أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১২৪) [ * *  *আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে নেয়ার অর্থ কী? : –   *পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার :- ** বান্দার সাথে মনিবের ভূমিকা কী:-] www.motaher21.net সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬ ১৩-২০ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১২৪)
[ * *  *আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে নেয়ার অর্থ কী? : –
*পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার :-
** বান্দার সাথে মনিবের ভূমিকা কী:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ পারা:২৬
১৩-২০ নং আয়াত:-
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৩
اِنَّ الَّذِیۡنَ قَالُوۡا رَبُّنَا اللّٰہُ ثُمَّ اسۡتَقَامُوۡا فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿ۚ۱۳﴾
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’ তারপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৪
اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ۚ جَزَآءًۢ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۴﴾
তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তারা যা আমল করত তার পুরস্কার স্বরূপ।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৫
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡہِ اِحۡسٰنًا ؕ حَمَلَتۡہُ اُمُّہٗ کُرۡہًا وَّ وَضَعَتۡہُ کُرۡہًا ؕ وَ حَمۡلُہٗ وَ فِصٰلُہٗ ثَلٰثُوۡنَ شَہۡرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا بَلَغَ اَشُدَّہٗ وَ بَلَغَ اَرۡبَعِیۡنَ سَنَۃً ۙ قَالَ رَبِّ اَوۡزِعۡنِیۡۤ اَنۡ اَشۡکُرَ نِعۡمَتَکَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنۡ اَعۡمَلَ صَالِحًا تَرۡضٰہُ وَ اَصۡلِحۡ لِیۡ فِیۡ ذُرِّیَّتِیۡ ۚؕ اِنِّیۡ تُبۡتُ اِلَیۡکَ وَ اِنِّیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿۱۵﴾
আমি মানুষকে এই মর্মে নির্দেশনা দিয়েছি যে, তারা যেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে। তার মা কষ্ট করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলো এবং কষ্ট করেই তাকে প্রসব করেছিলো। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধপান করাতে ত্রিশ মাস লেগেছে। এমন কি যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছেছে এবং তারপর চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয়েছে তখন বলেছেঃ “হে আমার রব, তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যেসব নিয়ামত দান করেছো আমাকে তার শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দাও। আর এমন সৎ কাজ করার তাওফীক দাও যা তুমি পছন্দ করো। আমার সন্তানদেরকে সৎ বানিয়ে আমাকে সুখ দাও। আমি তোমার কাছে তাওবা করছি। আমি নির্দেশের অনুগত (মুসলিম) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৬
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ نَتَقَبَّلُ عَنۡہُمۡ اَحۡسَنَ مَا عَمِلُوۡا وَ نَتَجَاوَزُ عَنۡ سَیِّاٰتِہِمۡ فِیۡۤ اَصۡحٰبِ الۡجَنَّۃِ ؕ وَعۡدَ الصِّدۡقِ الَّذِیۡ کَانُوۡا یُوۡعَدُوۡنَ ﴿۱۶﴾
আমি এদেরই সর্বোৎকৃষ্ট কর্মগুলো গ্রহণ করে থাকি এবং তাদের মন্দ কর্মগুলো ক্ষমা করে দিই, তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা সত্য প্রমাণিত হবে।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৭
وَ الَّذِیۡ قَالَ لِوَالِدَیۡہِ اُفٍّ لَّکُمَاۤ اَتَعِدٰنِنِیۡۤ اَنۡ اُخۡرَجَ وَ قَدۡ خَلَتِ الۡقُرُوۡنُ مِنۡ قَبۡلِیۡ ۚ وَ ہُمَا یَسۡتَغِیۡثٰنِ اللّٰہَ وَیۡلَکَ اٰمِنۡ ٭ۖ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ ۚۖ فَیَقُوۡلُ مَا ہٰذَاۤ اِلَّاۤ اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۱۷﴾
আর যে ব্যক্তি তার পিতা মাতাকে বললো : “আহ! তোমরা বিরক্তির একশেষ করে দিলে। তোমরা কি আমাকে এ ভয় দেখাচ্ছো যে, মৃত্যুর পর আমি আবার কবর থেকে উত্তোলিত হবো? আমার পূর্বে তো আরো বহু মানুষ চলে গেছে। (তাদের কেউ তো জীবিত হয়ে ফিরে আসেনি) ।” মা-বাপ আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলেঃ “আরে হতভাগা, বিশ্বাস কর। আল্লাহর ওয়াদা সত্য।” কিন্তু সে বলে, “এসব তো প্রাচীনকালের বস্তাপচা কাহিনী”
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৮
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ حَقَّ عَلَیۡہِمُ الۡقَوۡلُ فِیۡۤ اُمَمٍ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا خٰسِرِیۡنَ ﴿۱۸﴾
এরাই সেই সব লোক যাদের ব্যাপারে আযাবের সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। এদের পূর্বে জ্বীন ও মানুষদের মধ্য থেকে (এই প্রকৃতির) যেসব ক্ষুদ্র দল অতীত হয়েছে এরাও গিয়ে তাদের সাথে মিলিত হবে। নিশ্চয়ই এরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার লোক।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-১৯
وَ لِکُلٍّ دَرَجٰتٌ مِّمَّا عَمِلُوۡا ۚ وَ لِیُوَفِّیَہُمۡ اَعۡمَالَہُمۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ ﴿۱۹﴾
উভয় দলের প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা হবে তাদের কর্ম অনুযায়ী। যাতে আল্লাহ‌ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান দেন। তাদের প্রতি মোটেই জুলুম করা হবে না।
সূরা:৪৬- আল-আহক্বাফ-২০
وَ یَوۡمَ یُعۡرَضُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا عَلَی النَّارِ ؕ اَذۡہَبۡتُمۡ طَیِّبٰتِکُمۡ فِیۡ حَیَاتِکُمُ الدُّنۡیَا وَ اسۡتَمۡتَعۡتُمۡ بِہَا ۚ فَالۡیَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ الۡہُوۡنِ بِمَا کُنۡتُمۡ تَسۡتَکۡبِرُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ وَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَفۡسُقُوۡنَ ﴿٪۲۰﴾
অতঃপর এসব কাফেরদের যখন আগুনের সামনে এনে দাঁড় করানো হবে তখন তাদের বলা হবে, ‘তোমরা নিজের অংশের নিয়ামতসমূহ দুনিয়ার জীবনেই ভোগ করে নিঃশেষ করে ফেলেছো এবং তা ভোগ করেছো এবং যে নাফরমানি করেছো সে কারণে আজ তোমাদের লাঞ্ছনাকর আযাব দেয়া হবে’।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে নেয়ার অর্থ কী? : প্রথম পর্বের শেষভাগে বর্ণনা করা হচ্ছে সৎকর্মশীলদের প্রতিদান এবং কোরআন তাদেরকে যে সুসংবাদ দেয় তার ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। এই সাথে এই সুসংবাদের শর্তও উল্লেখ করা হচ্ছে যে, মহান আল্লাহর একক প্রভুত্বে তথা তাওহীদে ও তাওহীদের অনিবার্য দাবীর ব্যাপারে অটল ও অবিচল বিশ্বাসই হলো সুসংবাদের শর্ত। ‘যারা বলেছে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ অতপর এই কথার ওপর অবিচল থকেছে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তাঁদের কোনো দুর্ভাবনাও প্রয়োজন নেই। তারা জান্নাতবাসী হবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে। তাদের সৎ কাজের প্রতিদান হিসাবেই এ ব্যবস্থা।’ মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ ঐ কথাটা শুধু কথার কথা নয়। এমনকি এটা শুধু অন্তরে পােষণ করা আকীদা বিশ্বাসও নয়। বরং এ হচ্ছে জীবন যাপনের এক পূর্ণাংগ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড প্রত্যেকটা উদ্দ্যেশ্য ও লক্ষ্য প্রত্যেকটা তৎপরতা ও প্রত্যেকটা মনোভংগী এ বিধানেরা অন্তর্ভুক্ত। আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ এটা এমন একটা ঘােষণা, চিন্তা ও অনুভুতির জন্যে একটা মানদন্ড নির্ধারণ করে দেয় একটা সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি স্থির করে দেয় সকল মানুষের জন্যে, যাবতীয় বস্তু ও জিনিসের জন্যে, যাবতীয় কাজ ও ঘটনার জন্যে এবং এ সৃষ্টি জগতের যাবতীয় সম্পর্ক সম্বন্ধের জন্যেও। আল্লাহ তায়ালাই যখন আমাদের প্রভু ও প্রতিপালক’, তখন একমাত্র তাঁরই এবাদাত করতে হবে, একমাত্র তার দিকেই মনকে কেন্দ্রীভূত রাখতে হবে, একমাত্র তাকেই ভয় করতে হবে এবং একমাত্র তার ওপরই হতে হবে নির্ভরশীল। ‘একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই যখন আমাদের প্রভু ও মনিব’ তখন তিনি ছাড়া আর কারাে কাছে আমাদের হিসাব নিকাশ ও জবাবদিহির প্রশ্ন ওঠে না, তাকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করার প্রয়ােজন পড়ে না এবং তাকে ছাড়া আর কারাে জন্যে কৌতুহলেরও কিছু নেই। তিনিই যখন আমাদের প্রতিপালক তখন যাবতীয় চিন্তা, কর্ম, পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন একমাত্র তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে এবং একমাত্র ভার সৃষ্টির জন্যেই পরিচালিত হবে। তিনি যখন আমাদের একমাত্র মনিব ও হুকুমদাতা, তখন তিনি ছাড়া আর কেউ কোনো হুকুম জারী করতে পারে না, তার আইন ছাড়া আর কারাে আইন চলতে পারে না এবং তার নীতি ও নির্দেশনা ছাড়া আর কোনো নীতি ও নির্দেশনার আনুগত্য করা যেতে পারে না। তিনিই যখন আমাদের একমাত্র মনিব, তখন সৃষ্টিজগতের প্রতিটি সৃষ্টি আমাদের সাথে সম্পৃক্ত এবং আল্লাহর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে সে ক্ষেত্রে আমার প্রতিটি সৃষ্টির মাথে সমবেত ও একাত্ম। এভাবে আল্লাহ তায়ালা আমাদের একমাত্র প্রতিপালক এ কথাটা-একটা পূর্ণাংগ বিধান; কেবল মুখ দিয়ে উচ্চারিত একটা কথা মাত্র নয়, কিংবা জীবনের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন কোন নেতিবাচক আকীদা বিশ্বাসও নয়।  *সত্যের পথে অবিচল থাকা : অতপর অবিচল থেকেছে এ ইচ্ছে দ্বিতীয় শর্ত। বস্তুত এই বিধানের ওপর ঈমান তার ওপর অবিচল থাকা, বহাল থাকা বা টিকে থাকা হচ্ছে আর একটা স্তর। এর অর্থ হচ্ছে, মনের স্থিরতা ও প্রশান্তি ভাবাবেগের স্থিরতা ও চিন্তার স্থিতিশীলতা। যেদিক থেকে যতো আকর্ষণীয় বা লােভনীয় প্রস্তাবই আসুক, তার ঈমান নড়বড়ে হবে না বা সংশয়ের শিকার হবে না এই অবিচলতা অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। এ কাজ নানাভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে। যে জীবন বিধানকে একবার গ্রহণ করা হয়েছে, তার ওপর কাজ ও চরিত্র দ্বারা টিকে থাকা এবং পথের সব রকমের বাধা বিঘ্ন, পিচ্ছিলতা ও কাটাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়াই অবিচলতার মর্মার্থ। এই পথে প্রতি মুহূর্তে বিপথগামিতার সম্ভাবনা থাকে। বস্তুত আমাদের প্রভু আল্লাহ তায়ালা এ ঘোষণা আল্লাহর জীবন বিধানকে গ্রহণ করার ঘােষণা মাত্র। এই বিধানকে গ্রহণ করার পরই এর ওপর টিকে থাকার স্তরটা আসে। আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে টিকে থাকার ক্ষমতা দেন, তারা হলাে আল্লাহর নিষ্কলুষ ও পুণ্যবান বান্দা। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কবুল করে নিয়েছেন। তাদের কোনাে ভয়ও নেই, দুশ্চিন্তাও নেই। কিসের ভয় এবং কিসের দুশ্চিন্তা! তারা যে জীবনবিধানকে গ্রহণ করেছে, সেটাই তাে তাদেরকে তাদের গন্তব্যে পৌছানাের নিশ্চয়তা দেয়। এর ওপর অবিচল থাকা এই নিশ্চয়তাকে আরাে নিস্কন্টক করে।
** তারাই হচ্ছে জান্নাতবাসী। তারা সেখানে চিরদিন থাকবে-(থাকবে) তাদের সম্পাদিত সৎ কর্মের কারণে। তাদের সম্পাদিত সৎ কর্ম এই কথাটা আমাদের প্রভু আল্লাহ এই উক্তির চমৎকার ব্যাখ্যা দেয়। এই জীবন ব্যবস্থার ওপর টিকে থাকার অর্থ কী, তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই উক্তি থেকে। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, জান্নাতে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করা অনুরূপ একটা কাজেরই প্রতিদান। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের রব এই ঘােষণা দান এবং এই ঘোষণার ওপর স্থায়ী হওয়া ও টিকে থাকারই প্রতিদান হবে জান্নাতে চিরস্থায়ীভাবে থাকা- এটাই তাে স্বাভাবিক। সুতরাং আমরা একথা উপলব্ধি করতে পারি যে, ইসলামে আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত যেসব কলেমা রয়েছে, সেগুলাে কেবল মৌখিকভাবে উচ্চারিত হবার কলেমা নয়। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই-এ সাক্ষ্য দান নিছক একটা মৌখিক মন্ত্র জপ করা নয়, বরং এ হলাে একটা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণের অংগীকার। এটা যখন নিছক মৌখিক মন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করবে, তখন তা আর ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ বলে গণ্য হবে না। এ আলােচনা থেকে আমরা একথাও অনুধাবন করতে পারি যে, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান যে কলেমায়ে শাহাদাত পড়ে থাকে, তার প্রকৃত মর্যাদা ও মর্মার্থ কী? এই কলেমা তারা কেবল মুখেই উচ্চারণ করে থাকে, এটা তাদের মুখকে অতিক্রম করে না এবং এর কোনাে প্রভাবও তাদের বাস্তব জীবনে পড়ে না। ফলে কলেমা পড়া সত্তেও তারা পৌত্তলিকদের মতাে জাহেলী জীবন যাপন করে। তাদের মুখ দিয়ে কলেমা উচ্চারিত হলেও তা তাদের অন্তরে প্রবেশ করে না। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা বা ‘আল্লাহই আমাদের একমাত্র রব’ বলে ঘােষণা করা যে আসলে একটা পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা পালনের অংগীকার সে কথা না বুঝা বা বুঝেও বাস্তবজীবনের সাথে তার মর্মকে সম্পর্কহীন রাখা চরম ধৃষ্ঠতা বৈ কিছু নয় এবং এমনটি যারা করবে তাদের ও কাফেরদের মধ্যে কোনাে ব্যবহারিক ব্যবধান আছে বলে মনে করাটা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা বা আল্লাহই আমাদের একমাত্র রব বলে ঘােষণা করা যে আসলে একটা জীবন ব্যবস্থা পালনের অংগীকার সে কথা প্রত্যেক মােমেনের অন্তরে চিরস্থায়ীভাবে বদ্ধমূল হওয়া দরকার। এতে করে এই ঘােষণায় যে পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার অনুসন্ধানে সে ব্যাপৃত হয়ে পড়বে।
**   *পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার : এই পর্বটিতে মানবীয় স্বভাবপ্রকৃতির সরলতা ও বক্রতা এবং সেই সরলতা ও বক্রতার শেষ পরিণতির বিবরণ দেয়া হয়েছে। শুরুতেই উপদেশ দেয়া হয়েছে পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস অথবা এতদসংক্রান্ত আলােচনা প্রসংগে প্রায়ই এই উপদেশটি দেয়া হয়ে থাকে। কারণ পিতামাতা ও সন্তানের মাঝে যে বন্ধন বিদ্যমান শক্তি ও গুরুত্বের দিক দিয়ে ঈমানী বন্ধনের পরেই তার স্থান সর্বোচ্চে। আল্লাহ ও রাসূলের পর পিতা মাতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আল্লাহর আনুগত্যের পরেই পিতামাতার আনুগত্যকে এরূপ গুরুত্ব দেয়া দ্বারা দুটো বিষয় প্রমাণিত হয়। প্রথমত এই যে, পিতামাতার সম্মান ও মর্যাদা সন্তানের কাছে আল্লাহর রাসূলের পরেই সর্বাধিক। দ্বিতীয়ত আল্লাহ রাসূলের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যের বন্ধনই একজন মুসলমানের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাধিক অগ্রাধিকারসম্পন্ন। এর পরই রক্ত সম্পর্কীয় বন্ধন সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। এই পর্বে দুই ধরনের মানবীয় স্বভাব প্রকৃতির নমুনা প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রথম নমুনাটাতে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আনুগত্যের বন্ধন পিতামাতার আনুগত্যের বন্ধন উভয়ের মধ্যে কোনাে গরমিল নেই। উভয়টা একই সাথে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় নমুনায় সম্মান ও পিতামাতার মধ্যকার সম্পর্ক এবং আল্লাহর ও বান্দার মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পর বিরােধী। এই দুটোতে কোনাে মিল বা সাযুজ্য নেই। প্রথম নমুনার পরিণাম জান্নাত এবং সুসংবাদই তার প্রাপ্য। আর দ্বিতীয় নমুনার পরিণাম জাহান্নাম এবং তার জন্যে আযাব অনিবার্য। এই প্রসংগে কেয়ামতের একটা দৃশ্যে আযাবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে পাপাচার ও দাম্ভিকতার শাস্তি কি, তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি মানুষকে তার মা বাবার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। এ নির্দেশ শুধু কোনাে বিশেষ মানুষকে দেয়া হয়নি, বরং দেয়া হয়েছে সমগ্র মানব জাতিকে। এর ভিত্তি হলাে তার মনুষ্যত্ব ও মানবতা। অন্য কোনাে গুণাগুণের সাথে এর কোনাে সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ শর্তহীনভাবে মা বাবার সাথে সদাচার ও সদ্ব্যবহারের অধিকারী বানায়। এ জন্য তার ভেতরে অন্য কোনাে গুণাগুণ থাকার প্রয়ােজন হয় না। এই সদাচার ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ এসেছে স্বয়ং মানুষের স্রষ্টার পক্ষ থেকে। এ নির্দেশ বিশেষভাবে শুধু মানুষকেই দেয়া হয়েছে। পশুপাথী বা কীটপতংগের জগতে বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্যে কনিষ্ঠদেরকে কখনাে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। এইসব সৃষ্টির ক্ষেত্রে যা জন্মগতভাবেই তাদের জ্যেষ্ঠদেরকে কনিষ্ঠদের তদারকী ও লালন পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কাজেই আলোচ্য আয়াতে কনিষ্ঠ তথা সন্তানদেরকে মা বাবার তদারকী করা ও যত্ন নেয়ার যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য। কোরআনে ও রসূলুল্লাহ(স.)-এর হাদীসে মা বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্যে বার বার সন্তানকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। সন্তানদের সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্যে মা বাবাকে নির্দেশ দেয়ার দৃষ্ঠান্ত খুবই বিরল এবং কেবলমাত্র বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই তা দেয়া হয়। এর কারণ এই যে, মা বাবা কর্তৃক সন্তানদের সাথে সদ্ব্যবহার করা তথা সাহায্য করার জন্যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাই যথেষ্ট। মা বাবার সহজাত আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বতস্ফুর্ত ভাবেই সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ ও লালন পালন করে থাকে। এ জন্যে স্বতন্ত্র কোনাে উদ্বুদ্ধকারীর দরকার হয় না। শুধু তাই নয়, সন্তানের জন্যে এক বিস্ময়কর ও সর্বাত্মক ত্যাগের পরিচয় দিতে গিয়ে এসব সৃষ্টির মধ্যকার অনেক মা বাবা মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে দ্বিধাবােধ করে না। এ জন্যে তাঁরা কোনো বিনিময়েরও আশা করে না, এমনকি এ জন্যে কেউ বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক তাও তারা প্রত্যাশা করে না, কিন্তু নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরী বা উত্তরসূরী কারো দিকেই তেমন দৃষ্টি দেয় না। যে প্রজন্ম তার জন্যে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেয়, তার দিকেও দৃষ্টি দেয় না। কেননা সে আপনা থেকেই সামনের দিকে অগ্রসর হয় এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকেও এটাই আশা করে যে সে তার জনাে আপন উদ্যোগে ত্যাগ স্বীকায় করুক ও তার তদারকী করুক। এভাবেই পৃথিবীতে জীবনের বিকাশ ঘটতে থাকে।  *পরিবার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মযবুত ভিত্তি : পক্ষান্তরে ইসলাম তার নিজের ভবন নির্মাণের জন্যে পরিবারকেই প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে। গ্রহণ করে পরিবারকে সে মানব শিশুর লালন ক্ষেত্র হিসাবে প্রহণ করে যেখানে সে পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ করে ও বেড়ে ওঠে। সেখানে যতােটুকু ভালােবাসা, সাহায্য ও সহযােগিতা তার প্রাপ্য, তা সে পেয়ে থাকে। যে শিশু, পরিবারের লালন ক্ষেত্রে লালিত পালিত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, সে শিশু তার জীবনের বিভিন্ন দিকে অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম রূপে গড়ে ওঠে, চাই পরিবারের বাইরে তাকে লালন পালনের জন্য আরাম আয়েশের উপকরণের যতই প্রাচুর্য থাকুক  পরিবার ছাড়া আর যেখানেই মানব শিশু লালিত পালিত হবে, তার প্রকৃতিতে সর্বপ্রথম যে জিনিসটার অভাব অনুভূত হবে, তা হলাে ম্নেহ মমতা ও ভালােবাসা। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, শিশুর জন্মের প্রথম দুবছর তার মার ওপর তার একক অধিকার প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় এতে তার কোনাে অংশীদার সে সহ্য করতে পারে না। অথচ এতিমখানা বা কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে শিশুদের লালন পালনের যে ব্যবস্থা থাকে, সে ব্যবস্থায় এসব উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না। সেখানে যে মহিলা শিশুদের লালন পালনের দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকে, সে একসাথে বহুসংখ্যক শিশুকে লালন পালন করে এসব শিশু পরস্পর হিংসা বিদ্বেষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কারখানায় কর্মরত তাদের মাকে নিয়ে তাদের হৃদয়ে হিংসার বীজ রােপিত হয় প্রথম দিন থেকেই। সুতরাং তাদের মনে আর কখনো শিশুকালে এরূপ প্রয়ােজন দেখা দেয় যে, তার লালন পালনের দায়িত্বে কোনাে সুনির্দিষ্ট একক ব্যক্তিগত কর্তৃপক্ষ নিয়ােজিত থাকুক, যাতে তার সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সুযােগ সৃষ্টি হয়। অথচ এই প্রয়ােজনটা একমাত্র স্বাভাবিক পারিবারিক পরিমণ্ডলে ছাড়া আর কোথাও পূরণ হয় না। কলকারখানার শিশু নিকেতনে ভিন্ন ভিন্ন শিফটে ভিন্ন ভিন্ন আয়ার আবির্ভাব হতে থাকে। ফলে সেখানে সুনির্দিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক, কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব থাকে। এভাবে শিশুদের ব্যক্তিত্বও গড়ে ওঠে হরেক রকমের এবং তারা তাদের সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব গড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। শিশু নিকেতনগুলােতে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিদিনই একথা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে যে, নিখুঁত ও সুস্থ সমাজ গঠনে পরিবারকে প্রথম ভিত্তি প্রস্তর হিসাবে গ্রহণ করার প্রয়ােজনীয়তা কত তীব্র এবং কেনই বা ইসলাম সেই সুষ্ঠু, ভিত্তির ওপর তার ইপ্সিত সমাজ গড়তে এতাে উদগ্রীব।  *সন্তানের কল্যাণে মায়ের আত্মত্যাগ : মায়েরা সন্তানদের সুস্থ বিকাশ ও গঠনের নিমিত্তে যে নযীরবিহীন ত্যাগ স্বীকার করে এবং সন্তানরা আল্লাহর আদেশ মােতাবেক মা বাবার সাথে যে ভাল আচরণই করুক, সেই ত্যাগের বদলা যে কম্মিনকালেও দিতে পারে না, সে কথা কোরআন এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরেছে। এভাবে : তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে বারণ করেছে এবং তাকে এতি কষ্টে প্রসব করেছে তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও প্রসবান্ত দুধ ছাড়াতে ত্রিশ মাস লেগেছে।’ এখানে, মূল আয়াতের শব্দ চয়ন বাক্য গঠন ও সুর ব্যঞ্জনা সবমিলে গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন সময়ের কষ্ট ও যন্ত্রকে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার-মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে ও অতি কষ্টে প্রসব করেছে। এ যেন এমন এক মহিলার জ্বালা যন্ত্রণার সকাতর প্রকাশ যে, এক দীর্ঘস্থায়ী ভারী বােঝা বহন করে হিমশিম খেয়ে গেছে এবং তার শ্বাস প্রশ্বাস নেয়া যেন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এখন আসলে গর্ভকার শেষ-দিনগুলাের দৃশ্য-এবং প্রসবান্তের বেদনাকাতর দৃশ্য ফুটে উঠেছে। গর্ভধারণ যে-একজন, মায়ের কতবড় ত্যাগ, ও কুরবানী তা-প্রসূতি বিদ্যা ও ভ্রুণতত্ত্বের বিচারে, আমরা সুস্পষ্ট ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। শুক্রকীটের সাথে ডিম্বাণুর মিলন ঘটা মাত্রই তা জরায়ুর প্রাচীরের সাথে যুক্ত হবার জোর প্রচেষ্টা চালায়। এ সময় এই ডিম্বানু এক মহা রাক্ষুসীতে পরিণত হয়। সে জরায়ুর প্রাচীরকে খেয়ে খেয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে। ফলে এ ছিন্ন জায়গায় মায়ের রক্ত নেমে আসে। ডিম্বানু মায়ের রক্তে পরিপূর্ণ একটা পুকুরে সাতার কাটতে থাকে। এই রক্ত মায়ের শরীরের যাবতীয় উপাদানে সমৃদ্ধ। ডিম্বানু এই রক্ত চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে ও বড় হয়, আর জরায়ুর প্রাচীরকে খাওয়া তাে তার অব্যাহত থাকেই। একইভাধে রক্ত চুষে খেয়ে জীবনের উপাদানগুলোকে সে নিজ দেহে ধারণ করতে থাকে বেচারী মা যা কিছু পানাহার করে চুষে খায় ও হযম করে, সবই এই মহা খাদকিনী রাক্ষুসী ডিম্বানুর দেহে নিখাদ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খদ্য হয়ে প্রবেশ করে। ঐরপর যখন ভ্রুণের দেহে হাড্ডি জন্ম নিতে আরম্ভ করে, তখন মায়ের রক্ত থেকে তার শর্করা চোষা আরো বেড়ে যায়। কারণ সে তার-হাড়ের গুঁড়ো রক্তে ছড়িয়ে দেয় যাতে এই ক্ষুদ্র ডিম্বানুটা দ্বারা শক্তিশালী হয়। এই হলাে এসংক্রান্ত বিপুলসংখ্যক তথ্যের সংক্ষিপ্ত সার। এরপর আসে প্রসবের পালা। এইা এমন একটা কঠিন কাজ যে শরীরটাকে যেন ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে। কিন্তু এর ব্যথা ও যন্ত্রণার তীব্রতা প্রকৃতির কার্যধারাকে বন্ধ করতে পারে না আর এতো কষ্টের ভেতেরেও মা জার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আনন্দঘন ঘটনার কথা ভুলতে পারে না। ভুলতে পারে না যে সে পৃথিবীকে একটা নতুন জীবন উপহার দিতে যাচ্ছে অথচ বেদনায় সে কি বেহাল অবস্থা! প্রায় মৃত্নদশা ! এরপর আসে, দুধ খাওয়ানাে ও লালন পালনের স্তর। এ সময় মা তার হাড় ও গােশতের নির্যাস বিলীন করে দেয় সন্তানের লালন পালনের মধ্য দিয়ে। এতােবড় ত্যাগ স্বীকার করা সত্ত্বেও মা থাকে আনন্দিত, তৃপ্ত, দয়ালু ও মমতাময়ী, সদ্যপ্রসূত সন্তানের প্রতি কখনাে বিন্দুমাত্র বিরক্তও হয় না। তার জন্যে অনবরত কঠোর পরিশ্রম করে, কখনাে তার ধৈর্যের বাধও টোটে না সে তার সমস্ত দুঃখ বেদনার উপশম ও সান্তনা লাভ করে তখন, যখন দেখতে পায় তার সন্তান সুস্থ ও নিরাপদ আছে এবং নাদুসনুদুস হয়ে বেড়ে উঠছে। এটাই তার একমাত্র ও অতীব প্রিয় প্রতিদান ও® পুরস্কার। মায়ের এই অতুলনীয় ত্যাগ তিতিক্ষার প্রতিদান মানুষ কোনভাবেই দিতে পারে না-তা সে মায়ের মতােই সেবা করুক। তার কষ্ট ও ত্যাগের সামনে তার কত সমন্ত সেবা যত্ন তুচ্ছ। তাই রসূল(স,)এর কে যখন এক ব্যক্তি তার মাকে ঘাড়ে করে পবিত্র কা’বার তওয়াফ শেষে হাযির হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি ময়ের হক আদায় করতে পেরেছি। তখন তিনি বলেছিলেন, না। এমনকি তোমাকে লালন পালন করতে গিয়ে তােমার মাকে যে অসংখ্যবার নানা রকমের বিপদ মুসিবত উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও দুঃখ যাতনা পোহাতে হয়েছে; তার একটি বারের হক আদায় করতে পারেনি। বস্তুত রসুল(স.) যথার্থই বলছিলেন। মা বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার ও সেবা যত্নের উপদেশ দানের পর মায়ের ত্যাগ তিতিক্ষা ও দুঃখ যাতনা ভােগের এই বিবরণ দিয়ে মানুষের বিবেককে তাদের প্রতি অধিকতর সহানুভূতিশীল করার চেষ্টা করা হয়েছে।   *বয়সের পূর্ণতা ও বুদ্ধির পরিপক্কতা : তারপর সন্তানের পরিপক্কতা ও বােধশক্তি লাভ এবং স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি অর্জন ও মন মগযের সুপথ প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। ‘অবশেষে যখন সে পরিপক্কতা লাভ করলাে এবং চল্লিশ বছরে পদার্পণ করলাে, তখন সে বললাে, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে শক্তি দাও যেন আমার ওপর আমার মা বাবার ওপর তুমি যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেছে, তার শােকর আদায় করতে পারি, যেন তুমি সন্তুষ্ট হও এমন সৎ কাজ করতে পারি এবং আমার বংশধরদেরকেও তুমি সৎকর্মশীল বানাও। আমি তােমার কাছে তাওবা করলাম এবং আত্বসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলাম।’ ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত সময়টাকে বয়সের পরিপক্কতার স্তর ধরা হয়ে থাকে। আর চল্লিশ হচ্ছে পরিপক্কতা ও বিবেক বুদ্ধির পূর্ণতার স্তর। এ সময়েই মানব সত্ত্বার যাবতীয় শক্তিসামর্থ বল পূর্ণ পরিণতি অর্জন করে। এ স্তরে পৌছার পর মানুষ শান্তভাবে ও ধীরস্থিরভাবে চিন্তা ভাবনা ও পরিকল্পনার প্রস্তুতি নেয়। এই বয়সেই একজন সুস্থ, বিকারমুক্ত ও নির্মল স্বভাবধারী মানুষ চলমান জীবনধারার অন্তরালের বিষয় ও ইহকালীন জীবনের পরবর্তী সময়কার বিষয় নিয়ে ভাবতে প্রবৃত্ত হয়। এ সময়েই সে আখেরাত ও কর্মফল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে আগ্রহী হয়। এখানে কোরআন একজন সুস্থ ও নির্মল প্রকৃতির মানুষের মনে উদ্ভুত ধ্যান ধারণাকে তুলে ধরছে, বিশেষত সেই সময়কার ধ্যান ধারণাকে যখন সে জীবনের একটা যুগসন্ধিক্ষণে উপনীত হয় এবং জীবনের একটা স্তর পার হয়ে যখন সে অন্য একটা স্তরে পদার্পণ করতে যায়। এ সময় সে আল্লাহর দিকে মনােনিবেশ করে এবং বলে, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ক্ষমতা দাও যেন আমার ওপর ও আমার মা বাবার ওপর তুমি যে অনুগ্রহ করেছে, তার শােকর আদায় করতে পারি। এ হলাে মহান আল্লাহর দান ও অনুগ্রহকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে, এমন ব্যক্তির দোয়া তার নিজেকে ও তার আগে তার মা বাবাকে প্রদত্ত নেয়ামতসমূহকেই শুধু নয়, বরং সেই নেয়ামতের বিশালতা ও বিপুলতাকেও স্বীকার করে আর সে অনুপাতে তার শােকর আদায় খুবই অপ্রতুল রয়ে গেছে একথাও উপলব্ধি করে এমন ব্যক্তির দোয়া। এহেন ব্যক্তি তার প্রতিপালকের কাছে দোয়া করছে যেন তিনি তাকে এই অক্ষমতা, অপূর্ণতা ও অপ্রতুলতাকে অতিক্রম করে যথােচিত শােকর আদায়ে সাহায্য করেন এবং শােকর আদায়ের এই বিরাট ও মহান দায়িত্বকে উপেক্ষা করে অন্যান্য কাজে নিজের ক্ষমতার অপচয় না করে। ‘আর আমি যেন এমন সৎ কাজে লিপ্ত হই, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও।’ এ হচ্ছে তার আরেকটা দোয়া। সে এমন নেক কাজ করার ক্ষমতা চাইছে, তার প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করার মতাে উন্নত ও উৎকৃষ্টমানের হবে। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই হচ্ছে সকল সৎ কাজের চূড়ান্ত ও মূল উদ্দেশ্য এবং এটা প্রত্যেক পুণ্যবানের একমাত্র আশা, আকুতি ও অভিলাষ। আর আমার বংশধরকেও তুমি সৎকর্মশীল বানাও। এ হলাে তার তৃতীয় দোয়া। এখানে মােমেনের হৃদয়ের যে আকাংখা ও অভিলাষ ফুটিয়ে তােলা হয়েছে তা হলাে, তার নিজের সৎকর্ম যেন তার বংশধরের মধ্যেও চালু হয়ে যায়, তার হৃদয় যেন এই মর্মে আশ্বস্ত হয় যে, তার পরবর্তী প্রজন্মও আল্লাহর এবাদাত করবে ও তার সন্তুষ্টি কামনা করবে। আল্লাহর সৎ বান্দারা সব সময় সৎ বংশধর কামনা করে থকেন। পার্থিব ধন সম্পদ ও জাক জমকের চেয়েও এটা তাদের কাছে অনেক বেশী অগ্রগণ্য এবং অনেক বেশী তৃপ্তিদায়ক। পিতা মাতার দোয়া সন্তানদের পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়, যাতে পরবর্তী প্রজন্মগুলাে আল্লাহর আনুগত্য করে ও তার কাছে কৃত সুপারিশ পাওয়ার যােগ্য বিবেচিত হয়। এই একনিষ্ঠ দোয়ার মাধ্যমে যে সুপারিশ পেশ করা হচ্ছে তাহলাে তাওবা ও আত্মসমর্পণ, ‘আমি তােমার কাছে তাওবা করলাম ও আত্মসমর্পণ করলাম।’ এই হচ্ছে আপন মনিবের সামনে প্রকৃত সৎ ও নিষকলুষ স্বভাবধারী বান্দার ভূমিকা।
ওদিকে বান্দার সাথে মনিবের ভূমিকা কী, সেটাও কোরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছে, ‘এরাই হচ্ছে সেসব লােক, যাদের কৃত উৎকৃষ্টতম কাজগুলােকে আমি গ্রহণ করি এবং তাদের খারাপ কাজগুলােকে ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরকে জান্নাতবাসী করি। এটাই তাদের সাথে কৃত সত্য ওয়াদা।’ এ আয়াত থেকে জানা গেলাে যে, সর্বোত্তম কাজের জন্যেই পুরস্কৃত করা হবে উপরােক্ত গুণাবলীর অধিকারী বান্দাদেরকে আর তাদের কৃত অসৎ কাজগুলােকে ক্ষমা করা হবে। তারপর তাদের শেষ ঠিকানা হবে জান্নাত। জান্নাতের আসল অধিবাসীদের সাথেই তারা অবস্থান করবে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে যে সত্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা তিনি পালন করবেন। তিনি কখনাে ওয়াদা ভংগ করবেন না। তাদেরকে তিনি বিপুল নেয়ামত ও অনুগ্রহ দিয়ে পুরস্কৃত ও তুষ্ট করবেন।

