Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১৮/হে মানুষ :-২৫)
[#আবরাহার হস্তী বাহিনীর ঘটনা-]
সুরা: ১০৫: আল-ফীল
পারা:৩০
১- ৫ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1218/O Ye Mankind:-25)
[ # Story of the People of the Elephant :-]
Surah.105: Al-Fil
Para:30 Ayat:- 1-5
www.motaher21.net
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আল-ফীল
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১০৫
(১০৫-ফীল) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের আসহাবিল ফীল (أَصْحَابِ الْفِيلِ) শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
(১০৫-ফীল) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরাটির মক্কী হবার ব্যাপারে সবাই একমত। এর ঐতিহাসিক পটভূমি সামনে রাখলে মক্কা মু’আযযমায় ইসলামের প্রথম যুগে এটি নাযিল হয় বলে মনে হয়।
(১০৫-ফীল) : ঐতিহাসিক পটভূমি :
এর আগে সূরা বুরুজের ৪ টীকায় উল্লেখ করে এসেছি, ইয়ামনের ইহুদী শাসক যুনুওয়াস নাজরানে ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের ওপর যে জুলুম করেছিল তার প্রতিশোধ নেবার জন্য হাবশার (বর্তমান ইথিয়পিয়া) খৃস্টীয় শাসনকর্তা ইয়ামন আক্রমণ করে হিমইয়ারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। ৫২৫ খৃস্টাব্দে এই সমগ্র এলাকাটিতে হাবশার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আসলে কনস্টান্টিনোপলের রোমীয় শাসনকর্তা ও হাবশার শাসকের পারস্পরিক সহযোগিতায় এই সমগ্র অভিযান পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ সে সময় হাবশার শাসকদের কাছে কোন উল্লেখযোগ্য নৌবহর ছিল না। রোমীয়রা এ নৌবহর সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে হাবশা তার ৭০ হাজার সৈন্য ইয়ামন উপকূলে নামিয়ে দেয়। পরবর্তী বিষয়গুলো অনুধাবন করার জন্য শুরুতেই জেনে নেয়া উচিত যে, নিছক ধর্মীয় আবেগ তাড়িত হয়ে এসব কিছু করা হয়নি। বরং এসবের পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থও সক্রিয় ছিল। বরং সম্ভবত সেগুলোই এর মূলে আসল প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল এবং খৃস্টান মজলুমদের খুনের বদলা নেবার ব্যাপারটি একটি বাহানাবাজী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আসলে সেকালে পূর্ব আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ ও রোম অধিকৃত এলাকার মধ্যে যে ব্যবসা চলতো তার ওপর আরবরা শত শত বছর থেকে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলে আসছিল। রোমান শাসকরা মিসর ও সিরিয়া দখল করার পর থেকেই এই ব্যবসার ওপর থেকে আরবদের আধিপত্য বিলুপ্ত করে একে পুরোপুরি নিজেদের কর্তৃত্বাধীন করতে চাইছিল। কেননা মাঝখান থেকে আরব ব্যবসায়ীদেরকে হটিয়ে দিতে পারলে এর পুরো মুনাফা তারা সরাসরি নিজেরা লাভ করতে পারবে। এই উদ্দেশ্যে খৃস্টপূর্ব ২৪ বা ২৫ অব্দে কাইজার আগাষ্টাস রোমান জেনারেল ইলিয়াস গালুসের (Aelius Gallus) নেতৃত্বে একটি বিরাট সেনাদল আরবের পশ্চিম উপকূলে নামিয়ে দেয়। দক্ষিণ আরব থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সমুদ্রপথ অধিকার করে নেয়াই ছিল এর লক্ষ্য। (তাফহীমুল কুরআনের সূরা আনফালের আলোচনা প্রসঙ্গে আমি এ বাণিজ্য পথের নকশা পেশ করেছি।) কিন্তু আরবের চরম প্রতিকূল ভৌগলিক অবস্থা ও পরিবেশ অভিযানকে ব্যর্থ করে দেয়। এরপর রোমানরা লোহিত সাগরে তাদের নৌবহর স্থাপন করে। এর ফলে সমুদ্র পথে আরবদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের ব্যবসার জন্য কেবলমাত্র স্থলপথ উন্মুক্ত থেকে যায়। এই স্থলপথটি দখল করে নেবার জন্য তারা হাবশার খৃস্টান সরকারের সাথে চক্রান্ত করে এবং সামুদ্রিক নৌবহরের সহায়তায় তাকে ইয়ামনের ওপর কর্তৃত্ব দান করে।
ইয়ামন আক্রমণকারী হাবশী সেনাদল সম্পর্কে আরব ঐতিহাসিকগণ যে বিবরণ পেশ করেছেন তাতে বেশ মত পার্থক্য দেখা যায়। ঐতিহাসিক হাফেজ ইবনে কাসীর লিখেছেন, এ সেনাদল পরিচালিত হয়েছিল দু’জন সেনাপতির অধীনে। তাদের একজন ছিল আরইয়াত এবং অন্যজন আবরাহা। অন্যদিকে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে আরইয়াত ছিল এই সেনাবাহিনীর সেনাপতি এবং আবরাহা ছিল এর একজন সদস্য। এরপর এ দু’জন ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, পরে আরইয়াত ও আবরাহার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। যুদ্ধে আরইয়াতের মৃত্যু হয়। আবরাহা ইয়ামন দখল করে। তারপর তাকে হাবশার অধীনে ইয়ামনের গভর্ণর নিযুক্ত করার ব্যাপারে সে হাবশা সম্রাটকে সম্মত করতে সক্ষম হয়। বিপরীতপক্ষে গ্রীক ও সুরিয়ানী ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে ভিন্ন বিবরণ পেশ করেছেন। তাদের বর্ণনা মতে, ইয়ামন জয় করার পরে হাবশী সৈন্যরা যখন প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী ইয়ামনী সরদারদেরকে একের পর এক হত্যা করে চলছিল তখন তাদের “আস সুমাইফি আশওয়া” যাকে গ্রীক ঐতিহাসিকরা বলেছেন Esymphaeus নামক একজন সরদার হাবশীদের আনুগত্য স্বীকার করে জিজিয়া দেবার অঙ্গীকার করে এবং হাবশা সম্রাটের কাছ থেকে ইয়ামনের গভর্ণর হবার পরোয়ানা হাসিল করে কিন্তু হাবশী সৈন্যরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। তারা আবরাহাকে তার জায়গায় গভর্ণর পদে অধিষ্ঠিত করে। আবরাহা ছিল হাবশার আদুলিস বন্দরের একজন গ্রীক ব্যবসায়ীর ক্রীতদাস। নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরে সে ইয়ামন দখলকারী হাবশী সেনাদলে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। হাবশা সম্রাট তাকে দমন করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠায়। কিন্তু এই সেনাদল হয় তার পক্ষে যোগ দেয় অথবা সে এই সেনাদলকে পরাজিত করে। অবশেষে হাবশা সম্রাটের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী তাকে ইয়ামনে নিজের গভর্নর হিসেবে স্বীকার করে নেয়। (গ্রীক ঐতিহাসিকগণ তার নাম বলেছেন আবরামিস (Abrames) এবং সুরিয়ানী ঐতিহাসিকগণ তাকে আবরাহাম (Abraham) নামে উল্লেখ করেছেন। আবরাহা সম্ভবত এরই হাবশী উচ্চারণ। কারণ আরবীতে তো এর উচ্চারণ ইবরাহীম।)
এ ব্যক্তি ধীরে ইয়ামনের স্বাধীন বাদশাহ হয়ে বসে। তবে নাম কাওয়াস্তে হাবশা সম্রাটের প্রাধান্যের স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছিল এবং নিজের নামের সাথে সম্রাট প্রতিনিধি লিখতো। তার প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেশী বেড়ে গিয়েছিল। একটি ব্যাপার থেকে এ সম্পর্কে অনুমান করা যেতে পারে। ৫৪৩ খৃস্টাব্দে সদ্দে মাআরিব— এর সংস্কার কাজ শেষ করে সে একটি বিরাট উৎসবের আয়োজন করে। এই উৎসবে রোমের কাইজার, ইরানের বাদশাহ, হীরার বাদশাহ এবং গাসসানের বাদশাহর প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করে। সদ্দে মাআরিবে আবরাহা স্থাপিত শিলালিপিতে এ সম্পর্কিত পূর্ণ আলোচনা সংরক্ষিত রয়েছে। এই শিলালিপি আজো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। গ্লীসার (Glaser) তার গ্রন্থে এটি উদ্ধৃত করেছেন। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবা ৩৭ টীকা)।
এই অভিযান শুরুর গোড়াতেই রোমান সাম্রাজ্য ও তার মিত্র হাবশী খৃস্টানদের সামনে যে উদ্দেশ্য বর্তমান ছিল ইয়ামনে নিজের কর্তৃত্ব পুরোপুরি মজবুত করার পর আবরাহা সেই উদ্দেশ্য সফল করার কাজে আত্মনিয়োগ করে। এই উদ্দেশ্য ছিল, একদিকে আরবে খৃস্টধর্ম প্রচার করা এবং অন্যদিকে আরবদের মাধ্যমে রোম সাম্রাজ্যে ও প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে যে ব্যবসা চলতো তাকে পুরোপুরি নিজেদের দখলে নিয়ে আসা। ইরানের সাসানী সাম্রাজ্যের সাথে রোমানদের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের ফলে প্রাচ্য দেশে রোমানদের ব্যবসার অন্যান্য সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে এর প্রয়োজন আরো বেশী বেড়ে যায়।
এ উদ্দেশ্যে আবরাহা ইয়ামনের রাজধানী ‘সানআ’য় একটি বিশাল গীর্জা নির্মাণ করে। আরব ঐতিহাসিকগণ একে ‘আল কালীস’ বা ‘আল কুলীস’ ‘আল কুল্লাইস’ নামে উল্লেখ করেছেন। একটি গ্রীক Ekklesia শব্দের আরবীকরণ। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে একাজটি সম্পন্ন করার পর সে হাবশার বাদশাহকে লিখে জানায়, আমি আরবদের হজ্বকে মক্কার কা’বার পরিবর্তে সানআর এ গীর্জার দিকে ফিরিয়ে না দিয়ে ক্ষান্ত হবো না।* ইবনে কাসীর লিখেছেন, সে ইয়ামনে প্রকাশ্যে নিজের এই সংকল্পের কথা প্রকাশ করে এবং চতুর্দিকে ঘোষণা করে দেয়। আমাদের মতে তার এ ধরনের কার্যকলাপের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এর ফলে আরবরা ক্রুদ্ধ হয়ে এমন কোন কাজ করে বসবে যাকে বাহানা বানিয়ে সে মক্কা আক্রমণ করে কা’বাঘর ধ্বংস করে দেবার সুযোগ লাভ করবে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, তার এ ধরনের ঘোষণায় ক্রুদ্ধ হয়ে জনৈক আরব কোন প্রকারে তার গীর্জার মধ্যে প্রবেশ করে সেখানে মল ত্যাগ করে। ইবনে কাসীর বলেন, এ কাজটি করেছিল একজন কুরাইশী। অন্যদিকে মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের বর্ণনা মতে, কয়েকজন কুরাইশ যুবক গিয়ে সেই গীর্জায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এর মধ্য থেকে যে কোন একটি ঘটনাই যদি সত্যি ঘটে থাকে তাহলে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ আবরাহার এ ঘোষণাটি ছিল নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। এ কারণে প্রাচীন জাহেলী যুগের কোন আরব বা কুরাইশীর অথবা কয়েকজন কুরাইশী যুবকের পক্ষে উত্তেজিত হয়ে গীর্জাকে নাপাক করা অথবা তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া কোন অস্বাভাবিক বা দুর্বোধ্য ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আবরাহার নিজের পক্ষেও নিজের কোন লোক লাগিয়ে গোপনে গোপনে এই ধরনের কোন কাণ্ড করে ফেলাটাও অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয় না। কারণ সে এভাবে মক্কা আক্রমণ করার বাহানা সৃষ্টি করতে এবং কুরাইশদেরকে ধ্বংস ও সমগ্র আরববাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দিয়ে নিজের উভয় উদ্দেশ্যে সফলকাম হতে পারবে বলে মনে করছিল। মোটকথা দু’টি অবস্থার মধ্য থেকে যেকোন একটিই সঠিক হোক না কেন, আবরাহার কাছে যখন এ রিপোর্ট পৌঁছল যে, কাবার ভক্ত অনুরক্তরা তার গীর্জার অবমাননা করেছে তখন সে কসম খেয়ে বসে, কা’বাকে গুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমি স্থির হয়ে বসবো না।
* ইয়ামনের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ করার পর খৃস্টানরা মক্কার কা’বাঘরের মোকাবিলায় দ্বিতীয় একটি কা’বা তৈরি করার এবং সমগ্র আরবে তাকে কেন্দ্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য অনবরত প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা নাজরানেও একটি কা’বা নির্মাণ করেছিল। সূরা বুরুজের ৪ টীকায় এর আলোচনা এসেছে।
তারপর ৫৭০ বা ৫৭১ খৃস্টাব্দে সে ৬০ হাজার পদাতিক, ১৩ টি হাতি (অন্য বর্ণনা মতে ৯ টি হাতি) সহকারে মক্কার পথে রওয়ানা হয়। পথে প্রথমে যু-নফর নামক ইয়ামনের একজন সরদার আরবদের একটি সেনাদল সংগ্রহ করে তাকে বাধা দেয়। কিন্তু যুদ্ধে সে পরাজিত ও ধৃত হয়। তারপর খাশ’আম এলাকায় নুফাইল ইবনে হাবীব খাশ’আমী তার গোত্রের লোকদের নিয়ে তার পথ রোধ করে। কিন্তু সেও পরাজিত ও গ্রেফতার হয়ে যায়। সে নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য আবরাহার সেনাদলের পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ সেনাদল তায়েফের নিকটবর্তী হলে বনু সকীফ অনুভব করে এত বড় শক্তির মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং এই সংগে তারা এ আশংকাও করতে থাকে যে, হয়তো তাদের লাত দেবতার মন্দিরও তারা ভেঙে ফেলবে। ফলে তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আবরাহার সাথে সাক্ষাৎ করে। তারা তাকে বলে আপনি যে উপাসনালয়টি ভাঙতে এসেছেন আমাদের এ মন্দিরটি সে উপাসনালয় নয়। সেটি মক্কায় অবস্থিত। কাজেই আপনি আমাদেরটায় হাত দেবেন না। আমরা মক্কার পথ দেখাবার জন্য আপনাকে পথপ্রদর্শক সংগ্রহ করে দিচ্ছি। আবরাহা তাদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে বনু সাকীফ আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তি তখন আল মাগাম্মাস বা আল মুগাম্মিস নামক স্থানে পৌঁছে আবু রিগাল মারা যায়। আরবরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত তার কবরে পাথর মেরে এসেছে। বনী সাকীফকেও তারা বছরের পর বছর ধরে এই বলে ধিক্কার দিয়ে এসেছে। —-তোমরা লাতের মন্দির বাঁচাতে গিয়ে আল্লাহর ঘরের ওপর আক্রমণকারীদের সাথে সহযোগিতা করেছো।
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, আল মাগাম্মেস থেকে আবরাহা তার অগ্রবাহিনীকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। তারা তিহামার অধিবাসীদের ও কুরাইশদের উট, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি বহু পালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাদা আবদুল মুত্তালিবেরও দু’শো উট ছিল। এরপর সে মক্কাবাসীদের কাছে নিজের একজন দূতকে পাঠায়। তার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের কাছে এই মর্মে বাণী পাঠায়: আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমি এসেছি শুধুমাত্র এই ঘরটি (কা’বা) ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। যদি তোমরা যুদ্ধ না করো তাহলে তোমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পত্তির কোন ক্ষতি আমি করবো না। তাছাড়া তার এক দূতকেও মক্কাবাসীদের কাছে পাঠায়। মক্কাবাসীরা যদি তার সাথে কথা বলতে চায় তাহলে তাদের সরদারকে তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। আবদুল মুত্তালিব তখন ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বড় সরদার। দূত তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে আবরাহার পয়গাম তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আবরাহার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। এটা আল্লাহর ঘর তিনি চাইলে তাঁর ঘর রক্ষা করবেন। দূত বলে, আপনি আমার সাথে আবরাহার কাছে চলুন। তিনি সম্মত হন এবং দূতের সাথে আবরাহার কাছে যান। তিনি এতই সুশ্রী, আকর্ষণীয় ও প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, আবরাহা তাকে দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সে সিংহাসন থেকে নেমে এসে নিজে তাঁর কাছে বসে পড়ে। সে তাঁকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি চান? তিনি বলেন, আমার যে উটগুলো ধরে নেয়া হয়েছে সেগুলো আমাকে ফেরত দেয়া হোক। আবরাহা বলল, আপনাকে দেখে তো আমি বড়ই প্রভাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি নিজের উটের দাবি জানাচ্ছেন, অথচ এই যে ঘরটা আপনার ও আপনার পূর্বপুরুষদের ধর্মের কেন্দ্র সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না, আপনার এ বক্তব্য আপনাকে আমার দৃষ্টিতে মর্যাদাহীন করে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি তো কেবল আমার উটের মালিক এবং সেগুলোর জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আর এই ঘর। এর একজন রব, মালিক ও প্রভু আছেন। তিনি নিজেই এর হেফাজত করবেন। আবরাহা জবাব দেয়, তিনি একে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আবদুল মুত্তালিব বলেন, এ ব্যাপারে আপনি জানেন ও তিনি জানেন। একথা বলে তিনি সেখান থেকে উঠে পড়েন। আবরাহা তাঁকে তাঁর উটগুলো ফিরিয়ে দেয়।
ইবনে আব্বাস (রা.) ভিন্ন ধরনের বর্ণনা পেশ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় উট দাবীর কোন কথা নেই। আবদ ইবনে হুমাইদ, ইবনুল মুনযির, ইবনে মারদুইয়া, হাকেম, আবু নু’আইম ও বাইহাকী তাঁর থেকে যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাতে তিনি বলেন, আবরাহা আসসিফাই (আরাফাত ও তায়েফের পাহাড়গুলোর মধ্যে হারম শরীফের সীমানার কাছাকাছি একটি স্থান) পৌঁছে গেলে আবদুল মুত্তালিব নিজেই তার কাছে যান এবং তাকে বলেন, আপনার এখানে আসার কি প্রয়োজন ছিল? আপনার কোন জিনিসের প্রয়োজন থাকলে আমাদের কাছে বলে পাঠাতেন। আমরা নিজেরাই সে জিনিস নিয়ে আপনার কাছে পৌঁছে যেতাম। জবাবে সে বলে, আমি শুনেছি, এটি শান্তি ও নিরাপত্তার ঘর। আমি এর শান্তি ও নিরাপত্তা খতম করতে এসেছি। আবদুল মুত্তালিব বলেন, এটি আল্লাহর ঘর। আজ পর্যন্ত তিনি কাউকে এর ওপর চেপে বসতে দেননি। আবরাহা জবাব দেয়, আমি একে বিধ্বস্ত না করে এখান থেকে সরে যাবো না। আবদুল মুত্তালিব বলেন, আপনি যা কিছু চান আমাদের কাছ থেকে নিয়ে চলে যান। কিন্তু আবরাহা অস্বীকার করে। আবদুল মুত্তালিবকে পেছনে রেখে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সে সামনে দিকে এগিয়ে যায়।
উভয় বর্ণনার এ বিভিন্নতাকে যদি আমরা যথাস্থানে রেখে দিই এবং এদের মধ্য থেকে একটিকে অন্যটির ওপর প্রাধান্য না দিই তাহলে যে ঘটনাটিই ঘটুক না কেন আমাদের কাছে একটি জিনিস অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সেটি হচ্ছে, মক্কা ও তার চারপাশের গোত্রগুলো এতবড় সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করে কা’বাকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখতো না। কাজেই একথা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, কুরাইশরা তাদেরকে বাধা দেবার চেষ্টাই করেনি। কুরাইশরা তো আহযাবের যুদ্ধের সময় মুশরিক ও ইহুদি গোত্রগুলোকে সাথে নিয়ে বড় জোর দশ বারো হাজার সৈন্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল। কাজেই তারা ৬০ হাজার সৈন্যের মোকাবিলা করতো কিভাবে?
