Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১২৮/মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪১) [ *  *মােনাফেকদের মুখােশ উন্মোচন :- হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসূলের আনুগত্য করো:-   *বাতিলের সাথে আপােষ নয় : -] www.motaher21.net সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। পারা:২৬ ২৭-৩৮ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১২৮/মুনাফিক কি? কেন ও কিভাবে -৪১)
[ *  *মােনাফেকদের মুখােশ উন্মোচন :-
হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসূলের আনুগত্য করো:-
*বাতিলের সাথে আপােষ নয় : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪৭- মুহাম্মাদ। পারা:২৬
২৭-৩৮ নং আয়াত:-

তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-২৭
فَکَیۡفَ اِذَا تَوَفَّتۡہُمُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ یَضۡرِبُوۡنَ وُجُوۡہَہُمۡ وَ اَدۡبَارَہُمۡ ﴿۲۷﴾
সে সময় কী অবস্থা হবে যখন ফেরেশতারা তাদের রূহ কবজ করবে এবং তাদের মুখ ও পিঠের ওপর আঘাত করতে করতে নিয়ে যাবে।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-২৮
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمُ اتَّبَعُوۡا مَاۤ اَسۡخَطَ اللّٰہَ وَ کَرِہُوۡا رِضۡوَانَہٗ فَاَحۡبَطَ اَعۡمَالَہُمۡ ﴿٪۲۸﴾
এসব হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা এমন পন্থার অনুসরণ করেছে যা আল্লাহর অসন্তুষ্টি উৎপাদন করে এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করা পছন্দ করেনি। এ কারণে তিনি তাদের সব কাজ-কর্ম নষ্ট করে দিয়েছেন।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-২৯
اَمۡ حَسِبَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ اَنۡ لَّنۡ یُّخۡرِجَ اللّٰہُ اَضۡغَانَہُمۡ ﴿۲۹﴾
যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তাদের বিদ্বেষ ভাব কখনই প্রকাশ করবেন না?
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩০
وَ لَوۡ نَشَآءُ لَاَرَیۡنٰکَہُمۡ فَلَعَرَفۡتَہُمۡ بِسِیۡمٰہُمۡ ؕ وَ لَتَعۡرِفَنَّہُمۡ فِیۡ لَحۡنِ الۡقَوۡلِ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ اَعۡمَالَکُمۡ ﴿۳۰﴾
আমি ইচ্ছা করলে তোমাকে তাদেরকে দেখিয়ে দিতাম, ফলে তুমি তাদের লক্ষণ দেখে তাদেরকে চিনতে পারতে, তবে তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদেরকে চিনতে পারবে। আর আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩১
وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ حَتّٰی نَعۡلَمَ الۡمُجٰہِدِیۡنَ مِنۡکُمۡ وَ الصّٰبِرِیۡنَ ۙ وَ نَبۡلُوَا۠ اَخۡبَارَکُمۡ ﴿۳۱﴾
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই এবং আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করি।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩২
اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ صَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ شَآقُّوا الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُمُ الۡہُدٰی ۙ لَنۡ یَّضُرُّوا اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیُحۡبِطُ اَعۡمَالَہُمۡ ﴿۳۲﴾
যারা কুফরী করেছে, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং তাদের সামনে সঠিক পথ স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর রসূলের সাথে বিরোধ করেছে, প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং আল্লাহই তাদের সব কৃতকর্ম ধ্বংস করে দিবেন।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩৩
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ لَا تُبۡطِلُوۡۤا اَعۡمَالَکُمۡ ﴿۳۳﴾
হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, আর তোমরা তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩৪
اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ صَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ثُمَّ مَاتُوۡا وَ ہُمۡ کُفَّارٌ فَلَنۡ یَّغۡفِرَ اللّٰہُ لَہُمۡ ﴿۳۴﴾
নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করেছে, তারপর কাফির অবস্থায় মারা গেছে, আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩৫
فَلَا تَہِنُوۡا وَ تَدۡعُوۡۤا اِلَی السَّلۡمِ ٭ۖ وَ اَنۡتُمُ الۡاَعۡلَوۡنَ ٭ۖ وَ اللّٰہُ مَعَکُمۡ وَ لَنۡ یَّتِرَکُمۡ اَعۡمَالَکُمۡ ﴿۳۵﴾
তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির জন্য আহ্বান করো না। তোমরাই বিজয়ী থাকবে। আল্লাহ‌ তোমাদের সাথে আছেন। তিনি তোমাদের আমল কখনো নষ্ট করবেন না।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩৬
اِنَّمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا لَعِبٌ وَّ لَہۡوٌ ؕ وَ اِنۡ تُؤۡمِنُوۡا وَ تَتَّقُوۡا یُؤۡتِکُمۡ اُجُوۡرَکُمۡ وَ لَا یَسۡـَٔلۡکُمۡ اَمۡوَالَکُمۡ ﴿۳۶﴾
দুনিয়ার জীবন তো শুধু খেল-তামাশা ও অর্থহীন কথাবার্তা। আর যদি তোমরা ঈমান আন এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের পুরস্কার দেবেন এবং তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ চান না
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩৭
اِنۡ یَّسۡـَٔلۡکُمُوۡہَا فَیُحۡفِکُمۡ تَبۡخَلُوۡا وَ یُخۡرِجۡ اَضۡغَانَکُمۡ ﴿۳۷﴾
তিনি যদি কখনো তোমাদের সম্পদ চান এবং সবটাই চান তাহলে তোমরা কৃপণতা করবে এবং তিনি তোমাদের ঈর্ষা পরায়ণতা প্রকাশ করে দিবেন।
সূরা:৪৭-মুহাম্মাদ আয়াত:-৩৮
ہٰۤاَنۡتُمۡ ہٰۤؤُلَآءِ تُدۡعَوۡنَ لِتُنۡفِقُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۚ فَمِنۡکُمۡ مَّنۡ یَّبۡخَلُ ۚ وَ مَنۡ یَّبۡخَلۡ فَاِنَّمَا یَبۡخَلُ عَنۡ نَّفۡسِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ الۡغَنِیُّ وَ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ ۚ وَ اِنۡ تَتَوَلَّوۡا یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَکُمۡ ۙ ثُمَّ لَا یَکُوۡنُوۡۤا اَمۡثَالَکُمۡ ﴿٪۳۸﴾
দেখো, তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে অথচ তোমাদের মধ্যকার কিছু লোক কৃপণতা করেছে। যারা কৃপণতা করে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজের সাথেই কৃপণতা করছে। আল্লাহ‌ তো অভাব শূন্য। তোমরাই তার মুখাপেক্ষী। তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আল্লাহ‌ তোমাদের স্থানে অন্য কোন জাতিকে নিয়ে আসবেন। তারা তোমাদের মত হবে না।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

