Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২২৫) [#আল-ইখলাস] সুরা: ১১২:আল-ইখলাস পারা:৩০ ১-৪ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- #তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- কুরআন:- #তাফসীরে ফী জিলালিল # তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২৫)
[#আল-ইখলাস]
সুরা: ১১২:আল-ইখলাস
পারা:৩০
১-৪ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল

# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

(Book#1225)
[ # Al-Ikhlaas]
Surah.112: Al-Ikhlaas
Para:30 Ayat:- 1- 4
www.motaher21.net

সুরা: আল-ইখলাস

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:১১২
(১১২-ইখলাস) : নামকরণ:

ইখলাস শুধু এ সূরাটির নামই নয়, এখানে আলোচ্য বিষয়বস্তুর শিরোনামও। কারণ, এখানে খালেস তথা নির্ভেজাল তাওহীদের আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন মজীদের অন্যান্য সূরার ক্ষেত্রে সাধারণত সেখানে ব্যবহৃত কোন শব্দের মাধ্যমে তার নামকরণ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এ সূরাটিতে ইখলাস শব্দ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কাজেই এর এ নামকরণ করা হয়েছে এর অর্থের ভিত্তিতে। যে ব্যক্তি এ সূরাটির বক্তব্য অনুধাবন করে এর শিক্ষার প্রতি ঈমান আনবে, সে শির্ক থেকে মুক্তি লাভ করে খালেস তাওহীদের আলোকে নিজেকে উদ্ভাসিত করবে।

(১১২-ইখলাস) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এর মক্কী ও মাদানী হবার ব্যাপারে মতভেদ আছে। এ সূরাটি নাযিল হবার কারণ হিসেবে যেসব হাদীস উল্লেখিত হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতেই এ মতভেদ দেখা দিয়েছে। নীচে পর্যায়ক্রমে সেগুলো উল্লেখ করছি:

(১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, আপনার রবের বংশ পরিচয়* আমাদের জানান। একথায় এ সূরাটি নাযিল হয়। (তাবারানী)।

(২) আবুল আলীয়াহ হযরত উবাই ইবনে কাবের (রা.) বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন, মুশরিকরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, আপনার রবের বংশ পরিচয় আমাদের জানান। এর জবাবে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে জারীর, তিরমিযী, বুখারী ফিত তারীখ, ইবনুল মুনযির, হাকেম ও বায়হাকী) এ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস আবুল আলীয়ার মাধ্যমে ইমাম তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে হযরত উবাই ইবনে কা’বের বরাত নেই। ইমাম তিরমিযী একে অপেক্ষাকৃত বেশী নির্ভুল বলেছেন।

* আরববাসীদের নিয়ম ছিল, কোন অপরিচিত ব্যক্তির পরিচয় লাভ করতে হলে তারা বলতো, اِنْسِبَهُ لَنَا (এর বংশধারা আমাদের জানাও) কারণ তাদের কাছে পরিচিতির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হতো বংশধারার। সে কোন্ বংশের লোক? কোন্ গোত্রের সাথে সম্পর্কিত? একথা জানার প্রয়োজন হতো। কাজেই তারা যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাঁর রব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলো তিনি কে এবং কেমন, তখন তারা তাঁকে একই প্রশ্ন করলো। তারা প্রশ্ন করলো, اِنْسِبْ لَنَا رَبُّكَ অর্থাৎ আপনার রবের নসবনামা (বংশধারা) আমাদের জানান।

(৩) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, এক গ্রামীণ আরব (কোন কোন হাদীস অনুযায়ী লোকেরা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, আপনার রবের বংশধারা আমাদের জানান। এর জবাবে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন (আবু ইয়ালা, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, তাবারানী ফিল আওসাত, বায়হাকী ও আবু নু’আইম ফিল হিলইয়া)।

(৪) ইকরামা হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেন, ইহুদীদের একটি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়। তাদের মধ্যে ছিল কা’ব ইবনে আশরাফ ও হুই ইবনে আখতাব প্রমুখ লোকেরা। তারা বলে, “হে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার যে রব আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি কেমন সে সম্পর্কে আমাদের জানান।” এর জবাবে মহান আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন। (ইবনে আবী হতেম, ইবনে আদী, বায়হাকী ফিল আসমায়ে ওয়াস সিফাত)

এছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়া কয়েকটি হাদীস তাঁর সূরা ইখলাসের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হচ্ছে:

(৫) হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, খয়বারের কয়েকজন ইহুদী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলে, “হে আবুল কাসেম! আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নূরের পর্দা থেকে, আদমকে পঁচাগলা মাটির পিণ্ড থেকে, ইবলিসকে আগুনের শিখা থেকে, আসমানকে ধোঁয়া থেকে এবং পৃথিবীকে পানির ফেনা থেকে তৈরি করেছেন। এখন আপনার রব সম্বন্ধে আমাদের জানান (অর্থাৎ তিনি কোন বস্তু থেকে সৃষ্ট?” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথার কোন জবাব দেননি। তারপর জিব্রীল (আ) আসেন। তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ! ওদেরকে বলে দাও, “হুওয়াল্লাহু আহাদ” (তিনি আল্লাহ এক ও একক)——————–

(৬) আমের ইবনুত তোফায়েল রসূলুল্লাহকে (সা.) বলেন: হে মুহাম্মাদ! আপনি আমাদের কোন্ জিনিসের দিকে আহবান জানাচ্ছেন? তিনি জবাব দেন, “আল্লাহর দিকে।” আমের বলে: “ভালো, তাহলে তার অবস্থা আমাকে জানান। তিনি সোনার তৈরি, না রূপার অথবা লোহার?” একথার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়।

(৭) যাহহাক, কাতাদাহ ও মুকাতেল বলেন, ইহুদীদের কিছু আলেম রসূলুল্লাহ (সা.) কাছে আসে। তারা বলে: “হে মুহাম্মাদ! আপনার রবের অবস্থা আমাদের জানান। হয়তো আমরা আপনার ওপর ঈমান আনতে পারবো। আল্লাহ তাঁর গুণাবলী তাওরাতে নাযিল করেছেন। আপনি বলুন, তিনি কোন্ বস্তু দিয়ে তৈরি? কোন্ গোত্রভুক্ত? সোনা, তামা পিতল, লোহা, রূপা, কিসের তৈরি? তিনি পানাহার করেন কি না? তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে কার কাছ থেকে পৃথিবীর মালিকানা লাভ করেছেন? এবং তারপর কে এর উত্তরাধিকারী হবে? এর জবাবে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন।

(৮) ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নাজরানের খৃস্টানদের সাতজন পাদ্রী সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে। তারা তাঁকে বলে: “আমাদের বলুন, আপনার রব কেমন? তিনি কিসের তৈরি?” তিনি বলেন, “আমার রব কোন জিনিসের তৈরি নন। তিনি সব বস্তু থেকে আলাদা।” এ ব্যাপারে আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন।

এ সমস্ত হাদীস থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ (সা.) যে মাবুদের ইবাদাত ও বন্দেগী করার প্রতি লোকদের আহবান জানাচ্ছিলেন তার মৌলিক সত্তা ও অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক প্রশ্ন করেছিল। এ ধরনের প্রশ্ন যখনই এসেছে তখনই তিনিই জবাবে আল্লাহর হুকুমে লোকদেরকে এ সূরাটিই পড়ে শুনিয়েছেন। সর্বপ্রথম মক্কায় কুরাইশ বংশীয় মুশরিকরা তাঁকে এ প্রশ্ন করে। তাদের এ প্রশ্নের জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। এরপর মদীনা তাইয়েবায় কখনো ইহুদী, কখনো খৃস্টান আবার কখনো আরবের অন্যান্য লোকেরাও রসূলুল্লাহকে (সা.) এই ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। প্রত্যেকবারই আল্লাহর পক্ষ থেকে ইশারা হয় জবাবে এ সূরাটি তাদের শুনিয়ে দেবার। ওপরে উল্লেখিত হাদীসগুলোর প্রত্যেকটিতে একথা বলা হয় যে, এর জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। এর থেকে এ হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী একথা মনে করার কোন সংগত কারণ নেই। আসল হচ্ছে কোন বিষয় সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবতীর্ণ কোন আয়াত বা সূরা যদি থাকতো তাহলে পরে রসূলুল্লাহ (সা.) সামনে যখনই সেই বিষয় আবার উত্থাপিত হতো তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত আসতো, এর জবাব অমুক আয়াত বা সূরায় রয়েছে অথবা এর জবাবে লোকদেরকে অমুক আয়াত বা সূরা পড়ে শুনিয়ে দাও। হাদীসসমূহের রাবীগণ এ জিনিসটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, যখন অমুক সমস্যা দেখা দেয় বা অমুক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন এ আয়াত বা সূরাটি নাযিল হয়। একে বারংবার অবতীর্ণ হওয়া অর্থাৎ একটি আয়াত বা সূরার বারবার নাযিল হওয়াও বলা হয়।

কাজেই সঠিক কথা হচ্ছে, এ সূরাটি আসলে মক্কী। বরং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে একে মক্কায় একেবারে প্রথম যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনের কোন বিস্তারিত আয়াত তখনো পর্যন্ত নাযিল হয়নি। তখনো লোকেরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহর দিকে দাওয়াতের বার্তা শুনে জানতে চাইতো: তাঁর এ রব কেমন, যার ইবাদাত-বন্দেগী করার দিকে তাদেরকে আহবান জানানো হচ্ছে। এর একেবারে প্রাথমিক যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত হবার আর একটি প্রমাণ হচ্ছে, মক্কায় হযরত বেলালকে (রা.) তার প্রভু উমাইয়া ইবনে খালাফ যখন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকার ওপর চিৎ করে শুইয়ে তার বুকের ওপর একটা বড় পাথর চাপিয়ে দিতো তখন তিনি “আহাদ” “আহাদ” বলে চিৎকার করতেন। এ আহাদ শব্দটি এ সূরা ইখলাস থেকেই গৃহীত হয়েছিল।
(১১২-ইখলাস) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

নাযিল হওয়ার উপলক্ষ্য সম্পর্কিত যেসব হাদীস ওপরে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ওপর এক নজর বুলালে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তখন দুনিয়ার মানুষের ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা কি ছিল তা জানা যায়। মূর্তি পূজারী মুশরিকরা কাঠ, পাথর সোনা, রূপা ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসের তৈরি খোদার কাল্পনিক মূর্তিসমূহের পূজা করতো। সেই মূর্তিগুলোর আকার, আকৃতি ও দেহাবয়ব ছিল। এ দেব-দেবীদের রীতিমত বংশধারাও ছিল। কোন দেবী এমন ছিল না যার স্বামী ছিল না। আবার কোন দেবতা এমন ছিল না যার স্ত্রী ছিল না। তাদের খাবার দাবারেরও প্রয়োজন দেখা দিতো। তাদের পূজারীরা তাদের জন্য এসবের ব্যবস্থা করতো। মুশরিকদের একটি বিরাট দল খোদার মানুষের রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করায় বিশ্বাস করতো এবং তারা মনে করতো কিছু মানুষ খোদার অবতার হয়ে থাকে। খৃস্টানরা এক খোদায় বিশ্বাসী হলেও তাদের খোদার কমপক্ষে একটি পুত্র তো ছিলই এবং পিতা পুত্রের সাথে খোদায়ী সাম্রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে রুহুল কুদুসও (জিব্রীল) অংশীদার ছিলেন। এমন কি খোদার মাও ছিল এবং শাশুড়ীও। ইহুদীরাও এক খোদাকে মেনে চলার দাবীদার ছিল কিন্তু তাদের খোদাও বস্তুসত্তা ও মরদেহ এবং অন্যান্য মানবিক গুণাবলীর উর্ধ্বে ছিল না। তাদের এ খোদা টহল দিতো, মানুষের আকার ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করতো। নিজের কোন বান্দার সাথে কুস্তিও লড়তো। তার একটি পুত্রও (উযাইর) ছিল। এ ধর্মীয় দলগুলো ছাড়া আরো ছিল মাজূসী— অগ্নি উপাসক ও সাবী— তারকা পূজারী দল। এ অবস্থায় যখন লোকদেরকে এক ও লা- শরীক আল্লাহর আনুগত্য করার দাওয়াত দেয়া হয় তখন তাদের মনে এ প্রশ্ন জাগা নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে, সেই রবটি কেমন, সমস্ত রব ও মাবুদদেরকে বাদ দিয়ে যাকে একমাত্র রব ও মাবুদ হিসেবে মেনে নেবার দাওয়াত দেয়া হচ্ছে? এটা কুরআনের অলৌকিক প্রকাশ ভংগীরই কৃতিত্ব। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে কুরআন মূলত আল্লাহ অস্তিত্বের এমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা পেশ করে দিয়েছে, যা সব ধরনের মুশরিকী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটন করে এবং আল্লাহর সত্তার সাথে সৃষ্টির গুণাবলীর মধ্য থেকে কোন একটি গুণকেও সংযুক্ত করার কোন অবকাশই রাখেনি। শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব এ কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে এ সূরাটি ছিল বিপুল মহত্বের অধিকারী। বিভিন্নভাবে তিনি মুসলমানদেরকে এ গুরুত্ব অনুভব করাতেন। তারা যাতে এ সূরাটি বেশী করে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে একে বেশী করে ছড়িয়ে দেয় এজন্য ছিল তাঁর এ প্রচেষ্টা। কারণ এখানে ইসলামের প্রাথমিক ও মৌলিক আকীদাকে (তাওহীদ) এমন ছোট ছোট চারটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে, যা শুনার সাথে সাথেই মানুষের মনে গেঁথে যায় এবং তারা সহজেই মুখে মুখে সেগুলো আওড়াতে পারে। রসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতিতে লোকদের বলেছেন, এ সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান— এ মর্মে হাদীসের কিতাবগুলোতে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বুখারী, তিরমিযী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী ইত্যাদি কিতাবগুলোতে বহু হাদীস আবু সাঈদ, খুদরী, আবু হুরাইরা, আবু আইয়ুব আনসারী, কুলসুম বিনতে উকবাহ ইবনে আবী মু’আইত, ইবনে উমর, ইবনে মাসউদ, কাতাদাহ ইবনুন নূ’মান, আনাস ইবনে মালেক ও আবু মাস’উদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত হয়েছে। মুফাসসিরগণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তির বহু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তবে আমাদের মতে সহজ, সরল ও পরিষ্কার কথা হচ্ছে, কুরআন মজীদ যে দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা পেশ করে তার ভিত্তি রাখা হয়েছে তিনটি বুনিয়াদী আকীদার ওপর। এক, তাওহীদ। দুই, রিসালাত। তিন, আখেরাত। এ সূরাটি যেহেতু নির্ভেজাল তাওহীদ তত্ব বর্ণনা করেছে তাই রসূলুল্লাহ (সা.) একে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান গণ্য করেছেন।

হযরত আয়েশার (রা.) একটি রেওয়ায়াত বুখারী ও মুসলিম এবং হাদীসের অন্যান্য কিতাবগুলোতে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক অভিযানে এক সাহাবীকে সরদারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। তিনি সমগ্র সফরকালে প্রত্যেক নামাযে “কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ” পড়ে কিরআত শেষ করতেন। এটা যেন তার স্থায়ী রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফিরে আসার পর তার সাথীরা রসূলুল্লাহ (সা.) কাছে একথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তাকে জিজ্ঞেস করো, সে কেন এমনটি করেছিল? তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন: এতে রহমানের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এর পাঠ আমার অত্যন্ত প্রিয়। রসূলুল্লাহ (সা.) একথা শুনে লোকদের বলেন: أَخْبِرُوهُ أَنَّ اللَّهَ تَعَالَى يُحِبُّهُ “তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন।”

প্রায় এ একই ঘটনা বুখারী শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বললেন, জনৈক আনসারী কুবার মসজিদে নামায পড়াতেন। তাঁর নিয়ম ছিল, তিনি প্রত্যেক রাকাআতে قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ পড়তেন। তারপর অন্য কোন সূরা পড়তেন। লোকেরা এ ব্যাপারে আপত্তি উঠায়। তারা বলেন, তুমি এ কেমন কাজ করছো, প্রথমে قُلْ هُوَ اللَّهُ পড়ো তারপর তাকে যথেষ্ট মনে না করে আবার তার সাথে আর একটি সূরা পড়ো? এটা ঠিক নয়। শুধুমাত্র “কুল হুওয়াল্লাহ” পড়ো অথবা একে বাদ দিয়ে অন্য একটি সূরা পড়ো। তিনি জবাব দেন, আমি এটা ছাড়তে পারবো না। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নামায পড়াবো অথবা ইমামতি ছেড়ে দেবো। কিন্তু লোকেরা তাঁর জায়গায় আর কাউকে ইমাম বানানোও পছন্দ করতো না। অবশেষে ব্যাপারটি রসূলুল্লাহর (সা.) সামনে আসে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার সাথীরা যা চায় তা করতে তোমার বাধা কোথায়? কোন্ জিনিসটি তোমাকে প্রত্যেক রাকআতে এ সূরাটি পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে? তিনি বলেন: এ সূরাটিকে আমি খুব ভালোবাসি। রসূলুল্লাহ (সা.) জবাবে বলেন: حُبَّكَ إِيَّاهَا ادْخِلُكَ الْجَنَّةَ অর্থাৎ “এ সূরার প্রতি তোমার ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।”
সুরা: আল-ইখলাস
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1, 2, 3,

قُلْ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌۚ

বলো,১ তিনি আল্লাহ,২ একক।৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) এখানে ‘বলো’ শব্দে মাধ্যমে প্রথমত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ তাঁকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল রব কে? তিনি কেমন? আবার তাঁকেই হুকুম দেয়া হয়েছিল, প্রশ্নের জবাবে আপনি একথা বলুন। কিন্তু রসূলের ﷺ তিরোধানের পর এ সম্বোধনটি প্রত্যেক মু’মিনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। রসূলুল্লাহকে (সা.) যে কথা বলার হুকুম দেয়া হয়েছিল এখন সে কথা তাকেই বলতে হবে।

টিকা:২) অর্থাৎ আমার যে রবের সাথে তোমরা পরিচিত হতে চাও তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। এটি প্রশ্নকারীদের প্রশ্নের প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের সামনে আমি কোন নতুন রব নিয়ে আসিনি। অন্য সব মাবুদদের ইবাদাত ত্যাগ করে কোন নতুন মাবুদের ইবাদাত করতে আমি তোমাদের বলিনি। বরং আল্লাহ‌ নামে যে সত্তার সাথে তোমরা পরিচিত তিনি সেই সত্তা। আরবদের জন্য ‘আল্লাহ’ শব্দটি কোন নতুন ও অপরিচিত শব্দ ছিল না। প্রাচীনতম কাল থেকে বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার প্রতিশব্দ হিসেবে তারা আল্লাহ‌ শব্দটি ব্যবহার করে আসছিল। নিজেদের অন্য কোন মাবুদ ও উপাস্য দেবতার সাথে এ শব্দটি সংশ্লিষ্ট করতো না। অন্য মাবুদদের জন্য তারা “ইলাহ” শব্দ ব্যবহার করতো। তারপর আল্লাহ‌ সম্পর্কে তাদের যে আকীদা ছিল তার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছিল আবরাহার মক্কা আক্রমণের সময়। সে সময় কা’বা ঘরে ৩৬০টি উপাস্যের মূর্তি ছিল। কিন্তু এ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য মুশরিকরা তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে ছিল। অর্থাৎ তারা নিজেরা ভালোভাবে জানতো, এ সংকটকালে আল্লাহ‌ ছাড়া আর কোন সত্তাই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না। কা’বা ঘরকেও তারা এসব ইলাহের সাথে সম্পর্কিত করে বায়তুল আ-লিহাহ (ইলাহ–এর বহুবচন) বলতো না বরং আল্লাহর সম্পর্কিত করে একে বলতো বায়তুল্লাহ। আল্লাহ‌ সম্পর্কে আরবের মুশরিকদের আকীদা কি ছিল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তা বলা হয়েছে। যেমনঃ

সূরা যুখরুফে বলা হয়েছেঃ “যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে তাদের পয়দা করেছে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ।” ( ৮৭ আয়াত )

সূরা আনকাবুতে বলা হয়েছেঃ “যদি এদেরকে জিজ্ঞেস করো, আকাশসমূহ ও যমীনকে কে পয়দা করেছে এবং চাঁদ ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা বলবে আল্লাহ।…………আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলেন এবং কার সাহায্যে মৃত পতিত জমিকে সজীবতা দান করলেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ।” ( ৬১-৬৩ আয়াত )।

সূরা মু’মিনূনে বলা হয়েছেঃ “এদেরকে জিজ্ঞেস করো, বলো যদি তোমরা জানো, এ যমীন এবং এর সমস্ত জনবসতি কার? এরা অবশ্যি বলবে আল্লাহর।…………এদেরকে জিজ্ঞেস করো, সাত আকাশ ও মহাআরশের মালিক কে? এরা অবশ্যি বলবে, আল্লাহ।……এদেরকে জিজ্ঞেস করো, বলো যদি তোমরা জেনে থাকো প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর কার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত? আর কে আশ্রয় দান করেন এবং কার মোকাবিলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারেন না? এরা নিশ্চয়ই বলবে, এ ব্যাপারটি তো একমাত্র আল্লাহরই জন্য।” ( ৮৪-৮৯ আয়াত)

সূরা ইউনুসে বলা হয়েছেঃ “এদেরকে জিজ্ঞেস করো কে তোমাদের আকাশ ও যমীন থেকে রিযিক দেন? তোমরা যে শ্রবণ ও দৃষ্টি ক্ষমতার অধিকারী হয়েছো এগুলো কার ইখতিয়ারভুক্ত? আর কে জীবিতকে মৃত থেকে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন এবং কে এ বিশ্ব ব্যবস্থাপনা চালাচ্ছেন? এরা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ।” ( ৩১ আয়াত )

অনুরূপভাবে সূরা‌ ইউনুসের আর এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ “যখন তোমরা জাহাজে আরোহণ করে অনুকূলে বাতাসে আনন্দ চিত্তে সফর করতে থাকো আর তারপর হঠাৎ প্রতিকূল বাতাসের বেগ বেড়ে যায়, চারদিক থেকে তরঙ্গ আঘাত করতে থাকে এবং মুসাফিররা মনে করতে থাকে, তারা চারদিকে থেকে ঝনঝা পরিবৃত হয়ে পড়েছে, তখন সবাই নিজের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তাঁরই কাছে দোয়া করতে থাকো এই বলেঃ “হে আল্লাহ‌ যদি তুমি আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হবো। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে বাঁচিয়ে দেন তখন এই লোকেরাই সত্যচ্যূত হয়ে পৃথিবীতে বিদ্রোহ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।”

সূরা বনী ইসরাঈলে একথাটিরই পুনরাবৃত্তি এভাবে করা হয়েছেঃ “যখন সমুদ্রে তোমাদের ওপর বিপদ আসে তখন সেই একজন ছাড়া আর যাদেরকে তোমরা ডাকতে তারা সবাই হারিয়ে যায়। কিন্তু যখন তিনি তোমাদের বাঁচিয়ে স্থলভাগে পৌঁছিয়ে দেন তখন তোমরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” ( ৬৭ আয়াত )

এ আয়াতগুলো সামনে রেখে চিন্তা করুন, লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার সেই রব কে এবং কেমন, যার ইবাদাত বন্দেগী করার জন্য আপনি আমাদের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন? তিনি এর জবাবে করলেনঃ هُوَ اللَّهُ তিনি আল্লাহ! এ জবাব থেকে আপনা আপনি এ অর্থ বের হয়, যাকে তোমরা নিজেরাই নিজেদের ও সারা বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, প্রভু, আহারদাতা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক বলে মানো এবং কঠিন সংকটময় মুহূর্তে অন্য সব মাবুদদের পরিত্যাগ করে একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য করার আবেদন জানাও, তিনিই আমার রব এবং তাঁরই ইবাদাত করার দিকে আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। এ জবাবের মধ্যে আল্লাহর সমস্ত পূর্ণাংগ গুণাবলী আপনা আপনি এসে পড়ে। কারণ যিনি এ বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা, যিনি এর বিভিন্ন বিষয়ের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করেন, যিনি এর মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীর আহার যোগান এবং বিপদের সময় নিজের বান্দাদের সাহায্য করেন তিনি জীবিত নন, শুনতে ও দেখতে পান না, স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন, সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী নন, করুণাময় ও স্নেহশীল নন এবং সবার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী নন, একথা আদতে কল্পনাই করা যায় না।

টিকা:৩) ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে উলামায়ে কেরাম هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ বাক্যটির বিভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মতে যে বিশ্লেষণটি এখানকার সাথে পুরোপুরি খাপ খায় সেটি হচ্ছেঃ هُوَ উদ্দেশ্য (Subject) اَللهُ আল্লাহ‌ তার বিধেয় (Predicate) এবং اَحَدٌ তার দ্বিতীয় বিধেয়। এ বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে এ বাক্যটিতে অর্থ হচ্ছে, তিনি (যাঁর সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছো) আল্লাহ‌ একক। অন্য অর্থে এও হতে পারে এবং ভাষারীতির দিক দিয়ে এটা ভুলও নয় যে, তিনি আল্লাহ‌ এক। সর্বপ্রথম একথাটি বুঝে নিতে হবে যে, এ বাক্যটিতে মহান আল্লাহর জন্য “আহাদ” শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা আরবী ভাষায় এ শব্দটির একটি অস্বাভাবিক ব্যবহার। সাধারণত অন্য একটি শব্দের সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যেমনঃ يَوْمُ الْاَحَدِ “সপ্তাহের প্রথম দিন।” অনুরূপভাবে فَابْعَثُوْا اَحَدُكُمْ “তোমাদের কোন একজনকে পাঠাও।” অথবা সাধারণ নেতিবাচক অর্থে এর ব্যবহার হয়। যেমনঃ مَاجَاءَ نِى اَحَدٌ “আমার কাছে কেউ আসেনি।” কিংবা ব্যাপকতার ধারণাসহ প্রশ্ন সূচক বাক্যে বলা হয়। যেমনঃ هَلْ عِنْدِكَ اَحَدٌ “তোমার কাছে কি কেউ আছে?” অথবা এ ব্যাপকতার ধারণাসহ শর্ত প্রকাশক বাক্যে এর ব্যবহার হয় যেমনঃ هَلْ عِنْدِكَ اَحَدٌ “যদি তোমার কাছে কেউ এসে থাকে।” অথবা গণনায় বলা হয়। যেমনঃ اَحَدٌ , اِثْنَانِ , اَحَدَ عَشَرَ “এক, দুই, এগার।” এ সীমিত ব্যবহারগুলো ছাড়া কুরআন নাযিলের পূর্বে আরবী ভাষায় اَحَدٌ (আহাদ) শব্দটির গুণবাচক অর্থে ব্যবহার অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা জিনিসের গুণ প্রকাশ অর্থে “আহাদ” শব্দের ব্যবহারের কোন নজির নেই। আর কুরআন নাযিলের পর এ শব্দটি শুধুমাত্র আল্লাহর সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এ অস্বাভাবিক বর্ণনা পদ্ধতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথা প্রকাশ করে যে, একক ও অদ্বিতীয় হওয়া আল্লাহর বিশেষ গুণ। বিশ্ব-জাহানের কোন কিছুই এ গুণে গুণান্বিত নয়। তিনি এক ও একক, তাঁর কোন দ্বিতীয় নেই।

তারপর মুশরিক ও কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর রব সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন করেছিল সেগুলো সামনে রেখে দেখুন, هُوَ اللهُ বলার পর اَحَدٌ বলে কিভাবে তার জবাব দেয়া হয়েছেঃ

প্রথমত, এর মানে হচ্ছে, তিনি একাই রব। তাঁর ‘রবুবিয়াতে’ কারো কোন অংশ নেই। আর যেহেতু ইলাহ (মাবুদ) একমাত্র তিনিই হতে পারেন যিনি রব (মালিক ও প্রতিপালক) হন, তাই ‘উলুহীয়াতে’ও (মাবুদ হবার গুণাবলী) কেউ তাঁর সাথে শরীক নেই।

দ্বিতীয়ত, এর মানে এও হয় যে, তিনি একাই এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা। এ সৃষ্টিকর্মে কেউ তাঁর সাথে শরীক নয়। তিনি একাই সমগ্র বিশ্ব-রাজ্যের মালিক ও একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি একাই বিশ্ব-ব্যবস্থার পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। নিজের সমগ্র সৃষ্টি জগতের রিযিক তিনি একাই দান করেন। সংকটকালে তিনি একাই তাদের সাহায্য করেন ও ফরিয়াদ শোনেন। আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের এসব কাজকে তোমরা নিজেরাও আল্লাহর কাজ বলে মনে করো, এসব কাজে আর কারো সামান্যতম কোন অংশ নেই।

তৃতীয়ত, তারা একথাও জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি কিসের তৈরি? তাঁর বংশধারা কি? তিনি কোন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত? দুনিয়ার উত্তরাধিকার তিনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন? এবং তারপর কে এর উত্তরাধিকারী হবে? আল্লাহ‌ তাদের এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব একটিমাত্র “আহাদ” শব্দের মাধ্যমে দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছেঃ

(১) তিনি এক আল্লাহ‌ চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তাঁর আগে কেউ আল্লাহ‌ ছিল না এবং তাঁর পরেও কেউ আল্লাহ‌ হবে না।

(২) আল্লাহর এমন কোন প্রজাতি নেই, যার সদস্য তিনি হতে পারেন। বরং তিনি একাই আল্লাহ‌ এবং তাঁর সমগোত্রীয় ও সমজাতীয় কেউ নেই।

(৩) তাঁর সত্তা নিছক وَاحِدٌ এক নয় বরং اَحَدٌ একক, যেখানে কোন দিক দিয়ে একাধিক্যের সামান্যতম স্পর্শও নেই। তিনি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত কোন সত্তা নন। তাঁর সত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করা যেতে পারে না। তার কোন আকার ও রূপ নেই। তা কোন স্থানের গণ্ডীতে আবদ্ধ নয় এবং তার মধ্যে জিনিস আবদ্ধ হতে পারে না। তাঁর কোন বর্ণ নেই। কোন অংগ-প্রত্যংগ নেই। কোন দিক নেই। তাঁর মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটে না। সকল প্রকার ধরন ও প্রকরণ মুক্ত ও বিবর্জিত তিনি একমাত্র সত্তা, যা সবদিক দিয়েই আহাদ বা একক। (এ পর্যায়ে একথাটি ভালোভাবে ব্যবহার করা হয় যেমনভাবে আমাদের ভাষায় আমরা “এক” শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকি। বিপুল সংখ্যা সম্বলিত কোন সমষ্টিকেও তার সামগ্রিক সত্তাকে সামনে রেখে “ওয়াহেদ” বা “এক” বলা হয়। যেমন এক ব্যক্তি, এক জাতি, এক দেশ, এক পৃথিবী, এমন কি এক বিশ্ব-জাহানও। আবার কোন সমষ্টির প্রত্যেক অংশকেও আলাদা আলাদাভাবেও “এক”-ই বলা হয়। কিন্তু “আহাদ” বা একক শব্দটি আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারো জন্য ব্যবহার করা হয় না। এজন্য কুরআন মজীদে যেখানেই আল্লাহর জন্য ওয়াহেদ (এক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই বলা হয়েছেঃ “ইলাহুন ওয়াহেদ” এক মাবুদ বা “আল্লাহুল ওয়াহেদুল কাহহার” এক আল্লাহই সবাইকে বিজিত ও পদানত করে রাখেন। কোথাও নিছক “ওয়াহেদ” বলা হয়নি। কারণ যেসব জিনিসের মধ্যে বিপুল ও বিশাল সমষ্টি রয়েছে তাদের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিপরীতপক্ষে আহাদ শব্দটি একমাত্র আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ আল্লাহই একমাত্র সত্তা ও অস্তিত্ব যার মধ্যে কোন প্রকার একাধিক্য নেই। তাঁর একক সত্তা সবদিক দিয়েই পূর্ণাংগ।

সুরা: আল-ইখলাস
আয়াত নং :-2
টিকা নং:4,

اَللّٰهُ الصَّمَدُۚ

আল্লাহ কারোর ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল।৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) মূলে “সামাদ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ص م د ধাতু থেকে। আরবী ভাষায় এ ধাতুটি থেকে যতগুলো শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর ওপর নজর বুলালে এ শব্দটির অর্থের ব্যাপকতা জানা যায়। যেমনঃ

اَلصَّمَدُ মনস্থ করা, ইচ্ছা করা। বিপুলায়তন বিশিষ্ট উন্নত স্থান এবং বিপুল ঘনত্ব বিশিষ্ট উন্নত মর্যাদা। উচ্চ সমতল ছাদ। যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হয় না। প্রয়োজনের সময় যে সরদারের শরণাপন্ন হতে হয়।

اَلصَّمَدُ : প্রত্যেক জিনিসের উঁচু অংশ। যে ব্যক্তির ওপরে আর কেউ নেই। যে নেতার আনুগত্য করা হয় এবং তার সাহায্য ছাড়া কোন বিষয়ের ফায়সালা করা হয় না। অভাবীরা যে নেতার শরণাপন্ন হয়। চিরন্তন উন্নত মর্যাদা। এমন নিবিড় ও নিচ্ছিদ্র যার মধ্যে কোন ছিদ্র, শূন্যতা ও ফাঁকা অংশ নেই, যেখান থেকে কোন জিনিস বের হতে পারে না এবং কোন জিনিস যার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধা-তৃষ্ণার শিকার হয় না।

اَلْمُصْمَدُ : জমাট জিনিস, যার পেট নেই।

اَلْمُصْمَدُ : যে লক্ষ্যের দিকে যেতে মনস্থ করা হয়; যে কঠিন জিনিসের মধ্যে কোন দুর্বলতা নেই।

بَيْتٌ مُصْمَدٌ : এমন গৃহ, প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য যার আশ্রয় নিতে হয়।

بَنَاءٌ مُصْمَد : উঁচু ইমারত।

صَمَدَهُ وَصَمَدَ اِلَيْهِ صَمْدًا : ঐ লোকটির দিকে যাওয়ার সংকল্প করলো।

اَصْمَدَ اِلَيْهِ الْاَمْرُ : ব্যাপারটি তার হাতে সোপর্দ করলো; তার সামনে ব্যাপারটি পেশ করলো; বিষয়টি সম্পর্কে তার ওপর আস্থা স্থাপন করলো। (সিহাহ, কামূস ও লিসানুল আরব)

এসব শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থের ভিত্তিতে “আল্লাহুস সামাদ” আয়াতটিতে উল্লেখিত “সামাদ” শব্দের যে ব্যাখ্যা সাহাবা, তাবেঈ ও পরবর্তীকালের আলেমগণ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে নিচে আমরা তা উল্লেখ করছিঃ হযরত আলী (রা.), ইকরামা ও কা’ব আহবার বলেছেনঃ সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা যাঁর ওপরে আর কেউ নেই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও আবু ওয়ায়েল শাকীক ইবনে সালামাহ বলেছেনঃ তিনি এমন সরদার, নেতা ও সমাজপতি, যাঁর নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাসের দ্বিতীয় উক্তি হচ্ছেঃ লোকেরা কোন বিপদে-আপদে যার দিকে সাহায্য লাভের জন্য এগিয়ে যায়, তিনি সামাদ। তাঁর আর একটি উক্তি হচ্ছেঃ যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেনঃ যিনি কারো ওপর নির্ভরশীল নন, সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল, তিনিই সামাদ।

ইকরামার আর একটি বক্তব্য হচ্ছেঃ যার মধ্য থেকে কোন জিনিস কোনদিন বের হয়নি এবং বের হয়ও না আর যে পানাহার করে না, সে-ই সামাদ। এরই সমার্থবোধক উক্তি সা’বী ও মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কুরাযী থেকেও উদ্ধৃত হয়েছে।

সুদ্দী বলেছেনঃ আকাংখিত বস্তু লাভ করার জন্য লোকেরা যার কাছে যায় এবং বিপদে সাহায্য লাভের আশায় যার দিকে হাত বাড়ায়, তাকেই সামাদ বলে।

সাঈদ আবনে জুবাইর বলেছেনঃ যে নিজের সকল গুণ ও কাজে পূর্ণতার অধিকারী হয়।

রাবী ইবনে আনাস বলেছেনঃ যার ওপর কখনো বিপদ-আপদ আসে না। মুকাতেল ইবনে হাইয়ান বলেছেনঃ যিনি সকল প্রকার দোষ ত্রুটি মুক্ত। ইবনে কাইসান বলেছেনঃ অন্য কেউ যার গুণাবলীর ধারক হয় না।

হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেছেনঃ যে বিদ্যমান থাকে এবং যার বিনাশ নেই। প্রায় এই একই ধরনের উক্তি করেছেন মুজাহিদ, মা’মার ও মুররাতুল হামদানী।

মুররাতুল হামদানীর আর একটি উক্ত হচ্ছেঃ যে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ফায়সালা করে এবং যা ইচ্ছা তাই করে; যার হুকুম ও ফায়সালা পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা কারো থাকে না।

ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেনঃ যার দিকে লোকেরা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য এগিয়ে যায়।

আবু বকর আমবায়ী বলেছেনঃ সামাদ এমন এক সরদারকে বলা হয়, যার ওপরে আর কোন সরদার নেই এবং লোকেরা নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে ও নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য যার শরণাপন্ন হয়, অভিধানবিদদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই। আয যুজাজের বক্তব্য প্রায় এর কাছাকাছি। তিনি বলেছেনঃ যার ওপর এসে নেতৃত্ব খতম হয়ে গেছে এবং নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য প্রত্যেকে যার শরণাপন্ন হয়, তাকেই বলা হয় সামাদ।

এখন চিন্তা করুন, প্রথম বাক্যে “আল্লাহু আহাদ” কেন বলা হয়েছে এবং এ বাক্যে “আল্লাহুস সামাদ” বলা হয়েছে কেন? “আহাদ” সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলেছি, তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট আর কারো জন্য এ শব্দটি আদৌ ব্যবহৃত হয় না। তাই এখানে “আহাদুন” শব্দটি অনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে “সামাদ” শব্দটি অন্যান্য সৃষ্টির জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই “আল্লাহু সামাদুন” না বলে “আল্লাহুস সামাদ” বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে আসল ও প্রকৃত সামাদ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সৃষ্টি যদি কোন দিক দিয়ে সামাদ হয়ে থাকে তাহলে অন্য দিক দিয়ে তা সামাদ নয়। কারণ তা অবিনশ্বর নয়— একদিন তার বিনাশ হবে। তাকে বিশ্লেষণ ও বিভক্ত করা যায়। তা বিভিন্ন উপাদান সহযোগে গঠিত। যে কোন সময় তার উপাদানগুলো আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোন কোন সৃষ্টি তার মুখাপেক্ষী হলেও সে নিজেও আবার কারো মুখাপেক্ষী। তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আপেক্ষিক, নিরংকুশ নয়। কারো তুলনায় সে শ্রেষ্ঠতম হলেও তার তুলনায় আবার অন্য কেউ আছে শ্রেষ্ঠতম। কিছু সৃষ্টির কিছু প্রয়োজন সে পূর্ণ করতে পারে, কিন্তু সবার সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই। বিপরীতপক্ষে আল্লাহর সামাদ হবার গুণ অর্থাৎ তাঁর মুখাপেক্ষীহীনতার গুণ সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ। সারা দুনিয়া তাঁর মুখাপেক্ষী তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস নিজের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব এবং প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য সচেতন ও অবচেতনভাবে তাঁরই শরণাপন্ন হয়। তিনিই তাদের সবার প্রয়োজন পূর্ণ করেন। তিনি অমর, অজয়, অক্ষম, তিনি রিযিক দেন— নেন না। তিনি একক— যৌগিক ও মিশ্র নন। কাজেই বিভক্তি ও বিশ্লেষণযোগ্য নন। সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তিনি “সামাদ” নন বরং “আসসামাদ।” অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি মূলত সামাদ তথা অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত।

আবার যেহেতু তিনি “আসসামাদ” তাই তাঁর একাকী ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরিহার্য। কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন, যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না, বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়। দুই বা তার চেয়ে বেশী সত্তা সবার প্রতি অমুখাপেক্ষী ও অনির্ভরশীল এবং সবার প্রয়োজন পূরণকারী হতে পারে না। তাছাড়া তাঁর “আসসামাদ” হবার কারণে তাঁর একক মাবুদ হবার ব্যাপারটিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ মানুষ যার মুখাপেক্ষী হয় তারই ইবাদাত করে। আবার তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, “আসসামাদ” হবার কারণে এটাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, যে প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা ও সামর্থ্যই রাখে না, কোন সচেতন ব্যক্তি তার ইবাদাত করতে পারে না।

সুরা: আল-ইখলাস
আয়াত নং :-3
টিকা নং:5,

لَمْ یَلِدْ١ۙ۬ وَ لَمْ یُوْلَدْۙ

তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনি কারোর সন্তান নন।৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৫) মুশরিকরা প্রতি যুগে খোদায়ীর এ ধারণা পোষণ করে এসেছে যে, মানুষের মতো খোদাদেরও একটি জাতি বা শ্রেণী আছে। তার সদস্য সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যে বিয়ে-শাদী এবং বংশ বিস্তারের কাজও চলে। তারা আল্লাহ‌ রাব্বুল আলামীনকেও এ জাহেলী ধারণা মুক্ত রাখেনি। তাঁর জন্য সন্তান-সন্ততিও ঠিক করে নিয়েছে। তাই কুরআন মজীদে আরববাসীদের আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তারা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহর কন্যা গণ্য করতো। তাদের জাহেলী চিন্তা নবীগণের উম্মাতদেরকেও সংরক্ষিত রাখেনি। তাদের মধ্যে নিজেদের সৎ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করার আকীদা জন্ম নেয়। এ বিভিন্ন ধরনের কাল্পনিক চিন্তা-বিশ্বাসের মধ্যে দুই ধরনের চিন্তা সবসময় মিশ্রিত হতে থেকেছে। কিছু লোক মনে করেছে, যাদেরকে তারা আল্লাহর সন্তান গণ্য করছে তারা সেই মহান পবিত্র সত্তার ঔরসজাত সন্তান। আবার কেউ কেউ দাবী করেছে, যাকে তারা আল্লাহর সন্তান বলছে, আল্লাহ‌ তাকে নিজের পালকপুত্র বানিয়েছেন। যদিও তাদের কেউ কাউকে (মাআ’যাল্লাহ) আল্লাহর পিতা গণ্য করার সাহস করেনি। কিন্তু যখন কোন সত্তা সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, তিনি সন্তান উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের দায়িত্বমুক্ত নন এবং তাঁর সম্পর্কে ধারণা করা হয়, তিনি মানুষ জাতীয় এক ধরনের অস্তিত্ব, তাঁর ঔরসে সন্তান জন্মলাভ করে এবং অপুত্রক হলে তার কাউকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন মানুষের মন তাঁকেও কারো সন্তান মনে করার ধারণা মুক্ত থাকতে পারে না। এ কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, আল্লাহর বংশধারা কি? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, কার কাছ থেকে তিনি দুনিয়ার উত্তরাধিকার লাভ করেছেন এবং তাঁর পরে এর উত্তরাধিকারী হবে কে? এসব জাহেলী মূর্খতা প্রসূত ধারণা-কল্পনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এগুলোকে যদি নীতিগতভাবে মেনে নিতে হয়, তাহলে আরো কিছু জিনিসকেও মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমনঃ

একঃ আল্লাহ‌ এক নয়, বরং আল্লাহর কোন একটি জাতি ও গোষ্ঠী আছে। তাদের সদস্যরা আল্লাহর গুণাবলী, কার্যকলাপ ও কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় তাঁর সাথে শরীক। আল্লাহর কেবলমাত্র ঔরসজাত সন্তান ধারণা করে নিলে এ বিষয়টি অপরিহার্য হয় না, বরং কাউকে পালকপুত্র হিসেবে ধারণা করে নিলেও এটি অপরিহার্য হয়। কেননা কারো পালকপুত্র অবশ্যি তারই সমজাতীয় ও সমগোত্রীয়ই হতে পারে। আর (মা’আযাল্লাহ) যখন সে আল্লাহর সমজাতীয় ও সমগোত্রীয় হয়, তখনই সে আল্লাহর গুণাবলী সম্পন্নও হবে, একথা অস্বীকার করা যেতে পারে না।

দুইঃ পুরুষ ও নারীর মিলন ছাড়া কোন সন্তানের ধারণা ও কল্পনা করা যেতে পারে না। বাপ ও মায়ের শরীর থেকে কোন জিনিস বের হয়ে সন্তানের রূপ লাভ করে—-সন্তান বলতে একথাই বুঝায়। কাজেই এক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তান ধারণা করার ফলে (নাউযুবিল্লাহ) তাঁর একটি বস্তুগত ও শারীরিক অস্তিত্ব, তাঁর সমজাতীয় কোন স্ত্রীর অস্তিত্ব এবং তাঁর শরীর থেকে কোন বস্তু বের হওয়াও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

তিনঃ সন্তান উৎপাদন ও বংশধারা চালাবার কথা যেখানে আসে সেখানে এর মূল কারণ হয় এই যে, ব্যক্তিরা হয় মরণশীল এবং তাদের জাতির ও গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের সন্তান উৎপাদন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, এ সন্তানদের সাহায্যেই তাদের বংশধারা অব্যাহত থাকবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কাজেই আল্লাহর সন্তান আছে বলে মনে করলে (নাউযুবিল্লাহ) তিনি নিজে যে মরণশীল এবং তাঁর বংশ ও তাঁর নিজের সত্তা কোনটিই চিরন্তন নয় একথা মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া সমস্ত মরণশীল ব্যক্তির মতো (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহরও কোন শুরু ও শেষ আছে, একথাও মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে যায়। কারণ, সন্তান উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের ওপর যেসব জাতি ও গোত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাদের ব্যক্তিবর্গ অনাদি-অনন্তকালীন জীবনের অধিকারী হয় না।

চারঃ কারো পালকপুত্র বলবার উদ্দেশ্য এ হয় যে, একজন সন্তানহীন ব্যক্তি তার নিজের জীবনে কারো সাহায্যের এবং নিজের মৃত্যুর পর কোন উত্তারাধিকারের প্রয়োজন বোধ করে। কাজেই আল্লাহ‌ কাউকে নিজের পুত্র বানিয়েছেন একথা মনে করা হলে সেই পবিত্র সত্তার সাথে এমন সব দুর্বলতা সংশ্লিষ্ট করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যেগুলো মরণশীল মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। যদিও মহান আল্লাহকে “আহাদ” ও “আসসামাদ” বললে এসব উদ্ভট ধারণা-কল্পনার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, তবুও এরপর “না তাঁর কোন সন্তান আছে, না তিনি কারো সন্তান”—একথা বলায় এ ব্যাপারে আর কোন প্রকার সংশয়-সন্দেহের অবকাশই থাকে না। তারপর যেহেতু আল্লাহর মহান সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা-কল্পনা শিরকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্তর্ভুক্ত, তাই মহান আল্লাহ‌ শুধুমাত্র সূরা ইখলাসেই এগুলোর দ্ব্যর্থহীন ও চূড়ান্ত প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। এভাবে লোকেরা সত্যকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ নীচের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারেঃ

إِنَّمَا اللَّهُ إِلَهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ (النساء :171)

“আল্লাহ-ই হচ্ছেন একমাত্র ইলাহ। কেউ তাঁর পুত্র হবে, এ অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত-পাক-পবিত্র। যা কিছু আকাশসমূহের মধ্যে এবং যা কিছু যমীনের মধ্যে আছে, সবই তার মালিকানাধীন।” ( আন নিসা, ১৭১ )

أَلَا إِنَّهُمْ مِنْ إِفْكِهِمْ لَيَقُولُونَ – وَلَدَ اللَّهُ وَإِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ

“জেনে রাখো, এরা যে বলছে আল্লাহর সন্তান আছে, এটা এদের নিজেদের মনগড়া কথা। আসলে এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা।” ( আস সাফফাত, ১৫১-১৫২ )

وَجَعَلُوا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجِنَّةِ نَسَبًا وَلَقَدْ عَلِمَتِ الْجِنَّةُ إِنَّهُمْ لَمُحْضَرُونَ

“তারা আল্লাহ‌ ও ফেরেশতাদের মধ্যে বংশীয় সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে অথচ ফেরেশতারা ভালো করেই জানে এরা (অপরাধী হিসেবে) উপস্থাপিত হবে।” ( আস সাফফাত, ১৫৮ )

وَجَعَلُوا لَهُ مِنْ عِبَادِهِ جُزْءًا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَكَفُورٌ مُبِينٌ

“লোকেরা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে তাঁর অংশ বানিয়ে ফেলেছে। আসলে মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।” ( আয্‌ যুখরুফ, ১৫ )

وَجَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ الْجِنَّ وَخَلَقَهُمْ وَخَرَقُوا لَهُ بَنِينَ وَبَنَاتٍ بِغَيْرِ عِلْمٍ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يَصِفُونَ – بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ – (الانعام : 100-101)

“আর লোকেরা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়েছে। অথচ তিনি তাদের স্রষ্টা। আর তারা না জেনে বুঝে তাঁর জন্য পুত্র-কন্যা বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তারা যে সমস্ত কথা বলে তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র এবং তার উর্ধ্বে তিনি অবস্থান করছেন। তিনি তো আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। তাঁর পুত্র কেমন করে হতে পারে যখন তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।” ( আল আন’আম, ১০০-১০১)

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ

“আর তারা বললো, দয়াময় আল্লাহ‌ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন। তিনি পাক-পবিত্র। বরং (যাদেরকে এরা তাঁর সন্তান বলছে) তারা এমন সব বান্দা যাদেরকে মর্যাদা দান করা হয়েছে।” ( আল আম্বিয়া, ২৬)

قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ هُوَ الْغَنِيُّ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ إِنْ عِنْدَكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بِهَذَا أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

“লোকেরা বলে দিয়েছে, আল্লাহ‌ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন আল্লাহ‌ পাক-পবিত্র! তিনি তো অমুখাপেক্ষী। আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর মালিকানাধীন। এ বক্তব্যের সপক্ষে তোমাদের প্রমাণ কি? তোমরা কি আল্লাহর সম্পর্কে এমনসব কথা বলছো, যা তোমরা জানো না?” ( ইউনুস, ৬৮ )

وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ وَلِيٌّ مِنَ الذُّلِّ

“আর হে নবী! বলে দাও, সেই আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা যিনি না কাউকে পুত্র বানিয়েছেন, না বাদশাহীতে কেউ তাঁর শরীক আর না তিনি অক্ষম, যার ফলে কেউ হবে তাঁর পৃষ্ঠপোষক।” ( বনী ইসরাঈল, ১১১ )

مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِنْ وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَهٍ

“আল্লাহ কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে দ্বিতীয় কোন ইলাহও নেই।” ( আল মু’মিনূন, ৯১ )

যারা আল্লাহর জন্য ঔরসজাত সন্তান অথবা পালকপুত্র গ্রহণ করার কথা বলে, এ আয়াতগুলোতে সর্বতোভাবে তাদের এহেন আকীদা-বিশ্বাসের প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ আয়াতগুলো এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য যে সমস্ত আয়াত কুরআনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়, সেগুলো সূরা ইখলাসের অতি চমৎকার ব্যাখ্যা।

সুরা: আল-ইখলাস
আয়াত নং :-4
টিকা নং:6,

وَ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ۠

এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) মূলে বলা হয়েছে কুফূ (كفو) এর মানে হচ্ছে নজীর, সদৃশ, সমান, সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমতুল্য। বিয়ের ব্যাপারে আমাদের দেশে কুফূ শব্দের ব্যবহার আছে। এক্ষেত্রে এর অর্থ হয়, সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে ছেলের ও মেয়ের সমান পর্যায়ে অবস্থান করা। কাজেই এখানে এ আয়াতের মানে হচ্ছেঃ সারা বিশ্ব-জাহানের আল্লাহর সমকক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদা সম্পন্ন কিংবা নিজের গুণাবলী, কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোনদিন ছিল না এবং কোন দিন হতেও পারবে না।

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : সহীহ হাদীসমমূহের ভিত্তিতে এই সূরা কোরআন মজীদের এক-তৃতীয়াংশ ৷ বোখারী শরীফে হযরত আবু সাঈদ (রা.)-এর বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, এক ব্যক্তি আরেক জন ব্যক্তিকে বারবার এ সূরার পুনরাবৃত্তি করতে শুনলেন ৷ তিনি সকাল বেলায় রসূল (স.)-এর দরবারে হাযির হয়ে এই ঘটনা তাকে বললেন। তিনি বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, এত ছোট্ট একটি সূরা বারবার পড়ার কী প্রয়োজন আছে। ঘটনা শোনার পর রসূল (স.) বললেন, কসম সেই মহান সত্ত্বার যার হাতে আমার জীবন, এই সূরা হচ্ছে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ এবং এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কেননা, যে একত্ববাদের ঘোষণা আল্লাহ তায়ালা তার নবীর কাছে দিয়েছেন এই ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ হচ্ছে সেই একত্ববাদেরই মূলকথা ৷ এটি আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাখ্যা ও মানুষের জন্যে তার জীবন পদ্ধতিও বর্ণনা করে। ইসলামী তত্ত্বকথার বড়ো বড়ো কথাগুলোর মধ্যে এর স্থান অনেক শীর্ষে অবস্থিত ।

ফী জিলালিল কুরআন:

‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ বর্ণিত ‘আহাদ’ শব্দটি অনেক সূক্ষ। এই শব্দটি প্রথমেই এর সাথে একথাটি যোগ করে দেয় যে তিনি ছাড়া অন্য কোনো কিছ তার সাথে নেই । এবং এটাও সত্য আল্লাহ তায়ালার একত্তের অর্থ হচ্ছে অস্তিত্বে তিনি একা । তার অস্তিত্বের একথা ছাড়া আর কিছুই সত্য নয়, তার অস্তিত্ব ছাড়া অন্য কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই। তিনি ছাড়া অন্য যা কিছু আছে তা তারই দান। তার কাছ থেকেই সাহায্য গ্রহণ করে এবং নিজেদের অস্তিত্বের ধারণাও এবং তার মূল অস্তিত্ব থেকে গ্রহণ করে। এ কারণেই এই একত্ব হচ্ছে সবকিছুর কর্তা । অতএব তিনি ছাড়া আর কেউই করনেওয়ালা নেই। অন্য কারো কোনো প্রভাবও নেই ৷ অর্থাৎ এ বিশ্ব জগতের সবকিছুর অস্তিত্ব সত্যিকার অর্থে স্থায়ী কোনো অস্তিত্ব থাকলে তা আল্লাহ তায়ালারই আছে, অন্য কারো নয়। এ থেকে এ কথা জানা যায় যে, এই সূরায় বর্ণিত আকীদায় মানুষের বিশ্বাসগত আকীদা ও তার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা এ উভয়টাই প্রমাণ করে। তাওহীদের রূপরেখা ও উপকারীতা : সব তাওহীদের ব্যাখ্যা ও ধারণা যখন একবার মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন তার মন ধরনের সন্দেহ, সব ধরনের সন্দেহ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তার মন এমন সব কিছু থেকেই আলাদা হয়ে যায়, যা সে তার অস্তিত্বের ধারণা এবং তার ক্রিয়াকর্মে কর্তার ভূমিকায় একক ও অদ্বিতীয় সত্তার সাথে সাংঘর্ষিক দেখতে পায়। যদি সব কয়টি জিনিসের অস্তিত্বের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত না হতে পারে তবে অন্তত অন্যকিছুর তুলনা থেকে তা তাকে মুক্ত করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্বই আসল নয়। আল্লাহর কর্তা-বাচকের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কিছুই সত্য নয়। মনে তখন একক সত্যের অনুভূতি ছাড়া অন্য কোনো ধারণাই অবশিষ্ট থাকে না এবং এই সত্যের বাইরে অন্য সব কিছুর সম্পর্ক থেকেই তার মন পরিষ্কার হয়ে যায়৷ তখন সে সব ধরনের বিধি-বন্ধন থেকেও মুক্ত হয়ে যায়। নিয়মনীতির বাধা থেকেও তার মুক্তি মেলে । সব আকর্ষন থেকে মুক্ত হয়ে যায়, ভয়ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে যায়, যা অনেক কয়টি বিধি নিষেধের মূল ৷ যখন সে আল্লাহ তায়ালাকেই পেয়ে যায় তখন তার সামনে আর দ্বিতীয় কোনো লক্ষ্য থাকে না। এ অবস্থায় অন্য কিছুর আকর্ষণ তার কি কাজে লাগবে? যখন সে জেনে যায় যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারোই কিছু করার ক্ষমতা নেই। তখন সে কাকে ভয় করবে? অতএব অস্তিত্বের মূলগত ব্যাপারে যখন আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সে অন্য কোনো সত্যকে দেখতে পায় না এমন ধরনের একটি ধারণা তার মনে সৃষ্টি হলো, তখন তার মনে এই ধারণাও সৃষ্টি হয় যে, সবকিছুর অস্তিত্বের মূলে সেই আসল ও খাটি অস্তিত্বই ক্রিয়াশীল ৷ কেননা সব অস্তিত্বের ধারণা ও সৃষ্টি তো মূল সত্ত্বার অস্তিত্ব থেকেই এসেছে। আর এই হচ্ছে সে পর্যায়, যখন যা-ই দেখে তাতে সে আল্লাহর হাতকেই দেখতে পায়। এরপর আরো এক স্তর ওপরে উঠে সে এই কায়েনাতের সর্বত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কেননা দেখার মতো আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনো কিছুই তো নেই । তিনিই একমাত্র সত্য । এভাবেই আস্তে আস্তে তার অন্তর থেকে ‘উপায় উপকরণ কোনো কিছু করতে পারে’ এই বিশ্বাসই বিলীন হয়ে যায়। এভাবেই মানুষ প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি ঘটনা দুর্ঘটনাকে তার মূল উৎসের দিকে ফিরিয়ে নেবে যেখান থেকে তা শুরু হয়েছে এবং যা দিয়ে তা প্রভাবান্বিত হয়েছে । এই মহাসত্যটাকেই কোরআন বহুভাবে ঈমানদারদের মনে বসাতে চেষ্টা করেছে। এ কারণে সে কোনো ব্যাপারের বাহ্যিক কারণ না খুঁজে তাকে সরাসরি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও এরাদার সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়। কোরআনের আরো অনেক আয়াতে এই সত্যের দিকে ইংগিত প্রদান করা হয়েছে। যখন সব কয়টি বাহ্যিক উপায়-উপকরণকে সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া যায় এবং সমগ্র বিষয়কেই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও এরাদার সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়, তখন মনে দারুণ প্রশান্তি আসে । মানুষ যখন সে একক সত্ত্বার সন্ধান পেয়ে যায় তখন তার যা কিছুর প্রতি আকর্ষণ হয় তা শুধু তার কাছেই চায় । যতো কিছুকেই তার ভয় হয় তা থেকে বাঁচার জন্যে শুধু আল্লাহর কাছেই দোয়া করবে। এ অবস্থায় সব বাহ্যিক উপায় উপকরণ, ক্রিয়াকলাপের ফলাফল ও প্রভাব কোনোটাই তার মানসিক প্রশাস্তি নষ্ট করতে পারে না বরং এগুলো দেখে সে আরো বেশী পরিতৃপ্তি পায়। কারণ সে জানে এগুলোর কোনোই মূল্য নেই, এগুলো কোনোটাই কিছু করতে পারে না। সবকিছুর চূড়ান্ত ক্ষমতা এককভাবে আলাহ তায়ালার হাতেই ৷ এ হচ্ছে সে পর্যায়গুলো যা ‘তাসাউফের’ অনুসারীরা অবলম্বন করেছেন, কিন্তু তারা এ পর্যায়গুলোকে টেনে অনেক দুরে নিয়ে গেছেন। কেননা, ইসলাম মানুষের কাছে এই চায় যে, মানুষ এই মহাসত্যের দিকে চলার পথ যেন এভাবে দেখে নেয় যে তাদের এই দুনিয়ার বাস্তব মানুষের জীবনই তাকে কাটাতে হবে এবং এ যমীনে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের সব বিভাগগুলোকে সমভাবে গ্রহণ করে চলতে হবে। তার সাথে সাথে এই সত্যকেও মনে রাখবে যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনো সত্য নেই। তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কিছুর অস্তিত্বও নেই৷ তিনি ছাড়া আর কেউই কিছু করতে সক্ষম নয় এবং এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ সে গ্রহণ করবে না। এখান থেকেই জীবনের জন্যে পূর্ণাঙ্গ বিধানের প্রশ্নটি শুরু হয়ে যায়, যা এই ব্যাখ্যা ও এর আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ এ থেকে যে ধ্যান-ধারণা, অনুভূতি ও সংকল্প তৈরী হয় জীবনের ব্যবস্থা তার ওপরেই দাড়িয়ে থাকে। এই হচ্ছে একক আল্লাহর আনুগত্যের পথ, যিনি ছাড়া আর কারো অস্তিত্বের কোনোই সত্যতা নেই, তিনি ছাড়া এই বিশ্বজগতে অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। তার সংকল্প ছাড়া আর কারো কোনো সংকল্পের কোনোই প্রভাব নেই । এটা এমন এক পথ, যে পথে মানুষের ভালোবাসা, আকর্ষণ ও ভয়ভীতির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারো দিকেই আকৃষ্ট হয় না। আরাম ও কষ্টে, সুখ ও দুঃখে, নেয়ামত ও অভিশাপে শুধু বারবার তার দিকেই ফিরে যেতে হয়। কেননা, যার অস্তিত্ব মূলত কোনো অস্তিত্বই নয় তার দিকে চেয়ে কী লাভ? যিনি ছাড়া অন্য কেউই কিছু করতে পারে না তাকে বাদ দিয়ে অক্ষম কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকে কী হবে? এই পথ হচ্ছে সবকিছু এক আল্লাহর কাছ থেকে নেয়ার বিশ্বাস ও ধারণা, মর্যাদা ও মূল্যবোধ, মাপকাঠি ও পরিমাপযন্ত্র, শরীয়ত ও আইন-কানুন নিয়ম ও ব্যবস্থাপনা, শিষ্টাচার ও আনুষ্ঠানিকতা সবকিছুই একই সত্ত্বার কাছ থেকে নিতে হবে, যা সত্যিকার অর্থে একক সত্য- অন্য কিছুই এই মানের নয়। এ পথ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পথ যিনি একক ও মহান সত্ত্বা, তার কাছ থেকে ক্রিয়াকর্মের উৎসাহ ও প্রেরণা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে যাতে করে মানুষ তার কৃতকর্ম দিয়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছতে সক্ষম হয়। বাধা থেকে মুক্তি লাভ করে পথভ্রষ্টকারী বিষয় থেকে নাজাত হাসিল করতে পারে- চাই তা ব্যক্তি মানুষের মনের গভীরের কিছু হোক, অথবা তা যদি হয় মানুষের নিজস্ব কোনো ব্যক্তি ও জিনিস যা তার আশেপাশে ছড়িয়ে আছে কিংবা তা যদি হয় মানুষের নিজস্ব কোনো ব্যক্তিসত্ত্বার বিষয় অথবা সমগ্র সৃষ্টিকুলের কোনো জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ও ভীতির আকারে হোক, সর্বাবস্থায় এই পথ একজন ব্যক্তি মানুষকে কর্মের প্রেরণা যোগাবে । এ হচ্ছে এমন এক পথ-যার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের সাথে এই পৃথিবীর অন্য সব কয়টি জিনিসের স্নেহ ও মমতা, আকর্ষণ ও সহমর্মিতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয় । এসব কিছুর বিধি নিষেধ থেকে মুক্তি মানে এ নয় যে, এসব কিছুকে খারাপ মনে করতে হবে এবং ঘৃনায় মানুষ এসব কিছু থেকে দূরে সরে যাবে। এর সব কিছুই এসেছে আল্লাহর হাত দিয়ে, এগুলোর নিজেদের অস্তিত্বও সে অস্তিত্ব থেকেই পেয়েছে এবং এই সৃষ্টির সব কিছুতেই সে মৌলিক সত্যের অনুদান দৃষ্টিগোচর হবে৷ অতএব গোটা সৃষ্টি জগতের সব কিছুই আমাদের কাছে প্রিয়, কারণ এর প্রতিটি জিনিসই হচ্ছে প্রিয়জনের উপহার । এই পথ উন্মুক্ত ও অনেক উঁচু । এ পথে যমীন খুব ছোটো, বৈষয়িক জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত ৷ এই যিন্দেগীর সহায়-সম্পদ খুবই নগণ্য । এ পথের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে এই বিধিবন্ধন ও সীমাবদ্ধতা থেকে বাইরে চলে আসা ৷ তবে ইসলামের দৃষ্টিতে এ মুক্তির মানে দুনিয়ার জীবনকে ছেড়ে দেয়া কিংবা তাকে উদ্দেশ্যহীন মনে করা নয় এবং এটাকে ঘৃণা করে এ জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোও এর উদ্দেশ্য নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ সর্বদাই এ বৈষয়িক জীবনকে নিয়েই চলবে তবে মানবতার উৎকর্ষের থাতিরে তাকে সর্বদাই এসব কিছুর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। অপর কথায় এর অর্থ হচ্ছে মানুষদের তার সব কয়টি দায়দায়িত্ব সহই এ দুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব দেয়া হয়েছে। নেতৃত্বের আসনও তাকে দেয়া হয়েছে এ সবকিছুরই সাথে ৷ তবে সাথে সাথে প্রয়োজনে এ বৈষয়িক জীবনের বিধি-বন্ধন থেকে তার পূর্ণাঙ্গ আযাদীও সেখানে অবশিষ্ট থাকবে। আধুনিক গীর্জার পথ ধরে মানবতার যে মুক্তি আসে, তাকে বাহ্য দৃষ্টিতে মনে হয় খুবই সহজ । কিন্তু ইসলাম তা মোটেই চায় না। কেননা তার দৃষ্টিতে মুক্তির জন্যে খেলাফত তথা মানবতার পথ প্রদর্শন ইসলাম প্রদর্শিত এই পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । এই পথ যদিও কিছুটা কঠিন কিন্তু মানুষের মনুষত্বকে এটিই প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের অস্তিত্বের মাঝে উন্নত মান ও উচ্চতা বিরাজমান । তাই মানুষের আত্মাকে তার স্রষ্টার উৎসের দিকে সর্বদাই স্বাধীন করে রাখতে হবে এবং এ জন্যে সে পথেই একে চালাতে হবে যা আল্লাহ তায়ালা শিখিয়েছেন । এতক্ষণ পর্যন্ত যা কিছু বলা হলো তাকে ইসলামের প্রথম ও মৌলিক দাওয়াতের মূল ভিত্তি হিসেবে সামনে রাখুন । এই তাওহীদের ধারণা-বিশ্বাসকেই মানুষের হৃদয়ে বদ্ধমূল করে রাখা হয়েছে। কেননা তাওহীদ কিংবা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তাই হচ্ছে এর বিশ্বাসগত আকীদা-অস্তিত্বের ব্যাখ্যা ও জীবনের পূর্ণ বিধি-বিধান। এটা শুধু মুখে আওড়ানোর একটি বাক্য কিংবা অন্তরে বসিয়ে রাখার একটি ছবিই নয়। মূলত সবকিছুই হচ্ছে এই তাওহীদ । এই হচ্ছে জীবন বিধান, এই হচ্ছে দ্বীন । এরপর যা কিছুই এর ব্যাখ্যা ও পরিশিষ্ট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তা হচ্ছে এর ফলশ্রুতি মাত্র ৷ তাওহীদের এই মৌলিক বিশ্বাসকে এভাবেই অন্তরে বদ্ধমূল করতে হবে যেভাবে এর ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ তায়ালা এর আগে যাদের ওপর কেতাব নাযিল করেছেন তাদের মধ্যে যেসব ভাঙ্গন-বিপর্যয় ও গোড়ামি সৃষ্টি হয়েছে এবং তার ফলে তাদের বিশ্বাস কর্মধারা ও সমগ্র জীবন যেভাবে বদলে গেছে, তার মূল কারণ ছিলো এই যে, তাওহীদের নির্ভেজাল ধারণা তাদের অন্তর থেকে মিটে গেছে। এই মৌলিক গলদের কারণে তাদের জীবনের সর্বাংশে এই পরিবর্তনসমূহ সূচিত হয়েছে। তাওহীদের ইসলামী আকীদার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি মানুষের সমগ্র জীবনে ব্যাপৃত থাকে। এখানে জীবনের ভিত্তিই রাখা হয় এই আকীদা বিশ্বাসের ওপর । কর্মজীবনের ভিত্তিও এখানে একই জায়গায় । বিশ্বাস ও আইনে সর্বত্রই এ বিশ্বাসের প্রভাব থাকবে সমান সমান। প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, এক আল্লাহর শরীয়তই হবে জীবনের আইন ৷ যদি জীবনে ও জীবনের আইনে এসব প্রভাব বিদ্যমান না থাকে, তাহলে তাওহীদের এ বিশ্বাস সম্পূর্ণই মূল্যহীন ব্যাপার। কেননা কোথাও যখন তা প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার সব ক’টি প্রভাব নিয়েই সে প্রতিষ্ঠা লাভ করে । জীবনের সব কয়টি বিভাগ, সব কয়টি স্তর, সবখানেই সমভাবে তার প্রভাব পড়ে। আল্লাহ তায়ালা এক, এর মানে হচ্ছে, তিনি ‘সামাদ’ কারো মুখাপেক্ষী নন কারো ওপর নির্ভরশীলও নন। তার পিতা নেই, সন্তান নেই, না তার সমকক্ষ দ্বিতীয় কেউ আছে। অবশ্য কোরআন এ বিষয়টির আরো কিছু ব্যাখ্যা পেশ করার জন্যে বলেছে, ‘আল্লাহুস সামাদ’। ‘সামাদ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন এক সরদার, যার ইচ্ছা ও আদেশ ছাড়া কিছুই হয় না, কোনো সিদ্ধান্তও তার মরযী ছাড়া করা যায় না। আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি ছাড়া অদ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই। কেননা তিনি তার খোদায়ীতে একক, অন্য সবাই তার বান্দা। কিছু চাওয়া, কিছু আশা করার ব্যাপারে তার দিকেই ধাবিত হতে হয়। যারা তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের কথা শোনা ও তা যথাযথ পুরণ করার ব্যাপারে তিনি এক ও একক ৷ তিনিই হচ্ছেন সেই একক আল্লাহ তায়ালা, যার ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতিরেকে সমগ্র কায়েনাতে কিছুই সম্পাদিত হয় না। কোনো কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার কোনো সাথী নেই। তিনি যেহেতু এক তাই নির্ভরশীলতা ও মুখাপেক্ষীতার যাবতীয় দোষক্রটি থেকে তিনি মুক্ত । ‘লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইয়ুলাদ’ অর্থাৎ তিনিই প্রথম তিনিই শেষ ৷ নিজের অস্তিত্বের জন্যে তার কারো সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কের প্রয়োজন নেই৷ তাকে নিজের স্থায়িত্বের জন্যে কারো ওপর ভরসা করতে হয় না। তার অবস্থার কখনো পরিবর্তন হয় না। সর্বাবস্থায় তার গুণাবলী হচ্ছে বিধি বন্ধনহীন।জন্ম নেয়ার ভেতরে ত্রুটি ও দোষ থাকে৷ একটি জিনিস আগে ছিলো না জন্মের পরই অস্তিত্বে এসেছে। এ বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে অসম্ভব ও অবাস্তর। তাছাড়া জন্ম শব্দটির সাথে রয়েছে দু’জনের এক সমান হওয়ার সম্পর্ক ৷ এই বিষয়টিও আল্লাহ তায়ালার জন্যে অসম্ভব । এ কারণেই ‘আহাদ’ এ শব্দটির মাঝে জন্মদাতা ও জন্ম উভয় ধারণারই অস্বীকৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ’ অর্থাৎ তার কোনো সমকক্ষ নেই। অস্তিত্বের মূল সত্যেও নেই, সবকিছুই তিনি একা করেন, এ ধারণাতেও কেউ তার মতো নেই । তার নিজস্ব গুণাবলী অথবা অন্য কোনো গুণের ক্ষেত্রেও তার দ্বিতীয় কেউ নেই। একথাও তাঁর সে একা হওয়ার বিষয়টিকেই প্রমাণ করে । সম্পর্ণ একা হওয়ার এ হচ্ছে অপরিহার্য পরিণাম ৷ অবশ্য আলাদাভাবে একথাটা বলার মধ্যে এই গুণের আধিক্য ও এর অবশ্যম্ভাবিতাই বেশী প্রকাশ পেয়েছে। প্রকারান্তরে ভালোর খোদা একজন মন্দের খোদা আরেকজন এই বর্ণনা তাও অস্বীকার করে। সেখানে উভয় খোদার উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী পরস্পর বিরোধী একে অপরের উল্টো । এই দুই খোদার আক্বীদা ইরানী অগ্নিপূজকদের আকীদা থেকে এসেছে। তারা সব সময় আলো আঁধারের জন্যে মনে করে আলাদা খোদা রয়েছে। আরব উপদ্বীপের উত্তর দিকের কিছু এলাকায়ও এই ধারণা প্রচলিত ছিলো, যে সব এলাকায় ইরানীদের রাজত্ব ছিলো। এ সূরাটির তাওহীদের ইসলামী আকীদার স্বীকৃতি প্রদান করে। আর সূরায়ে ‘কাফেরূন’ তাওহীদ ও শিরকের আকীদার মাঝে কোনো প্রকার সামঞ্জস্য ও মিলমিশকে প্রত্যাখান করে । এ উভয় সূরার মাঝেই তাওহীদ বিশ্বাসের ভিন্ন ভিন্ন দুটি দিক বর্ণিত ও পরিস্ফূটিত হয়ে আছে। সহীহ হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী রসূল (স.) ফজরের সুন্নাত দুই রাকয়াতে এই দুই সূরা পড়ে দিনের আরম্ভ করতেন। এভাবে শুরু করার একটা গভীর ও উচুমানের উদ্দেশ্য নিহিত ছিলো ।

# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

সুরা: আল-ইখলাস

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

নামকরণ:

পবিত্র কুরআনুল কারীমের মাত্র দুটি সূরা যে সূরা দুটির নামকরণ সূরায় উল্লিখিত শব্দ বা সূরায় বর্ণিত ঘটনা থেকে করা হয়নি। বরং নামকরণ করা হয়েছে সূরার মুখ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। একটি হলো সূরা ফাতিহা আর দ্বিতীয়টি হলো সূরা ইখলাস। অত্র সূরায় একজন সত্যিকার মা‘বূদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।

الإخلَاص শব্দের অর্থ : একনিষ্ঠভাবে কোন কিছু করা। যেমন বলা হয় : أخلص لله عمله সে একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্যই তার আমলকে সম্পাদন করেছে। সূরাতে যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় ও তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে তাই إخلَاص নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

ফযীলত:

সূরাটি আকারে ছোট হলেও ফযীলতের দিক দিয়ে অনেক বড়। আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের বললেন : তোমাদের কেউ কি রাতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করতে অপারগ হবে? এটা তাদের জন্য কষ্ট কর হয়ে গেল। তারা বলল : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ)! আমাদের কে এরূপ করতে সক্ষম হবে? তখন রাসূল (সাঃ) বললেন : (قُلْ هُوَ اللّٰهُ أَحَدٌ) সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য। (সহীহ বুখারী হা. ৫০১৫)

অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়লে যে নেকী হবে সেই নেকী এ সূরা পাঠ করলে পাওয়া যাবে। এভাবে এ সূরাটি তিনবার পড়লে সম্পূর্ণ কুরআন পড়ার নেকী পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ। কারণ পবিত্র কুরআনে মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। তাওহীদ, আহকাম ও নসীহত। সূরা ইখলাসে তাওহীদ পূর্ণভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য, এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। (ইবনু কাসীর)

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাঃ) এক সাহাবীকে একদল বাহিনীর নেতা বানিয়ে প্রেরণ করলেন। সেই লোক বাহিনীর ইমামতি করে যখন সালাত আদায় করতেন তখন প্রত্যেক রাকাতেই সূরা ইখলাস দ্বারা কেরাত শেষ করতেন। সবাই যখন ফিরে আসল এবং নাবী (সাঃ)-কে বিষয়টি বলল তখন নাবী (সাঃ) বললেন : তাকে জিজ্ঞাসা কর কেন সে এরূপ করেছে? তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বললেন : আমি এ সূরা পড়তে ভালবাসি। কেননা এতে দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলি রয়েছে। নাবী (সাঃ) বললেন : তাকে বলে দাও আল্লাহ তা‘আলা তাকে ভালবাসেন। (সহীহ বুখারী হা. ৭৩৭৫)

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আগমন করলেন এবং বললেন : আমি এ সূরাকে ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : এ সূরাকে ভালবাসার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আহমাদ ৩/১৪১, সনদ সহীহ।)

আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে মাসজিদে প্রবেশ করেন। এমন সময় এক ব্যক্তি সালাত আদায় করছিল আর দু‘আ করে বলছিল।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللّٰهُ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কামনা করছি ঐ বাক্যসমূহের মাধ্যমে যে, নিশ্চয়ই আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমিই আল্লাহ। তুমি ছাড়া সত্যিকার কোন ইলাহ নেই। তুমি একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি কাউকে জন্ম দেননি, তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : ঐ সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ! এ ব্যক্তি ইসমে আযমের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার কাছে চেয়েছে। এ নামে চাইলে তিনি দেন আর এ নামে ডাকলে তিনি ডাকে সাড়া দেন। (আবূ দাঊদ হা. ১৪৯৪, তিরমিযী হা. ৩৪৭৫, ইবনু মাযাহ হা. ৩৮৫৮, সনদ সহীহ)

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাঃ) প্রত্যেক রাতে যখন বিছানায় যেতেন তখন দু হাত একত্রিত করে ফুঁ দিতেন, অতঃপর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন। তারপর যথাসম্ভব দু হাত দিয়ে শরীর মাসাহ করতেন। তিনি প্রথমে মাথা, মুখমন্ডল ও শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০১৭)

শানে নুযূল:

জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : এক গ্রাম্য ব্যক্তি নাবী (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল : তোমার রবের বংশ তালিকা বর্ণনা কর। তখন এ সূরা অবতীর্ণ হয়। (বায়হাকী ৭/১৪৬, হাসান।)

উবাই বিন কাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, মুশরিকরা নাবী (সাঃ)-কে বলল : হে মুহাম্মাদ তোমার রবের বংশ তালিকা বর্ণনা কর। তখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। প্রত্যেক জিনিস যা জন্ম নেয় তা অবশ্যই মারা যাবে এবং যে জিনিস মারা যাবে পরবর্তী বংশধর তার ওয়ারিশ হবে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা মারা যাবেন না এবং তাঁর ওয়ারিশও কেউ হবে না।

তাফসীর:

একজন সত্যিকার মা‘বূদের চারটি বৈশিষ্ট্য এ সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে। এ চারটি বৈশিষ্ট্য যে মা‘বূদের মাঝে পাওয়া যাবে তিনিই একমাত্র যাবতীয় ইবাদত পাওয়ার হকদার। এ চারটি বৈশিষ্ট্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো বা কোন কিছুর মাঝে পাওয়া যায় না। তাই সব বাতিল মা‘বূদ বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা উচিত।

প্রথম বৈশিষ্ট্য:

যে মা‘বূদের ইবাদত করা হবে তার প্রথম বৈশিষ্ট্য হবে তিনি একক হবেন তার কোন অংশীদার থাকবে না। এ বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন কিছুর নেই। তাই এখানে আল্লাহ তা‘আলা أَحَد শব্দটি ব্যবহার করেছেন যার কোন দ্বিবচন বা বহুবচন হয় না। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া যার ইবাদত করা হয় সবই মানুষের বানানো ও মস্তিস্কপ্রসূত চিন্তা-চেতনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِھ۪ٓ اِلَّآ اَسْمَا۬ئً سَمَّیْتُمُوْھَآ اَنْتُمْ وَاٰبَا۬ؤُکُمْ مَّآ اَنْزَلَ اللہُ بِھَا مِنْ سُلْطٰنٍﺚ اِنِ الْحُکْمُ اِلَّا لِلہِﺚ اَمَرَ اَلَّا تَعْبُدُوْٓا اِلَّآ اِیَّاھُﺚ ذٰلِکَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ وَلٰکِنَّ اَکْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ)‏

‘‘তাঁকে (আল্লাহকে) ছেড়ে তোমরা কেবল কতকগুলো নামের ‘ইবাদত করছ, যে নামগুলো তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ; এগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠাননি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এটাই সঠিক দীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা অবগত নয়।’’ (সূরা ইউসুফ ১২: ৪০)

এ থেকে আরো পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার শানে উপযোগী নয় এমন নামে তাঁকে অভিহিত করা যাবে না, বরং আল্লাহ তা‘আলাকে একমাত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত নামেই অভিহিত করতে হবে।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:

الصَّمَدُ অর্থাৎ যে মা‘বূদের ইবাদত করা হবে তিনি কোন কিছুর মুখাপেক্ষী হবেন না। তিনি কোন খাবার, পানীয় ও নিজ প্রয়োজন পূরণের জন্য অন্যের সহযোগিতা গ্রহণ হতে মুক্ত হবেন। মোট কথা যিনি নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই এ আয়াতের তাফসীরে মুজাহিদসহ অনেক মুফাসসির বলেছেন : الصَّمَدُ সামাদ হলেন তিনি যার মাঝে কোন শূন্যতা নেই। (ইবনু জারীর /২২২) এ বৈশিষ্ট্যটিও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার রয়েছে, তাই তিনিই একমাত্র ইবাদত পাওয়ার হকদার।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:

(لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ)

একজন সত্যিকার মা‘বূদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি কাউকে জন্ম দেন না। অর্থাৎ তার কোন স্ত্রী-সন্তান নেই। এটাও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(بَدِيْعُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ط أَنّٰي يَكُوْنُ لَه۫ وَلَدٌ وَّلَمْ تَكُنْ لَّه۫ صَاحِبَةٌ ط وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ ج وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ)

“তিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা, তাঁর সন্তান হবে কিরূপে? অথচ তাঁর তো কোন স্ত্রী নেই। তিনিই তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্বন্ধে তিনিই সবিশেষ অবহিত।” (সূরা আন‘আম ৬: ১০১)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمٰنُ وَلَدًاﮧﺚ لَقَدْ جِئْتُمْ شَیْئًا اِدًّاﮨﺫ تَکَادُ السَّمٰوٰتُ یَتَفَطَّرْنَ مِنْھُ وَتَنْشَقُّ الْاَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ ھَدًّاﮩﺫ اَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمٰنِ وَلَدًاﮪﺆ وَمَا یَنْۭبَغِیْ لِلرَّحْمٰنِ اَنْ یَّتَّخِذَ وَلَدًاﮫﺚ اِنْ کُلُّ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ اِلَّآ اٰتِی الرَّحْمٰنِ عَبْدًاﮬﺚ)

“তারা বলে, ‘দয়াময় সন্ত‎ান গ্রহণ করেছেন।’ তোমরা এমন এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করেছ; যাতে আকাশসমূহ বিদীর্ণ হবে, পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবে ও পর্বতগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পতিত হবে, যেহেতু তারা দয়াময়ের প্রতি সন্ত‎ান আরোপ করে। অথচ সন্ত‎ান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্য শোভনীয় নয়! আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের নিকট বান্দারূপে উপস্থিত হবে না।” (সূরা মারইয়াম ১৯: ৮৮-৯৩)

মূলত: কথা হচ্ছে যে, একজন সত্যিকার মা‘বূদকে কেউ জন্ম দিতে পারে না এবং বানাতেও পারে না।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) নাবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আদম সন্তান আমাকে অবিশ্বাস করে অথচ এটা তার জন্য সমীচীন নয়। সে আমাকে গালি দেয় অথচ এটাও তার জন্য সমীচীন নয়। আমাকে অবিশ্বাস করার অর্থ হলো সে বলে : আমাকে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় সৃষ্টি করতে পারবেন না। যেমন আমাকে প্রথমবার সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অথচ দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা প্রথমবার সৃষ্টি করার চেয়ে কি অধিক সহজ নয়? আর আমাকে গালি দেয়ার অর্থ হলো : সে বলে : আমার নাকি সন্তান আছে, অথচ আমি একক, অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী, আমার কোন সন্তান নেই, আমাকে কেউ জন্ম দেয়নি এবং আমার সমকক্ষ ও সমতুল্য কেউ নেই। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৭৪, সহীহ মুসলিম হা. ২০৭৮)

চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:

একজন সত্যিকার মা‘বূদের সত্ত্বা, গুণাবলী ও কাজকর্ম অন্য কোনো কিছুরই সমতুল্য ও সমকক্ষ হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(لَيْسَ كَمِثْلِه۪ شَيْءٌ ج وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ)

“কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা”। (সূরা শুরা ৪২: ১১)

এ চারটি বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তা‘আলার রয়েছে, তাই আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র সমস্ত মাখলুকের ইবাদত পাওয়ার যোগ্য; অন্য কোন মূর্তি, দেব-দেবী ইত্যাদি নয়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সূরার ফযীলত অনেক। যেমন : নেকীর দিক দিয়ে এ সূরা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।
২. যারা প্রকৃতপক্ষে এ সূরাকে ভালবেসে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে ও তাঁর ওপর ভরসা রাখবে আল্লাহ তা‘আলাও তাঁকে ভালবেসে জান্নাত দেবেন।
৩. একজন সত্যিকার মা‘বূদের চারটি বৈশিষ্ট্য যা অত্র সূরায় উল্লেখিত হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলাই সকল ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। কারণ উপরোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য কেবল তাঁর মাঝেই আছে।

Leave a Reply