Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২০৪/হে মানুষ:-১৪) [#ভালোমন্দ যাচাইয়ের সক্ষমতা:- # অহংকারী জাতির পরিণতি :-] www.motaher21.net সুরা: ৯১ : আস্ – শামস পারা:৩০ ১-১৫ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- #তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- #তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৪/হে মানুষ:-১৪)
[#ভালোমন্দ যাচাইয়ের সক্ষমতা:-
# অহংকারী জাতির পরিণতি :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯১ : আস্ – শামস
পারা:৩০
১-১৫ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আশ-শামস

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৯১

(৯১-শামস) : নামকরণ:

সূরার প্রথম শব্দ আশ শামসকে ( اَ لشَّمْسِ ) এর নাম গণ্য করা হয়েছে।
(৯১-শামস) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী থেকে জানা যায়, এ সূরাটিও মক্কা মু’আযযমায় প্রথম যুগে নাযিল হয়। কিন্তু এটি এমন সময় নাযিল হয় যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা তুংগে উঠেছিল।

(৯১-শামস) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে, সৎ ও অসৎ নেকী ও গোনাহর পার্থক্য বুঝানো এবং যারা এই পার্থক্য বুঝতে অস্বীকার করে আর গোনাহর পথে চলার ওপরই জোর দেয় তাদেরকে খারাপ পরিণতির ভয় দেখানো।

মূল বক্তব্যের দিক দিয়ে সূরাটি দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগটি শুরু হয়েছে সূরার সূচনা থেকে এবং ১০ আয়াতে গিয়ে শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগটি ১১ আয়াত থেকে শুরু হয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। প্রথম অংশে তিনটি কথা বুঝানো হয়েছে। এক, সূর্য ও চন্দ্র, দিন ও রাত, পৃথিবী ও আকাশ যেমন পরস্পর থেকে ভিন্ন এবং প্রভাব ও ফলাফলের দিক দিয়ে পরস্পর বিরোধী, ঠিক তেমনি সৎ ও অসৎ এবং নেকী ও গোনাহও পরস্পর ভিন্ন এবং প্রভাব ও ফলাফলও এক হতে পারে না। দুই, মহান আল্লাহ মানবাত্মাকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি শক্তি দিয়ে দুনিয়ায় একেবারে চেতনাহীনভাবে ছেড়ে দেননি বরং একটি প্রাকৃতিক চেতনার মাধমে তার অবচেতন মনে নেকী ও গোনাহর পার্থক্য, ভালো ও মন্দের প্রভেদ এবং ভালোর ভালো হওয়া ও মন্দের মন্দ হওয়ার বোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিন, মানুষের মধ্যে পার্থক্য বোধ, সংকল্প ও সিদ্ধান্ত গ্রহনের যে শক্তিসমূহ আল্লাহ রেখে দিয়েছেন, সেগুলো ব্যবহার করে সে নিজের প্রবৃত্তির ভালো ও মন্দ প্রবণতাগুলোর মধ্য থেকে কাউকে উদ্দীপিত করে আবার কাউকে দাবিয়ে দেয়। এরই ওপর তার ভবিষ্যত নির্ভর করে। যদি সে সৎ প্রবণতাগুলোকে উদ্দীপিত করে এবং অসৎ প্রবণতাসমূহ থেকে নিজের নফসকে পবিত্র করে তাহলে সে সাফল্য লাভ করবে। বিপরীত পক্ষে যদি সে নফসের সৎপ্রবণতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতে থাকে এবং অসৎ প্রবণতাকে উদ্দীপিত করতে থাকে তাহলে সে ব্যর্থ হবে।

দ্বিতীয় অংশে সামূদ জাতির ঐতিহাসিক নজীর পেশ করে রিসালাতের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে।‌ ভালো ও মন্দের যে চেতনালব্ধ জ্ঞান আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিতে রেখে দিয়েছেন তা মানুষের সঠিক পথের সন্ধান লাভ করার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং তাকে পুরোপুরি না বুঝার কারণে মানুষ ভালো ও মন্দের বিভ্রান্তিকর দর্শন ও মানদণ্ড নির্ণয় করে পথভ্রষ্ট হতে থেকেছে। তাই মহান আল্লাহ এই প্রকৃতিগত চেতনাকে সাহায্য করার জন্য আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামদের ওপর সুস্পষ্ট এ দ্ব্যর্থহীন অহী নাযিল করেছেন। এর ফলে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে লোকদেরকে নেকী ও গোনাহ কি তা জানাতে পারবেন। এই উদ্দেশ্যেই আল্লাহ দুনিয়ায় নবী ও রসূল পাঠিয়েছেন। এই ধরনেরই একজন নবী ছিলেন হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম। তাঁকে সামূদ জাতির কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সামূদরা তাদের প্রবৃত্তির অসৎপ্রবণতার মধ্যে ডুবে গিয়ে বড় বেশী হুকুম অমান্য করার ভূমিকা অবলম্বন করেছিল। যার ফরে তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করলো। তাদের মু’জিযা দেখাবার দাবি অনুযায়ী তিনি তাদের সামনে একটি উটনী পেশ করলেন। তাঁর সাবধান বাণী সত্ত্বেও এই জাতীয় সবচেয়ে দুশ্চরিত্র ব্যক্তিটি সমগ্র জাতির ইচ্ছা ও দাবি অনুযায়ী উটনীটিকে হত্যা করলো। এর ফলে শেষ পর্যন্ত সমগ্র জাতি ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেলো।

সামূদ জাতির এ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সমগ্র সূরার কোথাও একথা বলা হয়নি যে, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! যদি তোমরা সামূদদের মতো তোমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রত্যাখ্যান করো তাহলে তোমরাও সামূদের মতো একই পরিণামের সম্মুখীন হবে। সালেহ আলাইহিস সালামের মোকাবেলায় সামূদ জাতির দুশ্চরিত্র লোকেরা যে অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছিল মক্কায় সে সময় সেই একই অবস্থা বিরাজ করছিল। তাই এ অবস্থায় এই কাহিনী শুনিয়ে দেয়াটা আসলে সামূদদের এই ঐতিহাসিক নজীর কিভাবে মক্কাবসীদের সাথে খাপ খেয়ে যাচ্ছে, তা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই ছোট্ট সূরার মধ্যে একটিমাত্র আলোচ্য বিষয়, একটি মাত্র সুরের ঝংকার রয়েছে৷ তবে বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্য থেকে বেশ কয়েকটি সুন্দর ছবি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভংগিতে সূরাটির শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে। অন্য যে সব বিষয়ের আলোচনা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে মানব-সৃষ্টির রহস্য ও তার প্রকৃতিগত শক্তিনিচয়, তার ঝোঁক প্রবণতা, তার পছন্দ ও ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে তার নিজস্ব দায়িত্ব কর্তব্য । আবার এ সকল বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রাকৃতিক সকল জিনিসের সাথে এগুলোর যোগাযোগ সম্পর্কে এক বিশদ আলোচনা সূরাটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এরপর আলোচনা এসেছে সামুদ জাতির ইতিহাস নিয়ে । কিভাবে তারা তাদের রাসূলকে মিথ্যাবাদী সাজালো, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত উটনীকে কিভাবে পা কেটে দিয়ে হত্যা করলো, তার পরিণতিতে কিভাবে তাদের ওপর ধ্বংস ও সামগ্রিক অধপতন নেমে এলো । এগুলো সবই ছিলো সে হতভাগাদের ব্যর্থতা ও ধ্বংসের উদাহরণ, যারা পাপাচারী তাদের পাপ কাজ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা কিছু ঢিল দেন, যার কারণে বহু পাপ কাজে তারা লিপ্ত হয়ে যায়! আল্লাহ্‌র ভয়-ভীতিকে তারা শিকেয় তুলে রাখে, যেমন এই সূরার প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই সাফল্য লাভ করলো সে, যে নিজেকে পবিত্র রেখেছে এবং ব্যর্থ হলো সে, যে তার নফসকে কলুষিত করেছে ।’ ‘কসম সূর্যের এবং এর উজ্জ্বল আলোর ৷ কসম চাদের যখন তা এর পেছনে পেছনে আসে । কসম দিনের, যখন সে (দিনের) উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যায়! রাতের কসম, যখন রাত তাকে (সূর্যকে) ঢেকে ফেলে, আকাশের কসম এবং তারও কসম, যিনি তাকে বানিয়েছেন । কসম পৃথিবীর এবং তার যিনি তাকে বিছিয়ে দিয়েছেন। কসম প্রাণের এবং তার, যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। তারপর তার মধ্যে দান করেছেন ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যবোধ, সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র রেখেছে এবং ব্যর্থ মনোরথ হলো সে, যে তার নফসকে কলুষিত করেছে।’

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,

وَ الشَّمْسِ وَ ضُحٰىهَا۪ۙ

সূর্যের ও তার রোদের কসম।১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) মূলে দুহা (ضُحَى) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। দুহা মানে সূর্যের আলো ও তাপ দু’টোই। আরবী ভাষায় এর পরিচিত মানে হচ্ছে চাশতের সময়, যখন সূর্য উদয়ের পরে যথেষ্ট উপরে উঠে যায় কিন্তু উপরে ওঠার পরে কোন আলোই বেড়ে যায় না, তাপও বিকীরণ করতে থাকে। তাই ‘দুহা’ শব্দটি যখন সূর্যের সাথে সম্পর্কিত হয়, তখন তার আলো বা তার বদৌলতে যে দিনের উদয় হয় তা থেকে তার পুরোপুরি অর্থ প্রকাশ হয় না। বরং এর তুলনায় রোদ শব্দটি তার সঠিক ও পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-2

وَ الْقَمَرِ اِذَا تَلٰىهَا۪ۙ

চাঁদের কসম যখন তা সূর্যের পেছনে পেছনে আসে।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-3

وَ النَّهَارِ اِذَا جَلّٰىهَا۪ۙ

দিনের কসম যখন তা (সূর্যকে) প্রকাশ করে।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-4
টিকা নং:2,

وَ الَّیْلِ اِذَا یَغْشٰىهَا۪ۙ

রাতের কসম যখন তা (সূর্যকে) ঢেকে নেয়।২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২) রাতের আগমনে সূর্য লুকিয়ে যায়। সারা রাত তার আলো দেখা যায় না। এই অবস্থাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ রাত সূর্যকে ঢেকে নেয়। কারণ সূর্যের দিগন্ত রেখার নীচে নেমে যাওয়াকেই রাত বলে। এর ফলে পৃথিবীর যে অংশে রাত নামে সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-5
টিকা নং:3,

وَ السَّمَآءِ وَ مَا بَنٰىهَا۪ۙ

আকাশের ও সেই সত্তার কসম যিনি তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৩) ছাদের মতো পৃথিবীর বুকে তাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতে এবং এর পরের দু’টি আয়াতে ‘মা ’ (مَا ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ মা-বাহানা (مَا بَنهَا ) মা-তাহাহা(ما طحا ما ) ও মা-সাওওয়াহা ( ماسواها )। মুফাসসিরগণের একটি দল এই ‘মা’ শব্দটিকে ধাতুগত অর্থে ব্যবহার করেছেন। তারা এই আয়াতগুলো অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আকাশ ও তাকে প্রতিষ্ঠিত করার কসম, পৃথিবী ও তাকে বিছিয়ে দেবার কসম এবং মানুষের নফসের ও তাকে ঠিকভাবে গঠন করার কসম। কিন্তু এ অর্থ ঠিক নয়। কারণ এই তিনটি বাক্যের পরে নিম্নোক্ত বাক্যটি আনা হয়েছেঃ “তারপর তার পাপ ও তার তাকওয়া তার প্রতি ইলহাম করেছেন।” আর এই বাক্যটি আগের বাক্য তিনটির সাথে খাপ খায় না। অন্য মুফাসসিরগণ এখানে ‘ মা ’ ( ما ) কে মান (من ) বা ‘ আললাযী’ (الذين ) এর অর্থে ব্যবহার করেছেন। ফলে তারা এই বাক্যগুলোর অর্থ করেছেনঃ যিনি আকাশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যিনি পৃথিবীকে বিছিয়েছেন এবং যিনি মানুষের নফসকে ঠিকভাবে গঠন করেছেন। আমার মতে এই দ্বিতীয় অর্থটিই সঠিক। এর বিরুদ্ধে এ আপত্তি ওঠানো ঠিক হতে পারে না যে, আরবী ভাষায় ‘মা’ শব্দ প্রাণহীন বস্তু ও বুদ্ধিহীন জীবের জন্য ব্যবহার করা হয়। কারণ খোদ কুরআনেই ‘মা’ কে ‘মান’ অর্থে বহু জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ولَآاَنْتُمْ عبدُوْنَ مَااَعْبُدُ (আর না তোমরা তার ইবাদাত করো যার ইবাদাত আমি করি)। فَانْكِحُوْامَاطَابَ لَكُمْ مِّنَ ا لنِّسَاءِ (কাজেই মেয়েদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ করো বিয়ে করে নাও)। وَلاَتَنكحُوْامَانَكَعَ ابَاوأُكُمْ مِّنَ النِّسَاءِ (আর যেসব মেয়েকে তোমাদের বাপেরা বিয়ে করেছে তাদেরকে বিয়ে করো না)।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-6

