মুনাফেকি কী, কেন ও কীভাবে (২য় কিস্তি)
إِذَا جَآءَكَ الْمُنٰفِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُۥ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنٰفِقِينَ لَكٰذِبُونَ
যখন মুনাফিক (কপট)রা তোমার নিকট আসে তখন তারা বলে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল।’[১] আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রসূল[২] এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। [৩]
اتَّخَذُوٓا أَيْمٰنَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِنَّهُمْ سَآءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আর এ উপায়ে তারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করে তা কতই না মন্দ!
ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ ءَامَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلٰى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ
তার কারণ এই যে, তারা ঈমান আনে, অতঃপর কুফুরী করে। এজন্য তাদের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে তারা কিছুই বুঝে না
وَإِذَا رَأَيْتَهُمْ تُعْجِبُكَ أَجْسَامُهُمْ ۖ وَإِن يَقُولُوا تَسْمَعْ لِقَوْلِهِمْ ۖ كَأَنَّهُمْ خُشُبٌ مُّسَنَّدَةٌ ۖ يَحْسَبُونَ كُلَّ صَيْحَةٍ عَلَيْهِمْ ۚ هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ ۚ قٰتَلَهُمُ اللَّهُ ۖ أَنّٰى يُؤْفَكُونَ
তুমি যখন তাদের দিকে তাকাও তখন তাদের শারীরিক গঠন তোমাকে চমৎকৃত করে। আর যখন তারা কথা বলে তখন তুমি তাদের কথা আগ্রহ ভরে শুন, অথচ তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মত (দেখন- সুরত, কিন্ত কার্যক্ষেত্রে কিছুই না)। কোন শোরগোল হলেই তারা সেটাকে নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে (কারণ তাদের অপরাধী মন সব সময়ে শঙ্কিত থাকে- এই বুঝি তাদের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে গেল)। এরাই শত্রু, কাজেই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। এদের উপর আছে আল্লাহর গযব, তাদেরকে কীভাবে (সত্য পথ থেকে) ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে!
[১] কোন কোন বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, এ ঘটনাটি তাবুক যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল। [আস-সুনানুল কুবরা, নাসায়ী:১১৫৯৭ তিরমিয়ী: ৩৩১৪] কিন্তু বিশিষ্ট ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী পঞ্চম হিজরীতে ‘বনী-মুস্তালিক’ যুদ্ধের সময় এ আয়াত সংক্রান্ত ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। [তিরমিয়ী: ৩৩১৫, মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৯২, ইবনে হাজার: মুকাদ্দিমাহ ফাতহুল বারী ১/২৯৫, ৬/৫৪৭, ইবনে সা’দ: তাবাকাতুল কুবরা: ৪/৩৪৯] আর এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত।
কারণ, ঘটনায় বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। ঘটনাটির সার সংক্ষেপ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী মুস্তালিক যুদ্ধে বের হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম পানির ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছিলেন। এরপর যখন মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী একটি কুপের কাছে সমবেত ছিল, তখন একটি অগ্ৰীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। একজন মুহাজির ও একজন আনসারীর মধ্যে পানি ব্যবহার নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে হাতাহাতির সীমা অতিক্রম করে পারস্পরিক সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌছে গেল। মুহাজির ব্যক্তি সাহায্যের জন্যে মুহাজিরগণকে এবং আনসারী ব্যক্তি আনসার সম্প্রদায়কে ডাক দিল। উভয়ের সাহায্যার্থে কিছু লোক তৎপরও হয়ে উঠল। এভাবে ব্যাপারটি মুসলিমদের পারস্পরিক সংঘর্ষের কাছাকাছি পৌছে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ পেয়ে অনতিবিলম্বে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন এবং ভীষণ রুষ্ট হয়ে বললেন, مَابَالُ دَعْوَى الَجاهِلِيَّةِ অৰ্থাৎ “এ কি মূর্খতাযুগের আহবান।’ দেশ ও বংশগত জাতীয়তাকে ভিত্তি করে সাহায্য ও সহযোগিতার আয়োজন হচ্ছে কেন? তিনি আরও বললেন, دَعُوْهٓافَإِخَّمَامُنْتِنَةٌ এই শ্লোগান বন্ধ কর। এটা দুৰ্গন্ধময় স্লোগান।’ অর্থাৎ এই দেশ ও বংশগত জাতীয়তা একটা মূর্থিতাসুলভ দুৰ্গন্ধময় স্লোগান। এর ফল জঞ্জাল বাড়ানো ছাড়া কিছুই হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর এই উপদেশবাণী শোনামাত্ৰই ঝগড়া মিটে গেল। এ ব্যাপারে মুহাজির জাহ্জাহ ইবনে সা’দ আল-গিফারী এর বাড়াবাড়ি প্রমাণিত হল। তার হাতে সিনান ইবনে ওবরা আল-জুহানী আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আহত হয়েছিলেন। ওবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাফ করিয়ে নিলেন। ফলে ঝগড়াকারী জালেম ও মজলুম উভয়ই পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেল।
মুনাফিকদের যে দলটি যুদ্ধলব্ধ সম্পদের লালসায় মুসলিমদের সাথে আগমন করেছিল। তাদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখন মুহাজির ও আনসারীর পারস্পরিক সংঘর্ষের খবর পেল, তখন সে একে মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নিল। সে মুনাফিকদের এক মজলিসে, যাতে মুমিনদের মধ্যে কেবল যায়েদ ইবনে আরকাম উপস্থিত ছিলেন, আনসারকে মুহাজিরগণের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা মুহাজিরদেরকে দেশে ডেকে এনে মাথায় চড়িয়েছ, নিজেদের ধন-সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছ। তারা তোমাদের রুটি খেয়ে লালিত হয়ে এখন তোমাদেরই ঘাড় মটকাচ্ছে। যদি তোমাদের এখনও জ্ঞান ফিরে না আসে, তবে পরিণামে এরা তোমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। কাজেই তোমরা ভবিষ্যতে টাকা-পয়সা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করো না। এতে তারা আপনা-আপনি ছত্ৰভঙ্গ হয়ে চলে যাবে। এখন তোমাদের কর্তব্য এই যে, মদীনায় ফিরে গিয়ে সম্মানীরা বহিরাগত এসব বাজে লোকদের বহিষ্কার করে দিবে। সম্মানী বলে তার উদ্দেশ্য ছিল নিজের দল ও আনসার এবং বাজে লোক বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম। যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ কথা শোনা মাত্রই বলে উঠলেনঃ আল্লাহর কসম, তুই-ই বাজেলোক লাঞ্ছিত ও ঘূণিত। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিবলে এবং মুসলিমদের ভালবাসার জোরে মহাসম্মানী।
যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিইয়াল্লাহু ‘আনহু মজলিস থেকে উঠে সোজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে গেলেন এবং আদ্যোপান্ত ঘটনা তাকে বলে শোনালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে সংবাদটি খুবই গুরুতর মনে হল। মুখমণ্ডলে পরিবর্তনের রেখা ফুটে উঠল। যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অল্পবয়স্ক সাহাবী ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেনঃ বৎস দেখ, তুমি মিথ্যা বলছ না তো? যায়েদ কসম খেয়ে বললেনঃ না আমি নিজ কানে এসব কথা শুনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার বললেনঃ তোমার কোনরূপ বিভ্ৰান্তি হয় নি তো? যায়েদ উত্তরে পূর্বের কথাই বললেন। এরপর মুনাফিক সরদারের এই কথা গোটা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে এছাড়া আর কোন আলোচনাই রইল না। এদিকে সব আনসার যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে তিরস্কার করতে লাগলেন যে, তুমি সম্প্রদায়ের নেতার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করেছ এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছ। যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ আল্লাহর কসম, সমগ্ৰ খাযরাজ গোত্রের মধ্যে আমার কাছে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অপেক্ষা অধিক প্রিয় কেউ নেই। কিন্তু যখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধে এসব কথাবার্তা বলেছে, তখন আমি সহ্য করতে পারিনি। যদি আমার পিতাও এমন কথা বলত তবে আমি তাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গোচরীভূত করতাম।
অপরদিকে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এসে আরয করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ কথা বলেছিলেনঃ আপনি আব্বাদ ইবনে বিশারকে আদেশ করুন, সে তার মস্তক কেটে আপনার সামনে উপস্থিত করুক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ওমর, এর কি প্রতিকার যে, মানুষের মধ্যে খ্যাত হয়ে যাবে আমি আমার সাহাবীকে হত্যা করি। অতঃপর তিনি ইবনে উবাইকে হত্যা করতে বারণ করে দিলেন। এই ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে অসময়ে সফর শুরু করার কথা ঘোষণা করে দিলেন এবং নিজে কাসওয়া’ উল্পীর পিঠে সওয়ার হয়ে গেলেন। যখন সাহাবায়ে কেরাম রওয়ানা হয়ে গেলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে ডেকে এনে বললেনঃ তুমি কি বাস্তবিকই এরূপ কথা বলেছ? সে অনেক কসম খেয়ে বললঃ আমি কখনও এরূপ কথা বলিনি। এই বালক (যায়েদ ইবনে আরকাম) মিথ্যাবাদী। স্বগোত্রে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের যথেষ্ট সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। তারা সবাই স্থির করল যে, সম্ভবতঃ যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ভুল বুঝেছে। আসলে ইবনে উবাই এ কথা বলেনি।
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কসম ও ওযর কবুল করে নিলেন। এদিকে জনগণের মধ্যে যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর বিরুদ্ধে ক্রোধ ও তিরষ্কার আরও তীব্র হয়ে গেল। তিনি এই অপমানের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে লাগলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র মুজাহিদ বাহিনীসহ সারাদিন ও সারারাত সফর করলেন এবং পরের দিন সকালেও সফর অব্যাহত রাখলেন। অবশেষে যখন সূর্যকিরণ প্রখর হতে লাগল, তখন তিনি কাফেলাকে এক জায়গায় থামিয়ে দিলেন। পূর্ণ একদিন একরাত সফরের ফলে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সাহাবায়ে কেরাম মনযিলে অবস্থানের সাথে সাথে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।
