Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৪৯/এবং কাফের-রা বলে -১৫)
[*”আল-ওয়াক্বিয়া”যখন সেই মহা ঘটনা সংঘটিত হবে:-
*যারা ছিলেন ঈমান গ্রহণ করার ব্যাপারে অগ্রবর্তী এবং যাবতীয় নেকীর কাজে আগে বেড়ে অংশ গ্রহণকারী:-
*বাম দল এর অবস্থা:-
*তাদের স্ত্রীদেরা প্রেমময়ী ও সমবয়স্কা:-
*তারা বলত, ‘মরে অস্থি ও মাটিতে পরিণত হলেও কি আমাদেরকে উঠানো হবে? :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৬:”আল-ওয়াক্বিয়া”
পাহরা:২৭
১- ৫৬ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ইবনে কাছীর।
২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন।
৩) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন।
# ১-১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:- ইবনে কাছীর:-
**হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, একদা হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি তো বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যাঁ, আমাকে সূরায়ে হূদ, সূরায়ে ওয়াকিআহ, সূরায়ে মুরসালাত, সূরায়ে আম্মা ইয়াতাসাআলুন এবং সূরায়ে ইশ শামসু কুওভিরাত বৃদ্ধ করে ফেলেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)
হযরত আবু যাবিরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ রোগাক্রান্ত হন, যে রোগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তাঁর ঐ রোগের সময় হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) তাঁকে দেখতে যান। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনার অভিযোগ কি?” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “আমার পাপরাশি।” হযরত উসমান আবার প্রশ্ন করেনঃ “আপনার আকাক্ষা কি?” তিনি জবাব দেনঃ “আমার প্রতিপালকের রহমত।” হযরত উসমান (রাঃ) প্রশ্ন করেনঃ “কোন ডাক্তারকে পাঠিয়ে দেবো কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “ডাক্তারই তো আমাকে রোগাক্রান্ত করেছেন?” হযরত উসমান (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “আপনার জন্যে কিছু মাল পাঠাবার নির্দেশ দিবো কি?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “আমার মালের কোন প্রয়োজন নেই।” হযরত উসমান (রাঃ) বলেনঃ “আপনার পরে আপনার সন্তানদের কাজে লাগবে?” তিনি বললেনঃ “আমার সন্তানরা দরিদ্র হয়ে পড়বে আপনি এ আশংকা করেন? তাহলে জেনে রাখুন যে, আমি আমার সন্তানদেরকে প্রতি রাত্রে সূরায়ে ওয়াকিআহ পাঠের নির্দেশ দিয়েছি। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “যে ব্যক্তি প্রতি রাত্রে সূরায়ে ওয়াকিআহ পাঠ করবে সে কখনো অভাবগ্রস্ত হবে না বা না খেয়ে থাকবে না।” (এ হাদীসটি ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এ হাদীসের বর্ণনাকারী আবূ যাবিয়াহ (রাঃ) কখনো এ সূরাটি রাত্রে পাঠ ছাড়তেন না।
হযরত সাম্মাক ইবনে হারব (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত জাবির ইবনে সামরা (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “তোমরা আজ যেভাবে তোমাদের নামায পড়ছে, রাসূলুল্লাহও (সঃ) এভাবেই নামায পড়তেন। তবে তোমাদের নামাযের চেয়ে তাঁর নামায তিনি হালকা করতেন। তিনি ফজরের নামাযে সূরায়ে ওয়াকিআহ এবং এ ধরনের সূরাগুলো তিলাওয়াত করতেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
১-১২ নং আয়াতের তাফসীর:
ওয়াকিয়াহ কিয়ামতের নাম। কেননা, এটা সংঘটিত হওয়া সুনিশ্চিত। যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে।” (৬৯:১৫) এটার সংঘটন অবশ্যম্ভাবী। না এটাকে কেউ টলাতে পারে, না কেউ হটাতে পারে। এটা নির্ধারিত সময়ে সংঘটিত হবেই। যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ(আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দাও ঐ দিন আসার পূর্বে যাকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না।” (৪২:৪৭) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এক ব্যক্তি চাইলো সংঘটিত হোক শাস্তি যা অবধারিত কাফিরদের জন্যে, এটা প্রতিরোধ করার কেউ নেই।” (৭০:১-২) অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ যেই দিন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ হয়ে যাও, তখন হয়ে যাবে। তারই কথা সত্য, রাজত্ব তাঁরই, যেই দিন শিঙ্গায় ফুস্কার দেয়া হবে, তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি বিজ্ঞানময়, সম্যক অবগত।” (৬:৭৩)
কিয়ামত সংঘটনে কোন সন্দেহ নেই, বরং এটা চরম সত্য, এটা অবশ্যই সংঘটিত হবে।
(আরবী) ‘শব্দটি (আরবী) যেমন (আরবী) ও (আরবী) শব্দ দুটি মাসদার। এটা কাউকেও করবে নীচ, কাউকেও করবে সমুন্নত। ঐদিন বহু লোক নীচতম ও হীনতম হয়ে যাবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে যারা দুনিয়ায় সম্মানিত ও মর্যাদাবান ছিল। পক্ষান্তরে বহু লোক সেদিন সমুন্নত হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে যদিও তারা দুনিয়ায় নিম্নশ্রেণীর লোক ছিল এবং মর্যাদার অধিকারী ছিল না। সেই দিন আল্লাহর শত্রুরা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ অবস্থায় জাহান্নামে চলে যাবে। আর তাঁর বন্ধু ও ভক্তরা সম্মানিত অবস্থায় জান্নাতে চলে যাবে। ঐদিন অহংকারীরা হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত এবং বিনয়ীরা হবে সম্মানিত। এই কিয়ামত নিকটের ও দূরের লোকদেরকে সতর্ক করে দিবে। এটা নীচু হবে এবং নিকটের লোকদেরকে শুনিয়ে দিবে। তারপর উঁচু হবে এবং দূরের লোকদেরকে শুনাবে। পৃথিবী প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে এবং হেলা দোলা শুরু করবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “পৃথিবী যখন আপন কম্পনে প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে।” (৯৯:১) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে মানবমণ্ডলী! ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে, কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার।” (২২:১)।
এরপর বলেনঃ পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে। অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)অর্থাৎ “পর্বতসমূহ বহমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে।” (৭৩:১৪) আর এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ফলে ওটা পর্যবসিত হবে উৎক্ষিপ্ত ধূলি-কণায়।
(আরবী) ঐ অগ্নিস্ফুলিঙ্গকেও বলা হয় যেগুলো আগুন জ্বালাবার সময় পতঙ্গের মত উড়তে থাকে এবং উড়তে উড়তে নীচে পড়ে গিয়ে হারিয়ে যায়, কিছুই থাকে না।
(আরবী) ঐ জিনিসকে বলা হয় যাকে বাতাস উপরে তোলে নেয় এবং ছড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যেমন শুষ্ক পাতার গুঁড়াকে বাতাস এদিক-ওদিক করে দেয়। এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে যেগুলো দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, পাহাড় স্বীয় জায়গা হতে সরে পড়বে এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেণীতে। একটি দল আরশের ডান দিকে হবে। তারা হবে ঐসব লোক যারা হযরত আদম (আঃ)-এর ডান পার্শ্বদেশ হতে বের হয়েছিল এবং যাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে। তাদেরকে ডান দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এটা হবে জান্নাতীদের সাধারণ দল। দ্বিতীয় দলটি আরশের বাম দিকে হবে। এরা হবে ঐসব লোক যাদেরকে হযরত আদম (আঃ)-এর বাম পার্শ্বদেশ হতে বের করা হয়েছিল। এদের বাম হাতে। আমলনামা দেয়া হবে এবং এদেরকে বাম দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এরা সব জাহান্নামী। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে রক্ষা করুন!
তৃতীয় দলটি মহামহিমান্বিত আল্লাহর সামনে হবেন। তারা হবেন বিশিষ্ট ল। তারা আসহাবুল ইয়ামীনের চেয়েও বেশী মর্যাদাবান ও নৈকট্য লাভকারী ।। ভরা হবেন জান্নাতবাসীদের নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন নবী, রাসূল, সিদ্দীক ও শহীদগণ। ডান দিকের লোকদের চেয়ে তারা সংখ্যায় কম হবেন। সুতরাং হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষ এই তিন শ্রেণীরই থাকবে, যেমন এই সূরার শেষে সংক্ষিপ্তভাবে তাদের এই তিনটি ভাগই করা হয়েছে। অনুরূপভাবে অন্য জায়গায় বর্ণিত হয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করলাম আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি; তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী।” (৩৫:৩২) সুতরাং এখানেও তিন শ্রেণী রয়েছে। এটা ঐ সময়, যখন (আরবী)-এর ঐ তাফসীর নেয়া হবে যা এটা অনুযায়ী হয়, অন্যথায় অন্য একটি উক্তি রয়েছে যা এই আয়াতের তাফসীরের স্থলে গত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজনও এটাই বলেছেন। দু’টি দল তো জান্নাতী এবং একটি দল জাহান্নামী।
হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “দেহে যখন আত্মা পুনঃ সংযোজিত হবে” (৮১৪৭) বিভিন্ন প্রকারের অর্থাৎ প্রত্যেক আমলের আমলকারীর একটি দল হবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ তোমরা বিভক্ত হবে তিন শ্রেণীতে। ডান দিকের দল, কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল! আর বাম দিকের দল, কত হতভাগ্য বাম দিকের দল! আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী, তারাই নৈকট্য প্রাপ্ত।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবী) আয়াতগুলো পাঠ করেন, অতঃপর তার হস্তদ্বয়ের মুষ্টি বন্ধ করেন এবং বলেনঃ এগুলো জান্নাতী এবং আমি কোন পরোয়া করি না, আর এগুলো জাহান্নামী এবং আমার কোন পরোয়া নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়ার দিকে সর্বপ্রথম কোন্ লোকগুলো যাবে তা তোমরা জান কি?” সাহাবীগণ (রাঃ) উত্তর দেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন। তিনি তখন বললেনঃ “তারা হলো ঐ লোক যে, যখন তাদেরকে তাদের হক প্রদান করা হয় তখন তারা তা কবুল করে, তাদের উপর অন্যের হক থাকলে তা চাওয়া মাত্রই দিয়ে দেয় এবং তারা লোকদেরকে ঐ হুকুম করে যে হুকুম তাদের নিজেদেরকে করে।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
সাবেকুন বা অগ্রবর্তী তোক কারা এ ব্যাপারে বহু উক্তি রয়েছে। যেমন নবীগণ, ইল্লীঈনবাসীগণ, হয়রত ইউশা ইবনে নুন যিনি হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিলেন, ঐ মুমিনরা যাদের বর্ণনা সরায়ে ইয়াসীনে। রয়েছে, যারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর প্রথমে ঈমান এনেছিলেন, হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রতি অগ্রগামী ছিলেন, ঐ লোকগুলো, যারা দুই কিবলামুখী হয়ে নামায পড়েছেন, প্রত্যেক উম্মতের ঐ লোকগুলো যারা নিজ নিজ নবীর উপর পূর্বে ঈমান এনেছিলেন, ঐ লোকগুলো, যারা সর্বাগ্রে জিহাদে গমন করেন। প্রকৃতপক্ষে এই উক্তিগুলো সবই সঠিক অর্থাৎ এই লোকগুলোই অগ্রবর্তী। যারা আগে বেড়ে গিয়ে অন্যদের উপর অগ্রবর্তী হয়ে আল্লাহ তা’আলার ফরমান কবুল করে থাকেন তারা সবাই সাবেকুনের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়।” (৩:১৩৩) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে অগ্রগামী হও এবং এমন জান্নাতের দিকে যার প্রস্থ বা বিস্তৃতি আকাশ ও পৃথিবীর বিস্তৃতির মত।” (৫৭:২১) সুতরাং এই দুনিয়ায় যে ব্যক্তি পুণ্যের কাজে অগ্রগামী হবে, সে আখিরাতে আল্লাহ তা’আলার নিয়ামতের দিকেও অগ্রবর্তীই থাকবে। প্রত্যেক আমলের প্রতিদান ঐ শ্রেণীরই হয়ে থাকে। যেমন সে আমল করে তেমনই সে ফল পায়। এ জন্যেই মহান আল্লাহ এখানে বলেনঃ তারাই নৈকট্য প্রাপ্ত, তারাই থাকবে সুখদ উদ্যানে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহ তাআলার নিকট আরয করেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আদম সন্তানের জন্যে আপনি দুনিয়া বানিয়েছেন, সেখানে তারা পানাহার করে থাকে এবং বিয়ে-শাদী করে থাকে। সুতরাং আখিরাত আপনি আমাদের জন্যেই করুন।” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ “আমি এরূপ করবে না।” ফেরেশতারা তিনবার প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ “যাকে আমি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি তাকে কখনো তাদের মত করবে না যাদেরকে আমি শুধু (আরবী) শব্দ দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম রাযীও (রঃ) তার কিতাবুররাদ্দে আলাল জাহমিয়্যাহ’ নামক কিতাবে এই আসারটি আনয়ন করেছেন। এর শব্দগুলো হলোঃ মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “যাকে আমি আমার নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি তার সৎ সন্তানদেরকে ওর মত করবে না যাকে আমি বলেছিঃ হয়ে যাও’ তখন হয়ে গেছে”)
১৩-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা ঐ বিশিষ্ট নৈকট্যলাভকারীদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, তারা পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে হবে বহু সংখ্যক এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। এই পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের তাফসীরে কয়েকটি উক্তি রয়েছে। যেমন একটি উক্তি হলো এই যে, পূর্ববর্তী দ্বারা পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ এবং পরবর্তী দ্বারা এই উম্মত অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মাদ (সঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এই উক্তিটিকেই পছন্দ করেছেন এবং এই উক্তির সবলতার পক্ষে ঐ হাদীসটি পেশ করেছেন যাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা হলাম পরবর্তী, কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরাই হবো পূর্ববর্তী।” এই উক্তির সহায়ক মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হাদীসটিও হতে পারে। তা হলোঃ হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, যখন কুরআন কারীমের আয়াত (আরবী) অবতীর্ণ হয় তখন এটা নবী (সঃ)-এর সাহাবীদের উপর খুবই কঠিন ঠেকে। ঐ সময় (আরবী)-এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ “বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং বহুসংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে।” তখন নবী (সঃ) বলেনঃ “আমি আশা করি যে, তোমরা হবে জান্নাতবাসীদের এক চতুর্থাংশ, বরং এক তৃতীয়াংশ এমনকি অর্ধাংশ। তোমরাই হবে জান্নাতবাসীদের অর্ধাংশ। আর বাকী অর্ধাংশ সমস্ত উম্মতের মধ্যে বন্টিত হবে যাদের মধ্যে তোমরাও থাকবে। এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদেও রয়েছে।
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (আরবী) অবতীর্ণ হয় এবং তাতে বর্ণিত হয় যে, বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে, তখন হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে হবে বহু সংখ্যক এবং আমাদের মধ্য হতে হবে কম সংখ্যক?” এটা অবতীর্ণ হওয়ার এক বছর পর (আরবী) অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ “পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে বহুসংখ্যক হবে এবং পরবর্তীদের মধ্য হতেও বহুসংখ্যক হবে।” তখন রাসূলুল্লাহ হযরত উমার (রাঃ)-কে ডেকে বলেনঃ “হে উমার (রাঃ) শোন, হযরত আদম (আঃ) হতে আমি পর্যন্ত (অর্থাৎ হযরত আদম আঃ-এর যুগ হতে নিয়ে আমার যুগ পর্যন্ত) হলো (আরবী) বহুসংখ্যক। আর শুধু আমার উম্মতই হলো বা বহুসংখ্যক। আমরা আমাদের এই বহুসংখ্যককে পূর্ণ করার জন্যে ঐ হাবশীদেরকেও নিবো যারা উটের রাখাল, কিন্তু তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি এক, তার কোন অংশীদার নেই।”
এ হাদীসটি হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই রিওয়াইয়াতের সনদের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। হ্যাঁ, তবে বহু। সনদসহ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই উক্তিটিও প্রমাণিত যে, তিনি বলেছেনঃ “আমি আশা করি যে, তোমরা আহলে জান্নাতের এক চতুর্থাংশ হবে …… শেষ পর্যন্ত।” সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, এটা আমাদের জন্যে বড় সুসংবাদই বটে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) যে উক্তিটিকে পছন্দ করেছেন তাতে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। বরং প্রকৃতপক্ষে উক্তিটি খুবই দুর্বল। কেননা, কুরআনের ভাষা দ্বারা এই উম্মতের অন্যান্য সমস্ত উম্মতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। তাহলে আল্লাহ তা’আলার নিকট নৈকট্য প্রাপ্তদের সংখ্যা পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্য হতে বেশী এবং এই উম্মতের মধ্য হতে কম কি করে হতে পারে? হ্যাঁ, তবে এ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, সমস্ত উম্মতের নৈকট্যপ্রাপ্তগণ মিলে শুধু এই উম্মতের নৈকট্যপ্রাপ্তদের সংখ্যা হতে অধিক হবেন। কিন্তু বাহ্যতঃ তো এটা জানা যাচ্ছে যে, সমস্ত উম্মতের নৈকট্য প্রাপ্তদের সংখ্যা হতে শুধু এই উম্মতের নৈকট্য প্রাপ্তদের সংখ্যা অধিক হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এই বাক্যের তাফসীরে দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এই উম্মতের প্রথম যুগের লোকদের মধ্য হতে নৈকট্যপ্রাপ্তদের সংখ্যা অনেক বেশী হবে এবং পরবর্তী যুগের লোকদের মধ্য হতে কম হবে। এ উক্তিটি রীতি সম্মত।
হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেনঃ “নৈকট্য প্রাপ্তগণ তো গত হয়ে গেছেন। কিন্তু হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আসহাবুল ইয়ামীনের অন্তর্ভুক্ত করুন।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, তিনি বলেনঃ “এই উম্মতের মধ্যে যাঁরা গত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে নৈকট্যপ্রাপ্তগণ অনেক ছিলেন।” ইমাম ইবনে সীরীন (রঃ) একথাই বলেন।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে এই প্রথম যুগীয় লোকদের অনেকেই নৈকট্য প্রাপ্ত হয়েছেন এবং পরবর্তী যুগের লোকদের খুব কম সংখ্যকই এই মর্যাদা লাভ করেছেন। এ নিয়ম ধারাবাহিকভাবেই চলে আসছে। তাহলে ভাবার্থ এরূপ হওয়াও সম্ভব যে, প্রত্যেক উম্মতেরই প্রথম যুগের লোকদের মধ্যে নৈকট্য প্রাপ্তদের সংখ্যা অধিক এবং পরবর্তী লোকদের মধ্যে এ সংখ্যা কম। কারণ সহীহ গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হাদীসসমূহ দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বযুগের মধ্যে সর্বোত্তম যুগ হলো আমার যুগ, তারপর এর পরবর্তী যুগ, এরপর এর পরবর্তী যুগ, (শেষ পর্যন্ত)।” হ্যাঁ, তবে একটি হাদীসে এও এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির মত। সুতরাং প্রথম যুগের বৃষ্টি উত্তম কি শেষ যুগের বৃষ্টি উত্তম তা আমার জানা নেই।” হাদীসটির ইসনাদ বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলে এটাকে এই বিষয়ের উপর স্থাপন করা হবে যে, দ্বীনের জন্যে যেমন প্রথম যুগীয় লোকদের প্রয়োজন ছিল যারা পরবর্তী লোকদের জন্যে এর তাবলীগ করেছেন, অনুরূপভাবে শেষ যুগে এটাকে কায়েম রাখার জন্যে শেষ যুগীয় লোকদের প্রয়োজন রয়েছে। যাঁরা লোকদেরকে সুন্নাতে রাসূল (সঃ)-এর উপর একত্রিত করবেন, এর রিওয়াইয়াত করবেন এবং জনগণের উপর এটা প্রকাশ করবেন। কিন্তু পূর্বযুগীয় লোকদেরই ফযীলত বেশী হবে। এটা ঠিক এরূপ যে, জমিতে প্রাথমিক বৃষ্টিরও প্রয়োজন হয় এবং শেষের বৃষ্টিরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু জমি প্রাথমিক বৃষ্টি দ্বারাই বেশী উপকার লাভ করে থাকে। কেননা, প্রথম প্রথম যদি বৃষ্টি না হয় তবে শস্যের বীজ অংকুরিতই হবে না এবং জড় বা মূলও বসবে না। এ জন্যেই তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের একটি দল সদা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বিজয়ী থাকবে। তাদের শত্রুরা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তাদের বিরোধীরা তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে এবং তারা ঐরূপই থাকবে।” মোটকথা, এই উম্মত বাকী সমস্ত উম্মত হতে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। আর এই উম্মতের মধ্যে নৈকট্যপ্রাপ্তদের সংখ্যা অন্যান্য উন্মতদের তুলনায় বহুগুণে বেশী হবে। তারা হবে বেশী মর্যাদা সম্পন্ন। কেননা, দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়া এবং নবী (সঃ) সর্বাপেক্ষা মর্যাদা সম্পন্ন হওয়ার দিক দিয়ে এরাই সর্বোত্তম। ধারাবাহিকতার সাথে এ হাদীসটি প্রামাণ্য পৌছে গেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে এবং প্রতি সত্তর হাজারের সাথে আরো সত্তর হাজার করে লোক থাকবে।
হযরত আবূ মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! কিয়ামতের দিন একটি বৃহৎ দলকে দাঁড় করানো হবে। তারা সংখ্যায় এতো অধিক হবে যে, অন্ধকার রাত্রির মত তারা যমীনের সমস্ত প্রান্তকে ঘিরে ফেলবে। ফেরেশতারা বলবেনঃ “সমস্ত নবী (আঃ)-এর সঙ্গে যত লোক এসেছে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাথে তাদের সকলের সমষ্টির চেয়ে বহুগুণে বেশী এসেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
‘বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং বহু সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে।” এই আয়াতের তাফসীরের স্থলে এই হাদীসটিকে আনয়ন করা যুক্তিযুক্ত হবে যে হাদীসটিকে হাফিয আবু বকর বায়হাকী (রঃ) তাঁর ‘দালাইলুন নবুওয়াহ’ নামক গ্রন্থে আনয়ন করেছেন। হাদীসটি হলোঃ হযরত আবূ জামাল জুহনী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ফজরের নামায পড়তেন তখন তিনি পা দুটি মোড়ানো অবস্থাতেই সত্তর বার পাঠ করতেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “আমি আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবূলকারী।” তারপর বলতেনঃ “সত্তরের বদলে সাতশ’। একদিনে যার পাপ সাত শতেরও বেশী হয় তার জন্যে কল্যাণ নেই।” একথা তিনি দু’বার বলতেন। তারপর তিনি জনগণের দিকে মুখ করে বসতেন। স্বপ্ন তার নিকট প্রিয় ছিল বলে তিনি জিজ্ঞেস করতেনঃ “তোমাদের কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছ কি?” আবূ জামাল (রাঃ) বলেন, একদা অভ্যাসমত রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলে আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হ্যাঁ, আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। তিনি বললেনঃ “আল্লাহ কল্যাণের সাথে সাক্ষাৎ দান করুন, অকল্যাণ হতে বাঁচিয়ে রাখুন, আমাদের জন্যে মঙ্গলজনক করুন, শত্রুদের জন্যে করুন ক্ষতিকর, ঐ আল্লাহ সর্বপ্রকারের প্রশংসার অধিকারী যিনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক। তুমি এখন তোমার স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনা কর।” আমি তখন বলতে শুরু করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি দেখি যে, একটি রাস্তা রয়েছে যা প্রশস্ত, সহজ, নরম ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অসংখ্য লোক ঐ পথ ধরে চলছে। তারা চলতে চলতে একটি সবুজ-শ্যামল বাগান পেলো যার মত শস্য-শ্যামল ও চমৎকার বাগান আমি কখনো চোখে দেখিনি। ভিতর দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। নানা প্রকারের গাছ ফুলে ফলে ভরপুর রয়েছে। এখন আমি দেখি যে, প্রথম যে দলটি আসলো এবং ঐ বাগানের নিকট পৌঁছলো, তখন তারা তাদের সওয়ারীর গতি বেশ দ্রুত করলো এবং ডানে বামে না গিয়ে দ্রুত গতিতে ঐ স্থান অতিক্রম করলো। তারপর দ্বিতীয় দল আসলো যাদের সংখ্যা বেশী ছিল, যখন তারা এখানে পৌছলো তখন কতকগুলো লোক তাদের বাহনের পশুগুলোকে সেখানে চরাতে শুরু করলো, আর কতকগুলো লোক কিছু গ্রহণ করলো, অতঃপর সেখান হতে প্রস্থান করলো। তারপর আরো বহু লোকের একটি দল আসলো। যখন তারা এই সবুজ-শ্যামল বাগানের নিকট আসলো তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল এবং বলতে লাগলোঃ “এটা সবচেয়ে উত্তম জায়গা।” আমি যেন তাদেরকে এখনো দেখতে পাচ্ছি যে, তারা ডানে বামে ঝুঁকে পড়েছে। আমি এসব দেখলাম। কিন্তু আমি তো চলতেই থাকলাম। যখন বহু দূরে চলে গেলাম তখন দেখলাম যে, সাতটি সিঁড়ি বিশিষ্ট একটি মিম্বর বিছানো রয়েছে এবং আপনি সর্বোচ্চ সোপানে উপবেশন করেছেন। আর আপনার ডানদিকে এক ব্যক্তি রয়েছেন। তার চেহারা গোধূম বর্ণের, অঙ্গুলিগুলো মোটামোটা এবং দেহ লম্বা। যখন তিনি কথা বলছেন তখন সবাই নীরবে শুনছেন এবং জনগণ উঁচু হয়ে হয়ে মনোযোগের সাথে তাঁর কথায় কান লাগিয়ে দিয়েছেন। আপনার বাম দিকে একটি লোক রয়েছেন, যাঁর দেহের গঠন মধ্যম, শরীর মোটা এবং চেহারায় বহু তিল রয়েছে। তাঁর চুল যেন পানিতে সিক্ত। যখন তিনি কথা বলছেন তখন তাঁর সম্মানার্থে সবাই ঝুঁকে পড়ছেন। আর সামনে একজন লোক রয়েছেন, তিনি স্বভাব-চরিত্রে এবং চেহারা ও আকৃতিতে আপনার সাথে সম্পূর্ণরূপে সাদৃশ্যযুক্ত।
আপনারা সবাই তার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি উৎসুক নেত্রে চেয়ে আছেন। তাঁর সামনে একটি ক্ষীণ, পাতলা ও বৃদ্ধা উষ্ট্রী রয়েছে। আমি দেখলাম যে, আপনি যেন ওকে উঠাচ্ছেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর এ অবস্থা দূরীভূত হলো। অতঃপর তিনি বলতে লাগলেনঃ “সরল, সোজা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা হলো ঐ দ্বীন যা নিয়ে আমি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে এসেছি এবং যে হিদায়াতের উপর তোমরা রয়েছো। তুমি যে সবুজ শ্যামল বাগানটি দেখেছো ওটা হলো দুনিয়া এবং ওর মন মাতানো সাজ-সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র। আমার সাহাবীবর্গ তো ওটা অতিক্রম করে চলে যাবে। না আমরা তাতে লিপ্ত হবো, না ওটা। আমাদেরকে জড়িয়ে ধরবে। না ওর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকবে, না আমরা ওর প্রতি আকৃষ্ট হবো। অতঃপর আমাদের পর দ্বিতীয় দল আসবে যারা সংখ্যায় আমাদের চেয়ে বেশী হবে। তাদের মধ্যে কতক লোকে তো দুনিয়ার সাথে জড়িয়ে পড়বে। আর কেউ কেউ তা হতে প্রয়োজন মত গ্রহণ করবে। অতঃপর তারা চলে যাবে এবং পরিত্রাণ পেয়ে যাবে। তারপর তাদের পরে একটি বিরাট দল আসবে যারা এই দুনিয়ায় সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন হয়ে পড়বে। তারা ডানে বামে ঢুকে পড়বে। সুতরাং (আরবী) (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্যে এবং নিশ্চয়ই আমরা তারই নিকট প্রত্যাবর্তনকারী)। এখন থাকলো তোমার কথা। তাহলে জেনে রেখো যে, তুমি তোমার সোজা সরল পথে চলতে থাকবে, শেষ পর্যন্ত তুমি আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে।
সাতটি সিঁড়ি বিশিষ্ট মিম্বরের সর্বোচ্চ সোপানে যে তুমি আমাকে দেখেছো তার ব্যাখ্যা এই যে, দুনিয়ার আয়ু হচ্ছে সাত হাজার বছর। আমি শেষ বা সপ্তম হাজারে রয়েছি। আমার ডান দিকে গোধূম বর্ণের মোটা অঙ্গুলি বিশিষ্ট যে। লোকটিকে তুমি দেখেছো তিনি হলেন হযরত মূসা (আঃ)। যখন তিনি কথা বলেন তখন লোকেরা উচু হয়ে যায়। কেননা, আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং তার সাথে কথা বলে তাঁকে মর্যাদামণ্ডিত করেছেন। আর যে লোকটিকে তুমি আমার বাম দিকে দেখেছো, যিনি মোটা দেহ বিশিষ্ট এবং যার দেহের গঠন মধ্যম ধরনের আর যার চেহারায় বহু তিল রয়েছে এবং যার চুল পানিতে সিক্ত মনে হচ্ছে, তিনি হলেন হযরত ঈসা (আঃ)। যেহেতু স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্মান করেছেন। সেই হেতু আমরাও সবাই তাকে সম্মান করি। যে বৃদ্ধ লোকটিকে তুমি আমার সাথে সম্পূর্ণরূপে সাদৃশ্যযুক্ত দেখেছো তিনি হলেন আমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)। আমরা সবাই তাঁকে চাই, তার অনুসরণ করি এবং তাঁর আনুগত্য করে থাকি। আর যে বৃদ্ধা উষ্ট্রীটিকে তুমি দেখেছো যে, আমি ওকে দাঁড় করাচ্ছি ওর দ্বারা কিয়ামত উদ্দেশ্য যা আমার উম্মতের উপর সংঘটিত হবে। না আমার পরে কোন নবী আছে এবং না আমার উম্মতের পরে কোন উম্মত আছে।” এরপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছে কি না এ প্রশ্ন করা ছেড়ে দেন। হ্যাঁ, তবে যখন কেউ নিজেই কোন স্বপ্নের কথা বলতো তখন তিনি ঐ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে দিতেন।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ নৈকট্যপ্রাপ্তদের বিশ্রামের পালঙ্গটি সোনার তার দ্বারা বুননকৃত হবে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এটা (আরবী) ওযনে (আরবী)-এর অর্থে হবে। যেমন উষ্ট্রীর পেটের নীচে যেটা থাকে ওটাকে (আরবী) বলা হয়।
তারা ঐ আসনে হেলান দিয়ে বসবে, পরস্পর মুখখামুখি হয়ে। কেউ কারো দিকে পিঠ করে বসবে না।
তাদের সেবায় ঘোরাফিরা করবে চির কিশোরেরা। অর্থাৎ ঐ সেবকরা বয়সে একই অবস্থায় থাকবে। তারা বড়ও হবে না, বুড়োও হবে না এবং তাদের বয়সে কোন পরিবর্তনও হবে না, বরং তারা সদা কিশোরেই থাকবে।
(আরবী) বলা হয় ঐ কুঁজাকে যাতে নালী বা চুঙ্গি এবং ধরবার জিনিস থাকে না। (আরবী) আর বলা হয় ঐ পানপাত্রকে যাতে চুঙ্গি এবং ধরবার জিনিস আছে। এগুলো সুরার প্রবহমান প্রস্রবণ হতে পূর্ণ করা থাকবে, যে সুরা কখনো শেষ হবার নয়। কেননা, ওর প্রস্রবণ সদা জারী থাকবে। এই সদা-কিশোরেরা সুরাপূর্ণ এই পানপাত্রগুলো তাদের নরম হাতে নিয়ে ঐ জান্নাতীদের সেবায় এদিক ওদিক ঘোরাফিরা করতে থাকবে। সেই সুরা পানে তাদের শিরঃপীড়াও হবে না এবং তারা জ্ঞানহারাও হবে না। সুতরাং পূর্ণমাত্রায় তারা ঐ সুরার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। মদের মধ্যে চারটি বিশেষণ রয়েছে। (এক) নেশা, (দুই) মাথাব্যথা, (তিন) বমি এবং (চার) প্রস্রাব। মহান প্রতিপালক আল্লাহ জান্নাতের সুরা বা মদের বর্ণনা দিয়ে ওকে এই চারটি দোষ হতে মুক্ত বলে ব্যক্ত করলেন।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ঐ চির কিশোরেরা তাদের কাছে ঘোরাফিরা করবে তাদের পছন্দমত নানা প্রকারের ফলমূল নিয়ে এবং তাদের ঈপ্সিত পাখীর গোশত নিয়ে। যে ফল খাওয়ার তাদের ইচ্ছা হবে এবং যে গোশত খেতে তাদের মন চাইবে, সাথে সাথে তারা তা পাবে। এসব রকমারী খাবার নিয়ে তাদের এই চির কিশোরে সেবকরা সদা তাদের চারদিকে ঘোরাফিরা করবে। সুতরাং তাদের যখনই যা খেতে ইচ্ছা করবে তখনই তা তাদের নিকট থেকে নিয়ে নিবে। এই আয়াতে এই দলীল রয়েছে যে, মানুষ ফল বেছে বেছে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী খেতে পারে।
হযরত ইকরাশ ইবনে যুআয়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমার কওম মুররা আমাকে তাদের সাদকার মাল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট প্রেরণ করে। আমি ঐ মাল নিয়ে মদীনায় পৌঁছি। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। আমার সাথে যাকাতের বহু উট ছিল, উটগুলো যেন বালুকার উপর লেগে থাকা গাছগুলোতে চরানো যুবক উট। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কে?” আমি বললামঃ আমি ইকরাশ ইবনে যুআয়েব (রাঃ)। তিনি বললেনঃ “তুমি দূর পর্যন্ত তোমার বংশ তালিকা বর্ণনা কর।” আমি তখন মুররা ইবনে উবায়েদ পর্যন্ত বলে শুনালাম। আর সাথে সাথে আমি বললাম যে, এগুলো মুররা ইবনে উবায়েদের যাকাতের উট। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুচকি হাসলেন এবং বললেনঃ “এগুলো আমার কওমেরই উট, এগুলো আমার কওমের সাদুকার মাল। এগুলোতে সাদকার উটগুলোর চিহ্ন দিয়ে দাও এবং ওগুলোর সাথে এগুলোকে মিলিয়ে দাও।” অতঃপর তিনি আমার হাত ধরে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-এর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “খাবার কিছু আছে কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ আছে।” অতঃপর আমাদের কাছে চুর্ণ করা রুটির একটা বড় গামলা পাঠানো হলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং আমি খেতে শুরু করলাম। আমি এদিক ওদিক হতে খাবার উঠাতে লাগলাম। তখন তিনি তাঁর হাত দ্বারা আমার হাত ধরে নিলেন এবং বললেনঃ “হে ইকরাশ (রাঃ)! এটা তো একই প্রকারের খাদ্য, সুতরাং একই জায়গা হতে খেতে থাকো। এরপর রসাল খেজুর অথবা শুষ্ক খেজুরের একটি থালা আসলো। আমি ওটা হতে শুধু আমার সামনের দিক হতে খেতে লাগলাম। তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) পছন্দ মত থালার এদিক ওদিক হতে নিয়ে খাচ্ছিলেন এবং আমাকেও বললেনঃ “হে ইকরাশ (রাঃ)! এখানে নানা প্রকারের খেজুর আছে। সুতরাং যেখান হতে ইচ্ছা খাও।” তারপর পানি আসলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাত ধৌত করলেন এবং ঐ ভিজা হাত স্বীয় চেহারার উপর, দুই বাহুর উপর এবং মাথার উপর তিনবার ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেনঃ “হে ইকরাশ (রাঃ)! এটা অযু হলো ঐ জিনিস হতে যাকে আগুনে পরিবর্তিত করে ফেলেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বলেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বপ্ন খুব পছন্দ করতেন। কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছে কি না তা তিনি মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন। কেউ কোন স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলে এবং তাতে তিনি আনন্দিত হলে ওটা খুব ভাল স্বপ্ন বলে জানা যেতো। একদা একটি স্ত্রীলোক তার কাছে এসে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার কাছে যেন কেউ আসলো এবং আমাকে মদীনা হতে নিয়ে গিয়ে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দিলো। তারপর আমি এক ধমক শুনলাম, যার ফলে জান্নাতে হৈ চৈ পড়ে গেল। আমি চক্ষু উঠিয়ে তাকালে অমুকের পুত্র অমুক, অমুকের পুত্র অমুককে দেখতে পাই।” এভাবে স্ত্রীলোকটি বারোটি লোকের নাম করেন। এই বারোজন লোকেরই একটি বাহিনীকে মাত্র কয়েকদিন পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। মহিলাটি বলতে থাকেনঃ “এ লোকগুলো আতলাস (সাটিন) কাপড় পরিহিত ছিলেন। তাঁদের শিরাগুলো ফুটতে ছিল। নির্দেশ দেয়া হয়ঃ তাদেরকে নহরে বায়দাখ বা নহরে বায়খে নিয়ে যাও। যখন তারা ঐ নদীতে ডুব দিলেন তখন তাদের চেহারা চৌদ্দ তারিখের চাঁদের মত চমকাতে থাকলো। অতঃপর তাদের জন্যে সোনার থালায় খেজুর আনয়ন করা হয় যা তারা ইচ্ছামত খেলেন। তারপর নানা প্রকারের ফল-মূল তাঁদের কাছে হাযির করা হলো যেগুলো চারদিক হতে বাছাই। করে রাখা হয়েছিল। এগুলো হতেও তাঁরা তাঁদের মনের চাহিদা মত খেলেন। আমিও তাঁদের সাথে শরীক হলাম ও খেলাম।”
কিছুদিন পর একজন দূত আসলো এবং বললোঃ “অমুক অমুক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন যাদেরকে আপনি রণাঙ্গনে পাঠিয়েছিলেন।” দূতটি ঐ বারোজনেরই নাম করলো যে বারোজনকে ঐ মহিলাটি স্বপ্নে দেখেছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সতী মহিলাটিকে আবার ডাকিয়ে নেন এবং তাঁকে বলেনঃ “পুনরায় তুমি তোমার স্বপ্নের বৃত্তান্তটি বর্ণনা কর।” মহিলাটি এবারও ঐ লোকগুলোরই নাম করলেন যাদের নাম ঐ দূতটি করেছিলেন। (এ হাদীসটি হাফিয আবুল ইয়ালা মুসিলী (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতী ব্যক্তি যেই ফল জান্নাতের গাছ হতে ভেঙ্গে আনবে, সাথে সাথে ঠিক ঐরূপই আর একটি ফল গাছে এসে লেগে যাবে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ জান্নাতের পাখী বড় বড় উটের সমান হয়ে জান্নাতের গাছে চরে ও খেয়ে বেড়াবে।” এ কথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে ঐ পাখী তো বড় নিয়ামত উপভোগ করবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “যারা এই পাখীর গোশত খাবে তারাই হবে বেশী নিয়ামতের অধিকারী।” তিনবার তিনি একথাই বলেন। তারপর বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! আমি আশা করি যে, তুমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে যারা এই পাখীগুলোর গোশত খাবে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা নবী (সঃ)-এর সামনে ‘বা বৃক্ষের আলোচনা হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! তৃবা বৃক্ষ কি তা তুমি জান কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন তিনি বললেনঃ “এটা হলো জান্নাতের একটি বৃক্ষ যার দৈর্ঘ্য ও বিস্তৃতি যে কত তা একমাত্র আল্লাহই জানেন! এর এক একটি শাখার ছায়ায় একজন অশ্বারোহী সত্তর বছর ধরে চলবে তবুও ওর ছায়া শেষ হবে না। ওর পাতাগুলো খুবই চওড়া ও বড় বড় হবে। ওর উপর বড় বড় উটের সমান সমান পাখী এসে বসবে। তার একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে তো এই পাখী বড় রকমের নিয়ামতের অধিকারী হবে?” জবাবে তিনি বলেনঃ “এই পাখীগুলো অপেক্ষা বেশী নিয়ামতের অধিকারী হবে এগুলোকে ভক্ষণকারীরা। আমি আশা করি যে, তুমিও তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু আবদিল্লাহ আল মুকাদ্দাসী (রঃ) তাঁর ‘সিফাতুল জান্নাহ’ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। শেষের অংশটি হযরত কাতাদা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাওসার’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেনঃ “এটা হলো জান্নাতী নহর, যা মহামহিমান্বিত আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। এর পানি দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। এর ধারে বড় বড় উটের সমান পাখী রয়েছে। তখন হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “তাহলে তো এ পাখীগুলো বড়ই নিয়ামত উপভোগ করছে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এগুলোকে ভক্ষণকারীরা এগুলো অপেক্ষাও বেশী নিয়ামতের অধিকারী হবে।” (এটা আবু বকর ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতে একটি পাখী রয়েছে যার সত্তর হাজার পাখা আছে। পাখীটি জান্নাতীর দস্তরখানে আসবে। প্রত্যেক পাখা হতে একপ্রকার রঙ বের হবে। যা দুধের চেয়েও সাদা, মাখনের চেয়েও নরম এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। তারপর দ্বিতীয় পাখা হতে দ্বিতীয় প্রকারের রঙ বের হবে। এভাবে প্রত্যেক পাখা হতে পৃথক পৃথক রঙ বের হয়ে আসবে। তারপর ঐ পাখীটি উড়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি খুবই গরীব। এর বর্ণনাকারী অসাফী এবং তার উস্তাদ দু’জনই দুর্বল)
হযরত কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, জান্নাতী পাখী বড় বড় উটের মত, যেগুলো জান্নাতের ফল খায় এবং জান্নাতের নহরের পানি পান করে। জান্নাতী যে পাখীর গোশত খাওয়ার ইচ্ছা করবে ঐ পাখী তার সামনে চলে আসবে। সে যত চাইবে যে বাহুর গোশত পছন্দ করবে, খাবে। তারপর ঐ পাখী উড়ে যাবে এবং যেমন ছিল তেমনই হয়ে যাবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “জান্নাতের যেই পাখীর গোশত তোমার খাওয়ার ইচ্ছা হবে ঐ পাখীর গোশত রান্নাকৃত অবস্থায় তোমার সামনে এসে যাবে।”
(আরবী) শব্দটি অন্য কিরআতে যেরের সাথেও রয়েছে। পেশের সঙ্গে হলে তো অর্থ হবেঃ জান্নাতীদের জন্যে হরসমূহ রয়েছে। আর যেরের সাথে হলে ভাবার্থ এই হবে যে, এটা যেন পূর্ব ই’রাবেরই অনুসারী। যেমনঃ (আরবী)-এই কিরআত এবং যেমন (আরবী)-এই কিরআতে রয়েছে। আর এই অর্থও হতে পারে যে, কিশোরেরা নিজেদের সঙ্গে হুরদেরকেও নিয়ে নিবে। কিন্তু তারা থাকবে তাদের মহলে ও তাঁবুতে, সাধারণভাবে নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এই হরগুলো এমন হবে যেমন সতেজ, সাদা ও পরিষ্কার মুক্তা হয়ে থাকে। যেমন সূরায়ে সাফফাতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা যেন সুরক্ষিত ডিম্ব।” সূরায়ে রহমানেও এই বিশেষণ তাফসীরসহ গত হয়েছে। এটা তাদের সৎ কার্যের প্রতিদান। অর্থাৎ এই উপঢৌকন তাদের সকর্মেরই ফল।
সেথায় তারা শুনবে না কোন অসার অথবা পাপ বাক্য। ঘূণ্য ও মন্দ কথার একটি শব্দও তাদের কানে আসবে না। যেমন অন্য একটি আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেথায় তারা অসার বাক্য শুনবে না।” (৮৮:১১) হ্যাঁ, তবে তারা শুনবে শুধু ‘সালাম’ আর ‘সালাম’ বাণী। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের উপঢৌকন হবে তাদের একে অপরকে সালাম করা।” (১০:১০) তাদের কথাবার্তা বাজে ও পাপ হতে পবিত্র হবে।
২৭-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
অগ্রবর্তীদের অবস্থা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা’আলা পুণ্যবানদের অবস্থা বর্ণনা করছেন যাদের মর্যাদা অগ্রবর্তীদের তুলনায় কম। এদের অবস্থা যে কত সুখময় তার বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেনঃ এরা ঐ জান্নাতে অবস্থান করবে যেখানে কুলবৃক্ষ রয়েছে, কিন্তু এই কুলবৃক্ষগুলো কন্টকহীন হবে এবং ফল হবে অধিক ও উন্নতমানের। দুনিয়ার কুলবৃক্ষগুলো হয় কাটাযুক্ত এবং কম ফলবিশিষ্ট। পক্ষান্তরে, জান্নাতের কুলবৃক্ষগুলো হবে অধিক ফলবিশিষ্ট এবং সম্পূর্ণরূপে কন্টকহীন। ফলের ভারে শাখাগুলো নুয়ে পড়বে। হাফিয আবু বকর আহমদ ইবনে সালমান নাজ্জার (রঃ) একটি রিওয়াইয়াত আনয়ন করেছেন যে, আল্লাহর নবী (সঃ)-এর সাহাবীগণ (রাঃ) বলতেন, বেদুঈনদের নবী (সঃ)-এর কাছে আগমন করা এবং তাঁকে মাসআলা জিজ্ঞেস করা আমাদের জন্যে খুবই উপকারী হতো। একদা এক বেদুঈন এসে বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কুরআনে এমন একটি গাছের কথাও রয়েছে যা কষ্টদায়ক!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “ওটা কোন গাছ?” সে জবাবে বললোঃ “কুলগাছ।” তখন তিনি বললেনঃ “তুমি ওর সাথেই (আরবী) শব্দটি পড়নি?” আল্লাহ তা’আলা ঐ গাছের কাঁটা দূর করে দিয়েছেন এবং এর পরিবর্তে দিয়েছেন অধিক ফল। প্রত্যেক কুলের বাহাত্তর প্রকারের স্বাদ থাকবে, যেগুলোর রঙ ও স্বাদ হবে পৃথক পৃথক।” এই রিওয়াইয়াতটি অন্যান্য কিতাবেও বিদ্যমান আছে। সেখানে (আরবী) শব্দ রয়েছে এবং সত্তর প্রকার স্বাদের বর্ণনা আছে।
(আরবী) হলো একটা বিরাট গাছ, যা হিজাযের ভূ-খণ্ডে জন্মে থাকে। এটা কন্টকময় বৃক্ষ। এতে কাটা খুব বেশী থাকে।
(আরবী)-এর অর্থ হলো কাঁদি কাঁদি ফলযুক্ত গাছ। এ দুটি গাছের কথা উল্লেখ করার কারণ এই যে, আরবরা এই গাছগুলোর গভীরতা ও মিষ্টি ছায়াকে খুবই পছন্দ করতো। এই গাছ বাহ্যতঃ দুনিয়ার গাছের মতই হবে, কিন্তু কাটার স্থলে মিষ্ট ফল হবে।
জাওহারী (রঃ) বলেন, এই গাছকে -ও বলে এবং ও বলে। হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। তাহলে সম্ভবতঃ এটা কুলেরই গুণবিশিষ্ট হবে। অর্থাৎ ঐ গাছগুলো কন্টকহীন এবং অধিক ফলদানকারী। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
অন্যান্য গুরুজন (আরবী) দ্বারা কলার গাছকে বুঝিয়েছেন। ইয়ামনবাসী কলাকে (আরবী) বলে এবং হিজাবাসী (আরবী) বলে। লম্বা ও সম্প্রসারিত ছায়া তথায় থাকবে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতী গাছের ছায়ায় দ্রুতগামী অশ্বারোহী একশ বছর পর্যন্ত চলতে থাকবে, তথাপি ছায়া শেষ হবে না। তোমরা ইচ্ছা করলে (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ কর।” ইমাম বুখারী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমেও এ রিওয়াইয়াতটি বিদ্যমান আছে। আরো আছে মুসনাদে আহমাদে ও মুসনাদে আবি ইয়ালাতে। মুসনাদের অন্য রিওয়াইয়াতে সন্দেহের সাথে রয়েছে। অর্থাৎ সত্তর বছর অথবা একশ বছর এবং এও আছে যে, এটা হলো (আরবী) বা চিরবিদ্যমান গাছ। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এবং ইমাম তিরমিযীও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এ হাদীসটি মুতাওয়াতির বা ধারাবাহিক এবং এটা অকাট্য রূপে বিশুদ্ধ। এর ইসনাদ অনেক আছে এবং এর বর্ণনাকারী বিশ্বাসযোগ্য। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিম প্রভৃতিতেও এ হাদীসটি রয়েছে। হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) যখন এ হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং তা হযরত কা’ব (রাঃ)-এর কান পর্যন্ত পৌঁছে তখন তিনি বলেনঃ “যে আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত এবং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন তাঁর শপথ! কেউ যদি নবযুবতী উষ্ট্রীর উপর আরোহণ করে উষ্ট্রীটি বৃদ্ধা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে তবুও ঐ ছায়ার শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা ওটাকে স্বহস্তে রোপণ করেছেন এবং ওতে নিজের পক্ষ হতে রূহ ফুকে দিয়েছেন। ওর শাখাগুলো জান্নাতের দেয়ালগুলো হতে বাইরে বের হয়ে গেছে। জান্নাতের সমস্ত নহর এই গাছেরই মূল হতে বের হয়।
আবূ হুসাইন (রঃ) বলেনঃ “এক জায়গায় একটি দরযার উপর আমরা অবস্থান করছিলাম। আমাদের সাথে আবু সালেহ (রঃ) এবং শাকীক জুহনীও, (রঃ) ছিলেন। আবু সালেহ (রঃ) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং বলেন, তুমি কি আবু হুরাইরা (রাঃ)-কে মিথ্যাবাদী বলছো?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “না, তাকে তো নয়, বরং তোমাকে।” তখন এটা কারীদের কাছে খুব কঠিন ঠেকলো। (এ হাদীসটি ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আমি বলি যে, এই প্রমাণিত বিশুদ্ধ এবং মারফু’ হাদীসকে যে মিথ্যা বলে সে ভুলের উপর রয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতের প্রতিটি গাছের গুড়ি সোনার।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, জান্নাতে একটি গাছ রয়েছে যা প্রত্যেক দিকে শত শত বছরের রাস্তা পর্যন্ত ছায়া ছড়িয়ে রয়েছে। জান্নাতী লোকেরা ওর নীচে এসে বসে এবং পরস্পর আলাপ আলোচনা করে। কারো কারো দুনিয়ার খেল-তামাশা ও চিত্তাকর্ষক জিনিসের কথা স্মরণ হয়। তৎক্ষণাৎ এক জান্নাতী বাতাস প্রবাহিত হয় এবং ঐ গাছের মধ্য হতে গান-বাজনা ও খেল-তামাশার শব্দ আসতে শুরু করে। (এ আসারটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা দুর্বল আসার এবং এর সনদ সবল)
হযরত আমর ইবনে মাইমুন (রঃ) বলেন, এই ছায়া সত্তর হাজার সালের বিস্তৃতির মধ্যে হবে। হযরত আমর (রঃ) হতেই পাঁচশ’ বছরও বর্ণিত আছে। হযরত হাসান (রঃ) এক হাজার বছর বলেছেন।
হযরত হাসান (রঃ)-এর কাছে খবর পৌঁছেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই ছায়া কর্তিতই হয় না। তথায় না আছে সূর্য এবং না আছে গরম। ফজর হওয়ার পূর্বের সময়টা সব সময় ওর নীচে বিরাজ করে (অর্থাৎ সদা ঐরূপ সময়ই থাকে)।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, জান্নাতে সদা-সর্বদা ঐ সময় থাকবে যা সুবহে সাদিকের পর হতে নিয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মাঝামাঝিতে থাকে। ছায়া বিষয়ক রিওয়াইয়াতগুলোও ইতিপূর্বে গত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলার উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদেরকে সম্প্রসারিত ছায়ায় প্রবিষ্ট করবে।” (৪:৫৭)। (আরবী) অর্থাৎ “ওর খাদ্য ও ছায়া সার্বক্ষণিক।” (১৩:৩৫)। (আরবী) অর্থাৎ “(মুত্তাকীরা থাকবে) ছায়ায় ও প্রস্রবণ বহুল স্থানে।”
আর আছে প্রবহমান পানি। কিন্তু ওটা গর্ত এবং খননকৃত যমীন হবে না। এর পূর্ণ তাফসীর
(আরবী)-এই আয়াতের তাফসীরে গত হয়েছে।
আর তাদের কাছে থাকবে প্রচুর ফলমূল। ওগুলো হবে খুবই সুস্বাদু। এগুলো কোন চক্ষু দেখেছে, না কোন কর্ণ শ্রবণ করেছে, না মানুষের অন্তরে খেয়াল জেগেছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অথাৎ “যখনই তাদেরকে ফলমূল খেতে দেয়া হবে তখনই তারা বলবেআমাদেরকে পূর্বে জীবিকারূপে যা দেয়া হতো এটা তো তাই। তাদেরকে অনুরূপ ফলই দেয়া হবে।” (২:২৫) জান্নাতের ফলগুলো দেখতে দুনিয়ার ফলের মতই লাগবে, কিন্তু যখন খাবে তখন স্বাদ অন্য রকম পাবে। সহীহ্ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে সিদরাতুল মুনতাহার বর্ণনায় রয়েছে যে, ওর পাতাগুলো হবে হাতীর কানের মত এবং ফলগুলো বড় বড় মটকার মত হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত যে হাদীসে তিনি সূর্যে গ্রহণ লাগা এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সূর্য গ্রহণের নামায আদায় করার ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে এও রয়েছে যে, নামায শেষে তাঁর পেছনে নামায আদায়কারীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমরা এই জায়গায় আপনাকে সামনে অগ্রসর হতে এবং পিছনে সরে আসতে দেখলাম, ব্যাপার কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমি জান্নাত দেখেছি। জান্নাতের ফলের গুচ্ছ আমি নেয়ার ইচ্ছা করেছিলাম। যদি আমি তা নিতাম তবে দুনিয়া থাকা পর্যন্ত তা থাকতো এবং তোমরা তা খেতে থাকতে।”
আবূ ইয়া’লা (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, যুহরের নামায পড়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আগে বেড়ে যান এবং তাঁর দেখাদেখি সাহাবীগণও সামনের দিকে এগিয়ে যান। তিনি যেন কিছু নিতে চাচ্ছিলেন। তারপর তিনি পিছনে সরে আসেন। নামায শেষে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আজ তো আপনি এমন এক কাজ করেন যা ইতিপূর্বে কখনো করেননি। তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার সামনে জান্নাত আনয়ন করা হয়েছিল এবং তাতে যে সজীবতা ও শ্যামলতা ছিল সবই আমার সামনে আনা হয়েছিল। আমি ওগুলোর মধ্য হতে আঙ্গুরের একটি গুচ্ছ নেয়ার ইচ্ছা করেছিলাম। ইচ্ছা ছিল যে, তা এনে তোমাদেরকে দেবো। কিন্তু আমারও ঐ গুলোর মাঝে পর্দা ফেলে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। যদি আমি তোমাদের মধ্যে ওটা নিয়ে আসতাম তবে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার সমস্ত মাখলুক ওটা খেতে থাকতো, তবুও তা হতে কিছুই হ্রাস পেতো না।
মুসনাদে আহমাদে আছে যে, একজন বেদুঈন এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হাওযে কাওসার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং জান্নাতের কথাও উল্লেখ করে। সে প্রশ্ন করেঃ “সেখানে কি ফলও আছে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হ্যাঁ সেখানে তুবা নামক একটি গাছও আছে। বর্ণনাকারী বলেনঃ এর পরে আরো বর্ণনা করেন যা আমার স্মরণ নেই। তারপর লোকটি জিজ্ঞেস করেঃ “ঐ গাছটি আমাদের ভূ-খণ্ডের কোন গাছের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “তোমাদের অঞ্চলে ওর সাথে সাদৃশ্যযুক্ত গাছ নেই। তুমি কোন দিন সিরিয়ায় গেছো কি?” উত্তরে সে বললোঃ “না।” তখন নবী (সঃ) বললেনঃ “সিরিয়ায় এক প্রকারের গাছ জন্মে যাকে জাওযাহ বলা হয়। এর একটি মাত্র গুড়ি হয় এবং ওর উপরের অংশ হয় ছড়ানো। এ গাছটি ঐ বা গাছের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত।” লোকটি প্রশ্ন করলোঃ “ওর গুচ্ছ কত বড় হয়? তিনি উত্তর দিলেনঃ ‘কালো কাক এক মাস পর্যন্ত উড়ে যত দূর যাবে ততো বড়ো।” লোকটি জিজ্ঞেস করলোঃ “ঐ গাছের গুঁড়ি কত মোটা?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “তুমি যদি তোমার উষ্ট্রীর বাচ্চাকে ছেড়ে দাও এবং সে চলতে চলতে বৃদ্ধ হয়ে পড়ে যায় তবুও সে ঐ গাছের গুঁড়ি ঘুরে শেষ করতে পারবে না। লোকটি প্রশ্ন করলোঃ “সেখানে কি আঙ্গুর ধরবে?” তিনি জবাব দেনঃ “হ্যাঁ।” সে জিজ্ঞেস করলোঃ “কত বড়?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “তুমি কি তোমার পিতাকে তার যুথ হতে কোন মোটা-তাজা ছাগ নিয়ে যবেহ করে ওর চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তোমার মাকে দিয়ে ‘এর দ্বারা বালতি বানিয়ে নাও’ একথা বলতে শুনেছো?” সে জবাবে বলে? “হ্যাঁ।” তখন তিনি বললেনঃ “বেশ, এরূপই বড় বড় আঙ্গুরের দানা হবে। সে বললোঃ “তাহলে তো একটি আঙ্গুর দানাই আমার এবং আমার পরিবারের লোকদের জন্যে যথেষ্ট হবে?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “শুধু তোমার ও তোমার পরিবারের জন্যেই নয়, বরং তোমাদের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের জন্যেও যথেষ্ট হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যা শেষ হবে না ও যা নিষিদ্ধও হবে না। এ নয় যে, শীতকালে থাকবে এবং গ্রীষ্মকালে থাকবে না অথবা গ্রীষ্মকালে থাকবে এবং শীতকালে থাকবে না। বরং এটা হবে চিরস্থায়ী ফল। চাইলেই পাওয়া যাবে। আল্লাহর ক্ষমতা বলে সদা-সর্বদা ওটা মওজুদ থাকবে। এমন কি কোন কাঁটা শাখারও কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না এবং দূরেও হবে না। ফল পাড়তে কোন কষ্টই হবে না। এদিকে একটি ফল ভাঙ্গবে আর ওদিকে আর একটি ফল এসে ঐ স্থান পূরণ করে দিবে। যেমন এ ধরনের হাদীস ইতিপূর্বে গত হয়েছে।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আর তাদের জন্যে রয়েছে সমুচ্চ শয্যাসমূহ। এই বিছানা হবে খুবই নরম ও আরামদায়ক। হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “এর উচ্চতা হবে আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান অর্থাৎ পাঁচশ বছরের পথ। (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং আবু ঈসা তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন। এটাও লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, এ রিওয়াইয়াত শুধু রুশদ ইবনে সা’দ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে এবং তিনি দুর্বল। এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে হাতিমও (রঃ) বর্ণনা করেছেন) কোন কোন আহলুল ইলম বলেন যে, এই হাদীসের ভাবার্থ হলোঃ বিছানার উচ্চতার স্তর আসমান ও যমীনের স্তরের সমান অর্থাৎ এক স্তর অন্য স্তর হতে এই পরিমাণ উচ্চ যে, দুই স্তরের মধ্যে পাঁচশ বছরের পথের ব্যবধান রয়েছে।
হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ওর উচ্চতা আশি বছরের পথ।
এরপর (আরবী) বা সর্বনাম এনেছেন যার (আরবী) বা প্রত্যাবর্তন স্থল পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি, কেননা সম্বন্ধ বিদ্যমান রয়েছে। বিছানার বর্ণনা এসেছে যার উপর জান্নাতীদের স্ত্রীরা (হরীরা) থাকবে। সুতরাং ঐ দিকেই (আরবী) বা সর্বনামকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর (আরবী) শব্দ এসেছে। এবং (আরবী) শব্দ এর পূর্বে নেই। সুতরাং সম্বন্ধই যথেষ্ট। কিন্তু হযরত আবু উবাইদাহ (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ (আরবী) ই হলো এর (আরবী) বা প্রত্যাবর্তন স্থল।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি এই স্ত্রীদেরকে করেছি কুমারী। ইতিপূর্বে তারা ছিল একেবারে থুড়থুড়ে বুড়ী। আমি এদেরকে করেছি তরুণী ও কুমারী। তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা, কমনীয়তা, সৌন্দর্য, সচ্চরিত্রতা এবং মিষ্টিত্বের কারণে তাদের স্বামীদের নিকট খুবই প্রিয়পাত্রী হবে। কেউ কেউ বলেন যে, (আরবী) বলা হয় প্রেমের ছলনাকারিণী এবং মনোহর ভঙ্গি প্রদর্শনকারিণীকে। হাদীসে আছে যে, এরা ঐ সব মহিলা যারা দুনিয়ায় বৃদ্ধা ছিল, এখন জান্নাতে গিয়ে নব যুবতীর রূপ ধারণ করেছে। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, দুনিয়ায় তারা কুমারী অবস্থায় থাকুক অথবা বৃদ্ধা অবস্থায়ই থাকুক, জান্নাতে কিন্তু সবাই কুমারীর রূপ ধারণ করবে।
একটি বৃদ্ধা স্ত্রী লোক নবী (সঃ)-এর নিকট এসে আরয করলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার জন্যে দুআ করুন যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “হে অমুকের মা! কোন বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না।” বৃদ্ধা মহিলাটি তখন কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ (হে আমার সাহাবীবর্গ!) তোমরা তাকে খবর দাও যে, বৃদ্ধাবস্থায় কেউ জান্নাতে যাবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “তাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি বিশেষরূপে, তাদেরকে করেছি কুমারী।” (এ হাদীসটি শামায়েলে তিরমিযীতে বর্ণিত আছে)
হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে (আরবী) সম্পর্কে খবর দিন!” তিনি বলেনঃ (আরবী) হলো গৌরবর্ণের বড় বড় চক্ষু বিশিষ্টা, অত্যন্ত কালো ও বড় বড় চুল বিশিষ্টা, চুলগুলো যেন গৃধিনীর পালক (জান্নাতের এই ধরনের মহিলা)।” হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বললেনঃ (আরবী) সম্বন্ধে আমাকে সংবাদ দিন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এই জান্নাতী নারীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং ঔজ্জ্বল্য ঐ মুক্তার মত যা ঝিনুক হতে সবেমাত্র বের হয়েছে, যাতে কারো হাত পড়েনি।” তিনি বললেনঃ (আরবী)-এর তাফসীর কি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “চরিত্রবতী ও সুন্দরী সুশ্রী মহিলা।” তিনি প্রশ্ন করলেনঃ (আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য কি?” জবাবে নবী (সঃ) বললেনঃ “তাদের সৌন্দর্য ও নমনীয়তা ডিমের ঐ ঝিল্লীর মত যা ডিমের ভিতরে থাকে।” হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) (আরবী)-এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “এর দ্বারা দুনিয়ার ঐ মুসলিম জান্নাতী নারীদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা থুড়থুড়ে বুড়ী ছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং করেছেন সম্পূর্ণরূপে কুমারী ও নব যুবতী, যাদের প্রতি তাদের স্বামীরা পূর্ণমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে।” হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! দুনিয়ার নারীদের মর্যাদা বেশী, না হ্রদের মর্যাদা বেশী?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ
“হূরদের উপর দুনিয়ার নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। যেমন (ফরাশের) আস্তর অপেক্ষা বাহিরের অংশ উত্তম হয়ে থাকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “এই ফযীলতের কারণ কি?” নবী (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “নামায, রোযা এবং আল্লাহ তা’আলার অন্যান্য ইবাদত। আল্লাহ তা’আলা তাদের চেহারাকে নূর বা জ্যোতি দ্বারা এবং তাদের দেহকে রেশম দ্বারা সজ্জিত করেছেন। তাদের পরিধানে থাকবে সাদা, সবুজ, হলদে ও সোনালী বর্ণের পোশাক এবং মণি-মুক্তার অলংকার। তারা বলতে থাকবেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “আমরা সদা বিদ্যমান থাকবো, কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। আমরা নায ও নিয়ামত এবং সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারিণী, কখনো আমরা দরিদ্র ও নিয়ামত শূন্য হবে না। আমরা নিজেদের বাসস্থানে সদা অবস্থানকারিণী, কখনো আমরা সফরে গমন করবে না। আমরা সর্বদা আমাদের স্বামীদের উপর সন্তুষ্ট থাকবো, কখনো অসন্তুষ্ট হবে না, ভাগ্যবান তারাই যাদের জন্যে আমরা হবো এবং আমাদের জন্যে তারা হবে।” হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন কোন স্ত্রীলোকের দুটি, তিনটি এবং চারটিও স্বামী হয়ে যায়, এরপর তার মৃত্যু এসে যায়। মৃত্যুর পর যদি এই স্ত্রী লোকটি জান্নাতে যায় এবং তার সব স্বামীও জান্নাতী হয় তবে কার সাথে মিলিত হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “তাকে অধিকার দেয়া হবে, সে যার সাথে ইচ্ছা মিলিত হতে পারে। সুতরাং সে তার ঐ স্বামীগুলোর মধ্যে তার সাথে মিলিত হওয়া পছন্দ করবে যে দুনিয়ায় তার সাথে ভাল ব্যবহার করতো। সে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই এই (আমার এই স্বামী) আমার সাথে উত্তমরূপে জীবন যাপন করতো। সুতরাং এরই সাথে (আজ) আমার বিয়ে দিন!” হে উম্মে সালমা (রাঃ)! উত্তম চরিত্র দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিয়ে রয়েছে।” (এ হাদীসটি আবুল কাসেম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সূরের (শিঙ্গার) বিখ্যাত সুদীর্ঘ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সমস্ত মুসলমানকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করবেন। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “আমি তোমার সুপারিশ কবুল করলাম এবং তাদেরকে জানাতে পৌঁছিয়ে দেয়ার অনুমতি দিলাম।” রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি তখন তাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবো। আল্লাহর শপথ! যেমন তোমরা তোমাদের ঘরবাড়ী ও স্ত্রী-পরিজনকে চিনো, আহলে জান্নাত তাদের বাসস্থান ও স্ত্রীদেরকে এর চেয়েও বেশী চিনবে। একজন জান্নাতীর বাহাত্তরটি করে স্ত্রী হবে, যারা হবে আল্লাহর সৃষ্ট। আর দুটি করে স্ত্রী হবে আদম সন্তানের মধ্য হতে। এদেরকে এদের ইবাদতের কারণে সমস্ত স্ত্রীর উপর ফযীলত দান করা হবে। জান্নাতী ব্যক্তি তাদের এক একজনের কাছে যাবে। প্রত্যেকে এমন প্রাসাদে অবস্থান করবে যা হবে পদ্মরাগ নির্মিত। আর ঐ পালঙ্গের উপর থাকবে যা সোনার তার দিয়ে বানানো থাকবে এবং তাতে মণি-মুক্তা বসানো থাকবে। প্রত্যেকে মিহিন রেশম ও পুরু রেশমের সত্তর জোড়া কাপড় পরিধান করে থাকবে। এই স্ত্রী এমন নমনীয়া ও উজ্জ্বল হবে যে, স্বামী তার কোমরে হাত রেখে বক্ষের দিকে তাকালে সবই দেখতে পাবে। কাপড়, গোশত, অস্থি ইত্যাদি কোন জিনিসই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। তার পদনালীর মজ্জা পর্যন্ত সে দেখতে পাবে। অনুরূপভাবে জান্নাতীর দেহও হবে জ্যোতির্ময়। মোটকথা, এ তার দর্পণ হবে এবং সে এর দর্পণ হবে। জান্নাতী স্বামী তার স্ত্রীর সাথে শান্তিময় মিলনে মশগুল হয়ে পড়বে। স্বামী-স্ত্রী কেউই ক্লান্ত হবে না। কেউই কারো প্রতি বিরক্ত হবে না। স্বামী যখনই স্ত্রীকে কাছে করবে তখনই তাকে কুমারী পাবে। তার অঙ্গ অবসন্ন হবে না এবং তার কাছে কিছুই কঠিনও ঠেকবে না। সেখানে বিশেষ পানি (শুক্র) থাকবে না যাতে ঘৃণা আসে। তারা দু’জন এভাবে লিপ্ত থাকবে এমতাবস্থায় জান্নাতী ব্যক্তির কানে শব্দ আসবেঃ “এটা তো আমাদের খুব ভালই জানা আছে। যে, আপনাদের কারো মনের আকাক্ষা মিটবে না, কিন্তু আপনার অন্যান্য স্ত্রীরাও তো আছে?” তখন ঐ জান্নাতী ব্যক্তি বের হয়ে আসবে এবং এক একজনের কাছে যাবে। যার কাছে যাবে সেই তাকে দেখে বলে উঠবেঃ “আল্লাহর কসম! জান্নাতে আমার জন্যে আপনার চেয়ে ভাল জিনিস আর কিছুই নেই। আপনার চেয়ে অধিক ভালবাসা আমার কারো প্রতি নেই।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জান্নাতে জান্নাতী লোকে স্ত্রী সঙ্গমও করবে কি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যাঁ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে সেই আল্লাহর শপথ! সত্যি জান্নাতবাসী জান্নাতে স্ত্রী সঙ্গম করবে এবং খুব ভালভাবে উত্তম পন্থাতেই করবে। যখন তারা পৃথক হবে তখনই স্ত্রী এমনই পাক সাফ কুমারী হয়ে যাবে যে, তাকে যেন
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জান্নাতে মুমিনকে এতো এতো স্ত্রীদের কাছে যাওয়ার শক্তি দান করা হবে।” হযরত আনাস (রাঃ) তখন জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এতো ক্ষমতা সে রাখবে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “একশজন লোকের সমান শক্তি তাকে দান করা হবে।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি জান্নাতে আমাদের স্ত্রীদের সাথে মিলিত হবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “প্রতিদিন একজন লোক একশজন কুমারীর সাথে মিলিত হবে।” (এ হাদীসটি আবুল কাসেম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাফিয আবদুল্লাহ মুকাদ্দাসী (রঃ) বলেনঃ “আমার মতে এ হাদীসটি শর্তে সহীহ এর উপর রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবী)-এর তাফসীরে বলেন যে, জান্নাতে স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি আসক্ত হবে এবং স্বামীও তার স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হবে।
ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর অর্থ হলোঃ মনোহর ও চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিকারিণী। এক সনদে বর্ণিত আছে যে, এর অর্থ হলোঃ কমনীয় ভাব প্রদর্শনকারিণী। তামীম ইবনে হাযম (রঃ) বলেন যে, (আরবী) ঐ স্ত্রীলোককে বলা হয় যে তার স্বামীর মন তার মুঠোর মধ্যে রাখে। যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর অর্থ হলো উত্তম ও মধুর বচন। স্ত্রী তার স্বামীর অন্তর মোহিত করে দেয়। যখন কিছু বলে তখন মনে হয় যেন ফুল ঝরে পড়ছে এবং নূর বা জ্যোতি বর্ষিত হচ্ছে।
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে তাদেরকে (আরবী) বলার কারণ এই যে, তাদের কথাবার্তা আরবী ভাষায় হবে।
(আরবী)-এর অর্থ হলো সমবয়স্কা অর্থাৎ সবাই তেত্রিশ বছর বয়স্কা। এও অর্থ হয় যে, স্বামী এবং তার স্ত্রীদের স্বভাব চরিত্র সম্পূর্ণ একই রকম হবে। স্বামী যা পছন্দ করে স্ত্রীও তাই পছন্দ করে এবং স্বামী যা অপছন্দ করে স্ত্রীও তাই অপছন্দ করে।
এ অর্থও বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে কোন হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা থাকবে না। তারা পরস্পর সমবয়স্কা হবে, যাতে অকৃত্রিমভাবে একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারে এবং খেলা-ধুলা ও লাফালাফি করতে পারে।
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হুরেরা একটা চমৎকার বাগানে একত্রিত হয়ে এমন মধুর সুরে গান গায় যে, এরূপ মিষ্টি সুরের গান সৃষ্টজীব কখনো শুনেনি। তাদের গান ওটাই হবে যা উপরে বর্ণিত হলো।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এটাকে গারীব বলেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “বড় বড় চক্ষু বিশিষ্ট হৃরেরা জান্নাতে গান গাইবে। তারা বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমরা পাক-পবিত্র, চরিত্রবতী ও সুশ্রী মহিলা, আমাদেরকে সম্মানিত স্বামীদের জন্যে লুক্কায়িত রাখা হয়েছে। অন্য রিওয়াইয়াতে (আরবী)-এর স্থলে শব্দ এসেছে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এদেরকে ডান দিকের লোকদের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাদেরই জন্যে রক্ষিত রাখা হয়েছে। কিন্তু বেশী প্রকাশমান এটাই যে, এটা …(আরবী)-এর সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ আমি তাদেরকে তাদের জন্যে সৃষ্টি করেছি।
হযরত আবু সুলাইমান দারানী (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাযের পর দু’আ করতে শুরু করি। ঠাণ্ডা খুব কঠিন ছিল এবং খুব কুয়াশা পড়েছিল বলে আমি দু’হাত উঠাতে পারছিলাম না। সুতরাং আমি এক হাতেই দু’আ করতে থাকি। দু’আর অবস্থাতেই আমাকে ন্দ্রিীয় চেপে ধরে। স্বপ্নে আমি একটি হ্রকে দেখতে পাই, যার মত সুন্দরী ও নূরানী চেহারার মহিলা ইতিপূর্বে কখনো আমার চোখে পড়েনি। সে আমাকে বলেঃ “হে আবূ সুলাইমান! আপনি এক হাতে দু’আ করছেন? অথচ আপনার এটা ধারণা নেই যে, পাঁচশ বছর হতে আল্লাহ তা’আলা আমাকে আপনার জন্যে তার খাস নিয়ামতের দ্বারা লালন পালন করছেন”।
এও হতে পারে যে, এই (আরবী) সম্পর্কযুক্ত (আরবী)-এর সাথে। অর্থাৎ তাদেরই সমবয়স্কা হবে। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রথম যে দলটি জান্নাতে যাবে তাদের চেহারা চৌদ্দ তারিখের চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল হবে। তাদের পরবর্তী দলের চেহারা অত্যন্ত উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বল হবে। তারা পায়খানা, প্রস্রাব, থুথু এবং নাকের শ্লেষ্ম হতে পবিত্র হবে। তাদের কংকন হবে স্বর্ণনির্মিত। তাদের দেহের ঘর্ম মৃগনাভীর মত সুগন্ধময় হবে। তাদের আংটিগুলো হবে মুক্তা নির্মিত। বড় বড় চক্ষু বিশিষ্টা হুরেরা হবে তাদের স্ত্রী। তাদের সবারই চরিত্র হবে একই ব্যক্তির মত। তারা সবাই তাদের পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর আকৃতিতে ষাট হাত দীর্ঘ দেহ বিশিষ্ট হবে।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতবাসী চুল বিহীন, শ্মশ্রুবিহীন, গৌরবর্ণের উত্তম চরিত্র বিশিষ্ট, সুন্দর, কাজল কালো চক্ষু বিশিষ্ট, তেত্রিশ বছর বয়স্ক, ষাট হাত দীর্ঘ ও সাত হাত চওড়া, মযবূত দেহ বিশিষ্ট হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর কিছু অংশ জামে তিরমিযীতেও বর্ণিত হয়েছে)
অন্য এক হাদীসে আছে যে, যে কোন বয়সে মারা যাক না কেন, জান্নাতে প্রবেশের সময় সে তেত্রিশ বছর বয়স্ক হবে এবং ঐ বয়সেই সদা-সর্বদা থাকবে। জাহান্নামীদের অবস্থাও অনুরূপ হবে।” (এটা ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, তাদের দেহ ফেরেশতাদের হাতে ষাট হাত হবে। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আহলুল জান্নাত জান্নাতে যাবে এমন অবস্থায় যে, তাদের দেহ হবে হযরত আদম (আঃ)-এর মত, সৌন্দর্য হবে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মত, বয়স হবে হযরত ঈসা (আঃ)-এর মত অর্থাৎ তেত্রিশ বছর এবং ভাষা হবে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মত অর্থাৎ আরবী। তারা হবে চুলবিহীন এবং কাজল কালো চক্ষুবিশিষ্ট।” (এ হাদীসটি আবু বকর ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, জান্নাতে প্রবেশের পরেই তাদেরকে জান্নাতের একটি গাছের নিকট নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানে তাদেরকে কাপড় পরানো হবে। তাদের কাপড় না পচবে, না পুরানো হবে এবং না ময়লাযুক্ত হবে। তাদের যৌবনে কখনো ভাটা পড়বে না।
আসহাবুল ইয়ামীন বা ডান দিকের লোক অনেকে হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং অনেকে হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা বলেনঃ “আজ আমার সামনে নবীদেরকে তাদের উম্মতসহ পেশ করা হয়। কোন কোন নবী (আঃ)-এর একটি দল ছিল, কারো সাথে মাত্র তিনজন লোক ছিল এবং কারো সাথে একজনও ছিল না।” হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত কাতাদা (রঃ) এটুকু বর্ণনা করার পর নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তোমাদের মধ্যে কি একজনও বিবেকবান ব্যক্তি নেই?” (১১:৭৮) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, শেষ পর্যন্ত হযরত মূসা ইবনে ইমরান (আঃ) আগমন করেন। তার সাথে বানী ইসরাঈলের একটি বিরাট দল ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আমার প্রতিপালক! এটা কে? উত্তর হলোঃ “এটা তোমার ভাই হযরত মূসা ইবনে ইমরান (আঃ) এবং তার সাথে রয়েছে তার অনুসারী উম্মত। আমি প্রশ্ন করলামঃ হে আমার প্রতিপালক! তাহলে আমার উম্মত কোথায়? আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বললেনঃ “তোমার ডানে নীচের দিকে তাকাও।” আমি তাকালে এক বিরাট জামাআত আমার দৃষ্টিগোচর হলো। বহু লোকের চেহারা দেখা গেল। আল্লাহ তা’আলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি সন্তুষ্ট হয়েছো কি?” আমি উত্তরে বললামঃ হে আমার প্রতিপালক! হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তারপর তিনি আমাকে বললেনঃ “এখন তুমি তোমার বাম প্রান্তের দিকে তাকাও।আমি তখন তাকিয়ে দেখলাম যে, অসংখ্য লোক রয়েছে। আবার। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “এখন তুমি সন্তুষ্ট হয়েছে তো?” আমি উত্তর দিলামঃ হে আমার প্রতিপালক! হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। অতঃপর তিনি বললেনঃ “জেনে রেখো যে, এদের সাথে আরো সত্তর হাজার লোক রয়েছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে।” একথা শুনে হযরত উক্কাশা (রাঃ) দাড়িয়ে যান। তিনি বানু আসাদ গোত্রীয় মুহসিনের পুত্র ছিলেন। তিনি বদরের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। তিনি আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ তাআলার নিকট দু’আ করুন যেন তিনি আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাঁর জন্যে দুআ করেন। এ দেখে আর একটি লোক দাঁড়িয়ে যান এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর নবী (সঃ)! আমার জন্যে দুআ করুন।” তিনি বলেনঃ “উক্কাশা (রাঃ) তোমার অগ্রগামী হয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ
“হে লোক সকল! তোমাদের উপর আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, তোমাদের দ্বারা সম্ভব হলে তোমরা ঐ সত্তর হাজার লোকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে। আর এটা সম্ভব না হলে কমপক্ষে আসহাবুল ইয়ামীন বা ডান দিকের লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আমি অধিকাংশ লোককেই দেখি যে, তারা নিজেদের অবস্থার সাথেই ঝুলে পড়ে। তারপর তিনি বলেনঃ “আমি আশা রাখি যে, সমস্ত জান্নাতবাসীর এক চতুর্থাংশ তোমরাই হবে।” (বর্ণনাকারী বলেনঃ) তার একথা শুনে আমরা তাকবীর পাঠ করলাম। এরপর তিনি বললেনঃ “আমি আশা করি যে, তোমরা সমস্ত জান্নাতবাসীর এক তৃতীয়াংশ হবে। আমরা তাঁর একথা শুনে পুনরায় তাকবীর পাঠ করলাম। আবার তিনি বললেনঃ “তোমরাই হবে সমস্ত জান্নাতবাসীর অর্ধেক। এ কথা শুনে আমরা আবারও তাকবীর পাঠ করলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) পাঠ করলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ তাদের অনেকে হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং অনেকে হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে।” এখন আমরা পরস্পর আলোচনা করলাম যে, এই সত্তর হাজার লোক কারা হবে? তারপর আমরা মন্তব্য করলাম যে, এরা হবে ঐ সব লোক যারা ইসলামেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং কখনোই শিরক করেনি। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “বরং এরা হবে ঐসব লোক যারা দাগ দিয়ে নেয় না, ঝাড় ফুঁক করায় না এবং পূর্ব লক্ষণ দেখে ভাগ্যের শুভাশুভ নির্ধারণ করে না, বরং সদা প্রতিপালকের উপর নির্ভরশীল থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা বহু সনদে সাহাবীদের (রাঃ) রিওয়াইয়াতে বহু কিতাবে বিশুদ্ধতার সাথে বর্ণিত আছে)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবী)-এ আয়াতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, এই আয়াতের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দ্বারা আমার উম্মতেরই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
৪১-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা আসহাবুল ইয়ামীন বা ডান দিকের লোকদের বর্ণনা দেয়ার পর এখন আসহাবুশ শিমাল বা বাম দিকের লোকদের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, কত হতভাগা বাম দিকের দল! তারা কতই না কঠিন শাস্তি ভোগ করবে! অতঃপর তাদের শাস্তির বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা থাকবে অত্যন্ত উষ্ণ বায়ু ও উত্তপ্ত পানিতে এবং কৃষ্ণবর্ণ ধূম্রের ছায়ায়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তোমরা যাকে অস্বীকার করতে, চল তারই দিকে। চল তিন শাখা বিশিষ্ট ছায়ার দিকে, যে ছায়া শীতল নয় এবং যা রক্ষা করে না অগ্নিশিখা হতে। এটা উৎক্ষেপণ করবে বৃহৎ স্ফুলিঙ্গ অট্টালিকা তুল্য, ওটা পীতবর্ণ উষ্ট্ৰশ্রেণী সদৃশ। সেই দিন দুর্ভোগ মিথ্যা আরোপকারীদের জন্যে।” (৭৭:২৯-৩৪) এজন্যেই এখানে বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তারা থাকবে কৃষ্ণ বর্ণ ধূম্র ছায়ায়। যা শীতল নয়, আরামদায়কও নয়। এটা আরবদের বাক পদ্ধতি যে, তারা যখন কোন জিনিসের মন্দ গুণ অধিক রূপে বর্ণনা করে তখন ওর সর্বপ্রকারের খারাপ গুণ বর্ণনা করার পর (আরবী) বলে থাকে।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এ লোকেদেরকে শাস্তির যোগ্য বলার কারণ বর্ণনা করছেন যে, দুনিয়ায় তাদেরকে যে নিয়ামতের অধিকারী করা হয়েছিল তার মধ্যে তারা মত্ত ছিল। রাসূলদের (আঃ) কথায় তারা মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেনি। তারা ভোগ-বিলাসে সম্পূর্ণরূপে মগ্ন ছিল এবং অবিরাম ঘোরতর পাপকর্মে লিপ্ত ছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি এই যে, (আরবী) দ্বারা কুফরী ও শিরক উদ্দেশ্য। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মিথ্যা কসম।
এরপর তাদের আর একটি দোষের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা কিয়ামত সংঘটিত হওয়াকেও অসম্ভব মনে করে। তারা এটাকে মিথ্যা মনে করে এবং জ্ঞান সম্পর্কীয় দলীল পেশ করে যে, মৃত্যুর পরে মাটিতে মিশে গিয়ে পুনরায় জীবিত হওয়া কি কখনো সম্ভব হতে পারে? তাদেরকে উত্তর দেয়া হচ্ছে যে, কিয়ামতের দিন সমস্ত আদম সন্তানকে পুনরায় নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে এবং সবাই এক মাঠে একত্রিত হবে। একজন লোকও এমন থাকবে না যে দুনিয়ায় এসেছে এবং সেখানে থাকবে না। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “এটা সেই দিন যেদিন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে, এটা সেই দিন যেদিন সকলকে উপস্থিত করা হবে। আর আমি নির্দিষ্ট কিছুকালের জন্যে ওটা স্থগিত রাখি মাত্র। যখন সেদিন আসবে তখন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত। কেউ কথা বলতে পারবে না। তাদের মধ্যে কেউ হবে হতভাগ্য এবং কেউ হবে ভাগ্যবান।” (১১:১০৩-১০৫) এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা এখানে বলেনঃ “সকলকে একত্রিত করা হবে এক নির্ধারিত দিনের নির্দিষ্ট সময়ে।” কিয়ামতের দিন এবং সময় নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত রয়েছে। কম বেশী এবং আগে পরে হবে না।
প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর হে বিভ্রান্ত মিথ্যা আরোপকারীরা! তোমরা অবশ্যই আহার করবে যাকূম বৃক্ষ হতে এবং ওটা দ্বারা তোমরা উদর পূর্ণ করবে। কেননা, ওটা জোরপূর্বক তোমাদের কণ্ঠনালীতে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। তারপর তোমরা পান করবে অত্যুষ্ণ পানি এবং ঐ পানি তোমরা পান করবে তৃষ্ণার্ত উষ্ট্রের ন্যায়।
(আরবী) শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হলো (আরবী) এবং স্ত্রীলিঙ্গ (আরবী) হবে। এটাকে (আরবী) এবং (আরবী) ও বলা হয়। কঠিন তৃষ্ণার্ত উষ্ট্রকে (আরবী) বলা হয়, যার পিপাসাযুক্ত রোগ রয়েছে। সে পানি চুষে নেয় কিন্তু পিপাসা দূর হয় না। এই রোগেই সে শেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনুরূপভাবে জাহান্নামীকে গরম পানি পান করাবো, যা নিজেই একটা জঘন্যতম শাস্তি হবে। সুতরাং এর দ্বারা পিপাসা কিরূপে নিবারণ হতে পারে?
হযরত খালিদ ইবনে মাদান (রাঃ) বলেন যে, একই নিঃশ্বাসে পানি পান করাও পিপাসার্ত উষ্ট্রের পানের সাথে তুলনীয়। এ জন্যে এভাবে পানি পান করা মাকরূহ!
এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ “কিয়ামতের দিন এটাই হবে তাদের আপ্যায়ন। যেমন মুমিনদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্যে আছে ফিরদাউসের উদ্যান।” (১৮:১০৭) অর্থাৎ সম্মানিত আপ্যায়ন।