Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬০/হে মুমিনগণ!:-৮১,৮২ ও ৮৩)
[* হে মুমিনগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না:-(৮১)
*হে মুমিনগণ! ঈমানদার নারীরা যখন হিজরাত করে,পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নাও:-(৮২)
*কাফের নারী-পুরুসদের সাথে কোন বিবাহ বন্ধন থাকতে পারে না:-
**হে মুমিনগণ!যাদের ওপর আল্লাহ গযব নাযিল করেছেন তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না:-(৮৩)]
www.motaher21.net
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা।
পারা:২৮
১-১৩ নং আয়াত:-
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-১
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوۡا عَدُوِّیۡ وَ عَدُوَّکُمۡ اَوۡلِیَآءَ تُلۡقُوۡنَ اِلَیۡہِمۡ بِالۡمَوَدَّۃِ وَ قَدۡ کَفَرُوۡا بِمَا جَآءَکُمۡ مِّنَ الۡحَقِّ ۚ یُخۡرِجُوۡنَ الرَّسُوۡلَ وَ اِیَّاکُمۡ اَنۡ تُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ رَبِّکُمۡ ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ خَرَجۡتُمۡ جِہَادًا فِیۡ سَبِیۡلِیۡ وَ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِیۡ ٭ۖ تُسِرُّوۡنَ اِلَیۡہِمۡ بِالۡمَوَدَّۃِ ٭ۖ وَ اَنَا اَعۡلَمُ بِمَاۤ اَخۡفَیۡتُمۡ وَ مَاۤ اَعۡلَنۡتُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡہُ مِنۡکُمۡ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ السَّبِیۡلِ ﴿۱﴾
**হে মুমিনগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শক্রকে বন্ধুরূপে গ্ৰহণ করো না, তোমরা কি তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা প্রেরণ করছ, অথচ তারা, তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে , রাসূলকে এবং তোমাদেরকে বহিস্কার করেছে এ কারণে যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর উপর ঈমান এনেছ। যদি তোমরা আমার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে এবং আমার সস্তুষ্টি লাভের জন্য বের হয়ে থাক, তবে কেন তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছ? আর তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্ৰকাশ কর তা আমি সম্যক অবগত। তোমাদের মধ্যে যে কেউ এরূপ করে সে তো বিচ্যুত হয় সরল পথ থেকে।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-২
اِنۡ یَّثۡقَفُوۡکُمۡ یَکُوۡنُوۡا لَکُمۡ اَعۡدَآءً وَّ یَبۡسُطُوۡۤا اِلَیۡکُمۡ اَیۡدِیَہُمۡ وَ اَلۡسِنَتَہُمۡ بِالسُّوۡٓءِ وَ وَدُّوۡا لَوۡ تَکۡفُرُوۡنَ ؕ﴿۲﴾
তাদের আচরণ হলো, তারা যদি তোমাদের কাবু করতে পারে তাহলে তোমাদের সাথে শত্রুতা করবে এবং হাত ও জিহবা দ্বারা তোমাদের কষ্ট দেবে। তারা চায় যে, কোনক্রমে তোমরা কাফের হয়ে যাও।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৩
لَنۡ تَنۡفَعَکُمۡ اَرۡحَامُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ ۚۛ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚۛ یَفۡصِلُ بَیۡنَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۳﴾
তোমাদের আত্নীয়-স্বজন ও সন্তান–সন্ততি কিয়ামতের দিন কোন উপকার করতে পারবে না। আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন; আর তোমরা যা কর আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৪
قَدۡ کَانَتۡ لَکُمۡ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ فِیۡۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗ ۚ اِذۡ قَالُوۡا لِقَوۡمِہِمۡ اِنَّا بُرَءٰٓؤُا مِنۡکُمۡ وَ مِمَّا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ۫ کَفَرۡنَا بِکُمۡ وَ بَدَا بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃُ وَ الۡبَغۡضَآءُ اَبَدًا حَتّٰی تُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَحۡدَہٗۤ اِلَّا قَوۡلَ اِبۡرٰہِیۡمَ لِاَبِیۡہِ لَاَسۡتَغۡفِرَنَّ لَکَ وَ مَاۤ اَمۡلِکُ لَکَ مِنَ اللّٰہِ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ رَبَّنَا عَلَیۡکَ تَوَکَّلۡنَا وَ اِلَیۡکَ اَنَبۡنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۴﴾
অবশ্যই তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ‘ইবাদাত কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শক্ৰতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহ্তে ঈমান আন ।’ তবে ব্যতিক্রম তাঁর পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিঃ ‘আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব; আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোন অধিকার রাখি না ।’ ইব্রাহীম ও তার অনুসারীগণ বলেছিল, ’হে আমাদের রব! আমারা আপনারই উপর নির্ভর করেছি, আপনারই অভিমুখী হয়েছি এবং ফিরে যাওয়া তো আপনারই কাছে।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৫
رَبَّنَا لَا تَجۡعَلۡنَا فِتۡنَۃً لِّلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ اغۡفِرۡ لَنَا رَبَّنَا ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۵﴾
হে আমাদের রব, আমাদেরকে কাফেরদের জন্য ফিতনা বানিয়ে দিও না। হে আমাদের রব, আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দাও। নিঃসন্দেহে তুমিই পরাক্রমশালী এবং জ্ঞানী।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৬
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡہِمۡ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ فَاِنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ٪﴿۶﴾
যারা আল্লাহ্ ও শেষ দিবসের প্রত্যাশা করে অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে ওদের মধ্যে উত্তম আদর্শ। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, (সে জেনে রাখুক), নিশ্চয় আল্লাহ, তিনি অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৭
عَسَی اللّٰہُ اَنۡ یَّجۡعَلَ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَ الَّذِیۡنَ عَادَیۡتُمۡ مِّنۡہُمۡ مَّوَدَّۃً ؕ وَ اللّٰہُ قَدِیۡرٌ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۷﴾
অসম্ভব নয় যে, আজ তোমরা যাদের শত্রু বানিয়ে নিয়েছো আল্লাহ তা’আলা তাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন এক সময় বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমতাবান। আর তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৮
لَا یَنۡہٰىکُمُ اللّٰہُ عَنِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یُقَاتِلُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ لَمۡ یُخۡرِجُوۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ اَنۡ تَبَرُّوۡہُمۡ وَ تُقۡسِطُوۡۤا اِلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ ﴿۸﴾
দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখাতে ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন ।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-৯
اِنَّمَا یَنۡہٰىکُمُ اللّٰہُ عَنِ الَّذِیۡنَ قٰتَلُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ اَخۡرَجُوۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ وَ ظٰہَرُوۡا عَلٰۤی اِخۡرَاجِکُمۡ اَنۡ تَوَلَّوۡہُمۡ ۚ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّہُمۡ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۹﴾
আল্লাহ শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বের করাতে সাহায্য করেছে। আর তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই তো যালিম।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-১০
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا جَآءَکُمُ الۡمُؤۡمِنٰتُ مُہٰجِرٰتٍ فَامۡتَحِنُوۡہُنَّ ؕ اَللّٰہُ اَعۡلَمُ بِاِیۡمَانِہِنَّ ۚ فَاِنۡ عَلِمۡتُمُوۡہُنَّ مُؤۡمِنٰتٍ فَلَا تَرۡجِعُوۡہُنَّ اِلَی الۡکُفَّارِ ؕ لَا ہُنَّ حِلٌّ لَّہُمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحِلُّوۡنَ لَہُنَّ ؕ وَ اٰتُوۡہُمۡ مَّاۤ اَنۡفَقُوۡا ؕ وَ لَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ اَنۡ تَنۡکِحُوۡہُنَّ اِذَاۤ اٰتَیۡتُمُوۡہُنَّ اُجُوۡرَہُنَّ ؕ وَ لَا تُمۡسِکُوۡا بِعِصَمِ الۡکَوَافِرِ وَ سۡـَٔلُوۡا مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ وَ لۡیَسۡـَٔلُوۡا مَاۤ اَنۡفَقُوۡا ؕ ذٰلِکُمۡ حُکۡمُ اللّٰہِ ؕ یَحۡکُمُ بَیۡنَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۱۰﴾
*হে মুমিনগণ!ঈমানদার নারীরা যখন হিজরাত করে তোমাদের কাছে আসবে তখন (তাদের ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি) পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নাও। তাদের ঈমানের প্রকৃত অবস্থা অবশ্য আল্লাহই ভাল জানেন। অতঃপর যদি তোমরা বুঝতে পার যে, তারা সত্যিই ঈমানদার তাহলে তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। না তারা কাফেরদের জন্য হালাল না কাফেররা তাদের জন্য হালাল। তাদের কাফের স্বামীরা তাদেরকে যে মোহরানা দিয়েছে তা তাদের ফিরিয়ে দাও। তাদেরকে মোহরানা দিয়ে বিয়ে করায় তোমাদের কোন গোনাহ হবে না। আর তোমরা নিজেরাও কাফের নারীদেরকে নিজেদের বিয়ের বন্ধনে আটকে রেখো না। নিজেদের কাফের স্ত্রীদের তোমরা যে মোহরানা দিয়েছ তা ফেরত চেয়ে নাও। আর কাফেররা তাদের মুসলমান স্ত্রীদের যে মোহরানা দিয়েছে তাও যেন তারা ফেরত চেয়ে নেয়। এটি আল্লাহর নির্দেশ। তিনি তোমাদের সবকিছুর ফায়সালা করেন। আল্লাহ জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-১১
وَ اِنۡ فَاتَکُمۡ شَیۡءٌ مِّنۡ اَزۡوَاجِکُمۡ اِلَی الۡکُفَّارِ فَعَاقَبۡتُمۡ فَاٰتُوا الَّذِیۡنَ ذَہَبَتۡ اَزۡوَاجُہُمۡ مِّثۡلَ مَاۤ اَنۡفَقُوۡا ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ الَّذِیۡۤ اَنۡتُمۡ بِہٖ مُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۱﴾
তোমাদের কাফের স্ত্রীদেরকে দেয়া মোহরানার কিছু অংশ যদি তোমরা ফেরত না পাও এবং পরে যদি তোমরা সুযোগ পেয়ে যাও তাহলে যাদের স্ত্রীরা ওদিকে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে তাদের দেয়া মোহরানার সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দাও। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছো তাঁকে ভয় করে চলো।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-১২
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ اِذَا جَآءَکَ الۡمُؤۡمِنٰتُ یُبَایِعۡنَکَ عَلٰۤی اَنۡ لَّا یُشۡرِکۡنَ بِاللّٰہِ شَیۡئًا وَّ لَا یَسۡرِقۡنَ وَ لَا یَزۡنِیۡنَ وَ لَا یَقۡتُلۡنَ اَوۡلَادَہُنَّ وَ لَا یَاۡتِیۡنَ بِبُہۡتَانٍ یَّفۡتَرِیۡنَہٗ بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِنَّ وَ اَرۡجُلِہِنَّ وَ لَا یَعۡصِیۡنَکَ فِیۡ مَعۡرُوۡفٍ فَبَایِعۡہُنَّ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُنَّ اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۲﴾
হে নবী, ঈমানদার নারীগণ যখন তোমার কাছে বাইয়াত গ্রহণের জন্য আসে এবং এ মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না। সন্তান সম্পর্কে কোন অপবাদ তৈরী করে আনবে না এবং কোন ভাল কাজে তোমার অবাধ্য হবে না তাহলে তাদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।
সূরা:৬০: আল্-মুমতাহিনা:-১৩
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَوَلَّوۡا قَوۡمًا غَضِبَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ قَدۡ یَئِسُوۡا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ کَمَا یَئِسَ الۡکُفَّارُ مِنۡ اَصۡحٰبِ الۡقُبُوۡرِ ﴿٪۱۳﴾
*হে মুমিনগণ!যাদের ওপর আল্লাহ গযব নাযিল করেছেন তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। আখেরাত সম্পর্কে তারা ঠিক তেমনি নিরাশ যেমন কবরস্থ কাফেররা নিরাশ।
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এ সূরাটি কোরআনের সেই সূরাগুলাের অন্যতম, যেগুলাে ঈমানী যিন্দেগী, সামাজিক সংগঠন এবং কোনাে রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে নাগরিক জীবন যাপনের জন্যে মুসলমানদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ঈমানী জীবনের প্রশিক্ষণদানের সুদীর্ঘ শিকলের মধ্য থেকে এ সূরাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কড়ি, অথবা বলা যায়, উম্মতে মুসলিমার সামাজিক জীবন যাপনের জন্যে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে যে ব্যবস্থা প্রদত্ত হয়েছে, এ সূরাটিতে সেই শিক্ষা অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেছে এবং বাস্তব একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গােটা মানব জাতিকে সঠিক পথ পেতে সাহায্য করেছে। এই ভাবে আল কোরআন সামাজিক জীবন যাপনের জন্যে যে শিক্ষা উপস্থাপন করেছে তার থেকে মানব জাতি কখনও শিক্ষা গ্রহণ করেছে, আবার কখনও এ শিক্ষা থেকে সে দূরে সরে গেছে, কিন্তু আমরা যারা ইসলামকে একমাত্র সঠিক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে বুঝতে পেরেছি, তারা সদা সর্বদা সর্বপ্রকার চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে সে জীবন ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে রয়েছি এবং আশায় বুক বেঁধে রয়েছি যে, একদিন গােটা পৃথিবীর বুকে অবশ্যই এই জীবন ব্যবস্থা একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কায়েম হবে। অবশ্যই এক সময়ে এ জীবন ব্যবস্থা পুরােপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে যার ইংগিত সূরাটির শুরুতে দান করা হয়েছে। এ জন্যে ইসলামের সূচনালগ্নে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দান করা হয়েছে। এই দলীয় সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে যে সব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এবং আল্লাহর জানামতেই এসব ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ যা কিছু ঘটেছে বা ঘটছে, সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে। পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান চালু করার ব্যাপারে যে সব মানুষ চেষ্টা সাধনা ও কর্মকান্ডে নিয়ােজিত থেকেছে, তাতে কখনও দুঃখ কষ্ট এসেছে, আবার কখনও মানুষ জীবনের নিত্য নতুন স্বাদ লাভ করেছে। তাই সত্যের এই প্রদীপ্ত আলাে যখন উদ্ভাসিত করে দেবে গােটা ধরণীকে, তখন ঈমানের নতুন এই চেতনার কারণে অন্য সব কিছু থেকে মানুষ পৃথক হয়ে যাবে এবং ঈমানদারদের দলভুক্ত থাকার জন্যে চমকপ্রদ যে কোনাে ব্যক্তি বা জিনিসের সাথে সম্পৃক্ততা পরিত্যাগ করবে। সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী এই ঈমানী চিন্তাধারা গড়ে তােলার উদ্দেশ্যেই প্রয়ােজন ছিলাে সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণই মানুষের মন মগয ও প্রকৃতিকে তৎকালীন বিরাজমান সকল প্রকার ভুল ভ্রান্তি ও সারা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত জাহেলিয়াতের চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করেছিলাে; বিশেষ করে আরব উপদ্বীপের সকল পাপপূর্ণ চিন্তা থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলাে। ঈমানের এই মহীয়ান চিন্তার বিকাশ যাদের মধ্যে ঘটে, তারা জীবনের বাস্তবতা থেকে কিছুতেই দূরে থাকতে পারে না এবং বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ঘটনা তারা এড়িয়ে চলতে চায় না; বরং তারা দিনের পর দিন এবং একবারের পর আর একবার নানা প্রকার দুর্ঘটনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং তাদের কোনাে একটি বিষয় ও একটি সৃষ্টির দিকে বার বার ফিরে যেতে হয়, নানা প্রকার প্রভাবপূর্ণ জিনিসের অধীনতা স্বীকার করে নিতে হয়। কারণ আল্লাহ তায়ালাই তাে সকল ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেছেন, আর তিনি ভালাে করেই জানেন সব জিনিসের প্রভাব এক রকম হয় না এবং সৃষ্টির প্রথম থেকেই একইভাবে সব কিছু থেকে মানুষ প্রভাব গ্রহণ করে না, একইভাবে সব কিছুতে সাড়াও দেয় না এবং এক নযরে সব কিছু তারা দেখতে পায় না। সে একথা জানে এবং স্বীকারও করে যে, অতীতের অনেক রীতিনীতি, মানুষের স্বভাব প্রকৃতির ঝোকপ্রবণতা, মানবীয় দুর্বলতা, বাস্তবে সমাজের লােকদের সাথে মেলামেশা, আপনজন ও সংগী-সাথীদের। মতের গুরুত্বদান ও তাদের অভ্যাসের প্রভাব- এসব কিছুই মানুষের মধ্যে এমন কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে, একের পর এক সঠিক প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কাজও বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। এই জন্যেই এ সকল বাধা বিপত্তির মোকাবেলার কথা বার বার স্মরণ করানাের প্রয়ােজন হয়, প্রয়ােজন হয় নিবিড় ও আকর্ষণীয় সম্পর্ক স্থাপন করার। এর ফলেই আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ী অপ্রীতিকর ঘটনাসমূহ ঘটতে থাকে। এই কারণে উপর্যুপরি পরামর্শ দেয়া হয়, আর তারই আলােকে সে সতর্ক হতে থাকে এবং এই পথ প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে বার বার ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। রসূলুল্লাহ(স.) প্রকৃতপক্ষে বরাবরই জাগ্রত থাকতেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে যে স্পষ্ট পথনির্দেশনা (ইলহাম) পেতেন তারই আলােকে আগত সমস্ত সমস্যার সমাধান দান করতেন, আর তার প্রিয় সাহাবাদের চূড়ান্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে গড়ে তােলার জন্যে কাজে লাগাতেন। রসূলুল্লাহ(স.)-এর জামানায় ওহী ও এলহাম পরস্পর সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে এবং একটি অপরটিকে বলিষ্ঠ করেছে। এরই ফলে তার হাতে এই মুসলিম জামায়াত আল্লাহর ইচ্ছাতেই তাঁর পছন্দনীয় দল হিসেবে গড়ে ওঠতে সক্ষম হয়েছিলো। আলােচ্য সূরাটি এ দীর্ঘ প্রশিক্ষণ পদ্ধতির ধারার মধ্যে একটি বিশেষ ধারা। সূরাটির বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে আনীত অন্যান্য বিষয়ের সাথে রয়েছে; মুসলমানদের একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি একান্তভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা। এই বিশ্বাসের দৃঢ়তার ভিত্তিতেই মুসলমানরা পরস্পর নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ এমন এক রশির বাঁধন যা কখনও ছিন্ন হয় না। এ বন্ধনের কারণে সকল প্রকারের গােত্রীয় বা বংশীয় হিংসা বিদ্বেষ বিদূরীত হয়। এই মহান ঈমানী সম্পর্কের ফলে বংশীয় ও শ্রেণীগত আভিজাত্যবােধ, বিদ্বেষ এবং ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদী মনােভাব দূরীভূত হয়েছিলাে এবং তাদের সবার মধ্যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আল্লাহর পতাকাতলে সমবেত হয়ে একটি দলে আবদ্ধ হয়ে থাকাই প্রাধান্য পেয়েছিলাে। ইসলাম যে জগত গড়তে চায় তা হচ্ছে সম্পূর্ণ এক আল্লাহমুখী জগত, মানুষের প্রতি মমত্ববােধের জগত। আল্লাহমুখীতার অর্থ হচ্ছে, মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির পথে ও তাঁর নির্দেশ পালনার্থে নিয়ােজিত হবে। তার চিন্তা চেতনা ও কাজ হবে আল্লাহকেন্দ্রিক। আর মানবকেন্দ্রিক বলতে বুঝায় মুসলমানের সকল কাজ ও ব্যবহার হবে গােটা মানব জাতির শান্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে নিয়ােজিত। সকল বিশ্বাসের মূল লক্ষ্য হবে এই মানব কল্যাণ। বর্ণ, ভাষা, এলাকা, দেশ ও রাষ্ট্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মুক্তি এবং কল্যাণ সাধনই হবে মুসলমানের চেষ্টা ও সকল সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। এই উদ্দেশ্যেই মানুষে মানুষে পার্থক্য নির্ণীত হবে এবং তাদের কাছে ঈমান ব্যতীত অন্য কোনাে সম্পর্ক প্রাধান্য পাবে না। এই আল্লাহমুখী মহান জগতই হবে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান লােকদের জন্যে আরামদায়ক বাসস্থান, যেখানে আল্লাহর রহমতের বারিধারা অবিরত বর্ষিত হবে। এই শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলতে গিয়ে আমাদের বহু পর্যায় ও দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয় তৎকালীন আরবের পরিবেশে যেমন এসব পর্যায় ও কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছিলাে, তেমনি আজও বিশ্বের সবখানে অনেক পর্যায় ও কন্টকাকীর্ণ পথ পার হতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম জটিল পথ হচ্ছে নিজ বাড়ীর লােকের প্রতি দুর্বলতা, নিজ গােত্রের প্রতি অন্ধ আকর্ষণ, নিজ জাতির প্রতি দুর্বলতা, নিজ শ্রেণী (নারী বা পুরুষ)-এর প্রতি দুর্বলতা এবং নিজ এলাকা ও এলাকাবাসীদের প্রতি দুর্বলতা এবং কোনাে বিশেষ এলাকার জন্যে দুর্বলতা। এমনি করে মানসিক ঝোকপ্রবণতা এবং অন্তরের চাহিদা, লােভ লালসা, সংকীর্ণতা, ধনসম্পদ ও বিভিন্ন বিলাসদ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ, প্রাধান্য লাভের খাহেশ এবং অনেক সময় কৃচ্ছতা সাধনের প্রবণতা পোষণ করা- নানাবিধ অবস্থা ও পর্যায় মানুষকে অতিক্রম করতে হয়। এই ধরনের পৃথিবীর বুকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ইসলামী দলের মধ্যে বিরাজমান উপরােক্ত সর্বপ্রকার অবস্থা কার্যত সামাল দিয়েই পূর্ণাংগ ইসলামী ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা হয়েছে। আলােচ্য সূরাতে সামাজিক এসব সমস্যার মধ্যে একটি বিশেষ সমস্যার আলােকে সমাধান এসেছে। যে সকল মােহাজের মুসলমান তাদের ঈমান আকীদা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে নিজেদের দেশ ও সহায় সম্পদ পরিত্যাগ করে মদীনার পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তাদের অনেকেরই অন্তর প্রাণ পরিত্যক্ত মাতৃ-ভূমিতে আবদ্ধ বিবি-বাচ্চা ও আত্মীয়স্বজনের জন্যে উদ্বেলিত ছিলাে, আর মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও অপমান সহ্য করা সত্তেও তারা আশা করতেন যে, তাদের ও মক্কাবাসীদের মধ্যে সম্পর্ক ও ভালবাসা স্থাপনের কোনাে দুয়ার যদি খুলে যেতাে, পরিসমাপ্ত হতাে যদি এই ঝগড়া বিবাদ ও নিষ্ঠুরতার, যার কারণে তাদের ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ-বিগ্রহের দাবানল জ্বলে ওঠেছিলাে এবং তাদের সকল আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই লােকদেরকে সকল দিক দিয়ে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন তাদের এ সমস্ত ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত করতে, যার কারণে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বিকাশ, এ ব্যবস্থার প্রতি অবিচল আস্থা এবং এর কল্যাণকর দিকগুলাে তিনি পুরােপুরিভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা মানুষের স্বভাব প্রকৃতির মধ্যে নিহিত দুর্বলতাগুলাে ভালাে করেই জানেন। জানেন জাহেলী যামানায় গড়ে ওঠা তাদের নানা প্রকার সংকীর্ণতা সম্পর্কেও। বিশেষ করে আরবদের মধ্যে বংশীয় ও গােত্রীয় আভিজাত্যবােধ অত্যন্ত তীব্রভাবে বিরাজ করতাে। ঘরে ঘরে ছিলাে এসব সংকীর্ণ মনােবৃত্তি। তাই আল্লাহ পাক ধীরে ধীরে এক এক করে সেই সকল মানসিক ব্যাধি দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, যাতে করে এ কঠিন ব্যাধিগুলাে দূর করা তাদের জন্যে সহজ হয়ে যায়। এ সূরার মধ্যে যে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে আয়াত নাযিল হয়েছে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষেই সে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলাে, কিন্তু সরাসরি ওই ঘটনা সম্পর্কে আয়াত নাযিল হলেও উক্ত আয়াতের বক্তব্য বিষয় অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী, শুধুমাত্র সে ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তায়ালা স্থায়ীভাবে একটি শিক্ষা দান করেছেন, যা মানুষের জন্যে চিরদিনের তরে এক দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। উক্ত ঘটনা সম্পর্কে ষা জানা যায় তা হচ্ছে এই, হাতেব ইবনে আবী বালতায়(রা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতকারী ব্যক্তিদের অন্যতম (মুহাজির) এবং বদর যুদ্ধে যােগদানকারী সাহাবীদের মধ্যেও একজন ছিলেন। মক্কা শরীফে তার সন্তনাদি ও সহায় সম্পদ ছিলাে। অথচ তিনি কুরাইশ গােত্র উদ্ভূত ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন হযরত ওসমানের মিত্র ও তার সাথে চুক্তিবদ্ধ একজন বিদেশী মানুষ। এ সময় মক্কাবাসীরা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভংগ করায় রসূল(স.) মক্কা অভিযানের মনস্থ করলেন এবং মুসলমানদের যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে নির্দেশ দিলেন ও বললেন, ‘ওদের থেকে খবরটি গোপন রেখাে’ (এই এ জন্যে, যেন প্রস্তুতি সম্পর্কে কোরায়শরা জানতে না পারে)। কিন্তু রসূলুল্লাহ(স.) তার যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতির কথা মুসলমানদের মধ্য থেকে যাদের জানালেন, তাদের মধ্যে হাতেব ইবন আবী বালতায় ছিলেন অন্যতম। অতপর হাতেব মক্কা নগরী থেকে আগত মােযায়না গােত্রোদ্ভূত এক মহিলার হাতে রসূল(স.)-এর মক্কা বিজয়ের পরিকল্পনা সম্বলিত একটি চিঠি মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে করে মক্কাবাসীদের প্রতি তার এহসান প্রদর্শনের একটি প্রমাণ থাকে। এ মহিলাটি নাচ-গান করে তার জীবিকা নির্বাহ করতাে এবং এই উদ্দেশ্যেই সে মদীনায় এসেছিলাে। রসূল(স.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যেন তার মক্কা বিজয়ের পরিকল্পনার কথা গােপন থাকে। আল্লাহ তায়ালা এ দোয়া কবুল করেছিলেন এবং চেয়েছিলেন যেন মক্কা বিজিত হয়, তাই তিনি রসূল(স.)-কে এ খবর পাচারের ঘটনা জানিয়ে দিলেন। ফলে রসূল(স.) সে মহিলাটিকে ধরার জন্যে সংগে সংগে লােক পাঠালেন এবং তার থেকে পত্র উদ্ধার করা হলাে। বােখারী শরীফে কিতাবুল মাগাযীতে (যুদ্ধ সম্পর্কিত অধ্যায়) এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিমও তার কিতাব সহীহ মুসলিম শরীফে হুসায়ন ইবনে আবদুর রহমানের বরাত দিয়ে আলী(রা.) থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ(স.) আমাকে, আবু মারসাদ এবং জুবায়ের ইবনুল আওয়াম কে (একটি চিঠি উদ্ধারের জন্যে) পাঠালেন। আমরা সবাই ঘােড়সওয়ার ছিলাম। আমাদের তিনি বলে দিলেন, ‘তােমরা সে মহিলাটিকে ধরার জন্যে রওদাতুল খাক’ নামক স্থানে যাবে। সেখানে তােমরা মােশরেক এই মহিলাকে পাবে। তার কাছে মােশরেকদের হাতেব ইবনে আবী বালতায়ার পক্ষ থেকে লিখিত একটি চিঠি পাবে।’ আলী(রা.) বলেন, আমরা উক্ত মহিলাকে তার উটের ওপর সওয়ার অবস্থায় সেই স্থানে পেলাম, যেখানে পাবাে বলে রসূল(স.) বলেছিলেন। আমরা বললাম, চিঠিটি কই? সে বললাে, আমার কাছে কোনাে চিঠি নেই। এরপর আমরা উটটিকে বসিয়ে দিয়ে চিঠিটি খোঁজ করলাম, কিন্তু চিঠি পেলাম না। তখন আমরা বললাম, এটা নিশ্চিত, রসূল(স.) মিথ্যা বলেননি, অবশ্যই তােমার চিঠি বের করে দিতে হবে, নচেত আমরা তােমাকে উলংগ করে চিঠি অনুসন্ধান করবাে। আমাদের এই দৃঢ়তা দেখে সে নতি স্বীকার করলাে এবং কাপড় দিয়ে বাঁধা তার চুলের বেণীর মধ্য থেকে চিঠিটি বের করে দিলাে। আমরা চিঠিখানা নিয়ে রসূল(স.)-এর কাছে পৌছে দিলাম। এ অবস্থা দেখে ওমর(রা.) বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, এ ব্যক্তি (হাতেব) আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রসূল ও মােমেনদের সাথে গাদ্দারী করেছে। আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান মেরে দেই। তখন নবী(স.) সে ব্যক্তি (হাতেব)-কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ জিনিস তােমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করলাে? হাতেব বললেন, আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যতীত অন্য কিছু অবশ্যই নই। ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি চেয়েছিলাম উক্ত (কোরায়শ) জাতির প্রতি আমার কিছু এহসান থাকুক, যার ওসীলায় আল্লাহ তায়ালা মক্কায় অবস্থিত আমার পরিবার ও ধন সম্পদ রক্ষা করবেন। আপনার অন্য সাহাবাদের সবারই মক্কাতে আত্মীয়স্বজন আছে, যারা (মক্কা বিজয়কালে) তাদের পরিবার ও ধনসম্পদ রক্ষা করতে পারবে। একথা শুনে রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, হা, সে সত্য কথাই বলেছে, তাকে ভালাে কথা ছাড়া অন্য কিছু বলাে না। তখন ওমর(রা.) বললেন (না, ইয়া রসূলাল্লাহ), সে অবশ্যই আল্লাহ, রসূল ও মােমেনদের সাথে খেয়ানত (বিশ্বাস ভংগ) করেছে। আমাকে ছাড়ুন, তাকে আমি কতল করে দেই। তখন রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, ‘সে কি বদরী সাহাবী নয়? আরও বললেন, সম্ভবত আল্লাহ বদরী সাহাবীদের (তাদের মর্যাদা সম্পর্কে) জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘যা খুশী তাই করাে, অবশ্যই তােমাদের জন্যে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে, অথবা (এভাবে বলা হয়েছে), অবশ্যই আমি তােমাদের মাফ করে দিয়েছি। বদরী সাহাবীদের এ মর্যাদার কথা শুনে হযরত ওমর(রা.)-এর চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলাে এবং তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালাে জানেন। বােখারী শরীফে কিতাবুল মাগাযীতে আর একটি কথা বেশী এসেছে, এরপর আল্লাহ তায়ালা এ সূরাটি নাযিল করলেন, ‘হে মােমেনরা, আমার দুশমন ও তােমাদের দুশমনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করাে না। আর এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, যাদের (ওরা স্ত্রীলােকটির সন্ধানে ) পাঠানাে হয়েছিলাে, তারা ছিলেন আলী, যােবায়র ও মিকদাদ। এই ঘটনার সামনে দাড়িয়ে একটু থামুন এবং দেখুন, এ ঘটনা থেকে আল্লাহ তায়ালা কি শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, যা এ কিতাব ফী যিলালিল কোরআনে পাওয়া সম্ভব নয়। এ শিক্ষা একমাত্র কোরআনে বর্ণিত অভূতপূর্ব প্রশিক্ষণ ধারা, এর মধ্যে বর্ণিত ঘটনাবলী, ব্যাখ্যা এবং রসূলুল্লাহ(স.) থেকে প্রাপ্ত ধরপাকড়ের কাজ এই নিয়ম থেকে গ্রহণ করতে পারি, যেহেতু তিনিই আমাদের সবার একমাত্র নেতা, মহাপরিচালক ও মুরব্বী। এ প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে মানুষ প্রথম যে অবস্থা দেখতে পায় তা হচ্ছে ‘হাতেব’-এর আচরণ। তিনি ছিলেন একজন মােহাজের মুসলমান এবং সেই গুটিকয়েক ব্যক্তির একজন যাদের নিকট রসূলুল্লাহ(স.) মক্কাভিযানের বিষয় প্রকাশ করেছিলেন। এ অবস্থায় মানুষের যে সকল অদ্ভুত মানসিক অবস্থার প্রকাশ ঘটে, যে দুর্বলতা প্রকাশ পায় এবং তার মধ্যে যে পূর্ণত্ব ও শক্তির পূরণ দেখা দিতে পারে তা সবই এখানে ফুটে ওঠেছে। এ কথা অবশ্যই সত্য, এমন সব দুর্বলতার মুহূর্তে ক্ষতিকর যে পদক্ষেপ কোনাে ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই বাঁচাতে পারেন এবং প্রকৃতপক্ষে তিনিই এসব কঠিন অবস্থায় সাহায্য করেন। এরপর রসূল(স.)-এর মহত্ত্বের সামনে মানুষ থমকে দাড়ায়। সে দেখতে পায়, রসূলুল্লাহ(স.) জিজ্ঞেস না করে, আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযােগ না দিয়ে ব্যস্ত হয়ে হঠাৎ কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। বলছেন, কোন জিনিস তােমাকে এহেন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করলাে। রসূলুল্লাহ(স.)-এর হৃদয়ে তার সাহাবীর হৃদয়াবেগের প্রতি কী মধুর দরদ, কী চমৎকার সহানুভূতি। এ দরদ ও সহানুভূতি দ্বারা তিনি তাঁর সংগীকে, তার অন্তরে লুকায়িত সত্য ফুটিয়ে তােলার সুযােগ করে দিচ্ছেন এবং তার কথা সত্য বলে গ্রহণ করছেন। আরও লক্ষণীয়, অন্যদেরশক্ত কথা বলা থেকে থামাতে গিয়ে রসূল(স.) বলছেন, হাঁ, সে সত্য কথাই বলেছে, তাকে ভালাে ছাড়া মন্দ কিছু বলো না। এই ভুলের কারণে তিনি (হাতেব) অনুতাপের যে আগুনে দগ্ধীভূত হচ্ছিলেন তা রসূল(স.) সঠিকভাবে বুঝতে পেরেই তাে সেই কষ্ট থেকে বাঁচানাের জন্যে এই কথাগুলো বললেন, আর এ জন্যে নিজে তাে কোনাে তিরস্কার করলেনই না, অন্য কাউকেও তিরস্কার করতে দিলেন না। অপরদিকে, হযরত ওমর(রা.)-এর সে কঠিন কথাতে তার ব্যক্তিগত কোনাে ক্রোধের প্রকাশ ঘটেনি; বরং সে রাগ ছিলাে তার দৃঢ় ঈমান ও অকাট্য যুক্তিপূর্ণ কাজের প্রতি নিষ্ঠার বহিপ্রকাশ। অবশ্যই এই আচরণ দ্বারা সে আল্লাহ, রসূল ও মুসলমানদের সাথে বেঈমানী করেছে, অতএব আমাকে অনুমতি দিন তাকে আমি কতল করে দেবাে। একথা বলার কারণ, ওমর(রা.)-এর নযরে হাতেবের এই পদস্খলন প্রকটভাবে ধরা পড়াতেই তার অনুভূতি টনটন করে ওঠেছে এবং তার বলিষ্ঠ ঈমানে তীব্রভাবে সাড়া জেগেছে। অপরদিকে রসূল(স.) অত্যন্ত প্রশস্ত হৃদয় নিয়ে সকল দিক বিচার বিবেচনা করে অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন এবং মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সঠিক মূল্যায়ন করে দরদ সহানুভূতির সাথে চিন্তা করেছেন এবং কী প্রেরণাদায়ক কথা বলেছেন, যার ফলে প্রকৃত সত্য কথা বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে। এই ছিলাে সেই মহান ও মুরব্বী নেতার ভূমিকা, যিনি গভীরে তাকিয়ে সকল সত্য বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর যখন মানুষ হাতেব-এর কথাগুলাে সামনে রাখে, তখন বুঝতে পারে, এক দুর্বল মুহূর্তে তার দ্বারা এ ভুল সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ পাকের প্রতি তার নিষ্ঠা এবং তার নির্দেশ পালনের ব্যাপারে তার একাগ্রতার মধ্যে কোনাে ত্রুটি বা কমতি নেই, আর এই নিষ্ঠাই প্রকাশ পেয়েছে এ কথায় যখন তিনি বলেছেন, আমি শুধু মাত্র চেয়েছিলাম সে (কোরায়শ) জাতির প্রতি আমার এহসান দেখাতে, যার ওসীলায় আল্লাহ তায়ালা আমার পরিবার ও ধন-সম্পদ হেফাযত করবেন। তার কথায় এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিলাে যে, সহায় সম্পদ ও পরিবার হেফাযত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। এই এহসানই নিজে কোনাে হেফাযতকারী নয়, এর ওসীলায় আল্লাহ তায়ালা হেফাযত করবেন। তাঁর পরবর্তী কথায় এ বিশ্বাসের প্রতিফলন জোরদারভাবে ঘটেছে যখন তিনি বলেছেন, আপনার সাহাবীদের যারাই সেখানে আছে তাদের সবারই আত্মীয়স্বজন সেখানে রয়েছে, যাদের ওসীলায় আল্লাহ তায়ালা তাদের ও তাদের সম্পদ রক্ষা করবেন। একথায়, তার ধ্যান ধারণায় আল্লাহর চেতনা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে তিনিই যে পরিবারের একমাত্র রক্ষাকারী, আত্মীয়স্বজন রক্ষাকারী নয়, বরং তারা হচ্ছে ওসীলা, তার অন্তরের এ বিশ্বাস পরিষ্কার বুঝা যায়। আর সম্ভবত এই কারণেই রসূল(স.)-এর তীব্র অনুভূতি একথা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাে যে, তিনি (হাতেব) কোনাে মিথ্যা বা বানোয়াট কথা বলেননি, এটিই হচ্ছে রসূল(স.)-এর এই বলার কারণ, সে সত্য বলেছে, তাকে ভালাে ছাড়া মন্দ কিছু বলো না। কোনাে ঘটনার মধ্যে আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালাই চূড়ান্তভাবে কাজ করে- তাকদীরের এ বিধান কেউ লংঘন করতে পারে না। হাতেব ইবনে আবী বালতায়া তাঁর নিজ সংকটের কারণেই মক্কা আক্রমণের খবর পূর্বাহ্নে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিলাে না এ খবর মক্কাবাসীর কাছে পৌছে যাক যার জন্যে তিনিই এ পাচারের সংবাদ মুসলমানদের স্বার্থে রসূল(স.)-কে জানানাের ব্যবস্থা করলেন। এটাই তাকদীর, যা আল্লাহর ইচ্ছাতেই নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সে ইচ্ছার কাছে অন্য সবার ইচ্ছা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই দেখা যায়, আল্লাহ তায়ালা এ খবর পাচার শুধু বন্ধই করলেন না; বরং এ সম্পর্কে কানাকানি জানাজানিও বন্ধ করে দিলেন। এভাবে এ ঘটনা থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া যায় যে, কাউকে কোনাে তথ্য গােপন রাখার দায়িত্ব দিলে সে যদি খেয়ানতও করে, তবু তার প্রতি একমাত্র ধারণার ভিত্তিতে কোনাে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না। বিশেষ করে মুসলমানদের নেতৃবৃন্দের জন্যে এ বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে। নেতৃবৃন্দ যেন তার ভাইদের ত্রুটি বিচ্যুতির ব্যাপারে সতর্ক থাকে। এ ঘটনাটি মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত (অর্থাৎ, এতো অধিক সংখ্যক লােক এ হাদীসটি বর্ণনা করেছে যে, তারা সবাই একযােগে একটি ভুল কথা প্রচার করতে পারে তা মানুষের কল্পনাতেও আসে না)। এ বিষয়টির ওপর কোরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে, তাও বােখারী শরীফের একটি রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়। এ রেওয়ায়াতের সত্যতাকে আমরা দূরে নিক্ষেপ করতে পারি না; বরং আমরা তাে বলেছি, কোরআনের আয়াতের ভাষা সন্দেহ দূর করার ব্যাপারে সব থেকে বেশী সহায়ক এবং হাতেবের যে ঘটনাটি সম্পর্কে মুতাওয়াতির বর্ণনাধারা এসেছে তা সে ঘটনার সত্যতা সেভাবে প্রমাণ করে যেভাবে কোরআনের আয়াত প্রমাণ করে। এ ঘটনাটি পারিবারিক জীবনের জটিলতা এবং পরিবারের নিকটস্থ লােকদের জন্যে মানুষের দুর্বলতা যে কত বেশী তা তুলে ধরেছে এবং সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কতটা রেয়ায়াত করা যেতে পারে তাও তুলে ধরা হয়েছে, যাতে করে বিশ্ব মুসলিমের জীবনকে সংকট সমস্যা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। হাদীসটি এসব পরিবারের কর্তাদের এক নতুন চিত্র তুলে ধরেছে, নতুনভাবে তাদের মূল্যায়ন করেছে, নতুনভাবে তাদের পরিমাপ করেছে। গােটা সৃষ্টির জীবন ও মানবতা সম্পর্কে নতুন এক চিন্তাধারা পেশ করেছে। পেশ করেছে পৃথিবীতে মােমেনরা কি দায়িত্ব পালন করবে সে সম্পর্কে এবং মানব জাতির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে। আর এ যেন আল্লাহর সাহায্যে তৈরী সৃষ্টি মল্লিকার মধ্যে গ্রথিত সর্বপ্রকার পত্রপল্পবের এক বিপুল সমারােহ, যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে তাদের মৌলিক সত্য সম্পর্কে জানাতে এবং তার সৃষ্টি ও জীবন লক্ষ্য সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত করতে চেয়েছেন। এ ঘটনার মাধ্যমে তিনি তাদের দুশমনদের শত্রুতার ধরন ও নানা প্রকার চক্রান্তের প্রকৃতি তাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন, আর স্পষ্টভাবে তাদের বলে দিতে চেয়েছেন, তারা তাে তারই মানুষ, তারই দল এবং তাদের দ্বারা তিনি বিশেষ একটি কাজ নিতে চান এবং তাদের দ্বারা জীবনের একটি মহান মূল্যবােধ রচনা করতে চান। এভাবেই বিশ্ব-মানবতার দরবারে মুসলিম জাতি এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে, এক অতুলনীয় জীবনের রূপরেখা পেশ করেছে এবং অতি সুন্দর এক জীবনধারার আলােকেই তারা বিশ্বের দরবারে আপন পরিচিতি তুলে ধরেছে, আর এভাবে দুনিয়া ও আখেরাতে তারা সফলকাম হয়েছে। অতএব সকল মুসলমানকে নিজেদের আদর্শ ও নবী(স.)-এর শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হতে হবে, নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্ষতিকর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছাড়া চিন্তা চেতনা ও ব্যবহারের দিক দিয়ে অন্য সকল সম্বন্ধ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যেই সম্পূর্ণ সূরাটি নাযিল হয়েছে, এমনকি সূরার একেবারে শেষের দিকে বর্ণিত শরীয়ত ও সংগঠন সম্পর্কিত আয়াতগুলাে মােমেন মােহাজের মহিলাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর নিজেদের রসূল(স.)-এর মাধ্যমে আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দিয়েছিলাে এবং এ কারণে তাদের ও তাদের কাফের স্বামীদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিলাে। বিচ্ছেদ ঘটেছিলাে সে সকল মােমেন স্বামী ও তাদের কাফের স্ত্রীদের মধ্যে, যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃত জানিয়েছিলাে। সুতরাং আলােচ্য বিষয়ের সবটুকু এ একই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয়েছে। সূরাটির পরিসমাপ্তিতে আল্লাহর দুশমন, আল্লাহর নবীর দুশমন ও আল্লাহর কাছ থেকে আগত ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিরােধীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং নতুন করে যে কোনাে সম্পর্ক স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে যা আল্লাহর আক্রোশ ডেকে আনতে পারে। তা এ সব ব্যক্তি মােশরেক, ইহুদী, নাসারা যেই হােক না কেন। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা দ্বারা একথা প্রমাণ করাই উদ্দেশ্য যে, কোনাে মােমেন ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস ও ঈমান আকীদার সম্পর্ক ব্যতীত অন্য কারাে সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে না।
ফী জিলালিল কুরআন:
‘হে ঈমানদাররা, আমার দুশমন ও তােমাদের দুশমনদেরকে বন্ধুপে গ্রহণ করাে না… ওরা তাে চায় তােমরা (যে ঈমানী যিন্দেগী গ্রহণ করেছে তা তােমরা অস্বীকার করে) কুফরীর দিকে ফিরে যাও।'(আয়াত ১-২) *ইসলাম বিরোধীদের সাথে সর্বাত্মক সহযোগিতার নির্দেশ : সূরাটি শুরু হয়েছে অত্যন্ত আবেগ ও মহব্বতপূর্ণ এক আহবান দ্বারা ‘হে ঈমানদাররা’, এ ডাক সেই পাক পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে, যার ওপর তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে। যে ঈমান তার সাথে সংশ্লিষ্ট সেই ঈমান গ্রহণ করার নামেই ডাকা হচ্ছে। যথার্থতা সম্পর্কে চিন্তা করার জন্যে আহবান জানাচ্ছেন এবং তাদের দুশমনদের কাছ থেকে কোনাে প্রকার সাহায্য সহানুভূতির আশা পোষণ থেকে সতর্ক করছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের আরাে স্মরণ করাচ্ছেন সে সকল দুশমনের কাঁধের ওপর ভর করে কোনাে সফলতা পাওয়ার মনােবৃত্তি ছুঁড়ে ফেলতে। প্রকৃতপক্ষে এখানে যে মহাগুরুত্বপুর্ণ কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, মােমেনদের আল্লাহ তায়ালা আহবান জানাচ্ছেন যেন তার দুশমনকে ওরা দুশমন মনে করে এবং ওদের দুশমনকে তার দুশমন মনে করে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আমার ও তােমাদের দুশমনকে তােমরা দোস্ত বলে গ্রহণ করাে না, তােমরা কি তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে চাও?’ এরপর মােমেনদের একথা বুঝাতে আহবান জানানাে হচ্ছে যে, তারা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে এবং তার কাছেই ফিরে যাবে। যে তার সাথে শত্রুতা করছে সে তাদের সাথেও শত্রুতা করবে, কিন্তু তারা তাে সেসব ব্যক্তি যারা আল্লাহর পছন্দমতাে গুণাবলী ও ধাচে নিজেকে গড়ে তুলেছে এবং পৃথিবীতে তাঁর খলীফা হওয়ার দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে এবং তারাই আল্লাহ রবুল আলামীনের প্রিয়পাত্র ও বন্ধু। সুতরাং তাদের জন্যে আল্লাহর দুশমন ও তাদের নিজেদের দুশমনদের দিকে মহব্বতের হাত প্রসারিত করা কোনাে অবস্থাতেই সমীচীন নয়। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাদের পাপ সম্পর্কে স্মরণ করাচ্ছেন এবং তাদের আরও জানাচ্ছেন যে, তারা তাে সেসব ব্যক্তি যারা তাদের নিজেদের দুশমন, তাদের দ্বীনের দুশমন এবং তাদের রসূলের দুশমন, আর তাদের পক্ষ থেকে রসূলকে পাগল খেতাব দেয়া ও তার ওপর অকথ্য অত্যাচারের মাধ্যমে এই দুশমনী প্রকাশ পেয়েছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘এবং অবশ্যই তারা তাদের কাছে সত্য সমাগত হওয়ার পর কুফরী করেছে। তারা রসূলকে (তার দেশ থেকে) বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরও বের করে দিয়েছে। এসব কিছুর পেছনে অপরাধ শুধু একটিই, আর তা হচ্ছে সেই আল্লাহর প্রতি তােমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছো যিনি তােমাদের রব-প্রতিপালক। আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে এই নির্যাতন ও পাপপূর্ণ আচরণ এবং হিংস্র ব্যবহারের পর তাদের মধ্যে মানবতার আর কি অবশিষ্ট থাকতে পারে? তারা তাে জেনে বুঝে সত্য অস্বীকার করেছে এবং রসূল ও মােমেনদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে, কিন্তু এই বের করার পেছনে কারণ তাে এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, তারা তাদের রব আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে। আল্লাহ তায়ালা এ সূরার মাধ্যমে মােমেনদের অন্তরের মধ্যে একটি আন্দোলন গড়ে দিয়েছেন যা তাদের ঈমান ও আকীদার সাথে একান্তভাবে জড়িত। একমাত্র এই কারণেই এ মােশরেকরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, দ্বিতীয় অন্য কোনাে কারণে নয়। আর যে কারণে মতভেদ, ঝগড়া ও যুদ্ধ বেধেছে তা একমাত্র আকীদার বিভিন্নতার কারণেই বেধেছে। সত্য-সঠিক বিষয় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ঝগড়া বেধেছে এবং আল্লাহর রসূলকে তারা দেশ থেকে বের করে দিয়েছে, আর তারা ঈমান আঁকড়ে ধরার কারণেই ওরা তাদের দেশছাড়া করেছে। বিবাদ শুধু এই কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এবং এ বিবাদ যখন চরম আকার ধারণ করেছে তখনই তাদের স্মরণ করানাে হয়েছে যে, তাদের ও মােশরেকদের মধ্যে কোনাে ভালবাসার সম্পর্ক আর গড়ে ওঠতে পারে না। যদি প্রকৃতপক্ষেই তারা তাদের বাড়ী-ঘর-দুয়ার ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তোষপ্রাপ্তি ও তাঁর পথে জেহাদ করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে এসে থাকে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তোমরা আমার পথে ও আমার সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এসে থাকো।’ সুতরাং এমন একটি হৃদয়ের মধ্যে একথা একত্রিত হতে পারে না যে, সে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কথা জানাবে আবার সাহায্যের জন্যে মানুষের ওপর নির্ভর করবে। আর নিছক আল্লাহর জন্যে যারা সব কিছু ত্যাগ করেছে এবং তাদের সকল কাজ ও ব্যবহারে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে, তখনই তাদের তিনি উপদেশ দিচ্ছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্তি ও তার পথে জেহাদের জন্যে ঘর-বাড়ী জীবনের মতাে ত্যাগ করে বেরিয়ে তাদের পক্ষে পেছনের দিকে তাকানাে ও মোশরেকদের সাথে কোনাে প্রকার মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তােলার আর কোনাে সুযােগ নেই। এমতাবস্থায় কোন্ এমন জিনিস থাকতে পারে যা আল্লাহর পথে জেহাদের উদ্দেশ্যে হিজরত করা হৃদয়ের মধ্যে এ ব্যক্তির জন্যে এতটুকু মহব্বত পয়দা করবে, যে একমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার কারণে তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। সে তাে আল্লাহ তায়ালা ও রসূল উভয়ের দুশমন! এরপর মনের গােপন কন্দরে যে কথা গােপন করে রাখা হয়েছিলাে তার জন্যে মৃদুভাবে ও গােপনে তিরষ্কার করা হচ্ছে, এ জন্যেও তিরস্কার করা হচ্ছে যে, তাদের নিজেদের দুশমন, আল্লাহর দুশমন ও রসূলুল্লাহ(স.)-এর দুশমনের কাছ থেকে অনুকম্পা লাভ করার জন্যে মনে আকাংখা পােষণ করা হয়েছে। অথচ আল্লাহর কাছে অন্তরের গােপন ও প্রকাশ্য বিষয় সব কিছু সমানভাবেই জানা রয়েছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অনুকম্পা লাভের উদ্দেশ্যে গােপনে ওদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করছাে? অথচ আমি তাে তোমরা যা গােপন করাে এবং যা প্রকাশ করাে তা সবই জানি।’ এরপর এমন ভয়ংকরভাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের ধমক দিচ্ছেন যে, যে কোনাে মােমেন ব্যক্তির অন্তরই এতে ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বলা হচ্ছে, ‘যে এ কাজ করবে সে সরল সঠিক পথ থেকে বহু দূরে সরে যাবে। হেদায়াতপ্রাপ্তি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার পর সে পথ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভয় থেকে বড় ভয় কি আর কিছু হতে পারে। আর এই ধমক এবং হুঁশিয়ারী সংকেত তাদের শত্রুদের প্রকৃতি বুঝার জন্যে এক প্রকৃষ্ট ওসীলা হিসেবে কাজ করেছে। আয়াতটি নিখুঁতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, দুশমনেরা তাদের বিরুদ্ধে গােপনে কি ধরনের ধ্বংস ও বিপর্যয়ের জাল বিছিয়ে রেখেছিলাে। অবশেষে আরও কিছু কথা আসছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা তােমাদের ওপর বিজয়ী হয়ে তােমাদের চরম শত্রুতে পরিণত হয়ে যাবে এবং তােমাদের বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়ার জন্যে তাদের হাত ও জিহ্বা ব্যবহার করবে (অর্থাৎ কাজ ও কথা দিয়ে তােমাদের কষ্ট দেবে)।’ তখন একেবারে জাত শত্রুর মতাে ব্যবহার করা ব্যতীত অন্য কোনাে ব্যবহার তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না এবং কাজ, কথা, ব্যবহার ও সর্ব উপায়ে, সকল অজুহাতে তােমাদের যথাসম্ভব কষ্ট দেবে, আর এসব থেকে আরও ধ্বংসাত্মক আরও কঠিন যে আচরণ তারা করবে তা হচ্ছে, সর্বতােভাবে তারা চাইবে যে, তােমরা (ঈমানের মহামূল্যবান রত্নটুকু হারিয়ে) কাফের হয়ে যাও। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে চায়, হায় যদি তােমরা (ওদের মতাে) কাফের হয়ে যেতে।’ আর একজন মােমেনের জন্যে এ অবস্থা হচ্ছে সকল দুঃখ-কষ্ট থেকে বড় কষ্ট। হাত ও কথার কষ্ট থেকেও এ কষ্ট অনেক কঠিন। সুতরাং যে ব্যক্তি তার এই প্রিয় ধন কেড়ে নিতে চাইবে এবং চাইবে সে মুরতাদ (দ্বীন ইসলাম পরিত্যাগ করে পুনরায় কাফের) হয়ে যাক, সে ওই সকল শত্রু থেকে বড় শত্রু, যারা হাত ও কথা দ্বারা কষ্ট দেয়। আর যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার ফলে কুফরী অবস্থা থেকে ঈমানী যিন্দেগীর স্বাদ পেয়েছে এবং ভুল পথ পরিত্যাগ করে সত্য পথের দিকে এগিয়ে আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছে, সব চাইতে বড় কথা, একজন মােমেনের জীবন যাপন করতে পেরে ধন্য হয়েছে, কথা, কাজ, ব্যবহার ও চিন্তা-চেতনায় নিজেকে মােমেন হিসেবে পরিচিত করে এবং যে এ পথে দৃঢ়তা অবলম্বনে শান্তি লাভ করেছে, প্রশান্তিতে তার অন্তর-প্রাণ ভরে গেছে, সে এই ঈমানী যিন্দেগী পরিত্যাগ করে পুনরায় কুফরী জীবনের দিকে ফিরে যেতে তেমনি অপছন্দ করবে, যেমন কেউ আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপছন্দ করে। অথবা এর থেকে আরও বেশী অপছন্দ করবে। সুতরাং একথা অতীব সত্য যে আল্লাহর দুশমন তার সব চাওয়ার বড় চাওয়া হচ্ছে, একজন মােমেন ঈমান-রূপী জান্নাত থেকে বেরিয়ে এসে কুফরী-রূপী জাহান্নামের দিকে এগিয়ে যাক এবং আল্লাহর নেয়ামতে ভরপুর ঈমানী যিন্দেগী ত্যাগ করে এগিয়ে যাক কুফরীর খােলা জীবনের দিকে। এভাবেই আল কোরআন ধীরে ধীরে কাফেরদের বিরুদ্ধে মােমেনদের উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের আন্দোলনমুখী বানিয়ে অবশেষে চূড়ান্ত বাসনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। কোরআন বলছে, ‘আর ওরা বড় হৃদয়াবেগ নিয়ে কামনা করে, হায়, তােমরা যদি কাফের হয়ে যেতে।’ যে ধ্বংসের দিকে কাফেররা এগিয়ে যাচ্ছে সেই দিকেই ঈমানদারদের টেনে নেয়ার জন্যে তারা বিভিন্ন কায়দায় নিরন্তর যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রথম বিবরণ এখানে পেশ করা হলাে। এরপর আসছে, প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখার যে প্রবণতা বিরাজ করে, যার আকর্ষণ ক্রমান্বয়ে তাকে কর্তব্য থেকে গাফিল করে দেয়, অবশেষে তাকে তার ঈমান আকীদার পরিপন্থী কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে তার বিবরণ। এই পর্যায়ে সতর্ক করতে দিয়ে ঈমানদারদের প্রতি যে কথাগুলাে এসেছে তা হচ্ছে, ‘না, কিছুতেই তােমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং সন্তানাদি কোনাে কাজে আসবে না। কেয়ামতের দিন তােমাদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে এবং (আজ) তােমরা যা কিছু করলে আল্লাহ তায়ালা তা সবই দেখছেন।’ একজন মােমেনের কাজ হচ্ছে, সে যে কাজই করুক না কেন, তার ফল সে এখানে যতােটা পাবে বলে আশা করে, তার থেকে বেশী আখেরাতে পাওয়ার আশা রাখে। সে এখানে চাষাবাদ করে, কিন্তু কার্যত তার জমির ফসল সে চায় আখেরাতে। সুতরাং যে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে তার আকীদা বিশ্বাসের ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে তার থেকে অবশ্যই সে বিরত থাকে। দুনিয়ার এই স্বল্পস্থায়ী জীবনের সম্পর্কের খাতিরে বা আত্মীয়তার বন্ধন টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সে কিছুতেই তার আকীদা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় না; বরং সেই স্থায়ী সম্পর্কই সে গড়ে তুলতে চায় যার বন্ধন দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই টিকে থাকবে। এ কারণে সে এমন কোনাে সম্পর্ক রাখবে না যার ফলে আখেরাত বরবাদ হয়ে যাবে। এই জন্যেই তাদের সম্বােধন করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তােমাদের আত্মীয়স্বজন ও সন্তানাদি (আখেরাতে) কোনাে কাজেই লাগবে না। অথচ এদের দিকেই সর্বদা তােমরা ঝুঁকে থাক এবং এদেরই জন্যে তোমাদের অন্তর ব্যাকুল হয়ে থাকে, আর এদেরই নিরাপত্তার জন্যে তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তােমাদের দুশমনদের সাথে মহব্বত দেখানাের জন্যে অস্থির হয়ে যাও! হাতেব ইবনে আবী বালতায়ার ঘটনা ও তার সন্তান সম্পত্তির নিরাপত্তার লক্ষ্যেই সংঘটিত হয়েছিলাে এবং হিজরত করে আসা এলাকায় তার আত্মীয়স্বজন সম্পদ সম্পত্তির ও অপর ব্যক্তিদের নিরাপত্তার কথা বেমালুম তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। অথচ, প্রকৃত সত্য হচ্ছে ভবিষ্যতে এসব আত্মীয়স্বজন ও সন্তানসন্তুতি (ইসলাম থেকে দূরে থাকার কারণে তােমাদের কোনােই কাজে আসবে না। ‘কেয়ামতের দিনে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন। এর কারণ হচ্ছে, সেদিন যে সম্পর্কের কারণে তাদের প্রতি আকর্ষণ ছিলাে সেই সম্পর্কই ভেংগে যাবে। আল্লাহর কাছে সেদিন আজকের এই সম্পর্কের কোনােই মূল্য থাকবে না। ‘আর যা কিছু তােমরা করছাে আল্লাহ তায়ালা তা সবই দেখছেন। তিনি মানুষের বাহ্যিক কাজ সম্পর্কে যেমন ওয়াকেফহাল, তেমনি তার অন্তরের গভীরে যে গােপন ইচ্ছা এরাদা বিরাজ করে, তাও তিনি পুরােপুরিভাবে অবগত।’
ফী জিলালিল কুরআন:
*হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর ইসলাম বিবর্জিত ব্যবস্থা অস্বীকার করা : এরপর শুরু হচ্ছে আলােচনার তৃতীয় পর্যায়। এখানে সেই সকল প্রথম পর্যায়ের মুসলমানের মর্যাদার কথা পেশ করা হয়েছে, যারা তাওহীদের ধারক বাহক হিসাবে ছিলেন প্রথম কাতারে। এরা ছিলেন ঈমান আকীদার আলােকবাহী প্রথম কাফেলা, যারা সকল যামানার সকল মানুষের সেরা মানুষ, তাদের ঈমানী মর্যাদা সবার উপরে, যেহেতু তারা সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর মহব্বতে ঈমানের দিকে এগিয়ে এসেছিলেন। এই ছিলাে সেই জাতি, যাদের নিগূঢ় সম্পর্ক বিস্তৃত ছিলাে তাদের মহান পিতা, সত্যের ধারক ইবরাহীম(আ.) পর্যন্ত। শুধু আকীদা বিশ্বাসের দিক দিয়েই প্রথম দিকের এই সাহাবারা ইবরাহীম(আ.)-এর উত্তরসূরী ছিলেন না; বরং চরিত্র বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও তারা ছিলেন প্রথম সত্যাশ্রয়ী, ইবরাহীম(আ.)-এর সঠিক অনুসারী। ইবরাহীম(আ.)-এর প্রতি আসা বিভিন্ন পরীক্ষার মতােই চূড়ান্ত বিপদ আপদ সহ্য করে তারা তাদের পূর্বপুরুষের পরিত্যক্ত আদর্শকে সমাপ্তি পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্যে ছিলেন বন্ধপরিকর। দ্বীনের খাতিরে তারা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার দৃষ্টান্ত পর্যন্ত স্থাপন করেছেন। তারপর একমাত্র তাদের সাথে পরিপূর্ণ নিষ্ঠা সহকারে সম্পর্ক জুড়েছেন, যারা তাদের সাথে ঈমান গ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের ঈমান আকীদা বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্যে অন্য সকল বন্ধন ছিন্ন করেছেন। তাদের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই তােমাদের জন্যে রয়েছে চমৎকার আদর্শ ইবরাহীম ও তার সংগীদের মধ্যে, সেই কঠিন দুঃসময়ে যখন তারা জাতিকে বলেছিলাে, আমরা তােমাদের ও তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত হলাম আল্লাহর পরিবর্তে তােমরা যাদের গােলামী করো… যে, আল্লাহর দিকে পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে যে রুজু করে নিশ্চয়ই তার জন্যে আল্লাহ তায়ালা বড়ই উদার, তিনি চির প্রশংসিত।’ এরপর যখন মুসলমানরা তাদের পূর্ববর্তী ব্যক্তিদের দিকে তাকায় যেন অবাক বিস্ময়ে তারা দেখতে পায় যে, অতীত মুসলমানরা গভীর এক সম্বন্ধ সূত্রে আবদ্ধ, রয়েছে তাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য, রয়েছে তাদের যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা সুবিস্তীর্ণ আদর্শ, যা ইবরাহীম(আ.) পর্যন্ত পৌছেছে। এ আদর্শ শুধু বিশ্বাস স্থাপন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং বাস্তব কার্যক্রমের মধ্যে একইভাবে এ আদর্শের ছোঁয়াচ পাওয়া যায়, আর তখন মানুষ অনুভব করে, ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিফলিত ইসলামের এ আদর্শ যতােটুকু ফলপ্রসূ তার থেকে অনেক বেশী সুফলদায়ক হয় সামাজিক জীবনে, যেখানে সবার সাথে মিলে মিশে মানুষ বাস করে। আল্লাহর পতাকাতলে সমবেত থাকার ফলে আজও ইসলামী সমাজ বিভিন্ন যুগের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আল্লাহর দ্বীনের ওপর টিকে রয়েছে। ভবিষ্যতে যত প্রকার প্রতিকূলতা আসতে পারে তার সকল ভয়াবহতাই এ পর্যন্ত আঘাত হেনেছে এবং ইসলামী কাফেলা সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে অগ্রসর হয়ে চলেছে। নতুন কোনাে পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া এবং নতুন এমন কোনাে সংকট আর আসার মতাে নেই যার অভিজ্ঞতা পেছনে হয়নি। মােমেনদের জীবনের ওপর অভূতপূর্ব আর কোনাে সমস্যার উদ্ভব হবে না যা তাদের ধরাপৃষ্ঠ থেকে মুছে দিতে পারে। এ জাতির সামনে রয়েছে ঈমান আকীদার ওপর টিকে থাকার সংগ্রাম সংঘাতের এক দীর্ঘ ইতিহাস। যখনই ইসলামের দুশমনদের সাথে ইসলামী বিশ্বাসের মােকাবেলা হয়, তখনই ইসলামের বিজয় ডংকা বেজে ওঠে এবং এই মহান জীবন ব্যবস্থার সুবিস্তীর্ণ শাখা প্রশাখা ছেয়ে যায় গােটা পরিবেশের ওপর ও এর সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্যে সকল দিক থেকে এগিয়ে আসে শ্রান্ত ক্লান্ত যাযাবরের দল। আর এই মহান মহীরুহের বীজ বপন করে গেছেন প্রথম যুগের মুসলমানরা, যারা ছিলেন মহানবী ইবরাহীম(আ.)-এর যথার্থ অনুসারী। ইবরাহীম(আ.) ও তাঁর সংগী-সাথীরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে চলে গেছেন, রেখে গেছেন মোহাজেরদের জন্যে উজ্জ্বলতম পথের দিশা। আর রয়েছে প্রথম যুগের সেসব মুসলমানের মধ্যে আজকের শতধাবিভক্ত মুসলমানদের জন্যে উৎকৃষ্ট আদর্শ। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে সেই জনপদের কথা, যারা তাদের জাতিকে ডেকে বলেছিলাে, অবশ্যই আমরা তোমাদের থেকে এবং তােমরা অন্ধভাবে যেসব অপশক্তির বা জড় পদার্থের পূজা করাে সেসব কিছু থেকে সম্পর্ক মুক্ত। আজ তোমাদের এবং তােমাদের সকল শক্তিকে আমরা অস্বীকার করার ঘোষণা দিলাম। জেনে নাও, আজ থেকে শুরু হয়ে গেলাে তােমাদের এবং আমাদের মাঝে ঘােরতর বিদ্বেষ ও শত্রুতার সম্পর্ক, ততাে দিন এই তিক্ততা চলতে থাকবে যতাে দিন না তােমরা এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে।” বাতিলপন্থী জাতি ও তাদের মনগড়া অলীক মাবুদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের এই-ই ছিলাে স্পষ্ট ঘােষণা। ক্ষমতাগর্বী, মিথ্যার ধ্বজাধারী ও তাদের শক্তিকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করা এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কথা জানানােই ছিলাে এ ঘােষণার উদ্দেশ্য। এক আল্লাহর ওপর ঈমান না আনা পর্যন্ত এই শত্রুতা, বিদ্বেষ ও সম্পর্কচ্ছেদ সদা-সর্বদা বিরাজ করতে থাকবে। এ হচ্ছে সেই চুড়ান্ত সম্পর্কচ্ছেদ, যা ঈমান আকীদার পার্থক্যের কারণে গড়ে উঠে এবং যার কারণে পারিবারিক বন্ধন ও আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের যাবতীয় সম্পর্ক কেটে যায়, আর এই কারণে প্রত্যেক যুগে মােমেনদের এই অভিজ্ঞতার আলােকে পৃথক পৃথকভাবে সম্বােধন করা হয়েছে এবং ইতিহাস সাক্ষী যে, ইবরাহীম(আ.) ও তাঁর অনুসারীরা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলমানের জন্যে সুন্দরতম আদর্শ হয়ে থাকবেন। কোনাে কোনাে মুসলমানের মনে একথা জাগে যে, ইবরাহীম(আ.) তার মােশরেক পিতার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার ওয়াদা কেমন করে করলেন! এর দ্বারা তো মােশরেক আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখা ও তাদের জন্যে দরদ-সহানুভূতি দেখানাের একটি সুযােগ রয়েছে বলে মনে হয়। এজন্যে ইবরাহীম(আ.)-এর উচ্চারিত বাক্য, অবশ্যই আপনার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী হবাে কথাটির পেছনে কি দৃষ্টিভংগি ছিলাে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আল কোরআন বলছে, ইবরাহীম(আ.) উক্ত কথা তখন বলেছিলেন যখন তার পিতা আযরের শিরকের ওপর যিদ ধরে টিকে থাকাটা নিশ্চিতভাবে তিনি বুঝতে পারেননি। যখন কথাটি তিনি বলেছিলেন, তখন চাচ্ছিলেন, পিতা ঈমান আনুক এবং এ ব্যাপারে তিনি আশাবাদী ছিলেন। ‘তারপর যখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলাে যে, প্রকৃতপক্ষেই সে আল্লাহর দুশমন, তখন এ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ দায়িত্বমুক্ত হয়ে গেলেন।’ এই বিবরণটি অন্য আর একটি সূরায়ও এসেছে। এখানে বিষয়টি প্রমাণ হয়ে গেলাে যে, ইবরাহীম(আ.) বিষয়টি পুরােপুরিভাবে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁর ওপরই পরিপূর্ণভাবে ভরসা করেছিলেন এবং সর্বাবস্থায় তার দিকে রুজু করেছিলেন। না, আপনাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাচানাের মতাে কোনাে ক্ষমতা আমার নেই। ‘হে আমাদের রব, তোমার ওপর আমরা ভরসা করেছি, তোমারই দিকে আমরা রুজু করেছি এবং তােমার দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।’ এভাবে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা হয়েছে। ইবরাহীম(আ.)-এর মধ্যে এইভাবে ঈমানের দিকটি দেদীপ্যমান হয়ে ফুটে ওঠেছে যেন তার উত্তরসুরী মুসলমানদের মধ্যে ঈমানের দিকটিই যথাযথভাবে গুরুত্ব লাভ করে। প্রশিক্ষণদান ও মানুষের মন মগযকে আল্লাহর দিকে ফেরানাের জন্যে এ ঘটনা তুলে ধরা এক বিশেষ পদ্ধতি হিসাবে কাজ করে। এ বিষয়ে পাকড়াও করারও দৃষ্টান্ত রয়েছে যাতে করে বিষয়টি ইবরাহীম(আ.) যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন এবং আল কোরআনের দৃষ্টিভংগি তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। (‘আত্তাসবীরুল ফান্নী ফিল কুরআন’ অধ্যায় আল কিসসাতু ফিল কোরআনী ফী কিতাব) এরপরই ইবরাহীম(আ.)-এর প্রার্থনার অপর অংশ আসছে, যার মধ্যে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলছেন, ‘হে আমাদের রব, কাফেরদের জন্য আমাদের পরীক্ষার বস্তু বানাবেন না (তাদের কাছে আমরা খেলার বস্তুতে পরিণত না হই)’। ওদের আমাদের ওপর জয়যুক্ত করাে না, তাহলেই তাদের এ বিজয়ী অবস্থা আমাদের জন্যে একটা পরীক্ষার বিষয় হয়ে যাবে, আর তখন তারা বলতে শুরু করবে, ঈমান যদি তাদের সহায়তা করে থাকে, তাহলে আমরা তাদের ওপর বিজয়ী হই কেমন করে এবং তাদের প্রতি জবরদন্তিপূর্ণ ব্যবহার করি কেমন করে। তাদের সামনে আমরা হেয় হয়ে গেলে অন্তরের মধ্যে নানা প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সাময়িকভাবে সত্যের ওপর মিথ্যার বিজয়ী হওয়া এবং অহংকারী ও আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহ পােষণকারী ব্যক্তিদের ঈমানদারদের ওপর শক্তিমান হওয়া- এর মধ্যে রয়েছে এমন এক রহস্য যা আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। মােমেন যে কোনাে আপদ বিপদে অবশ্যই সবর করবে, তার অর্থ এ নয় যে, বিপদ মুক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাবে না। যেসব কারণে মনের মধ্যে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়ে মনকে দুর্বল করতে পারে তার থেকে বাঁচার জন্যে অবশ্যই সে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। দোয়ার অবশিষ্ট অংশ হচ্ছে, ‘এবং আমাদের মাফ করে দাও।’ কথাগুলাে উচ্চারণ করছেন মহদয়াময় প্রভুর বন্ধু ইবরাহীম(আ.)। এই দােয়া করার সময় তিনি অবশ্যই অনুভব করছেন যে, তিনি সেভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেছেন যা তার পাওনা। আল্লাহ পাকের নেয়ামত ও রহমত লাভ করার জন্যে যােগ্যতা হিসাবে মানুষের পক্ষে যে বিনয় প্রকাশ করা প্রয়ােজন এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণায় যে ব্যবহার আশা করা যেতে পারে তা সবই ইবরাহীম(আ.)-এর মধ্যে বর্তমান ছিলাে, যার কারণে তিনি তার রবের কাছে বড় আশা নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তার এই প্রার্থনার ভাষা ও ভংগি এমন মধুর যা বড়ই হৃদয়স্পর্শী এবং যা অপর যে কোনাে ব্যক্তির জন্যে অনুকরণীয়। এরপর ইবরাহীম(আ.) তার দোয়া শেষ করতে গিয়ে আল্লাহর সেই গুণাবলী তুলে ধরছেন যা দোয়া কবুলের জন্যে বড়ই উপযােগী। ‘হে আমাদের রব, অবশ্যই তুমি মহাশক্তিমান এবং যাবতীয় জ্ঞানের অধিকারী।’ ‘আল আযীয’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, তিনি যে কোনাে কাজ করতে সক্ষম এবং আল-হাকীম বলতে বুঝায়, চিন্তা ভাবনা করে কর্ম সম্পাদনকারী। ইবরাহীম(আ.) ও তাঁর সংগীরা তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অবশেষে অত্যন্ত বিনয় নম্রতার সাথে এবং পুরােপুরিভাবে নিজেদের আল্লাহর কাছে সােপর্দ করে এমন হৃদয়াবেগ নিয়ে প্রার্থনা করছেন যা অনুসরণের জন্যে মােমনদের মধ্যে এক নতুন প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে। তাই আল্লাহ পাক সে মহান ব্যক্তিদের কথা বলতে গিয়ে এরশাদ করছেন, অবশ্যই তােমাদের জন্যে রয়েছে সে ব্যক্তিদের মধ্যে উৎকৃষ্ট আদর্শ। আদর্শ তাদের জন্যে যারা আল্লাহকে পেতে চায় ও আখেরাতের সাফল্য আশা করে। আর যে ব্যক্তি এ আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জেনে রাখা দরকার, আল্লাহ তায়ালা চির অভাবমুক্ত এবং চির প্রশংসিত। তাহলে বুঝা গেলাে, ইবরাহীম(আ.) ও তাঁর সংগী সাথীদের জীবন তাদের জন্যেই আদর্শ, যারা আল্লাহকে পেতে চায় ও আখেরাতের শান্তিময় জীবন লাভ করার জন্যে লালায়িত থাকে। এরাই হচ্ছেন সেসব মহান ব্যক্তি, যারা সকল প্রকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং তার সুফলও লাভ করেন। এই পরীক্ষার মধ্যেই তারা অনুসরণযােগ্য আদর্শ লাভ করেন এবং সঠিক পথে চলার ব্যাপারে অগ্রগামী হয়। অতএব, যে কোনাে ব্যক্তি আল্লাহকে পেতে চাইবে ও আখেরাতের যিন্দেগীতে শান্তিতে থাকার কামনা করবে সে যেন এ মহান ব্যক্তিদের আদর্শ অনুসরণ করে। আজকের যুগের মােমেনদের জন্যে অবশ্যই এটা একটা সুসংবাদ। সুতরাং যে ব্যক্তি এ পথ পরিহার করবে, ইসলামের এই কাফেলার বাইরে যে যেতে চাইবে এবং এই ঈমানী সম্পর্ক ছিন্ন করে যে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাবে, মহান আল্লাহর কোনাে প্রয়ােজন নেই তাকে জোর করে কাছে টেনে আনার। কারণ আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় অভাব-অভিযােগের ঊর্ধ্বে এবং চির প্রশংসিত। ইসলামের প্রথম যুগ যখন সমাপ্তি পর্যায়ে এসে গেলাে এবং ইতিহাসের শুরুতে মােমেনরা তাদের সুদূরপ্রসারী উন্নতি লাভ করলাে, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লাে তাদের সুনাম। তাদের ওপর আগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সেগুলাে বলিষ্ঠভাবে অতিক্রম করার ইতিহাস পৃথিবীর জাতিসমূহের কাছে সংরক্ষিত হলাে এবং এসব পরীক্ষা শেষে তাদের সুমহান মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে দেখা গেলাে । যারা কোনাে দিন মানুষকে সাফল্যের পথে কিছুমাত্র দিকদর্শন দিতে দেখেনি, তাদের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রদর্শন করা হতে লাগলাে। কোরআনুল করীম তাদের সম্পর্কে এই গুরুত্বের ধারণা দিয়ে বার বার তাদের আনুগত্য করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে এবং তাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার কথা বলেছে। সুতরাং পরিচালকের আসনে সমাসীন এই জাতি যেন মানুষের কাছে আগন্তুক অথবা যে কোনাে দিক দিয়ে ভয়ংকর বলে বিবেচিত না হয়, যদিও পৃথিবীতে তারা বিচ্ছিন্ন একক জাতি হিসেবে থাকে। তাদের কার্যকলাপ ও ব্যবহার যেন এমন হয় যে, তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুকরণ করতে কাউকে কোনাে প্রকার কষ্ট পেতে না হয়।
ফী জিলালিল কুরআন:
এরপর সেই উন্নত জাতি পুনরায় ফিরে গেছে তাদের পূর্ববর্তী স্থানে। তাদের সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টি ভংগির পরিবর্তন ঘটেছে। তাদের প্রতি পূর্বের মতাে মানুষের আর কোনাে আকর্ষণ নেই, নেই তাদের ব্যাপারে কারও কোনাে আগ্রহ। ইসলামের ঝান্ডা তলে সমবেত হওয়ার জন্যে যারা এককালে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলাে, মুসলমানদের সারিতে স্থান লাভ করার জন্যে যারা ছিলো লালায়িত, তাদের অনুসরণের সেই পথ আজও আছে, কিন্তু যে কার্যকলাপ ও ব্যবহার দ্বারা ইসলামের দুশমনদেৱ ইসলামের পতাকার সুশীতল ছায়াতলে একত্রিত করা যায়, মুসলমানদের সারিতে তাদের হাযির করা যায়, সেই কাজ ও ব্যবহার আজ পরিবর্তিত হয়ে গেছে, যে জীবনাদর্শ বাস্তবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে শক্রতা বন্ধুত্বে পরিণত করা যেতাে এবং মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তােলা সম্ভব হতাে, তা আজ আর নেই। অবশ্য এটাও ঠিক যে, আর একবার ইসলামের সুমহান সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে একতা গড়ে তােলার চেষ্টা চলছে এবং অন্যদের মধ্যেও শত্রুতার মনােভাব দূর করা, ঝগড়া ফাসাদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা এগিয়ে চলেছে। এইভাবে শত্রুতার মনােভাব দূর হয়ে গেলে পারস্পরিক কল্যাণ কামনা জন্ম নেবে এবং তা বাস্তবায়িত হবে লেনদেনের স্বচ্ছতা ও সুবিচার কায়েম হওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহর মহান বাণী হয়তো অচিরেই আমাদের ও তােমাদের বিরােধীদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা মহব্বত পয়দা করে দেবেন। আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সব কিছু করতে সক্ষম এবং মহান আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও মেহেরবান…। এমতাবস্থায় যারা তাদের সাথে হৃদ্যতা গড়ে তুলতে চাইবে, তারাই হবে যালেম।'(আয়াত ৭-৯) *মুমিনের হৃদয় সবার জন্যে উন্মুক্ত : অবশ্যই ইসলাম হচ্ছে শান্তির জীবন ব্যবস্থা, সবাইকে মহব্বতের বন্ধনে আবদ্ধ করায় বিশ্বাসী এবং এমন এক শৃংখলাপূর্ণ ব্যবস্থা কায়েমে বিশ্বাসী, যার লক্ষ্য হবে গােটা বিশ্বকে শান্তির ছায়াতলে নিয়ে আসা, সেখানে ইসলামের সম্মােহনী ব্যবস্থা চালু করা এবং আল্লাহর পতাকাতলে সবাইকে সমবেত করে তাদের এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা, যেন তারা একে অপরের মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে পারে এবং পরস্পরকে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। ইসলাম এমন এক কল্যাণময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে মানুষে মানুষে এই মধুর সম্পর্ক গড়ে | তোলার পথে কোনাে বাধা থাকবে না। এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তারাই বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যারা সত্যের দুশমন এবং প্রকারান্তরে তারা নিজেদের ও নিজেদের পরিবারের দুশমন। সুতরাং এই শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে বাধাদানে যারা বিরত থাকবে এবং তাদের নিরাপত্তা দেবে, কিছুতেই ইসলাম তাদের সাথে বিরােধিতা বা তাদের সাথে বিবাদ বাধাতে চায় না। এমনকি ঝগড়া বিবাদের সময়ে বা যুদ্ধকালেও সুন্দর ব্যবহার ও লেনদেনের পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে যে কোনাে ব্যক্তির অন্তরের মধ্যে মহব্বত গড়ে তােলার কারণগুলাে অক্ষুন্ন রাখতে চায়। মুসলমানরা সেই সুন্দর সুবাসিত দিনের অপেক্ষায় রয়েছে, যখন মানুষের মধ্যে ঝগড়া বিবাদের মনােভাব দূর হয়ে যাবে এবং মহান ইসলামী পতাকার ছায়াতলে সমবেত হয়ে সবার জন্যে কল্যাণকামিতার জ্যোতি উদ্ভাসিত করে দেবে গােটা পরিবেশকে। সেদিন যে এক সময়ে আসবেই সে বিষয়ে ইসলাম মােটেই হতাশ নয়। সে দিন অবশ্যই মানুষ সত্যাশ্রয়ী হবে এবং সরল সঠিক পথ মানুষ মনে-প্রাণে গ্রহণ করবে। এই অধ্যায়ের প্রথম আয়াতে এমন এক আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে যে, নৈরাশ্য সেখানে বিজয়ী হবে আশা করা যায় না। অবশ্য কিছু সংখ্যক মােহাজেরের মনে ভীতির সঞ্চার হওয়ায়, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দূরত্বের কারণে আত্মীয়স্বজন এবং পরিবার পরিজনের সাথে বিচ্ছেদ ব্যথায় তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাে। এই অবস্থাটা তুলে ধরে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন, ‘হয়তাে শীঘ্রই সে সকল ব্যক্তি যাদের সাথে তােমাদের শত্রুতা বিরাজ করছে তাদের সাথে মহব্বত পয়দা করে দেবেন।’ এ আশাবাদ আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ খুবই স্পষ্ট। মােমেনদের মধ্যে | যারাই এই আশাব্যঞ্জক কথাটি শুনেছে তারা দৃঢ়ভাবে এ কথা বিশ্বাস করেছে। আর এর অল্প কিছুদিন পরেই মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে এই আশা বাস্তবায়িত হলাে। কোরায়শরা সবাই (একই সময়ে) ইসলাম গ্রহণ করলাে। একই পতাকাতলে সমবেত হয়ে গেলাে সকল মক্কাবাসী, পরস্পর কলহ বিবাদ এবং একে অপরকে পদানত করার চেষ্টার অবসান হলাে, পরস্পর সবাই গভীর মহব্বতের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে গেলাে। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই এ সব কিছু করতে সক্ষম।’ তিনি যা চান তাইই করেন, এতে তার কাছে কৈফিয়ত তলব করার কেউ নেই। ‘এবং আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল মেহেরবান।’ শিরক ও অন্যান্য যেসব অপরাধ ইতিপূর্বে হয়েছে তা তিনি মাফ করে দেবেন। রাজা (আশা) শব্দটি আল্লাহর যে ওয়াদা পূরণ করার দাবী জানায় তা পূরণ করার জন্যে যারা দ্বীন-ইসলাম কায়েমের প্রশ্নে তাদের সাথে যুদ্ধ করেনি এবং তাদের বাড়ীঘর থেকে বের করে দেয়নি তাদের ক্ষমা করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের এখতিয়ার দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের সাথে সৎ ও সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার করায় কোনাে অসুবিধা নেই। মুসলমানদের তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, লেনদেনের ক্ষেত্রে যেন তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা হয় এবং তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে কখনাে কোনােভাবে যেন তাদের বঞ্চিত করা না হয়, কিন্তু যে সকল লােক দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যারা তাদের বাড়ী ঘর থেকে বের করে দিয়েছে অথবা বহিষ্কারে সহায়তা করেছে, তাদের সাথে কোনাে প্রকার মহব্বতের সম্পর্ক স্থাপন করতে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং যারাই তাদের সাথে কোনাে হৃদ্যতা গড়ে তুলেছে তাদের সম্পর্কে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দিয়েছেন যে, তারা যালেম, আর আল্লাহ পাকের কথা অনুসারে যুলুমের এক অর্থ হচ্ছে শিরক, যেমন- এরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই শেরেক হচ্ছে মহা যুলুম।’ এ হচ্ছে ভয়ানক তিরস্কার, জানার সাথে সাথে যে কোনাে মােমেনের হৃদয় ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে এবং সে ইসলামের দুশমনদের সাথে সম্পর্ক রাখার ভয়ানক কঠিন পরিণাম থেকে বাচার জন্যে সচেষ্ট হয়। অমুসলমানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারে এ হচ্ছে সব থেকে সুবিচারপূর্ণ বিধান, যা এই দ্বীন (ইসলাম)-এর প্রকৃতির সাথে পুরােপুরি সংগতিপূর্ণ। মানুষের জীবনে সুখ শান্তি আনয়নের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভংগির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। আরও সত্য কথা হচ্ছে, এ ফয়সালা সমগ্র মানব জাতির মংগলের জন্যে, বরং পরম ও চরম বাস্তব সত্য হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে গােটা সৃষ্টির কল্যাণের জন্যেই এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে এবং তা তার তরফ থেকেই ঘোষণা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য মানুষকে নিরংকুশভাবে আল্লাহমুখী বানানাে। আল্লাহর এ বিধান চালু করার ব্যাপারে তার নিজের কুদরত ও সাহায্য অবশ্যই রয়েছে এবং এ বিধান তিনি চালু করবেনই, এটা তার চিরন্তন সিদ্ধান্ত। তাতে যে কোনাে ব্যক্তি যতাে প্রকার মতভেদ করুক না কেন। (দেখুন আস সালামুল আলামী অল ইসলাম, অধ্যায়ঃ তাবীয়াতুল ইসলাম ফিল ইসলাম) এটাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইনের মূলকথা, যা তার ও সকল মানুষের মধ্যে আত্মসমর্পণের অবস্থা গড়ে তুলতে শিখায় এবং এই আত্মসমর্পণের অবস্থাই হচ্ছে স্থিতিশীল অবস্থা আনয়নকারী। একমাত্র শান্তি, ভালবাসা, কল্যাণই মানুষের মধ্যে ইনসাফ আনয়ন করতে পারে।
ফী জিলালিল কুরআন:
*নিরীহ লােকদের ব্যাপারে ইসলামের নীতি : তারপর বলা যায়, এ হচ্ছে এমন একটি নিয়ম যা ইসলামের মূল চেতনার সাথে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যশীল এবং এ সমস্যাটি মােমেনরা ও তাদের বিরােধীদের মধ্যে বিরাজমান সমস্যা সম্পর্কিত এবং বিষয়টা ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ এ বিষয়টির সঠিক ব্যবহারের ওপর ঈমানদার থাকা না থাকা নির্ভর করে। এরই ওপর নির্ভর করে একজন মােমেনের কোনাে কিছু মূল্যায়ন করা। এই আকীদার অভাবের কারণেই সে কারও সাথে যুদ্ধ করে। মােমেনদের ও অন্যদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্ৰহ বাধার একটিই মাত্র কারণ, আর তা হচ্ছে, মােমেনরা তাদের আকীদা বিশ্বাস অটুট রাখতে চায় এবং অপরকেও সেই আকীদার দিকে আহবান জানানাের স্বাধীনতা দাবী করে, আর আল্লাহর রাজ্যে তারই আইন চালু করার মাধ্যমে তার শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে চায়। আলোচ্য সূরাটির সকল কথার মধ্যেই এই আকীদা বিশ্বাসের গুরুত্ব বিবৃত হয়েছে এবং একমাত্র সেই পতাকা সমুন্নত করার প্রেরণা দান করা হয়েছে যার নীচে সামগ্রিকভাবে গােটা মুসলিম জাতি একত্রিত হতে পারে। সুতরাং সেই পতাকার ছায়াতলে যারা আশ্রয় নেবে, তারাই হবে মুসলিম জামায়াতের লােক, আর যারা তাদের সাথে বিরােধ বা লড়াই করবে, তারা হবে তাদের দুশমন। যে কোনাে ব্যক্তি তাদের (মুসলমানদের) নিরাপত্তা দেবে, তাদেরকে তাদের আকীদা বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করতে দেবে এবং তাদের দাওয়াত অপরের কাছে পেশ করায় কোনাে বাধা দেবে না, মানুষকে ইসলামের দিকে এগিয়ে আসতেও মানা করবে না, আগ্রহী কোনাে ব্যক্তি ও মুসলমানদের সাথে (শয়তানের পাল্লায় পড়ে) মেলামেশায়ও কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না, তাদের কথা শুনতেও কোনাে বাধা দেবে না, মােমেনদের কোনাে প্রকার বিপদগ্রন্ত করবে না, সে অবশ্যই নিরাপদ থাকবে এবং তার প্রতি সদ্ব্যবহার ও সুবিচার করতে ইসলাম কখনই মানা করে না। মুসলমানরা পৃথিবীতে তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাস করতে পারে একমাত্র তার মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতেই। নিজেদের সকল কাজ তারা সম্পাদন করে এই আকীদা ঠিক রেখে এবং তার আশেপাশের জনগণের সাথে এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তােলে। কারও সাথে বিসম্বাদ করা, আত্ম-প্রতিষ্ঠা বা গােত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্যে মুসলমানরা সংগ্রাম বা যুদ্ধ করে না। এখন এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন বলতে কি বুঝায়? শ্রেণীগত আভিজাত্য, এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অথবা পরিবার ও বংশগত অভিজাত্য কায়েমের জন্যে ইসলামের জেহাদ? না তা নয়। ইসলামের জেহাদ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর কাজ ও কথা সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে এবং তার এই আকীদার ভিত্তিতেই মুসলমান রচনা করতে চায় জীবনের সমস্ত আইন কানুন। এ সূরার পর সূরা তাওবা নাযিল হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা ও তার রসুলের পক্ষ থেকে সকল দায়িত্বমুক্তির কথা ঘোষণা করা হলাে সেই সকল মােশরেকের জন্যে যাদের সাথে তােমরা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছো…।’ এ আয়াত দ্বারা ইতিপূর্বে মুসলমান ও মােশরেকদের মধ্যে গড়ে ওঠা সকল চুক্তি পুরােপুরিভাবে বাতিল ঘােষণা করা হয়েছিলাে। যে সকল লােকের সাথে মুসলমানরা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে আক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলাে তাদের জানানাে হলাে, যেন চার মাসের মধ্যে তারা তাদের সকল কর্মপন্থা নির্ধারণ করে নেয়। চার মাস পার হওয়ার পরই অনাক্রমণ চুক্তি বাতিল বলে ঘােষিত হওয়ার সাথে সাথে যে কোনাে পক্ষ অপর পক্ষের ওপর আক্রমণ করাটা কোনাে নীতিবিরােধী কাজ হবে না। এ ঘােষণা দ্বারা তাদের সাথেও কৃত চুক্তি বাতিল বলে ঘােষণা করা হলাে যাদের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে চুক্তি করা হয়েছিলাে। এই বাতিল ঘােষণা করার কারণ অতীতের অনেক অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানা গিয়েছিলাে যে, মােশরেকরা মুসলমানদের সাথে কৃত কোনাে চুক্তির পরওয়া করে না। তারা লাভবান হওয়ার জন্যেই চুক্তিতে আবদ্ধ হতাে এবং যখন দেখত চুক্তি তাদের স্বার্থের অনুকূল থাকছে না, তখনই তারা তা ভংগ করতাে। এজন্যে তাদের ব্যবহার উপযােগী দ্বিতীয় নিয়ম চালু করে দেয়া হলাে। যখনই তােমরা কোনাে জাতি বা দল থেকে চুক্তিভংগের আশংকা অনুভব করবে, তখনই (তাদের চুক্তি বাতিল ঘােষণার পূর্বে) তােমরা চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে দেবে, কারণ আল্লাহ তায়ালা আমানতের খেয়ানত করা (চুক্তি বাতিলের ঘােষণা না দিয়ে আক্রমণ করা) পছন্দ করেন না। ইসলামী নিয়ম ঠিক রাখার জন্যে এই চুক্তি বাতিল ঘােষণার প্রয়ােজন ছিলাে। এ সময়ে গােটা আরব উপদ্বীপের মােশরেক ও আহলে কিতাবদের মধ্যে সহ-অবস্থানকালে এভাবে চুক্তি রদ করার নিয়ম চালু ছিলাে। অবশ্য তারা বাতিল ঘোষণা না করেই অতীতে বার বার (চুক্তি বিরােধী কার্যকলাপ করে) বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অর্থাৎ চুক্তির শর্তের বিরােধী কাজ তারা বার বার করেছে। এই ভাবে তারা বার বার সীমালংঘন করেছে এবং কোনাে প্রকার নিয়ম কানুন মেনে চলার প্রয়ােজনবােধ করেনি। বিশেষ করে তৎকালীন পৃথিবীর দুটি বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নানা প্রকার জল্পনা কল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাে। এ উদ্দেশ্যে তারা আরব উপদ্বীপের সেই আমীরদের সাথে যােগাযােগ করতে শুরু করেছিলাে, যারা ছিলো রােম ও পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত। সর্বনাশা এক মহাযুদ্ধ আসন্ন হয়ে ওঠেছিলাে। যুদ্ধ ছাড়া শক্তিদর্পী এ সাম্রাজ্যবাদীদের দমন করার আর কোনাে উপায় ছিলাে না।
[
১০-১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
*মােহাজের নারীদের ব্যাপারে ইসলামের নীতি : এ পর্যন্ত আলােচনার পর আমরা আমাদের মূল আলােচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে যাই, যার থেকে কিছুক্ষণের জন্যে আমরা অন্য প্রসংগে চলে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রসংগ ছিলাে মােমেন স্ত্রীলোক যারা মক্কা থেকে হিজরত করে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন তাদের সম্পর্কে ইসলাম কি বিধান দিয়েছে সে সম্পর্কিত? এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, যখন মােমেন স্ত্রীলোক তােমাদের নিকট হিজরত করে চলে আসে, তখন তাদের (হিজরত করার মূল কারণ) পরখ করে নিশ্চিতভাবে জেনে নাও… এবং ভয় করাে আল্লাহকে যার প্রতি তােমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছো।'(১০-১১) মােহাজের মহিলাদের সম্পর্কে এ বিধান নাযিল হয়েছিলাে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর। সেখানে বলা হয়েছে, ‘(সন্ধির শর্তের মধ্যে এটা থাকতে হবে যে,) তােমাদের দ্বীন-এর ওপর আস্থা স্থাপনকারী কোনাে মুসলমান ব্যক্তি যদি আমাদের মধ্য থেকে তােমাদের কাছে চলে যায়, ‘তাহলে অবশ্যই তাকে ফেরত দিতে হবে।’ এ চুক্তি সম্পাদনের পর পরই যখন মােহাম্মদ(সঃ) ও তাঁর মুসলমান সাহাবারা হুদায়বিয়া প্রান্তর অতিক্রম করে চলে আসছিলেন, সেই মুহূর্তেই কয়েকজন মোমেন মহিলা মক্কা থেকে হিজরত করে এসে তাদের কাছে হাযির হলেন এবং ইসলামী রাষ্ট্র মদীনায় যাওয়ার জন্যে আশ্রয়প্রার্থী হলেন। সংগে সংগে কোরায়শের লােকজন হাযির হয়ে সন্ধির শর্ত উল্লেখ করে তাদের ফেরত দেয়ার দাবী জানান। প্রকাশ থাকে যে, সন্ধি-শর্তের মধ্যে মহিলাদের সম্পর্কে কোনাে চুড়ান্ত কথা ছিলাে না, যার কারণে উপরােক্ত আয়াত দুটি নাযিল হওয়া জরুরী হয়ে পড়েছিলাে। আয়াত দুটিতে মােহাজের মহিলাদের কাফেরদের নিকট ফেরত দিতে নিষেধ করা হলাে এবং প্রকৃতিগতভাবে তারা কিছু দুর্বল বিধায় তাদের হিজরতের প্রকৃত কারণ জানার জন্যে তাদের একটু পরীক্ষা করে নেয়ার জন্যে বলা হলাে। এ প্রসংগে কিছু রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনও নাযিল হলাে। এসব আইনের মধ্যে সকল প্রকার কার্যকলাপ সর্বাধিক সুবিচারপূর্ণ নীতির ওপর নির্ধারণ করা হলাে, তাতে প্রতিপক্ষ কি মনে করবে বা বাড়াবাড়ি অথবা যুলুম করতে পারে, এসব কিছুর কোনাে তােয়াক্কাই করা হলাে না। আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সকল প্রকার আদান-প্রদানে ইসলামের সুদৃঢ় নীতি অবলম্বন করা হলাে। হুদায়বিয়ার সন্ধির-শর্ত পালনে প্রথম পরীক্ষা এসে গেলাে, কিছু সংখ্যক মুসলিম মােহাজের মহিলাকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রশ্ন সামনে এলাে। এ ব্যাপারে কারাে বিবাহ-বন্ধনে জোর করে ধরে রাখার জন্যে, ব্যক্তিগত সুবিধার্থে তলব করা অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে ব্যক্তিগত কারাে ভালোবাসার মূল্যায়ন করার উদ্দেশ্যে কোন নীতির পরিবর্তন করা হয়নি! হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, উক্ত মহিলাদের পরীক্ষা করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “আল্লাহর কসম খেয়ে বলো, স্বামীর প্রতি ঘৃণার কারণে হিজরত করেছো? এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছো? দুনিয়ার কোনাে স্বার্থ পাওয়ার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছো, না কি একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের মহব্বতে হিজরত করেছো? ইকরামা(রা.) বলেন, তাকে (উক্ত মহিলাকে) বলা হবে, আল্লাহ-রসূলের মহব্বতে হিজরত করেছো, না কোনাে ব্যক্তির প্রেমে পড়ে হিজরত করেছো, না তােমার স্বামীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে হিজরত করেছো? এইভাবে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। তাদের বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে এবং আল্লাহর কসম খেয়ে তাদের নিজের স্বীকারােক্তির ওপর নির্ভর করে ফয়সালা দেয়া হয়েছে। অন্তরে কিছু গােপন করা হলে তা আল্লাহ পাকই বুঝবেন, মানুষের সে বিষয়ে কোনাে হাত নেই। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালাই তাদের ঈমান সম্পর্কে ভাল জানেন। কাজেই তারা যদি আল্লাহ-রসূলের মহব্বতেই হিজরত করে এসেছে বলে তাদের স্বীকারােক্তিতে জানা যায়, সে অবস্থায় কাফেরদের নিকট তাদের আর ফিরিয়ে দিয়াে না।’ এ স্ত্রীলােকরা ওদের (কাফের স্বামীদের) জন্যে হালাল নয়, অথবা এ পুরুষরাও ওদের জন্যে হালাল নয়।’ আলােচ্য আয়াতে আকীদাকেই প্রথম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- যেহেতু মুসলমানদের প্রথম সম্পর্ক গড়ে ওঠে আকীদার ভিত্তিতে। অন্য সম্পর্ক সেখানে গৌণ বিধায় সেটার কোনাে মূল্যই এ প্রসংগে দেয়া হয়নি। অন্য সম্পর্ক যে কোনাে সময় কেটে যেতে পারে। বৈবাহিক সম্পর্ক হচ্ছে পারস্পরিক মিলন, একে অপরের ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং স্থায়ীভাবে মিলেমিশে জীবন যাপন করা। মুসলমানের প্রথম (ঈমানের) সম্পর্কই যদি কেটে যায়, তাহলে পারস্পরিক সহ-অবস্থান আর সম্ভব হয় না, যেহেতু মুসলমানের অন্তরের জীবন-পরিচালিকা শক্তিই হচ্ছে ঈমান, যার বিকল্প অন্য কোনাে সম্পর্ক হতে পারে না। সুতরাং, সেই ঈমানের সম্পর্কই যদি নষ্ট হয়ে যায় আর অন্তর থেকে ঈমান রূপ রত্ন যদি হারিয়ে যায়, সে অবস্থায় মােমেনের অন্তর অন্য কোনাে কিছুতে সাড়া দিতে পারে না। না তাকে সে ভালােবাসতে পারে। না তার প্রতি কোনাে আকর্ষণ অনুভব করে, না তার সাথে বসবাস করতে পারে, আর না তার কাছ থেকে কোনাে শান্তি পেতে পারে। আর বৈবাহিক সম্পর্কই হচ্ছে পারস্পরিক মহব্বত, দয়া-সহানুভূতি ও এক সাথে শান্তিতে বসবাস করার জীবন। হিজরতের গোড়ার দিকে এ প্রসংগে সুনির্দিষ্ট কোনাে বিধান নাযিল না হওয়ার কারণে এ বিষয়টি পরিত্যক্তই ছিলো, অথবা এ বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি, আর এজন্যে মােমেন ও কাফের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদও ঘটানাে হয়নি। মােমেন স্ত্রীকে কাফের স্বামী থেকে অথবা মােমেন পুরুষকে কাফের স্ত্রী থেকে পৃথক করা হয়নি। কারণ তখনও ইসলামী সমাজের পূর্ণাংগ প্রতিষ্ঠা হয়নি এবং এ সম্পর্কে পূর্ণাংগ বিধানও নাযিল করা হয়নি। তারপর হােদায়বিয়ার সন্ধি অথবা অন্য বর্ণনায় হােদায়বিয়ার বিজয়ের পর পূর্ণাংগ ফয়সালা এসে গেলাে এবং মােমেন পুরুষ ও স্ত্রীলােকদের বিবেকের মধ্যে একথা স্থিরভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হলাে, যা সত্যিকারে ইতিমধ্যেই জানাজানি হওয়া (সম্ভবত) দরকার ছিলাে। স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হলাে যে, ঈমানের সম্পর্কই আসল সম্পর্ক, আকীদার বন্ধনই আসল বন্ধন এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের খাতিরেই অন্যান্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইনসাফ ও সমান সমান ব্যবহারের দাবী হচ্ছে, যখন বিচ্ছেদ ঘটানাের নীতি চালু করা হবে, তখন উভয় পক্ষে একই নীতি চালু করা হবে। এর ফলে কাফের স্বামী মােমেন স্ত্রীর জন্যে যা কিছু মােহর বাবদ খরচ করেছে তা পরিত্যাগ করার কারণে যে কষ্ট দেয়া হবে তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ উক্ত অর্থ ফিরিয়ে দিতে হবে। একইভাবে মােমেন পুরুষ কাফের স্ত্রীর জন্যে যা কিছু মাহর বাবদ খরচ করেছে, বিচ্ছেদজনিত কষ্টের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে তাও ফেরত দিতে হবে। এভাবে লেনদেন সমাপ্তির মাধ্যমে যখন বিচ্ছেদ কার্যকর হবে, তখনই মােমেনদের জন্যে সেসব মােহাজের মহিলাকে মোহর দান করে বিয়ে করা হালাল হবে। অবশ্য গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত বা বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত কোনাে ইদ্দত পালন করতে হবে কিনা, অথবা তিন তুহর (তিন মাস)-এর ইদ্দত পালন করা লাগবে কিনা, অথবা জরায়ু পরিষ্কার পাওয়ার জন্যে একবার হায়েয হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করা কি যথেষ্ট হবে এসব প্রশ্নে একটি ব্যাপারে বুঝার তারতম্যের কারণে কিছু মতভেদ আছে! (এ বিষয়টি যেহেতু অতীত হয়ে গেছে এবং এ ধরনের ঘটনা খুবই সীমিত আকারে ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে এসব সমস্যা আর আসার মতো নেই, এজন্যে সুনির্দিষ্ট কোনাে কথা এ সম্পর্কে আসেনি।) পরবর্তীতে এরশাদ হচ্ছে, ‘দাও তাদেরকে (মহিলাদের) যা তারা (পূর্বের স্বামীরা) খরচ করেছে (এবং যে মােহর ওই মহিলারা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে), তাদের মােহর বাবদ পাওনা যখন তােমরা দান করবে তখন তাদের বিয়ে করায় তােমাদের কোনাে অসুবিধা নাই। তােমরাও কাফের স্ত্রীদের তােমাদের বিবাহ বন্ধনে আটকিয়ে রেখাে না। যা তােমরা খরচ করেছো তােমরা তা চেয়ে নাও। কাফের স্বামীরাও তালাক দেয়ার সময় তাদের পাওনা চেয়ে নিক (যা তারা স্ত্রীর জন্যে খরচ করেছে)।’ তারপর মােমেন ব্যক্তির বিবেকের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আল্লাহর হুকুম পালন করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করানাে হচ্ছে, তাকে নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে যে, ‘অবশ্যই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা সব কিছু তদারকী করছেন।’ সুতরাং তাকে সকল অবস্থায় ভয় করে চলতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘এইই হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ ও ফয়সালা, তিনিই সব কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন এবং আল্লাহ তায়ালা সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকেফহাল, বিজ্ঞানময়।’ আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার মনােভাবই হচ্ছে একমাত্র নিশ্চয়তা, যা মানুষকে অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার হতে রক্ষা করে, কোনাে কিছুর চাপে ভেংগে পড়তে দেয় না এবং কোনাে অজুহাত তালাশ করতেও বলে না। আল্লাহর হুকুম মানেই মহাজ্ঞানী ও চির বিজ্ঞানময় আল্লাহর হুকুম। এ হুকুম সকল অন্তরেই অনুভূত হয়। এ হুকুমই সকল শক্তির আধার এবং এই হুকুমই সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহর হুকুম। এ হুকুমপ্রাপ্ত হওয়াই একজন মুসলমান ব্যক্তির পক্ষে সাড়া দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। যখন কোনাে ব্যক্তি গভীরভাবে বুঝতে পারে, এ হুকুম কোত্থেকে এসেছে, তখন সে এ হুকুম পালন করার ব্যাপারে দৃঢ়তা অবলম্বন করতে পারে এবং অপরকে এ হুকুম সম্পর্কে জানাতে পারে। আর তখনই সে স্থিরভাবে বিশ্বাস করতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত তাকে আল্লাহ পাকের কাছে ফিরে যেতে হবে। এমতাবস্থায় মােমেনদের খরচ করা কোনাে সম্পদ কোনাে ব্যক্তির কাফের হওয়ার কারণে যদি হারিয়ে যেতে চায়, তাহলে তা চেয়ে নিতে হবে অথবা কাফের স্ত্রীদের পরিবারের লােকেরা যদি মােমেন স্বামীর পাওনা বুঝিয়ে দিতে না চায়, যেমনটি কোনাে কোনাে অবস্থায় ঘটেছেও, সে অবস্থায় মুসলমানদের নেতার কর্তব্য হবে তার দাবী জানিয়ে আদায় করে লওয়া। আবার কোনাে স্ত্রী মােমেনা হয়ে গেলে তার কাফের স্বামী তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে, যেহেতু তার স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করায় ও দারুল ইসলামে (ইসলামী রাষ্ট্রে) চলে আসায় আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথবা তার সম্পদ গনীমতের মাল হিসাবে মুসলমানদের হস্তগত হয়ে যাওয়ার কারণে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তােমাদের মধ্যে কেউ কাফেরদের কাছে তােমাদের স্ত্রীদের থেকে যাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকো, সে অবস্থায় তােমাদের খরচকৃত অর্থ ফিরে পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করো… যার প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো।’ মােমেনদের অন্তরে এই আল্লাহভীতিই গভীরভাবে বিরাজ করে। এইভাবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানাের জন্যে সর্বোত্তম পন্থা হিসাবে এসব নির্দেশ জারি করা হয়েছে এবং জীবনের মূল্যবােধ ও জীবনের বিভিন্ন সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্যে ইসলামী চিন্তা চেতনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ইসলামী রীতিনীতির কথা জানিয়ে দিয়ে এটা যে অন্যান্য সকল রীতি নীতি থেকে ভালাে, তার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। জানানাে হয়েছে, গােটা জীবনের সৌধ রচিত হয়েছে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ওপর এবং ঈমানকে কেন্দ্র করেই সকল বিশ্বাস আবর্তিত হয়। মানব জগতের সৃষ্টির মধ্যে শ্রেণী, রং, ভাষা, বংশ ও এলাকার ভিত্তিতে অবশ্যই কিছু পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু এ সব পার্থক্যের ওপর তাদের মান-মর্যাদা নির্ভর করে না; বরং একটি মাত্র বৈশিষ্ট্য আছে, যা তাদের মর্যাদাবান বানায়, আর তা হচ্ছে আল্লাহভীতি, যার ভিত্তিতে কেউ হয় আল্লাহর দল, আর কেউ হয় শয়তানের দল। এভাবে কারও অগ্রগতি হয় আর কারাে হয় অধপতন।
ফী জিলালিল কুরআন:
*মােহাজের নারীদের থেকে বায়াত গ্রহণের নীতি : এরপর রসূলুল্লাহ(স.)-কে জানানাে হয়েছে, হিজরতকারী মহিলা থেকে ঈমানের ভিত্তিতে কিভাবে বায়াত গ্রহণ করা হবে, তারা এবং অন্য যারা ইসলাম গ্রহণ করছে তাদের কোন জিনিসের ভিত্তিতে বায়াত করানাে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী, যখন তােমার নিকট মােমেন মহিলারা এসব শর্তে বায়য়াত হতে আসে যে, তারা শিরক করবে না, চুরি করবে না, যেনা করবে না, তাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কারও ওপরে নিজেদের ব্যভিচারের অপবাদ চাপিয়ে দেবে না এবং কোনাে নেক কাজের নির্দেশ দিলে তা অমান্য করবে না, তখন তাদের বায়য়াত করাও এবং তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করাে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, মেহেরবান।’ এইই হচ্ছে সেসব মূল কাজ, যা ইসলামী আকীদা গ্রহণ করার পর পালন করা জরুরী হয়ে যায় এবং যা নতুন এক সমাজ জীবন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। এর মধ্যে সকল প্রকার শিরক পরিত্যাগ করতে, যেসব অপরাধ করলে শাস্তি পাওয়া জরুরী হয়ে যায় তা পরিত্যাগ করতে এবং সন্তানাদি হত্যা করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ দ্বারা জাহেলী যুগে জ্যান্ত কন্যা পুঁতে ফেলার প্রথা নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য অপরাধের মধ্যে ভ্ৰুণ হত্যার প্রতিও নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কারণ এসব ভ্রুণ তাে মায়ের পেটের মধ্যে আল্লাহর দেয়া আমানত এবং কেউ কারও প্রতি নিজেদের ব্যভিচারের মিথ্যা দোষ যেন চাপিয়ে না দেয়।’ এ বিষয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা.) বলেন, শেষের এ কথার অর্থ হচ্ছে, অবৈধভাবে ধারণ করা অন্যদের সন্তানদের নিজেদের স্বামীর সন্তান বলে দাবী করে মিথ্যা বলা। মোকাতেলও উক্ত কথার এই একই অর্থ বলেছেন। আর সম্ভবত বায়াত হওয়ার পর এসব অপরাধ থেকে পরহেয করার অংগীকার করার কথা বলা হয়েছে। জাহেলী যামানায় মহিলারা একাধিক পুরুষের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতাে। তারপর সন্তান জন্ম নিলে (সেসব পুরুষকে হাযির করে) দেখত কে সে সন্তানের সাথে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ এবং এভাবে যার সাথে বেশী সাদৃশ্য হতাে, তাকেই তারা সে সন্তান দিয়ে দিতাে। এইভাবে তারা উক্ত সন্তানদের বাপদের চিনে নিতাে। এই অবস্থার প্রতি সাধারণভাবে এখানে ইংগিত করা হয়েছে এবং এই রকম আরও অনেক মিথ্যা দাবী জাহেলী যুগে করা হতাে, যার প্রতি এখানে ইংগিত করা হয়েছে। আর এ কারণেই সম্ভবত ইবনে আব্বাস(রা.) ও মােকাতেল সে সময়কার অবস্থা সামনে রেখে উক্ত অর্থ বুঝেছেন। মােহাজের মহিলাদের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করলে তাদের প্রতি শেষ যে শর্তটি আরােপ করা হতাে তা হচ্ছে, ‘তারা কোনাে নেক কাজে তােমার অবাধ্যতা করবে না।’ একথা দ্বারা তাদের কাছ থেকে ওয়াদা নেয়া হয়েছে, তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর সকল নির্দেশ পালন করবে। আর নিশ্চিতভাবে একথা সত্য যে, রসূলুল্লাহ(স.) মানুষের জন্যে যা কিছু কল্যাণকর হতে পারে তারই নির্দেশ দিতেন। তবু ইসলামী সংবিধানে এ কথাটিকে অন্যতম শর্ত হিসাবে পেশ করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, এ কথা স্থির করে দেয়া যে, যে কোনো ব্যক্তির আনুগত্য করা হবে, চাই সে ইমাম হােক বা প্রশাসক হােক, তার ভালাে ও কল্যাণকর কাজের জন্যে দেয়া সকল নির্দেশ পালন করতে হবে, কোনাে মন্দ (জনহিতকর নয় এমন) কাজের জন্যে প্রদত্ত নির্দেশ পালন করা যাবে না, অর্থাৎ সে নির্দেশ আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ও শরীয়তের পরিপন্থী না হলেই কেবল তা মানা যাবে। একথা দ্বারা প্রমাণিত হলাে, বাছবিচার না করে নেতা বা শাসকের সকল নির্দেশ পালন করা যাবে না। এইই হচ্ছে আল্লাহর আইনের অধীনে থেকে আইন রচনার মূলনীতি। আল্লাহর বিধানের খেলাফ হলে সে বিষয়ে নির্দেশদাতা বা নির্দেশ পালনকারী উভয়ের জন্যে এ নিয়ম সমভাবে প্রযােজ্য। অর্থাৎ যেমন নির্দেশদানকারীর নির্দেশ শরীয়াসংগত হতে হবে, তেমনি শরীয়াসম্মত কাজেই সে নির্দেশ মানা জরুরী হবে। উভয়ের মধ্যে কেউই শরীয়ার এ সীমা লংঘন করতে পারবে না। এ সীমার মধ্যে থেকে নির্দেশ দিলে তা পালন করা ফরয হবে এবং এর বাইরের নির্দেশ, অর্থাৎ আল্লাহর আইনের বিপরীতে যে কোনাে আইন অমান্য করাই তখন ফরয হবে। অতএব, এসব মূলনীতি মেনে নিয়ে যারা বাইয়াত করতে চাইবে, তাদের বাইয়াত করানাে হবে এবং রসূলুল্লাহ(স.) আল্লাহর দরবারে তাদের পেছনের সমুদয় অপরাধের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। হবেন। ‘অবশ্যই আল্লাহ পাক ক্ষমাশীল মেহেরবান।’ তিনি মাফ করে দেবেন এবং রহমও করবেন। তার সকল ত্রুটি বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন। পরিশেষে আসছে সাধারণ নির্দেশ, যা সর্বসাধারণের জন্যেই সমভাবে প্রযােজ্য। ‘হে ঈমানদাররা, সেই জাতির সাথে বন্ধুত্ব করাে না যাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা গযব নাযিল করেছেন। ওরা অবশ্যই পরকাল সম্পর্কে তেমনি করে হতাশ হয়ে গেছে যেমন করে কবরবাসীরা হতাশ হয়েছে।’ অর্থাৎ আল্লাহর আক্রোশ তাদের ওপর এমনভাবে নেমে এসেছে যে, আখেরাতে মুক্তির আশা তারা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে, ঠিক যেমন করে অন্যায়কারী কবরবাসীদের মুক্তির কোনাে আশা থাকে না। লক্ষণীয়, এখানে ঈমানদার হওয়ার কারণেই ঈমান নামের দোহাই দিয়ে মােমেনদের ডাকা হয়েছে। তাদের এমন গুণের কথা বলা হয়েছে যা অন্য সকল জাতি থেকে তাদের পৃথক করে। এই গুণ তখনই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যখন তারা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আল্লাহর দুশমনদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক কেটে দেয়। এ প্রসংগে কোনাে কোনাে রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, গযবপ্রাপ্ত এ জাতি হচ্ছে ইহুদী। এর কারণ স্বরূপ বলা যায়, কোরআনের অনেক জায়গায় তাদের গযবপ্রাপ্ত হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু তাই বলে একমাত্র তারাই গযব প্রাপ্ত আর কেউ নয়, এ কথা ঠিক নয়; বরং ইহুদী মােশরেক যারাই আল্লাহর নাফরমানীতে অগ্রগামী হবে, তারাই এ আয়াতের লক্ষ্য হবে এবং আলােচ্য সূরাতেও এই কথারই ইংগিত পাওয়া যায়। আল্লাহর সকল দুশমন এবং সেসব জাতি, যাদের ওপর আল্লাহর আক্রোশ এসে পড়েছে, তারা সবাই এ আযাবের লক্ষ্য এবং তারা সবাই আখেরাতের জীবনে মুক্তির ব্যাপারে হতাশ। অত্যধিক অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকায় তারা নিজেরাই আখেরাতে মুক্তি পাবে বলে মনে করে না এবং কবরস্থ মৃত কাফেরদের ন্যায় তাদের কাছ থেকে কোনাে সহজ হিসাব গ্রহণ করা হবে বলে তারা মনে করে না। যেহেতু তাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মে গেছে, তাদের কাজ ও ব্যবহার এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তাদের তাওবা করার বা অন্যায় কাজ থেকে ফিরে আসার আর কোনাে উপায় নেই বলে তাদের বিশ্বাস। অতএব, কোনাে সহজ হিসাব আর তাদের হতে পারে না। সূরার মধ্যে বর্ণিত সকল ঘটনা ও বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘােষণা। সুতরাং যেভাবে সূরাটির মধ্যে আলোচনার সূচনা করা হয়েছিলাে সেই একইভাবে আলােচনা শেষ করা হয়েছে যাতে করে অপরাধীরা বুঝতে পারে যে, শেষ অবস্থা তাই হবে যার আওয়ায অন্তরের মধ্যে সদা সর্বদা গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে।