Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২০/ মুনাফেকি কী, কেন ও কীভাবে? :-৫১)
[#ঈমানের বাস্তব রূপরেখা:-]
সুরা: ১০৭: আল-মাউন
পারা:৩০
১- ৭ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে ফী জিলালিল
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
কুরআন:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1220/What Is Munafique, What & How?:-51)
[ # Practical framework of Islam :-]
Surah.107: Al-Maa’un
Para:30 Ayat:- 1- 7
www.motaher21.net
সুরা: আল-মাউন
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১০৭
ফী জিলালিল কুরআন:
সৎক্ষিপ্ত আলোচনা : এ সূরাটি কারো কারো মতে রসূল (স.)এর মক্কী যিন্দিগীতে অবতীর্ণ হয়েছে আর কারো কারো মতে তার মাদানী যিন্দিগীতে অবতীর্ণ হয়েছে। কারো কারো বর্ণনা মতে প্রথম তিনটি আয়াত মক্কী জীবনে ও পরবর্তী চারটি আয়াত মদীনার জীবনে অবতীর্ণ হয়েছে৷ ‘ফী যিলালিল কোরআন-এর’ মতে শেষোক্ত মতটিই গ্রহণযোগ্য । সূরাটি আগাগোড়া একই ধরনের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত । সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে এ ধারণাই প্রবলভাবে অনুভূত হয় যে, সূরার সমস্ত আলোচনাই মাদানী জীবনের সাথে সামঞ্জস্যশীল ৷ এ সূরায় মাদানী জীবনে প্রকাশিত বিভিন্ন ব্যাধি ও দুর্বলতা সংশোধনের প্রতিই ইংগিত করা হয়েছে। যেমন মুসলিম উম্মাহর সামষ্টিক জীবনধারায় ‘মোনাফেকী’ ‘রিয়া’ ইত্যাদি ব্যাধির উল্লেখ রয়েছে। আর স্বভাবতই এ ধরনের দুর্বলতা ও ব্যাধি মদীনার জীবনেই প্রকাশ, পেয়েছে। মক্কী জীবনে এর প্রকাশ ঘটেনি । এমনকি এ ধরনের্ন দূর্বলতা ও মানসিক ব্যাধি মক্কী জীবনে পরিচিতিও লাভ করেনি। অথচ প্রথম তিনটি আয়াতে যে বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছে, তা থেকে তা মক্কী জীবনের সাথে বেশী সম্পৃক্ত বলেই অনুভূত হয়। কেননা, তাতে আখেরাতে বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসীদের আচরন ও ক্রিয়াকান্ডের কথা উল্লেখ হয়েছে। আর পরবর্তী আয়াতে মদীনার জীবনের ক্রিয়াকান্ড, আচরণ ও দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে সামঞ্জস্য ও মিলের কারণেই পূর্ববর্তী তিনটি আয়াত ও পরবর্তী চারটি আয়াত একই সূরায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এখন আমরা এ সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ও মহান শিক্ষার আলোচনার দিকে অগ্রসর হতে পারি। সাতটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়াত সম্বলিত এ ছোট্ট সূরাটিতে এক ব্যাপক ও বিশাল বিষয়বস্তু আলোচিত হয়েছে ৷ ঈমান ও কুফরের ভিত্তিতে মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস ও চরিত্রে যে বিরাট পার্থক্য ও ব্যবধান আসে, এ সূরায় সুস্পষ্টভাবে তা নির্ণীত হয়েছে৷ ইসলামী জীবনদর্শন ও পরকালের শাস্তি ও পুরস্কারের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় মানব চরিত্র ও আচরণের যে সকল কল্যাণধর্মী গুণাবলী সৃষ্টি করে এবং যে সকল মহৎ গুণাবলী মানবীয় বৈশিষ্ট্যকে সুষমামন্ডিত করে তোলে তার বিশদ বর্ণনা এসেছে। অপরদিকে দ্বীন ও আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসীদের চরিত্র ও আচরণ কতো জঘন্য হতে পারে, তারা মানুষের প্রতি কতো নিষ্ঠুর ও নির্মম হতে পারে, আবার কপট বিশ্বাসী ও প্রদর্শনীমূলক মানসিকতা নিয়ে যারা ভন্ডধার্মিকতা, লোক দেখানো ও লেফাফা দুরস্তির ভান করে তারা মানুষের প্রতি কতোটা নির্দয় হয়, কতোটা অসহযোগিতামূলক আচরণ করে, এ সকল দিকই এ সূরায় আলোচিত হয়েছে। সবশেষে রসূল প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে কল্যাণধর্মী সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক শান্তির সমাজ ও রহমতের সমাজ আল্লাহ রব্বুল আলামীন গড়ে তুলতে চান, তার এক বাস্তব চিত্র এ ছোট্ট সূরাটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
(১০৭-মাউন) : নামকরণ:
নামকরণ শেষ আয়াতের শেষ শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(১০৭-মাউন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
ইবনে মারদুইয়া ইবনে আব্বাস (রা.) ও ইবনে যুবাইরের (রা.) উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তাঁরা এ সূরাকে মক্কী হিসেবে গণ্য করেছেন। আতা ও জাবেরও এ একই উক্তি করেছেন। কিন্তু আবু হাইয়ান বাহরুল মুহীত গ্রন্থে ইবনে আব্বাস, কাতাদাহ ও যাহ্হাকের এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, এটি মাদানী সূরা। আমাদের মতে, এই সূরার মধ্যে এমন একটি আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য রয়েছে যা এর মাদানী হবার প্রমাণ পেশ করে। সেটি হচ্ছে, এ সূরায় এমন সব নামাযীদেরকে ধ্বংসের বার্তা শুনানো হয়েছে যারা নিজেদের নামাযে গাফলতি করে এবং লোক দেখানো নামায পড়ে। এ ধরনের মুনাফিক মদীনায় পাওয়া যেতো। কারণ ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীরা সেখানে এমন পর্যায়ের শক্তি অর্জন করেছিল যার ফলে বহু লোককে পরিস্থিতির তাগিদে ঈমান আনতে হয়েছিল এবং তাদের বাধ্য হয়ে মসজিদে আসতে হতো। তারা নামাযের জামায়াতে শরীক হতেন এবং লোক দেখানো নামায পড়তো। এভাবে তারা মুসলমানদের মধ্যে গণ্য হতে চাইতো। বিপরীতপক্ষে মক্কায় লোক দেখাবার জন্য নামায পড়ার মতো কোন পরিবেশই ছিল না। সেখানে তো ঈমানদারদের জন্য জামায়াতের সাথে নামায পড়ার ব্যবস্থা করা দূরূহ ছিল। গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে নামায পড়তে হতো। কেউ প্রকাশ্যে নামায পড়লে ভয়ানক সাহসিকতার পরিচয় দিতো। তার প্রাণনাশের সম্ভাবনা থাকতো। সেখানে যে ধরনের মুনাফিক পাওয়া যেতো তারা লোক দেখানো ঈমান আনা বা লোক দেখানো নামায পড়ার দলভুক্ত ছিল না। বরং তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য নবী হবার ব্যাপারটি জেনে নিয়েছিল এবং মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের কেউ কেউ নিজের শাসন ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব বহাল রাখার জন্য ইসলাম গ্রহণ করতে পিছপাও হচ্ছিল। আবার কেউ কেউ নিজেদের চোখের সামনে মুসলমানদেরকে যেসব বিপদ-মুসিবতের মধ্যে ঘেরাও দেখছিল ইসলাম গ্রহণ করে নিজেরাও তার মধ্যে ঘেরাও হবার বিপদ কিনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সূরা আন কাবুতের ১০-১১ আয়াতে মক্কী যুগের মুনাফিকদের এ অবস্থাটি বর্ণিত হয়েছে। (আরো জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন আল আন কাবুত ১৩- ১৬ টীকা)
(১০৭-মাউন) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
আখেরাতের প্রতি ঈমান না আনলে মানুষের মধ্যে কোন্ ধরনের নৈতিকতা জন্ম নেয় তা বর্ণনা করাই এর মূল বিষয়বস্তু। ২ ও ৩ আয়াতে এমনসব কাফেরদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যারা প্রকাশ্যে আখেরাতকে মিথ্যা বলে। আর শেষ চার আয়াতে যেসব মুনাফিক আপাতদৃষ্টিতে মুসলমান মনে হয় কিন্তু যাদের মনে আখেরাত এবং তার শাস্তি-পুরস্কার ও পাপ-পূণ্যের কোন ধারণা নেই, তাদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আখেরাত বিশ্বাস ছাড়া মানুষের মধ্যে একটি মজবুত শক্তিশালী ও পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্র গড়ে তোলা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়, এ সত্যটি মানুষের হৃদয়পটে অংকিত করে দেয়াই হচ্ছে সামগ্রিকভাবে উভয় ধরনের দলের কার্যধারা বর্ণনা করার মূল উদ্দেশ্য।
ফী জিলালিল কুরআন:
ঈমানের বাস্তব রূপরেখা : এ সূরায় যে মহান শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে, দ্বীন ইসলাম কোনো সংকীর্ণ, অনুদার ও প্রদর্শনীমূলক লোক দেখানো মতাদর্শ নয়। আর এটি শুধু নিছক প্রদর্শনীমূলক অনুষ্ঠান ও রীতি নীতি সর্বস্ব ধর্মও নয়। ইসলাম নিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্ততা বর্জিত কোনো জীবনদর্শন নয়’। বরং একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়া, পরম নিষ্ঠা, একাগ্রচিত্ততা, আন্তরিকতা ও আত্মসমর্পনের আদর্শ ইসলাম । এ নিষ্ঠা, একাগ্রচিত্ততা, আন্তরিকতা ও একমাত্র আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পনের মানসিকতা এ জীবনবোধের অনুসারীদেরকে কতো সংকর্মশীল করে তুলতে পারে, কতো দৃষ্টান্তমূলক উত্তম আচরণ ও চরিত্র সৃষ্টি করতে পারে, কতো উন্নত ও মানব কল্যাণের মহৎ গুণাবলীতে ভূষিত করতে পারে, তার মনোজ্ঞ আলোচনা এখানে পেশ করা হয়েছে। সত্যি করে বলতে গেলে এই সকল, গুণাবলীই একটি মার্জিত, সুসভ্য ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনের প্রেরণা যোগায় । এমনিভাবে ইসলাম কোনো অপূর্ণাঙ্গ, বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত জীবন ব্যবস্থা নয়। জীবনের কোনো দিক ও বিভাগকে ইসলাম স্বতন্ত্র ও আলাদা করে দেখেনি। জীবনের কোনো একটি দিককে আংশিক ও বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করার স্বাধীনতা ইসলাম দেয়নি। ইসলামী জীবনদর্শনে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি ইসলামের কোনো দিক নিজ নিজ মরযী মতো মেনে চলবে, আর কোনো কোনো দিককে বর্জন করবে, এমন স্বেচ্ছাচারিতার স্থান ইসলামে নেই। ইসলামই একমাত্র পরিপূর্ণ জীবনপদ্ধতি । এর মৌলিক এবাদাত, ঐতিহ্য, সামাজিক বিধিবিধান, সাংস্কৃতিক জীবনধারা, ব্যক্তিগত অনুশাসন ও সামষ্টিক জীবনের ব্যবস্থা একটি অপরটির পরিপূরক ও সহায়ক ৷ ইসলামের জীবনপদ্ধতির প্রতিটি দিক ও বিভাগের অনুসরণ ও অনুশীলন এর মূল জীবন লক্ষ্যেরই পরিবর্ধক, পরিপূরক ও মানবতার পরিপূর্ণতা বিধায়ক । ইসলামই আত্মার পরিশুদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন, মানব সমাজের প্রকৃত সংস্কার ও সংশোধন, মানব কল্যাণ ও শান্তি বিধান, সভ্যতার উত্থান ও মানব সমাজের উন্নতি ও প্রগতির নিশ্চয়তা দান করে। ইসলামী জীবন বিধানের বাস্তবায়নই আল্লাহর বান্দাদের জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত রহমতভিত্তিক জীবন বিধানের বাস্তব দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করে। যেমন মানুষ মুখে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে, সে ইসলামের সত্যতা ও এর বিধানকে সত্য বলে গ্রহণ করারও দাবী করে এবং সে নামাযও আদায় করে! অথচ সাংস্কৃতিক জীবনধারা, আচরণ, সভ্যতা, আইন-আদালাত, সামাজিক রীতি নীতির ইসলাম থেকে অনেক দূরে, ইসলামও এমন ধরনের ব্যক্তি থেকে অনেক অনেক দূরে । কোনো ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক ও মৌলিক এবাদাতে অভ্যস্থ হওয়া, আর বাস্তব জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বিরোধী ক্রিয়াকান্ডে লিপ্ত হওয়া, স্বীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচার ঐতিহ্য বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত হওয়া দ্বারা, স্বতসিদ্ধভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতপক্ষে সে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী নয়! তার আচরণ দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, তার ইসলামের প্রতি সত্যিকার ঈমান ও আস্থা নেই৷ সে মুখে যা বলে মূলত এটি তার অন্তরের বিশ্বাস নয়। মুখে সে আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের দাবী করে, আনুষ্ঠানিকভাবে সে আল্লাহর বন্দেগী করে, আর বাস্তব জীবনে সে মানবরচিত ব্যবস্থার গোলামী করে। জীবনের এক অংশে সে আল্লাহর গোলামী করে এবং অপর দিকে তার গোটা জীবনধারায় সে মানুষের গোলামীতেই ব্যস্ত থাকে। আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ঈমান যার হৃদয়ে বিদ্যমান, যে অন্তরে আল্লাহর প্রতি প্রত্যয় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, তার গোটা জীবনেই তার প্রভাব, তার প্রতিফলনের প্রবাহ উৎসারিত হয়ে থাকে। মোমেনের সম জীবনধারাতে তার বিশ্বাসের নিদর্শন ফুটে ওঠে । তার ঈমান তার জীবন বৃক্ষকে আমলে সালেহের (সংকর্মশীলতার) শাখা-প্রশাখা ও ফলে -ফুলে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করে তোলে । (যে প্রসংগটি আমরা সূরা আসরের তাফসীরে আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছি) ৷ যখন কোনো ব্যক্তির জীবন তার মুখে দাবীকৃত অন্তরের বিশ্বাসের বিপরীত খাতে প্রবাহিত হয়, তার কথার সাথে তার বাস্তব জীবনের আচরণের অমিল দেখতে পাওয়া যায়, তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে তার জীবনের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত না হয়, তার ঈমান বিরোধী আচরণই একথার সুস্পষ্ট দলীল যে, তার মুখের দাবী সত্য নয়। তার হৃদয়ে ইসলামী জীবনাদর্শের আদৌ কোনো অস্তিত্বই নেই। সূরা মাউনের সুস্পষ্ট ভাষ্য দ্বারা এটিই প্রমাণিত হয়েছে। আয়াতের সূচনাতেই যারা উপলব্ধি চায়, যারা প্রত্যক্ষদর্শীর মতো এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তাদেরকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করা হয়েছে, কারা পরকালের শাস্তি ও পুরস্কার দিবসকে মিথ্যা মনে করে? কোরআনুল কারীমের এ প্রশ্নের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে যে, যারা নিম্নে উল্লেখিত আচরণে অভ্যস্ত, তারাই প্রকৃতপক্ষে দ্বীনের প্রতি অবিশ্বাসী তাই প্রথম আয়াতে তুমি কি দেখেছো সেই ব্যক্তিকে যে, দ্বীনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, যারা এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়, যারা মিসকীনকে আহার প্রদানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে না। ঈমানের দাবী : আলোচ্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রকৃত ঈমানের দাবী হচ্ছে, বাস্তব জীবনে ইসলামী জীবনধারাকে অনুসরণ করা । বস্তুত, আয়াতের মূল তাৎপর্য ও শিক্ষা হচ্ছে এই যে, যারা এতীমদের অধিকার হরণ করে, বল প্রয়োগ করে এতীমদের প্রাপ্য থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে, এতীমদের ওপর নির্যাতন চালায়, তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে ও তদের কষ্ট দেয়, তারাই তো দ্বীনের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যারা মিসকীনদেরকে খাদ্য প্রদানে উৎসাহিত করে না, অসহায় সর্বহারা দুস্থের পুনর্বাসনে অনুপ্রেরণা যোগায় না, যারা তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা ও তাদের অভাব পূরণের জন্যে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান করে না, তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দেয়া দ্বীনের প্রতি বিশ্বাসী ও আস্থাশীল নয়। যদি তারা দ্বীনের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাসী হতো, যদি তাদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে দ্বীনের প্রতি ঈমান থাকতো, তবে কক্ষনো তারা এতীমদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারতো না। এতীমদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার জঘন্য আচরণের দুঃসাহস করতো না, আর তারা কোনোমতেই মিসকীন ও সর্বহারাদেরকে খাদ্য প্রদানে নিরুৎসাহিত করার উদ্ধত আচরণ প্রদর্শন করতো না। তারা মিসকীনদের বঞ্চিত করার প্রেরণা যোগাতো না। প্রকৃতপক্ষে দ্বীন ইসলামের সত্যতাকে শুধু মুখে স্বীকার করার নামই ঈমান নয়; বরং ঈমান তাই যা অন্তরে গভীর প্রত্যয় জন্মায়, যা মানব জীবনে ঈমানের দাবী পূরণের সকল পারিপার্শ্বিক ও আনুষাঙ্গিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করে। সে বিশ্বাসই প্রকৃত বিশ্বাস যে বিশ্বাসের সাথে মানব কল্যাণের সকল আনুষাংগিক বৈশিষ্টাবলী বিকশিত হয়, যে বিশ্বাসের স্বীকৃতির সাথে জীবনের সকল কর্মের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা শুধু মানুষের মৌখিক স্বীকৃতিই চাননা; বরং মৌখিক স্বীকৃতির সাথে হৃদয়ের সুদৃঢ় বিশ্বাস ও জীবনের সকল ক্রিয়াকান্ডে তার সত্যতার প্রমাণ উপস্থাপনই আল্লাহ তায়ালা চান। যার মুখের কথার সাথে কর্মময় জীবনের কোনো মিল নেই, দাবী নিছক বুদবুদ, তা ধোয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। যে দাবী ও কথার সাথে কাজের মিল নেই, সে কথার আদৌ কোনো গুরুত্বই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে নেই। আলোচ্য তিনটি আয়াতে দ্বীন ইসলামের মূল প্রাণ শক্তি, এর প্রকৃত শিক্ষা, তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যকে অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই আয়াতগুলোতে সুস্পষ্টভাবে ইসলামের সৌন্দর্য ও তার মূর্তরূপ প্রতিভাত হয়েছে। এখানে আমরা আকায়েদ ও ফেকাহ শাস্ত্রের বর্ণনায় ঈমান ও ইসলামের জটিল বির্তক জালে জড়িত ও লিপ্ত হতে চাচ্ছি না। আমরা এ সূরা থেকে এ শিক্ষাই উপলব্ধি করতে পারি যে, এ সূরায় আল্লাহ্ তায়ালা জানাতে চেয়েছেন এ দ্বীনের প্রতি ঈমান ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের কারণে মানব চরিত্রে কোন ধরনের আচরণ ও গুণাবলী বিকশিত হয়, আল্লাহর কাছে দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের কোন ধরনের ঈমান পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের ও মূল্যায়নের প্রকৃত মানদন্ড কী? দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা, স্বরূপ ও তাৎপর্য কী-এর সবই সূরার মূল প্রতিপাদ্য ও আলোচ্য বিষয় । ধ্বংস হোক মুসল্লীরা : উপরোক্ত বিষয়াদি উপস্থাপনের পর এ সূরার পরবর্তী অংশে মূল বিষয়ের সম্পৃক্ততা অব্যাহত রেখেই পরবর্তী পর্যায়ে একান্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতে নামাযের প্রতি অনীহা, অমনোযোগ ও আলস্য প্রদর্শনকারী কারা? এর উত্তর প্রদান করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরবর্তী ছয় ও সাত নম্বর আয়াতে বলেছেন; তাদের পরিচয় হচ্ছে ‘মুস্বল্লীন’। তারা সে সকল লোক যারা নামায আদায় করে, অথচ নামায কায়েম করেনা। যারা শুধু নামাযের আনুষ্ঠানিকতা আদায় করে- রুকু, সেজদা, সূরা, দোয়া, তাসবীহ যথাযথভাবে পালন করে; কিন্তু তাদের রূহ নামাযের প্রাণশক্তি থেকে বঞ্চিত, তাদের আত্মা নামাযের জীবনীশক্তি দ্বারা সঞ্জিবীত নয়। তাদের জীবনধারা নামাযের চরিত্র, শিক্ষা ও বৈশিষ্টমন্ডিত নয়। তাদের কেরাত দোয়া ও তাসবীহে উচ্চারিত বাক্যসমূহের সাথে তাদের বাস্তব জীবনের কোনো মিল পরিলক্ষিত হয় না। তারা বাহ্যত, লোক দেখানো নামায আদায় করে। তাদের নামাযের প্রতি গভীর মনোযোগ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নেই। এভাবে তারা তাদের নামায অমনোযোগিতা, অনীহা, আলস্য ও প্রদর্শনীমূলক মনোভাব নিয়ে আদায় করে। অথচ নামাযের শিক্ষা ও তাৎপর্যকে জীবনে বাস্তবায়িত করে নামায় কায়েম করে না। আর নামায কায়েমের প্রকৃত শিক্ষা, তাৎপর্য, নামাযের যিন্দিগীও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নামায আদায় করা ছাড়া নামায কায়েমের লক্ষ্য অর্জিত হয়না। মূলত, পরিপূর্ণ জীবনে আল্লাহর রবুবিয়াত ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কায়েম করা যায়। যারা শুধু নামাযের কতিপয় অনুষ্ঠান, দোয়া-তাসবীহ পালন করে রিয়া বা প্রদর্শনী, তথা লোকদেখানো মানসিকতা সহকারে অনীহা, অবজ্ঞা ও অমনোযোগিতা নিয়ে নামায আদায়ে অভ্যস্ত, তাদের নামায কায়েম হয় না। নামাযের কোনো গুণাবলী ও নিদর্শন তাদের চরিত্র ও জীবনধারা পরিস্ফুট হয় না, তাদের অন্তরে এর কোন প্রভাব পড়েনা। এ ধরনের নামায আদায়কারীরাই তাদের ভাইদেরকে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো দ্রব্য গৃহ সামগ্রী, ও যে কোনো কল্যাণধর্মী সহযোগিতা, সহমর্মিতা প্রকাশ করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তারা আল্লাহর বান্দাদের উপকার সাধন, তাদের কল্যাণ কামনা ও সহযোগিতা প্রদান করে না। যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং নামায কায়েমের প্রকৃত তাৎপর্যকে উপলব্ধি করেই তারা নামায কায়েম করতো; তবে কিছুতেই তারা আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণ সাধন, সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকতো না। আল্লাহর দরবারে এবাদাত কবুল হওয়ার এবাদাতের সত্যিকার মর্ম শিক্ষা তাৎপর্য গ্রহণ ও নামায কায়েমের প্রকৃষ্ট পন্থাই হচ্ছে আল্লাহর এবাদাতের মাধ্যমে মানব কল্যাণের বৈশিষ্ট্য অর্জন তথা আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণধর্মী চরিত্র সৃষ্টি করা। এ পথেই আমরা আমাদের মন মানসিকতায়, চরিত্রে ও প্রবৃত্তিতে দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্যকে গ্রহণ করতে পারি । আর মানুষের কল্যাণধর্মী প্রবণতা, মননশীলতা ও মানব কল্যাণের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে যারা ব্যর্থ হয় সেই সব নামায আদায়কারীদের প্রতি অভিশাপ ও কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। যারা স্ব স্ব চরিত্রে মানব কল্যাণের বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতিফলন ঘটাতে পারে না তারা প্রকৃতপক্ষে নামায কায়েম করেনা। তারা শুধু বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতিফলন ঘটাতে পারে না তারা প্রকৃতপক্ষে নামায কায়েম করেনা। তারা শুধু প্রাণহীন কতিপয় অনুষ্ঠানই পালন করে। তারা একমাত্র আল্লাহর রেযামন্দীর উদ্দেশ্যে নামায আদায় করে না, বরং আত্মিক শক্তি ও জ্যোতিহীন কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও দৈহিক নড়াচড়া, উঠাবসা ও শরীর চর্চায় লিপ্ত হয়ে থাকে। তারা লোক দেখাবার মতো কিছু নিয়ম পদ্ধতির অনুসরণ করে মাত্র । তাদের নামায তাদের অন্তরে, কর্মে ও চরিত্রে কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। তাদের সকল আনুষ্ঠানিকতা, কালো ধোয়ার মতো মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। বরং এ প্রাণশক্তিহীন আনুষ্ঠানিকতার কারণে তাদেরকে কঠোর শাস্তি ও অশুভ পরিণামের প্রতীক্ষায় থাকতে হয়। এ সূরা থেকে আমরা এ শিক্ষা ও মর্ম উপলব্ধি করতে পারি যে, দ্বীন ইসলামকে গ্রহণ করার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার কোনো স্বার্থ নিহিত নেই; বরং দ্বীনের প্রতি আস্থা স্থাপনের মধ্যে মানব কল্যাণের আদর্শই নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের কল্যাণের জন্য নবী, রসূল প্রেরণ করেছেন। মানব কল্যাণের জন্য ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানব কল্যাণের জন্যই আল্লাহর এবাদাতের নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কর্তৃক রসূল প্রেরণ, ওহী নাযিল, দ্বীন ও জীবন পদ্ধতি প্রদান, তার রবুবিয়াতের ওপর ঈমান আনয়ন ও তার বন্দেগী করা এ সকল কিছুর বিনিময় বান্দার নিকট থেকে কোন কিছুই কামনা করে না। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তিনি কারও মুখপেক্ষী নন। আল্লাহ তায়ালা তো চান এসব কিছুর বিনিময়ে বান্দা যেন নিজেদেরই কল্যাণ সাধন করতে পারে । আল্লাহ্ তায়ালার এ সকল অফুরন্ত নেয়ামত ও হেদায়াত দ্বারা বান্দা যেন নিজ আত্মার, পরিশুদ্ধি সাধন, জীবনকে সবল, সুন্দর ও সৌভাগ্যবান করে গড়ে তুলতে পারে। আল্লাহ তো চান, বান্দা যেন উন্নত জীবন, পবিত্র ও বিশুদ্ধ অনুভূতি ও চেতনা, সুন্দর পরিবেশ, মার্জিত রুচি, সুবিচারমূলক সমাজ ও ভ্রাতৃপ্রেম, আত্মার পরিচ্ছন্নতা ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ, সৌন্দর্য ও পারস্পরিক কল্যাণ কামনার ভিত্তিতে সুসভ্য সমাজ গড়ে তুলুক। আজকের মানবসমাজ এমনি সুন্দর কল্যাণমুখী আদর্শ, এমনি শান্তিপূর্ণ রহমতের সমাজ, এমনি মার্জিত উন্নত প্রগতিশীল উচ্চতর মর্যাদাপূর্ণ জীবন দর্শনকে পরিহার করে কোন পথে যেতে চায়? আজকের মানব সমাজ কি এমন আলোকোজ্বল রাজপথকে বর্জন করে জাহেলিয়াতের তিমিরাচ্ছন্ন কলুষিত কন্টকাকীর্ণ পথকেই নিজেদের জন্যে বেছে নিতে চায়? আজকের বিশ্বমানব কি প্রগতির নামে অজ্ঞতা, বর্বরতা ও ধ্বংসের অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্গতির অতল গহবরেই পতিত হতে চায়?
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1, 2, 3,
اَرَءَیْتَ الَّذِیْ یُكَذِّبُ بِالدِّیْنِؕ
তুমি কি তাকে দেখেছো।১ যে আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তিকে২ মিথ্যা বলছে?৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) ‘তুমি কি দেখেছো’ বাক্যে এখানে বাহ্যত সম্বোধন করা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। কিন্তু কুরআনের বর্ণনাভংগী অনুযায়ী দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রত্যেক জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা সম্পন্ন লোকদেরকেই এ সম্বোধন করা হয়ে থাকে। আর দেখা মানে চোখ দিয়ে দেখাও হয়। কারণ সামনের দিকে লোকদের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রত্যেক প্রত্যক্ষকারী স্বচক্ষে দেখে নিতে পারে। আবার এর মানে জানা, বুঝা ও চিন্তা-ভাবনা করাও হতে পারে। আরবী ছাড়া অন্যান্য ভাষায়ও এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আমরা বলি, “আচ্ছা, ব্যাপারটা আমাকে দেখতে হবে।” অর্থাৎ আমাকে জানতে হবে। অথবা আমরা বলি, “এ দিকটাও তো একবার দেখো।” এর অর্থ হয়, “এ দিকটা সম্পর্কে একটু চিন্তা করো।” কাজেই “আরাআইতা” (أَرَأَيْتَ) শব্দটিকে দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহার করলে আয়াতের অর্থ হবে, “তুমি কি জানো সে কেমন লোক যে শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা বলে?” অথবা “তুমি কি ভেবে দেখেছো সেই ব্যক্তির অবস্থা যে কর্মফলকে মিথ্যা বলে?”