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, আবরাহার সেনাদলের কাছ থেকে ফিরে এসে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে বলেন, নিজেদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে পাহাড়ের ওপর চলে যাও, এভাবে তারা ব্যাপক গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে। তারপর তিনি ও কুরাইশদের কয়েকজন সরদার হারাম শরীফে হাযির হয়ে যান। তারা কা’বার দরজার কড়া ধরে আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করতে থাকেন যে, তিনি যেন তাঁর ঘর ও তাঁর খাদেমদের হেফাজত করেন। সে সময় কা’বা ঘরে ৩৬০ টি মূর্তি ছিল। কিন্তু এই সংকটকালে তারা সবাই এই মূর্তিগুলোর কথা ভুলে যায়। তারা একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার জন্য হাত ওঠায়। ইতিহাসের বইগুলোতে তাদের প্রার্থনাবাণী উদ্ধৃত হয়েছে তার মধ্যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নাম পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে আবদুল মুত্তালিবের নিম্নোক্ত কবিতাসমূহ উদ্ধৃত করেছেন:
لاهم ان العبد يمنع رحلة فامنع حلالك
“হে আল্লাহ! বান্দা নিজের ঘর রক্ষা করে
তুমিও তোমার ঘর রক্ষা করো।”
ومحالهم غدوا محالك لا يغلبن صليبهم
“আগামীকাল তাদের ক্রুশ ও তাদের কৌশল যেন
তোমার কৌশলের ওপর বিজয় লাভ না করে।”
ان كنت تاركهم وقبلتنا فامر مابدالك
“যদি তুমি ছেড়ে দিতে চাও তাদেরকে ও আমাদের কিবলাহকে
তাহলে তাই করো যা তুমি চাও।”
সুহাইলী ‘রঅযুল উনুফ’ গ্রন্থে এ প্রসংগে নিম্নোক্ত কবিতাও উদ্ধৃত করেছেন:
وعابدية اليوم الك وانصرنا على ال الصليب
“ক্রুশের পরিজন ও তার পূজারীদের মোকাবিলায়
আজ নিজের পরিজনদেরকে সাহায্য করো।”
আবদুল মুত্তালিব দোয়া করতে করতে যে কবিতাটি পড়েছিলেন ইবনে জারীর সেটিও উদ্ধৃত করেছেন। সেটি হচ্ছে:
يارب فامنع منهم حماكا يارب لا ارجو لهم سواكا امنعهم ان يخربوا قراكا ان عدو البيت من عاداكا
“হে আমার রব! তাদের মোকাবিলায় তুমি ছাড়া কারো প্রতি আমার আশা নেই, হে আমার রব! তাদের হাত থেকে তোমার হারমের হেফাজত করো। এই ঘরের শত্রু তোমার শত্রু, তোমার জনপদ ধ্বংস করা থেকে তাদের বিরত রাখো।”
এ দোয়া করার পর আবদুল মুত্তালিব ও তার সাথীরাও পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরের দিন আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু তার বিশেষ হাতী মাহমুদ ছিল সবার আগে, সে হঠাৎ বসে পড়ে। কুড়ালের বাঁট দিয়ে তার গায়ে অনেকক্ষণ আঘাত করা হয়। তারপর বারবার অংকুশাঘাত করতে করতে আহত করে ফেলা হয়। কিন্তু এত বেশী মারপিট ও নির্যাতনের পরেও সে একটুও নড়ে না। তাকে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে মুখ করে চালাবার চেষ্টা করলে সে ছুটতে থাকে কিন্তু মক্কার দিকে মুখ ফিরিয়ে দিলে সংগে সংগেই গ্যাট হয়ে বসে পড়ে। কোন রকমেই তাকে আর একটুও নড়ানো যায় না।
এ সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ঠোঁটে ও পাঞ্জায় পাথর কণা নিয়ে উড়ে আসে। তারা এ সেনাদলের ওপর পাথর বর্ষণ করতে থাকে। যার ওপর পাথর কণা পড়তো তার দেহ সংগে সংগে গলে যেতে থাকতো। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও ইকারামার বর্ণনা মতে, সেটা ছিল বসন্ত রোগ এবং আরব দেশে সর্বপ্রথম এ বছরই বসন্ত দেখা যায়। ইবনে আব্বাসের (রা.) বর্ণনা মতে যার ওপরই পাথর কণা পড়তো তার সারা গায়ে ভীষণ চুলকানি শুরু হতো এবং চুলকাতে চুলকাতে চামড়া ছিঁড়ে গোশত ও রক্ত পানির মতো ঝরতে থাকতো এবং হাড় বের হয়ে পড়তো। আবরাহা নিজেও এই অবস্থার সম্মুখীন হয়। তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তো এবং যেখান থেকে এক টুকরো গোশত খসে পড়তো সেখান থেকে রক্ত ও পুঁজ ঝরে পড়তে থাকতো। বিশৃঙ্খলা ও হুড়োহুড়ি ছুটাছুটির মধ্যে তারা ইয়ামনের দিকে পালাতে শুরু করে। খাশ’আম এলাকা থেকে যে নুফাইল ইবনে হাবীব খাশ’আমীকে তারা পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়ে আসে তাকে খুঁজে পেয়ে সামনে নিয়ে আসা হয় এবং তাকে ফিরে যাবার পথ দেখিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু সে সরাসরি অস্বীকার করে বসে। সে বলে:
والاشرم المغلوب ليس الغالب اين المفرو الاله الطالب
“এখন পালাবার জায়গা কোথায় যখন আল্লাহ নিজেই করছেন পশ্চাদ্ধাবন? আর নাককাটা আবরাহা পরাজিত সে বিজয়ী নয়।”
এই পলায়ন তৎপরতার মধ্যে লোকেরা পথে ঘাটে এখানে সেখানে পড়ে মরতে থাকে। আতা ইবনে ইয়াসার বর্ণনা করেছেন তখনই এক সাথে সবাই মারা যায়নি। বরং কিছু লোক সেখানে মারা পড়ে আর দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু লোক পথের ওপর পড়ে যেতে থাকে। এভাবে সারাটা পথে তাদের লাশ বিছিয়ে থাকে। আবরাহাও খাশ’আম এলাকায় পৌঁছে মারা যায়।*
* মহান আল্লাহ হাবশীদেরকে শুধুমাত্র শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি বরং তিন চার বছরের মধ্যে ইয়ামনের ওপর থেকে হাবশী কর্তৃত্ব পুরোপুরি খতম করে দেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাতির ঘটনার পর ইয়ামনে তাদের শক্তি সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে ইয়ামনী সরদাররা ইরানের বাদশাহর কাছ থেকে সামরিক সাহায্য গ্রহণ করে। ছয়টি জাহাজে চড়ে ইরানের এক হাজার সৈন্য ইয়ামনে অবতরণ করে। হাবশী শাসনের অবসান ঘটাবার জন্য এ এক হাজার সৈন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হয়। এটা ৫৭৫ খৃস্টাব্দের ঘটনা।
মুযদালিফা ও মিনার মধ্যে অবস্থিত মহাসাব উপত্যকার সন্নিকটে মুহাস্সির নামক স্থানে এ ঘটনাটি ঘটে। ইমাম মুসলিম ও আবু দাউদের বর্ণনা অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদায় হজ্বের যে ঘটনা ইমাম জাফর সাদেক তাঁর পিতা ইমাম বাকের থেকে এবং তিনি হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তাতে তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে চলেন তখন মুহাস্সির উপত্যকায় তিনি চলার গতি দ্রুত করে দেন। ইমাম নববী এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, আসহাবে ফীলের ঘটনা এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। তাই এ জায়গাটা দ্রুত অতিক্রম করে যাওয়াটাই সুন্নত। মুআত্তায় ইমাম মালিক রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন মুযদালিফার সমগ্র এলাকাটাই অবস্থান স্থল। তবে মুহাস্সির উপত্যকায় অবস্থান না করা উচিত। ইবনে ইসহাক নুফাইল ইবনে হাবীবের যেসব কবিতা উদ্ধৃত করেছেন তাতে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ এভাবে পেশ করা হয়েছে:
لدَى جنب المحصَّب ماراَينا رُدَينةُ لور أيتِ ولاتَريه وخفت حجارة تلقى علينا حمدت الله اذا بصرت طيرًا كأن على للجشان دينا وكل القوم يسئال عن نفيل
“হায় যদি তুমি দেখতে হে রুদাইনা! তবে তুমি দেখতে পাবে না যা কিছু দেখেছি আমি মুহাস্সাব উপত্যকার কাছে। আল্লাহর শোকর করেছি আমি যখন দেখেছি পাখিদেরকে শঙ্কিত হচ্ছিলাম বুঝিবা পাথর ফেলে আমাদের ওপরও। নুফাইলের সন্ধানে ফিরছিল তাদের সবাই আমি যেন হাবশীদের কাছে ঋণের দায়ে বাঁধা।”
এটা একটা মস্তবড় ঘটনা ছিল। সমগ্র আরবে এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক কবি এ নিয়ে কবিতা লেখেন। এ সমস্ত কবিতার একক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, সবখানেই একে আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কোন একটি কবিতাতেই ইশারা- ইঙ্গিতেই একথা বলা হয়নি যে, কা’বার অভ্যন্তরে রক্ষিত যেসব মূর্তির পূজা করা হতো তাদের কারো এতে সামান্যতম হাত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ আবদুল্লাহ ইবনে যিবা’রা বলেন:
ولم يعش بعد الاياب سقيمها ستون الفالم يؤبوا ارضهم والله من فوق العباد يقيمها كانت بها عادوجرهم قبلهم
“ষাট হাজার ছিল তারা ফিরতে পারেনি নিজেদের স্বদেশ ভূমিতে, আর ফেরার পরে তাদের রুগ্ন ব্যক্তি (আবরাহা) জীবিত থাকেনি। এখানে তাদের পূর্বে ছিল আদ ও জুরহুম, আর আল্লাহ বান্দাদের ওপর রয়েছেন, তাদেরকে রেখেছেন তিনি প্রতিষ্ঠিত করে।”
আবু কায়েস ইবনে আস্লাত তার কবিতায় বলেন:
بار كان هذا البيت بين الاخاشب فقوموا فصلوا ربكم وتمسحوا جنود المليك بين ساف وحاصب فلما اتاكم نصرذى العرش ردهم
“ওঠো, তোমার রবের ইবাদাত করো,
এবং মক্কা ও মিনার পাহাড়গুলোর মাঝখানে
বায়তুল্লার কোণগুলো স্পর্শ করো।
আরশবাসীদের সাহায্য যখন
পৌঁছল তোমাদের কাছে
তখন সেই বাদশাহর সেনাবাহিনী
তাদের ফিরিয়ে দিল এমন অবস্থায়—
তাদের কেউ পড়ে ছিল মৃত্তিকার পরে
আর কেউ ছিল প্রস্তরাঘাতে ছিন্নভিন্ন।”
শুধু এখানেই শেষ নয় বরং হযরত উম্মে হানী (রা.) ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামের (র) বর্ণনা অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: কুরাইশরা ১০ বছর (অন্য রেওয়ায়াত অনুযায়ী ৭ বছর) পর্যন্ত এক ও লা শরীক আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করেনি। উম্মে হানীর রেওয়ায়াতটি ইমাম বুখারী তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে এবং তাবারানী, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও বাইহাকী তাদের হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। আর তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া ও ইবনে আসাকির হযরত যুবাইরের (রা.) বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। খতীব বাগদাদী তার ইতিহাস গ্রন্থে হযরত ইবনুল মুসাইয়েবের যে মুরসাল রেওয়ায়াতটি উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। ।। । যে বছর এ ঘটনাটি ঘটে, আরববাসীরা সে বছরটিকে ‘আমূল ফীল’ (হাতির বছর) বলে আখ্যায়িত করে। সেই বছরেই রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম হয়। আসহাবে ফীলের ঘটনাটি ঘটে মহররম মাসে এবং রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম হয় রবিউল আউয়াল মাসে। এ বিষয়ে সকল মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক একমত পোষণ করেন। অধিকাংশের মতে, রসূলের (সা.) জন্ম হয় হাতির ঘটনার ৫০ দিন পরে।
(১০৫-ফীল) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
ওপরের যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংযোজন করা হয়েছে সেগুলো সামনে রেখে চিন্তা করলে এ সূরায় কেন শুধুমাত্র আসহাবে ফীলের ওপর মহান আল্লাহর আযাবের কথা বর্ণনা করেই শেষ করে দেয়া হয়েছে তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। ঘটনা খুব বেশী পুরানো ছিল না। মক্কার সবাই এ ঘটনা জানতো। আরবের লোকেরা সাধারণভাবে এ সম্পর্কে অবহিত ছিল। সমগ্র আরববাসী স্বীকার করতো আবরাহার এ আক্রমণ থেকে কোন দেবতা বা দেবী নয় বরং আল্লাহ কা’বার হেফাজত করেছেন। কুরাইশ সরদাররা আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দোয়া করেছিল। আবার এ ঘটনা কুরাইশদেরকে কয়েক বছর পর্যন্ত এত বেশী প্রভাবিত করে রেখেছিল যে, তারা সে সময় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করেনি। তাই সূরা ফীলে এসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। বরং শুধুমাত্র এ ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। এভাবে স্মরণ করিয়ে দেবার ফলে বিশেষ করে কুরাইশরা এবং সাধারণভাবে সমগ্র আরববাসী মনে মনে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিষয়ের দিকে আহবান জানাচ্ছেন সেটি অন্যান্য মাবুদদেরকে ত্যাগ করে একমাত্র লা শরীক আল্লাহর ইবাদাত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া তারা একথাটিও ভেবে দেখার সুযোগ পাবে যে, এ হকের দাওয়াত যদি তারা বল প্রয়োগ করে দমন করতে চায় তাহলে যে আল্লাহ আসহাবে ফীলকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন তারা তাঁরই ক্রোধের শিকার হবে।
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা :সূরা ফীলে আখেরী নবী মোহাম্মদ (স.)-এর নবুওতপ্রাপ্তির পূর্বে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক ও প্রসিদ্ধ ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে৷ এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র আরব ভূখন্ডকে তার সর্বশেষ সুমহান জ্যোতিকে উদ্ভাসিত করার জন্য পূর্বাহ্নেই নির্বাচিত করে রেখেছিলেন । এ ঘটনা থেকে আরো ইংগিত পাওয়া যায় যে, আরব ভূখন্ড থেকেই বিশ্বব্যাপী হেদায়াতের আলো ছড়িয়ে পড়বে এবং জাহেলিয়াতের মুলৎপাটন করে সত্য কল্যাণের প্রভায় স্নাত হবে গোটা বিশ্ব-নিখিল। আসহাবে ফীলের ঘটনা : বিভিন্ন রেওয়ায়াতের মাধ্যমে জানা যায় যে, ইয়েমেনে পারস্য শাসনের অবসানের পর আবরাহা নামক একজন ইথিওপিয়ান (হাবশী) শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আবরাহা ইয়েমেনে ইথিওপিয়ান শাসকের নামে স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন স্বরূপ এক সুবিশাল গীর্জা নির্মাণ করে৷ তার উদ্দেশ্য ছিলো যে, মক্কার পবিত্র বায়তুল্লাহর পরিবর্তে আরবসহ সকল দেশের অধিবাসীরা যেন এ গীর্জাকেই যেয়ারতের কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করে এবং তীর্থস্থান হিসাবে সবাই যেন এখানেই আসে সে আরো আশা করেছিলো যে, এ গীর্জা সমগ্র আরবের কেন্ত্রস্থলে অবস্থানের কারণে আরব উপদ্বীপের প্রধান তীর্থকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করুক আর উত্তর ও দক্ষিণের সকল অধিবাসীরাই দলে দলে এখানে ছুটে আসুক । রাজার কাছে তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুমোদন কামনা করে সে একটি চিঠিও পাঠায় । কিন্তু আরবদের দৃষ্টি পবিত্র বায়তুল্লাহকে পরিত্যাগ করে তার নবনির্মিত গীর্জার প্রতি আদৌ আকৃষ্ট হলো না। আরবরা নিজেদেরকে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর উত্তরসূরী হিসাবে দাবী করতো আর ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-এর নির্মিত বায়তুল্লাহকে পবিত্র ঘর হিসাবে এর মর্যাদা ও সম্মানের সংরক্ষণ এবং এর ঐতিহ্যকে ধরে রাখাকে নিজেদের জন্য অত্যন্ত গৌরবজনক বলে মনে করতো । তারা ইহুদী ও খৃষ্টানদের তীর্থভূমির চেয়ে ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর হওয়া ও তাদের প্রতিষ্ঠিত বায়তুল্লাহর সুউচ্চ গৌরব ও মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখাকে তাদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করতো । বায়তুল্লাহর মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া বা এর পতন ও বিপর্যয় সাধনের চিন্তা তাদের কাছে ছিলো অকল্পনীয় । তারা সকল আহলে কেতাবের চেয়ে কাবার রক্ষক ও তার প্রতিবেশী হিসাবে নিজেদেরকে অধিক সম্মানের অধিকারী মনে করতো । এমতাবস্থায় আবরাহা তার নির্মিত গীর্জার গুরুত্ব ও মর্যাদার স্বীকৃতি না পেয়ে কাবাঘরের ধ্বংস সাধন, একে ধূলিষ্মাৎ করা ও কাবা থেকে লোকদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। আবরাহা তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ৬০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল হস্তি বাহিনী নিয়ে কাবাঘর ধ্বংসের অভিযানে রওয়ানা হলো। আবরাহা রওয়ানা দেয়ার পর আরবরা এ সংবাদ শুনেও ফেললো ৷ ‘যুনফর’ নামক এক অভিজাত ইয়েমেনী নেতা আবরাহার এ অভিযান প্রতিরোধ ও বায়তুল্লাহর ধ্বংস থেকে তাকে বিরত রাখার জন্য তার নিজের গোত্র ও বিভিন্ন গোত্র থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে আবরাহার সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধে যুনফর ও তার বাহিনী আবরাহার মোকাবেলায় পরাজয় বরণ করে ও যুনফর আবরাহার হাতে বন্দী হয়। এরপর পথিমধ্যে আরবের দুটি প্রসিদ্ধ গোত্র ও বিপুল সংখ্যক আরবদেরকে সাথে নিয়ে নুফাইল ইবনে হাবীব আল খাসয়ামী আবরাহার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে এ বাহিনীও পরাজিত হয় এবং নুফাইল বন্দী হয়। এমনিভাবে এ সকল খন্ডযুদ্ধে আবরাহার বিজয়ের কারণে আরবের মনে আরো আতংক সৃষ্টি হয়। অতপর আবরাহা বাহিনী তায়েফের নিকটবর্তী সাকীফ গোত্রের এলাকায় এলে বনু সাকীফ তাদের দেবতা ‘লাত’-এর জন্য নির্মিত মন্দিরকে তাদের হাত থেকে হেফাযতের জন্যে আবরাহা বাহিনীকে সহযোগীতা করলো । বনু সাকীফের নেতা আবরাহা বাহিনীকে মক্কার পথ প্রদর্শনের জন্য তার গোত্র থেকে একজন রাহবারও তাদের সাথে দিয়ে দেয়। একজন মুশরিকের ঈমানী দৃঢ়তা! : আবরাহা অগ্রসর হয়ে তায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী স্থান মুগাম্মাসে অবস্থানকালীন ‘তেহামা’ ও ‘কোরায়শ’ সহ বিভিন্ন গোত্রের কয়েকশত গৃহপালিত পশু চারণভূমি থেকে নিয়ে যায়। এই পশুসমূহের মধ্যে আবদুল মোত্তালেব ও বনু হাশেমের দু’শত উটও ছিলো । আবদুল মোত্তালেব ছিলেন কোরায়শদের মধ্যে গণ্যমান্য ব্যক্তি ও গোত্রপতি । কোরায়শ, কেনানা ও হুযায়ল গোত্রের লোকেরা প্রথমত আবরাহা বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এতো বড়ো বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে পরাস্ত হতে হবে মনে করে তারা তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।(বিভিন্ন তাফসীর থেকে জানা যায় যে, আবরাহা বাহিনীতে ৬০ হাজার সৈন্য ও ১৩টি হস্তি ছিলো ।-সম্পাদক) মক্কায় প্রবেশ করে অবরাহা এ মর্মে দূত পাঠায় যে, সে শুধু কাবা ঘর ধ্বংসের জন্যই এসেছে, যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। সে মক্কাবাসীকে এটাও জানাতে চায় যে, কাবার প্রতিরক্ষার জন্যে যদি মক্কাবাসী মোকাবেলায় লিপ্ত না হয়; তাহলে রক্তপাতের কোনো ইচ্ছা তার নেই । আবদুল মোত্তালেব আবরাহার দূতের সাথে আলোচনার পর তাকে জানান যে, আল্লাহর কসম, আবরাহার সাথে যুদ্ধের কোনো ইচ্ছাই আমাদের নেই, তার সাথে যুদ্ধ করার শক্তিসামর্থও আমাদের নেই৷ এটি আল্লাহর পবিত্র ঘর ও ইবরাহীম (আ.)-এর নির্মিত । আল্লাহই এর রক্ষাকর্তা। আল্লাহ তায়ালা তার ঘরকে রক্ষা করতে চাইলে তিনিই তা রক্ষা করবেন। আর যদি তিনি তার ঘরকে রক্ষা না করেন, তবে আল্লাহর কসম, অন্যথায় প্রতিরোধের কোনো শক্তিই আমাদের নেই। আবরাহার দূতের সাথে আলোচনার পর আবদুল মোত্তালেব নিজেও আবরাহার কাছে যান। এতিহাসিক ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, আবদুল মোত্তালেব তৎকালীন সমাজে খুবই প্রসিদ্ধ ও সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী ৷ আবরাহা তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় । এমনকি তাকে নিচে বসিয়ে নিজে সিংহাসনে বসে থাকাও সমীচীন মনে করলো না। আবরাহা আবদুল মোত্তালেবের সম্মানে সিংহাসন থেকে নেমে বিছানায় বসে পড়লো এবং আবদুল মোত্তালেবকে তার পাশেই বসালো । তারপর আবরাহা তার (দোভাষীর মাধ্যমে জানতে চাইলো, কোরায়শ সরদার আবদুল মোত্তালেবের আগমনের উদ্দেশ্য কী? আবদুল মোত্তালেব বললেন, আমার উট ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছি। আবদুল মোত্তালেবের কথা শুনে আবরাহা বললো, হে কোরায়শ নেতা । আমি আপনাকে দেখে প্রথম মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম । আমি আপনাকে খুবই প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তি বলেই ধারণা করেছিলাম, কিন্তু আপনার কথা আমার সমস্ত ধারণাকেই পাল্টে দিলো। আপনি আপনার উটের প্রসংগটাই আমার কাছে উত্থাপন করলেন, অথচ আপনি ও আপনার পূর্ব পুরুষদের সম্মানিত ঘর ও আপনাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাণকেন্দ্র কাবাঘরের প্রসংগটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন! যে ঘর ধ্বংস করার জন্য আমি এসেছি, সে প্রসংগে কোনো কথাই আপনি উত্থাপন করলেন না? আবরাহার এ প্রশ্নের জবাবে আবদুল মোত্তালেব বললেন, হে রাজা! আমি উটের মালিক, তাই আমি উটের প্রসংগ উত্থাপন করেছি। কাবার মালিক তো আমি নই। তাই কাবা রক্ষার দায়িত্বও আমার নয়, কাবা ঘরের যিনি মালিক, তিনিই তার ঘর রক্ষা করবেন। আবরাহা বললো, আমার হাত থেকে কাবা ঘর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আবদুল মোত্তালেব বললেন, এ ব্যাপারে আপনার সাথে কাবার মালিকের সাথেই বুঝাপড়া হবে। এই আলাপ আলোচনার পর আবরাহা আবদুল মোত্তালেবের উটগুলো ফেরত দেয়। আব্দুল মোত্তালেবের দোয়া : আবদুল মোত্তালেব ফিরে এসে সবার কাছে আদ্যোপান্ত সমস্ত বিবরণ তুলে ধরলেন । আবদুল মোত্তালেব মক্কাবাসীকে ঘরবাড়ী ছেড়ে মক্কা থেকে বেরিয়ে পর্বত চুড়ায় আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেন। মক্কা নগরী থেকে রেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আবদুল মোত্তালেব আরও কিছু সংখ্যক কোরায়শসহ কাবার দরজায় কণ্ঠলগ্ন হয়ে অশ্রু বিগলিত নয়নে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। কথিত আছে, আবদুল মোত্তালেব তখন আবেগ ভরা কণ্ঠে নিম্নোক্ত কবিতা গুচ্ছ আবৃত্তি করছিলেন, ‘হে প্রভু! বান্দা তার নিজ ঘরকে রক্ষা করে তুমি তোমার ঘরকে রক্ষা করো। কাল যেন তোমার ঘরের ওপর ক্রুশ ও তাদের অভিযান বিজয়ী না হয়। তুমি যদি আমাদেরকে ও তোমার ঘরকে এমনি ছেড়ে দিতে চাও তাহলে সেটা হবে তোমার ব্যাপার, তোমার যা ইচ্ছা তাই করতে পারো !’ শেষ পর্যন্ত আবরাহা যখন তার সমস্ত সৈন্য ও হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবাঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো তখন তার হাতিগুলো আকস্মিকভাবে থমকে দাড়ালো, হাতিগুলোকে সামনেআগানোর জন্যে অনেক চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও এ হাতিগুলো এক পাও অগ্রসর হলো না। হাতির এ আচরণ বোখারী শরীফে বর্ণীত রসূলুল্লাহ (স.)-এর একটি হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয়। পরবর্তীকালে ওমরার উদ্দেশ্যে আল্লাহর রসূল (স.) যখন ১৪০০ সাহাবীকে নিয়ে মদীনা থেকে মক্কায় রওয়ানা হন, তখন হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছার পর আল্লাহর রসূলের উট আর মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো না। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ উটগুলো অবাধ্য হয়ে গেছে, ওরা মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে না। রসূল (স.) বললেন, উট অবাধ্য হয়নি- অবাধ্য হওয়ার জন্য ওদেরকে সৃষ্টি করা হয়নি বরং হস্তিবাহিনীর বন্ধনী তাদেরকে আটকে দিয়েছে (প্রকৃত পক্ষে এ বছর রসূল (স.) মক্কা গিয়ে ওমরাহ করতে পারেননি,হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তির পর পরের বছর গিয়ে ওমরাহ করেছেন ।-সম্পাদক) বোখারী ও মুসলিমে বর্ণীত হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, মহানবী (স.) মক্কা বিজয়ের দিন দশ হাজার সাহাবীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মক্কাকে হস্তিবাহিনী থেকে হেফাযত করেছিলেন, আর তাঁর রসূলকে ও মোমেনদেরকে বিজয়ীর বেশে প্রবেশের সম্মান দান করেছেন। মক্কা নগরীর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা সেদিন যেমনি অপরিহার্য ছিলো, আজও তেমনি অপরিহার্য । তোমরা যারা আমার যবান থেকে একথাগুলো শুনছো, তারা যারা এখানে অনুপস্থিত তাদের নিকট অবশ্যই এ কথাগুলো পৌছে দিও ।’ উল্লেখিত হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে হস্তিবাহিনীর ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আবরাহা বাহিনীর শোচনীয় অবস্থা : অতপর আল্লাহ তায়ালা শুধু হাতির পা গুলোকেই স্তব্ধ করে দিলেন না, বরং আবরাহা সহ পুরো বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্যে পাথরসহ দলে দলে আবাবীল পাখী পাঠালেন । ঝাঁকে বাঁকে পাখী মুখে ও পায়ে পাথর নিয়ে আবরাহা বাহিনীর ওপর নিক্ষেপ করতে লাগলো। পাথরের আঘাতে তাদের অবস্থা জন্তু জানোয়ারের চর্বিত ঘাষপাতার মতো হয়ে গেলো । তারা চর্বিতচর্বণে পরিণত হলো। যার বর্ণনা আল কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে। আবরাহা নিজেও পাথরের আঘাত থেকে বাচতে পরলোনা ৷ সে তার দলবল নিয়ে ক্ষতবিক্ষত ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ইয়েমেনের রাজধানী ‘সানা’য় গিয়ে পৌঁছে, পরে সে তার হৃদয় বিদীর্ণ অবস্থায় মারা যায়। এ ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা রয়েছে- পাখী ও পাথরের আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কেও নানা ধরনের মতামত পাওয়া যায়। মোট কথা, বিভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এক অলৌকিক এবং অস্বাভাবিক অতি প্রাকৃতিক ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা হস্তিবাহিনীর ধ্বংস সাধন করেন। কেউ কেউ বলেন, পাথরকুচি নিক্ষেপের ফলে এক ধরনের জটিল চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়ে তাদের শরীরে পচন ধরে তারা মৃত্যুবরণ করে। ওই বছর মক্কায় ভীষণ চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে । কেউ কেউ পাখী বলতে মশা মাছি, আর পাথর কুচি বলতে মশা-মাছির ছড়িয়ে দেয়া রোগ জীবাণুকে বুঝিয়েছেন । কেননা পাখি বলতে বুঝায় যা পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় । মশা মাছিও পাখা ছড়িয়ে উড়ে বেড়ায় ৷ ইমাম মোহাম্মাদ আবদুহু তার লিখিত তাফসীরে লিখেছেন, আবদুল মোত্তালেবের দোয়ার পরদিন ব্যাপকভাবে চর্ম ও খুজলী-পীচড়া রোগ ছড়িয়ে পড়ে! ইকরামা বলেন, হস্তিবাহিনীর এ ঘটনার মাধ্যমে আরব দেশে মহামারী আকারে চর্ম রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে ৷ ইয়াকুব ইবনে ওৎবা বর্ণনা করেছেন, এই ঘটনার বছরেই আরব দেশে চর্মরোগ, খুজলী-পাচড়া মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করে। সে এমন ধরনের জটিল ও কষ্টদায়ক চর্ম রোগ, যাতে প্রথম এক ধরনের খুজলীর মতো ওঠে, পরে তা পচে গলে চামড়া ঝরে পড়তে থাকে, তার পর খসে পড়া অংশ থেকে রক্ত পুঁজ নির্গত হতে থাকে এবং রুগ্ন ব্যক্তির দেহ ক্ষত-বিক্ষত ও দুর্গন্ধময় হয়ে যায় আর তিলে তিলে যন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এমনি ভাবে পাথরকুচি নিক্ষেপের ফলে আবরাহা ও তার সেনাবাহিনীর দেহে পচন ধরে। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করে। আবরাহা ক্ষতবিক্ষত দেহে ‘সানায়’ উপস্থিত হওয়ার পর মারা যায় । অবশ্য এ ব্যাপারে অধিকাংশের মতে এটিই বিশুদ্ধ মত যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখী দ্বারা নিক্ষিপ্ত পাথরকুচি দেহে পড়ার সাথে সাথে সেখানে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং বাতাসের মাধ্যমে বিষাক্ত জীবাণুর সংমিশ্রণে আহত ব্যক্তি বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। কারো কারো মতে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে এ মর্মও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, এ পাখীকুল মশা, মাছিও হতে পারে, যারা বিভিন্ন রোগ-জীবাণু বহন করে ঘুরে বেড়ায় । এ সকল জীবাণু পাকা মাটির সাথে মিশ্রিত ছিলো আর ছোট ছোট পাখীর দল মাটির ক্ষুদ্র কণা জীবাণুসহ হস্তিবাহিনীর ওপর নিক্ষেপ করে। পাখিদের নিক্ষিপ্ত পাথরের টুকরা থেকে বায়ুমন্ডলীয় প্রবাহের সাথে মানব দেহের লোমকুপে প্রবেশ করে এক মারাত্মক ধরনের ক্ষত ও চর্ম রোগের সৃষ্টি করে। তখন পচন ধরা সেই দেহগুলো ক্ষতবিক্ষত হয় এবং পুঁজ ও রক্ত নির্গত হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়। মানব সত্যতার ইতিহাসে এ ক্ষুদ্র প্রাণীকুল যুগে যুগে আল্লাহর শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করে আসছে । খোদাদ্রোহীদের বিনাশ সাধনে আজও এদের তৎপর হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আল্লাহ তায়ালা তার মহান কুদরতে ক্ষুদ্র পাখীদের দ্বারা শত্রুকে বিনাশ সাধন করতে পারেন, ‘আসহাবে ফীল’ এর ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ৷ এ ঘটনার তাৎপর্য এও হতে পারে, পর্বত চূড়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী এসে পাথরকুচি নিক্ষেপের ফলে তাদের ধ্বংস সাধিত হয়৷ আল্লাহর সৈনিক তো সবাই হতে পারে। সৃষ্টির প্রতিটি পরতে পরতে তারই অস্তিত্বের নিদর্শন বিরাজমান ৷ প্রকৃতির জগতের প্রতিটি অণু-পরামাণু সাক্ষ্য দিচ্ছে আল্লাহ শুধু একজন ৷ সমগ্র সৃষ্টিতে এমন কোনো শক্তিও নেই যা আল্লাহর শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। বিদ্রোহী আবরাহা তার সকল শক্তি নিয়ে আল্লাহর ঘর ধ্বংস করতে এলে আল্লাহ তায়ালা পাথরকুচিসহ ক্ষুদ্র পাখি প্রেরণ করে আবরাহা ও তার দলবলকে মক্কা নগরীতে প্রবেশের আগেই ধ্বংস করে দিলেন । এ ছিলো আল্লাহর এক বড়ো ধরনের অনুগ্রহ, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তার শেষ নবী (স.) ও তার ঘরের ও হেরেমের মর্যাদাকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা যদি সে মুহূর্ত তার ঘরের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ না করতেন, তাহলে আবরাহার হস্তিবাহিনী মক্কাবাসীসহ বায়তুল্লাহকে ধ্বংস করে দিতো । পুরো ঘটনার এ তাফসীরকেই আমরা নির্ভরযোগ্য, বিশুদ্ধ তাফসীর হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। এছাড়া অপরাপর ব্যাখ্যাকে নানাবিধ সুনির্দিষ্ট দলীল-প্রমাণ ব্যতীত গ্রহণ করা ও তার বিশুদ্ধতাকে মেনে নেয়া যায় না, যদিও বিশুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়। এখানে আরও লক্ষণীয় যে, চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে সর্বাদিক বিশাল বপুর অধিকারী হাতিকে আল্লাহর ক্ষুদ্র পক্ষীকুল ও পাথরকুচি দ্বারা ধ্বংস সাধনের ব্যাপারটিও সত্যিই বড় অদ্ভুত ও বিস্ময়কর! আমরা এর কোনো বাস্তব ব্যাখ্যা খুজে পাচ্ছি না যা মোহাম্মদ আবদুহ তার তাফসীরে পার্থীব চক্ষু, চোখ ও পায়ের মাটির সাথে জীবাণু ছড়িয়ে চর্ম রোগের প্রাদুর্ভাবের মাধ্যমে হস্তিবাহিনীর ধ্বংস হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন৷ অথচ ইকরামার রেওয়ায়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- ছোট ছোট পাথর নিক্ষেপ হাতি ও আরোহীদের মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে এবং তাদের দেহ চর্বিত চর্বনের মতো ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে গেছে এবং সূরার শেষ আয়াতে যাকে ”কা-আসফিম মা’কুল” বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো চর্বিত চর্বণের মতো হয়ে যাওয়া ৷ এ পন্থায়ও আল্লাহর কুদরতের উপলব্ধি আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা খুবই কঠিন। আল্লাহ তায়ালা যে কোনো পদ্ধতিতে তার ইচ্ছাকে কার্যকর করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা মানুষের পরিচিত পন্থায় উন্মুক্তভাবেই যদি কোনো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চান, ধ্বংস করতে পারেন। অথবা মানুষের অপরিচিত অকল্পনীয় ও অদৃশ্যভাবে তার পরিকল্পনাকে কার্যকর করতে পারেন। তিনি তাঁর ইচ্ছাকে কার্যকর করার ব্যাপারে সর্বশক্তিমান । তিনি কোনো নিয়মের অধীন নন, বরং তার গৃহীত পন্থাই হলো আসল নিয়ম। আল্লাহ্ তায়ালার নিয়ম তো তাই, যা তিনি করেন। আল্লাহর গৃহীত পন্থা, মানুষের চির পরিচিত হওয়া, মানুষের শক্তি-সামর্থ ও অনুভূত-ও বোধগম্য হওয়া মোটেই জরুরী নয়। আল্লাহ তায়ালা যদি চিরাচরিত পরিচিত পদ্ধতির বিপরীত অলৌকিক ও অতি প্রাকৃতিক পন্থায়ও কোনো কিছু করেন, তবে তাকেই আল্লাহর গৃহীত পন্থা ও পদ্ধতি হিসাবে মেনে নিতে হবে। যারা অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করে না, অথবা যারা বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে এ ঘটনার নানাবিধ ব্যাখ্যা করতে চায় তাদের কারও মতামতকে আমরা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য বলে গ্রহণ করতে পারি না। কোরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট ওহী দ্বারা ঘটনার বিস্ময়তা ও অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হয়। অথচ তা মানুষের সমাজে প্রচলিত পরিচিত সাধারণ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত ৷ মানুষের সমাজে প্রচলিত, পরিচিত নিয়ম ও ধারণা বহির্ভূত হলেই যে তা আল্লাহর নিয়ম ও সামর্থের বাইরে হবে তা নয়। সূর্যের প্রতিনিয়ত উদয়াস্ত, মানবদেহের অভ্যন্তর থেকে জীবিত মানব শিশুর প্রসব, এ সকল ঘটনাও তো মানুষের নিজস্ব শক্তি ও ক্ষমতা বহির্ভূত, অথচ তা মানুষের দৃষ্টিতে চির পরিচিত ও সব সময় তা ঘটছে। তাই আল্লাহ তায়ালা যদি ক্ষুদ্র পাখী ও পাথরকণা দ্বারা কোনো শক্তিধর শত্রুবাহিনীকে পরাস্ত ও পর্যদুস্ত করেন, তবে মহা শক্তিমান আল্লাহর জন্য তা একান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি যদি ক্ষুদ্র পাখি ও পাথরকুচি দ্বারা কোনো বাহিনীকে মহামারীর মতো ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত করে ধ্বংস সাধন করেন, এটি তার জন্য খুবই সহজতর ৷ তিনি নির্দিষ্ট সময় বিস্ময়কর ঘটনার মাধ্যমে মানব সমাজে সাধারণ প্রচলিত নিয়মের বিপরীত পন্থায় তার ঘরের সংরক্ষণ ও প্রতিরোধকল্পে অলৌকিক পদ্ধতিতে যদি পাখী ও পাথরকুচি দ্বারা শত্রু বাহিনীর দেহকে ক্ষতবিক্ষত করে থাকেন, তবে তা আল্লাহর গৃহীত সফল পদক্ষেপ এবং তা তার জন্য সহজ। এসবই তার অসীম কুদরতের প্রমাণ বহন করে । ঘটনার তাৎপর্য : এ ঘটনাকে আমরা যদি অলৌকিকত্বের কারণে গ্রহণ করতে ইতস্তত করি এবং পাখি ও পাথরকূচির আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে নানা ধরনের অভিমত পোষণ করি তবে এর পূর্বেও তো আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের শত্রুদেরকে ও বিভিন্ন নবীদের দাওয়াত অস্বীকার করার কারণে অনেক সম্প্রদায়কে অলৌকিক পন্থায় ধ্বংস সাধন করার ঘটনাবলির অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই কালামে পাকের মধ্যে । আমরা সে সকল ঘটনাকে কোন দৃষ্টিতে গ্রহণ করবো! প্রকৃত মানবীয় শক্তি ও সামর্থের দৃষ্টিতে যা সসীম মানুষের শক্তি ও সামর্থ বহির্ভূত বলে অনুভূত হয়, অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহর পক্ষে তা খুবই স্বাভাবিক ও সহজতর । আমরা অত্যন্ত সহজভাবেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আল্লাহ তায়ালা তার পবিত্র ঘরের হেফাযতের লক্ষে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল সংরক্ষণের জন্য তার অসীম কুদরতের মাধ্যমে মানবীয় দৃষ্টিতে অলৌকিক পদ্ধতিতে অভিযানকারীদেরকে ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন। তিনি তার অসীম ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাওহীদের দাওয়াত ও নবুওতের অস্বীকারকারী কোরায়শ সম্প্রদায়কে এ ঘটনা থেকে উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের ইংগিত প্রদান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের বিরোধীদের সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকে অনায়াসে ব্যর্থ ও পর্যদুস্ত করে দিতে সক্ষম ৷ এ ব্যাপারে তার কোনো বড়ো ধরনের প্রস্তুতি ও শক্তিশালী কোনো মাধ্যম ও উপায় উপকরণের প্রয়োজন নেই। সকল যুগের মানুষের সামনে তার কালজয়ী অসীম কুদরতের দৃষ্টান্ত তিনি উপস্থাপন করেছেন। রসূলুল্লাহ (স.)