Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৭৯/মুমিনের বৈশিষ্ট্য-৩)
[** ঈমান শূন্য মানুষের মন :-
*ঈমানদার ও বে-ঈমান ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী একটি গুন:-
**ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা : মােমেনদের বৈশিষ্ট্য:-
*মানব জীবনে পরকাল বিশ্বাসের সুফল:-
**পরিবার ইসলামী সমাজের ভিত্তি :-
**আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করা:-
*সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান মুমিনের বৈশিষ্ট্য:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ
পারা:২৯
১৯-৩৫ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৯
اِنَّ الۡاِنۡسَانَ خُلِقَ ہَلُوۡعًا ﴿ۙ۱۹﴾
নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্তরূপে ।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২০
اِذَا مَسَّہُ الشَّرُّ جَزُوۡعًا ﴿ۙ۲۰﴾
যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে, তখন সে হয় হা-হুতাশকারী।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২১
وَّ اِذَا مَسَّہُ الۡخَیۡرُ مَنُوۡعًا ﴿ۙ۲۱﴾
আর যে-ই সচ্ছলতার মুখ দেখে অমনি সে কৃপণতা করতে শুরু করে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২২
اِلَّا الۡمُصَلِّیۡنَ ﴿ۙ۲۲﴾
তবে সালাত আদায়কারীগণ ছাড়া,
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৩
الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَلٰی صَلَاتِہِمۡ دَآئِمُوۡنَ ﴿۪ۙ۲۳﴾
যারা তাদের সালাতে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত ,
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৪
وَ الَّذِیۡنَ فِیۡۤ اَمۡوَالِہِمۡ حَقٌّ مَّعۡلُوۡمٌ ﴿۪ۙ۲۴﴾
আর যাদের সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে-
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৫
لِّلسَّآئِلِ وَ الۡمَحۡرُوۡمِ ﴿۪ۙ۲۵﴾
প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৬
وَ الَّذِیۡنَ یُصَدِّقُوۡنَ بِیَوۡمِ الدِّیۡنِ ﴿۪ۙ۲۶﴾
আর যারা প্রতিদান দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৭
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ مِّنۡ عَذَابِ رَبِّہِمۡ مُّشۡفِقُوۡنَ ﴿ۚ۲۷﴾
আর যারা তাদের প্রতিপালকের শাস্তি সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৮
اِنَّ عَذَابَ رَبِّہِمۡ غَیۡرُ مَاۡمُوۡنٍ ﴿۲۸﴾
নিশ্চয় তাদের রবের শাস্তি হতে নিঃশঙ্ক থাকা যায় না;
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২৯
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ لِفُرُوۡجِہِمۡ حٰفِظُوۡنَ ﴿ۙ۲۹﴾
আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গসমূহের হিফাযতকারী ,
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩০
اِلَّا عَلٰۤی اَزۡوَاجِہِمۡ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُمۡ فَاِنَّہُمۡ غَیۡرُ مَلُوۡمِیۡنَ ﴿ۚ۳۰﴾
নিজের স্ত্রী অথবা মালিকানাধীন স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যদের থেকে। স্ত্রী ও মালিকানাধীন স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে তারা তিরস্কৃত হবে না।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩১
فَمَنِ ابۡتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡعٰدُوۡنَ ﴿ۚ۳۱﴾
তবে যারা এর বাইরে আর কেউকে চাইবে তারা সীমালংঘনকারী।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩২
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ لِاَمٰنٰتِہِمۡ وَ عَہۡدِہِمۡ رٰعُوۡنَ ﴿۪ۙ۳۲﴾
এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩৩
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ بِشَہٰدٰتِہِمۡ قَآئِمُوۡنَ ﴿۪ۙ۳۳﴾
আর যারা সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে সততার ওপর অটল থাকে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩৪
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَلٰی صَلَاتِہِمۡ یُحَافِظُوۡنَ ﴿ؕ۳۴﴾
আর যারা তাদের সালাতের হিফাযত করে —
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩৫
اُولٰٓئِکَ فِیۡ جَنّٰتٍ مُّکۡرَمُوۡنَ ﴿ؕ٪۳۵﴾
এসব লোক সম্মানের সাথে জান্নাতের বাগানসমূহে অবস্থান করবে।
১৯-৩৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
*ঈমান শূন্য মানুষের মন : এবারে সে আযাবের ও পুরস্কারের অধিকারী শ্রেণী দুটোর চিত্র আঁকা হচ্ছে। একদল ঈমানী জীবন যাপন করেছে এবং অপর দল বে-ঈমানী জীবন কাটিয়েছে। এর ফলে মােমেনদের আচরণ এবং কাফেরদের আচরণ ও প্রকৃতিও আলাদা হয়ে গেছে। দেখুন আল্লাহর বাণী, মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছে ব্যস্ত স্বভাবের সৃষ্টি রূপে; যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে তখন সে অস্থির হয়ে যায়, আবার যখন তাকে কোনাে কল্যাণ দান করা হয় তখন সে অন্যকে কিছু দান করা থেকে বিরত হয়ে যায়। তবে এ অবস্থা থেকে তারা মুক্ত যারা সর্বক্ষণ নামাযে যত্নবান হয়, যারা প্রয়ােজনীয় জীবন সামগ্রী থেকে বঞ্চিত অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করে, দান করে। যারা শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস করে এবং তারা তাদের পরওয়ারদিগারের পক্ষ থেকে যে ভয়ানক আযাব আসবে তাকে মনে প্রাণে ভয় করে।’ নিশ্চয়ই তাদের প্রতিপালকের কাছে যে আযাব রয়েছে তা কোনাে নিরাপদ জিনিস নয়, যারা নিজ নিজ লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী, নিজেদের স্ত্রীদের ও অধীনস্থ দাসীদের বাদে- তাদের ব্যাপারে এটা কোনাে নিন্দনীয় নয়। [দাসীদেরকে স্ত্রীর মতাে ব্যবহার করার রীতি বহু শতাব্দী ধরে সমাজে চলে আসছিলাে। পরবর্তী কালে ইসলামই সর্বপ্রথম মানুষের মর্যাদার উন্নয়ন সাধন করে। ইসলাম গ্রহণের পর সকল মুসলমান ভাই ভাই এই ঘােষণার় ব্যপ্তির কারণে সমাজ থেকে ধীরে ধীরে এই কুপ্রথার অবসান ঘটেছে। এই দাস প্রথা চালু ছিলাে দুইভাবে। এক. যুদ্ধবন্দী বিনিময় না হওয়া অবস্থায় তাদেরকে দাস বা দাসী হিসেবে বিজয়ী সেনাদের মধ্যে বিতরণ করা হতাে। দুই. বাজারে গরু-ছাগলের মতো তাদের বিক্রি করা হতাে। আদম ব্যবসায়ী ছিনতাইকারীরা স্বদেশ ও বিদেশ থেকে ধরে নিয়ে এদের বাজারে বাজারে বিক্রি করতাে। আর এটা সম্ভব ছিলাে এই জন্যে যে, তৎকালে বিশেষ করে আরব দেশে কোনাে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা সবার গ্রহণযােগ্য কোনাে আইন কানুন চালু ছিলাে না। ইসলাম ধীরে ধীরে এ অবস্থার উন্নয়ন করেছে। ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘােষণা করা হয় ও যুদ্ধবন্দীর ক্ষেত্রে বিনিময় প্রথা চালু করা হয়। দাস-মুক্তিতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলে’ এ ঘােষণায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ দাস-দাসীদেরকে মুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং অবশেষে তাদেরকে নিজেদের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে জামাই বানানাের প্রথাও সমাজে চালু হয়ে যায় । এইভাবে দেরীতে হলেও দাস প্রথা সমাজ থেকে বিদূরিত হয়ে যায়। বিস্তারিত আলােচনার জন্যে এই তাফসীরের (সূরা মুহাম্মদ) ১৯ তম খন্ড দ্রষ্টব্য] আর যারা সকল প্রকারের সাক্ষ্য প্রদানের ব্যাপারে দৃঢ়তা অবলম্বনকারী। সর্বোপরি নামায আদায় করার ব্যাপারে তারা সদা সতর্ক। এই সকল গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিরাই আল্লাহর জান্নাতগুলােতে স্থান লাভে ধন্য হবে, সেখানে তারা থাকবে সম্মান ও মর্যাদার সাথে। ঈমান শূন্য মানুষের অবস্থা হচ্ছে এমন এক অদ্ভূত ধরনের, যার বর্ণনা কোরআন বিশদভাবে পেশ করেছে। কোরআনের বর্ণনা মতে সে এই সৃষ্টির মধ্যে সবার কাছে এক ভিন্ন জাতের সৃষ্টি হিসেবে গণ্য। কারণ যে প্রকৃত সত্য অন্য সব সৃষ্টি স্বীকার করছে- তা সে মানতে প্রস্তুত নয়। সে তার মালিককে মানতে গিয়ে নানা প্রকার সংশয় অনুভব করে। এই দুর্বিসহ সংশয়ে পতিত হতভাগ্য ব্যক্তিটি ঈমানের বর্ম ব্যতীত মুক্তির কোনাে পথ খুঁজে পায় না। সমস্যা-পীড়িত এই ব্যক্তির সকল অস্থিরতা তখনই দূর হওয়া সম্ভব যখন সে ঈমানের বলে বলীয়ান হবে, আর তখনই সে অকল্যাণ ও সংকীর্ণতার ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে পারে। ‘অবশ্যই মানব জাতিকে ‘বে-সবর’ বা ধৈর্যহীন করে পয়দা করা হয়েছে। তার প্রকৃতিই হচ্ছে, যখন তাকে কোনাে অকল্যাণ স্পর্শ করে তখন সে অস্থির হয়ে যায়। আবার কোনাে কল্যাণ বা সাফল্য যখন সে পায় তখন এতাে সংকীর্ণ হৃদয়ের হয়ে যায় যে, আর কাউকেই সে কিছু দিতে চায় না।’ তখন এমন এক ভাবমূর্তি তার মধ্যে সৃষ্টি হয় যে, সে আরাম-আয়েশের স্পর্শে অন্যদের ভুলে যায়, যেখানেই সে একটু সুখ সম্পদের খোঁজ পায়, সেখানেই গিয়ে সে তা হাসিল করার জন্যে পাগল হয়ে উঠে। এ সময় তার মধ্যে প্রধানত তিনটি অবস্থা দেখা যায়, এক. অহংকারে সে তখন অন্যের সাথে বেশী কথা বলতে চায় না। দুই. আরাম-আয়েশের স্পর্শে জীবনের স্পন্দন তার গােটা সত্তাকে আন্দোলিত করতে থাকে, কিন্তু ফলে ফুলে সুশােভিত দেহ-অবয়ব নিয়ে থাকা সত্তেও তার মধ্যে সব সময় হাহাকার লেগেই থাকে এবং যখনই কোনাে সামান্য সংকট এসে হাযির হয় তখন সে একেবারে অস্থির হয়ে যায়, সমস্যার জ্বালা তাকে দারুণভাবে পীড়া দিতে থাকে। কোনাে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এমন ভাবে সে অস্থির হয়ে যায় যে মনে করতে থাকে এ সংকটের অবসান বুঝি আর কোনােদিন হবে না। সে এও ভাবতে থাকে যে, এই অবস্থাই তার স্থায়ী ভাগ্যলিপিতে পরিণত হয়ে গেছে, যার থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনাে রাস্তা নেই। বিপদ বা দুঃখের সেই অবস্থায় তার মনের মধ্যে নানা প্রকার বদখেয়ালও জটলা পাকাতে থাকে। এর কোনাে পরিবর্তন এবং এ দুঃখ বেদনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার ব্যাপারে সে হতাশ হয়ে পড়ে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এর কোনাে সমাধান আসবে বলেও তার মনে বিশ্বাস আসতে চায় না, এইভাবে চরম এক অস্থিরতা তাকে গ্রাস করে ফেলে। সকল ধৈর্যের বাঁধ তার ভেংগে যায়। এমন কোনাে অবলম্বন সে সামনে দেখতে পায় না, যা ধরে সে দাঁড়াতে পারে। হতাশার আঁধারে আশার আলাের ক্ষীণতম রেখাও সে দেখতে পায় না। আবার এই অবস্থা থেকে যখন সে উদ্ধার পেয়ে যায় সে মনে করতে থাকে, নিজ কৃতিত্ব বলেই সে এ মহাসংকট থেকে নাজাত লাভ করেছে, এতে কারাে কোনাে হাত বা অবদান নেই। এইভাবে যা কিছু সে লাভ করে তার মধ্যে তার মন-মগয, এমনকি তার গােটা সত্ত্বা আবদ্ধ হয়ে যায়, সে তখন লালসার পরিপূর্ণ দাসে পরিণত হয়। কেননা সে জানে না যে, জীবন ধারণের যাবতীয় উপায়- যা সে আজ লাভ করেছে এবং বিপদ-আপদ যা এখানে আসে তার আসল উৎস কোথায়? সে বুঝতে চায় না যে, এসব কিছুই তার মালিকের দান। কাজেই স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থাই তার জন্যে এমন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে যায় যে, সে কখনও স্থির হয়ে বসতে পারে না। দুর্দিনে সে যেমন থাকে তেমনি সুদিনেও সে সুস্থির থাকে না। মূলত ঈমানের অভাবেই এই অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। এবার শুরু হচ্ছে ঈমান সম্পর্কিত আলােচনা। মানুষের জীবনে ঈমানের প্রশ্নটি এতাে বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে এর সমকক্ষ অন্য কিছুই নেই। এই ঈমান একমাত্র হৃদয়ের অভ্যন্তরেই অনুভব করা সম্ভব। এই ঈমানের ব্যাপারটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে তার অন্তরের গভীরে পােষণ করে, যার ভিত্তিতে তার কাছে জীবন পরিচালনার এক বিশেষ নিয়ম পদ্ধতি নির্ণিত হয়। জীবনকে মূল্যবান বানানাের জন্যে, জীবনের যাবতীয় কাজ ও ব্যবহারকে সুনির্দিষ্ট গতি দান করার জন্যে এটি একটি বড় পরিচালিকা শক্তি। এ শক্তি মানুষকে সাহস দেয়, নির্ভীক বানায়, তাকে কর্মতৎপর করে এবং যে কোনাে ঝুঁকি নিতে তাকে উন্বুদ্ধ করে। যে অন্তরে ঈমান নেই সে অন্তর হয় দোদুল্যমান এবং পাখীর পাখনার মতাে তা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে উড়ে বেড়ায়। তাই ঈমান-শূন্য হৃদয় সর্বদা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও ভয়-ভীতির শিকার হয়। এসব অন্তরের প্রকৃতি হচ্ছে এই যে, যদি কোনাে অকল্যাণ বা দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করে তাহলে সে অস্থির হয়ে যায়, আবার যখন সে সুখ-শান্তি সমৃদ্ধির অধিকারী হয় তখন তার মধ্যে সংকীর্ণতা ও কৃপণতা এমনভাবে বাসা বাধে যে সে ভুলেই যায় যে এগুলাে পাওয়ার পেছনে তার নিজের ভূমিকা ছিলাে একেবারেই গৌণ, আল্লাহরকুদরতই ছিলাে এখানে মুখ্য। এ কারণেই বলা হয়, যার দিলে ঈমান স্থান করে নিয়েছে সে শান্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। নিশ্চিন্ততায় তার মন ভরপুর থাকে, এ অবস্থায় অন্যদেরকেও সে তার সুখ-শান্তির সাথে ভাগী বানিয়ে নিতে চায়, যেহেতু সে ভালােভাবে অনুভব করে যে এসব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, সবই আল্লাহর দান, তারই মেহেরবাণীতে সে এগুলাে লাভ করেছে। যে কোনাে সময়ে তার এসব ভােগ্য বস্তুকে সংকুচিত করে দিয়ে তাকে পরীক্ষা করা হতে পারে। এ কথা সে জানে এবং বুঝে বলেই সে তার জন্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। আবার প্রতিটি বিপদের পর অথবা তার পাশাপাশি বিপদমুক্তি ও স্বচ্ছলতা অবশ্যই আসবে একথাও সে বিশ্বাস করে, তাই সে কোনাে অবস্থাতেই অস্থির হয় না। যখন সুদিন আসে তখন কৃতজ্ঞচিত্তে সে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার দেয়া ‘রিযিক’ (সুখ-সম্পদের জিনিস) থেকে নির্দ্বিধায় সে খরচ করে। আর আল্লাহর পথে যখন সে খরচ করে তখন সে এর বিনিময়ে দুনিয়া ও আখিরাতে প্রতিদান পাবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। আখেরাতে বদলা পাওয়ার পূর্বে দুনিয়ার প্রাপ্য হিসেবে সে মুখ্যত ঈমানী প্রেরণাই পেতে চায়, যার কারণে সে পরম শান্তি ও তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে এবং জীবনের দীর্ঘ কঠিন পথে সে তৃপ্তি ও নিশ্চিন্ততার সাথে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়। মােমেনদের প্রধান গুণই হচ্ছে তারা সর্বাবস্থায় অস্থিরতা মুক্ত থাকে, অথচ সাধারণভাব মানুষ বিপদে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।
ফী জিলালিল কুরআন: *নামায কি ও কেন? : ঈমানদার ও বে-ঈমান ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী এই গুণটি একটি প্রধান গুণ, তাই বলা হচ্ছে, ‘তবে সে সকল নামাযী ব্যক্তি ছাড়া যারা নামাযে সদা যত্নবান থাকে।’ নামায হচ্ছে ইসলাম রূপী ঘরটির প্রধান স্তম্ভ। ঈমানের লক্ষণ প্রকাশ করার মাধ্যম ছাড়াও নামায মােমেনের জীবনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেহেতু নামায হচ্ছে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান উপায় এবং নামাযের মাপকাঠি দিয়েই এই সম্পর্কের গভীরতা নির্ণয় করা হয়। যে আনুষ্ঠানিক এবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রভুত্ব ও মানুষের দাসত্ব প্রকাশ পায় তা হচ্ছে এই নামায। মােমেনের এই স্থায়ী গুণটি সম্পর্কে এখানে বিশেষভাবে আলােচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তারা হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি, যারা নিয়মিতভাবে নামায পড়ে।’ নামাযীদের গুণের কথাটি বিশেষভাবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কোনাে সময়ের জন্যেও নামাযের সাথে সম্পর্ক-মুক্ত হয় না, অবহেলা বা টিলেমীও করে না। এইডাবে তারা আল্লাহর সাথে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক কায়েম রাখে। রসূলুল্লাহ(স.) আনুষ্ঠানিক এবাদাতের কোনাে একটি একবার করতে শুরু করলে তাকে স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখতেন, অর্থাৎ একবার শুরু করলে তা আর ছাড়তেন না। তিনি বলতেন, আল্লাহর কাছে সেই কাজটিই অধিক প্রিয় যা অল্প, কিন্তু নিয়মিতভাবে তা পালন করা হয়। বিশেষভাবে খেয়াল করার জিনিস হচ্ছে, আল্লাহর সংগে সম্পর্কের ভিত্তিতেই নামাযের প্রতি ভালােবাসা গড়ে উঠে। বলা বাহুল্য, আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাবােধের কারণেই এই স্থায়িত্ব সম্ভব। এটা কোনাে খেল-তামাশা নয় যে, ইচ্ছা হলাে এই সম্পর্ক স্থাপন করলাম, আবার ভালাে লাগলাে না সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলাম।
ফী জিলালিল কুরআন: *ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা : মােমেনদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আর তাদের ধন সম্পদের মধ্যে অধিকার রয়েছে তাদের-যারা কূপা প্রার্থী হয়ে হাত পাতে, আর যারা বঞ্চিত, একথা ওরা জানে ও মানে।’ যে সম্পদের দিকে এখানে ইংগীত দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে যা সম্পদশালী ব্যক্তির ওপর ফরয এবং কোনাে ব্যক্তির কাছে তা অজানা নয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল-সম্পদ এক বছর যাবত হাতে থাকলে অথবা ব্যবসায় পুঁজি হিসেবে বিনিয়ােগ করা থাকলে সেই মালের ওপর যাকাত ফরয হয়ে যায়। প্রত্যেক মােমেন ব্যক্তি এটা স্বীকারও করে। কিন্তু আয়াতের অর্থ আরও ব্যাপক হতে পারে। অর্থাৎ প্রত্যেক মােমেন ব্যক্তি জানে ও অনুভব করে যে, তার মালের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে। এই অনুভূতিই তাকে সংকীর্ণতা ও অহংকার থেকে দূরে রাখে। ধন-সম্পদের আসল মালিক যিনি, তিনি এতে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রেখে দিয়েছেন- এই বাণী মানুষকে উদার হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ বাণী তাকে এ কথাও শেখায় যে, আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন অভাবপূরণকারী। অভাবগ্রস্তদের আবার কয়েকটি শ্রেণী আছে। এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা নিজের অভাবের কথা নিজেই অন্যদের জানায়, আর এক শ্রেণীর অভাবগ্রস্ত আছে যারা আত্ম-সম্মানবােধের কারণে চাইতে পারে না, দাঁতে দাঁত এঁটে পড়ে থাকে, কষ্ট হযম করে। কষ্ট তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠুক, এরা তা চায় না চাইতেও পারে না। মােমেনের দিল তাই এদের জন্যে করুণায় ভরে যায়, তার মন বলে অবশ্যই ওদের সাহায্য করা দরকার। সে ওদের এই অধিকার অন্তরের মধ্যে অনুভব করে। আসলে তার এই অনুভূতি হচ্ছে তার প্রতি আল্লাহর এক মহা মেহেরবানী, এই অনুভূতি তার মধ্যে এক দায়িত্ববােধ সৃষ্টি করে যার অপর নাম হচ্ছে মানবতাবােধ। এই অনুভূতি মজ্জাগত সংকীর্ণতা ও কৃপণতার বিপরীত। ঈমানের কারণেই এই গুণটি তার মধ্যে সৃষ্টি হয়, আর এই জিনিসটাকেই বর্তমানে নাম দেয়া হয়েছে সামাজিক জামানত বা সােশ্যাল সিকিউরিটি। এই সামাজিক জামানতের অনুভূতি গােটা জাতির মধ্যে সাহায্য সহযােগিতা, সহানুভূতি ও অনুকম্পনার এক স্রোতধারা প্রবাহিত করে দেয়। এই কর্তব্যবােধকেই ইসলামী সমাজে ফরয (অবশ্য করণীয়) হিসেবে চালু করা হয়েছে। এই অনুভূতির প্রসার ঘটিয়ে ইসলামী সমাজ ও সভ্যতা দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তদের জন্যে এক রক্ষাকবচের কাজ করেছে। এই অনুভূতি মানুষের সুপ্ত বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে।
ফী জিলালিল কুরআন: *মানব জীবনে পরকাল বিশ্বাসের সুফল : আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, ‘তারা বিচার দিনের সত্যতাকে স্বীকার করে।’ এই গুণটি সূরার মূল বিষয়বস্তুর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। মুমিনের চরিত্রে এই গুণটি উল্লেখযােগ্যভাবে বর্তমানে থাকবে। হিসাব দিবসের ওপর ঈমান হচ্ছে গােটা ঈমানের অর্ধেক। এর অর্থ হচ্ছে আখেরাত বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই মানুষের জীবনপথকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার অনুভূতি ও চলার পথকে সঠিক গতি দান করে। রােজ হাশরের প্রতি বিশ্বাস হচ্ছে এমন এক পাল্লা, যার দ্বারা সে নিজেই নিজের কাজ কর্মের পরিমাপ করতে পারে। অপরদিকে যে ব্যক্তি রােজ-হাশর সংঘটিত হবে বলে বিশ্বাস করে না দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভংগি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে দুনিয়ার চাওয়া ও পাওয়ার মাপকাঠিতেই সকল কিছুর পরিমাপ করে। যার মধ্যে আখেরাত সংঘটিত হওয়া সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহ আছে তার পরিমাপযন্ত্রও হবে একই রকম। দুনিয়ার স্বার্থের মাপকাঠিতেই সে জীবনের মূল্য নির্ধারণ করে, সেই মাপকাঠি দিয়েই সে তার বিভিন্ন কাজ ও ঘটনার পরিমাপ করে। পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তি কোন কাজ করার সময় আকাশে রক্ষিত মাপ যন্ত্রের দিকে আগে তাকায়, পৃথিবীতে তার মূল্য কতটা সে বিচার করে না। তার কাছে আখেরাতের হিসাবটাই হচ্ছে আসল হিসাব, দুনিয়ার হিসাব তার কাছে সম্পূর্ণ গৌণ। আখেরাতের পরিণতির মানদন্ডে সে কোনাে ঘটনার ভালাে-মন্দ নির্ণয় করে। অর্থাৎ ঘটনা যাই ঘটুক না কেন যদি সে বুঝে আখেরাতে তার দ্বারা সাফল্য আসার সম্ভাবনা আছে তাহলে তার হৃদয়ের অনুভূতি ভালাে মন্দ সর্বাবস্থায় অবিচল থাকে। আবার আখেরাতে কর্মফল ভালো হবে না- কোনাে কাজের ব্যাপারে এমন যদি সে বুঝে তাহলে সে আল্লাহর কাছে কেঁদে পেরেশান হয় এবং আখেরাতের বিচারে আশানুরূপ ফল লাভ করার জন্যে দৃঢ় সংকল্প হয়ে তখন চেষ্টায় লেগে যায়। অপরদিকে আখেরাতের জীবনের পরিণতিকে যারা বিশ্বাস করে না বা তাতে সন্দেহ করে তাদের চেষ্টা সাধনা হয় সম্পূর্ণ দুনিয়াকেন্দ্রিক। অর্থাৎ সীমাবদ্ধ ও ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার মাপকাঠিতেই সে সবকিছুকে পরখ করতে থাকে। দুনিয়ালােভী আখেরাতে অবিশ্বাসী সেই ব্যক্তির সব কিছুর সীমা হচ্ছে এই দুনিয়া এবং এই দুনিয়ার জীবন। এই কারণে তার হিসাবও হবে ভিন্ন ধরনের এবং তার পরিমাপের ফলাফলও হবে বিভিন্ন । এর ফলে সর্বকালে ও সর্বদেশে সে অপরাধী বলেই বিবেচিত হবে, যদিও এই সময়কালটি একান্ত সীমাবদ্ধ। সর্বত্রই সে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে পতিত হবে, সর্বহারা এবং দিশেহারা হবে। কারণ জীবনের দুটি ভাগের মধ্যে দ্বিতীয় ভাগ তথা পরপারের জন্যে যখন সে পাথেয় সঞ্চয় করতে পারতাে তখন সে হিসাব করে চলেনি, যার ফলে দুনিয়ার জীবনে প্রকৃত সুখ বা শান্তি কোনােটাই সে লাভ করতে পারেনি। সে নিজের ওপর ইনসাফ করতে পারেনি- না অপর লােকদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করতে পেরেছে। না তার ব্যবহারগুলাে যুক্তিসংগত বিবেচিত হয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকবে তার জীবনের অপর ভাগ না আসা পর্যন্ত, যখন তার কষ্ট আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং তা আরও দীর্ঘায়িত হবে। আখেরাতের জীবনে যে তাকে হাযির হতে হবে এই হিসাব করে সে জীবন যাপন করেনি বলে অপরকে কষ্ট দিয়েছে, এই কারণে তার আখেরাতের জীবন অন্ধকারময় হবে, আর এ জীবনের ব্যাপারেও স্পষ্ট কথা এই যে, সে কারাে কাছ থেকেই কোনাে প্রতিদান পাওয়ার যােগ্য নয়। এ সকল কারণ ও অবস্থাগুলােকে সামনে রেখে যদি চিন্তা করা হয় তাহলে যে কোনাে লােক বুঝতে পারবে যে, পরকালের জীবনের প্রতি বিশ্বাস ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যবস্থাকেই সে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসাবে মেনে নিয়েছে এবং সেই অনুযায়ী নিজের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছে, আর এ আখেরাত বিশ্বাস তার দুনিয়ার জীবনকে সুষমামন্ডিত করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘সফলকাম ব্যক্তি তারা, যারা তাদের পরােয়ারদেগারের আযাবকে ভয় করে। অবশ্যই তাদের। পরােয়ারদেগারের আযাব মােটেই নিরাপদ কিছু নয়।’ আখেরাতের ওপর এই সাধারণ বিশ্বাসের পরবর্তী যে কাজ মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে নাড়া দেয় তা হচ্ছে অতন্দ্র প্রহরীর মতাে আল্লাহর যাবতীয় হুকুম পালন করার ব্যাপারে বান্দার সদা সতর্ক থাকা এবং অন্তরের মধ্যে জন্যে একটা তীব্র অনুভূতি জাগ্রত রাখা। অন্তরের অন্তস্থলের মধ্যে আল্লাহর এই ভয়কে জিইয়ে রাখা যে, যে কোনাে সময় আল্লাহর আযাব তাকে পাকড়াও করতে পারে। আল্লাহর সহায়তার জন্যে তার কাছে মােনাজাত করা ও তার আযাব থেকে বাঁচার জন্যে তার কাছে আকুতি পেশ করাও এর অন্তর্ভুক্ত। এগুলাে এমন গুণ যা তার মর্যাদাকে একধাপ উন্নীত করে । রসূলুল্লাহ (স.) কে? তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে কতটা তা তিনি ভালাে করেই জানেন। জানেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে পরিচালনা করছেন; এতদসত্তেও তিনি আল্লাহর আযাবের ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক ও শংকিত থাকতেন। দৃঢ়ভাবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর কাজ তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না এবং তা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতেই তিনি নাজাত পেতে পারেন এবং বেহেশত লাভ করতে পারেন। একদিন তিনি সাহাবাদের বললেন, ‘ব্যক্তির কাজ তাকে কখনও জান্নাতে দাখিল করাবে না।’ সাহাবার বললেন, ‘আপনাকেও না ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ তিনি বললেন, ‘না, আমাকেও না, আমাকে ও আমার কাজ জান্নাতে দাখিল করাতে পারবে না, তবে আল্লাহর মেহেরবানীই আমার একমাত্র ভরসা, তিনি যদি দয়া করে আমাকে নাজাত দেন! (বুখারী ও মুসলিম)। এ সম্পর্কে আল্লাহর ঘােষণা হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই তাদের পরােয়ারদেগারের আযাব থেকে কেউই নিরাপদ নয়।’ এ ঘােষণা মানুষকে এমন এক স্থায়ী অনুভূতি দান করে, যা সে এক মুহূর্তও বিস্মৃত হয় না। যখন মানুষ আযাবের কথা ভুলে যায় বা উদাসীন হয়ে যায় তখনই সে এমন কিছু কাজ করে বসে যা তাকে আযাবের হকদার বানিয়ে দেয়। আসলে আল্লাহ তায়ালা মানুষের শুধু এই সজাগ অবস্থা এবং এই সচেতনাটুকুই চান। তবুও যখন কোনাে সময় দুর্বলতা তাকে পেয়ে বসে তখন আল্লাহর সুমহান রহমতই হয় তার একমাত্র ভরসা। তার ক্ষমার ভান্ডার সর্বদা তার জন্যে উন্মুক্ত থাকে। তার তাওবার দরজা সর্বদা খােলা রয়েছে, কোনাে বান্দার জন্যে কখনাে তা বন্ধ হয় না। এই ক্ষমার আশ্বাসবাণী শত বাধাবিঘ্ন, অসুবিধা ও অস্থিরতার মধ্যেও মুসলিম সমাজের জন্য এক পরিচালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। পূর্ণাংগ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রাপ্তির চাইতেও বেশী প্রশান্তি মানুষকে দেয়া হয়েছে। আবার যে অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে তা একাধারে সচকিত ও আশ্বান্বিত থাকে; সে আল্লাহকে যেমন ভয় করে, তেমনি তার কাছে আশাও সে রাখে। মােমেনের দিল আল্লাহর রহমত পাবে বলে সদা নিশ্চিন্ত ও প্রশান্ত থাকে।
ফী জিলালিল কুরআন: *পরিবার ইসলামী সমাজের ভিত্তি : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর (তারা সফল) যারা তাদের লজ্জাস্থানগুলাের হেফাযতকারী, তবে তাদের স্ত্রী ও দাসীরা বাদে, তাদের সাথে মেলামেশায় কোনাে প্রকারের দোষ নেই। এই অনুমোদিত সীমার বাইরে যারা যাবে তারা সীমালংঘনকারী হবে।’ পরিবার ও পারিবারিক জীবনের ভিত্তিতেই ইসলাম সমাজ ব্যবস্থা গড়তে চায় এবং এ জন্যে শরীয়তে মযবুত পরিবার গড়ে তােলার বিধান রয়েছে। বাড়ীর খােলামেলা পরিবেষ্টনীর সব কয়টি জায়গাই সাধারণত পরিবারের সবার কাছে পরিচিত থাকে। ঘরােয়া পরিবেশে এ সমাজের প্রত্যেকটি বাচ্চা তার বাপকে জানে এবং নিজের জন্মের পরিচয় দিতে লজ্জা বা দ্বিধাবােধ করে না। এটা এই জন্যে নয় যে, একথা বলতে তার কোনাে লজ্জা শরম নেই। মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই তার সমাজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর ভিত্তিতেই মানুষের প্রসার ঘটেছে। এর ভিত্তিতেই মানুষের আশা ভরসা ও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা রচিত হয়। এটা কোনাে এলােমেলাে বা বিক্ষিপ্ত চিন্তা নয়, এর উদ্দেশ্য একান্ত স্পষ্ট। এই সম্পর্ক স্থাপনের শুরুতেই এর মানবীয় ও সামাজিক গুরুত্বসমূহ সুবিদিত থাকে। শুধুমাত্র একটা পাশবিক ইচ্ছা পূরণ ও যৌন সম্ভোগের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তায়ালা নারী পুরুষের পারস্পরিক এই মিলনের ব্যবস্থা দেননি। এই প্রসংগে আলােচনা করতে গিয়ে কোরআনে কারীমে মােমেনের চরিত্র ও ব্যবহার কি হবে তা জানিয়ে দিয়েছে, সাফল্যমন্ডিত তারা, যারা (আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক অনুমােদিত) দায়িত্বাধীন মহিলাদের ছাড়া তাদের লজ্জাস্থানগুলােকে সুরক্ষিত রাখে নিজেদের স্ত্রী এবং এদের সাথে মেলামেশায় আল্লাহর বিধানক্রমে কোনাে বাধা নেই বা তা কোনাে নিন্দনীয়ও নয়। এই সীমারেখা ডিংগিয়ে অন্য কোনাে পন্থায় যারা যৌন সম্ভোগের পথ খুঁজবে তারাই হবে সীমালংঘনকারী, আল্লাহর আইনের সুস্পষ্ট অমান্যকারী। একমাত্র বিয়ের মাধ্যমে অথবা কোনাে মহিলার অধিকার হাসিল করে তার পরিপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমেই এই বৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।[বন্দী বিনিময় বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করায় ও সারা পৃথিবীতে এখন মানুষ কেনাবেচা প্রথার বিলােপ সাধিত হওয়ায় দাসত্ব প্রথা এখন অনেকটাই বিলুপ্ত; তবে এমন যদি কখনও হয় যে বন্দী বিনিময় দীর্ঘদিন বিলম্বিত হয়ে পড়ে, রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ বন্দী ও বন্দিনীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সৈনিকদের মধ্যে তাদেরকে বন্টন বা বিলি ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন বােধ করে, তখন পুনরায় হয়তাে এর অনুমতি দেয়া হবে। কোরআন ও হাদীস নানা কারণে স্থায়ীভাবে এ প্রথা বিলুপ্তি ঘােষণা করেনি। এমন সব পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল মালিকদের কর্তব্য থাকবে তাদেরকে মুসলিম ভাই বোনের মর্যাদা দান করে, খােরাক পােশাক সমান সমান দান করা। তাদের দ্বারা কোনােরকম দেহ ব্যবসা না চালানাে, তাদের গর্ভজাত সন্তানের স্ত্রীদের মাধ্যমে প্রান্ত সন্তানদের সমান মর্যাদা দান করা, এরপর রয়েছে বিভিন্ন অপরাধের কাফফারা স্বরূপ তাদেরকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করা, আরও রয়েছে তাদেরকে মুক্ত করে দিলে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পাওয়ার বহু আশ্বাস বাণী। এ সকল অবস্থা বিবেচনায় আমরা এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারি যে, আল্লাহ তায়ালা চমৎকার এক পদ্ধতিতে মানুষকে মানুষের মর্যাদা দান করেছেন এবং প্রকারান্তারে এর বিলুপ্তিই সাধন করেছেন, যদিও সরাসরি এই ঘােষণা দেয়া হয়নি। কারণ অনাগত ভবিষ্যতে কোন সমাজে কার কি প্রয়ােজন দেখা দেবে তা তিনিই ভালাে জানেন-সম্পাদক] সূরা মােহাম্মদে-এ সম্পর্কিত ঘােষণায় জানা যায় যে একমাত্র আল্লাহর যমীনে তার জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে যুদ্ধ করা হবে, তাতে গ্রেফতারকৃত বন্দীদেরকে দাস বা দাসী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে উক্ত সূরার আয়াতগুলাে প্রণিধানযােগ্য। ‘অতএব যুদ্ধের ময়দানে যখন এই কাফেরদের মুখোমুখি হবে তখন তােমরা তাদের হত্যা করলে, তারা সম্পূর্ণভাবে পর্যদুস্ত হওয়ার পর তােমরা বন্দীদেরকে শক্ত করে বেঁধে রাখাে। এরপর তােমরা হয়তাে দয়া করে তাদের এমনিতেই ছেড়ে দেবে অথবা মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেবে। তবে যতােক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ তার বােঝা ফেলে না দেয় ততােক্ষণ পর্যন্ত তােমরাও ক্ষান্ত দেবে না।’ দুনিয়া যতােদিন আছে ততােদিন হক ও বাতিলের সংঘর্ষ থামার কথা নয়। যুদ্ধ চলতে থাকবে, চালাতে হবে। এ কাজ তারা করবে, যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করার মাধ্যমে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কখনও যদি এমন হয় যে দয়া প্রদর্শন কিংবা মুক্ত করা সত্তেও কোনাে কোনাে বন্দী বা বন্দিনী থেকেই যায়। তখন এই অনুমতি হবে একমাত্র সেই ব্যক্তির জন্য যার মালিকানা তাকে দেয়া হবে। এই বন্দীদের সাথে এ ধরনের ব্যবহার তথনই করা যাবে, যখন প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে মুসলমানদের সাথেও অনুরূপ ব্যবহার করা হবে। তাদেরকে তারা দাস দাসী নামে অভিহিত না করলেও তাদের সাথে সেই ব্যবহার করা হতে থাকবে। কিন্তু তা সত্তেও এই প্রথার বিলােপ সাধন ও মানবতার মূল্যায়নের জন্যে ইসলাম বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেগুলাে বিভিন্ন মাধ্যমে সমাজে চালু করেছে। একথা স্পষ্ট যে, এ কুপ্রথার অবসানের জন্যে একেবারে শুরু থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যার ফলে ধীরে ধীরে এ প্রথা সমাজ থেকে প্রায় উঠেই গেছে। এ প্রথাকে বর্তমান রেখে অতীতের ন্যায় বর্তমানেও যদি কোনাে অমুসলিম ক্যাম্পে তাদের সাথে এ ধরনের ব্যবহার করা হয় তাহলে শুধু যৌন সম্ভোগের উদ্দেশ্যে ইসলাম এ প্রথাকে কখনাে চালু থাকার অনুমতি দেবে না। স্বাধীন করে দেয়ার নাম নিয়ে প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে দাসীরূপে ব্যবহার করার কোনাে বাঁকা পথও ইসলাম গ্রহণ করবে না। ইসলামী ব্যবস্থা পরিষ্কার এবং যাবতীয় ধােকাবাজি থেকে মুক্ত।[যৌন স্পৃহা আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত একটি শক্তি এবং সৃষ্টিকুলের জন্যে একটি বড় নেয়ামত। এ নেয়ামত দান করে আল্লাহ তায়ালা নিজে এ নেয়ামত ভােগ করার পদ্ধতিও তাকে জানিয়েছেন। যারা নিজেদেরকে আল্লাহর অনুগত বলে মনে করে এবং না-ফরমানী করলে পরকালে জবাবদিহি করার ভয় রাখে, তাদের পক্ষে অবশ্যই আল্লাহর পদ্ধতি ও নিয়মের মধ্যে থাকা সম্ভব। যিনি সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতপক্ষে তিনিই জানেন- কাকে কতােটা শক্তি সামর্থ ও চাহিদা তিনি দিয়েছেন। তিনি তাঁর বান্দার প্রতি সর্বাধিক দরদী-বিধায় তাদের প্রয়ােজন মিটানাের সুপথও তিনি বাতলে দিয়েছেন। কিসে মানুষের কল্যাণ তা মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালাই সব জানেন। নারী পুরুষের মাঝে শক্তি ও চাহিদাও আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সমান দেননি, কাকে কতােটা দিয়েছেন তা তিনিই ভালাে জানেন। এ ব্যাপারে আসল কথা বুঝতে পারে না বিধায় মূর্খের মতাে অনেকেই নানা অর্বাচিন মন্তব্য করে। আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির এ সকল অবস্থা বিবেচনা করেই তাকে এক থেকে চার পর্যন্ত রাখার অনুমতি দিয়েছেন। অবশ্য সাথে সাথে ইনসাফ করার কঠিন শর্তও তিনি জুড়ে দিয়েছেন। আসলে মিলনাকাংখাও হচ্ছে একটি দ্বিপাক্ষিক প্রয়ােজন-এর প্রয়ােগে যদি ক্ষমতা ও শক্তি থাকে তাহলে একাধিক বিয়ের অনুমতি থাকবে, নচেৎ তার জন্যে একজনই যথেষ্ট। অনুরূপভাবে নারীকে বিয়ের পূর্বে প্রস্তাবিত ব্যক্তির সবকিছু বিবেচনা করে সম্মতি দেয়া না দেয়ার অধিকার দেয়া হবে। এক্ষেত্রে বাছাই ভুল হলে পরে নিজেকে মুক্ত করে পছন্দ মতাে লােক বেছে নেয়ার অধিকারও তার থাকবে। এটাই আল্লাহর বিধান ও এটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি। এতেই শান্তি ও কল্যাণ রয়েছে।-সম্পাদক] অন্যরা স্বাধীনতার নাম দিয়ে প্রকৃতপক্ষে তাদের দাসীরূপেই ব্যবহার করছে। এসব ধােকাবাজি নারীদের সাথে এবং দুর্বল মানুষের সাথে চলতে পারে, কিন্তু আল্লাহর সাথে কখনাে চলতে পারে না। এই জন্যেই বলা হয়েছে, এই সীমারেখা অতিক্রম করে যারা অন্য কোনাে পথ তালাশ করবে তারা সীমালংঘনারী হবে। এভাবে যৌন সম্ভোগের ঘৃণ্য সম্পর্ক স্থাপন করার অবকাশ কখনাে ইসলাম দেয়নি। এটা যে কোনাে সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন লােকই বুঝতে পারবে যে কু-প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া দিয়ে কোনাে ঘৃণ্য ও বাঁকা পথে চলা মানুষের জন্যে ক্ষতিকর।
ফী জিলালিল কুরআন: *আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করা : পরিচ্ছন্ন, মযবুত ও শান্তি বিধানকারী সফলকাম ব্যক্তিদের মধ্যে যে গুণাবলী থাকা প্রয়ােজন সেগুলোর অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছে আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করা। এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা আমানতসমূহ রক্ষা করে এবং ওয়াদা ও চুক্তির হক আদায় করে।’ নৈতিক চরিত্রের এই প্রধান গুণগুলাের ওপরই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এসব আমানত, ওয়াদা ও চুক্তি যা তারা অন্যদের সাথে সম্পন্ন করে সেগুলাের হক আদায় করা থেকেই ইসলামী সমাজ গড়ার কাজটি শুরু হয়। এই সবগুলাের ভিত্তি হচ্ছে সেই মহান আমানত রক্ষা করা যার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কাছে পেশ করেছিলেন, কিন্তু তারা এ দায়িত্ব বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলাে। তারা এ দায়িত্বভার বহন করার কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাে, কিন্তু মানুষ এ দায়িত্বের বােঝা ঘাড়ে তুলে নিলাে, আর সে আমানত হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাসের আমানত যা মানুষ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার পর দৃঢ়তার সাথে তার ওপর টিকে থাকে। এই দৃঢ়তা সে স্বেচ্ছায় অবলম্বন করে বাধ্য হয়ে নয়; (আল্লাহকে মেনে নেয়ার কাজটি তার নিজের ইচ্ছা অনুসারেই সম্পন্ন করে এবং এ ব্যাপারে দৃঢ়তা অবলম্বনও সে তার নিজ এখতিয়ারেই করতে থাকে)। চুক্তির হক আদায় করা ও ওয়াদা পূরণ করার প্রবণতা মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই তার মধ্যে মজ্জাগত হয়ে আছে। পরবর্তীকালে এ যোগ্যতা ও অনুভূতি বংশপরম্পরায় মানুষের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে; আল্লাহর সাথে সম্পাদিত এই চুক্তিটি হলাে, সৃষ্টির সূচনাতে মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা নিয়েছিলেন যে একমাত্র তাকেই তারা রব বা প্রতিপালক বলে মানবে, একমাত্র তারই আইন কানুন তারা মেনে চলবে। সৃষ্টিগতভাবে এ চুক্তির ব্যাপারে তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর সাক্ষী; অর্থাৎ তাদের সৃষ্টি যেমন আর কারাে দ্বারা সম্ভব নয়, তেমনি অন্য কাউকে শক্তি ক্ষমতার মালিক বলে মানা তাদের জন্য উচিত নয়- একথার সত্যতার ব্যাপারে তারা নিজেরাই সাক্ষী। এই আল্লাহ-বিশ্বাসের আমানত ও তাকে রব বলে মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করার সে দুটো হক যে ব্যক্তি আদায় করতে পারে সে ব্যক্তি সমাজের সাথে চুক্তি ও ওয়াদা পূরণ করার ক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকবে বলে অবশ্যই আশা করা যায়। ইসলাম এই জন্যেই আমানতের হক আদায় এবং ওয়াদা পূরণ করার ওপর কঠোর গুরুত্ব আরােপ করেছে, যাতে করে গােটা ইসলামী সমাজ মযবুত একটা বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, মানুষ মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে পারে, একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারে এবং শান্তি ও স্বস্তির সাথে তারা এই সমাজে জীবন যাপন করতে পারে। বিশ্বাস ঠিক রাখা ও ওয়াদা পূরণ করার গুণটিকে ইসলাম মােমেনের প্রধান গুণ বলে জানিয়েছে, যেমন করে মুনাফিকের ক্ষেত্রে আমানতের খেয়ানত ও ওয়াদা ভংগ করাকে তাদের বৈশিষ্ট বলে দেখানাে হয়েছে। কোরআন ও হাদীসের বহু স্থানে এই দুটো গুন সম্পর্কে বিশদ আলােচনা এসেছে। ইসলামে এই বিষয় দুটোর গুরুত্ব সম্পর্কে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ফী জিলালিল কুরআন: *সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান : ‘যারা তাদের সাক্ষ্যদানের বিষয়গুলােতে দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকে।’ একথা সত্য যে, সঠিকভাবে সাক্ষ্যদানের সাথে আরও অনেকেরই হক জড়িত থাকে। গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত যাবতীয় বিধানের সীমানা মূলত সঠিকভাবে সাক্ষ্যদানের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়। অতএব সঠিক সাক্ষ্যদানের কথাটি আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে ঘোষণা করা জরুরী মনে করেছেন। জানা সত্তেও সাক্ষ্য দানে অস্বীকার করা বা সাক্ষ্যদানকালে কোনাে কথা গােপন করাকে তিনি কঠোরভাবে মানা করেছেন। আর এ ব্যাপারে টালবাহানা করা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলা এবং কারাে প্রভাবে পড়ে সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকাকেও আল্লাহ তায়ালা কড়াকড়িভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তারই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এই সাক্ষ্যদানের কাজগুলােকে তার প্রতি আনুগত্যের একটি অংশ হিসেবেও ঘােষণা করেছেন। এ প্রসংগে আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ তায়ালার জন্যে সাক্ষ্যদানের কাজটিকে সঠিকভাবে কায়েম করো।’ মােমেনের জীবনে চলার যতাে পথ আছে সেগুলাের মধ্যে সঠিক সাক্ষ্য দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, অন্য কথায় বলতে গেলে যত প্রকার আমানত বা বিশ্বাসের বিষয় আছে তন্মধ্যে সঠিক সাক্ষ্যদান একটি বড় গুণ । এ গুণটির কথা পৃথকভাবে কায়েম করার উদ্দেশ্য হচ্ছে গুণটির মহত্ব ও গুরুত্ব বিশেষভাবে পেশ করা।
ফী জিলালিল কুরআন: *নামাযের সংরক্ষণ : ‘আর যারা তাদের নামায গুলোকে সংরক্ষণ করে।’ এ গুণটি হচ্ছে কোরআনে বর্ণিত সকল গুণের সেরা গুণ, আর তখনই এটা সেরাগুণে পরিণত হয় যখন নামায, ফরয সুন্নাত সহ যথাসময়ে যথাযথভাবে আদায় করা হয়। যেভাবে ধীর স্থিরভাবে ভক্তি-নিষ্ঠার সাথে এবং ভীতিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে নামায পড়া দরকার সেভাবে নামায আদায় করলেই নামাযগুলাের হেফাযত করার হক আদায় হয়। এভাবে যে ব্যক্তি নামায আদায় করতে পারে সে কখনও অবহেলা করে বা অলসতা করে কোনাে নামাযকে নষ্ট হতে দেয় না। শুধু ব্যক্তি জীবনেই নয়, পরিবার ও পরিবেশের মধ্যেও নামাযের ব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে সে নিজ কর্তব্য পালন করে এবং কোনাে সময়ই সে এই বিষয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন করে না। সূরাটি শুরু হয়েছে মুমিনের গুণাবলীর মধ্য থেকে নামাযের গুণ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে। মােমেনের অপরিহার্য সকল গুণের বর্ণনা সমাপ্তও করা হয়েছে সার্বিকভাবে এই নামায সংরক্ষণ করার কথা বলে। জামায়াতের সাথে ও সযত্নে এই নামায আদায় করার নির্দেশ এসেছে। মোমেনদের মধ্যে বাঞ্ছনীয় গুণাবলীর মধ্যে নামাযের সংরক্ষণই সেরা গুণ এ কথার উল্লেখ করেই এ প্রসংগের ইতিটানা হয়েছে। সীমালংঘনকারীদের পরিণতি বর্ণনা করার পর নামায সংরক্ষণকারীদের প্রত্যাবর্তনস্থলের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তারাই হবে বাগ বাগিচায় ভরা জান্নাতসমূহের অধিবাসী।’ কোরআনে কারীমের এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনার মধ্যে যেমন বাহ্যিক অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত নেয়ামতের বর্ণনা পাওয়া যায়, তেমনি যেসব নেয়ামত আত্মার গভীরে প্রশান্তি আনে তার বর্ণনাও পাওয়া যায়। বলা হয়েছে, ‘ওরা জান্নাতসমূহে বসবাস করবে।’ সেই ফুল ফলের বাগিচায় তারা হবে সম্মানিত মেহমান। অতএব যাবতীয় নেয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করার সাথে সাথে তারা সেখানে অভূতপূর্ণ সম্মানও লাভ করবে। মহৎ গুণের প্রতিদানস্বরূপ মােমেন এই পুরস্কার লাভ করবে, কেননা এসব গুণই তাকে বৈশিষ্টমন্ডিত করেছে।
১৯-৩৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
(اِنَّ الْاِنْسَانَ خُلِقَ ھَلُوْعًا… اُولٰ۬ئِکَ فِیْ جَنّٰتٍ مُّکْرَمُوْنَ)
এখানে মানুষের চিরাচরিত একটি স্বভাবের কথা আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন হা-হুতাশ করে আর যখন কোন নেয়ামত পায় তথা ধন-সম্পদ বা শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদি তখন কৃপণতা করে আল্লাহ তা‘আলার হক যথাযথ আদায় করে না, তবে যারা সৎ বান্দা তারা ব্যতীত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
্রشَرُّ مَا فِي رَجُلٍ شُحٌّ هَالِعٌ وَجُبْنٌ خَالِعٌগ্ধ
মানুষের মাঝে নিকৃষ্টতম স্বভাব হলো অত্যন্ত কৃপণতা ও চরম কাপুরুষতা। (আবূ দাঊদ : ২৫১৩, সিলসিলা সহীহাহ : ৫৬০)
পরের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের গুণাবলী উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা মু’মিনূনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
*সুখ-সাচ্ছন্দ্যে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা এবং দুঃখ-বেদনায় ধৈর্য ধারণ করা উচিত। সুখ-শান্তি পেয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা উচিত নয়।
*প্রকৃত মু’মিনরা সালাত ও লজ্জাস্থান হেফাজত করে ও সম্পদের হকের কথা ভুলে যায় না।
১৯-৩৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন: #যে বিষয়টিকে আমরা আমাদের ভাষায় এভাবে বলে থাকি, “এটি মানুষের প্রকৃতিগত অথবা এটা তার সহজাত দুর্বলতা” সে বিষয়টিকে আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেন যে, “মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে এভাবে।” এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, কুরআন মজীদের বহু জায়গায় মানব জাতির সাধারণ নৈতিক দুর্বলতা উল্লেখ করার পর ঈমান ও সত্যের পথ অনুসরণকারীদের তা থেকে ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে এ বিষয়টিই বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে এ সত্যটি আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের জন্মগত এসব দুর্বলতা অপরিবর্তনীয় নয়। বরং আল্লাহর দেয়া হিদায়াত গ্রহণ করে মানুষ যদি আত্মশুদ্ধির জন্য সত্যিকার প্রচেষ্টা চালায় তাহলে সে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। পক্ষান্তরে যদি সে তার প্রবৃত্তিকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয় তাহলে দূর্বলতাগুলো তার মধ্যে দৃঢ়মূল হয়ে যায়। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আম্বিয়া, টীকা ৪১ ;সূরা আয যুমার, টীকা ২৩ থেকে ২৮ এবং সূরা আশ শূরা, টীকা ৭৫ ) ।
সুরা: আল-মাআরিজ
আয়াত নং :-২২
اِلَّا الْمُصَلِّیْنَۙ
তবে যারা নামায পড়ে (তারা এ দোষ থেকে মুক্ত) ।
# কোন ব্যক্তির নামায পড়ার অপরিহার্য অর্থ হলো সে আল্লাহ, রসূল কিতাব ও আখেরাতের ওপর বিশ্বাস এবং সাথে সাথে নিজের ও বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করার প্রচেষ্টা ও চালিয়ে যায়।
সুরা: আল-মাআরিজ
আয়াত নং :-২৩
الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰى صَلَاتِهِمْ دَآئِمُوْنَ۪ۙ
যারা নামায আদায়ের ব্যাপারে সবসময় নিষ্ঠাবান।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ কোন প্রকার অলসতা, আরামপ্রিয়তা, ব্যস্ততা, কিংবা আকর্ষণ তাদের নামাযের ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নামাযের সময় হলে সে সবকিছু ফেলে রেখে তার প্রভুর ইবাদতের জন্য প্রস্তুত হয়। عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ এর আর একটি অর্থ বর্ণনা করেছেন হযরত উকবা ইবনে আমের। তাহলো, সে পূর্ণ প্রশান্তি এবং বিনয় ও নিষ্ঠাসহ নামায পড়ে, কাকের মত ঠোকর মারে না। ঠোকর মেরেই কোন রকমে নামায শেষ করার চেষ্টা করে না। আবার নামাযের মধ্যে এদিক সেদিক তাকিয়েও দেখেনা। প্রচলিত আরবী বাক রীতিতে বদ্ধ বা স্থির পানিকে ماء دائم মায়ে দায়েম বলা হয়। এরই আলোকে এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন: #সূরা যারিয়াতের ১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের সম্পদে প্রার্থী এবং বঞ্চিতদের নির্দিষ্ট হকে আছে। ” কেউ কেউ এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হকের অর্থ মনে করেছেন ফরয যাকাত। কারণ ফরয যাকাতেই নেসাব ও হার দু’টিই নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সূরা মা”আরিজ সর্বসম্মত মতে মক্কায় অবতীর্ণ সূরা। কিন্তু নেসাব ও হার নির্দিষ্ট করে যাকাত ফরয হয়েছে মদীনায়। অতএব হকের সঠিক অর্থ হলো, প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের সম্পদে একটা অংশ নির্দিষ্টকরে রেখেছে। এটাকে তাদের হক মনে করে তারা নিজেরাই তা দিয়ে দেয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, মুজাহিদ, শা”বী এবং ইবরাহীম নাখয়ী এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। প্রার্থী মানে পেশাদার ভিক্ষুক নয়, বরং যেসব অভাবী মানুষ অন্যের সাহায্যপ্রার্থী তারা। আর বঞ্চিত অর্থ এমন লোক যার কোন আয়-উপার্জন নেই। অথবা সে উপার্জনের জন্য চেষ্টা করে ঠিকই কিন্তু তাতে তার প্রয়োজন পূরণ হয় না। অথবা কোন দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার হয়ে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অথবা আয়-উপার্জনের সামর্থ্যই নেই। এ ধরনের লোকদের ব্যাপারে যখনই জানা যাবে যে, তারা প্রকৃতই বঞ্চিত তখন একজন আল্লাহভীরু মানুষ এ জন্য অপেক্ষা করে না যে, সে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুক। বরং তার বঞ্চিত থাকার কথা জানা মাত্র সে নিজেই অগ্রসর হয়ে তাকে সাহায্য করে।
# অর্থাৎ দুনিয়াতে নিজেকে দায়িত্বহীন এবং জবাবদিহি থেকে মুক্ত মনে করে না। বরং এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে যে, একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে তাদেরকে নিজেদের সব কাজের সব হিসেব দিতে হবে।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# অন্য কথায় তাদের অবস্থা কাফেরদের মত নয়। কাফেররা দুনিয়াতে সব রকম গোনাহ, অপরাধ ও জুলুম-অত্যাচারে লিপ্ত থেকেও আল্লাহকে ভয় করে না। কিন্তু তারা নিজস্বভাবে যথাসম্ভব নৈতিকতা ও কাজ-কর্মে সদাচরণ করা সত্ত্বেও সবসময় আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। সবসময় তারা এআশঙ্কা করে যে, আল্লাহর আদালতে আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের নেক কাজের তুলনায় অধিক বলে প্রমাণিত না হয় এবং এভাবে আমরা শাস্তির উপযুক্ত বলে প্রমাণিত না হই।
সুরা: আল-মাআরিজ
আয়াত নং :-২৯
وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَۙ
যারা নিজেদের লজ্জাস্থান হিফাযত করে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# লজ্জাস্থানের হিফাজতের অর্থ ব্যভিচার না করা এবং উলঙ্গপনা থেকেও দূরে থাকা। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা আল মু’মিনূন টীকা ৬; আন নূর, টীকা ৩০-৩২ এবং আল আহযাব, টীকা ৬২)।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন, সূরা আল-মু’মিনূন, টীকা-৭ ।
সুরা: আল-মাআরিজ
আয়াত নং :-৩২
وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَ عَهْدِهِمْ رٰعُوْنَ۪ۙ
যারা আমানত রক্ষা করে ও প্রতিশ্রুতি পালন করে।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# আমানতসমূহ বলতে এমন সব আমানত বুঝায়, যা আল্লাহ তা’আলা বান্দার হাতে সোপর্দ করেছেন এবং একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের ওপর আস্থা স্থাপন করে “আমানত” হিসেবে অর্পণ করে। ঠিক তেমনি চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি মানে বান্দা আল্লাহর সাথে যে চুক্তি বা প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয় এবং মানুষ পরস্পরের সাথে যেসব চুক্তি ও প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয় ও উভয় প্রকার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি। এ উভয় প্রকার আমানত এবং উভয় প্রকার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একজন মু’মিনের চরিত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। হাদীসে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সামনে যে বক্তব্যই পেশ করতেন তাতে অবশ্যই বলতেনঃ
لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ، وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
“সাবধান, যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। আর যে অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না তার দ্বীনদারী নেই। (বায়হাকী-শু’আবুল ঈমান।)
# অর্থাৎ তারা সাক্ষ্য যেমন গেপন করে না, তেমনি তাতে তেমন কোন কম বেশীও করে না ।
সুরা: আল-মাআরিজ
আয়াত নং :-৩৪
وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰى صَلَاتِهِمْ یُحَافِظُوْنَؕ
যারা নামাযের হিফাযত করে।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# এ থেকে নামাযের গুরুত্ব বুঝা যায়। যে ধরনের উন্নত চরিত্র ও মহৎ কর্মশীল লোক জান্নাতের উপযুক্ত তাদের গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে নামায দিয়ে শুরু করা হয়েছে এবং নামায দিয়েই শেষ করা হয়েছে। তাদের প্রথম গুণ হলো তারা হবে নামাযী।
দ্বিতীয় গুণ হলো, তারা হবে নামাযের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং সর্বশেষ গুণ হলো, তারা নামযের হিফাযত করবে। নামাযের হিফাযতের অর্থ অনেক কিছু। যথা সময়ে নামায পড়া, দেহ ও পোশাক-পরিচ্ছদ পাক-পবিত্র আছে কিনা নামাযের পূর্বেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া, অজু থাকা এবং অজু করার সময় অঙ্গ-প্রত্যংগগুলো ভালভাবে ধোয়া, নামাযের ফরয ওয়াজিব ও মোস্তাহাব গুলো ঠিকমত আদায় করা, নামাযের নিয়ম-কানুন পুরোপুরি মেনে চলা, আল্লাহর নাফরমানী করে নামাযকে ধ্বংস না করা, এসব বিষয়ও নামাযের হিফাযতের অন্তর্ভুক্ত।
১৯-৩৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১৯-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে মানব প্রকৃতির দুর্বলতা বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা বড়ই অসহিষ্ণু ও অস্থির চিত্ত। যখন কোন বিপদে পড়ে তখন বড়ই হা-হুতাশ করতে থাকে এবং নিরাশায় একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। পক্ষান্তরে, যখন কোন কল্যাণ লাভ করে ও অবস্থা স্বচ্ছল হয় তখন হয়ে যায় অতি কৃপণ। আল্লাহ তা’আলার হকের কথাও তখন সে ভুলে যায়।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “মানুষের নিকৃষ্টতম জিনিস হলো অত্যন্ত কৃপণতা ও চরম পর্যায়ের কাপুরুষতা।” (এ হাদীসটি সুনানে আবু দাউদেও বর্ণিত হয়েছে)
এরপর আল্লাহ্ পাক বলেনঃ তবে হ্যাঁ, এই নিন্দনীয় স্বভাব হতে তারাই দূরে রয়েছে যাদের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে এবং যারা চিরন্তনভাবে কল্যাণের তাওফীক লাভ করেছে। যাদের গুণাবলীর মধ্যে একটি বড় গুণ এই যে, তারা পুরোপুরিভাবে নামায কায়েম করে থাকে। তারা নামাযের সময়ের প্রতি যত্নবান থাকে। ফরয নামায তারা ভালভাবে আদায় করে। নিজেদের নামাযে তারা তা প্রকাশ করে। যেমন মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ, যারা বিনয়-নম্র নিজেদের নামাযে।” (২৩:১-২) আরবরা বদ্ধ ও হরকতবিহীন পানিকেও (আরবি) বলে থাকে। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, নামাযে ইতমীনান বা স্থিরতা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি ধীরে সুস্থে ও স্থিরতার সাথে রুকু-সিজদাহ্ আদায় করে না সে তার নামাযে সদা নিষ্ঠাবান নয়। কেননা, সে নামাযে স্থিরতা প্রকাশ করে না, বরং কাকের মত ঠোকর মারে। সুতরাং তার নামায তাকে মুক্ত করাবে না বা পরিত্রাণ লাভে সহায়তা করবে না। এটাও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা প্রত্যেক ঐ ভাল আমলকে বুঝানো হয়েছে যা স্থায়ী হয়। যেমন সহীহ্ হাদীসে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর নিকট ঐ আমলই অধিক পছন্দনীয় যা চিরস্থায়ী হয়, যদিও তা অল্প হয়। অন্য শব্দে রয়েছেঃ “যার উপর আমলকারী স্থায়ীভাবে থাকে।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, যখন তিনি কোন আমল করতেন তখন তাঁর উপর চিরস্থায়ী থাকতেন (অর্থাৎ কখনো ঐ আমল পরিত্যাগ করতেন না)
হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) (আরবি)-এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত দানইয়াল (আঃ) উম্মতে মুহাম্মাদী (সঃ)-এর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেনঃ “তারা এমন নামায পড়বে যে, যদি হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় এরূপ নামায পড়তো তবে তারা ডুবে মরতো না। আ’দ সম্প্রদায়ের এরূপ নামায় হলে তাদের উপর দিয়ে অকল্যাণকর বায়ু প্রবাহিত হতো না। সামূদ সম্প্রদায় এরূপ নামায পড়লে তাদেরকে ভীষণ চীৎকারের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হতো না। সুতরাং হে লোক সকল! তোমরা ভালভাবে নামাযের পাবন্দ হয়ে যাও। এটা মু’মিনদের জন্যে উত্তম চরিত্র (গত গুণ)।”
মহান আল্লাহ্ এরপর বলেনঃ যাদের সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের। (আরবি) ও (আরবি) এর পূর্ণ তাফসীর সূরা যারিয়াতে গত হয়েছে।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ এ লোকগুলো কর্মফল দিবসকে সত্য বলে জানে। এ কারণেই তারা এমন সব আমল করে যাতে পুরস্কার লাভ করবে এবং আযাব হতেও পরিত্রাণ পাবে।
আল্লাহ তা’আলা তাদের আরো গুণ বর্ণনা করছেন যে, তারা তাদের প্রতিপালকের শাস্তিকে ভয় করে, যে শাস্তি হতে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি নির্ভয় থাকতে পারে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তা’আলা যাকে নিরাপত্তা দান করেন সেটা স্বতন্ত্র কথা।
আর এ লোকগুলো নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, তাদের পত্নী অথবা তাদের অধিকারভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্র ব্যতীত, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। তবে কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালংঘনকারী। এ দু’টি আয়াতের পূর্ণ তাফসীর (আরবি)-এর মধ্যে গত হয়েছে।
এরা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, আত্মসাৎ করে না ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। এগুলো হলো মু’মিনদের গুণাবলী। আর যারা এদের বিপরীত আমল করে তারা মুনাফিক। যেমন সহীহ্ হাদীসে এসেছেঃ “মুনাফিকের লক্ষণ বা নিদর্শন তিনটি। কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে এবং তার কাছে কিছু আমানত রাখা হলে তা আত্মসাৎ করে।” অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, কখনও কোন অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে। আর ঝগড়া করলে গালি দেয়।
তারা তাদের সাক্ষ্যদানে অটল। অর্থাৎ তাতে কম বেশী করে না ও সাক্ষ্যদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে পালিয়েও যায় না। তারা সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে কিছুই গোপন করে না। যারা তা গোপন করে তাদের অন্তর পাপী।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তারা তাদের নামাযে যত্নবান থাকে। অর্থাৎ সময় মত ওয়াজিব ও মুসতাহাব পূর্ণভাবে বজায় রেখে নামায পড়ে। এ কথাটি এখানে বিশেষ লক্ষণীয় যে, এই জান্নাতীর গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ্ পাক শুরুতেও নামাযের উল্লেখ করেছেন এবং শেষেও করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, দ্বীনের কার্যসমূহে নামাযের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী এবং এটা খুবই মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এটা আদায় করা অত্যন্ত জরুরী এবং এর হিফাযত করা একান্ত কর্তব্য। সূরা (আরবি)-এর মধ্যে ঠিক এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। ওখানে আল্লাহ পাক এসব বিশেষণ বর্ণনা করার পর বলেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারাই হবে অধিকারী, অধিকারী হবে ফিরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে।” (২৩:১০-১১) আর এখানে বলেছেনঃ তারাই সম্মানিত হবে জান্নাতে। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকারের ভোগ্যবস্তু পেয়ে তারা আনন্দিত হবে এবং মহাসম্মান লাভ করবে।