়াতগুলির তিলাওয়াত শোনা গেল। কিন্তু কে তিলাওয়াত করেছেন তা জানা যায় নি। (এটা ইমাম ইবনু আবী হাতিম (রঃ) ও ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আবুহাশিম (রঃ) বলেনঃ রোম যুদ্ধে আমরা রোম রাজ্যে বন্দি হই। রোমক সম্রাট আমাদেরকে তার সামনে হাযির করে বলেঃ “তোমরা তোমাদের ধর্মমত পরিত্যাগ কর অথবা মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও।” তারপর একে একে প্রত্যেককে বলা হলোঃ “তোমরা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে আমাদের ধর্ম গ্রহণ কর, অন্যথায় আমি জল্লাদকে আদেশ দিচ্ছি, সে এক্ষুণি তোমাদের দেহ দ্বিখন্ডিত করে দিবে।” তিন জন মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়, কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তি স্বধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর দেহ হতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তারপর ঐ মস্তক এক পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। মস্তক পানিতে ডুবে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ভেসে উঠে ধর্মত্যাগকারী তিন ব্যক্তির প্রতি তাকিয়ে তাদের নাম ধরে ধরে ডেকে বললোঃ শোনো, আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ (আরবি)
এতোটুকু বলার পরেই ঐ ছিন্ন মস্তক পুনরায় পানিতে ডুবে গেল। স্বয়ং বাদশাহ্ এবং তার সভাষদবর্গ এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো। খ্রিষ্টানদের উপর এ ঘটনাটি এতো প্রভাব বিস্তার করলো যে, তারা তখনই মুসলমান হয়ে যেতে চাচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ্ দরবারের সমাপ্তি ঘোষণা করলো। ধর্মত্যাগকারী ঐ তিন ব্যক্তি পুনরায় স্বধর্মে ফিরে আসলো। আমরা সবাই তখন থেকে বন্দী জীবন যাপন করছিলাম। অবশেষে খলিফা আবুজা’ফর মনসূরের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে মুক্তিপণ প্রেরণ করা হয়। ফলে আমরা মুক্তি লাভ করি।
হযরত আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে নিম্নের দুআটি পাঠ করতে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এমন নর্স চাচ্ছি যা আপনার সত্তার প্রতি পরিতৃপ্ত থাকে, আপনার সাথে সাক্ষাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, আপনার ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং আপনার দানে তুষ্ট থাকে।” (এ হাদীসটি হাফিয ইবনু আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)।