-এর নবুওতের দাওয়াতের সূচনালগ্নেই কোরায়শদের চোখে আংগুল দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিলেন যে, কি বিস্ময়কর ও অকল্পনীয়ভাবে তিনি তার দ্বীনের ও তার ঘরের হেফাযতের জন্য বিরোধী ও চক্রান্তকারী শক্তিকে কতো সামান্য ও ক্ষুদ্র শক্তির মাধ্যমে চিরতরে পরাস্ত করে দিতে পারেন, পরাজিত, চূর্ণবিচুর্ণ, ক্ষতবিক্ষত, নিশ্চিহ্ন ও নাস্তানাবুদ করে দিতে পারেন। তার পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য কোনো পরিচিত পদ্ধতি ও পন্থা গ্রহণ করা তার জন্য জরুরী নয়। তার ইচ্ছা ও পরিকল্পনাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি এক ও একক শক্তিমান । উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা সূরা ফীলের সংশ্লিষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে শায়খ আবদুহুর ব্যাখ্যাকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারি না। বিশেষ করে, মহামারী আকারে মাটির সাথে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ফলে চর্মরোগ সৃষ্টি হয়েছে এ ব্যাখ্যা যদি গ্রহণ করা হয় তবে কোরআনে হাকীমে বর্ণীত পাখীদের বয়ে আনা পাথরকুচির আঘাতে সেনাবাহিনীর দেহ ক্ষতবিক্ষত, চুর্ণবিচুর্ণ, হৃদয় দীর্ণবিদীর্ণ ও চর্বিত চর্বনে পরিণত হওয়ার স্পষ্ট বর্ণনাকে গ্রহণ করা যায় না। অথচ কোরআনে অত্যস্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে- ‘কা-আসফিম মা’কুল’ ৷ এ আয়াতে তাদের দেহ খন্ড-বিখন্ড চূর্ণ বিচূর্ণ ও চর্বিত চর্বণের পরিণত কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণীত হয়েছে। ইকরামার বর্ণনায় সে বছর প্রথম বারের মতো মক্কায় চর্মরোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটিও সুস্পষ্ট নয়। সূরা ‘ফীলে’ বর্ণীত আয়াতে আবরাহা ও তার সেনাদলের মধ্যে চর্মরোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার কথাও পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি । এমন কি তৎকালীন সময়ে আরবে চর্মরোগে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি ঐতিহাসিক বর্ণনায়ও সত্য বলে প্রমাণিত হয় না। শায়খ আবদুহু বিষয়টি বৈষয়িক বিশ্লেষণ ও প্রচলিত নিয়মের বিপরীত হওয়ার কারণেই কিছুটা হীনমন্যতাপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে এ ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন সে প্রতিষ্ঠানটি তথাকথিত আধুনিক প্রগতিবাদীদের বিকৃত চিন্তা থেকে মুক্ত ছিলো না। সে প্রতিষ্ঠানে তথাকথিত যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেয়া হতো । তৎকালীন সময়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিকৃত চিন্তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রাণ কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিলো । কোরআনে কারীমের সব কিছুকে যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা প্রদান করার মানসিকতা ছিলো এই প্রতিষ্ঠানের সাথেজড়িত ব্যক্তিদের অন্যতম বৈশিষ্ট বুদ্ধি ও যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য মনে না হলেই কোরআনের আয়াতসমূহকে ইহুদীদের বানোয়াট গল্প কাহিনীর প্রলেপ ছড়িয়ে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের বানোয়াট ও বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদানের প্রবণতা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্লাবনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো । তৎকালীন সময়ে হাদীস অস্বীকার করার প্রবণতাও কিছু লোকের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আল কোরআনকে বৈষয়িক দর্শন ও তথাকথিত যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সমকালীন বিজয়ী সমাজ দর্শন ও প্রকৃতি দর্শনের ভিত্তিতে তারা কোরআনের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। তাদের চিন্তা, স্থূলদৃষ্টি ও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইসরাইলী ও খৃষ্টীয় চিন্তাধারা দ্বারা সংক্রামিত হয়। প্রত্যেক ব্যাপারে জড়বাদী ব্যাখ্যার মননশীলতার কারণে, শায়খ আবদুহু ও তার দু’জন সেরা ছাত্র শায়খ রশীদ রেজা ও শায়খ আবদুল কাদের মাগরেবী অনেক ক্ষেত্রে অলৌকিক অতি প্রাকৃতিক স্থুলবুদ্ধি ও জড় দর্শনের ইন্দ্রিয়াতীত অদৃশ্যমান ঘটনাসমূহকে অস্বীকার অথবা বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। আল কোরআনের ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাদের এ আত্মরক্ষা মূলক মানসিকতা গড়ে ওঠে, আর এ কারণেই উল্লেখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত চিন্তাবিদরা ইসলামের নবতর ব্যাখ্যা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন৷ এমনিভাবে তারা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের এমন ব্যাখ্যা প্রদান করেন যা সংশ্লিষ্ট মূল বক্তব্যের ও লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। অনেক ক্ষেত্রে বাহ্যিক যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে উপলব্ধি না করা গেলেও কোরআনের বর্ণীত বহু অলৌকিক ঘটনা আল্লাহর অসীম কুদরত ও সর্বশক্তিমান সত্ত্বারই প্রমাণ উপস্থাপন করে। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা : এ সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই চিন্তার বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে খুবই প্রজ্ঞা ও সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য ৷ বিশেষ করে তথাকথিত আধুনিক চিন্তাধারা থেকে আত্মরক্ষার ব্যাপারেও গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত৷ এখানে এটি অত্যন্ত নিখুত, নির্ভুল ও নিরাপদ পদ্ধতিতে আল কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতের দৃষ্টিভংগিই প্রমাণিত হয়। এ বিশ্বয়কর ও অভিনব পদ্ধতিতে আল্লাহর ঘরের হেফাযত ও অলৌকিকভাবে শত্রু নিপাতের ঘটনাকে উপস্থাপন ও প্রমাণ করাই হচ্ছে আলোচ্য সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । তাই কোরআনের সুস্পষ্ট ভাষ্যকে প্রচলিত বুদ্ধি-বিবেক ও স্থুলদৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে কোনো বিষয় বুঝে না আসলে তা অস্বীকার করা কিছুতেই আমাদের জন্য বৈধ ও সংগত হতে পারে না। আল্লাহর গৃহীত কার্যক্রম ও পদক্ষেপকে সবসময়ই সাধারণ নিয়মের নিরিখে বিচার ও বিশ্লেষণ করা যায় না। আর কোরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক তাফসীর পদ্ধতিও গ্রহণযোগ্য নয়, বরং আমাদের বুদ্ধি-বিবেক, যোগ্যতা, প্রতিভা ও সাধনাকে আল্লাহ প্রদত্ত ভাষ্যকে স্বপ্রমাণিত করার জন্যই নিয়োগ ও ব্যয় করা উচিত । এ পদ্ধতিতে আল্লাহর প্রতি আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় ও আমাদের ঈমানী শক্তি আরও মযবুত ও বৃদ্ধি পেতে পারে। আমাদের চিন্তা ও ভাষা, আমাদের অনুভূতি ও প্রজ্ঞাকে সামষ্টিকভাবে আল্লাহর ভাষ্যকে প্রমাণিত করার জন্য আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন । এক্ষেত্রে স্থুলবুদ্ধি, যুক্তি, আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে আমাদের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে গ্রহণ না করে ঈমান ও একীনের বুনিয়াদেই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়া অপরিহার্য । আল কোরআনের সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ভাষ্যের আলোকেই বিশ্ব প্রকৃতির ঘটনাসমূহ, ইতিহাস, ঐতিহা, অদৃশ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত ঘটনা, মানবিক চিন্তা ও মূল্যবোধ, স্থুলবুদ্ধির পরিবর্তে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে কোরআন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান দ্বারা আল কোরআন তথা অসীম কুদরতময় আল্লাহ তায়ালার ভাষ্যকে বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করার মানসিকতা কখনও গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত হতে পারে না। কেননা মানবীয় জ্ঞান বুদ্ধি খুবই সীমাবদ্ধ ও মানুষের বিশ্লেষণ শক্তি ও অভিজ্ঞতা একান্ত সসীম। মানুষের বুদ্ধি ও বিবেক যদিও জ্ঞান-সাধনা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ও ভূমিকার অধিকারী এবং অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বুদ্ধি-চিস্তা ও গবেষণা খুবই বিস্ময়কর অবদান রাখে, তথাপি প্রকৃত বিশ্লেষণ, তথ্যানুসন্ধান ও সত্য আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন । সে ক্ষেত্রেও মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান বারংবার ভুলের সমুদ্রে সাতার কাটতে থাকে । মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক প্রসূত অভিজ্ঞতা ও পর্যালোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হতে পারে । কেননা মানুষের বুদ্ধি ও জ্ঞান খুবই সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ । আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সাথে মানবীয় জ্ঞানের কোনো প্রকার তুলনা বা উপমাই হতে পারে না। আল কোরআনের প্রদত্ত জ্ঞান ও সিদ্ধান্ত সে অসীম প্রজ্ঞাময় সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত, তাই মানুষের জ্ঞান পিপাসা সে অসীম সত্ত্বার প্রশ্রবণ থেকে নিসৃত স্বচ্ছ জ্ঞান সুধা দ্বারা মিটতে পারে। পিপাসা কাতর মানুষ একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত আল কোরআনের আবে হায়াতের পেয়ালা পান করেই অতৃপ্ত হৃদয়ের সকল ক্ষুধা ও পিপাসার জ্বালা নিবারণ করতে পারে। তাই কোরআনে উপস্থাপিত কোনো ঘটনা, তথ্য ও তত্ত্বকে মানুষের স্থুল-বুদ্ধি বিবেকের সাথে সংঘাত ও সংঘর্ষশীল মনে করে তাকে অস্বীকার করা বা তার অপব্যাখ্যা করা আল কোরআনের প্রতি বিশ্বাসের দাবীদার কোনো মানুষের পক্ষে কশ্মিনকালেও সম্ভব হতে পারে না। বস্তুত, কোনো মোমেনেরই এ অধিকার নেই । অথচ স্থুল বুদ্ধি বিবেকের পর্যালোচনায় আল কোরআনের উপস্থাপিত অনেক ঘটনা ও ভাষ্যকে সংঘাত ও সংঘর্ষশীল মনে করে উপরোল্লিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা প্রদানের অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। তাদের এ সকল ব্যাখ্যাকে আমি তাদের ইচ্ছাকৃত ভ্রান্তি ও বিকৃত চিন্তার ফলশ্রুতি কিনা সে সম্পর্কে আমি মন্তব্য করবোনা, কিন্তু অজ্ঞাতসারে ও অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এসকল ক্ষেত্রে তারা মানুষের বুদ্ধি বিবেককে আল কোরআনের ওপর প্রাধান্য প্রদান করেছেন, যুক্তি ও বুদ্ধিকে কোরআনের নিয়ন্ত্রক শক্তির আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। আমরা কোনো মতেই আল কোরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও ভাষ্যের পরিপন্থী এ ধরনের বুদ্ধি ও যুক্তির আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে গ্রহণ করতে পারি না। আল কোরআনের সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন বক্তব্য ও ভাষ্যের পরিপন্থী ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা মোমেনের জন্যে অচিন্তনীয় ও অকল্পনীয় । আমাদের প্রত্যয়দীপ্ত সুস্থ বিবেক-বৃদ্ধি ও চেতনা কখনো এ ধরনের অপব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে না। এ ধরনের প্রবণতাকে প্রশ্রয় প্রদান করা মুসলিম জাতিসত্ত্বার অবলুপ্তি ও ইসলামী জীবনবোধ ও চেতনার অপমৃত্যুরই নামান্তর । এ ধরনের মন-মানসিকতা, চিন্তা ও কল্পনা প্রকৃতপক্ষে আল কোরআনের পেশকৃত সত্য তথ্য ও ঘটনারাজিকে অস্বীকার করার শামিল । আসুন এখন আমরা এ দীর্ঘ আলোচনা পরিহার করে সূরা আল ফীলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি এবং প্রকৃত ঘটনার প্রতি আলোকপাত করি।
সুরা: আল-ফীল
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1, 2,
اَلَمْ تَرَ كَیْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِاَصْحٰبِ الْفِیْلِؕ
তুমি কি দেখনি১ তোমার রব হাতিওয়ালাদের সাথে কি করেছেন?২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) বাহ্যত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু মূলত এখানে শুধু কুরাইশদেরকেই নয় বরং সমগ্র আরববাসীকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তারা এই সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিল। কুরআন মজীদের বহু স্থানে ‘আলাম তারা’ (তুমি কি দেখনি?) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নয় বরং সাধারণ লোকদেরকে সম্বোধন করাই উদ্দেশ্য। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নোক্ত আয়াতগুলো দেখুনঃ ইবরাহীম ১৯ আয়াত , আল হাজ্জ ১৮ ও ৬৫ আয়াত , আন নূর ৪৩ আয়াত , লোকমান ২৯ ও ৩১ আয়াত , ফাতের ২৭ আয়াত এবং আয্ যুমার ২১ আয়াত ) তাছাড়া দেখা শব্দটি এক্ষেত্রে ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, মক্কায় ও তার আশেপাশে এবং আরবের বিস্তৃত এলাকায় এ আসহাবে ফীলের ঘটনাটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে এ ধরনের বহু লোক সে সময় জীবিত ছিল। কারণ তখনো এই ঘটনার পর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে যায়নি। লোক মুখে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ সরাসরি এত বেশী বেশী সূত্রে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যার ফলে এটা প্রায় সব লোকেরই চোখে দেখা ঘটনার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
টিকা:২) এই হাতিওয়ালা কারা ছিল, কোথায় থেকে এসেছিল, কি উদ্দেশ্যে এসেছিল এসব কথা আল্লাহ এখানে বলছেন না। কারণ এগুলো সবাই জানতো।
সুরা: আল-ফীল
আয়াত নং :-2
টিকা নং:3, 4,
اَلَمْ یَجْعَلْ كَیْدَهُمْ فِیْ تَضْلِیْلٍۙ
তিনি কি তাদের কৌশল৩ ব্যর্থ করে দেননি?৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) মূলে কাইদা (كيد) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করবার জন্য গোপন কৌশল অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে গোপন কি ছিল? ষাট হাজার লোকের একটি সেনাবাহিনী কয়েকটি হাতি নিয়ে প্রকাশ্যে ইয়ামন থেকে মক্কায় আসে। তারা যে কা’বা শরীফ ভেঙ্গে ফেলতে এসেছে, একথাও তারা গোপন করেনি। কাজেই এ কৌশলটি গোপন ছিল না। তবে হাবশীরা কা’বা ভেঙ্গে ফেলে কুরাইশদেরকে বিধ্বস্ত করে এবং এভাবে সমগ্র আরববাসীদেরকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে দক্ষিণ আরব থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথ আরবদের কাছে থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিল। এটা ছিল তাদের মক্কা আক্রমণের উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যটিকে তারা গোপন করে রাখে। অন্যদিকে তারা প্রকাশ করতে থাকে কয়েকজন আরব তাদের গীর্জার যে অবমাননা করেছে, কা’বা শরীফ ভেঙে ফেলে তার প্রতিশোধ নিতে চায়।
টিকা:৪) মূলে বলা হয়েছে فِي تَضْلِيلٍ অর্থাৎ তাদের কৌশলকে তিনি ভ্রষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন। কিন্তু প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী কৌশলকে ভ্রষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করার মানে হয় তাকে নষ্ট ও বিধ্বস্ত করে দেয়া অথবা নিজের উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাকে ব্যর্থ করে দেয়া। যেমন আমরা বলি, অমুক ব্যক্তির তীর লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়েছে, তার সব প্রচেষ্টা ও কলাকৌশল ব্যর্থ হয়েছে। কুরআন মজীদের এক জায়গায় বলা হয়েছে وَمَا كَيْدُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ “কিন্তু কাফেরদের কলাকৌশল ব্যর্থ হয়েছে। (আল মু’মিন ২৫) অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي كَيْدَ الْخَائِنِينَ “আর আল্লাহ খেয়ানতকারীদের কৌশলকে সফলতার দ্বারে পৌঁছিয়ে দেন না।” (ইউসূফ ৫২) আরববাসীরা ইমরাউল কায়েসকে اَلْمَلِكُ الضَّلِيْلْ “বিনষ্টকারী বাদশাহ” বলতো। কারণ সে তার বাপের কাছ থেকে পাওয়া বাদশাহী হারিয়ে ফেলেছিল।
সুরা: আল-ফীল
আয়াত নং :-3
টিকা নং:5,
وَّ اَرْسَلَ عَلَیْهِمْ طَیْرًا اَبَابِیْلَۙ
আর তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠান,৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) মূলে বলা হয়েছে طَيْرًا أَبَابِيلَ আরবীতে আবাবীল মানে হচ্ছে, বহু ও বিভিন্ন দল যারা একের পর এক বিভিন্ন দিক থেকে আসে। তারা মানুষও হতে পারে আবার পশু হতে পারে। ইকরামা ও কাতাদাহ বলেন, লোহিত সাগরের দিক থেকে এ পাখিরা দলে দলে আসে। সাঈদ ইবনে জুবাইর ও ইকরামা বলেন, এ ধরনের পাখি এর আগে কখনো দেখা যায়নি এবং এরপরেও দেখা যায়নি। এগুলো নজদ, হেজায, তেহামা বা লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী উপকূলে এলাকার পাখি ছিল না। ইবনে আব্বাস বলেন, তাদের চঞ্জু ছিল পাখিদের মতো এবং পাঞ্জা কুকুরের মতো। ইকরামার বর্ণনা মতে তাদের মাথা ছিল শিকারী পাখীর মাথার মত। প্রায় সকল বর্ণনাকারীর সর্বসম্মত বর্ণনা হচ্ছে, প্রত্যেকটি পাখির ঠোঁটে ছিল একটি করে পাথরে কুচি এবং পায়ে ছিল দু’টি করে পাথরের কুচি। মক্কার অনেক লোকের কাছে এই পাথর দীর্ঘকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল। আবু নু’আইম নওফাল ইবনে আবী মু’আবীয়ার বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, আসহাবে ফীলের ওপর যে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল আমি তা দেখেছি। সেগুলোর এক একটি ছিল ছোট মটর দানার সমান। গায়ের রং ছিল লাল কালচে। আবু নু’আইম ইবনে আব্বাসের যে রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন তাতে বলা হয়েছে, সেগুলো ছিল চিলগুজার* সমান। অন্যদিকে ইবনে মারদুইয়ার বর্ণনা মতে, সেগুলো ছিল ছাগলের লেদীর সমান। মোটকথা, এসবগুলো পাথর সমান মাপের ছিল না। অবশ্যি কিছু না কিছু পার্থক্য ছিল।
* চিলগুজা চীনাবাদাম জাতীয় এক ধরনের শুকনা ফল। লম্বায় ও চওড়ায় একটি চীনাবাদামের প্রায় সমান।
সুরা: আল-ফীল
আয়াত নং :-4
টিকা নং:6,
تَرْمِیْهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّیْلٍ۪ۙ
যারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল পোড়া মাটির পাথর।৬
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৬) মূল শব্দগুলো হচ্ছে, بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ অর্থাৎ সিজ্জীল ধরনের পাথর। ইবনে আব্বাস বলেন, এ শব্দটি মূলত ফারসীর “সঙ্গ” ও “গীল” শব্দ দু’টির আরবীকরণ।* এর অর্থ এমন পাথর যা কাদা মাটি থেকে তৈরি এবং তাকে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হয়েছে। কুরআন মজীদ থেকেও এই অর্থের সত্যতা প্রমাণ হয়। সূরা হূদের ৮২ ও সূরা হুজুরাতের ৪ আয়াতে বলা হয়েছে, লূত জাতির ওপর সিজ্জীল ধরনের পাথর বর্ষণ করা হয়েছিল এবং এই পাথর সম্পর্কে সূরা যারিয়াতের ৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে, সেগুলো ছিল মাটির পাথর অর্থাৎ কাদামাটি থেকে সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল।
