أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১৪/এবং কাফেররা বলে-৭) [ ** কিয়ামত আকস্মিকভাবে আসবে এবং কাফেরদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হবে:-   *কোরআনের ক্যানভাসে মােমেন ও পাপীদের পরকালীন চিত্র :-] www.motaher21.net সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫ ৬৬- ৮৯ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১৪/এবং কাফেররা বলে-৭)
[ ** কিয়ামত আকস্মিকভাবে আসবে এবং কাফেরদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হবে:-
*কোরআনের ক্যানভাসে মােমেন ও পাপীদের পরকালীন চিত্র :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫
৬৬- ৮৯ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৬৬
ہَلۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَّا السَّاعَۃَ اَنۡ تَاۡتِیَہُمۡ بَغۡتَۃً وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۶۶﴾
ওরা তো ওদের অজ্ঞাতসারে আকস্মিকভাবে কিয়ামত আসারই অপেক্ষা করছে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৬৭
اَلۡاَخِلَّآءُ یَوۡمَئِذٍۭ بَعۡضُہُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿ؕ٪۶۷﴾
যখন সে দিনটি আসবে তখন মুত্তাকীরা ছাড়া অবশিষ্ট সব বন্ধুই একে অপরের দুশমন হয়ে যাবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৬৮
یٰعِبَادِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡکُمُ الۡیَوۡمَ وَ لَاۤ اَنۡتُمۡ تَحۡزَنُوۡنَ ﴿ۚ۶۸﴾
সূরাসেই দিন তাদের বলা হবে, “হে আমার বান্দারা, আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং কোন দুঃখও আজ তোমাদের স্পর্শ করবে না।৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৬৯
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ کَانُوۡا مُسۡلِمِیۡنَ ﴿ۚ۶۹﴾
যারা আমার আয়াতে ঈমান এনেছিল এবং যারা ছিল মুসলিম—
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭০
اُدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ اَنۡتُمۡ وَ اَزۡوَاجُکُمۡ تُحۡبَرُوۡنَ ﴿۷۰﴾
তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগণ সানন্দে জান্নাতে প্ৰবেশ কর।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭১
یُطَافُ عَلَیۡہِمۡ بِصِحَافٍ مِّنۡ ذَہَبٍ وَّ اَکۡوَابٍ ۚ وَ فِیۡہَا مَا تَشۡتَہِیۡہِ الۡاَنۡفُسُ وَ تَلَذُّ الۡاَعۡیُنُ ۚ وَ اَنۡتُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ ﴿ۚ۷۱﴾
স্বর্ণের থালা ও পান পাত্র নিয়ে ওদের মাঝে ফিরানো হবে,সেখানে রয়েছে এমন সমস্ত কিছু, যা মন চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয়। সেখানে তোমরা চিরকাল থাকবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭২
وَ تِلۡکَ الۡجَنَّۃُ الَّتِیۡۤ اُوۡرِثۡتُمُوۡہَا بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۷۲﴾
এটিই জান্নাত, তোমরা তোমাদের কর্মের ফলস্বরূপ যার অধিকারী হয়েছ।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৩
لَکُمۡ فِیۡہَا فَاکِہَۃٌ کَثِیۡرَۃٌ مِّنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿۷۳﴾
সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফলমূল, তা থেকে তোমরা আহার করবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৪
اِنَّ الۡمُجۡرِمِیۡنَ فِیۡ عَذَابِ جَہَنَّمَ خٰلِدُوۡنَ ﴿ۚۖ۷۴﴾
নিশ্চয় অপরাধীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে,
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৫
لَا یُفَتَّرُ عَنۡہُمۡ وَ ہُمۡ فِیۡہِ مُبۡلِسُوۡنَ ﴿ۚ۷۵﴾
তাদের আযাব কখনো কম করা হবে না এবং তারা সেখানে নিরাশ অবস্থায় পড়ে থাকবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৬
وَ مَا ظَلَمۡنٰہُمۡ وَ لٰکِنۡ کَانُوۡا ہُمُ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۷۶﴾
আমি তাদের প্রতি জুলুম করিনি। বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৭
وَ نَادَوۡا یٰمٰلِکُ لِیَقۡضِ عَلَیۡنَا رَبُّکَ ؕ قَالَ اِنَّکُمۡ مّٰکِثُوۡنَ ﴿۷۷﴾
তারা চিৎকার করে বলবে, ‘হে মালেক, তোমার রব যেন আমাদেরকে নিঃশেষ করে দেন।’ সে বলবে, ‘নিশ্চয় তোমারা অবস্থানকারী হবে।’
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৮
لَقَدۡ جِئۡنٰکُمۡ بِالۡحَقِّ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَکُمۡ لِلۡحَقِّ کٰرِہُوۡنَ ﴿۷۸﴾
আমি তো তোমাদের নিকট সত্য পৌঁছে দিয়েছিলাম; কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই তো সত্যবিমুখ ছিলে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৭৯
اَمۡ اَبۡرَمُوۡۤا اَمۡرًا فَاِنَّا مُبۡرِمُوۡنَ ﴿ۚ۷۹﴾
এ লোকেরা কি কোন পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে? বেশ তো! তাহলে আমিও একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮০
اَمۡ یَحۡسَبُوۡنَ اَنَّا لَا نَسۡمَعُ سِرَّہُمۡ وَ نَجۡوٰىہُمۡ ؕ بَلٰی وَ رُسُلُنَا لَدَیۡہِمۡ یَکۡتُبُوۡنَ ﴿۸۰﴾
নাকি তারা মনে করে যে, আমরা তাদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণা শুনতে পাই না? অবশ্যই হ্যাঁ। আর আমাদের ফেরেশতাগণ তাদের কাছে থেকে সবকিছু লিখছে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮১
قُلۡ اِنۡ کَانَ لِلرَّحۡمٰنِ وَلَدٌ ٭ۖ فَاَنَا اَوَّلُ الۡعٰبِدِیۡنَ ﴿۸۱﴾
এদের বলো, “সত্যিই যদি রহমানের কোন সন্তান থাকতো তাহলে তাঁর সর্বপ্রথম ইবাদতকারী হতাম আমি।”
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮২
سُبۡحٰنَ رَبِّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ رَبِّ الۡعَرۡشِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ ﴿۸۲﴾
‘তারা যা আরোপ করে তা থেকে আসমানসমূহ ও যমীনের রব এবং ‘আরশের রব পবিত্ৰ-মহান।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৩
فَذَرۡہُمۡ یَخُوۡضُوۡا وَ یَلۡعَبُوۡا حَتّٰی یُلٰقُوۡا یَوۡمَہُمُ الَّذِیۡ یُوۡعَدُوۡنَ ﴿۸۳﴾
ঠিক আছে, যে দিনের ভয় তাদের দেখানো হচ্ছে সেই দিন না দেখা পর্যন্ত তাদেরকে বাতিল ধ্যান-ধারণার মধ্যে ডুবে এবং নিজেদের খেলায় মেতে থাকতে দাও।”
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৪
وَ ہُوَ الَّذِیۡ فِی السَّمَآءِ اِلٰہٌ وَّ فِی الۡاَرۡضِ اِلٰہٌ ؕ وَ ہُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۸۴﴾
সেই একজনই আসমানেও আল্লাহ‌ এবং যমীনেও আল্লাহ। তিনি মহাকুশলী ও মহাজ্ঞানী।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৫
وَ تَبٰرَکَ الَّذِیۡ لَہٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ۚ وَ عِنۡدَہٗ عِلۡمُ السَّاعَۃِ ۚ وَ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۸۵﴾
কত মহান তিনি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর সার্বভৌম অধিপতি। কিয়ামতের জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৬
وَ لَا یَمۡلِکُ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِ الشَّفَاعَۃَ اِلَّا مَنۡ شَہِدَ بِالۡحَقِّ وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۸۶﴾
এরা তাঁকে বাদ দিয়ে যাদের ডাকে তারা শাফায়াতের কোন ইখতিয়ার রাখে না। তবে যদি কেউ জ্ঞানের ভিত্তিতে ন্যায় ও সত্যের সাক্ষ্য দান করে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৭
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَہُمۡ مَّنۡ خَلَقَہُمۡ لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰہُ فَاَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ ﴿ۙ۸۷﴾
যদি তোমরা এদের জিজ্ঞেস করো, কে এদের সৃষ্টি করেছে তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ।তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে?
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৮
وَ قِیۡلِہٖ یٰرَبِّ اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ قَوۡمٌ لَّا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿ۘ۸۸﴾
রসূলের এই কথার শপথ, ‘হে রব, এরাই সেই সব লোক যারা মানছে না।’
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ:৮৯
فَاصۡفَحۡ عَنۡہُمۡ وَ قُلۡ سَلٰمٌ ؕ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٪۸۹﴾
ঠিক আছে, হে নবী, এদের উপেক্ষা করো এবং বলে দাও, তোমাদের সালাম জানাই। অচিরেই তারা জানতে পারবে।

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৬৬-৭৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

যে সকল কাফির-মুশরিকরা কিয়ামত বিশ্বাস করে না, হঠাৎ করে কিয়ামত চলে আসুক এটা তারা কামনা করে। অথচ কিয়ামত তাদের ওপর এমনভাবে চলে আসবে, তারা তা উপলব্ধিও করতে পারবে না।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(ثَقُلَتْ فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ لَا تَأْتِيْكُمْ إِلَّا بَغْتَةً)

“সেটা হবে আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে একটি ভয়ংকর ঘটনা। আকস্মিকভাবেই সেটা তোমাদের ওপর আসবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৮৭)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَهَلْ يَنْظُرُوْنَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَا۬ءَ أَشْرَاطُهَا ج فَأَنّٰي لَهُمْ إِذَا جَا۬ءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ)

“তবে এরা কি শুধু কিয়ামতেরই অপেক্ষায় আছে যে, তা হঠাৎ তাদের ওপর এসে পড়–ক? কিয়ামতের লক্ষণগুলো তো এসেই গেছে। (যখন কিয়ামত এসে যাবে) তখন তাদের নসীহত কবূল করার আর কোন সুযোগ কোথায়?” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ : ১৮)

কিয়ামতের ভয়াবহ ও কঠিন পরিস্থিতি দেখে প্রকৃত বন্ধুদের পরিচয় পাওয়া যাবে। আল্লাহ বলেন : মুত্তাকিদের বন্ধুত্ব ছাড়া সকল প্রকার বন্ধু সেদিন শত্র“তে পরিণত হয়ে যাবে। কেননা, কাফিরদের বন্ধুত্ব কেবল কুফরী ও পাপাচারের ভিত্তিতে হয় এবং এ কুফরী ও পাপাচারই তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। আর এরই কারণে তারা একে অপরকে দোষারোপ করবে এবং পরস্পরের শত্র“ হয়ে যাবে। সেদিন তারা খারাপ লোকদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার কারণে আফসোস করবে, যেমন আল্লাহ বলেন :

(يٰوَيْلَتٰي لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيْلًا)

‘হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! (সূরা ফুরকান ২৫ : ২৮)

পক্ষান্তরে ঈমানদার ও আল্লাহ ভীরু লোকদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসা যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ভিত্তিতে হয়, আর এ দীন ও ঈমানই হলো কল্যাণ ও সওয়াব লাভের মাধ্যম, সেহেতু তাদের এ বন্ধুত্বে কোন বিচ্ছেদ ঘটবে না। আখিরাতেও তাঁদের এ বন্ধুত্ব অটুট থাকবে; যেমন দুনিয়াতে ছিল।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন ও মুত্তাকীদের পরকালীন সুখ ও শান্তি, দুশ্চিন্তামুক্ত বসবাস এবং তাদের আবাসস্থল জান্নাতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। যারা ঈমানদার ও আল্লাহ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণকারী তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন আহ্বান করবেন যা তাদের অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনবে ও সকল অনিষ্ট আর বিপদ কেটে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : হে আমার বান্দারা! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না। ফেরেশতারাও এ কথা বলবে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِيْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ ‏)

“নিশ্চয়ই যারা বলে : আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলেঃ তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার সুসংবাদ পেয়ে আনন্দিত হও।” (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১ : ৩০)

(وَأَزْوَاجُكُمْ)

‘তোমাদের সহধর্মিনীগণও’ কেউ বলেছেন- সহধর্মিণী দ্বারা উদ্দেশ্য হল দুনিয়াতে তাদের যে সব সহধর্মিণী তাদের মত মুত্তাকী ও ঈমানদার ছিল। কেউ বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল জান্নাতী স্ত্রীগণ, যা জান্নাতীদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)

জান্নাতে মন যা চাইবে এবং যা দ্বারা চক্ষু শীতল হবে এমন সব কিছুই দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَي قَلْبِ بَشَرٍ

আমি আমার বান্দাদের জন্য এমন কিছু তৈরি করে রেখেছি যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ণ শ্রবণ করেনি এবং মানুষের অন্তরে কল্পনাও জাগেনি। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৪৪)

(وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِيْٓ أُوْرِثْتُمُوْهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ)

‘এটাই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে, তোমাদের কর্মের ফলস্বরূপ।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের কেউ আমলের বিনিময়ে জান্নাতে যেতে পারবে না। সাহাবীরা বলল : আপনিও না, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন : আমিও না, তবে যদি আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ দ্বারা আচ্ছাদিত করে না নেন। (সহীহ বুখারী হা. ৫৬৭৪) আয়াত ও হাদীসের মাঝে বাহ্যিক বৈপরিত্য দেখা গেলেও মূলত কোন বৈপরিত্য নেই, কারণ আমল ছাড়া জান্নাতে যাওয়া যাবে না, আমল হল জান্নাতে যাওয়ার প্রধান মাধ্যম। আর হাদীসে যে আমলের কথা বলা হয়েছে তা হল এমন আমল যা আল্লাহ তা‘আলা কবূল করেন। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)

সুতরাং শুধু আমল করে কেউ জান্নাতে যাবে এমন নয়, বরং আমলের সাথে আল্লাহর অনুগ্রহ লাগবে। তাই সৎ আমল করার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ কামনা করতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামত অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে আর তা আকস্মিকভাবে চলে আসবে।
২. কাফিররা পরস্পর শত্র“ হয়ে যাবে আর মু’মিনদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হবে।
৩. জান্নাতে জান্নাতীরা অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করবে।
৪. প্রকৃত বন্ধুত্ব তা-ই যা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য হয়।
৫. জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায় হল সৎ আমল।
৭৪-৮০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

জান্নাতীদের আরাম-আয়েশের কথা বর্ণনা করার পর এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বর্ণনা করেছেন। তারা তথায় (জাহান্নামে) চিরস্থায়ী শাস্তিতে থাকবে, যে শাস্তি কখনো লাঘব করা হবে না। يفتر শব্দের অর্থ হলো- কমানো, লাঘব করা, হালকা করা ইত্যাদি।

তাদের এ শাস্তি তাদের আমলের পরিণতি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম করেন না। যেমন হাদীসে কুদসীতে এসেছে : আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَي نَفْسِي، وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا، فَلَا تَظَالَمُوا

হে আমার বান্দারা! আমি নিজের প্রতি জুলুম করা হারাম করে নিয়েছি, আর তা তোমাদের জন্যও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করো না। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৭৭) তারা এহেন শাস্তিতে অতিষ্ট হয়ে জাহান্নামের অধিকর্তা মালিক নামক ফেরেশতাকে লক্ষ্য করে বলবে- হে মালিক! তোমার প্রভুকে বলো, তিনি যেন আমাদের থেকে শাস্তি লাঘব করেন, আমাদেরকে যেন এ শাস্তি থেকে মুক্তি দান করেন। উত্তরে তাদেরকে বলা হবে, তোমাদের থেকে এ শাস্তি কমানো হবে না, বরং তোমরা এভাবেই থাকবে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَالَّذِیْنَ کَفَرُوْا لَھُمْ نَارُ جَھَنَّمَﺆ لَا یُقْضٰی عَلَیْھِمْ فَیَمُوْتُوْا وَلَا یُخَفَّفُ عَنْھُمْ مِّنْ عَذَابِھَاﺚ کَذٰلِکَ نَجْزِیْ کُلَّ کَفُوْرٍ)

“আর যারা কুফরী করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে দোযখের আযাবও হালকা করা হবে না। আমি এরূপই শাস্তি দিয়ে থাকি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে।” (সূরা ফা-ত্বির ৩৫ : ৩৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(ثُمَّ لَا يَمُوْتُ فِيْهَا وَلَا يَحْيٰي) ‏

“অতঃপর সে সেখানে মরবেও না, বাঁচবেও না।” (সূরা আ‘লা ৮৭ : ১১)

তারা তথায় চিরস্থায়ী শাস্তিতে থাকবে যে শাস্তির কোনই শেষ নেই। যেহেতু তারা সত্যকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করেছে, সেহেতু তারা জাহান্নামের অধিকারী হয়েছে। আর এজন্যই তাদের সমস্ত কার্যকলাপ আল্লাহ তা‘আলা ফিরিশ্তার মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে রাখছেন, যেন তা কিয়ামতের দিন সে অস্বীকার করার সুযোগ না পায়।

إبرام-এর অর্থ হলো সুদৃঢ়, চূড়ান্ত, পাকাপোক্ত ও মজবুত করা।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সত্য প্রত্যাখ্যান করলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
২. মানুষ যা করে ফেরেশতারা সবই লিখে রাখে।
৩. কোন চক্রান্তই আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে কাজে আসবে না।

৮১-৮৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

إِنْ শর্তমূলক, নাকি না-বোধক এ নিয়ে দুধরনের উক্তি রয়েছে; কেউ বলেছেন তা শর্তমূলক, সে হিসেবে অর্থ হল, যদি আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান থাকত তাহলে আমিই হতাম সে সন্তানের প্রথম ইবাদতকারী। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান নেই তাই একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি। কেউ বলেছেন, إِنْ না-বোধক, সুতরাং অর্থ হল আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান নেই, অতএব এক আল্লাহ তা‘আলার ইবদাতকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম (তোমাদের মধ্যে)। তাঁর সন্তান হবে এমন কথা থেকে পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং প্রত্যেক ঐসব থেকেও পবিত্রতা বর্ণনা করছি যা তাঁর শানে উপযোগী নয়। এটাই সঠিক কথা, কেননা এ অর্থেই কুরআনের অনেক আয়াত এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَّيُنْذِرَ الَّذِيْنَ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰهُ وَلَدًا ق ‏ مَا لَهُمْ بِه۪ مِنْ عِلْمٍ وَّلَا لِآبَا۬ئِهِمْ)

“এবং সতর্ক করার জন্য তাদেরকে যারা বলে যে, আল্লাহ সন্ত‎ান গ্রহণ করেছেন, এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৪-৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمٰنُ وَلَدًا لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا

“তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তোমরা এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করেছ” (সূরা মারাইয়াম ১৯ : ৮৮-৮৯, আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)

তাই মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলার সন্তান থাকার ব্যাপারে যে সকল কথা-বার্তা বলাবলি করে তিনি তা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র ও মহান। তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিপতি এবং আরশের অধিকারী। তিনি এক, অভাবমুক্ত, সমকক্ষ ও সন্তান নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(سُبْحٰنَه۫ أَنْ يَّكُوْنَ لَه۫ وَلَدٌ ﻣ لَه۫ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ط وَكَفٰي بِاللّٰهِ وَكِيْلًا)

“তাঁর সন্তান হবে- তিনি এটা হতে পবিত্র। আসমানে যা কিছু আছে ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই; কর্ম-বিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।” (সূরা নিসা ৪ : ১৭১)

সুতরাং সত্য সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও যারা আল্লাহ তা‘আলার শানে এরূপ কথা-বার্তা বলে তাদেরকে ঐ দিনের সাক্ষাত করার পূর্ব পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে যেদিনের প্রতিশ্রুতি তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তারা ক্রীড়া-কৌতুক ও হাসি-তামাশা করুক। যখন ঐদিন এসে যাবে তখন তারা তাদের পরিণাম সম্পর্কে জানতে পারবে।

এরপর মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, আসমান ও জমিনের সমস্ত মাখলূক তাঁর ইবাদতে লিপ্ত রয়েছে এবং সবাই তাঁর সামনে অপারগ ও শক্তিহীন। তিনিই প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَهُوَ اللّٰهُ فِي السَّمٰوٰتِ وَفِي الْأَرْضِ ط يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُوْنَ)‏

“আসমানসমূহ ও জমিনে তিনিই আল্লাহ, তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু তিনি জানেন এবং তোমরা যা অর্জন কর তাও তিনি অবগত আছেন।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৩) এ সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৩ নম্বর আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু রয়েছে সকল কিছুর মালিক। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নন। আর একমাত্র তিনিই কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন। এ সম্পর্কে সূরা আল আন‘আমের ৫৯ নম্বর আয়াতে ও সূরা লুক্বমানের শেষ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(وَلَا يَمْلِكُ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ الشَّفَاعَةَ)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদত করা হয় এ আশায় যে, তারা আমাদের জন্য শাফায়াত করবে। যেমন ফেরেশতা, নাবী, ওলী-আওলিয়া ও কবরে শায়িত ব্যক্তি ইত্যাদি; এরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কোন শাফায়াত করতে পারবে না। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :

(إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ)

অর্থ হল- যে সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাসূলুল্লাহ। অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার ও যে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছে সে ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান রাখে। সত্যের প্রতি সাক্ষ্য দেয়ার জন্য শর্ত হল- আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের সাক্ষ্য দেবে, সাক্ষ্য দেবে রাসূলগণের নবুওয়াতের ও তারা যা নিয়ে এসেছেন তা সঠিক। এসব ব্যক্তিরা আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে যার জন্য শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া হবে তার জন্য শাফায়াত করতে পারবে। এ সম্পর্কে সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর মুশরিকরাও আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ তথা সকল কিছুর মালিক ও সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তা স্বীকার করত কিন্তু ইবাদত করত বিভিন্ন প্রতিমা ও দেব-দেবীর। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : অর্থাৎ তারা সব কিছুর মালিক ও সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকে এক মেনে নিয়েও কিভাবে অন্যের ইবাদত করে? কেননা তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ তাওহীদে উলুহিয়্যাহ আবশ্যক করে। অর্থাৎ যিনি সব কিছুর মালিক তিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার।

وَقِيْلِه এখানে তিন ধরনের কিরাত রয়েছে। কেউ যবর দিয়ে পড়েছেন, কেউ পেশ দিয়ে পড়েছেন, কেউ যের দিয়ে পড়েছেন। যের দিয়ে পড়লে এর সম্পর্ক হল এর পূর্ব আয়াতের عِلْمُ السَّاعَةِ শব্দের সাথে। সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য হল নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অর্থ হল- আল্লাহ তা‘আলার নিকট রয়েছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার জ্ঞান। অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার কাছে অভিযোগ করে বলেছিলেন- হে আল্লাহ! যাদের কাছে আমাকে প্রেরণ করেছেন তারা আমাকে অস্বীকার করছে, তারা ঈমান আনছে না।

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভিযোগ শুনে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বললেন এবং সুন্দর করে বিদায় নিয়ে চলে আসতে বললেন। এখানে সালাম অর্থ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা নয়, বরং এটা এক প্রকার বাক্যপদ্ধতি। কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলে বলা হয়। আমরাও বাংলা ভাষায় ব্যবহার করে থাকি। যেমন কারো সাথে তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রে সঠিক দলীল-প্রমাণ তুলে ধরলেও যদি মেনে না নেয় তাহলে সুন্দর করে বিদায় দিয়ে বলি, ভাই! ‘সালাম’। অর্থাৎ আপনি আপনার মত নিয়ে থাকেন, আমি চললাম।

সুতরাং দীনের দিকে দাওয়াত দিলে কেউ সে দাওয়াতে সাড়া না দিলে মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন, যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন। বান্দার কাজ তার জ্ঞানানুপাতে দাওয়াতী কাজ করা।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই নিকট রয়েছে। অন্য কারো নিকট এ ব্যাপারে কোনই জ্ঞান নেই।
২. আল্লাহ তা‘আলার কোন স্ত্রী-সন্তান নেই, তিনি এক অদ্বিতীয়, তাঁর সকতুল্য কেউ নেই।
৩. যারা সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে তাদের থেকে সদ্ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসতে হবে, তাদের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলার ওপর।
৪. আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দেবেন সে ব্যতীত অন্য কেউ তাঁর সম্মুখে কোন কথা-বার্তা বলতে পারবে না ও শাফায়াতও করতে পারবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৬৬-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ দেখো, এই মুশরিকরা কিয়ামতের অপেক্ষা করছে, কিন্তু এতে কোন লাভ নেই, কেননা এটা তাদের অজ্ঞাতসারে আকস্মিকভাবে এসে পড়বে। কারণ এটা সংঘটিত হওয়ার সঠিক সময় তো কারো জানা নেই। হঠাৎ করে যখন এটা এসে পড়বে তখন এরা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেও কোন উপকার হবে না। এরা যদিও এই কিয়ামতকে অসম্ভব মনে করছে, কিন্তু এটা শুধু সম্ভবই নয়, বরং নিশ্চিত। ঐ সময় বা ঐ সময়ের পরের আমল কোন কাজে আসবে না। দুনিয়ায় যাদের বন্ধুত্ব গায়রুল্লাহর জন্যে রয়েছে ঐ দিন সেটা শত্রুতায় পরিবর্তিত হবে। হ্যা, তবে যে বন্ধুত্ব শুধু আল্লাহর জন্যে রয়েছে তা বাকী ও চিরস্থায়ী থাকবে। যেমন হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে বলেছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা আল্লাহ ছাড়া প্রতিমাগুলোর সাথে পার্থিব জীবনে যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে রেখেছে তা শুধু পার্থিব জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে, অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমাদের একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করবে এবং তোমাদের আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম, আর তোমাদের জন্যে কোন সাহায্যকারী হবে না।”(২৯:২৫)।

হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ দুই জন মুমিন যারা দুনিয়ায় পরস্পর বন্ধু হয়, যখন তাদের একজনের মৃত্যু হয় এবং আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে সে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয় তখন সে তার ঐ দুনিয়ার বন্ধুকে স্মরণ করে এবং বলেঃ “হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। সে আমাকে আপনার এবং আপনার রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যের নির্দেশ দিতো। আমাকে সে ভাল কাজের আদেশ করতো এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখতো। আমাকে সে বিশ্বাস করাতো যে, একদিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে। সুতরাং হে আল্লাহ! তাকে আপনি সত্য পথের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন এবং শেষে তাকে ওটাই দেখিয়ে দিবেন যা আমাকে দেখিয়েছেন এবং তার উপর ঐরূপই সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন যেমন সন্তুষ্ট আমার উপর হয়েছেন।” তখন আল্লাহ তাআলা তাকে জবাবে বলেনঃ “তুমি সন্তুষ্ট চিত্তে চলে যাও। আমি তার জন্যে যা কিছু প্রস্তুত রেখেছি তা যদি তুমি দেখতে তবে খুব হাসতে এবং মোটেই দুঃখিত হতে না।” অতঃপর যখন তার ঐ বন্ধু মারা যায় এবং দুই বন্ধুর রূহ মিলিত হয় তখন তাদেরকে বলা হয়ঃ “তোমরা তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বর্ণনা দাও।” তখন একজন অপরজনকে বলেঃ “তুমি আমার খুব ভাল বন্ধু ছিলে ও অত্যন্ত সৎ সঙ্গী ছিলে এবং ছিলে অতি উত্তম দোস্ত। পক্ষান্তরে, দুইজন কাফির, যারা দুনিয়ায় পরস্পর বন্ধু হয়, যখন তাদের একজন মারা যায় এবং তাকে জাহান্নামের দুঃসংবাদ দেয়া। হয় তখন দুনিয়ার ঐ বন্ধুর কথা তার স্মরণ হয় এবং সে বলেঃ “হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমার বন্ধু ছিল। সে আমাকে আপনার ও আপনার নবী (সঃ)-এর অবাধ্যাচরণের নির্দেশ দিতো। সে আমাকে মন্দ কাজে উৎসাহিত করতো এবং ভাল কাজ হতে বিরত রাখতো। আর আমার মনে সে এই বিশ্বাস জন্মাতো যে, আপনার সাথে সাক্ষাৎ হবে না। সুতরাং আপনি তাকে সুপথ প্রদর্শন করবেন না যাতে সেও যেন ওটাই দেখতে পায় যা আমাকে দেখানো হয়েছে এবং আপনি তার উপর ঐরূপই অসন্তুষ্ট থাকবেন যেরূপ আমার উপর অসন্তুষ্ট রয়েছেন।” তারপর যখন ঐ দ্বিতীয় বন্ধু মারা যায় এবং উভয়ের রূহ একত্রিত হয় তখন তাদেরকে বলা হয়ঃ “তোমরা একে অপরের গুণাগুণ বর্ণনা কর।” প্রত্যেকেই তখন অপরকে বলেঃ “তুমি আমার খুবই মন্দ ভাই ছিলে, ছিলে খারাপ সঙ্গী ও নিকৃষ্ট বন্ধু।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তবে আল্লাহভীরুদের বন্ধুত্ব তা হবে না।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে দুই ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবাসে, যাদের একজন রয়েছে পূর্ব দিকে এবং অপরজন রয়েছে পশ্চিম দিকে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদের দুজনকেই একত্রিত করে প্রত্যেককেই বলবেনঃ “এ হলো ঐ ব্যক্তি যাকে তুমি আমারই জন্যে ভালবাসতে।” (এ হাদীসটি হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ইরশাদ হচ্ছে যে, কিয়ামতের দিন মুত্তাকীদেরকে বলা হবেঃ হে আমার বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না। যারা আমার আয়াতে বিশ্বাস করেছিল এবং আত্মসমর্পণ করেছিল তোমরা এবং তোমাদের সহধর্মিণীগণ সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। এটা হলো তোমাদের . ঈমান ও ইসলামের প্রতিদান। অর্থাৎ ভিতরে বিশ্বাস ও পূর্ণ প্রত্যয়, আর বাইরে শরীয়তের উপর আমল।

