Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২০৫/হে মানুষ:-১৫) [#বহুমুখী জীবনধারা:-] www.motaher21.net সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌ পারা:৩০ ১- ২১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- #তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৫/হে মানুষ:-১৫)
[#বহুমুখী জীবনধারা:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌
পারা:৩০
১- ২১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১
وَ الَّیۡلِ اِذَا یَغۡشٰی ۙ﴿۱﴾
শপথ রাত্রির, যখন তা আচ্ছন্ন করে।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-২
وَ النَّہَارِ اِذَا تَجَلّٰی ۙ﴿۲﴾
শপথ দিবসের, যখন তা সমুজ্জ্বল হয়।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৩
وَ مَا خَلَقَ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰۤی ۙ﴿۳﴾
শপথ তাঁর যিনি নর-নারীর সৃষ্টি করেছেন।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৪
اِنَّ سَعۡیَکُمۡ لَشَتّٰی ؕ﴿۴﴾
অবশ্যই তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্নমুখী।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৫
فَاَمَّا مَنۡ اَعۡطٰی وَ اتَّقٰی ۙ﴿۵﴾
কাজেই কেউ দান করলে, তাকওয়া অবলম্বন করলে,
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৬
وَ صَدَّقَ بِالۡحُسۡنٰی ۙ﴿۶﴾
এবং যা উত্তম তা সত্য বলে গ্ৰহণ করলে,
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৭
فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡیُسۡرٰی ؕ﴿۷﴾
তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ ।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৮
وَ اَمَّا مَنۡۢ بَخِلَ وَ اسۡتَغۡنٰی ۙ﴿۸﴾
পক্ষান্তরে যে কার্পণ্য করে ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-৯
وَ کَذَّبَ بِالۡحُسۡنٰی ۙ﴿۹﴾
আর যা উত্তম তাতে মিথ্যারোপ করলে,
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১০
فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡعُسۡرٰی ﴿ؕ۱۰﴾
অচিরেই তার জন্য আমি সুগম করে দেব (জাহান্নামের) কঠোর পরিণামের পথ।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১১
وَ مَا یُغۡنِیۡ عَنۡہُ مَا لُہٗۤ اِذَا تَرَدّٰی ﴿ؕ۱۱﴾
যখন সে ধ্বংস হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১২
اِنَّ عَلَیۡنَا لَلۡہُدٰی ﴿۫ۖ۱۲﴾
আমারই দায়িত্ব পথ প্রদর্শন করা।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৩
وَ اِنَّ لَنَا لَلۡاٰخِرَۃَ وَ الۡاُوۡلٰی ﴿۱۳﴾
আর ইহকাল ও পরকালের কর্তৃত্ব আমারই।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৪
فَاَنۡذَرۡتُکُمۡ نَارًا تَلَظّٰی ﴿ۚ۱۴﴾
অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৫
لَا یَصۡلٰىہَاۤ اِلَّا الۡاَشۡقَی ﴿ۙ۱۵﴾
এতে সেই নিতান্ত হতভাগা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না;
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৬
الَّذِیۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿ؕ۱۶﴾
যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয় ।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৭
وَ سَیُجَنَّبُہَا الۡاَتۡقَی ﴿ۙ۱۷﴾
আর আল্লাহভীরুকে তা থেকে দূরে রাখা হবে।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৮
الَّذِیۡ یُؤۡتِیۡ مَالَہٗ یَتَزَکّٰی ﴿ۚ۱۸﴾
যেই পরম মুত্তাকী ব্যক্তি পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিজের ধন-সম্পদ দান করে।
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-১৯
وَ مَا لِاَحَدٍ عِنۡدَہٗ مِنۡ نِّعۡمَۃٍ تُجۡزٰۤی ﴿ۙ۱۹﴾
এবং তার প্রতি কারও এমন কোন অনুগ্রহ নেই যার প্রতিদান দিতে হবে ,
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-২০
اِلَّا ابۡتِغَآءَ وَجۡہِ رَبِّہِ الۡاَعۡلٰی ﴿ۚ۲۰﴾
শুধু তার মহান রবের সস্তুষ্টির প্ৰত্যাশায়;
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌:-২১
وَ لَسَوۡفَ یَرۡضٰی ﴿٪۲۱﴾
আর তিনি অবশ্যি (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৫/হে মানুষ:-১৫)
[#বহুমুখী জীবনধারা:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯২ : আল্ -লাইল‌
পারা:৩০
১- ২১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আল-লাইল

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৯২

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : আলোচ্য সূরাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্ব-জগতের মধ্যে অবস্থিত রহস্যরাজ ও মানব-প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্টগুলো বর্ণনা করা এবং তার সঠিক কাজ ও তার ফল কী হবে সে বিষয় নিশ্চিত জ্ঞানদান করা। সূরাটির মধ্যে এই সত্যকে বিভিন্ন কায়দায় চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই, তোমাদের চেষ্টাগুলো বিভিন্ন মুখী, এমতাবস্থায় যে দান করলো (সে-ই সাফল্যের পথে চললো), আল্লাহর ভয়ের কারণে বাছ বিচার করে চললো এবং ভালো কাজ ও সদ্ব্যহারকে (তার বাস্তব কাজ ও সদ্ব্যহারের মাধ্যমে) সত্যায়িত করলো…….খরচ করে । (আয়াত ৪-১৬) এই মহাসত্যটির বহিপ্রকাশ ঘটেছে দুইভাবে এবং দুইদিক থেকে ৷ প্রকৃতি ও স্বয়ং মানুষের নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে দুভাবে বিষয়টি সুন্দর করে আলোচনা করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘কসম নিশীথ রাতের, যখন তা ঘনীভূত অন্ধকারে (সব কিছুকে) আচ্ছন্ন করে। আর শপথ উজ্জ্বল দিবালোকের, যা আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেলো’ ৷ (একই আয়াতে দুটি কালের ব্যবহার, ‘ইয়াগশা’ ভবিষ্যত বা নিত্য বর্তমান এবং ‘তাজাল্লা’ অতীত, অবশ্যই কিছু তাৎপর্য রাখে । সে অর্থাৎ যা সবকিছু, এমনকি মানুষের মনগযকেও আচ্ছন্ন করে, তারা অবশ্যই সফল যারা গাফলতির ঘুমকে ঝেড়ে-মুছে ফেলে উঠে পড়লো । কতোই না সৌভাগ্যবান তারা, যেহেতু ঝলমলে দিনের আলোয় তারা খুঁজে নিতে পারলো নিজেদের প্রয়োজনীয় বস্তুকে । সুতরাং, এ সময় ও সে সময়-একটি আর একটির পরিপূরক বিধায় এই উভয় সময়ের কসম খেয়ে এবং দুটি সময়ের জন্য দুই ধরনের কাল ব্যবহার করে আল্লাহ্‌ তায়ালা অনাগত মানুষকে বলতে চেয়েছেন যে, প্রতিনিয়ত আগত অন্ধকারের ঘনঘটার মধ্য থেকে নিশ্চিতভাবে যখনই হেদায়াতের আলোর আভা বিচ্ছুরিত হবে তখন, যতো কষ্টই হোক না কেন গাফলতির চাদরকে দূরে নিক্ষেপ করে তাকে আলোর পথে আসতে হবে। ‘আর কসম সেই মহান সত্ত্বার, যিনি সৃষ্টি করেছেন পুরুষ ও নারীকে । আর এই বর্ণনা পদ্ধতি কোরআনে পাকের মধ্যে বর্ণীত ব্যাখ্যার অতি মনোহর একটি দিক ।(এ প্রসংগে আরো বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন লেখকের রচিত ‘কোরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য’ বই-এর শৈল্পিক সংগতি (আত্তাসওয়ীরুল কান্নিউ ফীল কোরআন-আত্তানাসুকূল ফান্নি ফীল কোরআন ।) “কসম নিশীথ-রাতের যখন তা আচ্ছন্ন করে । আর কসম দিবাভাগের যখন তা (রাত্রি শেষে) উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয় এবং কসম তার যিনি সৃষ্টি করেছেন পুরুষ ও নারীকে ।” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ওই দুটি আয়াতে রাত ও দিন এবং এ দুইয়ের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট বর্ণনা করে সেগুলোর কসম খেয়েছেন ‘রাত যখন ঢেকে ফেলে’ এবং ‘যখন দিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।’ এগুলোতে যে কথাগুলো বিধৃত হয়েছে তা হচ্ছে, রাত যখন বিস্তীর্ণ ধরণীকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলে, তার ওপর পর্দা নিক্ষেপ করে তাকে গোপন করে ফেলে আর দিনের কসম যখন তা উজ্জ্বল হয়, উদ্ভাসিত হয় এবং তার আলোতে সব কিছু আলোকিত হয়। সুতরাং এ দুটি সময় উন্মুক্ত আকাশের বুকে চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় পরস্পর মুখোমুখি হয়-সাক্ষাত করে, ওরা একে অপরকে নিজ নিজ চেহারা দেখিয়ে ৷ দুইয়ের মধ্যে অবস্থিত বৈশিষ্টগুলোও পরস্পর সাক্ষাত করে এবং তাদের প্রতিক্রিয়াগুলোও সামনাসামনি হয়। এমনি করে আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির সবকিছুকে দুই ভাগে ভাগ করে তাদের কসম খাচ্ছেন । ‘কসম তার যিনি পুরুষ ও নারীকে সৃষ্টি করেছেন ।’ বাক্যটির দুটি অর্থ হতে পারে। যেটাই গ্রহণ করা হোক না কেন, কোনোটাই অশুদ্ধ হবে না৷ ‘মা’ যদি ‘মান্‌’ অর্থে আসে তো বাক্যটির অর্থ দাড়াবে ‘এবং তার কসম যিনি পুরুষ ও নারীকে সৃষ্টি করেছেন ‘ আর যদি ‘মা’ (যা কিছু) নিজ অর্থে আসে, তাহলে বাক্যটির অর্থ দাড়াবে, সৃষ্টির ‘সব কিছুর মধ্যে পুরুষ ও নারী বা ধনাত্মক ও ঋণাত্মক যে বৈশিষ্টগুলো রয়েছে তাদের কসম ।’ একথা বলে সূরাটির বাইরে যে কথাগুলো বলা হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে সূরাটির অভ্যন্তরে যে কথাগুলো বর্তমান রয়েছে এই দুইয়ের মাঝে অবস্থিত সে বৈষম্য দূর করে দেয়া হয়েছে!

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-3

وَ مَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَ الْاُنْثٰۤىۙ

আর সেই সত্তার কসম যিনি পুরুষ ও স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

