Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৮৩/ এবং কাফের-রা বলে:-২৮) [*জিনদের মধ্যেও অনেক মু’মিন জিন রয়েছে:- **অজ্ঞ ও মূর্খ জ্বিনদের শিরকী আচরণ :- **জ্বীনদের কাছে আশ্রয় চাওয়া বাতুলতা মাত্র :- *গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন:- **রাসুলকে হেফাযত করার দায়িত্ব আল্লাহর :- **জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের:-] www.motaher21.net সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন পারা:২৯ ১-২৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- সুরা:১১৪: আন্-নাস।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৩/ এবং কাফের-রা বলে:-২৮)
[*জিনদের মধ্যেও অনেক মু’মিন জিন রয়েছে:-
**অজ্ঞ ও মূর্খ জ্বিনদের শিরকী আচরণ :-
**জ্বীনদের কাছে আশ্রয় চাওয়া বাতুলতা মাত্র :-
*গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন:-
**রাসুলকে হেফাযত করার দায়িত্ব আল্লাহর :-
**জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন
পারা:২৯
১-২৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
সুরা:১১৪: আন্-নাস।
পারা:৩০
১-৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

নামকরণ :

الجن-জিন একটি জাতি, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাদেরকেও আমাদের মত এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। জিনদের থেকে কোন নাবী-রাসূল আগমন করেনি। মানুষের মধ্য থেকে আল্লাহ তা‘আলা যে নাবী বা রাসূল প্রেরণ করেন তা উভয় জাতির জন্য নাবী বা রাসূল হিসাবে বিবেচিত। এ সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الجن শব্দ থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

শানে নুযূল :

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদল সাহাবী নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উকায বাজারের দিকে যাত্রা করলেন। এমন সময় জিনদের আসমানী খবরাদি শোনার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করে দেওয়া হল এবং তাদের দিকে ছুড়ে মারা হল লেলিহান অগ্নিশিখা। ফলে জিন শয়তানরা ফিরে আসলে অন্য জিনেরা বলল : তোমাদের কী হয়েছে? তারা বলল : আসমানী খবরাদি শোনার ক্ষেত্রে আমাদের ওপর বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং লেলিহান অগ্নিশিখা ছুঁড়ে মারা হয়েছে। তখন শয়তান বলল : আসমানি খবরাদি সংগ্রহের ক্ষেত্রে তোমাদের প্রতি যে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অবশ্যই নতুন কোন ঘটনা ঘটার কারণে। সুতরাং তোমরা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্ত (সারা পৃথিবী) সফর কর এবং দেখ কী নতুন ঘটনা ঘটেছে, যে কারণে আসমানি খবরাদি সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলছেন : যারা তিহামার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল, তারা “নাখলা” নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উপস্থিত হল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এখান থেকে উকায বাজারে যাওয়ার মনস্থ করছিলেন। এমন সময় সাহাবীদের নিয়ে ফজর সালাত আদায় করছিলেন। জিনদের ঐ দলটি কুরআন শুনতে পেয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল এবং বলল : আসমানি খবর আর তোমাদের মাঝে এটাই বাধা সৃষ্টি করেছে। এরপর তারা স্বজাতির কাছে ফিরে এসে বলল : হে আমাদের জাতি আমরা এক আশ্চর্য কুরআন শ্রবণ করেছি যা সঠিক পথ দেখায়। এতে আমরা ঈমান এনেছি আর আমরা কখনো প্রতিপালকের সাথে শরীক করব না। এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ সূরাটি অবতীর্ণ করলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯২১, সহীহ মুসলিম হা. ৪৪৯) সূরা আহকাফের ২৯ নম্বর আয়াতের টীকায় এ ঘটনা উল্লেখ আছে।

সূরায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় স্থান পেয়েছে :

১. এতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক আকীদাহর ওপর জিনদের সাক্ষ্য হাযির করা হয়েছে। এসব আকীদাহকে মুশরিকরা সরাসরি অস্বীকার করত এবং এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হত। কখনো তারা দাবী করত যে, মুহাম্মাদ তাদের কাছে অদৃশ্য আকীদাহ বিশ্বাস সংক্রান্ত যেসব কথা বলে থাকে তা সে জিনদের থেকে সংগ্রহ করে। এর জবাবে স্বয়ং জিনদের সাক্ষ্য উপস্থিত করা হয়েছে। জিনেরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে শ্রবণের পূর্বে কুরআন সম্পর্কে কিছুই জানতো না। এ কারণে যখনই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনলো তখনি তারা ভয়ে ও আতংকে এত অধীর হয়ে পড়লো যে, তারা কিছুতেই চুপ থাকতে পারলো না। তারা সর্বত্র এ কথা প্রচার করে দিলো।

২. এ সূরা দ্বারা পাঠকদের মনে জিনদের ব্যাপারে বিরাজমান অনেক ভ্রান্ত ধারণার সংশোধন করা হয়েছে। এসব ভুল ধারণা কুরআন নাযিল হওয়ার সময়কার শ্রোতাদের মনেও ছিল, তাদের ও পরের লোকদের মনেও ছিল। কুরআন এ অদৃশ্য সৃষ্টির প্রকৃত তথ্য কোন অতিরঞ্জন ও রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করেছে। কুরআনের প্রাথমিক শ্রোতা আরবরা ভাবতো যে, পৃথিবীর ওপর জিনদের একটি আধিপত্য রয়েছে, সে জন্যই একজন আরব পৌত্তলিক যখন কোন এলাকায় অবতরণ করত তখন তারা সে এলাকার জিনদের থেকে আশ্রয় চাইতো।

১-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলো প্রমাণ করছে, জিনদের মধ্যে একশ্রেণির জিন রয়েছে যারা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী। তারা মু’মিন। আব্দুর রহমান বলেন : আমি মাসরূককে জিজ্ঞাসা করলাম, যে রাতে জিনরা মনোযোগের সাথে কুরআন শ্রবণ করেছিল ঐ রাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাদের উপস্থিতির কথা জানানো হয়েছিল। তিনি বলেন : তোমার পিতা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, একটি গাছ তাদের উপস্থিতির খবর দিয়েছিল। (সহীহ বুখারী হা. ৩৮৫৯, সহীহ মুসলিম হা. ৪৫০)

شَطَطًا অর্থ جور বা মিথ্যা কথা।

(وَّأَنَّا ظَنَنَّآ أَنْ لَّنْ تَقُوْلَ….)

অর্থাৎ আমাদের বিশ্বাস ছিল-মানুষ ও জিনেরা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে মিথ্যা বলবে না। এখন আমরা কুরআন শুনলাম এবং তাদের ভ্রান্ত আকিদাহ জানতে পারলাম।

(…كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْإِنْسِ يَعُوْذُوْنَ)

অর্থাৎ জাহিলিয়াতের যুগে একটি প্রচলন ছিল যে, যখন তারা কোথাও সফর করত তখন সেখানে অবস্থিত জিনদের থেকে আশ্রয় চাইত। যেমন অঞ্চলের বিশেষ ব্যক্তি এবং সরদারের কাছে আশ্রয় চাওয়া হয়। ইসলাম এ প্রচলন বাতিল করে দিয়েছে। আশ্রয় চাইতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে সে শির্কে লিপ্ত হবে। যাবতীয় বালা মসিবত ও অনিষ্ট থেকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাইতে হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যে ব্যক্তি কোন জায়গায় অবতরণ করবে এবং বলবে :

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

আমি আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ কালেমার মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির সকল অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। তাহলে সে স্থান ত্যাগ করার পূর্বে তাকে কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম হা. ৭০৫৩)

رَهَقًا অর্থ : অবাধ্যতা, অহংকার। জিনদের কাছে মানুষের আশ্রয় চাওয়ার কারণে তাদের অহংকার আরো বেড়ে যেত।

يَّبْعَثَ اللّٰهُ এখানে بعث এর দু’টি অর্থ হতে পারে- (১) কাউকে পুনরুত্থিত করবেন না বলে বিশ্বাস করত, (২) কাউকে আর নাবীরূপে প্রেরণ করবেন না-এ বিশ্বাস রাখতো।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জিনদের মধ্যেও অনেক মু’মিন জিন রয়েছে।
২. আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে। কোন জিন শয়তান বা মানুষ শয়তানের কাছে নয়।
৮-১০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আকাশে শয়তানদের নির্দিষ্ট জায়গা আছে যেখান থেকে তারা ওয়াহী শ্রবণ করে। যদি একটি কথা শুনতে পায় তাহলে তার সাথে আরো নয়টি কথা সংযোজন করে দেয়। যে কথাটি পায় সেটি সত্য কিন্তু যে কথাগুলো সাথে সংযোজন করে সেগুলো মিথ্যা। যখন আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করলেন তখন তারা আর ওয়াহী শোনার জন্য আকাশে যেতে পারে না। যখন যেতে চায় তখনই সেখানে প্রহরী বাধা দেয় এবং তাদের দিকে উল্কাপিণ্ড ছুঁড়ে মারা হয়।

(حَرَسًا شَدِيْدًا وَّشُهُبًا) শব্দটি حَرَسًا في وَّشُهُبً

বা কর্তৃবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

(لَا نَدْرِيْٓ أَشَرٌّ أُرِيْدَ)

অর্থাৎ আসমানের এ পাহারার উদ্দেশ্যে দুনিয়াবাসীর কোন অমঙ্গলকে পূর্ণতা দান করা অর্থাৎ তাদের ওপর অবতীর্ণ করার ইচ্ছা করা হয়েছে, না তাদের ব্যাপারে মঙ্গলের তথা রাসূল প্রেরণের ইচ্ছা করা হয়েছে।
১১-১৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

জিনেরা নিজেদের ব্যাপারে সংবাদ দিচ্ছে যে, তাদের মধ্যে একশ্রেণি আছে যারা সৎ এবং আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি বিশ্বাসী, আর অপর শ্রেণি মু’মিন না, তারা জালিম। যেমন এক আয়াত পরে বলা হয়েছে :

وَّأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُوْنَ وَمِنَّا الْقٰسِطُوْنَ ط فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولٰ۬ئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا ‏))

“আমাদের কতক মুসলিম এবং কতক অত্যাচারী, যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে।”
قِدَدًا অর্থ : কোন বস্তুর খণ্ড। অর্থাৎ জিনদের মধ্যেও বিভিন্ন দল-উপদলে ভাগ রয়েছে। একদল মুসলিম, একদল কাফির ও আরেক দল ইয়াহূদী ইত্যাদি। কেউ বলেছেন : এদের মধ্যেও মুসলিমদের মত কাদারিয়াহ, মুরজিয়াহ এবং রাফিজিয়াহ ইত্যাদি ফির্কা আছে। (ফাতহুল কাদীর) ظن শব্দটি يقين অর্থে ব্যবহার হয়েছে।

الْقاسط অর্থ : الظالم জালিম, আর المقسط অর্থ العادل ন্যায়পরায়ণ। অর্থাৎ জিনদের মাঝেও মুসলিম ও জালিম রয়েছে যেমন মানুষের মাঝে রয়েছে।

(بَخْسًا وَّلَا رَهَقًا)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : যে ব্যক্তি রবের প্রতি ঈমান আনবে তার সৎ আমল কমে যাওয়ার বা অন্যের অসৎ আমল তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোন আশংকা থাকবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(( وَمَنْ يَّعْمَلْ مِنَ الصّٰلِحٰتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا يَخٰفُ ظُلْمًا وَّلَا هَضْمًا ‏

“এবং যে সৎকর্ম করে মু’মিন হয়ে, তার কোন আশংকা নেই অবিচারের এবং অন্য কোন ক্ষতির।” (সূরা ত্বহা ২০ : ১১২)

(فِيْهِ. . . . (وَّأَنْ لَّوِ اسْتَقَامُوْا عَلَي

মুফাসসিরগণ এর দু’টি তাফসীর করেছেন- (১) যারা জালিম ছিল তারা যদি ইসলামের পথে অটল থাকত তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে প্রচুর পরিমাণ রিযিক দিতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তারা যদি তাওরাত, ইঞ্জিল ও তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত করত, তাহলে তারা তাদের ওপর ও পায়ের নীচ হতে খাদ্য ভক্ষণ করত। তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা মধ্যপন্থী; কিন্তু তাদের অধিকাংশ যা করে তা নিকৃষ্ট।” (সূরা মায়িদাহ ৫ : ৬৬)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرٰٓي اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكٰتٍ مِّنَ السَّمَا۬ءِ وَالْأَرْضِ وَلٰكِنْ كَذَّبُوْا فَأَخَذْنٰهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ ‏)‏

“যদি সে সকল জনপদের অধিবাসীবৃন্দ ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত তবে আমি তাদের জন্য আকাশসমূহ ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল; সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৯৬)

এই হিসাবে

لِّنَفْتِنَهُمْ فِيْهِ এর অর্থ হল : لنختبرهم

বা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। (২) যদি জালিমরা পথভ্রষ্টতার ওপর অটল থাকে তাহলে আমি অবকাশস্বরূপ তাদের জন্য রিযিকের দরজা খুলে দেব। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُكِّرُوْا بِه۪ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَيْءٍ ط حَتّٰي إِذَا فَرِحُوْا بِمَآ أُوْتُوْآ أَخَذْنٰهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُّبْلِسُوْنَ) ‏

“তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল তখন আমি তাদের জন্য সমস্ত কিছুর (নেয়ামতের) দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেওয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল তখন অকস্মাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৪৪ )

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(أَيَحْسَبُوْنَ أَنَّمَا نُمِدُّهُمْ بِه۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِيْنَ نُسَارِعُ لَهُمْ فِي الْخَيْرَاتِ ط بَلْ لَّا يَشْعُرُوْنَ)

“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করি। তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।” (সূরা মু’মিনুন ২৩ : ৫৫-৫৬)

(عَذَابًا صَعَدًا) অর্থ عذابا شاقا شديدا موجعا مؤلما

অর্থাৎ অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টদায়ক আযাব।

সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ তথা তাঁর ইবাদত থেকে বিমুখ হবে-সে মানুষ হোক আর জিন হোক তাদেরকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। তাই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত শয়তানের প্ররোচনায় যেন আমরা আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ থেকে গাফেল না হই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যারা আল্লাহ তা‘আলার দীনের ওপর অটল থাকে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
২. সম্পদ একটি পরীক্ষার বস্তু, খুব কম মানুষ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
৩. বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হওয়াকে তিরস্কার করা হয়েছে।
৪. যারা কুফরীর ওপর অটল থাকে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অবকাশস্বরূপ দুনিয়ায় ভোগ্য সামগ্রী প্রদান করে থাকেন।
১৮-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা সকল ইবাদত পাওয়ার যোগ্য এবং তিনিই হিদায়াতদাতা, কোন নৈকট্যশীল ফেরেশতা বা নাবী রাসূলগণ নন। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চাওয়া-পাওয়া, আরাধনা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছেই ছিল, তিনি এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতেন, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করতেন না এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন ভাল-মন্দের মালিকও নন। এ কথাটিই এখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রস্ফুটিত হয়েছে।

মাসজিদ অর্থ : সিজদা দেওয়ার জায়গা। সিজদা সালাতের অন্যতম একটি রুকন। এজন্য সালাত আদায়ের স্থানকে মাসজিদ বলা হয়। আয়াতের উদ্দেশ্য হল কোন প্রকার সিজদা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারো জন্য করা যাবে না এবং কোন প্রকার দু‘আ, কিছু চাওয়ার জন্য দু‘আ (دعاء مسئلة) হোক বা অন্য কোন দু‘আ হোক সকল প্রকার দু‘আ প্রাপ্যের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। সালাত যেমন একটি ইবাদত তেমনি দু‘আও একটি ইবাদত। তাই সিজদা তথা সালাতের সাথে দু‘আকে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং সব ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য করব। কবরে শায়িত ব্যক্তি, পীর, ওলী-আওলিয়া ইত্যাদি কোন ব্যক্তিই ইবাদত পাওয়ার হকদার না, সে যত বড়ই হোক না কেন।

عَبْدُ اللہِ দ্বারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝোনো হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : যখন জিনেরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনলো তখন তারা হাঁটু গেঁড়ে বসে গেল মনযোগসহকারে তেলাওয়াত শোনার জন্য। এ খবর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতেন না, জিবরীল (রাঃ) এসে জানিয়ে দিলেন।

(لَآ أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَّلَا رَشَدًا)

অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাউকে হিদায়াত দিতে পারেন না এবং পথভ্রষ্ট করতে পারেন না। তিনি কেবল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত রিসালাত পৌঁছে দেন। আল্লাহ তা‘আলা যাকে চান তাকেই হিদায়াত দিতে পারেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلٰكِنَّ اللّٰهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَا۬ءُ ج وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ) ‏

“তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন।” (সূরা কাসাস ২৮ : ৫৬)

রিসালাতের বাণী কারো নিকট পৌঁছার পরেও যদি সে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের অবাধ্য হয় তাহলে তার জন্য আখিরাতে রয়েছে জাহান্নাম।

(إِذَا رَأَوْا مَا يُوْعَدُوْنَ)

অর্থাৎ ঐ সব মুশরিক মানুষ ও জিনেরা যখন কিয়ামতের দিনে পূর্ব প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী শাস্তি দেখতে পাবে তখন জানতে পারবে কারা সাহায্যকারী হিসাবে ও সংখ্যায় অতি দুর্বল।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ইবাদত করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য।
২. সিজদা সালাতের অন্যতম একটি রুকন, তা করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য। কোন মাযার বা খানকাতে না এবং পীর-মুরশিদের পায়েও না।
৩. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তাই আমাদের উচিত তাঁর কাছেই হিদায়াত চাওয়া।

(لَآ أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَّلَا رَشَدًا)

অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাউকে হিদায়াত দিতে পারেন না এবং পথভ্রষ্ট করতে পারেন না। তিনি কেবল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত রিসালাত পৌঁছে দেন। আল্লাহ তা‘আলা যাকে চান তাকেই হিদায়াত দিতে পারেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلٰكِنَّ اللّٰهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَا۬ءُ ج وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ) ‏

“তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন।” (সূরা কাসাস ২৮ : ৫৬)

রিসালাতের বাণী কারো নিকট পৌঁছার পরেও যদি সে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের অবাধ্য হয় তাহলে তার জন্য আখিরাতে রয়েছে জাহান্নাম।

(إِذَا رَأَوْا مَا يُوْعَدُوْنَ)

অর্থাৎ ঐ সব মুশরিক মানুষ ও জিনেরা যখন কিয়ামতের দিনে পূর্ব প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী শাস্তি দেখতে পাবে তখন জানতে পারবে কারা সাহায্যকারী হিসাবে ও সংখ্যায় অতি দুর্বল।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ইবাদত করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য।
২. সিজদা সালাতের অন্যতম একটি রুকন, তা করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য। কোন মাযার বা খানকাতে না এবং পীর-মুরশিদের পায়েও না।
৩. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তাই আমাদের উচিত তাঁর কাছেই হিদায়াত চাওয়া।
২৫-২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন- বলে দাও, তোমাদের ওপর যে শাস্তি আপতিত হওয়ার বা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছে তা কি অচিরেই আসবে না বিলম্ব হবে, তা আমি জানি না। এ জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলার কাছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে জিবরীল (আঃ) জিজ্ঞাসা করলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন :

مَا المَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ

এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে বেশি জানে না। (সহীহ বুখারী হা. ৫০, সহীহ মুসলিম হা. ৮)

অন্যত্র তিনি বলেন : হে আদম সন্তান! যদি তোমরা বুদ্ধিমান হও তাহলে নিজেদেরকে মৃতদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য কর। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ তোমাদের যে প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই আসবে। (সিলসিলা যঈফাহ হা. ৪৯৭৭, যঈফ)

(إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ)

অর্থাৎ গায়েবের খবর আল্লাহ তা‘আলা মনোনীত রাসূল ছাড়া অন্য কাউকে জানান না। রাসূলদেরকে যতটুকু জানান তারা কেবল ততটুকুই জানতে পারেন, এর বেশি না। তবে যখন গায়েবের খবর তাদের কাছে প্রদান করেন তখন সামনে পেছনে অনেক ফেরেশতা প্রহরী নিযুক্ত থাকে যাতে কোন জিন শয়তান তা না জানতে পারে।

لِّيَعْلَمَ এর সর্বনাম কার দিকে ফিরে গেছে তা নিয়ে মুফাসসিরগণের মাঝে মতামত রয়েছে : কেউ বলেছেন, রাসূলের দিকে। অর্থাৎ যাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জেনে যান যে, পূর্বের নাবীগণও আল্লাহ তা‘আলার পয়গাম তাঁর মত পৌঁছে দিয়েছেন। অথবা ফেরেশতা, অর্থাৎ যাতে ফেরেশতারা জেনে নেন যে, তারা রাসূলদের নিকট আল্লাহ তা‘আলার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ বেলেছেন : এর সর্বনাম আল্লাহ তা‘আলার দিকে গেছে। অর্থ হল : আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর নাবীদের হেফাযত করেন, যাতে তারা নবুওয়াতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এছাড়া নাবীদের প্রতি নাযিলকৃত

ওয়াহীও হেফাযত করেন যাতে তিনি জেনে নেন যে, নাবীরা তাঁর পয়গাম মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন।

(وَأَحَاطَ بِمَا لَدَيْهِمْ)

অর্থাৎ ফেরেশতা বা নাবীদের নিকট যা আছে (তথা ওয়াহীর যে জ্ঞান দান করেছেন) সব আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়ত্ত। তিনি সব কিছু হিসাব করে রাখেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন। কোন নৈকট্যশীল ফেরেশতা বা নাবী রাসূলগণও জানেন না, পীর-গাউছ-কুতুব তো দূরের কথা। তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তাঁরা কেবল ততটুকুই জানতে পারে।
২. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান দ্বারা সব কিছু বেষ্টন করে আছেন, কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।
নামকরণ:

সূরা ফালাক ও সূরা নাস উভয় সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকে। ফালাক (الفلق) শব্দের অর্থ : প্রভাতকাল। আর নাস (النَّاس) অর্থ : মানুষ। এ দুই সূরাকে একত্রে معوذتان বা আশ্রয় প্রার্থনা করার দুই সূরা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাদুগ্রস্থ হওয়ার পর এ সূরাদ্বয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হলে আল্লাহ তা‘আলার রহমতে তিনি সুস্থ হন, তাই এ নামেও এ সূরাদ্বয় পরিচিত।

শানে নুযূল:

মা আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মদীনার ইয়াহূদী গোত্র বনু যুরাইকের মিত্র লাবীদ বিন আসাম নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাথার ছিন্নচুল ও চিরুনীর ছিন্ন দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কোন কাজ করলে ভুলে যেতেন ও ভাবতেন যে করেননি। অন্য বর্ণনা মতে ৪০ দিন বা ৬ মাস এভাবে থাকেন। এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, দু’জন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে অন্যজন পায়ের কাছে বসে। অতঃপর তারা বলে যে, বনু যুরাইকের খেজুর বাগানে যারওয়ান কূয়ার তলদেশে পাথরের নীচে চাপা দেয়া খেজুরের কাঁদির শুকনো খোসার মধ্যে ঐ জাদু করা চুল ও চিরুনীর দাঁত রয়েছে। ওটা তুলে এনে গিরা খুলে ফেলতে হবে। রাসূল (সাঃ) সকালে আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠান এবং যথারীতি তা তুলে আনা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সূরাদ্বয় পড়ে ফুঁ দিয়ে গিরাগুলো খুলে ফেলেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। (সহীহ বুখারী হা. ৫৭৬৫, ৫৭৬৬)

আয়িশাহ (রাঃ) হতে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সাঃ)-এর যাদুকৃত চুল ও চিরুনীর দাঁত উদ্ধার হওয়ার পর সূরা ফালাক ও নাস নাযিল হয়। যার ১১টি আয়াতের প্রতিটি আয়াত পাঠের সাথে সাথে জাদুকৃত ১১টি চুলের গিরা পরপর খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হালকা বোধ করেন ও সুস্থ হয়ে যান। (ইবনু কাসীর)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রতিশোধ নিতে বলা হলে তিনি বলেন : আল্লহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি অপছন্দ করি যে, মানুষের মাঝে খারাপ কিছু ছড়িয়ে দেওয়া হোক। (সহীহ বুখারী হা. ৬৩৯১)

গুরুত্ব:

ওকবা বিন আমের আল যুহানী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার কাছে এমন কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার অনুরূপ আর দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক ও সূরা নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪) অন্য বর্ণনাতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তুমি কি জান আজ রাতে এমন কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার সদৃশ ইতোপূর্বে কখনই দেখা যায়নি। তাহলো সূরা ফালাক ও নাস। (সহীহ মুসলিম হা. ৮১৪)

ফযীলত:

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাঃ) প্রত্যেক রাতে যখন বিছানায় যেতেন তখন দু হাত একত্রিত করে ফুঁ দিতেন, অতঃপর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন। তারপর যথাসম্ভব দু হাত দিয়ে শরীর মাসাহ করতেন। তিনি প্রথমে মাথা, মুখমন্ডল ও শরীরের সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০১৭)

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিন ও মানুষের চোখ লাগা হতে আশ্রয় চাইতেন কিন্তু যখন সূরা ফালাক ও নাস অবতীর্ণ হলো তখন তিনি সব বাদ দিয়ে এ দু’টিই পড়তে থাকেন। (সূরা কালামের তাফসীর দ্রষ্ট্যব্য)

উকবা বিন আমের (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে প্রতি সালাতের শেষে সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (তিরমিযী হা. ২৯০৩ আবূ দাঊদ হা. ১৫২, মিশকাত হা. ৯৬৯)

আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অসুখে পড়তেন, তখন সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে নিজের দেহে হাত বুলাতেন। কিন্তু যখন ব্যাথা-যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে যেত তখন বরকতের আশায় আমি তাঁর দেহে হাত বুলিয়ে দিতাম। মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে : পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সূরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৯২, সহীহ মুসলিম হা. ২১৯২)

একদা ওকবা বিন আমির (রাঃ)-কে নাবী (সাঃ) বলেন : হে ওকবা! আমি কি তোমাকে শ্রেষ্ঠ দুটি সূরা শিক্ষা দেব না? অতঃপর তিনি আমাকে সূরা ফালাক ও নাস শিক্ষা দিলেন। তারপর তিনি সালাতের ইমামতি করেন এবং সূরাদ্বয় পাঠ করলেন। সালাত শেষে আমাকে বললেন : হে ওকবা! তুমি এ দুটি সূরা পাঠ করবেÑযখন ঘুমাবে এবং যখন ঘুম থেকে জাগবে। (আহমাদ হা. ১৭৩৩৫, নাসায়ী হা. ৫৪৩৭, সহীহুল জামে হা. ৭৯৪৮)

এ ছাড়াও সূরাদ্বয়ের ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস পাওয়া যায়।

জাদু টোনা, ঝাড়ফুঁক ও তাবীজ কবচ : ইসলামে জাদু হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাক। তার মধ্যে অন্যতম হলো জাদু। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৬৬, সহীহ মুসলিম হা. ৮৯)

ইসলামে ঝাড়-ফুঁক সিদ্ধ তবে অবশ্যই সে ঝাড়-ফুঁক কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে হতে হবে। যেমন সূরা ফালাক, নাস ও ইখলাস ইত্যাদি এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে যে সকল দু‘আ প্রমাণিত। যেমন

بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللّٰهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللّٰهِ أَرْقِيكَ

আমি আল্লাহ তা‘আলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সব বিষয় হতে যা আপনাকে কষ্ট দেয়। প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তির বা হিংসুক চোখের অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে নিরাময় করুন। আল্লাহ তা‘আলার নামে আপনাকে ঝেড়ে দিচ্ছি। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৮৬)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-কে নিম্নোক্ত দু‘আর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেন।

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ

আমি আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান হতে, বিষাক্ত কীট পতঙ্গ ও প্রত্যেক অনিষ্টকারীর চক্ষু হতে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৭১)। এ ছাড়াও ঝাড়-ফুঁকের অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।

কিন্তু যদি ঝাড় ফুঁক কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ অনুপাতে না হয়ে অন্য কোন বানোয়াট শির্কী কথা দ্বারা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ হারাম। বিভিন্ন বালা-মসিবত থেকে বাঁচার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাবিজ ঝুলানো বা তাবিজ বাঁধা চাই তা কুরআন দ্বারা হোক আর অন্য কিছু হোক তা সম্পূর্ণ নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল। (আহমাদ হা. ১৭৪৫৮, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৪৯২)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : >

مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ

যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকায় তাকে তার দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা. ২০৭২, মিশকাত হা. ৪৫৫৬, সনদ হাসান।)

তাই ঝাড়-ফুঁেকর প্রয়োজন হলে একমাত্র কুরআন ও স্ন্নুাহ দ্বারাই করতে হবে।

তাফসীর:

(قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) – الْفَلَقِ অর্থ الصبح

বা প্রভাত কাল, উষা। আবার ফালাক অর্থ বিদীর্ণ করা, ফেটে বের হওয়া। যেমন বলা হয় فلقت

الشئ أي شققته

আমি জিনিসটিকে ফালাক করেছি অর্থাৎ বিদীর্ণ করেছি। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّ اللّٰهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوٰي)

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শস্য-বীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করেন’ (সূরা আন‘আম ৫: ৯৫)

যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্রভাতের আলো বিকশিত করেন, তাই তাকে ফালাক বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে প্রভাতের প্রতিপালকের কাছে, নিজের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ এতে ইঙ্গিত রয়েছে সকল অনিষ্টের মূল হলো অন্ধকার। অনিষ্ট দূর হওয়ার পর আসে খুশির প্রভাত। মানুষ যখন বিপদে পতিত হয় তখন চেহারা মলিন ও অন্ধকার হয়ে যায়। আবার যখন বিপদ থেকে মুক্তি পায় তখন চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

(شَرِّ مَا خَلَق)

অর্থাৎ সকল মাখলুকের অনিষ্ট হতে। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন: জাহান্নাম, শয়তান ও তার সঙ্গী সাথী যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন।

(وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ) – غَاسِق

অর্থ: রাত। যেমন হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন :

انه الليل اذا اقبل بظلامه

এটা (গাসাক) হলো রাত যখন তা অন্ধকারসহ আগমন করে। (ই্বনু কাসীর)

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন :

الغسق اول ظلمة الليل

গসাক হলো রাতের প্রথম অন্ধকার। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(أَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلٰي غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ)

‘সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত‎ সালাত কায়েম কর এবং কায়েম কর ফজরের সালাত।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ৭৮)

আবার হাদীসে চাঁদকে غَاسِقٍ বলা হয়েছে। যেমন একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাতে আয়িশাহ (রাঃ)-এর হাত ধরে চাঁদ দেখিয়ে বলেন : হে আয়িশাহ! এর অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা এটা হলো গাসেক যখন সে সমাগত হয়। (তিরমিযী হা. ৩৩৬৬, মিশকাত হা. ২৪৭৫ সনদ সহীহ।)

যারা গাসেক বলে রাতকে বুঝিয়েছেন আর যারা চাঁদকে বুঝিয়েছেন উভয়ের মাঝে কোন প্রার্থক্য নেই। কেননা চাঁদ রাতের একটি নিদর্শন।

وَقَبَ অর্থ : প্রবেশ করা, চলে যাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ আমি আশ্রয় চাচ্ছি রাতের অনিষ্ট হতে যখন তা অন্ধকারে প্রবেশ করে। রাতের অন্ধকারেই হিংস্র জন্তু, ক্ষতিকর প্রাণী ও পোকা মাকড় অনুরূপভাবে অপরাধপ্রবণ হিংস্র মানুষ নিজ নিজ জঘন্য ইচ্ছা পূরণের আশা নিয়ে বাসা হতে বের হয়। এ বাক্য দ্বারা সে সকল অনিষ্টকর জীব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার কথা বলা হচ্ছে।

(وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثٰتِ فِي الْعُقَدِ)

হাসান বাসরী, যহহাক ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন :

النفاثات هن السواحر

নাফফাসাত হলো জাদুকারীগণ। আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন : গিরাতে ফুঁৎকারদানকারী আত্মার অনিষ্ট হতে অথবা গিরাতে ফুঁৎকারদানকারিণী মহিলাদের থেকে। (ফাতহুল কাদীর)

এ থেকে উদ্দেশ্য হলো : গিরাতে ফুঁক দানকারী প্রত্যেক জাদুকারিণী ও জাদুকর যারা মানুষের ক্ষতি করে থাকে।

حَسَدَ বলা হয় ‘যে ব্যক্তির সাথে হিংসা করা হচ্ছে তাকে আল্লাহ তা‘আলা যে নেয়ামত দান করেছেন তা দূরীভূত হয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা করা।’ (ফাতহুল কাদীর)

এরূপ হিংসা করা কবীরাহ গুনাহ ও মারাত্মক ব্যাধি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :

إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ

তোমরা হিংসা থেকে বেঁেচ থাকে। কেননা হিংসা মানুষের সৎ আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠ খেয়ে ফেলে। (আবূ দাঊদ হা. ৪৯০৩, সহীহ)

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : হিংসা হলো প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয় এবং প্রথম পাপ যা পৃথিবীতে করা হয়। যা আসমানে ইবলীস আদমের সাথে করেছিল। আর পৃথিবীতে কাবীল তার ছোট ভাই হাবীলের সাথে করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি অভিশপ্ত, বহিস্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত। (তাফসীর কুরতুবী)

তাই হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকেও আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। হিংসা থেকে বাঁচার উপায় হল বেশি বেশি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাওয়া। এজন্য নিম্নোক্ত দু‘আটি বেশি বেশি পাঠ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَآ إِنَّكَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْم)

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের সে-সব ভাইদের ক্ষমা কর যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং মু’মিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (সূরা হাশর ৫৯ : ১০)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সূরা ফালাক ও নাসের অন্যান্য নাম জানলাম।
২. এ দুটি সূরার গুরুত্ব ও ফযীলত জানলাম।
৩. জাদুটোনা ও তাবীজ-কবচ শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষেধ।
৪. কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক হলে বৈধ, অন্যথায় তা অবৈধ।
৫. জাদুর প্রভাব রয়েছে যার প্রমাণ নাবী (সাঃ) স্বয়ং নিজে।
৬. ইয়াহূদীরা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন চক্রান্ত ও অপকৌশল অবলম্বন করে আসছে যা আজও বিদ্যামান।
৭. হিংসা একটি বড় গুনাহ এবং মারাত্মক ব্যাধি যা মানুষের সৎ আমল বিনষ্ট করে দেয়।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৩/ এবং কাফের-রা বলে:-২৮)
[*জিনদের মধ্যেও অনেক মু’মিন জিন রয়েছে:-
**অজ্ঞ ও মূর্খ জ্বিনদের শিরকী আচরণ :-
**জ্বীনদের কাছে আশ্রয় চাওয়া বাতুলতা মাত্র :-
*গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন:-
**রাসুলকে হেফাযত করার দায়িত্ব আল্লাহর :-
**জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭২ : আল্-জ্বীন
পারা:২৯
১-২৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
সুরা:১১৪: আন্-নাস।
পারা:৩০
১-৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-

তাফসীরে‌ তাফহীমুল কুরআন:-
(৭২-জ্বিন) : নামকরণ:

আল জিন এ সূরার নাম। এর বিষয়বস্তুর শিরোনামও আল জিন। কারণ এতে কুরআন শুনে জিনদের নিজেদের জাতির কাছে যাওয়া এবং তাদের মধ্যে ইসলামের তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজ করার ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
(৭২-জ্বিন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বুখারী ও মুসলিম হাদীস গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে উকাযের বাজারে যাচ্ছিলেন। পথে নাখলা নামক স্থানে তিনি ফজরের নামাযে ইমামতি করেন। সে সময় একদল জিন ঐ স্থান অতিক্রম করছিলো। কুরআন তিলাওয়াতের শব্দ শুনে তারা সেখানে থেমে যায় এবং গভীর মনযোগসহ কুরআন শুনতে থাকে। এ সূরাতে এ ঘটনারই উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বর্ণনার ভিত্তিতে অধিকাংশ মুফাস্সির মনে করেছেন যে, এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইতিহাস খ্যাত তায়েফ সফরের ঘটনা। ঘটনাটি ঘটেছিল হিজরাতের তিন বছর আগে নবুওয়াতের ১০ম বছরে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ ধারণা ঠিক নয়। তায়েফের উক্ত সফরে জিন দের কুরআন শোনার যে ঘটনা ঘটেছিল তা সূরা আহকাফের ২৯ থেকে ৩২ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। ঐ আয়াতগুলো একবার দেখলেই বুঝা যায়, সে সময় যেসব জিন কুরআন শুনে তার প্রতি ঈমান এনেছিল তারা আগে থেকেই হযরত মূসা এবং পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান পোষণ করতো। পক্ষান্তরে এ সূরার ২ হতে ৭ পর্যন্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ সময় যে জিনেরা কুরআন শুনেছিল তারা ছিল মুশরিক। তারা আখেরাত ও রিসালাত অস্বীকার করতো। তাছাড়াও এ বিষয়টি ইতিহাস থেকে প্রমাণিত যে, তায়েফের সফরে যায়েদ ইবনে হারেসা ছাড়া আর কেউ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন না। পক্ষান্তরে এ সূরায় উল্লেখিত সফর সম্পর্কে ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, এ সময় কয়েকজন সাহাবী তাঁর সাথে ছিলেন। তা ছাড়াও অনেক গুলো বর্ণনা এ বিষয়ে একমত যে, সূরা আহকাফে বর্ণিত ঘটনায় জিনরা যখন কুরআন শুনেছিল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ থেকে মক্কা ফেরার পথে নাখলায় অবস্থান করছিলেন। আর ইবনে আব্বাসের বর্ণনা মতে এ সূরায় বর্ণিত সফরে জিনদের কুরআন শোনার ঘটনা তখন ঘটেছিল যখন তিনি মক্কা থেকে উকায যাচ্ছিলেন। এসব কারণে যে বিষয়টি সঠিক বলে জানা যায় তা হলো, সূরা আহকাফ এবং সূরা জিনে একই ঘটনার উল্লেখ করা হয়নি। বরং এ ছিল ভিন্ন ভিন্ন সফরে সংঘটিত ভিন্ন ভিন্ন দু’টি ঘটনা।

সূরা আহ্কাফে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে তা যে দশম নববী সনে তায়েফ সফরের সময় সংঘটিত হয়েছিল সে ব্যাপারে রেওয়ায়াতসমূহে ঐক্যমত পোষণ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ দ্বিতীয় ঘটনাটি কখন সংঘটিত হয়েছিল? ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় এর কোন জবার পাওয়া যায় না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদল সাহাবীকে সাথে নিয়ে কখন উকাযের বাজারে গিয়েছিলেন অন্য আর কোন ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকেও তা জানা যায় না। তবে এ সূরার ৮ থেকে ১০ পর্যন্ত আয়াতগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায়, এই নবূওয়াতের প্রাথমিক যুগের ঘটনা হবে। এসব আয়াতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত লাভের পূর্বে জিনরা ঊর্ধ্ব জগতের খবর জানার জন্য আসমান থেকে কিছু না কিছু শুনে নেয়ার একটা সুযোগ পেয়ে যেতো। কিন্তু এরপর তারা হঠাৎ দেখতে পেলো সবখানে ফেরেশতাদের কড়া পাহারা বসে গেছে এবং উল্কার বৃষ্টি হচ্ছে। তাই কোথাও তারা এমন একটু জায়গা পাচ্ছে না যেখানে অবস্থান নিয়ে কোন আভাস তারা লাভ করতে পারে। তাই একথা জানার জন্য তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো যে, পৃথিবীতে এমন কি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে যার জন্য এ কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। সম্ভবত তখন থেকেই জিনদের বিভিন্ন দল বিষয়টির অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছিল এবং তাদেরই একটি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র মুখ থেকে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত শুনে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, এটিই সে বস্তু, যার কারণে জিনদের জন্য ঊর্ধ্ব জগতের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
(৭২-জ্বিন) : নাযিলের উপলক্ষ / প্রেক্ষাপট :

জিনদের হাকীকত বা তাৎপর্য

মন-মগজ যাতে কোন প্রকার বিভ্রান্তির শিকার না হয় সে জন্য এ সুরা অধ্যয়নের আগে জিনদের তাৎপর্য সম্পর্কে জেনে নেয়া আবশ্যক। বর্তমান যুগের বহু লোক এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত আছে যে, জিন বলতে বাস্তবে কিছু নেই। বরং এটিও প্রাচীন কালের কুসংস্কার ভিত্তিক বাজে একটি ধারণা। তাদের এ ধারণার ভিত্তি কিন্তু এটা নয় যে, তারা গোটা বিশ্ব-জাহানের সবকিছুর তাৎপর্য ও বাস্তবতা জেনে ফেলেছে এবং এও জেনে ফেলেছে যে, জিন বলে কোথাও কিছু নেই। এমন জ্ঞান লাভের দাবি তারা নিজেরাও করতে পারে না। কিন্তু কোন প্রমাণ ছাড়াই তারা ধরে নিয়েছে যে, গোটা বিশ্ব-জাহানে শুধু তা-ই বাস্তব যা অনুভব করা যায় বা ধরা ছোয়ার মধ্যে আনা যায়। অথচ সমুদ্রের তুলনায় এক বিন্দু পানির যে অবস্থা এ বিরাট বিশাল-বিশ্ব জাহানের বিশালত্বের তুলনায় মানুষের অনুভূতি ও ধরা ছোয়ার গণ্ডির অবস্থা তাও নয়। যে ব্যক্তি মনে করে যে, যা অনুভব করা যায় না তার কোন অস্তিত্ব নেই। আর যার অস্তিত্ব আছে তা অবশ্যই অনুভূত হবে সে আসলে নিজের বুদ্ধি বিবেকের সংকীর্ণতারই প্রমাণ দেয়। এ ধরনের চিন্তাধারার অবলম্বন করলে শুধু এক জিন নয় বরং এমন কোন সত্যকেই মানুষ মেনে নিতে পারবে না যা সরাসরি তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না এবং অনুভব করা যায় না এমন কোন সত্যকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা আল্লাহর অস্তিত্ব পর্যন্তও তাদের কাছে মেনে নেয়ার মত থাকে না।

মুসলমানদের মধ্যে যারা এরূপ ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে কিন্তু কুরআনকেও অস্বীকার করতে পারেনি তারা জিন, ইবলীস এবং শয়তান সম্পর্কে কুরআনের ষ্পষ্ট বক্তব্যকে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিষয়ে পরিণত করেছে। তারা বলেন: জিন বলতে এমন কোন অদৃশ্য মাখলুক বুঝায় না যাদের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব আছে। বরং কোথাও এর অর্থ মানুষের পাশবিক শক্তি যাকে শয়তান বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোথাও এর অর্থ অসভ্য, বন্য ও পাহাড়ী এলাকায় বসবাসকারী জাতিসমূহ। আবার কোথাও এর দ্বারা ঐ সব লোকদের বুঝানো হয়েছে যারা গোপনে কুরআন শুনতো। কিন্তু এ ব্যাপারে কুরআন মজীদের বক্তব্য এত স্পষ্ট ও খোলামেলা যে, এ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সামান্যতম অবকাশও তাতে নেই।

কুরআন মজীদে এক জায়গায় নয় বহু জায়গায় এমনভাবে জিন ও মানুষের উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায়, এরা স্বতন্ত্র দু’টি মাখলুক। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন সূরা আরাফ আয়াত ৩৮; হূদ, ১৯; হা-মীম আস সাজদা, আয়াত ২৫ ও ২৯; ২৯;আল আহকাফ ১৮; আয যারিয়াত; ৫৬ এবং আন নাস, ৬। সূরা আর রাহমান তো পুরাটাই এ ব্যাপারে এমন অকাট্য প্রমাণ যে, জিনদের এক প্রকার মানুষ মনে করার কোন অবকাশই নেই। সূরা আ’রাফের ১২ আয়াত, সূরা হিজরের ২৬ ও ২৭ আয়াত এবং সূরা আর রাহমানের ১৪ ও ১৫ আয়াতে ষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টির মৌলিক উপাদান হলো মাটি আর জিন সৃষ্টির মৌলিক উপাদান হলো আগুন।

সূরা হিজরের ২৭ আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টির পূর্বে জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে। কুরআন মজীদের সাতটি স্থানে আদম ও ইবলীসের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এর সবগুলো স্থানের বর্ণনা থেকে প্রামানিত হয় যে, মানুষের সৃষ্টির সময় ইবলীস বর্তমান ছিল। এ ছাড়াও সূরা কাহফের ৫০ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইবলীস জিনদেরই একজন।

সূরা আ’রাফের ২৭ আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, জিনরা মানুষকে দেখতে পায় কিন্তু মানুষ জিনদের দেখতে পায় না।

সূরা হিজরের ১৭ থেকে ১৮, সূরা সাফ্ফাতের ৬ থেকে ১০ এবং সূরা মুলকের ৫ আয়াতে বলা হয়েছে, জিনেরা ঊর্ধ্ব জগতের দিকে উঠতে সক্ষম হলেও একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরে তারা যেতে পারে না। এর ঊর্ধ্বে যাওয়ার চেষ্টা করলে এবং উর্ধ্বজগতে বিচরণকারী ফেরেশতাদের কথাবার্তা শুনতে চাইলে তাদের থামিয়ে দেয়া হয়। গোপনে দৃষ্টির অগোচরে শুনতে চাইলে উল্কাপিণ্ড ছুড়ে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়। একথার মাধ্যমে আরবের মুশরিকদের একটি ধারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তাদের ধারণা ছিল জিনেরা গায়েবী বিষয়ের খবর জানে অথবা খোদায়ীর গোপন তত্ত্বসমূহ জানার কোন উপায় তাদের জানা আছে। সূরা সাবার ১৪ আয়াতেও এ ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

সূরা বাকারার ৩০ থেকে ৩৪ আয়াত এবং সূরা কাহফের ৫০ আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর খেলাফত দিয়েছেন মানুষকে। এও জানা যায় যে, মানুষ জিনদের চেয়ে উত্তম মাখলুক যদিও জিনদের কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আমরা সূরা নামলের ৭ আয়াতের এর একটি দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। কিন্তু মানুষের তুলনায় পশুরাও কিছু অধিক ক্ষমতা লাভ করেছে। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, পশুরা মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী।

কুরআন একথাও বলে যে, জিনরাও মানুষের মত একটি মাখলুক। তাদেরকেও মানুষের মত স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ইবলীসের কাহিনী এবং সূরা আহকাফ ও সূরা জিনে উল্লেখিত কিছু সংখ্যক জিনের ঈমান আনার ঘটনা এর সুস্পষ্ট প্রমাণ।

কুরআনের বহু জায়গায় এ সত্যটিও বর্ণনা করা হয়েছে যে, আদমকে সৃষ্টি করার মুহূর্তেই ইবলীস এ মর্মে দৃঢ় সংকল্প করেছিল যে, সে মানব জাতিকে গোমরাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। সে সময় থেকেই জিনদের শয়তানরা মানুষকে গোমরাহীর মধ্যে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় লেগে আছে। কিন্তু মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে জবরদস্তিমূলক ভাবে কোন কাজ করিয়ে নেয়ার সামর্থ্য তারা রাখে না। বরং তারা তা মনের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে, তাদের বিভ্রান্ত করে এবং অন্যায় ও গোমরাহীকে তাদের সামনে শোভনীয় করে পেশ করে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিম্ন বর্ণিত আয়াত গুলো পাঠ করুন। সূরা নিসা, আয়াত ১১৭ থেকে ১২০; আরাফ, ১১ থেকে ১৭ পর্যন্ত; ইবরাহীম ২২; আল হিজর ৩০ থেকে ৪২; আন নাহল, ৯৮ থেকে ১০০ এবং বনী ইসরাঈল, ৬১ থেকে ৬৫ আয়াত পর্যন্ত।

কুরআন শরীফে একথাও বলা হয়েছে যে, আরবের মুশরিকরা জাহেলী যুগে জিনদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করতো, তাদের ইবাদত বা পূজা-অর্চনা করতো এবং তাদেরকে আল্লাহর বংশধর বা সন্তান-সন্তুতি মনে করতো। দেখুন, সূরা আল আনআম, আয়াত ১০০; সাবা, আয়াত ৪০ থেকে ৪১ এবং আস সাফ্ফাত আয়াত ১৫৮।

এসব বিশদ আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, জিনরা একটা স্বতন্ত্র বহি:সত্তার অধিকারী এবং তারা মানুষের থেকে ভিন্ন প্রজাতির আরেকটি অদৃশ্য সৃষ্টি। তাদের রহস্যজনক গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অস্তিত্ব ও শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে কিছু অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করে আসছিলো এমনকি তাদের পূজা করতে শুরু করেছিল। কিন্তু কুরআন তাদের ব্যাপারে প্রকৃত সত্য একেবারে খোলাসা করে বলে দিয়েছে যা থেকে তারা কি এবং কি নয় তা ভালভাবে জানা যায়।
(৭২-জ্বিন) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য: জিনদের একটি দল কুরআন শুনার পর তার কি প্রভাব গ্রহণ করেছিল এবং ফিরে গিয়ে নিজ জাতির অন্যান্য জিনদের কি কি কথা বলেছিল, এ সূরার প্রথম আয়াত থেকে ১৫ আয়াত পর্যন্ত তা-ই বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা তাদের সব কথাবার্তা এখানে উল্লেখ করেননি। বরং উল্লেখযোগ্য বিশেষ বিশেষ কথাগুলোই উল্লেখ করেছেন। তাই বর্ণনাভঙ্গি ধারাবাহিক কথাবার্তা বলার মত নয়। বরং তাদের বিভিন্ন উক্তি এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, যারা এরূপ এরূপ কথা বলেছে। জিনদের মুখ থেকে উচ্চারিত এসব উক্তি যদি মানুষ গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ে তাহলে সহজেই একথা বুঝা যাবে যে, তাদের ঈমান আনার এ ঘটনা এবং নিজ জাতির সাথে কথোপকথন কুরআন মজীদে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের ব্যাখ্যায় আমি যে টীকা লিখেছি তাতে তাদের উক্তিসমূহের যে ব্যাখ্যা পেশ করেছি এ উদ্দেশ্য বুঝতে তা আরো অধিক সাহায্য করবে।

তারপর ১৬ থেকে ১৮ পর্যন্ত আয়াতে লোকদের বুঝানো হয়েছে যে, তারা যদি শির্ক পরিত্যাগ করে এবং সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে অবিচল থাকে তাহলে তাদের প্রতি অজস্র নিয়ামত বর্ষিত হবে। অন্যথায় আল্লাহর পাঠানো এ উপদেশবাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পরিণামে তারা কঠিন আযাবের মধ্যে নিপতিত হবে। অত:পর ১৯ থেকে ২৩ পর্যন্ত আয়াতে মক্কার কাফেরদের তিরস্কার করা হয়েছে। কারণ আল্লাহর রসূল যখন আল্লাহর দিকে উচ্চকণ্ঠে আহবান জানান তখন তারা তার ওপরে হামলা করতে উদ্যত হয়। অথচ আল্লাহর বাণী পৌছিয়ে দেয়াই রসূলের দায়িত্ব। তিনি তো এ দাবি করেছেন না যে, মানুষের ভালমন্দ এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ তারই ইখতিয়ারে। এরপর ২৪ থেকে ২৫ আয়াতে কাফেরদের এ মর্মে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে যে, আজ তারা রসূলের বন্ধুহীন ও অসহায় দেখে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এমন এক সময় আসবে যখন তারা জানতে পারবে, প্রকৃতপক্ষে বন্ধুহীন ও অসহায় কারা? সে সময়টি দূরে না নিকটে রসূল তা জানেন না। কিন্তু সেটি অবশ্যই আসবে। সব শেষে লোকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আলেমুল গায়েব বা গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই আছে। রসূল শুধু ততটুকুই জানতে পারেন যতটুকু আল্লাহ তাঁকে জানান। এ জ্ঞানও হয় রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন সম্পর্কিত বিষয়ে। এমন সুরক্ষিত পন্থায় রসূলকে এ জ্ঞান দেয়া হয় যার মধ্যে বাইরে থেকে হস্তক্ষেপের আদৌ কোন সম্ভবনা থাকে না।
সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১

قُلْ اُوْحِیَ اِلَیَّ اَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الْجِنِّ فَقَالُوْۤا اِنَّا سَمِعْنَا قُرْاٰنًا عَجَبًاۙ

হে নবী, বল, আমার কাছে অহী পাঠানো হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। তারপর (ফিরে গিয়ে নিজ জাতির লোকদেরকে) বলেছেঃ “আমরা এক বিস্ময়কর “কুরআন” শুনেছি।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এ থেকে জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ সে সময় জিনদের দেখতে পাচ্ছিলেন না এবং তারা যে কুরআন শুনছে একথাও তাঁর জানা ছিল না। পরবর্তী সময়ে আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁকে অহীর মাধ্যমে এ ঘটনা জানিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনাটির বর্ণনা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সে সময় রসূলুল্লাহ ﷺ জিনদের উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করেননি এবং তিনি তাদের দেখেনওনি। ” (মুসলিম, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর)

# মূল আয়াতে قُرْاَناً عَجَبًا (কুরআনান আজাবান) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। “কুরআন” মানে পড়ার মত জিনিস। জ্বীনেরা সম্ভবত শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহার করেছিল। কারণ তখন তারা প্রথম বারের মত এ বাণীর সাথে পরিচিত হয়েছিল। সে সময় হয়তো তাদের জানা ছিল না যে, যে জিনিস তারা শুনছে তার নামই কুরআন। عجب (আজাবা) আধিক্য অর্থনির্দেশক একটি শব্দ। আরবী ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় অত্যধিক বিস্ময়কর ব্যাপার বুঝাতে। সুতরাং জিনদের উক্তির অর্থ হলো, আমরা এমন একটি বাণী শুনে এসেছি যা ভাষাগত উৎকর্ষতা ও বিষয়বস্তু হিসেবে অতুলনীয়। এ থেকে জানা যায় যে, জিনরা শুধু মানুষের কথা শুনতে পারে তাই নয়, তারা মানুষের ভাষাও ভালভাবে বুঝতে পারে। তবে এটা জরুরী নয় যে, সব জিন মানুষের সব ভাষাই জানবে বা বুঝবে। সম্ভবত তাদের যে গোষ্ঠী পৃথিবীর যে এলাকায় বসবাস করে তারা সে এলাকার মানুষের ভাষা জানে। তবে কুরআনের এ বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐ সময় যেসব জিন কুরআন শুনেছিল তারা আরবী ভাষায় এত দক্ষ ছিল যে, তারা এ বাণীর অতুলনীয় ভাষাগত উৎকর্ষ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এর উচ্চমানের বিষয়বস্তুও ভালভাবে বুঝতে পেরেছিল।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২

یَّهْدِیْۤ اِلَى الرُّشْدِ فَاٰمَنَّا بِهٖ١ؕ وَ لَنْ نُّشْرِكَ بِرَبِّنَاۤ اَحَدًاۙ

যা সত্য ও সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা আর কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করবো না।”

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এ থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেল। এক, জিনরা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর “রব” হওয়াকে অস্বীকার করে না। দুই, তাদের মধ্যেও মুশরিক আছে যারা মুশরিক মানুষের মত অন্য জিনিসকে আল্লাহর উলুহিয়াতের মধ্যে শরীক করে। তাই জিনদের যে কওমের সদস্যরা কুরআন মজীদ শোনার পর কওমের কাছে ফিরে গিয়েছিল তারাও ছিল মুশরিক। তিন, নবুওয়াত এবং আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল হওয়ার ধারা জিনদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। বরং তাদের মধ্যে যেসব জিন ঈমান আনে তারা মানুষের মধ্যে প্রেরিত নবী এবং তাদের আনীত কিতাবসমূহের ওপর-ই ঈমান আনে। একথাটি সূরা আহকাফের ২৯-৩১ আয়াত থেকেও জানা যায়। ঐ আয়াত গুলোতে বলা হয়েছে, সে সময় যেসব জিন কুরআন শুনেছিল তারা হযরত মূসার অনুসারী ছিল। তারা কুরআন শোনার পর নিজের কওমকে এ মর্মে দাওয়াত দিয়েছিল যে, এখন আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বানী এসেছে এবং পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপন্ন করছে তার ওপর ঈমান আনো। সূরা আর রহমানও এ বিষয়টিই প্রমাণ করে। কারণ তার পুরা বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় যে, মানুষ ও জিন শুধু এ দু’টি সৃষ্টিই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে ছিল।

সুরা: আল-জ্বিন আয়াত নং :-৩

, وَّ اَنَّهٗ تَعٰلٰى جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَّ لَا وَلَدًاۙ
আর “আমাদের রবের মর্যাদা অতীব সমুচ্চ। তিনি কাউকে স্ত্রী কিংবা সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেননি।”

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# এখান থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল। এ জিনগুলো হয় ঈসায়ী বা খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল অথবা অন্য এমন কোন ধর্মের অনুসারী ছিল যে ধর্মে মহান আল্লাহর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আছে বলে বিশ্বাস করা হতো। দুই, সে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের মধ্যে পবিত্র কুরআনের এমন কোন অংশ তিলাওয়াত করছিলেন যা শুনে তাদের কাছে নিজেদের আকীদার ভ্রান্তি ধরা পড়েছিল এবং তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মহান আল্লাহর সমুন্নত ও অতি মর্যাদাবান সত্তার সাথে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সম্পর্কিত করা চরম অজ্ঞতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-৪

وَّ اَنَّهٗ كَانَ یَقُوْلُ سَفِیْهُنَا عَلَى اللّٰهِ شَطَطًاۙ

আর “আমাদের নির্বোধ লোকেরা আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী অনেক কথাবার্তা বলে আসছে।”

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মূল আয়াতে سَفِيْهُنَا (ছাফিহুনা) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি এক ব্যক্তির জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে আবার অনেক লোক বা দলের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। যদি শব্দটি একজন অজ্ঞ বা মূর্খ লোক অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার মানে হবে ইবলীস। আর যদি অনেক লোক বা দলের অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে অর্থ হবে জিনদের মধ্য থেকে অনেক নির্বোধ ও বুদ্ধি-বিবেকহীন লোক এ রকম কথা বলতো।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-৫

وَّ اَنَّا ظَنَنَّاۤ اَنْ لَّنْ تَقُوْلَ الْاِنْسُ وَ الْجِنُّ عَلَى اللّٰهِ كَذِبًاۙ

আর “আমরা মনে করেছিলাম যে, মানুষ এবং জিন আল্লাহর সম্বন্ধে কখনো মিথ্যা বলতে পারে না।”

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# তাদের ভ্রান্ত কথাবার্তা দ্বারা আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ হলো, আমরা কোন সময় চিন্তাও করতে পারিনি যে, মানুষ কিংবা জিন আল্লাহ‌ সম্পর্কে মিথ্যা বলার দুঃসাহসও করতে পারে কিন্তু এখন এ কুরআন শুনে আমরা জানতে পেরেছি যে, প্রকৃত পক্ষে তারা ছিল মিথ্যাবাদী।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-৬

وَّ اَنَّهٗ كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْاِنْسِ یَعُوْذُوْنَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوْهُمْ رَهَقًاۙ

আর “মানুষের মধ্য থেকে কিছু লোক জ্বীনদের কিছু লোকের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতো। এভাবে তারা জ্বীনদের অহংকার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।”

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# ইবনে আব্বাস বলেনঃ জাহেলী যুগে আরবরা যখন কোন জনহীন প্রান্তরে রাত্রি যাপন করতো তখন উচ্চস্বরে বলতো, “আমরা এ প্রান্তরের অধিপতি জ্বীনের আশ্রয় প্রার্থনা করছি। “জাহেলী যুগের অন্যান্য বর্ণনাতেও এ বিষয়টির বহুল উল্লেখ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কোন জায়গায় পানি এবং ঘাস ফুরিয়ে গেলে মুরুচারী যাযাবর বেদুঈনরা তাদের একজন লোককে এমন আরেকটি জায়গা খুঁজে বের করতে পাঠাতো যেখানে পানি এবং ঘাস পাওয়া যেতে পারে। অতঃপর উক্ত ব্যক্তির নির্দেশনা মুতাবিক এসব লোক নতুন জায়গায় পৌঁছলে সেখানে অবস্থান নেয়ার আগে চিৎকার করে বলতোঃ আমরা এ প্রান্তরের মালিকের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা এখানে সব রকম বিপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারি। ” তাদের বিশ্বাস ছিল, প্রত্যেক জনমানবহীন জায়গা কোন না কোন জ্বীনের দখলে আছে। তার আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়াই কেউ যদি সেখানে অবস্থান করে তাহলে সে জিন হয় নিজেই তাদের উত্যক্ত করে কিংবা অন্য জিনদের উত্যক্ত করার জন্য লেলিয়ে দেয়। ঈমান আনয়নকারী এ জিনরা এ বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করেছে। তাদের কথার অর্থ হলো এ পৃথিবীর খলিফা বা প্রতিনিধি মানুষ। তারাই যখন উল্টা আমাদের ভয় করতে শুরু করেছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের আশ্রয় প্রার্থনা করতে শুরু করেছে তখন আমাদের জাতির লোকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের গর্ব, অহংকার এবং কুফরী ও জুলুম অত্যাচারের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গিয়েছে এবং গোমরাহীর ক্ষেত্রে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-৭

وَّ اَنَّهُمْ ظَنُّوْا كَمَا ظَنَنْتُمْ اَنْ لَّنْ یَّبْعَثَ اللّٰهُ اَحَدًاۙ

আর “তোমরা যেমন ধারণা পোষণ করতে মানুষেরাও ঠিক তেমনি ধারণা পোষণ করেছিল যে, আল্লাহ‌ কাউকে রসূল বানিয়ে পাঠাবেন না।”

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মূল ভাষ্য হচ্ছে اَنْ لَّنْ يُّبْعَثَ اللهُ اَحَدًا এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি আমরা যা অনুবাদ করেছি। অপরটি হলো, “মৃত্যুর পর আল্লাহ‌ তা’আলা কাউকে আর জীবিত করে উঠাবেন না। ” যেহেতু কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক তাই তার এ অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, মানুষের মত জিনদের মধ্যে একদল আখেরাতকে অস্বীকার করতো। কিন্তু পরবর্তী বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যের দিক থেকে প্রথম অর্থটিই অধিক অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। কারণ, পরবর্তী আয়াতসমূহে এ বিষয়টির উল্লেখ আছে যে, ঈমান আনয়নকারী এসব জিন তাদের কওমকে বলছে, আল্লাহ‌ আর কোন রসূল পাঠাবেন না। তোমাদের এ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের জন্য আসমানের দরজা বন্ধ করার কারণ হলো আল্লাহ‌ একজন রসল পাঠিয়েছেন।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-৯

وَّ اَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ١ؕ فَمَنْ یَّسْتَمِعِ الْاٰنَ یَجِدْ لَهٗ شِهَابًا رَّصَدًاۙ

আর “ইতিপূর্বে আমরা ছিঁটেফোটা কিছু আড়ি পেতে শোনার জন্য আসমানে বসার জায়গা পেয়ে যেতাম। কিন্তু এখন কেউ গোপনে শোনার চেষ্টা করলে সে তার নিজের বিরুদ্ধে নিক্ষেপের জন্য একটি উল্কা নিয়োজিত দেখতে পায়।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এটাই সে কারণ যার ভিত্তিতে জিনরা এ বিষয়টি অনুসন্ধান করতে বেরিয়েছিল যে, পৃথিবীতে এমন কি ঘটনা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে যার খবরাখবর সুরক্ষিত করার জন্য এমন কঠোর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এখন আমরা ঊর্ধ্ব জগতের কোন খবর জানার সুযোগ পাই না এবং যেখানেই যাই আমাদের মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১০

وَّ اَنَّا لَا نَدْرِیْۤ اَشَرٌّ اُرِیْدَ بِمَنْ فِی الْاَرْضِ اَمْ اَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَدًاۙ

আর আমাদের বোধগম্য হচ্ছিল না যে, পৃথিবীবাসীদের সাথে কোন খারাপ আচরণ করার সংকল্প করা হয়েছে, নাকি তাদের প্রভু, তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে চান?

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এ থেকে জানা গেল যে, দু’টি পরিস্থিতিতে ঊর্ধ্ব জগতে এ ধরনের অসাধারণ ব্যবস্থাদি গৃহীত হয়ে থাকে।

এক, আল্লাহ‌ যদি পৃথিবী বাসীদের ওপর কোন আযাব নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং চান যে, তা নাযিল হওয়ার আগে জিনরা তার পূর্বাভাস পেয়ে তাদের মানুষ বন্ধুদের সাবধান করে না দিক।

দুই, আল্লাহ‌ যদি পৃথিবীতে কোন রসূল পাঠিয়ে থাকেন এবং তাঁর কাছে যেসব হিদায়াত ও বাণী পাঠানো হচ্ছে তাতে শয়তানরা যাতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং রসূলের কাছে কি কি হিদায়াত বা বানী পাঠানো হচ্ছে তা আগেভাগেই জেনে নিতে না পারে তার নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ কাম্য হয় তখন এ ধরনের অসাধারণ ব্যবস্থাটি গ্রহীত হয়। সুতরাং জিনদের একথাটির অর্থ হলো, আমরা যখন আসমানে এরূপ কঠোর প্রহরা দেখলাম এবং অজস্র উল্কা বর্ষণ লক্ষ করলাম তখন এ দু’টি অবস্থার কোনটি সংঘটিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে তা জানার উদ্বেগ সৃষ্টি হলো। আল্লাহ‌ তা’আলা কি হঠাৎ করে পৃথিবীর কোন জাতির ওপর আযাব নাযিল করেছেন না কোন এলাকায় কোন রসূল পাঠিয়েছেন? এ বিষয়টি অনুসন্ধানেই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। এরই এক পর্যায়ে আমরা এ বিস্ময়কর বাণী শুনতে পেলাম যা সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান দান করে। এভাবে আমরা জানতে পেরেছি, আল্লাহ‌ কোন আযাব নাযিল করেননি। বরং তাঁর সৃষ্টিকে সত্য ও সঠিক পথ দেখানোর জন্য একজন রসূল পাঠিয়েছেন। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হিজর, টীকা ৮ থেকে ১২ ; সূরা সাফ্ফাত, টীকা ৭ এবং সূরা আল মুলক টীকা ১১ )

# অর্থাৎ আমাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের দিক থেকেও ভাল ও মন্দ দু’প্রকারের জিন আছে এবং আকীদা-বিশ্বাসের দিক থেকেও মত ও পথ একটি নয়। এক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একথা বলে ঈমান আনয়নকারী এসব জিন নিজ জাতির জিনদের বুঝাতে চাচ্ছিল যে, নিঃসন্দেহে আমরা সত্য ও সঠিক পথ খুঁজে বের করার মুখাপেক্ষী। এর প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১২

وَّ اَنَّا ظَنَنَّاۤ اَنْ لَّنْ نُّعْجِزَ اللّٰهَ فِی الْاَرْضِ وَ لَنْ نُّعْجِزَهٗ هَرَبًاۙ

আর আমরা মনে করতাম যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম করে দিতে সক্ষম নই এবং পালিয়েও তাঁকে পরাভূত করতে পারবো না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# আমাদের এ ধারণাই আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। আমরা যেহেতু আল্লাহ‌ সম্পর্কে নির্ভয় বা বেপরোয়া ছিলাম না এবং এ ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, যদি আমরা তাঁর অবাধ্য হই তাহলে তাঁর পাকড়াও থেকে কোন অবস্থায়ই বাঁচতে পারবো না। তাই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শনকারী বাণী শুনে ন্যায় ও সত্যকে জানার পরও অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকদের প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত আকীদা-বিশ্বাসকেই আঁকড়ে থাকার দুঃসাহস আমরা দেখাইনি।

সুরা: আল-জ্বিন আয়াত নং :-১৩

, وَّ اَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدٰۤى اٰمَنَّا بِهٖ١ؕ فَمَنْ یُّؤْمِنْۢ بِرَبِّهٖ فَلَا یَخَافُ بَخْسًا وَّ لَا رَهَقًاۙ

আর আমরা যখন হিদায়াতের বানী শুনলাম তখন তার প্রতি ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তিই তার রবের ওপর ঈমান আনবে তার অধিকার বিনষ্ট হওয়ার কিংবা অত্যাচারিত হওয়ার ভয় থাকবে না।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন: #অধিকার বিনষ্ট হওয়ার অর্থ হলো, নেক কাজের জন্য যতটা পারিশ্রমিক বা পুরস্কার পাওয়ার কথা তার চাইতে কম দেয়া। আর জুলুম বা অত্যাচার হলো নেক কাজের জন্য আদৌ কোন পারিশ্রমিক বা পুরস্কার না দেয়া এবং তার দ্বারা যে ত্রুটি বা অপরাধ হয়েছে তার তুলনায় অধিক শাস্তি দেয়া, কিংবা অপরাধ ছাড়াই কাউকে শাস্তি দেয়া। আল্লাহ‌ তা’আলার দরবারে কোন ঈমানদারের প্রতি এ ধরনের কোন বে-ইনসাফী হওয়ারআশঙ্কা থাকবে না।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১৫

وَ اَمَّا الْقٰسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَبًاۙ

আর যারা ন্যায় ও সত্য থেকে বিমুখ তারা হবে জাহান্নামের ইন্ধন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# কুরআনের ভাষ্য অনুসারে জ্বীনেরা আগুন থেকে সৃষ্ট। তাই প্রশ্ন হতে পারে যে, জাহান্নামের আগুন দ্বারা তাদের আবার কি কষ্ট হবে? এর জবাব হলো, কুরআনের ভাষ্য অনুসারে মানুষও মাটি থেকে সৃষ্ট। তা সত্ত্বেও তাদের মাটির ঢিল ছুঁড়ে মারলে ব্যাথা পায় কেন? প্রকৃত সত্য হলো মানুষের গোটা দেহ মাটির উপাদান দ্বারা তৈরী হলেও এসব উপাদান থেকে যখন একজন রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ অস্তিত্ব লাভ করে তখন সে এসব উপাদান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিসে রূপান্তরিত হয় এবং একই উপাদান থেকে তৈরী অন্যান্য জিনিস তার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনিভাবে গঠনাকৃতির দিক থেকে জিন যদিও আগুনের তৈরী। কিন্তু আগুন থেকে তৈরী একটি জীবন্ত ও চেতনা সম্পন্ন সৃষ্টি যখন অস্তিত্ব লাভ করে তখন সে আগুনই তার জন্যে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা আর রহমান, টীকা ১৫)
সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১৬

وَّ اَنْ لَّوِ اسْتَقَامُوْا عَلَى الطَّرِیْقَةِ لَاَسْقَیْنٰهُمْ مَّآءً غَدَقًاۙ

আর (হে নবী, বলে দাও, আমাকে অহীর মাধ্যমে এও জানানো হয়েছে যে,) লোকেরা যদি সঠিক পথের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে আমি তাদের প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণের মধ্যে সমৃদ্ধ করতাম।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এর পূর্বে জিনদের কথা শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন এখান থেকে আল্লাহ‌ তা’আলা নিজের কথা শুরু হচ্ছে।

# একথাটিই সুরা নূহে এভাবে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। “(ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূহ, টীকা ২) প্রচুর পরিমাণ পানিকে নিয়ামতের প্রাচুর্য অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা, পানির ওপর নির্ভর করেই জনবসতি গড়ে ওঠে। পানি না থাকলে আদৌ কোন জনপদ গড়ে উঠতে পারে না। পানি না থাকলে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন যেমন পূর্ণ হয় না তেমনি মানুষের বিভিন্ন রকম শিল্পও গড়ে উঠতে পারে না।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:

# অর্থাৎ তিনি দেখতে চান তারা নিয়ামত লাভ করার পর কৃতজ্ঞ থাকে কিনা এবং আমার দেয়া নিয়ামতসমূহ সঠিক ভাবে কাজে লাগায়, না ভ্রান্ত পথে কাজে লাগায়।

# স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার একটা অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর প্রেরিত উপদেশ গ্রহণ করবে না। আরেকটি অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর যিকরের কথা শোনা পছন্দই করবে না। এর আরেকটি অর্থ হলো, সে আল্লাহর ইবাদাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-১৮

وَّ اَنَّ الْمَسٰجِدَ لِلّٰهِ فَلَا تَدْعُوْا مَعَ اللّٰهِ اَحَدًاۙ

আর মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। তাই তোমরা আল্লাহর সাথে আর কাউকে ডেকো না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মুফাস্সিরগণ مَسَاجِد (মাছাজিদ) শব্দটি সাধারণভাবে ইবাদাতখানা বা উপসানলায় অর্থে গ্রহণ করেছেনঃ “মাসাজিদ” শব্দটি এ অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতটির অর্থ হয় “উপাসনালয় সমূহে আল্লাহর ইবাদাতের সাথে সাথে আর কারো ইবাদাত যেন করা না হয়। হযরত হাসান বাসরী বলেনঃ সমস্ত পৃথিবীটাই ইবাদাতখানা বা উপাসনালয়। তাই আয়াতটির মূল বক্তব্য হলো আল্লাহর এ পৃথিবীতে কোথাও যেন শিরক করা না হয়। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী থেকে প্রমাণ পেশ করেছেন وَجُعِلَتْ لِىَ الاَرْضُ مَسْجِدًا وَطُهُوْرًا (আমার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে ইবাদতের স্থান এবং পবিত্রতা অর্জনের উপায় বানিয়ে দেয়া হয়েছে)। হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর মসজিদ বলতে যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ সিজদা করে সেগুলো অর্থাৎ হাত, হাঁটু, পা ও কপাল বুঝিয়েছেন। এ ব্যাখ্যানুসারে আয়াতটির অর্থ হলো, সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর তৈরী। এগুলোর সাহায্যে একমাত্র আল্লাহ‌ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা যাবে না।

সুরা: আল-জ্বিন আয়াত নং :-১৯

, وَّ اَنَّهٗ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللّٰهِ یَدْعُوْهُ كَادُوْا یَكُوْنُوْنَ عَلَیْهِ لِبَدًا٢ؕ۠

আর আল্লাহর বান্দা যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন তারা সবাই তার ওপর হামলা করতে উদ্যত হলো।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে আল্লাহর বান্দা অর্থ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২০

قُلْ اِنَّمَاۤ اَدْعُوْا رَبِّیْ وَ لَاۤ اُشْرِكُ بِهٖۤ اَحَدًا

হে নবী, বলো “আমি শুধু আমার রবকেই ডাকি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# অর্থাৎ আল্লাহকে ডাকা এমন কোন আপত্তিকর কাজ নয় যার জন্য মানুষ এতটা রাগান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়বে। তবে কেউ যদি আল্লাহর সাথে তাঁর প্রভুত্ব ও উলুহিয়্যাতের ব্যাপারে কাউকে শরীক করে তাহলে তা নিঃসন্দেহে খারাপ। আর এ কাজ আমি করিনি। বরং যারা আল্লাহর নাম শুনে আমার ওপর হামলা করতে চায় তারাই এ কাজ করেছে।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২৩

اِلَّا بَلٰغًا مِّنَ اللّٰهِ وَ رِسٰلٰتِهٖ١ؕ وَ مَنْ یَّعْصِ اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَاِنَّ لَهٗ نَارَ جَهَنَّمَ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًاؕ

আল্লাহর বাণী ও হুকুম-আহকাম পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার কাজ আর কিছুই নয়। এরপর যারাই আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের কথা অমান্য করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। এ ধরনের লোকেরা চিরকাল সেখানে থাকবে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# আমি কখনো এ দাবী করি না যে, আল্লাহর প্রভুত্বে আমার কোন দখলদারী বা কর্তৃত্ব আছে। কিংবা মানুষের ভাগ্য ভাঙা বা গড়ার ব্যাপারে আমার কোন ক্ষমতা আছে। আমি তো আল্লাহর একজন রসূল মাত্র। আমার ওপর যে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা তোমাদের কাছে আল্লাহ‌ তা’আলার বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার অধিক আর কিছুই নয়। আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ব্যাপার তো পুরোপুরি আল্লাহরই করায়ত্ব। অন্য কারো কল্যাণ বা ক্ষতি সাধন তো দূরের কথা নিজের ক্ষতি ও কল্যাণের ব্যাপারটিও আমার নিজের ইচ্ছাধীন নয়। আমি যদি আল্লাহর নাফরমানী করি তাহলে তাঁর পাকড়াও থেকে আত্মরক্ষা করে কোথাও আশ্রয় লাভ করতে পারবো না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে ছাড়া আমার আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা আশ্ শূরা, টীকা ৭)

# এর অর্থ এই নয় যে, প্রতিটি গোনাহ ও অপরাধের শাস্তিই হচ্ছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। বরং যে প্রসঙ্গে একথাটি বলা হয়েছে তার আলোকে আয়াতের অর্থ হলো আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে তাওহীদের যে আহবান জানানো হয়েছে তা যে ব্যক্তি মানবে না এবং শিরককেও বর্জন করবে না তার জন্য অবধারিত আছে জাহান্নামের চিরস্থায়ী শাস্তি।

আল-জ্বিন আয়াত নং :-২৪

حَتّٰۤى اِذَا رَاَوْا مَا یُوْعَدُوْنَ فَسَیَعْلَمُوْنَ مَنْ اَضْعَفُ نَاصِرًا وَّ اَقَلُّ عَدَدًا

(এসব লোক তাদের এ আচরণ থেকে বিরত হবে না) এমনকি অবশেষে যখন তারা সে জিনিসটি দেখবে যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হচ্ছে, তখন তারা জানতে পারবে যে, কার সাহায্যকারী দুর্বল এবং কার দল সংখ্যায় কম।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:

# এ আয়তটির পটভূমি হলো, সে যুগে যেসব লোক আল্লাহর পথের দিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহবান শুনেই তাঁর ওপর মারমুখী হতো তারা এ খোশ খেয়ালে নিমগ্ন ছিল যে, তাদের দলবলই বড়। অপরদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আছে আঙুলে গোণা কয়েকজন লোক। সুতরাং তারা অতি সহজেই তাকে পরাভূত করতে সক্ষম হবে। তাই বলা হচ্ছে, আজ এসব লোক রসূলকে ﷺ অসহায় ও বন্ধুহীন এবং নিজেদের সংখ্যাধিক্য দেখে ন্যায় ও সত্যের কণ্ঠ স্তদ্ধ করে দিতে দুঃসাহস দেখাচ্ছে। কিন্তু যে সময় সম্পর্কে তাদের সাবধান করে দেয়া হচ্ছে সে দুঃসময়টি যখন আসবে, তখন তারা বুঝতে পারবে প্রকৃত পক্ষে অসহায় ও বন্ধুহীন কারা।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২৫

قُلْ اِنْ اَدْرِیْۤ اَقَرِیْبٌ مَّا تُوْعَدُوْنَ اَمْ یَجْعَلُ لَهٗ رَبِّیْۤ اَمَدًا

বলো, আমি জানি না, যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা নিকটে, না তার জন্য আমার রব কোন দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করছেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# বর্ণনাভঙ্গি থেকেই বুঝা যায়, এটি একটি প্রশ্নের জওয়াব। এখানে প্রশ্নটি উল্লেখ না করে শুধু তার জবাব দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ওপরে উল্লেখিত কথা শুনে বিরোধীরা বিদ্রূপের ভঙ্গীতে প্রশ্ন করে থাকবে যে, যে সময়ের ভয় তিনি দেখাচ্ছেন সে সময়টি কখন আসবে? তার জবাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের বলো, সে সময়টি আগমন তো নিশ্চিত, তবে তার আগমনের দিনক্ষণ আমাকে জানানো হয়নি। সে সময়টি অতি আসন্ন, না তার জন্য দীর্ঘ সময় নির্দিষ্ট রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ‌ তা’আলাই জানেন।
সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২৬

عٰلِمُ الْغَیْبِ فَلَا یُظْهِرُ عَلٰى غَیْبِهٖۤ اَحَدًاۙ

তিনি গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# গায়েবী বিষয়ের সবটুকু জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। গায়েবী বিষয়ের এ পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তিনি কাউকেই দেন না।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২৭

اِلَّا مَنِ ارْتَضٰى مِنْ رَّسُوْلٍ فَاِنَّهٗ یَسْلُكُ مِنْۢ بَیْنِ یَدَیْهِ وَ مِنْ خَلْفِهٖ رَصَدًاۙ

তবে যে রসূলকে (গায়েবী বিষয়ের কোন জ্ঞান দেয়ার জন্য) মনোনীত করেছেন তাকে ছাড়া। তিনি তার সামনে ও পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# রসূল নিজে “আলেমুল গায়েব” বা গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী নন। বরং আল্লাহ‌ তা’আলা যখন তাকে রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য মনোনীত করেন তখন তিনি ইচ্ছামত তাঁকে অদৃশ্য বস্তুসমূহের জ্ঞান দান করেন

# প্রহরী মানে ফেরেশতা। অর্থাৎ আল্লাহ‌ তা’আলা যখন অহীর মাধ্যমে গায়েবী বিষয়ের গভীর জ্ঞান ও তাৎপর্য তাঁর রসূলের কাছে পাঠান তখন তার রক্ষণাবেক্ষণ ও পাহারাদারীর জন্য সবখানে ফেরেশতা মোতায়েন করেন। যাতে সে জ্ঞানটি অত্যন্ত সুরক্ষিত পন্থায় রসূলের কাছে পৌঁছতে পারে এবং তার মধ্যে বাইরের কোন কিছু সংমিশ্রত হতে না পারে। ওপরে ৮ও ৯ নং আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জ্বীনরা দেখলো তাদের ঊর্ধ্ব জগতে প্রবেশের সব পথ বন্ধ। তারা দেখলো সব জায়গায় কঠোর প্রহরা বসানো হয়েছে যার কারণে ছিটে ফোঁটা কিছু আভাস লাভের সুযোগও তাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

সুরা: আল-জ্বিন
আয়াত নং :-২৮

لِّیَعْلَمَ اَنْ قَدْ اَبْلَغُوْا رِسٰلٰتِ رَبِّهِمْ وَ اَحَاطَ بِمَا لَدَیْهِمْ وَ اَحْصٰى كُلَّ شَیْءٍ عَدَدًا۠

যাতে তিনি নিশ্চিতরূপে জানতে পারেন যে, রসূলগণ তাদের রবের বাণীসমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছেন তিনি তাদের গোটা পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। আর তিনি প্রতিটি জিনিস গুণে গুণে হিসেব করে রেখেছেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এর তিনটি অর্থ হতে পারে। এক, রসূল নিশ্চিতভাবে জানবেন যে, ফেরেশতারা তাঁর কাছে আল্লাহ‌ তা’আলার বাণীসমূহ ঠিক ঠিক পৌঁছিয়ে দিয়েছে। দুই, আল্লাহ‌ তা’আলা জানবেন যে, ফেরেশতারা তাদের রবের বাণীসমূহ তাঁর রসূলের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তিন, আল্লাহ‌ তা’আলা জানবেন যে রসূলগণ তাঁদের রবের বাণীসমূহ তাঁর বান্দাদের কাছে ঠিকমত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আয়াতটির শব্দমালা এ তিনটি অর্থেরই ধারক। অসম্ভব নয় যে, এখানে যুগপৎ এ তিনটি অর্থই বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও আয়াতটির আরো দু’টি অর্থ হয়। প্রথমটি হলো রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য রসূলকে যতটুকু “ইলমে গায়েব” বা অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান দান করা জরুরী ততটুকু জ্ঞান দান করা। দ্বিতীয়টি হলো, যেসব ফেরেশতাকে প্রহরা কাজে নিয়োজিত করা হয় তারা রসূল পর্যন্ত সুরক্ষিত পন্থায় অহী পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারটুকুই শুধু তত্ত্বাবধান করেন না বরং রসূল তাঁর রবের বাণীসমূহ তাঁর বান্দাদের কাছে যাতে পুরোপুরি পৌঁছিয়ে দিতে পারেন তার তত্ত্বাবধানও করে থাকেন।

# আল্লাহর ক্ষমতা রসূল ও ফেরেশতা উভয়কে এমনভাবে পরিব্যাপ্ত করে আছে যে, তারা যদি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুল পরিমাণ কাজও করেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও হবেন। আর যে বাণীসমূহ আল্লাহ‌ পাঠান তার প্রতিটি বর্ণ গোণা ও হিসেব করা। তার একটি বর্ণের হ্রাস-বৃদ্ধি করার ক্ষমতাও রস

সুরা: আন-নাস

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে * ভূমিকা:১১৪

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : নামকরণ:

কুরআন মজীদের এ শেষ সূরা দু’টি আলাদা আলাদা সূরা ঠিকই এবং মূল লিপিতে এ সূরা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন নামেই লিখিত হয়েছে, কিন্তু এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত গভীর এবং উভয়ের বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এত বেশী নিকট সম্পর্ক রাখে যার ফলে এদের একটি যুক্ত নাম “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা) রাখা হয়েছে। ইমাম বায়হাকী তাঁর “দালায়েলে নবুওয়াত” বইতে লিখেছেন: এ সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে। তাই উভয়ের যুক্ত নাম রাখা হয়েছে “মু’আওবিযাতাইন”। আমরা এখানে উভয়ের জন্য একটি সাধারণ ভূমিকা লিখছি। কারণ, এদের উভয়ের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী ও বক্তব্য সম্পূর্ণ একই পর্যায়ভুক্ত। তবে ভূমিকায় একত্র করার পর সামনের দিকে প্রত্যেকের আলাদা ব্যাখ্যা করা হবে।

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

হযরত হাসান বসরী, ইকরামা, আতা ও জাবের ইবনে যায়েদ বলেন, এ সূরা দু’টি মক্কী। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকেও এ ধরনের একটি উক্তি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর অন্য একটি বর্ণনায় একে মাদানী বলা হয়েছে। আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা:) ও কাতাদাহও একই উক্তি করেছেন। যে সমস্ত হাদীস এ দ্বিতীয় বক্তব্যটিকে শক্তিশালী করে তার মধ্যে মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বলে, হযরত উকবা ইবনে আমের (রা:) বর্ণিত একটি হাদীস হচ্ছে: একদিন রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেন:

أَلَمْ تَرَ آيَاتٍ أُنْزِلَتِ اللَّيْلَةَ , لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ , أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ-

“তোমরা কি কোন খবর রাখো, আজ রাতে আমার ওপর কেমন ধরনের আয়াত নাযিল হয়েছে? নজীরবিহীন আয়াত! কুল আউযু বি রব্বিল ফালাক এবং কুল আউযু বি রব্বিন নাস।”

হযরত উকবা ইবনে আমের (রা:) হিজরতের পরে মদীনা তাইয়েবায় ইসলাম গ্রহণ করেন বলেই এ হাদীসের ভিত্তিতে এ সূরা দু’টিকে মাদানী বলার যৌক্তিকতা দেখা দেয়। আবু দাউদ ও নাসাঈ তাদের বর্ণনায় একথাই বিবৃত করেছেন। অন্য যে রেওয়ায়াতগুলো এ বক্তব্যকে শক্তিশালী করেছে সেগুলো ইবনে সা’দ, মুহিউস সুন্নাহ বাগাবী, ইমাম নাসাঈ, ইমাম বায়হাকী, হাফেজ ইবনে হাজার, হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী, আবদ ইবনে হুমায়েদ এবং আরো অনেকে উদ্ধৃত করেছেন। সেগুলোতে বলা হয়েছে: ইহুদীরা যখন মদীনায় রসূলুল্লাহ ﷺ এর ওপর যাদু করেছিল এবং তার প্রভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তখন এ সূরা নাযিল হয়েছিল। ইবনে সা’দ ওয়াকেদীর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, এটি সপ্তম হিজরীর ঘটনা। এরই ভিত্তিতে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাও এ সূরা দু’টিকে মাদানী বলেছেন।

কিন্তু ইতিপূর্বে সূরা ইখলাসের ভূমিকায় আমরা বলেছি, কোন সূরা বা আয়াত সম্পর্কে যখন বলা হয়, অমুক সময় সেটি নাযিল হয়েছিল। তখন এর অর্থ নিশ্চিতভাবে এ হয় না যে, সেটি প্রথমবার ঐ সময় নাযিল হয়েছিল। বরং অনেক সময় এমনও হয়েছে, একটি সূরা বা আয়াত প্রথমে নাযিল হয়েছিল, তারপর কোন বিশেষ ঘটনা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পুনর্বার তারই প্রতি বরং কখনো কখনো বারবার তার প্রতি নবী ﷺ এর দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়েছিল। আমাদের মতে সূরা নাস ও সূরা ফালাকের ব্যাপারটিও এ রকমের। এদের বিষয়বস্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, প্রথমে মক্কায় এমন এক সময় সূরা দু’টি নাযিল হয়েছিল যখন সেখানে নবী করীমের ﷺ বিরোধিতা জোরেশোরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন মদীনা তাইয়েবায় মুনাফিক, ইহুদী ও মুশরিকদের বিপুল বিরোধিতা শুরু হলো, তখন তাঁকে আবার ঐ সূরা দু’টি পড়ার নির্দেশ দেয়া হলো। ওপরে উল্লেখিত হযরত উকবা ইবনে আমেরের (রা:) রেওয়ায়াতে একথাই বলা হয়েছে। তারপর যখন তাঁকে যাদু করা হলো এবং তাঁর মানসিক অসুস্থতা বেশ বেড়ে গেলো তখন আল্লাহর হুকুমে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে আবার তাঁকে এ সূরা দু’টি পড়ার হুকুম দিলেন। তাই আমাদের মতে যেসব মুফাস্‌সির এ সূরা দু’টিকে মক্কী গণ্য করেন তাদের বর্ণনাই বেশী নির্ভরযোগ্য। সূরা ফালাকের শুধুমাত্র একটি আয়াত وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ ওয়া মিন শার্‌রিন্‌ নাফ্‌ফাসাতি ফিল উ’কাদ) যাদুর সাথে সম্পর্ক রাখে, এছাড়া আল ফালাকের বাকি সমস্ত আয়াত এবং সূরা নাসের সবক’টি আয়াত এ ব্যাপারে সরাসরি কোন সম্পর্ক রাখে না। যাদুর ঘটনার সাথে এ সূরা দু’টিকে সম্পর্কিত করার পথে এটিও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :

মক্কা মু’আয্‌যমায় এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে এ সূরা দু’টি নাযিল হয়েছিল। তখন ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই মনে হচ্ছিল, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ যেন ভীমরুলের চাকে হাত দিয়ে ফেলেছেন। তাঁর দাওয়াত যতই বিস্তার লাভ করতে থেকেছে কুরাঈশ বংশীয় কাফেরদের বিরোধিতাও ততোই বেড়ে যেতে থেকেছে। যতদিন তাদের আশা ছিল কোনরকম দেয়া-নেয়া করে অথবা ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তাঁকে ইসলামী দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারা যাবে, ততদিন তো বিদ্বেষ ও শত্রুতার তীব্রতার কিছুটা কমতি ছিল। কিন্তু নবী করীম ﷺ যখন দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সাথে কোন প্রকার আপোষ রফা করার প্রশ্নে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে দিলেন এবং সূরা আল কাফেরূনে তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিলেন— যাদের বন্দেগী তোমরা করছো আমি তার বন্দেগী করবো না এবং আমি যাঁর বন্দেগী করছি তোমরা তাঁর বন্দেগী করো না, কাজেই আমার পথ আলাদা এবং তোমাদের পথও আলাদা— তখন কাফেরদের শত্রুতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। বিশেষ করে যেসব পরিবারের ব্যক্তিবর্গ (পুরুষ-নারী, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে) ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের মনে তো নবী করীমের ﷺ বিরুদ্ধে সবসময় তুষের আগুন জ্বলছিল। ঘরে ঘরে তাঁকে অভিশাপ দেয়া হচ্ছিল। কোন দিন রাতের আঁধারে লুকিয়ে তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। যাতে বনী হাশেমদের কেউ হত্যাকারীর সন্ধান পেয়ে আবার প্রতিশোধ নিতে না পারে এজন্য এ ধরনের পরামর্শ চলছিল। তাঁকে যাদু-টোনা করা ‌হচ্ছিল। এভাবে তাঁকে মেরে ফেলার বা কঠিন রোগে আক্রান্ত করার অথবা পাগল করে দেয়ার অভিপ্রায় ছিল। জিন ও মানুষদের মধ্যকার শয়তান সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা চাচ্ছিল জন-মানুষের মনে তাঁর এবং তিনি যে দ্বীন তথা জীবন বিধান কুরআন এনেছেন তার বিরুদ্ধে কোন না কোন সংশয় সৃষ্টি করতে। এর ফলে লোকেরা তাঁর প্রতি বিরূপ ধারণা করে দূরে সরে যাবে বলে তারা মনে করছিল। অনেক লোকের মনে হিংসার আগুন জ্বলছিল। কারণ তারা নিজেদের ছাড়া বা নিজেদের গোত্রের লোকদের ছাড়া আর কারো প্রদীপের আলো জ্বলতে দেখতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ, আবু জেহেল যে কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ এর বিরোধিতায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল সেটি ছিল তার নিজের ভাষায়: “আমাদের ও বনী আবদে মান্নাফের (তথা রসূলুল্লাহ ﷺ এর পরিবার) মধ্যে ছিল পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। তারা মানুষকে আহার করিয়েছে, আমরাও আহার করিয়েছি। তারা লোকদেরকে সওয়ারী দিয়েছে, আমরাও দিয়েছি। তারা দান করেছে, আমরাও দান করেছি। এমন কি তারা ও আমরা মান মর্যাদার দৌঁড়ে সমানে সমান হয়ে গেছি। এখন তারা বলছে কি, আমাদের মধ্যে একজন নবী আছে, তার কাছে আকাশ থেকে অহী আসে। আচ্ছা, এখন এক্ষেত্রে আমরা তাদের সাথে কেমন করে মোকাবেলা করতে পারি? আল্লাহর কসম, আমরা কখনো তাঁকে মেনে নেবো না এবং তাঁর সত্যতার স্বীকৃতি দেবো না।” (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, ৩৩৭-৩৩৮ পৃষ্ঠা)। এহেন অবস্থায় রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে বলা হয়েছে: এদেরকে বলে দাও আমি আশ্রয় চাচ্ছি সকাল বেলার রবের, সমুদয় সৃষ্টির দুষ্কৃতি ও অনিষ্ট থেকে, রাতের আঁধার থেকে, যাদুকর ও যাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে এবং হিংসুকদের দূষ্কৃতি থেকে। আর এদেরকে বলে দাও, আমি আশ্রয় চাচ্ছি সমস্ত মানুষের রব, সমস্ত মানুষের বাদশা ও সমস্ত মানুষের মা’বুদের কাছে। এমন প্রত্যেকটি সন্দেহ ও প্ররোচনা সৃষ্টিকারীর অনিষ্ট থেকে যা বারবার ঘুরে ফিরে আসে এবং মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে ও তাদেরকে প্ররোচিত করে। তারা জিন শয়তানদের মধ্য থেকে হতে পারে, আবার মানুষ শয়তানদের মধ্য থেকেও হতে পারে। এটা হযরত মূসার (আ:) ঠিক সেই সময়ের কথার মতো যখন ফেরাউন ভরা দরবারে তাঁকে হত্যা করার সংকল্প প্রকাশ করেছিল। হযরত মূসা তখন বলেছিলেন: إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ مِنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ “আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি এমন ধরনের প্রত্যেক দাম্ভিকের মোকাবেলায় যে হিসেবের দিনের প্রতি ঈমান রাখে না।” (আল মু’মিন, ২৭) وَإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَنْ تَرْجُمُونِ “আর তোমরা আমার ওপর আক্রমণ করবে এজন্য আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি।” (আদ দুখান, ২০)। উভয় স্থানেই আল্লাহ্‌র এ মহান মর্যাদাসম্পন্ন পয়গম্বরদের নিতান্ত সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় বিপুল উপায়-উপকরণ ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তির অধিকারীদের সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছিল। উভয় স্থানেই শক্তিশালী দুশমনদের সামনে তাঁরা নিজেদের সত্যের দাওয়াত নিয়ে অবিচল দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দুশমনদের মোকাবেলা করার মতো কোন বস্তুগত শক্তি তাদের ছিল না। উভয় স্থানেই তাঁরা “তোমাদের মোকাবেলায় আমরা বিশ্ব-জাহানের রবের আশ্রয় নিয়েছি” এই বলে দুশমনদের হুমকি-ধামকি মারাত্মক বিপজ্জনক কূট-কৌশল ও শত্রুতামূলক চক্রান্ত উপেক্ষা করে গেছেন। মূলত: যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে, আল্লাহর শক্তি সব শক্তির সেরা, তাঁর মোকাবেলায় দুনিয়ার সব শক্তি তুচ্ছ এবং যে ব্যক্তি তাঁর আশ্রয় নিয়েছে তার সামান্যতম ক্ষতি করার ক্ষমতাও কারো নেই। একমাত্র সেই ব্যক্তিই এ ধরনের অবিচলতা, দৃঢ় সংকল্প ও উন্নত মনোবলের পরিচয় দিতে পারে এবং সে-ই একথা বলতে পারে: সত্যের বাণী ঘোষণার পথ থেকে আমি কখনই বিচ্যূত হবো না। তোমাদের যা ইচ্ছা করে যাও। আমি তার কোন পরোয়া করি না। কারণ আমি তোমাদের ও আমার নিজের এবং সারা বিশ্ব-জাহানের রবের আশ্রয় নিয়েছি।

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : এ সূরা দু’টি কুরআনের অংশ কিনা ? :

এ সূরা দু’টির বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য অনুধাবন করার জন্য ওপরের আলোচনাটুকুই যথেষ্ট। তবুও হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থগুলোয় এদের সম্পর্কে এমন তিনটি বিষয়ের আলোচনা এসেছে যা মনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে, তাই আমরা সে ব্যাপারটিও পরিষ্কার করে দিতে চাই। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় সেটি হচ্ছে, এ সূরা দু’টির কুরআনের অংশ হবার ব্যাপারটি কি চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত অথবা এর মধ্যে কোন প্রকার সংশয়ের অবকাশ আছে? এ প্রশ্ন দেখা দেবার কারণ হচ্ছে এই যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের মতো উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী থেকে বিভিন্ন রেওয়ায়েতে একথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি এ সূরা দু’টিকে কুরআনের সূরা বলে মানতেন না এবং নিজের পাণ্ডুলিপিতে তিনি এ দু’টি সূরা সংযোজিত করেননি। ইমাম আহমাদ, বাযযার, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া, আবু ইয়ালা, আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল, হুমাইদী, আবু নু’আইয, ইবনে হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সূত্রে এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সহীহ সনদের মাধ্যমে একথা হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ হাদীসগুলোতে কেবল একথাই বলা হয়নি যে, তিনি এই সূরা দু’টিকে কুরআনের পাণ্ডুলিপি থেকে বাদ দিতেন বরং এই সাথে একথাও বলা হয়েছে যে, তিনি বলতেন: “কুরআনের সাথে এমন জিনিস মিশিয়ে ফেলো না যা কুরআনের অংশ নয়। এ সূরা দু’টি কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এর মাধ্যমে একটি হুকুম দেয়া হয়েছিল। তাঁকে বলা হয়েছিল, এ শব্দগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।” কোন কোন রেওয়ায়াতে আরো বাড়তি বলা হয়েছে যে, তিনি নামাযে এ সূরা দু’টি পড়তেন না।

এ রেওয়ায়াতগুলোর কারণে ইসলাম বিরোধীরা কুরআনের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টির এবং (নাউযুবিল্লাহ) কুরআন যে বিকৃতি মুক্ত নয় একথা বলার সুযোগ পেয়ে গেছে। বরং আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা:) মতো বড় সাহাবী যখন এই মত পোষণ করছেন যে, কুরআনের এ দু’টি সূরা বাইরে থেকে তাতে সংযোজিত হয়েছে তখন না জানি তার মধ্যে আরো কত কি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে। এ ধরনের সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ তারা সহজেই পেয়ে গেছে। কুরআনকে এ ধরনের দোষারোপ মুক্ত করার জন্য কাযী আবু বকর বাকেল্লানী ও কাযী ইয়ায, ইবনে মাসউদের বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ইবনে মাসউদ সূরা ফালাক ও সূরা নাসের কুরআনের অংশ হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করতেন না বরং তিনি শুধু এ সূরা দু’টিকে কুরআনের পাতায় লিখে রাখতে অস্বীকার করতেন। কারণ তাঁর মতে কুরআনের পাতায় শুধুমাত্র তাই লিখে রাখা উচিত যা লিখার অনুমতি রসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এ জবাব ও ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ ইবনে মাসউদ (রা:) এ সূরা দু’টির কুরআনের সূরা হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন, একথা নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত। ইমাম নববী, ইমাম ইবনে হাযম, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী প্রমুখ অন্য কতিপয় মনীষী ইবনে মাসউদ যে এ ধরনের কোন কথা বলেছেন, এ কথাটিকেই সরাসরি মিথ্যা ও বাতিল গণ্য করেছেন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সত্যকে সনদ ছাড়াই রদ করে দেয়া কোন সুস্থ জ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়।

এখন প্রশ্ন থেকে যায়, ইবনে মাসউদ (রা:) সংক্রান্ত এ রেওয়ায়াত থেকে কুরআনের প্রতি যে দোষারোপ হচ্ছে তার জবাব কি? এ প্রশ্নের কয়েকটি জবাব আমরা এখানে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছি।

এক: হাফেয বাযযার তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে ইবনে মাসউদ (রা:) সংক্রান্ত এ রেওয়ায়াতগুলো বর্ণনা করার পর লিখেছেন: নিজের এ রায়ের ব্যাপারে তিনি একান্তই নি:সঙ্গ ও একাকী। সাহাবীদের একজনও তাঁর এ বক্তব্য সমর্থন করেননি।

দুই: সকল সাহাবী একমত হওয়ার ভিত্তিতে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরআন মজীদের যে অনুলিপি তৈরি করেছিলেন এবং ইসলামী খেলাফতের পক্ষ থেকে ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকারী পর্যায়ে পঠিয়েছিলেন তাতে এ দু’টি সূরা লিপিবদ্ধ ছিল।

তিন: রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর মুবারক যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় কুরআনের যে কপির ওপর সমগ্র মুসলিম উম্মাহ একমত তাতেই সূরা দু’টি লিখিত আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের (রা:) একক রায় তাঁর বিপুল ও উচ্চ মর্যাদা সত্ত্বেও সমগ্র উম্মাতের এ মহান ইজমার মোকাবেলায় কোন মূল্যই রাখে না।

চার: রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর অত্যন্ত নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য হাদীস অনুযায়ী একথা প্রমাণিত হয় যে, তিনি নামাযে এ সূরা দু’টি নিজে পড়তেন, অন্যদের পড়ার আদেশ দিতেন এবং কুরআনের সূরা হিসেবেই লোকদেরকে এ দু’টির শিক্ষা দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীসগুলো দেখুন।

ইতিপূর্বে মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী ও নাসাঈর বরাত দিয়ে আমরা হযরত উকবা ইবনে আমেরের (রা:) একটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছি। এতে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ সূরা ফালাক ও সূরা নাস সম্পর্কে তাঁকে বলেন: আজ রাতে এ আয়াতগুলো আমার ওপর নাযিল হয়েছে। উকবা ইবনে আমের (রা:) থেকে বর্ণিত নাসায়ীর এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে: রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এ দু’টি সূরা ফজরের নামাযে পড়েন। ইবনে হিব্বানও এই হযরত উকবা ইবনে আমের (রা:) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন, নবী করীম ﷺ তাঁকে বলেন: “যদি সম্ভব হয় তোমার নামাযসমূহ থেকে এ সূরা দু’টির পড়া যেন বাদ না যায়।” সাঈদ ইবনে মনসুর হযরত মু’আয ইবনে জাবালের রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী করিম ﷺ ফজরের নামাযে এ সূরা দু’টি পড়েন। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে সহীহ সনদ সহকারে আরো একজন সাহাবীর হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী ﷺ তাঁকে বলেন: যখন তুমি নামায পড়বে, তাতে এ দু’টি সূরা পড়তে থাকবে। মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ ও নাসাঈতে উকবা ইবনে আমেরের (রা:) একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ তাঁকে বলেন: “লোকেরা যে সূরাগুলো পড়ে তার মধ্যে সর্বোত্তম দু’টি সূরা কি তোমাকে শেখাবো না? তিনি আরজ করেন, অবশ্যি শিখাবেন। হে আল্লাহ রসূল ﷺ ! একথায় তিনি তাঁকে এ আল ফালাক ও আন নাস সূরা দু’টি পড়ান। তারপর নামায দাঁড়িয়ে যান এবং নবী করীম ﷺ এ সূরা দু’টি তাতে পড়েন। নামায শেষ করে তিনি তাঁর কাছ দিয়ে যাবার সময় বলেন: “হে উকাব (উকবা)! কেমন দেখলে তুমি?” এরপর তাঁকে হিদায়াত দিলেন, যখন তুমি ঘুমাতে যাও এবং যখন ঘুম থেকে জেগে উঠো তখন এ সূরা দু’টি পড়ো।” মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈতে উকবা ইবনে আমেরের (রা:) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে: রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে প্রত্যেক নামাযের পর “মু’আওবিযাত” (অর্থাৎ সূরা ইখলাস, সূরা আল ফালাক ও সূরা আন নাস) পড়তে বলেন। নাসায়ী ইবনে মারদুইয়ার এবং হাকেম উকবা ইবনে আমেরের আর একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে: একবার নবী করিম ﷺ সওয়ারীর পিঠে চড়ে যাচ্ছিলেন এবং আমি তাঁর পবিত্র পায়ে হাত রেখে সাথে সাথে যাচ্ছিলাম। আমি বললাম, আমাকে কি সূরা হূদ, সূরা ইউসুফ শিখিয়ে দেবেন? বললেন: “আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য ‘কুল আউজু বি রব্বিল ফালাক’ —এর চাইতে বেশী বেশী উপকারী আর কোন জিনিস নেই।” নাসাঈ, বায়হাকী, বাগাবী ও ইবনে সা’দ, আবদুল্লাহ ইবনে আবেস আল জুহানীর রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী করিম ﷺ আমাকে বলেছেন: “ইবনে আবেস, আমি কি তোমাকে জানাবো না, আশ্রয় প্রার্থীরা যতগুলো জিনিসের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কোনগুলো?” আমি বললাম, অবশ্যি বলবেন হে আল্লাহর রসূল! বললেন: “কূল আউযু বিরব্বিল ফালাক” ও “কুল আউযু বিরব্বিন নাস” সূরা দু’টি।” ইবনে মারদুইয়া, হযরত ইবনে সালমার রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে: “আল্লাহ যে সূরাগুলো সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেন তা হচ্ছে, কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক ও কুল আউযু বিরব্বিন নাস।”

এখানে প্রশ্ন দেখা যায়, এ দু’টি কুরআন মজীদের সূরা নয়, হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রা:) এ ধরনের ভুল ধারণার শিকার হলেন কেমন করে? দু’টি বর্ণনা একত্র করে দেখলে আমরা এর জবাব পেতে পারি।

একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলতেন, এটিতো আল্লাহর একটি হুকুম ছিল। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে হুকুম দেয়া হয়েছিল, আপনি এভাবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। অন্য বর্ণনাটি বিভিন্ন সূত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম বুখারী সহীহ আল বুখারীতে, ইমাম মুহাম্মাদ তাঁর মুসনাদে, হাফেজ আবু বকর আল হুমাইদী তাঁর মুসনাদে, আবু নু’আইম তাঁর আল মুসতাখরাজে এবং নাসাঈ তাঁর সুনানে যির ইবনে হুবাইশের বরাত দিয়ে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তন সহকারে কুরাআনী জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হযরত উবাই ইবনে কা’ব থেকে এটি উদ্ধৃত করেছেন। যির ইবনে হুবাইশ বর্ণনা করেছেন, আমি হযরত উবাইকে (রা:) বললাম, আপনার ভাই আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ তো এমন এমন কথা বলেন। তাঁর এ উক্তি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? তিনি জবাব দিলেন: “আমি এ সম্পর্কে রসূলূল্লাহ্‌ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেন, আমাকে বলা হয়েছে, ‘কুল’ (বলো, কাজেই আমি বলেছি ‘কুল’। তাই আমরাও তেমনিভাবে বলি যেভাবে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলতেন।” ইমাম আহমাদের বর্ণনা মতে হযরত উবাইয়ের বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ আমাকে বলেছেন, জিব্রীল আলাইহিস সালাম তাঁকে বলেছিলেন, কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক” তাই তিনিও তেমনি বলেন। আর জিব্রীল (আ:) ‘কুল আউযু বিরব্বিন নাস’ বলেছিলেন, তাই তিনিও তেমনি বলেন। কাজেই রসূল ﷺ যেভাবে বলতেন আমরাও তেমনি বলি।” এ দু’টি বর্ণনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) উভয় সূরায় ‘কুল’ (বলো) শব্দ দেখে এ ভুল ধারণা করেছিলেন যে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কে “আউযু বিরব্বিল ফালাক (আমি সকাল বেলার রবের আশ্রয় চাচ্ছি) ও “আউযু বিরব্বিন নাস” (আমি সমস্ত মানুষের রবের আশ্রয় চাচ্ছি) বলার হুকুম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রসূলে করিমকে ﷺ এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। হযরত উবাই ইবনে কা’বের (রা:) মনে এ সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছিল। তিনি রসূলের ﷺ সামনে প্রশ্ন রেখেছিলেন। রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছিলেন: জিব্রীল আলাইহিস সালাম যেহেতু ‘কুল’ বলেছিলেন তাই আমিও ‘কুল’ বলি। একথাটিকে এভাবেও ধরা যায় যদি কাউকে হুকুম দেয়ার উদ্দেশ্য থাকে এবং তাকে বলা হয়, “বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি।” বরং সেক্ষেত্রে ‘বলো’ শব্দটি বাদ দিয়ে “আমি আশ্রয় চাচ্ছি” বলবে। বিপরীতপক্ষে যদি ঊর্ধ্বতন শাসকের সংবাদবাহক কাউকে এভাবে খবর দেয়, “বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি” এবং এ পয়গাম তার নিজের কাছে রেখে দেবার জন্য নয় বরং অন্যদের কাছেও পৌঁছে দেবার জন্য দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তিনি লোকদের কাছে এ পয়গামের শব্দগুলো, হুবহু পৌঁছে দেবেন। এর মধ্য থেকে কোন একটি শব্দ বাদ দেবার অধিকার তাঁর থাকবে না। কাজেই এ সূরা দু’টির সূচনা ‘কুল’ শব্দ দিয়ে করা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এটি অহীর কালাম এবং কালামটি রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর ওপর যেভাবে নাযিল হয়েছিল ঠিক সেভাবেই লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে তিনি বাধ্য ছিলেন। এটি শুধু নবী ﷺ কে দেয়া একটি হুকুম ছিল না। কুরআন মজীদে এ দু’টি সূরা ছাড়াও এমন ৩৩০টি আয়াত আছে যেগুলো ‘কুল’ শব্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোতে ‘কুল’ (বলো) থাকা একথাই সাক্ষ্য বহন করে যে, এগুলো অহীর কালাম এবং যেসব শব্দ সহকারে এগুলো নবী করিম ﷺ —এর ওপর নাযিল হয়েছিল হুবহু সেই শব্দগুলো সহকারে লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া তাঁর জন্য ফরয করা হয়েছিল। নয়তো প্রত্যেক জায়গায় ‘কুল’ (বলো) শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু সেই শব্দগুলোই বলতেন যেগুলো বলার হুকুম তাঁকে দেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি এগুলো কুরআনে সংযোজিত করতেন না। বরং এ হুকুমটি পালন করার জন্য শুধুমাত্র সেই কথাগুলোই বলে দেয়া যথেষ্ট মনে করতেন যেগুলো বলার হুকুম তাঁকে দেয়া হয়েছিল।

এখানে সামান্য একটু চিন্তা-ভাবনা করলে একথা ভালোভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে যে, সাহাবায়ে কেরামকে ভুল ত্রুটি মুক্ত মনে করা এবং তাদের কোন কথা সম্পর্কে ‘ভুল’ শব্দটি শুনার সাথে সাথেই সাহাবীদের অবমাননা করা হয়েছে বলে হৈ চৈ শুরু করে দেয়া কতই না অর্থহীন। এখানে দেখা যাচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রা:)- এর মত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর কুরআনের দু’টি সূরা সম্পর্কে কত বড় একটি ভুল হয়ে গেছে। এতবড় উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীর যদি এমনি একটি ভুল হয়ে যেতে পারে তাহলে অন্যদেরও কোন ভুল হয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা ইলমী তথা তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য এ ব্যাপারে যাচাই-বাছা‌ই করতে পারি। তবে যে ব্যক্তি ভুলকে ভুল বলার পর আবার সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁদের প্রতি ধিক্কার ও নিন্দাবাদে মুখর হবে সে হবে একজন মস্ত বড় জালেম। এ “মু’আওবিযাতাইন” প্রসঙ্গে মুফাস্‌সির ও মুহাদ্দিসগণ হযরত ইবনে মাসউদ (রা) এর রায়কে ভুল বলেছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই কথা বলার দু:সাহস করেননি যে, (নাউযুবিল্লাহ্‌) কুরআনের দু’টি সূরা অস্বীকার করে তিনি কাফের হয়ে গিয়েছিলেন।

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : নবী করীম (সা:) এর ওপর যাদুর প্রভাব :

এ সূরাটির ব্যাপারে আরেকটি প্রশ্ন দেখা। হাদীস থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর ওপর যাদু করা হয়েছিল। তার প্রভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ যাদুর প্রভাব দূর করার জন্য জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে তাঁকে এ সূরা দু’টি পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রাচীন ও আধুনিক বুদ্ধিবাদীদের অনেকে এ ব্যাপারটির বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তারা বলেছেন, এ হাদীসগুলো মেনে নিলে সমস্ত শরীয়াতটাই সন্দেহযুক্ত হয়ে যায়। কারণ, নবীর ওপর যদি যাদুর প্রভাব পড়তে পারে এবং এ হাদীসগুলোর দৃষ্টিতে তাঁর ওপর যাদুর প্রভাব পড়েছিল, তাহলে আমরা জানি না বিরোধীরা যাদুর প্রভাব ফেলে তাঁর মুখ থেকে কতো কথা বলিয়ে এবং তাঁকে দিয়ে কত কাজ করিয়ে নিয়েছে। আর তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার মধ্যেই বা কি পরিমাণ জিনিস আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং কতটা যাদুর প্রভাবে ছিল তাও আমরা জানি না। বরং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, একথা সত্য বলে মেনে নেয়ার পর যাদুরই মাধ্যমে নবীকে নবুওয়াতের দাবি করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল কি না এবং যাদুরই প্রভাবে তিনি বিভ্রান্তির শিকার হয়ে তাঁর কাছে ফেরেশতা এসেছে বলে মনে করেছিলেন কিনা একথাও নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে না। তাদের আরো যুক্তি হচ্ছে, এ হাদীসগুলো কুরআন মজীদের সাথে সংঘর্ষশীল। কারণ, কুরআন মজীদে কাফেরদের এ অভিযোগ বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারা নবীকে যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি বলেছে:

يَقُولُ الظَّالِمُونَ إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًا مَسْحُورًا

“জালেমরা বলে, তোমরা নিছক একজন যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির আনুগত্য করে চলছো।” (বনি ইসরাঈল, ৪৭) আর এ হাদীসগুলো কাফেরদের এ অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ করেছে। অর্থাৎ এ হাদীসগুলো থেকে প্রমাণ হচ্ছে সত্যিই নবীর ﷺ ওপর যাদু করা হয়েছিল।

এ বিষয়টির ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে সর্বপ্রথম দেখতে হবে, মূলত: রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর ওপর যাদুর প্রভাব পড়েছিল বলে কি সহীহ ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনায় প্রমাণিত হয়েছে? আর যদি প্রমাণিত হয়ে থাকে তাহলে তা কি ছিল এবং কতটুকু ছিল? তারপর যেসব আপত্তি করা হয়েছে, ইতিহাস থেকে প্রমাণিত বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সেগুলো উত্থাপিত হতে পারে কি না, তা দেখতে হবে।

প্রথম যুগের মুসলিম আলেমগণ নিজেদের চিন্তা ও ধারণা অনুযায়ী ইতিহাস বিকৃত অথবা সত্য গোপন করার প্রচেষ্টা না চালিয়ে চরম সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। বরং যা কিছু ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়েছে তাকে হুবহু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। এ সত্যগুলো থেকে যদি কেউ বিপরীত ফলাফল গ্রহণে উদ্যোগী হয় তাহলে তাদের সংগৃহীত এ উপাদানগুলোর সাহায্যে সে যে বিপুলভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারবে এ সম্ভাবনার কোন পরোয়াই তারা করেননি। এখন যদি কোন একটি কথা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বিপুল সংখ্যক ঐতিহাসিক তথ্য বিবরণীর ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, তাহলে তা মেনে নিলে অমুক অমুক ত্রুটি ও অনিষ্টকারিতা দেখা দেবে এ অযুহাত দেখিয়ে ইতিহাসকে মেনে নিতে অস্বীকার করা কোন ন্যায়নিষ্ঠ পণ্ডিত ও জ্ঞানী লোকের কাজ হতে পারে না। অনুরূপভাবে ইতিহাস থেকে যতটুকু সত্য বলে প্রমাণিত হয় তার ওপর কল্পনার ঘোড়া দৌড়িয়ে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিজের আসল আকৃতি থেকে অনেকগুণ বাড়িয়ে পেশ করাও ঐতিহাসিক সততার পরিচায়ক নয়। এর পরিবর্তে ইতিহাসকে ইতিহাস হিসেবে মেনে নিয়ে তার মাধ্যমে কি প্রমাণ হয় ও কি প্রমাণ হয় না তা দেখাই তার কাজ।

ঐতিহাসিক তথ্য বিবরণী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবী ﷺ এর ওপর যাদুর প্রভাব চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত। তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাকে যদি ভুল প্রমাণ করা যেতে পারে তাহলে দুনিয়ার কোন একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকেও সঠিক প্রমাণ করা যাবে না। হযরত আয়েশা (রা:), হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা:) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইমাম আহমাদ, আবদুর রাজ্জাক, হুমাইদী, বায়হাকী, তাবরানী, ইবনে মারদুইয়া, ইবনে সা’দ, ইবনে আবী শাইবা, হাকেম, আবদ ইবনে হুমাইদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এত বিভিন্ন ও বিপুলসংখ্যক সনদের মাধ্যমে এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, এর এক একটি বর্ণনা, ‘খবরে ওয়াহিদ’- এর পর্যায়ভুক্ত হলেও মূল বিষয়বস্তুটি ‘মুতাওয়াতির’ বর্ণনার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন হাদীসে এর যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে সেগুলো একত্র করে এবং একসাথে গ্রন্থিত ও সুসংবদ্ধ করে সাজিয়ে গুছিয়ে আমরা এখানে একটি ঘটনা আকারে তুলে ধরছি।

হোদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী ﷺ মদীনায় ফিরে এলেন। এ সময় সপ্তম হিজরীর মহররম মাসে খয়বর থেকে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় এলো। তারা আনসারদের বনি যুরাইক গোত্রের বিখ্যাত যাদুকর লাবীদ ইবনে আ’সমের সাথে সাক্ষাত করলো।১ (পাদ টীকা দেখুন) তারা তাকে বললো, মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের সাথে যা কিছু করেছেন তা তো তুমি জানো। আমরা তাঁর ওপর অনেকবার যাদু করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফল হতে পারেনি। এখন তোমার কাছে এসেছি। কারণ তুমি আমাদের চাইতে বড় যাদুকর। তোমার জন্য এ তিনটি আশরাফী (স্বর্ণ মুদ্রা) এনেছি। এগুলো গ্রহণ করো এবং মুহাম্মাদের ﷺ ওপর একটি শক্ত যাদুর আঘাত হানো। এ সময় একটি ইহুদী ছেলে রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ এর কাছে কাজ করতো। তার সাথে যোগসাজশ করে তারা রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ চিরুনীর একটি টুকরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। তাতে তাঁর পবিত্র চুল আটকানো ছিল। সেই চুলগুলো ও চিরুনীর দাঁতের ওপর যাদু করা হলো। কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, লাবীদ ইবনে আ’সম নিজেই যাদু করেছিল। আবার কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে– তার বোন ছিল তার চেয়ে বড় যাদুকর। তাদের সাহায্যে সে যাদু করেছিল। যাহোক এ দু’টির মধ্যে যে কোন একটিই সঠিক হবে। এক্ষেত্রে এ যাদুকে একটি পুরুষ খেজুরের ছড়ার আবরণের২ (পাদ টীকা দেখুন) নীচে রেখে লাবীদ সেটাকে বনী যুরাইকের যারওয়ান বা যী-আযওয়ান নামক কুয়ার তলায় একটি পাথর চাপা দিয়ে রাখলো। নবী ﷺ এর ওপর প্রভাব পড়তে পূর্ণ এক বছর সময় লাগলো। বছরের শেষ ছয় মাসে মেজাজে কিছু পরিবর্তন অনুভূত হতে থাকলো। শেষ চল্লিশ দিন কঠিন এবং শেষ তিন দিন কঠিনতর হয়ে গেলো। তবে এর সবচেয়ে বেশী যে প্রভাব তাঁর ওপর পড়লো তা কেবল এতটুকুই যে, দিনের পর দিন তিনি রোগা ও নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলেন। কোন কাজের ব্যাপারে মনে করতেন, করে ফেলেছেন অথচ তা করেননি। নিজের স্ত্রীদের সম্পর্কে মনে করতেন, তিনি তাদের কাছে গেছেন অথচ আসলে তাদের কাছে যাননি। আবার কোন কোন সময় নিজের দৃষ্টির ব্যাপারেও তাঁর সন্দেহ হতো। মনে করতেন কোন জিনিস দেখেছেন অথচ আসলে তা দেখেননি। এসব প্রভাব তাঁর নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি তাঁর ওপর দিয়ে কি ঘটে যাচ্ছে তা অন্যেরা জানতেও পারেনি।

পাদ টীকা: ১. কোন কোন বর্ণনাকারী তাকে ইহুদী বলেছেন। আবার কেউ বলেছেন, মুনাফিক ও ইহুদীদের মিত্র। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, সে ছিল বনী যুরাইকের অন্তর্ভুক্ত। আর বনী যুরাইক ইহুদীদের কোন গোত্র ছিল না, একথা সবাই জানে। বরং এটি ছিল খাযরাজদের অন্তর্ভুক্ত আনসারদের একটি গোত্র। তাই বলা যেতে পারে, সে মদীনাবাসী ছিল, কিন্তু ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল অথবা ইহুদীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ সহযোগী হবার কারণে কেউ কেউ তাকে ইহুদী মনে করে নিয়েছিল। তবুও তার জন্য মুনাফিক শব্দ ব্যবহার করার কারণে জানা যায়, বাহ্যত সে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিতো।

২. শুরুতে খেজুরের ছড়া একটি আবরণের মধ্যে থাকে। পুরুষ খেজুরের আবরণের রং হয় মানুষের রংয়ের মতো। তার গন্ধ হয় মানুষের শুক্রের গন্ধের মতো।

—————- পাদ টীকা সমাপ্ত———–

কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তায় তার মধ্যে সামান্যতম ব্যাঘাতও সৃষ্টি হতে পারেনি। কোন একটি বর্ণনায়ও একথা বলা হয়নি যে, সে সময় তিনি কুরআনের কোন আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। অথবা কোন আয়াত ভুল পড়েছিলেন। কিংবা নিজের মজলিসে, বক্তৃতায় ও ভাষণে তাঁর শিক্ষাবলীতে কোন পার্থক্য সূচিত হয়েছিল। অথবা এমন কোন কালাম তিনি অহী হিসেবে পেশ করেছিলেন যা আসলে তাঁর ওপর নাযিল হয়নি। কিংবা তাঁর কোন নামায তরক হয়ে গেছে এবং সে সর্ম্পকে তিনি মনে করেছেন যে, তা পড়ে নিয়েছেন অথচ আসলে তা পড়েননি। নাউযুবিল্লাহ্‌, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে গেলে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যেতো। সারা আরব দেশে খবর ছড়িয়ে পড়তো, যে নবীকে কেউ কাৎ করতে পারেনি, একজন যাদুকরের যাদুর কাছে সে কাৎ হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর নবুওয়াতের মর্যাদা এ অবস্থায় পুরোপুরি সমুন্নত থেকেছে। তার ওপর কোন প্রভাব পড়েনি। কেবলমাত্র নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এ জিনিসটি অনুভব করে পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। শেষে একদিন তিনি হযরত আয়েশার (রা:) কাছে ছিলেন। এ সময় বার বার আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে থাকলেন। এ অবস্থায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। জেগে উঠে হযরত আয়েশাকে (রা:) বললেন, আমি যে কথা আমার রবের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম তা তিনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। হযরত আয়েশা (রা:) জিজ্ঞেস করলেন, কি কথা? জবাব দিলেন, “দু’জন লোক (অর্থাৎ দু’জন ফেরেশতা দু’জন লোকের আকৃতি ধরে আমার কাছে এলো। একজন ছিল মাথার দিকে, আরেকজন পায়ের দিকে। একজন জিজ্ঞেস করলো, এঁর কি হয়েছে? অন্যজন জবাব দিল, এঁর ওপর যাদু করা হয়েছে। প্রথম জন জিজ্ঞেস করলো, কে করেছে? জবাব দিল, লাবীত ইবনে আ’সম। জিজ্ঞেস করলো, কোন্‌ জিনিসের মধ্যে করেছে? জবাব দিল, একটি পুরুষ খেজুরের ছড়ার আবরণে আবৃত চিরুনী ও চুলের মধ্যে। জিজ্ঞেস করলো, তা কোথায় আছে? জবাব দিল, বনী যারাইকের কূয়া যী-আযওয়ানের (অথবা যী-যারওয়ান) তলায় পাথর চাপা দেয়া আছে। জিজ্ঞেস করলো, তাহলে এখন এজন্য কি করা দরকার? জবাব দিল, কুয়ার পানি সেঁচে ফেলতে হবে। তারপর পাথরের নিচ থেকে সেটি বের করে আনতে হবে। এরপর নবী ﷺ হযরত আলী (রা:) হযরত ইবনে ইয়াসির (রা:) ও হযরত যুবাইরকে (রা:) পাঠালেন। তাদের সাথে শামিল হলেন হযরত জুবাইর ইবনে ইয়াস আযযুরাকী ও কায়েস ইবনে মিহসান আযযুরাকী (অর্থাৎ বনি যুরাইকের দুই ব্যক্তি)। পরে নবী ﷺ নিজেও কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলেন। পানি তোলা হলো। কুয়ার তলা থেকে কথিত আবরণটি বের করে আনা হলো। তার মধ্যে চিরুনী ও চুলের সাথে মিশিয়ে রাখা একটি সূতায় এগারোটি গিরা দেয়া ছিল। আর ছিল মোমের একটি পুতুল। তার গায়ে কয়েকটি সুঁই ফুটানো ছিল। জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে বললেন, আপনি সূরা আল ফালাক ও আন নাস পড়ুন। কাজেই তিনি এক একটি আয়াত পড়ে যাচ্ছিলেন এবং সেই সাথে এক একটি গিরা খুলে যাচ্ছিল এবং পুতুলের গা থেকে এক একটি সুঁইও তুলে নেয়া হচ্ছিল। সূরা পড়া শেষ হতেই সমস্ত গিরা খুলে গেলো, সমস্ত সুঁই উঠে এলো এবং তিনি যাদুর প্রভাবমুক্ত হয়ে ঠিক এমন অবস্থায় পৌঁছে গেলেন যেমন কোন ব্যক্তি রশি দিয়ে বাঁধা ছিল তারপর তার বাঁধন খুলে গেলো। তারপর তিনি লাবীদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সে তার দোষ স্বীকার করলো এবং তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। কারণ, নিজের ব্যক্তিসত্ত্বার জন্য তিনি কোনদিন কারো ওপর প্রতিশোধ নেননি।

শুধু এই নয়, তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কোন কথাবার্তা বলতেও অস্বীকৃতি জানালেন। কারণ তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করেছেন, কাজেই এখন আমি কারো বিরুদ্ধে লোকদের উত্তেজিত করতে চাই না।

এ হলো এ যাদুর কাহিনী। এর মধ্যে এমন কোন বিষয় নেই যা তাঁর নবুওয়াতের মর্যাদার মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি তাঁকে আহত করা যেতে পারে, যেমন ওহোদের যুদ্ধে হয়েছিল, যদি তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়ে পড়েন, যেমন বিভিন্ন হাদীস থেকে প্রমাণিত, যদি তাঁকে বিচ্ছু কামড় দেয়, যেমন অন্যান্য হাদীসে পাওয়া যায় এবং নবী হবার জন্য মহান আল্লাহ তাঁর সাথে যে সংরক্ষণের ওয়াদা করেছিলেন, যদি এগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিও তার পরিপন্থী না হয়ে থাকে, তাহলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি যাদুর প্রভাবে অসুস্থ হতেও পারেন। এতে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। নবীর ওপর যাদুর প্রভাব পড়তে পারে, একথা কুরআন মজীদ থেকেও প্রমাণিত। সূরা আ’রাফেও ফেরাউনের যাদুকরদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: হযরত মুসা (আ:) এর মোকাবিলায় তারা এলো। তারা সেখানে এ মোকাবিলা দেখতে উপস্থিত হাজার হাজার লোকের দৃষ্টিশক্তির ওপর যাদু করলো (سَحْرُوا اَعْيِنَ النَّاسَ) । সূরা ত্ব-হায় বলা হয়েছে: তারা যেসব লাঠি ও রশি দিয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে শুধু সাধারণ লোকেরাই নয়, হযরত মূসা (আ:)ও মনে করলেন সেগুলো সাপের মতো তাঁর দিকে দৌঁড়ে আসছে এবং তিনি এতে ভীত হয়ে পড়লেন। এমন কি মহান আল্লাহ তাঁর ওপর এই মর্মে অহী নাযিল করলেন যে, ভয় পেয়ো না, তুমি বিজয়ী হবে। তোমার লাঠিটা একটু ছুঁড়ে ফেলো।

فَإِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى – فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَى – قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَى – وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ (طه : 66-69)

এখানে যদি আপত্তি উত্থাপন করে বলা হয়, এ ধরনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে মক্কার কাফেরদের দোষারোপকেই সত্য প্রমাণ করা হলো। তারা তো নবী ﷺ কে যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি বলতো। এর জবাবে বলা যায়, তিনি কোন যাদুকরের যাদুর প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এ অর্থে মক্কার কাফেররা তাঁকে যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি বলতো না। বরং তাঁকে যাদুর প্রভাব পাগল করে দিয়েছিল এবং নবুওয়াতের দাবি ছিল তাঁর এ পাগলামীরই বহি:প্রকাশ। আর এ পাগলামীর বশবর্তী হয়েই তিনি জান্নাত ও জাহান্নামের গল্প শুনিয়ে যেতেন। একথা সুস্পষ্ট, যে বিষয় ইতিহাস থেকে প্রমাণিত, যে যাদুর প্রভাব শুধুমাত্র মুহাম্মাদ ﷺ এর ব্যক্তিসত্ত্বার ওপর পড়েছিল, তাঁর নবীসত্ত্বা ছিল এর আওতার সম্পূর্ণ বাইরে। তেমন ধরনের কোন বিষয়ের সাথে এ আপত্তি সম্পৃক্ত হতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখযোগ্য, যারা যাদুকে নিছক কাল্পনিক জিনিস মনে করেন, যাদুর প্রভাবের কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভবপর নয় বলেই তারা এ ধরনের মত পোষণ করেন। কিন্তু দুনিয়ায় এমন বহু জিনিসই রয়েছে যেগুলো অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, কিন্তু সেগুলো কিভাবে হয়, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তার বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। এ ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার অক্ষমতার ফলে একথা অপরিহার্য হয়ে ওঠে না যে, আমরা যে জিনিসটি বিশ্লেষণ করতে অক্ষম সেটিকে আমাদের অস্বীকার করতে হবে। আসলে যাদু একটি মন:স্তাত্বিক প্রভাব। শারীরিক প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিগুলো যেভাবে শরীরের সীমা অতিক্রম করে মনকে প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনি যাদুর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিও মনের সীমা পেরিয়ে শরীরকেও প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ভয় একটি মন:স্তাত্বিক জিনিস। কিন্তু শরীরের ওপর এর প্রভাব যখন পড়ে গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে যায় এবং দেহ থর থর করে কাঁপতে থাকে। আসলে যাদু প্রকৃত সত্ত্বায় কোন পরিবর্তন ঘটায় না। তবে মানুষের মন ও তার ইন্দ্রিয়গুলো এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনে করতে থাকে, বুঝি প্রকৃত সত্ত্বার পরিবর্তন হয়েছে। হযরত মূসার (আ:) দিকে যাদুকররা যেসব লাঠি ও রশি ছুঁড়ে ফেলেছিল সেগুলো সত্যি সাপে পরিণত হয়নি। কিন্তু হাজার হাজার লোকের চোখে এমন যাদুর প্রভাব পড়লো যে, তারা সবাই এগুলোকে সাপ মনে করলো। এমন কি হযরত মূসার (আ:) ইন্দ্রিয়ানুভূতিও এ যাদুর প্রভাব মুক্ত থাকতে পারেনি। অনুরূপভাবে কুরআনের সূরা আল বাকারার ১০২ আয়াতে বলা হয়েছে: বেবিলনে হারুত ও মারুতের কাছে লোকেরা এমন যাদু শিখতো যা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতো। এটা ছিল একটি মন:স্তাত্বিক প্রভাব। আর তাছাড়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লোকেরা যদি এ কাজে সফলতা না পেতো তাহলে তারা এর খরিদ্দার হতো না। একথা ঠিক, বন্দুকের গুলী ও বোমারু বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমার মতো যাদুর প্রভাবশালী হওয়াও আল্লাহ্‌র হুকুম ছাড়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু হাজার হাজার বছর থেকে যে জিনিসটি মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ধরা দিচ্ছে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা নিছক একটি হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : ইসলামে ঝাড়-ফুঁকের স্থান :

এ সূরা দু’টির ব্যাপারে তৃতীয় যে প্রশ্নটি দেখা দেয়, সেটি হচ্ছে এই যে, ইসলামে কি ঝাড়-ফুঁকের কোন অবকাশ আছে? তাছাড়া ঝাড়-ফুঁক যথার্থই কোন প্রভাব ফেলে কি না? এ প্রশ্ন দেখা দেবার কারণ হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক সহীহ হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ্‌ ﷺ প্রতি রাতে ঘুমাবার আগে বিশেষ করে অসুস্থ অবস্থায় সূরা আল ফালাক ও আন নাস এবং কোন কোন হাদীস অনুযায়ী এ দু’টির সাথে আবার সূরা ইখলাসও তিন তিন বার করে পড়ে নিজের দুই হাতের তালুতে ফুঁক দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেখানে যেখানে তাঁর হাত যেতে পারে— সব জায়গায় হাত বুলাতেন। শেষ বারে রোগে আক্রান্ত হবার পর যখন তাঁর নিজের পক্ষে এমনটি করা সম্ভবপর ছিল না তখন হযরত আয়েশা (রা:) এ সূরাগুলো (স্বেচ্ছাকৃতভাবে বা নবী করীমের ﷺ হুকুমে) পড়তেন এবং তাঁর (নবী ﷺ) মুবারক হাতের বরকতের কথা চিন্তা করে তাঁরই হাত নিয়ে তাঁর শরীরে বুলাতেন। এ বিষয়বস্তু সম্বলিত রেওয়ায়াত নির্ভুল সূত্রে বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ ও মুআত্তা ইমাম মালিকে হযরত আয়েশা (রা:) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আর রসূলের ﷺ পারিবারিক জীবন সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা:) —এর চাইতে আর কারো বেশী জানার কথা নয়।

এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গিটি ভালোভাবে বুঝে নেয়া উচিত। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এর একটি সুদীর্ঘ রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তার শেষের দিকে নবী করীম ﷺ বলেছেন: আমার উম্মাতের মধ্যে তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে যারা না দাগ দেয়ার চিকিৎসা করে, না ঝাড়-ফুঁক করায় আর না শুভাশুভ লক্ষণ গ্রহন করে। (মুসলিম) হযরত মুগীরা ইবনে শোবার (রা:) বর্ণনা মতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: যে ব্যক্তি দাগ দেয়ার চিকিৎসা করালো এবং ঝাড়-ফুঁক করালো সে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল থেকে নি:সম্পর্ক হয়ে গেলো (তিরমিযী)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বর্ণনা করেছেন: রসূলুল্লাহ ﷺ দু’টি জিনিস অপছন্দ করতেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ঝাড়-ফুঁক করা, তবে সূরা আল ফালাক ও আন নাস অথবা এ দু’টি ও সূরা ইখলাস ছাড়া (আবু দাউদ, আহমাদ, নাসাঈ, ইবনে হিব্বান ও হাকেম)। কোন কোন হাদীস থেকে একথাও জানা যায় যে, প্রথম দিকে নবী করীম ﷺ ঝাড়-ফুঁক করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু পরে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই শর্তগুলো হচ্ছে: এতে কোন শির্কের আমেজ থাকতে পারবে না। আল্লাহর পবিত্র নাম বা তাঁর পবিত্র কালামের সাহায্যে ঝাড়-ফুঁক করতে হবে। কালাম বোধগম্য হতে হবে এবং তাঁর মধ্যে কোন গুনাহর জিনিস নেই একথা জানা সম্ভব হতে হবে। আর এই সঙ্গে ভরসা ঝাড়-ফুঁকের ওপর করা যাবে না এবং তাকে রোগ নিরাময়কারী মনে করা যাবে না। এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে এ মর্মে যে, আল্লাহ চাইলে এ ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমেই সে রোগ নিরাময় করবেন। এ ব্যাপারে শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গী সুস্পষ্ট হয়ে যাবার পর এখন হাদীসের বক্তব্য দেখুন।

তাবারানী ‘সগীর’ গ্রন্থে হযরত আলীর (রা:) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে: একবার নামায পড়ার সময় রসূলে করীমকে ﷺ বিচ্ছু কামড় দেয়। নামায শেষ করে তিনি বলেন, বিচ্ছুর ওপর আল্লাহর লানত, সে না কোন নামাযীকে রেহাই দেয়, না আর কাউকে। তারপর পানি ও লবণ আনান। যে জায়গায় বিচ্ছু কামড়েছিল যেখানে নোনতা পানি দিয়ে ডলতে থাকেন আর কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন, কুল হু ওয়াল্লাহু আহাদ, কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক ও কুল আউযু বিরব্বিন নাস পড়তে থাকেন।

ইবনে আব্বাসের (রা:) বর্ণনা হাদীসে এসেছে। নবী ﷺ হযরত হাসান ও হযরত হুসাইনের ওপর এ দোয়া পড়তেন:

أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ

“আমি তোমাদের দু’জনকে প্রত্যেক শয়তান ও কষ্টদায়ক এবং বদনজর থেকে আল্লাহর ত্রুটিমুক্ত কালেমাসমূহের আশ্রয়ে দিয়ে দিচ্ছি।” (বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

উসমান ইবনে আবিল আস সাকাফী সম্পর্কে সামান্য শব্দের হেরফের সহকারে মুসলিম, মুআত্তা, তাবারানী, হাকেমে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে: তিনি রসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে নালিশ করেন, আমি যখন থেকে মুসলমান হয়েছি তখন থেকেই একটা ব্যথা অনুভব করছি। এ ব্যথা আমাকে মেরে ফেলে দিয়েছে। নবী ﷺ বলেন, যেখানে ব্যথা হচ্ছে সেখানে তোমার ডান হাতটা রাখো। তারপর তিনবার বিসমিল্লাহ পড়ো এবং সাতবার এ দোয়াটা পড়ে সেখানে হাত বুলাও أَعُوذُ بِاللَّهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ “আমি আল্লাহ ও তাঁর কুদরতের আশ্রয় চাচ্ছি সেই জিনিসের অনিষ্টকারিতা থেকে যাকে আমি অনুভব করছি এবং যার লেগে যাওয়ার ভয়ে আমি ভীত।” মুআত্তায় এর ওপর আরো এতটুকু বৃদ্ধি করা হয়েছে যে উসমান ইবনে আবিল আস বলেন, এরপর আমার সে ব্যথা দূর হয়ে যেতে থাকে এবং আমার ঘরের লোকদেরকেও আমি এটা শিখাই।

মুসনাদে আহমাদ ও তাহাবী গ্রন্থে তালাক ইবনে আলীর (রা:) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এর উপস্থিতিতেই আমাকে বিচ্ছু কামড় দেয়। তিনি কিছু পড়ে আমাকে ফুঁক দেন এবং কামড়ানো জায়গায় হাত বুলান। মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরীর (রা:) বর্ণনায় বলা হয়েছে: একবার নবী ﷺ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিব্রীল এসে জিজ্ঞেস করেন, “হে মুহাম্মাদ! আপনি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? ” জবাব দেন হ্যাঁ, জিব্রীল (আ:) বলেন,

بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ وَعَيْنِ حَاسِدٍ اللَّهِ وَاللَّهُ نشْفِيكَ باسم الله أَرْقِيكَ-

“আমি আল্লাহ্‌র নামে আপনাকে ঝাড়ছি এমন প্রত্যেকটি জিনিস থেকে যা আপনাকে কষ্ট দেয় এবং প্রত্যেকটি নফ্‌স ও হিংসুকের হিংসা দৃষ্টির অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ আপনাকে নিরাময় দান করুন। আমি তাঁর নামে আপনাকে ঝাড়ছি।”

প্রায় এ একই ধরনের আর একটি বর্ণনা মুসনাদে আহমাদে হযরত উবাদা ইবনে সামেত থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে: নবী করীম ﷺ অসুস্থ ছিলেন। আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। দেখলাম তাঁর বেশ কষ্ট হচ্ছে। বিকেলে দেখতে গেলাম, দেখলাম তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছেন তা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, জিব্রীল (আ:) এসেছিলেন এবং কিছু কালেমা পড়ে আমাকে ঝাড়-ফুঁক করেছিলেন (তাতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি)। তারপর তিনি প্রায় ওপরের হাদীসে উদ্ধৃত কালেমাগুলোর মতো কিছু কালেমা শুনালেন। মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা (রা:) থেকেও এমনি ধরনের রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে উম্মূল মুমেনীন হযরত হাফসার (রা:) বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে হযরত হাফসা (রা:) বলেন: একদিন নবী ﷺ আমার কাছে এলেন। তখন আমার কাছে শিফা * নামের এক মহিলা বসেছিলেন।

* ভদ্র মহিলার আসল নাম ছিল লাইলা। কিন্তু তিনি শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামে পরিচিত ছিলেন। হিজরতের আগে মুসলমান হন। তাঁর সম্পর্ক ছিল কুরাঈশদের বনি আদী বংশের সাথে। হযরত উমরও (রা:) এ বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এভাবে তিনি ছিলেন হযরত হাফসার (রা:) আত্মীয়া।

তিনি পিঁপড়া বা মাছি প্রভৃতির দংশনে ঝাড়-ফুঁক করতেন। রসূলে করীম ﷺ বললেন: হাফসাকেও এ আমল শিখিয়ে দাও। শিফা বিনতে আবদুল্লাহর এ সংক্রান্ত একটি রেওয়ায়াত ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও নাসাঈ উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, নবী ﷺ আমাকে বললেন, তুমি হাফসাকে যেমন লেখাপড়া শিখিয়েছো তেমনিভাবে এ ঝাড়-ফুঁকের আমলও শিখিয়ে দাও।

মুসলিমে আউফ ইবনে মালেক আশজায়ীর রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেন: জাহেলিয়াতের যুগে আমরা ঝাড়-ফুঁক করতাম। আমরা রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, তোমরা যে জিনিস দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করো তা আমার সামনে পেশ করো। তার মধ্যে যদি শির্ক না থাকে তাহলে তার সাহায্যে ঝাড়ায় কোন ক্ষতি নেই।

মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজায় হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ ﷺ ঝাড়-ফুঁক নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তারপর হযরত আমর ইবনে হাযমের বংশের লোকেরা এলো। তারা বললো, আমাদের কাছে এমন কিছু আমল ছিল যার সাহায্যে আমরা বিচ্ছু (বা সাপ) কামড়ানো রোগীকে ঝাড়তাম, কিন্তু আপনি তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তারপর তারা যা পড়তো তা তাঁকে শুনালো । তিনি বললেন, “এর মধ্যে তো আমি কোন ক্ষতি দেখছি না। তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের কোন উপকার করতে পারে তাহলে তাকে অবশ্যি তা করা উচিত।” জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা:) দ্বিতীয় হাদীসটি মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে: হাযম পরিবারের লোকেরা সাপে কামড়ানো রোগীর নিরাময়ের একটা প্রক্রিয়া জানতো। রসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে তা প্রয়োগ করার অনুমতি দেন। মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজায় হযরত আয়েশা (রা:) বর্ণিত রেওয়ায়াতটিও একথা সমর্থন করে। তাতে বলা হয়েছে: রসূলুল্লাহ ﷺ আনসারদের একটি পরিবারকে প্রত্যেক বিষাক্ত প্রাণীর কামড়ে ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসলিমেও হযরত আনাস (রা:) থেকে প্রায় এ একই ধরনের একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ বিষাক্ত প্রাণীদের কামড়, পিঁপড়ার দংশন ও নজর লাগার জন্য ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও হাকেম হযরত উমাইর মাওলা আবীল লাহাম (রা:) থেকে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেন, জাহেলী যুগে আমি একটি আমল জানতাম। তার সাহায্যে আমি ঝাড়-ফুঁক করতাম। আমি রসূলুল্লাহ ﷺ এর সামনে তা পেশ করলাম। তিনি বললেন, অমুক অমুক জিনিস এ থেকে বের করে দাও, এরপর যা থাকে তার সাহায্যে তুমি ঝাড়তে পারো।

মুআত্তায় বলা হয়েছে হযরত আবু বকর (রা:) তাঁর মেয়ে হযরত আয়েশা (রা:) এর ঘরে গেলেন। দেখলেন তিনি অসুস্থ এবং একটি ইহুদী মেয়ে তাঁকে ঝাড়-ফুঁক করছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব পড়ে ঝাড়ো। এ থেকে জানা গেলো, আহলি কিতাবরা যদি তাওরাত বা ইঞ্জিলের আয়াত পড়ে ঝাড়-ফুঁক করে তাহলে তা জায়েয। এখন ঝাড়-ফুঁক উপকারী কি না এ প্রশ্ন দেখা দেয়। এর জবাবে বলা যায়, রসূলুল্লাহ ﷺ চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহার করতে কখনো নিষেধ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, আল্লাহ প্রত্যেক রোগের ঔষধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তোমরা রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধ ব্যবহার করো। রসূল ﷺ নিজেও লোকদেরকে কোন কোন রোগের ঔষধ বলে দিয়েছেন। হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত ‘কিতাবুত তিব’ (চিকিৎসা অধ্যায়) পাঠ করলে একথা জানা যেতে পারে। কিন্তু ঔষধও আল্লাহর হুকুম ও অনুমতিক্রমেই উপকারী হতে পারে। নয়তো ঔষধ ও চিকিৎসা যদি সব অবস্থায় উপকারী হতো তাহলে হাসপাতালে একটি রুগীও মরতো না। এখন চিকিৎসা ও ঔষধের সাথে সাথে যদি আল্লাহর কালাম ও তাঁর আসমায়ে হুসনা (ভালো ভালো নাম) থেকে ফায়দা হাসিল করা যায় অথবা যেসব জায়গায় চিকিৎসার কোন সুযোগ-সুবিধা নেই সেখানে যদি আল্লাহর কালামের আশ্রয় গ্রহণ করে তাঁর পবিত্র নাম ও গুণাবলীর সহায়তা লাভ করা হয় তাহলে এ পদক্ষেপ একমাত্র বস্তুবাদীরা ছাড়া আর কারো কাছে বিবেক বিরোধী মনে হবে না।* তবে যেখানে চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহার করার সুযোগ-সুবিধা লাভ করা সম্ভব হয় সেখানে জেনে বুঝেও তা গ্রহণ না করে শুধুমাত্র ঝাড়-ফুঁকের ওপর নির্ভর করা কোনক্রমেই সঠিক পদক্ষেপ বলে স্বীকৃতি পেতে পারে না। আর এভাবে একদল লোককে মাদুলি তাবীজের দোকান খুলে সুযোগ মতো দু’পয়সা কামাই করার অনুমতিও কোনক্রমেই দেয়া যেতে পারে না।

* বস্তুবাদী দুনিয়ার অনেক ডাক্তারও একথা স্বীকার করেছেন যে, দোয়া ও আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ মানসিক সংযোগ রোগীদের রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর উপাদান। আমার নিজের জীবনেও আমি এ ব্যাপারে দু’বার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। ১৯৪৮ সালে কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় আমার মূত্রনালিতে একটি পাথর সৃষ্টি হয়। ষোল ঘন্টা পর্যন্ত পেশাব আটকে থাকে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, হে আল্লাহ! আমি জালেমদের কাছে চিকিৎসার জন্য আবেদন করতে চাই না। তুমিই আমার চিকিৎসা করো। কাজেই পেশাবের রাস্তা থেকে পাথরটি সরে যায় এবং পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত সরে থাকে। তারপর ১৯৬৮ সালে সেটি আবার কষ্ট দিতে থাকে। তখন অপারেশন করে তাকে বের করে ফেলা হয়। আর একবার ১৯৫৩ সালে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় আমি কয়েক মাস থেকে দু’পায়ের গোছায় দাদে আক্রান্ত হয়ে ভীষণ কষ্ট পেতে থাকি। কোন রকম চিকিৎসায় আরাম পাচ্ছিলাম না। গ্রেফতারীর পর আল্লাহর কাছে ১৯৪৮ সালের মতো আবার সেই একই দোয়া করি। এরপর কোন প্রকার চিকিৎসা ও ঔষধ ছাড়াই সমস্ত দাদ একেবারে নির্মূল হয়ে যায়। তারপর আর কখনো এ রোগে আক্রান্ত হইনি।

এ ব্যাপারে অনেকে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বর্ণিত একটি হাদীস থেকে যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন। হাদীসটি বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজায় উদ্ধৃত হয়েছে। বুখারীতে উদ্ধৃত ইবনে আব্বাসের (রা:) একটি বর্ণনাও এর সমর্থন করে। এতে বলা হয়েছে: রসূলে করীম ﷺ কয়েকজন সাহাবীকে একটি অভিযানে পাঠান। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) তাদের সাথে ছিলেন। তারা পথে একটি আরব গোত্রের পল্লীতে অবস্থান করেন। তারা গোত্রের লোকদের কাছে তাদের মেহমানদারী করার আবেদন জানান। কিন্তু তারা অস্বীকার করে। এ সময় গোত্রের সরদারকে বিচ্ছু কামড় দেয়। লোকেরা এ মুসাফির দলের কাছে এসে আবেদন জানায়, তোমাদের কোন ঔষধ বা আমল জানা থাকলে আমাদের সরদারের চিকিৎসা করো। হযরত আবু সাঈদ বলেন, আমরা জানি ঠিকই, তবে যেহেতু তোমরা আমাদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করেছো, তাই আমাদের কিছু দেবার ওয়াদা না করলে আমরা চিকিৎসা করবো না। তারা একটি ছাগলের পাল (কোন কোন বর্ণনা মতে ৩০ টি ছাগল) দেবার ওয়াদা করে। ফলে আবু সাঈদ সরদারের কাছে যান। তার ওপর সূরা ফাতেহা পড়ে ফুঁক দিতে থাকেন এবং যে জায়গায় বিচ্ছু কামড়েছে সেখানে নিজের মুখের লালা মলতে থাকেন।* অবশেষে বিষের প্রভাব খতম হয়ে যায়। গোত্রের লোকেরা তাদের ওয়াদা মতো ছাগল দিয়ে দেয়। কিন্তু সাহাবীগণ নিজেদের মধ্যে বলতে থাকেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে জিজ্ঞেস না করে এ ছাগলগুলো থেকে কোন ফায়দা হাসিল করা যাবে না। কারণ, এ কাজে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয কিনা তাতো জানা নেই। কাজেই তাঁরা নবী করীমের ﷺ কাছে আসেন এবং সব ঘটনা বয়ান করেন। তিনি হেসে বলেন, তোমরা কেমন করে জানলে এ সূরা ঝাড়-ফুঁকের কাজেও লাগতে পারে? ছাগল নিয়ে নাও, তাতে আমার ভাগও রাখো।

*হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) যে এ আমলটি করেছিলেন এ ব্যাপারে অধিংকাশ হাদীসে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। এমন কি হযরত আবু সাঈদ নিজে এ অভিযানে শরীক ছিলেন কি না একথাও সেখানে সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু তিরমিযী বর্ণিত হাদীসে এ দু’টি কথাই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

কিন্তু তিরমিযী বর্ণিত এ হাদীস থেকে মাদুলি, তাবীজ ও ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে রীতিমতো চিকিৎসা করার জন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কায়েম করার অনুমতি প্রমাণ করার আগে তদানীন্তন আরবের অবস্থাও সামনে রাখতে হবে। তৎকালীন আরবের এ অবস্থার চাপেই হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) এ কাজ করেছিলেন। রসুলে করীমও ﷺ একে শুধু জায়েযই ঘোষণা করেননি বরং এতে নিজের অংশ রাখার হুকুমও দিয়েছিলেন, যাতে তার জায়েয ও নাজায়েয হবার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট লোকদের মনে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ না থাকে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আরবের অবস্থা সেকালে যেমনটি ছিল আজকেও তেমনটি রয়ে গেছে। পঞ্চাশ, একশো, দেড়শো মাইল চলার পরও একটি জনবসতি চোখে পড়ে না। জনবসতিগুলোও ছিল ভিন্ন ধরনের। সেখানে কোন হোটেল, সরাইখানা বা দোকান ছিল না। মুসাফিররা এক জনবসতি থেকে রওয়ানা হয়ে কয়েকদিন পরিশ্রম করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য বসতিতে পৌঁছে যে খাবার-দাবার কিনে ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবে, এ ধরনের কোন ব্যবস্থাও সেকালে ছিল না। এ অবস্থায় আরবের প্রচলিত রীতি ছিল, মুসাফিররা এক জনবসতি থেকে আর এক জনবসতিতে পৌঁছলে সেখানকার লোকেরাই তাদের মেহমানদারী করতো। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের মেহমানদারী করতে অস্বীকৃতি জানালে মুসাফিরদের মৃত্যু অবধারিত হয়ে উঠতো। কাজেই এ ধরনের কার্যকলাপ আরবে অত্যন্ত নিন্দনীয় মনে করা হতো। এ কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ নিজের সাহাবীগণের এহেন কার্যকলাপকে বৈধ গণ্য করেন। গোত্রের লোকেরা যখন মুসাফিরদের মেহমানদারী করতে অস্বীকৃতি জানায় তখন তাদের সরদারের চিকিৎসা করতেও তারা অস্বীকার করেন এবং পরে বিনিময়ে কিছু দেয়ার শর্তে তার চিকিৎসা করতে রাজী হন। তারপর তাদের একজন আল্লাহর ওপর ভরসা করে সূরা ফাতেহা পড়েন এবং সরদারকে ঝাড়-ফুঁক করেন। এর ফলে সরদার সুস্থ হয়ে ওঠে। ফলে গোত্রের লোকেরা চুক্তি মোতাবেক পারিশ্রমিক এনে তাদের সামনে হাযির করে। রসূলুল্লাহ ﷺ এ পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হালাল গণ্য করেন।

বুখারী শরীফে এ ঘটনা সম্পর্কিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা:) যে রেওয়ায়াত আছে তাতে রসূলে করীমের ﷺ বক্তব্যে বলা হয়েছে: إِنَّ أَحَقَّ مَا أَخَذْتُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا كِتَابُ اللَّهِ “তোমরা অন্য কোন আমল না করে আল্লাহর কিতাব পড়ে পারিশ্রমিক নিয়েছো, এটা তোমাদের জন্য বেশী ন্যায়সঙ্গত হয়েছে।” তাঁর একথা বলার কারণ হচ্ছে, অন্যান্য সমস্ত আমলের তুলনায় আল্লাহর কালাম শ্রেষ্ঠ। তাছাড়া এভাবে আরবের সংশ্লিষ্ট গোত্রটির ওপর ইসলাম প্রচারের হকও আদায় হয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ﷺ যে কালাম এনেছেন তার বরকত তারা জানতে পারে। যারা শহরে ও গ্রামে বসে ঝাড়-ফুঁকের কারবার চালায় এবং একে নিজেদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পরিণত করে তাদের জন্য এ ঘটনাটিকে নজীর বলে গণ্য করা যেতে পারে না। নবী করীম ﷺ , সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও প্রথম যুগের ইমামগণের মধ্যে এর কোন নজীর পাওয়া যায় না।

(১১৩-ফালাক্ব-১১৪-নাস) : সূরা ফাতিহার সাথে এ সূরা দু’টির সম্পর্ক :

সূরা আল ফালাক ও সূরা আন নাস সম্পর্কে সর্বশেষ বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে, এ সূরা দু’টির সাথে কুরআনের প্রথম সূরা আল ফাতেহার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কুরআন মজীদ যেভাবে নাযিল হয়েছে, লিপিবদ্ধ করার সময় নাযিলের সেই ধারাবাহিকতার অনুসরণ করা হয়নি। তেইশ বছর সময়-কালে বিভিন্ন পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে এর আয়াত ও সূরাগুলো নাযিল হয়েছে। বর্তমানে আমরা কুরআনকে যে আকৃতিতে দেখছি, রসূলুল্লাহ ﷺ স্বেচ্ছাকৃতভাবে তাকে এ আকৃতি দান করেননি বরং কুরআন নাযিলকারী আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী এ আকারে তাকে বিন্যস্ত করেছেন। এ বিন্যাস অনুযায়ী সূচনা হয় সূরা ফাতেহা থেকে এবং সমাপ্তি হয় আল ফালাক ও আন নাসে এসে। এখন উভয়ের ওপর একবার দৃষ্টি বুলালে দেখা যাবে, শুরুতে রব্বুল আলামীন, রহ্‌মানুর রহীম ও শেষ বিচার দিনের মালিক আল্লাহ্‌র প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করে বান্দা নিবেদন করছে, আমি তোমারই বন্দেগী করি তোমারই কাছে সাহায্য চাই এবং তোমার কাছে আমি যে সবচেয়ে বড় সাহায্যটা চাই সেটি হচ্ছে এই যে আমাকে সহজ-সরল-সত্য পথটি দেখিয়ে দাও। জবাবে সোজা পথ দেখাবার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে পুরো কুরআন মজীদটি নাযিল করা হয়। একে এমন একটি বক্তব্যের ভিত্তিতে শেষ করা হয় যখন বান্দা সকাল বেলার রব, মানবজাতির বর, মানবজাতির বাদশাহ ও মানবজাতির ইলাহ্‌ মহান আল্লাহ্‌র কাছে এ মর্মে আবেদন জানায় যে, সে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রত্যেকটি ফিতনা ও অনিষ্টকারিতা থেকে সংরক্ষিত থাকার জন্য একমাত্র তাঁরই কাছে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে জিন ও মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত শয়তানদের প্ররোচনা থেকে সে একমাত্র তাঁরই আশ্রয় চায়। কারণ, সঠিক পথে চালার ক্ষেত্রে সে-ই হয় সবচেয়ে বড় বাধা। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সূরা ফাতিহার সূচনার সাথে এই শেষ দুই সূরার যে সম্পর্ক, তা কোন গভীর দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির আগোচরে থাকার কথা নয়।

সুরা: আন-নাস
আয়াত নং :-৩

اِلٰهِ النَّاسِۙ

মানুষের প্রকৃত মাবুদের কাছে,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# এখানেও সূরা আল ফালাকের মতো ‘আউযু বিল্লাহ’ বলে সরাসরি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার পরিবর্তে আল্লাহর তিনটি গুণের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এ তিনটি গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে, তাঁর রাব্বুন নাস অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির প্রতিপালক, মালিক ও প্রভু হওয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তাঁর মালিকুন নাস অর্থাৎ সমস্ত মানুষের বাদশাহ, শাসক ও পরিচালক হওয়া। তৃতীয়টি হচ্ছে, তাঁর ইলাহুন নাস অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির প্রকৃত মাবুদ হওয়া। (এখানে একথা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, ইলাহ শব্দটি কুরআন মজীদে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক, এমন বস্তু বা ব্যক্তি যার ইবাদাত গ্রহণ করার কোন অধিকারই নেই কিন্তু কার্যত তার ইবাদাত করা হচ্ছে। দুই, যার ইবাদাত গ্রহণ করার অধিকার আছে এবং যিনি প্রকৃত মাবুদ, লোকেরা তার ইবাদাত করুক বা না করুক। আল্লাহর জন্য যেখানে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এ দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে)।

এ তিনটি গুণের কাছে আশ্রয় চাওয়ার মানে হচ্ছেঃ আমি এমন এক আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি, যিনি সমস্ত মানুষের রব, বাদশাহ ও মা’বুদ হবার কারণে তাদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রাখেন, যিনি নিজের বান্দাদের হেফাজত করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন এবং যথার্থই এমন অনিষ্টের হাত থেকে মানুষের রক্ষা করতে পারেন, যার হাত থেকে নিজে বাঁচার এবং অন্যদের বাঁচাবার জন্য আমি তাঁর শরণাপন্ন হচ্ছি। শুধু এতটুকুই নয় বরং যেহেতু তিনিই রব, বাদশাহ ও ইলাহ, তিনি ছাড়া আর কেউ নেই যার কাছে আমি পানাহ চাইতে পারি এবং প্রকৃতপক্ষে যিনি পানাহ দেবার ক্ষমতা রাখেন।

সুরা: আন-নাস
আয়াত নং :-৫

الَّذِیْ یُوَسْوِسُ فِیْ صُدُوْرِ النَّاسِۙ

যে বারবার ফিরে আসে, যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে,

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মূলে الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে وسواس এর মানে হচ্ছে, বারবার প্ররোচনা দানকারী। আর “ওয়াসওয়াসাহ” মানে হচ্ছে, একের পর এক এমন পদ্ধতিতে মানুষের মনে কোন খারাপ কথা বসিয়ে দেয়া যে, যার মনে ঐ কথা বসিয়ে দেয়া হচ্ছে ওয়াসওয়াসাহ সৃষ্টিকারী যে তার মনে ঐ কথা বসিয়ে দিচ্ছে তা সে অনুভবই করতে পারে না। ওয়াসওয়াসাহ শব্দের মধ্যেই বারবার হবার অর্থ রয়েছে, যেমন ‘যালযালাহ’ (ভূমিকম্প) শব্দটির মধ্যে রয়েছে, বারবার ভূকম্পনের ভাব। যেহেতু মানুষকে শুধুমাত্র একবার প্রতারণা করলেই সে প্রতারিত হয় না বরং তাকে প্রতারিত করার জন্য একের পর এক প্রচেষ্টা চালাতে হয়, তাই এ ধরনের প্রচেষ্টাকে ‘ওয়াসওয়াসাহ’ (প্ররোচনা) এবং প্রচেষ্টাকারীকে ‘ওয়াসওয়াস’ (প্ররোচক) বলা হয়। এখানে আর একটি শব্দ এসেছে খান্নাস। خناس এর মূল হচ্ছে খুনূস। خنوس এর মানে প্রকাশিত হবার পর আবার গোপন হওয়া অথবা সামনে আসার পর আবার পিছিয়ে যাওয়া। আর ‘খান্নাস’ যেহেতু বেশী ও অত্যাধিক বৃদ্ধির অর্থবোধক শব্দ, তাই এর অর্থ হয়, এ কাজটি বেশী বেশী বা অত্যাধিক সম্পন্নকারী। একথা সুস্পষ্ট, প্ররোচনা দানকারীকে প্ররোচনা দেবার জন্য বারবার মানুষের কাছে আসতে হয়। আবার এই সঙ্গে যখন তাকে খান্নাসও বলা হয়েছে তখন এ দু’টি শব্দ পরস্পর মিলিত হয়ে আপনা আপনি এ অর্থ সৃষ্টি করেছে যে, প্ররোচনা দান করতে করতে সে পিছনে সরে যায় এবং তারপর প্ররোচনা দেবার জন্য আবার বারবার ফিরে আসে। অন্যকথায় একবার তার প্ররোচনা দান করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সে ফিরে যায়। তারপর সেই প্রচেষ্টা চালাবার জন্য বারবার সে ফিরে আসে।

“বারবার ফিরে আসা প্ররোচনাকারীর অনিষ্ট”-এর অর্থ বুঝে নেয়ার পর এখন তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার অর্থ কি, একথা চিন্তা করতে হবে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, আশ্রয় প্রার্থনাকারী নিজেই তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছে। অর্থাৎ এ অনিষ্ট তার মনে যেন কোন প্ররোচনা সৃষ্টি করতে না পারে। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পথের দিকে আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তিই লোকদের মনে কোন প্ররোচনা সৃষ্টি করে বেড়ায় তার অনিষ্ট থেকে সত্যের আহবায়ক আল্লাহর আশ্রয় চায়। সত্যের আহবায়কের ব্যক্তিসত্ত্বার বিরুদ্ধে যেসব লোকের মনে প্ররোচনা সৃষ্টি করা হচ্ছে তার নিজের পক্ষে তাদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে খুঁটে খুঁটে তাদের প্রত্যেকের বিভ্রান্তি দূর করে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার যে কাজ সে করে যাচ্ছে তা বাদ দিয়ে প্ররোচনাকারীদের সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করার এবং তাদের অভিযোগের জবাব দেবার কাজে আত্মনিয়োগ করাও তার পক্ষে সঙ্গত নয়। তার বিরুদ্ধবাদীরা যে পর্যায়ে নেমে এসেছে তার নিজের পক্ষেও সে পর্যায়ে নেমে আসা তার মর্যাদার পরিপন্থী। তাই মহান আল্লাহ‌ সত্যের আহবায়কদের নির্দেশ দিয়েছেন, এ ধরনের অনিষ্টকারীদের অনিষ্ট থেকে আল্লাহ‌র শরণাপন্ন হও এবং তারপর নিশ্চিন্তে নিজেদের দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করো। এরপর এদের মোকাবেলা করা তোমাদের কাজ নয়, রব্বুন নাস, মালিকিন নাস ও ইলাহিন নাস সর্বশক্তিমান আল্লাহরই কাজ। এ প্রসঙ্গে একথাটিও অনুধাবন করতে হবে যে ওয়াসওয়াসাহ বা প্ররোচণা হচ্ছে অনিষ্ট কর্মের সূচনা বিন্দু। যখন একজন অসতর্ক বা চিন্তাহীন মানুষের মনে তার প্রভাব পড়ে, তখন প্রথমে তার মধ্যে অসৎকাজ করার আকাংখা সৃষ্টি হয় তারপর আরো প্ররোচনা দান করার পর এ অসৎ আকাঙ্ক্ষা অসৎ ইচ্ছায় পরিণত হয়। এরপর প্ররোচনার প্রভাব বাড়তে থাকলে আরো সামনের দিকে গিয়ে অসৎ ইচ্ছা অসৎ সংকল্পে পরিণত হয়। আর তারপর এর শেষ পদক্ষেপ হয় অসৎকর্ম। তাই প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার অর্থ হবে, অনিষ্টের সূচনা যে স্থান থেকে হয়, আল্লাহ‌ যেন সেই স্থানেই তাকে নির্মূল করে দেন।

প্ররোচনা দানকারীদের অনিষ্টকারিতাকে অন্য এক দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে, প্রথমে তারা খোলাখুলি কুফরী, শির্‌ক, নাস্তিকতা বা আল্লাহ‌ ও রসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আল্লাহপন্থীদের সাথে শত্রুতার উস্কানী দেয়। এতে ব্যর্থ হলে এবং মানুষ আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করে গেলে তারা তাকে কোন না কোন বিদ’আতের পথ অবলম্বনের প্ররোচনা দেয়। এতেও ব্যর্থ হলে তাকে গোনাহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এখানেও সফলতা অর্জনে সক্ষম না হলে মানুষের মনে এ চিন্তার যোগান দেয় যে, ছোট ছোট সামান্য দু’চারটে গোনাহ করে নিলে তো কোন ক্ষতি নেই। অর্থাৎ এভাবে এ ছোট গোনাহ-ই যদি বিপুল পরিমাণে করতে থাকে তাহলে বিপুল পরিমাণ গোনাহে মানুষ ডুবে যাবে। এ থেকেও যদি মানুষ পিঠ বাঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে শেষমেশ তারা চেষ্টা করে মানুষ যেন আল্লাহর সত্য দ্বীনকে শুধুমাত্র নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে, কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি এ সমস্ত কৌশল ব্যর্থ করে দেয় তাহলে জিন ও মানুষ শয়তানদের সমস্ত দল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে লোকদেরকে উস্কানি ও উত্তেজিত করতে থাকে। তার প্রতি ব্যাপকভাবে গালিগালাজ ও অভিযোগ-দোষারোপের ধারা বর্ষণ করতে থাকে। চতুর্দিক থেকে তার দুনার্ম রটাবার ও তাকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করতে তাকে। তারপর শয়তান সেই মর্দে মু’মিনকে ক্রোধান্বিত করতে থাকে। সে বলতে থাকে, এসব কিছু নীরবে সহ্য করে নেয়া তো বড়ই কাপুরুষের কাজ। ওঠো, এ আক্রমণকারীদের সাথে সংঘর্ষ বাধাও। সত্যের দাওয়াতের পথ রুদ্ধ করার এবং সত্যের আহবায়কদেরকে পথের কাঁটার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করার জন্য এটি হয় শয়তানের শেষ অস্ত্র। সত্যের আহবায়ক এ ময়দান থেকেও যদি বিজয়ীর বেশে বের হয়ে আসে তাহলে শয়তান তার সামনে নিরুপায় হয়ে যায়। এ জিনিসটি সম্পর্কেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ

“আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে তোমরা কোন উস্কানী অনুভব করো তাহলে আল্লাহ‌র পানাহ চাও।” ( হা-মীম সাজদাহ, ৩৬ ) وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ

“বলো, হে আমার রব! আমি শয়তানদের উস্কানী থেকে তোমার পানাহ চাচ্ছি।” ( আল মু’মিনূন , ৯৭)

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ

“যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের অবস্থা এমন হয় যে, কখনো শয়তানের প্রভাবে কোন অসৎ চিন্তা তাদেরকে স্পর্শ করলেও সঙ্গে সঙ্গেই সজাগ হয়ে যায় এবং তারপর (সঠিক পথ) তাদের দৃষ্টি সমক্ষে পরিষ্কার ভেসে উঠতে থাকে।” ( আল আ’রাফ, ২০১ )

আর এজন্যই যারা শয়তানের এই শেষ অস্ত্রের আঘাতও ব্যর্থ করে দিয়ে সফলকাম হয়ে বেরিয়ে আসে তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ‌ বলেনঃ

وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ

“অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা ছাড়া আর কেউ এ জিনিস লাভ করতে পারে না।” ( হা-মীম আস সাজদাহ, ৩৫ )

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথাও সামনে রাখতে হবে। সেটি হচ্ছে, মানুষের মনে কেবল জিন ও মানুষ দলভুক্ত শয়তানরাই বাইরে থেকে প্ররোচনা দেয় না বরং ভেতর থেকে মানুষের নিজের নফসও প্ররোচনা দেয়। তার নিজের ভ্রান্ত মতবাদ তার বুদ্ধিবৃত্তিকে বিপথে পরিচালিত করে। তার নিজের অবৈধ স্বার্থ-লালসা, তার ইচ্ছা, সংকল্প, বিশ্লেষণ ও মীমাংসা করার ক্ষমতাকে অসৎপথে চালিত করে। আর বাইরের শয়তানরাই শুধু নয়, মানুষের ভেতরের তার নিজের নফসের শয়তানও তাকে ভুল পথে চালায়। এ কথাটিকেই কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়েছে এভাবে وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ

“আর আমি তাদের নফস থেকে উদ্ভূত প্ররোচনাসমূহ জানি।” ( ক্বাফ, ১৬ ) এ কারণেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক বহুল প্রচারিত ভাষণে বলেনঃ نَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا

“আমরা নফসের অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহ‌র পানাহ চাচ্ছি।”

সুরা: আন-নাস
আয়াত নং :-৬

مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ۠

সে জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# কোন কোন বিশেষজ্ঞদের মতে এ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে, প্ররোচনা দানকারীরাও দুই ধরনের লোকদের মনে প্ররোচনা দান করে। এক, জিন ও দুই, মানুষ। এ বক্তব্যটি মেনে নিলে এখানে ناس নাস জিন ও মানুষ উভয়কে বুঝাবে এবং তাঁরা বলেন, এমনটি হতে পারে। কারণ, কুরআনে যখন رِجَالٌ (পুরুষরা) শব্দটি জিনদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন সূরা জিনের ৬ নং আয়াতে দেখা যায় এবং যখন نَفَرٌ (দল) শব্দটির ব্যবহার জিনদের দলের ব্যাপারে হতে পারে, যেমন সূরা আহকাফের ২৯ আয়াতে দেখা যায়, তখন পরোক্ষভাবে ‘নাস’ শব্দের মধ্যে মানুষ ও জিন উভয়ই শামিল হতে পারে। কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়। কারণ ناس – انس and اِنْسَانُ শব্দগুলো আভিধানিক দিকে দিয়েই جن (জিন) শব্দের বিপরীতধর্মী। জিন-এর আসল মানে হচ্ছে গোপন সৃষ্টি। আর জিন মানুষের দৃষ্টি থেকে গোপন থাকে বলেই তাকে জিন বলা হয়। বিপরীতপক্ষে ‘নাস’ ও ‘ইনস’ শব্দগুলো মানুষ অর্থে এজন্য বলা হয় যে তারা প্রকাশিত, তাদের চোখে দেখা যায় এবং ত্বক অনুভব করা যায়। সূরা কাসাসের ২৯ আয়াতে آنَسَ مِنْ جَانِبِ الطُّورِ نَارًا বলা হয়েছে। এখানে اَنَسَ (আ-নাসা) মানে رَاى (রাআ) অর্থাৎ হযরত মূসা (আঃ) “তুর পাহাড়ের কিনারে আগুন দেখেন।” সূরা আন নিসার ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَإِنْ آنَسْتُمْ مِنْهُمْ رُشْدًا “যদি তোমরা অনুভব করো, এতিম শিশুদের এখন বুঝসুঝ হয়েছে। اَنَسْتُمْ (আ-নাসতুম) মানে اَحْسَسْتُمْ (আহসাসতুম) বা رَايْتُمْ (রাআইতুম)। কাজেই আরবী ভাষার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ‘নাস’ শব্দটির মানে জিন হতে পারে না। তাই এখানে আয়াতটির সঠিক মানে হচ্ছে, “এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে সে জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষদের মধ্য থেকে।” অর্থাৎ অন্য কথায় বলা যায়, প্ররোচনা দান করার কাজ জিন শয়তানরাও করে আবার মানুষ শয়তানরাও করে। কাজেই এ সূরায় উভয়ের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন থেকে এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় এবং হাদীস থেকেও। কুরআনে বলা হয়েছেঃ وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا “আর এভাবে আমি জিন শয়তান ও মানুষ শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু বানিয়ে দিয়েছি, তারা পরস্পরের কাছে মনোমুগ্ধকর কথা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে বলতে থাকে।” ( আল আন’আম, ১১২ ) আর হাদীসে ইমাম আহমাদ, নাসাঈ ও ইবনে হিব্বান, হযরত আবু যার গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি মসজিদে বসেছিলেন। তিনি বললেন, আবু যার! তুমি নামায পড়েছো? আমি জবাব দিলাম, না। বললেন, ওঠো এবং নামায পড়ো! কাজেই আমি নামায পড়লাম এবং তারপর আবার এসে বসলাম। তিনি বললেনঃ يَا أبَا ذَرٍّ نَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنْ شَرِّ شَيَاطِينِ الإِنْسِ وَالْجِنِّ- “হে আবু যার! মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহ‌র পানাহ চাও!” আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! মানুষের মধ্যেও কি আবার শয়তান হয়? বললেন, হ্যাঁ।

Leave a Reply