Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৯ : হে মানুষ:-১৯)
[# اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَۚ
পড়ো তোমার রবের নামে।]
www.motaher21.net
সুরা: ৯৬ : সুরা: আল্ -আলাক্ব
পারা:৩০
১- ১৯ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আল-আলাক্ব
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৯৬
(৯৬-আলাক্ব) : নামকরণ:
সূরাটির দ্বিতীয় আয়াতে উল্লেখিত আলাক عَلَقٍ শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
(৯৬-আলাক্ব) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এই সূরাটির দু’টি অংশ। প্রথম অংশটি اقۡرَاۡ থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম আয়াতে مَا لَمۡ يَعۡلَمۡؕ গিয়ে শেষ হয়েছে। আর দ্বিতীয় অংশটি كَلَّاۤ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَيَطۡغٰٓىۙ থেকে শুরু হয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। প্রথম অংশটি যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অবতীর্ণ সর্বপ্রথম অহী এ ব্যাপারে উম্মাতে মুসলিমার আলেম সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একমত। এ প্রসংগে ইমাম আহমাদ, বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ অসংখ্য সনদের মাধ্যমে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তা সর্বাধিক সহীহ হাদীস হিসেবে গণ্য। এ হাদীসে হযরত আয়েশা নিজে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ওহী শুরু হবার সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও ইবনে আব্বাস (রা., , আবু মূসা আশ’আরী (রা.) ও সাহাবীগণের একটি দলও একথা বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম কুরআনের এই আয়াতগুলোই নাযিল হয়েছিল। আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হারাম শরীফে নামায পড়া শুরু করেন এবং আবু জেহেল তাঁকে হুমকি দিয়ে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে তখন দ্বিতীয় অংশটি নাযিল হয়।
(৯৬-আলাক্ব) : অহীর সূচনা :
মুহাদ্দিসগণ অহীর সূচনাপর্বের ঘটনা নিজের নিজের সনদের মাধ্যমে ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম যুহরী এ ঘটনা হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে এবং তিনি নিজের খালা হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহীর সূচনা হয় সত্য স্বপ্নের (কোন কোন বর্ণনা অনুসারে ভালো স্বপ্নের) মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, মনে হতো যেন দিনের আলোয় তিনি তা দেখছেন। এরপর তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়েন। এরপর কয়েকদিন হেরা গুহায় অবস্থান করে দিনরাত ইবাদাতের মধ্যে কাটিয়ে দিতে থাকেন। হযরত আয়েশা (রা., তাহান্নুস تحنث শব্দ ব্যবহার করেছেন। ইমাম যুহরী তা’আব্বুদ تَعَبُّدُ বা ইবাদাত- বন্দেগী শব্দের সাহায্যে এর ব্যাখ্যা করেছেন।এখানে তিনি কোন ধরনের ইবাদাত করতেন? কারণ তখনো পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবাদাতের পদ্ধতি তাঁকে শেখানো হয়নি । ঘর থেকে খাবার- দাবার নিয়ে তিনি কয়েকদিন সেখানে কাটাতেন। তারপর হযরত খাদীজা (রা.) এর কাছে ফিরে আসতেন। তিনি আবার কয়েক দিনের খাবার সামগ্রী তাঁকে যোগাড় করে দিতেন। একদিন তিনি হেরা গুহার মধ্যে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ওপর ওহী নাযিল হলো। ফেরেশতা এসে তাঁকে বললেন: “পড়ো” এর পর হযরত আয়েশা (রা.) নিজেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন: আমি বললাম, “আমি তো পড়তে জানি না।” একথায় ফেরেশতা আমাকে ধরে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চেপে ধরলেন। এমনকি আমি তা সহ্য করার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেল্লাম। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ো।” আমি বললাম “আমি তো, পড়তে জানি না।” তিনি দ্বিতীয় বার আমাকে বুকের সাথে ধরে ভয়ানক চাপ দিলেন। আমার সহ্য করার শক্তি প্রায় শেষ হতে লাগলো। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ো।” আমি আবার বলালাম, “আমি তো পড়া জানি না।” তিনি তৃতীয় বার আমাকে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চেপে ধরলেন আমার সহ্য করার শক্তি খতম হবার উপক্রম হলো। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, اقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّكَ الَّذِىۡ خَلَقَۚ (পড়ো নিজের রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন) এখানে থেকে مَا لَمۡ يَعۡلَمۡؕ (যা সে জানতো না) পর্যন্ত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে ফিরলেন। তিনি হযরত খাদীজা (রা.) এর কাছে ফিরে এসে বললেন, আমার গায়ে কিছু (চাঁদর-কম্বল) জড়িয়ে দাও! আমার গায়ে কিছু (চাঁদর-কম্বল) জড়িয়ে দাও! তখন তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেয়া হলো। তাঁর মধ্য থেকে ভীতির ভাব দূর গেলে তিনি বললেন: “হে খাদীজা! আমার কি হয়ে গেলো? তারপর তিনি তাঁকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমার নিজের জানের ভয় হচ্ছে।” হযরত খাদীজা বললেন: “মোটেই না। বরং খুশী হয়ে যান। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমাণিত করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। সত্য কথা বলেন। (একটি বর্ণনায় বাড়তি বলা হয়েছে, আপনি আমানত পরিশোধ করে দেন, ) অসহায় লোকদের বোঝা বহন করেন। নিজে অর্থ উপার্জন করে অভাবীদেরকে দেন। মেহমানদারী করেন। ভালো কাজে সাহায্য করেন।” তারপর তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাথে নিয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই। জাহেলী যুগে তিনি ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আরবী ও ইবরানী ভাষায় ইঞ্জিল লিখতেন। অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন। হযরত খাদীজা (রা.) তাঁকে বললেন, ভাইজান! আপনার ভাতিজার ঘটনাটা একটু শুনুন। ওয়ারাকা রসূলুল্লাহকে(সা., বললেন: “ভাবিজা!তুমি কি দেখেছো ?” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু দেখেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকা বললেন: “ইনি সেই নামূস (অহী বহনকারী ফেরেশতা) যাকে আল্লাহ মূসার(আ, ওপর নাযিল করেছিলেন। হায়, যদি আমি আপনার নবুয়াতের জামানায় শক্তিশালী যুবক হতাম! হায়, যদি আমি তখন জীবিত থাকি যখন আপনার কওম আপনাকে বের করে দেবে।” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “এরা আমাকে বের করে দেবে?” ওয়ারাকা বললেন: “হাঁ, কখনো এমনটি হয়নি, আপনি যা নিয়ে এসেছেন কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে এবং তার সাথে শত্রুতা করা হয়নি। যদি আমি আপনার সেই আমলে বেঁচে থাকি তাহলে আপনাকে সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবো।” কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই ওয়ারাকা ইন্তিকাল করেন।
এ ঘটনা নিজেই একথা প্রকাশ করছে যে, ফেরেশতার আসার এক মূহূর্ত আগেও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে নবী বানিয়ে পাঠানো হবে এ সম্পর্কে তিনি বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। তাঁর এই জিনিসের প্রত্যাশী বা আকাংক্ষী হওয়া তো দূরের কথা, তাঁর সাথে যে এই ধরনের ব্যাপার ঘটতে পারে, একথা তিনি আদৌ কখনো কল্পনা করতে পারেননি। অহী নাযিল হওয়া এবং ফেরেশতার এভাবে সামনে এসে যাওয়া তাঁর জন্য ছিল একটি আকস্মিক ঘটনা। এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া তাঁর ওপর ঠিক তাই হয়েছে যা একজন বেখবর ব্যক্তির সাথে এত বড় একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে। এ কারণেই যখন তিনি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে আসেন তখন মক্কার লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে সব রকমের আপত্তি উঠায় কিন্তু তাদের একজনও একথা বলেনি, আমরা তো আগেই আশংকা করেছিলাম আপনি কোন একটি কিছু হওয়ার দাবি করবেন, কারণ আপনি বেশ কিছু কাল থেকে নবী হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এ ঘটনা থেকে নবুয়াতের আগে তাঁর জীবন কেমন পবিত্র ছিল এবং তাঁর চরিত্র ও কর্মকাণ্ড কত উন্নত পর্যায়ের ছিল সে কথাও জানা যায়। হযরত খাদীজা (রা.) কোন অল্প বয়স্কা মহিলা ছিলেন না। বরং এই ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছির পঞ্চান্ন বছর। পনের বছর ধরে তিনি রসূলের জীবন সঙ্গিনী ছিলেন। স্ত্রীর কাছে স্বামীর কোন দুর্বলতা গোপন থাকতে পারে না। বরং এই ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর। পনের বছর ধরে তিনি রসূলের জীবন সঙ্গিনী ছিলেন। স্ত্রীর কাছে স্বামীর কোন দুর্বলতা গোপন থাকতে পারে না। এই দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে হযরত খাদীজা (রা.) তাঁকে এমনই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে পেয়েছিলেন যে, যখনই তিনি তাঁকে হেরা গুহার ঘটনা শুনান তখনই নির্দ্বিধায় তিনি স্বীকার করে নেন যে, যথার্থই আল্লাহর ফেরেশতা তাঁর কাছে অহী নিয়ে এসেছিলেন। অনুরূপভাবে ওয়ারাকা ইবনে নওফলও মক্কার একজন বয়োবৃদ্ধ বাসিন্দা ছিলেন। তিনি শৈশব থেকে মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহর (সা.) জীবন দেখে আসছিলেন, তাছাড়া পনের বছরের নিকট আত্মীয়তার কারণে তাঁর অবস্থা তিনি আরো গভীরভাবে অবগত ছিলেন। তিনিও এ ঘটনা শুনে একে কোন প্ররোচনা মনে করেননি। বরং শুনার সাথে সাথেই বলে দেন, ইনি সেই একই “নামূস” যিনি মূসা আলাইহিস সালামের কাছে এসেছিলেন। এর অর্থ এই দাঁড়ায় তাঁর মতেও মুহাম্মাদ (সা.) এমনই উন্নত ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, তাঁর নবুয়াতের মর্যাদা লাভ করা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল না।
দ্বিতীয় অংশ নাযিলের প্রেক্ষাপট রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কা’বা শরীফে ইসলামী পদ্ধতিতে নামায পড়তে শুরু করেন এবং আবু জেহেল তাঁর হুমকি দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে, ঠিক সে সময় এই সূরার দ্বিতীয় অংশটি নাযিল হয়। দেখা যায়, নবী হবার পর প্রাকশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেবার কাজ শুরু করার আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর শেখানো পদ্ধতিতে হারম শরীফে নামায পড়তে শুরু করেন এবং এ কাজটির কারণে কুরাইশরা প্রথমবার অনুভব করে যে, তিনি কোন নতুন দ্বীনের অনুসারী হয়েছেন। অন্য লোকেরা অবাক চোখে এ দৃশ্য দেখছিল। কিন্তু আবু জেহেল জাহেলী শিরা-উপশিরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সে এভাবে হারম শরীফে ইবাদাত করা যাবে না বলে তাঁকে ধমকাতে থাকে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে কয়েকটি হাদীসে আবু জেহেলের এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন দুষ্কৃতি উল্লেখিত হয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন: আবু জেহেল কুরাইশদেরকে জিজ্ঞেস করে, “মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদের সামনে যমীনের ওপর মুখ রাখছে?” লোকেরা জবাব দেয়, “হাঁ”। একথায় সে বলল, “লাত ও উয্যার কসম, যদি আমি তাকে এভাবে নামায পড়তে দেখি তাহলে তার ঘাড়ে পা রেখে দেবো এবং মাটিতে তার মুখ রগড়ে দেবো।” তারপর একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায পড়তে দেখে সে তাঁর ঘাড়ের ওপর পা রাখার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্ত হঠাৎ লোকেরা দেখে সে পিছনের দিকে সরে আসছে এবং কোন জিনিস থেকে নিজের মুখ বাঁচাবার চেষ্টা করছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার কি হয়েছে? সে বলে, আমার ও তার মাঝখানে আগুনের একটি পরিখা, একটি ভয়াবহ জিনিস ও কিছু ডানা ছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সে যদি আমার ধারে কাছে ঘেঁসতো তাহলে ফেরেশতারা তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতো। (আহমদ, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম, ইবনুল মুনযির, ইবনে মারদুইয়া, আবু নাঈম ইসফাহানী ও বায়হাকী)
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: আবু জেহেল বলে, যদি আমি মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কা’বার কাছে নামায পড়তে দেখি তাহলে পায়ের নীচে তার ঘাড় চেপে ধরবো। একথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কানে পৌঁছে যায়। তিনি বলেন, যদি সে এমনটি করে তাহলে ফেরেশতারা প্রকাশ্যে তাকে এসে ধরবে। (বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে জারীর, আবদুর রাজ্জাক, আবদ ইবনে হুমাইদ, ইবনুল মুনযির ও ইবনে মারদুইয়া)
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত আর একটি হাদীসে বলা হয়েছে: রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাকামে ইবরাহীমে নামায পড়ছিলেন, আবু জেহেল সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। সে বললো, হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এ থেকে নিষেধ করিনি ? একথা বলে সে তাঁকে ধমকাতে শুরু করলো। জবাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কঠোরভাবে ধমক দিলেন। তাঁর ধমকানি শুনে সে বললো, হে মুহাম্মাদ! কিসের জোরে তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? আল্লাহর কসম! এই উপত্যকায় আমার সমর্থকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। (আহমাদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে জারীর, ইবনে আবী শাইবা, ইবনুল মুনযির, তাবারানী ও ইবনে মারদুইয়া)
এ ঘটনাবলীর কারণে كَلَّااِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَيَطۡغٰىۙ থেকে সূরা যে অংশটি শুরু হচ্ছে সেটি নাযিল হয়। কুরআনের এই সূরাটিতে এই অংশটিকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে স্বাভাবিকভাবে এর মর্যাদা তাই হওয়া উচিত। কারণ প্রথম অহী নাযিল হবার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের প্রথম প্রকাশ করেন নামাযের মাধ্যমে এবং এই ঘটনার ভিত্তিতেই কাফেরদের সাথে তাঁর প্রথম সংঘাত হয়।
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : সর্বসম্মত অভিমত এ সূরার প্রথম অংশটি কোরআনের সর্বপ্রথম নাযিল হয়েছে। আর যেসব বর্ণনায় সূরাটির অবশিষ্ট অংশটি ও শুরুর দিকে নাযিল হয়েছে বলে বলা হয়েছে, সেগুলো খুব নির্ভরযোগ্য নয়। ইমাম আহমদ বলেন, পর্যায়ক্রমে আবদুর রাযযাক, মোয়াম্মার ইবনে যুহরী, ওরওয়াহ, অবশেষে হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স.)-এর প্রতি ওহী নাযিল হতে শুরু হওয়ার পূর্বে প্রথম অবস্থা এভাবে এসেছে যে, ঘুমের মধ্যে তাকে সত্য স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। ভোর বেলার শুভ্র ও স্বচ্ছ আলোর মতোই তার দেখা স্বপ্নগুলো ছিলো সত্য সঠিক। তারপর তার কাছে একাকীত্ব প্রিয় হয়ে ওঠে এবং তিনি হেরা গুহার নির্জনতায় একাকী ধ্যানমগ্ন থাকতে শুরু করেন । এটাকে সাধারণভাবে তপস্যা নামে অভিহিত করা হয়৷ স্ত্রী-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েক রাত এ ভাবে তার কাটতে থাকে। এ জন্য কয়েক দিনের মতো কিছু খাদ্য-খাবার তিনি সংগে নিয়ে যেতেন । ফুরিয়ে গেলে আবার খাদিজা (রা.)-এর কাছ থেকে কয়েক দিনের খাবার নিয়ে যেতেন । শেষ পর্যন্ত, এই হেরা গুহায়ই একদিন সত্য সমাগত হলো । সর্বপ্রথম ওহী নাযিলের ঘটনা : একদিন ফেরেশতা এসে বললেন, ‘পড়ো’। তিনি বললেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না ।’ রসূল (স.) বলেন, সেই ফেরেশতা আমাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের সাথে এমন করে চাপ দিলেন যে, আমার দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো । তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার তিনি বললেন, পড়ো। আবার আমি বললাম, ‘আমি পড়তে জানি না।’ এরপর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আবারও আমাকে এমনভাবে সজোরে বুকে চেপে ধরলেন যাতে আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তিনি আমাকে ছেড়ে পুনরায় বললেন, ‘পড়ো’। আমি আবারও বললাম, ‘আমি পড়তে জানি না ।’ তারপর তিনি তৃতীয়বারের মতো আমাকে ধরে চাপ দিলেন, যাতে আমার দম যেন বেরিয়ে যেতে লাগলো। তারপর বললেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন রক্তপিন্ড থেকে, পড়ো! এবং তোমার রব অতি সম্মানিত ৷ যিনি শিখিয়েছেন কলমের সাহায্যে, শিখিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না ।’ তারপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ভয়ে কাপতে কাপতে খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এলেন। খাদিজা (রা.)-এর কাছে এসে তিনি বললেন, ‘কে আছো, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢাকো, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢাকো ।’ তারপর তিনি তাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন এবং এর কিছুক্ষণের মধ্যে তার ভয়টা দূর হয়ে গেলো। তারপর তিনি বললেন, ‘খাদিজা! কী হলো আমার!’ একথা বলে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা তিনি জানালেন । সব শুনে খাদিজা (রা.) বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, এ ঘটনা থেকে আপনি সুসংবাদ নিন। আপনি আত্মীয় স্বজনের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন। সত্য কথা বলেন, অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য করেন৷ মেহমানদারী করেন এবং সত্য পথে থাকতে গিয়ে কেউ বিপদে পড়লে তাকে আপনি সাহায্য করেন ।’ এসব সান্তনা বানী শোনানোর পর খাদিজা (রা.) তাকে নিয়ে তার আপন চাচাত ভাই ওরাকা ইবনে নওফেল-এর কাছে চলে গেলেন। ওই ব্যক্তি জাহেলিয়াতের অবস্থায় সত্য ধর্ম পাওয়ার ইচ্ছায় নাসারা (খৃষ্টান) হয়ে গিয়েছিলো ৷ তিনি আল্লাহর মর্জিতে হিব্রু ভাষায় রচিত ইনজীল কেতাবের আরবী অনুবাদ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং অন্ধ । তাকে খাদিজা (রা.) বললেন, “হে আমার চাচাত ভাই, আপনার ভাতিজার কথা একটু খেয়াল করে শুনুন । তিনি বললেন, ‘ভাতিজা, কী হয়েছে তোমার?’ রসূলুল্লাহ (স.) যা কিছু দেখেছিলেন সব তাকে খুলে বললেন। তখন ওরাকা বললেন, হা, তিনি সেই বিশ্বস্ত ফেরেশতা যিনি মূসার নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন জিবরাঈল (আ.)