Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২১১/এবং কফেরর-রা বলে:-৪৪) [# আহলি কিতাব ও মুশরিকদের কাফের :- # এটিই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন।:-] www.motaher21.net সুরা: ৯৮ : সুরা: আল-বাইয়েনাহ পারা:৩০ ১- ৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- #তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- #তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:- # তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:- # তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১১/এবং কফেরর-রা বলে:-৪৪)
[# আহলি কিতাব ও মুশরিকদের কাফের :-
# এটিই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন।:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯৮ : সুরা: আল-বাইয়েনাহ
পারা:৩০
১- ৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সুরা: আল-বাইয়েনাহ

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৯৮

(৯৮-বাইয়েনাহ) : নামকরণ:

প্রথম আয়াতের শেষ আল বাইয়েনাহ (اَلْبَيِّنَتُ ) থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
(৯৮-বাইয়েনাহ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এ সূরাটির মক্কী বা মাদানী হবার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। অনেক মুফাসসির বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতে এটি মক্কী সূরা। আবার অনেক মুফাসসির বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতে এটি মাদানী সূরা। ইবনুল যুবাইর ও আতা ইবনে ইয়াসারের উক্তি মতে এটি মাদানী সূরা। ইবনে আব্বাস ও কাতাদাহর এ ব্যাপারে দু’ধরনের উক্তি পাওয়া যায়। এক উক্তি অনুযায়ী এটি মক্কী এবং অন্য উক্তি অনুযায়ী মাদানী সূরা। হযরত আয়েশা (রা.) একে মক্কী গণ্য করেন। বাহরুল মুহীত গ্রন্থ প্রণেতা আবু হাইয়ান ও আহকামূল কুরআন গ্রন্থ প্রণেতা আবদুল মুনঈম ইবনুল ফারাস এর মক্কী হওয়াকেই অগ্রাধিকার দেন। অন্যদিকে সূরাটির বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন কোন আলামত পাওয়া যায় না যা থেকে এর মক্কী বা মাদানী হবার ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত ফায়সালা করা যেতে পারে।
(৯৮-বাইয়েনাহ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

কুরআন মজীদের বিন্যাসের ক্ষেত্রে একে সূরা আলাক ও সূরা কদরের পরে রাখাটাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সূরা আলাকে সর্বপ্রথম নাযিলকৃত অহী লিপিবদ্ধ হয়েছে। সূরা কদরে বলা হয়েছে সেগুলো কবে নাযিল হয়। আর এই সুরায় পবিত্র কিতাবের সাথে একজন রসূল পাঠানো জরুরী ছিল কেন তা বলা হয়েছে।

সর্বপ্রথম রসূল পাঠাবার প্রয়োজন বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, আহলি কিতাব ও মুশরিক নির্বিশেষে দুনিয়াবাসীরা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে। একজন রসূল পাঠানো ছাড়া এই কুফরীর বেড়াজাল ভেদ করে তাদের বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। এ রসূলের অস্তিত্ব তাঁর রিসালাতের জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হতে হবে এবং তিনি লোকদের সামনে আল্লাহর কিতাবকে তার আসল ও সঠিক আকৃতিতে পেশ করবেন। অতীতের আসমানী কিতাবসমূহে যেমন বাতিলের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছিল তেমন কোন মিশ্রণ তাতে থাকবে না এবং হবে পুরোপুরি সত্য ও সঠিক শিক্ষা সমন্বিত।

এরপর আহলি কিতাবদের গোমরাহী তুলে ধরা হয়েছে, বলা হয়েছে তাদের এই বিভিন্ন ভুল পথে ছুটে বেড়ানোর মানে এ নয় যে, আল্লাহ তাদেরকে পথ দেখাননি। বরং তাদের সামনে সঠিক পথের বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে এসে যাবার পরপরই তারা ভুল পথে পাড়ি জমিয়েছে। এ থেকে স্বাভাবিকভাবে প্রমাণ হয়, নিজেদের ভুলের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। এখন আবার আল্লাহর এই রসূলের মাধ্যমে সত্য আর এক দফা সুস্পষ্ট হবার পরও যদি তারা বিভ্রান্তের মতো ভুল পথে ছুটে বেড়াতে থাকে তাহলে তাদের দায়িত্বের বোঝা আরো বেশী বেড়ে যাবে।

এ প্রসংগে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব নবী এসেছিলেন তাঁরা সবাই একটি মাত্র হুকুম দিয়েছিলেন এবং যেসব কিতাব পাঠানো হয়েছিল সেসবে একটি মাত্র হুকুমই বর্ণিত হয়েছিল। সেটি হচ্ছে: সব পথ ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর পথ অবলম্বন করো। তাঁর ইবাদাত, বন্দেগী ও আনুগত্যের সাথে আর কারোর ইবাদাত-বন্দেগী, আনুগত্য ও উপাসনা আরাধনা শামিল করো না। নামায কায়েম করো এবং যাকাত দাও। চিরকাল এটিই সঠিক দ্বীন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। এ থেকেও স্বাভাবিকভাবে একথাই প্রমাণিত হয় যে, আহলি কিতাবরা এই আসল দ্বীন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের ধর্মে যেসব নতুন নতুন কথা বাড়িয়ে নিয়েছে সেগুলো সবই বাতিল। আর আল্লাহর এই নবী যিনি এখন এসেছেন তিনি তাদেরকে এই আসল দ্বীনের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দিচ্ছেন।

সবশেষে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে, যেসব আহলি কিতাব ও মুশরিক এই রসূলকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। তাদের শাস্তি চিরন্তন জাহান্নাম। আর যারা ঈমান এনে সৎকর্মের পথ অবলম্বন করবে এবং দুনিয়ায় আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করবে তারা সর্বোত্তম সৃষ্টি। তারা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। এই তাদের পুরস্কার। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও হয়েছে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : কেতাবের অধিকাংশ রেওয়ায়াত অনুসারে এ সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ । কোনো কোনো রেওয়ায়াতে একে মক্কী বলা হয়েছে। রেওয়ায়াতের দিক দিয়ে এবং বক্তব্য উপস্থাপনার ভংগির দিক দিয়ে সূরাটির মদীনায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা যদিও বেশী, তথাপি মক্কায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না। সূরায় যাকাত ও আহলে কেতাবের উল্লেখকে এ ক্ষেত্রে প্রতিকূল সাক্ষ্য হিসাবে ধরা যায় না! কেননা, অকাট্যভাবে মক্কায় অবতীর্ণ এমন সূরাতে ও আহলে উল্লেখ আছে। মক্কায় আহলে কেতাবের কিছু লোক বাসও করতো ৷ তাদের কেউবা ঈমান এনেছে, কেউ আনেনি । নাজরানের খৃষ্টান প্রতিনিধিদল যে রসূল (স.)-এর সাথে মক্কাতেই সাক্ষাত করতে এসেছিলো এবং ঈমান এনেছিলো, সেটা তো সুবিদিত। কতিপয় মক্কী সূরায় যাকাতেরও উল্লেখ দেখা যায়। মদীনায় অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে এমন রেওয়ায়াত তো রয়েছেই । তদুপরি এ সূরায় এমন কিছু এঁতিহাসিক ও ঈমান বিষয়ক সত্য প্রতিবেদনের ভংগিতে তুলে ধরা হয়েছে, যা এর মাদানী হওয়াকেই অগ্রগণ্য বলে সাব্যস্ত করে। উক্ত সত্যসমূহের মধ্যে পয়লা সত্যটি এই যে, আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্য থেকে যারা গোমরাহী ও মতদ্বৈধতার শেষ সীমায় পৌছে গিয়েছিলো, তাদেরকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য রসূল (স.)-কে পাঠানো অপরিহার্য ছিলো। তার আগমন ছাড়া তারা কিছুতেই সেই ভ্রান্তপথ থেকে ফিরে আসতো না । প্রথম তিনটি আয়াত আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্যে যারা কাফের ছিলো, তারা কুফরী ছাড়তে রাজী ছিলো না যতক্ষণ তাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ না আসে । অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রসূল, যিনি পবিত্র গ্রন্থ পড়ে শোনাবেন । যাতে শাশ্বত ও সঠিক বিধানসমূহ লেখা থাকবে-এর এটাই বক্তব্য। দ্বিতীয় সত্য এই যে, আহলে কেতাব তাদের ধর্মের ব্যাপারে যে দ্বিমত পোষণ করেছে সেটা তাদের অজ্ঞতার জন্যও নয় এবং এই ধর্মে কোনো অস্পষ্টতা থাকার জন্যও নয়। বরঞ্চ তাদের কাছে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ আসার পরেই তা করেছে। চতুর্থ আয়াতে, ‘পূর্বে যাদেরকে কেতাব দেয়া হয়েছিলো, তাদের কাছে সুস্পষ্ট ও অকাট্য প্রমাণ আসার পরই তারা বিভেদগ্রস্ত হয়েছিলো’-একথাই জোর দিয়ে বলা হয়েছে৷ তৃতীয় সত্য এই যে, দ্বীন বা ধর্ম মূলগতভাবে এক ও অভিন্ন । তার মূলনীতি ও বিধিগুলো সহজ-সরল ও স্পষ্ট। এ সব মূলনীতি ও বিধি এত সরল ও সহজ বৈশিষ্টের অধিকারী যে, তা কখনো মানুষকে বিভেদ ও কোন্দলের শিক্ষা বা প্ররোচনা দেয় না৷ সূরার চতুর্থ আয়াতের বক্তব্য এটাই । চতুর্থ সত্য এই যে, অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ আসার পরও যারা ইসলামকে অস্বীকার করে, তারা হলো নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। আর, যারা ঈমান আনে, তারা উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি । এ জন্য উভয় গোষ্ঠীর কর্মফলেও আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে, তারা জাহান্নামের আগুনে চিরদিন থাকবে । তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি । আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কাজ করেছে তারা হচ্ছে উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি । তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রতিদান হলো চিরস্থায়ী বেহেশ্ত । এ চারটি সত্যসহ ইসলামী আকীদা ও শেষ নবীর ভূমিকাকে অনুধাবন করার ব্যাপারে সূরাটি অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রাখে।
সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1, 2, 3,

