Book No. 12: আল্লাহকে কতটুকু ভালোবাসবো

কি (কতটুকু) ব্যয় করবে? / আমি আল্লাহ্‌কে কতটুকু ভালবাসি?

 

কি (কতটুকু) ব্যয় করবে?

َيَسْـَٔلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلِ ٱلْعَفْوَ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمُ ٱلْءَايَٰتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَবাকারা ২১৯

 

আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার।

 

আমরা কি কক্ষনো এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছি? এখানে আমাদেরকে কি নির্দেশ করা হয়েছে?

 

তাফসির ফী জিলালিল কুরআন এ বলা হয়েছে মধ্যম মানের জীবন যাপনের পর যা কিছু অতিরিক্ত থাকে এখানে তাই আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করতে নির্দেশ করা হয়েছে। কুরআনে ব্যয় করার জন্য যতগুলো আয়াতে নির্দেশনা এসেছে এই আয়াতটি আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হচ্ছে।

 

 

 

আপনাদের কি মনে হয়?আমি বা আপনি কি কক্ষনো এই আয়াত অনুযায়ি আমল করার চেষ্টা করি?

 

 

 

আমার মনে এই প্রশ্ন জাগার কারন হল এর চেয়ে আনেক সহজ কাজ ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহ বইটিতে শহীদ মাওলানা মতিউর রাহমান নিযামী বলেছেন। অথচ আমরা শেতাই মানতে চাইনা। অনেক গড়িমসি করি। সেখানে দুটো মানদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

একটি হচ্ছে আপনার আয় অথবা ব্যয় যেটা বেশী তার ৫%আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করতে নির্দেশ করা হয়েছে।

 

অথবা দীনি সংগঠনকে আপনার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা।যেমন আপনার পরিবারে আপনার যদি দুইজন সন্তান আপনি এবং আপনার স্ত্রী এই ৪ জনের সংসার হয়, আপনার আরেকজন সন্তান হলে আপনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা হত ৫ জন। আনুরুপ ভাবে আপনার ৪ জনের সংসারে ৫ম জন হিসেবে সংগঠনকে বিবেচনা করে আপনি বা আমি আপনার বা আমার মোট ব্যয়ের ১/৫ ( ৫ ভাগের এক ভাগ ) অর্থাৎ ২০% সংগঠনের জন্য ব্যয় করা।অনুরূপ ভাবে আপনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী এই হার কম বা বেশী হতে পারে।

 

 

 

আমরা কি এই তিনটির কোনটি আমল করছি?

 

 

 

সবচেয়ে সহজ যেই ৫% আমরা কি সেটাই খুশী মনে দিচ্ছি? তাহলে কেন এত গড়িমসি? কেন এত হিসেবের গণ্ডগোল?

 

 

 

অথচ আমাদের কেহ কেহ দাবি করি আমরা আল্লাহ্‌র রাস্তায় মাল এবং জান দিতে প্রস্তুত। আমাদের অনেকে শপথ নিয়েছেন জীবন ও মৃত্যু আল্লাহ্‌র জন্য ! কি আশ্চায্য!

 

 

 

তাহলে কি কুরআনের এই আয়াতটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়?

 

 

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ

 

সূরা সফ আয়াত#2 মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল?

 

আসুন আমরা নিজেদের আর্থিক কুরবানি এবং সকল খেত্রে কুরআন এবং হাদিছের আলোকে নিজেদেরকে পেশ করি। আল্লাহপাক আমাদেরকে তার দিনের জন্য কবুল করুন। আমীন।

 

 

 

আমি আল্লাহ্‌কে কতটুকু ভালবাসি?

 

চায়ের মত ভালবাসি কি? ধরুন আমি প্রতিদিন তিন কাপ চা পান করি। প্রতি কাপ চা ১০ টাকা হিসেবে ৩ কাপের দাম ৩০ টাকা। তাহলে মাসে চা এর জন্য আমার খরচ হয় ৩০ গুন ৩০ সমান নয় শত টাকা। এখন হিসেব করি আমি মাসে আল্লার পথে কত ব্যয় করি(এয়ানত দেই)? যদি আমি নয় শত টাকার কম দেই তাহলে আমি কি আল্লাহ্‌কে চায়ের মত ভালবাসতে পারলাম?

 

আল্লাহ্‌কে পানের মত ভালবাসি? আমার যদি মাসে পানের জন্য খরচ হয় ৫ শত টাকা অথচ আমি এয়ানত দেই ১ শত টাকা তাহলে আমি কি আল্লাহ্‌কে পানের মতো ভালবাসতে পারলাম?

 

আল্লাহ্‌কে গোস্তের মত ভালবাসি? আমার যদি মাসে গোস্তের জন্য খরচ হয় ৫ হাজার টাকা অথচ আমি এয়ানত দেই ২ শত টাকা তাহলে আমি কি আল্লাহ্‌কে গোস্তের মতো ভালবাসতে পারলাম?

 

এগুলো কিছু উদাহরণ মাত্র। আমি আপনি চিন্তা করি… আমি বা আপনি আল্লাহ্‌কে কতটুকু ভালবাসি? কিসের মত ভালবাসি?

 

আলে ইমরানের এই আয়াতটি নিয়ে আমরা কতটুকু চিন্তা করেছি?আর দেরি নয়। এখনি ভাবুন এবং সিধান্ত নিন।

 

আল্লাহ্‌আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখিরাতে যাবতীয় কল্যাণ দান করুন। আমীন।

 

ۗ وَيَسْـَٔلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ ۗ كَذٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْءَايٰتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ

আর তারা আপনাকে জিজ্জেস করে কি তারা ব্যায় করবে ? বলুন, যা উদ্বৃত্ত [৩]। এভাবে আল্লাহ্‌ তাঁর আয়াত সমূহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর।

সাধ্যমত দান করা উচিত

 

‘কুলিল ‘আফওয়া’ এর একটি পঠন ‘কুলিল ‘আফউ’ও রয়েছে অর্থাৎ العفو শব্দের ওয়াও বর্ণে যবর এবং যের উভয় পঠনই বিশুদ্ধ। দু’টির অর্থ প্রায় একই। আল-হাকাম (রহঃ) মিকসাম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেন ‘তারা জানতে চায় তারা কি পরিমাণ ব্যয় করবে’ এ আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে, তোমরা তোমাদের পরিবারের জন্য যতোটুকু দরকার ততোটুকু ব্যয় করার পর যা অতিরিক্ত হবে তাই ব্যয় করবে। ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) , মুজাহিদ (রহঃ) , ‘আতা (রহঃ) , ইকরামাহ (রহঃ) , সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ) , মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব (রহঃ) , হাসান বাসরী (রহঃ) , কাতাদাহ (রহঃ) , আল কাসিম (রহঃ) , সালিম (রহঃ) , ‘আতা আল খুরাসানী (রহঃ) এবং রাবী‘ ইবনু আনাস (রহঃ) -সহ প্রমুখ العفو এর অর্থ ‘অতিরিক্ত বস্তু’ বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ২/৬৫৬, ৬৫৭) রাবী‘ ইবনু আনাস (রহঃ) থেকে এ অভিমতও রয়েছে যে, العفو এর অর্থ হলো সর্বোত্তম সম্পদ। তবে সবগুলোই অতিরিক্ত বস্তু হওয়ার প্রতিই প্রমাণ বহন করে।

 

‘আবদ ইবনু হুমাইদ স্বীয় তাফসীরে বলেন, এর অর্থ হলো তোমার সম্পত্তিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করো না যার ফলে তোমাকে মানুষের নিকট ভিক্ষাবৃত্তি করতে হয়। আর এর প্রতি সমর্থন পাওয়া যায় ইবনু জারীর (রহঃ) -এর বর্ণিত হাদীসটি যা তিনি আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) -এর সূত্রে বর্ণনা করেন, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেনঃ ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বললোঃ

 

يَا رَسُولَ اللَّهِ، عِنْدِي دِينَارٌ؟ قَالَ: “أَنْفِقْهُ عَلَى نَفْسِكَ”. قَالَ: عِنْدِي آخَرُ؟ قَالَ: “أَنْفِقْهُ عَلَى أَهْلِكَ”. قَالَ: عِنْدِي آخَرُ؟ قَالَ: “أَنْفِقْهُ عَلَى وَلَدِكَ”. قَالَ: عِنْدِي آخَرُ؟ قَالَ: “فَأَنْتَ أبصَرُ.

 

‘হে মহান আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! আমার কাছে একটি স্বর্ণ মুদ্রা রয়েছে।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘তোমার কাজে লাগাও।’ লোকটি বললোঃ ‘আমার নিকট আরো একটি রয়েছে।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘তোমার স্ত্রীর জন্য খরচ করো।’ সে বললোঃ ‘আরো একটি আছে।’ তিনি বললেনঃ তোমার ছেলে মেয়ের প্রয়োজনে লাগাও।’ সে বললো আমার নিকট আরো একটি রয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘ তাহলে এখন তুমি চিন্তা ভাবনা করে দেখতে পারো।’ (তাফসীর তাবারী -৪/৩৪০/৪১৭০, মুসনাদ আহমাদ -২/২৫১/৭৪১৩, সুনান আবূ দাউদ-২/১৩২/১৬৯১, সুনান নাসাঈ -৫/৬৬/২৫৩৪, মুসতাদরাক হাকিম-১/৪১৫, সহীহ ইবনু হিব্বান-৫/১৪১/৩৩২৬) অবশ্য হাদীসটি ইমাম মুসলিমও স্বীয় সহীহ মুসলিমে বর্ণনা করেছেন।

 

ইমাম মুসলিম জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) -এর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন লোককে বললেনঃ

 

ابْدَأْ بِنَفْسِكَ فَتَصَدَّقْ عَلَيْهَا، فَإِنْ فَضَل شَيْءٌ فَلِأَهْلِكَ، فَإِنْ فَضُلَ شَيْءٌ عَنْ أَهْلِكَ فَلِذِي قَرَابَتِكَ، فَإِنْ فَضُلَ عَنْ ذِي قَرَابَتِكَ شَيْءٌ فَهَكَذَا وَهَكَذَا.

 

‘প্রথমে তুমি তোমার নিজ থেকে আরম্ভ করো। প্রথমে তারই ওপর সাদাকাহ করো। অতিরিক্ত থাকলে ছেলে মেয়ের জন্য খরচ করো। এরপরেও থাকলে নিজের আত্মীয় স্বজনের ওপর সাদাকাহ করো। এরপরেও যদি থাকে তাহলে অন্যান্য অভাগ্রস্তদের ওপর সাদাকাহ করো।’ (সহীহ মুসলিম-২/৪১/৬৯২, ৬৯৩, সুনান নাসাঈ -৫/৭৩,৭৪/২৫৪৫) অন্য একটি হাদীসে রয়েছেঃ

 

خير الصَّدَقَةِ مَا كَانَ عَنْ ظَهْر غِنًى، وَالْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى، وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولَ.

 

‘উত্তম দান হচ্ছে তা, যা মানুষ নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস দান করে। ওপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা উত্তম। প্রথমে তাদেরকে দাও যাদের খরচ বহন তোমার দায়িত্বে রয়েছে। (সহীহুল বুখারী-৩/৩৪৫/১৪২৬, সহীহ মুসলিম-২/৯৫/৭১৭, সুনান আবূ দাউদ-২/১২৯/১৬৭৬, সুনান নাসাঈ -৫/৬৬/২৫৩৩, মুসনাদ আহমাদ -২/২৪৫, ৪৩৪) অন্য একটি হাদীসে রয়েছেঃ

 

ابْنَ آدَمَ، إِنَّكَ إِنْ تبذُل الفضلَ خيرٌ لَكَ، وَإِنْ تُمْسِكْهُ شَرٌّ لَكَ، وَلَا تُلام عَلَى كَفَافٍ.

 

‘হে আদম সন্তান! তোমার হাতে তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা রয়েছে তা মহান আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করাই তোমার জন্য মঙ্গলকর এবং তা ব্যয় না করা তোমার জন্য ক্ষতিকর। তবে হ্যাঁ, নিজের প্রয়োজন অনুপাতে খরচ করায় তোমার প্রতি কোন ভর্ৎসনা নেই। (সহীহ মুসলিম-২/৯৭/৭১৮,জামি‘ তিরমিযী-৪/৪৯৫/২৩৪৩, মুসনাদ আহমাদ -৫/২৬২) তবে বলা হয়ে থাকে যে, যাকাতের আয়াতের দ্বারা অত্র আয়াতটি মানসূখ তথা রহিত হয়ে গিয়েছে। আর মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, যাকাতের আয়াতটি যেন এই আয়াতেরই তাফসীর এবং এর স্পষ্ট বর্ণনা। আর এটাই সঠিক উক্তি। অতঃপর ইরশাদ হচ্ছেঃ

 

﴿كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَكُمُ الْاٰیٰتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُوْنَۙ فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ﴾

 

‘এভাবে মহান আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি আদেশাবলী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছেন, যাতে তোমরা চিন্তা করো। দুনিয়া এবং আখিরাত সম্বন্ধে।’ অর্থাৎ আমি যেমন এই নির্দেশাবলী স্পষ্ট ও খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করেছি, তদ্রুপ অবশিষ্ট নির্দেশাবলীও আমি পরিস্কার ও বিস্তারিত বর্ণনা করবো। জান্নাতের অঙ্গীকার ও জাহান্নাম হতে ভয় প্রদর্শনের কথাও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হবে, যেন তোমরা এই নশ্বর জগত হতে বিরত বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরলৌকিক জগতের প্রতি আগ্রহী হতে পারো, যা অনন্তকালের জন্য স্থায়ী হবে। (তাফসীর তাবারী ৪/৩৪৮)

 

হাসান বাসরী (রহঃ) এ আয়াতটি পাঠ করে বলেন যে, ‘মহান আল্লাহ্‌র শপথ! যে চিন্তা ও গবেষণা করবে সে অবশ্যই জানতে পারবে যে, পার্থিব ঘর হচ্ছে বিপদের ঘর এবং পরিণামে এটা ধ্বংস হয়ে যাবে, আর পরজগতই হচ্ছে প্রতিদানের ঘর এবং তা চিরস্থায়ী থাকবে।’ আর কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, দুনিয়ার ওপর আখিরাতের যে কি মর্যাদা রয়েছে তা একটু চিন্তা করলেই পরিস্কারভাবে জানতে পারা যাবে। সুতরাং জ্ঞানীদের উচিত যে, তারা যেন পরকালের পুণ্য সংগ্রহ করার কাজে সদা সচেষ্ট থাকে। অবশ্য আমরা সূরাহ আলি ‘ইমরানের خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَاخْتِلَافِ الَّیْلِ وَالنَّهَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ﴾ ﴿اِنَّ فِیْ ‘নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য বহু নিদর্শন আছে।’ (৩নং সূরাহ আলি ‘ইমরান, আয়াত-১৯০)

يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا أَنفِقُوا مِمَّا رَزَقْنٰكُم

مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِىَ يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفٰعَةٌ ۗ وَالْكٰفِرُونَ هُمُ الظّٰلِمُونَ

 

হে মুমিনগণ! আমরা যা তোমাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে, যেদিন বেচা-কেনা , বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না, আর কাফেররাই যালিম।

 

 

২৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:

 

আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের আহ্বান করে তিনি যে রিযিক দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করার কথা বলেছেন সেদিন আসার আগেই যেদিন কোন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও কোন সুপারিশ করার সুযোগ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 

(وَاَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰکُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَکُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْلَآ اَخَّرْتَنِیْٓ اِلٰٓی اَجَلٍ قَرِیْبٍﺫ فَاَصَّدَّقَ وَاَکُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ)

 

“আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে; (অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে,) হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য কেন অবকাশ দাও না, দিলে আমি সদাকাহ করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।”(সূরা মুনাফিকুন ৬৩:১০)

 

তাই জীবদ্দশায় আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় যথাসাধ্য ব্যয় করা উচিত।

বিচার দিবসে কেউ কারো উপকারে আসবে না

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন নিজেদের সম্পদ সৎ পথে খরচ করে। তাহলে মহান আল্লাহ্‌র নিকট তার সাওয়াব জমা থাকবে। অতঃপর বলেন যে, তারা যেন তাদের জীবদ্দশাতেই কিছু দান-খায়রাত করে। কেননা কিয়ামতের দিন না ক্রয়-বিক্রয় চলবে, আর না পৃথিবীর পরিমাণ সোনা দিয়ে জীবন রক্ষা করা যাবে। কারো বংশ, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা কোন কাজে আসবে না। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ

 

﴿فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوْرِ فَلَاۤ اَنْسَابَ بَیْنَهُمْ یَوْمَىِٕذٍ وَّ لَا یَتَسَآءَلُوْنَ﴾

 

‘যে দিন সিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিন পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না, এবং একে অপরের খোজ খবর নিবে না।’ (২৩ নং সূরাহ্ মু’মিনূন, আয়াত নং ১০১) সেদিন সুপারিশকারীর সুপারিশ কোন কাজে আসবে না।

অতঃপর মহান আল্লাহ্‌ বলেন যে, কাফিররাই অত্যাচারী। অর্থাৎ পূর্ণ অত্যাচারী তারাই যারা কুফরী অবস্থায়ই মহান আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাৎ করে। ‘আতা ইবনু দীনার (রহঃ) বলেন, ‘আমি মহান আল্লাহ্‌র নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি কাফিরদেরকে অত্যাচারী বলেছেন, কিন্তু অত্যাচারীদেরকে কাফির বলেন নি। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম-৩/৯৬৬)

 

مَّثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوٰلَهُمْ فِى سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنۢبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِى كُلِّ سُنۢبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ ۗ وَاللَّهُ يُضٰعِفُ لِمَن يَشَآءُ ۗ وَاللَّهُ وٰسِعٌ عَلِيمٌ

 

যারা নিজেদের ধন সম্পদ আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ্‌ সর্বব্যাপী- প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ [১]।

 

২৬১  নং আয়াতের তাফসীর:

 

অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় দান-সদাকাহ করার ফযীলত ও দান-সদাকাহর প্রতিদান বাতিল হয়ে যায় এমন কিছু কর্মের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।

 

যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে অর্থাৎ দীনের ইলম প্রসারে দান করে, হাজ্জ, জিহাদ, ফকীর, মিসকীন, বিধবা ও ইয়াতীমদের জন্য কিংবা সাহায্যের নিয়্যতে দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অর্থ খরচ করে। মোটকথা এতে ঐ সকল উপকারী উৎস অন্তর্ভুক্ত যা মুসলিমদের কল্যাণে আসে। তাদের উপমা হল- কেউ গমের একটি দানা উর্বর জমিতে বপন করল। এ দানা থেকে একটি চারা গাছ উৎপন্ন হল, যাতে গমের সাতটি শীষ এবং প্রত্যেকটি শীষে একশত করে দানা থাকে। অতএব, এর ফল দাঁড়ালো যে, একটি দানা থেকে সাতশত দানা অর্জিত হল। এ মহান ফযীলতের হকদার তারাই হবে যারা দান করার পর খোঁটা দেয় না এবং কষ্টও দেয় না। অর্থাৎ দান করার পর বলে না- আমি দান ও সাহায্য-সহযোগিতা না করলে তোমার দুঃখ-কষ্ট দূর হত না, তোমার স্বচ্ছলতা ফিরে আসতো না, তুমি অভাব-অনটনেই থাকতে- এখন তুমি আমার সাথে বাহাদুরি কর… ইত্যাদি। আর এমন কোন কথা ও কাজ করবে না যার কারণে তারা কষ্ট পায়। এ বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক। অনেক বিত্তশালী রয়েছে যারা অভাবীদেরকে সহযোগিতা করে আবার এমন আচরণ করে যার দ্বারা ঐ ব্যক্তি খুব ব্যথিত হয়। আর ঐ বিত্তশালীর প্রভাবের কারণে সে কিছু বলতেও পারে না।

 

কিয়ামাতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের সাথে আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন না, তাদের প্রতি তিনি রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তার মধ্যে এক শ্রেণি হল যারা দান করে খোঁটা দেয়। (সহীহ মুসলিম হা: ১০৬)

 

যারা দান করে খোঁটা দেবে না এবং কষ্টও দেবে না তাদের জন্য আরো ফযীলত হল- তাদের কোন ভয় নেই, কোন দুশ্চিন্তাও নেই।

 

(قَوْلٌ مَّعْرُوْفٌ)

 

‘ভাল কথা বলা’অর্থাৎ যারা কিছুটা চাইতে আসবে তাদের সাথে, এমনকি সকল মানুষের সাথে উত্তম কথা বল।

 

الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوٰلَهُمْ فِى سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَآ أَنفَقُوا مَنًّا وَلَآ أَذًى ۙ لَّهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

 

 

যারা আল্লাহ্‌র পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে [১] তারপর যা  ব্যয় করে তা বলে বেড়ায় না এবং কোন প্রকার কষ্টও দেয় না , তাদের প্রতিদান রয়েছে রাদের রব-এর নিকট। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত ও হবে না।

 

দান করে খোটা দেয়া যাবে না

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর ঐ বান্দাদের প্রশংসা করছেন ‘যারা দান-খায়রাত করে থাকেন; অতঃপর যাদেরকে দান করেন তাদের নিকট নিজেদের কৃপার কথা প্রকাশ করেন না এবং তাদের নিকট হতে কিছু উপকারেরও আশা করেন না। তারা তাদের কথা ও কাজ দ্বারা দান গ্রহীতাদেরকে কোন প্রকারের কষ্টও দেন না। মহান আল্লাহ্‌ তাঁর এই বান্দাদেরকে উত্তম প্রতিদান প্রদানের ওয়া‘দা করেছেন যে, তাদের প্রতিদান মহান আল্লাহ্‌র দায়িত্বে রয়েছে। কিয়ামতের দিন তাদের ভয় ও চিন্তার কারণ থাকবে না। অতঃপর মহান আল্লাহ্‌ বলেন যে, মুখ দিয়ে উত্তম কথা বের করা, কোন মুসলিম ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করা, দোষী ও অপরাধীদের ক্ষমা করা ঐ দান-খায়রাত হতে উত্তম যার পিছনে থাকে ক্লেশ ও কষ্ট প্রদান। ইবনু আবী হাতিম (রহঃ) -এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘উত্তম কথা হতে ভালো দান আর কিছুই নেই। তোমরা কি মহান আল্লাহ্‌র এই ঘোষণা শোননি?

 

﴿قَوْلٌ مَّعْرُوْفٌ وَّ مَغْفِرَةٌ خَیْرٌ مِّنْ صَدَقَةٍ یَّتْبَعُهَاۤ اَذًى﴾

 

‘যে দানের পশ্চাতে থাকে ক্লেশ দান সেই দান অপেক্ষা উত্তম বাক্য ও ক্ষমা উৎকৃষ্টতর।’ (২নং সূরাহ আল বাকারাহ, আয়াত-২৬৩) সহীহ মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

 

ثلاثة لَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ، وَلَا يُزَكِّيهِمْ، وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ: الْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى، وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.

 

‘কিয়ামতের মহান আল্লাহ্‌ তিন প্রকারের লোকের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে দেখবেন না ও তাদেরকে পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। প্রথম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে দান করার পর কৃপা প্রকাশ করে। দ্বিতীয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে পায়জামা বা লুঙ্গী পায়ের গিঁটের নীচে ঝুলিয়ে পরিধান করে। তৃতীয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে মিথ

মিথ্যা শপথ করে নিজের পণ্য দ্রব্য বিক্রি করে। (সহীহ মুসলিম-১/১৭১/১০২, সুনান আবূ দাউদ-৪/৫৭/৪০৮৭, জামি‘ তিরমিযী-৩/৫১৬/১২১১, সুনান নাসাঈ -৫/৮৫/২৫৬২, সুনান ইবনু মাজাহ-২/৭৪৪/২২০৮, সুনান দারিমী-২/৩৪৫/২৬০৫, মুসনদ আহমাদ -৫/১৪৮/১৬২, ১৬৮, ১৭৭) একটি হাদীসে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

 

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَاقٌّ، وَلَا مَنَّانٌ، وَلَا مُدْمِنُ خَمْرٍ، وَلَا مُكَذِّبٌ بِقَدَرٍ.

 

‘বাবা-মার অবাধ্য, সাদাকাহ করে কৃপা প্রকাশকারী, মদ্যপায়ী এবং তকদীরকে অবিশ্বাসকারী জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে না।’ (মুসনাদ আহমাদ -৬/৪৪১, আল মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ-৭/২০২, সুনান ইবনু মাজাহ-২/১১২০/৩৩৭৬) সুনান নাসাঈ র মধ্যে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

 

ثَلَاثَةٌ لَا يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ، وَمُدْمِنُ الْخَمْرِ وَالْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى.

 

‘কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্‌ তিন ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাতও করবেন না। পিতা– মাতার অবাধ্য, মদ্যপানে অভ্যস্ত এবং দান করে অনুগ্রহ প্রকাশকারী।’ (হাদীস সহীহ। সুনান নাসাঈ – ৫/৮৪/২৫৬১, সহীহ ইবনু হিব্বান-১/১৫৬/৫৬, ৯/২১৮/৭২৯৬, মুসতাদরাক হাকিম-৪/১৪৬, ১৪৭) নাসাঈ র অন্য হাদীসে রয়েছে যে, ঐ তিন ব্যক্তি অর্থাৎ প্রাগুক্ত তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সুনান নাসাঈ -৩/১৭৬/৪৯২১, আল মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ-৫/৭৪)

এই জন্যই এই আয়াতেও ইরশাদ হচ্ছেঃ

 

﴿ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰى ﴾ অনুগ্রহ প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-খায়রাত নষ্ট করো না। এ অনুগ্রহ প্রকাশ ও কষ্ট দেয়ার পাপ দানের সাওয়াব অবশিষ্ট রাখে না। অতঃপর অনুগ্রহ প্রকাশকারী ও কষ্ট প্রদানকারীর সাদাকাহ নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপমা ঐ সাদাকাহর সাথে দেয়া হয়েছে, যা মানুষকে দেখানোর জন্য দেয়া হয় এবং উদ্দেশ্য থাকে যে, মানুষ তাকে দানশীল উপাধিতে ভূষিত করবে এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। মহান আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তার মোটেই থাকে না এবং সে সাওয়াব লাভেরও আশা পোষণ করে না। এ জন্যই এই বাক্যের পর বলেনঃ

 

﴿فَمَثَلُه كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَیْهِ تُرَابٌ فَاَصَابَه وَابِلٌ فَتَرَكَه صَلْدًا﴾ যদি মহান আল্লাহ্‌র ওপর ও কিয়ামতের ওপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে ঐ লোক দেখানো দান, অনুগ্রহ প্রকাশ করার দান এবং কষ্ট দেয়ার দানের দৃষ্টান্ত এরূপ যেমন এক বৃহৎ মসৃণ প্রস্তর খণ্ড, যার ওপরে কিছু মাটিও জমে গেছে। অতঃপর প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সমস্ত পাথরটি ধুয়ে গেছে এবং কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই দু’ প্রকার ব্যক্তির দানের অবস্থাও তদ্রুপ। লোকে মনে করে যে, সে দানের সাওয়াব অবশ্যই পেয়ে যাবে। যেভাবে এই পাথরের মাটি দেখা যাচ্ছিলো, কিন্তু বৃষ্টিপাতের ফলে ঐ মাটি দূর হয়ে গেছে, তেমনই এই ব্যক্তির অনুগ্রহ প্রকাশ করা ও কষ্ট দেয়ার ফলে এবং ঐ ব্যক্তির রিয়াকারীর ফলে ঐ সব সাওয়াব বিদায় নিয়েছে। মহান আল্লাহ্‌র নিকট পৌঁছে তারা কোন প্রতিদান পাবে না। ﴿وَاللّٰهُلَایَهْدِیالْقَوْمَالْكٰفِرِیْنَ﴾ মহান আল্লাহ্‌ অবিশ্বাসী

সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না

 

 

[১] এ আয়াতে সদকা কবুল হওয়ার দু’টি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। (১) দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না এবং (২) গ্রহীতাকে ঘৃণিত মনে করা যাবে না। অর্থাৎ তার সাথে এমন কোন ব্যবহার করতে পারবে না, যাতে সে নিজেকে ঘৃণিত ও হেয় অনুভব করে কিংবা কষ্ট পায়।

 

[২] এ উপমায় প্রবল বর্ষণ বলতে দান-সদকাকে এবং পাথরখণ্ড বলতে যে নিয়্যত ও প্রেরণার গলদসহ দান-সদকা করা হয়েছে, তাকে বুঝানো হয়েছে। মাটির আস্তর বলতে সৎকর্মের বাইরের কাঠামোটি বুঝানো হয়েছে, যার নীচে লুকিয়ে আছে নিয়্যতের গলদ। এ বিশ্লেষণের পর দৃষ্টান্তটি সহজেই বোধগম্য হতে পারে। বৃষ্টিপাতের ফলে মাটি স্বাভাবিকভাবেই সরস ও সতেজ হয় এবং তাতে চারা জন্মায়। কিন্তু যে মাটিতে সরসতা সৃষ্টি হয় তার পরিমাণ যদি হয় নামমাত্র এবং তা কেবল উপরিভাগেই লেপ্টে থাকে আর তার তলায় থাকে মসৃণ পাথর, তাহলে বৃষ্টির পানি এক্ষেত্রে তার জন্য লাভবান হওয়ার পরিবর্তে বরং ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। অনুরূপভাবে দান-সদকা যদিও সৎকর্মকে বিকশিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু তা লাভজনক হবার জন্য সদুদ্দেশ্য, সৎসংকল্প ও সৎনিয়্যতের শর্ত আরোপিত হয়েছে। নিয়্যত সৎ না হলে যত অধিক পরিমাণেই দান করা হোক না কেন তা নিছক অর্থ ও সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

[৩] এখানে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ্ তা’আলা কৃতঘ্ন-কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন না। এর তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ্‌ তা’আলার হিদায়াত ও আয়াত সব মানুষের জন্যই প্রেরিত হয়েছে। কিন্তু কাফেররা এসবের প্রতি ভ্ৰক্ষেপ না করে বরং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এর পরিণতিতে আল্লাহ্‌ তা’আলা তাদেরকে তাওফীক তথা সৎকাজের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে দেন। ফলে তারা কোন হেদায়াত কবুল করতে পারে না।

 

[১] সাদাকা কবুল হওয়ার জন্য যেমন জরুরী হল যে, তা অনুগ্রহ প্রকাশ, কষ্ট দেওয়া এবং কপটতা থেকে পাক হতে হবে, (যেমন পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে) অনুরূপ এটাও জরুরী যে, তা হালাল ও পবিত্র উপার্জন থেকে হতে হবে। তাতে তা ব্যবসা-বাণ্যিজের মাধ্যমে হোক অথবা জমি ও বাগান থেকে উৎপন্ন ফসল ও ফলাদির মাধ্যমে হোক। আর “মন্দ জিনিস–” কথার প্রথম অর্থ হল, এমন জিনিস যা অবৈধ পথে উপার্জন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তা কবুল করেন না। হাদীসে এসেছে, “আল্লাহ পবিত্র। তাই তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই কবুল করেন।” এর দ্বিতীয় অর্থ হল, খারাপ ও অতি নিম্নমানের জিনিস। নষ্ট হয়ে যাওয়া খারাপ জিনিসও যেন আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করা হয়। আর {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} আয়াতের দাবীও তা-ই। এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, মদীনার কোন কোন আনসার সাহাবী খারাপ হয়ে যাওয়া নিম্নমানের খেজুরগুলো সাদাকা স্বরূপ মসজিদে দিয়ে যেতেন। যার ফলে এই আয়াত নাযিল হয়। (ফাতহুল ক্বাদীরঃ তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ ইত্যাদি)

 

[২] অর্থাৎ, যেমন তুমি নিজের জন্য নষ্ট হয়ে যাওয়া খারাপ জিনিস নিতে পছন্দ করো না, অনুরূপ আল্লাহর পথেও ভাল ছাড়া খারাপ জিনিস ব্যয় করো না।

 

قَوْلٌ مَّعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِّن صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَآ أَذًى ۗ وَاللَّهُ غَنِىٌّ حَلِيمٌ

 

যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয় তার চেয়ে ভাল কথা ও ক্ষমা উত্তম। আর আল্লাহ্‌ অভাবমুক্ত ও পরম সহনশীল।

 

হালাল উপার্জন থেকেই ব্যয় করতে হবে

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর মু’মিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন ব্যবসার মাল, যা মহান আল্লাহ্‌ তাদরেকে দান করেছেন এবং সোনা, রূপা, শস্য ইত্যাদি যা তাদেরকে ভূমি হতে বের করে দেয়া হয়েছে তা হতে উত্তম ও পছন্দনীয় জিনিস তাঁর পথে খরচ করে। তারা যেন পচা, গলা ও মন্দ জিনিস মহান আল্লাহ্‌র পথে না দেয়। মহান আল্লাহ্‌ অত্যন্ত পবিত্র, তিনি অপবিত্র জিনিস গ্রহণ করেন না। আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে লক্ষ্য করে বলেনঃ ﴿وَلَا تَیَمَّمُوا الْخَبِیْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ﴾ এমন জিনিস তোমরা মহান আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করো না, যা তোমাদেরকে দেয়া হলে তোমরাও তা গ্রহণ করতে সম্মত হতে না।’ সুতরাং তোমরা এরকম জিনিস কিরূপে মহান আল্লাহ্‌কে দিতে চাও? আর তিনি তা গ্রহণই বা করবেন কেন? তবে তোমরা যদি সম্পদ হাত ছাড়া হতে দেখে নিজের অধিকারের বিনিময়ে কোন পচা-গলা জিনিস বাধ্য হয়ে গ্রহণ করে নাও তাহলে অন্য কথা। কিন্তু মহান আল্লাহ্‌ তো তোমাদের মতো বাধ্য ও দুর্বল নন যে, তিনি এ সব জঘন্য জিনিস গ্রহণ করবেন? তিনি কোন অবস্থায়ই এইসব জিনিস গ্রহণ করেন না।

 

‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

 

إن اللَّهَ قَسَمَ بَيْنَكُمْ أَخْلَاقَكُمْ، كَمَا قَسَمَ بَيْنَكُمْ أَرْزَاقَكُمْ، وَإِنَّ اللَّهَ يُعْطِي الدُّنْيَا مَنْ يُحِبُّ وَمَنْ لَا يُحِبُّ، وَلَا يُعْطِي الدِّينَ إِلَّا لِمَنْ أحبَّ، فَمَنْ أَعْطَاهُ اللَّهُ الدِّينَ فَقَدْ أَحَبَّهُ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا يُسْلِمُ عَبْدٌّ حَتَّى يُسلِمَ قلبُه وَلِسَانُهُ، وَلَا يُؤْمِنُ حَتَّى يَأْمَنَ جارُه بَوَائِقَهُ”. قَالُوا: وَمَا بَوَائِقُهُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ؟. قَالَ: “غَشَمُه وَظُلْمُهُ، وَلَا يَكْسِبُ عَبْدٌ مَالًا مِنْ حَرَامٍ فينفقَ مِنْهُ فيباركَ لَهُ فِيهِ، وَلَا يتصدقُ بِهِ فَيُقْبَلَ مِنْهُ، وَلَا يَتْرُكُهُ خَلْفَ ظَهْرِهِ إِلَّا كَانَ زَادَهُ إِلَى النَّارِ، إِنَّ اللَّهَ لَا يَمْحُو السَّيِّئَ بِالسَّيِّئِ، وَلَكِنْ يَمْحُو السَّيِّئَ بِالْحَسَن�

 

 

 

মহান আল্লাহ্‌ যেমন তোমাদের মাঝে তোমাদের রিযিক বন্টন করে দিয়েছেন, তদ্রুপ তোমাদের চরিত্রও বন্টন করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্‌ দুনিয়া তাঁর বন্ধুদেরকেও দেন এবং শত্রুদেরকেও দেন। কিন্তু দ্বীন শুধু তার বন্ধুদেরকেই দান করেন। অতএব যে দ্বীন লাভ করে সেই মহান আল্লাহ্‌র প্রিয় পাত্র। ঐ আল্লাহ্‌র শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, কোন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে না যে পর্যন্ত না তার প্রতিবেশি তার থেকে নির্ভয় হয়। জনগণ প্রশ্ন করেন তার কষ্ট কি, হে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ? জনগণের প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন কষ্টের ভাবার্থ হচ্ছে প্রতারণা ও উৎপীড়ন। যে ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে, মহান আল্লাহ্‌ তাতে কল্যাণ দান করেন না এবং তার দান-সাদাকাহও গ্রহণ করেন না। যা সে রেখে যায় তার জন্য তা জাহান্নামে যাবার পাথেয় ও কারণ হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ্‌ মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিহত করেন না বরং মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করেন। কেননা অপবিত্র বস্তু কখনো অপবিত্রতা দূর করতে পারে না।’  (হাদীসটি য‘ঈফ। মুসনাদ আহমাদ -১/৩৮৭/৩৬৭২, আল মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ-১০/২২৮, ১/৫৩)

 

বারা’ ইবনু ‘আযিব (রাঃ) বর্ণনা করেন, খেজুরের মৌসুমে আনসারগণ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খেজুরের গুচ্ছ এনে মাসজিদে নাবাবীর দু’টি স্তম্ভের মধ্যে রজ্জুতে ঝুলিয়ে দিতেন। ঐগুলো আসহাব-ই সুফ্ফা ও দরিদ্র মুজাহিরগণ ক্ষুধার সময় খেয়ে নিতেন। সাদাকাহ করার প্রতি আগ্রহ কম ছিলো এরূপ একটি লোক তাতে খারাপ খেজুর এনে ঝুলিয়ে দেন। সেই সময় এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং তাতে বলা হয়, যদি তোমাদেরকে এরকমই জিনিস উপঢৌকন স্বরূপ দেয়া হয় তাহলে তোমরা তা কখনো গ্রহণ করতে না। অবশ্য মনে না চাইলেও লজ্জার খাতিরে তা গ্রহণ করে নাও সেটা অন্য কথা। এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই ভালো ভালো খেজুর নিয়ে আসতেন। (তাফসীর তাবারী -৫/৫৫৯)

 

ইবনু আবী হাতিম (রহঃ) -এর গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, মানুষ হালকা ধরনের খেজুর ও খারাপ ফল দানের জন্য বের করতো। ফলে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই রকম জিনিস দান করতে নিষেধ করেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাগফাল (রহঃ) বলেন যে, মু’মিনের উপার্জন কখনো জঘন্য হতে পারে না। ভাবার্থ এই যে তোমরা বাজে জিনিস দান করো না।

 

মুসনাদ আহমাদের হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট গো সাপের অর্থাৎ গুইসাপের গোশত আনা হলে তিনি নিজেও খেলেন না এবং কাউকে খেতে নিষেধও করলেন না। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেনঃ কোন মিসকীনকে দিবো কি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা নিজেরা যা খেতে চাও না তা অপকে খেতে দিয়ো না। বারা’ (রাঃ) বলেনঃ যখন তোমাদের কারো ওপর কোন দাবি থাকে এবং সে তোমাকে এমন জিনিস দেয় যা বাজে ও মূল্যহীন তবে তোমরা তা কখনো গ্রহণ করবে না, কিন্তু তোমাদের হক নষ্ট হতে দেখবে তখন তোমরা চক্ষু বন্ধ করে তা নিয়ে নিবে।

 

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘এর ভাবার্থ এই যে, তোমরা কাউকে উত্তম মাল ধার দিয়েছো, কিন্তু পরিশোধ করার সময় সে নিকৃষ্ট মাল নিয়ে আসবে, এরূপ অবস্থায় তোমরা কখনো ঐ মাল গ্রহণ করবে না। আর যদি গ্রহণ করো তাহলে মূল্য কমিয়ে দিয়ে তা গ্রহণ করবে। তাই যে জিনিস তোমরা নিজেদের হকের বিনিময়েই গ্রহণ করছো না, তা তোমরা মহান আল্লাহ্‌র হকের বিনিময়ে কেন দিবে? সুতরাং তোমরা উত্তম ও পছন্দনীয় ধন-সম্পদ মহান আল্লাহ্‌র পথে খরচ করো। এর অর্থই হচ্ছে নিম্নের আয়াতটিঃ  ﴿ لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ﴾

তোমরা যা ভালোবাসো তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না। (৩নং সূরাহ্ আলি ‘ইমরান, আয়াত নং ৯২)

 

অতঃপর মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ ﴿وَاعْلَمُوْۤااَنَّاللّٰهَغَنِیٌّحَمِیْدٌ﴾ মহান আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে তাঁর পথে উত্তম ও পছন্দনীয় ধন-সম্পদ খরচ করার নির্দেশ প্রদান করলেন, এজন্য তোমরা এই কথা মনে করো না যে, মহান আল্লাহ্‌ তোমাদের মুখাপেক্ষী। না, না তিনি তো সম্পূর্ণরূপে অভাবমুক্ত। তিনি কারো প্রত্যাশী নন বরং তোমরা সবাই তার মুখাপেক্ষী। তাঁর নির্দেশ শুধু এজন্যই যে, দরিদ্র লোকেরাও যেন দুনিয়ার নি‘য়ামতসমূহ হতে বঞ্চিত না থাকে। যেমন অন্য জায়গায় কুরবানীর হুকুমের পরে মহান আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ  ﴿ لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ ﴾

মহান আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছে না কুরবানীর পশুর গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। (২২নং সূরাহ্ হাজ্জ, আয়াত নং ৩৭) তিনি বিপুলদাতা। তাঁর ধনভাণ্ডারে কোন কিছুর স্বল্পতা নেই। হালাল ও পবিত্র মাল হতে সাদাকাহ বের করে মহান আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও মহাদানের প্রতি লক্ষ্য করো। এর বহুগুণ বৃদ্ধি করে তিনি তোমাদেরকে প্রতিদান দিবেন। তিনি দরিদ্রও নন, অত্যাচারীও নন। তিনি প্রশংসিত। সমস্ত কথায় ও কাজে তাঁরই প্রশংসা করা হয়। তিনি ছাড়া কেউ ‘ইবাদতের যোগ্য নয়। তিনি সারা জগতের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কেউ কারো পালনকর্তা নয়।

 

আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্ওয়া।”(সূরা হাজ্জ ২২:৩৭)

 

পরবর্তী আয়াতে শয়তানের কুমন্ত্রণার কথা বল হয়েছে। সৎ পথে ব্যয় করতে চাইলে শয়তান নিঃস্ব ও দরিদ্র হওয়ার ভয় দেখায়। পক্ষান্তরে অন্যায় অশ্লীল বেহায়াপনাপূর্ণ কাজে উৎসাহ দেয় এবং এমনভাবে চাকচিক্য করে তুলে ধরে যে, মানুষ তাতে ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

 

মহান আল্লাহ তা‘আলা তার ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন। যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে ফেরেশতা তাদের জন্য দু‘আ করে বলে, হে আল্লাহ! তোমার পথে যারা ব্যয় করে তুমি তাদের মাল আরো বৃদ্ধি করে দাও। আর যারা ব্যয় করে না তাদের মাল ধ্বংস করে দাও। (সহীহ বুখারী হা: ১৪৪২)

 

(وَمَنْ یُّؤْتَ الْحِکْمَةَ)

 

‘আর যাকে হিকমত দান করা হয়’হিকমাতের অর্থ কী তা অনেকে অনেক প্রকারে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন: কুরআন; কেউ বলেছেন, নাসেখ, মানসূখ, হালাল, হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান। কেউ বলেছেন, কুরআন ও তার বুঝ। কেউ বলেছেন, কথায় ও কাজে সঠিকতা। কেউ বলেছেন, শরীয়তের রহস্য জানা ও বুঝা এবং কুরআন ও সুন্নাহ হিফজ করা ইত্যাদি। তবে মূল কথা হলো হিকমাতের মধ্যে সবকিছু শামিল

 

।রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দু’ব্যক্তির সাথে ঈর্ষা করা বৈধ: ১. যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন। আর সে তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে। ২. যাকে আল্লাহ তা‘আলা হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন সে তা দ্বারা মানুষের মাঝে ফায়সালা করে এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী হা: ৭৩)

 

আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

 

১. নিয়্যত খালেস রেখে আল্লাহ তা‘আলার পথে কেবল হালাল ও উত্তম জিনিস দান করতে হবে। হারাম ও নষ্ট বস্তু দান করে নেকীর আশা করা যায় না।

২. নিজের জন্য যা পছন্দ করি না তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করলে কবুল হবে না।

৩. শয়তান সর্বদা মানুষকে খারাপ কাজে উৎসাহ দেয় আর দরিদ্রতার ভয় দেখায়।

৪. মানুষ যতই সম্পদশালী হোক সবচেয়ে বড় সম্পদ হল দীনের জ্ঞান, সকল সম্পদের ওপর জ্ঞানের মর্যাদা অনেক বেশি।

৫. আল্লাহ তা‘আলার ডাকে সাড়া দান ও প্রদর্শিত পথে আমল করা প্রশংসনীয় কাজ।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দু’ব্যক্তির সাথে ঈর্ষা করা বৈধ: ১. যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন। আর সে তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে। ২. যাকে আল্লাহ তা‘আলা হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন সে তা দ্বারা মানুষের মাঝে ফায়সালা করে এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী হা: ৭৩)

 

আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

 

১. নিয়্যত খালেস রেখে আল্লাহ তা‘আলার পথে কেবল হালাল ও উত্তম জিনিস দান করতে হবে। হারাম ও নষ্ট বস্তু দান করে নেকীর আশা করা যায় না।

২. নিজের জন্য যা পছন্দ করি না তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করলে কবুল হবে না।

৩. শয়তান সর্বদা মানুষকে খারাপ কাজে উৎসাহ দেয় আর দরিদ্রতার ভয় দেখায়।

৪. মানুষ যতই সম্পদশালী হোক সবচেয়ে বড় সম্পদ হল দীনের জ্ঞান, সকল সম্পদের ওপর জ্ঞানের মর্যাদা অনেক বেশি।

৫. আল্লাহ তা‘আলার ডাকে সাড়া দান ও প্রদর্শিত পথে আমল করা প্রশংসনীয় কাজ।

 

يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا أَنفِقُوا مِن طَيِّبٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّآ أَخْرَجْنَا لَكُم مِّنَ الْأَرْضِ ۖ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنفِقُونَ وَلَسْتُم بِـَٔاخِذِيهِ إِلَّآ أَن تُغْمِضُوا فِيهِ ۚ وَاعْلَمُوٓا أَنَّ اللَّهَ غَنِىٌّ حَمِيدٌ

 

হে মুমিনগণ!  তোমরা যা উপার্জন কর [১] এবং আমরা যা যমীন থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করি [২] তা থেকে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর; এবং নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করো না, যদি না তোমরা চোখ বন্ধ করে থাক। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।

 

২৬৭ থেকে ২৬৯ নং আয়াতের তাফসীর:

 

শানে নুযূল:

 

বারা বিন আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এ আয়াতটি আমাদের আনসারদের ব্যাপারে নাযিল হয়। আমরা ছিলাম খেজুরের মালিক। যার যেমন সাধ্য ছিল সে অনুযায়ী কম-বেশি দান করার জন্য নিয়ে আসত। কিছু মানুষ ছিল যাদের কল্যাণমূলক কাজে কোন উৎসাহ ছিল না। তাই তারা খারাপ ও নিম্নমানের খেজুর নিয়ে এসে মাসজিদে নাববীর খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে দিত। ফলে

 

(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا….. مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ)

 

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমি জমিন থেকে যা উৎপন্ন করি তার মধ্য হতে পবিত্র জিনিস দান কর’নাযিল হয়। (সহীহ, তিরমিযী হা: ২৯৮৭) এ আয়াতের শানে নুযুলের ব্যাপারে এছাড়া আরো বর্ণনা পাওয়া যায়। (লুবাবুন নুকূল, পৃঃ ৫৭)

 

দান-সদাকাহ আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হওয়ার জন্য যেমন শর্ত হল দান-সদাকাহ করার পর খোঁটা বা কষ্ট দেয়া যাবে না, তেমনি আরো দু’টি শর্ত রয়েছে: (১) হালাল ও পবিত্র উপার্জন হতে দান করতে হবে। হালাল উপার্জন ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে হতে পারে অথবা কায়িম শ্রম ও চাকুরীর মাধ্যমেও হতে পারে। সেদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন ‘তোমরা যা উপার্জন করেছ।’আবার জমি থেকে উৎপাদিত পবিত্র ফসল হতেও দান করা যাবে। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন ‘আমি জমিন থেকে যা উৎপন্ন করি তার মধ্য হতে’। হারাম পন্থায় উপার্জন করে দান-সদাকাহ করলে, হজ্জ করলে কোন উপকারে আসবে না।

 

(২) যে দান-সদাকাহ করবে তাকেও সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হতে হবে। কোন খারাপ নিয়তে কিংবা নাম-যশ অর্জনের উদ্দেশ্যে দান-সদাকাহ করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হবে না। এ ব্যক্তি ঐ অজ্ঞ কৃষক সদৃশ, যে বীজকে অনুর্বর মাটিতে বপন করে, ফলে তা নষ্ট হয়ে যায়।

 

(أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْأَرْضِ)

 

‘আমি জমিন থেকে যা উৎপন্ন করি’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা জমিন থেকে যা উৎপন্ন করেন যেমন: শস্য, গুপ্তধন ইত্যাদি।

 

শস্য, গুপ্তধন ইত্যাদি। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা সেচ ব্যতীত উর্বরতার ফলে উৎপন্ন ফসলের ওপর উশর (দশ ভাগের একভাগ) ওয়াজিব। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের ওপর অর্ধ উশর (বিশ ভাগের এক ভাগ) ওয়াজিব। (সহীহ বুখারী হা: ১৪৮৩)

 

الْخَبِيْثُ বা ‘মন্দ জিনিস’এর দু’টি অর্থ হতে পারে:

 

 

(১) এমন জিনিস যা অবৈধ পথে উপার্জন করা হয়েছে। তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

 

إِنَّ اللّٰهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا

 

আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া গ্রহণ করেন না।

 

(২) খারাপ ও অতি নিম্নমানের জিনিস যা তাকে দেয়া হলে সে নিজেও নেবে না। এমন নষ্ট খারাপ জিনিস যা নিজে পছন্দ করে না তা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করলে আল্লাহ তা‘আলাও গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 

:

 

(لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّي تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ﹽ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللّٰهَ بِهِ عَلِيمٌ)

 

“তোমরা নেকী পাবে না যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস আল্লাহর পথে খরচ কর। আর তোমরা যা কিছুই দান কর আল্লাহ তা জানেন।”(সূরা আলি-ইমরান ৩:৯২)

 

এসব খারাপ জিনিস তোমরাও তো চক্ষু বন্ধ না করে গ্রহণ করতে চাও না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

 

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّي يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ

 

তোমাদের কেউ ততক্ষণ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্য যা পছন্দ করো তা অপর ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করো। (সহীহ বুখারী হা: ১৩)

 

আল্লাহ তা‘আলা এসব দান-সদাকাহ থেকে অনেক বড়, অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলার এসব নির্দেশ শুধু পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 

(لَنْ يَنَالَ اللّٰهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَي مِنْكُمْ)

 

“আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্ওয়া।”(সূরা হাজ্জ ২২:৩৭)

 

পরবর্তী আয়াতে শয়তানের কুমন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে। সৎ পথে ব্যয় করতে চাইলে শয়তান নিঃস্ব ও দরিদ্র হওয়ার ভয় দেখায়। পক্ষান্তরে অন্যায় অশ্লীল বেহায়াপনাপূর্ণ কাজে উৎসাহ দেয় এবং এমনভাবে চাকচিক্য করে তুলে ধরে যে, মানুষ তাতে ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

 

মহান আল্লাহ তা‘আলা তার ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন। যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে ফেরেশতা তাদের জন্য দু‘আ করে বলে, হে আল্লাহ! তোমার পথে যারা ব্যয় করে তুমি তাদের মাল আরো বৃদ্ধি করে দাও। আর যারা ব্যয় করে না তাদের মাল ধ্বংস করে দাও। (সহীহ বুখারী হা: ১৪৪২)

 

(وَمَنْ یُّؤْتَ الْحِکْمَةَ)

 

‘আর যাকে হিকমত দান করা হয়’হিকমাতের অর্থ কী তা অনেকে অনেক প্রকারে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন: কুরআন; কেউ বলেছেন, নাসেখ, মানসূখ, হালাল, হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান। কেউ বলেছেন, কুরআন ও তার বুঝ। কেউ বলেছেন, কথায় ও কাজে সঠিকতা। কেউ বলেছেন, শরীয়তের রহস্য জানা ও বুঝা এবং কুরআন ও সুন্নাহ হিফজ করা ইত্যাদি। তবে মূল কথা হলো হিকমাতের মধ্যে সবকিছু শামিল।রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দু’ব্যক্তির সাথে ঈর্ষা করা বৈধ: ১. যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন। আর সে তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে। ২. যাকে আল্লাহ তা‘আলা হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন সে তা দ্বারা মানুষের মাঝে ফায়সালা করে এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী হা: ৭৩)

 

আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

 

১. নিয়্যত খালেস রেখে আল্লাহ তা‘আলার পথে কেবল হালাল ও উত্তম জিনিস দান করতে হবে। হারাম ও নষ্ট বস্তু দান করে নেকীর আশা করা যায় না।

২. নিজের জন্য যা পছন্দ করি না তা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করলে কবুল হবে না।

৩. শয়তান সর্বদা মানুষকে খারাপ কাজে উৎসাহ দেয় আর দরিদ্রতার ভয় দেখায়।

৪. মানুষ যতই সম্পদশালী হোক সবচেয়ে বড় সম্পদ হল দীনের জ্ঞান, সকল সম্পদের ওপর জ্ঞানের মর্যাদা অনেক বেশি।

৫. আল্লাহ তা‘আলার ডাকে সাড়া দান ও প্রদর্শিত পথে আমল করা প্রশংসনীয় কাজ।يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوٰلَ النَّاسِ بِالْبٰطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۗ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِى سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍহে ঈমানদারগণ! পণ্ডিত এবং সংসার-বিরাগীদের মধ্যে অনেকেই তো জনসাধারণের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায় এবং মানুষকে আল্লাহ্‌র পথ থেকে নিবৃত্ত করে [১]। আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করে না [২] আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন [৩]।

 

يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوٰلَ النَّاسِ بِالْبٰطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۗ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِى سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

 

হে ঈমানদারগণ! পণ্ডিত এবং সংসার-বিরাগীদের মধ্যে অনেকেই তো জনসাধারণের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায় এবং মানুষকে আল্লাহ্‌র পথ থেকে নিবৃত্ত করে [১]। আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করে না [২] আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন [৩]।

 

 

 

৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:

 

এখানে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী উম্মাত তথা ইয়াহূদ খ্রিস্টানদের আলিমদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তারা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ খেত আর আল্লাহ তা‘আলার সঠিক পথে চলতে মানুষকে বাধা দিত।

সুদ্দী (রাঃ) বলেন: ইয়াহূদী আলিমদের আহবার “أَحْبَارٌ”এবং খ্রিস্টান আবেদদেরকে রুহবান “رَهْبَانٌ” বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لَوْلَا يَنْهٰهُمُ الرَّبّٰنِيُّوْنَ وَالْأَحْبَارُ عَنْ قَوْلِهِمُ الْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ ط لَبِئْسَ مَا كَانُوْا يَصْنَعُوْنَ)

“কেন আল্লাহওয়ালাগণ ও আলেমগণ তাদেরকে খারাপ কথা বলতে ও অবৈধ ভক্ষণে নিষেধ করে না? এরা যা করে তা কতই না নিকৃষ্ট!” (সূরা মায়িদাহ ৫:৬৩)

মূলত আয়াতের উদ্দেশ্য হল- যে সকল দরবেশ, সূফী, পীর ও একশ্রেণির আলেম ধর্মের নামে ব্যবসা করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে তাদের থেকে সতর্ক করা।

ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের আহবার ও রুহবানগণ যেমন ধর্মের নামে অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ খেত আর মানুষকে নিজের মনগড়া তৈরিকৃত তরীকাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে, তেমনি আমাদের সমাজেও এরূপ ধর্ম ব্যবসায়ী একশ্রেণির আলেম ও পীর-বুজুর্গ রয়েছে যারা পেটপূজারী লম্বা আলখেল্লা পরিধান করে নিজেকে খুব আল্লাহওয়ালা প্রকাশ করত মিথ্যা কথা বলে মানুষের সম্পদ হরণ করে, ধর্মের নামে গুমরাহীর পথ দেখায়। তাদের চক্রান্ত থেকে সাবধান!

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তির কথা বলেছেন, যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যাকাত প্রদান করে না।

যায়েদ বিন ওয়াহ হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি একদা রাবাযা নামক স্থানে আবূ যার (রাঃ) এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি (তাকে) জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কেন এ ভূমিতে এসেছেন? তিনি বললেন: আমি সিরিয়ায় ছিলাম, তখন আমি (মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে) এ আয়াত পাঠ করে শোনালাম: “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং সেটা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ।

يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوٰلُكُمْ وَلَآ أَوْلٰدُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذٰلِكَ فَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْخٰسِرُونَ

হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ আর তোমাদের সন্তানাদি তোমাদেরকে যেন আল্লাহর স্মরণ হতে গাফিল করে না দেয়। যারা এমন করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

৯-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে বেশি বেশি তাঁর যিকির করার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং সম্পদ, সন্তান-সন্ততির ভালবাসায় যেন আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে না যায় সে সম্পর্কে সতর্ক করছেন আর মৃত্যুর পূর্বেই বেশি থেকে বেশি তাঁর আনুগত্যপূর্ণ কাজে ব্যয় করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করছেন।

(وَأَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ)

‘আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় কর’ এখানে ব্যয় এর মাঝে সকল প্রকার ব্যয় শামিল। যাকাত, কাফফারা, স্ত্রীদের ভরণ-পোষণ ও নফল সদকাহ ইত্যাদি। (তাফসীর সা‘দী) এ আয়াত আরো প্রমাণ করছে, যাকাতসহ সকল প্রকার ইবাদতের সময় হয়ে গেলে যথাসময়ে আদায় করে নিতে হবে বিলম্ব করা বৈধ নয়।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : জনৈক সাহাবী বললেন- হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কোন্ সদকায় সওয়াব বেশি পাওয়া যায়? তিনি বললেন : সুস্থ ও কৃপণ অবস্থায় তোমার সদকাহ করা যখন তুমি দরিদ্রতার আশংকা কর ও ধনী হওয়ার আশা রাখ। সদকাহ করতে এ পর্যন্ত দেরী করবে না যখন প্রাণ বায়ু কণ্ঠাগত হবে আর তুমি বলবে অমুকের জন্য এতটুকু অমুকের জন্য এতটুকু অথচ তা অমুকের জন্য হয়ে গেছে। (সহীহ বুখারী হা. ১৪১৯ মুসলিম হা. ১০৩২)

সুতরাং সময় থাকতে সম্পদের সৎব্যবহার করা উচিত। সারা জীবন আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করলাম না কিন্তু মুমূর্ষু অবস্থায় সব দান করে দিলাম এমন দান কবূল হবে না এবং কোন কাজে আসবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ফরয, ওয়াজিব ইত্যাদি ইবাদত নষ্ট করে সন্তান ও সম্পদ নিয়ে ব্যস্ত থাকা হারাম।

২. সুস্থ ও কৃপণ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করা উত্তম।

৩. মুমূর্ষু অবস্থায় ব্যয় করা অনর্থক।

৪. মৃত্যুর সময় হলে একটুও বিলম্ব করা হবে না।

One comment

Leave a Reply