মাওলানা হামীদুদ্দিন ফারাহী মরহুম মগফুরও বর্তমান যুগে কুরআনের অর্থ বর্ণনা ও গভীরতত্ত্ব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি এ আয়াতে “তারমীহিম” (তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল) শব্দের কর্তা হিসেবে মক্কাবাসী ও অন্যান্য আরববাসীদেরকে চিহ্নিত করেছেন। “আলাম তারা” (তুমি কি দেখনি) বাক্যাংশেও তাঁর মতে এদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। পাখিদের সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা পাথর নিক্ষেপ করছিল না বরং তারা এসেছিল আসহাবে ফীলের লাশগুলি খেয়ে ফেলতে। এই ব্যাখ্যার সপক্ষে তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন তার নির্যাস হচ্ছে এই যে, আবদুল মুত্তালিবের আবরাহার কাছে গিয়ে কা’বার পরিবর্তে নিজে উট ফেরত নেবার জন্য দাবী জানানোর ব্যাপারটি কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অন্য দিকে কুরাইশরা এবং অন্যান্য যেসব লোকেরা হজ্জের জন্য এসেছিল তারা হানাদার সেনাদলের কোন মোকাবেলা না করে কা’বাঘরকে তাদের করুণা ও মেহেরবানির ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পাহাড়ের ওপর গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করবে, একথাও দুর্বোধ্য মনে হয়। তাই তাঁর মতে আসল ঘটনা হচ্ছে, আরবরা আবরাহার সেনাদলের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে এবং আল্লাহ পাথর বর্ষণকারী ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত করে এই সেনাদলকে বিধ্বস্ত করেন। তারপর তাদের লাশ খেয়ে ফেলার জন্য পাখি পাঠান। কিন্তু ভূমিকায় আমরা বলেছি, আবদুল মুত্তালিব তার উট দাবী করতে গিয়েছিলেন, রেওয়ায়াতে কেবল একথাই বলা হয়নি। বরং রেওয়ায়াতে একথাও বলা হয়েছে যে, আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটের দাবীই জানাননি এবং আবরাহাকে তিনি কা’বা আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টাও করেছিলেন। আমরা একথাও বলেছি, সমস্ত নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত অনুযায়ী আবরাহা মহররম মাসে এসেছিল। তখন হাজীরা ফিরে যাচ্ছিল আর একথাও আমরা জানিয়ে দিয়েছি যে, ৬০ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা করা কুরাইশদের ও তাদের আশেপাশের গোত্রগুলোর সামর্থ্যের বাইরে ছিল। আহযাব যুদ্ধের সময় বিরাট ঢাক ঢোল পিটিয়ে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে আরব মুশরিক ও ইহুদি গোত্রগুলোর যে সেনাদল তারা এনেছিল তার সংখ্যা দশ বারো হাজারের বেশী ছিল না। কাজেই ৬০ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা করার সাহস তারা কেমন করে করতে পারতো? তবুও এ সমস্ত যুক্তি বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র সূরা ফীলের বাক্য বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যায় তাহলে এ ব্যাখ্যা তার বিরোধী প্রমাণিত হয়। আরবরা পাথর মারে এবং তাতে আসহাবে ফীল মরে ছাতু হয়ে যায় আর তারপর পাখিরা আসে তাদের লাশ খাবার জন্য, ঘটনা যদি এমনি ধরা হতো তাহলে বাক্য বিন্যাস হতো নিম্নরূপভাবেঃ تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ- فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ- وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ (তোমরা তাদেরকে মারছিলে পোড়া মাটির পাথর। তারপর আল্লাহ তাদেরকে করে দিলেন ভুক্ত ভূষির মতো। আর আল্লাহ তাদের উপর ঝাঁকে ঝঁকে পাখি পাঠালেন) কিন্তু এখানে আমরা দেখছি, প্রথমে আল্লাহ পাখির ঝাঁক পাঠাবার কথা জানালেন তারপর তার সাথে সাথেই বললেনঃ تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ অর্থাৎ যারা তাদেরকে পোড়া মাটির তৈরী পাথরের কুচি দিয়ে মারছিল। সবশেষে বললেন, তারপর আল্লাহ তাদেরকে ভুক্ত ভুষির মতো করে দিলেন। * সঙ্গ মানে পাথর এবং গীল মানে কাদা।-অনুবাদক
সুরা: আল-ফীল
আয়াত নং :-5
টিকা নং:7,
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّاْكُوْلٍ۠
তারপর তাদের অবস্থা করে দেন পশুর খাওয়া ভূষির মতো।৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৭) আসল শব্দ হচ্ছে, كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ আসফ শব্দ সূরা আর রহমানের ১২ আয়াতে এসেছেঃ ذُو الْعَصْفِ وَالرَّيْحَانُ “শস্য ভূষি ও চারাওয়ালা।” এ থেকে জানা যায়, আসফ মানে হচ্ছে খোসা, যা শস্য দানার গায়ে লাগানো থাকে এবং কৃষক শস্য দানা বের করে নেবার পর যাকে ফেলে দেয় তারপর পশু তা খেয়েও ফেলে। আবার পশুর চিবানোর সময় কিছু পড়েও যায় এবং তার পায়ের তলায় কিছু পিষেও যায়।
[
সুরা: আল-ফীল
ফী জিলালিল কুরআন:
প্রথম আয়াতটিতে একটি প্রশ্নবোধক বাক্যের দ্বারা এক অভিনব, বিস্ময়কর ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সে অদ্ভুত ঘটনা তৎকালীন সমাজের প্রতিটি লোকের কাছেই প্রসিদ্ধ ও পরিজ্ঞাত ছিলো। এমনকি যে বছর এ ঘটনা ঘটে, তা ইতিহাসের উৎস হিসাবে গৃহীত হয়েছিলো ৷ সে সমাজের লোকেরা কোনো ঘটনার সন তারিখ উল্লেখ করতে গিয়ে এমনিভাবে বলতো- “অমুক ঘটনাটি ‘আমুল ফীলে’ (হস্তি বছরে) ঘটেছিলো ।” অথবা বলতো ‘আমুল ফীলের’ দু’বছর পূর্বে অমুকের জন্ম হয়েছিলো, অমুকের বিয়ে হয়েছিলো, অমুক ঘটনা ঘটেছিলো ।’ অথবা ‘আমুল ফীলের ১০ দশ বছর পর অমুক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো ।’ এ কথাও সর্বজনবিদিত ও প্রসিদ্ধ যে, মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহও (আল্লাহর রাসুল) ‘আমুল ফীলে’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন । সম্ভবত, এর মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালা প্রচ্ছন্ন ইংগিত রেখেছিলেন যে, যেভাবে রসূলের জন্মের বছরে হস্তিবাহিনীর ধ্বংসের মাধ্যমে আল্লাহর ঘরকে তিনি হেফাযত করেছিলেন, তেমনি পরবর্তী পর্যায়ে রসূলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তার ঘরকে রক্ষা করবেন এবং গোটা বিশ্ব থেকে শিরিক, বেদয়াত ও পৌত্তলিকতার প্রাধান্যকে দূরীভূত করে তাওহীদের পতাকাকে সমুন্নত করবেন। আল্লাহর ঘর থেকে মূর্তি অপসারণ করে তাকে এক আল্লাহর এবাদাতের কেন্দ্র হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন । আলোচ্য আয়াতে রসূলুল্লাহ (স.) কে সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার প্রশ্নের মাধ্যমে তৎকালীন আরব সমাজের প্রত্যক্ষদর্শী লোকদের সামনে আল্লাহ তায়ালা এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, তোমরা কি হস্তিবাহিনীর ঘটনা প্রত্যক্ষ করোনি? এতো বড়ো একটি শিক্ষণীয় ও বিস্ময়কর ঘটনাকে এতো স্বল্প সময়ের মধ্যেই তোমরা ভুলে গেলে? উল্লেখিত প্রশ্নবোধক বাক্যটির পরই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হস্তিবাহিনীর সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে ব্যর্থ করার চিত্র তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন, “তোমরা কি ভুলে গেছো যে, আমি হস্তিওয়ালাদেরকে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার সুযোগ দেইনি! আমি তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তজালকে ছিন্নভিন্ন, ব্যর্থ ও নিষ্ফল করে দিয়েছি। তারা যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বায়তুল্লাহর ধ্বংস সাধনের জন্যে মক্কায় অভিযান পরিচালনা করতে এসেছিলো আমি কি তাদের সে চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেইনি?কোরায়শদের প্রতি আল্লাহর করুণা : আলোচ্য আয়াতে কোরায়শ সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর সীমাহীন নেয়ামতের দিকেও ইংগিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, হে কোরায়শ সম্প্রদায়, তোমরাই তো আল্লাহর এ পবিত্র কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণকারীর দায়িত্বে ছিলে । এ ঘরের বিনাশের জন্য হস্তিবাহিনী যখন অভিযান পরিচালনা করেছিলো, তোমাদের প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি ও সামর্থ ছিলো না, তখন একমাত্র তিনিই তার ক্ষমতাবলে সে ঘরকে রক্ষা করলেন। তোমরা কি এ থকে উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারো না যে, আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের ওপর কতো বড়ো রহম করেছেন? তিনি নিজে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করে হস্তিবাহিনীর সকল উদ্দ্যোগ ও অভিযানকে ব্যর্থ ও ধুলিস্যৎ করে দেননি! অসহায় দুর্বল শক্তিহীন কোরায়শ গোত্র বিশাল শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হস্তিবাহিনীর মোকাবেলা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো এবং আল্লাহর ঘরের হেফাযতের দায়িত্ব ওই সময়ে পরম নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে মহাশক্তিমান আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করেছিলো। আল্লাহ তায়ালা তাদের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতার প্রতি অশেষ করুণা প্রদর্শন করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাবা ঘরের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব আনজাম দিয়েছিলেন । যাতে করে রসূলের দাওয়াতের সূচনায় (ঘটনার চারদশক পরে) কোরায়শরা হস্তিবাহিনীর ঘটনার স্মৃতি মন্থন করে এ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যে, আজকে যদি আমরা মোহাম্মাদ (স.)-এর উপস্থাপিত দাওয়াতে তথা আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতকে অস্বীকার করি ও বিরোধিতা করি, তবে আজকে মোহাম্মাদ (স.) ও তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা স্বল্পতা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তায়ালা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তার দ্বীনের হেফাযতের এন্তেযাম করে আমাদেরকে হস্তিওয়ালাদের মতো ধ্বংস, বিপর্যস্ত ও পর্যদুস্ত করে দিতে পারেন । আজ থেকে চার দশক পূর্বে যে শক্তিমান সত্ত্বা তার ঘরের হেফায়তের জন্য অলৌকিক ও বিস্ময়কর এবং এক অভিনব পন্থায় তার ঘরের হেফাযত করেছেন আজও তার হাবীব, তার প্রতি বিশ্বাসী স্বল্পসংখ্যক মোমেন ও তার প্রদত্ত দ্বীনের হেফাযতের জন্য তেমনি বিস্ময়কর পন্থায় তার দ্বীনের বিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্তকে অনায়াসে ব্যর্থ করে দিতে পারেন। যেমনভাবে তিনি বায়তুল্লাহ্র শত্রুদের নিপাত করেছেন, তেমনিভাবে আল্লাহর রসূলের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও যারা আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও প্রচারে লিপ্ত রয়েছে তাদের সকল প্রচেষ্টাকে আল্লাহ তায়ালা তেমনি ব্যর্থ ও নিষ্ফল করে দিতে পারেন । যারা আজ আল্লাহর রসূল ও তার উপস্থাপিত দাওয়াতের বিরুদ্ধে হস্তিবাহিনীর মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের দাওয়াতের প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আজও তেমনি শক্তিমান । ‘আবাবীল’ একদল পাখী আর ‘সিজ্জীল’ মূলত দু’টি ফার্সি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত । একটি হচ্ছে ‘হিজারাতিন’- পাথর, অপরটি হচ্ছে ‘সিজ্জীল’- মাটি অথবা এ শব্দের অর্থ হলো মাটি সংমিশ্রিত পাথরকুচি । আর “আসফ’” শব্দের অর্থ হচ্ছে ছিন্ন পাতা বা ঘাস বা ঘাষপাতার চর্বিতচর্বণ। কোনো পশু ঘাসপাতা প্রথমবার চিবানোর পর ঘাসের যে অবস্থা হয় তদ্রুপ অবস্থা । পশু ঘাসপাতা দাতে চিবিয়ে জাবর কাটলে যে রূপ ধারণ করে ঠিক তদ্রুপ ‘আসফ’ শব্দ থেক পশুর ভক্ষণকৃত ঘাসপাতার রূপই বর্ণনা করা হয়েছে! জীব জন্তুর দাতে কাটা ও চিবিয়ে চর্বনে পরিণত করাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এর দ্বারা পাখীদের বয়ে আনা মাটি মিশ্রিত পাথরকুচি হাতি ও সোনাবাহিনীর দেহে বা মস্তিষ্কে পড়ার পর তাদের চর্ম ও অস্থি ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও খন্ড-বিখন্ড হওয়ার অবস্থা ও রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এই ঘটনা থেকে যে শিক্ষা পাই : আর এ ঘটনার মধ্যে যে শিক্ষা, উপদেশ ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে তা অত্যন্ত ব্যাপক । প্রথমত, এর দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তার পবিত্র ঘরের হেফাযতের কাজকে মোশরেকদের সহযোগিতা থেকে মুক্ত রেখেছেন । যদিও তারা বায়তুল্লাহর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা পোষণ করতো, এ ঘরকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও খেদমত করতো । প্রচন্ড শক্তিমান শত্রুর হাত থেকে কাবাকে রক্ষা করার ভার যখন মোশরেকরা একমাত্র আল্লাহ্র ওপর ন্যস্ত করলো, তখন আল্লাহ তায়ালা শত্রুর হাত থেকে বায়তুল্লাহকে রক্ষা করার জন্য কোনো মোশরেকের হাতের পরশ লাগাতে দিলেন না। মূর্তিপূজারীদের দ্বারা তার ঘরের হেফাযতে কোনো প্রকার সহযোগিতা নিলেন না, জাহেলীয়াতের তিমীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন কোরায়শদেরকে তার ঘরের হেফাযতের সকল প্রকার উদ্যোগ ও সংশ্রব থেকে দূরে রাখলেন এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীন স্বয়ং অলৌকিক ও অভিনব পন্থায় তার ঘরের দুশমনদের ধ্বংসাভিযানকে প্রতিহত করলেন । সর্বশেষ আয়াত দু’টির এই ব্যাখ্যাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য । দ্বিতীয়ত, রসূলের আগমনের বছরে আল্লাহর ঘরকে তাঁর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হেফাযতের কালক্ষণ মক্কাবাসী যেন আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন স্বচক্ষে দেখতে পায় এবং নির্দিধায় ও নিসংকোচে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতকে কবুল করে, এমন এক পরিবেশ ও ক্ষেত্র এই ঘটনার মাধ্যমে আগে থেকেই প্রস্তুত করেছেন। এ থেকে মক্কার মোশরেকদের প্রতি এ ইংগীতও করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা যেমন তাঁর নিজস্ব কুদরত ও ব্যবস্থাপনায় তার ঘরের হেফাযতের এন্তেযাম করেছেন ঠিক তেমনভাবেই তার দ্বীন, রসূল ও দ্বীনের অনুসারীদের হেফাযত করার কুদরত ও ক্ষমতাও তার রয়েছে। ঠিক একই পন্থায় তিনি তার দ্বীনের বিরোধীশক্তি ও শত্রুদেরকে প্রতিহত করতে পারেন। এ ঘটনার মধ্যে এ শিক্ষা ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার পবিত্র ঘর বায়তুল্লাহ ও মক্কার পবিত্র ভূমির ওপর আহলেকেতাবদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ প্রদান করবেন না; যেমন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইয়েমেনের খৃষ্টান রাজা আবরাহা ও তার সেনাবাহিনীকে কাবাঘর ও মক্কাভূমির পবিত্রতা, এর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে দেননি, দুনিয়ার কোনো পৌত্তলিক, কোনো ত্রিত্ববাদী শক্তিকে আল্লাহ তায়ালা জয়ী করবেন না। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীদের সকল শক্তি ও প্রভাব বলয় থেকে তিনি তার এ ঘর ও ভুমিকে পবিত্র ও মুক্ত রাখবেন । কোনো বাতিল শক্তি তার দ্বীন, তার ঘর, ও এ পবিত্র ভূমিতে তাদের কোনো পরিকল্পনা ও কৌশলকে বাস্তাবায়িত করতে পারবে না। এ ঘটনার বছরে যে নবী জন্ম গ্রহণ করেছেন সে নবীর উপস্থাপিত দ্বীনকেও নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল করার যে কোনো চক্রান্তকে আল্লাহ তায়ালা তেমনিভাবে নস্যাত করে দেবেন যেমন করে খৃস্টান রাজা আবরাহার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ ও নিষ্ফল করে দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বের মুসলিম উম্মাহও এ ঘটনা থেকে এ শিক্ষা ও প্রত্যয় গ্রহণ করতে পারে যে, ‘আমুল ফীল তথা হস্তি বছরে জন্যগ্রহণকারী নবী মোহাম্মদ (স.)-এর প্রতিষ্ঠিত দ্বীনের বিরুদ্ধে আজ খৃষ্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক, নাস্তিক ও মুরতাদদের যে দুনিয়া জোড়া ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত পরিচালিত হচ্ছে এ সকল অভিশপ্ত সম্মিলিত শক্তির সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অবশ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাদের কোনো ষড়যন্ত্র, চক্রান্তকে তিনি সফল হতে দেবেন না। তাদের সকল অভিযানই বিফল হয়ে যাবে৷ যে আল্লাহ তায়ালা সেদিন ইহুদী, পৌত্তলিক ও খৃষ্টান শক্তির আক্রমণ থেকে তার ঘর হেফাযত করেছেন। সে আল্লাহ তায়ালা আজও তার ঘর, তার দ্বীন, তার রসূলের নগরীকে সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। এ ঘটনার তৃতীয় শিক্ষা ও তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, নবী করীম (স.)-এর আবির্ভাব ও ‘আমুল ফীলের’ ঘটনার পূর্বে সারা দুনিয়ার আরবদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলো না। কোনো শাসন বা কোনো সুগঠিত রাষ্ট্রক্ষমতাও তাদের ছিলো না। এমন কি হেজায ও ইয়েমেনও আরবদের শাসনাধীন ছিলো না। ইয়েমেন ছিলো পারস্যের অথবা ইথিওপিয়ার খৃষ্টান শাসনের অধীন। সিরিয়া সরাসরি ছিলো গ্রীকদের অধীন অথবা গ্রীক নিয়ন্ত্রিত শাসনের অধীনে ৷ গোত্রীয় শাসনাধীন সংঘাতময় জীবন অথবা অস্থিতিশীল যাযাবর জীবন ব্যবস্থাই গোটা আরবে প্রচলিত ছিলো। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আরবরা কোনো শক্তি হিসাবেই বিবেচিত হতো না প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল যাবত তারা গোত্রীয় সংঘাত ও যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো সাধারণ ঘটনা নিয়ে এক গোত্র অন্য গোত্রের সাথে অব্যাহত চার দশক যাবত মরণপণ যুদ্ধে কাটিয়ে দিয়েছিলো । বিভিন্ন গোত্রের সমন্বয়ে একক ভাবে কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করে বসবাস করার কোনো ব্যবস্থা তারা কখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। হস্তিবাহিনীর এই বিপর্যয়ের খবর আরবরা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিলো । দুর্দান্ত শক্তিশালী এক বাহিনীর এ নিদারুণ পতন ও চরম ধ্বংসের খবরশুনে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো ৷ ‘আমুল ফীলে’ জন্মলাভকারী নবী করীম (স.) আনীত ধর্ম ইসলামের ভিত্তিতে এক সময় গোত্র ও বর্ণবৈষম্যের মুক্তি একটি আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়া পত্তন করলে মুসলমান তথা আরবদের প্রভাব প্রতিপত্তি সমগ্র দুনিয়া ছড়িয়ে পড়লো । আরবদের উত্থান পতন : ইসলামী জীবনবোধ, ঐতিহ্য ও চেতনাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রদর্শন ও স্থিতিশীল পদ্ধতি কায়েম হলো। কতো রাজ্য ও সিংহাসন আরবদের পদতলে লুটিয়ে পড়ে ইসলামের সমুন্নত পতাকাতলে সমবেত হলো। ইসলামের প্রদীপ্ত জ্যোতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো ৷ জাহেলী যুগের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি লাভ করে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হলো। জাহেলী যুগের সকল তমসা, অন্যায়, অবিচার, যুলুম, নির্যাতন, সংকীর্ণতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, হানাহানি ও বিদ্বেষ দূরীভূত হলো । তারা সকল কুসংস্কার ও কূপমন্ডুকতাকে পরিহার করে নিজেদেরকে একমাত্র মুসলিম হিসাবে পরিচয় প্রদানের বৈশিষ্ট অর্জন করলো। তারা মানবপ্রেম, মানব কল্যাণ, শান্তি ও রহমতের মহান আদর্শের দীক্ষা গ্রহণ করলো । মানব রচিত সকল ধর্ম, দর্শন ও মতবাদের আবর্জনা ও জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে তারা ওহীভিত্তিক জীবনাদর্শ ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে বিশ্ব নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। বিশ্বের বৃহত্তম রাজশক্তি, গ্রীক সাম্রাজ্য ও পারস্য তাদের পদানত হলো । গ্রীক ও পারস্যের দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্তি লাভ করে বিভিন্ন রাজ্য ও ভূখণ্ড, জাতি ও সম্প্রদায় আরবদের আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলো । আরবরা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান পয়গাম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলো। এক আল্লাহর পথে জেহাদের পতাকা সমুন্নত করে তারা মানব জাতিকে মানুষের গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহর গোলামে পরিণত করলো । পার্থিব স্বার্থের সংকীর্ণতার বেড়াজাল ছিন্ন করে অনন্ত আখেরাতের কল্যাণ, মুক্তির উদারতার পথে মানবজাতিকে পরিচালিত করলো ৷ মানব রচিত মতবাদের যুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়ে মানুষ ইসলামের ইনসাফ, সুবিচার ও মুক্তির পথ খুজে পেলো ৷ ইসলামের নিশানবরদার হওয়ার কারণে সমকালীন বিশ্বের সর্বত্র আরবদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলো এবং প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব-নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আরবদের হস্তগত হলো। এ সব কিছু আরবদের গোত্রীয় প্রাধান্য বা আরব জাতীয়তাবাদের জন্য নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর রেযামন্দি হাসিলের লক্ষ্যে আল্লাহর পথে জেহাদের অবতীর্ণ হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছিলো ৷ যতোদিন আরব জাতি এ মহান ঐতিহ্য, আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো, ততোদিনই বিশ্ব নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে শক্তিমান জাতি হিসাবে তারা অধিষ্ঠিত ছিলো । আরবরা যতোদিন ইসলামী নীতিমালার অনুসারী ছিলো, আল্লাহ তায়ালাও ততোদিন তাদেরকে তার সৃষ্টির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত রেখেছিলেন । যখন আরবরা তাদের বাস্তব জীবনে ইসলামী ঐতিহ্য ও জীবনধারার অনুসরণকে পরিহার করলো, ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে আরব জাতীয়তাবাদের ৷ সংকীর্ণতা ও জাহেলী বিদ্বেষ পুনপ্রবর্তন করলো তখনই তারা বিশ্বনেতৃত্ব থেকে অপসারিত হলো, মানব জাতিও তাদেরকে বর্জন করলো । মুসলিম জাতি যখনই আল্লাহকে ছেড়ে দিয়েছে, আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, আল্লাহ তায়ালাও তখন তাদেরকে নেতৃত্বের আসন থেকে সারিয়ে দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব নির্ভর করছে একমাত্র ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ওপর ৷ ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মানব জাতির ওপর মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্বের অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। মানব জাতির ওপর আরবদের তথা মুসলিম উম্মাহর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র কারণ ছিলো ইসলামী চিন্তাদর্শন ও জীবনবোধের অধিকারী হওয়া ৷ পরবর্তীকালে আদর্শিক পতন ও বিপর্যয়ের কারনেই বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায় মুসলিম ও আরবদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ লাভ করেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আদর্শ ছাড়া যে সকল সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় অন্ত্র বলে বলীয়ান হয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তারা খুব বেশী দিন তাদের ক্ষমতাকে আকড়ে ধরে রাখতে পারেনি। বারবার ও তাতারীরা ধ্বংসের তান্ডবলীলার মাধ্যমে গোটা বিশ্বব্যাপী তাদের দাপট ও ক্ষমতার আলোড়ন সৃষ্টি করে ছিলো বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে খুব বেশী দিন তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। অপরদিকে পিরানিজ থেকে আল আলগ্প পর্বতমালা আর ভুমধ্যসাগর ও আটলান্টিকের উপকূল থেকে চীনের প্রাচীর পর্যন্ত আরব তথা মুসলমানদের দীর্ঘস্থায়ী প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব একমাত্র ইসলামী জীবনদর্শনের ও চিন্তাধারার প্রভাবেই সম্প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো । আর যখন ইসলামী জীবন ধারাকে তারা বর্জন করলো তাদের চিন্তা-বিশ্বাস ক্রিয়াকান্ড থেকে ইসলামী ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও জীবন ধারার প্রভাব স্তিমিত হয়ে গেলো, যখন তারা সে আদর্শ, চিন্তাধারা ও জীনবোধকে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করা থেকে বিরত হলো, তখন পৃথিবীতে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব তো দূরের কথা, মাথা গুঁজবার ঠাইটুকু পর্যন্ত তারা খুঁজে পেলো না। ইতিহাসে তাদের কোনো স্থানই হলো না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন কোনো ইতিহাস তারা সৃষ্টি করতে পারলোনা। কোনো যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করার মর্যাদা থেকে তারা বঞ্চিত রয়ে গেলো। আজ যদি আরব তথা মুসলিম উম্মাহ্ আবার পুনর্জাগরণের প্রত্যাশী হয়ে থাকে, তাদের প্রাধান্য ও কর্তৃত্বকে পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে চায় তবে অবশ্যই তাদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে স্মরণ করে ইসলামকে পুনরায় বাস্তবজীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ ছাড়া তাদের মর্যাদা ও অস্তিত্ব সংরক্ষণের বিকল্প কোনো পথ নেই। মনে রাখতে হবে, যাবতীয় গোমরাইী থেকে রক্ষা করে হেদায়াতের সমুজ্জল পথ কেবল আল্লাহ তায়ালাই দেখাতে পারেন।
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১৮/হে মানুষ :-২৫)
[#আবরাহার হস্তী বাহিনীর ঘটনা-]
সুরা: ১০৫: আল-ফীল
পারা:৩০
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:
الْفِيْلِ শব্দের অর্থ : হাতি। সূরার প্রথম আয়াতে الْفِيْلِ শব্দ উল্লেখ আছে। এখান থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া সূরাটি ইতিহাসের নিন্দিত আবরাহার হস্তীবাহিনী সম্পর্কে নাযিল করা হয়েছে বলে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে ইয়ামানের খ্রিস্টান গভর্ণর আবরাহা প্রশিক্ষিণপ্রাপ্ত হস্তীবাহিনীসহ বিশাল সৈন্যদল নিয়ে কাবাগৃহ ধ্বংস করার জন্য এসেছিল এবং আল্লাহ তা‘আলা যে পক্ষীকুল তাদের দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত আকারে আবরাহার হস্তী বাহিনীর ঘটনা:
৫৭০ খ্রীষ্টাব্দের কথা। হাবশার বাদশার তরফ থেকে ইয়ামান দেশে আবরাহা গভর্নর ছিল। সে সান‘আতে একটি খুব বড় গির্জা নির্মাণ করল। আর চেষ্টা করল, যাতে লোকেরা কাবা গৃহ ত্যাগ করে ইবাদত ও হাজ্জ উমরাহর জন্য এখানে আসে। এ কাজ মক্কাবাসী তথা অন্যান্য আরব গোত্রের জন্য অপছন্দনীয় ছিল। অতএব তাদের মধ্যে একজন আবরাহার নির্মাণকৃত উপাসনালয়ে পায়খানা করে নোংরা করে দিল। আবরাহার নিকট খবর পৌঁছল যে, গির্জাকে কেউ নোংরা ও অপবিত্র করে দিয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় সে কাবা ঘরকে ধ্বংস করার দৃঢ় সংকল্প করল। সে বহু সংখ্যক সৈন্যসহ মক্কার ওপর হামলা করার উদ্দেশ্যে রওনা হল। কিছু হাতীও তাদের সাথে ছিল। মক্কার নিকট পৌঁছে সৈন্যরা নাবী (সাঃ)-এর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের উটগুলো দখল করে নিল। এ ব্যাপারে আব্দুল মুত্তালিব আবরাহাকে বললেন : উটগুলো ফিরিয়ে দাও। (আবরাহা বলল : এখন আমরা তোমাদের কাবা ধ্বংস করতে এসেছি, আর তুমি কেবল উট ছেড়ে দেওয়ার দাবী কর? তিনি বললেন : উটগুলো আমার, তাই আমি সেগুলোর হেফাযত চাই) যিনি কাবা ঘরের মালিক তিনিই তাঁর ঘর রক্ষা করবেন। অতঃপর যখন এ সৈন্যদল “মুহাসসার” নামক উপত্যকার নিকট পৌঁছল, তখন আল্লাহ তা‘আলা ছোলা অথবা মসুরীর দানা সমপরিমাণ কাঁকর দিয়ে পাখি প্রেরণ করলেন, যারা ওপর থেকে সেই কাঁকর বর্ষণ করতে লাগল। যে সৈন্যের গায়ে এ কাঁকর লাগছিল তার গা থেকে মাংস খসে পড়ে গিয়েছিল এবং পরিশেষে মারা গিয়েছিল। সানআ পৌঁছতে পৌঁছতে খোদ আবরাহারও একই পরিণাম হয়েছিল। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ঘর হেফাযত করলেন। (আয়সারুত তাফাসীর)
হস্তিবাহিনীর এ ঘটনা আরবদের মাঝে বহুল প্রচলিত ছিল। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অনেকে জীবিত ছিল। যেমন হাকীম বিন হেযাম, হাতেব বিন আব্দুল ওযযা, নওফেল বিন মু‘আবিয়া প্রমুখ। যারা প্রত্যেকে ১২০ বছর করে বয়স পেয়েছিল। এছাড়া উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। যেমন হুদায়বিয়ার দিন রাসূল (সাঃ)-এর উট কাসওয়া বসে পড়লে তিনি বলেন: হস্তীবাহিনীকে বাধা দানকারী (আল্লাহ তা‘আলা) তাকে বাধা দিয়েছে। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৩১)
أَلَمْ تَرَ অর্থ أَلَمْ تعلم অর্থাৎ তুমি কি জান না? এখানে জিজ্ঞাসা সাব্যস্তের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থ হলো: তুমি জান অথবা ঐ সব লোকেরা জানে, যারা তোমার যুগের। এরূপ এজন্যই বলা হয়েছে যে, এ ঘটনা ঘটার পর বেশি দিন অতিবাহিত হয়নি (যা শানে নুযূলে উল্লেখ করা হয়েছে)।
(كَيْدَهُمْ فِيْ تَضْلِيْلٍ)
অর্থাৎ কাবা ধ্বংস করার যে চক্রান্ত তারা করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়নি।
أَبَابِيْلَ পাখির নাম নয়, বরং অর্থ হলো : ঝাঁকে ঝাঁকে। ইবনু আব্বাস ও মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : একের পিছে এক, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। ইকরিমা (রহঃ) বলেন: সবুজ পাখি যা সমুদ্রের দিক থেকে এসেছিল। এছাড়াও বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। অনেকে আবাবিল দ্বারা এক প্রকার পাখি বুঝিয়ে থাকেন, কিন্তু আসলে তা নয় বরং আবাবিল অর্থ ঝাঁকে ঝাঁকে।
سِجِّيْلٍ বলা হয় এমন মাটিকে যা পুড়িয়ে কাঁকর তৈরি করা হয়েছে। কাঁকরের বৈশিষ্ট্য শানে নুযূলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও ইকরিমা (রহঃ) বলেন : ঐ কংকর যার গায়ে লেগেছে তার গায়ের চামড়া ফেটে বসন্তের গুটি বেরিয়েছে এবং সেবারই প্রথম বসন্ত রোগ দেখা দেয়। ইবনু ইসহাক বলেন : সে বছরই প্রথম আরবদেশে হাম ও বসন্ত রোগের আবির্ভাব ঘটে। (ইবনু কাসীর) এ আয়াতকে বিশ্লেষণ করেই ক্ষেপণাস্ত্র, কামান, রকেট ইত্যাদি আবিস্কার করেছে।
(فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُوْلٍ) – عصف
বলা হয় শস্যের শুকনো পাতা। আর مَّأْكُوْل বলা হয় শুকনো পাতা বা ঘাস ইত্যাদি চিবানোর পর যে অবস্থা হয়। অর্থাৎ পাথর নিক্ষেপের ফলে তাদের দেহের মাংস চিবানো নিস্পেষিত ঘাসের মত হয়ে গিয়েছিল। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: এর অর্থ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ধ্বংস ও নির্মূল করে দেন। তাদের সমস্ত চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেন। তাদের প্রায় সকলেই ধ্বংস হয়ে যায়। যারা ফিরে গিয়েছিল তারাও আহত অবস্থায় ফিরেছিল। যেমন তাদের নেতা আবরাহা কিছু সাথীসহ রাজধানী সানআতে পৌঁছে। কিন্তু তখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে পড়ছিল। অবশেষে তার বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায় এবং সে মৃত্যুবরণ করে। তবে তার আগে সে লোকদের কাছে আল্লাহ তা‘আলার গযবের কাহিনী বর্ণনা করে যায়। (ইবনু কাসীর)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: আমাদের আলেমগণ বলেছেন: হস্তীবাহিনীর এ ঘটনা আমাদের নাবীর জন্য একটি মু‘জিযাহ ছিল। কেননা তিনি স্বচক্ষে ঘটনা দেখেননি অথচ যখন তিনি এ সূরা পাঠ করে শুনান তখন এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বহু লোক বেঁচে ছিল। তারা সবাই এ সূরার বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছে। এমনকি আয়িশাহ (রাঃ) ঐ সময় বাল্য বয়সের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তিনি বর্ণনা করেন যে, আমি হাতির চালক ও সহিসকে অন্ধ অবস্থায় মানুষের কাছে খাদ্য চাইতে দেখেছি। (ইবনু হিশাম)
সুতরাং বাইতুল্লাহর হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা নিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন শক্তিই তা ধ্বংস করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَنْ يُّرِدْ فِيْهِ بِإِلْحَادٍمبِظُلْمٍ نُّذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ)
“আর যে ইচ্ছা করে সীমালঙ্গন করে তাতে পাপ কার্যের, তাকে আমি আস্বাদন করাব যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা হাজ্জ ২২ : ২৫)
সূরা হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইতিহাসে নিন্দিত আবরাহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হস্তিবাহিনী সম্পর্কে জানলাম।
২. যারাই ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছে তারাই ধ্বংসে নিপতিত হয়েছে।
৩. ইসলাম বিদ্বেষীরা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ধ্বংস করতে ইচ্ছা করলে নিমেসেই যে-কোন আযাব দ্বারা শেষ করে দিতে পারেন।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা যে কুরায়েশের উপর বিশেষ নিয়ামত দান করেছিলেন, * এখানে তারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ যে বাহিনী হস্তী সঙ্গে নিয়ে কাবা গৃহ ধ্বংস করার জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। তারা কাবা গৃহের অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাআলা নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সর্বপ্রকারের ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। বাহ্যতঃ তারা ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। কিন্তু হযরত ঈসা (আঃ)-এর দ্বীনকে তারা বিকৃত করে ফেলেছিল। তারা প্রায় সবাই মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের অশুভ উদ্দেশ্য এবং তৎপরতা নস্যাৎ করে দেয়া ছিল মূলতঃ মহানবীর (সঃ) পূর্বাভাষ এবং তাঁর আগমনী সংবাদ। সেই বছরই তাঁর জন্ম হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ হে কুরায়েশের দল! আবিসিনিয়ার (হাবশের) ঐ বাহিনীর উপর আমি • তোমাদেরকে বিজয় দান করেছি, তাতে তোমাদের কল্যাণ সাধন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, আমি নিজের গৃহ রক্ষার জন্যেই ঐ বিজয় দান করেছি। আমার প্রেরিত শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নবুওয়াতের মাধ্যমে সেই গৃহকে আমি আরো অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করবো। মোটকথা, আসহাবে ফীল বা হস্তী অধিপতিদের সংক্ষিপ্ত ঘটনা এটাই যা বর্ণনা করা হলো। বিস্তারিত বর্ণনা (আরবি) এর বর্ণনায় গত হয়েছে যে, হুমায়ের গোত্রের শেষ বাদশাহ নূনুয়াম, যে ছিল মুশরিক, তার সময়ের মুসলমানদেরকে পরিখার মধ্যে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিল। ঐ সব মুসলমান ছিল হযরত ঈসা (আঃ)-এর সত্যিকার অনুসারী। তাঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। তাঁদের সবাইকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল। দাউস যু সালাবান নামক একটি মাত্র লোক বেঁচেছিলেন। তিনি সিরিয়ায় পৌছে রোমের বাদশাহ কায়সারের কাছে ফরিয়াদ করলেন। কায়সার। ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। তিনি হাবশের (আবিসিনিয়ার) বাদশাহ নাজাশীকে লিখলেনঃ “দাউস যু সালাবানের সঙ্গে পুরো বাহিনী পাঠিয়ে দিন। সেখান থেকে শক্রদেশ নিকটবতী ছিল। বাদশাহ নাজাশী আমীর ইবনে ইরবাত ও আবরাহা ইবনে সাহাব আবু ইয়াকসুমকে সৈন্য পরিচালনার যৌথ দায়িত্ব দিয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী যুনুয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল ইয়ামনে পৌঁছলো এবং ইয়ামন ও তথাকার অধিবাসীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলো। শূনুয়াস পালিয়ে গেল এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করলো। যুনুয়াসের শাসন ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার পর সমগ্র ইয়ামন হাবশের বাদশাহর কর্তৃত্বে চলে গেল। সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে আগমনকারী উভয় সর্দার ইয়ামনে বসবাস করতে লাগলো। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। শেষ পর্যন্ত উভয়ে নিজ নিজ বিভক্ত সৈন্যদলসহ মুখোমুখী সংঘর্ষের জন্যে প্রস্তত হলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে উভয় সর্দার পরস্পরকে বললোঃ অযথা রক্তপাত করে কি লাভ, চলো আমরা উভয়ে লড়াই করি। যে বেঁচে যাবে, ইয়ামন এবং সেনাবাহিনী তার অনুগত থাকবে।” এই কথা অনুযায়ী উভয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হলো। আমীর ইবনে ইরবাত আবরাহার উপর আক্রমণ করলো এবং তরবারীর এক আঘাতে তার চেহারা রক্তাক্ত করে ফেললো। নাক, ঠোট এবং চেহারার বেশ কিছু অংশ কেটে গেল। এই অবস্থা দেখে আবরাহার ক্রীতদাস আদাহ্ এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ইরবাতকে হত্যা করে ফেললো। মারাত্মকভাবে আহত আবরাহা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে গেল। বেশ কিছু দিন চিকিৎসার পর তার ক্ষত ভাল হলো এবং সে ইয়ামনের শাসনকর্তা হয়ে বসলো। আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজাশী এ খবর পেয়ে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং একপত্রে জানালেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি তোমার শহরসমূহ ধ্বংস করবো এবং তোমার টিকি কেটে আনবো।” আবরাহা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এ পত্রের জবাব লিখলো এবং দূতকে নানা প্রকারের উপটৌকন, একটা থলের মধ্যে ইয়ামনের মাটি এবং নিজের মাথার কিছু চুল কেটে ওর মধ্যে রাখলো ও ওর মুখ বন্ধ করে দিলো। তাছাড়া চিঠিতে সে নিজের অপরাধের ক্ষমা চেয়ে লিখলোঃ “ইয়ামনে মাটি এবং আমার মাথার চুল হাযির রয়েছে, আপনি নিজের কসম পূর্ণ করুন এবং আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিন!” এতে নাজাশী খুশী হলেন এবং ইয়ামনের শাসনভার আবরাহাকে লিখে দিলেন। তারপর আবরাহা নাজাশীকে লিখলোঃ “আমি ইয়ামনে আপনার জন্যে এমন একটি গীর্জা তৈরি করছি যে, এরকম গীর্জা ইতিপূর্বে পৃথিবীতে কখনো তৈরি হয়নি। অতি যত্ন সহকারে খুবই মযবুত ও অতি উঁচু করে ঐ গীর্জাটি নির্মিত হলো। ঐ গীর্জার চূড়া এতো উঁচু ছিল যে, চূড়ার প্রতি টুপি মাথায় দিয়ে তাকালে মাথার টুপি পড়ে যেতো। আরববাসীরা ঐ গীর্জার নাম দিয়েছিল কালীস’ অর্থাৎ টুপি ফেলে দেয়া গীর্জা। এবার আবরাহা মনে করলো যে, জনসাধারণ কা’বায় হজ্ব না করে বরং এ গীর্জায় এসে হজ্ব করবে। সারাদেশে সে এটা ঘোষণা করে দিলো। আদনানিয়্যাহ ও কাহতা নিয়্যাহ গোত্র এ ঘোষণায় খুবই অসন্তুষ্ট, আর কুরায়েশরা ভীষণ রাগান্বিত হলো। অল্প কয়েকদিন পরে দেখা গেল যে, এক ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে ঐ গীর্জায় প্রবেশ করে পায়খানা করে এসেছে। প্রহরীরা পরের দিন এ অবস্থা দেখে বাদশাহর কাছে খবর পাঠালো এবং অভিমত ব্যক্ত করলো যে, কুরায়েশরাই এ কাজ করেছে। তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলেই এ কাণ্ড তারা করেছে। আবরাহা তৎক্ষণাৎ কসম করে বললোঃ “আমি মক্কার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো এবং বায়তুল্লাহর প্রতিটি ইট পর্যন্ত খুলে ফেলবো।”
অন্য এক বর্ণনায় এরূপও আছে যে, কয়েকজন উদ্যোগী কুরায়েশ যুবক ঐ গীর্জায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই দিন বাতাস প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হয়েছিল বলে আগুন ভালভাবে ঐ গীর্জাকে গ্রাস করেছিল এবং ওটা মাটিতে ধ্বসে পড়েছিল। অতঃপর ক্রুদ্ধ আবরাহা এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলো। তাদের সাথে এক বিরাট উঁচু ও মোটা হাতী ছিল। ঐরূপ হাতী ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। হাতীটির নাম ছিল মাহমুদ। বাদশাহ নাজাশী মক্কা অভিযান সফল করার লক্ষ্যে ঐ হাতিটি আবরাহাকে দিয়েছিল। ঐ হাতীর সাথে আবরাহা আরো আটটি অথবা বারোটি হাতী নিলো। তার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে বায়তুল্লাহর দেয়ালে শিকল বেঁধে দিবে, তারপর সমস্ত হাতীর গলায় ঐ শিকল লাগিয়ে দিবে। এতে শিকল টেনে হাতীগুলো সমস্ত দেয়াল একত্রে ধ্বসিয়ে দিবে। মক্কার অধিবাসীরা এ সংবাদ পেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লো। যে কোন অবস্থায় এর মুকাবিলা করার তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। যুনফর নামক ইয়ামনের একজন রাজ বংশীয় লোক নিজের গোত্র ও আশে পাশের বহু সংখ্যক আরবকে একত্রিত করে দুবৃত্ত আবরাহার মুকাবিলা করলেন। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ইচ্ছা। ছিল অন্যরকম। যুনফর পরাজিত হলেন এবং আবরাহার হাতে বন্দী হলেন। যুনফরকেও সঙ্গে নিয়ে আবরাহা মক্কার পথে অগ্রসর হলো। খাশআম গোত্রের এলাকায় পৌঁছার পর নুফায়েল ইবনে হাবীব আশআমী একদল সৈন্য নিয়ে আবরাহার মুকাবিলা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁরাই আবরাহার হাতে পরাজয় বরণ করলেন। নুফায়েলকেও যুনফরের মত বন্দী করা হলো। আবরাহা প্রথম নুফায়েলকে হত্যা করার ইচ্ছা করলো, কিন্তু পরে মক্কার পথ দেখিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে জীবিতাবস্থায় সঙ্গে নিয়ে চললো। তায়েফের উপকণ্ঠে পৌঁছলে সাকীফ গোত্র আবরাহার সাথে সন্ধি করলো যে, লাত মূর্তিটি যে প্রকোষ্ঠে রয়েছে, আবরাহার সৈন্যরা ঐ প্রকোষ্ঠের কোন ক্ষতি সাধন করবে না। সাকীফ গোত্র আবু রিগাল নামক একজন লোককে পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্যে আবরাহার সঙ্গে দিলো। মক্কার কাছে মুগমাস নামক স্থানে তারা অবস্থান করলো। আবরাহার সৈন্যেরা আশেপাশের জনপদ এবং চারণভূমি থেকে বহু সংখ্যক উট এবং অন্যান্য পশু দখল করে নিলো। এগুলোর মধ্যে আবদুল মুত্তালিবের দু’শ উটও ছিল। এতে আরবের কবিরা আবরাহার নিন্দে করে কবিতা রচনা করলো সীরাতে ইবনে ইসহাকে ঐ কবিতার উল্লেখ রয়েছে।
অতঃপর আবরাহা নিজের বিশেষ দূত হানাতাহ হুমাইরীকে বললোঃ তুমি মক্কার সর্বাপেক্ষা বড় সর্দারকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। এবং ঘোষণা করে দাওঃ আমরা মক্কাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি, আল্লাহর ঘর ভেঙ্গে ফেলাই শুধু আমাদের উদ্দেশ্য। তবে হ্যা, মক্কাবাসীরা যদি কাবাগৃহ রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসে এবং আমাদেরকে বাধা দেয় তাহলে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। হানাতাহ মক্কার জনগণের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেমই মক্কার বড় নেতা। হানাতাহ আবদুল মুত্তালিবের সামনে আবরাহার বক্তব্য পেশ করলে আবদুল মুত্তালিব বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আমাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছাও নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও নেই।” আল্লাহর সম্মানিত ঘর। তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবন্ত স্মৃতি। সুতরাং আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিজের ঘরের হিফাজত নিজেই করবেন। অন্যথায় তাঁর ঘরকে রক্ষা করার সাহসও আমাদের নেই এবং যুদ্ধ করার মত শক্তিও আমাদের নেই।হানাতাহ তখন তাকে বললোঃ “ঠিক আছে, আপনি আমাদের বাদশাহর কাছে চলুন।” আবদুল মুত্তালিব তখন তার সাথে আবরাহার কাছে গেলেন। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শণ বলিষ্ঠ দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। তাঁকে দেখা মাত্র যে কোন মানুষের মনে শ্রদ্ধার উদ্রেক হতো। আবরাহা তাকে দেখেই সিংহাসন থেকে নেমে এলো এবং তার সাথে মেঝেতে উপবেশন করলোঃ সে তার দোভাষীকে বললোঃ তাকে জিজ্ঞেস করঃ তিনি কি চান? আবদুল মুত্তালিব জানালেনঃ “বাদশাহ আমার দু’শ উট লুট করিয়েছেন। আমি সেই উট ফেরত নিতে এসেছি।” বাদশাহ আবরাহা তখন দো-ভাষীর মাধ্যমে তাঁকে বললোঃ প্রথম দৃষ্টিতে আপনি যে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন, আপনার কথা শুনে সে শ্রদ্ধা লোপ পেয়ে গেছে। নিজের দু’শ উটের। জন্যে আপনার এতো চিন্তা অথচ স্বজাতির ধর্মের জন্যে কোন চিন্তা নেই! আমি আপনাদের ইবাদতখানা কা’বা ধ্বংস করে ধূলিসাৎ করতে এসেছি।” একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব জবাবে বললেনঃ “শুন, উটের মালিক আমি, তাই উট ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে এসেছি। আর কাবাগৃহের মালিক হলেন স্বয়ং আল্লাহ। সুতরাং তিনি নিজেই নিজের ঘর রক্ষা করবেন।” তখন ঐ নরাধম বললোঃ “আজ স্বয়ং আল্লাহও কাবাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।” একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব বললেনঃ “তা আল্লাহ জানেন এবং আপনি জানেন।” এও বর্ণিত আছে যে, মক্কার জনগণ তাদের ধন সম্পদের এক তৃতীয়াংশ আবরাহাকে দিতে চেয়েছিল, যাতে সে এই ঘৃণ্য অপচেষ্টা হতে বিরত থাকে। কিন্তু আবরাহা তাতেও রাজী হয়নি। মোটকথা, আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো নিয়ে ফিরে আসলেন এবং মক্কাবাসীদেরকে বললেনঃ “তোমরা মক্কাকে সম্পূর্ণ খালি করে দাও। সবাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও।” তারপর আবদুল মুত্তালিব কুরায়েশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কা’বা গৃহে গিয়ে কাবার খুঁটি ধরে দেয়াল ছুঁয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেন এবং কায়মনোবাক্যে ঐ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ গৃহ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করলেন। আবরাহা এবং তার রক্ত পিপাসু সৈন্যদের অপবিত্র ইচ্ছার কবল থেকে কাবাকে পবিত্র রাখার জন্যে আবদুল মুত্তালিব কবিতার ভাষায় নিম্নলিখিত দুআ করেছিলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমরা নিশ্চিন্ত, কারণ আমরা জানি যে, প্রত্যেক গৃহমালিক নিজেই নিজের গৃহের হিফাযত করেন। হে আল্লাহ! আপনিও আপনার গৃহ আপনার শত্রুদের কবল হতে রক্ষা করুন। আপনার অস্ত্রের উপর তাদের অস্ত্র জয়যুক্ত হবে এমন যেন কিছুতেই না হয়। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব কা’বা গৃহের খুঁটি ছেড়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে ওর আশে পাশের পর্বতসমূহের চূড়ায় উঠে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এমনও বর্ণিত আছে যে, কুরবানীর একশত পশুকে নিশান লাগিয়ে কা’বার আশে পাশে ছেড়ে দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যদি দুবৃত্তরা আল্লাহর নামে ছেড়ে দেয়া পশুর প্রতি হাত বাড়ায় তাহলে আল্লাহর গযব তাদের উপর অবশ্যই নেমে আসবে।
পরদিন প্রভাতে আবরাহার সেনাবাহিনী মক্কায় প্রবেশের উদ্যোগ আয়োজন করলো। বিশেষ হাতী মাহমুদকে সজ্জিত করা হলো। পথে বন্দী হয়ে আবরাহার সাথে আগমনকারী নুফায়েল ইবনে হাবীব তখন মাহমুদ নামক হাতীটির কান ধরে বললেনঃ “মাহমুদ! তুমি বসে পড়, আর যেখান থেকে এসেছে সেখানে ভালভাবে ফিরে যাও। তুমি আল্লাহর পবিত্র শহরে রয়েছে।” একথা বলে নুফায়েল হাতির কান ছেড়ে দিলেন এবং ছুটে গিয়ে নিকট এক পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করলেন। মাহমুদ নামক হাতীটি নুফায়েলের কথা শোনার সাথে সাথে বসে পড়লো। বহুচেষ্টা করেও তাকে নড়ানো সম্ভব হলো না। পরীক্ষামূলক ভাবে ইয়ামনের দিকে তার মুখ ফিরিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই হাতী তাড়াতাড়ি উঠে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগলো। পূর্বদিকে চালাবার চেষ্টা করা হলে সেদিকেও যাচ্ছিল, কিন্তু মক্কা শরীফের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চালাবার চেষ্টা করতেই বসে পড়লো। সৈন্যরা তখন হাতীটিকে প্রহার করতে শুরু করলো। এমন সময় দেখা গেল এক ঝাঁক পাখি কালো মেঘের মত হয়ে সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসছে। চোখের পলকে ওগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর মাথার উপর এসে পড়লো। এবং চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে। ফেললো। প্রত্যেক পাখির চঞ্চতে একটি এবং দুপায়ে দুটি কংকর ছিল। কংকরের ঐটুকরাগুলো ছিল মসুরের ডাল বা মাস কলাই এর সমান। পাখিগুলো কংকরের ঐ টুকরোগুলো আবরাহার সৈন্যদের প্রতি নিক্ষেপ করছিল। যার গায়ে ঐ কংকর পড়ছিল সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভবলীলা সাঙ্গ করছিল। সৈন্যরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছিল আর নুফায়েল নুফায়েল বলে চীৎকার করছিল কারণ তারা তাঁকেই পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে এনেছিল। নুফায়েল তখন পাহাড়ের শিখরে আরোহণ করে অন্যান্য কুরায়েশদের সাথে আবরাহা ও তার সৈন্যদের দুরাবস্থার দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। ঐ সময় নুফায়েল নিম্নলিখিত কবিতাংশ পাঠ করছিলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এখন আর আশ্রয়স্থল কোথায়? স্বয়ং আল্লাহই তো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। শোনো, দুবৃত্ত আশরম পরাজিত হয়েছে, জয়ী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।”
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নুফায়েল আরো বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হাতী ওয়ালাদের দুরাবস্থার সময়ে তুমি যদি উপস্থিত থাকতে! মুহাসসাব প্রান্তরে তাদের উপর আযাবের কংকর বর্ষিত হয়েছে। তুমি সে অবস্থা দেখলে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত হতে। আমরা পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করছিলাম। আমাদের হৃৎপিণ্ড কাঁপছিল এই ভয়ে যে, না জানি হয় তো আমাদের উপরও এই কংকর পড়ে যায় এবং আমাদেরও দফারফা করে দেয়। পুরো সম্প্রদায় মুখ ফিরিয়ে পালাচ্ছিল ও নুফায়েল নুফায়েল বলে চীৎকার করছিল, যেন নুফায়েলের উপর হাবশীদের ঋণ রয়েছে।”
ওয়াকেদী (রঃ) বলেন যে, পাখিগুলো ছিল সবুজ রঙএর। ওগুলো কবুতরের চেয়ে কিছু ছোট ছিল। ওদের পায়ের রঙছিল লাল। অন্য এক রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, মাহমুদ নামক হাতীটি যখন বসে পড়লো এবং সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে উঠানো সম্ভব হলো না। তখন সৈন্যরা অন্য একটি হাতীকে সামনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে পা বাড়াতেই তার মাথায় কংকরের টুকরো পড়লো এবং আর্তনাদ করে পিছনে সরে এলো। অন্যান্য হাতীও তখন এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করলো। কয়েকটির উপর কংকর পড়ায় তৎক্ষণাৎ ওগুলো মারা গেল। যারা ছুটে পালাচ্ছিল তাদেরও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। এবং অবশেষে সবগুলোই মারা গেল। আবরাহা বাদশাহও ছুটে পালালো, কিন্তু তারও এক একটি অঙ্গ খসে খসে পড়ছিল। সানআ (তৎকালীন ইয়ামনের রাজধানী) নামক শহরে পৌঁছার পর সে মাংসপিণ্ডে পরিণত হলো এবং কুকুরের মত ছটফট করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করলো। তার কলেজা ফেটে গিয়েছিল। কুরায়েশরা প্রচুর ধন সম্পদ পেয়ে গিয়েছিল। আবদুল মুত্তালিব তো সোনা সংগ্রহ করে করে একটি কূপ ভর্তি করেছিলেন। ঐ বছরই সারা দেশে প্রথম ওলা ওঠা এবং প্লেগ রোগ দেখা দেয়। হরল, হান্যাল প্রভৃতি কটুগাছও ঐ বছর উৎপন্ন হয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী (সঃ)-এর ভাষায় এ নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এবং যেন বলছেনঃ যদি তোমরা আমার ঘরের সম্মান এভাবে করতে থাকতে এবং আমার রাসূল (সঃ)-এর কথা মানতে তবে আমিও সেভাবে তোমাদের হিফাযত করতাম এবং শত্রু দল থেকে তোমাদেরকে মুক্তি দিতাম।
(আরবি) শব্দটি বহুবচন, এর একবচন আরবী অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর (আরবি) শব্দের অর্থ হলো খুবই কঠিন বা শক্ত। কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, (আরবি) এবং (আরবি) শব্দ দুটি ফারসী শব্দ। (আরবি) এর অর্থ হলো প্রস্তর সমন্বিত মৃত্তিকা। (আরবি) শব্দটি শব্দের (আরবি) বহুবচন।(আরবি) মাঠের ফসলের ঐ সব পাতাকে বলা হয় যেগুলো এখনো পাকেনি। (আরবি) এর অর্থ হলো ঝাক ঝক পাখী, বহুসংখ্যক এবং ক্রমাগত আগমনকারী। কোন কোন ব্যাকরণবিদ বলেন যে, (আরবি) শব্দটি (আরবি) শব্দের বহুবচন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ঐ পাখিগুলোর চঞ্চু ছিল পাখির মত এবং নখ ছিল কুকুরের মত।
ইকরামা (রঃ) বলেন যে, সবুজ রঙ-এর এই পাখিগুলো সমুদ্র হতে বের হয়ে এসেছিল। ওগুলোর মাথা ছিল জন্তুর মত। এ সম্পর্কে আরো বহু উক্তি রয়েছে। পাখির ঝাঁক আবরাহার সৈন্যদের মাথার উপর অবস্থান করে চীৎকার করছিল এবং কংকর নিক্ষেপ করছিল। যার মাথায় ঐ কংকর পড়ছিল তা তার পায়খানার দ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঐ ব্যক্তি দ্বিখণ্ডিত হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে প্রবল বাতাস বইতে লাগলো। এর ফলে আশে পাশের বালুকণা এসে তাদের চোখে পড়লো এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদেরকে ঘায়েল করে ফেললো।
(আরবি) এর অর্থ হলো ভূষি এবং (আরবি) অর্থহলো ভক্ষিত বা টুকরো টুকরো কৃত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, শস্যদানার উপরের ভূষিকে (আরবি) বলা হয়। হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো ক্ষেতের শস্যের ঐ পাতা যেগুলো পশুরা খেয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে তছনছ করে দিলেন এবং সবাইকে ধ্বংস করে দিলেন। তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। কোন কল্যাণই তারা লাভ করতে সমর্থ হলো না। তাদের দুরাবস্থার খবর অন্যদেরকে পৌছানোর মত কেউই তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। অল্পসংখ্যক যারা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বেঁচেছিল তারাও পরে ধুকে ধুকে মরেছিল। স্বয়ং বাদশাহ্ও এক টুকরো গোশতের মত হয়ে গিয়েছিল। কোনক্রমে সে সানআতে পৌছলো। সেখানে পৌছেই তার কলেজা ফেটে গেল এবং সে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকসূ ইয়ামানের শাসন ভার গ্রহণ করলো। তারপর তার অন্য ভাই মাসরুক ইবনে আবরাহা সিংহাসনে আরোহন করলো। এ সময়ে ঘূইয়াযান হুমাইরী কিসরার (পারস্য সম্রাট) কাছে গিয়ে হাবশীদের কবল থেকে ইয়ামনকে মুক্ত করার জন্যে সাহায্য প্রার্থনা করলো। কিসরা সাইফের সাথে একদল বাহাদুর সৈন্য পাঠালো। সেই সৈন্যদল হাবশীদেরকে পরাজিত করে আবরাহার বংশধরদের কবল থেকে ইয়ামনের শাসনক্ষমতা কেড়ে নেয়। অতঃপর হুমাইরীয় গোত্র ইয়ামন শাসন করতে থাকে। আরবের লোকেরা এই উপলক্ষে উৎসব পালন করে। চারদিক থেকে হুমাইরীয় গোত্রের বাদশাহকে অভিনন্দন জানানো হয়।
হযরত আয়েশা বিনতে আবী বকর (রাঃ) বলেনঃ “আবরাহার সৈন্যদলের দু’জন সৈন্যকে আমি মক্কা শরীফে দেখেছি। তারা উভয়েই অন্ধ এবং চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। তারা বসে বসে ভিক্ষা করতো।”
হযরত আসমা বিনতে আবী বকর (রাঃ) বলেন যে, যে আসাফ ও নায়েলা নামক মূর্তিদ্বয়ের পার্শ্বে মুশরিকরা কুরবানী করতো সেখানে বসে ঐ লোক দুটি লোকদের কাছে ভিক্ষা চাইতো। তাদের মধ্যে একজন ছিল হাতীর চালক, যার নাম ছিল আনীসা। কোন কোন ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত রয়েছে যে, আবরাহা নিজে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেনি, বরং শামর ইবনে মাকসূত নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বাধীনে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিল। সৈন্যসংখ্যা ছিল বিশ হাজার। পাখিগুলো তাদের উপর রাত্রিকালে এসেছিল এবং সকাল পর্যন্ত তাদের সকলকে তছনছ করে ফেলেছিল। কিন্তু এ রিওয়াইয়াতটি গারীব বা দুর্বল। আসল কথা হলো এই যে, স্বয়ং বাদশাহ্ আবরাহা আশরম হাবশী নিজেই সৈন্যদল নিয়ে এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল। শামর ইবনে মাকসূদ হয় তো কোন একদল সৈন্যের সেনাপতি ছিল। বহু সংখ্যক আরব কবি এ ঘটনাকে নানাভাবে তাঁদের কবিতায় বর্ণনা করেছেন।
একটি রিওয়াইয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধির দিনে নবী করীম (সঃ) একটি টিলার উপর উঠেছিলেন। সেখান থেকে কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর উষ্ট্ৰীটি সেখানে বসে পড়েছিল। সাহাবী (রাঃ)গণ বহু চেষ্টা করেও উস্ত্রীকে উঠাতে পারলেন না। তখন তারা বললেন যে, উষ্ট্রী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “না, সে ক্লান্তও হয়নি এবং বসে পড়া তার অভ্যাসও নয়। তাকে ঐ আল্লাহ্ থামিয়ে দিয়েছেন যিনি হাতীকে থামিয়ে দিয়েছিলেন, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! মক্কাবাসীরা যে শর্তে সম্মত হবে আমি সেই শর্তেই তাদের সাথে সন্ধি করবো। তবে, আল্লাহর অমর্যাদা হতে পারে এমন কোন শর্তে আমি সম্মত হবো” তারপর তিনি উস্ত্রীকে ধমক দেয়া মাত্রই সে উঠে দাঁড়ালো। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা মক্কার উপর হাতী ওয়ালাদের আধিপত্য বিস্তার করতে দেননি, বরং তিনি তাঁর নবী (সঃ) ও ঈমানদার বান্দাদেরকে মক্কার উপর আধিপত্য দান করেছেন। জেনে রেখো যে, মক্কার মর্যাদা আজ ঐ অবস্থাতেই ফিরে এসেছে যে অবস্থায় গতকাল ছিল। খবরদার! প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তিদের নিকট (খবর) পৌছিয়ে দিবে।”
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1218/O Ye Mankind:-25)
[ # Story of the People of the Elephant :-]
Surah.105: Al-Fil
Para:30 Ayat:- 1-5
www.motaher21.net
105:1
اَلَمۡ تَرَ کَیۡفَ فَعَلَ رَبُّکَ بِاَصۡحٰبِ الۡفِیۡلِ ؕ﴿۱﴾
Have you not considered, [O Muhammad], how your Lord dealt with the companions of the elephant?
This is one of the favors Allah did for the Quraysh. He saved them from the People of the Elephant who had tried to tear down the Ka`bah and wipe out all traces of its existence. Allah destroyed them, defeated them, thwarted their plans, made their efforts in vain and sent them back routed.
They were people who were Christians, and thus, their religion was closer to the True Religion (Islam) than the idolatry of the Quraysh. However, this was a means of giving a sign and preparing the way for the coming of the Messenger of Allah. For verily, he was born during that same year according to the most popular opinion. So the tongue of destiny was saying,
“We will not help you, O people of Quraysh, because of any status you may have over the Ethiopians (Abyssinians). We are only helping you in order to defend the Ancient House (the Ka`bah), which We will honor, magnify, and venerate by sending the unlettered Prophet, Muhammad , the Finality of all Prophets.”
A Summary of the Story of the People of the Elephant
This is the story of the people of the Elephant, in brief, and summarized.
It has already been mentioned in the story of the People of the Ditch that Dhu Nuas, the last king of Himyar, a polytheist — was the one who ordered killing the People of the Ditch. They were Christians and their number was approximately twenty thousand. None of them except a man named Daws Dhu Thalaban escaped. He fled to Ash-Sham where he sought protection from Caesar, the emperor of Ash-Sham, who was also a Christian.
Caesar wrote to An-Najashi, the king of Ethiopia (Abyssinia), who was closer to the home of the man. An-Najashi sent two governors with him:Aryat and Abrahah bin As-Sabah Abu Yaksum, along with a great army. The army entered Yemen and began searching the houses and looting in search of the king of Himyar (Dhu Nuwas). Dhu Nuwas was eventually killed by drowning in the sea.
Thus, the Ethiopians were free to rule Yemen, with Aryat and Abrahah as its governors. However, they continually disagreed about matters, attacked each other, fought each other and warred against each other, until one of them said to the other,
“There is no need for our two armies to fight. Instead let us fight each other (in a duel) and the one who kills the other will be the ruler of Yemen.”
So the other accepted the challenge and they held a duel. Behind each man was a channel of water (to keep either from fleeing). Aryat gained the upper hand and struck Abrahah with his sword, splitting his nose and mouth, and slashing his face. But Atawdah, Abrahah’s guard, attacked Aryat and killed him. Thus, Abrahah returned wounded to Yemen where he was treated for his injuries and recovered. He thus became the commander of the Abyssinian army in Yemen.
Then the king of Abyssinia, An-Najashi wrote to him, blaming him for what had happened (between him and Aryat) and threatened him, saying that he swore to tread on the soil of Yemen and cut off his forelock. Therefore, Abrahah sent a messenger with gifts and precious objects to An-Najashi to appease him and flatter him, and a sack containing soil from Yemen and a piece of hair cut from his forelock. He said in his letter to the king,
“Let the king walk upon this soil and thus fulfill his oath, and this is my forelock hair that I send to you.”
When An-Najashi received this, he was pleased with Abrahah and gave him his approval.
Then Abrahah wrote to An-Najashi saying that he would build a church for him in Yemen the like of which had never been built before. Thus, he began to build a huge church in San`a’, tall and beautifully crafted and decorated on all sides. The Arabs called it Al-Qullays because of its great height, and because if one looked at it, his cap would be in danger of falling off as he tilted his head back.
Then Abrahah Al-Ashram decided to force the Arabs to make their pilgrimage to this magnificent church, just as they had performed pilgrimage to the Ka`bah in Makkah. He announced this in his kingdom (Yemen), but it was rejected by the Arab tribes of Adnan and Qahtan.
The Quraysh were infuriated by it, so much so that one of them journeyed to the church and entered it one night. He then relieved himself in the church and ran away (escaping the people). When its custodians saw what he had done, they reported it to their king, Abrahah, saying;
“One of the Quraysh has done this in anger over their House in whose place you have appointed this church.”
Upon hearing this, Abrahah swore to march to the House of Makkah (the Ka`bah) and destroy it stone by stone.
Muqatil bin Sulayman mentioned that a group of young men from the Quraysh entered the church and started a fire in it on an extremely windy day. So the church caught on fire and collapsed to the ground. Due to this Abrahah prepared himself and set out with a huge and powerful army so that none might prevent him from carrying out his mission.
He took along a great, powerful elephant that had a huge body the like of which had never been seen before. This elephant was called Mahmud and it was sent to Abrahah from An-Najashi, the king of Abyssinia, particularly for this expedition.
It has also been said that he had eight other elephants with him; their number was also reported to be twelve, plus the large one, Mahmud — and Allah knows best.
Their intention was to use this big elephant to demolish the Ka`bah. They planned to do this by fastening chains to the pillars of the Ka`bah and placing the other ends around the neck of the elephant. Then they would make the elephant pull on them in order to tear down the walls of the Ka`bah all at one time.
When the Arabs heard of Abrahah’s expedition, they considered it an extremely grave matter. They held it to be an obligation upon them to defend the Sacred House and repel whoever intended a plot against it. Thus, the noblest man of the people of Yemen and the greatest of their chiefs set out to face him (Abrahah). His name was Dhu Nafr.
He called his people, and whoever would respond to his call among the Arabs, to go to war against Abrahah and fight in defense of the Sacred House. He called the people to stop Abrahah’s plan to demolish and tear down the Ka`bah. So the people responded to him and they entered into battle with Abrahah, but he defeated them.
This was due to Allah’s will and His intent to honor and venerate the Ka`bah.
The army continued on its way until it came to the land of Khatham where it was confronted by Nufayl bin Habib Al-Kath`ami along with his people, the Shahran and Nahis tribes. They fought Abrahah but he defeated them and captured Nufayl bin Habib. Initially he wanted to kill him, but he forgave him and took him as his guide to show him the way to Al-Hijaz.
When they approached the area of At-Ta’if, its people — the people of Thaqif — went out to Abrahah. They wanted to appease him because they were fearful for their place of worship, which they called Al-Lat. Abrahah was kind to them and they sent a man named Abu Righal with him as a guide.
When they reached a place known as Al-Mughammas, which is near Makkah, they settled there. Then he sent his troops on a foray to capture the camels and other grazing animals of the Makkans, which they did, including about two hundred camels belonging to Abdul-Muttalib. The leader of this particular expedition was a man named Al-Aswad bin Mafsud.
According to what Ibn Ishaq mentioned, some of the Arabs used to satirize him (because of the part he played in this historical incident). Then Abrahah sent an emissary named Hanatah Al-Himyari to enter Makkah, commanding him to bring the head of the Quraysh to him. He also commanded him to inform him that the king will not fight the people of Makkah unless they try to prevent him from the destruction of the Ka`bah.
Hanatah went to the city and he was directed to Abdul-Muttalib bin Hashim, to whom he relayed Abrahah’s message. Abdul-Muttalib replied,
“By Allah! We have no wish to fight him, nor are we in any position to do so. This is the Sacred House of Allah, and the house of His Khalil, Ibrahim, and if He wishes to prevent him (Abrahah) from (destroying) it, it is His House and His Sacred Place (to do so). And if He lets him approach it, by Allah, We have no means to defend it from him.”
So Hanatah told him, “Come with me to him (Abrahah).” And so Abdul-Muttalib went with him.
When Abrahah saw him, he was impressed by him, because Abdul-Muttalib was a large and handsome man. So Abrahah descended from his seat and sat with him on a carpet on the ground. Then he asked his translator to say to him, “What do you need”
Abdul-Muttalib replied to the translator, “I want the king to return my camels which he has taken from me which are two hundred in number.”
Abrahah then told his translator to tell him,
“I was impressed by you when I first saw you, but now I withdraw from you after you have spoken to me. You are asking me about two hundred camels which I have taken from you and you leave the matter of a house which is (the foundation of) religion and the religion of your fathers, which I have come to destroy and you do not speak to me about it”
Abdul-Muttalib said to him,
“Verily, I am the lord of the camels. As for the House, it has its Lord Who will defend it.”
Abrahah said, “I cannot be prevented (from destroying it).”
Abdul-Muttalib answered, “Then do so.”
It is said that a number of the chiefs of the Arabs accompanied Abdul-Muttalib and offered Abrahah a third of the wealth of the tribe of Tihamah if he would withdraw from the House, but he refused and returned Abdul-Muttalib’s camels to him.
Abdul-Muttalib then returned to his people and ordered them to leave Makkah and seek shelter at the top of the mountains, fearful of the excesses which might be committed by the army against them. Then he took hold of the metal ring of the door of the Ka`bah, and along with a number of Quraysh, he called upon Allah to give them victory over Abrahah and his army. Abdul-Muttalib said, while hanging on to the ring of the Ka`bah’s door,
“There is no matter more important to any man right now than the defense of his livestock and property. So, O my Lord! Defend Your property. Their cross and their cunning will not be victorious over your cunning by the time morning comes.”
According to Ibn Ishaq, then Abdul-Muttalib let go of the metal ring of the door of the Ka`bah, and they left Makkah and ascended to the mountains tops.
Muqatil bin Sulayman mentioned that they left one hundred animals (camels) tied near the Ka`bah hoping that some of the army would take some of them without a right to do so, and thus bring about the vengeance of Allah upon themselves.
When morning came, Abrahah prepared to enter the sacred city of Makkah. He prepared the elephant named Mahmud. He mobilized his army, and they turned the elephant towards the Ka`bah. At that moment Nufayl bin Habib approached it and stood next to it, and taking it by its ear, he said,
“Kneel, Mahmud! Then turn around and return directly to whence you came. For verily, you are in the Sacred City of Allah.”
Then he released the elephant’s ear and it knelt, after which Nufayl bin Habib left and hastened to the mountains.
Abrahah’s men beat the elephant in an attempt to make it rise, but it refused. They beat it on its head with axes and used hooked staffs to pull it out of its resistance and make it stand, but it refused. So they turned him towards Yemen, and he rose and walked quickly. Then they turned him towards Ash-Sham and he did likewise. Then they turned him towards the east and he did the same thing. Then they turned him towards Makkah and he knelt down again.
Then Allah sent against them the birds from the sea, like swallows and herons. Each bird carried three stones the size of chickpeas and lentils, one in each claw and one in its beak. Everyone who was hit by them was destroyed, though not all of them were hit. They fled in panic along the road asking about the whereabouts of Nufayl that he might point out to them the way home. Nufayl, however, was at the top of the mountain with the Quraysh and the Arabs of the Hijaz observing the wrath which Allah had caused to descend on the people of the elephant. Nufayl then began to say,
“Where will they flee when the One True God is the Pursuer For Al-Ashram is defeated and not the victor.”
Ibn Ishaq reported that Nufayl said these lines of poetry at that time,
“Didn’t you live with continued support We favored you all with a revolving eye in the morning (i.e., a guide along the way).
If you saw, but you did not see it at the side of the rock covered mountain that which we saw.
Then you will excuse me and praise my affair, and do not grieve over what is lost between us.
I praised Allah when I saw the birds, and I feared that the stones might be thrown down upon us.
So all the people are asking about the whereabouts of Nufayl, as if I have some debt that I owe the Abyssinians.”
Ata’ bin Yasar and others have said that all of them were not struck by the torment at this hour of retribution. Rather some of them were destroyed immediately, while others were gradually broken down limb by limb while trying to escape. Abrahah was of those who was broken down limb by limb until he eventually died in the land of Khatham.
Ibn Ishaq said that they left (Makkah) being struck down and destroyed along every path and at every water spring.
Abrahah’s body was afflicted by the pestilence of the stones and his army carried him away with them as he was falling apart piece by piece, until they arrived back in San`a’. When they arrived there he was but like the baby chick of a bird. And he did not die until his heart fell out of his chest. So they claim.
Ibn Ishaq said that when Allah sent Muhammad with the Prophethood, among the things that he used to recount to the Quraysh as blessings that Allah had favored them with of His bounties, was His defending them from the attack of the Abyssinians. Due to this they (the Quraysh) were allowed to remain (safely in Makkah) for a period of time. Thus, Allah said,
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ
105:2
اَلَمۡ یَجۡعَلۡ کَیۡدَہُمۡ فِیۡ تَضۡلِیۡلٍ ۙ﴿۲﴾
Did He not make their plan into misguidance?
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيلَ
تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولِ
Have you not seen how your Lord dealt with the Owners of the Elephant?
Did He not make their plot go astray?
And He sent against them birds, in flocks (Ababil).
Striking them with stones of Sijjil.
And He made them like `Asf, Ma’kul.
لاإِيلَـفِ قُرَيْشٍ
إِيلَـفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَأءِ وَالصَّيْفِ
فَلْيَعْبُدُواْ رَبَّ هَـذَا الْبَيْتِ
الَّذِى أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ وَءَامَنَهُم مِّنْ خوْفٍ
For the Ilaf of the Quraysh,
their Ilaf caravans, in winter and in summer.
So, let them worship the Lord of this House,
Who has fed them against hunger, and has made them safe from fear. (106:1-4)
meaning, that Allah would not alter their situation because Allah wanted good for them if they accepted Him.
Ibn Hisham said,
“Al-Ababil are the groups, as the Arabs do not speak of just one (bird).”
He also said,
“As for As-Sijjil, Yunus An-Nahwi and Abu Ubaydah have informed me that according to the Arabs, it means something hard and solid.”
He then said,
“Some of the commentators have mentioned that it is actually two Persian words that the Arabs have made into one word. The two words are Sanj and Jil, Sanj meaning stones, and Jil meaning clay. The rocks are of these two types:stone and clay.”
He continued saying,
“Al-`Asf are the leaves of the crops that are not gathered. One of them is called `Asfah.”
This is the end of what he mentioned.
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
105:3
وَّ اَرۡسَلَ عَلَیۡہِمۡ طَیۡرًا اَبَابِیۡلَ ۙ﴿۳﴾
And He sent against them birds in flocks,
And He sent against them birds, in flocks (Ababil).
Hammad bin Salamah narrated from Asim, who related from Zirr, who related from `Abdullah and Abu Salamah bin `Abdur-Rahman that they said,
(
طَيْراً أَبَابِيلَ
birds Ababil.) “In groups.”
Ibn `Abbas and Ad-Dahhak both said,
“Ababil means some of them following after others.”
Al-Hasan Al-Basri and Qatadah both said, “Ababil means many.”
Mujahid said, “Ababil means in various, successive groups.”
Ibn Zayd said,
“Ababil means different, coming from here and there. They came upon them from everywhere.”
Al-Kasa’i said,
“I heard some of the grammarians saying, “The singular of Ababil is Ibil.”
Ibn Jarir recorded from Ishaq bin Abdullah bin Al-Harith bin Nawfal that he said concerning Allah’s statement,
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيلَ
“This means in divisions just as camels march in divisions (in their herds).”
It is reported that Ibn `Abbas said,
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيلَ
“They had snouts like the beaks of birds and paws like the paws of dogs.”
Ikrimah said commenting on Allah’s statement,
طَيْراً أَبَابِيلَ
“They were green birds that came out of the sea and they had heads like the heads of predatory animals.”
It has been reported from `Ubayd bin `Umayr that about
طَيْراً أَبَابِيلَ
he commented:
“They were black birds of the sea that had stones in their beaks and claws.”
And the chains of narration (for these statements) are all authentic.
تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ
105:4
تَرۡمِیۡہِمۡ بِحِجَارَۃٍ مِّنۡ سِجِّیۡلٍ ۪ۙ﴿۴﴾
Striking them with stones of hard clay,
Striking them with stones of Sijjil.
It is reported from Ubayd bin Umayr that he said,
“When Allah wanted to destroy the People of the Elephant, he sent birds upon them that came from sea swallows. Each of the birds was carrying three small stones — two stones with its feet and one stone in its beak. They came until they gathered in rows over their heads. Then they gave a loud cry and threw what was in their claws and beaks. Thus, no stone fell upon the head of any man except that it came out of his behind (i.e., it went through him), and it did not fall on any part of his body except that it came out from the opposite side.
Then Allah sent a severe wind that struck the stones and increased them in force. Thus, they were all destroyed.”
Concerning Allah’s statement,
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ
105:5
فَجَعَلَہُمۡ کَعَصۡفٍ مَّاۡکُوۡلٍ ٪﴿۵﴾
And He made them like eaten straw.
And He made them like `Asf, Ma’kul.
Sa`id bin Jubayr said,
“This means straw, which the common people call Habbur.”
In a report from Sa`id he said, “The leaves of wheat.”
He also said,
“Al-`Asf is straw, and Al-Ma’kul refers to the fodder that is cut for animals.”
Al-Hasan Al-Basri said the same thing.
Ibn `Abbas said,
“Al-`Asf is the shell of the grain, just like the covering of wheat.”
Ibn Zayd said,
“Al-`Asf are the leaves of vegetation and produce. When the cattle eat it they defecate it out and it becomes dung.”
The meaning of this is that Allah destroyed them, annihilated them and repelled them in their plan and their anger. They did not achieve any good. He made a mass destruction of them, and not one of them returned (to their land) to relate what happened except that he was wounded. This is just like what happened to their king, Abrahah. For indeed he was split open, exposing his heart when he reached his land of San`a’. He informed the people of what happened to them and then he died.
His son Yaksum became the king after him, and then Yaksum’s brother, Masruq bin Abrahah succeeded him. Then Sayf bin Dhi Yazan Al-Himyari went to Kisra (the king of Persia) and sought his help against the Abyssinians. Therefore, Kisra dispatched some of his army with Sayf Al-Himyari to fight with him against the Abyssinians. Thus, Allah returned their kingdom to them (i.e., the Arabs of Yemen) along with all the sovereignty their fathers possessed. Then large delegations of Arabs came to him (Sayf Al-Himyari) to congratulate him for their victory.
We have mentioned previously in the Tafsir of Surah Al-Fath that when the Messenger of Allah approached the mountain pass that would lead him to the Quraysh on the Day of Al-Hudaybiyyah, his she-camel knelt down. Then the people attempted to make her get up but she refused. So, the people said,
“Al-Qaswa’ has become stubborn.”
The Prophet replied,
مَا خَلَاَتِ الْقَصْوَاءُ وَمَا ذَاكَ لَهَا بِخُلُقٍ وَلَكِنْ حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيل
Al-Qaswa’ has not become stubborn, for that is not part of her character. Rather, she has been stopped by He Who restrained the Elephant (of Abrahah).
Then he said,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَاا يَسْأَلُونِّي الْيَوْمَ خُطَّةً يُعَظِّمُونَ فِيهَا حُرُمَاتِ اللهِ إِلاَّ أَجَبْتُهُمْ إِلَيْهَا
I swear by He in Whose Hand is my soul, they (the Quraysh) will not ask me for any matter (of the treaty) in which the sacred things of Allah are honored except that I will agree with them on it.
Then he beckoned the she-camel to rise and she stood up.
This Hadith is of those that Al-Bukhari was alone in recording.
It has been recorded in the Two Sahihs that on the Day of the conquest of Makkah, the Messenger of Allah said,
إِنَّ اللهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الْفِيلَ وَسَلَّطَ عَلَيْهَا رَسُولَهُ وَالْمُوْمِنِينَ وَإِنَّهُ قَدْ عَادَتْ حُرْمَتُهَا الْيَوْمَ كَحُرْمَتِهَا بِالاَْمْسِ أَلَا فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَايِب
Verily, Allah restrained the Elephant from Makkah, and He has given His Messenger and the believers authority over it. And indeed its sacredness has returned just as it was sacred yesterday. So, let those who are present inform those who are absent.
This is the end of the Tafsir of Surah Al-Fil, and all praise and thanks are due to Allah
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran