Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২১৩/ হে মানুষ:-২১) [# মানুষের চিরন্তন স্বভাব:-] www.motaher21.net সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:- পারা:৩০ ১- ১১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- # তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:- # তাফসীরে ইবনে কাছীর:- #তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- #তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১৩/ হে মানুষ:-২১)
[# মানুষের চিরন্তন স্বভাব:-]
www.motaher21.net
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-
পারা:৩০
১- ১১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-১
وَ الۡعٰدِیٰتِ ضَبۡحًا ۙ﴿۱﴾
শপথ ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান অশ্বরাজির।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-২
فَالۡمُوۡرِیٰتِ قَدۡحًا ۙ﴿۲﴾
অতঃপর যারা ক্ষুরের আঘাতে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত করে ।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৩
فَالۡمُغِیۡرٰتِ صُبۡحًا ۙ﴿۳﴾
তারপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় প্রভাতকালে।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৪
فَاَثَرۡنَ بِہٖ نَقۡعًا ۙ﴿۴﴾
ফলে তারা তা দ্বারা ধূলি উৎক্ষিপ্ত করে ;
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৫
فَوَسَطۡنَ بِہٖ جَمۡعًا ۙ﴿۵﴾
এবং এ অবস্থায় কোন জনপদের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৬
اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لِرَبِّہٖ لَکَنُوۡدٌ ۚ﴿۶﴾
অবশ্যই মানুষ তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৭
وَ اِنَّہٗ عَلٰی ذٰلِکَ لَشَہِیۡدٌ ۚ﴿۷﴾
এবং নিশ্চয়ই সে নিজেই এ বিষয়ে সাক্ষী।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৮
وَ اِنَّہٗ لِحُبِّ الۡخَیۡرِ لَشَدِیۡدٌ ؕ﴿۸﴾
এবং অবশ্যই সে ধন-সম্পদের আসক্তিতে অত্যন্ত প্রবল।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-৯
اَفَلَا یَعۡلَمُ اِذَا بُعۡثِرَ مَا فِی الۡقُبُوۡرِ ۙ﴿۹﴾
তবে কি সে সেই সময়ের কথা জানে না যখন কবরের মধ্যে যা কিছু (দাফন করা) আছে সেসব বের করে আনা হবে।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-১০
وَ حُصِّلَ مَا فِی الصُّدُوۡرِ ﴿ۙ۱۰﴾
এবং অন্তরে যা আছে, তা প্রকাশ করা হবে।
সুরা: ১০০:আল্ -আদিয়াত:-১১
اِنَّ رَبَّہُمۡ بِہِمۡ یَوۡمَئِذٍ لَّخَبِیۡرٌ ٪﴿۱۱﴾
নিশ্চয় তাদের রব সেদিন তাদের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত ।

১- ১১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:

الْعٰدِيٰتِ হলো عادية এর বহুবচন। এর মূল ধাতু হলো عدو। যেমন غزو ধাতু হতে غازيات শব্দ থেকে এসেছে। মূল শব্দের و কে ى দ্বারা পরির্বতন করা হয়েছে। এর অর্থ : ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান অশ্ব বা ঘোড়া। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

সূরায় মানুষের আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও সে ধন-সম্পদের মায়ায় অন্ধ এবং আখিরাতে তার জবাবদিহিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরার সূচনাতেই আল্লাহ তা‘আলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুদক্ষ ও মালিকের আনুগত্যশীল অশ্বের শপথ করেছেন যেসব অশ্ব দুঃসাহসিকতার সাথে শত্রুপক্ষের ওপর হামলা করে। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, অবলা চতুষ্পদ জন্তু সর্বদা মালিকের কথা মেনে চলে কিন্তু মানুষ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের প্রতি আনুগত্যশীল হয় না।

ضبح শব্দের অর্থ হলো : হাঁপানো, ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : ঘোড়া যখন দৌড়ায় তখন যে আওয়াজ করে সে আওয়াজকে ضبح বলা হয়। (ইবনু কাসীর)

উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা সেই ঘোড়ার শপথ করেছেন যে ঘোড়া দৌড়ে গিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ করে।

الْمُوْرِيٰتِ শব্দটির উৎপত্তি ايراء থেকে, অর্থ : অগ্নি প্রজ্জ্বলনকারী। قدح শব্দের অর্থ : চলাচল কালে হাঁটু বা গোড়ালির সংঘর্ষ হওয়া অথবা ক্ষুর দ্বারা আঘাত করা। অর্থ হলো : সে ঘোড়ার শপথ, যার ক্ষুরের ঘর্ষণে পাথর থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয়।

الْمُغِيْرٰتِ শব্দটি يغير-أغار থেকে এসেছে, অর্থ হলো : হামলা করা। صبح অর্থ : সকাল, প্রভাত। অর্থ হলো : সকালে আক্রমণকারী ঘোড়ার শপথ। ইসলামে বিধান হলো কোন বসতি বা দেশের মানুষকে সতর্ক করার পরেও ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করলে বা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করলে তাদের ওপর রাতে আক্রমণ করা যাবে না। বরং দেখতে হবে সেখানে ফজরের আযান হয় কিনা, আযান না হলে বিসমিল্লাহ বলে হামলা করবে। আরবরা সাধারণত সকালেই হামলা করত।

أَثَرْنَ শব্দটির মূল ক্রিয়া হলো : أثار। অর্থ হলো : উৎক্ষিপ্ত করা, অবশিষ্ট অংশ। نفع শব্দের অর্থ : ধূলোবালি। অর্থাৎ যখন দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটে যায় অথবা হামলা করে তখন সে স্থান ধূলোবালিতে একাকার হয়ে যায়।

وسطن শব্দটি وسط থেকে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ : মাঝে, মধ্যে। جَمْعًا একত্র করা এখানে উদ্দেশ্য সেনা দলের সমষ্টি। অর্থাৎ যে ঘোড়াসমূহ সৈন্যদলের মাঝে প্রবেশ করে হামলা করে।

لَكَنُوْدٌ পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা যে শপথ করেছেন এ আয়াত হতে তার জবাব শুরু। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা প্রাগুক্ত বিষয়গুলোর শপথ করে বলছেন : নিশ্চয়ই মানুষ তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। ফলে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের অবাধ্য হওয়াটাই যেন মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوْعًا إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوْعًا وَّإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوْعًا) ‏

“নিশ্চয়ই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্থিরমনারূপে; যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় অতি কৃপণ; (সূরা মা‘আরিজ ৭০: ১৯-২১) অতএব আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া এক বড় ধরণের গুনাহ। এ থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

(وَإِنَّه عَلٰي ذٰلِكَ لَشَهِيْدٌ)

অর্থাৎ মানুষ তার অকৃতজ্ঞতার ব্যাপারে নিজেই সাক্ষ্য দেয়। অনেকে এখানে إِنَّه দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে বুঝিয়েছেন, কিন্তু প্রথমটাই সঠিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(يَّوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيْهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ‏)‏

“যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত‎ ও তাদের চরণ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে” (সূরা নূর ২৪: ২৪)

خَيْرِ দ্বারা ধন-সম্পদ উদ্দেশ্য। যেমন সূরা বাক্বারাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(کُتِبَ عَلَیْکُمْ اِذَا حَضَرَ اَحَدَکُمُ الْمَوْتُ اِنْ تَرَکَ خَیْرَاﺊ اۨلْوَصِیَّةُ لِلْوَالِدَیْنِ وَالْاَقْرَبِیْنَ بِالْمَعْرُوْفِﺆ حَقًّا عَلَی الْمُتَّقِیْنَ)

“তোমাদের ওপর এ বিধান দেয়া হল যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় সে যদি কোনো ধন-সম্পত্তি রেখে যায় তাহলে সে যেন ইনসাফের ভিত্তিতে মাতা-পিতা ও আত্মীয়দের জন্য অসিয়ত করে যায়। মুত্তাক্বীদের জন্য এটা কর্তব্য।” (সূরা বাক্বারাহ ২: ১৮০)

মূলত এখানে মানুষের সম্পদের প্রতি এ আসক্তিকে নিন্দা জানানো হয়েছে।

(أَفَلَا يَعْلَمُ إِذَا بُعْثِرَ مَا فِي الْقُبُوْرِ)

অর্থাৎ মানুষ কি দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, কবরে যা আছে তথা মানুষকে হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত হতে হবে? বরং প্রত্যেক আত্মাকে পুনরুত্থিত হতে হবে। এতে কোন সংশয় নেই।

حُصِّلَ অর্থ হলো: অন্তরে যা কিছু গোপন আছে তা প্রকাশ করে দেয়া হবে। এখানে সবাইকে অন্তরের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে বিশেষ করে মুনাফিকদেরকে, কারণ তারা দুনিয়াতে মু’মিনদের মতই আচরণ প্রকাশ করে থাকে। ফলে প্রকৃত সত্য বা অবস্থা জানা যায় না। তাই আল্লাহ তা‘আলা মনের কথা প্রকাশ করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরবেন।

(إِنَّ رَبَّهُمْ بِهِمْ)

অর্থাৎ মানুষ প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে যা কিছু করে সব কিছু সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অবগত। তিনি তাদের ভাল মন্দ কর্মের পুরোপুরি প্রতিদান প্রদান করবেন। সূরায় জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা ও জিহাদের সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করার প্রতিও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. জিহাদ ও তার সরঞ্জামাদী তৈরি করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
২. মানুষের চিরন্তন স্বভাব, তারা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়।
৩. অধিকাংশ মানুষই পার্থিব সম্পদের প্রতি মোহিত।

# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-১১ নং আয়াতের তাফসীর

মুজাহিদের ঘোড়া যখন আল্লাহর পথে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এবং হ্রেষাধ্বনি দিতে দিতে দৌড়ায়, আল্লাহ তা’আলা ঐ ঘোড়ার শপথ করছেন। তারপর শপথ করছেন, ঐ ঘোড়াসমূহের যারা পদাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত করতে থাকে। তারপর প্রভাতকালে অভিযান শুরু করে। অনন্তর ধুলি উড়ায়, তারপর শত্রুদলে ঢুকে পড়ে।

রাসূলুল্লাহর (সঃ) পবিত্র অভ্যাস ছিল এই যে, তিনি শত্রু বেষ্টিত কোন জনপদে গমন করলে সেখানে রাত্রে অবস্থান করে আযানের শব্দ কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করতেন। আযানের শব্দ কানে এলে তিনি থেমে যেতেন, আর তা কানে না এলে তিনি সঙ্গীয় সৈন্যদেরকে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিতেন।

অতঃপর সেই ঘোড়াসমূহের ধুলি উড়ানো এবং শত্রু দলের মধ্যে প্রবেশকরণের শপথ করে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা প্রকৃত প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন।

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি)এর অর্থ হলো উট। হযরত আলী (রাঃ) এ কথাই বলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ শব্দের অর্থ হলো ঘোড়া। হযরত আলী (রাঃ) এটা শোনার পর বলেনঃ “বদরের দিন আমাদের সাথে ঘোড়া ছিল কোথায়? ঘোড়া তো ছিল সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে যা শত্রুদের খবরের জন্যে বা ছোট খাট ব্যাপারে পাঠানো হয়েছে।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) একদা হাতিমে বসেছিলেন এমন সময় একজন লোকে এসে তাঁর কাছে এ আয়াতের তাফসীর জানতে চাইলো। তিনি লোকটিকে বললেনঃ “এর অর্থ হলোঃ মুজাহিদদের ঘোড়াসমূহ, যেগুলো যুদ্ধের সময় শক্রদের উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। তারপর রাত্রিকালে সেই ঘোড়ার আরোহী মুজাহিদ নিজের শিবিরে এসে খাবার রান্নার জন্যে আগুন জ্বালিয়ে বসে।” লোকটি এ জবাব শুনে হযরত আলীর (রাঃ) কাছে গেল। হযরত আলী (রাঃ) ঐ সময় জনগণকে যমযমের পানি পান করাচ্ছিলেন। লোকটি হযরত আলী (রাঃ)-এর কাছেও একই প্রশ্ন করলো। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ “আমার পূর্বে তুমি এটা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করেছো কি?” জবাবে লোকটি বললেনঃ “হ্যা, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছেন যে, এর অর্থ হলোঃ মুজাহিদদের ঘোড়া, যেগুলো যুদ্ধের সময় শত্রুদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে ধাবিত হয়।” হযরত আলী (রাঃ) তখন লোকটিকে বললেনঃ “যাও, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এলে হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ তুমি না জেনে মানুষকে ফতোয়া দিচ্ছ? আল্লাহর কসম! ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমাদের। সাথে মাত্র দুটি ঘোড়া ছিল। একটি হ্যরত যুবায়ের (রাঃ)-এর এবং অন্যটি হযরত মিকদাদ (রাঃ)-এর। কাজেই(আরবি) এ যুদ্ধ হতে পারে কি করে? এখানে আরাফাত থেকে মুযদালাফার দিকে যাওয়া এবং মুযদালাফা থেকে মিনার দিকে যাওয়ার কথাই বুঝানো হয়েছে।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন “এ কথা শুনে আমি আমার প্রথম কথা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। হযরত আলী (রাঃ) যা বলেছেন সেটাই আমিও বলতে শুরু করেছি।” মুযদালাফায় পৌঁছে হাজীরাও নিজেদের হাঁড়িতে রুটি তৈরীর জন্যে আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। মোটকথা হযরত আলী (রাঃ)-এর বক্তব্য হলো:(আরবি) দ্বারা উটকে বুঝানো হয়েছে। ইব্রাহীম (রঃ), উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও একথাই বলেছেন। পক্ষান্তরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত আতা (রঃ) এবং হযরত যহহাক (রঃ) বলেছেন যে, এখানে ঘোড়াকেই বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন। উপরন্ত হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), এবং হযরত আতা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) অর্থাৎ হাঁপাননা, ঘোড়ার ও কুকুর ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, হাঁপানোর সময় তাদের মুখ থেকে যে উহ্ উহ্ শব্দ বের হয় ওটাকেই (আরবি) বলে।

পরবর্তী আয়াতের অর্থ হলো ঐ সব ঘোড়ার পা পাথরের সাথে ঘর্ষণ লেগে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হওয়া। অন্য একটি অর্থ হচ্ছেঃ ঐ ঘোড়ার আরোহীর যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা। আবার যুদ্ধের সময় ধােকা বা প্রতারণা অর্থেও এটা ব্যবহৃত হয়েছে। কারো কারো মতে এর অর্থ হলোঃ রাত্রিকালে নিজেদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে আগুন জ্বালানো এবং মুযদালাফায় হাজীদের মাগরিবের পর পৌঁছে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ আমার মতে সবচেয়ে নির্ভুল এবং যথার্থ বক্তব্য হলোঃ ঘোড়ার পা এবং ক্ষুরের পাথরের সাথে ঘর্ষণ লেগে আগুন সৃষ্টি করা। তারপর সকাল বেলায় মুজাহিদদের শত্রুদের উপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। যারা এ শব্দের অর্থ উট বলেছেন তারা বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সকাল বেলায় মুযদালাফা হতে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। তারপর সবাই একটা কথার উপর একমত যে, যেই স্থানে তারা অবতরণ করেছেন, যুদ্ধের জন্যেই হোক অথবা হজ্বের জন্যেই হোক, তারা ধূলি উড়িয়ে পৌঁছেছেন। তারপর মুজাহিদীনের শত্রু শিবিরে পৌঁছে যাওয়া। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, সবাই একত্রিত হয়ে মধ্যবর্তী স্থানে হাযির হওয়া।

এ ব্যাপারে আবু বকর বাযযার (রঃ) একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উসূলে হাদীসের পরিভাষায় হাদীসটিকে গারীব বা দুর্বল বলা হয়েছে। ঐ হাদীসটিতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি সৈন্যদল পাঠান। কিন্তু একমাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের কোন খবর আসেনি। এই সময়ে এই আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। এতে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে ঐ মুজাহিদদের কথা বলা হয়েছে যাদের ঘোড়া হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছে। তাদের পদাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়েছে। সকাল বেলা তারা শত্রুদলের উপর পূর্ণ বিক্রমের সাথে আক্রমণ করেছে। তাদের ক্ষুর থেকে ধূলি উড়ছিল। তারপর তারা জয়লাভ করতঃ সবাই একত্রিত হয়ে অবস্থান করেছে।

এসব শপথের পর এবার যে উদ্দেশ্যে শপথ করা হয়েছে আল্লাহ সে সব ব্যক্ত করছেন। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ এবং সে এটা নিজেও জানে। কোন দুঃখ কষ্ট ভোগ করলে সে দিব্যি মনে রাখে, কিন্তু আল্লাহ তা’আলার বেহিসাব নিয়ামতের কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে একটি হাদীস রয়েছে যে, (আরবি) তাকে বলা হয় যে একাকী খায়, ভৃত্যদেরকে প্রহার করে এবং কারো সাথে ভাল ব্যবহার করে না। তবে এ হাদীসের সনদ উসূলে হাদীসের পরিভাষায় দুর্বল ।

এরপর আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ আল্লাহ্ অবশ্যই সেটা অবহিত আছেন। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, এটা সে নিজেও অবহিত আছে। তার অকৃতজ্ঞতা কথা ও কাজে প্রকাশ পায়। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “মুশরিকরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী স্বীকার করে তখন তারা আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন হতে পারে না।” (৯:১৭)।

অতঃপর আল্লাহপাক বলেনঃ অবশ্যই সে ধন সম্পদের আসক্তিতে প্রবল। তার কি ঐ সময়টির কথা জানা নেই যখন কবরে যা আছে তা উথিত হবে? অর্থাৎ তার ধন সম্পদের মোহ খুব বেশী! সেই মোহে পড়ে সে আমার পথে আসতে অনীহা প্রকাশ করে। পরকালের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ সমাধিস্থ মৃতদেরকে যখন জীবিত করা হবে তখনকার কথা কি তার জানা নেই? যা অন্তরসমূহে আছে তা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। নিঃসন্দেহে তাদের প্রতিপালক তাদের অবস্থা সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সমস্ত আমলের পূর্ণ প্রতিদান তাদের প্রতিপালক তাদেরকে প্রদান করবেন। এক বিন্দু পরিমাণও জুলুম বা অবিচার করা হবে না। সকলেরই প্রাপ্যের ব্যাপারে তিনি সুবিচারের পরিচয় দিবেন।

#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(১০০-আদিয়াত) : নামকরণ:

প্রথম শব্দ আল আদিয়াতকে (الۡعٰدِيٰتِ ) এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(১০০-আদিয়াত) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এই সূরাটির মক্কী বা মাদানী হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা., , জাবের (রা., , হাসান বসরী, ইকরামা ও আতা বলেন, এটি মক্কী সূরা। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) ও কাতাদাহ একে মাদানী সূরা বলেন। অন্যদিকে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে দুই ধরনের মত উদ্ধৃত হয়েছে। তাঁর একটি মত হচ্ছে এটি মক্কী সূরা এবং অন্য একটি বক্তব্যে তিনি একে মাদানী সূরা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সূরার বক্তব্য ও বর্ণনাভঙ্গী পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, এটি কেবল মক্কী সূরাই নয় বরং মক্কী যুগের প্রথম দিকে নাযিল হয়।
(১০০-আদিয়াত) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

মানুষ আখেরাতকে অস্বীকার করে অথবা তো থেকে গাফেল হয়ে কেমন নৈতিক অধ:পাতে যায় একথা লোকদের বুঝানোই এই সূরাটির উদ্দেশ্য। এই সঙ্গে আখেরাতে কেবল মানুষের বাইরের কাজকর্মই নয়, তাদের মনের গোপন কথাগুলোও যাচাই-বাছাই করা হবে, এ সম্পর্কেও এই সূরায় তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

এ উদ্দেশ্যে আরবে সাধারণভাবে যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে ছিল এবং যার ফলে সমগ্র দেশবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তাকে যুক্তি ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। সারা দেশের চতুর্দিকে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলছিল। লুন্ঠন, রাহাজানী, এক গোত্রের ওপর অন্য গোত্রের আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। রাতে কোন ব্যক্তিও নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারতো না। কারণ সবসময় আশংকা থাকতো, এই বুঝি কোন দুশমন অতি প্রত্যুষে তাদের জনপদ আক্রমণ করে বসলো। দেশের এই অবস্থার কথা আরবের সবাই জানতো। তারা এসব ক্ষতি ও অনিষ্ট সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ছিল। যার সবকিছু লুন্ঠিত হতো, সে এ অবস্থার জন্য মাতম করতো এবং যে লুন্ঠন করতো সে আনন্দে উৎফুল্ল হতো। কিন্তু এই লুন্ঠনকারী আবার যখন লুন্ঠিত হতো, তখন সেও অনুভব করতো, এ কেমন খারাপ অবস্থার মধ্যে কেমন দুর্বিসহ জীবন আমরা যাপন করে চলেছি।

এ পরিস্থিতির ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন এবং সেখানে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে মানুষ তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়েছে। সে আল্লাহর দেয়া ক্ষমতাগুলোকে জুলুম নিপীড়নের কাজে ব্যবহার করছে। সে ধন সম্পদের প্রেমে অন্ধ হয়ে তা অর্জন করার জন্য যে কোন অন্যায়, অসৎ ও গর্হিত পন্থা অবলম্বন করতে কুন্ঠিত হয় না। তা অবস্থা নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে সে নিজের রবের দেয়া শক্তিগুলোর অপব্যবহার করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাহীনতার প্রকাশ করছে। যদি সে সেই সময়ের কথা জানতো যখন কবর থেকে জীবিত হয়ে আবার উঠতে হবে এবং যেসব ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও স্বার্থ প্রবণতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সে দুনিয়ায় নানান ধরনের কাজ করেছিল সেগুলোকে তার মনের গভীর তলদেশ থেকে বের করে এনে সামনে রেখে দেয়া হবে, তাহলে সে এই দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি কখনই অবলম্বন করতে পারতো না দুনিয়ায় কে কি করে এসেছে এবং কার সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করা উচিত মানুষের রব সে সময় সে কথা খুব ভালোভাবেই জানবেন।

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,

وَ الْعٰدِیٰتِ ضَبْحًاۙ

কসম সেই (ঘোড়া) গুলোর যারা হ্রেষারব সহকারে দৌড়ায়।১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) দৌড়ায় শব্দের মাধ্যমে যে এখানে ঘোড়া বুঝানো হয়েছে আয়াতে শব্দগুলো থেকে একথা মোটেই স্পষ্ট নয়। বরং এখানে শুধু বলা হয়েছে (وَالۡعٰدِيٰتِ ) অর্থাৎ “কসম তাদের যারা দৌড়ায়।” এ কারণে কারা দৌড়ায় এর ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মধ্যে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। সাহাবী ও তাবেঈগণের একটি দল বলেছেন, ঘোড়া এবং অন্য একটি দল বলেছেন উট। কিন্তু যেহেতু দৌড়াবার সময় বিশেষ আওয়াজ, যাকে (ضَبۡح ) (হ্রেষারব) বলা হয়, একমাত্র ঘোড়ার মুখ দিয়েই দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস চলার কারণে বের হয় এবং পরের আয়াতগুলোতে অগ্নিষ্ফুলিংগ ঝরাবার, খুব সকালে কোন জনপদে অতর্কিত আক্রমণ চালাবার এবং সেখানে ধূলা উড়াবার কথা বলা হয়েছে, আর এগুলো একমাত্র ঘোড়ার সাথেই খাপ খায়, তাই অধিকাংশ গবেষক একে ঘোড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন। ইবনে জারীর বলেন, “এ ব্যাপারে যে দু’টি বক্তব্য পাওয়া যায় তার মধ্যে ঘোড়া দৌড়ায় এই বক্তব্যটি অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য। কারণ উট হ্রেষারব করে না, ঘোড়া হ্রেষারব করে। আর আল্লাহ‌ বলেছেন, যারা হ্রেষারব করে দৌড়ায় তাদের কসম।” ইমাম রাজী বলেন, “এই আয়াতগুলোর বিভিন্ন শব্দ চিৎকার করে চলছে, এখানে ঘোড়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ ঘোড়া ছাড়া আর কেউ হ্রেষারব করে না। আর আগুনের ষ্ফুলিংগ ঝরাবার কাজটিও পাথরের ওপর ঘোড়ার খুরের আঘাতেই সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া অন্যকোন ভাবেই তা হতে পারে না। অন্যদিকে খুব সকালে আক্রমণ চালাবার কাজটিও অন্য কোন প্রাণীর তুলনায় ঘোড়ার সাহায্যে সম্পন্ন করাই সহজতর হয়।”

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-2
টিকা নং:2,

فَالْمُوْرِیٰتِ قَدْحًاۙ

তারপর (খুরের আঘাতে) আগুনের ফুলকি ঝরায়। ২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২) আগুনের ফুলকি ঝরায় ইত্যাকার শব্দগুলো একথাই প্রকাশ করে যে, রাত্রিকালে ঘোড়া দৌড়ায়। কারণ তাদের পায়ের খুর থেকে যে আগুনের ফুলকি ঝরে তার রাতের বেলায়ই দেখতে পাওয়া যায়।

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-3
টিকা নং:3,

فَالْمُغِیْرٰتِ صُبْحًاۙ

তারপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় প্রভাতকালে।৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৩) আরববাসীদের নিয়ম ছিল, কোন জনপদে অতর্কিত আক্রমণে করতে হলে তারা রাতের আঁধারে বের হয়ে পড়তো। এর ফলে শত্রু পক্ষ পূর্বাহ্নে সতর্ক হতে পারতো না। এভাবে একেবারে খুব সকালে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। প্রভাতে আলো যেটুকু ছড়িয়ে পড়তো তাতে তারা সবকিছু দেখতে পেতো। আবার দিনের আলো খুব বেশী উজ্জ্বল না হবার কারণে প্রতিপক্ষ দূর থেকে তাদের আগমন দেখতে পেতো না। ফলে তারা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে পারতো না।

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-6
টিকা নং:4,

اِنَّ الْاِنْسَانَ لِرَبِّهٖ لَكَنُوْدٌۚ

আসলে মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) রাতের বেলা হ্রেষারব করে আগুনের ফুলকি ঝরাতে ঝরাতে যেসব ঘোড়া দৌড়ায়, তারপর খুব সকালে ধূলি উড়িয়ে কোন জনপদে চড়াও হয় এবং প্রতিরোধকারীদের ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সেসব ঘোড়ার কসম খাওয়া হয়েছে যে কথাটি বলার জন্য এটিই সেই কথা। অধিকাংশ তফসীরকার এই ঘোড়া বলতে যে ঘোড়া বুঝিয়েছেন তা দেখে অবাক হতে হয়। জিহাদকারী গাজীদের ঘোড়াকে তারা এই ঘোড়া বলে চিহ্নিত করেছেন এবং যে ভীড়ের এই ঘোড়া মধ্যে এই ঘোড়া প্রবেশ করে তাকে তারা কাফেরদের সমাবেশ মনে করেছেন। অথচ “মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ” এ কথাটির ওপরই কসম খাওয়া হয়েছে। একথা সুস্পষ্ট, আল্লাহর পথে জিহাদকারী গাজীদের ঘোড়ার দৌড়াদৌড়ি এবং কাফেরদের কোন দলের ওপর তাদের ঝাঁপিয়ে পড়ায় একথা বুঝায় না যে মানুষ তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর মানুষ নিজেই তার এই অকৃতজ্ঞতার সাক্ষী এবং সে ধন দৌলতের মোহে বিপুলভাবে আক্রান্ত এই পরবর্তী বাক্যগুলোও এমন সব লোকদের সাথে খাপ খায় না যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করতে বের হয়। তাই নিশ্চিতভাবে একথা মেনে নিতে হবে যে, এই সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াতে যে কসম খাওয়া হয়েছে তা সে সময়ের আরবে সাধারণভাবে যে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত চলছিল সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। জাহেলী যুগে রাতগুলো হতো বড়ই ভয়াবহ। প্রত্যেক গোত্র ও জনপদের লোকেরাআশঙ্কা করতো, না জানি রাতের আঁধারে তাদের ওপর কোন দুশমন চড়াও হবার জন্য ছুটে আসছে। আর দিনের আলো প্রকাশিত হবার সাথে সাথে তারা নিশ্চিন্ত হতো। কারণ রাতটা নির্ঝঞ্জাটে ও ভালোয় ভালোয় কেটে গেছে। সেখানে গোত্রে গোত্রে কেবলমাত্র প্রতিশোধমূলক লড়াই হতো না। বরং এক গোত্র আর এক গোত্রের ওপর আক্রমণ চালাতো তার ধন-দৌলত লুটে নেবার, তার উট, ভেড়া ইত্যাদি পশু কেড়ে নেবার এবং তার মেয়েদের ও শিশুদের গোলাম বানাবার জন্য। এসব লুটতরাজ ও জুলুম নিপীড়ন করা হতো সাধারণত ঘোড়ায় চড়ে। মানুষ যে তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ এই বক্তব্যের সপক্ষে এ বিষয়গুলোকে আল্লাহ‌ প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। অর্থাৎ যে শক্তিকে তারা ব্যয় করছে লুটতরাজ, হানাহানি, খুন-খারাবি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য সে শক্তি তো আল্লাহ‌ তাদেরকে মূলত এ কাজে ব্যয় করার জন্য দেননি। কাজেই আল্লাহর দেয়া এ উপকরণ ও শক্তিগুলোকে আল্লাহর সবচেয়ে বেশী অপ্রিয়, যে দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করা তার পিছনে ব্যয় করা তাঁর প্রতি সবচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-7
টিকা নং:5,

وَ اِنَّهٗ عَلٰى ذٰلِكَ لَشَهِیْدٌۚ

আর সে নিজেরই এর সাক্ষী। ৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৫) অর্থাৎ তার বিবেক এর সাক্ষী। আবার অনেক কাফের নিজ মুখেই প্রকাশ্যে এই অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ তাদের মতে আদতে আল্লাহর কোন অস্তিত্বই নেই। সে ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতি তাঁর কোন অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়া এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে অপরিহার্য করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-8
টিকা নং:6,

وَ اِنَّهٗ لِحُبِّ الْخَیْرِ لَشَدِیْدٌؕ

অবশ্য সে ধন দৌলতের মোহে খুব বেশী মত্ত।৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) কুরআনের মূল শব্দগুলো হচ্ছেঃ (وَاِنَّهٗ لِحُبِّ الۡخَيۡرِ لَشَدِيۡدٌؕ‏ ) এর শাব্দিক তরজমা হচ্ছে, “সে ভালোর প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করে।” কিন্তু আরবী ভাষায় খাইর শব্দটি কেবলমাত্র ভালো ও নেকীর প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না বরং ধন-দৌলত অর্থেও এর ব্যবহার প্রচলিত। সূরা আল বাকারার ১৮০ আয়াতে “খাইর” শব্দটি ধন-সম্পদ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বক্তব্যের প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে কোথায় এ শব্দটি নেকী অর্থে এবং কোথায় ধন-সম্পদ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে তা অনুধাবন করা যায়। এই আয়াতটির পূর্বাপর আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হচ্ছে যে, এখানে “খাইর” বলতে ধন-সম্পদ বুঝানো হয়েছে, নেকী বুঝানো হয়নি। কারণ যে ব্যক্তি নিজের রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং নিজের কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজের অকৃতজ্ঞতার স্বপক্ষে সাক্ষ্য পেশ করছে তার ব্যাপারে কখনো একথা বলা যেতে পারেনা যে, সে নেকী ও সৎবৃত্তির প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করে।

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-9
টিকা নং:7,

اَفَلَا یَعْلَمُ اِذَا بُعْثِرَ مَا فِی الْقُبُوْرِۙ

তবে কি সে সেই সময়ের কথা জানে না যখন কবরের মধ্যে যা কিছু (দাফন করা) আছে সেসব বের করে আনা হবে৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) অর্থাৎ মরা মানুষ যেখানে যে অবস্থায় আছে সেখান থেকে তাকে বের করে এনে জীবিত মানুষের আকারে দাঁড় করানো হবে।

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-10
টিকা নং:8,

وَ حُصِّلَ مَا فِی الصُّدُوْرِۙ

এবং বুকের মধ্যে যা কিছু (লুকানো) আছে সব বের করে এনে যাচাই করা হবে?৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৮) অর্থাৎ বুকের মধ্যে যেমন ইচ্ছা ও নিয়ত, স্বার্থ ও উদ্দেশ্য, চিন্তা, ভাবধারা এবং বাহ্যিক কাজের পেছনে যেসব গোপন অভিপ্রায় লুকিয়ে আছে সেসব খুলে সামনে রেখে দেয়া হবে। সেগুলো যাচাই করে ভালো ও খারাপগুলোকে আলাদা আলাদা করে দেয়া হবে। অন্য কথায় শুধুমাত্র বাইরের চেহারা দেখে মানুষ বাস্তবে যা কিছু করেছে সে সম্পর্কে শেষ সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেয়া হবে না। বরং মনের মধ্যে লুকানো রহস্যগুলোকে বাইরে বের করে এনে দেখা হবে যে, মানুষ যেসব কাজ করেছে তার পেছনে কি উদ্দেশ্য ও স্বার্থ-প্রেরণা লুকিয়েছিল। এ বিষয়টি চিন্তা করলে মানুষ একথা স্বীকার না করে পারে না যে, আসল ও পূর্ণাংগ ইনসাফ একমাত্র আল্লাহর আদালতে ছাড়া আর কোথাও কায়েম হতে পারে না। নিছক বাইরের কাজকর্ম দেখেকোন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া যায় না বরং কি উদ্দেশ্যে সে এ কাজ করেছে তাও দেখতে হবে। দুনিয়ার ধর্মহীন আইন ব্যবস্থাগুলোও নীতিগতভাবে একথা জরুরী মনে করে। তবে নিয়ত ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে তার সঠিক চেহারা সণাক্ত করার মতো উপকরণ দুনিয়ার কোন আদালতেরও নেই। একমাত্র আল্লাহই এ কাজ করতে পারেন একমাত্র তিনিই মানুষের প্রত্যেকটি কাজের বাইরের চেহারার পেছনে যে গোপন প্রেরণা ও উদ্দীপনা সক্রিয় থাকে তা যাচাই করে সে কোন্ ধরনের পুরস্কার বা শাস্তির অধিকারী হতে পারে তা নির্ধারণ করতে পারেন। তাছাড়া আয়াতের শব্দাবলী থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, মনের ভেতরে, ইচ্ছা, সংকল্প ও নিয়ত সম্পর্কে আল্লাহ‌ পূর্বাহ্নেই যে জ্ঞান রাখেন নিছক তার ভিত্তিতে এ ফায়সালা হবে না। বরং কিয়ামতের দিন এ রহস্যগুলো উন্মুক্ত করে সবার সামনে রেখে দেয়া হবে এবং প্রকাশ্য আদালতে যাচাই ও পর্যালোচনা করে এর কতটুকু ভালো ও কতটুকু খারাপ ছিল তা দেখিয়ে দেয়া হবে। এজন্য এখানে(حُصِّلَ مَا فِىۡ الصُّدُوۡرِۙ‏ ) বলা হয়েছে। কোন জিনিসকে বের করে বাইরে নিয়ে আসাকে ‘হুসসিলা’ বা ‘তাহসীল’ বলে। যেমন, বাইরের ছাল বা খোসা ছড়িয়ে ভেতরের মগজ বের করা। এভাবে বিভিন্ন ধরনের জিনিসকে ছেঁটে পরস্পর থেকে আলাদা করার জন্যও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কাজেই মনের মধ্যে লুকানো রহস্যসমূহের ‘তাহসীল’ বা বের করে আনার মধ্যে এ দু’টি অর্থ শামিল হবে। সেগুলোকে খুলে বাইরে বের করে দেয়াও হবে আবার সেগুলো ছেঁটে ভালো ও মন্দ আলাদা করে দেয়াও হবে। এ বক্তব্যটিই সুরা আত তারিকে এভাবে বলা হয়েছেঃ (يَوۡمَ تُبۡلَى السَّرَآٮِٕرُۙ ) “যেদিন গোপন রহস্য যাচাই বাছাই করা হবে।” ( ৯ আয়াত )

সুরা: আল-আদিয়াত
আয়াত নং :-11
টিকা নং:9,

اِنَّ رَبَّهُمْ بِهِمْ یَوْمَئِذٍ لَّخَبِیْرٌ۠

অবশ্য সেদিন তাদের রব তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত থাকবেন।৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৯) অর্থাৎ কে কি এবং কে কোন্ ধরনের শাস্তি বা পুরস্কারের অধিকারী তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানবেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

‘সেইসব ঘোড়ার শপথ, যারা হ্রেষা রব তুলে ছুটে চলে, পরে (নিজের ক্ষুর দিয়ে) স্ফূলিংগ সৃষ্টি করে, আর ভোর বেলায় আক্রমণ চালায় । আর সে সময় ধূলিঝড় সৃষ্টি করে এবং সে অবস্থায়ই কোনো ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে । বস্তুত মানুষ তার প্রতিপালকের গ্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ, সে নিজেই এর সাক্ষী, আর সে সম্পদের লালসায় খুবই কঠোর ।’ আল্লাহ তায়ালা যোদ্ধা ঘোড়ার গুণ একে একে বর্ণনা করে শপথ করেছেন। ঘোড়া দৌড়ানোর সময় যে সুবিদিত শব্দ করে থাকে সেই শব্দ সহকারে পায়ের ক্ষুর দ্বারা পাথরে আঘাত করে আগুনের ফুলকি তোলা, অতি ভোরে শত্রুর ওপর অতর্কিত হামলা চালানো, ধুলো উড়াতে উড়াতে অতর্কিতে শত্রুর লাইনের ভেতরে ঢুকে হৈচৈ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেয়া-এসব তৎপরতার একটি একটি করে বিবরণ দিচ্ছেন। অকৃতজ্ঞ মানুষ : বস্তুত এগুলো যুদ্ধের তৎপরতা এবং কোরআনের প্রথম সম্বোধিত লোকদের এসব তৎপরতার প্রতি স্বভাসুলভ আকর্ষণ ছিলো ৷ এই প্রসংগে ঘোড়ার শপথ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে এসব তৎপরতাকে ভালোবাসতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর দাড়িপাল্লায় এর মূল্য কতোখানি তা বুঝা এবং সেদিকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষথেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর এ ব্যাপারে যথার্থই উৎসাহ জন্মাবে। আগেই যেমন বলেছি, যেসব দৃশ্যের নামে শপথ করা হয়েছে এবং যেসব দৃশ্যের কথা পরবর্তীতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সাথে আলোচ্য দৃশ্যের পরিপূর্ণ সমন্বয় রয়েছে। তবে সেই সমর্য়ের চেয়েও বড় কথা হলো প্রকারান্তরে এই সামরিক তৎপরতাকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়া হয়েছে৷ পক্ষান্তরে আল্লাহ যে বিষয়টি বলার জন্যে শপথ করছেন, তা মানুষের ভেতরে একটা বাস্তব সত্যের আকারে বিরাজমান, যখন তার মন ঈমানী চেতনা ও উদ্দীপনা থেকে বঞ্চিত থাকে । কোরআন তাকে তার এই দূর্বল দিকটি সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছে, যাতে সে তার প্রতিরোধের জন্যে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে প্রস্তুত ও সবল করতে পারে৷ কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজেই জানেন, তার ভেতরে এ দুর্বলতার শেকড় কতো গভীরে উপ্ত এবং এর অস্তিত্বের বোঝা তার ব্যক্তিত্বে কতোখানি। ‘নিশ্চয় মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে।’ মানুষ তার মনিবের নেয়ামত ও বিপুল অনুগ্রহের কথা স্বীকার করে। এই অকৃতজ্ঞতা ও অস্বীকৃতি মানুষের বিভিন্ন কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সে সব কাজ ও কথা তার অকৃতজ্ঞতার সাক্ষীস্বরূপ। এগুলো তার নিজের সামনেও সাক্ষ্য দেয়, আবার কেয়ামতের দিনও সাক্ষ্য দেবে। ‘নিশ্চয়ই সে এর ওপর সাক্ষী ।’ অর্থাৎ কেয়ামতের দিন নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সাক্ষ্য দেবে। সেদিন কোনো জারিজুরিও খাটাবে না, কোনো বিতর্কেরও অবকাশ থাকবে না। ‘আর সে ধন-সম্পদের প্রতি অতিশয় আসক্ত ।’ যেহেতু সে নিজেকে অত্যধিক ভালোবাসে, তাই সে সম্পদকে এবং কল্যাণকেও ভালোবাসে ৷ তবে এই সম্পদের মোহ তাকে শুধু সম্পদের আসক্তিতেই সীমাবদ্ধ রাখে না বরং তাকে ক্ষমতার মোহেও পেয়ে বসে এবং তার মধ্যে দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ ভোগের স্পৃহা ও লালসা তীব্রতর হয়। এটাই তার সহজাত প্রবণতা এবং স্বভাবসুলভ স্পৃহা, যতক্ষণ তার অন্তরে ঈমানের ছোয়া না লাগে। পক্ষান্তরে ঈমান যদি হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে, তাহলে তার সমস্ত ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ ও গুরুত্ববোধ পাল্টে যায়। তার অকৃতজ্ঞতা ও নেয়ামতের অস্বীকৃতি আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় ও তার অনুগ্রহের স্বীকৃতিতে পরিবর্তিত হয়। তার অহংকার, স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতা অপরকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দান এবং করুণা ও দয়া প্রদর্শনের রূপ নেয় । এগুলোই হচ্ছে সেইসব মূল্যবোধ, যা মোমেনের কাছে যথার্থই কাম্য ও বাঞ্চিত বলে প্রতীয়মান হয় এবং যার জন্য আগ্রহী হওয়া, প্রতিযোগিতা করা ও কঠোর পরিশ্রম করা যথার্থই সমীচীন বলে মনে হয়। এসব মূল্যবোধ টাকা-কড়ির চেয়েও উচ্চ মূল্য, ক্ষমতা ও পদমর্যাদার চেয়েও সম্মানিত এবং পার্থিব সম্পদকে নিছক জৈবিক ও পাশবিক রুচি দ্বারা উপভোগ করার চেয়েও মর্যাদাবান । বস্তুত ঈমান ছাড়া মানুষ নিতান্ত ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ, ক্ষুদ্র তার গুরুত্ববোধ ও অগ্রাধিকারের বিচারে, তুচ্ছ তার লোভ-লালসা ও আসক্তির দিক দিয়ে । মানুষের লোভ যতোই বাড়বে, আকাংখা ও কামনা-বাসনা যতোই তীব্র হবে, আশা যতোই উচ্চ হবে, ততোই সে পৃথিবীর নোংরা কীদামাটিতে ডুবে যাবে, পার্থিব আয়ুষ্কালের সংকীর্ণ গন্ডীতে সীমিত হয়ে যাবে, আপন ব্যক্তিসত্ত্বার কারাগারে বন্দী হয়ে যাবে। সেই অবস্থা থেকে মুক্তি ও উন্নতি লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে দুনিয়ার চেয়ে বৃহত্তর এক জগত, পার্থিব জীবনের চেয়ে প্রশস্ততর এক জীবন এবং আপন সত্ত্বার চেয়ে মহত্তর এক সত্ত্বার সাথে তার সম্পর্ক স্থাপন । সে জগতের উৎপত্তি হয়েছে অনাদি-অনস্ত আল্লাহ থেকে, তার প্রত্যাবর্তনও ঘটেছে অনাদি-অনস্ত আল্লাহর দিকে এবং সেই জগতে গিয়ে ইহকাল ও পরকাল পরম্পরে মিলিত হয়ে এক অন্তহীন জগতের রূপ ধারণ করে। এ কারণে সূরার সর্বশেষ মনোযোগ-আকর্ষণী বক্তব্যটি অকৃতজ্ঞতা, অস্বীকৃতি, আত্মম্ভরিতা ও সংকীর্ণতার প্রতিকারের লক্ষ্যে প্রদত্ত হয়। এর উদ্দেশ্য প্রবৃত্তির কারাগার ভেংগে মানুষকে তা থেকে মুক্তি প্রদান । আর এ উদ্দেশ্যে কেয়ামতের দৃশ্য এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে সম্পদের মোহ বিস্মৃত হওয়া সম্ভব হয় এবং আত্মম্ভরিতাজনিত উদাসীনতা থেকে সম্বিত ফিরে পাওয়া যায়। ‘তবে কি সে জানে না যখন কবরের অধিবাসীদেরকে বিক্ষিপ্ত করা হবে এবং বুকের ভেতরে যতো গোপন কথা লুকিয়ে আছে, তা ফাঁস করা হবে?’ বস্তুত এটি একটি ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় দৃশ্য ৷ কবরের অধিবাসীদের সর্বত্র বিক্ষিপ্ত হওয়া, সেই বিক্ষিপ্ততাকে এই উত্তেজনা-নির্দেশক (বু’সেরা) শব্দটি দ্বারা তা ব্যক্ত করা এবং বুকে লুকিয়ে রাখা গোপন তথ্যগুলো প্রকাশ করা আর এ বিষয়টিও এই তেজোদ্দীপ্ত শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা-এ সব মিলে গোটা পরিবেশটাই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘তবে কি সে জানে না যে, যখন কবরে যা কিছু সমাহিত আছে তা বের করা হবে এবং বুকের ভেতর যা কিছু লুকিয়ে আছে, তা বের করে আনা হবে?’ কথাটির মর্ম দাড়াচ্ছে এই যে, এসব ঘটনা যে সময়ে ঘটবে সে সময়ের কথা কি তার জানা নেই? অথবা জানা থাকলে তা কি তার মনে নেই? কেননা সে দিনটির কথা জানা থাকাই চেতনা ও প্রেরণা উদ্দীপিত করার জন্যে যথেষ্ট । এরপর মানুষের মনকে এ প্রশ্নের উত্তেজনাপূর্ণ তৎপরতার কি পরিণতি ও প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা কল্পনা করতে হবে । অতপর এই সকল তেজস্বী তৎপরতার অবসান ঘটে এবং স্থিরতা ও স্তব্ধতা নেমে আসে । এভাবে সকল জিনিস, সকল কাজ ও সকল পরিণতিরই এক সময় অবসান ঘটে থাকে । ‘নিশ্চয়ই তাদের প্রতিপালক সেদিন তাদের সম্পর্কে ওয়াকেফহাল থাকবেন ।’ আর তাদের প্রতিপালকের কাছেই তাদেরকে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি সেদিন তাদের সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল থাকবেন। তাদের প্রকাশ্য ও গোপন সকল অবস্থা সম্পর্কে অবহিত থাকবেন । আল্লাহ, তায়ালা শুধু ‘সেদিন’ নয় সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় সকল গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু জানবেন-সে কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, এতে তাদের সচেতনতা ও সতর্কতা জাগ্রত হবে, বস্তুত জানার একটা পরিণতি আছে। এ জানার পেছনে জবাবদিহি ও কর্মফল যুক্ত রয়েছে। এই আনুষংগিক তত্ত্বটাই এখানে লক্ষণীয় বিষয় । সূরাটি আগাগোড়াই একটি উদ্দীপক সংবাদ বিশেষ, যা পরকালের জবাবদিহির চেতনা ও ভীতি জাগায়, প্রেরণা ও আবেগের সৃষ্টি করে এবং অবশেষে কোরআনের নিজস্ব ভংগিতে শাব্দিক, আর্থিক ও ছান্দিকভাবে এ সমাপনী বক্তব্যে গিয়ে উপনীত হয়।

Leave a Reply