Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৮৪/আমাদের ২৪ ঘন্টার রুটিন, ও ঘুম থেকে নামাজ উত্তম:-৩) [*যদি তোমরা কুফরী কর, তবে কি করে আন্তরক্ষা করবে সেদিন:-/এবং কাফির-রা বলে:-২৯] www.motaher21.net সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল পারা:২৯ ১-২০ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৪/আমাদের ২৪ ঘন্টার রুটিন, ও ঘুম থেকে নামাজ উত্তম:-৩)
[*যদি তোমরা কুফরী কর, তবে কি করে আন্তরক্ষা করবে সেদিন:-/এবং কাফির-রা বলে:-২৯]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল
পারা:২৯
১-২০ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১
یٰۤاَیُّہَا الۡمُزَّمِّلُ ۙ﴿۱﴾
বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-২
قُمِ الَّیۡلَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۙ﴿۲﴾
রাতে সালাতে দাঁড়ান , কিছু অংশ ছাড়া !
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৩
نِّصۡفَہٗۤ اَوِ انۡقُصۡ مِنۡہُ قَلِیۡلًا ۙ﴿۳﴾
অর্ধরাত্রি কিংবা তার চাইতে অল্প।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৪
اَوۡ زِدۡ عَلَیۡہِ وَ رَتِّلِ الۡقُرۡاٰنَ تَرۡتِیۡلًا ؕ﴿۴﴾
অথবা তার চেয়েও একটু বাড়ান। আর কুরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে;
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৫
اِنَّا سَنُلۡقِیۡ عَلَیۡکَ قَوۡلًا ثَقِیۡلًا ﴿۵﴾
আমি অতি শীঘ্র তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাযিল করবো।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৬
اِنَّ نَاشِئَۃَ الَّیۡلِ ہِیَ اَشَدُّ وَطۡاً وَّ اَقۡوَمُ قِیۡلًا ؕ﴿۶﴾
প্রকৃতপক্ষে রাতের বেলা জেগে ওঠা৬ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশী কার্যকর এবং যথাযথভাবে কুরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৭
اِنَّ لَکَ فِی النَّہَارِ سَبۡحًا طَوِیۡلًا ؕ﴿۷﴾
দিবাভাগে তোমার জন্য রয়েছে দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৮
وَ اذۡکُرِ اسۡمَ رَبِّکَ وَ تَبَتَّلۡ اِلَیۡہِ تَبۡتِیۡلًا ؕ﴿۸﴾
সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাতে মগ্ন হও।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-৯
رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ فَاتَّخِذۡہُ وَکِیۡلًا ﴿۹﴾
তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তাই তাঁকেই নিজের উকীল হিসেবে গ্রহণ করো।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১০
وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ اہۡجُرۡہُمۡ ہَجۡرًا جَمِیۡلًا ﴿۱۰﴾
আর লোকেরা যা বলে বেড়াচ্ছে সে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করো এবং ভদ্রভাবে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাও।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১১
وَ ذَرۡنِیۡ وَ الۡمُکَذِّبِیۡنَ اُولِی النَّعۡمَۃِ وَ مَہِّلۡہُمۡ قَلِیۡلًا ﴿۱۱﴾
এসব মিথ্যা আরোপকারী, সম্পদশালী লোকদের সাথে বুঝাপড়ার ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর কিছু কালের জন্য এদেরকে এ অবস্থায়ই থাকতে দাও।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১২
اِنَّ لَدَیۡنَاۤ اَنۡکَالًا وَّ جَحِیۡمًا ﴿ۙ۱۲﴾
আমার কাছে (এদের জন্য) আছে শক্ত বেড়ি, জ্বলন্ত আগুন,
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৩
وَّ طَعَامًا ذَا غُصَّۃٍ وَّ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿٭۱۳﴾
আর আছে এমন খাদ্য, যা গলায় আটকে যায় এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৪
یَوۡمَ تَرۡجُفُ الۡاَرۡضُ وَ الۡجِبَالُ وَ کَانَتِ الۡجِبَالُ کَثِیۡبًا مَّہِیۡلًا ﴿۱۴﴾
যেদিন পৃথিবী ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে এবং পর্বতসমূহ বহমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৫
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ رَسُوۡلًا ۬ۙ شَاہِدًا عَلَیۡکُمۡ کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ رَسُوۡلًا ﴿ؕ۱۵﴾
আমি তোমাদের নিকট একজন রসূল পাঠিয়েছি তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ যেমন ফেরাউনের নিকট একজন রসূল পাঠিয়ে ছিলাম।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৬
فَعَصٰی فِرۡعَوۡنُ الرَّسُوۡلَ فَاَخَذۡنٰہُ اَخۡذًا وَّبِیۡلًا ﴿۱۶﴾
কিন্তু ফির‘আউন সে রাসূলকে অমান্য করেছিল, ফলে আমরা তাকে অত্যন্ত শক্তভাবে পাকড়াও করেছিলাম।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৭
فَکَیۡفَ تَتَّقُوۡنَ اِنۡ کَفَرۡتُمۡ یَوۡمًا یَّجۡعَلُ الۡوِلۡدَانَ شِیۡبَۨا ﴿٭ۖ۱۷﴾
অতএব যদি তোমরা কুফরী কর, তবে কি করে আন্তরক্ষা করবে সেদিন যে দিনটি কিশোরদেরকে পরিণত করবে বৃদ্ধে,
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৮
السَّمَآءُ مُنۡفَطِرٌۢ بِہٖ ؕ کَانَ وَعۡدُہٗ مَفۡعُوۡلًا ﴿۱۸﴾
যেদিন আকাশ হবে বিদীর্ণ; তাঁর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-১৯
اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ﴿٪۱۹﴾
নিশ্চয় এটা এক উপদেশ, অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক !
সুরা: ৭৩ : আল্-মুজাম্মিল:-২০
اِنَّ رَبَّکَ یَعۡلَمُ اَنَّکَ تَقُوۡمُ اَدۡنٰی مِنۡ ثُلُثَیِ الَّیۡلِ وَ نِصۡفَہٗ وَ ثُلُثَہٗ وَ طَآئِفَۃٌ مِّنَ الَّذِیۡنَ مَعَکَ ؕ وَ اللّٰہُ یُقَدِّرُ الَّیۡلَ وَ النَّہَارَ ؕ عَلِمَ اَنۡ لَّنۡ تُحۡصُوۡہُ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ فَاقۡرَءُوۡا مَا تَیَسَّرَ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ عَلِمَ اَنۡ سَیَکُوۡنُ مِنۡکُمۡ مَّرۡضٰی ۙ وَ اٰخَرُوۡنَ یَضۡرِبُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ یَبۡتَغُوۡنَ مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ ۙ وَ اٰخَرُوۡنَ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۫ۖ فَاقۡرَءُوۡا مَا تَیَسَّرَ مِنۡہُ ۙ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ اَقۡرِضُوا اللّٰہَ قَرۡضًا حَسَنًا ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ عِنۡدَ اللّٰہِ ہُوَ خَیۡرًا وَّ اَعۡظَمَ اَجۡرًا ؕ وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿٪۲۰﴾
নিশ্চয় আপনার রব জানেন যে, আপনি সালাতে দাঁড়ান কখনও রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনও অর্ধাংশ এবং কখনও এক-তৃতীয়াংশ এবং দাঁড়ায় আপনার সঙ্গে যারা আছে তাদের একটি দলও। আর আল্লাহ্ই নির্ধারণ করেন দিন ও রাতের পরিমান । তিনি জানেন যে, তোমারা এটা পুরোপুরি পালন করতে পারবে না , তাই আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করলেন । কাজেই কুরান থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়, আল্লাহ্ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, আর কেউ কেউ আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্ৰমন করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহ্র পথে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। কাজেই তোমরা কুরআন হতে যতটুকু সহজসাধ্য ততটুকু পড়। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্ৰদান কর এবং আল্লাহ্কে দাও উত্তম ঋণ । তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম পাঠাবে তোমরা তা পাবে আল্লাহ্র কাছে । তা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর। আর তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহ্র কাছে; নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

১-২০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৭৩

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরা নাযিল হওয়ার কারণ প্রসংগে বর্ণিত আছে যে, একবার কোরায়শ নেতারা তাদের ‘দারুণ নাদওয়াহ’ নামে পরিচিত পরামর্শ গৃহে সমবেত হয়ে রসূল(স.) ও তাঁর দাওয়াতী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে। এ খবর জানতে পেরে রসূল(স.) অত্যাধিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি কাপড় চোপড় দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে ও কম্বল মুড়ি দিয়ে বেদনা ভারাক্রান্ত অবস্থায় শুয়ে পড়েন। এই সময় হযরত জিবরাঈল(আ.) তার কাছে এই সূরার প্রথম রুকু নিয়ে এলেন। এর দ্বিতীয় রুকু দীর্ঘ এক বছর পর নাযিল হয়। রসূল(স.) ও তার সাহাবীদের একটি দল তখন রাতের বেলায় এতাে বেশী নামায পড়তেন যে, তাদের পা ফুলে যেতাে। এ জন্যে বারাে মাস পর তাদেরকে আরাে কম নামায পড়ার নির্দেশ দিয়ে এই সূরার দ্বিতীয় রুকু নাযিল হয়। এ প্রসংগে আরাে একটি বর্ণনা রয়েছে। সেই বর্ণনাটি সূরা আল মােযযাম্মেল প্রসংগেও বর্ণিত হয়েছে। সূরা আল মুদ্দাসসির নাজিলের কারণ প্রসংগে তা আগামীতে আলােচনা হবে ইনশাআল্লাহ। এই বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার এই যে, রাসূল(স.) নবুওত লাভের তিন বছর পূর্ব থেকে হেরা পর্বতের গুহায় নির্জন বাস করতেন। অর্থাৎ পাক পবিত্র অবস্থায় একাকী এবাদাত করতেন। প্রতি বছর তিনি এক মাস এভাবে নির্জনে কাটাতেন। এটি থাকতাে রমযান মাস। মক্কা থেকে প্রায় দুই মাইল দূরবর্তী হেরা গুহায় এই নির্জন বাস কালে তার পরিবার তার কাছাকাছিই থাকতাে । পুরাে এক মাস তিনি এখানে কাটাতেন। এ সময়ে তার কাছে কোনো গরীব দুঃখী এলে তাকে খাবার দিতেন এবং ইবাদত ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তার ধ্যান ও চিন্তা-গবেষণার বিষয় ছিলাে তার চারপাশে বিদ্যমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এবং তার অন্তরালে অবস্থানরত মহা শক্তিধর স্রষ্টা। তার দেশবাসী যে অযৌক্তিক ও অসার পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাসে নিমজ্জিত ছিলাে, তাতে তিনি মােটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু এমন কোনাে সুস্পষ্ট বিকল্প পথ, কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা এবং কোনাে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি তার জানা ছিলাে না যা তিনি সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে ও পছন্দ করতে পারেন। রসূল(স.)-এর এই নির্জন বাসের কর্মসূচী তার জন্যে আল্লাহর গৃহীত সুপরিকল্পিত কৌশলের একটি অংশ ছিলাে। আগামী দিনে যে বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার অপেক্ষায় ছিলাে, তার জন্যে তাঁকে তৈরী করাই ছিলাে এই কৌশলের উদ্দেশ্য। এই সময় তিনি একান্তভাবে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন ও আপন মনে চিন্তাভাবনায় মশগুল থাকতেন। সংসারে যাবতীয় ঝামেলা ও খুটিনাটি ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে নিভৃতে বসে নিঝুম প্রকৃতির অস্ফুট ভাষা ও আকুতি বুঝতে চেষ্টা করতেন। জানতে চেষ্টা করতেন কিভাবে এই নির্বাক মহাবিশ্ব নিজেই তার নিপুন স্রষ্টার অস্তিত্বের অকাট্য সাক্ষ্য দিচ্ছে। পর্বতগুহার সেই মর্মবিদারী নিস্তব্ধতায় থেকে থেকে তার আত্মা গােটা সৃষ্টি জগতের আত্মার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে স্রষ্টার গুণগানে সােচ্চার হয়ে উঠতাে। সৃষ্টির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও নিঙ্কলূষ পরিপক্কতাকে তাঁর সত্ত্বা সানন্দে আলিংগন করতাে এবং তিনি আপন মনে পরম সত্যকে গড়ে তুলতেন। যে ব্যক্তিকে মানব জাতির বাস্তব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তার আমূল পরিবর্তন সাধন ও নিভৃতে অবস্থান এবং পৃথিবীর নিত্যকার ব্যস্ততা, হৈ, চৈ, সংসারের শােরগোল ও ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে কিছু সময় কাটানাে একান্ত প্রয়ােজন। বিশাল মহাবিশ্ব ও তার অগণিত তথ্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা, তার ব্যাপারে নীতি ও দৃষ্টি ভংগী নির্ণয়ের জন্যে কিছুটা আলাদা সময় অপরিহার্য। কেননা কর্মচঞ্চল সাংসারিক জীবনের সাথে সর্বাত্মক, সার্বক্ষণিক ও নিবিড়ভাবে মেলামেশা করতে করতে মানুষের মন-মেজাজ তার সাথে এতাে অভ্যস্ত ও পরিচিত হয়ে যায় যে, তাতে পরিবর্তন সাধনের জন্যে আর কোনাে চেষ্টা করতে চায় না। ক্ষণিকের জন্যে এই সব ছোটখাট ব্যস্ততা থেকে দুরে চলে যাওয়া, ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া এবং সংসার জীবনের বন্দীদশা থেকে অব্যহতি পেয়ে সাময়িকভাবে হলেও পূর্ণ মুক্ত জীবন যাপন মানুষের আত্মা ও বিবেককে প্রশস্ততা ও তীক্ষ্ণতা দান করে। তাকে পৃথিবীর চেয়ে বৃহত্তর জিনিস দেখার ও বুঝার যােগ্য বানায় এবং মানুষের সমাজ ও সামাজিক রীতি প্রথার মুখাপেক্ষী না হয়ে আপন সত্তার পূর্ণতা ও পরিপক্কতা অর্জনের জন্যে আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি সাহায্য গ্রহণ এবং স্বনির্ভর হতে অভ্যস্ত বানায়। বস্তুত, আল্লাহ তায়ালা মােহাম্মাদ(স.)-কে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহন, পৃথিবীর জীবন ধারাকে ও চেহরাকে আমূল পাল্টে দেয়া এবং ইতিহাসের মােড় ঘুরিয়ে দেয়ার যােগ্য করে গড়ে তােলার জন্যে এ পরিকল্পনা তৈরী করেছিলেন। নবুওতের তিন বছর আগে তাকে এই নির্জন বাসে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই নির্জনবাস বিরতিহীনভাবে একমাস স্থায়ী হতাে। এ সময় একমাত্র মুক্ত প্রকৃতিই হতাে তার সাথী। প্রকৃতির অন্তরালে অদৃশ্য জগতের সাথে তার সংযােগ স্থাপিত হওয়া পর্যন্ত এই নির্জনবাসের কর্মসূচী অব্যাহত থাকলাে। অবশেষে যখন আল্লাহর মর্জি হলো এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বিশ্ববাসীর ওপর তার এই করুণাধারা বর্ষণ অর্থাৎ ওহী নাযিল করবেন, তখন জিবরাঈল(আ.) রসূল(স.)-এর কাছে এলেন। তিনি তখনাে হেরার গুহায় অবস্থান করছিলেন। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মােতাবেক রসূল(স.) তার এ ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন, আমি তখন নিদ্রিত। সেই অবস্থায় জিবরাঈল এলেন রেশমী রুমাল নিয়ে। তাতে কি একটা কথা লেখা ছিল। জিবরাঈল আমাকে সেই লেখাটি দেখিয়ে বললেন, পড়ুন তাে! আমি বললাম, আমি পড়তে জানি না। জিবরাঈল আমাকে এমন জোরে আলিংগন করলেন যে, মনে হলাে আমি মরে যাচ্ছি। তারপর ছেড়ে দিলেন। তারপর পুনরায় বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি পড়তে জানি না। তারপর আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি এমন চাপ দিলেন যে, মনে হলাে আমার মৃত্যু এসে গেছে। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ূন! আমি বললাম, কী পড়বাে? এ কথাটা আমি শুধু এই আলিংগনের পুনরাবৃত্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে বলেছিলাম। জিবরাঈল বললেন, ‘পড়াে, তােমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়াে, আর তােমার মহান প্রভু, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতাে না।’ রাসূল(সা.) বলেন, আমি এগুলাে পড়লাম। অতপর পড়ার পালা শেষ হলাে এবং তিনি চলে গেলেন। আমি ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন মনে হলাে, আমার মানসপটে কথাগুলাে লিখে নিয়েছি। এরপর আমি গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে এসে শুনলাম, আকাশ থেকে আওয়ায আসছে, ‘হে মোহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল, আর আমি জিবরাঈল। আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম, জিবরাঈল একজন বিশালকায় মানুষের বেশে দাঁড়িয়ে। আকাশের এক প্রান্তে তার এক পা। তিনি বলছেন, হে মােহাম্মাদ। আপনি আল্লাহর রসূল, আর আমি জিবরাঈল। আমি তার দিকে তাকিয়েই রইলাম। আগে পিছে একটুও না সরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অথচ আকাশের যে প্রান্তেই তাকাই দেখি তিনি সেখানে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আগে পিছে এক চুলও সরছি না। এমতাবস্থায় খাদিজা আমার সন্ধানে লোকজন পাঠালাে। তারা মক্কার উচ্চতম প্রান্তে গিয়ে ঘুরে ফিরে আবার খাদিজার কাছে ফিরে গেলাে। আমি তখনাে আমার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। এরপর এক সময় জিবরাঈল চলে গেলেন। আমিও আমার পরিবারের কাছে ফিরে গেলাম। গিয়ে খাদিজার একবারে কোলের কাছে ঘনিষ্ট হয়ে বসলাম। তিনি বললেন, ওহে কাসেমের বাবা! আপনি কোথায় ছিলেন। আমি আপনার খোঁজে লােক পাঠিয়েছিলাম। তারা মক্কায় গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। অতপর আমি তাকে যা যা দেখেছি বললাম। খাদিজা বললাে, হে আমার চাচাতাে ভাই, আপনি এটিকে শুভ সংবাদ হিসাবে গ্রহণ করুন এবং স্থির থাকুন। খাদিজার প্রাণ যার হাতে, তার শপথ করে আমি বলছি যে, আমি মনে করি আপনি এ যুগের মানব জাতির নবী। এরপর রসূল(স.) পুনরায় পাহাড়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওহী স্থগিত থাকলাে। যেদিন পুনরায় সেখানে গেলেন, চোখ মেলে তাকাতেই জিবরাঈলকে দেখলেন। দেখে এবার তিনি ভয়ে কেঁপে উঠলেন। ভয়ে তিনি সংকুচিত হয়ে মাটির কাছাকাছি ঝুঁকে পড়লেন। তারপর কাঁপতে কাঁপতে বাড়ীতে গিয়ে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। সবাই তাকে ঢেকে দিলাে। তবু তার কাঁপুনি বন্ধ হলাে না। এই সময় জিবরাঈল তাকে ডেকে বললেন, ইয়া আইয়ুহাল মুদ্দাসসির (হে কম্বল মুড়ি দেয়া ব্যক্তি) কেউ কেউ বলেন, জিবরাঈল বললেন, ইয়া আইয়ুহাল মুযযাম্মিল’ (হে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি) প্রকৃত পক্ষে এ সময় কোন সূরা নাযিল হয়েছিলাে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। চাই পূর্ববর্তী বর্ণনাই সঠিক হােক, কিংবা শেষােক্ত বর্ণনাই সঠিক হােক, এ কথা সত্য যে, রসূল(স.) ভালােভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার আর ঘুম পাড়ার অবকাশ নেই, তার ঘাড়ে বিরাট দায়িত্বের বােঝা চেপেছে। তার সামনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ সংগ্রাম। জিবরাঈল-এর সেই ডাক শােনার পর তার জন্যে অপেক্ষা করছে শুধুই জাগরণ, কাঠোর প্ররিশ্রম ও অক্লান্ত চেষ্টা সাধনা। সেই ডাক তাকে আর ঘুমাতে দেবে না। রসূল(স.)-কে বলা হলাে, ওঠো, তিনি উঠলেন। তারপর বিশ বছরেরও বেশী কাল ধরে তিনি উত্থিতই রইলেন। অর্থাৎ কোনাে বিশ্রাম নিতে পারলেন না, স্থির হতে পারলেন না। নিজের জন্যে বা নিজের পরিবারের জন্য এক মুহূর্ত শান্তভাবে জীবন উপভােগ করতে পারলেন না। আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতে তিনি সেই যে উঠলেন- আর বসলেন না, আর থামলেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ভারী দায়িত্বের বােঝা ঘাড়ে তুললেন। সমগ্র মানব জাতির দায়িত্ব, গােটা দ্বীনের দায়িত্ব এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দায়িত্ব ঘাড়ে তুললেন। তার এ সংগ্রাম ছিলাে জাহেলিয়াতের সৃষ্ট মতবাদ ও ধ্যান ধারণায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ভােগ লালসার ভারে ভারাক্রান্ত ও তার প্রলােভনে আকৃষ্ট এবং প্রবৃত্তির গােলামীর যিঞ্জীরে আবদ্ধ মানবীয় বিবেককে মুক্ত করার সংগ্রাম। যখন তিনি তাঁর কিছু সংখ্যক সাহাবীর বিবেককে এই জাহেলিয়াতের আবর্জনার ভারমুক্ত এবং ইহলৌকিক জীবনের কলুষমুক্ত করতে সক্ষম হলেন, তখন আরেক রণাংগনে শুরু করলেন অপর এক যুদ্ধ। এটি যুদ্ধ তাে নয়, বরং বলতে গেলে যুদ্ধের এক অন্তহীন ধারা। ইসলামী আন্দোলনের যেসব দুশমন আন্দোলন ও আন্দোলনের সহযােগী মােমেনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলাে, ইসলামের এই সদ্য গজানাে নিস্পাপ চারা গাছটিকে অংকুরেই যারা বিনষ্ট করতে চেয়েছিলাে, এবং মাটিতে তার শিকড় ও আকাশে ডালপালা বিস্তার করার আগেই তাকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলাে, সেই ভয়ংকর আগ্রাসী দুশমনদের বিরুদ্ধে ছিলাে তাঁর এ যুদ্ধ, আর আরব উপদ্বীপের ভেতরকার যুদ্ধগুলাে শেষ করতে না করতেই রােম সাম্রাজ্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাে এই নতুন জাতিকে তার উত্তর সীমান্ত দিয়ে আঘাত হানতে। এই রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালেও প্রথমোক্ত বিবেকের যুদ্ধ থামেনি। কারণ, ওটা এক শাশ্বত যুদ্ধ। এই যুদ্ধের হােতা হচ্ছে শয়তান। মানুষের বিবেকের গভীরতম প্রকোষ্ঠে আপন তাৎপরতা চালিয়ে যাওয়া থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যেও বিরত হয় না। পক্ষান্তরে রসুল(স.)ও আল্লাহর পথের দিকে দাওয়াত দেয়ার কাজ একইভাবে অব্যাহত রাখলেন। দাওয়াতের পাশাপাশি চালিয়ে গেলেন বহুমুখী সংগ্রাম । দুনিয়ার যাবতীয় সুখ সম্ভোগের সুযােগ তার জন্য আবার ছিলাে, তথাপি তিনি কষ্টকর জীবন যাপন করতেন। কঠোর পরিশ্রম করতেন, মােমেনরা তার চারপাশে থেকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। তারা সেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কে প্রশমিত করতেন। রাত জেগে তারা নামায পড়তেন, আল্লাহর বন্দেগী করতেন, ধীরে ধীরে বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহর প্রতি একান্তভাবে মনােনিবেশ করতেন। আল্লাহ তায়ালা সুরার প্রথম দশ আয়াতে তাকে এভাবেই জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, ‘হে কম্বলাচ্ছাদিত! ওঠো, রাত্রি জাগরণ কর, তবে অল্প কিছু অংশ বাদে…’ এভাবে রসূল(স.) ২০টি বছর কাটিয়ে দিলেন। এ সময়ের ভেতরে কোনাে ক্ষেত্রেই এবং কোনাে অবস্থাতেই তিনি বিন্দুমাত্র শৈথিল্য দেখাননি। ওহীর প্রথম দিন থেকেই তিনি তার এই অক্লান্ত সাধনা অব্যাহত রাখেন। সূরার প্রথম রুকু একটি বিশেষ ধরনের ছন্দবদ্ধ গদ্যের সমাহার। এটি অত্যন্ত কোমল অথচ ভাবগম্ভীর ছন্দ। যে গুরুগম্ভীর দায়িত্ব ও কড়া নির্দেশাবলী এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার সাথে এ ছন্দ বেশ মানানসই। যে দুর্বহ বক্তব্য নাযিল করার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে আমরা আগেই আলােচনা করে এসেছি, তার ভয়াবহতা এবং ‘আমাকে ও রসূলের আহবান প্রত্যাখ্যানকারী বিত্তশালীদেরকে ছেড়ে দাও, তাদেরকে সামান্য অবকাশ দাও, আমার কাছে শাস্তি ও দোযখ রয়েছে এবং কাঁটাযুক্ত খাদ্য ও যন্ত্রণাদায়ক শান্তি রয়েছে’ এ উক্তির ভয়াবহাতার সাথে এই গুরুগম্ভীর ছন্দবদ্ধ গদ্য যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ। প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্যে এবং হৃদয়ের গভীরে যে ভীতিপ্রদ নিদর্শনাবলী প্রতিফলিত হয়েছে, তার সাথেও একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথা, ‘যেদিন পাহাড় ও পৃথিবী কাঁপতে থাকবে…. যেদিন শিশুদেরকে বৃদ্ধে পরিণত করবে, যেদিন আকাশ ফেটে যাবে…’ দ্বিতীয় রুকু যে দীর্ঘ আয়াতটি নিয়ে গঠিত, তা নাযিল হয়েছে রাত জেগে নামায পড়তে পড়তে রাসূল(স.) ও তার সহচরদের পা ফুলে যাওয়ার ঘটনার এক বছর পর। যে মহান দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে ও তার সাহাবীদেরকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, এই রাত্রি জাগরণের উদ্দেশ্যও ছিলো তাই। এ আয়াতে তাদের রাত্রি জাগরণের সময় কমানাে হয়েছে। সেই সাথে এ আশ্বাসও দেয়া হয়েছে যে, সময় কমানাের এই সিদ্ধান্তে বিচলিত হওয়ার কোনাে কারণ নেই। তাদের পরবর্তী কালের দায়দায়িত্বের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় জ্ঞান ও দূরদর্শিতা অনুসারে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লক্ষণীয় যে, এ আয়াতটির ছন্দ ও ভাষাগত কাঠামাে প্রথম রুকু থেকে ভিন্ন ধরনের। এটি দীর্ঘ আয়াত এবং এতে স্থীতি ও প্রশান্তির প্রতিফলন ঘটেছে। সুরাটি তার উভয় অংশের সম্মিলিত রূপ নিয়ে সামগ্রিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে তুলে ধরেছে। এর শুরু হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক স্নেহময় সম্বােধন ও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমর্পণের মধ্য দিয়ে। তারপর রাত জেগে নামায পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, একাগ্রচিত্তে আল্লাহকে স্মরণ করা, একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করা, দুঃখ কষ্ট ও নিপীড়নের ওপর ধৈর্য অবলম্বন, প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে ভালােভাবে পরিত্যাগ করা এবং তাদেরকেও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহকে একা ছেড়ে দেয়া, যাতে তিনি তাদেরকে সমুচিত শিক্ষা দিতে পারেন এই সব বিষয় সূরায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবশেষে সূরার উপসংহার টানা হয়েছে ‘নিশ্চয় আল্লাহ দয়ালু ও ক্ষমাশীল’ এই প্রশান্ত ও করুণাসিক্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এ সূরার উভয় রুকুতে রসূল(স.)-এর প্রিয় ও আল্লাহর মনােনীত সেই আদর্শ মােমেনদের দলটির মহৎ গুনাবলী চেষ্টা সাধনারও প্রশংসা করা হয়েছে। পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনা, দুঃখ কষ্টে ধৈর্যধারণ, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পার্থিব স্বার্থের মােহমুক্ত থাকা, প্রভৃতি মহৎ গুণাবলীতে তারা ভূষিত ছিলেন। এবার সুরার তাফসীর আলােচনা করার প্রয়াস পাবাে।
সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-১

یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُۙ

হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী।

ফী জিলালিল কুরআন:

‘হে কম্বলাচ্ছাদিত! ওঠো।’ মহাশক্তিধর ও মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, ‘ওঠো।’ অর্থাৎ যে গুরুদায়িত্ব তােমার জন্যে অপেক্ষা করছে, তা পালনের জন্যে জাগ্রত হও। অক্লান্ত চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম করার জন্যে ওঠো। ঘুম ও বিশ্রামের সময় আর নেই। ওঠো, এই দায়িত্বের জন্যে প্রস্তুতি নাও। এটি একটি গুরুতর উক্তি। এ উক্তি দ্বারা রসূল(স.)-কে তাঁর আয়েশী বিছানা থেকে তুলে নিয়ে কষ্টকর সংগ্রামের কন্টকাকীর্ণ রাজপথে নিয়ে দাঁড় করানাে হয়েছে। মানুষের হৃদয়ের অভ্যন্তরে এবং বহির্ভাগের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে সমান ভাবে সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে তাকে তার সুখের ঘর থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি শুধু নিজের জন্যে জীবন ধারণ করে, তার পক্ষে সুখ-শান্তির মধ্যে জীবন কাটানাে সম্ভব হতেও পারে, সে নগন্য তুচ্ছ মানুষ হিসেবেই বাঁচে এবং নগন্য অবস্থাতেই মারা যায় । কিন্তু পৃথিবীতে যে ব্যক্তি বড় ও মহৎ হয় এবং বড় দায়িত্ব গ্রহণ করে তার ঘুম আসে কি করে? তার বিশ্রামের অবকাশ কোথায়? আরামদায়ক বিছানার সাথে তার কিসের সম্পর্ক? আয়েশী জীবন যাপন তার কিভাবে সম্ভব? বিলাসী ও আয়েশী আসবাবপত্র সে পাবে কোথায়? এই বাস্তবতা রসূল(স.) বুঝতে পেরেছিলেন। তাই হযরত খাদীজা(রা.) যখন তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে বললেন, তখন বললেন, ‘ঘুমের যুগ আমার শেষ হয়ে গেছে খাদীজা।’ বাস্তবিকই তার ঘুমের যুগ শেষে হয়ে গিয়েছিলাে এবং জাগরণ, কষ্ট ও দীর্ঘ সংগ্রাম ছাড়া তার কাছে আর কিছুই ফিরে আসেনি।

ফী জিলালিল কুরআন:   *রাত জেগে এবাদাতের গুরুত্ব : ‘হে কম্বলাচ্ছাদিত! রাত জাগাে। তবে কিছু সময় বাদ দিয়ে। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কম বা বেশী। আর তারতীল সহকারে কুরআন পড়ো।’ এ হচ্ছে রিসালাতের বৃহত্তম দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতিপর্ব। আল্লাহর নির্ধারিত পন্থায় এ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এর ভেতরে রয়েছে রাত্রি জাগরণ। এর সর্বোচ্চ পরিমাণ হলাে অর্ধেকের বেশী ও দুই তৃতীয়াংশের কম। আর ন্যুনতম হচ্ছে এক তৃতীয়াংশ। নামায ও তারতীলসহ ধীরে ধীরে কোরআন পাঠের মধ্য দিয়ে এই রাত জেগে কাটাতে হবে। আরাে অবতীর্ণ হচ্ছে কোরআনকে টেনে টেনে ধীরে সুস্থে ও বিশুদ্ধভাবে কোনাে কৃত্রিম সূর ছাড়া পড়ো। বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, রসূল(স.) এগারাে রাকাতের বেশী নামায পড়তেন না। তবে এ কয় রাকাতেই তার রাতের দুই তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে সামান্য কিছু কম কেটে যেতাে। কেননা তিনি নামাযে তারতীল সহকারে কুরআন পড়তেন। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে যে, সাঈদ বিন হিশাম ইবনে আব্বাসের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন যে, রাসূল(স.) কিভাবে বিজোড় সংখ্যক নামায পড়তেন? হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) বললেন, এ ব্যাপারে হযরত আয়েশা(রা.) সবচেয়ে ভালাে জানেন, তার কাছে জিজ্ঞাসা করাে। তিনি কি জবাব দেন আমাকে জানিও। সাঈদ ইবনে হিশাম বলেন, আমি হযরত আয়েশাকে বললাম, হে উম্মুল মােমেনীন, আমাকে জানান রাসূল(স.) এর চরিত্র কেমন ছিল। তিনি বললেন, তুমি কি কুরআন পড়ােনা? আমি বললাম, হাঁ, পড়ি। তিনি বললেন, কোরআনই ছিলাে রসূল(স.) এর চরিত্র। এ কথা শোনার পর আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লাে, রসূল(স.) রাত্রি জেগে নামায পড়ার বিষয়। আমি বললাম, হে উম্মুল মােমেনীন! রাসূল(স.) কি রকম রাত জেগে নামায পড়তেন তা আমাকে বলুন। তিনি বললেন, তুমি সূরা আল মােযযাম্মেল পড়াে না? আমি বললাম, হাঁ, পড়ি। তিনি বললেন, এ সূরার প্রথমাংশে রাত জেগে নামায পড়াকে ফরয করা হয়েছিলাে। ফলে রসূল(স.) ও তাঁর সাহাবীরা রাত জেগে নামায পড়তে লাগলেন। পুরাে এক বছর এভাবে রাত জেগে নামায পড়ায় তাদের পা ফুলে গেলাে। এ সূরার শেষাংশকে আল্লাহ তায়ালা বারাে মাস আকাশে আটকে রাখলেন। তারপর সূরার শেষভাগে আংশিক অব্যাহতির বিধান নাযিল করলেন। তখন থেকে রাত জাগা নফল হয়ে গেলাে। অথচ ইতিপূর্বে তা ফরয ছিলাে। এরপর আমি বিদায় নেয়ার উদ্যোগ নিলাম সহসা মনে পড়লাে রসূল(স.) এর বেজোড় সংখ্যক নামায পড়ার বিষয়। আমি বললাম, উম্মুল মােমেনীন! রাসূল(স.)-এর বেজোড় সংখ্যক নামায পড়ার বিষয়টি আমাকে জানান। তিনি বললেন, আমরা রসূল(স.)-এর মিসওয়াক ও ওযুর পানি প্রস্তুত করে রাখতাম। এরপর আল্লাহ তায়ালা যেভাবে তাকে ঘুম থেকে জাগাতে চাইতেন জাগাতেন। তিনি জেগে মিসওয়াক করতেন, ওযু করতেন অতপর আট রাকাত নামায পড়তেন। এই আট রাকাতের একেবারে শেষে ছাড়া বসতেন না। অষ্টম রাকাতে বসে আল্লাহর যেকের করতেন, দোয়া করতেন; কিন্তু সালাম না ফিরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একই নিয়মে নবম রাকাত শেষ করে সালাম করতেন। এরপর দু’রাকাত বসে বসে পড়তেন। এই হচ্ছে এগারাে রাকাত। রসূল(স.) যখন বয়ােবৃদ্ধ হলেন, তখন সাত রাকাত নামায পড়ে সালাম ফিরিয়ে আরাে দু’রাকাত পড়তেন। এভাবে নয় রাকাত পড়তেন। আর রসূল(স.) যখন কোনাে নামায পড়তেন, তা অব্যাহত রাখা পছন্দ করতেন। কোনাে অসুখ, কিংবা ঘুমের কারণে রাতে জাগতে না পারলে তিনি দিনের বেলায় বারাে রাকাত পড়তেন। রসূল(স.) কখনো একই রাতে সকাল পর্যন্ত পুরাে কোরআন পড়েছেন বলে আমার জানা নেই। রমযান ছাড়া তিনি এক নাগাড়ে একমাস কখনাে রােযা রাখতেন না। (যাদুল মা’য়াদ)।
ফী জিলালিল কুরআন:   *কঠোর সংগ্রামের প্রস্তুতি : এতসব চেষ্টা সাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিলাে অচিরেই তার ওপর যে দুর্বহ বাণী নাযিল হবে, তার জন্যে তাকে প্রস্তুত করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি অচিরেই তােমার ওপর ভারী বাণী নাযিল করবেন।’ বস্তুত, সেই ভারী বাণী কোরআন এবং কোরআন সংক্রান্ত অন্যান্য দায়দায়িত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও কুরআন তার আংগিক ও ভাষাগত কাঠামোর দিক দিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজবােধ্য এবং উচ্চারণে তা একেবারেই হালকা, কিন্তু সত্যের দাঁড়িপাল্লায় তা খুবই ভারী এবং মানুষের মন-মগযে প্রভাব বিস্তারের দিক দিয়েও তা গুরুভার। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি যদি এই কোরআনকে পর্বতের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি তাকে আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে যেতে দেখতে।’ এ থেকে স্বভাবতই বুঝা যায় যে, যে হৃদয়ের ওপর আল্লাহ তায়ালা কোরআন নাযিল করেছেন, তা পর্বতের চেয়েও শক্ত ও মযবুত। আল্লাহর এই জ্যোতির্ময় ওহী ও অদৃশ্য জগতের জ্ঞানকে অর্জন করা খুবই কঠিন তাই এ কাজের যােগ্যতা অর্জনে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও অনুশীলনের প্রয়ােজন। মহাবিশ্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্যাবলীকে ধারণ করাও খুবই কঠিন ব্যাপার এবং এ কাজও দীর্ঘ প্রস্তুতি সাপেক্ষ। আল্লাহর ঘনিষ্টতম ফেরেশতাদের সাথে এবং সৃষ্টি জগতের জীব ও জড়ের প্রাণ শক্তির সাথে সংযােগ স্থাপনও কঠিন কাজ আর এ কাজের জন্যে ও দীর্ঘ প্রস্তুতি অপরিহার্য। আর কোনাে রকমের সংকোচ ও দোদুল্যমানতা ছাড়া এবং হাজারাে রকমের বাধা বিঘ্ন ও প্রলােভন উপেক্ষা করে দৃঢ়ভাবে ও একাগ্র চিত্তে ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজে নিয়ােজিত থাকা অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং তা দীর্ঘ প্রস্তুতি ছাড়া সম্ভব নয় । সকল মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন রাত জেগে নামায পড়া, নিত্যদিনের খুটিনাটি ব্যস্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, আল্লাহর সাথে সংযােগ স্থাপন করা এবং তার আলােকে আলােকিত হওয়া, আল্লাহর সাথে নিভৃতে ও নিরিবিলিতে মিলিত হওয়া, সমগ্র প্রকৃতি যখন নিঝুম নিস্তব্ধ, তখন তারতীলের সাথে কোরআন তেলাওয়াত করা, যাতে মনে হয় কোরআন বুঝি এখনই ফেরেশতাদের মাধ্যমে নাযিল হচ্ছে এবং আশপাশের প্রকৃতিতে যেন তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, আর অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনীতে কুরআন অধ্যয়নের সুফলগুলাে আহরণ করা এই সব কাজই হচ্ছে আল্লাহর এই দুর্বহ ও গুরুগম্ভীর বাণীকে গ্রহণের প্রস্তুতি ও অনুশীলন। এই প্রস্তুতি এবং কঠিন ও প্রাণান্তকর সাধনা প্রত্যেক নবীর এবং প্রত্যেক প্রজন্মের ইসলামের দাওয়াত ও প্রচার কাজে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের জন্যেই অপরিহার্য। তাদের কঠিন সাধনার পথে চলার জন্যে এটা প্রয়ােজনীয় মনােবল যােগায়, শয়তানের কুপ্ররােচনা থেকে তাদের রক্ষা করে এবং অন্ধকারে পথ হারানাের ঝুঁকি থেকে তাদের নিরাপত্তা দেয়।
ফী জিলালিল কুরআন:   *সংযমের মাধ্যমে সংগ্রামের প্রস্তুতি : ‘রাতে বিছানা থেকে ওঠা আত্ম সংযমের জন্যে অত্যন্ত কার্যকর এবং আবৃত্তির জন্যে অধিকতর উপযােগী।’ নাশিআতুল্লাইল’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে এশার পরবর্তী রাত্রি ভাগে জাগ্রত হওয়া। মুজাহিদের মতে, আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে, রাত্রের এই অংশে ঘুম থেকে জেগে এবাদত করা শরীরের পক্ষে অধিকতর কষ্টকর এবং অধিকতর স্থায়ী কল্যাণের নিশ্চয়তাদায়ক। কেননা সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর ঘুমের প্রবল আহবান ও বিছানার দুর্নিবার আকর্ষণকে উপেক্ষা করে আল্লাহর এবাদাত করা নিসন্দেহে কঠোরতর দৈহিক সাধনা। শুধু তাই নয়, এটা আত্মার আধিপত্যের ঘােষণা, আল্লাহর আহবানে সাড়া দান এবং আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ তার ত্যাগ স্বীকারের শামিল। এজন্যে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে, এটা আবৃত্তির জন্যে অধিকতর উপযােগী। কেননা গভীর রাতের জিকির বড়ই মজাদার, নামায খুবই একাগ্রতা সৃষ্টিকারী এবং মােনাজাত হৃদয়ে খুবই স্বচ্ছতা আনয়নকারী। গভীর রজনী মানুষের হৃদয়ে প্রেম, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বচ্ছতা ও ঔজ্জল্য এনে দেয়। দিনের বেলার নামায বা যিকিরে তা নাও পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা হৃদয়ের স্রষ্টা তাই হৃদয়ের প্রবেশদ্বার ও তার সংযােগকাল তিনিই ভালাে চেনেন, তিনিই ভালাে জানেন হৃদয়ে কি প্রবেশ করে ও তার ওপর কোন জিনিসের কেমন প্রভাব হয়। কোন কোন সময়ে হৃদয় কিছু গ্রহণের জন্যে অধিকতর প্রস্তুত বা যােগ্য হয় এবং কোন জিনিস হৃদয়কে অধিকতর আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দা মােহাম্মদ(স.)-কে এই গুরুভার বাণী গ্রহণের যােগ্য বানানাের উদ্দেশ্যে এবং এর জন্যে প্রয়ােজনীয় বিরাট ও কষ্টকর সাধনা ও সংগ্রামের উপযুক্ত বানানাের উদেশ্যে তার জন্যে রাত জেগে এবাদাত করার কর্মসূচী মনােনীত করেছেন। কেননা রাত জাগা এ ব্যাপারে অধিকতর উপকারী। তাছাড়া দিনের বেলায় যেহেতু তার অনেক কাজ ও ব্যস্ততা রয়েছে এবং তাতে অনেক সময়, শ্রম ও মনােযােগ খাটাতে হয়, তাই এ জন্যে রাতের এই অংশকে বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দিনের বেলায় তােমার অনেক ব্যস্ততা রয়েছে। কাজেই এইসব তৎপরতায় দিনের সময় ব্যয় করা উচিত আর রাত্রিকালকে আল্লাহর জন্যে তথা নামায ও যিকিরের কাজে ব্যয় করা উচিত। ‘আর তোমার প্রভুর যিকির করাে এবং তার দিকে ঘনিষ্ট হও।’ আল্লাহ তায়ালার যিকির কেবল একশত দানা বা হাজার দানা তাসবীহ গণনা করা, মুখে আল্লাহর নাম জপ করার নামই নয়। যিকির হচ্ছে সদা সচেতন হৃদয় দিয়ে স্মরণ করা এবং একই সাথে জিহবা দিয়ে উচ্চারণ বা জপ করা । অথবা নামায় পড়া ও নামাযে কোরআন পড়া। আর ‘তাবাত্তুল’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া অন্য সকলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং এবাদাত ও যিকির দ্বারা তার দিকে সর্বতােভাবে মনােযােগী হওয়া । যাবতীয় পার্থিব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সমস্ত আবেগ অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সব কিছুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার (তাবাত্তুল) উল্লেখ করার পরপরই জানানাে হয়েছে যে, বাস্তবিক পক্ষেও আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ এমন নেই, যার দিকে মনােনিবেশ করা যেতে পারে। ‘পূর্ব ও পশ্চিমের অধিপতি তিনি ছাড়া আর কোনাে ইলাহ নেই, কাজেই তাকেই সহায় হিসাবে গ্রহণ করাে।’ বস্তুত, তিনি যখন পূর্ব ও পশ্চিম সর্ব দিকের প্রভু, একক ও অদ্বিতীয় প্রভু এবং তিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই, তখন সব কিছুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার দিকে মনােনিবেশ করার অর্থ হলাে এ বিশ্ব জগতের একমাত্র সত্যের দিকে মনােনিবেশ করা, আর তার ওপর নির্ভর করার অর্থ বিশ্ব জগতের একমাত্র শক্তির ওপর নির্ভর করা। বস্তুত একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করা, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসেরই প্রত্যক্ষ ও স্বতস্ফুর্ত ফল। তার পূর্ব ও পশ্চিমের প্রভু হওয়ার অর্থ সমগ্র মহাবিশ্বের প্রভু হওয়া। রসূল(স.)-কে তাঁর দুর্বহ দায়িত্ব বহন করার জন্যে রাত্রি জাগরনের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এতে করে বুঝা যায় শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর সব কিছুকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া। কেননা একমাত্র তার কাছ থেকেই তিনি এই ভারী দায়িত্ব বহন করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার শক্তি ও পাথেয় যোগাড় করতে পারেন।
ফী জিলালিল কুরআন:   *দাওয়াতের কাজে ধৈর্য অপরিহার্য : অতপর আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে সর্বাত্মক ধৈর্যধারনের নির্দেশ দিয়েছেন। তার জাতির পক্ষ থেকে ক্রমাগত যে উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অপবাদ, অবরােধ ও প্রতিরােধের সম্মুখীন তিনি হয়ে আসছেন, তার জন্যে সবরের উপদেশ দিয়েছেন। সেই সাথে আরাে বলেছেন যে, সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে যাতে আমি উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারি সে জন্যে তাঁর ও প্রত্যাখ্যানকারীদের থেকে সরে দাড়াও, একটু সময় দাও ও অপেক্ষা করাে। কেননা আমার কাছে তাদের জন্যে কঠোর আযাব রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যে সব কথা বলে, তার ওপর ধৈর্যধারণ করাে এবং তাদেরকে পুরােপুরিভাবে বর্জন করাে।'(আয়াত১০-১৮) সূরার প্রথমাংশ নবুওতের সূচনাকালে নাযিল হয়েছে এ বর্ণনা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে তার এই আটটি আয়াত একটু বিলম্বে প্রকাশ্য দাওয়াত দেয়ার পর্ব শুরু হওয়ার পর নাযিল হয়ে থাকতে পারে। এই পর্বে দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান, তার বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং রসূল(স.) ও মােমেনদের ওপর যুলুম নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু অপর বর্ণনাটি শুদ্ধ হয়ে থাকলে সুরার প্রথম রুকুর পুরােটাই রাসূল(স.) মােশরেকদের অত্যাচার ও বিরােধিতার সম্মুখীন হওয়ার পর নাযিল হয়ে থাকবে। যাই হােক, আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাতের বেলা নামায ও যিকিরের আদেশ দেয়ার পরই সবরের আদেশ প্রদান করা হয়েছে। এ দুটো কাজকে প্রায়ই এক সাথে করতে নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে, যাতে দাওয়াতের দীর্ঘ কষ্টকর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মনােবল বহাল থাকে। এই কষ্টকর পথের মাঝে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ইসলামের পথ রােধকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই এই উভয় লড়াই একাকার হয়ে গেছে। এই দুটোই কঠিন লড়াই। আর যেহেতু ধৈর্যের আদেশ অনেক সময় ক্রোধ ও আক্রোশ বৃদ্ধি করে, তাই তার পরেই আদেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে সম্পূর্ণ বর্জন করার। কেননা বর্জনে আর কোনাে ক্রোধ ও আক্রোশ থাকে না। মক্কার প্রথম দিককার দাওয়াতের কর্মসূচী এভাবেই প্রণয়ন করা হয়েছিলাে। সাধারণত, কেবলমাত্র হৃদয় ও বিবেককেই আবেদন জানানাে হতাে এবং আবেদনটা হতাে নিরেট উপদেশ ও পথনির্দেশনামূলক। চরম ঔদ্ধত্য সহকারে দাওয়াতের বিরােধীতা ও রসূলকে মিথ্যাবাদী ঠাওরানাের মতাে আচরণের পর পুরােপুরি বর্জন করা যিকিরের পর ধৈর্যেরও দাবী জানায়। ধৈর্যের উপদেশ আল্লাহতায়ালা তার সকল নবীকেই একাধিকবার দিয়েছেন। সাধারণ মােমেনদেরকেও দিয়েছেন। বস্তুত, ধৈর্য ছাড়া আর যাই করা যাক, দাওয়াতের কাজ করা যায় না। সবরই এ কাজের ঢাল ও অস্ত্র। ধৈর্যই এ কাজের পাথেয়। ধৈর্যই দাওয়াতী কাজের কর্মীর আশ্রয়স্থল। ইসলামের দাওয়াত হচ্ছে আসলে এক সর্বাত্মক জিহাদ। এখানে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হয়। প্রবৃত্তির কু-প্ররোচনা, অসৎ কামনা-বাসনা, বিপথগামিতা, অবাধ্যত হতাশা, দুর্বলতা ও একগুয়েমীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। আবার দাওয়াতের শত্রুদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের যড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, তাদের উপায় উপকরণের বিরুদ্ধে এবং তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আবার সাধারণ মানুষের সাথেও এক ধরনের লড়াই চলতে থাকে। কেননা তারা এই দাওয়াতের দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে চায়না, তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। নানা রকমের ওযর আপত্তি তুলে তার বিরোধীতা করে তারা কোনাে অবস্থার ওপরই স্থীতিশীল থাকে না। দাওয়াত দাতার এই সব পরিস্থিতিতেই ধৈর্য ছাড়া আর কোনাে বিকল্প নেই। আর জিকির প্রায় ক্ষেত্রেই ধৈর্যের সহযােগী ও সহায়ক। আল্লাহ তায়ালা প্রচন্ড হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমার ও দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী বিত্তশালীদের মাঝখান থেকে সরে যাও এবং তাদেরকে একটু অবকাশ দাও।’ ভাববার বিষয় যে, মহাশক্তিধর মহাপরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী আল্লাহ তায়ালা এই হুমকি দিচ্ছেন ইসলামের শত্রুকে, যে মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। আর হুমকিদাতা হচ্ছেন তিনি, যিনি তাদেরকে এবং এই প্রকান্ড বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, তাও শুধুমাত্র একটি কুন(হও) শব্দ দ্বারা, এর বেশী নয়।
ফী জিলালিল কুরআন:   *দায়ীর কাজ শুধু দাওয়াত পৌছে দেয়া : আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আমাকে ছেড়ে দাও, ওদেরকে আমিই দেখে নেবাে। এ দাওয়াত তাে আমারই দাওয়াত। তােমার তাে এটা পৌছানাে ছাড়া আর কোনাে কাজ নেই। ওরা এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করছে এবং তােমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করছে তাই করতে দাও। ওদেরকে তুমি ত্যাগ কর। ওদেরকে কিভাবে জব্দ ও শায়েস্তা করতে হয়, তা আমি দেখবাে। সে দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দাও। তাদের চিন্তা তােমার করার দরকার নেই। তুমি শান্ত ও স্থির থাকো। মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তায়ালা যখন এই সকল নগন্য ও দুর্বল সৃষ্টিকে হুমকি দেন, তাদেরকে শায়েস্তা করার চরমপত্র দেন, তখন বুঝতে হবে তাদের মহা দুর্যোগ ও সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে। তারা যত বড় বিত্তশালী ও প্রতাপশালীই হােক না কেন, তাদেরকে রক্ষা করতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীতে নেই। বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে সামান্য সময় দাও।’ গােটা পার্থিব জীবন পরিমাণ সময়ও যদি তাদের দেয়া হয়, তাও সামান্য মাত্র। কারণ দুনিয়ার জীবন আল্লাহর হিসাবে এক দিন বা তারও কম সময়ের সমান। এমনকি কেয়ামতের দিন খােদ মানুষের কাছেও দুনিয়ার জীবনকে এক ঘন্টার মত মনে হবে। আর তারা যদি পৃথিবীর গােটা জীবনেও কোনাে শাস্তি বা প্রতিশােধের সম্মুখীন না হয়, তবে পরবর্তী জীবনে কঠোরতর শাস্তি তাদের জন্যে অবধারিত। ‘আমার কাছে শান্তি রয়েছে, দোযখ রয়েছে এবং কাঁটাযুক্ত খাদ্য এবং যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’ বস্তুত যারা বিপুল সম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েও সেই সম্পদের কদর করেনি ও শােকর করেনি এই সব কষ্টদায়ক আযাবই তাদের জন্যে উপযুক্ত। অতএব, হে মােহাম্মদ! তুমি সবর করাে এবং ধৈর্যধারণ কর। এদের উপযুক্ত শাস্তি আমার কাছে রয়েছে। তারা জাহান্নামে দগ্ধ হবে, কয়েদখানায় আবদ্ধ হবে, গলায় কাঁটা ফুটে যাওয়া খাদ্য গ্রহণ করবে এবং নানা রকম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভােগ করবে।

সুরা: আল-মুজ্জাম্মিল
আয়াত নং :-১৯

اِنَّ هٰذِهٖ تَذْكِرَةٌ١ۚ فَمَنْ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰى رَبِّهٖ سَبِیْلًا۠

এ একটি উপদেশ বাণী। অতএব যে চায় সে তার প্রভুর পথ অবলম্বন করুক।

ফী জিলালিল কুরআন:

  *কেয়ামতের ভীতিকর দৃশ্য : অতপর কেয়ামতের দিনের দৃশ্য অংকন করা হচ্ছে, ‘যেদিন পৃথিবী ও পাহাড় প্রকম্পিত হবে এবং পাহাড়গুলো চূর্ণবিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়ে যাবে।’ এত বড় বড় পাহাড় পর্বত যখন ভয়ে কাঁপবে ও চূর্ণবিচূর্ণ ও ধ্বংস হবে তখন ক্ষুদ্র দুর্বল মানুষের কি অবস্থা হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপর বিত্তশালী ইসলাম বিরােধীদেরকে প্রতাপশালী ফেরাউনের করুণ পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি তােমাদের কাছে একজন রসুল পাঠিয়েছি, যিনি তােমাদের ওপর সাক্ষী, যেমন ফেরাউনের কাছে একজন রসূল পাঠিয়েছিলাম। ফেরাউন সেই রসূলকে অমান্য করলাে, ফলে আমি তাকে শক্তভাবে পাকড়াও করলাম। কেয়ামতের দিন পৃথিবী ও পাহাড়ের কম্পন ও ধ্বংসের দৃশ্য দেখানাের পর ফেরাউনের করুণ পরিণতি সংক্ষেপে বর্ণনা করে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে। পৃথিবী ও পাহাড়ের যে পরিণতি সেটা আখেরাতের পরিণতি, আর ফেরাউনের যে পরিণতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে তা হচ্ছে দুনিয়ার পরিণতি। কাজেই ইসলামের দুশমনদের এই পরিণতি থেকে রেহাই নেই। ‘কিভাবে তােমরা রক্ষা পাবে যদি কুফরি করাে, যেদিন শিশুরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে, আকাশ ফেটে যাবে…’ কেয়ামতের সেই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্রটি মােটামুটি এরূপ দাঁড়াচ্ছে যে, পৃথিবী ও পাহাড় প্রকম্পিত হবে, ভেংগে চুরমার হবে, তারপর আকাশও ফেটে যাবে এবং শিশুরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে। কোরআন এভাবে এ দৃশ্যটিকে শ্রেতাদের অনুভূতিতে একটি বাস্তব ঘটনার আকারে পেশ করেছে। এরপর পুনরায় জোর দিয়ে বলছে, আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হবে। অর্থাৎ সে ওয়াদার কোনাে ব্যতিক্রম হবে না। আর আল্লাহ তায়ালা যা চান করেন, যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। এই ভীতি সৃষ্টি করার পর মানুষকে এই বলে সচেতন করে তুলছেন যে, তারা যেন শান্তি ও নিরাপত্তার যে পথ আল্লাহ তায়ালা দেখিয়েছেন তা গ্রহণ করে। ‘এ হচ্ছে স্মরণিকা- যার ইচ্ছা হয়, সে যেন তার প্রতিপালকের অভিমুখে যাত্রা করে।’ বস্তুত আল্লাহর অভিমুখী পথ সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ। সন্দেহ সংশয় ও ভীতি শংকা মুক্ত পথ! এ আয়াতগুলাে একদিকে যেমন দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের মনােবল ভেংগে দিয়েছে, অপরদিকে তেমনি রসূল(স.) ও মুষ্টিমেয় সংখ্যক দুর্বল মােমেনের মনে দৃঢ় বিশ্বাস, আস্থা ও আশার আলাে প্রজ্জলিত করেছে। তাদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, তাদের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা তাদেরই সাথে আছেন। তাদের শত্রুকে হত্যা করবেন, আটক করবেন এবং ক্ষুদ্র একটি মেয়াদ পর্যন্ত তাদেরকে সময় দেয়া হবে। তারপরই ফয়সালা চুকিয়ে দেয়া হবে। তখন তাদেরকে জাহান্নামে ঢোকানাে হবে এবং কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার দুশমনদেরকে যদিও সময় দেন, কিন্তু তার বন্ধুদেরকে তার শত্রুদের আগ্রাসন ও অত্যাচারের মুখে তাদের চিরদিন অসহায় ছেড়ে দেন না।
ফী জিলালিল কুরআন: এরপর আসছে সূরার দ্বিতীয় অংশ তথা দ্বিতীয় রুকু। মাত্র একটি আয়াতের মাধ্যমে রসূল(স.) ও মােমেনদের রাত জেগে নামায পড়ার পরিশ্রমকে অপেক্ষাকৃত সহজ করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের নিষ্ঠার ও আনুগত্যের কথা জানতেন। রাতে দীর্ঘ সময় কোরআন পড়ার কারণে তাদের পা ফুলে গিয়েছিলাে। আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে কোরআন পাঠ ও নামায পড়ার জন্যে এতাে কষ্ট দিতে চাননি। মূলত আল্লাহ তায়ালা তাকে পরবর্তী জীবনে যে বিরাট দায়িত্বের মুখােমুখী হতে হবে তার জন্যে তৈরী করতে চেয়েছিলেন। আয়াতটির ভাষায় আমরা দেখতে পাচ্ছি এতে আদর, স্নেহ ও আশ্বাস দানের ভংগী রয়েছে। ‘তোমার প্রতিপালক জানেন যে, তুমি ও তােমার সহকর্মী দলটি রাতের দুই তৃতীয়াংশের কম, রাতের অর্ধেক ও এক তৃতীয়াংশ নামায পড়ে কাটাও।’ অর্থাৎ তিনি তােমাকে দেখেছেন এবং তােমার নামায তার দাঁড়িপাল্লায় গৃহীত হয়েছে। তিনি জানেন যে তুমি ও তােমার সংগীরা শয্যা ত্যাগ করেছো, রাতে বিছানার আরাম ভােগ করার আহবানে সাড়া না দিয়ে আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়েছো। আল্লাহ তায়ালা তোমার উপর সহানুভুতিশীল হয়েছেন এবং তােমার ও তােমার সংগীদের জন্যে রাতের কাজ কিছুটা কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘রাত ও দিনকে (ছােট বড়াে করার) পরিকল্পনা আল্লাহ তায়ালাই করেন।’ এ জন্যে কতক রাতকে বড় ও কতক রাতকে ছােট করেন। কিছু রাত ছােট কিছু রাত বড় হয়। তুমি ও তােমার সাথীরা সবসময় রাতের এক তৃতীয়াংশ, অর্ধেক কিংবা দুই তৃতীয়াংশ জেগে কাটাও। তােমরা এটা অব্যাহত রাখার মতাে সবল নও, তা তিনি জানেন। তিনি তােমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না। তিনি চেয়েছিলেন তােমাদেরকে প্রস্তুত করতে। তােমরা এখন প্রস্তুত হয়ে গেছে। কাজেই এখন রাত জেগে এবাদাতের পরিমাণ কমাও। এখন জিনিসটাকে সহজ করে নাও। ‘কোরআনের যতটুকু সহজে পড়া যায় ততটুকু পড়ো।’ অর্থাৎ রাতের নামাযে যতােটুকু পড়লে কষ্ট না হয় ততেটুকু পড়াে। আল্লাহ তায়ালা এটাও জানেন যে, তােমাদের আরাে অনেক করণীয় কাজ আছে। সেসব কাজেও শক্তি ও শ্রম ব্যয় হবে। সেসব কাজ করতে তাদের পক্ষে কঠিন হবে। হলে এখন দীর্ঘ সময় রাত জাগা খুবই কষ্টকর হবে।’ আল্লাহ তায়ালা জানেন তােমাদের অনেকে রুগ্ন হয়ে পড়বে।’ ফলে এভাবে লম্বা সময় ধরে রাত জেগে নামায পড়া তাদের পক্ষে কঠিন হবে। ‘অন্যরা পৃথিবী সফর করবে আল্লাহর অনুগ্রহ আহরণের জন্যে।’ অর্থাৎ জীবিকা উপার্জনের জন্যে পরিশ্রম করবে। এটা জীবনের অপরিহার্য কাজ। আল্লাহ তায়ালা চান না, তােমরা তােমাদের জীবনের জরুরী প্রয়ােজনকে উপেক্ষা করাে এবং সন্যাসীদের মত শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক এবাদাতের জন্যে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও। ‘আরেক দল আল্লাহর পথে লড়াই করবে।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা অচিরেই লড়াই-এর মাধ্যমে তােমাদের ওপর যুলুমের প্রতিশােধ নেয়ার অনুমতি দেবেন এবং পৃথিবীতে ইসলামের পতাকা ওড়ানাের জন্যে জিহাদ করতে বলবেন, তা তিনি জানেন। অথচ ইসলাম বিরােধীরা এর খুবই ভয় করে। অতএব, নিজেদেরকে এই কড়াকড়ি থেকে কিছুটা অব্যাহতি দাও। ‘কোরআন যতােটা সহজে পড়তে পার তাই পড়ো।’ অর্থাৎ বিনা কষ্টে যা পারা যায় তাই পড়াে এবং ইসলামের ফরজ কাজগুলাের ওপর অবিচল থাকো। ‘নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও।’ ‘তারপর আল্লাহকে করযে হাসানা দাও, যার শুভ ফল তােমরা পাবে।’ আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হও। কেননা মানুষ যতােই ভালাে ও সৎ কাজ করতে চেষ্টা করুক, তার ভুল হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। ‘আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।’ প্রথমে রাত জেগে নামায পড়ার আহবান জানানাে হয়েছিলাে। তার এক বছর পর এই আদেশটি আসে। এতে রয়েছে স্নেহ, দয়া, ভালােবাসা ও সহজীকরণের উদার মনােভাবের প্রতিফলন। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে রাত জেগে নামায পড়াকে (এশা বাদে) ফরয নয় নফল বলে ঘােষণা করলেন। তবে রসূল(স.) তার আগের নিয়ম অব্যাহত রাখলেন। রাতের এক তৃতীয়াংশের কম নামায পড়তেননা। গভীর রাতে তিনি মােনাজাত করতেন। আর এ থেকে জীবনের ও জেহাদের পাথেয় ও বল আহরণ করতেন। অবশ্য তিনি এ ছাড়াও সর্বক্ষণ যিকিরে লিপ্ত থাকতেন এবং তার চোখে ঘুম আসলেও তার মন কখনাে ঘুমাতাে না।

১-২০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণঃ الْمُزَّمِّلُ শব্দের অর্থ :

বস্ত্রাবৃত, আর এর পরবর্তী সূরা الْمُدَّثِّرُ অর্থও বস্ত্রাবৃত, বস্ত্রাচ্ছাদিত। বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি দ্বারা উদ্দেশ্য হল নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেরা গুহায় অবস্থানকালে তাঁর ওপর সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত অবতীর্ণ হয়। তারপর দীর্ঘদিন ওয়াহী আগমন বন্ধ থাকার পর ধারাবাহিক পুনঃআগমন শুরু হয়। একদা তিনি হেরা গুহার পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে বিকট আওয়াজ শুনতে পান। আকাশের দিকে মাথা তুলে দেখতে পান সেই ফেরেশতা যিনি হেরা গুহায় এসেছিলেন, তিনি আকাশ-জমিনের মধ্যবর্তী একটি চেয়ারে বসে আছেন। এতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)-কে বলেন : আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত করে দাও। আমি নিজের প্রতি শঙ্কিত। তখন সূরা মুদ্দাসসির অবতীর্ণ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তিনি যেন মানুষকে আখিরাতের ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত জীবন শুরু হয়। এর পরে অথবা আগে সূরা মুযযাম্মিল নাযিল হয়। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الْمُزَّمِّلُ শব্দ থেকে এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আমার খালা [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী] মায়মূনা (রাঃ)-এর ঘরে একদা আমি রাত্রি যাপন করলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে সালাত আদায় করার জন্য উঠলেন। তিনি তের রাকাত সালাত আদায় করলেন, তার মধ্যে ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত। আমি তার প্রত্যেক রাকাতের দাঁড়ানোর পরিমাণ হিসেব করলাম যে, তা ছিল

يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ

এ সূরার লম্বা সমপরিমাণ। (আবূ দাঊদ হা. ১৩৬৫, সহীহ)।

১-৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নবুওয়াতের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করার পূর্বে তাঁকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশস্বরূপ অর্ধ-রাত সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়ে বলছেন- ওঠো, ঘুম ও বিশ্রামের সময় আর নেই। এ দায়িত্বের জন্য প্রস্তুতি নাও। এটা একটি গুরুতর নির্দেশ। কারণ যে ব্যক্তি কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত তার পক্ষে আরাম-আয়েশ ও নরম বিছানায় জীবন কাটানো সম্ভব হলেও যে ব্যক্তি সারা পৃথিবীর জন্য প্রেরিত, যার প্রতি মহৎ দায়িত্ব তার ঘুম আসে কি করে? আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন কিভাবে সম্ভব?

(قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيْلًا)

আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাতের কিছু অংশ ব্যতীত বাকি রাত কিয়াম (তাহাজ্জুদ) করার নির্দেশ প্রদান করছেন। إِلَّا قَلِيْلًا ‘রাতের কিছু অংশ ব্যতীত’ এর তাফসীর পরের দু‘আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই উল্লেখ করেছেন। তাহল : ‘তার অর্ধেক কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম। অথবা তদপেক্ষা বেশি।’ অর্থাৎ অর্ধ-রাত পর্যন্ত বা তার কম কিম্বা তার চেয়ে বেশি রাত কিয়াম কর, বাকি রাত ঘুমাও। অর্ধ-রাতের কিছু কম-বেশি হলে কোন অসুবিধা নেই। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে বাস্তবায়িত করত অর্ধ-রাত সালাত আদায় করতেন। এটা তাঁর ওপর ফরয ছিল। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَمِنَ الَّیْلِ فَتَھَجَّدْ بِھ۪ نَافِلَةً لَّکَﺣ عَسٰٓی اَنْ یَّبْعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا)

“এবং রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম কর, এটা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” আয়াতে এবং রাত্রির কিছু অংশের পরিমাণ এ আয়াতদ্বয়ে বলে দেওয়া হল। (ইবনু কাসীর)

আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন : আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে। তবে কোন্ আয়াত একে রহিত করেছে তা নিয়ে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। যেমন কেউ বলেছেন : অত্র সূরার ২০ নম্বর আয়াত।

কেউ বলেছেন :

(عَلِمَ أَنْ لَّنْ تُحْصُوْهُ)

“তিনি জানেন যে, তোমরা কখনও এর সঠিক হিসাব রাখতে পারবে না।” আবার কেউ বলেছেন : ফরয পাঁচ ওয়াক্ত সালাত রহিত করে দিয়েছে। এ কথা বলেছেন মুকাতিল, ইমাম শাফেয়ী ও ইবনু কায়সান। ( ফাতহুল কাদীর)।

সা‘দ বিন হিশাম বলেন : আয়িশাহ (রাঃ)-কে বললাম : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাতের কিয়াম সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি বললেন : তুমি কি সূরা মুযযাম্মিল পড়নি? আমি বললাম হ্যাঁ, পড়েছি। তিনি বললেন : এ সূরার শুরুতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর কিয়ামূল লাইল (রাতের সালাত) ফরয করে দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর পার্শ্বের সাহাবীরাও রাতে সালাত আদায় করতো ফলে তাদের পা ফুলে যেত। বার মাস পর এ সূরার শেষের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহ তা‘আলা এ ফরযকে হালকা করে দেন। ফলে রাতের সালাত ফরযের পর নফল থেকে যায়। (সহীহ মুসলিম : ৭৪৬, আবূ দাঊদ হা. ১৩৪২) এসত্ত্বেও নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে নিয়মিত তাহাজ্জুত সালাত আদায় করতেন।

(وَرَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِيْلًا)

অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, সুস্পষ্ট ও সুন্দরভাবে, যাতে ভালভাবে বুঝতে পারা যায়। বিশিষ্ট তাবেয়ী যহহাক (রহঃ) বলেন : কুরআনের প্রত্যেকটি অক্ষর স্পষ্ট উচ্চারণ করে পড়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও কুরআনকে তারতীল বা সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেকটি অক্ষর সস্থান থেকে উচ্চারণ করে পড়তেন। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআন খুবই ধীরে ধীরে ও থেমে থেমে তেলাওয়াত করতেন। ফলে খুব দেরীতে সূরা শেষ হতো। ছোট সূরাও যেন বড় হয়ে যেত। উম্মু সালামাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কিরাআত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : তিনি কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াত থেমে থেমে তেলাওয়াত করতেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কিয়ামতের দিন কুরআন তেলাওয়াতকারীদেরকে বলা হবে- তুমি পড় এবং ওপরে উঠতে থাক, দুনিয়াতে তুমি যেমন তারতীলের সাথে তেলাওয়াত করতে এখনও সেরূপ তারতীলের সাথে তেলাওয়াত কর। কেননা যে জায়গায় তুমি আয়াত পড়ে শেষ করবে সেখানে তোমার ঠিকানা। (আবূ দাঊদ হা. ১৪৬৪, তিরমিযী হা. ২৯১৪, হাসান সহীহ)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ

তোমাদের সুর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর। (আবূ দাঊদ হা. ১৪৬৮, ইবনু মাযাহ হা. ১৩৪২, সিলসিলা সহীহাহ হা. ৭৭১)

তাই কুরআনকে ধীরে ধীরে মাখরাজের সস্থান থেকে উচ্চারণ করে পড়া উচিত। মন্ত্রের মত খতম করার জন্য পড়া আদৌ উচিত না।

(قَوْلًا ثَقِيْلًا)

রাতের সালাত সাধারণত আদায় করা ভারী ও কষ্টকর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের বাক্যের সাথে সম্পর্কহীন বাক্য

(جملة معترضة)

স্বরূপ বললেন : আমি এর চেয়েও বেশি ভারী কথা তোমার ওপর অবতীর্ণ করব। তা হল : কুরআনুল কারীম। যার বিধি বিধানের ওপর আমল করা, তার দিকে দাওয়াত দেওয়া খুব কঠিন ও ভারী কাজ। কেউ বলেছেন : যেমন যায়েদ বিন সাবেত বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট যখন ওয়াহী অবতীর্ণ হয় তখন তার উরু আমার উরুর ওপর ছিল। ওয়াহীর ভারীতে যেন আমার উরু ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। (সহীহ বুখারী হা. ২৮৩২) ওয়াহী অবতীর্ণ হলে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কপাল ঘেমে যেত। (সহীহ বুখারী হা. ২)

(إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ) – نَاشِئَةَ

শব্দটি হাবশী, অর্থ হল : জাগরণ করা।

وَطْئًا অর্থ সমান করা, পদদলন। একটি বস্তু অন্যটির মাঝে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া। আয়াতের ভাবার্থ হল : রাতের সালাত উত্তম এজন্য যে, এর ফলে অন্তর ও রসনা এক হয়ে যায়। তেলাওয়াত করার কারণে মুখ দিয়ে যে সকল শব্দ উচ্চারিত হয় তা অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। দিনের তুলনায় রাত্রির নির্জনতায় অর্থ ও ভাব অন্তরে ভালভাবে গেঁথে যায়।

(سَبْحًا طَوِيْلًا) سَبْح-

অর্থ চলা ও ঘোরাফেরা করা। অর্থাৎ মানুষের দিনের বেলায় বহু কর্মব্যস্ততা থাকে, এদিক-সেদিক যেতে হয়, বিভিন্ন কাজ থাকে ফলে ইবাদতের জন্য যথাযথ সময় দিতে পারে না। সেহেতু রাতের বেলা সালাত আদায় ও তাতে কুরআন তেলাওয়াতের এক উপযুক্ত সময়, তাই রাতের কিয়দাংশ সালাত আদায় কর।

(وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ)

‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর’ ‎এতে সকল প্রকার যিকির শামিল। সালাত, কিয়াম, সালাতের আগে ও পরের দু‘আ ইত্যাদি।

(وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيْلًا) – تَبَتَّلْ

অর্থ : পৃথক ও আলাদা হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নিমিত্তে দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হওয়ার পর আলাদা হয়ে যাও। এটি বৈরাগ্যতা নয়। কেননা বৈরাগ্যতা হল : দুনিয়া থেকে সাংসারিক ব্যস্ততাসহ সকল কিছু বর্জন করা। আর এরূপ বৈরাগ্যবাদ ইসলামে নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতেন, আবার বিবাহ করে সংসার গড়েছেন, রোযা রাখতেন আবার রোযা ছাড়তেন, রাতে সালাত আদায় করতেন আবার ঘুমাতেন। এটাই সুন্নাত তরিকা। অতএব এ তরিকা বর্জন করে অন্য তরিকা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ শরীয়ত গর্হিত কাজ। কখনো এমন আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৫০৬৩)

তাই পার্থিব কর্ম ব্যস্ততার পাশাপাশি সময়-সুযোগ করে নিয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা প্রশংসনীয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতসহ যখন কোন আমল করতেন তখন তা নিয়মিত করার চেষ্টা করতেন। যদি রাতে ঘুমের কারণে অথবা অসুস্থতার কারণে তাহজ্জুত আদায় না করতে পারতেন তাহলে দিনে বার রাকাত আদায় করে নিতেন। তবে কখনো তিনি একরাতে কুরআন শেষ করেননি এবং সারা রাত জাগেননি, রমযান ছাড়া অন্য কোন পূর্ণমাস সিয়াম পালন করেননি। (সহীহ ইবনু খুযাইমাহ হা. ১১৭৭)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের সুন্নাতসহ তের রাকাতের বেশি রাতের সলাত আদায় করতেন না।
২. ধীরস্থিরতাসহ লম্বা কিরাআতে রাতের সালাত আদায় করা উত্তম।
৩. রাতের সালাত আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুবই প্রিয়।
৪. কুরআনকে মন্ত্রের মত না পড়ে সুন্দরভাবে প্রতিটি অক্ষর তার মাখরাজ থেকে উচ্চারণ করা আবশ্যক।
৫. ইসলামে বৈরাগ্যতা নিষেধ। তবে অবশ্যই ইবাদতের ব্যাপারে সচেতন এবং একাগ্রতা থাকা উচিত।
১০-১৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রিসালাত গ্রহণের প্রস্তুতি, আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে মগ্ন হওয়া ইত্যাদি নির্দেশের পর অত্র আয়াতগুলোতে কাফির-মুশরিকদের মিথ্যা অপবাদ, অকথ্য গালিগালাজ এবং ঠাট্টা-বিদ্রƒপে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে সৌজন্যতার সাথে পরিহার করার উপদেশ দিচ্ছেন। কারণ সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের স্বভাব হল তারা সত্য গ্রহণ করবে না, বরং সত্যাগ্রহীদের অপবাদ দেবে, গালিগালাজ করবে এবং তাদের নিয়ে ঠাট্টা-ব্যঙ্গ করবে। এটা নতুন নয়, পূর্বেও ফিরআ‘উন সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, ফলে তাকে পাকড়াও করেছিলাম। তাই এসব সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী ও মিথ্যুকদেরও পাকড়াও করব এবং তাদের জন্য আখিরাতে ন্যাক্কারজনক শাস্তি প্রস্তুত করা আছে।

(وَذَرْنِيْ وَالْمُكَذِّبِيْنَ)

অর্থাৎ যাদেরকে অনেক ধন-জন দিয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী বানিয়েছি তাদের মধ্যে যারা মিথ্যুক ও আখিরাতে অবিশ্বাসী তাদের ব্যাপারটা আমার কাছে ছেড়ে দাও। অথবা তাদের ব্যাপারে আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তাদেরকে কিছু দিন অবকাশ দেব, তারপর তাদের জন্য রয়েছে আয়াতে উল্লিখিত শাস্তিসমূহ। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(نُمَتِّعُھُمْ قَلِیْلًا ثُمَّ نَضْطَرُّھُمْ اِلٰی عَذَابٍ غَلِیْظٍ)

“আমি অল্প সময়ের জন্য তাদেরকে সুখ-সম্ভোগ দেব, পুনরায় তাদেরকে বাধ্য করব কঠিন শাস্তি ভোগ করতে।” (সূরা লুক্বমান ৩১ : ২৪)

تَرْجُفُ অর্থ تزلزل বা প্রকম্পন।

(كَثِيْبًا مَّهِيْلًا) مَّهِيْلًا

বলা হয় বালির স্তুপকে, আর كَثِيْب বলা হয় বহমান (ভূর ভূরে) বালি, যা পায়ের নিচে থেকে সরে যায়। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন পাহাড়সমূহ বহমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে।

(شَاهِدًا عَلَيْكُمْ) অর্থাৎ شاهدا بأعمالكم

বা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নিকট রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করেছেন যিনি তোমাদের আমলসমূহ প্রত্যক্ষ করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ফির‘আউনের নিকট মূসা (রাঃ)-কে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু ফির‘আউন মূসা (রাঃ)-এর অবাধ্য হলো, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সাগরে ডুবিয়ে মারলেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করলে রেহাই পাওয়ার কোন সুযোগ নেই যেমন রেহাই পায়নি ফির‘আউন ও তার দলবল।

شِيْبَ হল اشيب এর বহুবচন। কিয়ামতের দিন কিয়ামতের ভয়াবহতা দেখে শিশুরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে। অথবা কিয়ামতের মাঠের জটিল অবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরতে এ উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। অতএব বুদ্ধিমান তারাই যারা সেদিনের দূরবস্থা থেকে বাঁচার জন্য যথাসম্ভব পাথেয় অর্জন করে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কাফির-মুশরিকদের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট। তাদের কর্মের পরিণাম প্রস্তুত আছে।
২. কিয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানলাম।
৩. নাবী-রাসূলদের প্রেরণ করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হল উম্মতের আমল প্রত্যক্ষ করা। অবশ্য এটা প্রত্যেক রাসূলের জীবদ্দশার সাথে সম্পৃক্ত, মারা যাওয়ার পর না।
১৯-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(إِنَّ هٰذِه) অর্থাৎ এ সূরাটি একটি উপদেশ। এতে সত্য গ্রহণের পাথেয় ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার খারাপ পরিণামের বিবরণ রয়েছে। অতএব যারা চায় প্রতিপালকের পথ অবলম্বন করতে তারা যেন এখান থেকে উপদেশ গ্রহণ করে।

(فَاقْرَأُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْاٰنِ)

অত্র সূরার শুরুর ৩ নম্বর আয়াতে রাতে সালাত (তাহাজ্জুত) আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার পর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীরা রাতের দুই-তৃতীয়াংশ, অর্ধেক বা কখনো এক-তৃতীয়াংশ জাগরণ করে সালাত আদায় করতেন। অতঃপর অত্র আয়াতে বিধানকে হালকা করে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তিনি জানেন যে, তোমরা কখনও এর সঠিক হিসাব রাখতে পারবে না” অর্থাৎ এরূপ হিসাবে করে নিয়মিত তাহাজ্জুত সালাত আদায় করা কষ্টকর হয়ে যাবে। কারণ অনেকে কখনো অসুস্থ হয়ে যাবে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অন্য দেশে ভ্রমণ করবে, কেউ জিহাদ করতে যাবে ইত্যাদি কারণে তা যথাযথ পালন করা সম্ভব হবে না। তাই সময় নির্ধারণ না করে “কুরআনের যতটুকু পাঠ করা তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু পাঠ কর” অর্থাৎ যতটুকু সম্ভব রাতে সালাত আদায় কর, সময় ধরাবাঁধার প্রয়োজন নেই। এখানে সালাতকে কিরাআত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ কিরাআত সালাতের অন্যতম একটি রুকন। আবার অন্যত্র সালাত দ্বারা কিরাআত বুঝোনো হয়েছে। যেমন “তুমি তোমার সালাত অর্থাৎ কিরাআত উঁচু আওয়াজে পড় না।” (সূরা ইসরা ১৭ : ১১)

এ আয়াত দ্বারা ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) বলেন : সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব প্রমাণিত হয় না। বরং কেউ যদি কুরআনের অন্য কোন অংশ বা আয়াত পাঠ করে তাহলে তা যথেষ্ট হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ ব্যক্তিকে বললেন : যে ভালভাবে সালাত আদায় করতে পারছিল না।

(ثُمَّ اقْرَأْ بِمَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ القُرْآنِ)

কুরআনের যে অংশ তোমার সাথে আছে তার মধ্যে যা সহজ তা পাঠ কর। (সহীহ বুখারী হা. ৬২৫১)

অধিকাংশ আলেম সমাজ বলছেন : না, সূরা ফাতিহা ছাড়া সালাত হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যারা সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না তাদের সালাত হবে না। এরূপ অনেক প্রমাণ রয়েছে যা বলে- অবশ্যই সূরা ফাতিহা পাঠ করতেই হবে। এ সম্পর্কে সূরা ফাতিহার তাফসীরে আলোচনা করা হয়েছে। আর কুরআনের মধ্যে সবচেয়ে সহজ সূরা বা অংশ হল সূরা ফাতিহা। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সূরা ফাতিহা ও যা সহজ হয় তা পাঠ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। (আহমাদ ৩/৩, সনদ উত্তম)

(يَضْرِبُوْنَ فِي الْأَرْضِ)

অর্থাৎ ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কাজকর্ম করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় সফর করবে। ফলে রাতের সালাত আদায় কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই আল্লাহ তা‘আলা এ বিধান সহজ করে নফলের পর্যায়ে রাখলেন।

(قَرْضًا حَسَنًا)

অর্থাৎ ফরয যাকাত ব্যতীত অতিরিক্ত দান খয়রাত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(مَنْ ذَا الَّذِيْ يُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضٰعِفَه۫ لَه۫ أَضْعٰفًا كَثِيْرَةً ط وَاللّٰهُ يَقْبِضُ وَيَبْصُطُ ص وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ)‏

“কে আছে যে আল্লাহকে করযে হাসানা দেবে? পরে তিনি তাকে অনেক গুণে বাড়িয়ে দেবেন। আর আল্লাহ (মানুষের রিযিক) কমান ও বাড়ান এবং তাঁর দিকেই তোমরা ফিরে যাবে।” (সূরা বাক্বারাহ ২ : ২৪৫)

(مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ)

অর্থাৎ প্রত্যেক ভাল কাজের বিনিময় দশ থেকে সাতশত গুণ বা তার চেয়ে বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাওয়া যাবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ক্ষমার দিকে বান্দাদেরকে আহ্বান জানিয়ে বলছেন : বেশি বেশি আমায় স্মরণ কর ও আমার কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাকারী ও দয়ালু।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার দয়ার কথা জানতে পারলাম। তিনি রাতের সালাতকে ওয়াজিব করে দেননি বরং নফল রেখে তা অনেক প্রতিদানযোগ্য করেছেন।
২. সালাতে প্রত্যেকের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব।
৩. প্রত্যেক ভাল কাজের প্রতিদান দশ থেকে সাতশত গুণ বা তার চেয়েও বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাওয়া যাবে।
৪. কুরআন আরবের সাত হরফে (কিরাআতে) পাঠযোগ্য।

Leave a Reply