মু’তামার ইবনে সুলাইমান (রাঃ) স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন যখন মানুষ নিজ নিজ কবর হতে উথিত হবে তখন সবাই অশান্তি ও সন্ত্রাসের মধ্যে থাকবে। তখন একজন ঘোষক (আল্লাহর বাণী) ঘোষণা করবেনঃ “হে আমার বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং দুঃখিতও হবে না তোমরা।’ এ ঘোষণা শুনে সবাই খুশী হয়ে যাবে, কারণ তারা এটাকে সাধারণ ঘোষণা মনে করবে (অর্থাৎ তারা মনে করবে যে এ ঘোষণা সবারই জন্যে)। এরপর আবার ঘোষণা করা হবেঃ ‘যারা আমার আয়াতে বিশ্বাস করেছিল এবং আত্মসমর্পণ করেছিল। এ ঘোষণা শুনে খাটি ও পাকা মুসলমান ছাড়া অন্যান্য সবাই নিরাশ হয়ে যাবে। অতঃপর তাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা এবং তোমাদের সহধর্মিণীরা সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ সূরায়ে রূমে-এর তাফসীর গত হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করা হবে। সেখানে সবকিছু রয়েছে অন্তর যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে।

(আরবী) এবং (আরবী) এই দুই কিরআতই রয়েছে। অর্থাৎ সেখানে তাদের জন্যে সুস্বাদু, সুগন্ধময় এবং সুন্দর রঙ এর খাবার রয়েছে যা মনে চায়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘সর্বাপেক্ষা নিম্নশ্রেণীর জান্নাতী, যে সর্বশেষ জান্নাতে যাবে, তার দৃষ্টি শত বছরের পথের দূরত্ব পর্যন্ত যাবে, আর তত দূর পর্যন্ত সে শুধু নিজেরই ডেরা, . তাঁবু এবং স্বর্ণ ও পান্না নির্মিত প্রাসাদ দেখতে পাবে। ঐগুলো সবই বিভিন্ন প্রকারের ও রঙ বেরঙ এর আসবাবপত্রে ভরপুর থাকবে। সকাল-সন্ধ্যায় বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যে পরিপূর্ণ সত্তর হাজার করে রেকাবী ও পেয়ালা তার সামনে পেশ করা হবে। ঐগুলোর প্রত্যেকটি তার মনের চাহিদা মুতাবিক হবে। প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত তার চাহিদা একই রকম থাকবে। যদি সে সারা দুনিয়ার লোককে যিয়াফত দেয় তবে তাদের সবারই জন্যে ঐ খাদ্যগুলো যথেষ্ট হবে। অথচ ওগুলোর কিছুই কমবে না।” (এ হাদীসটি আবদুর রাযযাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জান্নাতের। বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “যার হাতে মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রাণ রয়েছে তাঁর। শপথ! জান্নাতী খাবারের একটি গ্রাস উঠাবে এবং তার মনে খেয়াল জাগবে যে, অমুক প্রকারের খাদ্য হলে খুবই ভাল হতো! তখন ঐ গ্রাস তার মুখে ঐ জিনিসই হয়ে যাবে যার সে আকাঙ্ক্ষা করেছিল।” অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটি পাঠ করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বনিম্ন শ্রেণীর জান্নাতীর সাত তলা প্রাসাদ হবে। সে ষষ্ঠ তলায় অবস্থান করবে এবং সপ্তম তলাটি তার উপরে থাকবে। তার ত্রিশজন খাদেম থাকবে যারা সকাল-সন্ধ্যায় স্বর্ণ নির্মিত তিনশটি পাত্রে তার জন্যে খাদ্য পরিবেশন করবে। প্রত্যেকটিতে পৃথক পৃথক খাদ্য থাকবে এবং ওগুলো হবে খুবই সুন্দর ও সুস্বাদু। প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত তার খাওয়ার চাহিদা একই রূপ থাকবে। অনুরূপভাবে তাকে তিন শ’টি সোনার পেয়ালা, পানপাত্র ও গ্লাসে পানীয় জিনিস দেয়া হবে। ওগুলোও পৃথক পৃথক জিনিস হবে। সে তখন বলবেঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে অনুমতি দিলে আমি সমস্ত জান্নাতীকে দাওয়াত দিতাম। সবাই যদি আমার এখানে খায় তবুও আমার খাদ্য মোটেই হ্রাস পাবে না।” আয়ত চক্ষু বিশিষ্ট হ্রদের মধ্য হতে তার বাহাত্তরটি স্ত্রী থাকবে এবং দুনিয়ার স্ত্রী পৃথকভাবে থাকবে। তাদের মধ্যে এক একজন এক এক মাইল জায়গার মধ্যে বসে থাকবে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সাথে সাথে তাদেরকে বলা হবেঃ তোমাদের এই নিয়ামত চিরস্থায়ী থাকবে। আর তোমরাও হবে এখানে স্থায়ী। অর্থাৎ কখনো এখান হতে বের হবে না এবং এটা হতে স্থানান্তর কামনা করবে না।

এরপর মহান আল্লাহ তাদের উপর নিজের অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন:“এটাই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে, তোমাদের কর্মের ফল স্বরূপ।” অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে এটা দান করেছি আমার প্রশস্ত রহমতের গুণে। কেননা, কোন ব্যক্তিই আল্লাহর রহমত ছাড়া শুধু নিজের কর্মের বলে জান্নাতে যেতে পারে না। হ্যা, তবে অবশ্যই জান্নাতের শেণীভেদ যে হবে তা সৎ কার্যাবলীর পার্থক্যের কারণেই হবে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জাহান্নামী তার জান্নাতের জায়গা জাহান্নামের মধ্যে দেখতে পাবে এবং দেখে দুঃখ ও আফসোস করে বলবে যে, যদি আল্লাহ তাকে হিদায়াত দান করতেন তবে সেও মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত হতো। আর প্রত্যেক জান্নাতী তার জাহান্নামের জায়গা জান্নাতের মধ্যে দেখতে পাবে এবং ওটা দেখে আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পূর্বক বলবে:“আল্লাহ তা’আলা আমাকে সুপথ প্রদর্শন না করলে আমি সুপথ লাভে সক্ষম হতাম না।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেনঃ “প্রত্যেক লোকেরই একটি স্থান জান্নাতে রয়েছে এবং একটি স্থান জাহান্নামে রয়েছে। সুতরাং কাফির মুমিনের জাহান্নামের জায়গার ওয়ারিস হবে এবং মুমিন কাফিরের জান্নাতের জায়গার ওয়ারিস হবে। আল্লাহ তা’আলার ‘এটাই জান্নাত, যার অধিকারী তোমাদেরকে করা হয়েছে তোমাদের কর্মের ফল স্বরূপ এই উক্তির দ্বারা এটাকেই বুঝানো হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

খাদ্য ও পানীয়ের বর্ণনা দেয়ার পর মহান আল্লাহ জান্নাতের ফলমূল ও তরিতরকারীর বর্ণনা দিচ্ছেন যে, সেখানে জান্নাতীদের জন্যে রয়েছে প্রচুর ফলমূল, তারা সেগুলো হতে আহার করবে। মোটকথা, তারা ভরপুর নিয়ামতরাজিসহ মহান আল্লাহর পছন্দনীয় ঘরে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৭৪-৮০ নং আয়াতের তাফসীর:

উপরে সৎ লোকদের বর্ণনা দেয়া হয়েছিল এ জন্যে এখানে মন্দ ও অসৎ লোকদের অবস্থার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, পাপীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের আযাব। ভোগ করতে থাকবে। এক ঘন্টার জন্যেও তাদের ঐ শাস্তি হালকা করা হবে না। জাহান্নামে সে হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে। সর্বপ্রকারের কল্যাণ হতে সে। নিরাশ হয়ে যাবে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের প্রতি যুলুম করিনি, বরং তারা নিজেরাই ছিল যালিম। দুষ্কর্যের মাধ্যমে তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করেছে। আমি রাসূল পাঠিয়েছিলাম, কিতাব নাযিল করেছিলাম এবং যুক্তি-প্রমাণ কায়েম করেছিলাম। কিন্তু তারা তাদের হঠকারিতা, অবাধ্যতা এবং সীমালংঘন হতে বিরত হয়নি। ফলে আমি তাদেরকে এর প্রতিফল প্রদান করেছি। এটা আমার তাদের প্রতি যুলুম নয়, আমি তো আমার বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুম করি না।

জাহান্নামীরা জাহান্নামের রক্ষক মালিককে চীৎকার করে ডাক দিয়ে বলবেঃ ‘তোমার প্রতিপালক যেন আমাদেরকে নিঃশেষ করে দেন। সহীহ বুখারী শরীফের মধ্যে হযরত ইয়ালা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মিম্বরের উপর এ আয়াতটি পড়তে শুনেন, অতঃপর তিনি বলেন যে, জাহান্নামীরা মৃত্যু কামনা করবে যাতে শাস্তি হতে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে এটা ফায়সালা হয়ে গেছে যে, না তাদের মৃত্যু হবে এবং না তাদের শাস্তি হালকা করা হবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের উপর এ সিদ্ধান্ত নেই যে, তারা মৃত্যু বরণ করবে, আর তাদের হতে শাস্তি হালকা করা হবে না।” (৩৫:৩৬) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ওটা (উপদেশ) উপেক্ষা করবে যে নিতান্ত হতভাগা, যে মহা অগ্নিতে প্রবেশ করবে, অতঃপর সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না।” (৮৭:১১-১৩)।

যখন জাহান্নামীরা জাহান্নামের রক্ষক মালিকের কাছে আবেদন করবে যে, আল্লাহ তাআলা যেন তাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন, তখন মালিক উত্তরে বলবেঃ ‘তোমরা এখানে এভাবেই থাকবে, তোমাদের আর মৃত্যু হবে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, হলো এক হাজার বছর। অর্থাৎ তোমরা মরবেও না, মুক্তিও পাবে না এবং এখান হতে পালাতেও পারবে না।

এরপর মহান আল্লাহ তাদের দুস্কার্যের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, যখন তিনি তাদের সামনে সত্যকে পেশ করেন অর্থাৎ তাদের সামনে তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেন। তখন তারা তা মেনে নেয়া তো দূরের কথা, ওর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতঃ মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওটা তাদের মনেই চায় না। তাই তারা হকপন্থীদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। তারা অসত্য ও অন্যায়ের দিকেই ঝুঁকে থাকে এবং অসৎপন্থীদের সাথেই তাদের খুব মিল মহব্বত। সুতরাং তাদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা আজ নিজেদেরকেই ভৎসনা কর এবং নিজেদের উপরই দুঃখ আফসোস কর। কিন্তু সেদিন তাদের আফসোসেও কোন উপকার হবে না।

এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ “তারা জঘন্য চক্রান্তের ইচ্ছা করেছিল, তখন আমিও কৌশল করেছিলাম।’ মুজাহিদ (রঃ) এটার এই তাফসীর করেছেন এবং এর স্বপক্ষে আল্লাহ্ পাকের নিম্নের উক্তিটি রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমিও এমন কৌশল করেছিলাম যে, তারা বুঝতেই পারে না।” (২৭:৫০) মুশরিকরা সত্যকে এড়িয়ে চলার জন্যে নানা প্রকারের কৌশল অবলম্বন করতো। আল্লাহ তাআলাও তখন তাদেরকে ধোকার মধ্যেই রেখে দেন এবং তাদের দুষ্কর্মের শাস্তি তাদের মাথার উপর এসে না পড়া পর্যন্ত তাদের চক্ষু খুললো না। এ জন্যেই এর পরেই প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমি অবশ্যই তাদের সমস্ত গোপন বিষয় অবগত রয়েছি। আর আমার ফেরেশতারা তো তাদের নিকট থেকে সবকিছু লিপিবদ্ধ করে। অর্থাৎ আমি নিজেই তো তাদের সমস্ত গোপন বিষয়ের খবর রাখি, তদুপরি আমার নির্ধারিত ফেরেশতারা তাদের ছোট বড় সব আমলই লিপিবদ্ধ করে রাখছে।
৮১-৮৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি ঘোষণা করে দাও- যদি এটা মেনে নেয়া হয় যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে তবে আমার মাথা নোয়াতে চিন্তা কি? না আমি তার কোন আদেশ অমান্য করি এবং না তার হুকুম হতে বিমুখ হই। যদি এরূপই হতো তবে আমি তো সর্বপ্রথম এটা স্বীকার করে নিতাম। কিন্তু মহান আল্লাহর সত্তা এরূপ নয় যে, কেউ তার সমান ও সমকক্ষ হতে পারে। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, শর্তরূপে যে বাক্য আনয়ন করা হয় তা পূর্ণ হয়ে যাওয়া জরুরী নয়। এমন কি ওর সম্ভাবনাও জরুরী নয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করার ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। পবিত্র ও মহান তিনি। তিনি আল্লাহ, এক, প্রবল পরাক্রমশালী।”(৩৯:৪)।

কোন কোন তাফসীরকার (আরবী)-এর অর্থ ‘অস্বীকারকারী’ও করেছেন। যেমন হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) তাঁদের মধ্যে একজন। সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, এখানে (আরবী)-এর অর্থ হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ অস্বীকারকারীদের অগ্রণী। আর এটা (আরবী) হবে, এবং যেটা ইবাদতের অর্থে হবে সেটা (আরবী) হবে। এর প্রমাণ হিসেবে এই ঘটনাটি রয়েছে যে, একটি মহিলা বিবাহের ছয় মাস পরেই সন্তান প্রসব করে। তখন হযরত উসমান (রাঃ) মহিলাটিকে রজম করার বা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) প্রতিবাদ করে বলেন যে, আল্লাহ তা’আলার কিতাবে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সন্তানের গর্ভধারণ ও দুধ ছাড়ানোর সময়কাল হচ্ছে ত্রিশ মাস।”(৪৬:১৫) আর অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তার (সন্তানের) দুই বছরে দুধ ছাড়ানো হয়। বর্ণনাকারী বলেন যে, হযরত আলী (রাঃ) যখন এই দলীল পেশ করলেন, (আরবী) অর্থাৎ “তখন হযরত উসমান (রাঃ) এটা অস্বীকার করতে পারলেন না। সুতরাং তিনি মহিলাটিকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। এখানেও (আরবী) শব্দ রয়েছে। কিন্তু এই উক্তির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, শর্তের জবাবে এ অর্থ ঠিকভাবে বসে না। এটা মেনে নিলে অর্থ দাঁড়াবে ? যদি রহমানের (আল্লাহর) সন্তান থাকে তবে আমিই হলাম প্রথম অস্বীকারকারী। কিন্তু এই কালামে কোন সৌন্দর্য থাকছে না। হ্যা, তবে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে, এখানে (আরবী) শব্দটি শর্তের জন্যে নয়, বরং নাফী বা নেতিবাচক হিসেবে এসেছে। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। তখন বাক্যটির অর্থ হবেঃ রহমান বা দয়াময় আল্লাহর কোন সন্তান নেই এবং আমিই তার প্রথম সাক্ষী।’ হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এটা হলো এমন কালাম যা আরবদের পরিভাষায় রয়েছে। অর্থাৎ না আল্লাহর সন্তান আছে এবং না আমি তার উক্তিকারী। আবু সাখর (রঃ) বলেন যে, উক্তিটির ভাবার্থ হচ্ছেঃ ‘আমি তো প্রথম হতেই তাঁর ইবাদতকারী এবং এটা ঘোষণাকারী যে, তাঁর কোন সন্তান নেই এবং আমি তার তাওহীদকে স্বীকার করে নেয়ার ব্যাপারেও অগ্রণী। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ ‘আমিই তাঁর প্রথম ইবাদতকারী এবং একত্ববাদী, আর তোমাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন, এর অর্থ হলোঃ ‘আমিই প্রথম অস্বীকারকারী। অভিধানে এ দুটিই রয়েছে, অর্থাৎ (আরবী), তবে প্রথমটিই নিকটতর। কেননা, এটা শর্ত ও জাযা হয়েছে। কিন্তু এটা অসম্ভব।

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ যদি তাঁর সন্তান হতো তবে আমিই সর্বপ্রথম তা স্বীকার করে নিতাম। কিন্তু তা হতে তিনি পবিত্র ও মুক্ত। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ উক্তিটিই পছন্দ করেছেন এবং যারা (আরবী) শব্দটিকে (আরবী) বা নেতিবাচক বলেছেন তিনি তাঁদের এ উক্তি খণ্ডন করেছেন। আর এজন্যে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তারা যা আরোপ করে তা হতে পবিত্র ও মহান, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অধিপতি এবং আরশের অধিকারী। তিনি তো এক, অভাবমুক্ত। তাঁর কোন নীর, সমকক্ষ ও সন্তান নেই।

মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তাদেরকে যে দিবসের কথা বলা হয়েছে তার সম্মুখীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদেরকে তুমি বাক-বিতণ্ডা ও ক্রীড়া-কৌতুক করতে দাও। তারা এসব খেল-তামাশা ও ক্রীড়া-কৌতুকে লিপ্ত থাকবে এমতাবস্থায়ই তাদের উপর কিয়ামত এসে পড়বে। ঐ সময় তারা তাদের পরিণাম জানতে পারবে।

এরপর মহান আল্লাহর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও বুযুর্গীর আরো বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, যমীন ও আসমানের সমস্ত মাখলুক তার ইবাদতে লিপ্ত রয়েছে এবং সবাই তাঁর সামনে অপারগ ও শক্তিহীন। তিনিই প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনিই আল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে, তিনি তোমাদের গোপনীয় ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা উপার্জন কর সেটাও তিনি জানেন।”(৬:৩) কত মহান তিনি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সবকিছুর সার্বভৌম অধিপতি! তিনি সর্বপ্রকারের দোষ হতে পবিত্র ও মুক্ত। তিনি সবারই অধিকর্তা। তিনি সর্বোচ্চ, সমুন্নত ও মহান। এমন কেউ নেই যে তার কোন হুকুম টলাতে পারে। কেউ এমন নেই যে তাঁর মজীর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সবকিছুই তার অধিকারভুক্ত। সবকিছুই তার ক্ষমতাধীন। কিয়ামতের জ্ঞান শুধু তারই আছে। তিনি ছাড়া কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সঠিক সময়ের জ্ঞান কারো নেই। তাঁর নিকট সবাই প্রত্যাবর্তিত হবে। প্রত্যেককেই তিনি তার কৃতকর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন।

অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে ডাকে, সুপারিশের ক্ষমতা তাদের নেই। অর্থাৎ কাফিররা তাদের যেসব বাতিল মাবুদকে তাদের সুপারিশকারী মনে করে রেখেছে, তাদের কেউই সুপারিশের জন্যে সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। কারো সুপারিশে তাদের কোন উপকার হবে না। এরপরে ইসতিসনা মুনকাতা রয়েছে অর্থাৎ তবে তারা ব্যতীত যারা সত্য উপলব্ধি করে ওর সাক্ষ্য দেয়। আর তারা নিজেরাও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। আল্লাহ তা’আলা সৎ লোকদেরকে তাদের জন্যে সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন এবং সেই সুপারিশ তিনি কবুল করবেন।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি যদি এই কাফিরদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে? তবে তারা জবাবে অবশ্যই বলবেঃ আল্লাহ। তবুও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?’ অর্থাৎ এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, তারা আল্লাহ তা’আলাকে এককভাবে সৃষ্টিকর্তা মেনে নেয়ার পরেও অন্যদেরও তারা উপাসনা করছে যারা সম্পূর্ণরূপে শক্তিহীন! তারা একটুও চিন্তা করে দেখে না যে, সৃষ্টি যখন একজনই করেছেন তখন অন্যদের ইবাদত করা যায় কি করে? তাদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা এতো বেশী বেড়ে গেছে যে, এই সহজ সরল কথাটি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তও তারা বুঝতে পারে না। আর বুঝালেও তারা বুঝে না। তাই তো মহান আল্লাহ বিস্ময় প্রকাশ পূর্বক বলেনঃ ‘তবুও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে!

ইরশাদ হচ্ছেঃ মুহাম্মাদ (সঃ) নিজের এ বক্তব্য বললেন অর্থাৎ স্বীয় প্রতিপালকের নিকট স্বীয় কওমের অবিশ্বাসকরণের অভিযোগ করলেন এবং বললেন যে, তারা ঈমান আনবে না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “রাসূল বললো- হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে।”(২৫:৩০) ইমাম ইবনে জারীরও (রাঃ) এই তাফসীরই করেছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন যে, ইবনে মাসউদ (রঃ)-এর কিরআত (আরবী) (৪৩:৮৮) এই রূপ রয়েছে। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ “এটা তোমাদের নবী (সঃ)-এর উক্তি, তিনি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে স্বীয় কওমের অভিযোগ করেন।” ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) (আরবী)-এর দ্বিতীয় কিরআত (আরবী)-এর উপর যবর দিয়েও বর্ণনা করেছেন। আর তিনি এর দু’টি তালিকা বর্ণনা করেছেন। একটি এই যে, এটা (আরবী)-এর উপর হয়েছে। দ্বিতীয় এই যে, এখানে। ক্রিয়া পদটি উহ্য মেনে নেয়া হবে। আর যখন (আরবী)-এর নীচে (আরবী) দিয়ে পড়া হবে তখন এটা (আরবী)-এর উপর (আরবী) হবে। তখন অর্থ হবেঃ কিয়ামতের জ্ঞান এবং এই উক্তির জ্ঞান তাঁরই রয়েছে।

সূরার শেষে ইরশাদ হচ্ছেঃ “(হে নবী সঃ)! সুতরাং তুমি তাদেরকে উপেক্ষা কর এবং বলঃ সালাম; শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।’ অর্থাৎ নবী (সঃ) যেন এ কাফিরদের মন্দ কথার জবাব মন্দ কথা দ্বারা না দেন, বরং তাদের মন জয়ের জন্যে কথায় ও কাজে উভয় ক্ষেত্রেই যেন নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করেন এবং ‘সালাম’ (শান্তি) একথা বলেন। সত্বরই তারা প্রকৃত অবস্থা জানতে পারবে। এর দ্বারা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে মুশরিকদেরকে কঠিনভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আর এটা হয়েও গেল যে, তাদের উপর এমন শাস্তি আপতিত হলো যা টলবার নয়। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় দ্বীনকে সমুন্নত করলেন এবং স্বীয় কালেমাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিলেন। তিনি তার মুমিন ও মুসলিম বান্দাদেরকে শক্তিশালী করলেন। অতঃপর তাদেরকে জিহাদ ও নির্বাসনের হুকুম দিয়ে দুনিয়ায় এমনভাবে জয়যুক্ত করলেন যে, আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে অসংখ্য লোক প্রবেশ করলো এবং প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লো। সুতরাং প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। আর তিনিই সর্বাপেক্ষা ভাল জ্ঞান রাখেন।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*কোরআনের ক্যানভাসে মােমেন ও পাপীদের পরকালীন চিত্র : এর পর আরবের মােশরেকরাও রসূল(স.)-এর সাথে হযরত ঈসা(আ.)-কে নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়। হযরত ঈসা পরবর্তীকালের দল-উপদলগুলাের অপতৎপরতা ও নানা রকমের বিভ্রান্তিকর গুজব ও অপবাদ রটনার কারণেই এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। যুলুমবাজ ও অপরাধপ্রবণ মােশরেকদের সম্পর্কে কথা বলার পর এবার হযরত ঈসার পরবর্তী সেই সব কোন্দলরত দল-উপদলগুলােকে রাসূল(সা.)-এর সময়ের বিতর্ক কারীদের সাথে একীভূত করে তাদেরকে কেয়ামতের দিন এক কাতারে সমবেত হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে, আর এই সাথে জান্নাতে অবস্থানকারী সম্মানিত মােত্তাকীদের বিবরণও দেয়া হচ্ছে।(আয়াত ৬৬-৭৭)। শুরুতে দেখানাে হয়েছে তাদের অজান্তে আকস্মিকভাবে কেয়ামতের আগমনের দৃশ্য।(আয়াত ৬৬) এই আকস্মিক ঘটনা একটা নতুন দৃশ্যের অবতারণ ঘটাবে, দুনিয়ার জীবনে শত্রু ও বন্ধুর যে অবস্থান সবার কাছে পরিচিতি ছিলাে, তা সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে, বন্ধুরা সেদিন পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে মােত্তাকীরা ছাড়া।'(আয়াত ৬৭) বন্ধুদের এভাবে শত্রুতে পরিণত হওয়ার কারণটা তাদের বন্ধুত্বের কারণের মধ্যেই নিহিত। তারা দুনিয়ার জীবনে অন্যায়ের ওপর একমত থাকতাে এবং একে অপরকে গােমরাহীর ব্যাপারে উৎসাহিত করতাে। কেয়ামতের দিন তারা পরস্পরকে ভৎর্সনা করবে এবং গােমরাহী ও আযাবের জন্যে একে অপরকে দায়ী করবে। কেয়ামতের দিন তারা অন্তরংগ বন্ধু থেকে প্রকাশ্য শত্রুতে রূপান্তরিত হবে। তবে মােত্তাকীদের অবস্থা এর ব্যতিক্রম। তাদের বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে। (এমনকি দুনিয়ার জীবনে কোনাে ভুল বুঝাবুঝি মনােমালিন্য থেকে থাকলে তাও দূর করে দেয়া হবে।(আল হিজর ৪৭) কেননা তারা হেদায়াতের পথের ওপর ঐক্যবদ্ধ ছিলাে। সত্য ও কল্যাণের ব্যাপারে এবং আখেরাতের মুক্তির ব্যাপারে তারা পরস্পরের শুভাকাংখী ছিলাে। বন্ধুরা শত্রুতে পরিণত হয়ে যখন ঝগড়া বিবাদ ও পারস্পরিক কলহ কোন্দলে লিপ্ত হবে, তখন মােত্তাকী ও পরহেযগারদেরকে আল্লাহ তায়ালা সম্বোধন করবেন। ‘হে আমার বান্দারা! তােমাদের আজ কোনাে ভয় নেই…!'(আয়াত ৬৮-৭১) অর্থাৎ আজ তােমরা আনন্দে মাতােয়ারা থাকবে। তারপর কল্পনার চোখে দেখা হচ্ছে, যেন স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র নিয়ে ঘােরা হচ্ছে, বেহেশতে মনে যা চায়, তাই পাওয়া যাচ্ছে এবং মন যা চায়, তা ছাড়াও যা দেখলে চোখ জুড়ায় তাও সেখানে বিদ্যমান। আর সৌন্দর্য ও পূর্ণতার সকল সাজ সরঞ্জামও সেখানে রয়েছে। তাদের কাছ দিয়ে স্বর্ণের পানপাত্র ও থালা ঘােরানাে হবে এবং যা মনে চায় এবং যা দেখলে চোখ জুড়ায়, তার সবই সেখানে থাকবে।’ আর এই নেয়ামতের সাথে সাথে থাকবে এর চেয়েও বড় ও উত্তম জিনিস, সেটা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন, ‘আর তােমরা সেখানে চিরদিন বসবাস করবে। ওটা হচ্ছে সেই জান্নাত, তােমাদেরই কৃত কর্মের কল্যাণে যার তােমরা মালিক হবে…(আয়াত ৭১-৭৩) এরপর শুরু হয়েছে অপরাধীদের অবস্থার বিবরণ, ‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা জাহান্নামের আযাব চিরস্থায়ী হবে।’ বস্তুত এটা হলাে চিরস্থায়ী আযাব। তারা কঠিন আযাব ভােগ করবে। যা এক মুহূর্তের জন্যেও কমবে না বা ঠান্ডা হবে না। তারা মুক্তির আশার কোনাে আলাের ঝলকও দেখতে পাবে না। তারা হতাশায় ভেংগে পড়বে।(আয়াত ৭৫) তারা এভাবেই নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের জায়গায় নিক্ষেপ করেছে।(আয়াত ৭৬) এরপর দূর থেকে একটা আর্তনাদ শােনা যাবে, যা হতাশা, বেদনা ও মর্ম যাতনায় পরিপূর্ণ, ‘তারা ডাকবে, হে মালেক, (দোখখের প্রহরী) তােমার প্রভু আমাদেরকে মেরে ফেলুক।(আয়াত ৭৭) এই আর্ত চিৎকার অনেক দূর থেকে ভেসে আসবে। জাহান্নামের রুদ্ধদ্বার কক্ষগুলাে থেকে ভেসে আসবে। এটা আসলে সেই সব অপরাধীর চিৎকার। তারা মুক্তি বা সাহায্য চাইবে না। কেননা তেমন কোনাে আশা থাকবে না। তারা নিজেদের তাৎক্ষণিক মৃত্যু চাইবে। এটা তাদেরকে শান্তি দেবে বলে তাদের মনে হবে। মৃত্যুই যেন প্রত্যাশায় পরিণত হবে। এই চিৎকার থেকেই বুঝা যায় কতাে কঠিন বিপদ মুসিবতে তারা থাকবে। এই আর্তনাদের আড়াল থেকে আমরা এমন কিছু লােকের সন্ধান পাই যারা আযাবের ভয়াবহতায় দিশেহারা হয়ে যাবে ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। আযাবের যন্ত্রণা তাদের ধৈর্যের বাধন ছিন্ন করে ফেলবে। ফলে সেই তিক্ত চিৎকার ধ্বনিটা স্বতস্ফূর্তভাবেই বেরিয়ে আসবে, ‘হে মালেক, তোমার প্রভু আমাদেরকে মেরে ফেলুক। কিন্তু এর জবাবটা আসবে অত্যন্ত অপমানজনক ও বেপরোয়া কন্ঠে, সে বলবে, তােমাদেরকে তাে এ অবস্থায়ই থাকতে হবে।’ অর্থাৎ মুক্তিও নেই, মৃত্যু নেই, যেমন আছ, তেমনিই থাকবে।’ এই ভয়ংকর দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে এই সব সত্যদ্রোহীকে সম্বােধন করা হচ্ছে, যারা হেদায়াত থেকে বিমুখ হওয়ায় এই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। সর্ব সমক্ষে তাদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে এবং এটা বিস্ময়ের সবচেয়ে উপযুক্ত পরিবেশ।(আয়াত ৭৮-৮০) সত্য ও ন্যায়কে অপছন্দ ও ঘৃণা করার এই মনােভাবটাই তাদের ও সত্যের অনুসারীদের মাঝে আড়াল সৃষ্টি করে রেখেছিলাে। সত্যকে বুঝতে তাদের বাকী ছিলাে না এবং রসূল(স.)-এর সত্যবাদিতায় তাদের সন্দেহের লেশমাত্রও ছিলাে না। কেননা যাকে তারা কখনাে কোনাে মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা বলতে দেখেনি, সে আল্লাহর ব্যাপারে কিভাবে মিথ্যা বলবে? যারা সত্যের বিরােধী, তাদের বেশীর ভাগই নিশ্চিতভাবে জানে যে, ওটা সত্য। কিন্তু তারা তা অপছন্দ করে। কেননা সেই সত্য তাদের প্রবৃত্তির খায়েশ ও কামনা বাসনার বিরােধী এবং তাদের খেয়ালখুশী ও প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার পথে বাধা দেয়। তারা তাদের প্রবৃত্তির লালসার সামনে কাপুরুষ ও দুর্বল। কিন্তু সত্য ও তার আহবায়কদের সামনে খুবই সাহসী ও স্পর্ধিত। হয়তাে বা প্রবৃত্তির লালসার সামনে তাদের দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই সত্যের সামনে তাদের দৃষ্টতা ও সাহসিকতার ইন্ধন যােগায়। এ কারণেই মহাশক্তিধর এবং গােপন ও প্রকাশ্য সর্ব বিষয়ে আগত মহান আল্লাহ তাদেরকে ধমক দিয়েছেন ৭৯ ও ৮০ নং আয়াতে। সত্য যেখানে উপস্থিত সেখানে বাতিলের ওপর বাতিলপন্থীদের জিদ ধরার কারণে মহান আল্লাহও বদ্ধপরিকর হন যে, সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করবেনই। আল্লাহ তায়ালা তার গােপন ও প্রকাশ্য বিষয়ে সম্যক জ্ঞান দ্বারা তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও কৃটিল চক্রান্তের জবাব দেবেন। এই দুর্বল সৃষ্ট জীবেরা যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহর মােকাবেলায় দাঁড়ায়, তখন এই মােকাবেলার পরিণতি কী হতে পারে, তা কারাে অজানা থাকতে পারে না। এই ভয়ংকর হুমকির পর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ছেড়ে দেন এবং রসূল(স.)-কে নির্দেশ দেন, ‘বলো, আল্লাহর যদি কোনো সন্তান থেকে থাকে তবে আমিই সর্বপ্রথম তার উপাসনা করবাে'(আয়াত ৮১-৮৩) তারা ফেরেশতাদের উপাসনা করতাে এই ধারণার ভিত্তিতে যে, তারা আল্লাহর মেয়ে। আর যদি সত্যিই আল্লাহর কোনাে সন্তান থাকতাে, তাহলে আল্লাহর নবী ও রসূলই সবার আগে জানতেন এবং তাদের উপাসনা করতেন। কেননা তিনি আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী ব্যক্তি। তার এবাদাতও আনুগত্য করা ও তার সন্তান থেকে থাকলে সে সন্তানের যথােচিত শ্রদ্ধা করার কাজটা তিনিই সবার আগে করতেন। কিন্তু তিনি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে এবাদাত করেন না। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর কোনাে সন্তান থাকার ব্যাপারে তারা যে দাবী করে, তার কোনই ভিত্তি নেই। আল্লাহ তায়ালা এমন উদ্ভট দাবী থেকে পবিত্র। ‘আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিপালক, আরশের প্রতিপালক তাদের অপবাদ থেকে পবিত্র।'(আয়াত ৮২) মানুষ যখন এই আকাশ ও পৃথিবী এর শৃংখলা, সমন্বয় এবং এর বিধি ব্যবস্থা ও পরিচালনার পেছনে যে মহা শক্তি ও পরাক্রম লুকিয়ে আছে, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে, তখন উল্লেখিত ধরনের যাবতীয় দাবী দাওয়া ও ধারণা তার কাছে বাতিল বলে মনে হয়। সে স্বভাবতই অনুধাবন করতে পারে যে, এই বিশাল বিশ্বের স্রষ্টার সমকক্ষ কেউ থাকতে পারে না। যে সৃষ্টির জন্ম আছে, মৃত্যু আছে, বংশ বৃদ্ধি আছে, সে সৃষ্টি কখনাে স্রষ্টার সমান হতে পারে না। তাই উক্ত দাবী নিছক কৌতুক ও ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আর এ ধরনের জিনিস আলােচনার যােগ্য নয় বরং তা উপেক্ষার যােগ্য এবং এ ধরনের লােকদেরকে সাবধান করে দেয়াই ন্যায়সংগত। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতএব ওদেরকে ছেড়ে দাও বাকবিতন্ডা ও ক্রীড়া কৌতুকে লিপ্ত থাকুক যতােদিন তারা প্রতিশ্রুত দিনের সম্মুখীন না হয়…’(আয়াত ৮৩) অর্থাৎ যে দিনের কিছু চিত্র তাদেরকে ইতিপূর্বে দেখানাে হয়েছে। এরপর তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দানের পর মহান স্রষ্টার পবিত্রতা ঘােষণা করা হয়েছে।(আয়াত ৮৬) এ আয়াতে ঘােষণা করা হয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবীতে মাত্র একজনই ইলাহ বা মাবুদ রয়েছেন, যার গুণাবলীতে আর কেউ শরীক নেই। তার সব কাজই বিজ্ঞানসম্মত ও প্রজ্ঞাময় এবং বিশাল প্রকৃতির রাজ্যে তার জ্ঞান অপরিসীম। এরপর পুনরায় তাবারাকা শব্দ দ্বারা আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা করা হচ্ছে। এ শব্দের অর্থ হলাে, তিনি তাদের কল্পিত দাবীর অনেক উর্ধে। তিনি আকাশ, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যকার সব কিছুর প্রতিপালক। একমাত্র তিনিই কেয়ামতের সঠিক তথ্য জানেন এবং তার কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। যে ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর মেয়ে ও শরীক মনে করা হতাে। তাদের কেউ সেদিন কারাে জন্যে কোনাে সুপারিশ করতে পারবে না। অথচ তারা তাদেরকে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে সমর্থ বলে মনে করতাে। কেননা সত্যকে স্বীকার করেনি এমন কেউ সুপারিশ করার ও পাওয়ার অধিকারী হবে না। আর সত্যের প্রতি যে সাক্ষ্য দিয়েছে ও ঈমান এনেছে, সে সত্যের বিরোধীর পক্ষে সুপারিশ করবে না। এরপর স্বাভাবিক যুক্তি নিয়ে তাদের মােকাবেলা করা হয়েছে। এটা সেই যুক্তি, যা নিয়ে তারাও সন্দেহ পােষণ করে না এবং তর্ক করে না। সেটা হলাে এই যে, আল্লাহ তায়ালাই তাদের স্রষ্টা। সুতরাং তার সাথে অন্য কাউকে তারা কিভাবে শরীক করে কিংবা যে শরীক করে তাকে কিভাবে সুপারিশের যােগ্য মনে করে?(আয়াত ৮৭) অর্থাৎ যে সত্যকে তাদের প্রকৃতি অস্বীকার করে না, বরং মেনে নেয়, সে সত্য থেকে তারা কিভাবে দূরে সরে যায় এবং কিভাবে তার অনিবার্য দাবীকে অস্বীকার করে? সূরার শেষে রসূল কর্তৃক মহান আল্লাহর কাছে কাফেরদের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানানােকে অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে।(আয়াত ৮৯) এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ বাচনভংগী এবং অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। এই ফরিয়াদের জবাবে রসূল(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তিনি তাদেরকে এড়িয়ে যান, তাদের পরােয়া না করেন, তাদেরকে নিয়ে মাথা না ঘামান, নিশ্চিন্ত থাকেন এবং ঠান্ডা মাথায়, শান্ত মনে, উদারচিত্তে বর্তমান পরিস্থিতির মােকাবেলা করেন। এই নির্দেশ হচ্ছে কেয়ামত সম্পর্কে, অতএব, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং বলো, সালাম! তারা শীঘ্রই জানতে পারবে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# অন্য কথায় কেবল সেই সব বন্ধুত্ব টিকে থাকবে যা পৃথিবীতে নেকী ও আল্লাহভীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্য সব বন্ধুত্ব শত্রুতায় রূপান্তরিত হবে। আজ যারা গোমরাহী, জুলুম-অত্যাচার এবং গোনাহর কাজে একে অপরের বন্ধু ও সহযোগী কাল কিয়ামতের দিন তারাই একে অপরের প্রতি দোষারোপ করবে এবং নিজেকে রক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এ বিষয়টি কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় বারবার বলা হয়েছে। যাতে প্রত্যেকটি মানুষ এই পৃথিবীতেই ভালভাবে ভেবে-চিন্তে দেখতে সক্ষম হয় যে, কোন্ প্রকৃতির লোকদের বন্ধু হওয়া তাদের জন্য কল্যাণকর এবং কোন্ প্রকৃতির লোকদের বন্ধু হওয়া ধ্বংসাত্মক।
# মূল আয়াতে أَزْوَاجٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা স্ত্রীদের বুঝাতেও ব্যবহৃত হতে পারে আবার কোন ব্যক্তির একই পথের পথিক সমমনা ও সহপাঠী বন্ধুদের বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। এই ব্যাপক অর্থবোধক শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এজন্য যে, তার মধ্যে যেন এই উভয় অর্থই শামিল হয়। ঈমানদারদের ঈমানদার স্ত্রীরা এবং তাদের মু’মিন বন্ধুরাও জান্নাতে তাদের সাথে থাকবে।
# মালেক অর্থ জাহান্নামের ব্যবস্থাপক। কথার ইঙ্গিত থেকেই এটিই প্রকাশ পাচ্ছে।
# আমি তোমাদের সামনে প্রকৃত সত্য সুস্পষ্ট করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা ছিলে সত্যের পরিবর্তে কেচ্ছা-কাহিনীর ভক্ত এবং সত্য ছিল তোমাদের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। এখন নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতা মূলক পছন্দের পরিণাম দেখে অস্থির হয়ে উঠছো কেন? হতে পারে এটা জাহান্নামের ব্যবস্থাপকের জবাবেরই একটা অংশ। আবার এও হতে পারে যে, “তোমরা এভাবেই এখানে পড়ে থাকবে” পর্যন্তই জাহান্নামের ব্যবস্থাপকের জবাব শেষ হয়ে গিয়েছে এবং এই দ্বিতীয় বাক্যংশটা আল্লাহর নিজের কথা। প্রথম ক্ষেত্রে জাহান্নামের ব্যবস্থাপকের উক্তি আমি তোমাদের কাছে ন্যায় ও সত্য নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনি যেমন সরকারের কোন বড় কর্মকর্তা সরকারের পক্ষ থেকে বলতে গিয়ে ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার করে এবং তার অর্থ হয় আমাদের সরকার এ কাজ করেছে বা এ নির্দেশ দিয়েছে।
# কুরাইশ নেতারা তাদের গোপন সভাসমূহে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে যেসব কথা আলোচনা করছিলো এখানে তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
# কাউকে আল্লাহর সন্তান হিসেবে মানতে আমার অস্বীকৃতি এবং তোমরা যাদেরকে তাঁর সন্তান বলে আখ্যায়িত করছো তাদের ইবাদাত করতে আমার অস্বীকৃতি কোন জিদ বা হঠকারিতার ভিত্তিতে নয়। আমি যে কারণে তা অস্বীকার করি তা শুধু এই যে, প্রকৃতপক্ষে কেউই আল্লাহর পুত্র বা কন্যা নয়। তোমাদের এই আকীদা-বিশ্বাস সত্য ও বাস্তবতার পরিপন্থী। আল্লাহর সন্তান আছে এটাই যদি বাস্তব হতো তাহলে আমি আল্লাহর এমন বিশ্বাসী বান্দা যে, তোমাদের সবার আগে আমি তাঁর বন্দেগী মেনে নিতাম।
# আসমান ও যমীনের আল্লাহ‌ আলাদা আলাদা নয়, বরং গোটা বিশ্ব-জাহানের আল্লাহ‌ একজনই। গোটা বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা তাঁরই জ্ঞান ও কৌশলে পরিচালিত হচ্ছে এবং সমস্ত সত্য তিনিই জানেন।
# খোদায়ীর ব্যাপারে কেউ তাঁর অংশীদার থাকবে এবং এই বিশাল বিশ্ব-জাহানের শাসন কর্তৃত্বে কারো দখল থাকবে এমন অবস্থা থেকে তাঁর মহান সত্তা অনেক ঊর্ধ্বে। নবী হোক বা অলী, ফেরেশতা হোক বা জিন কিংবা রূহ, তারকা হোক বা গ্রহ আসমানে ও যমীনে যারাই আছে সবাই তাঁর বান্দা, দাস ও নির্দেশের অনুগত। খোদায়ীর কোন গুণে গুণান্বিত হওয়া কিংবা খোদায়ী ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে অধিকারী হওয়া তাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
# পৃথিবীতে তোমরা যাকেই সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক বানাও না কেন মৃত্যুর পর সেই একমাত্র আল্লাহর সাথেই তোমাদের পাল্লা পড়বে। তাঁর আদালতেই তোমাদের সমস্ত কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
# এ আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থঃ

প্রথম অর্থ হচ্ছে, মানুষ পৃথিবীতে যাদেরকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছে তারা কেউই আল্লাহর কাছে শাফায়াতকারী নয়। তাদের মধ্যে যারা পথভ্রষ্ট ও দুষ্কর্মশীল তারা নিজেরাই তো সেখানে অপরাধী হিসেবে উপস্থিত হবে। তবে যারা জ্ঞানের ভিত্তিতে (না জেনে শুনে নয়) ন্যায় ও সত্যের সাক্ষ্য দিয়েছিলো তাদের কথা ভিন্ন।

দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যারা শাফায়াত করার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার লাভ করবে তারাও কেবল সেই সব লোকের জন্যই শাফায়াত করতে পারবে যারা পৃথিবীতে জেনে শুনে (গাফলতিতে ও অজান্তে নয়) ন্যায় ও সত্যের সাক্ষ্য দিয়েছে। যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের প্রতি রুষ্ঠ ছিল কিংবা না বুঝে শুনে أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ও বলতো এবং অন্যান্য উপাস্যদের উপাসনাও করতো এমন কোন ব্যক্তির শাফায়াত না তারা নিজেরা করবে না তা করার অনুমতি পাবে।

তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, কেউ যদি বলে, সে যাদের উপাস্য বানিয়ে রেখেছে তারা অবশ্যই শাফায়াতের ক্ষমতা ও এখতিয়ার রাখে এবং আল্লাহর কাছে তাদের এমন ক্ষমতা ও আধিপত্য আছে যে, আকীদা-বিশ্বাস যাই হোক না কেন তারা যাকে ইচ্ছা মাফ করিয়ে নিতে পারে, তাহলে সে মিথ্যা বলে। আল্লাহর কাছে কারোরই এই মর্যাদা নেই। যে ব্যক্তি কারো জন্য এমন শাফায়াতের দাবী করে সে যদি জ্ঞানের ভিত্তিতে একথা সত্য হওয়ার প্রমাণ পেশ করতে পারে তাহলে সাহস করে এদিকে আসুক। কিন্তু সে যদি এরূপ প্রমাণ পেশ করার মত পজিশনে না থাকে— এবং নিশ্চিতভাবেই নেই—তাহলে অযথা শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে কিংবা শুধু অনুমান, সংস্কার ও ধারণার বশবর্তী হয়ে এরূপ একটি আকীদা পোষণ করা একেবারেই অর্থহীন আর এই খেয়ালীপনার ওপর নির্ভর করে নিজেদের পরিণামকে বিপদগ্রস্ত করা চরম নির্বুদ্ধিতা।

এ আয়াত থেকে আনুসাঙ্গিকভাবে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পাওয়া যায়। এক, এ থেকে জানা যায়, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে জ্ঞানবিহীন সাক্ষ্য দুনিয়াতে গ্রহণযোগ্য হলেও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দুনিয়াতে যে ব্যক্তিই মুখে কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করবে আমরা তাকে মুসলমান হিসেবে মেনে নেবো এবং যতক্ষণ না সে প্রকাশ্যে সুস্পষ্ট কুফরী করবে ততক্ষণ আমরা তার সাথে মুসলমানদের মতই আচরণ করতে থাকবো। কিন্তু আল্লাহর কাছে শুধু সেই ব্যক্তিই ঈমানদার হিসেবে গণ্য হবে যে তার জ্ঞান ও বুদ্ধির সীমা অনুসারে জেনে বুঝে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলেছে এবং সে একথা বুঝে যে এভাবে সে কি কি বিষয় অস্বীকার করেছে এবং কি কি বিষয় স্বীকার করে নিচ্ছে।

দুই, এ থেকে সাক্ষ্য আইনের এই সূত্রটিও পাওয়া যায় যে, সাক্ষ্যের জন্য জ্ঞান থাকা শর্ত। সাক্ষী যে ঘটনার সাক্ষ্য দান করছে তার যদি সে সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তাহলে তার সাক্ষ্য অর্থহীন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের একটি ফায়সালা থেকেও এ বিষয়টি জানা যায়। তিনি একজন সাক্ষীকে বলেছিলেনঃ اذا رايت مثل الشمس فاشهد والافدع (احكام القران للجصاص)

“যদি তুমি নিজ চোখে ঘটনা এমনভাবে দেখে থাকো যেমন সূর্যকে দেখছো তা হলে সাক্ষ্য দাও। তা না হলে দিও না।”
# এর দু’টি অর্থ। একটি হচ্ছে, যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, তাদের কে সৃষ্টি করেছেন? তাহলে তারা বলবে, আল্লাহ। অপরটি হচ্ছে, যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, তাদের উপাস্যদের স্রষ্টা কে তাহলে তারা বলবে, আল্লাহ।
# কুরআন মজীদের যেসব আয়াতে আরবী ব্যাকরণের অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন দেখা দেয় এ আয়াতটি তার অন্যতম। এখানে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে, وقيله কথাটির মধ্যে واو কোন্ প্রকৃতির এবং ওপরের বক্তব্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে কোন জিনিসটির সাথে এর সম্পর্ক? তাফসিরকারগণ এ সম্পর্কে বহু আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাদের সেই সব আলোচনার মধ্যে আমি কোন সন্তোষজনক বিষয় পাইনি। শাহ আবদুল কাদের (র) সাহেবের অনুবাদ থেকে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেইটিই আমার কাছে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলে মনে হয় অর্থাৎ এখানে واو ‘আতাফ’-এর (বাক্য সংযোজনের জন্য) জন্য ব্যবহৃত হয়নি, বরং শপথের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ আয়াতাংশের সাথে সম্পর্কিত। আর قيله এর সর্বনাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। يَا رَبِّ إِنَّ هَؤُلَاءِ قَوْمٌ لَا يُؤْمِنُونَ (হে রব, এরাই সেই সব লোক যারা মানছে না) আয়াতাংশ যার প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করছে। এক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়ঃ

“রসূলের এই বাণীর শপথ যে, হে রব! এরাই সেই সব লোক যারা মানছে না” কী বিস্ময়কর এদের প্রতারিত হওয়া। এরা নিজেরাই স্বীকার করছে যে, এদের ও এদের উপাস্যদের স্রষ্টাও আল্লাহ। তা সত্ত্বেও স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টি উপাসনার জন্য গোঁ ধরে আছে।

রসূলের এই কথাটির শপথ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের এই আচরণ স্পষ্ট প্রমাণ করছিলো যে, তারা প্রকৃতই হঠকারী লোক। কারণ, তাদের নিজেদের স্বীকৃতি অনুসারে তাদের আচরণের অযৌক্তিকতা প্রকাশ পাচ্ছে। এ ধরনের অযৌক্তিকতা আচরণ শুধু সেই ব্যক্তিই করতে পারে যে, না মানার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। অন্য কথায় এ শপথের অর্থ হচ্ছে, রসূল অতীব সত্য কথাই বলেছেন। প্রকৃতই এরা মেনে নেয়ার মত লোক নয়।
# তাদের রূঢ় কথা এবং ঠাট্টা-বিদ্রূপের কারণে তাদের জন্য বদদোয়া করো না কিংবা তার জবাবে রূঢ় কথা বলো না। বরং সালাম দিয়ে তাদের কাছে থেকে সরে যাও।

Leave a Reply