Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬৪/হে মুমিনগণ!:-৮৭) [*যারা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও আমল করে না, তারা গাধার মত:- * হে মুমিনগণ!যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন, দৌড়ে আসো:- *জুমু‘আর খুতবার আযানের পর সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য হারাম:- **হালাল রিজিক অনুসন্ধানও আল্লাহর ইবাদাত:-] www.motaher21.net সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ পারা:২৮ ১- ১১ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৪/হে মুমিনগণ!:-৮৭)
[*যারা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও আমল করে না, তারা গাধার মত:-
* হে মুমিনগণ!যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন, দৌড়ে আসো:-
*জুমু‘আর খুতবার আযানের পর সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য হারাম:-
**হালাল রিজিক অনুসন্ধানও আল্লাহর ইবাদাত:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ
পারা:২৮
১- ১১ নং আয়াত:-

সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-১
یُسَبِّحُ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ الۡمَلِکِ الۡقُدُّوۡسِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ ﴿۱﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে আল্লাহর, যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, পূত-পবিত্র, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-২
ہُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ۙ﴿۲﴾
তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের২ মধ্যে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়।৩ অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৩
وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳﴾
এবং তাদের মধ্য হতে অন্যান্যদের জন্যও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি । আর আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৪
ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۴﴾
এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহশীল।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৫
مَثَلُ الَّذِیۡنَ حُمِّلُوا التَّوۡرٰىۃَ ثُمَّ لَمۡ یَحۡمِلُوۡہَا کَمَثَلِ الۡحِمَارِ یَحۡمِلُ اَسۡفَارًا ؕ بِئۡسَ مَثَلُ الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۵﴾
যাদেরকে তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি তাদের উপমা সেই সব গাধা যা বই-পুস্তক বহন করে। এর চেয়েও নিকৃষ্ট উপমা সেই সব লোকের যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দান করেন না।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৬
قُلۡ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ ہَادُوۡۤا اِنۡ زَعَمۡتُمۡ اَنَّکُمۡ اَوۡلِیَآءُ لِلّٰہِ مِنۡ دُوۡنِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۶﴾
বল, ‘হে ইয়াহুদীগণ! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য কোন মানবগোষ্ঠী নয়, তাহলে তোমরা মৃত্যু কামনা কর; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৭
وَ لَا یَتَمَنَّوۡنَہٗۤ اَبَدًۢا بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ ﴿۷﴾
কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আল্লাহ‌ এসব জালেমকে খুব ভালভাবেই জানেন।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৮
قُلۡ اِنَّ الۡمَوۡتَ الَّذِیۡ تَفِرُّوۡنَ مِنۡہُ فَاِنَّہٗ مُلٰقِیۡکُمۡ ثُمَّ تُرَدُّوۡنَ اِلٰی عٰلِمِ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ فَیُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ٪﴿۸﴾
তাদের বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাচ্ছো তা তোমাদের কাছে আসবেই তারপর তোমাদেরকে সেই সত্তার সামনে পেশ করা হবে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই জানেন। তখন তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করছিলে।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৯
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۹﴾
* হে মুমিনগণ!জুম’আর দিন যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় নামাযের জন্য তখন, দৌড়ে আসো, আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য বেশী ভাল যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-১০
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰﴾
তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-১১
وَ اِذَا رَاَوۡا تِجَارَۃً اَوۡ لَہۡوَۨا انۡفَضُّوۡۤا اِلَیۡہَا وَ تَرَکُوۡکَ قَآئِمًا ؕ قُلۡ مَا عِنۡدَ اللّٰہِ خَیۡرٌ مِّنَ اللَّہۡوِ وَ مِنَ التِّجَارَۃِ ؕ وَ اللّٰہُ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ ﴿٪۱۱﴾
আর যে সময় তারা ব্যবসায় ও খেল তামাশার উপকরণ দেখলো তখন তারা তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে সেদিকে দৌড়ে গেল। তাদের বলো, আল্লাহর কাছে যা আছে তা খেল-তামাশা ও ব্যবসায়ের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা।

১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : মদীনায় অবতীর্ণ এ সূরাটি ‘সূরা সফ’-এর পরেই অবতীর্ণ হয়েছে। ‘সুরা সফ’-এর মধ্যে যে বিষয়ের ওপরে আলােচনা এসেছে এ সূরার মধ্যে আলােচনার বিষয়ও প্রায় সেই একই প্রকার, তবে ভিন্ন এক পদ্ধতিতে সে বিষয়টিকে এ সূরার মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই এর প্রভাবও নতুন এবং আর একভাবে মানুষের মনে দাগ কাটে। এ সূরা মদীনার মুসলিম জনগােষ্ঠীর মনে ঈমানের আকীদা-বিশ্বাস অত্যন্ত গভীরভাবে প্রােথিত করতে চেয়েছে। রসূল(স.)-এর যমানায় বিভিন্ন গােষ্ঠীভুক্ত মুসলমানরা ঈমানের সম্পদ হাসিল করায় যে অভংগুর একতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাে, তা একমাত্র আল্লাহর মেহেরবানীতেই সম্ভব হয়েছিলাে। নিরক্ষর আরববাসীদের মধ্যে পাঠানাে হয়েছে শেষ রসূলকে, এটা আরবদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যই এক বিরাট এহসান, যার জন্যে আরববাসীদের অবশ্যই আকাশ থেকে অবতীর্ণ এ আমানতের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান ও মনােযােগী হওয়া দরকার এবং বিশেষভাবে আল্লাহর শােকরগােযারী করা দরকার। একই ভাবে যে জনগাষ্ঠী রসূল(স.)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং ঈমানের আমানত বহন করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে তাদের ওপর কিছু দায়িত্বও বর্তায় এবং এই একই দায়িত্ব ভবিষ্যতেও যুগের পর যুগ ধরে মুসলমানদের ওপর আসতে থাকবে। আল্লাহর নেয়ামতের শােকরগােযারী স্বরূপ তাদের আল্লাহ রসূলের বিধানমতাে জীবন যাপন করতে হবে এবং অপরের কাছেও এই আমানত পৌছে দিতে হবে। এ দায়িত্ব কোনাে সময়েই শেষ হয়ে যাবে না; বরং হেদায়াতের যে বীজ রসূল(স.) বপন করে গিয়েছেন তার বৃক্ষকে লালন পালন করতে হবে এবং বাড়াতে হবে। চার হাজার বছর ধরে এই দায়িত্ব বনী ইসরাঈল জাতির হাতে ছিলাে, কিন্তু এর হক আদায় না করার কারণে তারা আকাশ থেকে আসা আমানত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাে এবং তাদের থেকে এ দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে উম্মতে মােহাম্মদীকে দেয়া হলো। তাওরাত ছিলাে মূসা(আ.)-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহরই কিতাব, বনী ইসরাঈল জাতি গাধার মতাে এই কিতাবের বােঝা বহন করেছে বটে, কিন্তু এর থেকে কোনাে ফায়দা নিতে পারেনি। গাধা তাে বােঝা বহন করে খাদ্যস্বরূপ কিছু মজুরি পায়, কিন্তু বনী ইসরাঈলরা সে মজুরিও পায়নি এবং বােঝা বহন করার সময় তাদের কেউ সাহায্যও করেনি। মুসলমানদের অন্তরের মধ্যে এই মূল সত্যই আলােচ্য সূরাটি বদ্ধমূল করে দিতে চায়। বিশেষ করে মদীনাবাসী তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যেহেতু আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বারাই ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এভাবে তাদের পরে যারা এসেছেন- তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, পর্যায়ক্রমে সবার ওপরেই পর্যায়ক্রমে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব এসেছে। এখন আমরা দেখতে পাই ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের এমন কিছু বাস্তব অবস্থা এই সূরার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে, যা ওই কঠিন সময়ে ব্যক্তি চরিত্র গড়ে তােলার ব্যাপারে দীর্ঘ দিন ধরে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাজ করেছে এবং ধীরে ধীরে মানুষকে লােভ লালসা ও পার্থিব ফায়দা হাসিলের আকাংখা, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার মনােবৃত্তি এবং সুনাম অর্জন করার বাসনা থেকে মুক্ত করেছে, বিশেষ করে মুক্ত করেছে ধন দৌলতের আসক্তি থেকে এবং সেই খেল তামাশার আকর্ষণ থেকে যা মানুষকে প্রদত্ত আমানতের মহান দায়িত্ব পালন থেকে গাফিল করে দেয়, দূরে সরিয়ে দেয় খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে ব্যক্তিগত যােগ্যতা প্রদর্শন করা থেকে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্যে সূরাটি ইশারা করেছে বিশেষ একটি ঘটনার দিকে। ঘটনাটি হচ্ছে, এক জুময়ার নামাযে মসজিদে রসূলুল্লাহ(স.) খোতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় এক বাণিজ্য কাফেলা ব্যবসা-দ্রব্য নিয়ে দেশে ফিরলাে এবং শহরে এসে হাযির হলাে। তাদের আগমন সংবাদ জানার সাথে সাথে যারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর খােতবা শুনছিলাে, সেই শ্রোতারা হঠাৎ করে সেই কাফেলার দিকে ছুটে গেলাে। কাফেলার আগমন সংবাদ ঘােষণাকারী বাদ্যধ্বনি তাদের আবেগমুগ্ধ করে ফেললাে। অবশ্য এভাবেই আরব বাসীরা (ইসলাম-পূর্ব) জাহেলী যুগে বাণিজ্য ফিরত কাফেলাকে অভিনন্দন জানাত। কাফেলার মধ্য থেকে দফ নামক বাদ্যযন্ত্র (তবলা) সহ উট-হাঁকানাে গান ও সম্মিলিত কলরব ভেসে আসছিল। এতদ শ্রবণে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রসূলুল্লাহকে দন্ডায়মান অবস্থায় পরিত্যাগ করে চলে আসে। এদের মধ্যে বারাে জন ব্যক্তি ছিলেন ব্যতিক্রম। এরা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত সাহাবা, ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, যারা সর্বাবস্থায় রসূলুল্লাহ(স.)-কে ঘিরে থাকতেন। সুতরাং তারা স্থান ত্যাগ না করে মনােযােগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, এদের মধ্যে আবু বকর ও ওমর(রা.)-ও ছিলেন। যদিও সংখ্যার দিক দিয়ে এরা একেবারে নগণ্য ছিলেন না, কিন্তু কোরআনুল করীমে আসা সতর্কবাণী থেকে জানা যায়, উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এক উল্লেখযােগ্য সংখ্যক লােক ওঠে চলে গিয়েছিলাে। এ ঘটনাটি বিশেষভাবে পীড়াদায়ক ছিলাে এজন্যে যে, যে প্রথম ইসলামী দলটিকে এতাে কষ্ট করে ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে গড়ে তােলা হয়েছিলাে, তার এমন দশা হলাে। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি, ইসলামের ইতিহাসে এটা একটা বিশেষ ঘটনা এবং গােটা মানব জীবনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এ ঘটনা থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, যে কোনাে সময়ে এবং যে কোনাে কঠিন অবস্থাতে আমাদের সবর করতেই হবে। আসলে যে মুসলিম জামায়াত ইসলামের এই মহামূল্যবান আকীদার প্রচার প্রসারের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, তাকে সঠিকভাবে গড়ে তােলার জন্যে প্রয়ােজন অবিচল দৃঢ়তার। এই সবর দ্বারাই পরবর্তী কালের মুসলমানরা ইসলামকে বাস্তব জগতে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে, যেভাবে প্রথম যুগের ইসলামী জামায়াত এই আকীদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আলােচ্য সূরাটিতে ইহুদীদের সাথে মােবাহালা করার দৃশ্যও দেখা যায়, অর্থাৎ কারা সত্য পথে আছে তার জন্যে প্রতিযােগিতা করতে গিয়ে উভয় পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করা, ‘হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে ভুল পথে আছে তার প্রতি তােমার লানত বর্ষণ করাে এবং সে ধ্বংস হয়ে যাক।’ ইহুদীদের সাথে যে প্রতিযােগিতার কথাও এ সূরার মধ্যে ফুটে ওঠেছে, তা ছিলাে উভয় পক্ষ থেকে মিথ্যাপন্থীদের জন্যে মৃত্যু কামনা করা, আর ইহুদীরা অন্যান্য যে কোনাে জাতির তুলনায় নিজেদের আল্লাহর বন্ধু ও অধিক প্রিয়পাত্র বলে দাবী করত, আর বলত যে, অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে রাসূলের আগমন ঘটবে না- সেই দাবী প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেই এই মোবাহালা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এইভাবে আল কোরআনও চূড়ান্ত ভাবে দাবী করেছে যে, ওদের মােবাহালার জন্যে ডাকলে এই প্রতিযােগিতায় ওরা কিছুতেই সাড়া দেবে না, যেহেতু তাদের চেতনার মধ্যে গভীরভাবে একথা রয়েছে যে, তারা অবশ্যই মিথ্যাপন্থী এবং তাদের দাবী মিথ্যা। এর পর আল কোরআন মৃত্যুর তাৎপর্য জানাতে গিয়ে বলছে, এমন ভয়ানক বিপদ যার থেকে বাচার জন্যে ওরা সব সময়েই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়; কিন্তু সে মৃত্যু অবশ্যই ওদের সাথে সাক্ষাত করবে তা ওরা যখানেই থাকুক না কেন। অবশেষে তাদের অনুপস্থিত ও উপস্থিত সব কিছুর জাননেওয়ালা যে আল্লাহ তায়ালা, তার কাছে হাযির করা হবে। আর তখন তিনি তাদের সেই সকল বিষয়ে অবগত করবেন, যা অতীতে তারা করতে থেকেছে। এ কথাগুলাে শুধু ইহুদীদের জন্যেই নয় বরং সবার জন্যে, কেননা এ কথাগুলাে খাস করে ইহুদীদের নাম নিয়ে বলা হয়নি। কাজেই মােমেনদের ওপরেও কথাগুলাে সমানভাবে প্রযােজ্য। যেহেতু ঈমান আকীদার আমানত বহন করার প্রশ্নেই এ কথাগুলাে এসেছে, এজন্যে যারাই এ আমানতের হক আদায় না করবে, তাদের ওপরেই কথাগুলাে প্রযােজ্য হবে। কারণ, তারা এ আমানত সম্পর্কে জানে ও তার গুরুত্বও যথাযথভাবে বুঝে। তবু নিছক পার্থিব স্বার্থের কারণে তারা সে দায়িত্ব পালন করা থেকে পিছিয়ে থাকে। এই হচ্ছে সূরার মুখ্য আলােচ্য বিষয়। ইতিপূর্বে সূরা সফ-এ যে বিষয়টি আলােচনা করা হয়েছে, তা এখানে আলােচিত বিষয়ের খুবই কাছাকাছি। তবে প্রত্যেক সূরার বর্ণনাভংগি পৃথক এবং প্রতিটি সূরা ভিন্ন ভিন্নভাবে হৃদয়কে আকর্ষণ করে। যদিও উদ্দেশ্য তাদের এক অভিন্ন। সুতরাং এখন আমরা দেখি এ সূরার মাধ্যমে কোরআনুল কারীম কি পদ্ধতি পেশ করেছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবই নিরংকুশ আনুগত্য দান করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করে চলেছে। বিশ্বলােকে তিনি একচ্ছত্র অধিপতি, তিনি সকল প্রকার দুর্বলতা ও অক্ষমতার উর্ধ্বে, তিনি মহা শক্তিমান, মহা বিজ্ঞানময়।’ আলােচ্য আয়াতটি এখানে স্পষ্টভাবে এই সত্য তুলে ধরেছে যে, সৃষ্টিলােকে যা কিছু আছে তা সর্বক্ষণ আল্লাহর প্রশংসায় রত রয়েছে, অর্থাৎ নিরন্তর তার নির্দেশমতাে চলার মাধ্যমে এ কথার সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে যে, সকল শক্তি ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, আর এই সূরার মধ্যে আলােচ্য বিষয়বস্তু হিসাবে অতি সূক্ষ্মভাবে এই কথাই আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করছেন। তিনি সুরাটির নাম বেখেছেন আল জুমুয়া। এখানে জুমআর নামায সম্পর্কে কিছু শিক্ষাও রয়েছে, সময় হওয়ার সাথে সাথে এ নামাযে শরীক হওয়ার জন্যে সকল কাজকর্ম পরিত্যাগ করে ছুটে আসতে বলা হয়েছে। পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে সকল প্রকার বে-ফায়দা কাজ ও ব্যবহার এবং যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য। আর সেই মহামূল্যবান নেয়ামত চাইতে বলা হয়েছে যা একমাত্র আল্লাহর কাছেই বিদ্যমান। তাদের একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, হৃদয় মনকে প্রলুব্ধকারী এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন ব্যস্ততা এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যবসায়ের ধন সম্পদের তুলনায় আল্লাহর কাছে অবস্থিত নেয়ামত অতি উত্তম। এই জন্যেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনিই বাদশা ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি, তিনিই সব কিছুর মালিক। এমনকি ব্যবসা বাণিজ্য করে মানুষ যা কিছু উপার্জন করে সে সকল পণদ্রব্যের মালিকও তিনি। তিনি আরও স্মরণ করাচ্ছেন যে, তিনি সকল প্রকারের দুর্বলতার উর্ধে এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যে সকল জিনিস মানুষের নিকট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এবং যেসব জিনিসের প্রতি মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সেসব কিছু থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। একথাগুলাে বিশেষভাবে এই জন্যেই বলার প্রয়ােজন হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ(স.) যখন খোতবা দিচ্ছিলেন, তখন কাফেলার আগমনবার্তা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে খােতবা শােনার গুরুত্ব তাদের মনে কমে গেলাে এবং অহেতুক খুশীতে অস্থির হয়ে তারা মসজিদ ত্যাগ করে চলে গেলাে। সাময়িকভাবে হলেও তারা একথা ভুলে গেলাে যে, এ সব কিছুর ব্যাপারে একদিন তাদের আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*নিরক্ষর জনগােষ্ঠীর মাঝে নবী প্রেরণ : ইহুদীদের দাবী যে তারাই আল্লাহর নিকবর্তী লােক, সেই কথার প্রেক্ষাপটে মহাশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের সাথে মােবাহালা করার জন্যে নবী(স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন। এই মােবাহালার মধ্যে আরও একটি কথা রয়েছে, বেশ তাে, তােমরা যদি আল্লাহর বিশেষ প্রিয়পাত্রই হয়ে থাকো তাহলে আসন্ন মৃত্যু কামনা করাে, যেহেতু মৃত্যুর পরেই তােমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হিসেবে তাঁর কাছে হাযির হতে পারবে এবং হিসাব নিকাশের পর মহা পুরস্কার লাভ করতে পারবে, কিন্তু এ কপট আহলে কিতাবরা জানতাে যে, প্রকৃতপক্ষে তারা সঠিক কাজ ও ব্যবহার করছে না, এজন্যে তারা এইভাবে মােবাহালা করতে রাযি হতে পারেনি। অপরদিকে মহাবিজ্ঞানময় আল্লাহ তায়ালা উম্মী (নিরক্ষর) লোকদের মধ্য থেকে রাসূল পাঠাতে চাইলেন যাতে করে সেই রাসূল তার আয়াতগুলাে তাদের পড়ে শােনাতে পারেন, তাদের নিস্কলুষ চরিত্রের অধিকারী বানাতে পারেন এবং কিতাব ও বুদ্ধিমত্তার কথা তাদের শিক্ষা দিতে পারেন। এসব উপযুক্ত ও সূক্ষ্ম কথা তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যেন তারা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে এবং মুসলমানদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়। তারপর এ সূরার মধ্যে যে মূল বিষয়বস্তুর আলােচনা করতে চাওয়া হয়েছে তা শুরু হচ্ছে। আল্লাহ তাে সেই মহান সত্ত্বা, যিনি পাঠিয়েছেন তার রাসূল কে নিরক্ষর লােকদের মধ্যে রসূল বানিয়ে যেন তিনি তাদের আল্লাহর আয়াতগুলাে তেলাওয়াত করে শুনান, কলুষ-কালিমা ও নৈতিক অপরাধসমূহ থেকে তাদের মুক্ত করেন, তাদের আল-কোরআনের কথাগুলাে এবং বুদ্ধিমত্তাভরা বিদ্যা শেখান, যদিও এর পূর্বে তারা ছিলাে স্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে। তিনি রসূল হয়ে এসেছেন অন্যদের জন্যও, যারা এখন ও মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়নি। আর তিনিই মহা শক্তিমান, বিজ্ঞানময়। কথিত আছে, আরবদের উম্মি বলা হতাে। তাদের এই জন্যে নিরক্ষর বলে অভিহিত করা হতাে যে, সাধারণভাবে তারা পড়ালেখা করতাে না। নবী(স.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে জানা যায়, তিনি একদিন বললেন, মাস এই রকম, এই রকম এবং এই রকম। কথাগুলাে বলার সময় তিনি তার আংগুলগুলাে দ্বারা ইশারা করে দেখাচ্ছিলেন। তারপর বললেন, আমরা তাে এক নিরক্ষর (উম্মী) জাতি, আমরা হিসাবও করতে পারি না, গুনতেও পারি না (আহকামুল কোরআন প্রণেতা ইমাম জাসসাস এ কথাটি উল্লেখ করেছেন, তবে তিনি কোনাে হাদীসের কিতাবের বরাত দেননি) আরও একটি কথা বলা হয়েছে, তাঁকে উম্মী এ জন্যেই বলা হয়েছে যে, তিনি জন্মগ্রহণ করার পর লেখাপড়া শিখতে পারেননি এবং তার মায়ের কাছ থেকেই তার অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে, এ জন্যেও তাকে উম্মী বলা হতে পারে। লেখাপড়া জানতে হলে তাকে অবশ্যই কারাে কাছে শিখতে হয় এবং কারাে সাহায্য নিতে হয়। এই সুযােগ তিনি পাননি। নবী(স.)-কে লােকেরা উম্মী হয়তাে এ জন্যেও বলে থাকবে যে, ইহুদীরা নিজেদের ছাড়া অন্য সবাইকে উম্মী বলতাে। তারা অন্যদের সম্পর্কে বলতাে, ওরা হচ্ছে, ‘জুওয়াইয়েম।’ এই শব্দটি ইবরানী ভাষা থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক’ একথা দ্বারা ‘জাতিসমূহ’ অর্থও বুঝায়। একথা দ্বারা তারা বলতে চাইতাে যে, তারাই আল্লাহর গােত্র, বাকি সবাই সাধারণ জাতি। আর আরবি ভাষায় উম্মী’ একবচন, এর বহুবচন ‘উম্মিউন’। সম্ভবত এই উম্মিউন (বহুবচন) শব্দটি সূরাটির মধ্যে আলােচিত বিষয় বস্তুর সাথে বেশী সংশ্লিষ্ট, এই জন্যে এই শব্দটিই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। ইহুদীরা অপেক্ষায় ছিলাে যে, শেষ রসূল তাদের থেকেই প্রেরিত হবেন এবং তিনি আগমন করে তাদের মধ্যে বিরাজমান দল, উপদলের যে কোন্দল রয়েছে, সেগুলাে দূর করে দেবেন এবং তাদের পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্ত করে সম্মানের আসনে সমাসীন করবেন। তারা বলতাে, শীঘ্রই শেষ যমানার নবী আসবেন এবং তার সাহায্যে আরবদের ওপর তারা জয় লাভ করবে, অর্থাৎ শেষ নবীর সাহায্য তারা সবাই কামনা করতাে। কিন্তু আল্লাহর প্রজ্ঞার দাবী ছিলাে যে, এই নবীকে আরব দেশে পাঠানাে হােক এবং উম্মীদের মধ্যেই পাঠানাে হােক, ইহুদীদের মধ্য থেকে নয়। কারণ, আল্লাহর জানা হয়ে গিয়েছিলাে যে, ইহুদীরা নবুওতের বোঝা বহন করতে অক্ষম হয়ে গেছে এবং গােটা মানব জাতিকে পরিচালনার যে নতুন দায়িত্ব আসছে, তা পালন করার যােগ্যতা ওদের নেই। এ বিষয়ে আলােচ্য সূরার দ্বিতীয় বর্ণনা আসছে। সে জাতি সত্য সঠিক পথ থেকে সরে গেছে এবং সূরা ‘সফ’-এর বর্ণনামতে তারা গোমরাহ হয়ে গেছে। এ জাতির দীর্ঘ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ওদের এতাে বড়ো আমানতের বােঝা বহন করার দায়িত্ব আর দেয়া ঠিক হবে না। অপরদিকে রয়েছে আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়া। সে দোয়া অনুযায়ী জানা যায়, এই পবিত্র ঘরের ছায়াতলে থেকে যিনি এর কার্যক্রম পরিচালনা করবেন, তিনি হবেন ইসমাঈল(আ.)। ‘যখন এ ঘরটির ভিত্তি রচনা করলাে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (বাপ-বেটা) দু’জনে মিলে (এবং তারা বললো), হে আমাদের রব, আপনি আমাদের নিকট থেকে এ কাজ কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই, আপনি দোয়া শুননেওয়ালা, জাননেওয়ালা। হে আমাদের রব, আমাদের দুজনকে মুসলমান (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) বানিয়ে দিন এবং বানিয়ে দিন আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও মুসলিম উম্মত, দেখিয়ে দিন আমাদের হজ্জের কার্যক্রম পদ্ধতি এবং আমাদের তাওবা কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী, মেহেরবান। হে আমাদের রব, ওদের (আমাদের বংশধরদের) মধ্য থেকেই পাঠান এমন একজন রসূল, যে তাদের আপনার আয়াতসমূহ পড়ে শােনাবে, তাদের কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শিক্ষা দান করবে এবং তাদের পবিত্র (কলুষমুক্ত) করবে। অবশ্যই তুমি মহাশক্তিমান, বিজ্ঞানময়।’ অদৃশ্য মহাশক্তিমান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে এ দোয়া পৌছে গিয়েছিলো এবং যুগ যুগ ধরে এ দোয়া প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলাে আকাশে-বাতাসে অন্তরালে। এ দোয়া অবিস্মরণীয় এবং এমনভাবে আল্লাহর দরবারে সুরক্ষিত ছিলাে, যা কোনাে দিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না এবং কেয়ামত পর্যন্ত তার ফয়সালা এ দোয়া আল্লাহর জ্ঞানভান্ডারের মধ্যে ধ্বনিত হতে থাকবে, তারপর সঠিক ও উপযুক্ত সময়ে এ দোয়া অনুযায়ী কাজ হবে- এটাই আল্লাহর ফয়সালা এবং যথাযােগ্য ব্যবস্থা এবং অবশেষে সৃষ্টিজগতে নবুওতের দায়িত্ব পালনের কাজ নির্ধারিত ও সঠিক সময়ে আল্লাহর মর্জিমতােই গৃহীত হবে, তার আগেও নয়, পরেও নয়। তাই দেখা যায়, আল্লাহর নিজ কুদরত ও পরিচর্যায় এ দোয়ার বিকাশ ঘটেছে, বাস্তবায়িত হয়েছে মহান দুই নবীর আকুল আবেদন। কি চমৎকারভাবে এই সূরার মধ্যে ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে যেন আগমন করেন এমন একজন রসূল, যিনি তাদেরকে তার আয়াতগুলাে পড়ে শোনাবেন, পবিত্র করবেন তাদের এবং শেখাবেন তাদের কিতাব ও হিকমত। এটা আল্লাহরই দান, যেমন ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়াতেই আল্লাহর এই ক্ষমতার কথা ধ্বনিত হয়েছে। অবশ্য তুমিই মহাশক্তিমান প্রজ্ঞাময়। আর রসূলুল্লাহ(স.)-কে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, আমি তাে আব্বা ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়ার বাস্তব রূপ এবং ঈসা(আ.)-এর সুসংবাদের বাস্তবায়ন। আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই আমার আম্মা দেখেছিলেন এমন এক জ্যোতি, যার আলােতে সিরিয়ার রাজধানী বসরা শহর উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছিলাে (ইবনে ইসহাকের রেওয়ায়াত অনুযায়ী জানা যায়, তিনি বলেন, আমাকে এ হাদীসটি সওর ইবনে যায়দ উর্ধ্বতন বিভিন্ন রেওয়ায়াতকারীর বর্ণনা ধারা ও রসূল(স.)-এর সাহাবাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন। ইবনে কাসীর বলেন, এ হাদীসটির বর্ণনাধারা সঠিক ও সুন্দর। আরও বিভিন্ন উপায়ে হাদীসটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানা গেছে) অন্ধকার পেরিয়ে আলাের জগতে মানব জাতির অগ্রযাত্রা।

ফী জিলালিল কুরআন:

*অন্ধকার পেরিয়ে আলোর জগতে মানব জাতির অগ্রযাত্রা : ‘তিনিই তাে সেই মহান সত্ত্বা, যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদের থেকেই একজন রসূল পাঠাবেন। তার দায়িত্ব হবে, সে তার আয়াতগুলাে ওদের পড়ে শোনাবে, তাদের পবিত্র করবে এবং তাদের আল্লাহর কিতাব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা শিখাবে। যদিও এর পূর্বে তারা খােলাখুলি ভুল পথের মধােই ছিলাে।’ এখানে উম্মীদের আল্লাহর কিতাবের ধারক বাহক বানানাের উদ্দেশ্যেই তাদের প্রতি আল্লাহর ইহসানের কথা প্রকাশ করেছেন। এ ইহসান প্রদর্শন এজন্যেও বটে যে, তাদের মধ্য থেকেই তিনি এমন একজন রসূল পাঠিয়েছেন যাকে তারা আল্লাহরই ইচ্ছাতে সুমহান মর্যাদার আসনে বসিয়েছে এবং তিনি তাদের নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে বের করে এনেছেন, অথবা তাদের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাদের সাধারণ উম্মতের মধ্য থেকে মর্যাদাশীল উম্মতের পরিণত করেছেন, তাদের সাবেক অবস্থা থেকে উন্নীত করেছেন এবং সারা জগতে তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বানিয়েছেন। এবং পবিত্র করেছেন’। এর দ্বারা মনের পবিত্রতা বুঝায় এবং রসূল(স.)-এর শেখানাে পাক সাফ থাকাও বুঝায়। এ পবিত্রকরণ দ্বারা যেমন বিবেক বুদ্ধি, চেতনা, কাজ ও ব্যবহার বুঝায়, তেমনি বুঝায় দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা ও সামাজিক জীবনের মধ্যে বসবাসকালীন আদান-প্রদানের পরিচ্ছন্নতাকেও। এ পবিত্রকরণ দ্বারা মানুষের মন মগয শিরকের কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে তাওহীদী বিশ্বাসকে ধারণ করে এবং ভুল চিন্তা চেতনা থেকে মুক্তি লাভ করে সঠিক বিশ্বাসের দিকে মানুষ এগিয়ে যায়। এই পবিত্রকরণ দ্বারা সমস্ত প্রকারের সন্দেহ পূর্ণ কাহিনী ও মনগড়া কথা থেকেও পবিত্র করা এবং নিশ্চিত ও সন্দেহমুক্ত বিশ্বাসের দিকে এগিয়ে দেয়াও বুঝায়। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মনে যেসব খারাপ কথার উদয় হয় এবং চারিত্রিক দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, সেসব থেকে পবিত্র করে ঈমানী চরিত্র গড়ে তোলার দ্বারা পরিশুদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করার পর সূদ ও অন্যান্য হারাম পদ্ধতির মাধ্যমে রোজগার বন্ধ করে মুসলমানদের হালাল রুযি খেতে শিখানাে হয়েছে। এভাবে ব্যক্তি ও দলীয় জীবনে, কল্পনা ও বাস্তবতার ক্ষেত্রে সবখানেই যেন মুসলমানরা পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর হতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পবিত্রকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে মানবতাবােধ সৃষ্টি করা হয়েছে, জীবন সম্পর্কে সুস্থ সঠিক চিন্তা চেতনা পয়দা করা হয়েছে এবং মন-মগযকে এমনভাবে উন্নত করতে চাওয়া হয়েছে, যেন এ সুন্দর মন নিয়ে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে এবং পৃথিবীর সংকীর্ণতার গন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহর মহব্বত হাসিল করার জন্যে এগিয়ে যেতে পারে এবং মহান রব্বুল আলামীনের কাছে জওয়াবদিহি করার জন্যে তার মন-মানসিকতা সৃষ্টি হয় ও প্রত্যেকটি কাজ সেভাবে পরিচালিত হয়। (এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন, মােহাম্মদ কুতুব রচিত ‘আল ইনসানু বাইনাল মাদ্দিয়াতে অল ইসলাম) এবং তাদের তিনি কিতাব ও হিকমত (বুদ্ধিপূর্ণ কথা) শিক্ষা দিচ্ছেন। কিতাব শিক্ষা দেয়ার কারণে তারা আহলে কিতাব বা কিতাবের অধিকারী হচ্ছে এবং হিকমত শিক্ষা দেয়ায় তারা বস্তুজগতের বিভিন্ন তথ্য জানতে পারছে ও সেগুলাে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে। এভাবে তারা তাদের ভাগ্য উন্নয়ন করতে পারছে, উন্নত হচ্ছে তাদের মন ও জীবন যাপনের মান। এসব কিছু মিলেই ইসলাম গ্রহণ করার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। যদিও এর পূর্বে তারা ছিলাে স্পষ্ট ভুল পথে। এই ভুল পথ বা গােমরাহী ছিলাে অজ্ঞানতার (জাহেলিয়াতের) গােমরাহী। হযরত জাফর ইবনে আবু তালেবের ব্যাখ্যায় এ কথা জানা যায়। মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করে নাজ্জাশীর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যে কুরাইশরা আমর ইবনুল আস ও আবদুল্লাহ ইবনে রবীয়াকে সেখানে পাঠায়। এই কোরায়শ প্রতিনিধিরা যখন মুসলমান মােহাজেরদের সম্পর্কে নানা প্রকার ভুল কথা বলে তাদের ফেরত দেয়ার অনুরােধ করলাে, তখন নাজ্জাশী মুসলমানদের কাছে সঠিক অবস্থা জানতে চাইলেন। জওয়াবে মুসলমানদের পক্ষ থেকে জাফর বললেন, ‘হে বাদশাহ, আমরা জাহেলিয়াতবাসী ছিলাম (অর্থাৎ অজ্ঞানতার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম)। বিভিন্ন পুতুলের পূজা করতাম, মৃত জীবজন্তু খেতাম, নানা প্রকার লজ্জাকর কাজে ছিলাম, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীদের কষ্ট দিতাম এবং আমাদের সমাজের শক্তিশালী লােকেরা গরীবের ধন সম্পদ কেড়ে খেতাে, দীর্ঘকাল ধরে আমরা এই অবস্থার মধ্যে থেকে কষ্ট পাওয়ার পর আমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল এলেন, যার বংশ-পরিচয় ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে আমরা জানতাম, জানতাম তার আমানতদারী ও চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্ক। তিনি আমাদের এক আল্লাহ হুকুমদাতা ও মালিক বলে মানতে শেখালেন এবং একমাত্র তাঁরই হুকুম পালনের আহবান জানালেন। আমরা এবং আমাদের বাপ দাদারা আল্লাহ ব্যতীত যে সব জড় পাথর ও দেব দেবীর পূজা করতাম, সেগুলাে তিনি পরিত্যাগ করতে বললেন। তিনি আমাদের সত্য কথা বলার নির্দেশ দিলেন, আমানতের হক আদায় করতে বললেন এবং আত্মীয়স্বজনের প্রতি সদয় হতে বললেন, প্রতিবেশীর সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে শেখালেন, সম্মানী লােকদের বেইযযত করতে মানা করলেন এবং খুন খারাবী করা থেকে আমাদেরকে বিরত করলেন এবং নিষেধ করলেন লজ্জাকর কাজ করতে, মিথ্যা কথা বলতে, এতীমের সম্পদ ভক্ষণ করতে এবং পাক সাফ মহিলাদের বদনাম করতে। তিনি আমাদের একমাত্র আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্য ও পরিপূর্ণ দাসত্ব করতে নির্দেশ দিলেন এবং তার সাথে শক্তি ক্ষমতায় অন্য কাউকে অংশীদার করতে মানা করলেন, আর তিনি আমাদের নামায পড়তে, যাকাত আদায় করতে এবং রােযা রাখতে আদেশ করলেন। জাহেলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে তারা গােমরাহীর মধ্যে ডুবে থাকা সত্তেও আল্লাহ তায়ালা জানতেন, ভুল আকীদা বিশ্বাসের কারণেই তারা ওই ভুল পথে চলছিলাে। তার জানা ছিলাে যে, তাদের অন্তরের মধ্যে কল্যাণ ও সংশােধনী গ্রহণ করার শক্তি রয়েছে, যদি যুক্তি সহকারে তাদের সত্য সঠিক পথের দিকে দাওয়াত দেয়া হয় তাহলে তা গ্রহণ করার মতাে যােগ্যতা তাদের মধ্যে আছে। ইতিপূর্বে মিসরে ইহুদীদের অপমানজনক জীবন যাপন তারা দেখেছে, ভুল আকীদা গ্রহণ ও সত্য পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে তাদের অধােপতন এবং কিছুতেই দুনিয়ার কোনো জায়গাতেই এই অভিশপ্ত ইহুদী জাতির স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে না পারার করুণ অবস্থাও তারা প্রত্যক্ষ করেছে। এমনকি আল্লাহর নবী মূসা(আ.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর উম্মত ও অনুসারী হওয়া সত্তেও তাদের নাফরমানীর কারণে কোথাও তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেনি এবং পরবর্তীকালেও কোনাে দেশে তাদের স্থায়ী ঠিকানা ছিলাে না। অবশেষে তাদের অভিশপ্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত জাতি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের দায়িত্বও কেড়ে নেয়া হয়েছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত আর তাদের ফেরত দেয়া হবে না। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জ্ঞানভান্ডারে একথা ছিলাে যে, এই সময়ে জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে পৃথিবীবাসীকে মুক্ত করার জন্যে এবং তৎকালীন বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী রাজ্যসমূহের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে দাওয়াতী কাজের কেন্দ্রভূমি হবে এই আরব উপদ্বীপ। তৎকালীন ওই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে ছােট খাটো গােত্রীয় শক্তিগুলাে তেমনি করে মিশে গিয়েছিলো যেমন করে প্রদীপের মধ্যে পতংগরা ঝাপ দিয়ে আত্মােৎসর্গ করে, এমনকি মানুষের সাধারণ বুদ্ধিও তখন অকেজো হয়ে গিয়েছিলাে। তৎকালীন এই অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে জনৈক ইউরোপীয় লেখক বলছেন, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে গােটা পৃথিবী এতাে বেশী বস্তুবাদী হয়ে পড়েছিলাে যে, বস্তুর মহব্বতের কারণে ও আধিপত্য লাভের প্রতিযােগিতায় মানুষ চরম নীতি বিবর্জিত হয়ে গিয়েছিলাে। কারণ, যে আখেরাতকেন্দ্রিক আকীদা বিশ্বাসের কারণে মানুষ নীতিবান হয়, তা নিশেষ হয়ে যাওয়ার ফলে মানবতার চরম অধপতন হয় এবং মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে ধস নেমে আসে। এ কারণেই বনী ইসরাঈলদের হাতে চার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতার প্রাসাদে ধসের সূচনা শুরু হয়ে যায়। তাদের সীমা লংঘন ও যুলুমের কারণে সাধারণভাবে মানুষ তাদের নাগপাশ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মনে প্রাণে কামনা করতে থাকে এবং গােটা মানব জাতি পুনরায় বর্বরতার দিকে ফিরে যেতে উদ্যত হয়। গোত্রে গোত্রে মারামারি, কাটাকাটি, রাহাজানি, খুনখারাবী নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আইন কানুন ও সুষ্ঠু কোনাে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সর্বত্র স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। খৃষ্ট ধর্মের প্রচার প্রসারে যে শাসন ব্যবস্থা ও শৃংখলা গড়ে ওঠেছিলাে, তার বুনিয়াদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভেংগে পড়ে এবং গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােত্রীয় শাসন ব্যবস্থা। অথচ ইতিপূর্বে গড়ে ওঠা শাখা-প্রশাখা-পল্লবিত মহা বৃক্ষের ন্যায় নগর-সভ্যতা সারা পৃথিবীর বুকে প্রভাবশীল অবস্থায় বিরাজ করতাে। এই কেন্দ্রীয় রাজ্য থেকে বিচ্ছুরিত হত চতুর্দিকে জ্ঞান বিজ্ঞানের আলাে, কিন্তু জাহেলিয়াতের যুগে কেন্দ্রীয় কোনাে শাসন ব্যবস্থা না থাকায় সামাজিক সংহতি বলতে কোনাে কিছু থাকে না এবং সর্বত্র ধ্বংস ও বিপর্যয় নেমে আসে, এমনকি মানুষের সাধারণ বিবেক বুদ্ধি পর্যন্ত বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। এমন কঠিন যুগসন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন এমন এক মহাপুরুষ যিনি (তাওহীদের) এক পতাকাতলে সমবেত করেন গােটা পৃথিবীর মানুষকে।(Dinesan রচিত গ্রন্থ ‘আল আওয়াতিফু কাআসানুন লিল হাজারাহ। এই পুস্তকটি মৌলবী মােহাম্মদ আলী রচিত আল ইসলাম ওয়ান্নিজামুল আলামুল জাদীদ এবং এর অনুবাদক অধ্যাপক আহমাদ জুদাত আস সাহ্হার অবলম্বনে লিখিত) এই হচ্ছে আরব দেশের তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে ইসলামের চরম বিরােধী ইউরােপীয় লেখকের কলমের আঁকা ছবি। অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন আরব মরুর বুকে বিচরণরত সেই বেদুইন জাতিকে আল্লাহ তায়ালা বেছে নিলেন এই বিশ্বপ্লাবী দ্বীনের পতাকা সমুন্নত করার জন্যে। এই মহান সংশোধনী কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজেরা সংশােধিত হওয়ার ও অপরের কাছে এই আহ্বান পৌছে দেয়ার যােগ্যতা ও সক্ষমতা তাদের মধ্যে কতটুকু ছিলাে ও আছে তা আল্লাহ তায়ালা ভাল জানেন। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে তার রসূল পাঠালেন। তিনি তাদের তার আয়াতগুলাে তেলাওয়াত করে শােনালেন, তাদের যাবতীয় অসৎ ব্যবহার, বদঅভ্যাস ও খারাপ কাজ থেকে পবিত্র করলেন এবং তাদের মহান এ কিতাব ও যুক্তি-বুদ্ধিপূর্ণ কথা শেখালেন, যদিও এর পূর্বে তারা স্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে নিমজ্জমান ছিলাে। এ সংশোধনী প্রচেষ্টা ও এ শিক্ষা ছিলাে পরবর্তী সেসব লােকের জন্যেও, যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর তিনিই মহাশক্তিমান মহা বিজ্ঞানময়। মরুবাসী এ বেদুইনদের সম্পর্কে ইতিহাস ও অন্যান্য বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ইমাম বোখারী(র.) আবু হােরায়রা(রা.)-এর হাদীস রেওয়ায়াত করতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা বলেন, ‘আমরা একদিন নবী(স.)-এর কাছে বসে ছিলাম, তখন তাঁর কাছে সূরা জুমুয়া নাযিল হলাে, যার মধ্যে ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম লাম্মা ইয়ালহাকু বিহিম’ অর্থাৎ এরা বাদে অন্যান্য আরও ব্যক্তিদেরও পবিত্র করতে চাইলেন, যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি আয়াতটিও রয়েছে। আয়াতটি শােনার সাথে সাথে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা ইয়া রসূলাল্লাহ? কথাটির উত্তর দেয়ার পূর্বে তারা তিন বার কথাটি জিজ্ঞেস করলেন। তখন আমাদের সাথে সালমান ফারসীও উপস্থিত ছিলেন। অতপর রসূলুল্লাহ(স.) সালমান ফারেসী(রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঈমান যদি সুরাইয়া তারকার কাছেও থাকে, তাহলে অবশ্যই সেখান থেকেও এ সকল ব্যক্তি অথবা ওদের মধ্যে কোনাে ব্যক্তি তা পেয়ে যাবে। রসূলুল্লাহ(স.)-এর এই আচরণ এবং এই কথায় ইশারা পাওয়া গেলাে, অন্যান্য লােক বলতে পারস্যের লােকদের বুঝানাে হয়েছে, যেহেতু সালমান ফারসী ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। আর প্রখ্যাত আলেম মােজাহেদ এই আয়াত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এ আয়াতে আরব দেশের বাইরের যারাই নবীকে সত্য বলে জেনেছে ও মেনে নিয়েছে, তাদের সবাইকে বুঝানাে হয়েছে।’ ইবনে আবী হাতেম সাহল ইবনে সাদের বরাত দিয়ে রসূলুল্লাহ(স.)-এর হাদীস উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, আমার উম্মতের আওলাদ, তাদের আওলাদ, তাদের আওলাদের মধ্য থেকে বহু পুরুষ ও নারী বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ এরপর তিনি পাঠ করলেন, ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম লাম্মা ইয়ালহা বিহিম’, অর্থাৎ উম্মতে মােহাম্মদীর (উপস্থিত এই ব্যক্তিরা ছাড়া) অবশিষ্ট অংশ সবাই এই আয়াতের অন্তর্গত। এই আয়াত সম্পর্কে রসূল(স.)-এর উল্লিখিত দুটি কথাতেই উভয় শ্রেণীর লােকদের বুঝায়, অর্থাৎ অনারব ও রাসূল(স.)-এর যমানার পরবর্তী সকল উম্মত। এ কথাগুলাে থেকে এও বুঝা যায় যে, পৃথিবীর সকল এলাকায় সকল যমানায় যারাই এই ঈমান ও ইসলামের আমানত বহন করতে থাকবে এবং এই দ্বীন (ইসলামী জীবন ব্যবস্থা) অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, তারা সবাই এই আয়াতের লক্ষ্য। আর তিনিই মহাশক্তিমান মহাবিজ্ঞানময়। তিনিই সকল শক্তির মালিক, সব কিছু করতে সক্ষম ও সকল কিছুর ওপর একমাত্র তারই অধিকার বিদ্যমান। তিনিই জ্ঞানী ও সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনিই সবখান থেকে তার পছন্দমতাে লােক বাছাই করে তাদের দায়িত্ব দান করেন। তার মেহেরবানী ও সম্মান তিনি পূর্ববর্তী পরবর্তী সবাইকে দান করেছেন ও করেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, এই হচ্ছে আল্লাহর সেই মেহেরবানী, যা তিনি দান করেন যাকে ইচ্ছা তাকে। তার বাণী ও শিক্ষা বহন করার দায়িত্ব যে কোনাে উম্মত, দল বা ব্যক্তি, যাকে ইচ্ছা তাকেই তিনি দেন। আল্লাহর এ বাতি কার হাতে দিতে হবে, কার হাতে রাখা হবে, কার হাতে সােপর্দ করা হবে এ গুরুদায়িত্ব, আর কোন্ কেন্দ্রে এবং কোন্ স্থানে আসমান ও যমীনের মিলন হবে তা সবই তার জানা। এ দায়িত্বের বােঝা বহন করা এমন এক মর্যাদা যার কোনাে তুলনা নেই। এ মহান মর্যাদাবােধ গড়ে ওঠে একজন মােমেনের মধ্যে তার নিজের অন্তর থেকে, তার বিষয়-আশয় এবং জীবনের সব কিছু থেকে সে এ মর্যাদা পেতে থাকে। এমনকি জীবন পথে চলতে গিয়ে মানুষকে যেসব অসুবিধার মােকাবেলা করতে হয়, দুঃখ সংকট ও সংসারের নানা প্রকার জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয় এবং সত্য পথে থাকতে গিয়ে যে কঠিন সংগ্রাম করতে হয় এসব কিছুর মধ্যে সে এই মর্যাদা অনুভব করতে থাকে। মদীনার মুসলমান জামায়াত, আশেপাশের লােক ও অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষকে আল্লাহ তায়ালা একথা জানাচ্ছেন, স্মরণ করাচ্ছেন যে, তার এই কিতাব তিলাওয়াত করে শােনানাে, মানুষকে দোষত্রুটি মুক্ত করার কাজ এবং আল কোরআন ও এর সংশ্লিষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানের এই আমানত যারাই বহন করবে, তারাই এই মহান মর্যাদার অধিকারী হবে। রসূলকে অবশ্যই এই একই উদ্দেশ্যে পাঠানাে হয়েছিলাে। তাঁর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তিনি আল্লাহর কিতাব পড়ে শােনাতেন, তার নিজের মহান ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তাদের যাবতীয় দোষ, ত্রুটি ও কদর্য খাসলত থেকে পবিত্র করার কাজ করতেন এবং তাঁর সাহাবাদের যুক্তি-বুদ্ধিপূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শেখাতেন। অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষের জন্যে এই দুটি আয়াত আল্লাহর এমন মহান নেয়ামতভরা ভান্ডারের দরজা খােলা রেখে দিয়েছে, যেখানে যে কোনাে মানুষ প্রবেশ করে এ মহামূল্যবান সম্পদ হাসিল করতে পারে। এর সাথে আরও রয়েছে প্রথম যুগের ইসলামী দলের লােকদের বাস্তব জীবনের কর্মধারা। আল্লাহ তায়ালা তাদের এই মহান নেয়ামতের কথা স্মরণ করাতে গিয়ে জানাচ্ছেন যে, তার দেয়া এই নেয়ামতের পাশাপাশি মানুষের তৈরী যতো প্রকার মূল্যবোধ ও নেয়ামত লাভ করার জন্যে যতাে ত্যাগই স্বীকার হােক এবং যতাে দুঃখ-বেদনাই ভােগ করা হােক না কেন, সে নেয়ামতের মর্যাদার তুলনায় তা একেবারেই তুচ্ছ।

ফী জিলালিল কুরআন:

*দ্বীনী দায়িত্ব অবহেলার পরিণতি : এরপর গােটা মানব জাতির উপকারার্থে আল্লাহ পাক আর একটি কথা স্মরণ করাচ্ছেন যে, তার এই অমানত বহন করার জন্যে ইহুদী জাতিকে তিনি যে দীর্ঘ সময় দান করেছিলেন, তা সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে গেছে। আর কোনাে দিন তাদের এই আমানত বহন করার দায়িত্ব দেয়া হবে না এবং এই দায়িত্বভার বহন করার জন্যে তাদের মধ্যে আর কখনও কোনাে অন্তরও তৈরী হবে না, যেহেতু এই আমানত বহন করার জন্যে এমন যিন্দাদিল লােকের প্রয়ােজন, যারা সঠিক বুঝ গ্রহণ করতে সক্ষম, অন্তরে আগত সঠিক বুঝ ধরে রাখতেও সক্ষম এবং সেই বুঝ অনুসারে কাজ করতেও প্রস্তুত। তাই এরশাদ হচ্ছে, যাদের তাওরাতের আমানতের বােঝা বহন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলাে, কিন্তু এ দায়িত্ব লাভ করার পর তারা এর হক আদায় করলাে না, তারা এমন একটি গাধার মতো, যা বড় বড় বইয়ের বােঝা বহন করে বটে, কিন্তু তারা নিজেরা তা কিছুই বুঝে না। এর থেকেও নিকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সে ব্যক্তিদের, যারা আল্লাহর আয়াতগুলাে অস্বীকার করেছে এবং নবীকে মিথ্যাবাদী বলে দোষারােপ করেছে! এমন যালেম জাতিকে আল্লাহ তায়ালা কখনও হেদায়াত করেন না।’ বনী ইসরাঈল জাতিকে তাওরাত কিতাব দেয়া হয়েছিলাে এবং তাদের ঈমান আকীদা ও শরীয়তের বিধি বিধানের আমানত দান করা হয়েছিলো, ‘কিন্তু এ দায়িত্বের হক তারা আদায় করলাে না।’ এ দায়িত্বের দাবী ছিলাে, ওই কিতাবটিকে আল্লাহর কিতাব হিসাবে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করা, বিবেক বুদ্ধি খরচ করে বুঝতে চেষ্টা করা এবং অন্তরের গভীরে অনুধাবন করা, আর পরিশেষে বিবেকের কাছে গৃহীত ও বাস্তবতার নিরিখে যথার্থ বলে প্রমাণিত সত্যকে বাস্তব কর্মে রূপায়িত করা, কিন্তু আল কোরআনে বর্ণিত বনী ইসরাঈল জাতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এবং আজও বাস্তবে তাদের যে আচরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে কিছুতেই বুঝা যায় না যে, তারা এই মহান আমানতের কিছুমাত্র মূল্যায়নও করেছে, বরং এটাই সত্য কথা যে, তারা এর সত্যতা অনুধাবন তাে করেইনি আর না তারা এ কিতাব অনুসারে কোনাে কাজ করেছে। এই কারণেই বলা হয়েছে যে, গাধার মতাে তারা বড় বড় কিতাব বহন করেছে বটে, কিন্তু সেই ভারী বােঝা বহন করা ছাড়া এ কিতাব তাদের কোনােই উপকারে আসেনি। আসলে এ কিতাবের অধিকারী হওয়ার যােগ্যই তারা নয় এবং এর লক্ষ্যও তারা জানে না। তাদের এই চরম নিকৃষ্ট চরিত্র ও কদর্যতম ব্যবহার তুলে ধরে আল কোরআন তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে আহবান জানিয়েছে। চরম নিকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সেই জাতির, যারা আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলােকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছে এবং সেগুলাে মিথ্যা বলে অস্বীকারও করেছে। ‘আর কখনই আল্লাহ তায়ালা এই সব যালেম জাতিকে হেদায়াত করেন না।’ যাদের তাওরাত কিতাব বহন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু এ মহান ও পবিত্র দায়িত্ব লাভ করেও যারা এর হক আদায় করেনি, তাদের মতােই আজকের পৃথিবীতে এক জাতির উদাহরণ পাওয়া যায়, যাদের ঈমান ও ইসলামের আমানত দেয়া হয়েছে, কিন্তু তারা তার হক আদায় করছে না। ইতিপূর্বে যুগ যুগ ধরে মুসলমানদেরও অনেক সম্প্রদায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে এবং আজও যারা বর্তমান রয়েছে, তারা মুসলমান নাম ধারণ করে রেখেছে বটে, কিন্তু বাস্তবে মুসলমানের মতাে কোনাে কাজই তারা করছে না, বিশেষ করে সেসব ব্যক্তি যারা আল কোরআন এবং অন্যান্য বহু ইসলামী বইপত্র পড়ছে, কিন্তু এগুলাের শিক্ষা অনুসারে তাদের মধ্যে কোনাে জাগরণ আসছে না, এরা সবাই হচ্ছে সেই গাধার মতো, যা বড় বড় বইয়ের বােঝাই বহন করে চলে, কিন্তু সেই বইগুলাের কোনাে মর্ম সে বুঝে না। এ ধরনের গাধাসম ব্যক্তি আজ সমাজে বহু বহু সংখ্যায় বিরাজ করছে। অবশ্য প্রশ্ন এটা নয় যে, তারা বইয়ের বােঝা বহন করছে বা অধ্যয়ন করছে। প্রশ্ন তাে হচ্ছে এই যে, তারা এসব কিতাবপত্র বুঝেছে কিনা বা এসব কিতাব অনুসারে আমল করছে কিনা।  *ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে মােবাহালার পদ্ধতি : আগেও ইহুদীরা মনে করতাে এবং এখনও মনে করে, তারাই একমাত্র আল্লাহর প্রিয় জাতি এবং অন্যান্য সকল জাতি থেকে তারাই আল্লাহর বেশী মহব্বতধন্য, আর অন্যান্য মানুষ তারা তাে সব অশিক্ষিত জাহিল, অথবা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতি সাধারণ কতিপয় মানুষ। এসব সাধারণ মানুষের সাথে তার দ্বীনী হুকুম আহকামের ব্যাপারে কোনাে মতৈক্যে পৌঁছতে বা আপসে আসতে চায় না। তাই তারা বলে, ‘এই উন্মী লােকদের (মুক্তি ও উন্নতির) জন্যে আমাদের কাছে কোনাে পথ খােলা নেই।’ এতােটুকু বলেই তারা ক্ষান্ত নয়, বরং কোনাে দলীল প্রমাণ ছাড়াই তারা আল্লাহর ওপর নির্জলা মিথ্যা আরাপ করতে দ্বিধাবােধ করে না। আর সেই জন্যেই তাদের মােবাহালা করতে আহবান জানানাে হয়েছে। আহবান জানানাে হয়েছে নাসারা ও মােশরেকদেরও এই মােবাহালা করতে। ‘বলাে, হে ওসব ব্যক্তিরা, যারা নিজেদের ইহুদী বলে মনে করাে অথবা মনে করে নিজেদের হেদায়াতপ্রাপ্ত, তােমরা যদি মনে করাে যে… ব্যবহার সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন যা তোমরা পৃথিবীর বুকে করছিলে।’ মুবাহালা বলতে বুঝায় একই কথা বলার উদ্দেশ্যে দুটি বিবদমান দলের মুখােমুখি দাঁড়ানাে এবং উভয় দলের পক্ষ থেকে একই সাথে আল্লাহর কাছে প্রকৃত মিথ্যাবাদীর ওপর গযব নাযিল করার জন্যে দোয়া করা। রসূলুল্লাহ(স.) যখনই এইভাবে কাউকে মােবাহালা করার জন্যে আহবান জানিয়েছেন, তখনই তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে এবং প্রতি বারই তারা এই কঠিন প্রতিযােগিতা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং কিছুতেই এই প্রতিযােগিতায় নামতে রাযি হয়নি। কারণ তাদের অন্তরের মধ্যে তাে অবশ্যই তারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে সত্যবাদী বলে জানতাে এবং প্রকৃতপক্ষেই তিনি যে আল্লাহর রসূল, তাদের মনের গভীরে অবশ্যই এ বিশ্বাস ছিলাে এবং এই দ্বীন ই যে সত্য জীবন ব্যবস্থা তাও তারা বুঝতাে। ইমাম আহমাদ হযরত ইবনে আব্বাস(রা.)-এর হাদীস রেওয়ায়াত করতে গিয়ে বলেন, একদিন আবু জাহল বললাে, ওর ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত হােক, কাবা ঘরে ওকে যদি আমি দেখতে পাই, তাহলে অবশ্যই ওর গর্দানের ওপরে পা রেখে ওকে আমি দলিত মথিত করে ফেলবাে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রসূলুল্লাহ(স.) একথা শুনে বললেন, ওরা যদি সত্য সত্যই মোবাহালা করে তাহলে ফেরেশতারা তৎক্ষণাৎ তাদের পাকড়াও করে বসতাে। আর যদি ইহুদীরা মৃত্যু কামনা করতাে, তাহলে সাথে সাথেই মৃত্যু এসে যেতাে এবং এর পর পরই তারা নিজেদের দোযখে দেখতে পেতাে। যদি তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে মােবাহালা করার জন্যে বের হয়ে আসতাে, তাহলে তারা এমন অবস্থায় ফিরে যেতাে যে, তারা তাদের মাল-সম্পদ ও পরিবারের কাউকে আর খুঁজে পেতাে না।(বুখারী, তিরমিযী এবং নাসাঈ ও অনুরূপ হাদীস রেওয়ায়াত করেছেন) এই মােবাহালা করার উদ্দেশ্য ছিলাে সে হঠকারী ব্যক্তিদের মুখ বন্ধ করে দেয়া, যারা মনে করতাে যে, তারাই একমাত্র আল্লাহর বন্ধু ও প্রিয়পাত্র, অন্য কেউ এই মর্যাদার অধিকারী নয়। তারাই যদি একমাত্র প্রিয়পাত্র হবে, তাহলে তাদের মৃত্যুর এত ভয় কেন? সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সব থেকে তারা এতাে ভীরুই বা কেন ? মৃত্যুর পর পরই তাে তারা সেই মর্যাদার অধিকারী হয়ে যাবে, যা আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয়পাত্র ও তার আপন জনের জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজেদের কথাতে তাদের আটকিয়ে দেয়ার পর তাদের বুঝার সুযােগ করে দিচ্ছেন যে, যে জিনিসের দাবী তারা করছে তা সত্য নয়। আর এটাও তারা জানে যে, যে কথাগুলাে তারা বলছে তাতে তারা নিজেরাও তৃপ্ত বা নিশ্চিন্ত নয়। এসব কথা দ্বারা কোনাে সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার আশাও তারা করে না। তারা এমন নাফরমানীর কথা বলছে, যা তাদেরকেই মৃত্যুর ভয় ও মৃত্যুর পরবর্তী কঠিন অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং এ আচরণ জীবনের বন্ধুর পথের ভয়াবহতা কম করার ব্যাপারে তাদের সামান্যতম সাহায্যও করতে পারবে না। তাদের সামনে তাদের যে কাজের ফিরিস্তি রয়েছে, তার কারণেই তাে তারা কিছুতেই মৃত্যু কামনা করে না, করতে পারে না এবং আল্লাহ তায়ালা যালেমদের সম্পর্কে ভালাে করেই জানেন। আলােচনার সমাপ্তি টানতে গিয়ে ও আল্লাহ তায়ালা মৃত্যু ও তৎপরবর্তী অবস্থার সঠিক চিত্র ও তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে বলছেন, যে মৃত্যু থেকে পালানের চেষ্টা তারা করছে, তাতে আসলে তাদের কোনাে ফায়দা নেই; বরং এ ভয়ংকর অবস্থা আসবেই আসবে। এ অবস্থা থেকে তাদের বাঁচারও কোনাে উপায় নেই। মৃত্যু এসে গেলে আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়া ও তাঁর কাছে নিজেদের কাজে হিসাব নিকাশ দেয়া ছাড়া অন্য কোনাে গত্যন্তরও তাদের নেই। এ হিসাবের দিন যে আসবেই আসবে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। একথা বুঝাতে গিয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘বলে দাও (হে রসূল)! যে মৃত্যু থেকে তােমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছাে, তা তােমাদের সাথে সাক্ষাত করবেই, তারপর তােমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অনুপস্থিত ও উপস্থিত জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহর দিকে এবং তখন তিনি তােমাদেরকে তােমাদের অতীতের সকল কীর্তিকলাপ সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন, যা তােমরা জীবনভর করতে থেকেছ। আল কোরআন যাদের সরাসরি সম্বােধন করছে এবং যাদের পরােক্ষভাবে বলেছে, তাদের প্রত্যেকের জন্যে এ মহাগ্রন্থের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভংগি তুলে ধরা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এ এক বিশেষ দৃষ্টিভংগি। আল কোরআন সকল কথার মধ্যেই চিরন্তন এ সত্য বার বার তুলে ধরেছে যে, আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাত করতেই হবে, এ ছাড়া তাদের কোনাে উপায় নেই এবং তার আশ্রয় ছাড়া অন্য কোনাে আশ্রয়ও নেই। তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর কাছেই তাদের ফিরে যেতে হবে এবং তাঁর কাছে ফিরে গিয়ে অতীতের যাবতীয় কাজের হিসাব পেশ করতে। হবে। এ হিসাব দান করা থেকে পালানাের বা তার থেকে মুক্তি লাভ করারও কোনাে উপায় নেই। ইমাম তাবারী তাঁর রচিত অভিধান গ্রন্থে একটি বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, মৃত্যু থেকে পলায়নপর ব্যক্তি হচ্ছে এমন একটি শেয়ালের মতাে, যাকে পৃথিবীর মাটি তার দেনা পরিশােধ করার জন্যে খুঁজে বেড়াতে থাকে, কিন্তু সে এ দাবী এড়ানাের জন্যে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়ায়, শেষ পর্যন্ত কোন জায়গায় আশ্রয় না পেয়ে শ্ৰান্ত ক্লান্ত হয়ে আবার সে নিজের গর্তের মধ্যেই ঢুকে পড়ে। তখন আবার তাকে মাটি বলে, কোথায় হে শেয়াল পন্ডিত, আমার পাওনাটা কই? এরপর ছুরি বের করা হয় তাকে কতল করার জন্যে। তখন সে আবার পালায়, আবারও ঘুরে-ফিরে এসে সেই গর্তের মধ্যে আশ্রয় নেয়, অবশেষে তার গর্দান কেটে দিলে সে মারা যায়। মানুষকে তাদের পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে সজাগ করার জন্যে এ উদাহরণ বড়ই হৃদয়গ্রাহী।

ফী জিলালিল কুরআন:

এখন আমরা উপনীত হতে চলেছি সূরাটির শেষ অধ্যায়ের আলােচনায়। এ অধ্যায়ে বিশেষ ভাবে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে জুমার নামায সম্পর্কে কথা এসেছে, যার উল্লেখ বার বার করা হয়েছে। এখানে যে ভাষায় কথাটি ব্যক্ত হয়েছে তাতে বার বার বর্ণনার কথাই বুঝা যায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারা, জুমার দিনে নামাযের জন্যে আহবান জানানো হলে দ্রুতবেগে মসজিদের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনার সকল… হে, রসূল, আল্লাহর কাছে যা কিছু আছে তা এসব ঢােলডগর এবং তিজারতী মাল সামান থেকে উত্তম এবং আল্লাহ তায়ালাই উত্তম রিযিক দানকারী। ‘ *জুমার আযান ও বৈষয়িক কাজের নিষেধাজ্ঞা : জুমার নামায হচ্ছে সমষ্টিগতভাবে আদায় করার নামায। সাপ্তাহিক এ নামাযে মহল্লার লােক একত্রিত হয়ে আল্লাহর দরবারে হাযিরা দিয়ে নিজেদের একতা ও সংহতির প্রমাণ দেয়, এজন্যে একাকী অবস্থায় জুমার নামায শুদ্ধ হয় না। এ নামাযে তারা একত্রিত হয়ে একে অপরের সাথে সাক্ষাতের সুযােগ পায়। সবাই মিলে ইমাম সাহেবের খােতবা মনােযােগ দিয়ে শােনে। আল্লাহকে স্মরণ করে দুনিয়ার জীবন সুন্দরভাবে গড়ে তােলার জন্যে ও আখেরাতে হাসিমুখে আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়ার লক্ষ্যে ইসলামী পদ্ধতিতে সুসংগঠিতভাবে আল্লাহর আনুগত্য করার এ এক অনুপম উপায়। এ হচ্ছে এমন একটি আনুষ্ঠানিক এবাদাত যা একাধারে মুসলমানদের একত্রিত করে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন পেশ করে, আর বস্তুত (সংগঠন ও আনুগত্য) এ দুটি কাজই সমান ভাবে আল্লাহর কাছে এবাদাত হিসেবে কবুল হয় ।(দেখুন, মােহাম্মদ কুতুব রচিত আন্নাফসু অল মুজতামাউ পুস্তকের অধ্যায়, আল ইবাদাতুল ইসলামিয়্যাহ) আর এই এবাদাত ‘সূরা সফ’-এ উল্লেখিত ইসলামী জামায়াতের আকীদা বিশ্বাসের মধ্যে যে মূল প্রকৃতি রয়েছে, তা বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। আর জুমার নামাযের মর্যাদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এবং এ নামাযের জন্যে উৎসাহ দিতে গিয়ে গােসল করে পাক-সাফ কাপড় পরে খােশবু মেখে এ নামাযের জন্যে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশসূচক বহু হাদীস এসেছে। বােখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখিত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর(রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায়, রসূলুল্লাহ(স.) বলেছেন, ‘তােমাদের মধ্যে কোনাে ব্যক্তি যখন জুমার নামায পড়তে যাবে, তখন সে যেন গোসল করে নেয়।’ চার জন বিজ্ঞ সাহাবা (খোলাফায়ে রাশেদীন) আওস ইবনে আওস আস সাকাফী থেকে একটি হাদীস পেয়েছেন যাতে তিনি বলেছেন, ‘আমি রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করলাে এবং সুন্দরভাবে ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সাথে সমস্ত শরীর ধুয়ে মুছে নিলাে, তারপর মসজিদে যাওয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়লাে এবং সব থেকে আগে হেঁটে গেলো, কোনাে যানবাহন ব্যবহার করলাে না এবং ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে খােতবা শুনতে থাকলাে, আর কোনাে প্রকার বেফায়দা কাজে লিপ্ত হলাে না, তার প্রতিটি পদক্ষেপের জন্যে এক বছরের রােযা ও নামাযের সওয়াব তাকে দেয়া হবে।’ ইমাম আহমাদ(র.) আবু আইয়ুব আনসারীর একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যাতে তিনি বলেন, আমি রসূল(স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তির স্ত্রী আছে, জুমার দিনে গােসল করে তার কাছ থেকে আতর নিয়ে মেখে সে যদি সুন্দর কাপড় চোপড় পরে মসজিদে যায়, সময় পেলে তাহিয়্যাতুল মসজিদ দু’রাকআত নামায পড়ে নেয় এবং কাউকে কষ্ট না দেয় বা কারও কোনাে অসুবিধার সৃষ্টি না করে, এর পর ইমাম খােতবা দেয়ার জন্যে বেরিয়ে আসলে পরিপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে খােতবা শুনে এবং জুমার নামায আদায় করে নেয়, তার এ কাজগুলাে পরবর্তী জুমার দিন আসার মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে যেসব গুনাহখাতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি (সগীরা গুনাহ) হবে, তার জন্যে কাফফারা হিসাবে কবুল হয়ে যাবে। এ অধ্যায়ে প্রথম আয়াতটি দ্বারা আযান শােনার সাথে সাথে মুসলমানদের বেচাকেনা (ব্যবসা বাণিজ্য) বা অন্য যে কোনাে পেশাগত কাজ পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা, জুমার দিন যখন নামাযের জন্যে আহ্বান জানানাে হয়, তখন দ্রুতগতিতে আল্লাহর স্মরণ-এর দিকে এগিয়ে যাও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও।’ এ আয়াত দ্বারা জীবিকা অর্জনের যাবতীয় উপায় উপাদান যা কিছু আছে সেসব কিছুই পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে এবং এ সময়টিতে পুরােপুরিভাবে আল্লাহর স্মরণে নিজেদের মগ্ন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, ‘এটাই তােমাদের জন্যে মংগলজনক, তােমরা বুঝবে যদি তােমাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাও।’ এখানে এই নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ পেশাগত যেসব কাজে লিপ্ত থাকে, তার থেকে বের করে নিয়ে তাদের আল্লাহর স্মরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে উৎসাহ দান করা ও তাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি মহববত পয়দা করা- এই কাজটি সকল মানুষের জন্যেই একটি স্থায়ী শিক্ষা। সুতরাং মাঝে মাঝে মানুষের মনােযােগ আয় রােযগারের কাজ ও এ পৃথিবীর আকর্ষণীয় বস্তুসমূহের মহব্বত থেকে সরিয়ে নিছক আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে আসার জন্যে এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী রাব্বুল আলামীনের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার স্বাদ গ্রহণের সুযােগ করে দেয়ার জন্যে বড়ই চমৎকার এক ব্যবস্থা। এ মহব্বতের আমেজে এবং আল্লাহর সাথে নৈকট্য লাভের সুরভিতে মােমেনদের দিল ও মন মগজ পুলকিত এবং খুশীতে বক্ষ প্রসারিত হয়ে যায়।

ফী জিলালিল কুরআন:

*হালাল রিযিক অনুসন্ধানও আল্লাহর এবাদাত : ‘তারপর নামায শেষ হয়ে গেলে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আল্লাহর রহমত তালাশ করাে।’ এরপর আয়াতটি আল্লাহর স্মরণের সাথে সাথে মানুষের জীবিকা অর্জনের উপায় উপকরণের দিকে ফিরে এসে আমাদের জানাচ্ছে, নামায সমাপ্ত হলে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর রহমত তালাশ করাে এবং বেশী বেশী করে আল্লাহকে স্মরণ করো, হয়ত এভাবেই তােমরা সাফল্যমন্ডিত হবে। এই হচ্ছে সেই মহা সমন্বয় সাধন বা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে গােটা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তােলা হয়েছে। এ ভারসাম্য হচ্ছে জীবনের প্রয়ােজনে, কাজ, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও উপার্জন এবং মাঝে মাঝে এসব কিছু থেকে মানুষের আত্মা-মনকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আল্লাহর স্মরণ ও মহব্বতে নিমগ্ন করে দেয়া। অন্তর ও আত্মাকে জীবিত রাখার জন্যে এই পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরী। এ পদ্ধতি ব্যতীত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তার দেয়া আমানতের বােঝা বহন করা সম্ভব নয়। রােযগারের জন্যে চেষ্টা করার কালে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ অতীব জরুরী। এই স্মরণের কারণেই যা কিছু কাজকর্ম করা হয় এবং আয় রােযগারের যে চেষ্টা চালানাে হয়, তা সব কিছুই এবাদাতে পরিণত হয়ে যায়। এ স্মরণ সর্বক্ষণ তো থাকতেই হবে, তবু বিশেষভাবে কিছু সময় নিছক আল্লাহর জন্যে বের করে নেয়া এবং একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে নিজেকে নিবেদিত করে দেয়ার জন্যেই এ আয়াত দুটিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইরাক ইবনে মালেক(রা.) জুমার নামায শেষ করে যখন বের হতেন, তখন তিনি এসে মসজিদের দরজায় দাড়িয়ে বলতেন, হে আল্লাহ, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার নির্দেশমতাে (ফরয) নামায আদায় করেছি এবং আপনার নির্দেশ মতােই আমি রুজির তালাশে বেরিয়ে পড়েছি। অতএব, আপনার মেহেরবানী দ্বারাই আমার রুজির ব্যবস্থা করে দিন। অবশ্যই আপনি সর্বোত্তম রিযিকদানকারী (ইবনে হাতেম হাদীসটি রেওয়ায়াত করেন)। রুযি রােযগারের তালাশে কিভাবে বেরুতে হবে, তা উক্ত হাদীস সে চিত্রটি আমাদের কাছে অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। আল্লাহর হুকুম কি ভাবে পালন করতে হবে, তা বুঝার জন্যে একথাগুলাে শােনার পর আমাদের মধ্যে আর কোনাে প্রকার অস্পষ্টতা থাকে না, থাকে না এ কথাগুলাের তাৎপর্য বুঝতে কোনাে সংকট। জাহেলিয়াতের যমানায় ধন দৌলতের তালাশে মানুষ যেসব প্রচেষ্টা চালাতাে, তার মধ্যে থাকতাে না কোনাে নীতি নৈতিকতা, মানবতাবােধ বা কারও কাছে কোনাে জওয়াবদিহিতার মন মানসিকতা। সেই সমাজ থেকে বের করে নিয়ে আসা এই ক্ষুদ্র মানবগােষ্ঠীকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর কাছে জওয়াবদিহিতার মানসিকতা দান করে তাদের তিনি সােনার মানুষরূপে গড়ে তুলেছেন, যারা সামাজিক জীবনের মৌলিক উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে গােটা সমাজকে সুখ শান্তি, সমৃদ্ধি, পারস্পরিক বিশ্বাস ও মহব্বতের আমেজে ভরে দিলেন। জাহেলী সমাজের ছবি তুলে ধরে প্রকৃত সােনার মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার চেতনাকে পরবর্তী আয়াত জীবন্ত রূপ দিয়েছে, ‘যখন তারা দেখতে পেলাে বাণিজ্য কাফেলাটিকে দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে আসছে, অথবা শুনতে পেলাে মন মাতানাে আগমনবার্তাসূচক সংগীতধ্বনি, তখন তারা লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেলাে সেই দিকে, তারা তােমাকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ফেলে গেলো। ‘বলে দাও (হে রসূল), যা কিছু আল্লাহর কাছে রয়েছে, তা এসব খেল তামাশার মন মাতানাে জিনিস ও যা কিছু বাণিজ্য দ্রব্য সম্ভার, সেসব কিছু থেকে অনেক ভালাে এবং (জেনে রেখাে) আল্লাহ তায়ালাই সর্বোত্তম রিযিকদানকারী।’ জাবের(রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “আমরা নবী(স.)-এর সাথে নামায পড়ছিলাম, এমন সময় রসদ বােঝাই (কাফেলার) উটের বহরের আগমন ঘটলাে, তখন সবার মনােযােগ সেই দিকে গিয়ে পড়লাে এবং শেষ পর্যন্ত বার জন ব্যক্তি ব্যতীত নবী(স.)-এর সাথে আর কেউ অবশিষ্ট রইলাে না, যাদের মধ্যে আবু বকর এবং ওমর(রা.)-ও ছিলেন। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াতটিতে দুটি মন্তব্য পাওয়া যায়। এক. আল্লাহর কাছেই রয়েছে সকল রুযি রুটির ভান্ডারের চাবিকাঠি। দুই. আল্লাহর ভান্ডারের সে নেয়ামত, দুনিয়ার মন মাতানাে খেল তামাশা, বাদ্য বাজনা ও ব্যবসা বাণিজ্যলব্ধ মাল সামান এসব কিছু থেকে অনেক ভালাে। এখানে রয়েছে সেসব লোক, যারা অর্থ সম্পদের লােভে কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে যায়, তাদের জন্যে একটি উপদেশ যে, রিযিক সবই আসে আল্লাহর কাছ থেকে। ‘আর আল্লাহ তায়ালাই সর্বোত্তম রিযিকদানকারী।’ যে ঘটনা সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে কিছু আলােচনা করেছি, সে ঘটনাটি বিশেষভাবে এই জন্যেই ঘটানাে হয়েছিলাে যেন এর আলােকে মানুষকে পরিপূর্ণ মােমেন রূপে গড়ে তােলার প্রশিক্ষণ দেয়া যায় এবং তাদের মধ্যে এমন চারিত্রিক গুণাবলী সৃষ্টি করা যায়, যার স্পর্শে এক অভূতপূর্ব ও অদ্বিতীয় সমাজ গড়ে ওঠে, যা মানবেতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। যা সর্বকালে আল্লাহর পথে দাওয়াতী কাজে দৃঢ়তা অবলম্বনকারীদের জন্যে শত প্রকার দুর্বলতা, ক্ষতি, লােকসান, মতবিরােধ, বিবাদ বিসম্বাদ ও ভীষণ ভাংগন বিপর্যয়ের মধ্যেও পর্বতসম দৃঢ়তা সরবরাহ করতে পারে। মানুষের মন এই ভালাে ও মন্দ গ্রহণ করার আধার। ঈমানের এই সুবাসে সুরভিত এই মনই তাকে ঈমান আকীদার পরিপূর্ণতা লাভের স্তরে, সকল প্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে পৌছে দেয় এবং তাকে সীমাহীন পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতা গ্রহণ করার মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। এই পবিত্র মনই তাকে সবর, সঠিক বুঝ শক্তি, তীব্র অনুভূতি, পর্বতসম পথ অবলম্বন করার মতাে ভারসাম্যবােধ দান করে। আর আল্লাহ রব্বুল আলামীনই আমাদের একমাত্র সহায়।

Leave a Reply