Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৩/ এবং কাফের-রা বলে:-২৮)
[*জিনদের মধ্যেও অনেক মু’মিন জিন রয়েছে:-
**অজ্ঞ ও মূর্খ জ্বিনদের শিরকী আচরণ :-
**জ্বীনদের কাছে আশ্রয় চাওয়া বাতুলতা মাত্র :-
*গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন:-
**রাসুলকে হেফাযত করার দায়িত্ব আল্লাহর :-
**জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন
পারা:২৯
১-২৮ নং আয়াতের বেখ্যা :-
সুরা:১১৪: আন্-নাস।
পারা:৩০
১-৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল:-
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১
قُلۡ اُوۡحِیَ اِلَیَّ اَنَّہُ اسۡتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الۡجِنِّ فَقَالُوۡۤا اِنَّا سَمِعۡنَا قُرۡاٰنًا عَجَبًا ۙ﴿۱﴾
হে নবী(সা:), বলুন, আমার কাছে অহী পাঠানো হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। তারপর (ফিরে গিয়ে নিজ জাতির লোকদেরকে) বলেছেঃ “আমরা এক বিস্ময়কর “কুরআন” শুনেছি।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২
یَّہۡدِیۡۤ اِلَی الرُّشۡدِ فَاٰمَنَّا بِہٖ ؕ وَ لَنۡ نُّشۡرِکَ بِرَبِّنَاۤ اَحَدًا ۙ﴿۲﴾
‘যা সত্যের দিকে হেদায়াত করে; ফলে আমরা এতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না,
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৩
وَّ اَنَّہٗ تَعٰلٰی جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَۃً وَّ لَا وَلَدًا ۙ﴿۳﴾
আর “আমাদের রবের মর্যাদা অতীব সমুচ্চ। তিনি কাউকে স্ত্রী কিংবা সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেননি।”
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৪
وَّ اَنَّہٗ کَانَ یَقُوۡلُ سَفِیۡہُنَا عَلَی اللّٰہِ شَطَطًا ۙ﴿۴﴾
‘এও যে, আমাদের মধ্যকার নির্বোধেরা আল্লাহ্ সম্বন্ধে খুবই অবান্তর উক্তি করত ।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৫
وَّ اَنَّا ظَنَنَّاۤ اَنۡ لَّنۡ تَقُوۡلَ الۡاِنۡسُ وَ الۡجِنُّ عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا ۙ﴿۵﴾
‘অথচ আমরা মনে করতাম মানুষ এবং জিন আল্লাহ্ সম্পর্কে কখনো মিথ্যা বলবে না।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৬
وَّ اَنَّہٗ کَانَ رِجَالٌ مِّنَ الۡاِنۡسِ یَعُوۡذُوۡنَ بِرِجَالٍ مِّنَ الۡجِنِّ فَزَادُوۡہُمۡ رَہَقًا ۙ﴿۶﴾
আর কতিপয় মানুষ কতক জ্বিনদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করত, ফলে তারা জ্বিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিত।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৭
وَّ اَنَّہُمۡ ظَنُّوۡا کَمَا ظَنَنۡتُمۡ اَنۡ لَّنۡ یَّبۡعَثَ اللّٰہُ اَحَدًا ۙ﴿۷﴾
‘এও যে, তারা ধারণা করেছিল যেমন তোমরা ধারণা কর যে, আল্লাহ্ কাউকেও কখনো পুনরুথিত করবেন না ।’
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৮
وَّ اَنَّا لَمَسۡنَا السَّمَآءَ فَوَجَدۡنٰہَا مُلِئَتۡ حَرَسًا شَدِیۡدًا وَّ شُہُبًا ۙ﴿۸﴾
এবং আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা তা পরিপূর্ণ।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-৯
وَّ اَنَّا کُنَّا نَقۡعُدُ مِنۡہَا مَقَاعِدَ لِلسَّمۡعِ ؕ فَمَنۡ یَّسۡتَمِعِ الۡاٰنَ یَجِدۡ لَہٗ شِہَابًا رَّصَدًا ۙ﴿۹﴾
আর পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে (সংবাদ) শুনবার জন্য বসতাম, কিন্তু এখন কেউ (সংবাদ) শুনতে চাইলে সে তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডের সম্মুখীন হয়।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১০
وَّ اَنَّا لَا نَدۡرِیۡۤ اَشَرٌّ اُرِیۡدَ بِمَنۡ فِی الۡاَرۡضِ اَمۡ اَرَادَ بِہِمۡ رَبُّہُمۡ رَشَدًا ﴿ۙ۱۰﴾
আর আমাদের বোধগম্য হচ্ছিল না যে, পৃথিবীবাসীদের সাথে কোন খারাপ আচরণ করার সংকল্প করা হয়েছে, নাকি তাদের প্রভু, তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে চান?
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১১
وَّ اَنَّا مِنَّا الصّٰلِحُوۡنَ وَ مِنَّا دُوۡنَ ذٰلِکَ ؕ کُنَّا طَرَآئِقَ قِدَدًا ﴿ۙ۱۱﴾
এবং আমাদের কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক এর ব্যতিক্রম, আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথের অনুসারী।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১২
وَّ اَنَّا ظَنَنَّاۤ اَنۡ لَّنۡ نُّعۡجِزَ اللّٰہَ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَنۡ نُّعۡجِزَہٗ ہَرَبًا ﴿ۙ۱۲﴾
(এখন) আমরা বুঝেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাভূত করতে পারব না এবং পলায়ন করেও তাঁকে ব্যর্থ করতে পারব না।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৩
وَّ اَنَّا لَمَّا سَمِعۡنَا الۡہُدٰۤی اٰمَنَّا بِہٖ ؕ فَمَنۡ یُّؤۡمِنۡۢ بِرَبِّہٖ فَلَا یَخَافُ بَخۡسًا وَّ لَا رَہَقًا ﴿ۙ۱۳﴾
আর আমরা যখন হিদায়াতের বানী শুনলাম তখন তার প্রতি ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তিই তার রবের ওপর ঈমান আনবে তার অধিকার বিনষ্ট হওয়ার কিংবা অত্যাচারিত হওয়ার ভয় থাকবে না।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৪
وَّ اَنَّا مِنَّا الۡمُسۡلِمُوۡنَ وَ مِنَّا الۡقٰسِطُوۡنَ ؕ فَمَنۡ اَسۡلَمَ فَاُولٰٓئِکَ تَحَرَّوۡا رَشَدًا ﴿۱۴﴾
আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে মুসলমান (আল্লাহর আনুগত্যকারী) আর কিছু সংখ্যক লোক আছে ন্যায় ও সত্য থেকে বিমুখ। তবে যারা ইসলাম (আনুগত্যের পথ) গ্রহণ করেছে তারা মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৫
وَ اَمَّا الۡقٰسِطُوۡنَ فَکَانُوۡا لِجَہَنَّمَ حَطَبًا ﴿ۙ۱۵﴾
আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে মুসলমান (আল্লাহর আনুগত্যকারী) আর কিছু সংখ্যক লোক আছে ন্যায় ও সত্য থেকে বিমুখ। তবে যারা ইসলাম (আনুগত্যের পথ) গ্রহণ করেছে তারা মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৬
وَّ اَنۡ لَّوِ اسۡتَقَامُوۡا عَلَی الطَّرِیۡقَۃِ لَاَسۡقَیۡنٰہُمۡ مَّآءً غَدَقًا ﴿ۙ۱۶﴾
আর (হে নবী, বলে দাও, আমাকে অহীর মাধ্যমে এও জানানো হয়েছে যে,) লোকেরা যদি সঠিক পথের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে আমি তাদের প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণের মধ্যে সমৃদ্ধ করতাম।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৭
لِّنَفۡتِنَہُمۡ فِیۡہِ ؕ وَ مَنۡ یُّعۡرِضۡ عَنۡ ذِکۡرِ رَبِّہٖ یَسۡلُکۡہُ عَذَابًا صَعَدًا ﴿ۙ۱۷﴾
যাতে এ নিয়ামতের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করতে পারি। আর যারা তাদের প্রভুর স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তিনি তাদের কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করবেন।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৮
وَّ اَنَّ الۡمَسٰجِدَ لِلّٰہِ فَلَا تَدۡعُوۡا مَعَ اللّٰہِ اَحَدًا ﴿ۙ۱۸﴾
আর এই যে, মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকেও ডেকো না।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-১৯
وَّ اَنَّہٗ لَمَّا قَامَ عَبۡدُ اللّٰہِ یَدۡعُوۡہُ کَادُوۡا یَکُوۡنُوۡنَ عَلَیۡہِ لِبَدًا ﴿ؕ٪۱۹﴾
আর আল্লাহর বান্দা যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন তারা সবাই তার ওপর হামলা করতে উদ্যত হলো।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২০
قُلۡ اِنَّمَاۤ اَدۡعُوۡا رَبِّیۡ وَ لَاۤ اُشۡرِکُ بِہٖۤ اَحَدًا ﴿۲۰﴾
বলুন, ‘আমি তো কেবল আমার রাবকেই ডাকি এবং তাঁর সঙ্গে কাউকেও শরীক করি না।’
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২১
قُلۡ اِنِّیۡ لَاۤ اَمۡلِکُ لَکُمۡ ضَرًّا وَّ لَا رَشَدًا ﴿۲۱﴾
বল, ‘আমি তোমাদের অপকার অথবা উপকার কিছুরই মালিক নই।’
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২২
قُلۡ اِنِّیۡ لَنۡ یُّجِیۡرَنِیۡ مِنَ اللّٰہِ اَحَدٌ ۬ۙ وَّ لَنۡ اَجِدَ مِنۡ دُوۡنِہٖ مُلۡتَحَدًا ﴿ۙ۲۲﴾
বল, ‘আল্লাহর (শাস্তি) হতে কেউই আমাকে রক্ষা করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত আমি কোন আশ্রয়স্থলও পাব না।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২৩
اِلَّا بَلٰغًا مِّنَ اللّٰہِ وَ رِسٰلٰتِہٖ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَاِنَّ لَہٗ نَارَ جَہَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ﴿ؕ۲۳﴾
আল্লাহর বাণী ও হুকুম-আহকাম পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার কাজ আর কিছুই নয়। এরপর যারাই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা অমান্য করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। এ ধরনের লোকেরা চিরকাল সেখানে থাকবে।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২৪
حَتّٰۤی اِذَا رَاَوۡا مَا یُوۡعَدُوۡنَ فَسَیَعۡلَمُوۡنَ مَنۡ اَضۡعَفُ نَاصِرًا وَّ اَقَلُّ عَدَدًا ﴿۲۴﴾
(এসব লোক তাদের এ আচরণ থেকে বিরত হবে না) এমনকি অবশেষে যখন তারা সে জিনিসটি দেখবে যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হচ্ছে, তখন তারা জানতে পারবে যে, কার সাহায্যকারী দুর্বল এবং কার দল সংখ্যায় কম।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২৫
قُلۡ اِنۡ اَدۡرِیۡۤ اَقَرِیۡبٌ مَّا تُوۡعَدُوۡنَ اَمۡ یَجۡعَلُ لَہٗ رَبِّیۡۤ اَمَدًا ﴿۲۵﴾
বলো, আমি জানি না, যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা নিকটে, না তার জন্য আমার রব কোন দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করছেন।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২৬
عٰلِمُ الۡغَیۡبِ فَلَا یُظۡہِرُ عَلٰی غَیۡبِہٖۤ اَحَدًا ﴿ۙ۲۶﴾
তিনিই গায়েবী বিষয়ের জ্ঞানী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারও কাছে প্রকাশ করেন না।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২৭
اِلَّا مَنِ ارۡتَضٰی مِنۡ رَّسُوۡلٍ فَاِنَّہٗ یَسۡلُکُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ مِنۡ خَلۡفِہٖ رَصَدًا ﴿ۙ۲۷﴾
তাঁর মনোনীত রসূল ব্যতীত। সেই ক্ষেত্রে তিনি রসূলের অগ্রে এবং পশ্চাতে প্রহরী নিয়োজিত করেন।
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন:-২৮
لِّیَعۡلَمَ اَنۡ قَدۡ اَبۡلَغُوۡا رِسٰلٰتِ رَبِّہِمۡ وَ اَحَاطَ بِمَا لَدَیۡہِمۡ وَ اَحۡصٰی کُلَّ شَیۡءٍ عَدَدًا ﴿٪۲۸﴾
যাতে তিনি প্রকাশ করেন যে, অবশ্যই তারা তাদের রবের রিসালাত পৌছে দিয়েছেন । আর তাদের কাছে যা আছে তা তিনি জ্ঞানে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তিনি প্রতিটি বস্তু গণনা করে হিসেব রেখেছেন ।
সুরা:১১৪: আন্-নাস।
পারা:৩০
১-৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
সুরা:১১৪: আন্-নাস:-১
قُلۡ اَعُوۡذُ بِرَبِّ النَّاسِ ۙ﴿۱﴾
বলুন, ‘আমি আশ্ৰয় প্রার্থনা করছি মানুষের রবের,
সুরা:১১৪: আন্-নাস:-২
مَلِکِ النَّاسِ ۙ﴿۲﴾
যিনি মানুষের মালিক।
সুরা:১১৪: আন্-নাস:-৩
اِلٰہِ النَّاسِ ۙ﴿۳﴾
‘মানুষের ইলাহের কাছে,
সুরা:১১৪: আন্-নাস:-৪
مِنۡ شَرِّ الۡوَسۡوَاسِ ۬ۙ الۡخَنَّاسِ ۪ۙ﴿۴﴾
আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে।
সুরা:১১৪: আন্-নাস:-৫
الَّذِیۡ یُوَسۡوِسُ فِیۡ صُدُوۡرِ النَّاسِ ۙ﴿۵﴾
যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে।
সুরা:১১৪: আন্-নাস:-৬
مِنَ الۡجِنَّۃِ وَ النَّاسِ ٪﴿۶﴾
জ্বিন ও মানুষের মধ্য হতে।
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আল-জ্বিন
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৭২
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু, তত্ত্ব ও তথ্যের দিকে দৃষ্টি দেয়ার আগেই পাঠকের অনুভূতিতে এর ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত আকস্মিক অথচ স্বতস্ফূর্তভাবে রেখাপাত করে। সে বৈশিষ্ট্যটি এই যে, এ সূরাটি পড়া শুরু করতেই মানুষের মনে সর্বাগ্রে মন মাতানাে একটি ধ্বনির মুর্ছনা ও জোরালাে শব্দের একটি ঝংকার বেঝে উঠে। সেই সাথে এর ছন্দায়িত শব্দে রয়েছে কিছুটা বেদনার ছাপ, এর সূরে বুলানাে রয়েছে সহানুভূতির বিভিন্ন পরশ। রয়েছে এর প্রতিধ্বনিতে কিছুটা আবেগময় সূর। সুরার ভাষায় যে দৃশ্য ও ছবি অংকিত হয়েছে এবং উদ্দীপনার যে প্রাণশক্তি এতে নিহিত রয়েছে, বিশেষত সূরার শেষাংশে জ্বীনদের বক্তব্যের যে উদ্ধৃতি রয়েছে তা এর আংগিক বৈশিষ্ট্যকে সমর্থন করে এবং তা তার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুরার শেষাংশে রসূল(স.)-কে সম্বোধন করে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা এই সুরার প্রতিটি পাঠকের মনকে রসূল(স.)-এর ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট ও তাকে ভালােবাসতে উদ্বুদ্ধ করে। আর খােদ রসূল(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তিনি যেন দুটো বিষয় জনগণকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, প্রথমত. ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনে তার ভূমিকা এর চেয়ে বেশী কিছু নয় যে, তিনি মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌছে দেবেন। দ্বিতীয়ত. যতক্ষণ তিনি এই প্রচারের কাজে লিপ্ত থাকবেন ততক্ষণ তার ওপর আল্লাহর সার্বক্ষণিক প্রহরা ও তত্ত্বাবধান সক্রিয় থাকবে। সুরার দ্বিতীয় রুকুটি পড়লে এ কথার যথার্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ‘হে নবী! তুমি বলাে, আমি তাে কেবল আমার প্রতিপালককেই ডাকি এবং তার সাথে কাউকে শরীক করি না… এবং তিনি সকল জিনিসকে গুনে গুনে রেখেছেন।’ এর পাশাপাশি রয়েছে জ্বীনদের বক্তব্যের সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি এবং এর মধ্য দিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে তার বিবরণ। এই সকল তত্ত্ব ও তথ্যকে গ্রহণ করে নিলে তা মানুষের মনমানস ও চেতনায় এক গভীর চিন্তা ভাবনার জন্ম দেয়। মনমগযে এই চিন্তাভাবনার জন্ম সুরার সূরেলা ছন্দ, আবেগময় ধ্বনি ও বেদনা বিধুর করুণ সুরের সাথে পুরােপুরি সংগতিপূর্ণ। সুরাটিকে একটু ধীরে ধীরে থেমে থেমে পড়লে তা মানুষের চিন্তা চেতনায় উপরােক্ত ভাবধারা গুলােকে আরাে গভীরভাবে বদ্ধমূল করে। সুরার এই বাহ্যিক ও আংগিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পর আমরা যদি সূরার আলােচ্য বিষয়, তাৎপর্য ও শিক্ষা নিয়ে আলােচনা করি তাহলে আমরা তাতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্যের সন্ধান পাই। প্রথমত. এতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক আকীদার ওপর ভিন্ন একটা জগতের জ্বীন জগতের সাক্ষ্য হাযির করা হয়েছে। এসব আকীদাকে মােশরেকরা সরাসরি অস্বীকার করতাে, এ নিয়ে তীব্র বিতর্কে লিপ্ত হতাে এবং এগুলাে নিয়ে সময় সময় একেবারে যুক্তিহীন ভিত্তিহীন অলীক কল্পনার জাল বুনতাে। কখনাে তারা দাবী করতাে যে, মুহাম্মদ(স.) তাদের কাছে অদৃশ্য আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত যেসব কথা বলে থাকেন, তা তিনি জ্বীনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। এর জবাবে স্বয়ং জ্বীনদের সাক্ষ্য উপস্থাপিত করা হচ্ছে যে, জ্বীনদের থেকে মােহাম্মদ(স.)-এর কোনাে তথ্য লাভকরা সংক্রান্ত মোশরেকদের দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। জ্বীনরা মােহাম্মদ(স.)-এর কাছ থেকে কোরআনের সম্পর্কে কিছুই জানতাে না। এ কারণে যখনই রসূল(স.) এর কাছ থেকে কোরআনের আবৃত্তি শুনলাে, তখনি তারা ভয়ে ও আতংকে এতাে অধীর হয়ে পড়লাে যে, তারা কিছুতেই চুপ থাকতে পারলাে না। তারা সর্বত্র এ কথা প্রচার করে বেড়াতে লাগলাে। আকাশ, পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, জ্বীন, মানুষ ও ফেরেশতা সকলে মিলে যে মহাসত্যকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে এবং সমগ্র প্রকৃতি যার দ্বারা প্রভাবিত, তার কথা তারা জ্বিন জগতে প্রচার করলো। বলা বাহুল্য, মানুষের মনে জ্বীন জগতের এ স্বাক্ষ্যের যথেষ্ট প্রভাব ও মূল্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত. এই সূরা দ্বারা পাঠকদের মনে জ্বীনদের ব্যাপারে বিরাজমান অনেক ভ্রান্ত ধারণা সংশােধন করা হয়েছে। এসব ভুল ধারণা কোরআন নাযিল হওয়ার সময়কার শ্রোতাদের মনেও ছিলাে, তাদের আগের ও পরের লােকদের মনেও ছিলাে। কোরআন এই অদৃশ্য সৃষ্টির প্রকৃত তথ্য কোনাে অতিরঞ্জন ও রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করে দিয়েছে। কোরআনের প্রাথমিক শ্রোতা আরবরা ভাবতাে যে, পৃথিবীর ওপর জ্বীনদের একটা আধিপত্য রয়েছে, সে জন্যেই একজন আরব পৌত্তলিক যখন কোনাে মাঠ বা মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলতাে, তখন তারা সেই ভূখন্ডের শাসক জ্বীনের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করতাে। তারা বলতাে, এই উপত্যকা বা প্রান্তরের সরদারের কাছে এখানকার বখাটে অধিবাসীদের উৎপাত থেকে আমরা নিরাপত্তা চাই… এরপরই সে সেই এলাকায় নিজের রাত্রি যাপনকে নিরাপদ মনে করতাে। তারা এ ধারণাও পােষণ করতাে যে, জ্বীনরা অদৃশ্যের খবরাখবর জানে এবং তা দুনিয়ার জ্যোতিষীদেরকে জানিয়ে দেয়। এর ফলেই তারা ভবিষ্যৎ বাণী করতে সক্ষম হয়। তাদের অনেকে জ্বীনের পূজাও করতাে এবং আল্লাহর সাথে জ্বীনদের সম্পর্কও কল্পনা করতাে। কেউ কেউ বলতাে যে, জ্বীনদের মধ্যে থেকেই আল্লাহর একজন স্ত্রী আছেন, যার পেট থেকে ফেরেশতারা জন্মগ্রহণ করেন। (নাউযুবিল্লাহ) জ্বিন সম্পর্কে এ ধরনের আকিদা-বিশ্বাস সকল যুগের জাহেলী সমাজে চালু ছিলাে। এ ধরনের অলীক কল্পকাহিনী এ যুগেও অনেক সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। প্রাচীন যুগের মনগড়া কল্পকাহিনী দ্বারা যেমন মানুষের মনের ওপর জ্বিনদের আধিপত্য বিস্তার করে রাখা হতাে এখনও তেমনটি হয়। অপরদিকে এ যুগেও এমন লােকদের সাক্ষাত পাওয়া যায়, যারা আদৌ জ্বিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এই সৃষ্টি সম্পর্কে যে কোনাে বক্তব্যকে তারা কুসংস্কার মনে করা, অপরদিকে জিনদের নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জিত তথ্য প্রচার করা এই দুই প্রান্তিক ধারণার মাঝে কোরআন জিনের সম্পর্ক প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে তাদের সংক্রান্ত ধারণা সংশােধন করে দিয়েছে এবং তাদের ভয় ও কল্পিত কর্তৃত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করেছে। বস্তুত জ্বিনদের অস্তিত্ব আছে, এতে কোনাে সন্দেহ নেই। এই সূরায় তারা যেমন নিজেদের সম্পর্কে বলেছে যে, আমাদের ভেতরে সৎ লােকও আছে, আছে অসং কিছু লোক…। আসলেও তারা তেমনি। তাদের ভেতরে এমন লােকও আছে যারা নিজেরাও বিভ্রান্ত অন্যকেও বিভ্রান্ত করে, আবার অনেক সহজ সরল ও ধোকা খাওয়া লােকও সেখানে আছে। ‘আমাদের মধ্যে কোনাে কোনাে মূর্খ ও বােকা লােক আছে যারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আজে বাজে কথা বলে। তারা গােমরাহী থেকে শুদ্ধি ও হেদায়াত লাভের যােগ্য এবং তারা কোরআন শুনতে, বুঝতে ও তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে প্রস্তুত। ‘তুমি বলাে, আমার কাছে ওহী এসেছে যে, একদল জ্বিন (কোরআন) শ্রবণ করেছে তারপর তারা বলেছে যে, আমরা এক আশ্চর্যজনক কোরআন শুনেছি, যা সততা ও ন্যায়ের পথ দেখায়। আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমাদের প্রভুর সাথে কখনাে কাউকে শরীক করবাে না।’ তারা জন্মগতভাবে কর্মফল ভােগ করার যােগ্য এবং ঈমান ও কুফরের ফলাফল তাদের প্রাপ্য। ‘আমরা যখন হেদায়াতের কথা শুনলাম অমনি তার ওপর ঈমান আনলাম…’ মানুষ যখন জ্বিনদের কাছে নিরাপত্তা চাইবে, তখন জিনরা তাদের কোনাে উপকার তাে করতেই পারবে না বরং আরাে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করবে। তারা কোনাে অদৃশ্য তথ্য জানে না এবং আকাশের সাথে তাদের কোনাে সংযােগও নেই। ‘আমরা আকাশকে স্পর্শ করতেই দেখলাম তা কঠোর প্রহরা ও আগুনে ভেতরে পরিপূর্ণ’ জ্বিনদের সাথে আল্লাহর কোনাে আত্মীয়তা বা বংশীয় সম্পর্ক নেই। ‘আল্লাহর কোনাে স্ত্রী বা সন্তান নেই।’ আর আল্লাহর শক্তির সামনে জ্বিনদের কোনাে শক্তি নেই, কোনো চালাকিও তাদের চলে না। ‘আমরা জানতাম যে, আল্লাহকে আমরা কখনাে হারাতে পারবাে না…’ আলােচ্য সূরায় জ্বিন জাতি সম্পর্কে যা কিছু আলােচিত হয়েছে, ওপরে তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হলাে। এ ছাড়া কোরআনে আরাে কিছু কিছু বিবরণ আছে। যেমন জ্বিন বংশােদ্ভুত একদল শয়তানকে হযরত সােলায়মানের অনুগত করে দেয়া, জ্বিনেরা হযরত সােলায়মানের মৃত্যুর অনেক পরে টের পেয়েছিলাে যে, তিনি মারা গেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা গায়েব বা অদৃশ্য জানে না। ‘যখন আমি সােলায়মানের ওপর মৃত্যুর ফায়সালা কার্যকর করলাম, তখন শুধুমাত্র একটি উই পােকাই তার লাঠি খেয়ে দিয়ে তার মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলাে। সােলায়মানের লাশ যখন পড়ে গেল তখনি জ্বিনেরা বুঝতে পারলাে তারা যদি গায়ব জানতাে তাহলে এতাে দীর্ঘসময় অপমানজনক শাস্তি তারা ভুগত না'(সাবা-১৪) অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ইবলিস ও তার সহযােগীদের একটি খাসলাত তুলে ধরেছেন। ইবলিস জ্বিনের বংশােদ্ভুত, যাবতীয় অপকর্ম, অন্যায় ও বিপর্যয়ের সে হােতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইবলিস ও তার সাথী তােমাদেরকে দেখতে পায়, অথচ তােমরা তাদেরকে দেখতে পাওনা।’ সূরা আর রহমান-এ জিন কিসের তৈরী এবং মানুষ কিসের তৈরী তা জানানাে হয়েছে। যথা, ‘তিনি মানুষকে শুকনাে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং জ্বিনকে সৃষ্টি করছেন আগুন থেকে।’ এ আয়াতে উক্ত অদৃশ্য জীবের আকৃতির একটা ধারণা পাওয়া যায়, তার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় এবং তার অনেকগুলাে স্বভাব বা খাসলাত সম্পর্কে জানা যায়। একই সাথে এ আয়াত জ্বিন সম্পর্কে অনেক অমূলক ধারণা দূর করে, তার সম্পর্কে মুসলমানদের বিশ্বাসকে সকল কদর্য ও আবিলতা থেকে মুক্ত করে এবং তাকে অস্বীকার করার প্রবণতা রােধ করে। আরবের মােশরেকরা জ্বিনের ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক জগতে তাদের বিচরণ ও ভূমিকা সম্পর্কে যে ধারণা পােষণ করতে, এ সূরা সে ধারণা শুধরে দেয়। তবে যারা এর অস্তিত্বই পুরােপুরি অস্বীকার করে, আমি জানিনা তারা কিসের ভিত্তিতে জোর দিয়ে অস্বীকার করে, কিসের ভিত্তিতে তার অস্তিত্বের বিশ্বাসকে বিদ্রুপ করে এবং কুসংস্কার নামে আখ্যায়িত করে। তারা কি মহাবিশ্বে কোথায় কি আছে সব জেনে ফেলেছে, সেখানে জ্বিন নামের কাউকে তারা পায়নি আর এ জন্যেই কি তাদের এই অস্বীকৃতি। বিজ্ঞানীদের ভেতরে আজ পর্যন্ত কেউই এমন দাবী করেনি। মহাবিশ্বে তাে দূরের কথা, এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতেও এখনাে এমন বহু প্রাণী রয়েছে, যাদের অস্তিত্ব এখনাে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে এবং কেউ এ কথা বলার সাহস পায়নি যে, পৃথিবীতে জীবন্তু প্রাণী আবিষ্কারের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে, কিংবা কোনাে নির্দিষ্ট দিনে তা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা কি দেখেছে যে, এ বিশ্বজাহানে লুকায়িত সকল শক্তির গতিপথ বন্ধ হয়ে গেছে, তার ভেতরে কেবল জিনেরই কোনাে সন্ধান মিলেনি? কেউ এমন দাবী করেনি। প্রতিদিনই বহু সুপ্ত শক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে, যা গতকালও অজানা ছিলাে। বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক শক্তি ও উপকরণসমূহের অনুসন্ধানে একনিষ্ঠভাবে ব্যাপৃত রয়েছেন। তাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ব্যাপকতাই তাদেরকে বিনয়ের সাথে এ কথা বলতে বাধ্য করছে যে, আমরা প্রাকৃতিক জগতে এখনাে অজ্ঞতার স্তরেই রয়ে গেছি এবং এখনাে জানা শুরুই করিনি। তারা কি এ বিশ্বজাহানের সকল শক্তি ও উপকরণ দেখে এসেছে এবং তা ব্যবহারও করে ফেলেছে এবং তার ভেতরে জ্বিনকে দেখেনি বলেই তাদের এই অস্বীকৃতি। এটাও ঠিক নয়। এটমকে ভাংগার পর থেকে তারা ইলেক্ট্রনকে একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা বলে প্রচার করে আসছেন। অথচ কেউই আজ পর্যন্ত ইলেক্ট্রনকে দেখেননি। যে ইলেক্ট্রনের কথা এতাে জোরেশােরে প্রচার করে চলেছে, তাকে আলাদা করে দেখানাের কোনো হাতিয়ার কোনাে পরীক্ষাগারেও নেই । তাহলে জ্বিনের অস্তিত্ব অস্বীকারে এতে জিদ কেন? অথচ প্রকৃতি এবং তার উপায় উপকরণ উপাদান ও অধিবাসী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এতাে কম যে, নিজের বিবেক বুদ্ধির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা রাখে এমন কেউ কোনাে ব্যাপারেই অনমনীয় মত পােষণ করতে পারে না। যদি বলা হয় যে, জ্বিনের সাথে অনেক ভিত্তিহীন ও অতিরঞ্জিত কথাবার্তা জড়িত হয়ে গেছে বলেই তার অস্তিত্ব অস্বীকার করার এই প্রবণতা, তাহলে বলবাে, এমতাবস্থায় আমাদের কর্মপন্থা হবে কুসংস্কার ও অলীক কল্পনা প্রত্যাখ্যান করা, যেমন কোরআন তা আমাদের জন্যে করে দিয়েছে। কোনাে যুক্তি প্রমাণ ছাড়া একটি সৃষ্টির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা কোনাে বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। এ ধরনের অদৃশ্য বিষয়ের কোনাে তথ্য মেনে নেয়ার জন্যে পূর্বশর্ত এই যে, তাকে ওহীর নির্ভরযােগ্য উৎস থেকে উৎসারিত না হয়ে এই উৎসের বিরােধী হয়, তাহলে তা অস্বীকার করতে হবে। কেননা ওহীর উৎস থেকে আগত সত্যই একমাত্র চূড়ান্ত ও অকাট্য সত্য। পূর্ববর্তী সূরা গুলোর মতাে আলােচ্য সূরা স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক, বিভিন্ন সৃষ্টির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং খােদ স্রষ্টা ও সৃষ্টির ব্যাপারে ইসলামের নীতি ও দৃষ্টিভংগী নির্ণয়ে এক বিরাট অবদান রাখে। সূরার যে অংশে জ্বিনদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেখানে আল্লাহর একত্ব ছাড়াও আল্লাহর স্ত্রী ও সন্তান না থাকা এবং আখেরাতের কর্মফলের সত্যতার বিষয়টি দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া খুবই জোরের সাথে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হলাে এই যে, আল্লাহর কোনাে সৃষ্টি কর্তৃক আল্লাহকে হারিয়ে দেয়ার তাে প্রশ্নই ওঠে না, বরঞ্চ আল্লাহর হাত থেকেই তাে সে নিরাপদ নয়। আর আল্লাহর ন্যায়বিচারকেও সে ফাকি দিতে সক্ষম নয় । রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে যে কথাগুলাে এ সূরার দ্বিতীয় রুকুতে বলা হয়েছে, তাতে উপরােক্ত বক্তব্য একাধিকবার প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন, ‘হে নবী, তুমি বলাে আমি শুধু আমার মনিবকেই ডাকি এবং তার সাথে আর কাউকে শরীক করি না।’ এ সত্য সম্পর্কে জ্বিনরা পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে সাক্ষ্য দেয়ার পরই এ কথাটি বলা হয়েছে। জ্বিনদের সাক্ষ্য থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাই ইবাদত ও আনুগত্য লাভের অধিকারী। এ সত্যটি ব্যক্ত করেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহর বান্দা তাকে ডাকতে দাড়ায়, অমনি তারা (কাফেররা) তার ওপর ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়ে যায়।’ পরবর্তী আয়াতেও রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে এই সত্যেরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যে, ‘তুমি বলাে, আমি তােমাদের কোনাে ক্ষতি বা উপকার করতে সক্ষম নই।’ এ সূরায় এ সত্যটিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে যে, অদৃশ্যজ্ঞান এককভাবে শুধুমাত্র আল্লাহরই করায়ত্ত্ব। জ্বিনরা তা মােটেই জানে না। যেমন বলা হয়েছে, ‘আমরা জানি না পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্যে কোনাে অকল্যাণ কামনা করা হয়েছে, না তাদের প্রতিপালক তাদের সুপথ প্রাপ্তি কামনা করেছেন।’ এমনকি রাসূল(সা.) শুধু ততটুকুই অদৃশ্য তথ্য অবগত হন যতােটুকু আল্লাহ তায়ালা তার জ্ঞান কোনাে মহৎ উদ্দেশ্যে তাকে অবহিত করেন। ‘হে নবী! তুমি বলাে, তােমাদেরকে যে কর্মফল দিবসের প্রতিশ্রুত দেয়া হয়েছে তা খুব নিকটবর্তী-না আমার প্রতিপালক তাকে কিছু বিলম্বিত করবেন, তা আমার মােটেই জানা নেই। তিনিই অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তার অদৃশ্য তথ্য কাউকেই অবহিত করেন না। অবশ্য কোনাে রসূলকে তিনি কিছু জানাতে সম্মত হলে সেটা ভিন্ন কথা। সে রকম সিদ্ধান্ত নিলে সেই রসূলের আগে পেছনে তিনি প্রহরা লাগিয়ে দেন।’ পক্ষান্তরে আল্লাহর বিভিন্ন সৃষ্টি সম্পর্কে এই সূরা আমাদেরকে যে তথ্য জানায় তা হচ্ছে এই যে, জন্মগত ও প্রকৃতিগতভাবে পরস্পরের মধ্যে যে পার্থক্যই থাকুক না কেন, সকল ধরনের সৃষ্টির মধ্যেই পারস্পরিক অংশীদারিত্ব ও সংযােগ রয়েছে। যেমন জ্বিন ও মানুষের মধ্যে সংযােগ ও অংশীদারিত্বের কথা এই সূরাতে ও কোরআনের অন্যান্য জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ এই পৃথিবীতে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। কোনাে না কোনাে পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে সংযােগ ও সহযােগিতা বিদ্যমান রয়েছে। ব্যক্তিগত, গােত্রীয় ও জাতিগত পর্যায়ে তাে দূরের কথা, মানুষ হিসাবে সে যে বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব অনুভব করে প্রকৃতির স্বভাবে কিংবা বাস্তবে তার কোনাে অস্তিত্ব নেই। বিষয়টি আরাে স্পষ্ট করে বললে এ রকম দাঁড়ায় যে, মানুষ প্রকৃতি সম্পর্কে এবং প্রকৃতিতে অবস্থানরত অজস্র আত্মা, শক্তি ও রহস্য সম্পর্কে সচেতন। এইসব আত্মা, শক্তি ও রহস্যের অবস্থান সম্পর্কে সে যদিও সুনিশ্চিতভাবে কিছুই জানে না, তথাপি তা তার চারপাশে বাস্তবিক পক্ষেই বিরাজমান রয়েছে। বস্তুত, সে যে একাকী এই বিশ্বের অধিবাসী নয়, সে কথা অবশ্যই অনুভব করে। বিভিন্ন সৃষ্টির আল্লাহর প্রদর্শিত ও নির্ধারিত সঠিক পথে দৃঢ়ভাবে অবস্থান এই প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন উদ্যোগ আয়ােজন এবং বান্দাদের ব্যাপারে আল্লাহর পরিকল্পনা, আবার এসব কয়টির ভেতরে সম্পর্ক ও সংযােগ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যদি সঠিকপথে দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করতাে তাহলে আমি তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দান করতাম…’ বস্তুত এ তত্ত্বটির মধ্যেই মানুষ, প্রকৃতি ও বিভিন্ন সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর পরিকল্পনার সমন্বয় ও সংযােগ সম্পর্কে কিছুটা ইসলামী ধারণা ও দৃষ্টিভংগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এ সব বিবেচনা করলে মনে হয় সূরাটির মর্ম ও তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, যদিও এর আয়াত সংখ্যা মাত্র আটাশ এবং এটি একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনা উপলক্ষেই নাযিল হয়েছিলো। ঘটনাটি ছিল জ্বীনের একটি দল কর্তৃক কুরআন শ্রবণ। এই সূরায় ঘটনাটির কেবল আভাস ইংগিতই বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন রেওয়ায়াতে এর যে বিবরণ এসেছে তাতে সামান্য কিছু মতভেদ রয়েছে। ‘দালায়েলুন নবুওত’ নামক গ্রন্থে ইমাম বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন যে, ‘রাসূল(স.) জিনদের দেখেন নি, তাদেরকে লক্ষ্য করেও কোরআন পড়েননি। রসূল(স.) কতিপয় সাহাবীকে সাথে নিয়ে উকাযের মেলায় গিয়েছিলেন। এই সময় শয়তানদের আকাশ থেকে খবরাখবর সংগ্রহের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা তাদের ওপর উল্কাপাত হচ্ছিল। ফলে শয়তানরা তাদের স্বজাতির কাছে ফিরে গেলাে। তারা বললাে, ‘আমাদের আকাশ থেকে খবর সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের ওপর উল্কা নিক্ষেপ করা হয়েছে।’ স্বজাতির লােকেরা বললাে, তােমাদের আকাশ থেকে খবর সংগ্রহ যদি বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই কোনাে নবাগত জিনিসের কারণেই হয়েছে। অতএব, যাও সমগ্র পূর্ব পশ্চিমে একটা টহল দিয়ে এসাে এবং কিসের কারণে তােমরা বাধা পাচ্ছ তা খুঁজে দেখে এসাে। এ কথা শুনে শয়তানরা পূর্ব ও পশ্চিমের ভ্রমণে চলে গেলাে এবং তাদের আকাশ ভ্রমণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলাে। শয়তানদের এই দলটি ‘তিহামা’ অঞ্চলের দিকে চলে গেলাে। সেখানে রসূল(স.) উকাযের মেলায় যাওয়ার পথে নাখলায় যাত্রাবিরতি করছিলেন। জ্বিনরা যখন ওখানে উপস্থিত হলো, তখন রাসূল(স.)-এর কোরআন পাঠ শুনে তারা পরস্পরকে বললাে, এটাই হচ্ছে সেই জিনিস, যা আমাদের আকাশ থেকে খবর সংগ্রহকে অবরুদ্ধ করেছে। তৎক্ষণাৎ তারা আপন জাতির লােকদের কাছে ফিরে গিয়ে বললাে, ‘নিশ্চয় আমরা এক আজব কোরআন শুনেছি; যা সততা ও ন্যায়ের পথ দেখায়। আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আর কখনো আমাদের প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করব না।’ আর আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-এর কাছে ওহী নাযিল করলেন যে, ‘তুমি বলাে আমাকে ওহীযােগে জানানাে হয়েছে যে, জ্বিনের একটি দল কোরআন শুনেছে।’ আসলে তার কাছে জিনদের কথাটাই ওহীযােগে জানানাে হয়েছিলাে। (বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনাও এর কাছাকাছি।)। সহীহ মুসলিমে আরাে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, এই রেওয়ায়াতের বর্ণনাকারী আমের বলেন, আমি আলকামাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ইবনে মাসউদ কি রসূল(স.) এর সাথে সেই রাত্রে অবস্থান করছিলেন, যখন জিনরা সেখানে এসেছিলাে। আলকামা বললেন, আমি ইবনে মাসউদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আপনাদের কেউ কি সেই রাতে রসূল(স.)-এর সাথে ছিলেন যখন জিনরা এসেছিলাে? ইবনে মাসউদ বললেন, না, তবে আমরা অন্য কোনাে এক রাতে রসূল(স.)-এর সাথে ছিলাম, হঠাৎ আমরা তাকে হারিয়ে ফেললাম। আমরা পাহাড়ে ও সমতল প্রান্তরে সর্বত্র তাকে খুঁজলাম। আমাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলাে যে, ‘রসূল(স.)-কে কি কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেলাে, নাকি কেউ তাকে মেরে ফেললাে। এভাবে আমরা একটি ভয়ংকর রাত কাটালাম। সকালে রসূল(স.)-এর সাক্ষাত পেলাম। তিনি হেরার দিক থেকে এলেন। আমরা বললাম, হে রসূলুল্লাহ। আমরা আপনাকে হারিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করেছি, কিন্তু পাইনি। রাতটি আমাদের অত্যন্ত অন্বস্তির মধ্য দিয়ে কেটেছে। রসূল(স.) বললেন, ‘আমার কাছে জিনের দূত এসেছিলাে। আমি তাদের সাথে গিয়েছিলাম। তাদের কাছে গিয়ে কোরআন পড়েছি। এরপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে জ্বীনদের আগমনের লক্ষণসমূহ এবং তাদের আগমনের আলামত দেখালেন। সাথীরা তার কাছে রসদ চাইলাে। তিনি বললেন, তােমাদের হাতে যে কোনাে হাডিড আসুক, তার ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলেই তা গােশতে পরিণত হবে। আর জন্তুর পায়খানার প্রতিটি টুকরাে তােমাদের জন্তুসমূহের খাদ্য হবে, অতএব তােমরা হাড্ডি ও জন্তুর পায়খানা দ্বারা পেশাব পায়খানার পর কুলুখ করাে না। কেননা সেই জিনিস দুটো তােমাদের (অন্য) ভাইদের খাদ্য। ইবনে মাসউদের আরেকটি রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, তিনি সেই রাতে রসূল(স.)-এর সাথে ছিলেন। তবে প্রথমােক্ত রেওয়ায়াতের সনদ অধিকতর নির্ভরযোগ্য । তাই আমরা অন্য রেওয়ায়েতকে তেমন আমল দিতে চাই না। বুখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েত দুটি থেকে বুঝা যায় যে, হযরত ইবনে আব্বাসের মতে রসূল(স.) জ্বিনদের উপস্থিতি টের পাননি। আর ইবনে মাসউদ বলেন যে, তারা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাে। বায়হাকীর ব্যাখ্যা এই যে, উভয় রেওয়ায়েত আসলে আলাদা দুটো ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় আরেকটি রেওয়ায়েত ইবনে ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশদের পক্ষ থেকে রাসূল(স.) এতাে কষ্ট পেতে লাগলেন, যা আবু তালিবের জীবদ্দশায় পাননি। ফলে রাসূল(স.) তায়েফে চলে গেলেন। বনু সাকীফ থেকে তিনি সাহায্য পাওয়ার আশা করছিলেন এবং তার গােত্রের অত্যাচার থেকে তাকে তারা রক্ষা করবে ভেবেছিলেন। তাই তিনি তায়েফে গিয়েছিলেন। তিনি যখন তায়েফে পৌছলেন, তখন বন সাকিফের প্রধান তিন ব্যক্তির কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। এরা ছিলাে তিন ভাই। এই তিন ভাই এর নাম ছিলাে ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবীব। এরা সবাই ছিলাে অমর বিন উমাইয়ের পুত্র। তাদের একজন কোরায়শের মেয়ে বিয়ে করেছিলাে। রসূল(স.) তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানালেন এবং তাকে তার গােত্রের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার অনুরােধ জানালেন। তাদের একজন বললাে, আল্লাহ তায়ালা যদি তােমাকে সত্যিই পাঠিয়ে থাকে, তাহলে আমি কাবার গেলাফকে ছিড়ে ফেলবাে। অপরজন বললাে, আল্লাহ তায়ালা রসূল বানাতে তােমাকে ছাড়া আর কাউকে বুঝি পেলেন না! তৃতীয় জন বললাে, আমি তােমার সাথে কোনাে কথাই বলবাে না। তুমি যদি সত্যিই রাসূল হয়ে থাকে, তাহলে তােমার কথার জবাব দেয়া খুবই বিপদজনক। আর যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তাহলে তােমার সাথে আমার কথা বলাই সাজে না। এরপর রসুল (স.) তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। বনু সাকীফের কাছ থেকে তার আর কোনাে কল্যাণের আশা রইল না। বিদায় নেয়ার সময় বললেন, তােমরা যখন আমার দাওয়াত মানলেই না, তখন আমার ব্যাপারটা গােপন রাখাে। সাকীফের লােকেরা তার আগমনের খবর জানুক, এটা তিনি পছন্দ করলেন না। কেননা তাতে বখাটে লােকদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দেয়া হতে পারে। সাকীফের নেতারা রসূল(স.)-এর শেষ অনুরােধটিও রক্ষা করলাে না। তারা তাদের বখাটে তরুণদেরকে ও চাকর-বাকরদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দিলাে। তারা তাকে গালিগালাজ করতে লাগলাে এবং চিৎকার করতে করতে তার পিছু নিলাে। শেষপর্যন্ত বিপুলসংখ্যক লােকের ভিড় জমে উঠলাে এবং রাসূল(সা.) ওতবা ও শায়বার বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। তখন বখাটে তরুণগুলাে ফিরে গেলাে। একটি আংগুরের ঝােপের আড়ালে তিনি বসে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। রবীয়ার ছেলে ও ও শায়বা বখাটে তরুণদের অত্যাচারে তার কি হাল হয়েছে সে দৃশ্য উপভােগ করলাে। একটু বিশ্রাম নিয়ে রসূল(স.) আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। হে আল্লাহ তায়ালা, তোমার কাছে আমি নিজের শারীরিক অক্ষমতা, কৌশলগত দুর্বলতা এবং মানুষের চোখে মর্যাদাহীন হওয়ার কথা স্বীকার করছি। হে শ্রেষ্ঠ দয়ালু! তুমি দুর্বলদের প্রভু! তুমি আমার প্রভু। আমাকে তুমি এ কার গলগ্রহ বানাচ্ছাে? এমন কোনাে দূরবর্তী আত্মীয়ের কাছে, আমাকে সােপর্দ করছো, যে আমাকে অপর মনে করে। অথবা, এমন কোনো নিকটাত্মীয়ের কাছে আমাকে সঁপে দিচ্ছাে যে আমার মনিব হয়ে বসবে? তুমি যদি আমার ওপর রুষ্ট না হয়ে থাক, তাহলে আমার পরােয়া নেই। তবে তুমি শান্তি ও নিরাপত্তা দিলে সেটা আমার জন্যে প্রশস্ততা । তােমার নূরের আশ্রয় চাই যার আলােতে সকল অন্ধকার বিদূরিত হয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়। আমার ওপর তােমার গযব যেন না আসে, তােমার কাছেই ধর্ণা দিয়ে থাকি যতােক্ষণ না তুমি খুশী হও। তােমার শক্তি ছাড়া আর কারাে শক্তি আমার কাজে লাগবে না।’ তার এই অবস্থা দেখে ওৎবা ও শায়বার মনে করুণার উদ্রেক করলাে। তারা তাদের খৃষ্টান ভৃত্য আব্বাসকে দিয়ে একটি প্লেটে করে এক থলে আংগুর রাসূল(স.)-এর খাওয়ার জন্যে পাঠালাে, আব্বাস আঙ্গুর নিয়ে রসূল(স.) কে খেতে বললাে। তিনি “বিসমিল্লাহ’ বলে আংগুর খেলেন। আব্বাস তা শুনে রাসূল(স.)-এর মুখের দিকে তাকালাে এবং বললাে, এই দেশের লােকেরা এ ধরনের কথা বলে না। রাসূল(স.) বললেন, তুমি কোন দেশের মানুষ এবং তােমার ধর্ম কি? সে বললাে, আমি একজন খৃষ্টান এবং নিনােয়ার অধিবাসী। রসূল(স.) বললেন, পুণ্যবান মহাপুরুষ ইউনুস বিন মাত্তার শহরের অধিবাসী? আব্বাস বললেন, ইউনুস বিন মাত্তা কে, তা আপনি কি করে জানলেন? রসূল(স.) বললেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনিও নবী ছিলেন, আমিও নবী। সংগে সংগে আব্বাস মাথা নুইয়ে রসূল(স.)-এর কপালে, হাতে ও পায়ে চুমু খেলাে। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে ওৎবা ও শায়বা পরস্পরকে বললাে, ভূত্যটিকে বুঝি সে নষ্টই করে দিলাে।’ আব্বাস এলেই তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, কিরে আব্বাস! তুই সেই আগন্তুকের হাত পা ও কপালে চুমু খেলি কেন? সে বললাে, হে আমার মনিব। পৃথিবীতে এই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কেউ নেই। তিনি আমাকে এমন একটা জিনিস শিখিয়েছেন যা নবী ছাড়া আর কেউ শেখায় না। ওৎবা ও শায়বা ধমক দিয়ে বললাে, তুই কিন্তু সেই লােকটির প্ররােচনায় নিজের ধর্ম ছাড়িসনে। তাের ধর্ম ওর ধর্মের চেয়ে ভালাে। অতঃপর, রাসূল(স.) তায়েফ থেকে মক্কার দিকে ফিরে চললেন। বনু সাকীফের দিক থেকে তিনি এক বুক হতাশা নিয়ে ফিরলেন। রাত দুপুরের দিকে নাখলায় পৌছে নামায পড়তে লাগলেন। এসময়ে তার কাছ দিয়ে এক দল জ্বিন অতিক্রম করে। আল্লাহ তায়ালা এদের কথাই এই সূরায় বলেছেন। তারা ছিলাে নাসিবীনদের মধ্য থেকে সাতজন জিন। তারা তাঁর কোরআন পড়া শুনলাে। অতপর স্বগােত্রীয় জ্বিনদের কাছে গিয়ে ইসলাম প্রচার শুরু করে দিলাে। তারা আগেই ঈমান এনেছিলাে। আল্লাহ তায়ালা এই জিনদের খবর রসূল(স.) কে দিয়েছেন এই বলে, ‘আমি একদল জিনকে তোমার দিকে চালিত করলাম যেন তারা কোরআন শুনতে পায়। তারা সেখানে পৌছে পরস্পরকে বললাে, নীরবে শােনাে…'(সূরা আহকাফ) অতপর এই সুরার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নাযিল করলেন। বিশিষ্ট মুফাসসির ইবনে কাসীর ইবনে ইসহাকের উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘ঘটনা তাে ঠিকই। তবে সেই রাত্রেই যে জিনরা প্রথম কোরআন শুনেছে, এ কথা বিচার বিবেচনা সাপেক্ষ। কারণ ইবনে আব্বাসের হাদীস থেকে জানা যায় যে, জ্বীনেরা ওহীর সূচনাকালেই কোরআন শুনেছে। আর রসূল(স.)-এর তায়েফ যাত্রা ছিলাে তার চাচার মৃত্যুর পরের ঘটনা। হিজরতের মাত্র দুই বা এক বছর আগে এ ঘটনাটি ঘটে। ইবনে ইসহাকের এই বর্ণনাকে যদি সত্য ধরে নেয়া হয় যে, ঘটনাটা তার তায়েফ থেকে নির্যাতিত ও মর্মাহত হয়ে এবং সাকীফ গােত্রের নেতাদের নির্মম নিষ্ঠুর ও অমানুষিক ব্যবহারে মনােক্ষুন্ন হয় ফেরার পথেই ঘটেছিলাে, তাহলে এ দিক থেকে ঘটনাটা সত্যিই চমকপ্রদ মনে হয় । তায়েফবাসীর অত্যাচারে ব্যথিত হৃদয়ে তিনি যে দোয়া আল্লাহর কাছে করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যদি এই জ্বীনের দলটিকে তার কাছে পাঠিয়ে থাকেন এবং জ্বিনেরা যা যা করেছিলাে এবং স্বজাতির কাছে গিয়ে যা যা বলেছিলাে, তা যথাযথ অবহিত করে থাকেন, তবে এই ঘটনা ও তার এই বর্ণনা খুবই তাৎপর্যবহ মনে হয়। ঘটনার সময় যখনই হােক না কেন, এটি নিসন্দেহে অত্যন্ত শিক্ষণীয় ঘটনা। বিশেষত ইসলাম ও কুরআন সম্পর্কে জ্বিনদের বক্তব্য এখানে খুবই আকর্ষণীয়। এবারে আমি সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করবাে।
ফী জিলালিল কুরআন: সূরার প্রথম সাতটি আয়াত পড়ে যান। এখানে জ্বিনের যে দলটির কথা বলা হয়েছে তা তিন থেকে নয়জন হতে পারে। কারাে কারাে মতে তারা ছিলাে সাত জন। সূরার প্রারম্ভিক ভাষা থেকেই বুঝা যায় যে, জ্বিনেরা যে রসূল(স.) এর কোরআন পাঠ শুনেছিলাে এবং শােনার পর তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে, তা রসূল(স.) ওহীর মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলেন। ঘটনা রসূল(স.) ইতিপূর্বে জানতে পারেননি, তা আল্লাহই তাকে জানিয়েছেন। জিনদের কোরআন শ্রবণজনিত এই ঘটনা হয়তাে এটাই প্রথম ছিলাে। এরপর হয়তাে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকবে। রাসূল(স.) হয়তাে স্বেচ্ছায় তাদেরকে কোরআন পড়ে শুনিয়ে থাকবেন। রসূল(স.) কর্তৃক সূরা আর রাহমান পড়ার যে ঘটনা তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, তা থেকেও এরূপ মনে হয়। সেই হাদীসে হযরত জাবের(রা.) বলেন, রসূল(স.) একবার তার সাহাবীদের কাছে উপস্থিত হয়ে সম্পূর্ণ সূরা আর রাহমান পাঠ করলেন। শুনে সাহাবীরা কোনাে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। তখন রসূল(স.) বললেন, আমি এই সুরা জ্বিনদের সামনে পড়েছি। তারা এটি শুনে তােমাদের চেয়ে ভালাে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যখনই আমি পড়েছি ‘তবে তােমরা তােমাদের প্রতিপালকের কোনাে অনুগ্ৰহ অস্বীকার করবে?’ তখনি তারা বলে উঠেছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তােমার কোনাে অনুগ্রহই অস্বীকার করি না, তােমার প্রতি বরং আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।’ ইতিপূর্বে বর্ণিত ইবনে মাসউদের হাদীসও এ হাদীসের সমর্থন করে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এই সুরায় জিনদের যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, তা হুবহু সুরা আহকাফে বর্ণিত ঘটনা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমি একদল জিন কে তোমার দিকে পাঠিয়ে দিলাম যে কুরআন শুনে আসুক। তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে পরস্পরকে বললাে, নীরবে শুনতে থাকো। তারপর শােনা শেষ হলে তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে সাবধান করতে লাগলাে। তারা বললাে, হে আমাদের জনগণ! আমরা এক কিতাব শুনে এসেছি। মূসার পরে নাযিল হওয়া এ কিতাব তার কিতাবের সমর্থন করে এবং সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান দেয়। হে আমাদের জাতি। তােমরা আল্লাহর আহবানকারীর দাওয়াত গ্রহণ করো এবং তার ওপর ঈমান আনাে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আহ্বায়কের দাওয়াত গ্রহণ করে না, সে পৃথিবীতে অজেয় নয় এবং আল্লাহর মােকাবেলায় তার কোনাে বন্ধুও নেই। তারা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত।’ সূরা জ্বিনের মতাে এ আয়াতগুলো থেকেও মনে হয়, জ্বিনের আকস্মিকভাবেই কোরআনের আয়াত শােনার সুযােগ পেয়েছিলাে। এই আকস্মিকতা তাদেরকে অস্থির করে তুলেছিলাে, তাদের হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়েছিলাে, তাদের চেতনায় ও স্নায়ুতে প্রবল একটা ঝাকুনি দিয়েছিলোে, তাদের সমগ্র সত্তায় প্রচন্ড আবেগের সৃষ্টি করেছিলাে এবং সে আবেগে তাদের সত্তা কানায় কানায় বলে উপচে পড়েছিলাে। এরপর সেই ভাবাবেগে মত্ত মন নিয়েই তারা তাদের জাতির কাছে চলে গেল। এখন তাদের আবেগ উচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ যােগ্য ছিলাে না এবং তাদের মােটেই বিলম্ব সইছিলাে না। তারা যে আবেগ উদ্বেলিত, তা অন্যদের মধ্যেও একই গতিতে প্রবাহিত না করা পর্যন্ত তারা শান্ত হতে পারছিলাে না। আকস্মিকভাবে প্রথমবারের মতাে কোনাে প্রচন্ড অনুভূতি দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রত্যেকেরই এমন অবস্থা হয়। নিজের আবেগ অনুভূতিকে অন্যের ভেতরে সংক্রমিত করার জন্যে সে অধীর হয়ে ওঠে। ‘আমরা এক আশ্চর্য কোরআন শুনতে পেলাম।’ এ ছিলাে কোরআন সম্পর্কে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রথম অনুভূতি। তাদের মনে হয়েছিলাে, এ এক বিস্ময়কর কোরআন যা সচরাচর দেখা যায় না ও শােনা যায় না। হৃদয়ে তা প্রচন্ড বিস্ময় ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। খােলা মন, সচকিত অনুভূতি, সুস্থ ও অবিকৃত রুচি ও নির্মল ভাবাবেগ নিয়ে যে ব্যক্তিই কোরআন পড়ে বা শােনে, তার মনে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। কোরআনকে ‘বিস্ময়কর’ বলা হয়েছে তার প্রতি শ্রোতার স্বতস্ফূর্ত দূর্ণিবার আকর্ষণ, শ্রোতার ওপর কোরআনের অপ্রতিরােধ্য প্রভাব এবং শ্রোতার মন ও আবেগ-অনুভূতিতে শিহরণ সৃষ্টিকারী শ্রুতিমধুর ও ছন্দময় শব্দের জন্যে। কোরআনের আয়াত শুনে জিনের দলটি তার স্বাদে যেভাবে মাতােয়ারা হয়ে গিয়েছিলাে, তাতেও প্রমাণিত হয় যে, ‘কোরআন বাস্তবিক পক্ষেই বিস্ময়কর। সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান দেয়।’ এ হচ্ছে কোরআনের দ্বিতীয় বিশিষ্ট গুণ, যা জ্বিনের দলটি অনুভব করেছিলাে। এ গুণটির বাস্তবতা তারা তাদের অন্তরের অন্তস্থল দিয়ে হৃদয়ংগম করেছিলাে। ‘রুশদ’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবােধক। এর অর্থ দাঁড়ায়, কোরআন সত্য, ন্যায় ও সঠিক পথের সন্ধান দেয়। কিন্তু রুশদ’ শব্দটি শুধু সত্য ন্যায় ও সঠিক পথ পাওয়াকেই বুঝায় না, বরং আরাে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে সত্য, ন্যায় ও হেদায়াতের পথে স্থিতিশীলতা, পরিপক্কতা ও দৃঢ়তাকেও বুঝায়। ব্যক্তিগতভাবে যখন কেউ দ্বীনের জ্ঞান ও তার তাত্ত্বিক ও তথ্যগত বিষয়ে এতটা পারদর্শী হয় যে, তার ভেতরে আপনা-আপনি ও স্বতপ্রবৃত হয়ে ন্যায়পরায়ণ, কল্যাণকামী ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার যােগ্যতা ও প্রবণতা জন্মে, তখন সেই অবস্থাটাকেই রুশদ বলা হয়। এখানে প্রশ্ন হলাে কোরআন কিভাবে রুশদ বা হেদায়াত ও ন্যায়নিষ্ঠতার দিকে মানুষকে চালিত করে বা তার সন্ধান দেয়? এর জবাব এই যে, এ কাজটি সে মানুষের মনে ন্যায় ও অন্যায়ের ব্যাপারে তীব্র সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা জন্ম দেয় জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা, হেদায়াতের উৎসের সাথে সংযুক্ততা এবং আল্লাহর শরীয়তের প্রধান প্রধান আইন ও মূলনীতির সাথে তার স্বভাব চরিত্র ও মানসিকতার সমন্বয় গড়ে তােলে। তাছাড়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়নের জন্যে কোরআন যে নীতি, আদর্শ ও বিধান দেয় তার মাধ্যমেও সে এ কাজটি সম্পন্ন করে। কোরআনের দেয়া এই নীতি ও বিধান এতাে উঁচু ও উৎকৃষ্ট মানের যে, এর অধীনে মানব জাতি নিজের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে, নৈতিকতা, আচার ব্যবহারে ও লেনদেনে এক কথায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছিলাে। এতখানি উন্নতি, উৎকর্ষ, শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলাে যে, সমগ্র মানবেতিহাসে কোনাে সভ্যতা এবং কোনাে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে তা ততােটা সুখ সমৃদ্ধি ও উন্নতি কখনাে অর্জন করতে পারেনি।
ফী জিলালিল কুরআন: *জ্বীনদের ঈমান আনা : ‘তাই আমরা তার প্রতি ঈমান এনেছি।’ বস্তুত এটি হচ্ছে কোরআন শ্রবণের ফলে একটি বিকার মুক্ত, সুস্থ ও স্বাভাবিক বিবেক কর্তৃক তার দাওয়াতকে গ্রহণের শামিল। কোরআনের প্রতি ঈমান আনার ঘােষণা দিয়ে জিনরা তাদের বিবেকের এই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেছিলাে। তারা কোরআনের স্বাভাবিক দাবী এবং তার অন্তর্নিহিত সত্যকে মেনে নিয়েছিলাে। ওহীর মাধ্যমে এই দাবী কোরআনের শ্রোতা মুশরিকদের সামনে পেশ করা হচ্ছিল, অথচ তারা ঈমান আনছিলাে না। বরঞ্চ তারা কোরআনকে জ্বিনদের অবদান বলে আখ্যায়িত করছিলাে। তারা রসূল(স.)-কে জ্যোতিষী, কবি অথবা যাদুকর আখ্যায়িত করতাে। এই সব কটিই জ্বিনের প্রভাব থেকে উদ্ভূত । অথচ জ্বিনরা কোরআন শুনে এতাে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে গেলাে যে, তারা ঈমানের ঘােষণা না দিয়ে স্থির থাকতে পারলাে না, শুধু তাই নয়। তারা এ কথাও ঘােষণা করেছে ‘আমরা আমাদের প্রভুর সাথে কাউকে কখনাে শরীক করবো না।’ অর্থাৎ আমরা খালেছ ও নির্ভেজাল ঈমান এনেছি। এ ঈমান কোরআনের দাওয়াতের যথার্থ উপলব্ধির ফল। কোরআনে তাওহীদের আহবান জানিয়েছে, সেই তাওহীদ ভিত্তিক ঈমানে যেখানে শিরকের লেশমাত্রও নেই। ‘তিনি আমাদের অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন প্রতিপালক। তিনি কোনাে সন্তান বা স্ত্রী গ্রহণ করেননি।’ ‘জাদ্দ’ শব্দটির অর্থ ভাগ্য, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও পরাক্রম। এগুলাে নিছক শব্দের রকমফের মাত্র। আয়াতে এ শব্দ দ্বারা মােটামুটি এ কথাই বুঝানাে হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এতাে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যে, তার স্ত্রী বা সন্তান থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আরবরা মনে করতাে যে, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা। জ্বিন বংশােদ্ভুত স্ত্রীর গর্ভ থেকে আল্লাহ তায়ালা এই কন্যা সন্তান পেয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ) কিন্তু জ্বিনরা ঈমান এনে এই অলীক ও ভিত্তিহীন কুসংস্কার থেকে আল্লাহর পবিত্রতা ঘােষণা করলাে এবং উক্ত ধারণার প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার দিলাে। যদি এ ধারণার সত্যতার লেশমাত্রও থাকতাে, তাহলে আল্লাহর শ্বশুর কুলের আত্মীয় হবার গৌরব তারা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ করতাে। তার পরিবর্তে জ্বিনদের এই ঘােষণা মােশরেকদের অলীক ধ্যানধারণার ওপর একটি ভয়াবহ বােমার বিস্ফোরণ ঘটানাের সমতুল্য। যারা আল্লাহর সন্তান থাকার ধারণা বা তার সমপর্যায়ের কোনাে ধারণা না কোনাে উপায়ে লালন করে থাকে, তাদের সেই বাতিল ধারণার ওপর এ ঘােষণা এক প্রচন্ড মরণাঘাতস্বরূপ।
ফী জিলালিল কুরআন: *অজ্ঞ ও মূর্খ জ্বিনদের শিরকী আচরণ : ‘আমাদের মধ্যকার মূর্খ ও বখাটে লােকেরা আল্লাহ সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলতাে। আর আমরা ভাবতাম জ্বিন ও মানুষ কখনাে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরােপ করবে না?’ অজ্ঞ ও মূর্খ জ্বিনেরা আল্লাহর সাথে শিরক করতাে এবং তার স্ত্রী, সন্তান ও শরীক আছে বলে দাবী করতাে। তাদের সেই আচরণ সম্পর্ক ঈমান আনয়নকারী জিনরা এই মন্তব্য করে । কেননা কোরআন শ্রবণের পর তারা জানতে পারে যে, সেই দাবী ও ধারণা ভ্রান্ত । বরঞ্চ যারা এসব বলে তারা মুর্খ ও বােকা। কিন্তু এই মােমেন জিনরা ইতিপূর্বে তাদের এইসব বখাটে মূর্খদেরকে সমর্থন করতাে। কেননা তারা তখন ভাবতাে যে, কোনাে জ্বিন বা মানুষ আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যা বলতে পারে না। এ থেকে বুঝা গেলাে যে, আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যা আরােপ করাকে তারা অত্যন্ত মারাত্মক রকমের ধৃষ্টতা মনে করতাে। অসভ্য জ্বিনরা যখন প্রচার করলাে যে, আল্লাহর স্ত্রী ও সন্তান আছে, তখন তারা তাদের কথা বিশ্বাস করেছিলাে। কেননা তারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কখনাে মিথ্যা বলতে পারে তা ভাবতে পারেনি। আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরােপের ব্যাপারটাকে এতাে অবিশ্বাস্য ও ঘৃণ্য মনে করা জ্বিনদের এই দলটির একটি অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে ঈমান আনার যােগ্যতা সৃষ্টি করেছিলো। কেননা এ দ্বারা বুঝা যায় যে, তারা অত্যন্ত বিশুদ্ধ, নির্মল, অবিকৃত ও সুস্থ-স্বাভাবিক বিবেকের অধিকারী ছিলাে। নিছক সরলতা ও নিরীহ স্বভাবের কারণেই তারা বিপথগামী হয়েছিলাে। কিন্তু কোরআনের বাণী শােনার পর তাদের ভেতরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলাে, তারা ভালাে মন্দ বুঝতে ও বাছাই করতে শিখলাে, তাদের মধ্যে সঠিক রুচি ও জ্ঞানের স্ফূরণ ঘটলাে। তাই তারা ঘােষণা দিলাে, ‘আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শুনেছি, যা সত্য ও সততার পথ নির্দেশ করে, ফলে আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি। আমরা আর কখনাে আমাদের প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করবাে না। আমাদের প্রভু অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন। তিনি কোনাে স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেননি।’ সত্য সম্পর্কে জ্বিনদের মধ্যে সৃষ্ট এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সেইসব বিভ্রান্ত শীর্ষস্থানীয় কোরায়শ নেতাদের মন সম্বিত ফিরিয়ে আনতে পারতাে। তাদের হৃদয়ে সতর্কতা ও সচেতনতার সৃষ্টি করতে পারতাে। মুহাম্মদ(সা.) যা বলেন এবং কোরায়শ নেতারা যা বলে, তার মধ্যে কোনটি সঠিক, সে ব্যাপারে অনুসন্ধিৎসা ও কৌতুহল জাগিয়ে তুলতে পারতাে। কোরায়শদের বড় বড় নেতারা যা বলে, তার ওপর স্থাপিত অন্ধ বিশ্বাসকে তা বিচলিত করে দিতে পারতো। সুরা জিনে এ সত্যটিকে এভাবে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যও ছিল তাই। তাই বলা যেতে পারে যে, সূরার এ অংশটি আসলে কোরআন ও বিদ্রোহী কোরায়শের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বের একটি স্তর বিশেষ এবং জাহেলিয়াতের সৃষ্টি করা ধ্যান-ধারণা ও অনাচারের পর্যায়ক্রমিক প্রতিকারের একটি ধাপ মাত্র। এ সব ধ্যান-ধারণায় আক্রান্তদের অনেকেই ছিলাে নিরীহ কিন্তু বিভ্রান্ত অজ্ঞ ও মূর্খ নেতাদের অন্ধ অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের অনেকেই অনুসৃত বিভ্রান্তি কুসংস্কার ও অলীক ধ্যান ধারণার শিকার ছিলাে।
ফী জিলালিল কুরআন: *জ্বীনদের কাছে আশ্রয় চাওয়া বাতুলতা মাত্র : মানুষের মধ্য থেকে কিছু লােক জিনদের মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতো, কিন্তু তারা তাদের দুর্দশা আরো বাড়িয়ে দিতাে। এ উক্তিটির মধ্য দিয়ে জ্বীনরা এমন একটি প্রথার দিকে ইংগিত দিয়েছে, যা জাহেলী যুগেও প্রচলিত ছিলাে এবং আজও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। সেই প্রথাটি হলাে, পৃথিবীর ওপর ও মানুষের ওপর জিনদের এক ধরনের আধিপত্য রয়েছে বলে ধারণা করা। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষতি ও উপকার করার ক্ষমতাও তাদের আছে এবং পৃথিবীর স্থল ভাগ, সমুদ্র ও মহাশূন্যের অনেক জায়গায় তাদের কর্তৃত্ব চলে বলেও ধারণা করা হয়। এ সব ধারণার দরুণ লােকেরা কোনাে জনমানবহীন প্রান্তরে বা অজানা স্থানে রাত হয়ে গেলে সেখানকার অদৃশ্য সরকারের কাছে তার অসভ্য ও উচ্ছৃঙ্খল প্রজাদের কবল থেকে নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করতে বাধ্য হতাে। তারপর তারা নিজ নিজ ধারণা ও বিশ্বাস মােতাবেক নিরাপদে রাত কাটাতে সক্ষম হতাে। আল্লাহ তায়ালা যাকে বিশেষ অনুগ্রহ বলে রক্ষা করেছেন ও নিরাপত্তা দিয়েছেন, তার কথা স্বতন্ত্র। নচেৎ প্রত্যেক আদম সন্তানের হৃদয়ের ওপর শয়তান আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। যে ব্যক্তি শয়তানের দিকে ঝুকে পড়ে শয়তান তার কোনাে উপকার করে না, সে বরং তার দুশমন। সে কেবল তাকে কষ্ট দেয় ও দুর্দশাগ্রস্ত করে। উপরােক্ত ভ্রান্ত জাহেলী প্রথাটির কথাই জিনরা এ আয়াতে উল্লেখ করেছে। যে দুর্দশার কথা এ আয়াতে বলা হয়েছে, তা দ্বারা সম্ভবত, গােমরাহী, মানসিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হয়রানীকে বুঝানাে হয়েছে। শয়তানের ঘনিষ্ঠতা অর্জনকারীরা এ সব বিপর্যয়ের শিকার হয়ে থাকে। কেননা যিনি যথার্থই এ সব আপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন তার আশ্রয় তারা চায় না। অথচ আদি পিতা আদম(আ.)-এর আমল থেকেই মানুষকে শয়তান থেকে এবং সব রকমের আপদ বিপদ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সেই সময় থেকেই মানুষ ও ইবলিসের মধ্যে যে শক্রতার সৃষ্টি হয়েছে, তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ যখন কোনাে উপকারের আশায় কিংবা কোনাে ক্ষতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে আশ্রয় চায়, তখন সে হয়রানী ও উদ্বেগ ছাড়া আর কিছুই পায় । কোনাে শান্তি ও স্থীতি তার কপালে জোটে না। এটাই তার চরম দুর্দশা ও বিপর্যয়। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সব কিছুই পরিবর্তনশীল ও স্থীতিহীন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর যার সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করা হবে তার কাছ থেকে স্থীতিহীনতা, অস্থিরতা ও নিত্য পরিবর্তনশীলতা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। ভয় ও আশার দোলায় সর্বদা দোদুল্যমান থাকতে হবে। যার ওপর কেউ নিজের আশা-আকাংখাকে নির্ভরশীল করবে, সে সরে যাওয়ার সাথে সাথেই তার আশা-ভরসাস্থলও পাল্টে যাবে। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই এর ব্যতিক্রম। তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তার ভেতরে কখনাে পরিবর্তন আসে না। যে ব্যক্তি তার দিকে মুখ ফিরায় এবং তার ওপর নির্ভরশীল হয় সে অপরিবর্তনীয়, স্থীতিশীল ও অচল অটল কেন্দ্রের সাথে নিজেকে যুক্ত করে। ‘তোমরা যেমন ভেবেছিলে যে আল্লাহ তায়ালা কোনাে নবী কখনাে পাঠাবেন না, তারাও তেমনি ভাবে।’ অর্থাৎ এই জিনের দলটি নিজেদের লােকদের সাথে আলােচনা প্রসংগে বলে যে, মানুষের মধ্যে যারা জ্বিনদের আশ্রয় প্রার্থনা করতাে তারা তােমাদের মতােই মনে করতাে যে, আল্লাহ তায়ালা কোনাে রসূল পাঠাবেন না। কিন্তু এই তাে তিনি রসূল পাঠিয়েছেন। তার সাথে এই সত্য ও ন্যায়ের দিকনির্দেশনা সম্বলিত কোরআনও পাঠিয়েছেন। কিংবা এর মর্ম এই যে, তারাও তােমাদের মতােই ভাবতাে যে, আখেরাত এবং হিসাব নিকাশ বলতে কিছুই নেই। তাই আখেরাতের জন্যে তারা কোনাে কাজও করেনি। আখেরাতে যা যা হবে বলে রসূল(স.) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাকেও তারা মিথ্যা মনে করেছিলাে। কেননা ইতপূর্বে তারা এ সব কথায় বিশ্বাস করতাে না। উপরােক্ত দুটো ধারণার যেটিই গৃহীত হােক না কেন, বাস্তবের সাথে তার কোনােই মিল নেই। এ ধারণা নিরেট অজ্ঞতাপ্রসূত। মানুষকে সৃষ্টি করার পেছনে আল্লাহর যে মহৎ ও সুগভীর উদ্দেশ্য রয়েছে, তা উপলব্ধি না করার কারণেই এ ধারণার জন্ম হয়েছে। তিনি মানুষকে ভালাে মন্দ এবং সততা ও অসততা উভয়ের যােগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই সূরা থেকে আমরা জানতে পারি যে, জিনদেরও এরূপ দ্বৈত যােগ্যতা রয়েছে। তবে ইবলিস এর ব্যতিক্রম। সে শুধু অন্যায় ও অসৎ কাজেই নিজেকে নিয়ােজিত করেছে এবং আল্লাহর প্রত্যক্ষ নাফরমানীর কারণে আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত হয়ে নিজেকে নিরেট খারাপ কাজের যােগ্য করে তুলেছে। অন্যদের মতো ভালো ও মন্দ কাজের দ্বৈত যােগ্যতা তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় অনুগ্রহের বশে সেই সব মানুষকে নবী দ্বারা সহায়তা করার সিন্ধান্ত নিলেন। নবীরা তাদের মনে ভালাে কাজের যােগ্যতাকে জোরদার করবেন এবং তাদের ভেতরে জন্মগতভাবে যে সৎকাজের প্রবণতা ও যােগ্যতা নিহিত রয়েছে তাকে সংরক্ষণ করবেন। সুতরাং তাদের কাছে আল্লাহ তায়ালা কখনাে নবী পাঠাবেন না এমন কথা বিশ্বাস করার কোনাে অবকাশ নেই। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যাবে কেবল তখনই, যখন ‘বা’স’ শব্দের অর্থ হবে নবী প্রেরণ। কিন্তু যদি এর অর্থ ধরা হয় আখেরাতের পুনরুজ্জীবন ও পুনরুত্থান, তাহলে সেটিও অনিবার্য ও অবধারিত মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির কাছ থেকে তার পূর্ণ হিসাব নিকাশ ইহলৌকিক জীবনে গ্রহণ করেন না। এর পেছনে অবশ্য আল্লাহর কি মহৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, তা তিনিই ভালাে জানেন। সৃষ্টির সমন্বয় ও শৃংখলা বিধানের স্বার্থেই হয়তাে তিনি এরূপ ব্যবস্থা করেছেন, যা তিনিই জানেন, আমরা জানি না আল্লাহ তায়ালা স্বীয় সৃষ্টির কাছ থেকে পরিপূর্ণ হিসাব নেয়ার জন্যে আখেরাতে তাদের পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে প্রত্যেক সৃষ্টি তার পার্থিব জীবনের কাজকর্মের উপযােগী ফল পাবে। সুতরাং এই অর্থের দিক থেকে আয়াতের ব্যাখ্যা হবে এই যে, আল্লাহ তায়ালা কাউকে পুনরুজ্জীবিত করবেন না এরূপ ধারণা করার অবকাশ নেই। কেননা এরূপ ধারণা আল্লাহর সর্বোচ্চ বিচক্ষণতা ও কর্মকুশলতায় বিশ্বাস স্থাপনের পরিপন্থী। আলোচ্য আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জিনের এই দলটি তাদের স্বজাতির ভ্রান্ত ধারণা সংশােধনের চেষ্টা চালিয়েছিলাে। আর কোরআন তাদের উক্তি উদ্ধৃত করে এ দ্বারা মােশরেকদের ধারণা অপনােদন করতে চেয়েছে।
সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১১
وَّ اَنَّا مِنَّا الصّٰلِحُوْنَ وَ مِنَّا دُوْنَ ذٰلِكَ١ؕ كُنَّا طَرَآئِقَ قِدَدًاۙ
আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে নেককার আর কিছু লোক আছে তার চেয়ে নীচু পর্যায়ের। এভাবে আমরা বিভিন্ন মতে বিভক্ত ছিলাম।
ফী জিলালিল কুরআন:
*জ্বীনদের ঊর্ধ্ব জগতের খবর শােনা প্রসঙ্গ : এরপর জ্বিনরা বিশ্ব প্রকৃতির বিভিন্ন স্থানে রাসূল(স.)-এর রিসালাতের যে সব লক্ষণ দেখেছে, তার বিবরণ দেয়া অব্যাহত রেখেছে। কেননা তারা এই রিসালাত সংক্রান্ত আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয় এমন যে কোনাে চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে চায়। তারা কোনাে অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী যেমন করতে চায় না, তেমনি ওহীর কার্যক্রমে তাদের কোনাে হাত বা ক্ষমতা থাকার দাবী করা থেকেও বিরত থাকতে চায়। ‘আমরা আকাশকে স্পর্শ করেছি…’ এখানে পরপর তিনটি আয়াতে কোরআন জ্বিনদের উক্তি থেকে যে তথ্যগুলাে তুলে ধরেছে তা থেকে মনে হয় যে, জ্বিনেরা সম্ভবত হযরত ঈসা(আ.) ও মােহাম্মদ(স.)-এর রিসালাতের মধ্যবর্তী সময়ে উর্ধজগতের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের চেষ্টা করতাে। এই যােগাযােগের মাধ্যমে তারা ফেরেশতাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বসমূহ নিয়ে তাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা চলতাে তা আড়ি পেতে শুনতাে। পৃথিবীতে অবস্থানরত আল্লাহর বিভিন্ন সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহর সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে ফেরেশতারা পারস্পরিক আলাপ আলোচনা করতেন। জ্বিনরা সেগুলাে আড়ি পেতে শুনে পৃথিবীতে তাদের যেসব অভিভাবক রয়েছে, সেসব জ্যোতিষী ও ভবিষ্যৎ বক্তাদেরকে তা জানাতাে। আসলে তারা প্রকৃত সত্যের অতি সামান্য অংশই পেত এবং তার সাথে বিপুল পরিমাণে মিথ্যা মিশিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচার করতাে। উল্লিখিত দুই রিসালাতের মধ্যবর্তী যুগে যখন পৃথিবীতে কোনাে নবী রসূল ছিলেন না-এই জঘন্য কারসাজি তারা বিস্তার করে রেখেছিলাে। কিভাবে এই আড়ি পাতা ও তথ্য পাচারের অপচেষ্টা চলতাে, কোরআন সে বিষয়ে আমাদেরকে কোনাে বিস্তারিত তথ্য দেয়নি এবং আমাদের তার প্রয়ােজনও নেই। এর মােদ্দাকথা এটাই এবং সার্বিক তথ্য এতােটুকুই। আর এই জ্বিন দলটি জানাচ্ছে যে, সেই আড়ি পেতে শােনার কাজটি এখন আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ‘যখনই তারা এই চেষ্টা করতে চেয়েছে’ অর্থাৎ তাদের ভাষায় আকাশকে স্পর্শ করতে গেছে, দেখেছে যে, আকাশের দিকে যাওয়ার পথ সম্পূর্ণরূপে প্রহরীদের দখলে। যে কেউ আকাশের কাছে কাছে যায়, অমনি জ্বলন্ত উল্কার তীর মারা শুরু হয় এবং তা কাছে ঘেঁষা জিনকে হত্যা করে। তাই এখন আর জিনদের পক্ষে মানুষের জন্যে কি ভাগ্য নির্ধারিত আছে, তা জানার কোনাে উপায় নেই। অদৃশ্যের কোনাে কিছুই তাদের জানা সম্ভব নয় । ‘আমরা জানি না পৃথিবীবাসীর জন্যে কোনাে অকল্যাণ নির্ধারিত হয়েছে, না তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোনাে শুভ কামনা করা হয়েছে।’ বস্তুত এই অদৃশ্য জ্ঞান আল্লাহ তায়ালার সম্পূর্ণ একচেটিয়া। তিনি ছাড়া আর কেউই তা জানেন না। আল্লাহ তার বান্দাদের জন্যে কি ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন তা তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। তিনি কি তাদের জন্যে অকল্যাণ নির্ধারণ করেছেন এবং তাদেরকে তাদের গােমরাহীতে চিরদিনের জন্যে রেখে দিতে চেয়েছেন, না তাদের জন্যে হেদায়াত লাভের সৌভাগ্য নির্ধারণ করেছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, এ আয়াতে অকল্যাণের মােকাবেলায় রাখা হয়েছে হেদায়াত তথা ন্যায় ও সত্যের পথ প্রাপ্তিকে, কেননা এটিই প্রকৃত কল্যাণ, এর পরিণামও শুভ। যেহেতু জিনরাই ছিলাে জ্যোতিষীদের স্বকথিত অদৃশ্য জ্ঞানের উৎস, তাই জিনরা যখন স্বীকার করলাে যে তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তখন তাদের কোনাে ভবিষ্যদ্বাণী এবং কোনাে দাবীর আর কোনাে ভিত্তি রইলাে না। সবই বাতিল ও মিথ্যা বলে পরিগণিত হলো, এরপর মূলত জ্যোতিষ শাস্ত্রের কোনাে অস্তিত্বই থাকা উচিত নয় । অদৃশ্য জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহর আয়ত্তহীন। এ সম্পর্কে আর কারো কিছু জানার দাবী করা বা ভবিষ্যদ্বাণী করা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কোরআন এ ধরনের যাবতীয় আন্দায অনুমান ভিত্তিক ধ্যান ধারণা ও কথাবার্তা থেকে মানুষের বিবেককে মুক্তি দেয়ার কথা ঘােষণা করেছে। মানুষকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে সত্য ও ন্যায় পথের সন্ধান দিয়েছে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আকাশের কোথায় কোথায় পাহারা বসানাে হয়েছে, কারা পাহারা দিচ্ছে, শয়তান ও জিনদেরকে কিভাবে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড দিয়ে আঘাত করে বিতাড়িত করা হচ্ছে, তাহলে এসব প্রশ্নের জবাব আমরা দিতে পারবাে না। কেননা কোরআন ও হাদীস এ ব্যাপারে নীরব। অথচ কোরআন ও হাদীস ছাড়া এই অদৃশ্য তথ্য আর কোনাে সূত্র থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা যদি এ তথ্যটুকু জানাতে আমাদের কোনাে উপকার হবে জানতেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই কোরআন ও হাদীসের মাধ্যমেই তা আমাদেরকে জানাতেন। তা যখন তিনি জানাননি, তখন এই পথে আমাদের সকল চেষ্টা বৃথা যেতে বাধ্য। সে চেষ্টা আমাদের জ্ঞানও বাড়াবে না, আমাদের জীবনেরও কোনাে কল্যাণ বা উপকার সাধন করবে না। ঝুলন্ত উল্কাপাত নিক্ষেপের ব্যাপারেও আপত্তি বা তর্ক তােলার অবকাশ নেই। প্রাকৃতিক নিয়মের এ প্রক্রিয়া ওহী আগমনের আগেও চলতাে, পরেও চলবে। এর পেছনে কি কি কার্যকারণ রয়েছে, তা বিশ্লেষণের চেষ্টায় মহাশূন্য বিজ্ঞানীরা এখনাে ব্যস্ত রয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা অনেক মতামত ব্যক্ত করেছেন, যার ভেতরে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ উভয় রকমের তথ্যই আছে। এ সব বৈজ্ঞানিক মতবাদকে যদি নির্ভুলও ধরে নেয়া যায়, তবুও এ বিষয়টি আমাদের আলােচনার আওতায় আসে। এসব উল্কাপিন্ড আল্লাহর ইচ্ছায় এমনভাবেও পড়তে পারে যে, তাতে শয়তানরা বিতাড়িত হয়, আবার এমনভাবেও পড়তে পারে যাতে তাদের কোনাে ক্ষতি হয় না। যারা মনে করে যে, এ সকল বর্ণনা নিছক রূপক ও প্রতীকী এবং আল্লাহর ওহীকে সব প্রকারের বাতিলের স্পর্শ মুক্ত রাখা হয়েছিলাে এটা বুঝানাের জন্যেই এসব বর্ণনা দেয়া হয়েছে, এখানে এর বাহ্যিক ও শাব্দিক অর্থ গ্রহণযােগ্য নয়-তাদের এ ধরনের অভিমতের কারণ এই যে, তারা কোরআনের শরনাপন্ন হয় নিজেদের পূর্ব নির্ধারিত মতামত নিয়ে, যেসব মতামত তারা কোরআন ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে গ্রহণ করেছে। তারপর সেই সব পূর্ব নির্ধারিত মতামতের আলােকে তারা কোরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। এজন্যে তারা ফেরেশতাকে নিছক কল্যাণের প্রতীক এবং শয়তানকে অকল্যাণের প্রতীক শক্তি হিসাবে বিবেচনা করে আর উল্কা নিক্ষেপ করে শয়তান বিতাড়নের অর্থ দ্বারা ওহীর হেফাযত বুঝে। কেননা কোরআনের মুখােমুখি হওয়ার আগে তাদের মন-মগযে শয়তান, জ্বিন, ফেরেশতা ইত্যাদি সম্পর্কে এরূপ কিছু ধারণাই বদ্ধমূল ছিলাে যে, এ সবের আসলে কোনাে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব নেই এবং এগুলাের এ ধরনের কোনাে অনুভবযোগ্য তৎপরতা বা প্রভাবও নেই। তারা এসব ধ্যান ধারণা ও মতামত কোথায় পেলাে এবং এর আলােকে কোরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা করার স্পর্ধাই বা তাদের কেমন করে হয়, উৎসুক মনের তা সত্যিই জানতে ইচ্ছা করে। *কুরআন বুঝার সর্বোত্তম পন্থা : মানুষের জন্যে কোরআন, তার তাফসীর এবং ইসলামী আকীদা, আদর্শ ও বিধানকে বুঝার সর্বোত্তম পন্থা এই যে, মানুষকে তার মন-মগযে চেপে থাকা আগের সকল ধ্যান-ধারণা ঝেড়ে মুছে ফেলতে হবে। তাকে কোরআনের মুখােমুখি হতে হবে পূর্ববর্তী সকল ধ্যান ধারণা, চিন্তাধারা, মতবাদ, মতাদর্শ ও আবেগ তাড়িত কিংবা বুদ্ধি নির্ভর মতামত ও সিদ্ধান্তকে বাদ দিয়ে তথা সম্পূর্ণভাবে তার প্রভাব মুক্ত হয়ে । কোরআন বিশ্বজগত সংক্রান্ত যে তথ্যাবলী পেশ করেছে অবিকল তারই অনুরূপ করে তাকে তার যাবতীয় মতামত ও সিদ্ধান্তকে গড়ে নিতে হবে। তাই কোরআন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে কোরআন ও হাদীসকে বিচার করা যাবে না। আবার কোরআন যে সকল জিনিসের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে বা যাকে বাতিল ঘােষণা করেছে, তার অস্তিত্ব স্বীকার করা যাবে না এবং তাকে ন্যায়সংগত মনে করা যাবে না। বিবেক বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার আলােকে স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করা যাবে শুধু সেই বিষয়ে, যার পক্ষে বা বিপক্ষে কোরআন কোনাে বক্তব্য দেয়নি। স্বভাবতই আমাদের এ বক্তব্য শুধু তাদের জন্যে, যারা কোরআনে বিশ্বাসী হয়েও কোরআনের বক্তব্যকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ও ইনিয়ে বিনিয়ে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে, যাতে কোরআন তাদের মন-মগযে আগে থেকে বিরাজিত স্থিরীকৃত মতামত ও ধ্যান ধারণার অনুকূল হয়ে যায়। সেই ধ্যান ধারণায় বিশ্বজাহান ও তার বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য যেমন হওয়া উচিত বলে তারা মনে করে, কোরআনকে তারা তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে চায় ।(আমি নিজেও এ পর্যায়ে পুরােপুরি দোষমুক্ত নই। আমার একাধিক রচনায় ইতিপূর্বে আমি নিজেও এ ধরনের পদস্খলনের শিকার হয়েছি। সে সব বই-এর পরবর্তী সংস্করণে আমি এসব ভুল শুধরে নেয়ার আশা রাখি। এখানে আমি যে বক্তব্য পেশ করছি, তা আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে সত্য হেদায়াতের উৎস থেকে উৎসারিত-গ্ৰন্থকার) কিন্তু যারা কোরআনে বিশ্বাসী নয় এবং কোরআনের উপস্থাপিত তথ্য ও ধারণা বিশ্বাসকে এমনিই অস্বীকার করে তাদের ক্ষেত্রে একথা প্রজোয্য নয়। তাদের একমাত্র যুক্তি এই যে, এসব তত্ত্ব ও তথ্য নাকি বিজ্ঞানের ধরা ছােয়ার আওতার মধ্যেই রয়েছে এবং যাকে সে তার পরীক্ষাগারে ব্যবহারও করে চলেছে, সে সব বস্তু ও পদার্থের গুপ্ত রহস্য সে জানে না। কিন্তু তাই বলে সে সব বস্তু ও পদার্থের অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনাে যুক্তি নেই। উপরন্তু আজকাল অধিকাংশ বিজ্ঞানী ধার্মিক লােকদের মতােই অজানা বিষয়গুলােকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে ‘যা জানিনা তা মানিনা’ এই নীতি তারা এখন আর অনুসরণ করছে না। কারণ তারা বিজ্ঞানের চিরাচরিত নিয়মেই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেদের চারপাশে এমন সব বস্তুর সমাবেশ দেখতে পায়, যা তাদের একেবারেই অজানা। অথচ ইতিপূর্বে তাদের ধারণা ছিলাে যে ওসব জিনিস সম্পর্কে তাদের সব কিছুই জানা হয়ে গেছে। এ কারণে তারা অত্যন্ত ভদ্রজনােচিত ভাবে বিজ্ঞান সম্মত বিনয় প্রকাশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের ভেতরে কোনাে ব্যাপারেই জোর গলায় কিছু দাবী করার প্রবণতা যেমন নেই, তেমনি অজানা বিষয়ে মন্তব্য করার ধৃষ্টতাও নেই। অথচ বিজ্ঞানের পান্ডিত্য এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা গবেষণার দাবীদাররা তাদের অজানা তত্ত্ব ও ধর্মীয় বিষয়কে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য দেখায়। আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক জগত অগণিত অজানা রহস্যে পরিপূর্ণ। এখানে রয়েছে অসংখ্য আত্মা ও শক্তির সমাবেশ। অন্যান্য সূরার মতাে কোরআনের এ সূরাটিও আমাদের সামনে এই বিশাল প্রাকৃতিক জগতের বহু অজানা রহস্য উন্মােচন ও তথ্য উদঘাটন করে। সেসব তথ্য আমাদেরকে বিশ্বজগত, তার অভ্যন্তরে বিরাজিত জীবন, আত্মা ও শক্তিসমূহ সম্পর্কে সঠিক ও বিশুদ্ধ ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এসব জীবন আত্মা ও শক্তি ব্যবহারিক দিক থেকে আমাদের জীবন ও সত্তার সহায়ক, সহযােগী ও পরিপূরক। প্রকৃতি সম্পর্কে কোরআনের দেয়া এসব তথ্য ও ধারণা-বিশ্বাস একজন মুসলমানকে আরেক জন অমুসলিম থেকে পৃথক করে। *আন্দাজ অনুমান নয় কোরআন ও সুন্নাহই জ্ঞানের উৎস : কোরআন জানায় যে, আন্দায অনুমান ও অলীক ধ্যান-ধারণায় অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন এবং বিজ্ঞানের দোহাই পেড়ে যে কোনাে অজানা জিনিসকে অবিশ্বাস করার ধৃষ্টতা-এই দুই চরমপন্থার। ঠিক মাঝখানে মুসলমানের অবস্থান। মুসলমানের সকল জ্ঞান, চিন্তা ও কর্মের উৎস কোরআন ও সুন্নাহ। এই দুই দিগদর্শনের আলােকেই তাকে সকল চিন্তা, বক্তব্য ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিচার করতে হবে। এ কথা সত্য যে, অজানা রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপারে মানবীয় বিবেক বৃদ্ধির একটা ভূমিকা ও বিচরণ ক্ষেত্র রয়েছে। ইসলাম মানুষকে এই বিচরণ ক্ষেত্রে পরিভ্রমণে উৎসাহিতও করে। কিন্তু এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরে এতাে বিশাল ও বিস্তীর্ণ জগত রয়েছে, যা বিচরণ ও পরিভ্রমণ করা তার বিবেক বুদ্ধির সাধ্যাতীত। সেটা তার প্রয়ােজন নেই বলেই তাকে তার সাধ্যাতীত রাখা হয়েছে। পৃথিবীতে আল্লাহর খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনে যে কাজের প্রয়ােজন নেই, সে কাজের তাকে ক্ষমতাও দেয়া হয়নি, তাকে এসব কিছুর ব্যাপারে সাহায্যও করা হবে না। কেননা এ ব্যাপারে সাহায্য করার কোনাে যুক্তিই নেই। এটা তার দায়িত্বের আওতাভুক্তও নয়। মানুষ তার আশপাশের পরিবেশ, প্রতিবেশী এবং জীবজগত ও জড়জগতের বিচারে কোনাে পর্যায়ে আছে, তা জানার জন্যে যতােটুকু অদৃশ্য জ্ঞান অপরিহার্য, তা তাকে অবহিত করার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। জ্ঞান অর্জন করা তার নিজের শক্তি সামর্থের বাইরে। এই জ্ঞান যে পরিমাণে দিলে মানুষের শক্তি সামর্থের আওতায় থাকবে, সেই পরিমাণেই তাকে দিয়ে থাকেন। সেই অত্যাবশ্যকীয় পরিমাণ অদৃশ্য জ্ঞান হচ্ছে ফেরেশতা, শয়তান, আত্মা এবং জীবনের উৎস ও পরিণতি সংক্রান্ত জ্ঞান। যারা আল্লাহর হেদায়াত দ্বারা চালিত হন, তারা অদৃশ্য সংক্রান্ত বিষয়ে ঠিক ততােটুকু জেনেই ক্ষান্ত থাকেন, যতােটুকু আল্লাহ তাঁর কিতাবের মাধ্যমে ও রাসূলের মুখ দিয়ে জানিয়েছেন। এই জ্ঞান দ্বারা তারা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব তার সৃষ্টির নিগুঢ় রহস্য এবং পৃথিবীতে বিরাজমান বিভিন্ন জীবজগত ও জড়জগতের মােকাবেলায় মানুষের যথার্থ স্থান ও মর্যাদা নির্ণয়ে সক্ষম হন। এই জ্ঞান দ্বারা তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ সাধনে ও আবিষ্কার উদ্ভাবনে সাধ্যমত প্রয়ােগ করেন, চাই তা পৃথিবীর চৌহদ্দীর ভেতরেই হােক অথবা পৃথিবীর চারপাশের মহাশূন্যে বিরাজমান বিভিন্ন বস্তু ও জ্যোতিস্কে হােক। সর্বোপরি এই গুণকে তারা পৃথিবীতে নানারকম উন্নয়ন, উৎপাদক ও গঠনমূলক কর্মকান্ডে এবং আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালনে প্রয়ােগ করেন। আর এ সব কিছুই তারা আল্লাহর নির্দেশে ও আল্লাহরই অনুগত বান্দা হিসাবে আঞ্জাম দিয়ে থাকেন এবং এভাবেই তারা এক সময় সমগ্র সৃষ্টিজগতের শীর্ষে উন্নীত হন। *গােমরাহী দুই শ্রেণীতে বিভক্ত : যারা আল্লাহর হেদায়াত দ্বারা চালিত হয় না, তারা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত, একটি শ্রেণী তার সীমিত বিবেক বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহর সীমাহীন সত্তা সম্পর্কে এবং অদৃশ্য তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে আল্লাহর ওহীর জ্ঞান বহির্ভূত পন্থায় জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হয়। এই শ্রেণীর মধ্যে কিছুসংখ্যক দার্শনিক রয়েছেন, যারা প্রাকৃতিক জগতের ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বস্তু ও শক্তির ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন। তারা আকাশচুম্বী পর্বত শৃংগে আরােহনরত শিশুর মতাে অনবরত পদস্খলনেরই শিকার হয়েছেন। সৃষ্টির দুর্জেয় রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে তারা প্রাথমিক সাফল্যও লাভ করতে পারেনি। বড় বড় দিকপাল দার্শনিক হয়েও তারা এমন হাস্যোদ্দীপক মতবাদ পেশ করেছেন যে, তা ভাবতেও লজ্জা লাগে। জগত ও জীবন সম্পর্কে তাদের ধ্যান-ধারণা, মতবাদ ও চিন্তাধারাকে যখন কোরআনের দেয়া সুস্পষ্ট, সহজ সরল ও নির্মল নিখুঁত ধারণার সাথে তুলনা করা হয়, তখন বাস্তবিকই তাকে হাস্যকর মনে হয়। বিশেষত, যে বিশাল বিশ্বজগতের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে তারা সেসব মতবাদের সাহায্য নিয়েছেন ও তা উদ্ভাবন করেছেন, সেই মহাবিশ্বের বিশালতার সামনে সেই মতবাদগুলাের সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্র ও অসংগতি দেখে একজন সাধারণ পাঠকেরও হাসি পায়। আমি এই দার্শনিকদেরকে ব্যতিক্রমী মনে করছি না। প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা ও ইসলামী চিন্তাধারার মধ্যে যখন তুলনা করা হয়, তখন এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। অপর শ্রেণীটি জ্ঞান সাধনার এই পথটির সাফল্য সম্পর্কে হতাশ হয়ে নিজেকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রয়ােগের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং নানা অজানা বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানাে থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছে যে, বিজ্ঞানের হাতে অজানা বিষয়কে জানার কোনাে উপায় নেই। তারা এ ক্ষেত্রে আল্লাহর পথনির্দেশনা থেকে কোনাে সাহায্য নেবে না বলে স্থির করেছে। কেননা তারা জানে যে, বিজ্ঞান দ্বারা আল্লাহর সন্ধান পাওয়া যায় না। এই শ্রেণীটি অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে সর্বোচ্চ উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধন করেছিলাে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তারা তাদের বৈজ্ঞানিক একগুঁয়েমি থেকে মুক্ত হয়ে এরূপ মতবাদও প্রচার করতে শুরু করে যে, পদার্থ অদৃশ্য হয়ে এমন এক আলােক রশ্মীতে পরিণত হয় যার নিগুঢ় পরিচয় অজ্ঞাত এবং যার নিয়মবিধিও প্রায় অজ্ঞাত থেকে যায়। চূড়ান্ত বিচারে ইসলামই একমাত্র সুনিশ্চিত ও সংশয়মুক্ত আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। অজ্ঞাত বিষয় থেকে সে মানুষকে শুধুমাত্র প্রয়ােজনীয় পরিমাণে জ্ঞান দান করে এবং নিষ্প্রয়ােজন জ্ঞান চর্চায় বিবেক বুদ্ধির অপচয় করার পরিবর্তে তাকে পৃথিবীতে খেলাফাতের দায়িত্ব পালনের কাজে ব্যবহারের জন্যে সংরক্ষণ করে। সে মানুষের বিবেককে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করে এবং জানা ও অজানা উভয় ক্ষেত্রেই তা সবচেয়ে মজবুত নীতি অনুসরণ করে। *জ্বীনের আকিদা বিশ্বাস : পরবর্তী আয়াত এগুচ্ছে জ্বিন দলটি আল্লাহর বিধান সম্পর্কে তাদের নীতি ও অবস্থান বিশ্লেষণ করেছে। এই বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষের মতােই তাদের স্বভাব প্রকৃতিতে হেদায়াত ও গােমরাহী বা সততা ও অসততা উভয়ের যােগ্যতা বিদ্যমান। তারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের আকীদা বিশ্বাস ব্যক্ত করেছে এবং হেদায়াত গ্রহণকারী ও বিপথগামী উভয়ের পরিণতি ব্যাখ্যা করেছে। ‘আমাদের মধ্যে সৎ লােকও আছে অসৎ লােকও আছে… গােমরাহ লােকেরা হবে জাহান্নামের জ্বালানী।’ একমাত্র ইবলীস ও তার সহযােগী, যারা অসৎ কর্ম ও পাপাচারের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলাে, তারা ছাড়া সমগ্র জিন জাতিই যে মানুষের মতাে সৎ ও অসৎ এবং মুসলমান ও অমুসলমান উভয়ই হতে পারে, সে কথাই এই আয়াত কয়টিতে পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে। এ বিবরণ জ্বিনদের সম্পর্কে আমাদের ভ্রান্ত ধারণা সংশােধনের একান্ত সহায়ক। আমাদের ভেতরে অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তিরা পর্যন্ত মনে করে জ্বিনরা শুধু দুষ্কর্মেই লিপ্ত থাকে এবং একমাত্র মানুষই সততা ও অসততা উভয় প্রকার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রকৃতি, তার বিভিন্ন বস্তু ও প্রাণী সম্পর্কে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত মতামত থেকেই এই ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। কোরআন আগমনের পর এই ধারণাকে কোরআনের বিশুদ্ধ চিন্তাধারার আলােকে পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্গঠন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। ‘আমাদের মধ্যে সৎ লােকও আছে, অসৎ লােকও আছে।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জ্বিনরা তাদের একটা সাধারণ বর্ণনা পেশ করেছে। আমরা বিভিন্ন পথের অনুসারী ছিলাম। অর্থাৎ আমাদের ভেতরে বহু দল, শ্রেণী ও ফের্কা ছিল
সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১৩
وَّ اَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدٰۤى اٰمَنَّا بِهٖ١ؕ فَمَنْ یُّؤْمِنْۢ بِرَبِّهٖ فَلَا یَخَافُ بَخْسًا وَّ لَا رَهَقًاۙ
আর আমরা যখন হিদায়াতের বানী শুনলাম তখন তার প্রতি ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তিই তার রবের ওপর ঈমান আনবে তার অধিকার বিনষ্ট হওয়ার কিংবা অত্যাচারিত হওয়ার ভয় থাকবে না।
ফী জিলালিল কুরআন:
*জ্বিনদের নানামূখী অক্ষমতা : পরবর্তী আয়াতে জ্বিনেরা ঈমান আনার পর তাদের পরিবর্তিত চিন্তাধারার বর্ণনা দিয়েছে যে, আমরা বিশ্বাস করি যে, ‘আল্লাহকে আমরা কখনাে পর্যদুস্ত করতে পারবাে না এবং তার কাছ থেকে পালিয়ে আমরা তাকে অসহায়ও করে দিতে পারবাে না।’ অর্থাৎ তারা স্বীকার করছে যে, পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান, মহাপরাক্রান্ত ও অজেয়। আর তারা আল্লাহর আধিপত্যের বাইরে পালিয়ে যেতে সক্ষম নয় । অর্থাৎ তারা পৃথিবীতে অবস্থান করেও আল্লাহকে দুর্বল ও অক্ষম করতে পারে না, পৃথিবী থেকে অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়েও নয়। বিশ্ব প্রভুর সামনে তার বান্দা ও সৃষ্টি জ্বিনের এই অক্ষমতা এবং আল্লাহর সর্বাত্মক আধিপত্য ও পরাক্রমের এই অনুভূতিই এ আয়াতটির সারকথা । মজার ব্যাপার এই যে, এহেন অক্ষম ও হীনবল জ্বিনের কাছে এক শ্রেণীর মানুষরা নিরাপত্তা চাইতাে ও নিজেদের অভাব ও দারিদ্র থেকে মুক্তি চাইতাে। আর এদের সাথেই কিনা মােশরেকরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর বৈবাহিক সম্পর্ক কল্পনা করতাে! অথচ জ্বীনরা নিজেদেরকে অক্ষম ও আল্লাহকে সর্বশক্তিমান বলে জানে ও স্বীকার করে। এদ্বারা তারা শুধু স্বগােত্রীয় জ্বিনদের নয় বরং মানুষের ভেতরে যারা মােশরেক ও কাফের তাদেরও আকিদা বিশ্বাস শুধরাতে সাহায্য করে। পরবর্তী আয়াতে জিনরা হেদায়াতের আহ্বান শােনার পর তাদের তা মেনে নেয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে, ‘আমরা যখন হেদায়াতের বাণী শুনলাম তখন তার প্রতি ঈমান আনলাম।’ বস্তুত কোরআন শুনার পর প্রত্যেক মানুষেরই তার ওপর ঈমান আনা কর্তব্য হয়ে দাড়ায়। জ্বিনরা এখানে তাদের ভাষায় কোরআনকে ‘হুদা’ তথা পথনির্দেশনা-অন্যকথায় হেদায়াতের বাণী বলেছে। কোরআনের প্রকৃত পরিচয় এটাই। এটা কোরআনের আহবানের ফলও। এরপর তারা আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও এ বিশ্বাসের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে তার কোনাে ক্ষতি ও দুর্দশার আশংকা নেই।’ আল্লাহর ন্যায়বিচার, তার সীমাহীন শক্তি ও প্রতাপ এবং ঈমানের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে যে ব্যক্তি নিশ্চিত, তার এরূপ আস্থা হওয়াই স্বাভাবিক। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা ন্যায় বিচারক, তাই তার প্রতি ঈমান আনয়নকারীর এ অধিকার তিনি নষ্ট করবেন না এবং তার ওপর তিনি তার ক্ষমতার অতিরিক্ত বােঝাও চাপাবেন না। আর যেহেতু আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান, তাই অচিরেই তিনি তার মােমেন বান্দাকে সকল রকমের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করবেন এবং সাধ্যাতীত দায়িত্বের বােঝা থেকেও তিনি তাদের রক্ষা করবেন। আর মােমেন যখন আল্লাহর তত্ত্বাবধানে ও প্রহরায় আছে, তখন কে তাকে ঠকাবে? কে তার ক্ষতি সাধন করবে এবং কে তার ওপর অতিরিক্ত বােঝা চাপিয়ে জুলুম করবে? এ কথা সত্য যে, মােমেনকে কখনাে কখনাে দুনিয়ার কোনাে কোনাে স্বার্থ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। কিন্তু এটা আসলে তার কোনাে ক্ষতি নয়। কেননা যে জিনিস থেকে সে বঞ্চিত হয় তার এমন বদলা সে পায় যে সেই বঞ্চনা আর তার বন্ধ থাকে না। মােমেন কখনাে কখনাে দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসিবতেও ভােগে সত্য, কিন্তু এ বিপদ শেষ পর্যন্ত তার বিপদ-মুসিবত বা দুঃখ কষ্ট থাকে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দান করেন যে, তা দ্বারা সে আরাে উপকৃত হয় ও বৃহত্তর মর্যাদা লাভ করে। তাছাড়া আল্লাহর সাথে তার গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার কষ্টকে সহজ করে দেয় এবং সেই মুসিবতকে তার দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের উৎসে পরিণত করে। বস্তুত মােমেন ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদ মসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে মানসিক নিরাপত্তা লাভ করে। ‘তার কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদ মসিবতের আশংকা থাকে না।’ এই নিরাপত্তাবোেধ তাকে পরম মানসিক শান্তি ও স্বস্তি এনে দেয় এবং তা স্বাভাবিক শান্ত পরিস্থিতি যতােক্ষণ বিরাজ করে ততােক্ষণ অব্যাহত থাকে। সে কখনাে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবন যাপন করে না। তাই যখন বিপদাপদ আসে তখন অস্থির ও বেসামাল হয়ে যায় না, ভয় পায় না এবং হতাশাগ্রস্ত হয় না। বিপদ মুসিবতকে সে পরীক্ষা মনে করে, যাতে ধৈর্য ধারণ করলে পুরস্কার পাওয়া যায়। আবার আল্লাহর কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাইলে তাতেও পুরস্কার পাওয়া যায়। এই দুই অবস্থার কোনােটিতেই সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এবং নিজেকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত মনে করে না। বস্তুত মােমেন জিনেরা অত্যন্ত সত্য কথাই বলেছে।
ফী জিলালিল কুরআন: *মানুষের মতো তারা ভালো মন্দে মিশানাে : ‘অতপর জ্বিনের মধ্যে মুসলমানও আছে, যালেমও আছে। যারা মুসলমান হয়েছে, তারা সুপথ খুঁজে নিয়েছে। আর যারা যালেম তারা জাহান্নামের জ্বালানী হবে।’ ‘কাসিতুন’ শব্দের অর্থ যারা যুলুম নিপীড়নকারী এবং ইনসাফ ও সততার পথ থেকে যারা বিচ্যুত। ঈমান আনয়নকারী জ্বিন দলটি এখানে যালেম ও অত্যাচারী জ্বিনদেরকে মুসলিম জিনদের প্রতিপক্ষ হিসাবে উল্লেখ করেছে। এ বক্তব্য এই মর্মে সূক্ষ্ম ইংগিত বহন করছে যে, মুসলমান ন্যায়বিচারকও সংস্কার প্রয়াসী হয়ে থাকে আর অত্যাচারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা হয় মুসলমানের বিপরীত পক্ষের লোক। তাহাররাউ অর্থ খুঁজে পেয়েছে। এ শব্দটির প্রয়ােগ থেকে এই মর্মে ইংগিত পাওয়া যায় যে, ইসলামের সন্ধান লাভের অর্থই হচ্ছে সততা ও ন্যায়ের পথ অন্বেষণে নিষ্ঠা ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি প্রয়ােগ করা। গােমরাহীর পথ হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। ওটা খুঁজে পেতে তেমন নিষ্ঠা ও সুক্ষ্ম দৃষ্টি প্রয়ােজন হয় না। কেননা গােমরাহী সহজলভ্য। বস্তুত, ইসলাম গ্রহণের অর্থই হলাে জীবন যাপনের বিশুদ্ধ ও নির্ভুল পথ অনুসন্ধান করা এবং সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করার পর স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা। চোখ কান বুজে, না বুঝে, না শুনে কোনাে কিছু গ্রহণ করা নয়। জ্বিন দলটি বুঝাতে চেয়েছে যে, যারা স্বেচ্ছায় ইসলামকে গ্রহণ করেছে, তারাই সঠিক বিশুদ্ধ ও নির্ভুল পথ লাভ করেছে। ‘যালেমরা জাহান্নামের জ্বালানী হবে’ কথাটার তাৎপর্য এই যে, তাদের ব্যাপারে এটা চূড়ান্তভাবে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামের জ্বালানী হবে। জ্বালানী পেয়ে আগুন যেমন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, জাহান্নাম তাদেরকে পেয়ে তেমনি জ্বলে উঠবে। এ আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, জ্বিনরা জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হয়ে শাস্তি ভােগ করবে। আর এ কথা থেকে অনিবার্যভাবে এটাও বুঝা যায় যে, তারা বেহেস্তের নেয়ামতও উপভােগ করবে। এটা কোরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন উক্তি। কোরআন থেকেই আমরা আমাদের চিন্তাধারা ও মতামত গ্রহণ করি। কাজেই এরপর কোরআন বহির্ভূত কোনাে দর্শনের ধুয়া তুলে জিনের প্রকৃতি, আগুনের প্রকৃতি ও বেহেস্তের প্রকৃতি নিয়ে কোনাে কথা বলার অধিকার কারাে নেই। আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন, তা অবিসংবাদিত ও অকাট্য সত্য। আর জ্বিনদের বেলায় যা প্রযােজ্য, মানুষের বেলায়ও তা প্রযােজ্য। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার নবীর মুখ দিয়েই এসব উক্তি করিয়েছেন। ওহীর মাধ্যমে জ্বিনদের উক্তি হুবহু ও প্রত্যক্ষভাবে উদ্ধৃত করার পালা এখানে শেষ হয়েছে। এরপর জ্বিনদের বক্তব্যের হুবহু উদ্ধৃতি দেয়ার বদলে তার সার সংক্ষেপে দেয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। যারা আল্লাহর দৃঢ়তা ও অবিচলতা প্রদর্শন করে তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা কিরূপ আচরণ করে থাকেন, সে সম্পর্কে জ্বিনদের উক্তির এ সার সংক্ষেপ দেয়া হচ্ছে। এখানে জিনদের ভাষা নয়-বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘তারা যদি আল্লাহর পথে অবিচল থাকতাে তাহলে আমি তাদেরকে পর্যাপ্ত পানি পানকরতাম…’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, মােমেন জিনদের এই দলটি আমার সম্পর্কে এই মর্মে মন্তব্য করেছিলাে যে, সাধারণ মানুষ কিংবা উল্লেখিত যুলুমবাজ লােকেরা যদি সত্য ও সততার পথে অবিচল থাকতাে এবং জুলুম ও অসদাচরণে লিপ্ত না হতাে, তাহলে আমি তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দিতাম, ফলে তাদের প্রচুর জীবিকা ও সমৃদ্ধি লাভ হতাে। আর এই সমৃদ্ধি দিতাম এ জন্যে যেন তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারি যে, তারা আল্লাহর নেয়ামতে শােকর করে, না নাশােকরী করে। প্রথমে জ্বিনদের কথার হুবহু উদ্ধৃতি এবং তারপর সেই ধারা পরিবর্তন করে তাদের বক্তব্যের সংক্ষেপ তুলে দেয়া অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। যে পর্যায়ে এসে কথার পালাবদল হয়েছে, তাতে একটি অংগীকারকে সরাসরি আল্লাহর অংগীকার হিসাবে দেখানাে সম্ভব হয়েছে। এদিক থেকে এ বিষয়ে এই পরিবর্তিত বাকরীতি অধিকতর স্বার্থক ও তাৎপর্যবহ হয়েছে। কোরআনের বাচনভংগীতে এ ধরনের পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। বক্তব্যকে অধিকতর জীবন্ত ও জোরদার করা এবং কঠোরতর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা এর অন্যতম লক্ষ্য হয়ে থাকে। আলােচ্য আয়াতে মােমেনের আকীদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে বিরাজমান পরিবেশ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের আলোকে গঠন করার জন্যে কতিপয় অত্যাবশ্যকীয় তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পয়লা তথ্য এই যে, জীবন যাপনের যে নির্ভুল, বিশুদ্ধ পথ ও পদ্ধতি মানুষকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছিয়ে দিতে তথা তাঁর সন্তোষ নিশ্চিত করে দিতে সক্ষম, সেই পথ ও পদ্ধতি অবিচলভাবে ও অব্যাহতভাবে জাতিসমূহ ও মানব গােষ্ঠীসমূহ কর্তৃক অনুসরণ এবং পার্থিব প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি লাভ এ দুটি জিনিসের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও এরা উভয়ে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। প্রাচুর্য সমৃদ্ধির উপকরণসমূহের সাথেও জীবন যাপনের সঠিক পথ অনুসরণের অনুরূপ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সমৃদ্ধির সর্বপ্রধান উপকরণ হচ্ছে পানির প্রবাহ ও প্রাচুর্য । শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এবং জীবিকা ও সমৃদ্ধির জন্যে কৃষি আর একমাত্র উৎস হিসাবে বহাল নেই, এখনাে পানির প্রবাহের ওপর সুখ ও সমৃদ্ধি পুরােমাত্রায় নির্ভর করছে। বলতে গেলে, পানি আজও মানব সভ্যতা ও মানববসতির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। সত্য ও ন্যায়ের নির্ভুল পথে অবিচল থাকা ও পার্থিব জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধির মাঝে এই অবিচ্ছেদ্য ও ওতপ্রােত সম্পর্ক একটা চিরন্তন সত্য ও শাশ্বত বাস্তবতা। আরবরা মরুভূমির মধ্যে কষ্টকর জীবন যাপন করতাে। যখনই তারা সত্য ও ন্যায়ের সােজা ও নির্ভুল পথে প্রতিষ্ঠিত হলাে, অমনি পৃথিবীতে তাদের জন্যে পানির প্রবাহ ও খাদ্যের প্রাচুর্যের অবারিত দুয়ার খুলে গেলাে। তারপর পুনরায় যেই তারা বিপথগামী হলাে, অমনি তাদের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য কেড়ে নেয়া হলাে। যতােদিন তারা সেই সত্য ও ন্যায়ের পথে ফিরে আসবে না, ততােদিন তাদের এই দুঃখ দুর্যোগ অব্যাহত থাকবে। সৎপথে ফিরে আসা মাত্রই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালিত হবে এবং তাদের দুঃখ পৃথিবীর সকল এলাকাতেই পানির ওপর সব কিছুর জীবন নির্ভরশীল। আজকের যুগেও যখন দুর্দশা ঘুচে যাবে। এ কথা সত্য বটে যে, কিছু কিছু জাতি এমনও রয়েছে যারা আল্লাহর পথে বহাল নেই, তথাপি তাদের বিত্ত বৈভব ও প্রাচূর্য রয়েছে। কিন্তু সেই জাতিগুলাে তাদের মনুষ্যত্বে, নিরাপত্তায়, মানবীয় মান মর্যাদায় ও মূল্যবােধে নানা রকমের দুর্যোগের শিকার হয়ে চলেছে। এ সব দুর্যোগের কারণে তাদের প্রাচুর্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে এবং তা তাদের কাংখিত সুখ শান্তি দিতে পারেনি। সে সব দেশে মানুষের জীবন মানবতার জন্যে, নৈতিকতার জন্যে, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে এবং মানব সুলভ মর্যাদার জন্যে ভয়াবহ অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। (সূরা নূহ-এ এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।) এ আয়াতটি থেকে দ্বিতীয় যে তথ্যটি পরিস্ফূট হচ্ছে, তা এই যে, সুখ সমৃদ্ধিও আলাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি তােমাদেরকে সুখ ও দুঃখ উভয়টি দিয়েই পরীক্ষা করে থাকি।’ সত্য বলতে কি, বিপদ মসিবতে ধৈর্য ধারণের চেয়ে সুখ ও প্রাচুর্যে ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর শােকর আদায় করা ও আল্লাহর নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করা অনেক বেশী কঠিন ও দুর্লভ। অথচ আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, বিপদে ধৈর্য ধারণই কঠিনতর। এমন লােক অনেক রয়েছে যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং দৃঢ়তা ও অবিচলতার প্রমাণ দেয়। চেতনা ও প্রেরণা সক্রিয় থাকে এবং আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনার যে ধারা চলতে থাকে, তাই কল্যাণে বিপদ আপদে সকল সহায় টুটে গেলে আল্লাহর সহায়তার আশার ওপর ভর করে মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু সুখ ও সমৃদ্ধি মানুষকে একেবারে আত্মহারা ও আত্মভােলা করে দেয়। স্নায়ুমন্ডলকে শিথিল করে দেয় ও হৃদয়ে বিদ্যমান প্রতিরােধের শক্তিগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে নিস্তেজ করে দেয়। সুখ সর্বদাই মানুষের সুযােগ ও অবসরকে সম্পদের বড়াই করা ও শয়তানের সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করতে প্ররােচিত করে। সুখ সাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরী। একমাত্র এভাবেই বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সম্পদের প্রাচুর্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মানুষকে অকৃতজ্ঞ ও অহংকারী বানানাের পাশাপাশি তাকে অপব্যয়ী অথবা কৃপণও বানিয়ে ছাড়ে। শেষােক্ত এই দুটো দোষই মানুষের জন্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আবার সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে অকৃতজ্ঞ ও অহংকারী বানানাের পাশাপাশি অত্যাচারী, স্বৈরাচারী, গায়ের জোরে অন্যায়ভাবে মানুষের অধিকার গ্রাসকারী এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিসগুলাের ওপর আক্রমণ ও আগ্রাসন পরিচালনাকারীতে পরিণত করে। সৌন্দর্য ও একটি নেয়ামত। অনেক সময় এই নেয়ামত মানুষকে অতিমাত্রায় আত্মাভিমানী ও বিপথগামী বানিয়ে দেয় এবং পাপের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করে। আর মেধার নেয়ামত প্রায়ই মানুষকে অহংকারী বানিয়ে দেয় এবং অন্যদেরকে ও প্রতিষ্ঠিত মূল্যবােধকে তাচ্ছিল্য করতে প্ররােচিত করে। এককথায় বলা যায়, আল্লাহর প্রত্যেক নেয়ামতেই কোনো না কোনো বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। কেবলমাত্র যে ব্যক্তি সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করে তাকেই আল্লাহ তায়ালা এ সব বিপদাশংকা থেকে রক্ষা করেন। তৃতীয় তথ্য হচ্ছে এই যে, সুখ ও সমৃদ্ধিজনিত অহংকারের দরুণ মানুষের স্মরণে শৈথিল্য ও উপেক্ষা প্রদর্শন অনিবার্যভাবে আল্লাহর আযাবকে ডেকে আনে। আয়াতে আযাবের বিশেষণ হিসাবে ‘সায়াদান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ উর্ধে আরােহন। কিন্তু এখানে এর অর্থ কষ্টকর। উর্ধে আরােহন কষ্টকর বিধায় এ শব্দটি দ্বারা প্রতীকি অর্থে কষ্টকর বুঝানাে হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘সায়াদা’ ধাতু থেকে কষ্টকর ও দুরূহ অর্থ বুঝানাে একটি সাধারণ বাকরীতি। যেমন সূরা আরাফের একটি আয়াতে রয়েছে, আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান ইসলামের জন্যে তার বক্ষ উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে বিপথগামী করতে চান তার বক্ষকে এতাে সংকীর্ণ ও সংকুচিত করে দেন যে, সে যেন আকাশে আরােহন করেন।(আয়াত ১২৫) সূরা মুদ্দাসসির ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তাকে উর্ধে আরােহন করতে বাধ্য করবাে।’ অর্থাৎ আযাব ভােগ করাবাে। বস্তুত উর্ধে আরােহন কেমন কষ্টকর কাজ, তা সহজেই বােধগম্য। আর সুখ সমৃদ্ধি দ্বারা পরীক্ষা করা কষ্টকর আযাব ভােগ করানাের মধ্যে যে বৈপরীত্য বিদ্যমান তাও অত্যন্ত স্পষ্ট।
সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১৯
وَّ اَنَّهٗ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللّٰهِ یَدْعُوْهُ كَادُوْا یَكُوْنُوْنَ عَلَیْهِ لِبَدًا٢ؕ۠
আর আল্লাহর বান্দা যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন তারা সবাই তার ওপর হামলা করতে উদ্যত হলো।
ফী জিলালিল কুরআন:
*মাথা নত হবে শুধু আল্লাহর সামনে : পরবর্তী আয়াতটি জ্বিনদের উক্তির উদ্ধৃতিও হতে পারে, আবার মৌলিকভাবে আল্লাহর উক্তিও হতে পারে। ‘মসজিদগুলাে আল্লাহর, কাজেই আল্লাহর সাথে আর কাউকে ডেকো না।’ উক্তিটা আল্লাহর হােক আর জ্বিনেরই হােক, উভয় অবস্থাতেই এর মর্ম এই যে, সিজদা অথবা সিজদার স্থান মসজিদ একমাত্র আল্লাহর। কেননা সিজদার অবস্থায় এবং মসজিদে নির্ভেজাল তাওহীদ বিরাজ করে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে কিছুর ছায়াও সেখানে দেখা যায় না। সেখানকার পরিবেশ শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যকে ডাকার অর্থ অন্যের এবাদাত করা, অন্যের আশ্রয় বা নিরাপত্তা চাওয়া অথবা অন্যের জন্যে হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করা। আয়াতটিকে যদি জিনদের উক্তি ধরা হয় তাহলে তা হবে তাদের পূর্ববর্তী উক্তি ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করবাে না’ এর সমার্থক। অর্থাৎ আমরা এবাদাত ও সিজদার স্থানে কাউকে শরীক করবাে না আর যদি মৌলিকভাবে আল্লাহর উক্তি হয়, তাহলে তা হবে জ্বিনদের তাওহীদবাদী উক্তির সমর্থনে উচ্চারিত বাক্য। আল্লাহর এ ধরনের সমার্থক উচ্চারণ কোরআনের একটি সাধারণ রীতি। অনুরূপভাবে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন আল্লাহর বান্দাহ আল্লাহকে ডাকতে উদ্যত হয়, তখন কাফেররা তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ার উপক্রম করে।’ অর্থাৎ যখন সে নামায পড়ার উদ্যোগ নেয়, তখন কাফেররা সবাই একযাগে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়তে উদ্যত হয়, আর নামায মূলত দোয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। উপরােক্ত আয়াতটি যদি জ্বিনদের উক্তি হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে তাদের পক্ষ থেকে দেয়া আরবের পৌত্তলিকদের আচরণের একটি বিবরণ। কেননা রসূল(স.) যখন নামায পড়তেন, কিংবা কোরআন অধ্যয়ন করতেন, তখন কাফেররা দলে দলে এসে তার চারপাশে সমবেত হতাে এবং তাকে বিব্ৰত করতাে। সূরা মায়ারিজে এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কাফেররা কি পেয়েছে যে, তােমার দিকে ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে দলে দলে ধেয়ে আসছে?’ অর্থাৎ তারা গ্রহণ করার জন্যে নয় বরং নিছক কৌতুহল বশে শােনার ভান করে এবং উত্যক্ত ও বিরক্ত করার জন্যে সমবেত হয়। অতপর আল্লাহ তাকে তাদের উৎপাত থেকে রক্ষা করেন। এ ধরনের ঘটনা বহুবার সংঘটিত হয়েছে। উল্লেখিত আয়াতটি জ্বিনদের উক্তি হয়ে থাকলে প্রশ্ন জাগে যে, স্ব-জাতিকে দাওয়াত দেয়ার সময় জিনেরা এ কথা তাহলে কি উদ্দেশ্যে বলেছে? এর জবাব এই যে, এ কথা তারা মােশরেকদের এই আচরণের প্রতি যুগপৎ বিষয় ও নিন্দা প্রকাশের জন্যেই বলে থাকবে। পক্ষান্তরে এটি যদি মৌলিকভাবে আল্লাহর উক্তি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে ইসলাম গ্রহণকারী জ্বিন দলটির কর্মকান্ডের বিবরণ বলে ধরে নিতে হবে। তারা এই বিস্ময়কর কোরআন শুনে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছিলাে এবং রসূল(স.)-এর কাছে তারা একে অপরের গায়ে গায়ে লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাে। যেহেতু জিনদের কথাগুলাে সামগ্রিকভাবে বিস্ময়বিমূঢ় অভিভূত হওয়ার একটা চিত্র তুলে ধরে, তাই উক্ত প্রেক্ষাপটে আয়াতটির এই ব্যাখ্যাই সম্ভবত অধিকতর সমীচীন। জিনের উক্তি উদ্ধৃত করার পালা শেষে রাসূল(স.)-কে সম্বােধন করে কথা বলা শুরু হয়েছে। জ্বিনদের বক্তব্য ছিলাে কোরআন সম্পর্কে ও ইসলামের দাওয়াত সম্পর্কে। ইসলামের এই দাওয়াত ছিলাে তাদের কাছে অভিনব। এ দাওয়াত তাদের স্মায়ুতে শিহরন তুলেছিলাে। তাদেরকে জানিয়েছিলাে যে, সমগ্ৰ আকাশ, পৃথিবী, ফেরেশতা ও নক্ষত্ররাজি এই দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে তাদেরকে জানিয়েছিলাে যে, সমগ্র বিশ্ব জাহানের বিধি ব্যবস্থা আল্লাহর এই বিধান অনুসারেই চলে।
ফী জিলালিল কুরআন: *রসূল (স.)-এর প্রতি আল্লাহর আদেশ : রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে যে বক্তব্য দেয়া শুরু হয়েছে তা প্রধানত, তাবলীগ ও দাওয়াত সংক্রান্ত, তাকে বলা হয়েছে যে, দাওয়াত ও তাবলীগ ছাড়া তার আর কোনাে কাজ নেই, কোনাে অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী তুলে মানুষের ভাগ্য বেচাকেনার পসরা সাজানাে তার কাজ নয়। সূরার দ্বিতীয় রুকুর শুরু থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত নব পর্যায়ের এই ভাষণ বিস্তৃত রয়েছে। এর প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোহাম্মদ, তুমি বলাে, আমি শুধু আমার প্রতিপালককেই ডাকি এবং তার সাথে কাউকে শরীক করি না।’ লক্ষণীয় যে, ইতিপূর্বে জ্বিনদের যে ঘােষণাটি উদ্ধৃত হয়েছে তা ছিল এই, ‘আমরা কখনাে আমাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করবাে না।’ বস্তুত এ ঘােষণার স্বাদ এবং প্রভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। কেননা এটা জ্বিন ও মানুষের সম্মিলিত ঘােষণা। পৌত্তলিকরা বা অন্য কেউ এ ঘােষণায় একমত না হলে তাদেরকে গােটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। পরবর্তী আয়াতে রসূল(স.) কে পুনরায় আদেশ দেয়া হচ্ছে যে, ‘তুমি বলো, আমি তােমাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ঘটানাে বা সুপথ দেখানাের ক্ষমতা রাখি না।’ অর্থাৎ দাওয়াত ও তাবলীগ ছাড়া আর সব কিছু থেকে তুমি নিজেকে গুটিয়ে নাও। যেসব বিষয় একমাত্র আল্লাহর আয়ত্তাধীন, তার সবকিছু থেকে তুমি তােমার হাতকে গুটিয়ে নাও। কেননা একমাত্র আল্লাহই সকল কল্যাণ-অকল্যাণ, শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ ও লাভ-ক্ষতির মালিক। আল্লাহ তায়ালাই এখানে ক্ষয়ক্ষতির বিপক্ষে ‘রুশদ’ শব্দটি রেখেছেন। এর অর্থ হেদায়াত বা সুপথ প্রাপ্তি। ইতিপূর্বে জ্বিনদের একটি উক্তিতেও একইভাবে ‘রুশদ’ বা ‘রাশাদ’ শব্দটির প্রয়ােগ হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আমরা জানি না, বিশ্ববাসীর জন্যে কোনাে অকল্যাণ কামনা করা হয়েছে না সুপথ প্রাপ্তি।’ তাই দেখা যাচ্ছে, দুটো উক্তিই ভাব ও ভাষা উভয় দিক দিয়ে পরস্পরের সাথে সংগতিপূর্ণ। ঘটনায় ও ঘটনা সংক্রান্ত মন্তব্যে এ ধরনের ভাষা ও ভাবের মিল কোরআনের একটি বহুল প্রচলিত রীতি। এই উক্তি ও পূর্বোক্ত মর্ম অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবে জ্বিনকে ও রসূল(স.) -কে লাভক্ষতি ও শুভাশুভের ব্যাপার থেকে সম্পূৰ্ণরূপে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বিশেষত জিনদের ব্যাপারে এ বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাদের এ জাতীয় ক্ষমতা আছে বলে ধারণা করা হতাে। এ আয়াতে এতদসংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে। আর এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট অটল ও অনড় বিশ্বাস রাখার ওপর ঈমানের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি বলাে আমাকে আল্লাহ তায়ালা থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবং তার কাছে ছাড়া আর কারাে কাছে আমি নিরাপদ আশ্রয় পাবাে না। তবে আল্লাহর বাণী যদি আমি পৌছাতে থাকি তবে…’ এই উক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথাটা দ্বারা যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, আল্লাহর এই দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগ কতখানি গুরুত্ববহ কাজ। রাসূল(স.)-কে এই মর্মে ঘােষণা দিতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহর হাত থেকে আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবং আমি তার কাছে ছাড়া আর কোথাও নিরাপত্তা পাবাে না, তবে যদি এই দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করি এবং এই আমানতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকি, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। বস্তুত এই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজই একমাত্র রক্ষাকবচ ও রক্ষাব্যুহ। এটাই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় । দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজটি আমার কাজ নয়। আমার কাজ শুধু তা প্রচার করা । এ আদেশ পালন না করলে আল্লাহর হাত থেকে আমাকেও কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবং দাওয়াত ও প্রচারের কাজ না করলে আমি কোনাে নিরাপত্তা ও আশ্রয় পাবে না। এ উক্তির ভেতরে যে কি সাংঘাতিক ধরনের হুঁশিয়ারী সংকেত দেয়া হয়েছে তা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। এটা দাওয়াতকারীর জন্যে কোনাে ঐচ্ছিক বা নফল কাজ নয়। এটা তার জন্যে অত্যন্ত কঠোর বাধ্যতামূলক কাজ। এ কাজ না করে তার পালাবার উপায় নেই। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার তদারকী ও প্রহরায় নিয়ােজিত রয়েছেন। মানুষের কাছে হেদায়াত ও কল্যাণের বাণী পৌছানাে কোনাে ব্যক্তিগত অভিরুচি ও স্বাদ আহলাদের ব্যাপার নয়। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত একটি গুরু দায়িত্ব। এতে ইতস্তত করা বা একে উপেক্ষা করার কারাে অবকাশ নেই। সুতরাং দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের গুরুত্ব নাই। আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের নাফরমানী করবে, তার জন্যে রয়েছে চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুন। অবশেষে যখন তারা প্রতিশ্রুত কর্মফল দিবস দেখবে, তখন জানা যাবে সাহায্যকারীর দিক দিয়ে কে বেশী দুর্বল এবং কার জনবলের সংখ্যা অল্প। বস্তুত, দাওয়াত ও তাবলীগের এই আদেশ জানার পরও যে ব্যক্তি নাফরমানী করে, তার জন্যে এ আয়াতে রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ হুমকি ও হুঁশিয়ারী। যেহেতু মােশরেকরা বস্তুগত শক্তি ও সংখ্যার ব্যাপারটাকে বেশী গুরুত্ব দিতে এবং তাদের শক্তির সাথে মুহাম্মদ(স.)-এর ক্ষুদ্র ঈমানদার জনশক্তির তুলনা করতাে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, দুনিয়াতেই হােক বা আখেরাতেই হােক, প্রতিশ্রুত হিসাব নিকাশের আয়ােজন যখন দেখবে তখন টের পাবে কে সাহায্যকারী হিসেবে বেশী দুর্বল এবং কার জনসংখ্যা কম। তখন বুঝতে পারবে, দুই পক্ষের কে বেশী দুর্বল ও অক্ষম। এই পর্যায়ে এসে জিনদের উক্তিগুলাের দিকে নযর বুলালে দেখা যায় সেখানেও এ ধরনের একটি উক্তি রয়েছে, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, পৃথিবীতে আমরা কখনাে আল্লাহকে পর্যদুস্ত ও পরাভূত করতে পারবাে না এবং কখনাে পালিয়ে আল্লাহকে অক্ষম করে দিতে পারবাে না। এখানেও দেখতে পাই ঘটনার সাথে ঘটনার পর্যালােচনার ভাষাগত মিল ও সমন্বয় রয়েছে। আমরা এও দেখতে পাই যে, ঘটনাটা পর্যালোচনার ভূমিকা রচনা করেছে এবং পর্যালােচনাটাও ঠিক উপযুক্ত ও নির্ধারিত সময়ে এসেছে।
ফী জিলালিল কুরআন: এর পর রসূল(স.)-কে পুনরায় আদেশ দেয়া হচ্ছে, যেন তিনি অদৃশ্য সংক্রান্ত বিষয় থেকে নিজের হাত গুটিয়ে আনেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! তুমি বলাে, তােমাদেরকে যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে, তা কি আসন্ন হয়ে পড়েছে, না তার জন্যে আমার প্রভু সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এখানে যে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে তা এই যে, তিনি ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনের মালিক-মােক্তার নন এবং এতে তার কোনাে ব্যক্তিগত স্বার্থও নেই। শুধুমাত্র অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্যে এবং নিজের জন্যে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিশ্চিত করার খাতিরে তা জনগণের কাছে পৌছানাে ও প্রচার করা তার পবিত্র কর্তব্য। এই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় লাভ করা তাগলীগের কাজ করা ছাড়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে কাফেররা তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করার দরুণ যে আযাবের হুমকির সম্মুখীন সেটাও আল্লাহর দেখার বিষয়, রসূল(স.)-এর এতে কোনাে হাত নেই, অার তিনি এর কোনাে নির্দিষ্ট সময়ও জানেন না, চাই সেটা দুনিয়ার আযাব হােক কিংবা আখেরাতের আযাব। গােটা ব্যাপারটা অদৃশ্য জ্ঞানের আওতাভুক্ত। এ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর আছে। রসূল(স.)-এর এ সম্পর্কে কিছুই জানা নেই এবং এ ব্যাপারে তাঁর কোনাে হাতও নেই। *গায়ব জানেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই : তিনিই অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তার অদৃশ্য জ্ঞান তিনি কাউকে জানান না। রসূল(স.) আল্লাহর বান্দা হওয়া ছাড়া আর কোনাে গুণ বৈশিষ্ট্যর অধিকারী নন। তার প্রধানতম পরিচয় হচ্ছে তিনি আল্লাহর বান্দা। ইসলামী চিন্তাধারায় কোনাে সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। তাকে শুধু দ্বীন প্রচারের আদেশ দেয়া হয়েছে বলেই তিনি প্রচার করেন। এই আদেশই আলােচ্য আয়াতে এভাবে দেয়া হয়েছে, তুমি বলাে, আমি জানি না যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তােমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা আসন্ন, না আমার প্রভু তার জন্যে একটা সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, যিনি অদৃশ্য জ্ঞানের সর্বময় অধিকারী এবং এই জ্ঞান তিনি কাউকে দেন না। অবশ্য এখানে একটি মাত্র ব্যতিক্রমের উল্লেখ আছে। তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা যদি তার অদৃশ্য ভান্ডার থেকে কোনাে তথ্য প্রকাশ করার অনুমতি দেন এবং তা তার নবী রসূলদেরকে তাদের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের সুবিধার জন্যে যতােটুকু প্রয়ােজন ততােটুকু অবহিত করেন, তবে এই সীমিত পরিমাণের অদৃশ্য জ্ঞান লাভ মানুষের পক্ষে বা জ্বিনের পক্ষেই সম্ভব হতে পারে। এভাবে অনুমােদিত হওয়ার পর ওহীযােগে যে তথ্যই নবীদের কাছে পাঠানাে হয় তা আল্লাহর গায়েবী তথ্য ভান্ডারেরই একটি তথ্য হয়ে থাকে। যে মুহূর্তে প্রয়ােজন এবং যে মুহর্তে যতােটুকু তা নাযিল করা হবে বলে আল্লাহ সিন্ধান্ত নেন ঠিক সে মুহূর্তে ততােটুকুই নাযিল করেন। এই জ্ঞান নবীরা যখন তার উম্মতের কাছে বিতরণ করেন তখনও আল্লাহ তায়ালাই তা বিতরণ করেন, তখনও আল্লাহ তায়ালা সেই বিতরণ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করেন। আল্লাহ তায়ালা তার রাসূল(স.)-কে তার এই নীতি অত্যন্ত কড়াকড়ি ভাষায় ঘােষণা করার নির্দেশ দেন, তবে যদি কোনাে রসূলকে আল্লাহ তায়ালা মনােনীত করেন, তবে সে ক্ষেত্রে তিনি উক্ত রাসূলের সামনে ও পেছনে প্রহরা নিয়ােজিত করেন। যাতে আল্লাহ তায়ালা নিশ্চিত হতে পারেন যে, রসূলরা তার বাণী পৌছে দিয়েছেন, আর তাঁদের কাছে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সব কিছুকে তিনি গুনে গুনে রাখেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার দাওয়াতকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌছানাের জন্যে যে সব নবী ও রাসূল কে নির্বাচিত করেন তাদেরকে তার অদৃশ্য জ্ঞানের ভান্ডারের একটা অংশ তো অবশ্যই জানান। তা হচ্ছে এই ওহী। ওহীর বিষয়বস্তু, ওহী নাযিল হওয়ার প্রক্রিয়া, যে ফেরেশতা তা বহন করে আনেন তিনি, ওহীর উৎস এবং লাওহে মাহফুজে তার সংরক্ষণ ইত্যাকার যা কিছু তাদের রিসালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট, কি গায়েবের গােপন ভান্ডারে লুকানাে ছিলাে এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউই তার বিন্দুবিসর্গও জানতাে না, তার সবই অদৃশ্য ও গায়েবী বিষয়।
ফী জিলালিল কুরআন: *রাসুলকে হেফাযত করার দায়িত্ব আল্লাহর : রসূলদের কাছে এই ওহী নাযিল করার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কঠোর প্রহরা ও পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখেন। তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের জন্যে তাদের ওপর নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ােগ করেন। এই সব রক্ষী রসূলদের শয়তানের প্ররোচনা ও ধোকা থেকে, তাদের নিজেদের প্রবৃত্তির প্ররােচনা ও কামনা বাসনা থেকে, রিসালাতের দায়িত্বের ব্যাপারে মানবীয় দূর্বলতায় আক্রান্ত হওয়া থেকে, ভুলভ্রান্তি ও পদস্খলন থেকে এবং মানুষ যতাে রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতায় আক্রান্ত হতে পারে, তা থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন। আয়াতের শেষাংশ থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে, রসূলদের ওপর আল্লাহর সার্বক্ষণিক প্রহরা। ও পর্যবেক্ষণ চালু থাকে। কেননা তারা সর্বক্ষণ রেসালাতের মহান দায়িত্ব পালনে নিয়ােজিত থাকেন। যাতে আল্লাহ তায়ালা নিশ্চিত হতে পারেন যে, ‘রসূলরা তাদের প্রতিপালকের বাণী পৌছে দিয়েছেন’ আল্লাহ তায়ালা এটা নিশ্চিতভাবেই জানেন বটে। তবে এখানে একথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে রসূলরা যেন কার্যত নিয়ােজিত হন এবং আল্লাহ তায়ালা বাস্তবিকপক্ষে তা জানেন। ‘তাদের কাছে যা কিছু আছে তা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে আছে’ আয়াতের এ উক্তিটির অর্থ এই যে, নবীদের মনমগযে, তাঁদের জীবনে এবং তাদের পাশ্ববর্তী সকলের মধ্যে যা কিছুই থাক না কেন, তা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তার চোখের আড়ালে কিছুই নেই। ‘আর সব কিছুই তিনি গুণে গুণে রেখেছেন।’ অর্থাৎ শুধু রসূলের কাছে যা কিছু আছে তা নয় বরং অন্য জিনিসও তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তিনি সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে সেগুলাের খবর জানেন ও গুণে গুণে সেগুলাের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করেন। অবস্থাটা সত্যিই ভেবে দেখার মতাে। রাসূল(স.) স্বয়ং প্রহরা ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে অবরুদ্ধ। আর তার কাছে এবং তার চারপাশে বিরাজমান সব কিছুই আল্লাহর নখদর্পণে। তার ওপর একটা দায়িত্ব রয়েছে, যা তার পালন না করে উপায় নেই। তিনি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, অথচ তার প্রকৃতির কাছে,তার মানবীয় দুর্বলতার কাছে, তার ব্যক্তিগত কামনা-বাসনার কাছে এবং তার নিজের পছন্দ অপছন্দ ও রুচি-অরুচির কাছে তাকে অসহায় ছেড়ে দেয়া হয়নি। তাকে রাখা হয়েছে সুক্ষ্মতম ও সতর্কতম পর্যবেক্ষণের আওতায়। তিনি এ সব জানেন এবং নিজের পথে সঠিকভাবে চলতে থাকেন। চলার পথে একটুও এদিক সেদিক তাকান না। কেননা তার চারপাশে বিদ্যমান সার্বক্ষণিক প্রহরা ও পর্যবেক্ষণের কথা তিনি অবগত। এটি এমন একটি অবস্থা যা রসূলের(স.) প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। আর এই ভয়ংকর অবস্থা সম্পর্কে শংকার সৃষ্টি করে। এই ভয়াল ও আতংকজনক অনুভূতির মধ্য দিয়েই সূরা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সূরাটির শুরুও হয়েছিলাে জ্বিনদের দীর্ঘ বক্তব্য উদ্ধৃত করে একটি ভীতিসংকুল পরিবেশ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে। সর্বমােট আটাশ আয়াতে সীমাবদ্ধ এই সূরা মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাসের গঠন এবং নির্ভুল, সুস্পষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ ধ্যান ধারণা ও চিন্তা চেতনা সৃষ্টিকারী বেশ কিছু মৌলিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছে। এসব তত্ত্ব মানুষকে যেমন সব রকমের গোড়ামী, একগুয়েমী ও উগ্রতা থেকে মুক্তি দেয়, তেমনি তাকে রক্ষা করে শৈথিল্য ও উদাসীনতা থেকে। তার চারপাশে জ্ঞানার্জনের মুক্ত বাতায়নকে রুদ্ধ করে না, তেমনি তাকে অযৌক্তিক প্রাচীন কু-সংস্কারের বদ্ধ খাচায়ও আবদ্ধ করে । বস্তুত মােমেন জ্বিনরা কোরআন শােনার পর যখন বলেছিলাে, সত্য ও ন্যায়ের পথের সন্ধানদাতা এক বিস্ময়কর কোরআন আমরা শুনেছি এবং তার প্রতি ঈমান এনেছি’ তখন তারা চরম ও অকাট্য একটি সত্যকথাই বলেছিলাে।
সুরা: আন-নাস
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১১৪
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এ সূরায়ও আল্লাহ তায়ালার কাছে পানাহ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে । যিনি মানুষের প্রতিপালক, মানুষের বাদশাহ । মানুষের মাবুদ । আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে শয়তানের অনিষ্ট থেকে যে শয়তান মানুষদের কুমন্ত্রণা যোগায় । কুমন্ত্রণা দিয়ে সে পেছনে ফিরে যায় মাঝখানে কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করে কেটে পড়ে । আবার এ শয়তান মানুষ এবং জ্বিন উভয় দলের মধ্য থেকেই হতে পারে। এই পানাহ চাওয়ার ব্যাপারে যার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বলা হয়েছে, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি প্রতিপালক, তিনি রাজাধিরাজ, বাদশাহ, তিনি মাবুদ। সাধারণভাবে তার আশ্রয়ই যাবতীয় অনিষ্ট থেকে মানুষদের দূরে রাখে। আবার বিশেষ করে নানা ধরনের কুমন্ত্রণাদায়ী বস্তু যখন নানা ধরনের প্রলোভন দিয়ে মানুষদের খারাপ কাজে নিয়োগ করে তখন বিশেষভাবেও আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে । ‘রব’ হচ্ছেন সেই পবিত্র সত্ত্বা, যিনি সবকিছুকে লালন-পালন করেন, সবকিছু প্রদর্শন করেন, দেখাশোনা করেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন । ‘মালেক’ বাদশাহ, সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান শাসক। ‘ইলাহ’ মানে মাবুদ, উচু মর্যাদাসম্পন্ন সর্বোচ্চ বিজয়ী, সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তারকারী মহান সত্ত্বা। এ গুণাবলী স্মরণ করে আল্লাহর মহান সত্ত্বার কাছ থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে৷ কারণ আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন এ গুণাবলীর একক আধার ৷ অবশ্য এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা যে, আল্লাহ তায়ালার এসব গুণ কিভাবে মানুষকে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বাঁচায়, এটা আমাদের জানার উপায়ই বা কতোটুকু? আল্লাহ তায়ালাই তা ভালো জানেন । আল্লাহ্ তায়ালা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, একক ক্ষমতাসম্পন্ন মালিক, সবকিছুর ওপর তার ক্ষমতা কার্যকর। সবকিছু তারই হাতে ৷ ন্যায়-অন্যায়, উপকার অপকার, নিষ্ট অনিষ্ট সবকিছুর স্রষ্টাও তিনি। তাই তিনি তার গুণাবলী দিয়ে মানুষকেও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারেন। আগের সূরাটিতে মানুষদের বৈষয়িক কিছু জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর এই সূরায় বলা হয়েছে কিছু আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় থেকে আশ্রয় চাইতে ।
সুরা: আন-নাস
আয়াত নং :-৬
مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ۠
সে জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# কোন কোন বিশেষজ্ঞদের মতে এ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে, প্ররোচনা দানকারীরাও দুই ধরনের লোকদের মনে প্ররোচনা দান করে। এক, জিন ও দুই, মানুষ। এ বক্তব্যটি মেনে নিলে এখানে ناس নাস জিন ও মানুষ উভয়কে বুঝাবে এবং তাঁরা বলেন, এমনটি হতে পারে। কারণ, কুরআনে যখন رِجَالٌ (পুরুষরা) শব্দটি জিনদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন সূরা জিনের ৬ নং আয়াতে দেখা যায় এবং যখন نَفَرٌ (দল) শব্দটির ব্যবহার জিনদের দলের ব্যাপারে হতে পারে, যেমন সূরা আহকাফের ২৯ আয়াতে দেখা যায়, তখন পরোক্ষভাবে ‘নাস’ শব্দের মধ্যে মানুষ ও জিন উভয়ই শামিল হতে পারে। কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়। কারণ ناس – انس and اِنْسَانُ শব্দগুলো আভিধানিক দিকে দিয়েই جن (জিন) শব্দের বিপরীতধর্মী। জিন-এর আসল মানে হচ্ছে গোপন সৃষ্টি। আর জিন মানুষের দৃষ্টি থেকে গোপন থাকে বলেই তাকে জিন বলা হয়। বিপরীতপক্ষে ‘নাস’ ও ‘ইনস’ শব্দগুলো মানুষ অর্থে এজন্য বলা হয় যে তারা প্রকাশিত, তাদের চোখে দেখা যায় এবং ত্বক অনুভব করা যায়। সূরা কাসাসের ২৯ আয়াতে آنَسَ مِنْ جَانِبِ الطُّورِ نَارًا বলা হয়েছে। এখানে اَنَسَ (আ-নাসা) মানে رَاى (রাআ) অর্থাৎ হযরত মূসা (আঃ) “তুর পাহাড়ের কিনারে আগুন দেখেন।” সূরা আন নিসার ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَإِنْ آنَسْتُمْ مِنْهُمْ رُشْدًا “যদি তোমরা অনুভব করো, এতিম শিশুদের এখন বুঝসুঝ হয়েছে। اَنَسْتُمْ (আ-নাসতুম) মানে اَحْسَسْتُمْ (আহসাসতুম) বা رَايْتُمْ (রাআইতুম)। কাজেই আরবী ভাষার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ‘নাস’ শব্দটির মানে জিন হতে পারে না। তাই এখানে আয়াতটির সঠিক মানে হচ্ছে, “এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে সে জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষদের মধ্য থেকে।” অর্থাৎ অন্য কথায় বলা যায়, প্ররোচনা দান করার কাজ জিন শয়তানরাও করে আবার মানুষ শয়তানরাও করে। কাজেই এ সূরায় উভয়ের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন থেকে এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় এবং হাদীস থেকেও। কুরআনে বলা হয়েছেঃ وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا “আর এভাবে আমি জিন শয়তান ও মানুষ শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু বানিয়ে দিয়েছি, তারা পরস্পরের কাছে মনোমুগ্ধকর কথা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে বলতে থাকে।” ( আল আন’আম, ১১২ ) আর হাদীসে ইমাম আহমাদ, নাসাঈ ও ইবনে হিব্বান, হযরত আবু যার গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি মসজিদে বসেছিলেন। তিনি বললেন, আবু যার! তুমি নামায পড়েছো? আমি জবাব দিলাম, না। বললেন, ওঠো এবং নামায পড়ো! কাজেই আমি নামায পড়লাম এবং তারপর আবার এসে বসলাম। তিনি বললেনঃ يَا أبَا ذَرٍّ نَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنْ شَرِّ شَيَاطِينِ الإِنْسِ وَالْجِنِّ- “হে আবু যার! মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর পানাহ চাও!” আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! মানুষের মধ্যেও কি আবার শয়তান হয়? বললেন, হ্যাঁ।
ফী জিলালিল কুরআন:
ল্লাহ তায়ালা সবার ‘রব’, সবার ‘মালিক’, সবার ‘ইলাহ’। অবশ্য এখানে বিশেষভাবে মানুষের উল্লেখ করার মাঝে পানাহ কিংবা আশ্রয় চাওয়ার ব্যাপারে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া ও এর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কুমন্ত্রনা থেকে বাচার উপায় : আল্লাহ তায়ালা নিজের দয়া ও অসীম অনুগ্রহ দিয়ে স্বীয় নবী (স.) ও তার উম্মতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, তারা যেন আল্লাহর কাছ থেকে আশ্রয় চায় এবং নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে তার দিকেই ফিরে যায় এবং সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার এই অনুপম গুণাবলীকে স্মরণ রাখতে বলেছেন। এসব গুণ স্মরণে রেখে বলা হয়েছে তাঁর কাছে পানাহ চাইতে সেই গোপনে কুমন্ত্রণা দাতা শয়তানের কাছ থেকে, যার মোকাবেলা এই ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কোনোদিনই সম্ভব নয়। শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণার আক্রমণ বহুমুখী । সে কোন্ দিক থেকে মানুষকে ধরবে, তা কেউই বলতে পারে না। কোন উপায় উপকরণ দিয়ে সে মানুষের মনকে বিপথগামী করে, তাও কেউ বলতে পারে না। ‘ওয়াসওয়াসা’ মানে ‘ব্যক্তিগত আওয়ায’ ৷ ‘আল খামুস’ মানে ‘লুকিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা।’ ‘খান্নাস’ বলে এমন কিছুকে যার প্রকৃতিই হচ্ছে এমন যে, সে অন্যায় করে লুকিয়ে যায় যাতে করে তার অন্যায়ের পাত্তাই পাওয়া না যায়। কোরআন মাজীদ এই শয়তানের যে বর্ণনা দিয়েছে, সে মোতাবেক তাকে বলা হয়েছে ‘ওয়াসওয়া’সুল খান্নাস’ । তারপর তার কার্যাবলীর কথা বলেছে যে, সে মানুষের অন্তরে নানান ধরনের কুমন্ত্রণা যোগায় । তারপর তার মূল সূত্র বলা হয়েছে যে, সে জ্বিন থেকে যেমন হতে পারে- মানুষদের থেকেও আসতে পারে। বর্ণনার এ ধারার ফলে মানুষের অনুভূতিতে একটা জাগরণ চিন্তা ও সাবধানতার সৃষ্টি হয় এবং এভাবেই সে ‘ওয়াসওয়া’সুল খান্নাস’ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অভিহিত হতে পারে । বর্ণনার শুরুতে এর শুধু দোষটুকুই বলা হয়েছে যেন তার কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যের ধারণা পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে সে তার অনিষ্টসমূহ সম্পাদন করে, তাই মানুষের অন্তরে শয়তানকে মোকাবেলা করে তার থেকে দূরে থাকা এবং নিজেকে দেখা শোনা করার একটা যোগ্যতা সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে মানুষের প্রবৃত্তি এ জাগরণ ও হুশিয়ারীর ফলে যখন একথা জেনে যায় যে, ‘ওয়াসওয়াসুল খান্নাস’ মানুষের অন্তরে গোপনে কুমন্ত্রণা দেয়, তা লুকিয়ে থাকা জ্বীন হোক কিংবা প্রকাশ্য মানুষ হোক- যারা জ্বীনদের মতোই মানুষের অন্তরে নানান রকম খারাপ দিয়ে তাকে খারাপ পথে নিতে চায় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে প্রতিরক্ষার জনো প্রস্তুত হয়। কারণ কোন কোন পথ দিয়ে শয়তান মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে পারে তা সবই ইতিমধ্যে সে চিনে নিয়েছে। জ্বীনদের ‘ওয়াসওয়াসা’ কি ধরনের, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমাদের জানা নেই । অবশ্য তাদের ব্যাপারে মানব জীবনের কতিপয় বাস্তব ঘটনা দিয়ে এর কিছুটা ধারণা আমরা পেতে পারি। আমরা এও জানি যে, আদম-ইবলীসের ঘটনা বহু পুরানো এবং শয়তান একদিন মানুষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানব জাতির বিরুদ্ধে শয়তানের এ যুদ্ধ ঘোষণা তার অভ্যন্তরীণ অনিষ্ট থেকেই শুরু হয়েছে তাও আমরা জানি । এক পর্যায়ে সে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে অনুমতি চাইলো, কোন বিশেষ কারণে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন তাকে তিনি এই অনুমতি দিলেন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা শয়তানের মোকাবেলার এ লড়াইয়ে মানুষকে নিরস্ত্র ও একা ফেলে রাখেননি, বরং যুদ্ধ মোকাবেলার জন্যে ঈমানের ঢাল ও আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে আশ্রয় চাওয়ার একটা হাতিয়ার তার হাতে তুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর স্মরণ দিয়ে তাকে শয়তানের সাথে মোকাবেলা করতে বলেছেন। এরপরও যদি মানুষ খোদার দেয়া ঢাল ও হাতিয়ারের কথা ভুলে নিজের প্রস্তুতিতে অবহেলা করে, তাহলে সেজন্যে তাকে নিজেকেই দায়ী হতে হবে- অন্য কাউকে নয়। বোখারীতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, রসূল (স.) বলেছেন, শয়তান মানুষের অন্তর দখল করে বসে থাকে৷ যখন সে আল্লাহর নাম স্মরণ করে,য়তখন সে সরে যায়, আবার যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষ দূরে সরে আসে, তখন শয়তান আবার সেখানে এসে কুমন্ত্রণা যোগাতে শুরু করে। মানুষের কুমন্ত্রণার কথা তো প্রচুর জানি এবং এসব জানার ফলে আমরা এও বুঝতে পারি যে, মানুষের এসব কুমন্ত্রণা শয়তানের প্ররোচনার চেয়ে অনেক মারাত্মক ৷ যেমন একজন খারাপ বন্ধু তার বিভিন্ন কথাবার্তা ও কাজকর্মে বন্ধুর জ্ঞান বুদ্ধি ও মনের ওপর এমন সব বাজে প্রভাব বিস্তার করে, যা সে টের পর্যন্ত পায় না, অনুমানও করতে পারে না। কেননা, সে তাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুই মনে করে এসেছে। আবার ক্ষমতাসীন ও দরবারী লোকদের আশেপাশের পরিষদবর্গ তাদের অন্তরে এমনসব কুমন্ত্রণা যোগায়, যার বশবর্তী হয়ে সে সব শাসক দুনিয়ায় মূল মালিকের বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং এভাবেই এরা এক সময় খোদার যমীনে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হিসেবে নিজের নানা অপকর্ম সৃষ্টি করে জনপদের মানুষ ও ফসলেরও বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করে। আবার কিছু চোগলখোর আছে, যারা কথাবার্তাকে এমন রঙঢঙ দিয়ে পেশ করে যেন শুনে মনে হয় এটাই বুঝি সঠিক এবং এর মধ্যে কোনো সন্দেহ, শোবা নেই। আবার কিছু সংখ্যক আছে যারা কামনা-বাসনার বিষয়সমূহের বেচাকেনা করে, যা প্রাকৃতিক নিয়মনীতির বিপরীত জিনিসগুলোকেই উত্তেজিত করে। এসব বহুমুখী মানবীয় কূমন্ত্রণা ও প্ররোচনা থেকে বাচতে হলে মানুষের অন্তরে খোদার স্মরণ জাগরূক থাকা ও তার প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রয়োজন ৷ আবার এমন ধরনের বহু কুমন্ত্রণাদায়ী ‘খান্নাস’ আছে যারা প্ররোচনার জাল বিছিয়ে তাকে গোপন করে রাখে এবং এসব ঘড়যন্ত্রের জাল নিয়ে মানব মনের গোপন পথ দিয়ে মানুষের মনে প্রবেশ করে৷ কারণ এসব পথ তাদের ভালোই জানা, ভালোই চেনা। এসব শয়তান কুন্ত্রণা দানকারী জ্বিনের চেয়েও ভয়ংকর ৷ কারণ, এরা লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকে এবং এক পর্যায়ে এসে মানুষ এসব অদেখা ও গোপনীয় চক্রান্ত ও প্ররোচনার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে । এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তার অক্ষমতা দূর করে তাকে মোকাবেলার সময়ে ঢাল তলোয়ার ও হাতিয়ার দিয়ে প্রস্তুতির কথা বলেন, তাকে এসব হাতিয়ার পাবার পথ বাতলে দেন, যাতে আল্লাহর বান্দা শয়তানের সাঙ্গপাঙ্গদের মোকাবেলা নিজেকে রক্ষা করতে পারে। ‘ওয়াসওয়াস’ কুমন্ত্রণাদানকারীর প্রধান চরিত্র এটাই বলা হয়েছে যে, সে ‘খন্নাস’একথা বলে একদিকে এটা বুঝানো হয়েছে যে, সে গোপন-অদৃশ্য সব সময় সুযোগ ও সুবিধের সন্ধানে থাকে৷ যখনই সুযোগ পায় তখনি নিতান্ত চুপিসারে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে এবং তাকে কুমন্ত্রণা যোগায় । অপরদিকে এর মাধ্যমে তার এই গুণটিও বলা হয়েছে যে, খন্নাস সে ব্যক্তির সামনে অত্যন্ত দুর্বল, যে তার গোপন প্রতারণা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং তা থেকে সতর্ক হয়ে তার অন্তরের গোপন পথগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে । কেননা, শয়তান মানুষ হোক বা জ্বীন হোক, যখনই কেউ তার সামনাসামনি হবে, তখন সে ভেগে যাবে। এরপর অবশ্য সে আবারও আসে, তবে আসে নীরবে । যেমন রসূল (স.) এ ব্যাপারে একটি সু্ক্ষ উদাহরণ পেশ করে বলেছেন, যখন তার সামনে আল্লাহর নাম নেয়া হয়, তখন শয়তান পালিয়ে যায় । আবার যখন সে গাফেল হয়ে যায় তখন শয়তান পুনরায় কুমন্ত্রণা দেয়। এ কথাটি প্ররোচনাকারীর সাথে মোকাবেলার সময় মোমেনের মনে শক্তির সঞ্চার করে। বিশেষ করে যখন মোমেন জানতে পারে যে, অভিশপ্ত শয়তান হচ্ছে ‘খান্নাস’ মানে গোপনে ও অতর্কিতে আক্রমণকারী, সে মোমেনের প্রস্তুতির সামনে সর্বদাই থাকে দুর্বল। এ পর্যায়ে আরেকটি কথা স্মরণ রাখা দরকার এবং তা হচ্ছে শয়তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার এ পথ অনেক লম্বা, অনেক দীর্ঘ! কেয়ামত পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকবে। শয়তান চিরদিন এভাবেই অতর্কিতে আক্রমণ চালাতে থাকবে। একবার মোমেনের অন্তরকে জাগতে দেখলে কিছুক্ষণের জন্যে লুকিয়ে যাবে, আবার এসে হামলা করবে, কুমন্ত্রণা দেবে । সে সব সময়ই এই সুযোগের সন্ধানে থাকবে যে, কখন মোমেন-হৃদয় গাফেল হয়ে যাবে । এ কারণে অন্তরকে জাগিয়ে নেয়াই যথেষ্ট নয়, এর জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে ত্রমাগত জেগে থাকা । হৃদয় মনকে কখনো এ চেতনা থেকে গাফেল হতে দেয়া যাবে না, কারণ এ লড়াই কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। কোরআন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে এ চিত্র একেছে। তাকিয়ে দেখুন সূরায়ে ইসরার প্রতি, কি অপরূপ চিত্র আঁকা হয়েছে সেখানে! ”অতপর যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম তোমরা সবাই আদমকে সেজদা করো, একমাত্র ইবলীস ছাড়া আর সবাই সেজদাবনত হলো । সে সেজদা তো করলোই না, বরং দম্ভভরে বললো, আমি কি তাকে সেজদা করবো যাকে তুমি মাটি দিয়ে বানিয়েছো? তা, তুমি দেখে নিয়ো, আজ যাকে তুমি আমার ওপর অধিক মর্যাদা দিলে, আমাকে যদি তুমি কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ দাও, তাহলে আমি এই ব্যক্তির সন্তানদের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা দিয়ে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো। অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক এমন থাকবে, যাদের আমি গোমরাহ করতে পারবো না । আল্লাহ তায়ালা বললেন, হা, যাও তোমাকে আমি সময়-সুযোগ দিলাম। মানুষের মাঝে যারাই তোমার প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে তোমার আনুগত্য করবে তোমার সাথে তাদের সবার জন্যেও এর পরিপূর্ণ বিনিময় হিসেবে জাহান্নাম আমি নির্ধারণ করে দেবো । যাও, ডাকো তাদের । তোমার ডাক দিয়ে যদি পারো তাদের তুমি প্রলুব্ধ করো। তারপর তাদের ঘাড়ে উঠিয়ে নাও তোমার সঙ্গী-সাথী ও তাদের সামানপত্র। অতপর তাদের ধন-দৌলত ও সন্তান-সম্ততিতে তুমি তাদের অংশীদার হয়ে যাও এবং তাদের সাথে বিভিন্ন ধরনের রকমারি ওয়াদা করতে থাকো। আর এটা তো জানা কথাই যে, শয়তানের ওয়াদা মিথ্যা ও প্রাতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সবাই জেনে রাখো যে, আমার যারা অনুগত বান্দা তাদের ওপর শয়তানের কোনো রকম মাতব্বরী কিংবা শাসন চলবে না। আমার বান্দাদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে আমি একাই যথেষ্ট ।” এ যে ক্রমাগত যুদ্ধ, যা একজন মানুষকে তার পারিপার্শিক অন্যায় ও অনিষ্টকর প্ররোচনার সাথে চালিয়ে যেতে হচ্ছে তা সরাসরি শয়তানের নিজের পক্ষ থেকে হোক কিংবা তার সাঙ্গোপাঙ্গ মানুষ কর্মী বাহিনীর পক্ষ থেকে হোক, মানুষ যেন কখনো নিজেকে এ চিরন্তন যুদ্ধে পরাজিত পরাভুত না ভাবে। কেননা, সমগ্র সৃষ্টিকুলের ওপর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি তো পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালার একক । যিনি মানুষের মালিক, প্রতিপালক ও তার ওপর একচ্ছত্র বাদশাহ (তিনি রব্বুন্নাস, মালিকিন্নাস, ইলাহিন্নাস)। তিনি যেখানে ইবলীসকে মানুষের কুমন্ত্রণা দেয়ার ও তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, সেখানে তিনি শয়তানকে তার টিকি ধরে টানতেও সক্ষম ৷ আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে শুধু তাদের ওপরই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম করে বানিয়েছেন, যারা মূল মাবুদ রব ও মালিককে ভুলে যায়, কিন্তু যারা আল্লাহ্ তায়ালাকে স্মরণ করে, তারা সবাই এ অনিষ্ট থেকে নাজাত পাবে। নাজাত পাবে শয়তানের যাবতীয় অদেখা অজানা ষড়যন্ত্র থেকে । তাই বাঁচার একমাত্র পন্থা হচ্ছে মানুষ যেন সেই শক্তির আশ্রয় নেয়, যার ওপর দ্বিতীয় কোনো শক্তি নেই। সেই অমোঘ সত্যের ওপর ভরসা করবে যার বাইরে কোনো সত্য নেই । দুনিয়ার মালিক, দুনিয়ার মাবুদ, দুনিয়ার শাহানশাহর সাথেই তার সম্পর্ককে গভীর করতে হবে৷ অনিষ্ট ও অন্যায়ের সম্পর্ক হচ্ছে ‘ওয়াসওয়াস ও খান্নাসের’ (যারা গোপনে ও অতর্কিতে হামলা করে) সাথে । সম্মুখ সমরে তারা সর্বদাই পরাজিত ও পরাভুত থাকে। এরা হামেশাই প্রকাশ্য আক্রমণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে খোদার আশ্রয়ের সামনে । এদের পরাজয় অবধারিত । ন্যায় ও অন্যায়ের এ হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত সত্য । এ হচ্ছে এমন এক উৎকৃষ্ট পন্থা, যা মানুষের অন্তরকে পরাজয় থেকে বাচিয়ে রাখে । প্রয়োজনে তাকে শক্তি সাহস ও প্রশাস্তি যোগায় এবং এভাবেই তার জীবন-শক্তিকে অক্ষুন্ন রাখে ৷ আল হামদু লিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য।