Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৩২/হে মু’মিনগণ!-৭১,৭২ও ৭৩)
[* আল্লাহ ও তাঁর রসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না:-
*কুরআন ও সুন্নাহর ওপর নিজের মতকে প্রাধান দেয়া যাবে না:-
*তথ্যের সত্যতা যাচাই করা উচিত :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৯-হুজরাত। পারা:২৬
১-৮ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
সূরা:৪৯-হুজরাত- ১
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُقَدِّمُوۡا بَیۡنَ یَدَیِ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۱﴾
হে মু’মিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না।আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।
সূরা:৪৯-হুজরাত-২
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَرۡفَعُوۡۤا اَصۡوَاتَکُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ النَّبِیِّ وَ لَا تَجۡہَرُوۡا لَہٗ بِالۡقَوۡلِ کَجَہۡرِ بَعۡضِکُمۡ لِبَعۡضٍ اَنۡ تَحۡبَطَ اَعۡمَالُکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَشۡعُرُوۡنَ ﴿۲﴾
হে মু’মিনগণ! নিজেদের আওয়ায রসূলের আওয়াযের চেয়ে উঁচু করো না এবং উচ্চস্বরে নবীর সাথে কথা বলো না, যেমন তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো।এমন যেন না হয় যে, তোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজ-কর্ম ধ্বংস হয়ে যায়।
সূরা:৪৯-হুজরাত-৩
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَغُضُّوۡنَ اَصۡوَاتَہُمۡ عِنۡدَ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ امۡتَحَنَ اللّٰہُ قُلُوۡبَہُمۡ لِلتَّقۡوٰی ؕ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ ﴿۳﴾
যারা আল্লাহর রসূলের সামনে তাদের কণ্ঠ নিচু রাখে তারাই সেসব লোক, আল্লাহ যাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও বড় পুরস্কার।
সূরা:৪৯-হুজরাত-৪
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُنَادُوۡنَکَ مِنۡ وَّرَآءِ الۡحُجُرٰتِ اَکۡثَرُہُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ ﴿۴﴾
হে নবী! যারা তোমাকে গৃহের বাইরে থেকে ডাকাডাকি করতে থাকে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।
সূরা:৪৯-হুজরাত-৫
وَ لَوۡ اَنَّہُمۡ صَبَرُوۡا حَتّٰی تَخۡرُجَ اِلَیۡہِمۡ لَکَانَ خَیۡرًا لَّہُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۵﴾
তুমি বের হয়ে তাদের নিকট আসা পর্যন্ত যদি তারা ধৈর্যধারণ করত, তাহলে তাই তাদের জন্য উত্তম হত। আর আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সূরা:৪৯-হুজরাত-৬
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ جَآءَکُمۡ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوۡۤا اَنۡ تُصِیۡبُوۡا قَوۡمًۢا بِجَہَالَۃٍ فَتُصۡبِحُوۡا عَلٰی مَا فَعَلۡتُمۡ نٰدِمِیۡنَ ﴿۶﴾
হে ঈমান গ্রহণকারীগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখ। এমন যেন না হয় যে, না জেনে শুনেই তোমরা কোন গোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসবে এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।
সূরা:৪৯-হুজরাত-৭
وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ فِیۡکُمۡ رَسُوۡلَ اللّٰہِ ؕ لَوۡ یُطِیۡعُکُمۡ فِیۡ کَثِیۡرٍ مِّنَ الۡاَمۡرِ لَعَنِتُّمۡ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ حَبَّبَ اِلَیۡکُمُ الۡاِیۡمَانَ وَ زَیَّنَہٗ فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ وَ کَرَّہَ اِلَیۡکُمُ الۡکُفۡرَ وَ الۡفُسُوۡقَ وَ الۡعِصۡیَانَ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الرّٰشِدُوۡنَ ۙ﴿۷﴾
তোমরা জেনে রেখো যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রসূল রয়েছেন; তিনি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা শুনলে তোমরাই কষ্ট পাবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমান (বিশ্বাস)কে প্রিয় করেছেন এবং ওকে তোমাদের হৃদয়ে সুশোভিত করেছেন। আর কুফরী (অবিশ্বাস), পাপাচার ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। ওরাই সৎপথ অবলম্বনকারী।
সূরা:৪৯-হুজরাত-৮
فَضۡلًا مِّنَ اللّٰہِ وَ نِعۡمَۃً ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۸﴾
আল্লাহর দান ও অনুগ্রহস্বরূপ ; আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, হিকমতওয়ালা।
(৪৯-হুজুরাত) : নামকরণ:
৪ আয়াতের إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ বাক্যাংশ থেকে এ সূরার নাম গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ যে সূরার মধ্যে আল হুজরাত শব্দ আছে এটি সেই সূরা।
(৪৯-হুজুরাত) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় এবং সূরার বিষয়বস্তু থেকেও সমর্থন পাওয়া যায় যে, এ সূরা বিভিন্ন পরিবেশ ও ক্ষেত্রে নাযিল হওয়া হুকুম-আহকাম ও নির্দেশনাসমূহের সমষ্টি। বিষয়বস্তুর সাদৃশ্যের কারণে এগুলোকে এখানে একত্রিত করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন বর্ণনা থেকে একথাও জানা যায় যে, ঐ সব হুকুম-আহকামের বেশীর ভাগই মাদানী যুগের শেষ পর্যায়ে নাযিল হয়েছে। যেমন: ৪ আয়াত সম্পর্কে তাফসীরকারদের বর্ণনা হচ্ছে আয়াতটি বনী তামীম গোত্রে সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলো যার প্রতিনিধি দল এসে নবীর (সা.) পবিত্র স্ত্রীগণের হুজরা বা গৃহের বাইরে থেকে তাঁকে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিলো। সমস্ত সীরাত গ্রন্থে হিজরী ৯ম সনকে এ প্রতিনিধি দলের আগমনের সময় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অনুরূপ ৬ আয়াত সম্পর্কে বহু সংখ্যক হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তা ওয়ালীদ ইবনে উকবা সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলো- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে বনী মুস্তালিক গোত্র থেকে যাকাত আদায় করে আনতে পাঠিয়েছিলেন। একথা সবারই জানা যে, ওয়ালীদ ইবনে উকবা মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হয়েছিলেন।
(৪৯-হুজুরাত) : বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয় :
এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলমানদেরকে এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষা দেয়া, যা তাদের ঈমানদারসূলভ স্বভাব চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত ও মানানসই।
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ব্যাপারে যেসব আদব-কায়দা, ও শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে প্রথম পাঁচ আয়াতে তাদেরকে তা শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।
এরপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, প্রতিটি খবরই বিশ্বাস করা এবং সে অনুসারে কোন কর্মকাণ্ড করে বসা ঠিক নয়। যদি কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কওমের বিরুদ্ধে কোন খবর পাওয়া যায় তাহলে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে খবর পাওয়ার মাধ্যম নির্ভরযোগ্য কি না। নির্ভরযোগ্য না হলে তার ভিত্তিতে কোন তৎপরতা চালানোর পূর্বে খবরটি সঠিক কি না তা যাঁচাই বাছাই করে নিতে হবে।
এরপর বলা হয়েছে মুসলমানদের দু’টি দল যদি কোন সময় পরস্পর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তবে সেক্ষেত্রে অন্য মুসলমানদের কর্মনীতি কি হওয়া উচিত।
তারপর মুসলমানদেরকে সেসব খারাপ জিনিস থেকে আত্মরক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা সমাজ জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং যার কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। একে অপরকে ঠাট্রা বিদ্রূপ করা, বদনাম ও উপহাস করা, খারাপ নামে আখ্যায়িত করা, খারাপ ধারণা পোষণ করা, অন্যের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি ও অনুসন্ধান করা, অসাক্ষাতে মানুষের বদনাম করা এগুলো এমনিতেও গোনাহের কাজ এবং সমাজে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা’আলা এগুলোকে নাম ধরে ধরে হারাম ঘোষণা করেছেন।
অতপর গোত্রীয় ও বংশগত বৈষম্যের ওপর আঘাত হানা হয়েছে যা সারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও বংশের নিজ নিজ মর্যাদা নিয়ে গর্ব ও অহংকার করা, অন্যদেরকে নিজেদের চেয়ে নিম্নস্তরের মনে করা এবং নিজেদের বড়ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের হেয় করা— এসব এমন জঘন্য খাসলত যার কারণে পৃথিবী জুলুমে ভরে উঠেছে। আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত ছোট্ট একটি আয়াতে একথা বলে এসব অনাচারের মূলোৎপাটন করেছেন যে, “সমস্ত মানুষ একই মূল উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করা হয়েছে পারস্পরিক পরিচয়ের জন্য, গর্ব ও অহংকার প্রকাশের জন্য নয় এবং একজন মানুষের ওপর আরেকজন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য আর কোন বৈধ ভিত্তি নেই।”
সবশেষে মানুষকে বলা হয়েছে যে, ঈমানের মৌখিক দাবী প্রকৃত জিনিস নয়, বরং সরল মনে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে মানা, কার্যত অনুগত হয়ে থাকা এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর পথে জান ও মাল কুরবানী করা। সত্যকার মু’মিন সে যে এ নীতি ও আচরণ গ্রহণ করে। কিন্তু যারা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া ছাড়াই শুধু মৌখিকভাবে ইসলামকে স্বীকার করে এবং তারপর এমন নীতি ও আচরণ অবলম্বন করে যেন ইসলাম গ্রহণ করে তারা কোন মহা উপকার সাধন করেছে, পৃথিবীতে তারা মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে পারে, সমাজে তাদের সাথে মুসলমানের মত আচরণও করা যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তারা মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
# এটা ঈমানের প্রাথমিক ও মৌলিক দাবী। যে ব্যক্তি আল্লাহকে তার রব এবং আল্লাহর রসূলকে তার হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনকারী মানে সে যদি তার এ বিশ্বাসে সত্যবাদী হয়ে থাকে তাহলে সে নিজের মতামত ও ধ্যান-ধারণাকে কখনো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সিদ্ধান্তের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে পারে না, কিংবা বিভিন্ন ব্যাপারে স্বাধীন মতামত পোষণ করতে পারে না এবং ঐ সব ব্যাপারে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না বরং আল্লাহ ও তাঁর রসূল ঐ সব ব্যাপারে কোন হিদায়াত বা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন কিনা এবং দিয়ে থাকলে কি দিয়েছেন সে বিষয়ে আগে জানার চেষ্টা করবে। কোন মু’মিনের আচরণে এর ব্যতিক্রম কখনো হতে পারে না। এজন্য আল্লাহ বলছেন, “হে ঈমানদাররা, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অগ্রগামী হয়ো না।” অর্থাৎ তাঁর আগে আগে চলবে না, পেছনে পেছনে চলো। তাঁর আনুগত হয়ে থাকো। এ বাণীতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সূরা আহযাবের ৩৬ আয়াতের নির্দেশ থেকে একটু কঠোর। সেখানে বলা হয়েছিলো, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যে বিষয়ে ফায়সালা করে দিয়েছেন সে বিষয়ে আলাদা কোন ফায়সালা করার ইখতিয়ার কোন ঈমানদারের জন্য আর অবশিষ্ট থাকে না। আর এখানে বলা হয়েছে ঈমানদারদের নিজেদের বিভিন্ন ব্যাপারে আপনা থেকেই অগ্রগামী হয়ে ফায়সালা না করা উচিত। বরং প্রথমে দেখা উচিত ঐ সব ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসূলের সুন্নাতে কি কি নির্দেশনা রয়েছে।এ নির্দেশটি শুধু মুসলমানদের ব্যক্তিগত ব্যাপারসমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে এটি ইসলামী আইনের মৌলিক দফা। মুসলমানদের সরকার, বিচারালয় এবং পার্লামেন্ট কোন কিছুই এ আইন থেকে মুক্ত নয়। মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজায় সহীহ সনদে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যে, যে সময় নবী ﷺ হযরত মু’আয ইবনে জাবালকে ইয়ামানের বিচারক করে পাঠাচ্ছিলেন তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কিসের ভিত্তিতে ফায়সালা করবে? তিনি জবাব দিলেনঃ “আল্লাহর কিতাব অনুসারে।” নবী (সা.) বললেনঃ যদি কোন বিষয়ে কিতাবুল্লাহর মধ্যে হুকুম না পাওয়া যায় তাহলে কোন জিনিসের সাহায্য নেবে? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর রসূলের সুন্নাতের সাহায্য নেব। তিনি বললেনঃ যদি সেখানেও কিছু না পাও? তিনি বললেনঃ তাহলে আমি নিজে ইজতিহাদ করবো। একথা শুনে নবী (সা.) তার বুকের ওপর হাত রেখে বললেনঃ সে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করছি যিনি তাঁর রসূলের প্রতিনিধিকে এমন পন্থা অবলম্বন করার তাওফীক দান করেছেন যা তাঁর রসূলের কাছে পছন্দনীয়। নিজের ইজতিহাদের চেয়ে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং হিদায়াত লাভের জন্য সর্বপ্রথম এ দু’টি উৎসের দিকে ফিরে যাওয়াই এমন একটা জিনিস যা একজন মুসলিম বিচারক এবং একজন অমুসলিম বিচারকের মধ্যকার মূল পার্থক্য তুলে ধরে। অনুরূপ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাবই যে সর্বপ্রথম উৎস এবং তারপরই যে রসূলের সুন্নাত-এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তির কিয়াস ও ইজতিহাদ তো দূরের কথা গোটা উম্মতের ইজমাও এ দু’টি উৎসের পরিপন্থী কিংবা তা থেকে স্বাধীন হতে পারে না।
# যদি তোমরা কখনো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার নীতি গ্রহণ করো কিংবা নিজের মতামত ও ধ্যান-ধারণাকে তাঁদের নির্দেশের চেয়ে অগ্রাধিকার দান করো তাহলে জেনে রাখো তোমাদের বুঝাপড়া হবে সেই আল্লাহর সাথে যিনি তোমাদের সব কথা শুনছেন এবং মনের অভিপ্রায় পর্যন্ত অবগত আছেন।
# যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে ওঠাবসা ও যাতায়াত করতেন তাদেরকে এ আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল নবীর ﷺ সাথে দেখা-সাক্ষাত ও কথাবার্তার সময় যেন ঈমানদারা তাঁর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি একান্তভাবে লক্ষ্য রাখেন। কারো কণ্ঠ যেন তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চ না হয়। তাঁকে সম্বোধন করতে গিয়ে কেউ যেন একথা ভুলে না যায় যে, সে কোন সাধারণ মানুষ বা তার সমকক্ষ কাউকে নয় বরং আল্লাহর রসূলকে সম্বোধন করে কথা বলছে। তাই সাধারণ মানুষের সাথে কথাবার্তা এবং আল্লাহর রসূলের সাথে কথাবার্তার মধ্যে পার্থক্য থাকতে হবে এবং কেউ তাঁর সাথে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলবে না।যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসের জন্য এসব আদব-কায়দা শেখানো হয়েছিলো এবং নবীর ﷺ যুগের লোকদেরকে সম্বোধন করা হয়েছিলো। কিন্তু যখনই নবীর ﷺ আলোচনা হবে কিংবা তাঁর কোন নির্দেশ শুনানো হবে অথবা তাঁর হাদীসসমূহ বর্ণনা করা হবে এরূপ সকল ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ের লোকদেরও এ আদব-কায়দাই অনুসরণ করতে হবে। তাছাড়া নিজের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার লোকদের সাথে কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনার সময় কি কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে এ আয়াত থেকে সে ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। কেউ তার বন্ধুদের সাথে কিংবা সাধারণ মানুষের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলে, তার কাছে সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের সাথেও যদি একইভাবে কথাবার্তা বলে তাহলে তা প্রমাণ করে যে, সে ব্যক্তির জন্য তাঁর মনে কোন সম্মানবোধ নেই এবং সে তার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না।
# ইসলামে রসূলের ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ও স্থান কি এ বাণী থেকে তা জানা যায়। কোন ব্যক্তি সম্মান লাভের যতই উপযুক্ত হোক না কেন কোন অবস্থায়ই সে এমন মর্যাদার অধিকারী নয় যে, তার সাথে বেয়াদবী আল্লাহর কাছে এমন শাস্তিযোগ্য হবে যা মূলত কুফরীর শাস্তি। বড় জোর সেটা বেয়াদবী বা অশিষ্ট আচরণ। কিন্তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সামান্য শিথিলতাও এত বড় গোনাহ যে, তাতে ব্যক্তির সারা জীবেনের সঞ্চিত পূজি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই নবীর ﷺ প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরই শামিল, যিনি তাঁকে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি ভক্তি প্রদর্শনে অবহেলার অর্থ স্বয়ং আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ত্রুটি বা অবহেলার পর্যায়ভুক্ত।
# যারা আল্লাহ তা’আলার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এবং এসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, প্রকৃতই তাদের অন্তরে তাকওয়া বিদ্যমান তারাই আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখে। এ আয়াতাংশ থেকে আপনা আপনি প্রমাণিত হয় যে, যে হৃদয়ে রসূলের মর্যাদাবোধ নেই সে হৃদয়ে প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া নেই। আর রসূলের সামনে কারো কন্ঠস্বর উচ্চ হওয়া শুধু একটি বাহ্যিক অশিষ্টতাই নয় বরং অন্তরে তাকওয়া না থাকারই প্রমাণ।
# নবীর ﷺ পবিত্র যুগে যারা তাঁর সহচর্যে থেকে ইসলামী আদব-কায়দা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তারা সবসময় নবীর ﷺ সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। তিনি আল্লাহর কাজে কতটা ব্যস্ত জীবন যাপন করেন সে ব্যাপারে তাদের পূর্ণ উপলব্ধি ছিল। এসব ক্লান্তিকর ব্যস্ততার ভেতরে কিছু সময় তাঁর আরামের জন্য, কিছু সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এবং কিছু সময় পারিবারিক কাজকর্ম দেখা-শোনার জন্যও অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। এ জন্য তারা নবীর সাথে দেখা করার জন্য এমন সময় গিয়ে হাজির হতো যখন তিনি ঘরের বাইরেই অবস্থান করতেন এবং কখনো যদি তাঁকে মজলিসে না-ও পেতো তাহলে তাঁর বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। অত্যাধিক প্রয়োজন ছাড়া তাঁকে বাইরে আসার জন্য কষ্ট দিতো না। কিন্তু আরবের সে পরিবেশে যেখানে সাধারণভাবে মানুষ কোন প্রকার শিষ্টাচারের শিক্ষা পায়নি সেখানে বারবার এমন সব অশিক্ষিত লোকেরা নবীর ﷺ সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে হাজির হতো যাদের ধারণা ছিল ইসলামী আন্দোলন ও মানুষকে সংশোধনের কাজ যারা করেন তাদের কোন সময় বিশ্রাম গ্রহণের অধিকার নেই এবং রাতের বেলা বা দ্বীনের বেলা যখনই ইচ্ছা তাঁর কাছে এসে হাজির হওয়ার অধিকার তাদের আছে। আর তাঁর কর্তব্য হচ্ছে, যখনই তারা আসবে তাদের সাক্ষাত দানের জন্য তিনি প্রস্তুত থাকবেন। এ প্রকৃতির লোকদের মধ্যে সাধারণভাবে এবং আরবের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত লোকদের মধ্যে বিশেষভাবে এমন কিছু অজ্ঞ অভদ্র লোকও থাকতো যারা নবীর ﷺ সাথে সাক্ষাত করতে আসলে কোন খাদেমের মাধ্যমে ভিতরে খবর দেয়ার কষ্টটাও করতো না। নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের হুজরার চারদিক ঘুরে ঘুরে বাইরে থেকেই তাঁকে ডাকতে থাকতো। সাহাবীগণ হাদীসে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন। লোকজনের এ আচরণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুব কষ্ট হতো। কিন্তু স্বভাবগত ধৈর্যের কারণে তিনি এসব সহ্য করে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলেন এবং এ অবশিষ্ট কর্মনীতির জন্য তিরস্কার করে লোকজনকে এ নির্দেশনা দান করলেন যে, যখন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে তাঁকে পাবে না তখন চিৎকার করে তাঁকে ডাকার পরিবর্তে ধৈর্যের সাথে বসে সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যখন তিনি নিজেই তাদেরকে সাক্ষাতদানের জন্য বেরিয়ে আসবেন।
# এ যাবত যা হওয়ার তা হয়েছে। যদি ভবিষতে এ ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা হয় তবে আল্লাহ অতীতের সব ভুল ক্ষমা করে দেবেন এবং যারা তাঁর রসূলকে এভাবে কষ্ট দিয়েছে দয়া ও করুণা পরবশ হয়ে তিনি তাদের পাকড়াও করবেন না।
# অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে এ আয়াতটি ওয়ালিদ ইবনে উকবা আবী মু’আইত সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এর পটভূমি হচ্ছে, বনী মুসতালিক গোত্র মুসলমান হলে রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের থেকে যাকাত আদায় করে আনার জন্য ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে পাঠালেন। সে তাদের এলাকায় পৌঁছে কোন কারণে ভয় পেয়ে গেল এবং গোত্রের লোকদের কাছে না গিয়েই মদীনায় ফিরে গিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ বলে অভিযোগ করলো যে, তারা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। এ খবর শুনে নবী (সা.) অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাদের শায়েস্তা করার জন্য এক দল সেনা পাঠাতে মনস্থ করলেন। কোন কোন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সেনাদল পাঠিয়েছিলেন এবং কোন কোনটিতে বর্ণিত হয়েছে যে, পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মোটকথা, এ বিষয়েই সবাই একমত যে, এ সময় বনী মুসতালিক গোত্রের নেতা হারেস ইবনে দ্বেরার (উম্মুল মু’মিনীন হযরত জুয়াইরিয়ার পিতা) এক প্রতিনিধি দল নিয়ে নবীর ﷺ খেদমতে হাজির হন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম যাকাত দিতে অস্বীকৃতি এবং ওয়ালীদকে হত্যা করার চেষ্টা তো দূরের কথা তার সাথে আমাদের সাক্ষাত পর্যন্ত হয়নি। আমরা ঈমানের ওপর অবিচল আছি এবং যাকাত প্রদানে আদৌ অনিচ্ছুক নই। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়। এ ঘটনাটি ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী হাতেম, তাবারানী এবং ইবনে জারীর সামান্য শাব্দিক পার্থক্যসহ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হারেস ইবনে দ্বেরার মুজাহিদ, কাতাদা, আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা, ইয়াযীদ, ইবনে রূমান, দ্বহহাক এবং মুকাতিল ইবনে হাইয়ান থেকে উদ্ধৃত করেছেন। হযরত উম্মে সালামা বর্ণিত হাদীসে পুরো ঘটনাটি এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। তবে সেখানে সুস্পষ্টভাবে ওয়ালিদের নামের উল্লেখ নেই।এ নাজুক পরিস্থিতিতে যখন একটি ভিত্তিহীন খবরের ওপর নির্ভর করার কারণে একটি বড় ভুল সংঘটিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, সে মুহূর্তে আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে এ মৌলিক নির্দেশটি জানিয়ে দিলেন যে, যখন তোমরা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবে যার ভিত্তিতে বড় রকমের কোন ঘটনা সংঘটিত হতে পারে, তখন তা বিশ্বাস করার পূর্বে খবরের বাহক কেমন ব্যক্তি তা যাঁচাই করে দেখো। সে যদি কোন ফাসেক লোক হয় অর্থাৎ যার বাহ্যিক অবস্থা দেখেই প্রতীয়মান হয় যে, তার কথা নির্ভরযোগ্য নয় তাহলে তার দেয়া খবর অনুসারে কাজ করার পূর্বে প্রকৃত ঘটনা কি তা অনুসন্ধান করে দেখো। আল্লাহর এ হুকুম থেকে শরীয়াতের একটি নীতি পাওয়া যায় যার প্রয়োগ ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। এ নীতি অনুসারে যার চরিত্র ও কাজ-কর্ম নির্ভরযোগ্য নয় এমন কোন সংবাদদাতার সংবাদের ওপর নির্ভর করে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা জাতির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ ইসলামী সরকারের জন্য বৈধ নয়। এ নীতির ভিত্তিতে হাদীস বিশারদগণ হাদীস শাস্ত্রে, “জারহ ও তা’দীল” –এর নীতি উদ্ভাবন করেছেন। যাতে যাদের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসমূহ পরবর্তী বংশধরদের কাছে পৌঁছেছিলো তাদের অবস্থা যাঁচাই বাছাই করতে পারেন। তাছাড়া সাক্ষ্য আইনের ক্ষেত্রে ফকীহগণ নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, এমন কোন ব্যাপারে ফাসেক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না যার দ্বারা শরীয়াতের কোন নির্দেশ প্রমাণিত হয় কিংবা কোন মানুষের ওপর কোন অধিকার বর্তায়। তবে এ ব্যাপারে পণ্ডিতগণ একমত যে, সাধারণ পার্থিব ব্যাপারে প্রতিটি খবরই যাঁচাই ও অনুসন্ধান করা এবং খবরদাতার নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরী নয়। কারণ আয়াতে نيأ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি সব রকম খবরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, শুধু গুরুত্বপূর্ণ খবরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ কারণে ফকীহগণ বলেন, সাধারণ এ খুঁটিনাটি ব্যাপারে এ নীতি খাটে না। উদাহরণস্বরূপ আপনি কারো কাছে গেলেন এবং বাড়ীতে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলেন। বাড়ীর ভিতর থেকে কেউ এসে বললো, আসুন। এক্ষেত্রে আপনি তার কথার ওপর নির্ভর করে প্রবেশ করতে পারেন। বাড়ীর মালিকের পক্ষ থেকে অনুমতির সংবাদদাতা সৎ না অসৎ এক্ষেত্রে তা দেখার প্রয়োজন নেই। অনুরূপ ফকীহগণ এ ব্যাপারেও একমত যেসব লোকের ফাসেকী মিথ্যাচার ও চারিত্রিক অসততার পর্যায়ের নয়, বরং আকীদা-বিকৃতির কারণে ফাসেক বলে আখ্যায়িত তাদের সাক্ষ্য এবং বর্ণনাও গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু আকীদা খারাপ হওয়া তাদের সাক্ষ্য ও বর্ণনা গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রতিবন্ধক নয়।
# বনী মুসতালিক গোত্র সম্পর্কে ওয়ালিদ ইবনে উকবার খবরের ভিত্তিতে নবী ﷺ তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক যে তাদের বিরুদ্ধে তৎক্ষনাৎ আক্রমণ পরিচালনার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলো আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং কিছু সংখ্যক মুফাসসিরও আয়াতটি থেকে তাই বুঝেছেন। এ কারণে ঐ সব লোককে তিরস্কার করে বলা হয়েছে, আল্লাহর রসূল ﷺ নিজে তোমাদের মধ্যে বর্তমান, একথা ভুলে যেয়ো না। তিনি তোমাদের জন্য কল্যাণের বিষয়কে তোমাদের চেয়ে অধিক জানেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত তোমাদের কাছে যথোপযুক্ত মনে হয় তিনি যেন সে অনুসারেই কাজ করেন তোমাদের এরূপ আশা করাটা অত্যন্ত দুঃসাহস। যদি তোমাদের কথা অনুসারে সব কাজ করা হতে থাকে তাহলে বহু ক্ষেত্রে এমন সব ভুল-ত্রুটি হবে যার ভোগান্তি তোমাদেরকেই পোহাতে হবে।
# কতিপয় লোক তাদের অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরিচালনা করতে চাচ্ছিলো। তাদের এ চিন্তা ছিল ভুল। তবে মু’মিনদের গোটা জামায়াত এ ভুল করেনি। মু’মিনদের সঠিক পথের ওপর কায়েম থাকার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাঁর দয়া ও মেহেরবানীতে ঈমানী আচার-আচরণকে তাদের জন্য প্রিয় ও হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন এবং কুফরী, ফাসেকী ও নাফরমানীর আচরণকে তাদের কাছে ঘৃণিত করে দিয়েছেন। এ আয়াতের দু’টি অংশে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠিকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়েছে। لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِنَ الْأَمْرِ আয়াতাংশে সব সাহাবীকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়নি বরং, যারা বনী মুসতালিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য পীড়াপীড়ি করছিলো সে বিশেষ কিছু সাহাবীকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়েছে। আর وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ আয়াতাংশে সমস্ত সাহাবীদের সম্বোধন করা হয়েছে যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজেদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করার দুঃসাহস কখনো দেখাতেন না। বরং ঈমানের দাবী অনুসারে তাঁর হিদায়াত ও দিকনির্দেশনার ওপর নির্ভর করে সবসময় আনুগত্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতেন। এর দ্বারা আবার একথা বুঝায় না যে, যারা নিজেদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলো তাদের মধ্যে ঈমানের প্রতি কোন ভালবাসা ছিল না। একথা থেকে যে বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হচ্ছে ঈমানের এ দাবীর ব্যাপারে তাদের মধ্যে শিথিলতা এসে পড়েছিলো। এ কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতি সত্ত্বেও তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলো। তাই আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে প্রথমে এ ভুল ও এর কুফল সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং পরে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সাহাবীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে নীতির অনুসারী সেটিই সঠিক নীতি ও আচরণ।
# আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী কোন অযৌক্তিক ভাগ-বাঁটোয়ারা নয়। তিনি যাকেই এ বিরাট নিয়ামত দান করেন জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে দান করেন এবং নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে যাকে এর উপযুক্ত বলে জানেন তাকেই দান করেন।
তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : মাত্র আঠারােটি আয়াতে সমাপ্ত এই সূরাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস ও আইনগত বিধি-বিধানের বেশ কিছু প্রধান প্রধান তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বিশ্বজগত এবং মানুষ সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। সেই তথ্যগুলাে মানুষের মন মগজে এক সুদূরপ্রসারী দিগন্ত ও সুউচ্চ জগত তুলে ধরে, মানুষের হৃদয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব উচ্চকিত করে। বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার নিয়ম-বিধি, সৃষ্টিজগতের লালন, বিকাশ ও পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর আইন ও বিধানের বহু মূলনীতি এতে আলােচিত হয়েছে। এ সব মূল্যবান বিষয় আলােচনার ফলে সূরাটির আকৃতি তার আয়াত সংখ্যার তুলনায় শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সূরাটি আমাদের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তা গবেষণার আহবান জানায়। সর্বপ্রথম যে বিষয়টি এই সূরা অধ্যয়নের সময় পাঠকের মনােযােগ আকর্ষণ করে তা এই যে, এটি একটি পূর্ণাংগ মহৎ, উদার, পরিচ্ছন্ন ও নির্মল সমাজের বৈশিষ্টসমূহ চিহ্নিত করে। যে স্বতন্ত্র বিধি-বিধান, নীতিমালা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে এই সমাজটি গড়ে ওঠে, যে বিধিমালা এ সমাজের স্থিতি, প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে, সেই বিধিমালা ও নীতিমালা এই সূরায় আলােচিত হয়েছে। এ সমাজ শুধু সমাজ নয়, একটি স্বতন্ত্র জগত বা একটি স্বতন্ত্র বিশ্ব। এ বিশ্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে ও আল্লাহর উদ্যোগেই আবির্ভূত এবং আল্লাহরই অনুগত। এ জগত ও এ সমাজের অধিবাসীদের হৃদয় নির্মল, আবেগ-অনুভূতি পরিচ্ছন্ন এবং ভাষা ও ব্যক্তিগত জীবন পবিত্র ও সংযত। এ সমাজের মানুষ আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রসূল(স.)-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন, অন্যের সম্মান ও মর্যাদার রক্ষক এবং নিজের চিন্তায় ও চালচলনে নিয়মানুবর্তী। সেই সাথে এ সমাজ স্বীয় শৃংখলা রক্ষায় ও স্বীয় অস্তিত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নিজস্ব আইন-কানুনের অনুসারী যা উপরােক্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি থেকেই উদ্ভূত। ফলে এ সমাজের ভেতর ও বাইর পরস্পরে সুসমন্বিত, এর আইন-কানুন ও আবেগ-অনুভূতি পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এর উদ্বুদ্ধকারী ও সতর্ককারী নীতি ও বিধিসমূহ ভারসাম্যপূর্ণ এবং এর চেতনা-অনুভূতি ও বাস্তব পদক্ষেপ পরস্পরে একাত্ম । এরূপ পরিপূর্ণ সময় ও একাত্মতা সহকারে এ সমাজ আল্লাহর প্রতি অনুরাগী ও আল্লাহর দিকে অগ্রসরমান। এ সমাজের প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ শুধুমাত্র বিবেকের স্বতস্ফূর্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা-আবেগ-অনুভূতির পরিচ্ছন্নতার ওপর নির্ভরশীল নয়। অনুরূপ তা শুধুমাত্র আইন, শাসন ও ব্যবস্থাপনার ওপরও নির্ভরশীল নয়। বরং উভয়টির সৃষ্ট সময়ের ওপরই নির্ভরশীল। এ সমাজ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত চেতনা ও সাধনা অথবা শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় নিয়ম-বিধি ও পদক্ষেপসমূহের ভিত্তিতে গঠিত হয় না ও টিকে থাকে না। বরং এ সমাজে রাষ্ট্রের সাহায্যে ব্যক্তি ও ব্যক্তির সাহায্যে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়ের দায়িত্ব, কর্তব্য ও তৎপরতা পূর্ণ সহযােগিতা ও সহমর্মিতার নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। এ সমাজ আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল(স.)-এর আদব ও সম্মান রক্ষার্থে আল্লাহ তায়ালা ও আল্লাহর বাণীর বাহক রাসূল(স.)-এর সামনে বান্দার তৎপরতাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে, তার দৃষ্টান্ত এ সূরার প্রথম আয়াতে লক্ষণীয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মােমেনরা, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের সামনে আগ বাড়িয়ে কিছু করাে না। আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে সাবধান হও। আল্লাহ তায়ালা সব কিছু শােনেন ও জানেন।’ অর্থাৎ কোনাে আদেশ বা নিষেধ জারী করার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের সীমা অতিক্রম করা কোনাে মােমেন বান্দার পক্ষে সংগত নয়। কোনাে রায় দান বা ফয়সালা ঘােষণার বেলায়ও তার সামনে অনাহূতভাবে স্ব-উদ্যোগে কোনাে প্রস্তাব পেশ করা বৈধ নয়। তিনি যা আদেশ করেন বা যা থেকে বিরত থাকতে বলেন, তা লংঘন করাও বৈধ নয়। আল্লাহর মােকাবেলায় নিজের কোনাে মত বা ইচ্ছা পােষণ করাও জায়েয নেই। আল্লাহর ভয়, লজ্জা ও আদব তথা সম্মানের তাগিদেই এই অগ্রণী হওয়ার মনােভাব তাকে ত্যাগ করতে হবে। শুধু এখানেই শেষ নয়, রসূল(স.)-এর সাথে কথাবার্তা বলার সময়ও বিশেষ আদব মেনে চলতে হবে। যেমন দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মােমেনরা! তােমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর নিজেদের কষ্ঠস্বর চড়িয়ে দিও না। আর নিজেরা পরস্পরে যেরূপ চড়াগলায় কথা বলে থাকো, রাসূল(স.)-এর সাথে সেরূপ চড়া গলায় কথা বলাে না, পাছে তােমাদের অজান্তেই তোমাদের সৎ কাজগুলাে বাতিল হয়ে না যায়। আল্লাহ তায়ালা দয়াশীল ও ক্ষমাশীল। এ সমাজের আরাে একটা বৈশিষ্ট এই যে, এ সমাজের কারাে কথা ও কাজ সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তার উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরী। আর এই নীতিও আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর রসূলের কাছ থেকে পথ-নির্দেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থেকে উদ্ভূত। এ ছাড়া আল্লাহর রসূলের সামনে আগ বাড়িয়ে কোনাে কাজ না করা এবং কোনাে অনাহুত প্রস্তাব না দেয়ার বাধ্যবাধকতা তাে রয়েছেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, কোনাে ফাসেক ব্যক্তি যদি তােমাদের কাছে কোনাে খবর নিয়ে আসে, তাহলে তার তদন্ত করাে ও নিশ্চিত হও।… আর আল্লাহ তায়ালা মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান। এই সমাজে যে সব কলহ, কোন্দল সংঘটিত হয় এবং যার মীমাংসা না করলে সমাজে বিভেদ-বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে, তার প্রতিকার ও প্রতিরােধের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কার্যকর ব্যবস্থা বিদ্যমান। যে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ দ্বারা এই সব কলহ-কোন্দলের প্রতিকার ও প্রতিরােধ করা হয়, তার ভিত্তি হলাে মােমেনদের মধ্যকার সৌভ্রাতৃত্বের নীতি, ন্যায়বিচার ও মীমাংসার নীতি এবং আল্লাহভীতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ কামনা করার নীতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, মােমেনদের দুই দল যদি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তবে তােমরা তাদের বিবাদ মিটিয়ে দাও… আল্লাহকে ভয় করাে। আশা করা যায় যে, তোমরা অনুগ্রহভাজন হবে। এ সমাজে পরস্পরের আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে কিছু মনস্তাত্ত্বিক রীতিনীতি রয়েছে। পরস্পরের সাথে আচরণেরও কিছু নীতিমালা রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, হে মােমেনরা। কোনাে গােষ্ঠীর উচিত নয় অপর কোনাে গােষ্ঠীর প্রতি বিদ্রুপ করা… যারা তাওবা করে না তারাই যালেম।’ এ সমাজ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও পরিচ্ছন্ন মনােভাব পোষণকারী। এখানে প্রত্যেকের সম্মান নিরাপদ। কেউ কারাে অসাক্ষাতে নিন্দা করে না, কেউ নিছক ধারণার বশে কাউকে অভিযুক্ত করে না, কারাে নিরাপত্তা, সম্মান ও ব্যক্তি স্বাধীনতা একেবারেই ক্ষুন্ন হয় না। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মােমেনরা, তােমরা বেশী ধারণা পােষণ থেকে বিরত থাকে।… আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ এ সমাজে মানব জাতির ঐক্যের পূর্ণাংগ ও পরিপক্ক ধারণা বিদ্যমান এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নিখুঁত ও নির্মল মানদন্ড নির্দিষ্ট রয়েছে, যা দিয়ে সে সকল মানুষের মূল্যায়ন করে এবং বহু জাতিক মানব সমাজকে এক জাতিতে পরিণত করে। এরশাদ হয়েছে, ‘হে মানব জাতি, আমি তােমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি… আল্লাহর চোখে তােমাদের মধ্যকার সবচেয়ে সৎ ও আল্লাহভীরু ব্যক্তিই সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি।’ উল্লেখিত নির্মল, নিখুঁত, পরিচ্ছন্ন ও মহৎ সমাজের বড় বড় বৈশিষ্টের উল্লেখ করার পর সূরাটি এবার ঈমানের আলামতসমূহ নির্দেশ করছে। আর এই ঈমানের নামেই মােমেনদেরকে উল্লিখিত সমাজ গঠনের ডাক দেয়া হয়েছে। এজন্যে কয়েকবারই হে মােমেনরা’ বলে সম্বােধন করা হয়েছে। এ সম্বােধন প্রত্যেক মােমেনের কাছে এতাে প্রিয় যে, এর কারণে তার কাছে ইসলামের জন্যে যে কোনাে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করা সহজ হযে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বেদুইনরা বলেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি… আল্লাহ তায়ালা সকল বিষয়ে জ্ঞানী।’ সবার শেষে সূরায় যে জিনিসটি তুলে ধরা হয়েছে, তা এই যে, ঈমান আল্লাহর একটা বিরাট বড় অনুগ্রহ, যারা এর যােগ্য, তিনি তাদেরকেই এই অনুগ্রহ দান করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, বলে তােমার কাছে কৃতিত্বের দাবী করে। তুমি বলে দাও, ইসলাম গ্রহণের জন্যে কৃতিত্বের দাবী করো না। বরং আল্লাহ যে তােমাদেরকে ঈমানের পথ দেখিয়েছেন সে জন্যে তিনিই কৃতিত্বের দাবিদার…’ সূরার দ্বিতীয় যে বৈশিষ্টটি সূরাটি অধ্যয়ন ও এর আনুষংগিক ঘটনাবলী পর্যালােচনাকালে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা এই যে, কোরআনের নির্দেশাবলীর মধ্য দিয়ে এবং রসূল(স.)-এর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই মহৎ সমাজ গঠনের জন্যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ও অপ্রতিহতভাবে অত্যন্ত জোরদার ও আপােসহীন চেষ্টা চালানাে হয়েছে। এ সমাজ পৃথিবীতে এক সময় আবির্ভূত হয়েছিলাে এবং চালু ছিলাে। সুতরাং ইসলামের কাংখিত এই সমাজ ও এই বিশ্ব কোনাে অবাস্তব আকাশ কুসুম কল্পনা নয়। ইতিহাসের কোনাে এক যুগে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত এই আদর্শ সমাজটি আকস্মিকভাবে ও রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং তা পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন একটি গাছের বীজ সুনির্দিষ্ট মেয়াদ অতিক্রম করার পর বিরাট গাছে পরিণত হয়। এ জন্যে গাছের পেছনে অনেক দীর্ঘ পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ ও লালন-পালনের প্রয়ােজন হয়। মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতেও বহু দিনের ধৈর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়ােজন হয়েছিলাে। আল্লাহ তায়ালা এই সমাজকে তার আমানত বহনের জন্যে মনােনীত করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে পৃথিবীতে তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়িত করেছিলেন। সেই যুগের সেই প্রজন্মের মধ্যে এ কাজের যােগ্যতা নিহিত ছিলাে এবং সেই সময়কার পরিস্থিতি ও পরিবেশে এ কাজ সুসম্পন্ন করার ক্ষমতা তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছিলেন। এ সব উপাদানের সম্মিলন ঘটার কারণেই সেই অতুলনীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলাে। এবার আমি সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করবাে।
‘হে মােমেনরা’ সম্বােধন দ্বারা সূরাটির সূচনা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহকে না দেখেও যারা তার ওপর ঈমান এনেছে, তাদেরকে সম্বােধন করা হয়েছে। এই ঈমানের গুণটি দ্বারাই মুসলমানরা আল্লাহর সাথে সংযুক্ত। ঈমান এমন একটি গুণ, যা মুসলমানদের অন্তরে এই চেতনার সৃষ্টি করে যে, তারা তাদের প্রতিপালকের জন্যেই, তারা তারই ব্যাজ বহনকারী, এই উপগ্রহে তারা তার অনুগত গােলাম ও সৈনিক। এ পৃথিবীতে তাদের আগমন শুধু তাদের মনিবের ইচ্ছাকে বাস্তব রূপদানের জন্যে। তিনিই তাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিয়ে ধন্য ও অনুগৃহীত করেছেন। সুতরাং তাদের জন্যে এটাই বাঞ্ছনীয় যে, তিনি যা চেয়েছেন, সেটাই তারা করবে, যা নির্দেশ দিয়েছেন, তা পালন করবে, যে অবস্থায় রেখেছেন, সে অবস্থায়ই সন্তুষ্ট থাকবে এবং তার কাছে আত্বসমর্পণ করবে। *মুমিনদের নৈতিক শিষ্টাচার : ‘হে মুমিনরা! আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের সামনে আগ বাড়িয়ে কিছু করাে না। আল্লাহর সম্পর্কে সতর্ক হও। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ অর্থাৎ হে মুমিনরা, তােমরা আল্লাহ তায়ালা বা আল্লাহর রসূলের কাছে অযাচিতভাবে কোনাে প্রস্তাব দিও না। নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও না, আশপাশের কোনাে ব্যাপারেও না, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা নিজে স্বীয় রসূলের মাধ্যমে কিছু বলেন এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের নির্দেশের সন্ধান না করে নিজেরা কোনাে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিও না। কাতাদা বলেন, কিছু কিছু লােক বলতাে, আমাদের সম্বন্ধে এ রকম নির্দেশ নাযিল হলে ভালাে হতাে। আল্লাহ তায়ালা এ কথাটা পছন্দ করেননি। আওফী বলেন, রসূল(স.)-এর সামনে বসে কথাবার্তা বলাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মােজাহেদের মতে এর অর্থ হলাে, আল্লাহ তায়ালা তার রসূলের মাধ্যমে কোনাে কিছু না জানানাে পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রসূল(স.)-এর কাছে গিয়ে নিজের মত অযাচিতভাবে ব্যক্ত করা। যাহহাক বলেন, এর অর্থ এই যে, তােমরা শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ও রাসুল(স.)-এর নির্দেশের তােয়াক্কা না করে কোনাে বিষয়ে ফয়সালা করাে না। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, এর অর্থ কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোনাে বক্তব্য পেশ করাে না। এটা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের সাথে আচরণের মনস্তাত্ত্বিক আদব বা রীতি। এটা শরীয়তের আদেশ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পদ্ধতিও। তা ছাড়া এটা আইন প্রণয়ন ও কাজ করার একটা মূলনীতিও বটে। এর উৎস হচ্ছে আল্লাহর ভয় যা আল্লাহকে সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ বলে জানার ও মানার ফলে জন্ম লাভ করে। একটি ক্ষুদ্র আয়াতে এতগুলাে বড় বড় তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। এভাবেই মুমিনরা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের আদব শিখেছেন। ফলে কোনাে মুসলমান কোনাে ব্যাপারেই আল্লাহ তায়ালা ও আল্লাহর রসূলের নির্দেশের অপেক্ষা না করে কোনাে সিদ্ধান্ত নিতাে না। হাদীসে আছে যে, রাসূল(স.) মায়ায বিন জাবালকে ইয়েমেনে পাঠানাের সময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কিসের আলােকে বিচার-ফয়সালা করবে?’ মায়ায বললেন, আল্লাহর কিতাবের আলােকে। রাসূল(স.) বললেন, সেখানে যদি না পাও, তাহলে ? মায়ায বললেন, রসূলের সুন্নাহর আলােকে। রসূল(স.) পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, সেখানেও যদি না পাও?’ মায়ায বললেন, তাহলে আমি নিজের মতের আলােকে ইজতেহাদ করবাে। রসূল(স.) বললেন, আল্লাহর শােকর যে, তিনি তাঁর রসূলের দূতকে রাসূল(স.)-এর পছন্দ মােতাবেক কাজ করার যােগ্যতা দান করেছেন।(আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা) এমনকি রাসূল(স.) যখন তাদেরকে হুজ্জাতুল বিদার দিন স্থান ও দিনের কথা জিজ্ঞাসা করেন, তখন তারা তার জবাব জানা সত্তেও বলতে সংকোচ বােধ করেন। কেননা, এটা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের সামনে আগ বাড়িয়ে কথা বলার পর্যায়ে পড়তে পারে বলে আশংকা ছিলাে। তাই তারা এভাবে জবাব দেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূল ভালাে জানেন। হাদীসে আছে যে, বিদায় হজ্জে রসূল(স.) জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন মাস? সবাই বললাে, আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল ভালাে জানেন। রসূল(স.) খানিকক্ষণ চুপ থাকলেন। সবাই মনে করলাে যে, রসূল(স.) বােধ হয় এর কোনাে নতুন নাম রাখবেন। অতপর বললেন, এটা কি যিলহজ্জ মাস নয়? সবাই বললাে, হাঁ। অতপর রসূল(স.) জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন শহর? সবাই বললাে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল ভালাে জানেন। এবারও তিনি খানিকটা থামলেন। সবাই মনে করলাে যে, তিনি বােধ হয় এর কোনাে নতুন নাম রাখবেন। অতপর বললেন, এটা কি পবিত্র শহর নয়। সবাই বললাে, হাঁ। অতপর তিনি পুনরায় বললেন, এটা কোন দিন? সবাই বললাে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল(স.) ভালাে জানেন। অতপর তিনি থামলেন। সবাই ভাবলাে, তিনি বােধ হয় এ দিনটির কোনাে নতুন নাম রাখবেন। অতপর তিনি বললেন, এটা কি কোরবানীর দিন নয়? সবাই বললাে, হাঁ। এ হচ্ছে মুসলমানদের অর্জিত আল্লাহভীতিমূলক আদব বা সম্মানের একটি রূপ। আদব বা সম্মানের দ্বিতীয় রূপটি হচ্ছে রসূল(স.)-এর সাথে কথাবার্তায় ও সম্বােধনে অনুসৃত আদব বা শ্রদ্ধাপূর্ণ রীতি এবং তাদের অন্তরে রসূলের প্রতি এরূপ ভক্তিশ্রদ্ধা পােষণ করা, যা তাদের আচরণে ও কণ্ঠস্বরে পর্যন্ত প্রকাশ পায় এবং তাদের মধ্যে রসূল(স.)-এর উপস্থিতি ও উপবেশনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। আল্লাহ তায়ালা এই আদবের আহবানই জানিয়েছেন এ আয়াতে, ‘হে মুমিনরা। তােমরা তােমাদের কণ্ঠস্বরকে নবীর কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু করাে না এবং তােমরা পরস্পরে যেমন চড়া গলায় কথা বলে থাকো, তার সাথে সেভাবে কথা বলাে-না, পাছে তােমাদের অজান্তেই তােমাদের সৎ কাজগুলাে নষ্ট হয়ে না যায়।’ এখানে প্রকারান্তরে এ কথাই বলা হয়েছে যে, তােমরা যখন ঈমানদার, তখন যে নবী তােমাদেরকে ঈমানের দিকে ডেকেছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করাে, নচেৎ তোমাদের অজান্তেই তােমাদের সৎ কাজ নষ্ট হয়ে যাবে। মুসলমানদের হৃদয়ে এই আহবান খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিলাে। ইমাম বােখারী বর্ণিত এক হাদীসে আবু মুলায়কা বলেন যে, রসূল(স.)-এর সাহাবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুই ব্যক্তি আবু বকর ও ওমরের সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলাে। একবার বনু তামিম এর একটি কাফেলা রাসূল(স.)-এর কাছে এলে (৯ম হিজরীতে) তাদের একজন রসূল(স.)-কে পরামর্শ দিলেন যে, তিনি যেন বনু মােজাশে গােত্রের আকরা বিন হাবেস(রা.)-কে কাফেলার নেতা বানান। আর অপরজন এসে অপর এক ব্যক্তিকে (মতান্তরে কা’কা ইবনে মাবাদকে) নেতা বানাতে পরামর্শ দিলেন। আবু বকর(রা.) ওমর(রা.)-কে বললেন, তুমি শুধু আমার বিরােধিতাই করতে চেয়েছো। ওমর(রা.) জবাব দিলেন, আমি তােমার বিরােধিতা করতে চাইনি। এভাবে দু’জনে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হলে তাদের কণ্ঠস্বর চড়া হয়ে গেলাে। এই ঘটনা উপলক্ষেই এ আয়াতটি নাযিল হয়। এরপর রাসূল(স.)-এর কোনাে কথা শােনার পর হযরত ওমর(রা.) তা ভালােভাবে বুঝার চেষ্টা করতেন। আর হযরত আবু বকর(রা.) রসূল(স.)-কে বলেন, হে রসূলুল্লাহ আল্লাহর কসম, আমি আপনার সাথে ফিসফিস করে কথা বলবাে। ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, এই আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন সাবিত ইবনে কায়েস অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন। তিনি বললেন, আমিই তাে রসূল(রা.)-এর সামনে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতাম, আমি তাে দোযখবাসী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছি। আমার সমস্ত সৎ কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। অতপর তিনি নিদারুণ মর্মাহত অবস্থায় নিজ গৃহে বসে রইলেন। ওদিকে রাসূল(স.) তাকে খুঁজতে লাগলেন। কেউ কেউ সাবেতকে গিয়ে জানালাে যে, রসূল(স.) তােমাকে খুঁজছেন। তােমার হয়েছে কী? সাবেত বললেন, আমি রসূল(স.)-এর সামনে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতাম। আমার সৎকাজ বরবাদ হয়ে গেছে এবং আমি দোযখবাসী রূপে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছি। লােকেরা রসূল(স.)-এর কাছে গিয়ে তার কথা জানালাে। রসূল(স.) বললেন, না, সে বরং জান্নাতবাসী। হযরত আনাস(রা.) বলেন যে, আমরা তাকে আমাদের আশপাশে দেখতাম এবং জানতাম যে, সে এক জান্নাতবাসী। এভাবেই তাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয়ে গিয়েছিলাে উক্ত আয়াতের প্রভাবে। নিজেদের অজান্তে করা সকল সৎকাজ বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয়ে রসূল(স.)-এর সামনে এরপ আদব রক্ষা করে চলতেন। তাদের জ্ঞাতসারে ব্যাপারটা হলে তারা আগে ভাগেই এর ব্যবস্থা করে রাখতেন। এই অজানা আশঙ্কা তাদেরকে সর্বাধিক ভীত করে রাখতাে। পক্ষান্তরে যারা সংযত কণ্ঠস্বরে কথা বলতো, তাদের প্রশংসা করা হয় পরবর্তী আয়াতে, ‘যারা রসূলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর সংযত রাখে, আল্লাহ তায়ালা তাদের হৃদয়কে খােদাভীতি দ্বারা পূর্ণ করার জন্যে বেছে নিয়েছেন…’ এ থেকে বুঝা যায় যে, তাকওয়া বা আল্লাহভীতি এমন একটা মর্যাদাপূর্ণ নেয়ামত যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক একমাত্র উপযুক্ত হৃদয়কেই বাছাই করেন। যারা রসূল(স.)-এর সামনে সংযতভাবে কথা বলে, তাদের হৃদয়কে আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার জন্যে বাছাই করে নিয়েছেন এবং উক্ত দান গ্রহণের যোগ্যতা দিয়েছেন। এ ছাড়া ক্ষমা ও বড় বড় পুরস্কারও তাদেরকে দান করবেন। এভাবে ভয়ংকর ভীতি প্রদর্শনের পর আকর্ষণীয় পুরস্কারের আশ্বাস দিয়েই আল্লাহ তায়ালা তার পছন্দনীয় বান্দাদেরকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান কাজের জন্যে প্রস্তুত করেন। বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত ওমর(রা.) মসজিদে নববীতে দুই ব্যক্তির চড়া আওয়ায শুনতে পেলেন। তিনি তৎক্ষণাত মসজিদের ভেতরে গিয়ে তাদেরকে বললেন, তোমরা কি জান যে, তােমরা কোথায় আছো? তােমরা কোথা থেকে এসেছাে? তারা বললেন, আমরা তায়েফের অধিবাসী। হযরত ওমর(রা.) বললেন, তােমরা যদি মদীনার লােক হতে, তাহলে আমি তােমাদেরকে পিটুনি দিতাম। আলেমরা বলেন যে, রসূল(স.)-এর কবরের কাছেও উচ্চকণ্ঠে কিছু বলা বা পড়া মাকরুহ, যাতে তার প্রতি সর্বাবস্থায় সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত হয়। পরবর্তী আয়াতে নবম হিজরীতে রসূল(স.)-এর কাছে আগত বনু তামীমের প্রতিনিধি দলের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর এই বছর আরবের সকল অঞ্চল থেকে এতাে প্রতিনিধিদল রাসুল(স.)-এর কাছে এসেছিলাে যে, বছরকে আমুল উফুদ’ বা প্রতিনিধি দলসমূহের বছর বলা হয়। এই সমস্ত প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করতে আসতাে বনু তামীমের উক্ত প্রতিনিধি দলটিতে কিছু মূর্খ ও অমার্জিত ধরনের লােক ছিলো। যেহেতু রসূল(স.)-এর স্ত্রীদের কক্ষগুলােকে মসজিদে নববী থেকে দেখা যায়, তাই এই প্রতিনিধিদল মসজিদ থেকেই এভাবে হাঁক-ডাক শুরু করে দিলাে, ‘হে মােহাম্মদ, আমাদের কাছে বেরিয়ে আসুন!” এই বিব্রতকর ও অমার্জিত আচরণ রসূল(স.)-এর পছন্দ হয়নি। তাই নাযিল হলাে পরবর্তী আয়াত, ‘যারা তােমাকে বাড়ীর বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে, তাদের অধিকাংশ নির্বোধ…’ এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের অধিকাংশকে নির্বোধ আখ্যায়িত করলেন এবং এই বেয়াদবী ও অসম্মানজনক হাঁক-ডাক রসূল(স.)-এর সুমহান ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই নয়, তাও জানিয়ে দিলেন। সেই সাথে এও জানিয়ে দিলেন যে, তারা যদি রসূল(স.)-এর স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তাহলে ভালাে হতাে। আয়াতের শেষ ভাগে তাদেরকে তাওবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং আল্লাহর ক্ষমা ও অনাগ্রহের আশা করতে বলা হয়েছে। মুসলমানরা এই উচ্চ মানের আদব বা ভক্তিশ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণকে রপ্ত করেছে যে, তা শুধু রসূল(স.) পর্যন্ত সীমিত থাকেনি, বরং প্রত্যেক আলেমের সাথে এরূপ আচরণ করেছে। নিজে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত তারা কাউকে বিরক্ত করতাে না এবং না ডাকলে তার কাছে আসতাে না। বিশিষ্ট আলেম আবু ওবাদ বলেছেন যে, আমি কোনাে আলেমের কাছে যখনই গিয়েছি, তিনি নিজের নির্দিষ্ট সময়ে বের না হওয়া পর্যন্ত কখনাে তার দরজায় করাঘাত করিনি।
*তথ্যের সত্যতা যাচাই করা : ‘হে মুমিনরা, তোমাদের কাছে কোনাে ফাসেক কোনাে খবর আনলে তার সত্যাসত্য যাচাই করাে।’ বিশেষভাবে ফাসেকে উল্লেখ করার কারণ এই যে, তার সম্পর্কে মিথ্যার ধারণা প্রবল হয়ে থাকে। ফাসেকের কথা উল্লেখ করার আর একটি কারণ এই যে, মুসলিম সমাজে ও সংগঠনে প্রচারিত কোনাে খবর নিয়ে যেন সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। এমনটি হলে তার তথ্য প্রবাহে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। বস্তুত মােমেনদের দলে মৌলিক আকাংখিত জিনিস হলাে তার সদস্যদের বিশ্বস্ততা এবং তাদের প্রচারিত খবরের বিশ্বাসযােগ্যতা। শুধুমাত্র ফাসেকই সন্দেহজনক থাকবে-যতক্ষণ তার খবর প্রমাণিত না হয়। ইসলামী সমাজ ও সংগঠনের কাছে যখন কোনাে খবর পৌছবে, তখন তার প্রশাসন উক্ত খবর গ্রহণ ও বর্জনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। ফাসেকের খবরের ভিত্তিতে কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণে তাড়াহুড়া করবে না, যাতে অজ্ঞতাবশত কারাে বিরুদ্ধে অন্যায় ও অবিচারমূলক পদক্ষেপ গৃহীত না হয় এবং পরিণামে আল্লাহর ক্রোধােদ্দীপক কাজ করে অনুশােচনা করতে না হয়। *নাযিলের পটভূমি : বহু সংখ্যক মােফাসসের উল্লেখ করেছেন যে, এ আয়াত ওলীদ বিন ওকবার উপলক্ষে নাযিল হয়েছে। রাসূল(স.) তাকে বনু মুসতালিকের যাকাত আদায় করে আনার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। ইবনে কাসীর বলেন, ওলীদ ফিরে এসে জানালাে যে, বনুল মুসতালিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে (কাতাদার মতে তারা ইসলামও ত্যাগ করেছে বলে সে জানিয়েছিলাে) রসূল(স.) তাদের কাছে খালেদ বিন ওলীদকে পাঠালেন এবং তাকে আদেশ দিলেন, যেন তিনি তাড়াহুড়া না করেন, বরং ধীরস্থিরভাবে সত্যাসত্য যাচাই করেন। খালেদ তাদের কাছে রাতের বেলায় পৌঁছলেন এবং তার প্রধান প্রধান সহচরদেরকে তাদের কাছে পাঠালেন। তারা ফিরে এসে খালেদকে জানালাে যে, গােত্রটি ইসলামের ওপর অবিচল আছে এবং তারা তাদের আযান ও নামায শুনেছে। সকাল বেলা খালেদ নিজে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি রসূল(স.)-এর কাছে ফিরে এসে প্রকৃত ব্যাপার জানালেন। অতপর আল্লাহ তায়ালা এ আয়াত নাযিল করলেন। কাতাদা বলেছেন যে, রাসূল(স.) বলতেন, ধৈর্যের সাথে সত্যাসত্য যাচাই করা আল্লাহর প্রেরণা থেকে উদ্ভূত কাজ আর তাড়াহড়া করা শয়তানের প্ররােচিত কাজ। (ইবনে কাসীর) আয়াতের বক্তব্য ব্যাপক ও সর্বাত্মক। ফাসেকের খবর প্রমাণ সাপেক্ষ, আর সৎ মােমেন বিশ্বাসযােগ্য। কেননা, মােমেনদের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক ও মূলকথা। ফাসেকের খবর ব্যতিক্রম, আর সৎ লােকের খবর বিশ্বাস করা সত্যাসত্য যাচাই করার নীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। কেননা, সৎ লােক সঠিক খবরের অন্যতম উৎস, সকল খবরে ও সকল খবরদাতায় সন্দেহ প্রকাশ করা মুসলমানদের সমাজে প্রচলিত বিশ্বস্ততার সাধারণ নীতির পরিপন্থী এবং তাতে সমাজের সাধারণ জীবনযাত্রা অচল হয়ে যেতে বাধ্য । ইসলাম সাধারণ জীবনযাত্রা ব্যাহত না করে তাকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়ার পক্ষপাতী। সে যে সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কড়াকড়ি আরােপ করে, তা কেবল তার নিরাপত্তার জন্যেই করে। তাকে একেবারে অচল করে দেয়ার জন্যে নয়। খবরের সূত্র ও উৎস সম্পর্কে সাধারণ নীতি ও ব্যতিক্রমী নীতির মূলকথা এটাই।
সম্ভবত ওলীদ বিন ওকবার খবর শুনে মুসলমানদের কতকের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলাে। এবং তারা রসূল(স.)-কে ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে বনু মুসতালিককে শাস্তি দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলাে। এ পরামর্শের কারণ ছিলাে এই যে, উত্তেজিত গােষ্ঠীটি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ ছিলাে এবং যাকাত না দিতে চাওয়ায় ক্রোধে অধীর হয়ে পড়েছিলাে। এ জন্যে পরবর্তী আয়াতে তাদের কাছে বিদ্যমান এক দুর্লভ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে তারা এই নেয়ামতের মর্যাদা উপলব্ধি করে এবং সর্বদা তার ব্যাপারে সতর্ক থাকে। এই নেয়ামতটি আর কিছু নয়-স্বয়ং রসূলুল্লাহর অস্তিত্ব। জেনে রাখাে যে, তােমাদের মধ্যে আল্লাহর রসূল রয়েছেন। এটি এমন একটি সত্য যা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। কেননা, এটি বিদ্যমান ও দৃশ্যমান। তবে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায় যে, এটি একটি গরুত্বপূর্ণ সত্য, যা সহজে উপলব্ধি করা যায় না। মানুষ মহান আল্লাহর সাথে প্রতিনিয়ত যােগাযােগ করবে। আল্লাহ তায়ালা যখন তখন মানুষের সাথে কথা বলবেন, তাদের গােপন ও প্রকাশ্য খবর জানবেন, তাদের ভুলত্রুটি শুধরে দেবেন, তাদেরকে পরামর্শ ও উপদেশ দেবেন, তাদের কে কি করলাে, কে কি বললাে, কে মনের কোন কথা গােপন করলাে, তা আল্লাহ তায়ালা জেনে তাঁর রসূলকে জানাবেন এবং তাকে যা করা দরকার তা করতে বলবেন-এটা কি সহজ ব্যাপার ? নিশ্চয়ই নয়। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। রসূলকে যারা হাতের কাছে ও নাগালের মধ্যে পেয়েছে, তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি নাও করতে পারে। এ জন্যেই রসূল(স.)-এর বিদ্যমান থাকা সম্পর্কে এভাবে সাবধান করা হয়েছে যে, ‘জেনে রাখাে যে, তােমাদের মধ্যে আল্লাহর রসূল রয়েছেন।’ অর্থাৎ এই দুর্লভ নেয়ামতের যথাযথ কদর করাে। কেননা, এ এক অসাধারণ নেয়ামত। এই অসাধারণ নেয়ামতের অন্যতম দাবী এই যে, মুসলমানরা যেন আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের সামনে আগ বাড়িয়ে কোনাে কাজ না করে। এই নির্দেশকে অধিকতর স্পষ্ট ও জোরদার করা হয়েছে এই বলে যে, রসূল(স.) আল্লাহর ওহী ও ইলহাম দ্বারা তাদের জন্যে যা কিছু ব্যবস্থা করেন, তাতেই তাদের কল্যাণ, অনুগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিহিত রয়েছে। পক্ষান্তরে তারা নিজেরা যে জিনিসকে ভালাে মনে করে, তার জন্যে তারা যদি রসূলকে পরামর্শ দেয় এবং রসূল(স.) যদি তাদের পরামর্শ খুব বেশী মেনে চলেন, তাহলে তারা কষ্টে পতিত হবে। কেননা, তাদের কিসে ভালাে হবে, তা আল্লাহই সবচেয়ে ভালাে জানেন। আর তার রসূল মুসলমানদের জন্যে যা কিছু ব্যবস্থা করেন ও মনােনীত করেন, তা তাদের জন্যে আল্লাহর এক অনুগ্রহ বলা হয়েছে, ‘তিনি যদি তাদের পরামর্শের খুব বেশী আনুগত্য করেন, তাহলে তােমরা কষ্টে পতিত হবে।’ এখানে পরােক্ষভাবে এ কথাই বলা হয়েছে যে, তাদের উচিত তাদের যাবতীয় বিষয় আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের হাতে ন্যস্ত করা। পুরােপুরি ইসলামের ভেতরে প্রবেশ করা। আল্লাহর ফয়সালা ও ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং তাকে পরামর্শ না দিয়ে তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করা। *রিসালাতের অতুলনীয় নেয়ামত : অতপর মােমেনদের দৃষ্টি ফেরাচ্ছেন ঈমানের ন্যায় অমূল্য নেয়ামতের প্রতি, যার দিকে তিনি তাদেরকে পথ-প্রদর্শন করেছেন, তার প্রতি তাদের হৃদয়ে গভীর ভালােবাসা ও আসক্তি সৃষ্টি করেছেন, তার সৌন্দর্য ও মহত্ব প্রদর্শন করেছেন এবং কুফরী, ফাসেকী ও নাফরমানীকে তাদের কাছে অপছন্দনীয় করেছেন। এ সবই আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ। বলা হয়েছে, ‘কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তােমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তােমাদের অন্তরে তাকে সুন্দর করেছেন…’ আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তাঁর এক দল বান্দার বক্ষকে ঈমানের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া, ইসলামকে আকর্ষণীয় ও সুন্দর করে দিয়ে তার দিকে তাদের মনকে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা এবং ইসলামের কল্যাণ ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে দেয়া আল্লাহর অসাধারণ নেয়ামত ও অনুগ্রহ। অন্য সকল নেয়ামত ও অনুগ্রহ তার সামনে তুচ্ছ। এমনকি জীবন ও জগতের মতাে বিরাট ও বিশাল নেয়ামতও ঈমানের চেয়ে তুচ্ছ জিনিস। এ সম্পর্কে আলােচ্য সূরার শেষাংশে বিস্তৃত আলােচনা করার ইচ্ছা রইলাে। এখানে যে জিনিসটি পাঠককে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে, তা হলাে এই যে, আল্লাহই যে তাদের জন্যে এই কল্যাণ কামনা করেছেন এবং তিনিই যে তাদের মনকে কুফরী, ফাসেকী ও নাফরমানী থেকে মুক্ত করেছেন, সেই কথা তিনি তাঁর বান্দাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিনিই নিছক অনুগ্রহের বশে তাদেরকে সুপথগামী করেছেন, আর এসবই ছিলাে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে উদ্ভূত। আর এ কথা বলার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে বান্দাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ ও পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পন। এর ভেতরে যে কল্যাণ রয়েছে তাতে সন্তুষ্ট হওয়া এবং স্বকল্পিত কল্যাণের জন্যে পরামর্শ দান, তাড়াহুড়া করা ও উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত হওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। তাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের জন্যে যা সিন্ধান্ত নেন তাতেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর আল্লাহর রসূল এই কল্যাণের দিকে বান্দাদেরকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাদের মধ্যে রয়েছেন। এটাই এ আয়াতের মূল বক্তব্য। মানুষ তাড়াহুড়া করতে অভ্যস্ত। অথচ সে তার প্রতি পদক্ষেপের পরিণাম জানেনা। মানুষ নিজের জন্যে ও অন্যের জন্যে পরামর্শ দেয়। অথচ সে জানে না তার পরামর্শে কতটুকু কল্যাণ ও অকল্যাণ নিহিত আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষ কল্যাণের জন্যে যেমন প্রার্থনা করে, অকল্যাণের জন্যেও তেমনি করে। মানুষ বড়ই দ্রুততাপ্রিয়। মানুষ যদি পুরােপুরিভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর ও তার কাছে আত্মসমর্পণ করতাে এবং বুঝতাে যে, তার জন্যে আল্লাহ তায়ালা যা পছন্দ করেন, তা তার নিজের পছন্দের চেয়ে কল্যাণকর ও উপকারী, তাহলে সে প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পারতাে। পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র জীবনে সে সুখী হতে পারতাে। কিন্তু এই সুখও আল্লাহর দান, যাকে তা দেন সেই তা পায় ।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
الْحُجُرَات শব্দটি حُجْرَةٌ এর বহুবচন, অর্থ হলো কক্ষসমূহ, কামরা, রুম ইত্যাদি। অত্র সূরার ৪ নং আয়াতে الْحُجُرَاتِ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, তাছাড়া এ সংক্রান্ত একটি ঘটনাও উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তাই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরার মূল আলোচনা ও শিক্ষার প্রতি লক্ষ্য রেখে একে
سورة الأخلاق والأدب
বা শিষ্টাচারের সূরাও বলা হয়। সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়।
সূরা হুজরাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা। এতে সামাজিক বিধি-বিধানসহ ধর্মীয় বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণ ও শিষ্টাচার তুলে ধরা হয়েছে, বয়োজ্যেষ্ঠ ও ধর্মীয় আলেমদের সাথে কিরূপ আদব রেখে কথা বলতে হবে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নামে মিথ্যা হাদীস তৈরির ভয়াবহতা, সংবাদ সংগ্রহ ও তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা, মু’মিনদের মাঝে আপোষে কোন বিষয়ে দ্বন্দ্ব হলে করণীয়, মুসলিমদের সম্মানের মূল্য ও তা যেন ক্ষুণœ না হয় সেজন্য বর্জনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং যারা তাতে লিপ্ত হবে তাদের অপরাধের ভয়াবহতা, ঈমান ও ইসলামের মাঝে পার্থক্য এবং প্রকৃত সত্যবাদীদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নূযুল :
আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : বনু তামীম গোত্রের একটি কাফিলা (তাদের নেতা নির্বাচনে) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে আগমন করে। আবূ বাকর (রাঃ) বললেন : কা‘কা‘ বিন মা‘বাদকে তাদের আমীর নিযুক্ত করে দিন। উমার (রাঃ) বললেন : আকরা বিন হাবেসকে নিযুক্ত করে দিন। আবূ বকর (রাঃ) বললেন : (হে উমার) তুমি আমার বিরোধিতা করতে চাচ্ছ! উমার (রাঃ) বললেন : আমি আপনার বিরোধিতা করতে চাইনি। এভাবে কথা কাটাকাটি করতে করতে একপর্যায়ে তাদের আওয়াজ উঁচু হয়ে যায়। তখন
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُقَدِّمُوْا بَیْنَ یَدَیِ اللہِ وَرَسُوْلِھ۪ وَاتَّقُوا اللہَ)
আয়াতটি অবতীর্ণ হয়ে মু’মিনদেরকে সতর্ক করা হয় তারা যেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপস্থিতিতে উঁচু আওয়াজে কথা না বলে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৪৭) এ ছাড়াও উক্ত আয়াতের কয়েকটি শানে নূযুল পাওয়া যায়। (ইবনু কাসীর, লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল)
সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে সতর্ক করে বললেন : “হে মু’মিনগণ!” এর অর্থ হল আল্লাহ তা‘আলা পরবর্তী যে আদেশ বা নিষেধ করছেন তা খুব সতর্কতার সাথে খেয়াল করা। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন : যখন তুমি আল্লাহ তা‘আলাকে বলতে শুনবে, “হে মু’মিনগণ!” তাহলে তুমি তা খুব খেয়াল করে শুনবে। কারণ হয়তো মহান আল্লাহ কোন কল্যাণের নির্দেশ দেবেন অথবা কোন অকল্যাণ থেকে নিষেধ করবেন। সুতরাং আমাদের কতটুকু সতর্ক হওয়া উচিত।
মুফাসসিরগণ (لَا تُقَدِّمُوْا) ‘তোমরা অগ্রবর্তী হয়ো না’ আয়াতের এ অংশের তিন ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে অধিক সঠিক ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাটি হল : (لَا تُقَدِّمُوْا) এ শব্দটি ভবিষ্যতমূলক অকর্মক ক্রিয়া (فعل لازم), যার অর্থ হল অগ্রবর্তী হয়ো না। (আযওয়াউল বায়ান ৭/৩৬২) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী হতে নিষেধ করা হয়েছে তা বলে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তাই এতে ব্যাপকতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ যে কোন কাজ ও কথায় আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অগ্রবর্তী হয়ো না। বরং নির্দেশ বা অনুমতির অপেক্ষা কর এবং যে কাজ ও কথা থেকে নিষেধ করেন তা বর্জন কর। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :
(لَا تُقَدِّمُوْا بَيْنَ يَدَيِ اللّٰهِ)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা বলাকালীন কথা বলতে নিষেধ করা হচ্ছে। (ফাতহুল কাদীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সুতরাং দীনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা যা দেননি ও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলেননি, করেননি এবং অনুমোদনও দেননি তা করা ও বলা স¤পূর্ণ হারাম। কারণ এসব করা ও বলা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অগ্রণী হওয়ার শামিল। এখান থেকে আরো শিক্ষা হল- যারা জ্ঞানে বড় তাদের সাথে শিষ্টাচার বর্হিভূত আচরণ করা অন্যায়। বরং শ্রদ্ধা রেখে শালীন আচরণ করতে হবে।
(وَاتَّقُوا اللّٰهَ) ‘আল্লাহকে ভয় কর’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁকে ভয় কর। তাহলে ইহকালীন শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে আর পরকালে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী জাতিকেও তাকওয়ার অসিয়ত করেছিলেন। (সূরা নিসা ৪ : ১৩১)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : যখন
(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ…..)
ওহে ‘যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের আওয়াজ নাবীর আওয়াজের চেয়ে উঁচু কর না’ আয়াতটি অবতীর্ণ হল তখন সাবেত বিন কায়েস বিন শামমাস বললেন : আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আওয়াজের ওপর আমার আওয়াজকে উঁচু করেছিলাম। আমার সকল আমল বাতিল হয়ে গেছে। আমি জাহান্নামবাসী। তিনি তাঁর বাড়িতে চিন্তিত অবস্থায় বসে রইলেন। একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে অনেক সময় ধরে পাচ্ছেন না। কিছু মানুষ তাঁর কাছে গেল। তারা বলল : আপনাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাচ্ছেন না। আপনার কী হয়েছে? তিনি বললেন : আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আওয়াজের ওপর আমার আওয়াজকে উঁচু করেছিলাম। আমার সকল আমল বাতিল হয়ে গেছে। আমি তো জাহান্নামী হয়ে গেছি। তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে এ খবর জানালো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : না বরং সে জান্নাতবাসী। তারপর তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৪৬)
لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ))
‘তোমাদের আওয়াজ নাবীর আওয়াজের চেয়ে উঁচু কর না’ অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় মু’মিনদেরকে সতর্ক করার জন্য হে ঈমানদারগণ বলে সম্বোধন করেছেন, যাতে তারা বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন ‘তোমাদের আওয়াজ নাবীর আওয়াজের চেয়ে উঁচু কর না’ এখানে এ শিক্ষা ও নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি সতর্ক থাকে। তাদেরকে নিষেধ করছেন যেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কণ্ঠস্বর থেকে তাদের কন্ঠস্বর উঁচু না করে এবং নিজেদের মাঝে যেমন পরস্পর আওয়াজ করে কথা বলে তেমনভাবে তাঁর সাথে আওয়াজ করে কথা বলবে না। আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এমনভাবে সম্বোধন করবে না যেমনভাবে তোমরা একে অপরকে সম্বোধন করে থাক। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নাম ধরে ডাকবে না বরং তাঁর মর্যাদা ও সম্মানের সাথে উপযোগী হয় এমন ভাষায় সম্বোধন করবে। যেমন হে আল্লাহ তা‘আলার নাবী, হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لَا تَجْعَلُوْا دُعَا۬ءَ الرَّسُوْلِ بَيْنَكُمْ كَدُعَا۬ءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا)
রাসূলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহ্বানের মত গণ্য কর না (সূরা নূর ২৪ : ৬৩)। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের কোথাও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর নাম ধরে আহ্বান করেননি। কখনো হে নাবী (সূরা আনফাল ৮ : ৬৪) কখনো হে রাসূল (সূরা মায়িদা ৫ : ৪১) ইত্যাদি ভূষণে আহ্বান করেছেন। যেখানে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন সেখানে সম্মানজনক উপাধিও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অন্যান্য নাবীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা নাম নিয়ে সম্বোধন করেছেন। সুতরাং নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁকে সম্বোধন করা ও নিচু আওয়াজে কথা বলা আবশ্যক। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবরের সামনে বেশি উঁচুস্বরে সালাম ও কালাম করা নিষিদ্ধ। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান করা তাঁর মৃত্যুর পরও ওয়াজিব। তদনুরূপ যে মজলিসে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস পাঠ করা হয় সেখানে উঁচু আয়াজে কথা বলা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উত্তরাধিকারী আলেম ও ধর্মীয় নেতাদের সাথেও এ আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। তবে আদব দেখাতে গিয়ে যেন সীমালংঘন না হয়।
সুতরাং নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে উঁচু আওয়াজে কথা না বলার জন্য এতো কঠিনভাবে নিষেধ করা হয় তাহলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে কটুক্তি করা, ব্যঙ্গ করা, তাঁর নামে মিথ্যা হাদীস তৈরি কত বড় অপরাধ হতে পারে!
দু’টি মাসআলা :
(১) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্মান প্রদর্শন না করে তাঁর মানহানীকর কোন কথা ও কাজ করা, তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করা কুফরী কাজ এবং যে তা করে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। তাবূক যুদ্ধ ফেরত যে সকল মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের নিয়ে ঠাট্টা করেছিল তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَئِنْ سَاَلْتَھُمْ لَیَقُوْلُنَّ اِنَّمَا کُنَّا نَخُوْضُ وَنَلْعَبُﺚ قُلْ اَبِاللہِ وَاٰیٰتِھ۪ وَرَسُوْلِھ۪ کُنْتُمْ تَسْتَھْزِءُوْنَﮐ لَا تَعْتَذِرُوْا قَدْ کَفَرْتُمْ بَعْدَ اِیْمَانِکُمْ)
“এবং তুমি তাদেরকে প্রশ্ন করলে তারা নিশ্চয়ই বলবে : ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও ক্রীড়া-কৌতুক করছিলাম।’ বল : ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শন ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে বিদ্রূপ করছিলে? ‘তোমরা ওজর পেশ কর না। তোমরা ঈমান আনার পর কুফরী করেছ।” (সূরা তাওবা ৯ : ৬৫)
(২) আল্লাহ তা‘আলার হক ও বান্দার হকের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব যাতে এক জনের হক অপরজনকে প্রদান না করে। আল্লাহ তা‘আলার হক হল একমাত্র তাঁর ইবাদত করা আর বান্দার হকের মধ্যে নাবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হক হল তাঁকে নাবী হিসেবে গ্রহণ করত তাঁর নির্দেশ পালন করা এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা এবং তিনি ইবাদত করার যে পথ ও রীতি দিয়ে গেছেন সে পথ ও রীতিতে ইবাদত করা। সুতরাং নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে যেন ইলাহের মর্যাদায় পৌঁছে না দেই সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
(أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ)
‘এমন করলে তোমাদের আমল বরবাদ হয়ে যাবে আর তোমরা টেরও পাবে না’ অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে উঁচ আওয়াজে কথা বলা থেকে নিষেধের কারণ হল, তাঁর সাথে এমন বেআদবীমূলক আচরণ করার কারণে হয়তো তিনি নারাজ হবেন ফলে আল্লাহ তা‘আলাও নারাজ হয়ে তোমাদের আমল বাতিল করে দিবেন কিন্তু তোমরা তা বুঝতেও পারবে না।
অতঃপর সেসব লোকেদের প্রশংসা করছেন যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আওয়াজকে নিচু করে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. দীনের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় কুরআন ও সুন্নাহর ওপর নিজের মতকে প্রাধান দেয়া।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কথাবার্তা বলার শিষ্টাচার জানতে পারলাম।
৩. যেখানে হাদীসের দারস হয় সেখানে উঁচু আওয়াজে কথা বলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে উঁচু আওয়াজে কথা বলার নামান্তর।
৪. দীনে বিদ‘আত সৃষ্টি করা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের অগ্রগামী হওয়ার শামিল।
৫. আলেম-উলামা ও ধর্মীয় নেতাদের সম্মান করতে হবে তবে সম্মান করতে গিয়ে যেন বাড়াবাড়ি না হয় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
৪-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নূযুল :
বানী তামীম গোত্রের কিছু অজ্ঞ লোকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তারা দুপুর বেলায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিশ্রামের সময় আগমন করে। তাদের কাছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বের হয়ে আসার পূর্বেই ডাকতে শুরু করে, হে মুহাম্মাদ! হে মুহাম্মাদ! আমাদের কাছে বেরিয়ে আস, এরূপ কথা বলে ডাকতে থাকে। তখন
(إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ…)
আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আহমাদ : ৩/৪৮৮, সহীহ) আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তিরস্কার করে বলছেন, তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ। ডাকাডাকি না করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করত তাহলে এটা তাদের জন্য উত্তম ছিল।
এ আয়াত নাযিল হলে আবূ বকর (রাঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি আমার আওয়াজ কখনো উঁচু করব না, নিচু আওয়াজে কথা বলব। (মুসনাদ আহমাদ হা. ১৫৭০০, সহীহ)
প্রাচীর চতুষ্টয় দ্বারা বেষ্টিত স্থানকে الْحُجُرَاتِ বলা হয়। যাতে কিছু বারান্দা ও ছাদ থাকে। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ৯ জন স্ত্রী ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক হুজরা ছিল। তিনি পালাক্রমে এসব হুজরায় আসতেন। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : যখন আমি কোন আলেম সাহাবীর কাছ থেকে কোন হাদীস লাভ করতে চাইতাম তখন তাঁর গৃহে পৌঁছে ডাকাডাকি অথবা দরজার কড়া নাড়া থেকে বিরত থাকতাম এবং দরজার বাইরে বসে অপেক্ষা করতাম। তিনি যখন নিজেই বাইরে আগমন করতেন তখন আমি তাঁর কাছে হাদীস জিজ্ঞাসা করতাম। তিনি আমাকে দেখে বলতেন, হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চাচাত ভাই! আপনি দরজার কড়া নেড়ে আমাকে সংবাদ দিলেন না কেন? ইবনু অব্বাস (রাঃ) বলেন : আলেম সমাজ জাতির জন্য পয়গম্বরসদৃশ। আল্লাহ তা‘আলা পয়গম্বর সম্পর্কে আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁর বাহির হয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
আবূ ওবায়দা (রাঃ) বলেন : আমি কোনদিন কোন আলেমের দরজায় যেয়ে নাড়া দেইনি। বরং অপেক্ষা করেছি, তিনি নিজেই বাইরে আসলে সাক্ষাত করব।
সুতরাং নাবীদের ওয়ারিশ আলেম সমাজের সম্মান ও মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রাখা মু’মিনদের দায়িত্ব। তবে যদি আলেম বিদ‘আতী হয় তাহলে তাকে সম্মান করা যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুউচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের বর্ণনা পেলাম।
২. গ্রাম্য ব্যক্তিরা সাধারণত আদব আখলাক সম্পর্কে একটু অজ্ঞ। তাই তাদের আচরণে মনঃক্ষুণœ না হয়ে আদব শিক্ষা দেয়া উচিত।
৬-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, অলীদ বিন উকবা (রাঃ) সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। তাঁকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বানী মুসতালিক গোত্রের যাকাত আদায় করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি রাস্তা থেকে ফিরে এসেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল, তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করার মনন্থ করেছে (উল্লেখ্য যে, অলীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে উক্ত গোত্রের পূর্ব শত্র“তা ছিল)। এ সংবাদের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খালেদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করলেন। কিন্ত পরক্ষণে জানতে পারলেন যে, সংবাদটি ভুল ছিল। অলীদ (রাঃ) সেখানে যাননি। ঘটনাটি আরো বিস্তারিত রয়েছে। তবে ঘটনাকে অনেকে সনদ ও বাস্তবতার দিক দিয়ে দুর্বল বলেছেন। আবার অনেকে হাসান বলেছেন। তাই এ ধরণের কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের ব্যাপারে বলা ঠিক নয়। তবে আয়াতের শানে নূযুলের প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, এতে অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি নীতি বর্ণনা করা হয়েছে যা বৈষয়িক ও সামাজিক জীবনে বড় গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক সাংবাদিক ও শাসকের উচিত যে-কোন সংবাদ গ্রহণের পূর্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেয়া। অন্যথায় পরবর্তীতে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে। আয়াতটি প্রমাণ করছে পাপিষ্ট ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণের পূর্বে যাচাই-বাছাই করতে হবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَّلَا تَقْبَلُوْا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا ج وَأُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ)
“এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না; তারাই তো পাপাচারী।” (সূরা নূর ২৪ : ৪)
দীনের ব্যাপারে ফাসিক তথা পাপিষ্ঠ ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণ করা যাবে না এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত। আয়াতটি দুটি বিষয় প্রমাণ করছে :
১. ফাসিক ব্যক্তি কোন সংবাদ দিলে তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করা ওয়াজিব।
২. ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণ করা আবশ্যক।
উক্ত আয়াতের আলোকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম হাদীসে গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, সংরক্ষণ ও অন্যের কাছে বর্ণনার সময় সতর্কতা অবলম্বন এবং বর্ণনাকারীদের বিশস্ততার প্রতি খেয়াল রেখেছেন।
সুতরাং একজন ব্যক্তির কোন বিষয়ে আমল করার পূর্বে সে সম্পর্কে সঠিক প্রমাণ জেনে নেয়া আবশ্যক। অন্যথায় কখন যে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে নিজেও বুঝতে পারবে না। আর ধর্মসহ যে-কোন বিষয়ে কেউ কোন সংবাদ দিলে তা যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। বিশেষ করে বর্তমানে মিডিয়াগুলো অমুসলিম ও বামপন্থিদের কর্তৃত্বাধীন, তারা কোনদিন মুসলিমদের কল্যাণ ও উন্নতি চায় না, তাই তারা মুসলিমদের ব্যাপারে সঠিক সংবাদ প্রচার করবে না। তিলকে তাল বানাবে, সত্য গোপন করে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করবে। মুসলিম সাংবাদিকদের উচিত সঠিক তথ্য প্রচার করা, সত্য গোপন না করা।
نٰدِمِيْنَ অর্থাৎ সংবাদ যাচাই বাছাই না করত : তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে মিথ্যা সংবাদকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করে সত্য সংবাদকে মিথ্যা বলে, মুসলিমদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করে এবং সমাজে ভুল সংবাদ প্রচারের জন্য পরে আফসোস করবে।
সাহাবীদের ন্যায়পরায়ণতা : সাহাবীরা নিষ্পাপ নন, তাদের দ্বারাও কবীরা গুনাহ হতে পারে যা তাৎক্ষণিক ঈমানী দুর্বলতার প্রমাণ বহন করে। তাদের দ্বারাও কবীরা গুনাহ হলে দুনিয়াতে শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হত, যেমন স্বয়ং নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবী মায়েযকে ব্যভিচার করার কারণে পাথর মেরে হত্যা করে ছিলেন। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর বর্ণনানুপাতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদাহ হল সাহাবী গুনাহ করতে পারেন, তবে এমন কোন সাহাবী নেই যিনি গুনাহ থেকে তাওবা করেননি। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর সন্তুষ্টি ঘোষণা করেছেন-
((رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ
“আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা বাইয়্যিনাহ ৯৮ : ৮) গুনাহ ক্ষমা করা ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হন না। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, তারা সন্তুষ্টির ওপরই মৃত্যুবরণ করবেন।
তাছাড়া সাহাবীদের নেকীর কাজের তুলনায় গুনাহর কাজ খুবই কম ছিল। তারা ইসলামের জন্য নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করেছেন, নিজেদের ঘর-বাড়ি বিসর্জন দিয়েছেন; এরূপ দৃষ্টান্ত প্রচুর। তাদের ভাল কাজের নেকী সাধারণ মুসলিমদের থেকে বহুগুণ বেশি। তারা এমন মুহূর্তে ইসলামকে সহযোগিতা করেছেন যখন ইসলামের নাবীকে হত্যা ও ইসলামকে বিদায় করার জন্য কাফিররা ঐক্যবদ্ধ ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ তোমাদের কেউ উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ ব্যয় করলেও তাদের এক মুদ অথবা তার অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৩৬৭৩)
সুতরাং সাহাবীদের ব্যাপারে আমাদের জবান ও অন্তর সম্পূর্ণ স্বচ্ছ থাকবে। আমরা বিশ্বাস করব আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁরা উম্মাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।
(وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللّٰهِ)
অর্থাৎ জেনে রেখো যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদ্যমান রয়েছেন। সুতরাং তোমরা তাঁকে সম্মান কর, আদবের সাথে কথা বল। তাঁর দিক নিদের্শনা মেনে চল। কেননা তোমাদের কল্যাণ সম্পর্কে তিনি অধিক জানেন, তিনি তোমাদের প্রতি অধিক দয়ালু।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَلنَّبِيُّ أَوْلٰي بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ)
“নাবী মু’মিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ৬)
(لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ)
অর্থাৎ যে সকল সংবাদ তোমরা দিয়ে থাক তিনি যদি সে সকল সংবাদের ব্যাপারে তোমাদের অনুসরণ করতেন তাহলে তোমরাই কষ্টে পতিত হতে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَا۬ءَهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمٰوٰتُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيْهِنَّ ط بَلْ أَتَيْنٰهُمْ بِذِكْرِهِمْ فَهُمْ عَنْ ذِكْرِهِمْ مُّعْرِضُوْنَ)
“সত্য যদি তাদের কামনা-বাসনার অনুগামী হত তবে বিশৃংখল হয়ে পড়ত আকাশসমূহ, পৃথিবী এবং তাদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুই। বরং আমি তাদেরকে উপদেশ দিয়েছি, কিন্তু তারা উপদেশ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা মু’মিনুন ৪০ : ৭১)
(وَلَكِنَّ اللّٰهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ)
অর্থাৎ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করে নিয়েছেন এবং তা তোমাদের জন্য হৃদয়গ্রাহী করেছেন। ফলে তোমাদের ঈমান বিনষ্ট হয় এমন কোন কাজ হবে না।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট করে বলেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(مَنْ يَّهْدِ اللّٰهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ ج وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَه۫ وَلِيًّا مُّرْشِدًا )
“আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথপ্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনও তার কোন পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না।” (সূরা কাহফ ১৮ : ১৭)
আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কাছে কুফরী ও পাপাচার অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা পাপ কাজে লিপ্ত হবে না, শয়তানের প্রয়োচনায় লিপ্ত হলেও তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা চেয়ে পাপের কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ করে বলতেন :
اَللّٰهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الإِيمَانَ وَزَيِّنْهُ في قُلُوبِنَا وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ وَاجْعَلْنَا مِنَ الرَّاشِدِينَ
হে আল্লাহ তা‘আলা! তুমি আমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দাও এবং আমাদের অন্তরকে তা দ্বারা সুশোভিত করে দাও। আমাদের নিকট কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতা অপছন্দনীয় করে দাও। আমাদেরকে সুপথ প্রাপ্তদের মধ্যে শামিল করে নাও। (নাসাঈ হা. ৬০৯, সহীহ বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ) অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : যে ব্যক্তির ভাল কাজ তাকে আনন্দ দেয় এবং মন্দ কাজ তাকে কষ্ট দেয় সে ব্যক্তি মু’মিন। (তিরমিযী হা. ২১৬৫, সনদ সহীহ)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. যে কোন সংবাদ তড়িঘড়ি করে গ্রহণ না করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ করা উচিত। তবে আল্লাহ তা‘আলা যে সংবাদ দিয়েছেন তা যাচাইয়ের ঊর্ধ্বে।
২. সাহাবীদের ব্যাপারে এমন কথা বলা উচিত নয় যাতে তাদের ন্যায়পরায়ণতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
৩. নাবী-রাসূলদের পরেই সাহাবীদের মর্যাদা।
৪. অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার উৎসাহ পেলাম।
৫. সাংবাদিকদের করণীয় ও বর্জণীয় সম্পর্কে জানলাম।