। আহ্, আফসোস আমার দুর্বল শরীরের । যদি আমার শরীরে শক্তি থাকতো, যদি আমি বেচে থাকতাম সেই সময়, যখন তোমার জাতি তোমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে! একথা শুনে রসূলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘আমাকে কি আমার দেশবাসী বের করে দেবে?’ ওরাকা বললেন, ‘হাঁ, যে কাজ নিয়ে তুমি এসেছো, অতীতে এ কাজ নিয়ে যারাই এসেছে, তাদের প্রত্যেকের সাথে শত্রুতা করা হয়েছে। আহ্ সে দিনটিতে যদি আমি বেঁচে থাকতাম, তাহলে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাকে সাহায্য করতাম । এরপর অল্প কিছু দিনের মধ্যে ওরাকা মারা গেলেন। যুহরী বর্ণিত এ হাদীসটি বোখারী ও মুসলিম রেওয়ায়াত করেছেন। তাবারীও সঠিক বর্ণনাক্রমে আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা.) বর্ণিত এ হাদীসটি পেশ করেছেন, ‘রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তিনি তখন এলেন। তিনি রেশমী কাপড়ের একটি টুকরা নিয়ে এলেন। এ কাপড়ে কিছু লেখা ছিলো। অথবা সে কাপড়ে মোড়া ছিলো একটি কেতাব। তখন তিনি বললেন, ‘পড়ো’। বললাম, ‘আমি পড়তে জানি না।’ তিনি আমাকে সজোরে বুকে চেপে ধরলেন, এতো জোরে ধরলেন মনে হলো যেন আমি মরে যাবো। তারপর ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বললেন, ‘পড়ো’ ৷ বললাম, কী পড়ব আমি? একথাটি বললাম এ জন্য যাতে করে তিনি আমার সাথে পুনরায় পূর্বের মতো ব্যবহার না করেন । তখন তিনি বললেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন…….মানুষকে শিখিয়েছেন সেই জিনিস যা সে জানতো না ।’ এ পর্যন্ত পড়ে থামলেন । আল্লাহর রসূল বলেন, তখন আমি পড়লাম । তিনিও তখন ক্ষান্ত হলেন এবং আমার থেকে দূরে সরে গেলেন । আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম । তখন আমার মনে হচ্ছে, কেউ যেন আমার অন্তরের পাতায় কিছু কথা লিখে দিয়ে গেছে। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে আমার কাছে কবি বা পাগল থেকে অপ্রিয় আর কেউ নয়। তিনি বললেন, ‘আমি মনে মনে বললাম, আমি কি কবি বা পাগল হয়ে গেলাম! কোরায়শরা আমাকে কি চিরদিন এই কথাই বলবে? আমার দৃঢ় ইচ্ছা জাগলো আমি পাহাড়ের চুড়ায় গিয়ে উঠি এবং সেখান থেকে ঝাপ দিয়ে নীচে পড়ে আত্মহত্যা করি! এভাবে আমার সকল জ্বালার সমাপ্তি ঘটুক । এই সব কথা ভেবে আমি গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম এবং পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হলাম । পাহাড়ে আরোহণের মাঝপথে পৌছে আকাশ থেকে একটি আওয়ায শুনতে পেলাম । কেউ বলছিলো, ‘হে মোহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রসূল এবং আমি জিবরাঈল ।’ তিনি বললেন ‘আমি মাথা তুলে আকাশপানে তাকিয়ে দেখি সেখানে জিবরাঈল একজন মানুষের রূপ ধরে দাড়িয়ে আছে। তার পা দু’টি দিগন্ত বলয়ে পরিব্যাপ্ত। তিনি বলছেন, ‘হে মোহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রসূল, আর আমি হচ্ছি জিবরাঈল ।’ তিনি বললেন, তখন আমি তার দিকে তাকিয়েই রইলাম ৷ এ অবস্থা আমাকে আমার পূর্ব ইচ্ছা থেকে বিরত রাখলো । আমি সামনে বা পেছনে নড়তে পারছিলাম না। আকাশের দিগন্ত বলয়ের চতুর্দিকে আমি বারবার নযর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলাম ৷ কিন্তু যে দিকেই তাকাচ্ছিলাম সে দিকেই এ একই মূর্তি নযরে পড়ছিলো। এভাবে আমি ওই স্থানে দাঁড়িয়েই রয়ে গেলাম। না সামনে, না পেছনে আমি সরতে পারছিলাম ৷ এমনকি ওই সময়ে খাদিজা আমার খোঁজে লোক পাঠিয়েও আমার সন্ধান পেলো না। সে লোকেরা মক্কায় ফিরে গিয়ে আমাকে না পাওয়ার কথা জানালো, আর তখনো আমি সেই জায়গাতেই ঠায় দাড়িয়ে ৷ দীর্ঘ সময় পরে তিনি অদৃশ্য হলেন আর আমিও ফিরে এলাম আমার পরিবারের কাছে। ইবনে ইসহাক, পর্যায়ক্রমে ওহাব ইবনে কায়সার এবং ওবায়েদ-এর বরাত দিয়ে এই হাদীসটি রেওয়ায়াত করেছেন। আমি নিজেও আজ সে ঘটনার ইতিবৃত্ত সামনে নিয়ে দাড়িয়ে আছি, যা ইতিহাস ও তাফসীরের কেতাবে বারবার অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু মনে হচ্ছিলো ভাসা ভাসা ভাবেই তা পড়েছি। তারপর অন্য কাজে মনোনিবেশ করেছি অথবা খুব কমই গভীরভাবে খেয়াল দিয়েছি ওই ঘটনার প্রতি । পড়েছি এবং এক সময় তা ভুলে গিয়েছি। সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা : আসলে ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । বাস্তবতার নিরিখে এতো গুরুত্বপূর্ণ যে গুরুত্বের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ওই গুরুত্ব বুঝার জন্যে আজ পর্যন্ত যতো প্রকার প্রচেষ্টাই করা হয়েছে তা সবই তার প্রয়োজনের তুলনায় কম। ওই ঘটনার মধ্যে এমনও অনেক দিক আছে, যেগুলো সর্বদাই আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে, বরং অতিরঞ্জিত না করে বললেও বলতে হয় প্রকৃতপক্ষে মানব ইতিহাসে এ মুহূর্তের ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সব থেকে বেশী, যার সাথে অন্য কোনো জিনিসের তুলনাই হতে পারে না। আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা প্রয়োজন, কোন সে জিনিস যা এই দৃশ্যকে এতো গুরুত্বপূর্ণ করে দিলো । এই ঘটনাকে সামনে রেখে যে সকল বাস্তব সত্যকে আমরা উপলব্ধি করি, সেগুলোর মধ্যে প্রথম হচ্ছে, এ ঘটনা থেকে মহান আল্লাহ তায়ালা যে তার সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতাসহ বর্তমান আছেন তার সত্যতা প্রমাণিত হয়৷ তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন । তিনি সর্ববিজয়ী, তার শক্তি দিয়ে তিনি তার ইচ্ছাকে সর্বদা কার্যকর করতে পারেন এবং তার শ্রেষ্ঠতম প্রদর্শনে তিনি সম্পূর্ণ সক্ষম এ ঘটনাটি তারও সাক্ষ্য বহন করে। তিনি বিশ্ব-জোড়া রাজ্যের একমাত্র বাদশাহ । যার একচ্ছত্র আধিপত্য সর্বত্র চলে । অতএব সম্ভ্রম, বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র তাঁরই, তিনি মানুষ নামক এই জীবটির প্রতি এক সময় তার কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং বড় মেহেরবানী করে তার সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে বাছাই করে তার মাথায় খেলাফতের সম্মানজনক তাজ পরিয়ে দিলেন । অথচ তাকে বা তার নামকে সৃষ্টিকূলের অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বড় দয়া করে তিনি এই তুচ্ছ সৃষ্টিকে সম্মানিত করলেন। তিনিই সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তার হেদায়াতের নূর তিনি দিলেন, বানালেন তাকে ওহী ধারণ করার পাত্র এবং আল্লাহ তায়ালা তার এই তুচ্ছ সৃষ্টিটাকে কাংখিত সম্মান পাওয়ার যোগ্য বানালেন ৷ এ হচ্ছে এক মহা সত্য ৷ এটা এতো বড়ো সত্য যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই । এ সত্যের বিভিন্ন দিক মানুষের কাছে তখনই প্রকাশ পায়, যখন সে এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে, আর চিন্তা ভাবনা করলে সে অনুভব করে যে, চিরস্থায়ী সেই স্বাধীন সার্বভৌম সত্ত্বার পক্ষ থেকেই মানুষকে এই ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। মানুষকে এই নেয়ামত দান করায় একথাও সুস্পষ্ট বুঝা গেলো যে এই সীমিত, অস্থায়ী ও ধ্বংসশীল বান্দাকে তিনি কতো গভীরভাবে ভালোবাসেন । যারা আল্লাহ তায়ালার আপন হয়ে যায়, জীবন যাদের আল্লাহ কেন্দ্রিক হয়ে যায়, সেই মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানী অনেক ব্যাপক। এমতাবস্থায় মানুষ তার তীব্র ও প্রিয় অনুভুতির স্বাদও পেতে শুরু । বিনম্র চিত্তে, কৃতজ্ঞতা ভরে, পরম খুশীর সাথে ও নিবেদিতপ্রাণে মানুষ আল্লাহ তায়ালার এই মহাদান অনুভব করে। সে আল্লাহ তায়ালার কথাগুলোর গুরুত্ব গভীরভাবে অনুভব করে এবং বাস্তব আনুগত্যের মাধ্যমে সৃষ্টিকুলের সবাই এ কথাগুলোর জবাব দেয়। সৃষ্টিকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষই পেয়েছে সেই পবিত্র ওহী, অন্য আর কেউ নয়, যদিও অনেকের থেকে সে দুর্বল। আলোচ্য ঘটনাটি কোন বিশেষ জিনিসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে? ঘটনাটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দিকে মানুষের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। তাদের জানাচ্ছে যে, তিনি অতি বড় দয়াময়, তিনি পূর্ণ রহমতের মালিক । বড়ই মর্যাদাবান তিনি, অতি বড় প্রেমময় তিনি। তিনিই তার নেয়ামত প্রদর্শন করতে পারেন। তিনি তার বাস্তব দান ও মেহেরবানী মানুষকে বিনা কারণে এবং বিনা যুক্তিতেও দিতে পারেন । সীমা সংখ্যাহীন ও এ বিশেষ দান করার ক্ষমতা তার গুণাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট । আবার মানুষের প্রতি ওই ঘটনার হেদায়াত হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা যে হেদায়াতের মাধ্যমে তাকে এত বেশী সম্মান দিয়েছেন যার কল্পনাও করা যায় না এবং যার শোকরিয়া আদায় করাও তার ক্ষমতার বাইরে । এমনকি সারা যিন্দেগী ভর রুকু-সেজদায় কাটালেও তার শোকর আদায় করা সম্ভব হবে না। আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বদাই তার বান্দার কথা স্মরণে রাখেন এবং সর্বদাই তার দিকে মনোযোগী থাকেন। প্রতিনিয়ত তাকে আল্লাহকে পাওয়ার পথ বাতলে দিচ্ছেন মানুষের মধ্য থেকেই তিনি রসূল পাঠিয়েছেন। তার জন্যে বাসস্থান, নির্ধারণ করেছেন যেখানে সৃষ্টির সবাই ভয় ও নিষ্ঠা নিয়ে তার কথামতো চলে । সমগ্র মানুষের জীবনে এই ভয়ানক বিবর্তন ঘটার যে চিহ্ন বিদ্যমান তা মানব সৃষ্টির গোড়া থেকেই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। এটা মূলত শুরু হয়েছে মানব ইতিহাসের সূচনাতে ৷ যখন মানুষের বিবেকের শক্তি জাগ্রত হয়েছে, তখন থেকে মানুষ তার লাগাম ছাড়া চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে । তখন থেকেই সে তার চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়েছে, তার নিজের মূল্য ও ক্বদর বুঝতে পেরেছে। আসলে পৃথিবীতে মান-মর্যাদা, আকর্ষণ বা কূপ্রবৃত্তির চাহিদা দমনই এক্ষেত্রে মূল কথা নয়, বরং বিশ্বাস করা যে এটা হচ্ছে সর্বময় ক্ষমতার মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তায়ালার ইশারা ইংগীতে সংঘটিত কাজ। সৃষ্টির সূচনা থেকেই আল্লাহ তায়ালার চোখের সামনে (তদারকিতে) মানুষের অন্তর-প্রাণে উন্নতির এই অপ্রতিরোধ্য ভাবধারা জারি রয়েছে এবং এই অনুভুতি নিয়েই তারা নড়াচড়া ও কাজকর্ম করে চলেছে। তার৷ আশা করছে যে, আল্লাহ্ তায়ালার পরিচালনায় তাদের কর্মকুশলতার হাত আরো দীর্ঘায়িত হতে থাকবে এবং তাদের অগ্রগতির পদক্ষেপগুলো এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাবে। তাদের এই অগ্রগতির কারণে তাদের ভুল-ভ্রান্তিরও অবসান হতে থাকবে এবং সঠিক কাজের দিকে তারা ধীরে ধীরে এগুতে থাকবে৷ তাদের অগ্রযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে তারা সব সময়ই আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে ওহী (সরাসরি নির্দেশ) লাভের আশা করেছে । এ ওহী হচ্ছে আসলে তাদের অন্তরেরই প্রতিধ্বনি, অর্থাৎ অন্তরের মধ্যে যে দাবী সৃষ্টি হয়েছে এই পথনির্দেশনা দানের মাধ্যমে তাদের সেই সব দাবী পূরণ করা হয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা ডাক দিয়ে বলছেন এটা গ্রহণ করো এবং এটা পরিত্যাগ করো । প্রকৃতপক্ষে নবী (স.)-এর তেইশটি বছরের জীবনের সময়কাল বিশ্বমানবের ইতিহাসে এক অভিনব অধ্যায় । এ সময়ের মধ্যে মানুষ ও ফেরেশতাদের প্রকাশ্য ও সরাসরি যোগাযোগ অব্যাহত থাকে । এ সময়ের মূল্য ও সঠিক তাৎপর্য তারাই বুঝতে পেরেছিলেন, যারা তার সময়ে বর্তমান ছিলেন এবং ওহীর মাধ্যমে এ যোগাযোগকে নিজেরা অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন। এরা ওহী শুরু হওয়ার অবস্থাটি যেমন দেখেছিলেন, তেমনি দেখেছিলেন এর সমাপ্তি পর্যায়ের অবস্থা । তারা কথা ও কাজের এই সম্মিলনের মিষ্টতার স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্পষ্টভাবেই তারা অনুভব করতেন যে, আল্লাহ রব্বুল ইযযত কিভাবে তার অদৃশ্য হাত দ্বারা তাদের চলার পথ রচনা করেছেন। তারা তাদের এ পথ-পরিক্রমার করুণ সূচনালগ্ন যেমন দেখেছিলেন, তেমনি দেখেছিলেন ইসলামের বিজয় লাভের গৌরবজনক অবস্থা । এ সময়কাল ছিলো এমন একটি আশ্চর্যজনক অধ্যায় যার পরিমাপ পৃথিবীর কোনো মাপকাঠি দিয়েই করা সম্ভব নয়। কিন্তু সুবিশাল এই বিশ্বে সময়ের ব্যবধানে যে সব ঘটনা ঘটে তার একটা থেকে আর একটা যেমন দূর বলে আমরা অন্তরের মধ্যে অনুভব করি তার -থেকেও অনেক অনেক বেশী অনুভব করি এর গ্রহ-নক্ষত্রাদির মধ্যকার দূরত্বের ব্যবধান । এগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব পৃথিবীর কোনো জিনিসের পারস্পরিক দূরত্ব দিয়ে মাপা যাবে না। এমনকি কোনো একটি আকাশের দূরত্ব আন্দাজ করেও সেগুলোর দূরত্ব কল্পনা করা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে মানুষের মনগড়া মতবাদ ও ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জীবন বিধানের মধ্যে রয়েছে এক আকাশচুম্বী পার্থক্য ৷ জাহেলিয়াতের কার্যকলাপ ও ইসলামী ব্যবস্থার মধ্যেও অনুরূপ ব্যবধান রয়েছে। এর থেকেও বেশী দূরত্ব বিরাজ করছে সাধারণ মানবতাবোধসম্পন্ন ব্যক্তি ও আল্লাহওয়ালা লোকের মধ্যে পার্থক্য ৷ বরং একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, ওদের মধ্যকার পার্থক্য সৌরজগতের মধ্যে অবস্থিত আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার পার্থক্য থেকেও বেশী । সেই সোনার মানুষরা তাদের জীবদ্দশাতেই ঈমানের স্বাদ বুঝতে পেরেছেন, পেয়েছেন এর মিষ্টতা, বুঝেছেন এর মূল্য ৷ অন্তরের গভীরে প্রিয় নবী (স.)-কে হারানোর ব্যথাও তারা তীব্রভাবে অনুভব করেছেন, বিশেষ করে যখন নশ্বর এ পৃথিবী থেকে পরম প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্যে তিনি চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তেকালের পর আবু বকর (রা.), ওমর (রা.)-কে বললেন, চলো, আমরা উম্মে আয়মন (রা.)-এর সাথে একটু দেখা করে আসি, যেমন করে রসূলুল্লাহ (স.) মাঝে মাঝে তার সাক্ষাৎ করতেন । এরা দু’জন এ মহীয়সী মহিলার কাছে এলে তিনি কাঁদতে লাগলেন এরা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আপনাকে কাদাচ্ছে? আপনি কি জানেন না, রসূলুল্লাহ (স.) আল্লাহ্র কাছে অতান্ত ভালো অবস্থাতে আছেন? তিনি বললেন, অবশ্যই আমি তা জানি, তিনি আল্লাহর কাছে যে খুবই ভালো অবস্থায় আছেন সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি শুধু কাদছি এ জন্য যে, আকাশ থেকে ওহী আসার পথ বন্ধ হয়ে গেলো। একথা শুনে তারা দু’জনও ডুকরে কেঁদে উঠলেন এবং তিনজন বহুক্ষণ ধরে কাদতে থাকলেন। নবী (স.)-কে হারানোর ব্যথার প্রতিক্রিয়া সেদিন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত একইভাবে চলে আসছে, আর যতোদিন পৃথিবী বেঁচে থাকবে এবং এর অধিবাসীরা পৃথিবীর ওপরে বিচরণ করতে থাকবে ততোদিন এই শোকের প্রবাহ একইভাবে চলতে থাকবে । প্রিয়নবী (স.)-এর আগমনের পর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগত ওহীর শিক্ষা লাভ করেই মানুষ এক নতুন জীবন লাভ করেছিলো এবং জীবনের এমন এক নতুন মূল্য তারা খুঁজে পেয়েছিলো যা পৃথিবীর কোনো জিনিস বা কোনো মানুষের পক্ষ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই জীবনের এই মূল্যবোধ পাওয়া সম্ভব । ব্যক্তিগত কারো ইচ্ছা অথবা জ্ঞান-বুদ্ধির মাধ্যমে এ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবন পাওয়া সম্ভব নয়। (‘আবাসা ওয়া তাওয়াললা’ সূরাটির তাফসীর দ্রষ্টব্য) ওহীর নযুল শুরু হওয়ার পর ইতিহাসের গতিপথের এমন বিপ্লবাত্মক কিছু পরিবর্তন সূচিত হলো, যা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি এবং এর পরেও আর কখনও হবে না। যেদিন প্রথম জিবরাঈল (আ.)-এর আগমন ঘটলো, সেদিনকার সেই ঘটনা ছিলো হক ও বাতিল-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী এক অভিনব ও অভূতপূর্ব ঘটনা । পৃথিবীর বুকে এ ঘটনা এমন এক স্মরণীয় ঘটনা, এমন উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন ঘটনা, যা আতা’ও স্পষ্টভাবে সর্বত্র বিরাজ করছে। মহাকালের আবর্তন কোনোদিন তাকে মুছে দিতে পারে নি এবং এমন কোনো দিন আসবে না যখন মানুষ ওই ঘটনা একেবারে ভুলে যাবে । বস্তুতপক্ষে, সে ঘটনার কারণে মানুষের বিবেকের মধ্যে সৃষ্টিজগত ও জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে এমন ধ্যান ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে ইতিপূর্বে কখনও আর হয়নি এবং ভবিষ্যতেও সারা বিশ্বের কোথাও এতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর ঘটবে না। এ ঘটনার মধ্যে দিয়েই সর্বশক্তিমান আল্লাহর দেয়া কর্মসূচী পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং বিশ্বমানবের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিষয়ের যুক্তিভিত্তিক সমাধানও তাতে পেশ করা হয়েছিলো যাতে করে যুক্তির নিরীখেও ইসলাম তার ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পারে৷ ইসলামী জীবন বিধানের মধ্যে কোনো গোজামিল বা অস্পষ্টতা নেই, কোনো দ্ব্যর্থবোধক বা অন্ধবিশ্বাসের স্থানও এখানে নেই। সত্য সমাগত হওয়ার পর গোমরাহির পথ যারা এখতিয়ার করে তা- না জানা বা না বুঝার কারণে নয়, বরং সম্পূর্ণ জেনে-বুঝে ইচ্ছা করেই তারা সত্য থেকে দূরে থাকছে। ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাসের যে তুলনাহীন অধ্যায় শুরু হলো তা পূর্বেকার অধ্যায় থেকে ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । এ অধ্যায়ের সূচনার কারণেই পূর্ববর্তী অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো ৷ নবতর এই যুগান্তকারী ঘটনার আগমন মানবেতিহাসে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা নির্দিষ্ট কোনো জাতি বা এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সারা পৃথিবীতে তার দোলা লেগেছে। এ দোলা লাগার ফলে পূর্ববর্তী মানুষ থেকে এ অধ্যায়ের মানুষগুলো সম্পূর্ণ নতুন এক রূপ ও চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হলো। পূর্ববর্তী মানুষগুলো কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করতো না এবং বিবেকের ডাকে সাড়া দেয়ারও কোনো প্রয়োজন অনুভব করতো না । কিন্তু বর্তমান অধ্যায়ের মানুষ আখেরাতের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে বিবেকসম্মত কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো এবং যে মহান উপদেশমালা তারা পেলো তার অনুসরণে পুরোপুরী আত্মনিয়োগ করলো । নবী (স.)