لَمْ یَكُنِ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ وَ الْمُشْرِكِیْنَ مُنْفَكِّیْنَ حَتّٰى تَاْتِیَهُمُ الْبَیِّنَةُۙ

আহলি কিতাব ও মুশরিকদের১ মধ্যে যারা কাফের ছিল২ তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত তারা (নিজেদের কুফরী থেকে) বিরত থাকতে প্রস্তুত ছিল না।৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) আহলি কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দু’টি পৃথক নাম দেয়া হয়েছে। যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব। আর যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না। কোন আসমানী কিতাবও মানতো না তারা মুশরিক। কুরআন মজীদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শির্কের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খৃস্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা বলে, আল্লাহ‌ তিন খোদার একজন।”( আল মায়েদাহ ৭৩ ) “তারা মসীহকেও খোদা বলে।”( আল মায়েদাহ ১৭ ) “তারা মসীহকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করে।” ( আত তাওবা ৩০ ) আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তারা উযাইরকে আল্লাহর পুত্র বলে”( আত তাওবা ৩০ ) কিন্তু এসব সত্ত্বে কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে। অথবা ইয়াহুদ ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে। কারণ তারা তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর শিরক করতো। বিপরীত পক্ষে অ-আহলি কিতাবদের জন্য পারিভাষিক পর্যায়ে মুশরিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ তারা শিরককেই আসল ধর্ম গণ্য করতো। তাওহীদকে তারা পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করতো। এ দু’টি দলের মধ্যকার এ পার্থক্যটা শুধুমাত্র পরিভাষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, শরীয়াতের বিধানের মধ্যেও এ পার্থক্য ছিল। আহলি কিতাবরা আল্লাহর নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানের জন্য হালাল গণ্য করা হয়েছে। তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়নি।

টিকা:২) এখানে কুফরী শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার কুফরী দৃষ্টিভংগী এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কেউ এই অর্থে কাফের ছিল যে, সে আদৌ আল্লাহকে মানতো না। আবার কেউ আল্লাহকে মানতো ঠিকই কিন্তু তাঁকে একমাত্র মাবুদ বলে মানতো না। বরং আল্লাহর সত্ত্বা ও তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতায় কোন না কোনভাবে অন্যদেরকে শরীক করে তাদের বন্দেগীও করতো। কেউ আল্লাহর একত্ব স্বীকার করতো কিন্তু এ সত্ত্বেও আবার কোন না কোন্ ধরনের শিরকও করতো। কেউ আল্লাহকে মানতো কিন্তু তাঁর নবীদেরকে মানতো না এবং নবীদের মাধ্যমে যে হেদায়াত এসেছিল তাকে মানতে অস্বীকার করতো। কেউ এক নবীকে মানতো কিন্তু অন্য নবীকে অস্বীকার করতো। মোটকথা, বিভিন্ন ধরনের কুফরীতে লোকেরা লিপ্ত ছিল। এখানে ‘আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের ছিল’ একথা বলার অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে তাহলে কিছু লোক ছিল যারা কুফরীতে লিপ্ত ছিল না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, কুফরীতে লিপ্ত দু’টি দল ছিল, একটি আহলি কিতাব ও অন্যটি মুশরিক। এখানে মিন (مِنْ ) শব্দটি কতক বা কিছু অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং ‘মিন’এখানে বর্ণনামূলক। যেমন সূরা হজ্জের ৩০ আয়াতে বলা হয়েছেঃ

فَاجۡتَنِبُوۡا الرِّجۡسَ مِنَ الۡاَوۡثَانِ

অর্থাৎ মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। এর অর্থ এ নয় যে, মূর্তিদের মধ্যে যে অপবিত্রতা আছে তা থেকে দূরে থাকো। তেমনি

اَلَّذِيْنَكَفَرُوْامِنْ اَهْلِ الْكِتَلبِ والْمُشْرِكِيْن

এর অর্থও হচ্ছেঃ যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ এ নয় যে, এই দু’টি দলের মধ্য থেকে যারা কুফরী করে।

টিকা:৩) অর্থাৎ একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে তাদেরকে কুফরীর প্রতিটি গলদ ও সত্য বিরোধী বিষয় বুঝাবে এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে সত্য সঠিক পথ তাদের সামনে পেশ করবে, এছাড়া এই কুফরীর অবস্থা থেকে বের হবার আর কোন পথ তাদের সামনে ছিল না। এর মানে এ নয় যে, এ সুস্পষ্ট প্রমাণটি এসে যাবার পর তারা সবাই কুফরী পরিত্যাগ করবে। বরং এর মানে হচ্ছে এই প্রমাণটির অনুপস্থিতিতে তাদের এই অবস্থার মধ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভবপরই ছিল না। তবে তার আসার পরও তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের কুফরীর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। এরপর তারা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আপনি আমাদের হোদায়াতের কোন ব্যবস্থা করেননি। এই ধরনের কথা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। যেমন সুরা নাহলে বলা হয়েছেঃ وَعَلَى اللّٰهِ قَصۡدُ السَّبِيۡلِ “সোজা পথ দেখানো আল্লাহরই দায়িত্ব।” ( ৯ আয়াত ) সূরা লাইলে বলা হয়েছেঃ اِنَّ عَلَيۡنَا لَلۡهُدٰى‌ۖ “পথ দেখাবার দায়িত্ব আমার।” ( ১২ আয়াত )

اِنَّاۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلَيۡكَ كَمَاۤ اَوۡحَيۡنَاۤ اِلٰى نُوۡحٍ وَّالنَّبِيّٖنَ مِنۡۢ بَعۡدِهٖ‌ۚ …………………….. رُّسُلاً مُّبَشِّرِيۡنَ وَمُنۡذِرِيۡنَ لِئَلَّا يَكُوۡنَ لِلنَّاسِ عَلَى اللّٰهِ حُجَّةٌۢ بَعۡدَ الرُّسُلِ‌ؕ

“আমি তোমার প্রতি ঠিক তেমনিভাবে অহী পাঠিয়েছি যেভাবে নূহ ও তারপর নবীদের প্রতি পাঠিয়ে ছিলাম——————এই রসূলদেরকে সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী করা হয়েছে যাতে রসূলদের পর লোকদের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে।” (আন নিসা ১৬৩-১৬৫ আয়াত )

يٰۤاَهۡلَ الۡكِتٰبِ قَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُوۡلُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ عَلٰى فَتۡرَةٍ مِّنَ الرُّسُلِ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا مَا جَآءَنَا مِنۡۢ بَشِيۡرٍ وَّلَا نَذِيۡرٍ‌ فَقَدۡ جَآءَكُمۡ بَشِيۡرٌ وَّنَذِيۡرٌ‌ؕ

“হে আহলি কিতাব! রসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছে। যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদ দানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী। কাজেই নাও, এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও।” ( আল মায়েদাহ ১৯ )

সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-2
টিকা নং:4, 5,

رَسُوْلٌ مِّنَ اللّٰهِ یَتْلُوْا صُحُفًا مُّطَهَّرَةًۙ

(অর্থাৎ) আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রসূল৪ যিনি পবিত্র সহীফা পড়ে শুনাবেন,৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে। কারণ তাঁর নবুওয়াত লাভের আগের ওপরের জীবন, নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কুরআনের মতো কিতাব পেশ করা, তাঁর শিক্ষা ও সাহচর্যের প্রভাবে ঈমান গ্রহণকারীদের জীবনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন সূচিত হওয়া, তাঁর পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত আকীদা-বিশ্বাস, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ইবাদাত-বন্দেগী, চূড়ান্ত পর্যায়ের পবিত্র ও নিষ্কলুষ নৈতিক চরিত্র এবং মানব জীবন গঠনের জন্য সবচেয়ে ভালো মূলনীতি ও বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়া, তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে পুরোপুরি সামঞ্জস্য থাকা এবং সব ধরনের বিরোধিতা ও বাধা-বিপত্তির মোকাবেলায় সীমাহীন দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা সহকারে তাঁর নিজের দাওয়াতের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া—এসব বিষয়ই তিনি যে যথার্থই আল্লাহর রসূল সে কথারই ছিল সুস্পষ্ট আলামত।

টিকা:৫) আভিধানিক অর্থে ‘সহীফা’ বলা হয় “লিখিত পাতাকে।” কিন্তু কুরআন মজীদে এ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে নবীগণের ওপর নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর পবিত্র সহীফা মানে হচ্ছে এমন সব সহীফা যার মধ্যে কোনো প্রকার বাতিল কোন্ ধরনের গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা এবং কোন নৈতিক অপবিত্রতার মিশ্রণ নেই।কোন ব্যক্তি এই কথাগুলোর পুরোপুরি গুরুত্ব তখনই অনুধাবন করতে পারবেন যখন তিনি-কুরআনের পাশাপাশি বাইবেল (এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থগুলোও) অধ্যয়ন করবেন। সেখানে তিনি দেখবেন সঠিক কথার সাথে সাথে এমন কথাও লেখা আছে, যা সত্য ও ন্যায় এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী। আবার এই সঙ্গে নৈতিক দিক দিয়েও অত্যন্ত নিম্নমানের। এসব কথা পড়ার পর কুরআন পড়লে যেকোন ব্যক্তি তার অসাধারণ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।
সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-3

فِیْهَا كُتُبٌ قَیِّمَةٌؕ

যাতে একেবারে সঠিক কথা লেখা আছে।

সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-4
টিকা নং:6,

وَ مَا تَفَرَّقَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ اِلَّا مِنْۢ بَعْدِ مَا جَآءَتْهُمُ الْبَیِّنَةُؕ

