Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৫৬/মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৬) [*‌‌   *সভা সমাবেশ ও মজলিসের আদব :- **ইসলাম বিরােধীদের সাথে মােনাফেকদের সখ্যতা :- *তারা জেনে ও বুঝে মিথ্যা কসম করে:- **মোমেনের কাছে রক্তের চেয়ে আদর্শ বন্ধনের মূল্য অনেক বেশী:-] www.motaher21.net সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ। পারা:২৮ ১১- ২২ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৬/মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৬)
[*‌‌   *সভা সমাবেশ ও মজলিসের আদব :-
**ইসলাম বিরােধীদের সাথে মােনাফেকদের সখ্যতা :-
*তারা জেনে ও বুঝে মিথ্যা কসম করে:-
**মোমেনের কাছে রক্তের চেয়ে আদর্শ বন্ধনের মূল্য অনেক বেশী:-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ।
পারা:২৮
১১- ২২ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১১
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قِیۡلَ لَکُمۡ تَفَسَّحُوۡا فِی الۡمَجٰلِسِ فَافۡسَحُوۡا یَفۡسَحِ اللّٰہُ لَکُمۡ ۚ وَ اِذَا قِیۡلَ انۡشُزُوۡا فَانۡشُزُوۡا یَرۡفَعِ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ ۙ وَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ دَرَجٰتٍ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿۱۱﴾
হে ঈমানদারগণ! মজলিসে জায়গা করে দিতে বলা হলে জায়গা করে দিও, আল্লাহ‌ তোমাদেরকে প্রশস্ততা দান করবেন। আর যখন চলে যেতে বলা হবে, তখন চলে যেও। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা আল্লাহ‌ উন্নীত করবেন। বস্তুত আল্লাহ‌ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১২
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نَاجَیۡتُمُ الرَّسُوۡلَ فَقَدِّمُوۡا بَیۡنَ یَدَیۡ نَجۡوٰىکُمۡ صَدَقَۃً ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ وَ اَطۡہَرُ ؕ فَاِنۡ لَّمۡ تَجِدُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۲﴾
হে ঈমান্দারগণ ! তোমারা যখন রাসূলের সাথে চুপি চুপি কথা বলতে চাও, তখন তোমাদের এরূপ কথার পূর্বে কিছু সাদাকাহ পেশ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় ও পরিশোধক ; কিন্তু যদি তোমরা অক্ষম হও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৩
ءَاَشۡفَقۡتُمۡ اَنۡ تُقَدِّمُوۡا بَیۡنَ یَدَیۡ نَجۡوٰىکُمۡ صَدَقٰتٍ ؕ فَاِذۡ لَمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ تَابَ اللّٰہُ عَلَیۡکُمۡ فَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ ؕ وَ اللّٰہُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿٪۱۳﴾
গোপন আলাপ-আলোচনা করার আগে সাদকা দিতে হবে ভেবে তোমরা ঘাবড়ে গেলে না কি? ঠিক আছে, সেটা যদি না করতে চাও, —বস্তুত আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিয়েছেন। —তাহলে নামায কায়েম করতে ও যাকাত দিতে থাকো এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ নিষেধ মেনে চলতে থাকো। মনে রোখো তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ ওয়াকিফহাল।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৪
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا قَوۡمًا غَضِبَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ ؕ مَا ہُمۡ مِّنۡکُمۡ وَ لَا مِنۡہُمۡ ۙ وَ یَحۡلِفُوۡنَ عَلَی الۡکَذِبِ وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۴﴾
তুমি কি তাদের দেখনি যারা এমন এক গোষ্ঠীকে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে যারা আল্লাহর গযবে নিপতিত। তারা তোমাদেরও নয়, তাদেরও নয়। তারা জেনে ও বুঝে মিথ্যা বিষয়ে কসম করে।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৫
اَعَدَّ اللّٰہُ لَہُمۡ عَذَابًا شَدِیۡدًا ؕ اِنَّہُمۡ سَآءَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۵﴾
আল্লাহ্‌ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি। নিশ্চয় তারা যা করত তা কতই না মন্দ !
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৬
اِتَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَہُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ فَلَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ ﴿۱۶﴾
তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালস্বরুপ গ্রহণ করেছে, অতঃপর তারা আল্লাহর পথে বাধা প্রদান করেছে ; সুতরাং তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৭
لَنۡ تُغۡنِیَ عَنۡہُمۡ اَمۡوَالُہُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ شَیۡئًا ؕ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ؕ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۱۷﴾
আল্লাহর শাস্তির মুকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কোন কাজে আসবে না, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৮
یَوۡمَ یَبۡعَثُہُمُ اللّٰہُ جَمِیۡعًا فَیَحۡلِفُوۡنَ لَہٗ کَمَا یَحۡلِفُوۡنَ لَکُمۡ وَ یَحۡسَبُوۡنَ اَنَّہُمۡ عَلٰی شَیۡءٍ ؕ اَلَاۤ اِنَّہُمۡ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۸﴾
যে দিন আল্লাহ্‌ পুনরুথিত করবেন তাদের সবাইকে, তখন তারা আল্লাহর কাছে সেরূপ শপথ করবে যেরূপ শপথ তোমাদের কাছে করে এবং তারা মনে করে যে, এতে তারা ভাল কিছুর উপর রয়েছে। সাবধান ! তারাইতো প্রকৃত মিথ্যাবাদী ।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-১৯
اِسۡتَحۡوَذَ عَلَیۡہِمُ الشَّیۡطٰنُ فَاَنۡسٰہُمۡ ذِکۡرَ اللّٰہِ ؕ اُولٰٓئِکَ حِزۡبُ الشَّیۡطٰنِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ حِزۡبَ الشَّیۡطٰنِ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۱۹﴾
শয়তান তাদের ওপর চেপে বসেছে এবং তাদের অন্তর থেকে আল্লাহর স্মরণ মুছে দিয়েছে। তারা শয়তানের দলভুক্ত লোক। সাবধান! শয়তানের দলভুক্ত লোকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-২০
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحَآدُّوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗۤ اُولٰٓئِکَ فِی الۡاَذَلِّیۡنَ ﴿۲۰﴾
নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-২১
کَتَبَ اللّٰہُ لَاَغۡلِبَنَّ اَنَا وَ رُسُلِیۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ قَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿۲۱﴾
আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর রসূল অবশ্যই বিজয়ী হবেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী।
সূরা:৫৮: আল্-মুজালিদাহ:-২২
لَا تَجِدُ قَوۡمًا یُّؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ یُوَآدُّوۡنَ مَنۡ حَآدَّ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ لَوۡ کَانُوۡۤا اٰبَآءَہُمۡ اَوۡ اَبۡنَآءَہُمۡ اَوۡ اِخۡوَانَہُمۡ اَوۡ عَشِیۡرَتَہُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ کَتَبَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الۡاِیۡمَانَ وَ اَیَّدَہُمۡ بِرُوۡحٍ مِّنۡہُ ؕ وَ یُدۡخِلُہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ رَضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡہُ ؕ اُولٰٓئِکَ حِزۡبُ اللّٰہِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ حِزۡبَ اللّٰہِ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿٪۲۲﴾
তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদের ভালবাসছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করেছে। তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র অথবা ভাই অথবা গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। আল্লাহ‌ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ‘রূহ’ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহর দলের লোকেরাই সফলকাম।

১১- ২২ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

# সূরার ভূমিকায় এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কতক মুফাসসির এ আদেশকে শুধুমাত্র রসূল ﷺ এর মজলিসের মধ্যে সীমিত মনে করেছেন। তবে ইমাম মালেক প্রমূখের এ মতটিই সঠিক যে, মুসলমানদের সকল বৈঠকাদির জন্য এটি একটি স্থায়ী বিধি। আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুসলিম জাতিকে যে সামাজিক রীতি-নীতি, আদব আখলাক ও আচার-ব্যবহার শিখিয়েছেন। এটি তার অন্যতম। আগে থেকে কিছু লোক বসে আছে এমন একটি মজলিসে যখন আরো কিছু লোক যোগ দেবে, তখন আগের সমবেত লোকদের মধ্যে এ সৌজন্য বোধ থাকা বাঞ্ছনীয় যে, স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে নবাগতদের জন্য জায়গা করে দেবে এবং নিজেরা যথাসম্ভব চেপে বসে তাদের বসার সুযোগ করে দেবে। আবার নবাগতদের মধ্যেও এতটা ভদ্রতা থাকা উচিত যে, তারা যেন জোর জবরদস্তির সাথে ভেতরে না ঢোকে এবং একজনকে উঠিয়ে দিয়ে তার জায়গায় বসার চেষ্টা না করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদীসে রসূল ﷺ বলেছেনঃ

لا يقيم الرجل الرجل من مجلسه فيجلس فيه ولكن تفسحوا وتوسعوا-

“কেউ যেন কাউকে উঠিয়ে তার জায়গায় না বসে। তোমরা বরং স্বেচ্ছায় অন্যদের জন্য জায়গা করে দাও।” (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বর্ণনা করেন যে, রসূল (সাঃ) বলেছেনঃ لا يحل لرجل ان يفرق بين اثنين الا باذنهما

“দু’জনের মাঝখানে তাদের অনুমতি ছাড়া জোর পূর্বক চেপে বসা বৈধ নয়।” (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী)
# আবদুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম জানান যে, লোকেরা রসূল ﷺ এর মজলিসে দীর্ঘ সময় বসে থাকতো এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বসে থাকার চেষ্টা করতো। এতে অনেক সময় রসূল ﷺ এর কষ্ট হতো। তাঁর বিশ্রামের যেমন বিঘ্ন ঘটতো, তেমনি কাজকর্মেও অসুবিধার সৃষ্টি হতো। এজন্য এ আদেশ নাযিল হয় যে, যখন চলে যেতে বলা হয় তখন চলে যাও। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর)
# এরূপ ভেবো না যে, রসূল ﷺ এর মজলিসে অন্যদেরকে জায়গা করে দিতে গিয়ে যদি তোমাদের তার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বসতে হয় তাহলে তোমাদের সম্মান হানি ঘটবে, কিংবা তোমাদেরকে চলে যেতে বলা হলে তোমাদের অবমাননা হবে। মর্যাদা বৃদ্ধির আসল উৎস হলো ঈমান ও ইসলামী জ্ঞান। রসূল ﷺ এর মজলিসে কে তাঁর কতটা নিকটে বসলো এবং কে কত বেশী সময় বসে কাটালো, তা দ্বারা কারো সম্মান নিরূপিত হয় না। কেউ যদি রসূল ﷺ এর খুব কাছাকাছি বসতে পারে। তাহলেই যে তার মর্যাদা বেড়ে যাবে তা নয়। মর্যাদা বাড়বে তারই যার ঈমান ও ইসলামী জ্ঞান বেশী হবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি বেশী সময় বসে থেকে আল্লাহর রসূলকে বিব্রত করে তাহলে সে বরঞ্চ মূর্খতার কাজই করে। শুধুমাত্র রসুলের ﷺ কাছে অধিকতর মর্যাদা হবে সে ব্যক্তির যে রসূল ﷺ এর সাহচর্য দ্বারা ঈমান ও ইসলামী জ্ঞানের মত অমূল্য সম্পদ আহরণ করেছে এবং মু’মিন সুলভ স্বভাব ও চরিত্র অর্জন করেছে।
# হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনা অনুসারে এ আদেশের কারণ এই যে, মুসলমানরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে (নির্ভৃতে কথা বলার আবেদন জানিয়ে) এত বেশী জিজ্ঞাসাবাদ করতো যে, তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর ওপর থেকে এ বোঝা হালকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। (ইবনে জারীর) যায়েদ বিন আসলাম বলেন যে, যে কেউ রসূল ﷺ এর সাথে নিভৃতে কথা চলতে চাইতো, তিনি তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করতেন না। যার ইচ্ছা হতো, এসে বলতো, আমি একটু নিভৃতে কথা বলতে চাই। আর রসূল ﷺ তাতে সম্মতি দিতেন। এতে পরিস্থিতি এত দূর গড়ালো যে, নিভৃত বলার আদৌ প্রয়োজন হয় না এমন ব্যাপারেও অনেকে রসূল ﷺ কে কষ্ট দিতে লাগলো। এ সময়টা ছিল এমন যে, সমগ্র আরব মদীনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। কখনো কখনো এমনও হতো যে, কোন ব্যক্তি এভাবে রসূল ﷺ এর অমুক গোত্র কবে মদিনায় আক্রমণ চালাবে সে খবর দিয়ে গেল। এভাবে মদীনার গুজবের ছড়াছড়ি হতো। অপরদিকে মুসলমানদের এরূপ আচরণের দরুন মুনাফিকরা একথা বলার সুযোগ পেয়ে যেতো যে, মুহাম্মাদ ﷺ যে যা বলে তাই শোনেন, সত্য মিথ্যার বাছ-বিচার করেন না। এসব কারণে আল্লাহ এ বিধি-নিষেধ আরোপ করলেন যে, যে ব্যক্তি রসূল ﷺ এর সাথে গোপনে কথা বলতে চাইবে, তার আগে সাদকা দিতে হবে। (আহকামুল কুরআন ইবনূল আরাবী) কাতাদাহ বলেন যে, অন্যদের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ রসূল ﷺ এর সাথে নিভৃতে কথা বলতো।

হযরত আলী (রা.) বলেনঃ এ আদেশ নাযিল হবার পর রসূল ﷺ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, সাদকা কত ধার্য করা উচিত? এক দীনার? আমি বললাম, এটা মানুষের সাধ্যের বাইরে হবে। তিনি বললেনঃ আধা দীনার? আমি বললাম, এটাও তাদের ক্ষমতার আওতাবহির্ভূত। তিনি বললেন, তাহলে কত? আমি বললাম, একটা জবের দানা পরিমাণ স্বর্ণ। তিনি বললেন, انك لزهيد অর্থাৎ তুমি খুবই কম পরিমাণের পরামর্শ দিলে। (ইবনে জারীর, তিরমিযী, মুসনাদে আবু ইয়া’লা) অপর এক বর্ণনা মতে হযরত আলী (রা.) বলেনঃ এটি কুরআনের এমন এক আয়াত যা আমি ছাড়া আর কেউ বাস্তবায়িত করেনি। এ আদেশ আশা মাত্রই আমি একটি সাদকা দিয়ে রসূল ﷺ এর কাছ থেকে একটি মাসায়ালা গোপনে জেনে নেই। (ইবনে জারীর, হাকেম, ইবনুল মুনযির, আবদ বিন হুমাইদ)

# উপরোক্ত নির্দেশের অল্প দিন পরে এ দ্বিতীয় নির্দেশটি নাযিল হয়। এর দ্বারা সাদকার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়। সাদকার বাধ্যবাধকতা কতদিন ছিল, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কাতাদাহ বলেন, একদিনের চেয়েও কম সময় চালু ছিল, তারপর রহিত হয়ে যায়। মুকাতেল বিন হাইয়ান বলেন, দশ দিন ছিল। এটাই এ আদেশ বহাল থাকার সর্বোচ্চ বর্ণিত মেয়াদ।
# এখানে মদীনার ইহুদীদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, মুনাফিকরা এসব ইহুদীদেরকেই বন্ধু বানিয়ে রেখেছিল।
# মুসলমান বা ইহুদী কারো সাথেই তাদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল না। নিজেদের স্বার্থের কারণেই তারা উভয়ের সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে রেখেছিল।
# তারা এই বলে মিথ্যামিথ্যি কসম খায় যে, তারা ঈমান এনেছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের নেতা ও পথ প্রদর্শনকারী হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের প্রতি বিশ্বস্ত আছে।

# এর অর্থ একদিকে তারা নিজেদের ঈমান ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কসম খেয়ে মুসলমানদের আক্রোশ থেকে নিজেদের রক্ষা করে, অপরদিকে মানুষের মধ্যে ইসলাম, ইসলামের অনুসারী এবং ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে নানা রকম সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করে যাতে মানুষ এ কথা চিন্তা করে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে যে, ইসলামের ঘরের লোকেরাই যখন একথা বলছে তখন এর মধ্যে ব্যাপার কিছু একটা অবশ্যই আছে।
# তারা শুধু দুনিয়াতেই এবং শুধু মানুষের সামনেই মিথ্যা মিথ্যা শপথ করে না। আখেরাতে আল্লাহ‌ তা’আলার সামনেও তারা মিথ্যা শপথ করা থেকে বিরত হবে না। মিথ্যা এবং প্রতারণা তাদের মনের এত গভীরে স্থান করে নিয়েছে যে, মৃত্যুর পরও এরা তা থেকে মুক্ত হতে পারবে না।
# এ আয়াতে দুইটি কথা বলা হয়েছে। একটি নীতি কথা। অন্যটি প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা। নীতি কথায় বলা হয়েছে যে, সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান এবং দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা দু’টি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী জিনিস। এ দু’টি জিনিসের একত্র সমাবেশ বা অবস্থান কোনভাবে কল্পনাও করা যায় না। ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রুদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব একই হৃদয়ে একত্রিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কোন মানুষের হৃদয়ে যখন একই সাথে নিজের প্রতি ভালবাসা এবং শত্রুর প্রতি ভালবাসা একত্রিত হতে পারে না তখন এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যাপার। অতএব তোমরা যদি কাউকে দেখো, সে ঈমানের দাবীও করে এবং সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী লোকদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও রাখে তাহলে তোমাদর মনে কখনো যেন এ ভুল ধারণা না জন্মে যে, এ আচরণ সত্ত্বেও সে তার ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী। অনুরূপ যেসব লোক একই সাথে ইসলাম ও ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে সে নিজেও যেন তার এ অবস্থান ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখে যে, প্রকৃতপক্ষে সে কি, মু’মিন না মুনাফিক? সে প্রকৃতপক্ষে কি হতে চায়, মু’মিন হয়ে থাকতে চায়, নাকি মুনাফিক হয়ে? তার মধ্যে যদি সততার লেশমাত্রও থেকে থাকে এবং মুনাফিকীর আচরণ যে নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের জন্য নিকৃষ্টতম আচরণ এ বিষয় তার মধ্যে সামান্যতম অনূভূতিও থাকে তা হলে তার উচিত একই সাথে দুই নৌকায় আরোহণের চেষ্টা পরিত্যাগ করা। ঈমান এ ব্যাপারে তার কাছে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দাবী করে। সে যদি মু’মিন থাকতে চায় তাহলে যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন ইসলামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধনের সাথে সাংঘর্ষিক তার সবই তাকে বর্জন করতে হবে। ইসলামের সাথে সম্পর্কের চাইতে অন্য কোন সম্পর্ক প্রিয়তর হয়ে থাকলে ঈমানের মিথ্যা দাবী ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

এটি ছিল নীতিগত কথা। কিন্তু এখানে আল্লাহ তা’আলা শুধু নীতি বর্ণনা করাই যথেষ্ট মনে করেননি। বরং ঈমানের দাবীদারদের সামনে নমুনা স্বরূপ এ বাস্তব ঘটনাও পেশ করেছেন যে, সত্যিকার ঈমানদারগণ বাস্তবে সবার চোখের সামনে সে সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন করেছিল যা আল্লাহর দ্বীনের সাথে সম্পর্কের পথে প্রতিবন্ধক ছিল। এটা ছিল এমন একটা ঘটনা যা বদর ও উহুদ যুদ্ধের সময় সমগ্র আরব জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল। যেসব সাবাহায়ে কিরাম মক্কা থেকে হিজরত করে এসেছিলেন তারা শুধু আল্লাহ এবং দ্বীনের খাতিরে নিজেদের গোত্র এবং ঘনিষ্টতর নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। হযরত আবু উবাদাহ তাঁর নিজের পিতা আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহকে হত্যা করেছিলেন। হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের আপন ভাই উবাদাহ ইবনে উমায়েরকে হত্যা করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) তাঁর মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরাহকে হত্যা করেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর পুত্র আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন। হযরত আলী, হযরত হামযা এবং হযরত উবাইদা ইবনুল হারেস তাদের নিকটাত্মীয় উতবা, শায়বা এবং ওয়ালীদ ইবনে উতবাকে হত্যা করেছিলেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে হযরত উমর (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাদের সবাইকে হত্যা করার আবেদন করে বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে হত্যা করবে। এ বদর যুদ্ধেই এক আনসারী হযরত মুসআব ইবনে উমায়েরের আপন ভাই আবু আযীয ইবনে উমায়েরকে পাকড়াও করে বাঁধছিলেন। তা দেখে হযরত মুসআব চিৎকার করে বললেনঃ বেশ শক্ত করে বাঁধো। এর মা অনেক সম্পদশালিনী। এর মুক্তির জন্য সে তোমাদেরকে অনেক মুক্তিপণ দিবে। একথা শুনে আবু আযীয বললোঃ তুমি ভাই হয়ে একথা বলছো? জবাবে হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের বললেনঃ এ মুহূর্তে তুমি আমার ভাই নও, বরং যে আনসারী তোমাকে পাকড়াও করছে সে আমার ভাই। বদর যুদ্ধেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতা আবুল আস বন্দি হয়ে আসলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতা হওয়ার কারণে তার সাথে অন্য সব কয়েদী থেকে ভিন্ন বিশেষ কোন সৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়নি। খাঁটি ও নিষ্ঠাবান মুসলমান কাকে বলে এবং আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্ক কি এভাবে বাস্তবে তা দুনিয়াকে দেখানো হয়েছে।

দায়লামী হযরত মুয়ায থেকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ দোয়াটি উদ্ধৃত করেছেনঃ

اللهم لاتجعل لفاجر (وفى رواية لفاسق) على يدا ولانعمة فيوده قلبى فانى وجدت فيما او حيت الى لا تجد قوما يؤمنون بالله اليوم الاخر يوادون من حاد الله ورسوله-

“হে আল্লাহ আমাকে কোন পাপী লোকের দ্বারা (অপর একটি বর্ণনায় আছে ফাসেক) উপকৃত হতে দিও না। তাহলে আমার মনে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে। কারণ, তোমার নাযিলকৃত অহীর মধ্যে আমি একথাও পেয়েছি যে, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণকারী লোকদেরকে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না।”

১১-২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

*সভা সমাবেশ ও মজলিসের আদব : এরপর আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের সামষ্টিক জীবনের আর একটি ভদ্র রীতি শিক্ষা দিচ্ছেন, ‘হে মােমেনরা, যখন তােমাদের বলা হয়, মজলিসের মধ্যে স্থান প্রশস্ত করে দাও, তখন (তা) প্রশস্ত করে দিয়ো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের জন্যেও স্থান প্রশস্ত করে দেবেন।’(আয়াত ১১) এ আয়াত নাযিলের উপলক্ষ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে, মােনাফেকদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। এভাবে এ আয়াতের সাথে এর পূর্ববর্তী আয়াতগুলাের একাধিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কাতাদা বলেন, যিকিরের মজলিসগুলাে সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। কোনাে একটা বৈঠকে উপস্থিত লােকেরা যদি দেখতো যে, অন্য একজন সে বৈঠকে যােগদানের জন্যে এগিয়ে আসছে, তখন তাকে জায়গা দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা কৃপণতা প্রকাশ করতাে। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা জায়গা দেয়ার ব্যাপারে প্রশস্ততা অবলম্বন করার আদেশ দেন। মােকাতিল বলেছেন, এ আয়াত জুমার দিনে নাযিল হয়। রসূল(স.) সেদিন সুফফাতে একটা সংকীর্ণ স্থানে অবস্থান করছিলেন। মােহাজের ও আনসারদের মধ্য থেকে বদর যােদ্ধাদের তিনি বেশী শ্রদ্ধা করতেন। সেদিন বদর যােদ্ধাদের একটা দল তার কাছে এলেন। তারা একটু বিলম্বে এসেছিলেন। এসে রসূল(স.)-এর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারা রসূল(স.)-কে সালাম করলেন। তিনি সালামের জবাব দিলেন। তারপর তারা উপস্থিত জনতাকেও সালাম করলেন। জনতা তাদের সালামের জবাব দিলাে। তাদের বসতে জায়গা দেয়া হবে এই আশায় তারা দাড়িয়ে রইলেন। রসূল(স.) বুঝতে পারলেন তারা কেন দাড়িয়ে আছেন। তাদের বসার জায়গা দেয়া হয়নি বলেই তারা দাঁড়িয়ে আছেন। এ অবস্থা দেখে রসূল(স.) বিব্রত হলেন । তার আশপাশে যেসব অ-বদর যােদ্ধা মােহাজের ও আনসার রয়েছেন তাদের তিনি বললেন, ‘হে অমুক তুমি ওঠো। হে অমুক, তুমিও ওঠো।’ এভাবে তিনি তার কাছে দাঁড়ানাে কয়েকজন বদর যােদ্ধাকে বসাতে লাগলেন। যাদের মজলিস থেকে ওঠিয়ে তাদের বসানাে হয়েছিলো, তারা বিরক্ত হলাে এবং রসূল(স.) তা লক্ষ্য করলেন। তখন মােনাফেকরা বললাে, তােমরা কি দাবী করতে না যে, তােমাদের এই সাথী রসূল(স.) তােমাদের প্রতি সুবিচার করবে? আল্লাহর কসম, তিনি এদের ওপর সুবিচার করেছেন বলে আমাদের মনে হয়নি। একটা দল তাদের বসার জায়গায় বসলাে এবং তাদের নবীর নিকটবর্তী হতে চাইলো, অমনি তিনি তাদের দাড় করলেন এবং যারা পরে এসেছে তাদের বসিয়ে দিলেন। এরপর আমরা জানতে পারলাম, রসূল(স.) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের বসার জায়গা করে দিয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। এরপর দ্রুত গতিতে লােকেরা ওঠে তাদের ভাইদের বসালো। আর এ আয়াত জুমার দিনে নাযিল হলাে। এই রেওয়ায়াত যদি সঠিক হয়ে থাকে তবুও এটা সেই হাদীসের বিরোধী নয়, যাতে একজনকে উঠিয়ে তার জায়গায় অন্য জনকে বসাতে নিষেধ করা হয়েছে। সহীহ বােখারী ও সহীহ মুসলিমে আছে, রসূল(স.) বলেছেন, ‘কেউ কাউকে তার আসন থেকে ওঠিয়ে সেই আসনে নিজে বসবে না। তবে জায়গা প্রশস্ত করে দাও।’ অনুরূপভাবে সেই হাদীসেরও পরিপন্থী নয়, যাতে আগন্তুককে মজলিসের শেষ প্রান্তে বসতে বলা হয়েছে এবং সামনে স্থান পাওয়ার জন্যে মানুষের ঘাড় টপকাতে নিষেধ করা হয়েছে। আয়াতে আগন্তুকের জন্যে স্থান প্রশস্ত করে দিতে বলা হয়েছে যাতে সে বসতে পারে। অনুরূপভাবে কোনাে উপবিষ্ট লােককে ওঠতে বললে সেই আদেশ মান্য করে ওঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ আদেশ আসতে হবে নেতার পক্ষ থেকে, আগন্তুকের পক্ষ থেকে নয়। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলাে জায়গা প্রশস্ত করার আগে মন প্রশস্ত করা। মন যখন প্রশস্ত হবে, তখন স্থানও প্রশস্ত হবে, উদার হবে এবং উপবিষ্ট ব্যক্তি তার আগন্তুক ভাইকে স্বেচ্ছায় সাদরে বসাবে। নেতা যখন মনে করবে যে, স্থান খালি করে দেয়ার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে, তখন নির্দ্বিধায় ও সানন্দে তার আদেশ মান্য করতে হবে। সেই সাথে স্থায়ী মূলনীতিগুলােও বহাল রাখতে হবে, যেমন মানুষের ঘাড় টপকে টপকে পেছন থেকে সামনে না যাওয়া ও একজনকে ওঠিয়ে তার জায়গায় না বসা। কোথায় উদারতা প্রদর্শন করে স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে অন্য ভাইকে অগ্রাধিকার দিয়ে জায়গা করে দিতে হবে, কোথায় নেতার নির্দেশে বাধ্যতামূলকভাবে জায়গা দিতে হবে- এ দুটোর কোনটা কোথায় প্রযােজ্য হবে, সেটা স্থির করবে ইসলামের বিধান, তবে সদাচার ও সদ্ব্যবহার সর্বাবস্থায়ই অপরিহার্য। প্রত্যেকটি দায়িত্ব কর্তব্য ঘােষণা করার সময় সে জন্যে যথােপযুক্ত আবেগ ও প্রেরণা সৃষ্টি করা কোরআনের বিশেষ রীতি। তাই যারা বৈঠকাদিতে অন্য ভাইদের জন্যে জায়গা প্রশস্ত করে দেয়, তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাও তাদের প্রশস্ততা দান করবেন, জায়গা প্রশস্ত করে দাও, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের জন্যে জায়গা প্রশস্ত করে দেবেন। যারা রসূলের নির্দেশে স্বেচ্ছায় ওঠে যায় ও স্থান খালি করে দেয় তাদের উচ্চ মর্যাদাদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। ‘আর যখন তােমাদের বলা হবে ওঠো, তখন তােমরা ওঠে যাবে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের মধ্যকার ঈমানদার ও জ্ঞানলাভকারীদের উচ্চতর মর্যাদা দান করবেন।’ এটা তাদের জায়গা খালি করতে নির্দেশ মান্য করার ও বিনয়ের প্রতিদান। জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে রাসূল(স.)-এর কাছে বসার প্রসংগ নিয়ে আলােচনার সূত্রপাত ঘটেছিলাে। তাই এ আয়াতে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, ঈমান মানুষকে হৃদয়ের প্রশস্ততা ও রসূলের আনুগত্যের পথে টেনে নেয়, আর মানুষের জ্ঞান হৃদয়কে পরিশীলিত করার মাধ্যমে প্রশস্ত ও অনুগত করে। তাই ঈমান ও জ্ঞান উভয়ে মিলে আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা বাড়ায়। এভাবে তারা তাদের উচ্চতর সম্মান ও মর্যাদার যেটুকু স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলাে, অর্থাৎ নিজেদের আসন ছেড়ে ওঠে দাড়িয়ে অন্য ভাইকে শুধু রসূলের বিবেচনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বসতে দিয়েছিলাে, সেই ত্যাগের বদলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল’ অর্থাৎ তিনি তােমাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করে এ কাজের পেছনে যে আবেগ ও প্রেরণা সক্রিয় রয়েছে তার ভিত্তিতে তােমাদের তার উপযুক্ত বিনিময় প্রদান করেন। এভাবে কোরআন মানুষের লালন পালন ও পরিশীলনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। প্রেরণা উদ্দীপনা ও উৎসাহ যোগানোর মাধ্যমে তাকে উদারতা, মহানুভবতা ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়। বস্তুত ইসলাম আক্ষরিক অর্থে কেবল কতকগুলাে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমষ্টি নয়; বরং বিবেকের সচেতনতা ও জাগৃতি এবং আবেগ অনুভূতিতে আলােড়ন সৃষ্টি করার আরেক নাম হচ্ছে ইসলাম। অনুরূপ কোরআন মুসলমানদের আরাে একটা আদব শিক্ষা দেয়। এ আদবটা রসূল(স.)-এর সাথে সম্পর্ক রক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট। রসূল(স.)-এর সাথে একাকী সাক্ষাত করার ব্যাপারে একটা প্রতিযােগিতা লেগে থাকতাে। প্রত্যেকে তাঁকে নিভৃতে নিজের মনের কথা বলতে চাইতাে এবং তার প্রতি রসূল(স.)-এর ঐকান্তিক নির্দেশ ও মতামত গ্রহণ করতে চাইতাে। কেউবা নিছক শখের বশেই রাসূল(স.)-এর একক ও নিভৃত সাক্ষাতের স্বাদ উপভােগ করতে চাইতাে এবং তার সামষ্টিক দায়িত্ব ও তার সময়ের মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতাে না, আর তার সাথে একাকী সাক্ষাত করার গুরুত্ব যে কত এবং তা যে কেবল অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে ছাড়া হতে পারে না, সেটা অনেকেই বুঝতে চাইতাে না। এসব বিষয় উপলব্ধি করানাের জন্যে আল্লাহ তায়ালা একাকী সাক্ষাতকারীর ওপর এক ধরনের কর ধার্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ কর একাকী সাক্ষাতকারীর পক্ষ থেকে সমগ্র মুসলিম জামায়াতের জন্যে ধার্য করা হয়েছে। কেননা আলােচ্য ব্যক্তিটি সমগ্র মুসলিম জামায়াতের সময় ও অধিকারের একটা অংশ একাই ভােগ করতে চাইতাে। এ ধরনের নিভৃত সাক্ষাত প্রার্থনা করার আগেই সদকার আকারে এটা আগাম দিতে হতাে, হে মােমেনরা! তােমরা যখন রাসূলের সাথে চুপে চুপে কথা বলতে যাবে তখন অগ্রিম কিছু সদকা প্রদান করবে।'(আয়াত ১২) হযরত আলী(রা.) এই আয়াতের ওপর আমল করতেন। তিনি যখনই রসূল(স.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইতেন, এক দেরহাম সদকা দিয়ে নিতেন। তবে ব্যাপারটা সাধারণ মুসলানদের জন্যে কষ্টকর হয়ে দেখা দেয়। আল্লাহ তায়ালাও এটা জানতেন। যেহেতু এ নির্দেশের উদ্দেশ্যও ইতিমধ্যেই সফল হয়ে গিয়েছিলাে এবং মুসলমানরা রসূল(স.)-এর সাথে একাকী সাক্ষাতের মূল্য কতাে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাে। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর থেকে এ কড়াকড়ি শিথিল করলেন এবং এ কড়াকড়ি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে পরবর্তী আয়াত নাযিল হলাে। তার পরিবর্তে তাদের সাধারণ এবাদাতে মনােযােগী হবার উপদেশ দেয়া হলাে, যা অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত করে, ‘তাই আল্লাহ তায়ালা তােমাদের তা মাফ করেছেন, তখন নামায কায়েম করাে, যাকাত দাও।'(আয়াত ১৩) এ দুটো আয়াতে এবং এ আয়াত দুটোর নাযিল হওয়ার কারণ সম্বলিত বর্ণনাগুলােতে আরাে দেখতে পাই, ছােট বড় নানা ধরনের আচরণ ও ভাবাবেগকে সংযত করার লক্ষ্যে মুসলমানদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে কত চেষ্টা সাধনা করা হতাে।

ফী জিলালিল কুরআন:

এরপর পুনরায় সেসব মােনাফেক সম্পর্কে আলােচনা করা হচ্ছে, যারা ইহুদীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাে। তাদের কিছু কিছু তৎপরতা ও অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে এবং তাদের সকল গােপন অপতৎপরতা ফাঁস করে দেয়া ও তাদের ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন করার হুমকি দেয়া হয়েছে। সেই সাথে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সকল অপতৎপরতা ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হবে।   *ইসলাম বিরােধীদের সাথে মােনাফেকদের সখ্যতা : ‘তুমি কি তাদের দেখােনি, যারা আল্লাহর গজবে নিপতিত একটা গােষ্ঠীকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে।'(আয়াত ১৪-১৭) আল্লাহর গযবে নিপতিত এই গােষ্ঠীটি হচ্ছে ইহুদী সম্প্রদায়। এদের বন্ধুরূপে গ্রহণকারী মােনাফেকদের ওপর যে জোরদার আক্রমণ এই আয়াতগুলােতে চালানাে হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয়, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনবরত ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকতাে এবং তাদের জঘন্যতম শত্রুদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে তাদের বিরুদ্ধে নানারকমের ফন্দিফিকির করতাে। সেই সাথে এও প্রমাণিত হয় যে, এ সময়ে ইসলাম যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে গিয়েছিলো, ফলে মােনাফেকরা তাকে ভয় পেতাে। তাদের কিছু কিছু ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধি আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের কাছে ফাস করে দেয়ার পর রসূল(স.) ও মুসলমানরা যখন তা নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন, তখন তারা সেই ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধি আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে অস্বীকার করতাে। অথচ তারা জানতাে যে, এগুলাে মিথ্যা কসম । কিন্তু তবু মুসলমানদের সম্ভাব্য পাকড়াও ও তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এসব মিথ্যা কসম খেতে বাধ্য হতাে। ‘তারা তাদের কসমগুলােকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতাে।’ অর্থাৎ ব্যবহার করতাে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে। আর এভাবেই তারা মানুষদের আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখতাে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ আয়াতগুলাের মধ্য দিয়ে একাধিকবার শাসিয়েছেন। যেমন বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। তারা অত্যন্ত জঘন্য কাজে লিপ্ত থাকতাে।’ আবার বলেছেন, ‘তাদের জন্যে অপমানজনক শাস্তি রয়েছে।’ আবার বলেছেন, ‘তাদের ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি তাদের আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তারা জাহান্নামী এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।’ অতপর কেয়ামতের দিন তাদের যে শােচনীয় অবস্থা হবে তার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘দুনিয়াতে তারা যেমন মানুষের সামনে মিথ্যা কসম খেতাে, তেমনি আল্লাহর সামনেও মিথ্যা কসম খাবে। যেদিন আল্লাহ সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করবেন এবং তােমাদের সাথে যেমন কসম খায় তেমনি আল্লাহর সাথেও কসম খাবে।’ এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মােনাফেকী তাদের মেরুমজ্জায় মিশে গিয়েছিলাে। তাই কেয়ামত পর্যন্তও তা তাদের সাথে সাথে যাবে এবং অন্তর্যামী আল্লাহর সামনেও তা বহাল থাকবে। তারা মনে করবে, এতে তাদের কিছু না কিছু লাভ হবেই। অথচ তাতে তাদের কিছুই লাভ হবে না। তাদের সব কিছুই শূন্যে মিলিয়ে যাবে। এই বলে তাদের মূল মিথ্যাচারের মুখােশ খুলে দেয়া হবে। ‘জেনে রাখাে, তারা মিথ্যাবাদী।’ এরপর তাদের এই অবস্থার মূল কারণ বর্ণনা করা হচ্ছে। সে কারণটা হলাে, শয়তান তাদের ওপর পরাক্রান্ত হয়েছে পুরােমাত্রায়। ফলে সে তাদের আল্লাহর স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে। আর যে হৃদয় আল্লাহর স্মৃতি ভুলে যায়, তা বিকৃত হয়ে যায় এবং তা কেবল অন্যায় অসত্যের জন্যেই নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তারা হচ্ছে শয়তানের দল।’ অর্থাৎ তারা শয়তানের একনিষ্ঠ অনুসারী। তারই পতাকাতলে সমবেত হয়, তারই নামে কাজ করে এবং তারই উদ্দেশ্য সফল করে। এটা হচ্ছে নির্ভেজাল অন্যায়, যা সার্বিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মনে রেখাে, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।’ এটা হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন ও তীব্র আক্রমণ। মুসলমানদের কু-চক্রী দুশমনদের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত আঁটে এবং যে নির্যাতন তাদের ওপর চালায়, এটা তার সমান, তবে মুসলমানদের মন এ কথা জেনে আশ্বস্ত থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের পক্ষ থেকে তাদের গােপন দুশমনদের দাঁতভাংগা জবাব দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যেহেতু মােনাফেকরা ইহুদীদের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তি ভেবে একমাত্র তাদের কাছ থেকেই কিছু আশা করা যায় এবং একমাত্র তাদেরকেই ভয় করা যায় মনে করে তাদের কাছে আশ্রয় নিতো, তাদের কাছ থেকেই সাহায্য ও পরামর্শ চাইতাে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের ইহুদীদের সম্পর্কে হতাশ করে দিচ্ছেন এবং ঘােষণা দিচ্ছেন, তিনি শত্রুদের জন্যে পরাজয় ও লাঞ্ছনা বরাদ্দ করে রেখেছেন, নিজের জন্যে এবং নিজের রসূলের জন্যে বিজয় ও সর্বময় ক্ষমতা সুনিশ্চিত করে রেখেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের সাথে দুশমনী করে, তারা লাঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা লিখে রেখেছেন যে, আমি ও আমার রসূলরা অবশ্যই অবশ্যই জয়লাভ করবাে। কারণ আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।’ বস্তুত এটা সত্য প্রতিশ্রুতি। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছিলাে। সময়ে সময়ে বাহ্যত এই সত্য প্রতিশ্রুতির বিপরীত ঘটতে দেখা গেলেও ভবিষ্যতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হতে বাধ্য। কার্যত এটাই ঘটেছে যে, কুফর ও শিরকের ওপর তাওহীদ বিজয়ী হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনই পৃথিবীতে স্থিতি লাভ করেছে। শিরক ও পৌত্তলিকতার সকল বাধা ডিংগিয়ে এবং সকল ইসলামবিরােধী শক্তির সাথে লড়াই শেষে মানব জাতি এই দ্বীনের কাছেই নতিস্বীকার করেছে। যদিও পৃথিবীর কোনাে কোনাে অঞ্চলে সময়ে সময়ে শিরক বা কুফর ফিরে এসেছে, তথাপি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সাধারণত সর্বত্রই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে রেখেছে। অবশ্য কুফর ও শিরকের যুগ নিশ্চিতভাবে পতনের দিকে ধাবিত। কেননা এগুলাে টিকে থাকার যােগ্যই নয়। উপরন্তু মানব জাতি প্রতিনিয়ত এমন সব অকাট্য প্রমাণের সন্ধান পাচ্ছে, যা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের দিকেই টেনে নিয়ে যায় এবং ঈমান ও একত্বের ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে মুসলমান সর্বাবস্থায় বাস্তব সত্যই মনে করে, যদিও কোনাে সীমিত প্রজন্মে বা কোনাে সীমিত ভূখন্ডে কোনাে ছােটখাটো ঘটনা এর বিপরীত ঘটে থাকুক। বস্তুত এসব ঘটনা বাতিল ও অপসৃয়মান। কোনাে বিশেষ কারণে পৃথিবীতে সাময়িকভাবে এর আবির্ভাব ঘটতে পারে। সম্ভবত মােমেনদের ঈমান জোরদার করা ও শক্তিশালী করাই এর উদ্দেশ্য, যাতে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি যথাসময়ে বাস্তবায়িত হয়। মানুষ যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুদের চাপিয়ে দেয়া বহুমুখী ভয়াবহ যুদ্ধবিগ্রহগুলো দেখতে পায়, যা কখনাে সশস্ত্র যুদ্ধের আকারে আবার কথনাে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও চাপের আকের সুদীর্ঘকালব্যাপী এ দুনিয়ায় চালু রয়েছে, যার কোনাে কোনােটা মােমেনদের ব্যাপক গণহত্যা, নিপীড়ন অথবা বিতাড়নের কারণ হয়েছে এবং যার দরুন কোথাও বা তারা জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে অথবা নানা রকমের নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তখন বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছে, এতােকিছুর পরও মুসলমানদের অন্তরে ঈমান অটল রয়েছে, সেই ঈমানই তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেছে এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে হানাদার জাতিগুলাের মধ্যে বিলীন হওয়া ও তাদের পদানত হওয়া থেকে এই ঈমানই তাদের বাচিয়েছে। একমাত্র আকস্মিক আঘাত হানা ব্যতীত আর কোনাে উপায়ে হানাদাররা তাদের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি দিলেই যে কোনাে ব্যক্তি আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতির কার্যকরিতা নিজেরাই দেখতে পাবে। মোটকথা, চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহর প্রতিশ্রুতিই যে বিশ্বজগতে কার্যকর হবে, আল্লাহদ্রোহীরাই যে শােচনীয় পরাজয় বরণ করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের বিজয় যে অবধারিত অখন্ডনীয়, সে ব্যাপারে কোনাে মােমেনের মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ-সংশয় থাকতে পারে না।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মোমেনের কাছে রক্তের চেয়ে আদর্শ বন্ধনের মূল্য অনেক বেশী : সর্বশেষে আলােচিত হচ্ছে সেই চিরন্তন মূলনীতি, যাকে মােমেনরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে থাকে এবং যা ঈমানের চূড়ান্ত মানদন্ড হিসেবে জনগােষ্ঠীকে দেখবে না আল্লাহার ও তার রসূলের অবাধ্য কোনাে ব্যক্তির সাথে প্রীতি ভালোবাসার সম্পর্ক রাখে, এমনকি সে যদি তার মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই বােন অথবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনও হয়। বস্তুত এ হচ্ছে আল্লাহর দল ও শয়তানের দলের মধ্যকার চুড়ান্ত পার্থক্য, এ হচ্ছে সকল বাধা বন্ধন ও সকল আকর্ষণের উর্ধ্বে অবস্থিত একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং এটাই হচ্ছে একই আদর্শিক বন্ধনে আবদ্ধ একমাত্র ঈমানী যোগসূত্র। ‘তুমি দেখবে না আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোনাে গােষ্ঠীকে, যারা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের অবাধ্য কোনাে ব্যক্তির প্রতি প্রীতি ও ভালােবাসা পােষণ করে…’ কেননা আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানুষকে দুটো মন দেননি এবং কোনাে মানুষ তার একমাত্র অন্তরে দুটো ভালােবাসা একত্রিত করতে পারে না! একটা ভালােবাসা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের জন্যে এবং অপরটা তাদের শত্রুদের জন্যে! সুতরাং অন্তরে হয় ঈমান থাকবে নচেত বে-ঈমানী থাকবে, উভয়টা একই সাথে একত্র থাকতে পারে না। যদিও তারা তাদের মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই বােন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন হয়…। বস্তুত এসব আত্মীয়তার বন্ধন ঈমান ও কুফরীর শেষ সীমায় গিয়ে ছিন্ন না হয়ে পারে না। এ বন্ধন কেবল ততােক্ষণই বহাল থাকতে পারে যতােক্ষণ আল্লাহর দল ও শয়তানের দলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে না যায়। মোশরেক মাতাপিতার সাথে সন্তানের ভালাে সম্পর্ক ততােক্ষণই বহাল থাকবে, যতােক্ষণ আল্লাহর বাহিনী ও শয়তানের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ না বেধে যায়। এই সমস্ত আত্মীয়তার বন্ধন একই নীতি ও আদর্শের রজ্জুতে আবদ্ধ নয়। তাই এগুলাে শত্রুতা ও যুদ্ধের সময় বহাল থাকতে পারে না। এ কারণেই হযরত আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ(রা.) নিজের বাবাকে বদরের ময়দানে হত্যা করেছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক নিজের ছেলে আবদুর রহমানকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, হযরত মায়াব ইবনে ওমায়র নিজের ভাই ওবায়দ ইবনে ওমায়রকে হত্যা করেছিলেন এবং হযরত ওমর, হামযা, আলী, আবু ওবায়দা ও হারেস নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করেছিলেন। কেননা তারা রক্তের বন্ধন ও আত্মীয়তার বন্ধনের ওপর আদর্শ এবং বিশ্বাসের বন্ধনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আল্লাহর মানদন্ডে এর চেয়ে উত্তম বন্ধন ও মূল্যবােধ আর হতেই পারে না। ‘এরাই সেসব লােক, যাদের অন্তকরণে আল্লাহ ঈমান খোদাই করে দিয়েছেন…’ অর্থাৎ তাদের অন্তকরণে আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে ঈমান খােদাই করে দিয়েছেন। তাই এ ঈমান কোনো অবস্থায়ই বিলুপ্ত বা টলটলায়মান হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা তার নিজের পক্ষ থেকে একটা রূহ দিয়ে তাদের সাহায্য করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত রূহ বা আত্মা ছাড়া তাদের পক্ষে এতাে দৃঢ়চেতা হওয়া সম্ভব হবে না। এই আত্মাই তাদের অন্তরকে এমন ঈমানী আলােয় আলােকিত করেছে এবং এমন অমিততেজা শক্তি যুগিয়েছে। এই আত্মাকে তাদের প্রকৃত শক্তি ও আলাের উৎসের সাথে সংযুক্ত করেছে। ‘আর তিনি তাদের সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত থাকবে।’ দুনিয়ায় তারা যে সকল সম্পর্ক বন্ধন ছিন্ন করতে ও যে সকল স্বার্থ সুবিধা বিসর্জন দিতে পেরেছে, তার প্রতিদান হিসেবেই তাদের এই জান্নাতে প্রবেশ করানাে হবে। ‘আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট।’ এ উক্তি থেকে মােমেনদের একটা উজ্জ্বল সন্তোষজনক ও প্রশান্ত ভাবমূর্তি স্পষ্ট হয়ে যায়। তাদের অবস্থান যে কতাে উঁচুতে এবং পরিষ্কার হয়ে যায়। তাদের প্রতিপালক তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাদের প্রতিপালকের ওপর সন্তুষ্ট। তারা সব কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং শুধু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জুড়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজের সযত্ন আশ্রয়ে আশ্রয় দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টির কথা অবহিত করেছেন। তারা সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। তার নৈকট্য লাভ করে তার আপনজনে পরিণত হয়েছে। ‘তারাই আল্লাহর দল।’ বস্তুত তারা আল্লাহরই দল। তারই পতাকাতলে তারা সমবেত। তারই অধিনায়কত্বে চলমান। তাঁরই আদর্শে তারা উজ্জীবিত অনুপ্রাণিত। তাঁরই বিধান বাস্তবায়নে তারা তৎপর। তার যমীনে তাঁরই হুকুম ও ফয়সালা অনুসারে সক্রিয়। তাই তারা হচ্ছে আল্লাহর ফায়সালার একটা অংশবিশেষ। ‘জেনে রাখাে, আল্লাহর দলই সফলকাম।’ কেন সফলকাম হবে না? আল্লাহর মনোনীত বাহিনী যদি সফলকাম না হয় তাহলে আর হবে কে? এভাবে গােটা মানব জাতি দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহর দল ও শয়তানের দল। হকের বাহিনীও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। যে ব্যক্তি শয়তানের দলভুক্ত হবে, সে শয়তানের বাহিনীরও অন্তর্ভুক্ত হবে এবং বাতিলের পতাকার নীচে সমবেত হবে। এ দুটো সম্পূর্ণ পরস্পর বিরােধী দল, স্বতন্ত্র দল। এরা কখনাে পরস্পরের সাথে মিলিত হতে পারে না। ইসলামের মােকাবেলায় কোনাে আত্মীয়তা, কোনাে স্বাদেশিকতা, কোনাে জাতীয় এবং কোনাে বংশীয় বন্ধনের মূল্য নেই। ইসলামের আদর্শিক বন্ধনই একমাত্র গ্রহণযােগ্য বন্ধন। যারা আল্লাহর দলভুক্ত হবে ও আল্লাহর পতাকার নীচে সমবেত হবে, তারা সবাই ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। তারা সবাই পরস্পরের দ্বীনী ভাই। তা তাদের বর্ণ, দেশ, আত্মীয়তা ও বংশ যতােই ভিন্ন ভিন্ন হােক না কেন। তারা একমাত্র আল্লাহর দল হিসেবে এক পতাকার নীচে সমবেত হবে। এই এক পতাকার পরিচয় ছাড়া আর সমস্ত পরিচিতি তাদের বিলীন হয়ে যাবে। আর যাদের ওপর শয়তান প্রবল হয় এবং তারা বাতিলের পতাকার নীচে সমবেত হয়, তাদের আল্লাহর দলের সাথে কোনাে সম্পর্ক বন্ধন বা মৈত্রী থাকে না। এক দেশ, এক জাতি, এক বর্ণ, এক বংশ, এক ভাষা, এক আত্মীয়তা কোনাে কিছুই তাদের একান্ত করতে পারে না। একটি মাত্র ঐক্যের বন্ধন ইসলামের বন্ধনই এই সমস্ত বন্ধনকে একীভূত করতে পারে। এ আয়াত থেকে যদিও জানা যায় যে, মুসলমানদের দলে রক্ত ও আত্মীয়তার বন্ধনে এবং পার্থিব স্বার্থ ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ একটি গােষ্ঠী ছিলাে এবং এ আয়াত তাদের মনমানসিকতাকে সংশােধন করে, ঈমানের মানদন্ডকে চূড়ান্ত ও অকাট্য বন্ধন বলে স্থির করে দেয়, কিন্তু এ আয়াত থেকে মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি দলেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের কাছে দ্বীনী সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনাে সম্পর্ক বন্ধনের কোনাে গুরুত্ব ছিলাে না এবং ঈমানী ও দ্বীনী ভ্রাতৃত্বই তাদের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব বহন করতাে। বন্ধনের আনুগত্যের কারণেই তারা এতাে উঁচুস্তরে উন্নীত হতে পেরেছিলাে। সূরার সমাপ্তিতে মােমেনদের এই উৎকৃষ্ট গােষ্ঠীটির বিবরণ দেয়া একান্ত প্রাসংগিক ও সমীচীন। হয়েছে। কেননা সূরার শুরুতে ছিলাে একজন দরিদ্র মহিলার ঘটনার মধ্য দিয়ে এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর অসীম কৃপা ও দয়ার বিবরণ। সেই নগণ্য দরিদ্র মহিলার কথা আল্লাহ শুনেছিলেন, যে স্বয়ং রসূল(স.)-এর সাথে নিজের ও নিজের স্বামীর ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিলাে। সুতরাং এ সূরার শেষ কথা এটাই যে, মহান আল্লাহ তার মনােনীত এই উম্মতকে যে মহাজাগতিক ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তা হচ্ছে, তারা যেন তাদের প্রতি মহান আল্লাহর সে কৃপা ও দয়ার কথা না ভুলে সমস্ত পার্থিব স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হয়, আর এই নিবেদিত হওয়ার দাবী হলাে, স্বাভাবিক ও স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁর ডাকে সাড়া দেয়া এবং শয়তানের দল ও আল্লাহর দলের পার্থক্য স্মরণ রেখে আল্লাহর দলকে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দান।

১১-২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১১-১৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا…. وَاللہُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ)

এখানে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে মজলিসের আদব শিক্ষা দিচ্ছেন এবং জ্ঞানীদের মর্যাদার কথা বর্ণনা করছেন।

যখন মু’মিনরা কোন মজলিসে একত্রিত হবে তখন যদি আগত লোকদের জন্য মজলিসে জায়গা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে নড়েচড়ে বসে মজলিসে জায়গা করে দেবে। কেননা আগত লোকজন এসে দাঁড়িয়ে থাকবে বা কোন বসা লোককে উঠিয়ে দিয়ে বসতে হবে এমন যেন না হয়। কারণ এ দুটিই আদবের খেলাফ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কোন ব্যক্তি যেন অন্য কোন ব্যক্তিকে তার স্থান থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে না বসে। বরং মজলিসের জায়গাকে প্রশস্ত করে দাও। (সহীহ বুখারী হা. ৬২৬৯)

অন্যত্র তিনি বলেন : কোন ব্যক্তি তার জায়গা থেকে চলে গিয়ে ফিরে আসলে সে ব্যক্তি উক্ত জায়গার বেশি হকদার। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৭৯)

আল্লাহ তা‘আলা এর প্রতিদানস্বরূপ তোমাদেরকে জান্নাতে অতীব প্রশস্ত স্থান দান করবেন। অথবা যেখানেই প্রশস্ততা কামনা করবে সেখানেই তিনি তা দান করবেন। যেমন বাড়িতে প্রশস্ততা, রুযীতে প্রশস্ততা এবং কবরে প্রশস্ততা ইত্যাদি।

(وَإِذَا قِيْلَ انْشُزُوْا)

‘যখন বলা হয়, তোমরা উঠে যাও’ অর্থাৎ জিহাদের জন্য, সালাতের অথবা কোন ভাল কাজের জন্য যেতে বলা হয়, তখন সত্বর উঠে চলে যাও। আব্দুর রহমান বিন জায়েদ বলেন : সাহাবায়ে কেরাম যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসতেন তখন প্রত্যেকেই চাইতেন যে, তিনি সবশেষে যাবেন। কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রয়োজন থাকত; ফলে তাঁর জন্য এটা কষ্টকর হয়ে যেত। তাই নির্দেশ দেওয়া হল যখন চলে যেতে বলা হবে তখন যেন তারা চলে যায়।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَإِنْ قِيْلَ لَكُمُ ارْجِعُوْا فَارْجِعُوْا هُوَ أَزْكٰي لَكُمْ ط وَاللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ)‏

“যদি তোমাদেরকে বলা হয়, ‘ফিরে যাও’, তবে তোমরা ফিরে যাবে, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম এবং তোমরা যা কর‎ সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।” (সূরা নূর ২৪ : ২৮)

( يَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ لا وَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍ)

অর্থাৎ ঈমানদারদের মর্যাদা বেঈমানদারদের ওপর এবং (ঈমানদার) শিক্ষিতদের মর্যাদা অশিক্ষিত সাধারণ ঈমানদারদের থেকে অনেক বেশি। ঈমানদার আলেমদেরকে আখিরাতে নেকী অনেক বেশি দেওয়া হবে আর দুনিয়াতে অনেক মর্যাদা দেওয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আলেমের মর্যাদা ইবাদতকারীর ওপর তেমন যেমন পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মর্যাদা সমস্ত তারকার ওপর। (আবূ দাঊদ হা. ৩৬৪১)

অন্যত্র নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

الْعُلَمَاءُ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ

আলেমরাই নাবীদের ওয়ারিশ। এছাড়া আলেমদের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।

(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا اِذَا نَاجَیْتُمُ الرَّسُوْلَ….. وَاَطْھَرُﺚ فَاِنْ لَّمْ تَجِدُوْا فَاِنَّ اللہَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ)

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে প্রত্যেক মু’মিন নির্জনে কথা বলার আশা করত। কিন্তু সবার সাথে নির্জনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া তো একা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষে সম্ভব নয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন : অনেক মুনাফিকরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে চুপিচুপি কথা বলতে গিয়ে সময় নষ্ট করত। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারী করে দিলেন যে, যারাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে নির্জনে কথা বলতে চাইবে তারাই যেন সদকা প্রদান করে। এটা তাদের জন্য উত্তম অর্থাৎ সদকাহ প্রদান করে কথা বলা। কেননা এর মাধ্যমে তাদের অনেক কল্যাণ হাসিল হবে। কিন্তু এ নির্দেশ সাহাবীদের জন্য কষ্টকর হয়ে গেলে আল্লাহ তা‘আলা বিধানটি হালকা করে দিলেন। তাই পরবর্তী আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতকে রহিত করে দিয়েছে। (ইবনু কাসীর)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : মুসলিমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বেশি বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করত, এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মুশকিলে নিপতিত করত। আল্লাহ তা‘আলা চাইলেন এ সমস্যা থেকে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে উত্তরণ করতে, তাই তিনি পরবর্তী আয়াত নাযিল করলেন (কুরতুবী)। এছাড়াও এ সম্পর্কে আরো বর্ণনা রয়েছে।

আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : আয়াতটি রহিত হয়নি, বরং নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মানার্থে হুকুমটি বলবৎ আছে। তবে কেউ সদকাহ না দিলে আল্লাহ পাকড়াও করবেন না। (তাফসীর সা‘দী)

তাই ফরয সালাত, যাকাত ও আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য করলেই সদকার পরিবর্তে যথেষ্ট হয়ে যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মাজলিসের আদব জানতে পারলাম।
২. আলেমদের মর্যাদা সাধারণ লোকদের থেকে অনেক বেশি যদি সেই আলেম ইলম অনুযায়ী আমল করে।
৩. ইসলামী শরীয়তের আদেশ-নিষেধের হিকমত জানতে পারলাম।
১৪-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মদীনার মুনাফিকদের কথা উল্লেখ করছেন যারা ইয়াহূদীদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। এ-কথা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞাসাসূচক শব্দে বলছেন। যারা আল্লাহ তা‘আলার শত্রুদের সাথে সম্পর্ক রাখে তারা মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তারা মুনাফিক।

(قَوْمًا غَضِبَ اللّٰهُ)

এমন সম্প্রদায় যাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ রয়েছে; তারা হল ইয়াহূদী জাতি। এ সকল মুনাফিকরা ওপরে ওপরে ঈমানের কথা বললেও প্রকৃত পক্ষে তারা মু’মিনদের মধ্যে শামিল নয় এবং ইয়াহূদীদের মধ্যেও শামিল নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(مُّذَبْذَبِيْنَ بَيْنَ ذٰلِكَ لَآ إِلٰي هٰٓؤُلَا۬ءِ وَلَآ إِلٰي هٰٓؤُلَا۬ءِ ط وَمَنْ يُّضْلِلِ اللّٰهُ فَلَنْ تَجِدَ لَه۫ سَبِيْلًا)‏

“দোটানায় দোদুল্যমান-না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোন পথ পাবে না। (সূরা নিসা ৪ : ১৪৩)

(وَيَحْلِفُوْنَ عَلَي الْكَذِبِ)

অর্থাৎ এ সকল মুনাফিকরা জেনেশুনে মিথ্যা শপথ করে। এ শপথকে বলা হয় اليمين الغموس। তারা মু’মিনদের সাথে দেখা হলে বলে, আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আমরাও ঈমান এনেছি, আবার ইয়াহূদীদের সাথে একত্রিত হলে বলে, আরে আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি। আমরা কেবল তাদের সাথে ঠাট্টা করি। এদের জন্যই আল্লাহ কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।

(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً)

তারা তাদের শপথকে ঢালস্বরূপ গ্রহণ করে নিয়েছে। অর্থাৎ মু’মিনদের সাথে শপথ করে ঈমানের কথা বলে মু’মিনদের তিরস্কার থেকে বাঁচার জন্য, আবার ইয়াহূদীদের সাথে শপথ করে তাদের তিরস্কার থেকে বাঁচার জন্য।

(فَيَحْلِفُوْنَ لَه۫ كَمَا يَحْلِفُوْنَ لَكُمْ) শানে নুযূল :

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কোন এক কক্ষের ছায়ায় বসেছিলেন এবং কতক সাহাবীও তাঁর সাথে ছিলেন। ছায়াযুক্ত স্থান কম ছিল। কষ্ট করে তাঁরা সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : দেখ, এখানে অচিরেই এমন একজন লোক আসবে যে শয়তানী দৃষ্টিতে তাকাবে। সে আসলে তোমরা কেউই তার সাথে কথা বলবে না। অল্পক্ষণের মধ্যেই টেরা চোখবিশিষ্ট একজন লোক আসল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ডেকে নিয়ে বললেন : তুমি এবং অমুক অমুক লোক আমাকে গালি গালাজ কর কেন? এ কথা শুনেই লোকটি চলে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কয়জনের নাম নিয়েছিলেন তাদের সবাইকে সে ডেকে নিয়ে আসল এবং সবাই শপথ করে বলল : তাদের কেউই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বেয়াদবীমূলক কথা বলেনি। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আহমাদ হা. ২৪০৭, হাকেম ২/২৮৪ সনদ সহীহ)

(اِسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ) اِسْتَحْوَ ذَ শব্দের অর্থ হল :

ঘিরে নিয়েছে, বেষ্টন করে নিয়েছে, প্রভুত্ব বিস্তার করে নিয়েছে। শয়তান তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে; ফলে তারা আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ হতে গাফেল হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যে গ্রামে বা জঙ্গলে তিনজন আছে এবং তাদের মধ্যে সালাত প্রতিষ্ঠা করা হয় না তাদের ওপর শয়তান প্রভুত্ব বিস্তার করে। সুতরাং তোমরা জামা‘আতকে আঁকড়ে ধরে থাক। কেননা বাঘ দল বিচ্ছিন্ন ছাগলকেই ধরে খেয়ে ফেলে। (আবূ দাঊদ হা. ৫৪৭, সনদ হাসান)

সুতরাং মু’মিনদের উচিত হবে অমুসলিমদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে মু’মিনদের সাথে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে বসবাস করা, তাহলে দুনিয়াতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে এবং আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মুনাফিকদের দ্বিমুখী আচরণের কথা জানাতে পেলাম।
২. গযবপ্রাপ্ত জাতির কথা জানতে পারলাম।
৩. কাফিরদের সাথে সম্পর্ক গড়া হারাম।
৪. কারো প্রকৃত ইমান না থাকলে ধন-সম্পদ কোন কাজে আসবে না।
৫. মিথ্যা শপথ করা হারাম।
৬. শয়তানের দলের পরিচয় জানলাম।
৭. মুসলিমের জামা‘আত বর্জন করার কুফল জানতে পারলাম।
২০-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্বীয় দলের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।

(كَتَبَ اللّٰهُ لَأَغْلِبَنَّ)

অর্থাৎ তাকদীর ও লাওহে মাহফূজে আল্লাহ তা‘আলা এ বিজয়বাণী লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন যাতে কোন পরিবর্তন নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُوْمُ الْأَشْهَادُ لا يَوْمَ لَا يَنْفَعُ الظّٰلِمِيْنَ مَعْذِرَتُهُمْ وَلَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوْٓءُ الدَّارِ)

“নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদের ও মু’মিনদেরকে সাহায্য করবো পার্থিব জীবনে ও যেদিন সাক্ষীগণ দণ্ডায়মান হবে। যেদিন জালিমদের কোন আপত্তি কোন উপকারে আসবে না, তাদের জন্য রয়েছে লা‘নত এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।” ( সূরা মু’মিন ৪০ : ৫১-৫২)

(لَا تَجِدُ قَوْمًا يُّؤْمِنُوْنَ)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃত মু’মিন বান্দাদের পরিচয় তুলে ধরছেন যে, তারা কখনো আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের সাথে শত্রুতা পোষণকারীর সাথে সুসম্পর্ক রাখে না, যদিও তারা তাদের অন্তরঙ্গ লোক হয়। কেননা তারা তাদের পিতা মাতা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজের জীবনের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বেশি ভালবাসে। সূরা আলি ইমরানের ২৮ নম্বর ও সূরা তাওবার ২৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

(أُولٰ۬ئِكَ كَتَبَ فِيْ قُلُوْبِهِمُ الْإِيْمَانَ)

যারা উপরোক্ত গুণে গুণান্বিত তাদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলা ঈমান বদ্ধমূূূল করে দিয়েছেন; ফলে তারা তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে এবং তাদেরকে স্বীয় মদদ দ্বারা সহযোগিতা করবেন। এরাই হল আল্লাহ তা‘আলার দল, আর আল্লাহ তা‘আলার দলই হবে সফলকাম। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ দলের অন্তর্ভুক্ত করুন! আমীন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সর্বকালেই লাঞ্ছিত হয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সর্বদা বিজয়ী থাকবেন।
৩. প্রকৃত মু’মিনদের পরিচয় জানলাম।
৪. প্রকৃত মু’মিনরা নিজেদের জীবনের চেয়ে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলকে বেশি ভালবাসে।
৫. মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও উত্তম প্রতিদানের কথা জানতে পারলাম।

১১-২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
এখানে আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনদেরকে মজলিসে বসার আদব বা ভদ্রতা শিক্ষা দিতে গিয়ে এবং একে অপরের প্রতি অনুগ্রহ করার নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেনঃ যখন তোমরা কোন মজলিসে একত্রিত হবে এবং তোমরা বসে যাওয়ার পর কেউ এসে পড়বে তখন তার বসার জায়গা করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তোমরা একটু একটু করে সরে সরে বসবে এবং এই ভাবে জায়গা কিছুটা প্রশস্ত করে দিবে। এর বিনিময়ে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্যে স্থান প্রশস্ত করে দিবেন। কেননা প্রত্যেক আমলের বিনিময় ঐরূপই হয়ে থাকে। যেমন সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে মসজিদ বানিয়ে দিবে, আল্লাহ্ তাঁর জন্যে জান্নাতে ঘর বানিয়ে দিবেন।” অন্য হাদীসে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি কোন লোকের কাঠিন্য সহজ করবে, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তার (বিপদ-আপদের) কাঠিন্য সহজ করে দিবেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন যে পর্যন্ত বান্দা তার (মুসলমান) ভাইকে সাহায্য করতে থাকে। এই ধরনের আরো বহু হাদীস রয়েছে।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি যিকরের মজলিসের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। যেমন, ওয়া হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) কিছু উপদেশ বাণী প্রদান করছেন এবং জনগণ বসে শুনছেন। এমন সময় কেউ একজন এসে পড়লেন। কিন্তু কেউই নিজ জায়গা হতে একটু সরছেন না যে ঐ লোকটি বসতে পারেন। তখন আল্লাহ্ পাক আয়াত নাযিল করে নির্দেশ দিলেনঃ তোমরা একটু একটু করে সরে গিয়ে স্থান প্রশস্ত করে দাও, যাতে পরে আগমনকারীর বসার জায়গা হয়ে
যায়।

হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, জুমআর দিন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। ঐ দিন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) একটি সংকীর্ণ জায়গায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জায়গা কম ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, যেসব মুহাজির ও আনসার বদরের যুদ্ধে তাঁর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে তিনি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। ঐ দিন ঘটনাক্রমে কয়েকজন বদরী সাহাবী (রাঃ) কিছু বিলম্বে আগমন করেন। তারা এসে নবী (সঃ)-এর নিকট দাঁড়িয়ে যান। তাঁকে তাঁরা সালাম করেন এবং তিনিও উত্তর দেন। মজলিসের লোকদেরকেও তারা সালাম জানান এবং তারাও জবাব দেন। অতঃপর ঐ বদরী সহাবীগণ (রাঃ) এই আশায় দাঁড়িয়ে থাকেন যে, মজলিসে তাদের জন্যে একটু জায়গা করে দিলে তারা বসে পড়বেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদের এ অবস্থা লক্ষ্য করে আর থামতে পারলেন না, নাম ধরে ধরে তিনি কতক লোককে দাঁড়াতে বললেন এবং ঐ উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সহাবীদেরকে ঐ সব জায়গায় বসার নির্দেশ দিলেন। এতে যাদেরকে উঠিয়ে দেয়া হলো তাঁরা মনে কিছু ব্যথা পেলেন এবং তাঁদের কাছে এটা কিছু কঠিন ঠেকলো। মুনাফিকরা এটাকে একটা সুযোগে হিসেবে গ্রহণ করলো। তারা বলতে শুরু করলোঃ “দেখো, তিনি ন্যায় বিচার করার দাবীদার, অথচ যারা তাঁর উপদেশবাণী শুনবার আগ্রহে পূর্বেই এসে তার পার্শ্বে জায়গা নিয়েছিল তাদেরকে তিনি উঠিয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় বসিয়ে দিলেন এমন লোকেদেরকে, যারা পরে এসেছে। এর চেয়ে অবিচার মূলক আচরণ আর কি হতে পারে?” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির উপর দয়া করুন যে তাঁর ভাইয়ের জন্যে মজলিসে জায়গা করে দেয়।” তাঁর এ প্রার্থনা শোন মাত্রই সাহাবীগণ তাড়াতাড়ি খুশীমনে নিজ নিজ জায়গা হতে সরতে লাগলেন এবং তাঁদের ভাইয়ের জন্যে জায়গা করে দিলেন। অতঃপর জুমআর দিন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “কোন মানুষ যেন কোন মানুষকে উঠিয়ে দিয়ে তার জায়গার না বসে, বরং তোমরা মজলিসে স্থান প্রশস্ত করে দাও।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) নাফে’ (রঃ) হতে এটা সহীহাইনে তাখরীজ করেছেন)

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জুমআর দিন তোমাদের কেউ যেন তার ভাইকে তার জায়গা হতে উঠিয়ে না দেয়, বরং যেন বলে জায়গা করে দাও।” (এ হাদীসটি ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

কোন আগন্তুকের জন্যে দাঁড়ানো জায়েয কি-না এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ এতে অনুমতি দেন না এবং দলীল হিসেবে নিম্নের হাদীসটি পেশ করে থাকেনঃ “যে ব্যক্তি চায় যে, লোকেরা তার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুক, সে যেন জাহান্নামে তাঁর স্থান বানিয়ে নেয়।”

কেউ কেউ আবার এর ব্যাখ্যা করে বলেন যে, কেউ সফর হতে আসলে তার জন্যে এবং কোন হাকিমের জন্যে তাঁর হুকুমতের জায়গায় দাঁড়ানো জায়েয। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) বলেছিলেনঃ “তোমরা তোমাদের নেতার জন্যে দাঁড়িয়ে যাও।” এটা তাঁর তা’যীমের জন্যে ছিল না, বরং তার ফায়সালা জারী করিয়ে দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। এসব ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। হ্যাঁ, তবে এটাকে অভ্যাস করে নেয়া যে, মজলিসে যখনই কোন বড়লোকে এবং মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি আসবে তার জন্যেই মানুষ উঠে দাঁড়াবে, এটা আজমীদের রীতি-নীতি। সুনানের হাদীসে রয়েছে যে, সাহাবীদের (রঃ) নিকট আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর চেয়ে অধিক প্রিয় ও সম্মানিত আর কোন লোকই ছিলেন না। তথাপি তাঁকে দেখে তারা দাঁড়াতেন না। কারণ তাঁরা জানতেন যে, তিনি এটা পছন্দ করেন না। সুনানের অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এসেই মজলিসের শেষ প্রান্তে বসে পড়তেন এবং যেখানেই তিনি বসতেন সেটাই হয়ে যেতো সভাপতির স্থান। আর সাহাবীগণ নিজ নিজ মর্যাদা অনুযায়ী বসে যেতেন। প্রায়ই হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর ডান দিকে বসতেন এবং হযরত উমার (রাঃ) বাম দিকে বসতেন। সাধারণতঃ হযরত উসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) তাঁর সামনের দিকে বসতেন। কেননা, তাঁরা দু’জন ছিলেন অহীর লেখক। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদেরকে যা বলতেন তাঁরা তা লিখে নিতেন।

সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী ও বিবেকবান ব্যক্তি তারা যেন আমার কাছাকাছি বসে। তারপর যেন মর্যাদা অনুযায়ী সবাই ক্রমান্বয়ে বসতে থাকে।” এই ব্যবস্থা রাখার কারণ ছিল এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যা কিছু বলেন তা যেন এই জ্ঞানী লোকেরা ভালভাবে শুনেন ও বুঝেন। সুফফা যুক্ত মজলিসের বর্ণনা কিছু পূর্বেই গত হলো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) অন্যান্য লোকদেরকে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের স্থানে বদরী সহাবীদেরকে বসিয়ে দেন। যদিও এর সাথে অন্য কারণও ছিল। যেমন ঐ লোকদের নিজেদেরই উচিত ছিল ঐ মর্যাদাবান সহাবীদের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং নিজেরা সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেয়া। কিন্তু যখন তাঁরা নিজেরা তা করলেন না তখন হুকুমের মাধ্যমে তাদের দ্বারা তা করিয়ে নেয়া হলো। অনুরূপভাবে প্রথমে যারা এসেছিলেন তারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বহু কথা ও উপদেশ বাণী শুনেছেন। তারপর এই মর্যাদা সম্পন্ন লোকগণ আসলেন। তখন তিনি চাইলেন যে, তাঁরাও যেন আরামের সাথে বসে গিয়ে তাঁর উপদেশপূর্ণ কথা শোনর সুযোগে গ্রহণ করতে পারেন। এভাবে এই উম্মতকে এই শিক্ষা দেয়াও উদ্দেশ্য ছিল যে, তারা যেন তাদের বড়দেরকে ইমামের পার্শ্বে বসার সুযোগে দেন এবং তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দান করেন।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) নামাযের সফ বা সারি ঠিক করার সময় নিজেই আমাদের কাঁধ ধরে ধরে ঠিক করতেন এবং মুখেও বলতেনঃ ‘সোজাভাবে দাঁড়াও, বক্রভাবে দাঁড় হয়ো না। জ্ঞানী ও বিবেকবানরা আমার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে। তারপর মর্যাদা অনুপাতে ক্রমান্বয়ে দাঁড়াবে।” এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর হযরত আবু মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “বড়ই দুঃখের বিষয় যে, এই হুকুম সত্ত্বেও তোমরা এখনো লাইন বা সারিকে বক্রই করছো!” (ইমাম আহমাদ (রঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিম, সুনানে আবি দাউদ, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহুতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে) এটা স্পষ্টভাবে প্রকাশমান যে, নামাযের জন্যে যখন এই হুকুম ছিল তখন নামায ছাড়া অন্য সময়ে তো এই হুকুমের গুরুত্ব আরো বেশী থাকার কথা।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা লাইনগুলো ঠিক রেখো, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রেখো, সারিগুলোর মাঝে জায়গা ফাঁকা রেখো না, লাইনে নিজের (মুসল্লী) ভাইদের কাছে কোমল হয়ে যাও, সারিতে শয়তানের জন্যে ছিদ্র ছেড়ে রেখো না। যে ব্যক্তি লাইন বা সারি মিলিয়ে রাখে তাকে আল্লাহ্ মিলিয়ে রাখেন এবং যে ব্যক্তি লাইন কেটে দেয়, আল্লাহও তাকে কেটে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এজন্যেই সায়্যিদুল কুররা (কারীদের নেতা) হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) যখন নামাযে আসতেন তখন তিনি প্রথম সারিতে বা কাতারে যেতেন এবং সেখান হতে দুর্বল জ্ঞান বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পিছনে সরিয়ে দিতেন এবং নিজে তার স্থানে দাঁড়িয়ে যেতেন। আর ঐ হাদীসটিকেই তিনি দলীল হিসেবে গ্রহণ করতেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “জ্ঞানী ও বিবেকবান ব্যক্তি আমার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে এবং তারপর ক্রমান্বয়ে জ্ঞান অনুপাতে দাঁড়াবে।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-কে দেখে কেউ উঠে দাঁড়ালে তিনি তার জায়গায় বসতেন না এবং ঐ হাদীসটি পেশ করতেন যা উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, কেউ যেন কাউকেও উঠিয়ে দিয়ে তার জায়গায় না বসে।

এখানে নমুনা হিসেবে আমরা কতকগুলো মাসআলা এবং অল্প সংখ্যক হাদীস লিখে সামনে অগ্রসর হচ্ছি। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জায়গা এখানে নেই এবং সেই সুযোগেও নেই।

সহীহ্ হাদীসে রয়েছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বসেছিলেন, এমন সময় তিনজন লোক আসলো। একজন তো মজলিসের মাঝে শূন্য জায়গা দেখে সেখানে বসে পড়লো এবং দ্বিতীয়জন মজলিসের শেষ প্রান্তে স্থান নিলো। আর তৃতীয়জন ফিরে চলে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে তিন ব্যক্তির খবর দিবো না? এক ব্যক্তি তো আল্লাহর দিকে স্থান নিলো এবং আল্লাহ্ তাকে স্থান দিলেন। দ্বিতীয়জন আল্লাহ্ হতে লজ্জা করলো এবং আল্লাহও তার হতে লজ্জা করলেন। আর তৃতীয়জন মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং আল্লাহও তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “কারো জন্যে বৈধ নয় যে, সে দুইজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। হ্যাঁ, তবে যদি তাদের দু’জনের অনুমতিক্রমে হয় তাহলে সেটা স্বতন্ত্র কথা।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবূ দাঊদ (রঃ) এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত হাসান বসরী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, মজলিসে স্থান প্রশস্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে জিহাদের ব্যাপারে। অনুরূপভাবে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশও জিহাদের ব্যাপারেই দেয়া হয়েছে।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ যখন তোমাদেরকে কল্যাণ ও ভাল কাজের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তোমরা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়ে।

হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা বুঝানো হয়েছেঃ যখন তোমাদেরকে নামাযের জন্যে ডাক দেয়া হয় তখন তোমরা উঠে দাঁড়িয়ে যাবে।

হযরত আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম যখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট আসতেন তখন প্রত্যেকেই চাইতেন যে, তিনিই সব শেষে যাবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কোন প্রয়োজন থাকলে তিনি খুবই অস্বস্তি বোধ করতেন। কিন্তু মানবতার খাতিরে তিনি কিছুই বলতেন না। তখন নির্দেশ দেয়া হয় যে, যখন ফিরে যেতে বলা হয় তখন যেন তারা ফিরে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তোমাদেরকে বলা হয়ঃ তোমরা ফিরে যাও, তবে তোমরা ফিরে যাবে।” (২৪:২৮)

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ যখন তোমাদেরকে মজলিসে জায়গা করে দেয়ার কথা বলা হয় তখন জায়গা দেয়ায় এবং যখন উঠে যাওয়ার কথা বলা হয় তখন উঠে যাওয়ায় তোমরা নিজেদের জন্যে মানহানিকর মনে করো না, বরং এর মাধ্যমে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তোমাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন। তোমাদের এ পুণ্যময় কাজ তিনি বিনষ্ট করবেন না। বরং এর বিনিময়ে তিনি তোমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম পুরস্কার প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর আহকামের উপর বিনয়ের সাথে স্বীয় গর্দান ঝুঁকিয়ে দেয়, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। ঈমানদার ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারীদের অভ্যাস এটাই যে, তারা আল্লাহর হুকুমের সামনে তাদের গর্দান ঝুঁকিয়ে থাকে এবং এভাবে তারা উচ্চ মর্যাদা লাভের হকদার হয়ে যায়। মর্যাদার হকদার কারা এবং কারা এর হকদার নয় এ সম্পর্কে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত।

হযরত আবূ তুফায়েল আমির ইবনে ওয়ায়েলাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আসফান নামক স্থানে হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর সঙ্গে হযরত নাফে ইবনে হারিস (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। হযরত উমার (রাঃ) তাঁকে মক্কা শরীফের আমেল নিযুক্ত করেছিলেন। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “মক্কায় কাকে তুমি তোমার স্থলাভিষিক্ত করে এসেছো?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ইবনে ইবষী (রাঃ)-কে আমি আমার স্থলাভিষিক্ত করে এসেছি।” তখন হযরত উমার (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “সে তো আমার আযাদকৃত গোলাম! সুতরাং কি করে তাকে মক্কাবাসীর উপর আমীর নিযুক্ত করে আসলে?” তিনি জবাবে বললেনঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! তিনি আল্লাহর কিতাবের পাঠক, ফারায়েযের আলেম এবং একজন ভাল বক্তা।” এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “তুমি সত্য বলেছো। নবী (সঃ) বলেছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এই কিতাবের কারণে এক কওমকে সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করবেন এবং অন্যদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবেন এবং তাদের মর্যাদা কমিয়ে দিবেন।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

আলেমদের যে ফযীলতের কথা এই আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াত ও হাদীসসমূহে প্রকাশিত হয়েছে, এ সবগুলো আমি সহীহ্ বুখারীর কিতাবুল ইলমের শারায়ূতে জমা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর এবং তাঁরই নিকট আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
১২-১৩ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যখন তারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে চুপি-চুপি কথা বলতে চাইবে তখন যেন কথা বলার পূর্বে তাঁর পথে সাদকা প্রদান করে, যাতে তাদের অন্তর পবিত্র হয় এবং তোমরা তাঁর নবী (সঃ)-এর সাথে পরামর্শ করার যোগ্য হতে পার। হ্যাঁ, তবে যদি কেউ দরিদ্র হয় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ তা’আলার দয়া ও ক্ষমা রয়েছে। অর্থাৎ তার উপর এ হুকুম প্রযোজ্য নয়। এ হুকুম শুধুমাত্র ধনীদের উপর প্রযোজ্য।

এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তোমরা কি চুপে-চুপে কথা বলার পূর্বে সাদকা প্রদানকে কষ্টকর মনে কর এবং ভয় কর যে, এই নির্দেশ কত দিনের জন্যে রয়েছে? যাক, তোমরা যদি এই সাদকা প্রদানকে কষ্টকর ও অসুবিধাজনক মনে করে থাকো তবে তোমাদেরকে এজন্যে কোন চিন্তা করতে হবে না। আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। এখন আর তোমাদেরকে এ জন্যে সাদকা প্রদান করতে হবে না। এখন তোমরা নামায সুপ্রতিষ্ঠিত কর, যাকাত দিতে থাকো এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য কর।

কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে গোপন পরামর্শ করার পূর্বে সাদকা প্রদান করার গৌরব শুধুমাত্র হযরত আলী (রাঃ)-ই লাভ করেন। তারপর এ হুকুম উঠে যায়। এক দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) সাদকা করে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে চুপি-চুপি কথা বলেন। তিনি তাঁকে দশটি মাসআলা জিজ্ঞেস করেন। অতঃপর এ হুকুম রহিত হয়ে যায়। হযরত আলী (রাঃ) হতেও এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। তিনি বলেনঃ “এই আয়াতের উপর না কেউ আমার পূর্বে আমল করেছে না পরে কেউ আমল করতে পেরেছে। আমার কাছে একটি মাত্র দীনার ছিল। আমি ওটাকে ভাঙ্গিয়ে দশ দিরহাম পাই। এ দিরহাম আমি আল্লাহর নামে কোন একজন মিসকীনকে দান করি। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে তাঁর সাথে চুপে-চুপে কথা বলি। তারপর এ হুকুম উঠে যায়। সুতরাং আমার পূর্বেও কেউ এ আয়াতের উপর আমল করেনি এবং পরেও কেউ আমল করতে পারেনি।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করেন।

হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “সাদকার পরিমাণ কি এক দীনার নির্ধারণ করা উচিত?” হযরত আলী (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “এটা তো খুব বেশী হয়ে যাবে।” তিনি বললেনঃ “তাহলে অর্ধ দীনার?” তিনি জবাব দেনঃ “প্রত্যেকের এটাও আদায় করার ক্ষমতা নেই।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “আচ্ছা, তাহলে কত নির্ধারণ করতে হবে তুমিই বল?” তিনি বললেনঃ “এক যব বরাবর সোনা নির্ধারণ করা হোক।” তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) খুশী হয়ে বললেনঃ “বাঃ বাঃ! তুমি তো একজন সাধক ব্যক্তি।” হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “সুতরাং আমারই কারণে আল্লাহ্ তা’আলা এই উম্মতের উপর (কাজ) সহজ ও হালকা করে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। জামে তিরমিযীতেও এটা বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, মুসলমানরা বরাবরই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে চুপি-চুপি কথা বলার পূর্বে সাদকা করতো। কিন্তু যাকাত ফরয হওয়ার পর এ হুকুম উঠে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে খুব বেশী বেশী প্রশ্ন করতে শুরু করেন, ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর উপর তা কঠিন বোধ হয়। তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা পুনরায় এ হুকুম জারী করেন। ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর উপর হালকা হয়ে যায়। কেননা, এরপর জনগণ প্রশ্ন করা ছেড়ে দেয়। অতঃপর পুনরায় আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদের উপর প্রশস্ততা আনয়ন করেন এবং এ হুকুম রহিত করে দেন। হযরত ইকরামা (রাঃ) ও হযরত হাসান বসরীরও (রঃ) উক্তি এটাই যে, এ হুকুম রহিত হয়ে যায়। হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) ও হযরত মুকাতিলও (রঃ) এ কথাই বলেন। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, শুধু দিনের কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত এ হুকুম বাকী থাকে। হযরত আলীও (রাঃ) এ কথাই বলেন যে, এই হুকুমের উপর শুধু আমিই আমল করতে সক্ষম হই এবং এ হুকুম নাযিল হওয়ার পর খুব অল্প সময়ের জন্যেই এটা বাকী থাকে, অতঃপর এটা মানসূখ হয়ে যায়।
১৪-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ্ তা’আলা মুনাফিকদের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা অন্তরে ইয়াহুদীদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে, কিন্তু প্রকৃত তারা এ ইয়াহদীদেরও দলভুক্ত নয় এবং মুমিনদেরও দলভুক্ত নয়। তারা এদিকেরও নয়, ওদিকেরও নয়। তারা প্রকাশ্যভাবে মিথ্যা শপথ করে থাকে। মুমিনদের কাছে এসে তারা তাদের পক্ষেই কথা বলে। রাসূল (সঃ)-এর কাছে এসে কসম খেয়ে তারা নিজেদেরকে ঈমানদার হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে এবং বলে যে, তারা নিশ্চিতরূপে মুসলমান। অথচ অন্তরে তারা সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করে। তারা যে মিথ্যাবাদী এটা জেনে শুনেও মিথ্যা শপথ করতে মোটেই দ্বিধা বোধ করে না। তাদের এই দুস্কার্যের কারণে আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি। এই প্রতারণার জন্যে তাদেরকে মন্দ প্রতিদান দেয়া হবে। তারা তো তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং মানুষকে তারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে। মুখে তারা ঈমান প্রকাশ করে এবং অন্তরে কুফরী গোপন রাখে। কসমের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভিতরের দুস্কৃতিকে গোপন করে। অভিজ্ঞ লোকদের উপর তারা কসমের দ্বারা নিজেদেরকে সত্যবাদী রূপে পেশ করে এবং তাদেরকে তাদের প্রশংসাকারী বানিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে তারা তাদেরকে নিজেদের রঙে রঞ্জিত করে এবং এই ভাবে তাদেরকে আল্লাহর পথ হতে ফিরিয়ে রাখে। মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেন যে, এই মুনাফিকদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহর শাস্তির মুকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কোনই কাজে আসবে না, তারা জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে, কখনই তাদেরকে সেখান হতে বের করা হবে না।

কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তাদের সকলকেই এক ময়দানে একত্রিত করবেন, কাউকেও বাদ রাখবেন না তখন দুনিয়ায় যেমন তাদের অভ্যাস ছিল যে, নিজেদের মিথ্যা কথাকে তারা শপথ করে সত্যরূপে দেখাতো, অনুরূপভাবে ঐ দিনও তারা আল্লাহর সামনে নিজেদের হিদায়াত ও সঠিক পথের অনুসারী হওয়ার উপর বড় বড় কসম খাবে এবং মনে করবে যে, সেখানেও বুঝি তাদের চালাকী ধরা পড়বে না। কিন্তু মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর কাছে কি তাদের এই ফাকিবাজি ধরা না পড়ে থাকতে পারে? তিনি তো তাদের মিথ্যাবাদী হওয়ার কথা এ দুনিয়াতেও মুমিনদের নিকট বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ সাবধান! তারাই তো মিথ্যাবাদী।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (একদা) নবী (সঃ) তাঁর কোন এক কক্ষের ছায়ায় বসেছিলেন এবং কিছু সাহাবায়ে কিরামও (রাঃ) তাঁর নিকট ছিলেন। ছায়াযুক্ত স্থান কম ছিল। কষ্ট করে তারা সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সাহাবীদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “দেখো, এখানে এখনই এমন একজন লোক আসবে যে শয়তানী দৃষ্টিতে তাকাবে। সে আসলে তোমরা কেউই তার সাথে কথা বলবে না।” অল্পক্ষণের মধ্যেই একজন কয়বা চক্ষু বিশিষ্ট লোক আসলো। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেনঃ “তুমি এবং অমুক অমুক লোক আমাকে গালি দাও কেন?” একথা শুনেই লোকটি চলে গেল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যে কয়েকজনের নাম করেছিলেন তাদের সবাইকে সে ডেকে নিয়ে আসলো এবং সবাই শপথ করে করে বললো যে, তাদের কেউই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বেয়াদবী মূলক কথা বলেনি। তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ করলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তারা (আল্লাহর নিকট) সেই রূপ শপথ করবে যেই রূপ শপথ তোমাদের নিকট করে এবং তারা মনে করে যে, তাতে তারা উপকৃত হবে। সাবধান! তারাই তো মিথ্যাবাদী।” এই একই অবস্থা, আল্লাহর দরবারে মুশরিকদেরও হবে যে, তারা বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর শপথ! আমরা মুশরিক ছিলাম না।” (৬:২৩)

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেছে এবং তাদের অন্তরকে নিজের মুষ্টির মধ্যে নিয়ে ফেলেছে, ফলে তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে।

হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যে গ্রামে বা জঙ্গলে তিনজন রয়েছে এবং তাদের মধ্যে নামায প্রতিষ্ঠিত করা হয় না, তাদের উপর শয়তান প্রভুত্ব বিস্তার করে ফেলে। সুতরাং তুমি জামাআতকে অপরিহার্য রূপে ধরে নাও। বাঘ ঐ বকরীকে খেয়ে ফেলে যে দল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সায়েব (রঃ) বলেন যে, এখানে জামাআত দ্বারা নামাযের জামাআতকে বুঝানো হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ “তারা শয়তানেরই দল’ অর্থাৎ যাদের উপর শয়তান প্রভুত্ব বিস্তার করেছে এবং এর ফলে তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে।

এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ ‘সাবধান! শয়তানের দল অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।

২০-২২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, যারা সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হিদায়াত হতে দূরে সরে পড়েছে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং শরীয়তের বিধানসমূহের আনুগত্য হতে পৃথক হয়ে গেছে তারা হবে চরম লাঞ্ছিত। তারা আল্লাহ্ তা’আলার রহমত হতে ও তার করুণাপূর্ণ দৃষ্টি হতে হবে বঞ্চিত। তারা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আল্লাহ্ তা’আলা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, তিনি এবং তাঁর রাসূল (সঃ) অবশ্যই বিজয়ী হবেন। নিশ্চয়ই তিনি মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আমার রাসূলদেরকে ও মুমিনদেরকে সাহায্য করবে পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণদণ্ডায়মান হবে। যেদিন যালিমদের ওযর-আপত্তি কোন কাজে আসবে না, তাদের জন্যে রয়েছে লা’নত এবং তাদের জন্যে রয়েছে। নিকৃষ্ট আবাস।” (৪০:৫১-৫২) আর এখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “আল্লাহ্ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন- আমি এবং আমার রাসূল অবশ্যই বিজয়ী হবো। আল্লাহ্ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” অর্থাৎ ঐ শক্তিমান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, তিনি তাঁর শত্রুদের উপর জয়যুক্ত থাকবেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত অটল যে, ইহজগতে ও পরজগতে পরিণাম হিসেবে বিজয় ও সাহায্যলাভ মুমিনদের অংশ।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়কে, যারা ভালবাসে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচারীদেরকে হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোত্র। অর্থাৎ তারা কখনো এই বিরুদ্ধাচারীদেরকে ভালবাসবে না। যদিও তারা তাদের নিকটতম আত্মীয় হয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “মুমিনরা যেন মুমিনদের ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট হতে আত্মরক্ষার জন্যে সতর্কতা অবলম্বন কর।” (৩:২৮) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “বল- তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যার মন্দা পড়ার তোমরা আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ্ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।” (৯:২৪)

হযরত সাঈদ ইবনে আবদিল আযীম (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, (আরবী) এ আয়াতটি হযরত আবু উবাইদাহ্ আমির ইবনে আবদিল্লাহ্ ইবনুল জাররাহ্ (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যখন তিনি তাঁর (কাফির) পিতাকে বদরের যুদ্ধে হত্যা করেন। হযরত উমার (রাঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বক্ষণে যখন খিলাফতের জন্যে একটি দলকে নির্ধারণ করেন যে, তাঁরা মিলিতভাবে যাকে ইচ্ছা খলীফা নির্বাচন করবেন, ঐ সময় তিনি হযরত আবু উবাইদাহ্ সম্পর্কে বলেছিলেনঃ “যদি আজ তিনি বেঁচে থাকতেন তবে তাঁকেই আমি খলীফা বানাতাম।” একথাও বলা হয়েছে যে, এক একজনের মধ্যে পৃথক পৃথক গুণ ছিল। যেমন হযরত আবু উবাইদাহ্ (রাঃ) স্বীয় পিতাকে হত্যা করেছিলেন, হযরত আবূ বকর (রাঃ) স্বীয় পুত্র আব্দুর রহমানকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিলেন, হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের (রাঃ) তাঁর ভ্রাতা উবায়েদ ইবনে উমায়েরকে হত্যা করেছিলেন এবং হযরত উমার (রাঃ), হযরত হামযাহ (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত উবাইদাহ্ ইবনে হারিস (রাঃ) নিজেদের নিকতম আত্মীয় উবাহ্, শায়বাহ্ এবং ওয়ালীদ ইবনে উত্বহূকে হত্যা করেছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এতে এঘটনাটি অন্তর্ভুক্ত যে, যখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বদরী বন্দীদের সম্পর্কে মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করেন তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ গ্রহণ করা হোক যাতে মুসলমানদের অর্থিক সংকট দূর হয়ে যায় এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে যুদ্ধাস্ত্রমমূহ সংগৃহীত হতে পারে। আর এর বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে, হয়তো আল্লাহ্ তা’আলা তাদের অন্তর ইসলামের দিকে ফিরিয়ে দিবেন। তাছাড়া তারা তো আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন বটে। কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) এর সম্পূর্ণ বিপরীত মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যে মুসলমানের যে আত্মীয় মুশরিক তাকে তারই হাতে সমর্পণ করে দিন এবং তাকে নির্দেশ দিন যে, সে যেন তাকে হত্যা করে। আমরা আল্লাহ্ তা’আলাকে দেখাতে চাই যে, আমাদের অন্তরে মুশরিকদের প্রতি কোনই। ভালবাসা নেই। আমার হাতে আমার অমুক আত্মীয়কে সমর্পণ করুন।

হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে আকীলকে সঁপে দিন এবং অমুক সাহাবীর হাতে অমুক কাফিরকে সমর্পণ করুন!” এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ যারা নিজেদের অন্তর আল্লাহর শত্রুদের ভালবাসা হতে শূন্য করে এবং নিজেদের মুশরিক আত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা পরিত্যাগ করে তারা হলো পূর্ণ ঈমানদার। তাদের অন্তরে ঈমানের মূল গেড়ে বসেছে। তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা শক্তিশালী করেছেন নিজের পক্ষ হতে রূহ দ্বারা। তাদের দৃষ্টিতে তিনি ঈমানকে সৌন্দর্যময় করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তারা আল্লাহর জন্যে তাদের মুশরিক আত্মীয়দের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল বলে এর বিনিময়ে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাদের প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন এবং তাদেরকে এতো বেশী করে দিয়েছেন যে, তারাও তাঁর প্রতি প্রসন্ন হয়েছে। তারাই আল্লাহর দল এবং আল্লাহর দলই হবে সফলকাম। এ দলটি শয়তানী দলটির সম্পূর্ণ বিপরীত।

হযরত আবু হাযিম আ’রাজ (রঃ) হযরত যুহরী (রঃ)-এর নিকট লিখেনঃ “জেনে রাখুন যে, মাহাত্ম দুই প্রকার। প্রথম হলো ঐ মাহাত্ম্য যা আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাঁর ওলীদের হাতে জারী করে থাকেন, যারা সাধারণ লোকদের চোখে লাগেন না এবং যাদের সাধারণ কোন খ্যাতি থাকে না। যাদের বিশেষণ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ) এরূপে প্রকাশ করেছেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ভালবাসেন ঐ সব লোককে যারা হয় নামধাম শূন্য, আল্লাহভীরু ও সঙ্কৰ্মশীল। যদি তারা অনুপস্থিত থাকে তবে তাদের সম্পর্কে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না এবং উপস্থিত থাকলে তাদের কোন মর্যাদা দেয়া হয় না। তাদের অন্তর হলো হিদায়াতের প্রদীপ, যা প্রত্যেক কালো, অন্ধকার ফিত্না হতে বের হয়ে থাকে। এরাই হলো আল্লাহর ঐ আউলিয়া যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ এরাই আল্লাহর দল। জেনে রেখো যে, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হরত হাসান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) দুআ করতেনঃ “হে আল্লাহ! কোন ফাসেক ও ফাজেরের কোন নিয়ামত ও অনুগ্রহ আমার উপর রাখবেন না। কেননা, আমি আমার উপর আপনার নাযিলকৃত অহীতে পাঠ করেছিঃ তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় যারা ভালবাসে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধাচারীদেরকে।” (এটা হযরত নাঈম ইবনে হাম্মাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সুফইয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, পূর্বযুগীয় গুরুজনদের মতে এ আয়াতটি ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা বাদশাহদের সাথে মেলামেশা করে। (এটা আবু আহমাদ আসকারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)।

Leave a Reply