*পিতা মাতার মনে কষ্ট দেয়া : এরপর আসছে অন্য নমুনাটার বিবরণ। এটা হলাে বিভ্রান্তি, বিপথগামিতা ও পাপাচারের নমুনা, ‘আর যে ব্যক্তি তার মা বাবাকে বলে, তােমাদের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেলাম। তােমরা কি আমাকে এই এই ভয় দেখাচ্ছ যে, আমি কবর থেকে উত্থিত হব? অথচ আমার আগে কতাে জাতি অতিবাহিত হয়েছে।’ অর্থাৎ মােমেন পিতা মাতার অবাধ্য সন্তান সর্বপ্রথম অত্যন্ত আক্রমণাত্মক, ধৃষ্টতাপূর্ণ ও কটু বাক্যের মাধ্যমে তাদেরকে বলে, উহ, তােমাদের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেলাম। তারপর সে একেবারেই খোড়া ওজুহাত দেখিয়ে আখেরাতকে অস্বীকার করে। সে বলে, তােমরা কি আমাকে এই ভয় দেখাচ্ছ যে, আমাকে কবর থেকে বের করা হবে। অথচ আমার আগে বহু জাতি অতিবাহিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ যারা বলে গেছে, তাদের কেউ তাে ফিরে এসে ভয় দেখালাে না যে, কেয়ামত একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে। সকল মানুষকে পুনরুজ্জীবিত হতে হবে পার্থিব জীবনের সমাপ্তির পর। কেউ বলেনি যে, এভাবে জীবনটা ভাগ হয়ে গেছে। একটা প্রজন্ম এক সময়ে আবির্ভূত হবে, চলে যাবে এবং আরেকটা প্রজন্ম আসবে। সুতরাং দুনিয়াটা কোনাে খেলা নয় এবং নিরর্থকও নয়। পার্থিব জীবনের চূড়ান্ত হিসাব নিকাশ অবশ্যই দিতে হবে । (অর্থাৎ দুনিয়াতেই তার পর্যালােচনা হয়ে থাকে)। তার মা বাবা তার এই কুফরিতে পরিপূর্ণ কথাবার্তা ও আখেরাতের অস্বীকৃতি শুনতে থাকে, মা বাবার অবাধ্য ও আল্লাহর অবাধ্য এই সন্তানের উদ্ধৃত কথাবার্তা তাদেরকে আতঙ্কিত করে, তারা (মা বাবা) উভয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে, আর তাকে বলে, (তােমার সর্বনাশ হবে। ঈমান আনাে। আল্লাহর আযাবের বাণী ফলে গেছে সেই সব জাতির সাথে যারা ইতিপূর্বে জ্বিন ও মানুষের অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। নিশ্চয়ই তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। তার ওপর ও তার মতাে অন্য যেসব কাফেরের ওপর যে বাণী ফলেছে, তা হচ্ছে তাদের আখেরাতের আযাব। এসব কাফেরের সংখ্যা অনেক। তারা জিন ও মানুষ উভয় জাতভুক্ত এবং তারা অতীত হয়ে গেছে। তাদের ওপর আযাব আসা অবধারিত। আল্লাহর এ ওয়াদা কখনাে ভংগ হবার নয়। তারা ক্ষতিগ্রস্ত। বস্তুত পৃথিবীতে ঈমান থেকেও আখেরাতে বেহেশত থেকে বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে বড় ক্ষতি আর কিছু হতে পারে না। তদুপরি বিপথগামীদের জন্যে যে আযাব অবধারিত তার চেয়ে বড় ক্ষতি তাে আর কল্পনাই করা যায় না। সৎপথে চালিত ও বিপথগামী এই উভয় শ্রেণীর শান্তির কথা সাধারণভাবে বর্ণনা করার পর এই উভয় শ্রেণীর প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, প্রত্যেকের কৃতকর্ম অনুপাতে শ্রেণী বিন্যস্ত হবে। তাদের সকলের কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে। তাদের ওপর কোনােই অবিচার করা হবে না। বস্তুত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে সুনির্দিষ্ট শ্রেণী বা মান রয়েছে। অনুরূপ প্রত্যেক ব্যক্তির কৃতকর্মও রয়েছে। উপরােক্ত সাধারণ ঘােষণার আওতায় প্রত্যেক শ্রেণীকে শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। উল্লেখ্য যে, এই দুটো নমুনা মানব সমাজে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু এ দুটো নমুনাকে এখানে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, মনে হয় এ দুটো কোনাে শ্রেণী নয়, বরং এরা সুনির্দিষ্ট দুই ব্যক্তি। কিছু কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এ দুটো নমুনা আসলে দু’জন নির্দিষ্ট ব্যক্তি। তবে এই বর্ণনা শুদ্ধ নয়। তাই এই দুটোকে দুটো শ্রেণী মনে করাই উত্তম। ফলে উভয়ের যে ফলাফল জানানাে হয়েছে, তা সে নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্যেই নির্দিষ্ট থাকবে। প্রথম ফলটা হলাে, তারাই সেই সব লােক, যাদের সর্বোত্তম কাজ আমি গ্রহণ করি… দ্বিতীয় ফল হলাে, তারাই সেসব লােক, যাদের ওপর আল্লাহর আযাবের বাণী অবধারিত হয়ে গেছে … আর সবার শেষে সাধারণভাবে ঘােষণা করা হয়েছে, প্রত্যেকের জন্যে স্ব স্ব কৃতকর্ম অনুযায়ী মর্যাদা নির্ধারিত রয়েছে…’ এর প্রত্যেকটা আয়াত থেকে জানা যায় যে, এ দ্বারা প্রত্যেকটা নমুনার জন্যে আলাদা আলাদাভাবে ফলাফল ঘােষণা করা হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এরপর কাফেরদের সামনে আখেরাতের শাস্তিকে তুলে ধরা হয়েছে, সে দিনের কথা স্মরণ করাে, যেদিন কাফেরদেরকে জাহান্নামের সামনে রাখা হবে। বলা হবে, তােমরা তােমাদের পার্থিব জীবনে তােমাদের ভালাে ভালাে জিনিস নিয়ে গেছো ও উপভােগ করেছো। সুতরাং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে যে দম্ভ দেখাতে এবং যে পাপাচারে লিপ্ত থাকতে তার বিনিময়ে আজ তােমাদেরকে অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে। দৃশ্যটা অত্যন্ত অপ্রতিরােধ্য ও দ্রুতগামী। তবে এতে একটা গভীর তাৎপর্যবহ জিনিস রয়েছে। সেটা হলাে দোযখের সামনে কাফেরদের হাযির করার দৃশ্য। তারপর দোযখে নিক্ষেপের আগে তাদেরকে দোযখের কিনারে রাখা ও দোযখে নিক্ষেপের কারণ জানানাে হবে যে, ‘তােমরা তােমাদের পার্থিব জীবনে তােমাদের ভালাে ভালাে জিনিস নিয়েছে ও উপভোগ করেছো…’ অর্থাৎ ভালাে ভালাে জিনিস তাদের ছিলাে। কিন্তু তার সব তারা দুনিয়াতেই খেয়ে শেষ করেছে, আখেরাতের জন্যে কিছুই সঞ্চয় করেনি। আখেরাতের জবাবদিহীর কথা চিন্তা না করেই সব উপভােগ করেছে। যেভাবে জন্তু জানায়াররা উপভােগ করে সেইভাবে। আল্লাহর শােকরও আদায় করেনি। হালাল হারাম বাছ বিচারও করেনি। তাই তাদের জন্যে দুনিয়ার জীবনটাই সার হবে, আখেরাত বলতে তাদের কিছুই থাকবে না। দুনিয়ার ক্ষুদ্র একটা মুহূর্তকে তারা আখরাতের সেই বিশাল জীবনের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছে, যার কোনাে সীমা পরিসীমা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারাে জানা নেই। এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাই পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার ও পাপাচারে লিপ্ত থাকার কারণে আজ তােমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হবে।’

*মোমেনের মাপকাঠি : আজ তারা সবাই এর উচিত প্রতিদান পাবে, পাবে সেই সকল প্ররােচনা ও ধোঁকাবাজির বদলা যা দুনিয়ার জীবনে শুভাকাংখী হিসাবে সর্বদা তারা করেছে। তাদের কুমন্ত্রণা ও মিথ্যা শুভেচ্ছা প্রদর্শনের প্রতিশোধ পাবে। অপর দিকে বলা হচ্ছে, তারাই হচ্ছে সত্যিকারে মােমেন, যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, তারপর মযবুত হয়ে সেই সুন্দর সমুজ্জ্বল পথে অবিচল থাকে, যা তাদেরকে ঈমান ও তদনুযায়ী ভাল কাজসমূহের দিকে আহ্বান জানায়। এমন লােকদেরকে যাবতীয় খারাবী থেকে আল্লাহ রব্বুল ইযযত হেফাযত করবেন এবং কিছুতেই তাদের পিছনে নিকৃষ্ট জিন ও নিকৃষ্ট মানুষদেরকে লাগিয়ে দেবেন না। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের বন্ধু ও সাহায্যকারী ফেরেশতাদেরকে হিসাবে নিয়ােগ করে দেবেন। তারা তাদের অন্তরের মধ্যে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দেবেন এবং তাদেরকে সুসংবাদ দেবেন সেই জান্নাতের, যার ওয়াদা তাদের সাথে করা হয়েছিলাে। দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় স্থানেই তারা বন্ধু হিসাবে তাদের সংগে সংগে থাকবেন। নীচের আয়াতে এই কথাটাই জানানাে হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের রব আল্লাহ… তাদের মেহমানদারী করা হবে ক্ষমার মালিক মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে।’(৩০-৩২) অর্থাৎ আল্লাহকে প্রতিপালক, মনিব ও শাসনকর্তা মানার পর যেভাবে দৃঢ়তা অবলম্বন করা দরকার সেভাবেই মযবুত হয়ে টিকে থাকা। কোনাে সংকট ও তয়ভীতির কাছে নতি স্বীকার না করা। এই দৃঢ়তার তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝা, বুঝে সুঝে সচেতনভাবে ও বিবেক বুদ্ধি নিয়ে জীবন পথে পাড়ি দেয়া এবং এ পথে চলতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবী বাধার সামনে অবিচল হয়ে থাকার নাম হচ্ছে ‘এসতেকামাত’ যে কোনাে কঠিন দায়িত্ব আসুক না কেন তা যথাযথভাবে পালন করা, বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে নিজ নিজ কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে থাকা- এ সবকটি অর্থই এসতেকামাত’ শব্দের মধ্যে রয়েছে। এই দৃঢ়তা অবলম্বন করার জন্যে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোনাে বড় সন্দেহকে মনে জায়গা না দেয়া এবং সকল কঠিন অবস্থাতেই অবিচল থাকাও হচ্ছে, ‘এসতেকামাত’-এর তাৎপর্য। এই দৃঢ়তার জন্যেই আল্লাহর কাছ থেকে বড় পুরস্কার দেয়ার অংগীকার করা হয়েছে। ফেরেশতাদের সাথে থাকা বলতে কী বুঝানাে হয়েছে এবং তাদের বন্ধুত্ব ও ভালােবাসা বলতেই বা কী বুঝায় এ কথাগুলাে তাদের কথায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তারা তাদের মােমেন বন্ধুদের বলে, ‘ভয় পেয়াে না, দুঃখ করাে না, সুসংবাদ গ্রহণ করাে জান্নাতের, যার ওয়াদা তােমাদের সাথে করা হয়েছে। আমরা তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে এবং আখেরাতেও।’ তারপর তাদের জন্যে ওয়াদা করা জান্নাতের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। যারা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী এবং তার সত্যিকারের বন্ধু তাদের জন্যে তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার ওয়াদা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘সেখানে তােমাদের জন্যে রয়েছে তাই, যা তােমাদের অন্তর চাইবে এবং যার দাবী তােমরা করবে। এরপর তাদের জন্যে সৌন্দর্য ও সম্মান বৃদ্ধি করা হবে। এটা হবে তোমার মালিক মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আতিথেয়তা। তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই আপ্যায়ন করা হবে এবং এর সাথে থাকবে তার ক্ষমা ও মেহেরবানী… এর থেকে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
** হঠাৎ কখনো আল্লাহ‌কে রব বলে ঘোষণা করেই থেকে যায়নি এবং এ ভ্রান্তিতেও লিপ্ত হয়নি যে, আল্লাহ‌কে রব বলে ঘোষণাও করেছে এবং তাঁর সাথে অন্যদেরকেও রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। বরং একবার এ আকীদা পোষণ করার পর সারা জীবন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে, তার পরিপন্থী অন্য কোন আকীদা গ্রহণ করেনি কিংবা এর সাথে কোন বাতিল আকীদার সংমিশ্রণও ঘটায়নি এবং নিজের কর্মজীবনে তাওহীদের আকীদার দাবীসমূহও পূরণ করেছে।

তাওহীদের ওপর দৃঢ় থাকার অর্থ কি নবী ﷺ ও বড় বড় সাহাবা তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ

হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী ﷺ বলেছেনঃ قَدْ قَالَها النَّاسُ ثُمَّ كَفَرَ أَكْثَرُهُمْ فَمَنْ مَاتَ عَلَيْهَا فَهُوَ مِمَّنِ اسْتَقَامَ

“বহু মানুষ আল্লাহ‌কে তাদের রব বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আবার কাফের হয়ে গিয়েছে। দৃঢ় পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকীদা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।” (ইবনে জারির, নাসায়ী, ইবনে আবী হাতেম)

হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ لَمْ يُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًالَمْ يَلْتَفِتُوا الى إِلَيْهِ غيره “এরপর আল্লাহ‌র সাথে আর কাউকে শরীক করেনি, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্যের প্রতি আকৃষ্টও হয়নি।” (ইবনে জারির)

একবার হযরত উমর (রাঃ) মিম্বরে উঠে এ আয়াত পাঠ করে বললেনঃ “আল্লাহ্‌র শপথ, নিজ আকীদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহ‌র আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিয়ালের মত এদিক থেকে সেদিকে এবং সেদিক থেকে এদিকে ছুটে বেড়ায়নি।” (ইবনে জারির)
হযরত উসমান (রাঃ) বলেনঃ “নিজের আমলকে আল্লাহ‌র জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।” (কাশ্‌শাফ)

হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বিধিবদ্ধ করা ফরযসমূহ আনুগত্যের সাথে আদায় করেছে।” (কাশ্‌শাফ)
** উপলব্ধি করা যায় এমন অবস্থায় ফেরেশতারা নাযিল হবে এবং ঈমানদারগণ চর্ম চোখে তাদের দেখবে কিংবা তাদের আওয়াজ কানে শুনতে পাবে এটা জরুরী নয়। যদিও মহান আল্লাহ‌ যার জন্য ইচ্ছা ফেরেশতাকে প্রকাশ্যে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সাধারণত ঈমানদারদের কাছে বিশেষতঃ যখন তারা ন্যায় ও সত্যের দুশমনদের হাতে নাজেহাল হতে থাকে সেই সময় তাদের অবতরণ অমনুভূত পন্থায় হয় এবং তাদের কথা কানের পর্দায় প্রতিধ্বনিত হওয়ার পরিবর্তে হৃদয়ের গভীরে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি হয়ে প্রবেশ করে। কোন কোন তাফসীরকার ফেরেশতাদের এই আগমনকে মৃত্যুর সময় কিংবা কবরে অথবা হাশরের ময়দানের জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করেছেন। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে যদি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা যায় তাহলে এই পার্থিব জীবনে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার জন্য যারা জীবনপাত করছে তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতরণের কথা বর্ণনা করাই যে এখানে মূল উদ্দেশ্য সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। যাতে তারা প্রশান্তি লাভ করতে পারে, মনোবল ফিরে পায় এবং এই অনুভূতিতে তাদের হৃদয়-মন পরিতৃপ্ত হয় যে, তারা সহযোগী ও বন্ধুহীন নয়, বরং আল্লাহ‌র ফেরেশতারা তাদের সাথে আছে। যদিও মৃত্যুর সময়ও ফেরেশতারা ঈমানদারদের স্বাগত জানাতে আসে, কবরেও (আলমে বরযখ) তারা তাদের স্বাগত জানায় এবং যেদিন কিয়ামত হবে সেদিনও হাশরের শুরু থেকে জান্নাতে পৌঁছা পর্যন্ত সব সময় তারা তাদের সাথে থাকবে। তবে তাদের এই সাহচর্য সেই জগতের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এ পৃথিবীতেও চলছে। কথার ধারাবাহিকতা বলছে, হক ও বাতিলের সংঘাতে বাতিলের অনুসারীদের সাথে যেমন শয়তান ও অপরাধীরা থাকে তেমনি ঈমানদারদের সাথে ফেরেশতারাও থাকে। একদিকে বাতিলপন্থীদের কৃতকর্মসমূহকে তাদের সঙ্গী-সাথীরা সুদৃশ্য করে দেখায় এবং তাদেরকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দেয় যে, হককে হেয় করার জন্য তোমরা যে জুলুম-অত্যাচার ও বে-ঈমানী করছো সেটিই তোমাদের সফলতার উপায় এবং এভাবে পৃথিবীতে তোমাদের নেতৃত্ব নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। অপরদিকে হকপন্থীদের কাছে আল্লাহ‌র ফেরেশতারা এসে সেই সুখবরটি পেশ করে যা পরবর্তী আয়াতাংশে বলা হচ্ছে।
** এটা একটা ব্যাপক অর্থবোধক কথা যা দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত ঈমানদারদের জন্য প্রশান্তির একটি নতুন বিষয় বহন করে। পৃথিবীতে ফেরেশতাদের এই উপদেশের অর্থ হচ্ছে, বাতিল শক্তি যতই পরাক্রমশালী ও স্বৈরাচারী হোক না কেন তাদের দেখে কখনো ভীত হয়ো না এবং হকের অনুসারী হওয়ার কারণে যত দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাই সইতে হোক সেজন্য দূঃখ করবে না। কেননা, ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য এমন কিছু আছে যার কাছে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত তুচ্ছ। মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা যখন এই কথাগুলো বলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি সামনে যে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছো সেখানে তোমার জন্য ভয়ের কোন কারণ নেই। কারণ, সেখানে জান্নাত তোমার জন্য অপেক্ষমান। আর দুনিয়াতে তুমি যা কিছু ছেড়ে যাচ্ছো সেজন্য তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই কেননা, এখানে আমি তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু। আলমে বরযখ ও হাশরের ময়দানে যখন ফেরেশতারা এ কথাগুলো বলবে তখন তার অর্থ হবে, এখানে তোমাদের জন্য কেবল শান্তি আর শান্তি। পার্থিব জীবনে তোমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছো সেজন্য দুঃখ করো না এবং আখেরাতে যা কিছু সামনে আসবে সেজন্য ভয় করবে না। কারণ, আমরা তোমাদেরকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ জানাচ্ছি যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা হচ্ছে।
** সন্তানদের যদিও মা-বাপ উভয়েরই সেবা করতে হবে কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়া মায়ের অধিকার এ কারণে বেশী যে, সে সন্তানের জন্য বেশী কষ্ট স্বীকার করে। এ আয়াত এ দিকই ইঙ্গিত করে। একটি হাদীস থেকেও এ বিষয়টি জানা যায়। কিছুটা শাব্দিক পার্থক্যসহ হাদীসটি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমদ এবং ইমাম বুখারীর আদাবুল মুফরাদে উল্লেখিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি নবীকে ﷺ জিজ্ঞেস করলো, আমার ওপর কার খেদমতের হক সবচেয়ে বেশি? নবী (সা.) বললেনঃ তোমার মা’র; সে বললোঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। সে বললোঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। সে আবারো জিজ্ঞেস করলোঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার বাপ। নবীর ﷺ এই বাণী হুবহু এ আয়াতেরই ব্যাখ্যা। কারণ, এতেও মায়ের তিনগুণ বেশী অধিকারের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছেঃ (১) কষ্ট করে মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছে। (২) কষ্ট করেই তাকে প্রসব করেছে এবং (৩) গর্ভধারণ ও দুধ পান করাতে ৩০ মাস লেগেছে।

এ আয়াতে সূরা লোকমানের ১৪ আয়াত এবং সূরা বাকারার ২৩৩ আয়াতে থেকে আরো একটি আইনগত বিষয় পাওয়া যায়। একটি মামলায় হযরত আলী ও হযরত ইবনে আব্বাস সেই বিষয়টিই তুলে ধরেছিলেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে হযরত উসমান (রা:) তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন। ঘটনাটা হচ্ছে, হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত যুগে এক ব্যক্তি জুহায়না গোত্রের একটি মেয়েকে বিয়ে করে এবং বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই তার গর্ভ থেকে একটি সুস্থ ও ত্রুটিহীন শিশু ভুমিষ্ঠ হয়। লোকটি হযরত উসমানের কাছে ঘটনাটা পেশ করে। তিনি উক্ত মহিলাকে ব্যভিচারিণী ঘোষণা করে তাকে রজম করার নির্দেশ দেন। হযরত আলী (রা.) এই ঘটনা শোনা মাত্র হযরত উসমানের (রা.) কাছে পৌঁছেন এবং বলেনঃ আপনি এ কেমন ফয়সালা করলেন? জবাবে হযরত উসমান বললেন, বিয়ের ছয় মাস পরেই সে জীবিত ও সুস্থ সন্তান প্রসব করেছে। এটা কি তার ব্যভিচারিণী হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ নয়? হযরত আলী (রা.) বললেনঃ না, এর পর তিনি কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াত তিনটি ধারাবাহিভাবে পাঠ করলেন। সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেছেনঃ “যে পিতা দুধ পানের পূর্ণ সময় পর্যন্ত দুধ পান করাতে চায় মায়েরা তার সন্তানকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে।” সূরা লোকমানে বলেছেনঃ “তার দুধ ছাড়তে দুই বছর লেগেছে। সূরা আহক্বাফ:ে বলেছেনঃ “তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধ পান করাতে ত্রিশ মাস লেগেছে।” এখন ত্রিশ মাস থেকে যদি দুধ পানের দুই বছর বাদ দেয়া হয় তাহলে গর্ভে ধারণকাল ছয় মাস মাত্র অবশিষ্ট থাকে। এ থেকে জানা যায়, গর্ভ ধারণের স্বল্পতম মেয়াদ ছয় মাস। এই সময়ের মধ্যে সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হতে পারে। অতএব, যে মহিলা বিয়ের ছয় মাস পরে সন্তান প্রসব করেছে তাকে ব্যভিচারিণী বলা যায় না। হযরত আলীর (রা.) এই যুক্তি-প্রমাণ শুনে হযরত উসমান বললেনঃ আমার মন-মস্তিষ্কে এ বিষয়টি আদৌ আসেনি। এরপর তিনি মহিলাটিকে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর সিদ্ধান্ত পরবর্তন করলেন। একটি বর্ণনাতে আছে, হযরত ইবনে আব্বাসও এ বিষয়ে হযরত আলীর মতকে সমর্থন করেছিলেন এবং তারপর হযরত উসমান তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছিলেন। (ইবনে জারীর, আহকামুল কুরআন জাসসাস, ইবনে কাসীর)। এ তিনটি আয়াতে একত্রিত করে পাঠ করলে যেসব আইনগত বিধান পাওয়া যায় তা হচ্ছেঃ

একঃ যে মহিলা বিয়ের পর ছয় মাসের কম সময়ের মধ্যে সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ সন্তান প্রসব করবে (অর্থাৎ তা যদি গর্ভপাত না হয়, বরং স্বাভাবিক প্রসব হয়) সে ব্যভিচারিণী সাব্যস্ত হবে এবং এবং তার স্বামীর বংশ পরিচয় তার সন্তান পরিচিত হবে না।

দুইঃ যে মহিলা বিয়ের ছয় মাস পর বা তার চেয়ে বেশী সময় পর জীবিত ও সুস্থ সন্তান প্রসব করবে শুধু এই সন্তান প্রসব করার কারণে তাকে ব্যভিচারের অভিযুক্ত করা যাবে না। তার স্বামীকে তার প্রতি অপবাদ আরোপের অধিকার দেয়া যেতে পারে না এবং তার স্বামী ঐ সন্তানের বংশ পরিচয় অস্বীকার করতে পারে না। সন্তান তারই বলে স্বীকার করা হবে এবং মহিলাকে শাস্তি দেয়া যাবে না।

তিনঃ দুধপান করানোর সর্বাধিক মেয়াদ দুই বছর। এই বয়সের পর যদি কোন শিশু কোন মহিলার দুধ পান করে তাহলে সে তার দুধ মা হবে না এবং সূরা নিসার ২৩ আয়াতে দুধ পানের যে বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে তাও এই ধরনের দুধ পানের বেলায় প্রযোজ্য হবে না। এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা অধিক সতর্কতার জন্য দুই বছরের পরিবর্তে আড়াই বছরের মেয়াদ নির্ধারণ করেছেন যাতে দুধপান করানোর কারণে যে সব বিষয় হারাম হয় সেই সব নাজুক বিষয়ে ভুল করার সম্ভাবনা না থাকে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা লোকমান, টীকা ২৩ )

এখানে এ বিষয়টির অবগতি বে-ফায়েদা হবে না যে, সর্বাধুনিক মেডিকেল গবেষণা অনুসারে একটি শিশুকে পরিপুষ্টি ও পরিবৃদ্ধি লাভ করে জীবন্ত ভূমিষ্ঠ হওয়ার উপযোগী হতে হলে কমপক্ষে ২৮ সপ্তাহ মাতৃগর্ভে অবস্থান প্রয়োজন। এটা সাড়ে ছয় মাস সময়ের সামান্য বেশী। ইসলামী আইনে আরো প্রায় অর্ধ মাস সুযোগ দেয়া হয়েছে। কারণ, একজন মহিলার ব্যভিচারিণী প্রমাণিত হওয়া এবং একটি শিশুর বংশ পরিচয় থেকে বঞ্চিত হওয়া বড় গুরুতর ব্যাপার। মা ও শিশুকে আইনগত এই কঠিন পরিণাম থেকে রক্ষা করার জন্য বিষয়টির নাজুকতা আরো বেশি সুযোগ পাওয়ার দাবী করে। তাছাড়া গর্ভ কোন্ সময় স্থিতি লাভ করেছে তা কোন ডাক্তার, কোন বিচারক এবং এমনকি মহিলা নিজে এবং তাকে গর্ভদানকারী পুরুষও সঠিকভাবে জানতে পারে না। এ বিষয়টিও গর্ভধারণেরা স্বল্পতম আইনগত মেয়াদ নির্ধারণে আরো কয়েক দিনের অবকাশ দাবী করে।
** আমাকে এমন সৎ কাজ করার তাওফীক দান করো যা বাহ্যিক দিক দিয়েও অবিকল তোমার বিধান মোতাবেক হবে এবং বাস্তবেও তোমার কাছে গৃহিত হওয়ার উপযুক্ত হবে। কোনো কাজ যদি দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টিতে খুব ভালও হয়, কিন্তু তাতে যদি আল্লাহর আইনের আনুগত্য না করা হয়, তাহলে দুনিয়ার মানুষ তার যত প্রশংসাই করুক না কেন আল্লাহর কাছে তা আদৌ কোন প্রশংসার যোগ্য হতে পারে না। অপরদিকে একটা কাজ যদি অবিকল শরীয়ত মোতাবেক হয় এবং তার বাহ্যিক রূপ ও অহংকার এবং স্বার্থ লোভ তাকে ভেতর থেকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়, এমন কাজও আল্লাহর কাছে গৃহিত হওয়ার যোগ্য থাকে না।
** তারা পৃথিবীতে যত বেশী ভাল কাজ করেছে আখেরাতে সেই অনুপাতের তাদের মর্যাদা নিরূপণ করা হবে। তবে তাদেরকে পদস্খলন, দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য পাকড়াও করা হবে না। এটা ঠিক তেমনি যেমন কোন মহৎ হৃদয়, উদার ও মর্যাদাবোধ সম্পন্ন মনিব তার অনুগত ও বিশ্বস্ত চাকরকে ছোট ছোট সেবা ও খেদমতের নিরিখে মূল্যায়ন করে না বরং তার এমন কোনো কাজের বিচারে মূল্যায়ন করে যে ক্ষেত্রে সে বড় কোন কৃতিত্ব দেখিয়েছে কিংবা জীবনপাত ও বিশ্বস্ততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে। এ রকম খাদেমের ছোট ছোট ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে সে তার সমস্ত সেবাকে খাটো করে দেখানোর মত আচরণ করে না।
** এখানে দুই রকম চরিত্র পাশাপাশি রেখে শ্রোতাদেরকে যেন নিঃশব্দ এই প্রশ্ন করা হয়েছে যে, বলো, এ দু’টি চরিত্রের মধ্যে কোনটি উত্তম? সমাজে সেই সময় পাশাপাশি এই দু’টি চরিত্রই বিদ্যমান ছিল। প্রথম প্রকার চরিত্রের অধিকারী কারা এবং দ্বিতীয় প্রকার চরিত্রের অধিকারী কারা তা জানা মানুষের জন্য আদৌ কঠিন ছিল না। এটা কুরাইশ নেতাদের এই উক্তির জবাব যে, এই কিতাব মেনে নেয়া যদি কোন ভাল কাজ হতো তাহলে এই কতিপয় যুবক ও ক্রীতদাস এ ব্যাপারে আমাদের চেয়ে অগ্রগামী হতে পারতো না। এই জবাবের আলোকে প্রতিটি মানুষ নিজেই বিচার করে দেখতে পারতো কিতাব মান্যকারীদের চরিত্র কী এবং অমান্যকারীদের চরিত্র কী?
** না ভাল লোকদের ত্যাগ ও কুরবানী নষ্ট হবে, না মন্দ লোকদেরকে তাদের প্রকৃত অপরাধের অধিক শাস্তি দেয়া হবে। সৎ ব্যক্তি যদি তার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত থাকে কিংবা প্রকৃত প্রাপ্যের চেয়ে কম পুরস্কার পায় তাহলে তা জুলুম। আবার খারাপ লোক যদি তার কৃত অপরাধের শাস্তি না পায় কিংবা যতটা অপরাধ সে করেছে তার চেয়ে বেশী শাস্তি পায় তাহলে সেটাও জুলুম।
** তারা যেমন বড়াই ও গর্ব করেছে লাঞ্ছনাকর আযাব হবে সেই অনুপাতে। তারা নিজেদের বড় একটা কিছু বলে মনে করতো। তাদের ধারণা ছিল রসূলের প্রতি ঈমান এনে গরীব ও অভাবী মু’মিনদের দলে শামিল হওয়া তাদের মর্যাদার চেয়ে নীচু মানের কাজ। তারা ভেবেছিলো, কতিপয় ক্রীতদাস ও সহায় সম্বলহীন মানুষ যে জিনিষ বিশ্বাস করেছে আমাদের মত গণ্যমান্য লোকরো যদি তা বিশ্বাস করে তাহলে তাতে আমাদের মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হবে। এ কারণে আখেরাতে আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবেন এবং তাদের গর্ব ও অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেবেন।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১০-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি এই মুশরিক ও কাফিরদেরকে বল- সত্যিই যদি এই কুরআন আল্লাহর নিকট হতে এসে থাকে এবং এর পরও যদি তোমরা এটাকে অস্বীকার করতেই থাকে। তবে তোমাদের অবস্থা কি হতে পারে তা চিন্তা করেছো কি? যে আল্লাহ তাবারাকা, ওয়া তা’আলা আমাকে সত্যসহ তোমাদের নিকট এই পবিত্র কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছেন, তিনি তোমাদেরকে কি শাস্তি প্রদান করবেন তা কি ভেবে দেখেছো? তোমরা এই কিতাবকে অস্বীকার করছে এবং মিথ্যা জানছো, অথচ এর সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করছে ঐ সব কিতাব যেগুলো ইতিপূর্বে সময়ে সময়ে পূর্ববর্তী নবীদের উপর নাযিল হতে থেকেছে এবং বানী ইসরাঈলের একজন এর সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছে এবং এর হাকীকতকে চিনেছে ও মেনেছে এবং এর উপর ঈমান এনেছে। কিন্তু তোমরা এর অনুসরণ হতে গর্বভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

ভাবার্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ঐ সাক্ষী তার নবীর উপর এবং তার কিতাবের উপর বিশ্বাস করেছে, কিন্তু তোমরা তোমাদের নবীর সাথে ও তোমাদের কিতাবের সাথে কুফরী করেছো।

আল্লাহ তা’আলা যালিমদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।

(আরবী) শব্দটি (আরবী) এবং এটা স্বীয় সাধারণ অর্থের দিক দিয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) প্রমুখ সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করে। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এ আয়াতটি মাক্কী এবং এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অবতীর্ণ হয়। নিম্নের আয়াতটিও এ আয়াতের অনুরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তাদের কাছে পাঠ করা হয় তখন তারা বলে- আমরা এর উপর ঈমান আনলাম, নিশ্চয়ই এটা আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে সত্য, আমরা তো এর পূর্বেই মুসলমান ছিলাম।”(২৮:৫৩) অন্য জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলেঃ আমাদের প্রতিপালক পবিত্র, মহান। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে।”(১৭:১০৭-১০৮)

হযরত মাসরূক (রঃ) এবং হযরত শা’বী (রঃ) বলেন যে, এখানে এই আয়াত দ্বারা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-কে বুঝানো হয়নি। কেননা, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মক্কায়, আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মদীনায় হিজরতের পর।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এবং ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনিনি যে, ভূ-পৃষ্ঠে চলাফেরাকারী কোন মানুষকে তিনি জান্নাতবাসী বলেছেন, একমাত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ছাড়া। তাঁর ব্যাপারেই (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত যহহাক (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত ইউসুফ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে সালাম (রঃ), হযরত হিলাল ইবনে ইয়াসাফ (রঃ), হযরত সাওরী (রঃ) হযরত মালিক ইবনে আনাস (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এ আয়াত দ্বারা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালামকেই (রাঃ) বুঝানো হয়েছে।

ইরশাদ হচ্ছেঃ এই কাফিররা বলে- “এই কুরআন যদি ভাল জিনিসই হতো তবে আমাদের ন্যায় সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং আল্লাহর গৃহীত বান্দাদের উপর বিলাল (রাঃ), আম্মার (রাঃ), সুহায়েব (রাঃ), খাব্বাব (রাঃ) প্রমুখ নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা অগ্রগামী হতো না। বরং সর্বপ্রথম আমরাই এটা কবুল করতাম। কিন্তু এটা তাদের সম্পূর্ণ বাজে ও ভিত্তিহীন কথা। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এভাবেই আমি তাদের কাউকেও কারো উপর ফিত্নায় ফেলে থাকি, যেন তারা বলেঃ এরাই কি তারা, আমাদের মধ্য হতে যাদের উপর আল্লাহ তা’আলা অনুগ্রহ করেছেন?”(৬:৫৩) অর্থাৎ তারা বিস্মিত হয়েছে যে, কি করে এ লোকগুলো হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে! যদি এটাই হতো তবে তো তারাই অগ্রগামী হতো। কিন্তু ওটা ছিল তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এটা নিশ্চিত কথা যে, যাদের সুবুদ্ধি রয়েছে এবং যারা শান্তিকামী লোক তারা সদা কল্যাণের পথে অগ্রগামীই হয়। এ জন্যেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস এই যে, যে কথা ও কাজ আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর সাহাবীগণ (রাঃ) হতে প্রমাণিত না হয় ওটা বিদআত। কেননা, যদি তাতে কল্যাণ নিহিত থাকতো তবে ঐ পবিত্র দলটি, যারা কোন কাজেই পিছনে থাকতেন না, তাঁরা ওটাকে কখনো ছেড়ে দিতেন না।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন যে, এই কাফিররা কুরআন দ্বারা পরিচালিত নয় বলে তারা বলেঃ ‘এটা তো এক পুরাতন মিথ্যা।’ একথা বলে তারা কুরআন এবং কুরআনের ধারক ও বাহকদেরকে ভর্ৎসনা করে থাকে। এটাই ঐ অহংকার যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অহংকার হলো সত্যকে সরিয়ে ফেলা এবং লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।”

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এর পূর্বে ছিল মূসা (আঃ)-এর কিতাব আদর্শ ও অনুগ্রহ স্বরূপ। ওটা হলো তাওরাত। এই কিতাব অর্থাৎ কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সমর্থক। এই কুরআন আরবী ভাষায় অবতারিত। এর ভাষা অলংকার ও বাকচাতুর্যপূর্ণ এবং ভাবার্থ অতি স্পষ্ট ও প্রকাশমান। এটা যালিম ও কাফিরদেরকে সতর্ক করে এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয়। এর

পরবর্তী আয়াতের তাফসীর সূরায়ে হা-মীম আসসাজদাহর মধ্যে গত হয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই অর্থাৎ আগামীতে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই এবং তারা চিন্তিত ও দুঃখিত হবে না, অর্থাৎ তারা তাদের ছেড়ে যাওয়া জিনিসগুলোর জন্যে মোটেই দুঃখিত হবে না।

তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেথায় তারা স্থায়ী হবে। এটাই তাদের ভাল কর্মের ফল।

১৫-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:

এর পূর্বে আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদ, আন্তরিকতার সাথে তাঁর ইবাদত এবং ওর প্রতি অটলতার হুকুম ছিল বলে এখানে পিতা-মাতার হক আদায় করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এই বিষয়েরই আরো বহু আয়াত কুরআন পাকের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।”(১৭:২৩) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।” (৩১:১৪) এই বিষয়ের আরো অনেক আয়াত আছে। এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি।’

হযরত সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তাঁর মাতা তাঁকে বলেঃ “আল্লাহ তা’আলা পিতা-মাতার আনুগত্য করার কি নির্দেশ দেননি? জেনে রেখো যে, আমি পানাহার করবো না যে পর্যন্ত না তুমি আল্লাহর সাথে কুফরী করবে।” হযরত সা’দ (রাঃ) এতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর মাতা তাই করে অর্থাৎ পানাহার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে। শেষ পর্যন্ত লাঠি দ্বারা তার মুখ ফেড়ে জোরপূর্বক তার মুখে খাদ্য ও পানীয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তখন (আরবী) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) ছাড়া অন্যান্য আহলুস সুনানও এটা বর্ণনা করেছেন) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “তার জননী তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করে কষ্টের সাথে।

হযরত আলী (রাঃ) এ আয়াত দ্বারা এবং এর সাথে সূরায়ে লোকমানের (তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে) এবং আল্লাহ তাআলার নির্দেশঃ (আরবী) অর্থাৎ “মাতারা যেন তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করায় তাদের জন্যে যারা দুধ পান করানোর সময়কাল পূর্ণ করতে চায়।”(২:২৩৩) এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, গর্ভধারণের সময়কাল হলো কমপক্ষে ছয় মাস। তাঁর এই দলীল গ্রহণ খুবই দৃঢ় এবং সঠিক। হযরত উসমান (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামও এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

হযরত মুআম্মার ইবনে আবদিল্লাহ জুহনী (রাঃ) বলেন যে, তাঁর গোত্রের একটি লোক জুহনিয়্যাহ গোত্রের একটি মহিলাকে বিয়ে করে। ছয় মাস পূর্ণ হওয়া মাত্রই মহিলাটি সন্তান প্রসব করে। তখন তার স্বামী হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট তার ঐ স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। হযরত উসমান (রাঃ) তখন লোক পাঠিয়ে মহিলাটিকে ধরে আনতে বলেন। মহিলাটি প্রস্তুত হয়ে আসতে উদ্যতা হলে তার বোন কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মহিলাটি তখন তার বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেঃ “তুমি কাঁদছো কেন? আল্লাহর কসম! আমার স্বামী ছাড়া দুনিয়ার কোন একটি লোকের সাথেও আমি কখনো মিলিত হইনি। আমার দ্বারা কখনো কোন দুষ্কর্ম হয়নি। সুতরাং আমার ব্যাপারে মহান আল্লাহর কি ফায়সালা হচ্ছে তা তুমি সত্বরই দেখে নিবে।” মহিলাটি হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট হাযির হলে তিনি তাকে রজম (পাথর মেরে হত্যা) করার নির্দেশ দেন। এ খবর হযরত আলী (রাঃ)-এর কর্ণগোচর হলে তিনি খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উসমান (রাঃ)-কে প্রশ্ন করেনঃ “আপনি এটা কি করতে যাচ্ছেন?” জবাবে তিনি বলেনঃ “এই মহিলাটি তার বিয়ের ছয় মাস পরেই সন্তান প্রসব করেছে, যা অসম্ভব (সুতরাং আমি তাকে ব্যভিচারের অপরাধে রজম করার নির্দেশ দিয়েছি)। হযরত আলী (রাঃ) তখন তাকে বলেনঃ “আপনি কি কুরআন পড়েননি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হঁ্যা, অবশ্যই পড়েছি।” হযরত আলী (রাঃ) তখন বলেনঃ “তাহলে কুরআন কারীমের (আরবী) (অর্থাৎ তার গর্ভধারণ ও দুধ ছাড়ানোর সময়কাল হলো ত্রিশমাস) এ আয়াতটি এবং (আরবী) (অর্থাৎ দুধ ছাড়ানোর সময়কাল হলো পূর্ণ দুই বছর) এ আয়াতটি পড়েননি? সুতরাং গর্ভধারণ ও দুধ পান করানোর মোট সময়কাল হলো ত্রিশ মাস। এর মধ্যে দুধ পান করানোর সময়কাল দুই বছর বা চব্বিশ মাস বাদ গেলে বাকী থাকে ছয় মাস। তাহলে কুরআন কারীম দ্বারা জানা গেল যে, গর্ভধারণের সময়কাল হলো কমপক্ষে ছয় মাস। এ মহিলাটি এ সময়কালের মধ্যেই সন্তান প্রসব করেছে। সুতরাং তার উপর কি করে ব্যভিচারের অভিযোগ দেয়া যেতে পারে?”

এ কথা শুনে হযরত উসমান (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! এ কথা সম্পূর্ণরূপে সঠিক! বড়ই দুঃখের বিষয় যে, এটা আমি চিন্তাই করিনি। যাও, মহিলাটিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।” অতঃপর জনগণ মহিলাটিকে এমন অবস্থায় পেলো যে, সে যে দোষমুক্ত তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। হযরত মুআম্মার (রঃ) বলেনঃ “আল্লাহর শপথ! একটি কাকের সাথে অন্য কাকের এবং একটি ডিমের সাথে অন্য ডিমের যেমন সাদৃশ্য থাকে, মহিলাটির শিশুর সাথে তার পিতার সাদৃশ্য এর চেয়েও বেশী ছিল। স্বয়ং তার পিতাও তাকে দেখে বলেঃ “আল্লাহর কসম! এটা যে আমারই সন্তান এ ব্যাপারে এখন আমার কোনই সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা মহিলাটির স্বামীকে একটা ক্ষত দ্বারা আক্রান্ত করেন যা তার চেহারায় দেখা দিয়েছিল। অবশেষে তাতেই সে মৃত্যুবরণ করে। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এ রিওয়াইয়াতটি আমরা অন্য সনদে (আরবী)-এ আয়াতের তাফসীরে আনয়ন করেছি।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যদি কোন নারী নয় মাসে সন্তান প্রসব করে তবে তার দুধ পান করানোর সময়কাল একুশ মাসই যথেষ্ট। আর যদি সাত মাসে সন্তান ভূমিষ্ট হয় তবে দুধ পানের সময়কাল হবে তেইশ মাস। আর যদি ছয় মাসে সন্তান প্রসব করে তবে দুধ পান করানোর সময়কাল হবে পূর্ণ দুই বছর। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, গর্ভধারণ ও দুধ ছাড়ানোর সময়কাল হলো ত্রিশ মাস।

মহান আল্লাহ বলেনঃ ক্রমে সে পূর্ণ শক্তিপ্রাপ্ত হয় এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয় অর্থাৎ সে শক্তিশালী হয়, যৌবন বয়সে পৌছে, পুরুষদের গণনাভুক্ত হয়, জ্ঞান পূর্ণ হয়, বোধশক্তি পূর্ণতায় পৌঁছে এবং সহিষ্ণুতা লাভ করে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, চল্লিশ বছর বয়সে মানুষের যে অবস্থা হয়, বাকী জীবন তার প্রায় ঐ অবস্থাই থাকে।

হযরত মাসরূক (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ ‘মানুষকে কখন তার গুনাহর জন্যে পাকড়াও করা হয়? উত্তরে তিনি বলেনঃ “যখন তোমার বয়স চল্লিশ বছর হবে তখন তুমি নিজের মুক্তির জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।”

হযরত উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “বান্দার বয়স যখন চল্লিশ বছরে পৌঁছে তখন আল্লাহ তার হিসাব হালকা করে দেন। যখন তার বয়স ষাট বছর হয় তখন আকাশবাসীরা তাকে ভালবাসতে থাকেন। তার বয়স যখন আশি বছরে পৌঁছে তখন আল্লাহ তা’আলা পুণ্যগুলো ঠিক রাখেন এবং পাপগুলো মিটিয়ে দেন। যখন তার বয়স নব্বই বছর হয় তখন আল্লাহ তা’আলা তার পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন এবং তাকে তার পরিবার পরিজনদের জন্যে শাফাআতকারী বানিয়ে দেন এবং আকাশে লিখে দেন যে, সে আল্লাহর যমীনে তাঁর বন্দী।” (এ হাদীসটি হাফিয আবূ ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন। অন্য সনদে এটা মুসনাদে আহমাদেও বর্ণিত হয়েছে)

দামেস্কের উমাইয়া শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবনে আবদিল্লাহ হাকামী বলেনঃ “চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তো আমি লোক লজ্জার খাতিরে অবাধ্যাচরণ ও পাপসমূহ বর্জন করেছি, এরপরে আল্লাহকে বলে লজ্জা করে আমি এগুলো পরিত্যাগ করেছি।” কবির নিম্নের উক্তিটি কতই না চমৎকারঃ (আরবী) অর্থাৎ “বাল্যকালে অবুঝ অবস্থায় যা কিছু হওয়ার হয়ে গেছে, কিন্তু বার্ধক্য যখন তার মুখ দেখালো তখন মাথার (চুলের) শুভ্রতা নিজেই মিথ্যা ও বাজে জিনিসকে বলে দিলোঃ এখন তুমি দূর হয়ে যাও।”

এরপর মহান আল্লাহ বান্দার দু’আর বর্ণনা দিচ্ছেন যে, সে বলেঃ হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন, যাতে আমি আপনার নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার মাতা-পিতার প্রতি যে নিয়ামত ও অনুগ্রহ আপনি দান করেছেন তার জন্যে। আর যাতে আমি সন্ধার্য করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন। আমার জন্যে আমার সন্তান-সন্ততিদেরকে সঙ্কর্মপরায়ণ করে দিন। আমি আপনারই অভিমুখী হলাম এবং আত্মসমর্পণ করলাম।

এতে ইরশাদ হয়েছে যে, চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হলে মানুষের উচিত পূর্ণভাবে আল্লাহ তা’আলার নিকট তাওবা করা এবং নব উদ্যমে এমন কাজ করে যাওয়া যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তাশাহহুদে পড়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে নিম্নলিখিত দু’আটি শিক্ষা দিতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরে আপনি ভালবাসা সৃষ্টি করে দিন, আমাদের পরস্পরের মাঝে সন্ধি স্থাপন করুন, আমাদেরকে শান্তির পথ দেখিয়ে দিন, আমাদেরকে (অজ্ঞতার) অন্ধকার হতে রক্ষা করে (জ্ঞানের) আলোকের দিকে নিয়ে যান, আমাদেরকে প্রকাশ্য ও গোপনীয় নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ হতে বাঁচিয়ে নিন, আমাদের কানে, আমাদের চোখে, আমাদের অন্তরে, আমাদের স্ত্রীদের মধ্যে এবং আমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে বরকত দান করুন এবং আমাদের তাওবা কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু। আমাদেরকে আপনার নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী বানিয়ে দিন এবং ঐ নিয়ামতরাশির কারণে আমাদেরকে আপনার প্রশংসাকারী করুন ও আপনার এই নিয়ামতরাজিকে স্বীকারকারী আমাদেরকে বানিয়ে দিন। আর আমাদের উপর আপনার নিয়ামত পরিপূর্ণ করুন।” (এ হাদীসটি সুনানে আবি দাউদে বর্ণিত আছে)

যে লোকদের বর্ণনা উপরে দেয়া হলো অর্থাৎ আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ করে ও নিজেদের পাপের জন্যে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থী হয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি তাদের সুকৃতিগুলো গ্রহণ করে থাকি এবং মন্দকর্মগুলো ক্ষমা করি। তাদের অল্প আমলের বিনিময়েই আমি তাদেরকে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করে থাকি। তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা সত্য প্রমাণিত হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রূহুল আমীন (হযরত জিবরাঈল আঃ) বলেন:“বান্দার পুণ্য ও পাপগুলো আনয়ন করা হবে এবং একটিকে অপরটির বিনিময় করা হবে। অতঃপর যদি একটি পুণ্যও বাকী থাকে তবে ওরই বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে জানাতে পৌঁছিয়ে দিবেন।” হাদীসটির বর্ণনাকারী তার উস্তাদকে জিজ্ঞেস করেনঃ “যদি পাপরাশির বিনিময়ে সমস্ত পুণ্য শেষ হয়ে যায়?” উত্তরে তিনি আল্লাহ পাকের এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেনঃ “আমি তাদের সুকৃতিগুলো গ্রহণ করে থাকি এবং মন্দ কর্মগুলো ক্ষমা করি, তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা সত্য প্রমাণিত হবে।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত রূহুল আমীন (আঃ) এ উক্তিটি মহামহিমান্বিত আল্লাহ হতে উদ্ধৃত করেছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল, কিন্তু এর ইসনাদ খুবই উত্তম)

হযরত সা’দ (রঃ) বলেনঃ যখন হযরত আলী (রাঃ) বসরার উপর বিজয় লাভ করেন ঐ সময় হযরত মুহাম্মাদ ইবনে হাতিব (রঃ) আমার নিকট আগমন করেন। একদা তিনি আমাকে বলেনঃ আমি একদা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট হাযির ছিলাম। ঐ সময় তথায় হযরত আম্মার (রঃ), হযরত সা’সা’ (রাঃ), হযরত আশতার (রাঃ) এবং হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবি বকর (রাঃ) বিদ্যমান ছিলেন। কতকগুলো লোক হযরত উসমান (রাঃ) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য করেন। ঐ সময় হযরত আলী (রাঃ) মসনদে উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁর হাতে একটি ছড়ি ছিল। তখন তাদের মধ্যে কে একজন বলেনঃ “আপনাদের মাঝে তো এই বিতর্কের সঠিকভাবে ফায়সালাকারী বিদ্যমান রয়েছেন?” সুতরাং সবাই হযরত আলী (রাঃ)-কে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন, হযরত উসমান (রাঃ) নিশ্চিতরূপে ঐ লোকদের মধ্যে একজন ছিলেন যাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমি এদেরই সুকৃতিগুলো গ্রহণ করে থাকি এবং মন্দকর্মগুলো ক্ষমা করি। তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা সত্য প্রমাণিত হবে।” আল্লাহর কসম! এই আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন হযরত উসমান (রাঃ) এবং তাঁর সঙ্গীগণ।” একথা তিনি তিনবার বলেন। বর্ণনাকারী ইউসুফ (রঃ) বলেনঃ আমি হযরত মুহাম্মাদ ইবনে হাতিব (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করলামঃ আপনাকে আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, বলুন তো, আপনি কি এটা স্বয়ং হযরত আলী (রাঃ)-এর মুখে শুনেছেন? উত্তরে তিনি বলেনঃ “হ্যা, আল্লাহর কসম! আমি স্বয়ং এটা হযরত আলী (রাঃ)-এর মুখে শুনেছি।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১৭-২০ নং আয়াতের তাফসীর:

যেহেতু উপরে ঐ লোকদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছিল যারা তাদের মাতা-পিতার জন্যে দু’আ করে এবং তাদের খিদমতে লেগে থাকে, আর সাথে সাথে তাদের পারলৌকিক মর্যাদা লাভ ও তথায় তাদের মুক্তি পাওয়া এবং তাদের প্রতিপালকের প্রচুর নিয়ামত প্রাপ্ত হওয়ার বর্ণনা দেয়া হয়েছিল, সেহেতু এর পরে ঐ হতভাগ্যদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যারা তাদের পিতা-মাতার অবাধ্য হয় এবং তাদেরকে বহু অন্যায় কথা শুনিয়ে দেয়। কেউ কেউ বলেন যে, এ আয়াতটি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পুত্র হযরত আবদুর রহমান (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যেমন হযরত আওফী (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সঠিকতার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এটা খুবই দুর্বল উক্তি। কেননা, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রাঃ) তো মুসলমান হয়েছিলেন এবং উত্তমরূপে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। এমন কি তাঁর যুগের উত্তম লোকদের মধ্যে তিনি একজন ছিলেন। কোন কোন তাফসীরকারেরও এ উক্তি রয়েছে। কিন্তু সঠিক কথা এটাই যে, এ আয়াতটি আম বা সাধারণ। যে কেউই মাতা-পিতার অবাধ্য হবে তারই ব্যাপারে এটা প্রযোজ্য হবে।

বর্ণিত আছে যে, মারওয়ান একদা স্বীয় ভাষণে বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা আমীরুল মুমিনীনকে (হযরত মুআবিয়া রাঃ-কে) ইয়াযীদের ব্যাপারে এক সুন্দর মত পোষণ করিয়েছিলেন। যদি তিনি তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে গিয়ে থাকেন তবে তো হযরত আবূ বকর (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে তাঁর পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে গিয়েছিলেন। তাঁর এ কথা শুনে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “আপনি কি তাহলে সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও খৃষ্টানদের নিয়মনীতির উপর আমল করতে চান? আল্লাহর কসম!

প্রথম খলীফা (হযরত আবু বকর রাঃ) না তো নিজের সন্তানদের কাউকেও খলীফা হিসেবে মনোনীত করেছিলেন, না নিজের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কাউকে মনোনীত করেছিলেন। আর হ্যরত মুআবিয়া (রাঃ) যে এটা করেছিলেন তা শুধু নিজের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং নিজের সন্তানের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে।” তখন মারওয়ান তাকে বলেনঃ “তুমি কি ঐ ব্যক্তি নও যে, তুমি মাতা-পিতাকে (আরবী) বলেছিলে?” উত্তরে আবদুর রহমান (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “আপনি কি একজন অভিশপ্ত ব্যক্তির পুত্র নন? আপনার পিতার উপর তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) অভিশাপ দিয়েছিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এসব কথা শুনে মারওয়ানকে বলেনঃ “হে মারওয়ান! আপনি আবদুর রহমান (রাঃ) সম্পর্কে যে কথা বললেন তা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা কথা। এ আয়াতটি আবদুর রহমান (রাঃ) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়নি, বরং অমুকের পুত্র অমুকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।” অতঃপর মারওয়ান তাড়াতাড়ি মিম্বর হতে নেমে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বাড়ীর দরযায় এসে কিছুক্ষণ তাঁর সাথে কথা-বার্তা বলে ফিরে আসেন।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সহীহ বুখারীতেও এ হাদীসটি অন্য সনদে ও অন্য শব্দে এসেছে। তাতে এও রয়েছে যে, হযরত মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রাঃ)-এর পক্ষ হতে মারওয়ান হিজাযের শাসনকর্তা ছিলেন। তাতে এও আছে যে, মারওয়ান তাঁর সৈন্যদেরকে হযরত আবদুর রহমান (রাঃ)-কে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দৌড়ে গিয়ে তার বোন হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর গৃহে প্রবেশ করেছিলেন। ফলে, তারা তাকে ধরতে পারেনি। ঐ রিওয়াইয়াতে একথাও রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) পর্দার আড়াল হতে বলেনঃ “আমার পবিত্রতা ঘোষণা সম্বলিত আয়াত ছাড়া আল্লাহ তা’আলা আমাদের সম্পর্কে কুরআন কারিমে আর কিছুই অবতীর্ণ করেননি।”

সুনানে নাসাঈর রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, মারওয়ানের এই ভাষণের উদ্দেশ্য ছিল ইয়াযীদের পক্ষ হতে বায়আত গ্রহণ করা। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর উক্তিতে এটাও রয়েছেঃ “মারওয়ান তার উক্তিতে মিথ্যাবাদী। যার ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তার নাম আমার খুব জানা আছে, কিন্তু এখন আমি তার নাম প্রকাশ করতে চাই না। হ্যা, তবে মারওয়ানের পিতাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মালউন বা অভিশপ্ত বলেছেন। আর মারওয়ান হলো তার ঔরষজাত সন্তান। সুতরাং তার উপরও লানত বাকী রয়েছে।”

আল্লাহ তা’আলা ঐ লোকটির উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন যে, সে তার মাতা-পিতাকে বলেঃ আফসোস তোমাদের জন্যে! তোমরা কি আমাকে এই ভয় দেখাতে চাও যে, আমি পুনরুত্থিত হবো যদিও আমার পূর্বে বহু পুরুষ গত হয়েছে? অর্থাৎ আমার পূর্বে তো লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে, তাদের একজনকেও তো পুনর্জীবিত হতে দেখিনি? তাদের একজনও তো ফিরে এসে কোন খবর দেয়নি?’ পিতা-মাতা নিরুপায় হয়ে তখন আল্লাহ তাআলার নিকট ফরিয়াদ করে বলেঃ ‘দুর্ভোগ তোমার জন্যে! এখনো সময় আছে, তুমি আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু ঐ অহংকারী তখনও বলেঃ ‘এটা তো অতীতকালের উপকথা ছাড়া কিছুই নয়।’

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “এদের পূর্বে যে জ্বিন ও মানুষ সম্প্রদায় গত হয়েছে তাদের মত এদের প্রতিও আল্লাহর উক্তি সত্য হয়েছে। যারা নিজেদেরও ক্ষতি সাধন করেছে এবং পরিবার পরিজনকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।”

আল্লাহ তা’আলার এ উক্তিতে (আরবী) রয়েছে, অথচ এর পূর্বে (আরবী) শব্দ আছে। অর্থাৎ পূর্বে এক বচন এবং পরে বহু বচন এনেছেন। এর দ্বারাও আমাদের তাফসীরেরই পূর্ণ সহায়তা লাভ হয়। অর্থাৎ উদ্দেশ্য (আরবী) বা সাধারণ। যে কেউ পিতা-মাতার সাথে বেআদবী করবে এবং কিয়ামতকে অস্বীকার করবে তারই জন্যে এই হুকুম প্রযোজ্য হবে। যেমন হযরত হাসান (রঃ) একথাই বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কাফির, দুরাচার এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে অস্বীকারকারী।

হযরত আবু উমামা বাহিলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর হতে চার ব্যক্তির উপর লানত করেন এবং ফেরেশতামণ্ডলী আমীন বলে থাকেন। (প্রথম) যে ব্যক্তি কোন মিসকীনকে ফাকি দিয়ে বলে “তুমি এসো, আমি তোমাকে কিছু প্রদান করবো।” অতঃপর যখন সে তার কাছে আসে তখন সে বলেঃ আমার কাছে কিছুই নেই।’ (দ্বিতীয়) যে মাউনকে বলে, অথচ তার সামনে কিছুই নেই। (তৃতীয়) ঐ ব্যক্তি, যাকে কোন লোক জিজ্ঞেস করেঃ ‘অমুকের বাড়ী কোনটি? সে তখন তাকে অন্য কারো বাড়ী দেখিয়ে দেয়। (চতুর্থ) ঐ ব্যক্তি, যে তার পিতা-মাতাকে প্রহার করে, শেষ পর্যন্ত তার পিতা-মাতা তার বিরুদ্ধে আল্লাহ তা’আলার নিকট ফরিয়াদ করতে থাকে।” (এ হাদীসটি হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি খুবই গরীব বা দুর্বল)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী, এটা এই জন্যে যে, আল্লাহ প্রত্যেককে তার কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিবেন এবং তাদের প্রতি কোন অবিচার করা হবে না।

হযরত আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) বলেন যে, জাহান্নামের শ্রেণীগুলো নীচের দিকে গিয়েছে এবং জান্নাতের শ্রেণীগুলো গিয়েছে উপরের দিকে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যেদিন কাফিরদেরকে জাহান্নামের সন্নিকটে উপস্থিত করা হবে সেদিন তাদেরকে ধমক হিসেবে বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের পুণ্য ফল তো দুনিয়াতেই পেয়ে গেছে। সেখানেই তোমরা সুখ-সম্ভার ভোগ করে নিঃশেষ করেছে।

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এই আয়াতটিকে সামনে রেখেই বাঞ্ছিত ও সূক্ষ্ম খাদ্য ভক্ষণ হতে বিরত হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমি ভয় করছি যে, আল্লাহ তা’আলা ধমক ও তিরস্কারের সুরে যেসব লোককে নিম্নের কথাগুলো বলবেন, না জানি আমিও হয়তো তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবোঃ “তোমরা তো পার্থিব জীবনে সুখ-সম্ভার ভোগ করে নিঃশেষ করেছো।”

হযরত আবু জাফর (রঃ) বলেন যে, কতক লোক এমনও রয়েছে যে, যারা তাদের দুনিয়ায় কৃত পুণ্য কার্যগুলো কিয়ামতের দিন দেখতে পাবে না এবং তাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা তো পার্থিব জীবনে সুখ-সম্ভার ভোগ করে নিঃশেষ করেছে।’

অতঃপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ “সুতরাং আজ তোমাদেরকে দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি। কারণ তোমরা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে ঔদ্ধ্যত প্রকাশ করেছিলে এবং তোমরা ছিলে সত্যদ্রোহী।’ অর্থাৎ তাদের যেমন আমল ছিল তেমনই তারা ফল পেলো। দুনিয়ায় তারা সুখ-সম্ভার ভোগ করেছে, পরম সুখে জীবন অতিবাহিত করেছে এবং সত্যের অনুসরণ ছেড়ে অসত্য, অন্যায় ও আল্লাহর অবাধ্যাচরণে নিমগ্ন থেকেছে। সুতরাং আজ কিয়ামতের দিন তাদেরকে মহা লাঞ্ছনাজনক ও অবমাননাকর এবং কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিসহ জাহান্নামের নিম্নস্তরে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এসব হতে রক্ষা করুন!

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
** (إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ)

‘‘নিশ্চয়ই যারা বলেছে”, আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের প্রতিপালক’ অর্থাৎ যারা ঈমান আনার পর তার ওপর অটল থাকে পরকালে তাদের কোন দুশ্চিন্তা ও ভয় থাকবে না। এ আয়াতের তাফসীর সূরা হা-মীম সিজদার ২০ নং আয়াতেও করা হয়েছে।

৩০-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কুরআন, রিসালাত ও তাওহীদ অস্বীকারকারীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলী তাদের দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করে তাওহীদের দাওয়াত ও অস্বীকারকারীদের পরিণাম এবং আখিরাতের আযাব তথা জাহান্নামের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

এখানে পূর্ণ মু’মিনদের অবস্থা, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সম্মান এবং তাদের জন্য বিশেষ পথনির্দেশ উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ঈমান আনার পর ঈমানের ওপর অটল থাকে, পুরোপুরিভাবে শরীয়তের অনুসারী হয় এবং যারা অপরকেও আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দেয়, তাদের সংশোধনের চেষ্টা করে। তাদেরকে সবর করতে এবং মন্দের জওয়াবে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যারা বলে, আমাদের রব হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা এবং এর ওপরই অটল থাকে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে রব হিসেবে অন্তরে বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করে, তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে, কখনো র্শিক করে না, এক আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন বাতিল মা‘বূদের উপাসনা করে না, অন্যকে বিধানদাতা মনে করে না তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় খুশির সংবাদ নিয়ে যে, তোমরা ভীত হয়ো না ও চিন্তিতও হয়ো না এবং তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‏ أُولٰ۬ئِكَ أَصْحٰبُ الْجَنَّةِ خٰلِدِيْنَ فِيْهَا جَزَا۬ءًۭ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ) ‏

“নিশ্চয়ই যারা বলেছে, আল্লাহই আমাদের প্রতিপালক, তারপর এ কথার ওপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা পেরেশানও হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। চিরদিন তারা সেখানে থাকবে। তারা (দুনিয়ায়) যেসব আমল করছিল এটা তারই প্রতিদান।” (সূরা আহকাফ ৪৬ : ১৩-১৪)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَلَمْ يَلْبِسُوْآ إِيْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولٰ۬ئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُوْنَ ‏)‏

“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎ পথপ্রাপ্ত।” (সূরা আনআম ৬ : ৮২)

সা‘ঈদ ইবনু ‘ইমরান (রহঃ) বলেন : এ আয়াতটি আবূ বক্র (রাঃ)-এর সম্মুখে পাঠ করা হলে তিনি বলতেন যে, এর দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা কালিমা পাঠ করার পর আর কখনো র্শিক করে না। (তাবারী ২১/৪৬৪)

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, সুফিয়ান ইবনু ‘আবদুল্লাহ আস সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললাম : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ইসলামের ব্যাপারে এমন একটি কথা বলুন যা আপনার পর আর কাউকে জিজ্ঞাসা করব না, অন্য বর্ণনায় রয়েছে আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করব না। তিনি বললেন : তুমি বলো : আমি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান এনেছি, তারপর এর ওপর অটল থাকো। আমি বললাম : আমি বেঁচে থাকব কী থেকে? তিনি তার জিহ্বা ধরলেন এবং বললেন : এটা হতে। (সহীহ মুসলিম হা. ৩৮, তিরমিযী হা. ২৩১০)

(تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ)

‘তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা’ ফেরেশতাগণের এ অবতরণ ও সম্বোধন সম্পর্কে মুজাহিদ বলেন : তা হবে মৃত্যুর সময়। কাতাদাহ বলেন : পুনরুত্থানের জন্য কবর থেকে যখন উঠবে। ইবনু আব্বাস বলেন : এ সুসংবাদ হবে আখিরাতে।

এরপর ফেরেশতারা দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত মু’মিনদেরকে আরো সুসংবাদ প্রদান করেন যে, আমরা দুনিয়ায় তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য সমস্ত কিছু রয়েছে যা তোমাদের মন চায় এবং যা তোমরা আকাক্সক্ষা করো। ক্ষমাশীল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এটা তোমাদের জন্য আপ্যায়ন। জান্নাতের এ বর্ণনা পূর্বে আরো একাধিক স্থানে দেয়া হয়েছে। সুতরাং আখিরাতে ফেরেশতাদের এমন আচরণ পাওয়ার জন্য আমাদেরকে ঈমানের ওপর অটল থাকতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলাকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করতে হবে এবং তার ওপরই অবিচল থাকতে হবে।
২. ফেরেশতারা মু’মিন ব্যক্তিদের বন্ধু আর কাফিরদের বন্ধু হলো শয়তান।
৩. দীনের ওপর অটল থাকার অর্থ জানলাম।
৪. মু’মিনদের জন্য আখিরাতে কোন চাহিদা অপূর্ণ থাকবে না।

১৭-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতার প্রতি আনুগত্যশীল বান্দাদের কথা আলোচনা করেছেন। এখানে তার বিপরীত চরিত্রের সন্তানদের কথা আলোচনা করা হচ্ছে।

أف শব্দাট বিরক্তি বা অসন্তোষ প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ অবাধ্য সন্তানরা পিতার উপদেশমূলক বাণী বা ঈমান ও সৎ কর্মের প্রতি আহ্বানের দাওয়াতে বিরক্তি ও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে। অথচ সন্তানদের জন্য এ রকম করার কোন অনুমতি নেই। পিতা-মাতা উভয়ে মুসলিম, সন্তান পুনরুত্থানের ব্যাপারে অস্বীকার করলে উভয়ে তাকে বুঝাচ্ছেন, তোমার ধ্বংস হোক তুমি ঈমান আন আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা সত্য। তখন সে বলে এসব অতীত কালের উপকথা। এদের দ্বারাই আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম পূর্ণ করবেন। তিনি বলেন :

(لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِيْنَ)‏

“অবশ্যই আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব তোমাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের সবাইকে দিয়ে।” (সূরা সোয়াদ ৩৮ : ৮৫)

ইউসুফ বিন মাহাক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মারওয়ান ছিলেন হিজাযের গভর্নর। তাকে নিয়োগ করেছিলেন মু‘আবিয়াহ (রাঃ)। (মু‘আবিয়াহ (রাঃ) ইচ্ছা করলেন ইয়াযীদকে তার পরবর্তী খলীফা নিযুক্ত করবেন। সে লক্ষ্যে মারওয়ানের কাছে চিঠি লিখে ইয়াযীদের জন্য বাইয়াত নেয়ার আহ্বান জানালেন) তাই মারওয়ান একদা খুতবা দিলেন এবং তাতে ইয়াযীদ ইবনু মু‘আবিয়ার কথা বারবার বলতে লাগলেন, যেন মানুষ মু‘আবিয়াহর মৃত্যুর পর ইয়াযীদের খেলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করে। এ সময় তাকে আব্দুর রহমান বিন আবূ বকর অস্বীকৃতিকমূলক কিছু কথা বললেন। মারওয়ান বললেন, তাঁকে পাকড়াও কর। তৎক্ষণাৎ তিনি আয়িশাহ (রাঃ)-এর ঘরে চলে গেলেন। তারা তাঁকে ধরতে পারল না। তারপর মারওয়ান বললেন, এ তো সেই লোক যার সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেছেন

(وَالَّذِيْ قَالَ لِوَالِدَيْهِ أُفٍّ لَّكُمَآ أَتَعِدَانِنِيْ…..)

(সহীহ বুখারী হা. ৪৮২৭) অন্য বর্ণনায় এসেছে মারওয়ান বললেন, এ পদ্ধতিতে খেলাফতের বাইয়াত নেয়া আবূ বকর ও উমার (রাঃ)-এর সুন্নাত। আবদুর রহমান বিন আবূ বকর (রাঃ) বললেন, এটা হিরাকল ও কায়সারের সুন্নাত (আবূ বকর ও উমার (রাঃ)-এর সুন্নত নয়)। তখন মারওয়ান বলল, এ তো সেই লোক যার সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেছেন

(وَالَّذِيْ قَالَ لِوَالِدَيْهِ أُفٍّ لَّكُمَآ أَتَعِدَانِنِيْ…..) ।

এ সংবাদ আয়িশাহ (রাঃ) এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, আমাদের ব্যাপারে (অর্থাৎ আবূ বকর (রাঃ)্ এর পরিবারের ব্যাপারে) কুরআনে আমাকে ইফকের ঘটনা থেকে পবিত্র করা ব্যতীত আর কিছুই নাযিল হয়নি। তারপর তিনি বললেন, এ আয়াত কোন ব্যক্তির ব্যাপারে নাযিল হয়েছে আমাকে যদি তার নাম বলে নিতে বল তাহলে তার নাম বলে দিতে পারব।

(وَيَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا)

অর্থাৎ এরূপ তাদেরকে কিয়ামতের দিন ভর্ৎসনা করে বলা হবে : তোমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের ভাগের সব নিয়ামত শেষ করেছ, অতএব এখন তোমাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি ছাড়া আর কিছু বাকী নেই। উমার (রাঃ) অনেক পবিত্র হালাল পানীয় ও খাবার থেকে বিরত থাকতেন এ আশংকায় যে, না-জানি তাদের শামিল হয়ে যাই যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানদের জন্য দুর্ভোগ।
২. একশ্রেণির মানুষ ও জীন দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করা হবে।
৩. সৎ আমলকারী ও অসৎ আমলকারী প্রত্যেকেই পূর্ণ প্রতিদান পাবে।
৪. কাফিরদের সৎ আমল কিয়ামতের দিন কোন উপকারে আসবেনা।
৫. সন্দেহজনক বস্তু থেকে বেঁচে থাকা তাকওয়ার বড় পরিচয়।

Leave a Reply