প্রথমে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে তো বিভেদ সৃষ্টি হলো তাদের কাছে (সত্য পথের) সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর।৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) অর্থাৎ ইতিপূর্বে আহলি কিতাবরা বিভিন্ন ভুল পথে পাড়ি জমিয়ে যেসব বিভিন্ন দল ও উপদলের উদ্ভব ঘটিয়ে ছিল তার কারণ এ ছিল না যে, মহান আল্লাহ‌ নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে পথ দেখাবার জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ পাঠাবার ব্যাপারে কোন ফাঁক রেখেছিলেন। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে পথনির্দেশনা আসার পর তারা নিজেরাই এ কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল। কাজেই নিজেদের গোমরাহীর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী ছিল। কারণ তাদেরকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য পূর্ণাংগ ব্যবস্থা অবলম্বন করে প্রমাণ পূর্ণ করা হয়েছিল। অনুরূপভাবে এখন যেহেতু তাদের সহীফাগুলো পাক-পবিত্র ছিল না এবং তাদের কিতাব গুলো একেবারে সত্য সঠিক, শিক্ষা সম্বলিত ছিল না, তাই মহান আল্লাহ‌ একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে নিজের একজন রসূল পাঠিয়ে এবং তাঁর মাধ্যমে পুরোপুরি শর্ত-সঠিক শিক্ষা সম্বলিত পাক পবিত্র সহীফা পেশ করে আবার তাদের ওপর প্রমাণ পূর্ণ করে দিলেন। ফলে এর পরেও যদি তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় তাহলে এর দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে। আল্লাহর মোকাবেলায় তারা কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবে না। কুরআন মজীদের বহু জায়গায় একথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আল বাকারা ২১৩ আয়াত, আলে ইমরান ১৯ আয়াত , আল মায়েদাহ ৪৪-৫০ আয়াত , ইউসুফ ৯৩ আয়াত , আশ শূরা ১৩-১৫ আয়াত , আল জাসিয়াহ ১৬-১৮ আয়াত। এই সাথে তাফহীমুল কুরআনে এসব আয়াতের আমি যে ব্যাখ্যাগুলো লিখেছি সেগুলোর ওপরও যদি একবার নজর বুলানো যায় তাহলে বক্তব্যটি অনুধাবন করা আরো সহজ হবে।

সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-5
টিকা নং:7,

وَ مَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِیَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِیْنَ لَهُ الدِّیْنَ١ۙ۬ حُنَفَآءَ وَ یُقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ یُؤْتُوا الزَّكٰوةَ وَ ذٰلِكَ دِیْنُ الْقَیِّمَةِؕ

তাদেরকে তো এছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে, এটিই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন।৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) অর্থাৎ মুহাম্মাদ ﷺ যে দ্বীনটি পেশ করছেন। আহলি কিতাবদের কাছে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল এবং তাদের কাছে যেসব নবী এসেছিলেন তারাও তাদেরকে সেই একই দ্বীনের তালীম দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যেসব বাতিল আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজ-কর্মের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তার কোনটিরও হুকুম তারা দেননি। সবসময় সত্য ও সঠিক দ্বীন একটিই ছিল। আর সেটি হচ্ছেঃ একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করতে হবে। তাঁর বন্দেগীর সাথে আর কারো বন্দেগীর মিশ্রণ ঘটানো যাবে না। সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে একমাত্র আল্লাহর পূজারী এবং তাঁর ফরমানের অনুগত হতে হবে। নামায কায়েম করতে হবে। যাকাত দিতে হবে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন আল আ’রাফ ১৯ টীকা , ইউনুস ১০০-১০৯ টীকা , আররূম ৪৩-৪৭ টীকা এবং আয যুমার ৩ – ৪টীকা। )

এই আয়াতে ‘দ্বীনুল কাইয়েমা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির একে دِيْنُ المِلَّتِ الْقَيِّمَتٍ অর্থাৎ “সত্য-সঠিক পথাশ্রয়ী মিল্লাতের দ্বীন” অর্থে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ একে বিশেষ্যের সাথে বিশেষণের সম্বন্ধ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং قَيِّمَتٌ এর ه কে عَلَّامَهٌ ও فَهَّامَه এর মতো অত্যধিক বৃদ্ধি অর্থে গ্রহণ করেছেন। আমি এখানে অনুবাদে যে অর্থ গ্রহণ করেছি তাদের মতে এর অর্থও তাই।

ফী জিলালিল কুরআন:

এখন এর বিশদ বিবরণ দিচ্ছি, ‘আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্য থেকে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তাদের কাছে সুস্পষ্ট দলীল না আসা পর্যন্ত তারা এ পথ থেকে ফিরবে না। এই সুস্পষ্ট দলীল হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত একজন রসূল, যিনি পবিত্র লিপিসমূহ পাঠ করেন, সেই লিপিসমূহে রয়েছে অকাট্য ও অনড় বিষয়সমূহ ।’ পৃথিবী এক নতুন নবুওতের তীব্র প্রয়োজন অনুভব করছিলো। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে অন্যায়, অনাচার ও অরাজকতা এতো ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলো যে, একটি নতুন নবুওত, নতুন বিধান ও নতুন আন্দোলন ছাড়া সেই পরিস্থিতি শোধরানোর কোনো আশা ছিলো না । পূর্ববর্তী আসমানী কেতাবসমূহের জ্ঞান লাভকারী এবং পরে তাকে বিকৃতকারী আহলে কেতাব আরব উপদ্বীপ ও অন্যান্য জায়গায় পৌত্তলিকরা এদের সকলেরই আকীদা ও বিশ্বাস কুফরী তথা আল্লাহর অবাধ্যতার মানসিকতা দ্বারা প্রভাবিত ও কলুষিত হয়ে পড়েছিলো । এ কুফরীতে তারা এতটা আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো যে, এই রেসালাতের অভ্যুদয় ছাড়া এবং এই নবীর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া তারা তা থেকে ফিরে আসতো না। এই নবীর ব্যক্তিত্বই ছিলো একটি সুস্পষ্ট, অকাট্য ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী দলীল বিশেষ ৷ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত এক রসূল, যিনি পবিত্র লিপিসমূহ পাঠ করেন । অর্থাৎ কুফর ও শেরেক থেকে পবিত্র ৷ ‘তাতে রয়েছে সুসংহত ও অকাট্য বিষয়সমূহ ।’ কেতাব শব্দটি দ্বারা বিষয় বা অধ্যায় বুঝানো হয়ে থাকে । যেমন, ‘ কিতাবুত তাহারাত’ পবিত্রতা সংক্রান্ত অধ্যায় বা বিষয়, ‘কিতাবুস সালাত-নামাযের অধ্যায় বা বিষয়, ‘কিতাবুল কদর’ অদৃষ্ট সংক্রান্ত বিষয় বা অধ্যায়, ‘সুহুফাম্‌ মুতাহ্‌হারা’ দ্বারাও কোরআনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে কোরআনে সুদৃঢ় ও সুসংহত আলোচ্য বিষয়সমূহ, অধ্যায়সমূহ বা তথ্যসমূহ রয়েছে। সুতরাং এই রেসালাত এবং এই রসূল উপযুক্ত সময়েই এসেছেন । আর বিভিন্ন অধ্যায়, বিষয় ও তথ্য সম্বলিত এই কোরআন এই উদ্দেশ্যে এসেছে যেন সমগ্র পৃথিবীতে এমন এক নতুন ঘটনা ও নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, যা পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য ছিলো। এই রসূল এবং এই রেসালাত সমগ্র পৃথিবীর জন্য কিভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো, সে বিষয়টি বিশিষ্ট মুসলিম চিস্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী, নদভীর লেখা একটি গ্রন্থের কিছু উদ্ধৃতি দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তার সেই গ্রন্থের নাম ‘মা যা খাসেরাল আলামু বে এনহেতাতিল মুসলেমীন’ (মুসলমানদের অধোপতনে বিশ্ব কি হারালো) এ বিষয়ে আমি এ যাবত যতো লেখা পড়েছি, তন্মধ্যে এই পুস্তকটি সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট । এর প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে,…. অন্ধকার থেকে আলোর পথে : এ কথা সর্ববাদী সম্মত সত্য যে, খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দী ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে অধপতিত যুগ। শত শত বছর ধরে মানবতা ক্রমেই অবনতির দিকে এগিয়ে চলছিলো । পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো শক্তি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো না যা তাকে চরম্‌ অধপতন থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে। বরঞ্চ যুগের আবর্তনে ক্রমেই তার অধপতন তরান্বিত হচ্ছিলো । এই শতাব্দীর মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছিলো। সেই সাথে নিজেকে ও নিজের পরিণতিকেও ভুলে গিয়েছিলো ৷ সত্য জ্ঞান, ভালো ও মন্দের পার্থক্য এবং ন্যায় ও অন্যায়ের ভেদাভেদ জ্ঞানও সে হারিয়ে ফেলেছিলো। দীর্ঘকালব্যাপী নবীদের দাওয়াতও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। তাঁদের তিরোধানের পর তাদের জ্বালানো প্রদীপগুলো হয় নিভে গিয়েছিলো, নতুবা তার আলো এত নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলো যে, দেশ থেকে দেশে এবং জনপদ থেকে জনপদে তার আলো বিকীর্ণ হতো না। বড়োজোর দু’চার জন মানুষের মন ও বিবেকে কিছুটা দীপ্তি ছড়াতো । ধর্মপ্রাণ লোকেরা জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্র থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে উপাসনালয়ে অথবা নিভৃতস্থানে আশ্রয় নিয়েছিলো, যাতে দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা ও গোমরাহীর বিপদ থেকে তাদের ধর্ম ও সততা রক্ষা পায়, নিরাপদে ও শান্তিতে বেঁচে থাকা যায় এবং জীবনের রকমারি দায়-দায়িত্ব ও দুঃখ-কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকা যায়। তাদের অনেকে ধর্ম ও রাজনীতির দ্বন্দ্বে এবং আধ্যাত্মিকতা ও জড়বাদী ভোগবাদী জীবন ধারার সংঘাতে পরাজয় বরণ করার কারণেও কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়েছিলো । যারা ময়দানে টিকে ছিলো, তারা রাজ-রাজড়া ও দুনিয়াবাসীর সাথে আপোস রফা করে নিয়েছিলো, তাদের যুলুম ও অত্যাচার ও পাপ-পংকিল জীবনধারার সাথে সহযোগিতা করা এবং অবৈধ পন্থায় মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করার পথ অবলম্বন করেছিলো । সেখানে বড় বড় অপরাধী ও বকধার্মিকদের তামাশা ও ছিনিমিনি খেলার শিকার হয়ে পড়েছিলো ৷ ফলে তার প্রাণশক্তি ও বাহ্যিক রূপ-উভয়ই এত বিকৃত হয়ে পড়েছিলো মে, সেসব ধর্মের পূর্বসূরীরা পুনরুজ্জীবিত হলে সে ধর্মকে চিনতেই পারতো না। সভ্যতা ও সংস্কৃতির লীলাভূমি এবং রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলগুলো নৈরাজ্য, অনাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন, অত্যাচার ও অব্যবস্থার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। তারা এমন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে পড়েছিলো যে, তাদের জীবনেরও কোন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সারবত্তা ছিলো না। কোনো ঐশী ধর্মের কোনো পথ-নির্দেশ কিংবা কোনো স্থিতিশীল মানবীয় শাসন ব্যবস্থা তাদের করায়ত্ব ছিলো না।  এই ক্ষুদ্র বিবরণটি সংক্ষেপে মোহাম্মদ (স.)-এর নবুওতের পূর্বেকার বিশ্ব পরিস্থিতি ও ধর্মীয় অবস্থার চিত্র তুলে ধরে। পবিত্র কোরআনে একাধিক জায়গায় আহলে কেতাব ও পৌত্তলিকদের জীবনে সমভাবে বিরাজমান কুফরীর বৈশিষ্টসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। ইহুদী খৃষ্টানদের প্রসঙ্গে উচ্চারিত এসব আয়াতের একটি হচ্ছে সূরা তাওবার ৩০ নং আয়াত, ‘ইহুদীরা বলে ওযায়ের আল্লাহর পুত্র, আর খৃষ্টানরা বলে মাসীহ আল্লাহর পুত্র ।’ সূরা আল বাকারার ১১৩ নং আয়াত, ‘ইহুদীরা বলতো, খৃষ্টানদের কাছে কিছুই নেই । আর খৃষ্টানরা বলতো ইহুদীদের কাছে কিছুই নেই।’ সূরা আল মায়েদার ৬৪ নং আয়াত, ‘ইহুদীরা বলতো, আল্লাহর হাত বাধা রয়েছে। অথচ তাদেরই হাত বাধা। তাদের এ কথার জন্য তারা অভিশপ্ত হয়েছে। আল্লাহর হাত দু’টাই বরং উন্মুক্ত, যেমন খুশী তিনি তেমন ব্যয় করেন ।’ সূরা আল মায়েদার ৭৩ নং আয়াত, ‘ যারা বলেছে যে, মারইয়ামের পুত্র মাসীহই আল্লাহ, তারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে।’ আর পৌত্তলিকদের সম্পর্কে কোরআন বলেছে, ‘বলো, হে কাফেরগণরা! তোমরা যার পূজা করো আমি তার পূজা করি না, আর আমি যার এবাদাত করি, তোমরা তার এবাদাত করো না। তোমরা যার পূজা করো, আমি তার পূজা করি না। আর আমি যার এবাদাত করি তোমরা তার এবাদাত করো না । তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমার জন্য আমার ধর্ম ।’ এই কুফরী ছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাজ করতো অশান্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অত্যাচার-অনাচার ও শত্রুতা । মোটকথা, পৃথিবীতে সুস্থ মনমেযাজসম্পন্ন একটি জাতিও ছিলো না, চরিত্র ও সততার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো সমাজও ছিলো না । ইনসাফ ও সহৃদয়তা ভিত্তিক কোনো সরকার ছিলো না। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো নেতৃত্ব ছিলো না এবং নবীদের কাছ থেকে আগত কোনো বিশুদ্ধ ধর্ম ছিলো না।’ (মুসলমানদের অধপতনে বিশ্ববাসী কী হারালো) । এ কারণে মানব জাতির প্রতি দয়া ও মহানুভবতার তাগিদে আল্লাহ তায়ালা নিজের পক্ষ থেকে একজন রসূল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যিনি আল্লাহর কেতাব পড়ে তাদেরকে শোনাবেন । এই মহা ত্রাণকর্তা, মহান পথপ্রদর্শক রসূলকে না পাঠানো হলে পৌত্তলিক ও আহলে কেতাব গোষ্ঠী সেই অনাচার ও দুষ্কৃতি থেকে ফিরে আসতো না। সূরার শুরুতে এই সত্য বর্ণনা করার পর পুনরায় বলা হচ্ছে যে, বিশেষভাবে আহলে কেতাব তাদের ধর্মের ব্যাপারে যে বিভেদ ও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়েছে, সেটা ধর্মের ব্যাপারে কোনো অজ্ঞতা, অস্পষ্টতা বা জটিলতার কারণে নয়, বরং তাদের রসূলদের মাধ্যমে সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ ও পরিপূর্ণ জ্ঞান লাডের পরই তারা বিভেদ ও বিবাদে লিপ্ত হয়েছে। ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরই আহলে কিতাব বিভেদের শিকার হয়েছে।’ এ ধরনের প্রথম বিভেদের ঘটনা ঘটে হযরত ঈসা (আ.)-এর আগমনের পূর্বে ইহুদী উপদলসমূহের ভেতরে। তারা বহু দলে-উপদলে বিভক্ত হয়। অথচ একই তাওরাত তাদের কিতাব এবং একই হযরত মূসা (আ.) তাদের নবী ছিলো । তারা পাঁচটি প্রধান উপদলে বিভক্ত ছিলো । যথা, সাদুকী, ফারেসী, আসেয়ী, গালী ও সামেরী । প্রত্যেক উপদলের আলাদা নিদর্শন ও লক্ষ্য ছিলো। এ ছাড়া ইহুদী ও খৃষ্টানদের নিজেদের মধ্যেও ছিলো বৈরিতা ও বিভেদ। অথচ হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন বনী ইসরাঈলেরই অন্যতম নবী ও শেষ নবী। তিনি তাওরাত কিতাবের সমর্থক হয়েই এসেছিলেন ৷ তথাপি ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে চরম বিদ্বেষ ও শত্রুতার সৃষ্টি হয়। এই দুই জাতির মধ্যে সংঘটিত যে সব যুদ্ধ ও রক্তপাতের ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা এক কথায় লোমহর্ষক । বর্বর ইহুদী খৃষ্টানদের ইতিহাস : ৭ম শতান্দীর প্রথম দিকে এমন কিছু ঘটন৷ ঘটে, যা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে একে অপরের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তোলে এবং তাদের সুনাম মারাত্মকভাবে নষ্ট করে। শাহ ফোকাসের রাজত্বের শেষ বছরে অর্থাৎ ৬১০ খৃষ্টাব্দে ইহুদীরা এন্তাকিয়ার খৃষ্টানদের ওপর আক্রমণ চালায় ফলে সন্ত্রাট তাদের বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে তার সেনাপতি ইবনোসোসকে পাঠান। সেনাপতি এই বিদ্রোহ দমন করতে এমন নিষ্ঠুর দমন অভিযান চালায়, যার কোন নযির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সে তরবারি দিয়ে, ফাসি দিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, প্রহার করে, হিংস্র জানোয়ার লেলিয়ে দিয়ে গোটা শহরবাসীকে সম্পূর্ণরূপে নিধন করে। ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে এ ধরনের গণহত্যা মাঝে মাঝেই হতো। ঐতিহাসিক মিকরিযী স্বীয় গ্রন্থে বলেন যে, রোম সম্রাট ফোকাসের আমলে পারস্য সম্রাট কিসরা সিরিয়া ও মিসরে স্বীয় সৈন্য প্রেরণ করেন। তারা জেকরুযালেম, ফিলিস্তীন ও সিরিয়ার সকল গীর্জা ধ্বংস করে, সকল খৃষ্টান জনগণকে পাইকারীভাবে হত্যা করে। তাদেরকে খুঁজতে মিসরে এসে বিপুল সংখ্যক মিসরবাসীকে হত্যা করে এবং অসংখ্য মানুষকে বন্দী করে। পারস্যের এই হানাদার বাহিনীকে খৃষ্টানদের হত্যা ও গীর্জা ধ্বংস করার কাজে ইহুদীরা পূর্ণ সহযোগিতা দেয়। অতপর তাবারিয়া, জাবালুল জলীল, নাসেরিয়া শহর, সূর অঞ্চল ও জেরুযালেমের ভেতর দিয়ে পারস্যের দিকে অগ্রসর হয় এবং এই সময় খৃষ্টানদের ব্যাপক হত্যাকান্ড ও ধ্বংসলীলা চালায় । জেরুযালেমে তাদের দুটো গীর্জা ধ্বংস করে, তাদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দেয়, খৃষ্টানদের পবিত্র ক্রুশের কাঠের একটা অংশ ছিনিয়ে নেয় এবং জেরুজালেমের বিশপ ও তার বহু সহচরকে বন্দী করে নিয়ে যায়। জেরুজালেম বিজয়ের ঘটনা উল্লেখ করার পর তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সূর শহরে ইহুদীরা বিদ্রোহ করে, তারা তাদের অবশিষ্ট লোকজনকে নিজ নিজ শহরে পাঠিয়ে দেয় এবং খৃস্টানদের ওপর হামলা ও তাদের হত্যা করার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে। এভাবে ইহুদীদের নিজেদের ভেতরে যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার ইহুদী অংশ নেয়। সূর শহরের বাইরে খৃষ্টান গীর্জাগুলো ধ্বংস করা হয়। এতে খৃষ্টানরা তাদের ওপর মরিয়া হয়ে হামলা করে। ফলে ইহুদীরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে এবং তাদের অনেকেই নিহত হয়। এই সময় হিরাক্লিয়াস রোমের বাদশাহ হন। তিনি সুকৌশলে পারস্য বাহিনীকে পরাভূত করেন। পারস্য সম্রাট সেখান থেকে বিদায় হন। এরপর তিনি সিরিয়া ও মিসরে যান এবং পারসিকদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলকে পুনর্নিমাণ করেন৷ এ সময় তাবারিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের ইহুদীরা তার কাছে উপঢৌকনাদি নিয়ে সাক্ষাৎ করে এবং তার কাছে নিরাপত্তা চায়। হিরাক্লিয়াস তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেন এবং তাদের ওপর কোনো হামলা না করার শপথ করেন। তারপর তিনি জেরুজালেমে প্রবেশ করেন। খৃষ্টানরা তাকে ইঞ্জিল গ্রন্থসমূহ, ক্রুশ ও জ্বলন্ত মোমবাতিসহ স্বাগত জানায়। হিরাক্লিয়াস জেরুজালেমের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ভীষণ ব্যথিত হন। জেরুজালেমের খৃস্টানরা তাকে জানায় যে, পারসিক বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদীরা এই সব ধ্বংস অভিযান চালিয়েছে। তারা জানায় যে, ইহুদীরা স্বয়ং হানাদার পারসিকদের চেয়েও বেশী হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তারা হিরাক্লিয়াসকে ইহদীদেরকে হত্যা করার প্ররোচনা দেয়। হিরাক্লিয়াস প্রতিবাদ করে বলেন যে, তিনি তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছেন এবং শপথ করেছেন। কিন্তু সমস্ত খৃষ্টান পন্ডিত ও ধর্মযাজকরা তাকে এই মর্মে ফতোয়া দেয় যে, যেহেতু তারা হিরাক্লিয়াসকে তাদের অপকর্মের কথা জানবার সুযোগ না দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে তার কাছ থেকে নিরাপত্তা আদায় করেছে কাজেই তাদেরকে হত্যা করলে কোনো দোষ হবে না। আর এর প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ খৃষ্টানরা প্রতি বছরে এক সুত্রবার রোযা রাখবে এবং এটা অনন্তকাল ধরে চলবে। এরপর হিরাক্লিয়াস তাদের কথায় রাযী হয়ে যান এবং ইহুদীদেরকে এমন পাইকারী হত্যা করেন যে, সিরিয়া ও মিসরে দু’একজন পালিয়ে বাচা ছাড়া একজন ইহুদীও রক্ষা পায়নি । এ সব বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, ইহুদী ও খৃষ্টান এই দুই জাতি মানুষের রক্তের সাথে কিরূপ নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা দেখিয়েছে এবং কিভাবে শত্রুর কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মনুষ্যত্বের সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এরপর খোদ খৃষ্টানদের ভেতরেই বিভেদ ও কোন্দল শুরু হয়ে যায়। অথচ তারা একই কিতাব ও একই নবীর অনুসারী ৷ প্রথমে তারা মতভেদে লিপ্ত হয় আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে, তারপর পরস্পর বিরোধী ও পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণকারী দলে ও উপদলে বিভক্ত হয়৷ এমনকি হযরত ঈসা (আ.)-এর ব্যক্তি সত্ত্বা কি রকম ছিলো, তিনি কি অন্যান্য মানুষের মতো মরণশীল ছিলেন, না অমর ও অক্ষয় দেহের অধিকারী ছিলেন, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। সেই সাথে তার মাতা মরিয়ামের স্বভাব-প্রকৃতি নিয়েও বিরোধ দেখা দেয়৷ তাদের ধারণা অনুসারে যে ত্রিত্ব থেকে ‘আল্লাহ’র সৃষ্টি হয়, সেই ত্রিত্ব আসলে কি জিনিস, তা নিয়ে তারা মতভেদের শিকার হয়। কোরআন তাদের দুটি মত উল্লেখ করেছে। এক জায়গায় বলেছে, ‘যারা বলেছে যে, আল্লাহ্‌ হচ্ছে তিন ইলাহের একজন, তারা কাফের ।’ আল্লাহ্‌ জিজ্ঞাসা করবেন, হে মরিয়ামের পুত্র ঈসা! তুমি কি জনগণকে বলেছিলে যে, তোমরা আমাকে ও আমার মাকে আল্লাহ ছাড়া দুই ইলাহ, হিসাবে গ্রহণ করো?’ (সূরা আল মায়েদা, আয়াত ১১৬) আর এই ধর্মীয় মতভেদের সবচেয়ে উগ্র রূপ দেখা দেয় সিরিয়া, রোম সাম্রাজ্য ও মিসরের খৃষ্টানদের মধ্যে । অন্য কথায় মালাকানী ও মনোকেসী খৃষ্টানদের মধ্যে । মালাকানীদের বিশ্বাস, হযরত ঈসা (আ.) একাধারে মানুষ ও ইলাহ দুই ছিলেন । আর মনোকেসীদের আকীদা এই যে, হযরত ঈসা (আ.) শুধু ইলাহ ছিলেন, তার ভেতরে মানবীয় বৈশিষ্ট্য এমনভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো যেমন এক ফোটা সির্কা অথৈ সমুদ্রের পানিতে পড়ে বিলীন হয়ে যায়। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে এই দুই গোষ্ঠীর মতভেদ এমন যুদ্ধংদেহী রূপ ধারণ করে যে, তা দুটো প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের মধ্যকার বিরোধ বা ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যকার বিরোধ বলে মনে হতে থাকে। উভয়ে উভয়কে ধর্মচ্যুত বা বিধর্মী বলে আখ্যায়িত করতো । সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের ওপর বিজয় লাভের পর সকল খৃষ্টান উপদলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এজন্য এই ফর্মুলা উদ্ভাবন করা হয় যে, লোকেরা হযরত ঈসার প্রকৃত স্বরূপ কি, তিনি একক না দ্বৈত রূপের অধিকারী, সে বিষয়ে কোনো কথা বলবে না। তবে আল্লাহ্‌ যে একক ইচ্ছা বা একক ফায়সালার অধিকারী, সে কথা সবাই মেনে নেবে। ৬৩১ খৃস্টাব্দের শুরুতে ফর্মুলা স্বীকৃতি লাভ করে৷ ফলে মনোকেসী তত্ত্বটি রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত গীর্জাসমূহের অনুসারীদের জন্যও এই তত্ত্ব স্বীকৃতি লাভ করে৷ নতুন এই তত্ত্বকে হিরাক্লিয়াস অন্য সকল তত্ত্বের ওপর যে কোনো মূল্যে স্থান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । তবে মিসরের কিবতীরা এটিকে ‘বেদয়াত’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। তারা এর প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পুরানো তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরতে চায়। সম্রাট পুনরায় ধর্মের একীভূতকরণ ও মতান্তর নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন, তবে তিনি (ঐক্যের ভিত্তি হিসাবে) শুধু আল্লাহর একক ইচ্ছার ধারণাটি মেনে নেয়াকেই যথেষ্ট মনে করেন । এরপর দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো এই ইচ্ছাকে বাস্তবে কার্যকরী করা৷ এ ব্যাপারে সম্রাট যে কোনো বিতর্ক ও মত প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন । অতপর এই মতকে তিনি রাষ্ট্রীয় ও সরকারী অভিমত হিসাবে সমগ্র প্রাচ্য দেশে প্রচার করেন। কিন্তু এতে মিসরের কোন্দল থামলো না৷ ফলে রোম সম্রাটের হাতে মিসরে লোমহর্ষক অত্যাচার চলে এবং তা দশ বছর যাবত অব্যাহত থাকে। এক একজন ভিন্ন মতাবলম্বীকে নির্যাতন করে পানিতে ডুবিয়ে অথবা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কাউকে বালুভর্তি বস্তায় ঢুকিয়ে সাগরে ফেলে দিয়ে এবং অন্যান্য বহু বীভৎস পন্থায় কষ্ট দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। (সাইয়েদ আলী আহসান আলী নদভীর একই পুস্তক থেকে ) আর এই সমস্ত কোন্দল ও মতবিরোধ খোদ কিতাবধারীদের মধ্যেই সংঘটিত হয়৷ জ্ঞানের অভাবে বা অস্পষ্টতার কারণে এসব ঘটেনি, ঘটেছে বিকৃতি ও স্বার্থপরতার কারণে । যেহেতু দ্বীন তথা আল্লাহর নাযিল করা ধর্ম মূলত, সুস্পষ্ট এবং তার আকীদা-বিশ্বাস সহজ-সরল ও জটিলতামুক্ত, তাই এই পটভূমিতে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, ‘তাদেরকে শুধুমাত্র এই আদেশই দেয়া হয়েছিলো যে, তারা যেন আল্লাহর এবাদাত এমনভাবে করে যে, আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে নেয় এবং সর্বতোভাবে তার প্রতি একাগ্র থাকে, আর নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়। বস্তুত এটাই চিরস্থায়ী বিধান ।’ আল্লাহর দ্বীনের চিরন্তন মূলনীতি এটাই যে, একমাত্র আল্লাহর এবাদাত করতে হবে, আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে ও সর্ববিষয়ে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। শিরিক ও মোশরেকদেরকে বর্জন করতে হবে, নামায কায়েম করতে হবে ও যাকাত দিতে হবে। ‘এটাই চিরস্থায়ী দ্বীন বা বিধান ।’ অর্থাৎ অন্তরে নির্ভেজাল আকীদা-বিশ্বাস স্থাপন এবং সেই আকীদার আলোকে আল্লাহর এবাদাত ও আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয়। এই ব্যয়ের নাম হচ্ছে যাকাত । যে ব্যক্তি এইসব মূলনীতি বাস্তবায়িত করবে সে ঈমানকেই বাস্তব রূপ দান করবে। আহলে কিতাবকে এরই নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো এবং এটাই সামগ্রিকভাবে আল্লাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত । একই দ্বীন ও একই আকীদা বিশ্বাস নিয়ে একের পর এক রসূলদের আবির্ভাব ও রেসালাতের আগমন ঘটেছে। এ দ্বীনে কোনো অস্পষ্টতা নেই, জটিলতা নেই। এ আকীদা-বিশ্বাসে কোনো দ্বন্দ ও কোন্দলের উস্কানি ও প্ররোচনা নেই। আল্লাহর এহেন সহজ সরল ও উদার দ্বীনের সাথে মানবরচিত জটিল ও বিতর্কিত আদর্শের কোনো তুলনা হয় না।

সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-6
টিকা নং:8, 9,

اِنَّ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ وَ الْمُشْرِكِیْنَ فِیْ نَارِ جَهَنَّمَ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا١ؕ اُولٰٓئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِیَّةِؕ

আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে৮ তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। তারা সৃষ্টির অধম।৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৮) এখানে কুফরী মানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেনে নিতে অস্বীকার করা। অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি। অথচ তাঁর অস্তিত্বই একটি সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি সম্পূর্ণ ও নির্ভুল লিপি সম্বলিত মত পবিত্র সহীফা পাঠ করে তাদেরকে শুনাচ্ছেন। এ ধরনের লোকদের পরিণাম তাই হবে যা সামনের দিকে বর্ণনা করা হচ্ছে।

টিকা:৯) অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি আর নেই। এমন কি তারা পশুরও অধম। কারণ পশুর বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি নেই। কিন্তু এরা বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি সত্ত্বেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-7
টিকা নং:10,

اِنَّ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ١ۙ اُولٰٓئِكَ هُمْ خَیْرُ الْبَرِیَّةِؕ

যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা নিশ্চিত ভাবে সৃষ্টির সেরা।১০

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) অর্থাৎ তারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবার এমনকি ফেরেশতাদেরও সেরা। কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখে না। আর মানুষ এই নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে।

সুরা: আল-বাইয়েনাহ
আয়াত নং :-8
টিকা নং:11,

جَزَآؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنّٰتُ عَدْنٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًا١ؕ رَضِیَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ١ؕ ذٰلِكَ لِمَنْ خَشِیَ رَبَّهٗ۠

তাদের পুরস্কার রয়েছে তাদের রবের কাছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এসব সে ব্যক্তির জন্য যে তার রবকে ভয় করে।১১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) অন্য কথায় যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক এবং তাঁর মোকাবিলায় দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে জীবন যাপন করে না। বরং দুনিয়ায় প্রতি পদে পদে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করে। প্রতি পদক্ষেপে যে ব্যক্তি মনে করে, কোথাও আমি এমন কোনো কাজ তো করে বসিনি যার ফলে আল্লাহ‌ আমাকে পাকড়াও করে ফেলেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে এই প্রতিদান ও পুরস্কার।

ফী জিলালিল কুরআন:

অন্ধকারে আলোর দিশা : এভাবে ইতিপূর্বেও সকল জাতির কাছে তাদের নবীদের মাধ্যমে সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ এসেছিলো ৷ এবারও রসূল (স.)-এর মাধ্যমে এই দলীল-প্রমাণ জীবন্ত অবস্থায় এসেছে। তিনি পবিত্র গ্রন্থ আবৃত্তি করে শুনান এবং মানুষের কাছে সহজ-সরল সুস্পষ্ট আকীদা পেশ করেন। এভাবে মানুষের চলার পথ স্পষ্ট হয়ে যায়। আর যারা ঈমান আনে এবং যারা কুফরী করে উভয়ের পরিণাম অবহিত হওয়া যায়। “নিশ্চয় আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে, তারা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে। তারা সৃষ্টির অধম, নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারা সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম । তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রতিদান হলো চিরস্থায়ী বেহেশ্ত, যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমুহ প্রবাহিত থাকবে৷ সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। এটা তাদের জন্য যারা স্বীয় প্রতিপালককে ভয় করে ।” বস্তুত মোহাম্মদ (স.) শেষ রসূল এবং তিনি যে ইসলাম নিয়ে এসেছেন তা সর্বশেষ আসমানী বিধান । আবহমানকালের নিয়ম ছিলো এই যে, যখনই দুনিয়া অনাচার ও অরাজকতায় ভরে যেতো, অমনি একের পর এক নবীদের আগমন ঘটতো ৷ মানুষকে সততার পথে ফিরিয়ে আনাই ছিলো এর উদ্দেশ্য । পথহারা মানুষকে একের পর এক অবকাশ দেয়া হতো । বর্তমান রেসালাত সর্বশেষ ও পূর্ণাংগ রেসালাত ৷ এটি দ্বারা আল্লাহ্‌ সমস্ত নবুওত ও রেসালাতের সমাপ্তি ঘটাতে চান। সুতরাং সর্বশেষ রেসালাতের ব্যাপারে অবকাশ সীমিত ৷ ইমান আনলে মুক্তি কুফুরী করলে ধ্বংস ৷ কেননা এখন কুফুরী করলে তা হবে সীমাহীন অনাচার ও অকল্যাণের শামিল । আর ঈমান আনলে তা হবে অফুরন্ত কল্যাণের নামান্তর। “নিশ্চয়ই আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে, তারা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে । তারা সৃষ্টির অধম ।” এটা এক অকাট্য ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ৷ এ নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বাদানুবাদের অবকাশ নেই। কুফরীতে লিপ্ত এ সব লোকের ভেতর ব্যক্তিগত পর্যায়ে যতোই ভালো কাজ ও সৎ গুণাবলী এবং সামষ্টিকভাবে যতোই সৎ ও কল্যাণমূলক বিধি ব্যবস্থা, রীতিপ্রথা ও চালচলন থাকুক না কেন, শেষ নবী ও শেষ নবীর বিধানের প্রতি ঈমান না থাকলে তাতে কোনোই ফলোদয় হবে না। এ আয়াতে যে সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে, তা যে কোন ন্যায় ও সৎ গুণবৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেই সন্দেহাতীতভাবে বজায় থাকবে, যদি তা আল্লাহর চিরন্তন ও নিখুঁত বিধানের সাথে সংযোগহীন হয় । ‘নিশ্চয়ই যারা মোমেন ও সৎকর্মশীল, তারা সৃষ্টির সেরা ।’ এটিও একটি অকাট্য ও অনড় ফায়সালা। এতে কোনো বিবাদ বিসম্বাদের অবকাশ নেই। তবে স্পষ্টতই এর জন্যও শর্ত সত্যিকার ঈমান- শুধুমাত্র মুখে ইসলামের বুলি আওড়ানো, মুসলিম দেশে অথবা মুসলিম নামে পরিচিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা কিংবা মুখে ইসলামের বক্তব্য উচ্চারণ করা যথেষ্ট নয়। যে ঈমান বাস্তব জীবনে তার আলামত ও ফল উৎপন্ন করে, সেই ঈমানই আবশ্যক ৷ এজন্যই ‘মোমেন’ শব্দটির সাথেই রয়েছে ‘সংকর্মশীল’। বস্তুত ইসলাম শুধু ঠোট দিয়ে উচ্চারিত কথার নাম নয়। সৎকর্ম বলতে বুঝায় আল্লাহ যা কিছু করার আদেশ দিয়েছেন-চাই তা এবাদাত হোক, চরিত্র হোক, কাজ হোক বা ব্যবহার ও লেনদেন হোক । আর সবচেয়ে বড় ও প্রধান সংকর্ম হচ্ছে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন চালু করা এবং আল্লাহর সেই আইন অনুসারে বিচার-ফায়সালা ও শাসন চালানো । যারা এসব কিছু সহ সৎকর্মশীল, তারাই সৃষ্টির সেরা ৷ ‘তাদের প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের নিকট চিরস্থায়ী বেহেশত, যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত । তারা সেখানে চিরদিন থাকবে ।’ অর্থাৎ মনোরম উদ্যানসমূহ থাকবে এবং তার নেয়ামতসমূহের মধ্যে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করার ব্যবস্থা থাকবে। সেই নেয়ামত কখনো ধ্বংস হবে না ও তার মধ্যকার অবস্থানের মেয়াদ কখনো ফুরাবে না, এ ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা ও গ্যারান্টি রয়েছে। যে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দুনিয়ার জীবনের সকল সুখ-শান্তিকে কন্টকিত করে তোলে, সেই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বেহেশতের নিচ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়াও এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির প্রতীক ৷ কেননা এটা হচ্ছে সৌন্দর্য, সজীবতা ও স্বাচ্ছন্দের আলামত । এরপর এই চিরস্থায়ী নেয়ামতকে আরো এক মাত্রা বা কতক মাত্রা বৃদ্ধি করে চিত্রিত করা হচ্ছে নিম্নোক্ত বাক্যে ‘আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট ৷’ আল্লাহর এই সন্তুষ্টি হচ্ছে সকল নেয়ামতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট নেয়ামত । আর আল্লাহর প্রতি তার সংকর্মশীল বান্দাদের মনে সৃষ্টি হওয়া এই সন্তুষ্টির কারণ এই যে, তিনি তাদের সৎকর্মের মর্যাদা দিয়েছেন, তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও নেয়ামত বিতরণ করেছেন এবং তার সাথে তাদের এই দুর্লভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বস্তুত এই সম্তোষ মানুষের মনকে নিশ্চিন্ততা, নিরাপত্তাবোধ এবং নির্ভেজাল ও সুগভীর আত্মতৃপ্তিতে ভরে দেয়। বস্তুত, ‘আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট’- এই বাক্যটি প্রত্যক্ষভাবে এমন একটি ভাব প্রকাশ করে, যার সমতুল্য ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অন্য কোনো বাক্যের নেই। ‘এটি তারই জন্য যে স্বীয় প্রতিপালককে ভয় করে ।’ এ হচ্ছে মোমেনকে প্রদত্ত এই সূরার সর্বশেষ আশ্বাসবাণী । এ আশ্বাসবাণীতে বলা হচ্ছে যে, ওপরে যে সব মহান প্রতিদান ও অনুগ্রহের কথা বলা হলো, তা শুধুমাত্র আল্লাহর সাথে বান্দার আন্তরিক নিবিড় সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল, সে সম্পর্ক কেমন হবে তাও প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আর আল্লাহকে ভয়ের অনুভূতির ওপরও তা নির্ভরশীল । সে ভীতি এমন হওয়া চাই, যেন তা সততার দিকে মানুষকে চালিত করে এবং বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে বিরত রাখে । এই ভীতির অনুভূতি সকল বাধা সরিয়ে দেয়, সকল আবরণ তুলে দেয় এবং মানুষের মন সরাসরি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে সকল আচরণমুক্ত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। খোদাভীতির এই অনুভূতি মানুষের এবাদাতকে খালেস ও নির্ভেজাল হতে সাহায্য করে এবং তাকে সব রকমের লোক দেখানোর মনোবৃত্তি ও সর্ব প্রকারে শিরিক থেকে মুক্ত রাখে। যে ব্যক্তি যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করে, তার হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কারো বিন্দুমাত্র প্রভাব থাকতে পারে না। কেননা সে জানে যে, বান্দা যদি আল্লাহর সাথে সাথে আর কারো সন্তুষ্টির আশা নিয়ে কোনো এবাদাত করে, তবে তা কবুল হয় না৷ আল্লাহর কাছে শিরিক হচ্ছে সবচেয়ে বেশী বিরক্তিকর অপছন্দনীয় জঘন্য, ও অমার্জনীয় অপরাধ ৷ কাজেই একমাত্র তার জন্য এবাদাত করতে হবে ৷ নচেৎ তিনি তা গ্রহণ করবেন না। ওপরে সেই চারটি প্রধান সত্য বর্ণনা করা হলো, যা এই ক্ষুদ্র সূরার বক্তব্যের সমষ্টি । পবিত্র কোরআন এগুলো নিজস্ব ভংগিতে বর্ণনা করেছে। এ ধরনের ক্ষুদ্র সূরাগুলোতে কোরআনের এই ভংগিটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

নামকরণ ও গুরুত্ব:

الْبَيِّنَةُ অর্থ সুস্পষ্ট প্রমাণ, দলীল ইত্যাদি। অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও এ সূরাকে সূরা “লাম ইয়াকুন” বলা হয়।

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উবাই বিন কাব (রাঃ)-কে বললেন : আল্লাহ তা‘আলা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি যেন তোমাকে “লাম ইয়াকুনিল্লাযীনা কাফারু” পাঠ করে শুনাই। উবাই (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন : আল্লাহ তা‘আলা কি আপনার কাছে আমার নাম উল্লেখ করেছেন? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : হ্যাঁ, উবাই খুুশিতে কেঁদে ফেললেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৫৯)

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : এর মধ্যে ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের শিক্ষাদানের তাৎপর্যগত বিষয়টি ফুঠে উঠেছে। অন্য বিদ্বান বলেন : এর মধ্যে এ শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, কেউ নিম্নস্তরের কাউকে শিক্ষাদানে যেন কুণ্ঠাবোধ না করে।

১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর:

(أَهْلِ الْكِتٰبِ) আহলে কিতাব দ্বারা ইয়াহূদ ও খ্রিস্টানরা উদ্দেশ্য যারা আসমানী কিতাব পেয়েছিল।

الْمُشْرِكِيْنَ মুশরিক দ্বারা উদ্দেশ্য প্রত্যেক উম্মতের মুশরিক যারা মূর্তি ও অগ্নিপূজক।

مُنْفَكِّيْنَ অর্থ : تاركين অর্থাৎ ইয়াহূদী, খ্রিস্টান ও আরব-অনারব মুশরিকদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসা পর্যন্ত সর্বদা কুফর ও পথভ্রষ্টতার মধ্যে লিপ্ত ছিল। এখানে সুস্পষ্ট প্রমাণ বলতে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যেসব প্রমাণের ওয়াদা দেয়া হয়েছিল তা। যেমন পরের আয়াতেই আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন।

(رَسُوْلٌ مِّنَ اللّٰهِ) অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে।

(صُحُفًا مُّطَهَّرَةً) পবিত্র গ্রন্থ দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে যা লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(صُحُفٍ مُّکَرَّمَةٍﭜمَّرْفُوْعَةٍ مُّطَھَّرَةٍۭﭝبِاَیْدِیْ سَفَرَةٍﭞ کِرَامٍۭ بَرَرَةٍ)

“তা সম্মানিত কিতাবে (লাওহ মাহফূজে) লিপিবদ্ধ যা উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ও পবিত্র। এমন লেখকদের হাতে থাকে যারা সম্মানিত ও সৎ।” (সূরা ‘আবাসা ৮০ : ১৩-১৬)

(فِيْهَا كُتُبٌ قَيِّمَةٌ)

অর্থাৎ এ সব পবিত্রগ্রন্থে রয়েছে সত্য সংবাদ ও ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ যা সত্যের ও সঠিক পথের দিকে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।

(وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتٰبَ)

অর্থাৎ আহলে কিতাবগণ মুহাম্মাদ (সাঃ) যে সত্য নাবীÑএ ব্যাপারে তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরেই মতানৈক্য করেছে। এর পূর্বে তারা নাবী (সাঃ)-এর নবুওয়াতের ব্যাপারে একমত ছিল। যখন নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) আগমন করলেন তখন তারা অস্বীকার করল। মূলত এর কারণ হলো নাবী (সাঃ) তাদের ঘৃণ্য আশানুপাতে হয়নি। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْم بَعْدِ مَا جَا۬ءَهُمُ الْبَيِّنٰتُ ط وَأُولٰ۬ئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ)‏

“তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তাদের কাছে প্রমাণ আসার পর মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। (আল ইমরান ২: ১০৫)

(وَمَآ أُمِرُوْآ إِلَّا لِيَعْبُدُوا) এ কথাটি তেমন যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:

(وَمَآ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِکَ مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا نُوْحِیْٓ اِلَیْھِ اَنَّھ۫ لَآ اِلٰھَ اِلَّآ اَنَا فَاعْبُدُوْنِ)

“আমি তোমার পূর্বে যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ ওয়াহী করেছি যে, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর‎।’ (আম্বিয়া ২১ : ২৫)

حنيف শব্দের অর্থ হলো : ঝুঁকে যাওয়া, কোন একটি কাজের প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া। حُنَفَا۬ءَ শব্দটি তার বহুবচন। অর্থাৎ যারা শির্ক থেকে তাওহীদের প্রতি এবং সমস্ত দীন বর্জন করে কেবলমাত্র দীন ইসলামের প্রতি ঝুঁকে ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে।

(ذٰلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَة)

অর্থাৎ তাওহীদের সাথে একনিষ্ঠভাবে সকল ইবাদত সম্পাদন করার ধর্মই একমাত্র সঠিক ধর্ম, যা জান্নাতের পথে পৌঁছে দেয়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. পূর্ববর্তী দীনগুলোতে হকের সাথে বাতিল সংমিশ্রণ করা হয়েছিল।
২. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আহলে কিতাবের বর্র্ণনানুপাতে আসার পরেও তারা অহংকারবশত তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩. সকল দীনের মূলমন্ত্র ছিল একই, তা হলো এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা।
৬-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ তা‘আলা দুশ্রেণির মানুষের বিবরণ তুলে ধরছেন। একশ্রেণি সৃষ্টি জীবের মধ্যে নিকৃষ্ট, তারা হলো আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে। আর অপর শ্রেণি হলো সৃষ্টি জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যারা ঈমান আনয়ন করতঃ সৎ আমল করেন। এদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সন্তুষ্ট।

(ذٰلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّه۫)

অর্থাৎ উপরোক্ত উত্তম প্রতিদান তাদের জন্য যারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে পাপ কাজ বর্জন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّه۪ وَنَهَي النَّفْسَ عَنِ الْهَوٰي فَإِنَّ الْـجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوٰي ‏)‏‏

“পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় রেখেছে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রেখেছে, অবশ্যই তার ঠিকানা হবে জান্নাত।” (সূরা নাযিআত ৭৯: ৪০-৪১)

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৎবান্দাদের মধ্যে শামিল করে নিন। আমীন!

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সর্বোত্তম ও সর্ব নিকৃষ্ট দু’শ্রেণির মানুষের বিবরণ জানলাম।
২. সর্বোত্তম ও সর্ব নিকৃষ্ট হওয়ার কারণও জানতে পারলাম।
৩. যারা সৎ আমলকারী তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে যে প্রতিদান রয়েছে সে কথা জানতে পারলাম।

তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
মুসনাদে আহমাদে হযরত আমর ইবনু সাবিত আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ যখন (আরবি) সূরাটি শেষ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয় তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে এ সূরাটি হযরত উবাই (রাঃ)-এর নিকট পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত উবাই (রাঃ)-কে এ কথা জানানোর পর হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সেখানে কি আমার কথা আলোচিত হয়েছে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “হ্যা, হ্যাঁ।” হযরত উবাই (রাঃ) তখন কেঁদে ফেললেন।

মুসনাদেরই অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত উবাই (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহ্র রাসূল (সঃ)! আল্লাহ্ তা’আলা কি আমার নাম উচ্চারণ করেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে হ্যা’ বললেন। তখন হযরত উবাই (রাঃ) কেঁদে ফেললেন। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ)ও বর্ণনা করেছেন)

মুসনাদে আহমাদের অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, যে সময় হযরত উবাই (রাঃ) এ ঘটনাটি বর্ণনা করেন সে সময় বর্ণনাকারী হযরত উবাই (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে আবু মুনযির (রাঃ)! তাহলে তো আপনি খুবই আনন্দিত হয়েছেন?” উত্তরে হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ কেন আনন্দিত হবে না? আল্লাহ্ রাম্বুল আলামীন স্বয়ং বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তুমি বলে দাওঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা লাভ করে যেন তারা আনন্দিত হয়। এটা তারা যা পুঞ্জীভূত করে তার চেয়ে বহুগুণে উত্তম।” (১০:৫৮)

অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত উবাই (রাঃ)-এর সামনে এ সূরাটি পড়ার পর পাঠ করেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আদম সন্তান যদি একটা উপত্যকা পূর্ণ মাল যাঞ্চা করে, অতঃপর তাকে তা দেয়া হয় তবে অবশ্যই সে দ্বিতীয়টির জন্যে প্রার্থনা করবে, সেটাও যদি তাকে প্রদান করা হয় তবে সে তৃতীয়টির জন্যে প্রার্থনা করবে। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ভরবে না। তবে যে তাওবা করবে আল্লাহ্ তার তাওবা কবুল করবেন। আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তিই দ্বীনদার যে একাগ্রচিত্তে তাঁর ইবাদত করে। তবে সে মুশরিক, ইয়াহুদী এবং নাসারা হতে পারবে না। যে ব্যক্তি কোন পুণ্য কাজ করবে তার অমর্যাদা করা হবে না।” (জামে তিরমিযীতেও বর্ণনাটি রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)

হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আবুল মুনযির (রাঃ)! আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি যেন তোমার সামনে কুরআন পাঠ করি।” হযরত উবাই (রাঃ) তখন বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি, আপনার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং আপনার কাছে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেছি।” নবী করীম (সঃ) ঐ কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। হযরত উবাই (রাঃ) তখন আর করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার কথা কি সেখানে আলোচনা করা হয়েছে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা, তোমার নাম ও নসব এ সবই মালায়ে আ’লায় আলোচিত হয়েছে।” হযরত উবাই (রাঃ) তখন বললেনঃ “তা হলে পাঠ করুন!” (এ হাদীসটি হাফিজ আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ পদ্ধতিতে এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল। পূর্বে যেটা বর্ণনা করা হয়েছে সেটাই প্রমাণিত)

এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে হযরত উবাই (রাঃ)-এর মানসিক দৃঢ়তা এবং ঈমান বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর সামনে এ সূরাটি পাঠ করেছিলেন।

মুসনাদে আহমদ, সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ এবং সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, একবার হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআত শুনে হযরত উবাই (রাঃ) অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কেননা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে তিনি যেমনভাবে এ সূরার কিরআত শুনেছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) তেমনভাবে পড়েননি। রাগতভাবে হযরত উবাই হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) উভয়ের কিরআত শুনে বলেনঃ “উভয়ের কিরআতই বিশুদ্ধ।” হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ আমি এ কথা শুনে এমন সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেলাম যে, যেন অজ্ঞতার যুগের সন্দেহ আমার সামনে এসে গেল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ অবস্থা দেখে আমার বুকে হাত রাখলেন। আমার বুক ঘামে ভিজে গেল। আমার উপর এমন ভয় চাপলো যে, যেন আমি রাম্বুল আলামীন আল্লাহকে সামনে দেখতে পাচ্ছি। নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “শোনো, হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার সামনে এসেছিলেন। তিনি বললেনঃ “উম্মতকে একই কিরআতে কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্যে আল্লাহ। তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন।’ আমি বললামঃ আমি আল্লাহ্ তা’আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং মাগফিরাত কামনা করছি। অতঃপর আমাকে দু’প্রকারের কিরআতের অনুমতি প্রদান করা হলো। কিন্তু আমি আরো বাড়ানোর আবেদন জানালাম। অবশেষে সাত প্রকারের কিরআত পাঠের অনুমতি দেয়া হলো।” অতঃপর এ সূরা নাযিল হলো এবং এতে রয়েছেঃ (আরবি)

নবী করীম (সঃ) মানসিক দৃঢ়তার শিক্ষা দান এবং সতর্ককরণের উদ্দেশ্যে হযরত উবাই (রাঃ)-কে এ সূরাটি তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দেন। কেউ যেন এটা মনে না করে যে, শিখবার ও মনে রাখবার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত উবাই (রাঃ)-এর সামনে এ সূরাটি তিলাওয়াত করেছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) একাধিক কিরআতের মাধ্যমে কুরআন কারীম পাঠ করায় হযরত উবাই (রাঃ)-এর মনে যে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল তা নিরসন কল্পেই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এই সূরাটি হযরত উবাই (রাঃ)-কে পাঠ করে শোনান। হযরত উমর (রাঃ)-এর ঘটনাও একই ধরনের। তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির বছরে সন্ধির ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিলঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি কি বলেননি যে, আমরা কা’বা শরীফে যাবো এবং তাওয়াফ করবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “হ্যা, তা বলেছিলাম বটে, কিন্তু এটা তো বলিনি যে এ বছরই এটা হবে? নিঃসন্দেহে সে সময় আসছে যখন তুমি সেখানে পৌছবে ও তাওয়াফ করবে।” হুদাইবিয়া হতে ফিরবার পথে সূরা ফাতহ নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত উমর (রাঃ)-কে ডেকে সূরাটি পড়ে শোনালেন। তাতে নিম্নের আয়াতটিও ছিলঃ (আরবি)

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল (সঃ)-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে।” (৪৮:২৭)

হাফিয আবু নাঈম (রাঃ) তাঁর (আরবি) নামক গ্রন্থে একটি হাদীস সংযোজন করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা (আরবি) এ সূরাটির কিরআত শুনে বলেনঃ “হে আমার বান্দা! তুমি খুশী হয়ে যাও, আমার মর্যাদার শপথ! তোমাকে জান্নাতে এমন বাসস্থান দিবো যে, তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। (এ হাদীসটি উসূলে হাদীসের পরিভাষায় নিতান্ত গারীব বা দুর্বল)

হযরত মাতার আলমুযানী অথবা মাদানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা (আরবি) এ সূরাটির কিরআত শুনে। বলেনঃ আমি তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে কোন অবস্থাতেই বিস্মৃত হবো না এবং তোমাকে জান্নাতে এমন বাসস্থান দান করবো যাতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।” (আবু মূসা আলমাদানী (রঃ) এবং ইবনুল আমীর (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

১-৫ নং আয়াতের তাফসীর

আহলে কিতাব দ্বারা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বুঝানো হয়েছে। আর মুশরিকীন দ্বারা বুঝানো হয়েছে মূর্তি পূজক আরব এবং অগ্নিপূজক অনারবদেরকে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তারা প্রত্যাবর্তনকারী ছিল না যে পর্যন্ত তাদের সামনে সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়।

আল্লাহর কোন একজন রাসূল যিনি পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করে শুনিয়ে দেন, যাতে আছে সঠিক বিধান, এর দ্বারা কুরআন কারীমের কথা বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “ওটা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন, পবিত্র, মহান, পূতঃচরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ।” (৮০:১৩-১৬)

সঠিক বিষয়সমূহ লিপিবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভুল-ভ্রান্তি হয়নি।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, নবী করীম (সঃ) উত্তমভাবে কুরআনের ওয়ায করেন এবং কুরআনের সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এ সব সহীফায় সত্য ন্যায়ের কথা সম্বলিত বিষয়সমূহ রয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আর যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছিল তাদের নিকট এই স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হওয়ার পরই তারা বিভক্ত হয়ে গেল। যেমন বিভিন্নভাবে বর্ণিত একটি হাদীসে রয়েছেঃ “ইয়াহুদীরা একাত্তর ফিরকা বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে গেল, আর নাসারারা বা খ্রিস্টানরা বিভক্ত হলো বাহাত্তর ফিরকায়। এই উম্মতে মুহাম্মদী (সঃ) তিয়াত্তর ফিরকায় বিভক্ত। তার মধ্যে একটি মাত্র ফিরকা ছাড়া সবাই জাহান্নামে যাবে।” জনগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তারা কারা?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আমি এবং আমার সাহাবীগণ যে আদর্শের উপর রয়েছি (এই আদর্শের উপর যারা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।)।”

আল্লাহ তাআলা এরপর বলেনঃ অথচ তাদের প্রতি এই নির্দেশই ছিল যে, তারা আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমার পূর্বে আমি যতো রাসূল পাঠিয়েছি সবারই কাছে এই অহী করেছি যে, আমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো।” (২১:২৫) এখানেও আল্লাহ পাক বলেনঃ একনিষ্ঠ হয়ে অর্থাৎ শিরক হতে দূরে থেকে এবং তাওহীদ বা একত্ববাদে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে ইবাদত করো। যেমন অন্যত্র বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। (সেই কথা বলার জন্যে যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত করো এবং তাগূত হতে দূরে থাকো।” (১৬:৩৬)

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “তারা নামায কায়েম করবে ও যাকাত দিবে, এটাই সঠিক দ্বীন।’ যাকাত দিবে এর অর্থ এই যে, ফকীর মিসকীন এবং অভাবগ্রস্তদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। এই দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম মযবূত, সরল, সহজ এবং কল্যাণধর্মী। বহু সংখ্যক ইমাম যেমন ইমাম যুহরী (রঃ), ইমাম শাফিয়ী (রঃ) প্রমুখ এ আয়াত থেকে প্রমাণ পেশ করেছেন যে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এই আয়াতের সরলতা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর ইবাদত, নামায আদায় ও যাকাত প্রদানকেই দ্বীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৬-৮ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের পরিণাম বর্ণনা করছেন যে, কাফির, ইয়াহুদী, নাসারা, মুশরিক, আরব ও অনারব যেই হোক না কেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরোধ এবং আল্লাহর কিতাবকে অবিশ্বাস করে তারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে, সেখানেই তারা চিরকাল অবস্থান করবে। কোন অবস্থাতেই তারা সেখান থেকে ছাড়া বা রেহাই পাবে না। এরাই নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।

এরপর আল্লাহ তা’আলা পুণ্যবান বান্দাদের পরিণাম সম্পর্কে বলেনঃ নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে এবং ভাল কাজ করেছে তারাই উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি। এ আয়াত থেকে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং একদল আলেম ব্যাখ্যা করেন। যে, ঈমানদার মানুষ আল্লাহর ফেরেশতাদের চেয়েও উৎকৃষ্টতর। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তাদের প্রতিদান স্বরূপ তাদের প্রতিপালকের নিকট সর্বদা অবস্থানের জান্নাতসমূহ রয়েছে যেগুলোর নিম্নদেশে নহর সমূহ বইতে থাকবে। সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। এটা ঐ ব্যক্তির জন্যে যে নিজের প্রতিপালককে ভয় করে অর্থাৎ যার মনে আল্লাহ তাআলার প্রতি ভয় ভীতি রয়েছে। ইবাদত করার সময় যে মন প্রাণ দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে, এমনভাবে ইবাদত করে যেন চোখের সামনে রাব্বল আলামীন আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে। যে রাব্বল আলামীন সব কিছুরই মালিক এবং যিনি সর্বশক্তিমান।

মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বোত্তম সৃষ্ট জীব কে এ সংবাদ কি আমি তোমাদেরকে দিবো না?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদেরকে আপনি এ খবর দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “আল্লাহর সৃষ্ট মানুষের মধ্যে ঐ মানুষ সবচেয়ে উত্তম যে জিহাদের ডাক শোনার জন্যে ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে, যেন শোনা মাত্রই ঘোড়ায় আরোহণ করতে পারে এবং শত্রুদলে প্রবেশ করে বীরত্বের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়। এবার আমি তোমাদেরকে এক উৎকৃষ্ট সৃষ্টির সংবাদ দিচ্ছি। যে ব্যক্তি নিজের বকরীর পালের মধ্যে অবস্থান করা সত্ত্বেও নামায আদায় করতে এবং যাকাত দিতে কৃপণতা করে। এবার তোমাদেরকে এক নিকৃষ্ট সৃষ্টির সংবাদ দিচ্ছি। সে হলো ঐ ব্যক্তি যে (কোন অভাবগ্রস্তকে) আল্লাহর নামে কিছু চাওয়ার পর কিছু না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়।”

Leave a Reply