باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১৫) [ ** বস্তুতঃ ওরা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে খেল-তামাশা করছে:- **আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি:-] www.motaher21.net সূরা:৪৪: সূরা:- ‌দুখান‌ পারা:২৫ ১-১৬ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১৫)
[ ** বস্তুতঃ ওরা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে খেল-তামাশা করছে:-
**আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৪: সূরা:- ‌দুখান‌ পারা:২৫
১-১৬ নং আয়াত:-
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১
حٰمٓ ﴿ۚۛ۱﴾
হা – মীম।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :২
وَ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ ۙ﴿ۛ۲﴾
শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ اِنَّا کُنَّا مُنۡذِرِیۡنَ ﴿۳﴾
আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি। কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪
فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ ۙ﴿۴﴾
এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫
اَمۡرًا مِّنۡ عِنۡدِنَا ؕ اِنَّا کُنَّا مُرۡسِلِیۡنَ ۚ﴿۵﴾
আমার আদেশক্রমে, আমি তো রসূল প্রেরণ করে থাকি।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৬
رَحۡمَۃً مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ۙ﴿۶﴾
আপনার রবের রহমতস্বরূপ ; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ—
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৭
رَبِّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ۘ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّوۡقِنِیۡنَ ﴿۷﴾
আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও ওদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালকের নিকট হতে। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৮
لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ؕ رَبُّکُمۡ وَ رَبُّ اٰبَآئِکُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۸﴾
তিনি ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই, তিনি জীবন দান করেন এবং তিনি­ই মৃত্যু ঘটান। তিনি তোমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিপালক।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৯
بَلۡ ہُمۡ فِیۡ شَکٍّ یَّلۡعَبُوۡنَ ﴿۹﴾
কিন্তু বাস্তবে এসব লোকের দৃঢ় বিশ্বাস নেই) বরং তারা নিজেদের সন্দেহের মধ্যে পড়ে খেলছে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১০
فَارۡتَقِبۡ یَوۡمَ تَاۡتِی السَّمَآءُ بِدُخَانٍ مُّبِیۡنٍ ﴿ۙ۱۰﴾
অতএব তুমি অপেক্ষা কর সে দিনের, যেদিন আকাশ স্পষ্ট ধূমাচ্ছন্ন হবে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১১
یَّغۡشَی النَّاسَ ؕ ہٰذَا عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۱﴾
এবং তা মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এটা কষ্টদায়ক শাস্তি।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১২
رَبَّنَا اکۡشِفۡ عَنَّا الۡعَذَابَ اِنَّا مُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۲﴾
তখন ওরা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর হতে শাস্তি দূর কর, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করব।’
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১৩
اَنّٰی لَہُمُ الذِّکۡرٰی وَ قَدۡ جَآءَہُمۡ رَسُوۡلٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۙ۱۳﴾
তারা কি করে উপদেশ গ্ৰহণ করবে? অথচ ইতোপূর্বে তাদের কাছে এসেছে স্পষ্ট এক রাসূল;
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১৪
ثُمَّ تَوَلَّوۡا عَنۡہُ وَ قَالُوۡا مُعَلَّمٌ مَّجۡنُوۡنٌ ﴿ۘ۱۴﴾
তারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং বলেছিল, ‘এ এক শিক্ষাপ্রাপ্ত পাগল !’
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১৫
اِنَّا کَاشِفُوا الۡعَذَابِ قَلِیۡلًا اِنَّکُمۡ عَآئِدُوۡنَ ﴿ۘ۱۵﴾
আমি তোমাদের শাস্তি কিছু কালের জন্য দূর করলে, তোমরা তো তোমাদের পূর্বাবস্থায় আবার ফিরে যাবে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :১৬
یَوۡمَ نَبۡطِشُ الۡبَطۡشَۃَ الۡکُبۡرٰی ۚ اِنَّا مُنۡتَقِمُوۡنَ ﴿۱۶﴾
যেদিন আমি তোমাদেরকে প্রবলভাবে পাকড়াও করব(সেদিন) আমি অবশ্যই প্রতিশোধ গ্রহণ করব।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

নামকরণ ও ফযীলত :

(الدُّخَانُ) দুখান শব্দের অর্থ ধোঁয়া। কিয়ামত সংঘঠিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে এর আলামতস্বরূপ আকাশ সম্পূর্ণরূপে ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে যাবে, সেদিন আকাশে ধোঁয়া ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে না। অত্র সূরার ১০ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত দুখান শব্দ থেকে এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

এ সূরার ফযীলতের ব্যাপারে যত বর্ণনা রয়েছে প্রায় সকল বর্ণনাই ত্র“টিযুক্ত। সুতরাং তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

১-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা আল বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট কিতাব তথা পবিত্র কুরআনের শপথ করে বলেন, নিশ্চয়ই আমি এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে। এ বরকতময় রাতটি হলো রমাযান মাসের কদরের রাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْٓ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًي لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰي وَالْفُرْقَانِ)

“রমাযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৮৫)

কদরের রাতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّآ أَنْزَلْنٰهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ) ‏

“নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে।” (সূরা ক্বাদ্র ৯৭ : ১)

আর এ শবে কদর রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোন একটি রাত।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা লাইলাতুল কদর অšে¦ষণ করো রমাযানের শেষ দশকে। (সহীহ বুখারী হা. ২০২১)

সুতরাং কুরআন অবতীর্ণ হয় রমাযান মাসের কদরের রাতে, যা বরকতময় রাত হিসেবে এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রাত বরকতময় এ জন্য যে :

১. এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
২. এ রাতে বহু ফেরেশতাসহ জিবরীল আমীন পৃথিবীতে অবতরণ করেন।
৩. সারা বছরে সংঘটিত হবে এমন কার্যের ফায়সালা করা হয়।
৪. এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ইবরাহীম (আঃ)-এর সহীফাসমূহ রমাযানের প্রথম তারিখে, তাওরাত ছয় তারিখে, যাবূর বার তারিখে, ইঞ্জিল আঠার তারিখে এবং কুরআন চব্বিশ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছে। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ১৫৭৫)

কুরআন শবে কদরে নাযিল হওয়ার অর্থ এই যে, লাওহে মাহফূয থেকে সমগ্র কুরআন দুনিয়ার আকাশে এ রাতেই নাযিল হয়েছে। অতঃপর নবুওয়াতের তেইশ বছরে প্রয়োজনানুপাতে খণ্ড খণ্ড করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, প্রতি বছর যতটুকু কুরআন নাযিল হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটুকুই শবে কদরে দুনিয়ার আকাশে নাযিল হয়েছে। (কুরতুবী)

কেউ কেউ (لَيْلَةٌ مُبَارَكَةٌ) (বরকতময় রাত) বলতে শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বলে থাকেন। এ কথা সঠিক নয়। কুরআনের স্পষ্ট উক্তি দ্বারা এ কথা সাব্যস্ত যে, কুরআন কদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে, আর কদরের রাত রমাযান মাসে হয়, শাবান মাসে নয়। সুতরাং সূরা কদর ও সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াত বলে দিচ্ছে- এ বরকতময় রাত্রি হচ্ছে কদরের রাত, এ থেকে শবে বরাত অর্থ নেয়া কোনক্রমেই সঠিক নয়। তাছাড়া শবে বরাত এর ব্যাপারে যে-সব বর্ণনাতে মাহাত্ম্য ও ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে অথবা এ রাতকে ভাগ্য নির্ধারণের রাত বলা হয়েছে, সে সমস্ত বর্ণনাগুলো সনদের দিক থেকে জাল ও বানোয়াট। অতএব কুরআন কদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে; এটাই সঠিক কথা। যারা বলবে, কুরআন শবে বরাতের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে তাদের কথা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর এ রাত্রিতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা করা হয়। অর্থাৎ লাওহে মাহফূয হতে লেখক ফেরেশতাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

সারা বছরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন বয়স, জীবিকা এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত যা ঘটবে ইত্যাদি স্থিরীকৃত হয়। সাহাবা ও তাবেঈগণ উক্ত আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যাই করেছেন। আর এ সমস্ত কার্য-কলাপ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশক্রমেই হয়ে থাকে। এমন কোনই কার্য সম্পাদন হয় না যা তিনি জানেন না।

(رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّکَ)

এখানে রহমত বলতে যা বুঝোনো হয়েছে তা হলো, গ্রন্থসমূহ অবতীর্ণ করার সাথে সাথে রাসূলগণকে প্রেরণ করা। যাতে নাবী-রাসূলগণ উক্ত কিতাবের বিধি-বিধানগুলো স্পষ্টভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা করে দেন।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনিই আকাশসমূহ ও জমিনের মালিক এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে তারও। আর তিনিই একমাত্র ইলাহ, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। এ সম্পর্কে সূরা আল আ‘রাফ-এর ১৫৮ নম্বর আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআন শবে কদরে অবতীর্ণ হয়েছে, শবে বরাতে নয়।
২. শবে কদর একটি বরকতময় রাত, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।
৩. শবে কদরে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত করা হয়।
৪. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন সকলের জন্য রহমতস্বরূপ।
৯-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَا۬ءُ بِدُخَانٍ مُّبِيْنٍ) আয়াতের শানে নুযূল :

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশদের বিদ্বেষমূলক আচরণে বিরক্ত হয়ে তাদের জন্য বদ-দু‘আ করলেন, যেন তাদের ওপর ইউসুফ (আঃ)-এর যুগের মতো দুর্ভিক্ষ আপতিত হয়। তখন তাদের ওপর দুর্ভিক্ষ পতিত হলো। এমনকি খাদ্যের অভাবে তারা হাড় পর্যন্ত খেতে শুরু করল। এক ব্যক্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্ষুধার তাড়নায় শুধু ধোঁয়াই দেখতে পেল। পরবর্তীতে তাদের জন্য দু‘আ করতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলা হলে তিনি তাদের জন্য দু‘আ করেন। আর তাদেরকে ক্ষণিকের জন্য উক্ত শাস্তি থেকে নাজাত দেয়া হয়। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই

(فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَا۬ءُ بِدُخَانٍ مُّبِيْنٍ)

পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮২১-২২, ২৩, ২৪, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৯৮)

শেষ যুগে ধোঁয়া বের হওয়া কিয়ামতের অন্যতম একটি বড় আলামত, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।

অত্র আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী ও ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি কাফিরদের নিয়ে অপেক্ষা করুন ঐ দিনের, যেদিন আকাশ স্পষ্ট ধোঁয়াচ্ছন্ন হবে, মানুষকে আচ্ছন্ন করে নেবে এবং ঢেকে নেবে। সে সময় তাদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে বলা হবে- এটা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, অথবা তারা একে অপরকে এ কথা বলবে। (কুরতুবী ও ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

আয়াতে উল্লিখিত ধোঁয়া দ্বারা উদ্দেশ্য কী? তা কি সংঘটিত হয়ে গেছে, না ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে? এ ব্যাপারে আলেমদের দুটি উক্তি রয়েছে :

(১) তাওহীদের ডাকে সাড়া না দেয়ায় কুরাইশদের প্রতি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বদ্দু‘আর ফলে তাদেরকে এমন কঠিন বিপদ ও ক্ষুধা আক্রান্ত করেছিল যে, ক্ষুধার তাড়নায় তারা এমন হয়ে গিয়েছিল যেন আকাশে ধোঁয়ার মত কিছু দেখছিল। আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ও সালাফদের একটি দল এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর কুরতুবী ১৬/১৩১) শানে নুযূল থেকেও এরূপ কথা বুঝা যায়।

(২) উক্ত ধোঁয়া ভবিষ্যতে ঘটমান কিয়ামতের আলামত, তা এখনো প্রকাশ পায়নি, কিয়ামতের পূর্বে তা সংঘটিত হবে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও কতক সাহাবীসহ তাবেয়ীগণ এ মত পোষণ করেছেন।

ইবনু জারীর আত তাবারী ও ইবনু হাতেম আবদুল্লাহ ইবনে মুলাইকা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : একদা ভোরে আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। তখন তিনি বললেন, গত রাতে সকাল পর্যন্ত একটুও ঘুমাতে পারিনি। আমি বললাম : কেন? তিনি বললেন : আমি শুনেছি লেজবিশিষ্ট তারকাটি উদিত হয়েছে। ফলে আমি ভয় পেলাম যে, এখন ধোঁয়া দেখা দেবে, যার কারণে আমি সকাল পর্যন্ত ঘুমাইনি। (তাফসীর তাবারী ২৫/১১৩, তাফসীর ইবনে কাসীর ৭/২৩০)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবনে স্বাইয়াদকে বলেছিলেন :

إِنِّي خَبَأْتُ لَكَ خَبِيئًا قَالَ هُوَ الدُّخُّ قَالَ اخْسَأْ فَلَنْ تَعْدُوَ قَدْرَكَ

আমি তোমার জন্য একটি বিষয় গোপন রেখেছি। ইবনু স্বাইয়াদ বলল : তা হল- দুখ অর্থাৎ ধোঁয়া। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তোমার ধ্বংস হোক, তোমার শক্তি বৃদ্ধি পাবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধোঁয়া সম্পর্কিত উক্ত আয়াতটি গোপন রেখেছিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৬১৭৩) এতে প্রমাণিত হয় যে, ধোঁয়া ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে এমন একটি আলামত। কারণ ইবনে স্বাইয়াদ মদীনার ইয়াহূদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মদীনায় হিজরত করার পর এ ঘটনা ঘটেছে।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ছয়টি আলামত প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই তাড়াতাড়ি আমল কর। সেগুলো হচ্ছে- পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয়, ধোঁয়া, দাজ্জাল, ভূ-প্রাণী, তোমাদের কারো মৃত্যু অথবা কিয়ামত। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৫৮৫)

আবূ মালেক আল আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (রাঃ) বলেন : তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে তিনটি জিনিসের ভয় প্রদর্শন করছেন। যার একটি হচ্ছে ধোঁয়া, যা মু’মিনের ওপর সর্দির ন্যায় প্রভাব ফেলবে। আর কাফিরদের পেট ফুলে তা কান দিয়ে বের হবে। (তাফসীর তাবারী ২০/১১৪, ইবনে কাসীর ৭/২৩৫, ইবনে কাসীর বলেন : সনদ ভাল)

কিয়ামতের নিদর্শনস্বরূপ এ ধোঁয়া চল্লিশ দিন বহাল থাকবে যা কাফিরদেরকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলবে। আর মু’মিনদের অবস্থা সর্দি লাগার মত হবে। এ নিদর্শন কিয়ামতের পূর্বে প্রকাশ পাবে।

(إِنَّا كَاشِفُوا الْعَذَابِ)-এর দুটি অর্থ হতে পারে-

(১) আমি যদি তাদের থেকে আযাব সরিয়ে নেই এবং পুনরায় দুনিয়াতে প্রেরণ করি তাহলে তারা যে কুফরী ও অবাধ্যতায় লিপ্ত ছিল তা-ই করবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَوْ رَحِمْنٰهُمْ وَكَشَفْنَا مَا بِهِمْ مِّنْ ضُرٍّ لَّلَجُّوْا فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ) ‏

“আমি তাদেরকে দয়া করলেও এবং তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করলেও তারা অবাধ্যতায় বিভ্রান্তে‎র ন্যায় ঘুরতে থাকবে।” (সূরা মু’মিনূন ২৩ : ৭৫)

(২) শাস্তি যদি বিলম্ব করে দেই তাহলে তারা অপরাধে লিপ্ত থাকবেই।

(الْبَطْشَةَ الْكُبْرٰي)

