Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৫৭) [*‌‌ ইয়াহূদীদের কর্তৃক নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের:- *মুসলিম নিধনে ইয়াহূদীদের এরূপ চক্রান্ত এখনো বিদ্যামান:- **বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান :- **সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি :- *  *আনসার ও মােহাজেরদের আত্মত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন :-] www.motaher21.net সূরা:৫৯: আল-হাশর। পারা:২৮ ১- ১০ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:- ২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:- ৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৭)
[*‌‌ ইয়াহূদীদের কর্তৃক নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের:-
*মুসলিম নিধনে ইয়াহূদীদের এরূপ চক্রান্ত এখনো বিদ্যামান:-
**বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান :-
**সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি :-
*  *আনসার ও মােহাজেরদের আত্মত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৯: আল-হাশর।
পারা:২৮
১- ১০ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সূরা:৫৯: আল-হাশর:-১
سَبَّحَ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۱﴾
আল্লাহরই তাসবীহ করছে আসমান ও যমীনের প্রতিটি জিনিস। তিনিই মহাবিজ্ঞ এবং মহাজ্ঞানী।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-২
ہُوَ الَّذِیۡۤ اَخۡرَجَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ اَہۡلِ الۡکِتٰبِ مِنۡ دِیَارِہِمۡ لِاَوَّلِ الۡحَشۡرِ ؕؔ مَا ظَنَنۡتُمۡ اَنۡ یَّخۡرُجُوۡا وَ ظَنُّوۡۤا اَنَّہُمۡ مَّانِعَتُہُمۡ حُصُوۡنُہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ فَاَتٰىہُمُ اللّٰہُ مِنۡ حَیۡثُ لَمۡ یَحۡتَسِبُوۡا ٭ وَ قَذَفَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الرُّعۡبَ یُخۡرِبُوۡنَ بُیُوۡتَہُمۡ بِاَیۡدِیۡہِمۡ وَ اَیۡدِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ٭ فَاعۡتَبِرُوۡا یٰۤاُولِی الۡاَبۡصَارِ ﴿۲﴾
তিনিই আহলে কিতাব কাফেরদেরকে প্রথম আক্রমণেই তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে দিয়েছেন। তোমরা কখনো ধারণাও কর নাই যে, তারা বের হয়ে যাবে। তারাও মনে করে বসেছিলো যে, তাদের দুর্গসমূহ তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ‌ এমন এক দিক থেকে তাদের ওপর চড়াও হয়েছেন, যে দিকের ধারণাও তারা করতে পারেনি। তিনি তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফল হয়েছে এই যে, তারা নিজ হাতেও নিজেদের ঘর-বাড়ী ধ্বংস করছিলো এবং মু’মিনদের হাত দিয়েও ধ্বংস করেছিলো।অতএব, হে দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা, শিক্ষাগ্রহণ করো।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৩
وَ لَوۡ لَاۤ اَنۡ کَتَبَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمُ الۡجَلَآءَ لَعَذَّبَہُمۡ فِی الدُّنۡیَا ؕ وَ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابُ النَّارِ ﴿۳﴾
আল্লাহ যদি তাদের জন্য দেশান্তর হওয়া নির্দিষ্ট না করতেন তাহলে তিনি দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন। আর আখেরাতে তো তাদের জন্য দোজখের শাস্তি রয়েছেই।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৪
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ شَآقُّوا اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ ۚ وَ مَنۡ یُّشَآقِّ اللّٰہَ فَاِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ﴿۴﴾
এ হওয়ার কারণ হলো, তারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের চরম বিরোধিত করেছে। যে ব্যক্তিই আল্লাহর বিরোধিতা করে, তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ‌ অত্যন্ত কঠোর।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৫
مَا قَطَعۡتُمۡ مِّنۡ لِّیۡنَۃٍ اَوۡ تَرَکۡتُمُوۡہَا قَآئِمَۃً عَلٰۤی اُصُوۡلِہَا فَبِاِذۡنِ اللّٰہِ وَ لِیُخۡزِیَ الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿۵﴾
খেজুরের যেসব গাছ তোমরা কেটেছো কিংবা যেসব গাছকে তার মূলের ওপর আগের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো তা সবই ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে। (আল্লাহ এ অনুমতি দিয়েছিলেন এ জন্য) যাতে তিনি ফাসেকদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৬
وَ مَاۤ اَفَآءَ اللّٰہُ عَلٰی رَسُوۡلِہٖ مِنۡہُمۡ فَمَاۤ اَوۡجَفۡتُمۡ عَلَیۡہِ مِنۡ خَیۡلٍ وَّ لَا رِکَابٍ وَّ لٰکِنَّ اللّٰہَ یُسَلِّطُ رُسُلَہٗ عَلٰی مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۶﴾
আল্লাহ তাদের (ইয়াহুদীদের) নিকট হতে (বিনা যুদ্ধে) যে সম্পদ তাঁর রসূলকে দিয়েছেন, তার জন্য তোমরা ঘোড়া ছুটাওনি এবং উটও নয়। কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা তাঁর রসূলদেরকে কর্তৃত্ব দান করেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৭
مَاۤ اَفَآءَ اللّٰہُ عَلٰی رَسُوۡلِہٖ مِنۡ اَہۡلِ الۡقُرٰی فَلِلّٰہِ وَ لِلرَّسُوۡلِ وَ لِذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ۙ کَیۡ لَا یَکُوۡنَ دُوۡلَۃًۢ بَیۡنَ الۡاَغۡنِیَآءِ مِنۡکُمۡ ؕ وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ ٭ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ۘ﴿۷﴾
আল্লাহ এই জনপদবাসীদের নিকট হতে তাঁর রসূলকে (বিনা যুদ্ধে) যে সম্পদ দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, (তাঁর) আত্মীয়গণের এবং ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের জন্য, যাতে তোমাদের মধ্যে যারা ধনবান শুধু তাদের মধ্যেই ধন-মাল আবর্তন না করে। আর রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৮
لِلۡفُقَرَآءِ الۡمُہٰجِرِیۡنَ الَّذِیۡنَ اُخۡرِجُوۡا مِنۡ دِیَارِہِمۡ وَ اَمۡوَالِہِمۡ یَبۡتَغُوۡنَ فَضۡلًا مِّنَ اللّٰہِ وَ رِضۡوَانًا وَّ یَنۡصُرُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الصّٰدِقُوۡنَ ۚ﴿۸﴾
(তাছাড়াও এ সম্পদ) সেই সব গরীব মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘর-বাড়ী ও বিষয়-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। এসব লোক চায় আল্লাহর মেহেরবানী এবং সন্তুষ্টি। আর প্রস্তুত থাকে আল্লাহ‌ ও তার রসূলকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। এরাই হলো সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ লোক।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-৯
وَ الَّذِیۡنَ تَبَوَّؤُ الدَّارَ وَ الۡاِیۡمَانَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ یُحِبُّوۡنَ مَنۡ ہَاجَرَ اِلَیۡہِمۡ وَ لَا یَجِدُوۡنَ فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ حَاجَۃً مِّمَّاۤ اُوۡتُوۡا وَ یُؤۡثِرُوۡنَ عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِہِمۡ خَصَاصَۃٌ ؕ۟ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ۚ﴿۹﴾
(আবার তা সেই সব লোকের জন্যও) যারা এসব মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান এনে দারুল হিজরাতে বসবাস করছিলো। তারা ভালবাসে সেই সব লোকদের যারা হিজরত করে তাদের কাছে এসেছে। যা কিছুই তাদের দেয়া হোক না কেন এরা নিজেদের মনে তার কোন প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করে না এবং যত অভাবগ্রস্তই হোক না কেন নিজেদের চেয়ে অন্যদের অগ্রাধিকার দান করে। মূলত যেসব লোককে তার মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম।
সূরা:৫৯: আল-হাশর:-১০
وَ الَّذِیۡنَ جَآءُوۡ مِنۡۢ بَعۡدِہِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَا اغۡفِرۡ لَنَا وَ لِاِخۡوَانِنَا الَّذِیۡنَ سَبَقُوۡنَا بِالۡاِیۡمَانِ وَ لَا تَجۡعَلۡ فِیۡ قُلُوۡبِنَا غِلًّا لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا رَبَّنَاۤ اِنَّکَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿٪۱۰﴾
আর যারা তাদের পরে এসেছে , তারা বলে, ‘হে আমাদের রব ! আমাদেরকে ও ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’

১- ১০ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটি নাযিল হয়েছিলাে ৪র্থ হিজরীতে বনু নাযিরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বনু নযীর ছিলাে একটা ইহুদী গােত্র। বনু নযীরের ঘটনাটা কেন কিভাবে ঘটলাে এবং এরপর মুসলমানরা তাদের মােকাবেলায় কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলো এ সূরায় তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোরআনের বর্ণনাভংগিতেই এ বিষয়গুলাের বিবরণ দেয়া হয়েছে। অতপর ঘটনাবলী ও তার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের গৃহীত ব্যবস্থাবলীর ওপর কোরআনের সেই নির্দিষ্ট ভংগিতে বিস্তারিত পর্যালােচনাও পেশ করা হয়েছে। ঘটনা ও ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট দিকনির্দেশনাগুলাে সুন্দর পর্যালােচনার মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের সেই দলটিকে কোরআন এভাবে প্রাণবন্ত প্রশিক্ষণ দিতাে। সূরার মূল আয়াতগুলাের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আমরা সেই ঘটনার কিছু ঐতিহাসিক বিবরণ তুলে ধরবাে, যার প্রসংগে এ সূরাটি নাযিল হয়েছে। এভাবে আমরা এখানে কোরআনের উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবো। দেখতে পাবাে, যে ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে এটা নাযিল হয়েছে তার অন্তরালে কী সুদূরপ্রসারী কার্যকারণ সক্রিয় ছিলাে। এভাবে ঘটনাবলীর তাৎপর্যের চেয়েও ব্যাপকতর ও প্রশস্ততর পরিমন্ডলে তার বিস্তৃতি কতাে দূর তা নিয়ে কোরআনের আলােচনার বিশিষ্ট ধরন ও রীতি আমরা হৃদয়ংগম করতে পারবে। বনু নযীরের ঘটনাটা চতুর্থ হিজরী সনে ওহুদ যুদ্ধের পরে ও খন্দক যুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত হয়। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, একদিন রসূল(স.) হযরত আবু বকর, ওমর ও আলী(রা.)-সহ দশ জন শীর্ষস্থানীয় সাহাবীকে সাথে নিয়ে বনু নযীরের পল্লীতে গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি তাদের অনুরােধ করেন যে, তার মদীনায় আগমনের সূচনাতে তার সাথে বনু নযীরের যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলাে, সে অনুসারে তারা যেন নিহত ব্যক্তিদের দিয়াতে (আর্থিক ক্ষতিপূরণ) অংশগ্রহণ করে। বনু নযীর রাসুল(স.)-এর আগমনকে বাহ্যত স্বাগত জানায় এবং তাদের ওপর যে দায়দায়িত্ব বর্তে তা পালনের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু এর পাশাপাশি তারা গােপনে রসূল(স.) ও তাঁর সাথীদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটে। তিনি যখন তাদের একজনের বাড়ীর প্রাচীরের পাশে বসে ছিলেন, তখন তারা পরস্পরকে বলে, এই ব্যক্তিকে তােমরা এমন সুবিধাজনক অবস্থায় আর কখনাে পাবে না। তােমাদের মধ্যে কেউ এই প্রাচীর সন্নিহিত বাড়ীটির হাড়ের ওপর ওঠে গিয়ে ওর ওপর বড়ো এক পাথর ছুঁড়ে মারুক এবং আমাদের তার কবল থেকে রেহাই দিক। আমর বিন জাহশ এই দায়িত্ব গ্রহণ করলাে এবং বললাে, হাঁ, এ কাজটা আমি করবাে। তারপর সে ছাদের ওপর চড়াও হলাে, যাতে রসূল(স.)-এর ওপর বিশাল একটা পাথর ফেলে দিতে পারে। ইহুদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তৎক্ষণাত রসূল(স.)-কে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হলাে। সংগে সংগে তিনি একটা জরুরী কাজ সেরে আসার ভান করে স্থান ত্যাগ করলেন। তিনি তার সাথীদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন। এদিকে তার ফিরতে অনেক দেরী হচ্ছে বলে সাথীরাও তাঁর সন্ধানে ইহুদী পল্লী থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরে তারা জানতে পারলাে যে, রসূল(স.) মদীনায় প্রবেশ করেছেন। বনী নযিরের বিশ্বাসঘাতকতা ও মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভংগের বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর রসূল(স.) বনু নযীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। ইতিপূর্বে বনু নযীরের নেতা কাব ইবনে আশরাফ রাসূল(স.)-কে নিন্দা করে এবং তাকে হত্যা করার জন্যে তার শত্রুদের উস্কানি দিয়ে কবিতা লিখেছিলাে। তাছাড়া একথাও লােক মুখে প্রচারিত হয়েছিলো যে, রাসূল(স.)-এর সাথে বনু নযীর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযােগিতার চুক্তি থাকা সত্তেও বনু নযীরের লােকেরা দলে দলে গিয়ে কুরাইশ কাফেরদের সাথে যােগাযােগ ও সলাপরামর্শ করছে। রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ও গাঁটছড়া বাঁধাই ছিলাে এই যােগাযােগের উদ্দেশ্য। এসব কারণে রসূল(স.) মােহাম্মদ বিন মাসলামাকে অনুমতি দিলেন কা’ব ইবনে আশরাফকে হত্যা করার, অনুমতি পেয়ে মুহাম্মদ বিন মাসলামা তাকে হত্যা করে ফেললেন। বনু নযীরের মহল্লায় যখন রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালাে, তখন তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা ছাড়া রসূল(স.)-এর আর কোনাে উপায়ান্তর থাকলাে না। কেননা ইসলামের একটা মূলনীতি হলো, ‘কোন দলের পক্ষ থেকে যদি তুমি বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা করাে, তাহলে চুক্তিটা তাদের ওপর একইভাবে ছুঁড়ে মারে।। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বাসঘাতকদের ভালোবাসেন না।'(সূরা তাওবা) রসূল(স.) যথারীতি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বনু নযীরের মহল্লা অবরােধ করলেন। তাদের তিনি তিন দিনের মতান্তরে দশ দিনের চরম পত্র দিলেন যেন এই সময়ের মধ্যে তারা তাদের মহল্লা ছেড়ে চলে যায়। তিনি তাদেরকে তাদের অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে যাওয়া এবং ক্ষেতখামার ও বাগানগুলোর দেখাশুনার জন্যে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে যাওয়ার অনুমতি দিলেন, কিন্তু মােনাফেক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সলুল তাদের কাছে দূত পাঠিয়ে প্ররােচনা দিলো যেন তারা রসূলের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে তাকে প্রতিরােধ করে। সে তাদের আশ্বাস দিলাে যে, তােমরা অবিচল অনড় থাকে। আমরা তোমাদের কখনাে অসহায় ছেড়ে দেবাে না। তােমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলে আমরা তোমাদের পক্ষে লড়বাে, আর তোমাদের বহিষ্কার করা হলে আমরাও তােমাদের সাথে বেরিয়ে যাবাে। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসংগে বলেন, তুমি কি দেখাবে, মুনাফিকরা তাদের আহলে কিতাব কাফের ভাইদের বলে যে, তােমাদের যদি বের করে দেয়া হয় তবে আমরাও তােমাদের সাথে বেরিয়ে যাবে এবং তােমাদের ব্যাপারে আর কারাে হুকুম মানবাে না, আর যদি তােমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় তবে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো। অথচ আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা মিথ্যাবাদী। আহলে কিতাব গােষ্ঠীকে যদি বের করে দেয়া হয়, তবে মুনাফিকরা তাদের সাথে মদীনা থেকে বেরিয়ে যাবে না। আহলে কিতাব গােষ্ঠীকে যদি যুদ্ধ করতে হয় তবে তাদেরকে মােনাফেকরা সাহায্যও করবে না। আর যদি সাহায্য করে তাহলেও আহলে কিতাব গােষ্ঠী পরাভব মেনে নিয়ে পালিয়ে যাবে। এরপর তারা আর কোনো সাহায্য পাবে না। তাদের মনে আল্লাহর চেয়েও তােমাদের ভয় অধিক প্রবল। কেননা তারা একটা নির্বোধ জাতি।’ এরপর ইহুদীরা দুর্গের ভেতরে আশ্রয় নিলাে। ফলে রসূল(স.) তাদের খেজুর বাগান কেটে ফেলতে ও জ্বালিয়ে দিতে মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন। তা দেখে আহলে কিতাব গােষ্ঠী বললাে, হে মােহাম্মদ, আপনি তাে অরাজকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করতেন এবং অরাজকতা সৃষ্টিকারীর নিন্দা করতেন। এখন এই যে খেজুর বাগান কেটে ফেলা হচ্ছে ও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, এটা কেমন ব্যাপার? তাদের এই প্রশ্নের জবাবেই সূরা হাশরের আয়াত নাযিল হলাে, ‘তােমরা যদি কোনাে গাছ কেটে থাকো অথবা তাকে তার মূলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়ে থাকো, তবে সেটা আল্লাহর হুকুমেই করেছো, যাতে তিনি পাপিষ্ঠদের লাঞ্ছিত করতে পারেন। অবরোধ যখন একটানা ছাব্বিশ দিন পর্যন্ত গড়ালাে, তখন ইহুদীরা নিশ্চিত হলাে যে, মােনাফেকদের প্রতিশ্রুতি কার্যকরি হবার কোনাে আশা নেই। এ সময় আল্লাহ তায়ালাও তাদের মনে আতংকের সৃষ্টি করে দিলেন। তাই তারা রসূল(স.)-এর কাছে প্রার্থনা জানালাে যেন তিনি রক্তপাত না করে তাদের বিতাড়িত করেন, যেমন ইতিপূর্বে অপর ইহুদী গােষ্ঠী বনু কায়নুকা’কে করেছেন (এর কারণ ও পটভূমি সূরা আহযাবে বর্ণিত হয়েছে)। তারা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিলাে যে, তাদের উট যে পরিমাণ বইতে পারবে কেবল সেই পরিমাণ মালপত্রই তারা নেবে। কোনাে অন্ত্রশস্ত্র নেবে না। রসূল(স.) তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। তারা উটের বহনযােগ্য পরিমাণ মালপত্র নিয়ে চলে গেলাে। কেউ কেউ দরজার চৌকাঠসহ গােটা ঘর ভেংগে উটের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেলাে। কেউ নিজের ঘর এমনভাবে বিধ্বস্ত করে গেলাে, যাতে মুসলমানরা তা ব্যবহার করতে না পারে। অবরােধ চলাকালে যেসব প্রাচীর আত্মরক্ষার কাজে লাগানাে হয়েছিলাে, তার কোন কোন প্রাচীর মুসলমানরা পরে ভেংগে গুড়িয়ে দেয়। আল্লাহ তায়ালা এ সূরার ২-৪ নং আয়াতে এ প্রসংগটি আলোচনা করেছেন। মদীনা থেকে বহিস্কৃত এই বনু নযীর ইহুদী গােত্রের কেউ সিরিয়ায় কেউ বা খায়বরে চলে যায়। খায়বরে গমনকারীদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি ছিলাে সালাম বিন আবিল হাকীক, কেনানা ইবনুর রবী বিন আবিল হাকীক এবং হুওয়াই বিন আখতাব। পরবর্তীকালে আহযাব যুদ্ধ ও বনু কোরায়যার ঘটনা এবং খায়বরে যুদ্ধ বাধানােতে (সূরা আল-ফাতাহ দ্রষ্টব্য) এসব লােকের ভূমিকা ছিলাে। বনু নযীরের পরিত্যক্ত সম্পত্তি আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের সম্পত্তি হিসেবে নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। মুসলমানদের ঘােড়া বা উট ব্যবহার করে যুদ্ধ করে এগুলাে জয় করতে হয়নি। এগুলাে রসূল(স.) কেবল মােহাজেরদের মধ্যেই বন্টন করেন। আনসারদের মধ্যে দু’জন দরিদ্রতম ব্যক্তি সাহল বিন হানিফ ও আবু দুজানা সাম্মাক বিন খারশাকে ছাড়া আর কাউকে এর অংশ দেয়া হয়নি। কারণ মােহাজেররা মক্কায় তাদের যাবতীয় সহায় সম্পদ ত্যাগ করে চলে এসেছিলাে শুধু ঈমান রক্ষার তাগিদে, আর আনসাররা তাদের ঘরবাড়ী ও জমিজমায় মােহাজের ভাগ দিয়ে নযীরবিহীন ত্যাগ ও আন্তরিক ভ্রাতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এ সুযােগের সদ্ব্যবহার করার পর রাসূল(স.) মুসলিম সমাজে স্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠায় ত্বরিত পদক্ষেপ নিলেন, যাতে দরিদ্র লােকদের হাতে নিজস্ব সম্পত্তি থাকে এবং যাবতীয় ধন সম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে না যায়। আনসারদের মধ্যে কেবল দুজন দরিদ্র ব্যক্তিকেই তিনি এর ভাগ দিয়েছিলেন। বনু নযীরের পরিত্যক্ত সম্পত্তির ভাটবাটোয়ারা নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক তুলেছিলাে। প্রসিদ্ধ মতানুসারে এই লোকটি ছিলাে মুনাফিক। এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা এই সূরায় বলেন, আল্লাহ তায়ালা যে সম্পত্তি তার রসূলকে দিয়েছেন, তা অর্জন করতে তােমরা উট ও ঘােড়া ছুটাওনি, তবে আল্লাহ তার রসূলকে যার ওপর বিজয়ী করতে চান করতে পারেন, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।’ রাসূল(স.) আনসারদের বললেন, তােমরা যদি চাও, তােমাদের সম্পত্তি ও ঘরবাড়ীর একাংশ মােহাজেরদের বণ্টন করে দিতে পারাে, আর এই গনিমতে তােমরা তাদের সাথে অংশীদার হতে পারে। আর যদি চাও তােমাদের সম্পত্তি ও ঘরবাড়ী পুরোপুরি তােমাদেরই থাক এবং গনিমতের কোনাে অংশ তােমাদের মধ্যে বন্টন করা হবে না। আনসাররা বললেন, বরং আমরা আমাদের সম্পত্তি ও ঘরবাড়রি অংশও তাদের দেবো এবং গনিমতেও তাদের অগ্রাধিকার দেবো, তাদের সাথে আমরা শরীক হবো না। এ হচ্ছে সেই ঘটনা যার প্রেক্ষাপটে এ সূরা নাযিল হয়েছে। সমগ্র সূরাই এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত মুসলমানদের সম্বােধন করে সূরার শেষাংশে কিছু বক্তব্য রাখা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার পর্যালােচনা করে প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠনমূলক মন্তব্য করা এবং এ ঘটনাবলীকে তার মৌলিক তত্ত্ব ও নীতিসমূহের সাথে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে কোরআনের যে ঐতিহ্যবাহী রীতি রয়েছে, সূরার শেষভাগের বক্তব্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সূরার একেবারে শেষাংশে মহান আল্লাহর এমন কিছু গুণাবলীর বিবরণ দেয়া হয়েছে, যার কার্যকর প্রভাব এই সৃষ্টিজগতে সর্বক্ষণ বিদ্যমান। এ গুণাবলীর প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করার ওপরই সত্যিকার অন্তর্দৃষ্টি সম্বলিত, বােধগম্য ও বিবেকসম্মত ঈমানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। এ গুণাবলী হচ্ছে সেই আল্লাহর, যিনি এই কোরআন দ্বারা ঈমানদারদের সম্বোধন করেন ও তার দিকে আহবান করেন। সূরার সূচনা ও সমাপ্তি দুটোই ঘটেছে আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসের সর্বময় অধিপতি মহাপরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর তাসবীহ তথা পবিত্রতা ও মহিমা ঘােষণার মধ্য দিয়ে। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সূরার প্রথমাংশ ও শেষাংশ তার আলােচিত বিষয়ের সাথে এবং তাকওয়া, একাগ্রতা, আনুগত্য ও মহাবিজ্ঞানময় আল্লাহর বিশ্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তা গবেষণার আহবানের সাথে পরিপূর্ণভাবে সমন্বয়যুক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এবার আসুন, আমরা কোরআনের আয়াতগুলাের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আত্মনিয়ােগ করি এবং দেখি, কিভাবে কোরআন ঘটনাবলীকে চিত্রিত করে ও এই ঘটনাবলী দ্বারা কিভাবে তা ব্যক্তির মন মানস গঠন করে।

ফী জিলালিল কুরআন:

আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সকলেই আল্লাহর মহিমা ঘােষণা করে। তিনি মহা পরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞানী।’ (আয়াত-১) অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রতিটি জিনিস কর্তৃক আল্লাহর মহিমা ঘােষণা এবং পবিত্রতা ও প্রশংসা করার এই শাশ্বত সত্যটি দিয়েই এ সূরার উদ্বোধন করা হচ্ছে। এ সূরা আল্লাহর বিদ্রোহী ইহুদীদের তাদের ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করার কাহিনী বর্ণনা করেছে। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাদের বিতাড়িত করেছেন এবং আল্লাহ তায়ালা গুণ বর্ণনাকারী ও তাঁর পবিত্র নামসমূহ দ্বারা তার মহিমা ঘোষণাকারী মােমেনদের হাতে তাদের বসতবাড়ীর মালিকানা সমর্পণ করেছেন। ‘তিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী।’ অর্থাৎ তনি নিজের প্রিয় বান্দাদের সাহায্য করা ও শক্রদের ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখেন এবং নিজের যাবতীয় পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় তিনি বিজ্ঞানময়, প্রাজ্ঞ।

ফী জিলালিল কুরআন:

*ইহুদীদের দেশ থেকে বহিষ্কারের দৃষ্টান্ত : পরবর্তী আয়াত থেকেই শুরু হয়েছে সেই ঘটনার বিবরণ। যার প্রেক্ষাপটে এ সূরা নাযিল হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি কাফের আহলে কেতাৰ গােষ্ঠীকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে প্রথমবারেই একেক করে বহিষ্কার করেছেন। তােমরা ধারণাও করােনি যে, তারা বের হবে। তারা বরং ভেবেছিলাে যে, তাদেরকে তাদের দুর্গগুলাে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে, কিন্তু আল্লাহর শাস্তি তাদের ওপর এমনভাবে এসে পড়লাে যে, তারা কল্পনাও করেনি, আর আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন। ‘অতএব, হে চক্ষুম্মান ব্যক্তিরা, তােমরা শিক্ষা গ্রহণ করাে। আর আল্লাহ যদি তাদের জন্যে নির্বাসন দন্ড লিখে না দিতেন, তবে তিনি দুনিয়াতেই কঠোর শাস্তি দিতেন; আর পরকালে তাদের জন্যে আগুনের শাস্তি তাে রয়েছেই। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সুস্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাে। আর যে কেউ আল্লার বিরুদ্ধাচরণ করে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা।'(আয়াত ২-৪) এ আয়াতগুলাে থেকে আমরা জানতে পারি, আহলে কিতাব গােষ্ঠীকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে প্রথম বার একত্রে বহিষ্কার করেছিলেন আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং। যদিও সব কাজ আল্লাহই করে থাকেন, কিন্তু এখানে কথা এমনভাবে বলা হয়েছে যে, বিষয়টিকে প্রত্যক্ষভাবেই আল্লাহর কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ থেকে অনুভূত হয় যে, আল্লাহ তাদের বহিষ্কার করার ক্ষমতা মানুষের কাজের মধ্য দিয়ে প্রয়োগ করার পরিবর্তে সরাসরি নিজেই করেছেন এবং বহিস্কৃতদের এমন ভূখন্ডে নিয়ে গেছেন, যেখানে থেকে তারা আর পূর্ববর্তী নিবাসে ফিরে আসবে না। আয়াতের নিম্নোক্ত অংশ দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছে যে, তাদের বহিষ্কার ও বিতাড়নের কাজটি আল্লাহ তাআলা প্রত্যক্ষভাবেই করেছিলেন। ‘তােমরা ধারণাও করােনি যে, তারা বের হবে। তারা বরং ভেবেছিলাে, তাদেরকে তাদের দুর্গগুলাে আল্লাহ তায়ালা থেকে রক্ষা করবে।’ অর্থাৎ তােমরাও আশা করতে পারােনি যে, তারা বের হয়ে যাবে, আর তারাও মেনে নিতে পারছিলাে না যে, ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই ঘটবে। কেননা তারা তাদের দুর্গে এতােটাই শক্তিশালী ও নিরাপদ ছিলাে যে, তােমরা তাদের বহিষ্কার করতে পারবে, সে আশা অবশ্যই করতে পারােনি, আর এই নিরাপদ অবস্থান তাদের এতােটা গর্বিত করেছিলাে যে, তারা আল্লাহর দোর্দণ্ড শক্তিকে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাে। আল্লাহর সে শক্তিকে কোনাে দুর্গই যে হার মানাতে পারে না, তা তাদের মনেই ছিলাে না। ‘কিন্তু আল্লাহর শাস্তি তাদের ওপর এমনভাবে এসে পড়লাে যে, তারা কল্পনাও করতে পারেনি, আর আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন।’ অর্থাৎ শাস্তিটা দুর্গের ভেতর থেকে নয় বরং তাদের মনের ভেতর থেকে এসেছিলাে। আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করলেন। তাই তারা নিজ হতেই তাদের দুর্গ খুলে দিলাে। আল্লাহ তায়ালা তাদের দেখিয়ে দিলেন যে, তাদের নিজেদের ওপরই তারা কোনাে নিয়ন্ত্রণ রাখে না, নিজেদের মনকেই তারা বশে রাখতে পারে না এবং নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মােতাবেক আল্লাহর কাছ থেকেও তারা নিরাপদ থাকতে পারে না। তাদের দুর্গ ও ভবনসমূহের নিরপত্তার তাে প্রশ্নই ওঠে না। তারা সবদিক থেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিয়েছিলো, কিন্তু তাদের নিজেদের ভেতর থেকে কোনাে আক্রমণ আসবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। আল্লাহ তায়ালা যখন কোনাে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা এ রকমই ঘটে। যে দিক মানুষের জানা থাকে ও ক্ষমতার আওতাধীন থাকে, সেদিক থেকেই ঘটনা ঘটে। তিনি তাে সবই জানেন এবং তিনি সর্বশক্তিমান। সুতরাং মানুষের জানা ও তাদের ক্ষমতাধীন হওয়ার জন্যে কোনাে কারণ বা উপলক্ষের প্রয়ােজন হয় না। কারণ সব সময়ই সেখানে উপস্থিত থাকে এবং উপলক্ষ সর্বদাই প্রস্তুত থাকে। কারণ বা ফলাফল সবই আল্লাহর সৃষ্টি। উপলক্ষ এবং পরিণতিও তারই সৃষ্টি। কোর কারণ বা ফলাফলই আল্লাহর নাগালের বাইরে নয় বা সাধ্যাতীত নয়। তিনি মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞানী। আহলে কিতাব কাফেরদের যে গােষ্ঠীটি তাদের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলাে, তাদের কাছে আল্লাহর শাস্তি এমনভাবে এসেছিলাে যে, তারা ভাবতেও পারেনি। আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। তারা তাদের দুর্গে ও ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলাে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজেদের ও মােমেনদের হাত দিয়ে সেসব দুর্গ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এখানেই ইহুদী বনু নযীর গােত্রের ঘটনার সমাপ্তি ঘটে। তাদের দুর্গ তাদের নিজেদের কর্মকান্ডের কারণেই ধ্বংস হয়, তারপর তা তাদের নিজ নিজ হাতে ও মুসলমানদের হাতে বিধ্বস্ত হয়। এখানে ঘটনাটির ওপর সর্বপ্রথম এই বলে মন্তব্য করা হয়, অতএব ‘হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা, তােমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ মন্তব্যটি নিসন্দেহে উপযুক্ত সময়ে ও উপযুক্ত স্থানে করা হয়েছে, বিশেষ করে যখন শ্রোতাদের মন যথার্থই শিক্ষা গ্রহণের জন্যে তখন প্রস্তুত ছিলাে। পরবর্তী আয়াতে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে পার্থিব শাস্তি থেকে রেহাই দেয়ার ইচ্ছা পােষণ করেননি; বরং এ শাস্তি না দিলেও তাদের অন্য কোনাে পার্থিব শাস্তি তিনি অবশ্যই দিতেন, উপরস্থ আখিরাতের শাস্তি তাে রয়েছেই। ’আল্লাহ তায়ালা যদি তাদের জন্যে নির্বাসন স্থির না করতেন, তাহলেও তাদের দুনিয়ায় শাস্তি দিতেন, উপরন্তু তাদের জন্যে আখেরাতে রয়েছে দোযখের শাস্তি।’ অর্থাৎ দুনিয়াতে তাদের জন্যে শাস্তি অবধারিত ছিলাে। যেভাবে হয়েছে সেভাবে হােক অথবা অন্যভাবে হােক। আল্লাহ তায়ালা যদি তাদের নির্বাসনের শাস্তি না দিতেন, তবে তিনি তাদের অন্য কোনাে শাস্তি দিতেন, আর আখিরাতের দোযখের শাস্তি তো পৃথকভাবে নির্দিষ্ট রয়েছেই। মােটকথা, যে কোনাে ভাবেই হােক, পার্থিব শাস্তি তাদের জন্যে অনিবার্য ও অবধারিত ছিলাে। এ শাস্তির কারণ এই যে, তারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাে, আর যে কেউ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা। আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করার অর্থই হলাে আল্লাহর পথ ছেড়ে অন্য পথে চলা। আর আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ তায়ালা তাদের আযাবের যােগ্য হওয়ার এই কারণ জানিয়েছেন যে, আল্লাহর রসূলের পথই আল্লাহর পথ এবং সেই পথ ত্যাগ করাই তাদের আযাবের কারণ। এজন্যেই শেষাংশে আল্লাহ তায়ালা শুধু তার বিরুদ্ধাচরণের কথা বলেই ক্ষান্ত থেকেছেন। কেননা রসূলের বিরুদ্ধাচরণও এর অন্তর্ভুক্ত। আর যেহেতু আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা হয়ে তারই সামনে তার বিরুদ্ধাচরণ করা জঘন্য ধরনের ধৃষ্টতার নামান্তর, তাই এটা একটা বিপজ্জনক ও ভয়ংকর কাজ। যে নগণ্য তুচ্ছ সৃষ্টি মহান স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণের ধৃষ্টতা দেখায়, সে যে আল্লাহর আযাব ও গযবের শিকার হবে তা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। এভাবে সর্বযুগের ও সকল জায়গার আল্লাহদ্রোহীদের ভয়ংকর পরিণতির বিষয়টি ইহুদী গােত্র বনু নযীরের অপরাধ ও তার শাস্তির বিবরণের মধ্য দিয়ে অন্তরে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ ইহুদী গােত্র বনু নযীরকে চার বার কাফের আহলে কিতাব নামে আখ্যায়িত করেছেন। এটা একটা সত্য ঘটনাও বটে। কেননা আল্লাহর দ্বীন যখন মােহাম্মদ(স.)-এর মাধ্যমে পূর্ণাংগ ও সর্বশ্রেষ্ঠ অবয়বে উপস্থাপিত হয়েছে, তখন তারা এটা প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ তারা এর প্রত্যাশা ও প্রতীক্ষায় ছিলাে। তাই তাদের বার বার কাফের আহলে কিতাব নামে আখ্যায়িত করে তাদেরকে অপমানিত ও ধিকৃত করা হয়েছে। সেই সাথে মুসলমানরা ইহুদীদের সাথে যে কঠোর আচরণ করেছে এবং তাদের হাত দিয়ে তাদের যে শাস্তি দিয়েছে, সে ব্যাপারে মুসলমানদের মনকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, তারা কোনাে অন্যায় করেনি। এ কথাটা স্পষ্ট করে বলে দেয়াই এখানে উদ্দেশ্য।

ফী জিলালিল কুরআন:

পরবর্তী আয়াতে মুসলমানদের আরাে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারী এই ইহুদীদের খেজুর বাগানের কিছু গাছ নষ্ট করে তারা সঠিক কাজই করেছে। আসলে কিছু কিছু মুসলমানদের মনে এ ব্যাপারে সন্দেহ সংশয় ছিলাে, ‘কোনাে খেজুর গাছ যদি তােমরা কেটে থাকো বা বহাল রেখে থাকো, তবে সেটা আল্লাহর হুকুমেই করেছে এবং আল্লাহর অবাধ্য লােকদের লাঞ্ছিত করাই ছিলাে তার উদ্দেশ্য।’ মূলত আয়াতের ‘লীনাতুন’ শব্দটি দ্বারা তৎকালের আরবে সুপরিচিত উত্তম মানের খেজুর গাছ বুঝানাে হয়েছে। মুসলমানরা ইহুদীদের খেজুর বাগানের কিছু কিছু খেজুর গাছ কেটে ফেলেছিলাে এবং কিছু কিছু তারা বহাল রেখেছিলাে। এতে তাদের কিছু লােকের মনে আপত্তি ও সংশয় দেখা দিয়েছিলাে। কেননা এই ঘটনার আগে পরে যে কোনাে ধরনের জ্বালানি পােড়ানাে ও নাশকতার কাজ মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিলাে। এ জন্যে এই ব্যতিক্রমী কাজটির ব্যাপারে মুসলমানদের মনকে আশ্বস্ত করার জন্যে বিশেষ ধরনের বাচনভংগির প্রয়ােজন ছিলাে। তাই এখানে বলা হয়েছে, কিছু গাছ কাটা ও কিছু গাছ না কাটা দুটোই আল্লাহর হুকুমে ও অনুমতিতে হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এ ঘটনাটা ঘটানাের দায়িত্ব সরাসরি নিজেই গ্রহণ করেছিলেন। তাই এখানে তিনি যা ইচ্ছা করেছেন সেটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। পুরাে ঘটনাটাই আল্লাহর মর্জি অনুসারে সম্পাদিত হয়েছে। এ দ্বারা তিনি পাপিষ্ঠদের অপমানিত করতে চেয়েছেন। গাছ কাটা এজন্যে অপমানজনক যে, তা কাটা দেখে তাদের অন্তরে আক্ষেপ ও দুঃখ জন্মেছে। আর গাছগুলাে কাটা হয়নি, তাও ছেড়ে যেতে হবে ভেবে অন্তর্জালার সৃষ্টি হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা একই। এভাবে মুসলমানদের মনের সন্দেহ সংশয় দূরীভূত হয়েছে এবং তারা এ কথা বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হয়েছে যে, যা কিছু হয়েছে, সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে এবং আল্লাহই তা করেছেন। তিনি যা চান তাই করেন। তারা কেবল আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান : এ ঘটনা ও অনুরূপ অন্যান্য ঘটনার মাঝ দিয়ে মহান আল্লাহ তার রসূলকে যে সম্পত্তির মালিকানা অর্পণ করেছেন, যে সম্পত্তি অর্জন করতে মুসলমানদের কোনাে যুদ্ধ করতে হয়নি, কোনাে আক্রমণ চালাতে হয়নি, অর্থাৎ যেসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্যভাবে কোনাে মানুষ বা অন্য কোনাে সৃষ্টিকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়াও আল্লাহর হাতকে সরাসির সক্রিয় দেখা গেছে, সে বিষয়েই সূরার এই দ্বিতীয় পর্বটির আলােচনা কেন্দ্রীভূত।(আয়াত ৬-১০) এই সম্পত্তি ও অনুরূপ অন্যান্য সম্পত্তি সম্পর্কে আল্লাহর ফয়সালা সম্বলিত এই আয়াতগুলাে একই সাথে তৎকালীন মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা যেমন বর্ণনা করছে, তেমনি সর্বকালের মুসলিম উম্মাহর চিরন্তন স্বভাব ও মেজাজ এবং তার চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলােরও বিবরণ দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা কালগত ব্যবধান সত্তেও পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়, পৃথিবীর সকল অঞ্চলের ও সকল যুগের সকল প্রজন্ম পরস্পরের সাথে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং কখনাে কোনাে প্রজন্ম অপর প্রজন্ম থেকে, কোনাে জাতি অপর জাতি থেকে, কোনাে ব্যক্তি অপর ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। এটা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। ‘আর আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে যে সম্পত্তির মালিকানা অর্পণ করেছেন, তার ওপর তােমরা কোনাে ঘােড়া উট দাবড়াওনি, তবে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলদের যার ওপর ইচ্ছা করেন বিজয়ী করেন। আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’ এ আয়াতটিতে যে ‘আওজাফতুম’ কথাটা রয়েছে, তার মূল হচ্ছে ‘ইজাফ’, এর অর্থ ঘােড়া বা উট ইত্যাদি দ্রুত দাবড়ানাে বা হাঁকানাে, আর ‘রিকাব’ অর্থ উট। আয়াতটি মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, যে সম্পত্তি ইহুদী গােত্র বনু নযীর রেখে গেছে, মুসলমানরা তা ঘোড়া বা উট দাবড়িয়ে অর্থাৎ যুদ্ধ করে জয় করেনি। সুতরাং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গনীমত) থেকে যেভাবে আল্লাহর সাথে মুসলমান যােদ্ধাদের জন্যে চার পঞ্চমাংশ এবং আল্লাহর সাথে তার রসূল, তার আত্মীয়-স্বজন, এতীম, মিসকীন ও পথিকদের জন্যে মাত্র এক পঞ্চমাংশ বরাদ্দ করেছেন, যেমন বদর যুদ্ধের গনীমত তিনি বরাদ্দ করেছেন, এক্ষেত্রে সেভাবে বরাদ্দ করেননি। এ সম্পত্তি সম্পর্কে আল্লাহর বিধান হলাে, এর সমগ্রটাই আল্লাহ তায়ালা, তার রসূল, আত্মীয়-স্বজন, এতীম, মিসকীন ও পথিকদের জন্যে নির্দিষ্ট। রসূল(স.) স্বয়ং এ সম্পত্তি এই খাতগুলাের মধ্যে যেমন ইচ্ছা ব্যয় করার ক্ষমতা ভােগ করেন। এখানে যে আত্মীয়-স্বজনের কথা উল্লেখ রয়েছে, তারা হলাে রসূলের আত্মীয় স্বজন। তাদের জন্যে সদকা হালাল না হয়, অন্যদিকে তারা তার সম্পত্তির কোনাে ভাগও পাচ্ছে না; অথচ তাদের ভেতর কপর্দকহীন দরিদ্ররাও রয়েছে। তাই তাদের জন্যে গনীমতের এক পঞ্চমাংশ থেকে একটা অংশও এই সম্পত্তি (ফায়) থেকে বরাদ্দ করেছেন। এছাড়া অন্যান্য শ্রেণী ও ব্যয়ের খাত সংক্রান্ত বিধান সুবিদিত। রসূল(স.)-ই এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন। (রসূলের আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। শুধু দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনই এ সম্পত্তির অংশ পাওয়ার অধিকারী না সবাই, তা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। যে মতটি অগ্রগণ্য তা হলাে, সব আত্মীয়-স্বজনই অংশ পাওয়ার অধিকারী) এ আয়াতগুলােতে ফায় অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে দখলীকৃত সম্পত্তি সম্পর্কে শরীয়তের বিধান বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু শুধু বিধান ও তার বিশেষ কারণ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং অন্য একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলদের যার ওপর ইচ্ছা বিজয়ী করে দেন।’ অর্থাৎ এই ‘ফায়’ আল্লাহ নির্ধারিত তকদীরের ফায়সালার অন্তর্ভুক্ত, আর নীরা হচ্ছেন এই ফয়সালারই একটা পক্ষ। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের যখন যার ওপর বিজয়ী করতে চান বিজয় দান করেন। কোন মানবীয় চেষ্টা সাধনা, সাহায্য বা যুদ্ধ বিগ্রহের প্রয়ােজন হয় না। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। এ বক্তব্য দ্বারা নবীদের সম্পর্ককে সরাসরি আল্লাহর তাকদীর সংক্রান্ত ফায়সালার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। অদৃষ্টের এ ঘূর্ণায়মান চাকার ভেতরেই তাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, তারা যদিও মানুষ, তথাপি আল্লাহর ফয়সালা বাস্তবায়নে তাদের বিশেষ ভূমিকা নির্দিষ্টি রয়েছে। সে ভূমিকা তারা আল্লাহর ইচ্ছা, অনুমতি ও পরিকল্পনা অনুসারেই পালন করে থাকেন। নিজেদের প্রবৃত্তির খেয়াল খুশি অনুসারে তারা কোনাে কাজ করেন না। নিজেদের ইচ্ছা বা পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা কোনাে কিছু গ্রহণও করেন না। কোনাে কিছু বর্জনও করেন না তারা যখন কোনাে যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশ নেন অথবা শান্তি ও সন্ধি চুক্তি করেন, তা সবই করেন আল্লাহর ফয়সালার কোনাে না কোনাে অংশ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এবং তা এই পৃথিবীতে তাদের তৎপরতা ও আন্দোলনের সাথেই সম্পৃক্ত থাকে। সেসব তৎপরতার নেপথ্য প্রকৃত কার্য সম্পাদনকারী হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং। বস্তুত তিনি সব কিছুর ওপরই ক্ষমতাবান।

ফী জিলালিল কুরআন:

*সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি : আর আল্লাহ তাঁর রসূলকে যে সম্পত্তি দান করেন, তা আল্লাহর রসূলের, তার আত্মীয় স্বজন, এতিম, মিসকীন ও পথিকদের জন্যে। সম্পদ যেন কেবল তােমাদের ধনীদের মধ্যে ঘূর্ণায়মান না থেকে যায়। ‘রসূল তােমাদের যা দেন তা তােমরা গ্রহণ করো, আর যা থেকে তিনি তােমাদের নিষেধ করেন তা থেকে তােমরা বিরত থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করাে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কঠিন শাস্তিদাতা।’ আমি ইতিপূর্বে যে বিধানের কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি, এ আয়াতে সেই বিধানটিই বর্ণনা করা হয়েছে এবং এই বন্টনের যুক্তি আলােচনা করার মাধ্যমে ইসলামী সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক একটা মৌলিক বিধান তুলে ধরা হয়েছে- ‘যেন ধন সম্পদ কেবল তােমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ অনুরূপ ইসলামী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক আইনেরও একটা মৌল বিধান এখানে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে, রসূল তােমাদের যা কিছু দেন তা গ্রহণ করাে, আর যা কিছু নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো। যদিও এ দুটো বিধান এখানে এই ‘ফায়’ এর সম্পত্তি ও তার বণ্টন প্রসংগে এসেছে, কিন্তু এটা এই সুনির্দিষ্ট ঘটনা অতিক্রম করে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও রষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার বিস্তৃত পরিসর পর্যন্ত নিজ ভূমিকা পালন করে। প্রথম মূলনীতিটা অর্থনৈতিক বন্টন ব্যবস্থা সংক্রান্ত। মূলনীতিটাতে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বুনিয়াদী দর্শনের একটা বিরাট অংশ নিহিত রয়েছে। এই দর্শনে ব্যক্তিগত মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তবে তা একটি মৌলিক নীতিমালা দ্বারা সীমিত । সে নীতিমালা হচ্ছে এই যে, সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যে ঘূর্ণায়মান থাকতে পারবে না এবং দরিদ্রদের মধ্যে তার আবর্তন বন্ধ করা চলবে না। যে সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত হয়, সে সমাজ ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিপন্থী এবং তা গােটা সামাজিক বিন্যাসের লক্ষ্যেরও বিপরীত। ইসলামী সমাজের যাবতীয় সংযােগ-সম্পর্ক ও লেনদেন এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যেন তাতে এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, আর সৃষ্টি হলেও যেন তা বহাল না থাকে। ইসলাম তার সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কার্যত এই মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। এজন্যেই সে যাকাত ফরয করেছে এবং নগদ টাকার বার্ষিক শতকরা আড়াই ভাগ তার হার ধার্য করেছে। আর অন্য যাবতীয় আয় থেকে ধার্য করেছে দশ ভাগ অথবা পাঁচ ভাগ। এরই অনুরূপ হার ধার্য করেছে পশু সম্পদেও, আর খনিজ সম্পদেও প্রায় নগদ অর্থের মতাে হারে যাকাত প্রবর্তন করেছে। নিসন্দেহে এ হার বেশ বড়াে। ওদিকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের (গনীমত) চার পঞ্চমাংশ ধার্য করেছে ধনী অথবা গরীব মােজাহেদদের জন্যে, আর ‘ফায়’ অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে লন্ধ সম্পত্তির পুরােটাই দরিদ্রদের জন্যে বরাদ্দ করেছে। জমি লীজ দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম বর্গা চাষ পদ্ধতিকে মনােনীত করেছে। অর্থাৎ ভূমির মালিক ও চাষী উৎপন্ন ফসলের অংশীদার হবে, ধনীনের অতিরিক্ত সম্পদ গরীবদের মধ্যে বন্টন করার অধিকার সরকারকে দেয়া হয়েছে। সরকারী কোষাগার শূন্য হয়ে গেলে ধনীদের সম্পদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে। সম্পদ গােলাজাত করা এবং সুদ হারাম করা হয়েছে। কেননা এ দুটো হচ্ছে সম্পদ ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার নিকৃষ্ট মাধ্যম। মােটকথা, ইসলাম তার গােটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যাতে উল্লেখিত মূলনীতি বাস্তবায়িত হয়। কেননা সে মূলনীতিই (সম্পদ-ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না থাকা) হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানার অন্যান্য শর্তের পাশাপাশি একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থায় মালিকানার স্বীকৃতি থাকলেও তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নয়। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ইসলাম থেকে আসেনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যদি সুদ ও গােলাজাতকরণ ছাড়া চলে, তাহলে তা আল্লাহর নিজস্ব নিয়মে মনােনীত বিশেষ ব্যবস্থা হতে পারে। আসলে ইসলামী ব্যবস্থা নিজস্ব নিয়মে গঠিত হয়েছে, নিজস্ব নিয়মে পথ চলে আজ পর্যন্ত টিকে আছে। এটা সুসমন্বিত ভারসাম্যপূর্ণ নযীরবিহীন এক ব্যবস্থা, এতে অধিকার ও দায় দায়িত্বের সমন্বয় ঘটানাে হয়েছে। যেদিন মহান স্রষ্টা এ ব্যবস্থা রচনা করেছেন, সেদিন থেকেই তা গােটা সৃষ্টির মতােই ভারসাম্যপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে, আর সৃষ্টিজগতের ভারসাম্য ও সমন্বয়ের তাে কোনাে তুলনাই নেই।  *শরীয়তের উৎস : দ্বিতীয় যে মূলনীতিটার উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলাে, শরীয়ত একটি মাত্র উৎস থেকেই গ্রহণ করতে হবে। বলা হয়েছে, ‘রসূল তােমাদের যা দেন তা গ্রহণ করাে, আর যা তিনি নিষেধ করেন তা বর্জন করো।’ এ থেকে ইসলামের সাংবিধানিক মূলনীতিটিও পাওয়া যায়। ইসলামের আইনের গ্রহণযােগ্যতা ও শক্তির উৎস শুধু এই যে, তা রাসূল কর্তৃক প্রদত্ত। চাই কোরআনের মাধ্যমেই হােক অথবা হাদীসের মাধ্যমেই হােক। গােটা মুসলিম উম্মাহ এবং তাদের শাসকরা সবাই মিলেও রসূল যে বিধান দেন তার বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা এবং অধিকার রাখে না। এর বিরুদ্ধাচরণ করে তারা কোনাে আইন প্রণয়ন করলে সে আইনের কোনাে শক্তি ও গ্রহণযােগ্যতা থাকে না। কেননা যে প্রাথমিক উৎস থেকে এ জিনিসটা শক্তি অর্জন করে, সেই উৎসই সে তখন হারিয়ে ফেলে। ইসলামের এ মতবাদ মানবরচিত যাবতীয় মতবাদের পরিপন্থী। মানব রচিত মতবাদে জাতিকে ক্ষমতার উৎস ও সার্বভৌমত্বের মালিক বলা হয়। তাকে তার নিজের জন্যে আইন রচনার ক্ষমতা দেয়া হয়। তার সকল আইন গ্রহণযােগ্য ও সমাজে তা চালু হওয়ার শক্তি সম্পন্ন বলা হয়। পক্ষান্তরে ইসলামে ক্ষমতার উৎস হলাে আল্লাহর সেই বিধান যা রসূল(স.) নিয়ে এসেছেন, আর মুসলিম উম্মাহ শুধু এ বিধানের বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণেরই দায়িত্বসম্পন্ন। তাদের শাসকরা হচ্ছে এ ব্যাপারে তাদেরই প্রতিনিধি। তাদের অধিকার ও ক্ষমতা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আইন রচনায় রসূলের আনীত বিধানের বিরােধিতা করার কোনাে অধিকারই মুসলিম উম্মাহর বা তার শাসকদের নেই। তবে উম্মাহ যদি এমন কোনাে অবস্থা বা সমস্যার সম্মুখীন হয়, যা সম্পর্কে রসূলের আনীত বিধানে কোনাে সুস্পষ্ট উক্তি পাওয়া যায় না, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে এমনভাবে আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে রসূলের দেয়া কোনাে মূলনীতি লংঘিত না হয়, এই মূলনীতির বিরুদ্ধাচরণ করা না হয়। যে কোনাে আইন রচনার মূলনীতি হবে এই যে, যদি সে ব্যাপারে কোরআন বা সুন্নাহর কোনাে সুস্পষ্ট উক্তি থাকে, তাহলে তা অনুসরণ করতে হবে, আর যদি কোনাে সুস্পষ্ট উক্তি না থাকে তবে কোরআন ও সুন্নাহর কোনাে মূলনীতি লংঘিত না হয় এমনভাবে তা রচনা করতে হবে। উম্মাহ ও তার প্রতিনিধিত্বশীল শাসকের ক্ষমতা এ পর্যন্তই সীমিত থাকবে। মানব রচিত কোনাে বিধানের সাথে ইসলামের এ বিধানের কোনাে তুলনা করা যাবে না। এ বিধান দ্বারা মানুষের আইন রচনার প্রক্রিয়াকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের সাথে সমন্বিত করা হয়েছে এবং বিশ্বজগত পরিচালনার জন্যে আল্লাহর রচিত বিধানের সাথে মানব জাতির পরিচালনার জন্য আল্লাহর রচিত বিধানের সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। যাতে মানুষের আইন বিশ্ব প্রকৃতির বিধানের সাথে সংঘর্ষশীল না হয়। কেননা তা হলে মানুষ হয় এখানে অসুখী হবে, নচেত তারা ধ্বংস হবে, অথবা তার সমস্ত চেষ্টা সাধনা বিফলে যাবে। এই মূলনীতি দুটোকে এ আয়াত মােমেনদের অন্তরে তার মূল উৎসের সাথে সংযুক্ত করে দেয়। সেই মূল উৎস হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা । এই সংযােগ সাধনের লক্ষ্যেই তাদের আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হয়- ‘তােমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।’ এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড়াে গ্যারান্টি। এর সাথে কোনাে টালবাহানা চলে না এবং একে এড়িয়ে যাওয়ারও কোনাে উপায় নেই। কেননা মােমেনরা জানে, আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় গােপন তথ্য জানেন, সমস্ত কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি ওয়াকেফহাল, তার কাছেই সকলকে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। মােমেনরা জানে, সম্পদ কেবল ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে আবর্তনশীল ও সীমিত না করে তার আবর্তন সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে অবাধ ও উন্মুক্ত করে দেয়া তাদের দায়িত্ব। রসূল(স.) যা দেন তা সন্তুষ্ট চিত্তে ও পূর্ণ আনুগত্য সহকারে গ্রহণ করা তাদের কর্তব্য এবং তিনি যা কিছু থেকে নিষেধ করেন তা থেকে কোনাে রকম শৈথিল্য ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন ছাড়াই বিরত থাকতে তারা আদিষ্ট। কেননা তাদের সামনে একটা কঠিন হিসাব নিকাশের দিন রয়েছে। বনু নযীরের প্রায় সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তি কেবল মােহাজেরদের মধ্যেই বন্টন করা হয়েছিলাে। মাত্র দু’জন আনসারকে এই বণ্টনের সাথে যুক্ত করা হয়েছিলো। এই নিয়ম শুধু ফায় সম্পত্তির জন্যে নির্দিষ্ট। ‘সম্পদ যেন তােমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তনশীল না থাকে’- এই মূলনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এরূপ করা হয়েছিলাে। নচেত এই বিধানটা যেভাবে প্রযোজ্য তা হচ্ছে, এ ধরনের সম্পত্তি দরিদ্র শ্রেণীর সকলের জন্যেই নির্দিষ্ট থাকবে- মােহাজের হােক, আনসার হােক বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হােক। পরবর্তী আয়াতগুলাে থেকেও এই কথা জানা যায়।

ফী জিলালিল কুরআন:

*আনসার ও মােহাজেরদের আত্মত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন : তবে কোরআন কেবল নীরস ও নিরেট বিধান দিয়েই ক্ষান্ত থাকে না; বরং সে এমন প্রাণােচ্ছল পরিবেশে তার বিধান জারি করে, যেখানে সকল সজীব প্রাণী তার পক্ষে সাড়া দিতে গিয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে। এ জন্যে নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণীকে এর আওতাভুক্ত করে নেয়া হয়েছে এবং এদের গুণবৈশিষ্ট্যগুলাে এতাে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এই তিনটি শ্রেণীর প্রকৃত পরিচয় তা থেকে সহজেই জানা যায়। সেসব দরিদ্র মােহাজেরদের জন্যে, যারা নিজ নিজ ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ লাভ এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে, তারাই হচ্ছে সত্যবাদী।’ এ আয়াতে মােহাজেরদের প্রকৃত বৈশিষ্টগুলাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের এক নিখুঁত নির্ভুল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা নিজ নিজ ঘরবাড়ী ও সহায়-সম্পত্তি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। তাদের আত্মীয়-স্বজনের অত্যাচার ও নির্যাতন সব কিছু ছেড়ে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য তাদের করেছে। ‘আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রভু’ এ কথা বলা ছাড়া তাদের আর কোনাে অপরাধ ছিলাে না। তারা কেবল আল্লাহর অনুগ্রহ ও সম্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ী ও সহায় সম্পত্তি ত্যাগ করে হিজরত করেছিলাে। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষলাভে তাদের আস্থা ছিলাে অটুট। তার আশ্রয় ছাড়া তাদের আর কোনাে আশ্রয় নেই এবং তারা মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিতাড়িত লােক হলেও আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে সাহায্য করবেন বলে সুদৃঢ় সংকল্পে আবদ্ধ হলেন। ‘তারাই সত্যবাদী।’ অর্থাৎ তারা মুখ দিয়ে যে ঈমানের বাণী উচ্চারণ করেছে, নিজেদের কাজ দ্বারা তার সত্যতার প্রমাণ দিয়েছে। তারা যে আল্লাহকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেছে সে ব্যাপারে তারা সত্যবাদী ছিলাে। রসূল(স.)-কে যে তারা অনুসরণ করবে, তার আনুগত্য করবে, সে ব্যাপারেও তারা সত্যবাদী ছিলাে। আল্লাহর সত্য দ্বীনের সাথেও তারা ছিলাে নিষ্ঠাবান। কারণ পৃথিবীতে তারা যে এই দ্বীনের যথার্থ অনুগত ও বাস্তব অনুসারী, সাধারণ মানুষ তার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাে। যারা তাদের পূর্বেই এই আবাসভূমি ও ঈমানকে আবাসস্থল বানিয়েছে, তারা তাদের কাছে হিজরতকারীদের ভালােবাসে এবং তাদের যা দেয়া হয় তার প্রতি কোনাে প্রয়ােজন অনুভব করে না, তারা ক্ষুধার্ত হওয়া সত্তেও অন্যদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। আর যে ব্যক্তিকে প্রবৃত্তির সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে সে আসলেই সফলকাম।’ এ আয়াতে একইভাবে আনসারদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলাে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই শ্রেণীটি এমন অতুলনীয় গুণাবলীতে ভূষিত ছিলাে এবং এতাে উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলো যে, বাস্তব জগতে যদি তাদের অস্তিত্ব না থাকতাে, তাহলে তারা মানুষের মনে কেবল কল্পনার আকারেই ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে এবং কতগুলাে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কল্পচিত্র হিসাবেই মানুষের হৃদয়ে বিরাজ করতাে। ‘যারা তাদের পূর্বেই এই আবাসভূমি ও ঈমানকে আবাসস্থল বানিয়েছিলাে’, অর্থাৎ হিজরতের আবাসভূমি ইয়াসরিব তথা পবিত্র মদীনা, যেখানে মােহাজেরদের আগে থেকেই আনসাররা বসবাস করতাে এবং সেখানে ঈমানকেও তারা তাদের বাসস্থান বানিয়ে ছিয়েছিলো, অর্থাৎ ঈমান যেন তাদের বাড়ীঘরে পরিণত হয়েছিলাে। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। ঈমানের সাথে আনসারদের যে ঘনিষ্ঠ অবস্থান ছিলাে, সেটাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত ঈমানই ছিলাে তাদের ঘরবাড়ী ও বাসস্থান, এখানে তাদের অন্তরাত্মা বাস করতাে ও বিশ্রাম নিতাে, যেমন মানুষ নিজের বাড়ী ঘরে বাস করে ও বিশ্রাম নেয়। ‘তাদের কাছে হিজরতকারীদের তারা ভালােবাসে এবং তাদের যা দেয়া হয় তার প্রতি তারা কোনাে প্রয়ােজন অনুভব করে না।’ মদীনার আনসার কর্তৃক মােহাজেরদের সাদর অভ্যর্থনা জানানাের মতো ঘটনা সমগ্র মানবেতিহাসে সত্যিই নজিরবিহীন। এতো ভক্তি ও সমাদর এতো মুক্তহস্তের বদান্যতা, এমন স্বেচ্ছাপ্রণােদিত অংশগ্রহণ এবং আশ্রয়দান ও দায় বহনে এতে প্রতিযোগিতা ইতিহাসে সত্যিই বিরল। এমনকি এও জানা যায়, কোনাে মােহাজের কোনাে আনসারের বাড়ীতে লটারি ব্যতীত ওঠতে পারেননি। কেননা অভ্যর্থনাকারী ও আশ্রয়দানকারীর সংখ্যা ছিলাে মােহাজেরদের সংখ্যার চেয়ে বেশী। ‘তাদের যা কিছু দেয়া হতাে তার প্রতি তারা প্রয়ােজন অনুভব করতাে না।’ অর্থাৎ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মােহাজেরদের যে অগ্রাধিকার দেয়া হতাে, যেমন ‘ফায়’ সম্পত্তির কথাই ধরা যাক, এসবের ব্যাপারে তাদের মনে লেশমাত্রও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতাে না। অর্থাৎ মােহাজেরদের যেখানে যেটুকু অগ্রাধিকার দেয়া হতাে, সে ব্যাপারে আনসারদের মনে কোনােই সংকীর্ণতা বা আপত্তি থাকতাে না। তাদের মন থাকতাে সম্পূর্ণ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও ভাবলেশমুক্ত। তারা অন্যদের অগ্রাধিকার দেয় যদিও নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে। নিজের প্রয়োজন থাকা সত্তেও অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া সর্বোচ্চ স্তরের এক মহানুভবতা। আনসাররা এই স্তরেই উপনীত হয়েছিলাে, মানবেতিহাসে যার কোনাে নযীর নেই। সকল অবস্থায় ও সকল ক্ষেত্রেই তাদের এই মহত্ত্ব উদারতা অব্যাহত ছিলাে, যা প্রাচীন ও আধুনিক মানুষের আচরণে একটা অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। ‘আর যে ব্যক্তিকে নিজের প্রবৃত্তির সংকীর্ণতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সে সফলকাম।’ বস্তুত মনের ও প্রবৃত্তির সংকীর্ণতা প্রত্যেকটা সৎকাজের পথে প্রধান বাধা। সৎকাজ মাত্রই হচ্ছে তা কোনাে না কোনাে প্রকারের ত্যাগ স্বীকারের নামান্তর। হয় তা আর্থিক বদান্যতা, নচেত অন্তরে সহানুভূতির বদান্যতা, নচেত চেষ্টা সাধনার বদান্যতা, অথবা প্রয়ােজনে জীবন ও সময়ের ত্যাগ স্বীকার করা। যে ব্যক্তি এতােটা সংকীর্ণমনা ও স্বার্থপর যে, সব সময় কিছু না কিছু নিতে চায়, কিছুই দিতে চায় না, সে কখনাে কোনাে সৎকাজ বা কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে না, আর যে ব্যক্তি মনের এই সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে ওঠতে পারে, সে সৎকাজের পথের এই বাধা অতিক্রম করতে পারে এবং দান ও ত্যাগ করতে সক্ষম হয়। এটাই হচ্ছে যথার্থ সাফল্য।

ফী জিলালিল কুরআন:

*সব যুগে মুসলিম উম্মাহর অভিন্ন চরিত্র : ‘আর যারা তাদের পরে আসবে তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরও আমাদের যেসব ভাই আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে তাদের ক্ষমা করো। আমাদের মনে মােমেনদের প্রতি খারাপ ধারণা রেখাে না। হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি মমতাময়, দয়াময়।’ চমকপ্রদ এই তৃতীয় চিত্রটিতে তাবেঈন অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের অব্যবহিত পরবর্তী প্রজন্মের সর্বোত্তম গুণবৈশিষ্ট্য গুলাে এবং সামগ্রিকভাবে সকল যুগের ও সকল দেশের মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ গুণবৈশিষ্ট্যগুলাে তুলে ধরা হয়েছে। মােহাজের ও আনসারদের পরবর্তী এই মুসলিম প্রজন্মগুলো, যারা মদীনায় এই আয়াত নাযিলের সময় জন্ম গ্রহণ করেনি, তাদের অস্তিত্ব আল্লাহর জ্ঞানে এবং স্থান ও কালের অতীত বাস্তবতায় সব সময়ই বিদ্যমান ছিলাে। তাদের অন্যতম লক্ষণ এই যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে যখন আল্লাহর শরণাপন্ন হয় তখন শুধু নিজেদের জন্যেই ক্ষমা প্রার্থনা করে না; বরং তাদের পূর্ববর্তী মােমেনদের জন্যেও ক্ষমা প্রার্থনা করে। অনুরূপভাবে কোনাে মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ বা কুধারণা পােষণ থেকে মনকে মুক্ত রাখার জন্যেও দোয়া করে। সেই দোয়া হলাে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের যেসব ভাই আমাদের আগে ঈমান এনেছে তাদের ক্ষমা করাে, আমাদের মনে তাদের প্রতি কোনাে বিদ্বেষ খারাপ ধারণা রেখাে না, হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি দয়াময়, মমতাময়। একমাত্র ঈমানই এখানে যােগসূত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে। উল্লেখিত আয়াতসমূহের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর চরিত্র ও তার উজ্জ্বল চিত্র ভাস্বর হয়ে ওঠেছে। স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে, এই উম্মাহর শেষ প্রজন্মকে প্রথম প্রজন্মের সাথে এবং প্রথম প্রজন্মকে শেষ প্রজন্মের সাথে সংযুক্ত সংহত করার, একাত্মতা, পারস্পরিক মমত্ব, সহানুভূতি ও নিরাপত্তার শক্তিশালী বন্ধনটি। মূর্ত হয়ে ওঠেছে সেই গভীর আত্মীয়তার বন্ধন, যা স্থান, কাল, জাতি ও বংশ অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে হৃদয়ের অভ্যন্তরে টিকে থাকে, যার কারণে শত শত বছর পরও এক মােমেন তার অপর মােমেন ভাইকে জীবিত ভাইয়ের মতােই স্মরণ করে, এমনকি কখনাে কখনাে তার চেয়েও বেশী শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালােবাসা সহকারে স্মরণ করে, পরবর্তী মুসলমানরা তা অনুকরণ অনুসরণ করে, যেমন তারা সব একই কাতারে ও একই বাহিনীতে সারিবদ্ধবাবে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তাদের মাঝে স্থান ও কালের বিস্তার ব্যবধান রয়েছে। একই দয়াময় ও মমতাময় প্রভু আল্লাহর প্রতি নিবিষ্টচিত্তে তারা সবাই অবস্থান করে একই পতাকার নীচে। এটা একটা চোখ ধাধানাে চিত্র। এতে একটা বাস্তব সত্য ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। ফুটিয়ে তােলা হয়েছে মানবতার শ্রেষ্ঠতম ও মহােত্তম দৃষ্টান্ত, যা একমাত্র মহৎ হৃদয়ের মানুষই কল্পনা করতে পারে। এটা যে কতাে উজ্জ্বল ও মহৎ চিত্র, তা তখনই স্পষ্ট হয়ে আমাদের কাছে ধরা পড়ে, যখন কার্লমার্কসের গ্রন্থে কম্যুনিজম নামক মতবাদ কর্তৃক প্রচারিত জঘন্য শ্রেণী বিদ্বেষের সাথে এর তুলনা করা হয়। এ বিদ্বেষ অনবরত একজন মানুষের বিবেক ও মনকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে এবং সব সময় এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণীর মানুষকে উত্তেজিত করতে থাকে। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী যেসব মানব প্রজন্ম এবং বর্তমান যেসব জাতি এসব ঘৃনীত শ্রেণী এ বিদ্বেষ লালন করে না তাদের ঈমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে এবং সকল ধর্মের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে তারা উস্কানি দিতে থাকে। উল্লেখিত দুটো চিত্রের মধ্যে কোনাে মিল নেই, আকৃতিতেও নয়, প্রকৃতিতেও নয় এবং প্রভাবেও নয়। এর একটা চিত্র মানুষের মর্যাদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে। অপরটি তাকে নামিয়ে আনে সর্বনিম্নস্তরে। প্রথমটি স্থান, কাল, বর্ণ, বংশ, ভৌগােলিক এলাকা ইত্যাদির উর্ধ্বে উঠে এক প্রজন্মকে অপর প্রজন্মের সাথে একাত্ম করে দেয়। এক প্রজন্মের সাথে অপর প্রজন্মের প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তােলে। পারস্পরিক প্রীতি ও বন্ধুত্বের পাশাপাশি সবাইকে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এমনকি মসজিদে নামায পড়ার সময়ও মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি এ আচরণ, দৃষ্টিভংগি অভিন্ন থাকে। আর অপর চিত্রটি মানব জাতিকে পরস্পরের রক্ত পিপাসু শত্রু এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসা বিদ্বেষ প্রচারকারী, শোষণকারী ও প্রতারক হিসেবে দেখায়। তাদের এ চিন্তাধারা পুরােটাই একটা জাল ছাড়া আর কিছু নয়, যা পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের ঠকানাের জন্যে বিছিয়ে রাখে। মােমেনদের মহান কাফেলা আল্লাহর কাছে যে দোয়া করে তা হচ্ছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, ক্ষমা করাে আমাদের ও আমাদের সেই ভাইদের যারা আমাদের আগে চলে গেছে, তাদের প্রতি আমাদের মনে কোনাে হিংসা বিদ্বেষ রেখাে না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি মমতাময়, দয়াময়।’ এই আলােকোজ্জ্বল চিত্রটি তুলে ধরার পর পুনরায় সেই ঘটনার বিবরণ দেয়া হচ্ছে যে ঘটনা উপলক্ষে এই সূরাটি নাযিল হয়েছে। এতে সে ঘটনার অপর পক্ষ মােনাফেকদের চরিত্রের বিবরণ দেয়া হয়েছে।

১-১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ :

(الحشر) হাশর শব্দের অর্থ একত্রিত করা, জড়ো করা, পুনরুত্থিত করা ইত্যাদি। এখানে হাশর বলতে বনু নাযীর গোত্রের নির্বাসনকে বুঝানো হয়েছে। অত্র সূরার দ্বিতীয় আয়াতে উল্লিখিত الحشر শব্দটি থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও এ সূরাকে বনু নাযীর নামে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ সূরাটি বনু নাযীর গোত্রের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। (সহীহ বুখারী, সূরা হাশরের তাফসীর)।

সূরার শুরুর দিকে বনু নাযীরের নির্বাসন ও বনু নাযীরের যুদ্ধ, মালে ফাঈ বণ্টন পদ্ধতি এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শরীয়ত নিয়ে এসেছেন তার একচ্ছত্র অনুসরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর মুহাজির ও আনসারদের ফযীলত, দীনের খাতিরে একে অপরের জন্য উদারতা ও অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য দারে কথা ও পূর্ববর্তী ঈমানদার ভাইদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপর আহলে কিতাব কাফিরদেরকে মুনাফিকদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি নামক ছলনা, তাদের কাপুরুষতা এবং আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সূরার শেষের দিকে মু’মিনদেরকে আখিরাতের পাথেয় গ্রহণ, কুরআনের মহত্ত্ব ও আল্লাহ তা‘আলার কয়েকটি সুন্দর সুন্দর নামের পরিচিতি এসেছে।

ফযীলত : সূরা হাশরের ফযীলতের ব্যাপারে বলা হয়, যে ব্যক্তি সকাল বেলা

اعوذ بالله السميع العليم من الشيطان الرجيم

পড়ার পর অত্র সূরার শেষ তিনটি আয়াত পাঠ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন; তারা সে ব্যক্তির জন্য বিকাল পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আর সেদিন মারা গেলে তার শহীদি মৃত্যু হবে, আর বিকাল বেলা পাঠ করলেও অনুরূপ হবে। (এ হাদীসটি দুর্বল, দেখুন যঈফুল জামে হা. ৫৭৩২) এ ছাড়াও আরো দুটি ফযীলতের দুর্বল হাদীস রয়েছে (কুরতুবী)।

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় হিজরত করে আসেন তখন মদীনায় তিনটি ইয়াহূদী গোত্র ছিল। বনু নাযীর, বনু কুরাইযা ও বনু কাইনুকা। এসব গোত্রের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শান্তিচুক্তি করেন। বদর যুদ্ধের ছয় মাস বা তার কিছু কম-বেশি সময় পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কাছে কুল্লাবী গোত্রের নিহত ব্যক্তির দিয়াত আদায় করার জন্য যান। হত্যাকারী ছিল আমর বিন উমাইয়া আয যমরী। তারা দিয়াত দেবে বলে স্বীকার করে এবং বলে : হে আবুল কাশেম আপনি এখানে বসেন আমরা দিয়াত তুলে নিয়ে আসি। এ সুযোগে তারা গোপনে পরামর্শ করল যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। তারা ঠিক করল, ওপর থেকে পাথর ফেলে হত্যা করা হবে। কিন্তু কে পাথর ফেলবে? তখন সালাম বিন মাশকুস বলল : এরূপ করো না। কেননা তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হবে। আর এরূপ করলে আমাদের মধ্যস্থিত চুক্তি ভঙ্গ হয়ে যাবে। এমন সময় ওয়াহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দেওয়া হল যে, তারা তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে, অতত্রব এখনই এখান থেকে চলে যাও। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্রুত সেখান থেকে উঠে মদীনার দিকে রওনা দিলেন। সাহাবীরা তার পিছু পিছু রওনা হল এবং বলতে লাগল আপনি চলে আসলেন কেন, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন তাদের ষড়যন্ত্রের কথা বললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বিরুদ্ধে একটি সেনাদল প্রেরণ করলেন এবং বললেন : তাদেরকে মদীনা থেকে বের করে দাও। তাদেরকে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দশ দিন সময় দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন : এর পর কাউকে পেলে তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে। (সহীহ মুসলিম, সহীহ বুখারী হা. ৪০২৮)

তারা কয়েকদিন অবস্থান করে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। এদিকে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই লোক প্রেরণ করে বলল : তোমরা তোমাদের এলাকা থেকে বের হয়ে যেয়ো না। আমার সাথে দু হাজার সৈন্য আছে, তারা তোমাদের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। তাছাড়া বনু কুরাইযা ও গাতফান গোত্র তোমাদের সহযোগিতা করবে। বনু নাযীর গোত্রের নেতা হুয়াই বিন আখতাব (পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন) তার কথায় আশান্বিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট লোক প্রেরণ করে বলল : আমরা এখান থেকে চলে যাব না, আপনি যা পারেন করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণ তাকবীর বললেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাঃ)-এর হাতে ঝাণ্ডা তুলে দিলেন। সাহাবীরা তাদের গোত্র ঘেরাও করে তীর নিক্ষেপ করল। এদিকে ইবনু উবাই, গাতফান গোত্র ও কুরাইযা গোত্র সহযোগিতা করার যে কথা ছিল তারা কেউ সহযোগিতা করেনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের গাছগুলো কেটে ও পুড়িয়ে দিলেন। অবশেষে তারা পরাজিত হয়ে বলতে বাধ্য হল, আমরা মদীনা থেকে চলে যাব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বললেন : তোমরা নিজেরা সন্তানাদি ও অস্ত্র ছাড়া যতটুকু সম্ভব বহন করে নিয়ে যাও। তাদের সকল অস্ত্র ও বাকী সম্পদ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করায়ত্ত করে নেন। বনু নাযীর গোত্রের সম্পদ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুসলিমদের কল্যাণের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিল। তাতে খুমুস বা এক পঞ্চমাংশ বের করা হয়নি। কারণ এটা ফাঈ হিসাবে পেয়েছিলেন, এর জন্য যুদ্ধ করতে হয়নি। ফাঈ হিসাবে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৫০টি বর্ম, ৫০টি হেলমেট, ৩৪০টি তরবারী পেয়েছিলেন। এ ঘটনাকে أَوَّلُ الْحَشْرِ (প্রথম হাশর) বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ হল এটা ছিল তাদের প্রথম নির্বাসন। মদীনা থেকে তারা খায়বারে বসতি স্থাপন করে। উমার (রাঃ) পুনরায় নির্বাসন দিয়ে তাদেরকে সিরিয়াতে পাঠিয়ে দেন। যার ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, এখানেই প্রত্যেক মানুষের সর্বশেষ হাশর হবে।

১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আকাশ-জমিন ও এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু (জীব হোক আর জড় হোক) আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ ও পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাঁর ইবাদত করে ও তাঁর বড়ত্বের কাছে নত হয়। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(تُسَبِّحُ لَهُ السَّمٰوٰتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيْهِنَّ ط وَإِنْ مِّنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِه۪ وَلٰكِنْ لَّا تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ)

“সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্ত‎র্বর্তী সমস্ত‎ কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না।” ( সূরা ইসরা ১৭ : ৪৪)

(كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتٰبِ)

‘আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কাফির’ অর্থাৎ বনু নাযীরের ইয়াহূদীরা।

(لِأَوَّلِ الْحَشْر)

‘প্রথম সমাবেশেই’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি সিরিয়াকে হাশরের স্থান হিসাবে সন্দেহ পোষণ করে সে যেন এ আয়াতটি পাঠ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : এদেরকে বের করে দাও। তারা বলল : কোথায়? তিনি বললেন : হাশরের জমিনে। (দুররুল মানছুর ৩/১৮৭) কাতাদাহ বলেন : এটা প্রথম হাশরের স্থান।

(مَا ظَنَنْتُمْ أَنْ يَّخْرُجُوْا)

‘তোমরা কল্পনা করনি যে, তারা নির্বাসিত হবে’ অর্থাৎ তাদের শক্তি সামর্থ্য ও একাত্বতা এত মজবুত ছিল যে, তোমরা কল্পনাও করতে পারনি যে, ছয় দিনে তাদেরকে নির্বাসিত করতে পারবে। তারা ধারণা করেছিল যে, সাহায্য পাওয়া যাবে। যেমন ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং যে মজবুত দুর্গ নির্মাণ করেছিল তাতে তাদের আশা ছিল মুসলিমরা কোন দিন তাদেরকে বের করে দিতে সক্ষম হবে না। কিন্তু এমনভাবে তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার আযাব আসল যে, তারা বুঝতেও পারেনি। যেমন কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করা হল। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(قَدْ مَكَرَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَأَتَي اللّٰهُ بُنْيَانَهُمْ مِّنَ الْقَوَاعِدِ فَخَرَّ عَلَيْهِمُ السَّقْفُ مِنْ فَوْقِهِمْ وَأَتٰهُمُ الْعَذَابُ مِنْ حَيْثُ لَا يَشْعُرُوْنَ)‏

“তাদের পূর্ববর্তীগণও চক্রান্ত‎ করেছিল; আল্লাহ তাদের ইমারতের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিলেন; ফলে ইমারতের ছাদ তাদের ওপর ধ্বসে পড়ল এবং তাদের প্রতি শাস্তি‎ আসল এমন দিক হতে যা তারা উপলব্ধিও করতে পারেনি।” (সূরা নামল ১৬ : ২৬)

(وَقَذَفَ فِيْ قُلُوْبِهِمُ الرُّعْبَ)

‘তিনি তাদের অন্তরে ভয় সঞ্চার করলেন’ যেমন তাদের নেতা কাব বিন আশরাফকে হত্যা করার মাধ্যমে তাদের অন্তরে ভয় প্রবেশ করেছে। তাছাড়া এক মাসের দূরের পথ থেকেই শত্রুরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভয় করবে এ প্রতিশ্রুতি তো পূর্বেই প্রদান করা হয়েছে।

(بِأَيْدِيْهِمْ) অর্থাৎ যখন তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, দেশ থেকে চলে যেতেই হবে তখন তারা অবরোধ অবস্থায় ভেতর থেকেই নিজেদের বাড়িগুলো ধ্বংস করা শুরু করল যাতে মুসলিমরা কাজে না লাগাতে পারে।

(وَلَوْلَآ أَنْ كَتَبَ اللّٰهُ)

অর্থাৎ পূর্ব থেকেই যদি তাদের তাকদীরে দেশ ত্যাগের কথা লেখা না থাকত তাহলে দুনিয়াতেই তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হত। যেমন বনু কুরাইযাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদেরকে হত্যা করা হয়েছিল, নারীদেরকে বন্দী করা হয়েছিল, সম্পদকে গনিমত হিসাবে আটক করা হয়েছিল।

উরওয়া বিন যুবাইর (রাঃ) বলেন : তারপর বদর যুদ্ধের ছয় মাসের মাথায় বানী নাযীর গোত্রের ঘটনা ঘটে। তারা ছিল ইয়াহূদীদের একটি দল। তারা মদীনার এক পার্শ্বে বসবাস করত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ঘেরাও করলেন, তারা এখান থেকে চলে যাবে বলে দুর্গ থেকে নেমে আসে। উট বোঝাই করে যত মাল নিয়ে যেতে পারে তার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোন অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে সিরিয়ার দিকে নির্বাসন করে দেন। (দুররুল মানছুর ৬/১৮৭, হাকেম ২/৪৮৩, সহীহ) বর্ণনাকারী বলছেন তাদের এ নির্বাসনের কথা তাওরাতের আয়াতে উল্লেখ ছিল। ইকরিমা বলেন : الْجَلَا۬ءَ হল হত্যা করা, কাতাদাহ বলেন : الْجَلَا۬ءَ হল এক দেশ থেকে অন্য দেশে বের করে দেওয়া। তাদের এ শাস্তির কারণ হল তারা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ ও তাদের নির্দেশ ভঙ্গ করেছে। সুতরাং যারাই আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের সাথে নাফরমানী করবে ও তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের পরিণতি এমনি হবে।

(مَا قَطَعْتُمْ مِّنْ لِّيْنَةٍ) – لِّيْنَةٍ

কী তা নিয়ে ইমাম কুরতুবী দশটি মত বর্ণনা করেছেন। সঠিক কথা হল তা এক প্রকার খেজুর। যেমন আজওয়া, বারনী ইত্যাদি খেজুরের প্রকার। অবরোধকালে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশে সাহাবীরা বনু নাযীরের খেজুর গাছ কেটে ফেলেছিল ও আগুন লাগিয়ে দিলেছিল। কিছুৃ গাছ বাকী ছিল। এ কাজ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই হয়েছিল। এ রকম করার লক্ষ্য ছিল শত্রুর আড়ালকে ভেঙ্গে দেওয়া যাতে আত্মরক্ষা করতে না পারে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বনু নাযীর গোত্রের ইয়াহূদীদের কর্তৃক নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও উমার (রাঃ) তাদের যে শাস্তি দিয়েছেন তা জানতে পারলাম।
৩. মুসলিম নিধনে ইয়াহূদীদের এরূপ চক্রান্ত এখনো বিদ্যামান আছে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করার পরিণাম।
৫. দুনিয়াতে হাশরের স্থান হল সিরিয়া।
৬-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে মালে ফাঈ এর পরিচিতি ও তার হুকুম এবং বণ্টন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ফাঈ বলা হয় প্রত্যেক ঐ সম্পদকে যা বিনা যুদ্ধে কাফিরদের থেকে পাওয়া যায়। যেমন বনু নাযীর গোত্রের মাল। ফাঈ এর মাল পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে-

(১) এক ভাগ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের জন্য। এ সম্পদ মুসলিমদের সার্বিক কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
(২) দ্বিতীয় ভাগ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটাত্মীয়দের জন্য, যেমন বনু হাশেম, বনু মুত্তালিব। এতে নারী-পুরুষ সবাই সমান।
(৩) তৃতীয় ভাগ ইয়াতিমদের জন্য, (৪) চতুর্থ ভাগ মিসকিনদের জন্য (৫) পঞ্চম ভাগ মুসাফিরদের জন্য। (তাফসীর সা‘দী)

উমার (রাঃ) বলেন : বনু নাযীর গোত্রের সম্পদ আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ফাঈ হিসাবে প্রদান করেছেন যার জন্য ঘোড়া দৌড়ানো বা যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি। এটা একমাত্র নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা থেকে পরিবারের এক বছরের খরচের জন্য রাখতেন, বাকি যা থাকত মুসলিমদের অস্ত্র ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য দিয়ে দিতেন। ( সহীহ বুখারী হা. ২৯০৪)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর তা বাইতুল মালে জমা হবে। যেমন তিনি বলেছেন : আমরা নাবীরা কারো ওয়ারিশ বানাই না, যা কিছু ছেড়ে যাই সব সদকাহ। (সহীহ বুখারী হা. ৪০৩৩)

তাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্পত্তির কোন উত্তরাধিকারী নেই। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর পর আলী ও ফাতেমা (রাঃ) আবূ বকর ও উমার (রাঃ)-এর নিকট উত্তরাধিকার দাবী করলে তাদেরকে উক্ত হাদীস জানিয়ে দেন এবং তাদেরকে কিছুই দেননি। (সহীহ বুখারী হা. ৪০৩৩)

(وَمَآ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ)

‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর’ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শরীয়ত ও দীন নিয়ে এসেছেন তা ধারণ কর তথা মেনে চল, আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শরীয়ত ও দীন দিয়ে যাননি তা যতই জাকজমকপূর্ণ ও সুন্দর বা ভাল মনে হোক না কেন কখনো তা পালন করা যাবে না, যদিও একশ্রেণির আলেম তা ধর্মের নামে তৈরি করে থাকে। তাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ

যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যে ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা. ৪৫৯০)

সুতরাং যে কোন আকীদাহ পোষণ ও আমল করার পূর্বে দেখে নিতে হবে তা কি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত, তিনি কি তা করেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত নয় এমন আকীদাহ পোষণ করা এবং সেসব আমল করা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত।

মাসরূক (রাঃ) বলেছেন : জনৈক মহিলা ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর কাছে আগমন করে বলল : আমার কাছে খবর এসেছে আপনি নাকি মুখে উলকি তোলা ও পরচুলা লাগাতে নিষেধ করেন। এটা কি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবে পেয়েছেন নাকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে পেয়েছেন। মহিলা আরো বললেন : আমি সম্পূর্ণ কুরআন পাঠ করেছি, কোথাও এরূপ কথা পাইনি। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেন : তুমি কি

(وَمَآ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ)

আয়াতটি পাওনি? মহিলা বললেন : হ্যাঁ, পেয়েছি। তিনি বললেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি তিনি পরচুলা লাগানো, উলকি তোলা ও মুখমণ্ডলের পশম তুলতে নিষেধ করেছেন। (আহমাদ হা. ৩৯৪৫, সনদ সহীহ)।

আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন হারূন আল ফারইয়াবী (রহঃ) বলেন : ইমাম শাফিঈ (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, তোমরা আমাকে যা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা কর আমি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে তার উত্তর দেব। আমি তাঁকে বললাম, যে ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় ভীমরুল হত্যা করে তার ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? আব্দুল্লাহ বলেন তিনি বললেন : বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَمَآ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ ج وَمَا نَهٰكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا

‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক।’ (কুরতুবী)

হুযাইফা ইবনু ইয়ামান (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমার পরে যে দুজন রয়েছে তাদের অনুসরণ কর। (তিরমিযী হা. ৩৬৬২, ইবনু মাযাহ হা. ৯৭, সহীহ)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যখন আমি তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দিই তখন তা যথাসম্ভব পালন করবে আর যখন কোন কাজ বারণ করি তখন তা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। (সহীহ বুখারী হা. ৭২৮৮, সহীহ মুসলিম হা. ৪১২) সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শরীয়ত নিয়ে এসেছেন তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে হবে, কোন তরীকা, মাযহাব ও দলের দোহাই দিয়ে বর্জন করার সুযোগ নেই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ফাই এর মাল বণ্টননীতি জানতে পারলাম।
২. উলকি করা, পরচুলা লাগানো ও মুখমণ্ডলের পশম তোলা হারাম।
৩. কুরআন ও সহীহ স্ন্নুাহ-দুটিই শরীয়তের মূল উৎস।
৪. শরীয়তের নির্দেশাবলী যথাসম্ভব পালন আর নিষেধাজ্ঞা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
৫. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা করার নির্দেশ অথবা বিরত থাকতে বলেছেন-সবই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে।
৮-১০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

ফাঈ ও গনীমতের মাল সে সকল দরিদ্র মুহাজিরদের জন্য যারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সহযোগিতা করার জন্য নিজেদের বাড়ি-ঘর, সহায় সম্পদ ছেড়ে হিজরত করে চলে এসেছে।

(وَالَّذِيْنَ تَبَوَّئُوا)

‘এবং মুহাজিরদের (আগমনের) পূর্বে যারা এ নগরীতে (মদীনায়) বসবাস করেছে’ এ থেকে আনসারী সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে। যারা মুহাজিরদের মদীনায় আসার পূর্বেই মদীনার বাসিন্দা ছিলেন এবং মুহাজিরদের হিজরত করে আসার পূর্বেই তাদের অন্তরে ঈমান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মুহাজির সাহাবীদের ঈমান আনার পূর্বেই আনসারীগণ ঈমান এনেছিলেন। কেননা তাদের অধিকাংশ মুহাজির সাহাবীদের ঈমান আনার পর ঈমান এনেছেন। এখানে (مِنْ قَبْلِهِمْ) বলতে

من قبل هجرتهم

অর্থাৎ তাদের হিজরত করার পূর্বে বুঝানো হয়েছে।

دار الهجرة বলতে মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। উমার (রাঃ) বলেন : আমি আমার পরবর্তী খলীফাকে উপদেশ দিচ্ছি প্রথম শ্রেণির মুহাজিরদের সাথে উত্তম আচরণ করার জন্য। তাঁকে আমি আনসারদের সাথেও উত্তম আচরণের উপদেশ দিচ্ছি যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হিজরতের পূর্বে ঈমান এনেছিল ও মদীনায় বসবাস করত। তাদের মধ্যে যারা উত্তম আচরণকারী তাদের প্রতি এগিয়ে যাওয়ার এবং যারা মন্দ আচরণকারী তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার উপদেশ প্রদান করছি। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৮৮)

(وَلَا يَجِدُوْنَ فِيْ صُدُوْر)

অর্থাৎ মুহাজিরদের আল্লাহ তা‘আলা যে মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা কিছু দিতেন তাতে তাঁরা হিংসা করত না, আর মনে কোন প্রকার সংকীর্ণতা অনুভব করত না।

(وَيُؤْثِرُوْنَ عَلٰٓي أَنْفُسِهِمْ)

অর্থাৎ নিজেদের সকল প্রয়োজনের ওপর মুহাজিরদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিত। এমনকি নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকলেও মুহাজিরদেরকে খাওয়াতেন। যেমন হাদীসে একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, একদা একজন আনসারী সাহাবী এক মুহাজিরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে স্ত্রীকে জানালে স্ত্রী বললেন : ঘরে তো কেবল ছেলেদের খাওয়ার মত সামান্য কিছু আছে। পরে উভয়ে পরামর্শ করলেন যে, ছেলেদেরকে আজ (ভুলিয়ে-ভালিয়ে) ক্ষুধার্ত রেখেই ঘুম পাড়িয়ে দাও এবং আমরা নিজেরাও কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে যাব। তবে মেহমানকে খাওয়ানোর সময় (ছল করে) বাতিটা নিভিয়ে দেবে, যাতে সে আমাদের ব্যাপারে জানতে না পারে যে, আমরা তার সাথে খাচ্ছি না। সকালে যখন এ সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হলেন, তখন তিনি তাঁকে বললেন : মহান আল্লাহ তোমার ও তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন-

وَيُؤْثِرُوْنَ عَلٰٓي أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ।

(সহীহ বুখারী, সূরা হাশরের তাফসীর)।

তাদের ত্যাগের একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত এও যে, একজন আনসারী সাহাবীর নিকট দুজন স্ত্রী ছিল। তিনি তার মুহাজির ভাইকে প্রস্তাব দিলেন যে, আমি তোমার জন্য আমার একজন স্ত্রীকে ত্বালাক দেব। ইদ্দত অতিবাহিত হওযার পর তুমি তাকে বিবাহ করে নেবে। (সহীহ বুখারী, বিবাহ অধ্যায়)।

(وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه۪)- شُحَّ

অর্থ কৃপণ আর بخل অর্থও কৃপণ। তবে দুয়ের মাঝে পার্থক্য হল شُحَّ হলো নিজে কৃপণতা করে অন্যের কাছে পাওয়ার আশা করে, আর بخل শুধু কৃপণতা করা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাক, কারণ কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতা তাদেরকে নিজেদের রক্তপাত করতে এবং হারামকে হালাল করে নিতে প্ররোচিত করেছিল। (সহীহ মুসলিম হা. ৬৭৪১)

(وَالَّذِيْنَ جَا۬ءُوْ مِنْۭ بَعْدِهِمْ)

অর্থাৎ যারা আনসার ও মুহাজিরদের পরে আগমন করে তারা নিজেদের জন্য ও সকল মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এটা হল মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : তোমাদেরকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তোমরা তাদেরকে গালি দিচ্ছো। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি : এ জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না তাদেরকে যতক্ষণ না তাদের পরবর্তীগণ পূর্ববর্তী লোকদের অভিসম্পাত করবে। (মুসান্নফ ইবনু আবি শায়বাহ ১৫/১২৫, মুখতাসার তাফসীর বাগাভী ৬/৯৪৩) এ আয়াত প্রমাণ করছে সাহাবীদেরকে ভালবাসা ওয়াজিব। ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন; যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন সাহাবীর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে অথবা অন্তরে কোন প্রকার হিংসা রাখবে তার জন্য মুসলিমদের ফাঈ মালে কোন হক নেই, তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন (কুরতুবী)।

সুতরাং আমাদের পূর্বে যারা ঈমান নিয়ে বিদায় নিয়েছে তাদের জন্য আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করব, কখনো তাদের ভুল বা অন্যায়ের কারণে অশালীন মন্তব্য ও বিদ্বেষমূলক কোন কথা বলব না। তাদের ভাল-মন্দ সকল কর্মের হিসাব আল্লাহ তা‘আলার কাছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আনসার ও মুহাজিরদের ফযীলত অবগত হলাম।
২. একজন মু’মিন অন্য মু’মিনকে ভালবাসবে, কোন হিংসা বিদ্বেষ রাখবে না-এটাই ঈমানের দাবী।
৩. নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার ফযীলত অবগত হলাম।
৪. কৃপণতা নিন্দনীয়।
৫. সাহাবীদের গালি দেওয়া কুফরী কাজ, তাদের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও সম্মানের সাথে স্মরণ ঈমানী দাবী।
৬. মুসলিমদের ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রক্তের সম্পর্কের চেয়ে সুদৃঢ়।

Leave a Reply