Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৭৭/ এবং কাফের-রা বলে:-২৩) [*আল কোরআন ও মহাবিশ্ব :- **কোরআন ও কবিতার মৌলিক পার্থক্য :- *কাফেরদের জন্য অনুতাপ ও আফসোসের কারণ হবে:-] www.motaher21.net সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ পারা:২৯ ৩৮-৫২ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

( বই # ১১৭৭/ এবং কাফের-রা বলে:-২৩)
[*আল কোরআন ও মহাবিশ্ব :-
**কোরআন ও কবিতার মৌলিক পার্থক্য :-
*কাফেরদের জন্য অনুতাপ ও আফসোসের কারণ হবে:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ
পারা:২৯
৩৮-৫২ নং আয়াত:-

আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৩৮
فَلَاۤ اُقۡسِمُ بِمَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿ۙ۳۸﴾
অতএব তা নয়। আমি শপথ করছি ঐ সব জিনিসের ও যা তোমরা দেখতে পাও।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৩৯
وَ مَا لَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿ۙ۳۹﴾
এবং ঐসব জিনিসের যা তোমরা দেখতে পাওনা।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪০
اِنَّہٗ لَقَوۡلُ رَسُوۡلٍ کَرِیۡمٍ ﴿ۚۙ۴۰﴾
নিশ্চয়ই এই কুরআন এক সম্মানিত রসূলের বার্তা।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪১
وَّ مَا ہُوَ بِقَوۡلِ شَاعِرٍ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تُؤۡمِنُوۡنَ ﴿ۙ۴۱﴾
আর এটা কোন কবির কথা নয়; তোমরা খুব অল্পই ঈমান পোষণ করে থাক,
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪২
وَ لَا بِقَوۡلِ کَاہِنٍ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ ﴿ؕ۴۲﴾
আর এটা কোন গণকের গণনাও নয়। তোমরা খুব কমই চিন্তা-ভাবনা করে থাকো।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৩
تَنۡزِیۡلٌ مِّنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۴۳﴾
এটা বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৪
وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ ﴿ۙ۴۴﴾
তিনি যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতেন!
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৫
لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ بِالۡیَمِیۡنِ ﴿ۙ۴۵﴾
তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৬
ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡہُ الۡوَتِیۡنَ ﴿۫ۖ۴۶﴾
এবং কেটে দিতাম তার জীবন-ধমনী।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৭
فَمَا مِنۡکُمۡ مِّنۡ اَحَدٍ عَنۡہُ حٰجِزِیۡنَ ﴿۴۷﴾
তোমাদের কেউ-ই (আমাকে) এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতো না।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৮
وَ اِنَّہٗ لَتَذۡکِرَۃٌ لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۴۸﴾
এই কুরআন আল্লাহভীরুদের জন্য অবশ্যই এক উপদেশ।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৪৯
وَ اِنَّا لَنَعۡلَمُ اَنَّ مِنۡکُمۡ مُّکَذِّبِیۡنَ ﴿۴۹﴾
আমি জানি তোমাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে থাকবে।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৫০
وَ اِنَّہٗ لَحَسۡرَۃٌ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۵۰﴾
নিশ্চিতভাবে তা এসব কাফেরদের জন্য অনুতাপ ও আফসোসের কারণ হবে।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৫১
وَ اِنَّہٗ لَحَقُّ الۡیَقِیۡنِ ﴿۵۱﴾
এটি অবশ্যই এক নিশ্চিত সত্য।
সুরা: ৬৯: আল্ হাক্কাহ:-৫২
فَسَبِّحۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الۡعَظِیۡمِ ﴿٪۵۲﴾
অতএব আপনি আপনার মহান রবের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।
ফী জিলালিল কুরআন:   *আল কোরআন ও মহাবিশ্ব :  আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যা দেখতে পাও এবং যা দেখতে পাওনা উভয় প্রকারের জিনিসের শপথ করে বলছি যে, এ বাণী একজন সম্মানিত রসূলের মুখ উচ্চারিত বাণী-কোনাে কবির উক্তি নয়। তােমরা আসলে কদাচিতই ঈমান এনে থাকো। এটা কোনাে জ্যোতিষীর কথাও নয়। তােমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। এটা আসলে বিশ্ব প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিল করা শিক্ষা।’ ইসলাম যে সত্য, তার শিক্ষা যে সত্য ও নির্ভুল, তার আকীদা বিশ্বাস ও কর্মের শিক্ষা যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত, সে কথা কোনাে শপথের অপেক্ষা রাখে না। এ বাণী যে কোনাে কবি, কোনাে জ্যোতিষী কিংবা কোনাে মনগড়া মিথ্যা অলীক কাহিনী রচনাকারীর মুখ থেকে বের হয়নি বরং একজন নিরক্ষর ও পরম সত্যবাদী মানুষের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে, তা তৎকালীন আরবরাও খুব ভালাে করে জানতাে। তা সত্তেও এভাবে কসম খাওয়ার তাৎপর্য এই যে, যে বিশ্বজগতকে তােমরা দেখতে পাচ্ছ, তা যত প্রকাশ্যই হােক না কেন, যে জগত তােমরা দেখতে পাচ্ছ না, তা আরাে বড় আরাে বিশাল। মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র অংশই মানুষ দেখতে পায়। মহাবিশ্বের যে অংশে আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন, শুধু সেইটুকু নিয়েই তার বিবরণ। এ ছাড়া যে মহাবিশ্ব তার দৃষ্টির বাইরে, তা যে কত বড় তা সে ভাবতেও পারে না। এই পৃথিবী তার সামনে একটি ধুলিকণার চেয়ে বড় কিছু নয়। আল্লাহর বিশাল মহাবিশ্বের মোকাবেলায় তাকে অনুভব করাই দুষ্কর। এই বিশাল মহাবিশ্বের যেটুকু দেখা বা উপলব্ধি করা মানুষের নাগালের ভেতরে আছে, মানুষ তার সীমা ডিংগাতে সক্ষম নয়। বস্তুত, ‘তােমরা যা দেখতে পাও’এবং ‘যা দেখতে পাওনা তার শপথ’ এ কথাটা প্রমাণ করে যে, মহাবিশ্বের যে অংশ মানুষ দেখতে পায় তার বাইরেও বহু গােপন জগত রয়েছে। এ উক্তি মানুষের মনে প্রশস্ততা ও উদারতা জন্মায়। সে বুঝতে পারে যে, আমি অনেক কিছু দেখি না ও বুঝি না, তবু তা বাস্তবে বিরাজমান। এতে তার মনের সংকীর্ণতা দূর হয়, নিজের চোখ, কান ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে সে মুক্তি পায়। তার চিন্তা জগতের ব্যপ্তি বাড়ে। সে উপলব্ধি করে যে, শুধুমাত্র খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে যতটুকু দরকার, মহাবিশ্বের ততটুকুই আমার নাগালে। নচেৎ আল্লাহর রাজ্য এর চেয়ে অনেক বড়। যারা নিজেকে নিজের দৃষ্টি ও উপলব্ধির সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে এবং এর বাইরের কিছু বিশ্বাস করতে চায় না, তারা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের আওতাধীন বস্তুজগতের বন্দী। এই বাহ্যিক জগতের অলিগলির মধ্যে তারা ঘেরাও হয়ে আছে। অথচ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে যে জগত রয়েছে, তা জড় জগতের চেয়ে অনেক বড় ও মহান। মানবেতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মানব গােষ্ঠি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের গােলামী মেনে নিয়ে নিছক বর্তমান ও দৃশ্যমান জগতের চৌহদ্দীতে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে এবং নিজের চারপাশে আলাে ও জ্ঞানের জানালা বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা মহা সত্যের নাগাল পায় না। মূলত মহাসত্যের নাগাল শুধু ঈমান ও চেতনার পথ ধরেই পাওয়া যায়। নিজেদের জন্যে এই পথ বন্ধ করার পর তারা অন্যদের জন্যেও তা বন্ধ করে দিতে চায়। এ কাজ তারা কখনাে নিরেট জাহেলিয়াতের নামে করে, আবার কখনাে করে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে। আসলে এগুলােও এক একটা বড় বড় কারাগার এবং দুরন্ত একগুয়েমি ও হীনতার বদ্ধ খাঁচা। এগুলাে জ্ঞান ও আলাের উৎস থেকে বিছিন্নতার আরেক রূপ। বিজ্ঞান বিগত দুশাে শতাব্দীতে নিজেকে লৌহ কপাটের আড়ালে আটকে রেখেছিলাে। কিন্তু এখন তা আলোর সাথে সংযােগ স্থাপন করেছে। ইতিপূর্বে ইউরােপে চরম স্বেচ্ছাচারী ধর্মযাজক শ্রেণী বিজ্ঞানকে খাঁচায় আবদ্ধ করেছিলাে। [ইউরােপে শিল্প বিপ্লবের আগে খুষ্টান ধর্মযাজকরা যেভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিরােধীতা করেছে সে ইতিহাস আমাদের কারােই অজানা নয়। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যখন আজ থেকে ৪শ বছর আগে বলেছিলেন যে, সূর্য নয়-পৃথিবীই তার চারদিকে ঘুরে, তখন এই খৃষ্টান ধর্মযাজকরাই তাকে গরম তেলের কড়াইতে পুড়িয়ে মেরেছে। তাদের মতে খৃষ্টপূর্ব ২ শতাব্দীর মিশরীয় ভৌগলিক টলেমীর-পৃথিবীটা একটা সমতল ভূখন্ডের ন্যায়-এই থিউরী হচ্ছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ। গত বছর খৃষ্টানদের পোপ ভ্যাটিকানের এক বিশ্ব সম্মেলনে গ্যালিলিওর প্রতি খৃষ্টান পুরােহিতদের ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে বিষয়টি আমাদের সামনে আরাে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। আরাে বিস্তারিত জানার জন্যে মােহাম্মদ কুতুব রচিত ‘ইসলাম বনাম বস্তুবাদী সভ্যতা’ পুস্তকটি দ্রষ্টব্য-সম্পাদক] এখন সে তা থেকে শুধু মুক্তই হয়নি বরং নিজের চৌহদ্দিও চিনে নিয়েছে। সে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যে, তার সীমিত সাজ-সরঞ্জাম ও বিশ্বজগতে ও তার নিজ সত্তায় বিরাজমান বাস্তবতাই তাকে অসীমের দিকে পথ নির্দেশ করে। তারপর এই থেকে নিজেকে কিছুটা মুক্ত করে নিচ্ছে নিজেরই অভিজ্ঞতার পথ ধরে। তারপর মুক্ত বিজ্ঞানই আজ ঈমানের দিকে আহবান জানাচ্ছে।(নিউইয়র্কস্থ বিজ্ঞান একাডেমীর চেয়ারম্যান ক্রেসি মরিসন রচিত ও মহাশূন্য বিজ্ঞানী মাহমূদ সালেহ অনুদিত গ্রন্থ ‘বিজ্ঞান ঈমানের দিকে আহবান জানায়’ দেখুন) এটা একটা আনন্দদায়ক পরিবর্তন, যা মানুষের চিন্তার রাজ্যে আলােড়ন তুলেছে। তাই এখন মানুষ এই সব লৌহকপাট যুক্ত কারাগার থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। ১৯১২ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ফ্রান্সের মানবতত্ত্ব ইনষ্টিটিউটের পরিচালক বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী আলেক্সিস কারিল বলেন, ‘সমগ্র প্রাকৃতিক জগত জুড়ে আমাদের বিবেক বুদ্ধি ছাড়া আরাে বহু বিবেক বুদ্ধি তৎপর রয়েছে। মানুষের আশপাশে যে বিশাল শুন্যতা রয়েছে, তা থেকে মানুষ যদি সঠিক পথের সন্ধান পেতে চায় তবে তার বিবেক স্বেচ্ছায় সে পথের সন্ধান দিয়ে থাকে। আমাদের আশপাশে যে বিবেকগুলাে সক্রিয় রয়েছে, তার সাথে সংযােগ স্থাপনের একটা মাধ্যম হলাে নামায। নামাজ আমাদেরকে সেই আদি বিবেকের সাথেও সংযুক্ত করতে সক্ষম, যা সকল সৃষ্টির ওপর নিরংকুশভাবে কৃর্ত্বশীল, চাই তা দৃশ্যমান হােক কিংবা অদৃশ্য হােক।(আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ রচিত ‘বিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদদের আকীদা বিশ্বাস’ দ্রষ্টব্য) ‘ধর্মীয় চেতনা যখন আধ্যাত্মিক তৎপরতায় নিয়ােজিত শক্তি সমূহের সাথে মিলিত হয় তখন তা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখে। কেননা তা আমাদেরকে আধ্যাত্মিক জগতের গােপন স্থানগুলো সাথে সংযুক্ত করে দেয়। অধ্যাপক কুরী ও মাদাম কুরীর ঘনিষ্ঠ সহযােগী আর একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডঃ দিনভে লিখেছেন, অনেক সদুদ্দেশ্যপ্রনােদিত প্রতিভাবান লােকই ভাবেন যে, তারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে সক্ষম নন, কেননা তাঁরা আল্লাহকে কল্পনা করতে পারেন না। তা সত্তেও একজন সৎ ও বিদ্যোৎসাহী মানুষের জন্যে আল্লাহর কল্পনা করা জরুরী নয়। অবশ্য অতটুকু কল্পনা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে করা যায় যতটুকু একজন বিজ্ঞানী বিদ্যুৎ সম্পর্কে অনিবার্যভাবেই করে থাকে। উভয় ক্ষেত্রেই কল্পনা ত্রুটিপূর্ণ ও বাতিল। কেননা বিদ্যুৎ স্বীয় বস্তুগত অস্তিত্বের ক্ষেত্রে অকল্পনীয়। কিন্তু স্বীয় লক্ষণ ও প্রভাবের দিক দিয়ে বিদ্যুৎ কাঠের টুকরাের চেয়েও বাস্তব ও স্পষ্ট।’ স্কটল্যান্ডের খ্যাতনামা পদার্থ বিজ্ঞানী স্যার আরথার থমসন বলেন, আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি যখন শক্ত মাটিও স্ফটিকের মতাে স্বচ্ছ হয়ে গেছে। আর তা তার বস্তুগত সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। বস্তুগত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করার কারণে সততা ও পূণ্যকর্মে এ যুগের অবদান খুবই কম। একই বিজ্ঞানী ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান’ নামক গ্রন্থ বলেন, ধর্মীয় যুক্তিবাদীদের আজ এ নিয়ে আক্ষেপ করা উচিত নয় যে, প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির গন্ডী থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির স্রষ্টা ও বিধাতার দিকে মনােনিবেশ করছে না। কারণ এটা তার দৃষ্টিকোণ নয়। বিজ্ঞানীরা যখন প্রকৃতি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত থেকে সূত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে অতি প্রাকৃতিক জগতের দিকে ধাবিত হবেন, তখন সূত্রের চেয়ে সিদ্ধান্ত অনেক বড় হবে। তবে আপাতত আমরা এ জন্যে গর্বিত যে, প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে বৈজ্ঞানিক পরিবেশে টিকে থাকার সুযােগ এনে দিয়েছেন, যা আমাদের বাপ-দাদাদের আমলে মােটেই সহজ ছিলাে না।’ ‘মানুষ ও তার জগত’ নামক অভিনব গ্রন্থে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মি লিংতেন ডেভিস এই ভ্রান্ত মত ব্যক্ত করেছেন যে, আল্লাহকে নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। কিন্তু আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলাে, সে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত উদার ও ভদ্রোচিত মনােভাব গড়ে তুলেছে। এমনকি আমাদের এ কথা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, বিজ্ঞান মানুষের জন্যে নতুন আকাশ ও নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করেছে এবং সেখান থেকে তাকে বিকশিত করে তাকে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনার শেষ সীমায় পৌছে দিয়েছে। এ জন্যে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক সময় সে শুধু বুদ্ধিবৃত্তির সীমান্ত অতিক্রম করেই শান্তির নাগাল পেয়ে থাকে। আর এই সীমান্ত পেরিয়ে যে নতুন জায়গায় সে পা রখে তা হলাে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। আরেকজন বিজ্ঞানীকে আমরা দেখি। তিনি হচ্ছেন নিউইয়র্কের বিজ্ঞান একাডেমীর চেয়ারম্যান ও আমেরিকার জাতীয় গবেষণা পরিষদের পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য ক্রেসী মরিসন। ‘মানুষ একা অবস্থান করে না’ শীর্ষক গ্রন্থে (যার অনুবাদ করা হয়েছে ‘ঈমানের দিকে বিজ্ঞানের আহবান’) বলেন, ‘আমরা বাস্তবিক পক্ষে এক সুপরিসর অজানা জগতের কাছাকাছি হতে যাচ্ছি। কেননা আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থ মাত্রই এমন একটি মহা জাগতিক এককের প্রতীক যা মূলত বৈদ্যুতিক। তবে এ কথা সন্দেহাতীত রূপে সত্য যে, বিশ্ব সৃষ্টির মূলে আকস্মিক দুর্ঘটনার কোনাে ভূমিকা নেই। কেননা এই মহাবিশ্ব আইনের অনুগত।’ তিনি আরাে বলেন, মানুষের পাশবিক সত্ত্বার একটি চিন্তাশীল ও আত্মােপলব্ধিসম্পন্ন প্রাণীতে রূপান্তর নিছক বস্তুগত রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সম্ভব ছিলাে না, বরং তার সৃষ্টির মূলে একটি উদ্দেশ্য সক্রিয় ছিলাে। এই উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টির তত্ত্বকে যদি বাস্তব বলে গ্রহণ করা হয় তাহলে এ হিসাবে মানুষ নিছক একটি হাতিয়ার বা সাজ-সরঞ্জাম বলে গন্য হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে যে, এই সাজ-সরঞ্জামকে ব্যবহার করে এমন কে আছে? ব্যবহার করা ছাড়া তো তার দ্বারা কিছু অর্জিত হবে না। এই হাতিয়ার বা সরঞ্জামকে কে ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে বিজ্ঞান আমাদেরকে কিছু বলে না। অনুরূপভাবে বিজ্ঞান এ কথাও বলে না যে, মানুষ নিছক জড় পদার্থের মতাে প্রকৃতির নিয়মে রূপান্তর প্রক্রিয়ার অনুসারী এবং তাকে ব্যবহার করার জন্যে বিশেষ কেউ নেই। আমরা অগ্রগতির এমন এক ধাপে পৌছে গেছি, যেখানে আমাদেরকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নূরের একটা মশাল দিয়েছেন।’ এভাবে বিজ্ঞান নিজস্ব উপায় উপকরণ দ্বারা বস্তুবাদের কারাগার ও তার চতুর্দেয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বেরিয়ে এসে মুক্ত পরিবেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করা আরম্ভ করেছে। এই বিষয়টিই আল্লাহ তায়ালা ব্যক্ত করেছেন এ দুটি আয়াতের মাধ্যমে, ‘তােমরা যা দেখতে পাও ও যা দেখতে পাও না উভয়ের শপথ করছি।’ আমাদের ভেতরে যদি এমন কোনাে মতিভ্রম লােক থেকে থাকে, যে সব সময় জ্ঞানের আলাে অন্তরে প্রবেশের সকল দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে ও অন্যদেরকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে ইসলামের আলাে থেকে বঞ্চিত রাখে, তাহলে বুঝতে হবে, সে বিজ্ঞান থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, ধর্ম থেকে আধ্যাত্মিকভাবে এবং মহা সত্যকে জানার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন থেকে সচেতনভাবে পিছিয়ে আছে। সর্বোপরি মানুষ নামক মহৎ ও সম্মানিত প্রাণীর জন্যে যে উন্নতি ও উৎকর্ষ অর্জন করা প্রত্যাশিত, মানুষ হিসাবে তা থেকেও সে পিছিয়ে আছে। ‘তােমার যা দেখতে পাও এবং যা দেখতে পাও না উভয়ের শপথ করে বলছি… বিশ্ব প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিল করা গ্রন্থ।

