Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২২/ এবং কাফের-রা বলে :-৪৫)
[#বলে দাও, হে কাফেররা!:-]
সুরা: ১০৯: আল-কাফিরূন
পারা:৩০
১-৬ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
(Book#1222/ And The Qafir Say:-45)
[ # Say, “O disbelievers,:-]
Surah.109: Al-Kaafiroon
Para:30 Ayat:- 1- 6
www.motaher21.net
সুরা: আল-কাফিরূন
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১০৯
(১০৯-কাফিরূন) : নামকরণ:
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ আয়াতের “আল কাফিরূন” শব্দ থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে
(১০৯-কাফিরূন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত হাসান বসরী ও ইকরামা বলেন, এটি মক্কী সূরা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর বলেন, মাদানী। অন্যদিকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও কাতাদাহ থেকে উভয় মতই উদ্ধৃত হয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা একে মক্কী ও মাদানী উভয়ই বলেন। কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে এটি মক্কী সূরা। তাছাড়া এর বিষয়বস্তুই এর মক্কী হবার কথা প্রমাণ করে।
(১০৯-কাফিরূন) : ঐতিহাসিক পটভূমি :
মক্কায় এমন এক যুগ ছিল যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে কুরাইশদের মুশরিক সমাজে প্রচণ্ড বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা.) কোন না কোন প্রকার আপোস করতে উদ্বুদ্ধ করা যাবে বলে কুরাইশ সরদাররা মনে করতো। এ ব্যাপারে তারা তখনো নিরাশ হয়নি। এজন্য তারা মাঝে-মধ্যে তাঁর কাছে আপোসের ফরমূলা নিয়ে হাযির হতো। তিনি তার মধ্য থেকে কোন একটি প্রস্তাব মেনে নিলেই তাঁর ও তাদের মধ্যকার ঝগড়া মিটে যাবে বলে তারা মনে করতো। হাদীসে এ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো: আমরা আপনাকে এত বেশী পরিমাণ ধন- সম্পদ দেবো যার ফলে আপনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। যে মেয়েটিকে আপনি পছন্দ করবেন তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবো। আমরা আপনার পিছনে চলতে প্রস্তুত। আপনি শুধু আমাদের একটি কথা মেনে নেবেন— আমাদের উপাস্যদের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবটি আপনার পছন্দ না হলে আমরা আর একটি প্রস্তাব পেশ করছি। এ প্রস্তাবে আপনার লাভ এবং আমাদেরও লাভ। রসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করেন, সেটি কি? এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদাত করবেন এবং আমরাও এক বছর আপনার উপাস্যদের ইবাদাত করবো। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, থামো! আমি দেখি আমার রবের পক্ষ থেকে কি হুকুম আসে।* এর ফলে অহী নাযিল হয়:
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ…………….
এবং এই সংগে নাযিল হয়:
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ
“ওদের বলে দাও, হে মূর্খের দল! তোমরা কি আমাকে বলছো, আল্লাহ ছাড়া আমি আর কারো ইবাদাত করবো?” ইবনে আব্বাসের (রা.) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো: “হে মুহাম্মাদ! যদি তুমি আমাদের উপাস্য মুর্তিগুলোকে চুম্বন করো তাহলে আমরা তোমার মাবুদের ইবাদাত করবো।” একথায় এই সূরাটি নাযিল হয়। (আবদ ইবনে হুমাইদ)
* এর মানে এ নয় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রস্তাবটিকে কোন পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য তো দূরের কথা প্রণিধানযোগ্য মনে করেছিলেন। এবং (নাউযুবিল্লাহ) কাফেরদেরকে এ আশায় এ জবাব দিয়েছিলেন যে, হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি গৃহীত হয়ে যাবে। বরং একথাটি আসলে ঠিক এমন পর্যায়ের ছিল যেমন কোন অধীনস্থ অফিসারের সামনে কোন অবাস্তব দাবি পেশ করা হয় এবং তিনি জানেন সরকারের পক্ষে এ ধরনের দাবি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি নিজে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করার পরিবর্তে দাবি পেশকারীদেরকে বলেন, আমি আপনাদের আবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেখান থেকে যা কিছু জবাব আসবে তা আপনাদের জানিয়ে দেবো। এর ফলে যে প্রতিক্রিয়াটা হয় সেটা হচ্ছে এই যে, অধীনস্থ অফিসার নিজে অস্বীকার করলে লোকেরা বরাবর পীড়াপীড়ি করতে ও চাপ দিতেই থাকবে, কিন্তু যদি তিনি জানিয়ে দেন, ওপর থেকে কর্তৃপক্ষের যে জবাব এসেছে তা তোমাদের দাবীর বিরোধী তাহলে লোকেরা হতাশ হয়ে পড়বে।
আবুল বখতরীর আযাদকৃত গোলাম সাঈদ ইবনে মীনা রেওয়ায়াত করেন, অলীদ ইবনে মুগীরাহ, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব ও উমাইয়া ইবনে খালফ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে বলে: “হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা তোমার মাবুদের ইবাদাত করি এবং তুমি আমাদের মাবুদদের ইবাদাত করো। আর আমাদের সমস্ত কাজে আমরা তোমাকে শরীক করে নিই। তুমি যা এনেছো তা যদি আমাদের কাছে যা আছে তার চাইতে ভালো হয় তাহলে আমরা তোমার সাথে তাতে শরীক হবো এবং তার মধ্য থেকে নিজেদের অংশ নিয়ে নেবো। আর আমাদের কাছে যা আছে তা যদি তোমার কাছে যা আছে তার চাইতে ভালো হয়, তাহলে তুমি আমাদের সাথে তাতে শরীক হবে এবং তা থেকে নিজের অংশ নেবে।” একথায় মহান আল্লাহ এ আল কাফেরূন সূরাটি নাযিল করেন। (ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম। ইবনে হিশামও সীরাতে এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন)।
ওহাব ইবনে মুনাব্বাহ রেওয়ায়াত করেন, কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, যদি আপনি পছন্দ করেন তাহলে এই বছর আমরা আপনার দ্বীনে প্রবেশ করবো এবং এক বছর আপনি আমাদের দ্বীনে প্রবেশ করবেন। (আবদ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে আবী হাতেম।)
এসব রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, একবার একই মজলিসে নয় বরং বহুবার বহু মজলিসে কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এ প্রস্তাব পেশ করেছিল। এ কারণে একবার সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন জবাব দিয়ে তাদের এ আশাকে চিরতরে নির্মূল করে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিছু দাও আর কিছু নাও– এ নীতির ভিত্তিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সাথে কোন চুক্তি ও আপোস করবেন না, একথা তাদেরকে জানিয়ে দেয়া একান্ত জরুরী ছিল।
(১০৯-কাফিরূন) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :
সূরাটি উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে, আসলে ধর্মীয় উদারতার উপদেশ দেবার জন্য সূরটি নাযিল হয়নি। যেমন আজকাল কেউ কেউ মনে করে থাকেন বরং কাফেরদের ধর্ম, পূজা অনুষ্ঠান ও তাদের উপাস্যদের থেকে পুরোপুরি দায়িত্ব মুক্তি এবং তার প্রতি অনীহা, অসন্তুষ্টি ও সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দেয়া আর এই সাথে কুফরী ধর্ম ও দ্বীন ইসলাম পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তাদের উভয়ের মিলে যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই, একথা ঘোষণা করে দেয়ার জন্যই এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল। যদিও শুরুতে একথাটি কুরাইশ বংশীয় কাফেরদেরকে সম্বোধন করে তাদের আপোস ফরমূলার জবাবে বলা হয়েছিল কিন্তু এটি কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং একথাগুলোকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে কিয়ামত পর্যন্ত এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, কুফরী ধর্ম দুনিয়ার যেখানেই যে আকৃতিতে আছে তার সাথে সম্পর্কহীনতা ও দায়িত্ব মুক্তির ঘোষণা তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত। কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই তাদের একথা জানিয়ে দেয়া উচিত যে, দ্বীনের ব্যাপারে তারা কাফেরদের সাথে কোন প্রকার আপোস বা উদারনীতির আশ্রয় গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এ কারণেই যাদের কথার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল তারা মরে শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এটি পঠিত হতে থেকেছে। যারা এর নাযিলের সময় কাফের ও মুশরিক ছিল তারা মুসলমান হয়ে যাওয়ার পরও এটি পড়তে থেকেছে। আবার তাদের দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নেবার শত শত বছর পর আজো মুসলমানরা এটি পড়ে চলেছে। কারণ কুফরী ও কাফেরের কার্যকলাপ থেকে সম্পর্কহীনতা ও অসন্তুষ্টি ঈমানের চিরন্তন দাবি ও চাহিদা।
(১০৯-কাফিরূন) : গুরুত্ব :
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে এ সূরার কি গুরুত্ব ছিল, নিচে উল্লেখিত কয়েকটি হাদীস থেকে তা অনুমান করা যেতে পারে:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রেওয়ায়াত করেছেন, আমি বহুবার রসূলুল্লাহকে (সা.) ফজরের নামাযের আগে ও মাগরিবের নামাযের পরে দুই রাকায়াতে قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ এবং قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ পড়তে দেখেছি। (এই বিষয়বস্তু সম্বলিত বহু হাদীস সামান্য শাব্দিক হেরফের সহকারে ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান ও ইবনে মারদুইয়া ইবনে ওমর (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন)।
হযরত খাব্বাব (রা.) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন: যখন তুমি ঘুমুবার জন্য নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ো তখন قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ পড়ে নাও। আর রসূল (সা.) নিজেও যখন বিছানায় ঘুমুবার জন্য শুয়ে পড়তেন তখন এ সূরাটি পড়ে নিতেন। এটি ছিল তাঁর রীতি। (বায়হাকী, তাবারানি, ও ইবনে মারদুইয়া)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের বলেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি কালেমার কথা বলবো যা তোমাদের শির্ক থেকে হেফাজত করবে? সেটি হচ্ছে, তোমরা শোবার সময় قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ পড়ে নাও (আবুল ইয়ালা ও তাবারানি)।
হযরত আনাস (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মু’আয ইবনে জাবালকে বলেন, ঘুমুবার সময় قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ পড়ো। কারণ এর মাধ্যমে শির্ক থেকে সম্পর্কহীনতা সৃষ্টি হয়।
ফারওয়াহ ইবনে নওফাল ও আবদুর রহমান ইবনে নওফাল উভয়ে বর্ণনা করেছেন, তাদের পিতা নওফল ইবনে মু’আবিয়া আল আশজায়ী (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, আমি শোবার সময় পড়তে পারি এমন একটি জিনিস আমাকে বলে দিন। জবাবে তিনি বলেন, قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ শেষ পর্যন্ত পড়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কারণ এটি শির্ক থেকে সম্পর্কহীন করে— (মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ, ইবনে আবী শাইবা, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও বায়হাকী ফিশ শু’আব)। হযরত যায়েদ ইবনে হারেসার (রা.) ভাই হযরত জাবালাহ ইবনে হারেসা (রা.) এ ধরনের আবেদন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে করেছিলেন এবং তাকেও তিনি এ একই জবাব দিয়েছিলেন— (মুসনাদে আহমাদ ও তাবারানী)।
সুরা: আল-কাফিরূন
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,
قُلْ یٰۤاَیُّهَا الْكٰفِرُوْنَۙ
বলে দাও, হে কাফেররা!১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) এ আয়াতে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে ভেবে দেখার মতোঃ
(ক) যদিও নবীকে ﷺ হুকুম দেয়া হয়েছে, তুমি কাফেরদের পরিষ্কার বলে দাও। তবুও সামনের আলোচনা জানিয়ে দিচ্ছে, পরবর্তী আয়াতগুলোতে যেসব কথা বলা হয়েছে প্রত্যেক মু’মিনের সে কথাগুলোই কাফেরদেরকে জানিয়ে দিতে হবে। এমনকি যে ব্যক্তি কুফরী থেকে তাওবা করে ঈমান এনেছে তার জন্যও কুফরী ধর্ম, তার পূজা-উপাসনা ও উপাস্যদের থেকে নিজের সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্তির কথা প্রকাশ করতে হবে। কাজেই ‘কুল’ (বলে দাও) শব্দটির মাধ্যমে প্রধানত ও প্রথমত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এ হুকুমটি বিশেষভাবে শুধু তাঁকেই করা হয়নি বরং তাঁর মাধ্যমে প্রত্যেক মু’মিনকে করা হয়েছে।
(খ) এ আয়াতে প্রতিপক্ষকে যে “কাফের” বলে সম্বোধন করা হয়েছে, এটা তাদের জন্য কোন গালি নয়। বরং আরবী ভাষায় কাফের মানে অস্বীকারকারী ও অমান্যকারী (Unbeliever)। এর মোকাবিলায় ‘মু’মিন’ শব্দটি বলা হয়, মেনে নেয়া ও স্বীকার করে নেয়া অর্থে (Believer)। কাজেই আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের (হে কাফেররা!) বলার অর্থই হচ্ছে এই যে, “হে লোকেরা! তোমরা যারা আমার রিসালাত ও আমার প্রদত্ত শিক্ষা মেনে নিতে অস্বীকার করছো।” অনুরূপভাবে একজন মু’মিন যখন একথা বলবে অর্থাৎ যখন সে বলবে, “হে কাফেররা!” তখন কাফের বলতে তাদেরকে বুঝানো হবে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান আনেনি।
(গ) “হে কাফেররা!” বলা হয়েছে, “হে মুশরিকরা” বলা হয়নি। কাজেই এখানে কেবল মুশরিকদের উদ্দেশ্যেই বক্তব্য পেশ করা হয়নি বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যারা আল্লাহর রসূল এবং তিনি যে শিক্ষা ও হিদায়াত দিয়েছেন তাকে আল্লাহর শিক্ষা ও হিদায়াত বলে মেনে নেয় না, তারা ইহুদী, খৃস্টান ও অগ্নি উপাসক বা সারা দুনিয়ার কাফের, মুশরিক ও নাস্তিক যেই হোক না কেন, তাদের সবাইকে এখানে সম্বোধন করা হয়েছে। এ সম্বোধনকেই শুধুমাত্র কুরাইশ বা আরবের মুশরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোন কারণ নেই।
(ঘ) অস্বীকারকারীদেরকে ‘হে কাফেররা’ বলে সম্বোধন করা ঠিক তেমনি যেমন আমরা কিছু লোককে সম্বোধন করি “ওহে শত্রুরা” বা “ওহে বিরোধীরা” বলে। এ ধরনের সম্বোধনের ক্ষেত্রে আসলে বিরোধী ব্যক্তিরা লক্ষ্য হয় না, লক্ষ্য হয় তাদের বিরোধিতা ও শত্রুতা। আর এ সম্বোধন ততক্ষণের জন্য হয় যতক্ষণ তাদের মধ্যে এ গুণগুলো থাকে। যখন তাদের কেউ এ শত্রুতা ও বিরোধিতা পরিহার করে অথবা বন্ধু ও সহযোগী হয়ে যায় তখন সে আর এ সম্বোধনের লক্ষ্য থাকে না। অনুরূপভাবে যাদেরকে “হে কাফেররা” বলে সম্বোধন করা হয়েছে তারাও তাদের কুফরীর কারণে এ সম্বোধনের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে, তাদের ব্যক্তিসত্তার কারণে নয়। তাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমৃত্যু কাফের থাকে তার জন্য এ সম্বোধন হবে চিরন্তন। কিন্তু যে ব্যক্তি ঈমান আনবে তার প্রতি আর এ সম্বোধন আরোপিত হবে না।
(ঙ) অনেক মুফাসসিরের মতে এ সূরায় “হে কাফেররা” সম্বোধন কেবলমাত্র কুরাইশদের এমন কিছু লোককে করা হয়েছে যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দ্বীনের ব্যাপারে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এবং যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাঁর রসূলকে ﷺ বলে দিয়েছিলেন, এরা ঈমান আনবে না। দু’টি কারণে তারা এ মত অবলম্বন করেছেন।
প্রথমত, সামনের দিকে বলা হয়েছে لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ (যারা বা যাদের ইবাদাত তোমরা করো আমি তার বা তাদের ইবাদাত করি না)। তাদের মতে এ উক্তি ইহুদি ও খৃস্টানদের জন্য সঠিক নয়। কেননা, তারা আল্লাহর ইবাদাত করে।
দ্বিতীয়ত, সামনের দিকে একথাও বলা হয়েছেঃ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (আর না তোমরা তার ইবাদাত করো যার ইবাদাত আমি করছি)। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে, এ সূরা নাযিলের সময় যারা কাফের ছিল এবং পরে ঈমান আনে তাদের ব্যাপারে এ উক্তি সত্য নয়। কিন্তু এ উভয় যুক্তির কোন সারবত্তা নেই। অবশ্যি এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা আমি পরে করবো। তা থেকে জানা যাবে, এগুলোর যে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে তা সঠিক নয়। তবে এখানে এ যুক্তির গলদ স্পষ্ট করার জন্য শুধুমাত্র এতটুকু বলে দেয়াই যথেষ্ট মনে করি, যদি শুধুমাত্র উল্লেখিত লোকদেরকেই এ সূরায় সম্বোধন করা হয়ে থাকে তাহলে তাদের মরে শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ সূরার তেলাওয়াত জারী থাকার কি কারণ থাকতে পারে? কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের পড়ার জন্য স্থায়ীভাবে কুরআনে এটি লিখিত থাকারই বা কি প্রয়োজন ছিল?
ফী জিলালিল কুরআন:
এরশাদ হচ্ছে, ‘বলে দাও হে রসূল ‘ এ নির্দেশসূচক বাক্যের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এটি চূড়ান্তভাবে আল্লাহ তায়ালার ওহীভিত্তিক প্রত্যাদেশ ৷ আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে মোহাম্মদ (স.)-এর নিজস্ব মতামত ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করার কোনো অধিকার নেই। আল্লাহর তরফ থেকে তাদেরকে তুমি নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দাও, এ হচ্ছে সে মহান ও শক্তিমান এক আল্লাহর ঘোষণা ও নির্দেশ , যার নির্দেশকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি কারো নেই, যার হুকুম অপ্রতিরোধ্য, যার হুকুমকে বাতিল করার ক্ষমতা কারো নেই । এ আয়াতে কাফেরদেরকে তাদের যথার্থ উপাধিতে সম্বোধন করা হয়েছে। তাদেরকে তাদের প্রকৃত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেই আহ্বান জানানো হয়েছে। কেননা তারা সত্য দ্বীনের অনুসারী নয় এবং তারা সত্য ও সঠিক আদর্শে বিশ্বাসীও নয় বরং সত্য গোপনকারী, সত্যের বিরোধী ও সত্য আদর্শে অবিশ্বাসী, তাই তাদেরকে ‘কাফিরুন’ বলে ডাকা হয়েছে। আর যেহেতু তারা সত্য গোপনকারী, মিথ্যাশ্রয়ী, তাই তোমার ও তাদের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন ৷ এ দুই পরস্পর বিরোধী মত ও পথের মধ্যে কোনোক্রমেই সমঝোতা ও মিল হতে পারে না। হক ও বাতিলের মধ্যে সন্ধি হওয়া অসম্ভব ব্যাপার ।
সুরা: আল-কাফিরূন
আয়াত নং :-2
টিকা নং:2,
لَاۤ اَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَۙ
আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো।২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) সারা দুনিয়ার কাফের মুশরিকরা যেসব উপাস্যের উপাসনা, আরাধনা ও পূজা করে, ফেরেশতা, জিন, নবী, আউলিয়া, জীবিত ও মৃত মানুষের আত্মা তথা ভূত-প্রেত, চাঁদ, সূর্য, তারা, জীব-জন্তু, গাছপালা, মাটির মূর্তি বা কাল্পনিক দেব-দেবী সবই এর অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা যেতে পারে, আরবের মুশরিকরা মহান আল্লাহকেও তো মাবুদ ও উপাস্য বলে মানতো এবং দুনিয়ার অন্যান্য মুশরিকরাও প্রাচীনযুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তও আল্লাহর উপাস্য হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করেনি। আর আহলে কিতাবরা তো আল্লাহকেই আসল মাবুদ বলে মানতো। এক্ষেত্রে কোন প্রকার ব্যতিক্রমের উল্লেখ না করেই এদের সমস্ত মাবুদের ইবাদাত করা থেকে সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্তির কথা ঘোষণা করা, যেখানে আল্লাহও তার অন্তর্ভুক্ত, কিভাবে সঠিক হতে পারে? এর জবাবে বলা যায়, আল্লাহকে অন্য মাবুদদের সাথে মিশিয়ে মাবুদ সমষ্টির একজন হিসেবে যদি অন্যদের সাথে তাঁর ইবাদাত করা হয় তাহলে তাওহীদ বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তি অবশ্যি নিজেকে এ ইবাদাত থেকে দায়মুক্ত ও সম্পর্কহীন ঘোষণা করবে। কারণ তার দৃষ্টিতে আল্লাহ মাবুদ সমষ্টির একজন মাবুদ নন। বরং তিনি একাই এবং একক মাবুদ। আর এ সমষ্টি ইবাদাত আসলে আল্লাহর ইবাদাত নয়। যদিও আল্লাহর ইবাদাত এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মজীদে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে একমাত্র সেটিই আল্লাহর ইবাদাত যার মধ্যে অন্যের ইবাদতের কোন গন্ধও নেই এবং যার মধ্যে মানুষ নিজের বন্দেগীকে পুরোপুরি আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে। وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ লোকদেরকে এছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা পুরোপুরি একমুখী হয়ে নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁর ইবাদাত করবে। কুরআনের বহু জায়গায় সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে এবং অত্যন্ত জোরালো ভাষায় এ বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন সূরা আন নিসা ১৪৫ ও ১৪৬ , আল আ’রাফ ২৯ , আয যুমার ২, ৩ , ১১ , ১৪ ও ১৫ এবং আল মু’মিন ১৪ ও ৬৪-৬৬ আয়াতসমূহ। এ বক্তব্য একটি হাদীসে কুদসীতেও উপস্থাপিত হয়েছে। তাতে রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক শরীকের অংশীদারিত্ব থেকে আমি সবচেয়ে বেশী মুক্ত। যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করেছে যার মধ্যে আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করেছে, তা থেকে আমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং আমার সাথে যাকে সে ঐ কাজে শরীক করেছে, ঐ সম্পূর্ণ কাজটি তারই জন্য (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহ)। কাজেই আল্লাহকে দুই, তিন বা বহু ইলাহের একজন গণ্য করা এবং তাঁর সাথে অন্যদের বন্দেগী উপাসনা ও পূজা করাই হচ্ছে আসল কুফরী এবং এ ধরনের কুফরীর সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করাই এ সূরার উদ্দেশ্য)
সুরা: আল-কাফিরূন
আয়াত নং :-3
টিকা নং:3,
وَ لَاۤ اَنْتُمْ عٰبِدُوْنَ مَاۤ اَعْبُدُۚ
আর না তোমরা তাঁর ইবাদাত করো যাঁর ইবাদাত আমি করি।৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) এখানে মূলে مَا أَعْبُدُ বলা হয়েছে। আরবী ভাষায় مَا (মা) শব্দটি সাধারণত নিষ্প্রাণ বা বুদ্ধি-বিবেচনাহীন বস্তু বিষয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পন্ন জীবের জন্য مَنْ (মান) শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ কারণে প্রশ্ন দেখা দেয়, এখানে مَنْ اَعْبُدُ না বলে مَااَعْبُدُ বলা হলো কেন? মুফাসসিরগণ সাধারণত এর চারটি জবাব দিয়ে থাকেন। এক, এখানে مَا শব্দটি مَنْ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। দুই, এখানে مَا (মা) শব্দটি الَّذِى (আললাযী) অর্থাৎ যে বা যাকে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তিন, উভয় বাক্যেই مَا (মা) শব্দটি মূল শব্দ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে এখানে এর অর্থ হয়ঃ আমি সেই ইবাদাত করি না যা তোমরা করো। অর্থাৎ মুশরিকী ইবাদত। আর তোমরা সেই ইবাদাত করো না যা আমি করি অর্থাৎ তাওহীদবাদী ইবাদত। চার, প্রথম বাক্যে যেহেতু مَا تَعْبُدُونَ বলা হয়েছে তাই দ্বিতীয় বাক্যে বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখার খাতিরে مَا أَعْبُدُ বলা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একই শব্দ বলা হয়েছে কিন্তু এর মানে এক নয়। কুরআন মাজীদে এর উদাহরণ রয়েছে। যেমন সূরা আল বাকারাহ ১৯৪ আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ “যে ব্যক্তি তোমার ওপর বাড়াবাড়ি করে তুমিও তার ওপর তেমনি বাড়াবাড়ি করো যেমন সে তোমার ওপর করেছে।” একথা সুস্পষ্ট যে, কারো বাড়াবাড়ির জবাবে ঠিক তেমনি বাড়াবাড়িমূলক আচরণকে আসলে বাড়াবাড়ি বলে না। কিন্তু নিছক বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্দেশ্যেই জবাবী কার্যকলাপকে বাড়াবাড়ি শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরা তাওবার ৬৭ আয়াতে বলা হয়েছে نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ “তারা আল্লাহকে ভুলে গেলো কাজেই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেলেন।” অথচ আল্লাহ ভোলেন না। এখানে আল্লাহর বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাদেরকে উপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাদের ভুলে যাওয়ার জবাবে আল্লাহ ভুলে যাওয়া শব্দটি নিছক বক্তব্যের মধ্যে মিল রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ চারটি অর্থ যদিও এক এক দৃষ্টিতে যথার্থ এবং আরবী ভাষায় এসব গ্রহণ করার অবকাশও রয়েছে তবুও যে মূল বক্তব্যটিকে সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য مَنْ اَعْبُدُ এর জায়গায় مَا اَعْبُدُ বলা হয়েছে তা এর মধ্য থেকে কোন একটি অর্থের মাধ্যমেও পাওয়া যায় না। আসলে আরবী ভাষায় কোন ব্যক্তির জন্য مَنْ শব্দটি ব্যবহার করে তার মাধ্যমে তার ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এবং مَا শব্দটি ব্যবহার করে তার মাধ্যমে তার গুণগত সত্তা সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়। যেমন আমাদের ভাষায় কারো সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞেস করি, ইনি কে? তখন তার ব্যক্তিসত্তার পরিচিতি লাভ করাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করি, ইনি কি? তখন আসলে আমরা চাই তার গুণগত পরিচিতি। যেমন তিনি যদি সেনাবাহিনীর লোক হন তাহলে সেখানে তার পদমর্যাদা কি? তিনি যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তাহলে সেখানে তিনি রীডার, লেকচারার না প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত আছেন? তিনি কোন বিষয়টি পড়ান? তার ডিগ্রী কি ইত্যাদি বিষয় জানাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য। কাজেই যদি এ আয়াতে বলা হতো لَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ তাহলে এর অর্থ হতো, তোমরা সেই সত্তার ইবাদাত করবে না যার ইবাদাত আমি করছি। এর জবাবে মুশরিক ও কাফেররা বলতে পারতোঃ আল্লাহর সত্তাকে তো আমরা মানি এবং তার ইবাদতও করি। কিন্তু যখন বলা হলোঃ لَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ তখন অর্থ দাঁড়ালোঃ যেসব গুণের অধিকারী মাবুদের ইবাদাত আমি করি সেইসব গুণের অধিকারী মাবুদের ইবাদাত তোমরা করবে না। এখানে মূল বক্তব্য এটিই। এরই ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীন সব ধরনের কাফেরদের দ্বীন থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। কারণ সব ধরনের কাফেরদের খোদা থেকে তাঁর খোদা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের কারো খোদার ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করার পর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেবার প্রয়োজন হয়েছে। সে বিশ্ব-জগতের প্রভু নয় বরং ইসরাঈলের প্রভু। একটি গোষ্ঠীর লোকদের সাথে তার এমন বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে যা অন্যদের সাথে নেই। সে হযরত ইয়াকুবের সাথে কুস্তি লড়ে কিন্তু তাকে আছাড় দিতে পারে না। তার উযাইর নামক একটি ছেলেও আছে। আবার কারো খোদা হযরত ঈসা ﷺ মসিহ নামক একমাত্র পুত্রের পিতা। সে অন্যদের গুনাহের কাফফারা দেবার জন্য নিজের পুত্রকে ক্রুশ বিদ্ধ করায়। কারোর খোদার স্ত্রী সন্তান আছে। কিন্তু সে বেচারার শুধু কন্যা আবির্ভূত হয়েছে এবং মানুষের দেহ পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর বুকে এবং মানুষের মতো কাজ করে যাচ্ছে। কারো খোদা নিছক অনিবার্য অস্তিত্ব অথবা সকল কার্যকারণের কারণ কিংবা প্রথম কার্যকারণ (First cause)। বিশ্ব জগতের ব্যবস্থাপনাকে একবার সচল করে দিয়ে সে আলাদা হয়ে গেছে। তারপর বিশ্ব-জাহান ধরাবাধা আইন মোতাবেক স্বয়ং চলছে। অতঃপর মানুষের সাথে তার ও তার সাথে মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। মোটকথা, খোদাকে মানে এমন সব কাফেরও আসলে ঐ আল্লাহ মানে না যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থাপনার শুধু স্রষ্টাই নন বরং তার সার্বক্ষণিক পরিচালক। তাঁর হুকুম এখানে প্রতি মুহূর্তেই চলছে। তিনি সকল প্রকার দোষ, ত্রুটি, দুর্বলতা ও ভ্রান্তি থেকে মুক্ত। তিনি সব রকমের উপমা ও সাকার সত্তা থেকে পবিত্র, নজীর, সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য মুক্ত এবং কোন সাথী, সহকারী ও অংশীদারের মুখাপেক্ষী নন। তাঁর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও মাবুদ হবার অধিকারে কেউ তাঁর সাথে শরীক নয়। তাঁর সন্তানাদি থাকা, কাউকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার এবং কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর সাথে কোন বিশেষ সম্পর্ক থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিটি সত্তার সাথে রিজিকদাতা, পালনকর্তা, অনুগ্রহকারী ও ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তিনি প্রার্থনা শোনেন ও তার জবাব দেন। জীবন-মৃত্যু, লাভ-ক্ষতি এবং ভাগ্যের ভাঙা-গড়ার পূর্ণ ক্ষমতার তিনিই একচ্ছত্র মালিক। তিনি নিজের সৃষ্টির কেবল পালনকর্তাই নন বরং প্রত্যেককে তার মর্যাদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী হিদায়তও দান করেন। তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল এতটুকুই নয় যে, তিনি আমাদের মাবুদ এবং আমরা তাঁর পূজাঅর্চনাকারী বরং তিনি নিজের নবী ও কিতাবের সাহায্যে আমাদের আদেশ নিষেধের বিধান দান করেন এবং তাঁর বিধানের আনুগত্য করাই আমাদের কাজ। নিজেদের কাজের জন্য তাঁর কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। মৃত্যুর পর তিনি পুনর্বার আমাদের ওঠাবেন এবং আমাদের কাজকর্ম পর্যালোচনা করে পুরস্কার ও শাস্তি দেবেন। এসব গুণাবলী সম্পন্ন মাবুদের ইবাদাত মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর অনুসারীরা ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ করছে না। অন্যেরা খোদার ইবাদাত করলেও আসল ও প্রকৃত খোদার ইবাদাত করছে না। বরং তারা নিজেদের উদ্ভাবিত কাল্পনিক খোদার ইবাদাত করছে।
সুরা: আল-কাফিরূন
আয়াত নং :-4
وَ لَاۤ اَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدْتُّمْۙ
আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করে আসছো।
সুরা: আল-কাফিরূন
আয়াত নং :-5
টিকা নং:4,
وَ لَاۤ اَنْتُمْ عٰبِدُوْنَ مَاۤ اَعْبُدُؕ
আর না তোমরা তাঁর ইবাদাত করবে যাঁর ইবাদাত আমি করি।৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) একদল তাফসীরকারের মতে এ বাক্য দু’টিতে প্রথম বাক্য দু’টির বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। প্রথম বাক্য দু’টিতে যা কিছু বলা হয়েছে তাকে অত্যধিক শক্তিশালী ও বেশী জোরদার করার জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু অনেক মুফাসসির একে পুনরাবৃত্তি বলে মনে করেন না। তারা বলেন, এর মধ্যে অন্য একটি কথা বলা হয়েছে। প্রথম বাক্য দু’টিতে যে কথা বলা হয়েছে তা থেকে একথার বক্তব্যই আলাদা। আমার মতে, এ বাক্য দু’টিতে আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি নেই, এতটুকু কথা সঠিক বলে মেনে নেয়া যায়।
কারণ এখানে শুধুমাত্র “আর না তোমরা তার ইবাদাত করবে যার ইবাদাত আমি করি” একথাটুকুর পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আর আগের বক্তব্যে একথাটি যে অর্থে বলা হয়েছিল এখানে সে অর্থে এর পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। কিন্তু পুনরাবৃত্তি অস্বীকার করার পর মুফাসসিরগণের এ দলটি এ দু’টি বাক্যের যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তা পরস্পর অনেক ভিন্নধর্মী। এখানে তাদের প্রত্যেকের বর্ণিত অর্থ উল্লেখ করে তার ওপর আলোচনা করার সুযোগ নেই। আলোচনা দীর্ঘ হবার আশঙ্কায় শুধুমাত্র আমার মতে যে অর্থটি সঠিক সেটিই এখানে বর্ণনা করলাম।
প্রথম বাক্যে বলা হয়েছেঃ “আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করে আসছো।” এর বক্তব্য দ্বিতীয় আয়াতের বক্তব্য বিষয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে বলা হয়েছেঃ “আর আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো।” এ দু’টি বক্তব্যে দু’টি দিক দিয়ে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এক, অমুক কাজ করি না বা করবো না বলার মধ্যে যদিও অস্বীকৃতি ও শক্তিশালী অস্বীকৃতি রয়েছে কিন্তু আমি অমুক কাজটি করবো না একথার ওপর অনেক বেশী জোর দেয়া হয়েছে। কারণ এর অর্থ হচ্ছে, সেটা এত বেশী খারাপ কাজ যে, সেটা করা তো দূরের কথা সেটা করার ইচ্ছা পোষণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দুই “যাদের ইবাদাত তোমরা করো” একথা বলতে কাফেররা বর্তমানে যেসব মাবুদের ইবাদাত করে শুধুমাত্র তাদেরকে বুঝায়। বিপরীতপক্ষে “যাদের ইবাদাত তোমরা করেছো” বললে এমন সব মাবুদদের কথা বুঝায় যাদের ইবাদাত কাফেররা ও তাদের পূর্বপুরুষরা অতীতে করেছে। একথা সবাই জানে, মুশরিক ও কাফেরদের মাবুদদের মধ্যে হামেশা রদবদল ও কমবেশী হতে থেকেছে। বিভিন্ন যুগে কাফেরদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন মাবুদের পূজা করেছে। সবসময় ও সব জায়গায় সব কাফেরের মাবুদ কখনো এক থাকেনি। কাজেই এখানে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আমি তোমাদের শুধু আজকের মাবুদদের থেকে নয়, তোমাদের পিতৃপুরুষের মাবুদদের থেকেও দায়মুক্ত। এ ধরনের মাবুদদের ইবাদাত করার চিন্তাও মনের মধ্যে ঠাঁই দেয়া আমার কাজ নয়।
আর দ্বিতীয় বাক্যটিতে এ ব্যাপারে বলা যায়, যদিও ৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত এ বাক্যটির শব্দাবলী ও ৩ নম্বর আয়াতের শব্দাবলী একই ধরনের তবুও এদের উভয়ের মধ্যে অর্থের বিভিন্নতা রয়েছে। তিন নম্বর আয়াতে সংশ্লিষ্ট বাক্যটি নিম্নোক্ত বাক্যটির পরে এসেছেঃ “আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো।” তাই এর অর্থ হয়, “আর না তোমরা সেই ধরনের গুণাবলী সম্পন্ন একক মাবুদের ইবাদাত করবে যার ইবাদাত আমি করি।” আর পাঁচ নম্বর আয়াতে এই সংশ্লিষ্ট বাক্যটি নিম্নোক্ত বাক্যটির পরে এসেছেঃ “আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করেছো।” তাই এর মানে হয় “আর না তোমরা সেই একক মাবুদের ইবাদাত করবে বলে মনে হচ্ছে যার ইবাদাত আমি করি।” অন্য কথায়, তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষরা যাদের যাদের পূজা-উপাসনা করেছো তাদের পূজারী হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর বহু মাবুদের বন্দেগী পরিহার করে একক মাবুদের ইবাদাত করার ব্যাপারে তোমাদের যে বিতৃষ্ণা সে কারণে তোমরা নিজেদের এ ভুল ইবাদাত-বন্দেগীর পথ ছেড়ে দিয়ে আমি যাঁর ইবাদাত করি তাঁর ইবাদাত করার পথ অবলম্বন করবে, এ আশাও করি না।
সুরা: আল-কাফিরূন
আয়াত নং :-6
টিকা নং:5,
لَكُمْ دِیْنُكُمْ وَ لِیَ دِیْنِ۠
তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন আমার জন্য।৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) অর্থাৎ আমার দ্বীন আলাদা এবং তোমাদের দ্বীন আলাদা। আমি তোমাদের মাবুদদের পূজা-উপাসনা-বন্দেগী করি না এবং তোমরাও আমার মাবুদের পূজা-উপাসনা করো না। আমি তোমাদের মাবুদদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগী করতে প্রস্তুত নও। তাই আমার ও তোমার পথ কখনো এক হতে পারে না। এটা কাফেরদের প্রতি উদারনীতি নয় বরং তারা কাফের থাকা অবস্থায় চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণাবাণী। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা দ্বীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না— এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। এ সূরার পরে নাযিল হওয়া কয়েকটি মক্কী সূরাতে পর পর এ দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষ প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সূরা ইউনুসে বলা হয়েছেঃ “এরা যদি তোমাকে মিথ্যা বলে তাহলে বলে দাও, আমার কাজ আমার জন্য এবং তোমাদের কাজ তোমাদের জন্য। আমি যা কিছু করি তার দায়-দায়িত্ব থেকে তোমরা মুক্ত।” (৪১ আয়াত) এ সূরাতেই তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলা হয়েছেঃ “হে নবী! বলে দাও, হে লোকেরা, যদি তোমরা আমার দ্বীনের ব্যাপারে (এখানে) কোন রকম সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে (শুনে রাখো), আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের বন্দেগী করছো আমি তাদের বন্দেগী করি না বরং আমি শুধুমাত্র সেই আল্লাহর বন্দেগী করি যার কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু।” (১০৪ আয়াত) সূরা আশ শু’আরায় বলেছেনঃ “হে নবী! যদি এরা এখন তোমার কথা না মানে তাহলে বলে দাও, তোমরা যা কিছু করছো তা থেকে আমি দায়মুক্ত।” (২১৬ আয়াত) সূরা সাবায় বলেছেনঃ এদেরকে বলো, আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছো সেজন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না। বলো, আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন।” (২৫-২৬ আয়াত) সূরা যুমার-এ বলেছেনঃ “এদেরকে বলো, হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা নিজেদের জায়গায় কাজ করে যাও। আমি আমার কাজ করে যেতে থাকবো। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর আসছে লাঞ্ছনাকর আযাব এবং কে এমন শাস্তি লাভ করছে যা অটল।” (৩৯-৪০ আয়াত) আবার মদীনা তাইয়েবার সমস্ত মুসলমানকেও এই একই শিক্ষা দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয়ঃ তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে রয়েছে একটি ভালো আদর্শ। (সেটি হচ্ছেঃ ) তারা নিজেদের জাতিকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমরা তোমাদের থেকে ও তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদদের পূজা করো তাদের থেকে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। আমরা তোমাদের কুফরী করি ও অস্বীকৃতি জানাই এবং যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনো ততক্ষণ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে গেছে।” (আল মুমতাহিনা ৪ আয়াত) কুরআন মজীদের একের পর এক এসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর তোমরা তোমাদের ধর্ম মেনে চলো এবং আমাকে আমার ধর্ম মেনে চলতে দাও- “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” -এর এ ধরনের কোন অর্থের অবকাশই থাকে না। বরং সূরা যুমার-এ যে কথা বলা হয়েছে, একে ঠিক সেই পর্যায়ে রাখা যায় যেখানে বলা হয়েছেঃ
“হে নবী! এদেরকে বলে দাও, আমি তো আমার দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁরই ইবাদাত করবো, তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে যার যার বন্দেগী করতে চাও করতে থাক না কেন।” ( ১৪-১৫ আয়াত)