বর্ণনাকারী বলেনঃ সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে তাৎক্ষণিক ও অসময়ে সফর করা এবং সুদীর্ঘকাল সফর অব্যাহত রাখার পিছনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উদ্দেশ্য ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ঘটনা থাকে উদ্ভূত জল্পনা-কল্পনা হতে মুজাহিদদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া, যাতে এ সম্পর্কিত চর্চার অবসান ঘটে।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুণরায় সফর শুরু করলেন। ইতোমধ্যে উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে উপদেশাচ্ছলে বললেনঃ তুমি এক কাজ কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অপরাধ স্বীকার করে নাও। তিনি তোমার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এতে তোমার মুক্তি হয়ে যেতে পারে। ইবনে উবাই এই উপদেশ শুনে মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। ওবাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তখনই বললেনঃ আমার মনে হয়, তোমার এই বিমুখতা সম্পর্কে অবশ্যই কুরআনের আয়াত নাযিল হবে।
এদিকে সফর চলাকালে যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বার বার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে আসতেন। তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, এই মুনাফিক লোকটি আমাকে মিথ্যাবাদী বলে গোটা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। অতএব আমার সত্যায়ন ও এই ব্যক্তির মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন সম্পর্কে অবশ্যই কুরআন নাযিল হবে। হঠাৎ যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে ওহী অবতরণকালীন লক্ষণাদি ফুটে উঠছে। তার শ্বাস ফুলে উঠছে, কপাল ঘৰ্মাক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং তার উষ্ট্রী বোঝার ভারে নুয়ে পড়ছে। যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আশাবাদী হলেন যে, এখন এ সম্পর্কে কোন ওহী নাযিল হবে। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অবস্থা দূর হয়ে গেল। যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ ঘেঁষে যাচ্ছিল। তিনি নিজের সওয়ারীর উপর থেকে আমার কান ধরলেন এবং বললেন, “হে বালক, আল্লাহ তা’আলা তোমার কথার সত্যায়ন করেছেন”। আর সম্পূর্ণ সূরা আল-মুনাফিকুন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। [পুরো ঘটনাটি কোথাও একত্রে বর্ণিত হয়নি। ভিন্ন ভিন্ন অংশ হিসেবে নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহ দেখা যেতে পারে।
[বুখারী: ৪৯০০, ৪৯০২, ৪৯০৫, মুসলিম: ২৫৮৪, ২৭৭২, নাসায়ী, ৯৭৭, তিরমিয়ী: ৩৩১২, ৩৩১৩, ৩৩১৪, ৩৩১৫, মুসনাদে আবি ইয়া’লা: ১৮২৪, মুসনাদে আহমাদ: ৩/৩৩৮, ৪/৩৬৮, ৩৭৩, ইবনে হিব্বান: ৫৯৯০, দালায়েলুন নাবুওয়ত লিল বাইহাকী: ৪/৫৩-৫৫, সীরাতে ইবনে হিশাম: ৩/৬৯, সীরাতে ইবনে কাসীর: ৩/১০৩]
১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র সূরাতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যার অধিকাংশগুলো সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর মানুষ প্রতিনিয়ত ইসলামে দিক্ষিত হতে লাগল। এমনকি যখন আওস ও খাজরায গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করল তখন এক শ্রেণির লোক বাহ্যিক ঈমানের কথা প্রকাশ করল আর অন্তরে কুফরী গোপন রাখল যাতে সমাজে তাদের সম্মান, রক্ত ও সম্পদ হেফাযতে থেকে যায়। এরাই হল মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা এদের গুণাবলী উল্লেখ করে দিয়েছেন যাতে মু’মিনরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারে।
(إِذَا جَا۬ءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ)
‘যখন মুনাফিকরা তোমার নিকট আসে’ এখানে মুনাফিক বলতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সহচর মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। এরা নিজেদের কপটতা গোপন রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে এসে বলে, আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আপনি আল্লাহর রাসূল।
(وَاللّٰهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُه۫)
‘আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল’ এ বাক্যটি পূর্বের বাক্য থেকে আলাদা একটি বাক্য, যা পূর্বের বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করেছে এবং যার প্রকাশ মুনাফিকরা মুনাফিক হিসাবে করত। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : মুনাফিকদের এটা শুধু মুখের কথা, অন্তরে এর বিশ্বাস নেই। তবে আমি জানি যে, তুমি সত্যিই আমার রাসূল।
(إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ)
অর্থাৎ মুনাফিকরা কথায় ও দাবীতে মিথ্যেবাদী।
(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً)
‘তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে’ অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের মিথ্যা শপথসমূহকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে। কারণ যারা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানেনা তারা তাদেরকে মুসলিম মনে করবে। ফলে তাদেরকে মুরতাদ হিসাবে হত্যা করা হবে না। এভাবে তারা বেঁচে যাবে। তাদের এরূপ কার্যকলাপে মুসলিমদের অনেক ক্ষতি হয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদেরকে নিজেদের মত মুসলিম মনে করে তাদের কথা ও কাজের অনুসরণ করে। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :
(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ط إِنَّهُمْ سَا۬ءَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْن)
“তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে। তারা যা করছে তা কতই না মন্দ।”
মুনাফিকদের এসব কার্যকলাপের কারণ হল তারা তাদের কর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে কুফরীর ওপর বদ্ধমূল করে দিয়েছেন।
(ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا)
‘এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে’ এখানে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা কাফির। তারা মুখে ঈমানের কথা স্বীকার করেছে তারপর অন্তর দ্বারা অস্বীকার করেছে। তাই দুনিয়াতে তাদের ওপর কাফিরদের বিধান কার্যকর না হলেও আখিরাতে কাফিরদের কাতারে থাকবে।
(وَإِذَا رَأَيْتَهُمْ تُعْجِبُكَ)
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলছেন : তুমি তাদের দৈহিক কাঠামো, সৌন্দর্য ও সজীবতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে। আর তাদের ভাষার যে বিশুদ্ধতা ও তারা যে বাকপটু তাতে তুমি তাদের কথা সাগ্রহে শুনবে। কিন্তু তারা হিদায়াত থেকে বিমুখ। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :
(كَأَنَّهُمْ خُشُبٌ مُّسَنَّدَةٌ)
অর্থাৎ দেওয়ালে ঠেকানো কাঠ দেখতে ভাল কিন্তু কোন উপকারে আসে না, এ সকল মুনাফিকরাও প্রাচীরে ঠেকানো কাঠের মত, এরা হিদায়াতের কথা শোনার মত নয়।
(يَحْسَبُوْنَ كُلَّ صَيْحَةٍ)
অর্থাৎ এ সকল মুনাফিকদের অন্তরে সন্দেহ, দুর্বলতা, ভীরুতা ও ভয় থাকার কারণে যে কোন ভীতিকর অবস্থা বা হট্টগোল শুনলেই তারা মনে করে হয়তো কোন বিপদ আমাদের ওপর আপতিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ ج فَإِذَا جَا۬ءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُوْنَ إِلَيْكَ تَدُوْرُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِيْ يُغْشٰي عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ ج فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوْكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَي الْخَيْرِ ط أُولٰ۬ئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوْا فَأَحْبَطَ اللّٰهُ أَعْمَالَهُمْ ط وَكَانَ ذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرًا)
“তোমাদের প্রতি কার্পণ্য করে আর যখন কোন ভয়ের কারণ সামনে আসে, তখন আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা মৃত্যুভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। অতঃপর যখন সেই ভয় চলে যায়, তখন তারা ধন-সম্পদের লোভে তীব্র ভাষায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে। তারা ঈমান আনেনি। অতএব আল্লাহ তাদের কার্যসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এরূপ করা আল্লাহ্র জন্য খুবই সহজ।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ১৯)
মুনাফিকী একটি মারাত্মক ব্যাধি যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মুনাফিকরা মুসলিমদের জন্য কাফিরদের চেয়ে ভয়ংকর। সুতরাং নিজেরা মুনাফিকী চরিত্র থেকে বেঁচে থাকব এবং মুসলিম সমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক করব।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও মুসলিমদের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
২. মুনাফিকরা ফেতনা-ফাসাদ ও অরাজকতা সৃষ্টি করে বেড়ায়।
৩. মুনাফিকরা নিজেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বেশি বেশি শপথ করবে।
৪. মুনাফিকরা ঈমানদারদের সামনে খুব চমকপ্রদভাবে নিজেদের কথা উত্থাপন করে থাকে যাতে তারা তাদের অন্তরের খবর বুঝতে না পারে।
৫. মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলিমদের চরম শত্রু।
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا يَسْتَغْفِرْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ لَوَّوْا رُءُوسَهُمْ وَرَأَيْتَهُمْ يَصُدُّونَ وَهُم مُّسْتَكْبِرُونَ
তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘এসো, আল্লাহর রসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তুমি দেখতে পাও তারা সদম্ভে তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়।
سَوَآءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الْفٰسِقِينَ
আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন বা না করুন, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসিক সম্পপ্রদায়কে হেদায়াত দেন না।
هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنفِقُوا عَلٰى مَنْ عِندَ رَسُولِ اللَّهِ حَتّٰى يَنفَضُّوا ۗ وَلِلَّهِ خَزَآئِنُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَلٰكِنَّ الْمُنٰفِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ
তারাই বলে, ‘তোমারা আল্লাহর রাসূলের সহচরদের জন্য ব্যয় করো না, যাতে তারা সরে পড়ে।’ অথচ আসমানসমূহ ও যমীনের ধন-ভাণ্ডার তো আল্লাহরই ; কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না [১]।
يَقُولُونَ لَئِن رَّجَعْنَآ إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ ۚ وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِۦ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلٰكِنَّ الْمُنٰفِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ
তারা বলে, ‘আমরা মদীনায় ফিরে আসলে সেখান থেকে শক্তিশালীরা অবশ্যই দুর্বলদেরকে বের করে দেবে [১]।’ অথচ শক্তি-সম্মান তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা এটা জানে না।
৫-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে তুলে ধরে বলছেন। এদেরকে যদি বলা হয়, তোমরা তোমাদের কৃত অপরাধ ও কুফরীর জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট যাও, তিনি তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইবেন। অথচ তারা ক্ষমা না চেয়ে উদ্ধত্য ও বড়ত্ব প্রকাশ করে মাথা ফিরিয়ে নিবে। তারা কখনো ক্ষমা চাইবে না। কারণ তারা ক্ষমা চাইলেই নিজেদেরকে অপমানিত মনে করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষমা চান আর না চান তিনি ক্ষমা করবে না।
(هُمُ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ لَا تُنْفِقُوْا عَلٰي مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللّٰهِ) শানে নুযূল :
জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) বলছেন : যখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলল : আল্লাহ তা‘আলার রাসূলের নিকট যারা আছে (অর্থাৎ সাহাবীরা) তাদের জন্য কিছুই ব্যয় করো না। এবং আরো বলল : যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে সম্মানিত ব্যক্তিরা অসম্মানিতদেরকে বের করে দেব। আমি এ কথা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালাম (এ কথা শুনে) আনসারীরা আমাকে তিরস্কার করতে লাগলে। আব্দুল্লাহ বিন উবাই শপথ করে বলল : সে এসব কথা বলেনি। আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম এবং ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাকলেন আমি তাঁর কাছে আসলাম। তিনি বললেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্য বলে উল্লেখ করেছেন এবং
(هُمُ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ لَا تُنْفِقُوْا)
আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০২, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭২)
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমরা কোন এক যুদ্ধে ছিলাম। (যাকে ঐতিহাসিকগণ মুরাইসী অথবা বানী মুসতালিক বলেছেন)। জনৈক মুহাজির আনসারীদের এক ব্যক্তিকে নিতম্বে আঘাত করলেন। তখন আনসারী সাহাবী “মুহাজির ভাইগণ” বলে ডাক দিলেন। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলের কানে এ কথা পৌঁছে দিলেন। তিনি বললেন : এটা কেমন ডাকাডাকি। অন্য বর্ণনায় রয়েছে : তোমাদের কী হল যে, জাহিলিয়া যুগের প্রথা ডেকে নিয়ে আসছো। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০৫) উপস্থিত লোকেরা বললেন : জনৈক মুহাজির ব্যক্তি এক আনসারী ব্যক্তির নিতম্বে আঘাত করেছে। আনসারী ব্যক্তি হে আনসারী ভাইগণ বলে আর মুহাজির ব্যক্তি হে মুহাজির ভাইগণ বলে নিজ নিজ গোত্রকে ডাক দিলেন। এ কথা শুনে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : এ রকম ডাকাডাকি ত্যাগ কর, এগুলো অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত কথা। জাবের (রাঃ) বলছেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় হিজরত করে আসেন তখন আনসারী সাহাবীদের সংখ্যা বেশি ছিল। পরে মুহাজিরদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলল : সত্যিই তারা কি এমন করেছে? আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমরা মদীনায় ফিরে গেলে সম্মানিত ব্যক্তিরা অসম্মানিত ব্যক্তিদের বের করে দেব। উমার (রাঃ) বলছেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন, আমি এ মুনাফিকদের গর্দান উড়িয়ে দিই। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : উমার (রাঃ) তাকে ছেড়ে দাও যাতে লোকেরা এমন কথা বলতে না পারে মুহাম্মাদ তাঁর সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা. ২৫৮৪)
আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্মানিত বলতে নিজের দলবলের লোকদের বুঝাতো আর অসম্মানিত বলতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদেরকে বুুঝাতো। মূলত সম্মান তো কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল ও মু’মিনদের জন্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মু’মিনদের সাথে মুনাফিকদের চরম শত্রুতার কথা জানতে পারলাম।
২. মুনাফিকদের জন্য দু‘আ প্রার্থনা উপকারে আসবে না।
৩. রিযিক ও মান সম্মানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন।
৪. মুনাফিকরা মু’মিনদের বিপদ-আপদের সুযোগ খুঁজে।
ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল না করে
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلاَ أَوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّهِ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ ○
হে মুমিনগণ! তোমাদের সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল না করে। যারা এরূপ করবে তারাইতো ক্ষতিগ্রস্থ। (সূরা ৬৩, মুনাফিকুন, আয়াত-৯)
এ সূরার প্রথম রুকুতে মুনাফিকদের মিথ্যা শপথ ও চক্রান্তর উল্লেখ করা হয়েছে। দুনিযার মহব্বতে লিপ্ত হয়ে পড়াই এর মূল কারণ। এ কারণেই একদিকে তারা মুসলমানদের কবল থেকে আত্মরক্ষা এবং অপরদিকে সুযোগ সুবিধা ভোগ করার উদ্দেশ্যে বাহ্যত মুসলমান বলে প্রকাশ করত। অতঃপর এখানে মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে তোমরা মুনাফিকদর মত দুনিয়ার মহব্বতে মগ্ন হয়ে যেওনা। এখানে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এই জন্য যে মানুষ বেশীরভাগ এদের স্বার্থেই ঈমানের দাবী পূরণ ও দায়িত্ব পালন হতে মুখ ফিরিয়ে, মুনাফেকী, ঈমানের দুর্বলতা কিংবা ফাসেকী নাফরমানীর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আসলে এখানে দুনিয়ার সে সব কিছুকেই বুঝানো হয়েছে যা মানুষকে নিজের মধ্যে এতটুকু মশগুল করে রাখে, যার ফলে সে আল্লাহকে ভুলে যায়। আল্লাহর ব্যাপারে সম্পূর্ণ গাফিল হয়ে যায়। মূলত এই ভুলে যাওয়া ও আল্লাহর স্মরণ হতে গাফিল হয়ে যাওয়া সমস্ত দুষ্কর্মের মূল কারণ। মানুষ মোটেও স্বাধীন নহে, এক আল্লাহর বান্দাহ আর আল্লাহ তার কাজকর্ম পুরাপুরি জানেন এবং একদিন তার সমানে গিয়ে মানুষকে নিজের সমস্ত কাজে কর্মের হিসেব দিতে হবে। একথা যদি মানুষের মনে থাকে ভুলে না তাহলে কোন প্রকার গুমরাহী বা পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
মানবীয় দুর্বলতার কারণে কখনো পদঙ্খলন ঘটে গেলেও হুশ ফিরে আসার সাথে সাথে সে নিজেকে সামলে নেয়। ফলে ভুল পথ ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। আয়াতে একথা বলা হয়নি যে ধনমালের এবং সন্তান-সন্তুতির মহব্বত সর্বাবস্থায় নিন্দনীয়। বরং এগুলো নিয়ে ব্যাপৃত থাকা এক পর্যায়ে কেবল জায়েযই নয় বরং ওয়াজিবও হয়ে যায়। কিন্তু সর্বদা এই সীমানার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব বস্তু যেন মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে দেয়। আল্লাহর স্মরণ-এ প্রত্যেক কল্যাণ, সেবা, মহৎ চিন্তা, মহৎ কাজ অন্তভর্‚ক্ত। কারণ এটাই হল সেবা এবং উৎসর্গ যেটা আল্লাহ আমাদের কাছে চান। হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেন স্মরণ অর্থ যাবতীয় আনুগত্য ও ইবাদাত এই অর্থ সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। আমরা যদি এতে ব্যর্থ হই, ক্ষতি আমাদের নিজেরই অন্য কারো নয়। কারণ এটা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বন্ধ করে দেয়, জান্নাতের পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়।
স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতির ব্যাপারে সতর্ক থাক
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلاَدِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِن تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ○
হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রীগণ ও তোমাদের সন্তান-সন্তুতির মধ্যে কতিপয় তোমাদের শত্রæ। অতএব তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। আর তোমরা যদি ক্ষমা কর, উপেক্ষা কর এবং দোষত্রæটি ঢেকে রাখ তবে আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়াময়। (সূরা ৬৪, তাগাবুন, আয়াত-১৪)
আল্লাহর পথে চলার ব্যাপারে বহুসংখ্যক ঈমানদার পুরুষকে নিজের স্ত্রী-সন্তান হতে এবং বহু সংখ্যক স্ত্রীলোককে নিজের স্বামী ও সন্তান হতে পিতা-মাতাকে তাদের সন্তান হতে এবং সন্তানদেরকে তাদের পিতা-মাতা হতে অসংখ্য প্রকার দুঃখ-কষ্ট, বিপদ, অসুবিধা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। পুরুষের পক্ষে এমন স্ত্রী পাওয়া বা স্ত্রীর পক্ষে এমন স্বামী পাওয়া যে, ঈমান ও সততার জীবন যাপনে পরস্পর পূর্ণমাত্রায় সহযোগী ও সাহায্যকারী হবে এবং এরপর তাদের সন্তানদের আকীদা, বিশ্বাস, আমল ও চরিত্র স্বভাবে তাদের মনমত ও চোখের শীতলতা হবে। এমনটি খুব কমই ঘটে থাকে। সাধারণত দেখা যায় স্বামী ঈমানদার চরিত্রবান হল স্ত্রী ও সন্তান এমন হয় যারা তার ঈমানদারী, সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজেদের দুর্ভাগ্যের কারণ মনে করে। তারা চায় স্বামী বা পিতা তাদের জন্যা এমন কাজ করুক যার ফলে তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পাবে পরিণামে তাকে জাহান্নামে যেতে হলেও তাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। এর বিপরীত মুমিন স্ত্রীলোক এমন স্বামীর পাল্লায় পড়ে যে, তার শরীয়ত পালন করে চলা স্বামীর মোটেই সহ্য হয়না। সন্তানরা অসদাচারী পিতার পদাংক অনুসরণ করে অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে মায়ের জীবনকে দুঃসহ করে তোলে। অনুরূপভাবে অনেক সন্তান পিতা-মাতার কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হয়। বিশেষত কুফরী ও ঈমানের দ্ব›েদ্ব ঈমানদার ব্যক্তির দায়িত্ব হল আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের খাতিরে সর্বপ্রকার ক্ষতি ও দুঃখ বিপদ সহ্য করতে প্রস্তুত থাকা। কারাবরণ কিংবা দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হলেও কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হবেনা প্রকৃতঈমানের এটাই দাবী। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেই একজন ঈমানদার স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী ও সন্তানেরা স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী ও সন্তানরা এবং সন্তানদের ক্ষেত্রে পিতা মাতা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামী সমাজেও এ ধরনের অবস্থা অনেক দেখা যায়।
আয়াতটি নাযিল হওয়া কালী সময়ে বহু সংখ্যক ঈমানদারের জীবনে তদান্তিন বিশেষ অবস্থায় যে বিশেষ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, বর্তমান সময়েও অমুসলিম সমাজে ইসলাম গ্রহণকারী বহুলোকের জীবনে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে থাকে। তদানিন্তন মক্কা ও আরবের অন্যান্য অঞ্চলে সাধারণত এই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল যে, একজন পুরুষ ঈমান আনল, কিন্তু স্ত্রী-পুত্র পরিজন যে শুধু ঈমান আনতে প্রস্তুত নয় তা-ই নয় বরং তাকেই ইসলাম থেকে বিরত রাখার বা ফিরিয়ে নেয়ার জন্য দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল সেসব মহিলারা এবং সন্তানরাও যারা নিজেদের সমাজ পরিবেশে একাই ইসলাম গ্রহণ করত ও ঈমানের পথে চলতে চাইত।
এসকল অবস্থার সম্মুখীন ঈমানদার লোকদের সম্বোধন করে আলোচ্য আয়াতে তিনটি কথা বলা হয়েছেÑ প্রথমত বলা হয়েছে যে, বৈষয়িক সম্পর্ক ও আত্মীয়তার দৃষ্টিতে যদিও এই লোকেরা সর্বাধিক প্রিয়জন। কিন্তু দ্বীন ও ইসলামের দৃষ্টিতে এরা তোমাদের শত্রæ। অবশ্য সে শত্রæতা কয়েক প্রকার হতে পারে। তারা তোমাদেরকে নেক কাজ থেকে বিরত রাখতে ও পুনরায় কুফরীর দিকে টানতে পারে। অথবা হতে পারে তাদের সদিচ্ছা সহানুভ‚তি হবে কুফরীর প্রতি আর তোমাদের কাছে মুসলমানদের যুদ্ধ সংক্রান্ত অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোন গোপন তথ্য জানতে পারলে তারা ইসলামের দুশমনদের কাছে পৌঁছাতে পারে। এ ধরনের কাজে মূল শত্রæতার স্বরূপ ও অবস্থায় বা মাত্রায় তো পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু আসলে এতো শত্রæতাই। ঈমান যাদ তোমাদের অধিকতর প্রিয় বস্তু হয়ে থাকে তাহলে এসব দিক দিয়েই তাদেরকে শত্রæ মনে করাই কর্তব্য। তাদের প্রেম ভালবাসায় পড়ে তোমাদের ও তাদের মধ্যে ঈমান ও কুফরের কিংবা আল্লাহনুগত্য ও আল্লাহর নাফরমানীর দিক দিয়ে যে বিরাট প্রাচীর আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা তোমাদের কখনই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
অতঃপর আলোচন্য আয়াতে বলা হয়েছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। অর্থাৎ তাদের বৈষয়িক সুখ সুবিধা বিধান করতে গিয়ে স্বীয় পরকাল পরিণতি বরবাদ করোনা। তাদের প্রতি ¯েœহ ভালবাসা এতটা বেশী পোষণ করোনা যার ফলে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর সাথে তোমাদের সম্পর্ক রক্ষা ও ইসলাম পালনের পথে তারা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের প্রতি এতটা নির্ভরতা রেখনা যার ফলে তোমার অসতর্কতার সুযোগে মুসলিম সমাজের গোপন তত্ব জানতে পেরে শত্রæপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারে। রাসূল (সাঃ) একটি হাদীসে বলেছেনÑ “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, বলা হবে এর সন্তান সন্তুতিরা তার সব নেক আমল খেয়ে ফেলেছে।”
পরিশেষে বলা হয়েছে- “আর তোমরা যদি ক্ষমা ও সহনশীলতার ব্যবহার কর ও ক্ষমা করে দাও তাহলে অল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়াবান।” এর অর্থ এই যে তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা হচ্ছে শুধু তোমাদেরকে সাবধান করার উদ্দেশ্যে। যেন তোমরা সতর্ক থাক এবং দ্বীন ইসলামকে তাদের ক্ষতি হতে রক্ষা করার চিন্তা-ভাবনা কর। এর মূলে অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। তোমরা স্ত্রী-পুত্রকে মারপিট করবে কিংবা তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করবে বা দুর্ব্যবহার করবে অথবা তাদের সাথে সম্পর্ক এতটা তিক্ত করবে যার ফলে তোমাদের ও তাদের পারিবারিক জীবনই দুঃসহ হয়ে উঠবেÑ এটা কখনো উদ্দেশ্যে নয়। কেননা তা করা হলে দুটো বিরাট ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। একটি এই যে এর ফলে স্ত্রী-পুত্রকে সংশোধন করার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। আর দ্বিতীয় এই যে সমাজে এর দরুণ ইসলামের বিরুদ্ধে একটা সাধারণ বিরুদ্ধভাব সৃষ্টি হতে পারে। আশেপাশের লোকেরা মুসলমানদের চরিত্র ও আচরণ সম্পর্কে এরূপ ধারণা করতে পারে যে, ইসলাম গ্রহণ করলেই বুঝি নিজের ঘরেও স্ত্রী-পুত্র পরিজনের প্রতি কঠোর ও রূঢ় আচরণকারী হয়ে যেতে হয়।
এ ধরনের সমস্যা সম্পর্কে সূরা আন্-কাবুতের ৮নং আয়াতে, সূরা লোকমানের ১৪-১৫নং আয়াতে, সূরা তাওবা ২৩-২৪, সূরা মুমতাহানার ৩ ও মুনাফিক‚ন-৯নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। অতএব আমাদের কর্তব্য নিজ পরিবার পরিজনের ব্যাপারে সতর্ক থাকা যাতে তাদের জন্য ঈমানের ও ইসলামের কোনা ক্ষতি না হয় এবং তাদেরকে হেকমতের সাথে সংশোধনের চেষ্টা কর।
সন্তান-সন্তুতি ও পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لاَ يَعْصُوْنَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ ○
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর যার ইন্দ হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে কঠোর স্বভাব, পাষাণ হৃদয় ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহ তা’য়ালা যা আদেশ করেন তা অমান্য করেনা এবং যা করতে আদেশ করা হয় তা-ই করেন। (সূরা ৬৬, তাহরীম, আয়াত-৬)
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে কেবলমাত্র নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করতে থাকবে এবং তার চেষ্টা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে মুমিন ব্যক্তির কেবলমাত্র এতটুকুই দায়িত্ব নয় বরং সেই সাথে প্রাকৃতিক ব্যবস্থানুযায়ী যে পরিবার ও বংশের নেতৃত্বের বোঝা তার উপর অর্পিত হয়েছে যে পরিবার ও বংশের লোকজনকেও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আল্লাহর পছন্দের অনুরূপ বানাতে চেষ্টা করে যাওয়াও তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। তারা জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে তার পক্ষে যতটা সম্ভব তাদেরকে সেদিক হতে ফিরিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা চালাবে। সন্তানাদি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল অবস্থার হবে পিতৃগণের শুধু এই চিন্তাই হওয়া উচিত নয়। সেই সাথে বরং ইহা অপেক্ষাও বেশী চিন্তা করতে হবে তাদেরকে জাহান্নমের ইন্দন থেকে বিরত রাখার জন্য। বুখারী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে-রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই রাখাল এবং নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে। দেশ প্রশাসক রাখাল সে তার প্রজা সাধারণের ব্যাপারে জবাবদিহী করবে। স্ত্রী নিজের স্বামীর ঘর সন্তানদের ব্যাপারে দায়ী। সে তাদের ব্যাপারে জবাবদিহী করবে।”
অতঃপর জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে যে, এর ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। এটা অত্যন্ত মারাত্মক আগুন, এটা সাধারণ আগুনের মত যেটা কাঠ বা কয়লা বা এধরনের জিনিষকে জ্বালায় তা’নয়। এই আগুনের ইন্দর হবে মানুষ যারা পাপ কাজ করবে এবং যাদের অন্তর পাথরের মত কঠিন। অথবা পাথরের মূর্তি যে গুলো জীবনের সকল মিথ্যার প্রতিকৃতি। আমরা সাধারণত চিন্তা করি ফেরেশতারা স্বভাবগতভাবে খুবই নরম স্বভাবের দয়াদ্র এবং সুন্দর। কিন্তু অন্যদিকে তারা ন্যায় বিচারক, বিশ্বস্ত এবং সুশৃংখল এবং অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তাদেরকে দেয়া আল্লাহর আদেশ সমূহ পালন করেন। এই ব্যাপারে তাঁরা সামান্য শিথিলতা দেখান না বা আদেশ পালনে সাম্যন্য ত্রæটি বা হেরফের করেননা। তাঁরা আল্লাহর আদেশ সমূহ পুংখানুপুয়খ রূপে বাস্তবায়ন করেন।
অতএব আমাদের কর্তব্য জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
وَأَنفِقُوا مِن مَّا رَزَقْنٰكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِىَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَآ أَخَّرْتَنِىٓ إِلٰىٓ أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصّٰلِحِينَ
আর আমরা তোমাদেরকে যে রিফিক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে। তোমাদের কারও মৃত্যু আসার আগে। (অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে) ‘হে আমার রব ! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সাদাকাহ দিতাম ও সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম ! [১]’
وَلَن يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَآءَ أَجَلُهَا ۚ وَاللَّهُ خَبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ
আর যখন কারো নির্ধারিত কাল উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা আমল কর আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا أَنفِقُوا مِمَّا رَزَقْنٰكُم
مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِىَ يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفٰعَةٌ ۗ وَالْكٰفِرُونَ هُمُ الظّٰلِمُونَ
হে মুমিনগণ! আমরা যা তোমাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে, যেদিন বেচা-কেনা , বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না, আর কাফেররাই যালিম।
আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের আহ্বান করে তিনি যে রিযিক দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করার কথা বলেছেন সেদিন আসার আগেই যেদিন কোন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও কোন সুপারিশ করার সুযোগ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰکُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَکُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْلَآ اَخَّرْتَنِیْٓ اِلٰٓی اَجَلٍ قَرِیْبٍﺫ فَاَصَّدَّقَ وَاَکُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ)
তাই জীবদ্দশায় আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় যথাসাধ্য ব্যয় করা উচিত।
বিচার দিবসে কেউ কারো উপকারে আসবে না
মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন নিজেদের সম্পদ সৎ পথে খরচ করে। তাহলে মহান আল্লাহ্র নিকট তার সাওয়াব জমা থাকবে। অতঃপর বলেন যে, তারা যেন তাদের জীবদ্দশাতেই কিছু দান-খায়রাত করে। কেননা কিয়ামতের দিন না ক্রয়-বিক্রয় চলবে, আর না পৃথিবীর পরিমাণ সোনা দিয়ে জীবন রক্ষা করা যাবে। কারো বংশ, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা কোন কাজে আসবে না। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
﴿فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوْرِ فَلَاۤ اَنْسَابَ بَیْنَهُمْ یَوْمَىِٕذٍ وَّ لَا یَتَسَآءَلُوْنَ﴾
‘যে দিন সিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিন পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না, এবং একে অপরের খোজ খবর নিবে না।’ (২৩ নং সূরাহ্ মু’মিনূন, আয়াত নং ১০১) সেদিন সুপারিশকারীর সুপারিশ কোন কাজে আসবে না।
অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেন যে, কাফিররাই অত্যাচারী। অর্থাৎ পূর্ণ অত্যাচারী তারাই যারা কুফরী অবস্থায়ই মহান আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করে। ‘আতা ইবনু দীনার (রহঃ) বলেন, ‘আমি মহান আল্লাহ্র নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি কাফিরদেরকে অত্যাচারী বলেছেন, কিন্তু অত্যাচারীদেরকে কাফির বলেন নি। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম-৩/৯৬৬)