Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৬ : হে মানুষ:-১৬/এবং কফেরর-রা বলে:-৪৩)
[# তোমার রব তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেননি :-
#শীঘ্রই তুমি খুশী হয়ে যাবে:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯৩ : আদ্-দুহা
পারা:৩০
১- ১১ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আদ-দুহা
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৯৩
(৯৩-দুহা) : নামকরণ:
সূরার প্রথম শব্দ ওয়াদদুহা (وَالضُّحٰىۙ ) কে এই সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(৯৩-দুহা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এই সূরার বক্তব্য বিষয় থেকে একথা পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এটি মক্কা মু’ আযযমার প্রথম যুগে নাযিল হয়। হাদীস থেকে ও জানা যায়, কিছুদিন অহীর অবতরণ বন্ধ ছিল। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। বারবার তাঁর মনে এই আশংকার উদয় হচ্ছিল, হয়তো তাঁর এমন কোন ত্রুটি হয়ে গেছে যার ফলে তাঁর রব তাঁর প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। এ জন্য তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো প্রকার অসন্তুষ্টির কারণে অহীর সিলসিলা বন্ধ করা হয়নি। বরং এর পেছনে সেই একই কারণ সক্রিয় ছিল যা আলোকোজ্জ্বল দিনের পরে রাতের নিস্তব্ধতা এ প্রশান্তি ছেয়ে যাবার মধ্যে সক্রিয় থাকে। অর্থাৎ অহীর প্রখর কিরণ। যদি একনাগাড়ে তাঁর প্রতি বর্ষিত হতো তাহলে তাঁর স্নায়ু তা বরদাশত করতে পারতো না। তাই মাঝখানে বিরতি দেয়া হয়েছে। তাঁকে আরাম ও প্রশান্তি দান করাই এর উদ্দেশ্য। নবুয়াতের প্রাথমিক যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অবস্থার মুখোমুখি হন। সে সময় অহী নাযিলের কষ্ট বরদাশত করার অভ্যাস তাঁর গড়ে ওঠেনি। তাই মাঝে মাঝে ফাঁক দেবার প্রয়োজন ছিল। সূরা মুদদাসসিরের ভূমিকায় আমি একথা সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছি। আর অহী নাযিলের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্নায়ুর ওপর এর কী গভীর প্রভাব পড়তো তা আমি সূরা মুয্যাম্মিলের ৫ টীকায় বলেছি। পরে তাঁর মধ্যে এই মহাভার বরদাশত করার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়ে গেলে আর দীর্ঘ ফাঁক দেবার প্রয়োজন থাকেনি।
(৯৩-দুহা) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এর বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেয়া আর এই সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্য ছিল অহী নাযিলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তাঁর মধ্যে যে পেরেশানী দেখা দিয়েছিল তা দূর করা। প্রথমে আলো ঝলমল দিনের এবং রাতের নীরবতা ও প্রশান্তির কসম খেয়ে তাঁকে এই মর্মে নিশ্চিন্ততা দান করা হয়েছে যে, তার রব তাঁকে মোটেই পরিত্যাগ করেননি এবং তিনি তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হননি। এরপর তাঁকে সুসংবাদ দান করা হয়েছে যে, ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁকে যেসব কঠিন সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এগুলো মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার। তাঁর জন্য পরবর্তী প্রত্যেকটি পর্যায় পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে উন্নততর হয়ে যেতেই থাকবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই মহান আল্লাহ তাঁর ওপর এমনভাবে তাঁর দান বর্ষণ করতে থাকবেন যার ফলে তিনি খুশী হয়ে যাবেন। কুরআনের যেসব সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয় এটি তার অন্যতম। অথচ যে সময় এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তখন যেসব অসহায় সাহায্য-সম্বলহীন ব্যক্তি মক্কায় সমগ্র জাতির জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিল তারা যে কোনদিন এত বড় বিস্ময়কর সাফল্যের মুখ দেখবে এর কোন দূরবর্তী আলামতও কোথাও দেখা যায়নি।
তারপর মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, আমি তোমাকে পরিত্যাগ করেছি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছি- এ ধরনের পেরেশানীতে তুমি ভুগছো কেন ? আমি তো তোমার জন্মের দিন থেকেই তোমার প্রতি অবিরাম মেহেরবানী করে আসছি। তুমি এতিম অবস্থায় জন্মলাভ করেছিলে। আমি তোমার প্রতিপালন ও রক্ষাণাবেক্ষণের সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা করেছি। তুমি অনভিজ্ঞ ছিলে। আমি তোমাকে পথের সন্ধান দিয়েছি। তুমি অর্থ-সম্পদহীন ছিলে। আমি তোমাকে বিত্তশালী করেছি। এসব কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচেছ যে, তুমি শুরু থেকেই আমার প্রিয়পাত্র আছো এবং আমার মেহেরবানী, অনুগ্রহ দান স্থায়ীভাবে তোমার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সূরা ত্বা-হা’র ৩৭ থেকে ৪২ পর্যন্ত আয়াতগুলোও সামনে রাখতে হবে। এই আয়াতগুলোতে হযরত মূসাকে ফেরাউনের মতো শক্তিশালী জালেমের বিরুদ্ধে পাঠাবার সময় আল্লাহ তাঁর পেরেশানী দূর করার জন্য তাঁর জন্মের পর থেকে কিভাবে আল্লাহর মেহেরবানী তাঁকে ঘিরে রেখেছিল সে কথা তাঁকে বলেন। এই সংগে তাঁকে একথাও বলেন যে এ অবস্থায় তুমি নিশ্চিত থাকো, এই ভয়াবহ অভিযানে তুমি একাকী থাকবে না বরং আমার মেহেরবানীও তোমার সাথে থাকবে।
সবশেষে মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন তার জবাবে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে তাঁর কি ধরনের আচরণ করা উচিত এবং তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া কিভাবে আদায় করতে হবে একথা তাঁকে জানিয়ে দেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এ সূরাটির আলোচ্য বিষয়, বর্ণনাধারা, দৃশ্যাবলী, অন্তর্নিহিত অর্থ, এর আয়াতগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ছন্দের ও শব্দাবলীর চমৎকারিত্ব সব কিছু নিয়ে সূরাটি প্রতিটি পাঠকের মনে যেন এক স্নেহ ও মায়া-মমতার পরশ বুলিয়ে দেয় । এমন মধুমাখা শব্দ ও মমতা মাখা কথা এতে ব্যবহার করা হয়েছে যে, মনে হয় যেন প্রভাত বেলার সুরভিত মৃদু সমীরণ প্রেমের বার্তা পৌছে পরম প্রেমাস্পদের সাথে বিরহী হৃদয়ের এক যোগসূত্র কায়েম করতে চায়। তা যেন বিনম্র এক মহা শুভ সংবাদের বার্তা বয়ে আনে যেন মন থেকে যাবতীয় দুঃখ বেদনা ও ক্লান্তির ছাপকে মুছে দিতে চায়আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও তার রহমতের নিশ্চিত সম্ভাবনা আত্মাকে যেন দোলা দিয়ে যায়। অনাগত দিনের সাফল্যের আশা যেন ভরে দিতে চায় এবং রাব্বুল আলামীনের অদৃশ্য হাত তাঁর মহব্বতের অমিয়ধারা যেন আকাংখীদের হৃদয় কন্দরে পরম আবেগে ঢেলে দেয় আর তাকে কানায় কানায় প্রশান্তিতে ও বিশ্বাসের দৃঢ়তায় ভরে দিতে চায়। এ সব কিছুই বলা হয়েছে নবী মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জন্য । এসব কিছু তার রব ও প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাঁকে সান্ত্বনা দেয়া, তার কঠিন দিনগুলোর কষ্ট দূর করা এবং তাঁর মনকে নিশ্চিন্ততায় ভরে দিতে গিয়ে পরম করুণাময়ের পক্ষ থেকে আসা এ এক অমীয় বার্তা । এসব কিছু হচ্ছে তার রহমতের বারিধারার প্রতীক ৷ প্রেমের ডাক, নৈকট্যের স্বাদ এবং ব্যথিত ও শ্রান্ত-ক্লান্ত এবং সমস্যাপীড়িত হৃদয়ের জন্য আদরের এক মৃদু-মধুর দোলা । অনেক রেওয়ায়াতে পাওয়া যায় যে, যাঝে মাঝে রসূলুল্লাহ (স.)-এর নিকট ওহী আসা বন্ধ থেকেছে এবং জিবরাঈল (আ.) তার সাথে সাক্ষাতে বিলম্ব করেছেন। এ সময় মোশরেকরা বিদ্রুপাত্মকভাবে বলেছে, মোহাম্মদকে তার রব (প্রতিপালক) পরিত্যাগ করে গেছে। এতে তিনি যে দুঃখ পেয়েছেন তা প্রশমনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা এ সূরাটি নাযিল করেন। পরম প্রেমাস্পদ, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছ থেকে আসা ওহী, জিবরাঈল (আ.)-এর সাক্ষাত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভই ছিলো রসূল (স.)-এর জন্য ওই সংকটপূর্ণ জীবনের একমাত্র পাথেয়। অসভ্য জাতির হৃদয়হীন ব্যবহার ও হঠকারিতামূলক অস্বীকৃতির মধ্যে এগুলোই ছিলো তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা । প্রায় গোটা সমাজ যখন তাকে পরিত্যাগ করলো, নিষ্ঠুর ব্যবহারে তাকে ও তার সংগী সাথীদের জীবনকে বিপন্ন করে তুললো । ঈমান গ্রহণের জন্য তার উদাত্ত আহবানকে যুক্তিহীনভাবে ঠুকরে দিলো ও সত্যের এ বাতিকে নিভিয়ে দিতে নানা চক্রান্ত করতে থাকলো ৷ সেই কঠিন দিনে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের গভীরতা ও জিবরাঈল (আ.)-এর সান্ত্বনাবাণী রসূল (স.)-এর হৃদয়ে স্নিগ্ধ শান্তি ও সংকল্পের দৃঢ়তা আনতো । কিন্তু ওহী আসার এ ধারা (সাময়িকভাবে হলেও) যখন থেমে গেলো, তখন রসূল (স.)-এর চলার পথের সকল রসদ যেন ফুরিয়ে গেলো এবং তিনি আল্লাহর মহব্বত থেকে বঞ্চিত হয়ে বড় একাকী অনুভব করতে লাগলেন । তার মনে হতে লাগলো তিনি এক জনমানবহীন মরু প্রান্তরে এক শ্রান্ত-ক্লান্ত পথিক । বান্ধবহারা হয়ে তিনি বড়ই অসহায় বোধ করতে লাগলেন। সকল দিক থেকে তার পথ যেন রুদ্ধ হয়ে আসতে লাগলো । এমনই এক নাযুক মুহূর্তে এই সূরাটি নাযিল হলো প্রিয়তম মালিকের অমিয় সুধায় ভরা প্রিয় বাণী, তার নৈকট্য ও সান্নিধ্যের বার্তাবাহী ও সংবাদ তার স্নিগ্ধ ও মধুমাখা আশ্বাস পেয়ে মন আবার সতেজ হয়ে উঠলো । সামাজিক বন্ধনকে মযবুত করার জন্য তার প্রয়োজনীয় হেদায়াত এবং অন্তরের প্রশান্তি ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা আনয়নকারী বাক্যের সমাবেশ এ সূরাটিতে । এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাকে তোমার রব পরিত্যাগ করেননি, অযত্ন অবহেলা বা ঘৃণাভরে ছেড়ে দেননি তোমাকে ৷ (জেনে রেখো), অবশ্য অবশ্যই অতীতের থেকে ভবিষ্যত তোমার জন্য খুবই উজ্জল । আর শীঘ্র তোমার রব তোমাকে এমন কিছু দেবেন যাতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে ।’ (এটাও তোমার জানা দরকার যে) তোমার রব ইতিপূর্বেও তোমাকে কখনও পরিত্যাগ করেননি। তিনি এর আগে কোনো সময় তোমাকে ঘৃণা ভরে ছেড়েও দেননি। কখনও তার রহমত ও পরিচালনা থেকে তোমাকে দূরেও রাখেননি, তোমাকে আশ্রয়হীনও করেননি । (স্মরণ করে দেখো), তোমাকে কি তিনি এতীম অবস্থায় পাননি? যে অবস্থায় তিনি তোমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, আর যখন তুমি সঠিক পথটি খুঁজে পাচ্ছিলে না সে অবস্থায় তিনিই তোমাকে সে পথের সন্ধান দিয়ে দিলেন । আবার তোমাকে অসচ্ছল অবস্থায় পেলেন, সেখান থেকে তিনি তোমাকে অভাবযুক্ত করলেন ৷ এ সব কথার সত্যতা কি তুমি তোমার জীবনে দেখতে পাওনি? তোমার অন্তরের মধ্যে কি একেবারেই এ সকল কথার বাস্তবতা অনুভব করোনি? এসব নেয়ামতের কোনো প্রভাব কি তোমার পরিবেশে দেখোনি? না, না কিছুতেই তোমার রব তোমাকে ছেড়ে দেননি এবং তোমাকে তিনি অবহেলাও করেননি। তোমাকে তোমার সৎগুণাবলী, সততা ও সত্যবাদিতা থেকে কখনও দূরে সরিয়ে দেননি । ‘আর স্পষ্ট জেনে নাও যে, তোমার জন্য তোমার আগামী দিনগুলো অবশ্যই পূববর্তী দিনগুলো থেকে ভালো ।’ তখন আরো অনেক বেশী এবং আরো অনেক পূর্ণাংগ জিনিস তুমি লাভ করবে। ‘আর শীঘ্র এমন কিছু তোমাকে তিনি দেবেন যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে ।’ এই গভীর ও মধুর স্নেহের বাণী শুধু যে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে তা-ই নয়। এ কথাগুলোর প্রবল দোলা রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত করেছে৷ এর সাথে গোটা পরিবেশ পরিস্থিতি প্রিয়তমের ভালবাসার আবেগভরা মধুর গুঞ্জরণে ভরে গিয়েছে। গোটা বিশ্ব-চরাচরের যত স্থানে এ বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে সেখানেই এ সূরের মূর্ছনা সব কিছুকে যেন মাতিয়ে তুলেছে।
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,
وَ الضُّحٰىۙ
উজ্জ্বল দিনের কসম১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) এখানে ‘দুহা’ শব্দটি রাতের মোকাবেলায় ব্যবহার করা হয়েছে তাই এর অর্থ উজ্জ্বল দিবা। সূরা আ’রাফের নিম্নোক্ত আয়াতটিকে এর নজীর হিসেবে পেশ করা যায়ঃ
اَفَاَمِنَ اَهۡلُ الۡقُرٰٓى اَنۡ يَّاۡتِيَهُمۡ بَاۡسُنَا بَيَاتًا وَّهُمۡ نَآٮِٕمُوۡنَؕ اَوَاَمِنَ اَهۡلُ الۡقُرٰٓى اَنۡ يَّاۡتِيَهُمۡ بَاۡسُنَا ضُحًى وَهُمۡ يَلۡعَبُوۡنَ
‘জনপদবাসীরা কি এ ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে পড়েছে যে, তাদের ওপর রাতে আমার আযাব আসবে যখন তারা ঘুমিয়ে থাকবে? আর জনপদের লোকেরা কি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে যে তাদের ওপর দিন দুপুরে আমার আযাব আসবে যখন তারা খেলতে থাকবে? ” ( ৯৭-৯৮ আয়াত) এই আয়াতগুলোতে ও “দুহা” (ضُحى ) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে রাতের মোকাবেলায়। আর এর অর্থ চাশত এর সময় নয়, বরং দিন।
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-2
টিকা নং:2,
وَ الَّیْلِ اِذَا سَجٰىۙ
এবং রাতের কসম যখন তা নিঝুম হয়ে যায়।২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) মূলে রাতের সাথে سَجَى শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র অন্ধকার ছেয়ে যাবারই নয় বরং নিঝুম ও শান্ত হয়ে যাবার অর্থও পাওয়া যায়। সামনের দিকে যে বর্ণনা আসছে তার সাথে রাতের এই গুণাবলীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:
‘কসম আলোকজ্জ্বল মধ্যদিনের, আর কসম সেই নিশীথ বেলার যা গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যায় !’ ওপরের আয়াতে মহব্বতের স্রোতধারা পরম দরদী ও প্রিয়তম মালিকের প্রেম সাগর থেকে নির্গত হয়ে এসেছে, আরো এসেছে তাঁর প্রিয় রসূলের জন্য যে ব্যগ্রতার এমন কিছু ছোয়াচ তা যে কোনো পাঠক ও শ্রোতাকে মুগ্ধ আবেগে অভিভূত করবে। ‘না, কিছুতেই নয়, তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, অযত্ন অবহেলায় ছেড়েও দেননি তোমাকে । অবশ্যই ………. আর তোমাকে অভাবগ্রস্ত অবস্থাতে কি তিনি পাননি, যার পর তিনি তোমাকে অভাবযুক্ত করলেন?’ পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা সকল দয়ার আধার তিনি, সন্তুষ্টি দান করার মালিকও তিনি, আর তাঁর প্রিয় রসূলের জন্য তার এই যে ব্যগ্রতা, সূরাটির প্রতিটি ছত্রের কোমল বর্ণনা ধারায় এবং শব্দের মুর্ছনায় যার ছাপ পাওয়া যায়। যতো ব্যাখ্যা দান করা হোক না কেন, প্রত্যেক ভক্ত হৃদয়ের সুক্ষ তন্ত্রীতে এ সূরাটির ততোই যেন মধুর সুর বেজে ওঠে। এ সুর তার হৃদয়, মনে ও তার প্রতি পদক্ষেপে বেজে উঠে। আহ, কি মধুর সে সুর, যার লহরীতে ফুটে ওঠে এক প্রাণ মাতানো ব্যাগ্রতা! তারপর যখন ও করুণাময়ের কৃপাপ্রার্থী হওয়ার জন্য নবী পাক (স.) তার কোমল মেহের আলিংগনে, ঝুঁকে পড়লেন। তার সেই সত্তষ্টি পাওয়ার আশায় ব্যকুল হয়ে পড়লেন যার প্রবাহ সব কিছুর মধ্যে বিরাজমান রয়েছে, তখন তিনি যেন সুকোমল প্রভাতের পর আগত স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল ও স্বচ্ছ আলোর সন্ধান পেলেন যেন নীরব নিথর গভীর রাতের শীতল কোলে ঢলে পড়লেন ৷ এ সময়টি রাত ও দিনের মধ্যে সব থেকে স্বচ্ছ সময়, সব কিছুর কোলাহল থেমে যায়, ঘুমের চাদর মুড়ি দিয়ে সবাই এসময় প্রায় অচেতন হয়ে যায়। এ প্রহরে ভক্ত হৃদয় নিজ প্রভুর সান্নিধ্য লাভের বাসনায় ব্যকুলচিত্তে দাড়িয়ে যায়। সৃষ্টিজগত ও তার স্রষ্টার সাথে তখন সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সৃষ্টির সবকিছু তার উৎসের কথা অনুভব করে এবং সৃষ্টিকর্তার দিকে পাক সাফ হয়ে খুশীতে তার প্রশংসা গীতি গাইতে গাইতে অগ্রসর হয় । এখানে এই সকল বিষয়ের উপস্থাপনা অত্যস্ত হৃদয়গ্রাহী ও উপযুক্ত শব্দ বসিয়ে পেশ করা হয়েছে। সুতরাং এখানে রাত্রির যে বর্ণনা এসেছে তা হচ্ছে ওই গভীর রাত্রি যা ঘনীভূত হয়, কিন্তু তা ঘোর অন্ধকারও হয়ে যায় না। গভীর রাত বলতে বুঝায় মধ্য রাতের পর থেকে সুবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত সময়টি ৷ যখন হালকা মেঘের পাতলা পর্দা ছড়ানো থাকে। কখনও আকাশে এ চাদর ঝুলতে থাকে আবার কখনও তা একেবারেই মিলিয়ে গিয়ে তারকাখচিত স্বচ্ছ নীল আকাশ দৃশ্যমান হয়। কখনও আকাশ ঢেকে যায় পাতলা মেঘের ছায়ায়, যার ফাক দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় সুদূর নীল আকাশে । এ সময়ে ভক্তহৃদয়ে যে কোমল মধুর আবেগের সৃষ্টি হয়, এ যেন ওই এতীমের নাযুক অনুভূতির মতো যা মুগ্ধ আবেশে আপন পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার কামনায় দিশেহারা হয়ে যেতে চায়। এ সময়টি পার হওয়ার পরই দিনের উজ্জ্বল প্রথম দিবাভাগের আগমন ঘটে ৷ উজ্জ্বল সূর্যালোকের আলোকে আশপাশের সবকিছু রংগীন হয়ে যায় । এই ভাবে সব কিছুর মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়ে এক অপূর্ব ঐকতান সৃষ্টি হয়। (‘আত্তাস্ওয়ীরুল ফারি ফীল’ ৪র্থ সংস্করণ থেকে) প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে এই যে, সুন্দর কারুকার্যখচিত শিল্পের কাজ- এটা যখন কারো দৃষ্টিগোচর হয় তখন তার কাছে মনে হয় হঠাৎ পাওয়া এক আবিষ্কার । এ এমন শিল্প যার সাথে মানুষের তৈরী কোনো শিল্পের তুলনা হয় না। “কসম প্রথম দিবাভাগের এবং কসম গভীর রাত্রের যখন তা চারিদিকে ছেয়ে যায়। তোমাকে তোমার রব পরিত্যাগ করেননি এবং অযত্ন অবহেলায় তোমাকে ছেড়েও দেননি! আর তোমার জন্য পরবর্তীকাল পূর্ববর্তীকাল থেকে ভালো এবং শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এমন কিছু দেবেন যাতে তুমি পরম পরিতৃপ্তি লাভ করবে ।”
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-3
টিকা নং:3,
مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَ مَا قَلٰىؕ
(হে নবী!) তোমার রব তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি।৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) হাদীস থেকে জানা যায়, কিছুদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল বন্ধ ছিল। এ সময়টা কতদিনের ছিল, এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। ইবনে জুরাইজ ১২ দিন, কালবী ১৫ দিন, ইবনে আব্বাস ২৫ দিন, সুদ্দী ও মুকাতিল এর মেয়াদ ৪৫দিন বলে বর্ণনা করেছেন। মোটকথা, সময়টা এত দীর্ঘ ছিল যে রসুলুল্লাহ ﷺ নিজে এ জন্য ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলেন এবং বিরোধীরাও তাঁকে বিদ্রূপ করতে শুরু করেছিল। কারণ তাঁর ওপর নতুন নতুন সূরা নাযিল হলে তিনি তা লোকদের শুনাতেন। তাই দীর্ঘদিন যখন তিনি লোকদেরকে কোন অহী শুনালেন না তখন বিরোধীরা মনে করলো এ কালাম যেখান থেকে আসতো সে উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। জন্দুব ইবনে আবদুল্লাহ আল বাজালী (রা.) রেওয়ায়াত করেন, যখন জিব্রীল আলাইহিস সালামের আসার সিলসিলা থেমে গেলো, মুশরিকরা বলতে শুরু করলোঃ মুহাম্মাদকে ﷺ তাঁর রব পরিত্যাগ করেছেন। (ইবনে জারীর, তাবারানী, আবদ ইবনে হুমাইদ, সাঈদ ইবনে মনসূর ও ইবনে মারদুইয়া) অন্যান্য বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, রসূল ﷺ এর চাচী আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীলের ঘর ছিল তাঁর ঘরের সাথে লাগোয়া। সে তাঁকে ডেকে বললোঃ “মনে হচ্ছে তোমার শয়তান তোমাকে পরিত্যাগ করেছে।” আউফী ও ইবনে জারীর হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করে বলেনঃ কয়েকদিন পর্যন্ত জিব্রীলের আসা বন্ধ থাকার কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে মুশরিকরা বলতে শুরু করলো, তার রব তার প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তিনি তাকে পরিত্যাগ করেছেন। কাতাদাহ ও যাহহাক বর্ণিত মুরসাল* হাদীসেও প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ গভীর দুঃখ ও মর্মব্যাথার কথাও বর্ণিত হয়েছে। আর এমনটি হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। কারণ প্রেমাম্পদের দিক থেকে বাহ্যত অমনোযোগিতা ও উপেক্ষা, কুফর ও ঈমানের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাবার পর এই প্রাণন্তকর সংঘাত সংগ্রামের মাঝ দরিয়ায় যে শক্তিটি ছিল তাঁর একমাত্র সহায় তার সাহায্য থেকে বাহ্যত বঞ্চিত হওয়া এবং এর ওপর বাড়তি বিপদ হিসেবে শত্রুদের বিদ্রূপ-ভর্ৎসনা ইত্যাদি এসব কিছু মিলে অবশ্যি তাঁর জন্য মারাত্মক ধরনের পেরেশানী সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এ অবস্থায় তাঁর মনে বারবার এ সন্দেহ জেগে থাকবে যে, তিনি এমন কোন ভুল তো করেননি যার ফলে তাঁর রব তাঁর প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তিনি হক ও বাতিলের এই লড়াইয়ে তাঁকে একাকী ছেড়ে দিয়েছেন।
এই অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সূরাটি নাযিল হয়। এতে দিনের আলোর ও রাতের নিরবতার কসম খেয়ে রসূলুল্লাহকে ﷺ বলা হয়েছেঃ তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি নারাজও হননি। একথার জন্য যে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এই দু’টি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে দিনের আলোক মালায় উদ্ভাসিত হওয়া এবং রাতের নিঝুমতা ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়াযেমন আল্লাহর দিনে মানুষের প্রতি সন্তুষ্ট এবং রাতে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকার জন্য নয় বরং একটি বিরাট বিজ্ঞানময় ব্যবস্থা ও উদ্দেশ্যের আওতাধীনে এই দু’টি অবস্থার উদ্ভব ঠিক তেমনি তোমার কাছে কখনো অহী পাঠানো এবং তা পাঠানো বন্ধ করাও একটি বিরাট বিজ্ঞানময় ব্যবস্থাও উদ্দেশ্যের আওতাধীনেই হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে অহী পাঠান এবং যখন অহী পাঠান না তখন মনে করতে হবে, তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তোমাকে ত্যাগ করেছেন–এ ধরনের কোন কথা বা বক্তব্যের কোন সম্পর্ক এখানে নেই। এছাড়া এই বিষয়বস্তুর সাথে এই কসমের আরো সম্পর্ক রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, দিনে সূর্যের কিরণ যদি অনবরত মানুষের ওপর পড়তে থাকে তাহলে তা তাকে ক্লান্ত ও অবশ করে দেবে। তাই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত দিনের আলো বিরাজ করে। এরপরে রাতের আসা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এভাবে মানুষ ক্লান্তি দূর করতে ও প্রশান্তি লাভ করতে পারে। অনুরূপভাবে অহীর কিরণ যদি অনবরত তোমার ওপর পড়তে থাকে তাহলে তা তোমার স্নায়ুর সহ্যের অতীত হয়ে পড়বে। তাই মাঝে মধ্যে ফাতরাতুল অহীর (অহী নাযিলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে যাওয়া) একটি সময়ও আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন। এভাবে অহী নাযিল হওয়ার কারণে তোমার ওপর যে চাপ পড়ে তার প্রভাব খতম যাবে এবং তুমি মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবে। অর্থাৎ অহীসূর্যের উদয় যেন উজ্জ্বল দিনের সমতুল্য এবং ফাতরাতুল অহীর সময়টি রাতের প্রশান্তির পর্যায়ভুক্ত।
*মুরসাল এমন এক ধরনের হাদীসকে বলা হয় যেখানে হাদীসের মূল বর্ণনাকারী হিসেবে সাহাবীর নাম উল্লেখিত হয়নি অর্থাৎ তাবেয়ী সাহাবীর নাম উল্লেখ ছাড়াই রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমামদের মধ্যে আবু হানিফা(র) ও মালিক (র)-ই একমাত্র এ ধরনের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এক বর্ণনামতে ইমাম ইবনে হাম্বল (রা.) মুরসাল হাদীসের ভিত্তিতে ফতওয়া দিয়েছেন এবং এর বিপরীত রায়কে রদ করেছেন। (আ’ লামূল মুকিইন, ইবনে কাইয়েম)-অনুবাদক
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-4
টিকা নং:4,
وَ لَلْاٰخِرَةُ خَیْرٌ لَّكَ مِنَ الْاُوْلٰىؕ
নিঃসন্দেহে তোমার জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো।৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ সুখবরটি এমন এক সময় দেন যখন মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক ছিল তাঁর সহযোগী এবং অন্যদিকে সমগ্র জাতি ছিল তাঁর বিরোধী। বাহ্যত সাফল্যের কোন দূরবর্তী চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। ইসলামের প্রদীপ মক্কাতে টিম টিম করে জ্বলছিল। চতুর্দিক ে ঝড় উঠেছিল তাকে নিভিয়ে দেবার জন্য। সে সময় আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেনঃ প্রাথমিক যুগের সংকটে তুমি মোটেই পেরেশান হয়ো না। তোমার জন্য পরবর্তী প্রত্যেকটি যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো প্রমাণিত হবে। তোমার শক্তি, সম্মান, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা দিনের পর দিন বাড়তে থাকবে। তোমার প্রভাব ও অনুপ্রবেশের সীমানা বিস্তৃত হতেই থাকবে। আবার এই ওয়াদা কেবল দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে এ ওয়াদাও আছে যে, আখেরাতে তুমি যে মর্যাদা লাভ করবে তা দুনিয়ায় তোমার অর্জিত মর্যাদা থেকে অনেক গুণ বেশী হবে। তাবারানী তাঁর আওসাত গ্রন্থে এবং বাইহাকী তাঁর দালায়েল গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “আমার পরে আমার উম্মাত যেসব দেশ জয় করবে তা আমার সামনে পেশ করা হয় তাতে আমি খুব খুশী হই। তখন মহান আল্লাহ একথা নাযিল করেন যে, আখেরাত তোমার জন্য দুনিয়া থেকেও ভালো।”
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-5
টিকা নং:5,
وَ لَسَوْفَ یُعْطِیْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰىؕ
আর শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত দেবেন যে, তুমি খুশী হয়ে যাবে।৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) অর্থাৎ দিতে কিছুটা দেরী হলে সে সময় দূরে নয়, যখন তোমার ওপর তোমার রবের দান ও মেহেরবানী এমনভাবে বর্ষিত হবে যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে। এই ওয়াদাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনেই পূর্ণ হয়েছে। সমগ্র আরব ভূখণ্ড, দক্ষিণের সমুদ্র উপকূল থেকে উত্তরে রোম সাম্রাজ্যের সিরীয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের ইরাকী সীমান্ত এবং পূর্বে পারস্য উপসাগর থেকে নিয়ে পশ্চিম লোহিত পর্যন্ত এলাকা তাঁর শাসনাধীনে চলে আসে। আরবের ইতিহাসে এই প্রথমবার এই সমগ্র ভূখণ্ডটি একটি আইন ও শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন হয়। যে শক্তিই এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কালেমায় সমগ্র দেশ গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে। যে দেশে মুশরিক ও আহলি কিতাবরা নিজেদের মিথ্যা মতবাদ ও আদর্শকে বিজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সেখানে মানুষ কেবল আনুগত্যের শিরই নত করেনি বরং তাদের মনও বিজিত হয়ে যায় এবং তাদের বিশ্বাসে, নৈতিক চরিত্রে ও কর্মকাণ্ডে বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়। জাহেলিয়াতের গভীর পংকে নিমজ্জিত একটি জাতি মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে এমনভাবে বদলে যায় যে, সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এর কোন নজীর নেই। এরপর নবী (সা.) যে আন্দোলনের বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তা বিপুল শক্তিমত্তা সহকারে জেগে ওঠে এবং এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা তিন মহাদেশের বিরাট অংশে ছেয়ে যায় এবং দুনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার প্রভাব চড়িয়ে পড়ে। এসব মহান আল্লাহ তাঁর রসূলকে দিয়েছেন দুনিয়ায়। আর আখেরাতে তাঁকে যা কিছু যা দেবেন তার বিপুলতা ও মহত্বের কল্পনাই করা যাবে না। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ত্বা-হা ১১২ টীকা )
ফী জিলালিল কুরআন:
আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া সাত্ত্বনা বাণী : আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা এই শান্ত, সুশীতল আবেগ আনয়নকারী দুটি সময়ের কসম খেয়ে প্রকৃতির বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে মনোজগতের অনুভূতির যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান, সে বিষয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। মানব হৃদয়ে ভাবাবেগের যে প্রস্রবণ নিরন্তর প্রবাহিত হচ্ছে, যা প্রকৃতির মন মাতানো সৌন্দর্যের সংস্পর্শে এসে উদভ্রান্তের মতো নেচে ওঠে তার কাছে আল্লাহ তায়ালা এ মধুর বাণী পেশ করছেন। পথহারা অজানা-অচেনা শ্রান্ত, ক্লান্ত, তৃষিত মরুযাত্রী হঠাৎ করে পানির সন্ধান পেয়ে যেমন করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি যেন নবী(স.) মহব্বত ভরা অপূর্ব ও সূরার কথাগুলো পেয়ে পরম পুলকিত হয়ে উঠলেন! এ সূরার ছত্রে ছত্রে বর্ণিত কথাগুলোর মধ্যে দয়া মায়া মমতা ও গভীর ভালবাসার এক মধূর আমেজ রয়েছে, সময়ের প্রেক্ষিতে এটাও বান্দার চরম ও পরম কাম্য ৷ নিগৃহীত, নির্যাতিত, সমাজ পরিত্যক্ত রসূলের এ মুহূর্তে ওই মধুমাখা বাণীর প্রয়োজন ছিলো খুব বেশী । যার আগমনে মুহুর্তেই তার বুকভরা বেদনারাশি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেলো। পাহাড় সম নিষ্ঠুর বোঝা যেন অকস্মাৎ তার দুটি নাযুক কাধ থেকে নেমে গিয়ে তাঁকে মুক্ত করে দিলো । এ ভালোবাসা ভীতি আনয়নকারী নয়, নয় এটা কোনো নতুন অথবা বিচ্ছিন্ন কিছু। আলোচ্য সূরার মাধ্যমে সর্বত্র এ ভালোবাসারই বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই ভালোবাসাই সকল শক্তির মূল। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতুবন্ধন । আর সৃষ্টির সকল কিছুর মধ্যে, বিশেষ করে মানুষে মানুষে এ ভালবাসার বন্ধন মযবুত হোক এটাই আল্লাহ্ তায়ালা সূরাটির প্রথম অধ্যায়ে বলতে চেয়েছেন। এই ভালবাসার কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক সুশীতল হবে, মানুষ সুখী-সমৃদ্ধশালী হবে। গোটা সষ্টির মধ্যে ভালবাসার এ সম্পর্ককে উজ্জীবিত করার পর অতি গুরুত্ব সহকারে যে সুসংবাদটি এসেছে তা হচ্ছে, ‘না, তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, ঘৃণাও করেননি’ তিনি তোমাকে পরিত্যাগ করেননি বা অবহেলা করেননি। যারা তোমার অন্তরাত্মাকে কষ্ট দিতে চায়, তোমার দিলে যারা আঘাত দেয়ার জন্য সদা ব্যস্ত, যারা তোমার জীবনকে সংকটে ফেলতে চায়, তারাই এমনি করে কথা বলে । অসহায় অবস্থায় তাদের হাতে তিনি তোমায় ছেড়ে দেননি । তিনিই তোমার রব প্রতিপালক, আর তুমি তার বান্দা, তার সাথে তুমি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ৷ তার প্রভুভ্ব ও কর্তৃত্বের মধ্যে তুমি জীবন যাপন করছো। তিনিই তোমার পরিচালক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী ৷ তার মেহেরবানীর প্রস্রবণ কখনও শুকিয়ে যায়নি এবং তার দান কখনও থেমে যায়নি। সুতরাং সাময়িকভাবে ওহী বিরতির কারণে তোমার কিছু কষ্ট হয়ে থাকলেও দুনিয়ার জীবনে যা কিছু ভাল তোমাকে দেয়া হয়েছে, আখেরাতে তার থেকে অনেক বেশী কল্যাণ তোমাকে তিনি দেবেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর অবশ্যই পরবর্তীঁকাল তোমার জন্য পূর্ববর্তীকাল থেকে ভালো ।’ এ ‘ভালো’ হচ্ছে প্রথম ও শেষের কল্যাণ । অর্থাৎ কল্যাণ দিয়ে তোমার জীবন শুরু হয়েছে এবং কল্যাণের মধ্যেই তোমার পরিসমাপ্তি ঘটবে । মাঝখানে সাময়িকভাবে কিছু কষ্ট যদি আসেও তাতে তুমি মুষড়ে পড় না। মহান আল্লাহ তায়ালা তোমার দাওয়াতকে প্রসারিত করার জন্য তোমার যে যোগ্যতা প্রয়োজন তা অবশ্যই তোমাকে দান করবেন যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে। তোমার পথের অন্তরায়কে তিনি দূরীভূত করবেন । তোমাকে তোমার জীবন লক্ষ্যে পৌছানোর ব্যবস্থা করে দেবেন এবং সত্য প্রকাশের পথকে সুগম করে দেবেন । এ সকল কাজেই তো রসূল (স.)-কে সদা সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আর এ কারণেই তাকে শত্রুতা, অস্বীকৃতি, কষ্ট গালিগালাজ ও যড়যন্ত্রের শিকারও হতে হয়েছিলো । ‘অবশ্যই তিনি শীঘ্র তোমাকে দেবেন এমন কিছু যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে ।’
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-6
টিকা নং:6,
اَلَمْ یَجِدْكَ یَتِیْمًا فَاٰوٰى۪
তিনি কি তোমাকে এতিম হিসেবে পাননি? তারপর তোমাকে আশ্রয় দেননি?৬
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৬) অর্থাৎ তোমাকে ত্যাগ করার ও তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। যখন তুমি এতিম অবস্থায় জন্মলাভ করেছিলে তখন থেকেই তো আমি তোমার প্রতি মেহেরবানী করে আসছি। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন ছয় মাসের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা ইন্তিকাল করেন। কাজেই এতিম হিসেবেই তিনি পৃথিবীতে আসেন। কিন্তু এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিনও তাঁকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেননি। ছ’বছর বয়স পর্যন্ত মা তাঁকে লালন-পালন করতে থাকেন। তাঁর স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হবার পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর দাদা তাঁকে প্রতিপালন করেন। দাদা কেবল তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন তাই না বরং তাঁর জন্য গর্বও করতেন। তিনি লোকদের বলতেন, আমার এই ছেলে একদিন দুনিয়ায় বিপুল খ্যাতির অধিকারী হবে। তার ইন্তিকালের পর চাচা আবু তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। চাচা তাঁর সাথে এমন প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করেন যে, কোন পিতার পক্ষেও এর চেয়ে বেশী প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এমনকি নবুওয়াত লাভের পর সমগ্র জাতি যখন তাঁর শত্রু হয়ে গিয়েছিল তখন দশ বছর পর্যন্ত তিনিই তার সাহায্যার্থে চীনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-7
টিকা নং:7,
وَ وَجَدَكَ ضَآلًّا فَهَدٰى۪
তিনি তোমাকে পথ না পাওয়া অবস্থায় পান, তারপর তিনিই পথ দেখান।৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৭) মূলে “দাল্লান”( ضالا ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি এসেছে “দালালাত” ( ضلا لت ) থেকে। এর কয়েকটি অর্থ হয়। এর একটি অর্থ গোমরাহী। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এক ব্যক্তি পথ জানে না, এক জায়গায় গিয়ে সে সামনে বিভিন্ন পথ দেখে কোন পথে যাবে তা ঠিক করতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এর আর একটি অর্থ হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বা হারানো জিনিস। আরবী প্রবাদে বলা হয়, (ضَلَّ الْمَاءُفِى اللَّبَنِ ) অর্থাৎ পানি দুধের মধ্যে হারিয়ে গেছে। মরুভূমির মধ্যে যে গাছটি একাকি দাঁড়িয়ে থাকে এবং তার আশেপাশে কোন গাছ থাকে না তাকেও আরবীতে “দাল্লাহ” বলা হয়। নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থেও “দালাল” (ضلال ) বলা হয়। আবার গাফলতির জন্যও “দালাল” ব্যবহার করা হয়। যেমন কুরআন মজীদে এর দৃষ্টান্ত” দেখা যায়। (لَايَضِلُّ رَبِّىْ وَ لاَ يَنْسَى ) অর্থাৎ আমার রব না গাফেল হন আর না তিনি ভুলে যান। ( ত্বা-হা ৫২) এই বিভিন্ন অর্থের মধ্য থেকে প্রথম অর্থটি এখানে খাপ খায় না। কারণ ইতিহাসে রসূলের শৈশব থেকে নিয়ে নবুওয়াত লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত সময় কালের যেসব অবস্থা লিপিবদ্ধ রয়েছে তাতে কোথাও তিনি কখনো মূর্তিপূজা, শিরক বা নাস্তিক্যবাদে লিপ্ত হয়েছিলেন অথবা তাঁর জাতির মধ্যে যেসব জাহেলী কার্যকলাপ, রীতিনীতি ও আচার আচরণের প্রচলন ছিল তার সাথেও তিনি কোনক্রমে জড়িত হয়েছিলেন বলে সামান্যতম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই (وَوَجَدَكَ ضَالاَْ ) বাক্যে কোনক্রমেই এ অর্থ হতে পারে না যে, আল্লাহ তাঁকে বিশ্বাস ও কর্মের দিক থেকে গোমরাহ হিসেবে পেয়েছিলেন। তবে অন্যান্য অর্থগুলো কোন না কোনভাবে এখানে খাপ খেতে পারে। বরং বিভিন্ন দিক থেকে হয়তো প্রত্যেকটি অর্থই এখানে কার্যকর হতে পারে। নবুওয়াত লাভের পূর্বে নবী ﷺ আল্লাহর অস্তিত্বে ও তাঁর একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। সে সময়তাঁর জীবন গোনাহ মুক্ত এবং নৈতিক গুণাবলী সমন্বিত ছিল। কিন্তু সত্যদ্বীন এবং তার মূলনীতি ও বিধান সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ
مَا كُنۡتَ تَدۡرِىۡ مَا الۡكِتٰبُ وَلَا الۡاِيۡمَانُ
অর্থাৎ “তুমি জানতে না কিতাব কি এবং ঈমানই বা কি।” (আশশুরা ৫২ আয়াত ) এ আয়াতের এ অর্থও হতে পারে যে, নবী (সা.) একটি জাহেলী সমাজের বুকে হারিয়ে গিয়েছিলেন এবং নবুওয়াত লাভের আগে একজন পথপ্রদর্শক ও পথের দিশা দানকারী হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্ব সুস্পষ্ট হয়ে সামনে আসেনি। এর এ অর্থও হতে পারে যে, জাহেলিয়াতের মরুভূমিতে আপনি দাঁড়িয়েছিলেন একটি নিসঙ্গ বৃক্ষের মতো। এই বৃক্ষের ফল উৎপাদনের ও চারাগাছবৃদ্ধি করে আর একটি বাগান তৈরি করার যোগ্যতা ছিল। কিন্তু নবুওয়াতের পূর্বে এ যোগ্যতা কোনো কাজে লাগেনি। এ অর্থে হতে পারে যে, মহান আল্লাহ আপনাকে অসাধারণ ক্ষমতা দান করেছিলেন। জাহেলিয়াতের অনুপযোগী ও বিরোধী পরিবেশেতা নষ্ট হতে বসেছিল। “দালাল” কে গাফলতির অর্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ নবুওয়াত লাভের পরে আল্লাহ তাঁকে যেসব জ্ঞান ও সত্যের সাথে পরিচিত করিয়েছেন ইতিপূর্বে তিনি সেগুলো থেকে গাফেল ছিলেন। কুরআনেও এক জায়গায় বলা হয়েছে:
وَاِنۡ كُنۡتَ مِنۡ قَبۡلِهٖ لَمِنَ الۡغٰفِلِيۡنَ
“আর যদিও তুমি ইতিপূর্বে এসব বিষয়ে গাফেল ছিলে।” ( ইউসুফ ৩ ) এছাড়াও দেখুন সূরা আল বাকারাহ ২৮৩ আয়াত এবং আশ শু’আরা ২০ আয়াত )
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-8
টিকা নং:8,
وَ وَجَدَكَ عَآئِلًا فَاَغْنٰىؕ
তিনি তোমাকে নিঃস্ব অবস্থায় পান, তারপর তোমাকে ধনী করেন।৮
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৮) নবী ﷺ পৈতৃক সূত্রে উত্তরাধিকার হিসেবে শুধুমাত্র একটি উটনী ও একটি বাঁদী লাভ করেছিলেন। এভাবে দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের সূচনা হয়। তারপর এমন এক সময় আসে যখন মক্কার সবচেয়ে ধনী মহিলা হযরত খাদীজা (রা.) প্রথমে ব্যবসায়ে তাঁকে নিজের সাথে শরীক করে নেন। তারপর তিনি তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন। এভাবে তাঁর সমস্ত ব্যবসায়ের দায়িত্বও তিনি নিজের হাতে তুলে নেন। এই সুবাদে তিনি কেবল ধনীই হননি এবং তাঁর ধনাঢ্যতা নিছক স্ত্রীর ধনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না বরং তাঁর ব্যবসায়ের উন্নতি বিধানে তাঁর নিজের যোগ্যতা ও শ্রম বিরাট ভূমিকা পালন করে।
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-9
টিকা নং:9,
فَاَمَّا الْیَتِیْمَ فَلَا تَقْهَرْؕ
কাজেই এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না। ৯
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৯) অর্থাৎ যেহেতু তুমি নিজে এতিম ছিলে, আল্লাহ তোমার প্রতি মেহেরবানী করেছেন এবং এতিম অবস্থায় সর্বোত্তম পদ্ধতিতে তোমাকে সাহায্য-সহায়তা দান করেছেন, তাই আল্লাহর এই সাহায্যের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তুমি কখনো কোন এতিমের প্রতি জুলুম করবে না।
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-10
টিকা নং:10,
وَ اَمَّا السَّآئِلَ فَلَا تَنْهَرْؕ
এবং প্রার্থীকে তিরস্কার করো না।১০
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১০) এর দু’টি অর্থ হয়। যদি প্রার্থীকে সাহায্য প্রার্থনাকরী অভাবী হিসেবে ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হয়, তাকে সাহায্য করতে পারলে করো আর না করতে পারলে কোমল স্বরে তাকে নিজের অক্ষমতা বুঝিয়ে দাও। কিন্তু কোনক্রমে তার সাথে রূঢ় ব্যবহার করো না। এই অর্থের দিক দিয়ে নির্দেশটিকে আল্লাহর সেই অনুগ্রহের জবাবে দেয়া হয়েছে বলা যেতে পারে, যাতে বলা হয়েছে “তুমি অভাবী ছিলে তারপর আল্লাহ তোমাকে ধনী করে দিয়েছেন। আর যদি প্রার্থীকে জিজ্ঞেসকারী অর্থাৎ দ্বীনের কোন বিষয় বা বিধান জিজ্ঞেসকারী অর্থে ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হয়, এই ধরনের লোক যতই মূর্খ ও অজ্ঞ হোক না কেন এবং যতই অযৌক্তিক পদ্ধতিতে সে প্রশ্ন করুক বা নিজের মানসিক সংকট উপস্থাপন করুক না কেন, সকল অবস্থায়ই স্নেহশীলতা ও কোমলতা সহকারে তাকে জবাব দাও এবং জ্ঞানের অহংকারে বদমেজাজ লোকদের মতো ধমক দিয়ে বা কড়া কথা বলে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ো না। এই অর্থের দিক দিয়ে এই বাণীটিকে আল্লাহর সেই অনুগ্রহের জবাবে দেয়া হয়েছে বলা যেতে পারে, যাতে বলা হয়েছে—“তুমি পথের খোঁজ জানতে না তারপর তিনিই তোমাকে পথনির্দেশনা দিয়েছে।” হযরত আবু দারদা(রা.), হাসান বসরী (র), সুফিয়ান সওরী (র) এবং অন্যান্য কয়েকজন মনীষী এই দ্বিতীয় অর্থটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ তাদের মতে বক্তব্য বিন্যাসের দিক দিয়ে বিচার করলে এ বক্তব্যটি ( وَوَجَدَكَ ضَآلاًّ فَهَدٰى ) এর জবাবেই দেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
সুরা: আদ-দুহা
আয়াত নং :-11
টিকা নং:11,
وَ اَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ۠
আর নিজের রবের নিয়ামত প্রকাশ করো।১১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১১) নিয়ামত শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর অর্থ এমন সব নিয়ামত হয়, যা এই সূরাটি নাযিল হওয়ার সময় পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর রসূলকে দান করেছিলেন। আবার এমন সব নিয়মিতও হয়, যা এই সূরায় প্রদত্ত নিজের ওয়াদা এবং পরবর্তীকালে তা পূর্ণতা দান প্রসঙ্গে তিনি রসূলকে প্রদান করেছিলেন। এর ওপর আবার হুকুম দেয়া হয়েছে, হে নবী! আল্লাহ তোমাকে যেসব নিয়মিত দান করেছেন তার প্রত্যেকটির কথা স্মরণ কর। এ নিয়ামত বিশেষ আকারে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। সামগ্রিকভাবে সমস্ত নিয়ামত প্রকাশের পদ্ধতি নিম্নরূপঃ মুখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবেএবং একথার স্বীকৃতি দিতে হবে যে, আমি যেসব নিয়ামত লাভ করেছি সবই আল্লাহর মেহেরবানীও অনুগ্রহের ফল। নয়তো এর মধ্যে কোনো একটিও আমার নিজের ব্যক্তিগত উপার্জনের ফসল নয়। দাওয়াতও তাবলীগের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে নবুওয়াতের নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে। লোকদের মধ্যে বেশী বেশী করে কুরআন প্রচার করে এবং তার শিক্ষাবলীর সাহায্যে মানুষের হৃদয়দেশ আলোকিত করে কুরআনের নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে। পথহারা মানুষদের সরল সত্য পথ দেখিয়ে দিয়ে এবং সবরের সাহায্যে এই কাজের যাবতীয় তিক্ততা ও কষ্টের মোকাবেলা করে হেদায়েত লাভের নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে। এতিম অবস্থায় সাহায্য-সহায়তা দান করে আল্লাহ যে অনুগ্রহ দেখিয়েছেন এতিমদের সাথে ঠিক তেমনি অনুগ্রহপূর্ণ ব্যবহারকরে এই নিয়ামতটি প্রকাশ করা যেতে পারে। দারিদ্র্য ও অভাব থেকে সচ্ছলতাও ধনাঢ্যতা দান করার জন্য যে অনুগ্রহ আল্লাহ করেছেন অভাবী মানুষদের সাহায্য করেই সেই নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে। মোটকথা, আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ও নিয়ামতসমূহ বর্ণনা করার পর একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যের মাধ্যমে তাঁর রসূলকে এই গভীর ও ব্যাপক অর্থপূর্ণ হেদায়াত দান করেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
এরপর সূরার পরবর্তী কথাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সেই বিষয় সম্পর্কে জানানো হয়েছে যা তার জীবনের প্রথম অধ্যায়ে বিরাজমান ছিলো । যেন তিনি তার পরোয়ারদেগারের দেখা পরবর্তীকালের নেয়ামতগুলো উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি যেন বুঝতে পারেন কোন কোন জিনিসের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের মহব্বত ও মেহেরবানী তার ওপর বর্ষিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা চান, কোথায়, কিভাবে এবং কোন আকারে তার রহমত বর্ষণ করা প্রয়োজন এটা যেন তিনি বুঝেন। সেই সর্বব্যাপী নেয়ামত যা মানুষকে স্মরণ করানো হয় এই চমৎকার ভংগিতে তার বর্ণনা এসেছে। ‘তিনি কি তোমাকে এতীম অবস্থায় পাননি, সে অবস্থা থেকে তোমাকে তুলে নিয়ে তিনি কি আশ্রয় দেননি? আর তোমাকে কি সঠিক পথ থেকে দূরে দেখতে পাননি? সে অবস্থা থেকে উন্নীত করে তিনি কি তোমাকে অভাবমুক্ত করেননি? ‘ তাকিয়ে দেখো তোমার বর্তমান বাস্তব অবস্থার দিকে এবং তোমার পেছনের জীবনের দিকে। তোমার রব কি তোমাকে সত্যিই পরিত্যাগ করেছেন তোমাকে কি ঘৃণা বা অবহেলা করেছেন? এমনকি তোমাকে এ দায়িত্ব দান করার পূর্বেও কি তিনি তোমাকে অবহেলিত করেছেন? তোমার এতীম থাকা বয়সে কি তোমাকে তিনি পরিচালনা করেননি? তুমি কি দ্বিধাগ্রস্ত থাকা অবস্থায় তার পথ প্রদর্শন অনুভব করে নি? তোমার দারিদ্রকে তুমি কি তার মহান দান বলে বুঝতে পারোনি? তুমি এতীম অবস্থায় পিতার মৃত্যুর পর জন্ম গ্রহণ করেছিলে ৷ সে অবস্থায় কি তিনি তার নিজের কাছে তার নিজ তত্ত্বাবধানে তোমাকে আশ্রয় দেননি এবং তোমার প্রতি কি তিনি অনুরাগী থাকেননি! আর তুমি ছিলে অভাবগ্রস্ত। সে অবস্থায় কী তোমার মনে তিনি অল্পে তুষ্ট থাকার জন্য ধৈর্য দান করেননি? অর্থনৈতিকভাবে স্বল্প আয়ের ওপর তোমাকে তুষ্ট রেখেছিলেন। সে অবস্থায় তুমি অভাববোধ করোনি বা অন্যদের অর্থ সম্পদ দেখে মন খারাপ করোনি। এরপর খেয়াল করে দেখো, তৎকালীন আরব জাহেলিয়াতের মধ্যে যে সব ধারণা ও নানা প্রকার ধর্মীয় মতবাদ বিরাজ করতো সেই পরিবেশেই তো তুমি বড় হয়েছিলে । যখন মানুষের মন মগয পরস্পর বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ছিলো এবং নীতি নৈতিকতা বলতে কিছুই ছিলো না, সেই সব বিভিন্নমুখী ব্যবহারের মধ্যে তুমি তাদের কারো সাথে নিশ্চিন্ত মনে মিশে যেতে পারতে, কিন্তু তখনও তোমার নিজস্ব, স্বকীয় ও স্বতন্ত্র একটা পথ ছিলো । সে পথে তুমি পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিলে না, তুমি জাহেলী কোনো ধ্যান ধারণার সাথে ছিলে না, না মূসা ও ঈসা (আ.)-এর ভ্রান্ত অনুসারীদের পরিবর্তিত ও মনগড়া কোনো নিয়মনীতির মধ্যে ছিলে । তারপর, আল্লাহ রব্বুল ইযযত তোমাকে সেই সঠিক পথের সন্ধান দিলেন যার বাস্তবায়নের জন্য তোমার কাছে পরবর্তীতে ওহী পাঠালেন এবং সে সুস্পষ্ট পথ দিয়েই তিনি তোমাকে পরিচালনা করলেন। সে জাহেলী মতবাদের অনুসারী শ্রান্ত-ক্লান্ত দিশেহারা সমাজের প্রতি ছিলো তার নির্দেশনা । এ ছিলো এক এমন বাস্তব সম্মত পথ যার সমকক্ষ অন্য কোনো মত ও পথ কোনোদিন হতে পারে না। এ দিকদর্শন ছিলো সকলের জন্য এক তৃপ্তিজনক, চিন্তামুক্ত ও সংকটমুক্ত অবস্থা, যাকে কোনো সংকট এসে বিপর্যস্ত করতে পারেনি । যাকে কোনো বড় থেকে বড় সমস্যা এসে কোনদিন ক্লান্ত ও হতাশ করতে পারেনি । আর এ কারণেই তখন রসূলুল্লাহ্ (স.) বেশী ক্লান্ত ও মনোবেদনায় সাময়ীক ভেঙ্গে পড়েছিলেন যখন ওহী আসার ধারাবাহিকতা কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকলো এবং ওই সুযোগে ওই অভদ্র সমাজের মোশরেক লোকেরা তাঁর প্রতি নানা প্রকার কটুক্তি করলো। তারা চেয়েছিলো নানা প্রকার বাজে কথা বলে আল্লাহ তায়ালার এই প্রেমিককে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে । পরিশেষে এলো এই স্মরণিকা ও তার পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে নিশ্চিন্ততাদানকারী কথা যে, না তিনি কখনও তেমাকে ছাড়বেন না, ওহীও বন্ধ রাখবেন না। এটা কি সত্য কথা নয় যে, অতীতেও তোমাকে কখনও তিনি ছাড়েননি বা অবহেলিত করেননি!এ প্রসংগে তার রব অতীতে এতীম থাকা অবস্থায় তার করুন জীবনের কথা তাঁকে স্মরণ করাচ্ছেন । তারপর বিভ্রান্তির বেড়াজালে যখন তিনি আবদ্ধ ছিলেন এবং যখন তিনি পারিবারিক জীবনে নানা প্রকার সংকটের সম্মুখীন ছিলেন, তখন কিভাবে তার রব তাকে পরিচালনা করলেন। এই পথ প্রদর্শনায় তার সমস্যার সমাধান দান করার সাথে সাথে আশেপাশের অন্যান্য মুসলমানের কাছে এতীমের প্রতি কি ব্যবহার করতে হবে সে সমস্যার সমাধানের পথও খোলাসা হয়ে গেলো । যে ব্যক্তি বঞ্চিত বা অভাবগ্রস্ত অবস্থায় হাত পাততে বাধ্য হয়, তাদের সাথে ব্যবহারের নীতি এবং আল্লাহ্র নেয়ামতের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সদুপদেশ দানের হকও এতে আদায় হয়ে গেলো। প্রথম দিকের এই পথ নির্দেশনার মাধ্যমে এতীম ও অভাবীদেরকে দান করা দ্বীন ইসলামের কল্যাণকর ভাবধারার অবিচ্ছেদ্য একটি অংগে পরিণত হলো । ‘সুতরাং, যে এতীম বাচ্চা, তাকে কোনো চাপ দিয়ো না, আর যে হাত পেতে চায় তাকে ধমক দিয়ো না। তোমার রবের নেয়ামত (যা তুমি লাভ করেছো) তা প্রকাশ করতে থাকো ।’ এখন এতীম-অনাথ বাচ্চাদের কদর করা, তাদের প্রতি জবরদস্তি বা কোনো কঠোর ব্যবহার না করা, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা এবং কোনো অভাবী সাহায্যের জন্যে এলে তাকে নরম কথা বলা ও সাধ্যানুযায়ী তাদের অভাব দুর করার চেষ্টা করা এই সব বিষয়ে বারবার আমরা উল্লেখ করেছি। সে চরম নিষ্ঠুর সমাজে, নিগৃহীত, অবহেলিত মানবতা ইনসাফের আশায় দ্বারে দ্বারে কেঁদে ফিরছিলো, যেখানে দুর্বলদের অধিকারের কোনো মূল্যই যেখানে ওই দুর্বলদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো শক্তিও ছিলো না, সেখানে এসব কথা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে তোলার ছিলো অসাধারণ এক কৌশল ৷ এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইসলাম এগিয়ে এসেছে। বঞ্চিত ও মযলুমদের অধিকার আদায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল্লাহ্র ভয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে ব্রতী হয় এবং আল্লাহ্প্রদত্ত সীমার মধ্যে যেন সবাই জীবন যাপন করতে পারে সে ব্যবস্থা করেছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র দেয়া সীমানার মধ্যে থাকার কথা সর্বদা খেয়াল রাখে এবং যেসকল দুর্বল লোক নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো কোনো শক্তি বা ক্ষমতা রাখে না তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে এবং তাদের অধিকার যারা নষ্ট করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় তারা অবশ্যই আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করে। আল্লাহ্র নেয়ামত সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করা, বিশেষ করে হেদায়াত ও ঈমান-রূপে যে নেয়ামত আল্লাহ্ তায়ালা দান করেছেন সে সম্পর্কে পারস্পরিক আলোচনা এটাও তার শোকরগোযারির (একটি) অংশ । আল্লাহ্র নেয়ামতের এ স্বীকৃতির পর তার হুকুম পালনের মাধ্যমে তার শোকরগোযারীর পূর্ণতা লাভ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে, বাস্তব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এটাই হচ্ছে আসল শোকরগোযারী ৷
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:
ضُحٰي বলা হয় পূর্বাহ্ন বা চাশতের সময়কে। যখন সকালে সূর্য একটু উঁচুতে ওঠে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الضُّحٰي শব্দ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে আল্লাহ তা‘আলার সম্পর্ক বহাল রাখার কথা ও রাসূলের ওপর পূর্বাপর কয়েকটি নেয়ামতের কথা স্মরণ করে দেয়া হয়েছে।
শানে নুযূল:
সাহাবী জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা নাবী (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। দু-তিন রাত তাহাজ্জুদ পড়তে পারেননি। এক মহিলা তাঁর নিকট এসে বলল : হে মুহাম্মাদ! মনে হয় তোমার শয়তান তোমাকে ত্যাগ করেছে। তখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৫০, সহীহ মুসলিম হা. ১৭৯৭)। এ মহিলা হলো আবূ জাহলের স্ত্রী উম্মে জামিলা। (ফাতহুল বারী ৮/৯০৭)
(إِذَا سَجٰي) শব্দের অর্থ হলো: নিঝুম হওয়া। অর্থাৎ যখন রাত্রি নিঝুম হয়ে যায় এবং তার অন্ধকার পূর্নরূপে ছেয়ে যায়। যেহেতু তখনই প্রত্যেক জীব স্থির ও শান্ত হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَالِقُ الْإِصْبَاحِ ج وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَّالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ط ذٰلِكَ تَقْدِيْرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ)
“তিনিই সকালকে প্রকাশ করেন, তিনিই বিশ্রামের জন্য রাতকে সৃষ্টি করেছেন এবং গণনার জন্য সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন; এসবই পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিরূপণ।” (সূরা আনআম ৬: ৯৬)
(مَا وَدَّعَكَ) অর্থ : ما تركك বা আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে বর্জন করেননি। وَمَا قَلٰي অর্থ : وما ابغضك বা তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। সুতরাং যে বা যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদকে বর্জন করেছেন তাদের জন্য এ আয়াত দাঁতভাঙ্গা জবাব। বরং এ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিলেন যে, যখন থেকে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ভালবেসেছেন এবং ওয়াহী নাযিল করেছেন তখন থেকে তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হননি। বরং সর্বদা তোমার ওপরে তার অনুগ্রহ বর্ষণ হতে থাকবে।
(وَلَلْاٰخِرَةُ خَیْرٌ لَّکَ مِنَ الْاُوْلٰی)
অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন অপেক্ষা আখিরাতের জীবন উত্তম। এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার পর আমার উম্মতের জন্য যে বিজয় দেওয়া হবে তা আমার সামনে উত্থাপন করা হলো, ফলে আমার আনন্দ লাগল; তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সনদ হাসান, লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল।)
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চাটাইয়ের ওপর শুয়েছিলেন। ফলে তাঁর পার্শ্বদেশে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে বললাম : হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! চাটাইয়ের ওপর আমাকে কিছু বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দিন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি কোথায় ও দুনিয়া কোথায়? আমার ও দুনিয়ার উদাহরণ হলো সেই পথচারী পথিকের মত যে, একটি গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করে, তারপর গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে চলে যায়। (তিরমিযী হা. ২৩৭৭, ইবনু মাযাহ হা. ৪১০৯, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৪৩৯.)
(وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰي)
অর্থাৎ হে নাবী (সাঃ)! আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে এমন নেয়ামত দেবেন যা পেয়ে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য, আখিরাতে নাবী (সাঃ)-এর শাফায়াত। (ইবনু কাসীর)
হাফেয সালাহুদ্দীন ইউসুফ (রহঃ) বলেন : এর দ্বারা দুনিয়ার বিজয় এবং আখেরাতের নেকী বুঝানো হয়েছে। এতে ঐ সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত যা নাবী (সাঃ) নিজের গুনাহগার উম্মাতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট লাভ করবেন।
فَاٰوٰي অর্থাৎ তুমি শৈশবকালেই ইয়াতীম হয়ে পিতা-মাতার আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলে, তোমার কেউ ছিল না, আল্লাহ তা‘আলাই তোমাকে আশ্রয় দিয়ে দাদা আবদুল মুত্তালিবের দায়িত্বে দেন, আব্দুল মুত্তালিব মারা গেলে চাচা আবূ তালেবের দায়িত্বে দেন। এভাবেই তোমাকে তাঁর সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা শক্তিশালী করে তুলেছেন।
(وَوَجَدَكَ ضَآلًّا فَهَدٰي)
অর্থাৎ তুমি দীন, শরীয়ত ও ঈমান কী জিনিস এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলে। আমি ওয়াহী অবতীর্ণ করে সব কিছুর সঠিক পথ দেখালাম।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَکَذٰلِکَ اَوْحَیْنَآ اِلَیْکَ رُوْحًا مِّنْ اَمْرِنَاﺚ مَا کُنْتَ تَدْرِیْ مَا الْکِتٰبُ وَلَا الْاِیْمَانُ وَلٰکِنْ جَعَلْنٰھُ نُوْرًا نَّھْدِیْ بِھ۪ مَنْ نَّشَا۬ئُ مِنْ عِبَادِنَاﺚ وَاِنَّکَ لَتَھْدِیْٓ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ)
“আর এভাবেই আমি তোমার প্রতি ওয়াহী করেছি রূহ (কুরআন) আমার নির্দেশে; তুমি তো জানতে না কিতাব কী ও ঈমান কী পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা সঠিক পথনির্দেশ করি; তুমি অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন কর।” (সূরা শুরা ৪২: ৫২)
(عَآئِلًا فَأَغْنٰي)
অর্থাৎ তুমি দরিদ্র ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন শহর, দেশ বিজয় করে তোমাকে দারিদ্রমুক্ত করলেন। আর তোমার অন্তরকে পরিতৃপ্তি ও ধৈর্যের দ্বারা মানুষের অমুখাপেক্ষী করেছেন। সুতরাং তুমি অভাবী অবস্থায় ধৈর্যশীল এবং অভাব মুক্ত অবস্থায় কৃতজ্ঞ হও। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
لَيْسَ الغِنَي عَنْ كَثْرَةِ العَرَضِ، وَلَكِنَّ الغِنَي غِنَي النَّفْسِ
মাল ও আসবাবপত্রের আধিক্যই ধনী নয়, বরং আসল ধনী হলো অন্তরের ধনী। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৪৬)
(فَلَا تَقْهَرْ) অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ইয়াতীম অবস্থায় পেয়েছিলেন, তারপর তাঁর স্বীয় অনুগ্রহে তোমাকে বড় করে তুললেন, অতত্রব তুমিও ইয়াতীমদের প্রতি কঠোর হয়ো না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চরিত্র এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে তিনি চরম রাগ করলেও নিজেকে সংযত রাখতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللہِ لِنْتَ لَھُمْﺆ وَلَوْ کُنْتَ فَظًّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِکَﺕ فَاعْفُ عَنْھُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَھُمْ وَشَاوِرْھُمْ فِی الْاَمْرِﺆ فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَکَّلْ عَلَی اللہِﺚ اِنَّ اللہَ یُحِبُّ الْمُتَوَکِّلِیْنَ)
“অতএব আল্লাহর অনুগ্রহে, তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয়বান হয়েছিলে; আর তুমি যদি কর্কশ ভাষী, কঠোর হৃদয়বান হতে, তবে নিশ্চয়ই তারা তোমার সংস্পর্শে আসা হতে বিরত থাকত, অতএব তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর ও তাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কার্য সম্পর্কে তাদের সাথে পরামর্শ কর; অতঃপর যখন তুমি (কোন বিষয়ে) সঙ্কল্প করবে তখন আল্লাহর প্রতি ভরসা কর এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্ভরশীলগণকে ভালবাসেন।” (সূরা আলি ইমরান ৩: ১৫৯)
আর তুমি ছিলে নিঃস্ব, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে অভাবমুক্ত করেছেন। অতএব অভাবীদেরকে ধমক দিও না। আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে যে দুনিয়াবী ও দীনি নেয়ামত প্রদান করেছেনÑ যেমন তুমি ইয়াতীম ছিলে, আল্লাহ তা‘আলা তত্ত্বাবধায়নের ব্যবস্থা করেছেন; তুমি দরিদ্র ছিলে, আল্লাহ তা‘আলা দরিদ্রতা দূর করেছেন; তুমি দীন, শরীয়ত ও ঈমান বলতে কিছুই জানতে না আল্লাহ তা‘আলা তোমার প্রতি রিসালাত প্রদান করে সব জানিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁর প্রশংসা প্রকাশার্থে এসব নেয়ামতের বর্ণনা কর।
সূরা হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের বিবরণ জানলাম।
২. প্রত্যেক মু’মিনের জন্য আখিরাত শ্রেষ্ঠ।
৩. ইয়াতীম ও দরিদ্রদেরকে ধমক দিয়ে কথা বলা ঠিক না।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
হযরত ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত ইসমাঈল ইবনে কুসতুনতীন (রঃ) এবং হযরত শবল ইবনে ইবাদের (রঃ) সামনে কুরআন পাঠ করছিলেন। যখন তিনি (আরবি) পর্যন্ত পৌঁছেন তখন তারা উভয়েই বলেনঃ এখান হতে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক সূরার শেষে তাকবীর পাঠ করবেন। আমরা ইবনে কাসীর (রঃ)এর সামনে পাঠ করছিলাম, তিনি মুজাহিদ (রঃ)-এর সামনে পাঠ করলে তিনিও তাকে এই নির্দেশ দেন। তিনি আমাদেরকে অনুরূপ কথা বলেছিলেন। তিনি পাঠ করেছিলেন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর সামনে। তিনিও তাঁকে এই হুকুম করেছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পাঠ করেছিলেন হযরত উবাই ইবনে কাবের (রাঃ) সামনে। তিনিও তাঁকে এটারই আদেশ করেছিলেন। আর হযরত উবাই (রাঃ) পাঠ করেছিলেন রাসুলুল্লাহর সামনে এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে এরই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইমামুল কিরআত হযরত আবু হাসানও (রঃ) এই সুন্নাতের বর্ণনাকারী। হযরত আবু হাতিম রাযী (রঃ) এ হাদীসকে দুর্বল বলেছেন। কারণ আবুল হাসান বর্ণনাকারী হিসেবে দুর্বল। আবু হাতিম (রঃ) তাঁর নিকট হতে কোন হাদীসই নিতেন না। অনুরূপভাবে হযরত আবূ জাফর উকাইলীও (রঃ) তাঁকে মুনকারুল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শায়েখ শিহাবুদ্দীন আবু শামাহ (রঃ) শারহি শা’তিবিয়্যায় হযরত ইমাম শাফিয়ী (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একজন লোককে নামাযের মধ্যে এ তাকবীর বলতে শুনে বলেনঃ “তুমি ভাল কাজই করেছে এবং সুন্নাত পালন করেছে। এ ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, এ হাদীস সহীহ বা বিশুদ্ধ। এখন এ তাকবীর কোথায় ও কিভাবে পাঠ করতে হবে এ ব্যাপারে কারীদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, (আরবি) এই সূরা সমাপ্ত হওয়ার পর হতে এ তাকবীর পাঠ করতে হবে। অন্যেরা বলেছেন, (আরবি) সমাপ্ত হওয়ার পর হতে পড়তে হবে। আর কারো কারো মতে এটা পাঠের নিয়ম এই যে, শুধু আল্লাহু আকবার বলতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, (আরবি) বলতে হবে।
কোন কোন কারী সূরা আদ্দোহা হতে এই তাকবীর পাঠ করার কারণ এই বলে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট অহী আসা কিছু দিনের জন্যে বন্ধ ছিল। তারপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এই সূরা নিয়ে আসার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আনন্দের আতিশয্যে তাকবীর পাঠ করেন। কিন্তু এই বর্ণনা এমন কোন সনদের সাথে বর্ণিত হয়নি যেটা দ্বারা এটাকে বিশুদ্ধ অথবা দুর্বল বলা যেতে পারে। এ সব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
১-১১ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এ কারণে তিনি একদিন বা দুদিন রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাযের জন্যে উঠতে পারেননি। এটা জেনে একটি মহিলা এসে বলেঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! তোমাকে তোমার শয়তান পরিত্যাগ করেছে।” তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ (আরবি) এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ, ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জুনদুব (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর আসতে কয়েকদিন বিলম্ব হয়েছিল, এতে মুশরিকরা বলাবলি করতে শুরু করে যে, মুহাম্মদ(সঃ) কে তাঁর প্রতিপালক পরিত্যাগ করেছেন, তখন আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর আঙ্গুলে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হলে তিনি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তুমি শুধু একটি আঙ্গুল বৈ তো নও, আর আল্লাহর পথে তোমার এ যখম হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতা বশতঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) দুই তিন দিন উঠতে পারেননি, এতেই ঐ মহিলাটি উপরোক্ত অশালীন উক্তি করেছিল। অতঃপর উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। জানা যায় যে, ঐ দুষ্টা মহিলাটি ছিল আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল। তার প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত নাযিল হোক। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আঙ্গুল আহত হওয়া এবং তাতে উপরোক্ত পংক্তি আকস্মিকভাবে তার মুখে উচ্চারিত হওয়ার কথা তো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে, কিন্তু তাহাজ্জুদ আদায়ে অসমর্থতা যে সেই কারণে হয়েছিল এবং এই আয়াতগুলো যে ঐ উপলক্ষ্যে অবতীর্ণ হয়েছিল এ উক্তি উসূলে হাদীসের পরিভাষায় গারীব বলে উল্লিখিত হয়েছে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত খাদীজা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলেনঃ “আপনার প্রতিপালক আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট তো হননি?” তখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর আসতে বিলম্ব হওয়ায় রাসূলুল্লাহ শংকিত হয়ে পড়েন। এ কারণে হযরত খাদীজা (রাঃ) উপরোক্ত মন্তব্য করেন। তখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। এ দুটি বর্ণনাকে উসূলে হাদীসের পরিভাষায় মুরসাল বলা হয়েছে। তবে খাদীজা (রাঃ)-এর নাম ও উক্তি উল্লেখ এ ক্ষেত্রে সমীচীন মনে হয় না। হ্যা, তবে হয় তো দুঃখ ও বেদনার বশবর্তী হয়েই তিনি এ ধরনের উক্তি করে থাকবেন। এটা অসম্ভব নয়। তবে এ সব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
ইবনে ইসহাক (রঃ) এবং পূর্ব যুগীয় কোন কোন গুরুজন বলেছেন যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) যে সময় তার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং খুবই কাছাকাছি হয়েছিলেন সে সময় এই ধরনের অহী অবতীর্ণ হয়েছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, অহী বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে মুশরিকদের অবাঞ্ছিত উক্তির অসারতা প্রমাণের জন্যেই এ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। এখানে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা রোদ্র ওঠার সময়ের দিনের আলো, রাত্রির নীরবতা এবং অন্ধকারের শপথ করেছেন। এগুলো মহান স্রষ্টার কুদরতের এবং সৃষ্টির ঐশ্বর্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “শপথ রজনীর যখন ওটা আচ্ছন্ন করে এবং শপথ দিবসের যখন ওটা আবির্ভূত হয়।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়েও দেননি। এবং তোমার সাথে শত্রুতাও করেননি। তোমার জন্যে পরকাল ইহকাল অপেক্ষা বহুগুণে উত্তম। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ইবাদত করতেন এবং দুনিয়া বিমুখ জীবন যাপন করতেন। নবী করীম (সঃ)-এর জীবনী যারা পাঠ করেছেন তাদের কাছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।
মুসনাদে আহমদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি খেজুর পাতার চাটাইর উপর শুয়েছিলেন। ফলে তার দেহের পার্শ্বদেশে চাটাইর দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর আমি তার দেহে হাত বুলিয়ে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! চাটাইর উপর আমাকে কিছু বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দিন! তিনি আমার এ কথা শুনে বললেনঃ “পৃথিবীর সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি কোথায় এবং দুনিয়া কোথায়? আমার এবং দুনিয়ার দৃষ্টান্ত তো সেই পথচারী পথিকের মত যে একটি গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করে, তারপর গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে চলে যায়।” (এ হাদীসটি জামে তিরযিমীতেও বর্ণিত হয়েছে এবং উসূলে হাদীসের পরিভাষায় হাদীসটি হাসান)
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তোমার প্রতিপালক তোমাকে আখেরাতে তোমার উম্মতের জন্যে এতো নিয়ামত দিবেন যে, তুমি খুশী হয়ে যাবে। তোমাকে বিশেষ সম্মান দান করা হবে। বিশেষভাবে হাউযে কাওসার দান করা হবে। সেই হাউযে কাওসারের কিনারায় খাটি মুক্তার তাঁবু থাকবে। ওর মাটি হবে নির্ভেজাল মিশক। এ সম্পর্কিত হাদীস অচিরেই বর্ণনা করা হবে। ইনশাআল্লাহ।
একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, যে সব ধনাগার রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উম্মতের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে সেগুলো একে একে তার উপর প্রকাশ করা হয়। এতে তিনি খুবই খুশী হন। তারপর এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। জান্নাতে তাঁকে এক হাজার মহল দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক মহলে পবিত্র স্ত্রী এবং উৎকৃষ্ট মানের খাদেম রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইবনে আমর আওযায়ী (রঃ) ইবনে জারীর (রঃ) এবং ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পর্যন্ত এ হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ। আল্লাহর নবী (সঃ) হতে না শুনে এ ধরনের হাদীস বর্ণনা করা সম্ভব নয়)
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সঃ) সন্তুষ্টির এটাও একটা কারণ যে, তাঁকে জানানো হয়ঃ তাঁর আহলে বাইতের মধ্য থেকে কেউ জাহান্নামে যাবে না। হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা তাঁর শাফা’আত বুঝানো হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা এমন আহলে বায়েত যাদের জন্যে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার মুকাবিলায় আখেরাতকে পছন্দ করেছেন। তারপর তিনি (আরবি) পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইবনে আবী শায়বা (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি ইয়াতীম থাকা অবস্থায় আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করেছেন, হিফাযত করেছেন, প্রতিপালন করেছেন এবং আশ্রয় দিয়েছেন। নবী করিম (সঃ)-এর জন্ম লাভের পূর্বেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে, তাঁর জন্ম লাভের পর তার পিতা ইন্তেকাল করেন। ছয় বছর বয়সের সময় তাঁর স্নেহময়ী মাতা এই নশ্বর জগত হতে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। তারপর তিনি তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। তার বয়স যখন আট বছর তার দাদাও পরপারে চলে যান। অতঃপর তিনি তার চাচা আবু তালিবের নিকট প্রতিপালিত হতে থাকেন। আবু তালিব তাকে সর্বাত্মক দেখাশুনা এবং সাহায্য করেন। তিনি তাঁর স্নেহের ভ্রাতুস্পুত্রকে খুবই সম্মান করতেন, মর্যাদা দিতেন এবং স্বজাতির বিরোধিতার ঝড়ে মুকাবিলা করতেন। নিজেকে তিনি ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করতেন। চল্লিশ বছর বয়সের সময় নবী করীম (সঃ) নবুওয়াত লাভ করেন। কুরায়েশরা তখন তার ভীষণ বিরোধী এমনকি প্রাণের দুশমন হয়ে গেল। আবু তালিব মুশরিক মূর্তিপূজক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে সহায়তা দান করতেন এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের সাথে লড়াই করতেন। এই সুব্যবস্থা আল্লাহপাকের ইচ্ছা ও ইঙ্গিতেই হয়েছিল। নবী করীম (সঃ)-এর ইয়াতীমী অবস্থা এভাবেই কেটে যায়। আল্লাহ তা’আলা বিরুদ্ধবাদীদের নিকট হতে এভাবেই নবী করীমের (সঃ)-এর খিদমত নেন। হিজরতের কিছুদিনের পূর্বে আৰূ তালিবও ইন্তেকাল করেন। এবার কাফির মুশরিকরা কঠিনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। আল্লাহ তা’আলা তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দেন এবং মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়কে তার সাহায্যকারী বানিয়ে দেন। ঐ বুর্যগ আনসার ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে এবং তার সাহাবীদেরকে (রাঃ) আশ্রয় দিয়েছেন, জায়গা দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। আর শত্রুদের মুকাবিলায় বীরের মত সামনে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তাঁদের সবারই প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন! এ সবই আল্লাহর মেহেরবানী, অনুগ্রহ এবং রহম করমের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ) কে বলেনঃ তোমাকে আল্লাহ তাআলা পথহারা দেখতে পেয়ে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। যেমন অন্যত্র রয়েছে (আরবি)
অর্থাৎ “এ ভাবেই আমি নিজের আদেশে তোমার প্রতি রুহ অর্থাৎ জিবরাইল (আঃ) কে অথবা কুরআনকে অহী হিসেবে পাঠিয়েছি। ঈমান কি জিনিস তাও তোমার জানা ছিল না, কিতাব কাকে বলে তাও জানতে না তুমি। আমি এ কিতাবকে নুর বা জ্যোতি বানিয়ে এর দ্বারা আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেছি।” (৪২:৫২) কেউ কেউ বলেন, এখানে ভাবার্থ হলো এই যে, নবী করীম (সঃ) শৈশবে মক্কার গলিতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়া যাওয়ার পতে রাত্রিকালে শয়তান তাঁর উটের লাগাম ধরে চলার পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। তারপর জিবরাঈল (আঃ) এসে শয়তানকে যুঁদিয়ে আবিসিনিয়ায় রেখে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সওয়ারীকে সঠিক পথে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।” এই উভয় উক্তিই বাগাভী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা এরপর বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তিনি (আল্লাহ) তোমাকে পেলেন নিঃস্ব অবস্থায়, অতঃপর তিনি তোমাকে অভাবমুক্ত করলেন ফলে ধৈর্যধারণকারী দরিদ্র এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী ধনীর মর্যাদা তুমি লাভ করেছো। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন!
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এসব অবস্থা নবুওয়াতের পূর্বে হয়েছিল। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন “ধন সম্পদের প্রাচুর্য প্রকৃত ধনশীলতা নয়, বরং প্রকৃত ধনশীলতা হচ্ছে মনের ধনশীলতা বা মনের সন্তুষ্টি।”
সহীহ মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, আল্লাহ যা কিছু দিয়েছেন তা যথেষ্ট মনে করেছে এবং তাতেই সন্তুষ্ট হয়েছে সে সাফল্য লাভ করেছে।”
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ) কে সম্বোধন করে বলেনঃ সুতরাং তুমি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হয়ো না, তাকে ধমক দিয়ো না এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করো না, বরং তার সাথে সদ্ব্যবহার কর এবং নিজের ইয়াতীম হওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না।
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ইয়াতীমের সাথে ঠিক এমনই ব্যবহার করতে হবে যেমন ব্যবহার পিতা নিজের সন্তানের সাথে করে থাকেন। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ) কে আরো বলেনঃ প্রার্থীকে না করো না। তুমি যেমন পথহারা ছিলে, আল্লাহ তোমাকে হিদায়াত বা পথের দিশা দিয়েছেন, তেমনি কেউ তোমাকে জ্ঞানের কথা জিজ্ঞেস করলে তাকে রূঢ় ব্যবহার দ্বারা সরিয়ে দিয়ো না। গরীব, মিসকীন, এবং দুর্বল লোকদের প্রতি অহংকার প্রদর্শন করো না। তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করো না। তাদেরকে কড়া কথা বলো না। ইয়াতীম মিসকীনদেরকে যদি কিছু না দিতে পার তবে ভাল ও নরম কথা বলে তাদেরকে বিদায় করো এবং ভালভাবে তাদের প্রশ্নের জবাব দাও।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ নিজের প্রতিপালকের নিয়ামতসমূহ বর্ণনা করতে থাকো। অর্থাৎ যেমন আমি তোমার দারিদ্রকে ঐশ্বর্যে পরিবর্তিত করেছি, তেমনই তুমিও আমার এ সব নিয়ামতের কথা বর্ণনা করতে থাকো। যেমন নবী করীম (সঃ) এর দু’আও ছিলঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনি আপনার নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী করুন, ঐ নিয়ামতের কারণে আমাদেরকে আপনার প্রশংসাকারী করুন, ঐ নিয়ামত স্বীকারকারী করুন এবং পরিপূর্ণভাবে ঐ নিয়ামত আমাদেরকে দান করুন।”
আবু না (রঃ) বলেনঃ “মুসলমানরা মনে করতেন যে, নিয়ামতের বর্ণনা দেয়াও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শামিল। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলেনঃ “ যে ব্যক্তি অল্প পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। সে বেশী পেয়েও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো না সে আল্লাহ তা’আলার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো না। নিয়ামত স্বীকার ও বর্ণনা করাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শামিল, আর নিয়ামত অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। দলবদ্ধভাবে থাকা রহমত লাভের কারণ এবং দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শাস্তির কারণ।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সনদে দুর্বলতা রয়েছে)
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মুহাজিরগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আনসারগণ সমস্ত প্রতিদান নিয়ে গেছেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “না, যে পর্যন্ত তোমরা তাদের জন্যে দু’আ করতে থাকবে এবং তাদের প্রশংসা করতে থাকবে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “যারা মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না তারা আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জাবির (রাঃহতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন নিয়ামত লাভ করার পর তার বর্ণনা করেছে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী, আর যে তা গোপন করেছে সে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে।” (এ হাদীসটিও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “কাউকে কোন অনুগ্রহ করা হলে তার উচিত সম্ভব হলে ঐ অনুগ্রহের প্রতিদান দেয়া, আর যদি সম্ভব না হয় তবে উচিত অন্ততঃপক্ষে ঐ অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করা এবং তার প্রশংসা করা। যে ব্যক্তি এই প্রশংসা করেছে সে কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। আর যে ব্যক্তি প্রশংসাও করেনি এবং নিয়ামতের কথা প্রকাশও করেনি সে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে।” (এ হাদীসটিও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, এখানে নিয়ামত দ্বারা নবুওয়াতকে বুঝানো হয়েছে। এক বর্ণনায় রয়েছে যে, এখানে নিয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন।
হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলো কল্যাণকর যে সব কথা নিজে জান, সে সব তাদের কাছেও বর্ণনা কর। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ নবুওয়াতের যে নিয়ামত ও কারামত তুমি লাভ করেছে সেটা বর্ণনা কর। ঐ কথা আলোচনা কর। আর সেইদিকে জনগণকে দাওয়াত দাও।
কাজেই নবী করীম (সঃ) নিজের লোকদের কাছে অর্থাৎ যাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল তাদের কাছে প্রথমদিকে চুপি চুপি দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তাঁর উপর নামায ফরয হয়েছিল, তিনি সেই নামায আদায় করতেন।