Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২২৬ ও ১২২৭/হে মানুষ :-২৭)
[#“মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা):-
সুরা: ১১৩:আল-ফালাক্ব
সুরা: ১১৪-নাস
পারা:৩০
১-৫ নং আয়াতের বেখ্যা :-
১-৬ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে ফী জিলালিল
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
(Book#1226-1227/O Ye.Mankind :-27)
[ # Say, “I seek refuge in the Lord :-]
Surah.113: Al-Falaq
Surah.114: An- Nas
Para:30
Ayat:- 1-5
Ayat:- 1-6
www.motaher21.net
সুরা: আল-ফালাক্ব
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১১৩
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : প্রথমত এ সূরা এবং এর পরের সূরাটি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক উদাত্ত আহ্বান । আল্লাহর নবীর জন্যে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সাধারণভাবে সব ঈমানদার মানুষের জন্যে । এই আহ্বান হচ্ছে আল্লাহর আশ্রয়ে পানাহ চাওয়ার, তার সাহায্যের আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ করার, সব ভীতিমূলক কাজ থেকে আশ্রয় চেয়ে সঠিকভাবে আল্লাহর কাছে এসে আশ্রয় নেয়া। সেই ভীতিকর জিনিস গোপনীয় হোক কিংবা প্রকাশ্য হোক, জানা হোক কিংবা অজানা হোক, সব ধরনের ভীতি থেকে পানাহ চাইতে বলা হয়েছে। এই আহ্বানে সংক্ষেপে বলা হয়েছে, আবার বিস্তারিত ভাবেও বলা হয়েছে । এখানে আল্লাহ্ তায়ালা এদের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আশ্রয়ের স্থানটিকে প্রসারিত করে ধরেন এবং অত্যন্ত স্নেহ ও আদরের সাথে তাদের বলেন- এসো, এদিকে এসো, নিরাপদ জায়াগায় এসো, শান্তির জায়গায় এসো । এসো আমার কাছে। কারণ আমি জানি তোমরা দুর্বলতা, তার ওপর কিছু লোক রয়েছে যারা তোমাদের শত্রু ৷ তোমাদের চারদিকে রয়েছে ভীতিপ্রদ কিছু কিছু স্থান, তাই তোমরা এদিকে চলে এসো, তোমরা এখানে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করতে পারবে । এ কারণেই এ উভয় সূরা শুরু হচ্ছে এভাবে ‘কুল আউ’যু বিরাব্বিল ফালাক, কুল আউ’যু বিরাব্বিন্নাস।’ (হে নবী তুমি বলো, আমি আশ্রয় চাই সুবহে সাদিকের স্রষ্টার, হে নবী তুমি বলো আমি আশ্রয় চাই মানুষের প্রতিপালকের অর্থাৎ আশ্রয় চাওয়া দিয়েই এ সূরা দু’টি শুরু হয়েছে) এই সূরা দু’টোর শানে নযুলের ব্যাপারে যেসব হাদী ও রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে তার সব কিছুর সাথে এর মৌলিক উদ্দেশ্যের একটা মিল রয়েছে, যা আমি ইতিপূর্বে এখানে আলোচনা করেছি। এসব বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রসূল (স.) এ দুটো সূরা পেয়ে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন ও মানসিক প্রশান্তি পেয়েছেন। হযরত আকাবা বিন আমের থেকে এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, একদিন আল্লাহর নবী(স.) তাকে বলেছেন, তুমি কি জানো না আজ এমন কিছু আয়াত আমার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে যার মতো কিছু আর আগে কখনো দেখিনি ‘কুল আউযু’ বরাব্বিল ফালাক, কুল আউ’যু বিরাব্বিন্নাস’ (মুয়াত্তা, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী) নাসায়ীতে হযরত জাবের (রা.)-এর রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, একদিন রসূল (স.) আমাকে বললেন, ‘জাবের পড়ো । আমি বললাম, আমার মাতা-পিতা আপনার নামে উৎসর্গিত হোক, বলুন কী পড়বো? তিনি আমাকে বললেন, পড়ো ‘কুল আউযু’ বরাব্বিল ফালাক, কুল আউ’যু বিরাব্বিনাস।’ আমি পড়লাম ৷ তিনি বললেন, এগুলো পড়তে থাকো, এরপর এরকম অন্য কোনো জিনিস কখনো আর পড়তে পারবে না ।” হযরত যর বিন হুবায়শ বললেন, আমি একদিন উবাই বিন কা’বকে এ সূরা দু’টোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, হে আবুল মানযার, আপনার ভাই ইবনে মাসউদ এমন কথা বলেন যে, এটা নাকি কোরআনের আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি মনে করতেন এটা নাকি শুধু দোয়া ও ওযীফা, এ কারণেই তিনি একে কোরআনের অংশ মনে করেননি। অতপর তিনি সাহাবাদের সম্মিলিত রায় মেনে নেন এবং একে কোরআনের শামিল বলে মনে করেন। এরপর উবাই বিন কা’ব বললেন, আমি রসূল (স.)-কে একথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমাকে বলা হয়েছে ‘কুল’ (বলো) আমি বললাম ৷ অতএব আমরাও এভাবেই এগুলো বলি, যেভাবে রসূল (স.) আমাদের বলেছেন। (বোখারী) অর্থাৎ এখানে কুল (বলো) অর্থ কোরআনের অন্যান্য আয়াতে বর্ণিত কুল (বলো) শব্দের মতোই ৷ অতএব এ দুটো কোরআনেরই সূরা এবং আলোচ্য হাদীস কয়টি এই সুন্দর কয়টি বিষয়ের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা আমি এখানে আলোচনা করেছি। এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা নিজেকে নিজে তার সেই বিশেষ গুণ দিয়ে পেশ করেছেন যার কাছ থেকে এখানে বর্ণিত জিনিসসমূহ থেকে আশ্রয় চাওয়া যায়।
ফী জিলালিল কুরআন:
সকল অনিষ্ট থেকে শান্তিময় আশ্রয়ে : যেমন বলা হয়েছে, ‘কুল আউযু’ বিরাব্বিল ফালাক’ । ‘ফালাক্’ শব্দের এক অর্থ হচ্ছে ‘সকাল বেলা’ এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘সমগ্র সৃষ্টিকুল’ ৷ এই অর্থের আলোকে এর ইঙ্গিত এমন প্রতিটি জিনিসের দিকেই নিবদ্ধ যা থেকে জীবনের উৎপত্তি হয়। যেমন বলা হয়েছে সূরা ‘আল আনয়ামে, “অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা শস্যদানা ও তৃণরাজিকে জীবন দান করেন। জীবন্তকে জীবনহীন থেকে বের করেন আবার মৃতকে বের করে আনেন জীবিত কিছু থেকে ।’ আবার এও বলা হয়েছে, “সকালকে তিনি বের করেন রাত থেকে আবার এই রাতকেই তিনি বানিয়েছেন আরামের উপকরণ হিসেবে এবং চাদ সুরুজকে বানিয়েছেন হিসাব নিকাশের ব্যবস্থা হিসেবে ।” এ সূরায় আশ্রয় চাওয়ার দিক থেকে উভয় উদ্দেশ্যেই সমান কথা, যদি ফালাক্ব অর্থ সকাল বেলার মালিকের আশ্রয় নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে সেই মালিক যিনি দিনের আলোর আগ পর্যন্ত সব রকমের গোপন বিষয়সমূহকে গোপন রাখেন, আবার যদি ‘ফালাক্’ অর্থ সৃষ্টিকুল হয় তাহলে এর অর্থ হবে, এমন কিছু থেকে আশ্রয় চাওয়া যা মাখলূকাতের অনিষ্ট থেকে তাকে নিরাপদ রাখবে । উভয় অর্থের দিক থেকেই পরবর্তী আলোচনার সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘মিন শাররি মা খালাক্ব’ বলতে সামগ্রিকভাবে আল্লাহর মাখলুকাতকেই এখানে বুঝানো হয়েছে। সৃষ্টিরাজি যখন একে অপরের সাথে মিলিত হয়, তখন কিছু অনিষ্টও এর সাথে থাকে । কোনো কোনো অবস্থায় তাদের কাছ থেকে উপকার ও কল্যাণ হাসিল হতে পারে, এখানে তাদের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে যেন তাদের কল্যাণটুকু অবশিষ্ট থাকে৷ যে মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের তৈরী করেছেন, তিনি এতটুকু ক্ষমতাও রাখেন যেন তাদের দিয়ে অপকার না হয়ে শুধু উপকারই সাধিত হবে । বলা হয়েছে, ‘ওয়া মিন শাররি গা-সেকীন ইয়া ওক্বাব ।’ ‘গা-সিক’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন কোনো জিনিস যা ঝাঁপ দেয় । ‘ওয়াক্বাব’ বলা হয় পাহাড়ের সে উঁচু স্থানকে, যেখান থেকে পানি প্রাবাহিত হয়। সম্ভবত এখানে এর অর্থ রাত এবং তার অভ্যন্তরীণ জিনিসসমূহ বোঝানো হয়েছে। দিনের আলোর মাঝে যখন রাতের আঁধার ঝাঁপ দিয়ে এসে হাযির হয় তখন সে কায়েনাতকে ঢেকে ফেলে এবং রাত নিজের সবটুকু ভীতিপ্রদ বৈশিষ্ট নিয়ে হাযির হয়। তাছাড়া তার মাধ্যমে অদেখা অজানা কিছুর আশংকাও বৃদ্ধি পায়। যেমন হিংস্র জন্তুর হামলা, কূ-মতলবে লুকিয়ে থাকা চোর-ডাকাতের ভয়, ধোকাবাজ দুশমনের অতর্কিত আক্রমণ, বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের একত্রিত হওয়া, মনের ভেতরে নানা রকম দুশ্চিন্তা কূমন্ত্রণার আনাগোনা, যা অধিকাংশই রাতের বেলায় দেখা দেয় এবং মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে দাবিয়ে রাখে, শয়তান যার অন্ধকারে স্বাধীনভাবে কুমন্ত্রণা দেয়ার সুযোগ পায়। সর্বোপরি রাতের অন্ধকার ও নীরবতায় মানুষের মনে যে কামনা বাসনার সৃষ্টি হয় তার থেকেও পানাহ্ চাইতে হবে। এছাড়াও এতে রাতের সব ধরনের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়সমূহ থেকেও আশ্রয় চাওয়ার চিত্র আঁকা হয়েছে। এসব জাদুর মহিলা যারা মানুষের অনুভূতিকে ধোকা দিয়ে তাদের কষ্ট দিয়ে থাকে এবং শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে প্রতারণার সাহায্যে প্রভাবান্বিত করে, নানা রকম মানসিক প্রবঞ্চনায় লিপ্ত করে- যা বিভিন্নভাবে জ্ঞান ও অনুভূতিতেও প্রভাব বিস্তার করে। তারপর বিভিন্ন রশি ও রুমালে গিরা দেয়, এসব হচ্ছে জাদু ও এর প্রভাবের এক দিক । জাদু-টোনার ফলে কোনো বস্তুর মূল ও প্রকৃতিতে কোনোরকম পরিবর্তন সাধিত হয় না এবং বস্তুতে কোনো নতুন জিনিসের সৃষ্টিও করে না। কিছুক্ষণের জন্যে জাদুকরের জাদু মানুষের অনুভূতিতে কিছু ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়ে যায়। মুসা (আ.)-এর ঘটনা বলতে গিয়ে কোরআনের জাদুর যে চিত্র আকা হয়েছে, তা সূরা ‘ত্বহায়’ দেখুন। ‘জাদুকররা বললো, হে মূসা, তুমি (তোমার জাদুর চাল) আগে ফেলবে, না আমরা আগে ফেলবো? মূসা (আ.) বললো, বরং তোমরাই আগে ফেলো । তারপর তাদের নিক্ষেপ করা জাদুর রশি এবং লাঠির ওপর জাদুর প্রভাবে মুসা (আ.)-এর মনে এ ধারণা এসে যাচ্ছিলো যে, এগুলো বুঝি দ্রুতগতিতে চলছে। এ কারণে মূসা (আ.)-এর মনে কিছুটা ভয়ের উদ্রেক হলো । এরপর আমি বললাম, মূসা তুমি ভয় পেয়ো না, অবশ্যই তোমার মর্যাদা অনেক বড়ো । তুমি তোমার ডান হাতের জিনিসগুলো “মাটিতে’ ফেলে দাও, দেখবে তাদের বানানো সব কয়টি জিনিসকেই তোমার লাঠি খেয়ে ফেলবে। অবশ্যই তারা যা বানিয়েছে, তা ছিলো জাদুর একটা গোপন ফন্দি মাত্র । জাদুকররা যেখানেই থাকুক, তারা কোনোদিনই সফলতা পাবে না।’ এ থেকে এটা জানা গেলো যে, তাদের রশি ও লাঠি আসলে সাপে পরিণত হয়নি৷ কিন্তু তা মূসা (আ.) ও অন্যান্য লোকদের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করে দিয়েছিলো যে, এগুলো বুঝি দৌড়াচ্ছে। এমনকি মূসা (আ.) নিজে কিছুটা ভয়ও পেলেন। কারণ তিনি তো মূলত জাদুকর ছিলেন না। তার কাছে যা কিছু ছিলো তা আল্লাহর দেয়া মোজেযা ছিলো । আর তখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে অভয়বাণী তিনি পাননি। অতপর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে অভয়বাণী পেলেন, তখন সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলেন এবং শক্তভাবে তার মোকাবেলা করলেন। এরপর এক পর্যায়ে যখন দেখলেন যে, সত্যিই মূসা (আ.) এর লাঠি সাপে পরিণত হয়ে গেলো এবং জাদুর অন্যান্য ছোটখাটো রশি ও লাঠিকে খেয়ে ফেললো, তখন তার সামনে আল্লাহর সব কুদরত পরিষ্কার হয়ে গেলো । এ হচ্ছে জাদুর মূলকথা । এভাবেই আমাদের এটা বুঝতে হবে। মেনে নিতে হবে যে, মানুষের ওপর এটা প্রভাব বিস্তার করে এবং সে অনুযায়ী মানুষকে এক ধরনের খেয়ালে ফেলে দেয়। এই অনুভূতি ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহ মানুষের মনে এক ধরনের ভয় ও কষ্টের সৃষ্টি করে এবং এরই ফলে যাদুকর তার ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে মানুষদের ধাবিত করতে পারে। আরো কিছু রেওয়ায়াতে বর্ণিত আছে, যা মোতাওয়াতের নয় (মানে যা বর্ণনা বহুসংখথ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত নয়) এ ধরনের একটি রেওয়ায়াত আছে, লুবায়দ বিন আসাম নামক এক ইহুদী ব্যক্তি মদীনা শরীফে রসূল (স.)-এর ওপর জাদু টোনা করে। কয়েক দিন কিংবা কয়েক মাস পর্যন্ত এই জাদুর প্রভাব তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিলো । এ বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, তার মনে হতো তিনি বুঝি তার স্ত্রীদের কাছে গেছেন আসলে তিনি যাননি। অন্য রেওয়ায়াতে আছে তাঁর মনে হতো তিনি অমুক কাজটি বুঝি করেছেন, আসলে তিনি তা করেননি এবং আরেক রেওয়ায়াতের মতে এ সূরাগুলো ঝাঁড়ফুক থেকে বাচার জন্যে তার কাছে নাযিল করা হয়েছে। যখন তাকে জাদু করা হলো, যার কথা তাকে আগেই স্বপ্নে দেখানো হয়েছে, তখন তিনি এই সূরা দুটো পড়লেন এবং এর ফলে ঝাড়ফুঁকের গিরাগুলো আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেলো। তবে এই রেওয়ায়াতটি নবীর কর্ম ও তার তাবলীগের ব্যাপার ও নবী চরিত্রের নিষ্পাপ হওয়ার সাথে খাপ খায় না এবং রসূল (স.)-এর সব কাজই যে শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত এই বিশ্বাসের সাথেও এসব রেওয়ায়াতকে মিলানো যায় না। তা ছাড়া রসূল (স.) সম্পর্কে কাফেররা যে বলতো তিনি জাদুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত, এর প্রতিবাদ করে কোরআন যা বলেছে তাকেও এসব রেওয়ায়াত অস্বীকার করে। কোরআন কাফেরদের সেসব অভিযোগ এভাবে বর্ণনা করেছে, ‘অর্থাৎ তোমরা কোনো জাদুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত ব্যক্তিরই আনুগত্য করে চলেছো। কোরআন শরীফ বারবার এসব কাফের মোশরেকদের অভিযোগ ও অপবাদ খন্ডন করেছে। এসব কারণেই এসব রেওয়ায়াতকে আমরা শরীয়িত থেকে বেশ দূরবর্তী বলেই মনে করি। মানুষের আকীদা বিশ্বাসের ব্যাপারে হাদীস নয়, কোরআনের দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হয়। কোনো হাদীসকে আকীদার পর্যায়ে স্থান দিতে হলে তাকে হাদীসে মোতাওয়াতের হওয়াটা শর্ত । এই হাদীসগুলো কোনটাই মোতাওয়াতের নয়। তাছাড়া এ সূরা দুটোর মক্কায় নাযিল হওয়াটাই সঠিক, সেদিক থেকেও অন্য রেওয়ায়াতগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে। ‘হাসাদ’ হিংসা একটি মনস্তাত্ত্বিক রোগ । আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত দান ও অনুগ্রহের ব্যাপারে তাকে বিনষ্ট করে দেয়ার আগ্রহ থেকে কিছু মানুষের মনে এটি সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো এর প্রভাব শুধুমাত্র মানসিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে । আবার কখনো মানুষ এর ফলে হিংসা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অন্যের ওপর দেয়া আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুদানকে বিনষ্ট করে দেয়ার চেষ্টাও করে থাকে। এর উভয় অবস্থাই অন্যায় ও অবৈধ ৷ অবশ্য দ্বিতীয় অবস্থাটা প্রথম অবস্থার চেয়ে অনেক ক্ষতিকর । কেননা হিংসুক ব্যক্তি হিংসার আগুনে পুড়ে অনেক কিছুই করতে উদ্যত হয়। মানুষের ভেতরের কিছু গোপন শক্তি-সামর্থ মজুদ থাকে, যার প্রভাবে মানুষ অনেক কিছুই করে ফেলতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে অন্য মানুষকে হত্যা করতেও সে দ্বিধা করে না। মানুষের প্রাকৃতিক বিভিন্নতার কোনো সীমা নেই ৷ তার সব কয়টির কারণ পেশ করা সম্ভব নয়। অনেক সময় বিভিন্ন জাদুটোনা, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির প্রভাব দিয়ে ব্যক্তিকে দিয়ে কিছু করানো যায় । এরকম অনেক কিছুই আমরা নিজেদের চোখে দেখতে পাই। যদিও এর কারণ সবসময় ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। তাই হিংসার বশবর্তী হয়ে মানুষ যে অনেক অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে, তাতেও সন্দেহ নেই৷ এমন বহু ঘটনা দেখা যাবে যে, মানুষ শুধু হিংসার আগুনে ছারখার হয়ে অন্যকে খুন করে ফেলে, আহত করে ফেলে ৷ তার সহায়-সম্পদ লুট করে অথবা তাকে মারাত্মক কোনো ক্ষতির হুমকি প্রদান করে। হিংসুক ব্যক্তির প্রভাব তো তার আচার আচরণ দেখেই বোঝা যায়। একজন ব্যক্তির এই হিংসাত্মক মন মানসিকতার প্রভাব অবশ্যই আরেকজনের ওপর পড়ে। স্নেহ মমতা ও ভালোবাসার দৃষ্টি হামেশাই রাগ ও আক্রোশের দৃষ্টি থেকে ভিন্নতর হয়। আর এ দু’টো পরস্পর বিরোধী অবস্থার দুটি ভিন্নমুখী প্রভাবও ঘটনার আলোকে বিচার করা যাবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে এটা বলা মুশকিল বরং একান্তই অসম্ভব যে এমনটি হয় কেন? এটাও সে ধরনের প্রশ্ন যেখানে জিজ্ঞেস করা হয় যে, যাদুর আছর হয় কেন? অথবা অসুখের ফলে মানুষ অসুস্থ হয় কেন? যদি এর সব কিছু কোনো বিষাক্ত জীবাণুর প্রভাব হয় তাহলে সেসব বানানোর উদ্দেশ্য কি এবং তা অন্যকেই বা কেন প্রভাবান্বিত করে? এটা আল্লাহ পাকের দয়া যে, তিনি ক্ষতিকর মানুষ ও অন্যান্য অনিষ্টকর জিনিস থেকে বেঁচে থাকার জন্যে আল্লাহর আশ্রয় পাওয়ার নিয়ম আমাদের শিখিয়েছেন এবং এটাও পরীক্ষিত সত্য যে, এভাবে আশ্রয় চাইলে তা অবশ্যই কাজে লাগে৷ যে-ই আল্লাহর কাছে পানাহ্ চায় এবং তার আশ্রয়ে আসার জন্যে প্রার্থনা করে তিনি তাকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেন । যে-ই আল্লাহর কাছে আশ্রয়ে আসার জন্যে প্রার্থনা করে তিনি তাকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেন। যে-ই আল্লাহর কাছে দোয়া করে তিনি তা শুনেন এবং তা কবুল করেন। এটা মানুষের সাথে আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা। হযরত আয়শা (রা.) বর্ণিত এই হাদীসটি ইমাম বোখারী বর্ণনা করেছেন, রসূল (স.) যখন প্রতি রাতে বিছানায় আসতেন, তখন উভয় হাতকে সামনে খুলে ধরতেন এবং তাতে ফুঁ দিতেন এবং উভয় হাতের মাঝে কোরআনের শেষ সূরা তিনটি পড়তেন। তারপর উভয় হাত দিয়ে শরীরের সম্ভাব্য অংশগুলো মোসেহ করতেন, মাথা ও মুখমন্ডল থেকে শুরু করতেন । আস্ত শরীরের অন্যান্য অংশের দিকে হাত বাড়াতেন। এভাবে তিনি তিনবার করতেন বলে হাদীসে বর্ণনা পাওয়া যায়।
সুরা: আন-নাস
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১১৪
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এ সূরায়ও আল্লাহ তায়ালার কাছে পানাহ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে । যিনি মানুষের প্রতিপালক, মানুষের বাদশাহ । মানুষের মাবুদ । আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে শয়তানের অনিষ্ট থেকে যে শয়তান মানুষদের কুমন্ত্রণা যোগায় । কুমন্ত্রণা দিয়ে সে পেছনে ফিরে যায় মাঝখানে কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করে কেটে পড়ে । আবার এ শয়তান মানুষ এবং জ্বিন উভয় দলের মধ্য থেকেই হতে পারে। এই পানাহ চাওয়ার ব্যাপারে যার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বলা হয়েছে, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি প্রতিপালক, তিনি রাজাধিরাজ, বাদশাহ, তিনি মাবুদ। সাধারণভাবে তার আশ্রয়ই যাবতীয় অনিষ্ট থেকে মানুষদের দূরে রাখে। আবার বিশেষ করে নানা ধরনের কুমন্ত্রণাদায়ী বস্তু যখন নানা ধরনের প্রলোভন দিয়ে মানুষদের খারাপ কাজে নিয়োগ করে তখন বিশেষভাবেও আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে । ‘রব’ হচ্ছেন সেই পবিত্র সত্ত্বা, যিনি সবকিছুকে লালন-পালন করেন, সবকিছু প্রদর্শন করেন, দেখাশোনা করেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন । ‘মালেক’ বাদশাহ, সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান শাসক। ‘ইলাহ’ মানে মাবুদ, উচু মর্যাদাসম্পন্ন সর্বোচ্চ বিজয়ী, সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তারকারী মহান সত্ত্বা। এ গুণাবলী স্মরণ করে আল্লাহর মহান সত্ত্বার কাছ থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে৷ কারণ আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন এ গুণাবলীর একক আধার ৷ অবশ্য এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা যে, আল্লাহ তায়ালার এসব গুণ কিভাবে মানুষকে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বাঁচায়, এটা আমাদের জানার উপায়ই বা কতোটুকু? আল্লাহ তায়ালাই তা ভালো জানেন । আল্লাহ্ তায়ালা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, একক ক্ষমতাসম্পন্ন মালিক, সবকিছুর ওপর তার ক্ষমতা কার্যকর। সবকিছু তারই হাতে ৷ ন্যায়-অন্যায়, উপকার অপকার, নিষ্ট অনিষ্ট সবকিছুর স্রষ্টাও তিনি। তাই তিনি তার গুণাবলী দিয়ে মানুষকেও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারেন। আগের সূরাটিতে মানুষদের বৈষয়িক কিছু জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর এই সূরায় বলা হয়েছে কিছু আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় থেকে আশ্রয় চাইতে ।
ফী জিলালিল কুরআন:
ল্লাহ তায়ালা সবার ‘রব’, সবার ‘মালিক’, সবার ‘ইলাহ’। অবশ্য এখানে বিশেষভাবে মানুষের উল্লেখ করার মাঝে পানাহ কিংবা আশ্রয় চাওয়ার ব্যাপারে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া ও এর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কুমন্ত্রনা থেকে বাচার উপায় : আল্লাহ তায়ালা নিজের দয়া ও অসীম অনুগ্রহ দিয়ে স্বীয় নবী (স.) ও তার উম্মতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, তারা যেন আল্লাহর কাছ থেকে আশ্রয় চায় এবং নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে তার দিকেই ফিরে যায় এবং সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার এই অনুপম গুণাবলীকে স্মরণ রাখতে বলেছেন। এসব গুণ স্মরণে রেখে বলা হয়েছে তাঁর কাছে পানাহ চাইতে সেই গোপনে কুমন্ত্রণা দাতা শয়তানের কাছ থেকে, যার মোকাবেলা এই ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কোনোদিনই সম্ভব নয়। শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণার আক্রমণ বহুমুখী । সে কোন্ দিক থেকে মানুষকে ধরবে, তা কেউই বলতে পারে না। কোন উপায় উপকরণ দিয়ে সে মানুষের মনকে বিপথগামী করে, তাও কেউ বলতে পারে না। ‘ওয়াসওয়াসা’ মানে ‘ব্যক্তিগত আওয়ায’ ৷ ‘আল খামুস’ মানে ‘লুকিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা।’ ‘খান্নাস’ বলে এমন কিছুকে যার প্রকৃতিই হচ্ছে এমন যে, সে অন্যায় করে লুকিয়ে যায় যাতে করে তার অন্যায়ের পাত্তাই পাওয়া না যায়। কোরআন মাজীদ এই শয়তানের যে বর্ণনা দিয়েছে, সে মোতাবেক তাকে বলা হয়েছে ‘ওয়াসওয়া’সুল খান্নাস’ । তারপর তার কার্যাবলীর কথা বলেছে যে, সে মানুষের অন্তরে নানান ধরনের কুমন্ত্রণা যোগায় । তারপর তার মূল সূত্র বলা হয়েছে যে, সে জ্বিন থেকে যেমন হতে পারে- মানুষদের থেকেও আসতে পারে। বর্ণনার এ ধারার ফলে মানুষের অনুভূতিতে একটা জাগরণ চিন্তা ও সাবধানতার সৃষ্টি হয় এবং এভাবেই সে ‘ওয়াসওয়া’সুল খান্নাস’ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অভিহিত হতে পারে । বর্ণনার শুরুতে এর শুধু দোষটুকুই বলা হয়েছে যেন তার কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যের ধারণা পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে সে তার অনিষ্টসমূহ সম্পাদন করে, তাই মানুষের অন্তরে শয়তানকে মোকাবেলা করে তার থেকে দূরে থাকা এবং নিজেকে দেখা শোনা করার একটা যোগ্যতা সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে মানুষের প্রবৃত্তি এ জাগরণ ও হুশিয়ারীর ফলে যখন একথা জেনে যায় যে, ‘ওয়াসওয়াসুল খান্নাস’ মানুষের অন্তরে গোপনে কুমন্ত্রণা দেয়, তা লুকিয়ে থাকা জ্বীন হোক কিংবা প্রকাশ্য মানুষ হোক- যারা জ্বীনদের মতোই মানুষের অন্তরে নানান রকম খারাপ দিয়ে তাকে খারাপ পথে নিতে চায় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে প্রতিরক্ষার জনো প্রস্তুত হয়। কারণ কোন কোন পথ দিয়ে শয়তান মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে পারে তা সবই ইতিমধ্যে সে চিনে নিয়েছে। জ্বীনদের ‘ওয়াসওয়াসা’ কি ধরনের, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমাদের জানা নেই । অবশ্য তাদের ব্যাপারে মানব জীবনের কতিপয় বাস্তব ঘটনা দিয়ে এর কিছুটা ধারণা আমরা পেতে পারি। আমরা এও জানি যে, আদম-ইবলীসের ঘটনা বহু পুরানো এবং শয়তান একদিন মানুষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানব জাতির বিরুদ্ধে শয়তানের এ যুদ্ধ ঘোষণা তার অভ্যন্তরীণ অনিষ্ট থেকেই শুরু হয়েছে তাও আমরা জানি । এক পর্যায়ে সে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে অনুমতি চাইলো, কোন বিশেষ কারণে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন তাকে তিনি এই অনুমতি দিলেন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা শয়তানের মোকাবেলার এ লড়াইয়ে মানুষকে নিরস্ত্র ও একা ফেলে রাখেননি, বরং যুদ্ধ মোকাবেলার জন্যে ঈমানের ঢাল ও আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে আশ্রয় চাওয়ার একটা হাতিয়ার তার হাতে তুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর স্মরণ দিয়ে তাকে শয়তানের সাথে মোকাবেলা করতে বলেছেন। এরপরও যদি মানুষ খোদার দেয়া ঢাল ও হাতিয়ারের কথা ভুলে নিজের প্রস্তুতিতে অবহেলা করে, তাহলে সেজন্যে তাকে নিজেকেই দায়ী হতে হবে- অন্য কাউকে নয়। বোখারীতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, রসূল (স.) বলেছেন, শয়তান মানুষের অন্তর দখল করে বসে থাকে৷ যখন সে আল্লাহর নাম স্মরণ করে,য়তখন সে সরে যায়, আবার যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষ দূরে সরে আসে, তখন শয়তান আবার সেখানে এসে কুমন্ত্রণা যোগাতে শুরু করে। মানুষের কুমন্ত্রণার কথা তো প্রচুর জানি এবং এসব জানার ফলে আমরা এও বুঝতে পারি যে, মানুষের এসব কুমন্ত্রণা শয়তানের প্ররোচনার চেয়ে অনেক মারাত্মক ৷ যেমন একজন খারাপ বন্ধু তার বিভিন্ন কথাবার্তা ও কাজকর্মে বন্ধুর জ্ঞান বুদ্ধি ও মনের ওপর এমন সব বাজে প্রভাব বিস্তার করে, যা সে টের পর্যন্ত পায় না, অনুমানও করতে পারে না। কেননা, সে তাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুই মনে করে এসেছে। আবার ক্ষমতাসীন ও দরবারী লোকদের আশেপাশের পরিষদবর্গ তাদের অন্তরে এমনসব কুমন্ত্রণা যোগায়, যার বশবর্তী হয়ে সে সব শাসক দুনিয়ায় মূল মালিকের বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং এভাবেই এরা এক সময় খোদার যমীনে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হিসেবে নিজের নানা অপকর্ম সৃষ্টি করে জনপদের মানুষ ও ফসলেরও বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করে। আবার কিছু চোগলখোর আছে, যারা কথাবার্তাকে এমন রঙঢঙ দিয়ে পেশ করে যেন শুনে মনে হয় এটাই বুঝি সঠিক এবং এর মধ্যে কোনো সন্দেহ, শোবা নেই। আবার কিছু সংখ্যক আছে যারা কামনা-বাসনার বিষয়সমূহের বেচাকেনা করে, যা প্রাকৃতিক নিয়মনীতির বিপরীত জিনিসগুলোকেই উত্তেজিত করে। এসব বহুমুখী মানবীয় কূমন্ত্রণা ও প্ররোচনা থেকে বাচতে হলে মানুষের অন্তরে খোদার স্মরণ জাগরূক থাকা ও তার প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রয়োজন ৷ আবার এমন ধরনের বহু কুমন্ত্রণাদায়ী ‘খান্নাস’ আছে যারা প্ররোচনার জাল বিছিয়ে তাকে গোপন করে রাখে এবং এসব ঘড়যন্ত্রের জাল নিয়ে মানব মনের গোপন পথ দিয়ে মানুষের মনে প্রবেশ করে৷ কারণ এসব পথ তাদের ভালোই জানা, ভালোই চেনা। এসব শয়তান কুন্ত্রণা দানকারী জ্বিনের চেয়েও ভয়ংকর ৷ কারণ, এরা লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকে এবং এক পর্যায়ে এসে মানুষ এসব অদেখা ও গোপনীয় চক্রান্ত ও প্ররোচনার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে । এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তার অক্ষমতা দূর করে তাকে মোকাবেলার সময়ে ঢাল তলোয়ার ও হাতিয়ার দিয়ে প্রস্তুতির কথা বলেন, তাকে এসব হাতিয়ার পাবার পথ বাতলে দেন, যাতে আল্লাহর বান্দা শয়তানের সাঙ্গপাঙ্গদের মোকাবেলা নিজেকে রক্ষা করতে পারে। ‘ওয়াসওয়াস’ কুমন্ত্রণাদানকারীর প্রধান চরিত্র এটাই বলা হয়েছে যে, সে ‘খন্নাস’একথা বলে একদিকে এটা বুঝানো হয়েছে যে, সে গোপন-অদৃশ্য সব সময় সুযোগ ও সুবিধের সন্ধানে থাকে৷ যখনই সুযোগ পায় তখনি নিতান্ত চুপিসারে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে এবং তাকে কুমন্ত্রণা যোগায় । অপরদিকে এর মাধ্যমে তার এই গুণটিও বলা হয়েছে যে, খন্নাস সে ব্যক্তির সামনে অত্যন্ত দুর্বল, যে তার গোপন প্রতারণা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং তা থেকে সতর্ক হয়ে তার অন্তরের গোপন পথগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে । কেননা, শয়তান মানুষ হোক বা জ্বীন হোক, যখনই কেউ তার সামনাসামনি হবে, তখন সে ভেগে যাবে। এরপর অবশ্য সে আবারও আসে, তবে আসে নীরবে । যেমন রসূল (স.) এ ব্যাপারে একটি সু্ক্ষ উদাহরণ পেশ করে বলেছেন, যখন তার সামনে আল্লাহর নাম নেয়া হয়, তখন শয়তান পালিয়ে যায় । আবার যখন সে গাফেল হয়ে যায় তখন শয়তান পুনরায় কুমন্ত্রণা দেয়। এ কথাটি প্ররোচনাকারীর সাথে মোকাবেলার সময় মোমেনের মনে শক্তির সঞ্চার করে। বিশেষ করে যখন মোমেন জানতে পারে যে, অভিশপ্ত শয়তান হচ্ছে ‘খান্নাস’ মানে গোপনে ও অতর্কিতে আক্রমণকারী, সে মোমেনের প্রস্তুতির সামনে সর্বদাই থাকে দুর্বল। এ পর্যায়ে আরেকটি কথা স্মরণ রাখা দরকার এবং তা হচ্ছে শয়তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার এ পথ অনেক লম্বা, অনেক দীর্ঘ! কেয়ামত পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকবে। শয়তান চিরদিন এভাবেই অতর্কিতে আক্রমণ চালাতে থাকবে। একবার মোমেনের অন্তরকে জাগতে দেখলে কিছুক্ষণের জন্যে লুকিয়ে যাবে, আবার এসে হামলা করবে, কুমন্ত্রণা দেবে । সে সব সময়ই এই সুযোগের সন্ধানে থাকবে যে, কখন মোমেন-হৃদয় গাফেল হয়ে যাবে । এ কারণে অন্তরকে জাগিয়ে নেয়াই যথেষ্ট নয়, এর জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে ত্রমাগত জেগে থাকা । হৃদয় মনকে কখনো এ চেতনা থেকে গাফেল হতে দেয়া যাবে না, কারণ এ লড়াই কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। কোরআন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে এ চিত্র একেছে। তাকিয়ে দেখুন সূরায়ে ইসরার প্রতি, কি অপরূপ চিত্র আঁকা হয়েছে সেখানে! ”অতপর যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম তোমরা সবাই আদমকে সেজদা করো, একমাত্র ইবলীস ছাড়া আর সবাই সেজদাবনত হলো । সে সেজদা তো করলোই না, বরং দম্ভভরে বললো, আমি কি তাকে সেজদা করবো যাকে তুমি মাটি দিয়ে বানিয়েছো? তা, তুমি দেখে নিয়ো, আজ যাকে তুমি আমার ওপর অধিক মর্যাদা দিলে, আমাকে যদি তুমি কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ দাও, তাহলে আমি এই ব্যক্তির সন্তানদের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা দিয়ে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো। অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক এমন থাকবে, যাদের আমি গোমরাহ করতে পারবো না । আল্লাহ তায়ালা বললেন, হা, যাও তোমাকে আমি সময়-সুযোগ দিলাম। মানুষের মাঝে যারাই তোমার প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে তোমার আনুগত্য করবে তোমার সাথে তাদের সবার জন্যেও এর পরিপূর্ণ বিনিময় হিসেবে জাহান্নাম আমি নির্ধারণ করে দেবো । যাও, ডাকো তাদের । তোমার ডাক দিয়ে যদি পারো তাদের তুমি প্রলুব্ধ করো। তারপর তাদের ঘাড়ে উঠিয়ে নাও তোমার সঙ্গী-সাথী ও তাদের সামানপত্র। অতপর তাদের ধন-দৌলত ও সন্তান-সম্ততিতে তুমি তাদের অংশীদার হয়ে যাও এবং তাদের সাথে বিভিন্ন ধরনের রকমারি ওয়াদা করতে থাকো। আর এটা তো জানা কথাই যে, শয়তানের ওয়াদা মিথ্যা ও প্রাতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সবাই জেনে রাখো যে, আমার যারা অনুগত বান্দা তাদের ওপর শয়তানের কোনো রকম মাতব্বরী কিংবা শাসন চলবে না। আমার বান্দাদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে আমি একাই যথেষ্ট ।” এ যে ক্রমাগত যুদ্ধ, যা একজন মানুষকে তার পারিপার্শিক অন্যায় ও অনিষ্টকর প্ররোচনার সাথে চালিয়ে যেতে হচ্ছে তা সরাসরি শয়তানের নিজের পক্ষ থেকে হোক কিংবা তার সাঙ্গোপাঙ্গ মানুষ কর্মী বাহিনীর পক্ষ থেকে হোক, মানুষ যেন কখনোনিজেকে এ চিরন্তন যুদ্ধে পরাজিত পরাভুত না ভাবে। কেননা, সমগ্র সৃষ্টিকুলের ওপর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি তো পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালার একক । যিনি মানুষের মালিক, প্রতিপালক ও তার ওপর একচ্ছত্র বাদশাহ (তিনি রব্বুন্নাস, মালিকিন্নাস, ইলাহিন্নাস)। তিনি যেখানে ইবলীসকে মানুষের কুমন্ত্রণা দেয়ার ও তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, সেখানে তিনি শয়তানকে তার টিকি ধরে টানতেও সক্ষম ৷ আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে শুধু তাদের ওপরই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম করে বানিয়েছেন, যারা মূল মাবুদ রব ও মালিককে ভুলে যায়, কিন্তু যারা আল্লাহ্ তায়ালাকে স্মরণ করে, তারা সবাই এ অনিষ্ট থেকে নাজাত পাবে। নাজাত পাবে শয়তানের যাবতীয় অদেখা অজানা ষড়যন্ত্র থেকে । তাই বাঁচার একমাত্র পন্থা হচ্ছে মানুষ যেন সেই শক্তির আশ্রয় নেয়, যার ওপর দ্বিতীয় কোনো শক্তি নেই। সেই অমোঘ সত্যের ওপর ভরসা করবে যার বাইরে কোনো সত্য নেই । দুনিয়ার মালিক, দুনিয়ার মাবুদ, দুনিয়ার শাহানশাহর সাথেই তার সম্পর্ককে গভীর করতে হবে৷ অনিষ্ট ও অন্যায়ের সম্পর্ক হচ্ছে ‘ওয়াসওয়াস ও খান্নাসের’ (যারা গোপনে ও অতর্কিতে হামলা করে) সাথে । সম্মুখ সমরে তারা সর্বদাই পরাজিত ও পরাভুত থাকে। এরা হামেশাই প্রকাশ্য আক্রমণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে খোদার আশ্রয়ের সামনে । এদের পরাজয় অবধারিত । ন্যায় ও অন্যায়ের এ হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত সত্য । এ হচ্ছে এমন এক উৎকৃষ্ট পন্থা, যা মানুষের অন্তরকে পরাজয় থেকে বাচিয়ে রাখে । প্রয়োজনে তাকে শক্তি সাহস ও প্রশাস্তি যোগায় এবং এভাবেই তার জীবন-শক্তিকে অক্ষুন্ন রাখে ৷ আল হামদু লিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য।
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:
সূরা ফালাক ও সূরা নাস উভয় সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকে। ফালাক (الفلق) শব্দের অর্থ : প্রভাতকাল। আর নাস (النَّاس) অর্থ : মানুষ। এ দুই সূরাকে একত্রে معوذتان বা আশ্রয় প্রার্থনা করার দুই সূরা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাদুগ্রস্থ হওয়ার পর এ সূরাদ্বয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হলে আল্লাহ তা‘আলার রহমতে তিনি সুস্থ হন, তাই এ নামেও এ সূরাদ্বয় পরিচিত।
শানে নুযূল:
মা আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মদীনার ইয়াহূদী গোত্র বনু যুরাইকের মিত্র লাবীদ বিন আসাম নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাথার ছিন্নচুল ও চিরুনীর ছিন্ন দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কোন কাজ করলে ভুলে যেতেন ও ভাবতেন যে করেননি। অন্য বর্ণনা মতে ৪০ দিন বা ৬ মাস এভাবে থাকেন। এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, দু’জন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে অন্যজন পায়ের কাছে বসে। অতঃপর তারা বলে যে, বনু যুরাইকের খেজুর বাগানে যারওয়ান কূয়ার তলদেশে পাথরের নীচে চাপা দেয়া খেজুরের কাঁদির শুকনো খোসার মধ্যে ঐ জাদু করা চুল ও চিরুনীর দাঁত রয়েছে। ওটা তুলে এনে গিরা খুলে ফেলতে হবে। রাসূল (সাঃ) সকালে আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠান এবং যথারীতি তা তুলে আনা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সূরাদ্বয় পড়ে ফুঁ দিয়ে গিরাগুলো খুলে ফেলেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। (সহীহ বুখারী হা. ৫৭৬৫, ৫৭৬৬)
আয়িশাহ (রাঃ) হতে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সাঃ)-এর যাদুকৃত চুল ও চিরুনীর দাঁত উদ্ধার হওয়ার পর সূরা ফালাক ও নাস নাযিল হয়। যার ১১টি আয়াতের প্রতিটি আয়াত পাঠের সাথে সাথে জাদুকৃত ১১টি চুলের গিরা পরপর খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হালকা বোধ করেন ও সুস্থ হয়ে যান। (ইবনু কাসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রতিশোধ নিতে বলা হলে তিনি বলেন : আল্লহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি অপছন্দ করি যে, মানুষের মাঝে খারাপ কিছু ছড়িয়ে দেওয়া হোক। (সহীহ বুখারী হা. ৬৩৯১)
গুরুত্ব:
ওকবা বিন আমের আল যুহানী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার কাছে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার অনুরূপ আর দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক ও সূরা নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪) অন্য বর্ণনাতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তুমি কি জান আজ রাতে এমন কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার সদৃশ ইতোপূর্বে কখনই দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক ও নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪)
ফযীলত:
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাঃ) প্রত্যেক রাতে যখন বিছানায় যেতেন তখন দু হাত একত্রিত করে ফুঁ দিতেন, অতঃপর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন। তারপর যথাসম্ভব দু হাত দিয়ে শরীর মাসাহ করতেন। তিনি প্রথমে মাথা, মুখমন্ডল ও শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০১৭)
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিন ও মানুষের চোখ লাগা হতে আশ্রয় চাইতেন কিন্তু যখন সূরা ফালাক ও নাস অবতীর্ণ হলো তখন তিনি সব বাদ দিয়ে এ দু’টিই পড়তে থাকেন। (সূরা কালামের তাফসীর দ্রষ্ট্যব্য)
উকবা বিন আমের (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে প্রতি সালাতের শেষে সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (তিরমিযী হা. ২৯০৩ আবূ দাঊদ হা. ১৫২, মিশকাত হা. ৯৬৯)
আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অসুখে পড়তেন, তখন সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে নিজের দেহে হাত বুলাতেন। কিন্তু যখন ব্যাথা-যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে যেত তখন বরকতের আশায় আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে দিতাম। মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে : পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৯২, সহীহ মুসলিম হা. ২১৯২)
একদা ওকবা বিন আমির (রাঃ)-কে নাবী (সাঃ) বলেন : হে ওকবা! আমি কি তোমাকে শ্রেষ্ঠ দুটি সূরা শিক্ষা দেব না? অতঃপর তিনি আমাকে সূরা ফালাক ও নাস শিক্ষা দিলেন। তারপর তিনি সালাতের ইমামতি করেন এবং সূরাদ্বয় পাঠ করলেন। সালাত শেষে আমাকে বললেন : হে ওকবা! তুমি এ দুটি সূরা পাঠ করবেÑযখন ঘুমাবে এবং যখন ঘুম থেকে জাগবে। (আহমাদ হা. ১৭৩৩৫, নাসায়ী হা. ৫৪৩৭, সহীহুল জামে হা. ৭৯৪৮)
এ ছাড়াও সূরাদ্বয়ের ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস পাওয়া যায়।
জাদু টোনা, ঝাড়ফুঁক ও তাবীজ কবচ : ইসলামে জাদু হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাক। তার মধ্যে অন্যতম হলো জাদু। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৬৬, সহীহ মুসলিম হা. ৮৯)
ইসলামে ঝাড়-ফুঁক সিদ্ধ তবে অবশ্যই সে ঝাড়-ফুঁক কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে হতে হবে। যেমন সূরা ফালাক, নাস ও ইখলাস ইত্যাদি এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে যে সকল দু‘আ প্রমাণিত। যেমন
بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللّٰهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ
আমি আল্লাহ তা‘আলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সব বিষয় হতে যা আপনাকে কষ্ট দেয়। প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তির বা হিংসুক চোখের অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে নিরাময় করুন। আল্লাহ তা‘আলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৮৬)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-কে নিম্নোক্ত দু‘আর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেন।
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ
আমি আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান হতে, বিষাক্ত কীট পতঙ্গ ও প্রত্যেক অনিষ্টকারীর চক্ষু হতে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৭১)। এ ছাড়াও ঝাড়-ফুঁকের অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।
কিন্তু যদি ঝাড় ফুঁক কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে না হয়ে অন্য কোন বানোয়াট শির্কী কথা দ্বারা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ হারাম। বিভিন্ন বালা-মসিবত থেকে বাঁচার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাবিজ ঝুলানো বা তাবিজ বাঁধা চাই তা কুরআন দ্বারা হোক আর অন্য কিছু হোক তা সম্পূর্ণ নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল। (আহমাদ হা. ১৭৪৫৮, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৪৯২)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : >
مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ
যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকায় তাকে তার দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা. ২০৭২, মিশকাত হা. ৪৫৫৬, সনদ হাসান।)
তাই ঝাড়-ফুঁেকর প্রয়োজন হলে একমাত্র কুরআন ও স্ন্নুাহ দ্বারাই করতে হবে।
তাফসীর:
(قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) – الْفَلَقِ অর্থ الصبح
বা প্রভাত কাল, উষা। আবার ফালাক অর্থ বিদীর্ণ করা, ফেটে বের হওয়া। যেমন বলা হয় فلقت
الشئ أي شققته
আমি জিনিসটিকে ফালাক করেছি অর্থাৎ বিদীর্ণ করেছি। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ اللّٰهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوٰي)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শস্য-বীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করেন’ (সূরা আন‘আম ৫: ৯৫)
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্রভাতের আলো বিকশিত করেন, তাই তাকে ফালাক বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে প্রভাতের প্রতিপালকের কাছে, নিজের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ এতে ইঙ্গিত রয়েছে সকল অনিষ্টের মূল হলো অন্ধকার। অনিষ্ট দূর হওয়ার পর আসে খুশির প্রভাত। মানুষ যখন বিপদে পতিত হয় তখন চেহারা মলিন ও অন্ধকার হয়ে যায়। আবার যখন বিপদ থেকে মুক্তি পায় তখন চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
(شَرِّ مَا خَلَق)
অর্থাৎ সকল মাখলুকের অনিষ্ট হতে। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন: জাহান্নাম, শয়তান ও তার সঙ্গী সাথী যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন।
(وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ) – غَاسِق
অর্থ: রাত। যেমন হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন :
انه الليل اذا اقبل بظلامه
এটা (গাসাক) হলো রাত যখন তা অন্ধকারসহ আগমন করে। (ই্বনু কাসীর)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন :
الغسق اول ظلمة الليل
গসাক হলো রাতের প্রথম অন্ধকার। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلٰي غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ)
‘সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম কর এবং কায়েম কর ফজরের সালাত।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ৭৮)
আবার হাদীসে চাঁদকে غَاسِقٍ বলা হয়েছে। যেমন একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাতে আয়িশাহ (রাঃ)-এর হাত ধরে চাঁদ দেখিয়ে বলেন : হে আয়িশাহ! এর অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা এটা হলো গাসেক যখন সে সমাগত হয়। (তিরমিযী হা. ৩৩৬৬, মিশকাত হা. ২৪৭৫ সনদ সহীহ।)
যারা গাসেক বলে রাতকে বুঝিয়েছেন আর যারা চাঁদকে বুঝিয়েছেন উভয়ের মাঝে কোন প্রার্থক্য নেই। কেননা চাঁদ রাতের একটি নিদর্শন।
وَقَبَ অর্থ : প্রবেশ করা, চলে যাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ আমি আশ্রয় চাচ্ছি রাতের অনিষ্ট হতে যখন তা অন্ধকারে প্রবেশ করে। রাতের অন্ধকারেই হিংস্র জন্তু, ক্ষতিকর প্রাণী ও পোকা মাকড় অনুরূপভাবে অপরাধপ্রবণ হিংস্র মানুষ নিজ নিজ জঘন্য ইচ্ছা পূরণের আশা নিয়ে বাসা হতে বের হয়। এ বাক্য দ্বারা সে সকল অনিষ্টকর জীব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার কথা বলা হচ্ছে।
(وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثٰتِ فِي الْعُقَدِ)
হাসান বাসরী, যহহাক ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন :
النفاثات هن السواحر
নাফফাসাত হলো জাদুকারীগণ। আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন : গিরাতে ফুঁৎকারদানকারী আত্মার অনিষ্ট হতে অথবা গিরাতে ফুঁৎকারদানকারিণী মহিলাদের থেকে। (ফাতহুল কাদীর)
এ থেকে উদ্দেশ্য হলো : গিরাতে ফুঁক দানকারী প্রত্যেক জাদুকারিণী ও জাদুকর যারা মানুষের ক্ষতি করে থাকে।
حَسَدَ বলা হয় ‘যে ব্যক্তির সাথে হিংসা করা হচ্ছে তাকে আল্লাহ তা‘আলা যে নেয়ামত দান করেছেন তা দূরীভূত হয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা করা।’ (ফাতহুল কাদীর)
এরূপ হিংসা করা কবীরাহ গুনাহ ও মারাত্মক ব্যাধি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
তোমরা হিংসা থেকে বেঁেচ থাকে। কেননা হিংসা মানুষের সৎ আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠ খেয়ে ফেলে। (আবূ দাঊদ হা. ৪৯০৩, সহীহ)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : হিংসা হলো প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয় এবং প্রথম পাপ যা পৃথিবীতে করা হয়। যা আসমানে ইবলীস আদমের সাথে করেছিল। আর পৃথিবীতে কাবীল তার ছোট ভাই হাবীলের সাথে করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি অভিশপ্ত, বহিস্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত। (তাফসীর কুরতুবী)
তাই হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকেও আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। হিংসা থেকে বাঁচার উপায় হল বেশি বেশি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়া। এজন্য নিম্নোক্ত দু‘আটি বেশি বেশি পাঠ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَآ إِنَّكَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْم)
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের সে-সব ভাইদের ক্ষমা কর যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং মু’মিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (সূরা হাশর ৫৯ : ১০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরা ফালাক ও নাসের অন্যান্য নাম জানলাম।
২. এ দুটি সূরার গুরুত্ব ও ফযীলত জানলাম।
৩. জাদুটোনা ও তাবীজ-কবচ শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষেধ।
৪. কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক হলে বৈধ, অন্যথায় তা অবৈধ।
৫. জাদুর প্রভাব রয়েছে যার প্রমাণ নাবী (সাঃ) স্বয়ং নিজে।
৬. ইয়াহূদীরা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন চক্রান্ত ও অপকৌশল অবলম্বন করে আসছে যা আজও বিদ্যামান।
৭. হিংসা একটি বড় গুনাহ এবং মারাত্মক ব্যাধি যা মানুষের সৎ আমল বিনষ্ট করে দেয়।
নামকরণ:
সূরা ফালাক ও সূরা নাস উভয় সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকে। ফালাক (الفلق) শব্দের অর্থ : প্রভাতকাল। আর নাস (النَّاس) অর্থ : মানুষ। এ দুই সূরাকে একত্রে معوذتان বা আশ্রয় প্রার্থনা করার দুই সূরা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাদুগ্রস্থ হওয়ার পর এ সূরাদ্বয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হলে আল্লাহ তা‘আলার রহমতে তিনি সুস্থ হন, তাই এ নামেও এ সূরাদ্বয় পরিচিত।
শানে নুযূল:
মা আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মদীনার ইয়াহূদী গোত্র বনু যুরাইকের মিত্র লাবীদ বিন আসাম নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাথার ছিন্নচুল ও চিরুনীর ছিন্ন দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কোন কাজ করলে ভুলে যেতেন ও ভাবতেন যে করেননি। অন্য বর্ণনা মতে ৪০ দিন বা ৬ মাস এভাবে থাকেন। এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, দু’জন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে অন্যজন পায়ের কাছে বসে। অতঃপর তারা বলে যে, বনু যুরাইকের খেজুর বাগানে যারওয়ান কূয়ার তলদেশে পাথরের নীচে চাপা দেয়া খেজুরের কাঁদির শুকনো খোসার মধ্যে ঐ জাদু করা চুল ও চিরুনীর দাঁত রয়েছে। ওটা তুলে এনে গিরা খুলে ফেলতে হবে। রাসূল (সাঃ) সকালে আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠান এবং যথারীতি তা তুলে আনা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সূরাদ্বয় পড়ে ফুঁ দিয়ে গিরাগুলো খুলে ফেলেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। (সহীহ বুখারী হা. ৫৭৬৫, ৫৭৬৬)
আয়িশাহ (রাঃ) হতে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সাঃ)-এর যাদুকৃত চুল ও চিরুনীর দাঁত উদ্ধার হওয়ার পর সূরা ফালাক ও নাস নাযিল হয়। যার ১১টি আয়াতের প্রতিটি আয়াত পাঠের সাথে সাথে জাদুকৃত ১১টি চুলের গিরা পরপর খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হালকা বোধ করেন ও সুস্থ হয়ে যান। (ইবনু কাসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রতিশোধ নিতে বলা হলে তিনি বলেন : আল্লহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি অপছন্দ করি যে, মানুষের মাঝে খারাপ কিছু ছড়িয়ে দেওয়া হোক। (সহীহ বুখারী হা. ৬৩৯১)
গুরুত্ব:
ওকবা বিন আমের আল যুহানী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার কাছে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার অনুরূপ আর দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক ও সূরা নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪) অন্য বর্ণনাতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তুমি কি জান আজ রাতে এমন কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার সদৃশ ইতোপূর্বে কখনই দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক ও নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪)
ফযীলত:
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাঃ) প্রত্যেক রাতে যখন বিছানায় যেতেন তখন দু হাত একত্রিত করে ফুঁ দিতেন, অতঃপর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন। তারপর যথাসম্ভব দু হাত দিয়ে শরীর মাসাহ করতেন। তিনি প্রথমে মাথা, মুখমন্ডল ও শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০১৭)
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিন ও মানুষের চোখ লাগা হতে আশ্রয় চাইতেন কিন্তু যখন সূরা ফালাক ও নাস অবতীর্ণ হলো তখন তিনি সব বাদ দিয়ে এ দু’টিই পড়তে থাকেন। (সূরা কালামের তাফসীর দ্রষ্ট্যব্য)
উকবা বিন আমের (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে প্রতি সালাতের শেষে সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (তিরমিযী হা. ২৯০৩ আবূ দাঊদ হা. ১৫২, মিশকাত হা. ৯৬৯)
আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অসুখে পড়তেন, তখন সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে নিজের দেহে হাত বুলাতেন। কিন্তু যখন ব্যাথা-যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে যেত তখন বরকতের আশায় আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে দিতাম। মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে : পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৯২, সহীহ মুসলিম হা. ২১৯২)
একদা ওকবা বিন আমির (রাঃ)-কে নাবী (সাঃ) বলেন : হে ওকবা! আমি কি তোমাকে শ্রেষ্ঠ দুটি সূরা শিক্ষা দেব না? অতঃপর তিনি আমাকে সূরা ফালাক ও নাস শিক্ষা দিলেন। তারপর তিনি সালাতের ইমামতি করেন এবং সূরাদ্বয় পাঠ করলেন। সালাত শেষে আমাকে বললেন : হে ওকবা! তুমি এ দুটি সূরা পাঠ করবেÑযখন ঘুমাবে এবং যখন ঘুম থেকে জাগবে। (আহমাদ হা. ১৭৩৩৫, নাসায়ী হা. ৫৪৩৭, সহীহুল জামে হা. ৭৯৪৮)
এ ছাড়াও সূরাদ্বয়ের ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস পাওয়া যায়।
জাদু টোনা, ঝাড়ফুঁক ও তাবীজ কবচ : ইসলামে জাদু হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাক। তার মধ্যে অন্যতম হলো জাদু। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৬৬, সহীহ মুসলিম হা. ৮৯)
ইসলামে ঝাড়-ফুঁক সিদ্ধ তবে অবশ্যই সে ঝাড়-ফুঁক কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে হতে হবে। যেমন সূরা ফালাক, নাস ও ইখলাস ইত্যাদি এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে যে সকল দু‘আ প্রমাণিত। যেমন
بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللّٰهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ
আমি আল্লাহ তা‘আলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সব বিষয় হতে যা আপনাকে কষ্ট দেয়। প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তির বা হিংসুক চোখের অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে নিরাময় করুন। আল্লাহ তা‘আলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৮৬)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-কে নিম্নোক্ত দু‘আর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেন।
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ
আমি আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান হতে, বিষাক্ত কীট পতঙ্গ ও প্রত্যেক অনিষ্টকারীর চক্ষু হতে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৭১)। এ ছাড়াও ঝাড়-ফুঁকের অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।
কিন্তু যদি ঝাড় ফুঁক কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে না হয়ে অন্য কোন বানোয়াট শির্কী কথা দ্বারা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ হারাম। বিভিন্ন বালা-মসিবত থেকে বাঁচার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাবিজ ঝুলানো বা তাবিজ বাঁধা চাই তা কুরআন দ্বারা হোক আর অন্য কিছু হোক তা সম্পূর্ণ নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল। (আহমাদ হা. ১৭৪৫৮, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৪৯২)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : >
مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ
যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকায় তাকে তার দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা. ২০৭২, মিশকাত হা. ৪৫৫৬, সনদ হাসান।)
তাই ঝাড়-ফুঁেকর প্রয়োজন হলে একমাত্র কুরআন ও স্ন্নুাহ দ্বারাই করতে হবে।
তাফসীর:
(قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) – الْفَلَقِ অর্থ الصبح
বা প্রভাত কাল, উষা। আবার ফালাক অর্থ বিদীর্ণ করা, ফেটে বের হওয়া। যেমন বলা হয় فلقت
الشئ أي شققته
আমি জিনিসটিকে ফালাক করেছি অর্থাৎ বিদীর্ণ করেছি। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ اللّٰهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوٰي)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শস্য-বীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করেন’ (সূরা আন‘আম ৫: ৯৫)
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্রভাতের আলো বিকশিত করেন, তাই তাকে ফালাক বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে প্রভাতের প্রতিপালকের কাছে, নিজের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ এতে ইঙ্গিত রয়েছে সকল অনিষ্টের মূল হলো অন্ধকার। অনিষ্ট দূর হওয়ার পর আসে খুশির প্রভাত। মানুষ যখন বিপদে পতিত হয় তখন চেহারা মলিন ও অন্ধকার হয়ে যায়। আবার যখন বিপদ থেকে মুক্তি পায় তখন চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
(شَرِّ مَا خَلَق)
অর্থাৎ সকল মাখলুকের অনিষ্ট হতে। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন: জাহান্নাম, শয়তান ও তার সঙ্গী সাথী যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন।
(وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ) – غَاسِق
অর্থ: রাত। যেমন হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন :
انه الليل اذا اقبل بظلامه
এটা (গাসাক) হলো রাত যখন তা অন্ধকারসহ আগমন করে। (ই্বনু কাসীর)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন :
الغسق اول ظلمة الليل
গসাক হলো রাতের প্রথম অন্ধকার। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلٰي غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ)
‘সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম কর এবং কায়েম কর ফজরের সালাত।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ৭৮)
আবার হাদীসে চাঁদকে غَاسِقٍ বলা হয়েছে। যেমন একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাতে আয়িশাহ (রাঃ)-এর হাত ধরে চাঁদ দেখিয়ে বলেন : হে আয়িশাহ! এর অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা এটা হলো গাসেক যখন সে সমাগত হয়। (তিরমিযী হা. ৩৩৬৬, মিশকাত হা. ২৪৭৫ সনদ সহীহ।)
যারা গাসেক বলে রাতকে বুঝিয়েছেন আর যারা চাঁদকে বুঝিয়েছেন উভয়ের মাঝে কোন প্রার্থক্য নেই। কেননা চাঁদ রাতের একটি নিদর্শন।
وَقَبَ অর্থ : প্রবেশ করা, চলে যাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ আমি আশ্রয় চাচ্ছি রাতের অনিষ্ট হতে যখন তা অন্ধকারে প্রবেশ করে। রাতের অন্ধকারেই হিংস্র জন্তু, ক্ষতিকর প্রাণী ও পোকা মাকড় অনুরূপভাবে অপরাধপ্রবণ হিংস্র মানুষ নিজ নিজ জঘন্য ইচ্ছা পূরণের আশা নিয়ে বাসা হতে বের হয়। এ বাক্য দ্বারা সে সকল অনিষ্টকর জীব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার কথা বলা হচ্ছে।
(وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثٰتِ فِي الْعُقَدِ)
হাসান বাসরী, যহহাক ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন :
النفاثات هن السواحر
নাফফাসাত হলো জাদুকারীগণ। আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন : গিরাতে ফুঁৎকারদানকারী আত্মার অনিষ্ট হতে অথবা গিরাতে ফুঁৎকারদানকারিণী মহিলাদের থেকে। (ফাতহুল কাদীর)
এ থেকে উদ্দেশ্য হলো : গিরাতে ফুঁক দানকারী প্রত্যেক জাদুকারিণী ও জাদুকর যারা মানুষের ক্ষতি করে থাকে।
حَسَدَ বলা হয় ‘যে ব্যক্তির সাথে হিংসা করা হচ্ছে তাকে আল্লাহ তা‘আলা যে নেয়ামত দান করেছেন তা দূরীভূত হয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা করা।’ (ফাতহুল কাদীর)
এরূপ হিংসা করা কবীরাহ গুনাহ ও মারাত্মক ব্যাধি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
তোমরা হিংসা থেকে বেঁেচ থাকে। কেননা হিংসা মানুষের সৎ আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠ খেয়ে ফেলে। (আবূ দাঊদ হা. ৪৯০৩, সহীহ)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : হিংসা হলো প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয় এবং প্রথম পাপ যা পৃথিবীতে করা হয়। যা আসমানে ইবলীস আদমের সাথে করেছিল। আর পৃথিবীতে কাবীল তার ছোট ভাই হাবীলের সাথে করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি অভিশপ্ত, বহিস্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত। (তাফসীর কুরতুবী)
তাই হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকেও আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। হিংসা থেকে বাঁচার উপায় হল বেশি বেশি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়া। এজন্য নিম্নোক্ত দু‘আটি বেশি বেশি পাঠ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَآ إِنَّكَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْم)
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের সে-সব ভাইদের ক্ষমা কর যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং মু’মিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (সূরা হাশর ৫৯ : ১০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরা ফালাক ও নাসের অন্যান্য নাম জানলাম।
২. এ দুটি সূরার গুরুত্ব ও ফযীলত জানলাম।
৩. জাদুটোনা ও তাবীজ-কবচ শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষেধ।
৪. কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক হলে বৈধ, অন্যথায় তা অবৈধ।
৫. জাদুর প্রভাব রয়েছে যার প্রমাণ নাবী (সাঃ) স্বয়ং নিজে।
৬. ইয়াহূদীরা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন চক্রান্ত ও অপকৌশল অবলম্বন করে আসছে যা আজও বিদ্যামান।
৭. হিংসা একটি বড় গুনাহ এবং মারাত্মক ব্যাধি যা মানুষের সৎ আমল বিনষ্ট করে দেয়।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সুরা: আল-ফালাক্ব
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১১৩
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) সকাল বেলাকে বলা হয়। আওফী (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণনা করেছেন। কুরআন কারীমেরই অন্য জায়গায় (আরবি) রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, (আরবি) এর অর্থ হলো মাখলুক। হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো জাহান্নামের একটি জায়গা। ঐ জায়গার দরজা খোলা হলে তথাকার আগুনের উত্তাপ এবং ভয়াবহতায় জাহান্নামের সমস্ত অধিবাসী চীৎকার করতে শুরু করে। একটি মারফু হাদীসেও উপরোক্ত হাদীসেরই প্রায় অনুরূপ উক্তি রয়েছে। কিন্তু ওটাকে মুনকার হাদীস বলা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, (আরবি) জাহান্নামের নাম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, প্রথমটিই সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য উক্তি। অর্থাৎ (আরবি) এর অর্থ হলো সকাল বেলা। ইমাম বুখারীও (রঃ) একথাই বলেছেন এবং এটাই নির্ভুল।
সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অপকারিতার মধ্যে জাহান্নাম, ইবলীস ও ইবলীসের সন্তান সন্ততিও রয়েছে। (আরবি) এর অর্থ হলো রাত। (আরবি) এর অর্থ হলো সূর্যাস্ত। অর্থাৎ যখন অন্ধকার রাত উপস্থিত হয়। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, আরবের লোকেরা সুরাইয়া নক্ষত্রের অস্তমিত হওয়াকে বলে। অসুখ এবং বিপদ আপদ সুরাইয়া নক্ষত্র উদিত হওয়ার পর বৃদ্ধি পায় এবং ঐ নক্ষত্র অস্তমিত হওয়ার পর অসুখ বিপদ আপদ কেটে যায়।
একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) হলো নক্ষত্রের নাম। কিন্তু এ হাদীসের মারফু হওয়ার কথা সত্য নয়। কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, (আরবি) এর অর্থ হলো চাঁদ। তাফসীরকারদের দলীল হলো মুসনাদে আহমদে বর্ণিত একটি হাদীস, যাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর হাত ধরে চাঁদের প্রতি ইশারা করে বললেনঃ “আল্লাহর কাছে ঐ (আরবি) এর অপকারিতা হতে আশ্রয় প্রার্থনা কর।”
অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, (আরবি) দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে। উভয় উক্তির মধ্যে সহজেই সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে বলা যেতে পারে যে, এটা হলো চাদের ক্রমবৃদ্ধি এবং নক্ষত্ররাজির আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি। এসব কিছু রাত্রিকালেই হয়ে থাকে এবং যখন রাত্রির আগমন ঘটে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
গ্রন্থিসমূহের উপর পড়ে পড়ে ফুৎকারকারিণীরা অর্থাৎ যাদুকর নারীগণ।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, যেই মন্ত্র পাঠ করে সাপে কাটা রোগীর উপর ফু দেয়া হয় এবং ভূত প্রেত তাড়ানোর জন্যে ফু দেয়া হয় এগুলো শিরকের খুবই কাছাকাছি। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এসে বললেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ) আপনি কি রোগাক্রান্ত?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেন “হ্যা” হযরত জিবরাঈল (আঃ) তখন নিম্নের দু’আ দু’টি পাঠ করেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ফু দিচ্ছি সেই সব রোগের জন্যে যা আপনাকে কষ্ট দেয়, প্রত্যেক হিংসুকের অনিষ্ট ও কুদৃষ্টি হতে আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। এই রোগ দ্বারা সম্ভবতঃ ঐ রোগকেই বুঝানো হয়েছে যে রোগে তিনি যাদুকৃত হওয়ার পর আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ) কে সুস্থতা ও আরোগ্য দান করেন। এতে হিংসুটে ইয়াহুদীদের যাদুর প্রভাব নস্যাৎ হয়ে যায়। তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়া হয়। তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে যাদু করা সত্ত্বেও তিনি যাদুকারীদেরকে কোন কটু কথা বলেননি এবং ধমকও। দেননি। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ) কে সুস্থতা ও আরোগ্য দান করেন।
মুসনাদে আহমদে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) এর উপর একজন ইয়াহূদী যাদু করেছিল। এই কারণে নবী (সঃ) কয়েকদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। তারপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে তাঁকে জানান যে, অমুক ইয়াহূদী তার উপর যাদু করেছে এবং অমুক অমুক কুঁয়ায় গ্রন্থি বেঁধে রেখেছে। সুতরাং তিনি যেন কাউকে পাঠিয়ে ঐ গ্রন্থি খুলিয়ে আনেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোক পাঠিয়ে তখন কুঁয়া থেকে ঐ যাদু বের করিয়ে আনান এবং গ্রন্থিখুলে ফেলেন। ফলে যাদুর প্রভাব কেটে যেতে শুরু করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ। (সঃ) ঐ ইয়াহুদীকে এ সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। এবং তাকে দেখে। কখনো মুখও মলিন করেননি।
সহীহ বুখারীতে কিতাবুত তিব্বে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর যাদু করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ ভেবেছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে গিয়েছেন, অথচ তিনি তাদের কাছে যাননি। হযরত সুফইয়ান (রঃ) বলেন যে, এটাই যাদুর সবচেয়ে বড় প্রভাব। এ অবস্থা হওয়ার পর একদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! আমি আমার প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করেছি এবং তিনি আমাকে জানিয়েছেন। দু’জন লোকে আমার কাছে আসেন। একজন আমার মাথার কাছে এবং অন্যজন আমার পায়ের কাছে বসেন ‘আমার কাছে অর্থাৎ শিয়রে যিনি বসেছিলেন, তিনি দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “এর অবস্থা কি?” দ্বিতীয়জন উত্তরে বললেনঃ “এঁর উপর যাদু করা হয়েছে। প্রথম জন প্রশ্ন করলেনঃ “কে যাদু করেছে?” দ্বিতীয়জন জবাব দিলেনঃ “লুবাইদ ইবনে আসাম। সে বান্ যুরাইক গোত্রের লোক। সে ইয়াহূদীদের মিত্র এবং মুনাফিক।” প্রথম জন জিজ্ঞেস করলেনঃ “কিসের মধ্যে যাদু করেছে?” দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেনঃ “মাথার চুলে ও চিরুণীতে। প্রথমজন প্রশ্ন করলেনঃ “কোথায়, তা দেখাও।” দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেনঃ “খেজুর গাছের বাকলে, পাথরের নিচে এবং যারওয়ান কূপে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ কূপের কাছে গমন করলেন এবং তা থেকে ওসব বের করলেন। ঐ কূপের পানি ছিল যেন মেহদীর রঙ। ওর পাশের খেজুর গাছগুলোকে ঠিক শয়তানের মাথার মত মনে হচ্ছিল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ): এ কাজের জন্যে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথা শুনে বললেনঃ “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তিনি আমাকে নিরাময় করেছেন ও সুস্থতা দিয়েছেন। আমি মানুষের মধ্যে মন্দ ছড়ানো পছন্দ করি না।”
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কোন একটা কাজ করেননি। অথচ তাঁর মনে হতো যে, তিনি ওটা করেছেন। এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) নির্দেশক্রমে ঐ কূপে মাটি ভর্তি করে দেয়া হয়। এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ছয় মাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর (সঃ) এরূপ অবস্থা ছিল।
তাফসীরে সালাবীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ইয়াহূদীদের একটা ছেলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমত করতো। ঐ ছেলেটিকে ফুসলিয়ে ইয়াহুদীরা রাসূলুল্লাহর (সঃ) কয়েকটি চুল এবং তাঁর চুল আঁচড়াবার চিরুনীর কয়েকটি দাঁত হস্তগত করে। তারপর তারা ওগুলোতে যাদু করে। এ কাজে সবচেয়ে বেশী সচেষ্ট ছিল লুবাইদ ইবনে আসাম। এরপর যাদুর গ্রন্থি বা সুরাইক যারওয়ান নামক কূপে স্থাপন করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার স্ত্রীদের কাছে গমন না করেও তাঁর মনে হতো যে তিনি তাদের কাছে গমন করেছেন। এইমন ভুলো অবস্থা দূরীকরণের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু এরকম অবস্থা হওয়ার কারণ তাঁর জানা ছিল না। ছয় মাস পর্যন্ত ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে। তারপর উপরোল্লিখিত ঘটনা ঘটে। দুজন ফেরেশতা এসে কথােপকথনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন হযরত আলী (রাঃ), হযরত যুবায়ের (রাঃ) এবং হযরত আম্মার (রাঃ) কে পাঠিয়ে কূপ থেকে যাদুর গ্রন্থিগুলো বের করিয়ে আনেন। ঐ যাদুকৃত জিনিষগুলোর মধ্যে একটি ধনুকের রঞ্জু ছিল, তাতে ছিল বারোটি গ্রন্থি বা গেরো। প্রত্যেক গেরোতে একটি করে সূচ বিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপর আল্লাহ তা’আলা এ সূরা দু’টি অবতীর্ণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সূরা দু’টির এক একটি আয়াত পাঠ করছিলেন আর ঐ গ্রন্থিসমূহ একটি একটি করে আপনা আপনি খুলে যাচ্ছিল। সূরা দু’টি পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত গেরোই খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এদিকে হযরত জিবরাঈল (আঃ) উপরোল্লিখিত দু’আ পাঠ করেন। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি ঐ নরাধমকে ধরে হত্যা করে ফেলবো রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “না, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি মানুষের মধ্যে অনিষ্ট ও বিবাদ ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাই না।”এ বর্ণনায় গারাবাত ও নাকারাত রয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর
এ সূরায় মহা মহিমান্বিত আল্লাহর তিনটি গুণ বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি হলেন পালনকর্তা, শাহানশাহ এবং মা’বুদ বা পূজনীয়। সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন, সবই তার মালিকানাধীন এবং সবাই তার আনুগত্য করছে। তিনি তার প্রিয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির এবং মানুষের মা’বুদের, পশ্চাদপসরণকারীর অনিষ্ট হতে যে মানুষের অন্তরসমূহে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা দিয়ে থাকে। চাই সে জ্বিন হোক অথবা মানুষ হোক। অর্থাৎ যারা অন্যায় ও খারাপ কাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে চোখের সামনে হাজির করে পথভ্রষ্ট এবং বিভ্রান্ত করার কাজে যারা অতুলনীয়। আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু তাদের অনিষ্ট হতে রক্ষা পেতে পারে।
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের প্রত্যেকের সাথে একজন করে শয়তান রয়েছে।” সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সাথেও কি শয়তান রয়েছে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা আমার সঙ্গেও শয়তান রয়েছে? কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঐ শয়তানের মুকাবিলায় আমাকে সাহায্য করেছেন, কাজেই আমি নিরাপদ থাকি। সে আমাকে পুণ্য ও কল্যাণের শিক্ষা দেয়।”
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ই’তেকাফে থাকা অবস্থায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত সফিয়া (রাঃ) তাঁর সাথে রাতের বেলায় দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে যাবার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)ও তাঁকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকেন। পথে দু’জন আনসারীর সাথে দেখা হলো। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে তাঁর স্ত্রীকে দেখে দ্রুতগতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁদেরকে থামালেন এবং বললেনঃ “জেনে রেখো যে, আমার সাথে যে মহিলাটি রয়েছে এটা আমার স্ত্রী সফিয়া বিনতে হুইয়াই (রাঃ)।” তখন আনসারী দু’জন বললেনঃ “আল্লাহ্ পবিত্র। হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। এ কথা আমাদেরকে বলার প্রয়োজনই বা কি ছিল?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “মানুষের রক্ত। প্রবাহের স্থানে শয়তান ঘোরাফেরা করে থাকে। সুতরাং আমি আশংকা করছিলাম যে, শয়তান তোমাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় না কি।”
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন “শয়তান তার হাত মানুষের অন্তকরণের উপর স্থাপন করে রেখেছে। মানুষ যখন আল্লাহর ইবাদত করে তখন সে নিজের হাত মানুষের অন্তকরণ থেকে সরিয়ে নেয়। আর যখন মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় তখন শয়তান মানুষের অন্তকরণের উপর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটাই শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা এবং এটাই ওয়াসওয়াসাতুল খান্নাস।” (এ হাদীসটি হাফিয আবূইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি গারীব বা দুর্বল)
মুসনাদে আহমাদে এমন একজন সাহাবী হতে বর্ণিত আছে যিনি গাধার পিঠে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন। গাধা একটু হোঁচট খেলে ঐ সাহাবী বলে ওঠেনঃ “শয়তান ধ্বংস হোক।” তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “এভাবে বলো না, এতে শয়তান আরো বড় হয়ে যায়, আরো এগিয়ে আসে এবং বলেঃ আমি নিজের শক্তি দ্বারা তাকে কাবু করেছি। আর যদি বিসমিল্লাহ বলো তবে সে ছোট হতে হতে মাছির মতে হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর স্মরণে শয়তান পরাজিত ও নিস্তেজ হয়ে যায়। আর আল্লাহকে বিস্মরণ হলে সে বড় হয়ে যায় ও জয়যুক্ত হয়।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে শয়তান তার কাছে যায় এবং আদর করে তার গায়ে হাত বুলাতে থাকে, যেমন মানুষ গৃহপালিত পশুকে আদর করে। ঐ আদরে লোকটি চুপ করে থাকলে শয়তান তার নাকে দড়ি বা মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেনঃ “তোমরা স্বয়ং নাকে দড়ি লাগানো এবং মুখে লাগাম পরিহিত লোককে দেখতে পাও। নাকে দড়ি লাগানো হলো ঐ ব্যক্তি যে এক দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে না। আর মুখে লাগাম পরিহিত হলো ঐ ব্যক্তি যে মুখ খুলে রাখে এবং আল্লাহর যিক্র করে না।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, শয়তান আদম সন্তানের মনে তার থাবা বসিয়ে রাখে। মানুষ যেখানেই ভুল করে এবং উদাসীনতার পরিচয় দেয় সেখানেই সে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে। আর যেখানে মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করে সেখানে সে পশ্চাদপসরণ করে।
অন্য বর্ণনায় আছে যে, সুখ-শান্তি এবং দুঃখ কষ্টের সময় শয়তান মানুষের মনে ছিদ্র করতে চায়। অর্থাৎ তাকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। এ সময়ে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে তবে শয়তান পালিয়ে যায়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, শয়তানকে মানুষ যেখানে প্রশ্রয় দেয় সেখানে সে মানুষকে অন্যায় অপকর্ম শিক্ষা দেয়, তারপর কেটে পড়ে।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ মানব মণ্ডলীর অন্তর সমূহে কুমন্ত্রণা দেয়।
(আরবি) শব্দের অর্থ মানুষ। তবে এর অর্থ জ্বিনও হতে পারে। কুরআন কারীমের অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ জ্বিনের মধ্য হতে কতকগুলো তোক। কাজেই জ্বিনসমূহকে শব্দের অন্তর্ভুক্ত করা অসঙ্গত নয়। মোটকথা, শয়তান। জ্বিন এবং মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে।
(আরবি) (জ্বিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য হতে)। অর্থাৎ এরা কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে, চাই সে জ্বিন হোক অথবা মানুষ হোক। এর তাফসীর এরূপও করা হয়েছে। মানব ও দানব শয়তানরা মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এভাবেই আমি মানবরূপী অথবা দানবরূপী শয়তানকে প্রত্যেক নবীর শত্রু বানিয়েছি। একজন অন্যজনের কানে ধোকা-প্রতারণামূলক কথা সাজিয়ে গুছিয়ে ব্যক্ত করে।” (৬:১১২)।
মুসনাদে আহমদে হযরত আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট হাজির হন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) মসজিদে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু যার (রাঃ) তার পাশে বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আবু যার (রাঃ)! তুমি নামায পড়েছো কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “জ্বী, না।” তখন তিনি বললেনঃ “তা হলে উঠে নামায পড়ে নাও।” হযরত আবু যার (রাঃ) উঠে নামায পড়লেন। তারপর বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “হে আবু যার (রাঃ) মানবরূপী শয়তান হতে এবং দানবরূপী শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।” হযরত আবু যার (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মানুষের মধ্যেও কি শয়তান আছে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা”, হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস। করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) নামায কি?” তিনি জবাবে বললেনঃ “নামায খুব ভাল কাজ। যার ইচ্ছা কম পড়তে পারে এবং যার ইচ্ছা বেশী পড়তে পারে।” হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। রোযা কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “যথেষ্ট হওয়ার মত একটি ফরজ কাজ। আল্লাহর কাছে এর জন্যে বহু পুরস্কার রয়েছে। হযরত আবু যার (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ “সাদকা কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “সাদকা এমনই জিনিষ যার বিনিময় বহুগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে।” হযরত আবু যার (রাঃ) আর করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। কোন সাদকা সবচেয়ে উত্তম?” রাসূলুল্লাহ। (সঃ) উত্তর দিলেনঃ “সম্পদ কম থাকা সত্ত্বেও সাদকা করা, অথবা চুপে চুপে কোন ফকীর মিসকীন ও দুঃখী জনের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।” হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সর্বপ্রথম নবী কে ছিলেন?” তিনি জবাবে বললেনঃ “হযরত আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম নবী।” হযরত আবু যার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হযরত আদম (আঃ) কি নবী ছিলেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা, তিনি নবী ছিলেন, এবং এমন ব্যক্তি ছিলেন যার সঙ্গে আল্লাহ তা’আলা কথাবার্তা বলেছেন।” হযরত আবু যার (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। রাসূল কত জন ছিলেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “তিনশত দশের কিছু বেশী, বলা যায় একটি বড় জামাআত।” আবার এও বললেনঃ “তিনশত পনেরো।” হযরত আবু যার (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার প্রতি নাযিলকৃত আয়াতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আয়াত কোনটি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “আয়াতুল কুরসী অর্থাৎ,(আরবি) এই আয়াতটি।” (এ হাদীসটি ইমাম নাসায়ীও (রঃ) বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম আবু হাতিম ইবনে হিব্বানও (রঃ) অন্য সনদে এ হাদীসটি দীর্ঘভাবে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক নবী (সঃ)-এর নিকট এসে বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার মনে এমন সব চিন্তা আসে যেগুলো প্রকাশ করার চেয়ে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়াই আমার নিকট বেশী পছন্দনীয় (সুতরাং এ অবস্থায় আমি কি করবো?)। নবী (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “(তুমি বলবে): (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান আল্লাহ তা’আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যিনি শয়তানের প্রতারণাকে ওয়াসওয়াসা অর্থাৎ শুধু কুমন্ত্রণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, বাস্তবে কার্যে পরিণত করেননি।”