-এর সাহচর্য লাভে ধন্য হওয়ার সে শিক্ষা কোনোক্রমেই তারা ভুলে যায়নি। সর্বোতভাবে এই নতুন শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করে গোটা মানবমন্ডলী নতুনভাবে জন্মলাভ করলো। এই ধরনের আমুল পরিবর্তন এবং রসূলুল্লাহ (স.)-এর এমন আন্তরিক অনুসরণ ইতিহাসে এই একটি বারই মাত্র ঘটলো । এ পর্যন্ত এসে আলোচ্য সূরাটির প্রথম অধ্যায়ের আলোচনা সমাপ্ত হলো । সূরাটির বাকি অংশের আলোচনা এখন শুরু হচ্ছে। আমরা সবাই জানি যে, দ্বিতীয় অধ্যায়টি নাযিল হয়েছে পরবর্তীকালে ৷ এ অধ্যায়ে আলোচনা এসেছে নবুওত প্রাপ্তির পরে যে সব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে। ওই সময়ে তার নবী হওয়ার ঘোষণা এসে গেছে। প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ ও আনুষ্ঠানিক এবাদাত চলছিলো এবং এগুলোর প্রতিক্রিয়ায় মোশরেকদের বিরোধিতাও চলছিলো । তাই এগুলোর দিকে আল্লাহ্ তায়ালা দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইংগিত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তুমি কি দেখেছো সেই ব্যক্তিকে যে বাধা দিয়েছে সে বান্দাকে যে নামায পড়ছিলো……. ।’ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নাযিল হলেও সূরাটির মধ্যে আলোচিত পূর্ব ও পরের অংশগুলোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। বর্ণনা-পরস্পরা ও উভয় অংশে বর্ণিত বিষয়গুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ মিল থাকায় মনে হয় উভয় অংশ অবিচ্ছেদ্যভাবে পরস্পরের সাথে জড়িত ।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1, 2, 3,
اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَۚ
পড়ো১ (হে নবী) , তোমার রবের নামে।২ যিনি সৃষ্টি করেছেন।৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলে এসেছি, ফেরেশতা রসূলুল্লাহ ﷺ কে বললেন, পড়ো। তিনি জবাবে দিলেন, আমি পড়া জানি না। এ থেকে জানা যায়, ফেরেশতা অহীর এই শব্দগুলো লিখিত আকারে তাঁর সামনে পেশ করেছিলেন এবং তাঁকে সেগুলো পড়তে বলেছিলেন। কারণ ফেরেশতার কথার অর্থ যদি এই হতো, আমি বলতে থাকি এবং আপনি পড়তে থাকুন তাহলে আমি পড়া জানি না একথা বলা তাঁর প্রয়োজন হতো না।
টিকা:২) অর্থাৎ তোমার রবের নাম নিয়ে পড়ো। অন্য কথায়, বিসমিল্লাহ বলো এবং পড়ো। এ থেকে একথাও জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ এই অহী আসার আগে একমাত্র আল্লাহকেই জানতেন ও মানতেন। এ জন্যই তাঁর রবকে, একথা বলার প্রয়োজন হয়নি বরং বলতে হয়েছে, তোমার রবের নাম নিয়ে পড়ো।
টিকা:৩) শুধু বলা হয়েছে, “সৃষ্টি করেছেন।” কাকে সৃষ্টি করেছেন তা বলা হয়নি। এ থেকে আপনা আপনিই এ অর্থ বের হয়ে আসে, সেই রবের নাম নিয়ে পড়ো যিনি স্রষ্টা, যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহান এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-2
টিকা নং:4,
خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍۚ
জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) সাধারণ ভাবে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টি কথা বলার পর বিশেষ করে মানুষের কথা বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ কেমন হীন অবস্থা থেকে তার সৃষ্টিপর্ব শুরু করে তাকে পূর্ণাংগ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন। আলাক عَلَقٍۚ হচ্ছে আলাকাহ (عَلَقَه ) শব্দের বহুবচন। এর মানে জমাট বাঁধা রক্ত। গর্ভ সঞ্চারের পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় এটি হচ্ছে সেই প্রাথমিক অবস্থা। তারপর তা গোশতের আকৃতি ধারণ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে মানুষের আকৃতি লাভের কার্যক্রম শুরু হয়। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হজ্জ ৫ আয়াত, ৫ থেকে ৭ টীকা)
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-3
اِقْرَاْ وَ رَبُّكَ الْاَكْرَمُۙ
পড়ো এবং তোমার রব বড় মেহেরবান,
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-4
টিকা নং:5,
الَّذِیْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِۙ
যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) অর্থাৎ তাঁর অশেষ মেহেরবানী। এই হীণতম অবস্থা থেকে শুরু করে তিনি মানুষকে জ্ঞানের অধিকারী করেছেন এটি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় গুণ হিসেবে স্বীকৃত। আর তিনি মানুষকে কেবল জ্ঞানের অধিকারীই করেননি, কলম ব্যবহার করে তাকে লেখার কৌশল শিখিয়েছেন। এর ফলে কলম জ্ঞানের ব্যাপক প্রসার, উন্নতি এবং বংশানুক্রমিক প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যদি তিনি ইলহামী চেতনায় সাহায্যে মানুষকে কলম ব্যবহার করার ও লেখার কৌশল না শেখাতেন তাহলে মানুষের জ্ঞানগত যোগ্যতা স্তব্ধ ও পংগু হয়ে যেতো। তার বিকশিত ও সম্প্রসারিত হবার এবং বংশানুক্রমিক অগ্রগতি তথা এক বংশের জ্ঞান আর এক বংশে পৌঁছে যাবার এবং সামনের দিকে আরো উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করার সুযোগই তিরোহিত হতো।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-5
টিকা নং:6,
عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ یَعْلَمْؕ
মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না।৬
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৬) অর্থাৎ মানুষ আসলে ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। আল্লাহর কাছ থেকে সে যা কিছু জ্ঞান লাভ করেছে। আল্লাহ যে পর্যায়ে মানুষের জন্য জ্ঞানের দরজা যতটুকু খুলতে চেয়েছেন ততটুকুই তার জন্য খুলে গিয়েছে। আয়াতুল কুরসীতে একথাটি এভাবে বলা হয়েছেঃ
وَلَا يُحِيۡطُوۡنَ بِشَىۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِهٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَۚ
“আর লোকেরা তাঁর জ্ঞান থেকে তিনি যতটুকু চান তার বেশী কিছুই আয়ত্ব করতে পারে না।” (আল বাকারাহ ২৫৫ ) যেসব জিনিসকে মানুষ নিজের তাত্বিক আবিষ্কার বলে মনে করে সেগুলো আসলে প্রথমে তার জ্ঞানের আওতায় ছিল না। আল্লাহ যখন চেয়েছেন তখনই তার জ্ঞান তাকে দিয়েছেন। মানুষ কোনক্রমেই অনুভব করতে পারেনি যে, আল্লাহ তাকে এ জ্ঞান দান করছেন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল সেগুলোর আলোচনা এখান পর্যন্ত শেষ। যেমন হযরত আয়েশার (রা.) হাদীস থেকে জানা যায়ঃ এই প্রথম অভিজ্ঞতাটি খুব বেশী কঠিন ছিল। রসূলুল্লাহ ﷺ এর চাইতে বেশী বরদাশত করতে পারতেন না। তাই তখন কেবল এতটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে যে, তিনি যে রবকে প্রথম থেকে জানেন ও মানেন তিনি সরাসরি তাঁকে সম্বোধন করছেন। তাঁর পক্ষ থেকে অহীর সিলসিলা শুরু হয়ে গেছে এবং তাঁকে তিনি নিজের নবী বানিয়ে নিয়েছেন। এর বেশ কিছুকাল পরে সূরা আল মুদদাসসিরের প্রথম দিকের আয়াতগুলো নাযিল হয়। সেখানে তাঁকে বলা হয়েছে, নবুওয়াত লাভ করার পর এখন কি কি কাজ করতে হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআন আল মুদদাসসিরের ভূমিকা)।
ফী জিলালিল কুরআন:
এরশাদ হচ্ছে, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্ত-পিন্ড থেকে । পড়ো, এবং (জেনে রেখো) তোমার প্রভূ সম্মানিত, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা । শিখিয়েছেন মানুষকে এমন কিছু যা সে জানতো না ।’ কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সূচনালগ্নে অবতীর্ণ এটিই প্রথম সূরা। রসূলুল্লাহ (স.) এই সর্বপ্রথম মনোযোগী হলেন আল্লাহর আরশ থেকে আগত সেই দূতের দিকে! তিনি তাকিয়ে দেখলেন তাকে- যিনি এই সূরাটি বহন করে প্রথম আগমন করলেন। ভ্রান্ত মানুষকে সত্যের দিকে আহবান জানানোর জন্যে দাওয়াতী কাজের সূচনাতে এই হলো তার প্রথম পদক্ষেপ, গোটা মানবমন্ডলীর মধ্য থেকে তার মনোযোগকে সর্বপ্রথম আকর্ষণ করা হলো আল্লাহর নামে পড়ার কথা বলে । বলা হলো, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে ।’ এখানে আল্লাহ রব্বুল ইযযতের গুণাবলীর মধ্যে সেই গুণটির কথা উল্লেখ করে ওহী নাযিল হওয়া শুরু হলো যা দিয়ে সৃষ্টির সূচনা হলো, তাই বলা হয়েছে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। এরপর বিশেষভাবে মানব সৃষ্টি ও তার সূচনার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন রক্তপিণ্ড থেকে ৷ সেই একটি শুক্রবিন্দু যা পর্যায়ক্রমে জমাট হয় এবং মাতৃগর্ভে রক্তপিন্ডের আকার ধারণ করে! সৃষ্টিলোকে সেই ক্ষুদ্র সৃষ্টিটি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায় এবং পরিশেষে সুন্দর ও বলিষ্ঠ শরীরের আকার ধারণ করে সৃষ্টিকর্তার মহত্ব প্রকাশ করে। জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস ও তার মাধ্যম : তুচ্ছ একটি শুক্রবিন্দুকে এমন সুন্দর মানুষে পরিণত করা তার মহা ক্ষমতার কী চমৎকার বহিপ্রকাশ! তারপর আল্লাহ তায়ালা যাকে মর্যাদাবান বানাতে চান, তাকে ওই রক্তপিস্ড থেকে উন্নীত কবে পরিপূর্ণ এমন মানবের রূপ দান করেন যে সে জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখায় ও শেখে ৷ আল্লাহ তায়ালা একথাটাই আলোচ্য অংশে জানাচ্ছেন “পড়ো এবং (জেনে রেখো) তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিখিয়েছেন কলম দ্বারা, শিখিয়েছেন মানুষকে এমন কিছু যা সে জানতো না ।” মানুষের এই বিবর্তন- সৃষ্টির সূচনা থেকে তার পরিণত বয়স এবং পরিশেষে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত- এটা কোন সহজ ব্যাপার নয়, চিন্তা বা ইচ্ছা দ্বারা এটা সম্ভব বলে কেউ মনে করে না, বা করতে পারে না বরং এ কাজ সেই মহা বিজ্ঞানময় ক্ষমতাধর আল্লাহ তায়ালা আঞ্জাম দেন৷ তিনি মহা সম্মানিত ৷ এই পরিবর্তন ও পরিবর্তনের কথা চিন্তা করতে গেলে যে কোনো লোকের মাথা ঘুরে যায়। আর এই সত্যের দিকে ইশারা করতে গিয়েই শিক্ষা দানের গুরুত্ব প্রকাশিত হয়েছে। এ শিক্ষাদান হচ্ছে কলম দ্বারা । কলম মানুষের জন্যে সারা বিশ্বের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটা বড়ো নেয়ামত ৷ এ শিক্ষাদান পূর্বেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এবং আজও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা বুঝতে পারছি। শুধু তাই নয় শিক্ষা দানের যতো উপায় আছে সেগুলোর মধ্যে কলমের গুরুত্ব সর্বাধিক । এর গুরুত্ব বেশী প্রভাবশালী এবং বেশী কার্যকর। আগে কলমের দ্বারা শিক্ষা লাভ যতোটা সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, আজ তা তার থেকে অনেক বেশী সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ । কলমের মাধ্যমে আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষাদান চলছে এবং এর বহমুখী উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কলমের গুরুত্ব পূর্বেও জানতেন এখনও জানেন বিধায় রেসালাতের অধ্যায়গুলোর মধ্যে প্রথম অধ্যায়েই সেই দিকে ইশারা করেছেন৷ পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরাতে এ বিষয়ের প্রতি ইশারা করেছেন। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ কলমের গুরুত্বের কথা নিয়ে যে নবীর কাছে এই সূরাটি নাযিল হলো, তিনি নিজে ছিলেন নিরক্ষর, কলমের ব্যবহার তিনি জানতেন না। আসলে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তাকে নিরক্ষর রাখার রহস্য হচ্ছে, মানুষকে একথা জানার সুযোগ দেয়া যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ এই মহাগ্রন্থ পেশ করা ওহী এবং রেসালাত লাভ ছাড়া এই নিরক্ষর নবীর দ্বারা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না! (তার সংগী-সাথী যারা ওহীর কথাগুলো লিখতেন, তারাই এর সর্বোত্তম সাক্ষী যে, তিনি নিজ হাতে কিছুই লেখেননি। তিনি কোথাও কারো কাছে পড়েননি; কোনো জ্ঞানী-গুণী লোকের সাথে বেড়ানোর সুযোগও তিনি পাননি। ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কিছুই জানতেন না। হঠাৎ করে ৪০ বছরে পড়তেই ‘পড়ার’ গুরুত্ব, কলম দ্বারা লেখার গুরুত্ব, এতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা এবং আগত কথাগুলো চিরদিন নির্ভুল থাকা ওহী ছাড়া কি করে সম্ভব হলো! সূরা ইউনুসের ১৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবী (স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘বলো, আল্লাহ না চাইলে আমি তোমাদেরকে একথাগুলো পড়ে শুনাতাম না। একথাগুলো আসার পূর্বে আমি তো তোমাদের মধ্যে পুরো বয়সটাই কাটিয়ে দিয়েছে, তোমরা কি কিছুই বুঝো না-অনুবাদক) এরপর শিক্ষার উৎস বলা হচ্ছে। সে উৎসটি হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালা । মানুষ যা কিছু জেনেছে বা জানবে একমাত্র তার কাছ থেকেই জানবে । সারা বিশ্বের সৃষ্টিরহস্যের যে দ্বার তার সামনে উদঘাটিত হয়েছে। জীবনের যে দুর্ভেদ্য তথ্য সে জানতে পেরেছে, তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে সব তথ্য সে অবগত হয়েছে তা সবই তার কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে। জানতে পেরেছে সেই একমাত্র উৎস থেকে, যিনি ব্যতীত স্থায়ী আর কেউ নেই, কেউ হতে পারে না। আলোচ্য অধ্যায়ে যখন নবী (স.) মহাকাশের মালিক আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত হলেন এবং তখন থেকে তিনি ঈমানের বহিপ্রকাশ ঘটানোর জন্যে এক নিয়মের অনুবর্তী হয়ে গেলেন। আর নিয়মটি হচ্ছে, প্রতিটি ব্যাপার, প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি পদক্ষেপ এবং প্রত্যেক কাজের শুরু আল্লাহর নাম নিয়ে করা। আল্লাহর নামে চলতে থাকা, আল্লাহমুখী হওয়া এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ তায়ালা সেই মহান সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি শিখিয়েছেন, তার কাছ থেকেই সকল কিছুর সূত্রপাত হয়েছে, তার থেকেই শিক্ষা লাভ ও জ্ঞান অর্জন …….. আর মানুষ যা কিছু শেখে বা জানে সে সব কিছুর মূলে রয়েছেন আল্লাহ রব্বুল আলামীন, যিনি সৃষ্টি করেছেন যিনি শিখিয়েছেন, ‘শিখিয়েছেন মানুষকে এমন কিছু- যা সে জানত না’ । কোরআনের প্রথম সত্য এটাই, যা নবুওতের প্রথম অবস্থাতে রসূল (স.)-অনুভব করেছিলেন এবং যহাসত্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তার সমগ্র চেতনা হয়ে উঠেছিলো । এই সময়েই তার যবান গিয়েছিলো এবং তার কাজ ও জীবনের গতিপথ নির্ণীত হয়ে গিয়েছিলো এবং ঈমানের প্রথম গুণ হিসাবে সর্বত্র তার নাম নিয়ে চলার অভ্যাস গড়ে উঠেছিলো । ইমাম শামসুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে কাইয়েম আল জাওযী তার রচিত যাদুল মায়াদ ফী হাদয়ি খাইরিল ইবাদ’ গ্রন্থে যিকিরকে রসূলুল্লাহ (স.)-এর পথ প্রদর্শনার সারসংক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, ‘নবী (স.) ছিলেন আল্লাহকে স্মরণ করার ব্যাপারে সৃষ্টিজগতে সব থেকে পূর্ণাংগ মানুষ। অন্য কথায় বলতে গেলে তার সমস্ত কথাই ছিলো আল্লাহর। তিনি যে সব ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেছিলেন তাও ছিলো আল্লাহর যিকির ৷ তার নির্দেশ ও নিষেধ এবং উম্মাতের জন্যে আইন প্রবর্তন সবই ছিলো আল্লাহর যিকির ৷ রব্বুল আলামীন-এর নাম, গুণাবলী, ফয়সালাসমূহ, কাজ, ওয়াদা ও তিরস্কার সব কিছুই ছিলো আল্লাহর যিকির । আল্লাহর নেয়ামতের কথা উল্লেখ ও তার প্রশংসা করা, তার বড়ত্ব, তার কৃতিত্ব এবং তার আনুগত্য করা সম্পর্কে যতো কথা আছে সবই তাঁর পক্ষ থেকে আল্লাহর যিকির। তার প্রার্থনা, আল্লাহ তায়ালার দিকে ঐকান্তিক একাগ্রচিত্তে এগিয়ে যাওয়া, তার নীরবতা ও কোনো কিছু জানতে বা শুনতে পেরে চুপ থাকা ছিলো তার অন্তরের যিকির ৷ অতএব, প্রকৃত সত্য ও সঠিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা তাও হবে আল্লাহর যিকির। আল্লাহ তায়ালার স্মরণ হবে তার অন্তরের মধ্যে দাড়ানো, বসা ও শোয়া অর্থাৎ সর্বাবস্থায়। তার চলা-ফেরা, ওঠা বসা, খাওয়া দাওয়া জীবনের প্রতিটি কাজের মধ্যেই আল্লাহর যিকির পরিস্ফূট হয়েছিলো । রসূলুল্লাহ (স.)-এর পুরোটা জীবন এভাবেই কেটেছে। তার সমস্ত মন-প্রাণ ছিলো আল্লাহ কেন্দ্রিক। নবুওতের প্রথম সূচনাতে যে আবেগ-অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন তার উজ্জ্বল আভায় তা ছিলো উদ্দীপিত । তার ধ্যান-ধারণায় সেই ঈমানী চেতনাটি সদা-সর্বদা দোলা দিয়ে যেতো।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-6
টিকা নং:7,
كَلَّاۤ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَیَطْغٰۤىۙ
কখনই নয়,৭ মানুষ সীমালংঘন করে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৭) অর্থাৎ যে মেহেরবান আল্লাহ এত বড় মেহেরবানী করেছেন তাঁর মোকাবেলায় মূর্খতার বশবর্তী হয়ে কখনো এমন কর্মনীতি অবলম্বন করা উচিত নয় যা সামনের দিকে বর্ণনা করা হচ্ছে।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-7
টিকা নং:8,
اَنْ رَّاٰهُ اسْتَغْنٰىؕ
কারণ সে নিজেকে দেখে অভাবমুক্ত।৮
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৮) অর্থাৎ দুনিয়ায় ধন-দৌলত, সম্মান-প্রতিপত্তি যা কিছু সে চাইতো তার সবই সে লাভ করেছে এ দৃশ্য দেখে সে কৃতজ্ঞ হবার পরিবর্তে বরং বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেছে এবং সীমালঙ্ঘন করতে শুরু করেছে।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-8
টিকা নং:9,
اِنَّ اِلٰى رَبِّكَ الرُّجْعٰىؕ
(অথচ) নিশ্চিতভাবেই তোমার রবের দিকেই ফিরে আসতে হবে।৯
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৯) অর্থাৎ দুনিয়ায় সে যাই কিছু অর্জন করে থাকুক না কেন এবং তার ভিত্তিতে অহংকার ও বিদ্রোহ করে ফিরুক না কেন, অবশেষে তাকে তোমার রবের কাছেই ফিরে যেতে হবে। তখন এই মনোভাব ও কর্মনীতির পরিণাম সে জানতে পারবে।
ফী জিলালিল কুরআন:
