باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১৭/ এবং কাফিররা বলে -৮) [ ** নিশ্চয় ওরা বলে থাকে, ‘আমাদের প্রথম মৃত্যুই একমাত্র মৃত্যু এবং আমরা আর পুনরুত্থিত হবো না।:- **পুনরুত্থান সৃষ্টিরই অনিবার্য দাবি : -] www.motaher21.net সূরা:৪৪: সূরা:- ‌দুখান‌ পারা:২৫ ৩৪-৫৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১৭/ এবং কাফিররা বলে -৮)
[ ** নিশ্চয় ওরা বলে থাকে, ‘আমাদের প্রথম মৃত্যুই একমাত্র মৃত্যু এবং আমরা আর পুনরুত্থিত হবো না।:-
**পুনরুত্থান সৃষ্টিরই অনিবার্য দাবি : -]
www.motaher21.net
সূরা:৪৪: সূরা:- ‌দুখান‌ পারা:২৫
৩৪-৫৯ নং আয়াত:-
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩৪
اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ لَیَقُوۡلُوۡنَ ﴿ۙ۳۴﴾
নিশ্চয় ওরা বলে থাকে,
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩৫
اِنۡ ہِیَ اِلَّا مَوۡتَتُنَا الۡاُوۡلٰی وَ مَا نَحۡنُ بِمُنۡشَرِیۡنَ ﴿۳۵﴾
আমাদের প্রথম মৃত্যুই একমাত্র মৃত্যু এবং আমরা আর পুনরুত্থিত হবো না।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩৬
فَاۡتُوۡا بِاٰبَآئِنَاۤ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۳۶﴾
“যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদের বাপ-দাদাদের জীবিত করে আনো।”
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩৭
اَہُمۡ خَیۡرٌ اَمۡ قَوۡمُ تُبَّعٍ ۙ وَّ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ اَہۡلَکۡنٰہُمۡ ۫ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا مُجۡرِمِیۡنَ ﴿۳۷﴾
এরাই উত্তম না তুব্বা’ কওম এবং তাদের পূর্ববর্তী লোকেরা? আমি তাদের ধ্বংস করেছিলাম। কারণ তারা অপরাধী হয়ে গিয়েছিলো।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩৮
وَ مَا خَلَقۡنَا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا لٰعِبِیۡنَ ﴿۳۸﴾
আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যে কোন কিছুই খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি;
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৩৯
مَا خَلَقۡنٰہُمَاۤ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۹﴾
আমি এ দুটিকে যথার্থরূপেই সৃষ্টি করেছি; কিন্তু ওদের অধিকাংশই তা জানে না।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪০
اِنَّ یَوۡمَ الۡفَصۡلِ مِیۡقَاتُہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿ۙ۴۰﴾
সূরা:এদের সবার পুনরুজ্জীবনের জন্য নির্ধারিত সময়টিই এদের ফায়সালার দিন।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪১
یَوۡمَ لَا یُغۡنِیۡ مَوۡلًی عَنۡ مَّوۡلًی شَیۡئًا وَّ لَا ہُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ ﴿ۙ۴۱﴾
সেটি এমন দিন যেদিন কোন নিকটতম প্রিয়জনও কোন নিকটতম প্রিয়জনের কাজে আসবে না এবং তারা কোথাও থেকে কোন সাহায্য লাভ করবে না।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪২
اِلَّا مَنۡ رَّحِمَ اللّٰہُ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ﴿٪۴۲﴾
শুধুমাত্র আল্লাহ‌ যাকে রহমত দান করবেন সে ছাড়া । তিনি মহাপরাক্রমশালী ও অত্যন্ত দয়াবান।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৩
اِنَّ شَجَرَتَ الزَّقُّوۡمِ ﴿ۙ۴۳﴾
নিশ্চয়ই যাক্কুম গাছ হবে,
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৪
طَعَامُ الۡاَثِیۡمِ ﴿ۖۛۚ۴۴﴾
পাপীর খাদ্য ;
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৫
کَالۡمُہۡلِ ۚۛ یَغۡلِیۡ فِی الۡبُطُوۡنِ ﴿ۙ۴۵﴾
গলিত তামার মত তা পেটের ভিতর ফুটতে থাকবে,
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৬
کَغَلۡیِ الۡحَمِیۡمِ ﴿۴۶﴾
ফুটন্ত পানি ফুটার মত।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৭
خُذُوۡہُ فَاعۡتِلُوۡہُ اِلٰی سَوَآءِ الۡجَحِیۡمِ ﴿٭ۖ۴۷﴾
পাকড়াও করো একে এবং টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যখানে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৮
ثُمَّ صُبُّوۡا فَوۡقَ رَاۡسِہٖ مِنۡ عَذَابِ الۡحَمِیۡمِ ﴿ؕ۴۸﴾
তারপর ঢেলে দাও তার মাথার ওপর ফুটন্ত পানির আযাব।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৪৯
ذُقۡ ۚۙ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡکَرِیۡمُ ﴿۴۹﴾
এখন এর মজা চাখো। তুমি বড় সম্মানী ব্যক্তি কিনা, তাই।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫০
اِنَّ ہٰذَا مَا کُنۡتُمۡ بِہٖ تَمۡتَرُوۡنَ ﴿۵۰﴾
এটা সেই জিনিস যার আসার ব্যাপারে তোমরা সন্দেহ পোষণ করতে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫১
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ مَقَامٍ اَمِیۡنٍ ﴿ۙ۵۱﴾
নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে ।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫২
فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿ۚۙ۵۲﴾
বাগান ও ঝর্ণা ঘেরা জায়গায়।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৩
یَّلۡبَسُوۡنَ مِنۡ سُنۡدُسٍ وَّ اِسۡتَبۡرَقٍ مُّتَقٰبِلِیۡنَ ﴿ۚۙ۵۳﴾
তারা রেশম ও মখমলের পোশাক পরে সামনাসামনি বসবে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৪
کَذٰلِکَ ۟ وَ زَوَّجۡنٰہُمۡ بِحُوۡرٍ عِیۡنٍ ﴿ؕ۵۴﴾
এরূপই ঘটবে ওদের; আর আয়তলোচনা হুরদের সাথে তাদের বিবাহ দেব।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৫
یَدۡعُوۡنَ فِیۡہَا بِکُلِّ فَاکِہَۃٍ اٰمِنِیۡنَ ﴿ۙ۵۵﴾
সেখানে তারা নিশ্চিন্তে মনের সুখে সবরকম সুস্বাদু জিনিস চেয়ে চেয়ে নেবে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৬
لَا یَذُوۡقُوۡنَ فِیۡہَا الۡمَوۡتَ اِلَّا الۡمَوۡتَۃَ الۡاُوۡلٰی ۚ وَ وَقٰہُمۡ عَذَابَ الۡجَحِیۡمِ ﴿ۙ۵۶﴾
সেখানে তারা কখনো মৃত্যুর স্বাদ চাখবে না। তবে দুনিয়াতে যে মৃত্যু এসেছিলো তা তো এসেই গেছে। আর আল্লাহ‌ তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন-
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৭
فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ ذٰلِکَ ہُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿۵۷﴾
তোমার রবের করুণায় । এটাই বড় সফলতা।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৮
فَاِنَّمَا یَسَّرۡنٰہُ بِلِسَانِکَ لَعَلَّہُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿۵۸﴾
আমি তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে।
সূরা:৪৪: সূরা:- দুখান :৫৯
فَارۡتَقِبۡ اِنَّہُمۡ مُّرۡتَقِبُوۡنَ ﴿٪۵۹﴾
কাজেই আপনি প্রতীক্ষা করুন, নিশ্চয় তারা প্ৰতীক্ষমাণ।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*পুনরুত্থান সৃষ্টিরই অনিবার্য দাবি : ফেরাউন ও তার লােক লঙ্করদের করুণ পরিণতি, মুসা(আ.) ও তার সম্প্রদায়ের মুক্তি, পরবর্তীকালে তাদের পরীক্ষা ও শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার ঘটনার পর এখন আলােচনা করা হচ্ছে পরকাল ও পুনর্জন্ম সম্পর্কে মােশরেকদের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের প্রসংগ। এরপর গােটা বিষয়কে জীবন ও জগতের সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত করে দেখানাে হয়েছে যে, পরকালের পুনরুত্থান ও পুনর্জন্ম এই জীবন ও জগত সৃষ্টিরই অনিবার্য ফলশ্রুতি। আয়াতে এ প্রসংগে বলা হয়েছে, কাফেররা বলেই থাকে, প্রথম মৃত্যুর মাধ্যমেই আমাদের সব কিছুর অবসান হবে এবং আমরা পুনরুত্থিত হবে না…। (আয়াত ৩৪-৪২) আরবের মােশরেক সম্প্রদায় বলে বেড়াতাে, মৃত্যু একবারই হবে এবং এই মৃত্যুর পর আর কোনাে জীবন নেই। পরকালের হিসাব নিকাশ বলতেও কিছু নেই। এই মৃত্যুকে তারা বলতাে প্রথম মৃত্যু। অর্থাৎ পুনরুত্থানের অগ্রবর্তী মৃত্যু। তাদের মতে এটাই প্রথম এটাই শেষ। প্রমাণস্বরূপ তারা বলে, তাদের পূর্ব পুরুষরা একবারই মৃত্যুবরণ করেছে। এরপর তারা আর পৃথিবীতে ফিরে আসেনি। পুনরুত্থান বলতে কিছু থাকলে নিশ্চয়ই তারা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসতাে। যদি এই পুনরুত্থান সত্য হয়ে থাকে তাহলে তাদের মৃত পূর্বপুরুষদেরকে জীবিত করে উঠানাে হােক। তারা এই দাবী করতে গিয়ে পুনর্জন্ম ও পুনরুত্থানের মূল রহস্যটাই বেমালুম ভুলে যায়। তারা বুঝতে চেষ্টা করে না যে, মানবসৃষ্টির পেছনে কিছু রহস্য আছে, নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য আছে। মানবজীবনের কয়টি স্তর আছে। জীবনের প্রথম স্তরের সৎ বা অসৎ কর্মের ফলাফল মানুষকে জীবনের শেষ স্তরে প্রদান করা হবে। সৎকর্মশীলদের পরিণতি হবে শুভ, মঙ্গলজনক ও সম্মানজনক। অপরদিকে জীবনের প্রথম স্তরে যারা ভুল পথে চলেছে, অন্যায় ও অবিচার করেছে, অবাধ্যচিরণ করেছে, তাদের পরিণতি হবে অভ, অমঙ্গলজনক ও অসম্মানজনক। আর এটা সম্ভব হবে না যদি জাগতিক জীবনের অবসানের পর দ্বিতীয় স্তরের জন্যে পুনরুত্থান না ঘটে। তাদের মনে রাখতে হবে যে, পুনরুত্থান ও কোনাে হেলা-খেলার বিষয় নয় যে, তা ব্যক্তির খেয়াল খুশী মতাে ঘটবে বা তাদের ফরমায়েশ অনুযায়ী তা প্রকাশ পাবে, যাতে করে পরকালীন জীবনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা তাদের পক্ষে সহজতর হয়। অথচ তাদের জানা উচিৎ যে, যতােক্ষণ পর্যন্ত চোখে না দেখেই এই অদৃশ্য বিষয়টি স্বীকার করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঈমানই পূর্ণতা লাভ করবে না। এই বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে প্রত্যেক নবী ও রসূল সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং নিজ নিজ জাতিকে অবহিত করেছেন। বিষয়টি বুঝতে হলে এই জীবনের প্রকৃতি ও তাৎপর্য বুঝতে হবে এবং কি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তায়ালা জীবন সৃষ্টি করেছেন, তা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে। এই গভীর চিন্তাই পরকালের বিশ্বাসের জন্যে যথেষ্ট এবং পুনরুত্থানের সত্যতার জন্যে যথেষ্ট। জীবন ও জগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে তাদেরকে চিন্তা ভাবনা করার নির্দেশ দেয়ার পূর্বে বিগত জাতিসমূহের পতনের ঘটনা উল্লেখ করে তাদের মনে একটা তীব্র ঝাকুনির সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর উপদ্বীপের হিময়ার সম্প্রদায়ভুক্ত রাজা বাদশাদের এসব করুণ ঘটনা যেহেতু তাদের জানা ছিলাে। তাই তাদেরকে অনুরূপ পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে এবং তাদের বিবেককে নাড়া দেয়ার লক্ষ্যে এখানে কেবল মূল ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওরা শ্রেষ্ঠ, না ‘তুব্বা’ সম্প্রদায় ও তাদের পূর্ববর্তীরা। আমি ওদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি। ওরা ছিলাে অপরাধী’ (আয়াত ৩৭) এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে যখন তাদের হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি হবে, তখনই তারা এই বিশ্বজগতের সৃষ্টি রহস্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংবেদনশীল মন নিয়ে চিন্তা করতে প্রস্তুত হবে। তখন তারা বিশ্বজগতের মাঝে এক অদ্ভূত শুংখলা লক্ষ্য করবে, এর পেছনে এক বিস্ময়কর নিয়মকে ক্রিয়াশীল পাবে। তাই তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আমি আসমান ও যমীন এবং এর মধ্যকার সবকিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এগুলাে যথাযথ উদ্দেশে সৃষ্টি করেছি…।'(আয়াত ৩৮-৪২) খুব কোমলভাবে এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আসমান যমীন ও এর মধ্যকার যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টির মাঝে এবং পুনরুত্থানের মাঝে একটা সুক্ষ্ম সম্পর্ক রয়েছে। আর মানুষ সেটাকে খুব সহজে তখনই অনুভব করতে পারে যখন তার সামনে বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করা হয়। আসলে মানুষ যখন গভীরভাবে বিশ্বজগতের সৃষ্টির পেছনে ক্রিয়াশীল রহস্য, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দৃশ্যমান শৃংখলা তলিয়ে দেখবে, যখন লক্ষ্য করবে যে, প্রতিটি বস্তুকে একটা নির্ধারিত পরিমাণে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে; যখন লক্ষ্য করবে আল্লাহর সৃষ্টি প্রতিটি বস্তু অন্যান্য সকল বস্তু ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সমন্বয় সাধন করে চলছে এবং যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সে তা পূরণ করে চলছে; যখন লক্ষ্য করবে যে, এই বিশাল জগতের ছােটো বড়াে কোনাে কিছুই দৈবক্রমে বা অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি, বরং এর প্রতিটির সৃষ্টির পেছনে এক গভীর রহস্য, সুক্ষ্ম তাৎপর্য এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে তখনই মানুষ বুঝতে পারবে এই সৃষ্টিজগত তাৎপর্যহীন নয়, উদ্দেশ্যহীন নয়; বরং এই গােটা সৃষ্টিজগত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, মিথ্যার ওপর নয়। এর সমাপ্তি আছে। তবে এর সময় এখনও আসেনি এবং এই গ্রহের সংক্ষিপ্ত যাত্রা শেষে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলেই এই জগতের সমাপ্তি ঘটবে না। সে আরও বুঝতে পারবে যে, পরকালের বিষয় এবং পরকালে হিসাব নিকাশের বিষয়টি সত্য ও অনিবার্য; নিছক যৌক্তিক দিক থেকেও সত্য। কারণ পরকাল না হলে জীবন ও জগত সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যই সাধিত হবে না। পার্থিব জীবনের ভালাে মন্দের হিসাব নিকাশ ও প্রতিদানের কাজ এই পরকালেই সম্পন্ন করা হবে, অন্য কোথাও নয়। পরকালের শাস্তি বা পুরস্কার মূলত ভাল ও মন্দকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ বা বর্জনের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হবে। অর্থাৎ ভাল বা মন্দের গ্রহণ বা বর্জনের সময় মানুষের চেষ্টা ও ইচ্ছার প্রকাশ এবং স্বেচ্ছায় দুটোর যে কোনাে একটির গ্রহণ বা বর্জনই হচ্ছে তার পরকালীন জীবনের পুরস্কার বা শান্তির মাপকাঠি। এই দ্বৈত যোগ্যতার মাধ্যমে মানব সৃষ্টি এবং আল্লাহর কর্মের উদ্দেশ্যহীনতার অস্বীকৃতিই প্রমাণ করে যে, মানুষের একটি নির্ধারিত পরিণতি আছে এবং এই পরিণতির দিকে সে তখনই অগ্রসর হবে যখন তার এই পার্থিব জীবনের যাত্রা সাংগ হবে। আর এটাই হচ্ছে পরকালের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাই বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় ফয়সালার দিন তাদের সবারই নির্ধারিত সময়…'(আয়াত ৪০-৪২), এই বক্তব্য খুবই সংগত এবং পূর্বে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে ওৎপ্রােতভাবে জড়িত। সাধারণ যুক্তির দাবী হচ্ছে এই যে, এমন একটি দিন নির্ধারিত হওয়া উচিৎ যেদিন সকল প্রাণীর বিচার হবে, হেদায়াত ও গােমরাহীর ফয়সালা হবে, সৎলােকদেরকে সম্মানিত করা হবে, অসৎ লােকদেরকে লাঞ্ছিত করা হবে, যেদিন মানুষ তার পার্থিব জীবনের সকল সহায় সম্বল হতে মুক্ত হবে, আত্মীয়তার সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হবে এবং সম্পূর্ণ একা একা নিজ প্রভুর দরবারে উপস্থিত হবে। তাঁর কাছ থেকে নিজেদের কৃতকর্মের ফল লাভ করবে। তাকে কেউ সাহায্য করতে আসবে না, কেউ দয়া করতে আসবে না। তবে সে সৎকর্মশীল হলে আপন প্রভুর কাছ থেকেই দয়া লাভ করবে, যে প্রভু মহা পরাক্রমশালী, ক্ষমতাধর, দয়ালু ও করুণাময়, যে প্রভুর হাতে তার জন্ম এবং সে প্রভুর হাতেই সে ফিরে এসেছে নিজের প্রাপ্য প্রতিদান গ্রহণ করতে। তাদের সৃষ্টি ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকু ছিলাে কর্মের ও পরীক্ষার।
** অবিশ্বাসীদের পরিণতি ও মােমেনদের সাফল্য : পরকালীন জীবন সম্পর্কিত এই মূলনীতিটি প্রতিষ্ঠিত করার পর এখন পরকালীন জীবনে সৎকর্মশীল ও পাপীরা কী পাবে বা ভােগ করবে সে দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে। এই দৃশ্য আলােচ্য সূরার মূল ভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, দৃশ্যটি আয়াতে এভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, ‘নিশ্চয় যাক্কুম বৃক্ষ পাপিষ্ঠদের খাদ্য হবে। গলিত তামার মতাে পেটে ফুটতে থাকবে, যেমন পানি ফুটে…।’(আয়াত ৪৩-৫৭) এখানে প্রথমেই যাক্কুম বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে এবং জানানাে হয়েছে যে, এটা পাপীষ্ঠদের খাদ্য হবে। এই খাদ্যের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা লােমহর্ষক ও ভীতিকর। বর্ণনা অনুযায়ী এই খাদ্য হবে গলিত ও ফুটন্ত তামার ন্যায় যা পেটের ভেতর গিয়ে জুলন্ত ডেগের ভেতর তেল যেমন টগবগ করে ফুটে সেভাবেই ফুটতে থাকবে। এই খাদ্য গ্রহণ করবে সেই পাপিষ্ঠরা যারা নিজেদের সৃষ্টিকর্তার ওপরে বড়াই করতো, তার সত্যনিষ্ঠ রসূলের ওপর বড়াই করতাে। তাই আজ তাদেরকে তাদের উপযুক্ত স্থানে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যে জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলা হচ্ছে, ‘একে ধর এবং টেনে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যস্থলে, অতপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও।’(আয়াত ৪৭-৪৮) অর্থাৎ এই পাপিষ্ঠকে ভালাে করে পাকড়াও করাে, শক্ত করে বেঁধে ফেলাে, নির্মমভাবে নিক্ষেপ করাে জাহান্নামে, আজ কোনাে দয়া নেই, মায়া নেই, কোনাে সম্মান নেই, এরপর ওর মাথায় ঢেলে দাও ফুটন্ত গরম পানি যা তার নাড়িভূড়ি জ্বালিয়ে দেবে, পুড়িয়ে দেবে। এই অসম্মান, এই শাস্তি এবং এই টানাহেঁচড়ার মধ্যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতাে করে বলা হচ্ছে, ‘স্বাদ গ্রহণ করাে, তুমিতাে (দুনিয়াতে ছিলে) সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত'(আয়াত ৪৯) এই হচ্ছে সম্মানহীন ও মর্যাদাহীন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির প্রাপ্য পুরস্কার। সম্মান ও মর্যাদার হকদার কেবলই আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল ও তার অনুসারীরা। এরপর বলা হচ্ছে, ‘এ সম্পর্কে তোমরা সন্দেহে লিপ্ত ছিলে…।’ অর্থাৎ এই পরকাল সম্পর্কে তােমরা সংশয় সন্দেহে ভুগতে এবং এ নিয়ে হাসি তামাশা করতে। একদিকে এই ধর পাকড়, টানা হেঁচড়া, দাহন পােড়ান এবং ভর্ৎসনা গঞ্জনা, অপরদিকে ভিন্নতর এক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। এই দৃশ্যের চরিত্রে রয়েছে সংকর্মশীল ও আল্লাহভীরু লােকজন। এরা তারা, যারা পরকালকে বিশ্বাস করতাে এবং ভয় করতাে। আজ তারা নিরাপদ স্থানে রয়েছে। এখানে ভয় নেই, ভীতি নেই, টানা হেঁচড়া নেই, ধর পাকড় নেই এবং নেই দহন ও পােড়ন। এখানে তারা অত্যন্ত আরামে আয়েশে আছে। উদ্যানের মাঝে হুর পরিবেষ্টিত অবস্থায় আছে। তারা চিকন ও পুরু রেশমীবস্ত্র পরিধান করেছে। মুখোমুখি বসে আলাপচারিতায় মগ্ন। সুনয়না হুররা তাদের সংগী হিসেবে তাদের পাশেই রয়েছে। তারা জান্নাতে বড় বড় অট্টালিকার মালিক। হুকুম করলেই যা চায় তা পাচ্ছে। সেখানে নিরাপদে বিভিন্ন ফলমূল ভক্ষণ করবে। তাদের এসব নেয়ামত কখনও শেষ হবে না। তাদের কোনো মৃত্যু হবে না। তাদের প্রথম মৃত্যুই শেষ মৃত্যু। এরপর আর কোনাে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে না। (এই বক্তব্য মােশরেকদের সেই বক্তব্যের বিপরীতে এসেছে যে বক্তব্যের ভাষা ছিলাে এই ‘আমাদের মৃত্যু একবারই হবে এবং আমরা পুনরুত্থিত হব না…।’ নিশ্চয়ই মৃত্যু মানুষের জীবনে একবারই আসে। কিন্তু এই মৃত্যুর পর জান্নাত-জাহান্নামও আছে। আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে তাঁর এ সকল প্রিয় বান্দাকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে জাহান্নামের আযাব থেকে কেউ রেহাই পাবে না। তাই এটাকে মহা সাফল্য বলা হয়েছে। এই পরস্পর ভিন্নমুখী দুটো ভয়াল ও মর্মস্পর্শী দৃশ্যের পর আলােচ্য সূরার সমাপ্তি ঘটছে রেসালাত ভিত্তিক নেয়ামতের স্মরণ এবং এর অস্বীকৃতির পরিণতি সম্পর্কে সতর্কীকরণের মাধ্যমে। বলা হচ্ছে, ‘আমি তােমার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ রাখে। অতএব তুমি অপেক্ষা করাে, তারাও অপেক্ষা করছে।’(আয়াত ৫৮-৫৯)। এই উপসংহারে আলােচ্য সূরার মূল বক্তব্যটির সারমর্ম বর্ণিত হয়েছে। সূরার সূচনা ও প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে এর সামঞ্জস্য রয়েছে। সূরার সূচনা হয়েছিলাে কিতাবের অবতরণ, সতর্কীকরণ ও স্মরণের মধ্য দিয়ে, পরবর্তী গভীর পর্যায়ে অবিশ্বাসীদের পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যেদিন আমি প্রবলভাবে পাকড়াও করবাে, সেদিন পুরােপুরি প্রতিশােধ গ্রহণ করবই’ আর উপসংহারে আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে রসূলের মাতৃভাষায় সহজ ও বােধগম্য করে এই কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে বলে জানানাে হচ্ছে। এটাকে নেয়ামত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ এর ফলে মানুষ কোরআনকে বুঝতে পারে, এর মর্ম অনুধাবন করতে পারে। এরই সাথে সাথে তাদেরকে পরােক্ষভাবে শেষ পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘তুমি অপেক্ষা করাে, তারাও অপেক্ষা করছে।’

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# প্রথমবার মরার পরই আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। তারপর আর কোন জীবন নেই। ‘প্রথম মৃত্যু’ কথা দ্বারা একথা বুজায় না যে, এরপর আরো মৃত্যু আছে। আমরা যখন বলি, অমুক ব্যক্তির প্রথম সন্তান জন্ম নিয়েছে তখন একথা সত্য হওয়ার জন্য জরুরী নয় যে, এরপর অবশ্যই তার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেবে। একথার অর্থ হচ্ছে, এর পূর্বে তার কোন সন্তান হয়নি।
# তাদের যুক্তি ছিল এই যে, মৃত্যুর পর আমরা কখনো কাউকে পুনরায় জীবিত হতে দেখিনি। তাই আমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি মৃত্যুর পরে আর কোন জীবন হবে না। তোমরা যদি দাবী করো, মৃত্যুর পর আরেকটি জীবন হবে তাহলে আমাদের বাপ-দাদাদের কবর থেকে উঠিয়ে আন যাতে মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তোমরা যদি তা না করো তাহলে আমরা মনে করবো তোমাদের দাবী ভিত্তিহীন। তাদের মতে এটা যেন মৃত্যুর পরের জীবনকে অস্বীকার করার মজবুত প্রমাণ। অথচ এটি একেবারেই নিরর্থক কথা। কে তাদেরকে একথা বলেছে যে, মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে আবার এই দুনিয়াতেই ফিরে আসবে? নবী ﷺ বা অন্য কোন মুসলমান কবে এ দাবী করেছিল যে, আমরা মৃতদের জীবিত করতে পারি?
# হিময়ার গোত্রের বাদশাহদের উপাধি ছিল তুব্বা যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাদশাহদের উপাধি ছিল কিসরা, কায়সার, ফেরাউন প্রভৃতি। তুব্বা কওম সাবা কওমের একটি শাখার সাথে সম্পর্কিত ছিল। খৃস্টপূর্ব ১১৫ সনে এরা সাবা দেশটি দখল করে এবং ৩০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তা শাসন করে। শত শত বছর ধরে আরবে এদের শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী সবার মুখে মুখে ছিল (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবা, টীকা ৩৭)।
# এটা কাফেরদের আপত্তির প্রথম জবাব। এ জবাবের সারকথা হচ্ছে, আখেরাত অস্বীকৃতি এমনই জিনিস যাকোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতিকে অপরাধী না বানিয়ে ছাড়ে না। নৈতিক চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া এর অনিবার্য ফল। মানবেতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জাতিই জীবন সম্পর্কে এই মতবাদ গ্রহণ করেছে পরিণামে সে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন বাকি থাকে এই প্রশ্নটির ব্যাখ্যা যে, এরাই উত্তম না তুব্বা কওম এবং তাদের পূর্ববর্তী লোকেরা? এর অর্থ হচ্ছে তুব্বা কওম তার পূর্বের সাবা ও ফেরাউনের কওম এবং আরো অন্য কওম যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং গৌরব ও শান-শওকত অর্জন করেছিলো মক্কার এই কাফেররা তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু এই বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং পার্থিব গৌরব ও জাঁকজমক নৈতিক অধঃপতনের ভায়াবহ পরিণাম থেকে কবে তাদের রক্ষা করতে পেরেছিলো যে, তারা নিজেদের সামান্য পুঁজি এবং উপায়-উপকরণের জোরে তা থেকে রক্ষা পাবে? (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবা, টীকা ২৫ ও ৩৬ )।
# এটা তাদের আপত্তির দ্বিতীয় জবাব। এর সারমর্ম হচ্ছে, যে ব্যক্তিই মৃত্যুর পরের জীবন এবং আখেরাতের প্রতিদান ও শাস্তিকে অস্বীকার করে প্রকৃতপক্ষে সে এই বিশ্ব সংসারকে খেলনা এবং তার স্রষ্টাকে নির্বোধ শিশু মনে করে। তাই সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, মানুষ এই পৃথিবীতে সব কিছু করে একদিন এমনি মাটিতে মিশে যাবে এবং তার ভাল বা মন্দ কাজের কোন ফলাফল দেখা দেবে না। অথচ এই বিশ্বজাহান কোন খেলোয়াড়ের সৃষ্টি নয়, এক মহাজ্ঞানী স্রষ্টার সৃষ্টি। মহাজ্ঞানী সত্তা কোন অর্থহীন কাজ করবেন তা আশা করা যায় না। আখেরাত অস্বীকৃতির জবাবে কুরআনের বেশ কয়েকটি স্থানে এই যুক্তি পেশ করা হয়েছে এবং আমরা তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও পেশ করেছি (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আনয়াম, টীকা ৪৬ ; ইউনুস, টীকা ১০ ও ১১ ; আল আম্বিয়া, টীকা ১৬ ও ১৭ ; আল মু’মিনুন, টীকা ১০১ ও ১০২ ; আর রূম, টীকা ৪ থেকে ১০ )।
# এটা তাদের এই দাবীর জবাব যে, যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আমাদের বাপ-দাদাদের জীবিত করে আনো। অর্থাৎ মৃত্যুর পরের জীবন কোন তামাশা নয় যে, যেখানেই কেউ তা অস্বীকার করবে তখনি কবরস্থান থেকে একজন মৃতকে জীবিত করে তাদের সামনে এনে হাজির করা হবে। বিশ্বজাহানের রব এ জন্য একটি সময় বেঁধে দিয়েছেন। সেই সময় তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের সবাইকে পুনরায় জীবিত করে তাঁর আদালতে সমবেত করবেন এবং তাদের মোকদ্দমার রায় ঘোষণা করবেন। তোমরা বিশ্বাস করলে তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণ হবে। কারণ, এভাবে সময় থাকতেই সতর্ক হয়ে ঐ আদালতে সফলকাম হওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারবে। বিশ্বাস না করলে নিজেদেরই ক্ষতি করবে। কারণ সে ক্ষেত্রে এই ভুলের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করবে যে ভাল-মন্দ যাই আছে এই দুনিয়া পর্যন্তই তা সীমাবদ্ধ। মৃত্যুর পর কোন আদালত হবে না যেখানে আমাদের ভাল অথবা মন্দ কাজকর্মের স্থায়ী কোন ফল থাকতে পারে।
# মূল আয়াতে مَوْلًى শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বলা হয়, যে কোন সম্পর্কের কারণে অন্যকোন ব্যক্তিকে সহযোগিতা করে। সেই সম্পর্ক আত্মীয়তার সম্পর্ক হোক কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হোক অথবা অন্য কোনো প্রকারের সম্পর্ক হোক তা দেখার বিষয় নয়।
# ফায়সালার দিন যে আদালত কায়েম হবে তা কেমন প্রকৃতির হবে সে কথা এই আয়াতাংশ গুলোতে বলা হয়েছে। সেদিন কারো সাহায্য-সহযোগিতা কোন অপরাধীকে রক্ষা করতে কিংবা তার শাস্তি হ্রাস করতে পারবে না। নিরংকুশ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সত্যিকার সে বিচারকের হাতে থাকবে যার সিদ্ধান্ত কার্যকরী হওয়া রোধ করার শক্তি কারো নেই এবং যার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও কারো নেই। তিনি দয়াপরবশ হয়ে কাকে শাস্তি দিবেন না আর কাকে কম শাস্তি দিবেন এটা সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিজের বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে। ইনসাফ করার ক্ষেত্রে তিনি দয়ামায়াহীনতা নয় বরং দয়া ও করুণা প্রদর্শন করেন এবং এটাই তাঁর নীতি। কিন্তু যার মোকদ্দমায় যে ফায়সালাই তিনি করবেন তা সর্বাবস্থায় অবিকল কার্যকর হবে। আল্লাহর আদালতের এই অবস্থা বর্ণনা করার পর যারা ঐ আদালতে অপরাধী প্রমাণিত হবে তাদের পরিণাম কি হবে এবং যাদের সম্পর্কে প্রমাণিত হবে, তারা পৃথিবীতে আল্লাহকে ভয় করে তার অবাধ্যতা থেকে বিরত থেকেছে তাদেরকে কি কি পুরস্কারে ভূষিত করা হবে ছোট ছোট কয়েকটি বাক্যে তা বলা হয়েছে।
# মূল আয়াতে المُهْلِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার কয়েকটি অর্থ আছেঃ গলানো ধাতু, পুঁজ, রক্ত, গলানো আলকাতরা, লাভা এবং তেলের তলানি। আরবী ভাষাভাষী এবং মুফাসসিরগণ এই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন। আমাদের দেশে যাকে ফনীমনসা বলা হয় ‘যাককুম’ বলতে যদি সেই জিনিসকেই বুঝানো হয়ে থাকে তাহলে তা চিবালে যে রস নির্গত হবে তা তেলের তলানির সাথে বেশী সার্দশ্য পূর্ণ হবে।
# শান্তি ও নিরাপত্তার জায়গা অর্থ এমন জায়গা যেখানে কোনো প্রকারআশঙ্কা থাকবে না। কোন দুঃখ, অস্থিরতা, বিপদ,আশঙ্কা এবং পরিশ্রম ও কষ্ট থাকবে না। হাদীসে আছে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “জান্নাতবাসীদের বলে দেয়া হবে, তোমরা এখানে চিরদিন সুস্থ থাকবে, কখনো রোগাক্রান্ত হবে না, চিরদিন জীবিত থাকবে, কখনো মরবে না, চিরদিন সুখী থাকবে, কখনো দুর্দশাগ্রস্ত হবে না এবং চিরদিন যুবক থাকবে, কখনো বৃদ্ধ হবে না।” (মুসলিম-আবু হুরাইরা ও আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিত হাদীস)।
# মূল আয়াতে سُنْدُسٍ ও إِسْتَبْرَقٍ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় সূক্ষ্ম রেশমী কাপড়কে سُنْدُسٍ বলে। إِسْتَبْرَقٍ ফারসী শব্দ এর আরবী রূপ। মোটা রেশমী কাপড় বুঝাতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
# মূল শব্দ হচ্ছে بِحُورٍ عِينٍ । حور শব্দটি حَوْرَاء শব্দের বহুবচন। আরবী ভাষায় সুন্দরী নারীকে حَوْرَاء বলা হয়। عَيْنٌ শব্দটি عيناء শব্দের বহুবচন। এ শব্দটি বড় চোখ বিশিষ্ট নারীদের বুঝাতে ব্যবহার হয়। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, সূরা সাফফাত, টীকা ২৬ ও ২৯)।
# ‘নিশ্চিন্তে মনের সুখে’ চাওয়ার অর্থ যে জিনিস যত পরিমাণে ইচ্ছা দ্বিধাহীনভাবে জান্নাতের খাদেমদেরকে তা আনার নির্দেশ দেবে এবং তা এনে হাজির করা হবে। দুনিয়াতে হোটেল তো দূরের কথাকোন ব্যক্তি নিজের বাড়িতেও এরূপ নিশ্চিন্তে ও মনের সুখে কোন কিছু এমনভাবে চাইতে পারে না যেমন সে জান্নাতে চাইবে। কারণ, এখানে কারো কাছেই কোন জিনিসের অফুরন্ত ভাণ্ডার থাকে না এবং ব্যক্তি যাই ব্যবহার করে তার মূল্য তাকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। জান্নাতে সম্পদ হবে আল্লাহর এবং ব্যক্তিকে তা ব্যবহারের অবাধ অনুমতি দেয়া হবে। কোন জিনিসের ষ্টক শেষ হয়ে যাওয়ার বিপদ যেমন থাকবে না তেমনি পরে বিল আসারও কোন প্রশ্ন থাকবে না।
# এ আয়াতে দু’টি বিষয় লক্ষণীয়ঃ

এক-জান্নাতের নিয়ামত সমূহের উল্লেখ করার পর জাহান্নাম থেকে রক্ষা করার কথা আলাদা করে বিশেষভাবে বলা হয়েছে। অথচকোন ব্যক্তির জান্নাত লাভ করাই আপনা আপনিই তার জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়াকে অনিবার্য করে তোলে। এর কারণ, মানুষ আনুগত্যের পুরস্কারে মূল্য পুরোপুরি তখনই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যখন নাফরমানিতে লিপ্ত হয়ে সে কোথায় পৌঁছেছে এবং কোন্ ধরনের মন্দ পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়েছে তা তার সামনে থাকে।

দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, এ লোকদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়া এবং জান্নাত লাভ করাকে আল্লাহ‌ তাঁর দয়ার ফলশ্রুতি বলে আখ্যায়িত করছেন। এর দ্বারা মানুষকে এই সত্য সম্পর্কে অবহিত করা উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর অনুগ্রহ না হওয়া পর্যন্তকোন ব্যক্তির ভাগ্যেই এই সফলতা আসতে পারে না। ব্যক্তি তার সৎকর্মের পুরস্কার লাভ করবে। কিন্তু প্রথমত আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া ব্যক্তি তার সৎকর্ম করার তাওফীক বা সামর্থ্য কিভাবে লাভ করবে। তাছাড়া ব্যক্তি দ্বারা যত উত্তম কাজই সম্পন্ন হোক না কেন তা পূর্ণাঙ্গ ও পূর্ণতর হতে পারে না। সুতরাং সে কাজ সম্পর্কে দাবী করে একথা বলা যাবে না যে তাতে কোন ত্রুটি বা অপূর্ণতা নেই। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যে তিনি বান্দার দুর্বলতা এবং তার কাজকর্মের অপূর্ণতাসমূহ উপেক্ষা করে তার খেদমত কবুল করেন এবং তাকে পুরস্কৃত করে ধন্য করেন। অন্যথায়, তিনি যদি সূক্ষ্মভাবে হিসেব নিতে শুরু করেন তাহলে কার এমন দুঃসাহস আছে যে নিজের বাহুবলে জান্নাত লাভ করার দাবী করতে পারে? হাদীসে একথাই রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ

اعْلَمُوا وَسَدِّدُوا وقَارِبُوا وَاعْلَمُوا أَنَّ أَحَداً لَنْ يَدْخُلُه عَمَلُه الْجَنّة“আমল করো এবং নিজের সাধ্যমত সর্বাধিক সঠিক কাজ করার চেষ্টা করো। জেনে রাখো,কোন ব্যক্তিকে শুধু তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না।”

লোকেরা বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, আপনার আমলও কি পারবে না? তিনি বললেনঃ

ولا انا الا ان يتغمدنى الله برحمته

“হাঁ, আমিও শুধু আমার আমলের জোরে জান্নাতে যেতে পারবো না। তবে আমার রব যদি তাঁর রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছাদিত করেন।”
# এখন যদি এসব লোক উপদেশ গ্রহণ না করে তাহলে দেখো, কিভাবে তাদের দুর্ভাগ্য আসে। আর তোমার এই দাওয়াতের পরিণাম কি হয় তা দেখার জন্য এরাও অপেক্ষমান।

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৪-৩৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যারা বিচার দিবসকে অস্বীকার করে এবং বলে যে, আমাদের প্রথম মৃত্যুই (দুনিয়ার জীবন শেষে মৃত্যু) শেষ আর আমাদেরকে জীবিত করা হবে না, তারা বলে- যদি পুনরায় জীবিত করা হয় তাহলে আমাদের বাপদাদা যারা মারা গেছে তাদের নিয়ে আসো। তাদের কথার জবাবস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা “তুব্বা” সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন যে, তারা ছিল মক্কার কুরাইশদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। কিন্তু তারাও তাদের অবাধ্যতার কারণে এ শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি। আর তাদের তুলনায় মক্কার কুরাইশরা তো সামান্য একটি দল মাত্র।

কুরআনে দুজায়গায় তুব্বার উল্লেখ রয়েছে- এখানে এবং সূরা ক্বাফে। কিন্তু উভয় জায়গায় কেবল নামই উল্লেখ করা হয়েছে- বিস্তারিত কোন ঘটনা বিবৃত হয়নি। তাই এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। মূলত তুব্বা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নয়, বরং এটা ইয়ামানের হিমইয়ারী সম্রাটের উপাধি বিশেষ। যেমন পারস্যের বাদশাকে কিসরা, রোমের বাদশাদেরকে কায়সার, মিশরের বাদশাদেরকে ফির‘আউন এবং হাবশা অর্থাৎ ইথিওপিয়ার রাজাদেরকে নাজ্জাসী বলা হত। তারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইয়ামানের পশ্চিমাংশকে রাজধানী বানিয়ে আরব, শাম, ইরাক আফ্রিকার কিছু অংশ শাসন করেছিল।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা তুব্বাকে গালি দিও না। কারণ তিনি মু’মিন ছিলেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৪৩৩) এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, তুব্বা কোন ব্যক্তির নাম যিনি মু’মিন ছিলেন। মোটকথা তারা কালক্রমে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয়ে যায়, মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজা শুরু করে ফলে আল্লাহ তা‘আলা আযাব দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. প্রত্যেক মানুষকেই মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করা হবে।
২. যে যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন তাকে মৃত্যু বরণ করতেই হবে এবং তার কর্মের ফল তাকে ভোগ করতেই হবে।
৩৮-৪২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহ, জমিন এবং এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে তা অনর্থক সৃষ্টি করেননি বরং এগুলো যথাযথ কারণেই সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা আস্ সোয়াদ-এর ২৭ নম্বর আয়াতসহ আরো অন্যান্য স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, বিচার দিবসে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন কেউ কারো কোন প্রকার উপকারে আসবে না। সেদিন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَلَآ أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَّلَا يَتَسَا۬ءَلُوْنَ‏)‏

“এবং যেদিন শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে সেদিন পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না, এবং একে অপরের খোঁজ-খবর নেবে না” (সূরা মু’মিনূন ২৩ : ১০১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَلَا يَسْأَلُ حَمِيْمٌ حَمِيْمًا)

“আর কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুর খোঁজ নেবে না” (সূরা মা‘আরিজ ৭০ : ১০)

তবে যার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার করুণা হবে অর্থাৎ যারা ঈমানদার ও মুত্তাকী হবে তাদের কথা ভিন্ন। তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে তাঁর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করতে পারবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আকাশ, জমিনসহ সকল বস্তু আল্লাহ তা‘আলা যথাযথ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন।
২. পরকালে কাফির-মুশরিকদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, তবে মু’মিনদের কথা ভিন্ন।
৪৩-৫০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে বিচার দিবসে কাফিরদের অবস্থা এবং তাদেরকে তাদের অপরাধের কারণে যে শাস্তি প্রদান করা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যারা দুনিয়াতে কুফরী করত, আল্লাহ তা‘আলাকে অন্যের সাথে শরীক করত, পরকালে তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী, তাদের জন্য জাহান্নামে খাদ্য হিসেবে থাকবে যাক্কুম বৃক্ষ, তা তাদের পেটে গলিত তামার মতো ফুটতে থাকবে। আর পানীয় হিসেবে তাদের জন্য থাকবে গরম পানি যা তাদের নাড়ী-ভূড়িকে গলিয়ে দেবে। আর জাহান্নামে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের মাথায় ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হবে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

‏ (يُصَبُّ مِنْ فَوْقِ رُؤُوْسِهِمُ الْحَمِيْمُ يُصْهَرُ بِه۪ مَا فِيْ بُطُوْنِهِمْ وَالْجُلُوْدُ)

“তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেয়া হবে ফুটন্ত‎ পানি, যা দ্বারা তাদের উদরে যা আছে তা এবং তাদের চর্ম বিগলিত করা হবে।” (সূরা হাজ্জ ২২ : ১৯-২০)

তাদেরকে তথায় এ সকল খাদ্য দিয়ে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করণার্থে বলা হবে যে, এগুলোর স্বাদ আস্বাদন করো, তুমিতো দুনিয়াতে ছিলে সম্মানিত ও অভিজাত। সুতরাং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। এ সম্পর্কে পূর্বে আরো অনেক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং কোন ব্যক্তির ঈমান না থাকলে দুনিয়াবী প্রভাব-প্রতিপত্তি কোন কাজে আসবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যাক্কুম বৃক্ষ হলো জাহান্নামীদের এক প্রকার কন্টকাকীর্ণ খাবার, আর পানীয় হিসেবে থাকবে তথায় গরম পানি।
২. অপরাধী ছোট হোক আর বড় হোক অপরাধ করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে।
৫১-৫৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

জাহান্নামীদের দুর্দশা বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বর্ণনা নিয়ে এসেছেন। যারা মুত্তাক্বী, পরহেযগার ও সৎ আমলকারী তারা কিয়ামতের দিন জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা সেখানে নিরাপদে অবস্থান করবে। কোন প্রকার বিপদ তাদেরকে পাকড়াও করবে না। তারা থাকবে বাগানসমূহে ও ঝর্ণারাজিতে আর তারা পরিধান করবে মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং পরস্পর মুখোমুখি হয়ে বসবে। আর সেখানে তাদেরকে বিবাহ দেয়া হবে হুরদের সাথে। তারা তথায় ইচ্ছা অনুপাতে ফলমূল ভক্ষণ করবে, যা প্রয়োজন হবে তাই পাবে, কোন কিছুর ঘাটতি সেখানে থাকবে না। আর তারা

الْمَوْتَةَ الْأُوْلٰ

তথা দুনিয়ার মৃত্যু ব্যতীত অন্য দ্বিতীয় কোন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে না।

আর সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো যে, তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করা হবে। এ সকল কিছুই মহান আল্লাহর অনুগ্রহ মাত্র। মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সাধারণত ছয়টি- (১) উত্তম আবাসস্থল, (২) উত্তম পোশাক, (৩) উত্তম জীবনসঙ্গিণী, (৪) সুস্বাদু খাবার, (৫) এসব নেয়ামতের স্থায়ীত্বের নিশ্চয়তা এবং (৬) দুঃখ-কষ্ট থেকে পূর্ণরূপে নিরাপদ থাকার আশ্বাস। জান্নাতীদের জন্য জান্নাতে এ ছয়টি বস্তুই থাকবে।

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : এ কথা জেনে নাও যে, তোমাদের মধ্যে কাউকেও তার আমল জান্নাতে নিয়ে যাবে না। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনাকেও না? উত্তরে তিনি বললেন : হ্যাঁ, আমাকেও নয়। তবে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তাঁর দয়ায় ও অনুগ্রহে আচ্ছাদিত করে নেবেন। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৬৩, সহীহ মুসলিম হা. ২৮১৮)

সুতরাং জাহান্নাম থেকে বাঁচার ও জান্নাত লাভের জন্য আমাদের অসৎ কর্ম বর্জন করে বেশি বেশি সৎ কর্ম করা উচিত।

(فَإِنَّمَا يَسَّرْنٰهُ بِلِسَانِكَ)

অর্থাৎ কুরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করে বুঝতে সহজ করে দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ) ‏

“কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?” (সূরা কামার ৫৪ : ১৭)

(فَارْتَقِبْ) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে কল্যাণ ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন তার জন্য ধৈর্য ধারণ করুন, আর কাফিরদের জন্য যে শাস্তির প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে তার জন্য তারাও অপেক্ষা করুক।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. জান্নাতীরা আরাম-আয়েশের সাথে জান্নাতে থাকবে ।
২. কোন ব্যক্তিই আমলের বিনিময়ে জান্নাতে যেতে পারবে না, যদি আল্লাহ তা‘আলা রহম না করেন।
৩. কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে যাতে সহজে বুঝা যায়।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩৪-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের কিয়ামতকে অস্বীকারকরণ এবং এর দলীলের বর্ণনা দেয়ার পর এটাকে খণ্ডন করেন। তাদের ধারণা ছিল এই যে, কিয়ামত হবে না এবং মৃত্যুর পর পুনর্জীবনও নেই। আর হাশর নশর ইত্যাদি সবই মিথ্যা। তারা দলীল এই পেশ করে যে, তাদের পিতা-মাতা তো মারা গেছে, তারা জীবিত হয়ে পুনরায় ফিরে আসে না কেন?

তাদের এই দলীল কতইনা বাজে, অর্থহীন এবং নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ! পুনরুত্থান ও মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ এটা তো হবে কিয়ামতের সময়। এর অর্থ এটা নয় যে, জীবিত হয়ে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসবে। ঐদিন এই যালিমরা জাহান্নামের ইন্ধন হবে। ঐ সময় উম্মতে মুহাম্মাদ (সঃ) পূর্বের উম্মতদের উপর সাক্ষী হবে এবং তাদের উপর তাদের নবী (সঃ) সাক্ষী হবেন।

এরপর আল্লাহ তা’আলা এদেরকে ভীতি প্রদর্শন করছেন যে, এদের এই পাপেরই কারণে এদের পূর্ববর্তীদের উপর যে শাস্তি এসেছিল ঐ শাস্তিই না জানি হয় তো এদের উপরও এসে পড়বে এবং তাদের ন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের ঘটনাবলী সূরায়ে সাবার মধ্যে গত হয়েছে। তারা ছিল কাহতানের আরব এবং এরা হলো আদনানের আরব।

সাবার হুমায়েরগণ তাদের বাদশাহকে ‘তুব্বা বলতো, যেমন পারস্যের বাদশাহকে ‘কিসরা’, রোমের বাদশাহকে কায়সার, মিসরের বাদশাহকে ফিরাউন’ এবং হাবশের বাদশাহকে নাজ্জাসী’ বলা হতো। তাদের মধ্যে একজন তুব্বা ইয়ামন হতে বের হয় এব চরণ করতে থাকে। সে সমরকন্দে পৌছে যায় এবং সব দেশের বাদশাদেরকে পরাজিত করতে থাকে এবং নিজের সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে। নিজ সেনাবাহিনী এবং অসংখ প্রজা তাঁর অধীনস্থ ছিল। সে-ই হীরা নামক শহরটি স্থাপন করে। তার যুগে সে মদীনাতেও এসেছিল। তথাকার অধিবাসীদের সাথে সে যুদ্ধও করেছিল। কিন্তু জনগণ তাকে বাধা দেয়। মদীনাবাসীরা তার সাথে এই আচরণ করে যে, দিনে তার সাথে যুদ্ধ করতো, আবার রাত্রে তার মেহমানদারী করতো। শেষে সেও লজ্জা পায় এবং যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। তথাকার দু’জন ইয়াহুদী আলেম তার সঙ্গী হয়েছিলেন যারা হযরত মূসা (আঃ)-এর সত্য দ্বীনের উপর ছিলেন। তাঁরা সদা-সর্বদা তাকে ভাল-মন্দ সম্পর্কে উপদেশ দিতে থাকতেন। তারা তাকে বলেনঃ “আপনি মদীনা ধ্বংস করতে পারেন না। কেননা, এটা হলো শেষ নবীর হিজরতের জায়গা।” সুতরাং সে সেখান হতে ফিরে যায় এবং ঐ দু’জন আলেমকেও সঙ্গে নেয়। যখন সে মক্কায় পৌঁছে তখন সে বায়তুল্লাহ শরীফকে ভেঙ্গে দেয়ার ইচ্ছা করে। কিন্তু ঐ দু’জন আলেম তাকে ঐ কাজ হতে বিরত রাখেন এবং ঐ পবিত্র ঘরের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কথা তার সামনে পেশ করেন। তারা তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, এ ঘরের ভিত্তি স্থাপনকারী ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) এবং শেষ নবী। (সঃ)-এর হাতে এ ঘরের মূল শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মান প্রকাশ পাবে। ঐ বাদশাহ তুব্বা তাদের এ কথা শুনে স্বীয় সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে। এমনকি নিজেই সে বায়তুল্লাহ শরীফের খুব সম্মান করে, ওর তাওয়াফ করে এবং ওর উপর গেলাফ চড়িয়ে দেয়। অতঃপর সে সেখান হতে ইয়ামনে ফিরে যায়। স্বয়ং সে হযরত মূসা (আঃ)-এর ধর্মে প্রবেশ করে এবং সমগ্র ইয়ামনে এ ধর্মই ছড়িয়ে দেয়। তখন পর্যন্ত হযরত ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাব ঘটেনি এবং ঐ যুগের লোকদের জন্যে হযরত মূসা (আঃ)-এর ঐ সত্য ধর্মই পালনীয় ছিল। ঐ তুব্বা বাদশাহর ঘটনা সীরাতে ইবনে ইসহাকের মধ্যে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং হাফিয় ইবনে আসাকিরও (রঃ) স্বীয় কিতাবে সুদীর্ঘভাবে আনয়ন করেছেন। তাতে রয়েছে যে, ঐ তুব্বার সিংহাসন দামেস্কে ছিল। তার সেনাবাহিনীর সারি দামেস্ক হতে ইয়ামন পর্যন্ত পৌঁছেছিল।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “(অপরাধীকে) হদ লাগানো বা নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের পর ঐ শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয়ে যায় কি-না তা আমি জানি না, আর তুব্বা (বাদশাহ) অভিশপ্ত ছিল কি-না সেটাও আমার জানা নেই এবং যুলকারনাইন নবী ছিল কি বাদশাহ ছিল এখবরও আমি রাখি না। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, নবী (সঃ) এ কথাও বলেনঃ “হযরত উযায়ের নবী ছিল কি-না এটাও আমি জানি না।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ইমাম দারকুতনী (রঃ) বলেন যে, এ হাদীসটি শুধু আবদুর রাযযাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন। অন্য সনদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত উযায়ের নবী ছিলেন কি-না তা আমার জানা নেই এবং তুব্বার উপর লা’নত করা হয়েছে কি-না এটাও আমি জানি না।” এ হাদীসটি আনয়নের পর হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) ঐ দু’টি রিওয়াইয়াত এনেছেন যাতে তুব্বাকে গালি দিতে ও লা’নত করতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন আমরাও বর্ণনা করবো ইনশাআল্লাহ। জানা যাচ্ছে যে, সে পূর্বে কাফির ছিল এবং পরে মুসলমান হয়েছিল, অর্থাৎ হযরত মূসা (আঃ)-এর দ্বীনে প্রবেশ করেছিল। ঐ যুগের আলেমদের হাতে সে ঈমান ককূল করেছিল। এটা হযরত ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বের ঘটনা। জুরহুমের যুগে সে বায়তুল্লাহর হজ্ব করেছিল এবং বায়তুল্লাহর উপর গেলাফও উঠিয়েছিল। এইভাবে সে বায়তুল্লাহ শরীফের প্রতি অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করেছিল। আল্লাহর নামে সে ছয় হাজার উট কুরবানী করেছিল। আরো খুব দীর্ঘ ঘটনা রয়েছে যা হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। মূল ঘটনার স্থিতি হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-এর উপর নির্ভরশীল। অহাব ইবনে মুনাব্বাহও (রঃ) এ কাহিনী এনেছেন! হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) এই তুব্বার কাহিনীর সাথে অন্য তুব্বার কাহিনীও মিলিয়ে দিয়েছেন যে এর বহু পরে ছিল। এই তুব্বার কওম তো এর হাতে মুসলমান হয়েছিল। এর ইন্তেকালের পর তারা কুফরীর দিকে পুনরায় ফিরে যায় এবং আবার আগুনের ও মূর্তির পূজা শুরু করে দেয়। যেমন এটা সূরায়ে সাবায় বর্ণিত হয়েছে। ওর তাফসীরে আমরাও সেখানে এর পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।

হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ) বলেন যে, এই ঠুব্বা কা’বার উপর গেলাফ চড়িয়েছিল। হযরত সাঈদ (রঃ) জনগণকে বলতেনঃ “তোমরা তুব্বাকে মন্দ বলো না।’ এ হলো মাঝামাঝির তুব্বা। তার নাম ছিল আসআদ আবু কুরায়েব ইবনে মুলাইকারব ইয়ামানী। তার রাজত্ব তিনশ’ ছাব্বিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তখনকার রাজাদের মধ্যে কেউই তার মত এতো দীর্ঘস্থায়ী রাজত্ব পায়নি। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নবুওয়াতের প্রায় সাতশ’ বছর পূর্বে সে মারা যায়। ঐতিহাসিকরা এটাও বর্ণনা করেছেন যে, মদীনা নগরী শেষ নবী (সঃ)-এর হিজরতের জায়গা হওয়ার কথা যখন মদীনাবাসী ঐ দু’জন আলেম তাকে নিশ্চিতরূপে জানিয়ে দেন তখন সে একটি কবিতা রচনা করে এবং আমানত হিসেবে মদীনাবাসীর কাছে তা রেখে যায়। আর ওটা উত্তরাধিকার সূত্রে পরস্পর হস্তান্তর হতে থাকে। সনদসহ ওর রিওয়াইয়াত বরাবরই আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হিজরতের সময় ওর হাফিয ছিলেন হযরত আবু আইয়ুব খালেদ ইবনে যায়েদ (রাঃ)! ঘটনাক্রমে, বরং আল্লাহর নির্দেশক্রমে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর অবতরণস্থল হয়েছিল তার বাড়ীটিই। কবিতার পংক্তিগুলো নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত আহমাদ (সঃ) ঐ আল্লাহর রাসূল যিনি সমস্ত প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা। আমি যদি তার যুগ পর্যন্ত জীবিত থাকি তবে অবশ্যই তাঁর মন্ত্রী ও তার চাচাতো ভাই হিসেবে থাকবো (এবং তাঁকে সাহায্য করবো)। আর আমি তার শত্রুদের বিরুদ্ধে তরবারী দ্বারা জিহাদ করবো এবং তার অন্তর হতে সমস্ত চিন্তা-দুঃখ দূর করে দিবো।”

বর্ণিত আছে যে, ইসলামের যুগে সানআ নামক শহরে একটি কবর খনন করা হয়, তখন দেখা যায় যে, তাতে দু’টি মহিলা সমাধিস্থ রয়েছে, যাদের দেহ সম্পূর্ণরূপে সহীহ সালিম এবং অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তাদের শিয়রে একটি চাদির ফালি লেগে রয়েছে। তাতে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছেঃ “এ হচ্ছে হাই ও তামীসের কবর।” আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, তাদের নাম ছিল হাই ও তামাযুর। মহিলা দু’টি তুব্বার ভগ্নী ছিল। মহিলা দু’টি মৃত্যু পর্যন্ত এ সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কেউই ইবাদতের যোগ্য নেই। তারা আল্লাহর সাথে কাউকেও শরীক করেনি। তাদের পূর্ববর্তী সমস্ত সৎ লোকই এই সাক্ষ্যদান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিল। সূরায়ে সাবার মধ্যে আমরা এই ঘটনা সম্পর্কে সাবার কবিতাগুলোও বর্ণনা করেছি। হযরত কা’ব (রঃ) বলতেনঃ “কুরআন কারীম দ্বারা তুব্বার প্রশংসা এভাবে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তার কওমের নিন্দে করেছেন, তার নয়।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলতেন ? “তোমরা তুব্বাকে মন্দ বলো না, সে সৎ লোক ছিল।”

হযরত সা’দ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা তুব্বাকে গালি দিয়ো না, সে মুসলমান হয়েছিল।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ), ইমাম আহমাদ (রঃ) এবং ইমাম বিতরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তুব্বা নবী ছিল কি-না তা আমি জানি না। (এ হাদীসটি আবদুর রাযযাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আর একটি রিওয়াইয়াত গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তুব্বা অভিশপ্ত ছিল কি-না তা আমার জানা নেই। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। এই রিওয়াইয়াতটিই হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও বর্ণিত আছে। হযরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (রঃ) বলেনঃ “তোমরা তুব্বাকে গালি দিয়ো না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে মন্দ বলতে নিষেধ করেছেন। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
৩৮-৪২ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ তা’আলা নিজের আদল ও ইনসাফ এবং তার বৃথা ও অযতা কোন কাজ না করার বর্ণনা দিচ্ছেন। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতোদুভয়ের মধ্যস্থিত জিনিস বৃথা সৃষ্টি করিনি। এটা কাফিরদের ধারণা। সুতরাং কাফিরদের জন্যে জাহান্নামের দুর্ভোগ রয়েছে।”(৩৮:২৭) অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না? মহিমান্বিত আল্লাহ যিনি প্রকৃত মালিক, তিনি ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই, সম্মানিত আরশের তিনি অধিপতি।”(২৩:১১৫-১১৬)

ফায়সালার দিন অর্থাৎ কিয়ামতের দিন যেই দিন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্যে হক ফায়সালা করবেন। কাফিরদেরকে শাস্তি দিবেন এবং মুমিনদেরকে দিবেন পুরস্কার। ঐ দিন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাই আল্লাহ তা’আলার সামনে একত্রিত হবে। ওটা হবে এমন এক সময় যে, একে অপর হতে পৃথক হয়ে যাবে। এক আত্মীয় অন্য আত্মীয়ের কোনই উপকার করতে পারবে না। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে সেই দিন তাদের মধ্যে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকবে না এবং তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না।”(২৩:১০১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সুহৃদ সুহৃদের তত্ত্ব নিবে না, তাদেরকে করা হবে একে অপরের দৃষ্টিগোচর।”(৭০:১০-১১) অর্থাৎ কোন বন্ধু তার বন্ধুকে তার অবস্থা সম্পর্কে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করবে না, অথচ তারা একে অপরকে দেখতে পাবে। ঐদিন কেউ কাউকেও কোন সাহায্য করবে না এবং বাহির হতেও কোন সাহায্য আসবে। না। হ্যা, তবে আল্লাহ যার প্রতি দয়া করেন তার কথা স্বতন্ত্র। তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।
৪৩-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:

কিয়ামতকে অস্বীকারকারীদের জন্যে যে শাস্তি রয়েছে আল্লাহ তা’আলা এখানে তারই বর্ণনা দিচ্ছেন যে, যারা কিয়ামতকে অবিশ্বাস করতঃ দুনিয়ায় সদা পাপকার্যে লিপ্ত থেকেছে তাদেরকে কিয়ামতের দিন যাককূম গাছ খেতে দেয়া হবে। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা আবু জাহেলকে বুঝানো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহ যে, এ আয়াতের ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে সেও শামিল রয়েছে, কিন্তু শুধু তারই সম্পর্কে আয়াতটি নাযিল হয়েছে এটা মনে করা ঠিক নয়। হযরত আবু দারদা একটি লোককে এ আয়াতটি পড়াচ্ছিলেন, কিন্তু সে (আরবী) শব্দটি উচ্চারণ করতে অপারগ হচ্ছিল এবং সে (আরবী) এর স্থলে (আরবী) শব্দ বলে দিচ্ছিল। তখন তিনি (আরবী) (পাপীর খাদ্য) পড়িয়ে দেন। অর্থাৎ তাদেরকে যাককূম গাছ। ছাড়া অন্য কোন খাদ্য খেতে দেয়া হবে না।

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এই যাককূমের একটা বিন্দু যদি এই যমীনের উপর পড়ে তবে যমীনবাসীর সমস্ত জীবিকা নষ্ট হয়ে যাবে। একটি মারফু হাদীসেও এটা এসেছে যা পূর্বে গত হয়েছে।

এটা হবে গলিত তাম্রের মত, এটা তার পেটে ফুটন্ত পানির মত ফুটতে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামের রক্ষকদের বলবেনঃ “এই কাফিরকে ধর এবং টেনে জাহান্নামের মধ্যস্থলে নিয়ে যাও। অতঃপর তার মস্তকের উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দাও।” যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে, ফলে তার পেটের সমুদয় জিনিস এবং চামড়া দগ্ধ হয়ে যাবে।”(২২:১৯-২০) ইতিপূর্বে এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ফেরেশতারা তাদেরকে হাতুড়ী দ্বারা প্রহার করবে, ফলে তাদের মস্তিষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তারপর উপর হতে তাদের মাথার উপর গরম পানি ঢেলে দেয়া হবে। এই পানি যেখানে যেখানে পৌছবে, হাড়কে চামড়া হতে পৃথক পৃথক করে দিবে, এমনকি তাদের নাড়িভূড়ি কেটে পায়ের গোছা। পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এর থেকে রক্ষা করুন!

অতঃপর তাদেরকে আরো লজ্জিত করার জন্যে বলা হবেঃ “আস্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত অভিজাত।” অর্থাৎ আজ তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মোটেই সম্মানিত ও মর্যাদাবান নয়।

উমুভী (রঃ) তাঁর ‘মাগাযী’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) অভিশপ্ত আবু জাহেলকে বলেনঃ “আমার প্রতি আল্লাহর হুকুম হয়েছে যে, আমি যেন তোমাকে বলিঃ দুর্ভোগ তোমার জন্যে, দুর্ভোগ! আবার দুর্ভোগ তোমার। জন্যে, দুর্ভোগ!” তখন সে তার কাপড় তাঁর হাত হতে টেনে নেয় এবং বলেঃ “তুমি এবং তোমার প্রতিপালক আমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। এই সমগ্র উপত্যকায় সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি আমিই।” অতঃপর বদরের যুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে সে নিহত হয় এবং তাকে তিনি লাঞ্ছিত করেন। ঐ সময় তিনি। অবতীর্ণ করেনঃ “আস্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত, অভিজাত।” অর্থাৎ আজ তোমার সম্মান ও আভিজাত্য কোথায় গেল?

তারপর ঐ কাফিরদেরকে বলা হবেঃ “এটা তো ওটাই (ঐ শাস্তি), যা সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ পোষণ করতে। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে, (এবং বলা হবেঃ) এটা ঐ আগুন যাকে তোমরা অবিশ্বাস করতে। এটা কি যাদু, না তোমরা দেখছো না?”(৫২:১৩-১৫) আল্লাহ তাআলা এখানেও বলেনঃ “এটা তো ওটাই, যে বিষয়ে তোমরা সন্দেহ করতে।”
৫১-৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা হতভাগ্যদের বর্ণনা দেয়ার পর সৌভাগ্যবানদের বর্ণনা দিচ্ছেন। এ জন্যেই কুরআন কারীমকে (আরবী) বলা হয়েছে। দুনিয়ায় যারা অধিকর্তা, সৃষ্টিকর্তা এবং ক্ষমতাবান আল্লাহকে ভয় করে চলে তারা কিয়ামতের দিন জান্নাতে অত্যন্ত শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করবে। সেখানে তারা মৃত্যু, বহিষ্কার, দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, ব্যথা-বেদনা, শয়তান ও তার চক্রান্ত, আল্লাহর অসন্তুষ্টি ইত্যাদি সমস্ত বিপদ-আপদ হতে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ থাকবে। কাফিররা তো সেখানে পাবে যাককূম বৃক্ষ এবং আগুনের মত গরম পানি, পক্ষান্তরে এই জান্নাতীরা লাভ করবে সুখময় জান্নাত এবং প্রবাহমান নদী ও প্রস্রবণ। আর পাবে তারা মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং তারা বসে থাকবে মুখখামুখী হয়ে। কারো দিকে কারো পিঠ হবে না, বরং তারা পরস্পর মুখখামুখী হবে। এই দানের সাথে সাথে তারা আয়ত লোচনা হ্র লাভ করবে, যাদেরকে ইতিপূর্বে কোন মানব অথবা দানব স্পর্শ করেনি। তারা যেন প্রবাল ও পদ্মরাগ! তাদের এসব নিয়ামত লাভের কারণ এই যে, তারা দুনিয়ায় আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে চলতো এবং তাঁর নির্দেশকে সামনে রেখে পার্থিব ভোগ্যবস্তু হতে দূরে থাকতো। সুতরাং আজ তিনি তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার কেন করবেন না? যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “উত্তম কাজের জন্যে উত্তম পুরস্কার ব্যতীত কি হতে পারে?”(৫৫:৬০)

হযরত আনাস (রাঃ) হতে মার’রূপে বর্ণিত আছেঃ “যদি এই হ্রদের মধ্যে কোন একজন সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে থুথু ফেলে তবে ওর সমস্ত পানি মিষ্ট হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘সেখানে তারা প্রশান্ত চিত্তে বিবিধ ফলমূল আনতে বলবে। তারা যা চাইবে তা-ই পাবে। তাদের ইচ্ছা হওয়ামাত্রই তাদের কাছে তা হাযির হয়ে যাবে। ওগুলো শেষ হবার বা কমে যাবার কোন ভয় থাকবে না।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “প্রথম মৃত্যুর পর তারা সেখানে আর মৃত্যু আস্বাদন করবে না।’ ইসতিসনা মুনকাতা এনে এর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা জান্নাতে কখনই মৃত্যুবরণ করবে না। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মৃত্যুকে ভেড়ার আকারে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে আনয়ন করা হবে, অতঃপর ওকে যবেহ করে দেয়া হবে। তারপর ঘোষণা করা হবেঃ “হে জান্নাতবাসীরা! এটা তোমাদের জন্যে চিরস্থায়ী বাসস্থান, আর কখনো মৃত্যু হবে না। আর হে জাহান্নামবাসীরা! তোমাদের জন্যেও এটা চিরস্থায়ী বাসস্থান। কখনো আর তোমাদের মৃত্যু হবে না।” সূরায়ে মারইয়ামের তাফসীরেও এ হাদীস গত হয়েছে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতবাসীদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা সদা সুস্থ থাকবে, কখনো রোগাক্রান্ত হবে না। সদা জীবিত থাকবে, কখনো মৃত্যু বরণ করবে না। সদা নিয়ামত লাভ করতে থাকবে, কখনো নিরাশ হবে না। সদা যুবক থাকবে, কখনো বৃদ্ধ হবে না। (এ হাদীসটি আবদুর রাযযাক (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে সে নিয়ামত লাভ করবে, কখনো নিরাশ হবে না। সদা জীবিত থাকবে, কখনো মরবে না। সেখানে তার কাপড় ময়লা হবে না এবং তার যৌবন নষ্ট হবে না।”

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “জান্নাতবাসীরা নিদ্রা যাবে কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ন্দ্রিা তো মৃত্যুর ভাই।। জান্নাতীরা দ্রিা যাবে না।” (এ হাদীসটি আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “নিদ্রা মৃত্যুর ভাই এবং জান্নাতবাসীরা নিদ্রা যাবে না।” [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবু বকর ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ)] এ হাদীসটি অন্য সনদেও বর্ণিত আছে এবং এর বিপরীতও ইতিপূর্বে গত হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এই আরাম, শান্তি এবং নিয়ামতের সাথে সাথে এই বড় নিয়ামতও রয়েছে যে, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করবেন। সারমর্ম এই পাওয়া গেল যে, তাদের সর্বপ্রকারের ভয় ও চিন্তা দূর হয়ে যাবে। এজন্যেই এর সাথে সাথেই বলেছেনঃ ‘এটা শুধু আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও দয়া। এটাই তো মহাসাফল্য। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা ঠিকঠাক থাকো, কাছে কাছে থাকো এবং বিশ্বাস রাখো যে, কারো আমল তাকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে না।” জনগণ জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার আমলও কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা, আমার আমলও আমাকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে না যদি না আমার প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ হয়।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “(হে নবী সঃ)! আমি তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।” অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমকে খুবই সহজ, স্পষ্ট, পরিষ্কার, প্রকাশমান এবং উজ্জ্বল রূপে রাসূল (সঃ)-এর উপর তাঁরই ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন, যা অত্যন্ত বাকচাতুর্য, অলংকার এবং মাধুর্যপূর্ণ। যাতে লোকদের সহজে বোধগম্য হয়। এতদসত্ত্বেও লোকেরা এটাকে অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ “তুমি তাদেরকে সতর্ক করে দাও এবং বলে দাও- তোমরাও অপেক্ষা কর এবং আমিও অপেক্ষমাণ রয়েছি। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে কার প্রতি সাহায্য আসে, কার কালেমা সমুন্নত হয় এবং কে দুনিয়া ও আখিরাত লাভ করে, তা তোমরা সত্বরই দেখতে পাবে।” ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এ বিশ্বাস রাখো যে, তুমিই জয়যুক্ত ও সফলকাম হবে। আমার নীতি এই যে, আমি আমার নবীদেরকে ও তাদের অনুসারীদেরকে সমুন্নত করে থাকি। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-(আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেনঃ আমি (আল্লাহ) এবং আমার রাসূলরাই জয়যুক্ত থাকবো।”(৫৮:২১) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে ও মুমিনদেরকে সাহায্য করবো পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দণ্ডায়মান হবে। যেদিন যালিমদের ওর-আপত্তি কোন কাজে আসবে না, তাদের জন্যে রয়েছে লা’নত এবং তাদের জন্যে রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।”(৪০:৫১-৫২)।

Leave a Reply