বলতে এর দুটো অর্থ হতে পারে- একটি হলো, এখানে পাকড়াও বলতে বদরের যুদ্ধের দিন পাকড়াও করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, এর দ্বারা কিয়ামত দিবসে যে শাস্তি প্রদান করা হবে তা-ই বুঝোনো হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের পূর্বে আকাশ ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যাবে, যা কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে শাস্তি দানের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন যে, তারা ঈমান নিয়ে আসে কিনা।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : ছােট ছােট ছন্দময় আয়াত এবং প্রত্যেক আয়াতের শেষে প্রায় মিত্রাক্ষর শব্দসম্বলিত এই মক্কী সূরার তীব্র সূরের ঝংকার, ভয়াবহ দৃশ্য ও তাৎপর্যময় শিক্ষা আমাদের হৃদয়ে প্রচন্ড ভাবান্তর সৃষ্টি করে। সমগ্র সূরা একটা অখন্ড ও এককেন্দ্রিক একক বলে মনে হয়। সেই কেন্দ্রের সাথে এর সব কটা অংশ এক সূত্রে বাধা, চাই সে অংশ কিসসা কাহিনী সম্বলিত হােক, কেয়ামতের দৃশ্য সম্বলিত হােক, অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্তদের কাহিনী সম্বলিত হােক, প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত হােক। এগুলাে সবই মানুষের হৃদয়ে চেতনা সঞ্চারে কার্যকর ও সহায়ক এবং কোরআন মানুষের অন্তরে ঈমানের যে সতেজ ও প্রাণবন্ত বীজ বপন করে, তাকে সাদরে গ্রহণের জন্যে প্রেরণাদায়ক ও উদ্বুদ্ধকারী। সূরাটি কুরআন সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়ে এবং তাকে সেই কল্যাণময় রজনীতে নাযিল করার বর্ণনা দানের মাধ্যমে শুরু হয়েছে যে রাতে প্রতিটা প্রজ্ঞাময় আদেশ বিতরণ করা হয় তা দিয়ে আরম্ভ করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন ও সতর্ক করা হয়। অতপর মানুষের কাছে তাদের প্রতিপালককে পরিচিত করা হয়, যিনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তার মধ্যবর্তী সব কিছুর প্রভু। তারপর তার একত্ব প্রকাশ করে তাকে জীবন ও মৃত্যুর মালিক এবং অতীত ও বর্তমানের সকলের প্রতিপালক বলে ঘােষণা করা হয়। এরপর প্রসংগ পরিবর্তন করে আরবদের সম্পর্কে বক্তব্য রাখা হয়েছে, ‘বরং তারা সংশয়ে পতিত হয়ে ছিনিমিনি খেলছে।’ আর এর অব্যবহিত পর এই সংশয় ও ছিনিমিনি খেলার জন্যে শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে, (আয়াত ১০-১১) এরপর আযাব দূর করার জন্যে তাদের দোয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যেদিন আযাব এসে পড়বে, সেদিন তা আর দূর হবে না। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই আযাব এখনাে আসেনি, এখনাে এই আযাব তাদের কাছ থেকে দূরে আছে, কাজেই আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের এই সুযােগ কাজে লাগানাে উচিত। কেননা আল্লাহর কাছে ফিরে গেলে আযাব থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর কোনাে সুযােগ থাকবে না।(আয়াত ১৬) আযাব, প্রতিশােধ ও কঠিনতম পাকড়াও এর দৃশ্য সংক্রান্ত ভয়ংকর ঘােষণা প্রদানের পর ফেরাউন ও তার দলবলের ধ্বংসের বিবরণ দেয়া হয়েছে। সেদিন ফেরাউনের কাছে আল্লাহর রসূল এসেছিলাে এবং বলেছিলাে, আমার কাছে আল্লাহর বান্দাদেরকে সােপর্দ কর, আমি তােমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রসূল, আল্লাহর সাথে বাড়াবাড়ি করাে না। তারা তার কথায় কর্ণপাত করলাে না। ফলে আল্লাহর রসূল হতাশ হয়ে পড়লেন। কিন্তু এত হাম্বি তান্বি ও দম্ভোক্তি করার পরও ফেরাউন ও তার দলবল চরম অসহায় অবস্থায় ধ্বংস হয়ে গেলাে।(আয়াত ২৫-২৯) এরপর এই দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে তাদের আখেরাত প্রত্যাখ্যান সংক্রান্ত বক্তব্যে ফিরে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের এই উক্তি উদ্ধৃত করা হচ্ছে যে, আমাদের প্রথম মৃত্যুই শেষ কথা। আমাদের আর পুনরুজ্জীবিত হতে হবে না। বেশ, তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে আমাদের বাপ-দাদাদেরকে নিয়ে এসাে। ‘তুব্বা’ নামক জাতির ধ্বংসের কাহিনী সক্ষরণ করিয়ে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। কেননা আরবরা তাদের চেয়ে ভালাে নয় যে, তাদের ন্যায় পরিণতি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। এরপর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির যৌক্তিকতা ও আখেরাতের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করা হয়েছে।(আয়াত ৩৮-৩৯) একটুপরেই কেয়ামতের উল্লেখ করা হয়েছে।(আয়াত ৪০) এরপর যাক্কুম গাছ ও অন্যান্য আযাবের উপকরণ সহ ভয়াবহ আযাবের দৃশ্য তুলে ধরে চরম বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলা হয়েছে, ‘নাও, স্বাদ গ্রহণ করাে, তুমি তাে পরম সম্মানিত ও প্রতাপশালী, এই যে সেই জিনিস, যা নিয়ে তুমি সন্দেহ প্রকাশ করতে।’ এর পাশাপাশিই দেখানাে হয়েছে জান্নাতের গভীর উপভােগ্য দৃশ্য। জাহান্নামের আযাব যতাে কঠিন, জাহান্নামের নেয়ামত তাতে সুখময় সূরার সামগ্রিক কাঠামাের সাথে এই তুলনামূলক বিবরণ অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূরার শুরুর মতাে সমাপ্তিও টানা হয়েছে কোরআন সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়ে। সেই সাথে একটা প্রচ্ছন্ন হুশিয়ারীও দেয়া হয়েছে সর্বশেষ আয়াতে, ‘অতএব অপেক্ষা করে, তারাও অপেক্ষায় আছে।’ সূরাটা শুরু শেষ পর্যন্ত এর দ্রুত ও ক্রমাগত ধ্বনি দ্বারা এবং এর বিভিন্ন দৃশ্য ও রকমারি তাৎপর্যময় বক্তব্য দ্বারা মানুষের মনের ওপর ক্রমাগত ও প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিতে থাকে। তাকে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী বিভিন্ন জগত, দুনিয়া আখেরাত, জান্নাত ও জাহান্নাম, অতীত ও বর্তমান, দৃশ্য ও অদৃশ্য অংগন, জীবন ও মরণ এবং সৃষ্টির বিধান ও প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানায়। এককথায় বলা যায়, সূরাটা অপেক্ষাকৃত ছােটো হলেও এতে রয়েছে দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের এক বিরাট তথ্যভান্ডার।
** কোরআন নাযিলের বরকতময় মুহূর্ত : ‘হা-মীম- সুস্পষ্ট কেতাবের শপথ…'(১-৮) সূরাটা হা-মীম এই দুটো অক্ষর দিয়ে শুরু হয়েছে। এখানে এই অক্ষর দুটোর এবং এই অক্ষর দুটো দিয়ে লেখা এই কিতাবের শপথ করা হয়েছে। সূরার শুরুতে বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার উপস্থিতি নিয়ে বহুবার আলােচনা করা হয়েছে। এসব বর্ণমালার কসম খাওয়াটা কোরআনের কসম খাওয়ার মতােই। কেননা প্রত্যেকটা বর্ণই একটা যথার্থ অলৌকিক নিদর্শন অথবা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মানুষ সৃষ্টি, তাকে বাক শক্তি দান, তার বর্ণমালা উচ্চারণের উচ্চারণস্থল বিন্যাস, অক্ষরের নাম ও ধ্বনির প্রতীক নির্ণয় এবং মানুষের জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা লাভের নিদর্শন। এর প্রত্যেকটাই এক একটা বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে অভ্যাস ও পরিচিতি গড়ে ওঠার কারণে মানব মনে এগুলাের গুরুত্ব হালকা হয়ে যায়। এই অভ্যাস ও পরিচিতির উর্ধে উঠে চিন্তা করলে এ জিনিসগুলাে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন জাগে যে, কিসের জন্যে এই কসম খাওয়া হলাে? এর উদ্দেশ্য হলাে, একটা পবিত্র ও কল্যাণময় রাতে এই কোরআন নাযিল হয়েছে এ কথা বলার। (আয়াত ১-৬) যে পবিত্র কল্যাণময় রাতে কোরআন নাযিল হয়েছে, সেটা কোনটা? এ সম্পর্কে নিগুঢ়তম সত্য ও নির্ভুলতম তথ্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তবে আমরা এতটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এটা রমযানের কোনাে এক রাত, যখন এই কোরআন নাযিল হওয়ার সূচনা হয়েছে। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে।’ এ কথা সুবিদিত যে, সেই রাতে সম্পূর্ণ কোরআন একত্রে নাযিল হয়নি। তবে এই রাতে পৃথিবীর সাথে এর যােগাযােগ শুরু হয়েছে। ‘কল্যাণময় রাতে কোরআন নাযিল করেছি’ এ উক্তির তাফসীর প্রসংগে এটুকু বলাই যথেষ্ট। বস্তুত যে রাতে মানবজাতির ওপর এই বিজয়াভিযান শুরু হয়েছে, যে রাতে মানবজাতির জীবনে এই ঐশী বিধানের বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে, যে রাতে কোরআনের মাধ্যমে মহাজাগতিক বিধানের সাথে মানুষের সংযােগ শুরু হয়েছে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায়, যে রাতে মানুষের সহজাত বিবেক একে অত্যন্ত বিনম্রভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এর ভিত্তিতে একটা স্বভাবসিদ্ধ স্থীতিশীল যে সৃষ্টিজগতে সে বাস করে, তার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ রক্ষা করে মানব সমাজের প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছে, পবিত্র ও পরিচ্ছন্নভাবে এবং ঐশী জগতের সাথে পূর্ণ সংযােগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জীবন যাপনের প্রক্রিয়া যে রাতে শুরু হয়েছে, সে রাত যথার্থই কল্যাণময় ও পবিত্র। যাদের কাছে সর্বপ্রথম কোরআন নাযিল হয়েছিলাে, তারা মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একটা বিস্ময়কর যুগ অতিক্রম করেছে। মহান আল্লাহর সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। তিনি তাদেরকে সর্বপ্রথম তাদের ভেতরকার ভালাে-মন্দ, যােগ্যতা, ক্ষমতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, তিনি তাদের ওপর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রেখেছেন। এই দৃষ্টির কথা তারা তাদের প্রতিটা মুহূর্তে মনে রাখতাে। আর প্রয়ােজনীয় মূহূর্তে সর্বপ্রথম তার কাছেই আশ্রয় নিতাে, কেননা তারা বিশ্বাস করতাে যে, তিনি অত্যন্ত নিকটবর্তী ও কার্যকর আশ্রয়দাতা। সেই প্রজন্ম চলে গেছে। তারপর কোরআন উন্মুক্ত গ্রন্থ হিসাবে এবং মানব হৃদয়ের সাথে সংযুক্ত গ্রন্থ হিসাবে বহাল রয়েছে। মানব হৃদয়ে তা এমন প্রভাব সৃষ্টি করে, যা যাদুও করতে পারে না। আর মােমেনের চেতনা ও আবেগে এমন পরিবর্তন সাধন করে, যা অনেক সময় রূপকথার মতাে মনে হয়। এরপর এই কোরআন কেয়ামত পর্যন্ত কালের জন্যে একটা পূর্ণাংগ ও ন্যায়ভিত্তিক বিধান হিসেবে বহাল রয়েছে, যাতে সে সকল যুগে ও সকল পরিবেশে এমন আদর্শ মানব জীবন গড়ে তুলতে পারে, যা সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আল্লাহর বিধান অনুসারে উৎকৃষ্টতম জীবন যাপন করবে এবং কখনাে কোনাে বিকৃতি ও বিভ্রান্তির শিকার হবে না। এটা হচ্ছে একমাত্র ঐশী জীবন বিধানের বৈশিষ্ট্য। মানুষ যা কিছু তৈরী করে বা রচনা করে, তা হয়তাে বা তারই মতাে অন্য কারাে সৃষ্টির সমান বা উৎকৃষ্টতর হয়, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে এবং নির্দিষ্ট কোনাে স্থান বা পরিবেশের মধ্যে তার উপযােগিতা সীমাবদ্ধ থাকে। পক্ষান্তরে আল্লাহর সৃষ্ট জিনিস দীর্ঘস্থায়ী, পূর্ণাংগ, সর্বাবস্থার উপযােগী ও সকল পরিস্থিতি ও পরিবেশে উপকারী হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এই কোরআনকে কল্যাণময় রজনীতে নাযিল করেছেন, প্রথমত মানুষকে সতর্ক সচেতন ও সচকিত করার জন্যে। আমি সতর্ককারী। কেননা আল্লাহ তায়ালা মানুষের উদাসীনতা ভ্রমপ্রবণতা ও তাকে প্রতিনিয়ত সতর্ক করার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত। কোরআন নাযিল হওয়ার কল্যাণে কল্যাণময় এই রজনী এই কিতাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ছিলাে, ‘এই রাতে প্রত্যেকটা প্রজ্ঞাময় নির্দেশ দেয়া হয়।’ অর্থাৎ এই কোরআনের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রত্যেক বিষয়ে নিষ্পত্তি করা হয় চিরন্তন সত্য ও মিথ্যার মাঝে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এই রাতের পর কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্যে মানব জাতির জীবনে সর্বাত্মক পরিবর্তন সূচিত হয়। ফলে মানবজাতির জীবনে এমন কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিধান বা নীতি নেই, যা অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ থেকে যেতে পারে। শাশ্বত প্রাকৃতিক বিধানে যেমন সব কিছু স্পষ্ট ও স্বচ্ছ, মানব জীবনের নীতিমালারও তদ্রুপ সব কিছু স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। এসব ব্যবস্থাই করা হয়েছিলাে আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুসারে। তার ইচ্ছা অনুসারেই নবী ও রসূলদের পাঠিয়ে এই বিধানকে সুস্পষ্ট রূপ দেয়া হয়েছিলাে। ‘আমার পক্ষ থেকে নির্দেশের মাধ্যমে, আমিই, পাঠিয়েছি।’ আর এসবই ছিলাে কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্যে মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্বরূপ।(আয়াত ৬) এই কোরআন নাযিল হওয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ যেমন সুস্পষ্টভাবে ও সহজভাবে প্রতিভাত হয়, তেমন আর কোনােভাবে হয় না। আল্লাহর এই রহমত কোরআনকে অন্তরে এমনভাবে বদ্ধমূল করে এবং হৃদয়ে এমন স্বাভাবিকভাবে তা গৃহীত হয়, যেমন স্বাভাবিকভাবে রক্ত শিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটা মানুষকে পরম দয়ালু মানুষে এবং মানব সমাজকে অত্যন্ত সহনশীল সমাজে রূপান্তরিত কর যদিও চর্মচক্ষু দিয়ে তা বাস্তবে দেখা যায় না। কোরআন যে আকীদা বিশ্বাসের বর্ণনা দেয়, তা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুসমন্বিত হওয়ার কারণে এতাে সুন্দর যে, তার প্রতি মানুষের মনে গভীর ভালােবাসা ও আসক্তি জন্মে যায় এবং তার প্রতি অন্তর আকৃষ্ট হয়। এখানে পূর্ণতা, নিপুণতা, উপযোগিতা ও কল্যাণকারিতার প্রশ্ন বিবেচ্য নয়। কেননা কোরআনে এসব বৈশিষ্ট্য ক্রমাগত উৎকর্ষ লাভ করে চলেছে এবং পূর্ণতা লাভ করেছে। পূর্ণতা লাভ করার কারণে তা এমন সৌন্দর্যে পরিণত হয়েছে যে, তা স্বতস্ফৃর্ত ভালােবাসা ও আসক্তির উদ্রেক করে। এই সৌন্দর্য যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়কে বিশদভাবে ও নিখুঁতভাবে তুলে ধরে, অতপর সেগুলােকে একত্রিত ও সমন্বিত করে এবং সবগুলােকে প্রধান মূলনীতির সাথে সংযুক্ত করে। তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ। অর্থাৎ এই কোরআন কল্যাণময় রজনীতে রহমত বহন করে এনেছে। ‘নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।’ অর্থাৎ লােকে কি বলে ও কি করে, সে সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য জেনেই তিনি মানুষের জন্যে যা নাযিল করা দরকার এবং যে ধরনের আইন কানুন, রীতি নীতি ও নির্দেশ তাদের জন্যে উপযােগী ও কল্যাণকর, তা নাযিল করেন। ‘তিনি আকাশ ও পৃথিবী এবং এই উভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সে সবের প্রতিপালক, যদি তােমরা বিশ্বাসী হও।’ অর্থাৎ তিনি তাদের জন্যে যা কিছুই নাযিল করেন, তা দ্বারা তাদেরকে প্রতিপালন করেন। এটা তার বিশ্বপ্রতিপালনেরই একটা দিক মাত্র এবং তার সেই প্রাকৃতিক বিধানেরই একটা অংশ, যা গােটা বিশ্বকে পরিচালিত করছে। এখানে বিশ্বাসী হও কথাটা দ্বারা তাদের বিশ্বাসের দোদুল্যমানতা ও অস্থিরতার দিকে ইংগিত দেয়া হয়েছে। কেননা তারা আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা যে আল্লাহ তায়ালা, তা স্বীকার করে, অথচ তার সাথে অন্যদের শরীক করে। এ দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা বিশ্বস্রষ্টা এই সত্যটাও তাদের মনে অস্পষ্ট, অগভীর এবং এর ওপর তাদের পুরােপুরি বিশ্বাস নেই। তিনিই সেই একক মাবুদ, যিনি জীবন ও মৃত্যুর স্রষ্টা এবং অতীত ও বর্তমানের সকলের প্রতিপালক।(আয়াত ৮) মৃত্যু ঘটানাে ও জীবন দান এমন দুটো বাস্তব ব্যাপার যা সবাই সচোক্ষে দেখতে পায় এবং তা কোনাে সৃষ্টিরই ক্ষমতার আওতাধীন নয়। এ সত্যটা যে কেউ অতি সহজে হৃদয়ংগম করতে পারে। মৃত্যুর দৃশ্য সর্বাবস্থায় জীবনের দৃশ্যের মতােই। মানুষের হৃদয়কে তা স্পষ্ট করে, নাড়া দেয়, উদ্দীপিত করে, উদ্বুদ্ধ করে ও প্রভাবিত করে। এ জন্য কোরআনে এ জিনিসটার ঘন ঘন উল্লেখ ও এ দ্বারা মানুষের ভাবাবেগকে আলােড়িত করার ব্যাপক চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
** দোখান বা ধুয়াসহ কেয়ামতের কিছু আলামত : উদ্দীপনা ও সচেতনতা সৃষ্টির এই পর্যায়ে উপনীত হবার পর এ আলােচনা এখানেই শেষ করে আরবদের বর্তমান অবস্থার পর্যালােচনা শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা অত্যন্ত পরিতাপজনক এবং যে রকম হওয়া উচিত তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। (আয়াত ৯-১৬) কোরআন বলছে যে,তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে এবং সেই সব অকাট্য নিদর্শনাবলীতে সন্দেহ করছে। ‘বেশ, ওদেরকে সেই ভয়ংকর দিন পর্যন্ত যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে দাও। অতএব সেই দিনের অপেক্ষায় থাকো, যেদিন আকাশে সুস্পষ্ট ধোয়া দেখা দেবে, তা মানব জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে…’ প্রাচীন তাফসীরকার দোখান বা ধোঁয়া সংক্রান্ত এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মতভদে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ বলেন, এটা কেয়ামতের দিনের ধোয়া। এর জন্যে অপেক্ষা করতে বলার হুমকি কোরআনের অন্যান্য হুমকি ও হুঁশিয়ারির মতােই। এই নিদর্শনটা আসবেই এবং রসূল(স.) ও অন্যরা তার প্রতীক্ষা করেছেন। কেউ বলেন, এ ধোয়া ইতিপূর্বেই দেখা গেছে। রসূল(স.)-এর হুমকি দেয়ার পর এটা যথারীতি দেখা গিয়েছিলাে এবং রসূল(স.)-এর দোয়ায় তা আবার সরেও গিয়েছিলাে। এখানে এই দুটো মত সাবিস্তারে তুলে ধরছি। হযরত সােলায়মান বিন মাহরান আল আ’মান, আবুয যােহা মুসলিম ইবনে সাবীহ থেকে এবং আবু যোহা হযরত মাসরূক থেকে বর্ণনা করেন, মাসরূক বলেন, ‘আমরা একবার কুফার মসজিদে গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। দেখলাম এক ব্যক্তি তার সাথীদের বলছে, যেদিন আকাশে সুস্পষ্ট ধোয়া দেখা যাবে, তােমরা জানাে এই ধোঁয়া কী? এই ধোঁয়া কেয়ামতের দিন আসবে, এই ধোয়া মােনাফেকদের চোখ কান ছিনিয়ে নেবে। আর মােমেনরা সর্দির মতাে সামান্য একটু বােগে আক্রান্ত হবে। মাসরূক বলেন, এরপর আমরা ইবনে মাসউদের কাছে এলাম। তাকে ঘটনাটা জানালাম। তিনি শুয়েছিলেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে বসলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের নবীকে বলেছেন, ‘তুমি বলাে, আমি তােমাদের কাছে এর বিনিময়ে কোনাে প্রতিদান চাই না এবং আমি কৃত্রিম লৌকিকতাকারী নই।’(ছােয়াদ ৮৬) মানুষ যখন কোনাে জিনিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে, তখন সে সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তার বলা উচিত, আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। এ সম্পর্কে আমি তােমাদেরকে একটা ঘটনা জানাচ্ছি, যখন কোরায়শরা ইসলাম গ্রহণে অত্যধিক বিলম্ব করে ফেললো এবং রসূল(স.)-এর প্রতি অবাধ্যতা দেখাতে লাগলাে, তখন তিনি হযরত ইউসুফের দুর্ভিক্ষের ন্যায় দুর্ভিক্ষ সংঘটিত করার আবেদন জানিয়ে বদদোয়া করলেন। এর ফলে তারা এতাে কষ্ট ও ক্ষুধা ভােগ করতে লাগলাে যে, তারা হাড়গোড় ও মৃত জন্তু খেতে লাগলো। তখন তারা আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাতাে। কিন্তু ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতাে না। অন্য রেওয়াতে আছে যে, কোনাে ব্যক্তি আকাশের দিকে তাকালে ক্ষুধার কষ্টের জ্বালায় ধোয়ার আকৃতির মতাে দৃশ্য দেখতে পেতো। আল্লাহ তায়ালা বললেন, অতএব সেই দিনের জন্যে অপেক্ষা করে যখন আকাশে সুস্পষ্ট ধোয়া দেখা দেবে। এই ধোয়া জনগণকে কঠিন আযাবে ঢেকে ফেললাে। তখন লােকেরা রসূল(স.)-এর কাছে এলাে। সবাই তাকে বললাে, ইয়া রসূলাল্লাহ, মুযারের (কোরায়শ) জন্যে পানি প্রার্থনা করুণ। তারা ধ্বংসের সম্মুখীন। রসূল(স.) পানি প্রার্থনা করলেন এবং বৃষ্টি নামলাে। তখন নাযিল হলো, আমি অল্প সময়ের জন্যে এ আযাব হটিয়ে দেবাে। তােমরা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।(দোখান ১৫) হযরত ইবনে মাসউদ(রা.) বলেন, কেয়ামতের দিন কি তাদের আযাব হটানাে হবে। পরে যখন তারা সুখ সমৃদ্ধি ফিরে পেলাে, অমনি সাবেক অবস্থায় ফিরে গেলাে। তখন আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন, ‘যেদিন আমি বৃহত্তম পাকড়াও করবে, সেদিন প্রতিশােধ নেবাে।’ ইবনে মাসউদ(রা.) বলেন, এই বৃহত্তম পাকড়াওয়ের দিন দ্বারা বদর যুদ্ধের দিনকে বুঝানাে হয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ বলেন, ধোঁয়া, রােম, চাঁদ, পাকড়াও, ও লিযাম এই পাঁচটা ভবিষ্যদ্বাণী অতিক্রান্ত হয়েছে।’ এ হাদীসটা বুখারী ও মুসলিম থেকে গৃহীত হয়েছে। ইমাম আহমাদ স্বীয় মােসনাদেও এটা উদ্ধৃত করেছেন। তিরমিযী ও নাসায়ীর তাফসীর অধ্যায়েও এ হাদীস এসেছে। ইবনে জারীর ও ইবনে আবি হাতেমও এটা বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাসউদ(রা.)-এর এই তাফসীরের সাথে এবং ধোয়া অতিবাহিত হয়ে গেছে এই মতের সাথে প্রাচীন মনীষীদের অনেকে একমত হয়েছেন, যেমন মুজাহিদ, আবুল আলিয়া ইবরাহীম নখয়ী, যাহহাক ও আতিয়া আল- মূসা। অন্য এক দল বলেছেন, এই ধোয়া এখনাে অতিবাহিত হয়নি; বরং এটা কেয়ামতের পূর্ব লক্ষণ। হযরত আবু হােরায়রার হাদীসে আছে যে একবার রসূল(স.) আরাফা থেকে আমাদের কাছে এলেন। আমরা তখন কেয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। রসূল(স.) বললেন, তােমরা দশটা লক্ষণ না দেখা পর্যন্ত কেয়ামত হবে না। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা, ধোয়া, একটা অদ্ভুত প্রাণী ইয়াজুজ ও মাজুযের আবির্ভাব, হযরত ঈসা ইবনে মারইয়ামের আবির্ভাব, দাজ্জাল, তিনটে ধ্বংসের ঘটনা, একটা প্রাচ্যে, একটা পাশ্চাত্যে ও একটা আরব উপদ্বীপে এবং এডেন সাগরের তলা থেকে একটা আগুন বেরিয়ে এসে মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তারা যেখানে ব্রত যাপন করবে, আগুনটাও সেখানে তাদের সাথে রাত কাটাবে এবং যেখানে তারা ঘুমাবে সেখানে সেও ঘুমাবে। (সহীহ মুসলিম) ইবনে জরীর আবু মালেক আশয়ারী(রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল(স.) বলেছেন, তোমাদের প্রতিপালক তােমাদেরকে তিনটে জিনিস সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, প্রথমত ধোয়া, যা মােমেনকে আক্রান্ত করলে তার সর্দি হবে, আর কাফেরকে আক্রান্ত করলে তার শরীর ফুলে যাবে, দ্বিতীয়ত, অদ্ভুত প্রাণী, তৃতীয়ত দাজ্জাল। (তাবরানী, ইবনে কাসীর) ইবনে জারীরের বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে আবি মুলকিয়া বলেন, একদিন সকালে ইবনে আব্বাসের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, আজ ভাের পর্যন্ত আমার ঘুম হয়নি। আমি বললাম, কেন? তিন বললেন, লােকেরা বলেছিলাে যে, লেজ বিশিষ্ট তারকা উঠেছে। আমি এই ভেবে ভয় পেয়ে গেলাম যে, ধোয়া বােধ হয় এসে গেছে। তাই সকাল পর্যন্ত আমি ঘুমাতে পারিনি। ইবনে কাসীর স্বীয় তাফসীরে লিখেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস ও তার সাথে একমত সাহাবী ও তাবেয়ীদের বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস থেকে যেমন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তেমনি কোরআনের আয়াতের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধোয়া দেখা যাবে। অর্থাৎ এতাে স্পষ্ট যে সবাই দেখতে পাবে। কিন্তু ইবনে মাসউদের তাফসীর অনুসারে এটা শুধু মক্কাবাসী ক্ষুধা ও কষ্টের আতিশয্যে কল্পনার চোখে দেখেছিলাে। আয়াতে আল্লাহ তয়ালা বলেন, সকল মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। অর্থাৎ তাদেরকে ঢেকে ফেলবে ও অন্ধ করে ফেলবে। ব্যাপারটা যদি কাল্পনিক হতাে, যা শুধু মক্কাবাসী মােশরেকদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাে, তাহলে ‘সকল মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে’ একথা বলা হতাে না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন এই যে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। অর্থাৎ তাদেরকে ধমক ও শাসানি স্বরূপ একথা বলা হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেছেন, যেদিন তাদেরকে দোযখের দিকে ঠেলে দেয়া হবে, আর বলা হবে, এই যে সেই দোষখ, যাকে তােমরা অস্বীকার করতে। এমনও হতে পারে যে, এ কথা দোযখবাসীরাই দোযখে প্রবেশের প্রাক্কালে পরস্পরকে বলবে। ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের কাছ থেকে আযাব সরিয়ে নাও। আমরা ঈমানদার।’ অর্থাৎ কাফেররা সচোক্ষে আযাব দেখে আযাব সরিয়ে নেয়ার আবেদন জানাবে আর এ কথা বলবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তুমি যদি দেখতে যখন তাদেরকে দোযখের পাশে দাঁড় করানাে হবে এবং তারা বলবে ‘হায়, আমাদেরকে দুনিয়ায় ফেরত পাঠানাে হলে আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনগুলােকে অবিশ্বাস করতাম না, বরং ঈমানদার হয়ে যেতাম।’ অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মানব জাতিকে আযাব আসার দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও, সেদিন অপরাধীরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে স্বল্প মেয়াদের জন্যে অবকাশ দাও… আল্লাহ তায়ালা এখানে বলেছেন, ‘তারা কেমন করে উপদেশ গ্রহণ করবে?’ অর্থাৎ কিভাবে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে, অথচ আমি তাদেরকে রসুল পাঠিয়ে সতর্ক করেছিলাম। তবুও তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং মেনে নেয়নি, বরং তাকে অস্বীকার করেছে আর তারা তাকে বলেছে, শিক্ষাপ্রাপ্ত পাগল। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সেদিন মানুষ উপদেশ গ্রহণ করবে, কিন্তু কিভাবে উপদেশ গ্রহণ করবে… এবং আল্লাহ বলেছেন, যদি তুমি দেখতে, যখন তারা ঘাবড়ে যাবে…. (সূরা সাবার শেষ কটা আয়াত) আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি কিছুকালের জন্যে আযাব দূর করে দেবাে, তােমরা আবার ফিরে যাবে।’ এর দুটো অর্থ হতে পারে, এক. ‘আমি যদি সাময়িকভাবে তোমাদের আযাব দূর করে দিয়ে তােমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিতাম, তাহলে তােমরা আবার তােমাদের সাবেক কুফরীতে ফিরে যেতে।’ যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি আমি তাদের ওপর অনুগ্রহ প্রদর্শন করতাম এবং তাদের আযাব দূর করে দিতাম, তাহলে তারা তাদের অবাধ্যতায় অন্ধভাবে ডুবে যেতাে… এবং যেমন তিনি বলেছেন, তাদেরকে যদি পুনরায় ফেরত পাঠানাে হতাে, তাহলে তারা সেই কাজই আবার শুরু করতাে, যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে…।’ দুই. এর অর্থ এও হতে পারে যে, পার্থিব জীবনেই তােমাদের অপকর্মের দরুন তােমাদের ওপর আযাব নাযিল হওয়া অবধারিত হওয়া সত্বেও আমি সাময়িকভাবে তােমাদের ওপর থেকে আযাব বিলম্বিত করেছি। তথাপি তােমরা তােমাদের বিভ্রান্তি ও অবাধ্যতা অব্যাহত রেখেছে। আযাব দূরে সরানাের জন্যে আযাব শুরু হয়ে যাওয়া জরুরী নয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ইউনুসের জাতি যখন ঈমান আনলাে, তখন আমি তাদের কাছ থেকে আযাব হটিয়ে দিলাম…’ তাদের ওপর আযাব শুরু হয়ে যায়নি, বরং তাদের অপকর্মের দরুন তা অবধারিত ও তাদের প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিলাে। কাতাদা এভাবে তাফসীর করেছেন তােমরা আল্লাহর আযাবের দিকে ফিরে যাবে। ‘আর যেদিন আমি বড়াে পাকড়াও করবাে, সেদিন আমি প্রতিশােধ নেবাে’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে মাসউদ বলেন, এর অর্থ বদরযুদ্ধের দিন। হযরত ইবনে মাসউদ এর সমমনা কিছু সংখ্যক মনীষীও এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আওফী ও উবাই ইবনে কাব-এর বর্ণনা অনুসারে হযরত ইবনে আব্বাস এভাবেও তাফসীর করেছেন। এটা সম্ভব। আসলে এর প্রকাশ্য অর্থ হলাে কেয়ামতের দিন যদিও বদর যুদ্ধের দিনও একটা পাকড়াও এর দিন ছিলাে বটে। ইবনে জারীর ইকরামা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে আব্বাস(রা.) বলেছেন, ইবনে মাসউদ বলেছেন, এর অর্থ বদর যুদ্ধের দিন। কিন্তু আমার মতে, এটা কেয়ামতের দিন। এটাই তার থেকে উদ্ধৃত বিশুদ্ধ বর্ণনা। হাসান বসরী ও ইকরামার মতে এটাই বিশুদ্ধতম বর্ণনা। বাকী আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন।’ ইবনে কাসীরের উদ্ধৃতি শেষ। দোখান বা ধোয়ার ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাসের বক্তব্যই আমি গ্রহণ করেছি। অর্থাৎ এটা কেয়ামতের দিন। ইবনে কাসীরও তার তাফসীরে এই মতটা অবলম্বন করেছেন। এটা একটা হুমকি এবং কোরআনে এর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর অর্থ দাড়ালাে তারা সন্দেহ সংশয়ে লিপ্ত হচ্ছে এবং ছিনিমিনি খেলছে। তাদেরকে সেভাবেই থাকতে দাও এবং সেই ভয়াবহ দিনের অপেক্ষায় থাক, যেদিন আকাশে সুস্পষ্ট ধোয়া দেখা দেবে এবং তা মানবজাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। একে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের মিনতি উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে, হে আমাদের প্রভু, আমাদের ওপর থেকে আযাব হটিয়ে দাও, আমরা ঈমান আনবাে। এর জবাবে বলা হয়েছে যে, এ মিনতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। কেননা এর সময় পার হয়ে গেছে, কিভাবে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে। তাদের কাছে একজন প্রকাশ্য রসূল এসেছিলাে। এরপর তারা মুখ ফিরিয়ে নিলাে এবং বললাে, তাে একজন অনারব যুবক তাকে শিখিয়ে দেয়। তাদের ধারণামতে তিনি পাগল। যে প্রেক্ষাপটে তারা আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা করে, কিন্তু তা মেনে নেয়া হয় না, সেই প্রেক্ষাপটে তাদেরকে বলা হচ্ছে, তােমাদের এখনাে সুযােগ রয়েছে, এ সুযােগ এখনাে নষ্ট হয়নি। এ আযাব এখন তােমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তােমরা এখন দুনিয়ায় আছ। এখন তােমরা এই আযাব থেকে মুক্ত। অতএব তােমরা ঈমান আনাে। আখেরাতের অপেক্ষায় থেকো না। কেননা সেখানে ঈমান আনলে তা গৃহীত হবে না। এখন তােমরা শান্তিতে আছ। এ শান্তি চিরস্থায়ী নয়। কেননা তােমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। সেই বৃহত্তম পাকড়াও’-এর দিন যখন তােমরা ধোয়া দেখবে, সেদিন আমি তােমাদের আজকের ছিনিমিনি খেলা ও রাসূল(স.)-কে শিক্ষাপ্রাপ্ত পাগল বলে মিথ্যা আখ্যাদানের প্রতিশােধ নেব। কেননা তিনি তাে সত্যবাদী ও বিশ্বাসী। এভাবেই এ আয়াতগুলাের তাফসীর সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি রাত্রে সূরায়ে হা-মীম আদ দুখান পাঠ করে, সকাল পর্যন্ত তার জন্যে সত্তর হাজার ফেরেশতা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি গারীব। এর আমর ইবনে খুশউম নামক একজন বর্ণনাকারী দুর্বল। ইমাম বুখারী (রঃ) তাকে মুনকারুল হাদীস বলেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি হা-মীম আদ দুখান জুমআর রাত্রে পাঠ করে তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।” (এ হাদীসটিও ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। এটাও গারীব হাদীস। এর আবুল মিকদাম হিশাম নামক একজন বর্ণনাকারী দুর্বল এবং দ্বিতীয় বর্ণনাকারী হাসানের হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে শোনা সাব্যস্ত নয়)

হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা ইবনে সাইয়াদের সামনে সূরায়ে দুখানকে নিজের অন্তরে গোপন রেখে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আমার অন্তরে কি আছে বল তো?” উত্তরে সে বললোঃ (আরবী) রয়েছে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি ধ্বংস হও। তুমি ব্যর্থ মনোরথ হয়েছে। আল্লাহ যা চান তাই হয়। অতঃপর তিনি সেখান হতে ফিরে আসেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে বাযযারে বর্ণিত হয়েছে)

১-৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, এই কুরআন কারীমকে তিনি কল্যাণময় রাত্রিতে অর্থাৎ কদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি এটা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে।”(৯৭:১) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ রমযান মাস যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়।”(২:১৮৫) সূরায়ে বাকারায় এর তাফসীর গত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।

কোন কোন লোক এ কথাও বলেছেন যে, যে মুবারক রজনীতে কুরআন কারীম অবতীর্ণ হয় তা হলো শাবান মাসের পঞ্চদশ তম রাত্রি। কিন্তু এটা সরাসরি কষ্টকর উক্তি। কেননা, কুরআনের স্পষ্ট ও পরিষ্কার কথা দ্বারা কুরআনের রমযান মাসে নাযিল হওয়া সাব্যস্ত হয়েছে। আর যে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, শা’বান মাসে পরবর্তী শা’বান মাস পর্যন্ত সমস্ত কাজ নির্ধারণ করে দেয়া হয়, এমনকি বিবাহ হওয়া, সন্তান হওয়া এবং মৃত্যু বরণ করাও নির্ধারিত হয়ে যায়, ঐ হাদীসটি মুরসাল। এরূপ হাদীস দ্বারা কুরআন কারীমের স্পষ্ট কথার বিরোধিতা করা যায় না।

আল্লাহ পাক বলেনঃ “আমি তো সতর্ককারী অর্থাৎ আমি মানুষকে ভাল ও মন্দ এবং পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে অবহিতকারী, যাতে তাদের উপর যুক্তিপ্রমাণ। সাব্যস্ত হয়ে যায় এবং তারা শরীয়তের জ্ঞান লাভ করতে পারে। এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। অর্থাৎ লাওহে মাহফুয হতে লেখক ফেরেশতাদের দায়িত্বে অর্পণ করা হয়। সারা বছরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন বয়স, জীবিকা ইত্যাদি স্থিরীকৃত হয়। (আরবী) শব্দের অর্থ হলো মুহকাম বা মযবূত, যার পরিবর্তন নেই। সবই আল্লাহর নির্দেশক্রমে হয়ে থাকে। তিনি রাসূল প্রেরণ করে থাকেন যেন তারা তাঁর নিদর্শনাবলী তার বান্দাদেরকে শুনিয়ে দেন, যেগুলোর তারা খুবই প্রয়োজন বোধ করে।

এটা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর অনুগ্রহ স্বরূপ। তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ যিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সবকিছুরই প্রতিপালক এবং সবকিছুরই অধিকর্তা। সবারই সৃষ্টিকর্তা তিনিই। মানুষ যদি বিশ্বাসী হয় তবে তাদের বিশ্বাসযোগ্য যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান রয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনিই একমাত্র মাবুদ। তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন। তিনিই তোমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও প্রতিপালক।

এ আয়াতটি আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! তুমি ঘোষণা করে দাও- হে লোক সকল! আমি তোমাদের সবারই নিকট ঐ আল্লাহর রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছি যার রাজত্ব হচ্ছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীব্যাপী, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন।”(৭:১৫৮)।

৯-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ সত্য এসে গেছে, অথচ এই মুশরিকরা এখনো সন্দেহের মধ্যেই রয়ে গেছে এবং তারা খেল-তামাশায় মগ্ন রয়েছে! সুতরাং হে নবী (সঃ)! তমি তাদেরকে ঐ দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও যেই দিন আকাশ হতে ভীষণ ধূম্র আসতে দেখা যাবে।

হযরত মাসরূক (রাঃ) বলেনঃ “একদা আমরা কুফার মসজিদে গেলাম যা কিনদাহ্র দরযার নিকট রয়েছে। গিয়ে দেখি যে, এক ব্যক্তি তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে ঘটনাবলী বর্ণনা করছেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন যে, এই আয়াতে যে ধূম্রের বর্ণনা রয়েছে এর দ্বারা ঐ ধূম্রকে বুঝানো হয়েছে যা কিয়ামতের দিন মুনাফিকদের কানে ও চোখে ভর্তি হয়ে যাবে এবং মুমিনদের সর্দির মত অবস্থা হবে। আমরা সেখান হতে বিদায় হয়ে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট গমন করি এবং ঐ লোকটির বক্তব্য তাঁর সামনে পেশ করি। তিনি ঐ সময় শায়িত অবস্থায় ছিলেন, একথা শুনেই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে বসলেন এবং বললেনঃ আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি বলে দাও- আমি এর জন্যে তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না এবং আমি লৌকিকতাকারী নই।”(৩৮:৮৬) জেনে রেখো যে, মানুষ যা জানে না তার ‘আল্লাহই খুব ভাল জানেন এ কথা বলে দেয়াও একটা ইলম। আমি তোমাদের নিকট এই আয়াতের ভাবার্থ বর্ণনা করছি, মনোযোগ দিয়ে শুনো। যখন কুরায়েশরা ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করলো এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কষ্ট দিতে থাকলো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের উপর বদদু’আ করলেন যে, হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর যুগের মত দুর্ভিক্ষ যেন তাদের উপর আপতিত হয়। আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-এর এ দু’আ কবূল করলেন এবং তাদের উপর এমন দুর্ভিক্ষ পতিত হলো যে, তারা হাড় ও মৃত জন্তু খেতে শুরু করলো। যখন তারা আকাশের দিকে তাকাতো তখন ধূম্র ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতো না। অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, ক্ষুধার জ্বালায় তাদের চোখে চক্কর দিতো। তখন তারা আকাশের দিকে তাকাতো এবং যমীন ও আসমানের মাঝে এক ধূম্র দেখতে পেতো। এই আয়াতে এই ধূম্রেরই বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এরপর যখন জনগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে নিজেদের দুরবস্থার কথা প্রকাশ করলো তখন তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহ তা’আলার নিকট বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করলেন। তখন মহান আল্লাহ মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। (ফলে তারা দুর্ভিক্ষের কবল হতে রক্ষা পেল)। এরই বর্ণনা এর পরবর্তী আয়াতে রয়েছে যে, শাস্তি দূর হয়ে গেলেই অবশ্যই তারা পুনরায় তাদের পূর্বাবস্থায় অর্থাৎ কুফরীতে ফিরে যাবে। এর দ্বারা এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, এটা দুনিয়ার শাস্তি। কেননা, আখিরাতের শাস্তি তো দূর হওয়ার কথা নয়। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) আরো বলেনঃ পাঁচটি জিনিস গত হয়ে গেছে। (এক) ধূম্র অর্থাৎ আকাশ হতে ধূম্র আসা, (দুই) রোম অর্থাৎ রোমকদের পরাজয়ের পর পুনরায় তাদের বিজয় লাভ, (তিন) চন্দ্র অর্থাৎ চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া, (চার) পাকড়াও অর্থাৎ বদরের যুদ্ধে কাফিরদেরকে পাকড়াও করা এবং (পাঁচ) লিযাম অর্থাৎ খেচাদাতা শাস্তি।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন)

প্রবলভাবে পাকড়াও দ্বারা বদরের দিনের যুদ্ধকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) ধূম্র দ্বারা যে ভাবার্থ গ্রহণ করেছেন, হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত আবুল আলিয়া (রঃ), হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রঃ), হযরত যহ্হাক (রঃ), হযরত আতিয়্যাহ আওফী (রঃ) প্রমুখ গুরুজনদেরও এটাই উক্তি। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

আবদুর রহমান আ’রাজ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এটা মক্কা বিজয়ের দিন। হয়। কিন্তু এই উক্তিটি সম্পূর্ণরূপেই গারীব, এমন কি মুনকারও বটে। আর কোন কোন মনীষী বলেন যে, এগুলো গত হয়নি, কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সময় এগুলোর আবির্ভাব হবে।

পূর্বে এ হাদীস গত হয়েছে যে, সাহাবীগণ একদা কিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের মধ্যে এসে পড়েন। তিনি বলেনঃ “যত দিন তোমরা দশটি আলামত দেখতে না পাও তত দিন কিয়ামত সংঘটিত হবে না। ওগুলো হলোঃ সূর্য পশ্চিম দিক হতে উদিত হওয়া, দাব্বাতুল আরদ, ধূম্র, ইয়াজুজ মাজুজের আগমন, হযরত ঈসা (আঃ)-এর আগমন, দাজ্জালের আগমন, পূর্বে, পশ্চিমে ও আরব উপদ্বীপে যমীন ধ্বসে যাওয়া এবং আদন হতে আগুন বের হয়ে জনগণকে হাঁকিয়ে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় একত্রিত করা। লোকগুলো যেখানে রাত্রি যাপন করবে ঐ আগুনও সেখানে রাত্রি যাপন করবে এবং যেখানে তারা দুপুরে বিশ্রাম করবে সেখানে ঐ আগুনও থাকবে।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে)

রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় অন্তরে (আরবী) গোপন রেখে ইবনে সাইয়াদকে বলেছিলেন:“আমি আমার অন্তরে কি গোপন রেখেছি বল তো?” সে উত্তরে বলেঃ (আরবী) রেখেছেন।” তিনি তখন তাকে বলেনঃ “তুমি ধ্বংস হও। তুমি আর সামনে বাড়তে পার না।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

এতেও এক প্রকারের ইঙ্গিত রয়েছে যে, এখনও এর জন্যে অপেক্ষা করার সময় বাকী রয়েছে। এটা আগামীতে আগমনকারী কোন জিনিস হবে। ইবনে সাইয়াদ যাদুকর হিসেবে মানুষের অন্তরের কথা বলতে পারার দাবী করতো। তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার জন্যেই নবী (সঃ) তার সাথে এরূপ করেন। যখন সে পূর্ণভাবে বলতে পারলো না তখন তিনি জনগণকে তার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেন যে, তার সাথে শয়তান রয়েছে, যে কথা চুরি করে থাকে। এ ব্যক্তি এর চেয়ে বেশী ক্ষমতা রাখে না।

হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন:“কিয়ামতের প্রথম আলামতগুলো হচ্ছে, দাজ্জালের আগমন, হযরত ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ, আদনের মধ্য হতে অগ্নি বের হওয়া যা জনগণকে ময়দানে মাহশারের দিকে নিয়ে যাবে, দুপুরের শয়নের সময় এবং রাত্রে দ্রিার সময় ঐ আগুন তাদের সাথে থাকবে। আর ধূম্র আসা। তখন হযরত হুযাইফা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ধূম্র কি?” উত্তরে তিনি (আরবী)-এই আয়াত দু’টি পাঠ করলেন এবং বললেন:এই ধূম্র চল্লিশ দিন পর্যন্ত থাকবে। এতে মুমিনদের সর্দির মত অবস্থা হবে এবং কাফিররা অজ্ঞান হয়ে যাবে। তাদের নাক, কান ও পায়খানার দ্বার দিয়ে ঐ ধূম্র বের হতে থাকবে।” ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন যে, হাদীসটি যদি বিশুদ্ধ হতো তবে তো ধূম্রের অর্থ নির্ধারণের ব্যাপারে কোন কথাই থাকতো না। কিন্তু এর সঠিকতার সাক্ষ্য দেয়া যায় না। রাওয়াদ নামক এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারীকে মুহাম্মাদ ইবনে খালফ আসকালানী (রঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “সুফিয়ান সাওরী (রঃ) হতে কি তুমি স্বয়ং এ হাদীস শুনেছো?” উত্তরে সে বলেঃ “না।” আবার তিনি তাকে প্রশ্ন করেনঃ “তুমি কি পড়েছো আর তিনি শুনেছেন?” সে জবাব দেয়ঃ “না।” পুনরায় তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার উপস্থিতির সময় কি তাঁর সামনে এ হাদীসটি পাঠ করা হয়?” সে উত্তর দেয়ঃ “না।” তখন তিনি তাকে বললেনঃ “তাহলে তুমি এ হাদীসটি কি করে বর্ণনা কর?” উত্তরে বলেঃ “আমি তো এটা বর্ণনা করিনি। আমার কাছে কিছু লোক আসে এবং হাদীসটি আমার সামনে পেশ করে। অতঃপর তারা আমার নিকট হতে চলে গিয়ে আমার নামে এটা বর্ণনা করতে শুরু করে ।” কথাও এটাই বটে। হাদীসটি সম্পূর্ণরূপে মাওযূ’। এটা আসলে বানিয়ে নেয়া হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকে কয়েক জায়গায় আনয়ন করেছেন। এর মধ্যে বহু অস্বীকার্য কথা রয়েছে। বিশেষ করে মসজিদে আকসায়, যা সূরায়ে বানী ইসরাঈলের শুরুতে রয়েছে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

হযরত আবু মালিক আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে তিনটি জিনিস হতে ভয় প্রদর্শন করেছেন। (১) ধূম্র, যা মুমিনদের অবস্থা সর্দির ন্যায় করবে, আর কাফিরদের সারাদেহ ফুলিয়ে দিবে। তার দেহের প্রতিটি গ্রন্থি হতে ধূম্র বের হবে ।(২) দাব্বাতুল আরদ। (৩) দাজ্জাল।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর সনদ খুবই উত্তম)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “লোকদের মধ্যে ধূম্র ছড়িয়ে পড়বে। মুমিনের অবস্থা সর্দির মত হবে, আর কাফিরের দেহ ফুলে যাবে এবং প্রতিটি গ্রন্থি হতে তা বের হবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, ধূম্র গত হয়নি, বরং আগামীতে আসবে। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতেও ধূম্রের ব্যাপারে উপরে বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ রিওয়াইয়াত রয়েছে।

ইবনে আবি মুলাইকা (রঃ) বলেনঃ “আমি একদা সকালে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গমন করি। তিনি আমাকে বলেন, আজ সারা রাত আমার ঘুম হয়নি।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ কেন? তিনি উত্তরে বললেনঃ “জনগণ বলেছে যে, লেজযুক্ত তারকা উদিত হয়েছে। সুতরাং আমি আশংকা করলাম যে, এটা ধূম্র তো নয়? কাজেই ভয়ে আমি সকাল পর্যন্ত চোখের পাতা বুজিনি।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর সনদ বিশুদ্ধ)

কুরআনের ব্যাখ্যাতা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ধূম্র সম্পর্কে এরূপ কথা বললেন এবং আরো বহু সাহাবী ও তাবেয়ী তার অনুকূলে রয়েছেন। এ ব্যাপারে মারফু হাদীসসমূহও রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে সহীহ, হাসান প্রভৃতি সব রকমেরই হাদীস আছে। এগুলো দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ধূম্র কিয়ামতের একটি আলামত, যার আবির্ভাব আগামীতে ঘটবে। কুরআন কারীমের বাহ্যিক শব্দও এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কেননা, কুরআনে একে স্পষ্ট ধূম্র বলা হয়েছে, যা সবাই দেখতে পায়। আর কঠিন ক্ষুধার সময়ের ধূম্রের দ্বারা এর ব্যাখ্যা দেয়া ঠিক নয়। কেননা, এটা তো একটা কাল্পনিক জিনিস। ক্ষুধা ও পিপাসার কাঠিন্যের কারণে চোখের সামনে ধোয়ার মত দেখা যায়, যা আসলে ধোয়া নয়। কিন্তু কুরআনের শব্দ (আরবী) (স্পষ্ট ধোয়া) রয়েছে।

এরপরে আছে ও ‘এটা আবৃত করে ফেলবে মানব জাতিকে।’ এ উক্তিটিও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর তাফসীরের পক্ষ সমর্থন করে। কেননা, ক্ষুধার ঐ ধোঁয়া শুধু মক্কাবাসীকে আবৃত করেছিল, দুনিয়ার সমস্ত লোককে নয়।

এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ ‘এটা হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ অর্থাৎ তাদেরকে এটা ধমক ও তিরস্কার হিসেবে বলা হবে। যেমন মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের অগ্নির দিকে, (বলা হবেঃ) এটা সেই অগ্নি যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে।”(৫২:১৩-১৪) অথবা ভাবার্থ এই যে, সেই দিন কাফিররা নিজেরাই একে অপরকে এই কথা বলবে।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘তখন তারা বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই শাস্তি হতে মুক্তি দিন, আমরা ঈমান আনবো।’ অর্থাৎ কাফিররা যখন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তা তাদের উপর হতে উঠিয়ে নেয়ার আবেদন করবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তুমি দেখতে, যখন তাদেরকে আগুনের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবেঃ হায়, যদি আমাদেরকে (পুনরায় দুনিয়ায়) ফিরিয়ে দেয়া হতো তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম!”(৬:২৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তাদের শাস্তি আসবে সেই দিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক কর, তখন যালিমরা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে কিছুকালের জন্যে অবকাশ দিন, আমরা আপনার আহ্বানে সাড়া দিবে এবং রাসূলদের অনুসরণ করবো। (বলা হবেঃ) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের পতন নেই?”(১৪:৪৪)

এখানে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তারা কি করে উপদেশ গ্রহণ করবে? তাদের নিকট তো এসেছে স্পষ্ট ব্যাখ্যাতা এক রাসূল। অতঃপর তারা তাকে অমান্য করে বলেঃ সে তো শিখানো বুলি বলছে, সে তো এক পাগল।’ যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ দিন মানুষ উপদেশ গ্রহণ করবে, কিন্তু তখন তাদের উপদেশ গ্রহণের সময় কোথায়?”(৮৯:২৩) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি যদি দেখতে যখন তারা ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে, তারা অব্যাহতি পাবে না এবং তারা নিকটস্থ স্থান হতে ধৃত হবে। আর তারা বলবেঃ আমরা তাকে বিশ্বাস করলাম। কিন্তু এতো দূরবর্তী স্থান হতে তারা নাগাল পাবে কিরূপে?”(৩৪:৫১-৫২)

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘আমি তোমাদের শাস্তি কিছুকালের জন্যে রহিত করছি- তোমরা তো তোমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। এর দু’টি অর্থ হতে পারে। প্রথম অর্থঃ মনে করা যাক, যদি আমি আযাব সরিয়ে নেই এবং তোমাদেরকে দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিই তবে সেখানে গিয়ে আবার তোমরা ঐ কাজই করবে যা পূর্বে করে এসেছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি আমি তাদের উপর দয়া করি এবং তাদের প্রতি আপতিত বিপদ দূর করে দিই তবে আবার তারা তাদের অবাধ্যতায় চক্ষু বন্ধ করে বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে।”(২৩:৭৫) যেমন আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয় তবে অবশ্যই তারা আবার ঐ কাজই করবে যা হতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।”(৬:২৮)

দ্বিতীয় অর্থঃ যদি শাস্তির উপকরণ কায়েম হয়ে যাওয়া এবং শাস্তি এসে যাওয়ার পরেও আমি অল্প দিনের জন্যে শাস্তি রহিত করি তবুও তারা কপটতা, অশ্লীলতা এবং অবাধ্যাচরণ হতে বিরত থাকবে না।

এর দ্বারা এটা অপরিহার্য হয় না যে, আযাব তাদের উপর এসে যাওয়ার পর আবার সরে যায়, যেমন হযরত ইউনুস (আঃ)-এর কওমের ব্যাপারে হয়েছিল। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(কোন জনপদবাসী কেন এমন হলো না যারা ঈমান আনতো এবং তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসতো?) তবে ইউনুস (আঃ)-এর সম্প্রদায় ব্যতীত, তারা যখন বিশ্বাস করলো তখন আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে হীনতাজনক শাস্তি হতে মুক্ত করলাম এবং কিছুকালের জন্যে জীবনোপকরণ ভোগ করতে দিলাম।”(১০:৯৮) সুতরাং এটা জ্ঞাতব্য বিষয় যে, হযরত ইউনুস (আঃ)-এর কওমের উপর আযাব শুরু হয়ে যায়নি, তবে অবশ্যই ওর উপকরণ বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তাদের উপর আল্লাহর আযাব পৌঁছে যায়নি।

আর এর দ্বারা এটাও অপরিহার্য নয় যে, তারা তাদের কুফরী হতে ফিরে গিয়েছিল, অতঃপর পুনরায় ওর দিকে ফিরে এসেছিল। যেমন হযরত শুআয়েব (আঃ) এবং তাঁর উপর ঈমান আনয়নকারীদেরকে যখন তাঁর কওম বলেছিলঃ “হয় তোমরা আমাদের জনপদ ছেড়ে দাও, না হয় আমাদের মাযহাবে ফিরে এসো। তখন তিনি তাদেরকে বলেছিলেনঃ “যদিও আমরা তা অপছন্দ করি তবুও কি? যদি আমরা তোমাদের মাযহাবে ফিরে যাই আল্লাহ আমাদেরকে তা হতে বাঁচিয়ে নেয়ার পর তবে আমাদের চেয়ে বড় মিথ্যাবাদী ও আল্লাহর প্রতি অপবাদদাতা আর কে হতে পারে?”এটা স্পষ্ট কথা যে, হযরত আয়েব (আঃ) ওর পূর্বেও কখনো কুফরীর উপর পা রাখেননি।

কাতাদা (রঃ) বলেন যে, তোমরা প্রত্যাবর্তনকারী’ এর ভাবার্থ হচ্ছে ‘তোমরা আল্লাহর আযাবের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।’ প্রবলভাবে পাকড়াও দ্বারা বদর যুদ্ধকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং তাঁর সঙ্গীয় ঐ দলটি যারা ধূম্র গত হয়ে গেছে বলেন তারা (আরবী)-এর অর্থ এটাই করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) এবং একটি জামাআত হতে এটাই বর্ণিত আছে। যদিও ভাবার্থ এটাও হয়, কিন্তু বাহ্যতঃ তো এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, এর দ্বারা কিয়ামতের দিনের পাকড়াওকে বুঝানো হয়েছে। অবশ্য বদরের দিনও নিঃসন্দেহে কাফিরদের জন্যে কঠিন পাকড়াও এর দিন ছিল।

হযরত ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “কঠিন পাকড়াও দ্বারা বদরের দিনকে বুঝানো হয়েছে এ কথা হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেও আমার মতে এর দ্বারা কিয়ামতের দিনের পাকড়াওকে বুঝানো হয়েছে।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ বিশুদ্ধ। হযরত হাসান বসরী (রঃ) এবং হযরত ইকরামা (রঃ)-এর মতেও এ দু’টি রিওয়াইয়াতের মধ্যে এ রিওয়াইয়াতটি সঠিকতর। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)

তাফসীরে‌ তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৪৪-দুখান) : নামকরণ:

সূরার ১০ নম্বর আয়াত يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِينٍ এর دُخَان শব্দকে এ সারার শিরোনাম বানানো হয়েছে। অর্থাৎ এটি সেই সূরা যার মধ্যে دُخَان শব্দটি আছে।

(৪৪-দুখান) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে এ সূরার নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানা যায় না। তবে বিষয়বস্তুর আভ্যন্তরীন সাক্ষ্য বলছে, যে সময় সূরা ‘যুখরুফ’ ও তার পূর্ববর্তী কয়েকটি সূরা নাযিল হয়েছিল। এ সূরাটিও সেই যুগেই নাযিল হয়। তবে এটি ঐগুলোর অল্প কিছুকাল পরে নাযিল হয়। এর ঐতিহাসিক পটভূমি হচ্ছে, মক্কার কাফেরদের বৈরী আচরণ যখন কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! ইউসুফের দুর্ভিক্ষের মত একটি দুর্ভিক্ষ দিয়ে আমাকে সাহায্য কর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনে করেছিলেন, এদের উপর বিপদ আসলে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং ভাল কথা শোনার জন্য মন নরম হবে। আল্লাহ নবী (সা.) দোয়া কবুল করলেন। গোটা অঞ্চলে এমন দুর্ভিক্ষ নেমে এলো যে, সবাই অস্থির হয়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত কতিপয় কুরাইশ নেতা- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ যাদের মধ্যে বিশেষভাবে আবু সূফিয়ানের নাম উল্লেখ করেছেন- নবী (সা.) কাছে এসে আবেদন জানালো যে, নিজের কওমকে এ্ বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। এ অবস্থায় আল্লাহ এই সূরাটি নাযিল করেন।

(৪৪-দুখান) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :

এই পরিস্থিতিতে মক্কার কাফেরদের উপদেশ দান ও সতর্ক করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যে বক্তব্য নাযিল করা হয় তার ভূমিকায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে:

এক: এই কুরআনকে তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা মনে করে ভূল করছো। এ গ্রন্থ তো আপন সত্তায় নিজেই এ বিষয়ের স্পষ্ট সাক্ষ্য যে তা কোন মানুষের নয়, বরং বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহর রচিত কিতাব।

দুই: তোমরা এই গ্রন্থের মর্যাদা ও মূল্য উপলব্ধি করতেও ভূল করছো। তোমাদের মতে এটা একটা মহাবিপদ। এ মহাবিপদেই তোমাদের ওপর নাযিল হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাঁর রহমতের ভিত্তিতে যে সময় সরাসরি, তোমাদের কাছে তাঁর রাসূল প্রেরণ ও কিতাব নাযিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেই মুহূর্তটি ছিল অতীব কল্যাণময়।

তিন: নিজেদের অজ্ঞতার কারণে তোমরা এই ভুল ধারণার মধ্যে ডুবে আছো যে, এই রসূল এবং এই কিতাবের বিরুদ্ধে লড়াই করে তোমরাই বিজয়ী হবে। অথচ এমন এক বিশেষ মূহুর্তে এই রসূলকে রিসালাত দান ও এই কিতাব নাযিল করা হয়েছে যখন আল্লাহ সবার কিসমতের ফায়সালা করেন। আর আল্লাহর ফায়সালা এমন অথর্ব ও দুর্বল বস্তু নয় যে, ইচ্ছা করলে যে কেউ তা পরিবর্তিত করতে পারে। তাছাড়া তা কোন প্রকার মূর্খতা ও অজ্ঞতা প্রসূত হয় না যে, তাতে ভ্রান্তি ও অপূর্ণতার সম্ভাবনা থাকবে। তা তো বিশ্বজাহানের শাসক ও অধিকর্তার অটল ফায়সালা যিনি সর্বশ্রোতা। সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করা কোন ছেলেখেলা নয়।

চার: তোমরা নিজেরাও আল্লাহকে যমীন, আসমান এবং বিশ্ব জাহানের প্রতিটি জিনিসের মালিক ও পালনকর্তা বলে মানো এবং একথাও মানো যে, জীবন ও মৃত্যু তাঁরই এখতিয়ারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমরা অন্যদেরকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণের জন্য গোঁ ধরে আছো। এর সপক্ষে এছাড়া তোমাদের আর কোন যুক্তি নেই যে, তোমার বাপ-দাদার সময় থেকেই এ কাজ চলে আসছে। অথচ কেউ যদি সচেতনভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, আল্লাহই মালিক ও পালনকর্তা এবং তিনিই জীবন ও মৃত্যুর মালিক মুখতার তাহলে কখনো তার মনে এ বিষয়ে সন্দেহ পর্যন্ত দানা বাঁধতে পারে না যে, তিনি ছাড়া আর কে-উপাস্য হওয়ার যোগ্য আছে। কিংবা উপাস্য হওয়ার ব্যাপারে তাঁর সাথে শরীক হতে পারে। তোমাদের বাপ-দাদা যদি এই বোকামি করে থাকে তাহলে চোখ বন্ধ করে তোমরাও তাই করতে থাকবে তার কোন যুক্তি নেই।প্রকৃতপক্ষে সেই এক আল্লাহ তাদেরও রব ছিলেন যিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের যেমন সেই এক আল্লাহর দাসত্ব করা উচিত তাদেরও ঠিক তেমনি তাঁর দাসত্ব করা উচিত ছিল।

পাঁচ: আল্লাহর রবুবিয়াত ও রহমতের দাবি এ নয় যে, তিনি শুধু তোমাদের পেট ভরাবেন। তিনি তোমাদেরকে পথপ্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন তাও এর অন্তর্ভূক্ত। সেই পথ প্রদর্শনের জন্যই তিনি রসূল পাঠিয়েছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন।

এই প্রারম্ভিক কথাগুলো বলার পর সেই সময় যে দুর্ভিক্ষ চলছিলো সে কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়টি আমরা ওপরে বর্ণনা করেছি। এ দুর্ভিক্ষ এসেছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়ার ফলে। তিনি দোয়া করেছিলেন এই ধারণা নিয়ে যে বিপদে পড়লে কুরাইশেদের বাঁকা ঘাড় সোজা হবে এবং তখন হয়তো তাদের কাছে উপদেশ বাণী কাযর্কর হবে। সেই সময় এই প্রত্যাশা কিছুটা পূরণ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো। কেননা ন্যায় ও সত্যের বড় বড় ঘাড় বাঁকা দুশমনও দুর্ভিক্ষের আঘাতে বলতে শুরু করেছিলো, হে প্রভু, আমাদের ওপর থেকে এ বিপদ দূর করে দিন, আমরা ঈমান আনবো। এ অবস্থায় একদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে, এ রকম বিপদে পড়ে এরা ঈমান আনার লোক নয়। যে রসূলের জীবন, চরিত্র, কাজকর্ম এবং কথাবার্তায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছিলো যে তিনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল সেই রসূল থেকেই যখন এরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন শুধু একটি দুর্ভিক্ষ এদের গাফলতি ও অচৈতন্য কি করে দুর করবে? অপরদিকে কাফেরদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তোমাদের ওপর থেকে এ আযাব সরিয়ে নিলেই তোমরা ঈমান আনবে, এটা তোমাদের চরম মিথ্যাচার। আমি এ আযাব সরিয়ে নিচ্ছি। এখনই বুঝা যাবে তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতিতে কতটা সত্যবাদী। তোমাদের মাথার ওপরে দুর্ভাগ্য খেলা করছে। তোমরা একটি প্রচন্ড আঘাত কামনা করছো। ছোট খাট আঘাতে তোমাদের বোধোদয় হবে না।

এ প্রসংগে পরে ফেরাউন ও তার কওমের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বর্তমানে কুরাইশ নেতারা যে বিপদের সম্মুখীন তাদের ওপর ঠিক একই বিপদ এসেছিল। তাদের কাছেও এ রকম একজন সম্মানিত রসূল এসেছিলেন। তারাও তাঁর কাছ থেকে এমন সব সুস্পষ্ট আলামত ও নিদর্শনাদি দেখেছিলো যা তাঁর আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হওয়া প্রমাণ করছিলো। তারাও একের পর এক নিদর্শন দেখেছে কিন্তু জিদ ও একগুঁয়েমি থেকে বিরত হয়নি। এমন কি শেষ পর্যন্ত রসূলকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। ফলে এমন পরিণাম ভোগ করেছে যা চিরদিনের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে আছে।

এরপর দ্বিতীয় যে বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে সেটি হচ্ছে আখেরাত, যা মেনে নিতে মক্কার কাফেরদের চরম আপত্তি ছিল। তারা বলতো: আমরা কাউকে মৃত্যুর পর জীবিত হয়ে উঠে আসতে দেখিনি। আরেক জীবন আছে তোমাদের এ দাবি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে আমাদের মৃত বাপ-দাদাকে জীবিত করে আনো। এর জবাবে আখেরাত বিশ্বাসের অস্বীকৃতি সবসময় নৈতিক চরিত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়েছে। আরেকটি হচ্ছে বিশ্ব জাহান কোন খেলোয়াড়ের খেলার জিনিস নয়, বরং এটি একটি জ্ঞানগর্ভ ব্যভস্থাপনা। আর জ্ঞানীর কোন কাজ অর্থনীন হয় না। তাছাড়া “আমাদের বাপ-দাদাদের জীবিত করে আনো” কাফেরদের এই দাবির জবাব দেয়া হয়েছে এই বলে যে, এ কাজটি প্রতি দিনই একেকজনের দাবী অনুসারে হবে না। আল্লাহ এ জন্য একটি সময় নির্ধারিত করে রেখেছেন। সেই সময় তিনি সমস্ত মানব জাতিকে যুগপত একত্রিত করবেন এবং নিজের আদালতে তাদের জবাবদিহি করাবেন। কেউ যদি সেই সময়ের চিন্তা করতে চায় তাহলে এখনই করুক। কারণ, সেখানে কেউ যেমন নিজের শক্তির জোরে রক্ষা পাবে না তেমনি কারো বাঁচানোতে বাঁচতে পারবে না।

আল্লাহ সেই আদালতের উল্লেখ করতে গিয়ে যারা সেখানে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে তাদের কি হবে তা বলা হয়েছে এবং যারা সেখানে সফলকাম হবে তারা কি পুরস্কার লাভ করবে তাও বলা হয়েছে। সব শেষে কথার সমাপ্তি টানা হয়েছে এই বলে যে, তোমাদের বুঝানোর জন্য পরিস্কার ও সহজ-সরল ভংগিতে তোমাদের নিজের ভাষায় এই কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এখন যদি বুঝানো সত্ত্বেও তোমরা না বুঝো এবং চরম পরিণতি দেখার জন্যই গোঁ ধরে থাকো তাহলে অপেক্ষা করো। আমার নবীও অপেক্ষা করছেন। যা হওয়ার তা যথা সময়ে দেখতে পাবে।

# কিতাবুম মুবীন বা সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ করার উদ্দেশ্য সূরা যুখরুফের ১ নম্বর টীকায় বর্ণনা করা হয়েছে এখানেও যে বিষয়টির জন্য শপথ করা হয়েছে তা হলো এ কিতাবের রচিয়তা মুহাম্মাদ ﷺ নন, আমি নিজে। তার প্রমাণ অন্য কোথাও অনুসন্ধান করার দরকার নেই, এ কিতাবই তার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। এর পর আরো বলা হয়েছে, যে রাতে তা নাযিল করা হয়েছে সে রাত ছিল অত্যন্ত বরকত ও কল্যাণময়। অর্থাৎ যেসব নির্বোধ লোকদের নিজেদের ভালমন্দের বোধ পর্যন্ত নেই তারাই এ কিতাবের আগমনে নিজেদের জন্য আকস্মিক বিপদ মনে করছে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বড়ই চিন্তিত। কিন্তু গাফলতির মধ্যে পড়ে থাকা লোকদের সতর্ক করার জন্য আমি যে মুহূর্তে এই কিতাব নাযিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তাদের ও গোটা মানব জাতির জন্য সেই মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত সৌভাগ্যময়।

কোন কোন মুফাসসির সেই রাতে কুরআন নাযিল করার অর্থ গ্রহণ করেছেন এই যে, ঐ রাতে কুরআন নাযিল শুরু হয় আবার কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ গ্রহণ করেন, ঐ রাতে সম্পূর্ণ কুরআন ‘উম্মুল কিতাব’ থেকে স্থানান্তরিত করে অহীর ধারক ফেরেশতাদের কাছে দেয়া হয় এবং পরে তা অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজন মত ২৩ বছর ধরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করা হতে থাকে। প্রকৃত অবস্থা কি তা আল্লাহই ভাল জানেন।

ঐ রাত অর্থ সূরা কদরে যাকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ আর এখানে বলা হয়েছে إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ তাছাড়া কুরআন মজীদেই একথা বলা হয়েছে যে সেটি ছিল রমযান মাসের একটি شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ (البقرة : 185 )

# মূল আয়াতে আরবী اَمْرٍحَكِيْمٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে, সেই নির্দেশটি সরাসরি জ্ঞানভিত্তিক হয়ে থাকে। তাতে কোন ত্রুটি বা অপূর্ণতার সম্ভাবনা নেই। অপর অর্থটি হচ্ছে, সেটি অত্যন্ত দৃঢ় ও পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। তা পরিবর্তন করার সাধ্য কারো নেই।
# এ বিষয়টি সূরা কদরে বলা হয়েছে এভাবেঃ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ সেই রাতে ফেরেশতারা ও জিবরাঈল তাদের রবের আদেশে সব রকম নির্দেশ নিয়ে অবতীর্ণ হয়।

এ থেকে জানা যায়, আল্লাহর রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় এটা‌ এমন এক রাত যে রাতে তিনি ব্যক্তি, জাতি এবং দেশসমূহের ভাগ্যের ফয়সালা অনুসারে কাজ করতে থাকে। কতিপয় মুফাসসিরের কাছে এ রাতটি শা’বানের পনের তারিখের রাত বলে সন্দেহ হয়েছে তাদের মধ্যে হযরত ইকরিমার নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। কারণ, কোন কোন হাদীসে এ রাত সম্পর্কে এ কথা উল্লেখ আছে যে, এ রাতেই ভাগ্যের ফয়সালা করা হয়। কিন্তু ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, মুজাহিদ, কাতাদা, হাসান বাসারী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, ইবনে যায়েদ, আবু সালেক, দাহ্‌হাক এবং আরো অনেক মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে, এটা রমযানের সেই রাত যাকে “লাইলাতুল কদর” বলা হয়েছে। কারণ, কুরআন মজীদ নিজেই সুস্পষ্ট করে তা বলছে। আর যে ক্ষেত্রে কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তি বিদ্যমান সে ক্ষেত্রে ‘আখবারে আহাদ’* ধরনের হাদীসের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। ইবনে কাসীর বলেনঃ এক শা’বান থেকে অন্য শা’বান পর্যন্ত ভাগ্যের ফয়সালা হওয়া সম্পর্কে উসমান ইবনে মুহাম্মাদ বর্ণিত যে হাদীস ইমাম যুহরী উদ্ধৃত করেছেন তা একটি ‘মুরসাল’** হাদীস। কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তির (نص) বিরুদ্ধে এ ধরনের হাদীস পেশ করা যায় না। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেনঃ শা’বানের পনের তারিখের রাত সম্পর্কে কোন হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়, না তার ফযীলত সম্পর্কে, না ঐ রাতে ভাগ্যের ফয়সালা হওয়া সম্পর্কে। তাই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করা উচিত।(আহকামুল কুরআন)*আখবারে আহাদ বলতে এমন হাদীস বুঝায় যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রের কোনো এক স্তরে বর্ণনাকারী মাত্র একজন থাকে। এ বিষয়টি হাদীসের মধ্যে তুলনামূলভাবে কিছুটা দুর্বলতা সঞ্চার করে।

**যে হাদীসে মূল রাবী সাহাবীর নাম উল্লেখিত থাকে না বরং তাবেঈ নিজেই রাসূলের ﷺ থেকে হাদীস বর্ণনা করেন তাকে মুরসাল হাদীস বলে। ইমাম মালেক ও ইমাম আবু হানীফা ছাড়া অন্য কোনো ইমামই এ ধরনের হাদীসকে নিঃসংকোচে গ্রহণ করেননি।
# এই কিতাবসহ একজন রসূল পাঠানো শুধু জ্ঞান ও যুক্তির দাবীই ছিল না, আল্লাহর রহমতের দাবীও তাই ছিল। কারণ, তিনি রব। আর রবুবিয়াত শুধু বান্দার দেহের প্রতিপালন ব্যবস্থা দাবীই করে না, বরং নির্ভুল জ্ঞানানুযায়ী তাদের পথপ্রদর্শন করা, হক ও বাতিলের পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত করা এবং অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে না দেয়ার দাবীও করে।
# এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহর এ দু’টি গুণ বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষকে এ সত্য জানিয়ে দেয়া যে, কেবল তিনিই নির্ভুল জ্ঞান দিতে পারেন। কেননা, তিনিই সমস্ত সত্যকে জানেন। একজন মানুষ তো দূরের কথা সমস্ত মানুষ মিলেও যদি নিজেদের জন্য জীবন পদ্ধতি রচনা করে তবুও তার ন্যায়, সত্য ও বাস্তবানুগ হওয়ার কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ, গোটা মানব জাতি এক সাথে মিলেও একজন سَمِيْعٌ ও عَلِيُمٌ (সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী) হয় না। একটি সঠিক ও নির্ভুল জীবন পদ্ধতি রচনার জন্য যেসব জ্ঞান সত্য জানা জরুরী তার সবগুলো আয়ত্ব করা তার সাধ্যাতীত। এরূপ পূর্ণ জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে। তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী। তাই মানুষের জন্য কোনটি হিদায়েত আর কোনটি গোমরাহী, কোনটি হক আর কোনটি বাতিল এবং কোনটি কল্যাণ আর কোনটি অকল্যাণ তা তিনিই বলতে পারেন।
# আরববাসীরা নিজেরাই স্বীকার করতো, আল্লাহই গোটা বিশ্বজাহান ও তার প্রতিটি জিনিসের রব (মালিক ও পালনকর্তা)। তাই তাদের বলা হয়েছে, যদি তোমরা না বুঝে শুনে এবং শুধু মৌখিকভাবে একথা না বলে থাকো, বরং প্রকৃতই যদি তাঁর প্রভুত্বের উপলব্ধি ও মালিক হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস তোমাদের থাকে তাহলে তোমাদের মেনে নেয়া উচিত যে,

(১) মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য কিতাব ও রসূল প্রেরণ তাঁর রহমত ও প্রতিপালন গুণের অবিকল দাবী এবং

(২) মালিক হওয়ার কারণে এটা তাঁর হক এবং তাঁর মালিকানাধীন হওয়ার কারণে তোমাদের কর্তব্য হলো, তাঁর পক্ষ থেকে যে হিদায়াত আসে তা মেনে চলো এবং যে নির্দেশ আসে তার আনুগত্য করে।
# উপাস্য অর্থ প্রকৃত উপাস্য। আর প্রকৃত উপাস্যের হক হচ্ছে তাঁর ইবাদতের (দাসত্ব ও পূজা-অর্চনা) করতে হবে।
# এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং থাকতে পারে না। অতএব যিনি নিষ্প্রাণ বস্তুর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে তোমাদের জীবন্ত মানুষ বানিয়েছেন এবং যিনি এ ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার মালিক যে, যতক্ষণ ইচ্ছা তোমাদের এ জীবনকে টিকিয়ে রাখবেন এবং যখন ইচছা এটা পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। তোমরা তাঁর দাসত্ব করবে না, কিংবা তাঁর ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করতে শুরু করবে তা সরাসরি বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী।
# এখানে এ বিষয়ের প্রতি একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে যে, তোমাদের যে পূর্বসূরীরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদের উপাস্য বানিয়েছিল প্রকৃতপক্ষে তাদের রবও তিনিই ছিলেন। তারা তাদের প্রকৃত রবকে বাদ দিয়ে অন্যদের দাসত্ব কর ঠিক কাজ করেনি। তাই তাদের অন্ধ অনুসরণ করে তোমরা ঠিকই করেছো এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে নিজেদের ধর্মের সঠিক হওয়ার যুক্তি-প্রমাণ বলে ধরে নেবে তা ঠিক নয়। তাদের কর্তব্য ছিল একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা। কারণ তিনিই ছিলেন তাদের রব। কিন্তু তারা যদি তা না করে থাকে তা হলে তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, সবার দাসত্ব পরিত্যাগ করে কেবল সেই এক আল্লাহর দাসত্ব করা। কারণ, তিনিই তোমাদের রব।
# এই সংক্ষিপ্ত আয়াতাংশের মধ্যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। নাস্তিক হোক বা মুশরিক তাদের জীবনে মাঝে মধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন ভেতর থেকে তাদের মন বলে ওঠেঃ তুমি যা বুঝে বসে আছো তার মধ্যে কোথাও না কোথাও অসঙ্গিত বিদ্যমান। নাস্তিক আল্লাহকে অস্বীকার করার ব্যাপারে বাহ্যত যতই কঠোর হোক না কেন, কোন না কোন সময় তাদের মন এ সাক্ষ্য অবশ্যই দেয় যে, মাটির একটি পরমাণু থেকে শুরু করে নীহারিকা পুঞ্জ পর্যন্ত এবং একটি তৃণপত্র থেকে শুরু করে মানুষের সৃষ্টি পর্যন্ত এই বিস্ময়কর জ্ঞানময় ব্যবস্থা কোন মহাজ্ঞানী স্রস্টা ছাড়া অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। অনুরূপ একজন মুশরিক শিরকের যত গভীরেই ডুবে থাক না কেন তার মনও কোন না কোন সময় একথা বলে ওঠে, যাকে আমি উপাস্য বানিয়ে বসে আছি সে আল্লাহ‌ হতে পারে না। মনের এই ভেতরের সাক্ষ্যের ফলশ্রুতিতে না পারে তারা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর তাওহীদের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করতে না পারে নাস্তিকতার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস পোষণ ও তা থেকে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে। ফলে বাহ্যিকভাবে তারা যত কঠোর ও দৃঢ় বিশ্বাসই প্রদর্শন করুক না কেন তাদের জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয় সন্দেহের ওপরে। এখন প্রশ্ন হলো, এই সন্দেহ তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে না কেন এবং দৃঢ় বিশ্বাস ও সন্তোষজনক ভিত্তি খুজে পাওয়ার জন্য তারা ধীর ঠাণ্ডা মেজাজে প্রকৃত সত্যে অনুসন্ধান করে না কেন? এ জবাব হলো দ্বীন বা জীবনাদর্শের ব্যাপারে তারা যে জিনিসটি থেকে বঞ্চিত হয় সেটি হচ্ছে ধীর ও ঠাণ্ডা মেজাজ। তাদের দৃষ্টিতে মূল গুরুত্ব লাভ করে শুধু পার্থিব স্বার্থ এবং তার ভোগের উপকরণ। এই বস্তুটি অর্জনের চিন্তা তারা তাদের মন-মগজ ও দেহের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে ফেলে। এরপর থকে জীবনাদর্শের ব্যাপার। সেটা তাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে একটা খেলা, একটা বিনোদন এবং একটা বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই তারাএ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে কয়েক মুহূর্তও ব্যয় করতে পারে না। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি হলে বিনোদন হিসেবে পালন করা হচ্ছে। নিরীশ্বরবাদ ও নাস্তিকতা বিষয়ক বিতর্ক বিনোদনমূলক ভাবে করা হচ্ছে। দুনিয়ার বাস্তবতার মধ্যে কার এত অবসর আছে যে বসে একটু ভেবে দেখবে, আমরা ন্যয় ও সত্যের প্রতি বিমুখ নই তো? আর যদি তা হই তাহলে পরিণামই বা কি?
#
) رَسُولٌ مُبِينٌ এর দু’টি অর্থ। এক, তাঁর জীবন, তাঁর নৈতিক চরিত্র এবং তার কাজকর্ম থেকে তার রসূল হওয়া পুরোপুরি স্পষ্ট। দুই, তিনি প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে কোন ত্রুটি করেননি।
# তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো, এ বেচারা তো ছিল সাদামাটা মানুষ। অন্য কিছু লোক তাকে নেপথ্য থেকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। তারা আড়ালে থেকে কুরআনের আয়াত রচনা করে একে শিখিয়ে দেয়। আর এ সাধারণ মানুষের কাছে এসে তা বলে ফেলে। তারা মজা করে লোক চক্ষুর অন্তরালে বসে থাকে আর এ গালমন্দ শোনে এবং পাথর খায়। রসূলুল্লাহ ﷺ বছরের পর বছর তাদের সামনে ক্রমাগত যেসব প্রমাণ, সদুপদেশ এবং যুক্তিপূর্ণ শিক্ষা পেশ করে ক্লান্ত প্রায় হয়ে পড়ছিলেন এভাবে একটি সস্তা কথা বলে তারা তা উড়িয়ে দিতো। কুরআন মজীদের যেসব যুক্তিপূর্ণ কথা বলা হচ্ছিল তারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতো না। আবার যিনি এসব কথা পেশ করছিলেন তিনি কেমন মর্যাদার লোক তাও দেখতো না। তাছাড়া এসব অভিযোগ আরোপের সময়ও এ কথা ভেবে দেখার কষ্টটুকু পর্যন্ত স্বীকার করতো না যে, তারা যা বলছে তা অর্থহীন কথাবার্তা কিনা। এটা সর্বজন বিদিত যে নেপথ্যে বসে শেখানোর মত অন্যকোন ব্যক্তি যদি থাকতো তাহলে তা খাদীজা (রা.), আবু বকর (রা.), আলী (রা.) যায়েদ ইবনে হারেসা এবং প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী অন্যন্য মুসলমানদের কাছে কি করে গোপন থাকতো। কারণ তাদের চাইতে আর কেউ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ও সার্বক্ষনিক সাথী ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব লোকই নবীর ﷺ সর্বাধিক ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন তারই বা কারণ কি? অথচ নেপথ্যে থেকে অন্য কারোর শেখানোর ওপর ভিত্তি করে নবুওয়াতের কাজ চালানো হয়ে থাকলে এসব লোকই সর্ব প্রথম তাঁর বিরোধিতা করতো। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নাহল, টীকা ১০৭; আল ফুরকান, টীকা ১২)।

# # এ আয়াত দু’টির অর্থ বর্ণনায় মুফাসসিরদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে এবং এই দু’টি মতভেদ সাহাবাদের যুগেও ছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) এর বিখ্যাত শাগরেদ মাসরুক বলেনঃ একদিন আমরা কুফার মসজিদে প্রবেশ করে দেখলাম এক বক্তা লোকদের সামনে বক্তৃতা করছে। সে يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِينٍ পাঠ করলো। তারপর বলতে লাগলঃ জানো, সে ধোঁয়া কেমন? কিয়ামতের দিন আসবে এবং কাফের ও মুনাফিকদের অন্ধ ও বধির করে দেবে। কিন্তু ঈমানদারদের ওপর তার প্রতিক্রিয়া হবে শুধু এতটুকু যেন সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছে। তার এই বক্তব্য শুনে আমরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের ﷺ কাছে গেলাম এবং তাকে বক্তার এই তাফসীর বর্ণনা করে শুনালাম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ শুয়ে ছিলেন। এ তাফসীর শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, কারো যদি জানা না থাকে তাহলে যারা জানে তাদের কাছে জেনে নেয়া উচিত। প্রকৃত ব্যাপার হলো, কুরাইশরা যখন ক্রমাগত ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতাই করে চলছিলো তখন তিনি এই বলে দোয়া করলেনঃ হে আল্লাহ, ইউসুফ আলাইহিস সালামের দুভিক্ষের মত দুর্ভিক্ষ দিয়ে আমাকে সাহায্য করো। সুতরাং এমন কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দিল যে, মানুষ হাড়, চামড়া এবং মৃতজন্তু পর্যন্ত খেতে শুরু করলো। তখনকার অবস্থা ছিল, যে ব্যক্তিই আসমানের দিকে তাকাতো ক্ষুধার যন্ত্রনায় সে শুধু ধোঁয়াই দেখতে পেতো। অবশেষে আবু সুফিয়ান নবীর ﷺ কাছে এসে বললোঃ আপনি তো আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার আহবান জানান আপনার কওম ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন এ বিপদ দূর করে দেন। ‌ এ যুগেই কুরাইশরা বলতে শুরু করেছিলোঃ হে আল্লাহ! আমাদের ওপর থেকে আযাব দূর করে দাও, আমরা ঈমান আনবো। এ আয়াত দু’টিতে এ ঘটনারই উল্লেখ করা হয়েছে। আর বড় আঘাত অর্থ বদর যুদ্ধের দিন কুরাইশদের যে আঘাত দেয়া হয়েছিলো তাই। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ, বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে জারীর এবং ইবনে আবী হাতেম কতিপয় সনদে মাসরুক থেকে উদ্ধৃত করেছেন। মাসরুক ছাড়া ইবরাহীম নাখায়ী, কাতাদা, আসেম এবং আমেরও বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এ আয়াতটির এ ব্যাখ্যাই বর্ণনা করেছিলেন। তাই এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না যে, প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এটিই ছিল তার অভিমত। তাবেয়ীদের মধ্যে থেকে মুজাহিদ, কাতাদা, আবুল আলিয়া, মুকাতিল, ইবরাহীম নাখায়ী, দাহহাক, আতায়িতুল আওফী এবং অন্যরাও এ ব্যখ্যার ক্ষেত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

অপরদিকে হযরত আলী, ইবনে উমর, উবনে আব্বাস, আবু সাঈদ খুদরী, যায়েদ ইবনে আলী এবং হাসান বাসারীর মত পণ্ডিতবর্গ বলেনঃ এ আয়াতগুলোতে যে আলোচনা করা হয়েছে তা সবই কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ের ঘটনা। আর এতে যে ধোঁয়ার কথা বলা হয়েছে তা সেই সময়েই পৃথিবীর ওপর ছেয়ে যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থেকে যেসব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে সেই সব হাদীস থেকেও এ ব্যাখ্যা আরো দৃঢ়তা লাভ করে। হুযাইফা ইবনে আসীদ আল গিফারী বলেনঃ একদিন আমরা পরস্পর কিয়ামত সম্পর্কে কথাবার্তা বলছিলাম। ইতিমধ্যে নবী ﷺ হাজির হলেন এবং বললেনঃ যতদিন না একের পর এক দশটি আলামত প্রকাশ পাবে ততদিন কিয়ামত হবে না। পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়া, ধোঁয়া, দাব্বা বা জন্তু, ইয়াজুজ ও মাজুজের আবির্ভাব, ঈসা ইবনে মারয়ামের অবতীর্ণ হওয়া, ভূমি ধ্বস, পূর্বে, পশ্চিমে ও আরব উপদ্বীপে এবং আদন থেকে আগুনের উৎপত্তি হওয়া যা মানুষকে তাড়া করে নিয়ে যাবে (মুসলিম)। ইবনে জারীর ও তাবারনীর উদ্ধৃত আবু মালেক আশআরী বর্ণিত হাদীস এবং ইবনে আবী হাতেম উদ্ধৃত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিত হাদীসও এ বর্ণনা সমর্থন করে। এ দু’টি হাদীস থেকে জানা যায়, নবী ﷺ ধোঁয়াকে কিয়ামতের আলামতের মধ্যে গণ্য করেছেন। তাছাড়া নবী (সা.) এও বলেছেন যে, যখন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলবে তখন মু’মিনের ওপর তার প্রতিক্রিয়া হবে সর্দির মত। কিন্তু তা কাফেরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় প্রবেশ করবে এবং তার শরীরের প্রতিটি ছিদ্র ও নির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে আসবে।

পূর্ববর্তী আয়াতগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে এ দু’টি ব্যখ্যার গরমিল ও বৈপরিত্য সহজেই দূর হতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের ﷺ ব্যাখ্যার ব্যাপারে বলা যায়, নবীর ﷺ দোয়ার ফলে মক্কায় কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিলো যার ফলে কাফেরদের বিদ্রূপ ও উপহাসে কিছুটা ভাটা পড়েছিলো এবং দুর্ভিক্ষ দূর করার জন্য তারা নবী (সা.) কাছে দোয়ার আবেদন জানিয়েছিলো। কুরআন মজীদের বেশ কিছু জায়গায় এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আন’আম ২৯ , আল আরাফ ৭৭ , ইউনুস ১৪ , ১৫ ও ২৯ এবং আল মু’মিনুন ৭২ টীকা)। এই আয়াতগুলোর মাধ্যমেও যে ঐ পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যায়। কাফেরদের উক্তি, “হে প্রভু, আমাদের ওপর থেকে এ আযাব সরিয়ে নিন, আমরা ঈমান আনবো।” আর আল্লাহর এ উক্তি, “কোথায় এদের গাফলতি দূর হচ্ছে? এদের অবস্থা এই যে, এদের কাছে ‘রসূলে মুবীন’ এসেছেন। তা সত্ত্বেও এরা তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি এবং বলেছেঃ এতো শিখিয়ে নেয়া পাগল।” তাছাড়া এই উক্তিও যে, “আমি আযাব কিছুটা সরিয়ে নিচ্ছি। এরপরও তোমরা আগে যা করছিলে তাই করবে।” এ ঘটনাগুলো নবীর ﷺ যুগের হলে কেবল সেই পরিস্থিতিতেই এসব কথা খাপ খায়। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে সংঘটিত হবে এমন ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে এসব কথার প্রয়োগ বোধগম্য নয়। তাই ইবনে মাসউদের ﷺ ব্যাখ্যার এতটুকু অংশ সঠিক বলে মনে হয়। কিন্তু ধোঁয়াও সেই যুগেই প্রকাশ পেয়েছিলো এবং প্রকাশ পেয়েছিলো এমনভাবে যে, ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ যখন আসমানের দিকে তাকাতো তখন শুধু ধোঁয়াই দেখতে পেতো, তার ব্যাখ্যার এই অংশটুকু সঠিক বলে মনে হয় না। একথা কুরআন মজীদের বাক্যের সাথেও বাহ্যত খাপ খায় না এবং হাদীসসমূহেরও পরিপন্থী। কুরআনে একথা কোথায় বলা হয়েছে যে, আসমান ধোঁয়া নিয়ে এসেছে এবং মানুষের ওপর ছেয়ে গিয়েছে? সেখানে তো বলা হয়েছে, ‘বেশ, তাহলে সেই দিনটির অপেক্ষা করো যেদিন আসমান সুস্পষ্ট ধোঁয়া নিয়ে আসবে এবং তা মানুষকে আচ্ছন্ন কর ফেলবে। পরবর্তী আয়াতের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিচার করলে এ বাণীর পরিষ্কার অর্থ যা বুঝা যায় তা হচ্ছে, তোমরা যখন উপদেশও মানছো না এবং দুর্ভিক্ষের আকারে যেভাবে তোমাদের সতর্ক করা হলো তাতেও সম্বিত ফিরে পাচ্ছো না, তাহলে কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করো। সেই সময় যখন দুর্ভাগ্য ষোলকলায় পূর্ণ হবে তখন তোমরা ঠিকই বুঝতে পারবে হক কি আর বাতিল কি? সুতরাং ধোঁয়া সম্পর্কে সঠিক কথা হলো তা দুর্ভিক্ষকালীন সময়ের জিনিস নয়, বরং তা কিয়ামতের একটি আলামত। হাদীস থেকেও একথাই জানা যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বড় বড় মুফাসসিরদের মধ্যে যারা হযরত ইবনে মাসউদের মত সমর্থন করেছেন তারা পুরো বক্তব্যই সমর্থন করেছেন। আবার যারা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন তারাও পুরোটাই প্রত্যাখ্যান করে বসেছেন। অথচ কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদীস সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে এর কোন অংশ ঠিক এবং কোন অংশ ভুল তা পরিষ্কার বুঝা যায়।

Leave a Reply