এ আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেয়ী এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, কাফেরদের ধর্ম পরস্পর যতই বিভিন্ন হোক না কেন সামগ্রিকভাবে সমস্ত কাফেররা মূলত একই গোষ্ঠীভুক্ত। কাজেই তাদের মধ্যে যদি বংশ বা বিবাহের ভিত্তিতে অথবা অন্য কোন কারণে এমন কোন সম্পর্ক থাকে যা একের সম্পত্তিতে অন্যের উত্তরাধিকারী স্বত্ব দাবী করে তাহলে একজন খৃস্টান একজন ইহুদীর, একজন ইহুদী একজন খৃস্টানের এক ধর্মের কাফের অন্য ধর্মের কাফেরের উত্তরাধিকারী হতে পারে। বিপরীতপক্ষে ইমাম মালিক, ইমাম আওযায়ী ও ইমাম আহমাদের মতে এক ধর্মের লোকেরা অন্য ধর্মের লোকদের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে এমত পোষণ করেন। এ হাদীসের রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ لاَ يَتَوَارَثُ أَهْلُ مِلَّتَيْنِ شَتَّى “দুই ভিন্ন ধর্মের লোক পরস্পরের ওয়ারিশ হতে পারে না।” (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, দারে কুতনী)। প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী হযরত জাবের (রা.) থেকে, ইবনে হিব্বান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে এবং বাযযার আবু হুরাইরা (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ বিষয়টি আলোচনা প্রসঙ্গে হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম শাসসুল আয়েম্মা সারাখসী লিখেছেনঃ যে সমস্ত কারণে মুসলমানরা পরস্পরের ওয়ারিশ হয় সে সমস্ত কারণে কাফেররাও পরস্পরের ওয়ারিশ হতে পারে। আবার তাদের মধ্যে এমন কোন কোন অবস্থায়ও উত্তরাধিকার স্বত্ব জারী হতে পারে যে অবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে হয় না। …………………… প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে দ্বীন হচ্ছে দু’টি, একটি সত্য দ্বীন এবং অন্যটি মিথ্যা দ্বীন। তাই তিনি বলেছেনঃ لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ এই সাথে তিনি মানুষদের দু’দলে বিভক্ত করেছেন। একদল জান্নাতী এবং তারা হচ্ছে মু’মিন। একদল জাহান্নামী এবং সামগ্রিকভাবে তারা হচ্ছে কাফের সমাজ। এ দু’দলকে তিনি পরস্পরের বিরোধী গণ্য করেছেন তাই তিনি বলেছেনঃ هَذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ (এই দু’টি পরস্পর বিরোধীদল। এদের মধ্যে রয়েছে নিজেদের রবের ব্যাপারে বিরোধ।—– আল হজ্জ ১৯ আয়াত ) অর্থাৎ সমস্ত কাফেররা মিলে একটি দল। তাদের বিরোধ ঈমানদার বা মু’মিনদের সাথে।————–তাদের নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে আলাদা আলাদা মিল্লাতে তথা মানব গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে আমরা মনে করি না। বরং মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা সবাই একটি মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ মুসলমানরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত ও কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে। অন্যদিকে তারা এসব অস্বীকার করে। এজন্য তাদেরকে কাফের বলা হয়। মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা একই গোষ্ঠীভুক্ত হয় لَا يَتَوَارَثُ أَهْلُ مِلَّتَيْنِ হাদীসটি আমি ইতিপূর্বে যে কথার উল্লেখ করেছি সেদিকেই ইঙ্গিত করে। কারণ, “মিল্লাতাইন” (দুই মিল্লাত তথা দুই গোষ্ঠী) শব্দের ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর নিম্নোক্ত হাদীসের মাধ্যমে করে দিয়েছেনঃ
لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلاَ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ
অর্থাৎ “মুসলমান কাফেরের ওয়ারিশ হতে পারে না এবং কাফের হতে পারে না মুসলমানের ওয়ারিশ।” আল মাবসূত ৩ খণ্ড, ৩০-৩২পৃষ্ঠা। ইমাম সারাখসী এখানে যে হাদীসটির বরাত দিয়েছেন সেটি বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন।
ফী জিলালিল কুরআন:
শিরক ও তাওহীদের চূড়ান্ত ব্যবধান : তাওহীদ ও শিরিকের মধ্যে চুড়ান্ত ব্যবধান সৃষ্টির লক্ষে সূরার প্রথম সম্বোধনের সূচনাতেই এমন এক বাক্য সংযোজন করা হয়েছে যে, দুই পরস্পর বিরোধী বিচ্ছিন্ন মতাদর্শের মধ্যে কোনক্রমেই মিলের আশা করা যায়না। এ দুই বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন ও ভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে সন্ধি ও সমঝোতা আদৌ সম্ভবপর নয়। এরশাদ হচ্ছে যে, ‘আমার এবাদাত ও তোমাদের এবাদাত এক ধরনের নয়, আমার মাবুদ ও তোমাদের মাবুদও এক ও অভিন্ন নয় ।’ ‘আর তোমাদের এবাদাতের পদ্ধতি ও আমার এবাদাতের পদ্ধতি এক নয়, আর তোমাদের মাবুদ ও আমার মাবুদও এক এবং অভিন্ন নয় ।’ এটি দ্বারা প্রথম বাক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, এবং ‘আমি’ নামবাচক বিশেষ্যের উল্লেখ করে দৃঢ়তা এবং স্থায়িত্বের প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছে, আমিও কোনো অবস্থায়ই দেব-দেবী ও মূর্তিদের এবাদাতে লিপ্ত হতে পারি না। তোমাদের মনগড়া ও কল্পিত মিথ্যা মাবুদদেরকে আমার পক্ষে মাবুদ হিসাবে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এ আয়াতটি পুনরুল্পেখের মাধ্যমে দ্বিতীয় বাক্যটির প্রতি আরো অধিক জোর ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় একই বাক্য একাধিকবার উল্লেখের মাধ্যমে এর প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। এখানেও একই কথা বারবার উল্লেখ করে কথাটির গুরুত্ব পাঠকের মনে এতদূর বদ্ধমূল করতে চাওয়া হয়েছে যে, এ ব্যাপারে আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে। তাই বারংবার তাকিদ ও পুনরুল্লেখ করে হক ও বাতিলের সমঝোতা ও সন্ধির সকল সম্ভাবনার দ্বারকে কঠোরভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে। অতপর সামগ্রিকভাবে চূড়ান্ত ও প্রকৃত সত্য উদঘাটিত করে বলা হয়েছে, এ দুটোর মধ্যে এতো বেশী দূরত্ব বর্তমান যে কোনোক্রমেই এ’দুয়ের মধ্যে মিল, সমঝোতা ও সন্ধি হতে পারে না। সত্য ও মিথ্যা, ইসলাম ও কুফর, তাওহীদ ও শিরিকের মধ্যে এতো বিরাট ব্যবধান বিদ্যমান যে, এদু’য়ের মিলনের কোনো দৃষ্টান্তও নেই, আর এ দু’য়ের মধ্যে মিল ও সংমিশ্রণের কল্পনাও করা যায় না। এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, তোমাদের দ্বীন তোমাদের রীতি-নীতি পদ্ধতি ও আমার গৃহীত ও প্রচারিত দ্বীন, রীতি-নীতি ও পদ্ধতির মধ্যে কোনোক্রমেই সমঝোতা, সন্ধি ও মিল করা সম্ভব নয়, তখন তোমরা তোমাদের অবস্থানে থাকো, আমি আমার অবস্থানে দৃঢ়ভাবে থাকবো, তোমরা ওপারে থাকো, আমি এপারে আছি। এ দু’য়ের মিলের জন্য মাঝখানে কোনো মিলন-পথ ও সেতুবন্ধ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আর এ সূরায় উল্লেখিত পার্থক্য, ব্যবধান, স্বাতন্ত্র ও সুস্পষ্ট বিরোধ ও দূরত্বের ঘোষণা প্রদান, জীবন পথের নির্ভুল সন্ধান ও সঠিক দিশা প্রাপ্তির জন্য অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যকীয় ছিলো ৷ কারণ এ বিরোধ ও পার্থক্য এমনি মৌলিক যার মধ্যে মিলনের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণ সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়, অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার । এ দুটো সংঘাতমুখর পরস্পর বিরোধী মতাদর্শের মধ্যে কোনো মিল ও সেতুবন্ধনই সৃষ্টি করা যায় না। এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন ও চিরস্থায়ী । এ পার্থক্য মৌলিক চিন্তা-বিশ্বাসের পার্থক্য, মৌলিক অনুভুতি, জীবন বোধ, চেতনা, পদ্ধতি, আচরণ, প্রবৃত্তি ও পন্থার পার্থক্য । তাওহীদ এক স্বতন্ত্র চলার পথ ও শিরিক এক ভিন্নধর্মী চলার পথ। মানব প্রবৃত্তি ও জীবনধারার মধ্যে এ দুই বিপরীতমুখী মতাদর্শের অবস্থান কশ্মিনকালেও সম্ভব নয়, এ দু’য়ের একীভূত করাও কল্পনাতীত । তাওহীদ হচ্ছে শিরিকমুক্ত একত্ববাদের পথ। তাওহীদ হচ্ছে সমগ্র জীবনধারা আল্লাহমুখী হওয়ার পথ ৷ তাওহীদ-বিশ্বাস এমন এক চিন্তা, চেতনা, প্রত্যয় ও জীবনপদ্ধতি যা মানুষকে একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করে তোলে । মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, জীবনাদর্শ, মানদন্ড, মূল্যবোধ, অনুভুতি, চেতনা, শিষ্টাচার, আচরণ ও নৈতিকতা এবং চরিত্র সকল, পর্যায়ে তাওহীদের প্রভাবে ও বিশ্বাসের বুনিয়াদেই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাওহীদ এমন কেন্দ্রবিন্দু, যাকে কেন্দ্র করে সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়। তাওহীদ বিশ্বাস এমন এক নিয়ন্ত্রণকক্ষ, যা গোটা জীবনকেই নিয়ন্ত্রিত করে। এ তাওহীদ বিশ্বাসই এর প্রতি প্রত্যয়শীল প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ প্রাপ্তি ও আল্লাহর সাথে মিলনের তৃপ্তি ও স্বস্তি প্রদান করে। লা-শরীক আল্লাহ- একক অদ্বিতীয় । তাই তাওহীদে বিশ্বাসী মানুষ এক আল্লাহর পথকে জীবনপদ্ধতি হিসাবে বেছে নেয় এবং সে তাওহীদ ভিত্তিক জীবনাদর্শের প্রতি দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। তার বিশ্বাস ও চেতনায়, কর্ম প্রেরণায়, ক্রিয়াকান্ডে তার ভেতর ও বাহির সবকিছুই তাওহীদের আলোকে ও তাওহীদের প্রভাবেই পরিচালিত হয় । প্রকাশ্য ও গোপন সকল পর্যায়েই তাওহীদের প্রভা ও জ্যোতি দ্বারা জীবন উদ্ভাসিত হয়। তার ভেতর বাইর, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তাওহীদের সাথে শিরিকের জাল ও সংমিশ্রণ দ্বারা দূষিত ও প্রভাবিত হয় না। সে সহজ সরল পথেই সর্বদা জীবন অতিবাহিত করে। আর এ পার্থক্য আহবানকারী ও আহুতদের মধ্যে সুস্পষ্ট হওয়া জরুরী । এ পার্থক্য সুস্পষ্ট না হলে ইসলামী ও জাহেলী চিন্তা চেতনার মধ্যে মিশ্রণ ঘটে যেতে পারে। বিশেষ করে সে গোষ্ঠীর মাঝে এটি আরও পরিচ্ছন্ন হওয়া অপরিহার্য, যারা সঠিক আসসকীদার সাথে পরিচিত হওয়ার পর তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। আর তারা ছিলো এমন জনগোষ্ঠী, যারা মোমেন জনগোষ্ঠীর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে। নিছক অজ্ঞতা ও মূর্থতার কারণে সত্যকে বর্জন করেছে। এরা এমন দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলো যারা সঠিক আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কে সচেতন ছিলো না। তথাপি তারা মনে সহকরতো, তারা হেদায়াতের ওপরই প্রতিষ্ঠিত আছে। অবশ্য প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলো ন্যায়, সত্য ও হেদায়াত বর্জনকারী। তাদের আকীদা-বিশ্বাস ছিলো সংমিশ্রিত ৷ তাদের ক্রিয়াকান্ড ছিলো, ভাল-মন্দ মিশ্রিত । এতদসত্ত্বেও তারা অহমিকায় লিপ্ত ছিলো যে, তারাই সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথের অনুসারী । আর এ মিথ্যা অহমিকাই ছিলো তাদের বিভ্রান্তির বড় কারণ । এটিই ছিলো সবচেয়ে আশংকাজনক । জাহেলিয়াত, সম্পূর্ণটাই জাহেলিয়াত। আর ইসলাম সবটাই ইসলাম। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে ব্যবধান প্রচুর, দূরত্ব অনেক । ইসলামে প্রবেশ করতে হলে জাহেলিয়াত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হবে, আর ইসলামকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে। ইসলামকে গ্রহণ করতে হলে জাহেলিয়াতের সকল রজ্জুকে ছিন্ন করে এবং সকল প্রতিবন্ধকতা চূর্ণ বিচূর্ণ করে পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। ইসলামে দাখিল হওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, জাহেলিয়াতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে জেনে শুনে এবং সচেতনতার সাথে এবং স্বতস্ফূর্ত ও পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে জীবনের পদ্ধতি ও কর্মনীতি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে জাহেলিয়াতের সাথে সহ অবস্থানের কোনো মাঝামাঝি পথ ইসলামে নেই । জাহেলিয়াতের সহযোগিতার কোনো অবকাশ ইসলামে নেই । বরং জাহেলিয়াতকে বর্জন করে যে ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করবে তাকে জাহেলিয়াতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিপূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হতে হবে। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ও উভয়ের মধ্যে সমঝোতা ও সন্ধির মাধ্যমে মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বনের অনুমোদন ইসলামে নেই। ইসলামের সৌন্দর্যকে গ্রহণ করতে হলে জাহেলিয়াতকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের এ সুস্পষ্ট পার্থক্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভই এ দাওয়াতের সঠিক চেতনা ও উপলব্ধির বুনিয়াদী স্তম্ভ। জাহেলিয়াত একটি ভ্রান্ত নীতি; আর ইসলাম এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণাংগ জীবন দর্শন । তাই শেষোক্ত এ ঘোষণাই উচ্চারিত হয়েছে মোশরেকদের জন্য তাদের ধর্ম ও তাদের মতাদর্শ আর রসূলের জন্য রয়েছে তার নিজস্ব ধর্ম ও জীবন পদ্ধতি । মোশরেকরা তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করবে, আর রসূল (স.) তার নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ করবেন, তাদের জন্যে তাদের দ্বীন, আর রসূলের জন্য রসূলের দ্বীন। এ দুই জীবনধারা একই ধারায় প্রবাহিত হওয়া কখনও সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জীবনধারা অনুযায়ী চলবে । মোশরেকদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী উভয় মতাদর্শের মধ্যে কোনো সন্ধি প্রস্তাব কোনোমতেই অনুমোদনযোগ্য নয়। এক মতাদর্শের মধ্যে অন্য মতাদর্শের বিন্দুমাত্র অনুপ্রবেশের কোনো অবকাশ নেই । ইসলামকে গ্রহণ করতে হলে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে, আর বর্জন করতে হলেও পুরোপুরি বর্জন করতে হবে। এ সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত ঘোষণাই আয়াতে বলা হয়েছে। এ দ্ব্যর্থহীন চ্যালেঞ্জ যেমন তদানীন্তন যুগে ছিলো, আজকের যুগের দায়ী ইলাল্লাহর নিকটও এ ঘোষণা এক চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ। আজকের দিনেও এ চিরন্তন ব্যবধান ও পার্থক্য সমভাবে প্রযোজ্য । আজকেও যারা ইসলামের অনুসারী হওয়ার দাবীদার তাদেরকে অবশ্যই জাহেলী পরিবারের সকল বন্ধন ও প্রভাবমুক্ত হয়ে জাহেলিয়াতের সকল রজ্জু ছিন্ন করে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। অনেকেই এ সত্য উপলব্ধি করে এবং এ আকীদাকে বুঝে সত্য গ্রহণের প্রবল আকাংখা তার হৃদয়ে জাগ্রত হয় কিন্তু এরপর পুনরায় তার অন্তর পাষাণে পরিণত হয় এবং আবার তারা সীমালংঘন করে সত্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ‘অতপর তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেলো এবং তাদের অনেকেই সীমালংঘন করলো ।’ আর এ দুটি পরস্পর বিরোধী পথের মধ্যে মিশ্রণ ও মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বনের কোনো সুযোগ নেই। নেই শিরকের ত্রুটি সংস্কারের কোনো সুযোগ । নেই এ দুয়ের মিলনের কোনো পন্থা। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে পার্থক্য ও ব্যবধান দাওয়াতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্তমান । ইসলাম তার পরিপূর্ণ স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই টিকে আছে। জাহেলিয়াতের সাথে কোনোক্রমেই এবং কোনো স্তরেই তার কোনো মিল নেই । বলা হয়েছে আমার দ্বীন হচ্ছে নির্ভেজাল তাওহীদ ভিত্তিক দ্বীন ৷ এর চেতনা, আকীদা, পদ্ধতি, ধ্যান-ধারণা, আইন-বিধান, চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণ আল্লাহর দেয়া। এতে শিরকের বিন্দুমাত্র লেশ নেই। এর কোনো স্তরে এবং কোনো পর্যায়ে শিরকের কোনো স্পর্শও নেই৷ কোনো দূর্বল ধ্যান ধারণা, কোনো নমনীয়তা, শিরকের কোনো প্রকার মিশ্রণ, শিরকের কোনো প্রভাব ইসলামী দাওয়াতের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত হতে পারে না। ইসলামী জীবনাদর্শ, এর অদম্য সাহসিকতা, বীরত্বব্যঞ্জক মানসিকতা এবং আপোষহীন দৃঢ়তা, প্রচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র বজায় রাখা ছাড়া প্রতিষ্ঠিতই হতে পারেনা। তাই ইসলামী দাওয়াতের প্রথম স্তরেই এ চিরন্তনী ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হয়েছে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন, আর আমার জন্য আমার দ্বীন । এ দু’য়ের সংমিশ্রণ বা সমঝোতা ও সন্ধির কোনো পথই খোলা নেই ।
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২২/ এবং কাফের-রা বলে :-৪৫)
[#বলে দাও, হে কাফেররা!:-]
সুরা: ১০৯: আল-কাফিরূন
পারা:৩০
১-৬ নং আয়াতের বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও গুরুত্ব:
الكافرون শব্দটি كافر এর বহুবচন। অর্থ : কাফিররা, কাফির-দল। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাওয়াফ শেষে দু’রাকাত সালাতে সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাস পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হজ্জ হা. ১৪৮)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফজরের দুরাকাত সুন্নাতে এ সূরাদ্বয় পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ হা. ১২৫৬)
মাগরীবের পর দুরাকাত সুন্নাত সালাতে এ দুটি সূরা পড়ার কথাও বর্ণিত হয়েছে। (আহমাদ হা. ৪৭৬৩, সনদ সহীহ)। এছাড়া তিন রাকাতবিশিষ্ট বিতর সালাতের শেষের দু রাকাতে এ সূরাদ্বয় পাঠ করতেন।
ফারওয়া বিন নাওফেল আল-আশআরী (রাঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ)! যখন আমি বিছানায় ঘুমাতে যাব তখন কী বলব তা আমাকে শিক্ষা দিন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : তুমি সূরা কাফিরূন পড় এবং এর সমাপ্তির উপরেই ঘুমাও, কেননা তা শিরক থেকে সম্পর্ক ছিন্নকারী। (সহীহ, তিরমিযী হা. ৩৪০৩, আবূ দাঊদ হা. ৫০৫৫)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ সূরাটি হল মুশরিকরা যে-সব কাজ করে তা থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষণাকারী এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতি একনিষ্ঠতার আদেশ দানকারী সূরা। (ইবনু কাসীর)
তাফসীর:
এ সূরা কাফির-মুশরিকরা যে-সব আমল করে তা থেকে মুক্ত ঘোষণা করার সূরা এবং এতে ইখলাসের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
الكافرون দ্বারা সব কাফির সমাজ এতে শামিল, সে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক যাই হোক। যদিও এখানে বিশেষভাবে কুরাইশ কাফিরদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে। তারা নাবী (সাঃ)-কে প্রস্তাব দিয়েছিল যে, আপনি এক বছর আমাদের প্রতিমার পূজা করেন আরেক বছর আমরা আপনার মা‘বূদের পূজা করব। তখন এ সূরা নাযিল হয়। (ফাতহুল কাদীর, ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর।)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা শিখিয়ে দিলেন বলে দাও : তোমরা যে-সব মূর্তি ও বাতিল মা‘বূদের ইবাদত কর আমি তাদের ইবাদত করি না। আর আমি যে মা‘বূদের ইবাদত করি তোমরা সে মা‘বূদের ইবাদত কর না। তোমরা যার বা যাদের ইবাদত কর আমি তাদের থেকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিণভাবে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُلْ أَفَغَيْرَ اللّٰهِ تَأْمُرُوْنِّيْٓ أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجٰهِلُوْنَ بَلِ اللّٰهَ فَاعْبُدْ وَكُنْ مِّنَ الشّٰكِرِيْنَ)
“বল : ওহে মূর্খরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে বলছ? অতএব তুমি আল্লাহরই ইবাদত কর ও কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হও।” (সূরা যুমার ৩৯ : ৬৪, ৬৬)
সুতরাং কখনও মাসজিদে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত আবার কখনও মন্দিরে পূজো ইত্যাদি আচরণ ইসলাম বরদাশত করে না বরং সর্বদা এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَلَا لِلہِ الدِّیْنُ الْخَالِصُﺚ وَالَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِھ۪ٓ اَوْلِیَا۬ئَﺭ مَا نَعْبُدُھُمْ اِلَّا لِیُقَرِّبُوْنَآ اِلَی اللہِ زُلْفٰیﺚ اِنَّ اللہَ یَحْکُمُ بَیْنَھُمْ فِیْمَا ھُمْ فِیْھِ یَخْتَلِفُوْنَﹽ اِنَّ اللہَ لَا یَھْدِیْ مَنْ ھُوَ کٰذِبٌ کَفَّارٌ)
“জেনে রেখ, দৃঢ় আস্থার সাথে বিশুদ্ধ ‘ইবাদত একমাত্র আল্লাহরই জন্য। আর যারা আল্লাহকে ছেড়ে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছে এবং বলে যে, আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দেয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন সে বিষয়ে, যে বিষয়ে তারা নিজেদের মধ্যে দ্বিমত করেছে। আল্লাহ তো তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না, যে মিথ্যাবাদী কাফির।” (সূরা যুমার ৩৯: ৩)
(لَآ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ)
এ আয়াতটি দ্বিতীয়বার নিয়ে আসার চারটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে:
১. প্রথম বাক্যে মা‘বূদ আর দ্বিতীয় বাক্যে ইবাদতের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
২. প্রথম বাক্যে বর্তমান আর দ্বিতীয় বাক্যে ভবিষ্যত বুঝানো হয়েছে। এ কথা ইমাম বুখারীও বলেছেন।
৩. প্রথম বাক্যের তাকীদস্বরূপ দ্বিতীয় বাক্যের অবতারণা করা হয়েছে।
৪. আরবি ব্যাকরণ অনুপাতে প্রথম বাক্য ক্রিয়াবাচক আর দ্বিতীয় বাক্য নামবাচক। অর্থাৎ আমি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করি না এবং আমার নিকট থেকে কেউ এরূপ আশাও করতে পারে না। এ কথাটি ইমাম ইবনু তাইমিয়াহও সমর্থন করেন। (ইবনু কাসীর)
আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন : এরূপ কষ্টকল্পনার কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু তাকীদের জন্য একই বাক্য পুনরাবৃত্তি আরবি ভাষায় সাধারণ রীতি। এরূপ সূরা মুরসালাতে ও সূরা আর রহমানেও ব্যবহার করা হয়েছে। (তাফসীর ফাতহুল কাদীর, অত্র আয়াতের তাফসীর।)
এ আয়াত তাদের জন্য বড় শিক্ষা যারা ইসলামের সাথে অন্য তন্ত্র বা মতবাদকে সমন্বয় করে ইসলামকে মানতে চায়। অপারগতার দোহাই দিয়ে কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম মানা আর কিছু ক্ষেত্রে তাগুতকে মানা এটা তৎকালীন মুশরিকদের আচরণ। অতএব তাগুতের সাথে আপোষ করে কোন দিন তাওহীদের ওপর বহাল থাকা যায় না।
(لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ)
এর তাফসীর প্রসঙ্গে ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: এ বাক্যটি তেমন যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে:
(وَإِنْ كَذَّبُوْكَ فَقُلْ لِّيْ عَمَلِيْ وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ ج أَنْتُمْ بَرِيْ۬ئُوْنَ مِمَّآ أَعْمَلُ وَأَنَا بَرِيْءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ)
“এবং তারা যদি তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে তুমি বল: ‘আমার কর্ম আমার এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য। আমি যা করি সে বিষয়ে তোমরা দায়মুক্ত এবং তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমিও দায়মুক্ত।’ (সূরা ইউনুস ১০: ৪১)
সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমনের পর কোন ব্যক্তি ইসলাম মেনে না নিলে সে জাহান্নামে যাক আর যাই হোক সেজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দায়ী থাকবেন না।
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন : এখানে তাদের দীন বলতে মুশরিকদের কুফরীকে বুঝানো হয়েছে আর আমাদের দীন বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। এখানে دِيْنِ বলা হয়েছে ديني বলা হয়নি, কারণ এ সূরার সব কয়টি আয়াত نون বিশিষ্ট, তাই শেষ অক্ষরের ى অক্ষরটি বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। যেমন فهو يهدين এ আয়াত থেকে نون বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। (সহীহ বুখারী)
অত্র আয়াত দ্বারা অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগ খুঁজে থাকেন। মূলত এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে কাফির-মুশরিকরা যদি ইসলাম মেনে না নেয় তাহলে তাদের ধর্ম তারা পালন করুক, আর তোমরা ইসলামের বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করতে থাক। কাফিররা যেমন তাদের ধর্ম বর্জন করেনি তেমনি তোমরাও ইসলামের কোন বিধি-বিধান লংঘন করবেনা। সুতরাং এ আয়াত এ নির্দেশ দেয় না, কখনও ইসলাম মানব আর প্রয়োজন হলে মন্দিরে যাব আবার অসাম্প্রদায়িকতার দোহাই দিয়ে গীর্জায় যাব। বরং সকল ধর্ম বর্জন করে ইসলাম মেনে চলতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
এ সূরাগুলো যেমন সূরা ফাতিহা, কদর, কাফিরূন, নাসর, ইখলাস, ফালাক ও নাস এ সাতটি সূরা বিশেষভাবে পাঠ করে চারটি ‘কুল’ সূরার প্রতিটি ১ লক্ষবার পড়ে মৃতের নামে বখশে দেওয়া বিদআত। যাকে এদেশে কুলখানী বলা হয়। এগুলো একশ্রেণির নামধারী ধর্মব্যবসায়ী আলেম তৈরি করেছে যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাহ পরিপন্থী।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাফির-মুশরিকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত এ সূরা সে শিক্ষাই প্রদান করে।
২. বাতিলের সাথে কখনও আপোষ করা যাবে না।
৩. ‘ধর্ম যার যার, অনুষ্ঠান সবার’ একটি শিরকি ও কুফরী মতবাদ।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)। তাওয়াফের পর দুই রাকআত নামাযে এই সূরা এবং (আরবি) সূরা পাঠ করতেন। সহীহ মুসলিমেই হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফজরের দুই রাকআত সুন্নত নামাযেও এ সূরা দুটি পাঠ করতেন। মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফজরের পূর্বের দুই রাকআতে এবং মাগিরিবের পরের দুই রাকআ’তে (আরবি) এই সূরা দুইটি বিশেরও অধিকবার অথবা দশেরও অধিকবার পাঠ করতেন।
মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত নামাযে এবং মাগরিবের দুই রাকআত সুন্নাত নামাযে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে (আরবি) এবং এই সূরা দুটি চব্বিশ বার অথবা পঁচিশবার পড়তে দেখেছি।
মুসনাদে আহমদেরই অন্য এক রিওয়াইয়াতে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে এক মাস ধরে ফজরের পূর্বের দুই রাকআত নামাযে এবং মাগরিবের পরের দুই রাকআতে নামাযে (আরবি) এ সূরা দু’টি পাঠ করতে দেখেছেন। (এ হাদীসটি জামে তিরমিযী, সুনানে ইবনে মাজাহ এবং সুনানে নাসায়ীতেও রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন)
এই সূরাটি যে কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমতুল্য এ বর্ণনাটি ইতিপূর্বে গত হয়েছে। (আরবি) সূরাটিও একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।
মুসনাদে আহমদে হযরত নওফিল ইবনে মুআবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁকে (তাঁর পিতাকে) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যয়নব (রাঃ) কে তুমি তোমার কাছে নিয়ে প্রতিপালন কর।” নওফিলের (রাঃ) পিতা এক সময়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “মেয়েটি সম্পর্কে তুমি কি করেছো?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আমি তাকে তার মায়ের কাছে রেখে এসেছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “কেন রেখে এসেছো?” তিনি (নওফিল (রাঃ)-এর পিতা মুআবিয়া উত্তরে বললেনঃ “শয়নের পূর্বে পড়ার জন্যে আপনার কাছে কিছু ওয়াযীফা শিখতে এসেছি।” রাসূলুল্লাহ তখন বললেনঃ (আরবি) পাঠ করো, এতে শিরক থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে।”
হযরত জিবিল্লাহ ইবনে হা’রিসাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তুমি বিছানায় শয়ন করতে যাবে তখন। সূরাটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে। কেননা, এটা হলো শিরক হতে মুক্তি লাভের উপায়।” (এ হাদীসটি ইমাম আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আবদুর রহমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন বিছানায় শয়ন করতে যেতেন তখন (আরবি) সূরাটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করতেন। (এ হাদীসটিও ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত হারিস ইবনে জিবিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ “আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যা আমি ঘুমোবার সময় পাঠ করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যখন তুমি বিছানায় ঘুমোতে যাবে তখন (আরবি) পাঠ করবে। কেননা, এটা শিরক হতে মুক্তি লাভের উপায়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর
এই মুবারক সূরায় আল্লাহ তা’আলা মুশরিকদের আমলের প্রতি তাঁর অসন্তুষ্টির কথা ঘোষণা করেছেন এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে মক্কার কুরায়েশদেরকে সম্বোধন করা হলেও পৃথিবীর সমস্ত কাফিরকে এই সম্বোধনের আওতায় আনা হয়েছে। এই সূরার শানে নুযূল এই যে, কাফিররা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বললোঃ “এক বছর আপনি আমাদের মাবুদ প্রতিমাগুলোর ইবাদত করুন, পরবর্তী বছর আমরাও এক আল্লাহর ইবাদত করবো।” তাদের এই প্রস্তাবের জবাবে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা এ সূরা নাযিল করেন।
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ) কে আদেশ করছেনঃ তুমি বলে দাওঃ হে কাফিরগণ! না আমি তোমাদের উপাস্যদের উপাসনা করি, না তোমরা আমার মাবুদের উপাসনা কর। আর না আমি তোমাদের উপাস্যদেরকে উপাসনা করবো, তোমরা আমার মাবুদের উপাসনা করবে। অর্থাৎ আমি শুধু আমার মায়ূদের পছন্দনীয় পদ্ধতি অনুযায়ী তাঁরই উপাসনা করবো, তোমাদের পদ্ধতি তো তোমরা নির্ধারণ করে নিয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ তারা শুধু মনগড়া বিশ্বাস এবং খাহেশাতে নাফসানী বা কুপ্রবৃত্তির পিছনে পড়ে রয়েছে, অথচ তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের হিদায়াত বা পথ। নির্দেশ পৌছে গেছে।” (৫৩:২৩) অতএব, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সংস্পর্শ হতে নিজেকে সর্বপ্রকারে মুক্ত করে নিয়েছেন এবং তাদের উপাসনা পদ্ধতি ও উপাস্যদের প্রতি সর্বাত্মক অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। লক্ষ্যণীয় যে, প্রত্যেক ইবাদতকারীরই মাবুদ বা উপাস্য থাকবে এবং উপাসনার পদ্ধতি থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর উম্মত শুধু আল্লাহ তা’আলারই ইবাদত বা উপাসনা করেন। নবী করীমের (সঃ) অনুসারীরা তাঁরই শিক্ষা অনুযায়ী ইবাদত করে থাকে। এ কারণেই ঈমানের মূলমন্ত্র হলোঃ , (আরবি) অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর রাসূল।” পক্ষান্তরে কাফির মুশরিকদের উপাস্য বা মাবুদ আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন, তাদের উপাসনার পদ্ধতিও ভিন্ন ধরনের। আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতির সাথে তাদের কোনই সম্পর্ক নেই। এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ) কে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন কাফিরদেরকে জানিয়ে দেনঃ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্যে আমার দ্বীন। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে নবী (সঃ) যদি তারা তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তবে তাদেরকে বলে দাওঃ আমার আমল আমার জন্যে এবং তোমাদের আমল তোমাদের জন্যে, আমি যে আমল করি তা হতে তোমরা মুক্ত এবং তোমরা যে আমল কর তা হতে ক্ত।” (১০:৪১) আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমাদের কর্ম আমাদের জন্যে এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্যে।” (৪২:১৫) অর্থাৎ আমাদের কর্মের জন্যে তোমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না এবং তোমাদের কর্মের জন্যে আমাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে না।
সহীহ বুখারীতে এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হয়েছেঃ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন অর্থাৎ কুফর, আর আমার জন্যে আমার দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম। আয়াতের শব্দ হলো (আরবি) কিন্তু অন্যান্য আয়াতে যেহেতু এর উপর ওয়াকফ হয়েছে সেই হেতু এখানেও (আরবি) কে উহ্য রাখা হয়েছে। যেমন (আরবি) এবং (আরবি) এর মধ্যে (আরবি) কে উহ্য রাখা হয়েছে।
কোন কোন তাফসীরকারের মতে এ আয়াতের অর্থ হলোঃ আমি তোমাদের বর্তমান উপাস্যদের উপাসনা করি না, ভবিষ্যতের জন্যেও তোমাদেরকে হতাশ করছি যে, সমগ্র জীবনে ঐ কুফরী আমার (নবী (সঃ)-এর) দ্বারা কখনো সম্ভব হবে না। একইভাবে তোমরা আমার প্রতিপালকের ইবাদত বর্তমানেও কর না এবং ভবিষ্যতেও করবে না।
এখানে ঐ সব কাফিরকে বুঝানো হয়েছে যাদের ঈমান আনয়ন না করার ব্যাপার আল্লাহ তা’আলার জানা রয়েছে। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমার প্রতি যা কিছু অবতীর্ণ করা হয় ঐ ব্যাপারে তাদের অধিকাংশ হঠকারিতা ও কুফরীতে লিপ্ত হয়।” (৫:৬৮)
কোন কোন আরবী সাহিত্য বিশারদ হতে ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) উদ্ধৃত করেছেন যে, একটি বাক্যকে দু’বার গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে, অবশ্য কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।” আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই, আবার বলি তোমরা তো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যক্ষে।
আলোচ্য সূরায় একই রকম বাক্য দু’বার ব্যবহারের তিনটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ প্রথম বাক্যে উপাস্য এবং দ্বিতীয় বাক্যে ইবাদত বা উপাসনার পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ প্রথম বাক্যে বর্তমান এবং দ্বিতীয় বাক্যে ভবিষ্যৎ বুঝানো হয়েছে। তৃতীয়তঃ প্রথম বাক্যের তাগীদের জন্যেই দ্বিতীয় বাক্যের অবতারণা করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এখানে চতুর্থ একটি কারণ আবু অব্বিাস ইবনে তাইমিয়া (রঃ) তার কোন এক কিতাবে উল্লেখ। করেছেন। তিনি বলেনঃ আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় প্রথম বাক্য জুমলায়ে ফেলিয়া এবং দ্বিতীয় বাক্য জুমলায়ে ইসমিয়া অর্থাৎ আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করি না, আমার নিকট হতে অনুরূপ কোন আশাও কেউ করতে পারে না। এ উক্তিটিও ভালো বলেই মনে হয়। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ইমাম শাফিয়ী (রঃ) এ আয়াত থেকেই দলীল গ্রহণ করেছেন যে, কাফিররা। সবাই এক জাতি। এ কারণে ইয়াহূদীরা খৃস্টানদের এবং খৃস্টানরা ইয়াহূদীদের উত্তরাধিকারী হতে পারে। উভয়ের মধ্যে বংশগত ও কার্যকরণ গত সামঞ্জস্য ও অংশীদারিত্ব রয়েছে। এ কারণে ইসলাম ছাড়া কুফরীর যতগুলো পথ রয়েছে, বাতিল হিসেবে সবই এক ও অভিন্ন। ইমাম আহমদ (রঃ) এবং তাঁর অনুসারীদের মাযহাব এর বিপরীত। তাঁরা বলেন যে, ইয়াহূদীরা খৃষ্টানদের বা খৃষ্টানরা ইয়াহূদীদের উত্তরাধিকারী হতে পারবে না, কেননা, হাদীসে রয়েছে যে, দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী একে অন্যের অংশীদার ও উত্তরাধিকারী হতে পারে না।
(Book#1222/ And The Qafir Say:-45)
[ # Say, “O disbelievers,:-]
Surah.109: Al-Kaafiroon
Para:30 Ayat:- 1- 6
www.motaher21.net
109:1
قُلۡ یٰۤاَیُّہَا الۡکٰفِرُوۡنَ ۙ﴿۱﴾
Say, “O disbelievers,
The Declaration of Innocence from Shirk
This Surah is the Surah of disavowal (renunciation) from the deeds of the idolators. It commands a complete disavowal of that.
Allah’s statement,
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ
Say:O disbelievers!
includes every disbeliever on the face of the earth, however, this statement is particularly directed towards the disbelievers of the Quraysh.
It has been said that in their ignorance they invited the Messenger of Allah to worship their idols for a year and they would (in turn) worship his God for a year. Therefore, Allah revealed this Surah and in it
He commanded His Messenger to disavow himself from their religion completely
Allah said,
لَاا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ
109:2
لَاۤ اَعۡبُدُ مَا تَعۡبُدُوۡنَ ۙ﴿۲﴾
I do not worship what you worship.
I worship not that which you worship.
meaning, statues and rival gods.
وَلَا أَنتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ
109:3
وَ لَاۤ اَنۡتُمۡ عٰبِدُوۡنَ مَاۤ اَعۡبُدُ ۚ﴿۳﴾
Nor are you worshippers of what I worship.
Nor will you worship whom I worship.
and He is Allah Alone, Who has no partner. So the word Ma (what) here means Man (who).
Then Allah says,
وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدتُّمْ
109:4
وَ لَاۤ اَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدۡتُّمۡ ۙ﴿۴﴾
Nor will I be a worshipper of what you worship.
وَلَا أَنتُمْ
عَـبِدُونَ
مَا أَعْبُدُ
109:5
وَ لَاۤ اَنۡتُمۡ عٰبِدُوۡنَ مَاۤ اَعۡبُدُ ؕ﴿۵﴾
Nor will you be worshippers of what I worship.
And I shall not worship that which you are worshipping.
Nor will you worship whom I worship.
meaning, `I do not worship according to your worship, which means that I do not go along with it or follow it. I only worship Allah in the manner in which He loves and is pleased with.’
Thus, Allah says,
وَلَا أَنتُمْ عَـبِدُونَ مَأ أَعْبُدُ
(Nor will you worship whom I worship.)
meaning, `you do not follow the commands of Allah and His Legislation in His worship. Rather, you have invented something out of the promptings of your own souls.’
This is as Allah says,
إِن يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الاٌّنفُسُ وَلَقَدْ جَأءَهُم مِّن رَّبِّهِمُ الْهُدَى
They follow but a guess and that which they themselves desire, whereas there has surely come to them the guidance from their Lord! (53:23)
Therefore, the disavowal is from all of what they are involved. For certainly the worshipper must have a god whom he worships and set acts of worship that he follows to get to him. So the Messenger and his followers worship Allah according to what He has legislated. This is why the statement of Islam is
“There is no God worthy of being worshipped except Allah, and Muhammad is the Messenger of Allah.”
This means that there is no (true) object of worship except Allah and there is no path to Him (i.e., way of worshipping Him) other than that which the Messenger came with.
The idolators worship other than Allah, with acts of worship that Allah has not allowed. This is why the Messenger said to them,
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
109:6
لَکُمۡ دِیۡنُکُمۡ وَلِیَ دِیۡنِ ٪﴿۶﴾
For you is your religion, and for me is my religion.”
To you be your religion, and to me my religion.
This is similar to Allah’s statement,
وَإِن كَذَّبُوكَ فَقُل لِّى عَمَلِى وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ أَنتُمْ بَرِييُونَ مِمَّأ أَعْمَلُ وَأَنَاْ بَرِىءٌ مِّمَّا تَعْمَلُونَ
And if they belie you, say:
“For me are my deeds and for you are your deeds!
You are innocent of what I do, and I am innocent of what you do!” (10:41)
and He said,
لَنَأ أَعْمَـلُنَا وَلَكُمْ أَعْمَـلُكُمْ
To us our deeds, and to you your deeds. (28:55)
Al-Bukhari said,
“It has been said,
لَكُمْ دِينَكُمْ
(To you be your religion.) means disbelief.
وَلِىَ دِينِ
(and to me my religion.) means, Islam.
This is the end of the Tafsir of Surah Al-Kafirun, and all praise and blessings are due to Allah
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran