Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬৪/হে মুমিনগণ!:-৮৭) [*যারা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও আমল করে না, তারা গাধার মত:- * হে মুমিনগণ!যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন, দৌড়ে আসো:- *জুমু‘আর খুতবার আযানের পর সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য হারাম:- **হালাল রিজিক অনুসন্ধানও আল্লাহর ইবাদাত:-] www.motaher21.net সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ পারা:২৮ ১- ১১ নং আয়াত:- ১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:- #তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:- #তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:- #তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৪/হে মুমিনগণ!:-৮৭)
[*যারা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও আমল করে না, তারা গাধার মত:-
* হে মুমিনগণ!যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন, দৌড়ে আসো:-
*জুমু‘আর খুতবার আযানের পর সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য হারাম:-
**হালাল রিজিক অনুসন্ধানও আল্লাহর ইবাদাত:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ
পারা:২৮
১- ১১ নং আয়াত:-
১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
#তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-১
یُسَبِّحُ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ الۡمَلِکِ الۡقُدُّوۡسِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ ﴿۱﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে আল্লাহর, যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, পূত-পবিত্র, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-২
ہُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ۙ﴿۲﴾
তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের২ মধ্যে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়।৩ অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৩
وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳﴾
এবং তাদের মধ্য হতে অন্যান্যদের জন্যও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি । আর আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৪
ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۴﴾
এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহশীল।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৫
مَثَلُ الَّذِیۡنَ حُمِّلُوا التَّوۡرٰىۃَ ثُمَّ لَمۡ یَحۡمِلُوۡہَا کَمَثَلِ الۡحِمَارِ یَحۡمِلُ اَسۡفَارًا ؕ بِئۡسَ مَثَلُ الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۵﴾
যাদেরকে তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি তাদের উপমা সেই সব গাধা যা বই-পুস্তক বহন করে। এর চেয়েও নিকৃষ্ট উপমা সেই সব লোকের যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দান করেন না।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৬
قُلۡ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ ہَادُوۡۤا اِنۡ زَعَمۡتُمۡ اَنَّکُمۡ اَوۡلِیَآءُ لِلّٰہِ مِنۡ دُوۡنِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۶﴾
বল, ‘হে ইয়াহুদীগণ! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য কোন মানবগোষ্ঠী নয়, তাহলে তোমরা মৃত্যু কামনা কর; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৭
وَ لَا یَتَمَنَّوۡنَہٗۤ اَبَدًۢا بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ ﴿۷﴾
কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আল্লাহ‌ এসব জালেমকে খুব ভালভাবেই জানেন।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৮
قُلۡ اِنَّ الۡمَوۡتَ الَّذِیۡ تَفِرُّوۡنَ مِنۡہُ فَاِنَّہٗ مُلٰقِیۡکُمۡ ثُمَّ تُرَدُّوۡنَ اِلٰی عٰلِمِ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ فَیُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ٪﴿۸﴾
তাদের বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাচ্ছো তা তোমাদের কাছে আসবেই তারপর তোমাদেরকে সেই সত্তার সামনে পেশ করা হবে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই জানেন। তখন তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করছিলে।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-৯
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۹﴾
* হে মুমিনগণ!জুম’আর দিন যখন নামাযের জন্য তোমাদের ডাকা হয় নামাযের জন্য তখন, দৌড়ে আসো, আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য বেশী ভাল যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-১০
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰﴾
তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।
সুরা: ৬২ : আল-জুমুয়াহ:-১১
وَ اِذَا رَاَوۡا تِجَارَۃً اَوۡ لَہۡوَۨا انۡفَضُّوۡۤا اِلَیۡہَا وَ تَرَکُوۡکَ قَآئِمًا ؕ قُلۡ مَا عِنۡدَ اللّٰہِ خَیۡرٌ مِّنَ اللَّہۡوِ وَ مِنَ التِّجَارَۃِ ؕ وَ اللّٰہُ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ ﴿٪۱۱﴾
আর যে সময় তারা ব্যবসায় ও খেল তামাশার উপকরণ দেখলো তখন তারা তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে সেদিকে দৌড়ে গেল। তাদের বলো, আল্লাহর কাছে যা আছে তা খেল-তামাশা ও ব্যবসায়ের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা।

১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
#তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
(৬২-জুমুয়া) : নামকরণ: \n ৯ নং আয়াতের إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ আয়াতাংশ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ সূরার মধ্যে যদিও জুম’আর নামাযের আহকাম বা বিধি-বিধানও বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু জুম’আ সামগ্রিকভাবে এর বিষয়বস্তুর শিরোনাম নয়। বরং অন্যান্য সূরার নামের মত এটিও এ সূরার প্রতীকী বা পরিচায়মূলক নাম।
(৬২-জুমুয়া) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

প্রথম রুকূ’র আয়াতসমূহ ৭ হিজরীতে সম্ভবত খায়বার বিজয়ের সময় অথবা তার নিকটবর্তী সময়ে নাযিল হয়েছে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী এবং ইবনে জারীর হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের খেদমতে বসে থাকা অবস্থায় এ আয়াতটি নাযিল হয়। হযরত আবু হুরাইরা সম্পর্কে এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে এবং খায়বার বিজয়ের পূর্বে ঈমান এনেছিলেন। ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুসারে ৭ হিজরীর মুহাররাম মাসে আর ইবনে সা’দের বর্ণনা অনুসারে জমাদিউল উলা মাসে খায়বার বিজিত হয়েছিল। অতএব যুক্তির দাবি হলো, ইহুদীদের এই সর্বশেষ দুর্গটি বিজিত হওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্বোধন করে এ আয়াতগুলো নাযিল করে থাকবেন কিংবা খায়বারের পরিণাম দেখে উত্তর হিজাযের সমস্ত ইহুদী জনপদ যখন ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে গিয়েছিল তখন হয়তো এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল। ।। । দ্বিতীয় রুকূ’র আয়াতগুলো হিজরতের পরে অল্পদিনের মধ্যে নাযিল হয়েছিল। কেননা নবী(সা.) মদীনা পৌছার পর পঞ্চম দিনেই জুম’আর নামায কায়েম করেছিলেন। এই রুকূ’র শেষ আয়াতটিতে যে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আয়াতটি জুম’আর নামায আদায় করার ব্যবস্থা হওয়ার পর এমন এক সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে যখন মানুষ দ্বীনী উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সমাবেশের আদব-কায়দা ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে তখনও পুরো প্রশিক্ষণ লাভ করেনি।

(৬২-জুমুয়া) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

ওপরে আমরা একথা বলেছি যে, এ সূরার দুটি রুকূ’ দুটি ভিন্ন সময়ে নাযিল হয়েছে। অতএব এর বিষয়বস্তু যেমন আলাদা তেমনি যাদের সম্বোধন করে নাযিল করা হয়েছে সে লোকজনও আলাদা। তবে এ দুটি রুকূর আয়াতসমূহের মধ্যে এক প্রকার সাদৃশ্য আছে এবং এ জন্য তা একই সূরাতে সন্নিবেশিত হয়েছে। সাদৃশ্য কি তা বুঝার আগে রুকূ’ দুটির বিষয়বস্তু আলাদাভাবে আমাদের বুঝে নেয়া উচিত।

ইসলামী আন্দোলনের পথ রোধ করার জন্য বিগত ছয় বছরে ইহুদীরা যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা ব্যর্থতায় পর্যবসতি হয়েছে এমনি এক সময় প্রথম রুকূ’র আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল। প্রথমত মদীনায় তাদের তিন তিনটি শক্তিশালী গোত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। তারা এর ফল দেখতে পেল এই যে, একটি গোত্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল এবং অপর দুটি গোত্রকে দেশান্তরিত হতে হলো। অতপর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা আরবের বহুসংখ্যক গোত্রকে মদীনার ওপর আক্রমণের জন্য নিয়ে আসল কিন্তু আহযাব যুদ্ধে তারা সবাই চপেটাঘাত খেল। এরপর তাদের সবচেয়ে বড় দুর্গ বা আখড়া রয়ে গিয়েছিল খায়বারে। মদীনা ত্যাগকারী ইহুদীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাও সেখানে সমবেত হয়েছিল। এসব আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সেটিও অস্বাভাবিক রকমের কোন সংঘর্ষ ছাড়াই বিজিত হয় এবং মুসমানদের ভূমি কর্ষণকারী হিসেবে থাকতে খোদ ইহুদীরাই আবেদন জানায়। সর্বশেষ এই পরাজয়ের পর আরবে ইহুদীদের শক্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ওয়াদিউল কুরা, ফাদাক, তায়ামা, তাবুক সব একের পর এক আত্মসমর্পণ করতে থাকে। ইসলামের অস্তিত্ব বরদাশত করা তো দূরের কথা তার নাম শুনতেও যারা পছন্দ করত না, আরবের সেইসব ইহুদীই শেষ পর্যন্ত সেই ইসলামের প্রজায় পরিণত হয়। এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা এই সূরার মধ্যে আরো একবার তাদেরকে সম্বোধন করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে কুরআন মজীদে উল্লেখিত এটাই সম্ভবত সর্বশেষ বক্তব্য। এতে তাদের উদ্দেশ্য করে তিনটি কথা বলা হয়েছে:

এক: তোমরা এ রসূলকে মানতে অস্বীকার করছো এই কারণে যে, তিনি এমন এক কওমের মধ্যে প্রেরিত হয়েছেন যাদেরকে অবজ্ঞা ভরে তোমরা ‘উম্মী’ বলে থাক। তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রসূলকে অবশ্যই তোমাদের নিজেদের কওমের মধ্যে থেকে হতে হবে। তোমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে ছিলে যে, তোমাদের কওমের বাইরে যে ব্যক্তিই রিসালাতের দাবি করবে সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী। কারণ এই পদমর্যাদা তোমাদের বংশের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং ‘উম্মী’ দের মধ্যে কখনো কোন রসূল আসতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সেই উম্মীদের মধ্যেই একজন রসূল সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের চোখের সামনেই যিনি তাঁর কিতাব শুনাচ্ছেন, মানুষকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সেই মানুষকে হিদায়াত দান করেছেন তোমরা নিজেরাও যাদের গোমরাহীর অবস্থা জান। এটা আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানী, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। তাঁর করুণা ও মেহেরবানীর ওপর তোমাদের কোন ইজারাদারী নেই যে, তোমরা যাকে তা দেয়াতে চাও তাকেই তিনি দিবেন আর তোমরা যাকে বঞ্চিত করতে চাও, তাকে তিনি বঞ্চিত করবেন।

দুই: তোমাদের তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল। কিন্তু তোমরা এর গুরুদায়িত্ব উপলদ্ধিও করোনি, পালনও করোনি। তোমাদের অবস্থা সেই গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে কিন্তু সে কি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তা জানে না। তোমাদের অবস্থা বরং ঐ গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। গাধার তো কোন প্রকার-বুদ্ধি-বিবেক নেই, কিন্তু তোমাদের বুদ্ধি-বিবেক আছে। তাছাড়া, তোমরা আল্লাহর কিতাবের বাহক হওয়ার গুরুদায়িত্ব শুধু এড়িয়েই চলছো না, জেনে বুঝে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলা থেকেও বিরত থাকছো না। এসব সত্ত্বেও তোমাদের ধারণা এই যে, তোমরা আল্লাহর অতি প্রিয় এবং রিসালাতের নিয়ামত চিরদিনের জন্য তোমাদের নামে লিখে দেয়া হয়েছে। তোমরা যেন মনে করে নিয়েছ, তোমরা আল্লাহর বাণীর হক আদায় করো আর না করো কোন অবস্থায়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ছাড়া আর কাউকে তাঁর বাণীর বাহক বানাবেন না।

তিন সত্যিই যদি তোমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে এবং এ বিশ্বাসও তোমাদের থাকতো যে, তাঁর কাছে তোমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থান সংরক্ষিত আছে তাহলে মৃত্যুর এমন ভীতি তোমাদের মধ্যে থাকতো না যে, অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন গ্রহণীয় কিন্তু কোন অবস্থায়ই মৃত্যু গ্রহণীয় নয়। আর মৃত্যুর এই ভয়ের কারণেই তো বিগত কয়েক বছরে তোমরা পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছো। তোমাদের এই অবস্থা-ই প্রমাণ করে যে, তোমাদের অপকর্মসমূহ সম্পর্কে তোমরা নিজেরাই অবহিত। তোমাদের বিবেক ভাল করেই জানে যে, এসব অপকর্ম নিয়ে যদি মারা যাও তাহলে পৃথিবীতে যতটা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছো আল্লাহর কাছে তার চেয়ে অধিক লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।

এ হচ্ছে প্রথম রুকূ’র বিষয়বস্তু। দ্বিতীয় রুকূ’টি এর কয়েক বছর আগে নাযিল হয়েছিল। দ্বিতীয় রকূ’র আয়াতগুলো এ সূরার অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হলো, আল্লাহ তা’আলা ইহুদীদের ‘সাবত’ বা শনিবারের পরিবর্তে মুসলমানদের ‘জুম’আ’ দান করেছেন। তাই তিনি মুসলমানদের সাবধান করে দিতে চান যে, ইহুদীরা, ‘সাবতে’র সাথে যে আচরণ করেছে তারা যেন জুম’আর সাথে সেই আচরণ না করে। একদিন ঠিক জুম’আর নামাযের সময় একটি বাণিজ্য কাফেলা আসলে তাদের ঢোল ও বাদ্যের শব্দ শুনে বারজন ছাড়া উপস্থিত সবাই মসজিদে নববী থেকে বেরিয়ে দৌড়িয়ে কাফেলার কাছে গিয়ে হাজির হয়। অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন খোতবা দিচ্ছিলেন। তাই নির্দেশ দেয়া হয় যে, জুম’আর আযান হওয়ার পর সব রকম কেনাবেচা এবং অন্য সব রকম ব্যস্ততা হারাম। ঈমানদারদের কাজ হলো, এ সময় সব কাজ বন্ধ রেখে আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হবে। তবে নামায শেষ হওয়ার পর নিজেদের কারবার চালানোর জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। জুম’আর হুকুম আহকাম সম্পর্কিত এ রুকূটিতে একটি স্বতন্ত্র সূরাও বানানো যেত কিংবা অন্য কোন সূরার অন্তর্ভুক্ত ও করা যেতে পারত। কিন্তু তা না করে এখানে যেসব আয়াতে ইহুদীদেরকে তাদের মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে বিশেষভাবে সেই সব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য তাই যা আমরা ওপরে বর্ণনা করেছি।
ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা হাদীদের ১ ও ২ নং টীকা, আল হাশরের ৩৬, ৩৭ ও ৪১ টীকা। পরবর্তী বিষয়ের সাথে এই প্রারম্ভিক কথাটির গভীর সম্পর্কে বিদ্যমান। আরবের ইহুদীরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিসত্তা, গুণাবলী ও কার্যকলাপে রিসালাতের স্পষ্ট নিদর্শন চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর সম্পর্কে তাওরাতে স্পষ্ট ভাষায় যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন তা যে তাঁর ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না তা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও শুধু এজন্য তাঁকে অস্বীকার করেছিল যে, নিজ জাতি ও বংশের বাইরের আর করো রিসালাত মেনে নেয়া তাদের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় ব্যাপার ছিল। তারা পরিষ্কার বলতো, আমাদের কাছে যা কিছু এসেছে আমরা কেবল তাই মানবো। কোনো অইসরাঈলী নবীর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকেও কোনো শিক্ষা এসে থাকলে তো মেনে নিতে তারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। এই আচরণের কারণে পরবর্তী আয়াতগুলোতে তাদেরকে তিরষ্কার করা হচ্ছে। তাই এই প্রারম্ভিক আয়াতাংশ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। এতে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো, বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি বন্তু আল্লাহর তাসবীহ করছে। অর্থাৎ গোটা বিশ্ব-জাহান একথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যেসব অপূর্ণতা ও দুর্বলতার ভিত্তিতে ইহুদীরা তাদের বংশীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা কায়েম ও বদ্ধমূল করে রেখেছে আল্লাহ‌ তা’আলা তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি কারো আত্মীয় নন। তাঁর কাছে পক্ষপাতিত্বমূলক () কোন কাজ নেই। তিনি নিজের সমন্ত সৃষ্টির সাথে সমানভাবে ইনসাফ, রহমত ও প্রতিপালক সুলভ আচরণ করেন। কোনো বিশেষ বংশধারা বা কওম তাঁর প্রিয় নয় যে, তারা যাই করুক না কেন সর্বাবস্থায় তাঁর অনুগ্রহ তার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে এবং অন্য কোনো জাতি গোষ্ঠী বা কওমের সাথে তাঁর কোন শত্রুতা নেই যে, তাদের মধ্যে সদগুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তাঁর দান ও করুণা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। এরপর বলা হয়েছে তিনি বাদশাহ। অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের কোন শক্তিই তার ক্ষমতা ও ইখতিয়ারকে সীমিত করতে পারে না। তোমরা তাঁর দাস এবং প্রজা। তোমাদের হিদায়াতের জন্য তিনি কাকে পয়গাম্বর বানাবেন আর কাকে বানাবেন না, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত পদমর্যাদা তোমরা কবে থেকে লাভ করছে? তারপর বলা হয়েছে, তিনিقدوس মহা পবিত্র। অর্থাৎ তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল-ত্রুটির কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। তোমাদের বুঝ ও উপলব্ধিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু তার সিদ্ধান্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে না। শেষ দিকে আল্লাহ‌ তা’আলার আরো দু’টি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে একটি হলো, তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশারী। অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ জয়লাভ করতে পারে না। অপরটি হলো তিনি জ্ঞানময়, অর্থাৎ যা কিছু করেন, বুদ্ধি, বিবেক ও প্রজ্ঞার দাবীও হুবহু তাই। আর তাঁর কৌশল ও ব্যবস্থাপনা এতই সুদৃঢ় হয়ে থাকে যে, বিশ্ব-জাহানের কেউই তা ব্যর্থ করতে পারে না।

# এখানে ‘উম্মী’ শব্দটি ইহুদীদের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ বা তিরষ্কার প্রচ্ছন্ন আছে। অর্থাৎ ইহুদীরা যাদেরকে অবজ্ঞা করে ‘উম্মী’ বলে থাকে এবং নিজেদের তুলনায় নগণ্য ও নীচু বলে মনে করে পরাক্রমশালী ও জ্ঞানময় আল্লাহ‌ তাদের মধ্যেই একজন রসূল সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজে রসূল হয়ে বসেননি, বরং তাঁকে পাঠিয়েছেন তিনিই যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ, মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। তাঁর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে এরা নিজেদেরই ক্ষতি করবে তাঁর কোনো ক্ষতি করতে এরা আদৌ সক্ষম নয়।

জেনে রাখা দরকার যে, কুরআন মজীদে, ‘উম্মী’ শব্দটি বেশ কটি স্থানে এসেছে। তবে সব জায়গায় শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও যাদের কাছে অনুসরণ করার জন্য কোন আসমানী কিতাব নেই আহলে কিতাবেরদের বিপরীতে তাদেরকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ

قُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ (ال عمران : 20)

আহলে কিতাব ও উম্মীদের জিজ্ঞেস করঃ তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ? ”-(সূরা আলে ইমরানঃ ২০) এখানে উম্মী বলতে আরবের মুশরিকদের বুঝানো হয়েছে এবং তাদেরকে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী ও খৃস্টানদের থেকে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কোথাও এ শব্দটি আহলে কিতাবদেরই নিরক্ষর ও আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অজ্ঞ ও অনবহিত লোকদের সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ

وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ (البقرة : 78) “এই ইহুদীদের কিছু লোক আছে ‘উম্মী’ কিতাবের কোন জ্ঞান তাদের নেই। তারা কেবল নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনাকেই চিনে। “-(সূরা বাকারাঃ ৭৮)

আবার কোথাও এ শব্দটি নিরেট ইহুদী পরিভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘উম্মী’ বলতে অ-ইহুদী সবাইকে বুঝানো হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছেঃ

ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ (ال عمران : 75)

“তাদের মধ্যে এ অসাধুতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো, তারা বলেঃ ‘উম্মীদের অর্থ-সম্পদ লুটেপুটে ও মেরে খাওয়ার কোন দোষ নেই। “-(সূরা আলে ইমরানঃ ৭৫ )

আলোচ্য আয়াতে এই তৃতীয় অর্থটিই গ্রহণ করা হয়েছে। এ শব্দটি ইব্রিয় ভাষায় “গোয়েম” শব্দের সমার্থক। ইংরেজী বাইবেলে এর অনুবাদ করা হয়েছে Gentiles এবং এর দ্বারা সমস্ত অ-ইহুদী বা-ইসরাঈলী লোককে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু শুধু এতটুকু ব্যাখ্যার, সাহায্য এ ইহুদী পরিভাষাটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝা সম্ভব নয়। ইবরানী বা ইব্রিয় ভাষায় ‘গোয়েম’ শব্দটি প্রথমত কেবল জাতি বা কওমসমূহ অর্থে বলা হতো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইহুদীরা এটিকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। প্রথমে তারা এটিকে নিজেদের ছাড়া অন্যসব কওমের জন্য নির্দিষ্ট করে। পরে এ শব্দটির অর্থে এ ভাবধারাও সৃষ্টি করে যে, ইহুদীরা ছাড়া অন্য সব জাতিই অসভ্য ও অভদ্র, ধর্মের দিক থেকে নিকৃষ্ট, অপবিত্র এবং নীচ ও হীন। শেষ পর্যন্ত অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা-বিদ্ধেষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ শব্দটি উদ্দেশ্যে অগ্রীকদের জন্য গ্রীকদের ব্যবহৃত পরিভাষা Barbarian শব্দটিকেও ছাড়িয়ে যায়। রিব্বীদের সাহিত্যে ‘গোয়েম’রা এমনই ঘৃণ্য মানুষ যে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে ভাই বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না এবং তাদের সাথে সফরও করা যেতে পারেনা। বরং তাদের কেউ যদি পানিতে ডুবে মারতে থাকে তাহলে তাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টাও করা যেতে পারে না। ইহুদীরা বিশ্বাস করতো, মাসীহ এসে সমস্ত গোয়েমকে ধ্বংস করে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবেন।-(আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরান টীকা ৬৪ )।
# কুরআন মজীদের চারটি স্থানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রত্যেক স্থানই বর্ণনা করার ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সূরা বাকারার ১২৯ আয়াতে এসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী উল্লেখিত হয়েছ আরববাসীদের একথা বলার জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হয়েছে আসাকে তারা যে নিজেদের জন্য দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত বলে মনে করছে, তা ঠিক নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে তা তাদের জন্য একটি বড় নিয়ামত। এটি লাভের জন্য হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করতেন। সূরা বাকারার ১৫১ আয়াতে এসব গুণাবলী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানরা যেন নবীর ﷺ মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে নবী বানানোর মাধ্যমে যে নিয়ামত তাদের দিয়েছেন তা থেকে পুরোপুরি উপকৃত হতে পারে। সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ আয়াতে আবার এসব গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের মানুষগুলোকে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা তাদের কাছে তাঁর রসূল পাঠিয়ে কত বড় ইহসান করেছেন। কিন্তু তারা এমনই অপদার্থ যে, তাঁকে কোনো মর্যাদাই দিচ্ছে না। চতুর্থবারের মত এ সূরাতে ঐসব গুণাবলী পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ইহুদীদের একথা জানিয়ে দেয়া যে, মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের চোখের সামনে যেসব কাজ করেছেন, তা স্পষ্টত একজন রসূলের কাজ। তিনি আল্লাহর আয়াত শুনাচ্ছেন। এসব আয়াতের ভাষা, বিষয়বস্তু, বর্ণনাভঙ্গি সবকিছুই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তা প্রকৃতই আল্লাহর আয়াত। তা মানুষের জীবনকে সুন্দর, পরিপাটি ও সুবিন্যস্ত করছে, তাদের নৈতিক চরিত্র, অভ্যাস ও রীতিনীতি এবং লেনদেন ও জীবনচারণকে সব রকমের কলূষ-কালিমা থেকে পবিত্র করছে এবং উন্নতমানের নৈতিক মর্যাদায় ভূষিত করছে। এটা ঠিক সেই কাজ যা ইতিপূর্বে সমস্ত নবী-রসূলও করেছেন। তাছাড়া তিনি শুধু আয়াতসমূহ শুনানোকেই যথেষ্ট মনে করেন না, বরং সবসময় নিজের কথা ও কাজ দ্বারা নিজের বাস্তব জীবনের উদাহরণ দ্বারা মানুষকে আল্লাহর কিতাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝাচ্ছেন। তিনি তাদের এমন যুক্তি, বুদ্ধি ও জ্ঞানের শিক্ষা দিচ্ছেন যা কেবল নবী-রসূলগণ ছাড়া আর কেউ-ই শিক্ষা দেয়নি। এ ধরনের চরিত্র ও কাজ নবী-রসূলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণ। এর সাহায্যেই তাদের চেনা যায়। সত্যিকার অর্থে নিজের কর্মকাণ্ড থেকে যার রসূল হওয়া প্রমাণিত হচ্ছে তাঁকে তোমরা কেবল এজন্য অস্বীকার করছো, যে তাঁকে তোমাদের কওমের মধ্য থেকে না পাঠিয়ে এমন এক কওমের মধ্য থেকে পাঠানো হয়েছে যাদেরকে তোমরা ‘উম্মী’ বলে অবজ্ঞা করে থাকেন।
# এটা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের আরো একটি প্রাণ। ইহুদীদের সত্যোপলদ্ধির জন্য এ প্রমাণটি পেশ করা হয়েছে। তারা শত শত বছর পূর্বে থেকে আরব ভূমিতে বসবাস করে আসছিল। আরবের অজানা ছিল না। তাদের পূর্বতন এ অবস্থার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলা হচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে এ জাতির চেহারা যেভাবে আমূল পরিবর্তিত হয়েছে তা তোমরা নিজ চোখে দেখেছ। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এমন লোক যে অবস্থার মধ্যে ডুবে ছিল তা তোমাদের জানা আছে। ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদের অবস্থা কি হয়েছে তাও তোমরা নিজ চোখে দেখছ। আর এ জাতির যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের অবস্থাও কি তোমরা দেখতে পাচ্ছ। একজন অন্ধও এই স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে ও বুঝতে পারে। এটা কি তোমাদেরকে একথা বিশ্বাস করানোর জন্য যথেষ্ট নয় যে, একজন নবী ছাড়া এটা আর কারো কীর্তি হতে পারে না? বরং এর তুলনায় পূর্ববর্তী নবী-রসূলদের কীর্তিও ম্লান হয়ে গিয়েছে।

# মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত শুধু আরব জাতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। তা সারা দুনিয়ার সেইসব জাতি ও বংশ-গোষ্ঠীর জন্য যারা এখনো ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়নি, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। মূল আয়াতাংশ হলোঃ وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ তাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক যারা এখনো তাদের সাথে শামিল হয়নি। এ আয়াতের مِنْهُمْ (তাদের মধ্য থেকে) শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেই অন্যান্য লোকগুলো উম্মীদের মধ্যে থেকে অর্থাৎ তারা হবে দুনিয়ার সেইসব জাতি ও বংশ-গোষ্ঠীর জন্য যারা এখনো ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়নি, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। মূল আয়াতাংশ হলোঃ () তাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক যারা এখনো তাদের সাথে শামিল হয়নি। এ আয়াতের———(তাদের মধ্য থেকে, ) শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেই অন্যান্য লোকগুলো উম্মীদের মধ্যে থেকে, অর্থাৎ তারা হবে দুনিয়ার অ-ইসরাঈলী জাতি-গোষ্ঠীর লোক। দুই, তারা হবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণকারী। তবে এখনো ঈমানদারদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু পরে এসে শামিল হবে। এভাবে এ আয়াতটিও সেই সব আয়াতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত সমগ্র মানব জাতির জন্য এবং চিরদিনের জন্য। কুরআন মজীদের আর যেসব স্থানে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সূরা আল আনআম আয়াত ১৯ , আল আরাফ ১৫৮ , আল আম্বিয়া ১০৭ , আল ফুরকান ১ , সাবা ২৮ ; (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবা টীকা ৪৭ )।

# এটি তাঁর শক্তি-সমর্থ ও জ্ঞানের বিস্ময়কর দিক যে, তিনি এ ধরনের এক অশিষ্ট উম্মী কওমের মধ্য থেকে এমন মহান নবী সৃষ্টি করেছেন যার শিক্ষা ও হিদায়াত এতটা বিপ্লবাত্মাক ও এমন বিশ্বজনীন স্থায়ী নীতিমালার ধারক, যার ওপর ভিত্তি করে গোটা মানব জাতি একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হতে পারে এবং এ নীতিমালা থেকে চিরদিন দিকনির্দেশনা লাভ করতে পারে। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে কোনো মানুষই এই স্থান ও মর্যাদা লাভ করতে পারতো না। আরবদের মত পশ্চাদপদ জাতি তো দূরের কথা, দুনিয়ার কোন বড় জাতির সর্বাধিক মেধা-সম্পন্ন ব্যক্তিও এভাবে কোন জাতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে দিতে এবং গোটা মানব জাতিকে চিরদিনের জন্য একটি আদর্শ এবং একটি সংস্কৃতির বিশ্বজনীন ও সর্বাত্মক আদর্শ পরিচালনার যোগ্য হওয়ার মত একটা ব্যাপক নীতিমালা গোটা বিশ্বকে উপহার দিতে পারতো না। এটি আল্লাহর কুদরাতে সংঘটিত একটি মু’জিযা। আল্লাহ‌ তাঁর কৌশল অনুসারে যে ব্যক্তি, যে দেশ এবং যে জাতিকে চেয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে বাছাই করে নিয়েছেন। এতে কোন নির্বোধ যদি মনে কষ্ট পায় তাহলে পেতে থাকুক।

# এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ। একটি সাধারণ অর্থ এবং অপরটি বিশেষ অর্থ। সাধারণ অর্থ হলো, যাদের ওপর তাওরাতের জ্ঞান অর্জন, তদনুযায়ী আমল এবং তাওরাত অনুসারে দুনিয়াকে পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা তাদের এ দায়িত্ব বুঝেনি এবং তার হকও আদায় করেনি। বিশেষ অর্থ হলো, তাওরাতের ধারক ও বাহক গোষ্ঠী হওয়ার কারণে যাদের কাজ ছিল সবার আগে অগ্রসর হয়ে সেই রসূলকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যার আগমনের সুসংবাদ তাওরাতের স্পষ্ট ভাষায় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারাই তাঁর সবচেয়ে বেশী শত্রুতা ও বিরোধিতা করেছে এবং তাওরাতের শিক্ষার দাবী পূরণ করেনি।

# গাধার পিঠে বই-পুস্তকের বোঝা চাপানো থাকলেও পিঠের ওপর কি আছে সে যেমন তা জানে না। অনুরূপ এই তাওরাতের বোঝাও তাদের ওপর চাপানো আছে। কিন্তু তারা আদৌ জানে না, এই মহান গ্রন্থ কি জন্য এসেছে এবং তাদের কাছে কি দাবী করছে।

# তাদের অবস্থা গাধার চেয়েও নিকৃষ্টত। গাধার কোন বিবেক-বুদ্ধি ও উপলব্ধি নেই বলে সে অক্ষম, কিন্তু এদের তো বিবেক-বুদ্ধি ও উপলব্ধি আছে। এরা নিজেরা তাওরাত পড়ে এবং অন্যদের পড়ায় তাই এর অর্থ তাদের অজানা নয়। এরপরও তারা জেনে শুনে এর হিদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ও উপেক্ষা করছে এবং সেই নবীকে মানতে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করছে যিনি তাওরাত অনুসারে অবিসংবাদিতভাবে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এরা জানে না বা বুঝে না বলে দোষী নয়, বরং জেনে শুনে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী।

# এ বিষয়টি লক্ষণীয় যে, এখানে, “হে ইহুদীরা” বলা হয়নি। বলা হয়েছে “হে ইহুদী হয়ে যাওয়ার লোকগণ” অথবা “যারা ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছো।” এর কারণ হলো, মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর আগের ও পরের নবী-রাসূগগণ আসল যে দ্বীন এনেছিলেন, তা ছিল ইসলাম। এসব-রসূলদের কেউই ইহুদী ছিলেন না এবং তাদের সময়ে ইহুদীদের সৃষ্টিও হয়েছিল না। এই নামে এ ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে বহু পরে। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের চতুর্থ পুত্র ইয়াহুদার বংশোদ্ভুত গোত্রটির নামানুসারে এ ধর্মের নামকরণ হয়েছে। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের পরে তার সাম্রাজ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে এই গোত্রটি ইয়াহুদীয়া নামক রাষ্ট্রটির মালিক হয় এবং বনী ইসরাঈলদের অন্যান্য গোত্রগুলো নিজেদের একটি আলাদা রাষ্ট্র কায়েম, করে যা সামেরিয়া নামে খ্যাত হয়। পরবর্তীকালে আসিরীয়রা সামেরিয়াকে শুধু ধ্বংসই করেনি, বরং এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা ইসরাঈলী গোত্রগুলোর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছে। এরপরে শুধু ইয়াহুদা এবং তার সাথে বিন ইয়ামীনের বংশ অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু তার ওপর ইয়াহুদা বংশের প্রভাব ও আধিপত্যের কারণে তাদের জন্য ইয়াহুদ শব্দটির প্রয়োগ হতে থাকে। ইহুদী ধর্মযাজক, রিব্বী এবং আহবাররা নিজেদের ধ্যান-ধারণা, মতবাদ ও ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী এই বংশের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানের যে কাঠামো শত শথ বছর ধরে নির্মাণ করেছে তার নাম ইহুদীবাদ। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই কাঠামো নির্মাণ শুরু হয় এবং খৃস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত চলতে থাকে। আল্লাহর রসূলদের আনীত আল্লাহর হিদায়াতের উপাদান খুব সামান্যই এতে আছে এবং যা আছে তার চেহারাও অনেকখানি বিকৃত হয়েছে। এ কারণে কুরআন মজীদের অধিকাংশ স্থানে তাদেরকে الَّذِينَ هَادُوا বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ সেই সব লোক যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছে বা ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যকার সবাই আবার ইসরাঈলী ছিল না। যেসব অইসরাঈলী ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছিল তারাও এর মধ্যে ছিল। কুরআন মজীদে যেখানে বনী ইসরাঈল জাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে সেখানে “হে বনী ইসরাঈল” বলা হয়েছে। আর যেখানে ইহুদী ধর্মের অনুসারীদের সম্বোধন করা হয়েছে সেখানে الَّذِينَ هَادُوا বলা হয়েছে।

# কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের এই দাবী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমনঃ তারা বলেন, ইহুদীরা ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না। (আল বাকারাহ, ১১১)। দোযখের আগুন আমাদের কখনো স্পর্শ করতে না। আর আমাদেরকে যদি নিতান্তই শাস্তি দেয়া হয় তাহলে মাত্র কয়েক দিনের জন্য দেয়া হবে (আল বাকারাহ, ৮০; আলে ইমরান, ২৪)। আমরা আল্লাহর বেটা এবং তাঁর প্রিয়পাত্র (আল মায়েদা, ১৮)। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থসমূহেও এ ধরনের কিছু দাবী-দাওয়া দেখা যায়। সারা বিশ্বে অন্তত এতটুকু কথা জানে যে, তারা নিজেদেরকে আল্লাহর বাছাই করা সৃষ্টি বলে থাকে। তারা এরূপ এক খোশ খেয়ালে মত্ত যে, তাদের সাথে খোদার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে যা অন্য কোন মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে নেই।
# এখানে কুরআন মজীদে একথাটি দ্বিতীয়বারের মত ইহুদীদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে। প্রথম সূরা বাকারায় বলা হয়েছিল, এদের বলো, আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষকে বাদ দিয়ে আখেরাতকের ঘর যদি কেবল তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট থেকে থাকে আর এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে মৃত্যু কামনা করো। কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু করবে না। আল্লাহ‌ জালেমদের খুব ভাল করেই জানেন। বরং তোমরা দেখবে তারা কোন না কোন কোনভাবে বেঁচে থাকতে সমস্ত মানুষের চেয়ে এমনকি মুশরিকদের চেয়েও বেশী লালায়িত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আকাঙ্ক্ষা করে হাজার বছর বেঁচে থাকার। অথচ দীর্ঘ আয়ূ লাভ করলেও তা তাদেরকে এই আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। তাদের সমস্ত কৃতকর্মেই আল্লাহর দৃষ্টিতে আছে (আয়াত ৯৪-৯৬)। এ কথাটিই এখানে পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটা শুধু পুনরুক্তিই নয়। সূরা বাকারার আয়াতগুলোতে একথা বলা হয়েছে। তখন, যখন ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের কোন যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু এই সূরায় তার পুনরুক্তি করা হয়েছে এমন এক সময় যখন তাদের সাথে ইতিপূর্বে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর আরবভুমিতে চূড়ান্তভাবে তাদের শক্তি চূর্ণ করা হয়েছে। পূর্বে সূরা বাকারায় যে কথা বলা হয়েছিল এসব যুদ্ধ এবং তাদের পরিণাম অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষন দুই ভাবেই তা প্রমাণ করে দিয়েছিল। মদীনা এবং খায়বারে সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদী শক্তি কোনভাবেই মুসলমানদের তুলনায় কম ছিল না এবং উপায়-উপকরণ ও তাদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাছাড়া আরবের মুশরিকদের ধ্বংস করার জন্য তারা মুনাফিকরাও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করছিল। কারণ মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু এই অসম মোকাবিলায় যে জিনিসটি মুসলমানদের বিজয়ী এবং ইহুদীদের পরাজিত করেছিল তা ছিল এই যে, মুসলমানগণ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করতে ভীত হওয়া তো দূরের কথা বরং হৃদয়ের গভীর থেকে মৃত্যু কামনা করতো এবং মরণপণ করে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কারণ, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তারা আল্লাহর পথে লড়াই করছে। আর এ বিষয়ে ও পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, এ পথে শাহাদাত বরণকারীর জন্য রয়েছে জান্নাত। অপরদিকে ইহুদীদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা কোন পথেই জান দিতে প্রস্তুত ছিল না; না খোদার পথে, না নিজের কওমের পথে এবং না নিজের জান, মাল ও ইজ্জত রক্ষার পথে। যে ধরনের জীবনই হোক না কেন তাদের প্রয়োজন ছিল কেবল বেঁচে থাকার। এ জিনিসটিই তাদেরকে ভীরু ও কাপুরুষ বানিয়ে দিয়েছিল।
# অন্য কথায় মৃত্যু থেকে তাদের এই পালানো বিনা কারণে নয়। মুখে তারা যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, আল্লাহর দ্বীনের সাথে তারা যে আচরণ করেছে এবং পৃথিবীতে তারা যা করেছে আখেরাতে সেই সব আচরণ ও কাজকর্মের কিরূপ ফলাফল আশা করা যায় তাদের জ্ঞান ও বিবেক তা ভাল করেই জানতো। এ কারণে তাদের প্রবৃত্তি আল্লাহর আদালতের মুখোমুখি হতে টালবাহানা করে।
# এ আয়াতে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত। প্রথমটি হলো, এতে নামাযের জন্য ঘোষণা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, এমন একটি নামাযের জন্য ঘোষণা দেয়ার কথা আছে যা বিশেষভাবে শুধু জুমআর দিনেই পড়তে হবে। তৃতীয়টি হলো এই দু’টি জিনিসের কথা এভাবে বলা হয়নি যে, তোমরা নামাযের জন্য ঘোষণা করো এবং জুমআর দিনে একটি বিশেষ নামায পড়। বরং বর্ণনাভঙ্গী ও পূর্বাপর বর্ণনা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, নামাযের ঘোষণা এবং জুমআর দিনের বিশেষ নামায উভয়টিই আগে থেকেই চালু ছিল। তবে মানুষ ভুল করতো এই যে, জুমআর নামাযের ঘোষণা শুনেও তারা নামাযের জন্য দ্রুত অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে গাফলতি করতো এবং কেনাবেচার কাজেই ব্যস্ত থাকতো। তাই আল্লাহ‌ তা’আলা এ আয়াতটি শুধু এ উদ্দেশ্যে নাযিল করেছেন যে, মানুষ এই ঘোষণা এবং এই বিশেষ নামাযের গুরুত্ব উপলব্ধি করুক এবং ফরয মনে করে এবং উদ্দেশ্যে দ্রুত অগ্রসর হোক। এ তিনটি বিষয়ে যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে তা থেকে এই মৌলিক, বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ‌ তা’আলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন কিছু নির্দেশও দিতেন যা কুরআনের মধ্যে নেই। কিন্তু সেই সব নির্দেশ ও কুরআনের নির্দেশাবলীর মত অবশ্য পালনীয় ছিল। বর্তমানে গোটা পৃথিবীর প্রতিটি মসজিদে প্রতিদিন পাঁচবার যে আযান দেয়া হয় সেই আযানই নামাযের জন্য ঘোষণা। কিন্তু কুরআন মজীদের কোন স্থানে না এ আযানের ভাষা উল্লেখ করা হয়েছে, না মানুষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, নামাযের জন্য এভাবে আহবান জানাও। এটি রসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক নির্ধারিত জিনিস। কুরআন মজীদে শুধু দু’টি স্থানে একে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা হয়েছে। প্রথমত এই আয়াতে। দ্বিতীয়ত সূরা মায়েদার ৫৮ আয়াতে। অনুরূপ সারা দুনিয়ার মুসলমান আজ যে জুম’আর নামায পড়ে থাকে কুরআন মজীদে তারও কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি এবং পড়ার সময় ও নিয়ম-পদ্ধতিও বলে দেয়া হয়নি। এ নামায পড়ার নিয়ম-পদ্ধতিও রসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক চালু করা। কুরআনে এ আয়াতটি শুধু এর গুরুত্ব এবং অলংঘনীয়ভাবে পালন করার বিষয়টি বুঝানোর জন্যই নাযিল হয়েছে। স্পষ্ট এই দলীল থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বলে যে, শুধু কুরআনে বর্ণিত হুকুম-আহকামেই শরয়ী হুকুম-আহকাম-সে প্রকৃতপক্ষে শুধু সুন্নাতকেই অস্বীকার করে না, কুরআনকেও অস্বীকার করে।

এ বিষয়ে আরো বক্তব্য পেশ করার পূর্বে জুম’আ সম্পর্কে আরো কয়েকটি বিষয়ও জেনে নেয়া দরকার।

জুম’আ কথাটি প্রকৃতপক্ষে একটি ইসলামী পরিভাষা। জাহেলী যুগে আরবের অধিবাসীরা একে ‘ইয়াওমে আরূবা’ বলত। ইসলামী যুগে এ দিনটিকে মুসলমানদের সমাবেশের দিন হিসেবে নির্ধারিত করে এর নাম দেয়া হয় জুম’আ। ঐতিহাসিকগণ যদিও বলেন যে, কা’ব ইবনে লুয়াই কিংবা কুসাই ইবনে কিলাবও এদিনটির জন্য এ নাম ব্যবহার করেছিল। কারণ এ দিনেই তারা কুরাইশদের লোকজনের সমাবেশ করতেন (ফতহুল বারী)। কিন্তু তার এই কাজ দ্বারা প্রাচীন এই নামের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং সাধারণ আরবাসী এ দিনটিকে ‘আরূবা’ই বলত। সত্যিকার অর্থে নামের পরিবর্তন হয় তখন যখন ইসলামী যুগে এর নতুন রাখা হয়। ইসলাম-পূর্ব যুগে সপ্তাহে একটি দিনকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা এবং তাকে জাতির প্রতীক হিসেবে নির্ধারিত করার রীতি আহলে কিতাবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ইহুদীরা ঐ উদ্দেশ্যে ‘সাবতের(শনিবার) দিনটিকে নির্ধারিত করেছিল। কারণ আল্লাহ‌ তা’আলা এ দিনেই বনী ইসরাঈল জাতিকে ফেরাউনের গোলামী থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। খৃস্টানরা নিজেদেরকে ইহুদীদের থেকে আলাদা করে দেখানোর জন্য রবিবার দিনকে তাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে নির্ধারিত করে। যদিও এ সম্পর্কিত কোন নির্দেশ না হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম দিয়েছিলেন না ইনজীল তথা বাইবেলে এর কোন উল্লেখ আছে। তবে খৃস্টানদের বিশ্বাস হলো ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ উৎসর্গ করার পর এ দিনেই হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কবর থেকে বেরিয়ে আসমানের দিকে গিয়ে ছিলেন। এ কারণেই পরবর্তীকালে খৃস্টানরা এ দিনটিকে তাদের উপাসনার দিন হিসেবে গ্রহণ করে। তারপর ৩২১ খৃস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্য একটি নির্দেশের দ্বারা এ দিনটিকে সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। এ দু’টি জাতি থেকে নিজ জাতিকে আলাদা করার জন্য ইসলাম এ দু’টি দিন বাদ দিয়ে জুম’আর দিনকে সামষ্টিক ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করেছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও হযরত আবু মাসউদ আনসারীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, হিজরাতের কিছুকাল পূর্বে পবিত্র মক্কাতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর জুম’আর ফরয হওয়ার বিধান নাযিল হয়। কিন্তু সে সময় তিনি এ নির্দেশের ওপর আমল করতে পারতেন না। কারণ মক্কায় সামষ্টিক কোন ইবাদাত করা সম্ভব ছিল না। তাই যেসব লোক নবীর ﷺ আগে মদীনায় হিজরত করেছিলেন তিনি তাদের নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন যে, তারা যেন সেখানে জুম’আ কায়েম করে। অতএব প্রথম দিকে হিজরাতকারীদের নেতা হযরত মুস’আব ইবনে উমায়ের ১২ জন লোক নিয়ে মদীনায় সর্বপ্রথম জুম’আর নামায আদায় করেন। (তাবারানী, দারু কুতনী)। হযরত কা’ব ইবনে মালেক এবং ইবনে সিরীনের বর্ণনা মতে এরও পূর্বে আনসারগণ আপনা থেকেই (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পৌঁছার পূর্বে) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তারা সবাই মিলে সপ্তাহে একদিন সামষ্টিকভাবে ইবাদাত করবেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা ইহুদীদের সাবত এবং খৃস্টানদের রবিবার বাদ দিয়ে জুম’আর দিনকে মনোনীত করেছিলেন এবং বনী বায়দা এলাকায় হযরত আসআদ ইবনে যুরারা প্রথম জুম’আ পড়েছিলেন। এতে ৪০ ব্যক্তি শরীক হয়েছিল (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, ইবনে হিব্বান, আবদ ইবনে হুমায়েদ, আবদুর রাযযাক, বায়হাকী)। এ থেকে জানা যায় ইসলামী জনতার আবেগ অনুভূতি তখন এমন একটি দিন থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিল যেদিন অধিক সংখ্যক মুসলমান একত্র হয়ে সামষ্টিকভাবে ইবাদাত করবে। তা শনিবার ও রবিবার থেকে আলাদা কোন দিন হওয়াটিও ইসলামী রুচি ও মেজাজ-প্রকৃতিরই দাবী ছিল। যাতে মুসলমানদের জাতীয় প্রতীক ইহুদী ও খৃস্টানদের জাতীয় প্রতীক থেকে আলাদা থাকে। এটা সাহাবা কিরামের ইসলামী মানসিকতার একটি বিস্ময়কর কীর্তি। অনেক সময় নির্দেশ আসার পূর্বে তাদের এই রুচি ও মেজাজ-প্রকৃতিই বলে দিতো যে, ইসলামের মেজাজ ও প্রকৃতি অমুক জিনিসের দাবী করছে। হিজরত করার পর রসূলুল্লাহ ﷺ সর্বপ্রথম যে কাজগুলো করেন জুম’আর নামায কায়েম করা তার অন্যতম। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে সোমবার দিন তিনি কুবায় উপনীত হন, চারদিন সেখানে অবস্থান করেন এবং পঞ্চম দিন জুম’আর দিনে সেখানে থেকে মদীনার দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে বনী সালেম ইবনে আওফের এলাকায় জুম’আর নামাযের সময় হয়। সেখানেই তিনি প্রথম জুম’আর নামায পড়েন। (ইবনে হিশাম)।

এ নামাযের জন্য রসূলুল্লাহ ﷺ সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার পরের সময় নির্দিষ্ট করেছিলেন অর্থাৎ ঠিক যোহরের নামাযের সময়। হিজরাতের পূর্বে হযরত মুসআব ইবনে উমায়েরকে তিনি যে লিখিত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তাতে বলেছিলেনঃ

فَاِذَا مَالَ النَّهَارَ عَنْ شَطْرِهِ ،عِنْدَ الزَّوَالِ مِنْ يَوْمِ الْجُمْعَةِ ، فَتَقَرَّبُوْا إِلَى اللهِ تَعَالَى بِرَكْعَتَيْنِ (دار قطنى) “জুম’আর দিন সূর্য যখন মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়বে তখন দুই রাকআত নামাযের সাহায্যে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কর। “(দারু কুতনী)।

হিজরাতের পরে তিনি মৌখিকভাবেও এ নির্দেশ দিয়েছেন এবং কার্যতও ঐ সময়ে জুম’আর নামায পড়াতেন। হযরত আনাস (রা.) হযরত সালামা ইবনে আকওয়া (রা.), হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.), হযরত সাহল (রা.) ইবনে সা’দ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, (রা.), হযরত আম্মার (রা.) ইবনে ইয়াসির এবং হযরত বেলাল (রা.), থেকে হাদীস গ্রন্থসমূহে এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। ঐ সব বর্ণনায় আছে সূর্য মাথার ওপর থেকে হেলে পড়ার পর নবী (সা.) জুম’আর নামায পড়তেন। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ-কর্ম থেকে এ বিষয়টিও প্রমাণিত যে, জুম’আর দিন তিনি যোহরের নামাযের পরিবর্তে জুম’আর নামায পড়াতেন। এ নামায ছিল মাত্র দু’রাকআত। নামাযের আগে তিনি খুতবা দিতেন। এটা ছিল জুম’আর নামায এবং অন্যান্য দিনের যোহরের নামাযের মধ্যে পার্থক্যসূচক। হযরত উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেনঃ

صَلَاة الْمُسَافِر رَكْعَتَانِ, وصَلَاةِ الْفَجْرِ رَكْعَتَانِ, وَصَلَاةِ الْجُمُعَةِ رَكْعَتَانِ تَمَامٌ غَيْرُ قَصْرٍ عَلَى لِسَانِ النَّبِىِّكم صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَإِنَّمَا قُصِرَتْ الْجُمُعَةُ لاَجْلِ الْخُطْبَةِ(احكام القران للجصاص)

“তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ নিসৃতবাণী অনুসারে মুসাফিরের নামায দুই রাকআত, ফজরের নামায দু রাকআত এবং জুমআর নামায দুই রাকআত। এটা কসর নয়, বরং পূর্ণ নামায। আর খোতবা থাকার কারণে জুম’আর নামায সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। “

এখানে যে আযানের উল্লেখ করা হয়েছে তা খোতবার বেশ আগে যে আযানের মাধ্যমে মানুষকে জুম’আর নামাযের সময় আরম্ভ হওয়ার বিষয়টি অবগত করা হয় সে আযান নয়, বরং খোতবার ঠিক আগে যে আযান দেয়া হয় সেই আযান। হযরত সায়েব (রা.) ইবনে ইয়াযীদ কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে শুধু একটি আযান দেয়া হতো। আর তা দেয়া হতো ইমাম মিম্বরে উঠে বসার পর। হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমরের (রা.) যুগেও এ কাজটিই করা হয়েছে। অতঃপর হযরত উসমানের (রা.) সময়ে জনবসতি বৃদ্ধি পেলে তিনি আরো একটি আযান দেয়ানো শুরু করেন। মদীনার বাজারে অবস্থিত তাঁর যাওরা নামক বাড়ীতে এ আযান দেয়া হতো। (বুখারী, আবু দাউদ, নাসায়ী, তাবারানী)।
# এই নির্দেশের মধ্যে উল্লেখিত (যিকর) শব্দের অর্থ হচ্ছে খোতবা। কারণ, আযানের পরে নবী ﷺ প্রথম যে কাজটি করতেন তা ছিল খোতবা। তিনি সবসময় খোতবার পরে নামায পড়াতেন। হযরত আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “জুম’আর ফেরেশতাগণ নামাযের জন্য আগমণকারী ব্যক্তির নাম তাদের আগমনের পরম্পরা অনুসারে লিখতে থাকেন। অতঃপরاذا خرج الامام حضرت الملئكة يسمعون الذكر ইমাম যখন খোতবার জন্য দাঁড়ান তখন তাঁর নাম লেখা বন্ধ করে দেন এবং যিকর (অর্থাৎ খোতবা) শুনতে মনোনিবেশ করেন” (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী।)। এ হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয় যে, যিকর অর্থ খোতবা। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী থেকেও এ অর্থের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কুরআনে প্রথমে বলা হয়েছেঃ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ “আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও। “পরে বলা হয়েছেঃ فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ “তারপর নামায শেষ হয়ে গেলে ভু-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো।” এ থেকে জুম’আর দিনের কাজের যে পরম্পরা বুঝা যায় তা হচ্ছে প্রথম আল্লাহর যিকির এবং তারপর নামায। মুফাসসিরগণও এ বিষয়ে একমত যে, যিকির অর্থ হয় খোতবা, নয়তো খোতবা ও নামায উভয়টাই। খোতবার জন্য ذكر الله (যিকরুল্লাহ-আল্লাহর যিকির) শব্দ ব্যবহার করায় আপনা থেকেই এ অর্থ প্রকাশ পায় যে, খোতবার মধ্যে এমন সব বিষয় থাকতে হবে যা আল্লাহর স্মরণের সাথে সম্পর্কিত। যেমনঃ আল্লাহর তারিফ ও প্রশংসা ও তাঁর রসূলের প্রতি দরুদ ও সালাত, তাঁর হুকুম আহকাম তাঁর শরীয়াত অনুসারে আমলের শিক্ষা ও উপদেশ এবং তাঁকে ভয় করেন এমন সব নেক বান্দাদের প্রশংসা ইত্যাদি। এ কারণে যামাখশারী কাশশফে লিখেছেন যে, খোতবার জালেম শাসকদের তারিফ ও প্রশংসা করা কিংবা তাদের নাম উল্লেখ করা এবং তাদের জন্য দোয়া করার “যিকরুল্লাহ”র সাথে দূরতম সম্পর্কেও নেই। বরং তা “যিকরুশ শাইতান”-শয়তানের যিকির হিসেবে পরিগণিত।

“আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও, অর্থাৎ দৌড়িয়ে আসা নয়। বরং এর অর্থ হলো, তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছার চেষ্টা করো। আমাদের ভাষায়ও আমরা এ ধরনের অনেক কথা বলে থাকি। এসব কথার অর্থ হয়ে থাকে তৎপরতা দেখানো। দৌড়ানো অর্থে তা ব্যবহার করা হয় না। অনুরূপ আরবীতেও سعى শব্দ দ্বারা শুধু দৌড়ানোই বুঝায় না। কুরআনের অধিকাংশ স্থানে سعى শব্দটি প্রচেষ্টা চালানো এবং চেষ্টা-সাধনা করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ

لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى- وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا – فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ – وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا

মুফাসসিরগণও সর্বসম্মতভাবে এ শব্দটিকে গুরুত্ব আরোপ করা অর্থে গ্রহণ করেছেন তাঁদের মতে سعى অর্থ হলো, আযান শোনার পর মানুষ অবিলম্বে মসজিদে পৌঁছার চিন্তা করতে থাকবে। ব্যাপারটা শুধু এতটুকু নয়, বরং নামাযের জন্য দৌড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ নামায শুরু হলে ধীরে সুস্থে ও স্থিরচিত্তে গাম্ভীর্যের সাথে নামাযে শরীক হওয়ার জন্য অগ্রসর হও, দৌড়িয়ে শরীক হয়ো না। এভাবে অগ্রসর হয়ে যতটা নামায পাবে তাতে শরীক হবে এবং যতটা ছুটে যাবে তা পরে পূরণ করে নেবে। (সিহাহ সিত্তাহ) হযরত আবু কাদাতা আনসারী (রা.) বলেনঃ একবার আমরা নবীর ﷺ সাথে নামায পড়ছিলাম। হঠাৎ আমরা লোকজনের দৌড়দৌড়ি করে চলার শব্দ শুনতে পেলাম। নামায শেষ করে নবী (সা.) ঐ লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম? তারা বললঃ নামাযে শরীক হওয়ার জন্য আমরা দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে আসছিলাম। তিনি বললেন, এরূপ করবে না। যখনই নামাযে আসবে শান্তভাবে ও স্থিরচিত্তে আসবে। এভাবে ইমামের সাথে যতটা নামায পাওয়া যাবে পড়বে। আর যে অংশ ছুটে যাবে তা পরে পড়ে নেনে। (বুখারী, মুসলিম)। ‘কেনা-বেচা পরিত্যাগ করো’ কথাটার অর্থ শুধু কেনা-বেচাই পরিত্যাগ করা নয়, বরং নামাযের জন্য যাওয়ার চিন্তাও ব্যবস্থা ছাড়া অন্য আর সব ব্যস্ততা পরিত্যাগ করা। বিশেষভাবে বেচা-কেনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে শুধু এজন্য যে, জুম’আর দিন ব্যবসায় বাণিজ্য খুব জমে উঠতো। এই দিন আশেপাশের জনপদের লোকজন একস্থানে সমবেত হতো। ব্যবসায়ীরা তাদের পন্যদ্রব্য নিয়ে সেখানে পৌঁছত। লোকজনও তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কেবল কেনা-বেচা পর্যন্তই সীমিত নয়, অন্যান্য সব ব্যস্ততাও এর অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু আল্লাহ‌ তা’আলা পরিষ্কাভাবে ঐ সব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তাই ফিকহবিদগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, জুম’আর আযানের পর কেনা-বেচা এবং অন্য সবরকমের কাজ কারবার হারাম।

এ নির্দেশটি থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, জুম’আর নামায ফরয। প্রথমত আযান শোনামাত্র জুম’আর নামাযের জন্য যাওয়ার তাগাদাই তার প্রমাণ। তাছাড়া জুম’আর নামাযের জন্য কেনা-বেচার মত একটা হালাল কাজ হারাম হয়ে যাওয়াও এর ফরয হওয়া প্রমাণ করে। উপরন্তু জুম’আর দিন যোহরের ফরয নামায রহিত হয়ে যাওয়া এবং তার পরিবর্তে জুম’আর নামায প্রতিষ্ঠিত হওয়াও এর ফরয হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ। কারণ, কোন ফরয কেবল তখনই রহিত হয় যখন তার চেয়ে ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন ফরয তার স্থান পূরণ করে। বহু সংখ্যক হাদীসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। এসব হাদিসে রসূলুল্লাহ ﷺ জুম’আর নামাযের জন্য কঠোরভাবে তাকীদ করেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় তাকে ফরয বলে ঘোষণা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ আমার মন চায়, অন্য কাউকে আমার পরিবর্তে নামায পড়াতে দাঁড় করিয়ে দেই এবং নিজে গিয়ে সেসব লোকদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেই যারা জুম’আর নামায পড়তে আসে না। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী)। হযরত আবু হুরাইরা (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমরা জুম’আর খোতবায় নবীকে ﷺ একথা বলতে শুনেছিঃ মানুষের জুম’আর নামায পরিত্যাগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অন্যথায় আল্লাহ‌ তাদের মনের ওপর মোহর মেরে দেবেন এবং তারা গাফিল হয়ে যাবে। (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম, নাসায়ী)। হযরত আবুল জা’দ (রা.) দামরী, হযরত জাবের (রা.) ইবনে আবদুল্লাহ ও হযরত আবদুল্লাহ (রা.) ইবনে আবী আওফার বর্ণিত হাদীসসমূহে নবীর ﷺ যেসব বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, “যে ব্যক্তি প্রকৃত কোন কারণ ও সঙ্গত ওযর ছাড়া শুধু বে-পরোয়া মানসিকতার কারণে পরপর তিনটি জুম’আ পরিত্যাগ করে আল্লাহ‌ তার দিলের ওপর মোহর মেরে দেন। বরং একটি হাদীসে তো এতদূর বলা হয়েছে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা তার দিলকে মুনাফিকের দিল বানিয়ে দেন” (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজা, দারেমী, হাকেম, ইবনে হিব্বান, বাযযার, তাররানী ফিল কাবীর)। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেনঃ “আজ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের ওপর জুম’আর নামায ফরয। যে ব্যক্তি তাকে মামুলি ব্যাপার মনে করে এবং তার গুরুত্ব স্বীকার না করে পরিত্যাগ করবে আল্লাহ‌ যেন তার অবস্থা ভাল না করেন এবং তাকে কোন প্রকার বরকতও না দেন। কান পেতে শুণে নাও যতক্ষণ সে তাওবা না করবে তার নামায নামায নয়, তার যাকাত যাকাত নয়, তার হজ্জ হজ্জ নয়, তার রোযা রোযা নয়, তার কোন নেক কাজ নেক কাজ নয়। অতঃপর যে তাওবা করবে আল্লাহ‌ তাকে ক্ষমাকারী। “(ইবনে মাজা, বাযযার) প্রায় একই অর্থের একটি হাদীস তাবারানীতার ‘আওসাত’গ্রন্থে উমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও বহু সংখ্যক হাদীসে নবী (সা.) স্পষ্ট ভাষায় জুম’আর নামাযকে ফরয এবং অবশ্য পালনীয় হক বলে উল্লেখ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ইবনে আস বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যারা আযান শুনতে পায় জুম’আর নামায তাদের ওপরই ফরয (আবু দাউদ, দারুকুতনী)। জাবের (রা.) ইবনে আবদুল্লাহ ও আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেনঃ “জেনে রেখো, আল্লাহ‌ তোমাদের উপর জুম’আর নামায ফরয করেছেন” (বায়হাকী)। তবে তিনি নারী, শিশু, ক্রীতদাস, অসুস্থ ব্যক্তি এবং মুসাফিরকে এ ফরয পালনের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়েছেন। হযরত হাফসা বর্ণনা করেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ “জুম’আর নামাযের জন্য বের হওয়া প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব। “(নাসায়ী)। হযরত তারেক ইবনে শিহাব বর্ণিত হাদীসে নবী (সা.) বলেছেনঃ ক্রীতদাস, নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া জামায়াতের সাথে জুম’আ পড়া প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব, (আবু দাউদ ও হাকেম।)। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত হাদীসে নবীর ﷺ ভাষ্য হলোঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ‌ ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান পোষণ করে তার ওপরে জুম’আ ফরয। তবে নারী, মুসাফির, ক্রীতদাস, বা অসুস্থ ব্যক্তির ওপরে জুম’আ ফরয নয়। (দারু কুতনী, বায়হাকী)। কুরআন ও হাদীসের এই স্পষ্ট বক্তব্যের ভিত্তিতে জুম’আর নামায ফরয হওয়া সম্পর্কে গোটা মুসলিম উম্মাহ ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
# একথার অর্থ এ নয় যে, জুম’আর নামায পড়ার পর ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়া বা রিযিকের অনুসন্ধানে তৎপর হয়ে উঠা জরুরী। বরং এ নির্দেশ থেকে শুধু এ কাজ করার অনুমতি বুঝায়। যেহেতু জুম’আর আযান শোনার পর সব কাজ কর্ম পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাই বলা হয়েছে, নামায শেষ হওয়ার পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার এবং যে কাজ-কর্ম করতে চাও তা করার অনুমতি তোমাদের জন্য আছে। এটা ঠিক ইহরাম অবস্থায় শিকার নিষিদ্ধ করার পরوَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا “যখন ইহরাম খুলবে তখন শিকার করো” (আল মায়েদাহ, ৩ ) বলার মত। এ কথার অর্থ এটা নয় যে, ইহরাম খোলার পর অবশ্যই শিকার করতে হবে। বরং এর অর্থ হলো, ইহরাম খোলার পর শিকার করার ব্যাপারে আর কোন বাধা নিষেধ থাকে না। কিংবা সূরা নিসাতে যেমন فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ আয়াতাংশে একাধিক বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখানে যদিও নির্দেশসূচক শব্দ فَانْكِحُوا ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কেউ-ই একে নির্দেশ অর্থে গ্রহণ করেননি। এর থেকে মৌলিক একটি মাসায়ালার তথা সূত্র পাওয়া যায় যে, আদেশসূচক শব্দ দ্বারা সবসময় কোন জিনিস ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয় বলে প্রমাণিত হয় না। বরং তা কখনো অনুমতি আবার কখনো কোন জিনিসকে তুলনামূকভাবে বেশী পছন্দ করা অর্থ বুঝায়। এক্ষেত্রে কোথায় তা আদেশ অর্থে, কোথায় অনুমতি অর্থে এবং কোথায় আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় হওয়া অর্থে ব্যবহার হয়েছে সে বিষয়টি আগের ও পরের প্রসঙ্গ থেকে বুঝা যায়। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই যে কাজটি ফরয বা ওয়াজিব সেই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এ আয়াতাংশের ঠিক পরের আয়াতাংশেই বলা হয়েছে وَذَكَرُوا اللَّهَ كَثِيرًا “আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করো।” এখানেও আদেশসূচক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ শব্দ ওয়াজিব বা অবশ্য করণীয় অর্থ প্রকাশ করছে না, বরং “পছন্দনীয় হওয়া” অর্থ প্রকাশ করছে। এখানে এ বিষয়টিও উল্লেখ্য যে, কুরআনে যদিও ইহুদীদের সাবত এবং খৃস্টানদের রোববারের মত জুম’আর দিনকে সাধারণ ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু একথা কেউ-ই অস্বীকার করতে পারে না যে, শনিবার ও ররিবার ইহূদী ও খৃস্টানদের জাতির প্রতীক জুম’আও ঠিক তেমনি মুসলমানদের জাতির প্রতীক। সুতরাং তামাদ্দুনিক বা সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে যদি সপ্তাহের কোন দিনকে সাধারণ ছুটির জন্য মনোনীত করতে হয় তহলে ইহুদীরা যেমন স্বাভাবিকভাবে শনিবারকে এবং খৃস্টানরা রোববারকে বেছে নিয়েছে তেমনি এ উদ্দেশ্যে মুসলমানরাও (যদি তাদের মন-মানস ও স্বভাব প্রকৃতিতে লেশমাত্র ইসলামী অনুভূতি বিদ্যমান থেকে থাকে) জুম’আর দিনকেই বেছে নেবে। খৃস্টানরা তো তাদের নিজের দেশ ছাড়া এমনসব দেশের ওপরও তাদের রোববার চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। যেখানে খৃস্টানদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য ছিল। ইহুদীরা ফিলিস্তিনে তাদের ইসরাঈলী রাষ্ট্র কায়েম করলে সর্বপ্রথম যে কাজটি করেছিল তা হচ্ছে রোববারের পরিবর্তে শনিবারকে ছুটির দিন হিসেবে নির্ধারিত করা। বিভাগ পূর্ব ভারতে বৃটিশ ভারত এবং মুসলিম দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে যে উল্লেখ্যযোগ্য পার্থক্য নজরে পড়ত তা হচ্ছে দেশের এক অংশে রোববারে সাপ্তাহিক ছুটি হতো এবং অন্য অংশে জুম’আর দিনে ছুটি হতো। তবে যেসব জায়গায় মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী অনুভূতি ও ভাবধারা বর্তমান থাকত না সেখানে ক্ষমতা নিজেদের হাতে আসার পরও তারা রোববারকেই বুকে জড়িয়ে রাখে যা আমরা পাকিস্তানে দেখতে পাচ্ছি। আর চেতনাহীনতার মাত্রা এর চেয়েও অধিক হলে জুম’আর দিনের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে রোববার দিন সাপ্তাহিক ছুটি চালু করা হয়। মুস্তাফা কামাল তুরস্কে এ কাজটিই করেছেন।

# নিজেদের কাজ-কর্ম ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়েও আল্লাহকে ভুলে যেও না। বরং সর্বাবস্থায় তাঁকে স্মরণে রাখো এবং তাঁকেই স্মরণ করতে থাকো। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আহযাব, টীকা, ৬৩)।

# কুরআন মজীদে বেশ কিছু সংখ্যক জায়গায় একটি হিদায়াত বা দিক নির্দেশনা, কিংবা একটি উপদেশ অথবা একটি নির্দেশ দেয়ার পর لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (হয়তো তোমরা সফল হবে, কল্যাণ লাভ করবে) এবং لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (হয়ত তোমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে) বলা হয়েছে। এসব স্থানে “হয়ত” বা “সম্ভবত” শব্দ ব্যবহার করার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ‌ তা’আলার (মা’আযাল্লাহ) কোন সন্দেহ আছে। মূল ব্যাপার তা নয়। বরং এটি একটি রাজকীয় বর্ণনাভঙ্গি। এটা ঠিক তেমন যেন কোন দয়ালু মনিব তাঁর কর্মচারীকে বলছেন, তুমি অমুক কাজটি করো, হয়তো তোমার পদোন্নতি হবে। এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি থাকে যার আশায় কর্মচারীটি মনযোগ দিয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে ঐ কাজটি আঞ্জাম দিতে থাকে। কোন বাদশাহর মুখ থেকে তার কোন কর্মচারীর উদ্দেশ্যে একথা উচ্চারিত হলে তার ঘরে খুশীর বন্যা বয়ে যায়।

এখানে যেহেতু, জুম’আর নামাযের হুকুম-আহকাম বর্ণনা শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই কুরআন, হাদীস, সাহাবীদের উক্তি এবং ইসলামের সাধারণ মূলনীতির আলোকে চারটি ফিকহী মাযহাবের জুম’আর নামায সম্পর্কে যেসব হুকুম-আহকাম বের করে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে এখানে তার সারসংক্ষেপ বর্ণনা করা সমীচীন হবে বলে মনে হয়।

হানাফী মাযহাবের মতে যোহরের নামাযের সময়ই জুম’আর নামাযের সময়। জুম’আ এ সময়ের পূর্বেও পড়া যেতে পারে না, পরেও পড়া যেতে পারে না। প্রথম আযানের সময় থেকেই কেনা-বেচা হারাম হয়ে যায়,-ইমাম মিম্বরের ওপর বসার পর দ্বিতীয় আযান দেয়ার সময় থেকে নয়। কারণ, কুরআনে শুধু إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ কথাটি বলা হয়েছে। তাই সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার পর যখন জুম’আর সময় শুরু হয় তখন জুম’আর নামাযের যে আযানটিই দেয়া হোক না কেন তা শোনার পর লোকদের কেনা-বেচা বন্ধ করে দেয়া কর্তব্য। তবে সেই সময় যদি কোন ব্যক্তি ক্রয়-বিক্রয় করে তবে সেই ক্রয়-বিক্রয় অবৈধ বা বাতিল হবে না, বরং তা কেবল একটি গোনাহের কাজ হবে। জুম’আর নামায প্রতিটি জনপদেই অনুষ্ঠিত হবে না, বরং শুধু مصر جامع “মিসরে জামে”-তে অনুষ্ঠিত হতে পারবে। নির্ভরযোগ্য সংজ্ঞা অনুসারে ‘মিসরে জামে’ বলা হয় এমন শহরকে যেখানে বাজার আছে, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা আছে এবং তার জনবসতিও এত যে, যাদের ওপর জুম’আর নামায ফরয তারা সবাই যদি ঐ শহরের সর্বাপেক্ষা বড় মসজিদে সমবেত হয় তাহলে সেখানে স্থান সংকুলান হবে না। যেসব লোক শহরের বাইরে বসবাস করেন তাদের জন্য শহরে এসে জুম’আর নামায পড়া কেবল তখনই ফরয যখন আযাবের শব্দ তারা শুনতে পাবে কিংবা খুব বেশী হলে শহর থেকে ৬ মাইল দূরে অবস্থিত হবে। নামায মসজিদেই হতে হবে তা জরুরী নয়। নামায খোলা মাঠেও হতে পারে। এমন মাঠেও জুম’আর নামায হতে পারে যা শহরের বাইরে অবস্থিত হলেও মূল শহরের একটি অংশ বলে বিবেচিত। যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির শরীক হওয়ার সাধারণ অনুমতি আছে শুধু সেখানেই জুম’আর নামায অনুষ্ঠিত হতে পারে। কোন বন্ধ জায়গায় যত মানুষই একত্রিত হোক না কেন, সেখানে সবারই আসার অনুমতি না থাকলে, জুম’আর সহীহ হবে না। জুম’আর নামায সহীহ হওয়ার জন্য জামায়াতে আবু হানীফার (র) মতে ইমাম ছাড়া কমপক্ষে তিন জন অথবা আবু ইউসুফ (র) ও মুহাম্মাদের মতে ইমাম সহ দুইজন এমন লোক থাকতে হবে যাদের ওপর জুম’আ ফরয। যেসব ওজর থাকলে জুম’আ পড়া থেকে অব্যহতি পাওয়া যায় তা হচ্ছেঃ সফরে থাকা, অথবা এমন রুগ্ন হওয়া যে, নিজে হেঁটে মসজিদে আসার ক্ষমতা নেই। অথবা দু’টি পা-ই অক্ষম অথব অন্ধ, (কিন্তু ইমাম আবু ইউসূফ (র) ও মুহাম্মাদের (র) মতে অন্ধ ব্যক্তি কেবল তখনই জুমআ পড়া থেকে অব্যহতি পাবে যখন তাকে মসজিদে নিয়ে যাবার মত কোন লোক পাবে না।) অথবা কোন অত্যাচারীর পক্ষ থেকে তার জীবন ও মান-ইজ্জতহানীর কিংবা সহ্যসীমা বহির্ভূত আর্থিক ক্ষতিরআশঙ্কা থাকে অথবা প্রচণ্ড বৃষ্টি অথবা কাদা পানি থাকে অথবা যদি সে বন্দী থাকে। কয়েদী ও অক্ষমদের জন্য জুম’আর দিনে যোহরের নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ। যারা জুম’আর নামায পায়নি তাদের জন্য যোহরের নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ। খোতবা জুম’আ সহীহ হওয়ার একটি শর্ত। কারণ, নবী কখনো খোতবা ছাড়া জুম’আর নামায পড়েননি। আর খোতবা অবশ্যই দু’টি হতে হবে এবং নামাযের আগে হতে হবে। ব্যক্তি যে স্থানে বসে আছে সে স্থানে পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছুক আর না পৌঁছুক খোতবা দেয়ার জন্য ইমাম যখন মিম্বরের দিকে অগ্রসর হবেন তখন থেকে খোতবা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবরকম কথাবার্তা নিষিদ্ধ। এই সময় নামাযও না পড়া উচিত। (হিদায়া, ফাতহুল কাদীর, আহকামুল কুরআন,-জাসসাস আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া, উমদাতুল কারী)।

শাফেয়ী মাযাহাবের মতে যোহরের নামাযের সময়ই জুম’আর নামাযের সময়। যখন দ্বিতীয় আযান (অর্থাৎ ইমাম মিম্বরের ওপর বসার পর যে আযান দেয়া) হবে তখন থেকে কেনা-বেচা হারাম ও নামাযের জন্য যাওয়া ওয়াজিব। তা সত্ত্বেও কেউ যদি এ সময় কেনা-বেচা করে তবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে না। এমন প্রত্যেকটি জনপদেই জুম’আ অনুষ্ঠিত হতে পারবে যেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে ৪০ জন লোক এমন আছে যাদের ওপর জুম’আর নামায ফরয। জনপদের বাইরের যেসব এলাকার লোক আযান শুনতে পায় তাদের জন্য জুম’আর নামাযে হাজির হওয়া অবশ্য কর্তব্য। জনবসতির অভ্যন্তরেই জুম’আর নামায অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। তবে জরুরী নয় যে, তা মসজিদেই পড়তে হবে। যারা মরুভূমির মধ্যে তাঁবুতে অবস্থান করে তাদের ওপরে জুম’আর ফরয নয়। জুম’আ শুদ্ধ হওয়ার জন্য যাদের ওপর জুম’আ ফরয ইমাম সহ কমপক্ষে এ রকম ৪০ জন লোকের জামায়াতে উপাস্থিত থাকা অবশ্যক। যেসব ওজর থাকার কারণে কোন ব্যক্তি জুম’আর নামায পড়া থেকে অব্যহতি লাভ করে তা হচ্ছেঃ সফরে থাকা অথবা কোন স্থানে চারদিন বা তার কম সময় অবস্থান করার ইচ্ছা করা, তবে সফর বৈধ হতে হবে। এমন বৃদ্ধ বা রুগ্ন যে সওয়ারীতে চড়েও জুম’আয় হাজির হতে অক্ষম। অন্ধ হওয়া এবং তাকে নামাযের জন্য মসজিদে নিয়ে যাওয়ার মত কোন লোক না পাওয়া। প্রাণ, সম্পত্তি অথবা-মান-ইজ্জাতহানীরআশঙ্কা থাকা। বন্দী অবস্থায় থাকা। তবে এই বন্দিদশা তার নিজের কোন অপরাধের কারনে না হওয়া। নামাযের পূর্বে দু’টি খোতবা থাকতে হবে। খোতবার সময় চুপচাপ থাকা সুন্নাত, তবে কথা বলা হারাম নয়। যে ব্যক্তি ইমামের এতটা কাছে বসেছে যে, খোতবা শুনতে পায় তার জন্য কথাবার্তা বলা মাকরূহ। তবে সে সালামের জবাব দিতে পারে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের উল্লেখ শুনে উচ্চাস্বরে দরূদ পাঠ করতে পারে। (মুগনিউল মুহতাজ, আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া)।

মালেকী মাযাহাবের মতে জুম’আর নামাযের সময় হচ্ছে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার পর থেকে শুরু করে মাগরিবের এতটা পূর্ব পর্যন্ত যেন সূর্যাস্তের আগেই খোতবা ও নামায শেষ হয়ে যায়। কেনা-বেচা হারাম ও নামাযের জন্য যাওয়া ওয়াজিব হয় দ্বিতীয় আযান থেকে। এ সময়ের পর কোন কেনা-বেচা হলে তা অবৈধ ও বাতিল বলে গণ্য হবে। কেবল সেই সব জনপদেই জুম’আ অনুষ্ঠিত হতে পারে যেখানকার অধিবাসীগণ স্থায়ীভাবে সেখানে বাসস্থান তৈরী করে বসবাস করছে। শীত গ্রীষ্মে তারা অন্য কোন স্থানে চলে যায় না। তারা ঐ জনপদেই তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুর সরবরাহ পেয়ে থাকে এবং সংখ্যার দিক দিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারে। অস্থায়ী অবস্থান স্থলে যত লোকই থাক না কেন এবং তারা যতদিনই অবস্থান করুক না কেন সেখানে জুম’আ অনুষ্ঠিত হতে পারে না যে জনপদে জুম’আ অনুষ্ঠিত হয় তার তিন মাইল দূরত্বের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের ওপর জুম’আর নামাযে হাজির হওয়া ফরয। জুম’আর নামায কেবল এমন সব মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতে পারে যা জনপদের ভিতরে বা সংলগ্নস্থানে অবস্থিত হবে এবং যার ইমরাত জনপদের সাধারণ অধিবাসীদের ঘরের চেয়ে নিম্নমানের হবে না। এক্ষেত্রে কোন কোন মালেকী ফিকাহবিদ এরূপ শর্তও আরোপ করেছেন যে, মসজিদ ছাদ বিশিষ্ট হতে হবে এবং তাতে যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ব্যবস্থা নেই। যা কেবল জুম’আর নামায পড়ার জন্য তৈরী করা হয়েছে। জুম’আর নামায সহীহ হওয়ার জন্য যাদের ওপর জুম’আর নামায ফরয ইমাম ছাড়া কমপক্ষে এ রকম ১২ জন লোকের জামায়াতে উপস্থিত থাকা জরুরী। যেসব ওজর বর্তমান থাকলে কোন ব্যক্তির ওপর থেকে জুম’আর নামায পড়ার নির্দেশ রহিত হয়ে যায় তা হচ্ছেঃ সফলে থাকা অথবা সফর অবস্থায় কোন স্থানে চারদিনের কম সময় অবস্থানের নিয়ত করা। এমন রুগ্ন হওয়া যে, তার পক্ষে মসজিদে আসাই অসম্ভব। মা অথবা বাপ অথবা স্ত্রী অথবা সন্তান রুগ্ন ও অসুস্থ থাকা অথবা সে এমন কোন অপরিচিত রোগীর সেবা যত্ন করছে যার সেবা যত্ন করার মত আর কেউ নেই, অথবা তার কোন নিকটাত্মীয় কঠিন রোগে আক্রান্ত অথবা মরণাপন্ন। যে সম্পদের ক্ষতি সে বরদাশত করতে অক্ষম এমন সম্পদের ক্ষতিরআশঙ্কা থাকা। অথবা মারপিট ও বন্দীত্বের ভয়ে আত্মগোপন করে থাকা। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তাকে মজলুম বা অত্যাচারিতের পর্যায়ভুক্ত হতে হবে। প্রচণ্ড বৃষ্টি বা কাদা পানি থাকা কিংবা প্রচণ্ড গরম বা ঠাণ্ডা মসজিদ পর্যন্ত যেতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে। নামাযের পূর্বে দু’টি খোতবা হওয়া অত্যাবশ্যক। এমনকি খোতবা যদি নামাযের পরে দেয়া হয় তাহলে নামায পুনরায় পড়া জরুরী। খোতবা মসজিদের ভিতরে হতে হবে। খোতবা দেয়ার জন্য ইমাম যখন মিম্বরের দিকে অগ্রসর হবেন সেই সময় নফল নামায পড়া হারাম এবং খোতবা শুরু হলে তা শোনা না গেলেও কথাবার্তা বলাও হারাম। তবে খতীব যদি খোতবা বহির্ভুত কোন বাজে বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন অথবা গালির উপযুক্ত নয় এমন কোন ব্যক্তিকে গালি দেন অথবা এমন কোন ব্যক্তির প্রশংসা করতে শুরু করেন যার প্রশংসা করা জায়েয নয়, অথবা খোতবার সাথে সম্পর্কহীন কোন কিছু পড়তে শুরু করেন তাহলে তার প্রতিবাদ করার অধিকার লোকজনের আছে। তাছাড়া জীবনেরআশঙ্কা না থাকলে বর্তমানে বাদশাহ বা শাসকের জন্য খোতবার মধ্যে দোয়া করাও মাকরূহ। যিনি নামায পড়াবেন তাঁকেই খোতবা দিতে হবে। খতীব ছাড়া অন্য কেউ নামায পড়ালে সে নামায বাতিল হয়ে যাবে। (হাশিয়াতুদ দুসুকী আলশ শারহিল কাবীর, আহকামুল কুরআন-ইবনে আরাবী, আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া)।

হাম্বলী মাযহাবের মতে জুম’আর নামাযের সময় সকাল বেলা সূর্য কিছুটা ওপরে ওঠার পর থেকে আসরের সময় শুরু হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার আগে জুম’আর নামায পড়া শুরু জায়েয এবং পরে ওয়াজিব ও উত্তম। দ্বিতীয় আযান থেকে কেনা-বেচা হারাম এবং নামাযের জন্য প্রস্তুত হওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়। এরপর কেনা-বেচা হলে তা কেনা-বেচা হয়েছে বলে ধরা হবে না। যাদের ওপর জুম’আর নামায ফরয এমন ৪০ জন লোক যে স্থানে আছে কেবল সেখানেই জুম’আ অনুষ্ঠিত হতে পারে। এসব লোকের স্থায়ীভাবে বাড়ীঘরে (তাঁবুতে নয়) বসবাসকারী হতে হবে। অর্থাৎ শীত বা গ্রীষ্মকালে তারা কোথাও স্থানান্তরিত হয় না। এ জন্য জনবসতির বাড়ী ঘর ও মহল্লাসমূহ পরস্পর সংলগ্ন হোক বা বিচ্ছিন্ন হোক তাতে কোন পার্থক্য হয় না। এই জনপদের বিভিন্ন অংশের মধ্যকার দূরত্ব কয়েক মাইল হলেও যদি তা সমষ্টিগতভাবে একটি নামে পরিচিত হয় তাহলে তা একটি জনপদ বলে গণ্য হবে। এ ধরনের জনপদ থেকে যারা তিন মাইল দূরত্বের মধ্যে বসবাস করে তাদের জন্য জুম’আর নামায পড়তে মসজিদে আসা ফরয। জামায়াতে ইমাম সহ ৪০ ব্যক্তির উপস্থিত থাকা জরুরী। নামায মসজিদেই হতে হবে এমনটি জরুরী নয়। বরং খোলা মাঠেও নামায হতে পারে। যেসব কারণ বর্তমান থাকলে কোন ব্যক্তির ওপর জুম’আর নামায আর ফরয থাকে না তা হচ্ছেঃ মুসাফির হওয়া, যে জনপদের লোকদের ওপর জুম’আ ফরয এমন জনপদে চারদিন বা তার কম সময় অবস্থানের ইচ্ছা করা, এমন রুগ্ন হওয়া যে সওরীতে উঠে মসজিদে আসাও অসসম্ভব, অন্ধ হওয়া-তবে সে নিজে যদি পথ হাতড়িয়ে আসতে পারে তাহলে আসবে। অন্য কোন লোকের সাহায্য নিয়ে অন্ধ ব্যক্তির জন্য মসজিদে আসা ওয়াজিব নয়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বা গরম অথবা প্রচণ্ড বৃষ্টি বা কাদা নামাযের স্থানে পৌঁছতে প্রতিবন্ধক হওয়া। কোন জালেমের জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মগোপন করে থাকা। প্রাণ ও মান-ইজ্জতহানিরআশঙ্কা কিংবা এমন আর্থিক ক্ষতিরআশঙ্কা থাকা যা বরদাশত করা যাবে না। নামাযের আগে দু’টি খোতবা হতে হবে। খতীবের কথা শোনা যায়, যে ব্যক্তি খতীবের এতটা নিকটে আছে খোতবার সময় তাঁর জন্য কথাবার্তা বলা হারাম। তবে দূরে অবস্থিত লোক যার কাছে খতীবের আওয়াজ পৌঁছে না সে কাথাবার্তা বলতে পারে। খতীব ন্যায়পরায়ন হোক বা না হোক খোতবার সময় সবার চুপচাপ থাকা উচিত। জুমআর দিনে ঈদ হলে যারা ঈদের নামায পড়বে তাদের জন্য জুম’আর নামায পড়া ফরয নয়। এ বিষয়ে হাম্বলী মযহাবের মত তিন ইমামের মত থেকে ভিন্ন (গায়তুল মুনতাহা, আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া)।

যে ব্যক্তির ওপর জুম’আ ফরয নয় সে যদি জুম’আর নামাযে শরীক হয় তাহলে তার নামায সহীহ হবে এবং তার ওপর যোহরের নামায আর ফরয থাকবে না। এ বিষয়ে সমস্ত ফিকহবিদ একমত।

#: ১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে জুম’আর হুকুম-আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে এটিই সেই ঘটনা। হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবু হুরাইরা, হযরত আবু মালেক এবং হযরত হাসান বসরী, ইবনে যায়েদ, কাতাদা এবং মুকাতিল ইবনে হাইয়ান থেকে ঘটনার যে বিবরণ বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছেঃ পবিত্র মদীনা নগরীতে সিরিয়া থেকে একটি বাণিজ্য কাফেলা ঠিক জুম’আর নামাযের সময় এসে পৌঁছলো এবং জনপদের লোকজন যাতে তাদের আগমনের খবর জানতে পারে সেজন্য ঢোল-বাদ্য বাজাতে শুরু করলো। রসূলুল্লাহ ﷺ সে সময় খোতবা দিচ্ছিলেন। ঢোল ও বাদ্য যন্ত্রের শব্দ শুনে সব মানুষ অস্থির হয়ে উঠল এবং ১২ জন লোক ছাড়া সবাই ‘বাকী’ নামক স্থানে ছুঁটে গেল। বাণিজ্য কাফেলা এখানেই অবস্থান করেছিল। এই ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা আছে। এর মধ্যে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর বর্ণনাটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এ বর্ণনাটিকে ইমাম আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু উওয়ানা, আবদ ইবনে হুমাইদ, আবু ইয়ালা, প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সময়ে বর্ণনা করেছেন। এসব বর্ণনার মধ্যে অসামঞ্জস্য শুধু এতটুকু যে, কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে ঘটনাটি নামাযরত অবস্থায় ঘটেছিল। আবার কোন বর্ণনাতে বলা হয়েছে যে, নবী (সা.) যখন খোতবা দিচ্ছিলেন ঘটনাটি তখন ঘটেছিল। কিন্তু হযরত জাবের এবং অন্য সব সাহাবী ও তাবেয়ীদের সবগুলো বর্ণনা একসাথে বিচার করলে যে কথাটি সঠিক বলে মনে হয় তাহলো ঘটনাটি খোতবার সময় সংঘটিত হয়েছিল। যেখানে তিনি বলেছেন যে, ঘটনাটি জুম’আর নামাযের সময় ঘটেছিল সেখানে তিনি জুম’আর নামায বলতে খোতবা ও নামায উভয়ের সমষ্টিকে বুঝিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় বলা হয়েছে, সে সময় ১২ জন পুরুষের সাথে সাত জন মহিলাও রয়ে গিয়েছেন। (ইবনে মারদুইয়া) কাতাদা বর্ণনা করেছেন যে, ১২ জন পুরুষের সাথে ১ জন মহিলা ও ছিলেন। (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম)। দরুকুতনীর একটি রেওয়ায়াতে ৪০ ব্যক্তি এবং আবদ ইবনে হুমায়াদের রেওয়ায়াতে ৭ জন্যর কথা বলা হয়েছে। ফাররা, আটজনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এগুলো সবই দুর্বল রেওয়ায়াত। কাতাদার এ রেওয়ায়াতও দুর্বল যে, এ ধরনের ঘটনা তিনবার ঘটেছিল। (ইবনে জারীর)। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রেওয়ায়াতটিই নির্ভরযোগ্য। এতে মসজিদে থেকে যাওয়া লোকের সংখ্যা ১২ জন বলা হয়েছে। আর কাতাদার একটি রেওয়ায়াত ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত সাহাবী ও তাবেয়ীদের বর্ণনাসমূহ এ বিষয়ে একমত যে, এ ঘটনা মাত্র একবারই ঘটেছে। মসজিদে থেকে যাওয়া লোকদের সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়াত একত্রে বিচার করলে জানা যায়, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উমর (রা.), হযরত উসমান(রা.), হযরত আলী(রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা.), হযরত আম্মার(রা.)। ইবনে ইয়াসির, হুযাফার আযাদ কৃতদাস হযরত সালেম (রা.) এবং হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ। হাফেস আবু ইয়ালা, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর যে রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন তাতে বলা হয়েছে। লোকজন যখন এভাবে বের হয়ে চলে গেল এবং মাত্র ১২ জন অবশিষ্ট থাকলেন তখন নবী (সা.) তাদের সম্বোধন করে বললেনঃ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ تَتَابَعْتُمْ حَتَّى لَمْ يَبْقَ مِنْكُمْ أَحَدٌ لَسَالَ بِكُمُ الْوَادِىْ نَارًا- “তোমরা সবাই যদি চলে যেতে এবং একজনও অবশিষ্ট না থাকত তাহলে এ উপত্যকা আগুনের প্রবাহে প্লাবিত হয়ে যেত। “ ইবনে মারদুইয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এবং ইবনে জারীর কাতাদা থেকে প্রায় এর অনুরূপ বিষয় বর্ণনা করেছেন।

শিয়াগণ এ ঘটনাটিকেও সাহাবীদের (রা.) প্রতি কটাক্ষ করার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাঁরা বলেনঃ এত বিপুল সংখ্যক সাহাবীর খোতবা এবং নামায ছেড়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও খেল তামাশার দিকে ছুটে যাওয়া প্রমাণ করে, তারা দুনিয়াকে আখেরাতের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এটি এমন একটি কঠোর অমূলক দোষারোপ যা শুরু বাস্তব থেকে চোখ বন্ধ করেই করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনাটি ঘটেছিল হিজরাতের অব্যবহিত পরে। সে সময় একদিকে সাহাবীদের সামষ্টিক প্রশিক্ষণ ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যদিকে মক্কার কাফেররা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা মদীনার অধিবাসীদের কঠোরভাবে অবরোধ করে রেখেছিল যার কারণে মদীনায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিল। হযরত হাসান বসরী বলেন, সেই সময় মদীনায় মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ছিল আকাশ ছোয়া (ইবনে জারীর)। ঠিক এই পরিস্থিতিতে মদীনায় একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে হাজির হলে নামাযরত লোকজন এই ভেবেআশঙ্কাবোধ করলো, আমরা নামায শেষ করতে করতে সব জিনিসপত্র বিক্রি না হয়ে যায়। এই ভয়ে তারা সেদিকে ছুটে গিয়েছিল। এটা ছিল এমন একটি ত্রুটি ও দুর্বলতা যা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব ও কঠোর পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে সেই সময় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে এসব সাহাবী ইসলামের জন্য যেসব কুরবানী ও ত্যাগ-তিতিক্ষা দেখিয়েছেন, তা যদি কেউ দেখে এবং ইবাদাত-বন্দেগী ও সামষ্টিক কাজ-কর্মে তাদের জীবন যে অতুলনীয় আল্লাহভীতির সাক্ষ্য দেয় তাও দেখে তাহলে সে একথা বলে তাদের ওপর দোষারোপ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না যে, তাদের মধ্যে আখেরাতের চেয়ে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া ব্যাধি ছিল। তবে তার নিজের হৃদয় মনে যদি সাহাবীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের ব্যাধি থেকে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।

এ ঘটনা সাহাবীদের (রা.) প্রতি কটাক্ষকারীদের যেমন সমর্থন করে না তেমনি সেসব লোকের ধ্যান-ধারণার প্রতিও সমর্থন জানায় না যারা সাহাবীদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার আতিশয্যে দাবী করেন যে, তাদের দ্বারা কখনো কোন ভুল হয়নি, কিংবা হয়ে থাকলেও কখনো তা উল্লেখ করা উচিত নয়। কারণ তাঁদের ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করা এবং তাকে ভুল-ত্রুটি বলা তাদের অপমান করার শামিল। এতে হৃদয় মনে তাদের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া তাদের ভুল-ত্রুটির উল্লেখ সেসব আয়াত ও হাদীসেরও পরিপন্থী যার মধ্যে স্পষ্ট ভাষায় সাহাবীদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া আল্লাহর নিকট প্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব কথা স্পষ্ট বাড়াবাড়ি। এর সমর্থনে কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল নেই। এখানে যে কেউ দেখতে পারেন, বিপুল সংখ্যক সাহাবীর (রা.) একটি দল কর্তৃক যে ত্রুটি হয়েছিল আল্লাহ‌ তা’আলা নিজে এখানে তাদের সেই ত্রুটির উল্লেখ করেছেন। এমন গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত উম্মাতকে পড়তে হবে। সেই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে গ্রন্থে তাদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কথাও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া হাদীস ও তাফসীরের সমস্ত গ্রন্থে সাহাবা কিরাম (রা.) থেকে পরবর্তীকালের আহলে সুন্নাত ওয়া জামায়াতের বড় বড় মনীষীগণ পর্যন্ত তাদের এই ত্রুটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ কি এই যে, আল্লাহ‌ তায়ালা মানুষের মন থেকে ঐ সব সাহাবীর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঐ ত্রুটির উল্লেখ করেছেন যা তিনি নিজেই মানুষের মনে কায়েম করতে চান? অথবা এর অর্থ কি এই যে, এসব অন্ধ ও গোঁড়া ভক্তগণ শরীয়াতের যে মাসয়ালাটি বলে থাকেন সাহাবায়ে কিরাম (রা.), তাবেয়ীগণ, মুহাদ্দিসগণ এবং মুফাসসিরগণের সে মাসায়ালাটি জানা থাকার কারণে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তারা উল্লেখ করেছেন? আর যারা সূরা জুম’আ পড়েন এবং তার তাফসীর অধ্যয়ন করেন তাদের মন থেকে কি সত্যি সত্যিই সাহাবা কিরামের (রা.) প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা উধাও হয়ে গেছে? এ সব প্রশ্নের জবাব যদি নেতিবাচক হয়, আর নেতিবাচক তো অবশ্যই হবে তাহলে সাবাহায়ে কিরামের (রা.) মর্যাদার নামে কিছু লোক যেসব অনর্থক এবং বাড়াবাড়ি অতিরঞ্জিত ও অতিশয়োক্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকেন তা অবশ্যই ভ্রান্ত।

প্রকৃতপক্ষে সাহাবায়ে কিরাম কোন আসমানী মাখলুক ছিলেন না। বরং এই পৃথিবীতে জন্মলাভকারী মানুষ ছিলেন। তারা যা কিছু হয়েছিলেন তা হয়েছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার গুণে। তাদের এ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর ধরে। কুরআন ও হাদীসে আমরা এ শিক্ষার যে নিয়ম-পদ্ধতি দেখতে পাই, তা হচ্ছে যখনই তাদের মধ্যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে আল্লাহ‌ ও আল্লাহর রসূল যথাসময়ে সেদিকে মনোনিবেশ করেছেন এবং দুর্বলতার সেই বিশেষ ক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণদানের একটি কর্মসূচী শুরু করা হয়েছে। জুম’আর নামাযের এই ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই যে, বাণিজ্য কাফেলা সংক্রান্ত ঘটনাটি ঘটলে আল্লাহ‌ তা’আলা সূরা জুম’আর এ রুকূ’র আয়াতসমূহ নাযিল করে এ বিষয়ে সতর্ক করলেন এবং জুম’আর নামাযের নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা অবহিত করলেন। তাছাড়া রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুম’আর অনেকগুলো খোতবায় লোকজনের মনে জুম’আ ফরয হওয়ার গুরুত্ব বদ্ধমূল করে দিলেন এবং বিস্তারিতভাবে তাদেরকে জুম’আর নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা শিক্ষা দিলেন। আমরা বিভিন্ন হাদীস থেকে এসব হিদায়াত ও নির্দেশনা স্পষ্টভাবে পেয়ে থাকি। আমরা এ বিষয়ে ১৫ নং টীকায় উল্লেখ করেছি। হযরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ জুম’আর দিন প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য গোসল করা, দাঁত পরিষ্কার করা, যে উত্তম পোশাক তার আছে তা পরিধান করা এবং যদি সম্ভব হয় সুগন্ধি ব্যবহার করা। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী) হযরত সালমান ফারসী বলেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ যে মুসলমান জুম’আর দিনে গোসল করবে এবং সাধ্যমত নিজেকে বেশী করে পাক পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে, মাথায় তেল দেবে, ঘরে যে খোশবুই থাক না কেন ব্যবহার করবে, তারপর মসজিদে যাবে এবং দুই জন মানুষকে সরিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে বসবে না, তারপর আল্লাহর দেয়া সমর্থ অনুসারে নামায (নফল) পড়বে এবং ইমাম যখন খোতবা দিবেন তখন চুপ থাকবে, এক জুম’আর থেকে পরবর্তী জুম’আ পর্যন্ত তার কৃত অপরাধসমূহ মাফ হয়ে যায়। (বুখারী, মুসনাদে আহমাদ)। হযরত আবু আইয়ূব আনসারী (রা.), হযরত আবু হুরাইরা (রা.) এবং হযরত নুবাইশাতুল হুযালী (রা.) ও তাদের বর্ণনায় নবী (সা.) থেকে প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছেন (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, তাবারানী)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ ইমাম যখন খোতবা দেন, তখন যে ব্যক্তি কথা বলে সে গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে। আর যে ব্যক্তি তাকে বলেঃ চুপ কর তারও কোন জুম’আ হয়নি (মুসনাদে আহমাদ) হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেনঃ জুম’আর দিন খোতবার সময় যে ব্যক্তি কথা বলে তাকে যদি তোমরা বলো, “চুপ করো” তাহলে তোমরাও অর্থহীন কাজ করলে (বুখারী মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ)। ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও তাবারানী হযরত আলী (রা.) ও হযরত আবদু দারদা (রা.) থেকে প্রায় অনুরূপ কিছু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে নবী (সা.) খতীবদেরকেও দীর্ঘ খোতবা দিয়ে মানুষকে বিরক্ত ও অতিষ্ট না করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি নিজে জুম’আর দিন সংক্ষিপ্ত খোতবা দিতেন এবং নামাযও খুব দীর্ঘ করে পড়াতেন না। হযরত জাবের (রা.) ইবনে সামুরা বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) খোতবা দীর্ঘায়িত করতেন না। তাঁর খোতবা হতো কয়েকটি সংক্ষিপ্ত কথার সমষ্টি (আবু দাউদ)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফ বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খোতবা নামাযের তুলনায় সংক্ষিপ্ত হতো এবং নামায খোতবার চেয়ে দীর্ঘ হতো (নাসায়ী)। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির বর্ণনা করেনঃ নবী (সা.) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি নামায দীর্ঘ হওয়া এবং খোতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রমাণ করে সে দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞানের অধিকারী (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)। বাযযার আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। নবী (সা.) লোকজনকে কিভাবে জুম’আর নামাযের নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা শিখাতেন এসব হাদীসের ভাষ্য থেকে তা অনুমান করা যায়। এভাবে এ নামাযের এমন একটি মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার নজীর পৃথিবীর কোন জাতির সামষ্টিক ইবাদতে দেখা যায় না।

# সাহাবীদের যে ত্রুটি হয়েছিল তা কি ধরনের ত্রুটি ছিল এ আয়াতাংশ থেকে তা বুঝা যায় (নাউযুবিল্লাহ)। যদি ঈমানের দুর্বলতা ও জেনে শুনে আখেরাতের ওপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া এর কারণ হতো তাহলে আল্লাহ‌ তা’আলার ক্রোধ, শাসানি এবং তিরষ্কারের ধরন হতো ভিন্ন। কিন্তু এ ধরনের কোন অপরাধ যেহেতু সেখানে হয়নি বরং, যা হয়েছিল তা প্রশিক্ষনের অভাবে হয়েছিল। তাই প্রথমে শিক্ষকসুলভ ভঙ্গিতে জুম’আর নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা শেখানো হয়েছে। তারপর তাদের ত্রুটির কথা উল্লেখ করে মরুব্বিয়ানা ভঙ্গিতে বুঝানো হয়েছে যে, জুম’আর খোতবা শোনা এবং নামায পড়ার জন্য আল্লাহর নিকট থেকে তোমরা যা লাভ করবে তা এই দুনিয়ার ব্যবসায়-বাণিজ্য ও খেল তামাশার চেয়ে উত্তম।

# এ পৃথিবীতে রিযিকদানের পরোক্ষ মাধ্যম যে বা যাই হোক না কেন তাদের সবার চেয়ে উত্তম রিযিকদাতা হলেন আল্লাহ‌ তা’আলা। কুরআন মজীদের বহু সংখ্যকস্থানে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। কোথাও আল্লাহ‌ তা’আলাকেأَحْسَنُ الْخَالِقِينَ “সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা” কোথাও خَيْرُ الْغَافِرِينَ “সর্বোত্তম ক্ষমাকারী” কোথাও خَيْرُ الْحَاكِمِينَ “সর্বোত্তম বিচারক”, خَيْرُ الرَّاحِمِينَ কোথাও “সর্বোত্তম দয়ালু” এবং কোথাও خَيْرُ النَّاصِرِينَ “সর্বোত্তম সাহায্যকারী” বলা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সৃষ্টি বা মাখলুকের সাথে রিযিক দেয়া, সৃষ্টি করা, দয়া করা এবং সাহায্য করার যে সম্পর্ক তা রূপক বা পরোক্ষ অর্থ প্রয়োগ করা হয়েছে এবং আল্লাহ‌ তা’আলার ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ দুনিয়াতে যারাই তোমাদেরকে বেতন, পারিশ্রমিক বা খাদ্য দিচ্ছে বলে দেখা যায়, যাদেরকেই তাদের শিল্প ও কারিগরী দক্ষতা দিয়ে কিছু তৈরী করতে দেখা যায় অথবা যাদেরকেই অন্যদের অপরাধ ক্ষমা করতে, দয়া করতে এবং সাহায্য করতে দেখা যায় আল্লাহ‌ তাদের সবার চেয়ে বড় রিযিকদাতা, বড় সৃষ্টিকর্তা, বড় দয়ালু, বড় ক্ষমাকারী এবং বড় সাহায্যকারী।

১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও গুরুত্ব :

الجمعة জুমু‘আহ অর্থ : একত্রিত করা, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। জুমু‘আহ বলতে জুমু‘আর সালাত উদ্দেশ্য। জুমু‘আর সালাতকে এজন্য জুমু‘আহ বলা হয় এ সালাতের জন্য মুসলিমরা দূর দূরান্ত থেকে সপ্তাহে একদিন সমবেত হয়। এ দিনে সমস্ত মাখলুকের সৃষ্টি পরিপূর্ণ করা হয়েছে, কারণ যে ছয় দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে তার ৬ষ্ঠ দিন ছিল জুমু‘আর দিন। এ দিন আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং জান্নাত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এ দিনই কিয়ামত সংঘঠিত হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১০৪৬)

এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যদি কোন মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার কাছে কল্যাণকর কিছু চায় আল্লাহ তা‘আলা তা দান করেন। (সহীহ বুখারী হা. ৯৩৫)

الجمعة শব্দটি অত্র সুরার ৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর সালাতে সূরা জুমু‘আহ ও সূরা মুনাফিকূন পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম হা. ৮৭৭)

১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা বলছেন; আকাশে ও জমিনে এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে। অর্থাৎ জীবজন্তু ও জড় পদার্থ যা কিছু আছে সবই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَإِنْ مِّنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِه۪ وَلٰكِنْ لَّا تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ ط إِنَّه۫ كَانَ حَلِيْمًا غَفُوْرًا) ‏

“এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” (সূরা ইসরা ১৭ : ৪৪)

الْقُدُّوْسِ অর্থ হল : সকল অপূর্ণাঙ্গ গুণাবলী থেকে পবিত্র, সকল পূর্ণাঙ্গ গুণে গুণান্বিত।

(هُوَ الَّذِيْ بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّيْنَ) – اميين

(নিরক্ষর) বলতে যাদের কোন আসমানী কিতাব নেই এবং রিসালাতের চিহ্নও নেই। তারা আরব হোক কিম্বা অনারব হোক। (তাফসীর সা‘দী)।

হাফেয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : اميين (নিরক্ষর) বলা হয় আরবদেরকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَقُلْ لِّلَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتٰبَ وَالْأُمِّيِّيْنَ أَأَسْلَمْتُمْ ط فَإِنْ أَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَوْ)

“আর কিতাবধারী এবং নিরক্ষরদেরকে বল : ‎তোমরা কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তাহলে তারা হিদায়াত পাবে।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ২০)

এখানে বিশেষ করে اميين (নিরক্ষর) উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত অন্যদের জন্য ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিরক্ষরদের মাঝে প্রেরণ করে তাদের ওপর যে অনুগ্রহ করেছেন সে জন্য তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত সারা জাহানের জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعَا)‏

“বল ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৫৮)

এ সম্পর্কে সূরা আনআমে আলোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতটি ইবরাহীম (আঃ)-এর দু‘আর প্রমাণ। ইবরাহীম (আঃ) মক্কাবাসীর মাঝে রাসূল প্রেরণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করে বলেছিলেন :

(رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ ط إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)

“হে আমাদের রব! সে দলে তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারাহ ২ : ১২৯)

(وَّاٰخَرِيْنَ مِنْهُمْ)

অর্থাৎ যারা এখনো নিরক্ষরদের সাথে মিলিত হয়নি সে সকল মানুষের জন্যও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাসূল।

اٰخَرِيْنَ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে মুফাসসিরগণের অভিমত :

(১) ইকরিমা (রহঃ) বলেন : তারা হল তাবেয়ী,
(২) ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন : সাহাবীদের পর কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যত মানুষ আসবে সবাই শামিল।
(৩) ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন : আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমন সময় সূরা জুমু‘আহ অবতীর্ণ হল। সাহাবীগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! اٰخَرِيْنَ তথা অন্যান্য এরা কারা? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কোন জবাব দিলেন না। এমনকি তিনবার জিজ্ঞাসা করা হল। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলছেন, আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী (রাঃ) ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালমান ফারেসীর গায়ে হাত রেখে বললেন :

لَوْ كَانَ الإِيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هَؤُلاَءِ

ঈমান যদি সুরাইয়া নামক তারকাতেও থাকে তাহলে এ সকল লোক নিয়ে আসবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৯৭)

এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুম ও পারস্যসহ অন্যান্য জাতির নিকট বিভিন্ন চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন। মুজাহিদ (রহঃ)-সহ অনেকে বলেছেন : اٰخَرِیْنَ বা অন্যান্যদের দ্বারা উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক অনারবরা যারাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনবে। আল্লামা জাবের আল জাযায়েরী (রহঃ) বলেন : আরব ও অনারব প্রত্যেক সে সকল লোক যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় উপস্থিত হয়নি। (আয়সারুত তাফাসীর)

অতএব বুঝা গেল اٰخَرِيْنَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল অনারবের সকল মু’মিন মুসলিমরা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

إِنَّ فِي أَصْلَابِ أَصْلَابِ أَصْلَابِ رِجَالٍ مِنْ أَصْحَابِي، رِجَالًا وَنِسَاءً يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ

আমার সাহাবী হতে বংশানুক্রমে তিন পুরুষ পর্যন্ত আগমনকারী আমার উম্মাতের নারী ও পুরুষরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। (মাযমাউজ জাওয়ায়েদ ১০/৪০৮ সনদ ভাল)।

(ذٰلِكَ فَضْلُ اللّٰهِ)

অর্থাৎ যে নবুওয়াত নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদান করেছেন তা বিশেষ অনুগ্রহ, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করে থাকেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জুমু‘আর সালাতে এ সূরা পড়া সুন্নাত।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত সারা জাহানের জন্য।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মী ছিলেন। লিখতে-পড়তে জানতেন না।
৪. আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কেউ দেখুক আর না দেখুক যারাই ঈমান আনবে তাদের ফযীলত জানতে পারলাম।
৫-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতেগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের নিন্দা করছেন। তাদেরকে তাওরাত প্রদান করা হয়েছিল তারা আমল করার জন্য তাওরাতকে গ্রহণ করে নিয়েছিল কিন্তু আমল করেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন তাদের উপমা হল গাধার মত, যে গাধা তার পিঠে পুস্তক বহন করে কিন্তু সে জানে না তাতে কী মূল্যবান জিনিস আছে এবং তা থেকে কোন উপকারও নিতে পারে না। অনুরূপভাবে এ ইয়াহূদীরা বাহ্যিকভাবে তাওরাতের শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করছে কিন্তু তা বুঝে না ও আমল করে না। বরং পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছে। সুতরাং তারা নির্বোধ গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন :

(أُولٰ۬ئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ط أُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ)

“তারাই পশুর ন্যায়, বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত তারাই গাফিল।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৭৯)

তাই আল্লাহ তা‘আলা এরূপ জালিম জাতির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার পর বলেন :

(بِئْسَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِاٰيٰتِ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظّٰلِمِيْنَ)

“কত নিকৃষ্ট সেই সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।”

পূর্বের আয়াতগুলোতে উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রতি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ ও আসমানী কিতাব কুরআন দ্বারা যে অনুগ্রহ করেছেন সে আলোচনা করার পর এ আয়াতগুলোতে ইয়াহূদীরা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব তাওরাতের সাথে যে আচরণ করেছে সে সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হল আমরা উম্মাতে মুহাম্মাদীও যেন ইয়াহূদীদের মত আচরণ না করি। ইয়াহূদীদের মত কিতাবে বিকৃতি এবং কোনরূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন না করি।

ইয়াহূদীদের অন্যতম জুলুম ছিল তারা জানত যে, আমরা বাতিলের ওপর আছি তারপরেও দাবী করত আমরা হকের ওপর আছি এবং অন্যদের বাদে আমরা আল্লাহ তা‘আলার ওলী। যেমন তারা বলত “আমরা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয় পাত্র” (সূরা মায়িদা ৫ : ১৮)

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিতে বলছেন, যদি তাই হয় তাহলে তারা যেন মৃত্যু কামনা করে, তখন জেনে নেবে প্রকৃত ব্যাপার কী? আল্লাহ তা‘আলা বলছেন তারা যে কুফরী করেছে ও যে জুলুম করেছে তা তাদের জ্ঞাত, তাই তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৯৪-৯৬ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হযেছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আবূ জাহল বলল : আমি যদি মুহাম্মাদকে কাবার নিকট দেখতে পাই তাহলে তার গর্দান পিষে দেব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : যদি সে এরূপ করত তাহলে ফেরেশতারা তাকে জনগণের সামনেই পাকড়াও করত। ইয়াহূদীরা যদি মৃত্যু কামনা করত তাহলে তারা মারা যেত এবং জাহান্নামে তাদের ঠিকানা দেখতে পেত। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৫৮)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ইয়াহূদীদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত, কারণ তারা তাওরাতের ওপর আমল করেনি।
২. যারা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও আমল করে না তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার তিরস্কার।
৩. ইয়াহূদীদের মিথ্যা দাবীর কথা জানতে পারলাম।
৪. মৃত্যু নামক পেয়ালা অবশ্যই সবাইকে পান করতে হবে। অতঃপর দুনিয়ার কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে।
৫. জেনে শুনে আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের শাব্দিক ও আর্থিক পরিবর্তন করা ইয়াহূদীদের চরিত্র।
৯-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতগুলোতে জুমু‘আর দিনে একজন মুসলিম ব্যক্তির করণীয় ও বর্জণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

(إِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلٰوةِ)

জুমু‘আর সালাতের জন্য যখন আযান দেওয়া হবে তখন সবকিছু বর্জন করে সালাতের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এখানে النداء বা আযান বলতে খতিব সাহেব মিম্বারে বসার পর যে আযান প্রদান করা হয় তা বুঝানো হয়েছে। এটাকে দ্বিতীয় আযান বলা হয়। প্রথম আযান হল উসমান (রাঃ) মানুষের সংখ্যাধিক্যতার কারণে যে আযান চালু করেছিলেন। সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবূ বকর ও উমার (রাঃ)-এর যুগে আযান ছিল যখন খতিব সাহেব মিম্বারে বসতেন তখন। যখন উসমান (রাঃ) খলিফা হলেন আর মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেল তখন জাওরাতে দ্বিতীয় আরেকটি আযান বৃদ্ধি করলেন। জাওরা হল الزوراء মদীনার একটি বাড়ি যা খুব উঁচু ছিল এবং মাসজিদের নিকটে ছিল। (ইবনু কাসীর, সহীহ বুখারী হা. ৯১২)

(فَاسْعَوْا إِلٰي ذِكْر)

অর্থাৎ জুমু‘আর সালাত আদায় করার জন্য মনোনিবেশ কর, সালাতের গুরুত্ব দাও। السعي দ্বারা দৌড়ানো উদ্দেশ্য নয়। কারণ সালাতের জন্য তাড়াহুড়া করা বা দৌড়ানো নিষেধ করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা. ৬৩৬)

উমার (রাঃ) বলেন :

فامضوا الي ذكر الله

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার যিকির বা সালাতের দিকে অগ্রসর হও। (ইবনু কাসীর)

ذكر الله আল্লাহ তা‘আলার স্মরণে বলতে জুমু‘আর সালাত ও উভয় খুৎবাকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর সা‘দী)।

(وَذَرُوا الْبَيْعَ)

অর্থাৎ যখন আযান দেওয়া হয় তখন সকল কাজকর্ম এমনকি ব্যবসায়-বাণিজ্য বর্জন করে সালাত আদায় করতে চলো। এজন্য সকল আলেমগণ একমত যে, দ্বিতীয় আযানের পর সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয় হারাম। (ইবনু কাসীর)

(ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ)