জীবন সায়াহ্নে এই চক্রান্তকারীদের সাথে আল্লাহর সৈনিক ফেরেশতারা কি আচরণ করবে তা খােলামেলা হুমকির ভাষায় এইভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘ফেরেশতারা যখন তাদের মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের অবস্থা কেমন হবে?'(আয়াত ২৭) এই আয়াতে যে দূশ্যের অবতারণা করা হয়েছে তা একই সাথে ভয়ঙ্কর এবং লজ্জাকরও। কারণ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় যখন তাদের কোনােই শক্তি সামর্থ থাকবে না সেই অসহায় অবস্থায় তারা এই পার্থিব জীবনের চৌহদ্দী পেরিয়ে পরকালীন জীবনে পা রাখতেই তাদেরকে এক করুণ ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তখন ফেরেশতারা তাদের মুখে আঘাত করতে থাকবে, তাদের পাছায় আঘাত করতে থাকবে। একদিকে মৃত্যুর কঠিন, কষ্টকর ও ভয়ংকর মুহূর্ত, অপরদিকে পশ্চাদদেশে আঘাতের পর আঘাত। কি করুণ পরিণতি। কেন এই পরিণতির শিকার হতে হলাে তাদেরকে, তার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এটা এ জন্যে যে, তারা সে বিষয়ের অনুসরণ করে, যা আল্লাহর অসন্তোষ সৃষ্টি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে। ফলে তিনি তাদের কর্মসমূহ ব্যর্থ করে দেন।'(আয়াত ২৮) অর্থাৎ ওরা নিজেরাই এই অশুভ পরিণতিকে নিজেদের জন্যে বেছে নিয়েছে এবং পছন্দ করেছে। ওরা নিজেরাই মােনাফেকী, নাফরমানী এবং আল্লাহর শত্রু, ইসলামের শত্রু ও আল্লাহর রাসুলের শত্রুদের সাথে মিলে মিশে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার মতাে আল্লাহর অসন্তুষ্টি সৃষ্টিকারী কাজে নিয়ােজিত হয়েছে। তাই এই সন্তুষ্টি লাভের উপযুক্ত কোনাে কাজ ওরা করেনি। বরং এমন সব কাজ করেছে যা আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও গযবকেই উস্কিয়ে দিয়েছে। কাজেই তিনি তাদের সকল কাজ ব্যর্থ করে দেন। এসব চক্রান্তমূলক কাজকে তারা নিজেদের জন্যে গর্বের বিষয়, যােগ্যতা ও কৌশলের বিষয় বলে মনে করতাে। অথচ তাদের এই চক্রান্ত ছিলাে ইসলামের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আর সে কারণেই এসব চক্রান্ত ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং এক সময় বিস্ফোরিত হয়ে তাদের জন্যে ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
*মােনাফেকদের মুখােশ উন্মোচন : মুনাফিকের আলোচনা শেষ পর্যায়ে এসে আল্লাহর রাসূল(স.)-এর সামনে এবং মুসলমানদের সামনে তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। ফলে মুসলমান সমাজ জানতে পারবে যে, ওরা প্রকৃত মুসলমান নয়, ইসলামের মুখােশ পরে ওরা এতােকাল সমাজকে ধোকা দিয়ে এসেছে এবং নিজেদের আসল রূপ লুকিয়ে রেখেছিলাে। এ প্রসঙ্গে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরের বিদ্বেষ প্রকাশ করে দেবেন? আমি ইচ্ছা করলে তােমাকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম।'(আয়াত ২৯-৩১) মােনাফেকদের বড় ভরসাই ছিলাে তাদের কপটতার বিভিন্ন কলাকৌশল এবং অধিকাংশ মুসলমানদের কাছ থেকে নিজেদের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখার যােগ্যতা। তারা মনে করতাে যে, তাদের এই কৌশল চিরকাল গােপন থাকবে। কিন্তু পবিত্র কোরআন তাদের এই ধারণাকে বােকামী বলে আখ্যায়িত করছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা হিংসাবিদ্বেষ ও শক্রতার বিষয়টি ফাঁস করে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে রসূল(স.)-কে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে, আমি ইচ্ছা করলে তােমাকে তাদের সাথে পরিচিত করিয়ে দিতাম। অর্থাৎ আমি আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে তোমার সামনে প্রত্যেক মােনাফেকের নাম ধাম ও বংশ পরিচয় তুলে ধরতাম। ফলে তুমি তাদের কথাবার্তার লক্ষণ দেখেই চিনতে পারতে। (এটা সেই সময়ের কথা ছিলাে যখন রসূলুল্লাহ(স.)-এর সামনে মােনাফেকদের নামধাম প্রকাশ করা হয়নি) অর্থাৎ নামধাম জানা না থাকলেও মােনাফেকদের পরিচয় তাদের বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ও রসূলকে সম্বােধন করার সময় উচ্চারণ বিকৃতির মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়ে যেতাে। তাই বলা হয়েছে, তুমি তাদেরকে অবশ্যই তাদের কথার ভঙ্গিতে চিনতে পারবে। তবে মানুষের গােটা কর্মকান্ড ও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্য কারাে জানার কথা নয়। এর পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহৱই আছে। তাই বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কর্মসমূহের খবর রাখেন।’ কাজেই কোনাে গােপন বিষয় তার অজানা নয়।  *আল্লাহর পরীক্ষা : এরপর আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা করবেন বলে ঘােষণা করেন। বলা বাহুল্য, এই পরীক্ষা হবে গােটা উম্মতের জন্যে। এর মাধ্যমে নির্ণয় করা হবে, কারা সত্যিকার অর্থে মােজাহেদ ও ধৈর্যশীল। ফলে তাদের পরিচয় সবার সামনে স্পষ্ট থাকবে, তাদের নিজেদের মাঝে কোনাে ধরনের বিভ্রান্তি থাকবে না এবং মােনাফেকদের ব্যাপারে, ভীরু ও কাপুরুষদের ব্যাপারে কোনো ধরনের অস্পষ্টতার অবকাশ থাকবে না। তাই বলা হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তােমাদেরকে পরীক্ষা করবাে যে পর্যন্ত না জানতে পারি তােমাদের মাঝে কারা মােজাহেদ এবং কারা ধৈর্যশীল এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থাসমূহ যাচাই করি।'(আয়াত ৩১) মানুষের অন্তরের ভেদ ও রহস্য আল্লাহ তায়ালা জানেন। তিনিই জানেন অন্তরের গােপন কামনা বাসনা। অন্তরের বর্তমান অবস্থা তিনি যেমন জানেন, ঠিক তেমনিভাবে জানেন এর ভবিষ্যত অবস্থাও। কাজেই, এই পরীক্ষা নেয়ার আবার প্রয়ােজন কি? তিনি যা জানেন, তার অতিরিক্ত কিছু ঘটবে তার কি আদৌ কোনাে সম্ভাবনা আছে? আল্লাহর এটা একটা বড় হেকমত যে, তিনি মানুষের ওপর ততােটুকুই দায়িত্ব আরােপ করেন যতটুকু তার সাধ্যে কুলায় এবং তার প্রকৃতি ও প্রতিভার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যে গােপন তত্ত্ব ও রহস্যাদি আল্লাহ তায়ালা জানেন, মানুষ তা জানে না। কাজেই তাদের জন্যে এসব তত্ত্ব ও রহস্য উন্মােচিত হওয়ার প্রয়ােজন আছে। ফলে তারা এসব জানবে, বুঝবে এবং বিশ্বাস করবে এবং সবশেষে এর দ্বারা তারা উপকৃত হবে। বলা বাহুল্য যে, বিপদ আপদ, সুখশান্তি, দুঃখকষ্ট, আরাম আয়েশ ও অভাব অনটন দিয়ে পরীক্ষা করে অন্তরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। এমন অজানা ভেদও জানা যায় যা সে অন্তরের অধিকারী ব্যক্তিরও থাকে অজানা। পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকাশিত অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহর জানার অর্থ হচ্ছে, অন্তরের যে বাহ্যিক অবস্থাটা মানুষ দেখতে ও উপলব্ধি করতে পারে সে অবস্থার সাথে আল্লাহর জ্ঞানের যােগসূত্র থাকা। অন্তরের যে অবস্থাটা মানুষ দেখতে পারে এবং ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উপলব্ধি করতে পারে সেটাই তাকে প্রভাবিত করে, তার অনুভূতিকে খাপ খাইয়ে নেয় এবং তার সাধ্যাধীন উপায় উপকরণের মাধ্যমে তার জীবনকে পরিচালিত করে, আর এভাবেই পরীক্ষার পেছনে নিহিত আল্লাহর উদ্দেশ্য ও লক্ষ সাধিত হয়। এরপরেও কোনাে মােমেন বান্দা আল্লাহর পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার কামনা করে না। বরং এর থেকে মুক্তি ও আল্লাহর রহমত কামনা করে। তবে কোনাে সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনাে পরীক্ষা এসে গেলে সে ধৈর্যের সাথে এর মােকাবেলা করে। কারণ, এর পেছনে যে হেকমত নিহিত আছে, তা সে বুঝতে পারে। তাই সে এ হেকমতের প্রতি আস্থা ও ভরসা রেখে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সাথে সাথে এই পরীক্ষায় যাতে উত্তীর্ণ হতে পারে সে জন্যে তার রহমত ও তৌফিকও কামনা করে। বিশিষ্ট সাধক ও বুযুর্গ হযরত ফুযাইল যখন এই আয়াতটি পাঠ করতেন তখন তিনি কেঁদে ফেলতেন এবং বলতেন, ‘হে পরওয়ারদেগার তুমি আমাদের পরীক্ষা নিয়াে না। কারণ তুমি পরীক্ষা নিলে আমাদের সব দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়ে যাবে, আমাদের সব গােপন ভেদই ফাঁস হয়ে যাবে, আর তখন তুমি আমাদেরকে শাস্তি দেবে।’ আলােচ্য সূরার এই শেষ পর্বের প্রথম অংশে যাদের সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে তারা হলাে কাফের গােষ্ঠী- যারা আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলাে এবং সত্য পথের সন্ধান পাওয়ার পরও তারা রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে নির্যাতন চালিয়েছিলাে। এরা খুব সম্ভবত মক্কার মােশরেক সম্প্রদায় যাদের প্রসঙ্গ আলােচ্য সূরার প্রথম দিকে এসেছে। কারণ, ইসলাম বিরােধিতার পরাকাষ্ঠা যারা দেখিয়েছিলাে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরুদ্ধাচরণ ও আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা যারা সৃষ্টি করেছিলাে তারা মক্কার মােশরেক গােষ্ঠী ছাড়া আর কেউ নয়। তবে এখানে অন্য কারাে কথা হতে পারে। যেমন এর দ্বারা মদীনার ইহুদী ও মােনাফেকসহ ইসলাম বিরােধী ও আল্লাহ তায়ালা বিরােধী যে কোনাে ব্যক্তি ও সমাজের কথা বুঝানাে হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে এটা এক ধরনের হুমকি স্বরূপ যে তারা প্রকাশ্য বা গােপনে এ জাতীয় নীতি অবলম্বন করলে তাদের পরিণতিও মক্কার মােশরেকদের অনুরূপ হবে। তবে অবস্থা ও প্রসঙ্গের প্রতি লক্ষ্য করলে প্রথম ব্যাখ্যাটিই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। আলােচ্য পর্বের দ্বিতীয় ও শেষ অংশ থেকে নিয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত মােমেনদের প্রসঙ্গই আলােচিত হয়েছে। এখানে তাদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার জন্যে আহ্বান করা হয়েছে এবং তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন এই জেহাদের ব্যাপারে অত্যাচারী ও সীমালংঘনকারী কাফেরদের সাথে কোনাে চাপের মুখে বা কোনাে দুর্বলতার কারণে বা আত্মীয়তার কারণে বা কোনাে স্বার্থের কারণে নমনীয়তা ও আপােসকামিতার প্রশ্রয় না দেয়। এই জেহাদের জন্যে আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে খরচ করতে কোনােরূপ কার্পণ্য না করার উপদেশও তাদেরকে দেয়া হয়েছে। তবে প্রত্যেকেই তার সামর্থ অনুযায়ী খরচ করবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা সামর্থের বাইরে কাউকে কিছু করার নির্দেশ দেন না। বিশেষ করে ধন সম্পদের ক্ষেত্রে মানুষের স্বভাবজাত দুবর্লতার বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা বিবেচনায় রাখেন। তারা যদি জেহাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই গৌরবময় দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি দেবেন, বঞ্চিত করবেন এবং তাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে এর জন্যে নির্বাচিত করবেন যারা এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে এবং এর মর্যাদা বুঝবে। এটা নিসন্দেহে এক ধরনের ভয়ানক ও মারাত্মক হুমকি যা আলােচ্য সূরার প্রেক্ষিতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং একই সাথে তৎকালীন মুসলিম সমাজের মুনাফিক ও ব্যধিগ্রস্থ লোকদের মানসিক অবস্থার জন্যে চিকিৎসা স্বরূপও। এটা ঠিক যে, অধিকাংশ মুসলমানের মাঝে ত্যাগ, আন্তরিকতা, বীরত্ব ও কোরবানীর গুণাবলী বিদ্যমান ছিলো যার প্রমাণ ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী। তবে মুসলিম সমাজ দুর্বল চিত্তের লোকদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে তাদেরকে জেহাদের জন্যে প্রস্তুত করছে।
*কাফেররা আল্লাহর কোনাে ক্ষতি করতে পারবে না : আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা কাফের এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে এবং নিজেদের জন্যে সৎপথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রসূল(স.)-এর বিরােধিতা করে, তারা আল্লাহর কোনােই ক্ষতি করতে পারবে না এবং তিনি তাদের কর্মসমূহকে ব্যর্থ করে দেবেন।'(আয়াত ৩২) এই আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে তা নিশ্চিত ও চূড়ান্ত। কাজেই যারা আল্লাহর দ্বীনকে অস্বীকার করেছে, সত্যের প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে, শক্তি প্রয়ােগ করে, অর্থের বিনিময়ে অথবা প্রতারণা করে অথবা অন্য যে কোনাে উপায়ে মানুষকে সং ও সঠিক পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে, যারা রসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় যুদ্ধ বিগ্রহ বাধিয়ে অথবা তার বিরুদ্ধাচরণ করে, তার শত্রুদের দলে ভিড়ে তাকে কষ্ট দিয়েছে অথবা তার মৃত্যুর পর তার প্রচারিত ধর্ম, শরীয়ত ও জীবনাদর্শের বিরােধিতা করেছে এবং তার আদর্শের অনুসারী ও প্রচারকদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে তারা আল্লাহর কোনােই ক্ষতি করতে পারবে না, বরং তাদেরই আমল বরবাদ হবে। কারণ, তাদের সামনে সত্য প্রকাশিত হয়েছিলাে এবং তারা এই সত্যকে চিনতে ও জানতে পেরেছিলাে। কিন্তু তারা নিজেদের খেয়াল খুশীর বশবর্তী হয়ে পড়ে, তাদেরকে গোয়ার্তুমিতে পেয়ে বসে, ব্যক্তিস্বার্থ তাদেরকে অন্ধ করে ফেলে এবং তারা নগদ সুযােগ সুবিধার পেছনে পড়ে যায়। যার ফলে সত্যকে গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় ন। এরা আল্লাহর কোনােই ক্ষতি করতে পারবে না, এটা অবধারিত সত্য এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও ঘােষণা। কারণ, সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর ক্ষতি করার মতাে শক্তি সামর্থ্য তাদের থাকবে তাে দূরের কথা, বরং তারা ক্ষতি করতে পারে, এমন কথা উল্লেখ করাও তাদের ক্ষেত্রে সাজে না। আসলে এখানে স্বয়ং আল্লাহর ক্ষতি সাধনের কথা বলা হয়নি, বরং আল্লাহর দ্বীনের ক্ষতি, আল্লাহর মনােনীত জীবনাদর্শের ক্ষতি এবং এর ধারক বাহক ও প্রচারকদের ক্ষতির কথাই বলা হয়েছে। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তারা কোনাে কোনাে মোমেন মুসলমানের ক্ষতি করতে পারলেও এর দ্বারা তারা আল্লাহর অমােঘ বিধান ও প্রাকৃতিক নিয়ম নীতির ক্ষেত্রে আদৌ কোনাে হেরফের বা পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। মুসলমানদের যে ক্ষতি তারা করে থাকে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে সাময়িক পরীক্ষাস্বরূপ। এর পেছনে আল্লাহর কোনাে উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। এটাকে কোনােভাবেই আল্লাহর অমােঘ বিধান, প্রাকৃতিক নিয়ম নীতি, তার মনােনীত জীবনাদর্শ এবং এই জীবনাদর্শের অনুসারী ও ধারক ও বাহকদের জন্যে প্রকৃত ক্ষতি বলে গণ্য হতে পারে না। কারণ, যারা এই ক্ষতি করতে আসবে তাদের অশুভ পরিণতি আল্লাহ তায়ালা নিজেই নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘তিনি অচিরেই তাদের কর্মসমূহকে ব্যর্থ করে দেবেন…’ কাজেই তাদের সকল চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এদের পরিণাম সেই গবাদি পশুর ন্যায় হবে যে পশু বিষাক্ত লতাপাতা খেয়ে উদরপূর্তি করে।

*মােমেনদের প্রতি কিছু নির্দেশনা : আল্লাহর দ্বীনের শত্রু, আল্লাহর রসূলের শত্রু এই কাফের গােষ্ঠীর ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করার পর এখন মােমেনদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হচ্ছে, তাদেরকে এই পরিণামের ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল(স.)-এর আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে লক্ষ্য করে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মােমেনরা, তােমরা আল্লাহর আনুগত্য করাে, রাসূল (স.)-এর আনুগত্য করাে এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করাে না।’ (আয়াত ৩৩) আলােচ্য আয়াতের বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, তৎকালীন সমাজে এমন কিছু মুসলমানের অস্তিত্বও ছিলাে যাদের মাঝে ইসলামের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের অভাব ছিলাে, অথবা যাদের জন্যে ইসলামের কোনাে কোনাে অনুশাসন কষ্টকর ছিলাে, অথবা জেহাদের জন্যে প্রয়ােজনীয় ত্যাগ স্বীকার করা কঠিন ছিলাে। বিশেষ করে সেই সব শক্তিধর ও আগ্রাসী জাতিগুলাের বিরুদ্ধে যারা ইসলামের পথে বাধার সৃষ্টি করতাে এবং সব দিক থেকে ইসলামকে কোনঠাসা করতে চেষ্টা করতাে। শুধু তাই নয়, বরং যাদের সাথে মুসলমানদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিলাে, স্বার্থ জড়িত ছিলাে যা চূড়ান্তভাবে ত্যাগ করা তাদের জন্যে কঠিন ছিলাে, অথচ ইসলামের দাবীই ছিলাে সেটা। যারা সত্যিকার অর্থে মুসলমান ছিলাে, তাদের অন্তরে এই নির্দেশ প্রচন্ড কম্পনের সৃষ্টি করে এবং অনেকেই নিজ নিজ আমল বরবাদ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাতর হয়ে পড়। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন নাসর আল মিরওয়াজী আবুল আলিয়ার বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর কোনাে কোনাে সাহাবীরা মনে করতেন যে, কালেমা পাঠ করার পর গােনাহ করলে কোনাে ক্ষতি হবে না এবং শিরক করার পর আমল করলে কোনাে লাভ হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতটি নাযিল করেন, ‘তােমরা আল্লাহর ও রসূলের আনুগত্য করাে এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করাে না … তখন তারা গােনাহের কারণে আমল বিনষ্ট হওয়ার ভয়ে কাতর হয়ে পড়লেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর(রা.) বর্ণনা করেন যে, আমরা সাহাবী সমাজ মনে করতাম যে, ভালাে কাজের সব কিছুই আল্লাহর কাছে গ্রহণযােগ্য। শেষে এই আয়াতটি নাযিল হয়, তােমরা আল্লাহর ও রসূলের আনুগত্য করাে এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করাে না। তখন আমরা বললাম, কোন জিনিস আমাদের আমলকে বিনষ্ট করতে পারে? আমরা নিজেরাই বললাম, কবীরা গােনাহ ও অশ্লীলতা তখন সূরা নেসার এই আয়াতটি নাযিল হয়, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তার সাথে শিরককে ক্ষমা করবেন না এবং এর বাইরে যা কিছু আছে তা যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।’ এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর আমরা আমাদের আগের মত ত্যাগ করলাম এবং কবীরা গােনাহ ও অশ্লীলতায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আশঙ্কা করতে লাগলাম এবং এর থেকে মুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আশা পােষণ করতে লাগলাম। এসব বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, নিখাদ ও নির্ভেজাল ঈমানের অধিকারী বান্দারা কোরআনের মর্মবাণীকে কি মন-মানসিকতা নিয়ে গ্রহণ করতাে। কোরআনের আয়াত তাদের হৃদয়ে কি চঞ্চলতা ও অস্থিরতার সৃষ্টি করতাে তাতে কি শিহরণ ও প্রকম্পনের সৃষ্টি হতাে। কিভাবে তারা নিজেদের জীবনকে কোরআনমুখী করার জন্যে সচেষ্ট থাকতাে এবং এর বিপরীতমুখিতা পরিহার করার জন্যে সদা সতর্ক থাকতাে। কোরআনের বাণী ও নির্দেশকে যারা এই পর্যায়ের মন মানসিকতা ও আবেগ অনুভূতি নিয়ে গ্রহণ করতাে তারাই ছিলাে খাঁটি ও নির্ভেজাল মুসলমান।

*কাফেরদের পরিণাম : পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সেই সকল লােকের পরিণতি সম্পর্কে আলােচনা করছেন যারা তার দ্বীনকে অস্বীকার করেছে, তার সত্য পথে বাধার সৃষ্টি করেছে, তার রসূলকে কষ্ট দিয়েছে, তার নির্দেশ অমান্য করেছে এবং এই অবস্থায়ই পৃথিবী হতে বে ঈমান ও কাফের হয়ে বিদায় নিয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা কাফের এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে, অতপর কাফের অবস্থায় মারা যায়, আল্লাহ তায়ালা কখনই তাদের ক্ষমা করবেন না।'(আয়াত ৩৪) অর্থাৎ ক্ষমার সুযােগ কেবল এই জাগতিক জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। যমদূত আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাওবার দরজা পাপীতাপী ও কাফের মােশরেক সবার জন্যে খোলা থাকবে। কিন্তু আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করতে যাবে তখন আর তাওবারও সুযােগ থাকবে না এবং ক্ষমারও সুযােগ থাকবে না। সুযােগ শেষ। এই সুযােগ আর ফিরে আসবে না। এ জাতীয় আয়াতের লক্ষ্য কাফের ও মােমেন সবাই। কাফেরদের ক্ষেত্রে হুশিয়ারবাণী হিসেবে বিবেচিত, যেন এর ফলে তারা নিজেদেরকে সংশােধন করে নেয় এবং তাওবা ও ক্ষমার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই তাওবা করে ফিরে আসে। অপরদিকে মােমেনদের ক্ষেত্রে এসব আয়াত সতর্কবাণী ও উপদেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, এর মাধ্যমে যেন তারা এমন সব ক্রিয়া কলাপ ও আচার আচরণ পরিহার করে চলতে পারে যা মানুষকে সে বিপদ সঙ্কুল ও অশুভ পথে নিয়ে যায়।
*বাতিলের সাথে আপােষ নয় : এই সত্যটি আমরা পরবর্তী আয়াতের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ও বিন্যাস থেকেই উপলব্ধি করতে পারি। পূর্ববর্তী আয়াতে কাফেরদের পরিণতির বিপরীতে পরবর্তী আয়াতে মুসলমানদেরকে হীনবল হয়ে সন্ধির আহ্বান জানাতে নিষেধ করা হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অতএব তােমরা হীনবল হয়াে না এবং সন্ধির আহ্বান জানিও না। তােমরাই হবে বিজয়ী। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই তােমাদের সাথে আছেন। তিনি কখনও তােমাদের কর্মফল বিনষ্ট করবেন না।'(আয়াত ৩৫) এটাই হচ্ছে মােমেনদের জন্যে সাবধানবাণী। এখানে তাদের সামনে রসূলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কাফেরদের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মােমেনরা যেন দূর থেকে এ দানবরূপী পরিণতিকে ভয় করে চলে। এই সাবধানবাণী ইংগিত বহন করে যে, তৎকালীন মুসলিম সমাজে এমন বেশ কিছু লোেকও ছিলাে যাদের জন্যে জেহাদের মতাে দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য দায়িত্ব ছিলাে একটা বােঝাস্বরূপ। এই বােঝা বহন করতে গিয়ে তারা হীনবল ও ধৈর্যহারা হয়ে পড়তো এবং যুদ্ধ বিগ্রহের কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে সন্ধি ও শান্তিচুক্তি করতে আগ্রহবােধ করতাে। তাছাড়া মােশরেকদের সাথে তাদের অনেকেরই আত্মীয়তার সম্পর্কসহ ব্যবসায়িক ও আর্থিক স্বার্থও জড়িত ছিলাে। এসব কারণে তারা সন্ধি ও শান্তিচুক্তির জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠতো। এটাই মানবিক দুর্বলতা। এই দুর্বলতা এবং স্বভাবজাত মনােবৃত্তি কাটিয়ে ওঠার জন্যে ইসলামী শিক্ষা মানুষকে সর্বতােভাবে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা অভাবনীয় সফলতা দেখাতে সক্ষমও হয়েছে। তা সত্তেও মাদানী যুগের সেই গোড়ার দিকে দুর্বলচিত্তের কিছু লােকের অস্তিত্ব থাকাটা বিচিত্র ছিলাে না। এসব আয়াত তাদেরকেই সংশােধন করার জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে। আর এই দুর্বল চিত্তের লােকদের সংশােধন পবিত্র কোরআন কিভাবে করে তা লক্ষণীয়। কোরআনের এ শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের মানবীয় দুর্বলতা সব যুগে একই ধরনের থাকে। আয়াতে বলা হয়েছে, তােমরাই বিজয়ী হবে, কাজেই হীনবল হয়ে সন্ধি ও শান্তিচুক্তির পেছনে পড়ো না। কারণ তােমরা ওদের তুলনায় জীবন বােধ, বিশ্বাস ও জীবন দর্শনের ক্ষেত্রে উন্নত, মহাশক্তির অধিকারী আল্লাহর সাথে যোগসূত্রের ক্ষেত্রেও তােমরা উন্নত। আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রেও তােমরা উন্নত। অর্থাৎ শক্তির দিক থেকে, অবস্থানের দিক থেকে এবং সাহায্য সহযােগিতার দিক থেকে তােমরাই উন্নত ও প্রবল। কারণ তােমাদের সাথে রয়েছেন মহা শক্তিধর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তােমরা একা নও। তােমরা রয়েছে সর্বশক্তিমান, মহাপরাক্রমশালী, ক্ষমতাধর সত্ত্বার তত্ত্বাবধানে। তিনিই তােমাদের সাহায্যকারী এবং তােমাদের সাথে সর্বদা বিচরণকারী। তিনিই তােমাদের রক্ষক ও সহায়ক। কাজেই যখন আল্লাহ তায়ালা নিজে তােমাদের সাথে রয়েছেন তখন তোমাদের শত্রুরা তােমাদের কি ক্ষতি করতে পারবে? তাছাড়া এই জেহাদের জন্যে তােমরা যা কিছু খরচ করছো, যে শ্রম দিচ্ছো এবং যে ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করছে এর সব কিছুই তােমাদের আমলনামায় লেখা হচ্ছে। এর একটিও বৃথা যাবে না। তাই বলা হয়েছে, “তিনি কখনও তােমাদের কর্ম হ্রাস করবেন না।’ অর্থাৎ তােমাদের কর্মের প্রতিদান, ফলাফল ও বিনিময় থেকে আল্লাহ তায়ালা বিন্দুমাত্র হ্রাস করবেন না। যার সম্বন্ধে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিচ্ছেন যে সে প্রবল, তার সাথে আল্লাহর সাহায্য সহযােগিতা রয়েছে, তার কোনাে কর্মই বৃথা যাবে না এবং সে সম্মানিত হবে, সমাদৃত হবে, সাহায্যপুষ্ট হবে এবং পুরস্কৃত হবে, তাহলে এমন ব্যক্তি কি কারণে হীনবল হবে এবং সন্ধি ও শান্তিচুক্তির জন্যে অধীর হয়ে পড়বে? এই হচ্ছে প্রথম মর্মবাণী ।

*দুনিয়ার জীবন : দ্বিতীয় মর্মবাণী হচ্ছে, এই পার্থিব জীবন তুচ্ছ ও নগণ্য। এই জীবনে মােমেন বান্দারা কখনও কখনও ত্যাগ ও কষ্টের শিকার হতে পারে। তবে পরকালে তাদেরকে এর বিনিময় পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হবে অথচ এই বিনিময় লাভের জন্যে তাদেরকে বড় অংকের অর্থ খরচ করতে হবে না। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পার্থিব জীবন তাে কেবল খেলাধূলা, যদি তােমরা বিশ্বাসী হও এবং সংযম অবলম্বন করাে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে তােমাদের প্রতিদান দেবেন এবং তিনি তােমাদের ধন সম্পদ চাইবেন না।'(আয়াত ৩৬) অর্থাৎ এই পার্থিব জীবনের পেছনে যদি কোনাে মহৎ ও স্থায়ী উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে এই জীবন নিছক খেলাধুলা ও রং তামাশায় পর্যবশিত হবে। আল্লাহর মনােনীত জীবন বিধান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই পার্থিব জীবন অতিবাহিত করলে তা খেল তামাশা ছাড়া আর কিছুই হবে না। কারণ সেই জীবন বিধানের ফলে পার্থিব জীবন পরকালের জন্যে শষ্যক্ষেত্রস্বরূপ বলে গণ্য হয়। যারা এই পার্থিব জগতে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে, তারাই পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে। আলােচ্য আয়াতে দ্বিতীয় অংশে সে কথাই বলা হয়েছে। যেমন, ‘তােমরা যদি বিশ্বাসী হও এবং সংযম অবলম্বন করাে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে তােমাদের প্রতিদান দেবেন।’ এর দ্বারা বুঝা গেলাে যে, ঈমান ও তাকওয়ার ফলেই পার্থিব জীবন খেল তামাশার পর্যায় থেকে বের হয়ে আসে এবং তাতে যথার্থতার গুণ সৃষ্টি হয় । এই ঈমান ও তাকওয়াই পার্থিব জীবনকে নিছক জৈবিক ভােগের স্তর থেকে তুলে নিয়ে খেলাফতে রাশেদার স্তরে নিয়ে পৌছিয়ে দেয়, যার সম্পর্ক হচ্ছে ঊর্ধলােকের সাথে। পার্থিব জীবন যখন এই স্তরে উন্নীত হয় তখন মােমেন মােত্তাকী বান্দা এই পৃথিবীর ধন সম্পদ থেকে যা কিছু খরচ করবে তা বৃথা যাবে না। বরং সেটাই হবে তার জন্যে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের পরম পাওনার উপায় । তা সত্তেও আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার গােটা ধন সম্পদ তাঁর রাস্তায় খরচ করার কথা বলেন না। এমন কোনাে দায় দায়িত্বও তাদের ওপর চাপিয়ে দেন না যা তাদের জন্যে দুঃসাধ্য। কারণ, তিনি মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতাগুলাে জানেন এবং সম্পদের প্রতি তাদের মনের দুর্বলতার কথাও জানেন। তাই তিনি সাধ্যের বাইরে কোনাে কিছু করার দায়িত্ব কাউকে দেন না। তিনি বান্দাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়েই তাদেরকে তাদের গােটা ধন সম্পদ খরচ করার নির্দেশ দেন না। তিনি জানেন যে, এরূপ নির্দেশ দেয়া হলে সেটা হবে তাদের জন্যে কঠিন এবং তা পালনে তারা কার্পণ্য দেখাবে। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি তােমাদের কাছে ধন সম্পদ চাইলে অতপর তোমাদেরকে অতিষ্ঠ করলে তােমরা কার্পণ্য করবে এবং তিনি তােমাদের মনের সংকীর্ণতা প্রকাশ করে দেবেন।'(আয়াত ৩৭) আলােচ্য আয়াতের বক্তব্যে যে বিষয়টি স্পষ্টরূপে বুঝা যাচ্ছে, তা হলাে মহাজ্ঞানী ও সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। তিনি যে বিধান তার বান্দাদের জন্যে মনােনীত করছেন তা তাদের স্বভাবের সাথে, তাদের প্রকৃতির সাথে, তাদের যােগ্যতার সাথে, তাদের সামর্থের সাথে এবং তাদের অবস্থার সাথে সম্পূর্ণরূপে সংগতিপূর্ণ। বস্তুত এই বিধান হচ্ছে একটি খােদায়ী ও মানবিক নীতির গােড়াপত্তন করা। এই নীতিটি খােদায়ী হবে এই কারণে যে, এর রূপকার হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। আর মানবিক হবে এই কারণে যে, এতে মানবীয় শক্তি সামর্থ্য এবং চাহিদা ও প্রয়ােজনের প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু নিজেই স্রষ্টা, কাজেই তিনি তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে পুরােপুরি অবহিত। তাছাড়া তিনি সৃক্ষদর্শী ও সর্বজ্ঞাতাও।
*আল্লাহর পথে ব্যয় : এর পরের আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার আহ্বানে সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মনােভাব কি ছিলাে, সে সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। সাথে সাথে ধন দৌলতের প্রতি মানবীয় দুর্বলতার চিকিৎসার জন্যে কোরআনের নিজস্ব পদ্ধতিও গ্রহণ করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছে জিহাদের প্রতি ঔদাসীন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে। যেমন আয়াতে বলা হয়েছে, ‘শোনে, তােমরাই তাে তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহ্বান জানানাে হচ্ছে, অতপর তােমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছো। যারা কৃপণতা করছে, তারা নিজেদের প্রতি কৃপণতা করছো। আল্লাহ তায়ালা অভাবমুক্ত এবং তােমরা অভাবগ্রস্ত। যদি তােমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তােমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তােমাদের মতাে হবে না।'(আয়াত ৩৮) আলোচ্য আয়াতে তৎকালীন মুসলিম সমাজের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ধন সম্পদ ব্যয় করার আহ্বানের প্রতি তারা কি ধরনের মনােভাবের পরিচয় দিতাে, সে কথাও বলা হয়েছে। এখানে কোরআন নিজেই ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তাদের কেউ কেউ কার্পণ্য দেখাতাে। এর দ্বারা একথাও বুঝা যায় যে, তাদের মাঝে এমন অনেকেই ছিলাে যারা আদৌ কোনাে কার্পণ্যের আশ্রয় নিতাে না। এটাই হচ্ছে তখনকার যুগের বাস্তবতা। বিভিন্ন সত্য ও নির্ভরযােগ্য বর্ণনায় তা জানা যায়। স্বয়ং কুরআন শরীফেই এ সম্পর্কে একাধিক জায়গায় আলোচনা করা হয়েছে। সেচ্ছায় ও সানন্দে আল্লাহর রাস্তায় দান ও ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত ইসলাম স্থাপন করেছে তা রীতিমতাে বিরল ও অভাবনীয়। কিন্তু তা সত্তেও সম্পদের বেলায় কার্পণ্য দেখানাের মতাে লােকের অস্তিত্ব থাকাটা অসম্ভব নয়। বরং অনেকের কাছে অর্থ বিসর্জনের চেয়ে প্রাণ বিসর্জন অনেক সহজ। সেই জাতীয় কার্পণ্যের চিকিৎসা করতে গিয়েই সম্ভবত আয়াতে বলা হয়েছে, যারা কৃপণতা করবে, তারা নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করবে। বলা বাহুল্য, মানুষ ইহজগতে আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করে তার জমার খাতায় তা সঞ্চয় হিসেবে থাকে; এই সঞ্চয় প্রয়ােজনের মুহূর্তে তার কাজে আসবে। সেই মুহুর্তটি যখন আসবে তখন তা শেষ সম্বল হিসেবে কাজে আসবে। কাজেই মানুষ যদি ইহজগতে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে গিয়ে কৃপণতা করে, তাহলে এই কৃপণতা প্রকৃতপক্ষে সে নিজের সাথেই করছে। কারণ, এর ফলে তার নিজ সঞ্চয়ের ঘাটতি দেখা দেবে, এই সম্পদ তার নিজের জন্যেই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং সে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করবে। একথা ঠিক যে, আল্লাহ তায়ালা যখন মানুষকে তার রাস্তায় খরচ করতে বলেন, তখন এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তাদের মঙ্গলই কামনা করে থাকেন, তাদের সচ্ছলতাই কামনা করেন এবং এই দলকে পরকালে তাদের জন্যে বিরাট সঞ্চয় হিসেবে রেখে দেন। এই দান থেকে তিনি নিজে কিছুই লাভ করেন না। কারণ, তিনি তাদের এই দানের আদৌ মুখাপেক্ষী নন। তাই বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন অভাবমুক্ত আর তােমরা হচ্ছে অভাবী’ কারণ তিনিই তােমাদেরকে ধন সম্পদ দান করেছেন এবং তিনিই তােমাদের দানকে তােমাদের জন্যে সঞ্চয় করে রেখে দেন। তিনি দুনিয়াতে তােমাদেরকে যা কিছু দান করেছেন সেগুলাে থেকেও তিনি বে নিয়ায এবং পরকালের জন্যে যা কিছু তােমাদের হিসেবে সঞ্চয় করে রাখেন, সেগুলাে থেকেও তিনি বে নিয়ায। এসবে তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। বরং উভয় জগতে ও উভয় অবস্থায় তােমরাই তার প্রতি মুখাপেক্ষী। পৃথিবীতে জীবিকার জন্যে তােমরা তার মুখাপেক্ষী। কারণ, তিনি জীবিকার ব্যবস্থা না করে দিলে তা যােগান দেয়ার মতাে ক্ষমতা ও শক্তি তােমাদের নেই। তেমনিভাবে পরকালেও তােমরা তার প্রতিদানের প্রতি মুখাপেক্ষী। কারণ তিনিই অনুগ্রহ করে তাোমাদেরকে প্রতিদান দেবেন। তােমাদের নিজের প্রয়ােজন মিটানাের মতাে ব্যবস্থাই যেখানে তােমাদের নেই, সেখানে পরকালের জন্যে অতিরিক্ত আর কী থাকবে? কাজেই সেখানে যা পাওয়া যাবে তা আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাহলে আর এই কার্পণ্য কেন? কেন এই হাত গুটিয়ে রাখা? তােমাদের নিজেদের হাতে যা কিছু আছে এবং তােমাদের দানের বিনিময় হিসেবে যা কিছু পাবে সবই তাে আল্লাহর দেয়া এবং তাঁরই অনুগ্রহ! এরপর শেষ কথাটি বলা হচ্ছে এবং সর্বশেষ একটি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর সেটি হলাে এই, ‘যদি তােমরা মুখ ফিরিয়ে নাও,তবে তিনি তােমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন’ কারণ আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীনের দাওয়াতের জন্যে তােমাদেরকে নির্বাচিত করেছিলেন। এটা তােমাদের প্রতি তার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ, সম্মান ও দান ব্যতীত আর কিছুই নয়। এখন তােমরা যদি নিজেদেরকে এই সম্মান ও অনুগ্রহের উপযুক্ত বলে প্রমাণ করতে সক্ষম না হও, এই মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট দায় দায়িত্ব পালনে সক্রিয় না হও এবং তােমাদেরকে যে সম্মান দান করা হয়েছে তার যথাযথ মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম না হও তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নেবেন এবং তােমাদের পরিবর্তে অন্য কোনাে জাতিকে এই সম্মানের জন্যে মনােনীত করবেন যারা এর মর্যাদা বুঝে ও কদর করে। আলােচ্য আয়াতের এই বক্তব্যের মাঝে এক ধরনের সতর্কবাণী লুকিয়ে আছে। এটা কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা ঈমানের স্বাদ পেয়েছে, যারা আল্লাহর কাছে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন, যারা এই জগতের বুকে আল্লাহর আমানতের বাহক হিসেবে নিজেদের মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন, যারা নিজেদের অন্তরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে ধারণ করে পৃথিবীতে বিচরণ করে, যাদের অস্তিত্বে আল্লাহর নূর উদ্ভাসিত হয়ে আছে এবং যারা নিজ প্রভুর দেয়া গুণ বৈশিষ্ট ধারণ করে চলাফেরা করে। যে মানুষ একবার ঈমানের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছে, যে মানুষ অন্তরে ঈমানের এই তাৎপর্যকে ধারণ করে জীবন পরিচালনা করেছে, তার কাছ থেকে যদি এই ঈমানকে ছিনিয়ে নেয়া হয় তাকে যদি আল্লাহর দরবার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, তার মুখের সামনে যদি আল্লাহর সকল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে তার জন্যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়বে, জীবনের আনন্দই সে হারিয়ে ফেলবে। বরং এ জীবন বিশেষ করে তাদের জন্যে এক অসহনীয় নরক হয়ে দাঁড়াবে যারা একবার আল্লাহর নৈকট্য লাভের পর তা বিচ্ছেদের শিকার হয়েছে। এটা সন্দেহাতীত সত্য যে, ঈমান হচ্ছে একটা বড় নেয়ামত। দুনিয়াতে কোনাে কিছুই এর সমতুল্য হতে পারে না। অপরদিকে জীবন হচ্ছে খুব তুচ্ছ ও নগণ্য। তেমনিভাবে ধন সম্পদও হচ্ছে অতি নগণ্য ও তুচ্ছ। তাই ঈমানকে যদি এক পাল্লায় রাখা হয়, আর অপর পাল্লায় রাখা হয় অন্য সব কিছু তাহলে ঈমানের পাল্লাই ভারী থাকবে। কাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন মােমেনের জন্যে এটা একটা গুরুতর সতর্কবাণীই বটে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# পৃথিবীতে তারা এ কর্মপন্থা অবলম্বন করেছে এজন্য যাতে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে এবং কুফর ও ইসলামের যুদ্ধের বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর পরে আল্লাহর পাকড়াও থেকে কোথায় গিয়ে রক্ষা পাবে? সে সময় তাদের কোন কৌশলই তাদেরকে ফেরেশতাদের মারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

যেসব আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে ‘বরযখ’ অর্থাৎ কবরের আযাব প্রমাণিত হয় এটি তার একটি। এ আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মৃত্যুর সময় থেকেই কাফের ও মুনাফিকদের আযাব শুরু হয়ে যায়। কিয়ামতে তাদের মোকাদ্দমার ফয়সালা হওয়ার পর যে শাস্তি দেয়া হবে এ আযাব তা থেকে ভিন্ন জিনিস। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নিসা, আয়াত ৯৭ ; আল আন’আম, ৯৩, ৯৪ ; আল আনফাল ৫০ ; আন নাহল ২৮ , ৩২ , আল মু’মিনূন, ৯৯ , ১০০ ; ইয়াসীন ২৬, ২৭ ; টীকা ২২ ও ২৩ ; মুহাম্মাদ ২৭ , টীকা ৩৭ )।
# কাজ-কর্ম সেসব কাজ যা তারা মুসলমান সেজে করেছে। তাদের নামায, রোযা, যাকাত, মোটকথা সেসব ইবাদাত-বন্দেগী ও নেকীর কাজসমূহ যা বাহ্যিকভাবে নেকীর কাজ বলে গণ্য হতো। এসব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে তারা মুসলমান হয়েও আল্লাহ, তার দ্বীন এবং ইসলামী মিল্লাতের সাথে আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার আচরণ করেনি বরং শুধু নিজের পার্থিব স্বার্থের জন্য দ্বীনের দুশমনদের সাথে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদের সুযোগ আসা মাত্রই নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কুফর ও ইসলামের যুদ্ধে যে ব্যক্তির সমবেদনা ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে নয়। কিংবা কুফরী ব্যবস্থা ও কাফেরদের পক্ষে আল্লাহর কাছে তার কোন আমল গ্রহণযোগ্য হওয়া তো দূরের কথা তার ঈমানই আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
# এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হলো, নিজেদের বিবেচনায় তারা যেসব কাজ-কর্মকে নেকীর কাজ মনে করে আঞ্জাম দিয়েছে আল্লাহ তা সবই ধ্বংস করে দিবেন এবং তার জন্য তারা আখেরাতেও কোন পারিশ্রমিক পাবে না। অন্য অর্থটি হচ্ছে তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দ্বীনের পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করেছে তা সবই ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে যাবে।
# অন্য কথায় আমলসমূহের কল্যাণকর ও ফলপ্রসূ হওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে আল্লাহ‌ এবং তাঁর রসূলের আনুগত্যের ওপর। আনুগত্য থেকে ফিরে যাওয়ার পর কোন আমলই আর নেক আমল থাকে না। তাই এ ধরনের ব্যক্তি সে আমলের জন্য প্রতিদানের উপযুক্তও হতে পারে না।
# এখানে এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে, এমন এক সময় একথাটি বলা হয়েছিল, যখন মদীনার ক্ষুদ্র জনপদে মুহাজির ও আনসারদের একটি ক্ষুদ্র দল ইসলামের পতাকা বহন করেছিলো। তাদেরকে শুধু কুরাইশদের মত শক্তশালী গোত্রের মোকাবিলা করতে হচ্ছিলো না বরং গোটা আরবের ও মুশরিকদের মোকাবিলা করতে হচ্ছিলো। এমন এক পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছে সাহস হারিয়ে এ দুশমনদের সন্ধির আহবান জানাবে না, বরং জীবন বাজি রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। মুসলমনারা কোন সময়ই সন্ধির জন্য আলোচনা করবে না এ কথার অর্থ তা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে সন্ধির আলোচনা করা ঠিক নয় যখন তার অর্থ দাঁড়াবে নিজেদের দূর্বলতা প্রকাশ করা এবং তাতে শত্রু আরো দুঃসাহসী হয়ে উঠবে। মুসলমানদের উচিত প্রথমে নিজেদের শক্তিমত্তা দেখিয়ে দেয়া। এরপর সন্ধির জন্য আলোচনা করলে কোন ক্ষতি নেই।
# আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার অবস্থা কয়েকদিনের মন ভুলানোর চেয়ে অধিক কিছু নয়। এখানকার সফলতা ও বিফলতা সত্যিকার ও স্থায়ী কোন কিছু নয় যা গুরুত্বের দাবী রাখে। প্রকৃত জীবন হচ্ছে আখেরাতের জীবন। সে জীবনের সফলতার জন্য মানুষের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। (অধিক জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আনকাবুত, টীকা ১০২)।
# তিনি অভাব শূন্য। তাঁর নিজের জন্য তোমাদের থেকে নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি যিনি তোমাদেরকে তার পথে কিছু ব্যয় করতে বলেন, তা নিজের জন্য বলেন না, বরং তোমাদেরই কল্যাণের জন্য বলেন।
# তিনি তোমাদেরকে এত বড় পরীক্ষায় ফেলেন না যা থেকে তোমাদের দূর্বলতাই শুধু প্রকাশ পেতো।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
আয়াত ২৭-২৮ নং আয়াতে তাপসীর:-
(فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَا۬ئِكَةُ)

‘ফেরেশতারা যখন তাদের রূহ কবয করে মুখ ও পিঠে মারতে মারতে তাদেরকে নিয়ে যাবে তখন তাদের কেমন দশা হবে?’ এখানে কাফিরদের সে সময়কার অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে, যখন ফেরেশতারা তাদের আত্মা বের করবেন। মৃত্যুর সময় কাফির ও মুনাফিকদের আত্মা ফেরেশতার হাত থেকে বাঁচার জন্য দেহের মধ্যে লুকোচুরি করতে থাকে এবং এদিক-ওদিক পালাবার চেষ্টা করে। সে সময় ফেরেশতাগণ তা কঠোরভাবে ধরে সজোরে টানেন এবং মুখে ও পিঠে আঘাত করতে থাকেন। এ সম্পর্কে সূরা আনআমের ১৯৩ নং ও সূরা আনফালের ৫০ নং আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

মৃত্যুকালীন কাফিরদের কঠিন অবস্থার কথা জানতে পারলাম।
২৯-৩১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

أَضْغَانَهُمْ শব্দটি ضغن এর বহুবচন। যার অর্থ হিংসা ও বিদ্বেষ। মুনাফিকরা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করত এবং বাহ্যতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করত, কিন্তু অন্তরে শত্র“তা ও বিদ্বেষ পোষণ করত। আলোচ্য আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলাকে আলিমুল গায়িব জানা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে এমন নিশ্চিত যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরের গোপন ভেদ ও বিদ্বেষ মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেবেন না। বরং তাদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে হিংসা-বিদ্বেষ ছিল আল্লাহ তা‘আলা তা প্রকাশ করে দেবেন, সে কথাই এখানে বলা হয়েছে।

(فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيمَاهُمْ)

‘যাতে তুমি তাদের চেহারা দেখেই চিনে নিতে পার’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে কারা কারা মুনাফিক তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তা দেখিয়ে দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে তাদের বাহ্যিক আলামত ও কথাবার্তা দ্বারা চিনতে পারতেন।

আল্লাহ তা‘আলা তা করেননি; কারণ তিনি মানুষের বাহ্যিক অবস্থার ভিত্তিতে বিচার করেন এবং গোপনীয় বিষয়গুলো নিজের দিকে ফিরিয়ে নেন।

(وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتّٰي نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ)

‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব’ এ আয়াতের অনুরূপ তাফসীর সূরা বাকারার ২১৪, তাওবার ১১, আনকাবূতের ২-৩ আয়াতে এবং আলি ইমরানে গত হয়েছে।

৩২-৩৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যারা নিজেরা কুফরী করে, মানুষকে ইসলাম গ্রহণে বাধা দেয় এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরম বিরোধিতা করে – তারা (১) কুফরীর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (২) কুফরীর কারণে তাদের সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যাবে। (৩) তারা কুফরী অবস্থায় মারা যাবে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন না। বরং তারা হবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এ আয়াত সেসব মুনাফিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে যারা বদর যুদ্ধের সময় কুরাইশ কাফিরদেরকে সাহায্য করেছে এবং তাদের বারজন লোক সমগ্র কুরাইশ বাহিনীর পানাহারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। প্রত্যহ একজন লোক গোটা কাফির বাহিনীর পানাহারের ব্যবস্থা করত।

(وَسَيُحْبِطُ أَعْمَالَهُمْ)

‘আল্লাহই তাদের সব আমল বরবাদ করে দেবেন’ এখানে আমল বরবাদ করে দেয়ার দুটি অর্থ হতে পারে : (১) ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেবেন না। বরং ব্যর্থ করে দেবেন। (২) কুফর ও নিফাকের কারণে তাদের সৎ কর্মের প্রতিদান বরবাদ করে দেবেন।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে একনিষ্ঠ হতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর তাদের আনুগত্যের সীমারেখা থেকে বের হয়ে নিজেদের আমলসমূহ বাতিল করতে নিষেধ করেছেন। সূরা আলি ইমরানে রাসূলের আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

(فَلَا تَهِنُوْا وَتَدْعُوْا إِلَي السَّلْمِ)

‘অতএব তোমরা হীনতা স্বীকার করে সন্ধির প্রস্তাব দিও না’ অর্থাৎ শত্র“দের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে নিজেরা হীনবল হয়ো না, ফলে তোমাদের ওপর ভয় নেমে আসবে। বরং ধৈর্য ধারণ কর ও নিজেদেরকে জিহাদের মাঠে অটল রাখ। আর জিহাদ বর্জন করার জন্য ও নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য সন্ধির প্রস্তাব করো না। কারণ তোমাদের সাথে আল্লাহ তা‘আলা আছেন, তোমরা বিজয়ী হবেই। এ আয়াতে কাফিরদেরকে সন্ধির দিকে আহ্বান জানাতে নিষেধ করা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَإِنْ جَنَحُوْا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَي اللّٰهِ ط إِنَّه۫ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‏)‏

“তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করবে; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা আনফাল ৮ : ৬১) এ আয়াত থেকে সন্ধি করার অনুমতি বুঝা যায়। এ কারণে কেউ কেউ বলেন : অনুমতির আয়াতের অর্থ হল কাফিরদের পক্ষ থেকে সন্ধির প্রস্তাব হলে তোমরা সন্ধি করতে পার। আর নিষেধাজ্ঞার আয়াতের অর্থ হল তোমরা প্রথমে সন্ধির প্রস্তাব দেবে না। তবে সঠিক কথা হল মুসলিমরাও প্রথমে সন্ধির প্রস্তাব করতে পারবে যদি তাতে নিজেদের কল্যাণ দেখে এবং নিজেদের মধ্যে কাপুরুষতা ও দুনিয়াপ্রিয়তা প্রবেশ না করে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুফরী করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে বাধা দেয়া এবং রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করার পরিণাম জাহান্নাম।
২. সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য ওয়াজিব। মাযহাবী গোঁড়ামী করে রাসূলের সুন্নাত বর্জন করা ঠিক নয়।
৩৬-৩৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে মানুষকে তার প্রতি নিরুৎসাহিত করে বলেন : দুনিয়ার জীবন তো একটি ধোঁকা ও প্রতারণা মাত্র। এ জীবনের কোন ভিত্তি নেই। মানুষ সম্পদ, সন্তান, দুনিয়ার চাকচিক্য, নারী, ভোজন বিলাসিতা, চোখ জোড়ানো অট্টালিকা ইত্যাদি নিয়ে মত্ত ও তার ভালবাসায় নিমগ্ন। আর এমন কাজ-কর্মে লিপ্ত হওয়া কোন উপকারে আসে না বরং আল্লাহ তা‘আলা থেকে গাফেল করে রাখে। এমনিভাবে তার জীবনের আয়ূ শেষ হয়ে যায়, মৃত্যু চলে আসে কিন্তু তাকে দুনিয়াতে প্রেরণ করার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কিছুই করেনি। ফলে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন : ‏ “তোমরা জেনে রেখ, দুনিয়ার জীবন তো খেল-তামাশা, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহঙ্কার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়; এর উপমা বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, অতঃপর ওটা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি ওটা হলুদ বর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড় কুটোয় পরিণত হয়। আখিরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। দুনিয়ার জীবন ছলনাময় ধোঁকা ব্যতীত কিছুই নয়।” (সূরা হাদীদ ৫৭ : ২০)

(وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا)

‘যদি তোমরা ঈমান আন এবং তাকওয়ার জীবন যাপন কর’ তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমলের প্রতিদান দেবেন।

ঈমান ও তাকওয়ার ফযীলত সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللہَ وَاٰمِنُوْا بِرَسُوْلِھ۪ یُؤْتِکُمْ کِفْلَیْنِ مِنْ رَّحْمَتِھ۪ وَیَجْعَلْ لَّکُمْ نُوْرًا تَمْشُوْنَ بِھ۪ وَیَغْفِرْ لَکُمْﺚ وَاللہُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ)‏

“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন আলো, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা হাদীদ ৫৭ : ২৮)

(وَلَا يَسْأَلْكُمْ أَمْوَالَكُمْ)

‘আর তিনি তোমাদের কাছ থেকে তোমাদের ধন-সম্পদ চাইবেন না’ অর্থাৎ তিনি তোমাদের ধন-সম্পদের মুখাপেক্ষী নন। আর এ জন্যই তিনি তোমাদের নিকট সমস্ত সম্পদ চাননি। বরং তা থেকে অতি সামান্যতম অংশ চান। আবার তাও এক বছর পূর্ণ হবার পর প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে। তার প্রতিদানও তোমাদেরকে দেবেন। যদি তোমাদের প্রয়োজনের অধিক অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদ চাইতেন তাহলে তোমরা কার্পণ্য করতে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নিজেদের বিদ্বেষ ও শত্র“তা প্রকাশ করতে।

(تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ)

‘তোমাদেরকে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহর পথে মাল খরচ কর’ অর্থাৎ যখন যাকাত হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করতে বলা হয় তখন একশ্রেণির লোকেরা কার্পণ্য করে। যারা কার্পণ্য করে তারা মূলত নিজেদেরকে পূণ্য থেকে বঞ্চিত করল। আল্লাহ তা‘আলা ব্যয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান করার অর্থ এই নয় যে, তিনি তোমাদের সম্পদের মুখাপেক্ষী। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন কারণ-

১. তোমাদের আত্মা ও সম্পদকে পবিত্র করার জন্য।
২. অভাবীদের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য।
৩. তোমরা যাতে শত্র“দের ওপর বিজয়ী ও উন্নত থাক।

(وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا)

‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে রাখ তাহলে আল্লাহ তোমাদের বদলে অন্য কাওমকে নিয়ে আসবেন’ আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। সাহাবীরা বলল : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা ঈমান থেকে বিমুখ হলে যে অন্য জাতিকে নিয়ে আসা হবে তারা কারা যারা আমাদের মত হবে না? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালমান ফারসীর কাঁধে হাত মেরে বললেন : তারা হল এ (সালমান) ও তাঁর সম্প্রদায় যদি দীন সুরাইয়া নামক তারকাতেও থাকে তাহলে ফারসীর ঐসব লোকেরা তা নিয়ে আসবে। অন্য বর্ণনাতে রয়েছে ঐ সকল লোকেরা নিয়ে আসবে। (তিরমিযী হা. ৩২৬১, সহীহ)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. দুনিয়ার জীবন হল অস্থায়ী, তাই তার পিছনে মত্ত হয়ে আখিরাতকে ভুলে যাওয়া যাবে না।
২. সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কার্পণ্য করা হারাম।
৩. যাকাত না দেয়ার পরিণাম নিজের ওপরেই বর্তাবে।
৪. সালমান ফারসী (রাঃ)-এর ফযীলত জানতে পারলাম।
৫. আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আয়াত ২৭ থেকে ২৮ পর্যন্ত:-
প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “ফেরেশতারা যখন তাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের দশা কেমন হবে!” যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তুমি দেখতে, যখন কাফিরদের প্রাণ হরণ করার সময় ফেরেশতারা তাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত ও প্রহার করবে!”(৮:৫০) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তুমি দেখতে, যখন যালিমরা মৃত্যু যাতনায় থাকবে এবং ফেরেশতারা তাদের হস্তগুলো (তাদেরকে মারার জন্যে) প্রসারিত করবে এবং বলবে- বের কর স্বীয় আত্মা। আজ তোমাদেরকে দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি, কারণ তোমরা আল্লাহর উপর অন্যায় কথা বলতে এবং তার নিদর্শনাবলী হতে গর্বভরে মুখ ফিরিয়ে নিতে ।”(৬:৯৩) এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে (আরবী) বলেনঃ “এটা এই জন্যে যে, যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় তারা তার অনুসরণ করে এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের প্রয়াসকে অপ্রিয় গণ্য করে। তিনি এদের কর্ম নিষ্ফল করে দেন।”
২৯-৩১ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ মুনাফিকদের ধারণা এই যে, আল্লাহ পাক তাদের অভিসন্ধি, ষড়যন্ত্র এবং প্রতারণার কথা মুসলমানদের নিকট প্রকাশ করবেন না। কিন্তু তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহ তাআলা তাদের ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা এমনভাবে প্রকাশ করবেন যে, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি ওগুলো জানতে পারবে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ দুক্রিয়া হতে তারা বেঁচে থাকবে। তাদের বহু কিছু অবস্থার কথা সূরায়ে বারাআতে বর্ণিত হয়েছে এবং সেখানে তাদের কপটতাপূর্ণ বহু অভ্যাসের উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি এই সূরার অপর নাম ফাযেহা’ বা অপমানকারী রেখে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এটা হলো মুনাফিকদেরকে অপমানকারী সূরা ।

(আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দের বহুবচন। (আরবী) বলা হয় হিংসা ও শক্রতাকে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি ইচ্ছা করলে তোমাকে (নবী সঃ-কে) তাদের (মুনাফিকদের) পরিচয় দিতাম। তখন তুমি খোলাখুলিভাবে তাদেরকে জেনে নিতে। কিন্তু আমি এরূপ করিনি। সমস্ত মুনাফিকের পরিচয় আমি প্রদান করিনি, যাতে মাখলুকের উপর তাদের পর্দা পড়ে থাকে। মানুষের কাছে যেন তাদের দোষ ঢাকা থাকে। প্রত্যেকের নিকট যেন তারা লাঞ্ছিত রূপে ধরা না পড়ে। ইসলামী বিষয়গুলো বাহ্যিকতার উপরই বিচার্য। আভ্যন্তরীণ বিষয়ের হিসাব রয়েছে মহান আল্লাহর কাছে। তিনি প্রকাশ্য ও গোপনীয় সবকিছুই জানেন। তবে মুনাফিকদেরকে তাদের কথা বলার ধরন দেখে চেনা যাবে।

আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি মনের মধ্যে কোন কিছু গোপন রাখে, আল্লাহ তা’আলা তার মুখমণ্ডলে ও কথায় তা প্রকাশ করে দেন। অর্থাৎ তার চেহারায় ও কথাবার্তায় তা প্রকাশ পেয়ে যায়।”

হাদীসে এসেছেঃ “যে ব্যক্তি কোন রহস্য গোপন রাখে, আল্লাহ তা’আলা তা প্রকাশ করে দেন, ভাল হলে ভাল এবং মন্দ হলে মন্দ।” মানুষের কাজে, কথায় ও বিশ্বাসে যে কপটতা প্রকাশ পায় তা আমরা সহীহ বুখারীর শরাহর প্রারম্ভে পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। হাদীসে মুনাফিকদের একটি দলকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। হযরত উকবা ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদের মধ্যে ভাষণ দান করেন। আল্লাহ তাআলার হামদ ও সানার পর তিনি বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে কতক লোক মুনাফিক রয়েছে। আমি যাদের নাম নিবো তারা যেন দাঁড়িয়ে যায়।” অতঃপর তিনি বলেনঃ “হে অমুক ব্যক্তি! তুমি দাঁড়াও, হে অমুক লোক! তুমি দাঁড়িয়ে যাও।” শেষ পর্যন্ত তিনি ছত্রিশটি লোকের নাম নিলেন। তারপর বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে অথবা তোমাদের মধ্য হতে কতক মুনাফিক রয়েছে, সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।” এরপরে এই লোকদের মধ্যে একজনের সামনে দিয়ে হযরত উমার (রাঃ) গমন করেন। ঐ সময় লোকটি কাপড় দিয়ে তার মুখ ঢেকে রেখেছিল। হযরত উমার (রাঃ) লোকটিকে খুব ভালরূপে চিনতেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ব্যাপার কি?” উত্তরে সে উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করলো। তখন হযরত উমার (রাঃ) তাকে বললেনঃ “সারা দিন তোমার জন্যে দুর্ভোগ (অর্থাৎ তুমি ধ্বংস হও)।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ আমি হুকুম আহকাম দিয়ে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পরীক্ষা করবো এবং এভাবে জেনে নিবো যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর পথে জিহাদকারী কারা এবং ধৈর্যশীল কারা? আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করতে চাই।

সমস্ত মুসলমান তো এটা জানে যে, অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা আল্লাহ প্রত্যেক জিনিস এবং প্রত্যেক মানুষ ও তার আমল প্রকাশিত হবার পূর্বেই ওগুলো সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তাহলে এখানে তিনি জেনে নিবেন’ এর ভাবার্থ হলোঃ তিনি তা দুনিয়ার সামনে খুলে দিবেন এবং ঐ অবস্থা দেখবেন ও দেখাবেন। এজন্যেই হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এরূপ স্থলে -এর অর্থ করতেন অর্থাৎ যাতে আমি দেখে নিই।
৩২-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, যারা কুফরী করে, মানুষকে আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে এবং নিজেদের নিকট পথের দিশা ব্যক্ত হবার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিরোধিতা করে, তারা আল্লাহ তাআলার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করছে। কাল কিয়ামতের দিন তারা হবে শূন্যহস্ত, একটিও পুণ্য তাদের কাছে থাকবে না। যেমন পুণ্য পাপকে সরিয়ে দেয়, অনুরূপভাবে তাদের পাপকর্ম পুণ্যকর্মগুলোকে বিনষ্ট করে দিবে।

ইমাম আহমাদ ইবনে নসর আল মারূযী (রঃ) কিতাবুস সলাত’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেনঃ সাহাবীদের (রাঃ) ধারণা ছিল যে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাথে কোন গুনাহ ক্ষতিকারক নয় যেমন শিরকের সাথে কোন পুণ্য উপকারী। নয়। তখন (আরবী)-এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। এতে সাহাবীগণ (রাঃ) ভীত হয়ে পড়েন যে, না জানি হয় তো পাপকর্ম পুণ্যকর্মকে বিনষ্ট করে ফেলবে।

অন্য সনদে বর্ণিত আছেঃ সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর ধারণা ছিল যে, প্রত্যেক পুণ্যকর্ম নিশ্চিতরূপে গৃহীত হয়ে থাকে। অবশেষে যখন (আরবী)-এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন তারা বলেনঃ “আমাদের পূণ্যকর্ম বিনষ্টকারী হচ্ছে গুনাহ কবীরা ও পাপকর্ম।” তখন আল্লাহ তা’আলা (আরবী) (৪:১১৬)-এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। সাহাবীগণ তখন এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হতে বিরত থাকেন এবং যারা কবীরা গুনাহতে লিপ্ত থাকে তাদের সম্পর্কে তাদের ভয় থাকতো। আর যারা এর থেকে বেঁচে থাকেন তাঁদের ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন আশাবাদী।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তার ঈমানদার বান্দাদেরকে তাঁর এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যের নির্দেশ দিচ্ছেন যা তাদের জন্যে দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্যের জিনিস। অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ যারা কুফরী করে ও আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে, তারপর কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করলে তিনি এ পাপ কখনো ক্ষমা করবেন না এবং এ পাপ ছাড়া অন্য পাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।”(৪:১১৬)।

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় মুমিন বান্দাদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুকাবিলায় হীনবল হয়ো না ও কাপুরুষতা প্রদর্শন করো না এবং তাদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করো না। তোমরা তো প্রবল। আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো ক্ষুন্ন করবেন না।” তবে হ্যা, কাফিররা যখন শক্তিতে, সংখ্যায় ও অস্ত্রে-শস্ত্রে প্রবল হবে তখন যদি মুসলমানদের নেতা সন্ধি করার মধ্যেই কল্যাণ বুঝতে পারেন তবে এমতাবস্থায় কাফিরদের নিকট সন্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করা জায়েয। যেমন হুদায়বিয়াতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) করেছিলেন। যখন মুশরিকরা সাহাবীবর্গসহ তাকে মক্কায় প্রবেশে বাধা দেয় তখন তিনি তাদের সাথে দশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ রাখার ও সন্ধি প্রতিষ্ঠিত রাখার চুক্তি করেন।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ মুমিনদেরকে বড় সুসংবাদ শুনাচ্ছেনঃ আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন, সুতরাং সাহায্য ও বিজয় তোমাদেরই জন্যে। তোমরা এটা বিশ্বাস রাখো যে, তোমাদের ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম পুণ্যকর্মও বিনষ্ট করা হবে , বরং ওর পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে প্রদান করা হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৩৬-৩৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার তুচ্ছতা, হীনতা ও স্বল্পতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ও খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়, তবে যে কাজ আল্লাহর জন্যে করা হয় তা-ই শুধু বাকী থাকে।

আল্লাহ তা’আলা যে বান্দার মোটেই মুখাপেক্ষী নন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেনঃ তোমাদের ভাল কর্মের সুফল তোমরাই লাভ করবে, তিনি তোমাদের ধন-মালের প্রত্যাশী নন। তিনি তোমাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন এই কারণে যে, যাতে ওর মাধ্যমে গরীব-দুঃখীরা লালিত-পালিত হতে পারে। আর এর মাধ্যমে তোমরাও যাতে পরকালের পুণ্য সঞ্চয় করতে পার।

এরপর মহান আল্লাহ মানুষের কার্পণ্য এবং কার্পণ্যের পর অন্তরের হিংসা প্রকাশিত হওয়ার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ ধন-সম্পদ বের করার ব্যাপারে এটা তো হয়েই থাকে যে, ওটা মানুষের নিকট খুবই প্রিয় হয় এবং তা বের করতে তার কাছে খুবই কঠিন ঠেকে।

অতঃপর কৃপণদের কার্পণ্যের কুফল বর্ণনা করা হচ্ছে যে, আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ খরচ করা হতে বিরত থাকলে প্রকৃতপক্ষে নিজেরই ক্ষতি সাধন করা হয়। কেননা, যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে, এই কৃপণতার শাস্তি তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। আর দান-খয়রাতের ফযীলত এবং ওর পুরস্কার হতেও তারা বঞ্চিত থাকবে। আল্লাহ তা’আলা সম্পূর্ণরূপে অভাবমুক্ত এবং মানুষ অভাবগ্রস্ত আর তারা তাঁর চরম মুখাপেক্ষী। অভাবমুক্ত ও অমুখাপেক্ষী হওয়া আল্লাহ তা’আলার অপরিহার্য গুণ এবং অভাবগ্রস্ত ও মুখাপেক্ষী হওয়া মাখলুক বা সৃষ্টজীবের অপরিহার্য গুণ। ঐ গুণ আল্লাহ তা’আলা হতে কখনো পৃথক হবে না এবং এই গুণ মাখলূক হতে কখনো পৃথক হবে না।

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ তোমরা যদি শরীয়ত মেনে চলতে অস্বীকার কর তবে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে আনয়ন করবেন, যারা তোমাদের মত (অবাধ্য) হবে না। তারা শরীয়তকে পূর্ণভাবে মেনে চলবে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা (আরবী) -এই আয়াতটি পাঠ করেন, তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যাদেরকে আমাদের স্থলবর্তী করা হতো তারা কোন জাতি হতো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত সালমান ফারেসীর (রাঃ) স্কন্ধে হস্ত রেখে বলেনঃ “এ ব্যক্তি এবং এর কওম। দ্বীন যদি সুরাইয়ার (সপ্তর্ষিমণ্ডলস্থ নক্ষত্রের) নিকটেও থাকতো তবুও পারস্যের লোকেরা ওটা নিয়ে আসতো।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) ও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন খালিদ যনজী নামক এর একজন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে কোন কোন ইমাম কিছু সমালোচনা করেছেন)

Leave a Reply