أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বই#১১১৮) [ ** যে সৎকাজ করবে সে নিজের জন্যই করবে। আর যে অসৎ কাজ করবে তার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে:-] www.motaher21.net সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া পারা:২৫ ১- ১৫ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১১৮)
[ ** যে সৎকাজ করবে সে নিজের জন্যই করবে। আর যে অসৎ কাজ করবে তার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া পারা:২৫
১- ১৫ নং আয়াত:-
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১
حٰمٓ ۚ﴿۱﴾
হা – মীম।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:২
تَنۡزِیۡلُ الۡکِتٰبِ مِنَ اللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ ﴿۲﴾
এ কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, যিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৩
اِنَّ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ لَاٰیٰتٍ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ؕ﴿۳﴾
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মু’মিনদের জন্য আসমান ও যমীনে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৪
وَ فِیۡ خَلۡقِکُمۡ وَ مَا یَبُثُّ مِنۡ دَآبَّۃٍ اٰیٰتٌ لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ ۙ﴿۴﴾
তোমাদের নিজেদের সৃষ্টির মধ্যে এবং যেসব জীব-জন্তুকে আল্লাহ‌ পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার মধ্যে বড় বড় নিদর্শন রয়েছে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী লোকদের জন্য।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৫
وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ وَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ رِّزۡقٍ فَاَحۡیَا بِہِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِہَا وَ تَصۡرِیۡفِ الرِّیٰحِ اٰیٰتٌ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ ﴿۵﴾
বহু নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য রাত ও দিনের পরিবর্তনে, যে বৃষ্টি বর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর তিনি পুনর্জীবিত করেন তাতে‌‌ এবং বায়ুর পরিবর্তনে।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৬
تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰہِ نَتۡلُوۡہَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ ۚ فَبِاَیِّ حَدِیۡثٍۭ بَعۡدَ اللّٰہِ وَ اٰیٰتِہٖ یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۶﴾
এগুলো আল্লাহর নিদর্শন, যা আমি তোমাদের সামনে যথাযথভাবে বর্ণনা করছি। আল্লাহ ও তাঁর নিদর্শনাদি ছাড়া এমন আর কী আছে যার প্রতি এরা ঈমান আনবে?
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৭
وَیۡلٌ لِّکُلِّ اَفَّاکٍ اَثِیۡمٍ ۙ﴿۷﴾
ধ্বংস এমন প্রত্যেক মিথ্যাবাদী ও দুষ্কর্মশীল ব্যক্তির জন্য।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৮
یَّسۡمَعُ اٰیٰتِ اللّٰہِ تُتۡلٰی عَلَیۡہِ ثُمَّ یُصِرُّ مُسۡتَکۡبِرًا کَاَنۡ لَّمۡ یَسۡمَعۡہَا ۚ فَبَشِّرۡہُ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۸﴾
সে আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনে যা তার কাছে তিলাওয়াত করা হয়, তারপর সে ঔদ্ধত্যের সাথে অটল থাকে যেন সে তা শোনেনি। অতএব, আপনি তাকে সুসংবাদ দিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির;
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:৯
وَ اِذَا عَلِمَ مِنۡ اٰیٰتِنَا شَیۡئَۨا اتَّخَذَہَا ہُزُوًا ؕ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ ؕ﴿۹﴾
যখন সে আমার আয়াতসমূহের কোন কথা জানতে পারে তখন তা নিয়ে উপহাস ও বিদ্রূপ করে। এরূপ প্রতিটি ব্যক্তির জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১০
مِنۡ وَّرَآئِہِمۡ جَہَنَّمُ ۚ وَ لَا یُغۡنِیۡ عَنۡہُمۡ مَّا کَسَبُوۡا شَیۡئًا وَّ لَا مَا اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَوۡلِیَآءَ ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿ؕ۱۰﴾
তাদের সামনে রয়েছে জাহান্নাম। তারা পৃথিবীতে যা কিছু অর্জন করেছে তার কোন জিনিসই তাদের কাজে আসবে না আবার আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তারা অভিভাবক বানিয়ে রেখেছেন তারাও তাদের জন্য কিছু করতে পারবে না। তাদের জন্য রয়েছে বড় শাস্তি।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১১
ہٰذَا ہُدًی ۚ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّہِمۡ لَہُمۡ عَذَابٌ مِّنۡ رِّجۡزٍ اَلِیۡمٌ ﴿٪۱۱﴾
এ কুরআন সৎপথের দিশারী ; আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে,তাদের জন্য রয়েছে খুবই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১২
اَللّٰہُ الَّذِیۡ سَخَّرَ لَکُمُ الۡبَحۡرَ لِتَجۡرِیَ الۡفُلۡکُ فِیۡہِ بِاَمۡرِہٖ وَ لِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِہٖ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿ۚ۱۲﴾
তিনিই তো আল্লাহ‌ যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর নির্দেশে জাহাজসমূহ সেখানে চলে আর তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে এবং কৃতজ্ঞ হতে পার।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৩
وَ سَخَّرَ لَکُمۡ مَّا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا مِّنۡہُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ ﴿۱۳﴾
তিনি তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিজের পক্ষ হতে, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে বহু নিদর্শন।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৪
قُلۡ لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا یَغۡفِرُوۡا لِلَّذِیۡنَ لَا یَرۡجُوۡنَ اَیَّامَ اللّٰہِ لِیَجۡزِیَ قَوۡمًۢا بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۱۴﴾
বিশ্বাসীদের বল, তারা যেন ক্ষমা করে ওদেরকে; যারা আল্লাহর দিনগুলির আশা করে না।‌‌ যাতে আল্লাহ এক সম্প্রদায়কে তার কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দেন।
সূরা:৪৫: আল্ জাসিয়া:১৫
مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ اَسَآءَ فَعَلَیۡہَا ۫ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۱۵﴾
যে সৎকাজ করবে সে নিজের জন্যই করবে। আর যে অসৎ কাজ করবে তার পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে। সবাইকে তো তার রবের কাছেই ফিরে যেতে হবে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন;-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই মক্কী সূরাটা ইসলামী আন্দোলনের সাথে মােশরেকদের আচরণ, ইসলামী দাওয়াতের যুক্তি প্রমাণ ও নিদর্শনাবলীর মােকাবেলায় তাদের কর্মপন্থা, ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের গােয়ার্তুমি ও হঠকারিতা এবং প্রবৃত্তির সর্বাত্মক অনুকরণে তাদের সংকোচহীনতা ও লজ্জাহীনতার একটা দিক তুলে ধরেছে। সেই সাথে এটাও তুলে ধরেছে যে, কোরআন কিভাবে তাদের গোঁড়ামি ও একগুয়েমিতে পরিপূর্ণ মনের চিকিৎসা করে। কোরআন তাদের এসব জটিল ব্যাধিকে তার গভীর প্রভাবশালী, সুতীক্ষ্ম আয়াতগুলাের সাহায্যে সম্পূর্ণ নিরাময় করে তােলে, তাদেরকে আল্লাহর আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তার পুরস্কার ও প্রতিদানের বিবরণ দেয় এবং তার নিয়ম নীতি ও বিশ্বজগতে কার্যকর তার প্রাকৃতিক বিধান তাকে অবহিত করে। যারা মক্কায় বসে ইসলামী আন্দোলনের বিরােধিতায় লিপ্ত ছিলাে এই সূরার আয়াতগুলােতে তাদের বিবরণ পড়তে গিয়ে আমরা তাদের মধ্য থেকে এমন একটা গােষ্ঠীকে দেখতে পাই, যারা গােমরাহী ও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত থাকতে বদ্ধপরিকর, যারা সত্যের বিরুদ্ধে চরম আগ্রাসী ও হঠকারী মানসিকতায় আক্রান্ত। আল্লাহ তায়ালা ও তার বাণীর প্রতি চরম বেয়াদব ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত এবং তার মােকাবেলায় তারা এমন কর্মকান্ডের আশ্রয় নেয়, যা তাদেরকে কঠিন আযাবের মকির যােগ্য বানায়। ৭ থেকে ৯ আয়াত পর্যন্ত এই গােষ্ঠীটার পরিচয় ছড়িয়ে আছে। আরাে একটা মানবগােষ্ঠীর পরিচয় পাই, যারা খুব সম্ভবত আহলে কিতাবের অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধ্যান ধারণা ও কুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি। নির্ভেজাল ঈমানদার ও সৎ মানুষের কোনাে মূল্যই তাদের কাছে নেই। তারা নিজেরা অত্যন্ত অসৎ কর্মশীল হওয়ায় তাদের সাথে সৎ কর্মশীল মােমেনদের মৌলিক পার্থক্য কী, তা তারা অনুধাবন করে না। কোরআন তাদের জানিয়ে দেয় যে, আল্লাহর মানদন্ডে এই দুই গােষ্ঠীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে এ কারণে তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তের সমালােচনা করেছে এবং সৃষ্টির আদিকাল থেকে আল্লাহর মানদন্ডে ন্যায়বিচারই যে সৃষ্টির মূল ভিত্তি সে কথা জানিয়ে দিয়েছে।(আয়াত ২১-২২) আরাে একটা মানবগােষ্ঠী আমরা দেখতে পাই, যাদের একমাত্র মনিব হলাে তাদের প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিকে তারা উপাস্য মেনে বসে আছে এবং এর নির্দেশ শিরােধার্য করে চোখ বুজে তারা তার আনুগত্য করে। এ গােষ্ঠীটার পরিচয় দেয়া হয়েছে ২৩ নং আয়াতে। এই গােষ্ঠী আখেরাতকে অস্বীকার করে, পুনরুজ্জীবন ও হিসাব নিকাশকে অবিশ্বাস করে এবং তার জন্যে এমন প্রমাণ চায় যা এই পৃথিবীতে দেয়ার কোনাে উপায় নেই। কোরআন এই গােষ্ঠীকে আখেরাতের সত্যতার যেসব অখন্ডনীয় যুক্তি প্রমাণ রয়েছে, তার দিকে মনােনিবেশ করার আহ্বান জানায়। অথচ তারা এ আহ্বানকে উপেক্ষা করে।(আয়াত ২৪-২৬) এই সব কটা গােষ্ঠীকে একই গােষ্ঠীরূপেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। আবার মক্কায় যারা ইসলামের দাওয়াতের বিরােধিতা করতাে, তারা একাধিক গােষ্ঠীও হতে পারে। এদের মধ্যে একশ্রেণীর আহলে কিতাবও ছিলাে, যাদের সংখ্যা মক্কায় খুবই কম ছিলাে। এমনও হতে পারে যে, মক্কাবাসীর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে এই গােষ্ঠীটার উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে তারা মক্কায় বাস করে না এবং বাস করা জরুরীও নয়। যাই হােক, কুরআন এই শ্রেণীর মানুষগুলাের এসব অসদগুণ ও অসৎ কর্মের কঠোর সমালােচনা করেছে, এই সূরায় তাদের সম্পর্কে ব্যাপক আলােচনা করেছে, প্রকৃতিতে ও তাদের সত্ত্বায় বিদ্যমান আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সাহায্যে তাদের মােকাবেলা করেছে, কেয়ামতের হিসাব নিকাশ সম্পর্কে সতর্ক করেছে এবং আল্লাহর দ্বীন থেকে অতীতে যারা বিপথগামী হয়েছে তাদের কী পরিণতি হয়েছে, তা দেখিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সাহায্যে অতি সহজেই এসব সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়।(আয়াত ৩ -৬) আল্লাহর নেয়ামতগুলােকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমেও তাদের মােকাবেলা করা হয়েছে। (১২-১৩ নং আয়াত দ্রষ্টব্য) অনুরূপভাবে কেয়ামতের দিন তাদের অবস্থা ও পরিণতির উল্লেখ করেও তাদের মােকাবেলা করা হয়েছে।(আয়াত ২৭-৩৬) অনুরূপভাবে ১৫ নং আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে ইসলামের কঠোর কর্মফল নীতি ও জবাবদিহিতার নীতি। যারা অন্যায় ও অসৎ কর্মে নিমজ্জিত থেকেও মনে করে যে, তারা আল্লাহর কাছে সৎকর্মশীলদের মতােই বিবেচিত হবে, তাদের জবাব দেয়া হয়েছে ২১ ও ২২ নং আয়াতে। যদিও সমগ্র সূরা তার বিষয়বস্তুর বিচারে একটা একক ও অখন্ড সূরা, কিন্তু এর ব্যাখ্যা ও পর্যালােচনার সুবিধার্থে একে আমরা দুটো পর্বে ভাগ করেছি, হা-মীম এই দুটো বর্ণ দিয়ে সূরাটি শুরু হয়েছে। আর এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। মহা পরাক্রমশালী মহা বিজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা কিতাব। আর সূরার সমাপ্তি টানা হয়েছে আল্লাহর প্রশংসা। তার সর্বময় প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের উল্লেখ, তার মহত্ব ও শ্রেষ্ঠতু ঘােষণার মাধ্যমে। আর এসব ঘােষণা করা হয়েছে যারা আল্লাহর আয়াতগুলাে সম্পর্কে উদাসীন, অহংকারী ও বিদ্রুপকারী তাদের মােকাবেলায়। ‘অতএব আল্লাহর জন্যেই প্রশংসা'(আয়াত ৩৬ ও ৩৭) সূরাটা তার বিষয়বস্তুকে অত্যন্ত স্পষ্ট ও সাবলীল ভাষায় পেশ করে। এদিক দিয়ে এ সূরা সূরা দোখানের বিপরীত। কেননা সূরা দোখানে মানুষের হৃদয়ের ওপর হাতুড়ি পেটানাে হয়েছে। হৃদয়ের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। কোরআন নাযিলকারীও আল্লাহ তায়ালা। পরিস্থিতি ও পরিবেশের বিভিন্নতার প্রেক্ষাপটে তিনি কখনাে হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে আঘাত করেন, কখনাে মৃদু মৃদু ও কোমল পরশ বুলান। কখনাে শান্ত ও বিনম্র ভাষায় কথা বলেন। তিনি সূক্ষ্মদর্শী, গভীর তত্ত্বজ্ঞানী, মহা পরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী। এবার বিশদ তাফসীরে মনােনিবেশ করছি।

প্রথমে দুটো অক্ষর হা-মীম এর উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরআন নাযিল হবার কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, এ কিতাবের উৎস মহান আল্লাহ ছাড়া আর কিছু নয় এবং কেউ নয়। যেমন বিচ্ছিন্ন যে সব বর্ণমালা কতিপয় সূরার শুরুতে রয়েছে, তার সম্পর্কে আমরা আগেই আলােচনা করেছি। এ দ্বারা ইংগিত করা হয়েছে যে, এই কোরআন এই সব অক্ষর দিয়ে লেখা। অথচ এই মােশরেকরা এ সব অক্ষর ব্যবহার করে কিছুই লিখতে পারলাে না। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ কিতাব সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে, যিনি এতাে শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী যে তাকে কেউ পরাভূত করতে পারে না। তিনি এমন বিজ্ঞ ও কুশলী (হাকীম) যে, প্রতিটা জিনিস পরিমাণ মতাে সৃষ্টি করেন এবং প্রতিটা কাজ কৌশলে সম্পন্ন করেন। এ মন্তব্যটা সূরার সার্বিক পরিবেশ ও মানবীয় মন মানসিকতার বিভিন্নতার সাথে সংগতিপূর্ণ ও মানানসই।  *মানুষ ও পশুপাখী সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর নিদর্শন : এই কিতাবের প্রতি মােশরেকদের আচরণ ও ভূমিকা আলােচনা করার আগে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু এই সব নিদর্শনই তাদেরকে ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। তাই এগুলাের দিকে মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে। যাতে তা তাদের মনকে জাগ্রত ও সচেতন করে এবং তাতে এই কিতাব নাযিলকারী ও বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে অনুভূতিকে তীব্রতর করা হয়েছে। ‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ আকাশ ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা নিদর্শনাবলী অগণিত। মানুষ শুধু চোখ মেলে তাকালেই এই বিশ্ময়কর জগতে তার নিদর্শনাবলীকে দেখতে পায়। এমন কোন জিনিসটা দেখানাে যাবে, যা নিদর্শন নয়? এই বিশাল মহাকাশে কতাে বড় বড় জ্যোতিষ্ক মন্ডলী, কতো গ্রহ-উপগ্রহ ও ছায়াপথ ইত্যাদি রয়েছে। এগুলাে বিশালাকায় হওয়া সত্তেও মহাশূন্যে এক একটা ক্ষুদ্র ইদুরের মতাে দেখা যায়। আর ভয়ংকর বিশাল ও সুন্দর মহাশূন্য যে কত বড়, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। এই সব বিশাল বিশাল জ্যোতিষ্কের নিজ নিজ কক্ষপথে সুশৃংখলভাবে ও অব্যাহতভাবে কোটি কোটি বছর ধরে ভ্রমণ করতে থাকা এতা বিস্ময়কর যে, ভেবেই কূল কিনারা করা যায় না। এগুলাের মধ্যে এমন নিখুঁত সময় ও শৃংখলা বিরাজ করে, যা দেখে চোখের স্বাদ মিটতে চায় না এবং মনের চাহিদা পূরণ হতে চায় না। এই পৃথিবী এরই মধ্যে বসবাসকারী একটা মহিষের তুলনায় অত্যন্ত বড় ও বিশাল। অথচ এই বিশাল মহাশূন্য ও গ্রহ নক্ষত্রের তুলনায় তা একটা ধূলিকণা বা একটা অণুর মতাে। আর এই পৃথিবীর বিশেষ মহাজাগতিক অবস্থানে এর প্রকৃতিতে আল্লাহ তায়ালা জীবন ধারণের ও জীবনের অস্তিত্বের বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে রেখেছেন এবং অসংখ্য সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এখানে লুকিয়ে রেখেছেন। এ সব বৈশিষ্ট্যের একটাও যদি অনুপস্থিত থাকতাে বা ক্রুটিপূর্ণ হতাে, তাহলে এতে জীবনের অস্তিত্ব বা স্থায়িত্ব সম্ভব হতাে না।(সূরা ফোরকান, আয়াত ২) এই পৃথিবীতে বিদ্যমান বা বিচরণশীল প্রতিটা বস্তু ও প্রাণী, তাদের প্রতিটা অংশ ছােট, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তু থেকে নিয়ে বিশাল ও প্রকান্ড বস্তু বা প্রাণী, বিশাল বা ক্ষুদ্র গাছের ছােটো একটা পাতা, মানুষ বা প্রাণীর দেহের এক একটা চুল বা লােম এবং পাখির ডানার প্রতিটা পালক এক একটা নিদর্শন। প্রত্যেকটা বস্তু তার আকৃতিতে, বর্ণে, দেহের ত্বকের কোমলতায়, প্রত্যেকটা বস্তুর গঠনে, কাজে, উপযােগিতায় ও উপকারিতা অপকারিতায়, তার সমন্বয়ে ও গঠনে একটা স্বতন্ত্র নিদর্শন। আকাশ বা পৃথিবীর যেদিকেই মানুষ চোখ মেলে তাকাবে সেদিকেই সে অসংখ্য নিদর্শন দেখতে পাবে। নিদর্শনগুলাে নিজের অস্তিত্বকে মানুষের মন, চোখ ও কানের সামনে প্রকাশ করবেই। তবে কার জন্যে করবে, কে এগুলােকে দেখবে ও অনুধাবন করবে? ঈমানদার লােকদের জন্য। ঈমানদার লােকেরা দেখবে ও অনুধাবন করবে। কেননা ঈমানই মানুষের মনকে উনুক্ত করে। শব্দ, আলাে ও জীবনী শক্তি গ্রহণ করে। আকাশ ও পৃথিবীতে যে আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, সেই অনুভূতি ও ঈমান থেকেই জন্মে। ঈমানই হৃদয়কে উজ্জীবিত, বিনয়ী, বিনম্র ও কোমল করে এবং মহাবিশ্বের যেখানে যতাে গােপন ও প্রকাশ্য শিক্ষা রয়েছে, তা গ্রহণের উপলব্ধি করার যােগ্যতা দান করে। এসব গােপন ও প্রকাশ্য শিক্ষা আল্লাহর সৃজনী হাতের কুশলী তৎপরতা ও তার সৃষ্টি করা প্রতিটা বস্তু প্রাণীর ওপর তার নৈপুণ্যের ছাপ দেখিয়ে দেয়। এই কুশলী হাত থেকে যা কিছুই নির্মিত হয়, তা অপূর্ব ও অলৌকিক এবং আল্লাহর কোনাে সৃষ্টির পক্ষে তা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। পরবর্তী আয়াত মানুষের মনােযােগকে প্রকৃতির বহিরাঙ্গন থেকে তার অভ্যন্তর ভাগের নিদর্শনাবলীর দিকে আকৃষ্ট করেছে। এই অংগনটা তার সবচেয়ে কাছে অবস্থিত এবং এর প্রতি সে অধিকতর সংবেদনশীল। ‘আর তােমাদের সৃষ্টিতে এবং চারদিকে ছড়িয়ে থাকা জীব জন্তুতে বিশ্বাসীদের জন্যে প্রচুর নিদর্শন রয়েছে।’ মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এমন বিস্ময়কর শারীরিক ও মানসিক কাঠামাে, অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য ও রকমারি আংগিক কর্মক্ষমতার সমন্বয়ে তৈরী করেছেন যে, তা রীতিমত একটা অলৌকিক ব্যাপার। দীর্ঘদিন যাবত অব্যাহতভাবে নিকট থেকে বারবার দেখার কারণে এর অলৌকিকতুকে আমরা ভুলে গিয়েছি। কিন্তু এই মানুষের অংগ-প্রত্যংগগুলাের মধ্য থেকে যে কোনাে একটা অংগের গঠন ও বিন্যাসকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বিস্ময়ে মাথা ঘুরে যাবে। জীবন যতাে ক্ষুদ্র ও সহজ সরল রকমেরই হােক না কেন তা অলৌকিক। এমনকি যে প্রাণী মাত্র একটা কোষের দ্বারা তৈরী সেও অলৌকিক। মানুষের তাে কথাই আলাদা। কেননা তার দেহ ও মনের গঠন প্রণালী অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য। তার আংগিক গঠন প্রণালীর চেয়ে মানসিক গঠন প্রণালী অধিকতর জটিল ও দুর্বোধ্য। আর তার চারপাশে রয়েছে অজস্র জাতির, আকৃতি ও প্রকৃতির জীবজন্তু, যার সংখ্যা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। ছােটো বড়াে নির্বিশেষে প্রত্যেকটা প্রাণী তার গঠন প্রণালী, শারীরিক কাঠামাে, চাল-চলন, পৃথিবীতে তার অনুপাত-সব কিছুর দিক দিয়েই অলৌকিক ও বিস্ময়কর। এই অনুপাত এমন সুক্ষ্মভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে যে, এগুলাের কোনাে কোনাে বিশেষ প্রাণীর প্রজনন যে পরিমাণে ও সংখ্যায় হলে তার অস্তিত্ব ও প্রজাতি রক্ষা পাবে এবং সে অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীগুলাের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবে না, ঠিক সেই পরিমাণেই তার প্রজনন ও উৎপাদন হতে পারবে। তার কমও নয়, বেশীও নয়। এই সকল প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতির রক্ষণাবেক্ষণ ও হ্রাস-বৃদ্ধি একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সুপরিকল্পিত উপায়ে সম্পাদন করেছেন এবং তাদের মধ্যে প্রয়ােজন অনুপাতে যােগ্যতা ও গুণাবলী বন্টন করেছেন, যা তাদের সকলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। শকুন হিংস্র, আগ্রাসী ও ক্ষতিকর প্রাণী এবং তার আয়ুস্কালও দীর্ঘ। কিন্তু অপরপক্ষে তা চড়ুই, শালিক ইত্যাদির তুলনায় খুবই কম। শকুনের বংশ যদি চড়ুই ইত্যাদির হারে বাড়তাে, তাহলে কী অবস্থা হতাে এবং কিভাবে তা অন্যান্য পাখীগুলােকে ধ্বংস করতাে, তা আমরা সহজেই কল্পনা করতে পারি। পশুর জগত সিংহ ও বাঘ আগ্রাসী, হিংস্র ও মাংসাশী। এই প্রাণীটা যদি হরিন বা ছাগলের হারে বৃদ্ধি পেতাে তাহলে কেমন অবস্থা দাঁড়াতাে? জংগলে কোনাে প্রাণীকে আর সে বাঁচতে দিতে না। কিন্তু মহান আল্লাহ এর বংশবৃদ্ধি প্রয়ােজনের সীমার মধ্যে সীমিত রেখেছেন। পক্ষান্তরে ছাগল, হরিণ প্রভৃতি গােশতসমৃদ্ধ প্রাণীর বংশ বৃদ্ধি ব্যাপক এবং এর কারণ আমাদের অজানা নয়। একটা মাছি প্রতিবার লক্ষ লক্ষ ডিম পাড়ে। অন্য দিকে তা দু সপ্তাহের বেশী বাঁচে না। এর ওপর থেকে যদি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নেয়া হতো এবং মাছি যদি মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর বাঁচতাে। তাহলে মাছি আমাদের শরীর আচ্ছন্ন করে ফেলতাে। কিন্তু মহান আল্লাহর কুশলী হাত সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রয়ােজন, পরিস্থিতি ও পরিবেশের নিরীখে সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আলাকে সব কিছুকে সীমার মধ্যে রাখছে ও ভারসাম্য বজায় রাখছে। এভাবেই নিয়ম চলছে প্রতিটা সৃষ্টির ক্ষেত্রে। মানুষ, পশু এবং সব কিছুর পরিকল্পিতভাবে বিকাশ ঘটানাে হচ্ছে। এ সব কিছুর মধ্যেই নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু কার জন্যে এ নিদর্শন? সেই বিশ্বাসীদের জন্যে, যারা এগুলােকে পর্যবেক্ষণ করে, এগুলাে নিয়ে চিন্তা ভাবনা ও উপলব্ধি করে। ইয়াকীন বা বিশ্বাস হচ্ছে মনের এমন একটা অবস্থার নাম। যার উপস্থিতি মনকে অনুভূতিশীল করে, সচেতন করে, তাকে অনুগত ও প্রভাবিত করে। বিশ্বাস মনকে প্রশান্ত, ধীরস্থির ও পরিতৃপ্ত করে। প্রকৃতির যাবতীয় তথ্যকে সে ঠান্ডা মাথায়, সহজ-সরলভাবে, আস্থার সাথে, নিরুদ্বেগ ও নিরুত্তাপভাবে গ্রহণ ও বিবেচনা করে। ফলে ন্যূনতম তথ্য থেকে সে বড় বড় ফল লাভ করে ও জগতে বড় বড় কীর্তি সম্পাদন করে।
*আল্লাহর নিদর্শন উপেক্ষা করার পরিণতি : দেহ মনের আভ্যন্তরীণ জগত ও পারিপার্শিক প্রাণীজগত পর্যবেক্ষণের পর পরবর্তী আয়াতে প্রাকৃতিক জগতের বৈশিষ্টসমূহের দিকে মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে এবং সকল প্রাণীর জীবনের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণগুলাের উল্লেখ করা হয়েছে।(আয়াত ৫) দিন রাতের পালাক্রমিক আবর্তন বারবার হওয়ার কারণে এর নতুনত্ব প্রাচীন ও বাসি হয়ে যায় বলে মনে হয়। কিন্তু প্রথমবার দিন বা রাতকে অবলােকন করলে কোন বিস্ময়কর জিনিসটা মানুষের চেতনাকে আলােড়িত করে। প্রকৃত সচেতন মন দিন রাতের আবর্তনের এই বিস্ময়কে যতােবারই অবলােকন করুক, সব সময়ই তা তার অনুভূতিকে চাংগা করে এবং প্রতিবারই সে মহান আল্লাহর হাতকে বিশ্বজগত পরিচালনারত দেখতে পায়। মানুষের জ্ঞান উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত কোনাে কোনাে প্রাকৃতিক বিষয়ে তার জ্ঞানের প্রসার ঘটছে। মানুষ এখন জেনেছে যে, দিন ও রাত সূর্যের সামনে প্রতি ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীর নিজের চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করায় অর্থাৎ তার আহ্নিক গতির ফল। কিন্তু এই তথ্য জানার কারণে প্রকৃতির এই বিস্ময় কিছুমাত্র ম্লান হয় না। কারণ পৃথিবীর এই আবর্তনটাও তাে আর এক বিস্ময়। এই গ্রহটা যে এমন নিয়মিতভাবে একই গতিতে নিজেরই চারপাশে ঘুরছে এবং মহাশূন্যে বাতাসের ওপর ভর করে সাতার কাটা অবস্থায় এভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনাে বস্তুর ওপর তাকে ভর করতে হচ্ছে না, আর ঘুরপাক খাওয়া অবস্থায় তার পিঠের ওপর যাবতীয় বস্তু ও প্রাণী বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারছে- এটাও তাে এক মহাবিস্ময়! মহাশূন্যে কেবল সেই মহাশক্তির ওপর নির্ভর করে সে এই তৎপরতা চালাতে পারছে, যিনি তাকে সামাল দিয়ে রেখেছেন এবং এই মহাজাগতিক ব্যবস্থার নির্দিষ্ট ছকে যেভাবে চাইছেন সেভাবেই তাকে ঘােরাচ্ছেন। মানুষের জ্ঞান যতােই বাড়ছে, ততােই তারা পৃথিবীর জীবন ও জীবজগতের ওপর দিন রাতের আবর্তনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে। তারা জানতে পারছে যে, পৃথিবীর পূষ্ঠের ওপর সময়কে রাত ও দিনের বর্তমান অনুপাতে বিভক্ত করা জীবনের অস্তিত্ব ও জীব জগতের স্থায়িত্বের প্রধান সহায়ক উপাদান। এই দুটো জিনিস অর্থাৎ দিন ও রাতকে যদি ঠিক এইভাবেই তৈরী না করা হতাে এবং এই বিধি ব্যবস্থা অনুসারে পরিচালনা করা না হতাে, তাহলে পৃথিবীতে সব কিছুই ওলট-পালট ও বিশৃংখল হয়ে যেতাে। বিশেষত সেই বিশেষ স্টাইলের মানব জীবন, যা আরবদের সাথে সংশ্লিষ্ট । এ জন্যে মানুষের চেতনা ও অনুভূতিতে দিন ও রাতের গুরুত্ব কখনাে কমে না, বরং বাড়ে। আর যে জীবিকা আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে নাযিল করেছেন, অতপর তা দিয়ে-মৃত মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ‘রিযিক’ বা জীবিকা শব্দটা দ্বারা কখনাে কখনাে বৃষ্টিও বুঝানাে হয়। প্রাচীন তাফসীরকার এই অর্থই গ্রহণ করেছেন। তবে আকাশের জীবিকা জিনিসটা আরাে ব্যাপক অর্থবােধক। আকাশ থেকে যে সূর্য রশ্মী বা রৌদ্র নামে, মৃত মাটিকে সজীব তথা উর্বর বানানােতে এর অবদান পানির চেয়ে কম নয়; বরং আল্লাহর ইচ্ছায় এই সূর্যরশ্মী থেকেই পানি উৎপন্ন হয়। সূর্য রশ্মীই সমুদ্র থেকে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে। তারপর সেই বাষ্প ঘনীভূত হয়। বৃষ্টি নামায়, নদ নদী, খাল বিল পানিতে ভরে দেয় এবং তা দিয়ে মাটিকে চাষযােগ্য ও উর্বর বানায়। সুতরাং পানি, তাপ ও কিরণ এই তিনটের সাহায্যে ভূমি উর্বরা শক্তি পায়। এবং বাতাস চালনা করে। উত্তরে দক্ষিণে, পূর্ব পশ্চিমে, এঁকে বেঁকে, সােজা হয়ে, কখনাে ঠান্ডা হয়ে, কখনাে গরম হয়ে বায়ু চালিত হয়। বিশ্ব প্রকৃতির পরিকল্পিত পরিচালনা ব্যবস্থার সাথে কিছুই আকস্মিক ও অপরিকল্পিতভাবে ঘটে না। পৃথিবীর আবর্তনের সাথে বায়ু পরিচালনার সম্পর্ক রয়েছে, সেটা সুবিদিত। দিন রাতের আবর্তন ও আকাশ থেকে আগত জীবিকার সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। এসব কিছুই মহাবিশ্বে আল্লাহর ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে একযােগে কাজ করে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও পরিচালনা তিনি নিজের স্বাধীন ইচ্ছামতােই করেন। এতে বহু নিদর্শন তথা শিক্ষা রয়েছে। কিন্তু সে শিক্ষা কাদের জন্যে? যারা বুদ্ধিমান তাদের জন্যে। বস্তুত এ ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও বিবেকের অনেক করণীয় রয়েছে এবং তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ হচ্ছে কতিপয় প্রাকৃতিক নিদর্শন। সেই ঈমানদার লােকদের জন্যে এ সব তাৎপর্যময় নিদর্শন, যারা দৃঢ় প্রত্যয়ী ও বুদ্ধিমান বিবেকবান। কোরআনের আয়াত দ্বারা এই সব প্রাকৃতিক নিদর্শনের সন্ধান দেয়া হচ্ছে। এতে করে মােমেনের হৃদয় উদ্দীপিত হবে। তার বিবেক জাগ্রত হবে এবং তার স্বভাব প্রকৃতিকে তার নিজ ভাষাতেই সম্বােধন করা হবে। কেননা মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সাথে প্রাকৃতিক জগতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের প্রকৃতিকে জাগিয়ে তুলতে কোরআনের আয়াত সবচেয়ে কার্যকর উপকরণ। যে ব্যক্তি কোরআনের আয়াতের ওপর ঈমান আনে না, সে অন্য কোনাে উপায়ে ঈমান আনবে, তা আশা করা যায় না। কোরআনের এই সব আয়াত কে জাগাতে পারে না, তাকে অন্য কোনাে জিনিস দ্বারা জাগানাে সম্ভব নয়।(আয়াত ৬) কেননা দুনিয়ার কোন কথাই যেমন কোরআনের করার মতো হৃদয়গ্রাহী হতে পারে না, তেমনি প্রকৃতিতে আল্লাহর যে সৃষ্টি কুশলতার সাক্ষর রয়েছে, তাও আর কেউ দেখাতে পারেনি। আর আল্লাহর দেয়া তথ্যের মতাে সুস্পষ্ট, অকাট্য, অখন্ডনীয় প্রামাণ্য ও নির্ভুল আর কোন তথ্য হতে পারে না। সুতরাং তারা আল্লাহর পর ও তার আয়াতের পর আর কোন কথায় ঈমান আনবে? এ পর্যায়ে যে ব্যক্তি ঈমান আনে না, সে শাস্তির হুমকি ও শাসানি ছাড়া আর কিছুর যােগ্য নয়।(আয়াত ৭-১০) সূরার ভূমিকায় বলে এসেছি যে, এই আয়াতগুলােতে মক্কার ইসলামী দাওয়াতের প্রতি মােশরেকদের আচরণ, বাতিলের ওপর তাদের জিদ ও গােয়ার্তুমি, অখন্ডনীয়ভাবে সত্য প্রমাণিত তাওহীদের বাণীকে অযৌক্তিকভাবে ও হঠকারিতার সাথে প্রত্যাখ্যান, এই সত্যের বিরুদ্ধে তাদের অনড় অবস্থান, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর বাণীর সাথে বেয়াদবী ও অসম্মান প্রদর্শন এবং এই সব আচরণের মােকাবেলায় তাদের প্রতি কোরআনের পক্ষ থেকে হুমকি প্রদর্শন ও কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। ‘প্রত্যেক মিথ্যা অপবাদ আরােপকারী পাপিষ্টের জন্যে সর্বনাশ।’ ‘ওয়ল’ অর্থ ধ্বংস ও সর্বনাশ। আফফাক অর্থ সীমাহীন মিথ্যাবাদী। আর আসীম’ অর্থাৎ অতিশয় পাপাচারী। সর্বনাশের হুমকি স্বয়ং মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, যিনি ধ্বংস ও সর্বনাশ ঘটাতে সক্ষম, যিনি সুসংবাদ অথব্য দুঃসংবাদ উভয়টাতেই সত্যবাদী। সুতরাং তার এ হুমকি যথার্থই আতংক সৃষ্টিকারী। এই মিথ্যাবাদী পাপিষ্টের চিহ্ন হলাে, সে অন্যায় ও অসত্যের ওপর অনড় থাকে ও জিদ ধরে, সত্যের বিরুদ্ধে অহংকার প্রদর্শন করে, আল্লাহর কিতাবের প্রতি আনুগত্য দেখায় না এবং আল্লাহর সাথে যথােচিত আদব প্রদর্শন করে না। এই ঘৃণ্য অবস্থাটা যদিও মক্কার এক শ্রেণীর মােশরেকদের মধ্যে দেখা যেতাে। কিন্তু আসলে প্রত্যেক জাহেলিয়াতেই এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। বর্তমানেও ঘটছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। আজকের দুনিয়ায় স্বয়ং মুসলমান নামধারীদের মধ্যেও এমন বহু লােক রয়েছে, যে আল্লাহর আয়াতগুলাে শুনতে পায়, কিন্তু অহংকারের সাথে না শােনার ভান করে চলে যায়। কেননা সেটা তার মনের কামনা বাসনার বিপরীত, তার আদত-অভ্যাসের পরিপন্থী, তাকে তার বাতিল নীতিতে টিকে থাকতে সাহায্য করে না, তার অন্যায় অপকর্মকে সমর্থন করে না এবং তার অসৎ মনস্কামনা পূর্ণ করে না। ‘অতএব তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।’ সুসংবাদ ভালাে জিনিসের জন্যে হয়ে থাকে। এখানে বিদ্রুপের ভংগীতে কথাটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সে যখন সতর্কবাণী শুনছে না, তখন তার কাংখিত সর্বনাশ এসে যাওয়াই উচিত। ওটাই তার জন্যে শুভ সংবাদ। এভাবে আরাে তীব্রভাবে বিদ্রুপ করা হলাে। ‘আর যখন সে আমার কিছু আয়াত জানতে পারে, তখন তা নিয়ে ব্যংগ বিদ্রুপ শুরু করে দেয়।’ অথচ সে জানে এই আয়াত কার এবং কোথা থেকে এসেছে। এটা অধিকতর মারাত্মক ও কলংকজনক। আর এ আচরণটাও প্রাচীন ও আধুনিক উভয় ধরনের জাহেলিয়াতে পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, বরং মুসলমান নামধারীদেরও অনেকে জেনে-শুনে আল্লাহর বাণীকে উপহাস করে থাকে এবং তাকে ও তার ভক্তদেরকে উপহাসের পাত্র বানায়। বিশেষত যারা চায় যে, ‘আল্লাহর বাণীই পুনরায় জনগণের জীবনে বাস্তবায়িত হােক। তাদের জন্যে অপমানজনক আযাব।’ বস্তুত অপমান ও লাঞ্ছনা তাদেরই প্রাপ্য, যারা জেনে শুনে আল্লাহর বাণীকে উপহাস করে তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন ও বেয়াদী করে। এ আযাব খুবই নিকটে প্রস্তুত রয়েছে, যদিও তার কার্যকর হওয়ার সময় কিছু পরে আসবে। প্রকৃতপক্ষে এ আযাব প্রস্তুত রয়েছে। ‘তাদের আড়ালেই রয়েছে জাহান্নাম।’ এখানে তাদের আড়ালেই কথাটা তাৎপর্যবহ। অর্থাৎ এই আযাব তাদের আড়ালে রয়েছে বলে তারা দেখতে পায় না। আর এর প্রতি উদাসীন রয়েছে বলে তারা তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে না এবং এ আযাব থেকে কিছুতেই উদ্ধার পাবে না। ‘তারা যা কিছু উপার্জন করেছে তা তাদের কাজে আসবে না, যে সব জিনিসকে তারা আল্লাহর বিকল্প অভিভাবক মনে করেছে, তাও কোনাে উপকারে আসবে না।’ অর্থাৎ তাদের করা কোনাে কাজ এবং উপার্জিত কোনাে সম্পদ তাদের কাজে লাগবে না। এমনকি তারা কোনাে ভালাে কাজ করলেও তা ধূলাের মতাে উড়ে যাবে, ধরে রাখতে পারবে না। কেননা তার ভিত্তি ঈমানের ওপর ছিলাে না। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া যাদেরকে তারা অভিভাবক দেবদেবী, উপাস্য, সাহায্যকারী, বন্ধু-হিসাবে গ্রহণ করেছে, তারা তাকে সাহায্য করতেও পারবে না, সুপারিশও করতে পারবে না। ‘তাদের জন্যে মন্ত বড় আযাব রয়েছে।’ অর্থাৎ সে আযাব শুধু অপমানজনকই নয়, বরং বিরাটও। কেননা আল্লাহর কালামের সাথে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে তারা যে অপরাধ করেছে, তা এতাে জঘন্য যে, সে জন্যে অপমানজনক শাস্তিও তাদের প্রাপ্য, আবার এই অপরাধ এতাে বড় যে, তার শাস্তিটাও বড় হওয়া উচিত। এ আয়াতে যেহেতু আল্লাহর সাথে ঠাট্টা বিদ্রপের উল্লেখ রয়েছে এবং তা থেকে মানুষকে ফেরানাে ও তার বিরুদ্ধে অহংকার ও দম্ভ প্রদর্শনের বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাই পরবর্তী আয়াতে এই আয়াতের প্রকৃত পরিচয় ও তাকে প্রত্যাখ্যানের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। এ হচ্ছে হেদায়াতের উৎস। আর যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতের সাথে কুফরী করেছে। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক নােংরা শাস্তি। কোরআনের পরিচয় এটাই যে, তা হেদায়াতের উৎস। নির্ভুল ও নির্ভেজাল হেদায়াতের পথ। এর সাথে গােমরাহীর কোনাে মিশ্রণ নেই। যে কোরআনের পরিচয় এই, তার আয়াতগুলােকে অস্বীকার করার শাস্তি যন্ত্রণাদায়ক না হয়ে পারে না। রিজস হচ্ছে কঠিন শাস্তি। এই কঠিন শাস্তির হুমকি তাদের দেয়া হচ্ছে। এভাবে একই হুমকি বিভিন্ন ভাষায় পুনরাবৃত্তি করে হুমকিকে কঠোরতর রূপ দেয়া হয়েছে, যা নির্ভেজাল হেদায়াতকে প্রত্যাখ্যানকারীর জন্যে খুবই উপযুক্ত।
*সৃষ্টিজগতের সবকিছু মানুষের সেবায় নিয়ােজিত : প্রচন্ড আযাবের হুমকি দেয়ার পর পুনরায় কোমল ভাষা প্রয়ােগ করে আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। (আয়াত ১২ ও ১৩) মানুষ একটা ক্ষুদ্র সৃষ্টি হলেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণে অনুগ্রহ লাভ করেছে। তিনি তাঁর বহু বড় বড় সৃষ্টিকে তার অনুগত করে দিয়েছেন। সেগুলাে দ্বারা সে নানাভাবে উপকৃত হয়। এ দ্বারা সে আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানের কিছুটা রহস্যের সন্ধান পায়। এই সমস্ত সৃষ্টি সেই বিধি অনুসারে চলে এবং অবাধ্যতা প্রদর্শন করে না। এই রহস্যের সন্ধান না পেলে মানুষ তার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে প্রকৃতির কোন জিনিস দ্বারা উপকৃত হতে পারতাে না। এমনকি ক্ষুদ্র মানুষ এই বিশাল প্রকৃতির বড় বড় শক্তির সাথে সহ অবস্থানও করতে পারতাে না। সমুদ্র হচ্ছে প্রকৃতির এই প্রকান্ড শক্তিগুলাের অন্যতম, যাকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অনুগত করেছেন। মহান আল্লাহ মানুষকে এই সমুদ্রের কিছু গােপন রহস্যের সন্ধান দিয়েছেন। এই গােপন রহস্যের কিছুটা সন্ধান পেয়েছে নৌকা। তাই সে তার বুকের ওপর দিয়ে তরংগমালার তােয়াক্কা না করে নিয়ে চলাচল করে। যেন তার ওপর তার নির্দেশে নৌকা চলাচল করে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রকে এরূপ বৈশিষ্ট্য দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। নৌকার উপাদানকেও এরূপ বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বায়ুর চাপ, বাতাসের দ্রুততা ও মাটির মধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং অনুরূপ অন্যসব প্রাকৃতিক গুণবৈশিষ্ট্য সৃষ্ট করেছেন, যা সমুদ্রে নৌকা ও জাহাজ চলাচলের অনুকূল বানিয়েছে। তারপর মানুষকে এই সব কিছুর সন্ধান দিয়েছেন। ফলে তার পক্ষে এ দ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব হয়েছে। আরাে সম্ভব হয়েছে সমুদ্র দ্বারা অন্যান্য ব্যাপারেও উপকৃত হওয়া। যেমন আহার ও সৌন্দর্যোপকরণ সংগ্রহের জন্যে সমুদ্রের প্রাণী শিকার করা, অনুরূপভাবে সামুদ্রিক ভ্রমণের মাধ্যমে বাণিজ্য, জ্ঞানার্জন, বিনােদন ইত্যাদি। এভাবে আল্লাহর আরাে বহু অনুগ্রহ লাভ করার পথ সুগম হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে সমুদ্র ও নৌকা দুটোই অনুগত করেছেন, যাতে সে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করে, আল্লাহর এ সব নেয়ামতের জন্যে এবং অনুগত করা ও রহস্যের সন্ধান দেয়ার জন্যে তার শােকর আদায় করে। যেন তােমরা শােকর আদায় করো। আল্লাহ তায়ালা এই কোরআন দ্বারা মানুষের মনকে এই কর্তব্য পালনে উদুদ্ধ করছেন এবং মানুষের মাঝে ও অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে উৎসের ঐক্য ও লক্ষ্যের ঐক্য রয়েছে-এ কথা বুঝিয়েছেন। সমুদ্রকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার পর ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, শুধু সমুদ্র নয়, বরং আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু-সকল সম্পদ ও শক্তি মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন। কেননা এ সব কিছুই তার খেলাফতের আওতাধীন। তোমাদের জন্যে আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছুই নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছে। বস্তুত সৃষ্টিজগতের সব কিছু তাঁর কাছ থেকেই এসেছে এবং তার দিকেই ফিরে যাবে। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা ও পরিচালক। তিনিই সব কিছুকে অনুগত করে দেন অথবা পরাক্রান্ত করে দেন। আর এই ক্ষুদ্র সৃষ্টি মানুষকে আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক রহস্যের কিছুটা জানবার যােগ্যতা দিয়েছেন। এই সৃষ্টি জগতের কিছু শক্তিকে মানুষের অনুগত করে দেন। আবার কিছু শক্তিকে তার আয়ত্তের বাইরে রাখেন। উভয় অবস্থায়ই তার জন্যে কল্যাণকর এবং তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্বরূপ। এই প্রত্যেকটাতেই চিন্তাশীল মানুষের জন্যে শিক্ষা রয়েছে, ‘যারা চিন্তাশীল তাদের জন্যে এতে নিদর্শন রয়েছে।’ চিন্তা তখনই বিশুদ্ধ, নির্ভুল, ব্যাপক ও গভীর হতে পারে। যখন তা সেই সব শক্তিকে অতিক্রম করে যায়, যার গােপন রহস্য সে উদঘাটন করতে পারে। এই সৰ পার্থিব শক্তির উৎসের সন্ধান পাওয়া, এই শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী প্রাকৃতিক বিধানের সন্ধান পাওয়া, সব প্রাকৃতিক বিধান এবং মানুষের প্রকৃতির মধ্যকার যােগসূত্রের সন্ধান পাওয়ার পরই মানুষের চিন্তা নির্ভুল হতে পারে। এই যােগসূত্রই মানুষের জন্যে তার সাথে সংযােগ স্থাপন সহজ করে দেয়। এই যোগসূত্রের সন্ধান না পেলে সে সংযােগ স্থাপনও করতে পারতাে না এবং এই সব প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা সে উপকৃতও হতে পারতাে না।
“বেইমান হতভাগাদের প্রতি মােমেনদের করুণা : সূরার এই পর্যায়ে যখন মােমেনের অন্তর প্রকৃতির অন্তরের সাথে মিলিত হয় এবং সে প্রকৃত শক্তির উৎসের সন্ধান পায়, তখনই মোমেনদেরকে আহ্বান জানানাে হচ্ছে, তারা যেন সেসব দুর্বল ও অক্ষম মানুষের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করে, যাদের অন্তর উক্ত উৎসের সাথে এখনাে মিলিত হতে পারেনি। আলােকোজ্জবল মহাসত্যের সন্ধান থেকে বঞ্চিত এই সব দুস্থ হতভাগা মানুষের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হবার জন্যে মােমেনদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছে।(আয়াত ১৪-১৫) এ হচ্ছে আখেরাতে অবিশ্বাসীদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্যে মােমেনদের প্রতি উপদেশ। এই সদয় হওয়া ও ক্ষমা করার নির্দেশ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হয়েছে মােমেনরা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, মহৎ, উদার ও শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে যারা আখেরাতে ও আল্লাহর আযাবে বিশ্বাস করে না, তারা দুস্থ মানুষ বটে। তারা সহানুভূতি পাওয়ার যােগ্য। কেননা তারা সেই অঢেল শক্তি, সমৃদ্ধি ও করুণার উৎস তথা আল্লাহর প্রতি ঈমানের উৎস, নিরাপত্তার উৎস, তার সাহায্যের উৎস, বিপদের সময়ের একমাত্র নির্ভরযােগ্য আশ্রয় থেকে বঞ্চিত। অনুরূপভাবে তারা প্রাকৃতিক বিধানের সাথে যুক্ত প্রকৃত নির্ভুল জ্ঞান থেকেও বঞ্চিত। মােমেনরা, যারা ঈমানের ন্যায় মহামূল্যবান সম্পদের অধিকারী এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার অধিকারী, এসব বঞ্চিত মানুষের নির্বুদ্ধিতা ও ঝোক প্রবণতার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করাই তাদের পক্ষে উত্তম। অন্যদিকে, মােমেনদের উচিত, তাদের ব্যাপার আল্লাহর কাছে সােপর্দ করা, যিনি সৎকর্মশীল ও অসৎকর্মশীল উভয়কে যথােচিত প্রতিফল দিতে পারেন, যিনি তাদের অন্যায় অত্যাচারে ক্ষমা প্রদর্শনকে সৎকাজের তালিকাভুক্ত করেন। অবশ্য এই ক্ষমা ও মহানুভবতা কেবল সেই অপরাধের ক্ষেত্রেই সীমিত থাকবে, যা সমাজে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টির সাথে জড়িত নয় এবং ফৌজদারী অপরাধের আওতায় পড়ে না। সবার শেষে এই বলে উপসংহার টানা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষ তার অপকর্মের জন্যে ব্যক্তিগতভাবেই দায়ী, প্রত্যেক কাজের উপযুক্ত বদলা পাওয়া মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার এবং প্রত্যেক মানুষকেই সর্বশেষে তার কাছে ফিরে যেতে হবে। ‘যে সৎ কাজ করবে, সেটা সে নিজের কল্যাণের জন্যেই করবে। আর যে খারাপ কাজ করবে। সে নিজের অকল্যাণের জন্যই করবে। এরপর তােমরা তােমাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে।’ এর দ্বারা মােমেনের বুকটা বড় হয়ে যায়। তার মনােবল বেড়ে যায়। ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত অনাচার ও অত্যাচার হাসিমুখে সয়ে নেয়। কারও প্রতি কোনাে দুর্বলতা প্রকাশ করে না, কোনাে বিরক্তি প্রকাশ করে না। কারণ, সে আদর্শের দিক থেকে বড়, মনের দিক থেকে বড় এবং শক্তির দিক থেকে বড়। সে হেদায়াতের মশালবাহী, তার হাতে রয়েছে মৃতসঞ্জীবনী । তার কাজের জন্যে সে নিজে দায়ী। অন্য কারাে অপরাধের ভাগী সে হবে না। সর্বশেষ বিচার আল্লাহর হাতে। তারই কাছে সকলকে ফিরে যেতে হবে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
#(৪৫-জাসিয়া) : নামকরণ:

২৮ আয়াতের وَتَرَى كُلَّ أُمَّةٍ جَاثِيَةً বাক্যাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ এটি সেই সূরা যার মধ্যে ‘জাসিয়াহ’ শব্দ আছে।
(৪৫-জাসিয়া) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এ সূরাটির নাযিল হওয়ার সময়-কাল কোন নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়নি। তবে এর বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় এটি সুরা ‘দুখান’ নাযিল হওয়ার অল্প দিন পরই নাযিল হয়েছে। এ দুটি সূরার বিষয়বস্তুতে এতটা সাদৃশ্য বর্তমান যে সূরা দুটিকে যমজ বা যুগ্ম বলে মনে হয়।
(৪৫-জাসিয়া) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :

এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে তাওহীদ ও আখেরাত সম্পর্কে মক্কার কাফেরদের সন্দেহ, সংশয় ও আপত্তির জবাব দেয়া এবং কুরআনের দাওয়াতের বিরুদ্ধে তারা যে নীতি ও আচরণ গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে সতর্ক করা।

তাওহীদের সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মানুষের নিজের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নিদর্শনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে, যেদিকেই চোখ মেলে তাকাও না কেন তোমরা যে তাওহীদ মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছো প্রতিটি বস্তু তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। নানা রকমের এসব জীব-জন্তু, এই রাতদিন, এই বৃষ্টিপাত এবং তার সাহায্যে উৎপন্ন উদ্ভিদ রাজি, এই বাতাস এবং মানুষের নিজের জন্ম এর সবগুলো জিনিসকে কোন ব্যক্তি যদি চোখ মেলে দেখে এবং কোনো প্রকার গোঁড়ামি বা অন্ধ আবেগ ছাড়া নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এসব নিদর্শন তার মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট যে এই বিশ্ব জাহান খোদাহীন নয় বা এখানে বহু খোদায়ী চলছে না, বরং এক আল্লাহ এটি সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একাই এর ব্যবস্থাপক ও শাসক। তবে যে ব্যক্তি মানবে না বলে শপথ করেছে কিংবা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কথা ভিন্ন। দুনিয়ার কোন জায়গা থেকেই সে ঈমান ও ইয়াকীনের সম্পদ লাভ করতে পারবে না।

দ্বিতীয় রুকূ’র শুরুতে বলা হয়েছে, এই পৃথিবীতে মানুষ যত জিনিসের সাহায্য গ্রহণ করছে এবং এই বিশ্ব জাহানে যে সীমাসংখ্যাহীন বস্তু ও শক্তি তার স্বার্থের সেবা করছে তা আপনা আপনি কোথাও থেকে আসেনি বা দেব-দেবীরাও তা সরবরাহ করেনি, বরং এক আল্লাহই তাঁর নিজের পক্ষ থেকে তাকে এসব দান করেছেন এবং এসবকে তার অনুগত করে দিয়েছেন। কেউ যদি সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার বিবেক-বুদ্ধিই বলে দেবে, সেই আল্লাহই মানুষের প্রতি অনুগ্রহকারী মানুষ তাঁর শোকর গোজারী করবে এটা তাঁর প্রাপ্য।

এরপর মক্কার কাফেররা হঠকারিতা, অহংকার, ঠাট্টা-বিদ্রূপ এবং কুফরকে আঁকড়ে ধরে থেকে কুরআনের দাওয়াতের যে বিরোধিতা করছিলো। সে জন্য তাদেরকে কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়েছে এবং সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, এ কুরআন সেই নিয়ামত নিয়ে এসেছে যা ইতিপূর্বে বনী-ইসরাঈলদের দেয়া হয়েছিলো যার কল্যাণে বনী ইসরাঈলরা গোটা বিশ্বের সমস্ত জাতির ওপর মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলো। কিন্তু তারা এই নিয়ামতের অমর্যাদা করেছে এবং দ্বীনের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি করে তা হারিয়ে ফেলেছে। তাই এখন তা তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এটা এমন একটি হিদায়তনামা যা মানুষের দ্বীনের পরিষ্কার রাজপথ দেখিয়ে দেয়। নিজেদের অজ্ঞতা ও বোকামির কারণে যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তারা নিজেদেরই ধ্বংসের আয়োজন করবে। আর আল্লাহর সাহায্য ও রহমতের উপযুক্ত বিবেচিত হবে কেবল তারাই যারা এর আনুগত্য করে তাকওয়ার নীতি ও আচরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

এ ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বলা হয়েছে, এসব লোক আল্লাহকে ভয় করে না। এরা তোমাদের সাথে যে অশোভন আচরণ করছে তা উপেক্ষা করো এবং সহিষ্ণুতা অবলম্বন করো। তোমরা ধৈর্য অবলম্বন করলে আল্লাহ নিজেই এদের সাথে বুঝাপড়া করবেন এবং তোমাদের এই ধৈর্যের প্রতিদান দিবেন।

তারপর আখেরাত বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত কাফেরদের জাহেলী ধ্যান-ধারণা আলোচনা করা হয়েছে। কাফেররা বলতো: এই দুনিয়ার জীবনই সব। এরপর আর কোন জীবন নেই। যুগের বিবর্তনে আমরা ঠিক তেমনি মরে যাব যেমন একটি ঘড়ি চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর পরে রূহের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না যে, তা কবজ করা হবে এবং পুনরায় কোন এক সময় এনে দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হবে। তোমরা যদি এ ধরনের দাবি করো তাহলে আমাদের মৃত বাপ দাদাদের জীবিত করে দেখাও। এর জবাবে আল্লাহ একের পর এক কয়েকটি যুক্তি পেশ করেছেন:

এক : কোন জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে তোমরা একথা বলছো না, বরং শুধু ধারণার ভিত্তিতে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছ। সত্যিই কি তোমাদের জানা আছে যে, মৃত্যুর পরে আর কোন জীবন নেই এবং রূহ কবজ করা হয় না, বরং ধ্বংস হয়ে যায়?

দুই : তোমাদের এই দাবীর ভিত্তি বড় জোর এই যে, তোমরা কোন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে দেখোনি। এতটুকু বিষয়ই কি এতবড় দাবি করার জন্য যথেষ্ট যে মৃতরা আর কখনো জীবিত হবে না? তোমাদের অভিজ্ঞতায় ও পর্যবেক্ষণে কোন জিনিস ধরা না পড়ার অর্থ কি এই যে, তোমরা তার অস্তিত্বহীন হওয়ার জ্ঞান লাভ করছো?

তিন : এ কথা সরাসরি বিবেক-বুদ্ধি ও ইনসাফের পরিপন্থী যে ভাল ও মন্দ, অনুগত ও অবাধ্য এবং জালেম ও মজলুম সবাইকে শেষ পর্যন্ত একই পর্যায়ভুক্ত করে দেয়া হবে। কোন ভাল কাজের ভাল ফল এবং মন্দ কাজের মন্দ ফল দেখা দেবে না। কোন মজলুমের আর্তনাদ শোনা হবে না কিংবা কোন জালেম তার কৃতকর্মের শাস্তি পাবে না। বরং সবাই একই পরিণাম ভোগ করবে। আল্লাহর সৃষ্টি এই বিশ্ব জাহান সম্পর্কে যে এই ধারণা পোষণ করে সে অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে। জালেম ও দুষ্কর্মশীল লোকদের এ ধারণা পোষণ করার কারণ হলো এই যে, তারা তাদের কাজ-কর্মের মন্দ ফলাফল দেখতে চায় না। কিন্তু আল্লাহর এই সার্বভৌম কর্তৃত্ব কোন অনিয়মের রাজত্ব নয়। এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, যেখানে সৎ ও অসৎকে এক পর্যায়ভুক্ত করে দেয়ার মত জুলুম কখনো হবে না।

চার : আখেরাত অস্বীকৃতির এই আকীদা নৈতিকতার জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। এই আকীদা তারাই গ্রহণ করে যারা প্রবৃত্তির দাস হয়ে আছে। তারা এ আকীদা গ্রহণ করে এ জন্য, যাতে প্রবৃত্তির দাসত্ব করার অবাধ সুযোগ লাভ করতে পারে। কাজেই তারা যখন এ আকীদা গ্রহণ করে তখন তা তাদেরকে চরমতম গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। এমনকি তাদের নৈতিক অনুভূতি একেবারেই মরে যায় এবং হিদায়াত লাভের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

এসব যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার পর আল্লাহ অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, যেভাবে তোমরা নিজে নিজেই জীবন লাভ করোনি, আমি জীবন দিয়েছি বলে জীবন লাভ করছো, তেমনি নিজে নিজেই মরে যাবে না, বরং আমি মৃত্যু দিই বলে মারা যাও এবং এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন তোমাদের সবাইকে যুগপৎ একত্র করা হবে। আজ যদি মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে তোমরা একথা না মানতে চাও তাহলে মেনো না। কিন্তু সে সময়টি যখন আসবে তখন নিজের চোখেই তোমরা দেখতে পাবে যে, তোমরা তোমাদের আল্লাহর সামনে হাজির আছো এবং কোনো প্রকার কমবেশী ছাড়াই তোমাদের পুরো আমলনামা প্রস্তুত আছে, যা তোমাদের প্রতিটি কাজের সাক্ষ্য দিচ্ছে। সে সময় তোমরা জানতে পারবে আখেরাতের আকীদার এই অস্বীকৃতি এবং এ নিয়ে যে ঠাট্টা-বিদ্রূপ তোমরা করছো এর কত চড়া মূল্য তোমাদের দিতে হচ্ছে।
এটা এই সূরার সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। এতে শ্রোতাদেরকে দু’টি বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।এর একটি বিষয় হচ্ছে, এ কিতাব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা নয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কিতাব নাযিল করছেন আল্লাহ, যিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী। তাঁর মহাপরাক্রমশালী হওয়ার দাবী হলো, মানুষ যেন তাঁর আদেশের অবাধ্য হওয়ার দুঃসাহস না দেখায়। কারণ অবাধ্য হয়ে সে তাঁর শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। তাঁর মহাজ্ঞানী হওয়ার দাবী হলো মানুষ পূর্ণ মানসিক প্রশান্তিসহ স্বেচ্ছায় আগ্রহ নিয়ে তাঁর হিদায়াত ও আদেশ-নিষেধ পালন করবে। কারণ, তাঁর শিক্ষা ভ্রান্ত, অসঙ্গত ও ক্ষতিকর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
# ভূমিকার পর মূল বক্তব্য এভাবে শুরু করায় স্পষ্ট বুঝা যায় এর পটভূমিতে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার বিরুদ্ধে মক্কার লোকদের পেশকৃত আপত্তিসমূহ। তারা বলতোঃ আজ পর্যন্ত যেসব সম্মানিত সত্তার আস্তানার সাথে আমাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা জড়িত তারা সবাই তুচ্ছ, নগণ্য আর সার্বভৌম কর্তৃত্ব শুধু এক মাত্র আল্লাহর, এক ব্যক্তির কথায় এত বড় একটা জিনিস আমরা কী করে মেনে নেই। এর জবাবে বলা হচ্ছে, যে সত্যটি মানার জন্য তোমাদের আহবান জানানো হচ্ছে সারা বিশ্বজাহান তার সত্যতার নিদর্শনে ভরা। চোখ মেলে দেখো। তোমাদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র শুধু নিদর্শনে ভরা। চোখ মেলে দেখো। তোমাদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র শুধু নিদর্শনই ছড়িয়ে আছে। এসব নিদর্শন সাক্ষ্য দিচ্ছে, গোটা এই বিশ্বজাহান একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি এবং তিনি একাই এর মালিক, শাসক ও ব্যবস্থাপক। আসমান ও যমীনে কোন জিনিসের নিদর্শন আছে তা বলার প্রয়োজন ছিল না। কারণ তখন বিবাদের মূল বিষয় ছিল এই যে, মুশরিকরা আল্লাহর সাথে অন্য সব খোদা এবং উপাস্যদের মানার জন্য জিদ ধরেছিলো। পক্ষান্তরে কুরআনের দাওয়াত ছিল এই যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই। তাই নিদর্শনসমূহ অর্থ যে তাওহীদের সত্যতা ও শিরক বাতিল হওয়ার নিদর্শন একথা বলা না হলেও পরিবেশ পরিস্থিতি থেকেই তা প্রকাশ পাচ্ছিলো।তাছাড়া এই যে বলা হয়েছে, “এসব হচ্ছে মু’মিনদের জন্য নিদর্শন” এর অর্থ, যদিও এগুলো সমস্ত মানুষের জন্যই নিদর্শন, কিন্তু এসব দেখে সঠিক সিদ্ধান্ত কেবল তারাই নিতে পারে যারা ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত। গাফলতির মধ্যে পড়ে থাকা মানুষ, যারা পশুর ন্যায় বেঁচে থাকে এবং একগুঁয়ে ও জেদী লোক, যারা না মানার সংকল্প করে বসেছে তাদের জন্য এগুলো নিদর্শন হওয়া না হওয়া সমান কথা। বাগানের চাকচিক্য ও সৌন্দর্য তো চক্ষুষ্মানদের জন্য। অন্ধরা কোন চাকচিক্য ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। তাদের জন্য বাগানের অস্তিত্বই অর্থহীন।
# যারা না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিংবা যারা নিজেদের জন্য সন্দেহের গোলক ধাঁধায় হাতড়িয়ে বেড়ানো পছন্দ করেছে তাদের ব্যাপার তো ভিন্ন। কিন্তু যাদের মনের দরজা বন্ধ হয়নি তারা যখন নিজের জন্মের প্রতি নিজের অস্তিত্বের গঠন আকৃতির প্রতি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা নানা রকম জীব-জন্তুর প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকাবে তখন এমন অসংখ্য আলামত দেখতে পাবে যা দেখার পর এ সন্দেহ পোষণের সামান্যতম অবকাশও থাকবে না যে, এসব কিছু হয়তো কোন আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে কিংবা তার সৃষ্টির ক্ষেত্রে হয়তো একাধিক খোদার হাত আছে (ব্যাখ্যর জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আন’আম, টীকা ২৫ থেকে ২৭ ; আন নাহল, টীকা ৭ থেকে ৯ ; আল হাজ্জ, টীকা ৫ থেকে ৯ ; আল মু’মিনূন টীকা ১২ ও ১৩ ; আর ফুরকান টীকা ৬৯ ; আশ শুআরা, টীকা ৫৭ ও ৫৮ ; আন নামল, টীকা ৮০ ; আর রূম, টীকা ২৫ থেকে ৩২ ও ৭৯ ; আস সাজদা, টীকা ১৪ থেকে ১৮ ; ইয়াসীন, আয়াত ৭১ থেকে ৭৩ ; আয যুমার আয়াত ৬ এবং আল মু’মিন, টীকা ৯৭ , ৯৮ ও ১১০ )।
# রাত ও দিনের এই পার্থক্য ও ভিন্নতা এদিক দিয়েও নিদর্শন যে, দু’টিই পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে একটার পর আরেকটা আসে। আবার এদিক দিয়েও নিদর্শন যে, একটি আলো আরেকটি অন্ধকার। তাছাড়া তার নিদর্শন হওয়ার আরো একটি কারণ হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দিন ক্রমান্বয়ে ছোট এবং রাত বড় হতে থাকে এবং এক সময়ে দু’টি এক সমান হয়ে যায়। তারপর আবার ক্রমান্বয়ে দিন বড় এবং রাত ছোট হতে থাকে। তারপর এক সময় দিন রাত আবার সমান হয়ে যায়। রাত ও দিনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের এই যে পার্থক্য ও ভিন্নতা দেখা যায় তার সাথে বিরাট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জড়িত। এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্পষ্টরূপে একথাই প্রমাণ করে যে, সূর্য, পৃথিবী এবং পৃথিবীর সব বস্তুর স্রষ্টা মাত্র একজন এবং তিনি এক মহাশক্তির সত্তা। তিনিই এ দু’টি গ্রহকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কোন অন্ধ, বধির ও অযৌক্তিক ক্ষমতা নয়, বরং এমন জ্ঞানগর্ভ ক্ষমতা যা এই অনড় হিসাব-নিকাশ প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীকে তার সৃষ্ট উদ্ভিদ, জীবজন্তু ও মানুষের মত অসংখ্য প্রজাতির জীবনসত্তার জীবন ধারনের উপযোগী করে দিয়েছেন। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস, টীকা ৬৫ ; আন নামল টীকা-১০৪ ; আল কাসাস, টীকা ৯২ ; লোকমান, আয়াত ২৯; টীকা ৫০ , ইয়াসীন, আয়াত ৩৭; টীকা ৩২ )।
# এখানে রিযিক অর্থ যে বৃষ্টি তা পরবর্তী আয়াতাংশ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়।
#.ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল মু’মিনুন, টীকা ১৭ ; আল ফুরকান, টীকা ৬২ থেকে ৬৫ ; আশ শুআরা, টীকা ৫ , আন নামল, টীকা ৭৩ ও ৭৪ ; আর রূম, টীকা ৩৫ ও ৭৩ এবং ইয়াসীন, টীকা ২৬ থেকে ৩১ ।
# বায়ু প্রবাহ অর্থ বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্নভাবে হাওয়া প্রবাহিত হওয়া, যার কারণে ঋতুর পরিবর্তন সংঘটিত হয়। দেখার বিষয় শুধু এটাই নয় যে পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরিভাগে একটি বিশাল বায়ু স্তর আছে যার মধ্যে এমন সব উপাদান বিদ্যমান যা প্রাণীকুলের শ্বাস গ্রহণের জন্য প্রয়োজন এবং বাতাসের এই আবরণ পৃথিবীবাসীদের বহু আসমানী বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বরং এর সাথে এটাও দেখার বিষয় যে, এ বাতাস উর্ধ বায়ুমণ্ডলে শুধু বিদ্যমান নয়, মাঝে মধ্যে তা বিভিন্নভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। কখনো মৃদুভাবে প্রবাহিত হয়, কখনো তীব্রভাবে প্রবাহিত হয় এবং কখনো আবার ঝড় তুফানের রূপ ধারণ করে। কখনো শুষ্ক হাওয়া প্রবাহিত হয়, কখনো আর্দ্র হাওয়া প্রবাহিত হয়। কখনো বৃষ্টিবাহী হাওয়া প্রবাহিত হয় এবং কখানো আবার তা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার হাওয়া প্রবাহিত হয়। নানা ধরনের এসব বাতাস আপনা থেকেই এলোমেলোভাবে প্রবাহিত হয় না। এরও একটা নিয়ম-কানুন ও শৃংখলা আছে, যা সাক্ষ্য দেয়, এ ব্যবস্থা পূর্ণ মাত্রায় যুক্তিনির্ভর এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যাবলী পূরণ হচ্ছে। তাছাড়া পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অবস্থা অনুসারে শীত ও গ্রীষ্মের যে হ্রাস বৃদ্ধি হয় তার সাথেও এর অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। তাছাড়াও ঋতু পরিবর্তন ও বৃষ্টি বন্টনের সাথেও এর অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর সবগুলো জিনিসই ডেকে ডেকে বলছে, কোন অন্ধ প্রকৃতি আকস্মিকভাবে এর ব্যবস্থা করে দেয়নি। কিংবা সূর্য ও পৃথিবী হাওয়া ও পানি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের জন্য আলাদা আলাদা কোন ব্যবস্থাপক নেই। বরং নিশ্চিতরূপে এক মাত্র আল্লাহই এসবের স্রষ্টা এবং এক বিরাট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর জ্ঞান ও কৌশল এ ব্যবস্থা করেছে। তাঁর অসীম ক্ষমতাবলেই এ ব্যবস্থা পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে চলছে।
# আল্লাহর সত্তা ও তাঁর “ওয়াহদানিয়াত” বা একত্বের স্বপক্ষে স্বয়ং আল্লাহর পেশকৃত এসব যুক্তি-প্রমাণ সামনে আসার পরও যখন এসব লোক ঈমান গ্রহণ করছে না তখন এমন কী জিনিস আর আসতে পারে যার কারণে ঈমানের সম্পদ তাদের ভাগ্যে জুটবে? আল্লাহর কালামই তো সেই চূড়ান্ত বস্তু যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি এই নিয়ামত লাভ করতে পারে। আর একটি অদেখা সত্য সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত যেসব দলীল প্রমাণ পেশ করা সম্ভব তা এই পবিত্র কালামে পেশ করা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ অস্বীকার করতেই বদ্ধপরিকর থাকে তাহলে করতে থাকুক। তার অস্বীকৃতির ফলে প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হবে না।
# অন্য কথায় যে ব্যক্তি সদুদ্দেশ্যে খোলা মনে আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনে এবং ঠাণ্ডা মাথায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তার এবং সেই ব্যক্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য যে অস্বীকৃতির পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে তা শোনে এবং কোনো প্রকার চিন্তা ভাবনা ছাড়াই এসব আয়াত শোনার পূর্বেই যে সিদ্ধান্ত সে গ্রহণ করেছিলো তার ওপর স্থির থাকে। প্রথম প্রকারের ব্যক্তি এই আয়াত শুনে যদিও আজ ঈমান আনছে না কিন্তু তার কারণ এ নয় যে, সে কাফের থাকতে চায়। এর কারণ বরং এই যে, সে আরো নিশ্চিত হতে চায়। এ কারণে যদিও তার ঈমান আনায় বিলম্ব হচ্ছে তবু এটা অবশ্যই আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে অন্য কোন আয়াত হয়তো তার মনে ধরবে এবং সে নিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত হয়ে ঈমান আনবে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের ব্যক্তি কোন আয়াত শুনে কখনো ঈমান আনতে পারে না। কারণ, আল্লাহর আয়াতের জন্য সে আগে থেকেই তার মনের দরজা বন্ধ করে নিয়েছে। যেসব মানুষের মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তারাই সাধারণত এই অবস্থার শিকার হয়। এক, তারা মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে। তাই সত্য ও সততা তাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। দুই, তারা দুষ্কৃতকারী হয়ে থাকে। তাই তাদের পক্ষে এমন কোন শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা মেনে নেয়া অত্যন্ত কঠিন হয় যা তাদের ওপর নৈতিক বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। তিন, তারা অংকারে আত্মমগ্ন থাকে যে, তারা সব কিছুই জানে কাজেই তাদেরকে আবার কে কী শিখাবে। এ কারণে তাদেরকে আল্লাহর যেসব আয়াত শুনানো হয় তারা তা আদৌ ভেবে চিন্তে-দেখার মত কোন জিনিস বলে মনে করে না এবং তাদের শোনা ও না শোনার ফলাফল একই হয়ে থাকে।
# ঐ একটি আয়াত নিয়ে বিদ্রূপ করাই যথেষ্ট মনে করে না, সব আয়াত নিয়েই বিদ্রূপ করতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন সে শোনে যে কুরআনে অমুক কথা বলা হয়েছে তখন তার সোজা অর্থ গ্রহণ করার পরিবর্তে প্রথমে তার মধ্যেই কোন বাঁকা অর্থ অনুসন্ধান করে নেয়, যাতে তাকে বিদ্রূপের লক্ষ্যস্থল বানাতে পারে। অতঃপর তা নিয়ে বিদ্রূপ করার পরে বলে, জনাব, তার কথা কি বলেন, সে তো প্রতিদিন একেকটি অদ্ভুত কথা শুনাচ্ছে। দেখুন, অমুক আয়াতে সে এই মজার কথাটা বলেছে এবং অমুক আয়াতের মজার বিষয়ের তো কোন জুড়িই নেই।
# মূল আয়াতে আছেمِنْ وَرَائِهِمْ جَهَنَّمُ । আরবী ভাষায় وَرَاء শব্দটি এমন প্রতিটি জিনিস বুঝাতে ব্যবহৃত হয় যা সামনে থাক বা পেছনে থাক মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকে। সুতারাং এর আরেকটি অনুবাদ হতে পারে “তাদের পেছনে রয়েছে জাহান্নাম।” যদি প্রথম অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে আয়াতের অর্থ হবে, তারা নিশ্চিন্তে দ্বিধাহীন চিত্তে এ পথে ছুটে চলেছে, অথচ সামনেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে সে অনুভীতি তাদের নেই। দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হবে, তারা আখেরাত সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেদের এই দুষ্কর্মের মধ্যে ডুবে আছে। কিন্তু জাহান্নাম তাদের অনুসরণ করছে তা তারা জানে না।
# এখানে ولى শব্দ দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক, সেই সব দেব-দেবী এবং জীবিত বা মৃত নেতাদের বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে যাদের সম্বন্ধে মুশরিকরা ধরে নিয়েছে, যে ব্যক্তিই তাদের নৈকট্য লাভ করেছে সে পৃথিবীতে যাই করুক না কেন আল্লাহর দরবারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না। কেননা, তাদের হস্তক্ষেপ তাকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করবে। দুই, সেই সব নেতা, আমীর-উমরাহ ও শাসকদের বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ যাদেরকে পথপ্রদর্শক ও অনুসরণীয় বানিয়ে থাকে, অন্ধভাবে তাদের আনুগত্য করে এবং তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহকে অসন্তস্ট করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এ আয়াত এসব লোককে এ মর্মে সাবধান করে যে, এই আচরণ ও ভূমিকার ফলে যখন তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে তখন এই দুই শ্রেণীর নেতাদের কেউই তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আশ শূরার ব্যাখ্যা, টীকা ৬)।
# সমুদ্র পথে বাণিজ্য, মৎস্য শিকার, ডুবুরীর কাজ, জাহাজ চালনা এবং অন্যান্য উপায়ে রিযিক অর্জনের চেষ্টা করো।
# এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ। একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর এই দান দুনিয়ার বাদশাহদের দানের মত নয়। কেননা, তারা প্রজার নিকট থেকে নেয়া সম্পদ প্রজাদেরই কিছু লোককে দান করে থাকে। বিশ্বজাহানের সমস্ত সম্পদ আল্লাহর নিজের সৃষ্টি। তিনি নিজের পক্ষ থেকে তা মানুষকে দান করেছেন। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, এসব নিয়ামত সৃষ্টি করার ব্যাপারে যেমন কেউ আল্লাহর শরীক নয়, তেমনি মানুষের জন্য এগুলোকে অনুগত করার ব্যাপারেও অন্য কোন সত্তার কোনো প্রকার দখল বা কর্তৃত্ব নেই। আল্লাহ‌ একাই এ সবের স্রষ্টা এবং তিনিই নিজের পক্ষ থেকে তা মানুষকে দান করেছেন।
# অনুগতকরণে এবং এসব জিনিসকে মানুষের জন্য কল্যাণকর বানানোর মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের জন্য বড় বড় নিদর্শন রয়েছে। এসব নিদর্শন পরিষ্কারভাবে এ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত দান করছে যে, পৃথিবী থেকে আসমান পর্যন্ত বিশ্বজাহানের সমস্ত বস্তু এবং শক্তির স্রষ্টা, মালিক, প্রশাসক ও ব্যবস্থাপক একমাত্র আল্লাহ, যিনি সব কিছুকেই একটি নিয়ম-বিধির অনুগত করে রেখেছেন এবং সেই আল্লাহই মানুষের রব-যিনি তাঁর অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান ও কৌশল এবং রহমতে এসব বস্তু ও শক্তিসমূহকে মানুষের জীবন, জীবিকা, আয়েশ-আরাম, উন্নতি ও তাহযীব-তমদ্দুনের উপযোগী ও সহায়ক বানিয়েছেন এবং একা তিনিই মানুষের দাসত্ব, কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য লাভের অধিকারী। অন্য সত্তাসমূহ এসব বস্তু ও শক্তি সৃষ্টিতে যাদের কোন অংশ নেই কিংবা এসব বস্তু ও শক্তি মানুষের অনুগত করা ও কল্যাণকর বানানোর ক্ষেত্রে যাদের কোন কর্তৃত্ব নেই, মানুষের দাসত্ব, কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য লাভের অধিকারও তাদের নেই।
# মূল আয়াতাংশ হচ্ছে لِلَّذِينَ لَا يَرْجُونَ أَيَّامَ اللَّهِ । এর শাব্দিক অনুবাদ হবে, “যেসব মানুষ আল্লাহর দিনসমূহের আশা রাখে না।” কিন্তু আরবী বাকরীতিতে এ রকম ক্ষেত্রে اَيَّام অর্থ শুধু দিন নয়, বরং এমন সব স্মরনীয় দিন যখন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়েছে। যেমন اَيَّامُ الْعَرَبْ শব্দ আরব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এবং আরব গোত্রসমূহের এমন সব বড় বড় যুদ্ধ-বিগ্রহ বুঝানোর জন্য বলা হয় যা পরবর্তী বংশধররা শত শত বছর ধরে স্মরণ করে আসছে। এখানে اَيَّامُ الله অর্থ কোন জাতির জীবনের সর্বাধিক অকল্যাণকর দিন, যেদিন তাদের ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসে এবং নিজ কৃতকর্মের পরিণামে তাদের ধ্বংস করে দেয়া হয়। এই অর্থ অনুসারে আমরা এই আয়াতাংশের অনুবাদ করেছি, ‘যারা আল্লাহর পক্ষে থেকে ভয়াবহ দিন আসারআশঙ্কা করে না। অর্থাৎ যাদের এ চিন্তা নেই যে, কখনো এমন দিনও আসতে পারে যখন আমাদের এসব কাজ-কর্মের ফলশ্রুতিতে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য নেমে আসবে। এই উদাসীনতাই তাদেরকে জুলুম-অত্যাচারের ব্যাপারে দুঃসাহস যুগিয়েছে।
# মুফাসসিরগণ এ আয়াতের দু’টি অর্থ বর্ণনা করেছেন। আয়াতের শব্দাবলী থেকে এ দু’টি অর্থ গ্রহণেরই অবকাশ আছে। একটি অর্থ হচ্ছে, মু’মিনদেরকে এ জালেম গোষ্ঠীর অত্যাচার উপেক্ষা করতে হবে যাতে আল্লাহ তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে তাদের ধৈর্য ও মহানুভবতা এবং শিষ্টাচারের প্রতিদান দেন এবং তারা আল্লাহর পথে যে দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছে তার পুরস্কার দান করেন।আরেকটি অর্থ হচ্ছে, মু’মিনগণ যেন, এই গোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে যাতে আল্লাহ নিজেই তাদের অত্যাচারের প্রতিফল দান করেন।

কতিপয় মুফাসসির এ আয়াতকে ‘মনসূখ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেনঃ যতদিন মুসলমানদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়নি ততদিন এ আদেশ বহাল ছিল। কিন্তু যুদ্ধের অনুমতি দেয়ার পর এ হুকুম ‘মনসূখ’ হয়ে গিয়েছে। তবে আয়াতের শব্দসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মনসুখ হওয়ার এ দাবী ঠিক নয়। ব্যক্তি যখন কারো জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে সক্ষম নয় তখন তাকে ক্ষমা করে দেয়া অর্থে এই ‘মাফ’ শব্দটি কখনো ব্যবহৃত হয় না। বরং এক্ষেত্রে ধৈর্য, সহ্য ও বরদাশত শব্দগুলো প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ শব্দগুলো বাদ দিয়ে এখানে যখন ‘মাফ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তখন আপনা থেকেই তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঈমানদারগণ সেই সব লোকের জুলুম ও বাড়াবাড়ির জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকবে আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক হওয়া যাদেরকে নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের সীমালংঘনের দুঃসাহস যুগিয়েছে। যেসব আয়াতে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে তার সাথে এ নির্দেশের কোন অমিল বা বৈপরীত্য নেই। যুদ্ধের অনুমতি দানের প্রশ্নটি এমন অবস্থার সাথে সম্পর্কিত যখন কোন কাফের কওমের বিরুদ্ধে যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মুসলিম সরকারের কাছে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে। আর ক্ষমার নির্দেশ এমন সাধারণ পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত যখন কোন না কোনভাবে মু’মিনদের সম্মুখীন হতে হয় আল্লাহর ভয়ে ভীত নয় এমন সব লোকদের এবং তারা তাদের বক্তব্য, লেখনী ও আচার-আচরণ দ্বারা মু’মিনদেরক নানাভাবে কষ্ট দেয়। এ নির্দেশের উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানরা যেন তাদের উচ্চতর আসন থেকে নেমে এসব হীন চরিত্র লোকদের সাথে ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিটি অর্থহীন কাজের জবাব দিতে শুরু না করে। যতক্ষণ পর্যন্ত শিষ্টতা ও যৌক্তিতার সাহায্যে কোন অভিযোগ ও আপত্তির জবাব দেয়া কিংবা কোন জুলুমের প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তা থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। কিন্তু যখনই এ সীমা লংঘিত হবে তখনই সেখানেই ক্ষান্তি দিয়ে ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতে হবে। মুসলমানরা নিজেরাই যদি তাদের মোকাবিলায় ময়দানে নেমে পড়ে তাহলে আল্লাহ তাদের সাথে মোকাবিলার ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে তাদের আপন অবস্থার ওপর ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তারা যদি ক্ষমা ও উপেক্ষার নীতি অনুসরণ করে তাহলে আল্লাহ নিজেই জালেমদের সাথে বুঝাপড়া করবেন এবং মজলুমদেরকে তাদের ধৈর্য ও মহানুভবতার পুরস্কার দান করবেন।

তাফসীরৈ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :

الْجَاثِيَةُ শব্দের অর্থ- অবনত হওয়া, নতজানু হওয়া। কিয়ামতের মাঠে প্রত্যেকেই ভয়ে আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে নতজানু অবস্থায় থাকবে। অত্র সূরার ২৮ নম্বর আয়াতে الْجَاثِيَة শব্দটি থেকেই এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলাকে চেনার ও জানার কয়েকটি নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলার একত্বতার ওপর প্রমাণ বহন করে। যারা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে তাদের পরিণতি, মানুষের ভাল-মন্দ আমলের ফলাফল তার ওপর বর্তাবে এবং বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে শরীয়ত প্রদান করেছেন তার অনুসরণ, পাপীদের নাজাত পাওয়ার ভুল ধারণা, বস্তুবাদে বিশ্বাসী লোকদের বিবরণ এবং কিয়ামতের নিশ্চয়তা ও সেদিন কাফিরদের ভয়াবহ পরিণতির কথা তুলে ধরা হয়েছে।

১-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

আল্লাহ তা‘আলা সূরার প্রথমেই তাঁর ক্ষমতার ও এককত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে এমন কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা ছয়টি জিনিষের বর্ণনা করেছেন যা প্রমাণ করে যে, তিনিই একমাত্র প্রতিপালক, আর ইবাদতের যোগ্যও তিনিই, অন্য কেউ নয়, বিষয়গুলো হলো- (১) আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি। (২) মানব জাতির সৃষ্টি। (৩) চতুষ্পদ জন্তুর সৃষ্টি। (৪) দিবা-রাত্রির পরিবর্তন। (৫) আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে মৃত জমিনকে জীবিতকরণ এবং (৬) বায়ুর পরিবর্তন- এ প্রত্যেকটিই আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন : ‏ “তারা কি কখনও তাদের ওপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিভাবে আমি তা তৈরি করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোন (সূক্ষ্মতম) ফাটলও নেই। আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি ও সেখানে উৎপন্ন করেছি চোখ জুড়ানো সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী ব্যক্তির জন্য জ্ঞান আহরণ ও উপদেশ স্বরূপ।” (সূরা কাফ ৫০ : ৬-৮)

আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন এ ব্যাপারে তিনি বলেন,

(وَمِنْ اٰيَاتِه۪ٓ أَنْ خَلَقَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ إِذَآ أَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُوْنَ ‏)‏

“আর তাঁর দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে (অন্যতম) এই যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর এখন তোমরা মানুষ সব জায়গায় বিস্তার লাভ করেছ।” (সূরা রূম ৩০ : ২০)

চতুষ্পদ জন্তু জমিনে বিস্তার করার ব্যাপারে তিনি বলেন,

(وَمِنْ اٰيٰتِه۪ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَثَّ فِيْهِمَا مِنْ دَا۬بَّةٍ ط وَهُوَ عَلٰي جَمْعِهِمْ إِذَا يَشَا۬ءُ قَدِيْرٌ)

“তাঁর মহা নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হল আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এতদুভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন সেগুলো; তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাদেরকে সমবেত করতে সক্ষম।” (সূরা শূরা- ৪২ : ২৯)

দিবা-রাত্রির পরিবর্তন হওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

(إِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَاٰيٰتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ)

“নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টির মধ্যে এবং দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (সূরা আলি ‘ইমরান ৩ : ১৯০)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(يُقَلِّبُ اللّٰهُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُولِي الْأَبْصَارِ ‏)‏

“আল্লাহ দিন ও রাতের পরিবর্তন ঘটান, নিশ্চয়ই‎ এতে শিক্ষা রয়েছে সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য।” (সূরা নূর ২৪ : ৪৪) আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে মৃত জমিনকে জীবিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَمَآ أَنْزَلَ اللّٰهُ مِنَ السَّمَا۬ءِ مِنْ مَّا۬ءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا)

“আর আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন ।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৬৪) এবং বাতাসের গতি পরিবর্তন করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَّتَصْرِيْفِ الرِّيٰحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَآءِ وَالْأَرْضِ لَاٰيٰتٍ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ ‏)‏

“এবং বাতাসের গতি পরিবর্তনে আর আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থ নিয়ন্ত্রিত মেঘমালায় (এসবগুলোর মধ্যে) জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৬৪)

এ ব্যাপারে অনেক দলীল-প্রমাণ বিদ্যমান যেগুলো প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই, অন্য কেউ নয়।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : যারা এ সকল নিদর্শন ও দলীল-প্রমাণ দেখার পরও বিশ্বাস স্থাপন করেনা, বরং অস্বীকার করত ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে এবং আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সাথে উপহাস করে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআন নিয়ে শত্র“দের শহরে সফর করতে নিষেধ করেছেন এ আশঙ্কায় যে, তারা হয়তো কুরআনের অবমাননা করবে। (সহীহ বুখারী হা. ২৯৯০, সহীহ মুসলিম হা. ১৪৯১)

এরাই হলো দুর্ভাগা জাতি, আর এদের জন্যই রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। তাদের আমলসমূহ তাদের কোনই উপকারে আসবে না এবং তারা আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে যাদের ইবাদত করত তারাও তাদের কোন উপকারে আসবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না।
৩. অহঙ্কার পোষণ করা যাবে না।
৪. কুরআন মানুষকে সৎ পথের সন্ধান দেয়।

১২-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এখানেও আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি তার দেওয়া কিছু নিয়ামতের বর্ণনা করেছেন। তিনি সমুদ্রকে মানুষের কল্যাণার্থে নিয়োজিত করেছেন এবং পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে তার প্রত্যেকটি জিনিসও মানুষের কল্যাণার্থে নিয়োজিত রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَمَا بِکُمْ مِّنْ نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللہِ ثُمَّ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فَاِلَیْھِ تَجْئَرُوْنَ)

“তোমাদের নিকট যে সমস্ত‎ নেয়ামত রয়েছে তা আল্লাহরই পক্ষ হতে; আবার যখন দুঃখ-কষ্ট তোমাদেরকে স্পর্শ করে তখন তোমরা তাঁকেই ব্যাকুলভাবে আহ্বান কর‎।” (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৫৩)

এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা নাহ্লসহ আরো অন্যান্য স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর মু’মিনদেরকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে যে, তারা যেন তাদের শত্র“দেরকে ক্ষমা করে দেয়। এ বিধান ইসলামের প্রথম যুগের। পরবর্তীতে যখন মুসলিমরা শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন শত্র“দের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।

সুতরাং সামর্থ্য না থাকলে কাফিরদের ওপর চড়াও হওয়া যাবে না, বরং ধৈর্য ধারণ করাটাই উত্তম। আর আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। আর যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে ব্যক্তি সৎ আমল করবে তার ফল সে নিজেই ভোগ করবে, অন্য কেউ তা ভোগ করার সুযোগ পাবে না। পক্ষান্তরে যে মন্দ কাজ করবে তার পরিণতিও সে নিজেই ভোগ করবে, অন্য কেউ তার থেকে তার মন্দ বোঝা হালকা করে দেবে না।

অর্থাৎ যার যার কৃতকর্মের প্রতিদান তার নিজেকেই ভোগ করতে হবে, কেউ এ ব্যাপারে ভাগী হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( إِنْ أَحْسَنْتُمْ أَحْسَنْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ قف وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَا)

“তোমরা সৎ কর্ম করলে সৎ কর্ম নিজেদের জন্য করবে এবং মন্দ কর্ম করলে তাও করবে নিজেদের জন্য।” (সূরা বানী ইসরা-ঈল ১৭ : ৭)

সুতরাং যে সকল ব্যক্তি তাদের অনুসারী বা মুরীদদের অপরাধের বোঝা বহন করার আশ্বাস প্রদান করে তাদের প্রদত্ত আশ্বাস অনর্থক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( وَلَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلَّا عَلَيْهَا ج وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ أُخْرٰي)

“প্রত্যেকে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো (পাপের) ভার গ্রহণ করবে না।” (সূরা আন‘আম ৬ : ১৬৪)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পৃথিবীর সকল জিনিস মানুষের কল্যাণার্থে সৃষ্টি হয়েছে।
২. বিপদে বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
৩. বাতিলকে প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকলে তা প্রতিহত করতে হবে।
৪. প্রত্যেকে নিজের কৃতকর্মের ফলাফল নিজেই ভোগ করবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় মাখলুককে হিদায়াত করছেন যে, তারা যেন মহা ক্ষমতাবান আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শনাবলীর উপর চিন্তা ও গবেষণা করে, তাঁর নিয়ামতরাজিকে জানে ও বুঝে, অতঃপর এগুলোর কারণে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তারা যেন এটা দেখে যে, আল্লাহ কত বড় ক্ষমতাবান! যিনি আসমান, যমীন এবং বিভিন্ন প্রকারের সমস্ত মাখলুক সৃষ্টি করেছেন! ফেরেশতা, দানব, মানব, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি সবকিছুরই স্রষ্টা তিনিই। সমুদ্রের অসংখ্য সৃষ্টজীবেরও সৃষ্টিকর্তা তিনিই। দিবসকে রজনীর পরে এবং রজনীকে দিবসের পিছনে আনয়ন তিনিই করছেন। রাত্রির অন্ধকার এবং দিনের ঔজ্জ্বল্য তাঁরই অধিকারভুক্ত জিনিস। প্রয়োজনের সময় মেঘমালা হতে পরিমিত পরিমাণে বৃষ্টি তিনিই বর্ষণ করে থাকেন। রিযক দ্বারা বৃষ্টিকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, এর দ্বারাই খাদ্য জাতীয় জিনিস উৎপন্ন হয়ে থাকে। শুষ্কভূমি সিক্ত হয় এবং তা হতে নানা প্রকারের শস্য উৎপাদিত হয়। দিবস ও রজনীতে উত্তরা হাওয়া ও দক্ষিণা হাওয়া এবং পুবালী হাওয়া ও পশ্চিমা হাওয়া এবং শুষ্ক ও সিক্ত হাওয়া তিনিই প্রবাহিত করেন। কোন কোন বায়ু মেঘ আনয়ন করে এবং কোন কোন বায়ু মেঘকে পানিপূর্ণ করে। কোন কোন বাতাস রূহের খোরাক হয় এবং এগুলো ছাড়া অন্যান্য কাজের জন্যেও প্রবাহিত হয়ে থাকে।

আল্লাহ পাক প্রথমে বলেন যে, এতে নিদর্শন রয়েছে মুমিনদের জন্যে, এরপর বলেছেনঃ এতে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্যে রয়েছে নিদর্শন এবং শেষে বলেছেনঃ এতে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে। এটা একটা সম্মান বিশিষ্ট অবস্থা হতে অন্য একটা বেশী সম্মান বিশিষ্ট অবস্থার দিকে উন্নত করা। এ আয়াতটি সূরায়ে বাকারার নিম্নের আয়াতটির সাথে সাদৃশ্যযুক্তঃ (আরবী) অর্থাৎ “আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে, যা মানুষের হিত সাধন করে তা সহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে, আল্লাহ আকাশ হতে যে বারি বর্ষণ দ্বারা ধরিত্রিকে ওর মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। তাতে এবং ওর মধ্যে যাবতীয় জীব-জন্তুর বিস্তারে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্যে নিদর্শন রয়েছে।”(২:১৬৪) ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এখানে একটি দীর্ঘ আসার আনয়ন করেছেন, কিন্তু ওটা গারীব। ওতে মানুষকে চার প্রকারের উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করার কথাও রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

৬-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এই যে কুরআন, যা অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে নবী (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, ওর আয়াতগুলো যথাযথভাবে তার নিকট আবৃত্তি করা হয় তা কাফিররা শুনে, অথচ এর পরেও ঈমান আনে না এবং আমলও করে না, তাহলে আর কোন বাণীতে তারা বিশ্বাস করবে? তাদের জন্যে। দুর্ভোগ, তাদের জন্যে আফসোস! যারা কথায় মিথ্যাবাদী, আমলে পাপী এবং অন্তরে কাফির! আল্লাহর বাণী শুনেও স্বীয় কুফরী ও অবিশ্বাসের উপর অটল ও স্থির থাকছে! যেন ওটা তারা শুনেইনি। তাই তিনি স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তাদেরকে সংবাদ দিয়ে দাও যে, তাদের জন্যে আল্লাহ তাআলার নিকট বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

যখন তারা আল্লাহর কোন আয়াত অবগত হয় তখন তা নিয়ে তারা পরিহাস করে। সুতরাং আজ যখন তারা আল্লাহর বাণীর অমর্যাদা করছে তখন কাল কিয়ামতের ময়দানে তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনাজনক শাস্তি।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন নিয়ে শত্রুদের শহরে সফর করতে নিষেধ করেছেন। এই আশংকায় যে, তারা হয়তো কুরআনের অবমাননা করবে। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁর বাণীর অবমাননাকারীদের শাস্তির বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাদের পশ্চাতে রয়েছে জাহান্নাম। তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি এবং সারাজীবন ধরে যেসব বাতিল মা’বুদের তারা উপাসনা করে এসেছে তারাও তাদের কোনই কাজে আসবে না। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ কুরআন সৎপথের দিশারী। যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী প্রত্যাখ্যান করে তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন বেদনাদায়ক শাস্তি। এসব ব্যাপারে মহামহিমান্বিত আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

১২-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নিয়ামতের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাঁরই হুকুমে মানুষ তাদের ইচ্ছানুযায়ী সমুদ্রে সফর করে থাকে। মালভর্তি বড় বড় নৌযানগুলো নিয়ে তারা এদিক হতে ওদিক ভ্রমণ করে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আয়-উপার্জন করে থাকে। আল্লাহ তা’আলা এই ব্যবস্থা এ জন্যেই রেখেছেন যে, যেন তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়।

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আকাশের জিনিস যেমন সূর্য, চন্দ্র, তারাকারাজি এবং পৃথিবীর জিনিস যেমন পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী এবং মানুষের উপকারের অসংখ্য জিনিস তাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন। এগুলোর সবই তাঁর অনুগ্রহ, ইহসান, ইনআম এবং দান। সবই তাঁর নিকট হতে এসেছে। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের নিকট যেসব নিয়ামত রয়েছে সবই আল্লাহ প্রদত্ত, অতঃপর যখন তোমাদেরকে কষ্ট ও বিপদ স্পর্শ করে তখন তোমরা তাঁরই কাছে অনুনয় বিনয় করে থাকো।”(১৬:৫৩)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সব জিনিসই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে এবং তাতে যে নাম রয়েছে তা তাঁরই নামসমূহের মধ্যে নাম। সুতরাং এগুলোর সবই তাঁরই পক্ষ হতে আগত। কেউ এমন নেই যে তার নিকট হতে এগুলো ছিনিয়ে নিতে পারে বা তার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে পারে। সবাই এ বিশ্বাস রাখে যে, তিনি এরূপই।

একটি লোক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেঃ “মাখলুককে কি জিনিস দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আলো, আগুন, অন্ধকার এবং মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।” অতঃপর তিনি লোকটিকে বলেনঃ “হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর সাথে দেখা হলে তাকেও জিজ্ঞেস করে নিয়ো। লোকটি সেখান হতে ফিরে গিয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলো। তিনিও ঐ উত্তরই দিলেন এবং লোকটিকে বললেনঃ “তুমি আবার হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর নিকট ফিরে যাও এবং জিজ্ঞেস কর যে এ সবগুলো কি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে?” লোকটি পুনরায় হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে ওটা জিজ্ঞেস করলো। তখন তিনি (আরবী) -এ আয়াতটি পাঠ করেন। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা গারীব আসার, এমনকি অস্বীকার্যও বটে)

মহান আল্লাহ বলেনঃ চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে এতে বহু নিদর্শন রয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, মুমিনদেরকে ধৈর্যধারণের অভ্যাস রাখতে হবে। যারা কিয়ামতকে বিশ্বাস করে না তাদের মুখ হতে তাদেরকে বহু কষ্টদায়ক কথা শুনতে হবে এবং মুশরিক ও আহলে কিতাবের দেয়া বহু কষ্ট সহ্য করতে হবে।

এই হুকুম ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে জিহাদ এবং নির্বাসনের হুকুম নাযিল হয়।

আল্লাহ পাকের ‘যারা আল্লাহর দিবসগুলোর প্রত্যাশা করে না’ এই উক্তির ভাবার্থ হলোঃ যারা আল্লাহর নিয়ামত লাভ করার চেষ্টা করে না। তাদের ব্যাপারে মুমিনদেরকে বলা হচ্ছেঃ তোমরা পার্থিব জীবনে তাদের অপরাধকে ক্ষমার চক্ষে দেখো। তাদের আমলের শাস্তি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা প্রদান করবেন। এ জন্যেই এর পরেই বলেনঃ তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে। সেই দিন প্রত্যেককে তার ভাল ও মন্দের প্রতিফল দেয়া হবে। সকর্মশীলকে পুরস্কার এবং পাপীকে শাস্তি প্রদান করা হবে।

Leave a Reply