وَ الْاَرْضِ وَ مَا طَحٰىهَا۪ۙ

পৃথিবীর ও সেই সত্তার কসম যিনি তাকে বিছিয়েছেন।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-7
টিকা নং:4,

وَ نَفْسٍ وَّ مَا سَوّٰىهَا۪ۙ

মানুষের নফসের ও সেই সত্তার কসম যিনি তাকে ঠিকভাবে গঠন করেছেন।৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) ‘ঠিকভাবে গঠন করেছেন ’ মানে হচ্ছে, তাকে এমন একটি দেহ দান করেছেন, যা তার সুডৌল গঠনাকৃতি, হাত-পা ও মস্তিস্ক সংযোজনের দিক থেকে মানবিক জীবন যাপন করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ছিল। তাকে দেখার, শুনার, স্পর্শ করার, স্বাদ গ্রহণ করার ও ঘ্রাণ নেবার জন্য এমন ইন্দ্রিয় দান করেছেন যা তার বৈশিষ্ট্য ও আনুপাতিক কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে তার জন্য জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারতো। তাকে চিন্তা ও বুদ্ধি শক্তি, যুক্তি উপস্থাপন ও প্রমাণ পেশ করার শক্তি, কল্পনা শক্তি, স্মৃতিশক্তি, পার্থক্য করার শক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার শক্তি, সংকল্প শক্তি এবং এমন অনেক মানসিক শক্তি দান করেছেন যার ফলে সে এই দুনিয়ায় মানুষের মতো কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এছাড়া “ঠিকভাবে গঠন করার” মধ্যে এ অর্থও রয়েছে যে, তাকে জন্মগত পাপী ও প্রকৃতিগত বদমায়েশ হিসেবে তৈরি না করে বরং সহজ-সরল প্রকৃতির ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন। তার গঠনাকৃতিতে এমন ধরনের কোন বক্রতা রেখে দেননি যা তাকে সোজাপথ অবলম্বন করতে চাইলেও করতে দিতো না। এ কথাটিকেই সূরা রূমে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ فِطْرَتَ اللّهِ الَّتِىْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا “সেই প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও যার ওপর আল্লাহ‌ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (২০ আয়াত) নবী ﷺ এ কথাটিকেই একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ এমন কোন শিশু নেই যে প্রকৃতি ছাড়া অন্য কিছুর ওপর পয়দা হয়। তারপর মা-বাপ তাকে ইহুদি, খৃস্টান বা অগ্নি উপাসক বানায়। এটা তেমনি যেমন পশুর পেট থেকে সুস্থ, সবল ও পূর্ণ অবয়ব বিশিষ্ট বাচ্চা পয়দা হয়। তোমরা কি তাদের কাউকে কানকাটা পেয়েছো? (বুখারী ও মুসলিম) অর্থাৎ পরবর্তী কালে মুশরিকরা তাদের জাহেলী কুসংস্কারের কারণে পশুদের কান কেটে দেয়। নয়তো আল্লাহ‌ কোন পশুকে তার মায়ের পেট থেকে কানকাটা অবস্থায় পয়দা করেননি। অন্য একটি হাদীসে নবী ﷺ বলেনঃ “আমার রব বলেন, আমার সকল বান্দাকে আমি হানীফ (সঠিক প্রকৃতির উপর) সৃষ্টি করেছিলাম। তারপর শয়তানরা এসে তাদেরকে তাদের দ্বীন (অর্থাৎ তাদের প্রাকৃতিক দ্বীন) থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং তাদের ওপর এমন সব জিনিস হারাম করে দিয়েছে যা আমি তাদের জন্য হালাল করে দিয়েছিলাম। শয়তানরা আমার সাথে তাদেরকে শরীক করার জন্য তাদেরকে হুকুম দিয়েছে, অথচ আমার সাথে তাদের শরীক হবার ব্যাপারে আমি কোন প্রমাণ নাযিল করিনি।” (মুসনাদে আহমাদ, ইমাম মুসলিম ও প্রায় একই রকম শব্দ সহকারে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন)

ফী জিলালিল কুরআন:

এখানে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে সৃষ্টিজগত ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের কসম খেয়েছেন, সেইভাবে মানব প্রাণের, তার সুবিন্যস্ত হওয়া ও তার মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে গোপন নির্দেশ (এলহাম) আসা সম্পর্কেও কসম খেয়েছেন। এখানে কসমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সৃষ্টিলোকের সব কিছুর মধ্যেই যে বিশেষ বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, তা ফুটিয়ে তোলা এবং সেদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যাতে মানুষ সে সব কিছুর তাৎপর্য বুঝার চেষ্টা করে এবং সেগুলোর সাথে মানুষের সম্পর্ক কি তার জীবনে সেগুলো থেকে সেও শিখতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। আল্লাহর শপথবাক্য : প্রকৃতির এই দৃশ্যাবলী, এগুলোর আত্মপ্রকাশ ও বিবর্তনের সাথে মানুষের এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে, যার কারণে এগুলোর সাথে মানুষের যোগাযোগ হয় অজানা, অচেনা বা অব্যক্ত ছায়ার মাধ্যমে । এ গোপন যোগাযোগ হয় মানুষের অন্তরের সাথে ৷ রহস্যরাজির অব্যক্ত ভাষা মানুষের হৃদয়ে যে দোলা দিয়ে যায়, তা অনুভূতিশীল মানুষ গভীরভাবে অনুভব করে। জাগ্রত মানব-হৃদয় যখন প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার মানসে প্রতিবেশ ও পরিবেশের সকল কিছুর দিকে তাকায়, তখন প্রকৃতি যেন জীবন্ত রূপ নিয়ে তার সামনে হাযির হয়ে এমনভাবে তাকে অনেক কিছু বলে যায়, যে আল্লাহর শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কে তার মনে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে না। তার মন নির্লিপ্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। সমস্যায় জর্জরিত সমাধানপ্রার্থী মন যখন উন্মুখ হয়ে ওই রহস্যরাজির দিকে তাকায়, তখন যেন সব কিছু তার চাওয়া পাওয়ার রূপ নিয়ে তাকে প্রশান্ত করতে থাকে। প্রকৃতির পক্ষ থেকে এ প্রতিক্রিয়া কখনও আসে সরাসরি শব্দের মাধ্যমে, আর কখনও বা আসে কোনো আনন্দঘন মুহুর্তে সূক্ষ ইংগিতের আকারে । এ কারণেই দেখা যায় কোরআন মজীদ মানুষের অন্তরকে বেশী বেশী করে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। সমগ্র কোরআন ব্যাপীই রয়েছে এই আহবান । কোথাও সরাসরি ডাক দিয়ে কোনো রহস্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে, আবার কখনও রয়েছে পরোক্ষভাবে চিন্তা করার আহবান ৷ যেমন আলোচ্য সূরাটিতে উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক জিনিসের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সে জিনিসগুলোর গুরুত্ব এবং বিশ্বসৃষ্টির স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতার জন্য সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। কোরআনে পাকের এই অংশের (আমপারার) মধ্যে প্রাকৃতিক বহু দৃশ্য ও সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণী বহু আবেদনের নযীর পাওয়া যায়। আর সত্যিকারে বলতে কি, এ অংশের একটি সূরাও এমন নেই, যার মধ্যে এ প্রকৃতির দৃশ্যের বর্ণনা তথা অন্তর মনকে জাগিয়ে তোলার মতো কোনো না কোনো আবেদন নেই৷ নেই, আবেগ ভরা মনের গোপন আকুতি এবং তার জবাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত জওয়াব-যা প্রাকৃতিক রহস্যাবলীর মধ্যে মূর্ত হয়ে রয়েছে। এটা আল্লাহ পাকের উপস্থিতি ও ক্ষমতার কথা বর্ণনায় প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল রয়েছে। এখানে আমরা সূর্য ও তার উজ্জ্বল আলোকের শপথ গ্রহণ করা দেখতে পাই । সাধারণভাবে সূর্যের কসম খাওয়া হয়ে থাকে, কিছু এখানে সুর্যের কসম খাওয়ার সাথে সাথে দিকচক্রবালে উদীয়মান সদ্যস্নাত প্রভাত-বেলার এই স্নিগ্ধ আলো বড়োই মধুর, বড়ই মনো-মুগ্ধকর একথা বলা হয়েছে! আরও মিষ্টি লাগে তখন যখন শীতের সকালের স্বচ্ছ আকাশে উদীয়মান সূর্য মুঠো মুঠো রূপালী আলো ছড়িয়ে শীতক্লিষ্ট শরীরগুলোকে উত্তপ্ত করে তোলে ৷ আর গ্রীষ্মকালে এশরাকের নামাযের সময়ে প্রভাতের আলোর সৌন্দর্য বড়ই চমৎকার লাগে, যেহেতু দুপুরের প্রাণাত্তকর তাপের ছোয়া লাগার পূর্বেই এ সময়ের সুশীতল স্নিগ্ধতা হৃদয়-মনকে পুলকিত করে। এ আলোর ছটায় আশপাশের সবকিছু স্বচ্ছ ও আলোয় ঝলমল হয়ে উঠে । অবশ্য অনেকে মনে করেন ‘দোহা’ অর্থ সারাটা দিন৷ কিন্তু এ শব্দটির নিকটতর অর্থ বাদ দিয়ে অন্য একটি রূপক অর্থ গ্রহণ করার কোনো কারণ আমরা খুঁজে পাইনা, অবশ্য আমরা এটা লক্ষ্য করেছি  ‘দোহা’ শব্দটি এ প্রসংগেই এই বিশেষ সময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আর চাদ,-এর পেছনে পেছনে আসে’ বলতে বুঝানো হয়েছে যখন এই চাদ সূর্যকে অনুসরণ করে এবং তার পেছনে মৃদু আলো নিয়ে এগিয়ে এসে পৃথিবীকে স্নিগ্ধতা ও সোনালী আভায় ভরে দেয়। চাদের সাথে মানুষের মনের গভীর ভালোবাসা বহু প্রাচীন কাল থেকে কিংবদন্তীর মতো প্রচলিত রয়েছে। এ ভালোবাসা মানব মনের গভীরে গ্রথিত। চাদের এ আলো মানুষের মনের গহীনে বরাবরই প্রেম-ভালোবাসার আবেগ জাগায় । চাদনী রাতে মনের মাঝে কোন প্রিয়সী যেন ফিসফিসিয়ে তার প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে হৃদয়-মনকে উজ্জীবিত করে তোলে । মনে হয় সব কিছু প্রিয়তম স্রষ্টার প্রেমে বিভোর হয়ে তার তাসবীহ জপতে শুরু করেছে। কবিমন এ মধুর জোৎস্নালোতে যেন এক সুমধুর সুরের লহরী শুনতে পায়। এই চাদনী রাতেই প্রেমিক মন আল্লাহ তায়ালার মহব্বতের সুধা পান করে তার প্রেমগাথা গাইতে গাইতে মুগ্ধ আবেগে আত্মহারা হয়ে যায়, বিধৌত হয়ে যায় তার কলুষিত মন । জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোকে অবগাহন করে প্রেমাম্পদ আল্লাহ তায়ালার আলিংগনে নিজেকে সঁপে আল্লাহর পাগলরা পরম পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ে ৷ আবার আল্লাহ্‌ তায়ালা দিনের কসম খাচ্ছেন,যখন দিন রৌদ্রের আলোকে আলোকিত হয়। ওহী স্বরূপ যে ‘দোহা’ শব্দটি এসেছে তার দ্বারা বিশেষ একটি সময়কে বুঝানো হয়েছে-দিনের সমগ্র সময়টি নয়। ‘জাল্লাহা’র মধ্যে যে ‘হা’ সর্বনামটি রয়েছে, তার দ্বারা বাহ্যত সুর্যকেই বুঝায় । কিন্তু কোরআনের বর্ণনার ধারাতে এর দ্বারা গোটা বিশ্বব্যাপী সব কিছুকেই বুঝায় । কোরআন পাক আরও যে জিনিসগুলোর প্রতি বিশেষভাবে ইংগিত দিয়েছে তা হচ্ছে, সূর্য উদয়ের সাথে সাথে আশেপাশের সব কিছু আলোকজ্জ্বল হয়ে যায় এবং এগুলো মানুষের হৃদয়ানাভূতিতে বিপুল সাড়া জাগায় । মানুষের অবচেতন মনে তার অজান্তেই আলোকোজ্জ্বল দিন এমন এক আনন্দানুভূতি সৃষ্টি করে, যা ব্যক্ত করতে মানুষের ভাষা সত্যিই অক্ষম। মানুষের জীবনে দিনের আলোর প্রয়োজন ও প্রভাব যে কতো গভীর, তা প্রত্যেক মানুষই জানে । কিন্তু অধিকাংশ মানুষই দিনের সৌন্দর্য ও তার প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন থাকে ৷ এজন্যই এখানে তাদের অনুভূতিতে সাড়া জাগানোর উদ্দেশ্য এবং কতো ব্যাপকভাবে এসব জিনিস মানুষের জীবনে ক্রিয়াশীল, সে বিষয়ে সজাগ করার জন্য এই বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে।এমনি করে কসম খেয়ে বলা হয়েছে, ‘রাতের কসম যখন তা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে’ আচ্ছন্ন করে ফেলা উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করার বিপরীত ৷ রাতের ঢেকে ফেলা বলতে বুঝায় রাতের আগমনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাওয়া ৷ যেমন দিনের আলো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, তেমনি রাতের অন্ধকারও বিভিন্নভাবে মানুষের মনের ওপর ক্রিয়াশীল । তারপর আকাশের এবং এর সৃষ্টি-নৈপুণ্যের কসম খাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আকাশের কসম এবং যিনি একে বানিয়েছেন তার কসম ।’ আরবী ‘মা’ শব্দটি এখানে ‘উৎস’কে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আকাশ শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে আমাদের মাথার ওপর অবস্থিত এই মুক্ত শুন্যলোককে ৷ যেদিকে তাকালে গোলাকার বিশাল এক ছাদ, যাকে ছাতার মতো মনে হয়। এই বিশাল শূন্যলোকে তারকারাজি ও গ্রহ-উপগ্রহগুলো দিন-রাত নিজ নিজ কক্ষপথে এক নির্ধারিত গতিতে যেন সাতার কেটে বেড়াচ্ছে । সত্যিকারে বলতে কি, আকাশ বলতে আমরা কিছুই জানি না, বুঝিনা ৷ যে জিনিসটি আমাদের চর্মচোখে আমরা নিরন্তর দেখি তা হচ্ছে এক মহা‌নিপুণ শিল্পীর নির্মিত কারুকার্য খচিত এক ভুবনজোড়া আকৃতি, যা দিবানিশি একই ভাবে এক বিশেষ নিয়মে ও অবিরাম ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার মধ্যে কোনো ছেদ নেই, নেই কোনো বিরতি বা বিশৃংখলা। দেখলে মনে হয় সুবিশাল অট্টালিকার এ এক মধযবুত ছাদ! এই অট্টালিকাটি কি এবং কি দিয়ে এটা তৈরী সে কথা বুঝার সাধ্য আমাদের নেই । এই মহাশূন্যলোকের শুরু বা শেষ কোথায় তাও আমরা জানি না। আর আকাশ সম্পর্কে এতদিন যতো কথা বলে আসা হয়েছে তা নিছক আন্দাজ-অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের তৈরী মতবাদ যে কোনো সময় নাকচ হয়ে যেতে পারে, তার কোনো স্থিরতাও নেই, স্থায়িত্বও নেই । সর্বশেষে আমরা এই বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র অদৃশ্য হাত এই মহাপ্রাসাদকে দাড় করিয়ে রেখেছে। বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে এমন ভাবে ধরে রেখেছেন যে, তা ঢলে পড়ে যায় না বা স্থানচ্যুত হয় না। যদি এগুলো স্থানচ্যুত বা অচল হয়ে পড়তো, তাহলে এগুলোকে সচল ও কার্যকর করার ক্ষমতা আর কারো থাকতো না । এটিই হচ্ছে নিশ্চিত এবং একমাত্র সঠিক জ্ঞান ভিত্তিক কথা। এভাবে কসম খাওয়া হচ্ছে পৃথিবীর ও তাকে বিছিয়ে রাখার ৷ বলা হচ্ছে, ‘কসম যমীনের এবং তার যিনি একে বিছিয়ে রেখেছেন’ এবং ‘আদ দুহ্‌উ’ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । অর্থাৎ বিছানা ও জীবনের জন্য আরামদায়ক বানানো ৷ এ জিনিসটি এমন এক প্রতিষ্ঠিত সত্য, যার ওপর মানব জীবনের অস্তিত্ব নির্ভর করে। অন্যান্য জীবজন্তু ও কীটপতংগ সবকিছুই এই পৃথিবীর বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল। সৃষ্টিকর্তা নিজেই এই পৃথিবীকে তাদের বাসোপযোগী করে ওদের শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব কিছু দিয়ে একে সাজিয়ে দিয়েছেন । সে সকল দ্রব্যসামগ্রীর কোনো একটিও যদি কোনো সময় দূর হয়ে যায়, তাহলে কোনো প্রাণীই বাচতে পারে না। এমনকি প্রাকৃতিক জিনিসগুলো নিজ নিজ পথে নিরন্তর যে এগিয়ে চলছে তাও আর চলবে না-একথা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের মাধ্যমেই বুঝতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীকে আরামদায়ক বানানো সম্পর্কে অন্য আর একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এরপর পৃথিবীকে আরামদায়ক বানানো হয়েছে, বের করা হয়েছে তার থেকে তার পানি ও গবাদিপশুর জন্য ঘাসপাতা ।'(আন নাযিয়াত:আয়াত ৩০-৩১) পৃথিবীর পক্ষে বাসোপযোগী হওয়ার জন্য এই দু’ধরনের জিনিস পানি ও সবুজ শাকসবজী, তরুলতা, গুল্ম ও গাছপালা সর্বাধিক জরুরী । আর এসব কিছুর পেছনে মহা দয়াময় আল্লাহর অদৃশ্য হাত সদা সক্রিয় রয়েছে। মানুষ এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসগুলোর দিকে তাকালে চিন্তাভাবনার জন্য সেসব থেকে সে যথেষ্ট উপাদান পেতে পারে। এরপর এই কসম খাওয়ার মধ্যে যে মহাসত্যটি ফটে উঠেছে তা হচ্ছে. মানষের মানবসত্তা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ ৷ চেয়ে দেখুন মানুষের জীবন কিভাবে প্রকৃতির সব কিছুর সাথে এক সুতোয় বাঁধা। সৃষ্টির সব কিছুর মধ্যে পারম্পরিক যে নিবিড় সম্বন্ধ বর্তমান, তার মধ্যে মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা, আল্লাহকে চেনার জন্য এক বিরাট নিদর্শন হিসেবে কাজ করছে। এ বিষয়ে যে আলোচনা এসেছে তা হচ্ছে, কসম মানবাত্মার এবং তীর যিনি একে সুবিন্যস্ত করেছেন, করেছেন সুসামঞ্জস্যভাবে গঠিত । সকল সৃষ্টবস্তুর মধ্যে সৃষ্টি -নৈপুণ্যের বিশেষ বিশেষ দিক চিন্তাশীল হৃদয়কে সত্যিই চমৎকৃত করে, কিন্তু মানব সৃষ্টির মধ্যে যে নৈপুণ্য বর্তমান রয়েছে তার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে তার প্রতিটি অংগপ্রত্যংগ সম্পর্কে চিন্তা করলে মানুষ দেখতে পাবে যে, এর কোনো একটিকেও যদি নিজস্ব স্থান থেকে সরিয়ে অন্য কোনো জায়গায় স্থাপন করা হয়, তাহলে গোটা দেহযন্ত্রটা বিকল হয়ে যাবে। মহা শিল্পী আল্লাহর সৃষ্টি পরিকল্পনার এ এক অত্যাশ্চর্য দিক যে, দেহযন্ত্রের মধ্যে যে যন্ত্রাংশটি যেখানে সর্বাধিক খাপ খায়, সেখানেই সেটিকে বসানো হয়েছে। এর যে কোনো বিকল্প চিন্তা শুধু বিপর্যয়ই ডেকে আনতে পারে। তারপর তার মধ্যে তিনি দিয়েছেন যুগপৎ পাপ-প্রবণতা ও আল্লাহ্‌তীতি এমতাবস্থায় সে-ই সাফল্যমন্ডিত হবে, যে নিজের প্রবৃত্তিকে পবিত্র রাখলো ৷ আর ব্যর্থতায় ভরে গেলো তার জীবন, যে এ প্রবৃত্তিকে অন্যায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে কলুষিত ও অপবিত্র করলো ।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-8
টিকা নং:5,