সুরা: আল-হাক্বাহ্
আয়াত নং :-৪০-৪৯

وَ اِنَّا لَنَعْلَمُ اَنَّ مِنْكُمْ مُّكَذِّبِیْنَ

আমি জানি তোমাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে থাকবে।

 

ফী জিলালিল কুরআন:

*কোরআন ও কবিতার মৌলিক পার্থক্য : প্রসংগত উল্লেখ্য যে, কুরআন ও রাসূল(স.) সম্পর্কে কাফেররা যে সব অপবাদ দিত তার মধ্যে এও ছিলাে যে, তারা তাকে কবি ও জ্যোতিষী বলতাে। কারণ কোরআনের ভাষা সাধারণ মানবীয় ভাষার তুলনায় অনেক উঁচু মানের হওয়ার কারণে তারা এরূপ সন্দেহ করতাে। তাদের ভেতরে এরূপ কুসংস্কার প্রচলিত ছিলাে যে, কবি ও জ্যোতিষীর অধীন একটা জিন থাকে, সেই তাকে উঁচু মানের ভাষা শেখায় এবং অতি প্রাকৃতিক জ্ঞান ও তথ্য সরবরাহ করে। অথচ কোরআন ও নবুওতের প্রকৃতি এবং কবি ও জ্যোতিষীর প্রকৃতি নিয়ে সামান্য চিন্তাভাবনা করলেই এ সন্দেহ দূর হয়ে যায়। কবিতায় সুরেলা ছন্দ, অভিনব চিন্তা এবং চমকপ্রদ দৃশ্য ও ছবির সমাবেশ ঘটতে পারে। কিন্তু সে জন্যে তা কোরআনের সাথে কখনাে সাদৃশ্যপূর্ণ ও একাকার হয়ে যেতে পারে না। উভয়ের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কোরআন জীবনের জন্যে একটা পূর্ণাংগ ব্যবস্থা দেয়, যা পরিপূর্ণ ও চিরন্তন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার আগাগোড়া একই ধরণের দৃষ্টিভংগী। বিরাজ করে, যা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এবং জীবন ও জগত সম্পর্কে অটল অনড় ও সার্বিক ধারণা পােষণ করে। পক্ষান্তরে কবিতা হলাে ধারাবাহিকভাবে উদ্ভূত প্রতিক্রিয়া এবং উদ্বেলিত ও উচ্ছসিত ভাবাবেগের নাম। এতে স্থীতিশীলতা ও দৃঢ়তা অত্যন্ত কম। আনন্দ ও বেদনা, ঘৃণা-বিদ্বেষ ও প্রীতি-ভালােবাসা, সন্তোষ ও ক্রোধ এবং সুখ ও দুঃখ প্রভৃতি পরিবর্তনশীল অবস্থায় কবিতা কখনাে একই মত, পথ ও দৃষ্টিভংগীর ওপর স্থির থাকে না। পক্ষান্তরে কোরআন যে আদর্শ ও মতবাদ নিয়ে এসেছে, তার আগাগোড়া খুটিনাটি সহ একেবারে ভিত্তিমূল থেকে তাকে গড়ে তুলেছে কোরআন নিজেই। তার উৎস যে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, সে কথাও সে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। কোরআনের আনীত এই আদর্শের সব কিছুই সাক্ষ্য দেয় যে, এ আদর্শ কোনাে মানুষের গড়া নয়। এ ধরণের একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পুর্ণাংগ মহাজাগতিক আদর্শ ও মতবাদ গড়া মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয়, সে ক্ষমতা তার ভেতরে জন্মগতভাবেই নেই, কোনােদিন ছিলাে না, কোনাে দিন হবেও না। মানবীয় স্বভাব প্রকৃতি সৃষ্টিজগত এবং তার স্রষ্টা ও পরিচালক সম্পর্কে যেসব মতবাদ ও মতাদর্শ উদ্ভাবন করেছে এবং দর্শন, কবিতা ইত্যাদির মাধ্যমে যেসব চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাকে যখন কোরআনের উপস্থাপিত মতবাদ মতাদর্শের সাথে তুলনা করা হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই কাব্য কবিতার মতাদর্শ ও চিন্তাধারার উৎস কোরআনী আদর্শের উৎস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং যাবতীয় মানবীয় চিন্তাধারা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। জ্যোতির্বিদ্যা ও এধরনের অন্যান্য বিদ্যার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ইতিহাসের প্রাচীন কিংবা আধুনিক কোনাে যুগেই এমন কোনাে জ্যোতিষীর সাক্ষাৎ মেলে না যে, কোরআনের আনীত বিধানের মতাে একটি পরিপূর্ণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমগ্র জীবনব্যাপী বিধান রচনা করবে। জ্যোতিষীদের কাছ থেকে যা কিছু কিংবদন্তী, প্রবাদ বা জনশ্রুতির আকারে সমাজে প্রচলিত, তা হয় কিছু ছন্দবদ্ধ বাক্য, নতুবা কিছু জ্ঞানের কথা, নয়তাে কোনাে হেয়ালী বা রহস্যময় আভাস ইংগিত।  *কোরআনে বর্ণিত কিছু তত্ত্ব ও তথ্য : কোরআনে এমন বহু সংখ্যক প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক তত্ত্ব ও তথ্য বর্ণিত হয়েছে, যার সমমানের তত্ত্ব ও তথ্য বর্ণনা করা মানুষের সাধ্যাতীত। আলােচ্য তাফসীর গ্রন্থে আমি এ ধরণের বহু বর্ণনার প্রতি পাঠক-পাঠিকার মনােযােগ আকর্ষণ করেছি ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করেছি। অত সুক্ষ্ম ও ব্যাপক জ্ঞান সম্বলিত বক্তব্য দেয়া কোনাে মানুষের পক্ষে অতীতেও সম্ভব ছিলাে না, আজও সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না। কোরআনে বর্ণিত এ ধরনের কিছু কিছু তত্ত্ব লক্ষ্য করুন, •(আনয়াম-৫৯)’তাঁরই কাছে রয়েছে সকল অদৃশ্য জ্ঞানের চাবিকাঠি। তিনি ছাড়া আর কেউ তার সন্ধান জানে না। জলে ও স্থলে কোথায় কি আছে ও ঘটছে, তা তিনিই জানেন। তিনি জানেন না এমন একটি পাতাও কোথাও পড়ে না, পৃথিবীর কোনাে তিমিরাচ্ছন্ন জায়গায় এমন একটি বীজও লুকিয়ে থাকতে পারে না এবং এমন কোনাে সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ, পরিণত বা অপরিণত জিনিসও থাকতে পারে না, যা তার উজ্জ্বল গ্রন্থে লিপিবদ্ধ নেই।’ •(হাদীদ-৪)’পৃথিবীর অভ্যন্তরে কি ঢােকে এবং কি বের হয়, আর আকাশ থেকে কি নামে এবং আকাশে কি ওঠে সবই তিনি জানেন । তােমরা যেখানেই থাকো, তিনি তােমাদের সাথে আছেন। তােমরা যাই করাে, তিনি তা দেখেন।’ •(ফাতির-১১)’কোনো নারী তার অজান্তে সন্তান ধারণও করে না, প্রসবও করে না, কারাে আয়ুঙ্কাল বাড়ুক বা কমুক, তা একখানা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছেই। আল্লাহর জন্যে এসব রেকর্ড রাখা একেবারেই সহজ।’ কত বড় শক্তিধর ও বিচক্ষণ সত্ত্বা, কি নিপুনভাবে মহাবিশ্বের সংরক্ষণ ও পরিচালনা করছেন, তার যে সূক্ষ্ম ও নিখুঁত বর্ণনা কোরআন দিয়েছে, অমনটি কোনাে মানুষ অতীতে বা আগামীতে দিতে পারেনি এবং পারবেও না। •(ফাতির-৪১)’আকাশ ও পৃথিবী যাতে পতন ও বিপর্যয়ের কবলে না পড়ে, সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীকে সংরক্ষণ করছেন, আর যদি তা বিপর্যয়ের কবলে পড়েই যায়, তবে তাকে ঠেকিয়ে রাখে এমন সাধ্য কারাে নেই।’ •সূরা আল আনয়াম-এর ৯৫-৯৯ আয়াতে মহান স্রষ্টার অতুলনীয় কুশলী হাতের অকল্পনীয় উদ্ভাবনী ক্ষমতার ছােয়ায় বিশ্ব প্রকৃতিতে জীবনের আবির্ভাব এবং তার চতুর্দিকে বিরাজমান প্রাকৃতিক শক্তি সমূহ, ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার বদৌলত জীবনের অনুকুল ও সহায়ক পরিবেশ গড়ে ওঠার যে অনবদ্য বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাও কোনাে মানবীয় ভাষায় দেয়া সম্ভব নয়, আল্লাহ তায়ালা বীজ ও তার আঁটি থেকে অংকুরোদ্গম করেন। তিনিই মৃত থেকে জীবকে এবং জীব থেকে মৃতকে বের করেন। তিনিই আল্লাহ তায়ালা। অতএব তােমরা উদভ্রান্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ? তিনি উষ্ণকালের উদগাতা। রাতকে তিনি বিশ্রামের সময় এবং সূর্য ও চাঁদকে হিসাব নিকাশের উপায় বানিয়েছেন। এটা হচ্ছে মহা পরাক্রমশালী মহাজ্ঞানীর পরিকল্পনা। তিনিই তােমাদের জন্যে নক্ষত্ররাজি তৈরী করেছেন, যাতে জল স্থলের অন্ধকারে তােমরা তা দ্বারা পথের সন্ধান পাও। জ্ঞানী লোকদের জন্যে আমি আয়াতগুলাে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছি। তিনি তােমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর বসবাসের জায়গাও দিয়েছেন, কবরের জায়গা দিয়েছেন। বুদ্ধিমানদের জন্যে আমি আয়াতগুলােকে বিশ্লেষণ করেছি। তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, তারপর তা দিয়ে আমি সকল রকমের উদ্ভিত উদগত করি, তারপর তা থেকে তৈরী করি সবুজ ডালপালা এবং সেই সবুজ ডালপালা থেকে স্তরে স্তরে সাজানাে খাদ্যশস্য। খেজুর গাছের ঝুলে থাকা খেজুরের কাদি, আঙ্গুরের বাগান, যায়তুন ও আপেল, যা সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈশাদৃশ্যপূর্ণ দু’রকমেরই আছে। এ সব ফসল যখন ফলে ও পাকে তখন তাকিয়ে দেখাে। জ্ঞানীদের জন্যে এতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।’ কোরআনে এ ধরণের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা সম্বলিত আয়াত অনেক রয়েছে। কোরআনের এসব বর্ণনায় যে মনােজ্ঞ তত্ত্ব ও তথ্য রয়েছে, তার কোনাে তুলনা মানুষের রচনায় দুর্লভ, আর এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এ কিতাবের উৎস একমাত্র আল্লাহ তায়ালা এবং এটা তাঁরই রচনা। এ ব্যাপারে আর কোনাে সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়ােজন থাকে না।  *কোরআন নিয়ে ভিত্তিহীন সংশয় : সুতরাং কোরআন মানব রচিত কবিতা বা জ্যোতিষীর বাণী কি-না এ জাতীয় সন্দেহ সংশয় একেবারেই বাজে ও ভিত্তিহীন। এমনকি কোরআন যখন পুরােপুরি নাযিল হয়নি, কেবল কতিপয় সূরা ও আয়াত মাত্র নাযিল হয়েছে, তখনো এ সন্দেহ ধােপে টেকেনি। তখনাে এর ভেতরে আল্লাহর বাণীর বৈশিষ্ট্য ও তার অতুলনীয় উৎসের সাক্ষ্য প্রমাণ পুরােমাত্রায় বিদ্যমান ছিলাে। কোরায়েশ নেতারা নিজেরাও যখন চিন্তাভাবনা করতাে, তখন এসব সন্দেহ সংশয়কে সময় সময় নিজেরাই খন্ডন করতাে। কিন্তু স্বার্থপরতা মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দেয়। কোরআন নিজেই বলেছে যে, যখন তারা কোরআনের হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়, তখন বলে এ তাে সেই প্রাচীন মিথ্যাচার। সীরাত গ্রন্থাবলীতে কোরায়শ নেতাদের এ ধরণের বেশ কিছু ঘটনা ও মতামত পাওয়া যায় । যাতে দেখা যায় যে, তারা নিজেরা এ জাতীয় সন্দেহ সংশয়কে ভুল আখ্যায়িত করতাে। ওলীদ বিন মুগীরা, নযর ইবনুল হারেস এবং উতবা ইবনে রবীয়া কোরায়শ বংশের এই তিন দিকপাল সম্পর্কে ইবনে ইসহাক থেকে তিনটি বর্ণনা পাওযা যায়। ওলীদ বিন মুগীরা সম্পর্কে তার বর্ণনা নিম্নরূপ, হজ্জের মওসুম সমাগত হলে প্রবীণ কুরাইশ নেতা ওলীদ বিন মুগীরার কাছে গােত্রের কিছু লােক সমবেত হলাে। ওলীদ তাদেরকে বললাে, হে কোরায়শের জনগণ! হজ্জের মওসুম এসে গেছে। এ সময় সমগ্র আরব থেকে বিভিন্ন তীর্থযাত্রী দল আমাদের এখানে আসবে। তােমাদের এই স্বগােত্রীয় লােকটির (অর্থাৎ মােহাম্মদের) কথা নিশ্চয়ই তাদের কানে গেছে। কাজেই তার ব্যাপারে তােমরা একটা ঐক্যবদ্ধ কৌশল গ্রহণ করাে। ভিন্ন ভিন্ন মতাে অবলম্বন করাে না, তাহলে তােমাদের একজনের মত আরেক জনর মতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। সবাই বললাে, আপনি বলুন আমাদের কী করতে হবে। আমাদের সবার জন্যে একটা বক্তব্য স্থির করে দিন, সবাই সেটাই বলবে। ওলীদ বললাে, বরং তােমরাই বলাে, আমি শুনি। তখন তারা বললাে, আমরা তো বলি মোহাম্মদ একজন জ্যোতিষী। ওলীদ বললাে, না, আল্লাহর কসম! সে জ্যোতিষী নয়। আমরা অনেক জ্যোতিষী দেখেছি। মোহাম্মদ তাদের মতাে করে কথা বলে না। তার কথায় সে ধরণের ছন্দও নেই, হেঁয়ালীও নেই। তারা বললাে, ‘তাকে পাগল বলা যেতে পারে।’ ওলীদ বললাে, ‘সে পাগলও নয়। পাগলামি আমরা দেখেছি এবং তা চিনি। পাগলের মতাে শ্বাসবদ্ধতা, বেহুশ হয়ে যাওয়া এবং মানসিক অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি এ রকম কিছু তাে মােহাম্মদের ভেতরে নেই।’ তারা বললাে, তাহলে তাকে আমরা কবি বলি। ওলীদ বললো, ‘না, সে কবিও নয়। আমরা সব ধরণের কবিতা দেখেছি। মােহাম্মদ যা বলে, তার সাথে কবিতার কোনাে মিল নেই।’ তারা বলল, তাহলে আমরা তাকে জাদুকর বলবে। ওলীদ বললাে, ‘না সে জাদুকর নয়। আমরা জাদুকর দেখেছি, জাদুও দেখেছি। তাদের গিরে দেয়া ও গিরে খােলা মোহাম্মদের কালামে নেই। তখন সবাই বললাে, ‘তাহলে আপনি কী বলেন?’ ওলীদ বললাে, ‘মােহাম্মদ যে বাণী পাঠ করে তা বড়ই মধুর। তার মূলে অজস্র শিকড় আর ডালে রয়েছে প্রচুর ফল।’ তােমরা এ সব কথার যেটিই বলবে, লােকে তা বাতিল বলেই ধরে নেবে। তবে যে কথাটা সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি তা এই যে, তােমরা তীর্থযাত্রীদেরকে বলবে, সে একজন জাদুকর। সে এমন বাণী নিয়ে এসেছে, যা জাদুই বটে। এ বাণী বাপ বেটায়, ভাইয়ে ভাইয়ে, ও স্বামী স্ত্রীতে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং সর্বোপরি আত্মীয়স্বজন থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কাজেই তোমরা তার সংস্পর্শ এড়িয়ে চল। এরপর লােকেরা তীর্থযাত্রীদের আগমনের পথের মােড়ে মােড়ে বসতে লাগলাে। যে ব্যক্তিই তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করতাে, তাকেই সাবধান করে দিত এবং মুহাম্মাদ(স.)-এর ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে দিত। নযর ইবনুল হারেস সম্পর্কে ইবনে ইসহাক বলেন, সে বললাে, ওহে কোরায়শ! আল্লাহর কসম, তােমাদের ওপর এক মহা আপদ নেমে এসেছে। তােমরা একে প্রতিরােধের কোনাে কার্যকর কৌশল এখানে খুঁজে পাওনি। মােহাম্মদ তােমাদের ভেতরে একটা বালক হিসেবে বসবাস করেছে। সবচেয়ে সত্যবাদী, সবচেয়ে বিশ্বাসী এবং সবচেয়ে প্রিয়। তারপর যেই তার ভেতরে পরিপঙ্কতা এলাে এবং একটা নতুন মত প্রচার করা শুরু করলাে, অমনি তােমরা বললে, সে এ একজন জাদুকর। আল্লাহর কসম, সে জাদুকর নয়। আমরা জাদুকর অনেক দেখেছি, তাদের গিরে দেয়া গিরে খােলা ইত্যাদি দেখেছি। তােমরা তাকে জ্যোতিষীও আখ্যায়িত করলে। আল্লাহর কসম, সে জ্যোতিষী নয়। আমরা জ্যোতিষীদের কান্ডকারখানা অনেক দেখেছি। তাদের ছন্দবদ্ধ ও হেয়ালীপূর্ণ কথাবার্তা শুনেছি। তােমরা তাকে কবিও বলেছ। আল্লাহর কসম, সে কবিও নয়। আমরা সব রকমের কবিতা শুনেছি। তােমরা তাকে পাগল বলেছ। আল্লাহর কসম, সে পাগলও নয়। পাগলের হাবভাব চালচলন কিরকম হয় আমরা জানি। হে কোরায়শ। তােমরা এখন বুঝে দেখ কী করবে। আমি শুধু বলতে পারি, তােমাদের সামনে এক মহা সংকট উপনীত হয়েছে।’ নযর ও ওলীদের কথাবার্তায় প্রায় ষােল আনা মিল দেখা যায়। হতে পারে আসলে ঘটনা একটাই ছিলাে। বর্ণনাকারীদের বর্ণনায় কখনাে এটা ওলীদের কখনাে নযরের ঘটনা হিসাবে পরিচিত হয়েছে। আবার এটাও বিচিত্র নয় যে, দু’জন শীর্ষস্থানীয় কোরায়শ নেতার বক্তব্য একই রকম হবে। কারণ কোরআনের সামনে তাদের সকলেরই এমনি অসহায় অবস্থা ছিলাে এবং সেটাই হয়তাে তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। আর ওৎবার বক্তব্য সূরা আল কালামের তাফসীর প্রসংগে আমি ইতিপূর্বে তুলে ধরেছি। মুহাম্মদ(স.) ও কুরআন সম্পর্কে তার বক্তব্যও ওলীদ ও নযরের বক্তব্যের কাছাকাছি। রসূল(স.)-কে তারা জাদুকরই বলুক আর জ্যোতিষী বলুক, না কখনাে ছিলাে একটা প্রতারণার কৌশল আবার কখনাে একটা সংশয় মাত্র। অথচ সামান্য চিন্তাভাবনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যেত যে, কথাটা আসলে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটা অপবাদ মাত্র। তাই এ নিয়ে আদৌ কোনাে শপথের প্রয়ােজন পড়ে না। *রসূল(স.)-এর বাণী বলতে কী বুঝায়? : ‘এ বাণী একজন সম্মানিত রসূলের বাণী’ এ কথার অর্থ এ নয় যে, এটা তার রচনা। এ কথা দ্বারা আসলে বুঝানাে হয়েছে এই যে, এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কথা, কোনাে কবি বা জ্যোতিষী এ ধরণের কথা বলে না। শুধু রসূলই এ ধরণের কথা বলতে পারেন। কেননা তিনি এ কথা আল্লাহর কাছ থেকে পান। পরবর্তী আয়াত ‘বিশ্ব প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বাণী’ থেকে এ ব্যাখ্যা অকাট্য ভাবে প্রমাণিত হয়। আর এ মন্তব্য যে, ‘তােমরা কমই ঈমান এনে থাকো’ এবং ‘কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো’ এর অর্থ হচ্ছে মােটেই ঈমান আনাে না এবং মােটেই উপদেশ গ্রহণ করাে না। প্রচলিত বাকরীতি অনুসারে এই অর্থ গৃহীত হয়ে থাকে। হাদীসে রসূল(স.) এর গুণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘তিনি খুব কমই বাজে কথা বলতেন।’ অর্থাৎ বাজে কথা একেবারেই বলতেন না। বস্তুত, তাদের মধ্যে আদৌ ঈমান এবং উপদেশ গ্রহণের মনােভাব নেই একথাই বলা হয়েছে। নচেৎ কোনাে মােমেন রাসূল(স.) কে কবি বা জ্যোতিষী বলতে পারে না। যে ব্যক্তি কোরআন থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণেচ্ছুক সেও এ ধরণের উক্তি করতে পারে না। বস্তুত এ ধরণের উক্তির মধ্য দিয়ে একজন কাফের ও চরম উদাসীনের মনােভাবই প্রতিফলিত হয়। সর্বশেষে একটি ভয়ংকর হুমকি উচ্চারিত হয়েছে। আকীদা বিশ্বাসের প্রশ্নে যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করে, তার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে এক কড়া হুঁশিয়ারী। এ হুঁশিয়ারীতে বিন্দুমাত্র নমনীয়তার অবকাশ রাখা হয়নি। এতে দ্ব্যর্থহীন কষ্ঠে জানানাে হয়েছে যে, রাসূল(স.) যে ওহীর বাণী মানুষের কাছে পৌছান, তাতে তিনি সম্পূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত। এ ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্রও উদাসীনতা, বিচ্যুতি বা অসততার সম্ভাবনা নেই। কেননা আল্লাহ স্বয়ং সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি তাকে এ ধরণের কোনাে কিছুর দায়ে কখনাে পাকড়াও করেননি। অথচ ইসলামের বাণী প্রচারে সামান্যতম ত্রুটি বিচ্যুতি হলেও তিনি তাকে সমালােচনা না করে ছাড়েন । আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘যদি সে আমার সম্পর্কে মনগড়া কোনাে কথা বলতাে তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে বসতাম এবং তার ঘাড়ের শিরা কেটে দিতাম। তখন তােমাদের কেউ তাকে বাঁচাতে পারতাে না।’ এ উক্তির মর্মার্থ এই যে, মুহাম্মদ(স.) ওহীর বাণী পৌছানাের ব্যাপারে পুরােপুরি ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যবাদী। তিনি যদি তার কাছে পাঠানাে হয়নি এমন কোনাে কথা বানিয়ে বলতেন, তাহলে এ আয়াতে যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে হত্যা করতেন। এ ধরণের কোনাে ব্যাপার যখন ঘটেনি, তখন বুঝতে হবে যে, তিনি সম্পূর্ণ সত্যবাদী। এ তাে হলাে তাত্ত্বিকভাবে আল্লাহর সাক্ষ্যদান ও সত্যায়নের ব্যাপার। কিন্তু যে বাস্তব প্রেক্ষাপটে এ সাক্ষ্য ও হুশিয়ারী এসেছে তা একটা ভিন্ন জিনিস। এর তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, আর এর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত আতংকজনক ও ভীতিপ্রদ । ডান হাত ধরে ঘাড়ের শিরা কেটে দেয়ার বক্তব্য একদিকে যেমন ভীতিকর ও লােমহর্ষক কর্মকান্ডের ছবি তুলে ধরেছে, অপরদিকে তেমনি এতে আল্লাহর দোর্দন্ড প্রতাপ ও পরাক্রমেরও প্রতিফলন ঘটেছে। সমগ্র মানবজাতি যে তার সামনে একেবারেই অক্ষম ও অসহায় এবং তার কোনাে ইচ্ছায় বাধ সাধতে পারে না, তা এখানে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে এ কথাও পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর দ্বীন ওহীর বিষয় অত্যন্ত নাযুক ও গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ব্যাপারে কোনাে অবস্থাতেই কোনাে মানুষের ব্যাপারেই নমনীয়তা দেখানাে হয়না, এমন কি স্বয়ং আল্লাহর প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ(স.) এর সাথেও নয়।

ফী জিলালিল কুরআন: *আল্লাহর বাণী অস্বীকারকারীদের পরিণতি : সূরার উপসংহারে আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীন ও কোরআনের সত্যতা ও অকাট্যতার বিষয়ে পুনরায় দৃঢ়তার সাথে বক্তব্য দিয়েছেন, নিশ্চয়ই এটি আল্লাহভীরুদের জন্যে স্মরনিকা । আমি জানি যে, তােমাদের ভেতরে অনেকে একে মিথ্যা মনে করে থাকো। নিশ্চয়ই এ বাণী অবিশ্বাসীদের অনুশােচনার কারণ হবে। নিশ্চয়ই এ বাণী সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিখুঁত, নির্ভুল, বিশুদ্ধ ও অকাট্য সত্য বাণী। বস্তুত এই কোরআন আল্লাহভীরু ও সৎ লােকদের মনকে সত্য, ন্যায় ও আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয়া মাত্রই তারা তা স্মরণ করে ও সংযত হয়। কেননা যে বক্তব্য নিয়ে কোরআন নাযিল হয়েছে, তা তাদের মনে আগে থেকেই সুপ্ত থাকে। কোরআন শুধু তাকে জাগায় ও স্মরণ করিয়ে দেয়। এতেই তাদের মন আলােড়িত ও জাগ্রত হয়। কিন্তু যারা আল্লাহভীরু নয় এবং পাপ থেকে সংযত ও সাবধান নয়, তাদের মন ও রুচি বিকৃত হয়ে যায়। ফলে তাদের উদাসীনতা কোরআনের হুঁশিয়ারীতেও ঘুচে না। কোনাে উপদেশে তাদের কাজ হয় না, কোনাে কথায় তারা সম্বিত ফিরে পায় না। অথচ আল্লাহভীরু ও সদাচারী লােকেরা কোরআনে এমন জ্ঞান, জ্যোতি, কর্মস্পৃহা, চেতনা ও জীবনী শক্তি খুঁজে পায়, যা গাফেল ও উদাসীন লােকেরা পায় না। ‘আমি জানি তােমাদের অনেকে ওহী কে বিশ্বাস করো।’ আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে বলতে চান যে, তােমাদের অবিশ্বাসে কিছু এসে যায়না। কিছু লােক অবিশ্বাস করলেই সত্য অসত্য হয়ে যায় না। সত্য সত্যই থাকে, চাই কেউ তা মানুক বা না মানুক। ‘নিশ্চয়ই এ কোরআন কাফেরদের অনুশােচনার কারণ হবে।’ অর্থাৎ এটা হবে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গায়। দুনিয়ায় হক একদিন বিজয়ী হবে, তখন মােমেনদের মর্যাদা ও প্রতাপ বেড়ে যাবে, অবিশ্বাসীদের কদর কমে যাবে এবং তারা যে বাতিলকে আঁকড়ে ধরে আছে, তা পরাভূত ও পর্যুদস্তু হবে। আর আখেরাতে কোরআন কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদী হবে। অতপর কঠিন আযাবে ভুগবে ও অনুশােচনায় দগ্ধ হবে। তারা যদি কোরআনকে অমর্যাদা ও অবিশ্বাস না করতাে, তাহলে অনুশােচনার কোনাে প্রয়ােজন পড়তাে না। ‘নিশ্চয়ই এ কোরআন সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিশ্চিত ও অকাট্য সত্য বাণী।’ অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা যতই একে মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক, তথাপি তা চরম সত্য ও অকাট্য সত্য। হক্কুল একীন একটি পরিভাষা। চরম ও অকাট্য সত্যকে হক্কুল একীন বলা হয়। অর্থাৎ যা নিজে সত্য, নির্ভেজাল সত্য বহন করে এবং নির্ভুল উৎস থেকে আবির্ভূত। বস্তুত এ কোরআন কবির কবিতাও নয়, জ্যোতিষীর হেঁয়ালীও নয়, মনগড়া কল্পকথাও নয়। এটা শুধু আল্লাহর নাযিল করা বিধান। মুত্তাকী লােকদের জন্যে স্মরণিকা। অতপর বলা হচ্ছে, ‘তুমি তােমার মহান প্রভুর তাসবীহ পাঠ করো।’ তাসবীহ বলতে বুঝায় কারাে পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা ঘােষণা করা। মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা। অধীনতা ও আনুগত্যের স্বীকৃতি দান ও অংগীকার করা। আল্লাহর সীমাহীন প্রতাপ ও শক্তির বর্ণনার পর স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা অনুসারেই এই আনুগত্যের স্বীকৃতি ও পবিত্রতার ঘােষণা এসেছে।

৩৮-৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৩৮-৪৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সৃষ্ট বস্তুর মধ্য হতে ঐ সব নিদর্শনের শপথ করছেন যেগুলো মানুষ দেখতে পায় আর যেগুলো দেখতে পায় না উভয়ের। তিনি শপথ করে বলছেন : এ কুরআন তাঁর বাণী যা স্বীয় বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করেছেন, যাকে তিনি আমানত আদায় ও রিসালাত প্রচারের জন্য পছন্দ ও মনোনীত করেছেন।

رسول كريم

দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝোনো হয়েছে। কারণ তিনি এর প্রচারক ও উপস্থাপক। এজন্য رسول বা দূত শব্দটি আনা হয়েছে। কেননা রাসূল কেবল তাঁর কথা প্রচার করেন যিনি তাঁকে প্রেরণ করেছেন। এজন্য জিবরীলের দিকেও এ
কুরআনের সম্বন্ধ লাগানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ)

“নিশ্চয়ই এই কুরআন সম্মানিত বার্তাবাহকের আনীত বাণী, সে শক্তিশালী আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন, সেখানে তাঁকে মান্য করা হয় এবং সে বিশ্বাস ভাজন। ” (সূরা তাকভীর ৮১ : ১৯-২১)

তাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে কখনো ফেরেশতা রাসূল জিবরীলের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন আবার কখনো মানুষ রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। কারণ উভয়েই আল্লাহ তা‘আলার কথার প্রচারক। জিবরীল প্রচার করেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে, আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রচার করেন মানুষের কাছে। তাই এ কুরআন কোন গণক, জ্যোতিষী বা মানুষের তৈরি কথা নয় বরং তা নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব।

কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কাফিররা যেসব অপবাদ দিত তার মধ্যে এও ছিল যে, তারা তাকে কবি ও জ্যোতিষী বলতো। কারণ কুরআনের ভাষা সাধারণ মানবীয় ভাষার তুলনায় অনেক উঁচু মানের হওয়ার কারণে তারা এরূপ সন্দেহ করত। তাদের মাঝে এরূপ কুসংস্কার প্রচলিত ছিল যে, কবি ও জ্যোতিষীর অধীন একটা জিন থাকে, সে তাকে উঁচু মানের ভাষা শেখায় এবং অজ্ঞাত অজ্ঞাত তথ্য সরবরাহ করে। অথচ কুরআন ও নবুওয়াতের প্রকৃতি এবং কবি ও জ্যোতিষীর প্রকৃতির মাঝে আকাশ-জমিন পার্থক্য বিদ্যমান। কবিতার সুরেলা ছন্দ, অভিনব চিন্তা এবং তাতে চমকপ্রদ দৃশ্য ও ছবির সমাবেশ ঘটতে পারে। কিন্তু সে জন্য তা কুরআনের মত হতে পারে না। কেননা কুরআন হল জীবনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, চিরন্তন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কথার কোন বৈপরিত্য নেই। পক্ষান্তরে কবিতা হল ধারাবাহিকভাবে উদ্ভুত প্রতিক্রিয়া এবং উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত ভাবাবেগের নাম। এতে স্থীতিশীলতা ও দৃঢ়তা অত্যন্ত কম। আনন্দ-বেদনা, ঘৃণা বিদ্বেষ ও প্রীতি ভালবাসা, সন্তোষ ও ক্রোধ এবং সুখ ও দুঃখ প্রভৃতি পরিবর্তনশীল অবস্থায় কবিতা কখনো একই মত ও দৃষ্টিভংগীর ওপর স্থির থাকে না। অনুরূপ জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে একই কথা। ইতিহাসের প্রাচীন কিংবা আধুনিক কোন যুগেই এমন কোন জ্যোতিষীর সাক্ষাত মেলেনি যে, কুরআনের বিধানের মত একটি পরিপূর্ণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমগ্র জীবনের উপযোগী বিধান রচনা করবে। পক্ষান্তরে কুরআন যে আদর্শ ও মতবাদ দিয়েছে তা আগাগোড়া খুঁটিনাটি সব ভিত্তিমূল থেকে গড়ে তুলেছে কুরআন নিজেই। তার উৎস আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজে সে কথাও তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাজ্জের সময় বহিরাগত হাজীদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা এ দাওয়াতী কার্যক্রম থেকে বাধা দেওয়ার ফন্দি করল। অলীদ বিন মুগীরাহ তার গৃহে সলাপরামর্শের জন্য একটি বৈঠক ডাকল। অলীদ বলল : হাজীদেরকে মুহাম্মাদ দাওয়াত দিতে গেলে আমরা কী বলে তাকে হাজীদের থেকে সরাতে পারব? আমাদেরকে একটি কথার ওপর একমত হওয়া দরকার যাতে পরে মতবিরোধ না হয়। সবাই বলল আপনি একটি কথা ঠিক করে দেন। অলীদ বলল : তোমরাই বল, আমি শুনব। কেউ বলল : আমরা বলব, সে একজন গণক; আপনারা তার কথা শুনবেন না। অলীদ বলল : আল্লাহ তা‘আলার কসম! না। আমি গণকের কথা শুনেছি তার কথা গণকের কথার সাথে কোন মিল নেই। কেউ বলল : তাহলে বলব, সে পাগল। অলীদ বলল : সে পাগল নয়, আমি পাগল দেখেছি। কেউ বলল : তাহলে বলব, সে কবি। অলীদ বলল : না, সে কবিও না, আমি সব ধরনের কবিতা দেখেছি। মুহ্ম্মাাদ যা বলে কবিতার সাথে তার কোন মিল নেই। তারপর বলল : তাহলে বলব : সে জাদুকর। অলীদ বলল : না সে জাদুকরও না, আমি অনেক জাদুকর দেখেছি। অবশেষে অলীদ বলল : আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তার কথা বড়ই মিষ্টি মধুর, তাঁর ভিত ও শিকড় বড়ই শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা বড়ই মনোমুগ্ধকর। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যাই বল তাঁর সংস্পর্শে যারা কিছুক্ষণ থাকবে তোমাদের কথা-বার্তাকে অবশ্যই মিথ্যা মনে করবে। (আর রাহীকূল মাখতুম)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা যে কারো নামে শপথ করতে পারেন, কিন্তু বান্দা আল্লাহ তা‘আলার নাম বা গুণাবলী ছাড়া অন্য কোন নামে শপথ করতে পারবে না।
২. কুরআনকে রাসূলের বাণী বলে সম্পৃক্ত করার হিকমত জানলাম।
৩. কুরআন কোন গণক, জ্যোতিষী বা মানুষের তৈরি কিতাব নয়; বরং তা নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার বাণী।
৪৪-৫২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

কাফির-মুশরিকদের সামনে আল্লাহ তা‘আলার কালাম কুরআন তেলাওয়াত করা হলে তারা বলে এটা একটি সুস্পষ্ট জাদু। আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন জাদুকর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন

(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِلْحَقِّ لَمَّا جَا۬ءَهُمْ لا إِنْ هٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ مُّبِيْنٌ ‏)‏

“আর কাফিরদের কাছে যখন এ সত্য (কুরআন) আসল তখন তারা বলল- এটা প্রকাশ্য জাদু ব্যতীত আর কিছুই নয়।।” (সূরা সাবা ৩৪:৪৩)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَمَّا جَا۬ءَهُمُ الْحَقُّ قَالُوْا هٰذَا سِحْرٌ وَّإِنَّا بِه۪ كٰفِرُوْنَ ‏)‏

“যখন তাদের নিকট সত্য আসল তখন তারা বললো- এটা তো জাদু এবং আমরা অবশ্যই এর প্রতি অস্বীকার জ্ঞাপন করি।”

মূলত কাফিরদের এসব কথা দ্বারা উদ্দেশ্য- নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব নিজের পক্ষ থেকে তৈরি করে এনেছেন।

আল্লাহ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শিখিয়ে দিচ্ছেন, বলে দাও, যদি আমি নিজের পক্ষ থেকে তৈরি করে আনতাম তাহলে আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে তোমরা আমাকে রক্ষা করতে পারতে না। যেমন তিনি বলেন, যদি সে নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিত, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, এবং কেটে দিতাম তার হৃৎপিণ্ডের শিরা। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকত না, যে তার থেকে আমাকে বিরত রাখতে পারে। (সূরা হাক্কাহ ৬৯ : ৪৪-৪৭)

(وَإِنَّهُ لَتَذْكِرَةٌ لِلْمُتَّقِينَ)

অর্থাৎ এ কুরআন মুত্তাকীদের জন্য উপদেশবাণী। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًي وَشِفَا۬ءٌ وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًي)

‘বল: মু’মিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার; কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব।’ (সূরা মু’মিন ৪১ : ৪৪)

দীন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা করে দেওয়ার পরেও এক শ্রেণির মানুষ থাকবে যারা কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। কুরআন, ইসলাম ও রাসূল কোন কিছুই তারা মানবে না, এটা আল্লাহ তা‘আলা ভাল করেই জানেন। কাফিরদের এ মিথ্যা প্রতিপন্ন করাটা আখিরাতে আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ তা‘আলার এ কথা শত ভাগ সত্য। অবশ্যই এরূপ ঘটবে এতে কোন সন্দেহ নেই। অতএব হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি তোমার প্রভুর নামে তাসবীহ পাঠ কর।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা বানিয়ে যদি আল্লাহ তা‘আলার নামে চালিয়ে দিতেন তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ছাড়তেন না।
২. কিয়ামতের দিন কাফিররা কুরআন মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে বড়ই আফসোস করবে কিন্তু এ আফসোস তাদের কোনই উপকারে আসবে না।

৩. سبحان ربي العظيم

দ্বারা তাসবীহ করা শরীয়তসম্মত। আর রুকুতে এ তাসবীহ পড়ার নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণ রয়েছে।

৩৮-৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৩৮-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় সৃষ্টবস্তুর মধ্য হতে তার ঐ সব নিদর্শনের শপথ করছেন যেগুলো মানুষ দেখতে পাচ্ছে এবং ঐগুলোরও কসম খাচ্ছেন যেগুলো মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে। তিনি এর উপর শপথ করছেন যে, কুরআন কারীম তাঁর বাণী ও তাঁর ওহী, যা তিনি স্বীয় বান্দা ও রাসূল (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন, যাকে তিনি আমানত আদায় ও রিসালাতের প্রচারের জন্যে পছন্দ ও মনোনীত করেছেন। (আরবি) দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। এর সম্বন্ধ তার সাথে লাগানোর কারণ এই যে, এর প্রচারক ও উপস্থাপক তো তিনিই। এ জন্যে (আরবি) শব্দ আনয়ন করা হয়েছে। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তো তাঁর পয়গাম পৌঁছিয়ে থাকেন যিনি তাঁকে প্রেরণ করেছেন। ভাষা তাঁর হলেও উক্তি হলো তাঁকে যিনি প্রেরণ করেছেন তাঁর। এ কারণেই সূরা তাকভীরে এর সম্বন্ধ লাগানো হয়েছে ফেরেশতা-দূতের সাথে (অর্থাৎ হযরত জিবরাঈলের আঃ) সাথে। ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই এই কুরআন সম্মানিত বার্তাবহের আনীত বাণী। যে সামর্থশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদা সম্পন্ন, যাকে সেখানে মান্য করা হয় এবং যে বিশ্বাসভাজন।”(৮১:১৯-২১) আর ইনি হলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ)। এ জন্যেই এর পরেই বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমাদের সাথী (হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)) পাগল নয়।”(৮১:২২) তারপর বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “অবশ্যই মুহাম্মাদ (সঃ) তাকে জিবরাঈলকে (আঃ) তার প্রকৃত আকৃতিতে স্পষ্ট প্রান্তে দেখেছে।”(৮১:২৩) এরপর বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সে অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে কৃপণ নয়।”(৮১:২৪) (আরবি) অর্থাৎ “এটা অভিশপ্ত শয়তানের বাক্য নয়।”(৮১:২৫)

অনুরূপভাবে এখানেও বলেনঃ “এটা কোন কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করে থাকে। এটা কোন গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করে থাকো।” সুতরাং মহান আল্লাহ কোন কোন সময় নিজের বাণীর সম্বন্ধ লাগিয়েছেন মানব দূতের দিকে, আবার কখনো কখনো সম্বন্ধ লাগিয়েছেন ফেরেশতা দূতের দিকে। কেননা, তারা উভয়েই আল্লাহর বাণীর প্রচারক এবং তারা বিশ্বাস ভাজন। হ্যাঁ, তবে প্রকৃতপক্ষে বাণী কার? এটাও সাথে সাথে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ।”

মুসনাদে আহমাদে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আমি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উদ্দেশ্যে বের হই। দেখি যে, তিনি আমার পূর্বেই মসজিদে হারামে হাযির হয়ে গেছেন। আমি তার পিছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি সূরা হাককাহ পাঠ করতে শুরু করেন। কুরআনের অলংকারপূর্ণ ভাষা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। আমি মনে মনে বলি যে, কুরায়েশরা যে এঁকে কবি বলেছে তা সঠিকই বটে। আমার মনে এ খেয়াল জেগেই আছে, ইতিমধ্যে তিনি পাঠ করলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই এই কুরআন এক সম্মানিত রাসূলের বাহিত বার্তা। এটা কোন কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করে থাকো।” তখন আমার মনে খেয়াল জাগলো যে, ইনি কবি না হলে অবশ্যই যাদুকর। তখন তিনি পাঠ করলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “এটা কোন যাদুকর বা গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করে থাকো। এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ। সে যদি আমার নামে কিছু রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতো, তবে অবশ্যই আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম এবং কেটে দিতাম তার জীবন-ধমনী। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, যে তাকে রক্ষা করতে পারে (শেষ আয়াত পর্যন্ত)।” এটা ছিল প্রথম ঘটনা, যার ফলে ইসলাম আমার অন্তরে পূর্ণভাবে ঘর করে বসে এবং প্রতিটি লোমকূপে ওর সত্যতা প্রবেশ করে। সুতরাং যেসব কারণ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে সুপথ প্রদর্শনে ক্রিয়াশীল হয়েছিল তন্মধ্যে এটাও ছিল একটি বিশেষ কারণ। আমরা তাঁর ইসলাম গ্রহণের পূর্ণ ঘটনাটি ‘সীরাতে উমারফূ’ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছি। আল্লাহরই জন্যে সমস্ত প্রশংসা এবং আমরা তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
৪৪-৫২ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে কাফির ও মুশরিকদের দল! তোমাদের কথা হিসেবে সত্যিই যদি আমার রাসূল (সঃ) এরূপই হতো, অর্থাৎ আমার রিসালাতের মধ্যে কিছু কম বেশী করতো বা আমি যে কথা বলিনি সেই কথা আমার নামে চালিয়ে দিতো তবে অবশ্যই তৎক্ষণাৎ আমি তাকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিতাম অর্থাৎ আমার ডান হাত দ্বারা তার ডান হাত ধরে ফেলতাম এবং তার ঐ শিরা কেটে ফেলতাম যার উপর হৃদয় লটকানো রয়েছে। এমতাবস্থায় আমার এবং তার মাঝে এমন কেউ আসতে পারতো না যে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতো। সুতরাং ভাবার্থ এই দাড়ালো যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সত্যবাদী, পবিত্র ও সুপথগামী ছিলেন। এ কারণেই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাবলীগের এ মহান দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করেছিলেন। আর নিজের পক্ষ হতে বহু মু’জিযা এবং তাঁর সত্যবাদিতার বড় বড় নিদর্শন তাঁকে প্রদান করেছিলেন।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এই কুরআন অবশ্যই মুত্তাকীদের জন্যে এক উপদেশ। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “(হে নবী সঃ!) তুমি বলে দাও যে, এই কুরআন মুমিনদের জন্যে হিদায়াত ও শিফা (অন্তর রোগের প্রতিষেধক), আর বে-ঈমানদের কর্ণে তো বধিরতা ও চক্ষে অন্ধত্ব রয়েছে (তারা দেখেও দেখে না এবং শুনেও শুনে)।” (৪১:৪৪)

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি অবশ্যই জানি যে, তোমাদের মধ্যে মিথ্যা আরোপকারী রয়েছে। অর্থাৎ এভাবে স্পষ্ট বর্ণনার পরেও এমন কতকগুলো লোক রয়েছে যারা কুরআনকে অবিশ্বাস করেই চলেছে। এই অবিশ্বাস ঐ লোকদের জন্যে কিয়ামতের দিন অনুশোচনার কারণ হবে। অথবা ভাবার্থ হচ্ছেঃ এই কুরআনই কাফিরদের অনুশোচনার কারণ হবে। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায়
বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “এভাবেই আমি পাপীদের অন্তরে এটা অবতীর্ণ করি যে, তারা ওর উপর ঈমান আনয়ন করে না।”(২৬:২০০-২০১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তাদের মাঝে ও তাদের প্রবৃত্তির মাঝে পর্দা ফেলে দেয়া হয়েছে।”(৩৪:৫৪)

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই এটা সম্পূর্ণরূপে সত্য খবর। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ অতএব, হে নবী (সঃ)! এই কুরআন অবতীর্ণকারী মহান প্রতিপালকের নামের তুমি পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।

৩৮-৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#অর্থাৎ তোমরা যা মনে করে নিয়েছো ব্যাপার তা নয়।
# এখানে সম্মানিত রসূল মানে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কিন্তু সূরা তাকবীরে (আয়াত ১৯) সম্মানিত রসূলের যে উল্লেখ আছে তার অর্থ হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। এখানে যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই সম্মানিত রসূল বলা হয়েছে তার প্রমাণ হলো, কুরআনকে সম্মানিত রসূলের বাণী বলার পরেই বলা হয়েছে যে তা কোন কবি বা গণকের কথা নয়। আর একথা সবারই জানা যে, মক্কার কাফেররা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই কবি বা গণক বলতো। তারা জিবরাঈল আলাইহিস সাল্লামকে কবি বা গণক বলতো না। পক্ষান্তরে সূরা তাকবীরে কুরআন মজীদকে সম্মানিত রসূলের বাণী বলার পরে বলা হয়েছে যে, সে রসূল অত্যন্ত শক্তিশালী, আরশের অধিপতির কাছে উচ্চমর্যাদার অধিকারী, সেখানে তাঁর কথা গ্রহণ করা হয়, তিনি বিশ্বস্তও আমানতদার এবং মুহাম্মাদ ﷺ তাঁকে পরিষ্কার দিগন্তে দেখেছেন। সূরা নাজমের ৫ থেকে ১০ আয়াতে জিবরাঈল আলাইহিস সাল্লাম সম্পর্কে প্রায় এ একই বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে। তাহলো, কুরআনকে মুহাম্মাদ ﷺ ও জিবরাঈল আলাইহি সালামের বাণী বলার তাৎপর্য কি? এর জওয়াব হলো, মানুষ কুরআনের এ বাণী শুনতো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে এবং রসূলুল্লাহ ﷺ শুনতেন জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মুখ থেকে। তাই এক বিচারে এটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানী এবং আরেক বিচারে এটি হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের বাণী। কিন্তু পরক্ষণেই বিষয়টি স্পস্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের রবের নাযিলকৃত বাণী। তবে তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিবরাঈলের মুখ থেকে এবং লোকদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে শুনানো হচ্ছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের কথা থেকেও এ সত্যটিই ফুটে উঠে। তিনি বলেছেন যে, এসব তাদের দুজনের কথা নয়। বরং বার্তাবাহক হিসেবে তাঁর এ বাণী মূল বাণী প্রেরকের পক্ষ থেকে পেশ করেছেন।
# “কমই ঈমান পোষণ করে থাকো” প্রচলিত আরবী বাকরীতি অনুসারে এর একটি অর্থ হতে পারে তোমরা আদৌ ঈমান পোষণ করো না। এর আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, কুরআন শুনে কোন সময় তোমাদের মন হয়তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে ওঠে যে, এটা মানুষের কথা হতে পারে না। কিন্তু তোমরা নিজেদের হঠকারিতার ওপর অবিচল রয়েছ এবং এ বানীর ওপর ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থাকো।

সুরা: আল-হাক্বাহ্
আয়াত নং :-৪৩

تَنْزِیْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ

এ বাণী বিশ্ব-জাহানের রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২৪) সারকথা হলো তোমরা যা কিছু দেখতে পাও এবং যা কিছু দেখতে পাও না তার কসম আমি এ জন্য করছি যে, এ কুরআন কোন কবি বা গণকের কথা নয়। বরং সারা বিশ্ব-জাহানের রবের নাযিলকৃত বাণী। এ বাণী এমন এক রসূলের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যিনি মর্যাদাবান (অত্যন্ত সম্মানিত ও ভদ্র)। এখন দেখা যাক কসম করার উদ্দেশ্য কি? লোকজন যা কিছু দেখতে পাচ্ছিল তাহলোঃ
একঃ এ বাণী এমন ব্যক্তি পেশ করেছিলেন যার মার্জিত ও ভদ্র স্বভাবের বিষয়টি মক্কা শহরের কারোই অজানা ছিল না। সমাজের সবাই একথা জানতো যে, নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে তিনি তাদের জাতির মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি। এরূপ লোক আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করবে এবং নিজে কোন কথা বানিয়ে মহান আল্লাহর কথা বলে তা চালিয়ে দেবে, এত বড় মিথ্যার বেসাতি এ লোকের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
দুইঃ তারা আরো দেখছিল যে, এ ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে এ বাণী পেশ করছে না। বরং এ কাজ করতে গিয়ে সে নিজের স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দিয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে সে নিজের ব্যবসায়-বাণিজ্য ধ্বংস করেছে, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেছে, যে সমাজে তাকে অভাবনীয় সম্মান দেখানো হতো সেখানেই তাকে গালিগালিজের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, আর এসব করে নিজেই যে শুধু দুঃখ-দুর্দশার মুখে ঠেলে দিয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থের পূজারী হলে সে নিজেকে এ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে টেনে আনবে কেন?
তিনঃ তারা নিজের চোখে এও দেখেছিলো যে, তাদের সমাজের যেসব লোক ঐ ব্যক্তির প্রতি ঈমান আনছিলো তাদের জীবনে হঠাৎ একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে যাচ্ছে। কোন কবি অথবা গণকের কথার এতটা প্রভাব কি কখনো দেখা গিয়েছে যে তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক নৈতিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে আর তার অনুসারীরা এ জন্য সব রকমের বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে?
চারঃ কবিদের ভাষা কেমন হয়ে থাকে এবং গণকদের কথাবার্তা কিরূপ হয় তাও তাদের অজানা ছিল না। কুরআনের ভাষা, সাহিত্য ও বিষয়বস্তুকে কবির কাব্য এবং গণকের গণনা সদৃশ বলা একমাত্র হঠকারী ব্যক্তি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। (আমি এ বিষয়ে তাফহীমুল কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ৭নং টীকায় , সূরা শুআরার ১৪২ থেকে ১৪৫ নং টীকায় এবং সূরা আত্ তূরের ২২ নং টীকায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি)।
পাঁচঃ সমগ্র আরব ভূমিতে উন্নত ভাষাশৈলীর অধিকারী এমন কোন ব্যক্তি ছিল না যার চমকপ্রদ ও অলংকারময় ভাষাকে কুরআনের মোকাবিলায় পেশ করা যেতো। কুরআনের সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা কারো ভাষার বিশুদ্ধতা ও শ্রুতিমাধুর্য কুরআনের উন্নত ভাষাশৈলীর ধারে কাছে ঘেঁষারও যোগ্যতা রাখতো না। এ বিষয়টিও তাদের জানা ছিল।
ছয়ঃ মুহাম্মাদ ﷺ নিজের কথাবার্তা ও ভাষার সাহিত্যিক উৎকর্ষ ও কুরআনের সাহিত্যিক মান ও উৎকর্ষ থেকে যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল তাও তাদের অগোচরে ছিল না। আরবী ভাষাভাষী কোন ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তৃতা এবং কুরআন শোনার পর বলতে পারতো না যে, এ দু’টি একই ব্যক্তির মুখের কথা।
সাতঃ যেসব বিষয়বস্তু ও জ্ঞান-বিজ্ঞান কুরআনে পেশ করা হয়েছে নবুওয়াত দাবী করার একদিন আগেও মক্কার লোকেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে তা শোনেনি। তারা এও জানতো যে তাঁর কাছে এসব তথ্য ও বিষয়বস্তু জানার কোন উপায়-উপকরণ ও নেই। তাই নবী ﷺ কোন গোপনীয় সূত্র থেকে এসব তথ্য ও জ্ঞান লাভ করেছেন বলে তাঁর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলেও মক্কার কেউ-ই তা বিশ্বাস করতো না। (আমি তাফহীমুল কোরআনের সূরা আন নাহলের ১০৭ নং টীকা এবং সূরা আল ফুরকানের ১২ নং টীকায় এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছি।)
আটঃ এ পৃথিবী থেকে সুদূর আসমান তথা মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত এ বিরাট-বিশাল বিশ্ব-জাহানকে তারা নিজ চোখে সুচারু রূপে পরিচালিত হতে দেখছিল। তারা এও দেখছিলো যে, এ বিশাল বিশ্বলোক একটি জ্ঞানগর্ভ আইন-বিধান এবং সর্বব্যাপী নিয়ম-শৃংখলা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আরবের লোকেরা শিরকে লিপ্ত ছিল এবং আখেরাত অস্বীকার করতো। এটা ছিল তাদের আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্গত। কিন্তু এ বিশাল বিশ্বলোকের পরিচালনা ও নিয়ম-শৃংখলার কোন ক্ষেত্রেই তারা শিরক ও আখেরাত অস্বীকৃতির পক্ষে কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁজে পেতো না। বরং কুরআন তাওহীদ ও আখেরাতের যে ধারণা পেশ করছে সর্বত্র তারই সত্যতার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
এসবই তারা দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু যেসব জিনিস তারা দেখতে পাচ্ছিল না তাহলো, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ‌ তাআলাই এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, মালিক এবং শাসক, বিশ্ব-জাহানের সবাই তাঁর বান্দা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ ইলাহ নয়, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে, আল্লাহ‌ তাআলাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূল করে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকেই তাঁর ওপর কুরআন নাযিল হচ্ছে। পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে যা বলা হয়েছে তা বলা হয়েছে এ দুধরনের সত্যের কসম খেয়ে।
# নিজের পক্ষ থেকে অহীর মধ্যে কম বেশী করার ইখতিয়ার নবীর নেই, নবী যদি এ কাজ করে তাহলে আমি তাকে কঠিন শাস্তি দেবো, একথাটি বলাই এ আয়াতের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এথাটি বলতে যে বাচনভংগী গ্রহণ করা হয়েছে তাতে চোখের সামনে এমন একটি চিত্র ভেসে উঠে যে, বাদশাহর নিযুক্ত কর্মচারী বাদশাহের নামে জালিয়াতী করলে তিনি তাকে পাকড়াও করে তার গর্দান মেরে দেবেন। কিছু লোক এ আয়াত থেকে এ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কোন ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করলে তৎক্ষণাৎ আল্লাহর তরফ থেকে যদি তার গর্দানের রগ কেটে দেয়া না হয় তাহলে এটা হবে তার নবী হওয়ার প্রমাণ। অথচ এ আয়াতে যা বলা হয়েছে তা সত্য নবী সম্পর্কে বলা হয়েছে। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার সম্পর্কে তা প্রযোজ্য নয়। মিথ্যা দাবীদার তো শুধু নবুওয়াতের দাবীই করে না, খোদায়ীর দাবী পর্যন্ত করে বসে এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে বুক ফুলিয়ে চলে। এটা তাদের সত্য হওয়ার কোন প্রমাণ নয়। (আমি তাফহীমুল কোরআনের সূরা ইউনুসের ২৩ নং টীকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।) ।
# অর্থাৎ যারা ভুল-ভ্রান্তি ও তার খারাপ পরিণাম থেকে রক্ষা পেতে চায় কুরআন তাদের জন্য উপদেশ বাণী। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা আল বাকারাহ, টীকা ৩ ) ।
# অর্থাৎ পরিশেষে তাদেরকে এ জন্য অনুশোচনা করতে হবে যে, কেন তারা কুরআনকে মিথ্যা মনে করেছিল!

Leave a Reply