রাত ও দিন-এই দুটি অবস্থা, প্রাকৃতিক অন্য যে কোনো অবস্থার তুলনায় মানুষের অন্তরের মধ্যে বেশী অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। এ দুটি অবস্থা সম্পর্কে যখন মানুষ চিন্তা করে, তখন তার সামনে সৃষ্টি রহস্যের অনেক অজানা তথ্য উদঘাটিত হতে থাকে । রাত ও দিনের আবর্তনের সাথে সাথে মানুষের অজান্তে সে এমনভাবে প্রভাবিত হতে থাকে যে, ইচ্ছা করলেই সে প্রভাব থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। বিস্ময়কর কিছু কসম : ‘রাত যখন ঢেকে ফেলে এবং সব কিছুর ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায়, আর দিন যখন আলোকিত হয় এবং শুভ্র আলো ছড়াতে থাকে ।’ এই বিবর্তনে মানুষের মনেও পরিবর্তন আসে এবং জীবনে সজীবতার ছোয়া লাগে। এই ক্রমাগত রাত ও দিনের যে নিরন্তর আবর্তন চলছে তার কারণে মানুষের মনে নিজে থেকেই পরিবর্তন আসতে থাকে । একবার রাতের পর্দা সব কিছুকে ঢেকে দিয়ে মানুষের অনেক কিছুকে গোপন করে ফেলে, যার কারণে অব্যক্ত এক আমেজ ও দুর্বলতা মানুষ অনুভব করে, আবার দিনের শুভাগমনে দুনিয়া যখন উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে, তখন স্তিমিত হৃদয়-মন পুলকিত হয়ে ওঠে এবং নতুন এক আবেগ এসে তাকে কঠোর থেকে কঠোর কাজে উদ্বদ্ধ করে। রাত ও দিনের এই গমনাগমনের প্রভাব এমনই তীব্র ও শক্তিশালী যে, ইচ্ছা করলেই এর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া বা এর প্রভাবকে উপেক্ষা করে চলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলতে কি, যে যতো, শক্তিশালীই হোক না কেন, রাত-দিনের পরিবর্তনের প্রভাব বলয় থেকে বাইরে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ওপরে বর্ণীত এই সত্য অবস্থাটির ওপর গভীর ভাবে চিন্তা করলে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে এই যে, এই আবর্তন ও প্রভাব বিস্তারকারী অবস্থার অন্তরালে এমন এক শক্তিশালী ও মযবুত শক্তি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে যার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কারো নেই, তা সে যেই হোক না কেন, এই সত্যটি থেকে আরো যে মহাসত্যটি প্রকাশ পাচ্ছে তা হচ্ছে এই বিশাল সৃষ্টিকে যে ব্যবস্থাপক সুনিপুণভাবে পরিচালনা করছেন তিনি সারা বিশ্বের সকল মানুষকেও সেই একই সুদৃঢ় হাতে পরিচালনা করছেন। অতএব, তাদেরকে তিনি এমনিই ছেড়ে দেবেন না, যেহেতু তিনি তাদের অযথা সৃষ্টি করেননি। বিরোধি ও গোমরাহ লোকেরা এ সত্যকে যতোই দাবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন এবং এ সত্য থেকে মানুষের দৃষ্টি যতোই ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, বিশ্বজগতের এ সকল রহস্যপূর্ণ জিনিসের দিকে মানুষের দৃষ্টি ফিরে আসতে বাধ্য । এসব ঘটনার সাথে তার সাক্ষাত হবেই ৷ এই পরিবর্তনগুলো একটু খেয়াল করলে তার নযরে পড়বেই এবং সত্যি বলতে কি, এসব কিছুর মধ্যে বিরাজমান রহস্যগুলো অনুভব করার জন্য খুব বেশী চেষ্টা-তদ্বীরেরও প্রয়োজন হয় না। এসব কিছুর পরিচালনায় মহা এক ব্যবস্থাপকের হাত নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে এটা মানুষের বোধশক্তিতে ধরা পড়বেই ৷ এই সবকিছুর মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব যে বর্তমান রয়েছে, তা যে কোনো সুস্থ বুদ্ধি ও বিবেকবান ব্যক্তির কাছে ধরা পড়বেই, নির্বোধ ও হঠকারী ব্যক্তিরা তা যতোই অস্বীকার করুক না কেন? এমনি করে চিন্তা উদ্রেককারী তথ্য, নর ও নারী সৃষ্টি মানুষ ও স্তন্যপায়ী সকল পশুর মধ্যে যে একই নিয়মে সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলছে তা হচ্ছে এই যে, নারী বা স্ত্রীলিংগের প্রাণীর গর্ভাশয়ে বাচ্চাদানীতে শুক্র জীবাণু গিয়ে স্থির হয়ে দাড়ায় এবং নারীদেহের ডিম্বাশয়ের সাথে মিলিত হয়ে বাচ্চাগঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই একই পদ্ধতিতে সব জীবজন্তুর সৃষ্টির সূচনা হলেও প্রশ্ন আসে বাচ্চা কেন বিভিন্ন প্রকারের হয়? কোনোটা হয় নর শিশু এবং কোনোটা হয় নারীশিশু ৷ এসব কিছু সংঘটিত হয় কোন সে অদৃশ্য শক্তির নীরব ইশারায়? কোন সে শক্তি, কোন সে মহান সত্ত্বা যিনি কোনোটিকে বলেছেন, ‘পুরুষ হয়ে যাও’ আবার কোনোটিকে বলেছেন, ‘হয়ে যাও নারী?’ অথচ প্রক্রিয়ায় যে সব কার্যকারণ ক্রিয়াশীল সেগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তবু ফলশ্রুতিতে কেন এই বিভিন্নতা আসে? কিভাবে মায়ের গর্ভে শুক্রানু পুরুষ হয়ে যায় আবার কোনোটা হয়ে যায় নারী? এটা যদি হয় এক ঘটনাচক্র যার মাধ্যমে সকল জীবের জীবন প্রবাহ একই নিয়মে চলছে এবং ভবিষ্যতেও এভাবেই চলতে থাকবে৷ এতে কোনো পরিবর্তন আনা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে কোন সে মহা নিয়ন্তার অমোঘ নিয়ম-শৃংলা যার মধ্যে পরিবর্তন আনা কারো পক্ষে সম্ভব নয়? আসলে এটা কি নিছক একটি আকস্মিকতা বা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়ে যাওয়া কোনো এক ঘটনা । তাই যদি হয়, তাহলে তারও তো একটা নিয়ম কানুন থাকবে । সে নিয়ম হচ্ছে, আকস্মিক ঘটনাবলীর মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃংখলা কার্যকর থাকে না, অর্থাৎ আকস্মিক কোনো ঘটনার মধ্যে ক্রিয়াশীল সকল অংশগুলো পরস্পর সংগতি রক্ষা করে চলতে পারে না। এক্ষেত্রে একটি মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, আর তা হচ্ছে এক মহা প্রকৌশলীর নিয়ন্ত্রণাধীন এসব কিছু আবর্তিত হচ্ছে, যার ইচ্ছার খেলাফ কেউ কিছু করতে পারে না, কিছুই সংঘটিত হতে পারে না। তিনিই সৃষ্টি করছেন একই নিয়মে এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে, যা ব্যাহত করার সাধ্য কারো নেই৷ এই ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনার কারো এখতিয়ার নেই । স্তন্যপায়ী জীব ছাড়াও সৃষ্টিকুলের অন্যান্য জীব ও জিনিসের মধ্যেও এই একই নিয়ম ক্রিয়াশীল ৷ সবকিছুর মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বা জোড় ও বেজোড় আছে। জীবজন্তু, কীটপতংগ, গাছপালা, তরুলতা, শাকসবজী সবকিছুর মধ্যে একই নিয়ম বিরাজমান, যার ব্যতিক্রম কোথাও নেই। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া একক শক্তি বা এক বলতে কিছু নেই, যিনি ত্রুটি বা দুর্বলতার উর্ধে, যার সমকক্ষ বা যার মতো কেউ নেই, কিছু নেই। বিশ্বসভার অসংখ্য জিনিসের মধ্য থেকে এই কয়েকটি জিনিস তুলে ধরা হলো যা আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে মানব মনে যথেষ্ট পরিমাণে সাড়া জাগায় । মানব সমাজের এই চরম ও পরম সত্যটির কসম খেয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা, যাতে করে তার পরিচালনার শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার পরিচালনা যে সুগভীরভাবে সকল বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল তা জানা যায়। এই প্রেক্ষাপটে কোরআন এই মহাসত্যটি তুলে ধরেছে যে, বিশ্বলোকের এই রহস্যরাজি অবলোকন করার পর যে কোনো বিবেকবান মানুষ ভাল-মন্দ কাজের তাৎপর্য বুঝবে এবং সকল কাজে সত্যনিষ্ঠ হবে। মন্দ, কাজ ও ব্যবহার পরিহার করে পরকালে সুন্দর প্রতিদানের অপেক্ষায় থাকবে এবং দুনিয়ার জীবনের তুলনায় আখেরাতের জীবনের গুরুত্ব অনুভব করবে ।

ফী জিলালিল কুরআন: বহুমুখী জীবনধারা : এ সব প্রকাশ্য জিনিস এবং প্রতিনিয়ত যে সব দৃশ্য বিশ্বপ্রকৃতির মধ্য থেকে ফুটে উঠছে এবং মানুষের মধ্যকার যে সব জিনিস আমাদের মনোযোগকে আকর্ষণ করছে এ সকল জিনিসের কসম খেয়ে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন যে, মানুষের চেষ্টা বিভিন্নমুখী-তার জীবনপথও বিভিন্ন । আর এ কারণেই তাদের প্রাপ্য প্রতিদানও বিভিন্ন ৷ এতএব, ভালো কখনও মন্দের সমান হতে পারে না, সংশোধনী প্রচেষ্টা বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী অশান্তিকর ব্যবহারের মতো নয়। এভাবে যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহ্‌র ভয়ের ভিত্তিতে জীবন যাপন করে আর যে কার্পণ্য করে এবং তার মন্দ পরিণতির ব্যাপারে বেপরোয়া ভাব দেখায়, তারা৷ কখনও একই প্রকারের হতে পারে না। যে ব্যক্তি ঈমান আনার পর সত্য পথের কল্যাণকারিতা মেনে নেয়, সে কখনও নবী ও তার আনীত জীবন পথকে মিথ্যা বলে ঠুকরিয়ে দেয় যে ব্যক্তি- তার সমান হতে পারে না। প্রত্যেকের জন্যে রয়েছে তার নিজের পছন্দ করা জীবনপথ, প্রত্যেকেই নিজ নিজ গন্তব্যস্থান বেছে নেয় এবং প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে তার স্বকীয় কাজের সঠিক পরিণতি । “অবশ্যই তোমাদের চেষ্টা নানা-প্রকারের ৷ ……. আর কিই বা উপকারে লাগবে তার জন্য তার মাল-সম্পদ যখন (নিজেই) সে ধ্বংস হয়ে যাবে ।” (আয়াত-৪-১১) অবশ্যই তোমাদের চেষ্টা নানা ধরনের বলতে বুঝায় তাদের প্রচেষ্টা প্রকৃতপক্ষেই উদ্দেশ্যের বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হবে এবং প্রয়োজনের কারণেও বিভিন্ন হবে, আর বিভিন্ন হবে প্রচেষ্টা শেষে যে ফল তাও পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান । ঝোকপ্রবণতা ও ধ্যান-ধারণার দিক দিয়েও যেমন তাদের মধ্যে বিভিন্নতা আছে, তেমনি বিভিন্নতা আছে তাদের কোনো বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ ও যত্নবান হওয়া-না হওয়ার দিক দিয়েও । এমনকি একই নেতৃত্বাধীন বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও চিন্তা ও চেষ্টার বিভিন্নতা বর্তমান। এটাই বাস্তব সত্য, কিন্তু আরো একটি সত্য আছে, যা সকল সত্যের চাইতে বড়। আর তা হচ্ছে, নানা দিক দিয়ে মানুষে মানুষে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কিছু জিনিস এমন আছে যার ভিত্তিতে সকল মানুষ নিজেদের মধ্যে এক ও অবিচ্ছিন্ন মিল অনুভব করে এবং এ কারণেই দৃশ্যমান সকল জিনিস একই সুতায় আবদ্ধ রয়েছে বলে দেখা যায়। তারা পরস্পরকে ধরে রেখেছে পৃথক পৃথক দুটি বন্ধনের মাধ্যমে, পরস্পর মুখোমুখি দুটি সারিতে দুটি পতাকার তলে । দেখুন, বলা হচ্ছে, যে দান করলো ও ভয় করে চললো এবং ভালো মত ও পথকে মেনে নেয়ার সাথে সত্যকে দৃঢ় সমর্থন জানালো পাশাপাশি আর এক শ্রেণীর লোকের কথা বলা হয়েছে, ‘যে (দান করার পরিবর্তে) কৃপণতা করলো, অভাবী লোকদের সংকট-সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন হলো এবং ভালো কাজ ও কথাকে উপেক্ষা করলো ।’ যে তার জান ও মাল দান করলো এবং আল্লাহর গযব ও আযাবকে ভয় করলো আর এই বিশ্বাসের সাথে মেনে নিলো সত্য সঠিক জিনিসকে এবং যখন ‘নেকী’র কথা তার কাছে পেশ করা হলো, তখন এ সত্য অবশ্যই তাকে কল্যাণের পথ দেখাবে বলে সে বিশ্বাস করলো, এমতাবস্থায় সে এটা স্পষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে পারবে যে, এটাই প্রকৃতপক্ষে সাফল্যের পথ । অপরদিকে বলা হয়েছে আর এক ব্যক্তির কথা, যে জান ও মাল দেয়ার ব্যাপারে কৃপণতা করলো সংকীর্ণতা দেখালো এবং আল্লাহ তায়ালা ও তার প্রদর্শিত পথ থেকে বেপরোয়া হয়ে গেলো । সে হেদায়াতকে উপেক্ষা করলো এবং এই কল্যাণকর পথকে অস্বীকার করলো । এই হচ্ছে সেই দুই শ্রেণীর মানুষ যার অন্তর্গত সকল মানুষ যারা বিভিন্ন মত, পথ, অনুভূতি, লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্ম প্রচেষ্টায় বিভক্ত । তাদের প্রত্যেকেরই আছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভংগি ও চলার পথ । প্রত্যেকেরই রয়েছে পৃথক পৃথক যোগ্যতা। এসব কিছুকে সামনে নিয়ে আবারও চিন্তা করে দেখুন! যে ব্যক্তি দান করলো ও তাকওয়া-পরহেযগারীর জীবন যাপন করলো ও কল্যাণকর কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তা মনে প্রাণে মেনে নিলো। ‘আমি মহান আল্লাহ তার জন্য সরল সঠিক পথপ্রাপ্তিকে অচিরেই সহজ করে দেবো ।’ এটা অতি সত্য কথা যে, যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহকে সদা-সর্বদা ভয় করে চলে এবং নেকী ও কল্যাণকর কাজ এবং ভালো মত ও পথকে ভাল বলে গ্রহণ করে সে অবশ্যই তার চেষ্টা সঠিক পথেই ব্যয় করে এবং তার চেষ্টা সঠিক খাতেই প্রবাহিত হয়। যার কারণে তার আত্মাকে সে পবিত্র করতে পারে এবং আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের পথ গ্রহণ করতে পারে। এই অবস্থাতেই সে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য লাভ করে এবং তখনই অনিবার্যভাবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তার যোগ্যতাকে বাড়িয়ে দেয়া হয়। তখন তাকে, তার ইচ্ছাকে এবং তার কর্ম-প্রচেষ্টাকে আল্লাহ রাব্বুল ইযযত নিজ কুদরতী হাতে পরিচালনা করেন। অপরদিকে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানীর তোয়াক্কা করে না, সে যেমন তার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি দুনিয়ার জীবনেও তার উদ্দেশ্য শেষ নাগাদ ব্যর্থ হয়। সে সহজ জীবন লাভে ধন্য হয়। দ্বীনের পথে চলা তার জন্যে আল্লাহ তায়ালা সহজ করে দেন, সে অবশ্যই সহজ ও শান্তিপূর্ণ জীবন লাভে ধন্য হয়। আল্লাহর মেহেরবানীতে অতি আসানীতে তার লক্ষ্যে সে উপনীত হয়। পৃথিবীতে যেমন, আখেরাতেও তেমনি সে শান্তির মুখ দেখতে পাবে ৷ তার আশপাশের সবকিছু তার জন্য ক্রমান্বয়ে শান্তিদায়ক হয়ে ওঠে এবং দেরীতে হলেও অন্য সবার জন্য সে শান্তিদায়ক হয়ে যায়। তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ হবে সহজ ও সাবলীল । তার চলার পথ যা এক সময় ছিলো অতি কঠিন তা হয়ে যাবে তার জন্য সুগম । বিভিন্ন কাজের জটিলতা তার জন্য হয়ে যায় সহজসাধ্য । আর ছোটো-বড়ো সকল কাজ পরম পরিতৃপ্তির সাথে সে সমাধা করার যোগ্যতা লাভ করে। এভাবে এমন একটি পর্যায়ে সে উপনীত হয়, যখন সকল দিক থেকে তার যোগ্যতার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে । এটাই হচ্ছে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যায়, যখন সে রসূল (স.)-এর সাথী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াদার এই হকদার হয়! “আমি (মহান আল্লাহ) সহজ করে দেবো তার জন্য সহজ সুন্দর জীবন পথকে ।” ‘আর যে ব্যক্তি কৃপণতা করলো ও বেপরোয়া হয়ে গেলো এবং সত্য সঠিক ও ভালো কাজকে অস্বীকার করলো আমি (মহান আল্লাহ) তার জন্য কষ্টের পথপ্রাপ্তি সহজ করে দেবো। আর তার ধন-দৌলত তার কোনোই কাজে লাগবে না যখন তার ওপর ধ্বংস নেমে আসবে ।’ আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কাজ করতে গিয়ে নিজের জান-মালের কোনো কষ্ট বরদাশত করতে রাজী নয় এবং নিজ প্রভুর সন্তোষ পাওয়ার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখায় ও তার কাছ থেকে হেদায়াত লাভ করতে চায় না, উপরন্তু তার দিকে আহবান জানানো হলে এবং তার দেয়! জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হলে সে তা অস্বীকার করে। দ্বীনের দাওয়াতকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে চায়। অর্থাৎ তার কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌছানো হলে সে কোনো কৌশলে তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে অথবা সরাসরি অত্যন্ত কর্কশভাবে তা অস্বীকার করে ও চরম ভাবে বিরোধিতা করে এবং এভাবে আল্লাহ্‌ তায়ালার গযবের যোগ্য হয়ে যায়, যার কারণে সব দিক থেকে তার ওপরে কষ্টই এসে পড়ে, তখন তার জন্য কষ্টের পথই- সামনে এসে যায়। এই অবস্থায় সব দিক থেকে সে ক্লাস্তিকর অবস্থার শিকার হয় এবং তার প্রতি পদে পদে ভুল হতে থাকে, সহজ অবস্থা তার জন্য যেন হারাম হয়ে যায় এবং তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ কষ্ট ও বাধা-বিঘ্নের মধ্যে পড়ে যায়। এ অবস্থায় সে নেক পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নোংরামী ও নষ্টামির পথে চলতে থাকে৷ অথচ সে মনে করে যে, এটাই তার জন্য সার্বিক সাফল্যের পথ । আসলে এই ধরনের হতভাগা ব্যক্তির প্রতি পদে পদে পদস্খলন হতে থাকে । যতোবার সে পদস্খলন থেকে দূরে সরে যাবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজ থেকে দূরে সরে যাবে ততোবার সে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে এবং সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে ও পা পিছলে ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকবে, তখন তার সেই ধন-সম্পদ যা সে কৃপণতা করে করে জমা করে রেখেছিলো তা তাকে উদ্ধার করার ব্যাপারে কোনো কাজেই লাগবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার পথ প্রদর্শন থেকে বেপরোয়া ছিলো তার অবস্থাও ওই একই প্রকার হবে। তাই বলা হচ্ছে,’ যখন সে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে, তখন তার ধন-সম্পদ তার কোনো কাজেই লাগবে না।’ অন্যায় অসৎ ও অকল্যাণকর কাজে লিপ্ত হওয়া সহজ, একথার অর্থ হচ্ছে কষ্টটাই সহজলভা হওয়া । আর ধরে নেয়া যাক যদি পার্থিব জীবনে এহেন ব্যক্তি সফলতা লাভ করে ও কষ্ট থেকে মুক্তি পায়ও, কিন্তু কি অবস্থা হবে তার আখেরাতের জীবনে? সেখানে যদি মুক্তি না পায় এবং সেখানকার চূড়ান্ত কষ্ট জাহানাম তার ভাগ্যে জুটে যায়, তাহলে সে কষ্ট কি তার জন্য আরো বেশী কঠিন নয়? জাহান্নাম লাভ থেকে বেশী কষ্টকর আর কোনো জিনিস হতে পারে? বরং, সেটা হচ্ছে চূড়ান্ত কষ্ট।

ফী জিলালিল কুরআন: পথ মাত্র দুটি : এভাবে সূরার প্রথম অধ্যায়টি শেষ হলো। এখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, প্রত্যেক যামানায় এবং প্রতিটি দেশে মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বদাই দুটি মত ও পথ বিরাজ করছে। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সর্বদাই পৃথিবীতে দুটি দল ও দুটি অভিমত বর্তমান ছিলো-তা সে মতের অনুসারীরা যে ধরনের হোক বা সংখ্যায় তাদের তারতম্য যাই হোক না কেন এবং তাদের সংকট-সমস্যা যাই থাকুক না কেন। আর এটাও সত্য কথা যে, প্রত্যেক মানুষ তা-ই করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। তখন তার পছন্দমতো পথপ্রাপ্তিকেই তার জন্য আল্লাহ তায়ালা সহজ করে দেন তা সে সহজ জিনিসের জন্যই হোক বা কঠিন জিনিসের জন্য হোক । দ্বিতীয় অধ্যায়ে দুই শ্রেণীর প্রত্যেকের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে ওই শ্রেণীর পরিণতির কথা যাদের জন্য তাদের সঠিক পথপ্রাপ্তিকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে যাদের জন্য সঠিক পথপ্রাপ্তিকে দূর্গম করা হয়েছে, তাদের পরিণতির কথাও সাফ সাফ করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত পরিণতিকে সম্পূর্ণ ইনসাফভিত্তিক ও যুক্তিসংগত বলে ঘোষণা করা হয়েছে-সে পরিণতি পুরস্কার আকারে হোক বা শাস্তি আকারেই আসুক । এটাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ওই পরিণতিগুলো অবশ্যই আসবে এবং নির্দিষ্ট সময়েই আসবে । সুতরাং আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী, ওই পরিণতিসমূহ আসার পূর্বেই তিনি হেদায়াতের পথকে মানুষের সামনে স্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে স্ফুলিংগবিশিষ্ট আগুনের ভয় দেখিয়েছেন। নিশ্চয়ই, অবশ্যই আমার ওপর রয়েছে হেদায়াতের দায়িত্ব, আর দুনিয়া ও আখেরাতের নিরংকুশ মালিকানা আমারই জন্যে ৷ সুতরাং, আমি তোমাদেরকে স্কুলিংগে ভরা ডগডগে আগুনের আযাবের ভয় দেখাচ্ছি । এতে সে হতভাগা ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করবে না, যে আল্লাহর রসূলকে মিথ্যাবাদী বলে বদনাম করেছে এবং সত্য গ্রহণ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে। অচিরেই এর থেকে নাজাত দেয়া হবে সেই মোত্তাকী পরহেযগার লোককে, যে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজ দায়িত্ববোধে ভাল কাজ করে এবং ইচ্ছায় অভাবগ্রস্তকে অভিলাষে পবিত্র হওয়ার দান করে। ‘আর তাঁর কাছে কারো কোনো কিছু পাওয়ার অধিকার নেই । শুধু এটুকুই তার সম্বল যে, সে সুমহান আল্লাহ্‌ তায়ালার সন্তুষ্টি পেতে চায়। এই সন্তুষ্টি প্রাপ্তির প্রচেষ্টাই তাকে আল্লাহর নেয়ামত লাভের সন্তুষ্টি ও অধিকার দান করে। সুতরাং, এই একটি মাত্র উপায়ে যখন সে আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চাইবে, তখন অবশ্যই তিনি তার ওপর খুশী হয়ে যাবেন । আর শীঘ্রই সে খুশী হয়ে যাবে । অবশ্যই, আল্লাহ তায়ালা নিজের পক্ষ থেকে তার বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করাকে নিজের ওপর বাধ্যতামূলক বানিয়ে নিয়েছেন। মানুষকে সুপথ দেখানোর যে ব্যবস্থা তিনি করেছেন সে পথ গ্রহণ করার যোগ্যতাও প্রকৃতিগতভাবে তিনি মানুষের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন। আর এই সঠিক পথকে ব্যাখ্যা করে বুঝানোর জন্য তিনি ঐশী বাণী দিয়ে পয়গাম্বরদেরকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। যাতে করে সে অস্বীকার করা বা না মানার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে না পায় বা কেউ কারো ওপর যুলুম না করতে পারে। এ জন্যই তার ঘোষণা, ‘অবশ্যই আমার ওপরে রয়েছে তাদেরকে হেদায়াতের দায়িত্ব ।’ এর পরে আসছে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার যিনি অধিকারী সেই মহান সত্ত্বার বিবরণ ৷ যার ক্ষমতা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সমগ্র মানবমন্ডলীর ওপর এবং যার ক্ষমতার সীমানা পার হয়ে কোথাও কারো আশ্রয় পাওয়ার জায়গা নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর অবশ্যই দুনিয়া আখেরাতের নিরংকুশ মালিকানা একমাত্র আমারই’। সুতরাং আমার থেকে সরে গিয়ে কোন্‌ সুদূরে তারা চলে যাবে? উপরে তিরঙ্কারের সাথে কিছু কথা বলার পর আল্লাহ্‌ তায়ালা পুনরায় সান্ত্বনার স্বরে জানাচ্ছেন যে, তিনি তার বান্দাদের জন্যে সঠিক পথ দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন এবং জানিয়েছেন যে, নেক কাজ করার জন্যে দূনিয়া ও তার যথাযথ প্রতিদান পাওয়ার জন্যে আখেরাতই উত্তম সময়। একথাগুলো বলে মৃদু তিরস্কারের সাথে আল্লাহ্‌ তায়ালা মৃত্যুর কথা স্মরণ করাচ্ছেন এবং প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সময়মতো বিশদভাবে জানিয়ে দিয়ে তাদেরকে আসলে কেয়ামতের ভয় দেখিয়েছেন এবং তার আযাব থেকে বাচার জন্য সময়মতো সতর্ক করেছেন। বলছেন, ‘আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি ডগড়গে আগুনের আযাব সম্পর্কে ।’ সেদিন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে এই কঠিন আগুন । ‘সেখানে ভয়ানক দুষ্ট লোক ছাড়া কেউ প্রবেশ করবে না ।’ অর্থাৎ বান্দাদের মধ্যে ভয়ানক দুষ্ট লোক যারা, তারা সবাই ওই আগুনে প্রবেশ করবে। আর ওই আগুনে যারা প্রবেশ করবে তাদের থেকে হতভাগা ও অসহায় আর কে হতে পারে? এরপর যে হতভাগা ব্যক্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সে হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে নবীকে এবং তার আনীত দ্বীনকে মিথ্যাবাদী ঠাওরিয়েছে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে। দ্বীন ইসলামের দাওয়াতকে সে যুক্তিহীনভাবে ঠুকরে দিয়েছে । কোরআনরূপী হেদায়াতের আলো এবং তার মহান প্রভুর আহবান থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে। অথচ ওই ব্যক্তিকে তিনি সঠিক পথ দেখানোর ওয়াদা করেছেন যে, তার নিকট থেকে হেদায়াত পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে এগিয়ে আসবে ৷ ‘আর যে তাকওয়া পরহেযগারী করে চলবে তাকে সরিয়ে নেয়া হবে ওই আগুন থেকে ।’ এ হচ্ছে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে ওই হতভাগা দুষ্ট লোকটির মোকাবেলায় সঠিক ভূমিকা প্রদর্শন করবে । তারপর আল্লাহ তায়ালা এ পরহেযগার ব্যক্তির বর্ণনা পেশ করতে গিয়ে বলছেন, “সে হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে পবিত্রতা অর্জন করার উদ্দেশ্যে তার ধন-সম্পদ দান করে, সে হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে তার ধন-সম্পদ খরচ করে, যাতে করে সে এ মাল দ্বারা নিজেকে পবিত্র করতে পারে, মানুষকে দেখানোর জন্য বা নিজের প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য নয়। সে আনুগত্যবোধে খরচ করে, কারো সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে নয় বা কারো প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে নয়; বরং নিছক তার পরওয়ারদেগারের সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির আশাতে সে খরচ করে, যেহেতু একমাত্র তিনিই তার সুমহান প্রতিপালক। ‘অথচ তোমাদের কারোরই তার কাছে এমন কিছু ছিলোনা যে যার জন্যে তোমাদের কোনোরকম প্রতিদান দেয়া হবে। সা, পাওনা এটুকুই যে সে শুধু তার মহান মালিকের সনুষ্টিই কামনা করেছে।’ তারপর কী হবে? কী অপেক্ষা করবে এই নেক ব্যক্তির জন্যে? যে পবিত্রতা লাভ করার মানসে দান করে এবং তার সুমহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় এই ত্যাগ স্বীকার করে। অবশ্যই, রূহ্গুলো বা মোমেন মানবাত্মাসমূহকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য কোরআন পাক যে আকর্ষণীয় পদ্ধতি ব্যবহার করেছে তা বড়ই চমৎকার, বিস্ময়কর এবং অসাধারণ ৷ ‘এবং অবশ্যই খুব শীঘ্র সে খুশী হয়ে যাবে।’ এই পরহেযগার ব্যক্তির হৃদয়ে এই পৃথিবীতেই সন্তুষ্টি ঢেলে দেয়া হয়। এই সন্তুষ্টিই তার অংগ-প্রত্যংগে দান করা হয়, এই সন্তুষ্টিই ছেয়ে যায় তার সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে । এই সন্তুষ্টির অনুভূতিই তার জীবনকে সজীব করে, উজ্জীবিত করে তার গোটা সত্ত্বাকে। কি চমৎকার তার প্রতিদান, আর কি চমৎকারই না তার মহান নেয়ামত । ‘আর অবশ্যই, অতি শীঘ্র সে খুশী হয়ে যাবে ।’ খুশী হয়ে যাবে সে তার জীবন পথে যা আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকে দিয়েছেন, খুশী হয়ে যাবে তার পরওয়ারদেগারের ওপর, যখন যা পাবে তাতেই সে খুশী থাকবে, খুশী থাকবে সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় স্বাচ্ছন্দে-সংকটে, বিপদে শান্তিতে সর্বাবস্থায় সে সন্তুষ্ট থাকবে। তখন কিছুতেই সে পেরেশান হবে না, সংকীর্ণ হবে না তার হৃদয়, ব্যস্তও হবে না সে । কোনো বোঝা তাকে ক্লান্ত করবে না, কোনো পক্ষই তার কাছে খুব দুর মনে হবে না। এই সন্তুষ্টিই হচ্ছে তার প্রতিদান, এই প্রতিদানই হচ্ছে সব কিছুর সেরা । যা কিছু জান-মালের কোরবানী দিয়েছে সে দুনিয়ার জীবনে তার কারণেই সে এই প্রতিদান পাওয়ার যোগ্য । প্রতিদান তার জন্য, যে দান করে পবিত্রতা লাভের আশায়- আর যে খরচ করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় । এ প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। এই মহাদানের পবিত্র সুধা তিনি ঢেলে দেন সেই সকল হৃদয়ে যেগুলো পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে এবং ঐকান্তিকভাবে তার জন্য ঢেলে দেন সেই সকল হৃদয়ে যেগুলো পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে এবং ঐকান্তিকভাবে তার জন্য নিবেদিত এ হৃদয়গুলো আর কিছু দেখেনা, আর কিছু বুঝেনা । এদের প্রত্যেকের জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে উদাত্ত ঘোষণা, ‘আর অতি শীঘ্র অবশ্যই সে খুশী হয়ে যাবে ।’ যখন সে টাকা পয়সা খরচ করেছে এবং যা কিছু দেয়ার মতো সবই দিয়েছে, তখনই সে খুশী হয়ে যাবে। এ সন্তুষ্টি বোধ প্রত্যেক মোমেনের দিলে হঠাৎ করে উদিত হবে না বরং এ সন্তুষ্টি বোধ ওই হৃদয়ে ধীরে ধীরে দানা বাধতে থাকবে, যে পবিত্র উদ্দেশ্যে তার মাল সম্পদ দান করতে থাকবে । আর সে কখনোই আল্লাহর সম্তোষ ছাড়া অন্যকিছু আশা করেনা করতে পারেনা ৷

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:

اللَّيْلِ শব্দের অর্থ : রাত। সূরার প্রথম আয়াতের اللَّيْلِ শব্দ থেকেই উক্ত নামে সুরার নামকরণ করা হয়েছে।

১-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর:

সূরাটির শুরুতেই মহান আল্লাহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের শপথ করেছেন যে সময়গুলোতে মানুষ বিভিন্ন আমল করে থাকে। কর্ম প্রচেষ্টার দিক দিয়ে পৃথিবীতে মানুষ দু’ধরণের হতে পারে। এক. যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সঠিক পথে চলার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এরাই সফলকাম এবং তাদের তিনটি গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। দুই. যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভ্রান্তপথে চলার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এরা ব্যর্থকাম এবং এদের তিনটি দোষ বর্ণনা করা হয়েছে।

(إِذَا يَغْشٰي) অর্থ: يعم الخلق بظلامه

বা সমস্ত সৃষ্টি জীবকে রাত তার অন্ধকার দ্বারা আচ্ছাদিত করে নেয়। ফলে সবাই স্বীয় আশ্রয়স্থলে আশ্রয় নেয় এবং সারাদিনের ক্লেশ ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম গ্রহণ করে।

تَجَلّٰي অর্থাৎ সৃষ্টি জীবের জন্য যখন দিন আলোকজ্জ্বল হয়ে যায়। ফলে সবকিছু তার আলোয় আলোকিত হয় এবং সবাই কর্মস্থলে চলে যায়। আলকামাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদের কতক ছাত্রদের একটি দলের সাথে শামে গেলাম। আবূ দারদা আমাদের আগমনের কথা শুনতে পেয়ে কাছে এসে বললেন : তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে কুরআন পড়তে পারে? আমরা বললাম : হ্যাঁ, তিনি বললেন : কে অধিক ভাল পড়তে পারে? (আলকামাহ) বললেন: সবাই আমার দিকে ইশারা করল। তিনি বললেন: পড়! আমি পড়লাম,

(وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشٰي …….الذَّكَرَ وَالْأُنْثٰٓي)

তুমি কি তোমার সাথীর (ইবনু মাসঊদ) মুখ থেকে শুনেছ? আমি বললাম: হ্যাঁ, তিনি বললেন: আমিও তা নাবী (সাঃ)-এর মুখ থেকে শুনেছি। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৩) রাতের আচ্ছন্ন করা এবং দিনের আলোকিত হওয়ার শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা এ দুয়ের কল্যাণকর বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রতি যেমন বান্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তেমনি দুনিয়ায় নেক আমলের মাধ্যমে আখিরাতে মুক্তির পথ বেছে নেয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।

(وَمَا خَلَقَ) এখানে আল্লাহ তা‘আলা নিজ সত্ত্বার শপথ করেছেন। কেননা তিনি হলেন নর নারী উভয়ের সৃষ্টিকর্তা। এ ক্ষেত্রে ما মাওসূলা الذي বা যিনি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ما মাসদার বা ক্রিয়ামূল হলে অর্থ হবে শপথ নর নারী সৃষ্টির। (তাফসীর সা‘দী) মোট কথা আল্লাহ তা‘আলা নর নারী সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ)

“আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায়-জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা যারিয়াত ৫১: ৪৯)

(إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتّٰي)

এটা হলো পূর্ববর্তী শপথসমূহের জবাব। মানুষ বিভিন্ন রকম আমল করে থাকে। যে ব্যক্তি ভাল আমল করবে তার প্রতিদান জান্নাত আর যে খারাপ আমল করবে তার প্রতিদান জাহান্নাম।

অথবা আয়াতের অর্থ হলো তোমাদের কাজকর্ম ভিন্ন ভিন্ন। কেউ চাকুরী করে, কেউ কৃষি কাজ করে ইত্যাদি। তবে যে যাই করুক সব ধরনের কাজের হিসাব দিতে হবে।

(مَنْ أَعْطٰي وَاتَّقٰي)

অর্থাৎ সম্পদ ব্যয় করে যেসব ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেমন যাকাত প্রদান করা, সাদকাহ করা ও ভাল কাজে ব্যয় করা ইত্যাদি। আর যে সকল শারীরিক ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যেমন সালাত আদায় করা, সিয়াম পালন করা। যে সকল ইবাদত অর্থ ব্যয় ও শারীরিক পরিশ্রম উভয়ের সমন্নয়ে হয়ে থাকে; যেমন হাজ্জ, উমরা ইত্যাদি। এসব ইবাদত যারা করে থাকে এবং হারাম কাজ বর্জন ও নিদের্শমূলক কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আর আমলের হিসাব ও নেকীর বিশ্বাস রাখে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : صدق بالحسني বা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং এটা যার ওপর প্রমাণ বহন করে সব সত্য বলে বিশ্বাস করে। (তাফসীর সা‘দী)

لِلْيُسْرٰي ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : কল্যাণকর কাজের পথ সহজ করে দেব। জায়েদ বিন আসলাম (রহঃ) বলেন : জান্নাতের পথ সহজ করে দেব। মোট কথা তার জন্য এমন সব কাজ সহজ করে দেয়া হবে যা করলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি بَخِلَ অর্থাৎ সম্পদ সম্পর্কীয় ও শারীরিকসহ সকল ফরয বিধান পালন করে না এবং الحسني (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তা অস্বীকার করে তার জন্য জাহান্নামের কাজ সহজ করে দেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ)

“তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।” (সূরা আনআম ৬: ১১০)

আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা কোন এক জানাযায় নাবী (সাঃ)-এর সাথে আমরা ছিলাম। তখন নাবী (সাঃ) বললেন :

مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَقَدْ كُتِبَ مَقْعَدُهُ مِنَ الجَنَّةِ، وَمَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ

তোমাদের প্রত্যেকের স্থান জান্নাতে বা জাহান্নামে নির্ধারিত করা আছে। সাহাবী বললেন : তার ওপর নির্ভর করে থাকব না? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন:

اعْمَلُوا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ

তোমরা আমল করে যাও কারণ প্রত্যেকের জন্য সেই আমলই সহজ করে দেয়া হয়েছে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর নাবী (সাঃ) এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৫)

আলী (রাঃ) থেকেই অন্য বর্ণনায় রয়েছে জনৈক ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! আমরা কি আমাদের লিপিবদ্ধ কিতাবের ওপর নির্ভর করে আমল করা ছেড়ে দেব না? আমাদের মধ্যে যে সৌভাগ্যবান সে সৌভাগ্যবানদের আমলের দিকেই ধাবিত হবে। আর যে দুর্ভাগ্যবান সে দুর্ভাগ্যবানদের আমলের দিকেই ধাবিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : যারা সৌভাগ্যবান তাদের জন্য সৌভাগ্যবানদের আমল করা সহজ হয়ে যাবে। তারপর

(فَأَمَّا مَنْ أَعْطٰي…. لِلْيُسْرٰي)

আয়াতগুলো পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৮)

(إِذَا تَرَدّٰي) মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: অর্থ হলো إذا مات বা যখন মারা যাবে। জায়েদ বিন আসলাম বলেন:

إِذَا تَرَدّٰي في النار

বা যখন সে জাহান্নামে পতিত হবে তখন তার সম্পদ কোন উপকারে আসবে না। কেননা মানুষ মারা গেলে তার আমলই কেবল সাথে যায়, অন্যদিকে দুনিয়াতে যে সম্পদ রেখে গেছে যার হক আদায় করেনি তা তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

অতএব এ কথা বলার কোন সুযোগ নেই, আমার তাকদীর তো পূর্বে লেখাই আছে আর আমল করার কোন প্রয়োজন নেই। না, এরূপ ধারণা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দুনিয়াতে প্রেরণ করছেন পরীক্ষা করার জন্য, কে সৎ আমলে উত্তম।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. যারা সৎ আমল করে এবং আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে তাদের জন্য তিনি জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। পক্ষান্তরে যারা এর বিপরীত আমল করে তাদের জন্য জাহান্নামের পথ সহজ করে দেন।
২. তাকদীর পূর্ব থেকেই লিপিবদ্ধ রয়েছে বলে আমল ছেড়ে বসে থাকা যাবে না।
১২-২১ নম্বর আয়াতের তাফসীর:

(إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدٰي)

অর্থাৎ হালাল-হারাম, ভাল-মন্দ, হিদায়াত ও ভ্রষ্টতা সব কিছু বর্ণনা করার দায়িত্ব আমার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّا هَدَيْنٰهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِرًا وَّإِمَّا كَفُوْرًا) ‏

“আমি তাকে পথ দেখিয়েছিÑ এরপর হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো হবে অকৃতজ্ঞ।” (সূরা দাহর ৭৬ : ৩)

মূলত এ সঠিক পথ দেখানোর জন্যই আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে রাসূল প্রেরণ করেছেন, তাদের সাথে দিয়েছেন পথনির্দেশক কিতাব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হাজ্জে বলেছেন : আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতদিন তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও আমার সুন্নাহ। (মিশকাত হা. ১৮৬, সহীহ)

(وَاِنَّ لَنَا لَلْاٰخِرَةَ وَالْاُوْلٰی)

অর্থাৎ উভয় জগতের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক একমাত্র তিনি। এতে কেউ শরীক নেই। অতএব যারা আখিরাতের আশা করে তারা যেন তাঁর কাছে হিদায়াত অন্বেষণ করে। এখানে আখেরাতকে আগে আনা হয়েছে তার গুরুত্ব ও স্থায়ীত্ব বুঝানোর জন্য।

(نَارًا تَلَظّٰي)

‘প্রজ্জ্বলিত অগ্নি’ অর্থাৎ জাহান্নাম, যা এখনো বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি দাহ্যশক্তিসম্পন্ন। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৬৫) যার সর্বনিম্ম শাস্তি হল, পাপীকে আগুনের জুতো পরিধান করানো হবে; ফলে মাথার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে। (সহীহ বুখারী হা. ১৪১১)

الْأَشْقَي ‘হতভাগ্য ব্যক্তি’-এর তাফসীর পরের আয়াতে উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(الَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰي)

“যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।” অর্থাৎ যে নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে অস্বীকার করে এবং ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। (তাফসীর মুসায়সসার)

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন :

لَا يَدْخُلُ النَّارَ إِلَّا شَقِيٌّ

দুর্ভাগা ছাড়া কেউ জাহান্নামে যাবে না। বলা হলো : দুর্ভাগা কে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন :

مَنْ لَمْ يَعْمَلْ لِلّٰهِ بِطَاعَةٍ، وَلَمْ يَتْرُكْ لَهُ مَعْصِيَةً

যে আনুগত্যপরায়ণ নয় এবং আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে পাপ কাজ হতে বিরত থাকে না। (আহমাদ ২/৩৪৯, ইবনু মাযাহ হা. ৪২৯৮, সনদ সহীহ।)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিই জান্নাতে যাবে তবে যারা ابي বা অবাধ্য তারা ব্যতীত। বলা হলো আবা বা অবাধ্য কারা? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : যারা আমার আনুগত্য করে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যারা আমার অবাধ্য তারাই হলো আবা। (সহীহ বুখারী হা. ৭২৮০)

(وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَي)

অর্থাৎ মুত্তাকী জাহান্নামে যাবে না। তাক্বওয়ার ফলাফল ও গুরুত্ব সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুর দিকে আলোচনা করা হয়েছে।

(الَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَه)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজ সম্পদ আল্লাহ তা‘আলার হুকুম অনুযায়ী ব্যয় করে যাতে তার অন্তর ও সম্পদ পবিত্র হয়ে যায়।

يَتَزَكّٰي অর্থাৎ কেউ উপকার করেছে তার বদলাস্বরূপ দান করে না, বরং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য দান করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবে। তার মধ্যে একশ্রেণি হলো, যারা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় এমনভাবে ব্যয় করে যে, ডান হাত কী ব্যয় করল বাম হাত তা জানে না। অর্থাৎ লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে না। (সহীহ বুখারী হা. ১৪২৩) আর যদি মানুষকে দেখানোর জন্য কিম্বা দানবীর হিসাবে খ্যাতি লাভ করার জন্য দান করে তাহলে এ নেকী পাবে না, বরং গুনাহগার হবে।

(وَلَسَوْفَ يَرْضٰي)

অর্থাৎ যারা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাদের আমলসমূহ সম্পাদন করে থাকে তাদের আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত দেবেন যা পেয়ে তারা সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(مَثَلُ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَھُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللہِ کَمَثَلِ حَبَّةٍ اَنْۭبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِیْ کُلِّ سُنْۭبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍﺚ وَاللہُ یُضٰعِفُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُﺚ وَاللہُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ‏)‏

“যারা আল্লাহর পথে তাদের মাল খরচ করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে একটি শস্যদানা যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করে। প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা থাকে আর আল্লাহ যাকে চান তাকে আরো বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রশস্তকারী, মহাজ্ঞানী।” (সূরা বাক্বারাহ ২ : ২৬১)

ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে অত্র আয়াতগুলো আবূ বকর (রাঃ)-এর শানে নাযিল হয়েছে। তবে আয়াতগুলো ব্যাপক, যাতে আবূ বকর (রাঃ)-ও শামিল। এর সপক্ষে একটি হাদীসও রয়েছে : একদা নাবী (সাঃ) বললেন : যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় কোন বস্তুর জোড়া দান করবে উক্ত ব্যক্তিকে জান্নাতের প্রত্যেক দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে। আবূ বকর বললেন : সকল দরজা দিয়ে আহ্বান করার প্রয়োজন নেই (এক দরজা দিয়ে আহ্বান করলেই যথেষ্ট)। তবে এমনকি কেউ আছে যাকে সব দরজা হতে আহ্বান করা হবে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : আশা করি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। (সহীহ বুখারী হা. ৩৬৬৬)

সুতরাং সব ধনবান মুসলিম ভাইদের আবূ বকর (রাঃ)-এর মত দানবীর হওয়া উচিত। তাহলে জান্নাতের পথ অনেক সুগম হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. দুনিয়া ও আখিরাতের কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার।
২. জাহান্নামীদের পরিচয় জানতে পারলাম।
৩. যারা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমল করে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে জানলাম।

তাফসীরে‌ ইবনে কাছীর:-

নবী করীম (সঃ) হযরত মুআযের (রঃ) প্রতি যে উক্তিটি করেছিলেন তা পূর্বেই গত হয়েছে। তাহলো “কেন তমি নামাযে (আরবি) এবং (আরবি) এই সূরাগুলো পাঠ কর না?”

১-১১ নং আয়াতের তাফসীর

মুসনাদে আহমদে হযরত আলকামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি সিরিয়ায় আগমন করেন এবং দামেস্কের মসজিদে গিয়ে দুই রাকআত নামায পড়েন। অতঃপর দুআ করেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে একজন উত্তম সাথী দান করুন!” এরপর হযরত আবুদ দারদা’র (রাঃ) সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কোথাকার লোক? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি একজন কুফার অধিবাসী।” হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ “আপনি ইবনে উমি আবৃদ (রাঃ)-কে (আরবি) এ সূরাটি কিভাবে পড়তে শুনেছেন?” জবাবে হযরত আলকামা (রাঃ) বলেনঃ “তিনি পড়তেন (আরবি)।” তখন হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) বললেনঃ “আমিও রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে এ সূরাটি এ ভাবেই পড়তে শুনেছি। অথচ জনগণ আমাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “আপনাদের মধ্যে কি বালিশ ওয়ালা (অর্থাৎ সফরে যার কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বিছানাপত্র থাকতো) এবং যিনি এমন কিছু গোপনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে জ্ঞান অন্য কারো ছিল না এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ভাষায় যিনি শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) নেই?”

হযরত ইবরাহীম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর সঙ্গী-সাথীগণ হযরত আবুদ দারদা (রাঃ)-এর খোঁজে আগমন করেন। হযরত আবুদ দারদা (রাঃ)ও তাদেরকে খোঁজ করতে করতে পেয়ে যান। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর কিরআত অনুযায়ী কুরআন পাঠকারী কেউ আছেন কি? উত্তরে তারা বললেনঃ “আমরা সবাই (তার কিরআতের অনুসারী)।” তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “আপনাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহর কিরআত অধিক স্মরণকারী কে আছেন?” তাঁরা জবাবে হযরত আলকামা (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করলেন। তখন হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আপনি হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাঃ)-কে (আরবি) এ সূরাটি কিভাবে পড়তে শুনেছেন? তিনি (আরবি) উত্তরে বললেন, “তিনি পাঠ করতেন।” হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) একথা শুনে বললেনঃ “আমিও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এভাবেই পড়তে শুনেছি। অথচ জনগণ চায় যে, আমি যেন পাঠ করি। আল্লাহর কসম! তাদের কথা আমি মানব না’’’’ (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এভাবে বর্ণনা করেছেন) মোট কথা, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আবুদ দারদা (রাঃ)-এর কিরআত এরূপ। হযরত আবুদ দারদা এ বর্ণনাকে উসূলে হাদীসের পরিভাষায় মারফু বলেও উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য জমহূরের কিরআত বর্তমানে কুরআনে উল্লিখিত কিরআতের অনুরূপ।

আল্লাহ তা’আলা সমগ্র সৃষ্টি জগতের উপর ছেয়ে যাওয়া রাত্রির শপথ করছেন, সব কিছুকে আলোকমণ্ডিত করে দেয়া দিবসের শপথ করেছেন এবং সমস্ত নর-নারী, নর ও মাদী জীবসমূহের স্রষ্টা হিসেবে নিজের সত্ত্বার শপথ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।” (৭৮:৮) আরো বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি প্রত্যেক জিনিসের জোড়া সৃষ্টি করেছি।” (৫১৪ ৪৯) এই শপথ করার পর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলছেনঃ অবশ্যই তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকৃতির। অর্থাৎ তোমাদের প্রচেষ্টা এবং আমলসমূহ পরস্পরবিরোধী, একটি অন্যটির বিপরীত। যারা ভাল কাজ করছে তারাও আছে এবং যারা মন্দ কাজে লিপ্ত রয়েছে তারাও আছে।

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যে ব্যক্তি দান করলো ও মুত্তাকী হলো অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তার পথে খরচ করলো, মেপে মেপে পা বাড়ালো, প্রত্যেক কাজে আল্লাহর ভয় রাখলো আল্লাহর ওয়াদাকৃত পুরস্কারকে সত্য বলে জানলো এবং তাঁর পুণ্যের অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বাস করলো, আর যা উত্তম। গ্রহণ করলো, আমি তার জন্যে সহজ পথ সুগম করে দিবো।

(আরবি) শব্দের অর্থ ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, করা হয়েছে। কেউ কেউ এর অর্থ ‘নিয়ামত’ করেছেন। আবার কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, এর ভার্থ হলোঃ নামায, রোযা, যাকাত, সাদকা, সাদকায়ে ফিত্র এবং জান্নাত।

মহান আল্লাহ বলে আমি তার জন্যে সহজ পথ সুগম করে দিবো। অর্থাৎ কল্যাণ, অত এ উত্তম বিনিময়ের পথ।

পারে সে ব্যক্তি কার্পণ্য করলো এবং নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলো এবং হুসন’ অর্থাৎ কিয়ামতের বিনিময়কে অবিশ্বাস করলো, তার জন্যে আমি সুগম করে দিবো কঠোর পরিণামের পথ। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি তাদের অন্তঃকরণ ও তাদের চক্ষু উল্টিয়ে দিবো, যেমন তারা প্রথমবার কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি এবং তাদেরকে আমি অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দিবো।” (৬৪১১০) প্রত্যেক আমলের বিনিময় যে সেই আমলের অনুরূপ হয়ে থাকে এ সম্পর্কিত আয়াত কুরআন কারীমের মধ্যে বহু রয়েছে। যে ভাল কাজ করতে চায় তাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়। পক্ষান্তরে যে মন্দ কাজ করতে চায় তাকে মন্দ কাজ করার সামর্থ্য প্রদান করা হয়। এ অর্থের সমর্থনে বহু হাদীসও রয়েছে। একটি হাদীস এই যে, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের আমলসমূহ কি তকদীরের লিখন অনুযায়ী হয়ে থাকে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বলেনঃ “হ্যা তকদীরের লিখন অনুযায়ীই আমল হয়ে থাকে।” একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ) তাহলে আমলের প্রয়োজন কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তির উপর সেই আমল সহজ হবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা বাকী’ গারকাদে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে এক জানাযায় শরীক ছিলাম। তিনি বললেনঃ “জেনে রেখো যে তোমাদের প্রত্যেকের স্থানই জান্নাতে অথবা জাহান্নামে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং লিপিবদ্ধ রয়েছে।” একথা শুনে জনগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে আমরা তো সেই ভরসায় নিষ্ক্রীয় হয়ে থাকলেই পারি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ তোমরা আমল করে যাও, কারণ প্রত্যেক লোকের জন্য সেই আমলই সহজ করা হবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” অতঃপর তিনি (আরবি) হতে (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করলেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এ বর্ণনাটিই অন্যভাবেও বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে এক টুকরো কাঠি ছিল এবং মাথা নীচু করে তিনি তা এদিক ওদিক করছিলেন। শব্দের মধ্যে কিছু কম বেশীও রয়েছে। উপরে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর প্রশ্ন সম্বলিত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। মুসনাদে আহমদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ)-এর একই ধরনের প্রশ্ন সম্বলিত একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং নবী করীমের (সঃ) উত্তরও প্রায় একই রকমের রয়েছে।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হযরত জাবির (রাঃ) হতেও একই ধরনের বর্ণনার উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনে জারীরেরই (রঃ) অন্য একটি বর্ণনায় দু’জন যুবকের একই রকম প্রশ্ন এবং রাসূলুল্লাহ (স)-এর একই রকম উত্তর বর্ণিত রয়েছে। তারপর সেই দুই যুবকের নিম্নের উক্তিও উল্লিখিত রয়েছেঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় সৎ আমল করতে থাকবো।” হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) হতেও একইভাবে বর্ণিত আছে যে, রাসুলে কারীম (সঃ) বলেনঃ “প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় সূর্যের উভয় পাশে দু’জন ফেরেশতা উপস্থিত হন এবং উচ্চস্বরে দু’আ করেন, যে দু’আ মানুষ ও জ্বিন ছাড়া সকল সৃষ্টি জীবই শুনতে পায়। তারা দু’আ করেনঃ “হে আল্লাহ! দানশীলকে পূর্ণ বিনিময় প্রদান করুন এবং কৃপণের মাল ধ্বংস করে দিন।” কুরআনে এ চারটি আয়াতের অর্থ এটাই।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোকের একটি খেজুরের বাগান ছিল। ঐ বাগানের একটি খেজুর গাছের শাখা একটি দরিদ্রলোকের ঘরের উপর ঝুঁকেছিল। ঐ দরিদ্র লোকটি ছিল পুণ্যবান। তার সন্তান সন্ততিও ছিল। বাগানের মালিক খেজুর নামাতে এসে ঝুঁকে থাকা শাখার খেজুরও নির্দ্বিধায় নামিয়ে নিতো। নীচে দরিদ্র লোকটির আঙ্গিনায় পড়া খেজুরও সে কুড়িয়ে নিতো। এমনকি দরিদ্র লোকটির ছেলে মেয়েদের কেউ দু একটা খেজুর মুখে দিলে বাগানের ঐ মালিক তার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঐ খেজুর বের করে নিতো। দরিদ্র লোকটি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে অভিযোগ করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, তুমি যাও (আমি এর সুব্যবস্থা করছি)।” অতঃপর তিনি বাগানের মালিকের সাথে দেখা করে বললেনঃ “তোমার যেই খেজুর গাছের শাখা অমুক দরিদ্রলোকের ঘরের উপর ঝুঁকে আছে সেই খেজুর গাছটি আমাকে দিয়ে দাও, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে সেই গাছের বিনিময়ে জান্নাতে একটি গাছ দিবেন।” বাগানের মালিক বললোঃ “ঠিক আছে, দিয়ে দিলাম। কিন্তু উক্ত গাছের খেজুর আমার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়। আমার বাগানে বহু গাছ আছে, কিন্তু ঐ গাছের মত সুস্বাদু খেজুর গাছ আর একটিও নেই।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) চুপচাপ ফিরে আসলেন। একটি লোক গোপনে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)এবং ঐ লোকেটির কথােপকথন শুনছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ গাছটি যদি আমার হয়ে যায় এবং আমি ওটা আপনাকে দিয়ে দিই তবে কি ঐ গাছের বিনিময়ে আমিও জান্নাতে একটি গাছ পেতে পারি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হা (অবশ্যই)। লোকটি তখন বাগান মালিকের কাছে গেলেন। তার নিজেরও একটি বাগান ছিল। প্রথমোক্ত বাগান-মালিক তাকে বললোঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে আমার অমুক খেজুর গাছের বিনিময়ে জান্নাতের একটি গাছ দিতে চেয়েছেন। আমি তাঁকে এই জবাব দিয়েছি। তার একথা শুনে আগন্তুক লোকটি তাকে বললেনঃ “তুমি কি গাছটি বিক্রি করতে চাও?” উত্তরে লোকটি বললোঃ “না। তবে হ্যা, ইতি মূল্য কেউ যদি দেয় তবে ভেবে দেখতে পারি। কিন্তু কে দিবে সেই মূল্য?” তখন আগন্তুক লোকটি জিজ্ঞেস করলেনঃ “কত মূল্য তুমি চাও?”বাগান মালিক জবাব দিলোঃ “এর বিনিময়ে আমি চল্লিশটি খেজুর গাছ চাই।” আগন্তুক বললেনঃ “এটা তো খুব বেশী হয়ে যায়। একটি গাছের বিনিময়ে চল্লিশটি গাছ।” তারপর উভয়ে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর আগন্তুক তাকে বললেনঃ “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমার ইপ্সিত মূল্যেই তোমার খেজুর গাছ ক্রয় করলাম।” মালিক বললোঃ “যদি তাই হয় তবে সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করে কথা পাকাপাকি করে নাও।” সুতরাং কয়েকজন লোক ডেকে নিয়ে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করা হলো এবং এইভাবে ক্রয় বিক্রয়ের কাজ পাকাপাকি হয়ে গেল। কিন্তু এতেও বাগান-মালিকের খুৎ খুঁৎ মনোভাব কাটলো না। সে বললোঃ “দেখো ভাই, আমরা এখান হতে পৃথক না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু বেচা কেনা সিদ্ধ হবে না?” ক্রেতা বললেনঃ “ঠিক আছে, তাই হবে।”বাগানের মালিক বললোঃ “আমি সম্মত হয়ে গেলাম যে তুমি আমাকে আমার এই খেজুর গাছের বিনিময়ে তোমার চল্লিশটি খেজুর গাছ প্রদান করবে। কিন্তু ভাই গাছগুলো ঘনশাখা বিশিষ্ট হওয়া চাই।” ক্রেতা বললেনঃ “আচ্ছা তা দিবো।” তারপর সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে এ বেচাকেনা সম্পন্ন হলো। তারপর তারা দুজন পৃথক হয়ে গেল (ক্রেতা লোকটি তখন আনন্দিত চিত্তে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর দরবারে হাযির হয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)। আমি ঐ বৃক্ষের মালিকানা লাভ করেছি এবং ওটা আপনাকে দিয়ে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন ঐ দরিদ্র লোকটির নিকট গিয়ে বললেনঃ “এই খেজুর গাছ তোমার এবং তোমার সন্তানদের মালিকানাভুক্ত হয়ে গেল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ সম্পর্কেই এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস)

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতসমূহ হযরত আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় তিনি বৃদ্ধ ও দুর্বল দাস-দাসীদেরকে মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর আযাদ করে দিতেন। এ ব্যাপারে একবার তাঁর পিতা আবু কাহাফা (তিনি তখনো মুসলমান হননি) বলেনঃ “তুমি দুর্বল ও বৃদ্ধদেরকে মুক্ত করছো, অথচ যদি সকল যুবকদেরকে মুক্ত করতে তবে তারা তোমার কাজে আসততা। তারা তোমাকে সাহায্য করতে পারতো এবং শত্রুদের সাথে লড়াই করতে পারতো।” একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন “আব্বাজান! ইহলৌকিক লাভালাভ আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করি।” এরপর এখান হতে সূরা শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

(আরবি) শব্দের অর্থ হলো মৃত্যুবরণ করা এবং আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া, এই উভয় অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।

১২-২১ নং আয়াতের তাফসীর

কাতাদা (রঃ) বলেন যে,(আরবি) এর ভাবার্থ হলোঃ আমার কাজ তো শুধু হালাল হারাম প্রকাশ করে দেয়া। এটাও অর্থ হয় যে, যে ব্যক্তি হিদায়াতের পথে চলেছে নিশ্চয়ই তার আল্লাহর সঙ্গে মিলন ঘটবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তো পরলোকের ও ইহলোকের মালিক। আমি তোমাদেরকে লেলিহান অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি।

মুসনাদে আহমদে হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে ভাষণে বলতে শুনেনঃ “(হে জনমণ্ডলী!) আমি তোমাদেরকে লেলিহান অগ্নি সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করছি।” তিনি একথা এতো উচ্চস্বরে বলছিলেন যে, বাজার থেকেও লোক তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছিল। তিনি একথা বারবার বলছিলেন এমন কি তাঁর চাদর মুবারক তাঁর কাঁধ থেকে লুটিয়ে পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে।

হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন যে জাহান্নামী ব্যক্তি সবচেয়ে কম শাস্তি প্রাপ্ত হবে তার পদদ্বয়ের নিচে দু’টুকরো অগ্নি স্ফুলিঙ্গ রাখা হবে, ঐ আগুনের তাপে লোকটির মগজ ফুটতে থাকবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সহীহ মুসলিমে হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যেই জাহান্নামীকে সবচেয়ে হালকা শাস্তি দেয়া হবে তার পদদ্বয়ে আগুনের এক জোড়া ফিতাযুক্ত সেণ্ডেল পরিয়ে দেয়া হবে, সেই আগুনের তাপে তার মাথার মগজ উনুনের উপরের হাঁড়ির পানির মত টগবগ করে ফুটতে থাকবে। যদিও তাকে সবচেয়ে কম শাস্তি দেয়া হবে তবুও সে মনে করবে যে, তার চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কাউকেও দেয়া হচ্ছে না।” মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, তাতে প্রবেশ করবে সেই নিতান্ত যে হতভাগা। অর্থাৎ এই জাহান্নামে শুধু ঐ লোকদেরকে পরিবেষ্টিত করে শাস্তি দেয়া হবে যারা অস্বীকার করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। যারা ইসলামের বিধান অনুযায়ী আমল করে না।

মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ শুধু শকী বা বদকার লোক ছাড়া কেউ জাহান্নামে যাবে না।” জিজ্ঞেস করা হলোঃ “শকী বা বদকার লোক কে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ যে আনুগত্যপরায়ণ নয় এবং আল্লাহর ভয়ে যে পাপ কাজ হতে বিরত থাকে।”

মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, শুধু তারা প্রবেশ করবে না যারা অস্বীকার করে।” জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আল্লাহর রাসূল (সঃ)! অস্বীকারকারী কারা? তিনি উত্তরে বললেনঃ “যারা আমার আনুগত্য করেছে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যারা আমার নাফরমানী করেছে তারাই অস্বীকারকারী।”

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আর জাহান্নাম হতে বহু দূরে রাখা হবে পরম ‘ মুত্তাকীকে। যে নিজেকে ও নিজের ধন সম্পদকে পবিত্র করার জন্যে, দ্বীন দুনিয়ার পবিত্রতা লাভের জন্যে নিজের ধন মালকে আল্লাহর পথে দান করে। আর সে কারো সাথে এই জন্যে সদ্ব্যবহার করে না যে, তার উপর তার অনুগ্রহ রয়েছে, বরং ঐ ক্ষেত্রেও সে পরকালে জান্নাত লাভের আশা পোষণ করে এবং সেখানে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার সন্তুষ্টি ও সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখে।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “অচিরেই এই ধরনের গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তি সন্তোষ লাভ করবে।” অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে এই আয়াত হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর শানে নাযিল হয়। এমনকি কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, এ ব্যাপারে সবারই মতৈক্য রয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এসবগুণ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রাঃ) অবশ্যই রয়েছেন। কিন্তু এখানে সাধারণভাবে সকল উম্মতের কথা বলা হয়েছে। তবে হযরত আবু বকর (রাঃ) সবারই প্রথমে রয়েছেন। কেননা, তিনি ছিলেন সিদ্দীক, পরহেযগার ও দানশীল। নিজের ধন মাল তিনি মহান প্রতিপালকের আনুগত্যে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহায্যার্থে মন খুলে দান করতেন। প্রত্যেকের সাথে তিনি সদ্ব্যবহার করতেন। এতে পার্থিব কোন লাভ বা উপকার আশা করতেন না। কোন বিনিময় তিনি চাইতেন না। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আনুগত্য। ছোট হোক আর বড় হোক প্রত্যেকেরই উপর হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর অনুগ্রহের ছোঁয়া ছিল। শকীফ গোত্রপতি উরওয়া ইবনে মাসউদকে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় হযরত আবু বকর (রাঃ) কিছু কড়া কথা শুনিয়ে ছিলেন। এবং ধমকিয়ে ছিলেন। তখন উরওয়া বলেছিলঃ “আমার উপর আপনার এমন কিছু অনুগ্রহ রয়েছে যার প্রতিদান দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি তা না হতো তবে আপনাকে অবশ্যই আমি জবাব দিতাম।” একজন বিশিষ্ট গোত্রপতির উপরও যখন হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর এমন অনুগ্রহ ছিল যে, তার সামনে তার মাথা উঁচু করে কথা বলার ক্ষমতা ছিল, তখন অন্যদের কথা আর কি বলা যাবে? এজন্যেই বলা হয়েছে যে, কারো প্রতি অনুগ্রহের বিনিময়ে পার্থিব কোন উপকার বা প্রতিদান তিনি চাইতেন না। শুধু আল্লাহর দীদার লাভই ছিল তার কাম্য।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জোড়া দান করবে তাকে কিয়ামতের দিন জান্নাতের রক্ষক ডাক দিয়ে বলবেনঃ “হে আল্লাহর বান্দা! এ দিকে আসুন। এই দরজা সবচেয়ে উত্তম।” তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কোন ব্যক্তিকে কি সকল দরজা থেকে আহ্বান করা হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যাঁ, আর আমি আল্লাহর নিকট আশা রাখি যে, তুমিও হবে তাদের অন্তর্ভুক্ত।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৯২-লাইল) : নামকরণ:

সূরার প্রথম শব্দ ওয়াল লাইল (وَالَّيْلِ )- কে এই সূরার নাম গণ্য করা হয়েছে।
(৯২-লাইল) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

পূর্ববর্তী সূরা আশ শামসের সাথে এই সূরাটির বিষয়বস্তুর গভীর মিল দেখা যায়। এদিক দিয়ে এদের একটিকে অপরটির ব্যাখ্যা বলে মনে হয়। একই কথাকে সূরা আশ শামসে একভাবে বলা হয়েছে আবার সেটিকে এই সূরায় অন্যভাবে বলা হয়েছে। এ থেকে আন্দাজ করা যায়, এ দু’টি সূরা প্রায় একই যুগে নাযিল হয়।

(৯২-লাইল) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

জীবনের দু’টি ভিন্ন ভিন্ন পথের পার্থক্য এবং তাদের পরিণাম ও ফলাফলের প্রভেদ বর্ণনা করাই হচ্ছে এর মূল বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এ সূরাটি দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগটি শুরু থেকে ১১ আয়াত পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ভাগটি ১২ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত।

প্রথম অংশে বলা হয়েছে, মানুষ ব্যক্তিগত, জাতিগত ও দলগতভাবে দুনিয়ায় যা কিছু প্রচেষ্টা ও কর্ম তৎপরতা চালায় তা অনিবার্যভাবে নৈতিক দিক দিয়ে ঠিক তেমনি বিভিন্ন যেমন দিন ও রাত এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। তারপর কুরআনের ছোট ছোট সূরাগুলোর বর্ণনাভংগী অনুযায়ী প্রচেষ্টা ও কর্মের সমগ্র যোগফল থেকে এক ধরনের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং অন্য ধরনের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নমুনা হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা শুনে এদের মধ্যকার পার্থক্য সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। কারণ এক ধরনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যে ধরনের জীবন পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করে অন্য ধরনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যে ঠিক তার বিপরীতধর্মী জীবন পদ্ধতির চিহ্ন ফুটে ওঠে। এই উভয় প্রকার নমুনা বর্ণনা করা হয়েছে ছোট ছোট, আকর্ষণীয়, সুন্দর ও সুগঠিত বাক্যের সাহায্যে। শোনার সাথে সাথে এগুলোর মর্মবাণী মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে যায় এবং সে সহজে সেগুলো আওড়াতে থাকে। প্রথম ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে: অর্থ- সম্পদ দান করা, আল্লাহভীতি ও তাকওয়া অবলম্বন করা এবং সৎবৃত্তিকে সৎবৃত্তি বলে মেনে নেয়া। দ্বিতীয় ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে: কৃপণতা করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির পরোয়া না করা এবং ভালো কথাকে মিথ্যা গণ্য করা। তারপর বলা হয়েছে, এই উভয় ধরনের সুস্পষ্ট পরস্পর বিরোধী কর্মপদ্ধতি নিজের পরিণাম ও ফলাফলের দিক থেকে মোটেই এক নয়। বরং যেমন এরা পরস্পর বিপরীতধর্মী, ঠিক তেমনি এদের ফলাফলও বিপরীতধর্মী। যে ব্যক্তি বা দল প্রথম কর্মপদ্ধতিটি গ্রহণ করবে তার জন্য মহান আল্লাহ জীবনের সত্য সরল পথটি সহজ লভ্য করে দেবেন। এ অবস্থায় তার জন্য সৎকাজ করা সহজ ও অসৎকাজ করা কঠিন হয়ে যাবে। আর যারা দ্বিতীয় কর্মপদ্ধতিটি অবলম্বন করবে আল্লাহ জীবনের নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ও কঠিন পথ তাদের জন্য সহজ করে দেবেন। এ অবস্থায় তাদের জন্য অসৎকাজ করা সহজ এবং সৎকাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ বর্ণনা এমন একটি বাক্যের দ্বারা শেষ করা হয়েছে যা তীরবেগে হৃদয়ে প্রবেশ করে মনের ওপর প্রভার বিস্তার করে সে বাক্যটি হচ্ছে: দুনিয়ার এই ধন- সম্পদ যার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়ে দেয়, এসব তো কবরে তার সাথে যাবে না, তাহলে মরণের পরে এগুলো তার কি কাজে লাগবে ? দ্বিতীয় অংশের ও এই একই রকম সংক্ষিপ্তভাবে তিনটি মৌলিক তত্ব পেশ করা হয়েছে। এক, দুনিয়ার এই পরীক্ষাগারে আল্লাহ মানুষকে অগ্রিম কিছু না জানিয়ে একেবারে অজ্ঞ করে পাঠিয়ে দেননি। বরং জীবনের বিভিন্ন পথের মধ্যে সোজা পথ কোনটি এটি তাকে জানিয়ে দেবার দায়িত্ব তিনি নিজের জিম্মায় নিয়েছেন। এই সংগে একথা বলার প্রয়োজন ছিল না যে, নিজের রসূল ও নিজের কিতাব পাঠিয়ে দিয়ে তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ সবাইকে পথ দেখাবার জন্য রসূল ও কুরআন সবার সামনে উপস্থিত ছিল। দুই, দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তাঁর কাছে দুনিয়া চাইলে তাও পাওয়া যাবে আবার আখেরাত চাইলে তাও তিনি দেবেন। এখন মানুষ এর মধ্য থেকে কোনটি চাইবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানুষের নিজের দায়িত্ব। তিন, রসূল ও কিতাবের মাধ্যমে যে ন্যায় ও কল্যাণ পেশ করা হচ্ছে, যে হতভাগ্য ব্যক্তি তাকে মিথ্যা গণ্য করবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে জ্বলন্ত আগুন। আর যে আল্লাহভীরু ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিস্বার্থভাবে নিছক নিজের রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের ধন মাল সৎ পথে ব্যয় করবে তার রব তার প্রতি সন্তুষ্টি হবেন এবং তাকে এত বেশী দান করবেন যার ফলে সে খুশী হয়ে যাবে।
সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-4
টিকা নং:1,

اِنَّ سَعْیَكُمْ لَشَتّٰىؕ

আসলে তোমাদের প্রচেষ্টা নানা ধরনের।১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) এ কথার জন্যই রাত ও দিন এবং নারী ও পুরুষের জন্মের কসম খাওয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, যেভাবে রাত ও দিন এবং পুরুষ ও নারী পরস্পর থেকে ভিন্ন এবং তাদের প্রত্যেক জোড়ার প্রভাব ও ফলাফল পরস্পর বিরোধী, ঠিক তেমনি তোমরা যেসব পথে ও যেসব উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছো সেগুলোও বিভিন্ন ধরনের এবং সেগুলোর পরিণাম বিভিন্ন বিপরীতধর্মী ফলাফলেরও উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী আয়াতগুলোতে বলা হয়েছেঃ এসব বিভিন্ন প্রচেষ্টা দু’টি বড় বড় ভাগে বিভক্ত।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-7
টিকা নং:2, 3,

فَسَنُیَسِّرُهٗ لِلْیُسْرٰىؕ

২ তাকে আমি সহজ পথের সুযোগ- সুবিধা দেবো।৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২) এটি এক ধরনের মানবিক প্রচেষ্টা। তিনটি জিনিসকে এর অংগীভূত করা হয়েছে। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এগুলোর মধ্যে সব গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, মানুষ যেন অর্থ লিপ্সায় ডুবে না যায়। বরং নিজের অর্থ-সম্পদ, যে পরিমাণ আল্লাহ‌ তাকে দিয়েছেন, তা আল্লাহ‌ ও তাঁর বান্দাদের অধিকার আদায়ে, সৎ কাজে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে সাহায্য করার কাজে ব্যয় করে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার মনে যেন আল্লাহর ভয় জাগরুক থাকে। সে যেন নিজের যাবতীয় কর্ম, আচার-আচরণ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি বিভাগে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে এমন প্রত্যেকটি কাজ থেকে দূরে থাকে। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, সে যেন সৎবৃত্তি ও সৎকাজের সত্যতার স্বীকৃতি দেয়। সৎবৃত্তি ও সৎকাজ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র ও কর্ম তিনটি সৎবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সৎবৃত্তির স্বীকৃতি হচ্ছে, শিরক, কুফরী ও নাস্তিক্যবাদ পরিত্যাগ করে মানুষ তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতকে সত্য বলে মেনে নেবে। আর কর্ম ও নৈতিক চরিত্রের ক্ষেত্রে সৎবৃত্তির স্বীকৃতি হচ্ছে, কোন নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ও পদ্ধতি ছাড়াই নিছক নিজের অজ্ঞাতসারে কোন সৎকাজ সম্পাদিত হওয়া নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ ও সৎবৃত্তির যে ব্যবস্থা দান করা হয়েছে মানুষ তার সত্যতার স্বীকৃতি দেবে। আল্লাহ‌ শরীয়াত নামক যে ব্যাপকতর ব্যবস্থাটি দান করেছেন এবং যার মধ্যে সব ধরনের ও সকল প্রকার সৎবৃত্তি ও সৎকাজকে সুশৃংখলভাবে একটি ব্যবস্থার আওতাধীন করেছেন, মানুষ তাকে স্বীকার করে নিয়ে সেই অনুযায়ী সৎকাজ করবে।

টিকা:৩) এটি হচ্ছে এই ধরনের প্রচেষ্টার ফল। সহজ পথ মানে মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতির সাথে মিল রয়েছে এমন পথ। যে স্রষ্টা মানুষ ও এই সমগ্র বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করেছেন তিনি যেমন চান তেমন পথ। যে পথে নিজের বিবেকের সাথে লড়াই করে মানুষকে চলতে হয় না। যে পথে মানুষকে নিজের দেহ, প্রাণ, বুদ্ধি ও মনের শক্তিগুলোর ওপর জোর খাটিয়ে যে কাজের জন্য তাদেরকে এ শক্তি দান করা হয়নি জবরদস্তি তাদের থেকে সেই কাজ আদায় করে নিতে হয় না। বরং তাদের থেকে এমন কাজ নেয় যে জন্য তাদেরকে প্রকৃত পক্ষে এই শক্তিগুলো দান করা হয়েছে। পাপপূর্ণ জীবনে চতুর্দিকে যেমন প্রতি পদে পদে সংঘাত, সংঘর্ষ ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, এ পথে মানুষকে তেমনি ধরনের কোন বাধা ও সংঘাতের সম্মুখীন হতে হয় না। বরং মানুষের সমাজে প্রতি পদে পদে সে সহানুভূতি, সহযোগিতা, প্রেম, ভালোবাসা, মর্যাদা ও সম্মান লাভ করতে থাকে। একথা সুস্পষ্ট, যে ব্যক্তি নিজের ধনসম্পদ মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে, নিজের জীবনকে অশ্লীল কার্যকলাপ ও দুস্কৃতিমুক্ত রাখে, নিজের লেন-দেনের ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন ও ন্যায়-নিষ্ঠ থাকে, কারো সাথে বেঈমানী, শপথ ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করে না, যার পক্ষ থেকে কারোর প্রতি জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায় আচরণেরআশঙ্কা থাকে না। যে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং যার চরিত্র ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করার সুযোগ কারোর থাকে না, সে যতই নষ্ট ও ভ্রষ্ট সমাজে বাস করুক না কেন সেখানে অবশ্যি সে মর্যাদার আসনে সমাসীন থাকে। মানুষের মন তার দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। মানুষের হৃদয়ে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তার নিজের মন ও বিবেকও নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। সমাজে তার এমন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কোন অসৎব্যক্তি ও দুস্কৃতিকারী কোন দিন লাভ করতে পারে না। এ কথাটিকেই সূরা আন নাহলে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَكَرٍ اَوۡ اُنۡثٰى وَهُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡيِيَنَّهٗ حَيٰوةً طَيِّبَةً‌ۚ

“যে ব্যক্তি সৎকাজ করে, সে পুরুষ হোক বা নারী, সে মু’মিন হলে আমি অবশ্যি তাকে ভালো জীবন যাপন করাবো।” ( ৯৭ আয়াত )

আবার একথাটি সূরা মারয়ামে নিম্নোক্তভাবে বলা হয়েছেঃ

اِنَّ الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوۡا الصّٰلِحٰتِ سَيَجۡعَلُ لَهُمُ الرَّحۡمٰنُ وُدًّا

“নিঃসন্দেহে যারা ইমান এনেছে এবং যারা সৎকাজ করেছে রহমান তাদের জন্য হৃদয়গুলোতে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন।” ( ৯৬ আয়াত )

তাছাড়া এটিই মানুষের জন্য দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত পূর্ণ আনন্দের একমাত্র পথ। একমাত্র এ পথেই আছে আরাম ও প্রশান্তি। এর ফলাফল সাময়িক ও ক্ষণকালীন নয় বরং এটা হচ্ছে চিরন্তন ও চিরস্থায়ী ফল, এর কোন ক্ষয় নেই।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ‌ বলছেন, আমি তাকে এ পথে চলার সহজ সুযোগ দেবো। এর মানে হচ্ছে, যখন সে সৎবৃত্তিকে স্বীকার করে নিয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে, এটিই তার উপযোগী পথ এবং দুষ্কৃতির পথ তার উপযোগী নয়, আর যখন সে কার্যত আর্থিক ত্যাগ ও তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে একথা প্রমাণ করবে যে, তার এই স্বীকৃতি সত্য, তখন আল্লাহ‌ এ পথে চলা তার জন্য সহজ করে দেবেন। এ অবস্থায় তার জন্য আবার গোনাহ করা কঠিন এবং নেকী করা সহজ হয়ে যাবে। হারাম অর্থ-সম্পদ তার সামনে এলে সে তাকে লাভের সওদা মনে করবে না। বরং সে অনুভব করবে, এটা জ্বলন্ত অংগার, একে সে হাতের তালুতে উঠিয়ে নিতে পারে না। ব্যভিচারের সুযোগ সে পাবে। কিন্তু তাকে সে ইন্দ্রিয় লিপ্সা চরিতার্থ করার সুযোগ মনে করে সেদিকে পা বাড়াবে না। বরং জাহান্নামের দরজা মনে করে তা থেকে দূরে পালিয়ে যাবে। নামায তার কাছে কঠিন মনে হবে না বরং নামাযের সময় হয়ে গেলে নামায না পড়া পর্যন্ত তার মনে শান্তি আসবে না। যাকাত দিতে তার মনে কষ্ট হবে না। বরং যাকাত আদায় না করা পর্যন্ত নিজের ধন-সম্পদ তার কাছে নাপাক মনে হবে। মোটকথা, প্রতি পদে পদে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই পথে চলার সুযোগ ও সুবিধা সে লাভ করতে থাকবে। অবস্থাকে তার উপযোগী বানিয়ে দেয়া হবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে সাহায্য করা হবে।

এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, ইতিপূর্বে সূরা আল বালাদে এ পথটিকে দুর্গম পার্বত্য পথ বলা হয়েছিল আর এখানে একে বলা হচ্ছে, সহজ পথ। এই দু’টি কথাকে কিভাবে এক করা যাবে? এর জবাব হচ্ছে, এই পথ অবলম্বন করার আগে এটা মানুষের কাছে দুর্গম পার্বত্য পথই মনে হতে থাকে। এ উঁচু দুর্গম পার্বত্য পথে চলার জন্য তাকে নিজের প্রবৃত্তির লালসা নিজের বৈষয়িক স্বার্থের অনুরাগী পরিবার পরিজন, নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও কাজ-কারবারের লোকজন এবং সবচেয়ে বেশী শয়তানের সাথে লড়াই করতে হয়। কারণ এদের প্রত্যেকেই তাকে এ পথে চলতে বাধা দেয় এবং একে ভীতিপ্রদ বানিয়ে তার সামনে হাযির করে। কিন্তু যখন মানুষ সৎবৃত্তির স্বীকৃতি দিয়ে সে পথে চলার সংকল্প করে, নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে কার্যত এই সংকল্পকে পাকাপোক্ত করে নেয়, তখন এই দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া তার জন্য সহজ এবং নৈতিক অবনতির গভীর খাদে গড়িয়ে পড়া কঠিন হয়ে পড়ে।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-9
টিকা নং:4,

وَ كَذَّبَ بِالْحُسْنٰىۙ

এবং সৎবৃত্তিকে মিথ্যা গণ্য করেছে,৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) এটি দ্বিতীয় ধরনের মানসিক প্রচেষ্টা। প্রথম ধরনের প্রচেষ্টাটির সাথে প্রতি পদে পদে রয়েছে এর অমিল। কৃপণতা মানে শুধুমাত্র প্রচলিত অর্থে যাকে কৃপণতা বলা হয় তা নয়। অর্থাৎ এক একটি পয়সা গুণে গুণে রাখা, খরচ না করা, না নিজের জন্য না নিজের ছেলেমেয়ের জন্য। বরং এখানে কৃপণতা বলতে আল্লাহর পথে এবং নেকী ও কল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় না করা বুঝাচ্ছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে এমন ব্যক্তিকেও কৃপণ বলা যায়, যে নিজের জন্য, নিজের আরাম-আয়েশ ও বিলাস-ব্যাসনের স্বার্থে এবং নিজের ইচ্ছামতো খুশী ও আনন্দ বিহারে দু’হাতে টাকা উড়ায় কিন্তু কোন ভালো কাজে তার পকেট থেকে একটি পয়সাও বের হয় না। অথবা কখনো বের হলেও তার পেছনে থাকে এর বিনিময়ে দুনিয়ার খ্যাতি, যশ, শাসকদের নৈকট্য লাভ বা অন্য কোন রকমের পার্থিব স্বার্থ উদ্ধার। বেপরোয়া হয়ে যাওয়ার অর্থ দুনিয়ার বৈষয়িক লাভ ও স্বার্থকে নিজের যাবতীয় প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের লক্ষ্যে পরিণত করা এবং আল্লাহর ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যাওয়া। কোন্ কাজে আল্লাহ‌ খুশী হন এবং কোন্ কাজে নাখোশ হন তার কোন তোয়াক্কা না করা। আর সৎবৃত্তিকে মিথ্যা গণ্য করার মানে হচ্ছে, সৎকাজকে তার সকল বিস্তারিত আকারে সত্য বলে মেনে না নেয়া এখানে এর ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ ইতিপূর্বে সৎবৃত্তিকে সত্য বলে মেনে নেয়ার বিষয়টি আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-10
টিকা নং:5,

فَسَنُیَسِّرُهٗ لِلْعُسْرٰىؕ

তাকে আমি কঠিন পথের সুযোগ-সুবিধা দেবো।৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৫) এ পথকে কঠিন বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এ পথে যে পাড়ি জমাতে চায় সে যদিও বৈষয়িক লাভ, পার্থিব ভোগ-বিলাস ও বাহ্যিক সাফল্যের লোভে এ দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু এখানে সর্বক্ষণ তাকে নিজের প্রকৃতি, বিবেক, বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার তৈরি করা আইন এবং তার চার পাশের সমাজ পরিবেশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। সততা, ন্যায় পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা, ভদ্রতা, চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতা ও নীতি-নৈতিকতার সীমালঙ্ঘন করে যখন সে সর্বপ্রকারে নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও লোভ-লালসা পূর্ণ করা প্রচেষ্টা চালায়, যখন তার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ হতে থাকে এবং সে অন্যের অধিকার ও মর্যাদার ওপর হস্তক্ষেপ করতে থাকে তখন নিজের চোখেই সে লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত জীবে পরিণত হয় এবং যে সমাজে সে বাস করে সেখানেও তাকে প্রতি পদে পদে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়। সে দুর্বল হলে এসব কার্যকলাপের জন্য তাকে নানা ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হয়। আর সে ধনী, শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হলে সারা দুনিয়া তার শক্তির সামনে মাথা নত করলেও কারো মনে তার জন্য সামান্যতমও শুভাকাংক্ষা, সম্মানবোধ ও ভালোবাসার প্রবণতা জাগে না। এমন কি তার কাজের সাথী-সহযোগীরাও তাকে একজন বজ্জাত-দুর্বৃত্ত হিসেবেই গণ্য করতে থাকে। আর এ ব্যাপারটি কেবলমাত্র ব্যক্তি পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী জাতিরাও যখন নৈতিকতার সীমানা লংঘন করে নিজেদের শক্তি ও অর্থের বিভ্রমে পড়ে অসৎকাজে লিপ্ত হয় তখন একদিকে বাইরের জগত তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এবং অন্যদিকে তাদের নিজেদের সমাজ অপরাধমূলক কার্যকলাপ, আত্মহত্যা, নেশাখোরী, দুরারোগ্য ব্যাধি, পারিবারিক জীবনের ধ্বংস, যুব সমাজের অসৎপথ অবলম্বন, শ্রেণী সংঘাত এবং জুলুম-নিপীড়নের বিপুলাকার রোগে আক্রান্ত হয়। এমন কি উন্নতির উচ্চতম শিখর থেকে একবার পতন ঘটার পর ইতিহাসের পাতায় তাদের জন্য কলঙ্ক, লানত ও অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই থাকেনি।

আর এ ধরনের লোককে আমি কঠিন পথে চলার সুবিধা দেবো, একথা বলার মানে হচ্ছে, তার থেকে সৎপথে চলার সুযোগ ছিনিয়ে নেয়া হবে। অসৎপথের দরজা তার জন্য খুলে দেয়া হবে। অসৎকাজ করার যাবতীয় উপকরণ ও কার্যকারণ তার জন্য সংগ্রহ করে দেয়া হবে। খারাপ কাজ করা তার জন্য সহজ হবে এবং ভালো কাজ করার চিন্তা মনে উদয় হওয়ার সাথে সাথেই সে মনে করবে এই বুঝি তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই অবস্থাটিকেই কুরআনে অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছেঃ

“আল্লাহ যাকে পথ দেখাবার সংকল্প করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য খুলে দেন। আর যাকে তিনি গোমরাহীর মধ্যে ঠেলে দেবার এরাদা করেন তার বক্ষদেশেকে সংকীর্ণ করে দেন এবং তাকে এমনভাবে সংকুচিত করেন যার ফলে (ইসলামের কথা মনে হলেই) সে অনুভব করতে থাকে যেন তার প্রাণবায়ু উড়ে যাচ্ছে।” ( আনআম ১২৫ আয়াত )

আর এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ নিঃসন্দেহে নামায একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ, কিন্তু আল্লাহ‌ অনুগত বান্দার জন্য নয়।” (আল বাকারাহ ৪৬ আয়াত )

আর মোনাফেকদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা নামাযের দিকে এলেও গড়িমসি করে আসে এবং আল্লাহর পথে খরচ করলেও যেন মন চায় না তবুও খরচ করে।” (আত তাওবাহ ৫৪ আয়াত )

আরো বলা হয়েছেঃ “তাদের মধ্যে এমন সব লোক রয়েছে যারা আল্লাহর পথে কিছু খরচ করলে তাকে নিজেদের ওপর জবরদস্তি আরোপিত জরিমানা মনে করে।” ( আত তাওবাহ ৯৮ আয়াত )।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-11
টিকা নং:6,

وَ مَا یُغْنِیْ عَنْهُ مَالُهٗۤ اِذَا تَرَدّٰىؕ

আর তার ধন-সম্পদ তার কোন কাজে লাগবে যখন সে ধ্বংস হয়ে যাবে?৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) অন্য কথায় বলা যায়, একদিন তাকে অবশ্যি মরতে হবে। তখন এখানে আয়েশ আরামের জন্য সে যা কিছু সংগ্রহ করেছিল সব এই দুনিয়াতেই রেখে যেতে হবে। যদি নিজের আখেরাতের জন্য এখান থেকে কিছু কামাই করে না নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে দুনিয়ার এ ধন-সম্পদ তার কোন্ কাজে লাগবে? সে তো কোন দালান কোঠা, মোটরগাড়ী, সম্পত্তি বা জমানো অর্থ সঙ্গে করে কবরে যাবে না।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-12
টিকা নং:7,

اِنَّ عَلَیْنَا لَلْهُدٰى٘ۖ

নিঃসন্দেহে পথনির্দেশ দেয়া তো আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) অর্থাৎ মানুষের স্রষ্টা হবার কারণে মহান আল্লাহ‌ নিজের জ্ঞানপূর্ণ কর্মনীতি, ন্যায়নিষ্ঠা ও রহমতের ভিত্তিতে নিজেই মানুষকে এ দুনিয়ায় এমনভাবে ছেড়ে দেননি যে, সে কিছুই জানে না। বরং সঠিক পথ কোনটি ও ভুল পথ কোনটি, নেকী, গোনাহ, হালাল ও হারাম কি, কোন কর্মনীতি তাকে নাফরমান বান্দার ভূমিকায় এনে বসাবে——এসব কথা জানিয়ে দেবার দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন।

এ কথাটিকেই সূরা আন নাহলে এভাবে বলা হয়েছেঃ

وَعَلَى اللّٰهِ قَصۡدُ السَّبِيۡلِ وَمِنۡهَا جَآٮِٕرٌ‌ؕ

“আর সোজা পথ দেখাবার দায়িত্ব আল্লাহরই ওপর বার্তায় যখন বাঁকা পথও রয়েছে।” ( ৯ আ য়াত)

ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নাহল, ৯ টীকা ।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-13
টিকা নং:8,

وَ اِنَّ لَنَا لَلْاٰخِرَةَ وَ الْاُوْلٰى

আর আসলে আমি তো আখেরাত ও দুনিয়া উভয়েরই মালিক।৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৮) এ বক্তব্যটির কয়েকটি অর্থ হয়। সবগুলো অর্থই সঠিক। এক, দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত কোথাও তোমরা আমার নিয়ন্ত্রণ ও পাকড়াও এর বাইরে অবস্থান করছো না। কারণ আমিই উভয় জাহানের মালিক। দুই, তোমরা আমার দেখানো পথে চলো বা না চলো আসলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের ওপর আমার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত। তোমরা ভুল পথে চললে তাতে আমার কোন ক্ষতি হবে না, তোমাদের ক্ষতি হবে। আর তোমরা সঠিক পথে চললে আমার কোন লাভ হবে না, তোমরাই লাভবান হবে। তোমাদের নাফরমানির কারণে আমার মালিকানায় কোন কমতি দেখা দেবে না এবং তোমাদের আনুগত্য তার মধ্যে কোন বৃদ্ধিও ঘটাতে পারবে না। তিন, আমিই উভয় জাহানের মালিক। দুনিয়া তথা বৈষয়িক স্বার্থ চাইলে তা আমার কাছ থেকেই তোমরা পাবে। আবার আখেরাতের কল্যাণ চাইলে তাও দেবার ক্ষমতা একমাত্র আমারই আছে। একথাটিই সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ আয়াতে এভাবে বলা হয়েছেঃ

وَمَنۡ يُّرِدۡ ثَوَابَ الدُّنۡيَا نُؤۡتِهٖ مِنۡهَا‌ۚ وَمَنۡ يُّرِدۡ ثَوَابَ الۡاٰخِرَةِ نُؤۡتِهٖ مِنۡهَا‌ؕ

“যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সওয়াব হাসিলের সংকল্পে কাজ করবে আমি তাকে দুনিয়া থেকেই দেবো আর যে ব্যক্তি আখেরাতের সওয়াব হাসিলের সংকল্পে কাজ করবে আমি তাকে আখেরাত থেকে দেবো।”

সূরা শুরা ২০ আয়াতে একথাটি নিম্নোক্তভাবে বলা হয়েছেঃ

مَنۡ كَانَ يُرِيۡدُ حَرۡثَ الۡاٰخِرَةِ نَزِدۡ لَهٗ فِىۡ حَرۡثِهٖ‌ۚ وَمَنۡ كَانَ يُرِيۡدُ حَرۡثَ الدُّنۡيَا نُؤۡتِهٖ مِنۡهَا وَمَا لَهٗ فِىۡ الۡاٰخِرَةِ مِنۡ نَّصِيۡبٍ‏

“যে ব্যক্তি আখেরাতের কৃষি চায় তার কৃষিকে আমি বাড়িয়ে দেই আর যে দুনিয়ার কৃষি চায় তাকে দুনিয়া থেকেই দান করি, কিন্তু আখেরাতে তার কোন অংশ নেই।” আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরান ১০৫ টীকা এবং আশ শূরা ৩৫ টীকা ।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-18
টিকা নং:9,

الَّذِیْ یُؤْتِیْ مَالَهٗ یَتَزَكّٰىۚ

যেই পরম মুত্তাকী ব্যক্তি পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিজের ধন-সম্পদ দান করে৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৯) এর অর্থ এই নয় যে, চরম হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ জাহান্নামে যাবে না এবং পরম মুত্তাকী ছাড়া আর কেউ তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। বরং দু’টি চরম পরস্পর বিরোধী চরিত্রকে পরস্পরের বিরুদ্ধে পেশ করে তাদের পরস্পর বিরোধী চরম পরিণাম বর্ণনা করাই এখানে উদ্দেশ্য। এক ব্যক্তি আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের শিক্ষাকে মিথ্যা বলে এবং আনুগত্যের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কেবল ঈমান এনেই ক্ষান্ত হয় না বরং পরম আন্তরিকতা সহকারে কোনো প্রকার লোক দেখানো প্রবণতা, নাম যশ ও খ্যাতির মোহ ছাড়াই শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে পাক-পবিত্র মানুষ হিসেবে গণ্য হবার আকাংখায় আল্লাহর পথে নিজের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। এই দু’ধরনের চরিত্র সম্পন্ন লোক সে সময় মক্কার সমাজে সবার সামনে বর্তমান ছিল। তাই কারো নাম না নিয়ে লোকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, জাহান্নামের আগুনে দ্বিতীয় ধরনের চরিত্র সম্পন্ন লোক নয় বরং প্রথম ধরনের চরিত্র সম্পন্ন লোকই পুড়বে। আর এই আগুন থেকে প্রথম ধরনের লোক নয় বরং দ্বিতীয় ধরনের লোককেই দূরে রাখা হবে।

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-20
টিকা নং:10,

اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْاَعْلٰىۚ

সেতো কেবলমাত্র নিজের রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজ করে।১০

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) এখানে সেই মুত্তাকী ও আল্লাহভীরু ব্যক্তির আন্তরিকতার আরো বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। সে নিজের অর্থ যাদের জন্য ব্যয় করে, আগে থেকেই তার কোন অনুগ্রহ তার ওপর ছিল না, যার বদলা সে এখন চুকাচ্ছে অথবা ভবিষ্যতে তাদের থেকে আরো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদেরকে উপহার উপঢৌকন ইত্যাদি দিচ্ছে এবং তাদেরকে দাওয়াত খাওয়াচ্ছে। বরং সে নিজের মহান ও সর্বশক্তিমান রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য এমন সব লোককে সাহায্য করছে, যারা ইতিপূর্বে তার কোন উপকার করেনি এবং ভবিষ্যতেও তাদের উপকার করার কোন আশা নেই। এর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর গোলাম ও বাঁদীদের আযাদ করার কাজটি। মক্কা মু’আযযমার সে অসহায় গোলাম ও বাঁদীরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং এই অপরাধে তাদের মালিকরা তাদের ওপর চরম অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাচ্ছিল হযরত আবু বকর (রা.) তাদেরকে মালিকদের জুলুম থেকে বাঁচাবার জন্য কিনে নিয়ে আযাদ করে দিচ্ছিলেন। ইবনে জারীর ও ইবনে আসাকির হযরত আমের ইবনে আবদুল্লাহ যুবাইরের এই রেওয়ায়াতটি উদ্ধৃত করেছেনঃ হযরত আবু বকরকে এভাবে গরীব গোলাম ও বাঁদীদেরকে গোলামী মুক্ত করার জন্য অর্থ ব্যয় করতে দেখে তাঁর পিতা তাকে বলেন, হে পুত্র! আমি দেখছি তুমি দুর্বল লোকদের মুক্ত করে দিচ্ছো, যদি এ টাকাটা তুমি শক্তিশালী জোয়ানদের মুক্ত করার জন্য খরচ করতে তাহলে তারা তোমার হাতকে শক্তিশালী করতো। একথায় হযরত আবু বকর (রা.) তাঁকে বলেনঃ

اى اباه انما اريد ما عند اللّه

“আব্বাজান! আমি তো আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান চাই।”

সুরা: আল-লাইল
আয়াত নং :-21
টিকা নং:11,

وَ لَسَوْفَ یَرْضٰى۠

আর তিনি অবশ্যি (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন।১১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) এ আয়াতের দু’টি অর্থ হতে পারে। দু’টি অর্থই সঠিক। একটি অর্থ হচ্ছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ‌ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন! আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, শীঘ্রই আল্লাহ‌ এ ব্যক্তিকে এতসব কিছু দেবেন যার ফলে সে খুশী হয়ে যাবে।

Leave a Reply