فَاَلْهَمَهَا فُجُوْرَهَا وَ تَقْوٰىهَا۪ۙ

তারপর তার পাপ ও তার তাকওয়া তার প্রতি ইলহাম করেছেন।৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৫) ইলহাম শব্দটির উৎপত্তি লহম ( لَهُمْ ) থেকে। এর মানে গিলে ফেলা। যেমন বলা হয় ( لَهُمْ الشَّىْءَ الْتَهَمَه ) উমুক ব্যক্তি জিনিসটিকে গিলে ফেলেছে। আর ( الْتَهَمْتُهُ الشَّىْءَ ) মানে হয়, আমি উমুক জিনিসটি তাকে গিলিয়ে দিয়েছি বা তার গলার নীচে নামিয়ে দিয়েছি। এই মৌলিক অর্থের দিক দিয়ে ইলহাম শব্দ পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কল্পনা বা চিন্তাকে অবচেতনভাবে বান্দার মন ও মস্তিষ্কের গোপন প্রদেশে নামিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। মানুষের প্রতি তার পাপ এবং তার নেকী ও তাকওয়া ইলহাম করে দেয়ার দু’টি অর্থ হয়। এক, স্রষ্টা তার মধ্যে নেকী ও গোনাহ উভয়ের ঝোঁক প্রবণতা রেখে দিয়েছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিই এটি অনুভব করে। দুই, প্রত্যেক ব্যক্তির অবচেতন মনে আল্লাহ‌ এ চিন্তাটি রেখে দিয়েছেন যে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোন জিনিস ভালো ও কোন জিনিস মন্দ এবং সৎ নৈতিক বৃত্তি ও সৎকাজ এবং অসৎ নৈতিক বৃত্তি ও অসৎকাজ সমান নয়। ফুজুর (দুস্কৃতি ও পাপ) একটি খারাপ জিনিস এবং তাকওয়া (খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা) একটি ভালো জিনিস, এ চিন্তাধারা মানুষের জন্য নতুন নয়। বরং তার প্রকৃতি এগুলোর সাথে পরিচিত। স্রষ্টা তার মধ্যে জন্মগতভাবে ভালো ও মন্দের পার্থক্য বোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। একথাটিই সূরা আল বালাদে এভাবে বলা হয়েছেঃ

وَهَدَيۡنٰهُ النَّجۡدَيۡنِ‌ۚ‏

“আর আমি ভালো ও মন্দ উভয় পথ তার জন্য সুস্পষ্ট করে রেখে দিয়েছি।” ( ১০ আয়াত ) সূরা আদদাহরে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

“আমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, চাইলে তার কৃতজ্ঞ হতে পারে আবার চাইলে হতে পারে অস্বীকারকারী।” ( ৩ আয়াত )

একথাটিই সূরা আল কিয়ামাহে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেঃ মানুষের মধ্যে একটি নফসে লাওয়ামাহ (বিবেক) আছে। সে অসৎকাজ করলে তাকে তিরস্কার করে। ( ২ আয়াত ) আর প্রত্যেক ব্যক্তি সে যতই ওজর পেশ করুক না কেন সে কি তা সে খুব ভালো করেই জানে। ( ১৪-১৫ আয়াত )

এখানে একথাটি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, মহান আল্লাহ‌ স্বভাবজাত ও প্রকৃতিগত ইলহাম করেছেন প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি তার মর্যাদা, ভূমিকা ও স্বরূপ অনুযায়ী। যেমন সূরা ত্বা-হা’য় বলা হয়েছেঃ

الَّذِىۡۤ اَعۡطٰى كُلَّ شَىۡءٍ خَلۡقَهٗ ثُمَّ هَدٰى‏

“যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন, তারপর তাকে পথ দেখিয়েছেন।” ( ৫০ আয়াত )

যেমন প্রাণীদের প্রত্যেক প্রজাতিকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ইলহামী জ্ঞান দান করা হয়েছে। যার ফলে মাছ নিজে নিজেই সাঁতার কাটে। পাখি উড়ে বেড়ায়। মৌমাছি মৌচাক তৈরি করে। চাতক বাসা বানায়। মানুষকেই তার বিভিন্ন পর্যায় ও ভূমিকার ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক ইলহামী জ্ঞান দান করা হয়েছে। মানুষ এক দিক দিয়ে প্রাণী গোষ্ঠীভুক্ত। এই দিক দিয়ে তাকে যে ইলহামী জ্ঞান দান করা হয়েছে তার একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, মানবশিশু জন্মের সাথে সাথেই মায়ের স্তন চুষতে থাকে। আল্লাহ‌ যদি প্রকৃতিগতভাবে তাকে এ শিক্ষাটি না দিতেন তাহলে তাকে এ কৌশলটি শিক্ষা দেবার সাধ্য কারো ছিল না। অন্য দিক দিয়ে মানুষ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী। এদিক দিয়ে তার সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ‌ তাকে অনবরত ইলহামী পথনির্দেশনা দিয়ে চলছেন। এর ফলে সে একের পর এক উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে মানব সভ্যতার বিকাশ সাধন করছে। এই সমস্ত উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ইতিহাস অধ্যয়নকারী যেকোন ব্যক্তিই একথা অনুভব করবেন যে, সম্ভবত মানুষের চিন্তা ও পরিশ্রমের ফল হিসেবে দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকটি আবিষ্কার আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছে। হঠাৎ এক ব্যক্তির মাথার একটি চিন্তার উদয় হয়েছে এবং তারই ভিত্তিতে সে কোন জিনিস আবিষ্কার করেছে। এই দু’টি মর্যাদা ছাড়াও মানুষের আর একটি মর্যাদা ও ভূমিকা আছে। সে একটি নৈতিক জীবও। এই পর্যায়ে আল্লাহ‌ তাকে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি এবং ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ জানার অনুভূতি ইলহাম করেছেন। এই শক্তি, বোধ ও অনুভূতি একটি বিশ্বজনীন সত্য। এর ফলে আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় এমন কোন সমাজ সভ্যতা গড়ে ওঠেনি যেখানে ভালো ও মন্দের ধারণা ও চিন্তা কার্যকর ছিল না। আর এমন কোন সমাজ ইতিহাসে কোন দিন পাওয়া যায়নি এবং আজও পাওয়া না যেখানকার ব্যবস্থায় ভালো ও মন্দের এবং সৎ ও অসৎকর্মের জন্য পুরস্কার ও শাস্তির কোন না কোন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়নি। প্রতি যুগে, প্রত্যেক জায়গায় এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রত্যেক পর্যায়ে এই জিনিসটির অস্তিত্বই এর স্বভাবজাত ও প্রকৃতিগত হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এছাড়াও একজন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ স্রষ্টা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই এটি গচ্ছিত রেখেছেন, একথাও এ থেকে প্রমাণিত হয়। কারণ যেসব উপাদানে মানুষ তৈরি এবং যেসব আইন ও নিয়মের মাধ্যমে জড় জগত চলছে তার কোথাও নৈতিকতার কোন একটি বিষয়ও চিহ্নিত করা যাবে না।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-9