যারা সত্যকে গ্রহণ করেনা : মানুষ যখন এ সত্য জানতে-বুঝতে পারলো যে, আল্লাহ তায়ালাই তাকে সৃষ্টি করেছেন, শিক্ষা দান করেছেন এবং সৃষ্টিকুলের সবার ওপর তাকে সম্মানিত করেছেন, তখন মানুষের একান্ত কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহকে সঠিকভাবে চেনা এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষের ব্যবহারে তার বিপরীত অবস্থা পাওয়া যায় যে কারণে এ সূরাটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে তার কর্তব্যে গাফলতি, সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং দায়িত্বহীন ব্যবহারের কথা আলোচিত হয়েছে । বলা হয়েছে, ‘ না, কিছুতেই তারা বিরোধিতা করে সাফল্য লাভ করবে না। এই ব্যবহার দ্বারা নিশ্চয়ই মানুষ সঠিক মালিকের সাথে বিদ্রোহ করছে। কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত দেখতে পাচ্ছে। অবশ্যই তোমার রবের কাছে (সবাইকে) ফিরে যেতে হবে। যিনি তাকে এতো সব জীবনসামগ্রী দান করেছেন এবং অতাবমুক্ত করেছেন তিনিই আল্লাহ তায়ালা । তিনিই তাকে সৃষ্টি করেছেন, সম্মানিত করেছেন এবং শিক্ষাদান করেছেন। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষ সেই মহান দাতাকে অস্বীকার করে, তার না-শোকরি করে এবং তার থেকেই বেপরোয়া হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশেষ রহমত দিয়ে যার ঈমানকে রক্ষা করেছেন তার কথা স্বতন্ত্র আসলে সেই অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি যে তাকে অস্বীকার করে অথচ তিনিই তাকে সৃষ্টি করে অতি সুন্দর অবয়ব দিয়েছেন, ভাল-মন্দ বুঝবার জ্ঞান, এরপর পৃথিবীতে বসবাসকালীন সময়ে তাকে তিনি দিয়েছেন প্রয়োজনীয় সকল জীবন সামগ্রী-এর পরেও সে মূল মালিকের সাথে বিদ্রোহ করে এবং তার নাফরমানী করে, অহংকার করে এবং নিজের বড়ত্ব প্রদর্শন করে। অথচ এটি অবধারিত সত্য যে, তার কাছেই একদিন তাকে ফিরে যেতে হবে। একথা যদি সে অনুভব না করে বা বুঝতে না চায়, তাহলে ওই অহংকারী এবং বেপরোয়া ব্যক্তি মৃত্যুর পরে কোথায় যাবে? অথবা যখন সে বুঝতে পেরেছে যে, সেই মহান মালিকের কাছেই তাকে ফিরে যেতে হবে, তার পরেও সে বিদ্রোহ করে কোথায় পালাবে? কার কাছে আশ্রয় পাবে? এই আলোচনায় একথাটিও প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, যে যাই-ই করুক না কেন, আর যতো অর্থ-বৈভব নিয়ে সে পৃথিবীতে দাপট দেখিয়ে চলুক না কেন-অবশেষে তাঁর কাছেই তাকে যেতে হবে। মৃত্যুর পরে আল্লাহ তায়ালার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী থাকাটাই হলো ঈমানের মুল দাবী ৷ তার প্রতিটি পদক্ষেপে, অন্তরের প্রতিটি গোপন কথার মধ্যে একথা থাকতে হবে যে, সব কিছুর পরিণতি ও পরিসমাপ্তিতে সেই মালিকের দরবারে তাকে যেতে হবে। ভাল ও মন্দ সবাইকেই সেখানে যেতে হবে৷ তাঁর কাছেই অনুগত ও অপরাধী, হকপন্থী ও না-হকপন্থী সবার প্রত্যাবর্তন অবধারিত ৷ নেক লোক ও দুষ্ট লোক, সচ্ছল ও অভাবগ্রস্ত সবার শেষ গন্তব্যস্থল হলো আল্লাহর দরবার, আজ সে যতোই দাম্ভিকতা, অহংকার কিংবা উদাসীনতা দেখাক না কোনো একদিন তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। জেনে রেখো, সব কিছুকেই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে শুরু যেমন তার কাছ থেকে প্রত্যাবর্তনও তাঁর কাছেই ।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-9
اَرَءَیْتَ الَّذِیْ یَنْهٰىۙ
তুমি কি দেখেছো সেই ব্যক্তিকে, যে নিষেধ করে
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-10
টিকা নং:10,
عَبْدًا اِذَا صَلّٰىؕ
এক বান্দাকে, যখন সে নামায পড়ে।১০
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১০) বান্দা বলতে এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। এ পদ্ধতিতে কুরআনের কয়েক জায়গায় তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন
سُبۡحٰنَ الَّذِىۡۤ اَسۡرٰى بِعَبۡدِهٖ لَيۡلاً مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَى الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا
“পবিত্র সেই সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে নিয়ে গিয়েছেন এক রাতে মসজিদে হারম থেকে মসজিদে আকসার দিকে।” ( বনি ইসরাঈল ১ )
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِىۡۤ اَنۡزَلَ عَلٰى عَبۡدِهِ الۡكِتٰبَ
“সমস্ত প্রশংসা সেই সত্তার যিনি তাঁর বান্দার ওপর নাযিল করেছেন কিতাব।”( আল কাহফ ১ ) وَأَنَّهُ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللَّهِ يَدْعُوهُ كَادُوا يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَدًا
“আর আল্লাহর বান্দা যখন তাকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন লোকেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হলো।” ( আল জিন ১৯ )
এ থেকে জানা যায়, এটা ভালোবাসার একটা বিশেষ ধরনের প্রকাশভংগী। এ পদ্ধতিতে আল্লাহ তাঁর কিতাবে তাঁর রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও এ থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ নবুওয়াতের দায়িত্বে নিযুক্ত করা পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায পড়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআনের কোথাও এই পদ্ধতির কথা বলা হয়নি। কোথাও বলা হয়নি, হে নবী! তুমি এভাবে নামায পড়ো। কাজেই কুরআনের যে অহী লিখিত হয়েছে কেবলমাত্র এই অহীটুকুই যে রসূলের ﷺ ওপর নাযিল হতো না—এটি তার আর একটি প্রমাণ। বরং এরপরও অহীর মাধ্যমে আরো এমন সব বিষয়ের তালিম দেয়া হতো যা কুরআনে লিখিত হয়নি।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-11
اَرَءَیْتَ اِنْ كَانَ عَلَى الْهُدٰۤىۙ
তুমি কি মনে করো, যদি (সেই বান্দা) সঠিক পথে থাকে
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-12
اَوْ اَمَرَ بِالتَّقْوٰىؕ
অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়?
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-13
اَرَءَیْتَ اِنْ كَذَّبَ وَ تَوَلّٰىؕ
তুমি কি মনে করো, যদি (এই নিষেধকারী সত্যের প্রতি) মিথ্যা আরোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়?
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-14
টিকা নং:11,
اَلَمْ یَعْلَمْ بِاَنَّ اللّٰهَ یَرٰىؕ
সে কি জানে না, আল্লাহ দেখছেন?১১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১১) বাহ্যত মনে হয়, এখানে প্রত্যেকটি ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তুমি কি সেই ব্যক্তির কার্যকলাপ দেখেছো যে আল্লাহর এক বান্দাকে ইবাদাত করা থেকে বিরত রাখছে? যদি সেই বান্দা সঠিক পথে থাকে অথবা মানুষকে আল্লাহর ভয় দেখায় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে, আর এই ইবাদাতে বাধা প্রদানকারী সত্যের প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তার এই তৎপরতা সম্পর্কে তুমি কি মনে করো। যে ব্যক্তি এই কর্মনীতি অবলম্বন করেছে সে যদি জানতো, যে বান্দা নেকীর কাজ করে আল্লাহ তাকেও দেখেন আবার যে সত্যের প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সচেষ্ট তাকেও দেখেন তাহলে সে কি এই কর্মনীতি অবলম্বন করতে পারতো? আল্লাহ জালেমের জুলুম দেখছেন এবং মজলুমের মজলুমীও দেখছেন। তাঁর এই দেখা এ বিষয়টিকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে যে, তিনি জালেমের শাস্তি দেবেন এবং মজলুমের ফরিয়াদ শুনবেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
আল্লাহর চরমপত্র : এমনি করে সূরাটির দুই অংশের মধ্যে ঈমানের ধ্যান-ধারণার বিভিন্ন দিক ও বিভাগের সম্মিলন ঘটেছে। সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধি দান করা সম্মানিত করা ও শিক্ষা দান করা তারপর প্রত্যাবর্তন করা- এ সবই নির্ধারিত ৷ এরপর এ ছোট্ট সূরার মধ্যে রয়েছে তৃতীয় আর একটি অধ্যায় যার মধ্যে অহংকারের বিভিন্ন অবস্থার মধ্য থেকে মাত্র একটি অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এটি মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় । যে কোনো মানুষই এথেকে বাঁচতে চায় এবং কোরআনের তুলনাহীন বর্ণনায় জানা যায় যে, সে অবস্থাটি অত্যন্ত ভয়াবহ । যে ব্যক্তি নামাযে বাধা দেয় তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে- ‘দেখেছো কি ওই ব্যক্তিকে যে বাধা দেয় সেই ব্যক্তিকে- যে নামায পড়ে? …….. এবং সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় (এই উভয় ব্যক্তির কী পরিণতি হতে পারে?’ বাধা দানকারী ওই ব্যক্তি কি সত্যিই জানে না যে আল্লাহ তায়ালা সব শ্রেণীর লোকের সকল ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করছেন? নামাযে বাধা দানকারীর বিশ্রী কাজের চিত্র যেভাবে এই আয়াতে ফুটে উঠেছে সে ধরনের বর্ণনার কোনো ভাষা আজও লিখিত হয়নি এবং যা বুঝানোর জন্যে এমন কথাও ব্যবহৃত হয়নি। আলোচ্য আয়াতের বর্ণনাভংগি অত্যন্ত দ্রুতবেগে এবং সংগোপনে মনের ওপর দাগ কাটে । দেখুন বলা হচ্ছে, ‘তুমি দেখেছো কি? অপ্রীতিকর কাজটিকে? দেখেছো কি ওই লজ্জাজনক মুহূর্তটিকে যখন এ জঘন্য ব্যবহারটি সংঘটিত হচ্ছিলো? দেখেছো কি ওই ব্যক্তিকে যে বাধা দিচ্ছিলো নামায আদায়কারীকে ৷ ওই বাধা দান করার কদর্য কাজটি বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘আরাআইতা’ এই শব্দ দ্বারা ওই কাজের বীভৎসতা অত্যন্ত প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে । বলা হচ্ছে, সে ব্যক্তি যখন নামায পড়ছিলো, তখন তাকে যে নির্দয়-নিষ্ঠুর ভাবে বাধা দিচ্ছিলো এই অসভ্য লোকটিকে তুমি দেখেছো কি? এতে সেই ব্যক্তির চরিত্রের যে জঘণ্য কদর্যতা ফুটে উঠেছে তা বর্ণনা করার মতো এর চেয়ে যুৎসই কোনো ভাষা নেই । নামায আদায়কারী ব্যক্তিটি তো সত্য সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো অথবা মানুষকে সে ‘তাকওয়া’ পরহেযগারী তথা আল্লাহকে ভয় করে চলার শিক্ষা দিচ্ছিলো অথচ এই জঘন্য লোকটি তাকে এই কল্যাণময় কাজে বাধা দিচ্ছিলো ৷ ‘আরাআইতা’ শব্দটি দ্বারা ওই অপ্রিয় কাজটির প্রতি চরম ঘৃণা প্রদর্শন করা হচ্ছে৷ ‘তুমি কি দেখেছো যে, সে বাধা দান করার পর তাকে কেমন করে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করছে এবং পরে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে? পূর্বের অধ্যায়ের শেষে যেভাবে ধমকের সুরে কথা বলা হয়েছে, এখানে এসেও একই ধমকের সুর বর্তমান রয়েছে! সে কি জানে না যে, আল্লাহ তায়ালা সবকিছু দেখছেন, তার মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রয়াস এবং মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া সবই তার নযরে রয়েছে৷ যে বান্দা নামায পড়ছে, তাকে বাধা দানের অবস্থাটাও তিনি দেখছেন, অথচ সে তো সত্য-সঠিক পথেই আছে। সেও এটা জানে এবং অন্তরে বিশ্বাস রাখে যে, এ ব্যক্তি সঠিক পথে রয়েছে কিন্তু স্বার্থ নষ্ট হবে বলে প্রকাশ করে না। সে সদা-সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলতে বলে এটাও বাধা দানকারীর অজানা নয়। সে নিজে রসূল (স.)-এর কর্মধারাকে দেখছে এবং পরবর্তী অবস্থা দেখার ব্যাপারেও অন্তরে বিশ্বাস পোষণ করে । সে হঠকারিতা করে। বুঝেও না বুঝার ভান করছে। তার এই কৃত্রিমতা কি আল্লাহর কাছে ধরা পড়ছে না, আল্লাহ্ তায়ালা দেখছেন বলে কি সে জানে না? দাওয়াত ও ঈমানের পথে বাধা দানকারী এই অহংকারী ব্যক্তিটি দ্বীনের পথে কাটা হিসাবে দাড়িয়ে আছে। সে নিজে আল্লাহর আনুগত্য করে না, অন্যকেও আনুগত্য করার ব্যাপারে সে বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। অতএব, তার জন্যেই এই চূড়ান্ত ধমক এবং এ ধমক এখানে খোলাখুলিভাবেই দেয়া হয়েছে, কোনো আকারে-ইংগিতে নয়। না কিছুতেই সে এই হঠকারিতার মন্দ পরিণতি থেকে বাচতে পারবে না। যদি সে তার এ কদর্য ব্যবহার থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাকে তার মাথার সামনের দিকের চুল ধরে আমি হেচড়াতে হেঁচড়াতে টেনে নিয়ে আসবো। চুল ধরে টানা- এই চরম অপমানজনক পরিণতি এ জন্যে যে, সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী অপরাধী ৷ এ অবস্থা থেকে বাচার জন্যে সে যেন তার দলের সাথীদেরকে ডাকে, আমি দোযখের দারোয়ান ফেরেশতাকে ডেকে বলবো তাকে পাকড়াও করো । এই চূড়ান্ত এবং কঠিনতম ধমক হচ্ছে মহা দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে । এখানে ‘নাসফায়াম বিন নাসিয়াহ’ শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার কঠিন পরিণতি বুঝানোর জন্য৷ শব্দটি শুনতেও বেশ কঠিন! ‘নাসিয়াহ’ হচ্ছে মাথার সামনের উঁচু জায়গার চুল । এ অহংকারীরা সাধারণভাবে অহংকার প্রদর্শনের জন্য এভাবে চুল রাখে এবং অহংকার দেখানোর জন্য এই চুলের গুচ্ছকে ঝাঁকি মেরে ওপরে তুলে দেয় এবং আবোল-তাবোল বলতে থাকে৷ এই এখানে মিথ্যার সাথে মাথার অগ্রভাগের চুলের একটা সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এ চুল কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এ দ্বারা অহংকার ও অপরাধপ্রবণতা বুঝায় ‘এ চুল মিথ্যাবাদী অপরাধী ।’ যে তা রাখে যেন নিজেই নিজের মুখে একটা কলংক কালিমা লেপে দেয়। সে ব্যক্তি ভাবছে যে, তার দলের এবং তার গোষ্ঠীর লোকজন তাকে শক্তি যোগাবে। এজন্য সে তাদের ডাকতে বলছে বা ডাকার হুমকি দিচ্ছে। এজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব আসছে, ঠিক আছে, সে তার লোকদের ডাকুক ৷ আমিও ঘোষণা দিচ্ছি যে, আমিও জাহান্নামের প্রহরী ফেরেশতাদের ডাকবো । তারা হবে বড়ই কঠোর।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-15
টিকা নং:12,
كَلَّا لَئِنْ لَّمْ یَنْتَهِ١ۙ۬ لَنَسْفَعًۢا بِالنَّاصِیَةِۙ
কখনই নয়, ১২ যদি সে বিরত না হয় তাহলে আমি তার কপালের দিকে চুল ধরে তাকে টানবো,
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১২) অর্থাৎ মুহাম্মাদ ﷺ যদি নামায পড়েন তাহলে এই ব্যক্তি নিজের পায়ের চাপে তার ঘাড় পিষে ফেলবে বলে যে হুমকি দিচ্ছে তা কখনো সম্ভবপর হবে না। সে কখনো এমনটি করতে পারবে না।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-17
টিকা নং:14,
فَلْیَدْعُ نَادِیَهٗۙ
সে তার সমর্থক দলকে ডেকে নিক১৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৪) যেমন ভূমিকায় আমরা বলেছি, আবু জেহেলের হুমকির জবাবে যখন রসূলুল্লাহ ﷺ তাকে ধমক দিয়েছিলেন তখন সে বলেছিল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কিসের জোরে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? আল্লাহর কসম, এই উপত্যকায় আমার সমর্থকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। তার এই কথায় এখানে বলা হচ্ছেঃ নাও, এখন তাহলে তোমার সেই সমর্থকদের ডেকে নাও।
সুরা: আল-আলাক্ব
আয়াত নং :-19
টিকা নং:16,
كَلَّا١ؕ لَا تُطِعْهُ وَ اسْجُدْ وَ اقْتَرِبْ۠۩
কখনই নয়, তার কথা মেনে নিয়ো না, তুমি সিজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো।১৬
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১৬) সিজদা করা মানে নামায পড়া। অর্থাৎ হে নবী! তুমি নির্ভয়ে আগের মতো নামায পড়তে থাকো। এর মাধ্যমে নিজের রবের নৈকট্য লাভ করো। সহীহ মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ “বান্দা সিজদায় থাকা অবস্থায় তার রবের সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হয়।” আবার মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরার (রা.) এ রেওয়ায়াতটিও উদ্ধৃত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ আয়াতটি পড়তেন তখন তেলাওয়াতে সিজদা করতেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
সুতরাং সে অবস্থা থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্যে কিছু চেষ্টা-সাধনা অবশ্যই সবার প্রয়োজন ৷ সে ভয়ানক অবস্থা থেকে প্রত্যাবর্তনের চিন্তাকে সামনে রেখে সূরাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে যাতে করে আল্লাহবিশ্বাসী ও অনুগত বান্দারা ঈমানের ওপর দৃঢ় থাকতে পারে এবং আল্লাহর আনুগত্যে অটল হতে পারে। ‘কিছুতেই সে ব্যক্তি সাফল্য পাবে না, ওর কথা মেনে নিয়ো না, বিশ্ব পালক আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্যে তুমি সাজদা করো এবং তার নৈকট্য লাভে ধন্য হও ।’ কিছুতেই সফলতা পাবে না। যে অহংকারী ব্যক্তি নামায় ও ইসলামের দাওয়াতকে বাধাগ্রস্ত করছে সে কিছুতেই সফল হতে পারে না। তুমি তোমার রব-এর উদ্দেশ্যে সাজদা করো এবং আনুগত্য প্রদর্শন ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক এবাদাত এবং যাবতীয় হুকুম পালনের মাধ্যমে তুমি তাঁর নৈকট্য হাসিল করো। আর ছেড়ে দাও এই অহংকারী ও সত্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিটিকে, জাহান্নামের দারোয়ান ফেরেশতাদের হাতে ওকে ছেড়ে দাও। কোনো কোনো সহীহ রেওয়ায়াতের মাধ্যমে জানা যায় যে, এ সূরার প্রথম অবতীর্ণ অংশটুক (১-৫ আয়াত) বাদে বাকী অংশটুকু আবু জাহল সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলো । নাযিল হয়েছিলো সেই সময়টিকে কেন্দ্র করে যখন মাকামে ইবরাইীমের কাছে নামাযে রত রসূলুল্লাহ (স.)-এর পাশ দিয়ে সে যাওয়ার সময় সে বলেছিলো, “ওহে মোহাম্মদ, আমি তোমাকে কি এই কাজ (নামায আদায়) করতে মানা করিনি?” এ কথা বলার সময় সে হতভাগা রসূলুল্লাহ (স.)-কে ধমকাতে লাগলো এবং এক পর্যায়ে অত্যন্ত কড়া ভাষা প্রয়োগ করলো। এই সময়েই সম্ভবত রসূলুল্লাহ (স.) তার গলা টিপে ধরে বলেছিলেন, ধ্বংস হয়ে যাও হতভাগা, আবারও বলছি, তুমি চিরদিনের মতো ধ্বংস হয়ে যাও । সে তখন বলেছিলো, হে মোহাম্মদ কোন্ সাহসে তুমি আমাকে এমন করে ধমকাচ্ছো? তুমি কি জানো না এই অঞ্চলে আমার দলই সবচেয়ে বড়ো দল? তাদেরকে নিয়ে আমি সভা-সমিতি করি এবং তারা আমার যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়? ঠিক ওই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই অধ্যায়টি নাযিল হয়েছে। “ঠিক আছে, ডাকুক সে তার দলীয় লোকদের আমিও শীঘ্র জাহান্নামের ফেরেশতাদের ডাকবো ।” হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যদি নিজের লোকদের সে সত্য সত্যই ডাক দিতো তাহলে আযাবের ফেরেশতারাও সংগে সংগে হাযির হয়ে যেতো । সূরাটির শিক্ষা হচ্ছে বিদ্রোহী, অহংকারী, নামাযে বাধা সৃষ্টিকারী, আনুগত্য করতে অস্বীকারকারী এবং যারা শক্তির বড়াই করে পরিণামের দিক থেকে তারা সবাই সমান। আল্লাহ তায়ালার যে উদ্দেশ্য এ সূরার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে তা হচ্ছে- না, কারোই কোনো ক্ষমতা নেই, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সব ক্ষমতার মালিক অতএব, আনুগত্য অন্য কাউকে দিও না, সাজদা করো আল্লাহকে এবং এই সাজদার মাধ্যমে তার নৈকট্য হাসিল করো । যেহেতু সাজদার মাধ্যমেই সব থেকে বেশী নৈকট্য লাভ করা যায় । এভাবে সূরাটির অংশগুলো বিভিন্ন সময়ে নাযিল হওয়া সত্ত্বেও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সেগুলোর মধ্যে চমৎকার মিল রয়েছে এবং ঘটনাগুলো একটি আর একটির পরিপূরক হিসাবে কাজ করেছে।