অর্থাৎ ব্যবসায় বাণিজ্যসহ সবকিছু বর্জন করে সালাত আদায়ের দিকে ধাবিত হওয়া উভয় জগতের জন্য কল্যাণকর। অতত্রব আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদেরকে সালাত শেষে দুনিয়াতে তিনি যে فَضْلِ বা রিযিক রেখে দিয়েছেন তা অন্বেষণ করার নির্দেশ প্রদান করছেন।

বি : দ্র : এ নির্দেশ (তথা সালাত শেষে রিযিক অন্বেষণ কর) পালন করা ওয়াজিব না। কেউ সালাত শেষে রিযিক অন্বেষণে বের না হলে গুনাহগার হবে না। মূলত এখানে নির্দেশমূলক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হল আযানের পর ব্যবসায়-বাণিজ্য নিষেধ করা হয়েছিল নির্দেশমূলক শব্দ দ্বারা তাই বৈধ হওয়ার জন্যও নির্দেশমূলক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

আরাক বিন মালেক (রাঃ) জুমু‘আর সালাত আদায় শেষে মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে বলতেন : হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি ফরয সালাত আদায় করছি, এখন আপনার নির্দেশ মতে জমিনে ছড়িয়ে পড়ছি। অতএব আপনি আমাকে আপনার উত্তম রিযিক দান করুন, আপনি তো উত্তম রিযিকদাতা। কতক সালাফ থেকে বর্ণনা এসেছে : যে ব্যক্তি জুমু‘আর সালাতের পর ক্রয়-বিক্রয় করবে আল্লাহ তা‘আলা তাতে সত্তরবার বরকত দেবেন। (ইবনু কাসীর)।

(وَاذْكُرُوا اللّٰهَ كَثِيْرًا)

অর্থাৎ ব্যবসায় বাণিজ্য লেনদেন ওঠাবসাসহ সর্বাবস্থায় বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার যিকির কর। কোন অবস্থাতেই যেন তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল না হও। এজন্য হাদীসে এসেছে : যে ব্যক্তি কোন এক বাজারে প্রবেশ করল এবং বলল :

لَا اِلٰهَ اِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَاشَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰي كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ

অর্থাৎ ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই ও তার জন্য যাবতীয় প্রশংসা এবং তিনি সবকিছুর উপরে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’-তাহলে তার জন্য এক লক্ষ নেকী লেখা হবে এবং এক লক্ষ গুনাহ মোচন করা হবে। )তিরমিযী হা. ৩৪২৮, ইবনু মাযাহ হা. ২২৩৫ হাসান)।

জুমু‘আর দিনে করণীয় :

জুমু‘আর দিন মাসজিদে আসার পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব। এটা অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ)।

অতঃপর জুমু‘আর সালাত আদায়ের জন্য সামর্থ্যানুযায়ী পরিষ্কার ও সুন্দর পোশাক পরিধান করবে। (আবূ দাঊদ হা. ১০৭৮, সনদ সহীহ)। তারপর যথাসম্ভব সুগন্ধি ব্যবহার করবে। অতঃপর আগেভাগে মাসজিদের দিকে রওনা দেবে। হাদীসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন ফরয গোসলের মত গোসল করে মাসজিদে রওনা দেবে সে যেন একটি উট কুরবানী করল। তারপর যে যাবে সে ব্যক্তি গরু কুরবানী করল….। (সহীহ বুখারী হা. ৮৮১)

তারপর যথাসম্ভব সালাত আদায় করে খতীব সাহেবের খুৎবা মনযোগসহকারে শুনবে, কোন প্রকার কথাবার্তা বলবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যে ব্যক্তি ইমাম সাহেবের খুৎবা চলাকালীন তার পার্শ্ববর্তী ভাইকে বলল : চুপ করুন, সে ব্যক্তি অনর্থক কাজ করল। (সহীহ বুখারী হা. ৮৯২)।

এভাবে যদি কেউ জুমু‘আর সালাত আদায় করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ফযীলত সম্পর্কে বলেন : এক জুমু‘আহ থেকে অপর জুমু‘আহ পর্যন্ত যে সকল অপরাধ হয়েছে তার জন্য তা কাফফারা হয়ে যাবে, তবে কবীরাহ গুনাহ থেকে বেঁেচ থাকতে হবে। (সহীহ বুখারী হা. ২৩৩)

(وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً) শানে নুযূল :

জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একটি (বাণিজ্যিক) কাফেলা জুমু‘আর দিন আগমন করল। আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। মানুষেরা ১২ জন ব্যতীত সবাই চলে গেল। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৯৯) তিরমিযীর বর্ণনামতে জাবের (রাঃ) বলছেন : একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর দিন খুৎবা প্রদান করছিলেন। এমন সময় মদীনাতে একটি (বাণিজ্যিক) কাফেলা আগমন করল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ১২ জন সাহাবী ব্যতীত সবাই সেদিকে দৌড়ালো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেন : ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! যদি তোমরাও তাদের মতো চলে যেতে, একজনও যদি না থাকতে তাহলে উপত্যকা আগুন হয়ে তোমাদের ওপর পতিত হতো। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (তিরমিযী হা. ৩৩১১ সহীহ।) জাবের (রাঃ) বলছেন, ১২ জনের মধ্যে আবূ বকর ও উমার (রাঃ)-ও ছিলেন।

ঘটনাটি হচ্ছে : মদীনাতে তখন খুব অভাব-অনটন ছিল। বাইরের এলাকা থেকে কেউ কিছু আমদানী করে নিয়ে আসে না। দীর্ঘদিন পর এ কাফেলাটি আসছিল জুমু‘আর দিন খুৎবার সময়। তখন একজন ঘোষণা দিল অমুকের কাফেলা পণ্য নিয়ে এসেছে। যার কারণে সাহাবীগণ ছুটে গিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর দিন আগে সালাত আদায় করতেন পরে খুৎবা দিতেন ঈদের সালাতের মত। যখন এরূপ একদিন সালাত আদায় করে খুৎবা দিচ্ছিলেন আর একজন লোক প্রবেশ করে বলল : দাহইয়া বিন খলিফা তার বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে আগমন করেছে। তখন কয়েকজন সাহাবী ব্যতীত সবাই চলে গেল। (আবূ দাঊদ তার মারাসিল গ্রন্থে জুমু‘আর খুৎবা অধ্যায়, বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য)।

(وَتَرَكُوْكَ قَآئِمًا)

এ আয়াত প্রমাণ করছে খতিব সাহেব দাঁড়িয়ে খুৎবা প্রদান করবেন। সহীহ মুসলিমের হাদীস : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খুৎবা দুটি ছিল। দু খুৎবার মাঝে বসতেন। (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা. ১৪০৫)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জুমু‘আহ প্রত্যেক সুস্থ ও বাড়িতে অবস্থানকারী প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম পুরুষ ব্যক্তির ওপর ফরয।
২. জুমু‘আর খুতবার আযানের পর সকল প্রকার ব্যবসায় বাণিজ্য হারাম।
৩. জুমু‘আর দিনের ফযীলত জানতে পারলাম।
৪. জুমু‘আর দিন দ্বিতীয় আযান দেওয়া বৈধ হবে উসমান (রাঃ) যে কারণে চালু করেছেন যদি সে কারণ পাওয়া যায়।
৫. জুমু‘আর দিনের করণীয় ও বর্জণীয় সম্পর্কে জানলাম।
৬. জুমু‘আর খুতবা হবে দু’টি এবং তা হবে দাঁড়িয়ে ও প্রয়োজনে মাতৃভাষায়।
৭. জুমু‘আর সালাত আদায় করা যেমন ওয়াজিব তেমন খুৎবা শোনাও ওয়াজিব। খুৎবা চলাকালে কথা বলা ও কোন কাজ করা নিষেধ।

১-১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) জুমআর নামাযে সূরায়ে জুমআহ ও সূরায়ে মুনাফিকূন পাঠ করতেন।

১-৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, সৃষ্ট সব কিছু বাকশক্তি সম্পন্ন হোক বা নির্বাক হোক, সদা-সর্বদা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় মগ্ন রয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এমন কোন জিনিস নেই যে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করে না।” (১৭:৪৪) সমস্ত মাখলুক, আসমানেরই হোক বা যমীনেরই হোক, তাঁর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় মশগুল রয়েছে। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর বাদশাহ্ এবং এ দু’টির মধ্যে তিনি পূর্ণভাবে স্বীয় ব্যবস্থাপনা ও হুকুম জারীকারী। তিনি সর্ব প্রকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি দোষ মুক্ত এবং সমস্ত উত্তম গুণাবলী ও বিশেষণের সাথে বিশেষিত। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানময়। এর তাফসীর কয়েক জায়গায় গত হয়েছে।

উম্মী দ্বারা আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বলঃ তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছো? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমার কর্তব্য শুধু প্রচার করা। আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” (৩:২০)

এখানে আরবের উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, অনারব এর অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং কারণ শুধু এটাই যে, তাদের উপর অন্যদের তুলনায় ইহ্সান ও ইকরাম বহুগুণে বেশী রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)

অথাৎ “নিশ্চয়ই এটা তোমার জন্যে ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্যে উপদেশ।” (৪৩:৪৪) এখানেও কওমকে খাস করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, কুরআন সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে উপদেশ। অনুরূপভাবে আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দেরকে ভীতি প্রদর্শন কর।” (২৬:২১৪) এখানেও উদ্দেশ্য এটা কখনই নয় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ভীতি প্রদর্শন শুধুমাত্র তাঁর আত্মীয়-স্বজনের জন্যেই খাস, বরং তাঁর সতর্ককরণ তো সাধারণভাবে সবারই জন্যে। মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ!) তুমি বলঃ হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবারই নিকট আল্লাহর রাসূল (রূপে এসেছি)।” (৭:১৫৮) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এর মাধ্যমে আমি তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে এবং তাদেরকেও, যাদের কাছে পৌঁছবে।” (৬:১৯) অনুরূপভাবে কুরআন সম্পর্কে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “সমস্ত দলের মধ্যে যে কেউই এটাকে অস্বীকার করবে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।” (১১:১৭) এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে যেগুলো দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সারা বিশ্ববাসীর জন্যে রাসূল। সমস্ত মাখলুকের তিনি নবী, তারা লাল হোক না কালোই হোক। সূরায়ে আনআমের তাফসীরে আমরা এটা পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছি এবং বহু আয়াত ও হাদীসও আনয়ন করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই জন্যে।

এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, ঐ নিরক্ষর অর্থাৎ আরবদের মধ্যে তিনি স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এটা এই জন্যে যে, যেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দু’আ কবূল হওয়া জানা যায়। তিনি মক্কাবাসীর জন্যে আল্লাহ্ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেছিলেন যে, তিনি যেন তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে পাপ হতে পবিত্র করবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর এ দু’আ কবূল করেন।

ঐ সময় সমস্ত মাখলুকের জন্যে আল্লাহর নবীর কঠিন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আহলে কিতাবের শুধুমাত্র কতক লোক হযরত ঈসা (আঃ)-এর সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা ইফরাত ও তাফরীত হতে বেঁচে ছিলেন। তাঁরা ছাড়া দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সত্য দ্বীনকে ভুলে বসেছিল এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন। তিনি ঐ নিরক্ষরদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনালেন, তাদেরকে পাপ হতে পবিত্র করলেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিলেন। অথচ ইতিপূর্বে তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে ছিল।

আরবরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের দাবীদার ছিল বটে, কিন্তু অবস্থা এই ছিল যে, তারা ঐ দ্বীনকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বদল করে ফেলেছিল। তারা ঐ দ্বীনের মধ্যে এতো বেশী পরিবর্তন আনয়ন করেছিল যে, তাওহীদ শিরকে এবং বিশ্বাস সন্দেহে পরিবর্তিত হয়েছিল। তারা নিজেরাই বহু কিছু বিদআত আবিষ্কার করে নিয়ে আল্লাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছিল। অনুরূপভাবে আহলে কিতাবও তাদের কিতাবগুলো বদলিয়ে দিয়েছিল, সাথে সাথে অর্থেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা হয়রত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে আযীমুশ শান শরীয়ত এবং পরিপূর্ণ দ্বীনসহ দুনিয়াবাসীর নিকট প্রেরণ করেন, যেন তিনি এই গোলযোগ মিটিয়ে দিতে পারেন। যেন তিনি আহলে কিতাবের নিকট মহান আল্লাহর আসল আহকাম পৌঁছিয়ে দেন, তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির আহকাম জনগণকে জানিয়ে দেন, এমন আমল তাদেরকে বাতলিয়ে দেন যা তাদেরকে জানাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভ করাবে, তিনি সমস্ত মাখলুকের জন্যে পথ প্রদর্শক হন, শরীয়তের মূল ও শাখা সবই শিক্ষা দেন, ছোট বড় কোন কথা ও কাজ না ছাড়েন, সবারই সমস্ত শক-সন্দেহ দূর করে দেন এবং জনগণকে এমন দ্বীনের উপর আনয়ন করেন যার মধ্যে সর্বপ্রকারের মঙ্গল বিদ্যমান রয়েছে।

এসব মহান দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মধ্যে এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও বুযুর্গী একত্রিত করেন যা না তার পূর্বে কারো মধ্যে ছিল এবং না তার পরে কারো মধ্যে থাকতে পারে। মহান আল্লাহ সদা-সর্বদা তার উপর দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করতে থাকুন!

(আরবী)-এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পার্শ্বে বসেছিলাম এমন সময় তার উপর সূরায়ে জুমআহ অবতীর্ণ হয়। জনগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! (আরবী)দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে?” কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না। তিনবার এই প্রশ্ন করা হয়। আমাদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসীও (রঃ) ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাতখানা হযরত সালমান ফারসীর (রাঃ) উপর রেখে বললেনঃ “ঈমান যদি সারিয়্যা নক্ষত্রের নিকট হতো তাহলেও এই লোকগুলোর মধ্যে এক বা কয়েক ব্যক্তি এটা পেয়ে যেতো।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু আবদিল্লাহ বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এ রিওয়াইয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এটা মাদানী সূরা এবং এটাও প্রমাণিত হচ্ছে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে নবী, শুধু আরববাসীদের জন্যে নয়। কেননা, তিনি এই আয়াতের তাফসীরে পারস্যবাসীদের সম্পর্কে উপরোক্তে মন্তব্য করেন। এ জন্যেই তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) পারস্য ও রোমের সম্রাটদের নিকট ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও বলেন যে, এর দ্বারা অনারবদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে এবং তাঁর অহীর সত্যতা স্বীকার করেছে।

হযরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ “এখন হতে নিয়ে বংশানুক্রমে তিন পুরুষ (পিড়ী) পর্যন্ত আগমনকারী আমার উম্মতের নারী ও পুরুষরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” অতঃপর তিনি ….(আরবী) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

‘তিনি (আল্লাহ) পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ অর্থাৎ তিনি স্বীয় শরীয়ত ও তকদীর নির্ধারণে প্রবল পরাক্রম ও মহাবিজ্ঞানময়।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা এটা তিনি দান করেন। আল্লাহ তো বড় অনুগ্রহশীল।’ অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে এরূপ আযীমুশ শান নবুওয়াত দান করা এবং এই মহান অনুগ্রহে অনুগৃহীত করা আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করে থাকেন। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল।
৫-৮ নং আয়াতের তাফসীর:

এই আয়াতগুলোতে ইয়াহূদীদেরকে নিন্দে করা হচ্ছে যে, তাদেরকে তাওরাত। প্রদান করা হয় এবং আমল করার জন্যে তারা তা গ্রহণ করে, কিন্তু আমল করেনি। ঘোষিত হচ্ছে যে, তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে পুস্তক বহনকারী গর্দভ। যদি গর্দভের উপর কিতাবের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তবে সে তো এটা বুঝতে পারবে যে, তার উপর বোঝা রয়েছে, কিন্তু কি বোঝা রয়েছে তা সে মোটেই বুঝতে পারবে না। অনুরূপভাবে এই ইয়াহূদীরা বাহ্যিকভাবে তো তাওরাতের শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করছে, কিন্তু মতলব কিছুই বুঝে না। এর উপর তারা আমল তো করেই না, এমন কি একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে ফেলছে। সুতরাং প্রকতপক্ষে তারা এ নির্বোধ ও অবুঝ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা, মহান আল্লাহ এদেরকে বোধশক্তিই দান করেননি। কিন্তু এ লোকগুলোকে তো তিনি বোধশক্তি দিয়েছেন, অথচ তারা তা ব্যবহার করে না ও কাজে লাগায় না। এ জন্যেই অন্য আয়াতে বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট! তারাই গাফিল।” (৭:১৭৯)

এখানে বলা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাদের দৃষ্টান্ত কতই না নিকৃষ্ট। তারা অত্যাচারী এবং আল্লাহ তা’আলা অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি জুমআর দিন ইমামের খুৎবাহ দান অবস্থায় কথা বলে সে পুস্তক বহনকারী গর্দভের মত এবং যে ব্যক্তি তাকে বলেঃ চুপ কর তার জুমআ’হ্ হয় না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে ইয়াহুদীগণ! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য কোন মানব গোষ্ঠী নয়, তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ অর্থাৎ হে ইয়াহূদীদের দল! যদি তোমাদের দাবী এই হয় যে, তোমরা সত্যের উপর রয়েছে আর হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এবং তাঁর সহচরবৃন্দ অসত্যের উপর রয়েছেন তবে তোমর প্রার্থনা করঃ আমাদের দুই দলের মধ্যে যারা অসত্যের উপর রয়েছে তাকে যেন আল্লাহ মৃত্যু দান করেন।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “কিন্তু তাদের হস্ত যা অগ্রে প্রেরণ করেছে তার কারণে কখনো মত্য কামনা করবে না। অর্থাৎ যারা যে কুফরী, যুলম ও পাপের কাজ করেছে সেই কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না।

আল্লাহ তা’আলা যালিমদের সম্পর্কে সম্যক অবগত।

সূরায়ে বাকারার নিম্নের আয়াতগুলোর তাফসীরে ইয়াহুদীদের সাথে। মুবাহালার পূর্ণ বর্ণনা গত হয়েছেঃ “বলঃ যদি আল্লাহর নিকট পরকালের বাসস্থান অন্য লোকে ব্যতীত বিশেষভাবে শুধু তোমাদের জন্যেই হয় তবে তোমরা মুত্যু কামনা কর- যদি সত্যবাদী হও। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের জন্যে তারা কখনো ওটা কামনা করবে না এবং আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে অবহিত। তুমি অবশ্যই তাদেরকে জীবনের প্রতি সমস্ত মানুষ, এমনকি মুশরিকদের অপেক্ষা অধিক লোভী দেখতে পাবে। তাদের প্রত্যেকে সহস্র বছর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু দীর্ঘায়ু তাদেরকে শাস্তি হতে দূরে রাখতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ ওর দ্রষ্টা।” সূরায়ে আলে ইমরানের নিম্নের আয়াতে খৃষ্টানদের সাথে মুবাহালার বর্ণনা রয়েছেঃ

“তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বলঃ এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে; অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দিই আল্লাহর লানত।” আর মুশরিকদের সাথে মুবাহালার বর্ণনা রয়েছে সূরায়ে মারইয়ামের নিম্নের আয়াতে “বলঃ যারা বিভ্রান্তিতে রয়েছে, দয়াময় তাদেরকে প্রচুর ঢিল দিবেন।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আবু জেহেল (আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি লা’নত বর্ষণ করুন!) বলেঃ “আমি যদি মুহাম্মাদ (সঃ)-কে কা’বার নিকট দেখতে পাই তবে অবশ্যই তার গর্দান পরিমাপ করবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি বলেনঃ “যদি সে এরূপ করতো তবে অবশ্যই ফেরেশতাগণ জনগণের চোখের সামনে তাকে পাকড়াও করতেন। আর যদি ইয়াহূদীরা মৃত্যু কামনা করতো তবে অবশ্যই তারা মরে যেতো এবং জাহান্নামে তাদের জায়গা দেখে নিতো। আর আল্লাহর সাথে যারা মুবাহালা করতে চেয়েছিল তারা যদি মুবাহালার জন্যে বের হতো তবে অবশ্যই তারা এমন অবস্থায় ফিরে আসতো যে, তাদের পরিবারবর্গ এবং মাল-ধন তারা। পেতো না।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার উক্তিঃ বলঃ (হে মুহাম্মাদ সঃ)! তোমরা যে মৃত্যু হতে পলায়ন কর সেই মৃত্যুর সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হবেই। অতঃপর তোমরা প্রত্যানীত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা আল্লাহর নিকট এবং তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে যা তোমরা করতে। যেমন সূরায়ে নিসার মধ্যে আল্লাহ তা’আলার উক্তি রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, সুউচ্চ ও সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও।”

তিবরানী (রঃ)-এর মু’জাম গ্রন্থে হযরত সমরা’ (রাঃ) হতে একটি মারফ হাদীস বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি মৃত্যু হতে পলায়ন করে তার দৃষ্টান্ত হলো ঐ খেকশিয়াল যার কাছে ভূমি তার প্রদত্ত ঋণ চায়। তখন সে দ্রুত বেগে পালাতে শুরু করে। শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তার গর্তে ঢুকে পড়ে। তখন ভূমি তাকে বলেঃ “হে খেকশিয়াল! আমাকে আমার ঋণ দিয়ে দাও।” একথা শুনে সে পুনরায় লেজগুটিয়ে ভীষণ বেগে দৌড়াতে শুরু করে। অবশেষে তার গর্দান ভেঙ্গে যায় এবং সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।”
৯-১০ নং আয়াতের তাফসীর:

(আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দ হতে বের করা হয়েছে, কারণ এই যে, এই দিনে মুসলমানরা বড় বড় মসজিদে ইবাদতের জন্যে জমা বা একত্রিত হয়ে থাকে। আর এটিও একটি কারণ যে, এই দিনে সমস্ত মাখলুকের সৃষ্টি-কার্য পূর্ণ হয়েছিল। ছয় দিনে সারা জগত বানানো হয়। ষষ্ঠ দিন ছিল জুমআর দিন। এই দিনেই হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়। এই দিনেই জান্নাতে তাঁর অবস্থান ঘটে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত হতে বের করে দেয়া হয়। এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এই দিনের মধ্যে এমন একটি সময় রয়েছে যে, ঐ সময়ে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট যা যা করা হয় তা-ই তিনি দান করে থাকেন।

হযরত সালমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে সালমান (রাঃ)! জুমআর দিন কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জমুআহর দিন এমন এক দিন যে, এ দিনে তোমাদের পিতা-মাতাকে (হযরত আদম আঃ ও হযরত হাওয়া আঃ কে) আল্লাহ একত্রিত করেন। অথবা বলেনঃ “তোমাদের পিতাকে (হযরত আদমকে আঃ) জমা করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে (মাওকুফরূপেও) অনুরূপ বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

প্রাচীন অভিধানে এটাকে ইয়াওমুল আরূবাহ বলা হতো। পূর্ববর্তী উম্মতদেরকেও প্রতি সাতদিনে একটি দিন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জুমআর দিনের হিদায়াত তারা লাভ করেনি। ইয়াহূদীরা শনিবারকে পছন্দ করে যেদিন মাখলুকের সৃষ্টি কার্য শুরুই হয়নি। নাসারাগণ রবিবারকে পছন্দ করে যেই দিন মাখলুক সৃষ্টির সূচনা হয়। আর এই উম্মতের জন্যে আল্লাহ তা’আলা জুমআ’হূকে পছন্দ করেছেন যেই দিন তিনি মাখলুকের সৃষ্টিকার্য পরিপূর্ণ করেছেন। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা (দুনিয়ায়) সর্বশেষে আগমনকারী, আর কিয়ামতের দিন আমরা সর্বাগ্রে হবো। যাদেরকে আমাদের পূর্বে (আসমানী) কিতাব দেয়া হয় তারা এ দিনের ব্যাপারে মতভেদ করে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। এ ব্যাপারেও তারা আমাদের পিছনে রয়েছে। ইয়াহূদীরা আগামী কাল এবং খৃষ্টানরা আগামী কালের পরের দিন।” এটা সহীহ বুখারীর শব্দ আর সহীহ মুসলিমের শব্দ হলোঃ আল্লাহ তা’আলা জুমআহ্ হতে ভ্রষ্ট করেছেন আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে। ইয়াহুদীদের জন্যে ছিল শনিবার এবং খৃষ্টানদের জন্যে ছিল রবিবার। অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আমাদেরকে আনয়ন করেন এবং জুমআ’হর জন্যে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেন। সুতরাং তিনি রেখেছেন শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার। এভাবে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা কিয়ামতের দিন আমাদের পিছনে থাকবে। দুনিয়াবাসীর হিসেবে আমরা শেষে রয়েছি। কিন্তু কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকের মধ্যে সর্বপ্রথম আমাদের ব্যাপারে ফায়সালা করা হবে।”

এখানে আল্লাহ তা’আলা জুমআর দিন স্বীয় মুসলিম বান্দাদেরকে তাঁর ইবাদতের জন্যে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। (আরবী) দ্বারা এখানে দৌড়ানো উদ্দেশ্য নয়, বরং ভাবার্থ হচ্ছেঃ তোমরা আল্লাহর যিকর অর্থাৎ নামাযের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়, কাজ-কর্ম ছেড়ে দিয়ে মসজিদ পানে অগ্রসর হও। যেমন মহান আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “মুমিন অবস্থায় যে আখিরাতের কামনা করে এবং ওর জন্যে চেষ্টা সাধনা করে।” (১৭:১৯)

হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআত (আরবী) এর স্থলে (আরবী) রয়েছে। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, নামাযের জন্যে দৌড়িয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা ইকামত শুনলে নামাযের জন্যে ধীরে সুস্থে যাবে, দৌড়াবে না। নামাযের যে অংশ (জামাআতের সাথে) পাবে তা পড়ে নিবে এবং যা ছুটে যাবে তা পুরো করবে।” অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) নামাযে ছিলেন এমতাবস্থায় তিনি দরযার কাছে জনগণের পায়ের জোর শব্দ শুনতে পান। নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “ব্যাপার কি?” সাহাবীগণ উত্তরে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তাড়াতাড়ি করে নামাযে শরীক হয়েছি।” তখন তিনি বললেনঃ “না, না, এরূপ করো না। ধীরে সুস্থে নামাযে আসবে। যা পাবে পড়বে এবং যা ছুটে যাবে তা পুরো করে নিবে।” হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “আল্লাহর শপথ! এখানে এ হুকুম কখনো নয় যে, মানুষ নামাযের জন্যে দৌড়িয়ে আসবে। এটা তো নিষেধ। বরং এখানে উদ্দেশ্য হলো অত্যন্ত আগ্রহ, মনোযোগ ও বিনয়ের সাথে নামায পড়া। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ স্বীয় মন ও আমল দ্বারা চেষ্টা কর। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তিনি (হযরত ইসমাঈল আঃ) এমন বয়সে পদার্পণ করলেন যে, তাঁর সাথে (হযরত ইবরাহীম আঃ এর সাথে) চলাফেরা করতে সক্ষম হলেন।” (৩৭:১০২) জুমআর নামাযের জন্যে আগমনকারীর জুমআ’হর পূর্বে গোসল করা উচিত।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যখন জুমআ’হর জন্যে আসবে তখন যেন সে গোসল করে নেয়। এ দু’ গ্রন্থেই হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জুমআর দিন প্রত্যেক মুসলমানের উপর গোসল ওয়াজিব।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ প্রত্যেক মুসলমানের উপর আল্লাহর হক এই যে, সে প্রতি সাত দিনে এক দিন গোসল করবে, যাতে সে তার মাথা ও শরীর ধৌত করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে প্রতি সাত দিনে একদিন গোসল রয়েছে এবং তা হলো জুমআর দিন।” (ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম হিব্বান (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

হযরত আউস ইবনে আউস সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন ভালভাবে গোসল করে এবং সকালেই মসজিদ পানে রওয়ানা হয়ে যায়, পায়ে হেঁটে যায়, সওয়ার হয় না, ইমামের নিকটবর্তী হয়ে বসে মনোযোগের সাথে খুৎবাহ শুনে এবং বাজে কথা বলে না, সে প্রতি পদক্ষেপের বিনিময়ে সারা বছরের রোযা ও সারা বছরের কিয়ামের (রাত্রে দাঁড়িয়ে ইবাদত করার) পুণ্য লাভ করে।” (এ হাদীসটি আহলে সুনানে আরবাআহ ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে খুবই উত্তম বলেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জুমআর দিন যে ব্যক্তি নাপাক অবস্থার গোসলের ন্যায় গোসল করে আওয়াল বা প্রথম সময়ে মসজিদে গেল সে যেন একটা উট কুরবানী করলো, যে দ্বিতীয় সময়ে হাযির হলো সে যেন একটা গরু কুরবানী করলো, যে তৃতীয় সময়ে পৌঁছলো সে একটা মেষ কুরবানী করার সওয়াব পেলো, যে হাযির হলো চতুর্থ ওয়াক্তে সে যেন সাদকাহ করলো একটা মোরগ এবং যে হাযির হলো পঞ্চম ওয়াক্তে, একটা ডিম আল্লাহর পথে সাদকাহ করার মত পুণ্য সে লাভ করলো। অতঃপর যখন ইমাম (খুত্বাহ দেয়ার উদ্দেশ্যে) বের হয় তখন ফেরেশতামণ্ডলী। হাযির হয়ে যিক্র শুনতে থাকেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

জুমআ’র দিন স্বীয় সাধ্য অনুযায়ী ভাল পোশাক পরা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, মিসওয়াক করা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পাক-পবিত্র হয়ে জুমআর নামাযের জন্যে আসা উচিত। একটি হাদীসে গোসলের বর্ণনার সাথে সাথেই মিসওয়াক করা ও সুগন্ধি ব্যবহারের বর্ণনাও রয়েছে।

হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করে ও স্বীয় পরিবারের লোকদেরকে সুগন্ধি মাখায় যদি থাকে, অতঃপর ভাল কাপড় পরিধান করে মসজিদে আসে ও ইচ্ছা হলে কিছু নফল নামায পড়ে নেয় এবং কাউকেও কষ্ট দেয় না (অর্থাৎ কারো ঘাড়ের উপর দিয়ে যায় না ও কোন উপবিষ্ট লোককে উঠায় না), অতঃপর ইমাম এসে খুৎবাহ শুরু করলে নীরবে তা শুনতে থাকে, তার এই জুমআহ্ হতে পরবর্তী জুমআ’হ্ পর্যন্ত যত পাপ হয় সবই কাফফারা বা মাফ হয়ে যায়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সুনানে আবু দাউদে ও সুনানে ইবনে মাজা হতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে। সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি মিম্বরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি দৈনন্দিনের পরিশ্রমের কাপড় ছাড়া দু’টি কাপড় ক্রয় করে নিয়ে জুমআর নামাযের জন্যে খাস বা নির্দিষ্টি করে রাখে তবে ক্ষতি কি?” একথা তিনি ঐ সময় বলেন যখন দেখেন যে, জনগণ সাধারণ কাপড় পরিধান করে রয়েছে। তাই তিনি বলেন যে, শক্তি থাকলে কেন এরূপ করবে না?

এ আয়াতে যে আযানের বর্ণনা রয়েছে ওর দ্বারা ঐ আযান উদ্দেশ্য যা ইমামের মিম্বরের উপর বসার পর দেয়া হয়। নবী (সঃ)-এর যুগে এ আযান ছিল। যখন নবী (সঃ) বাড়ী হতে বেরিয়ে এসে মিম্বরে উপবেশন করতেন তখন তাঁর সামনে এই আযান দেয়া হতো। এর পূর্ববর্তী আযান নবী (সঃ)-এর যুগে ছিল না। আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান (রাঃ) শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এই আযান চালু করেন। সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, নবী (সঃ), হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ)-এর যুগে জুমুআহর আযান শুধু ঐ সময় হতো যখন ইমাম খুৎবাহ দেয়ার জন্যে মিম্বরে বসতেন। হযরত উসমান। (রাঃ)-এর যুগে যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলো তখন তিনি এই দ্বিতীয় আযান একটি পৃথক স্থানের উপর বলিয়ে নেন। ঐ স্থানটির নাম ছিল যাওরা, মসজিদের নিকটবর্তী সর্বাপেক্ষা উঁচু জায়গা এটাই ছিল।

হযরত মাকল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন ইমাম জুমআর খুত্বার জন্যে বেরিয়ে আসতেন তখনই শুধু মুআযযিন আযান দিতেন। এর পর শুধু তাকবীর দেয়া হতো এবং মুসল্লীগণ নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। এই সময়েই ক্রয়-বিক্রয় হারাম হয়ে যায়। হযরত উসমান (রাঃ) শুধু লোক জমা করবার জন্যেই প্রথম আযান চালু করেন।

জুমআ’হয় হাযির হওয়ার হুকুম শুধু আযাদ-পুরুষদের উপর রয়েছে। নারী, গোলাম ও শিশুদের উপর এ হুকুম নেই। রুগ্ন, মুসাফির এবং অন্যান্য মাযুর ব্যক্তিদের উপরও এ হুকুম প্রযোজ্য নয়। যেমন ফুরূর কিতাব সমূহের মধ্যে এর প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। অর্থাৎ বেচা-কেনা ত্যাগ করে তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও।

উলামায়ে কিরাম এই ব্যাপারে একমত যে, জুমআর দিন যখন আযান হয়ে যাবে তখন এর পরে বেচা-কেনা সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যাবে। তবে দাতা যখন দিবে তখন সেটাও শুদ্ধ হবে কি-না এই ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। প্রকাশ্য আয়াত দ্বারা তো এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, ওটাও শুদ্ধ হবে না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ বেচা-কেনা ছেড়ে আল্লাহর যিকর ও নামাযের দিকে তোমাদের গমন তোমাদের জন্যে শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। হ্যাঁ, তবে যখন তোমাদের নামায পড়া হয়ে যাবে তখন সেখান হতে চলে যাওয়া এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধানে লেগে পড়া তোমাদের জন্যে বৈধ।

আরাক ইবনে মালিক (রাঃ) জুমআর নামায হতে ফারেগ হয়ে মসজিদের দরযার উপর দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নিম্নের দু’আটি পাঠ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি ও আপনার হুকুম অনুযায়ী এই সমাবেশ হতে উঠে এসেছি (ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি), সুতরাং আপনি আমাকে আপনার অনুগ্রহ দান করুন, আপনি তো সর্বোত্তম রিযকদাতা।” (এটা ইমাম ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এই আয়াতকে সামনে রেখে পূর্বযুগীয় কয়েকজন মনীষী বলেছেন যে, যে ব্যক্তি জুমআর দিন নামাযের পরে ক্রয়-বিক্রয় করে আল্লাহ তা’আলা তাকে সত্তর গুণ বেশী বরকত দান করবেন।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে। অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ের অবস্থাতে আল্লাহকে স্মরণ করবে। দুনিয়ার লাভের মধ্যে এমনভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়বে না যে, পরকালের লাভের কথা একেবারে ভুলে যাবে। এজন্যেই হাদীসে এসেছেঃ “যে ব্যক্তি কোন বাজারে গিয়ে পাঠ করেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, রাজত্ব ও প্রশংসা তাঁরই এবং তিনি প্রত্যেক জিনিসের উপর ক্ষমতাবান।” আল্লাহ তা’আলা তার জন্যে এক লক্ষ পুণ্য লিখে নেন এবং এক লক্ষ পাপ ক্ষমা করে থাকেন।

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, বান্দা তখনই আল্লাহর অধিক যিকরকারী হতে পারে যখন সে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে সর্বাবস্থাতেই আল্লাহর যিকর করে।
# জুমআ’হ্‌র দিন মদীনায় ব্যবসার মাল আসার কারণে যেসব সাহাবী খুৎবাহ ছেড়ে দিয়ে উঠে গিয়েছিলেন তাঁদেরকে এখানে আল্লাহ তা’আলা ধমক দিচ্ছেন যে, এই সব লোক যখন কোন ব্যবসা ও খেল-তামাশা দেখে তখন ওদিকে ছুটে যায় এবং নবী (সঃ)-কে দণ্ডায়মান অবস্থায় ছেড়ে দেয়। হযরত মুকাতিল ইবনে হিব্বান (রঃ) বলেন যে, ওটা ছিল দাহইয়া ইবনে খালফিয়্যাহ (রাঃ)-এর ব্যবসার মাল। তিনি জুমআ’রহ দিন ব্যবসার মালসহ মদীনায় আগমন করেন এবং খবর প্রচারের উদ্দেশ্যে ঢোল বাজাতে শুরু করেন। তিনি তখন পর্যন্ত মুসলমান হননি।

ঢোলের শব্দ শুনে মাত্র কয়েকজন ছাড়া সবাই মসজিদ হতে বেরিয়ে পড়েন। মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, মাত্র বারো জন লোক বসে থাকেন এবং বাকী সবাই ঐ বাণিজ্যিক কাফেলার দিকে ছুটে যান। ঐ সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। মুসনাদে আবূ ইয়ালায় হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে যে হাদীসটি বর্ণিত আছে তাতে এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যদি তোমরা সবাই চলে যেতে এবং তোমাদের একজনও বাকী না থাকতো তবে যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! এই উপত্যকা আগুন হয়ে তোমাদের উপর পতিত হতো। “যাঁরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট রয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে হযরত আবূ বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ)-ও ছিলেন।

এই আয়াত দ্বারা এটাও জানা গেল যে, জুমআ’র খুৎবা দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির ইবনে সামরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) জুমআ’’র দিন দু’টি খুৎবাহ পাঠ করতেন, মাঝে বসতেন, কুরআন কারীম তিলাওয়াত করতেন এবং জনগণকে উপদেশ দিতেন। এখানে একথাটিও স্মরণ রাখার বিষয় যে, কারো কারো মতে এটা হলো ঐ সময়ের ঘটনা যখন নবী (সঃ) জুমআ’হর নামাযের পরে খুৎবাহ পাঠ করতেন।

মারাসীলে আবি দাউদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুৎবাহর পূর্বে জুমআ’হর নামায পড়তেন, যেমন ঈদের নামায পড়া হয়। একদা তিনি খুৎবাহ দিচ্ছিলেন। এমন সময় একটি লোক এসে বললোঃ “দাহিয়্যাহ্ খালফিয়্যাহ (রাঃ) ব্যবসার মাল নিয়ে এসেছে।” একথা শোনামাত্রই কয়েকজন ছাড়া সবাই উঠে যান।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি জনগণকে জানিয়ে দাও যে, আখিরাতের সাওয়াব, যা আল্লাহর নিকট রয়েছে তা ক্রয়-বিক্রয় ও খেল-তামাশা হতে বহুগুণে উত্তম। আল্লাহর উপর ভরসা করে অনুমতিযুক্ত সময়ে যে ব্যক্তি রিযক তলব করবে, আল্লাহ তাকে উত্তমরূপে রিযক দান করবেন।

Leave a Reply