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا۪ۙ

নিঃসন্দেহে সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তির নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-10
টিকা নং:6,

وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَاؕ

এবং যে তাকে দাবিয়ে দিয়েছে সে ব্যর্থ হয়েছে।৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) একথাটির ওপরই ওপরের আয়াগুলোতে বিভিন্ন জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে। ওই জিনিসগুলো থেকে একথাটি কিভাবে প্রমাণ হয় তা এখন চিন্তা করে দেখুন। যেসব গভীর তত্ব আল্লাহ‌ মানুষকে বুঝাতে চান সেগুলো সম্পর্কে তিনি কুরআনে যে বিশেষ নিয়ম অবলম্বন করেছেন তা হচ্ছে এই যে, সেগুলো প্রমাণ করার জন্য তিনি হাতের কাছের এমন কিছু সুস্পষ্ট ও সর্বজন পরিচিত জিনিস পেশ করেন, যা প্রত্যেক ব্যক্তি তার আশেপাশে অথবা নিজের অস্তিত্বের মধ্যে প্রতিদিন ও প্রতি মুহূর্তে দেখে। এই নিয়ম অনুযায়ী এখানে এক এক জোড়া জিনিস নিয়ে তাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে পেশ করা হয়েছে। তারা পরস্পরের বিপরীতধর্মী কাজেই তাদের প্রভাব ও ফলাফলও সমান নয়। বরং অনিবার্যভাবে তারা পরস্পর বিভিন্ন। একদিকে সূর্য, অন্যদিকে চাঁদ। সূর্যের আলো অত্যন্ত প্রখর। এর মধ্যে রয়েছে তাপ। এর তুলনায় চাঁদের নিজের কোন আলো নেই। সূর্যের উপস্থিতিতে সে আকাশে থাকলেও আলোহীন থাকে। সূর্য ডুবে যাবার পর সে উজ্জ্বল হয়। সে সময়ও তার আলোর মধ্যে রাতকে দিন বানিয়ে দেবার ঔজ্জ্বল্য থাকে না। সূর্য তার আলোর প্রখরতা দিয়ে দুনিয়ায় যে কাজ করে চাঁদের আলোর মধ্যে সে প্রখরতা থাকে না। তবে তার নিজস্ব কিছু প্রভাব রয়েছে। এগুলো সূর্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এভাবে একদিকে আছে দিন এবং অন্যদিকে রাত। এরা পরস্পরের বিপরীতধর্মী। উভয়ের প্রভাব ও ফলাফল এত বেশী বিভিন্ন যে, এদেরকে কেউ একসাথে জমা করতে পারে না। এমন কি সবচেয়ে নির্বোধ ব্যক্তিটির পক্ষেও একথা বলা সম্ভব হয় না যে, রাত হলেই বা কি আর দিন হলেই বা কি, এতে কোন পার্থক্য হয় না। ঠিক তেমনি একদিকে রয়েছে আকাশ। স্রষ্টা তাকে উঁচুতে স্থাপন করেছেন। অন্যদিকে রয়েছে পৃথিবী। এর স্রষ্টা একে আকাশের তলায় বিছানার মতো করে বিছিয়ে দিয়েছেন। এরা উভয়েই একই বিশ্বজাহানের ও তার ব্যবস্থার সেবা করছে এবং তার প্রয়োজন পূর্ণ করছে। কিন্তু উভয়ের কাজ এবং প্রভাব ও ফলাফলের মধ্যে আসমান-যমীন ফারাক। উর্ধজগতের এই সাক্ষ্য প্রমাণগুলো পেশ করার পর মানুষের নিজের শরীর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার অংগ-প্রত্যংগ এবং ইন্দ্রিয় ও মস্তিস্কের শক্তিগুলোকে আনুপাতিক ও সমতাপূর্ণ মিশ্রণের মাধ্যমে সুগঠিত করে স্রষ্টা তার মধ্যে সৎ ও অসৎ প্রবনতা ও কার্যকারণসমূহ রেখে দিয়েছেন। এগুলো পরস্পরের বিপরীত ধর্মী ইলহামী তথা অবচেতনভাবে তাকে এদের উভয়ের পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, এদের একটি হচ্ছে ফুজুর-দুষ্কৃতি, তা খারাপ এবং অন্যটি হচ্ছে, তাকওয়া-আল্লাহভীতি, তা ভালো। এখন যদি সূর্য ও চন্দ্র, রাত ও দিন এবং আকাশ ও পৃথিবী এক না হয়ে থাকে বরং তাদের প্রভাব ও ফলাফল অনিবার্যভাবে পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে থাকে তাহলে, মানুষের নফসের দুস্কৃতি ও তাকওয়া পরস্পরের বিপরীতধর্মী হওয়া সত্ত্বেও এক হতে পারে কেমন করে? মানুষ নিজেই এই দুনিয়ায় নেকী ও পাপকে এই মনে করে না। নিজের মনগড়া দর্শনের দৃষ্টিতে সে ভালো ও মন্দের কিছু মানদণ্ড তৈরি করে নিয়েই থাকে তাহলেও যে জিনিসটিকে সে নেকী মনে করে, সে সম্পর্কে তার অভিমত হচ্ছে এই যে, তা প্রশংসনীয় এবং প্রতিফল ও পুরস্কার লাভের যোগ্য। অন্যদিকে যাকে সে অসৎ ও গোনাহ মনে করে, সে সম্পর্কে তার নিজের নিরপেক্ষ অভিমত হচ্ছে এই যে, তা নিন্দনীয় ও শাস্তির যোগ্য। কিন্তু আসল ফয়সালা মানুষের হাতে নেই। বরং যে স্রষ্টা মানুষের প্রতি তার গোনাহ ও তাকওয়া ইলহাম করেছেন তার হাতেই রয়েছে এর ফায়সালা। স্রষ্টার দৃষ্টিতে যা গোনাহ ও দুষ্কৃতি আসলে তাই হচ্ছে গোনাহ ও দুষ্কৃতি এবং তাঁর দৃষ্টিতে যা তাকওয়া আসলে তাই হচ্ছে তাকওয়া। স্রষ্টার কাছে এ দু’টি রয়েছে পৃথক পরিণাম। একটির পরিণাম হচ্ছে, যে নিজের নফসের পরিশুদ্ধি করবে সে সাফল্য লাভ করবে এবং অন্যটির পরিণাম হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজের নফসকে দাবিয়ে দেবে সে ব্যর্থ হবে।

তাযাক্কা تز كى পরিশুদ্ধ করা মানে পাক-পবিত্র করা, বিকশিত করা এবং উদ্বুদ্ধ ও উন্নত করা। পূর্বাপর সম্পর্কের ভিত্তিতে এর পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ায়, যে ব্যক্তি নিজের নফস ও প্রবৃত্তিকে দুষ্কৃতি থেকে পাক-পবিত্র করে, তাকে উদ্বুদ্ধ ও উন্নত করে তাক‌ওয়ার উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং তার মধ্যে সৎপ্রবণতাকে বিকশিত করে, সে সাফল্য লাভ করবে। এর মোকাবেলায় দাসসাহা دَسّٰىهَا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর শব্দমূল হচ্ছে তাদসীয়া تدسيه তাদসীয়া মানে হচ্ছে দাবিয়ে দেয়া, লুকিয়ে ফেলা, ছিনিয়ে নেয়া, আত্মসাৎ করা ও পথভ্রষ্ট করা। পূর্বাপর সম্পর্কের ভিত্তিতে এর অর্থও এখানে সুস্পষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ সেই ব্যক্তি ব্যর্থ হবে, যে নিজের নফসের মধ্যে নেকী ও সৎকর্মের যে প্রবণতা পাওয়া যাচ্ছিল তাকে উদ্দীপিত ও বিকশিত করার পরিবর্তে দাবিয়ে দেয়, তাকে বিভ্রান্ত করে অসৎপ্রবণতার দিকে নিয়ে যায় এবং দুস্কৃতিকে তার ওপর এত বেশী প্রবল করে দেয়া যার ফলে তাকওয়া তার নীচে এমন ভাবে মুখ ঢাকে যেমন কোন লাশকে কবরের মধ্যে রেখে তার ওপর মাটি চাপা দিলে তা ঢেকে যায়। কোন কোন তাফসীরকার এই আয়াতের অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন قَد افْلَحَ مَنْ زَكّاهَا الَّهُ نَفْسَه وَقَدْ جَابَ مَنْ دَسَّى اللّاهُ نَفْسَه অর্থাৎ যে ব্যক্তির নফসকে আল্লাহ‌ পাক-পবিত্র করে দিয়েছেন সে সাফল্য লাভ করেছে এবং যার নফসকে আল্লাহ‌ দাবিয়ে দিয়েছেন সে ব্যর্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এ ব্যাখ্যাটি প্রথমত ভাষার দিক দিয়ে কুরআনের বর্ণনাভঙ্গির পরিপন্থী। কারণ আল্লাহর যদি একথা বলাই উদ্দেশ্য হতো তাহলে তিনি এভাবে বলতেনঃ قَد افْلَحَت مَنْ زَكّاهَا الَّهُ نَفْسَه وَقَدْ جَابَت مَنْ دَسَّهَا اللّاهُ (যে নফসকে আল্লাহ‌ পাক-পবিত্র করে দিয়েছেন সে সফল হয়ে গেছে এবং ব্যর্থ হয়ে গেছে সেই নফস যাকে আল্লাহ‌ দাবিয়ে দিয়েছেন।) দ্বিতীয়, এই ব্যাখ্যাটি এই বিষয়বস্তু সম্বলিত কুরআনের অন্যান্য বর্ণনার সাথে সংঘর্ষশীল। সূরা আ’লায়মহান আল্লাহ‌ বলেছেনঃ قَد افْلَحَ مَنْ تَزَكَْى (সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তি যে পবিত্রতা করেছে-৪ আয়াত) সূরা ‘আবাসায় মহান আল্লাহ‌ রসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ وَمَا عَلَيْكَ اَلاَّ تَزَكَْى “তোমাদের ওপর কি দায়িত্ব আছে যদি তারা পবিত্রতা অবলম্বন না করে? এই দু’টি আয়াতে পবিত্রতা অবলম্বন করাকে বান্দার কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ সত্যটি বর্ণনা করা হয়েছে যে, এই দুনিয়ায় মানুষের পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে। যেমন সূরা দাহ্‌র-এ বলা হয়েছেঃ “আমি মানুষকে একটি মিশ্রিত শুক্র থেকে পয়দা করেছি, যাতে তাকে পরীক্ষা করতে পারি, তাই তাকে আমি শোনার ও দেখার ক্ষমতা দিয়েছি।” (২ আয়াত) সূরা মূলকে হয়েছেঃ “তিনি মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে। “(২ আয়াত) যখন একথা সুস্পষ্ট পরীক্ষা গ্রহণকারী যদি আগেভাগেই একজন পরীক্ষার্থীকে সামনে বাড়িয়ে দেয় এবং অন্যজনকে দাবিয়ে দেয় তাহলে আদতে পরীক্ষাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কাজেই কাতাদাহ, ইকরামা, মুজাহিদ ও সাঈদ ইবনে জুবাইর যা বলেছেন সেটিই হচ্ছে এর আসল তাফসীর। তারা বলেছেনঃ যাক্কাহা ও দাসসাহা’র কর্তা হচ্ছে বান্দা, আল্লাহ‌ নন। আর ইবনে আবী হাতেম জুওয়াইর ইবনে সাঈদ থেকে এবং তিনি যাহহাক থেকে এবং যাহহাক ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যাতে রসূলুল্লাহ ﷺ নিজেই এই আয়াতের অর্থ বর্ণনা করে বলেছেনঃ

افْلَحَت نَفْسُ زَكّاهَا الَّهُ عَزَّ وَجَلَّ

(সফল হয়ে গেছে সেই ব্যক্তি যাকে মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ‌ পবিত্র করে দিয়েছেন) এই হাদীসটি সম্পর্কে বলা যায়, এখানে রসূলুল্লাহ ﷺ এর যে উক্তি পেশ করা হয়েছে তা আসলে তাঁর থেকে প্রমাণিত নয়। কারণ এই সনদের রাবী জুওয়াইর একজন প্রত্যাখ্যাত রাবী। অন্যদিকে ইবনে আব্বাসের সাথে যাহহাকের সাক্ষাত হয়নি। তবে ইমাম আহমাদ, মুসলিম, নাসাঈ ও ইবনে আবী শাইবা হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে যে রেওয়ায়াতটি করেছেন সেটি অবশ্যি একটি সহীহ হাদীস। তাতে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করতেনঃ

اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِى تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا

“হে আল্লাহ! আমার নফসকে তার তাকওয়া দান করো এবং তাকে পবিত্র করো। তাকে পবিত্র করার জন্য তুমিই সর্বোত্তম সত্তা। তুমিই তার অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক। ’

রসূলের প্রায় এই একই ধরনের দোয়া তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া ও ইবনুল মুনযির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এবং ইমাম আহমাদ হযরত আয়েশা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। মূলত এর অর্থ হচ্ছে, বান্দা কেবল তাকওয়া ও তাযকীয়া তথা পবিত্রতা অবলম্বন করার ইচ্ছাই প্রকাশ করতে পারে। তবে তা তার ভাগ্যে যাওয়া আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওফীকের ওপর নির্ভর করে। তাদসীয়া তথা নফসকে দাবিয়ে দেবার ব্যাপারেও এই একই অবস্থা অর্থাৎ আল্লাহ‌ জোর করে কোন নফসকে দাবিয়ে দেন না। কিন্তু বান্দা যখন এ ব্যাপারে একেবারে আদা-পানি খেয়ে লাগে তখন তাকে তাকওয়া ও তাযকীয়ার তাওফীক থেকে বঞ্চিত করেন এবং সে তার নফসকে যে ধরনের ময়লা আবর্জনার মধ্যে দাবিয়ে দিতে চায় তার মধ্যেই তাকে ছেড়ে দেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

ভালোমন্দ যাচাইয়ের সক্ষমতা : এই কয়েকটি আয়াতকে পূর্বের সুরা ‘আল-বালাদ’-এর আয়াত ‘আর আমি (আল্লাহ তায়ালা) তাকে দুটি পথ দেখিয়েছি’ এবং সূরায়ে ‘আল্‌ ইনসান’-এর আয়াত ‘আমি (আল্লাহ তায়ালা) তাকে পরিচালিত করেছি সঠিক পথে, তা সে শোকর করুক আর না শোকরি করুক’-এই দুটি আয়াত ইসলামী দৃষ্টিভংগির উজ্জ্বল নমুনা তুলে ধরেছে। এ আয়াতগুলোতে এই কথাটিই মুখ্যত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, মানব-প্রকৃতি কোনো একক সন্ত্বা হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে না; তার অস্তিত্বযেমন নির্ভরশীল তার স্বগোত্রীয় মানৰ গোষ্ঠীর সাথে, তার সম্পর্কের ভিত্তির ওপর, তেমনই গোটা বিশ্বসৃষ্টির সবকিছুর সাথে নিবিড় এক বন্ধনে আবদ্ধ থাকার ভিত্তির ওপরও । যেমন বলা হয়েছে সূরা’ ‘সোয়াদে’, “স্মরণ করে দেখো ওই সময়ের কথা, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘আমি মাটি দ্বারা মানুষ বানাতে চাই ।’ তারপর যখন তার সুসামঞ্জস্য গঠন-ক্রিয়া সমাপ্ত করলাম এবং আমার রূহ (আত্মা) তার মধ্যে ফুঁকে দিলাম, তখন তার জন্য তারা সেজদায় পড়ে গেলো ৷ (‘লাহু’ বুঝায় তার জন্য তার উদ্দেশ্যে, তার খাতিরে, তার সম্মানার্থে। ‘সেজদা’ শব্দটি দ্বারা বুঝায় বিনয়ের সাথে অবনত হওয়া: যদিও পারিভাষিক অর্থে নামাযে দৃষ্টি অংগ দ্বারা মাটিতে মাথা রাখাকেই সেজদা বুঝায় । এখানে আরবী আভিধ্যনিক অর্থই বুঝান হয়েছে: যেমন সূরায়ে ইউসুফ-এ বল! হয়েছে ‘ওয়া খাররা লাহু সুজ্জাদান’ আর তার জন্যে তারা অনবত হল।) এটা যেন বহু আয়াতে আলোচিত অনেক কথারই সমাপ্তি । যেমন সূরা ‘মোদ্দাসসির’-এ আল্লাহর কথা ‘প্রত্যেক ব্যক্তিকেই দায়ী হতে হবে সে বিষয়ে যা সে উপার্জন করেছে ।’ আর এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিভিন্ন ব্যবহার বুঝানোর জন্য অন্য কোনো মানুষেরই কর্মকান্ডকে তুলে ধরেছেন। যেমন সূরা ‘রা’দ’-এ বলা হয়েছে “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতির ভাগ্য ততোক্ষণ পরিবর্তন করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন করে ।” ওপরে বার্ণিত আয়াতগুলো ও উদাহরণসমূহ থেকে মানুষ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সারা বিশ্বলোকে যতো সৃষ্টিই আছে তার কেউই এককভাবে বর্তমান নেই। বরং সবাই প্রকৃতিগতভাবে পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ । তাদের যোগ্যতার ও কর্মতৎপরতার বিকাশ ঘটে পারস্পরিক চেষ্টায় এবং তারা জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে উপনিত হওয়ার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন বোধ করে। দ্বৈত সম্পর্ক বা জোড় সম্পর্ক বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি প্রকৃতিগতভাবে সবকিছুই দুই-এর সম্মিলনে সৃষ্ট ও প্রসারিত । দেখুন মানুষের প্রথম সৃষ্টিতেও তাকে মাটি দ্বারা গঠন ও আল্লাহ্‌ তায়ালার রূহ ফুঁকে দেয়ার মাধ্যমেই তা পূর্ণাংগ মানুষের অস্তিত্বে এসেছে। যোগ্যতা গড়ে তুলতে গিয়ে কম-বেশী করা, বিচার করা এবং ভাল মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষমতা সে নিজে অর্জন করেনি। তার প্রকৃতির মধ্যে আল্লাহ তায়ালা নিজেই এই ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন।জন্মগতভাবে এবং আল্লাহ পাকের দেয়া এই যোগ্যতাকে কখনও কোরআন ‘এলহাম’ বলে আখ্যায়িত করেছে। বলা হচ্ছে, ‘আর মানুষ এবং তাঁর কসম, যিনি তাকে সুসামঞ্জস্য করেছেন। তারপর তার মধ্যে পাপপ্রবণতা ও আল্লাহভীতি যুগপৎভাবে দান করেছেন ।’ আবার কখনও এই ভালমন্দের বুঝকে হেদায়াত বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আমি (মহান আল্লাহ) দেখিয়েছি তাকে দুটি পথ ।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের এই ক্ষমতা তার মজ্জাগত বা তার অন্তরের অন্তস্থলের মধ্যে গোপনে লুকিয়ে আছে, যা হয় ভালো বা মন্দ যে কোনো একটি কাজ করার প্রস্তুতি আকারে প্রকাশিত । ঐশী বার্তা প্রেরণ (রেসালাত) পথ প্রদর্শন এবং বাহ্যিক কার্যকারণ এসবই সে মজ্জাগত যোগ্যতাকে জাগিয়ে তোলে, তীব্র করে, ধারালো বানায় এবং তার মনোযোগকে কখনও এদিকে ফেরায় আবার কখনও ওদিকে ফেরায় কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, ভাল-মন্দের তারতম্য বোধ এটা মানুষের নিজস্ব সৃষ্টি কোনো গুণ নয়, এটা হচ্ছে প্রকৃতিগততাবে প্রাপ্ত এক মহা গুণ! এটা মানুষের ব্যক্তিস্ত্বার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অতি সংগোপনে মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে! এ কারণেই এই প্রকৃতি প্রদত্ত সত্য মিথ্যা বা ভাল ও মন্দের জ্ঞানের মধ্যে তারতম্য করার যোগ্যতা এটা একটা গোপন শক্তি, যা মানুষের চেতনার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। এই শক্তির দ্বারাই তাকে সে যে কোনো পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই শক্তিকে যে নিজ আত্মা পবিত্র করার জন্য ব্যবহার করে, যে একে সুন্দর করতে চায়, সে-ই প্রকৃতপক্ষে সাফল্যের অধিকারী হয়। আর যে ব্যক্তি এ শক্তিকে দাবিয়ে দেয়, গোপন করে রাখে বা দুর্বল করে ফেলে, সে নিজেকে কলুষিত করে, ব্যর্থ হয় তার জীবন । আল্লাহর ঘোষণা, ‘সাফল্য লাভ করলো সে, যে একে পবিত্র করলো এবং ব্যর্থ হলো সে, যে একে দাবিয়ে দিলো ।’ এখানে এসে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি তা হচ্ছে, মানুষকে ভাল বা মন্দ গ্রহণ করার এক সজ্ঞান ও সজাগ শক্তি দেয়া হয়েছে, যা তার এখতিয়ারাধীন এবং যে তাকে পরিচালনা করতে সক্ষম। এ শক্তি তার অনাগত প্রকৃতি প্রদত্ত যোগ্যতাকে কল্যাণের কাজে যেমন এগিয়ে দিতে পারবে, তেমনি এগিয়ে দিতে পারবে অকল্যাণকর কাজেও ৷ এ পর্যায়ে এসে স্বাধীনতার সাথে তার দায়িত্ববোধ সক্রিয় হয়ে উঠবে। তাকে বিবেক ও বুঝশক্তি দেয়ার সাথে বিশেষ দায়িত্ববোধও দেয়া হয়েছে। মানুষের ওপর আল্লাহ্‌র রহমত সদা সর্বদা আছে বলেই তিনি তাকে প্রকৃতিগতভাবে প্রাপ্ত বুঝ ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করার জন্য ছেড়ে দেননি অথবা যে শক্তিকে কাজে লাগানোর এখতিয়ার তাকে দেয়া হয়েছে, সেই শক্তির ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করার জন্য তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেননি বরং রেসালাত-রূপ নেয়ামত তাকে দেয়া হয়েছে, যাতে করে সে কঠিন ভাবে ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা লাভ করে এবং ঈমানের দাবী অনুযায়ী সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে চলতে পারে। এই ভাবে রেসালাত (আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আসা ওহীর জ্ঞান) তার অন্তরের মধ্যে সঠিক পথ চেনার যুক্তিপ্রমাণ হাযির করে এবং আশেপাশের সবকিছু থেকে সে জ্ঞান পেতে পারে। এই ওহীর জ্ঞানের কারণে সে কূপ্রবৃত্তির বলগাহীন আবেগ থেকে রেহাই পেয়ে সত্যকে তার আসল ও সঠিক চেহারায় দেখতে সক্ষম হয় । আর এভাবে তার সত্য সঠিক পথ এমন ভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তার মনের মধ্যে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। তখন সে তার সচেতন শক্তিকে উদঘাটনের জন্য এবং সঠিক পথ-প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তাকে কাজে লাগিয়ে সেই পথে চলতে থাকে। মোট কথা, আল্লাহ্‌ তায়ালা মানুষকে এই উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন এবং তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে যা সে করে তাই তার কাছে আল্লাহ্‌ তায়ালার দাবী এবং এতোটুকুর জন্যই আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকে মর্যাদা দান করবেন। স্বাধীনতার স্বরূপ : এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে বেশ কিছু জরুরী তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম, এই মতবাদ মানুষকে তার কাজের জন্য যে তাকে দায়ী হতে হবে এই অনুভূতি দান করে এবং নিজ ইচ্ছাকে পরিচালনার স্বাধীনতা দান করে। (এই স্বাধীনতা হচ্ছে আল্লাহ্‌ তায়ালার মরজীর গন্ডির মধ্যে থেকে নিজেকে পরিচালনার স্বাধীনতা) ৷ সুতরাং স্বাধীনতা ও আনুগত্য-এই দুটি যোগ্যতা মানুষকে সারা জগতে যথাযথ মর্যাদার অধিকারী করে এবং সৃষ্টিকুলের সেই যোগ্যতার আসনে তাকে বসায়, যার জন্য আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকে সৃষ্টি করেছেন, সুসামঞ্জস্য করেছেন এবং বিশ্বজগতের অনেকের ওপর তাকে সম্মান দিয়েছেন। দ্বিতীয় সত্য হচ্ছে, এই মতবাদ অনুসারে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার হাতেই । (এটাও আল্লাহ্‌রই ইচ্ছাক্রমে, যেমন পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে) এবং জানানো হয়েছে যে তার যে কোনো ভাল-মন্দের জন্য সে নিজেই দায়ী ৷ এই অনুভূতির ফলে তার মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দায়িত্বানুভূতি এবং আল্লাহর ইচ্ছা তার কাজ ও সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে কার্যকরী হয়। এ জন্যই বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তায়ালা কোনো জাতির ভাগ্য ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজে তার ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টা করে না ।’, আসলে পরিবর্তনের এই ইচ্ছাটা হচ্ছে এমন এক দায়িত্ব যা মানুষের কাছে সর্বদা সজাগ ও দৃঢ় থাকার দাবী জানায়, যাতে করে সে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে যমীনের বুকে টিকে থাকতে পারে এবং তার কূপ্রবৃত্তি তাকে ধোকা দিতে না পারে বা ভুল পথে চালিত করতে না পারে, তাকে ধ্বংসের দিকে না নিতে পারে। সর্বোপরি তার জন্য একথাও যেন প্রমাণিত না হয় যে, সে তার কুপ্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়েছে। এ ভাবেই সে আল্লাহ্‌ তায়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারে। তার পথনির্দেশনাতেই পথ দেখে এবং বিভিন্ন পথের গোলকধাধার মধ্য থেকে বেছে নেয় হেদায়াতের শুভ্র সমুজ্বল পথ। এভাবে আত্মার পরিশুদ্ধির পথ সরাসরি মানুষ আল্লাহর কাছ থেকেই পায়। আর তখন সে যেন তার নূরের আলোকে অবগাহন করতে থাকে এবং মানুষের অস্তিত্বকে ধ্বংস করা ও তাকে ভুল পথে পরিচালনার জন্য যে সকল স্রোতধারা মানব সমাজে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সেগুলো থেকে আল্লাহ তায়ালাই তাকে বাচান।

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-11
টিকা নং:7, 8,

كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ بِطَغْوٰىهَا۪ۤۙ

সামূদ জাতি৭ বিদ্রোহের কারণে মিথ্যা আরোপ করলো। ৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) ওপরের আয়াতগুলোতে নীতিগতভাবে যেসব কথা বর্ণনা করা হয়েছে এখন একটি ঐতিহাসিক নজীরের সাহায্য তাকে সুস্পষ্ট করে তোলা হচ্ছে। এটি কিসের নজীর এবং ওপরের বর্ণনার সাথে এর কি সম্পর্ক তা জানার জন্য কুরআন মজীদের অন্যান্য বর্ণনার আলোকে ৭ থেকে ১০ আয়াতে বর্ণিত দু’টি মৌলিক সত্য সম্পর্কে ভালভাবে চিন্তা গবেষণা করা উচিত।

একঃ সেখানে বলা হয়েছে, মানুষের নফসকে একটি সুগঠিত ও সুসামঞ্জস্য প্রতিকৃতির ওপর সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ‌ তার দুস্কৃতি ও তাকওয়া তার প্রতি ইলহাম করেছেন। কুরআন এ সত্যটি বর্ণনা করার পর একথাও পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, দুষ্কৃতি ও তাকওয়ার এই ইলহামী (চেতনালব্ধ) জ্ঞান প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্বভাবে বিস্তারিত পথনির্দেশনা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং এই উদ্দেশ্য মহান আল্লাহ‌ অহীর মাধ্যমে নবীগণকে বিস্তারিত পথনির্দেশনা দান করেছেন। তাতে দুষ্কৃতির আওতায় কি কি জিনিস পড়ে, যা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং তাকওয়া কাকে বলে, তা কিভাবে হাসিল করা যায়-এসব কথা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে। যদি অহীর সাধ্যমে প্রেরিত এই বিস্তারিত পথনির্দেশনা মানুষ গ্রহণ না করে, তাহলে সে দুস্কৃতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না এবং তাকওয়া অবলম্বনের পথও পাবে না।

দুইঃ এই আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, দুস্কৃতি ও তাকওয়া মধ্যে থেকে যে কোনটি অবলম্বন করার অনিবার্য ফল হচ্ছে পুরস্কার ও শাস্তি। নফসকে দুষ্কৃতি মুক্ত ও তাকওয়ার সাহায্যে উন্নত করার ফলে সাফল্য অর্জিত হয়। আর তার সৎপ্রবণতাগুলোকে দাবিয়ে দিয়ে তাকে দুষ্কৃতির মধ্যে ডুবিয়ে দেবার ফল হচ্ছে ব্যর্থতা ও ধ্বংস।

একথাটি বুঝাবার একটি জন্য ঐতিহাসিক নজীর পেশ করা হচ্ছে। এ জন্য নমুনা হিসেবে সামূদ জাতিকে পেশ করা হয়েছে। কারণ অতীতে ধ্বংস প্রাপ্ত জাতিদের মধ্যে এই জাতিটির এলাকা ছিল মক্কাবাসীদের সবচেয়ে কাছে। উত্তর হিজাযে এর ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ ছিল। মক্কাবাসীদের বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া যাবার পথে প্রায়ই এই স্থানটি অতিক্রম করতো। জাহেলী যুগের কবিতায় এই জাতির উল্লেখ যেমন ব্যাপকভাবে করা হয়েছে তাতে বুঝা যায়, আরববাসীদের মধ্যে তাদের ধ্বংসের চর্চা অত্যন্ত ব্যাপক ছিল।

টিকা:৮) অর্থাৎ তারা হযরত সালেহ আলাইহিস সালামের নবুওয়াততে মিথ্যা গণ্য করলো। তাদেরকে হেদায়াত করার জন্য হযরত সালেহকে পাঠানো হয়েছিল। যে দুস্কৃতিতে তারা লিপ্ত হয়েছিল। তা ত্যাগ করতে তারা প্রস্তুত ছিল না এবং হযরত সালেহ (আ) যে তাকওয়ার দিকে তাদেরকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন তা গ্রহণ তারা চাইছিল না। নিজেদের এই বিদ্রোহী মনোভাব ও কার্যক্রমের কারণে তাই তারা তার নবুওয়াতকে মিথ্যা বলছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পডুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আরাফ ৭৩-৭৬ আয়াত , হুদ ৬১-৬২ আয়াত , আশ শু’আরা ১৪১-১৫৩ আয়াত , আন নামল ৪৫-৪৯ আয়াত , আল ক্বামার ২৩-২৫ আয়াত ।
সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-12

اِذِ انْۢبَعَثَ اَشْقٰىهَا۪ۙ

যখন সেই জাতির সবচেয়ে বড় হতভাগ্য লোকটি ক্ষেপে গেলো,

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-13
টিকা নং:9,

فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللّٰهِ نَاقَةَ اللّٰهِ وَ سُقْیٰهَاؕ

আল্লাহর রসূল তাদেরকে বললোঃ সাবধান! আল্লাহর উটনীকে স্পর্শ করো না এবং তাকে পানি পান করতে (বাধা দিয়ো না)৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৯) কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সামূদ জাতির লোকেরা হযরত সালেহ আলাইহিস সালামকে এই বলে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল, যদি তুমি সত্যবাদী হও তাহলে কোন নিশানী (মুজিযা) পেশ করো। একথায় হযরত সালেহ (আ) মুজিযা হিসেবে একটি উটনী তাদের সামনে হাযির করেন, তিনি বলেনঃ এটি আল্লাহর উটনী। যমীনের যেখানে ইচ্ছা সে চরে বেড়াবে। একদিন সে একা সমস্ত পানি পান করবে এবং অন্যদিন তোমরা সবাই ও তোমাদের পশুরা পানি পান করবে। যদি তোমরা তার গায়ে হাত লাগাও তাহলে মনে রেখো তোমাদের ওপর কঠিন আযাব বর্ষিত হবে। একথায় তারা কিছুদিন পর্যন্ত ভয় করতে থাকলো। তারপর তারা তাদের সবচেয়ে বড় শয়তান ও বিদ্রোহী সরদারকে ডেকে বললো, এই উটনীটিকে শেষ করে দাও। সে এই কাজের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলো। ‌ (আল আরাফ ৭৩ আয়াত , আশ শু’আরা ১৫৪-১৫৬ আয়াত এবং আল ক্বামার ২৯ আয়াত )

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-14
টিকা নং:10,

فَكَذَّبُوْهُ فَعَقَرُوْهَا١۪ۙ۬ فَدَمْدَمَ عَلَیْهِمْ رَبُّهُمْ بِذَنْۢبِهِمْ فَسَوّٰىهَا۪ۙ

কিন্তু তারা তার কথা প্রত্যাখ্যান করলো এবং উটনীটিকে মেরে ফেললো।১০ অবশেষে তাদের গোনাহের কারণে তাদের রব তাদের ওপর বিপদের পাহাড় চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) সূরা আরাফে বলা হয়েছেঃ উটনীকে হত্যা করার পর সামূদের লোকেরা সালেহ আলাইহিস সালামকে বললো, তুমি আমাদের যে আযাবের ভয় দেখাতে এখন সেই আযাব আনো। (৭৭ আয়াত) সূরা হুদে বলা হয়েছে, হযরত সালেহ (আ) তাদেরকে বললেন, তিনদিন পর্যন্ত নিজেদের গৃহে আরো আয়েশ করে নাও, তারপর আযাব এসে যাবে এবং এটি এমন একটি সতর্কবাণী যা মিথ্যা প্রমাণিত হবে না। (৬৫ আয়াত)

সুরা: আশ-শামস
আয়াত নং :-15
টিকা নং:11,

وَ لَا یَخَافُ عُقْبٰهَا۠

আর তিনি (তাঁর এই কাজের) খারাপ পরিণতির কোন ভয়ই করেন না।১১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) অর্থাৎ দুনিয়ার বাদশাহ ও শাসকদের মতো নন। তিনি কোন জাতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময় এর পরিণাম কি হবে, একথা ভাবতে বাধ্য হন না। তিনি সবার ওপর কর্তৃত্বশালী। সামূদ জাতির সাহায্যকারী এমন কোন শক্তি আছে যে তার প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসবে, এ ভয় তাঁর নেই।

ফী জিলালিল কুরআন:

অহংকারী জাতির পরিণতি : এরপর সুরাটিতে ওই সকল লোকের কিছু উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, যারা নিজেদেরকে নানা প্রকার পাপ কাজের দ্বারা কলুষিত করেছে এবং এভাবে হেদায়াতের আলো থেকে নিজেদেরকে আড়াল করে আপন সম্মানকে লাঞ্ছিত করেছে। এই উদাহরণগুলোর মধ্যে সামুদ জাতির গযবপ্রাপ্ত হওয়া ও আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাদের জন্যে আসা শাস্তি এবং অবশেষে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । বলা হচ্ছে, ‘সামুদ জাতি (নবীকে) অস্বীকার করলো, মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো ও উপেক্ষা করলো তাদের অহংকার ও সীমালংঘন করার মাধ্যমে (তারা বাড়াবাড়ি করলো) । স্মরণ করে দেখো সেই সময়ের কথা, যখন তারা তাদের সব থেকে দুষ্ট লোকটিকে (তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য) পাঠালো। তখন তাকে আল্লাহ্‌র রসূল বললেন, ছেড়ে দাও আল্লাহর উটনীকে, তাকে তার নিজ হিসসার পানি খেতে দাও ৷ কিন্তু তারা তাকে হত্যা করলো । এর ফলে, তাদের রব, তাদের অপরাধের দরুন উপর্যুপরি আযাবের কশাঘাত হানলেন এবং তাদের শহর-নগরগুলোসহ তাদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন ৷ এভাবে নাফরমান জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে বিশ্বপালক আল্লাহ্‌ তায়ালা কাউকে ভয় করেন না ভয় করার তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই যেহেতু তার ওপর কথা বলার ক্ষমতা কারো নেই । সামুদ জাতি ও তাদের নবী সালেহ (আ.) সম্পর্কে কোরআন পাকের বহু স্থানে অল্প-বিস্তর বর্ণনা এসেছে। সর্বত্রই তাদের বিষয়ে বিভিন্নমুখী কিছু আলোচনাও এসেছে। বেশ কিছু বিস্তারিত বিবরণ এসেছে এই পারার সূরা ‘আল ফজর’-এ দেখুন । আলোচ্য সূরটিতে বলা হয়েছে, অহংকারের কারণেই সামুদ জাতি তাদের নবীকে মিথ্যাবাদী বলে দোষারোপ করেছে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একমাত্র অহংকারই ছিলো তাদের মিথ্যাবাদী বলে দোষারোপ ও নবীকে অস্বীকার করার কারণ ৷ তাদের এই অহংকার ও বিদ্রোহ তাদের সব থেকে দুষ্ট ও হতভাগা লোকটিকে চরম সর্বনাশা এ কাজটি করার উদ্দেশ্য বের করে আনলো যা অবশেষে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো, আর সে কাজটি ছিলো, উটনীকে মেরে ফেলা । সে ব্যক্তিটি ছিলো চরম কুলক্ষণে ও সব থেকে বড় বদমায়েশ। যে অপরাধ সে করেছিলো তার পরিণতি ছিলো সার্বিক ধ্বংশ। অবশ্য এই দুঃসাহসিক কাজ করার পূর্বেই আল্লাহ্‌র রসুল তাদেরকে যথাযথভাবে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন তোমরা হুঁশিয়ার হয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহর উটনীকে হত্যা করো অথবা যদি ওই উটনীর পানি পান করার নির্ধারিত দিনে তোমরা পানি স্পর্শ করো, তাহলে তোমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওই উটনীটিকে সত্যতার এক নিদর্শন রূপে পাঠানো হয়েছিল । নিশ্চিত সে উঁটনীর কোনো কোনো বিশেষত্ব ছিলো, যে বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাবো না। আসলে মাথা ঘামানোর কোনো অধিকারও আমাদের নেই। কারণ সে বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা কিছু বলেননি। অকৃতজ্ঞ ও সীমালংঘনকারী জাতি ওরা, সতর্ককারী নবীকে তারা মিথ্যাবাদী করলো এবং উটনীটিকে হত্যা করলো । যে ব্যক্তি নিজ হাতে উটনীটিকে হত্যা করেছিলো সে-ই ছিলো তাদের মধ্যকার সব থেকে বড় বদমায়েশ এবং চরম হতভাগা । যদিও উটনীটিকে সে একাই হত্যা করেছিলো, তবু যেহেতু তাদের পক্ষ থেকেই সে এ কাজটি করেছিলো এবং তারাই তাকে এ কাজে নিয়োগ করেছিলো, আর হত্যা করার পরে তারা অনুতপ্তও হয়নি এবং সে লোককে কোনো ভৎর্সনাও করেনি, বরং এ কাজকে তারা পছন্দই করেছিলো, এজন্য গোটা জনপদকে এই হত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে। এটা ইসলামের মূলনীতিসমূহের অন্যতম যে, দুনিয়ার জীবনে যখন কোনো কাজের কোনো পরিণতি বা ফল দেখা যায়, তখন তার জন্য সে জাতির সকল লোককেই যৌথতাবে দায়িত্ব বহন করতে হয়। এ কথা তখন আর বলার সুযোগ থাকে না যে, একের কাজের ফলে সবাইকে কেন দায়ী হতে হবে। সেদিন ‘কেউ কারো বোঝা বহন করবে না ।’ প্রকৃতপক্ষে দুটি কথার মধ্যে আসলে কোনো বৈপরীত্য নেই এসব যুক্তি খাটানো যাবে না। যেহেতু ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সয়ে তারা একই সমান’। কোনো এক ব্যক্তির অন্যায় কাজের প্রতিরোধে গোটা জাতির লোকগুলো এগিয়ে না এলে অথবা এতে খুশী হলে, তারাও প্রকারান্তরে সে অন্যায় কাজের সহযোগী বলে বিবেচিত হবে। এহেন অবস্থায় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ তায়ালার অদৃশ্য হাত নড়ে ওঠে এবং ভীষণভাবে সে যালেম জাতিকে পাকড়াও করে বসে ৷ ‘আর এরই কারণে, তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ তাদের ওপর কঠিন ও ধ্বংসকর এক আযাব এসে পড়লো, যা সম্পূর্ণভাবে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো এবং তাদের শহর ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়ে গেলো।’ ‘দামদামাতু’ শব্দটি দ্বারা আল্লাহ্‌র ক্রোধ এবং তার ফলে আগত চরম শাস্তিকে বুঝায় । শব্দটির মুল হচ্ছে ‘দাম্দামু’ যার অর্থ সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া । শব্দটির মধ্যে এমন একটি প্রলয়ের ঝংকার রয়েছে যার দ্বারা ভয়ংকর এক অবস্থা মনের মধ্যে জেগে ওঠে ৷ প্রকৃতপক্ষে সে আযাবের ফলে যমীনকে ওলট-পালট করে দেয়া হয়েছিলো । এ এমন এক দৃশ্য, যার ভয়াবহতা, যার ধ্বংসকর চেহারা কল্পনা করাও দুষ্কর । ‘তিনি ভয় করেন না এর পরিণতিকে’ মহাপবিত্র আল্লাহ তায়ালাই সর্বশক্তি ও সকল ক্ষমতার একমাত্র উৎস! তিনি আবার কাকে ভয় করতে যাবেন? কোন জিনিসকেই বা তিনি ভয় করবেন। তার ভয় করার প্রশ্নই বা কেমন করে আসতে পারে? একথার ব্যাখ্যা করতে নিয়ে  বারবার আল্লাহ্‌ তায়ালার সর্বব্যাপী শক্তি-ক্ষমতার কথাই এসে যায়। যার কোনো ভয় নেই, তিনি সে বিদ্রোহী জাতিকে শাস্তি দিতে কেন কুষ্ঠাবোধ করবেন?-যারা তার রাজ্যে তার প্রভৃত্বকে অস্বীকার করে ও তার দূতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এবং নিজেদের প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়? ‘অবশ্যই তিনি তাদেরকে চরম শক্তভাবে পাকড়াও করবেন’ একথার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। যখন তিনি ধরবেন, তখন এমন শক্তভাবে ধরবেন যে, কোনোভাবেই আর থেকে সে নাফরমানদের বাচা সম্ভব হবে না। এ কথাটাই আল্লাহ তায়ালা এভাবে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই, আল্লাহর পাকড়াও বড় শক্ত ।’ সেই কঠিন পাকড়াও আসার আগে আল্লাহ্‌ তায়ালা দুনিয়ার মানুষের কাছে একথাগুলো পেশ করে তাদেরকে সময় থাকতেই সাবধান হতে বলছেন। এভাবে এই বিশাল সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে মানুষকে যথাসময়ে অবহিত করা হচ্ছে এবং বিশ্বজগতের স্থায়ী দৃশ্যাবলীর দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রকৃতির সবকিছুর সাথে তার একটি নিবিড় যোগসূত্র কায়েম করার জন্য তাকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে । যারা এগুলো দেখার পরও আল্লাহ তায়ালা থেকে মন ফিরিয়ে রাখবে তাদেরকে ওই কঠিন অবস্থার মধ্যে নির্ঘাত পাকড়াও হতে হবে । সতর্ক না করে তিনি কাউকে শাস্তি দেন না তাই এ কঠিন অবস্থাগুলোর কথা বারংবার তুলে ধরা হচ্ছে। এটাই মিথ্যাবাদী ও বিদ্রোহীদেরকে পাকড়াও করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার রীতি। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিটি কাজের জন্য যে সীমানা নির্ধারিত রয়েছে, তারই ভিত্তিতে প্রত্যেক জিনিসের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য একটা দিনক্ষণও নির্দিষ্ট রয়েছে। প্রত্যেক ফায়সালার পেছনে রয়েছে যুক্তি ও বুদ্ধি। তিনিই সকল প্রাণী জগৎ ও জড় জগতের মালিক ও সকল ভাগ্য-নিয়ন্তা।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:

الشَّمْسِ অর্থ সূর্য। সূরার প্রথম আয়াতের الشَّمْسِ শব্দ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরায় সফলকামদের বৈশিষ্ট্য এবং ব্যর্থদের ব্যর্থতার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।

১-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর:

কারা আখিরাতে সফলকাম আর কারা ব্যর্থ সে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ধারাবাহিকভাবে তাঁর সাতটি বড় বড় মাখলুক নিয়ে শপথ করেছেন। প্রথমেই আল্লাহ তা‘আলা সূর্যের শপথ করেছেন। এটা আল্লাহ তা‘আলার একটি অন্যতম বড় মাখলুক এবং নিদর্শন।

وَضُحٰهَا অর্থ : ضوءها বা সূর্যের আলোর শপথ। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : এখানে যুহা দ্বারা সারা দিন উদ্দেশ্য। ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন : এটাই সঠিক। অর্থাৎ সূর্য ও তার কিরণের শপথ, যে কিরণ সারাদিন থাকে। মূলত বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার জন্য কিরণের শপথ পৃথকভাবে করেছেন।

إِذَا تَلٰهَا ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : يتلو النهار বা শপথ চন্দ্রের যা সূর্য অস্তমিত হবার সাথে সাথে আগমন করে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা বলেছেন : চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই, বরং সে সূর্যের আলো ধার করে চলে সে জন্য চন্দ্র সূর্যের পরে আসে।

إِذَا جَلّٰهَا অর্থ : إذا جلي الظلمة و كسفها

বা যখন অন্ধকার দূরীভূত ও মোচন করে দেয়।

إِذَا يَغْشٰهَا অর্থ : إذا يغشى الشمس حين تغيب

বা সূর্য অস্তমিত হবার সময় যখন তাকে রাত আচ্ছদিত করে নেয়।

وَمَا بَنٰهَا এখানে ما শব্দটি من বা ‘যিনি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ শপথ আকাশের এবং যিনি তা বানিয়েছেন। তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‏

(وَالسَّمَا۬ءَ بَنَيْنٰهَا بِأَيْدٍ وَّإِنَّا لَمُوْسِعُوْنَ)

আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার (নিজ) হাতে এবং আমি অবশ্যই মহা সম্প্রসারণকারী।” (সূরা জারিয়াত ৫১: ৪৭-৪৮)

وَمَا طَحٰهَا অর্থ : مد الارض ووسعها বা জমিনকে বি¯ৃ—ত ও প্রশস্ত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَالْأَرْضَ فَرَشْنٰهَا فَنِعْمَ الْمٰهِدُوْنَ ‏)‏‏

“এবং আমি পৃথিবীকে বিছিয়ে দিয়েছি, সুতরাং আমি কত সুন্দরভাবে বিছিয়েছি।” (সূরা যারিয়াত ৫১: ৪৮)

وَّمَا سَوّٰٿھَا ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : শপথ মানুষের এবং তাকে যে সঠিক ফিতরাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে সৃষ্টি করেছেন তার। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا ط فِطْرَتَ اللّٰهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا ط لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللّٰهِ ط ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ لا ق وَلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ)

“অতএব তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ; এটাই আল্লাহর ফিতরাত (প্রকৃতি) যার ওপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল-সঠিক দীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।” (সূরা রূম ৩০ : ৩০)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :

مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلَّا يُولَدُ عَلَي الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ

প্রত্যেক সন্তান ফিতরাত বা ইসলামের উপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে হয় ইয়াহূদী বানায় অথবা খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজক বানায়। (সহীহ বুখারী হা. ১৩৮৫)

(فَأَلْهَمَهَا فُجُوْرَهَا وَتَقْوٰـهَا)

অর্থাৎ মানুষকে সৃষ্টি করার পর অসৎ ও সৎ কর্মের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর যারা অসৎ কাজ বর্জন করার মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র করে নিতে পারল তারাই সফলকাম। পক্ষান্তরে যারা অসৎ কাজে জড়িত হয়ে নিজেকে কলুষিত করে নিয়েছে তারা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৎ কাজ করার মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার তাওফীক দান করুন।

১১-১৫ নম্বর আয়াতে সালেহ -এর নিদর্শন উটনীর কথা বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে সূরা আ‘রাফের ৭৮-৮৩ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা যেসব জিনিসের শপথ করেন তার গুরুত্ব অপরিসীম।
২. প্রত্যেক সন্তান ইসলাম ধর্মের ওপর জন্ম নেয়। অতঃপর পিতা-মাতা যে ধর্ম বা প্রকৃতির হয় সন্তানকে সেভাবেই লালন-পালন করে গড়ে তুলে।
৩. যে ব্যক্তি নিজের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে দীনের পথে জীবনকে অতিবাহিত করেছে সেই সফলকাম।
৪. যারা নিজেদের পাপের পংকিলতা থেকে মুক্ত করতে পারল না তারাই আখিরাতে ব্যর্থ।

তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীস ইতিপূর্বে। গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত মুআয(রাঃ) কে বলেনঃ “তুমি কি (আরবি) এসব সূরা দ্বারা নামায পড়তে পার না?

১-১০ নং আয়াতের তাফসীর

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) শব্দের অর্থ হলো আলোক। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে পূর্ণদিন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা সূর্য ও দিবসের শপথ করেছেন। আর সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর যে চাদ চমকায় তার শপথ করেছেন। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, মাসের মধ্যে প্রথম পনেরো দিন চন্দ্র সূর্যের পিছনে থাকে এবং শেষের পনেরো দিন সূর্যের আগে থাকে। যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ লাইলাতুল কদরের চাঁদ। তারপর দিবসের শপথ করা হয়েছে যখন তা আলোকিত হয়। কোন কোন আরবী ভাষাবিদ বলেছেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ দিন যখন অন্ধকারকে আলোকিত করে দেয়। কিন্তু যদি বলা হয় যে, দিগদিগন্তকে যখন সেই সূর্য চমকিত, আলোক উদ্ভাসিত করে দেয়, তাহলে বেশি মানানসই হয় এবং (আরবি) এর অর্থের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এ কারণে হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ দিনের শপথ, যখন সূর্য তাকে আলোকিত করে দেয়। এখানে সূর্যের কথাই বলা হয়েছে।

রাত্রি যখন সূর্যকে ঢেকে দেয় এবং চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে যায়। ইয়াযীদ ইবনে যী হামামাহ (রঃ) বলেন যে, যখন রাত্রি আসে তখন আল্লাহ জাল্লাজালালুহু বলেনঃ আমার বান্দাদেরকে আমার এক বিপুলাকার মাখলুক ঢেকে দিয়েছে। কাজেই মাখলুক বা সৃষ্টিজগত যখন রাত্রিকে ভয় করে তখন রাত্রির স্রষ্টাকে আরো বেশী ভয় করা উচিত। এটা মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে বর্ণিত হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আকাশের শপথ করেছেন। এখানে যে ব্যবহার (আরবি) করা হয়েছে, আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় এটাকে মা মাসদারিয়্যাহও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ আসমান ও তার সৃষ্টি কৌশলের শপথ। হযরত কাতাদা (রঃ) এ কথাই বলেন। আর এই (আরবি) অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তাহলে অর্থ হবেঃ আসমানের শপথ এবং তার স্রষ্টা অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার শপথ। মুজাহিদও (রঃ) এ কথাই বলেন। এ দু’টি অর্থ একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। (আরবি) এর অর্থ হচ্ছে উচ্চ করা যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আসমানকে আমি প্রশস্ততা সম্পন্ন করে সৃষ্টিকারী। আর জমীনকে আমি বিছিয়ে দিয়েছি এবং আমি কতইনা উত্তমরূপে বিছিয়ে থাকি।” {৫১:৪৭-৪৮) এখানে বলা হয়েছেঃ জমীনের, ওকে সমতলকরণের, ওর বিছানোর, ওকে প্রশস্তকরণের, ওর বন্টনের এবং ওর মধ্যকার সৃষ্ট জীবসমূহের শপথ। এর তাফসীরে একে প্রশস্তকরণের উক্তিটিই বেশী প্রসিদ্ধ। ভাষাবিদদের নিকটেও এটাই পরিচিত। জাওহারী (রঃ) বলেন যে, (আরবি) শব্দটি (আরবি) শব্দের মত, যার অর্থ হলো বিস্তৃত করা। অধিকাংশ তাফসীরকারের উক্তি এটাই।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ শপথ মানুষের এবং তাঁর যিনি তাকে সুঠাম করেছেন অর্থাৎ যখন তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তখন সে ঠিকঠাক অবস্থায় অর্থাৎ ফিতরাতের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তুমি একাগ্রতার সাথে স্বীয় চেহারাকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো, এটা হলো আল্লাহর ফিতরাত যার উপর তিনি লোকদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই।” (৩০৪ ৩০)।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা মাতা তাকে ইয়াহুদী, খ্রিস্টান বা মাজুসীরূপে গড়ে তোলে। যেমন চতুষ্পদ জন্তু নিখুঁত ও স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব করে থাকে। তোমরা তাদের কাউকেও কান কাটা অবস্থায় দেখতে পাও কি?” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে)

সহীহ মুসলিমে হযরত আইয়াম ইবনে হাম্মাদ মাজাশেঈ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমি আমার বান্দাদেরকে একাগ্রচিত্ত অবস্থায় সৃষ্টি করেছি, অতঃপর শয়তানরা এসে ধর্মপথ থেকে সরিয়ে তাদেরকে বিপথে নিয়ে গেছে।”

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তিনি তাকে তার অসকর্ম এবং তার সঙ্কর্মের জ্ঞান দান করেছেন আর তার ভাগ্যে যা কিছু ছিল সে দিকে তাকে পথ নির্দেশ করেছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ তিনি ভালমন্দ প্রকাশ করে দিয়েছেন। হযরত আবুল আসওয়াদ (রঃ) বলেনঃ আমাকে হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ মানুষ যা কিছু আমল করে এবং কষ্ট সহ্য করে এসব কি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ভাগ্যে নির্ধারিত রয়েছে? তাদের ভাগ্যে কি এরকমই লিপিবদ্ধ আছে? না তারা নিজেরাই নিজেদের স্বভাবগতভাবে আগামীর জন্যে করে যাচ্ছে? যেহেতু তাদের কাছে নবী এসেছেন এবং আল্লাহর হুজ্জত তাদের উপর পূর্ণ হয়েছে এবং এজন্যে এ সব কিছু এভাবে করছে? আমি জবাবে বললামঃ না, না। বরং এসবই পূর্বহতে নির্ধারিত ও স্থিরীকৃত হয়ে আছে। হযরত ইমরান (রঃ) তখন বললেনঃ তা হলে কি এটা জুলুম হবে না? এ কথা শুনে আমি কেঁপে উঠলাম। আতঙ্কিত স্বরে বললামঃ সবকিছুর স্রষ্টা ও মালিক তো সেই আল্লাহ। সমগ্র সাম্রাজ্য তাঁরই হাতে রয়েছে। তাঁর কার্যাবলী সম্পর্কে কারো কিছু জিজ্ঞেস করার শক্তি নেই। তিনিই বরং সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। আমার এ জবাব শুনে হযরত ইমরান খুবই খুশী হলেন। তারপর বললেনঃ আল্লাহ তাআলা তোমাকে সুস্থতা দান করুন। আমি পরীক্ষামূলকভাবেই তোমাকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। শোন, মুযাইনা অথবা জুহাইনা গোত্রের একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে ঐ প্রশ্নই জিজ্ঞেস করে যে প্রশ্ন আমি তোমাকে করেছি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে তোমার মতই উত্তর দিয়েছিলেন। লোকটি তখন বলেছিলঃ “তা হলে আর আমাদের আমলে কি হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেছিলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা যাকে যে জায়গার জন্যে সৃষ্টি করেছেন তার থেকে সেই সেই জায়গার অনুরূপ আমলই প্রকাশ পাবে। যদি আল্লাহ তাকে জান্নাতের জন্যে সৃষ্টি করে থাকেন তবে জান্নাতের কার্যাবলীই তার জন্যে সহজ হবে। আর যদি জাহান্নামের জন্যে সৃষ্টি করে থাকেন তবে জাহান্নামের কার্যাবলীই তার জন্যে সহজ হবে। এই কথার সত্যতা আল্লাহর কিতাবের নিম্নের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়ঃ (আরবি)

অর্থাৎ “শপথ মানুষের এবং তার, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও তার সঙ্কর্মের জ্ঞান দান করেছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

আল্লাহ পাকের উক্তিঃ সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র রাখবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে। অর্থাৎ যে নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত রাখবে সে কৃতকার্য হবে যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামায আদায় করে। আর সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে, এ ভাবে যে, সে নিজেকে হিদায়াত থেকে সরিয়ে নিবে, ফলে সে নাফরমানীতে নিয়োজিত থাকবে এবং আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে দিবে। পরিণামে সে ব্যর্থ ও নিরাশ হবে। আর এও অর্থ হতে পারেঃ যে নক্সকে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র করেছেন সে সফলকাম হয়েছে। আর যে নক্সকে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা নিচে নিক্ষেপ করেছেন সে বরবাদ, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরুপায় হয়েছে। আওফী (রঃ) এবং আলী ইবনে আবী তালহা (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এরূপই বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের একটি ক্রটি এই যে, জুওয়াইবির (ইবনে সাঈদ) হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে পরিত্যক্ত অর্থাৎ উসূলে হাদীসের পরিভাষায় মাতরূকুল হাদীস’। দ্বিতীয় ক্রটি এ যে, হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণনাকারী যহহাকের (রঃ) তার সাথে সাক্ষাৎ প্রমাণিত নয়।

মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী করীম (সঃ) কে (আরবি) এ আয়াতের তাফসীরে বলতে শুনেছেনঃ “যে নক্সকে আল্লাহ পবিত্র করেছেন সেই নক্স নিষ্কৃতি লাভ করেছে।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন (আরবি) পাঠ করতেন তখন তিনি থেমে যেতেন। অতঃপর বলতেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার নক্সকে আপনি ধর্মানুরাগ দান করুন! আপনিই ওর অভিভাবক ও প্রভু এবং ওর সর্বোত্তম পবিত্রকারী।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে (আরবি) পাঠ করার পর বলতে শুনেছেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার নক্সকে আপনি সংযমশীলতা দান করুন। এবং ওকে পবিত্র করুন! আপনি তো ওর সর্বোত্তম পবিত্রকারী! আপনিই ওর ওয়ালী ও মাওলা।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা রাত্রে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি দেখি যে, নবী করীম (সঃ) বিছানায় নেই। আমি তখন অন্ধকারে হাতরাতে লাগলাম। হঠাৎ তার উপর আমার হাত পড়ে গেল। ঐ সময় তিনি সিজদায় ছিলেন এবং পাঠ করছিলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার নফসকে আপনি সংযমশীলতা দান করুন! এবং ওকে পবিত্র করুন! আপনি তো ওর সর্বোত্তম পবিত্রকারী। আপনি ওর ওয়ালী ও মাওলা।” (এ হাদীসটি শুধু ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিম্নের দু’আটি পাঠ করতেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি অক্ষমতা ও অলসতা হতে, এবং বার্ধক্য, ভীরুতা,কৃপণতা ও কবরের আযাব হতে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমার অন্তরে তাকওয়া দান করুন এবং ওকে পবিত্র করে দিন! আপনিই তো ওর সর্বোত্তম পবিত্রকারী। আপনিই ওর ওয়ালী ও মাওলা। হে আল্লাহ! আপনার ভয় নেই এমন অন্তরের অধিকারী হওয়া থেকে আমাকে রক্ষা করুন এবং এমন নফস হতে রক্ষা করুন যা কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। এমন ইলম হতে রক্ষা করুন যা কোন উপকারে আসে না। আর এমন দু’আ হতে রক্ষা করুন যা কবুল হয় না।”

হযরত যায়েদ (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে এ দু’আ শিখাতেন এবং আমরা তোমাদেরকে তা শিখাচ্ছি।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১১-১৫ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ সামূদ গোত্রের লোকেরা হঠকারিতা করে এবং অহংকারের বশবর্তী হয়ে তাদের রাসূল (আঃ) কে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করেছে। মুহাম্মদ ইবনে কাব (রঃ) বলেন, (আরবি) এর ভাবার্থ হলোঃ তারা সবাই মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছে। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই অধিক উত্তম। হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা ও (রঃ) এ কথাই বলেছেন। এ হঠকারিতা এবং মিথ্যাচারের কারণে তারা এমন দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হয়েছিল যে, তাদের মধ্যে যে ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে প্রস্তুত হয়ে যায়। তার নাম ছিল কিদার ইবনে সালিফ। সে হযরত সালিহ্র (আঃ) উন্ত্রীকে কেটে ফেলে। এ সম্পর্কে কুরআন কারীমে বলা হয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তারা তাদের সঙ্গীকে আহ্বান করলো, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে এসে গেল এবং উস্ত্রীকে মেরে ফেললো।” (৫৪:২৯) এ লোকটিও তার কওমের মধ্যে সম্মানিত ছিল। সে ছিল সদ্বংশজাত, সম্ভ্রান্ত এবং কওমের নেতা।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যামআহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একবার তাঁর ভাষণে ঐ উস্ত্রীর এবং ওর হত্যাকারীর বিষয়ে আলোচনা করেন এবং এ আয়াত তিলাওয়াত করেন। তারপর বলেনঃ “ঠিক যেন আবু যামআ’হ। এ লোকটিও কিদারের মতই নিজের কওমের নিকট প্রিয়, সম্মানিত এবং সম্ভ্রান্ত ছিল।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে, ইমাম মুসলিম (রঃ) সিফাতুন্নারের মধ্যে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) তাফসীরের মধ্যে বর্ণনা করেছেন)

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলীকে (সঃ) বলেনঃ “আমি তোমাকে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে পাপী ও নিকৃষ্ট দু’টি লোকের কথা বলছি। এক ব্যক্তি হলো সামূদ জাতির সেই নরাধম যে হযরত সালিহ্র (আঃ) উষ্ট্রীকে হত্যা করেছে, আর দ্বিতীয় হলো ঐ ব্যক্তি যে তোমার কপালে যখম করবে। তাতে তোমার শ্মশু রক্ত রঞ্জিত হয়ে যাবে।”

আল্লাহর রাসূল হযরত সালিহ (আঃ) তাঁর কওমকে বললেনঃ হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর উস্ত্রীর কোন ক্ষতি করা হতে বিরত থাকো। তার পানি পান করার নির্ধারিত দিনে জুলুম করে তার পানি বন্ধ করো না। তোমাদের এবং তার পানি পানের দিন তারিখ এবং সময় নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু ঐ দুবৃত্তরা নবীর (আঃ) কথা মোটেই গ্রাহ্য করলো না। এই পাপের কারণে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল। তারপর তারা তাদের প্রকাশ্য মুকাবিলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল এবং ঐ উস্ত্রীকে হত্যা করলো, যাকে আল্লাহ পিতা মাতা ছাড়াই পাথরের একটা টুকরোর মধ্য হতে সৃষ্টি করেছিলেন। ঐ উষ্ট্ৰীটি ছিল হযরত সালিহ্র (আঃ) একটি মু’জিযা। এবং আল্লাহর কুদরতের পূর্ণ নিদর্শন। ফলে আল্লাহ তা’আলাও তাদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং পাইকারী হারে আযাব দিয়ে তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেন। নবী (আঃ)-এর উষ্ট্রী হত্যাকারী ব্যক্তিকে তার সম্প্রদায়ের ছোট বড় নারী পুরুষ সবাই এ ব্যাপারে সমর্থন করেছিল এবং সবারই পরামর্শক্রমেই সেই নরাধম উষ্ট্রীকে হত্যা করেছিল। এ কারণে আল্লাহর আযাবে সবাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

(আরবি) শব্দটি (আরবি) রূপেও পঠিত হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কাউকে শাস্তি দিয়ে তার পরিণাম কি হবে তা চিন্তা করেন না। তারা বিগড়ে বসে কিনা সেটারও আল্লাহ তাবারাকাওয়া তাআলা কোন পরোয়া করেন না। এখানে এও অর্থ হতে পারে যে ঐ দুবৃত্ত উস্ত্রীকে মেরে ফেলেছে, কিন্তু এর পরিণামকে ভয় করেনি। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই উত্তম। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

Leave a Reply