টিকা:২) আসলে বলা হয়েছেঃ يُكَذِّبُ بِالدِّينِ । কুরআনের পরিভাষায় “আদ্ দ্বীন” শব্দটি থেকে আখেরাতে কর্মফল দান বুঝায়। দ্বীন ইসলাম অর্থেও এটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সামনের দিকে যে বিষয়ের আলোচনা হয়েছে তার সাথে প্রথম অর্থটিই বেশী খাপ খায় যদিও বক্তব্যের ধারাবাহিকতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অর্থটিও খাপছাড়া নয়। ইবনে আব্বাস (রা.) দ্বিতীয় অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ তাফসীরকার প্রথম অর্থটিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে সমগ্র সূরায় বক্তব্যের অর্থ হবে, আখেরাত অস্বীকারের আকীদা মানুষের মধ্যে এ ধরনের চরিত্র ও আচরণের জন্ম দেয়। আর দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করলে দ্বীন ইসলামের নৈতিক গুরুত্ব সুস্পষ্ট করাটাই সমগ্র সূরাটির মূল বক্তব্যে পরিণত হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বক্তব্যের অর্থ হবে, এ দ্বীন অস্বীকারকারীদের মধ্যে যে চরিত্র ও আচরণবিধি পাওয়া যায় ইসলাম তার বিপরীত চরিত্র সৃষ্টি করতে চায়।
টিকা:৩) বক্তব্য যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে মনে হয়, এখানে এ প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করার উদ্দেশ্য একথা জিজ্ঞেস করা নয় যে, তুমি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো কি না। বরং আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কার অস্বীকার করার মনোবৃত্তি মানুষের মধ্যে কোন্ ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করে শ্রোতাকে সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার দাওয়াত দেয়াই এর উদ্দেশ্য। এই সঙ্গে কোন্ ধরনের লোকেরা এ আকীদাকে মিথ্যা বলে সে কথা জানার আগ্রহ তার মধ্যে সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য। এভাবে সে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনার নৈতিক গুরুত্ব বুঝার চেষ্টা করবে।
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-2
টিকা নং:4, 5,
فَذٰلِكَ الَّذِیْ یَدُعُّ الْیَتِیْمَۙ
সে-ই তো৪ এতিমকে ধাক্কা দেয়৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) আসলে فَذَلِكَ الَّذِي বলা হয়েছে। এ বাক্যে “ف” (“ফা”) অক্ষরটি একটি সম্পূর্ণ বাক্যের অর্থ পেশ করছে। এর মানে হচ্ছে, “যদি তুমি না জেনে থাকো তাহলে তুমি জেনে নাও” “সে-ইতো সেই ব্যক্তি” অথবা এটি এ অর্থে যে, “নিজের এ আখেরাত অস্বীকারের কারণে সে এমন এক ব্যক্তি যে—————-”
টিকা:৫) মূলেيَدُعُّ الْيَتِيمَ বলা হয়েছে এর কয়েকটি অর্থ হয়। এক, সে এতিমের হক মেরে খায় এবং তার বাপের পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে বেদখল করে তাকে সেখান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। দুই, এতিম যদি তার কাছে সাহায্য চাইতে আসে তাহলে দয়া করার পরিবর্তে সে তাকে ধিক্কার দেয়। তারপরও যদি সে নিজের অসহায় ও কষ্টকর অবস্থার জন্য অনুগ্রহ লাভের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। তিন, সে এতিমের ওপর জুলুম করে। যেমন তার ঘরেই যদি তার কোন আত্মীয় এতিম থাকে তাহলে সারাটা বাড়ির ও বাড়ির লোকদের সেবা যত্ন করা এবং কথায় কথায় গালমন্দ ও লাথি ঝাঁটা খাওয়া ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছুই জোটে না। তাছাড়া এ বাক্যের মধ্যে এ অর্থও নিহিত রয়েছে যে, সেই ব্যক্তি মাঝে মাঝে কখনো কখনো এ ধরনের জুলুম করে না বরং এটা তার অভ্যাস ও চিরাচরিত রীতি সে যে এটা একটা খারাপ কাজ করছে, এ অনুভূতিও তার থাকে না। বরং বড়ই নিশ্চিন্তে সে এ নীতি অবলম্বন করে যেতে থাকে। সে মনে করে, এতিম একটা অক্ষম ও অসহায় জীব। কাজেই তার হক মেরে নিলে, তার ওপর জুলুম-নির্যাতন চালালে অথবা সে সাহায্য চাইতে এলে তাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলে কোন ক্ষতি নেই।
এ প্রসঙ্গে কাজী আবুল হাসান আল মাওয়ারদী তাঁর “আলামূন নুবুওয়াহ” কিতাবে একটি অদ্ভূত ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি হচ্ছেঃ আবু জেহেল ছিল একটি এতিম ছেলের অভিভাবক। ছেলেটি একদিন তার কাছে এলো। তার গায়ে এক টুকরা কাপড়ও ছিল না। সে কাকুতি মিনতি করে তার বাপের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তাকে কিছু দিতে বললো। কিন্তু জালেম আবু জেহেল তার কথায় কানই দিল না। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষে নিরাশ হয়ে ফিরে গেলো। কুরাইশ সরদাররা দুষ্টুমি করে বললো, “যা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে চলে যা। সেখানে গিয়ে তাঁর কাছে নালিশ কর। সে আবু জেহেলের কাছে সুপারিশ করে তোর সম্পদ তোকে দেবার ব্যবস্থা করবে।” ছেলেটি জানতো না আবু জেহেলের সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কি সম্পর্ক এবং এ শয়তানরা তাকে কেন এ পরামর্শ দিচ্ছে। সে সোজা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছে গেলো এবং নিজের অবস্থা তাঁর কাছে বর্ণনা করলো। তার ঘটনা শুনে নবী (সা.) তখনই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের নিকৃষ্টতম শত্রু আবু জেহেলের কাছে চলে গেলেন। তাঁকে দেখে আবু জেহেল তাঁকে অভ্যর্থনা জানালো। তারপর যখন তিনি বললেন, এ ছেলেটির হক একে ফিরিয়ে দাও তখন সে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কথা মেনে নিল এবং তার ধন-সম্পদ এনে তার সামনে রেখে দিল। ঘটনার পরিণতি কি হয় এবং পানি কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্য কুরাইশ সরদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। তারা আশা করছিল দু’ জনের মধ্যে বেশ একটা মজার কলহ জমে উঠবে। কিন্তু এ অবস্থা দেখে তারা অবাক হয়ে গেলো। তারা আবু জেহেলের কাছে এসে তাকে ধিক্কার দিতে লাগলো। তাকে বলতে লাগলো, তুমিও নিজের ধর্ম ত্যাগ করেছো। আবু জেহেল জবাব দিল, আল্লাহর কসম! আমি নিজের ধর্ম ত্যাগ করিনি। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডাইনে ও বাঁয়ে এক একটি অস্ত্র রয়েছে। আমি তার ইচ্ছার সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণ করলে সেগুলো সোজা আমার শরীরের মধ্যে ঢুকে যাবে। এ ঘটনাটি থেকে শুধু এতটুকুই জানা যায় না যে, সে যুগে আরবের সবচেয়ে বেশী উন্নত ও মর্যাদা গোত্রের বড় বড় সরদাররা পর্যন্ত এতিম ও সহায়-সম্বলহীন লোকদের সাথে কেমন ব্যবহার করতো বরং এই সঙ্গে একথাও জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ কত উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর নিকৃষ্টতম শত্রুদের ওপরও তাঁর এ চারিত্রিক প্রভাব কতটুকু কার্যকর হয়েছিল। ইতিপূর্বে তাফহীমুল কুরআন সূরা আল আম্বিয়া ৫ টীকায় আমি এ ধরনের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে জবরদস্ত নৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে কুরাইশরা তাঁকে যাদুকর বলতো এ ঘটনাটি তারই মূর্ত প্রকাশ।
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-3
টিকা নং:6, 7,
وَ لَا یَحُضُّ عَلٰى طَعَامِ الْمِسْكِیْنِؕ
এবং মিসকিনকে খাবার দিতে৬ উদ্বুদ্ধ করে না।৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৬) اطَعَامِ الْمِسْكِينِ নয় বরং طَعَامِ الْمِسْكِينِ বলা হয়েছে “ইত্’আমুল মিসকিন” বললে অর্থ হতো, সে মিসকিনকে খানা খাওয়াবার ব্যাপারে উৎসাহিত করে না। কিন্তু “তাআমুল মিসকিন” বলায় এর অর্থ দাঁড়িয়েছে, “সে মিসকিনকে খানা দিতে উৎসাহিত করে না।” অন্য কথায়, মিসকিনকে যে খাবার দেয়া হয় তা দাতার খাবার নয় বরং ঐ মিসকিনেরই খাবার। তা ঐ মিসকিনের হক এবং দাতার ওপর এ হক আদায় করার দায়িত্ব বর্তায়। কাজেই দাতা এটা মিসকিনকে দান করছে না বরং তার হক আদায় করছে। সূরা আয্ যারিয়াতের ১৯ আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ “আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে ভিখারী ও বঞ্চিতদের হক।”
টিকা:৭) لَا يَحُضُّ শব্দের মানে হচ্ছে, সে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে না, নিজের পরিবারের লোকদেরকেও মিসকিনকে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ করে না এবং অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে না যে, সমাজে যেসব গরীব ও অভাবী লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে তাদের হক আদায় করা এবং তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য কিছু করো। এখানে মহান আল্লাহ শুধুমাত্র দু’টি সুস্পট উদাহরণ দিয়ে আসলে আখেরাত অস্বীকার প্রবণতা মানুষের মধ্যে কোন্ ধরনের নৈতিক অসৎবৃত্তির জন্ম দেয় তা বর্ণনা করেছেন। আখেরাত না মানলে এতিমকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ না করার মতো দু’টি দোষ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায় বলে শুধুমাত্র এ দু’টি ব্যাপারে মানুষকে পাকড়াও ও সমালোচনা করাই এর আসল উদ্দেশ্য নয়। বরং এই গোমরাহীর ফলে যে অসংখ্য দোষ ও ত্রুটির জন্ম হয় তার মধ্য থেকে নমুনা স্বরূপ এমন দু’টি দোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রত্যেক সুস্থ বিবেক ও সৎ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি যেগুলোকে নিকৃষ্টতম দোষ বলে মেনে নেবে। এই সঙ্গে একথাও হৃদয়পটে অংকিত করে দেয়াই উদ্দেশ্য যে, এ ব্যক্তিটিই যদি আল্লাহর সামনে নিজের উপস্থিতি ও নিজের কৃতকর্মের জবাবদিহির স্বীকৃতি দিতো, তাহলে এতিমের হক মেরে নেবার, তার ওপর জুলুম-নির্যাতন করার, তাকে ধিক্কার দেবার এবং মিসকিনকে নিজে খাবার না দেবার ও অন্যকে দিতে উদ্বুদ্ধ না করার মতো নিকৃষ্টতম কাজ সে করতো না। আখেরাত বিশ্বাসীদের গুণাবলী সূরা আসর ও সূরা বালাদে বয়ান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি করুণা করার জন্য তারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় এবং وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ তারা পরস্পরকে সত্যপ্রীতি ও অধিকার আদায়ের উপদেশ দেয়।
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-4
টিকা নং:8,
فَوَیْلٌ لِّلْمُصَلِّیْنَۙ
তারপর সেই নামাযীদের জন্য ধ্বংস,৮
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৮) এখানে শব্দ فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে “ফা” ف ব্যবহার করার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, প্রকাশ্যে যারা আখেরাত অস্বীকার করে তাদের অবস্থা তুমি এখনই শুনলে, এখন যারা নামায পড়ে অর্থাৎ মুসলমানদের সাথে শামিল মুনাফিকদের অবস্থাটা একবার দেখো। তারা যেহেতু বাহ্যত মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আখেরাতকে মিথ্যা মনে করে, তাই দেখো তারা নিজেদের জন্য কেমন ধ্বংসের সরঞ্জাম তৈরি করছে। “মূসাল্লীন” মানে নামায পাঠকারীগণ। কিন্তু যে আলোচনা প্রসঙ্গে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং সামনের দিকে তাদের যে গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর প্রেক্ষিতে এ শব্দটির মানে আসলে নামাযী নয় বরং নামায আদায়কারী দল অর্থাৎ মুসলমানদের দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-5
টিকা নং:9,
الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَۙ
যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে গাফলতি করে৯
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৯) فى صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ যদি বলা হতো “ফী সালাতিহিম” তাহলে এর মানে হতো, নিজের নামাযে ভুলে যায়। কিন্তু নামায পড়তে পড়তে ভুলে যাওয়া ইসলামী শরীয়াতে নিফাক তো দূরের কথা গোনাহের পর্যায়েও পড়ে না। বরং এটা আদতে কোন দোষ বা পাকড়াও যোগ্য কোন অপরাধও নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের নামাযের মধ্যে কখনো ভুল হয়েছে। তিনি এই ভুল সংশোধনের জন্য পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। এর বিপরীতে عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ মানে হচ্ছে তারা নিজেদের নামায থেকে গাফেল। নামায পড়া ও না পড়া উভয়টিরই তাদের দৃষ্টিতে কোন গুরুত্ব নেই। কখনো তারা নামায পড়ে আবার কখনো পড়ে না। যখন পড়ে, নামাযের আসল সময় থেকে পিছিয়ে যায় এবং সময় যখন একেবারে শেষ হয়ে আসে তখন উঠে গিয়ে চারটি ঠোকর দিয়ে আসে। অথবা নামাযের জন্য ওঠে ঠিকই কিন্তু একবারে যেন উঠতে মন চায় না এমনভাবে ওঠে এবং নামায পড়ে নেয় কিন্তু মনের দিক থেকে কোন সাড়া পায় না। যেন কোন আপদ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। নামায পড়তে পড়তে কাপড় নিয়ে খেলা করতে থাকে। হাই তুলতে থাকে। আল্লাহর স্মরণ সামান্যতম তাদের মধ্যে থাকে না। সারাটা নামাযের মধ্যে তাদের এ অনুভূতি থাকে না যে, তারা নামায পড়ছে। নামাযের মধ্যে কি পড়ছে তাও তাদের খেয়াল থাকে না, নামায পড়তে থাকে এবং মন অনত্র পড়ে থাকে। তাড়াহুড়া করে এমনভাবে নামাযটা পড়ে নেয় যাতে কিয়াম, রুকূ’ ও সিজদা কোনটাই ঠিক হয় না। কেননা কোন প্রকারে নামায পড়ার ভান করে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করে। আবার এমন অনেক লোক আছে, যারা কোন জায়গায় আটকা পড়ে যাবার কারণে বেকায়দায় পড়ে নামাযটা পড়ে নেয় কিন্তু আসলে তাদের জীবনে এ ইবাদাতটার কোন মর্যাদা নেই। নামাযের সময় এসে গেলে এটা যে নামাযের সময় এ অনুভূতিটাও তাদের থাকে না। মুয়াজ্জিনের আওয়াজ কানে এলে তিনি কিসের আহবান জানাচ্ছেন, কাকে এবং কেন জানাচ্ছেন একথাটা একবারও তারা চিন্তা করে না। এটাই আখেরাতের প্রতি ঈমান না রাখার আলামত। কারণ ইসলামের এ তথাকথিত দাবীদাররা নামায পড়লে কোন পুরস্কার পাবে বলে মনে করে না এবং না পড়লে তাদের কপালে শাস্তি ভোগ আছে একথা বিশ্বাস করে না। এ কারণে তারা এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে। এজন্য হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) ও হযরত আতা ইবনে দীনার বলেনঃ আল্লাহর শোকর তিনি “ফী সালাতিহিম সাহুন” বলেননি বরং বলেছেন, “আন সালাতিহিম সাহুন।” অর্থাৎ আমরা নামাযে ভুল করি ঠিকই কিন্তু নামায থেকে গাফেল হই না। এজন্য আমরা মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত হবো না। কুরআন মজীদের অন্যত্র মুনাফিকদের এ অবস্থাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَى وَلَا يُنْفِقُونَ إِلَّا وَهُمْ كَارِهُونَ
“তারা যখনই নামাযে আসে অবসাদগ্রস্তের মতো আসে এবং যখনই (আল্লাহর পথে) খরচ করে অনিচ্ছাকৃতভাবে করে।” ( তাওবা ৫৪ )
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ, تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ, تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَأَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللَّهَ فِيهَا إِلاَّ قَلِيلاً-
“এটা মুনাফিকের নামায, এটা মুনাফিকের নামায, এটা মুনাফিকের নামায। সে আসরের সময় বসে সূর্য দেখতে থাকে। এমনকি সেটা শয়তানের দু’টো শিংয়ের মাঝখানে পৌঁছে যায়। (অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময় নিকটবর্তী হয়) তখন সে উঠে চারটে ঠোকর মেরে নেয়। তাতে আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করা হয়।” (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
হযরত সা’দ ইবেন আবী ওয়াক্কাস (রা.) থেকে তাঁর পুত্র মুসআব ইবনে সা’দ রেওয়ায়াত করেন, যারা নামাযের ব্যাপারে গাফলতি করে তাদের সম্পর্কে আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, যারা গড়িমসি করতে করতে নামাযের সময় শেষ হয় এমন অবস্থায় নামায পড়ে তারাই হচ্ছে এসব লোক। (ইবনে জারীর, আবু ইয়ালা, ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী হাতেম, তাবারানী ফিল আওসাত, ইবনে মারদুইয়া ও বাইহাকী ফিস সুনান। এ রেওয়ায়াতটি হযরত সা’দের নিজের উক্তি হিসেবেও উল্লেখিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে এর সনদ বেশী শক্তিশালী। আবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হিসেবে এ রেয়ায়াতটির সনদ বাইহাকী ও হাকেমের দৃষ্টিতে দুর্বল) হযরত মুস’আবের দ্বিতীয় রেয়ায়াতটি হচ্ছে, তিনি নিজের মহান পিতাকে জিজ্ঞেস করেন, এ আয়াতটি নিয়ে কি আপনি চিন্তা-ভাবনা করেছেন? এর অর্থ কি নামায ত্যাগ করা? অথবা এর অর্থ নামায পড়তে পড়তে মানুষের চিন্তা অন্য কোনদিকে চলে যাওয়া? আমাদের মধ্যে কে এমন আছে নামাযের মধ্যে যার চিন্তা অন্য দিকে যায় না? তিনি জবাব দেন, না এর মানে হচ্ছে মানুষের সময়টা নষ্ট করে দেয়া এবং গড়িমসি করে সময় শেষ হয় হয় এমন অবস্থায় তা পড়া। (ইবনে জারীর, ইবনে আবী শাইবা, আবু ইয়া’লা, ইবনুল মুনযির, ইবনে মারদুইয়া ও বাইহাকী ফিস্ সুনান)
এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, নামাযের মধ্যে অন্য চিন্তা এসে যাওয়া এক কথা এবং নামাযের প্রতি কখনো দৃষ্টি না দেয়া এবং নামায পড়তে পড়তে সবসময় অন্য বিষয় চিন্তা করতে থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। প্রথম অবস্থাটি মানবিক দুর্বলতার স্বাভাবিক দাবি। ইচ্ছা ও সংকল্প ছাড়াই অন্যান্য চিন্তা এসে যায় এবং মু’মিন যখনই অনুভব করে, তার মন নামায থেকে অন্যদিকে চলে গেছে তখনই সে চেষ্টা করে আবার নামাযে মনোনিবেশ করে। দ্বিতীয় অবস্থাটি নামাযে গাফলতি করার পর্যায়ভুক্ত। কেননা এ অবস্থায় মানুষ শুধুমাত্র নামাযের ব্যায়াম করে। আল্লাহকে স্মরণ করার কোন ইচ্ছা তার মনে জাগে না। নামায শুরু করা থেকে নিয়ে সালাম ফেরা পর্যন্ত একটা মুহূর্তও তার মন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। যেসব চিন্তা মাথায় পুরে সে নামাযে প্রবেশ করে তার মধ্যেই সবসময় ডুবে থাকে।
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-6
টিকা নং:10,
الَّذِیْنَ هُمْ یُرَآءُوْنَۙ
যারা লোক দেখানো কাজ করে১০
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১০) এটি একটি স্বতন্ত্র বাক্যও হতে পারে আবার পূর্বের বাক্যের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। একে স্বতন্ত্র বাক্য গণ্য করলে এর অর্থ হবে, কেননা সৎকাজও তারা আন্তরিক সংকল্প সহকারে আল্লাহর জন্য করে না। বরং যা কিছু করে অন্যদের দেখাবার জন্য করে। এভাবে তারা নিজেদের প্রশংসা শুনাতে চায়। তারা চায়, লোকেরা তাদের সৎ লোক মনে করে তাদের সৎকাজের ডংকা বাজাবে। এর মাধ্যমে তারা কোন না কোনভাবে দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধার করবে। আর আগের বাক্যের সাথে একে সম্পর্কিত মনে করলে এর অর্থ হবে তারা লোক দেখানো কাজ করে। সাধারণভাবে মুফাস্সিরগণ দ্বিতীয় অর্থটিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ প্রথম নজরেই টের পাওয়া যায় আগের বাক্যের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ “এখানে মোনাফিকদের কথা বলা হয়েছে, যারা লোক দেখানো নামায পড়তো। অন্য লোক সামনে থাকলে নামায পড়তো এবং অন্য লোক না থাকলে পড়তো না।” অন্য একটি রেওয়ায়াতে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, “একাকী থাকলে পড়তো না। আর সর্ব সমক্ষে পড়ে নিতো।” (ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে মারদুইয়া ও বায়হাকী ফিশ শু’আব) কুরআন মজীদেও মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছেঃ
وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا
“আর যখন তারা নামাযের জন্য ওঠে অবসাদগ্রস্তের ন্যায় ওঠে। লোকদের দেখায় এবং আল্লাহকে স্মরণ করে খুব কমই।” ( আন নিসা ১৪২ )
সুরা: আল-মাউন
আয়াত নং :-7
টিকা নং:11,
وَ یَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَ۠
এবং মামুলি প্রয়োজনের জিনিসপাতি১১ (লোকদেরকে) দিতে বিরত থাকে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১১) মূলে মাউন (الْمَاعُونَ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত আলী (রা.), ইবনে উমর (রা.) সাঈদ ইবনে জুবাইর, কাতাদাহ, হাসান বসরী, মুহাম্মাদ ইবন হানাফীয়া, যাহ্হাক, ইবনে যায়েদ, ইকরামা, মুজাহিদ আতা ও যুহরী রাহেমাহুমুল্লাহ বলেন, এখানে এই শব্দটি থেকে যাকাত বুঝানো হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে মাসউদ (র), ইবরাহীম নাখয়ী (র), আবু মালেক (র) এবং অন্যান্য লোকদের উক্তি হচ্ছে, এখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র যেমন হাড়ী-পাতিল, বালতি, দা-কুমড়া দাড়িপাল্লা, লবণ, পানি, আগুন, চকমকি (বর্তমানে এর স্থান দখল করেছে দেয়াশলাই) ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কারণ লোকেরা সাধারণত এগুলো দৈনন্দিন কাজের জন্য পরস্পরের কাছ থেকে চেয়ে নেয়। সাঈদ ইবনে জুবাইর ও মুজাহিদের একটি উক্তিও এর সমর্থনে পাওয়া যায়। হযরত আলীর (রা.) এক উক্তিতেও বলা হয়েছে, এর অর্থ যাকাত হয় আবার ছোট ছোট নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রও হয়। ইবনে আবী হাতেম ইকরামা থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, মাউনের সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে যাকাত এবং সর্বনিম্ন পর্যায় হচ্ছে কাউকে চালুনী, বালতী বা দেয়াশলাই ধার দেয়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথীরা বলতামঃ (কোন কোন হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক জামানায় বলতাম) মাউন বলতে হাঁড়ি, কুড়াল, বালতি, দাঁড়িপাল্লা এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিস অন্যকে ধার দেয়া বুঝায়। (ইবনে জারীর, ইবনে আবী শাইবা, আবু দাউদ, নাসায়ী, বায্যার, ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী হাতেম, তাবারানী ফিল আওসাত, ইবনে মারদুইয়া ও বাইহাকী ফিস সুনান) সাঈদ ইবনে ইয়ায স্পষ্ট নাম উল্লেখ না করেই প্রায় এ একই বক্তব্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের সাহাবীদের থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তার অর্থ হচ্ছে, তিনি বিভিন্ন সাহাবী থেকে একথা শুনেছেন। (ইবনে জারীর ও ইবনে আবী শাইবা) দাইলামী, ইবনে আসাকির ও আবু নু’আইম হযরত আবু হুরাইরার একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেছেনঃ রসূলুল্লাহ ﷺ নিজে এ আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এ থেকে কুড়াল, বালতি এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিস বুঝানো হয়েছে। এ হাদীসটি যদি সহীহ হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত এটি অন্য লোকেরা জানতেন না। জানলে এরপর কখনো তারা এর অন্য কোন ব্যাখ্যা করতেন না।
মূলত মাউন ছোট ও সামান্য পরিমাণ জিনিসকে বলা হয়। এমন ধরনের জিনিস যা লোকদের কোন কাজে লাগে বা এর থেকে তারা ফায়দা অর্জন করতে পারে। এ অর্থে যাকাতও মাউন। কারণ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মধ্য থেকে সামান্য পরিমাণ সম্পদ যাকাত হিসেবে গরীবদের সাহায্য করার জন্য দেয়া হয়। আর এই সঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এবং তাঁর সমমনা লোকেরা অন্যান্য যেসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলোও মাউন। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে, সাধারণত প্রতিবেশীরা একজন আর একজনের কাছ থেকে দৈনন্দিন যেসব জিনিস চেয়ে নিয়ে থাকে সেগুলোই মাউনের অন্তর্ভুক্ত। এ জিনিসগুলো অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নেয়া কোন অপমানজনক বিষয় নয়। কারণ ধনী-গরীব সবার এ জিনিসগুলো কোন না কোন সময় দরকার হয়। অবশ্যি এ ধরনের জিনিস অন্যকে দেবার ব্যাপারে কার্পণ্য করা হীন মনোবৃত্তির পরিচায়ক। সাধারণত এ পর্যায়ের জিনিসগুলো অপরিবর্তিত থেকে যায় এবং প্রতিবেশীরা নিজেদের কাজে সেগুলো ব্যবহার করে, কাজ শেষ হয়ে গেলে অবিকৃত অবস্থায়ই তা ফেরত দেয়। কারো বাড়িতে মেহমান এলে প্রতিবেশীর কাছে খাটিয়া বা বিছানা-বালিশ চাওয়াও এ মাউনের অন্তর্ভুক্ত। অথবা নিজের প্রতিবেশীর চূলায় একটু রান্নাবান্না করে নেয়ার অনুমতি চাওয়া কিংবা কেউ কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে এবং নিজের কোন মূল্যবান জিনিস অন্যের কাছে হেফাজত সহকারে রাখতে চাওয়াও মাউনের পর্যায়ভুক্ত। কাজেই এখানে আয়াতে মূল বক্তব্য হচ্ছে, আখেরাত অস্বীকৃতি মানুষকে এতবেশী সংকীর্ণমনা করে দেয় যে, সে অন্যের জন্য সামান্যতম ত্যাগ স্বীকার করতেও রাজি হয় না।
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ :
অত্র সূরার সর্বশেষ আয়াতে উল্লিখিত الْمَاعُوْنَ মাউন শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও এ সূরাকে সূরা আদ-দীন ও সূরা ইয়াতীম নামেও আখ্যায়িত করা হয়। (ফাতহুল কাদীর)
সূরায় কাফিরদের দুটি বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত মুসল্লিদের তিনটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে।
أَرَأَيْتَ ক্রিয়া দ্বারা নাবী (সাঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। মূলত প্রশ্নবোধক বাক্য দ্বারা বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। أَرَأَيْتَ অর্থ ألم تعلم তুমি কি জানো? মূলত এর দ্বারা শ্রোতাকে বক্তব্যের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও আকৃষ্ট করা হচ্ছে। يُكَذِّبُ অর্থ মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
الدِّيْنِ দ্বারা আখিরাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যারা পুনরুত্থান, হিসাব, প্রতিদান ইত্যাদিসহ আখিরাতের ব্যাপারে নাবী রাসূলগণ যে সংবাদ দিয়েছেন তা অস্বীকার করে।
(يَدُعُّ الْيَتِيْمَ) يَدُعُّ
ক্রিয়ার অর্থ হলো: دع বা রূঢ় আচরণ করে হাঁকিয়ে দেয়া। দুনিয়াতে অবিশ্বাসীরা ইয়াতীমদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করত : রূঢ় আচরণের সাথে হাঁকিয়ে দিত এবং তাদের প্রতি জুলুম করত, খাদ্য দেওয়া তো দূরের কথা তাদের সাথে ভাল ব্যবহারও করত না।
আরেকটি অর্থ হল গলাধাক্কা দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَوْمَ يُدَعُّوْنَ إِلٰي نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا)
“সেদিন তাদেরকে চরমভাবে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের অগ্নির দিকে”। (সূরা তুর ৫২: ১৩)
لَا يَحُضُّ عَلٰي طَعَامِ…..))
‘মিস্কীনদের খাবার দিতে কখনও সে (অন্যদের) উৎসাহ দেয় না’ যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(كَلَّا بَلْ لَّا تُكْرِمُوْنَ الْيَتِيْمَ وَلَا تَحَآضُّوْنَ عَلٰي طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ )
“কক্ষনও নয়, বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না। এবং মিসকীনকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না।” (সূরা ফাজর ৮৯: ১৭-১৮)
সুতরাং ইয়াতীমদের দেখাশুনা করা এবং তাদের প্রয়োজনা পূরণ করা ঈমানের দাবী।
অতঃপর যে-সব মুসল্লিরা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন তাদের কঠিন ধমক ও জাহান্নামের হুমকি দেয়া হয়েছে।
(عَنْ صَلٰوتِهِمْ سَاهُوْنَ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এরা হচ্ছে মুনাফিক অর্থাৎ যারা সকলের সাথে থাকলে সালাত আদায় করে কিন্তু একাকী বা গোপনে থাকলে সালাতের ধার ধারে না। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : لِّلْمُصَلِّيْنَ অর্থাৎ যারা সালাত আদায়কারী এবং সালাতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সালাতের ব্যাপারে অলসতা প্রর্দশন করতঃ হয় সালাত সম্পূর্ণ বর্জন করে অথবা শরীয়ত নির্ধারিত সময়ে আদায় না করে অথবা সালাত রাসূলের শেখানো পদ্ধতিতে আদায় না করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَخَلَفَ مِنْ ۭبَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلٰوةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا)
“তাদের পরে এলো অপদার্থ পরবর্তীগণ, তারা সালাত নষ্ট করল ও কুপবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।” (সূরা মারইয়াম ১৯: ৫৯)
তাই প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মাসরূক, আবূ যুহা ও আতা বিন দীনার (রহঃ) বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা তিনি
(عَنْ صَلٰوتِهِمْ سَاهُوْنَ)
এ কথা বলেছেন,
فِيْ صَلٰوتِهِمْ سَاهُوْنَ
বলেননি। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার এ কথার অর্থ হলো : তারা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন। সালাতের মাঝে উদাসীন এ কথা বলেননি। কেননা যারা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন তারা হয়তো নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবেই সালাতের উত্তম সময় থেকে বিলম্ব করে মাকরূহ সময়ে আদায় করে, আবার হয়তো বিনয় নম্রতাসহ সালাতের রুকন-আরকান ও শর্তসমূহ ভালভাবে আদায় করে না। তাই নাবী (সাঃ) বলেন : ওটা মুনাফিকের সালাত (তিনবার বলেছেন)। সে সূর্য অস্তমিত যাওয়ার প্রতিক্ষায় বসে থাকে, সূর্য অস্ত যেতে শুরু করে এমনকি তা শয়তানের দুশিং এর মাঝামাঝি চলে যায় তখন সে দাঁড়িয়ে চারটি ঠোকর মারে। অল্প সময় ছাড়া তারা আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণই করে না। (সহীহ মুসলিম হা. ১৪৪৩)
يُرَآؤُوْنَ অর্থাৎ এ শ্রেণির লোকেরা মানুষকে দেখানোর জন্য সালাত আদায় করে; আল্লাহ তা‘আলার সন্তষ্টির জন্য করে না। তাই সবার সাথে থাকলে চক্ষু লজ্জায় সালাত আদায় করে, আর গোপনে চলে গেলে সালাতের প্রয়োজন বোধ করে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللہَ وَھُوَ خَادِعُھُمْﺆ وَاِذَا قَامُوْٓا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا کُسَالٰیﺫ یُرَا۬ءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْکُرُوْنَ اللہَ اِلَّا قَلِیْلًا)
“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে শাস্তি দেন, আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে দাঁড়ায় কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।” (সূরা নিসা ৪: ১৪২)
রাসূলুল্লাহ বলেছেন :
مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللَّهُ بِه۪
যে ব্যক্তি লোকদের শুনানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দিয়েই তা শুনিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি লোকদের দেখানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার মাধ্যমে তা দেখিয়ে দেন। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৯৯, সহীহ মুসলিম হা. ২৯৮৬)
মূলত ইবাদত করা উচিত একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তা‘আলার জন্যই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّه۫ يَرَاكَ
তুমি এমনভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাচ্ছ, আর তা না পারলে এমন বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত করবে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০, সহীহ মুসলিম হা. ১০২)
সুতরাং আমল করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়ার জন্য, কোন ব্যক্তির সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আমল করলে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না, বরং এমন আমলের জন্য গুনাহগার হতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَقَدِمْنَآ إِلٰي مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنٰهُ هَبَا۬ءً مَّنْثُوْرًا)
“আমি তাদের কৃতকর্মের দিকে অগ্রসর হব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব।” (সূরা ফুরকান ২৫: ২৩)
(يَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَ)
শব্দের অর্থ সামান্য, ছোটখাট জিনিস। অর্থাৎ ওপরে বর্ণিত শ্রেণির লোকেরা এমন সব জিনিস দিতেও কার্পণ্য করে যা দিলে তার কোন ক্ষতি হবে না। যেমন পাত্র, বালতি, পেয়ালা ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। যে ব্যক্তি সামান্য জিনিস দিতে কার্পণ্য করে সে বেশি জিনিস তো কখনই দেবে না। (তাফসীর সা‘দী)
অতএব প্রত্যেক মুসলিমের ভেবে দেখা উচিত, তার মাঝে এসব দোষগুলো আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে তাওবা করে ফিরে আসা উচিত। আর তাওবা না করলে আখিরাতে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইয়াতীম ও মিসকীনদের খাদ্য খাওয়ানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।
২. যারা সালাতের ব্যাপারে অমনোযোগী তাদের সতর্ক করা হচ্ছে।
৩. লোক দেখানো আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
৪. সৎ কাজের প্রতি উৎসাহী হওয়া দরকার।
৫. সালাতের ব্যাপারে উদাসীন ব্যক্তিদের জন্য দুর্ভোগ।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
ঐ সূরার তাফসীর যার মধ্যে মাঊন (গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোট খাট জিনিস) এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং এটা মক্কী।
১-৭ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ হে মুহাম্মদ (সঃ)! তুমি কি ঐ লোকটিকে দেখেছো যে প্রতিফল দিবসকে অবিশ্বাস করে? সেতো ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে আহার্যদানে উৎসাহ প্রদান করে না। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “না, কখনই নয়। বস্তুতঃ তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না এবং তোমরা অভাবগ্রস্তদেরকে খাদ্য দানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না।” (৮৯:১৭-১৮) অর্থাৎ ঐ ভিক্ষুককে, যে প্রয়োজন অনুপাতে ভিক্ষা পায় না।
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ সুতরাং দুর্ভোগ ঐ নামাযীদের যারা নিজেদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। অর্থাৎ সর্বনাশ রয়েছে ঐসব মুনাফিকের জন্যে যারা লোকদের সামনে নামায আদায় করে, কিন্তু অন্য সময় করে না। অর্থাৎ লোক দেখানোই তাদের নামায আদায়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ অর্থই করেছেন। এ অর্থও করা হয়েছে যে, তারা নির্দিষ্ট সময় পার করে দেয়। মাসরূক (রঃ) এবং আবু যুহা (রঃ) এ কথা বলেছেন।
হযরত আতা ইবনে দীনার (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি (আরবি) বলেছেন, (আরবি) বলেননি। অর্থাৎ আল্লাহপাক বলছেন যে, তারা নামাযের ব্যাপারে উদাসীন থাকে, নামাযের মধ্যে গাফিল বা উদাসীন থাকে এরূপ কথা বলেননি। আবার এ শব্দেই এ অর্থও রয়েছে যে, এমন নামাযীদের জন্যেও সর্বনাশ রয়েছে যারা সব সময় শেষ সময় নামায আদায় করে। অথবা আরকান আহকাম আদায়ের ব্যাপারে মনোযোগ দেয় না। রুকু সিজদার ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দেয়। এসব কিছু যার মধ্যে রয়েছে সে নিঃসন্দেহে দুর্ভাগা। যার মধ্যে এসব অন্যায় যতো বেশী রয়েছে সে ততো বেশী সর্বনাশের মধ্যে পতিত হয়েছে। তার আমল ততো বেশী ক্রটিপুর্ণ এবং ক্ষতিকারক।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ওটা মুনাফিকের নামায, ওটা মুনাফিকের নামায, ওটা মুনাফিকের নামায, যে সূর্যের প্রতীক্ষায় বসে থাকে, সূর্য অস্ত যেতে শুরু করলে শয়তান যখন তার শিং মিলিয়ে দেয় তখন এ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে মোরগের মত চারটি ঠোকর মারে। তাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই করে।” এখানে আসরের নামাযকে বুঝানো হয়েছে। এ নামাযকে “সালাতুল ভূসতা” বা মধ্যবর্তী নামায বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত ব্যক্তি মাকরূহ সময়ে উঠে দাড়ায় এবং কাকের মত ঠোকর দেয়। তাতে আরকান, আহকাম, রুকু, সিজদাহ ইত্যাদি যথাযথভাবে পালন করা হয় না এবং আল্লাহর স্মরণও খুব কম থাকে। লোক দেখানো নামায আদায় করা করা একই কথা। ঐ মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “মুনাফিকরা আল্লাহকে ধােকা দেয় এবং তিনি তাদেরকে ধােকা (-র প্রতিফল) দেন, তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন অলসতা ও উদাসীনতার সাথে দাঁড়ায়, তারা শুধু লোক দেখানোর জন্যেই নামায পড়ে থাকে এবং তারা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে থাকে।” (৪:১৪২)।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ (আরবি) জাহান্নামের একটি ঘাঁটির নাম। ওর আগুন এমন তেজস্বী ও গরম যে, জাহান্নামের অন্যান্য আগুন এই আগুন থেকে আল্লাহর কাছে দৈনিক চারশ’ বার আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে। এই (আরবি) এই উম্মতের অহংকারী আলেমদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে এবং যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও গর্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে দান খায়রাত করে থাকে তাদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে। আর যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও গর্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে হজ্ব করে ও জিহাদ করে তাদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
তবে হ্যা, এখানে স্মরণ রাখার বিষয় যে, কোন ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণ সদুদ্দেশ্যে কোন ভাল কাজ করে, আর জনগণ তা জেনে ফেলে এবং এতে সে খুশী হয় তাহলে এটা রিয়াকারী ও অহংকার বলে গণ্য হবে না।
মুসনাদে আবী ইয়ালা মুসিলীতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি একাকী (নফল) নামায পড়ছিলাম এমন সময় হঠাৎ করে একটি লোক আমার কাছে এসে পড়ে, এতে আমি কিছুটা আনন্দিত হই (এতে কি আমার রিয়া হবে?)” উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন “(না, না, বরং) তুমি এতে দুটি পুণ্য লাভ করবে। একটি গোপন করার পুণ্য এবং আরেকটি প্রকাশ করার পুণ্য।” ইবনে মুবারক (রঃ) বলেন যে, (এ হাদীসটি রিয়াকারদের জন্যে খুবই উত্তম। কিন্তু সনদের দিক থেকে এটা গারীব। তবে একই অর্থবোধক হাদীস অন্য সনদেও বর্ণিত আছে)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) একটি গারীব সনদে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, যখন (আরবি) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ মহান! তোমাদের প্রত্যেককে সারা পৃথিবীর সমান দেয়ার চেয়েও এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম। এখানে ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে নামায পড়লে কোন কল্যাণের আশা করে না এবং না পড়লেও স্বীয় প্রতিপালকের:ভয় তার মনে কোন রেখাপাত করে না।”
অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, নবী করীম (সঃ)-কে এ আয়াতের তাৎপর্য জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “এখানে ঐ সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা নামায আদায়ের ব্যাপারে নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্ব করে। এর একটি অর্থ এও রয়েছে যে, আদৌ নামায পড়ে না। অন্য একটি অর্থ এই আছে যে, শরীয়ত অনুমোদিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর নামায পড়ে। আবার এটাও অর্থ রয়েছে যে, সময়ের প্রথম দিকে নামায পড়ে না।
একটি মাওকুফ হাদীসে রয়েছে যে, হযরত সা’দ ইবনে আবী অক্কাস (রাঃ) বলেনঃ এর ভাবার্থ হলোঃ নামাযের সময়কে সংকীর্ণ করে ফেলে। এ বর্ণনাটিই সবচেয়ে নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য। ইমাম বায়হাকীও (রঃ) বলেছেন যে, মার’ রিওয়াইয়াত যঈফ বা দুর্বল এবং মাওকূফ রিওয়াইয়াত সহীহ বা বিশুদ্ধ। ইমাম হাকিমও (রঃ) একথা বলেছেন। কাজেই এসব লোক আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমন অলসতা করে, তেমনি লোকদের অধিকারও আদায় করে না। তারা রিয়াকারী করে ও যাকাত দেয় না।
হযরত আলী (রাঃ) মাউন শব্দের অর্থ যাকাত পরিশোধ বলেও উল্লেখ করেছেন। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) এবং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য তাফসীরকারগণও একই কথা বলেছেন। হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেন যে, তাদের নামায আদায়ও রিয়াকারী ও অহংকার প্রকাশক। তাদের সম্পদের সাদকার মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানো উদ্দেশ্য রয়েছে। হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) বলেন যে, এই মুনাফিকরা লোক দেখানোর জন্যে নামায আদায় করে, কারণ নামায প্রকাশ্য ব্যাপার। তবে তারা যাকাত আদায় করে না, কারণ যাকাত গোপনীয় ব্যাপার। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, মাউন ঐ সব জিনিষকে বলা হয় যা মানুষ একে অন্যের নিকট চেয়ে থাকে। যেমন কোদাল, বালতি, ডেকচি ইত্যাদি। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীগণ মাউনের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, বর্ণনাকারী বলেনঃ “আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম এবং মাউনের আমরা এ তাফসীর করেছি।”
সুনানে নাসাঈতে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “প্রত্যেক ভাল জিনিষই সদকা। ডোল, হাঁড়ি, বালতি ইত্যাদি দেয়াকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আমলে আমরা মাউন নামে অভিহিত করতাম। মোটকথা, এর অর্থ হলো যাকাত না দেয়া, আনুগত্য না করা, কোন জিনিষ চাইলে না দেয়া, ছোট ছোট জিনিষ কেউ কিছু সময়ের জন্যে নিতে চাইলে না দেয়া, যেমন চালুনি, কোদাল, দা, কুড়াল, ডেকচি ডোল ইত্যাদি।
একটি গারীব বা দুর্বল হাদীসে রয়েছে যে, নুমায়ের গোত্রের প্রতিনিধি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আমাদেরকে বিশেষ আদেশ কি দিচ্ছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “মাউনের ব্যাপারে নিষেধ করো না। প্রতিনিধি পুনরায় প্রশ্ন করলেনঃ “মাঊন কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “পাথর, লোহা, পানি।” প্রতিনিধি জিজ্ঞেস করলেনঃ “লোহা দ্বারা কোন লোহাকে বুঝানো হচ্ছে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “মনে কর, তোমাদের তামার পাতিল, লোহার কোদাল ইত্যাদি। প্রতিনিধি প্রশ্ন করলেনঃ “পাথরের অর্থ কি?” রাসূলুল্লাহ বললেনঃ “ডেকচি, শীলবাটা ইত্যাদি।” (এ হাদীসটি খুবই গরীব বা দুর্বল) এর রাভী বা বর্ণনাকারী মাশহুর’ শ্রেণীভুক্ত নন।
আলী ইবনে ফুলান নুমাইরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “মুসলমান মুসলমানের ভাই। দেখা হলে সালাম করবে, সালাম করলে ভাল জবাব দিবে এবং মাঊনের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাবে অর্থাৎ নিষেধ করবে না।” আলী নুমাইরী (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “মাউন কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “পাথর, লোহা এবং এ জাতীয় অন্যান্য জিনিষ।” এসব ব্যাপারে আল্লাহ সবচেয়ে ভাল জানেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1220/What Is Munafique, What & How?:-51)
[ # Practical framework of Islam :-]
Surah.107: Al-Maa’un
Para:30 Ayat:- 1- 7
www.motaher21.net
107:1
اَرَءَیۡتَ الَّذِیۡ یُکَذِّبُ بِالدِّیۡنِ ؕ﴿۱﴾
Have you seen the one who denies the Recompense?
Allah says,
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ
“O Muhammad! Have you seen the one who denies the Din”
Here the word Din means the Hereafter, the Recompense and the Final Reward.
فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ
107:2
فَذٰلِکَ الَّذِیۡ یَدُعُّ الۡیَتِیۡمَ ۙ﴿۲﴾
For that is the one who drives away the orphan
That is he who repulses the orphan,
meaning, he is the one who oppresses the orphan and does not give him his just due. He does not feed him, nor is he kind to him.
وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ
107:3
وَ لَا یَحُضُّ عَلٰی طَعَامِ الۡمِسۡکِیۡنِ ؕ﴿۳﴾
And does not encourage the feeding of the poor.
And urges not the feeding of Al-Miskin.
This is as Allah says,
كَلَّ بَل لاَّ تُكْرِمُونَ الْيَتِيمَ
وَلَا تَحَاضُّونَ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ
Nay! But you treat not the orphans with kindness and generosity!
And urge not one another on the feeding of Al-Miskin! (89:17-18)
meaning, the poor man who has nothing to sustain him and suffice his needs.
Then Allah says,
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ
107:4
فَوَیۡلٌ لِّلۡمُصَلِّیۡنَ ۙ﴿۴﴾
So woe to those who pray
الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَتِهِمْ سَاهُونَ
107:5
الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَنۡ صَلَاتِہِمۡ سَاہُوۡنَ ۙ﴿۵﴾
[But] who are heedless of their prayer –
So, woe unto those performers of Salah,
those who with their Salah are Sahun.
Ibn Abbas and others have said,
“This means the hypocrites who pray in public but do not pray in private.”
Thus, Allah says,
لِّلْمُصَلِّينَ
(unto those performers of Salah),
They are those people who pray and adhere to the prayer, yet they are mindless of it.
– This may either be referring to its act entirely, as Ibn Abbas said, or
– it may be referring to performing it in its stipulated time that has been legislated in Islam. This means that the person prays it completely outside of its time.
This was said by Masruq and Abu Ad-Duha.
Ata’ bin Dinar said,
“All praise is due to Allah, the One Who said,
عَن صَلَـتِهِمْ سَاهُونَ
(with their Salah are Sahun) and He did not say, `those who are absent minded in their prayer.”‘
It could also mean the first time of the prayer, which means they always delay it until the end of its time, or they usually do so.
It may also refer to not fulfilling its pillars and conditions, and in the required manner.
It could also mean performing it with humility and contemplation of its meanings.
The wording of the Ayah comprises all of these meanings. However, whoever has any characteristic of this that we have mentioned then a portion of this Ayah applies to him. And whoever has all of these characteristics, then he has completed his share of this Ayah, and the hypocrisy of actions is fulfilled in him. This is just as is confirmed in the Two Sahihs that the Messenger of Allah said,
تِلْكَ صَلَةُ الْمُنَافِقِ تِلْكَ صَلَةُ الْمُنَافِقِ تِلْكَ صَلَةُ الْمُنَافِقِ
يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَي الشَّيْطَانِ
قَامَ فَنَقَرَ أَرْبَعًا لَاا يَذْكُرُ اللهَ فِيهَا إِلاَّ قَلِيلًا
This is the prayer of the hypocrite, this is the prayer of the hypocrite, this is the prayer of the hypocrite.
He sits watching the sun until it is between the two horns of Shaytan.
Then he stands and pecks four (Rakahs) and he does not remember Allah (in them) except very little.
This Hadith is describing the end of the time for the `Asr prayer, which is the middle prayer as is confirmed by a text (Hadith). This is the time in which it is disliked to pray. Then this person stands to pray it, pecking in it like the pecking of a crow. He does not have tranquility or humility in it at all. Thus, the Prophet said,
لَاا يَذْكُرُ اللهَ فِيهَا إِلاَّ قَلِيلًا
He does not remember Allah (in them) except very little.
He probably only stands to pray it so that the people will see him praying, and not seeking the Face of Allah. This is just as if he did not pray at all.
Allah says,
إِنَّ الْمُنَـفِقِينَ يُخَـدِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُواْ إِلَى الصَّلَوةِ قَامُواْ كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلاَّ قَلِيلً
Verily, the hypocrites seek to deceive Allah, but it is He Who deceives them. And when they stand up with laziness and to be seen of men, and they do not remember Allah but little. (4:142)
and Allah says here,
الَّذِينَ هُمْ يُرَاوُونَ
107:6
الَّذِیۡنَ ہُمۡ یُرَآءُوۡنَ ۙ﴿۶﴾
Those who make show [of their deeds]
Those who do good deeds only to be seen,
Imam Ahmad recorded from Amr bin Murrah that he said,
“We were sitting with Abu Ubaydah when the people mentioned showing-off. A man known as Abu Yazid said, “I heard `Abdullah bin `Amr saying that the Messenger of Allah said,
مَنْ سَمَّعَ النَّاسَ بِعَمَلِهِ سَمَّعَ اللهُ بِهِ سَامِعَ خَلْقِهِ وَحَقَّرَهُ وَصَغَّرَه
Whoever tries to make the people hear of his deed, Allah, the One Who hears His creation, will hear it and make him despised and degraded.”
from what is related to his statement,
الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ
(Those who do good deeds only to be seen), is that whoever does a deed solely for Allah, but the people come to know about it, and he is pleased with that, then this is not considered showing off.
Allah said:
وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ
107:7
وَ یَمۡنَعُوۡنَ الۡمَاعُوۡنَ ٪﴿۷﴾
And withhold [simple] assistance.
And withhold Al-Ma`un.
This means that they do not worship their Lord well, nor do they treat His creation well. They do not even lend that which others may benefit from and be helped by, even though the object will remain intact and be returned to them. These people are even stingier when it comes to giving Zakah and different types of charity that bring one closer to Allah.
Al-Mas`udi narrated from Salamah bin Kuhayl who reported from Abu Al-Ubaydin that he asked Ibn Mas`ud about Al-Ma`un and he said,
“It is what the people give to each other, like an axe, a pot, a bucket and similar items.”
This is the end of the Tafsir of Surah Al-Ma`un, and all praise and thanks are due to Allah
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran