Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫১)
[*তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন:-
*কি ব্যাপার যে, তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করছো না?:-
*যারা বিজয়ের পরে অর্থ ব্যয় করবে ও জিহাদ করবে তারা কখনো সমকক্ষ হতে পারে না !:-
*এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ঋণ দিতে পারে?:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ।
পারা:২৭
১-১১ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১
سَبَّحَ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۱﴾
যমীন ও আসমানসমূহের প্রতিটি জিনিসই আল্লাহর তাসবীহ করেছে। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও অতিশয় বিজ্ঞ।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-২
لَہٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۚ وَ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۲﴾
পৃথিবী ও আকাশ সাম্রাজ্যের সার্বভৌম মালিক তিনিই। তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৩
ہُوَ الۡاَوَّلُ وَ الۡاٰخِرُ وَ الظَّاہِرُ وَ الۡبَاطِنُ ۚ وَ ہُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۳﴾
তিনিই আদি তিনি অন্ত এবং তিনিই প্রকাশিত তিনিই গোপন।তিনি সব বিষয়ে অবহিত।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৪
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ؕ یَعۡلَمُ مَا یَلِجُ فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا یَخۡرُجُ مِنۡہَا وَ مَا یَنۡزِلُ مِنَ السَّمَآءِ وَ مَا یَعۡرُجُ فِیۡہَا ؕ وَ ہُوَ مَعَکُمۡ اَیۡنَ مَا کُنۡتُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۴﴾
তিনিই আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর আরশে সমাসীন হয়েছেন।৪ যা কিছু মাটির মধ্যে প্রবেশ করে, যা কিছু তা থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কিছু আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু আসমানে উঠে যায় তা তিনি জানেন। তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সাথে আছেন। তোমরা যা করছো আল্লাহ তা দেখছেন।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৫
لَہٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ ﴿۵﴾
আসমান ও যমীনের নিরংকুশ সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র তাঁরই। সব ব্যাপারের ফায়সালার জন্য তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হয়।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৬
یُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّہَارِ وَ یُوۡلِجُ النَّہَارَ فِی الَّیۡلِ ؕ وَ ہُوَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۶﴾
তিনিই রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করেন। তিনি অন্তরের গোপন কথা পর্যন্ত জানেন।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৭
اٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ اَنۡفِقُوۡا مِمَّا جَعَلَکُمۡ مُّسۡتَخۡلَفِیۡنَ فِیۡہِ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ اَنۡفَقُوۡا لَہُمۡ اَجۡرٌ کَبِیۡرٌ ﴿۷﴾
তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা হতে ব্যয় কর। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৮
وَ مَا لَکُمۡ لَا تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ ۚ وَ الرَّسُوۡلُ یَدۡعُوۡکُمۡ لِتُؤۡمِنُوۡا بِرَبِّکُمۡ وَ قَدۡ اَخَذَ مِیۡثَاقَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸﴾
তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনছো না? অথচ তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আনার জন্য রসূল তোমাদের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন অথচ তিনি তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। যদি তোমরা সত্যিই স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত হও!
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-৯
ہُوَ الَّذِیۡ یُنَزِّلُ عَلٰی عَبۡدِہٖۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ لِّیُخۡرِجَکُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ بِکُمۡ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۹﴾
সেই মহান সত্তা তো তিনিই যিনি তাঁর বান্দার কাছে স্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করছেন যাতে তোমাদেরকে অন্ধাকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতীব দয়ালু ও মেহেরবান।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১০
وَ مَا لَکُمۡ اَلَّا تُنۡفِقُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ لِلّٰہِ مِیۡرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ لَا یَسۡتَوِیۡ مِنۡکُمۡ مَّنۡ اَنۡفَقَ مِنۡ قَبۡلِ الۡفَتۡحِ وَ قٰتَلَ ؕ اُولٰٓئِکَ اَعۡظَمُ دَرَجَۃً مِّنَ الَّذِیۡنَ اَنۡفَقُوۡا مِنۡۢ بَعۡدُ وَ قٰتَلُوۡا ؕ وَ کُلًّا وَّعَدَ اللّٰہُ الۡحُسۡنٰی ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿٪۱۰﴾
কি ব্যাপার যে, তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করছো না? অথচ যমীন ও আসমানের উত্তরাধিকার তাঁরই। তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের পরে অর্থ ব্যয় করবে ও জিহাদ করবে তারা কখনো সেসব বিজয়ের সমকক্ষ হতে পারে না যারা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। বিজয়ের পরে ব্যয়কারী ও জিহাদকারীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা অনেক বেশী। যদিও আল্লাহ উভয়কে ভাল প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।তোমরা যা করছো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১১
مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یُقۡرِضُ اللّٰہَ قَرۡضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَہٗ لَہٗ وَ لَہٗۤ اَجۡرٌ کَرِیۡمٌ ﴿ۚ۱۱﴾
এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ঋণ দিতে পারে? উত্তম ঋণ যাতে আল্লাহ তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেন। আর সেদিন তার জন্য রয়েছে সর্বোত্তম প্রতিদান।
১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটি সামগ্রিকভাবে মুসলিম জাতিকে আহবান জানায় যে, যে ইসলামের প্রতি সে ঈমান এনেছে, তা যেন তার নিজ জীবনে পরিপূর্ণরূপে ও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করে। মহান আল্লাহর আহবানে যে মহাসত্যের প্রতি সে একাগ্র ও একনিষ্ঠভাবে সাড়া দিয়েছে, তার পথে সে যেন আর কোনাে কার্পণ্য না করে এবং কোনাে বাধাবিপত্তি না মানে। জান হােক বা মাল হােক, অন্তর্দ্বন্দ্ব হােক বা মনের কোণে লুকানাে কোনাে চিন্তা ভাবনা হােক, কোনাে কিছুই যেন তার আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে। আল্লাহর এই দ্বীন হচ্ছে সেই মহাসত্য, যা পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষকে আল্লাহর অনুগত বান্দায় পরিণত করে। আল্লাহর মানদন্ডই তার মানদন্ড হয়ে যায় এবং যে মূল্যবােধ দ্বারা সে গৌরব বােধ করে এবং যে মূল্যবােধ অর্জন করার জন্যে সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তা হয় আল্লাহর নির্ধারিত মূল্যবােধ। এই মূল্যবােধই তার দাঁড়িপাল্লায় সব সময় ভারী হয়ে থাকে। এই মহাসত্যই মানুষের মন মগযে আল্লাহর অস্তিত্ব উৎকীর্ণ করে দেয়। ফলে তার মন আল্লাহর স্মরণে বিগলিত ও প্রকম্পিত হয় এবং তা আল্লাহর কাছে আশ্রয় গ্রহণের পথে সকল বাধা ডিংগাতে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। এই মহাসত্যের ভিত্তিতেই এ সূরা মুসলিম জাতিকে আল্লাহর পথে জান ও মাল উৎসর্গ করার আহবান জানায়। যথা, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনাে এবং আল্লাহ তায়ালা তােমাদের যে সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়েছেন তা ব্যয় করো।… তোমরা যা কিছু করাে, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। অনুরূপভাবে এই সত্যের আলােকেই মুসলিম জাতিকে আল্লাহর স্মরণে বিগলিত হবার এবং আল্লাহ তায়ালা যে সত্য নাযিল করেছেন তার প্রতি অনুগত হবার আহবান জানায়। যাতে ঈমানের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট বিনয় ও আনুগত্য তাকে আল্লাহর পথে জান-মাল ব্যয়ে অনুপ্রাণিত করতে পারে। যেমন বলা হয়েছে, মােমেনদের কাছে সেই সময়টি কি আসেনি, যখন আল্লাহর স্মরণে তাদের মন বিগলিত ও বিনয়ী হবে… অনুরূপভাবে এ সূরায় সত্যের দাঁড়িপাল্লায় একদিকে দুনিয়ার মূল্যবােধ, অপরদিকে আখেরাতের মূল্যবোেধকে রেখে কোন্টি অগ্রাধিকার লাভের যােগ্য তা বেছে নেয়ার জন্যে এবং যেটি চিরস্থায়ী তা গ্রহণ করার জন্যে আহ্বান জানানাে হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘জেনে রেখাে, দুনিয়ার জীবন খেলাধুলা, সাজসজ্জা, পারস্পরিক দম্ভ, ধনজনের আধিক্যের প্রতিযােগিতা ছাড়া আর কিছু নয়… আল্লাহ তায়ালা বিপুল অনুগ্রহের অধিকারী। সূরার বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, যদিও এতে ইসলামের চিরন্তন ও সাধারণ দাওয়াতই প্রতিফলিত হয়েছে, তথাপি এর পাশাপাশি এতে এই সূরার অবতরণকালীন সময়কার মদীনার মুসলিম সমাজের বাস্তব অবস্থা নিয়েও আলােচনা করা হয়েছে। হিজরী ৪র্থ বছর থেকে শুরু করে মক্কা বিজয়ের পরবর্তী সময় পর্যন্তকার অবস্থা এই আলােচনার আওতাধীন। এই সমাজে একদিকে ছিলাে আনসার এবং মােহাজেরদের ন্যায় অগ্রণী ও তেজোদ্দীপ্ত মুসলমানদের দল, যারা নিজেদের জীবনে ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়নের মাধ্যমে এবং সকল পার্থিব আকর্ষণ, লােভ লালসা ও বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সর্বাত্মক আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ত্যাগের মনােভাব নিয়ে জান ও মাল আল্লাহর পথে বিসর্জন দিয়ে মানবেতিহাসের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। অপরদিকে এই অতুলনীয় মানবগােষ্ঠীর পাশাপাশি এমন একটি গােষ্ঠীও মুসলিম সমাজে বিদ্যমান ছিলাে, যাদের ঈমান অতােটা উন্নত, উৎকৃষ্ট ও একনিষ্ঠ পর্যায়ের ছিলাে না। বিশেষত কাউকে মক্কা বিজয়ের পর যখন ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং লােকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে, তখন মুসলিম সমাজে এমন একটি গােষ্ঠী বিদ্যমান ছিলো, যারা ঈমানের মহাসত্যকে ঠিক সেইভাবে উপলব্ধি করেনি এবং সেভাবে আপন জীবনে বাস্তবায়িত করেনি যেমন করেছিলাে বিজয় পূর্বকালে ঈমান আনয়নকারী একনিষ্ঠ মুসলমানরা। বিজয়ােত্তর কালের এই মুসলমানদের পক্ষে আল্লাহর পথে জান ও মালের ত্যাগ স্বীকার করা অত্যন্ত কঠিন ছিলাে এবং পার্থিব জীবনের রূপসৌন্দর্যের মোহ তাদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করতাে। ফলে তারা দুনিয়ার আকর্ষণ ও প্রলােভনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারতাে না। সূরা হাদীদ এই গােষ্ঠীটিকে দুনিয়ার মােহ থেকে মুক্ত করে ঈমানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার জন্যে উপদেশ দেয় ও প্রেরণা যোগায়। ঈমানের এই পর্যায়ে উন্নীত হলে দুনিয়ার মােহ আপন বেড়াজালে আটকে রাখতে পারে না এবং কোনাে বাধাই তার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। এই উভয় গােষ্ঠী থেকে পৃথক আরাে একটা গােষ্ঠী ছিলাে মদীনায়। তারা হচ্ছে মােনাফেক গােষ্ঠী। এর চিহ্নিত ছিলাে না। মুসলমানদের সাথে মিলে-মিশে থাকতাে। বিশেষত ইসলামের বিজয় লাভের পর তারা গা ঢাকা দিতে বাধ্য হলাে। অথচ তাদের মানসিকতায় কোনাে পরিবর্তন আসেনি। যথারীতি তাদের মন ছিলাে দুমুখাে। তারা ছিলাে সুযােগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী আর মুসলমানদের দুর্যোগ দুর্বিপাক প্রত্যাশী। কেয়ামতের দিন যখন এরা চিহ্নিত ও পৃথক হতে বাধ্য হবে এবং গা ঢাকা দেয়ার আর কোনাে সুযোগ পাবে না, তখন তাদের কী পরিণতি হবে, তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে পর পর তিনটি আয়াতে, যেদিন তুমি মােমেন পুরুষ ও নারীদের দেখবে তাদের জ্যোতি তাদের সামনে দিয়ে ও ডান দিক দিয়ে ছুটতে থাকবে…। এ ছাড়া যে ইহুদী ও খৃষ্টান জনগােষ্ঠী তখনাে আরব উপদ্বীপে অবশিষ্ট ছিলাে, তাদের প্রতিও এই সূরায় ইংগিত করা হয়েছে। তাদের তত্কালীন ভূমিকা, আচরণ ও হালচালের কথা এ সূরায় আলােচিত হয়েছে। আর এ আয়াতে মােমেনদের তাদের মতাে না হওয়ার জন্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে গিয়ে তাদের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। এ ইংগিত খুব সম্ভবত ইহুদীদের প্রতি। সূরার শেষের দিকে একটি আয়াতে খৃষ্টানদের কথাও আলােচিত হয়েছে এবং বৈরাগ্যবাদসহ তাদের বিভিন্ন ভ্রান্ত নীতির সমালােচনা করা হয়েছে। যেহেতু সূরার সর্বপ্রধান কেন্দ্রীয় বক্তব্য হৃদয়ে ঈমান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ঈমান থেকে উদ্ভূত বিনয়, আল্লাহভীতি, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরােপ সংক্রান্ত, তাই সে সময়ে মুসলিম সমাজে বিরাজমান অপেক্ষাকৃত কম পরিপক্ক মােমেনদের মনে ঈমান মযবুত করার লক্ষ্যে সূরায় ক্রমাগত আলােচনা চালানাে হয়েছে। বস্তুত এ ধরনের লােকেরা শুধু যে মদীনার মুসলমানদের মধ্যেই ছিলাে তা নয় বরং সকল যুগের মুসলিম সমাজেই থাকে। এ আলােচনা এমন প্রভাবশালী ও কার্যকর বাচনভংগিতে করা হয়েছে, যা মক্কী সূরার বাচনভংগির সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ এবং যা মন মগয ও চেতনা অনুভূতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। বিশেষভাবে সূরার সূচনাই করা হয়েছে অত্যন্ত প্রভাবশালী ভংগিতে। এতে আল্লাহর কতিপয় গুণ মানব হৃদয়ের সামনে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এ সব গুণ বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহর একক অস্তিত্ব ও সমগ্র বিশ্বচরাচরে তার নিরংকুশ সার্বভৌম এবং কর্তৃত্বের পরিচয় দিয়ে মানুষকে তার প্রতি একাগ্র ও একনিষ্ঠ বানানাের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর মানুষের মনের অভ্যন্তরে লুকানাে গুপ্তভেদও যে আল্লাহ তায়ালা জানেন, সে কথা ব্যক্ত করে তার প্রতি সকল প্রাণী ও জড় বস্তুর আনুগত্য এবং তার এবাদাত উপাসনা করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। সূরার শুরু থেকে একাধিক্রমে ছয়টি আয়াত জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে আল্লাহর এই পরিচিতি ও গুণাবলীর বর্ণনা। যথা, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই গুণগান করে চলেছে আল্লাহর এবং তিনি মহাপরাক্রান্ত মহা কৌশলী।… এবং তিনি মানুষের হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকানাে বিষয় অবগত। সূরার সূচনাতেই এরূপ বক্তব্য থাকা হৃদয়কে ভীত সন্ত্রস্ত ও প্রকম্পিত করে তােলার জন্যে যথেষ্ট। অনুরূপভাবে, এটা মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্ত হওয়া এবং তার জন্যে জান মালের ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধা সংকোচ ও কার্পণ্য থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু সূরার পরবর্তী আয়াতসমূহে প্রচুর আবেগ উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী বক্তব্য রয়েছে। এ সব উদ্দীপনা ও প্রেরণা সঞ্চারকারী বক্তব্য উপরােক্ত উদাত্ত আহবানের মাঝে মাঝে এসেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় তা উক্ত আহবানকে জোরদার করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মােমেনদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘তাদের জ্যোতি তাদের সামনে ও ডানে দৌড়াতে থাকবে।’ অনুরূপভাবে আরেকটি আয়াতে দুনিয়ার জীবন ও তার সহায় সম্পদকে আখেরাত ও তার বড় বড় ঘটনাবলীর সামনে নিতান্ত তুচ্ছ নগণ্য করে তুলে ধরা হয়েছে। অনুরূপভাবে আরেক জায়গায় অদৃষ্ট সম্পর্কে বক্তব্য রাখা হয়েছে। এ বক্তব্য রেখে মানুষের মনকে সেই অদৃষ্টের দিকে আবর্তিত করা হয়েছে, যা সৃষ্টি জগতের সব কিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, পৃথিবীতে এবং তােমাদের ওপর যে বিপদ আপদই আসুক, তা পৃথিবী সৃষ্টির আগে থেকেই একটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে।… আল্লাহ তায়ালা অভাবশূন্য স্বতপ্রশংসিত।’ এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর পথে থাকা ও চলা অবস্থায় মানুষের ওপর ভালাে বা মন্দ যাই আসুক, তার মন যেন স্থির অবিচল থাকে। খারাপ অবস্থায় বিমর্ষ এবং ভালো অবস্থায় যেন দাম্ভিক না হয়। মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ যাই আসুক, সে যেন কোনাে কারণ, পরিস্থিতি বা দুর্ঘটনাকে আল্লাহর সাথে অংশীদার না বানিয়ে বসে। কেননা, এ সবই যে নির্দিষ্ট পরিমাণে নির্দিষ্ট সময়ে আসবেই, তা অবধারিত। সব কিছুর ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে, সে কথা বিশ্বাস করতে হবে। সুরাটি স্বীয় আলােচ্য বিষয় নিয়ে দুই পর্যায়ে আলােচনা করেছে। প্রথমটি আমরা এ ভূমিকার শুরুতে উল্লেখ করেছি। আর দ্বিতীয়টি সম্পর্কে সূরার মাঝে বক্তব্য এসেছে, কিন্তু এই দুটো বিষয়ই পরস্পরে সম্পৃক্ত ও সামঞ্জস্যশীল। এ বিষয়ে আপাতত আর আলােচনা করতে চাই না। এখন আমরা সূরাটির বিস্তারিত তাফসীর আলােচনা করবাে।
ফী জিলালিল কুরআন:
‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবই আল্লাহর গুণকীর্তন করে।… তিনি অন্তর্যামী।’ সূরার প্রথমাংশের এই মনােনীত বাণীতে আল্লাহর যে গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, তিনি যাবতীয় জিনিসের স্রষ্টা, যাবতীয় জিনিসকে পরিবেষ্টনকারী, অর্থাৎ যাবতীয় জিনিসের ওপর নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী, সব কিছুর ওপর আধিপত্যশীল, সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, আকাশ ও পৃথিবীতে তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি অন্তর্যামী এবং বিশ্বচরাচরে যা কিছু ঘটে তার তিনিই উদ্যোক্তা। *সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহর গুণগান করে : সূরার সূচনার এ সকল বক্তব্য মানুষের মনকে প্রকম্পিত ও আলােড়িত করে এবং তার মনকে সারা বিশ্বে পরিভ্রমণ করায়। অথচ পৃথিবীর কোথাও সে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না, আর কাউকে অনুভব করে না, তার শক্তির নাগালের বাইরে কোনাে স্থান সে দেখতে পায়। না, তার জ্ঞানের আওতার বাইরে কিছুই সে দেখতে পায় না, তার ছাড়া আর কারাে কাছে প্রত্যাবর্তন এবং আর কারাে প্রতি একাগ্র হওয়ার কোনাে অবকাশ সে দেখতে পায় না। প্রথম আয়াত আল্লাহ তায়ালা বলেন, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা আল্লাহর গুণগান করে। বস্তুত তিনি মহাকুশলী এবং মহাপরাক্রমশালী। সূরার শুরুতে এভাবেই কোরআনের ভাষণ শুরু হয়েছে, আর এর প্রতিক্রিয়ায় গােটা বিশ্বজগত আল্লাহর গুণগানে মুখর হয়ে ওঠে। আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু এক ধরনের ঝিরঝির শব্দ করে। মুক্তমনা ও স্বাধীনচেতা মানুষ মাত্রই এ শব্দ শুনতে পায়, যদি তার হৃদয়ের কানে কোনাে পর্দা না পড়ে থাকে। কোরআনের এ উক্তির প্রকাশ্য অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থ গ্রহণ করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। কেননা, এ উক্তি স্বয়ং আল্লাহর, যিনি গোটা বিশ্ব নিখিলের স্রষ্টা। এ বিশ্ব প্রকৃতির স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য কী, তা আমাদের জানা নেই। যিনি এগুলাের স্রষ্টা, তার চেয়ে নির্ভুলভাবে এটা জানা আর কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি যখন বলেছেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহর গুণগান করে’, তখন তার অর্থই এই যে, আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস আল্লাহর গুণগান করে। এখানে আর কোনাে ওলটপালট ও ব্যাখ্যার মারপ্যাচ দেয়ার অবকাশ নেই। আমরা এ উক্তি থেকে নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর ও পদার্থের প্রাণ আছে, যা দিয়ে সে নিজ স্রষ্টার প্রশংসা ও গুণগান করে, তার প্রতি মনােনিবেশ করে। এ তত্ত্বটি বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা যেমন সমর্থিত হয়, তেমনি কারাে কারাে হৃদয় পরম স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্যের মুহূর্তে এবং বস্তুর বাহ্যিক রূপের আড়ালে যে আসল রূপ রয়েছে তার সাথে সংযােগ সাধিত হওয়ার সময় অর্জিত অভিজ্ঞতার আলােকে এ তত্ত্বকে অকাট্য সত্য বলে উপলব্ধি করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে পর্বতমালা, দাউদ ও পক্ষীকুলের সাথে সাথে তােমরাও বিনীত হও।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পর্বতমালা পাখীর মতােই দাউদের সাথে বিনীত হতে পারে। হাদীসে আছে, জাবের ইবনে সামুরা বর্ণনা করেন, রাসুল(স.) বলেছেন, মক্কায় একটি পাথর আছে, নবুওত লাভকালীন রজনীগুলােতে সে আমাকে সালাম করতাে। আমি এখনাে তাকে চিনি।'(সহীহ মুসলিম) তিরমিযীতে বর্ণিত আছে, হযরত আলী(রা.) বলেন, আমি মক্কায় রসূল(স.)-এর সাথে ছিলাম। একবার তার সাথে মক্কার আশেপাশে ঘুরতে বেরুলাম। দেখলাম, যে পাহাড় বা গাছেরই সামনে দিয়ে তিনি যাচ্ছেন, সে তাকে বলছে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনাকে সালাম! বােখারীতে বর্ণিত আছে, হযরত আনাস বিন মালেক(রা.) বলেন, রসূল(স.) প্রথমে একটি লম্বা বৃক্ষকান্ডের সাথে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন। পরে যখন লােকেরা তার জন্যে একটি মিম্বার বানালাে এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি খােতবা দিতে আর করলেন, অমনি সে বৃক্ষকান্ডটি উষ্ট্রীর ন্যায় শব্দ করে কেঁদে ওঠলাে। তা শুনে রসূল(স.) নেমে এলেন এবং তার ওপর হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে সে শান্ত হয়ে গেল। এই নৈসর্গিক সত্যটি কোরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা নূরে আছে, তুমি কি দেখােনি যে, আল্লাহর জন্যে আকাশ ও পৃথিবীর সকল জিনিস এবং কাতারবন্দী পাখীরা গুণগান করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ নামায ও তাসবীহ জেনে নিয়েছে।’ সূরা হজ্জে আছে, ‘তুমি কি দেখােনি যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও বহু সংখ্যক মানুষ আল্লাহর জন্যে সিজদা করে? সূরা বনী ইসরাঈলে আছে, ‘আল্লাহর প্রশংসা সহকারে গুণকীর্তন করে না এমন কোনাে জিনিসই নেই, তবে তোমরা তাদের গুণকীর্তন বুঝতে পারে না।’ কোরআনের এসব দ্ব্যর্থহীন উক্তির এমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিতান্তই অবাঞ্ছিত, যা দুনিয়ার বস্তু ও পদার্থসমূহ সম্পর্কে আমাদের আগে থেকে তৈরী করা কল্পিত ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে, অথচ তা কোরআন থেকে গৃহীত নয়। বস্তুত সৃষ্টিজগত ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্ত, ধ্যান-ধারণ যাই থাক না কেন, তা সর্বপ্রথম এই বিশ্বজগতের স্রষ্টার সিদ্ধান্ত থেকেই উদ্ভূত হওয়া উচিত। ‘তিনি মহাপরাক্রমশালী, মহাকুশলী।’ অর্থাৎ নিজের শক্তির জোরেই তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান, আধিপত্যশীল ও পরাক্রান্ত। আর নিজের প্রজ্ঞা ও কৌশল অনুসারেই তিনি সব জিনিস তৈরী করে থাকেন। বস্তুত আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তারা যে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে, সেটা আল্লাহর পরাক্রম ও প্রজ্ঞারই ফল।
ফী জিলালিল কুরআন:
*সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার : প্রথম আয়াতের বক্তব্য এবং সমগ্র আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে মহান স্রষ্টার গুণগানকারী সৃষ্টির সমাবেশ সত্তেও মানব মনে ইন্সিত প্রেরণা ও চেতনার উন্মেষ ঘটতে বিলম্ব দেখে পরবর্তী আয়াতে মানুষকে আকাশ ও পৃথিবীর রাজ্যে নতুন সফরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাতে উক্ত চেতনার উন্মেষ ঘটা ত্বরান্বিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে তারই রাজত্ব বিরাজিত, তিনিই জীবন ও মৃত্যু দেন। আর তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’ বস্তুত আকাশ ও পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিস আল্লাহর তাসবীহ তথা গুণগান করে। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধপতি। সুতরাং এ তাসবীহ একক ও অদ্বিতীয় মনিবের তাসবীহ। এই মনিব জীবন ও মৃত্যুর স্রষ্টা। প্রতিটি প্রাণীর জীবন ও মৃত্যুর নিয়ন্তা ও নির্ধারক। তিনি যে ভাগ্য নির্ধারণ করেন তা ছাড়া কোথাও কিছু সংঘটিত হয় না। জীবন কী জিনিস, কোথা থেকে আসে তা এক গভীর রহস্য। কেউ বলতে পারে না কোথা থেকে কীভাবে জীবনের উদ্ভব ঘটেছে। কোরআন বলে, ‘আল্লাহ তায়ালা জীবন দেন। তিনি সকল প্রাণীর দেহে প্রাণের সঞ্চার করেন।’ এ সত্য কেউ অস্বীকারও করতে পারে না। এর বিপরীত কোনাে তত্ত্বও কেউ প্রমাণ করতে পারে না। মৃত্যুও জীবনের ন্যায় এক অভেদ্য রহস্য। মৃত্যুর প্রকৃতি কিরূপ তা কেউ জানে না এবং কেউ তা সৃষ্টিও করতে পারে না। কেননা, জীবন যে দিতে পারে না, সে তা ছিনিয়েও নিতে পারে না। এই দুটো জিনিস অর্থাৎ জীবনদান ও মৃত্যু সংঘটিত করা, আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহর একচ্ছত্র রাজত্ব এবং আধিপত্যের প্রতীক। ‘তিনি সকল জিনিসের ওপর ক্ষমতাশালী।’ অর্থাৎ তার ক্ষমতা সর্বব্যাপী ও সর্বাত্মক, সীমাহীন ও বাধা বন্ধনহীন। বস্তুত আল্লাহর অবাধ ইচ্ছার কার্যকারিতাও অবাধ অসীম। তাঁর ইচ্ছা যদি কোনাে কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, তবে সেটাও তার ইচ্ছাক্রমেই হয়। যার সাথে ইচ্ছার সংশ্লিষ্ট হওয়া তিনি পছন্দ করেন, তার সাথেই সংশ্লিষ্ট হয়। মানবীয় বিবেকবুদ্ধি নিজস্ব যুক্তি অনুসারে আল্লাহর ইচ্ছাকে যে ধরনের সীমায়ই আবদ্ধ বলে ধারণা করে, সে ধারণা সম্পূর্ণ বাতিল ও ভিত্তিহীন। কেননা, তা সীমাবদ্ধ মানবীয় বিবেকবুদ্ধি থেকেই উদ্ভূত। আল্লাহর ইচ্ছা যে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে নেয় সেটাও তার অবাধ ও অসীম কর্তৃত্বেরই আওতাধীন। কেননা, প্রাকৃতিক নিয়মকে সে কোনাে বাধ্যবাধকতার কারণে নয়, বরং স্বাধীনভাবেই মেনে নেয় এবং স্বাধীনভাবেই কাজে লাগায়। এই স্বাধীন ইচ্ছা প্রাকৃতিক নিয়মের পেছনে সর্বদাই সক্রিয় রয়েছে। কোরআন এই বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সে উপযুক্ত প্রসংগ পেলেই উল্লেখ করে, আল্লাহর ইচ্ছা এত অবাধ ও শর্তহীন যে, তা এমন কি তার নিজের কাজের বাধাও মানে না। এর উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর সর্বশক্তিমান হওয়ার তত্ত্বটি যেন স্পষ্ট ও স্বচ্ছ থাকে এবং এ সংক্রান্ত ধারণায় যেন কোনাে জড়তা না থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, আল্লাহ জান্নাতবাসী ও দোযাসী সম্পর্কে ওয়াদা করেছেন, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এই ওয়াদা তাঁর স্বাধীন ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত, কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছাকে খােদ তার এই ওয়াদার বাধ্যবাধকতা থেকেও মুক্ত রেখেছেন। অথচ এই ওয়াদা তার নিজেরই একটি কাজ এবং স্বেচ্ছামূলক কাজ। তিনি দোযখ ও বেহেশতের অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, কেবল তােমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া।’ এ ধরনের প্রসংগ যেখানেই এসেছে, সেখানেই তিনি এরূপ উক্তি করেছেন। মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি উদ্ভূত যুক্তি বা তার কোনাে মনগড়া ধ্যানধারণার এ অবকাশ বা ক্ষমতা নেই যে, এ উক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেয়; বরং তার কর্তব্য হলাে তার যাবতীয় ধ্যানধারণা বা সিদ্ধান্ত কোরআন থেকেই গ্রহণ করা এবং কোরআন ছাড়া আর কোনাে উৎস থেকে গ্রহণ না করা। তাই এ আয়াতের মধ্য দিয়ে মানব হৃদয়ের কাছে এই সত্যটিই প্রস্ফুটিত হয় যে, আল্লাহর একক ও একচ্ছত্র শাসনাধীন এই বিশাল বিশ্বচরাচর, তার ক্ষমতা অবাধ সীমাহীন ও সর্বাত্মক। তাই তার সৃষ্টি এ মহাবিশ্ব তারই গুণগানে নিয়ােজিত এবং তিনি যথার্থই এর উপযুক্ত। এই মহাসত্য হৃদয়ংগম করার পরও যখন মানুষের মধ্যে চেতনা ও জাগরণের সঞ্চার হয় না, তখনই তার সামনে আর একটা মহাসত্য তুলে ধরা হয়, যা অধিকতর বড় ও অধিকতর শক্তিশালী। সেটি এই যে, প্রকৃতপক্ষে এই মহাবিশ্বে স্বয়ং আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া আর কোনাে কিছুরই অস্তিত্ব নেই। তাই তার অস্তিত্ব বিশ্বজগতের আর সব কিছুকে নিজ বলয়ে ধারণ করে রেখেছে এবং সব কিছু সম্পর্কে তিনি ওয়াকিফহাল। পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই প্রথম তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশ্য ও তিনিই গোপন। আর তিনি সর্ববিষয়ে অবগত।’ যেহেতু তিনিই প্রথম, তাই তার আগে কিছু ছিলাে না, তিনিই শেষ, তাই তার পরেও কিছু নেই। তিনিই প্রকাশ্য, তাই তার চেয়ে প্রকাশ্য কিছু নেই। আর যেহেতু তিনিই গােপন, সুতরাং তার চেয়ে গােপন আর কিছু নেই। প্রথম ও শেষ এ দুটি শব্দ দ্বারা সমগ্র কাল বা সমগ্র সময় বুঝানাে হয়েছে। আর গােপন ও প্রকাশ্য এ দুটি শব্দ দ্বারা সমগ্র স্থানকে বুঝানাে হয়েছে। মানুষের মন-মগয যখন আল্লাহর এই দুটি বৈশিষ্ট্য বা গুণের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে, তখন সে মহাবিশ্বে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে অনুভব করে না। আসলে অস্তিত্বের দৃশ্যমান যাবতীয় বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই নির্ধারিত, অন্য কারাে জন্যে নয়। এমন কি খােদ এই হৃদয়ের অস্তিত্বও আল্লাহর অস্তিত্ব থেকেই উদ্ভূত। সুতরাং আল্লাহর অস্তিত্বই একমাত্র আসল অস্তিত্ব এবং প্রতিটি জিনিসের অস্তিত্বের উৎস। আর এই সত্য হচ্ছে প্রথম সত্য, যা থেকে প্রতিটি জিনিস তার সত্যতা ও বাস্তবতা অর্জন করেছে। এর বাইরে এই মহাবিশ্বে কোনাে সত্য নেই এবং কোনাে জিনিসের বাস্তব অস্তিত্ব নেই। ‘তিনি সর্ববিষয়ে অবগত।’ অর্থাৎ পূর্ণাংগ সত্যের জ্ঞান কেবল তারই আছে, আর কারাে নেই। এটি এমন জ্ঞান, যাতে তার সাথে আর কেউ শরীক নেই। এ জ্ঞানের ধরন, প্রকৃতি ও অর্জনের পন্থা একমাত্র তারই আয়ত্তাধীন। মানুষ বা অন্যান্য সৃষ্টি কেবল বস্তুনিচয়ের বাহ্যিক রূপ ও বৈশিষ্ট্য জানতে সক্ষম, অন্তর্নিহিত রূপ ও বৈশিষ্ট্য নয়। কারো অন্তরে যখন এই মহাসত্য বদ্ধমূল হয়, তখন এই বিশ্বজগতে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কোনাে জিনিসের প্রতি সে আকৃষ্ট হতে পারে না। আর এই মহাসত্য থেকে যা কিছু উদ্ভূত, তা ছাড়া আর কোনাে জিনিসের অস্তিত্বও নেই, বাস্তবতাও নেই, এমন কি মানুষের মনেরও কোনাে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। সকল জিনিসই নিছক ক্ষণস্থায়ী কল্পনামাত্র। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসহ বহাল আছেন ও থাকবেন। এই মহাসত্য হৃদয়ে বদ্ধমূল ও স্থিতিশীল হওয়ার ফলে হৃদয় স্বয়ং এই মহাসত্যের অংগে পরিণত হয়। কারাে হৃদয়ে এ মহাসত্য বদ্ধমূল হওয়ার আগ পর্যন্ত কোরআনের এই আয়াতই তার জন্যে যথেষ্ট। এই আয়াত নিয়ে, এর মর্মার্থ নিয়ে এবং এর একমাত্র মর্মার্থ পৌঁছার চেষ্টা কিভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে সে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। তাসাওউফপন্থীরা এই মৌলিক সত্য অবলম্বন করে আজীবন সাধনা করেছেন এবং বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেছেন, আমি বিশ্বজগতের প্রতিটি জিনিসের মধ্যে আল্লাহকে দেখতে পাই। কেউ বলেছেন, বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তুর অন্তরালে আল্লাহকে দেখেছি। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আমি বিশ্ব নিখিলে শুধু আল্লাহকেই দেখি, তাকে ছাড়া আর কিছুই দেখি না। এই কথাগুলাে শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করা চলে না। কেননা এ সব শব্দ এর প্রকৃত অর্থ ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়। যখন এ সব কথার শাব্দিক অর্থের উর্ধ্বে ওঠা যায়, তখন বুঝা যায়, এগুলাে সে মহাসত্যের দিকেই ইংগিত করছে। তবে মােটামুটিভাবে তাদের ওপর যে আপত্তি উত্থাপিত হয়, সেটা এই যে, তারা এ চিন্তাধারার মাধ্যমে পার্থিব জীবন উপেক্ষা করেছেন। যেহেতু ইসলাম একটা ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, তাই সে একদিকে যেমন মানুষের বিবেকের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে যে, সে এই মহাসত্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করুক এবং এরই জন্যে ও এরই উদ্দেশ্যে জীবন যাপন করুক, অপরদিকে একই সাথে সে পৃথিবীতে আল্লাহর আইন ও বিধান বাস্তবায়নের জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা সাধন, সংগ্রাম ও নিষ্ঠাসহকারে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করুক। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন সে উক্ত মহাসত্যকে পূর্ণ ভারসাম্য সহকারে এবং মানুষ ও বিশ্বজগতের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সমন্বয় সাধন করে উপলব্ধি করবে। সেই মহাসত্য দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরার পর তা থেকে বিশ্বজগতের অন্যান্য সত্য কিভাবে উদ্ভূত হয়েছে, তার উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে, ‘তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতপর আরশের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন.. এবং তিনি অন্তরের গােপন বিষয় সম্পর্কে অবহিত।’ এ তিনটি আয়াতে যে সত্যগুলাে আলাচিত হয়েছে, তা হলাে এই যে, আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি আরশের অধিপতি ও সকল সৃষ্টির ওপর নিরংকুশ কর্তৃত্বসম্পন্ন, সৃষ্টিজগতের প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে অবহিত, প্রতিটি সৃষ্টির সাথে তিনি বিরাজমান, তা সে যেখানেই থাক না কেন। সকল জিনিসের তারই কাছে প্রত্যাবর্তন অবধারিত, সৃষ্টিজগতকে তিনি সকলের দৃষ্টির বাইরে থেকে পরিচালিত করছেন এবং তিনি অন্তর্যামী। এই সব কটি সত্য উপরােক্ত মহাসত্য থেকেই উদ্ভূত। এই মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে এ সত্যগুলাে বর্ণনা করায় মানুষের মনের ওপর বিপুল প্রভাব পড়ে। বিশাল নীল আকাশ ও বিশাল পৃথিবী নিজের বিরাটত্ব, গাম্ভীর্য, পারস্পরিক সমন্বয়, অপরূপ সৌন্দর্য, সুষ্ঠ সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা এবং চিরন্তন বৈশিষ্ট্যসমূহ দ্বারা মানব হৃদয়কে প্রভাবিত ও অভিভূত করে। তা ছাড়া মানুষের হৃদয় যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, এই জিনিসগুলােও তেমনি আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং এগুলাের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও আত্মীয়সুলভ। এই সকল মহাজাগতিক জিনিসগুলাে ও সত্যগুলাের প্রতি যখন সে মনােযােগ দেয়, এগুলাের আহবান শ্রবণ করে এবং তা অনুভব করে, তখন তা তার হৃদয়ে আল্লাহর উপলব্ধি এনে দেয়। এ জিনিসগুলাে অর্থাৎ আকাশ, পৃথিবী ও তার অভ্যন্তরের প্রতিটি বস্তু তাকে যেন বলতে থাকে, তাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানুষকেও সৃষ্টি করেছেন এবং তারা যেমন আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে থাকে, তেমনি তারও আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করা উচিত। তাদের অস্তিত্ব তাদের স্রষ্টার অস্তিত্ব থেকেই উদ্ভূত। মানুষের অস্তিত্বও তদ্রূপ। সুতরাং এই মহাসত্যকেই সগৌরবে মেনে নেয়া উচিত। ছয় দিনের প্রকৃত মর্ম কি, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। আমাদের দিন রাত তাে পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফল। পৃথিবী ও সূর্যের সৃষ্টির পরই এর উৎপত্তি। সুতরাং যে ছয় দিনে আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সে দিন আর আমাদের এইদিন এক নয়। কাজেই এইদিনের প্রকৃত মর্ম কি, সেটা আমরা আল্লাহর কাছেই সমর্পণ করছি। তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের জানাবেন। আরশের ব্যাপারটাও অনুরূপ। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন, আমরা তার ওপরই ঈমান আনয়ন করি। এর প্রকৃত তাৎপর্য কি তা জানি না। তবে আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হওয়া প্রসংগে আমরা বলতে পারি, এ দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি জগতের ওপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও প্রভূত্ব বুঝানাে হয়েছে। এর একটি প্রমাণ এই যে, কোরআন থেকে আমরা অকাট্যভাবে জানতে পারি, আল্লাহর কোনাে অবস্থান্তর ঘটে না, সুতরাং এমনটি কখনাে হওয়া সম্ভব নয় যে, তিনি এক সময় আরশে অধিষ্ঠিত থাকেন না। পরে আবার অধিষ্ঠিত হন। আমরা যদি বলি, আমরা আল্লাহর আরশে অধিষ্ঠিত হওয়ায় বিশ্বাস রাখি, কিন্তু তা কিভাবে সংঘটিত হয় বুঝি না, তাহলে অতপর তিনি আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হলেন এই কথাটার কোনাে ব্যাখ্যাই করা হয় না তবে ইতিপূর্বে আমরা যে বলেছি, আরশে অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ সমগ্র সৃষ্টির ওপর নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব, সেটাই সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। এ ব্যাখ্যা আমাদের আলােচিত জীবন বিধানের আওতার বাইরে যায় না। কেননা, এ ব্যাখ্যা আমাদের মনগড়া ধ্যান ধারণা থেকে উদ্ভূত নয়। এটা খােদ কোরআনের চিন্তাধারা এবং কোরআন আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে যে ধারণা দেয়, তার সাথেই সামঞ্জস্যশীল এবং তা থেকেই উদ্ভূত। সৃষ্টি করা ও সৃষ্টিজগতের ওপর সর্বাত্মক নিয়ন্তণ এবং নিরংকুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়া আল্লাহর এই দুটি গুণের উল্লেখের অব্যবহিত পরেই তাঁর সর্বব্যাপী সূক্ষ জ্ঞানের উল্লেখ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে কোরআন নিজের কর্মক্ষেত্র ও প্রভাববলয়কে অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে বিচিত্র করেছে। এই বিরাট বিশাল কর্মক্ষেত্রে মানুষের মন যেন সর্বদা সচেতন সক্রিয় থাকে এটাই তার উদ্দেশ্য। সৃষ্টি ও কর্তৃত্ব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর গুণের কথা উল্লেখ করলে এই উদ্দেশ্য সফল হতাে না। এভাবে উল্লেখ করে সে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মনমগযকে এবং তার সকল মানসিক শক্তি ও কল্পনাকে প্রভাবিত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু প্রবেশ করে ও তা থেকে যা কিছু বহির্গত হয় এবং আকাশ থেকে যা কিছু অবতরণ করে ও তার ওপর যা কিছু আরােহণ করে সে সব সম্পর্কে তিনি অবগত।’ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য প্রাণী ও বস্তুর আগমন নির্গমন হচ্ছে। এ সবের পরিচয় ও সংখ্যা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। অনুরূপভাবে প্রতি মুহূর্তে আকাশ থেকে অসংখ্য জিনিস নেমে আসছে, যেমন বৃষ্টি, আলােকরশ্মি, উল্কা, ফেরেশতা, অদৃষ্ট ও অজানা রহস্য। আবার দৃশ্য-অদৃশ্য বহু জিনিস আকাশে ওঠেও যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসবের সীমাসংখ্যা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না! আয়াতের এই ক্ষুদ্র বাক্যটি এই নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম এবং এই অগণিত ঘটনাবলীর দিকেই ইংগিত দিচ্ছে, আকাশ ও পৃথিবীতে আগমন নির্গমনরত এবং অবতরণ ও আরােহণরত অগণিত সৃষ্টির প্রতি মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করছে আর আল্লাহর সর্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কে সর্তক করে দিচ্ছে। কেননা, আল্লাহর এই জ্ঞান এই সকল ঘটনা ও কার্যক্রমকে সর্বদা গভীরভাবে তদারক এবং নিরীক্ষণ করছে। মানুষের মন এ সব জিনিস ও ঘটনাবলীর প্রতি মনােযােগ দেয়া এবং সচেতন থাকা অবস্থায় আল্লাহর অতি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থান করে, তার বিশাল রাজ্যে বিচরণ করে এবং বিশ্ব প্রকৃতির প্রতিটি স্থানে সুতীব্র অনুভূতি ও স্বচ্ছতা সহকারে ভয়ে কম্পমান অবস্থায় পরিভ্রমণ করে। তার মন যখন আকাশ ও পৃথিবীর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত থাকে ঠিক তখনই কোরআন তাকে আল্লাহর সত্তার দিকে প্রত্যাবর্তিত করে, আর সে আল্লাহকে নিজের ঘনিষ্ঠতম সাথী, তার তৎপরতা নিরীক্ষণকারী ও তার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানী হিসাবে পায়। এ কথাই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে। ‘আর তােমরা যেখানেই থাক, তিনি তােমাদের সাথে আছেন, আর তিনি তােমাদের কার্যকলাপের প্রতি দৃষ্টি রাখছেন। এ কথাটা কোনাে রূপক অর্থে নয়, বরং স্বাভাবিক ও আসল অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা যথার্থই প্রত্যেক প্রাণী ও বস্তুর সাথে সর্বদা সর্বত্র রয়েছেন, বান্দাদের প্রতি দৃষ্টি রাখছেন এবং তাদের কার্যকলাপ দেখছেন। এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ সত্য, যা অনুধাবন করলে মানব হৃদয় পবিত্রতা অর্জন করে, উন্নত হয়, পৃথিবীর যাবতীয় লােভ লালসা থেকে মুক্ত হয় এবং নিরবচ্ছিন্ন খোদাভীতি, সতর্কতা, লজ্জা ও সকল নােংরামি থেকে সাবধানতা অর্জন করে। পরবর্তী আয়াতে পুনরায় আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব এবং আধিপত্যের বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। তবে পূর্বে যে প্রেক্ষাপটে বর্ণনা করা হয়েছে, এবারকার প্রেক্ষাপট তা থেকে স্বতন্ত্র। আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তারই এবং তাঁর কাজেই সকল বিষয় প্রত্যাবর্তন করবে। পূর্ববর্তী আয়াতে ‘আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহর’- একথা বলে জীবন ও মৃত্যু দানের ক্ষমতা এবং সর্ববিষয়ে সর্বাত্মক ক্ষমতার উল্লেখ করা হয়েছে। আর এখানে একথাটা বলার পর যাবতীয় বিষয় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে বলে ঘােষণা করা হয়েছে। আর তার কাছে সব কিছুর প্রত্যাবর্তন, আকাশ পৃথিবীতে তাঁর নিরংকুশ রাজত্ব আধিপত্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পরিপূরক। এ বিষয়টি অনুধাবন করলে হৃদয় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া যে কোনাে জিনিসের আর্কষণ ও মােহ থেকে মুক্ত হয়। যে কোনাে কাজে আল্লাহ ছাড়া আর কারাে পরােয়া করা থেকে অব্যাহতি পায়। গােপন ও প্রকাশ্যে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা অপরিহার্য মনে করে এবং সকল কাজে, কথায় ও চিন্তায় আল্লাহর আদেশ মেনে চলে। কেননা, সে জানে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে কাছে তার আশ্রয় লাভের সম্ভাবনা নেই। সুরার এই প্রথমাংশটির উপসংহারে বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব হৃদয়ের একটি সূক্ষ্ম দিক তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তিনি রাতকে দিনের অভ্যন্তরে ও দিনকে রাতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করান। আর তিনি হৃদয়ের অভ্যন্তরে কি আছে তা জানেন। রাতের অভ্যন্তরে দিনের প্রবেশ ও দিনের অভ্যন্তরে রাতের প্রবেশ একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। সেই সাথে এটি একটি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াও, চাই এর অর্থ দিনের অংশ নিয়ে রাতের দীর্ঘস্থায়ী হওয়া কিংবা রাতের অংশ নিয়ে দিনের দীর্ঘস্থায়ী হওয়া যেটাই হােক না কেন। এর অর্থ অস্ত যাওয়ার সময় দিনের মধ্যে রাতের প্রবেশ এবং উদয়ের সময় রাতের ভেতর দিনের প্রবেশও হতে পারে। প্রত্যেকের হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকানাে সব কিছু জানাও দিন রাতের আগমনের মতােই সূক্ষ্ম প্রচ্ছন্ন একটি কাজ। মনের অভ্যন্তরে লুকানাে জিনিস মাত্রই এক একটি গোপন রহস্য, যা কখনাে মন থেকে লুপ্ত হয় না। আল্লাহ কর্তৃক দিনের অভ্যন্তরে রাতকে এবং রাতের অভ্যন্তরে দিনকে প্রবেশ করানাের সূক্ষ্ম ও রহস্যময় কাজটা যে অনুধাবন করে, তার হৃদয়ে সূক্ষ্ম চিন্তা ও স্বচ্ছ অনুভূতির উন্মেষ ঘটে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহর অন্তর্যামী হওয়ার বিষয়টা উপলব্ধি করে, তার মনেও সূক্ষ্ম চিন্তা ও স্বচ্ছ অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
ফী জিলালিল কুরআন:
*ঈমানের আহবান ও তার পুরস্কার : সূরার এই প্রারম্ভিক অংশটি মানুষের হৃদয়ে সত্যকে গ্রহণ করার যােগ্যতা সৃষ্টি করে। এ জন্যে পরবর্তী আয়াতে তাকে ঈমান আনার আহবান জানানাে হয়েছে। শুধু ঈমান আনা নয়, সেই সাথে ঈমানের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য জিনিসেরও আহবান জানানাে হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনাে এবং ব্যয় করাে সেসব জিনিস থেকে, যার ওপর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের নিজের প্রতিনিধি বানিয়েছেন…।'(৭-১০) আল্লাহ তায়ালা নিজের সৃজিত হৃদয়গুলােকে সম্বােধন করেন। কেননা, তিনিই জানেন হৃদয়ের অভ্যন্তরে কোথায় কী লুকিয়ে আছে, তার অবস্থাই বা কী এবং তার প্রবেশদ্বারগুলাে কোথায়। তিনি এও জানেন, মানুষের আকীদা বিশ্বাসকে কলুষমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করা, হৃদয়কে একাগ্র ও একনিষ্ঠ করা, হৃদয়ে ঈমান এতােটা মযবুত ও স্থিতিশীল হওয়া যাতে সে অনুসারে তার বাস্তব জীবন গড়ে ওঠে, তথা একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে সে সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়ে যায় এমনভাবে জীবন গড়ে ওঠে- এগুলাে সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এর জন্যে মানুষকে প্রচুর শ্ৰম ও শক্তি ব্যয় করতে হয় এবং দীর্ঘ সংগ্রাম সাধনা করতে হয়। এ জন্যেই তাকে উদ্বুদ্ধকারী ও তার মধ্যে প্রেরণা সঞ্চারকারী এসব বাণী ও বক্তব্যের সমাবেশ করেছেন এবং তার সামনে বিশ্ব-প্রকৃতির অজানা রহস্যগুলাে উন্মোচন করেছেন, যাতে সে সেগুলাে অবলােকন করে, তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয় এবং সব কিছুকেই তার সক্ষ্ম ও বিরাট মানদন্ডে যাচাই এবং মূল্যায়ন করে। মানুষের হৃদয়কে তিনি বারংবার ও পদে পদে সদুপদেশ দিয়ে সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু একবার একটা আহবান জানিয়ে, একটা বক্তব্য দিয়ে বা একটা উদ্বুদ্ধকারী ঘােষণা দিয়েই তার কাছ থেকে উধাও হয়ে যান না। আর প্রকৃতপক্ষে মানুষের হৃদয়ের সুচিকিৎসার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে এই নীতিই ধার্য করেছেন যে, যারা আল্লাহর দিকে আহবান জানাবে, তারা যেন আহত ব্যক্তির পাশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে, তাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে ও তাকে চুড়ান্তভাবে বশীভূত করেই ক্ষান্ত হয়। সূরার শুরুতে যে প্রেরণাদায়ক বক্তব্যগুলাে এসেছে, তা এতো তেজোদ্দীপ্ত, এতো গভীর, এতে প্রভাবশালী এবং এতােটা ধারাবাহিক যে, তা পাষাণ ও স্থবির হৃদয়গুলােকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়, বিগলিত করে ও তীব্র অনুভূতিশীল করে। তথাপি কোরআন মােমেনদের হৃদয়গুলােকে শুধু এসব উদ্বুদ্ধকারী প্রারম্ভিক কথাবার্তার ওপর নির্ভরশীল করে রেখে দেয় না, বরং তাকে ঈমান আনা ও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার আহবানও জানায়। সে বলে, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান আনাে এবং ব্যয় করাে সেই সম্পদ থেকে, যার ওপর আল্লাহ তায়ালা তােমাদের নিজের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এখানে যাদের সম্বোধন করেছেন তারা মুসলমান হওয়া সত্তেও তাদের ঈমান আনার আহবান জানানাে হয়েছে। এ থেকে বুঝা গেলো, তিনি তাদেরকে তাদের অন্তরে যথার্থ ও প্রকৃত ঈমান বদ্ধমূল করার আহবান জানাচ্ছেন। এটা একটা সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যময় ইংগিত। তাদের যে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহবান জানানাে হয়েছে, তার সাথেও রয়েছে একটা তাৎপর্যময় উক্তি। বলা হয়েছে, তাদের নিজেদের সম্পদ থেকে নয়; বরং যে সম্পদে আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজের প্রতিনিধি বানিয়েছেন তা থেকে যেন দান করে। বস্তুত আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের মালিক আল্লাহ তায়ালা। আর তিনি সমগ্র মানব জাতিকে তার মালিকানাভুক্ত সেই সম্পদের কিছু অংশে প্রতিনিধি বানিয়েছেন। আর যেহেতু তিনি জীবন-মৃত্যুর একক নিয়ন্তা, তাই এক বংশধরকে মৃত্যু দেয়ার পর তিনি আর এক বংশধরের আবির্ভাব ঘটান। এভাবে এক প্রজন্মের পর আর এক প্রজন্মকে তিনি প্রতিনিধি বানান। এভাবে এই ইংগিত সূরার শুরুতে যে সত্যগুলাে বর্ণিত হয়েছে তার সাথে নিজেকে যুক্ত করে। অতপর তা মানুষকে এই বলে লজ্জা দেয় যে, যে আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক এবং যিনি তার সম্পত্তিতে তাদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন, সেই আল্লাহ যখন তা থেকে কিছু অংশ তার পথে ব্যয় করতে বলছেন, তখন তাতে তাদের আর কী বলার থাকতে পারে? তাদের কার্পণ্য থেকে দূরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে বলা হয়েছে, আল্লাহই তাে সবকিছুর দাতা, তার কাছে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে এবং মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই দেয়া সম্পদ। সুতরং তাদের দান না করার কারণ কী? কিন্তু আল্লাহ তায়ালা শুধু এই লজ্জা দিয়ে এবং আহবান জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং তাকে পুরস্কারের আশ্বাসও দিয়েছেন, ‘তােমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও আল্লাহর পথে দান করবে, তাদের জন্যে রয়েছে বিরটি প্রতিদান।’ এমন প্রতিদিন ও অনুগ্রহের আশ্বাসের মুখে এমন কে আছে যে ঈমান না এনে ও আল্লাহর পথে দান না করে থাকতে পারে? কোরআন এতটুকু বলেও ক্ষান্ত থাকেনি, বরং তাদের বাস্তব জীবনের অনিবার্য দাবী এবং ঈমানের অপরিহার্য ফল হিসাবেই যে তাদের ঈমান আনা উচিত, তাও উল্লেখ করেছে পরবর্তী আয়াতে। ‘তোমাদের কী হয়েছে যে, তােমরা ঈমান আনো না, অথচ রাসূল তােমাদেরকে তােমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনার আহবান জানাচ্ছেন?…’ অর্থাৎ তাদের ভেতরে যখন রসূল স্বয়ং যথাযথভাবে ঈমান আনার দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন এবং তারাও ইতিপূর্বে তার সাথে অংগীকার করেছে, তখন কে তাদের ঈমান আনতে বাধা দিচ্ছে? আর আল্লাহ তায়ালা যখন তাঁর বান্দার ওপর এমন সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করছেন, যা তাদের গােমরাহী, সন্দেহ সংশয় ও অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে হেদায়াত, বিশ্বাস ও নিশ্চিন্ততার আলাের দিকে নিয়ে যায়, তখন তাদের ঈমান আনা কে ঠেকাচ্ছে। বস্তুত রসূল ও কোরআন দ্বারা এভাবে ঈমানের দাওয়াত দেয়া তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণারই স্বাক্ষর বহন করে। একটি জাতির অভ্যন্তরে রসূলের সশরীরে উপস্থিতি, রসূল কর্তৃক জাতিকে সরাসরি আল্লাহর বাণী শােনানাে এবং জনগণের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সকল ব্যাপারে আল্লাহর সাথে তাদের সংযােগ স্থাপন যে কত বড় নেয়ামত, তা এতো দূর থেকে কল্পনা করাও আমাদের সাধ্যাতীত। যে যুগে রসূল জীবিত ছিলেন এবং ওহী আসতাে, সে যুগটি ছিলাে সত্যই এক বিস্ময়কর যুগ! আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁর বান্দার মুখ দিয়ে তার সৃষ্টি করা মানুষকে সম্বোধন করে পরম দয়া ও মমতার সাথে বলতেন, ‘এটা গ্রহণ করাে, আর ওটা বর্জন করাে। এটা আমার পথ। এই পথে চলাে। তােমাদের পা বিপথগামী হয়ে গেছে। এই নাও আমার রজ্জু। একে আঁকড়ে ধরাে। তােমরা ভুল করেছাে, পাপ করেছো। এসো, আমার দ্বার উন্মুক্ত। তাওবা করাে। এসো, দূরে সরে যেও না। আমার দয়া থেকে নিরাশ হয়াে না। আমার দয়া সকল গুনাহ মাফ করার জন্যে যথেষ্ট প্রশস্ত। হে অমুক, তুমি এই কথা বলেছিলে। ওটা অন্যায়। এইরূপ সংকল্প করেছিলে। ওটা গুনাহ। এইরূপ কাজ করেছো। ওটা পাপ। এখন আমার কাছে এসাে, তাওবা করাে, পবিত্র হও, আমার সংরক্ষিত স্থানে আশ্রয় নাও। তােমার অমুক কঠিন সমস্যার এই নাও সমাধান। তোমার অমুক জটিল প্রশ্নের এই নাও জবাব। তােমার অমুক কাজের এই নাও মূল্যায়ন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার সেসব প্রিয় বান্দার সাথে এভাবেই কথা বলেন। বান্দারা তাঁর সান্নিধ্যেই অবস্থান করে এবং তার নৈকট্য অনুভব করে। সে অনুভূতি বাস্তব ও যথার্থ। তিনি গভীর রাতে তাদের অভিযােগ শােনেন এবং সাড়া দেন। তিনি তাদের প্রতি পদে পদে তদারক করেন ও তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। যারা ওহীর যুগে জীবন যাপন করেনি, তাদের জন্যে এমন প্রত্যক্ষ তদারকী অকল্পনীয়, কিন্তু এই আয়াতগুলােতে যাদের সম্বােধন করা হয়েছে, তারা সেই যুগেই জীবন যাপন করেছেন এবং তা সত্তেও তাদের এভাবে সতর্ক করা ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়ােজন হয়েছে। এটা তাদের জন্যে আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ। কিন্তু যারা সেই বিস্ময়কর যুগে জীবন যাপন করার সুযােগ পায়নি, তারাও এই কোরআনের কল্যাণে অনুরূপ তদারকী ও সতর্কীকরণের সুযােগ লাভ করেছে। সহীহ বােখারীতে বর্ণিত হয়েছে, রসূল(স.) একদিন তার সাহাবীদের বললেন, মােমেনদের মধ্যে কারা তােমাদের কাছে অধিক বিস্ময়কর? তারা বললেন, ‘ফেরেশতারা। রাসূল(স.) বললেন, তারা তাে তাদের প্রতিপালকের নিকটেই থাকে। কাজেই তাদের ঈমান আনাতে বিস্ময়ের কী আছে? সাহাবীরা বললেন, তাহলে নবীরা। রসূল(স.) বললেন, তাদের ওপর তাে সরাসরি ওহী নাযিল হয়। সুতরাং তাদের ঈমান না আনার কী কারণ থাকতে পারে? সাহাবীরা বললেন, তাহলে আমরা।’ রসূল(স.) বললেন, আমি স্বয়ং যখন তােমাদের মধ্যে উপস্থিত আছি, তখন তােমাদের ঈমান আনায় বিস্ময়ের কী আছে? বস্তুত মােমেনদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে বিস্ময়কর মােমেন, যারা তােমাদের পরে দুনিয়ায় আসবে, তারা কেবল কিছু লিখিত পুস্তকাদি পাবে এবং তাতে যা লেখা আছে তার ওপর ঈমান আনবে।’ আল্লাহর রাসূল সত্য কথাই বলেছেন। বস্তুত পূর্ববর্তীদের ঈমান আনাটা একেবারেই স্বতন্ত্র ব্যাপার। যে জিনিস তাদের ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করেছে তা অত্যন্ত বিস্ময়কর বটে। রসূল(স.) বিস্ময় প্রকাশ করেই বলেছেন, তাদের ঈমান না আনার কী কারণ থাকতে পারে। এর পরও তাদের বলা হয়েছে, মােমেন হয়ে থাকলে তারা যেন তাদের অন্তরে ঈমানকে বদ্ধমূল ও বাস্তবায়িত করে!
ফী জিলালিল কুরআন:
*দুঃসময়ের ঈমান ও ত্যাগের মর্যাদা : ঈমানের প্রেরণা সৃষ্টিকারী বক্তব্য দেয়ার পর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করা ও তার জন্যে তাগিদ দিয়ে বক্তব্য রাখা হয়েছে। লক্ষ্য করুন, ‘তােমাদের কী হয়েছে যে, তােমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করবে না? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর সকল উত্তরাধিকার একমাত্র আল্লাহর।’ এ আয়াতে আসলে পূর্ববর্তী আয়াত ‘আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব শুধু তাঁরই এবং তাঁর দিকেই সব কিছু প্রত্যাবর্তন করবে’ এ বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কেননা, আকাশ ও পৃথিবীর উত্তরাধিকার আসলে তারই রাজত্ব এবং তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে। আর মানুষকে যে সম্পদে আল্লাহর প্রতিনিধি করা হয়েছে, সে সম্পদ উত্তরাধিকার হিসাবে আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যখন তাদের আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করার আহবান জানাচ্ছেন, তখন তাদের এটা না করার কোনাে কারণ নেই। অথচ আল্লাহ তায়ালা আগেই বলেছেন, তাদের এই সম্পদে আল্লাহর প্রতিনিধি বানানাে হয়েছে। আর এখানে বলা হচ্ছে, সমস্ত সম্পদ আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে। এ সব অকাট্য যুক্তির পর কার্পণ্য করার আর কী যুক্তি অবশিষ্ট থাকে? প্রথম ঈমান আনয়নকারী আনসার ও মােহাজেররা আল্লাহর পথে তাদের সাধ্যানুযায়ী জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আর সেটা করেছেন চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এবং নিদারুণ দরিদ্র ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে, মক্কা বিজয় ও হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে। ইসলাম যখন চরম অসহায় অবস্থায় ছিলাে, চারদিক থেকে শত্ৰু পরিবেষ্টিত ছিলাে এবং তার সমর্থকের সংখ্যা ছিলাে নিতান্তই মুষ্টিমেয় । পরবর্তীতে হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয় দ্বারা প্রভূত শক্তি ও সম্মান লাভ করেছিলো, কিন্তু তার আগে ইসলামের চরম দুর্দিনে তারা আল্লাহর পথে যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। অথচ এই দানের বিনিময়ে তারা কোনাে পার্থিব পুরস্কার বা প্রতিদান পাওয়ারও আশা করতেন না। আর পরবর্তীকালের বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কাছে নিজেদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করে বাহবা কুড়াতেও চাইতেন না। তাদের ত্যাগ, কোরবানী ও দান ছিলাে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল, খালেস ও একনিষ্ঠ। এ দান ও কোরবানীতে তারা উদ্বুদ্ধ হতেন শুধু আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান লাভের আশায় এবং যে আদর্শকে তারা নিজেদের জীবন ও যাবতীয় সহায় সম্পদের চেয়ে বড় মনে করে গ্রহণ করেছিলেন, তার মর্যাদা রক্ষার অদম্য বাসনায়। তবে তারা যে সম্পদ ব্যয় করতেন, তা পরিমাণের দিক থেকে বিজয় পরবর্তীকালের মুসলমানদের চেয়ে কম ছিলাে। পরবর্তীদের কেউ কেউ ঠিক সেই পরিমাণ দান করতাে, যা পূর্ববর্তীরা দান করেছেন বলে শুনতাে বা জানতাে। এই পর্যায়েই কোরআনের আয়াত নাযিল হলাে এবং সত্যের দাঁড়িপাল্লায় মেপে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মুসলমানদের দানের সঠিক মূল্য নিরূপণ করলাে। এ আয়াতের পরবর্তী অংশে জানিয়ে দেয়া হলো যে, দানের পরিমাণটাই আসল বিবেচ্য বিষয় নয় বরং আসল বিবেচ্য বিষয় হলাে তার ঈমান, যা তাকে দানে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। ‘তােমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিজয়ের পূর্বে দান করেছে ও লড়াই করেছে, সে এবং বিজয়ের পরে দানকারী ও লড়াইকারী সমান নয়। পূর্ববর্তীরা পরবর্তী দানকারী ও লড়াইকারীদের চেয়ে অধিক মর্যাদাশালী।’ ইসলাম যখন শত্রুদের আক্রমণের লক্ষবস্তু ছিলাে, তার সমর্থকরা যখন ছিলাে সংখ্যালঘু এবং কোনাে লাভ, সুখ ও ক্ষমতাপ্রাপ্তির কোনাে সম্ভাবনাই দৃষ্টিগোচর হতাে না, তখন যে ব্যক্তি ইসলামের জন্যে দান করেছে ও লড়াই করেছে, সে ওই ব্যক্তির সমপর্যায়ের নয়, যে ইসলামের জন্যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিবেশ, বিপুলসংখ্যক সমর্থক এবং সাফল্য ও বিজয় নাগালের মধ্যে থাকা অবস্থায় দান করে ও লড়াই করে। প্রথমােক্ত ব্যক্তির সম্পর্ক ছিলাে সরাসরি আল্লাহর সাথে, তার প্রতি তার ভরসা ও আনুগত্য ছিলাে সন্দেহাতীতভাবে আন্তরিক ও নির্ভেজাল এবং সকল প্রকারের বাহ্যিক উপায় উপকরণ থেকে সে ছিলাে অনেক দূরে। ইসলামের প্রতি অটুট বিশ্বাস ও আস্থা থেকে সে যে শক্তি সঞ্চয় করতাে, সেই শক্তি ছাড়া সত্য ও কল্যাণের পথে লড়াইতে তার আর কোনাে সাহায্যকারী বা প্রেরণাদাতা ছিলাে না। আর শেষােক্ত ব্যক্তি যদিও নিষ্কলুষ নিয়তের অধিকারী হয়ে থাকে এবং পূর্ববর্তীদের ন্যায় আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হয়ে থাকে, তাহলেও ন্যায়ের পথে সংগ্রাম সাধনা চালাতে তার কিছু না কিছু সমর্থক ও সাহায্যকারী জুটে যাওয়া একেবারে দুর্লভ নয়। ইমাম আহমদ হযরত আনাস(রা.) থেকে বর্ণনা করেন, একবার খালেদ ইবনে ওলীদ ও আবদুর রহমান ইবনে আওফের মধ্যে কিঞ্চিত কথা কাটাকাটি হয়ে যায়। খালেদ আবদুর রহমানকে বললেন, ‘বুঝেছি, তােমরা আমাদের কিছু দিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেছো বলে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ফলাচ্ছো।’ হযরত আনাস বলেন, শুনতে পেয়েছি, এই বাকবিতন্ডার খবর রাসূল(স.)-এর কর্ণগােচর হলে তিনি বললেন, আমার সাথীদের ব্যাপারটা তােমরা আমার ওপর সমর্পণ করাে। সেই আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, তােমরা যদি ওহুদ পর্বত পরিমাণ সম্পদও আল্লাহর পথে দান করাে, তবু তারা যে সব কাজ করেছে, তার সমান মর্যাদায় তােমরা কখনাে পৌছতে পারবে না।’ {যদিও সাহাবী এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ঈমান আনার পর রসূল (স.)-এর সাক্ষাত লাভ করেছে, কিন্তু এখানে আমার সাথী’ বলে তিনি ইসলামের শুরু থেকেই যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর সহচর সহযােগী হয়েছে তাদের বুঝিয়েছেন} সহীহ বােখারীতে এক হাদীসে রসূল(স.) বলেছেন, “তােমরা আমার সাথীদের গালি দিও না। আল্লাহর কসম, তােমাদের কেউ যদি ওহুদ পর্বত সমান স্বর্ণও আল্লাহর পথে ব্যয় করাে তবু তাদের সমান এমনকি তাদের অর্ধেক মর্যাদাও পাবে না। (এখানেও আমার সাথী বলে অগ্রণী সাহাবীদের বুঝানাে হয়েছে) উভয় শ্রেণীর সাহাবীদের প্রকৃত মান আল্লাহর মানদণ্ডে কিরূপ, তা পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করার পর পুনরায় উভয় শ্রেণীকে উত্তম প্রতিদানের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সকলকেই আল্লাহ তায়ালা উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ কেননা, সকলেই সাধ্যমত সৎকাজে ব্রতী ছিলেন, তাই তাদের পরস্পরের মধ্যে মান মর্যাদার যতাে ব্যবধানই থাক না কেন। আর যেহেতু তাদের মান সম্পর্কে এবং তাদের কাজের পেছনে যে উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও সংকল্প সক্রিয় ছিলাে, তার সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই অবহিত, তাই পরস্পরের মানগত পার্থক্য ও সবার জন্য উত্তম প্রতিদানের বিষয়টি আল্লাহর গুণের সাথেই সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।’ এ কথা দ্বারা মনকে সচেতন ও সজাগ করা হয়েছে এবং বাহ্যিক কার্যকলাপের পেছনে যে গােপন সংকল্প ও উদ্দেশ্য নিহিত থাকে, তার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কেননা, এই গােপন সংকল্প ও উদ্দেশ্য তথা নিয়তের ওপরই কাজের মূল্য ও মান নির্ভরশীল এবং দাঁড়িপাল্লায় নিয়তই অগ্রগণ্য।
জিলালিল কুরআন:
এরপর পুনরায় ঈমান ও আল্লাহর পথে দান করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, ‘আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে প্রস্তুত এমন কে আছো? তাহলে তিনি তাকে বহুগুণ বর্ধিত করে তার প্রতিদান দেবেন এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। যে দিন মােমেন নারী ও পুরুষদের দেখবে… বস্তুত, তা হচ্ছে নিকৃষ্টতম বিধান।’ *দানশীল মােমেনদের সংবর্ধনা ও মােনাফেকদের পরিণতি : এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে একট চমৎকার প্রেরণাদায়ক ভাষণ। যে বান্দারা আল্লাহর কাছে নিতান্ত দরিদ্র ও মুখাপেক্ষী, সেই বান্দাদেরই তিনি দান করতে উদ্বুদ্ধ করছেন এবং তাদের কাছে ঋণ চাইছেন। কোনাে বান্দা শুধু যদি এতােটুকু কল্পনা করে যে, সে একজন নিঃস ফকীর হলেও আল্লাহকে ঋণ দিতে পারে, তবে এই কল্পনাই তাকে আল্লাহর পথে দানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। কোনাে বিত্তশালী লােক যদি ঋণ চায়, তবে লােকেরা তাকে ঋণ দিতে প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। কেননা, এই ঋণ যে যথাসময়ে পরিশােধ করা হবে তা সুনিশ্চিত। উপরন্তু একজন বিত্তশালী লােককে ঋণ দেয়ার জন্যে তারা বাড়তি সম্মানেরও অধিকারী হয়ে থাকে। তাহলে যে আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বিত্তশালী এবং যিনি সদা প্রশংসিত, তাকে ঋণ দিতে কুষ্ঠিত হবে কেন? আল্লাহ তায়ালা শুধু যে ঋণ পরিশােধের নিশ্চয়তা দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়; বরং তিনি এই ঋণ যদি সদুদ্দেশ্যে ও শুধুমাত্র তার সন্ভুষ্টির লক্ষ্যে দেয়া হয়, তবে তার জন্যে বহগুণ বেশী প্রতিদান ও তদুপরি বাড়তি সম্মানজনক পুরস্কার ধার্য করেছেন। এরপর সেই সম্মানজনক পুরস্কারের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এ দৃষ্টান্তটি হচ্ছে উক্ত সম্মানজনক পুরস্কার যেদিন দেয়া হবে সেদিনকার একটি চমকপ্রদ দৃশ্য। কোরআনী দৃশ্যসমূহের মধ্যে এটি একটি অভিনব দৃশ্য। এটি সেসব দৃশ্যের অন্যতম, যার চলন্ত ছবি সুসংহতভাবে অংকিত হবার পর আলােচনার মাধ্যমে তাকে জীবন্ত করে তােলা হয়। এভাবে আমরা যারা এখন কোরআন পড়ছি তারা একটি মনােমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। মােমেন নারী-পুরুষকে তাে আমরা অহরহই দেখে থাকি, কিন্তু এখন কোরআনের আয়াতে তাদের এমন ভংগিতে দেখতে পাচ্ছি যে, তাদের সামনে ও ডান দিকে রয়েছে প্রশান্ত স্থির প্রদীপ্ত আলাে। এ আলাে তাদেরই। তাদের দেহ থেকেই তা বিষ্ছুরিত হচ্ছে এবং তাদের সম্মুখভাগকে আলােকিত করছে। এই মানব মানবীরা এমন আলাে বিকিরণ করছে, যা দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা দ্বারা তারা সামনে ও ডানে দেখতে পাচ্ছে। এটি সেই জ্যোতি, যা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা এই মােমেন নরনারীদের অন্ধকার থেকে বের করে নিজের দিকে এগিয়ে এনেছেন, এটি সেই আলাে, যা তাদের আত্মায় প্রজ্বলিত হওয়ার পর তারা তাদের প্রবৃত্তির ওপর জয়যুক্ত হয়েছে। এমনকি সম্ভবত এটিই সেই জ্যোতি বা নূর, যা থেকে আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্বজগতকে এবং এর অভ্যন্তরে যা কিছু আছে তা সৃষ্টি করেছেন। {আজকাল এটাই বিশ্বাস করা হচ্ছে যে, বিশ্ব-প্রকৃতি সৃষ্টির মূল উপাদান হচ্ছে আলো। যে অণুপরমাণু দিয়ে বিশ্ব-প্রকৃতি গঠিত, তা মূলত আলো ছাড়া আর কিছু নয়। সম্ভবত এই মতবাদই প্রকৃত সত্যের নিকটতম। কেননা, এটা কোরআনের সাথে সংগতিপূর্ণ} এই জ্যোতি নিজের আসল রূপ নিয়ে এই মানবগােষ্ঠীর ভেতরে আত্মপ্রকাশ করেছে, যারা নিজেদের প্রকৃত মানুষরূপে বিকশিত করেছেন। অতপর আমরা শুনতে পাই, এই মােমেন নরনারীকে কিরূপ শ্রদ্ধাপূর্ণ অভিনন্দন জানানাে হয়েছে এবং কিরূপ সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। আজ তােমাদের সুসংবাদ হলাে জান্নাত, যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত। এতে তােমরা চিরকাল থাকবে। এটা এক বিরাট সাফল্য।
১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ :
اَلْحَدِيْدُ শব্দের অর্থ : লোহা। اَلْحَدِيْدُ শব্দটি অত্র সূরার ২৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
ফযীলত :
অত্র সূরার ফযীলতের ব্যাপারে সাহাবী ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করে বলা হয় : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়নের পূর্বে ঐ সূরাগুলো পাঠ করতেন যেগুলোর শুরুতে سَبَّحَ বা يُسَبِّحُ রয়েছে এবং বলতেন : এগুলোর মধ্যে এমন একটি আয়াত রয়েছে যা হাজার আয়াত হতেও উত্তম। কিন্তু হাদীসটি দুর্বল। (আবূ দাঊদ হা. ৫০৫৭, তিরমিযী হা. ২৯২১)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেছেন : এ হাদীসে যে আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে (আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন) তা হল :
(ھُوَ الْاَوَّلُ وَالْاٰخِرُ وَالظَّاھِرُ وَالْبَاطِنُﺆ وَھُوَ بِکُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمٌ)
“তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই জাহের, তিনিই বাতেন এবং তিনি সর্ববিষয়ে অধিক অবহিত।”
সূরাতে কয়েকটি বিষয়ের আলোচনা স্থান পেয়েছে যেমন, আল্লাহ তা‘আলার শানে অনুপযোগী এমন সবকিছু থেকে প্রতিটি সৃষ্টি মহান আল্লাহকে পবিত্রতা ঘোষণা করে, আল্লাহ তা‘আলার কয়েকটি গুণাবলীর বিবরণ, ছয়দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি, আল্লাহ তা‘আলার পথে জান-মাল উৎসর্গের জন্য মু’মিনদেরকে আহ্বান, প্রকৃত দৃষ্টিতে দুনিয়া ও আখিরাতের মূল্য, পুল-সিরাতে মু’মিনদের উজ্জ্বলাকৃতি ও মুনাফিকদের বিপরীত অবস্থা ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে।
১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আকাশ-জমিন ও এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে (চাই তা জড় পদার্থ হোক কিম্বা জীব হোক), মহান আল্লাহর শানে যা অনুপযোগী ও আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব গুণে গুণান্বিত করা যায় না সেসব কিছু থেকে পবিত্রতা বর্ণনা করে। এ সম্পর্কিত আয়াত অনেক রয়েছে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(تُسَبِّحُ لَھُ السَّمٰوٰتُ السَّبْعُ وَالْاَرْضُ وَمَنْ فِیْھِنَّﺚ وَاِنْ مِّنْ شَیْءٍ اِلَّا یُسَبِّحُ بِحَمْدِھ۪ وَلٰکِنْ لَّا تَفْقَھُوْنَ تَسْبِیْحَھُمْﺚ اِنَّھ۫ کَانَ حَلِیْمًا غَفُوْرًا)
“সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” (সূরা ইসরা ১৭ : ৪৪)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন :
(اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللہَ یُسَبِّحُ لَھ۫ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَالطَّیْرُ صٰ۬فّٰتٍﺚ کُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَھ۫ وَتَسْبِیْحَھ۫)
“তুমি কি দেখ না যে, আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা এবং উড্ডীয়মান পাখিগুলো আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই জানে তার প্রার্থনা ও পবিত্রতা ঘোষণার পদ্ধতি।” (সূরা নূর ২৪ : ৪১)
সুতরাং তাসবীহ শব্দটি যখন আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার হবে তখন তার অর্থ হল- যা আল্লাহ তা‘আলার শানে উপযোগী নয় তা থেকে বিশ্বাসে, কথায় ও আমলে পূত-পবিত্রতা ঘোষণা করা। আল্লাহ তা‘আলার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে, তাঁর শরীক আছে, আল্লাহ তা‘আলা নিরাকার, আল্লাহ তা‘আলা সকল ক্ষমতা ওলীদের হাতে দিয়ে নিজে রিক্তহস্ত ইত্যাদি থেকে বিশ্বাসকে পবিত্র রাখতে হবে, মুখে বলা যাবে না এবং আমলেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। আকাশ-জমিন ও তার মাঝে যত জীব-জন্তু, জড়-পদার্থ এবং মু’মিন মুওয়াহহিদ রয়েছে সকলে আল্লাহ তা‘আলাকে এ সকল ক্রটি থেকে পবিত্র বলে বিশ্বাস করে ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে না।
الْعَزِیْزُ অর্থ পরাক্রমশালী, সবকিছুর ওপর বিজয়ী, যার ওপর কেউ জয় লাভ করতে পারে না। এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার ১২৯ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
الْحَکِیْمُ বলা হয় তাকে যিনি সকল বিষয় উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন। প্রত্যেক বিষয়কে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
(لَھ۫ مُلْکُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ)
অর্থাৎ আকাশ-জমিনের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁর আজ্ঞাবহ, কর্তৃত্বাধীন, মালিক ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী।
(هُوَ الْأَوَّلُ وَالْاخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ)
‘তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই জাহের, তিনিই বাতেন’ এখানে আল্লাহ তা‘আলার চারটি নাম এসেছে যার প্রত্যেকটি স্থান ও কাল ভেদে বিপরীত।
الْأَوَّلُ তিনিই আদি বা প্রথম। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : এর অর্থ হল :
الذي ليس قبله شيء
তাঁর পূর্বে কিছুই ছিল না। (সহীহ মুসলিম হা. ২৭১৩)
وَالْاخِرُ তিনিই অন্ত বা সর্বশেষ। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অর্থ বর্ণনা করে বলেন :
الذي ليس بعده شيء
অর্থাৎ তাঁর পর কিছুই থাকবে না।
وَالظَّاهِرُ শব্দটি الظهور থেকে এসেছে। অর্থ হল العلو বা ঊর্ধ্বে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(هُوَ الَّذِيْٓ أَرْسَلَ رَسُوْلَه۫ بِالْهُدٰي وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَه۫ عَلَي الدِّيْنِ كُلِّه۪ لا وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ)
“তিনিই সে সত্ত্বা যিনি তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন সুপথ ও সত্য দীনসহকারে সকল দীনের ওপর একে বিজয়ী করার জন্য যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সূরা তাওবা ৯ : ৩৩)
নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ অংশের তাফসীর করে বলেন :
الذي ليس فوقه شئ
বা তাঁর উপরে কিছুই নেই। তিনিই সবার উপরে।
الْبَاطِنُ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
الذي ليس دونه شيء
তাঁর চেয়ে নিকটে আর কেউ নেই। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সবার উপরে থেকেও তাঁর জ্ঞান দর্শন ও শ্রবণ দ্বারা তিনি প্রত্যেকটি বস্তুর নিকটে। এ আয়াতের তাফসীর সম্বলিত একটি দু‘আ রয়েছে যা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়নকালে পাঠ করতেন। দু‘আটি হল :
اللّٰهمَّ أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ، وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْر
হে আল্লাহ তা‘আলা আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কেউ নেই; আপনিই শেষ, আপনার পরে আর নেই; আপনিই সবার ঊর্ধ্বে, আপনার উপরে আর কেউ নেই; আপনি সবার নিকটে, আপনার চেয়ে নিকটে আর কেউ নেই; আমাদের পক্ষ থেকে আপনি ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং দরিদ্রতা থেকে অমুখাপেক্ষী করে রাখুন। (সহীহ মুসলিম হা. ২৭১৩)
অতএব আমরা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে এমন বিশ্বাস রাখব না যা তাঁর শানে উপযোগী নয়। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল মাখলূক আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ ও পবিত্রতা পাঠ করে।
২. জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৩. আল্লাহ তা‘আলা স্বসত্ত্বায় সাত আকাশের ওপর রয়েছেন।
৪. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান, দর্শন ও শ্রবণ দ্বারা প্রত্যেকের কাছে রয়েছেন।
৫. যখন কিছু ছিল না তখন আল্লাহ তা‘আলা ছিলেন, আর যখন কিছু থাকবে না তখন আল্লাহ তা‘আলা থাকবেন।
৪-৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা সাত আকাশ ও জমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। কবে সৃষ্টি শুরু করেছেন তা নিয়ে ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) তিনটি মত বর্ণনা করেছেন- (১) তাওরাতধারীরা বলে : রবিবারে সৃষ্টির কাজ শুরু করা হয়েছে, (২) ইঞ্জিলধারীরা বলে : সোমবারে শুরু করা হয়েছে। (৩) আর আমরা মুসলিমরা বলি আল্লাহ তা‘আলা শনিবার সৃষ্টির কাজ শুরু করেছেন। কাজ শেষ করেছেন শুক্রবারে। কারণ শনিবারের ব্যাপারে হাদীস রয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা. ৭২৩১) এ ছয়দিনের চারদিনে জমিন সৃষ্টি করেছেন। বাকি দুদিনে আকাশ সৃষ্টি করেছেন। (সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১ : ৯-১২) তবে শনিবার সৃষ্টির সূচনা করলে সাতদিন হচ্ছে। তাই আয়াতে উল্লিখিত ছয়দিনের সাথে সামঞ্জস্য হচ্ছে না। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে।
(ثُمَّ اسْتَوٰی عَلَی الْعَرْشِ)
এর মমার্থ সূরা আ‘রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
(يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْض)
অর্থাৎ জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে যেমন বৃষ্টির ফোঁটা, বীজ ও মানুষের মরদেহ ইত্যাদি এবং জমিন থেকে যা কিছু বের হয় সব কিছু আল্লাহ তা‘আলা জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “সকল গায়েবের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত, তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে (লাওহে মাহফূজে) নেই।” (সূরা আনআম ৬ : ৫৯)
(وَمَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَا۬ءِ)
অর্থাৎ আকাশ থেকে যা অবতীর্ণ হয় যেমন বৃষ্টি, বরকত, ভাগ্য ও সে সব বিধানাবলী যা ফেরেশতাগণ নিয়ে অবতরণ করে।
(وَمَا يَعْرُجُ فِيْهَا)
আকাশে যা উত্থিত হয় যেমন ফেরেশতা ও মানুষের আমল ইত্যদি। হাদীসে এসেছে : রাতের আমল দিনের পূর্বে এবং দিনের আমল রাতের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার নিকট উঠে যায়। (সহীহ মুসলিম হা. ৫০)
(وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتم)
অর্থাৎ তাঁর জ্ঞান, দর্শন ও শ্রবণ ইত্যাদি দ্বারা প্রত্যেকের সাথে রয়েছেন। এর অর্থ এই নয়, তিনি স্বসত্তায় সবার নিকটে রয়েছেন। বরং তিনি স্বসত্তায় আরশের ওপর, আর তাঁর জ্ঞান, দর্শন ও শ্রবণ দ্বারা প্রত্যেকের সাথে রয়েছেন। সব কিছু দেখছেন, শুনছেন এবং জানেন, যেন তিনি সব গুণের দ্বারা সবার সাথেই রয়েছেন। যেমন অত্র আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তোমরা যা কিছু কর তা তিনি প্রত্যক্ষ করছেন। তাই মানুষের কর্ম ও অবস্থা জানার জন্য আল্লাহ তা‘আলা স্বসত্তায় বান্দার সাথে থাকা হতে অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা আরশে রয়েছেন এ কথা যেমন কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তেমনি তিনি সবার সাথে রয়েছেন এ কথাও প্রমাণিত। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার এ সকল গুণকে অস্বীকার করা ও অপব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই। সূরা মায়িদাহর ১২ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং সূরা মুজাদালাহর ৭ নম্বর আয়াতেও আলোচনা আসবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আকাশ-জমিন সৃষ্টির সার্বিক তত্ত্ব জানলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপর থেকেই তাঁর জ্ঞান, দর্শন ও শ্রবণ দ্বারা প্রত্যেকের সাথে রয়েছেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা অন্তরযামী।
৪. আকাশ ও জমিনের সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৭-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ঈমান আনার পাশাপাশি তাদেরকে যে সম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ কথা ইঙ্গিত প্রদান করছে, তোমাদের নিকটে যে ধন-সম্পদ আছে তা চিরদিন তোমাদের কাছে থাকবে না। তোমরা যেমন উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছো তোমরা মারা গেলে পরবর্তীরা উত্তরাধিকারী সূত্রে মালিক হয়ে যাবে। অতএব তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় না করলে তারা ব্যয় করে অশেষ নেকী হাসিল করে নেবে। হাদীসে এসেছে : মানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ। অথচ তোমার সম্পদ হল প্রথমত সেটা যা খেয়ে শেষ করে ফেলেছো। দ্বিতীয়ত : যা পরিধান করে নষ্ট করে ফেলেছো। তৃতীয়ত : যা তুমি আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করেছো। এছাড়া যা কিছু থাকবে তা সবই অন্যদের ভাগে আসবে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৫৯, তিরমিযী হা. ২৩৪৯) সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সম্পদ দান করেছেন, যে পথে ব্যয় করলে তিনি খুশি হবেন সে পথেই ব্যয় করা উচিত। তাঁর অবাধ্য ও পাপ কাজে ব্যয় করা উচিত হবে না।
(وَمَا لَکُمْ لَا تُؤْمِنُوْنَ بِاللہِ)
এখানে মহান আল্লাহ তাদের তিরস্কার করছেন যাদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দাওয়াত পৌঁছেছে কিন্তু তারপরে ঈমান আনছে না। তিরস্কার করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তোমাদের কী আপত্তি ও কী বাধা রয়েছে যে- তোমরা ঈমান আনছ না, অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদেরকে ঈমানের দিকে আহ্বান করছেন!
(وَقَدْ أَخَذَ مِيْثَاقَكُمْ)
আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) أَخَذَ ক্রিয়ার কর্তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের নিকট থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন যে, সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তাঁর কথা শুনবে ও মানবে। ইবনু জারীর (রহঃ) এ ক্রিয়ার কর্তা আল্লাহ তা‘আলাকে বুঝিয়েছেন। অর্থ হল : সেই অঙ্গীকার যা মহান আল্লাহ রূহ জগতে আদম (আঃ)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করে সকল মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। যেমন সূরা আ‘রাফের ১৭২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে- তোমরা ঈমান আনবে; অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও সে ঈমানের দিকে আহ্বান করছেন তারপরেও ঈমান আনছ না।
(لَا يَسْتَوِيْ مِنْكُمْ مَّنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ)
‘তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে, উভয়ে সমান নয়’ এখানে الْفَتْحِ বা বিজয় দ্বারা কোন্ বিজয়কে বুঝোনো হয়েছে তা নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়।
(১) বিজয় দ্বারা উদ্দেশ্য হল হুদায়বিয়ার সন্ধি। (সহীহ বুখারী হা. ৪১৫০)
(২) বিজয় দ্বারা উদ্দেশ্য হল মক্কা বিজয়। এটা অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। (ইবনু কাসীর, শরহু আকিদাহ ওয়াসিতিয়াহ)
অর্থাৎ যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করেছেন ও জিহাদ করেছেন তারা অধিক নেকী ও মর্যাদাসম্পন্ন তাদের থেকে যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করেছেন ও জিহাদ করেছেন। কেননা হুদায়বিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পূর্বের ব্যয় ও জিহাদ উভয়টাই ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
(وَكُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الْحُسْنٰي)
অর্থাৎ সাহাবীদের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য থাকা সত্ত্বেও সকলের জন্য রয়েছে কল্যণের প্রতিশ্রুতি তথা জান্নাত। তাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হল : মর্যাদাগত তারতম্য থাকা সত্ত্বেও সকল সাহাবীদের ব্যাপারে আমাদের অন্তর সকল প্রকার হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত এবং জবান সকল প্রকার অকথ্য ও অশালীন কথা থেকে মুক্ত। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিয়ো না। সে সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ (প্রায় ৬২৫ গ্রাম) এর সমান হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৩৬৭৩, সহীহ মুসলিম হা. ২৫৪১)।
(مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللہَ)
আল্লাহ তা‘আলাকে উত্তম ঋণ দেওয়ার অর্থ হল তাঁর পথে ব্যয় করা। যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করবে তিনি তাদের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং উত্তম প্রতিদান দেবেন। তবে অবশ্যই তা হতে হবে হালাল ও উত্তম সম্পদ হতে, সুস্থ-সবল ও সম্পদের প্রতি মোহ থাকাবস্থায় এবং আল্লাহ তা‘আলাকে সস্তুষ্ট করার জন্য; কাউকে খুশি করা বা বাহবা পাওয়ার জন্য নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সম্পদকে নেয়ামত মনে করে তার সৎব্যবহার করা উচিত।
২. ঈমানের সাথে নেকীর আশায় দান করলে আল্লাহ তা‘আলা মহা পুরস্কার প্রদান করবেন।
৩. সাহাবীদের মর্যাদা জানতে পেলাম।
৪. সাহাবীদের ব্যাপারে কুটক্তি করা, হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করা সে যে কোন সাহাবীর ব্যাপারে হোক না কেন তা হারাম।
৫. আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করার ফযীলত জানতে পারলাম।
৬. সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, মানুষকে তা ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছেন।
৭. আমলের তারতম্য অনুপাতে জান্নাতে মর্যাদার তারতম্য হবে।