Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২৪)
[#শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা করা:-]
সুরা: ১১১: আল-মাসাদ (লাহাব)
পারা:৩০
১-৫ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
(Book#1224)
[ # Arrogance of Abu Lahab toward the Messenger:-]
Surah.111: Al-Masad
Para:30 Ayat:- 1- 5
www.motaher21.net
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১১১
(১১১-লাহাব) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের লাহাব (لَهَبٍ) শব্দকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(১১১-লাহাব) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এর মক্কী হবার ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। কিন্তু মক্কী যুগের কোন্ সময় এটি নাযিল হয়েছিল তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে আবু লাহাবের যে ভূমিকা এখানে দেখা গেছে তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, এ সূরাটি এমন যুগে নাযিল হয়ে থাকবে যখন রসূলের (সা.) সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে সে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি ইসলামের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধার সৃষ্টি করেছিল। সম্ভবত কুরাইশরা যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর বংশের লোকদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের শে’বে আবু তালেবে (আবু তালেব গিরিপথ) অন্তরীণ করেছিল এবং একমাত্র আবু লাহাবই তার বংশের লোকদেরকে পরিত্যাগ করে শত্রুদের সাথে অবস্থান করছিল, তখনই এ সূরাটি নাযিল হওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের এ অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, আবু লাহাব ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। আর ভাতিজার মুখে চাচার প্রকাশ্যে নিন্দাবাদ ততক্ষণ সংগত হতে পারতো না যতক্ষণ চাচার সীমা অতিক্রমকারী অন্যায়, জুলম ও বাড়াবাড়ি উন্মুক্তভাবে সবার সামনে না এসে গিয়ে থাকে। এর আগে যদি শুরুতেই এ সূরাটি নাযিল করা হতো তাহলে লোকেরা নৈতিক দিক দিয়ে একে ত্রুটিপূর্ণ মনে করতো। কারণ ভাতিজার পক্ষে এভাবে চাচার নিন্দা করা শোভা পায় না।
(১১১-লাহাব) : পটভূমি :
কুরআনে মাত্র এ একটি জায়গাতেই ইসলামের শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা করা হয়েছে। অথচ মক্কায় এবং হিজরতের পরে মদীনায়ও এমন অনেক লোক ছিল যারা ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যক্তিটির এমনকি বিশেষত্ব ছিল যে কারণে তার নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে? একথা বুঝার জন্য সমকালীন আরবের সামাজিক অবস্থা অনুধাবন এবং সেখানে আবু লাহাবের ভূমিকা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রাচীন যুগে যেহেতু সারা আরব দেশের সব জায়গায় অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, লুটতরাজ ও রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল এবং শত শত বছর থেকে এমন অবস্থা চলছিল যার ফলে কোন ব্যক্তির জন্য তার নিজের বংশ ও রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়- পরিজনের সহায়তা ছাড়া নিজের ধন-প্রাণ ও ইজ্জত-আবরুর হেফাজত করা কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। এজন্য আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে মহাপাপ মনে করা হতো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন আরবের ঐ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তাদের সরদাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব (হাশেমের ভাই মুত্তালিবের সন্তানরা) কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেনি বরং প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেনি। কুরাইশের অন্যান্য পরিবারের লোকেরাও রসূলুল্লাহর (সা.) রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের এ সমর্থন-সহযোগিতাকে আরবের নৈতিক ঐতিহ্যের যথার্থ অনুসারী মনে করতো। তাই তারা কখনো বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে এই বলে ধিক্কার দেয়নি যে, তোমরা একটি ভিন্ন ধর্মের আহবায়কের প্রতি সমর্থন দিয়ে নিজেদের পৈতৃক ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছো। তারা একথা জানতো এবং স্বীকারও করতো যে, নিজেদের পরিবারের একজন সদ্যস্যকে তারা কোনক্রমেই শক্রর হাতে তুলে দিতে পারে না। কুরাইশ তথা সমগ্র আরবের অধিবাসীরাই নিজেদের আত্মীয়ের সাথে সহযোগিতা করাকে একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করতো।জাহেলী যুগেও আরবের লোকেরা এ নৈতিক আদর্শকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতো। অথচ শুধুমাত্র একজন লোক ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এ আদর্শ ও মূলনীতি লংঘন করে। সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। রসূলের (সা.) পিতা এবং এ আবু লাহাব ছিল একই পিতার সন্তান। আরবে চাচাকে বাপের মতই মনে করা হতো। বিশেষ করে যখন ভাতিজার বাপের ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল তখন আরবীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী চাচার কাছে আশা করা হয়েছিল, সে ভাতিজাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু এ ব্যক্তি ইসলাম বৈরিতা ও কুফরী প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে এ সমস্ত আরবীয় ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছিল।মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সূত্রে ইবনে আব্বাস থেকে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বসাধারণের কাছে দাওয়াত পেশ করার হুকুম দেয়া হলো এবং কুরআন মজীদে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হলো: “সবার আগে আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখান।” এ নির্দেশ পাওয়ার পর সকাল বেলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠে বুলন্দ আওয়াজে চিৎকার করে বললেন يا صباحاه (হায়, সকাল বেলার বিপদ!) আরবে এ ধরনের আওয়াজ এমন এক ব্যক্তি দিয়ে থাকে যে ভোর বেলার আলো আঁধারীর মধ্যে কোন শত্রুদলকে নিজেদের গোত্রের ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে থাকে। রসূলুল্লাহর (সা.) এ আওয়াজ শুনে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কে আওয়াজ দিচ্ছে? বলা হলো মুহাম্মাদ (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আওয়াজ দিচ্ছেন। একথা শুনে কুরাইশদের সমস্ত পরিবারের লোকেরা দৌঁড়ে গেলো তাঁর দিকে । যে নিজে আসতে পারতো সে নিজে এসে গেলো এবং সে নিজে আসতে পারতো না সে তার একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল। সবাই পৌঁছে গেলে তিনি কুরাইশের প্রত্যেকটি পরিবারের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে বললেন: হে বনী হাশেম! হে বনী আবদুল মুত্তালিব! হে বনী ফেহর! হে বনী উমুক! হে বনী উমুক! যদি আমি তোমাদের এ কথা বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে রয়েছে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য, তাহলে আমার কথা কি তোমরা সত্য বলে মেনে নেবে? লোকেরা জবাব দিল, হ্যাঁ, আমরা কখনো আপনার মুখে মিথ্যা কথা শুনিনি। একথা শুনে তিনি বললেন: তাহলে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আগামীতে কঠিন আযাব আসছে। একথায় অন্য কেউ বলার আগে তাঁর নিজের চাচা আবু লাহাব বললো: تَبًّا لَكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا “তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি কি এজন্য আমাদের ডেকেছিলে?” অন্য একটি হাদীসে একথাও বলা হয়েছে, সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য একটি পাথর উঠিয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর ইত্যাদি)।ইবনে যায়েদ বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে: আবু লাহাব একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, যদি আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করি তাহলে এর বদলে আমি কি পাবো? তিনি জবাব দিলেন, অন্যান্য ঈমানদাররা যা পাবে আপনিও তাই পাবেন। আবু লাহাব বললো: আমার জন্য কিছু বাড়তি মর্যাদা নেই? জবাব দিলেন: আপনি আর কি চান? একথায় সে বললো: تَبَّا لَهَذَا الدِّيْنَ تَبَّا اَنْ اَكُوْنَ وَهَوْلَاءِ سَوَاءً “সর্বনাশ হোক এ দ্বীনের যেখানে আমি ও অন্যান্য লোকেরা একই পর্যায়ভুক্ত হবে।” (ইবনে জারীর) মক্কায় আবু লাহাব ছিল রসূলুল্লাহর (সা.) নিকটতম প্রতিবেশী । উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। এছাড়াও হাকাম ইবনে আস (মারওয়ানের বাপ), উকবা উবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা ও ইবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশী ছিল। এরা বাড়িতেও রসূলুল্লাহকে নিশ্চিন্তে থাকতে দিতো না। তিনি যখন নামায পড়তেন, এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হতো এরা হাঁড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিতো। রসূলুল্লাহ (সা.) বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, “হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?” আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন) প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ। যাতে রসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকী, ইবন আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির ও ইবনে হিশাম)।নবুওয়াত লাভের পূর্বে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই মেয়েকে আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। নবুওয়াতের পরে যখন তিনি ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন আবু লাহাব তার দুই ছেলেকে বলে, তোমরা মুহাম্মাদের (রসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়েদের তালাক না দিলে আমার পক্ষে তোমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত হারাম হয়ে যাবে। কাজেই দু’জনেই তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়। উতাইবা জাহেলিয়াতের মধ্যে খুব বেশী অগ্রসর হয়ে যায়। সে একদিন রসূলুল্লাহর (সা.) সামনে এসে বলে: আমি وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى এবং اَلَّذِى دَنَا فَتَدَلَّى অস্বীকার করছি। একথা বলে তাঁর দিকে থুথু নিক্ষেপ করে। থুথু তাঁর গায়ে লাগেনি। তিনি বলেন: হে আল্লাহ! তোমার কুকুরদের মধ্য থেকে একটি কুকুর এর ওপর চাপিয়ে দাও। এরপর উতাইবা তার বাপের সাথে সিরিয়া সফরে রওয়ানা হয়। সফরকালে রাতে তাদের কাফেলা এক জায়গায় অবস্থান করে। স্থানীয় লোকেরা জানায়, সেখানে রাতে হিংস্র জানোয়ারদের আনাগোনা হয়। আবু লাহাব তার কুরাইশী সাথীদের বলে, আমার ছেলের হেফাজতের ভালো ব্যবস্থা করো। কারণ আমি মুহাম্মাদের (সা.) বদ দোয়ার ভয় করছি। একথায় কাফেলার লোকেরা উতাইবার চারদিকে নিজেদের উটগুলোকে বসিয়ে দেয় এবং তারা নিজেরা ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে একটি বাঘ আসে। উটদের বেষ্টনী ভেদ করে উতাইবাকে ধরে এবং সেখানেই তাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে খেয়ে ফেলে (আল ইসতিআব লি ইবনে আবদিল বার, আল ইসাবা লি ইবনে হাজার, দালায়েলুন নুবুওয়া লি আবী নাঈম আল ইসফাহানী ও রওদুল উনুফ লিস সুহাইলী)। বর্ণনাগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন বর্ণনাকারী তালাকের ব্যাপারটি নবুওয়াতের ঘোষণার পরের ঘটনা বলেন। আবার কোন কোন বর্ণনাকারীর মতে “তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাব” এর নাযিলের পরই তালাকের ঘটনাটি ঘটে। আবার আবু লাহাবের এ তালাক দানকারী ছেলেটি উতবা ছিল না উতাইবা— এ ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর উতবা ইসলাম গ্রহণ করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক হাতে বাই’আত গ্রহণ করেন, একথা প্রামাণিত সত্য। তাই আবু লাহাবের তালাকদানকারী ছেলেটি যে উতাইবা ছিল, এতে সন্দেহ নেই।সে যে কেমন জঘন্য মানসিকতার অধিকারী ছিল তার পরিচয় একটি ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলে হযরত আবুল কাসেমের ইন্তিকালের পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে হযরত আবদুল্লাহরও ইন্তিকাল হয়। এ অবস্থায় আবু লাহাব তার ভাতিজার শোকে শরীক না হয়ে বরং আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌঁড়ে কুরাইশ সরদারদের কাছে পৌঁছে যায়। সে তাদেরকে জানায়: শোনো, আজ মুহাম্মাদের (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম নিশানা মুছে গেছে। তার এ ধরনের আচরণের কথা আমরা ইতিপূর্বে সূরা কাউসারের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করে এসেছি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে যেখানে ইসলামের দাওয়াত দিতে যেতেন আবু লাহাবও তাঁর পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে পৌঁছতো এবং লোকদের তাঁর কথা শুনার কাজে বাধা দিতো। রাবী’আহ ইবনে আব্বাদ আদদীলী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি একদিন আমার আব্বার সাথে যুল-মাজাযের বাজারে যাই। তখন আমার বয়স ছিল কম। সেখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামকে দেখি। তিনি বলছিলেন: “হে লোকেরা! বলো, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। একথা বললেই তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে।” এ সময় তাঁর পেছনে পেছনে এক ব্যক্তি বলে চলছিল, “এ ব্যক্তি মিথ্যুক, নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছে।” আমি জিজ্ঞেস করি, এ লোকটি কে? লোকেরা বললো ওঁর চাচা আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও বায়হাকী) এ একই বর্ণনাকারী হযরত রাবীআহ (রা.) থেকে আর একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম। তিনি প্রত্যেকটি গোত্রের শিবিরে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন: “হে বনী অমুক! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রসূল। তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছি, একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমরা আমাকে সত্য নবী বলে মেনে নাও এবং আমার সাথে সহযোগিতা করো। এভাবে আল্লাহ আমাকে যে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছেন তা আমি পূর্ণ করতে পারবো।” তাঁর পিছে পিছে আর একটি লোক আসছিল এবং সে বলছিল: “হে বনী অমুক! এ ব্যক্তি নিজে যে নতুন ধর্ম ও ভ্রষ্টতা নিয়ে এসেছে লাত ও উযযার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমাদের সেদিকে নিয়ে যেতে চায়। এর কথা একদম মেনো না এবং এর পেছনেও চলো না।” আমি আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম: এ লোকটি কে? তিনি বললেন: এ লোকটি ওঁরই চাচা আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও তাবারানী) তারেক ইবনে আবদুল্লাহ আল মাহারেবীর (রা.) রেওয়ায়াতও প্রায় এ একই ধরনের। তিনি বর্ণনা করেছেন: যুল মাজাযের বাজারে দেখলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের বলে যাচ্ছেন, “হে লোকেরা! তোমরা লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো, তাহলে সফলকাম হয়ে যাবে।” ওদিকে তাঁর পিছে পিছে একজন লোক তাঁকে পাথর মেরে চলছে। এভাবে তাঁর পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি বলে চলেছে, “এ মিথ্যুক, এর কথা শুনো না।” আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে? লোকেরা বললো: ওঁরই চাচা আবু লাহাব। (তিরমিযী)নবুওয়াতের সপ্তম বছরে কুরাইশদের সমস্ত পরিবার মিলে যখন বনি হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট করলো এবং এ পরিবার দু’টি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমর্থনে অবিচল থেকে আবু তালেব গিরিপথে অন্তরীণ হয়ে গেলো তখন একমাত্র আবু লাহাবই নিজের পরিবার ও বংশের সহগামী না হয়ে কুরাইশ কাফেরদের সহযোগী হলো। এ বয়কট তিন বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে অনেক সময় অনাহারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আবু লাহাবের ভূমিকা ছিল মারমুখী। বাইর থেকে মক্কায় কোন বাণিজ্য কাফেলা এলে আবু তালেব গিরিপথে অন্তরীণদের মধ্য থেকে কেউ তাদের কাছ থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে যেতো। আবু লাহাব তখন চিৎকার করে বনিকদেরকে বলতো: ওদের কাছে এতো বেশী দাম চাও যাতে ওরা কিনতে না পারে। এজন্য তোমাদের যত টাকা ক্ষতি হয় তা আমি দেবো। কাজেই তারা বিরাট দাম হাঁকতো। ক্রেতা মহাসংকটে পড়তো। শেষে নিজের অনাহারের কষ্ট বুকে পুষে রেখে খালি হাতে পাহাড়ে ফিরে যেতে হতো ক্ষুধা কাতর সন্তানদের কাছে। তারপর আবু লাহাব সেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই পণ্যগুলোই বাজার দরে কিনে নিতো। (ইবনে সা’দ ও ইবনে হিশাম)এ সূরায় যে ব্যক্তিটির নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে এগুলো ছিল তারই কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে এর প্রয়োজন এজন্য দেখা দিয়েছিল যে, মক্কার বাইরের আরবের যেসব লোকেরা হজ্বের জন্য আসতো অথবা বিভিন্ন স্থানে যেসব বাজার বসতো সেখানে যারা জমায়েত হতো, তাদের সামনে যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের চাচা তাঁর পিছনে ঘুরে ঘুরে তাঁর বিরোধিতা করতো তখন বাইরের লোকদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়তো। কারণ আরবের প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে কোন চাচা বিনা কারণে অন্যদের সামনে তার নিজের ভাতিজাকে গালিগালাজ করবে, তার গায়ে পাথর মারবে এবং তার প্রতি দোষারোপ করবে এটা কল্পনাতীত ছিল। তাই তারা আবু লাহাবের কথায় প্রভাবিত হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেতো। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার পর যখন আবু লাহাব রাগে অন্ধ হয়ে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতার ব্যাপারে তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে নিজের ভাতিজার শত্রুতায় অন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া নাম নিয়ে নিজের চাচার নিন্দা করার পর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীনের ব্যাপারে কারো মুখ চেয়ে কোন প্রকার সমঝোতা বা নরম নীতি অবলম্বন করবেন, এ আশা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেলো। যখন প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে রসূলের চাচার নিন্দা করা হলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো, এখানে কোন কিছু রেখে ঢেকে করার অবকাশ নেই। এখানে ঈমান আনলে পরও আপন হয়ে যায় এবং ইসলামের বিরোধিতা ও কুফরী করলে আপনও হয়ে যায় পর। এ ব্যাপারে অমুকের ছেলে, অমুকের ভাই বা অমুকের বাপের কোন গুরুত্ব নেই।
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,
تَبَّتْ یَدَاۤ اَبِیْ لَهَبٍ وَّ تَبَّؕ
ভেঙে গেছে আবু লাহাবের হাত এবং ব্যর্থ হয়েছে সে।১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা। তাকে আবু লাহাব বলে ডাকার কারণ, তার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল সাদা লালে মেশানো। লাহাব বলা হয় আগুনের শিখাকে। কাজেই আবু লাহাবের মানে হচ্ছে আগুনবরণ মুখ। এখানে তার আসল নামের পরিবর্তে ডাক নামে উল্লেখ করার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর একটি কারণ হচ্ছে এই যে, মূল নামের পরিবর্তে ডাক নামেই সে বেশী পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় কারণ, তার আবদুল উযযা (অর্থাৎ উযযার দাস) নামটি ছিল একটি মুশরিকী নাম। কুরআনে তাকে এ নামে উল্লেখ করা পছন্দ করা হয়নি। তৃতীয় কারণ, এ সূরায় তার যে পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে তার এ ডাক নামই বেশী সম্পর্কিত। تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ —এর অর্থ কোন কোন তাফসীরকার করেছেন, “ভেঙে যাক আবু লাহাবের হাত” এবং وَتَبٌ শব্দের মানে করেছেন, “সে ধ্বংস হয়ে যাক” অথবা “সে ধ্বংস হয়ে গেছে।” কিন্তু আসলে এটা তার প্রতি কোন ধিক্কার নয়। বরং এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী। এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীতকালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মানে, তার হওয়াটা যেন এত বেশী নিশ্চিত যেমন তা হয়ে গেছে। আর আসলে শেষ পর্যন্ত তাই হলো যা এ সূরায় কয়েক বছর আগে বর্ণনা করা হয়েছিল। হাত ভেঙে যাওয়ার মানে শরীরের একটি অংগ যে হাত সেটি ভেঙে যাওয়া নয়। বরং কোন ব্যক্তি যে উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যাওয়াই এখানে বুঝানো হয়েছে। আর আবু লাহাব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা জন্য যথার্থই নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার মাত্র সাত আট বছর পরেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সরদার নিহত হয়। তারা সবাই ইসলাম বিরোধিতা ও ইসলামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের সহযোগী ছিল। এ পরাজয়ের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সে এত বেশী মর্মাহত হয় যে, এরপর সে সাত দিনের বেশী জীবিত থাকতে পারেনি। তারপর তার মৃত্যুও ছিল বড়ই ভয়াবহ ও শিক্ষাপ্রদ। তার শরীরে সাংঘাতিক ধরনের ফুসকুড়ি (Malignant pustule) দেখা দেয়। রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। মরার পরও তিন দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষেনি। ফলে তার লাশে পচন ধরে। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। শেষে লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে। একটি বর্ণনা অনুসারে তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে তার লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশীকে নিয়োগ করে এবং তারা তার লাশ দাফন করে। অন্য এক বর্ণনা অনুসারে, তারা গর্ত খুঁড়ে লম্বা লাঠি দিয়ে তার লাশ তার মধ্যে ফেলে দেয় এবং ওপর থেকে তার ওপর মাটি চাপা দেয়। যে দ্বীনের অগ্রগতির পথরোধ করার জন্য সে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তার সন্তানদের সেই দ্বীন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার আরো বেশী ও পূর্ণ পরাজয় সম্পন্ন হয়। সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মু’আত্তাব হযরত আব্বাসের (রা.) মধ্যস্থতায় রসূলুল্লাহর (সা.) সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাতে বাইআত করেন।
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
আয়াত নং :-2
টিকা নং:2,
مَاۤ اَغْنٰى عَنْهُ مَالُهٗ وَ مَا كَسَبَؕ
তার ধন-সম্পদ এবং যা কিছু সে উপার্জন করেছে তা তার কোন কাজে লাগেনি।২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) আবু লাহাব ছিল হাড়কৃপণ ও অর্থলোলুপ। ইবনে আসীরর বর্ণনা মতে, জাহেলী যুগে একবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, সে কা’বা শরীফের কোষাগার থেকে দু’টি সোনার হরিণ চুরি করে নিয়েছে। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে সেই হরিণ দু’টি অন্য একজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তবুও তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনার ফলে তার সম্পর্কে মক্কার লোকদের মনোভাব উপলব্ধি করা যায়। তার ধনাঢ্যতা সম্পর্কে কাজী রশীদ ইবনে যুবাইর তাঁর “আযযাখায়ের ওয়াত’তুহাফ” (الذَّخَايِّرَ وَالتَّحَفْ) গ্রন্থে লিখেছেনঃ কুরাইশদের মধ্যে যে চারজন লোক এক কিনতার (এক কিনতার = দু’শো আওকিয়া আর এক আওকিয়া = সোয়া তিন তোলা, কাজেই এক কিনতার সমান ৮০ তোলার সেরের ওজনে ৮ সের ১০ তোলা) সোনার মালিক ছিল আবু লাহাব তাদের একজন। তার অর্থলোলুপতা কি পরিমাণ ছিল বদর যুদ্ধের সময়ের ঘটনা থেকে তা আন্দাজ করা যেতে পারে। এ যুদ্ধে তার ধর্মের ভাগ্যের ফায়সালা হতে যাচ্ছিল। কুরাইশদের সব সরদার এ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য রওয়ানা হয়। কিন্তু আবু লাহাব নিজে না গিয়ে নিজের পক্ষ থেকে আস ইবনে হিশামকে পাঠায়। তাকে বলে দেয়, তার কাছে সে যে চার হাজার দিরহাম পায় এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে এর বদলে তার সেই ঋণ পরিশোধ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। এভাবে সে নিজের ঋণ আদায় করার একটা কৌশল বের করে নেয়। কারণ আস দেওলিয়া হয়ে গিয়েছিল। ঋণ পরিশোধের কোন ক্ষমতাই তার ছিল না।
কোন কোন তাফসীরকার مَا كَسَبَ শব্দটিকে উপার্জন অর্থে নিয়েছেন। অর্থাৎ নিজের অর্থ থেকে সে যে মুনাফা অর্জন করেছে তা তার উপার্জন। আবার অন্য কয়েকজন তাফসীরকার এর অর্থ নিয়েছেন সন্তান-সন্ততি। কারণ রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সন্তানরা মানুষের উপার্জন (আবু দাউদ ও ইবনে আবী হাতেম)। এ দু’টি অর্থই আবু লাহাবের পরিণতির সাথে সম্পর্কিত। কারণ সে মারাত্মক ফুসকুড়ি রোগে আক্রান্ত হলে তার সম্পদ তার কোন কাজে লাগেনি এবং তার সন্তানরাও তাকে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করার জন্য ফেলে রেখে দিয়েছিল। তার ছেলেরা তার লাশটি মর্যাদা সহকারে কাঁধে উঠাতেও চাইল না। এভাবে এ সূরায় আবু লাহাব সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা সত্য হতে দেখলো।
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
আয়াত নং :-3
سَیَصْلٰى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍۚۖ
অবশ্যই সেই লেলিহান আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
আয়াত নং :-4
টিকা নং:3, 4,
وَّ امْرَاَتُهٗ١ؕ حَمَّالَةَ الْحَطَبِۚ
এবং (তার সাথে) তার স্ত্রীও,৩ লাগানো ভাঙানো চোগলখুরী করে বেড়ানো যার কাজ,৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল “আরদায”। “উম্মে জামীল” ছিল তার ডাক নাম। সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে সে তার স্বামী আবু লাহাবের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না। হযরত আবু বকরের (রা.) মেয়ে হযরত আসমা (রা.) বর্ণনা করেছেনঃ এ সূরাটি নাযিল হবার পর উম্মে জামীল যখন এটি শুনলো, সে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খোঁজে বের হলো। তার হাতের মুঠোয় পাথর ভরা ছিল, রসূলুল্লাহকে ﷺ গালাগালি করতে করতে নিজের রচিত কিছু কবিতা পড়ে চলছিল। এ অবস্থায় সে কা’বা ঘরে পৌঁছে গেলো। সেখানে রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আবু বকরের (রা.) সাথে বসেছিলেন। হযরত আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রসূল! দেখুন সে আসছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে আপনাকে দেখে কিছু অভদ্র আচরণ করবে। তিনি বললেন, সে আমাকে দেখতে পাবে না। বাস্তবে হলোও তাই। তাঁর উপস্থিতি সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পেলো না। সে আবু বকরকে (রা.) জিজ্ঞেস করলো, শুনলাম তোমার সাথী আমার নিন্দা করেছে। হযরত আবু বকর (রা.) জবাব দিলেনঃ এ ঘরের রবের কসম, তিনি তো তোমার কোন নিন্দা করেননি। একথা শুনে সে ফিরে গেলো— (ইবনে আবু হাতেম, সীরাতে ইবন হিশাম। বাযযারও প্রায় একই ধরনের একটি রেওয়ায়াত হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন)। হযরত আবু বকরের (রা.) এ জবাবের অর্থ ছিল, নিন্দা তো আল্লাহ করেছেন রসূলুল্লাহ ﷺ করেননি।
টিকা:৪) মূল শব্দ হচ্ছে حَمَّالَةَ الْحَطَبِ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, “কাঠ বহনকারিনী।” মুফাসসিরগণ এর বহু বর্ণনা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে যায়েদ, যাহহাক ও রাবী ইবনে আনাস বলেনঃ সে রাতের বেলা কাঁটা গাছের ডালপালা এনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরজায় ফেলে রাখতো। তাই তাকে কাঠ বহনকারিনী বলা হয়েছে। কাতাদাহ, ইকরামা, হাসান বসরী, মুজাহিদ ও সুফিয়ান সওরী বলেনঃ সে লোকদের মধ্যে ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য চোগলখুরী করে বেড়াতো। তাই আরবী প্রবাদ অনুযায়ী তাকে কাঠ বহনকারিনী বলা হয়েছে। কারণ যারা এর কথা ওর কাছে বলে এবং লাগানো ভাঙানোর কাজ করে ফিতনা-ফাসাদের আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করে আরবরা তাদেরকে কাঠ বহনকারিনী বলে থাকে। এ প্রবাদ অনুযায়ী “হাম্মালাতাল হাতাব” শব্দের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে, “যে লাগানো ভাঙানোর কাজ করে।” সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেনঃ যে ব্যক্তি নিজের পিঠে গোনাহের বোঝা বহন করে আরবী প্রবাদ অনুসারে তার সম্পর্কে বলা হয়, فٌلَانٌ يُحْطَتِبُ عَلَى ظَهْرِهِ (অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি নিজের পিঠে কাঠ বহন করছে)। কাজেই হাম্মালাতাল হাতাব (حَمَّالَةَ الْحَطَبِ) মানে হচ্ছে, “গোনাহের বোঝা বহনকারিনী।” মুফাসসিরগণ এর আরো একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন। সেটি হচ্ছে, আখেরাতে তার এ অবস্থা হবে। অর্থাৎ সেখানে যে আগুনে আবু লাহাব পুড়তে থাকবে তাতে সে (উম্মে জামীল) কাঠ বহন করে এনে ফেলতে থাকবে।
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
আয়াত নং :-5
টিকা নং:5,
فِیْ جِیْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ۠
তার গলায় থাকবে খেজুর ডালের আঁশের পাকানো শক্ত রশি।৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) তার গলার জন্য জীদ (جيد) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় যে গলায় অলংকার পরানো হয়েছে তাকে জীদ বলা হয়। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, হাসান বসরী ও কাতাদা বলেনঃ এ হার বিক্রি করে আমি এর মূল্য বাবদ পাওয়া সমস্ত অর্থ মুহাম্মাদের ﷺ বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কাজ করার জন্য ব্যয় করবো। এ কারণে জীদ শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যঙ্গার্থে। অর্থাৎ এ অলংকার পরিহিত সুসজ্জিত গলায়, যেখানে পরিহিত হার নিয়ে সে গর্ব করে বেড়ায়, কিয়ামতের দিন সেখানে রশি বাঁধা হবে। এটা ঠিক সমপর্যায়েরই ব্যাঙ্গাত্মক বক্তব্য যেমন কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছেঃ بَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ “তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।”
তার গলায় বাঁধা রশিটির জন্য حَبْلٌ مِنْ مَسَدٍ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ সে রশিটি হবে ‘মাসাদ’ ধরনের। অভিধানবিদ ও মুফাসসিরগণ এ শব্দটির বহু অর্থ বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কিত একটি বক্তব্য হচ্ছে, খুব মজবুত করে পাকানো রশিকে মাসাদ বলা হয়। দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, খেজুর গাছের (ডালের) ছাল থেকে তৈরি রশি মাসাদ নামে পরিচিত। এ সম্পর্কে তৃতীয় বক্তব্য হচ্ছে, এর মানে খেজুরের ডালের গোড়ার দিকের মোটা অংশ থেঁতলে যে সরু আঁশ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাকানো রশি অথবা উটের চামড়া বা পশম দিয়ে তৈরি রশি। আর একটি বক্তব্য হচ্ছে, এর অর্থ লোহার তারের পাকানো রশি।
সুরা: আল-মাসাদ (লাহাব)
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১১১
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : আবু লাহাব, তার নাম ছিলো আবদুল ওযযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব । সে ছিলো প্রিয় নবী(স.)-এর চাচা । প্রভাতকালীন সূর্যের লালিমার মতো উজ্জল ও সুন্দর ছিলো তার মুখমন্ডল-এ কারণে তাকে ‘আবু লাহাব’ বলা হতো । তার স্ত্রীর নাম ছিলো ‘আরদা’ ৷ অত্যধিক সুন্দরী হওয়ার কারণে তাকে ‘উম্মে জামিল’ নামেও ডাকা হতো । তারা ছিলো রাসলুল্লাহ (স.)-এর উপস্থাপিত দাওয়াতের পরম শত্রু ও বিরোধিতাকারী ৷ আবূ লাহাব ও তার স্ত্রীই ছিলো রসূলের প্রতি সর্বাধিক অত্যাচারী ও যন্ত্রণাদানকারী । রসূলুল্লাহ (স.)-এর প্রসিদ্ধ জীবনীকার এঁতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেন, আমার কাছে হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ আমি রাবিয়া ইবনে ইবাদুদ দায়েলীকে বলতে শুনেছি, আমি ও আমার পিতা একজন সুশ্রী যুবককে সাথে নিয়ে একদিন ভোর বেলা রসূলুল্লাহ (স.) ও তার সংগী একদল লোকের সাথে পথ অতিক্রম করছিলাম; এমন সময় অপূর্ব সুন্দর চেহারার এক ব্যক্তিকে রসূলের পেছনে দেখতে পেলাম । রসূলুল্লাহ (স.) গোত্রের লোকদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “হে অমুক গোত্রের জনমন্ডলী আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত রসূল । আল্লাহ তায়ালা হুকুম করেছেন, তোমরা একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করবে, আল্লাহর সাথে কোনো প্রকার শিরক করবে না, তোমরা আমার রেসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, আমার আনুগত্য করবে । আমি তোমাদেরকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দান করবো, যাতে করে আমার ওপর আল্লাহর অর্পিত সে দায়িত্ব সম্পাদন করে যেতে পারি, যে পায়গাম সহ আল্লাহ তায়ালা আমাকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর রসুল যখন তার ভাষণ সমাপ্ত করলেন, তখন রসূলের পেছন থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠলোঃ “হে অমুক গোত্রের জনমন্ডলী! এ ব্যক্তি তোমাদেরকে তোমাদের মাবুদ লাত, ওযযা ও তোমাদের দেবদেবীদের থেকে আলাদা করতে চাচ্ছে। তোমাদের সাথে বনু আকমাস গোত্রের সাথে সংঘাত ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে, সে এক অদ্ভুত ও অভিনব কথাবার্তা ও ধর্ম নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের পূর্ববর্তী বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও চেতনার বিলুপ্তি সাধন করবে। তোমাদেরকে সতর্ক করছি, তোমরা তার কথায় কর্ণপাত করো না, তার অনুসরণ করোনা ৷ আমি তখন আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে পিতা! (আল্লাহর রসূলের প্রকাশ্য বিরোধীতাকারী) এ সুন্দর যুবকটি কে? পিতা বললেন, ‘এ হচ্ছে রসূলুল্লাহ (স.) এর চাচা আবু লাহাব ।’ (আহমাদ ও তিবরানী)। রসূলুল্লাহ (স.) ও তার দাওয়াতের বিরোধীতা ও চক্রান্ত সম্পর্কে আবু লাহাবের এমনি অসংখ্য ঘটনার বিবরণ ও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিল কর্তৃক রসূলুল্লাহ (স.)-এর ওপর পাশবিক নির্যাতন, বিরোধিতা, শত্রুতা ও জঘন্য নির্মম আচরণের বর্ণনা আরওয়াহ বিনতে হারব ইবনে উমাইয়ার বর্ণনা থেকেও পাওয়া যায় । এ আরওয়াহ ছিলো আবু সুফিয়ানের বোন । আবু লাহাব রসূলুল্লাহ (স.)-এর দাওয়াতের সূচনালগ্ন থেকেই প্রচন্ড শত্রুতা ও বিরোধীতার এ জঘন্য তৎপরতাকে অব্যাহত রাখে। ইমাম বোখারী (র.) বিশুদ্ধ বর্ণনা সূত্রে এ হাদীসটি সংকলিত করেছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একদা নবী করীম (স.) বাত্হায় গমন করে পর্বত শৃংগে (আবু কোবায়েস পর্বতের ওপর) আরোহণ করেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ‘ইয়া সাববাহ’ বলে উচ্চ স্বরে চীৎকার শুরু করলে কোরায়শরা পর্বতের পাদদেশে সমবেত হয়। আল্লাহর রসূল (স.) সমবেত জনমন্ডলীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি যদি তোমাদেরকে বলি (এ পর্বতের আড়ালে) একদল শত্রু তোমাদের ধ্বংস সাধনের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে, তবে কি তোমরা আমার কথাকে সত্য মনে করবে? তখন সকলেই সমস্বরে বললো, হাঁ, অবশ্যই আমরা তা সত্য বলে বিশ্বাস করবো। (কেননা ইতিপূর্বে আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি) । তাদের এ জবাবের পর আল্লাহর রসুল (স.) পুনরায় তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি তোমাদের সতর্ককারী । আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের জন্য কঠিন আযাব অপেক্ষা করছে। সাথে সাথে আবু লাহাব (রাগত স্বরে রূঢ় কণ্ঠে) বললো, তুমি ধ্বংস হও, এ জন্যই কি তুমি (চীৎকার করে) আমাদেরকে ডেকেছিলে? রসূলুল্লাহ (স.)-এর প্রতি আবু লাহাবের রূঢ় আচরণ ও অভিশাপের জবাবে আল্লাহ্ তায়ালা এ পূর্ণ সূরা লাহাব অবতীর্ণ করেন। অপর বর্ণনায় রয়েছে, রসূলুল্লাহ্ (স.)-এর উক্তির পর আবু লাহাব উত্তেজিত হয়ে হাত নাড়িয়ে রসূলকে লক্ষ্য করে বললো তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হও, (সর্বদা তুমি ধ্বংসে পতিত হও) তুমি কি এ উদ্দেশ্যেই আমাদেরকে একত্রিত করেছো? আবু লাহাবের এ উক্তি প্রসংগেই আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা লাহাব নাযিল করেছেন। বনু হাশেমের লোকেরা রসূলুল্লাহ (স.)-এর উপস্থাপিত ইসলামে দীক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ (স.)-এর ওপর যে কোনো ধরনের কষ্ট ও নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য আবু তালেবের নেতৃত্বে অংগীকারাবদ্ধ হলো এবং তারা সম্মিলিত ভাবে রসূলের সাহায্য ও নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি লিখিত চুক্তিনামায়ও স্বাক্ষর করে। রসূলুল্লাহ (স.)-এর দুই কন্যা রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুম নবুওত যুগের পূর্বে আবু লাহাবের দুই পুত্র ওত্বা ও ওতাইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। ওহী অবতীর্ণের পর আল্লাহর রসূল (স.) ইসলামের দাওয়াত প্রদান করা শুরু করলেই আবু লাহাব তার পুত্রদ্বয়কে রসূল (স.) দুহিতাদেরকে তালাক দানের কড়া নির্দেশ প্রদান করে এবং রসূলুল্লাহ (স.)-এর মতোই রসূলের কন্যাদেরকেও নিষ্ঠুর আচরণ ও যন্ত্রণা দিতে থাকে। এ ভাবে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিল প্রিয়নবী (স.)-এর জাত শত্রুতে পরিণত হয়। বিভিন্নভাবে ইসলামী দাওয়াতের বিরোধিতা, প্রতিরোধ ও রসূলের প্রতি নির্যাতনমূলক তৎপরতাকে আরো জোরদার করে । রসূলের বাসগৃহটি ছিলো আবু লাহাবের ঘরের খুবই কাছে। আর এ কারণে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী আল্লাহর রসূলকে নানাভাবে কঠোর যন্ত্রণা ও কষ্ট দিতে থাকে । কোনো কোনো বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, যে কূটনী উম্মে জামিল কাঁটার ডাল বহন করে এনে রসূলের ঘরের দরজায় বিছিয়ে রাখতো । রসূলের চলার পথে কাটা বিছিয়ে যন্ত্রনা ও কষ্ট দেয়ার কারণেই এ সূরায় উম্মে জামিলকে কাটাযুক্ত কাঠের বোঝা বহনকারিণী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধে অভিশপ্ত আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিলের এ নিষ্ঠুর পাশবিক আচরণ ও প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণার কারণেই আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং রসূলের অভিভাবকত্বের দায়িত্বের ঘোষণা দিয়ে রসূলের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং আবু লাহাব দম্পতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধের ঘোষণা ও ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী সহ সূরা ‘লাহাব’ অবতীর্ণ করেন৷
ফী জিলালিল কুরআন:
এরশাদ হচ্ছে, ‘তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাব’ । প্রথম ‘তাব্বাত’ শব্দটি দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রসুলের শানে দুর্বৃত্ত আবু লাহাবের চরম বেয়াদবী, রসূলের প্রতি আবু লাহাবের অভিশাপের প্রতিবাদে আবু লাহাবের প্রতি পাল্টা লা’নত ও বদদোয়া তথা অভিশাপের চূড়ান্ত ঘোষণা এবং আল্লাহর ঘোষিত লা’নত যে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হবে এবং নিশ্চিতভাবে আবু লাহাব দম্পতি আল্লাহর গযবে পতিত হবে, তারই নিশ্চয়তা ঘোষণা করা হয়েছে। ‘তাব্বুন’ শব্দের অর্থ হলো, ধ্বংস হওয়া, চূর্ণ বিচর্ণ হওয়া ও ছিন্নভিন্ন হওয়া । আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অত্যন্ত দৃঢ়তা ও গুরুত্ব সহকারে ইসলামী দাওয়াতের বিরোধীতাকারী ব্যক্তিটির ধ্বংসাত্মক কথা উল্লেখ করেছেন। সরওয়ারে কায়েনাত(স.)এর ওপর নির্যাতন, শত্রুতায় লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ্ তায়ালা স্বয়ং আবু লাহাব ও উন্মে জামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিরোধের সুনিশ্চিত ঘোষণা দিয়েছেন অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস কিভাবে এবং কিভাবে তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলবে তার স্তর ও পর্যায়ক্রমিক বিবরণও প্রদান করেছেন। তাদের শক্তি সামর্থ, ধন সম্পদ, সৌন্দর্য, বীরত্ব, ও বাহাদুরী কোনো কিছুই তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। নিশ্চিতভাবে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘অবশ্যই ধ্বংস হলো তাদের উভয় হাত এবং তারা উভয়েই ধ্বংস হলো ।’ অর্থাৎ তারা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস ও চূর্ণ বিচুর্ণ হয়েই যাবে। তাদের অগাধ ধন সম্পদ তাদের কোনো কাজেই লাগবে না। তাদের কোনো চেষ্টা সাধনা বা কোনো উদ্যোগই তাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন হওয়া এবং অনিবার্য ধ্বংস ও বিপর্যয়কে প্রতিরোধ করতে পারবে না। এসব বিপর্যয় তো আসবে তাদের পার্থিব জীবনেই ৷ অতপর পরকালের জীবনে তারা নিক্ষিপ্ত হবে প্রজ্জলিত লেলিহান অগ্নি শিখায় । এখানে ‘না-রান যা-তা লাহাব’ শব্দটি জ্বলন্ত অগ্নির উদিত লেলিহান শিখাকে চিত্রিত করে তার ভয়াবহ অবস্থার দৃশ্য অংকন করা হয়েছে। জ্বলন্ত অগ্নির দাহিকা শক্তির বিভীষিকা, তীব্রতা ও প্রখরতা লেলিহান শিখা দ্বারা বুঝানো হয়েছে। ‘ওয়াম রাআতুহু হাম্মা লাতাল হাতাব’ আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইসলামী দাওয়াতের বিরোধীতা ও সরওয়ারে কায়েনাত (স.)-এর ওপর পাশবিক ও নির্মম নির্যাতনের কারণে শুধু আবু লাহাবকেই জলন্ত অনলের লেলিহান শিখায় নিক্ষেপ করা হবে না; বরং তার স্ত্রী উম্মে জামিলও নরককুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবে কাটাযুক্ত কাঠের বোঝা বহন করা অবস্থায় । ‘ফী জী-দেহা হাবলূম মিম মাসাদ’ আয়াতে বলা হয়েছে উম্মে জামিলকে শুধু কাটাযুক্ত কাঠের বোঝা বহন করা অবস্থায় নয়, উপরন্তু তার গলদেশে খেজুর গাছের অগ্রভাগে অবস্থিত পদার্থের পাকানো রশি দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাকে লেলিহান অগ্নিশিখায় নিক্ষেপ করা হবে। এ সূরায় উম্মে জামিলের প্রতি এ ধরনের শাস্তির সুক্ষ তাৎপর্য, বিষয়বস্তু ও কারণ সহ কেয়ামত দিবসের দৃশ্যগুলো প্রসিদ্ধ গ্রন্থ, ‘মাশাহাদুল কিয়ামাহ ফিল কোরআন’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উম্মে জামিলের চরম উন্মাদনা ও পাগলামির যে সকল চিত্র এ গ্রন্থে অংকিত রয়েছে, তার কিছু উদ্ধৃতি এখানে উপস্থাপন করছি। দ্বীনের শত্রুদের চরম পরিণতি : এই সূরাটিতে শব্দের মাধ্যমেই এ দৃশ্যের ও অবস্থার চিত্রাংকন করা হয়েছে। (অনেক ক্ষেত্রে রেখাচিত্রের চেয়ে কথাচিত্র হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে প্রকৃত অবস্থাকে বেশী স্পষ্ট ও দৃশ্যমান করে তোলে ।) এখানে জাহান্নামের আগুনের ভয়াবহতা, বীভৎসতা ও তীব্রতার প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছে যে, জাহান্নামের সে আগুন লেলিহান অগ্নিশিখাযুক্ত । সে ভীষণ উত্তপ্ত লেলিহান অগ্নিশিখায় (অগ্নির মতো লালবর্ণ সুন্দর ব্যক্তি) আবু লাহাবকে নিক্ষেপ করা হবে এবং তার সাথে তার স্ত্রী উম্মে জামিলকেও- যে কাটাযুক্ত কাঠের বোঝা বহন করে রসূলুল্লাহ (স.)-কে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে রসূলের চলার পথে (গৃহদ্বারে) বিছিয়ে দিতো। এখানে এটিকে প্রকৃত (হাকিকী) ও রূপক (মাজাযী) উভয় অর্থেই গ্রহণ করা যায় । আর কাঠ হচ্ছে তাই, যা আগুনের জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়, আবার কাঠের বোঝা রশি দ্বারা বাধা হয়। দুনিয়ায় সে রসূলকে কষ্ট দিতো কাটাযুক্ত কাঠ দিয়ে, যে কাঠ সে বেঁধে আনতো খেজুর পাতার পাকানো রশি দিয়ে এবং সেই বোঝা বহন করে এনে রসূলের চলার পথে বিছিয়ে দিতো তাকেও পরকালে রশি দ্বারা বাধা কাঠের বোঝার সাথে বেঁধে এনে জাহান্নামের ইন্ধন হিসাবে ব্যবহার করা হবে এবং সে কাঠ দ্বারা প্রজ্বলিত অনলের লেলিহান শিখায় তাকে নিক্ষেপ করা হবে। এখানে কাঠ, রশি, অগ্নি, লেলিহান শিখা সবকিছুর উল্লেখ করে তাতে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীকে নিক্ষেপ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে এর রূপক অর্থ করা যেতে পারে, রশি দ্বারা বাধা কাঠের বোঝা বহনকরাকালীন তালে তালে যে মৃদু সংগীতের শব্দ শোনা যায় সে ধরনের শব্দ উত্থিত হবে, আর কণ্ঠ রশি দ্বারা চেপে ধরলে তাদের কণ্ঠ থেকে মৃদু শব্দ উথিত অবস্থায় তারা লেলিহান অগ্নি শিখায় নিক্ষিপ্ত হবে। কঠিন অবস্থায় রশি ও কাঠের কঠিন বেষ্টনীর ফলে যেমনি কষ্টকর অবস্থার সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি কষ্টকর অবস্থায় তারা আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। এমনিভাবে মৃদু যন্ত্রসংগীতের মতোই শব্দ উথিত হবে৷ বিভিন্ন কর্মসম্পাদনকালীন নড়া চড়ার মাধ্যমে যে গুঞ্জন ও আওয়ায হয়, তাকে শব্দ তরঙ্গের ধ্বনির সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং উম্মে জামিলের এ সকল তৎপরতা ও আবু লাহাবের ইসলামী দাওয়াতের প্রতিরোধের চুড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে মাত্র ৫টি আয়াতসম্পন্ন এ ক্ষুদ্র সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। আর এটি কোরআনে করীমের ছোট্ট সূরাসমূহের মধ্যে একটি । কোরআনে হাকীমের শক্তিশালী রূপক উপমা বিশিষ্ট এই সূরাটি ইসলামী দাওয়াত ও রেসালাতের মর্যাদার প্রতি বিদ্বেষ ও বিদ্রুপকারী আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিলের জঘন্য পরিণতির ইংগিত বহন করে অবতীর্ণ হওয়ার পর উম্মে জামিল মনে করেছিলো রসূলুল্লাহ (স.) তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও দুর্নাম রটনা করে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপাত্মক কবিতা রচনা করেছেন। এ ছোট্ট সূরাটির শব্দসমূহ, উম্মে জামিলের পরিণতি সম্পর্কিত সতর্কবাণী, বিশেষ করে আত্মগর্বিতা, আভিজাত্য, কৌলীন্য ও সৌন্দর্যের অহমিকা ও আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত মহিলা উম্মে জামিল সম্পর্কিত নিন্দাসূচক ও শ্লেষাত্মক কথা চিত্রে তীর্যক সংগীত লহবী মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লো এবং এ আয়াতের বিদ্বূপবান হচ্ছে ‘কন্টকযুক্ত কাঠের বোঝা বহনকারিণী, যার গলদেশে পাকানো রশি জড়ানো থাকবে৷” এ তীব্র আঘাত ও ভয়ংকর পরিণতির কথা যখন আরবের ঘরে ঘরে আলোচিত ও প্রচারিত হতে লাগলো তখন উম্মে জামিলের অন্তরে নিদারুণ জ্বালা, অস্থিরতা ও চরম মানসিক অস্বস্তি সৃষ্টি হলো ৷ এ প্রসংগে প্রসিদ্ধ সীরাত গ্রন্থকার ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক উদ্ধৃত করেছেন- আবু লাহাবের স্ত্রী কাঠের বোঝা বহনকারিণী উম্মে জামিল যখন তার ও তার স্বামী প্রসংগে কোরআনে কারীমে অবতীর্ণ বিদ্রুপ ও শ্লেষাত্মক উক্তিসমূহ শুনতে পেলো, তখন ক্ষিপ্ত ও ক্রোধান্বিত অবস্থায় সোজা আল্লাহর রসূলের সামনে এসে উপস্থিত হলো। প্রিয় নবী (স.) তখন হযরত আবু বকর (রা.) সহ কাবাঘরের সামনে বসে ছিলেন । উম্মে জামিল এক মুঠি পাথর নিয়ে উভয়ের সামনে গিয়ে দাড়ালো । আল্লাহ্ তায়ালা মহান কুদরতের মাধ্যমে তার হাবীবকে অলৌকিক ভাবে উম্মে জামিলের দৃষ্টির আড়ালে রেখে দিলেন। উম্মে জামিলের চোখের সামনে বসে থাকা সত্ত্বেও উম্মে জামিল একমাত্র আবু বকর রো.) ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলো না। হযরত আবু বকর (রা.)-কে লক্ষ্য করে উম্মে জামিল বললো, ‘হে আবু বকর। তোমার সংগী কোথায়? আমি জানতে পারলাম যে, সে নাকি আমার দূর্ণাম রচনা করে কবিতা রচনা করেছে। আল্লাহর কসম! আমি তাকে এখন সামনে পেলে এ মুষ্টিবদ্ধ পাথর তার মুখমন্ডলে ছুঁড়ে মারতাম । তার জেনে রাখা দরকার যে, আমিও একজন মহিলা কবি। আমরা তার দাওয়াতকে অস্বীকার করায় সে আমাদের নামে দুর্নাম রটাচ্ছে। এই বলে সে রাগে গড়গড় করতে করতে চলে গেলো। তার চলে যাওয়ার পর রসূলুল্লাহ (স.)-কে লক্ষ্য করে হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহ রসূল, আপনি কি লক্ষ্য করেছিলেন যে, সে আপনাকে দেখতে পেয়েছে প্রিয়নবী (স.) বললেন, সে আমাকে দেখতে পায়নি, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখা থেকে তার দৃষ্টি শক্তিকে বিরত রেখেছেন ।’প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্র বিশারদ হাফেয আবু বকর বাযযার বিশুদ্ধ বর্ণনা সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই সূরা অবতীর্ণ হলো, তখন রসূলুল্লাহ (স.) হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাথে এক জায়গায় বসেছিলেন ৷ এসময় আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলকে রসূলের দিকে আসতে দেখে হযরত আবু বকর (রা.) রসূলুল্লাহ (স.)কে বললেন, আপনি যদি একদিকে সরে না যান, (আত্মগোপন না করেন) তাহলে অবশ্যই সে আপনাকে কোনো কিছু দ্বারা (কঠিন) আঘাত হানবে ৷ রসূলুল্লাহ (স.) শান্তভাবে বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা তার দৃষ্টি থেকে আমাকে আড়াল করে রাখবেন । উম্মে জামিল এগিয়ে এসে হযরত আবু বকর (রা.)-এর সামনে দাড়িয়ে বললো, হে আবু বকর! তোমার সংগী আমার দূর্ণামমূলক কবিতা রচনা করে তা গেয়ে বেড়াচ্ছে। তদুত্তরে হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, না, কখনো না, এ গৃহের (কাবাগৃহের) মালিকের শপথ, আমার সংগী কখনও কবিতা রচনা করেন না, তার মুখ থেকে কখনও কবিতা নিসৃত হয় না। তখন উম্মে জামিল বললো, তুমি অবশ্য সত্যবাদী ৷ সে চলে চাওয়ার পর হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, ওকি আপনাকে দেখতে পায়নি? রসূলুল্লাহ (স.) বললেন, যতক্ষণ সে এখানে দাড়িয়ে ছিলো, আমার মালিক তার দৃষ্টিশক্তি ও আমার মধ্যে আবরণ সৃষ্টি করে রেখেছিলেন । এমনিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার মাহবুব রসূলে পাক (স.)-কে উম্মে জামিলের ক্রোধ, বিদ্বেষ ও ক্ষতি থেকে হেফাযত করেছেন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার ফলে তার ক্রোধ ও হিংসা অবদমিত হলো। হযরত আবু বকর (রা.) যে বলেছেন, কাবার প্রভুর শপথ, তার মুখ থেকে তোমার দুর্নামসূচক কবিতা নিসৃত হয়নি একথাও সম্পূর্ণ সত্য । কেননা আল কোরআন রসূলের রচিত কোনো কবিতা গ্রন্থ নয়, এটি স্বয়ং আল্লাহর বাণী । যদিও ছন্দের মত অনেকাংশে মিলের সন্ধান পাওয়া যায় তবুও আল কোরআন কোনো কবিতার গ্রন্থ নয়। আর সূরা লাহাব কোনো দুর্ণামসূচক ছড়া বা কবিতা নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি নিজের প্রবৃত্তির ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো কথা বলেন না বরং তা হচ্ছে আল্লাহর প্রত্যাদেশ ।’ সূরা লাহাব যেহেতু রসূলুল্লাহ (স.) রচিত কোনো দুর্ণামমূলক কবিতা বা ছড়া নয় সেহেতু হযরত আবুবকর (রা.) আল্লাহর নামে শপথ করে একথা বলেন যে, আমার সংগী তোমার দূর্নামমূলক কোনো কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করেননি। এ উক্তি একান্ত বাস্তব ও সত্য এবং হযরত আবু বকর (রা.) একান্তভাবে ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যবাদী । অথচ এ সূরায় আল্লাহর দ্বীনের নিকৃষ্ট দুশমন আবু লাহাব ও উম্মে জামিলের চরিত্রের যে জঘন্য চিত্র অংকিত হয়েছে, তা বিশেষ করে উম্মে জামিলের ও তার স্বামীর চরম পরিণতি সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছে, যে বিদ্রূপ ও শ্লোষাত্মক বাক্য সন্নিবেশিত হয়েছে, উম্মে জামিলের গলদেশে রশি পরিবেষ্টনের যে চিরন্তন ঘোষণার উল্লেখ রয়েছে, তা অনন্তকাল পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট প্রচারিত হতে থাকবে । ইসলামী দাওয়াতের বিরোধিতা ও সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল ও শ্রেষ্ঠ মানব মোহাম্মদ (স.)-এর শানে চরম বেয়াদবী ও ধৃষ্টতার জঘন্য আচরণের কারণে আল্লাহর গযব তাদের ওপর পতিত হয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা ইতিহাসে চির স্মরণীয় ও শিক্ষণীয় নিদর্শন স্বরূপ ধ্বংস ও নির্মূল করেছেন এবং তাদেরকে আখেরাতের চিরস্থায়ী শান্তির সুনিশ্চিত দুঃসংবাদ প্রদান করেছেন। তার গলায় রশি বেষ্টিত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীও উচ্চারণ করেছেন। বর্তমান যুগের দ্বীনের দাওয়াতের প্রতিরোধ ও নির্মূলের প্রত্যাশা পোষণকারী ও কেয়ামত পর্যন্ত দ্বীনের নিকৃষ্ট দুশমন ও জঘন্য ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীদের ধ্বংস ও নির্মূলের ব্যাপারে সূরাটি এক শিক্ষণীয় ঘটনা ও তাদের ধ্বংস, নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন হওয়ার তা এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ও সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে কাজ করছে।
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২৪)
[#শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা করা:-]
সুরা: ১১১: আল-মাসাদ (লাহাব)
পারা:৩০
১-৫ নং আয়াতের বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:
لهب শব্দের অর্থ : অগ্নিশিখা, আগুনের শিষ, স্ফুলিঙ্গ ইত্যাদি। তৃতীয় আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরাকে সূরা মাসাদও বলা হয়।
শানে নুযূল: (রাঃ)/b>
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন
(وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ)
“আর তুমি তোমর নিকটতম আন্তীয়-স্বজনদের ভীতি প্রদর্শন কর” (সূরা শুআরা ২৬: ২১৪) আয়াতটি অবতীর্ণ হয় অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন ও একনিষ্ঠ দলভুক্ত লোকদেরকে ভয় দেখানো ও তাদের মাঝে তাবলীগ করার নির্দেশ প্রদান করা হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেন এবং ইয়া সাবাহা বলে উঁচু আওয়াজ করলেন। (এটা বিপদসংকেতমূলক শব্দ, তৎতালে কেউ বিপদে পড়লে এ শব্দ ব্যবহার করত) সবাই বলল: এটা কে? সবাই তাঁর কাছে একত্রিত হলো। এমনকি কোন লোক আসতে না পারলে অন্য একজন দূত প্রেরণ করেছিল। তখন নাবী (সাঃ) বললেন : তোমরা কি লক্ষ্য করেছো? আমি যদি তোমাদেরকে বলি এক দল অশ্বারোহী সৈন্য এ পাহাড়ের পশ্চাতে তোমাদের ওপর হামলা করার জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে তোমরা কি বিশ্বাস করবে? সবাই বলল : কেন বিশ্বাস করব না? আমরা তো তোমাকে কখনও মিথ্যারূপে পাইনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : তাহলে শোন, আমি তোমাদেরকে আসন্ন এক ভয়াবহ কঠিন শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করছি। আবূ লাহাব বলল : তোমার ধ্বংস হোক! এজন্য তুমি আমাদেরকে একত্রিত করেছো। তখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৭১, সহীহ মুসলিম হা. ২০৮)
أبو لَهَبٍ – আবূ লাহাব এর প্রকৃত নাম আব্দুল উয্যা। তার রূপ সৌন্দর্য ও মুখমন্ডলের উজ্জ্বলতার (লাল আভার) কারণে আবূ লাহাব বলা হয়। তা ছাড়া পরিণামের দিক দিয়েও সে জাহান্নামের ইন্ধন। আবূ লাহাব কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের দশজন পুত্রের অন্যতম একজন। আবূ লাহাব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা, তার নিকট রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এত প্রিয় ছিল যে, তাঁর জন্মের খবর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সর্বত্র দৌড়ে গিয়ে লোকদের জানিয়ে দিয়েছিল যে, তার মৃত ছোট ভাই আব্দুল্লাহর বংশ রক্ষা হয়েছে। এ সুসংবাদটি প্রথম তাকে শোনানোর জন্য সে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দাসী সুওয়াইবাকে আযাদ করে দেয়। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/২৭৩; আলবানী, সহীহ সীরাতুন নববিয়্যাহ পৃ : ১৫)
নবুওয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দুকন্যা রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমকে আবূ লাহাবের দুপুত্র উৎবা ও উতাইবার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। (আর রাহীকুল মাখতূম পৃ : ৮৬)
এত আন্তরিকতা ও সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের পর আবূ লাহাব চরম শত্রুতে পরিণত হয় এবং রাসূল (সাঃ)-কে খুব কষ্ট দেয়। তার ছেলেদ্বয়কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দু কন্যাকে তালাক দিতে বাধ্য করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ মারা গেলে আবূ লাহাব খুশীতে বেশামাল হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলে, মুহাম্মাদ আবতার অর্থাৎ নির্বংশ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় হাজ্জের মওসুমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আগত হাজীদের তাঁবুতে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন কিন্তু আবূ লাহাব তাঁর পেছন থেকে লোকদের তাড়িয়ে দিত এবং বলত ‘তোমরা এর কথা শুননা, সে ধর্মত্যাগী ও মহা মিথ্যুক। এভাবে সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে ও কষ্ট দিতে থাকে। (মুসনাদে আহমাদ হা. ১৬০৬৬, সহীহ ইবনু হিব্বান হা. ৬৫৬২, ইবুন কাসীর)
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের লোক ছিল। ১. যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিল যেমন হামযাহ ও আব্বাস (রাঃ)। ২. যারা তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেনি যেমন আবূ তালেব। ৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শত্রুতা করেছিল যেমন আবূ লাহাব।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের খুশীতে আবূ লাহাবের দাসী আযাদ করাকে কেন্দ্র করে বিদআতীরা জাল হাদীস বর্ণনা করে বলে থাকে : রাসূলের জন্মের খুশীতে আবূ লাহাব দাসী আযাদ করার কারণে যদি প্রতি সোমবার জাহান্নামের শাস্তি লাঘব করা হয় তাহলে অবশ্যই ঈদে মীলাদুনাবী উদ্যাপন ফযীলতের কাজ। এ বিষয়ে কুফরী অবস্থায় চাচা আব্বাস-এর একটি স্বপ্নের কথা বলা হয়, যার কোন ভিত্তি নেই। সুতরাং এসব বিদআতী কর্মকান্ড অবশ্যই পরিত্যাজ্য, কোনক্রমেই রাসূলুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম বার্ষিকী পালন করা বা ঈদে মীলাদুন্নাবী উদ্যাপন করা ইবাদত হতে পারে না। যদি তা ইবাদত হত তাহলে অবশ্যই সাহাবীগণ তা করতেন, কিন্তু কোন সাহাবী করেছেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। বরং এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হল : ইসলাম গ্রহণ করার কারণে বেলালের মত একজন হাবশী গোলাম সম্মানের পাত্রে পরিণত হল আর কুরাইশদের সম্মানিত নেতা আবূ লাহাব ইসলাম বর্জন করার কারণে অসম্মানিত ও জাহান্নামী হল। একজন মুসলিম যত বার এ সূরা পাঠ করবে ততবার একটি অক্ষরের বিনিময়ে দশটি নেকী পাবে, অপরপক্ষে আবূ লাহাব ও তার স্ত্রী অভিশাপ ও ধ্বংসের বদদু‘আ পাবে।
تَبَّ শব্দের অর্থ : বরবাদ হওয়া, ধ্বংস হওয়া ইত্যাদি। শব্দটি অতীতকাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থ : আবূ লাহাবের দু হাত ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ তখনও সে ধ্বংস হয়নি। অর্থাৎ অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই পূর্বেই এর নিশ্চয়তা দিয়ে দেয়া হয়েছে। সত্যিই তাই হলো, আবূ লাহাব বদরের যুদ্ধের কয়েকদিন পর এক চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। সে রোগের কারণে দেহে প্লেগের মত গুটলি প্রকাশ পায়। ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যু মুখেমুখে পতিত হয়। তিন দিন পর্যন্ত তার লাশ এভাবেই পড়েছিল। পরিশেষে তা খুবই দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে। অতঃপর ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় এবং মান সম্মানের ভয়ে তার ছেলেরা তাকে দূর থেকে পাথর ফেলে ও মাটি ঢেলে দিয়ে দাফন করে। (আইসারুত তাফাসীর)
দ্বিতীয় تَبَّ ক্রিয়া দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যে বদ্দুআ দেওয়া হয়েছিল তার জবাবস্বরূপ পুনরায় বদ্দুআ করা হয়েছে।
يَدَآ শব্দটি দ্বিবচন, অর্থ : হাতদ্বয়। এখানে শুধু হাত উদ্দেশ্য নয় বরং সম্পূর্ণ শরীর উদ্দেশ্য।
(مَآ أَغْنٰي عَنْهُ مَالُه۫ وَمَا كَسَبَ)
অর্থাৎ সে যেসব সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এবং যা উপার্জন করেছে ও তার স্ত্রী সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারেনি। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ অনেক মুফাসসির বলেন : এর অর্থ তার সন্তানাদি। যেমন আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلْتُمْ مِنْ كَسْبِكُمْ، وَإِنَّ أَوْلَادَكُمْ مِنْ كَسْبِكُم
মানুষ যা উপার্জন করে সেটাই তার সর্বাধিক পবিত্র খাদ্য। আর তার সন্তান তার উপার্জনের অংশ। (আবূ দাঊদ হা. ৩৫৩০, মিশকাত হা. ২৭৭০, সহীহ)
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় জাতিকে ঈমানের দাওয়াত ও আখেরাতের আযাবের ভয় দেখান, তখন আবূ লাহাব তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল : আমার ভাতিজার কথা যদি সঠিক হয় তাহলে আমি কিয়ামতের দিন আমার ধন-সম্পদ ও সন্তানাদির বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করে নেব। অত্র আয়াতে তার জবাব এসেছে। (ইবনু কাসীর)
وامراته অর্থাৎ আবূ লাহাব জাহান্নামে যাবে, সাথে তার স্ত্রীও জাহান্নামে যাবে। তার স্ত্রীর নাম উম্মে জামীলা আরওয়া বিনতে হারব। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে দুশমনীর দিক দিয়ে স্বামীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
(حَمَّالَةَ الْـحَطَبِ)
অর্থাৎ জাহান্নামে সে স্বামীর আগুনে কাঠ এনে নিক্ষেপ করবে। ফলে আগুন আরো বৃদ্ধি পাবে। এটা হবে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। অর্থাৎ দুনিয়াতে যেমন স্বামীকে কুফর ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দানে সহযোগিতা করছিল আখিরাতেও জাহান্নামে সে ভাবে সাহায্য করবে।
(فِيْ جِيْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ) – جيد
শব্দের অর্থ গর্দান, ঘাড়। مَّسَد অর্থ ليف বা আঁশ, ছিলকা ইত্যাদি। অর্থাৎ জাহান্নামে তার গলায় লোহার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে যা খেজুরের আঁশের মত পাকানো হবে। অথবা তার গলায় লোহার বেড়ি পরিহিত অবস্থায় জাহান্নামে স্বামীর জন্য কাঠ বহন করবে। যহহাক ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেন: ঐ রশিই কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের রশি হবে। আর সাঈদ বিন মুসাইয়িব (রহঃ) বলেন: আবূ লাহাবের স্ত্রীর মণিমুক্তাখচিত বহু মূল্যবান একটি কণ্ঠহার ছিল। যেটা দেখিয়ে সে লোকদের বলত: লাত ও ওযযার কসম! এটা আমি অবশ্যই ব্যয় করব মুহাম্মাদের শত্রুতার পেছনে। এ কণ্ঠহারই তার জন্য কিয়ামতের দিন আযাবের কণ্ঠহার হবে। (তাফসীর কুরতুবী)
ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যুগোপযোগি মাধ্যম কাজে লাগাতে হবে যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তৎকালীন নিয়মানুযায়ী সাফা পাহাড়ে উঠে জাতির কাছে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আর দাওয়াত দিলে পক্ষ বিপক্ষ দুশ্রেণির লোকই পাওয়া যাবে। তাই বলে পশ্চাদপদ হওয়া যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে শত্রুতা করে তারা সবাই ধ্বংস হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
২. ঈমান-আমল না থাকলে ধন-সম্পদ, জ্ঞান-গরিমা ও ক্ষমতা কোন কাজে আসবে না।
৩. সফলকাম তারাই যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শে গড়ে তুলেছে, অতঃপর তাতে অবিচল থেকেছে।
৪. ইসলাম প্রচারে যুগোপযোগি মাধ্যম গ্রহণ করা যেতে পারে।
৫. ঈদে মীলাদুন্নাবী উদ্যাপন বিদ‘আত। কোন সাহাবী, তাবেয়ী এমনকি চার ইমামের কেউ তা করেননি।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর
সহীহ বুখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বাতহা’ নামক স্থানে গিয়ে একটি পাহাড়ের উপর আরোহণ করলেন এবং উচ্চস্বরে “ইয়া সাবা’হাহ্, ইয়া সাবা’হা’হ্” (অর্থাৎ হে ভোরের বিপদ, হে ভোরের বিপদ) বলে ডাক দিতে শুরু করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত কুরায়েশ নেতা সমবেত হলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “যদি আমি তোমাদেরকে বলি যে, সকালে অথবা সন্ধ্যাবেলায় শত্রুরা তোমাদের উপর আক্রমণ চালাবে তবে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে?” সবাই সমস্বরে বলে উঠলোঃ “হ্যা হ্যা অবশ্যই বিশ্বাস করবো।” তখন তিনি তাদেরকে বললেনঃ “শোননা, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর ভয়াবহ শাস্তির আগমন সংবাদ দিচ্ছি।” আবু লাহাব তার একথা শুনে বললোঃ “তোমার সর্বনাশ হোক, একথা বলার জন্যেই কি তুমি আমাদেরকে সমবেত করেছো?” তখন আল্লাহ তা’আলা এ সূরা অবতীর্ণ করেন। অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, আবু লাহাব হাত ঝেড়ে নিম্ন লিখিত বাক্য বলতে বলতে চলে গেলঃ
(আরবি) অর্থাৎ “তোমার প্রতি সারাদিন অভিশাপ বর্ষিত হোক।” আবূ লাহাব ছিল রাসূলুল্লাহর (সঃ) চাচা। তার নাম ছিল আবদুল উযযা ইবনে আবদিল মুত্তালিব। তার কুনইয়াত বা ছদ্ম পিতৃপদবীযুক্ত নাম আবূ উত্মাহ ছিল। তার সুদর্শন ও কান্তিময় চেহারার জন্যে তাকে আবু লাহাব অর্থাৎ শিখা বিশিষ্ট বলা হতো। সে ছিল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকৃষ্টতম শক্র। সব সময় সে তাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে এবং তার ক্ষতি সাধনের জন্যে সচেষ্ট থাকতো।
হযরত রাবীআহ ইবনে ইবাদ দাইলী (রাঃ) তার ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর ইসলাম পূর্ব যুগের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ “আমি নবী করীম (সঃ) কে যুল মাজায এর বাজারে দেখেছি, সে সময় তিনি বলছিলেনঃ “হে লোক সকল! তোমরা বলঃ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহলে তোমরা মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করবে।” বহু লোক তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। আমি লক্ষ্য করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনেই গৌরকান্তি ও সুডোল দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারী একটি লোক, যার মাথার চুল দুপাশে সিঁথি করা, সে এগিয়ে গিয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বললোঃ “হে লোক সকল! এ লোক বে-দ্বীন ও মিথ্যাবাদী।” মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর সুদর্শন এই লোকটি তার বিরুদ্ধে বলতে বলতে যাচ্ছিল। আমি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ এ লোকটি কে? উত্তরে তারা বললোঃ “এ লোকটি হলো রাসূলুল্লাহর (সঃ) চাচা আবু লাহাব।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাবীআ’হ্ (রাঃ) বলেনঃ “আমি আমার পিতার সাথে ছিলাম, আমার তখন যৌবন কাল। আমি দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক একটি লোকের কাছে যাচ্ছেন আর লোকেদেরকে বলছেনঃ “হে লোক সকল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছি। আমি তোমাদেরকে বলছি যে, তোমরা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। তোমরা আমাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করো এবং আমাকে শত্রুদের কবল হতে রক্ষা করো, তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাকে যে কাজের জন্যে প্রেরণ করেছেন সে কাজ আমি করতে পারবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) যেখানেই এ পয়গাম পৌছাতেন, পরক্ষণেই আবু লাহাব সেখানে পৌছে বলতোঃ “হে অমুক গোত্রের লোকেরা! এ ব্যক্তি তোমাদেরকে লাত, উয্যা থেকে দূরে সরাতে চায় এবং বানু মালিক ইবনে আকইয়াসের ধর্ম থেকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য। সে নিজের আনীত গুমরাহীর প্রতি তোমাদেরকেও টেনে নিতে চায়। সাবধান! তার কথা বিশ্বাস করো না।”
আল্লাহ তাআলা এ সূরায় বলছেনঃ আবু লাহাবের দুই হস্ত ধ্বংস হোক! না তার ধন-সম্পদ তার কোন কাজে এসেছে, না তার উপার্জন তার কোন উপকার করেছে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন তার। স্বজাতিকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানালেন তখন আবু লাহাব বলতে লাগলোঃ “যদি আমার ভাতিজার কথা সত্য হয় তবে আমি কিয়ামতের দিন আমার ধন সম্পদ আল্লাহকে ফিদিয়া হিসেবে দিয়ে তার আযাব থেকে আত্মরক্ষা করবো।” আল্লাহ তাআলা তখন এ আয়াত অবতীর্ণ করেন যে, তার ধন সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসেনি।
এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অচিরে সে দগ্ধ হবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও। অর্থাৎ আবু লাহাব তার স্ত্রীসহ জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনে প্রবেশ করবে। আবু লাহাবের স্ত্রী ছিল কুরায়েশ নারীদের নেত্রী। তার কুনিয়াত ছিল উম্মু জামীল, নাম ছিল আরওয়া বিনতু হারব ইবনে উমাইয়া। সে আবূ সুফিয়ান (রাঃ) এর বোন ছিল। তার স্বামীর কুফরী, হঠকারিতা এবং ইসলামের শত্রুতায় সে ছিল সহকারিণী, সহযোগিণী। এ কারণে কিয়ামতের দিন সেও স্বামীর সঙ্গে আল্লাহর আযাবে পতিত হবে। কাঠ বহন করে নিয়ে সে তা ঐ। আগুনে নিক্ষেপ করবে যে আগুনে তার স্বামী জ্বলবে। তার গলায় থাকবে আগুনের পাকানো রশি।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যে ইন্ধন বহন করে, তার গলদেশে পাকানো রঞ্জু। অর্থাৎ সে স্বামীর ইন্ধন সগ্রহ করতে থাকবে।
(আরবি) এর ‘গীবতকারিণী’ অর্থও করা হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ অর্থই পছন্দ করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বর্ণনা করেছেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রী জঙ্গল থেকে কাটাযুক্ত কাঠ কুড়িয়ে আনতে এবং ঐ কাঠ রাসূলুল্লাহর চলার পথে বিছিয়ে দিতো। এটাও বলা হয়েছে যে, এ নারী রাসুলুল্লাহকে ভিক্ষুক বলে তিরস্কার করতো। এ কারণে তাকে কাষ্ঠ বহনের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রথমোক্ত কথাই নির্ভুল। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ) বলেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রীর কাছে একটি সুন্দর গলার মালা ছিল সে বলতোঃ “আমি এ মালা বিক্রী করে তা মুহাম্মদ (সঃ)-এর বিরোধিতায় ব্যয় করবো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, তার গলদেশে থাকবে পাকানো রঞ্জু। অর্থাৎ তার গলদেশে আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।
(আরবি) শব্দের অর্থ হলো খেজুর গাছের আঁশের রশি। উরওয়া (রঃ) বলেন যে, এটা হলো জাহান্নামের শিকল, যার এক একটি কড়া সত্তর গজের হবে। সওরী (রঃ) বলেন যে, এটা জাহান্নামের শিকল, যা সত্তর হাত লম্বা। জওহরী (রঃ) বলেন যে, এটা উটের চামড়া এবং পশম দিয়ে তৈরি করা হয়। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা লোহার বেড়ী বা শিকল।।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর ধাঙ্গড় নারী উম্মু জামীল বিনতু হারব নিজের হাতে কারুকার্য খচিত, রং করা পাথর নিয়ে কবিতা আবৃত্তির সূরে নিম্নলিখিত কথাগুলো বলতে বলতে রাসূলুল্লাহর নিকট আগমন করেঃ(আরবি)
অর্থাৎ “আমি মুযাম্মামের (নিন্দনীয় ব্যক্তির) অস্বীকারকারিণী, তার দ্বীনের দুশমন এবং তার হুকুম অমান্যকারিণী।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময় কা’বা গৃহে বসেছিলেন। তাঁর সাথে আমার আব্বা হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন। আমার আব্বা তাকে এ অবস্থায় দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সে আসছে, আপনাকে আবার দেখে না ফেলে!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! নিশ্চিন্ত থাকো, সে আমাকে দেখতে পাবেই না। তারপর তিনি ঐ দুষ্টা নারীকে এড়ানোর উদ্দেশ্যে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ ‘যখন তুমি কুরআন পাঠ কর তখন আমি তোমার মধ্যে এবং যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে গোপন পর্দা টেনে দিই।” (১৭:৪৫) ডাইনী নারী হযরত আবু বকরের (রাঃ) কাছে এসে দাড়ালো। রাসূলুল্লাহও (সঃ) তখন হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পাশেই ছিলেন। কিন্তু কুদরতী পর্দা তার চোখের সামনে পড়ে গেল। সুতরাং সে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কে দেখতে পেলো না। ডাইনী নারী হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বললোঃ “আমি শুনেছি যে, তোমার সাথী (সঃ) আমার দুর্নাম করেছে অর্থাৎ কবিতার ভাষায় আমার বদনাম ও নিন্দে করেছে। হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “কা’বার প্রতিপালকের শপথ! রাসূলুল্লাহ (সঃ) তোমার কোন নিন্দে করেননি।” আবু লাহাবের স্ত্রী তখন ফিরে যেতে যেতে বললোঃ “কুরায়েশরা জানে যে, আমি তাদের সর্দারের মেয়ে।”
একবার এ দুষ্টা রমনী নিজের লম্বা চাদর গায়ে জড়িয়ে তাওয়াফ করছিল, হঠাৎ পায়ে চাদর জড়িয়ে পিছনে পড়ে গেল। তখন বললোঃ “মুযাম্মাম ধ্বংস হোক।” তখন উম্ম হাকীম বিনতু আবদিল মুত্তালিব বললোঃ “আমি একজন পূত পবিত্র রমনী। আমি মুখের ভাষা খারাপ করবো না। আমি বন্ধুত্ব স্থাপনকারিণী, কাজেই আমি কলঙ্কিনী হবো না এবং আমরা সবাই একই দাদার সন্তান, আর কুরায়েশরাই এটা সবচেয়ে বেশী জানে।”
আবু বকর বার (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ যখন(আরবি) এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। তখন আবু লাহাবের স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট আগমন করে। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) বসেছিলেন এবং তার সাথে হযরত আবু বকরও (রাঃ) ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ যে সে আসছে, আপনাকে সে কষ্ট দেয়। না কি!” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, সে আমাকে দেখতে পাবে না।” অতঃপর আবু লাহাবের স্ত্রী হযরত আবু বকর (রাঃ) কে বললোঃ “তোমার সাথী (কবিতার ভাষায়) আমার দুর্নাম রটনা করেছে।” হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন কসম করে বললেমঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাব্য চর্চা করতে জানেন না এবং তিনি কবিতা কখনো বলেননি।” দুষ্টা নারী চলে যাওয়ার পর হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তার চলে যাওয়া পর্যন্ত ফেরেশতা আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলেন। কোন কোন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছেন যে, উম্মু জামীলের গলায় আগুনের রশি লাগিয়ে দেয়া হবে এবং ঐ রশি ধরে টেনে তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর রশি ঢিলে করে তাকে জাহান্নামের গভীর তলদেশে নিক্ষেপ করা হবে এ শাস্তিই তাকে ক্রমাগতভাবে দেয়া হবে।
ঢোলের রশিকে আরবের লোকেরা (আরবি) বলতো। আরবী কবিতায় এ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হতো। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, এ সূরা আমাদের প্রিয় নবী (সঃ)-এর নবুওয়াতের একটি উচ্চতর প্রমাণ। আবু লাহাব এবং তার স্ত্রী দুস্কৃতির এবং পরিণতির যে সংবাদ এ সূরায় দেয়া হয়েছে। বাস্তবেও তা-ই ঘটেছে। এ দম্পতির ঈমান আনয়নের সৌভাগ্য হয়নি। তারা প্রকাশ্য বা গোপনীয় কোনভাবেই মুসলমান হয়নি। কাজেই, এ সূরাটি রাসূলুল্লাহর (সঃ) নবুওয়াতের উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট প্রমাণ।
(Book#1224)
[ # Arrogance of Abu Lahab toward the Messenger:-]
Surah.111: Al-Masad
Para:30 Ayat:- 1- 5
www.motaher21.net
111:1
تَبَّتۡ یَدَاۤ اَبِیۡ لَہَبٍ وَّ تَبَّ ؕ﴿۱﴾
May the hands of Abu Lahab be ruined, and ruined is he.
The Reason for the Revelation of this Surah and the Arrogance of Abu Lahab toward the Messenger of Allah
Al-Bukhari recorded from Ibn Abbas that;
The Prophet went out to the valley of Al-Batha and he ascended the mountain. Then he cried out,
يَا صَبَاحَاه
O people, come at once! So the Quraysh gathered around him. Then he said,
أَرَأَيْتُمْ إِنْ حَدَّثْتُكُمْ أَنَّ الْعَدُوَّ مُصَبِّحُكُمْ أَوْ مُمَسِّيكُمْ أَكُنْتُمْ تُصَدِّقُونِّي
؟
If I told you all that the enemy was going to attack you in the morning, or in the evening, would you all believe me?
They replied, “Yes.”
Then he said,
فَإِنِّي نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيد
Verily, I am a warner (sent) to you all before the coming of a severe torment.
Then Abu Lahab said,
“Have you gathered us for this! May you perish!”
Thus, Allah revealed,
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ
Perish the two hands of Abu Lahab and perish he! to the end of the Surah.
In another narration it states that he stood up dusting of his hands and said,
“Perish you for the rest of this day! Have you gathered us for this”
Then Allah revealed,
تَبَّتْ يَدَا أَبِى لَهَبٍ وَتَبَّ
The first part is a supplication against him and the second is information about him.
This man Abu Lahab was one of the uncles of the Messenger of Allah. His name was Abdul-Uzza bin Abdul-Muttalib. His surname was Abu Utaybah and he was only called Abu Lahab because of the brightness of his face. He used to often cause harm to the Messenger of Allah. He hated and scorned him and his religion.
Imam Ahmad recorded from Abu Az-Zinad that;
a man called Rabi`ah bin Abbad from the tribe of Bani Ad-Dil, who was a man of pre-Islamic ignorance who accepted Islam, said to him, “I saw the Prophet in the time of pre-Islamic ignorance in the market of Dhul-Majaz and he was saying,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لَاا إِلهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا
O people! Say there is no god worthy of worship except Allah and you will be successful.
The people were gathered around him and behind him there was a man with a bright face, squint (or cross) eyes and two braids in his hair. He was saying,
“Verily, he is an apostate (from our religion) and a liar!”
This man was following him (the Prophet) around wherever he went. So, I asked who was he and they (the people) said,
“This is his uncle, Abu Lahab.”
Ahmad also recorded this narration from Surayj, who reported it from Ibn Abu Az-Zinad, who reported it from his father (Abu Zinad) who mentioned this same narration.
However in this report, Abu Zinad said,
“I said to Rabi`ah, `Were you a child at that time!’
He replied,
`No. By Allah, that day I was most intelligent, and I was the strongest blower of the flute (for music).”‘
Ahmad was alone in recording this Hadith.
Concerning Allah’s statement,
مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَب
111:2
مَاۤ اَغۡنٰی عَنۡہُ مَالُہٗ وَ مَا کَسَبَ ؕ﴿۲﴾
His wealth will not avail him or that which he gained.
His wealth and his children (Kasab) will not benefit him!
Ibn Abbas and others have said,
وَمَا كَسَبَ
and his children (Kasab) will not benefit him!
“Kasab means his children.”
A similar statement has been reported from Aishah, Mujahid, Ata’, Al-Hasan and Ibn Sirin.
It has been mentioned from Ibn Masud that when the Messenger of Allah called his people to faith, Abu Lahab said,
“Even if what my nephew says is true, I will ransom myself (i.e., save myself) from the painful torment on the Day of Judgement with my wealth and my children.”
Thus, Allah revealed,
مَأ أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ
(His wealth and his children will not benefit him!)
Then Allah says,
سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ
111:3
سَیَصۡلٰی نَارًا ذَاتَ لَہَبٍ ۚ﴿ۖ۳﴾
He will [enter to] burn in a Fire of [blazing] flame
He will enter a Fire full of flames!
meaning, it has flames, evil and severe burning.
The Destiny of Umm Jamil, the Wife of Abu Lahab
Allah also says,
وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ
111:4
وَّ امۡرَاَتُہٗ ؕ حَمَّالَۃَ الۡحَطَبِ ۚ﴿۴﴾
And his wife [as well] – the carrier of firewood.
And his wife too, who carries wood.
His wife was among the leading women of the Quraysh and she was known as Umm Jamil. Her name was Arwah bint Harb bin Umayyah and she was the sister of Abu Sufyan. She was supportive of her husband in his disbelief, rejection and obstinacy. Therefore, she will be helping to administer his punishment in the fire of Hell on the Day of Judgement.
Thus, Allah says,
حَمَّالَةَ الْحَطَبِ
فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ
111:5
فِیۡ جِیۡدِہَا حَبۡلٌ مِّنۡ مَّسَدٍ ٪﴿۵﴾
Around her neck is a rope of [twisted] fiber.
Who carries wood. In her neck is a twisted rope of Masad.
meaning, she will carry the firewood and throw it upon her husband to increase that which he is in (of torment), and she will be ready and prepared to do so.
فِى جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ
In her neck is a twisted rope of Masad. Mujahid and Urwah both said,
“From the palm fiber of the Fire.”
Al-Awfi narrated from Ibn Abbas, Atiyah Al-Jadali, Ad-Dahhak and Ibn Zayd that;
she used to place thorns in the path of the Messenger of Allah.
Al-Jawhari said,
“Al-Masad refers to fibers, it is also a rope made from fibers or palm leaves.
It is also made from the skins of camels or their furs.
It is said (in Arabic) Masadtul-Habla and Amsaduhu Masadan, when you tightly fasten its twine.”
Mujahid said,
فِى جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ
In her neck is a twisted rope of Masad.
“This means a collar of iron.”
Don’t you see that the Arabs call a pulley cable a Masad.
A Story of Abu Lahab’s Wife harming the Messenger of Allah
Ibn Abi Hatim said that his father and Abu Zurah both said that Abdullah bin Az-Zubayr Al-Humaydi told them that Sufyan informed them that Al-Walid bin Kathir related from Ibn Tadrus who reported that Asma’ bint Abi Bakr said,
“When
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ
(Perish the two hands of Abu Lahab and perish he!) was revealed, the one-eyed Umm Jamil bint Harb came out wailing, and she had a stone in her hand. She was saying,
`He criticizes our father, and his religion is our scorn, and his command is to disobey us.’
The Messenger of Allah was sitting in the Masjid (of the Ka`bah) and Abu Bakr was with him. When Abu Bakr saw her he said,
`O Messenger of Allah! She is coming and I fear that she will see you.’
The Messenger of Allah replied,
إِنَّهَا لَنْ تَرَانِي
Verily, she will not see me.
Then he recited some of the Qur’an as a protection for himself.
This is as Allah says,
وَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرءَانَ جَعَلْنَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ الَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ بِالاٌّخِرَةِ حِجَابًا مَّسْتُورًا
And when you recite the Qur’an, We put between you and those who believe not in the Hereafter, an invisible veil. (17:45)
So she advanced until she was standing in front of Abu Bakr and she did not see the Messenger of Allah.
She then said,
`O Abu Bakr! Verily, I have been informed that your friend is making defamatory poetry about me.’
Abu Bakr replied,
`Nay! By the Lord of this House (the Ka`bah) he is not defaming you.’
So she turned away saying,
`Indeed the Quraysh know that I am the daughter of their leader.”‘
Al-Walid or another person said in a different version of this Hadith,
“So Umm Jamil stumbled over her waist gown while she was making circuits (Tawaf) around the House (the Ka`bah) and she said,
`Cursed be the reviler.’
Then Umm Hakim bint Abdul-Muttalib said,
`I am a chaste woman so I will not speak abusively and I am refined so I do not know. Both of us are children of the same uncle. And after all the Quraysh know best.”
This is the end of the Tafsir of Surah Masad, and all praise and blessings are due to Allah.
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran