Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৩৯) [*‌‌  *সৃষ্টিজগত সম্পর্কে জড়বাদীদের চিন্তাধারা:- যারা আজ, তামাসাচ্ছলে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যস্ত আছে:-] www.motaher21.net সূরা:৫২-আত-তূর। পারা:২৭ ১-২৮ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩৯)
[*‌‌  *সৃষ্টিজগত সম্পর্কে জড়বাদীদের চিন্তাধারা:-
যারা আজ, তামাসাচ্ছলে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যস্ত আছে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫২-আত-তূর। পারা:২৭
১-২৮ নং আয়াত:-
সূরা:৫২-আত-তূর-১
وَ الطُّوۡرِ ۙ﴿۱﴾
শপথ ত্বূর (পর্বতের),
সূরা:৫২-আত-তূর-২
وَ کِتٰبٍ مَّسۡطُوۡرٍ ۙ﴿۲﴾
এবং এমন একখানা খোলা গ্রন্থের শপথ,
সূরা:৫২-আত-তূর-৩
فِیۡ رَقٍّ مَّنۡشُوۡرٍ ۙ﴿۳﴾
যা সূক্ষ্ম চামড়ার ওপর লিখিত।
সূরা:৫২-আত-তূর-৪
وَّ الۡبَیۡتِ الۡمَعۡمُوۡرِ ۙ﴿۴﴾
শপথ বায়তুল মা’মূরের,
সূরা:৫২-আত-তূর-৫
وَ السَّقۡفِ الۡمَرۡفُوۡعِ ۙ﴿۵﴾
সুউচ্চ ছাদের,
সূরা:৫২-আত-তূর-৬
وَ الۡبَحۡرِ الۡمَسۡجُوۡرِ ۙ﴿۶﴾
শপথ উদ্বেলিত (প্রজ্বালিত) সমুদ্রের,
সূরা:৫২-আত-তূর-৭
اِنَّ عَذَابَ رَبِّکَ لَوَاقِعٌ ۙ﴿۷﴾
নিশ্চয় আপনার রবের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী,
সূরা:৫২-আত-তূর-৮
مَّا لَہٗ مِنۡ دَافِعٍ ۙ﴿۸﴾
যার রোধকারী কেউ নেই।
সূরা:৫২-আত-তূর-৯
یَّوۡمَ تَمُوۡرُ السَّمَآءُ مَوۡرًا ۙ﴿۹﴾
তা ঘটবে সেদিন, যেদিন আসমান প্রচণ্ডভাবে প্রকম্বিত হবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১০
وَّ تَسِیۡرُ الۡجِبَالُ سَیۡرًا ﴿ؕ۱۰﴾
এবং পাহাড় শূন্যে উড়তে থাকবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১১
فَوَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
ধ্বংস রয়েছে সেদিন সেসব অস্বীকারকারীদের জন্য।
সূরা:৫২-আত-তূর-১২
الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ خَوۡضٍ یَّلۡعَبُوۡنَ ﴿ۘ۱۲﴾
যারা আজ, তামাসাচ্ছলে নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যস্ত আছে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৩
یَوۡمَ یُدَعُّوۡنَ اِلٰی نَارِ جَہَنَّمَ دَعًّا ﴿ؕ۱۳﴾
সেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৪
ہٰذِہِ النَّارُ الَّتِیۡ کُنۡتُمۡ بِہَا تُکَذِّبُوۡنَ ﴿۱۴﴾
‘এটাই সে আগুন যাকে তোমারা মিথ্যা মনে করতে।’
সূরা:৫২-আত-তূর-১৫
اَفَسِحۡرٌ ہٰذَاۤ اَمۡ اَنۡتُمۡ لَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿ۚ۱۵﴾
এখন বলো, এটা কি যাদু না এখনো তোমরা উপলব্ধি করতে পারছো না?
সূরা:৫২-আত-তূর-১৬
اِصۡلَوۡہَا فَاصۡبِرُوۡۤا اَوۡ لَا تَصۡبِرُوۡا ۚ سَوَآءٌ عَلَیۡکُمۡ ؕ اِنَّمَا تُجۡزَوۡنَ مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۶﴾
যাও, এখন এর মধ্যে ঢুকে দগ্ধ হতে থাকো। তোমরা ধৈর্য্য ধর আর না ধর, এখন উভয়টিই তোমাদের জন্য সমান। তোমরা যেমন কাজ করে এসেছো ঠিক তেমন প্রতিদানই তোমাদের দেয়া হচ্ছে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৭
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ نَعِیۡمٍ ﴿ۙ۱۷﴾
মুত্তাকীরা সেখানে বাগান ও নিয়ামতসমূহের মধ্যে অবস্থান করবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৮
فٰکِہِیۡنَ بِمَاۤ اٰتٰہُمۡ رَبُّہُمۡ ۚ وَ وَقٰہُمۡ رَبُّہُمۡ عَذَابَ الۡجَحِیۡمِ ﴿۱۸﴾
তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দেবেন, তারা তা সানন্দে উপভোগ করবে এবং তিনি তাদেরকে রক্ষা করবেন জাহান্নামের শাস্তি হতে।
সূরা:৫২-আত-তূর-১৯
کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا ہَنِیۡٓـًٔۢا بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿ۙ۱۹﴾
তোমরা যেসব কাজ করে এসেছো তার বিনিময়ে মজা করে পানাহার করো।
সূরা:৫২-আত-তূর-২০
مُتَّکِئِیۡنَ عَلٰی سُرُرٍ مَّصۡفُوۡفَۃٍ ۚ وَ زَوَّجۡنٰہُمۡ بِحُوۡرٍ عِیۡنٍ ﴿۲۰﴾
তারা সামনা-সামনি রাখা সুসজ্জিত আসনসমূহে হেলান দিয়ে বসবে এবং আমি সুনয়না হুরদের সাথে তাদের বিয়ে দেব।
সূরা:৫২-আত-তূর-২১
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ اتَّبَعَتۡہُمۡ ذُرِّیَّتُہُمۡ بِاِیۡمَانٍ اَلۡحَقۡنَا بِہِمۡ ذُرِّیَّتَہُمۡ وَ مَاۤ اَلَتۡنٰہُمۡ مِّنۡ عَمَلِہِمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ ؕ کُلُّ امۡرِیًٴۢ بِمَا کَسَبَ رَہِیۡنٌ ﴿۲۱﴾
যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানসহ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে আমি তাদের সেসব সন্তানকেও তাদের সাথে (জান্নাতে) একত্রিত করে দেব। এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করব না।
প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ।
সূরা:৫২-আত-তূর-২২
وَ اَمۡدَدۡنٰہُمۡ بِفَاکِہَۃٍ وَّ لَحۡمٍ مِّمَّا یَشۡتَہُوۡنَ ﴿۲۲﴾
আমি তাদেরকে সব রকমের ফল, গোশত এবং তাদের মন যা চাইবে তাই প্রচুর পরিমাণে দিতে থাকবো।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৩
یَتَنَازَعُوۡنَ فِیۡہَا کَاۡسًا لَّا لَغۡوٌ فِیۡہَا وَ لَا تَاۡثِیۡمٌ ﴿۲۳﴾
সেখানে তারা একে অপরের নিকট হতে গ্রহণ করবে পান-পাত্র, যা হতে পান করলে কেউ অসার কথা বলবে না এবং পাপ কর্মেও লিপ্ত হবে না।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৪
وَ یَطُوۡفُ عَلَیۡہِمۡ غِلۡمَانٌ لَّہُمۡ کَاَنَّہُمۡ لُؤۡلُؤٌ مَّکۡنُوۡنٌ ﴿۲۴﴾
তাদের (সেবায়) তাদের কিশোরেরা তাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে; যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৫
وَ اَقۡبَلَ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ یَّتَسَآءَلُوۡنَ ﴿۲۵﴾
তারা একে অপরকে অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৬
قَالُوۡۤا اِنَّا کُنَّا قَبۡلُ فِیۡۤ اَہۡلِنَا مُشۡفِقِیۡنَ ﴿۲۶﴾
তারা বলবে, নিশ্চয় আগে আমরা পরিবার-পরিজনের মধ্যে শংকিত অবস্থায় ছিলাম।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৭
فَمَنَّ اللّٰہُ عَلَیۡنَا وَ وَقٰىنَا عَذَابَ السَّمُوۡمِ ﴿۲۷﴾
অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে উত্তপ্ত ঝড়ো হাওয়ার শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন।
সূরা:৫২-আত-তূর-২৮
اِنَّا کُنَّا مِنۡ قَبۡلُ نَدۡعُوۡہُ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡبَرُّ الرَّحِیۡمُ ﴿٪۲۸﴾
নিশ্চয় আমরা আগেও আল্লাহকে ডাকতাম, নিশ্চয় তিনি কৃপাময়, পরম দয়ালু।
১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আলােচ্য সূরাটি মানুষের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং পড়ার সময় পাঠকের অন্তর থেকে যাবতীয় পেরেশানী, সন্দেহ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং নানাভাবে আগত যেসব ভুল চিন্তা ও চেতনা, যা তার অন্তরে বাসা বেঁধে রয়েছে-দূর হয়ে যায়, আর যেসব ওযর-অজুহাত দিয়ে এই মিথ্যার মায়াজাল তাকে অভিভূত করে রেখেছিলাে এবং সত্য গ্রহণ করা থেকে সরিয়ে রেখেছিলাে তা খান খান হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর। সূরাটি এত গভীরভাবে অন্তরকে প্রভাবিত করে যে, কোনাে পাঠকই এ প্রভাবকে উপেক্ষা করতে পারে না, যার ফলে আল্লাহর কাছে সে আত্মসমর্পণ করে, তার হুকুম মানতে সে বাধ্য হয়ে যায়। সূরাটির মধ্যে ব্যবহৃত শব্দাবলী এবং হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতাে বিভিন্ন আলােচ্য-বিষয় রয়েছে, এ উভয়ের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে এ বশীভূত করার ক্ষমতা। উপরন্তু এতে রয়েছে অর্থ ও শক্তিশালী যুক্তি-প্রমাণের ব্যাপকতা। আরও রয়েছে এর মধ্যে ছবির মতাে আঁকা বিবরণসমূহ। বিভিন্ন ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে সূরাটির মধ্যে এতাে সুন্দরভাবে যে, বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ও অধ্যায়ে বর্ণিত কথাগুলাে যেন সুরের এক মূর্ছনা সৃষ্টি করেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণিত ঘটনা পরম্পরা তাই পাঠক হৃদয়কে দারুণভাবে অভিভূত করে। সূরাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলাে যেন তীরবেগে পাঠকের হৃদয়ে বিদ্ধ হয়, ঘটনাবলী যেন বজ্রপাতের মতাে এবং চিত্রের মতাে আপতিত হয় আঁকা কথাগুলাে যেন অনুভূতির দুয়ারে এমনভাবে কষাঘাত করতে থাকে যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি মুহূর্তই যেন তা থামতে চায় না। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা যমীন ও আসমানের বিভিন্ন পবিত্র বিষয় ও জিনিসের নাম নিয়ে শপথ গ্রহণ করার সাথে সূরাটি শুরু করছেন। সে বিষয়গুলাের মধ্যে কোনাে কোনােটি আমাদের সুপরিচিত যা খােলাখুলি বাহ্যিক চোখে দেখা যায় এবং কোনাে কোনােটি থাকে চোখের আড়ালে এবং মানব সাধারণের কাছে অপরিচিত ও বুদ্ধিরও অগম্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘কসম তূর পর্বতের এবং লিপিবদ্ধ কিতাবের, যা লিখিত হয়েছে সপ্রশস্ত কিতাবে। কসম বায়তুল মা’মুর-এর সমুন্নত ছাদের এবং উত্তাল সমুদ্রের।’ এখানে অতি ভয়ানক কিছু বিষয়ের কসম খাওয়া হয়েছে, যা অন্তরকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তােলে এবং অনুভূতিকে প্রবলভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে। সূরাটির ব্যাখ্যার মধ্যে ‘ভয়’ কথাটিই প্রাধান্য লাভ করেছে। আর যেসব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে তাতে দারুণভাবে হৃদয় প্রকম্পিত হতে থাকে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই তােমার মালিকের আযাব সংঘটিত হবে, কোনাে কিছুই তাকে রােধ করতে পারবে না। সে দিন আকাশ ভীষণভাবে আন্দোলিত হতে থাকবে এবং পাহাড়-পর্বত স্থানচ্যুত হয়ে ভীষণ গতিবেগে সঞ্চালিত হতে থাকবে।’ এ ভয়ংকর দৃশ্যের মধ্যে আমরা প্রবল কম্পনের একটা দৃশ্য দেখতে পাব এবং তার ভয়ানক আওয়াজও শুনতে পাব। চতুর্দিকে দেখা যাবে শুধু ধ্বংস-বিপর্যয়, প্রচন্ড ধাক্কা ও সব কিছু ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার ভয়ংকর দৃশ্য। তাই এরশাদ হচ্ছে, সুতরাং চরম ধ্বংস নেমে আসবে সেদিন সেইসব মিথ্যারােপকারীদের জন্য, যারা হেলায় খেলায় নানা প্রকার মিথ্যা কথা বলে। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তাদেরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, এ-ই হচ্ছে সেই অগ্নিকুন্ড, যাকে তােমরা অস্বীকার করতে এবং যার খবর দেয়ার কারণে তােমরা নবীদের মিথ্যাবাদী বলতে। কেমন, এটা কি কোনাে জাদু না তোমরা প্রকৃতপক্ষে তােমরা দেখতেই পাচ্ছ না! যাও, প্রবেশ করো এর মধ্যে, সহ্য করতে পারাে আর না পারাে এর মধ্যেই ধৈর্য ধরে থাকতে হবে তোমাদের। সহ্য করাে, আর না করাে উভয় অবস্থা আজ তােমাদের জন্য সমান। তােমাদের তাে সেই সকল কাজের প্রতিদান দেয়া হচ্ছে যা তােমরা (দুনিয়াতে) করতে থেকেছে। পাপীদের প্রতি উপর্যুপরি যে আক্রমণ হবে তার শেষ পরিণতি হবে এই দোযখ। অবশ্য অন্য আরও অনেকভাবে কঠিন পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষমান থাকবে। অতি কঠিন ও ভয়ানক এ পরিণামের দিকে তাদের এগিয়ে যাওয়ার কারণ হবে তাদের বল্গাহারা কুপ্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে গিয়ে বেপরােয়া হয়ে যাওয়া। যখন দুনিয়াতে তারা নিরাপত্তা লাভ করেছে ও নানাপ্রকার বিলাসিতার উপকরণ লাভে ধন্য হয়েছে, তখনই কুপ্রবৃত্তির তাড়নে তারা গা ভাসিয়ে দিয়েছে। কেয়ামতের সে ভয়াবহ দিনে তারা আশাভরা চাহনি নিয়ে তাকাতে থাকবে। নিরাপদ অবস্থানে থেকে নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাহদের দিকে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত নানা বর্ণের নানা প্রকৃতির ভােগ-বিলাসের অফুরন্ত উপকরণ ও সম্মানপ্রাপ্তি দেখে, আযাবে পতিত সে হতভাগারা লালায়িত হবে, সেসব নেয়ামতের প্রাচুর্য দেখে তাদের অনুভূতি ছটফট করবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহভীরু লােকেরা বাগ-বাগিচায় ভরা বেহেশতে এবং স্বয়ং আল্লাহ পাকের দেয়া নেয়ামতের মধ্যে মাতােয়ারা হয়ে থাকবে এবং তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচিয়ে নেবেন। তাদেরকে বলা হবে, ‘খাও পান করাে তৃপ্তির সাথে, যে সকল কাজ তােমরা (অতীতে) করেছে তারই বিনিময়ে এসব নেয়ামত তােমাদের জন্য দেয়া হচ্ছে। সারিবদ্ধ খাট-পালং-এ হেলান দিয়ে তারা আরামের সাথে উপবিষ্ট থাকবে।’ আল্লাহ তায়ালা আরও জানাচ্ছেন, আমি আয়ত-লােচনা সুন্দরী রমণীদের সাথে তাদের বিয়ে দেব। আর যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানের সাথে যে সকল সন্তান-সন্ততি তাদের অনুসরণ করেছে, তাদেরকে ওদের সাথে মিলিত করে দেব, তাদের নেক কাজকে কিছুমাত্র হ্রাস করবাে না। প্রত্যেক মানুষই তার নিজের কৃতকর্মের জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। আমি তাদেরকে, তাদের চাহিদা মতাে ফলমূল ও গোশত সরবরাহ করবো। শরবতের পাত্রগুলাে তারা পরস্পর বিনিময় করতে থাকবে, যার মধ্যে কোনাে মাদকতা, মাথাধরা অথবা বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যাওয়ার খারাবী থাকবে না। এসব পানপাত্র নিয়ে মতির মতাে সুন্দর সুন্দর বালকের দল তাদের মধ্যে ছুটোছুটি করতে থাকবে। বেহেশতীরা এই বলে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাবে, ‘আমরা তাে এর পূর্বেও এমনি করে পরস্পরের প্রতি দরদী ও সহানুভূতিশীল ছিলাম, তাই না? এজন্যই আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি এই দয়া করেছেন এবং আমাদেরকে প্রচন্ড উত্তপ্ত আগুনের আযাব থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। অবশ্যই আমরা ইতিপূর্বে আল্লাহ রবুল আলামীনের কাছে দোয়া করেছি, ‘নিশ্চয়ই তিনি অতি মহান ও নেক কাজের প্রতিদান দেন এবং তিনি অতি মেহেরবান।’ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আলোচ্য সূরার মধ্যে প্রথমেই মানুষের সামনে আযাবের কষাঘাতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়ের মধ্যে বলা হয়েছে যে, মানুষের অন্তর আল্লাহ্ পাকের অতুলনীয় নেয়ামতের স্বাদ অবশ্যই অনুভব করে এবং তৃতীয় আলােচ্য বিষয়ের মধ্যে দেখানাে হয়েছে, মানুষ এমনই এক জীব যে সে কোনাে কিছু যেন বেশীদিন স্থিরভাবে ধরে রাখতে পারে না, বরং নানা প্রকার পেরেশানী ও প্ররােচনা তাকে যেন তাড়িয়ে বেড়ায়, তার মনের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় দানা বাঁধতে থাকে এবং নানাপ্রকার ভ্রান্তির বেড়াজালে সে আবদ্ধ হয়ে যায়। তখন সে বিবিধ হিলা-বাহানা ও ওযর-আপত্তি পেশ করে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে চায়, অথচ পরিষ্কারভাবে তাদের সামনে সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে এবং অত্যন্ত ব্যাপকভাবে সত্যের বাতিকে উজ্জ্বল করে তােলা হয়েছে। সত্যের বাণীকে এমন উত্তম যুক্তি সহকারে পেশ করা হয়েছে যে অন্য কোনাে ব্যাখ্যা করে সত্য থেকে দূরে থাকার কোনাে সুযােগ নেই। সত্য-সঠিক পথ হচ্ছে এমন সরল ও মযবুত পথ যে তার মধ্যে কোনাে অস্পষ্টতা বা মারপ্যাচ নেই। সত্যের জোরালাে যুক্তির কাছে মানুষের ঘাড় আপনা থেকেই ঝুঁকে পড়ে এবং পরিশেষে মেনে নিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, আর এ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই কথা বলার জন্য রসূলুল্লাহ(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তিনি মানুষকে সঠিক উপদেশ দিতে পারেন। যদিও রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে তারা চরম বেআদবী করে আসছিলাে, তবু অত্যন্ত শক্তিশালী ও যুক্তিপূর্ণ কথা দ্বারা তাদের হৃদয় দুয়ারে বারবার আঘাত হানার জন্য রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি এ নির্দেশ ছিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব, (হে আমার নবী) উপদেশ দিতে থাকো, তুমি তােমার রব-এর মেহেরবানীতে কোনাে গনক নও এবং পাগলও নও। ওরা কি (তােমাকে) বলছে, ও তাে নিছক একজন কবি, যার জন্য আমরা মৃত্যুসম কোনাে এক (দৈব) দুর্ঘটনার অপেক্ষা করছি ? হে রসূল, (তুমিও) বলাে, আমার ওপর এধরনের বিপদ আসুক তােমরা এ অপেক্ষা করতে থাকো, আমিও তােমাদের সাথে সে বিপজ্জনক অবস্থার জন্য অপেক্ষা করছি……..তার ক্ষমতায় কেউ অংশীদারি গ্রহণ করুক এ দুর্বলতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।’ মােটকথা, এইসব উপর্যপুরি প্রশ্নের পেছনে একথা বলা রয়েছে, নবী(স.)-কে আঘাত দেয়ার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত এই প্রশ্নবাণের মূলে কোন, ইচ্ছা কাজ করছে। হাঁ, এসব কটুক্তি দ্বারা তারা চাইছে যে, যে সত্য সমাগত হয়েছে তা বাতিল শক্তির এইসব প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে ময়দান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক শ্রেষ্ঠত্ব লাভের প্রতিযোগিতা এবং হিংসাত্মক কাজ করার সংগ্রামে তারাই বিজয়ী হোক, মােহাম্মদ(স.)-এর পয়গাম পৌছানাের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাক, সত্য প্রচারের আন্দোলন থেমে যাক এবং এর প্রচারক হাল ছেড়ে দিক। এর পেছনে সত্যের নিশানবর্দারকে নিস্তেজ করে দেয়ার অসৎ ইচ্ছা ও বিদ্বেষপ্রসূত মনােভাব যে প্রকটভাবে রয়েছে তা সহজেই অনুভব করা যায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি ওরা কখনও আকাশের কোনাে টুকরাকে পতিত হতে দেখে তখন বলে উঠে এটা তাে নিছক ঘণীভূত এক খন্ড মেঘমালা’। কিন্তু আকাশ থেকে কোনাে টুকরার স্খলিত হওয়া এবং মেঘমালার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সে সব কিছু জেনে-বুঝেও স্পষ্ট সত্যের বিরােধিতা করার অসদুদ্দেশ্যে তারা সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে চলেছে। এখানে তাদের প্রতি শেষ বাণ নিক্ষেপ করা হচ্ছে, এ হচ্ছে প্রচন্ড এক ধমকের বাণ যখন এ ভয়ানক দৃশ্য তারা দেখবে তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে আযাবের এই ধমক, আর এরই উল্লেখ হয়েছে সূরার শুরুতে, ‘ছেড়ে দাও ওদেরকে সেই প্রলয়ংকরী চিৎকার ধ্বনির আযাবের মধ্যে পতিত হওয়ার জন্য যখন তারা তার মুখােমুখি হয়ে যাবে। সে দিন তাদের চক্রান্ত তাদের কোনাে কাজেই লাগবে না এবং তাদেরকে কোনাে দিক থেকে সাহায্যও করা হবে না।’ এইভাবে এই রকম আরও একপ্রকার শাস্তির ধমক তাদেরকে দেয়া হচ্ছে, ‘যারা যুলুম করেছে তাদেরকে এ আযাব ছাড়া আরও একপ্রকার আযাব দেয়া হবে। কিন্তু ওদের অধিকাংশই এ বিষয়ে কোনাে জ্ঞান রাখে না।’ এরপর কিছু নমনীয় ও সন্তোষজনক কথা দ্বারা সূরাটিকে সমাপ্ত করা হয়েছে, ওরা রসূল(স.)-কে যে সব কথা বলতাে তার উল্লেখ করে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ও ত একজন কবি, যার ওপর মৃত্যুসম কোনাে বিপদ নেমে আসুক এরই অপেক্ষায় আমরা আছি।’ ওরা নবী সম্পর্কে আরও বলতাে, ‘এ লােকটি একজন গনক বা জ্যোতির্বিদ অথবা পাগল।’ আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী(স.)-কে লক্ষ্য করে সম্ভ্রম ও সান্তনার স্বরে এমন মধুর বচনে বলা হয়েছে যার কোনাে নযির ইতিপূর্বে কোরআন করীমে পাওয়া যায়নি এবং কোনাে নবী-রসূলকে এর আগে এই ভাবে সম্বােধন করাও হয়নি-‘তোমার রব-এর পক্ষ থেকে আসা ফায়সালার অপেক্ষা করাে, আমি বলছি, কিসের চিন্তা, যখনই তুমি নামাযে দাঁড়াবে, তখন তােমার রব-এর প্রশংসায় আত্মনিয়ােগ করবে এবং রাতের এক অংশে তার নামের গুণ গাইতে থাকবে আর তখনও তার প্রশংসায় তােমার কণ্ঠধ্বনি যেন সােচ্চার হয়, যখন তারকারাজি অস্তাচলে যায়।’ উক্ত মধুর বচন দ্বারা মেহেরবান পরওয়ারদেগার তাঁর প্রিয় নবীর ওপর দুশমনদের পক্ষ থেকে নিক্ষিপ্ত বাক্যবাণের প্রলেপ দান করছেন। অবশ্যই সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে আসা এ কথাগুলাে রসূল(স.)-এর জর্জরিত হৃদয়ে এমন মধুর পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলাে, যার কারণে শক্র কর্তৃক উপর্যুপরি আঘাতের ঘা সহজেই শুকিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ্ তায়ালা তুর পর্বতের কসম খেয়ে বলছেন, কসম তুর পর্বতের, লিখিত আকারে আসা কিতাবের…'(আয়াত ১-১৬) এই ছােট ছােট আয়াতগুলাে যা বড়ই মনােরম সংগীতের মতাে অবতীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে মানুষদের কাছে গাওয়া হয়েছে। সূরাটির শুরুর দিক লক্ষ্যণীয়, এক একটি শব্দ উচ্চারণ করে তার কসম খাওয়া হয়েছে, তারপরই দুটি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে, তারপর একটু একটু করে অগ্রসর হয়ে সূরাটি সমাপ্ত হয়েছে বারােটি কথায়। এই কথাগুলােতে শক্তিশালী একটি প্রসংগ বিধৃত হয়েছে।
‘ওয়াতু তুর’-কসম তুর পর্বতের, যার মধ্যে বহু গাছপালাও রয়েছে। বরং আরও বেশী গ্রহণযােগ্য এই অর্থটি- কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে এবং যা মূসা(আঃ)-এর কিসসাতেও বর্ণিত হয়েছে, এই প্রসংগে তার ওপরে কিছু ফলকও নাযিল হয়েছে। এ সময় বায়ুমন্ডলে যে পবিত্র অবস্থা বিরাজ করছিলাে তার কসম খেয়ে আল্লাহ তায়ালা সেই মহা বিষয়টির উল্লেখ করছেন-যা শীঘ্র আসতে যাচ্ছে।  *বিস্ময়কর কিছু জিনিসের কসম : কসম সেই লিখিত কিতাবের যা প্রশন্ত খােলাপাতায় রয়েছে। এ কথার দ্বারা মূসার কাছে প্রেরিত কিতাব-এর অর্থই বেশী গ্রহণযােগ্য, তা কয়েকটি ফলকে লিখিত আকারে নাযিল হয়েছিলাে, কারণ এ কিতাবের সাথে তুর পর্বতের সম্পর্ক আছে। অবশ্য এ বিষয়ে আর একটি অর্থ বলা হয়েছে, তা হচ্ছে, লাওহে মাহফুযে (সুরক্ষিত সেই মহা প্রশস্ত ফলক), আল্লাহ্ পাকের কাছে সৃষ্টির শুরু থেকেই এটি খোলা অবস্থায় রয়েছে। এই ফলক ও এর পরবর্তী দুটি জিনিস চির আবাদ (মক্কা নগরে অবস্থিত কাবা) ঘর এবং সমুন্নত ছাদ সে ফলকের সাথে একই কাজে নিয়ােজিত বলে মনে হয়। অবশ্য এ অর্থের সাথে আগের অর্থের তেমন কোনাে বিরােধ নেই। বায়তুল মা’মুর বলতে যদিও কা’বা ঘরকে বুঝানাে হয়, কিন্তু আরও বেশী গ্রহণযােগ্য অর্থ হচ্ছে সেই ঘরটি যা মহাকাশে ফেরেশতাদের এবাদাতের জন্য বর্তমান রয়েছে, বােখারী ও মুসলিম শরীফে ইসরা’ সংক্রান্ত হাদীসে এসেছে, এরপর আমাকে বায়তুল মামুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলাে। আর সেটি এমন এক গৃহ যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে, যারা আর কখনও ফিরে আসে না। অর্থাৎ প্রবেশকারী প্রতিটি ফেরেশতার দল সেই গৃহে এবাদাত করে এবং পৃথিবীর অধিবাসীরা যেমন করে কা’বাঘরের তাওয়াফ করে সে ঘরেও ফেরেশতার দল একইভাবে তাওয়াফ করে। এভাবে প্রতিদিনই একই সংখ্যক ফেরেশতার দল প্রবেশ করে চলেছে। আর সমুন্নত ছাদ কি? এ হচ্ছে আমাদের মাথার ওপরে অবস্থিত আকাশ। এ বিষয়ে সুফিয়ান ছওরী, শো’বা এবং আবুল আহওয়াস সাম্মাক ইবনে খালিদ ইবনে আ’রআ’বার বরাত দিয়ে হযরত আলী(রা.) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তারপর রসূলুল্লাহ(স.) পড়লেন, আমি মহাকাশকে সুরক্ষিত ছাদ হিসাবে বানালাম, কিন্তু ওরা আমার এসব নিদর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাে (ইচ্ছা করেই দেখল না)। এরপর কসম খাওয়া হয়েছে উত্তাল তরংগাভিঘাতে উন্মত্ত মহাসাগরের, অর্থাৎ পরিপূর্ণ এ মহাসমুদ্রের। আলোচ্য অংশে আকাশের বর্ণনা প্রসঙ্গে এই মহাসাগরের উল্লেখ বড়ই উপযােগী, কেননা মহাকাশের পূর্ণত্ব ও প্রশস্ততার সাথে অকূল সমুদ্রের পূর্ণতা ও প্রশস্ততার যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। এ এমন একটি আয়াত যার মধ্যে যেমন রয়েছে ভয়, তেমনি রয়েছে ভয় সৃষ্টি করার মতাে উপাদান। আলােচ্য বিষয়টিকে বুঝানাের জন্য এই দুটি জিনিসেরই সমধিক গুরুত্ব রয়েছে, ‘মাসজুর’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়, জ্বলে উঠা ও বিস্ফোরিত হওয়া। যেমন অপর আর একটি সূরাতে বলা হয়েছে, (স্মরণ করে দেখাে সে সময়ের কথা, যখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে, অথবা সমুদ্রে আগুন লেগে তা বিস্ফোরিত হবে। এভাবে আর একটি সৃষ্টির দিকে ইশারা করা হয়েছে, যেমন, ‘বাইতুল মা’মুর-অর্থাৎ সমুন্নত ঘরটি, এটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝানাের উদ্দেশ্যে মহাসৃষ্টির কসম খেয়েছেন, যাতে করে আমাদের অনুভূতিসমূহ বর্ণিত এসব ঘটনা অনুভব করে এবং এই তীব্র অনুভূতির মাধ্যমে আগামীতে যে মহা বিষয়টি সংঘটিত হবে তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।

*অবধারিত আল্লাহর আযাব : এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই, তােমার রব-এর (পক্ষ থেকে) আযাব আসবে। কেউ সেই আষাবকে রুখতে পারবে না।’ সে অবস্থাটি অবশ্যই আসবে। কেউই সে আযাব আসাকে বন্ধ করতে পারবে না। পৃথক পৃথকভাবে এই দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়াটা অকাট্য সত্য এবং অবশ্যম্ভাবী। এর বর্ণনাভংগি অনুভূতির দুয়ারে আঘাত হেনে বলে, অবশ্যই এ ভয়ানক ঘটনার আগমন অকাট্য সত্য, তা যখন আসবে তখন সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। সে অবস্থা থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না বা সে অবস্থাকে কেউ রুখতেও পারবে না। এ ভয়ানক ঘটনার অনুভূতি যখন মানুষের হৃদয়পটে অপ্রতিরােধ্যভাবে আঘাত হানে, তখন তার গােটা সত্তা প্রচন্ডবেগে কেঁপে উঠে এবং তাকে যেন এই অনুভূতি ভেংগে চুরমার করে দেয়। এ প্রসংগে হাফেয আবু বকর ইবনে আবিদ্দুনিয়া একটি হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, হযরত ওমর(রা.) রাতের বেলায় সংগােপনে প্রজাদের খবর নেয়ার উদ্দেশ্যে বেরুলে এক রাতে মদীনার শহরে এলেন। অতপর তিনি একজন মুসলিম ব্যক্তির ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাড়িয়ে গেলেন, শুনতে পেলেন, ভেতর থেকে নামাযের মধ্যে কোরআন পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। পড়া হচ্ছিল, সূরায়ে ওয়াত তুর। যখন সে ব্যক্তি এই আয়াত পড়লেন, ‘তােমার রব-এর আযাব অবশ্যই সংঘটিত হবে, তা থামাবার মতাে কেউই নেই’, তখন লােকটি বলে উঠল, ‘কাবাঘরের রব-এর কসম- একথা অবশ্যই সত্য।’ একথা শােনার সাথে সাথে ওমর(রা.) তার গাধার পিঠ থেকে নেমে বহুক্ষণ ধরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকলেন। তারপর বাড়িতে ফিরে এলেন। এরপর তিনি মাসাধিককাল সময় শয্যশায়ী হয়ে রইলেন। এ সময়ে কত মানুষ তাকে সেবা-শুশ্রষা করতে ও দেখতে এলাে। কিন্তু কেউ তার রােগ নির্ণয় করতে পারলাে না।’ ওমর(রা.) ইতিপূর্বে সূরাটি বহুবার অন্যকে পড়তে শুনেছেন, নিজেও পড়েছেন। এ সূরা তিনি নামাযেও অনেকবার পড়েছেন। রসূলুল্লাহ(স.)-ও মাগরিবের নামাযে প্রায়ই এ সূরাটি পড়তেন তাই ওমর(রা.) এ সূরাটি অবশ্যই জানতেন এবং বহুবার এ সূরাটি পড়েছেন এবং পড়ার সময় অনেক দীর্ঘ নিশ্বাসও ছেড়েছেন। কিন্তু সে রাতে, কি জানি কী হলাে, তার অন্তরের ওপর কী আজব আছর হলাে, তার হৃদয়ানুভূতি যেন খুলে গেলাে, যার ফলে সূরাটি তার ওপর দারুণ ক্রিয়া করলাে এবং তার অবস্থা এমন হয়ে গেলাে যে, তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আসলে এ সময়ে তিনি এ সূরার মধ্যে ব্যক্ত কথাগুলাের চাপ সহ্য করতে পারেননি। এর মধ্যে বর্ণিত কথাগুলাের তাৎপর্য তার হৃদয়ে সরাসরি প্রবিষ্ট হয়ে তার হৃদয়কে গলিয়ে দিয়েছিলাে এবং তিনি অনুভব করেছিলেন সূরাটি মূল উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে এসে যেন তার হৃদয়-দুয়ারে এই বিশেষ মুহূর্তটিতে আঘাত হেনেছিলাে। এর ফলে হৃদয়ের অন্তস্থলে তা গভীরভাবে ক্রিয়া করেছিলো। এ ক্রিয়া ছিলাে (মূলত) প্রত্যক্ষ এক স্পর্শ। রসূলুল্লাহ(স.)-এর হৃদয়কে এসব আয়াত যেমন করে স্পর্শ করতাে, সেই রকমই এক গভীর ও প্রত্যক্ষ স্পর্শ তাকে অভিভূত করে ফেলেছিলাে। যারা আয়াতের এই অংশটি খেয়াল করে পাঠ করে তাদের ওপরেও এই ধরনের অনুভূতি অবশ্যই কিছু না কিছু প্রতিফলিত হবে যেমন করে ওমর(রা.)-এর অন্তরে এসেছিলাে।

*কেয়ামতের দিন আকাশ ও পাহাড়ের অবস্থা : এরপর আরও অধিকতর ভয়ংকর একটি ঘটনার বর্ণনা আসছে, ‘যে দিন ভয়ানকভাবে আকাশ আন্দোলিত হতে থাকবে এবং পর্বতমালা (নিজ নিজ স্থান থেকে) উৎখাত হয়ে যাবে।’ স্থির আকাশের মধ্যে এই ধরনের পরিবর্তন আসার জন্য প্রয়ােজন এক মহাশক্তির যা মহাকাশকে অস্থির করে দিতে পারে এবং তার চেহারাকে ওলট-পালট করে দিতে পারে-যেমন করে প্রচন্ড তুফান মহাসাগরের অথৈ পানিকে তােলপাড় করে ফেলে এবং উত্তাল তরংগ শান্ত সাগরের চেহারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। আবার তাকিয়ে দেখুন, সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত পাথরের পাহাড় গুলো চালিত হওয়ার দৃশ্যের দিকে, কেমন করে এগুলাে হালকা হয়ে যাবে এবং স্থানচ্যুত হয়ে প্রচন্ডবেগে সঞ্চালিত হতে থাকবে। এসব দৃশ্য মানুষের বুদ্ধিকে হতভম্ব করে দেয় এবং হৃদয়ের মধ্যে প্রচন্ড এক কম্পন সৃষ্টি করে। এসব বর্ণনা যখন আমাদের সামনে আসে, তখন প্রচন্ড বেগে আকাশের মধ্যে আন্দোলন হওয়ার ঘটনা বুঝা কিছুটা সহজ হয়ে যায়। আকাশ ও পৃথিবীর বুকে যখন এই ভীষণ অবস্থা সংঘটিত হবে, তখন ধরণীর বক্ষে অবস্থিত এই তুচ্ছ ও অতি দুর্বল মানবকুলের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

*কেয়ামত অস্বীকারকারীদের ভয়াবহ অবস্থা : এই প্রলয়ংকর ও ভীষণ ভীতিজনক অবস্থাতে যখন কিছুই স্থির হয়ে থাকতে পারবে না এবং প্রচন্ড গতিবেগে যখন সব কিছু সঞ্চালিত হতে থাকবে, তখন সে দিনকে অস্বীকারকারীদের অবস্থা আরও মারাত্মক হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং নিদারুণ দুঃখ সেদিন নেমে আসবে তাদের জন্য, যারা রসূল(স.)-কে মিথ্যাবাদী বলে দাবী করতাে, যারা খেলাচ্ছলে {রসূল(স.)-কে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে} নানা প্রকার ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ বর্ষণ এবং দুঃখের ডাক দেয়ার অর্থই হচ্ছে তাদের প্রতি দুঃখ নেমে আসার ফায়সালা শুনিয়ে দেয়া। সুতরাং হঠকারী, বিদ্রোহী, সত্যকে জেনে বুঝে অস্বীকারকারী ও রসূল(স.)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রচন্ড বেদনাদায়ক কষ্ট আসাটা অবধারিত। এ কঠিন অবস্থাকে কেউই ঠেকাতে পারবে না। সেদিন আসবেই আসবে। এই দুঃসহ অবস্থায় যেদিন আকাশ ভীষণভাবে আন্দোলিত হবে এবং পর্বতমালা প্রচন্ড গতিবেগে সঞ্চালিত হতে থাকবে। আর এ কারণেই এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে সর্বগ্রাসী ভয় মানুষকে ঘিরে ফেলবে এটা স্বাভাবিক। আর বিশেষভাবে মিথ্যাবাদী ও মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে এই ভয় স্থায়ীভাবে এসে গ্রাস করবে, যারা হেলা ও খেলাচ্ছলে নবী(স.)-কে বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করেছে। নবীকে উপহাস বিদ্রুপ করা প্রথমত মােশরেকদেরই বৈশিষ্ট্য এবং তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসেরই বহিপ্রকাশ। যেসব ভুল বিশৃঙ্খল এবং অর্থহীন চিন্তাধারার মধ্যে তারা ডুবে ছিলাে তারই কারণে দয়ার নবী, সর্বগুণে গুণান্বিত ও পরম দরদী নবী(স.)-কে তারা নিষ্ঠুর বাক্যবাণে কষ্ট দিয়েছে। তাদের হেলা খেলার জীবন, অসংলগ্ন আচরণ এবং স্বার্থপরতায় অন্ধ তাদের এই নিতুর জীবন গােটা সমাজকে অতল তলে তলিয়ে দেয়, এই নিষ্ঠুর ব্যবহারের আওতায় এনে তারা গােটা মানবদেহকে দুঃখ-বেদনায় ভরে দেয়। এ বিষয়গুলাে কোরআনের বহু জায়গায়ই উল্লেখিত হয়েছে। এগুলাে সবই তাদের অর্থহীন এক খেলা, প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনাে কল্যাণ নেই। যেসব জিনিস নিয়ে তারা মেতে থাকে তা হচ্ছে এমনই এক খেলা যার সাথে সেই সাঁতারুর তুলনা করা যায় যে পানিতে লক্ষ্যহীন ভাবে সাঁতার কেটে বেড়ায়, যার কিনারায় উঠার কোনাে খেয়াল থাকে না। অবশেষ যে চরম শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে পানিতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এধরনের সাঁতারু না নিজের কোনাে উপকার করতে পারে, না তার এই আচরণে অন্য কেউ উপকৃত হয়।
*সৃষ্টিজগত সম্পর্কে জড়বাদী দার্শনিকদের চিন্তাধারা :  যখনই কোন মােশরেক ব্যক্তি ইসলামী চিন্তাধারা বহির্ভূত অন্য চিন্তা-চেতনার আলােকে নিজের কার্যকলাপকে সত্য ও কল্যাণকর বলতে চায়, তখনই তার চিন্তার অসারতা তার কাছে ধরা পড়ে বিশেষ করে যখন সে তার সকল চিন্তা-চেতনা তখন বিষয়টা তার কাছে আরাে পরিস্কার হয়ে উঠবে। মানুষের অস্তিত্ব ও অন্যসব সৃষ্টির কল্যাণের নিরিখে ইসলামী চিন্তাধারার সাথে তুলনা করবে। অর্থাৎ পাশাপাশি দুটি ব্যবস্থার ভাল-মন্দ ও উপযােগিতা ও অনুপযযাগিতা পরীক্ষা করে দেখলেই কোনটি গ্রহণযােগ্য তা প্রতীয়মান হয়ে যাবে। এমনকি দার্শনিকদের ইতিহাসে যারা খ্যাতিমান বলে পরিচিত সেই সকল দার্শনিকের কাছে মানবরচিত এসব চিন্তাধারা নিছক ছেলেখেলা বলে মনে হয়েছে। যেহেতু সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধি নিয়ে তারা অসীম বিশ্বের রহস্যরাজি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছে এবং নিজেদের সংকীর্ণ বুদ্ধি বলে সত্যকে উদ্ঘাটনের চেষ্টায় নিয়ােজিত থেকেছে। যে সকল সত্য ইসলামী মতবাদে বিধৃত হয়েছে, বিশেষ করে কোরআন মজীদে উল্লিখিত হয়েছে , তা অবশ্যই নিখুঁত ও সব কিছু থেকে সুন্দর সুবিস্তীর্ণ ব্যাপক ও সুগভীর অর্থব্যঞ্জক। সে ব্যবস্থা যে প্রকৃতির সাথে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যশীল এ কথা বুঝতেও কোনাে কষ্ট পেতে হয় না। এ কথা বিনা চেষ্টাতেই বুঝা যায় এবং কোনাে প্রকার অস্পষ্টতাও এখানে নেই, কেননা এ সত্য সত্যের সেই মূল শেকড়ের সাথে বাঁধা রয়েছে, যেখান থেকে মূল সত্য উৎসারিত হয়েছে এবং সেই মূল থেকেই গােটা সৃষ্টির অস্তিত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ কাজ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নিজেই করছেন এবং তার ইচ্ছাই সবখানে কার্যকর রয়েছে। তারই ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু চলছে। এ বিষয়ের ওপর যতবারই আমি চিন্তা করেছি মােশরেক মিথ্যার ধ্বজাধারী নেতৃবৃন্দের আচরণে আমি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছি। বড় বড় দার্শনিকের চিন্তাধারা আমি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি। দেখেছি, তারা লাগামহীনভাবে চিন্তা করতে গিয়ে অযথাই কষ্ট পাচ্ছে। তারা এই সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এবং সৃষ্টি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টায় তেমনি গবেষণা করে চলেছে, ঠিক যেমন করে ছােট এক বাচ্চা কোনাে জটিল অংকের সমাধান খোজার চেষ্টা করে। অথচ আমাদের সবার সামনে রয়েছে আল কোরআনের সুস্পষ্ট চিন্তাধারা, যা অবিমিশ্র সত্য, সহজ এবং বাস্তব জীবনে প্রয়ােগের কোনাে জটিলতা বরং তা সরল ও স্বাভাবিকভাবে জীবনের সকল বিষয়ের মীমাংসা করে দেয়। তার মধ্যে কোনাে বক্রতা নেই, নেই কোনাে গোজামিল বা অস্পষ্টতা এবং এমন কোনাে জটিলতা এতে নেই যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। এ পাক কালামের মধ্যে উপস্থাপিত কথাগুলাে সবই আমাদের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিশ্ব-প্রকৃতির যে ব্যাখ্যা কোরআন দিয়েছে তা হচ্ছে স্বয়ং এর সৃষ্টিকর্তা ও নির্মাতার নিজস্ব ব্যাখ্যা। এর প্রকৃতি কি এবং সব কিছুর পারস্পরিক সম্পর্কই বা কি তা তিনিই আমাদের জানিয়েছেন। অথচ সীমাবদ্ধ বয়সের, সীমাবদ্ধ জ্ঞান, বুদ্ধি ও দৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিকদের সমীক্ষায় অতি অল্প কিছু রহস্য ধরা পড়ে যার ওপর জ্ঞান-গবেষণা চালাতে গিয়ে জীবনভর তারা শুধু হোঁচটই খেতে থাকে। তাদের সীমাবদ্ধ চেষ্টা-সাধনার ফল একইভাবে সীমাবদ্ধই হতে বাধ্য।  *জীবনের মূল্যায়ন ও কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি : আল কোরআন যখন মানব কল্যাণের লক্ষ্য পরিপক্ক চিন্তাধারা ও পূর্ণ জীবনদর্শন পেশ করছে, তখন বিদগ্ক ব্যক্তিদের কাছে এসব দার্শনিকের জ্ঞান-গবেষণা এবং অলীক চিন্তা, জগাখিচুড়ি সাধনা ও কষ্ট-কল্পনা সবই মিথ্যা বলে প্রতিভাত হবে, তখন তারা সেসব নিম্ফল ক্রটিপূর্ণ, অবাস্তব ও অসম্ভব প্রয়াস পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে এবং তখনই তারা তাদের সেই সব জ্ঞান-সাধনা প্রত্যাখ্যান করবে যা কোনাে দিন পরিপক্কতা লাভ করবে না কিংবা তা পরিপূর্ণ উৎকর্ষ বয়ে আনতে পারবে না। জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে মানুষ পেরেশান হয়েছে, লাগামহীন চিন্তা-গবেষণা করতে গিয়ে বরাবর তারা শুধু কষ্টই পেয়েছে, বিপরীতমুখী চিন্তাধারার জালে আবদ্ধ হয়ে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে এবং ক্রুটিপূর্ণ চেষ্টায় শুধু সময়ের অপচয়ই করেছে। এরপর আল-কোরআনের আয়াতে পেশ করা দাওয়াত পেয়ে তারা একদিন সচকিত হয়ে উঠেছে। তারপর তাদের দীর্ঘদিনের পেরেশানীর ব্যাপারে যখন তৃপ্তিজনক সমাধান খুঁজে পেয়েছে, তখন হেদায়াতের এ নূরকে তারা সাদরে গ্ৰহণ করেছে। তারা দেখতে পেয়েছে এ মহাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পরিপূর্ণ ইনসাফের বিধান। প্রতিটি জিনিস নিজ নিজ স্থানে সুদৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত। প্রতিটি বিষয় স্বস্থানে সমাদৃত এবং প্রত্যেকটি সত্য বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ও দৃঢ়তার সাথে দিক-নির্দেশনা দিয়ে চলেছে। সেখানে কোনাে অস্থিরতা নেই, নেই কোনাে দোদুল্যমান অবস্থা। এসব সত্যসন্দর্শনে তাদের মন বড়ই আরাম বােধ করেছে, তাদের মেজাজ শান্ত হয়েছে এবং তাদের বুদ্ধি প্রশান্তি লাভ করেছে, এটা এই কারণে যে, স্পষ্ট সত্যপ্রাপ্তির প্রয়াসে তারা সফল হয়েছে। তারা অন্তর থেকে বিগত জীবনের সকল প্রকার অস্পষ্টতা ও পেরেশানীকে ঝেড়ে-মুছে ফেলতে পেরেছে এবং তাদের জীবনের সকল বিষয় এখন স্থির হয়ে গেছে। আল কোরআনের উজ্জ্বল আভায় তিমিরাচ্ছন্ন মানুষগুলাে যখন সমুজ্জ্বল হয়ে গেছে, তখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এতদিন তারা সত্যিই অন্ধ বিশ্বাসের পংকিলতার মধ্যে আকন্ঠ ডুবেছিলাে এবং জীবনের অমূল্য সময় তারা হেলায় ও খেলায় কাটিয়ে দিয়েছে। আজ তারা ইসলামের সুমহান শিক্ষার আলােকে উদ্ভাসিত। এই যে সত্য মতাদর্শ তাদেরকে প্রিয় বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছে এতে তারা ধন্য। আজ ইসলামের ছায়াতলে এসে তারা সুষ্ঠু চিন্তা-ভাবনার সুযােগ পেয়েছে এবং সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তারা নিয়ােজিত হতে পেরেছে এই পরম তৃপ্তিতে তারা পুলকিত। তাদের কাছে জাহেলিয়াতের যাবতীয় পেরেশানী ও ভ্রান্ত পরিচালনার কথা পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। মুসলমানরাও নয়ন-ভরে দেখছে, যারা মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে দূরে ছিলাে এবং বৈরীভাব পােষণ করছিলাে তারা ধীরে ধীরে তাদের সাথে শামিল হয়ে যাচ্ছে, বরং তাদের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের হারানাে সম্মান আবার ফিরে আসছে এবং তাদের সাথে যখন কথা বলছে তখন ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে তারা যেন স্বীকার করে নিচ্ছে। মুসলমানরা সেইভাবে খুশীর সাথে তাদের দিকে তাকাচ্ছে যেমন করে কোনাে অনুষ্ঠানে মিষ্টি-মড়া ও কোরবানী করা পশুর দিকে বাচ্চারা খুশীর সাথে তাকিয়ে থাকে। তারা ভাবে, এই তাে মজার মজার খাবার তৈরী হয়ে আসছে আর এই আশাতেই তারা গান, বাজনা ও খেলাধুলায় সময় কাটাতে থাকে। মানব গােষ্ঠীর অস্তিত্বের জন্য এবং বিশ্ববাসী সবার প্রয়ােজনের খাতিরে যতটুকু জরুরী, ইসলাম অবশ্যই ততটুকু দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিপদ আসার পরও ইসলাম ততটাই তা দূর করার উদ্যোগ নেয় যতটা মানুষের জন্যে অস্তিত্বের প্রয়ােজন আর ততদিন ইসলাম মানুষকে দুনিয়াতে টিকিয়ে রাখতে চায় যতদিন তার মধ্যে মৃত্যুর পরে আসা প্রশ্নাবলীর জওয়াব দেয়ার যােগ্যতা পয়দা না হয় ততােদিনই তার প্রয়ােজন। সে প্রশ্নগুলাে হচ্ছে, কোত্থেকে এসেছি, কেন এসেছি এবং কোথায় যাবো? এসব প্রশ্নের জওয়াব দিতে গিয়ে মানুষের নিজের ও গােটা সৃষ্টিলােকের অস্তিত্বের প্রয়ােজনে ইসলাম বিশেষ এক সীমারেখা টেনে দিয়েছে। আসলে মানুষ সৃষ্টির সব কিছু থেকে পৃথক, নতুন কোনাে এক জীব নয়, বরং সৃষ্টির সকল কিছুর মধ্যে সেও একজন, তা সে যেখান থেকেই আসুক না কেন। তার অস্তিত্বের প্রয়ােজনে সে সবার সাথে একজন শরীকদার হিসেবে থাকতে বাধ্য। যে সময় তার সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানী হবে এবং তাকে তিনি তুলে নিতে চাইবেন, সেই সময়েই তুলে নেবেন। সুতরাং গােটা সৃষ্টির প্রয়ােজনেই উপরােক্ত প্রশ্নগুলাের জওয়াব হতে হবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই জওয়াবের মধ্যে তার নিজের যাবতীয় সম্পর্ক এবং অন্য সকল মানুষের সম্পর্কের কথাও নিহিত থাকতে হবে। আরও থাকতে হবে এ জওয়াবের মধ্যে সর্বসাধারণের সাথে সম্পর্কের কথা এবং সবার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাকের সাথে সম্পর্কের কথাও। গােটা মানব জীবনে যেসব দুঃখ-কষ্ট বিরাজ করছে তার মধ্যে ওপরে বর্ণিত ব্যাখ্যারই মােটামুটি প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি মানুষকে তার সঠিক অবস্থানে পৌছে দেয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা দিয়েছেন। আর এই উদ্দেশ্যেই মানুষকে আল্লাহ তায়ালা বহু দুঃখ-কষ্ট ও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে রেখেছেন। মুসলমানকে এই মহা সৃষ্টির মধ্যে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার জন্য নিয়ােজিত করা হয়েছে তাই এব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ জন্য তাকে সাধারণ খেলোয়াড়দের মতাে তুচ্ছ দুঃখ-কষ্টভারে নুয়ে পড়লে চলবে না। বরং সর্বপ্রকার পরিস্থিতির মােকাবেলায় তাকে মর্দে মােজাহিদের মতাে মজবুত হয়ে দাঁড়াতে হবে। মানুষের মধ্যে মুসলমানদের জীবন আসলেই এক মহৎ জীবন। অর্থাৎ মহৎ এক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। গােটা বিশ্বের অস্তিত্বের সাথে তার যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পৃক্ত। তার সকল ব্যবহার ও কাজকর্মের প্রভাব পড়ে এই মহাবিশ্বের ওপর। তার আত্ম-সম্ভ্রমবােধের দাবী হচ্ছে, সে তার সময়, মনোযােগ, কার্যকলাপ ও জ্ঞান-গবেষণাকে কোনাে হেলা ও খেলার বস্তু বানাবে না। মহাবিশ্বের সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য মানুষকে অর্থাৎ মুসলমানকে (যে আল্লাহর ইচ্ছা পূরণ করতে স্বেচ্ছায় প্রস্তুত হয়েছে)-সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন এ মহান উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য সে আত্মনিয়ােগ করে, তখন তার যাবতীয় কর্মকান্ডের তুলনায় অন্যদের সমস্ত কাজ ও ব্যবহার তুচ্ছ, অর্থহীন ও বেফায়দা বলে মনে হয়। (আরাে ব্যখ্যার জন্য আমার ‘ফিকরাতুল ইসলামি আনিল কওনি আল হায়াতিল ইনসানি’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য) সেদিন যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে চরম দুর্দশা এবং আল্লাহর অভিশাপ সেসব দার্শনিক বুদ্ধিজীবীর জন্য যারা নানাপ্রকার মনগড়া কথা ও চিন্তাভাবনায় বিভাের রয়েছে এবং রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি নানা কটাক্ষপাত করছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করাে সেই দিনের কথা যেদিন তাদেরকে প্রচন্ডভাবে ধাক্কা মেরে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে।’ এ দৃশ্য হবে সত্যিই বড় ভয়াবহ। ধাক্কা মারার এই শব্দটি দ্বারা বুঝানাে হয়েছে, প্রকাশ্যভাবে তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হবে আর এটা হবে এ জ্ঞানপাপী মূর্খদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি, যারা প্রকৃতপক্ষে চতুষ্পার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক বিষয়সমূহের প্রতি খেয়াল করে না, হিসাব করে দেখে যে, এ মহা সৃষ্টির বুকে চলমান ঘটনাবলী কোন মহা শক্তির ইশারায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং তাদেরকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে তাড়িয়ে যাওয়া হবে, তাদের পিঠে প্রচন্ড ধাক্কা মারা হবে। এইভাবে ধাক্কা মারতে মারতে তাদেরকে যখন আগুনের একেবারে কিনারায় পৌছিয়ে দেয়া হবে, তখন বলা হবে, ‘এই যে সেই আগুনে ভরা জাহান্নাম যাকে তােমরা অস্বীকার করতে এবং রসূলুল্লাহ(স.)-কে মিথ্যাবাদী বলে গালি দিতে।’ এই কঠিন দুঃখজনক অবস্থায় তাদের পড়তে হবে এটা তারা কোনাে দিন কল্পনাও করেনি। মূলত তাদের ইচ্ছা-ইখতিয়ারের বাইরেই এ কঠিন শাস্তি প্রদত্ত হবে। পার্থিব জীবনে তাদের অস্বীকৃতি, হঠকারিতা ও নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিদানস্বরূপ অপমানজনক শাস্তি তাদের জন্য অবধারিত থাকবে। ‘বলা হবে, কেমন লাগছে, এটা কি যাদু বলে মনে হয়, না তোমরা চোখে এ অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না?’ এ কথাগুলাে বলা হবে এজন্য যে তারা কোরআন সম্পর্কে বলতাে এটাত যাদু, তাহলে এখন যে আগুন তারা দেখছে তাও কি যাদু? না এটা সেই ভয়াবহ ও কঠিন সত্য? না তারা এ অবস্থাকে চোখে দেখতে পাচ্ছে না, যেমন করে কোরআনুল করীমে বর্ণিত সত্যকে তারা দেখতে পেতাে না। হুমকি দেয়ার অবিলম্বে তাদেরকে ধাক্কা মেরে আগুনে ফেলে দিয়ে বলা হবে, ‘দাখিল হয়ে যাও তােমাদের উপযুক্ত স্থানে, সহ্য হােক আর না-ই হােক, তাতে কিছু আসে-যায় না, এখানেই তােমাদের থাকতে হবে। তােমাদের কৃতকর্মের ফলই তােমাদেরকে দেয়া হচ্ছে।’ যখন কেউ জানতে পারে যে, শান্তি এসে পড়ার পর ‘সহ্য করি আর না-ই করি, কোনাে ছাড়াছাড়ি নই’, তখন তার অবস্থা কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া পশুর মতােই হয়ে যায়। অতএব এ অবস্থা যখন এসে যাবে তখন শাস্তি হবেই, সে আযাব কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না। এ অবস্থাতে সবর করলেই বা কি, আর না করলেই বা কি, কষ্ট যা হওয়ার তা তাে হবেই। যত অস্থিরই হােক না কেন, সে আযাবের সময় তাে পূর্ব থেকে নির্ধারিত রয়েছে। এ পরিণতির কারণ তাে এই যে, এটা তার কৃতকর্মের প্রতিদান। যে কারণে এ প্রতিদান সে পাবে তা তাে সে নিজেই ইচ্ছা করে ঘটাচ্ছে, সুতরাং তার পরিবর্তন বা এ আযাব দূর হয়ে যাওয়ার কোনাে প্রশ্নই উঠে না। এই দৃশ্যের বিবরণ দান করার পর এই ভয়ানক অবস্থার বর্ণনা শেষ হচ্ছে, একই ভাবে সূরায়। বর্ণিত প্রথম কথাগুলাের উদ্দেশ্যও এখানে শেষ হচ্ছে।

*যারা সেদিন পরম আনন্দে থাকবে : আলােচ্য সূরায় বর্ণিত কথাগুলাের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের অনুভূতিতে তাদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে রেখাপাত করানাে। কিন্তু সূরাটিতে দুঃখের সাথে, আরাম-আয়েশ ও আনন্দধ্বনি উচ্চারণের কথাও এসেছে। এমন সুখ-সম্ভোগের বিবরণ এসেছে যার কোনাে তুলনাই হতে পারে । বিশেষ করে সে কঠিন আযাবের বিবরণ দানের পর যখন নেয়ামতের বিবরণ আসে, তখন তা বড়ই মধুর লাগে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ-ভীরু লােকেরা থাকবে নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত (বাগ-বাগিচা) সমূহে। তাদের রব তাদেরকে যা দেবেন তাতে তারা আনন্দে বিভাের থাকবে এবং তাদের রব তাদেরকে বাঁচিয়ে নেবেন জাহান্নামের আযাব থেকে। বলা হবে, ‘খাও, পান করো তৃপ্তির সাথে, এহচ্ছে তােমাদের সেই সকল কাজের প্রতিদান যা তােমরা (পৃথিবীর বুকে) করতে থেকেছো। ওরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাটের ওপর তাকিয়ায় আরামছে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে। আর তাদের সাথে বড় বড় চোখ বিশিষ্ট হুরদের বিয়ে দেব।’ ১৭,১৮ নং আয়াতেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। যে সব নেয়ামতের দৃশ্যের কথা ওপরে বলা হলাে, তা যে কোনাে ব্যক্তির অনুভূতির কাছেই বােধগম্য। যে সব নেয়ামতের স্বাদের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এ পরিচ্ছন্নতার উল্লেখ হয়েছে সে কঠিন আযাবের উল্লেখের পাশাপাশি যা ছিদ্রান্বেষণকারী এবং বিদ্রুপকারীদেরকে দেয়া হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভীরুরা থাকবে নেয়ামত ভরা জান্নাতসমূহে। তাদের রবের কাছে থেকে যে প্রতিদান তারা পাবে তাতে তারা খুশীতে বিভাের থাকবে এবং তাদেরকে তাদের রব জাহান্নামের আযাব থেকে অবশ্যই বাঁচিয়ে নেবেন।’ আসলে আল্লাহ পাকের মেহেরবানী ও নেয়ামতের কারণেই তারা সাধারণভাবে আযাব থেকে বেঁচে যাবে। তারপরও জান্নাতের বাগবাগিচাসমূহ এবং নানাপ্রকার নেয়ামত দেয়া হবে-একথার অর্থ কি হতে পারে? এর অর্থ হচ্ছে, তাদের রব তাদেরকে যা দেবেন তার স্বাদ তারা আকষ্ঠভাবে গ্রহণ করবে এবং আনন্দ-উল্লাসে তারা মেতে থাকবে।

*জান্নাতের অপরিসীম নায-নেয়ামত : এসব নেয়ামত, স্বাদযুক্ত ফলমূল, সম্মান ও সাদর সম্ভাষণের সাথে বলা হয়েছে, ‘খাও, পান করাে পরম পরিতৃপ্তির সাথে, তােমরা যা কিছু করে এসেছে তার প্রতিদান হচ্ছে আজকের এই আপ্যায়ন। আল্লাহর পক্ষ থেকে এইভাবে যে মেহমানদারী করা হবে, তা-ই তাদের মর্যাদাপ্রাপ্তির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তাদেরকে সুউচ্চ মর্যাদা দিয়ে ডাকা হবে এবং যে অধিকার ও নেয়ামত তাদেরকে দেয়া হবে আজকে তারই ঘােষণা দেয়া হচ্ছে, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাট-পালং-এ তারা আরামে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে। এইসব আদর-আপ্যায়ন, নেককার লােকদের মান-মর্যাদার সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ হবে। এই নেয়ামত ভরা পরিবেশে তারা ভাই-বেরাদরের সাথে থাকার মজা পাবে। আরও ওয়াদা দেয়া হয়েছে, ‘আমি তাদের সাথে বড় বড় সুন্দর চোখ বিশিষ্ট হুরদের বিয়ে দেবাে’ মানুষ সৌন্দর্যের যে নেয়ামত সব থেকে বেশী পছন্দ করে তাই ওখানে দেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এই সম্মান দানের মধ্যে আরও উল্লেখযােগ্য হচ্ছে তাদের নেক সন্তান-সন্তুতিদেরকেও তাদের সাথে (এসব নেয়ামতের মধ্যে) মিলিত করে দেয়া হবে। এটা হবে তাদের প্রতি শুভেচ্ছা ও অতিরিক্ত পুরস্কার-এর একটি বিশেষ নিদর্শন। তাদের সন্তানরা তাকওয়া-পরহেযগারী মানদন্ডে তাদের সাথে মিলিত হওয়ার যােগ্য না হওয়া সত্ত্বেও শুধু ঈমানদার হওয়ার সুবাদে এই বিশেষ ইহসান দান করা হবে, আর এই কারণে সে পিতামাতাদের পুরস্কার বা মর্যাদা থেকে কোনাে কিছু হ্রাস করা হবে না, আর এজন্য তাদের অনুসারীদের মধ্যে কোনাে ব্যক্তির মধ্যস্থতারও প্রয়ােজন হবে না, বা কারও কোনাে কিছুর বদৌলতে এ নেয়ামত দেয়া হবে তা নয়। নিছক আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতেই তাদেরকে এই মহামূল্যবান মর্যাদা দান করা হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে যারা ঈমানদার হবে তাদেরকে আমি তাদের সাথে মিলিয়ে দেবাে এবং এ কারণে তাদের সকর্ম থেকে কোনাে কিছু কমিয়ে দেবাে না এবং যে কোনাে ব্যক্তি যা কিছু উপার্জন করবে তার জন্য সেই দায়ী হবে।’ আলোচনার ধারাতে অন্য দৃশ্য সামনে আসছে, আল্লাহ পাকের নেয়ামতের ভান্ডারে রকম বেরকমের নেয়ামত এবং প্রাণ-মাতানাে স্বাদযুক্ত বিভিন্ন জিনিসের বিবরণ পেশ করা হচ্ছে। দুনিয়ায় মানুষ যা কামনা করে তারই অনুরূপ ফলমূল এবং চাহিদামতাে গােশত থাকবে, আর তারা পরস্পর পানপাত্র বিনিময় করবে, যাতে কোনাে মাদকতা থাকবে না, যা দুনিয়ার মদের মধ্যে মানুষ প্রত্যক্ষ করে। এ পানীয় পান করে কারও বুদ্ধি নষ্ট হওয়া অথবা আবােল-তাবােল বকাবকি করার মতাে বিভ্রান্তিকর কোনােটিই এতে থাকবে না। সাধারণত দুনিয়ায় মানুষ যে সুরা পান করে তাতে মানুষের হুশ নষ্ট হয়, হাত পাগুলাে নিসাড় হয়ে যায়, আবার অনেক সময় যৌন অনুভূতি তীব্রতর হয় যার কারণে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না এবং একারণে লজ্জাকর কাজের প্রসার ঘটে। আল্লাহ পাকের সরবরাহ করা পানীয়তে আকর্ষণীয় সব কিছুই থাকবে। কিন্তু এর মন্দ পার্শ্বক্রিয়া যা মানুষ জানে তার কোনােটিই থাকবে না। থাকবে না তাতে কোনাে বকাবকি বা অপরাধ প্রবণতা। এ সুরা পান করার পর তারা নিজেদের প্রিয় সমাবেশে পরম্পর মহব্বত বিনিময় করবে। এ মধুময় পরিবেশে তাদের মধ্যে মহব্বত যেমন অন্য যে কোনাে সময়ের থেকে বেশী হবে, তেমনি বেশী হবে ওখানকার নেয়ামত ও তার স্বাদ। এ সময়ে তাদের খেদমতে নিয়ােজিত থাকবে শুভ্র শিশির বিন্দুর মতাে মনােম কিশাের দল। এরা যেমন হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তেমনি রাতের শিশির-বিন্দুর মতো এরা সুকোমল স্বচ্ছ ও সজীব। যেন তারা গুপ্ত হীরক খন্ড। এই সুন্দর কিশােররা এ সমাবেশের শােভা ও শরীরের অংগ-প্রত্যংগের মধ্যে আনন্দানুভূতি বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবে। এই সুন্দর-সুমিষ্ট পরিবেশের পরিপূর্ণতা আসবে তাদের খােশগল্পের আসর জমে উঠা ও অবস্থানের বৈশিষ্ট্য হবে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা, হাসি-খুশী ও প্রাচুর্য, ভালবাসা ও সর্বপ্রকার মনােলােভা ভোগ-বিলাস সামগ্রী, ‘(এ সময়ে) তারা একে অন্যের সামনে এগিয়ে আসবে এবং তারা পরস্পর প্রশ্ন করতে থাকবে। বলবে, আমরা অবশ্যই ইতিপূর্বে আমাদের পরিবারের মধ্যে স্নেহ ও মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাে। তারপর আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি এহসান করলেন এবং আমাদেরকে প্রচন্ড তাপসম্পন্ন আগুনের আযাব থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। আমরা এর আগে তাকে ডাকতাম, তিনি বড়ই মেহেরবান এবং সৎ কাজের প্রতিদানকারী।’

*একমাত্র পরহেজগাররাই মুক্তি পাবে : এতে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা হচ্ছে, দুনিয়ার জীবনে তারা আজকের দিন সম্পর্কে ভেবে ভেবে ভয়ে ভয়ে কালাতিপাত করতাে। তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়ার ভয় করতাে। তার কাছে হিসাব দিতে হবে এ ভয় তাদের ছিলাে। যখন পরিবারের সাথে জীবন যাপন করেছে, তখনও এ ভয় তাদের থেকেছে। কোনাে কোনাে মানুষের সাথে ধোকাবাজি করার সুযােগ এসেছে, কিন্তু তারা ধোকাবাজি করেনি। বাজে খেলাধুলা ও অবৈধ তৎপরতার সুযােগ পেয়েও তারা তা গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নিকটেই তারা প্রতিদানের আশা করেছে, যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভীষণ উত্তপ্ত সেই আগুনের আযাব থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন যা শরীরের মধ্যে সাপের দংশনে নির্গত গরম বিষের মতাে প্রবেশ করে। আল্লাহ তায়ালা তার মেহেরবানীতে তাদের প্রতি এহসানস্বরূপ। এবং তাদেরকে মর্যাদা দিতে গিয়ে এইভাবে এ আযাব থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। যেহেতু তিনি জানতে পেরেছেন যে, তারা আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে মন্দ কাজ পরিহার করে চলেছে। সব ব্যাপারেই তারা আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখেছে এবং মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করেছে। এসব ভাল কাজ করার সময়ে তাদের এ চেতনাও প্রবলভাবে থেকেছে যে, যত ভাল কাজই তারা করুক না কেন, নাজাতের জন্য সেগুলাে মােটেই যথেষ্ট নয়, বরং মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য আল্লাহ পাকের মেহেরবানীই হচ্ছে একমাত্র সহায়। মােমেন ব্যক্তির নেক কাজ করার দাবী এর থেকে বেশী কিছু নয় যে, তার কাজ সাক্ষ্য দেবে যে, সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং আল্লাহ পাকের নিকটেই নেক প্রতিদানের আশা করেছে। প্রকৃতপক্ষে এটাই তাকে আল্লাহ পাকের রহমত পাওয়ার যােগ্য বানিয়েছে। অবশ্যই অত্যন্ত সতর্কতা, আল্লাহর ভয় ও অন্যায় থেকে দূরে থাকার মানসিকতা নিয়েই সে বরাবর আল্লাহকে ডেকেছে। এজন্যেই তারা সে দিন বলতে পারবে, ‘এর আগে অবশ্যই আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি।’ হাঁ তারা জানে ও বিশ্বাস করে যে মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার প্রতি বড়ই মেহেরবান এবং তাঁর বান্দার সকল নেক আমলের প্রতিদান দানকারী। সেই জন্যই তাে তিনি ‘বাররুর রহীম’ অর্থাৎ নেক আমলের মূল্যায়নকারী মেহেরবান। আর, এইভাবে বুঝা যায় এবং এ রহস্যের দ্বার খুলে যায় যে, এই নেক লােকদের দোয়া আল্লাহ তায়ালা কেন কবুল করেন এবং তাদেরকে তার নেয়ামতের ভান্ডার দান করেন।

১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
হযরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (রাঃ) বলেনঃ “আমি মাগরিবের নামাযে নবী (সাঃ)-কে সূরায়ে তূর পড়তে শুনেছি। তার চেয়ে অধিক সুমিষ্ট সুর বিশিষ্ট উত্তম কিরআতকারী লোক আমি একটিও দেখিনি।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক তাঁর মুআত্তা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “হজ্বের সময় আমি রুগ্না হয়ে পড়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে আমি আমার অবস্থা বর্ণনা করলে তিনি আমাকে বলেনঃ “তুমি সওয়ারীর উপর আরোহণ করে জনগণের পিছনে পিছনে তাওয়াফ করে নাও।” সুতরাং আমি সওয়ারীর উপর বসে তাওয়াফ করলাম। ঐ সময় নবী (সঃ) বায়তুল্লাহ শরীফের এক কোণে নামায পড়ছিলেন এবং (আরবী)-এর তিলাওয়াত করছিলেন।” (ইমাম বুখারী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:

যেগুলো আল্লাহ তাআলার ব্যাপক ও মহাশক্তির নিদর্শন সেগুলোর শপথ করে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ তার শাস্তি অবশ্যই আসবে। যখন তাঁর শাস্তি আসবে তখন কারো ক্ষমতা নেই যে, তা প্রতিরোধ করতে পারে।

যে পাহাড়ের উপর গাছ থাকে ঐ পাহাড়কে ‘র’ বলে। যেমন ঐ পাহাড়টি, যার উপর আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেছিলেন এবং যেখান হতে হযরত ঈসা (আঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন। আর শুষ্ক পাহাড়কে ‘জাবাল বলা হয়। এটাকে ‘র’ বলা হয় না।

(আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো লাওহে মাহফুয’ বা রক্ষিত ফলক। অথবা এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলার অবতারিত ও লিখিত কিতাব সমূহকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো মানুষের সামনে পাঠ করা হয়। এ জন্যেই এর পরেই বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ উন্মুক্ত পত্রে।

বায়তুল মা’মূর’ এর ব্যাপারে মিরাজ সম্বলিত হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সপ্তম আকাশ হতে সামনে অগ্রসর হওয়ার পর আমাকে বায়তুল মা’মূর দেখানো হয় যেখানে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে থাকেন। দ্বিতীয় দিনও এই সংখ্যকই ফেরেশতাদের সমাবেশ সেখানে ঘটে থাকে। কিন্তু প্রথম দিন যাদের সমাবেশ হয়, কিয়ামত পর্যন্ত আর তাঁদের পালা পড়বে না। ভূ-পৃষ্ঠে যেমন কাবা শরীফের তাওয়াফ হয়ে থাকে তেমনই বায়তুল মা’মূর হলো আকাশবাসীদের তাওয়াফ ও ইবাদতের জায়গা।” ঐ হাদীসেই রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময় হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে বায়তুল মা’মূরের সাথে কোমর লাগিয়ে বসে থাকতে দেখেন। এতে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এই রয়েছে যে, যেহেতু হযরত ইবরাহীম (আঃ) বায়তুল্লাহ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং তাঁর হাতেই তা নির্মিত হয়েছে সেই হেতু সেখানেও তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওর সাথে লেগে থাকতে দেখতে পান। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা যেন তাকে তার আমলেরই অনুরূপ প্রতিদান দিলেন। এই বায়তুল মা’মূর কাবা শরীফের ঠিক উপরে রয়েছে। আর ওটা রয়েছে সপ্তম আকাশের উপর। এমন তো প্রতিটি আকাশে এমন একটি ঘর রয়েছে যেখানে ঐ আকাশের ফেরেশতারা আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করে থাকেন। প্রথম আকাশে এরূপ যে ঘরটি রয়েছে ওটাকে বলা হয় বায়তুল ইযত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “সপ্তম আকাশে একটি ঘর রয়েছে যাকে মা’মূর বলা হয়, যা কা’বার দিকে রয়েছে। চতুর্থ আকাশে একটি নহর আছে যার নাম হাইওয়ান। তাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রত্যহ ডুব দিয়ে থাকেন এবং উঠে দেহ ঝেড়ে থাকেন। ফলে তাঁর দেহ হতে সত্তরটি বিন্দু ঝরে পড়ে। প্রত্যেক বিন্দু হতে আল্লাহ তা’আলা এক একজন ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তারা যেন বায়তুল মামুরে গিয়ে নামায আদায় করেন। তারপর তারা সেখান হতে বেরিয়ে আসে। অতঃপর আর তাদের সেখানে যাওয়ার সুযোগে ঘটে না। তাঁদের একজন নেতা থাকেন যাঁকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তিনি যেন তাদেরকে নিয়ে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে যান। তারপর তারা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতে থাকেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এই ব্যস্ততাই থাকে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা খুবই গারীব হাদীস। এর বর্ণনাকারী রাওহ্ ইবনে সবাহ এতে একাকী রয়েছেন। হাফিযদের একটি দল তার উপর এ হাদীসটিকে অস্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জাওজানী (রঃ), আকীল (রঃ), হাকিম আবু আবদিল্লাহ নীশাপুরী (রঃ) প্রমুখ। হাকিম (রঃ) হাদীসটিকে ভিত্তিহীন বলেছেন)

হযরত খালিদ ইবনে আরআরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেঃ “বায়তুল মা’মূর কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ওটা আকাশে রয়েছে। ওটাকে সুরাহ বলা হয়। কা’বার ঠিক উপরে ওটা রয়েছে। যমীনের কা’বা যেমন মর্যাদা সম্পন্ন স্থান, অনুরূপভাবে ওটা আসমানে মর্যাদা সম্পন্ন স্থান। প্রত্যহ তাতে সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায আদায় করে থাকেন। কিন্তু একদিন যারা তাতে প্রবেশ করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত আর তাঁদের সেখানে যাওয়ার পালা পড়বে না। কেননা, ফেরেশতা অসংখ্য রয়েছেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) একটি রেওয়াইয়াতে রয়েছে যে, এই প্রশ্নকারীর নাম ছিল ইবনুল কাওয়া (রাঃ)। হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বায়তুল মা’মূর আরশের পাদদেশে রয়েছে।

একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, একদা বাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “বায়তুল মা’মূর কি তা তোমরা জান কি?” তারা উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন তিনি বললেনঃ “ওটা হলো আসমানী কাবা। ওটা যমীনী কাবার ঠিক উপরে রয়েছে। যদি ওটা পড়ে যায় তবে যমীনের কা’বার উপরই পড়বে। এতে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায আদায় করে থাকেন। এক দল যখন ওটা হতে বের হন তখন কিয়ামত পর্যন্ত আর তারা সেখানে ফিরে যান না।

যহহাক (রঃ) বলেন যে, এই ফেরেশতাগুলো ইবলীস গোত্রের জ্বিনদের অন্তর্ভুক্ত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

সমুন্নত ছাদ’ দ্বারা আকাশকে বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশকে রক্ষিত ছাদ করেছি।” (২১:৩২)।

রাবী’ ইবনে আনাস (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আরশ’কে বুঝানো হয়েছে। কেননা, ওটা সমস্ত মাখলুকের ছাদ স্বরূপ। এই উক্তির ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যেতে পারে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আ’ম বা সাধারণ।

(আরবী) বা উদ্বেলিত সমুদ্র দ্বারা ঐ পানি উদ্দেশ্য যা আরশের নীচে রয়েছে। ওটা বৃষ্টির মত বর্ষিত হবে যার দ্বারা কিয়ামতের দিন মৃতরা পুনর্জীবন লাভ করে নিজ নিজ কবর হতে উথিত হবে। জমহুর বলেন যে, এর দ্বারা সাধারাণ সমুদ্র উদ্দেশ্য।

এটাকে (আরবী) বলার কারণ এই যে, কিয়ামতের দিন এতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সমুদ্র যখন স্ফীত হবে।” (৮১:৬) অর্থাৎ যখন তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং ওটা ছড়িয়ে গিয়ে সারা হাশরের মাঠকে পরিবেষ্টন করে ফেলবে।

হযরত আ’লা ইবনে বদর (রঃ) বলেনঃ এটাকে উদ্বেলিত সমুদ্র বলার কারণ এই যে, ওর পানি পানের অযোগ্য হয়ে যাবে। ওটাকে জমিতে দেয়াও চলবে না। কিয়ামতের দিন সমুদ্রগুলোর অবস্থা এরূপই হবে। এর অর্থ প্রবাহিত সমুদ্রও করা হয়েছে। আবার বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলোঃ পরিপূর্ণ সমুদ্র, যার পানি এদিকে ওদিকে প্রবাহিত।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী)দ্বারা উদ্দেশ্য হলো খালি বা শূন্য। কোন দাসী পানি আনতে যায়, অতঃপর ফিরে এসে বলেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই চৌবাচ্ছা শূন্য।” এটাও বলা হয়েছেঃ এর অর্থ এই যে, এটাকে যমীন হতে থামিয়ে দেয়া হয়েছে, যেন ডুবিয়ে না দেয়।

হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রতি রাত্রে সমুদ্র তিন বার করে আল্লাহ তা’আলার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে যে, সমস্ত মানুষকে ডুবিয়ে দেয়ার যেন তাকে হুকুম দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাকে থামিয়ে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একজন বুযুর্গ ব্যক্তি, যিনি একজন মুজাহিদ ছিলেন এবং সমুদ্রের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তিনি জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণে সেখানে অবস্থান করছিলেন, তিনি। বলেনঃ “একদা রাত্রে আমি পাহারার উদ্দেশ্যে বের হই। ঐ রাত্রে অন্য কোন প্রহরী ছিল না। আমি টহল দিতে দিতে ময়দানে পৌছি। সেখান হতে আমি সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এরূপ মনে হয় যে, সমুদ্র যেন পর্বতের চূড়ার সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। বার বার এই দৃশ্যই আমার দৃষ্টিগোচর হয়। আমি ঘটনাটি হযরত আবু সালেহ (রঃ)-এর কাছে বর্ণনা করলে তিনি হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত উপরোক্তে হাদীসটি আমাকে শুনিয়ে দেন।” (এর সনদে একজন বর্ণনাকারী অস্পষ্ট রয়েছেন, যার নাম উল্লেখ করা হয়নি)

যে বিষয়ের উপর এসব শপথ করা হয়েছে সেগুলোর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, ওটা নিশ্চিত রূপেই আসবে এবং যখন তা এসে পড়বে তখন ওর নিবারণকারী কেউই হবে না।

হাফিয আবু বকর ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, একদা রাত্রে হযরত উমার (রাঃ) শহরের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে বের হন। একজন মুসলমানের বাড়ীর পার্শ্বদিয়ে গমনকালে তিনি দেখতে পান যে, লোকটি নামায পড়ছেন এবং সূরায়ে তূর পাঠ করছেন। তখন তিনি সওয়ারী থামিয়ে দিয়ে কুরআন শুনতে শুরু করেন। লোকটি যখন পড়তে পড়তে (আরবী)পর্যন্ত পৌঁছেন তখন তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েঃ “কা’বার প্রতিপালকের শপথ! এ কথা সত্য।” অতঃপর তিনি স্বীয় গাধার উপর হতে নেমে পড়েন এবং দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। চলাফেরার শক্তি তাঁর থাকলো না। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর যখন তিনি শক্তি ফিরে পেলেন তখন বাড়ী ফিরে গেলেন। কিন্তু আল্লাহ পাকের কালামের এই ভীতিপূর্ণ আয়াত তাঁর উপর এমন ক্রিয়াশীল হলো যে, দীর্ঘ এক মাস পর্যন্ত রুগ্ন অবস্থায় থাকলেন। জনগণ তাঁকে দেখতে আসতো, কিন্তু তিনি কি রোগে ভুগছেন তা তারা জানতে পারতো না। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।

হযরত আবু উবায়েদ (রঃ) ফাযায়িলুল কুরআনের মধ্যে বর্ণনা করেছেন যে, একদা হযরত উমার (রাঃ) (আরবী)-এই আয়াতগুলো পাঠ করেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর হেঁচকী বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা তাঁর অন্তরে এমন ক্রিয়াশীল হয় যে, তিনি রুগ্ন হয়ে পড়েন। বিশ দিন পর্যন্ত জনগণ তাকে দেখতে আসতে থাকে।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ঐ দিন আকাশ আন্দোলিত হবে এবং ফেটে যাবে ও ঘুরতে শুরু করবে। আর পর্বত দ্রুত চলতে থাকবে। ওটা নিজ স্থান হতে সরে যাবে, এদিক হতে ওদিক চলে যাবে, কাঁপতে কাঁপতে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং ধুনো কূলার মত এদিক-ওদিক উড়তে থাকবে। এভাবে ওটার কোন নাম ও নিশানা থাকবে না। ঐ দিন মিথ্যাচারীদের বড়ই দুর্ভোগ পোহাতে হবে, যারা ক্রীড়াস্থলে আসার কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। আল্লাহর শাস্তি, ফেরেশতাদের মার এবং জাহান্নামের আগুন তাদের জন্যে হবে যারা দুনিয়ায় মগ্ন ছিল। যারা দ্বীনকে খেল-তামাশারূপে নির্ধারণ করে নিয়েছিল। সেই দিন তাদের ধাক্কা মারতে মারতে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। জাহান্নামের রক্ষক তাদেরকে বলবেনঃ “এটা ঐ অগ্নি যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে। তারপর আরো ধমকের সুরে বলা হবেঃ “এটা কি যাদু? না কি তোমরা দেখছো না? যাও, তোমরা এতে প্রবেশ কর। এটা তোমাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবে। তোমরা এখন ধৈর্যধারণ কর অথবা না কর উভয়ই তোমাদের জন্যে সমান। কোনক্রমেই তোমরা এখান হতে বের হতে পারবে না। এটা তোমাদের উপর আল্লাহ তা’আলার যুলুম নয়, বরং তোমরা যা করতে তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হচ্ছে।

১৭-২০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা সৌভাগ্যবানদের পরিণাম বর্ণনা করছেন যে, তারা ঐ সব শাস্তি হতে রক্ষা পাবে যেসব শাস্তি হতভাগ্যদেরকে দেয়া হবে এবং তাদেরকে সুখময় জান্নাতে প্রবিষ্ট করা হবে। সেখানে তারা উন্নতমানের নিয়ামত ভোগ করতে থাকবে। সেখানে তাদের জন্যে সর্ব প্রকারের ভোগ্যবস্তু, নানা প্রকারের সুখাদ্য, বিভিন্ন প্রকারের সুপেয় পানীয়, উন্নত মানের পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাল ভাল সওয়ারী, সুউচ্চ অট্টালিকা এবং সব রকমের নিয়ামতরাশি প্রস্তুত রয়েছে। সেখানে তাদের কোন প্রকারের ভয়-ভীতি থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনি তাদেরকে রক্ষা করবেন জাহান্নামের শাস্তি হতে। মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাদেরকে বলবেনঃ তোমরা যা করতে তার প্রতিফল স্বরূপ তোমরা তৃপ্তির সাথে পানাহার করতে থাকো। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা পানাহার কর তৃপ্তির সাথে, তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে।” (৬৯:২৪)

মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘তারা শ্ৰেণীবদ্ধভাবে সজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে।’ হযরত হায়সাম ইবনে মালিক তাঈ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “মানুষ বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকবে। চল্লিশ বছর পর্যন্ত সে এভাবে আরামে বসে থাকবে, তার নড়াচড়া বা উঠবার কোনই প্রয়োজন হবে না। যা তার মনে চাইবে এবং যাতে তার চক্ষু ঠাণ্ডা হবে তাই তার কাছে এসে যাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমাদের কাছে খবর পৌঁছেছে যে, জান্নাতে মানুষ সত্তর বছর পর্যন্ত বালিশে হেলান দিয়ে আরামে বসে থাকবে। তার কাছে পরমা সুন্দরী হুরীগণ বিদ্যমান থাকবে। তারা তার মনের চাহিদা মেটাবে। বহু খাদেম তার খিদমতের জন্যে তার চারদিকে ঘোরা ফেরা করবে। অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে সে ডুবে থাকবে। সত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন সে অন্য দিকে ঘুরবে তখন সে সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য দেখতে পাবে। সে এমন হ্রদেরকে দেখতে পাবে যাদেরকে পূর্বে কখনো দেখেনি। তারা তাকে বলবেঃ “আমরা আপনার প্রতি বড়ই কৃতজ্ঞ যে, আপনার দৃষ্টি আমাদের দিকে পড়েছে।” মোটকথা, এভাবে মন মাতানো ও প্রাণ ভুলানো নিয়ামতরাশির মধ্যে তারা নিমগ্ন থাকবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের একের মুখ অপরের মুখের দিকে থাকবে। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা মুখখামুখি হয়ে আসনে আসীন হবে।” (৩৭:৪৪)।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের মিলন ঘটাবো আয়ত-লোচনা হুরের সঙ্গে। অর্থাৎ আমি তাদের জন্যে রাখবো উত্তম সঙ্গিনী ও সুন্দরী স্ত্রী, যারা হবে আয়ত-লোচনা হুরদের মধ্য হতে। আর মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ আমি আয়ত-লোচনা হুরদের সাথে তাদের বিয়ে দিয়ে দিবো। এদের গুণাবলী সম্বলিত হাদীসগুলো কয়েক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ওগুলোর পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।

২১-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় ফল ও করম এবং স্নেহ ও করুণার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, যেসব মুমিনের সন্তানরা ঈমানের ব্যাপারে বাপ-দাদাদের অনুসারী হয়, কিন্তু সৎ কর্মের ব্যাপারে তাদের পিতৃপুরুষদের সমতুল্য হয় না, আল্লাহ তা’আলা তাদের সৎ আমলকে বাড়িয়ে দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের সমপর্যায়ে পৌছিয়ে দিবেন, যাতে পূর্বপুরুষরা তাদের উত্তরসূরীদেরকে তাদের পার্শ্বে দেখে শান্তি লাভ করতে পারে। আর উত্তরসূরীরাও যেন পূর্বসূরীদের পার্শ্বে থাকতে পেরে সুখী হতে পারে। মুমিনদের আমল কমিয়ে দিয়ে যে তাদের সন্তানদের আমল বাড়িয়ে দেয়া হবে তা নয়, বরং অনুগ্রহশীল ও দয়ালু আল্লাহ তার পরিপূর্ণ ভাণ্ডার হতে তা দান করবেন। এই বিষয়ের একটি মারফু হাদীসও আছে।

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, জান্নাতীরা যখন জান্নাতে চলে যাবে এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে সেখানে পাবে না তখন তারা আরয করবেঃ “হে আল্লাহ! তারা কোথায়?” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “তারা তোমাদের মর্যাদায় পৌছতে পারেনি। তারা তখন বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তো নিজেদের জন্যে ও সন্তানদের জন্যে নেক আমল করেছিলাম!” তখন মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে এদেরকেও ওদের সমমর্যাদায় পৌছিয়ে দেয়া হবে।

এও বর্ণিত আছে যে, জান্নাতীদের যেসব সন্তান ঈমান আনয়ন করেছে তাদেরকে তো তাদের সাথে মিলিত করা হবেই, এমনকি তাদের যেসব সন্তান শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকেও তাদের কাছে পৌছিয়ে দেয়া হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত শাবী (রঃ), হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ), হযরত ইবরাহীম (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত আবূ সালেহ (রঃ), হযরত রাবী’ ইবনে আনাস (রঃ) এবং হযরত যহহাকও (রঃ) একথাই বলেন। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন।

হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত খাদীজা (রাঃ) নবী (সঃ)-কে তাঁর ঐ দুই সন্তানের অবস্থানস্থল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যারা জাহেলিয়াতের যুগে মারা গিয়েছিল। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তারা দু’জন জাহান্নামে রয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে দুঃখিতা হতে দেখে। বলেনঃ “তুমি যদি তাদের বাসস্থান দেখতে তবে অবশ্যই তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতে।” হযরত খাদীজা (রাঃ) পুনরায় বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার মাধ্যমে আমার যে সন্তান হয়েছে তার স্থান কোথায়?” জবাবে তিনি বলেনঃ “জান্নাতে।” তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “নিশ্চয়ই মুমিনরা ও তাদের সন্তানরা জান্নাতে যাবে এবং মুশরিকরা ও তাদের সন্তানরা জাহান্নামে যাবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আয়াতটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এতো হলো পিতাদের আমলের বরকতে পুত্রদের মর্যাদার বর্ণনা। এখন পুত্রদের দু’আর বরকতে পিতাদের মর্যাদার বর্ণনা দেয়া হচ্ছেঃ

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, হঠাৎ করে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৎ বান্দাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করবেঃ “হে আল্লাহ! আমাদের মর্যাদা এভাবে হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেয়ার কারণ কি?” আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলবেনঃ “তোমাদের সন্তানরা তোমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, তাই আমি তোমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছি।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটির ইসনাদ সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ। তবে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এ শব্দগুলোর দ্বারা এভাবে বর্ণিত হয়নি)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন আদম সন্তান মারা যায় তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু -এ তিনটি আমলের সওয়াব সে মৃত্যুর পরেও পেতে থাকে। (এক) সদকায়ে জারিয়াহ। (দুই) দ্বীনী ইলম, যার দ্বারা উপকার লাভ করা হয়। (তিন) সৎ সন্তান, যে মৃত ব্যক্তির জন্যে দু’আ করতে থাকে।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

এখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মুমিনদের সন্তানরা আমলহীন হলেও তাদের আমলের বরকতে তাদের সন্তানদের মর্যাদাও তাদের সমপর্যায়ে আনয়ন করা হবে, আল্লাহ তাআলা তাঁর এই অনুগ্রহের বর্ণনা দেয়ার সাথে সাথেই নিজের আদল ও ইনসাফের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, কাউকেও অন্য কারো আমলের কারণে পাকড়াও করা হবে না, বরং প্রত্যেকেই নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্যে দায়ী থাকবে। পিতার পাপের বোঝা পুত্রের উপর এবং পুত্রের পাপের বোঝা পিতার উপর চাপানো হবে না। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ, তবে দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ব্যক্তিরা নয়, তারা থাকবে উদ্যানে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করবে- অপরাধীদের সম্পর্কে।” (৭৪:৩৮-৪১)

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি তাদেরকে দিবো ফলমূল এবং গোশত যা তারা পছন্দ করে। সেখানে তারা একে অপরের নিকট হতে গ্রহণ করবে পান-পাত্র, যা হতে পান করলে কেউ অসার কথা বলবে না এবং পাপ কর্মেও লিপ্ত হবে না। এটা পানে তারা অজ্ঞান হবে না। এতে তারা পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করবে। এটা পান করে তারা আবোল তাবোল বকবে না এবং পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে না। দুনিয়ার মদের অবস্থা এই যে, যারা এটা পান করে তাদের মাথায় চক্কর দেয়, জ্ঞান লোপ পায় এবং বক্ করে বকতে থাকে। তাদের মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ বের হয় এবং চেহারার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয়। কিন্তু জান্নাতের মদ এসব বদ অভ্যাস হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। এর রঙ সাদা ও পরিষ্কার। এটা সুপেয়। এটা পানে কেউ অজ্ঞানও হবে না এবং বাজে কথা বকবেও না। এতে ক্ষতির কোন সম্ভাবনাই নেই। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “শুভ্র উজ্জ্বল, যা হবে পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু। তাতে ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না এবং তাতে তারা মাতালও হবে না।” (৩৭:৪৬-৪৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই সুরা পানে তাদের শিরঃপীড়া হবে না, তারা জ্ঞান হারাও হবে ।” (৫৬:১৯)

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে কিশোরেরা, তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ। যেমন অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে চিরকিশোরেরা পান-পাত্র, কুঁজা ও প্রস্রবণ-নিসৃত সুরাপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে।” (৫৬:১৭-১৮)

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা একে অপরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করবে অথাৎ পরস্পর আলাপ আলোচনা করবে। তাদের পার্থিব আমল ও অবস্থা সম্পর্কে তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারা বলবেঃ পূর্বে আমরা পরিবার পরিজনের মধ্যে শংকিত অবস্থায় ছিলাম। আজকের দিনের শাস্তি সম্পর্কে আমরা সদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতাম। মহান আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন। পূর্বেও আমরা তাকেই আহ্বান করতাম। তিনি আমাদের দু’আ কবূল করেছেন এবং আমাদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছেন। তিনি তো কৃপাময়, পরম দয়ালু।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতী যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন সে তার (মুমিন) ভাইদের সাথে মিলনের আকাক্ষা করবে, আর ওদিকে তার বন্ধুর মনেও তার সাথে মিলিত হবার বাসনা জাগবে। অতঃপর দু’দিক হতে দু’জনের আসন উড়বে এবং পথে উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটবে। তারা উভয়ে নিজ নিজ আসনে আরামে বসে থাকবে এবং পরস্পর আলাপ আলোচনা করবে। তারা তাদের পার্থিব কথাবার্তা বলবে। তারা একে অপরকে বলবেঃ “অমুক দিন অমুক জায়গায় আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলাম এবং আল্লাহ তা’আলা তা কবূল করেছেন।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযার (রঃ) তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের সনদ দুর্বল)

হযরত মাসরূক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) (আরবী) এ আয়াত দুটি পাঠ করে দু’আ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন! নিশ্চয়ই আপনি কৃপাময়, পরম দয়ালু।” হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত আমাশ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “তিনি কি নামাযে এই দু’আ করেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হ্যাঁ।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)।

Leave a Reply