أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১২৩/ এবং কাফের-রা বলে -১১) [ * বলবে, ‘এ এক পুরোনো মিথ্যা।’:- *ইহুদী আলেমের ইসলাম গ্রহণ :- *দ্বীন গ্রহনে গরীবরা এগিয়ে :-] www.motaher21.net সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬ ১-১২ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১২৩/ এবং কাফের-রা বলে -১১)
[ * বলবে, ‘এ এক পুরোনো মিথ্যা।’:-
*ইহুদী আলেমের ইসলাম গ্রহণ :-
*দ্বীন গ্রহনে গরীবরা এগিয়ে :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬
১-১২ নং আয়াত:-
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১
حٰمٓ ۚ﴿۱﴾
হা-মীম।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-২
تَنۡزِیۡلُ الۡکِتٰبِ مِنَ اللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ ﴿۲﴾
এই কিতাব মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৩
مَا خَلَقۡنَا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَاۤ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا عَمَّاۤ اُنۡذِرُوۡا مُعۡرِضُوۡنَ ﴿۳﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছুই আমি যথাযথভাবে নির্দিষ্টকালের জন্য সৃষ্টি করেছি; কিন্তু অবিশ্বাসীরা তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৪
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ مَّا تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَرُوۡنِیۡ مَاذَا خَلَقُوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ اَمۡ لَہُمۡ شِرۡکٌ فِی السَّمٰوٰتِ ؕ اِیۡتُوۡنِیۡ بِکِتٰبٍ مِّنۡ قَبۡلِ ہٰذَاۤ اَوۡ اَثٰرَۃٍ مِّنۡ عِلۡمٍ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۴﴾
বল, ‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক, তাদের কথা ভেবে দেখছ কি? তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আকাশমন্ডলীতে তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি? এর পূর্ববর্তী কোন কিতাবে অথবা পরম্পরাগত জ্ঞান থাকলে তা তোমরা আমার নিকট উপস্থিত কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৫
وَ مَنۡ اَضَلُّ مِمَّنۡ یَّدۡعُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَنۡ لَّا یَسۡتَجِیۡبُ لَہٗۤ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ وَ ہُمۡ عَنۡ دُعَآئِہِمۡ غٰفِلُوۡنَ ﴿۵﴾
আর সে ব্যাক্তির চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের আহ্বান সম্বদ্ধেও গাফেল।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৬
وَ اِذَا حُشِرَ النَّاسُ کَانُوۡا لَہُمۡ اَعۡدَآءً وَّ کَانُوۡا بِعِبَادَتِہِمۡ کٰفِرِیۡنَ ﴿۶﴾
যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে এবং তাদের উপাসনাকে অস্বীকার করবে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৭
وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُنَا بَیِّنٰتٍ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَہُمۡ ۙ ہٰذَا سِحۡرٌ مُّبِیۡنٌ ؕ﴿۷﴾
যখন এসব লোকদের আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ শুনানো হয় এবং সত্য তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করে তখন এই কাফেররা বলে এতো পরিষ্কার যাদু।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৮
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىہُ ؕ قُلۡ اِنِ افۡتَرَیۡتُہٗ فَلَا تَمۡلِکُوۡنَ لِیۡ مِنَ اللّٰہِ شَیۡئًا ؕ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَا تُفِیۡضُوۡنَ فِیۡہِ ؕ کَفٰی بِہٖ شَہِیۡدًۢا بَیۡنِیۡ وَ بَیۡنَکُمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۸﴾
তারা কি বলতে চায় যে রসূল নিজেই এসব রচনা করেছেন?৯ তাদের বলে দাওঃ “আমি নিজেই যদি তা রচনা করে থাকি তাহলে কোন কিছু আমাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করতে পারবে না। যেসব কথা তোমরা তৈরী করছো আল্লাহ তা ভাল করেই জানেন। আমার ও তোমাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তিনিই যথেষ্ট। তিনি অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-৯
قُلۡ مَا کُنۡتُ بِدۡعًا مِّنَ الرُّسُلِ وَ مَاۤ اَدۡرِیۡ مَا یُفۡعَلُ بِیۡ وَ لَا بِکُمۡ ؕ اِنۡ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی اِلَیَّ وَ مَاۤ اَنَا اِلَّا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۹﴾
বলুন, ‘রাসূলদের মধ্যে আমিই প্রথম নই। আর আমি জানি না, আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে; আমি আমার প্রতি যা ওহী করা হয় শুধু তারই অনুসরণ করি। আর আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্ৰ।’
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১০
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ کَانَ مِنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ وَ کَفَرۡتُمۡ بِہٖ وَ شَہِدَ شَاہِدٌ مِّنۡۢ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ عَلٰی مِثۡلِہٖ فَاٰمَنَ وَ اسۡتَکۡبَرۡتُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿٪۱۰﴾
বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি যে, যদি এ (কুরআন) আল্লাহর নিকট হতে (অবতীর্ণ) হয়ে থাকে, আর তোমরা এতে অবিশ্বাস কর, অথচ বানী ইস্রাঈলের একজন এর অনুরূপ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে এতে বিশ্বাস স্থাপন করল, আর তোমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, (তাহলে তোমাদের পরিণাম কী হবে?) নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১১
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَوۡ کَانَ خَیۡرًا مَّا سَبَقُوۡنَاۤ اِلَیۡہِ ؕ وَ اِذۡ لَمۡ یَہۡتَدُوۡا بِہٖ فَسَیَقُوۡلُوۡنَ ہٰذَاۤ اِفۡکٌ قَدِیۡمٌ ﴿۱۱﴾
আর যারা কুফরী করেছে তারা যারা ঈমান এনেছে তাদের সম্পর্কে বলে, ‘যদি এটা ভাল হত তবে তারা এর দিকে আমাদেরকে অতিক্রম করে যেতে পারত না । আর যখন তারা এটা দ্বারা হেদায়াত পায়নি তখন তারা অচিরেই বলবে, ‘এ এক পুরোনো মিথ্যা।’
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১২
وَ مِنۡ قَبۡلِہٖ کِتٰبُ مُوۡسٰۤی اِمَامًا وَّ رَحۡمَۃً ؕ وَ ہٰذَا کِتٰبٌ مُّصَدِّقٌ لِّسَانًا عَرَبِیًّا لِّیُنۡذِرَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ٭ۖ وَ بُشۡرٰی لِلۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿ۚ۱۲﴾
এর পূর্বে ছিল মূসার গ্রন্থ আদর্শ ও করুণাস্বরূপ। আর এই সমর্থক গ্রন্থ আরবী ভাষায়, যাতে এটা সীমালংঘনকারীদেরকে সতর্ক করে এবং তা সৎকর্মশীলদের জন্য সুসংবাদবাহক।

ফী জিলালিল কুরআন‌ বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : হিজরতের আগে অবতীর্ণ এই সুরাটিতে সামগ্রিকভাবে ঈমান ও আকীদার বিষয় আলােচিত হয়েছে, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয়, এই সমগ্র সৃষ্টি জগতে যতাে জীৰ ও জড় বিদ্যমান তাদের সকলের তিনি একমাত্র সর্বময় কর্তা, মালিক ও প্রভু প্রতিপালক, ওহী ও রিসালাত সত্য, হযরত মুহাম্মদ(সা.) একজন রসূল, তার পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়েছেন। হযরত মোহাম্মদের ওপর কোরআন নাযিল করা হয়েছে তার পূর্ববর্তী কিতাবগুলােকে সত্য প্রতিপন্নকারী হিসাবে। মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হওয়া অনিবার্য তার পরে পার্থিব জীবনে অর্জিত সকল কাজ ও উপার্জন এবং সকল ভালাে ও মন্দ আচরণের হিসাব ও প্রতিফল লাভ অকাট্য ও অবধারিত। এই মর্মে বিশ্বাস স্থাপনের আহবানই এ সূরার কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয়। এই প্রাথমিক আকীদা বিশ্বাসের ওপরই ইসলাম তার সমগ্র ইমারতের ভিত্তি গড়ে তােলে। এ কারণেই কোরআন তার প্রত্যেকটা মক্কী সূরায় এ বিষয়টাকে মৌলিক আলােচ্য বিষয়ে পরিণত করেছে। এমনকি মুসলিম জাতি ও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর মাদানী সূরাগুলােতে যখনই সে জীবন যাপনের কোনাে বিধিবিধান বা নির্দেশ জারী করতে চেয়েছে, তখনও সে এই ঈমান ও আর্কীদা বিষয়ক মূলনীতিসমূহের ওপর নির্ভর করেছে। কেননা এই দ্বীনের প্রকৃতিই এরূপ যে, তা আল্লাহর একত্ব, মুহাম্মদ(স.)-এর রিসালাত এবং আখেরাতের হিসাব নিকাশ ও কর্মফলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকে তার যাবতীয় নিয়ম বিধি আইন কানুন, রীতিনীতির ভিত্তি, তার সবচেয়ে মযবুত যােগসূত্র ও তার সফল প্রেরণা ও উদ্দীপনার উৎস গণ্য করে। আর এই ঈমানের শাশ্বত প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েই ইসলামের সকল আইন কানুন, রীতিনীতি ও বিধিবিধান চিরঞ্জীব, চিরউদ্দীপ্ত ও চির উষ্ণ থাকে। সূরা আল আহকাফ তার এই ঈমান বিষয়ক বক্তব্যকে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে সর্বতােভাবে মনােজ্ঞ ও হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেছে, তার তন্ত্রীতে আঘাত হেনেছে এবং সর্বপ্রকারের জাগতিক, মানসিক ও ঐতিহাসিক প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গনে তাকে তুলে ধরেছে। এমনকি এই ঈমান ও আকীদার বিষয়কে এ সূরা শুধু মানবজাতির নয়, বরং সমগ্র সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্যবস্তু রূপে গণ্য করে। এ কারণেই সে কোরআনের সাথে জিনদের সংশ্লিষ্টতার ঘটনার একটা দিকও বর্ণনা করে, যেমন বর্ণনা করে কোরআনের প্রতি বনী ইসরাঈলের কারাে কারাে আকৃষ্ট হওয়ার প্রসংগটিও। একইভাবে এ সূরায় সত্যের নীরব সাক্ষী প্রাকৃতিক জগতের সাক্ষ্য এবং বনী ইসরাঈলের এক (তাওরাত অভিজ্ঞ) ব্যক্তির সাক্ষ্যকেও সমান গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিশেষে এই সূরা মানব হৃদয়কে আকাশ ও পৃথিবীর বিশাল দিগন্তে ও পরকালের কেয়ামত নামক প্রান্তরে বিচরণ করায়। অনুরূপভাবে এটি তাদেরকে হুদ সম্প্রদায় এবং মক্কার চারপাশের বিধ্বস্ত জনপদগুলাের ধ্বংসলীলাও পরিদর্শন করায়। সেই সাথে আকাশ ও পৃথিবীকে সে কোরআনের মতােই একটা সত্যভাষী গ্রন্থ রূপে উপস্থাপন করে। সূরাটি এমন চারটি পর্বে বিভক্ত, যার প্রতিটি পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। পুরাে সূরাটা চারটা অংশে বিভক্ত হলেও মূলত একটা একক ও একীভূত সূরা। প্রথম পর্বের সাথে সাথেই সূরার সূচনা হয়েছে। পূর্ববর্তী ছ’টা সূরার মতােই এটিও আরবী বর্ণমালার অক্ষর ‘হা মীম দিয়ে আরম্ভ হয়েছে। আর এ দুটো অক্ষরের অব্যবহিত পরই মহান আল্লাহর পক্ষ হতে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের নাযিল হওয়ার কথা ঘােষিত হয়েছে। বলা হয়েছে, এই কিতাব নাযিল হয়েছে। মহাবিজ্ঞানী ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে। এর পরপরই মহাবিশ্বরূপী গ্রন্থের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা সুপরিকল্পিত ও সুপরিচালিত। ‘আমি আকাশ পৃথিবী ও উভয়ের মাঝে বিরাজমান সব কিছুকে কেবল সত্যের ভিত্তিতে ও নির্দিষ্ট সময়ের ‍জন্যেই সৃষ্টি করেছি। সুতরাং পঠিত কোরআনরূপী গ্রন্থ ও দৃশ্যমান জগতরূপী গ্রন্থ উভয়েই সত্যানুগ ও সুপরিকল্পিত হওয়ার দিক দিয়ে সমান। আল্লাহ তায়ালা এর পরই বলছেন, আর কাফেরদের যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই।’ এই সর্বাত্মক ও শক্তিশালী ভূমিকা দেয়ার পর আল্লাহ তায়ালা আকীদা সংক্রান্ত বিষয়ের আলােচনা শুরু করেছেন। শুরুতেই বলেছেন যে, তৎকালীন জাহেলী সমাজের মানুষ যে শিরকের অনুসারী ছিলাে, তা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলাে না, অপরদিকে তেমনি তার পেছনে কোন সঠিক তথ্য ও বিশ্বস্ত সনদও ছিলাে না, তুমি বলো, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর যেসব জিনিসের উপাসনা করে থাকো, সেগুলাে নিয়ে ভেবে দেখেছো কি? তারা পৃথিবীর কী কী জিনিস সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও তাে দেখি! না কি আকাশে তাদের কোনাে অংশদারিত্ব আছে?’ সেই সাথে যারা নিজেদের উপাসকদের ফরিয়াদ শুনতেই পায় না, গ্রহণ করা তাে দূরের কথা তাদের পূজারীদের ঘােরতর নির্বুদ্ধিতারও নিন্দা করা হয়েছে। সেসব অপদার্থ উপাস্যরা কেয়ামতের দিন তাদের উপাসকদের সাথে ঝগড়া করবে এবং সেই বিপদের দিনে তাদের কৃত উপাসনাকেই প্রত্যাখ্যান করবে। এরপর হযরত মােহাম্মদ(স.) তাদের কাছে যে সত্যের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন, তার সাথে তাদের অন্যায় ও অশােভন আচরণের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে, তারা তাকে প্রকাশ্য জাদু তাে বলেছেই উপরন্তু তাকে মােহাম্মদ(স.)-এর মনগড়া বাণী বলেও অপবাদ দিয়েছে। এই পর্যায়ে রসূল(স.)-কে শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে, তিনি যেন এর এমন দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন, তার নবুওত, আল্লাহভীতি এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার সার্বিক আল্লাহ নির্ভরতার সপক্ষে যুক্তি পেশ করেন এবং এসব বিদ্বান আহলে কিতাবের সাক্ষ্য দেয়ার পরও দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে যেন তাদের নিন্দা ও সমালােচনা করেন।(আয়াত ৮-১০) এরপর এই অব্যাহত প্রত্যাখ্যানের পক্ষে তারা যেসব খোড়া ওজুহাত পেশ করে থাকে, পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে তার স্বরূপ উন্মােচন অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখানে তাদের এই গোয়ার্তুমির আসল কারণ তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের প্রতি কোরআনের সমর্থন এবং এ কিতাবের প্রকৃত ভূমিকা ও লক্ষ্য কি সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষে যারা ঈমান এনেছে ও ঈমানের ওপর অবিচল থেকেছে, তাদের শুভ পরিণামের বিবরণ দিয়ে প্রথম পর্বের সমাপ্তি টানা হয়েছে। (আয়াত ১১-১৪) দ্বিতীয় পর্বে মানবীয় স্বভাব প্রকৃতির দুটো নমুনা তুলে ধরা হয়েছে, একটা সুস্থ অপরটা বিকৃত। আকিদা বিষয়ক বিতর্কের ক্ষেত্রে এই দুটো নমুনাই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। উভয় নমুনার বিবরণ দেয়া শুরু করা হয়েছে উডয়ের প্রথম উন্মেষকাল থেকেই, অর্থাৎ যখন তারা আপন আপন মা বাবার কোলে অবস্থান করে তখন থেকেই। তারপর তাদের বয়ােপ্রাপ্তি ও বিচার বিবেচনার ক্ষমতা প্রাপ্তিকাল পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ড পর্যালােচনা করা হয়েছে। প্রথম নমুনার মানুষ আল্লাহর নেয়ামতের ব্যাপারে সচেতন, মা বাবার প্রতি সদাচারী, কৃতজ্ঞ, তাওবাকারী অনুগত ও আত্মসমর্পণকারী।(আয়াত ১৫) এই শ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারাই হচ্ছে সেসব লােক, যাদের সর্বোত্তম কাজগুলাে আমি গ্রহণ করি।(আয়াত ১৬) অপর নমুনাটা হলাে মা ও বাবার অবাধ্য হওয়া। সে আল্লাহর অবাধ্য এবং সে আখেরাতকেও অস্বীকার করে। এই শ্রেণীর মানুষের প্রতি তার মা ও বাবা বিরক্ত অসন্তুষ্ট থাকে। এই শ্রেণীটা সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, এরাই হচ্ছে সেইসব লােক, যাদের ওপর আল্লাহর উক্তি সত্য প্রমাণিত হয়েছে…… তারা ক্ষতিগ্রস্ত। এই শ্রেণীর লােকদের ভয়াবহ পরিণতি সম্বলিত একটা ত্বরিত দৃশ্য দেখিয়ে এই পর্বটার ইতি টানা হয়েছে। সে দৃশ্যটা হলাে, ‘যেদিন কাফেরদেরকে আগুনের সামনে হাযির করা হবে। বলা হবে, তােমরা তাে তােমাদের সমস্ত উত্তম উপকরণগুলাে পার্থিব জীবনেই শেষ ও উপভােগ করে এসেছো। তাই আজ তো তােমরা শুধু অপমানজনক আযাবই ভােগ করবে…।(আয়াত ২০) তৃতীয় পর্বে আদ জাতির ধ্বংসলীলা দেখানাে হয়েছে। তাদের সতর্ককারী নবীকে প্রত্যাখ্যান করেই তাদেরকে ধ্বংস হতে হয়েছিলাে। এই কাহিনীর কেবল একটা অংশই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তাদের কাছে পানিবিহীন বাতাস ও মেঘ ভেসে আসছিলাে। তারা তা থেকে জীবন ও বৃষ্টির প্রত্যাশা করছিলাে। অথচ তা তাদের কাছে নিয়ে এসেছিলাে সর্বাত্মক ধ্বংস ও তাদের ঈপ্সিত আযাব।(আয়াত ২৪-২৫) এই ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা আরবের কাফেরদেরকে বুঝাতে চেয়েছেন যে, আদ জাতি এদের চেয়েও অনেক বেশী শক্তিশালী ও বিত্তশালী ছিলাে, তথাপি তারা আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে পারেনি।(আয়াত ২৬) এ পর্বের শেষ ভাগে মক্কার পার্শ্ববর্তী জনপদগুলাের আযাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, তাদের তথাকথিত দেবদেবীর তাদের সাহায্যে অক্ষম হওয়া এবং তাদের মিথ্যাচারের মুখােশ উন্মােচিত হওয়ার বৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়েছে। কেননা এ দ্বারা আরবের বর্তমান মােশরেকরা সচেতন হবে ও হেদায়াত লাভ করবে বলে আশা করা যায় । চতুর্থ পর্বে রয়েছে একদল জিনের কোরআনের সংস্পর্শে আসার কাহিনী। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কোরআন শুনতে রসূল(স.)-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। তারা সেখানে গিয়ে কোরআন শুনে এতােই অভিভূত হলাে যে, কোরআনকে সত্য বলে বিশ্বাস করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর থাকলাে না। তারা বলতে বাধ্য হলাে যে, এ কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবকে সত্য বলে, সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করে। এরপর তার স্বজাতির লােকদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকেও সতর্ক করে ও ঈমানের দাওয়াত দেয়। তারা বলে, হে আমাদের জনগণ, আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি দাওয়াত দিচ্ছেন তার কথা শােনাে ও তার প্রতি ঈমান আনাে।(আয়াত ৩১, ৩২) এই জ্বিন দলটি তাদের স্বজাতির লােকদের কাছে গিয়ে যে বক্তৃতা দিয়েছে, তা ৩১-৩৩ নং আয়াত জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। ৩৩ নং আয়াতে প্রকৃতির উন্মুক্ত গ্রন্থের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা প্রথম সৃষ্টি ও পুনসৃষ্টি উভয় কাজেই আল্লাহর ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে। এই পর্যায়ে কাফেরদেরকে দোযখের সামনে উপস্থাপনের দৃশ্যটা দেখিয়ে মক্কার কাফেরদের মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে। তখন দোযখ সামনে দেখে তারা স্বীকার করবে যে, দোযখ সত্য। অথচ দুনিয়ায় থাকাকালে তারা তা স্বীকার করতাে না, কিন্তু সেদিন দোযখকে স্বচক্ষে দেখে সত্য বলে স্বীকার করায় কোনাে লাভ হবে না। সূরার শেষ আয়াতটিতে রসূল(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন ধৈর্যধারণ করেন ও কাফেরদেরকে আযাব দেয়ার জন্যে তাড়াহুড়ো না করেন। কারণ তাদের তো একটা ক্ষুদ্র মেয়াদ পর্যন্তই অবকাশ দেয়া হয়েছে। এ মেয়াদটুকু শেষ হওয়া মাত্রই তারা আযাব ও ধ্বংসের শিকার হবে। বলা হয়েছে, দৃঢ় প্রতিষ্ঠ ও সাহসী নবীরা যেরূপ ধৈর্যধারণ করেছে, তুমিও তদ্রুপ ধৈর্যধারণ করাে।(আয়াত ৩৫) এবার এই চারটি পর্বের আয়াতগুলাের বিস্তারিত তাফসীর নিয়ে আলােচনা পেশ করছি।

** ‘হা মীম, এ কিতাব মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। আমি আকাশ, পৃথিবী ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী যা কিছুই সৃষ্টি করেছি, একমাত্র সত্যের ভিত্তিতে ও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যেই সৃষ্টি করেছি। কিন্তু কাফেরদেরকে যে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে, তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ সূরার শুরুর দুটো অক্ষর হচ্ছে প্রথম সুরেলা সুললিত আবেদন । এটা আসলে আরবদের ভাষায় ব্যবহৃত আরবী বর্ণমালার সাথে এই বর্ণমালা দিয়ে লেখা এই কিতাবের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ইংগিত দেয়। এ ধরনের প্রতীকী উচ্চারণ বা বাকধারা মানবীয় ভাষায় সম্পূর্ণ অভিনব ও নযীরবিহীন। এই নযীরবিহীন বাকধারার ব্যবহার মূলত এই সাক্ষ্য বহন করে যে, এ কিতাব কোনাে মানুষের রচনা নয় বরং মহাবিজ্ঞ ও মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া বাণী। অনুরূপভাবে এ দ্বারা এ কথাও বুঝানাে হচ্ছে যে, আল্লাহর রচিত ও তাঁর কাছ থেকে নাযিল করা এই গ্রন্থ এবং আল্লাহর সৃজিত দৃশ্যমান ও হৃদয় দ্বারা উপলব্ধ এই মহাবিশ্বরূপী গ্রন্থখানি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য ওতপ্রােতভাবে জড়িত। উভয় গ্রন্থ আগাগােড়া সত্যের ওপর ও বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এদিকে মহাপ্রাজ্ঞ ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ হতে এ কিতাব এর অবতরণ সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা নিপুণতম ব্যবস্থাপনা ও বিচক্ষণতম প্রজ্ঞা দক্ষতা ও কর্মকুশলতার পরিচায়ক। অপরদিকে আকাশ পৃথিবী ও তার মাঝখানে বিরাজমান যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টিও সর্বাধিক নিখুঁত নির্ভুল ও সঠিক কাজ। শুধু তাই নয়, এটা অত্যন্ত সুখ, নিপুণ ও ভারসাম্যপূর্ণ কাজ। নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অর্থাৎ আল্লাহর সৃজনকুশলতা ও তার মহৎ উদ্দেশ্য যাতে সফল ও কার্যকর হয় সে জন্যে এ মহাবিশ্ব একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বহাল থাকবে।  *কোরআন ও সৃষ্টিজগত : আল্লাহর এই উভয় গ্রন্থ অর্থাৎ কোরআন ও সৃষ্টিজগত উন্মুক্ত ও প্রকাশ্য । দুটোই দেখা যায় ও শােনা যায়। দুটোই আল্লাহর অসীম ক্ষমতা, নিপুণ কর্মকুশলতা ও প্রজ্ঞা, তার সুদক্ষ শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং সুষম পরিকল্পনার জাজ্জল্যমান প্রমাণ। বিশ্বপ্রকৃতিরূপী গ্রন্থখানি কোরআনরূপী গ্রন্থের সত্যতার সাক্ষ্য দেয় এবং তাতে যে হুঁশিয়ারী ও সুসংবাদ রয়েছে তার যথার্থতা প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসংগে বলেন, যারা কুফরী করেছে, তারা যেসব বিষয়ে তাদের সতর্ক করা হয়েছে, সে ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এখানে আল্লাহর নাযিল করা গ্রন্থ কোরআন ও দৃশ্যমান গ্রন্থ বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি ইংগিত করে উভয় গ্রন্থের শিক্ষা ও হুশিয়ারীর প্রতি কাফেরদের অবজ্ঞা ও অবহেলায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। মানুষের কাছে নাযিল করা এই পঠিত গ্রন্থ আল কোরআন বলে, আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয়, তিনি বিশ্বজগতের প্রতিটি জিনিসের মনিব ও প্রভু। কেননা তিনি প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা, প্রতিটি জিনিসের শাসক ও পরিচালক এবং প্রতিটি জিনিসের পরিকল্পক, নিয়ন্তা ও ভাগ্যবিধাতা। ওদিকে বিশ্বপ্রকৃতির এই জীবন্ত এই একই সত্যের সাক্ষ্য দেয়। এর সুষ্ঠু পরিচালনা, নিখুঁত সমন্বয় এবং পারস্পরিক সাজুয্য ও সংহতি সাক্ষ্য দেয় যে, এর সৃষ্টিকর্তা, শাসক, পরিচালক ও ভাগ্য বিধাতা এক ও একক, তিনি নিজের পরিপূর্ণ ও পরিপক্ক জ্ঞানের আলােকেই এ বিশ্বপ্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন। কেননা তিনি যা কিছুই সৃষ্টি করেন, সেইসব কিছুর স্বভাবপ্রকৃতি একই রকম। তাহলে মানুষ কোন যুক্তিতে একাধিক সত্ত্বাকে মনিব ও মাবুদরূপে বরণ করে তাদের এসব কথিত মাবুদ কী কী জিনিস সৃষ্টি করেছে। এই যে বিশ্বজগত আমাদের চোখের সামনে ও বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এর সৃষ্টিতে তাদের কী অবদান আছে। এ বিশাল সৃষ্টিজগতের কোন্ কোন্ সৃষ্টিকে তারা সৃষ্টি করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা এ প্রশ্নটাই তুলে ধরেছেন ৪ নং আয়াতে, ‘তুমি বলাে, তােমরা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া যাদের পূজা করে থাকে, তাদের বিষয়ে ভেবে দেখেছাে কি? আমাকে দেখাও তাে, তারা পৃথিবীতে কোন বস্তুটি সৃষ্টি করেছে অথবা আকাশ সৃষ্টিতে কি তাদের কোনাে অবদান আছে? যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।’ আল্লাহ তায়ালা এখানে তাঁর রসূল(স.)-কে একথাই শিক্ষা দিচ্ছেন, যেন তিনি তার জাতির সামনে বিশ্বপ্রকৃতির উন্মুক্ত গ্রন্থখানির সাক্ষ্য তুলে ধরেন। কেননা এটা এমন এক গ্রন্থ, যার সাক্ষ্য কোনাে বিতর্কের অবকাশ রাখে না কিংবা কোনাে ভুল ব্যাখ্যার সুযােগ কাউকে দেয় না। এ গ্রন্থ প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক যুক্তি দিয়েই মানুষের সহজাত বােধশক্তিকে সম্বােধন করে। কারণ সে সহজাত বােধ শক্তির সাথে এ বিশ্বপ্রকৃতিরূপী গ্রন্থের এক নিজস্ব, সূক্ষ্ম ও গােপন সংযােগ রয়েছে, যাকে কেউ ধামাচাপা দিতে পারে না কিংবা প্রতারিত করতে পারে না। ‘আমাকে দেখাও তাে, তারা পৃথিবীর কোন জিনিসটি সৃষ্টি করেছে?’ কোনাে মানুষ কম্মিনকালেও এ কথা দাবী করতে পারবে না যে, আল্লাহ তায়লা ছাড়া যেসব গাছ, পাথর, জ্বিন, ফেরেশতা বা অন্য যা কিছুরই পূজা করা হয় তা পৃথিবীর কোন বস্তুকে সৃষ্টি করেছে কিংবা পৃথিবীতে কোন বস্তুর উদ্ভব ঘটিয়েছে। প্রকৃতির যুক্তি এমনিই অখন্ডনীয় ও অকাট্য বাস্তব যুক্তি। যে কোনাে অবাস্তব ও অযৌক্তিক দাবীর সামনে তা চিৎকার করে তার অসারতা প্রমাণ করে দেয়। ‘অথবা আকাশ সৃষ্টিতে কি তাদের কোনাে অবদান আছে?’ বস্তুত একথাও সত্য যে, কোনাে মানুষ কস্মিনকালেও এমন দাবী করতে পারে না যে, আকাশ মন্ডলের সৃষ্টিতে বা তার মালিকানায় এবং তার কর্তৃত্ব ও আধিপত্যে সেসব কল্পিত উপাস্যের কোনাে হাত বা অংশীদারী বা অবদান আছে। আকাশমন্ডলীর প্রতি একটা নজর বুলালেই অন্তরে সৃষ্টিকর্তার অকল্পনীয় ক্ষমতা ও অভাবনীয় মাহাত্ম এবং তার একত্বের চেতনা ও বিশ্বাস গভীরভাবে বদ্ধমূল হয়ে যায়, আর মন থেকে উধাও হয়ে যায় যাবতীয় বিকৃতি ও বিপথগামিতা। যে আল্লাহ তায়ালা এই কোরআনকে নাযিল করেছেন, তিনি ভালাে করেই জানেন বিশ্বপ্রকৃতিকে অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করলে মানুষের অন্তরে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তাই তিনি মহাবিশ্বরূপী বইটির দিকে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করেন, যাতে তারা মহাবিশ্বকে অবলােকন ও পর্যবেক্ষণ করে তা থেকে যথােচিত শিক্ষা গ্রহণ করে। এরপর আল্লাহ তায়ালা মানব মনে বিভিন্ন সময়ে যেসব বিকৃতি ও গােমরাহীর প্রাদুর্ভাব ঘটে, সেগুলােকে দূর করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এসব বিকৃতি ও গোমরাহীর কারণে মানুষের মন নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবী দাওয়া বা মতামতের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা এসব ধ্যান ধারণার অসারতা তুলে ধরেছেন এবং তার কোনাে যুক্তি প্রমাণ থাকলে তা প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। সেই সাথে সঠিক যুক্তি প্রমাণ প্রদর্শনের পদ্ধতিও শিক্ষা দিয়েছেন এবং পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মূল্যায়নের নির্ভুল পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘তোমরা আমার কাছে পূর্ববর্তী কোনাে পুস্তক অথবা তার সুত্র ধরে আসা ধারাবাহিক কোনাে জ্ঞান নিয়ে এসাে, যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।’ অর্থাৎ হয় আল্লাহর কোনাে সত্য পুস্তক নিয়ে এসাে, নচেত অন্য কোনাে নির্ভুল ও প্রামাণ্য জ্ঞান নিয়ে এসাে। কোরআনের পূর্বেকার কোনাে ঐশী পুস্তকই এমন নেই, যা মহান বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্বপালনকর্তা আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য না দেয়। আর এমন কোনাে ঐশী গ্রন্থও কখনাে নাযিল হয়নি, যা একাধিক উপাস্যের ধারণাকে সমর্থন করে, অথবা বলে যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে তাদের কোনাে অংশ বা অবদান আছে। বস্তুত এমন কোনাে নির্ভুল ও নির্ভরযােগ্য জ্ঞান কোথাও নেই, যা অমন উদ্ভট ধ্যান ধারণাকে সমর্থন করে। এভাবেই কোরআন মানব জাতির কাছে বাস্তবমুখী সাক্ষ্য তুলে ধরে। এই সাক্ষ্য অকাট্য ও অখন্ডনীয়। কুরআন মানব জাতিকে বিনা প্রমাণে কোনাে কিছু বলতে বা দাবী করতে নিষেধ করে এবং তর্ক করার বিশুদ্ধ পন্থা শিখিয়ে দেয় একটিমাত্র আয়াতে। এ আয়াতটি শব্দের সংখ্যা তেমন বেশী নয়, কিন্তু এর মর্ম অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, এর সুর ও ঝংকার অত্যন্ত তেজোদ্দীপ্ত ও ক্ষুরধার এবং এর যুক্তিপ্রমাণ অকাট্য ও অখন্ডনীয়।
**   *আল্লাহর বদলে অন্যদের ডাকা : এরপর পরবর্তী আয়াতে এইসব কল্পিত উপাস্যদের অসারতা তুলে ধরা হয়েছে এবং তাদের উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করার মতাে চরম বিকৃত ও বিভ্রান্তির নিন্দা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এসব কল্পিত মাবুদেরা তাদের উপাসকদের ডাকে সাড়া দেয়া তাে দূরে থাকো, তাদের আহবান ও ফরিয়াদ তারা টেরও পায় না এবং কিয়ামতের দিনও তারা তাদের সাথে ঝগড়া করবে ও তাদের পূজার দাবীকে প্রত্যাখ্যান করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহকে বাদ দিয়ে যারা এমন উপাস্যদের উপাসন করে, যারা কিয়ামত পর্যন্তও তাদের আহবানে সাড়া দেবে না… তাদের চেয়ে বিপথগামী আর কে আছে?(আয়াত-৫) আরবের মূর্তিপূজারীদের কেউবা খােদ মূর্তিগুলােকেই উপাস্য মনে করতাে, কেউবা ওগুলােকে ফেরেশতাদের প্রতি মূর্তি মনে করতাে। আবার কেউবা গাছপালার কেউবা ফেরেশতাদের প্রত্যক্ষভাবে অথবা শয়তানের পূজা করতাে। অথচ এ সবের কেউই তাদের পূজারীদের প্রার্থনায় সাড়া দিতে সমর্থ ছিল না, কেউ সাড়া দিতে পারলেও তাতে কোনাে লাভ হতাে না। পাথর ও গাছপালাতে সাড়া দিতেই পারে না। ফেরেশতারা মােশরেকদের ডাকে সাড়া দেয় না, আর শয়তানে সাড়া দিতে পারতাে কেবল কু-প্ররােচনা ও বিভ্রান্তকরনের মাধ্যমে। কেয়ামতের দিন যখন সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর সামনে সমবেত করা হবে, তখন এই সমস্ত কল্পিত উপাস্যদের সকলেই তাদের বিপথগামী পূজারীদের পূজা প্রত্যাখ্যান করবে, তাদের সাথে তাদের সকল সম্পর্ক অস্বীকার করবে, এমনকি সূরা ইবরাহীমে বলা হয়েছে যে, শয়তানও তা অস্বীকার করবে। আল্লাহতায়ালা সূরা ইবরাহীমে বলেন কেয়ামতের বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর শয়তান বলবে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সাথে যা ওয়াদা করেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, আর আমি যা কিছুই তােমাদের সাথে ওয়াদা করতাম, তা ভঙ্গ করতাম। তােমাদের ওপর তাে আমার কোনাে জরবদন্তি ছিলাে না। আমি তাে কেবল তােমাদের আহ্বান করতাম, আর তােমরা তা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করতে। সুতরাং তােমরা আমাকে তিরস্কার করাে না, নিজেদেরকে তিরস্কার করে। আজ আমিও তােমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবাে না, তোমরাও পারবে না আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তােমরা যে ইতিপূর্বে আমাকে আল্লাহর সাথে শরীক করেছিলে, তা আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। অপরাধীদের জন্যে আজ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। এভাবেই কোরআন মােশরেকদের সামনে তাদের মিথ্যাদাবীর মুখােশ খুলে দেয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার ব্যর্থতা ও অসারতা দেখিয়ে দেয়। ইতিপূর্বে সে তাদের সামনে প্রাকৃতিক জগতের সেই মহাসত্যকে তুলে ধরে, যা তাদের কুফরী ও শিরকীকে বাতিল বলে ঘােষণা করে ও প্রত্যাখ্যান করে। সে আল্লাহর একটা এমন এক শাশ্বত মহাসত্য বলে আখ্যায়িত করে যার সম্পর্কে মহাবিশ্বরূপী গ্রন্থ একই কথা বলে। সে বলে, একত্ববাদ স্বয়ং মােশরেকদের পার্থিব কল্যাণের জন্যেও অপরিহার্য, আর দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের শিরক ও কুফরী কি ফলাফল বয়ে আনবে সে দিকে লক্ষ্য রাখার অপরিহার্যতা সম্পর্কেও তাদের হুশিয়ারী করা হয়েছে। এখানে কোরআন মোশরেকদের উপাস্য সেসব অচেতন ও প্রাণহীন প্রতিমূর্তিগুলারই নিন্দা সমালােচনা করেছে এগুলো কুরআন নাযিল হবার সময় জনগণের কাছে ঐতিহাসিক উপাস্য হিসাবে পরিচিত ছিলো। কিন্তু এ আয়াতের ভাষা সেই ঐতিহাসিক প্রথাসিদ্ধ মূর্তিপূজার চেয়ে অনেক ব্যাপক অর্থবােধক। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে কোনাে যুগের এবং যে কোনাে স্থানেরই হােক না কেন পূজারী ও প্রার্থনাকারীদের ডাকে সাড়া দিতে পারে না এমন বস্তু, প্রাণী বা ব্যক্তির যারা পূজা বা আনুগত্য বা গােলামী করে। তাদের চেয়ে বেকুফ, নির্বোধ ও বিপথগামী আর কে আছে? মানুষের ডাকে সাড়া দেয়া, তার ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা তাে শুধুমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালাই রাখেন। বস্তুত শিরক শুধুমাত্র প্রাচীন পৌত্তলিকদের সাদামাটা মূর্তিপূজাতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এমন বহু মােশরেক রয়েছে, যারা আল্লাহর এবাদাতের সাথে সাথে ক্ষমতাশালী, প্রতাপশালী অথবা বিত্তশালীদের গােলামী ও আনুগত্য করে থাকে এবং তাদের কাছে অনেক কিছু প্রার্থনা করে থাকে। এভাবে তাদের আল্লাহর সাথে শরীক করে। অথচ তারা তাদের কাছে প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা যথাযথভাবে মঞ্জুর করার কোনাে ক্ষমতাই রাখে না। এমনকি তারা নিজেদেরও লাভ লােকসান করতে অক্ষম। তাদের কাছে কোনাে জিনিস চাওয়া শিরক। তাদের কাছে কোনাে কিছু আশা করাও শিরক। তাদেরকে ভয় করাও শিরক। তবে এই শিরক অপ্রকাশ্য হওয়ার কারণে অনেকেই এ ধরনের শিরকে অবচেতন ভাবে লিপ্ত হয়ে থাকে।
**”মানুষের আনুগত্য ও শিরক : এরপর ৭ নং আয়াত থেকে রসূল(স.) ও তাঁর দাওয়াতের সাথে মােশরেকদের ভূমিকা ও আচরণ নিয়ে আলােচনা অব্যাহত রয়েছে। তাদের চলমান অবস্থা ও মােশরেকসুলভ আকীদা বিশ্বাসের অসারতা প্রমাণ করার পর এক্ষণে ওহী ও তাওহীদ বিশ্বাস নিয়ে আলােচনা শুরু হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট আয়াতগুলাে পাঠ করা হয়, তখন কাফেররা তাদের কাছে সত্য সমাগত হওয়ার পরও বলে, এতাে প্রকাশ্য জাদু।’(আয়াত ৭-১২) এ আয়াতগুলাের শুরুতেই ওহী নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। এই ওহী সম্পর্কে তারা যে আজেবাজে মন্তব্য করতাে ও বিরক্তি প্রকাশ করতাে, তার নিন্দার মাধ্যমে এ আলােচনার সূচনা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া এই ওহী তাে হচ্ছে এমন সব বাণী, যার ভেতরে কোনাে অস্পষ্টতা বা সন্দেহ সংশয় নেই। এ হচ্ছে অকাট্য ও সন্দেহাতীত সত্য। অথচ একেই কিনা তারা বলে জাদু! কোথায় সত্য বাণী আর কোথায় জাদু! এ দুটোর মাঝে তাে আকাশ পাতালের ব্যবধান। এ দুটোর মধ্যে না আছে কোনাে মিল, না আছে কোনাে সাদৃশ্য।
** তাদের এ অন্যায় মন্তব্য ও নিকৃষ্ট বক্তব্যের কোনাে ভিত্তি নেই এবং এর পেছনে যুক্তিপ্রমাণের লেশমাত্রও নেই। তাই এই জঘন্য মন্তব্য ও বক্তব্যের ওপর কঠোর আক্রমণ দিয়েই এ আলােচনার সূত্রপাত করা হয়েছে। তারপর পরবর্তী আয়াতে (৮ নং আয়াত) এ আক্রমণকে আরাে জোরদার তাদের আরেকটা বক্তব্য খন্ডন করা হয়েছে, তবে কি তারা বলছে, মােহাম্মদ নিজেই এগুলাে রচনা করেছে। তাদের এই অপবাদটাকে এ আয়াতে জিজ্ঞাসাবােধক বাক্যের আওতায় আনা হয়েছে। এ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, এ ধরনের কথা বলা একেবারেই অসংগত ও অন্যায়। আসলে তাদের ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা এতো বেড়ে গিয়েছে যে, তারা এমন কথাও বলতে পারছে যা কল্পনায়ও আসে না।  *মােশরেকদের কথার প্রতিউত্তর : আয়াতের শেষাংশে রসূল(স.)-কে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, তিনি যেন নবীসুলভ সৌজন্য ও শালীনতা রক্ষা করেই এর জবাব দেন। কেননা তিনি যখন তার প্রতিপালক সম্পর্কে সচেতন, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, এই মহাবিশ্বের প্রকৃত শক্তি কার হাতে এবং প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা কার, সে সম্পর্কে অবহিত, তখন সেই চেতনা থেকেই তাে তার সৌজন্যবােধ ও শালীনতাবােধ উৎসারিত। কাজেই তিনি কিভাবে সৌজন্য, শালীনতা ও গাম্ভীর্য থেকে মুক্ত হতে পারেন? ‘তুমি বলাে, আমি যদি নিজেই এ বাণী রচনা করে থাকি, তাহলে তাে তােমরা আমাকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারাে না। তােমরা এ ব্যাপারে যা কিছু বলছাে, তা আল্লাহ তায়ালা ভালােভাবেই জানেন। এ সম্পর্কে আমার ও তােমাদের মাঝে সাক্ষী হিসাবে তিনিই যথেষ্ট। তিনি ক্ষমাশীল, দয়াশীল।’ অর্থাৎ তুমি তাদেরকে বলাে, আমি কিভাবে এটা রচনা করতে পারি? কার ওপর নির্ভর করে রচনা করবাে। কী উদ্দেশ্যে রচনা করবাে? তােমরা যাতে আমার ওপর ঈমান আনো ও আমার অনুসারী হও, সেই উদ্দেশ্যে? কিন্তু আমি যদি এটা রচনা করতাম, তাহলে তো তােমরা আমাকে এর ভয়াবহ পরিণাম থেকে রক্ষা করতে পারতে না। তিনি তাে আমাকে আমার মনগড়া বাণী প্রচারের জন্যে শাস্তি দিতেন। তাহলে তােমরা আমার সাথে থাকলে ও আমার অনুসারী হলে আমার কী লাভ হতাে? আল্লাহ তায়ালা যদি আমার মনগড়া কথা বার্তা প্রচার করার দায়ে আমাকে শান্তি দিতেন, তাহলে সে শাস্তি থেকে রক্ষার বা আমাকে সাহায্য করার ক্ষমতাই তাে তােমাদের নেই। বস্তুত একজন নবীর পক্ষে এটাই যথােচিত জবাব। এ জবাব তিনি তাঁর সেই প্রতিপালকের কাছ থেকেই লাভ করেন। যাকে ছাড়া তিনি বিশ্ব চরাচরে আর কাউকে দেখতে পান না এবং যার শক্তি ছাড়া আর কারাে কোনাে শক্তি আছে বলে তার জানা নেই, রসূল(স.)-এর শ্রোতা সেই মােশরেকরা যদি তাদের বিবেককে কাজে লাগাতাে, তাহলে তারা বুঝতাে যে, এটাই যুক্তিসঙ্গত জবাব। এই জবাব দিয়ে তিনি তাদের বিষয়টাকে আল্লাহর হাতে সােপর্দ করছেন এই বলে, ‘তােমরা যা বলছাে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ভালােভাবেই অবগত আছেন।’ অর্থাৎ তােমাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ সবই আল্লাহ তায়ালা জানেন এবং নিজের জানা মােতাবেক তােমাদেরকে কর্মফল দেবেন। আমার ও তােমাদের মাঝে সাক্ষী হিসাবে তিনিই যথেস্ট।’ অর্থাৎ সাক্ষী ও ফায়সালাকারী উভয় হিসাবেই যথেষ্ট। তিনি ক্ষমাশীল দয়াশীল।’ তিনি তােমাদের প্রতি কৃপা দেখিয়ে তােমাদেরকে সুপথে চালিত করতে পারেন এবং হেদায়াত লাভ ও ঈমান আনয়নের পূর্বের কৃত আমাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করতে পারেন। এ জবাবে যেমন হুশিয়ারী ও সতর্কবাণী রয়েছে, তেমনি রয়েছে উদ্বুদ্ধকরণ ও উৎসাহিত করনের বাণীও। মানবহৃদয়ের গভীরে এবং তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে এ বাণী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। শ্রোতাদের বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেভাবে হাসি তামাশা ও উপহাস বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে জিনিসটাকে হালকা করে দেখছে, আসলে তা মােটেই ততােটা হালকা নয়। বরং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মহান দাওয়াত দাতা রসূল(স.)-এর বিচার বিবেচনায় তা এতােটা বিরাট ও শুরুতর, তারা তা অনুভব করতে পারে না।
** *রাসূলের মর্যাদা : ‘আমি কোনাে নতুন বা অভূতপূর্ব রাসূল নই।’ এরপর পুনরায় অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে ওহীর সত্যতা প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, সে দৃষ্টিকোণটা হচ্ছে বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টিকোণ। বলা হচ্ছে যে, তারা মােহাম্মদ(স.)-এর ওহী ও রেসালাতের কোন জিনিসটা অস্বীকার করবে? কেনইবা তারা তার ওপর জাদুমন্ত্র বা মনগড়া বক্তব্য প্রচারের মিথ্যা অপবাদ আরােপ করছে? অথচ তাঁর ওহী ও রেসালাত তাে নতুন বা অভিনব কিছু নয়। ‘তুমি বলাে আমি তো নতুন বা অভূতপূর্ব কোনাে রাসূল হয়ে আসিনি।… আমি তাে সুস্পষ্ট সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নই।’ বস্তুত তিনি প্রথম রসূল নন। তার আগেও বহু রসূল এসেছেন। তার ব্যাপারটা তাদের মতােই। তিনি কোনাে অভিনব রসূল নন। তিনি একজন মানুষ। আল্লাহ তায়ালা জানতেন যে, তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি রসূল হিসাবে দায়িত্ব পালনের যােগ্যতা রাখেন। তাই তিনি তার কাছে ওহী পাঠালেন। আর তিনিও কোন রাখ ঢাক না রেখে আল্লাহ তায়ালা যা কিছু প্রকাশ ও প্রচার করার আদেশ দিয়েছেন, তা খােলাখুলি ও স্পষ্ট ভাষায় প্রচার করেছেন। এই হলাে রেসালাতের প্রকৃতি ও মূল কথা। যিনিই রসূল হিসাবে নিযুক্ত হন মহান আল্লাহর সাথে তার আন্তরাত্মার এতাে গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে যে, তিনি তাঁর কাছে কোনাে প্রমাণ চান না। নিজের জন্যে তিনি কোনাে বিশেষ পদমর্যাদাও আল্লাহর কাছ থেকে কামনা করেন না। তিনি তো তার পথেই এগিয়ে চলেন। তিনি তার প্রতিপালকের বার্তা ও বাণী প্রচার করেন ঠিক যেভাবে তার কাছে ওহী যােগে পাঠানাে হয়েছে সেইভাবে। ‘আমি জানিনা আমার সাথেই কী আচরণ করা হবে, আর তােমাদের সাথেই বা কী আচরণ করা হবে। আমি তাে কেবল আমার কাছে যে ওহী আসে, তাই অনুসরণ করি।’ তিনি কোনাে অদৃশ্য বা গায়েবী তত্ত্ব জানেন কিংবা তার নিজের, তার জাতির ও তার রেসালাতের দশা ও পরিণতি কী হবে, তা জানেন বলে যে তিনি রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন তা নয়। বরঞ্চ তিনি আল্লাহর নির্দেশমতাে কাজ করেন, তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাজ করেন এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ করে ও তার আদেশের পূর্ণ অনুগত থেকে প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে যেদিকে নিয়ে যান, সেই দিকেই তার পা চলে। গায়েব বা অদৃশ্য তার সম্পূর্ণ অজানা। তার গােপন রহস্য কেবল আল্লাহই জানেন। তিনি কোনাে গােপন তথ্য জানতে কৌতুহলী হন না। কেননা তার অন্তর নিশ্চিন্ত ও সন্তুষ্ট। মহান আল্লাহর প্রতি তার অগাধ ভক্তি ও আদব তাকে যা জানানাে হয়নি তা জানার জন্যে কৌতুহলী হতে নিষেধ করে। তাই তিনি সব সময় তার নিজ দায়িত্বসীমার মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। একথাই বলা হয়েছে এভাবে, আর আমি তাে একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নই।। বস্তুত যারা মহান আল্লাহর প্রতি ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর প্রকৃত পরিচয় অবহিত, এটা তাদেরই রীতি। এর মধ্য দিয়ে তারা রসূল(স.)-এর কাছ থেকে সান্ত্বনা পান। তাই তারা আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত চালিয়ে যান নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায়। এর পরিণাম কী, ভবিষ্যত.কী তা তারা জানেন না। এর ভবিষ্যতের ওপর তাদের বিন্দুমাত্র কোনাে নিয়ন্ত্রণও নেই। তারা শুধু এতােটুকুই জানে এবং জানাকে যথেষ্ট মনে করে যে, এটা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নবী রসূলরা এর জন্য আল্লাহর কাছ থেকে কোনাে প্রমাণও চান না। কেননা তাদের প্রমাণ তাদের অন্তরে রয়েছে। তারা তাদের জন্যে কোনাে বিশেষ মর্যাদাও চান না। কেননা তাদের বিশেষ মর্যাদা হিসাবে এটাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে রাসূল হিসাবে মনােনীত করেছেন। রাসূল(স.) নিজস্ব গন্ডীর মধ্যে থেকে কাজ করে যেতে যেতে এক সময় আহলে কিতাবের মধ্য থেকে সাক্ষী পেয়ে যান। কেননা ওহী ও রেসালাতের প্রকৃতি ও স্বরূপ তাদের কাছে সুপরিচিত।
**   *ইহুদী আলেমের ইসলাম গ্রহণ : ‘তুমি বলাে, তােমরা কি ভেবে দেখেছাে, এ ওহী যদি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসে থাকে, আর তােমরা তা অস্বীকার করাে বনী ইসরাঈলের একজন সাক্ষ্য দিয়ে এর সত্যতা প্রতিপন্ন করে, তারপর সে নিজে ঈমান আনে, কিন্তু তােমরা অহংকার করাে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা যালেমদেরকে হেদায়াত করেন না।’ এখানে একটা বাস্তব ঘটনার দিকে ইংগিত করা হয়ে থাকতে পারে এবং এ ধরনের একাধিক সাক্ষী আহলে কিতাবের মধ্য থেকে ছিলাে যারা জানতাে যে, এই কোরআন অবিকল আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া অন্যসব কিতাবের মতােই। কেননা তারা তাওরাতের প্রকৃতি ও স্বরূপ জানতাে। তাই ঈমান এনেছিলাে। একাধিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এ আয়াত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ছালাম সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। অবশ্য এ বর্ণনা এজন্যে বেখাপ্পা লাগে যে, এ সূরাটা মক্কী সূরা এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ছালাম ইলসাম গ্রহণ করেছিলেন মদীনায়। কোনাে কোনাে বর্ণনায় বলা হয় যে, সূরা মক্কী হলেও এ আয়াতটা মাদানী। এভাবে আয়াত হযরত আব্দুল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয়। অন্য বর্ণনায় বলা হয় যে, আয়াতটা মক্কী এবং এটা হযরত আব্দুল্লাহ সম্পর্কে নাযিল হয়নি। এমন হওয়াও বিচিত্র নয় যে, এ আয়াত মক্কারই অন্য একটা ঘটনার দিকে ইংগিত দিচ্ছে। ঘটনাটা হলাে, মক্কী যুগেই কিছু আহলে কিতাব ঈমান এনেছিলাে যদিও তাদের সংখ্যা খুবই অল্প। আহলে কিতাব হয়ে তাদের ঈমান আনা অজ্ঞ মােশরেকদের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলাে। এ কারণে কোরআন একাধিক জায়গায় এ ঘটনার উল্লেখ করে। মােশরেকরা ওহী ও কিতাব সম্পর্কে অজ্ঞ হলেও ওহীকে অস্বীকার করার যে অন্যায় ঔদ্ধত্য দেখাতাে, এ ঘটনার উল্লেখ করে তার প্রতিবাদ করা হয়। ‘বলাে, তােমরা কি ভেবে দেখেছাে, এ ওহী যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে।’ এই উক্তির মধ্য দিয়ে বিতর্কের যে পদ্ধতিটা অবলম্বন করা হয়েছে, তা আসলে মক্কাবাসীর অব্যাহত গোয়ার্তুমি ও হঠকারীতাকে দূর করার উদ্দেশ্যে অবলম্বন করা হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে রসূল(স.)-এর দাওয়াতকে ক্রমাগত অগ্রাহা করতে থাকার ব্যাপারে তাদের মনে এই মর্মে ভয়ভীতি ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব জাগিয়ে তােলা হয়েছে যে, এ ওহী মােহাম্মদ(স.)-এর বর্ণনা অনুসারে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেও তাে থাকতে পারে। আর যদি সত্যই তাই হয়ে থাকে, তাহলে এই অগ্রাহা করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। সুতরাং এই বিপদজনক পরিণতি এড়াতে তাদের সতর্ক হওয়াই ভালাে। যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি যে আযাবের ভয় দেখান, তা তাদের ওপর নেমে আসবেই। সুতরাং প্রত্যাখ্যান ও অগ্রাহ্য করার নীতিটা অব্যাহত রাখা তাদের ঠিক হচ্ছে কিনা, তা আর একবার ভেবে দেখা উচিত। সেই ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হবার আগে তাদের ভেবে দেখা উচিত অশুভ পরিণাম থেকে বাঁচার উপায় কী এবং শুভ পরিণাম লাভ করার উপায় কী। বিশেষত যখন আহলে কিতাবের এক বা একাধিক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছে যে, কোরআনের স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং তার পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থের স্বরূপ ও প্রকৃতি একইরকম আর যখন আহলে কিতাবের কেউ না কেউ এই উপলব্ধির ভিত্তিতে ঈমানও এনেছে। অথচ এখন যাদের কাছে কোরআন এলাে তাদেরই মাতৃভাষায় রচিত হয়ে, তারা কিনা তার প্রতি কুফরী করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। এটা সুস্পষ্ট যুলুম এবং সত্যের প্রকাশ্য লংঘন। এ কুফরী আল্লাহর গযব ডেকে আনতে পারে এবং যাবতীয় সৎকাজকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। আল্লাহ তায়ালা যালেমদেরকে সুপথ দেখান না। মানুষের মন থেকে যাবতীয় সন্দেহ সংশয় ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্যে ও তার সংশােধনের নিমিত্তে কোরআন বিবিধ পন্থা অবলম্বন করেছে। কোরআনের অনুসৃত এসব রকমারি পস্থা ও পদ্ধতিতে ইসলামের দাওয়াত দাতাদের জন্যে যথেষ্ট কার্যকর ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কোরআন যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব, সে ব্যাপারে কোনাে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও এখানে প্রত্যয়ী পদ্ধতির পরিবর্তে সন্দেহ সৃষ্টিকারী পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে, তা আমি আগেই বলেছি, ক্ষেত্র বিশেষে এটা একটা হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতি বটে।
**   *দ্বীন গ্রহনে গরীবরা এগিয়ে : এরপর পুনরায় কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে মােশরেকদের কিছু কিছু উক্তির সমালােচনা করা হয়েছে। এখানে তাদের যে উক্তির সমালােচনা করা হয়েছে, তাতে তারা তাদের কোরআন প্রত্যাখ্যানের পক্ষে একটা খোড়া ওজুহাত দাড় করানাের চেষ্টা করেছে। আসলে এর মাধ্যমে তারা মুসলমানদের ওপর তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশেরই চেষ্টা করেছে। কাফেররা বলে, কোরআন যদি ভালাে হতাে তাহলে মুসলমানরা আমাদের আগে এর দিকে এগিয়ে যেত না…। কার্যত দেখা গেল, শুরুতে একদল দরিদ্র ও দস শ্রেণীর মানুষই সমাজের অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়ে আগে আগে ইসলাম গ্রহণ করে বসলাে। সমাজের ধনি শ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর লােকদের চোখে এটা বিরক্তিকর ঠেকলাে। তারা বলতে লাগলাে, এই নতুন ধর্ম যদি ভালাে হতাে, তাহলে ওরা এ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশী জানতাে না এবং আমাদের আগে তা গ্রহণ করতো। যেহেতু আমরা অভিজাত ও উচ্চতর মর্যাদাশালী, আমাদের বুদ্ধিজ্ঞান ওদের চেয়ে বেশী, আমাদের মূল্যায়ন ও বিচার বিবেচনাও অপেক্ষাকৃত ভালাে ও সঠিক, সেহেতু আমরাই ওদের চেয়ে বেশী জানি কোনটা ভালাে ও কোনটা মন্দ । আসলে কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম নয়। তারা কোনাে সন্দেহ সংশয়ের কারণে নয়, কিংবা কোনটা সত্য ও কিসে কল্যাণ তা না জানার কারণেও নয়, বরং নিজেদেরকে মােহাম্মদ(স.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের চেয়ে অনেক উর্ধে মনে-করার কারণে এবং সমাজের শীর্ষস্থানীয় পদগুলাের দখল এ অর্থনৈতিক সুবিধাগুলাে হারানাের ভয়েই তারা ইসলাম গ্রহণে বিমুখ ছিলাে। তাছাড়া বাপদাদার নামে ও বাপদাদার ধর্মের, নামে তারা, যে গর্ব করতাে, সেটাও ছিলাে তাদের এই একগুয়েমির একটা অনাতম কারণ। পক্ষান্তরে যারা সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের অন্তরে সেসব বাধারিঘ্ন ছিলাে না, যা অভিজাতদেরকে ইসলাম গ্রহণে বিরত রেখেছিলাে। আসলে, আত্মম্ভরিতা ও সেচ্ছাচারিতাই অভিজাত আরবদের ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেয়নি। এই আত্মম্ভরিতা ও অহংকারই তাদেরকে একগুয়েমি, হঠকারিতা ও প্রত্যাখ্যানে প্ররােচিত করতাে। নানা রকমের অজুহাত সৃষ্টি করতো ও হকপন্থীদের বিরুদ্ধে বাতিলপন্থীদেরকে উঙ্কে দিতো। তারা কখনাে স্বীকার করতে না যে, তারা ভুল করতে পারে। তারা নিজেদেরকে কেন্দ্র করে একটা বৃত্ত গড়ে তুলতাে এই বৃত্তের চারপাশেই, জীবন কেন্দ্রীভূত থাকুক, এটা আশা করতো। ‘আর যখন তারা এ কুরআন দ্বারা হেদায়াত লাভ করতো না, তখন বলতাে, এতো পুরানাে যুগের আজগুবি কাহিনী। বটেই তাে তারা যখন সত্যের অনুসারী হতে পারছে না তখন সত্যের ভেতরেই নিশ্চয়ই কোনাে ক্রুটি বা খুঁত রয়েছে! তাদের পক্ষে তাে আর ভুল করা সম্ভব নয়। নিজেদের চোখে তারা একেবারেই নিষ্পাপ ও নির্ভুল।
**   *কোরআন ও তাওরাত : ওহী ও রিসালাত সংক্রান্ত পর্বটার সমাপ্তি টানা হচ্ছে হযরত মূসার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের উল্লেখ এবং এই কোরআন কর্তৃক সেই কিতাবের প্রতি সমর্থন বাক্ত করার মধ্য দিয়ে। যেমন ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলের একজন কর্তৃক কোরআনের পক্ষে সাক্ষ্য দানের উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে মূসার কিতাব এসেছিলাে পথনির্দেশক ও করুণাস্বরূপ আব এই কিতাব আরবী আষায়, সে কিতাবের সমর্থনে করুণা হয়ে এসেছে, যা অপরাধীদের কে সতর্ক করে ও সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দেয়। কোরআন ও তার পূর্বেকার, নাযিল হওয়া কিতাব গুলোর বিশেষত, হযরত মুসার ওপর নাযিল, হওয়া কিতাব এর মধ্যকার সম্পর্কের কথা কোরআন বরাবরই উল্লেখ-করে থাকে।হয়রত ঈসার ওপর নাযিল হওয়া কিতাব আসলে তাওরাতেই পরিপূরক ও ধরাবাহিকতা। তাওরাতেই রয়েছে মূল আকীদা বিশ্বাস ও আইন কানুন। এ জন্যেই হযরত মূসার কিতাবকে ইমাম বা পথ নির্দেশক, বলা হয়েছে এবং রহমাত বা করুণা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত প্রত্যেক রাসূলের রেসালাতই পৃথিবী ও পৃথিরীবাসীর জন্যে করুণা ও আশীর্বাদস্বরূপ দুনিয়া ও আখেরাতের সকল অর্থেই তা করুণা। আর এটা সত্যায়নকারী ও সমর্থক, যার ওপর সকল নবীর আল-শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত, আল্লাহ তায়ালার সেই মূল বিধানের সমর্থক, যার অনুসরণ করেন সকল নবী এবং সেই কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ও গন্তব্য সমার্থক যার দিকে সমগ্র মানবজাতিকে এগিয়ে যেতে হবে আর প্রতিপালকের সান্নিধ্যে উপনীত হবার উদ্দেশ্যে। কোরআন যে আরবী ভাষায় রচিত সে কথাটা বলার উদ্দেশ্য কেবল আরবদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, আল্লাহ-অয়ালা, তোমাদের ওপর এই বাড়তি অনুগ্রহটাও করেছেন এই অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছেন এবং এই বিশেষ সম্মানেও ভূষিত করেছেন যে, শেষ নবীর মিশনটা সফল করার জন্য তিনি তাদেরকে মনোনীত করেছেন এবং তাঁদের মাতৃভাষাকেই এই মহাগ্রন্থ কোরআনের ভাষা বানিয়েছে আয়াতের শেষাংশে রেসালাতের প্রকৃতি ও তার ভূমিকা বর্ণনা, করা হচ্ছে, যাতে এ কিতাব অপরাধীদেরকে সতর্ক করে দেয় এবং সংকর্মশীলদের দেয়-সুসংবাদ।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৪৬-আহক্বাফ) : নামকরণ:

২১ নম্বর আয়াতের إِذْ أَنْذَرَ قَوْمَهُ بِالْأَحْقَافِ বাক্যাংশ থেকে নাম গৃহীত হয়েছে।

(৪৬-আহক্বাফ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এ সূরা নাযিল হওয়ার সময়-কাল ২৯ থেকে ৩২ আয়াতে বর্ণিত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে নিরূপিত হয়ে যায়। এ আয়াতগুলোতে রসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে জিনদের ইসলাম গ্রহণ করে ফিরে যাওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ অনুসারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সময় তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে আসার পথে নাখলা নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করেছিলেন সেই সময় ঘটনাটি ঘটেছিলো। সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা অণুসারে হিজরতের তিন বছর পূর্বে নবী (সা.) তায়েফ গমন করেছিলেন। সুতরাং এ সূরা যে নবুয়াতের ১০ম বছরে শেষ দিকে অথবা ১১ শ বছরের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছিলো তা নিরূপিত হয়ে যায়।

(৪৬-আহক্বাফ) : ঐতিহাসিক পটভূমি :

নবীর (সা.) পবিত্র জীবনে নবওয়াতের ১০ম বছর ছিল অত্যন্ত কঠিন বছর। তিন বছর ধরে কুরাইশদের সবগুলো গোত্র মিলে বনী হাশেম এবং মুসলমানদের পুরোপুরি বয়কট করে রেখেছিলো। নবী (সা.) তাঁর খান্দানের লোকজন ও মুসলমানদের সাথে শে’বে আবি তালিব * মহল্লায় অবরুদ্ধ হয়ে ছিলেন। কুরাইশদের লোকজন এই মহল্লাটিকে সব দিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো। এ অবরোধ ডিঙিয়ে কোনো প্রকার রসদ ভেতরে যেতে পারতো না। শুধু হজ্বের মওসুমে এই অবরুদ্ধ লোকগুলো বের হয়ে কিছু কেনাকাটা করতে পারতো। কিন্তু আবু লাহাব যখনই তাদের মধ্যে কাউকে বাজারের দিকে বা কোন বাণিজ্য কাফেলার দিকে যেতে দেখতো চিৎকার করে বণিকদের বলতো, ‘এরা যে জিনিস কিনতে চাইবে তার মূল্য এত অধিক চাইবে যেন এরা খরিদ করতে না পারে। আমি ঐ জিনিস তোমাদের নিকট থেকে কিনে নেব এবং তোমাদের লোকসান হতে দেব না। একাধারে তিন বছরের এই বয়কট মুসলমান ও বনী হাশেমদের কোমর ভেঙে দিয়েছিলো। তাদেরকে এমন সব কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছিলো যখন কোন কোন সময় ঘাস এবং গাছের পাত খাওয়ার মত পরিস্থিতি এসে যেতো। * শে’বে আবি তালিব মক্কার একটি মহল্লার নাম। এখানে বনী হাশেম গোত্রের লোকজন বসবাস করতেন। আরবী ভাষায় شعب শব্দের অর্থ উপত্যকা বা পাহাড়ের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র বাস যোগ্য ভূমি। মহল্লাটি যেহেতু ‘আবু কুরাইস ’ পাহাড়ের একটি উপত্যকায় অবস্থিত ছিল এবং আবু তালিব ছিলেন বনী হাশেমদের নেতা। তাই এটিকে শে’বে আবি তালিব বলা হতো। পবিত্র মক্কার যে স্থানটি বর্তমানে স্থানীয়দের বর্ণনানুসারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম স্থান হিসেবে পরিচিত তার সন্নিকটেই এই উপত্যকা অবস্থিত ছিল। বর্তমানে একে শে’বে আলী বা শে’বে বনী হাশেম বলা হয়ে থাকে।

অনেক কষ্টের পর এ বছরই সবেমাত্র এই অবরোধ ভেঙ্গেছিলো। নবী (সা.) চাচা আবু তালিব, যিনি দশ বছর ধরে তাঁর জন্য ঢাল স্বরূপ ছিলেন ঠিক এই সময় ইন্তেকাল করেন। এই দুর্ঘটনার পর এক মাস যেতে না যেতেই তাঁর জীবন সঙ্গিনী হযরত খাদীজাও ইন্তেকাল করেন যিনি নবুয়াত জীবনের শুরু থেকে ঐ সময় পর্যন্ত নবীর (সা.) জন্য প্রশান্তি ও সান্ত্বনার কারণ হয়ে ছিলেন। একের পর এক এসব দু:খ কষ্ট আসার কারণে নবী (সা.) এ বছরটিকে (عَامُ الْحَزن) “আমুল হুযন” বা দু:খ বেদনার বছর বলে উল্লেখ করতেন।

হযরত খাদীজা ও আবু তালিবের মৃত্যুর পর মক্কার কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে আরো অধিক সাহসী হয়ে উঠলো এবং তাঁকে আগের চেয়ে বেশী উত্যক্ত করতে শুরু করলো। এমন কি তাঁর জন্য বাড়ীর বাইরে বের হওয়াও কঠিন হয়ে উঠলো। ইবনে হিশাম সেই সময়ের একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, একদিন কুরাইশদের এক বখাটে লোক জনসমক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথায় ধূলা নিক্ষেপ করে।

অবশেষে তিনি তায়েফে গমন করলেন। উদ্দেশ্য সেখানে বনী সাকীফ গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেবেন। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে অন্তত এ মর্মে তাদের সম্মত করাবেন যেন তাঁকে তাদের কাছে শান্তিতে থেকে তারা ইসলামের কাজ করার সুযোগ দেবে। সেই সময় তাঁর কাছে কোন সওয়ারীর জন্তু পর্যন্ত ছিল না। মক্কা থেকে তায়েফ পর্যন্ত গোটা পথ তিনি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করলেন। কোন কোন বর্ণনা অনুসারে তিনি একাই তায়েফ গিয়েছিলেন এবং কোন কোন বর্ণনা অনুসারে শুধু যায়েদ ইবনে হারেস তাঁর সাথে ছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তিনি কয়েক দিন সেখানে অবস্থান করলেন এবং সাকীফের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে আলাপ করলেন। কিন্তু তারা তাঁর কোন কথা যে মানলো না শুধু তাই নয়, বরং স্পষ্ট ভাষায় তাদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুকুম শুনিয়ে দিল। কেননা তারা শংকিত হয়ে পড়েছিলো তাঁর প্রচার তাদের যুবক শ্রেণীকে বিগড়ে না দেয়। সুতরাং বাধ্য হয়েই তাঁকে তায়েফ ত্যাগ করতে হলো। তিনি তায়েফ ত্যাগ করার সময় সাকীফ গোত্রের নেতারা তাদের বখাটে ও পাণ্ডাদের তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। তারা পথের দুই পাশ দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত তাঁর প্রতি বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ, গালিবর্ষণ এবং পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে অগ্রসর হতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত তিনি আহত হয়ে অবসন্ন হয়ে পড়লেন এবং তাঁর জুতা রক্তে ভরে গেলো। এ অবস্থায় তিনি তায়েফের বাইরে একটি বাগানের প্রাচীরের ছায়ায় বসে পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে এই বলে ফরিয়াদ করলেন:

হে আল্লাহ! আমি শুধু তোমার কাছে আমার অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা এবং মানুষের দৃষ্টিতে নিজের অমর্যাদা ও মূল্যহীনতার অভিযোগ করছি। হে সর্বাধিক দয়ালু ও করুণাময়! তুমি সকল দুর্বলদের রব। আমার রবও তুমিই। তুমি আমাকে কার হাতে ছেড়ে দিচ্ছ? এমন কোন অপরিচিতের হাতে কি যে আমার সাথে কঠোর আচরণ করবে? কিংবা এমন কোন দুশমনের হাতে কি যে আমর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করবে? তুমি যদি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হও তাহলে আমি কোন বিপদের পরোয়া করি না। তবে তোমার নিরাপত্তা ও কল্যাণ লাভ করলে সেটা হবে আমার জন্য অনেক বেশী প্রশস্ততা। আমি আশ্রয় চাই তোমার সত্তার সেই নূরের যা অন্ধকারকে আলোচিত এবং দুনিয়া ও আখেরাতের ব্যাপার সমূহের পরিশুদ্ধ করে। তোমার গযব যেন আমার ওপর নাযিল না হয় তা থেকে তুমি আমাকে রক্ষা করো এবং আমি যেন তোমার ক্রোধ ও তিরস্কারের যোগ্য না হই। তোমার মর্জিতেই আমি সন্তুষ্ট যেন তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। তুমি ছাড়া আর কোন জোর বা শক্তি নেই।” (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬২)

ভগ্ন হৃদয় ও দু:খ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাওয়ার পথে যখন তিনি “কারনুল মানাযিল” নামক স্থানের নিকটবর্তী হলেন তখন মাথার ওপর মেঘের ছায়ার মত অনুভব করলেন। দৃষ্টি তুলে চেয়ে দেখলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সামনেই হাজির। জিবরাঈল ডেকে বললেন: “আপনার কওম আপনাকে যে জবাব দিয়েছে আল্লাহ তা শুনেছেন। এই তো আল্লাহ পাহাড়ের ব্যবস্থাপক ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। আপনি যা ইচ্ছা তাকে নির্দেশ দিতে পারেন।” এরপর পাহাড়ের ব্যবস্থাপক ফেরেশতা তাঁকে সালাম দিয়ে আরজ করলেন: আপনি যদি আদেশ দেন তাহলে দুই দিকের পাহাড় এই সব লোকদের ওপর চাপিয়ে দেই।” তিনি বললেন: না, আমি আশা করি আল্লাহ তাদের বংশ এমন সব লোক সৃষ্টি করবেন যারা এক ও লা-শরীক আল্লাহর দাসত্ব করবে।” (বুখারী, বাদউল খালক, যিকরুল মালাইকা, মুসলিম, কিতাবুল মাগাযী, নাসায়ী, আলবু’য়স, ।

এরপর তিনি নাখালা নামক স্থানে গিয়ে কয়েক দিনের জন্য অবস্থান করলেন। এখন কিভাবে মক্কায় ফিরে যাবেন সে কথা ভাবছিলেন। তায়েফে যা কিছু ঘটেছে সে খবর হয়তো সেখানে ইতোমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। এখন তো কাফেররা আগের চেয়েও দু:সাহসী হয়ে উঠবে। এই সময়ে একদিন রাতের বেলা যখন তিনি নামাযে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করছিলেন সেই সময় জিনদের একটি দল সেখানে এসে হাজির হলো। তারা কুরআন শুনলো, তার প্রতি ঈমান আনলো এবং ফিরে গিয়ে নিজ জাতির মধ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করলো। আল্লাহ তাঁর নবীকে এই সুসংবাদ দান করলেন যে, আপনার দাওয়াত শুনে মানুষ যদিও দূরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু বহু জিন তার ভক্ত অনুরক্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা একে স্বজাতির মধ্যে প্রচার করছে।
(৪৬-আহক্বাফ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য : এই পরিস্থিতিতে সূরাটি নাযিল হয়। যে ব্যক্তি একদিকে নাযিল হওয়ার এই পরিস্থিতি সামনে রাখবে এবং অন্য দিকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে সূরাটি পড়বে তার মনে এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকবে না যে এটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী নয়। বরং “এটি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।” কেননা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা সূরার মধ্যে কোথাও সেই ধরনের মানবিক আবেগ ও প্রতিক্রিয়ার সামান্য লেশ মাত্র নেই যা সাধারণত এরূপ পরিস্থিতির শিকার মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয়। এটা যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হতো যাকে একের পর এক বড় বড় দু:খ বেদনা ও মুসিবত এবং তায়েফের সাম্প্রতিক আঘাত দুর্দশার চরমে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলো-তাহলে এই পরিস্থিতির কারণে তাঁর মনের যে অবস্থা ছিল সূরার মধ্যে কোথাও না কোথাও তার চিত্র দৃষ্টিগোচর হতো। উপরে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে দোয়া উদ্বৃত করেছি তার প্রতি একটু লক্ষ্য করুন। সেটা তাঁর নিজের বাণী। ঐ বাণীর প্রতিটি শব্দ সেই পরিস্থিতিরই চিত্রায়ন। কিন্তু এই সূরাটি সেই একই সময়ে একই পরিস্থিতিতে তাঁরই মুখ থেকে বেরিয়েছে, অথচ সেই পরিস্থিতিজনিত প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত।

কাফেররা বহুবিধ গোমরাহীর মধ্যে শুধু ডুবেই ছিল না বরং প্রচণ্ড জিদ, গর্ব ও অহংকারের সাথে তা আঁকড়ে ধরে ছিল। আর যে ব্যক্তি এসব গোমরাহী থেকে তাদেরকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট ছিল তাকে তারা তিরস্কার ও সমালোচনার লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছিলো। এই সব গোমরাহীর ফলাফল সম্পর্কে কাফেরদের সাবধান করাই সূরার মূল আলোচ্য বিষয়। তাদের কাছে দুনিয়াটা ছিল একটা উদ্দেশ্যহীন খেলার বস্তু। তারা এখানে নিজেদেরকে দায়িত্বহীন সৃষ্টি মনে করতো। তাদের মতে তাওহীদের দাওয়াত ছিল মিথ্যা তাদের উপাস্য আল্লাহর অংশীদার, তাদের এ দাবীর ব্যাপারে তারা ছিল একগুঁয়ে ও আপোষহীন। কুরআন আল্লাহর বাণী একথা মানতে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। রিসালাত সম্পর্কে তাদের মন-মগজে ছিল একটি অদ্ভুত জাহেলী ধারণা এবং সেই ধারণার ভিত্তিতে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের দাবি পরখ করার জন্য নানা ধরনের অদ্ভুত মানদণ্ড পেশ করছিলো। তাদের মতে ইসলামের সত্য না হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল এই যে, তাদের নেতৃবৃন্দ, বড় বড় গোত্রীয় সর্দার এবং তাদের কওমের গবুচন্দ্ররা তা মেনে নিচ্ছিলো না এবং শুধু কতিপয় যুবক, কিছু সংখ্যক দরিদ্র লোক এবং কতিপয় ক্রীতদাস তার ওপর ঈমান এনেছিলো। তারা কিয়মাত, মৃত্যুর পরের জীবন এবং শাস্তি ও পুরস্কারের বিষয়কে মনগড়া কাহিনী বলে মনে করতো তাদের ধারণা ছিল, বাস্তবে এসব ঘটা একেবারেই অসম্ভব।

এ সূরায় এসব গোমরাহীর প্রত্যেকটিকে সংক্ষেপে যুক্তি-প্রমাণসহ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং কাফেরদের এই বলে সাবধান করা হয়েছে যে, তোমরা বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে সত্য ও বাস্তবতা বুঝার চেষ্টা করার পরিবর্তে যদি গোড়ামি ও হঠকারিতার মাধ্যমে কুরআনের দাওয়াত ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতকে প্রত্যাখ্যান করো তাহলে নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরাই ধ্বংস করবে।

# প্রকৃত সত্য হলো বিশ্বজাহানের এই ব্যবস্থা উদ্দেশ্যহীন কোন খেলার বস্তু নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থা যেখানে ভাল ও মন্দ এবং জালেম ও মজলুমের ফয়সালা অবশ্যই ইনসাফ মোতাবেক হতে হবে। আবার বিশ্বজাহানের এই ব্যবস্থা স্থায়ীও নয়। এর জন্য একটা সময় নির্ধারিত আছে যা শেষ হওয়ার পর তাকে অবশ্যই ধ্বংস হতে হবে। তাছাড়া আল্লাহর আদালতের জন্যও একটা সময় নির্ধারিত আছে। সেই সময় আসলে তা অবশ্যই কায়েম হবে। কিন্তু যারা আল্লাহর রসূল ও তাঁর কিতাব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা এসব সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। তারা এ চিন্তা মোটেই করছে না যে, এমন এক সময় অবশ্যই আসবে যখন তাদেরকে নিজেদের কাজ-কর্মের জবাবদিহি করতে হবে। তারা মনে করে এসব পরম সত্য সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে আল্লাহর রসূল তাদের কোন ক্ষতি করেছেন। অথচ তিনি তাদের অনেক কল্যাণ করেছেন। কারণ, হিসাব, নিকাশ ও জবাবদিহির সময় আসার পূর্বেই তিনি তাদের শুধু বলেননি যে, সে সময় আসবে বরং যাতে তারা সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে সেজন্য কোন্ কোন্ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে সাথে সাথে তাও বলে দিয়েছেন।

পরবর্তী বক্তব্য বুঝার জন্য এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ সম্পর্কে তার আকীদা বা বিশ্বাস নির্ধারণে যে ভুল করে সেটিই তার সবচেযে বড় মৌলিক ভুল। এ ব্যাপারে ঢিলাঢালা ও উদাসীন ভাব দেখিয়ে কোন গভীর এবং গঠনমূলক চিন্তা ও বিশ্লেষণ ছাড়া ভাসা ভাসা, হালকা, অগভীর আকীদা গড়ে নেয়া এমন একটি বড় বোকামী যা পার্থিব জীবনে মানুষের চাল চলন ও আচার-আচরণকে এবং চিরদিনের জন্য তার পরিণামকে ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু যে কারণে মানুষ এই বিপজ্জনক গাছাড়া ভাব ও উদাসীনতার মধ্যে হারিয়ে যায় তা হলো, সে নিজেকে দায়িত্বহীন ও জবাবদিহি মুক্ত মনে করে এবং এই ভুল ধারণা পোষণ করে বসে যে, আমি আল্লাহ সম্পর্কে যে আকীদাই গ্রহণ করি না কেন তাতে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না। কেননা, হয় মৃত্যুর পরে আদৌ কোন জীবন নেই যেখানে আমাকে কোনো প্রকার জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে, কিংবা এমন কোন জীবন হবে যেখানে জবাবদিহি করতে হলেও আমি যেসব সত্তার আশ্রয় নিয়ে আছি তারা আমাকে খারাপ পরিণতি থেকে রক্ষা করবে। দায়িত্বানুভূতির এই অনুপস্থিতি ব্যক্তিকে ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুরু করে শিরকের চরম অযৌক্তিক পন্থা পর্যন্ত নানা ধরনের অর্থহীন আকীদা-বিশ্বাস নিজেই রচনা করে অথবা অন্যদের রচিত আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করে নেয়।
# যেহেতু শ্রোতারা একটি মুশরিক জাতির লোক তাই তাদের বলা হচ্ছে, দায়িত্বানুভূতির অনুপস্থিতির কারণে তারা না বুঝে শুনে কিভাবে এক চরম অযৌক্তিক আকীদা ধরে আছে। তারা আল্লাহকে বিশ্বজাহানের স্রষ্টা স্বীকার করার সাথে সাথে আরো বহু সত্তাকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছেলো। তাদের কাছে প্রার্থনা করতো, তাদেরকে নিজের প্রয়োজন পূরণকারী ও বিপদ ত্রাণকারী মনে করতো, তাদেরকে তোসামোদ করতো এবং নজর-নিয়াজ পেশ করতো এবং মনে করতো, আমাদের ভাগ্য গড়ার ও ভাঙার সমস্ত ক্ষমতা তাদেরই আছে। সেই সব ব্যক্তিদের সম্পর্কেই তাদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে যে, তোমরা কী কারণে তাদেরকে নিজেদের উপাস্যের মর্যাদা দান করেছো? একথা সবারই জানা যে, উপাস্য হওয়ার অধিকারে আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করার দু’টি ভিত্তি হতে পারে। সে ব্যক্তি নিজে কোন মাধ্যমের সাহায্য জেনে নিয়েছে যে, যমীন ও আসমান সৃষ্টি ব্যাপারে সত্যিই তার কোন অংশ আছে, নয়তো আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন যে, খোদায়ীর কাজে অমুক ব্যক্তি আমার অংশীদার। এখন যদি কোন মুশরিক ও দাবী করতে না পারে যে তার উপাস্যদের আল্লাহর শরীক হওয়ার ব্যাপারে তার কাছে সরাসরি জ্ঞান আছে, অথবা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত কোন কিতাবে দেখাতে না পারে যে আল্লাহ নিজেই কাউকে তাঁর শরীক ঘোষণা করেছেন, তাহলে তার এই আকীদা অবশ্যই চূড়ান্তরূপে ভিত্তিহীন।

এই আয়াতে “ইতিপূর্বে প্রেরিত কোন কিতাব” অর্থ এমন কোন কিতাব যা আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআন নাযিলের পূর্বে প্রেরিত হয়েছে। আর জ্ঞানের “অবশিষ্টাংশ” অর্থ প্রাচীনকালের নবী-রসূল ও নেক লোকদের শিক্ষার এমন কোন অংশ যা পরবর্তী বংশধরদের কাছে শিরকের লেশমাত্র নেই। কুরআন যে তাওহীদের দিকে আহবান জানাচ্ছে সমস্ত আমসানী কিতাব সর্বসম্মতভাবে সেই তাওহীদই পেশ করছে। প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতটুকু স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট আছে তার মধ্যেও কোথাও এ প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, নবী, অলী বা নেককার ব্যক্তিগণ মানুষকে কখনো আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করার শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি কিতাব অর্থ যদি আল্লাহর কিতাব এবং জ্ঞানের অবশিষ্টাংশ অর্থ যদি নবী-রসূল ও নেক লোকদের রেখে যাওয়া জ্ঞান এই অর্থ গ্রহণ নাও করা হয় তাহলেও পৃথিবীর কোন জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ এবং দ্বীনী বা দুনিয়াবী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন বিশেষজ্ঞের গবেষণা ও বিশ্লেষণেও আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি যে, পৃথিবী বা আসমানের অমুক বস্তু খোদা সৃষ্টি করেননি, বরং অমুক বুজর্গ অথবা অমুক দেবতা সৃষ্টি করেছে অথবা এই বিশ্বজাহানে মানুষ যেসব নিয়ামত ভোগ করছে তার মধ্যে অমুক নিয়ামতটি আল্লাহর নয়, অমুক উপাস্যের সৃষ্টি।
# জবাব দেয়ার অর্থ কার্যত জবাবী, তৎপরতা দেখানো, শুধু মুখে উচ্চস্বরে জবাব দেয়া কিংবা লিখিতভাবে জবাব পাঠিয়ে দেয়া নয়। অর্থাৎ কেউ যদি সেই উপাস্যদের কাছে নালিশ বা সাহায্য প্রার্থনা করে, কিংবা তাদের কাছে দোয়া করে তাহলে যেহেতু তাদের আদৌ কোন শক্তি ও কর্তৃত্ব নেই তাই তার আবেদনে কোনো প্রকার ইতিবাচক বা নেতিবাচক বাস্তব তৎপরতা চালাতে সক্ষম নয়। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আয যুমার, টীকা ৩৩) কিয়ামত পর্যন্ত জবাব না দিতে পারার অর্থ হচ্ছে, যত দিন পর্যন্ত এই পৃথিবী আছে ততদিন পর্যন্ত ব্যাপারটা ওখানেই স্থির থাকবে। অর্থাৎ সেই সব উপাস্যদের পক্ষ থেকে তাদের আবেদনের কোন জবাব পাওয়া যাবে না। কিন্তু যখন কিয়ামত হবে তখন ব্যাপারটা আরো অগ্রসর হয়ে এই দাঁড়াবে যে, সেই সব উপাস্যরা উল্টা এসব উপাসনাকারীদের দুশমন হয়ে যাবে। পরের আয়াতে একথাই বলা হয়েছে।
# এসব আহ্বানকারীদের আহবান আদৌ তাদের কাছে পৌঁছে না। না তারা নিজের কানে তা শোনে, না অন্য কোন সূত্রে তাদের কাছে এ খবর পৌঁছে যে পৃথিবীতে কেউ তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে। আল্লাহর এ বাণীকে আরো পরিষ্কার করে এভাবে বুঝুনঃ সারা পৃথিবীর মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া যেসব সত্তার কাছে প্রার্থনা করছে তারা তিনভাগে বিভক্ত। এক, প্রাণহীন ও জ্ঞান-বুদ্ধিহীন সৃষ্টি। দুই, অতীতের বুযুর্গ মানুষেরা। তিন, সেই সব পথভ্রষ্ট মানুষ যারা নিজেরাও নষ্ট ছিল এবং অন্যদেরও নষ্ট করে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছিলো। প্রথম প্রকারের উপাস্যদের তাদের উপাসনাকারীদের উপাসনা সম্পর্কে অনবহিত থাকা সুস্পষ্ট। এরপর থাকে দ্বিতীয় প্রকারের উপাস্য যারা ছিল আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী মানুষ। এদের অনবহিত থাকার কারণ দু’টি। একটি কারণ হচ্ছে, তারা আল্লাহর কাছে এমন একটি জগতে আছে যেখানে মানুষের আওয়াজ সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছে না। আরেকটি কারণ হচ্ছে, সারা জীবন যেসব মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা শিখিয়েছেন তারাই এখন উল্টা তাদের কাছে প্রার্থনা করছে আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা তাদের কাছে এ খবর পৌঁছিয়ে দেন না। কারণ, তাদের কাছে এই খবরের চেয়ে বেশী কষ্টদায়ক জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ তাঁর সেই নেক বান্দাদের কষ্ট দেয়া কখনো পছন্দ করেন না। এরপর তৃতীয় প্রকারের উপাস্যদের সম্পর্কেযদি চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন, তাদের অনবহিত থাকার ও দু’টি মাত্র কারণ। একটি কারণ হচ্ছে তারা আল্লাহর কাছে অপরাধী হিসেবে বিচারের অপেক্ষায় বন্দী। সেখানে দুনিয়ার কোন আবেদন-নিবেদন পৌঁছে না। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারাও তাদের এ খবর দেন না যে, পৃথিবীতে তোমাদের মিশন খুব সফলতা লাভ করেছে এবং তোমাদের মৃত্যুর পর মানুষ তোমাদেরকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। কারণ এ খবর তাদের জন্য খুশীর কারণ হবে। অথচ আল্লাহ জালেমদের কখনো খুশী করতে চান না।

এ প্রসঙ্গে একথাও বুঝতে হবে যে, আল্লাহ তাঁর সৎ বান্দাদের কাছে দুনিয়ার মানুষের সালাম এবং তাদের রহমত কামনার দোয়া পৌঁছিয়ে দেন। কেননা এসব তাদের খুশীর কারণ হয়। একইভাবে তিনি অপরাধীদেরকে দুনিয়ার মানুষের অভিশাপ ক্রোধ ও তিরস্কার সম্পর্কেও অবহিত করেন। যেমন একটি হাদীস অনুসারে বদর যুদ্ধে নিহত কাফেরদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিরস্কার শুনানো হয়েছিলো। কারণ তা ছিল তাদের জন্য কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু যা নেককার বান্দাদের জন্য দুঃখ ও মনকষ্টের এবং অপরাধীদের জন্য আনন্দের কারণ হয় সে রকম বিষয় তাদের কাছে পৌঁছানো হয় না। এই ব্যাখ্যার সাহায্যে মৃতদের শুনতে পাওয়া সম্পর্কত বিষয়টির তাৎপর্য অতি উত্তম রূপে সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
# তারা সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেবে না আমরা কোন সময় তোমাদের একথা বলেছি যে, আমাদের ইবাদাত করতে হবে, না আমাদের জানা আছে যে, এ লোকেরা আমাদের ‘ইবাদত’ করতো। এই গোমরাহীর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। তাই তার পরিণাম তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। এ গুনাহে আমাদের কোন অংশ নেই।
# এর অর্থ হচ্ছে, যখন কুরআনের আয়াতসমূহ মক্কার কাফেরদের শুনানো হতো তখন তারা পরিষ্কার উপলব্ধি করতো যে, এ বাণীর মর্যাদা মানুষের কথার চাইতে অনেক গুণ বেশি। কুরআনের অতুলনীয় অলংকার সমৃদ্ধ ভাষা হৃদয় বিমুগ্ধকারী ভাষণ, উন্নত বিষয় বস্তু এবং হৃদয় উত্তপ্তকারী বর্ণনাভংগির সাথে তাদের কোন কবি, বক্তা এবং শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্মের কোন তুলনাই ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বাণীর মধ্যে যে উৎকর্ষতা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বাণীর মধ্যেও তা ছিল না। যারা শৈশব থেকে তাঁকে দেখে আসছিলো তারা কুরআনের ভাষা এবং তাঁর ভাষার মধ্যে কত বড় পার্থক্য ছিল তা ভাল করেই জানতো। এক ব্যক্তি, যে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে রাত দিন তাদের মাঝেই অবস্থান করে আসছে সে হঠাৎ কোন সময় এমন এক বাণী রচনা করে ফেলছে যার ভাষার তাঁর নিজের জানা ভাষার সাথে আদৌ কোন মিল নেই, একথা বিশ্বাস করা তাদের জন্য মোটেই সম্ভব ছিল না। এই জিনিসটি তাদের সামনে সত্যকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে তুলে ধরছিলো। কিন্তু তারা যেহেতু কুফরীকে আঁকড়ে ধরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তাই এই সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখেও এই বাণীকে অহীর বাণী হিসেবে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে বলতো যে, তা কোন যাদুর কারসাজি। (আরো যে দিকটি বিচার করে তারা কুরআনকে যাদু বলে আখ্যায়িত করতো তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা ইতিপূর্বেই করেছি। দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া, টীকা ৫ ; সূরা সোয়াদের তাফসীর, টীকা ৫ )।
# এই প্রশ্নমূলক বর্ণনাভংগির মধ্যে অতি বিস্ময় পরিলক্ষিত হয়। এর অর্থ হচ্ছে, এরা কি এতই নির্লজ্জ যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে কুরআন নিজে রচনা করার অপবাদ আরোপ করে। অথচ এরা ভাল করেই জানে যে, এটা তাঁর রচিত বাণী হতে পারে না। তাছাড়া এ বাণীকে তাদের যাদু বলা পরিষ্কাভাবে একথাই স্বীকার করে নেয়া যে, এটা একটা অসাধারণ বাণী যা তাদের নিজেদের মতেও কোন মানুষের রচনা হওয়া সম্ভব নয়।
# তাদের অপবাদ যে ভিত্তিহীন এবং সরাসরি হঠকারিতামূলক তা যেহেতু সম্পূর্ণ স্পষ্ট ছিল তাই তার প্রতিবাদে যুক্তি প্রমাণ পেশ করার কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না। অতএব, শুধু একথা বলাই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে যে, যদি প্রকৃতই আমি নিজে একটি বাণী রচনা করে তা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার মত মহা অপরাধ করে থাকি- যে অভিযোগে তোমরা আমাকে অভিযুক্ত করছো- তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করার জন্য তোমরা আসবে না। কিন্তু এটা যদি আল্লাহরই বাণী হয়ে থাকে আর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তোমরা তা প্রতিরোধ করে থাকো তাহলে তোমাদের সাথে আল্লাহই বুঝাপড়া করবেন। প্রকৃত সত্য আল্লাহর অজানা নয়। সুতরাং মিথ্যা ও সত্যের ফায়সালার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। সারা পৃথিবী যদি কাউকে মিথ্যাবাদী বলে আর আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হয়ে থাকে তাহলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই তার পক্ষে হবে। আর গোটা পৃথিবী যদি কাউকে সত্যবাদী বলে কিন্তু আল্লাহর কাছে সে মিথ্যাবাদী হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত সে মিথ্যাবাদীই সাব্যস্ত হবে। অতএব, আবোল তাবোল না বলে নিজের পরিণামের কথা চিন্তা করো।
# এখানে এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা। যারা আল্লাহর বাণীকে মিথ্যা বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করতে কুণ্ঠিত নয়, এই দয়া ও ক্ষমার কারণেই তারা পুথিবীর বুকে বেঁচে আছে। কোন নির্দয় ও কঠোর আল্লাহ যদি এই বিশ্বজাহানের মালিক হতেন তাহলে এরূপ ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারীদের একটি শ্বাস গ্রহণের পর আরেকটি শ্বাস গ্রহণের ভাগ্য হতো না। এ আয়াতাংশের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এই যে, হে জালেমরা এখনো যদি এই হঠকারিতা থেকে বিরত হও তাহলে আল্লাহর রহমতের দরজা তোমাদের জন্য খোলা আছে এবং অদ্যাবধি তোমরা যা কিছু করেছো তা মাফ হতে পারে।
# এ বাণীর পটভূমি এই যে, নবী ﷺ যখন নিজেকে আল্লাহর রসূল হিসেবে পেশ করলেন তখন মক্কার লোকেরা একথা শুনে নানা রকম কথা বলতে শুরু করলো। তারা বলতোঃ এ আবার কেমন রসূল যার সন্তানাদি আছে, যে বাজারে যায়, পানাহার করে এবং আমাদের মত মানুষের ন্যায় জীবন যাপন করে। তাহলে তার মধ্যে আলাদা কী বৈশিষ্ট্য আছে যে দিক দিয়ে সে সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন এবং যার ফলে আমরাও বুঝতে পারবো যে, আল্লাহ বিশেষভাবে এই ব্যক্তিকেই তাঁর রসূল বানিয়েছেন? তারা আরো বলতো, আল্লাহ যদি এই ব্যক্তিকেই তাঁর রসূল বানাতেন তাহলে তার আরদালী হিসেবে কোন ফেরেশতা পাঠাতেন। সেই ফেরেশতা ঘোষণা করতো, তিনি আল্লাহর রাসূল। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে সামান্যতম বে-আদবীও করত সে তাকেই শাস্তি স্বরূপ বেত্রাঘাত করতো। আল্লাহ যাকে তার রাসূল হিসেবে নিয়োগ করবেন তাঁকে মক্কার অলিতে গলিতে এভাবে চলতে এবং সব রকম জুলুম-অত্যাচার বরদাশত করার জন্য অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবেন তা কী করে হতে পারে? আর কিছু না হলেও অন্তত এতটুকু হতো যে, আল্লাহ তাঁর রসূলের জন্য একটি জাকালো রাজ প্রাসাদ এবং একটি সবুজ-শ্যামল তরতাজা বাগান তৈরী করে দিতেন। তাহলে তাঁর রসূলের স্ত্রীর অর্থ-সম্পদ যখন নিঃশেষ হতো তখন তাঁর অভুক্ত থাকার মতো পরিস্থিতি আসতো না এবং তায়েফ যাওয়ার জন্য সওয়ারী থাকতো। এমন অবস্থাও দেখা দিতো না। তাছাড়া তারা তাঁর কাছে নানা ধরনের মু’জিযার দাবী করতো এবং গায়েবী বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইতো। তাদের ধারণায় কোন ব্যক্তির আল্লাহর রসূল হওয়ার অর্থ ছিল সে অতি মানবিক শক্তির মালিক হবে। তাঁর একটি ইঙ্গিত পাহাড় স্থানচ্যুত হবে, চোখের পলকে মরুভূমি শ্যামল শস্য ক্ষেতে পরিণত হবে, অতীত ও ভবিষ্যত সব কিছু তাঁর জানা থাকবে এবং অদৃশ্য সব কিছু তাঁর কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হবে।

আয়াতটির বিভিন্ন ছোট ছোট অংশে একথাগুলোরই জবাব দেয়া হয়েছে। এর প্রতিটি অংশের মধ্যেই ব্যাপক অর্থ প্রচ্ছন্ন আছে।

একটি অংশে বলা হয়েছে, এদের বলো ‘আমি অন্য রসূলদের থেকে ভিন্ন কোন রসূল নই। ’অর্থাৎ আমাকে রসূল বানানো দুনিয়ার ইতিহাসে রসূল বানানোর প্রথম ঘটনা নয় যে, রসূল কী এবং কী নন তা বুঝতে তোমাদের কষ্ট হবে। আমার পূর্বে বহু রসূল এসেছিলেন। আমি তাদের থেকে আলাদা কিছু নই। পৃথিবীতে এমন কোন রসূল কখন এসেছেন যার সন্তানাদি ছিল না, কিংবা যিনি পানাহার করতেন না অথবা সাধারণ মানুষদের মত জীবন যাপন করতেন না? কোন্ রসূলের সাথে ফেরেশতা এসে তাঁর রিসালাতের ঘোষণা দিতো এবং তাঁর আগে আগে চাবুক হাতে চলতো? কোন্ রসূলের জন্য বাগান ও রাজ প্রাসাদ তৈরী করে দেয়া হয়েছে এবং আমি যে দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করছি আল্লাহর পথে ডাকতে গিয়ে কে তা করেনি? এমন রসূল কে এসেছিলেন যিনি তাঁর ইচ্ছামত মু’জিযা দেখাতে পারতেন কিংবা নিজের জ্ঞান দিয়েই সব কিছু জানতেন? তাহলে শুধু আমার রিসালাত পরখ করে দেখার জন্য এই অভিনব ও স্বতন্ত্র মানদণ্ড তোমরা কোথা থেকে নিয়ে আসছো?

এর পরে বলা হয়েছে, জবাবে তাদের একথাও বলো, “কাল তোমাদের সাথে কী আচরণ করা হবে এবং আমার সাথেই বা কী আচরণ করা হবে তা আমি জানি না।” আমি তো কেবল আমার কাছে প্রেরিত অহী অনুসরণ করি। অর্থাৎ আমি গায়েব নই যে, আমার কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব কিছু সুস্পষ্ট থাকবে এবং দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসই আমার জানা থাকবে। তোমাদের ভবিষ্যত তো দূরের কথা আমার নিজের ভবিষ্যতও আমার জানা নেই। আমাকে অহীর মাধ্যমে যে জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া হয় আমি শুধু সেটাই জানি। এর চেয়ে বেশি জানার দাবী আমি কবে করেছিলাম এমন জ্ঞানের অধিকারী রসূলই বা পৃথিবীতে কবে এসেছিলেন যে তোমরা আমার রিসালাত পরখ করার জন্য আমার গায়েবী জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে চাচ্ছো। হারানো বস্তুর সন্ধান বলা, গর্ভবতী নারী পুত্র সন্তান প্রসব করবে না কন্যা সন্তান এবং রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে না মারা যাবে এসব বলা কবে থেকে রসূলের কাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

সব শেষে বলা হয়েছে, তাদের বলে দাও, আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নই। অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী নই যে, তোমরা প্রতিনিয়ত আমার কাছে যে মু’জিযার দাবী করছো তা দেখিয়ে দেবো। আমাকে যে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে তা শুধু এই যে, আমি মানুষের সামনে সঠিক পথ পেশ করবো এবং যারা তা গ্রহণ করবে না তাদেরকে এর মন্দ পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দেবো।
# মুফাসসিরদের একটি বড় দল এই সাক্ষী বলতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালামকে বুঝিয়েছেন। তিনি মদীনার একজন বড় ইহুদী আলেম ছিলেন। তিনি হিজরতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান আনেন। এ ঘটনা যেহেতু মদীনাতে সংঘটিত হয়েছিলো তাই মুফাসসিরদের মত হলো, এটি মদীনায় অবতীর্ণ আয়াত। আয়াতটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলো, হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াককাসের এই বর্ণনাই এ ব্যাখ্যার ভিত্তি। (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে জারীর)। এ কারণেই ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদা, দাহহাক, ইবনে সিরীন, হাসান বাসারী, ইবনে যায়েদ এবং ‘আওফ ইবনে মালেক আল-আশজায়ীর মত কিছু সংখ্যক বড় বড় মুফাসসিরও এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অপর দিকে ইকরিমা, শাবী ও মাসরুক বলেনঃ এ আয়াত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম সম্পর্কে হতে পারে না। কারণ, গোটা সূরাই মক্কায় অবতীর্ণ। ইবনে জারীর তাবারীও এ মতটিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি হলো, প্রথম থেকেই মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ্য করে ধারাবাহিকভাবে গোটা বক্তব্য চলে আসছে এবং পরের সবটুকু বক্তব্যও তাদের উদ্দেশেই পূর্বাপর এই প্রসঙ্গের মধ্যে হঠাৎ মদীনায় অবতীর্ণ আয়াত এসে যাওয়া কল্পনা করা যায় না। পরবর্তীকালের যেসব মুফাসসির এই দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করেছেন তারা হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াককাসের বর্ণনাটি প্রত্যাখ্যান করেন না। তারা মনে করেন, আয়াতটি যেহেতু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালামের ঈমান গ্রহণের ব্যাপারেও খাটে তাই হযরত সা’দ প্রাচীনদের অভ্যাস অনুসারে বলেছেন এটি আবদুল্লাহ ইবনে সালাম সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি যখন ঈমান এনেছেন তখন এটি তাঁর সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। বরং এর অর্থ হলো, এ আয়াত তাঁর বেলায়ও হুবহু ঠিক। তাঁর ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে এ আয়াত পুরোপুরি প্রযোজ্য।

বাহ্যত এই দ্বিতীয় মতটিই অধিক বিশুদ্ধ ও যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এরপর আরো একটি প্রশ্নের সমাধান দেয়া দরকার যে, সাক্ষী বলতে এখানে কাকে বুঝানো হয়েছে? যেসব মুফাসসির এই দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করেছেন তাদের কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা মূসা আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী বাক্যাংশ, “সে ঈমান এনেছে। কিন্তু তোমরা আত্মম্ভরিতায় ডুবে আছো।” এর এই ব্যাখ্যার সাথে কোন মিল নেই। মুফাসসির নিশাপুরী ও ইবনে কাসীর যে মত ব্যক্ত করেছেন সেটিই অধিক বিশুদ্ধ বলে মনে হয়। অর্থাৎ এখানে সাক্ষী অর্থ কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, বরং বনী ইসরাঈলদের যে কোন সাধারণ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর বাণীর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, কুরআন তোমাদের সামনেই যে শিক্ষা পেশ করছে তা কোন অভিনব জিনিস নয়। পৃথিবীতে প্রথমবারের মত শুধুমাত্র তোমাদের সামনেই তা পেশ করা হয়নি যে, তোমরা ওজর পেশ করে বলবেঃ এ ধরণের কথা তো ইতিপূর্বে মানব জাতির কাছে আসেনি। তাই আমরা কী করে তা মানতে পারি। ইতিপূর্বেও এসব শিক্ষা এভাবেই অহীর মাধ্যমেই বণী ইসরাঈলদের একজন সাধারণ মানুষও তা মেনে নিয়েছিলো যে, অহীই হচ্ছে এসব শিক্ষা নাযিল হওয়ার মাধ্যম। তাই অহী এবং এই শিক্ষা দুর্বোধ্য জিনিস তোমরা সে দাবী করতে পার না। আসল কথা হলো, তোমাদের গর্ব, অহংকার এবং ভিত্তিহীন আত্মম্ভরিতা ঈমানের পথে অন্তরায়।
# কুরাইশ নেতারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য যেসব যুক্তি কাজে লাগাতো এটা তার একটা। তারা বলতো, ‘এ কুরআন যদি সত্য হতো এবং মুহাম্মাদ ﷺ যদি একটি সঠিক জিনিসের দাওয়াত দিতেন তাহলে কওমের নেতারা, গোত্রসমূহের অধিপতিরা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অগ্রসর হয়ে তা গ্রহণ করতো। এটা কী করে হতে পারে যে, কতিপয় অনভিজ্ঞ বালক এবং কিছু সংখ্যক নীচু পর্যায়ের ক্রীতদাস একটি যুক্তিসঙ্গত কথা মেনে নেবে কিন্তু কওমের গণ্যমান্য ব্যক্তি যারা জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ এবং আজ পর্যন্ত কওম যাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে আসছে তারা তা প্রত্যাখ্যান করবে? নতুন এই আন্দোলনে মন্দ কিছু অবশ্যই আছে। তাই কওমের গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তা মানছে না। অতএব, তোমরাও তা থেকে দূরে সরে যাও, এই প্রতারণামূলক যুক্তি খাড়া করে তারা সাধারণ মানুষকে শান্ত করে রাখার চেষ্টা করতো।
# এসব লোক নিজেরাই নিজেদেরকে হক ও বাতিলের মানদণ্ড গণ্য করে রেখেছে। এরা মনে করে, এরা যে হিদায়াতকে গ্রহণ করবে না তাকে অবশ্যই গোমরাহী ও পথভ্রষ্ট হতে হবে। কিন্তু এরা একে নতুন মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করার সাহস রাখে না। কারণ, এর আগের যুগের নবী-রসূলগণ এ শিক্ষাই পেশ করেছেন এবং আহলে কিতাবদের কাছে যেসব আসমানী কিতাব আছে তার সবই এ আকীদা-বিশ্বাস ও নির্দেশনায় ভরপুর। এ কারণে এরা একে পুরনো মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করে। যারা হাজার হাজার বছর ধরে এসব সত্য পেশ করে এসেছে এবং মেনেছে এদের মতে তারা সবাই জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে বঞ্চিত। সমস্ত জ্ঞান শুধু এদের অংশেই পড়েছে।
# সেই সব লোককে খারাপ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেবেন যারা আল্লাহর সাথে কুফরী এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দাসত্ব করে নিজের এবং ন্যায় ও সত্যের প্রতি জুলুম করছে এবং নিজের এই গোমরাহীর কারণে নৈতিক চরিত্র ও কর্মের এমন সব ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে ডুবে আছে যার ফলে মানব সমাজ নানা প্রকার জুলুম-অত্যাচার ও বে-ইনসাফীতে ভরে উঠেছে।

 

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ : أحقاف

শব্দটি حقف এর বহুবচন, যার অর্থ হল : প্রচুর বালু, বালুর উঁচু ও লম্বা পাহাড়। কেউ অর্থ করেছেন পাহাড় ও গুহা। এটা আরব উপ-দ্বীপের দক্ষিণ পাশে তথা ইয়ামানের হাযরামাউতের নিকটস্থ হূদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্প্রদায় প্রথম ‘আদ এর এলাকার নাম। সূরা আল আহক্বাফ মক্কায় অবতীর্ণ। এ সূরায় আহক্বাফ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে আর তা থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

সূরাতে কয়েকটি আলোচনা স্থান পেয়েছে : (১) আকাশ জমিন সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং এর একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, সময় শেষ হলে সব শেষ হয়ে যাবে। (২) আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং যারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যদেরকে মা‘বূদ হিসেবে ডাকে তারা সবচেয়ে পথভ্রষ্ট। (৩) মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন নতুন রাসূল নন, বরং তাঁর মত অনেক রাসূল অতীতে চলে গেছেন। (৪) কাফিরদের দাবী- মুহাম্মাদ যে ইসলাম নিয়ে এসেছে তা কল্যাণকর হলে আমরাই তা প্রথমে গ্রহণ করতাম। (৫) পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ এবং তাদের অবদান উল্লেখ করা হয়েছে, সবশেষে আহকাফবাসী ও তাদের ওপর আপতিত শাস্তি সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে।

১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর অর্থ ও প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

মক্কার কাফির-মুশরিকরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতকে অস্বীকার, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবকে অবিশ্বাস, বরং এটা মানব রচিত একটি কিতাব বলে বিশ্বাস করার কথা খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এ কুরআন পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতারিত। এর বিধি-বিধান সত্য, এতে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় নেই।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَإِنَّه۫ لَكِتٰبٌ عَزِيْزٌ لا ‏- لَّا يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْمبَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِه۪ ط تَنْزِيْلٌ مِّنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ)‏

“এবং এটা অবশ্যই এক মহিমাময় গ্রন্থ। কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না- অগ্র হতেও নয়, পশ্চাত হতেও নয়। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসনীয় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।” (সূরা হা-মীম আস্ সাজদাহ্ ৪১ : ৪১-৪২)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَاِنَّھ۫ لَتَنْزِیْلُ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَﰏﺚنَزَلَ بِھِ الرُّوْحُ الْاَمِیْنُﰐﺫعَلٰی قَلْبِکَ لِتَکُوْنَ مِنَ الْمُنْذِرِیْنَﰑﺫبِلِسَانٍ عَرَبِیٍّ مُّبِیْنٍﰒ)

“নিশ্চয়ই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হতে অবতীর্ণ। জিব্রাঈল এটা নিয়ে অবতরণ করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পার। (অবতীর্ণ করা হয়েছে) সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়।” (সূরা আশ্ শু‘আরা- ২৬ : ১৯২-১৯৫)

(بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّي)

‘সত্যতার সাথে ও এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য’ অর্থাৎ আকাশসমূহ ও জমিন সৃষ্টির পেছনে আল্লাহ তা‘আলা দুটি বিষয় সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন- (১) আল্লাহ তা‘আলা সত্যসহ আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, অনর্থক সৃষ্টি করেননি, বরং সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য, আর তা হল : মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে সৎ আমলে উত্তম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(ھُوَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ فِیْ سِتَّةِ اَیَّامٍ وَّکَانَ عَرْشُھ۫ عَلَی الْمَا۬ئِ لِیَبْلُوَکُمْ اَیُّکُمْ اَحْسَنُ عَمَلًاﺚ وَلَئِنْ قُلْتَ اِنَّکُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ مِنْۭ بَعْدِ الْمَوْتِ لَیَقُوْلَنَّ الَّذِیْنَ کَفَرُوْٓا اِنْ ھٰذَآ اِلَّا سِحْرٌ مُّبِیْنٌ‏)‏

“আর তিনিই আকাশসমূহ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর ‘র্আশ ছিল পানির ওপর, (সৃষ্টি করেছেন) তোমাদের মধ্যে কে সৎকর্মে শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করার জন্য। তুমি যদি বল : ‎ ‘মৃত্যুর পর তোমরা অবশ্যই উত্থিত হবে’, কাফিররা নিশ্চয়ই বলবে, ‘এটা তো সুস্পষ্ট জাদু।’ (সূরা হূদ ১১ : ৭)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَي الْأَرْضِ زِيْنَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ‏)‏

“পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে সৎকর্মে কে শ্রেষ্ঠ।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৭)

এছাড়াও এ ব্যাপারে অনেক আয়াত প্রমাণ করে আল্লাহ তা‘আলা অনর্থক এ মহা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেননি। (২) এ আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। যখন প্রতিশ্র“ত সময় উপস্থিত হবে তখন আকাশ ও পৃথিবীর বর্তমান এ সকল নিয়মশৃংখলা ভেঙ্গে পড়বে। তা হল কিয়ামত দিবস। তখন আর আকাশ ও জমিন থাকবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمٰوٰتُ وَبَرَزُوْا لِلّٰهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ‏)‏

“যেদিন এ পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশসমূহও; এবং মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সম্মুখে- যিনি এক, পরাক্রমশালী।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪৮)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَيَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الرُّوْحِ ط قُلِ الرُّوْحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّيْ وَمَآ أُوْتِيْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيْلًا ‏)‏

“আর তোমাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল : ‎ ‘রূহ আমার প্রতিপালকের আদেশমাত্র এবং তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে সামান্যই।” (সূরা হিজর ১৫ : ৮৫)

(وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ)

‘কিন্তু যারা কাফির তাদেরকে এ বিষয়ে সাবধান করা সত্ত্বেও তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছে’ অর্থাৎ একমাত্র কাফিররাই আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন ও দীনের প্রতি আমলের সতর্কতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঈমান না আনার কারণে যখন তাদেরকে পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ ও প্রতিদানের ব্যাপারে ভয় দেখানো হয় তখন তারা তার কোন পরওয়া করেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَمَا تَأْتِيْهِمْ مِّنْ اٰيَةٍ مِّنْ اٰيٰتِ رَبِّهِمْ إِلَّا كَانُوْا عَنْهَا مُعْرِضِيْنَ) ‏

“তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলীর এমন কোন নিদর্শন তাদের নিকট উপস্থিত হয় না যা হতে তারা মুখ না ফেরায়।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৪)

তাই আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, দীনি জ্ঞানার্জন না করা ও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না করা কুফরী কাজ। কেউ কেউ এদেরকে নাস্তিক এবং ধর্মনিরপেক্ষবাদী বলেছেন। আসলে এরা হলো শয়তান পূজারী। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে ইবাদত করে না। যে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে না, প্রকৃত পক্ষে সে শয়তানের ইবাদত করে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আকাশ ও জমিন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য মানুষকে পরীক্ষা করা, কে সৎ আমলে উত্তম।
২. দুনিয়া একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সেদিন দুনিয়ার এ নিয়ম-কানুন বহাল থাকবে না।
৩. আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, দীনি জ্ঞানার্জন না করা ও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না করা কুফরী কাজ।

৪-৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে মনগড়া মা‘বূদদেরকে সমস্যা নিরসন ও কল্যাণের আশায় আহ্বান করে তাদেরকে ভর্ৎসনার সাথে আল্লাহ প্রশ্ন করছেন : আমাকে দেখাও যে, তারা এ সুবিশাল আকাশ ও জমিনের কোন অংশ সৃষ্টি করেছে, না আল্লাহর সাথে তার সৃষ্টিতে অংশীদার হয়েছে? এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ থাকলে নিয়ে আসো। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(قُلْ اَرَءَیْتُمْ شُرَکَا۬ءَکُمُ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِﺚ اَرُوْنِیْ مَاذَا خَلَقُوْا مِنَ الْاَرْضِ اَمْ لَھُمْ شِرْکٌ فِی السَّمٰوٰتِﺆ اَمْ اٰتَیْنٰھُمْ کِتٰبًا فَھُمْ عَلٰی بَیِّنَةٍ مِّنْھُﺆ بَلْ اِنْ یَّعِدُ الظّٰلِمُوْنَ بَعْضُھُمْ بَعْضًا اِلَّا غُرُوْرًا‏)‏

“বল, তোমরা তোমাদের শরীক যাদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে ডাকতে তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? আমাকে দেখাও, জমিনের কোন অংশ তারা সৃষ্টি করেছে, নাকি আসমানের সৃষ্টিতে তাদের কোন অংশিদারীত্ব আছে, অথবা আমি কি তাদেরকে এমন কোন গ্রন্থ দিয়েছি যার প্রমাণের ওপর তারা প্রতিষ্ঠিত। বরং জালিমরা একে অন্যকে শুধু প্রতারণামূলক ওয়াদা দিয়ে থাকে।” (সূরা ফাতির ৩৫ : ৪০)

সূরা সাবার ২২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(قُلِ ادْعُوا الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ ج لَا يَمْلِكُوْنَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمٰوٰتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيْهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَّمَا لَه۫ مِنْهُمْ مِّنْ ظَهِيْرٍ ‏)

“বল, তোমরা তাদেরকে আহ্বান কর, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মা‘বূদ) মনে করতে, তারা আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ কিছুরও অধিকারী নয়, এতদুভয়ে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহর সহায়তাকারীও নয়।”

পূর্ববর্তী কোন আসমানী কিতাবের প্রমাণ না থাকলে

(أَثٰرَةٍ مِّنْ عِلْمٍ)

তথা রাসূলদের পরম্পরাগত কোন উক্তি নিয়ে আসো যে, তারা এরূপ শিরক করতে বলেছেন।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :

( أَثٰرَةٍ مِّنْ عِلْمٍ)

হল জমিনে দাগ টানা যা আরবরা করত। (ফাতহুল বারী ৮/৫৭৬, সহীহ) মোট কথা মুশরিকরা কোন প্রকার দলীল আনতে সক্ষম হয়নি। বরং সকল আসমানী কিতাব ও নাবীগণ এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন, কখনো তারা শিরক করার নির্দেশ দেননি।

সুতরাং যারা কিছুই সৃষ্টি করেনি এবং আল্লাহ তা‘আলার সাথে সৃষ্টিতে শরীকও হয়নি, যারা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের আহ্বানে সাড়া দিতে অক্ষম এমন মা‘বূদদেরকে যারা মুশকিলের আসানদাতা ও কল্যাণ বয়ে আনার জন্য আহ্বান করে তাদের চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে? অতএব আমাদের জানা উচিত যারা কবরে শায়িত তাদের কাছে বিপদাপদ নিরসনের প্রস্তাব পেশ করলে এবং কল্যাণ কামনা করলে কি তারা সাড়া দিতে সক্ষম হবে? কখনো নয়, বরং তারাই তো কবরে অসহায়। মানুষের দু‘আর মুখাপেক্ষী, তাদের পক্ষ থেকে দান-সদকার মুখাপেক্ষী। তাই সকল বিপদ-আপদ ও সুখ-সাচ্ছন্দ্যে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ডাকতে হবে।

(وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ)

‘(হাশরের ময়দানে) যখন সব মানুষকে একত্রিত করা হবে’ অর্থাৎ যখন হাশর হবে তখন কাফিররা একে অপরের শত্র“তে পরিণত হবে এবং তারা যাদের ইবাদত করত তারাও শত্র“তে পরিণত হবে ও ইবাদত অস্বীকার করবে। এর কারণ হল কাফির-মুশরিকরা তাদের মা‘বূদের ইবাদত করতো এ আশায় যে, তারা কিয়ামতের দিন তাদের উপকারে আসবে, তাদের জন্য শাফায়াত করবে। কিন্তু কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে তারা সব অস্বীকার করবে এবং বলবে আমরা তো তোমাদেরকে আমাদের ইবাদত করতে বলিনি। তবে মুমিনরা পরস্পর শত্র“তে পরিণত হবে না। কারণ তাদের সম্পর্ক ছিল আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের সাথে। এ সম্পর্কে সূরা ইউনুসের ২৯ নং আয়াতে, মারইয়ামের ৮১-৮২ নং আয়াতে, আনকাবুতের ২৫ নং আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে ।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যাকে ডাকা হচ্ছে কিয়ামতের দিন তারা কোন উপকার তো দুরের কথা আরো শত্র“ হয়ে দাঁড়াবে।
৩. যিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনি সকল ইবাদত পাওয়ার হকদার।
৭-৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

কাফির-মুশরিকদের সামনে আল্লাহ তা‘আলার কালাম কুরআন তেলাওয়াত করা হলে তারা বলে এটা একটি সুস্পষ্ট জাদু। আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন জাদুকর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন

(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِلْحَقِّ لَمَّا جَا۬ءَهُمْ لا إِنْ هٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ مُّبِيْنٌ ‏)‏

“আর কাফিরদের কাছে যখন এ সত্য (কুরআন) আসল তখন তারা বলল- এটা প্রকাশ্য জাদু ব্যতীত আর কিছুই নয়।।” (সূরা সাবা ৩৪ : ৪৩)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَمَّا جَا۬ءَهُمُ الْحَقُّ قَالُوْا هٰذَا سِحْرٌ وَّإِنَّا بِه۪ كٰفِرُوْنَ ‏)‏

“যখন তাদের নিকট সত্য আসল তখন তারা বললো- এটা তো জাদু এবং আমরা অবশ্যই এর প্রতি অস্বীকার জ্ঞাপন করি।”

মূলত কাফিরদের এসব কথা দ্বারা উদ্দেশ্য- নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব নিজের পক্ষ থেকে তৈরি করে এনেছে।

আল্লাহ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শিখিয়ে দিচ্ছেন, বলে দাও, যদি আমি নিজের পক্ষ থেকে তৈরি করে আনতাম তাহলে আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে তোমরা আমাকে রক্ষা করতে পারতে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- “যদি সে নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিত, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, এবং কেটে দিতাম তার হৃৎপিণ্ডের শিরা। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকত না, যে তার থেকে আমাকে বিরত রাখতে পারে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯ : ৪৪-৪৭)

(مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ)

‘আমি কোন নতুন রাসূল নই’ بدع অর্থ নতুন, যার পূর্ব কোন উপমা নেই। তাই আল্লাহ তা‘আলাকে বলা হয়

(بَدِيْعُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)

“তিনি আকাশ ও পৃথিবীর অস্তিত্ব দান করেন” (সূরা বাকারাহ ২ : ১১৭) অর্থাৎ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নতুন ও প্রথম রাসূল নন, তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল অতীত হয়ে গেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ رُسُلًا إِلٰي قَوْمِهِمْ فَجَا۬ءُوْهُمْ بِالْبَيِّنٰتِ)

“আমি তো প্রেরণ করেছিলাম তোমার পূর্বে বহু রাসূল তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিকট, তারা তাদের কাছে সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত নিয়ে এসেছিল।” (সূরা রুম ৩০ : ৪৭) এছাড়াও এ ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে যা যুগে যুগে অসংখ্য নাবী-রাসূলের আগমনের কথা প্রমাণ করে।

(وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلَا بِكُمْ)

‘আর আমি জানি না যে, আমার সাথে ও তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে’ অর্থাৎ দুনিয়াতে কী করা হবে, তা আমার অজানা।

আমি মক্কায় থাকব, না এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হবে, আমার সাধারণ মরণ হবে না কারো হাতে মৃত্যু হবে? এটাও জানা নেই আগামী কাল আমার অথবা তোমাদের সাথে কী আচরণ করা হবে? তবে পরকাল সম্পর্কে আমি নিশ্চিতরূপে বিদিত যে, মুুমিনরা জান্নাতে আর কাফিররা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কোন সাহাবীর মৃত্যুর সময় তার ব্যাপারে সু-ধারণা প্রকাশ করা হলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আমি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল হওয়া সত্ত্বেও এ কথা জানিনা যে, আমার ও তোমাদের সাথে কী ব্যবহার করা হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৯৩৯)

ইবনু আব্বাস, আনাস, কাতাদাহ প্রমুখ মুফাসসিরগণ বলেন : যখন এ আয়াত নাযিল হয় তখন মুশরিক, ইয়াহূদ ও মুনাফিকরা খুব খুশি হয় এবং বলে : কিভাবে এমন রাসূলের অনুসরণ করব যে জানেনা তাঁর সাথে ও আমাদের সাথে কি আচরণ করা হবে? তাহলে আমাদের ওপর তাঁর কোন ফযীলত নেই। তখন নাযিল হয়-

(لِيَغْفِرَ لَكَ اللّٰهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْۭبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ)

(সূরা ফাতহ ৪৮ : ২, তাফসীর আযওয়াউল বায়ান)

এসব প্রমাণ করছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গায়েব জানেন না, বরং তিনি কেবল তাঁর প্রতি যে ওয়াহী করা হয় তার অনুসরণ করেন এবং ওয়াহীর মাধ্যমে গায়েবের যতটুকু জ্ঞান দান করা হয় ততটুকু জানেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সত্য আগমনের পর তা সত্য হিসেবে জানার পরেও একশ্রেণির মানুষ বিভিন্ন বাহানা করে সত্য পরিত্যাগ করে।
২. আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন মিথ্যা কথা বললে আল্লাহ তা‘আলা ছেড়ে দেবেন না।
৩. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন নতুন রাসূল নন, তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল অতীত হয়ে গেছেন।
১০-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতের এবং

(أَوَلَمْ يَكُنْ لَّهُمْ اٰيَةً أَنْ يَّعْلَمَه۫ عُلَمٰٓؤُا بَنِيْ۬ إِسْرَا۬ئِيْلَ) ‏

“বানী ইস্রাঈলের পণ্ডিতগণ এটা অবগত আছে- এটা কি তাদের জন্য নিদর্শন নয়?” সূরা শুআরার অত্র আয়াতের অর্থ একই রকম। সারমর্ম এই যে, যেসব ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রেসালাত ও কুরআনকে অমান্য করে তারা স্বয়ং তাদের কিতাব সম্পর্কেও অজ্ঞ। কেননা, বানী ইসরাঈলের অনেক আলেম তাদের কিতাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। সে আলেমদের সাক্ষ্যও কি এ মুর্খদের জন্য যথেষ্ট নয়? কিন্তু তোমরা যদি না মান তবে এ সম্ভাবনার প্রতিও লক্ষ্য কর যে, আমার দাবী যদি সত্য হয় এবং কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কিতাব হয় আর তোমরা একে অমান্য করে যাও তবে তোমাদের পরিণতি কী হবে। এ জ্ঞান লাভের পরও যদি তোমরা জেদ ও অহংকারে অটল থাক তবে তোমরা গুরুতর শাস্তির যোগ্য হয়ে যাবে।

(وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّنْۭ بَنِيْٓ إِسْرَا۬ئِيْلَ)

‘বানী ইসরাঈলের একজন সাক্ষী সাক্ষ্যও দিয়েছে’ বানী ইসরাঈলের এই সাক্ষী থেকে কাকে বুঝানো হয়েছে- তা নিয়ে অনেক মতভেদ পাওয়া যায় : কেউ বলেছেন যে, এ শব্দটি জাতি বা সম্প্রদায় অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। বানী ইসরাঈলের সকল ঈমান আনয়নকারী এর অন্তর্ভুক্ত। কারো মতে, সূরাটি মাক্কী হওয়ার ফলে মক্কায় অবস্থানকারী কোন এক বানী ইসরাঈল উদ্দেশ্য হবে অথবা আয়াতটি ভবিষ্যতবাণী হিসেবে গণ্য করা হবে। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) আবার যারা আয়াতকে মাদানী বলে গণ্য করেছেন তারা আব্দুল্লাহ বিন সালামকে বুঝিয়েছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ননা থেকেও এ উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়। (সহীহ বুখারী হা. ৩৮১২, সহীহ মুসলিম হা. ২৪৮৩) ইমাম শাওকানী (রহঃ) এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

عَلَي مِثْلِهِ এর অর্থ হল : তাওরাতের সাক্ষ্য দেয়া যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কথা একান্তভাবে প্রমাণ করে। কেননা, কুরআনেও তাওহীদ ও পরকালের ওপর বিশ্বাসের ব্যাপার তাওরাতের মতই।

(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَوْ كَانَ خَيْرًا مَّا سَبَقُوْنَآ إِلَيْهِ)

“কাফিররা ঈমানদারদের সম্পর্কে বলে যে, যদি এটা (কিতাবকে মেনে নেওয়া সত্যিই) কোনো ভাল কাজ হতো তাহলে তারা এ বিষয়ে আমাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারত না।” আল্লাহ তা‘আলার হিকমত হল : আল্লাহ তা‘আলা কতক মানুষ দ্বারা কতক মানুষকে পরীক্ষা করবেন। যারা বিত্তশালী ও মর্যাদার অধিকারী তারা বলে : যদি ইসলামে কল্যাণ থাকত তাহলে আমাদের আগে এ দুর্বলেরা ইসলাম গ্রহণ করতে পারত না। আমরাই অধিক হকদার কল্যাণ গ্রহণ করার। তাদের এ মিথ্যা দাবীর প্রতিবাদ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(أَلَيْسَ اللّٰهُ بِأَعْلَمَ بِالشّٰكِرِيْنَ)

“আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকেদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন?” (সূরা আন্‘আম ৬ : ৫৩)

جهالة অজ্ঞতাবশত যদি কেউ খারাপ কাজ করে অতঃপর তাওবাহ করে। এ সম্পর্কে সূরা নিসার ১৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ)

‘‘নিশ্চয়ই যারা বলেছে”, আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের প্রতিপালক’ অর্থাৎ যারা ঈমান আনার পর তার ওপর অটল থাকে পরকালে তাদের কোন দুশ্চিন্তা ও ভয় থাকবে না। এ আয়াতের তাফসীর সূরা হা-মীম সিজদার ২০ নং আয়াতেও করা হয়েছে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি এই কুরআন কারীম স্বীয় বান্দা ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন। তিনি এমনই সম্মানের অধিকারী যে, তা কখনো নষ্ট হবার নয় এবং তিনি এমনই প্রজ্ঞাময় যে, তাঁর কোন কথা ও কাজ প্রজ্ঞাশূন্য নয়।

এরপর ইরশাদ হচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতোদুভয়ের সব জিনিসই যথাযথভাবে নির্দিষ্ট কালের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। কোনটাই তিনি অযথা ও বৃথা সৃষ্টি করেননি।

(আরবী) -এর অর্থ হচ্ছে নির্দিষ্ট কাল, যা বৃদ্ধিও পাবে না এবং কমেও যাবে। এই রাসূল (সঃ), এই কিতাব (কুরআন) এবং সতর্ককারী অন্যান্য নিদর্শনাবলী হতে যে দুষ্টমতি লোকেরা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বেপরোয়া হয় তারা নিজেদের কি পরিমাণ ক্ষতি করেছে তা তারা সত্বরই জানতে পারবে।

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ এই মুশরীকদেরকে তুমি জিজ্ঞেস কর- তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো এবং যাদের ইবাদত কর, তাদের কথা কিছু ভেবে দেখেছো কি? তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও তো? অথবা আকাশমণ্ডলীতে তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি? প্রকৃত ব্যাপার তো এই যে, আকাশ হোক, পৃথিবী হোক, যে কোন জিনিসই হোক না কেন সবকিছুরই সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া কারো এক অণুপরিমাণ জিনিসেরও অধিকার নেই। সমগ্র রাজ্যের মালিক তিনিই। প্রত্যেক জিনিসের উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান একমাত্র তিনি। তিনিই সবকিছুর ব্যবস্থাপক। সবকিছুরই উপর পূর্ণ অধিকার একমাত্র তিনিই রাখেন। সুতরাং মানুষ তাঁর ছাড়া অন্যদের ইবাদত কেন করে? কেন তারা তাদের বিপদ-আপদের সময় অল্লাহ ছাড়া অন্যকে ডাকে? কে তাদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছে? কে তাদেরকে এ শিরক করতে | শিখিয়েছে? প্রকতপক্ষে কোন সৎ ও জ্ঞানী মানুষের এ শিক্ষা হতে পারে না ।
মহান আল্লাহ তাদেরকে এ শিক্ষা দেননি। তাই তো তিনি বলেনঃ “পূর্ববর্তী কোন কিতাব অথবা পরম্পরাগত কোন জ্ঞান থাকলে তা আমার নিকট উপস্থিত কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ কিন্তু আসলে তো এটা তোমাদের বাজে ও বাতিল কাজ। সুতরাং তোমরা এর স্বপক্ষে না পারবে কোন শরীয়ত সম্মত দলীল পেশ করতে এবং না পারবে কোন জ্ঞান সম্মত দলীল পেশ করতে। এক কিরআতে (আরবী) রয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তীদের হতে কোন সঠিক জ্ঞানের বর্ণনা পেশ কর।

মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ এমন কাউকেও উপস্থিত কর যে সঠিক ইলমের বর্ণনা দিতে পারে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ এই বিষয়ের কোন দলীল আনয়ন কর।

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান-লিপি। বর্ণনাকারী বলেন যে, তাঁর ধারণামতে এ হাদীসটি মার’। হযরত আবু বকর ইবনে আইয়াশ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা বাকী ইলমকে বুঝানো হয়েছে। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ ‘কোন গোপন দলীলও পেশ কর?’ এই সব গুরুজন হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা পূর্ববতী লিপি উদ্দেশ্য। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা কোন বিশেষ জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। এসব উক্তি প্রায় একই অর্থবোধক। ভাবার্থ ওটাই যা আমরা প্রথমে বর্ণনা করেছি। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দিবে না? এবং এগুলো তাদের প্রার্থনা সম্বন্ধে অবহিতও নয়। কেননা এগুলো তো পাথর এবং জড় পদার্থ। এরা না শুনতে পায়, না দেখতে পায়।

কিয়ামতের দিন যখন সব মানুষকে একত্রিত করা হবে তখন এসব বাতিল মা’বুদ বা উপাস্য তাদের উপাসকদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তারা এদের ইবাদত অস্বীকার করবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য মাবুদ গ্রহণ করে এ জন্যে যে, যাতে তারা তাদের সহায় হয়। কখনই নয়; তারা তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।”(১৯:৮১-৮২) অর্থাৎ যখন এরা তাদের পূর্ণ মুখাপেক্ষী হবে তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিবে।

হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (সঃ) তাঁর উম্মতকে বলেছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা আল্লাহ ব্যতীত প্রতিমাগুলোর সাথে যে পার্থিব সম্পর্ক স্থাপন করেছো এর ফলাফল তোমরা কিয়ামতের দিন দেখে নিবে, যখন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরকে লা’নত করবে, আর তোমাদের আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের জন্যে কোন সাহায্যকারী হবে না।”
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

মুশরিকদের হঠকারিতা, ঔদ্ধত্য এবং কুফরীর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার প্রকাশ্য, স্পষ্ট এবং পরিষ্কার আয়াতসমূহ শুনানো হয় তখন তারা বলে থাকেঃ এটা তো যাদু ছাড়া কিছুই নয়। মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, অপবাদ দেয়া, পথভ্রষ্ট হওয়া এবং কুফরী করাই যেন তাদের নীতি। তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে শুধু যাদুকর বলেই ক্ষান্ত হয় না, বরং একথাও বলে যে, তিনি কুরআনকে নিজেই রচনা করেছেন। তাই মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তাদেরকে বল- আমি যদি নিজেই কুরআনকে রচনা করে থাকি এবং আমি আল্লাহ তাআলার সত্য নবী না হই তবে অবশ্যই তিনি আমাকে আমার এ মিথ্যা অপবাদের কারণে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন, তখন তোমরা কেন, সারা দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে আমাকে তাঁর এ আযাব হতে রক্ষা করতে পারে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! তুমি বলঃ আল্লাহ হতে কেউ আমাকে বাঁচাতে পারে না এবং তিনি ছাড়া আমি কোন আশ্রয়স্থল ও পলায়নের জায়গা পাবো না। কিন্তু আমি তার পক্ষ হতে প্রচার ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।”(৭২:২২) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সে যদি আমার নামে কিছু রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতো, তবে অবশ্যই আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, এবং কেটে দিতাম তার জীবন ধমনী, অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, যে তাকে রক্ষা করতে পারে।”(৬৯:৪৪-৪৭)।

এরপর কাফিরদেরকে ধমকানো হচ্ছে যে, তারা যে বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত আছে, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। তিনি সবারই মধ্যে ফায়সালা করবেন।

‘এই ধমকের পর তাদেরকে তাওবা করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যদি তোমরা তার দিকে ফিরে আসো এবং তোমাদের কৃতকর্ম হতে বিরত থাকো তবে তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। সূরায়ে ফুরকানে এ বিষয়েরই আয়াত রয়েছে। সেখানে আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা বলেঃ এগুলো তো সেকালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়ে এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তার নিকট পাঠ করা হয়। বলঃ এটা তিনিই অবতীর্ণ করেছেন যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমুদয় রহস্য অবগত আছেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(২৫:৫-৬)

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেন, তুমি বলঃ আমি তো প্রথম রাসূল নই। আমার পূর্বে তো দুনিয়ায় মানুষের নিকট রাসূল আসতেই থেকেছেন। সুতরাং আমার আগমনে তোমাদের এতো বিস্মিত হবার কারণ কি? আমার এবং তোমাদের ব্যাপারে কি করা হবে তাও তো আমি জানি না।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি হিসেবে এই আয়াতের পরে (আরবী) (যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ক্রটিসমূহ মার্জনা করেন ৪৮:২)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অনুরূপভাবে হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত হাসান (রঃ) এবং হযরত কাতাদাও (রঃ) .. (আরবী) আয়াতটি দ্বারা (আরবী)-এ আয়াতটি রহিত বলেছেন। যখন (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “এ আয়াত দ্বারা তো আল্লাহ তা’আলা আপনার সাথে যা করবেন তা বর্ণনা করলেন, এখন আমাদের সাথে তিনি কি করবেন?” তখন আল্লাহ তা’আলা নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেন আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে প্রবিষ্ট করেন এমন জান্নাতে যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত।”(৪৮:৫)

সহীহ হাদীস দ্বারাও এটা প্রমাণিত যে, মুমিনরা বলেছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনাকে মুবারকবাদ! বলুন, আমাদের জন্যে কি আছে?” তখন আল্লাহ তা’আলা … (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।

হযরত যহহাক (রঃ) (আরবী)-এ আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ ‘আমাকে কি হুকুম দেয়া হবে এবং কোন জিনিস হতে নিষেধ করা হবে তা আমি জানি না।’

হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতের ভাবার্থ হলোঃ ‘পরকালের পরিণাম তো আমার জানা আছে যে, আমি জান্নাতে যাবো, কিন্তু দুনিয়ার অবস্থা আমার জানা নেই যে, পূর্ববর্তী কোন কোন নবী (আঃ)-এর মত আমাকে হত্যা করা হবে, না আমি আমার আয়ু পূর্ণ করে আল্লাহ তা’আলার নিকট হাযির হবো? অনুরূপভাবে আমি এটাও জানি না যে, তোমাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে, না তোমাদের উপর পাথর বর্ষিত হবে?’ ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকেই বিশ্বাসযোগ্য বলেছেন। আর প্রকৃতপক্ষেও এটা ঠিকই বটে যে, তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা যে জান্নাতে যাবেন এটা তার নিশ্চিত রূপে জানা ছিল এবং দুনিয়ার অবস্থার পরিণাম সম্পর্কে তিনি ছিলেন বে-খবর যে, তার এবং তার বিরোধী কুরায়েশদের অবস্থা কি হতে পারে? তারা কি ঈমান আনবে, না কুফরীর উপরই থাকবে ও শাস্তিপ্রাপ্ত হবে, না কি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে?

উম্মুল আলা (রাঃ) হতে বর্ণিত, যিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন, তিনি বলেনঃ “লটারীর মাধ্যমে মুহাজিরদেরকে যখন আনসারদের মধ্যে বন্টন করা হচ্ছিল তখন আমাদের ভাগে আসেন হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রাঃ)। আমাদের এখানেই তিনি রুগ্ন হয়ে পড়েন এবং অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হন। আমরা যখন তাকে কাফন পরিয়ে দিই এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-ও আগমন করেন তখন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েঃ হে আবূ সায়েব (রাঃ)! আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন! আপনার ব্যাপারে আমার সাক্ষ্য এই যে, আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে সম্মান দান করবেন! আমার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বললেনঃ “তুমি কি করে জানতে পারলে যে, আল্লাহ তাকে সম্মান প্রদান করবেন?” তখন আমি বললামঃ আপনার উপর আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক! আমি কিছুই জানি না। তিনি তখন বললেনঃ “তাহলে জেনে রেখো যে, তার কাছে তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিশ্চিত বিষয় (মৃত্যু) এসে গেছে। তার সম্পর্কে আমি কল্যাণেরই আশা রাখি। আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর রাসূল হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে কি করা হবে তা আমি জানি না।” আমি তখন বললামঃ “আল্লাহর কসম! আজকের পরে আর কখনো আমি কাউকেও পবিত্র ও নিস্পাপ বলে নিশ্চয়তা প্রদান করবো না। আর এতে আমি বড়ই দুঃখিত হই। কিন্তু আমি স্বপ্নে দেখি যে, হযরত উসমান ইবনে মাউন (রাঃ)-এর একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে এটা বর্ণনা করি। তখন তিনি বলেনঃ “এটা তার আমল।” এর অন্য একটি সনদে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি আল্লাহর রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে কি করা হবে তা জানি না। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং শুধু ইমাম বুখারী (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন, ইমাম মুসলিম (রঃ) করেননি) অবস্থা হিসেবে এ শব্দগুলোই সঠিক বলে মনে ধরছে। কেননা, এর পরেই হযরত উম্মুল আ’লা (রাঃ)-এর উক্তি রয়েছেঃ এতে আমি বড়ই দুঃখ পাই।’

মোটকথা, এই হাদীস এবং এর অর্থেরই আরো অন্যান্য হাদীসসমূহ এটাই প্রমাণ করে যে, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জান্নাতী হওয়ার নিশ্চিত জ্ঞান কারো নেই এবং কারো এ ধরনের মন্তব্য করা উচিতও নয় যে, অমুক ব্যক্তি জান্নাতী। তবে ঐ মহান ব্যক্তিবর্গ এর ব্যতিক্রম যাদেরকে শরীয়ত প্রবর্তক (সঃ) জান্নাতী বলে ঘোষণা করেছেন। যেমন সুসংবাদ প্রদত্ত দশজন ব্যক্তি (আশারায়ে মুবাশশারাহ রাঃ), হযরত ইবনে সালাম (রাঃ), হযরত আমীসা (রাঃ), হযরত বিলাল (রাঃ), হযরত জাবির (রাঃ)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম (রাঃ), বি’রে মাউনায় শাহাদাত প্রাপ্ত সত্তরজন কারী (রাঃ), হযরত যায়েদ ইবনে হারেসাহ (রাঃ), হযরত জাফর (রাঃ), হযরত ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) এবং এঁদের মত আরো যারা বুযুর্গ ব্যক্তি রয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা তাদের সবারই প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলঃ আমি আমার প্রতি অবতারিত অহীরই শুধু অনুসরণ করি এবং আমি এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। আমার কাজ প্রত্যেক জ্ঞানী ও বিবেকবান ব্যক্তির নিকট স্পষ্টভাবে প্রকাশমান। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
১০-১২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি এই মুশরিক ও কাফিরদেরকে বল- সত্যিই যদি এই কুরআন আল্লাহর নিকট হতে এসে থাকে এবং এর পরও যদি তোমরা এটাকে অস্বীকার করতেই থাকে। তবে তোমাদের অবস্থা কি হতে পারে তা চিন্তা করেছো কি? যে আল্লাহ তাবারাকা, ওয়া তা’আলা আমাকে সত্যসহ তোমাদের নিকট এই পবিত্র কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছেন, তিনি তোমাদেরকে কি শাস্তি প্রদান করবেন তা কি ভেবে দেখেছো? তোমরা এই কিতাবকে অস্বীকার করছে এবং মিথ্যা জানছো, অথচ এর সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করছে ঐ সব কিতাব যেগুলো ইতিপূর্বে সময়ে সময়ে পূর্ববর্তী নবীদের উপর নাযিল হতে থেকেছে এবং বানী ইসরাঈলের একজন এর সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছে এবং এর হাকীকতকে চিনেছে ও মেনেছে এবং এর উপর ঈমান এনেছে। কিন্তু তোমরা এর অনুসরণ হতে গর্বভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

ভাবার্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ঐ সাক্ষী তার নবীর উপর এবং তার কিতাবের উপর বিশ্বাস করেছে, কিন্তু তোমরা তোমাদের নবীর সাথে ও তোমাদের কিতাবের সাথে কুফরী করেছো।

আল্লাহ তা’আলা যালিমদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।

(আরবী) শব্দটি (আরবী) এবং এটা স্বীয় সাধারণ অর্থের দিক দিয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) প্রমুখ সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করে। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এ আয়াতটি মাক্কী এবং এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অবতীর্ণ হয়। নিম্নের আয়াতটিও এ আয়াতের অনুরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তাদের কাছে পাঠ করা হয় তখন তারা বলে- আমরা এর উপর ঈমান আনলাম, নিশ্চয়ই এটা আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে সত্য, আমরা তো এর পূর্বেই মুসলমান ছিলাম।”(২৮:৫৩) অন্য জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলেঃ আমাদের প্রতিপালক পবিত্র, মহান। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে।”(১৭:১০৭-১০৮)

হযরত মাসরূক (রঃ) এবং হযরত শা’বী (রঃ) বলেন যে, এখানে এই আয়াত দ্বারা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-কে বুঝানো হয়নি। কেননা, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মক্কায়, আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মদীনায় হিজরতের পর।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এবং ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনিনি যে, ভূ-পৃষ্ঠে চলাফেরাকারী কোন মানুষকে তিনি জান্নাতবাসী বলেছেন, একমাত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ছাড়া। তাঁর ব্যাপারেই (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত যহহাক (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত ইউসুফ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে সালাম (রঃ), হযরত হিলাল ইবনে ইয়াসাফ (রঃ), হযরত সাওরী (রঃ) হযরত মালিক ইবনে আনাস (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এ আয়াত দ্বারা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালামকেই (রাঃ) বুঝানো হয়েছে।

ইরশাদ হচ্ছেঃ এই কাফিররা বলে- “এই কুরআন যদি ভাল জিনিসই হতো তবে আমাদের ন্যায় সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং আল্লাহর গৃহীত বান্দাদের উপর বিলাল (রাঃ), আম্মার (রাঃ), সুহায়েব (রাঃ), খাব্বাব (রাঃ) প্রমুখ নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা অগ্রগামী হতো না। বরং সর্বপ্রথম আমরাই এটা কবুল করতাম। কিন্তু এটা তাদের সম্পূর্ণ বাজে ও ভিত্তিহীন কথা। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এভাবেই আমি তাদের কাউকেও কারো উপর ফিত্নায় ফেলে থাকি, যেন তারা বলেঃ এরাই কি তারা, আমাদের মধ্য হতে যাদের উপর আল্লাহ তা’আলা অনুগ্রহ করেছেন?”(৬:৫৩) অর্থাৎ তারা বিস্মিত হয়েছে যে, কি করে এ লোকগুলো হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে! যদি এটাই হতো তবে তো তারাই অগ্রগামী হতো। কিন্তু ওটা ছিল তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এটা নিশ্চিত কথা যে, যাদের সুবুদ্ধি রয়েছে এবং যারা শান্তিকামী লোক তারা সদা কল্যাণের পথে অগ্রগামীই হয়। এ জন্যেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস এই যে, যে কথা ও কাজ আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর সাহাবীগণ (রাঃ) হতে প্রমাণিত না হয় ওটা বিদআত। কেননা, যদি তাতে কল্যাণ নিহিত থাকতো তবে ঐ পবিত্র দলটি, যারা কোন কাজেই পিছনে থাকতেন না, তাঁরা ওটাকে কখনো ছেড়ে দিতেন না।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন যে, এই কাফিররা কুরআন দ্বারা পরিচালিত নয় বলে তারা বলেঃ ‘এটা তো এক পুরাতন মিথ্যা।’ একথা বলে তারা কুরআন এবং কুরআনের ধারক ও বাহকদেরকে ভর্ৎসনা করে থাকে। এটাই ঐ অহংকার যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অহংকার হলো সত্যকে সরিয়ে ফেলা এবং লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।”

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এর পূর্বে ছিল মূসা (আঃ)-এর কিতাব আদর্শ ও অনুগ্রহ স্বরূপ। ওটা হলো তাওরাত। এই কিতাব অর্থাৎ কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সমর্থক। এই কুরআন আরবী ভাষায় অবতারিত। এর ভাষা অলংকার ও বাকচাতুর্যপূর্ণ এবং ভাবার্থ অতি স্পষ্ট ও প্রকাশমান। এটা যালিম ও কাফিরদেরকে সতর্ক করে এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয়। এর

পরবর্তী আয়াতের তাফসীর সূরায়ে হা-মীম আসসাজদাহর মধ্যে গত হয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই অর্থাৎ আগামীতে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই এবং তারা চিন্তিত ও দুঃখিত হবে না, অর্থাৎ তারা তাদের ছেড়ে যাওয়া জিনিসগুলোর জন্যে মোটেই দুঃখিত হবে না।

তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেথায় তারা স্থায়ী হবে। এটাই তাদের ভাল কর্মের ফল।

Leave a Reply