Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫২/মুনাফিক কী, কেন ও কীভাবে?:-৪২)
[*যেদিন তোমরা ঈমানদার নারী ও পুরুষদের দেখবে,:-
*সেদিন মুনাফিক নারী পুরুষের অবস্থা হবে এই যে,:-
*ঈমান গ্রহণকারীদের জন্য এখনো কি সে সময় আসেনি যে?:-
**সিদ্দীক ও শহীদদের মর্যাদা :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ।
পারা:২৭
১২-১৯ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১২
یَوۡمَ تَرَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ یَسۡعٰی نُوۡرُہُمۡ بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ بِاَیۡمَانِہِمۡ بُشۡرٰىکُمُ الۡیَوۡمَ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ ذٰلِکَ ہُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿ۚ۱۲﴾
যেদিন তোমরা ঈমানদার নারী ও পুরুষদের দেখবে, তাদের ‘নূর’ তাদের সামনে ও ডান দিকে দৌড়াচ্ছে। (তাদেরকে বলা হবে) “আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ।” জান্নাতসমূহ থাকবে যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই বড় সফলতা।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৩
یَوۡمَ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا انۡظُرُوۡنَا نَقۡتَبِسۡ مِنۡ نُّوۡرِکُمۡ ۚ قِیۡلَ ارۡجِعُوۡا وَرَآءَکُمۡ فَالۡتَمِسُوۡا نُوۡرًا ؕ فَضُرِبَ بَیۡنَہُمۡ بِسُوۡرٍ لَّہٗ بَابٌ ؕ بَاطِنُہٗ فِیۡہِ الرَّحۡمَۃُ وَ ظَاہِرُہٗ مِنۡ قِبَلِہِ الۡعَذَابُ ﴿ؕ۱۳﴾
সেদিন মুনাফিক নারী পুরুষের অবস্থা হবে এই যে, তারা মু’মিনদের বলবেঃ আমাদের প্রতি একটু লক্ষ্য কর যাতে তোমাদের ‘নূর’ থেকে আমরা কিছু উপকৃত হতে পারি। কিন্তু তাদের বলা হবেঃ পেছনে চলে যাও। অন্য কোথাও নিজেদের ‘নূর’ তালাশ কর। অতঃপর একটি প্রাচীর দিয়ে তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে। তাতে একটি দরজা থাকবে। সে দরজার ভেতরে থাকবে রহমত আর বাইরে থাকবে আযাব।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৪
یُنَادُوۡنَہُمۡ اَلَمۡ نَکُنۡ مَّعَکُمۡ ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ لٰکِنَّکُمۡ فَتَنۡتُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ وَ تَرَبَّصۡتُمۡ وَ ارۡتَبۡتُمۡ وَ غَرَّتۡکُمُ الۡاَمَانِیُّ حَتّٰی جَآءَ اَمۡرُ اللّٰہِ وَ غَرَّکُمۡ بِاللّٰہِ الۡغَرُوۡرُ ﴿۱۴﴾
তারা ঈমানদারদের ডেকে ডেকে বলবে আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? ঈমানদাররা জওয়াব দেবে হ্যাঁ, তবে তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করেছিলে, সুযোগের সন্ধানে ছিলে, সন্দেহে নিপতিত ছিলে এবং মিথ্যা আশা-আকাংখা তোমাদেরকে প্রতারিত করেছিলো। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ফায়সালা এসে হাজির হলো এবং শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সে বড় প্রতারক আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারণা করে চললো।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৫
فَالۡیَوۡمَ لَا یُؤۡخَذُ مِنۡکُمۡ فِدۡیَۃٌ وَّ لَا مِنَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ؕ مَاۡوٰىکُمُ النَّارُ ؕ ہِیَ مَوۡلٰىکُمۡ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۱۵﴾
অতএব, তোমাদের নিকট থেকে আর কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না। আর তাদের নিকট থেকেও গ্রহণ করা হবে না যারা সুস্পষ্টভাবে কুফরীরতে লিপ্ত ছিল। তোমাদের ঠিকানা জাহান্নাম। সে (জাহান্নাম) তোমাদের খোঁজ খবর নেবে। এটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট পরিণতি।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৬
اَلَمۡ یَاۡنِ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ تَخۡشَعَ قُلُوۡبُہُمۡ لِذِکۡرِ اللّٰہِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الۡحَقِّ ۙ وَ لَا یَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلُ فَطَالَ عَلَیۡہِمُ الۡاَمَدُ فَقَسَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ ؕ وَ کَثِیۡرٌ مِّنۡہُمۡ فٰسِقُوۡنَ ﴿۱۶﴾
ঈমান গ্রহণকারীদের জন্য এখনো কি সে সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে তাদের মন বিগলিত হবে, তাঁর নাযিলকৃত মহা সত্যের সামনে অবনত হবে এবং তারা সেসব লোকদের মত হবে না যাদেরকে ইতিপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে তাদের মন কঠোর হয়ে গিয়েছে এবং আজ তাদের অধিকাংশই ফাসেক হয়ে গেছে।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৭
اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ یُحۡیِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِہَا ؕ قَدۡ بَیَّنَّا لَکُمُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۷﴾
খুব ভাল করে জেনে নাও, আল্লাহ ভূ-পৃষ্ঠকে মৃত হয়ে যাওয়ার পর জীবন দান করেন। আমরা তোমাদেরকে স্পষ্টভাবে নির্দশনসমূহ দেখিয়ে দিয়েছি যাতে তোমরা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগাও।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৮
اِنَّ الۡمُصَّدِّقِیۡنَ وَ الۡمُصَّدِّقٰتِ وَ اَقۡرَضُوا اللّٰہَ قَرۡضًا حَسَنًا یُّضٰعَفُ لَہُمۡ وَ لَہُمۡ اَجۡرٌ کَرِیۡمٌ ﴿۱۸﴾
দান সাদকা প্রদানকারী নারী ও পুরুষ এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে, নিশ্চয়ই কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে তাদেরকে ফেরত দেয়া হবে। তাছাড়াও তাদের জন্য আছে সর্বোত্তম প্রতিদান।
সূরা:৫৭:আল-হাদীদ:-১৯
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖۤ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الصِّدِّیۡقُوۡنَ ٭ۖ وَ الشُّہَدَآءُ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ ؕ لَہُمۡ اَجۡرُہُمۡ وَ نُوۡرُہُمۡ ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ ﴿٪۱۹﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাই তাদের রবের কাছে ‘সিদ্দীক’ ও ‘শহীদ’ বলে গণ্য। তাদের জন্য তাদের পুরস্কার ও ‘নূর’ রয়েছে। আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতকে অস্বীকার করেছে তারাই দোযখের বাসিন্দা।
১২-১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# এ আয়াতটি এবং পরবর্তী আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় হাশরের ময়দানে শুধুমাত্র নেককার ঈমানদারদেরই ‘নূর’ থাকবে। কাফের, মুনাফিক, ফাসেক ও ফাজেররা দুনিয়াতে যেমন অন্ধকারে পথ হারিয়ে হাতড়িয়ে মরেছে সেখানেও তেমনি অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরতে থাকবে। যেখানে আলো যেটুকু হবে তা সৎ আকীদা-বিশ্বাস ও সৎ আমলের। ঈমানের সততা এবং সৎচরিত্র ও কর্মের পবিত্রতাই ‘নূরে’ রূপান্তরিত হবে যার কারণে সৎ লোকদের ব্যক্তিত্ব ঝলমলিয়ে উঠবে। যার কর্ম যতটা উজ্জল হবে তার ব্যক্তিসত্তার আলোক রশ্মিও তত বেশী তীব্র হবে। সে যখন হাশরের ময়দান থেকে জান্নাতের দিকে যাত্রা করবে তখন তার ‘নূর’ বা আলো তার আগে আগে ছুটতে থাকবে। এর সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হচ্ছে কাতাদা বর্ণিত একটি ‘মুরসাল’ হাদীস। উক্ত হাদীসে তিনি বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কারো কারো ‘নূর’ এত তীব্র হবে যে, মদীনা থেকে “আদন” এর সম পরিমাণ দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছতে থাকবে। তাছাড়া কারো ‘নূর’ পৌঁছবে মদীনা থেকে সান’আ পর্যন্ত কারো তার চেয়েও কম এমনকি এমন মু’মিন থাকবে যার নূর তার পায়ের তলা থেকে সামনে যাবে না” (ইবনে জারীর)। অন্য কথায় যার মাধ্যমে পৃথিবীর যত বেশী কল্যাণ হবে তার ‘নূর’ তত বেশী উজ্জ্বল হবে এবং পৃথিবীর যেসব স্থানে তার কল্যাণ পৌঁছবে হাশরের ময়দানেও তার নূরের আলো ততটা দূরত্ব পর্যন্ত দৌড়াতে থাকবে।
এখানে একটি প্রশ্ন মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। প্রশ্নটি হচ্ছে, নূর বা আলোক রশ্মির আগে আগে দৌড়ানোর ব্যাপারটি বোধগম্য হয়। কিন্তু শুধু ডান পাশে নূর দৌড়ানোর অর্থ কি? তবে কি তাদের বাঁ দিকে অন্ধকার থাকবে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, কেউ যদি তার ডান হাতে আলো নিয়ে পথ চলতে থাকে তাহলে তার বাঁ দিকটাও কিন্তু আলোকিত হবে। অথচ বাস্তব ঘটনা এই যে, আলো আছে তার ডান হাতে। হযরত আবু যার ও আবুদ দারদা কর্তৃক বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীস থেকে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। নবী (সা.) বলেছেনঃ
اعرفهم بنورهم الذى يسعى بين ايديهم وعن ايمانهم وعن شمائلهم-
“আমি সেখানে আমার উম্মতের নেককার লোকদের তাদের নূরের সাহায্যে চিনতে পারবো—যে নূর তাদের সামনে ডানে ও বাঁয়ে দৌড়াতে থাকবে” (হাকেম, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে মারদুইয়া)।
# হচ্ছে, মু’মিনগণ যখন জান্নাতের দিকে যেতে থাকবেন তখন আলো থাকবে তাদের সামনে আর মুনাফিকরা পেছনের অন্ধকারে ঠোকর খেতে থাকবে। সে সময় তারা ঈমানাদারদেরকে ডেকে ডেকে বলতে থাকবে। আমাদের দিকে একটু ফিরে তাকাও যাতে আমরাও কিছু আলো পেতে পারি। কারণ এ মুনাফিকরা দুনিয়াতে ঈমানদারদের সাথে একই মুসলিম সমাজে বসবাস করতো।
# এর অর্থ হচ্ছে, জান্নাতবাসীগণ ঐ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তারপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। দরজার এক দিকে থাকবে জান্নাতের নিয়ামতসমূহ আর অপরদিকে থাকবে দোযখের আযাব। যে সীমারেখা জান্নাত ও দোযখের মাঝে আড়াল হয়ে থাকবে মুনাফিকদের পক্ষে তা অতিক্রম করা সম্ভব হবে না।
# আমরা কি তোমাদের সাথে একই মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না? আমরা কি কালেমায় বিশ্বাসী ছিলাম না? তোমাদের মত আমরাও কি নামায পড়তাম না? রোযা রাখতাম না? হজ্জ ও যাকাত আদায় করতাম না? আমরা তোমাদের মজলিসে শরীক হতাম না? তোমাদের সাথে কি আমাদের বিয়ে শাদী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না? তাহলে আমাদের ও তোমাদের মাঝে আজ এ বিচ্ছিন্নতা আসলো কিভাবে?
# মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তোমরা খাঁটি মুসলমান হও নাই, বরং ঈমানও কুফরের মাঝে দোদুল্যমান ছিলে, কুফরী ও কাফেরদের প্রতি তোমাদের আকর্ষণ কখনো ছিন্ন হয়নি এবং তোমরা নিজেদেরকে কখনো ইসলামের সাথে পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত করনি।
# আয়াতে মূল শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে تَرَبَّصْتُمْ । আরবী ভাষায় تربص বলে অপেক্ষা করা ও সুযোগ লাভের প্রতীক্ষায় থাকাকে। কেউ যখন দু’টি পথের কোন একটিকে চলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, বরং এই ভেবে অপেক্ষা করতে থাকে যে, যেদিকে যাওয়া লাভজনক বলে মনে হবে সেদিকেই যাবে তখন বলা হয় সে تربص এ পড়ে আছে। কুফর ও ইসলামের মধ্যকার সে নাজুক যুগে মুনাফিকরা এ ভূমিকাই গ্রহণ করেছিল। তারা খোলাখুলি কুফরের পক্ষও অবলম্বন করছিল না। আবার পূর্ণ তৃপ্তি ও প্রশান্তির সাথে নিজের শক্তিকে ইসলামের সাহায্য-সহযোগিতায় কাজে লাগাচ্ছিলো না। বরং যথারীতি বসে বসে দেখছিলো, এ শক্তি পরীক্ষায় কোন দিকের পাল্লা শেষ পর্যন্ত ভারী হয়। যাতে ইসলাম বিজয়ী হচ্ছে বলে মনে হলে সে ইসলামের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়তে পারে এবং মুসলমানদের সাথে কালেমায় বিশ্বাস করার যে সম্পর্ক আছে তা কাজে লাগে। আর যদি কুফরী শক্তি বিজয়ী হয় তাহলে তার সহযোগীদের সাথে যেয়ে শামিল হতে পারে এবং তখন ইসলামের পক্ষ থেকে যুদ্ধে কোন প্রকার অংশ গ্রহণ না করা তার জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হয়।
# এর অর্থ বিভিন্ন রকম সংশয়-সন্দেহ। মুনাফিকরা এ ধরনের সংশয়-সন্দেহে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এগুলোই মুনাফিকীর মূল কারণ। সে আল্লাহর অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করে। রসূলের রিসালাতে সন্দেহ পোষণ করে, কুরআন যে আল্লাহর কিতাব তাতেও সন্দেহ পোষণ করে। আখেরাত, আখেরাতের জবাবদিহি এবং প্রতিদান ও শাস্তির ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করে এবং তার মনে এরূপ সন্দেহও সৃষ্টি হয় যে, হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বের সত্যিই কি কোন স্বার্থকতা আছে? না কি এসবই একটা ঢং। সত্য শুধু এতটুকুই যে, সুখে স্বচ্ছন্দে থাকো। এটাই সত্যিকারের জীবন। যতক্ষণ না কেউ এ ধরনের সন্দেহ সংশয়ে নিমজ্জিত হবে ততক্ষণ সে মুনাফিক হতে পারে না।
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, তোমাদের মৃত্যু এসে গেল এবং তোমরা মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত এ প্রতারণার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারোনি। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, ইসলাম বিজয় লাভ করলো আর তোমরা তামাশার মধ্যেই ডুবে রইলে।
# শয়তান।
# এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, আখেরাতে কাফেরের পরিণতি যা হবে মুনাফিকের পরিণতিও ঠিক তাই হবে।
# মূল আয়াতে ব্যবহৃত কথাটি হচ্ছে, هِيَ مَوْلَاكُمْ ” দোযখই তোমাদের مولى । এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, সেটিই তোমাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা তো আল্লাহকে তোমাদের অভিভাবক বানাওনি যে, তিনি তোমাদের তত্বাবধান করবেন। এখন দোযখই তোমাদের অভিভাবক। সে-ই তোমাদের যথোপযুক্ত তত্বাবধান করবে।
# এখানেও “ঈমান গ্রহণকারী” কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক কিন্তু তা দ্বারা সব মুসলমানকে বুঝানো হয়নি, বরং মুসলমানদের সে বিশেষ গোষ্ঠীকে বুঝানো হয়েছে যারা ঈমান গ্রহণের অঙ্গীকার করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের মধ্যে শামিল হয়েছিলো এবং তা সত্ত্বেও ইসলামের জন্য তাদের মনে কোন দরদ ছিল না। তারা নিজ চোখে দেখছিলো সমস্ত কুফরী শক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বদ্ধ পরিকর হয়েছে, মু’মিনদের ক্ষুদ্র একটি দলকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। আরব ভূমির বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার বানানো হচ্ছে। দেশের নানা স্থান থেকে নির্যাতিত মুসলমানরা নিতান্ত সহায় সম্বলহীন অবস্থায় আশ্রয় লাভের জন্য মদীনার দিকে ছুটে আসছে। এসব মজলুমের সহায়তা দিতে দিতে সত্যিকার মুসলমানদের কোমর ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এরাই আবার জীবন বাজি রেখে শত্রুর মোকাবিলা করছে। কিন্তু এসব দেখে ঈমানের দাবীদার এ লোকগুলোর মধ্য কোন পরিবর্তনই আসছে না। এজন্য তাদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলা হচ্ছে, তোমরা কেমন ঈমানদার? ইসলামের জন্য পরিস্থিতি নাজুক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। আল্লাহর কথা শুনে তোমাদের অন্তর বিগলিত হবে, তাঁর দ্বীনের জন্য তোমাদের অন্তরে ত্যাগ ও কুরবানীর মনোভাব প্রবল হবে এবং সেজন্য প্রাণপাত করতে আবেগ উদ্বেলিত হয়ে উঠবে, এখনো কি তোমাদের জন্য সে সময় আসেনি? ঈমান গ্রহণকারীরা কি এমনই হয়ে থাকে যে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির দেখা দিলেও সেজন্য সামান্যতম দরদও অনুভব করবে না? আল্লাহর নাম নিয়ে তাদের আহবান জানানো হবে, কিন্তু তারা আপন স্থান থেকে একটুও নড়বে না? আল্লাহ তাঁর নাযিলকৃত কিতাবে নিজে দান করার জন্য আহবান জানিয়ে তাকে নিজের জন্য ঋণ হিসেবে ঘোষণা করবেন এবং স্পষ্টভাবে এও জানিয়ে দেবেন যে, এ পরিস্থিতিতে যারা তাদের অর্থ সম্পদকে আমার দ্বীনের চেয়ে প্রিয় মনে করবে তারা মু’মিন নয়, মুনাফিক—এতেও তাদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে কেঁপেও উঠবে না, তাঁর নির্দেশের আগে তাদের মাথাও নত হবে না?
# নবীদের তিরোধানের শত শত বছর পর তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদের চেতনাহীন মৃত আত্মা এবং নৈতিকভাবে মৃত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছ। অথচ তোমাদের রসূল তোমাদের মধ্যে বর্তমান, আল্লাহর কিতাব নাযিল হচ্ছে, তোমাদের ঈমান গ্রহণের পর দীর্ঘ দিনও অতিবাহিত হয়নি, অথচ তোমাদের অবস্থা ঠিক তেমনি হয়ে যাচ্ছে, শত শত বছর ধরে আল্লাহর দ্বীন ও তাঁর আয়াত নিয়ে খেল তামাশা করতে থাকার পর ইহুদী ও খৃস্টানদের অবস্থা যা হয়েছে।
# এখানে যে প্রসঙ্গে একথাটি বলা হয়েছে তা ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার। কুরআন মজীদে বেশ কিছু জায়গায় নবুওয়াত ও কিতাব নাযিলকে বৃষ্টির বরকতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কেননা, ভু-পৃষ্ঠের ওপর বৃষ্টিপাত যে কল্যাণ বয়ে আনে নবুওয়াত এবং কিতাবও মানবজাতির জন্য সে একই রকমের কল্যাণ বয়ে আনে। মৃত ভূ-পৃষ্ঠে যেমন রহমতের বৃষ্টির এক বিন্দু পড়তেই শস্য শ্যামল হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি আল্লাহর রহমতে যে দেশে নবী প্রেরিত হন এবং অহী ও কিতাব নাযিল হওয়া শুরু হয় সেখানে মৃত মানবতা, অকস্মাৎ জীবন লাভ করে। তার এমন সব প্রতিভা ও গুণাবলীর বহির্প্রকাশ ঘটতে থাকে, যা জাহেলিয়াত দীর্ঘদিন থেকে মাটিতে মিশিয়ে রেখেছিলো। তার মধ্য থেকে মহত নৈতিক চরিত্রের ঝর্ণাধারা ফুটে বের হতে থাকে এবং কল্যাণ ও সৎকর্মের ফুল বাগিচা শ্যামলিমায় ভেসে উঠে। এখানে যে উদ্দেশ্যে এ সত্যটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হচ্ছে, দুর্বল ঈমান মুসলমানদের চোখ যেন খুলে যায় এবং তারা যেন নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে দেখে। নবুওয়াত ও অহীর কল্যাণময় বৃষ্টিধারা থেকে মানবতার মধ্যে যেভাবে নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছিলো এবং যেভাবে তার আঁচল কল্যাণে ভরে উঠছিলো তা তাদের জন্য সুদূর অতীতের কোন কাহিনী ছিল না। সাহাবা কিরামের (রা.) পুত পবিত্র সমাজে তারা নিজ চোখে তা দেখছিলো। এ ব্যাপারে তারা দিনরাত সর্বক্ষণ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলো। জাহেলিয়াত ও তার সমস্ত অকল্যাণসহ তাদের সামনে বর্তমান ছিল এবং জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম থেকে যে গুণাবলী ও কল্যাণ উৎসারিত হয়ে পূর্ণরূপে বিকশিত হচ্ছিলো। তাই এসব বিষয় তাদেরকে বিস্তারিত বলার কোন প্রয়োজন ছিল না। অতএব, মৃত’ ভূ-পৃষ্ঠে আল্লাহ তা’আলা রহমতের বারিধারা দ্বারা কিভাবে জীবন দান করেন তোমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে তার নিদর্শন দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে সেদিকে শুধু ইঙ্গিত করাই যথেষ্ট ছিল। এখন তোমরা বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে নিজেদের অবস্থা ভেবে দেখ যে, এ নিয়ামত দ্বারা তোমরা কতখানি উপকৃত হচ্ছো।
# বাংলা ভাষায় صدق (সাদকা) শব্দটি অত্যন্ত খারাপ অর্থে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় ‘সাদকা’ বলা হয় এমন দানকে যা সরল মনে খাঁটি নিয়তে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিতে দেয়া হয়। যার মধ্যে কোন প্রদর্শনীর মনোভাব থাকে না, কাউকে উপকার করে খোঁটা দেয়া হয় না। দানকারী তার রবের দাসত্ব ও আনুগত্যের খাঁটি মনোবৃত্তি পোষণ করেন বলেই দেন। এ শব্দটি صدقه শব্দটি থেকে গৃহীত। তাই এর পেছনে কাজ করে সততা। কোন দান বা কোন অর্থ ব্যয় ততক্ষণ ‘সাদকা’ বলে গণ্য হয় না যতক্ষণ তার মধ্যে “ইনফাক ফীসাবীলিল্লাহ” আল্লাহর পথে ব্যয় করার খাঁটি নিয়ত এবং নির্ভেজাল আবেগ ও ভাবধারা কার্যকর না থাকে।
# এখানে ঈমান গ্রহণকারী অর্থ সেসব লোক যারা ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী এবং যাদের কর্মপদ্ধতি ঈমানের মিথ্যা দাবীদার ও দুর্বল ঈমানের লোকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সে সময় যারা একে অন্যের তুলনায় অধিক আর্থিক কুরবানী পেশ করছিলো এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য জীবণপণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল।
# এটি صدق শব্দের অর্থের আধিক্য প্রকাশক শব্দ। صادق অর্থ সত্যবাদী এবং صديق অর্থ অতিশয় সত্যবাদী। কিন্তু একথা ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, صدق কেবল সত্য ও বাস্তবের সাথে সমঞ্জস্যপূর্ণ কথাকেই বলে না। যে কথা যথাস্থানে সত্য, যার বক্তা মুখে যা বলছে অন্তরেও সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে কেবল সে কথার ক্ষেত্রেই এ শব্দটি প্রযোজ্য। যেমনঃ কেউ যদি বলে যে মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রসূল, তা হলে তা বাস্তবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কথা। কারণ তিনি তো সত্যকার অর্থেই আল্লাহর রসূল। কিন্তু ঐ ব্যক্তিকে একথার ক্ষেত্রে কেবল তখনই সত্যবাদী বলা যাবে যখন সে বিশ্বাস করবে যে, সত্যিই তিনি আল্লাহর রসূল। সুতরাং কোন কথা সত্য হতে হলে প্রয়োজন বাস্তবের সাথে এবং বক্তার মন ও বিবেকের সাথে তার মিল থাকা। অনুরূপভাবে صديق শব্দের অর্থের মধ্যে বিশ্বস্ততা, সরলতা এবং বাস্তব কাজ কর্মে সততাও অন্তর্ভুক্ত। صادق الوعد (প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যবাদী) সে ব্যক্তিকে বলা হবে যে কার্যত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। صديق (সত্যিকার বন্ধু) তাকেই বলা হবে যে বিপদের সময় বন্ধুত্বের হক আদায় করেছে এবং কেউ কখনো তার থেকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। যুদ্ধে صادق فى القتال (খাঁটি সৈনিক) কেবল সেই ব্যক্তিকেই বলা হবে যে তার কাজ দ্বারা নিজের বীরত্ব প্রমাণ করেছে। বক্তার কাজ তার কথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়াটাও صدق শব্দের অর্থ ও তাৎপর্যের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি তার কথার পরিপন্থী কাজ করে তাকে সত্যবাদী বলা যেতে পারে না। এ কারণে যে ব্যক্তি বলে এক কথা কিন্তু করে ভিন্ন কিছু, তাকে সবাই মিথ্যাবাদী বলে। এখন ভেবে দেখা দরকার যে, صادق ও صدق শব্দের অর্থ যেখানে এই সেখানে صديق (অতিশয় সত্যবাদী) এ আধিক্য প্রকাশক শব্দটি বলার অর্থ কি হবে। এর অনিবার্য অর্থ হবে এমন সত্যবাদী লোক যার মধ্যে কোন ভেজাল নেই, যে ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে কখনো বিচ্যুতি হয়নি। যার নিকট থেকে বিবেকের বিরুদ্ধে কোন কথা আশাই করা যায় না, যে কোন কথা মেনে নিয়ে থাকলে পূর্ণ সততার সাথেই মেনে নিয়েছে, যথার্থভাবে তা পালন করেছে এবং নিজের কাজ দ্বারা প্রমাণ করেছে যে, একজন মান্যকারীকে বাস্তবে যা হওয়া উচিত সে তেমনি একজ মান্যকারী (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আন নিসা, টীকা-৯৯)।
# এ আয়াতের তাফসীরে বড় বড় মুফাসসিরদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। ইবনে আব্বাস (রা.), মাসরূক, দাহহাক, মুকাতিল ইবনে হাইয়ান, প্রমুখ, মুফাসসিরদের মতেأُولَئِكَ هُمُ الصِّدِّيقُونَ পর্যন্ত একটি বাক্য শেষ হয়েছে। এরপর وَالشُّهَدَاءُ عِنْدَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ পর্যন্ত কথাগুলো একটা স্বতন্ত্র বাক্য। এ ব্যাখ্যা অনুসারে আয়াতের অনুবাদ হবে “যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান এনেছে তারাই ‘সিদ্দীক’। আর শহীদদের জন্য তাদের রবের কাছে তাদের পুরস্কার ও ‘নূর’ রয়েছে। পক্ষান্তরে মুজাহিদ এবং আরো কিছু সংখ্যক মুফাসসির এ পুরা বক্তব্যকে একটা বাক্য বলে মনে করেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে আয়াতের অনুবাদ হবে তাই যা আমি ওপরে আয়াতের অনুবাদে লিখেছি। উভয় ব্যাখ্যার মধ্যে ভিন্নতার কারণ হচ্ছে, প্রথমোক্ত দল শহীদ বলতে আল্লাহর পথে নিহতদের বুঝেছেন। তারা এও দেখেছেন যে, প্রত্যেক মু’মিন আল্লাহর পথে নিহত হয় না। তাই তারা وَالشُّهَدَاءُ عِنْدَ رَبِّهِمْ কথাটিকে একটি পূর্ণাংগ বাক্য ধরে নিয়েছেন। কিন্তু শেষোক্ত দলটি ‘শহীদকে’ আল্লাহর পথে নিহত অর্থে গ্রহণ করেননি, বরং সত্যের সাক্ষ্যদাতা অর্থে গ্রহণ করেছেন। এ বিচারে প্রত্যেক নিষ্ঠাবান মু’মিনই শহীদ হিসেবে গণ্য। আমাদের এ দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিই অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য। কুরআন ও হাদীসেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا (ابقرة : 143)
“আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি যেন তোমরা লোকদের জন্য সাক্ষী হতে পার এবং রসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হন।” ( আল বাকারা ১৪৩)।
هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ (الحج : 78)
“আল্লাহ পূর্বেও তোমাদের নাম রেখেছিলেন মুসলমান। এ কুরআনেও (তোমাদের এ নাম-ই রাখা হয়েছে।) যেন রসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হন আর তোমরাও মানুষের জন্য সাক্ষী হও।” (আল হজ্জ ৭৮)।
হাদীসে হযরত বারা ইবনে আযেব বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা বলতে শুনেছেন যে, مُؤْمِنُوْا اُمَّتِى شُهَدَاءُ ” আমার উম্মতের মু’মিনগণই শহীদ।” তারপর নবী (সা.) সূরা হাদীদের এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন (ইবনে জারীর)। ইবনে মারদুইয়া হযরত আবুদ দারদা থেকে এই একই অর্থের একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
من فربدينه من ارض مخافة الفتنة على نفسه ودينه كتب عند الله صديقا فاذا مات قبضه الله شهيدا ثم تلا هذه الاية-
“যে ব্যক্তি তার প্রাণ ও দ্বীন বিপন্ন হবে ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে এ আশঙ্কায় কোন দেশ বা ভূ-খণ্ড ছেড়ে চলে যায় তাকে আল্লাহর কাছে ‘সিদ্দীক’ বলে লেখা হয়। আর সে যখন মারা যায় তখন আল্লাহ শহীদ হিসেবে তার রূহ কবজ করেন। একথা বলার পর নবী (সা.) এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন (শাহাদাতের এই অর্থ বিশদভাবে বুঝার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, টীকা, ১৪৪ , আন নিসা, টীকা ৯৯ , আল আহযাব, টীকা ৮২ )।
# তাদের মধ্য থেকে যে যে মর্যাদার পুরস্কার ও যে মর্যাদার ‘নূরের’ উপযুক্ত হবে তা সে পাবে। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পুরস্কার ও ‘নূর’ লাভ করবে। তাদের প্রাপ্য অংশ এখন থেকেই তাদের জন্য সংরক্ষিত আছে।
১২-১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
# আল্লাহতায়ালা বলেন, যেদিন মােনাফেক নরনারী মােমেনদের বলবে, তােমরা আমাদের দিকে একটু তাকাও না। আমরা তােমাদের কাছ থেকে একটু আলাে নেই। তাদের বলা হবে, ‘তােমাদের অতীত জীবনে ফিরে যাও এবং সেখানে আলাের সন্ধান করো। মােনাফেকদের কাতর অনুনয়ের ফলে যখন মােমেনরা তাদের দিকে তাকাবে, তখন আলাে বিচ্ছুরিত হতে থাকবে, কিন্তু মােনাফেকরা সারাটা জীবন গােমরাহীর অন্ধকারে কাটিয়ে দেয়ার কারণে সেই আলাে দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না এবং পথ দেখতে পাবে না। তখন একটি অপরিচিত ধ্বনি উচ্চারিত হবে, ‘তােমরা তােমাদের পেছনের জীবনে ফিরে যাও এবং সেখানে আলাে সন্ধান করাে।’ এ কথার মধ্যে ধমকের সুর প্রতিধ্বনিত। তাদের দুনিয়ার জীবনের মোনাফেকী, শঠতা, কপটতা, দোমুখাে নীতি ও ধােকাবাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, তােমরা তােমাদের দুনিয়ার জীবনে যেসব কাজ করতে, দুনিয়ায় ফিরে গিয়ে সেসব কাজ করো। আলাে যদি পেতে চাও, তবে দুনিয়ায় ফিরে যাও। কেননা, ওখানে বসেই সৎকর্ম দ্বারা আলাের ব্যবস্থা করে আসতে হয় আজ এখানে বসে আলোর কোনাে ব্যবস্থা হবে না। আর এই কথা বলার সাথে সাথেই মােমেনদের ও মােনাফেকদের মাঝে চুড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটানাে হবে। দুনিয়ায় মােমেন ও মােনাফেকরা পাশাপাশি অবস্থান করলেও কেয়ামতের দিন সেটা হবে না। কেননা কিয়ামত হচ্ছে সৎ লোক ও অসৎ লােকদের পৃথক করার দিন। তৎক্ষণাত তাদের মাঝে একটা দরজা বিশিষ্ট দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে। তার অভ্যন্তরে থাকবে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ, আর বাইরের দিকে থাকবে আযাব। মনে হয়, এই দেয়াল এমন ধরনের হবে, যার এক পাশ থেকে অপর পাশের দৃশ্য দেখা যাবে না, কিন্তু শব্দ শােনা যাবে। মােনাফেকরা মােমেনদের ডেকে বলবে, ‘আমরা কি তােমাদের সাথে ছিলাম না?’ অর্থাৎ আজ আমাদের কী দোষ হলাে যে, তােমাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যেতে হবে? দুনিয়াতে কি আমরা একই জায়গায় বাস করতাম ? আর আজও কি একই জায়গায় সমবেত হইনি? মােমেনরা বলবে, ‘হা, ঠিকই। কিন্তু তােমরা নিজেদের ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করেছো। ফলে তােমরা হেদায়াত থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছো। আর তােমরা অপেক্ষায় থেকেছো।’ অর্থাৎ সময়মতাে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মতাে দৃঢ়তা দেখাতে পারনি। ‘তােমরা সন্দেহে নিমজ্জিত ছিলে।’ ফলে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারােনি। তােমাদের আশা তােমাদের প্রতারিত করেছে। অর্থাৎ এই মিথ্যা আশাই তােমাদের ধোঁকা দিয়েছে যে, এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে লিপ্ত থেকেই তােমরা মুক্তি পেয়ে যাবে। অবশেষে আল্লাহর সিদ্ধান্ত এসে গেছে। অর্থাৎ সময় শেষ ও সুযােগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। আর চরম বিভ্রান্তকারী তোমাদের আল্লাহর ব্যাপারে বিভ্রান্ত করেছে। এই চরম বিভ্রান্তকারী হচ্ছে শয়তান, যে মানুষকে মিথ্যা আশার মরীচিকার পেছনে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। পরবর্তী বাক্যটি মােনাফেকদের উদ্দেশ্য করে দেয়া মােমেনদের বক্তব্যের ধারাবাহিকতাও হতে পারে, অথবা তা ফেরেশতাদের বা স্বয়ং আল্লাহর কথাও হতে পারে। ‘আজ তােমাদের কাছ থেকেও কোনাে মুক্তিপণ নেয়া হবে না, কাফেরদের কাছ থেকেও নয়। তােমাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। ওটাই তােমাদের আশ্রয়স্থল এবং জঘন্যতম ঠিকানা।’ দৃশ্য তুলে ধরার প্রতি যদি শৈল্পিক বিন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকাই, তাহলে মনে হয়, এখানে বিশেষভাবে আলাের দৃশ্যটা নির্বাচনে কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এখানে আলােচ্য বিষয় হচ্ছে মােনাফেক নরনারী। আর মােনাফেকদের স্বভাব এই যে, তারা তাদের মনের আসল কথা গােপন করে এবং যা তাদের মনের কথা নয় তাই প্রকাশ করে। এভাবে তারা শঠতা, ভণ্ডামি ও জালিয়াতির ঘাের অন্ধকারে বিচরণ করে। আর আলাের বৈশিষ্ট্য হলাে, তা গােপন জিনিসকে প্রকাশ করে। অন্য কথায়, আলাে হচ্ছে তমসাচ্ছন্ন ও বিকারগ্রস্ত মােনাফেকীর সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস। তাই এই বিরাট দৃশ্যটির ওপর আলােকপাত করার জন্যে এই আলােই সর্বাপেক্ষা উপযােগী। এই আলােই মােমেনদের সামনে ও ডানে আলো বিস্তারের সবচেয়ে উপযুক্ত। আর মােনাফেকরা তাে অন্ধকারে থাকে, যা বিবেকের অন্ধকার ও গােপনীয়তার অন্ধকারের সাথে মানানসই। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, কেয়ামতের দিন এই আলাের জন্যে লালায়িত হবে না এমন কেউ থাকবে না। আর তাই আল্লাহর পথে জান মাল দিয়ে সংগ্রাম সাধনার আহবানেও প্রত্যেকেরই সাড়া দেয়া উচিত। কোরআন নিরন্তর মানুষকে এই আহ্বানই শুধু জানাচ্ছে না; বরং এই আহবানে সাড়া দেয়ার জন্যে তাকে নিরন্তর উদ্বুদ্ধ এবং প্রস্তুতও করছে। সূরার পরবর্তী অংশে এই আহবান ও এই উদ্বুদ্ধকরণেরই ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। এ অংশটি সূরার মূল আলােচ্য বিষয়েরই ধারাবাহিকতা। এর মূল আলােচ্য বিষয় হলাে অন্তরে প্রকৃত ঈমান বদ্ধমূল করা, যাতে তার ভেতরে আল্লাহর পথে জান ও মালের ত্যাগ স্বীকারের প্রেরণা সঞ্চারিত হয়। ঈমানের প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী বক্তব্যে এ অংশটি প্রথমাংশের মতােই পরিপূর্ণ। এ অংশটি শুরু হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মােমেনদের লক্ষ্য করে মৃদু তিরস্কারের মধ্য দিয়ে। কারণ, তারা তখন পর্যন্ত আল্লাহর প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হতে পারেনি। সেই সাথে তাদের ইহুদী ও খৃষ্টানদের ন্যায় নিষ্ঠুরতা ও পাপাচার থেকে এবং দীর্ঘকাল এই নিষ্ঠুরতা ও পাপাচারে অভ্যন্তরে থাকার কারণে ইহুদী ও খৃষ্টানরা যে শোচনীয় পরিণামের সম্মুখীন হয়েছিলাে তা থেকে সাবধান করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তাদের আল্লাহর সাহায্যের জন্যে আশাবাদী করে তােলা হয়েছে, যা মৃত পৃথিবীকে সজীব করার মতাে মৃত হৃদয়কেও পুরুজ্জীবিত করে। এর পরই আখেরাত সংক্রান্ত আলােচনা এসেছে। পূর্ববর্তী অংশে আলােচিত আল্লাহকে ঋণ প্রদান অর্থাৎ আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টির পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সেই সাথে আল্লাহকে ঋণদাতাদের জন্যে কিরূপ গুণিতক হারে পুরস্কার ও প্রতিদান ধার্য করা হয়েছে তাও বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় যে বিষয়টি আলােচিত হয়েছে, তা হলাে আল্লাহর মানদন্ডে পরকালের তুলনায় ইহকালের মূল্যমান। এখানে দেখানাে হয়েছে যে, দুনিয়ার জীবনের মূল্য নিতান্তই খেলা তামাশার মত। আল্লাহর মানদন্ডে আখেরাতের পাল্লাই ভারী এবং এর গুরুত্বই সর্বাধিক। এজন্যে আখেরাতের মর্যাদা লাভের জন্যে প্রতিযোগিতা করার আহ্বান জানানাে হয়েছে। আহ্বান জানানাে হয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর ন্যায় প্রশস্ত ও বিশাল বেহেশতে প্রবেশের প্রতিযােগিতা করতে, যা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের জন্যেই নির্দিষ্ট। চতুর্থ যে বিষয়টি এখানে আলােচিত হয়েছে তা তাদের আখেরাতের অংগন থেকে দুনিয়ার বাস্তব জীবন ও তার ঘটনাবলীর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের মনকে সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল বানায়। এভাবে আল্লাহর পথে ব্যয় করা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে যায় এবং দুনিয়ার সহায়-সম্পদের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি না হয়ে যাবতীয় আবেগ অনুভূতি শুধুমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
ফী জিলালিল কুরআন:
*পাষাণ হৃদয় মানুষের ঈমান আনার উৎসাহ দান : এরপর আলােচিত হয়েছে পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত ও আন্দোলনের ইতিহাসের একটি অংশ। এতে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আল্লাহর বিধান সর্বকালেই এক অভিন্ন এবং এটাই একমাত্র সঠিক মত ও পথ। প্রত্যেক যুগে আল্লাহর বিধানকে যারা অগ্রাহ্য ও অমান্য করে, তারাই ফাসেক। সেই সাথে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী ও খৃষ্টানদের কিছু ভ্রষ্টতা বিপথগামিতার সমালােচনা ও তা থেকে মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে, যেমনটি করা হয়েছিলো সূরার পূর্ববর্তী অংশে। সবার শেষে মুসলমানদের আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের প্রতি সুদৃঢ় ঈমান আনয়ন ও তাকওয়া অবলম্বনের আহবান জানানাে হয়েছে। এতে আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বিগুণ রহমত দান করবেন, তাদের পথ চলার আলাে ও ক্ষমা দান করবেন। আল্লাহর এসব অনুগ্রহ শুধু আহলে কিতাবদের জন্যে নির্দিষ্ট বলে আহলে কিতাব গােষ্ঠী মনে করে, কিন্তু আসলে তা নয়, এ সব আল্লাহর হাতে এবং তিনি যাকে ইচ্ছা দিয়ে থাকেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা বিপুল অনুগ্রহের অধিকারী।’ এ ভাবে সমগ্র সূরাটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক অটুট সংযােগ ও সমন্বয় বিদ্যমান। মানুষের মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত, আলােড়িত ও উজ্জীবিত করার উপাদানে এ সূরা সমৃদ্ধ। কোথাও কোথাও প্রয়ােজনীয় পরিমাণে কোনাে কোনাে বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যাতে এর প্রভাব হৃদয়ে গভীরভাবে বদ্ধমূল হয় ও আবেগে উদ্দীপনার উষ্ণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। ১৬ নং আয়াত দিয়ে এ অংশটি শুরু হয়েছে। এ আয়াতটিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহর স্মরণের জন্যে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া সত্যের জন্যে মােমেনদের হৃদয় উদ্দীপিত হবার সময় কি এখনাে আসেনি! ইতিপূর্বে যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিলাে। তাদের দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলাে, ফলে তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিলাে এবং তাদের অনেকেই ফাসেক হয়ে গিয়েছিলাে, তাদের মতাে যেন মােমেনদের অবস্থা না হয়। তােমরা জেনে রাখে যে, পৃথিবী মৃত হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তাকে পুনরুজ্জীবিত করে থাকেন। ‘তােমাদের জন্যে আমি নিদর্শনাবলী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি যেন তোমরা হৃদয়ংগম করাে।’ পরম দয়ালু ও পরম করুণাময় মনিবের পক্ষ থেকে এটি একটি কার্যকর তিরস্কার। যে অন্তরগুলাের ওপর তিনি তার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর আহবানে পরিপূর্ণরূপে সাড়া দিতে বিলম্ব হওয়ায় এখানে খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। কেননা, তাদের কাছে তিনি রসূল প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের ওপর ঈমান আনার দাওয়াত দেন, তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলাের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাদের ওপর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেছেন এবং সৃষ্টিজগতে তার এমন সব নিদর্শন তাদের প্রত্যক্ষ করিয়েছেন, যা সতর্কীকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণে সক্ষম। এ তিরস্কার স্নেহ মিশ্রিত, উদ্বুদ্ধকারী, আল্লাহর মহত্ব উপলব্ধি করার প্রেরণা সঞ্চারক, তার স্মরণে উৎসাহদানকারী এবং যে মহাসত্য নাযিল হয়েছে তা যথােপযুক্ত ভীতি ও আত্মসমর্পণের মনােভাব নিয়ে গ্রহণের আগ্রহ সঞ্চারক। কিছুটা নিন্দা ও ক্ষোভের ভাব সহকারে প্রশ্ন করা হয়েছে, আল্লাহর স্মরণের জন্যে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া মহাসত্যের জন্যে মুমিনের হৃদয় উদগ্রীব হবার সময় কি আসেনি? উদ্বুদ্ধ করা ও ক্ষোভ প্রকাশ করার পাশাপাশি সত্য গ্রহণে শৈথিল্য ও বিলম্ব প্রদর্শন থেকে সতর্কও করা হয়েছে, দীর্ঘকালব্যাপী এই শৈথিল্য প্রদর্শনে মানব হৃদয়ে যে মরিচা পড়ে ও আল্লাহর স্মরণে ক্রমাগত উদাসীনতা এবং সত্য গ্রহণে আগ্রহী না হওয়ার কারণে হৃদয়ে যে কঠোরতার সৃষ্টি হয়, এখানে তারও বিবরণ দেয়া হয়েছে, আর তারা যেন তাদের মতাে না হয়ে যায় যাদের ইতিপূর্বে কিতাব প্রদত্ত হয়েছিলাে, অতপর তাদের ওপর দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হয়েছিলাে, ফলে তাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গিয়েছিলাে এবং তাদের অনেকেই ফাসেক হয়ে গিয়েছিল। হৃদয় কঠিন হওয়ার পেছনে আল্লাহর অবাধ্য ও বিদ্রোহী হওয়া ছাড়া আর কোনাে কারণ নেই। মানব হৃদয় দ্রুত পরিবর্তনশীল ও দ্রুত বিস্মৃতিপ্রবণ। এই হৃদয় যতােক্ষণ স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল থাকে, ততােক্ষণ তা হেদায়াতের আলাে দ্বারা উপকৃত হয় ও উজ্জ্বলতর হয়, কিন্তু যখন তাকে আখেরাতের কথা ও তাকওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় না এবং সেও তা স্মরণ করে না, আর এই অবস্থায় দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে যায়, তখন তা কঠিন পাষাণের মতাে হয়ে যায়, তার স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্য অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় । তাই এই হৃদয়কে সব সময় আখেরাতের কথা ও আল্লাহভীতির কথা স্মরণ করতে থাকা উচিত যাতে সে আল্লাহর অনুগত ও বিনত হয়, তার ওপর ক্রমাগত করাঘাত করতে থাকা উচিত, যাতে তা স্বচ্ছতা লাভ করে ও তার মরিচা ঝরে যায়। সর্বদা তাকে সজাগ ও সতর্ক করা উচিত, যাতে তা কঠিন ও পাষাণ না হয়ে যায়। তবে যদি কোনাে হৃদয় কঠিন ও পাষাণ হয়েই যায়, তবে হতাশ হওয়া অনুচিত। কেননা, সেই পাষাণ হৃদয়ও সজীব হয়ে ওঠতে পারে, তা হেদায়াতের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে যেতে পারে এবং তা আল্লাহর স্মরণে বিগলিত হয়ে যেতে পারে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা তাে নির্জীব মাটিতেও প্রাণ সঞ্চার করে থাকেন। আল্লাহর দেয়া উজ্জীবনী শক্তিতে তা উজ্জীবিত হয়ে থাকে, তাতে ফল ও ফুল ফোটে এবং প্রাণীকুলকে খাদ্য জোগায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা করেন তখন মৃত হৃদয়গুলােকেও পুনরুজ্জীবিত করেন। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এ কথাই বুঝিয়েছেন, ‘তােমরা জেনে রাখাে যে, আল্লাহ তায়ালা মৃত মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করে থাকেন। আর মৃত ও নির্জীব মাটিতে যেমন প্রাণ সঞ্চারিত হয়, তেমনি মৃত হৃদয়ে প্রাণ সঞ্চারের জন্যেও এই কোরআনে প্রয়ােজনীয় উপকরণ, খাদ্য ও পানীয় রয়েছে।’ আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তায়ালা এ কথাই বলেছেন, ‘তোমাদের জন্যে আমি (কোরআনে) আয়াতসমূহ বিশ্লেষণ করেছি, যাতে তােমরা বুঝতে পার।’
ফী জিলালিল কুরআন:
*সিদ্দীক ও শহীদদের মর্যাদা : কিভাবে তিনি মৃতকে জীবনদান করেন তার বর্ণনা, মােমেনদের আল্লাহর স্মরণে বিগলিত হওয়ার সময় এখনাে কি হয়নি বলে মৃদু তিরস্কার এবং তাদের আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া ও সাবধান করার পরই নতুন করে আল্লাহর পথে ব্যয় ও কোরবানীর জন্যে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই সদকাদানকারী নারী ও পুরুষরা এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিয়ে থাকে, তাদের প্রতিদান বহু গুণ বাড়ানাে হবে এবং তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। আর যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে…’ অর্থাৎ সদকাদানকারী মােমেন নারী ও পুরুষরা সদকা গ্রহণকারীদের কাছে নিজেদের বড়ত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যে তা করে না এবং এ ক্ষেত্রে তারা মানুষের সাথে কোনাে লেনদেন করে না। তারা সরাসরি আল্লাহর সাথে লেনদেন করে এবং তাকেই ঋণ দিয়ে থাকে। দানকারীর জন্যে এর চেয়ে কার্যকর ও গভীর প্রেরণাদায়ক বিষয় আর কিছু হতে পারে না যে, সে চির প্রশংসিত ও সর্বাধিক ধনাঢ্য আল্লাহকে ঋণ দিচ্ছে। সারা বিশ্বের মালিকের সাথে আদান প্রদান করছে। সে যা দান করছে তার বহুগুণ বেশী প্রতিদান সে পাবে এবং সর্বোপরি তার জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। একাধিক হাদীস থেকে জানা যায়, সিদ্দীকদের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ, কিন্তু যতাে উচ্চই হােক, তা কোনাে ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়; বরং যে ব্যক্তিই তা অর্জনে ইচ্ছুক, তার জন্যে তা অর্জন করার সুযােগ অবারিত। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলদের ওপর যথাযথভাবে ঈমান আনে, সে এই উচ্চ মর্যাদা লাভের আশা করতে পারে। আল্লাহর অনুগ্রহ কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। পরবর্তী আয়াতে এই বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলদের ওপর ঈমান এনেছে, তারাই সিদ্দীক। বস্তুত ইসলামের এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য যে, তার দ্বার সকলের জন্যে অবারিত ও উন্মুক্ত, সকল মানুষ ইসলামের নির্দিষ্ট সকল সম্মান মর্যাদা লাভ করতে পারে। এতে কারাে একচেটিয়া অধিকার নেই। নির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির জন্যে কোনাে নির্দিষ্ট মর্যাদা নেই, সঙ্কর্ম ব্যতীত আর কোনাে জিনিস এমন নেই যা মানুষকে উচ্চতর মর্যাদায় উন্নীত করতে পারে। ইসলাম এমন ধর্ম, যাতে কোনাে কুলীন ও অভিজাত শ্রেণী-গােষ্ঠীর স্থান নেই। ইমাম মালেক স্বীয় হাদীস গ্রন্থ ‘মােয়াত্তা’য় আবু সাঈদ খুদরী(রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূল(স.) বলেন, ‘জান্নাতবাসী তাদের উর্ধে অবস্থানকারী বিশেষ কক্ষসমূহে অবস্থানকারীদের দিকে এমনভাবে তাকাবে, যেমন তােমরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে গমনকারী উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে তাকাও। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্তরভেদ থাকার কারণেই এরূপ হবে। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ, এসব মর্যাদাপূর্ণ বাসগৃহ তাে নবীদের জন্যে, অন্যেরা তা পাবে না।’ রসূল(স.) বললেন, সেই আল্লাহর কসম যার হাতে আমার প্রাণ, যারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে এবং রসূলদের সত্য জানবে, তারা এসব বাসগৃহের অধিকারী হবে।’ এ হচ্ছে ঈমানের মর্যাদা। পরবর্তীতে আল্লাহর পথে প্রাণ বিসর্জনের মর্যাদা কতাে বড়ো তা বলা হচ্ছে। ‘আর শহীদরা তাে আল্লাহর কাছে থাকবে, তাদের জন্যে রয়েছে তাদের প্রতিদান ও তাদের আলাে।’ শহীদদের মর্যাদা সম্পর্কে কোরআনে একাধিক বিবরণ রয়েছে। এতদসংক্রান্ত হাদীসের সংখ্যাও প্রচুর। কারণ, আল্লাহর দ্বীন প্রহরা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না এবং জেহাদ ব্যতীত তা পৃথিবীতে বাস্তবায়িত হতে পারে না। ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস সংরক্ষণ করা, ইসলামের দাওয়াতের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং মুসলমানদের ফিতনা গোমরাহী থেকে ও ইসলামী আইন বিধানকে বিপর্যয় বিকৃতি থেকে রক্ষা করার জন্যে জেহাদ অপরিহার্য। এ জন্যেই শহীদদের এতাে বড় মর্যাদা। শহীদদের শহীদ অর্থাৎ সাক্ষী নামকরণের কারণ এটাই। আর এ কারণেই তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। তারা আল্লাহর কাছে থাকবে এ কথা দ্বারা এই নৈকট্যই বুঝানাে হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল(স.) বলেছেন, শহীদদের রূহসমূহ এক ধরনের সবুজ পাখির পেটে অবস্থান করে এবং সেই পাখি জান্নাতের যেখানে খুশী বিচরণ করে। অতপর তারা জান্নাতের আলােক স্তম্ভগুলােতে এসে আশ্রয় নেবে। অতপর আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে একটু নযর বুলাবেন এবং জিজ্ঞেস করবেন, তােমরা কি চাও? তারা বলবে, আমরা চাই তুমি আবার আমাদের দুনিয়ায় পাঠাও এবং আমরা তােমার জন্যে লড়াই করি ও শহীদ হই, যেমন ইতিপূর্বে হয়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘আমি ফায়সালা করেছি যে, মৃত ব্যক্তিরা আর দুনিয়ায় ফিরে যাবে না।’ সহীহ বােখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস(রা.) থেকে আরাে বর্ণিত হয়েছে, রসূল(স.) বলেছেন, জান্নাতে প্রবেশকারী কোনাে ব্যক্তিকে যদি সারা পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়, তবু সে দুনিয়ায় ফিরে যেতে চাইবে না। একমাত্র শহীদরাই হবে এর ব্যতিক্রম। সে কামনা করবে যে, তাকে আরাে দশ বার পৃথিবীতে পাঠানাে হােক এবং প্রতিবার সে শহীদ হােক। জান্নাতে সে যে সম্মান লাভ করবে, তার কারণেই তার এরূপ অভিলাষ হবে।’ এরূপ প্রেরণাদায়ক উক্তি যে শ্রবণ করে এবং আল্লাহর নিকট শহীদের মর্যাদা কিরূপ তা জানে, তার জন্যে দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত তুচ্ছ হয়ে যায়। ইমাম মালেক(র.) ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন, একবার রসূল(স.) জেহাদের জন্যে উৎসাহ দিলেন ও জান্নাতের উল্লেখ করলেন। এই সময় জনৈক আনসারী সাহাবী খােরমা খাচ্ছিলেন এবং তাঁর হাতে কয়েকটি খােরমা ছিলাে। সে বললাে, আমি যদি সব কয়টা খােরমা খাওয়ার জন্যে আরাে খানিকক্ষণ বসে কাটাই, তবে সেটা হবে আমার দুনিয়ার লােভে লালায়িত হওয়ার লক্ষণ।’ এই বলেই সে হাতের বাকী খােরমাগুলাে ফেলে দিয়ে তরবারি নিয়ে জেহাদে চলে গেলেন এবং লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেলেন। এই ব্যক্তির নাম ছিলাে ওবায়র ইবনুল হামাম(রা.)। সিদ্দীক ও শহীদদের এই উচ্চ মর্যাদা বর্ণনা করার পর কোরআন কাফেরদের সম্পর্কে বলেছে, আর যারা কাফের হয়েছে এবং আমার আয়াতগুলাে অস্বীকার করেছে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।’ এ আলােচনার পর এমন কে আছে যে, জান্নাতের নেয়ামত ও সম্মান পরিত্যাগ করবে এবং জাহান্নামের অধিবাসী হতে চাইবে ?
১২-১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১২-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতে ঈমান ও তাওহীদের দিকে আহ্বান জানিয়ে অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের ব্যাপারে বলছেন : কিয়ামতের মাঠে মু’মিনদের সামনে ও ডানে আমলানুযায়ী নূর বা জ্যোতি থাকবে। কারো নূর পাহাড় সমান হবে, কারো নূর একজন দণ্ডায়মান ব্যক্তির সমান হবে, যে ব্যক্তি সর্বনিম্ন নূর পাবে তার পরিমাণ হল তার বৃদ্ধাঙ্গুলে নূর থাকবে যা একবার নিভবে আরেকবার জ্বলবে। এ নূরের কম-বেশি মু’মিনের আমলের কম বেশির ওপর নির্ভর করে। যার সৎআমল বেশি হবে তার নূরের পরিমাণ বেশি হবে, আর যার সৎআমল যত কম হবে তার নূর তত কম হবে। মু’মিনরা কিয়ামতের দিন এ নূর দ্বারা পুলসিরাত পার হবে। ইবনু কাসীর (রহঃ) ও ইবনু জারীর (রহঃ) بِأَيْمَانِهِمْ দ্বারা মু’মিনদের ডান হাতে আমলনামা থাকার কথা বুঝিয়েছেন।
(انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ)
‘তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর’ অর্থাৎ মুনাফিকদেরও নূর থাকবে কিন্তু কিছু দূর গিয়ে তাদের নূর নিভে যাবে, ফলে তাদের পথ অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন তারা মু’মিনদেরকে এ কথা বলবে।
(قِيْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَكُمْ)
‘বলা হবে : তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও’ অর্থাৎ মু’মিনরা বিদ্রƒপ করে বলবে : পেছনে যেখানে নূর বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে নিয়ে আসো। সেখানে তারা গিয়ে কিছুই পাবে না। ফলে যখন ফিরে আসবে তখন তাদের ও মু’মিনদের মাঝে একটি দরজাবিশিষ্ট প্রাচীর স্থাপিত হবে।
(أَلَمْ نَكُنْ مَّعَكُمْ)
‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’ অর্থাৎ প্রাচীর স্থাপিত হওয়ার পর মুনাফিকরা মু’মিনদের বলবে- আমরা কি তোমাদের সাথে সালাত, জিহাদ ও অন্যান্য কাজে শরীক ছিলাম না? আজ কেন আমরা তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি, আমরা কেন নূর পাচ্ছি না?
فَتَنْتُمْ অর্থাৎ তোমরা তোমাদের অন্তরে কুফরী ও মুনাফিকী গোপন রেখেছিলে।
(وَتَرَبَّصْتُمْ) অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যু ও মু’মিনদের বিপদের অপেক্ষা করতে। আর দীনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে। এমনকি মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমরা সন্দেহ ও অলীক আশা-ভরসায় ডুবে ছিলে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মু’মিনরা কিয়ামতের দিন আমলানুযায়ী নূর পাবে যা দ্বারা পুলসিরাত পার হবে। তাই আমাদের বেশি বেশি সৎআমল করা উচিত।
২. মুনাফিকরা সেদিন বেহাল দশায় জর্জরিত হবে।
৩. মুনাফিকরা অন্তরে সর্বদা ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষতি কামনা করে।
৫. কিয়ামত দিবসে কোন বিনিময় চলবে না।
৬. নারী-পুরুষ যে কোন সৎআমল করলে তার প্রতিদান পাবে তাতে কোন তারতম্য করা হবে না।
১৬-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতে মু’মিন ও মুনাফিকদের পারলৌকিক অবস্থা বর্ণনা করার পর এখানে মু’মিনদেরকে তাঁর স্মরণে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া ও কুরআন থেকে নিদের্শনা গ্রহণের প্রেরণা দিচ্ছেন।
خشوع অর্থ : নরম অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ঝুঁকে পড়া। حق (সত্য) হলো কুরআনুল কারীম। এ আয়াত থেকে একশ্রেণির দরবেশ, ফকীর ও পীর বুজুর্গরা দলীল গ্রহণ করে সালাত, সিয়াম, খাবার, পোশাক পরিচ্ছেদ ও সংসার সব বর্জন করে আল্লাহ তা‘আলার যিকিরের নামে নিজেদের তৈরি করা ভণ্ডামী হৈ-হুল্লায় মগ্ন থাকে যা ইসলামী শরীয়ত সমর্থিত নয়। মূলত আয়াতে এরূপ কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়নি, কারণ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী মু’মিনদের ব্যাপারে যারা তাদের নাবীদের ওপর ঈমান এনেছে কিন্তু নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনেনি। এ আয়াতটি (وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَرُسُلِه۪) ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনে’ এ আয়াতের পরে এসেছে। অর্থাৎ যারা তাওরাত ও ইঞ্জিলের প্রতি ঈমান এনেছে তাদের কি এখনো সময় হয়নি যে, তাদের অন্তর কুরআনের জন্য নম্র হবে (কুরতুবী)।
তারপর মু’মিনদেরকে ইয়াহূদ ও খ্রিস্টানদের মত হতে নিষেধ করছেন যাদের ওপর দিয়ে বহুকাল অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পর স্বহস্তে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব পরিবর্তন করেছে এবং তা পেছনে নিক্ষেপ করে ধর্ম যাজকদেরকে মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে। ফলে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গিয়েছিল। কোন ওয়াজ নসিহত তাদের কাজে আসেনি।
(يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا)
‘আল্লাহই পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর জীবন দান করেন’ এ অংশ প্রমাণ করছে আল্লাহ যেমন মৃত জমিনকে বৃষ্টির পানি দ্বারা পুনরায় জীবিত করতে পারেন তেমনি মানুষকে পথভ্রষ্টের পর হিদায়াত দিতে পারেন, দুঃখের পর সুখ দিতে পারেন, কঠিন অন্তরকেও নরম করে দিতে পারেন এবং মানুষের মুত্যৃর পর পুনঃজীবিত করতে পারেন। মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশ করে মু’মিনদেরকে জান্নাত আর কাফিরদেরকে জাহান্নাম দেওয়ার জন্য অবশ্যই সকলকে পুনরুত্থিত করবেন।
(يُّضَاعَفُ لَهُمْ)
অর্থাৎ এক-এর বদলে কমপক্ষে দশগুণ এবং তার চেয়েও বেশি সাতশত গুণ বরং তার থেকেও অধিক মাত্রায়। যেমন আল্লাহ বলেন :
(مَثَلُ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَھُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللہِ کَمَثَلِ حَبَّةٍ اَنْۭبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِیْ کُلِّ سُنْۭبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍﺚ وَاللہُ یُضٰعِفُ لِمَنْ یَّشَا۬ئُﺚ وَاللہُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ)
“যারা আল্লাহর পথে তাদের মাল খরচ করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে একটি শস্যদানা যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করে। প্রত্যেক শীষে এক শত শস্যদানা থাকে আর আল্লাহ যাকে চান তাকে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রশস্তকারী, মহাজ্ঞানী।”
(هُمُ الصِّدِّيْقُوْنَ)
এ আয়াতের তাফসীর মুফাসসিরে কেরাম দু’ভাবে করেছেন :
১. আল্লামা ইবনু কাসীর ও সা‘দী (রহঃ)-সহ অনেকে বলেছেন : আয়াতটি
(هُمُ الصِّدِّيْقُوْنَ)
এখানে পরিপূর্ণ। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-ও এ কথা বলেছেন। অর্থ হল : যারা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি সত্যিকার ঈমান এনেছে তারা সিদ্দীক। আর শহীদরা তাদের প্রতিপালকের নিকট শহীদের মর্যাদায় রয়েছে শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে যেভাবে হাদীসে বলা হয়েছে।
২. আল্লামা ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন : আয়াতটি
(لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُوْرُهُمْ)
এখানে পরিপূর্ণ। অর্থ হল : যারা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি সত্যিকার ঈমান এনেছে তারা সিদ্দিক ও শহীদ। তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার ও জ্যোতি। যেমন হাদীসে এসেছে : জান্নাতে একশতটির মত মর্তবা রয়েছে। এক মর্তবা থেকে অন্য মর্তবার দূরত্ব হল আকাশ-জমিনের মত দূরত্ব। এসব আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পথে জিহাদকারীদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। প্রথমটি অধিক সঠিক, কারণ প্রত্যেক সত্যিকার মু’মিন সিদ্দিক হতে পারে কিন্তু শহীদ হতে পারে না। (আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার যিকির করা উচিত।
২. আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় দান করার ফযীলত জানলাম।
৩. যারা প্রকৃত ঈমানদার তারাই সিদ্দিক। যেহেতু তারা আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল ও দীনের সব কিছু সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছে।
৪. শহীদদের মর্যাদা জানতে পারলাম।
৫. শরীয়ত গর্হিত পন্থায় ইবাদত করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
১২-১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১২-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:
দান-খয়রাতকারী মুমিনদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ কিয়ামতের দিন তারা তাদের সৎ আমল অনুযায়ী নূর বা জ্যোতি লাভ করবে। ঐ জ্যোতি তাদের সাথে সাথে থাকবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, তাদের কারো কারো জ্যোতি হবে পাহাড়ের সমান, কারো হবে খেজুরের গাছের সমান এবং কারো হবে দণ্ডায়মান মানুষের দেহের সমান। যে পাপী মুমিনদের জ্যোতি সবচেয়ে কম হবে তার শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর নূর থাকবে, যা কখনো জ্বলবে এবং কখনো নিভে যাবে। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কোন কোন মুমিন এমন হবে যার নূর এই পরিমাণ হবে যে পরিমাণ দূরত্ব মদীনা ও আদনের মাঝে রয়েছে। কারো এর চেয়ে কম হবে, কারো এর চেয়ে আরো কম হবে। কারো নূর এতো কম হবে যে, তার পদদ্বয়ের পার্শ্বই শুধু আলোকিত হবে।”
হযরত হুব্বাদ ইবনে উমাইয়া (রঃ) বলেনঃ হে লোক সকল! তোমাদের নাম পিতাসহ এবং বিশেষ নিদর্শনসহ আল্লাহ তা’আলার নিকট লিখিত রয়েছে। অনুরূপভাবে তোমাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় আমলও লিখিত আছে। কিয়ামতের দিন নাম নিয়ে নিয়ে ডাক দিয়ে বলা হবেঃ হে অমুক! এটা তোমার জ্যোতি। হে অমুক! তোমার কোন নূর আমার কাছে নেই। অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করেন।
হযরত যহহাক (রঃ) বলেনঃ প্রথমে তো প্রত্যেক লোককেই নূর দেয়া হবে। কিন্তু যখন পুলসিরাতের উপর যাবে তখন মুনাফিকদের নূর নিভে যাবে। এ দেখে মুমিনরাও ভীত হয়ে পড়বে যে, না জানি হয়তো তাদেরও জ্যোতি নিভে যাবে। তখন তারা আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্যে আমাদের নূর পুরো করে দিন!”
হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতে বর্ণিত নূর বা জ্যোতি দ্বারা পুলসিরাতের উপর নূর লাভ করাকে বুঝানো হয়েছে। যাতে ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থান সহজেই অতিক্রম করা যায়। হযরত আবু দারদা (রাঃ) ও হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমাকেই সিজদার অনুমতি দেয়া হবে এবং অনুরূপভাবে সর্বপ্রথম আমাকেই সিজদা হতে মাথা উঠাবারও হুকুম দেয়া হবে। আমি সামনে, পিছনে, ডানে ও বামে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে এবং নিজের উম্মতকে চিনে নিবো।” তখন একজন লোক প্রশ্ন করলেনঃ “হযরত নূহ (আঃ) থেকে নিয়ে আপনি পর্যন্ত সবারই উম্মত হাশরের ময়ানে একত্রিত হবে। সুতরাং এতোগুলো উম্মতের মধ্য হতে আপনার উম্মতকে আপনি কি করে চিনতে পারবেন?” জবাবে তিনি বললেনঃ “আমার উম্মতের অযুর অঙ্গগুলো অযুর কারণে চমকাতে থাকবে, এই বিশেষণ অন্য কোন উম্মতের মধ্যে থাকবে না। আর আমার উম্মতকে ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে এবং তাদের চেহারা হবে উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময়। আর তাদের নূর বা জ্যোতি তাদের অগ্রে অগ্রে চলতে থাকবে এবং তাদের সন্তানরা তাদের সঙ্গে থাকবে।” যহহাক (রঃ) বলেন যে, তাদের আমল নামা তাদের ডান হাতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যাকে তার ডান হাতে কিতাব (আমলনামা) দেয়া হবে (শেষ পর্যন্ত)।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আজ তোমাদের জন্যে সুসংবাদ জান্নাতের, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেথায় তোমরা স্থায়ী হবে, এটাই মহাসাফল্য।
এর পরবর্তী আয়াতে কিয়ামতের মাঠের ভয়াবহ ও কম্পন সৃষ্টিকারী ঘটনার বর্ণনা রয়েছে যে, তথায় খাঁটি ঈমানদার সৎকর্মশীল লোক ছাড়া আর কেউই পরিত্রাণ পাবে না।
হযরত সুলায়েম ইবনে আমির (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বাবে দামেশকে আমরা একটি জানাযায় ছিলাম। যখন জানাযার নামায শেষ হয় এবং মৃতদেহ দাফন করার কাজ শুরু হয় তখন হযরত আবু উমামা বাহিলী (রাঃ) বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! তোমরা এই দুনিয়ার মনযিলে সকাল-সন্ধ্যা করছে। তোমরা এখানে পুণ্য কার্যও করতে পার এবং পাপ কার্যও করতে পার। এরপরে অন্য মনযিলের দিকে তোমাদেরকে যাত্রা শুরু করতে হবে। এই কবরই হচ্ছে ঐ মনযিল যা নির্জনতা, অন্ধকার, পোকা-মাকড় এবং সংকীর্ণতার ঘর। কিন্তু যাকে আল্লাহ প্রশস্ততা দান করেন সেটা অন্য কথা। এরপর তোমরা কিয়ামত মাঠের বিভিন্ন স্থানে গমন করবে। এক জায়গায় বহু লোকের চেহারা সাদা-উজ্জ্বল হবে এবং বহু লোকের চেহারা হবে কালো কুৎসিত। তারপর এক ময়দানে যাবে যেখানে হবে কঠিন অন্ধকার। সেখানে ঈমানদারদেরকে নূর বা জ্যোতি বন্টন করা হবে। সেখানে কাফির ও মুনাফিকদের জন্যে কোন জ্যোতি থাকবে না। এরই বর্ণনা নিম্নের আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “অথবা গভীর সমুদ্র তলের অন্ধকার সদৃশ যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ যার উর্ধে মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের উপর স্তর, এমনকি সে হাত বের করলে তা আদৌ দেখতে পাবে না। আল্লাহ যাকে জ্যোতি দান করেন না তার জন্যে কোন জ্যোতিই নেই।” (২৪:৪০) সুতরাং যেমন চক্ষুষ্মনদের। দৃষ্টিশক্তি দ্বারা অন্ধ ব্যক্তি কোন উপকার লাভ করতে পারে না, তেমনই মুনাফিক ও কাফিররা ঈমানদারদের নূর বা জ্যোতি দ্বারা কোন উপকার লাভ করতে সক্ষম হবে না। মুনাফিক ঈমানদারের কাছে আবেদন জানাবেঃ “তোমরা এতো বেশী সামনের দিকে এগিয়ে যেয়ো না, একটু থামো, যাতে আমরাও তোমাদের জ্যোতিকে আশ্রয় করে চলতে পারি ।” দুনিয়ায় এই মুনাফিকরা যেমন মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করতো, তেমনই সেদিন মুসলমানরা মুনাফিকদেরকে বলবেঃ “তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর।” এরা তখন ফিরে গিয়ে নূর বন্টনের জায়গায় হাযির হবে। কিন্তু সেখানে কিছুই পাবে না। এটাই আল্লাহ তা’আলার প্রতারণা, যার বর্ণনা নিম্নের আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তারা আল্লাহকে প্রতারিত করছে এবং আল্লাহও তাদেরকে। প্রতারিতকারী।” (৪:১৪২) অতঃপর তারা যখন সেখানে ফিরে যাবে তখন দেখবে যে, মুমিন ও তাদের মাঝে স্থাপিত হয়েছে একটি প্রাচীর যার একটি দরজা রয়েছে, ওর অভ্যন্তরে আছে রহমত এবং বহির্ভাগে রয়েছে শাস্তি। সুতরাং মুনাফিকরা নূর বন্টন হওয়ার সময় পর্যন্ত প্রতারণার মধ্যেই থাকবে। অতঃপর যখন মুমিনরা নূর পাবে এবং তারা পাবে না তখন রহস্য উঘাটিত হয়ে যাবে এবং তারা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ে যাবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন অন্ধকার পূর্ণভাবে ছেয়ে যাবে এবং মানুষ তার হাতটিও দেখতে পাবে না তখন আল্লাহ তাআলা একটা নূর প্রকাশ করবেন। মুসলমান ঐ দিকে যাবে, তখন মুনাফিকরাও তাদের পিছনে পিছনে যেতে শুরু করবে। মুমিনরা যখন সামনের দিকে অনেক বেশী এগিয়ে যাবে তখন মুনাফিকরা তাদেরকে ডাক দিয়ে থামতে বলবে এবং তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিবে যে, দুনিয়ায় তারা সবাই তো এক সাথেই ছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন মানুষকে তাদের গোপনীয়তা রক্ষার্থে তাদের নাম ধরে ধরে ডাক দিবেন। মুমিনরাও নূর পাবে এবং মুনফিকরাও পাবে। কিন্তু পুলসিরাতের উপর তাদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হবে। যখন তারা পুলসিরাতের মাঝপথে পৌঁছবে তখন মুনাফিকদের নূর নিভে যাবে। তারা তখন সন্ত্রস্ত থাকবে। সবারই অবস্থা অত্যন্ত করুণ হবে। সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
যে প্রাচীরের কথা এখানে বলা হয়েছে তা হলো জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে পার্থক্যসীমা। এরই বর্ণনা (আরবী)-এর মধ্যে রয়েছে। সুতরাং জান্নাতে বিরাজ করবে রহমত ও শান্তি এবং জাহান্নামে থাকবে অশান্তি ও শাস্তি। সঠিক কথা এটাই। কিন্তু কারো কারো উক্তি এই যে, এর দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রাচীরকে বুঝানো হয়েছে যা জাহান্নামের উপত্যকার নিকট থাকবে।
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এটা হলো বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব দিকস্থ প্রাচীর, যার অভ্যন্তরে রয়েছে মসজিদ ইত্যাদি এবং বহির্ভাগে রয়েছে জাহান্নামের উপত্যকা। আরো কতক লোকেও একথাই বলেছেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এ আয়াতে নির্দিষ্টভাবে এই প্রাচীরই যে তাঁদের উদ্দেশ্য, তা নয়, বরং কাছাকাছি অর্থ হিসেবে এ আয়াতের তাফসীরে তারা এটা উল্লেখ করেছেন। কেননা, জান্নাত আকাশে সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে এবং জাহান্নাম সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে।
হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এই আয়াতে যে দরজার বর্ণনা আছে এর দ্বারা মসজিদের বাবুর রহমত উদ্দেশ্য, এটা বানী ইসরাঈলের রিওয়াইয়াত, যা আমাদের জন্যে সনদ হতে পারে না। সঠিক তত্ত্ব এই যে, প্রাচীরটি কিয়ামতের দিন মুমিন ও কাফিরদের মাঝে প্রভেদ সৃষ্টি করার জন্যে দাঁড় করানো হবে। মুমিন তো এর দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আর মুনাফিকরা হতবুদ্ধি হয়ে অন্ধকার ও শাস্তির মধ্যে থাকবে, যেমন তারা দুনিয়াতে কুফরী, অজ্ঞতা, সন্দেহ ও হতবুদ্ধিতার অন্ধকারে ছিল। এখন এই মুনাফিকরা মুমিনদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবেঃ “দেখো, দুনিয়ায় আমরা তোমাদের সঙ্গেই ছিলাম, জুমআর নামায জামাআতের সাথে আদায় করতাম, আরাফাতে ও যুদ্ধের মাঠে এক সাথে থাকতাম এবং এক সাথে অবশ্যপালনীয় কাজগুলো পালন করতাম (সুতরাং আজ আমাদেরকে তোমাদের সাথেই থাকতে দাও, পৃথক করে দিয়ো না)।” তখন মুমিনরা বলবেঃ “দেখো, কথা তোমরা ঠিকই বলছো বটে, কিন্তু নিজেদের কৃতকর্মগুলোর প্রতি একটু লক্ষ্য কর তো! সারা জীবন তোমরা কুপ্রবৃত্তি ও আল্লাহর নাফরমানীর কাজে ডুবে থেকেছো। আজ তাওবা করবে, কাল মন্দ কাজ পরিত্যাগ করবে’ এ করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে এবং মুসলমানদের পরিনাম কি হয় তার দিকেই চেয়ে থেকেছে। কিয়ামত যে সংঘটিত হবেই এ বিশ্বাসও তোমাদের ছিল না, কিংবা তোমরা এই আশা পোষণ করতে যে, যদি কিয়ামত সংঘটিত হয়েও যায় তবে তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর মৃত্যু পর্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ তা’আলার দিকে ঝুঁকে পড়ার তোমরা তাওফীক লাভ করনি এবং আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে প্রতারক শয়তান তোমাদেরকে প্রতারণার মধ্যেই ফেলে রেখেছে। অবশেষে আজ তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ করেছো।” ভাবার্থ হলোঃ হে মুনাফিকের দল! দৈহিকরূপে তোমরা আমাদের সাথে ছিলে বটে, কিন্তু অন্তর ও নিয়তের সাথে আমাদের সঙ্গে ছিলে না। বরং সন্দেহ ও রিয়াকারীর মধ্যেই পড়েছিলে এবং মন লাগিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করারও সৌভাগ্য তোমরা লাভ করনি।
মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এই মুনাফিকরা মুমিনদের সাথে বিয়ে-শাদী, মজলিস-সমাবেশ এবং জীবন-মরণ ইত্যাদিতে শরীক থাকতো। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে দেয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ। তবে দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ব্যক্তিরা নয়। তারা থাকবে উদ্যানে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেতোমাদেরকে কি সে সাকারে (জাহান্নামে) নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবেঃ আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে আহার্য দান করতাম না এবং আমরা আলোচনাকারীদের সাথে আলোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল অস্বীকার করতাম, আমাদের নিকট মৃত্যুর আগমন পর্যন্ত।” (৭৪:৩৮-৪৭) প্রকাশ থাকে যে, এ প্রশ্ন করা হবে শুধু তাদেরকে ধমক, শাসন গর্জন এবং লজ্জিত করার জন্যে। আসলে তো প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে মুসলমানরা পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিফহাল থাকবে।
অতঃপর ওখানে যেমন বলা হয়েছিল যে, কারো সুপারিশ তাদের কোন • উপকার করবে না, অনুরূপভাবে এখানে বলেনঃ আজ তোমাদের নিকট হতে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা কুফরী করেছিল তাদের নিকট হতেও না, যদি তারা যমীন ভর্তি সোনাও প্রদান করে। তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। এটাই তাদের যোগ্য স্থান, কত নিকৃষ্ট এই পরিণাম।
১৬-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ মুমিনদের জন্যে কি এখন পর্যন্ত ঐ সময় আসেনি যে, তারা আল্লাহর যিকির, নসীহত, কুরআনের আয়াতসমূহ এবং নবী (সঃ)-এর হাদীসসমূহ শুনে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়? তারা শুনে ও মানে, আদেশসমূহ পালন করে এবং নিষিদ্ধ জিনিস হতে বিরত থাকে?
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, কুরআন কারীম অবতীর্ণ হতে হতে তেরো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়, এরপরেও মুসলমানদের অন্তর ইসলামের প্রতি পুরোপুরি আকৃষ্ট হয়নি, এখানে এরই অভিযোগ করা হয়েছে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “চার বছর অতিক্রান্ত হতেই আমাদেরকে এ ব্যাপারে নিন্দে করে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।”
সাহাবীগণ (রাঃ) দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের নিকট কিছু বর্ণনা করুন।” তখন (আরবী) অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ)! আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি ।” (১২-৩) কিছুদিন পর আবার তারা এই আরজই করলে আল্লাহ তা’আলা (আরবী) অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ “আল্লাহ উত্তম বাণী অবতীর্ণ করেছেন।” (৩৯:২৩) আরো কিছুদিন পর পুনরায় তাঁরা একথাই বললে আল্লাহ তা’আলা … (আরবী)-এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মানুষের মধ্য হতে প্রথম (ভাল বিষয়) যা উঠে যাবে তা হবে এই বিনয়-নম্রতা।”
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মত যেন এরা না হয়, বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিল। আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ইয়াহুদী নাসারার মত হতে নিষেধ করছেন। তারা আল্লাহর কিতাবকে পরিবর্তন করে ফেলেছিল। স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল। কিতাবুল্লাহকে পৃষ্ঠের পিছনে নিক্ষেপ করে নিজেদের মনগড়া মত ও কিয়াসের পিছনে পড়ে গিয়েছিল। নিজেদের আবিষ্কৃত উক্তিগুলো তারা মানতে থাকে। আল্লাহর দ্বীনে তারা অন্যদের অন্ধ অনুকরণ করতে থাকে। নিজেদের আলেম ও দরবেশদের সনদ বিহীন কথাগুলো তারা দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এই দুস্কার্যের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাআলা তাদের হৃদয় কঠোর করে দেন। আল্লাহ তা’আলার হাজারো কথা শুনালেও তাদের অন্তর নরম হয় না। কোন ওয়াজ নসীহত তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কোন প্রতিশ্রুতি ও ভীতি প্রদর্শন তাদের অন্তরকে আল্লাহর দিকে ফিরাতে সক্ষম হয় না। তাদের অধিকাংশই ফাসেক ও প্রকাশ্য দুষ্কৃতিকারী হয়ে যায়। তাদের অন্তর অপবিত্র এবং আমল অপরিপক্ক হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদের উপর অভিসম্পাত নাযিল করেছি ও তাদের অন্তর কঠোর করে দিয়েছি, তারা কথাগুলো স্বস্থান হতে ফিরিয়ে দেয় এবং আমার উপদেশাবলী তারা ভুলে যায়।” (৫:১৩) অর্থাৎ তাদের অন্তর নষ্ট হয়ে যায়। তাই তারা আল্লাহর কথাগুলোর পরিবর্তন ঘটায়, সৎকার্যাবলী পরিত্যাগ করে এবং অসৎকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ জন্যেই রাব্দুল আ’লামীন এই উম্মতকে সতর্ক করছেনঃ সাবধান! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদের মত হয়ো না। সর্বদিক দিয়েই তাদের হতে পৃথক থাকো।
হযরত রাবী ইবনে আবি উমাইলা (রাঃ) বলেন, কুরআন হাদীসের মিষ্টত্ব তো অনস্বীকার্য বটেই, কিন্তু আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে একটি খুবই প্রিয় ও মধুর কথা শুনেছি যা আমাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেছেনঃ “যখন বানী ইসরাঈলের আসমানী কিতাবের উপর কয়েক যুগ অতিবাহিত হলো তখন তারা কিছু কিতাব নিজেরাই রচনা করে নিলো এবং তাতে ঐ মাসআলাগুলো লিপিবদ্ধ করলো যেগুলো তাদের নিকট পছন্দনীয় ছিল। ওগুলো ছিল তাদের নিজেদেরই মস্তিষ্ক প্রসূত। এখন তারা সানন্দে জিহ্বা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওগুলো পড়তে লাগলো। ওগুলোর অধিকাংশ মাসআলা আল্লাহর কিতাবের বিপরীত ছিল। যেসব হুকুম মানতে তাদের মন চাইতো না তা তারা পরিবর্তন করে দিতো এবং নিজেদের রচিত কিতাবে নিজেদের চাহিদা মত মাসআলা জমা করে নিতো। ঐগুলোর উপরই তারা আমল করতো। এখন তারা জনগণকেও মানতে উদ্বুদ্ধ করলো। তাদেরকে তারা এরই দাওয়াত দিলো এবং জোরপূর্বক মানাতে শুরু করলো। এমনকি যারা মানতে অস্বীকার করতে তাদেরকে তারা শাস্তি দিতো, কষ্ট দিতো, মারপিঠ করতো এবং হত্যা করে। ফেলতেও কুণ্ঠিত হতো না। তাদের মধ্যে একজন আল্লাহওয়ালা, আলেম ও মুত্তাকী লোক ছিলেন। তিনি তাদের শক্তি ও বাড়াবাড়িতে ভীত হয়ে আল্লাহর। কিতাবকে একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম জিনিসে লিখে একটি শিঙ্গায় ভরে দেন এবং ঐ শিঙ্গাটিকে স্বীয় স্কন্ধে লটকিয়ে দেন। তাদের দুষ্কার্য ও হত্যাকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চললো। শেষ পর্যন্ত তারা ঐ লোকদেরকে হত্যা করে ফেললো যারা আল্লাহর কিতাবের উপর আমলকারী ছিলেন। অতঃপর তারা পরস্পর পরামর্শ করলোঃ “দেখো, এভাবে এক এক করে কতজনকে আর হত্যা করতে থাকবে? এদের বড় আলেম, আমাদের এই কিতাবকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারকারী এবং সমস্ত বানী ইসরাঈলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহর কিতাবের উপর আমলকারী অমুক আলেম রয়েছেন, তাঁকে ধরে নিয়ে এসো এবং তার সামনে তোমাদের এই কিতাব পেশ কর। যদি তিনি মেনে নেন তবে তো আমাদের জন্যে সোনায় সোহাগা হবে। আর যদি না মানেন তবে তাকে হত্যা করে ফেলে। তাহলে তোমাদের এই কিতাবের বিরোধী আর কেউ থাকবে না। আর অন্যেরা সবাই আমাদের এই কিতাবকে কবুল করে নিবে এবং মানতে শুরু করবে। এই পরামর্শ অনুযায়ী ঐ লোকগুলো আল্লাহর কিতাবের আলেম ও আমেল ঐ বুযুর্গ ব্যক্তিকে ধরে আনলো এবং বললোঃ “দেখুন, আমাদের এই কিতাবের সব কিছুই আপনি মানেন তো? না, মানেন না? এর উপর আপনার ঈমান আছে, না নেই?” উত্তরে ঐ আল্লাহওয়ালা আলেম লোকটি বললেনঃ “তোমরা এতে যা লিখেছো তা আমাকে শুনিয়ে দাও।” তারা শুনিয়ে দেয়ার পর বললোঃ “এটা আপনি মানেন তো?” ঐ ব্যক্তির জীবনের ভয় ছিল, এ কারণে সাহসিকতার সাথে মানি না’ এ কথা সরাসরি বলতে পারলেন না, বরং তাঁর ঐ শিঙ্গার দিকে ইশারা করে বললেনঃ “আমার এর উপর ঈমান রয়েছে। তারা বুঝলো যে, তার ঈমান তাদের কিতাবের উপরই রয়েছে। তাই তারা তাঁকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকলো। তথাপিও তারা তাঁর কাজ কারবার দেখে সন্দেহের মধ্যেই ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন তার মৃত্যু হলো তখন তারা তদন্ত শুরু করলো যে, না জানি হয় তো তার কাছে আল্লাহর কিতাবের ও সত্য মাসআলার কোন গ্রন্থ রয়েছে। অবশেষে তারা তার ঐ শিঙ্গাটি উদ্ধার করলো। পড়ে দেখলো যে, ওর মধ্যে আল্লাহর কিতাবের আসল মাসআলাগুলো বিদ্যমান রয়েছে। এখন তারা কথা বানিয়ে নিয়ে বললোঃ “আমরা তো কখনো এই মাসআলাগুলো শুনিনি। এরূপ কথা আমাদের ধর্মে নেই।” ফলে ভীষণ হাঙ্গামার সৃষ্টি হলো। তারা বাহাত্তরটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো। এই বাহাত্তরটি দলের মধ্যে যে দলটি সত্যের উপর ছিল সেটা হলো ঐ দল, যারা ঐ শিঙ্গাযুক্ত মাসআলাগুলোর উপর আমলকারী ছিল।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এই ঘটনাটি বর্ণনা করার পর বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! তোমাদের মধ্যে যারা বাকী থাকবে তারা অনুরূপ সমস্যারই সম্মুখীন হবে এবং হবে সম্পূর্ণরূপে শক্তিহীন ও নিরুপায়। সুতরাং এই অক্ষমতা, অসহায়তা ও শক্তিহীনতার সময়েও তাদের অবশ্য কর্তব্য হবে আল্লাহর দ্বীনের উপর স্থির ও অটল থাকা এবং আল্লাহদ্রোহীদেরকে ঘৃণার চক্ষে দেখা।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইবরাহীম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইত্রীস ইবনে উরকূব (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আবদুল্লাহ (রাঃ)! যে ব্যক্তি ভাল কাজের আদেশ করে না এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করে না সে তো ধ্বংস হয়ে যাবে।” একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “ধ্বংস হবে ঐ ব্যক্তি যে অন্তরে ভালকে ভাল ও মন্দর্কে মন্দ বলে জানে না।” অতঃপর তিনি বানী ইসরাঈলের উপরোক্তে ঘটনাটি বর্ণনা করেন।” (এটা ইমাম আবু জাফর তাবারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘জেনে রেখো যে, আল্লাহই ধরিত্রীকে ওর মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। এতে ইঙ্গিত রয়েছে ঐ বিষয়ের দিকে যে, আল্লাহ তাআলা কঠোর হৃদয়কে কঠোরতার পরেও নরম করে দিতে সক্ষম। পথভ্রষ্টদেরকে তাদের পথভ্রষ্টতার পরেও তিনি সরল সঠিক পথে আনয়নের ক্ষমতা রাখেন। বৃষ্টি যেমন শুষ্ক ভূমিকে সিক্ত করে থাকে, তেমনই আল্লাহ তাআলা মৃত হৃদয়কে জীবিত করতে পারেন। অন্তর যখন গুমরাহীর অন্ধকারে ছেয়ে যায় তখন আল্লাহর কিতাবের আলো আকস্মিকভাবে ঐ অন্তরকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলে। আল্লাহর অহী অন্তরের তালা চাবি স্বরূপ। সত্য ও সঠিক হিদায়াতকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ। তিনিই পথভ্রষ্টতার পর সরল সঠিক পথে আনয়নকারী। তিনি যা চান তাই করে থাকেন। তিনি বিজ্ঞানময়, সূক্ষদর্শী, সম্যক অবগত এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চতার অধিকারী। তিনি মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।
১৮-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, ফকীর, মিসকীন ইত্যাদি অভাবগ্রস্তদেরকে যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে স্বীয় হালাল ধন-সম্পদ থেকে সৎ নিয়তে দান করে, আল্লাহ বিনিময় হিসেবে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে তাদেরকে প্রদান করবেন। তিনি তাদেরকে ঐ দান দশ গুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত এবং তারও বেশী বদ্ধি করবেন। তাদের জন্যে রয়েছে বেহিসাব সওয়াব ও মহাপুরস্কার।
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীরাই সিদ্দীক ও শহীদ। এই দুই গুণের অধিকারী শুধুমাত্র এই ঈমানদার ললাকেরাই। কোন কোন গুরুজন কে পৃথক বাক্য বলেছেন। মোটকথা, তিন শ্রেণী হলো। (এক) (আরবী) (দানশীল), (দুই) (আরবী) (সত্যনিষ্ঠ) এবং (তিন) (আরবী)-(শহীদগণ)। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আর যে আল্লাহ এবং রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করবে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সঙ্কর্মপরায়ণ যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, তাদের সঙ্গী হবে।” (৪:৬৯) এখানেও সিদ্দীক ও শহীদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করা হয়েছে, যার দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এঁরা দুই শ্রেণীর লোক। সিদ্দীকের মর্যাদা নিঃসন্দেহে শহীদ অপেক্ষা বেশী।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই জান্নাতবাসীরা তাদের উপরের প্রাসাদের জান্নাতীদেরকে এভাবেই দেখবে, যেমন তোমরা পূর্ব দিকের ও পশ্চিম দিকের উজ্জ্বল নক্ষত্রকে আকাশ প্রান্তে দেখে থাকো।” সাহাবীগণ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ মর্যাদা তো শুধু নবীদের, তাঁরা ছাড়া তো এ মর্যাদায় অন্য কেউ পৌছতে পারবে না?” জবাবে তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! এরা হলো ঐ সব লোক যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং রাসূলদের (আঃ) সত্যতা স্বীকার করেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
একটি গারীব হাদীস দ্বারা এটাও জানা যায় যে, এই আয়াতে শহীদ ও সিদ্দীক এ দুটো এই মুমিনেরই বিশেষণ।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমার উম্মতের মুমিন ব্যক্তি শহীদ।” অতঃপর তিনি এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন।
হযরত আমর ইবনে মায়মূন (রঃ) বলেনঃ “এ দু’জন কিয়ামতের দিন দুটি অঙ্গুলীর মত হয়ে আসবে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, শহীদদের রূহ সবুজ রঙ এর পাখীর দেহের মধ্যে থাকবে। জান্নাতের মধ্যে যথেচ্ছা পানাহার করে ঘুরে বেড়াবে। রাত্রে লণ্ঠনের মধ্যে আশ্রয় নিবে। তাদের প্রতিপালক তাদের উপর প্রকাশিত হয়ে বলবেনঃ “তোমরা কি চাও?” উত্তরে তারা বলবেঃ “আমাদেরকে পুনরায় দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা আবার আপনার পথে জিহাদ করে শহীদ হতে পারি।” আল্লাহ তা’আলা জবাব দিবেনঃ “আমি তো এই ফায়সালা করেই দিয়েছি যে, দুনিয়ায় কেউ পুনরায় ফিরে যাবে না।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদের জন্যে রয়েছে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার ও জ্যোতি। ঐ নূর বা জ্যোতি তাদের সামনে থাকবে এবং তা তাদের আমল অনুযায়ী হবে।
হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “শহীদগণ চার প্রকার। (এক) ঐ পাকা ঈমানদার যে শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রাণপণে যুদ্ধ করেছে, অবশেষে শহীদ হয়েছে। সে এমনই ব্যক্তি যে, (তার মর্যাদা দেখে) লোকেরা তার দিকে এই ভাবে তাকাবে।” ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর মস্তক এমনভাবে উঠান যে, তাঁর টুপিটি মাথা হতে নীচে পড়ে যায়। আর এ হাদীসটি বর্ণনা করার সময় হযরত উমার (রাঃ)-এরও মাথার টুপি নীচে পড়ে যায়। (দুই) ঐ ব্যক্তি যে ঈমানদার বটে এবং জিহাদের জন্যে বেরও হয়েছে। কিন্তু অন্তরে সাহস কম আছে। হঠাৎ একটি তীর এসে তার দেহে বিদ্ধ হয় এবং দেহ হতে রূহ বেরিয়ে যায়। এ ব্যক্তি হলো দ্বিতীয় শ্রেণীর শহীদ। (তিন) ঐ ব্যক্তি যার ভাল মন্দ আমল রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাকে পছন্দ করেছেন। সে জিহাদের মাঠে নেমেছে এবং কাফিরদের হাতে নিহত হয়েছে। এ ব্যক্তি তৃতীয় শ্রেণীর শহীদ। (চার) ঐ ব্যক্তি যার গুনাহ খুব বেশী আছে। সে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছে এবং শক্রর হাতে নিহত হয়েছে। এ হলো চতুর্থ শ্রেণীর শহীদ।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)
এই সৎ লোকেদের পরিণাম বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা’আলা অসৎ লোকদের পরিণাম বর্ণনা করছেন যে, যারা কুফরী করেছে ও আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকার করেছে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী।